Wednesday, August 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 167



কনে_দেখা_আলো পর্ব-০১

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_এক

‘ওই সুফিয়া, ইদিকে আয়…দ্যাখ দ্যাখ কী সুন্দোর আলো! দ্যাখছস?’
যাকে বলা হলো সেই সুফিয়া এদিক সেদিকে তাকিয়ে কোনো আলোর দেখা পেল না। ভ্যাবলার মতো ওপর নীচেও মাথাটাকে কয়েকবার ঘুরিয়ে আনলো। পাশে দাঁড়ানো জুলেখা তার ঘাড় ধরে মাথাটাকে সোজা বরাবর লাগিয়ে দিয়ে জোরের সাথে বললো,
‘এইবার দ্যাখছস?’
বিকেল প্রায় অস্তমিত হতে চলেছে। আকাশ আর দিগন্তরেখার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে শেষ বিকেলের ম্লান বিমোহিত আলো। সম্মূখের দিগন্ত বিস্তৃত মাঠজুড়ে সোনারঙা ফসলের গায়ে গায়ে লেপ্টে আছে সেই আলোর মোহনীয় মায়াজাদু। একটু পরেই মিলিয়ে যাওয়ার শঙ্কা তখনো এসে গ্রাস করতে পারেনি তাকে। সুফিয়া নিস্পৃহ সুরে উত্তর দিল,
‘হ দ্যাখলাম। রোইজই তো দেখি! এ্যার মইধ্যে দ্যাখোনের কী আছে?’
জুলেখা তখনো উত্তেজিত। একটু পরেই হারিয়ে যাবে এই অপূর্ব আলো, এই আশঙ্কা তাকে এর মধ্যেই ঘিরে ধরেছে। মুহূর্তটাকে সে এক্ষুনি প্রাণভরে উপভোগ করে নিতে চায়। সুফিয়ার নিস্পৃহতাকে পাত্তা না দিয়ে সেই আলোর দিকে মুখ করে সে দ্বিগুণ উত্তেজনা নিয়ে বলল,
‘এইবার আমার দিকে চাইয়া ক’তো দ্যাখি…আমারে কেমুন দ্যাখা যায়?’
‘ও বাবা! তর কী হইলো রে বুবু?’
‘আহ! তুই ক না!’
সুফিয়া মুখটাকে ভেটকি মাছের মতো করে জুলেখার দিকে অনিচ্ছাসূচক একটা দৃষ্টিপাত করেই একেবারে হাঁ হয়ে গেল। তাইতো! জুলেখাকে এত সুন্দর দেখাচ্ছে কীভাবে? জুলেখার গায়ের রঙ যেন হলুদের ছোঁয়া পেয়ে জ্বলজ্বল করছে। শ্যামলাবরণী জুলেখা’র অনুজ্জ্বল লুকিয়ে থাকা চাপা সৌন্দর্য একেবারে আগুনের শিখার মতো ধিক ধিক করে জ্বলছে।

সুফিয়ার হাঁ করে থাকা মুখটা দেখেই জুলেখা জেনে গেল, যা সে জানতে চাইছিল। মুহূর্তেই মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠল। সুফিয়াকে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গদগদ মুখে বলল,
‘ল চল ওহন, বাড়িত যাই! আর বেশি দেরি হইলে মায়ের প্যাঁচালে মাথা ধইরা যাইব।’
সুফিয়ার গলায় অনাগ্রহ। এখনই ঘরে ফিরতে তার তীব্র অনিহা। মাথা নেড়ে বলল,
‘আরেকটু বইয়া লই না গো বু! এত জলদি কীসের?’
‘তোর আর কীয়ের জলদি! জলদি তো আমার। আমার তো আর তোর লাগান রাজরানীর কপাল না! ঘরে সৎ মা, উঠতে বইতে খোঁটা। তুই বাড়িত যাইয়া মায়ের লগে পুটুরপুটুর কইরা গল্প করবি। মায়ে তোর মাথাত তেল দিয়া বেণী কইরা দিব। আর আমার…’
শেষের দিকে গলার স্বর ভারি হয়ে আসে জুলেখার। চেনা দুঃখে আর কত কান্না আসে? তবু কেন যে গলা ধরে আসে বার বার, কে বলতে পারে!
সুফিয়া তবু নিশ্চল বসে থাকে। তার সত্যিই এখুনি ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। একটু আগে দেখা জুলেখার মুখের অপূর্ব ছায়া তখনো তার মনকে মোহাবিষ্ট করে রেখেছে। সে মুখ তুলে আবার তাকাল জুলেখার দিকে। জুলেখাকে এখনো সেইরকমই উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। হঠাৎ কী মনে হতেই সুফিয়া খুশি মনে বলল,
‘বুবু, আমারে দ্যাখো তো কেমুন দ্যাখা যায়!’
জুলেখার মুখেও খুশির ঝিলিক খেলে গেল। স্বচ্ছ সুন্দর হাসিতে চারদিক উদ্ভাষিত করে বলল,
‘তুই তো এমনিতেই সুন্দোর! তোরে দ্যাখতে কি এ্যাই সময়ের লাইগা খাইড়া থাওন লাগে? আমি তো কাইলা কাক। এই আলো আইয়া আমার মুখের উপরে পড়লে আমারে ধলা লাগে। আমি জানি। ছুডোবেলায় মায়ের মুখে হুনছি।’
সুফিয়া নির্ভেজাল কৌতুহলে জিজ্ঞেস করে,
‘বুবু, তুমি তো ম্যালা ছুডো আছিলা যহন তুমার মায়ে মরছে। এত কথা ক্যামনে মনে আছে?’
জুলেখার মুখের হাসি তখনো অমলিন। মায়ের কথা মনে হলে সে কোন জগতে যেন চলে যায়! সেই আদর, সেই স্নেহভরা দৃষ্টি মাখানো দুটি চোখ…আহা! আজ অবধি কেউ ওমন করে জুলেখার দিকে চেয়ে দেখেনি! হয়ত আর কখনো চাইবেও না! নিজের মনটাকে বহুকষ্টে বর্তমানে ফিরিয়ে এনে জুলেখা উত্তর দেয়,
‘খুব বেশি কি আর ছুডো আছিলাম! সাত বছরের লাগান তো হইছিলামই! মনে থাকব না ক্যা? মায় মরার পরের মাসেই বাজান আবার বিয়া বইল। তার পরের বছর তুই হইলি!’
খিক খিক করে হেসে উঠে সুফিয়া। ‘বাপরে! কেমুন হিসাব কইরা মনে রাখছ বেবাক কিছু!’
আর কিছু বলে না জুলেখা। তাকিয়ে থাকে তার সৎবোনের দিকে। অবশ্য সুফিয়াকে তার মোটেও সৎবোন বলে মনে হয় না। মনে হয়, যেন ওর মায়ের পেটেরই বোন। মায়ের পরে যে মানুষটার কাছ থেকে সে কিছু একটু ভালোবাসা পেয়েছে, তা এই সুফিয়া। ও ছিল বলেই জুলেখার দিনরাত্রিগুলো আঁধার কালো রাতে হারিয়ে যায়নি।
‘বুবু, তুমি কিন্তু ঠিক ঠিক কইরা কও নাই অহনো আমারে কেমুন দ্যাখা যাইতাছে! তুমার লাগান সুন্দোর লাগতাছে না, তাই না?’ সুফিয়া মুখ ভার করে কপট অভিমানী গলায় বলে।
‘তর যা খুশি তাই ভাইবা নে গা যা! সুন্দোর মাইনষের এগুলান সব ঢঙ্গের কথা!’
সুফিয়া হেসে কুটি কুটি হয়। সে জানত এই কথা বললেই জুলেখা তেতে আগুন হবে।

সুফিয়া বয়সে জুলেখার চেয়ে আট বছরের ছোট। তার গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। গ্রামাঞ্চলে এমন উজ্জ্বল গায়ের রঙ তেমন একটা চোখে পড়ে না। নাক মুখের গড়ন খুব যে সুন্দর, তা নয়। নাকটা একটু চাপা, বোঁচা বললেও ভুল বলা হয় না। চোখ দুটি অবশ্য বেশ বড়। কিন্তু সুফিয়ার নিজের ভাষায় ওর চোখজোড়া হলো গরুর চোখ। গরুর যেমন বেশ বড় বড় চোখ থাকে কিন্তু সেই বড় চোখে কোনো আকর্ষণ থাকে না, ঠিক তেমনি ওর নিজের চোখও নাকি সেইরকম। শুধু গঠনগত ভাবেই তা বড়। ঠোঁটের ছাঁদেও সেই একই বস্তুর অনুপস্থিতি, আকর্ষণ। কিন্তু তাতে কী! গায়ের রঙ দেখেই লোকে তাকে সুন্দরী হিসেবে গণ্য করে। যে শাড়িই পরে, সেটাই তার ধবল বরণের জন্য সুন্দরভাবে শরীরের সাথে মানিয়ে যায়।
সুফিয়ার বয়স পনেরো ছাড়িয়েছে। হাতে পায়ে সে বেশ বেড়েও উঠেছে। তাই আশপাশ থেকে ইতোমধ্যেই তার জন্য প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। সেদিকে অবশ্য সুফিয়ার তেমন কোনো আগ্রহ নেই। সে লেখাপড়া করতে চায়। গ্রামের প্রাইমারী স্কুল থেকে ক্লাস ফাইভ পাস করে সে বেশ অনেকটা দূরের হাইস্কুলে পড়তে যায়। এই বছরে ক্লাস সেভেনে উঠেছে। বিয়ে করার কোনো চিন্তা ভাবনা আপাতত তার মাথাতে নেই।

সুফিয়ার মা অবশ্য অন্য ভাবনা ভাবছেন। তিনি এর মধ্যেই সুফিয়ার জন্য আসা সব প্রস্তাব দেখে শুনে যাচাই বাছাই করাও শুরু করে দিয়েছেন। যেসব বেশি মনে ধরছে, সেগুলোকে আলাদা করে বিবেচনায় রাখছেন।
সামনে শুধু একটাই ফাঁড়া। পোড়ারমুখীকে কোনোমতে একবার বিদায় করতে পারলেই সুফিয়ার বিয়ে নিয়ে একটু শান্তিমত ভাবনাচিন্তা শুরু করা যাবে। তার মৃতা সতীন কী যে এক আপদ ঝুলিয়ে দিয়ে গিয়েছে তার ঘাড়ে! এটাকে ভালোয় ভালোয় বিদায় করতে পারলেই সুফিয়ার পথের কাঁটা তার দূর হয়!
কিন্তু পোড়ারমুখীকে বিদায়টা করবেন কীভাবে? মেঘে মেঘে বেলা তো কিছু কম হয়নি। গ্রামদেশে বাইশ তেইশ বছর মানে অনেক বয়স। এত বয়সে কোনো মেয়ের বিয়ে না হলে তার আর বিয়ে হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা থাকে না। সেকথা সুফিয়ার মা তার স্বামীকে অনেকভাবেই বুঝিয়েছেন।
‘দ্যাখো, তুমার মাইয়ার লাইগা আমি আমার মাইয়ারে ভাসাইয়া দিবার পারুম না। হ্যারে কেউ বিয়া না করবার চাইলে বটগাছের লগে বিয়া দিয়া দাও। আমি আমার মাইয়ারে বসাইয়া রাখবার পারুম না। এত্ত ভালা ভালা প্রস্তাব আসে চারদিক থাইকা। আর বেশি দেরি করলে আমার মাইয়ার কপালডাও পুড়বো, এই আমি কইয়া রাখলাম। হেইডা কইলাম আমি মাইনা লমু না!’
জুলেখার বাবা মিনমিন করে হাল্কা প্রতিবাদের সুরে বলেছেন,
‘আর কয়টা দিন দেখি বউ। তেমুন হইলে তো যাহোক একটা কিছু কইরা বিদায় করনই লাগবো। এ্যাদ্দিন দ্যাখলা…আর কয়টা দিন একটু কষ্ট করো। মা মরা মাইয়া, এক্কেরে ত আর পানিত ভাসাইয়া দিবার পারি না! আর বড় মাইয়া থুইয়া ছোটটারে বিয়া দিলে মানুষজন কী কইবো?’

জুলেখার গায়ের রঙ কালো। বড় ঘরের মেয়েরা এই বর্ণধারী হলে তাদেরকে আদর করে শ্যামলা বলে ডাকা হয়। কিন্তু গরীবের মেয়েকে কেউ আহলাদ করে শ্যামলা বলে না। তাকে কালো বলেই পরিচিতি পেতে হয়।
কিন্তু কালো হলে কী হবে, জুলেখার নাক চোখ মুখের গড়ন অপূর্ব। একেবারে কাটা কাটা। সুফিয়ার চোখ যদি হয় গরুর মতো, জুলেখা তবে হরিণনয়না। হরিণের মতোই টানাটানা দুটি চোখ। খাড়া টিকোলো নাক আর তার নীচে কমলার কোয়ার মতো পাতলা দুটি ঠোঁট। কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও তাকে অসুন্দরের তকমা গায়ে লাগিয়ে চলতে হয়। লোকে তো আগে বরণখানিই দেখে। পরে না বিস্তারিত এতকিছু চোখে পড়ে! সেই বরণ দেখেই পাত্রপক্ষের মুখও কালো হয়ে যায়। তাই এই এত বয়সেও আজ অব্দি জুলেখার পাত্র জোটেনি।

জুলেখার বাবা তার এই বড়মেয়ের জন্য যৌতুকেরও ব্যবস্থা করে রেখেছেন। কালো মেয়েকে বিদায় করতে কিছু তো টাকা পয়সা খসাতেই হবে! সেটুকু গচ্চা দিতে রাজি আছেন তিনি। তবু মেয়েটার একটা কিছু যদি হিল্লে হয়ে যেত! সেটুকুই আর হয় না! গায়ের রঙের কাছে লোভও হার মেনে যায়। পাত্রপক্ষ মুখ অন্ধকার করে বলে, ‘নাতিপুতির কথাও তো ভাবতে হইবো গো মিয়া! ছোট মাইয়ারে বিয়া দিবার রাজি থাকলে কও, ভাইবা দেখি!’
একটা একটা করে সন্মন্ধ ভেঙে যায় আর জুলেখা প্রতিদিন আরো একটু একটু করে কালো হতে থাকে। গ্রামে লোকজনের কাছে অনাদর বাড়ে, বাড়িতে বিরক্তি অবহেলা সীমা ছাড়ায়, শরীরের অবহেলিত যৌবন প্রতিবাদের ভাষা খোঁজে… জুলেখার চারপাশে কোনো আলোই আর ভিড়তে পারে না।

বিকেলের আলো এখন একেবারেই কমে এসেছে। গ্রামে সন্ধ্যা নেমে আসে ঝুপ করে। চারদিকে তাকিয়ে এবার বেশ জোরের সাথেই তাড়া দেয় জুলেখা, ‘তুই তাইলে এইহানেই বইয়া থাক। আমি বাড়িত গেলাম। বাড়িত গিয়া মায়েরে কমু তরে ভূতে ধরছে।’
সুফিয়ার মুখে আবার খিলখিল হাসি। বয়সের দোষেই কী না কে জানে, সে কিছু একটুতেই হেসে কুটিপাটি হয়। হাসতে হাসতেই বললো, ‘তুমার সাহস থাকলে কইও। মায়ে আগে তুমার ভূত ছাড়াইয়া দিবনি! হি হি হি…’
‘বড় বুনের লগে কেমুন কইরা কতা কয় দেহ! আবার জিগাইতাছি, তুই যাবি কী না ক!’
‘এ কতা ও কতা…দে মা এট্টু এ্যালাপাতা। যাইতাছি লও! ইস! বাড়িত গিয়া না জানি কী হাতি ঘোড়া হইবো!’
দুইবোনে যখন ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো, তখন চারপাশে অন্ধকার বেশ ভালোমতোই নেমে এসেছে। ওরা আজ অনেকদূরে চলে এসেছে। এখন পা চালিয়ে হাঁটলেও বাড়ি ফিরতে ফিরতে বিশ পঁচিশ মিনিটের মতো লেগে যাবে।
জুলেখা মনে মনে তিরষ্কার করলো নিজেকে। সুফিয়া না হয় ছেলেমানুষ, বোঝে কম। তার নিজের বুদ্ধি বিবেচনা কই হারিয়ে গিয়েছিল? এত দূরে দুজন সোমত্ত মেয়েমানুষের এভাবে একা একা চলে আসাটা মোটেও কোনো ভাল কাজ হয়নি। গ্রামে আজকাল আজেবাজে অনেক ঘটনা ঘটে। কিছু ঘটনা সামনে আসে, সবাই জানতে পারে। আবার অনেক ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়, কেউ কিছু জানতেও পারে না। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-১৮ এবং শেষ পর্ব

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#অন্তিমপর্ব_১৮

“মায়া মা তুই কি তোর বড় মায়ের সাথে রেগে আছিস?”

মায়া ফোলা ফোলা চোখে বড় মায়ের দিকে তাকায়। মাথা নেড়ে না ইঙ্গিত করে হাত দিয়ে ছবির দিকে ইশারা করে। আমি তার অনুসরণ করে ছবির দিকে তাকাতেই মুখটা মলিন হয়ে গেলো। এটুকু মেয়ে মা-হীন অনুভূতি বড্ড কষ্টময়। আমি নিজেই সেই ট্রমা এখনো বয়ে বেড়ায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে মায়া কে কোলে নিলাম। ছবির দিক থেকে সরিয়ে তাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হলাম। বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত কবরস্থানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সেখানকার পাহারাদার আমাদের দেখে দরজা খুলে দিলেন। আমি মায়া কে নিয়ে একটি কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলাম। মায়া নাক টেনে ফুঁপিয়ে উঠে। ইশ্ মেয়েটার ফুঁপিয়ে কান্না করাটা একেবারে বুকে গিয়ে বিঁধে। এইটুকুন মেয়ের মুখে কতশত মায়ায় ভরা। মুখ থেকে আপনাআপনি ‘মাশাআল্লাহ্’ চলে আসল। সন্তপর্ণে কবরের দিকে তাকিয়ে চোখ বুজে দোয়া পাঠ করলাম। মায়া একবার তার বড় মায়ের মুখের দিকে আরেকবার কবরের দিকে তাকিয়ে নিজেও দু’হাত তুলে প্রার্থনা করতে লাগল। তখনি পেছন থেকে কেউ কাঁধে হাত রাখে। দোয়া পাঠ সমাপ্ত করে মুচকি হেসে বললাম।

“ছেলেকে নিয়ে তবে এসেই গেলেন আপনি!”

“কি করব বলো ছেলের মা যে বাসায় নেই। তাই মনও টিক ছিল না। দারোয়ান বলল তোমরা এখানে আসছো। তাই ছেলেকে জামা পরিয়ে নিয়ে আসলাম। এতে একসাথে দুই কবর জিয়ারত হয়ে গেলো। ঐ দেখো আব্বুও আম্মুর কবরের দিকে তাকিয়ে আছেন।”

শারফানের কথায় সেদিক তাকালাম। শ্বশুর আব্বু মৃত শ্বাশুড়ির কবরের দিকে তাকিয়ে চোখ মুচ্ছেন। আমি শারফান এর সঙ্গে এগিয়ে গেলাম। শ্বশুর আব্বু আমাদের দেখে চোখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে গেলেন। হাস্যজ্জ্বল মুখে ‘মায়া দাদুভাই দাদুর কাছে আসবে?’ মায়া কে উদ্দেশ্য করে কথাটি বলেন তিনি। মায়া ঠোঁট ফুলিয়ে ‘দাদু দাদু’ বলে শ্বশুর আব্বুর কোলে উঠে পড়ল। শ্বশুর আব্বু মায়ার সাথে মজা করে কথা বলছেন। আমি শারফানের কোলে থাকা আমার আর শারফানের প্রথম পুত্র সন্তান শাহেদ মারুফ সদ্য দুবছরের সন্তান আমাদের। মায়া শেরহাজ আর মিমলির প্রথম কন্যা সন্তান মায়া মারুফ সবে তিনবছর চলছে তার।‌অথচ পাকনা বুড়ি একটা। এইটুকুন বয়সে দুষ্টুমির সেরা।‌ শেরহাজের জান যায় যায় অবস্থা হয়ে পড়ে। তবুও সে তার দেবরকে দেখেছে। স্বচক্ষে দেখেছে এইটুকুন বাচ্চা পেলেও সে খুশি। সে খুশি তার বউহীনা। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে এলো হৃদয়ের গোপনচিত্ত ভেদ করে। শারফান আমার কাঁধ ধরে তার বাবার উদ্দেশ্যে বলে,

“চলো আমাদের এবার ফেরা যাক। অনেকক্ষণ হলো এসেছি। আকাশের অবস্থাও মেঘলা। বৃষ্টি হতে পারে।”

শ্বশুর আব্বুর সাথে আমিও সহমত পোষণ করলাম তার কথায়। একসঙ্গে বাড়িতে এসে হাজির হলাম। শারফানের কোলে শাহেদ কে দিয়ে মায়া কে কোলে নিয়ে রান্নাঘরে গেলাম। চেয়ারে বসিয়ে রেখে নিজ হাতে সবটা প্রস্তত করতে লেগে গেলাম। দুঘণ্টা পর জোহরের আযান পড়ে। শারফান শাহেদকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। বিধেয় সে শান্তিমনে তার বাবার সাথে জোহরের নামাজ পড়ার জন্য তৈরি হয়ে গেলো। আমি হাতের কাজটুকু করে মায়া কে নিয়ে রুমে আসলাম। শাহেদের পাশে বসিয়ে তাকে বললাম।

“মা আমার তোর ছোট ভাইটারে একটু দেখে রাখিস। ঘুম ভাঙ্গার পর প্রচুর কান্না করে সে। তাই কান্না করতে চাইলেই মাথায় হাত বুলিয়ে দিস কেমন?”

মায়া মাথা নাড়ল। আমি শারফান এর কাছে গিয়ে মায়ার চোখের আড়ালে একচুমু খেয়ে দিলাম।‌ শারফান চমকে গেলেও হাসল। লাজুকতা ফুটেছে আমার স্বামীর চেহারায়। তিনি আমার কপালে চুমু এঁকে বেরিয়ে গেলেন। আমি মায়ার কাছে ছেলেকে রেখে গোসলে চলে গেলাম। গোসল সেরে এসে দেখি ছেলে-মেয়ে দুটোই একে অপরকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মুচকি হেসে চুলের থেকে তোয়ালে খুলে আয়নার সামনে গিয়ে চুল মুছতে লাগলাম। তখনি গরম শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শ কোমরে পড়তেই শরীর শিউরে উঠল। শারফান তার বউয়ের কাঁধে মুখ এগিয়ে ঘন এক ঘ্রাণ নিলো চুলের থেকে। নেশালো কণ্ঠে বলে উঠে।

“জানেমান আজ রাতে আমার জন্য সাজবে?”

নিসংকোচ প্রেমের আবেদন পেয়ে কি আর তা হেলা করা যায়? লাজুক হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলাম। পরক্ষণে মায়া আর শাহেদ এর কথা মাথা আসতেই শারফানের দিকে ঘুরলাম। সেও কিছুটা ঘোর থেকে বেরিয়ে এলো। তবুও কোমর ছাড়ল না। চিন্তাময় গলায় বলে উঠলাম।

“কিন্তু শাহেদ আর মায়ার কি হবে? আব্বুর শরীর প্রায় অসুস্থ থাকে। উনার কাছে বাচ্চাদের সামলানোর জন্য দিতে ইতস্তত লাগে। শেরহাজ তো দেশের বাহিরে গিয়েছে এখন আসার কথা নয়। তাহলে আপনি যে আবদার করছেন।”

শারফান মৃদু হেসে আমার গাল ধরে বলেন,

“শেরহাজ আজই আসছে। তার সামনে ইয়ার ভেকশনের ছুটি। তাই আজকে বিকালের ফ্লাটেই চলে আসছে। কতদিন আর বাহিরের আউল ফাউল খাবার খাবে। এবার নাকি তার ভাবীর হাতের রান্না খেতে আসবে।”

শেরহাজ আসার খবরে খুশি হলাম খুব। এমনিতে বেচারা মেয়ের বাপ হয়ে মেয়েকে সময় দেয়, পড়াশুনাও করছে , জবও করছে। তার মত ছেলেরা প্রায় ধনীর আদরের রাজপুত্রের মত চলে। সেখানে শেরহাজ একেবারে শারফানের মত বুঝদার হয়ে গেলো। এই যেনো ঢের খুশির। আমি শারফানকে বাচ্চাদের দেখে রাখতে বলে রান্নাঘরে গেলাম। কেননা শেরহাজ আসবে তাহলে কিছুটা রান্নার আইটেম বাড়ানো উচিৎ। সেই ভেবে বিরিয়ানির জন্য মশলাপাতি বের করে কাজের বুয়াকে কাটাকুটি করতে বসিয়ে দিলাম। বিরিয়ানি, ভুনা চিংড়ি, রোস্ট আইটেম করলেই যথেষ্ট। কাজের বুয়া কাটাকুটি করতে থেকে মুখে পান এঁটে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,

“আপা মিমলি আপার কথা বহুত মনে পড়ে। আহা কত অভাগী ছিল মাইয়াটা। যহন এ বাড়িত আইল তহনো অপমান হইল। যহন ছোট সাহেবের লগে বিয়া হলো তহন ও অবহেলায় মরতো। যাও আপনি আইয়োনের পর সুখের দিন পাছিল। তাও কুয়ে দিলো বাচ্চার লাইগা। ছোট সাহেবের লাই বহুত মনে কাঁদে আপা। ছেলেটার যৌবনের দার শেষ হওয়ার আগেই মিমলি আপা মইরা গেলো। ছোট সাহেব কেনে নিজেরে সামলাই আর তো অবাক লাগে।”

কাজের বুয়া প্রায় বছরখানেক হচ্ছে এ বাড়িতে কাজ করেন। তাই তার কথাগুলো স্বাভাবিক বলা। কিন্তু মিমলির পরিণতির কথা ভাবলেই বুক কামড়ে উঠে। সেই দিনের কথাগুলো আজও চোখ ভাসে।

অতীত….

মিমলি কে না দেখে আমি শেরহাজকে খবর পাঠায়। সেও চিন্তিত হয়ে চারদিক খোঁজা শুরু করে। তখনি মিমলির মা কল দিয়ে কান্নার সুরে বলে, ‘বাবা শেরহাজ আমার মেয়ের কি হয়েছে? ও বাসায় এসেই আমায় বকেঝকে রুমবদ্ধ হলো। ও বাবা আমার মেয়েটারে বাঁচাও। একটা মাত্র নাড়িছেঁড়া ধন আমার।’
শেরহাজের ফোন লাউডে ছিলো। মিমলির মা অর্থাৎ আমার চাচী শ্বাশুড়ির কথায় চমকে গিয়েছি আমরা। তৎক্ষণাৎ বিয়ের আমেজ শেষ করে রওনা দিলাম চাচী শ্বাশুড়ির বাড়িতে। অন্যদিকে মিমলি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের সুন্দররুপ কে ঘৃণার সহিতে নানান কথা চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলছে। রুমের দরজার বাহির থেকে মিমলির মা মিসেস জাহানারা দরজায় হাত পিটিয়ে খুলতে বলছেন। মিমলির বাবাও পরিস্থিতি বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনিও চিন্তিত হয়ে স্ত্রীকে সরিয়ে দরজায় হাত পিটিয়ে খুলতে বলছেন। কিন্তু মিমলির কানে সেসব কথা যাচ্ছে না। সে তার রুমে থাকা ফলের ঝুড়ি থেকে ছুড়ি নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। নিজের হাতের উপর ছুড়িটা রেখে কান্নার সুরে নিজের মত বিড়বিড় করতে লাগে। তখনি শেরহাজের আওয়াজ শুনে সে থমকে গেলো। শেরহাজ দরজার বাহির থেকে জোরে জোরে দরজা পিটিয়ে খুলতে বলছে। তার নাম ধরে ডাকছে। মিমলির হাতে থাকা ছুড়িটা কাঁপছে। বুকের ভেতর কম্পন বেড়ে গিয়েছে তার। শেরহাজের পরিবার মাত্রই এসেছে। পরিস্থিতি কি হচ্ছে বুঝতে না পেরে শেরহাজও তাল মিলিয়ে দরজা পিটিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে মিমলির সাড়াশব্দ না পেয়ে তার মাঝে ভয় হানা দিলো। সে শারফান কে ইশারা করে কাছে ডাকে। দুভাই একত্রে ধাক্কা মারল দুবার। তৃতীয়বার আঘাত করতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরে নজর পড়তেই দেখে ছুড়ি মাটিতে পড়া কিন্তু রক্তের ছিটেফোঁটা নেই। মিমলি ছুড়ির পাশেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। শেরহাজ চমকে তৎক্ষণাৎ মিমলিকে খুলে নিয়ে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের হাসপাতালে নিয়ে এলো। সকলে ডক্টরের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি শেরহাজ কে কি বলে শান্ত্বনা দেবো বুঝছি না বিধেয় শারফানকে ইশারা করলাম। সেই গিয়ে শেরহাজকে জড়িয়ে ধরে চিন্তামুক্ত থাকতে বলে। ঘণ্টাখানেক পর ডক্টর এসে পেশেন্ট এর হাসবেন্ড এর কথা জিজ্ঞেস করেন। তার কথামত শেরহাজ এগিয়ে গেলো। তখনি ডক্টর সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ দেয়। মিমলির স্কিন ক্যানসার হয়েছে। শুনেই থম মেরে গেলো পুরো পরিবার। মিমলির মা মিসেস জাহানারা মাথা চেপে ধরে ধপ করে বসে গেলেন। মিমলির বাবা স্তদ্ধ । স্ত্রীর সাথে যতই মনোমালিন্য থাকুক না কেনো মেয়েকে নিয়ে তার মনে কখনো বিরুপ প্রভাব ছিল না। মেয়ে কালো বর্ণধারী হলেও তার চোখের অগোচরে মেয়ের খেয়াল রাখা, আবদার পূরণ করা কখনো মেয়েকে বুঝতে দিতেন না যে, তিনি মেয়েকে ভালোবাসেন। আজ মেয়েই কি তবে অভিমান করে এত বড় রোগ বাঁধালো। ওহ তারা তো পাপী! তাদের কারণেই তাদের শাস্তি তাদের মেয়ের উপর এসে পড়েছে। শেরহাজ কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করে।

“এএসব কি বলছেন আপনি ডক্টর? পেশেন্ট একেবারে নরমাল আছে বোধহয় আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। প্লিজ আরেকবার দেখুন না।”

ডক্টর রিপোর্ট দেখিয়ে দেয়। এমনকি এর চিকিৎসা সূত্র বলার পর বলেন,

“এর কেমোথেরাপিতে বাচ্চাকে বাঁচানো যাবে না। তাই যদি চিকিৎসা করাতে চান তবে বাচ্চা হারাতে হবে।‌ কিন্তু সেটা যদি প্রথমবার হতো তবে মানা যেতো। কিন্তু কেমোথেরাপির ফলে জরায়ুর মুখে ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে আপনার স্ত্রী মা হওয়ার ক্ষমতা হারাবেন। এখন যদি বাচ্চা চান তবে ধরে রাখুন মিসেস শেরহাজ এর আয়ুষ্কাল আনুমানিক দুবছর হতে পারে অথবা তারও কম। এটি সম্পূর্ণ আল্লাহর উপর নির্ভর করে। এতে বাচ্চা পাবেন ঠিক তবে স্ত্রী হারাতে হবে। দ্যাটস ইট।”

ডক্টরের কথায় শেরহাজ টলে পড়ল মাটিতে। শারফান আর শ্বশুর আব্বু মিলে নার্স সমেত শেরহাজকে কেবিনে শুয়ে দেয়। ডক্টর পালস চেক করে সবাইকে কিছুক্ষণের জন্য শেরহাজকে কেবিনে রেখে বের হতে বলেন। যাওয়ার আগ মুহূর্তে থামিয়ে বলেন,

“আপনার ভাই চাপ সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে। নার্থিং ডেঞ্জারাস।”

শারফান মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেলো। বাহিরে এসেই জ্বলন্ত চোখে মিসেস জাহানারার কাছে গিয়ে তার গলা টিপে ধরল। শারফানের রাগের বশে করা কাজটা দেখে হতভম্ব হয়ে দ্রুত তার হাত সরিয়ে নিলাম। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)মিসেস জাহানারা কান্নার সঙ্গে গলার ব্যাথায় কাঁদতে কাঁদতে সিটের উপর বসে পড়লেন। আমি শারফানকে চেপে ধরে রেখেছি। কিন্তু তার হিংস্রতা কমছে না। তাকে চেপে ধরে কান্নার সুরে বলে যাচ্ছি।

“প্লিজ প্লিজ নিজেকে সামলে নেন। এখন লড়াইয়ের সময় নয়। শেরহাজকে আপনার থেকে সামলাতে হবে।”

“আরে কি সামলাবো তুমিই বলো? শেরহাজের আগের অভ্যাসের কথা মনে আছে নিশ্চয়ই। ছেলেটা তার ভালোবাসা কে হারিয়ে পাগলপ্রায় হয়ে নেশায় মগ্ন হয়ে ছিল। সেই কারণটাও এই মহিলার জন্য। ডাইনি কোথাকার তোর নাকি সংসার আছে যে শুধু। ছিঃ তোর মুখে তো থুথু মারি। আপনি বলতেও ঘৃণ লাগে আপনাকে। মিমলির জীবনটা একেবারে নষ্ট করে দিয়েছেন আপনি। শুনছেন আপনি নষ্ট করেছেন।”

মিমলির বাবা সেই জায়গার থেকে উঠে ধীরপায়ে মেয়ের কেবিনের গ্লাস দিয়ে ভেতরে নজর দেন। মেয়েকে নিস্তেজ পড়ে থাকতে দেখে চোখের সামনে মেয়েটির বাচ্চাকালীন সময়ের দৃশ্য চোখে ভাসে। তিনি নিজ হাতে মেয়েকে খাওয়ে দিতেন,খেলতেন,আদর করতেন। কিন্তু যত মেয়ে বড় হতে লাগে তত তিনিও দূরত্ব টেনে পর করে দিলেন একেবারে। আজ তারও বুক ফাটছে মেয়ের করুণ কষ্টে। আচমকা তিনি বুকে হাত চেপে ঢলে পড়লেন। জয়নাল মিয়া তাকে ধরে জোরে জোরে শারফানকে ডাকেন। শারফান তৎক্ষণাৎ ডক্টর নিয়ে এলেও কাজ হলো না। তিনি আফসোসের গলায় বলেন,

“সরি মিস্টার শারফান। উনি হার্ট অ্যাটাক করেছেন। হয়ত মেয়ের সাথে হওয়া রোগের করুন দৃশ্য সহ্য করতে পারবেন না দেখেই তিনিও…।”

জয়নাল মিয়া মাথায় হাত চেপে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন। আমি নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে আছি। আজ পুরো পরিবার মাতমে পূর্ণ। কান্না আর কান্নার রোল চলছে। শারফান চুপটি করে চাচার শরীরকে দাফনের জন্য তৈরি করতে বলেন নার্সদের। কিন্তু মিসেস জাহানারা এসে থামিয়ে দিলেন। করুণ গলায় বলেন,

“স্বামী আমার মরেছে তার দাফনের কার্য আমাকে করতে দাও বাবা। আমার পাপের শাস্তি আমার পরিবার ভোগে ফেলেছে। হয়ত আমারও ভোগতে হবে তবে দেরিতে।”

মৃদু হেসে তিনি নার্সদের সাহায্যে লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। শারফান দেখে গেলো শুধু। থামালো ও না সাহায্য ও করল না। আমি এগিয়ে শারফানের কাঁধে হাত রাখলাম।

ঘণ্টাখানেক পর মিমলির জ্ঞান ফেরে। সে নিথর দৃষ্টিতে পুরো পরিবারের দিকে তাকায়। কেউ তাকে তার বাবার মৃত্যুর খবর এখন দিলো না। নাহলে হিতে বিপরীত হতে পারে। মিমলি উঠতে চাইলে শেরহাজ চোখ রাঙালো। আমি গিয়ে মিমলির পেটে হাত রেখে বললাম।

“এত বড় রোগ নিয়ে আমাদের জানালে না। আমরা কি এতটাও পর?”

মিমলি কেঁদে ফেলল। সে শেরহাজ এর হাত শক্ত করে চেপে ধরে বলে,

“ভাবী আমার স্বামীকে দেখে রাখিয়েন। আমার যাওয়ার পর সুন্দর এক মেয়ের সাথে তার সংসার পাতিয়ে দিয়েন ভাবী। আমি যে বড্ড অবেলায় তাকে ছেড়ে চলে যাবো।”

কথাটা সে শেরহাজের দিকে তাকিয়ে বলে। আমি শারফান আর শ্বশুর নিয়ে বেরিয়ে গেলাম। স্বামী স্ত্রী মধ্যকার কান্নার মাঝেও যেনো সুখ খুঁজে পায় সেই প্রত্যাশায়। শেরহাজ মিমলিকে বুকে নিয়ে বলে,

“এই মেয়ে তুই ভাবলিও কেমনে তোকে আমি ছেড়ে দেবো? হুম আমাকে ছেড়ে চলে যাবি তাই বলে আরেকজন কে তোর জায়গায় বসাবো। তোর জ্বলবে না?”

মিমলি শুনেই কুটিকুটি কেঁদে শেরহাজের বুক ভাসাতে থাকে। শেরহাজও মনকে মানিয়ে নিলো।
এভাবে বছর ঘুরতে লাগল। একবছর পর মিমলির বাচ্চা সুস্থ ভাবে হলেও মিমলি অসুস্থ থাকে প্রায়। তার শরীর আর কেমোথেরাপি নেওয়ার মত অবস্থায় নেই। বুকে দুধ খুব কম আসে তার। খাওয়া দাওয়া করলেও বেশিক্ষণ পেটে রাখতে পারে না। বমি করে দেয়। তার সদ্য জম্মানো শিশু। যার নাম মায়া রেখেছে শেরহাজ। তাকে নিয়ে খুব কষ্টে দিনযাপন করতে থাকে। নার্স রেখেছে মিমলির অসুস্থ শরীরকে পরিষ্কার রাখার জন্য। কেননা আমি আর শেরহাজ মিলে বাচ্চা সামলায়। মিমলির রুমে গিয়ে দেখি। মায়া মিমলির বুকের কাছে মুখ দিয়ে রেখেছে। মিমলির চোখ থেকে পানি পড়ছে। যা দেখে তৎক্ষণাৎ মিমলিকে টেনে বিছানায় শরীর হেলিয়ে বললাম।

“কি করছো তুমি মিমলি? মায়া কে এই অসুস্থ শরীরে খাওয়াছো কেনো? তোমার শরীর আরো দূর্বল হয়ে যাবে।”

মিমলি কান্নার মাঝেও তৃপ্তির গলায় বলে,

“ভাবী মারাই তো যাবো। যাওয়ার আগে অন্তত মেয়েটাকে শেষ কয়েকদিন বুকের দুধ খাওয়ে নেয়। আপনাকে একটা অনুরোধ করব ভাবী। আপনিও তো গর্ভবতী এখন। আমার মারা যাওয়ার পর আমার মেয়েটার দুধমাতা হবেন প্লিজ ভাবী। মেয়েটাকে শেরহাজ যতই পাউডার দুধ খাওয়াক না কেন! সেগুলোতে মায়ের মমতা থাকে না। একপ্রকার কেমিক্যাল সেগুলো। আপনি আমার অনুরোধটা রাখিয়েন ভাবী প্লিজ। কবে মরে যায় ঠিক নেই। ডক্টরে তো দুবছর বলেছিল অথবা যখন আল্লাহ চাই চলে যেতেই হবে। এখন আর শরীর মানতে চাইনা ভাবী। কখন না কখন শরীর নেতিয়ে পড়ে আল্লাহ জানেন।”

মিমলির কথায় নিজেও উদাসী হয়ে পড়লাম। পেটে হাত রেখে মায়ার সদ্য এগারো মাসের কন্যার দিকে তাকিয়ে আছি। মায়া মায়ের বুকের দুধ কতটা তৃপ্তি সহকারে গ্রহণ করছে। আমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম।

“তুমি একেবারে চিন্তা করো না। মায়া আমারো মেয়ে ও আমার বড় সন্তান।”

“ভাবী মায়ার জন্ম তো দেখে ফেলেছি। তার বাড়ন্ত সময় হয়ত আমার আর দেখা হবে না। ওর একটা সুন্দর জীবন গড়িয়েন। তার রুপ নিয়ে কখনো তিরস্কার করিয়েন না। আমার মেয়েটা শ্যামী কিন্তু কালো নয়। শেরহাজের মাথার তাজরাণী মায়া।”

“এই মেয়ে তুমি আবারো আগের কথা শুরু করেছো। তোমার মায়ের কথা মনে পড়ছে?”

মিমলির চোখজোড়া ভিজল পুনরায়। জানি তার মন খারাপ হয় মায়ের জন্য। তার মা যাবত কয়েকদিন বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। তিনিও মৃত্যুর দিন গুণছেন। চাচী শ্বাশুড়ির চিকিৎসার পূর্ণ দায়িত্ব পালন করে চলেছে শেরহাজ। মিমলিকে মাঝেমধ্যে শেরহাজ মায়ের সাথে দেখা করিয়ে আনে। এতে মা-মেয়ের মধ্যকার মনোমালিন্যের সমাপ্তি হয়ে যায়। মায়াকে খাওয়ে বিছানায় শুয়ে দিলো। কি সুন্দর ঘুমিয়ে গেলো মেয়েটা। আমি মিমলির পাশেই বসা রইলাম।

তিনবছর পর….

মায়া ধীরে সুস্থে কথা বুঝতে শিখেছে। বড় মা বলতেই সে পাগল। তবে খুব কম কথা বলে। শেরহাজের সাথে থাকলে একে বারে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসে। মায়ার মা মিমলি আচমকা শেরহাজের পাশে বসারত অবস্থায় মেয়েকে বুকের দুধ খাওয়ানোর মাঝে শরীর কেঁপে ঢলে পড়ে। তখনি কান্নার রোল ছেয়ে যায় পুরো‌ বাড়িতে। মিমলি সেসময় মারা গেলেও মায়া চোখ পিটপিট করে খালি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি গিয়ে তাকে বুকে নিয়ে ঘুম পাড়ায়। তারপর থেকে খাওয়ার সময় আমিই তাকে খাওয়ে দেয়। আমার দুবছরের পুত্রসন্তান শাহেদ ততটা কান্না করে না। খাওয়ার সময়ই কাঁদে। তখন আমি খাওয়ে দিলি সে ঘুমিয়ে যায়। মায়া তো ছোট বাবু পেয়ে খুশিতে প্রাণভরা হাসে খেলে থাকে।

বর্তমান….
হঠাৎ কারো ডাকে চমকে অতীত থেকে ফিরলাম। তেল পাতিলে লেগে ছাইছাই হয়ে গেলো। কাজের বুয়া আমাকে সরিয়ে পাতিলটি বেসিনে রেখে নতুন পাতিল বসায়। আমার দিকে তাকিয়ে বলে,

“আপা আপনি ভাবনায় এতো ডুব্বা গেলেন। যে গন্ধ অব্দি পেলেন না। আজ অঘটন ঘটে যাইতো।”

“ক্ষমা করবে আন্টি। আপাতত আপনিই কাজগুলো করে রাখুন। আমি একটু মায়ার কাছে যায়।”

“হই আপা যান সমস্যা নাই।”

মায়া আর শাহেদকে নিয়ে সোফার রুমে বসে আছি। মায়া শাহেদের দোলনার পাশে ছুটাছুটি করে হাঁটছে। কাজের বুয়া রান্না শেষ করে চলে গেলো। আমি অপেক্ষা করছি শারফানদের জন্য। তিনি আর শ্বশুর মিলে শেরহাজকে রিসিভ করতে এয়ারপোর্ট গিয়েছেন। মায়ার কাছে শাহেদকে রেখে চটজলদি শরবত বানিয়ে রাখলাম।
একঘণ্টা পর বাড়ির বেল বেজে উঠে। আমার আগেই মায়া গিয়ে দরজা খোলার চেষ্টা করে। কিন্তু ছোট হাত হ্যান্ডেল পর্যন্ত পৌঁছে না দেখে আমিই তাকে কোলে নিয়ে হ্যান্ডেল চেপে দরজা খুলে দিলাম। শেরহাজ কে দেখে মেয়েটা ‘বাবাবাবা’ বলে কোলে উঠার জন্য পাগলাটে ভাব ধরল। মেয়েকে অনেক দিন পর দেখে শেরহাজের চোখে জল চলে আসল। সেও মেয়েকে কোলে উঠিয়ে হেঁটে সোফার রুমে এসে বসে পড়ে। বাপ-মেয়ে নানান কথায় মশগুল হলো। আমি তার মাঝে খাবার পরিবেশন করতে গেলাম। শাহেদকে দেখে শেরহাজ খুলে নিয়ে চুমু খেয়ে ভাইয়ের হাতে দিয়ে দেয় ফ্রেশ হবার জন্য। মায়াও আজ বাবার সাথে খেতে বসবে বলে টেবিলের কাছে এসে বসে গেলো। তার জন্য টেবিলে তেমন কোনো খাবার রাখা নেয়। তবে আমি বুদ্ধি করে খিচুড়ি ব্লেন্ড করে ফিডারে ভরে রেখেছি। শেরহাজ সেটাই খাওয়ে দেবে মায়াকে। হঠাৎ আমাকে টেনে দেওয়ালে চেপে ধরল শারফান। তার কান্ডে ভয় পেলেও পরক্ষণে স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। সে প্রতিবার আমার সাথে এমনটা করে। আমার চুলের কানের পেছনে গুঁজে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আলমারির ড্রয়ারে যে স্লিভলেজ ব্লাউজের সাথে শাড়ি দেখবে সেটাই পড়িও আজ রাতে।”

আমি চুপটি করে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে চলে আসলাম। নাহলে লোকটার অসভ্যতামি থেকে রেহাই পাবো না।

রাত বারোটা
শেরহাজ মায়াকে কোলে নিয়ে বেলকনিতে বসে আকাশের দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আছে। মিমলি তাকে ছেড়ে গেলেও সে তো নিজেকে সামলে নিয়েছিল। কিন্তু তবুও তার ভাগ কাউকে দেয়নি। মেয়েকে নিয়েই তার যতস্বপ্ন। শেরহাজকে তার মেয়ের সাথে বেলকনিতে দেখে রুমের দরজা আলগা করে চলে এলাম রুমে। ঘুমন্ত শাহেদের কপালে চুমু এঁকে ছাত্রদের খাতা কাটা অবস্থায় শারফানের দিকে নজর দিলাম। ইচ্ছে করছে লোকটার কাজে বাঁধা দিতে। ইতস্তত বোধ না করে তার কাছে গিয়ে খাতা বন্ধ করে তার কোলে বসে গেলাম। তার বুকে মাথা রেখে বললাম।

“আমি খু*নি জেনেও কেনো আপনি প্রতিবাদ করলেন না?”

“সেটা তোমার অতীত ছিলো। এখন তুমিই বর্তমান তুমিই ভবিষ্যৎ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শাহেদ পরবর্তীতে আরো আসলে আসবে।”

লাজুক হেসে তার বুকে মৃদু চাপড় মেরে মুখ গুঁজে রইলাম। বিড়বিড় করে বললাম।

“আমার এক ফালি রোদ্দুরের বিনিময়ে আপনার কাছে আমি সমর্পণ করলাম নিজেকে।”

শারফান কথাটির ধারে আমায় কোলে উঠিয়ে বিছানায় শুয়ে তার বুকে রেখে বলে,

“আপনার আগমনে আমি স্বার্থক বাবা। আপনার কাছ থেকে #এক_মুঠো_সুখপ্রণয় পেয়ে আমি সুখের রাজ্যে রাজত্ব করি গো।”

মুচকি হেসে চোখ বুজে নিলাম দু’জনে। এভাবেই হয়ত এক মুঠো সুখপ্রণয় তাদের মাঝে চলতে থাকবে।

সমাপ্ত

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-১৭

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৭

চোখমুখে পানি ছিটানোর মাঝে ধরফড়িয়ে জেগে উঠলাম। চোখের সামনে শারফান কে সুস্থ রুপে দেখে চট করে জড়িয়ে ধরলাম। তার চেহারা পরখ করে কাঁপা গলায় বললাম।

“আআপনি ঠিক আছেন? আপনার লাগেনি তো? ঐ ঐ ট্রাক আপনাকে…।”

“এই জান হুশশশ আর কথা বলো না নিজেকে সামলে নাও। আমি একেবারে সুস্থ শরীরে তোমার পাশে বসে আছি গো। যেখানে বউ নিজেই আমার শেরওয়ানি ধরে টান মেরে নিচে পড়ে গেলো। সেখানে আমি কেমনে ট্রাকের নিচে চাপা প…।”

শারফানের মুখ চেপে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলাম। তখনকার দৃশ্য মাথায় আসতেই কোলে থাকা বাচ্চাটির কথা ধ্যানে আসল। শারফানের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে ঠোঁট নেড়ে নম্র গলায় প্রশ্ন করলাম।

“ঐ বাচ্চাটা?”

“তাকে তার বাবা এসে নিয়ে গেছে। সেই সাথে তার মাকে উচিৎ শিক্ষাও দেওয়া হয়েছে। বাচ্চাটির মা নিজের রুপের ফটোশুট এ ব্যস্ত ছিল। যখন তার স্বামী কল দিয়ে বাচ্চার কথা জিজ্ঞেস করে। তখনি মহিলাটি আশপাশ খোঁজা শুরু করে। তোমাকে দেখে তো বাচ্চাচোর ভেবেছিল। পরক্ষণে আমি তাকে কড়া জবাবে কিছু কথা শুনিয়ে তার আইফোন কেড়ে নিয়ে স্বামী কে কল করে তার আইফোনই আছাড় মে*রে ভেঙ্গে দিলাম। কি দরকার ঐসব যন্ত্রের যেগুলো সামান্য এক বাচ্চাকে দেখে রাখতে দেয় না। তার স্বামী এসে স্ত্রীকে চড় মেরে আমার কাছ থেকে বাচ্চা নিয়ে শোকরিয়া আদায় করে চলে যায়। তারপর আমার অজ্ঞান বউরে নিয়ে চলে এলাম রিসোর্ট এ। উফ কি শোকনাকাঠি তুমি। মনে হয় বছরখানেক হবে তোমার শরীরে দানাপানি পড়েনি। এই মেয়ে তুমি কিছু খাও না নাকি? চিন্তা করবে না আজকের পর থেকে সব দায়িত্ব আমার। দেখবে আজ রাতের পর তিনমাস গেলেই তুমি বমি করা শুরু করবে।”

বলেই চোখ মারল শারফান। আমি চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আছি। তার কথা বোধ্যগম্য হতেই চারপাশ খেয়াল করলাম। রুমের ভেতর আমার শ্বশুর,দেবর দেবরের বউ আর শাহানা দাঁড়িয়ে মিটমিটে হাসছে। লজ্জায় মাথা নামিয়ে ঘোমটা দিয়ে দিলাম মাথায়। ইশ্ লোকটাও না নিজের লাজ লজ্জা খেয়ে ধেয়ে বসে আছে। চোখ রাঙানি দিয়ে সবাইকে সামলাতে ইঙ্গিত দিলাম। শাহানা না পারতে হাহা করে হেসে ফেলল। লজ্জায় আষ্টেপৃষ্ঠে গেলাম। তখনি লাঠির ঠকঠক আওয়াজে দরজার দিকে তাকালাম। স্বয়ং নানুকে সামনে দেখে চোখজোড়া কান্নাময় করে জড়িয়ে ধরলাম। তিনিও হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলেন।

“আরে নাতনী আমার আজ খুশির দিনে তুমি এভাবে কুটকুট করে কাঁদলে তো লোকে পাগল বউ আসছে বলবে। আসো আসো বরের পাশে সুন্দর করে বসে যাও।”

মৃদু হেসে নানুর হাত ধরে বসে পড়লাম। শারফান সকলের অগোচরে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলে,

“এবার তো ক্ষমা পেয়েছি জনাবা তাই না?”

শুনে লজ্জা পেলেও ঠোঁট কামড়ে মৃদু গলায় বললাম।

“উহুম যতক্ষণ না কবুল বলে গ্রহণ করছেন ততক্ষণ ক্ষমা শব্দকে আমি ধরছি না।”

শারফান বুকের মাঝে হাত রেখে সাইরির নজরে তাকিয়ে বলে,

“ইস্ক আমার তোমার নামে করে দিলাম,
কবুল বলতে কতক্ষণ আর?”

ফিক করে হেসে ফেললাম। লোকটাকে গাড়িতে কত জিজ্ঞেস করলাম জবাব না পেয়ে ভাবলাম সত্যিতে বোধ হয় তিনি বিয়ের পীড়িতে বসবেন।‌ তবে ধারণা আমার সত্যি হলো সে আমায় পুনরায় বিয়ে করছে। তবে এক কথা মনে পড়তেই তেজি চোখে তাকিয়ে বললাম।

“এই তাহলে আপনি আর আপনার পরিবার এই একসপ্তাহ ঢং মেরে কথা বলেননি শুধু আমায় চেতিয়ে রাখার জন্য? জানেন কত কষ্ট পেয়েছি সবাই যখন আমায় ইগনোর করছিল মনে হচ্ছিল সেখানে আমি মরে যাচ্ছি।”

“এই চুপ মরার কথা আসছে কেনো হুম? আমরা জাস্ট তোমাকে এই বড় সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য ছোটখাটো নাটক রচনা করছিলাম ব্যস।”

শারফান এর দিকে ঝুঁকে চোখ রাঙিয়ে বললাম।

“এর মাশুল না বাসরে পাবেন। ভেবে ছিলাম ক্ষমা করে দেবো। তবে এই দোষের বোঝা দ্বিগুণ বেড়েছে আপনার। ক্ষমা শব্দটা আজ কপাল থেকে দূরেই রেখে দেন। পাচ্ছেন না কোনো ক্ষমা আর হবেও না কোনো বাসর রাত্রি অথবা মধুর রাত্রি।”

শারফান ব্যবলাকান্তের মত তাকিয়ে আচমকা ঠোঁট কামড়ে কান্নার সুরে বুক চেপে ধরল। তাজ্জব বনে গেলাম। শেরহাজ ভাইয়ের অবস্থা দেখে রীতিমত ঘাবড়ে বলে,

“কি হলো ভাই বাসরের আগেই মরেটরে যাচ্ছো নাকি?”

জয়নাল মিয়া শেরহাজের পিঠে চাপড় মেরে তাকে সরিয়ে নিজে শারফানকে ধরে বলেন,

“হ্যারে বাপ কি হয়ছে বল? কাঁদছিস কেন আজকে তো তোর জন্য বড় দিন। তবুও কেন মেয়েদের মত কেঁদেকেটে নাক লাল করছিস?”

“আব্বু তুমিও শুরু করলে শেরহাজের মত ফাজলামি। এখানে আমার কপাল ফুটো হয়ে যাচ্ছে। আমাকে নাকি ক্ষমা করবে না এই ডাইনি মেয়ে।”

সকলের নজর হামলে পড়ে আমার উপর। অস্বস্তিতে মাথা নেড়ে না ইঙ্গিত করলাম। শারফান তবুও নাক মুছতে থেকে বলে,

“দেখছো আব্বু তুমি তাকিয়েছো বলে না বলছে। অথচ এতক্ষণ আমাকে ক্ষমা না করার বড় বড় বাণী শুনিয়ে হার্ট অ্যাটাক দিতে যাচ্ছিল মেয়েটা। ওওওও আম্মু শুনছো তোমার বউমার কথা।”

ন্যাকামি মার্কা কথা বলে শারফান অবলা মহিলাদের মত বুক চাপড়াতে লাগল। যা দেখে আমার অস্বস্তির চেয়েও রাগ লাগছে। সকলের দৃষ্টিজোড়া থেকে বাঁচতে স্বামীর হাত ধরে টান দিলাম। শারফান টানের ধারে আমার পাশে ঘেঁষে বসে। তার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম।

“থেমে যান না হয় বাসররাতে আপনার জন্য বড় মুসিবত অপেক্ষা করছে বলে দিলাম।”

শারফান পুনরায় কান্নার ভান ধরতে লাগলে না পারতে তার হাত চেপে ধরে করুণ গলায় বললাম।

“এই প্লিজ চুপ চুপ করেন আল্লাহর ওয়াস্তে। আমি ক্ষমা করে দিচ্ছি আপনাকে। আমাদের মাঝে সব হবে ওকে একেবারে সব ফাইন নাউ?”

কথাগুলো শুনেই শারফান প্রাণখোলা হেসে আমায় জড়িয়ে ধরল। সকলের সামনে স্বামীর আলিঙ্গনে লজ্জায় তাকে মৃদু ধাক্কা দিলাম। সে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“পরিশেষে আমার বউ পটানোর মিশন সাকসেসফুল আলহামদুলিল্লাহ। এবার ভালোই ভালোই বিয়েটা সারলে বাঁচি।”

জয়নাল মিয়া চমৎকার হেসে কাজীকে সামনে ডাকলেন। তিনিও কাবিননামা এনে আমাদের সামনে রেখে রাখলেন। আমি তাকিয়ে আছি নতুন কাবিননামার দিকে। এইতো মনে পড়ছে সেদিনের কথা আচমকা এক ঝড়ো হাওয়া এসে শারফান নামক মানুষটার সঙ্গে আমার জীবন জুড়ে গিয়ে ছিল। তবে তখন না ছিল আপন করে পাওয়ার সুখ , না ছিল আকাঙ্ক্ষা একে অপরের হাত ধরে বাঁচার। আজ শারফান আমার হাত ধরে বসে আছে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছে না। তার চোখমুখে হারিয়ে পাওয়ার মত খুশির ঝলক তীব্র হতে তীব্র ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। শারফান খেয়াল করল তার বউয়ের দিকে। কাবিননামায় তাকিয়ে থাকার বিষয়টা বুঝতে হাতজোড়া স্নেহের মায়ায় চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আজ থেকে আপনাকে হৃদয়ের রাজ্যের রাণী করে নিলাম বেগম সাহেবা।”

ঘোমটার ভেতর চোখজোড়া থেকে টপ করে একফুটো পানি ঝরল। যা শারফানের হাতেই পড়ল। সে দেখে সন্তপর্ণে সকলের চোখের অগোচরে চুষে নেয়। আমার হাতটা ধরে কাজীকে বলেন,

“আঙ্কেল বিয়ে পড়ানো শুরু করুন।”

সকল নিয়মনীতি মেনে আমাদের দ্বিতীয় পূর্ণ বিবাহ সম্পন্ন হলো। তার হাতে আমার হাত বন্দী। ছাড়ার নামমাত্র নেই। মিমলি খুশিতে সকলকে মিষ্টি মুখ করাচ্ছে। এর মাঝে হঠাৎ তার মাথা ঘুরতে লাগে। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলো। নিজের শরীরের অবস্থা সম্পর্কে সে অবগত। তবুও এমন ঘনঘন মাথা ঘূর্ণন, কোমরে ব্যথা কিসের ইঙ্গিত হতে পারে? মিমলি আপাতত খুশির মহলে ব্যাপারটা ঘাঁটল না। শেরহাজ ভাইয়ের খুশিতে দু’পাউন্ড এর বড় কেক অর্ডার করেছে শেরহাজ। টাকা সে নিজ হাতে জমানো টাকা থেকে খরচ করেছে।‌ শারফান অবাক হয়ে বলে,

“তোর টাকা তোর বিপদের সময়ে লাগবে। ধর এগুলো রাখ।”

শারফান তার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিলো শেরহাজের হাতে। শেরহাজ অস্বীকৃতি দিলেও বড় ভাইয়ের জেদের কাছে হার মেনে গ্রহণ করে নিলো। আমি আর শারফান কেক কেটে বাটির মধ্যে সবার জন্য পরিবেশন করছি। মিমলিও এসে হাতে হাত লাগিয়ে পরিবেশন করছে। যা বেঁচে যাবে তার থেকে অর্ধেক ফ্রিজে রেখে বাকি অর্ধেক কাজের লোক, ড্রাইভারদের দিয়ে বাকিটা মসজিদের ইমান আর মসজিদের বাহিরে বসা ফকিরদের দেওয়ার কথা ভেবে রেখেছে শেরহাজ। মিমলি নিজের কেকের বাটি নিয়ে সোফায় বসে হালকা মুখে নিলো। আচমকা তার বমির উদ্রেক পেয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ সকলের অগোচরে ওয়াশরুমে চলে যায়। বেসিনের কাছে আসতেই গলগলিয়ে র*ক্তা*ক্ত বমি হলো তার। বেসিনের মধ্যে বমির সাথে রক্ত দেখে চমকে গেলো। পানির ট্যাপ ছেড়ে দিলো। র*ক্ত ধুয়ে গেলেও তার মনের সন্দেহ কমলো না। নিজের পেটে হাত রেখে ঠোঁট কামড়ে ভাবল।

“সবাই এখন বিয়ের আমেজে ব্যস্ত। এটাই সুবর্ণ সুযোগ। হাসপাতালে চলে যায় কেউ জানতেও পারবে না।”

মিমলি তার ভাবনাময় কাজ করল। শেরহাজকে শুধু জানালো সে ওয়াশরুমে যাচ্ছে। সে আসতে চাইলেও মিমলি বারণ করে বিয়েতে থাকতে বলল। গাড়ি ভাড়া করে হাসপাতালের উদ্দেশ্য রওনা দিলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)একঘণ্টার মধ্যে হাসপাতাল পৌঁছে যায়। এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে সিরিয়ালে বসে গেলো। ঠিক তিন লোকের পর তার সিরিয়াল আসল। নিজেকে শান্ত্বনা দিতে থেকে কেবিনে ঢুকে পড়ে। ডক্টর তার চেকাপের জন্য বেডে শুয়ে যেতে বলেন।
সব চেকাপ করার পর ডক্টর রিপোর্ট এর জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। তিনি কিছুটা সন্দেহের বশেই বলে উঠলেন।

“আপনার পুরো চামড়ার প্লাস্টিক সার্জারি হয়েছে?”

মিমলি উদাসীন মুখখানা নিয়ে মাথা নাড়ল। ডক্টর কপাল চুলকে ইতস্তত গলায় বললেন।

“আপনার বেবি পেটে এসেছে কখন?”

“এক/দেড় মাস চলছে।”

“আপনি সিউর আপনি প্রেগন্যান্ট?”

ডক্টরের কথায় বুক কেঁপে উঠল মিমলির। চোখজোড়া বিস্ফোরিত হয়ে যায় তার। ডক্টরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলে বলে,

“জজজ্বি আমি জানি আমি প্রেগন্যান্ট কিন্তু আপনি এমন প্রশ্ন কেনো করছেন? প্লিজ আমার বাচ্চা ঠিকাছে তো?”

ডক্টর নিজেও দোটানায় ভোগছেন। রোগীকে কান্না করানোর কোনো ইচ্ছেই তার নেই। তবুও তিনি ডক্টর রোগীর শরীরের অবস্থার উপর ভিত্তিতে সংবাদ দুঃখ হলেও বলতে হবে সুখময় হলেও জানাতে হবে। তিনি তপ্ত শ্বাস ফেলে বললেন।

“নো নো মিসেস শেরহাজ মারুফ। আমার প্রশ্নের সেই অর্থ ছিল না। বাচ্চা নরমাল আছে। আমি কিছুটা দোটানায় পড়ে প্রশ্নটি করেছি। বাকিটা রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে।”

রিপোর্ট আসলো দুঘণ্টা পর। তার মাঝে শেরহাজ কতবার যে কল করেছে তার ঠিক নেই। চিন্তায় মিমলি বেডে মাথা রেখে নির্লিপ্ত হয়ে শুয়ে আছে। ডক্টর রিপোর্ট চেক করেই ধপ করে চেয়ারে বসে গেলেন। ডক্টরের ভাবভঙ্গি তার মনে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি করছে। সে ধীরপায়ে চেয়ার টেনে বসে বলে,

“ডডডক্টর রিপোর্ট কি বলছে? আমার বাচ্চা ঠিকাছে তো? আমার কিছু হয়নি তাই না?”

ডক্টর চোখের চশমা খুলে চোখ চুলকে ঢোক গিলে বললেন।

“দেখেন মিসেস শেরহাজ মারুফ। আপনাকে শক্ত হতে হবে। আপনার এ কথা আমি আপনাকে নয় বরং আপনার স্বামী কে জানাতে চাই। প্লিজ তাকে কল দিন।”

“না না ডক্টর আজ তিনি খুশির মহলে আছেন। তাকে কল দিয়ে চিন্তায় ফেলতে চাইনা প্লিজ বলুন না কি হয়েছে আমার?”

“আসলে মিসেস শেরহাজ মারুফ আপনার স্কিন ক্যানসার হয়েছে। আপনার যে রুপের রং পূর্বে ছিল সেটা হঠাৎ চেঞ্জ করে মাত্রাতিরিক্ত রং ধারা আপনার চেহারা আর চামড়ায় অধিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। যার কারণে আপনার শরীর সেই মাত্রার পিএইচ সহ্য করতে পারেনি। স্বাভাবিক চামড়ার চেয়েও ভারী কেমিক্যাল এই নতুন রুপ আপনার। এতে আপনার অজান্তেই আপনার শরীরে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল। আপনি হয়ত খেয়াল করেছেন তবে পাত্তা দেননি হতে পারে। আপনার শরীরের কিছু কিছু অংশে অবশ্যই লাল বর্ণের ডট অথবা মেজতার চাপ পড়েছে নিশ্চয়?”

ডক্টরের কথায় মিমলি ভাবনায় পড়ে গেল। হ্যাঁ সে দেখেছিল গোসলের সময় তার কোমর, বগলের নিচে, বুকের মাঝে এমন চাপ বসেছে। মিমলি তৎক্ষণাৎ মাথা নাড়ল। ডক্টর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন।

“এইতো কারণে আপনার ইনফেকশন স্বাভাবিক থেকে দিনের পর দিন শরীরে গেঁথে থাকায় ক্যানসারে রুপ নিয়েছে। বড়জোর আপনার শরীর একবছর বা দুবছর সহ্য করতে পারবে। তারপর হয়ত!”

ডক্টরের কথা আটকে গেলো। মিমলি কাঁপা গলায় প্রশ্ন করে।

“তারপর কি ডক্টর সব সত্যি জানিয়ে দিন প্লিজ!”

“হয়ত আপনার শরীর সহ্য না করতে পেরে আপনার মৃত্যু অব্দি হতে পারে। এখন এর উত্তম চিকিৎসা কানাডায় আছে। আপনি চাইলে করাতে পারেন। তবে একটা শর্ত আছে এতে। আপনি নিজেকে সুস্থ করে পূর্বের রুপ ধারণ করতে চাইলে বেবি ক্যারি করতে পারবেন না। কারণ কেমিক্যাল দূর করতে কেমোথেরাপি ইউজ করা হবে। এতে আপনার সদ্য জন্মানো ভ্রুণর মৃত্যু হতে পারে। আপনার শরীরের অবস্থা দেখে বলা হচ্ছে আপনি চিকিৎসা করতে চাইলে এ বছরের মধ্যে করিয়ে নিতে হবে। তবেই আপনি জীবিত থাকবেন। নাহলে আপনার বাঁচা মুশকিল। আপনার বেবি ক্যারি করতেই নয়মাস অপেক্ষা করা লাগবে। এবার আপনিই জানেন আপনি কি করবেন? বেবি নাকি রুপ! বেবি চাইলে আপনার শরীর অন্তত দুবছর তার চেয়ে বেশি আছে কিনা তা এক আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। পরিশেষে আরেকটি কথা আপনার ক্যানসার অথবা ইনফেকশন জেনিটিক্যালি আপনার বেবির উপর প্রভাব করবে কিনা এখনো বলতে পারছি না। আপনি প্লিজ সামনের সপ্তাহে আবার আসবেন। বেবি অর্থাৎ ভ্রুণর কন্ডিশন চেকাপ করে বিষয়টি নির্ধারণ করতে হবে।”

মিমলি হতবাক। ডক্টরের সাথে কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। বাহিরে গিয়ে সিটের মধ্যে বসে পড়ে। না পারতে সে কেঁদে ফেলল। মুখ টিপে কাঁদতে লাগল। তার শেরহাজ তার পরিবার তার আগমনী বাচ্চা কে ছাড়া সে চলে যাবে! কেমনে থাকবে তিন হাত পরিমাণ মাটির নিচে! মিমলি গাড়ি ভাড়া তার মায়ের বাড়িতে যেতে উদ্যত হলো। আজ তার মাকে এর কঠিনতম কথা শুনাবে সে। তার মায়ের বদ পরিকল্পনায় তার জীবন মৃত্যুর পথ অব্দি গিয়ে ঠেকেছে।

চলবে……

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-১৫+১৬

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৫

শারফানকে নিজের ওষ্ঠদ্বয়ের কাছাকাছি দেখে আবেগে চোখজোড়া বন্ধ হয়ে গেলো। হারিয়ে যেতে ইচ্ছুক হলো দুজনার হৃদয়ে। শারফান কিছুটা ঝুঁকল। বউকে মোহনীয় রুপে বসে থাকতে দেখে সে নিজের অনুভূতি দমিয়ে রাখতে পারছিল না। তাইত এই অসাধ্য অবাধ্য কাজ সে আজ হাসিল করেই ছাড়বে বলে পণ করে ফেলেছে। শারফানের কাছ থেকে কোনো রুপ সাড়া না পেয়ে চোখজোড়া ফট করে খুলতেই ওষ্ঠদ্বয় আবদ্ধ হয়ে গেলো। চমকে গেলো হৃদয়ের অনুভূতি। এই কাছে আসা এ প্রথম শারফানের কাছ থেকে প্রথম স্ত্রী সোহাগের প্রতি অনুভূতির সঞ্চার জোরালো হচ্ছে। হাতজোড়া লোকটার চুলে এগিয়ে দিলাম। শারফান ঝুঁকে আমার কোমর পেঁচিয়ে কোলে উঠিয়ে নিলো। আমি চুপটি করে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস ছাড়ছি। বালিশের উপর মাথা শুইয়ে দিয়ে তিনি আমার মুখের উপর ঝুঁকলেন। তার সান্নিধ্যে পাগলাটে অনুভূতি জাগ্রত হতে গিয়েই থেমে গেলো শারফানের ফোনকলে। সে বিরক্ত হয়ে ফোন ঘেঁটে দেখল প্রিন্সিপাল স্যার এ কল দিচ্ছেন। মুখটা বাংলা পেঁচার মত করে বউয়ের উপর থেকে সরে ফোন লাউডে দিলো। প্রিন্সিপাল স্যার শারফানকে জরুরি ভিত্তিতে পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক বিষয়ের দাবিতে মিটিং রেখেছেন বললেন। শারফানকে জানিয়ে দিলেন সকাল আটটায় মিটিং উপস্থিত হতে। সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে এটাই বাধ্যতামূলক। শারফান বাধ্যতার সাথে দাঁতে দাঁত চেপে ‘জ্বি স্যার’ বলে কল কেটে দিলো। মনেমনে শখানেক গা*লি ছুঁড়ল এই প্রিন্সিপালের উপর। তার রোমান্সের মাঝে বাঁধা দেয় কেন সবাই বুঝে না সে। বিড়বিড় করে বলে,

“বউটা এমনিতে ধানিলঙ্কা। তার উপর এই প্রিন্সিপালের বাচ্চা রাতবিরেতে কল দিয়ে রোমান্সের মাঝে বাঁধা দিয়ে দিলো। বউটাকে কত কষ্টে রোমান্সের মাঝে ডুবিয়ে ছিলাম। এখন তো সেই অনুভূতি কি আর থাকবে? দূর মুডটাই নষ্ট করে দিলো। তাও একচান্স মেরে দেখি।”

শারফান বিছানার দিকে তাকাল। আমি চুপচাপ উঠে বসে চুল খোঁপা করছি। সে দেখে দুঃখের মত মুখ করে আমার হাত ধরে বিছানার উপর বসে বলে,

“ওও বউ সরি আসো আবারো আমরা রোমান্সে মন দেয়। আমি কি করছিলাম? হে চুমু দিচ্ছিলাম। এই নাও উমমমম।”

শারফানকে পাগলাটের মত চুমু দিতে কাছে আসতে দেখেই ‘ইয়ু’ করে উঠে পড়লাম। সে অবাক হয়ে বলে,

“কি হলো ইয়ু বললে কেন? আর বিছানা থেকে নামলা কেনো? এই প্লিজ যেয়ো না আসো না কাছে আসো।”

“ছিঃ ছিঃ অসভ্য পুরুষ। ব্রাশ করেন নাই একটু আগে কি চুমু খেলেন। ইয়াক যান ব্রাশ করে আসুন। আমার কাজ আসে আপনার সাথে এখনো আমার বিয়ে হয়নি। পুনরায় বিয়ে হওয়ার পরই চুম্মা*চাটি করতে পারবেন। তার আগে নো নেভার।”

বলেই তড়িঘড়ি বিছানার থেকে নেমে দরজার দিকে ছুটে গেলাম। শারফান পেছন থেকে ‘এ না না’ করেই বিছানায় মুখ থুবড়ে পড়ল। বালিশে মুখ চেপে রাগে রি রি করে কয়েকটা চাপড় মেরে বাচ্চাদের মত বালিশ কামড়ে ‘উফ আল্লাহ’ বলে বিছানার থেকে উঠে পড়ল। সুন্দর করে বিছানা গুছিয়ে আলমারি খুলে পরণের জন্য জামা বের করে রুমেই জামা পরে ফেলল।
রাতে সবাই খেয়ে ধেয়ে যার যার রুমে চলে গেলো। শারফানকে বালিশ জড়িয়ে ধরে ঠোঁট গোল করে ঘুমাতে দেখে আনমনে হাসলাম। আজকে লোকটার কাণ্ড মনে পড়তেই প্রাণখোলা হাসি পেয়ে ছিল। মিটমিটে হেসে ধীরপায়ে বিছানায় গিয়ে বসলাম। শারফানের চুলে বিলি কেটে দিয়ে ভাবছি।

“আপনি আমার। শুধুই আমার নিরামিষ ভীতু বর।”

আবেগ ভরা স্নেহের চুমু দিলাম শারফানের কপালে। ভালোই ধকল গিয়েছে লোকটার উপরে। তাই হয়ত খেয়ে এসে শুয়ে পড়তেই ঘুমিয়ে গিয়েছেন। মৃদু হেসে উঠে পড়লাম। দরজা আটকে রুমের অগোছালো জিনিস গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে উড়না খুলে বিছানার কোণারে রেখে ধীরে ধীরে শারফান এর বুক থেকে কোলবালিশ কে সরিয়ে পায়ের কাছে মা*লা দিলাম। এই কোলবালিশ চরম শক্র হু। স্বামীর বুকের ভেতর মাথা ঠেকিয়ে তার পিঠে হাত চেপে চোখ বুজে নিলাম। শারফান ঘন ঘুমের মাঝেও শব্দহীন ঠোঁটের কোণে হেসে টানল। হাতজোড়া জোরালো করে বউকে আগলে নিলো। তার বুকের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লাম স্বামীর ঘুমন্ত অবস্থায় শক্ত হাতের স্পর্শে।

দিনের বেলা টেবিলের মধ্যে বই খুলে ম্যাথ করছি। শারফান দিনে হোমওয়ার্ক এর লিস্ট লিখে মিটিং এ চলে গিয়ে ছিলো। হঠাৎ রুমে চলে আসল শাহানা। তাকে খেয়ালে পড়ল না। ম্যাথের মাঝে যে ডুবে ছিলাম।
তখনি শাহানার কথায় চোখ ফিরিয়ে তার দিকে তাকালাম।

“ভাবী আপনি কি মিমলি ভাবী কে ক্ষমা করে দিয়েছেন? ভাবী তো এখন আপনার সাথে মিশতে চাই। কিন্তু আপনি মুখ ফিরিয়ে নেন দেখে আমি আর আব্বুও চুপ করে থাকি। কিন্তু গতকাল কে ভাবীকে পানিতে পা পিছলে পড়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করলেন। তার উপর জোরালো শাসনও করলেন। আপনি কি তবে মিমলি ভাবীকে ক্ষমা করেছেন?”

শাহানার কথায় মৃদু হেসে বললাম।

“কোনো ব্যক্তি যদি ভুল করে সেই ভুলের পথ শোধরে সামনে আগানোর পথ দেখানোই এক মুমিনের কর্তব্য। সেখানে মিমলি নিজ মুখেই তার দোষ স্বীকার করে প্রায়শ্চিত্ত করতে লেগে পড়ে ছিল। তুমিই তো আমায় বলেছিলে পুরো ঘটনা। হ্যা আমি প্রথম প্রথম রিয়েক্ট করে ছিলাম। তবে কয়েক দিন নিজের থেকে ভেবে দেখলাম না মিমলি দোষী না সবটা দোষ চাচী শ্বাশুড়ির। এখন তিনিও এই বাড়িতে নেই। তার মেয়েকে শোধরে ভালোবাসা দেওয়া আমাদের পরিবারের দায়িত্ব। দেখো না শেরহাজকেও মাফ করে দিয়েছি। আজ সকালে পায়ের কাছে বসে কতই না আহাজারি করছিল বেচারা। আমি তো কবেই মাফ করে ছিলাম তাকে। সে আমার ছোট ভাইয়ের মতই। ছোট ভাই দোষ করলে যেমন শাস্তি দিয়ে শোধরানো দরকার। ঠিক তেমনি তাকে তোমার ভাই শোধরে দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বড় ব্যাপার কি জানো?
এক মেয়ে যেমন ছেলের জীবন ধ্বংসাত্মক এ পরিণত করতে পারে ঠিক তেমনি শোধরে বদলে দিতেও তার মাসের পর মাসের দরকার পড়ে না। মেয়ে আমরা এমনি। আমাদের সংস্পর্শে ছেলে খারাপ হবে কি ভালো তা একমাত্র মেয়েদের উপরেই নির্ভর করে। তাইত সবখানে তালাক শব্দটা মানাই না। তোমার ভাইয়াকে আমি দূরে গিয়ে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়েছি। সেই গুরুত্বের রেশ ধরে সে আমায় চোখে হারাই। আমি যদি অমানুষিক মনে তার কথায় তালাকনামা দিতে প্রস্তুত হতাম। তবে আজ এই সুখের দিন দেখতাম না। জানো তো তালাক হলো একটি অভিশাপ মেয়েদের জীবনে। তাইত হযরত আলী (রাঃ) বলেছেন,
‘বিয়ে করো কিন্তু তালাক দিও না, কেননা তালাকে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে!’🖤
কবুল বলে বিয়ের মাহাত্ম্য না বুঝে যেমন বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া সহজ। তাতে স্বেচ্ছায় তালাক প্রদান করে শয়তানকে জয়ী করানোও একই কথা। তাই যত মুসিবত সামনে আসুক আমি আমার পদবী ধরে রাখতেই এতটা পথ পেড়িয়েছি। মিমলি আবেগে জড়িয়ে শয়তানের ফাঁদে পড়ে সংসার ভাঙ্গতে চেয়ে ছিল‌। কিন্তু দেখো তার জীবনটাই জুড়ে গেল শেরহাজের সাথে। এজন্য সেও এখন মা হতে চলেছে। এক মাকে আমি পিছলে পড়া থেকে বাঁচিয়েছি। নিশ্চয় আল্লাহ আমায় সহায় হবেন।”

শাহানা চট করে আমায় জড়িয়ে ধরে বলে,

“ভাবী আপনি এত ভালো কেনো? আপনার এই ভালোর নজরবন্দি দেখেই তবে আব্বু ভাইয়ার গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছেন তাই না?”

শাহানার কথায় তার মাথায় চাপড় মেরে বললাম।

“আচ্ছা শাহানা চুলায় রান্না গরম করতে দিয়েছি। একটু দেখিও হে। আমাকে তোমার ঐ খারুশ ভাই এতগুলো হোমওয়ার্ক দিয়ে রাখছে। রাতের আটটার ভেতর শেষ না করলে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবে বললেন। একটু করে ফেলি তুমি একটু ঐদিক নজর রাখিও।”

শাহানাও সরল মনে ‘ওকে ভাবী’ বলে রুম থেকে চলে গেলো। আমি আর অন্যদিক খেয়াল না দিয়ে লিখতে আরম্ভ করলাম।

শেরহাজ শারফান রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিয়ের জন্য কি কি কেনা লাগবে সব জোগাড় করছে। শারফানের মিটিং শেষ হতেই শেরহাজ কে ঘুমাতে দিলো না। দশটায় কল করে তৎক্ষণাৎ শপিং সেন্টারে চলে আসতে বলে। শেরহাজ আর কি করবে? ভাইয়ের কথায় বাধ্য হয়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়ে। এমুহুর্তে সে চরম বিরক্তির চোটে বলে,

“উফফ ভাই তাড়াতাড়ি করো না। এই কাঠফাঁটা রোদে দাড়িয়ে থেকে কালো হওয়ার শখ জেগেছে নাকি তোমার? সেই কখন থেকে একটা নুপূরের দিকে তাকিয়ে আছো। নিলে নাও নাহলে আসো গাড়িতে বসে এসির বাতাস খাই।”

শারফান চোখ রাঙিয়ে বলে,

“নিজে বিয়েসাদি করে কয়েক মাস পর বাচ্চার বাপ হয়ে যাবি। আর এদিকে তোর ভাই অনাহারে অনাদরে পড়ে আছে সেদিক খেয়াল দিস না। নিজের বেলায় ষোলআনা আর আমার বেলায় এক কানা কুড়িও না। তোর শাস্তি এটাই আমার সাথে কম্পোটিশন দিতে এসেছিলি না। এবার বুঝ।”

“ভাই এত বড় শাস্তি দিও না। তুমি চাইলে বলো এখনি তোমার আর ভাবীর বিয়ে করিয়ে দিচ্ছি। প্লিজ তাও এই গরমে আমার এত ঘার্ম নষ্ট করিও না। এগুলো রাতের বেলা ঝরিয়ে নিতে হয়। দিনের বেলা নয় বুঝছো না কেনো?”

শারফান কিংবদন্তি হয়ে তাকালো তার ছোট ভাইয়ের দিকে। সে কি বলেছে তা বুঝতে পেরেই হাতে থাকা প্যাকেট দিয়ে জোরালো আঘাত করল শেরহাজের পিঠে। তার মুখ ধরে বলে,

“চুপ কর বেশরম কোথাকার। না তোকে চুপ করিয়ে লাভ নেই। স্ট্যাচু করে দিলাম তোরে।”

শেরহাজ যন্ত্রমানবের মত হার্টছে তার বড় ভাইয়ের পিছে। মুখে তার কসটেপ লাগানো। এতক্ষণ ফটর ফটর করার শাস্তি হিসেবেই তার মুখে কসটেপ লাগিয়েছে। শারফান তার মনের মত সব জিনিস নিয়েই ক্ষান্ত হলো। প্রাণমেলে হেসে শেরহাজের কাঁধে মৃদু স্পর্শ করে বলে,

“শেষ ভাই এবার তোর বড় ভাইকে বিয়ে করে বাচ্চার বাপ হওয়ার থেকে আর কেউ থামাতে পারবে না।”

শেরহাজ তো মহাখুশি হয়ে দৌড়ে গাড়িতে গিয়ে বসে গেলো। শারফান ব্যাপারটা হলো কি বুঝেই পাগলাটে হেসে সে নিজেও গাড়ির কাছে এসে বসে গেলো। ড্রাইভার আঙ্কেল কে গাড়ি বাড়ির দিকে নিতে বলল। শেরহাজকে বলে,

“সবকিছু ঠিকঠাক করে রাখি। সামনেই শুক্রবার। সেদিনই ঘরোরা ভাবে বিয়েটা সেরে ফেলব।”

“জ্বি ভাই দোয়া রইল এবার যেনো তুমিও বাপ হওয়ার সংবাদ পাও।”

ড্রাইভার আঙ্কেল এর সামনে বেহায়া ছেলেটা কি হলো দেখে শারফান ঠোঁট কামড়ে চ’ড় লাগল। শেরহাজ এবার ভদ্রভাবে মুখে আঙ্গুল চেপে ধরে বসে রইল।

_____
মিমলির কোমরে খুব ব্যথা হচ্ছে। সে উচ্চ গলায় শাহানা কে ডাকল। কিন্তু শাহানা শুনল না। সে কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে আর রান্নাঘরের থেকে কিছুটা দূরে ডাইনিং রুমে বসে রইল। মিমলি কষ্টে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো। আজ সারাদিন সে শুয়ে ছিলো।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)সকালে কোমরে হঠাৎ করেই ব্যথা অনুভব করে চলেছে। ভুলেও কাউকে বলে চিন্তায় ফেলতে চাইনি। যখন থেকে ফারজানা তাকে মেনে নিয়েছে সকলে তাকে আদর-যত্ন দিয়ে ভরিয়ে রাখছে। কমতি শব্দটা হারিয়ে গিয়েছে। মিমলি গরম পানি করার জন্য রান্নাঘরে এলো।‌ শাহানা কে নিজের মত ব্যস্ত দেখে পুনরায় ডাক দিলো না। সে নিজেই গোলাকার মাঝারি সাইজের পাতিল নিয়ে কলের কাছে এনে রাখল। পানি ভরে ঢের কষ্ট সহে চুলার কাছে রাখল। চুলায় রান্না করা পাতিল দেখে ভাবল চুলা বন্ধ। আর রান্নাগুলো গরম করে রেখে দেওয়া হয়েছে। সে তাই সব পাতিল সরিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশে থাকা ছোট সাইজের ট্রি টেবিলে রাখল। শাহানা তখনো তাকে খেয়াল করেনি। সব পাতিল সাজিয়ে রেখে মিমলি চুলায় তার পানি ভর্তি পাতিলটা রাখল।

হঠাৎ নাকের মধ্যে তীব্র গ্যাসের গন্ধ পেয়ে কলিজা মোচড়ে উঠল। তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকালাম। শাহানাকে গান শুনতে দেখে অঘটনের মাত্রা বুঝে গেলাম। সেখানে ছুটে গিয়ে দেখলাম মিমলি চুলা জ্বালানোর চেষ্টা করছে। আমি জোরে জোরে মিমলিকে ডাক দিলাম। মিমলি শুনে রান্নাঘর থেকে বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখল আমাকে। আমি থামিয়ে দিয়ে তার কাছে গেলাম। তাকে ধরে শাহানার পাশে এনে দাঁড় করিয়ে রান্নাঘরের জানালা দরজা খুলে দিলাম। সেখান থেকে রেগেমেগে বেরিয়ে শাহানাকে ধরে বসা থেকে দাঁড় করালাম। তার কানের থেকে ইয়ারফোন খুলে ছিঁড়ে মাটিতে ফেলে দিলাম। হাতে থাকা ফোনটাও সোফায় ছুঁড়ে দিয়ে জোরে সরে এক চ’ড় বসালাম। চ’ড়ের কারণে সে গিয়ে পড়ল শ্বশুর আব্বুর পায়ে। আমি দেখেই থমথমে চেহারা নিয়ে তাকালাম। সে সময় শাহানার দুভাইও এসে বোনের চ’ড় খাওয়ার দৃশ্য দেখে ফেলেছে। শারফান শেরহাজ দুজন রেগে এগিয়ে আসল। আমি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মূলত নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করার প্রয়াস করছি। মিমলি হতবাক চোখে শুধু তাকিয়ে রইল। সেও বুঝছে না ফারজানা ভাবী কেনো তার আদরের ননদীকে চ’ড় মারল? শাহানা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। সে কান্নার চোটে বলে,

“ভাবী আমি আপনাকে এত ভালোবাসি আর আপনি আমাকে চ’ড় দিলেন। আমি আপনার কাছ থেকে এমনটা আশা করিনি ভাবী।”

শাহানা ফুঁপানো অবস্থায় ছুটে নিজের রুমে চলে গেলো। আমারও খারাপ লাগল। কিন্তু কি করব রেগে গিয়ে অস্বাভাবিক কাজ করে ফেলেছি। আসলেই তেমনটা করা উচিৎ হয়নি। শারফান তার হাতে থাকা প্যাকেট গুলো সোফায় ছুঁড়ে ফেলে বোনের নিকট চলে গেলো‌। শেরহাজও মুখ ফিরিয়ে মিমলিকে ধরে রুমে চলে গেলো। মিমলি তার ভাবীর কাছে থাকার জন্য মুখ খুলতে চাইলে শেরহাজ ধমকে বলে,

“যে আমাদের বোনের গায়ে হাত তুলে নিজের আধিপত্য দেখান তার কাছে গিয়ে তোমার সহানুভূতি দেখাতে হবে না।”

মিমলি স্বামীর ধমকে চুপ করে চলে গেলো সঙ্গেই। আমি অসহায় চোখে শ্বশুর আব্বুর কাছে এগোতে নিলেই তিনিও চোখ ফিরিয়ে ধীরস্থির পায়ে হেঁটে নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলেন। পরিস্থিতি প্রতিকূল দেখে আপাতদৃষ্টিতে সবাইকে একা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু হৃদয়ের জ্বলন শারফান দেখল না। তার হাতে থাকা প্যাকেটের উপর আমার নজর আঁটকালো। প্যাকেটগুলো ছুঁতে নিয়েও ছুঁয়ে দেখলাম না। চোখ থেকে টপ করে পানি পড়ল। মুছেই কৃত্রিম হেসে নিজের কাজ শেষ করতে চলে গেলাম।
শারফান নিজের বোনকে বুঝিমে সুজিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। তার রাগ লাগছিল বোনকে চ’ড় মেরেছে দেখে। পরক্ষণে ভাবল আজ কি ভেবেছিল আর কি হয়ে গেলো! সত্যি মানুষকে কখনো আশা রাখতে নেই। আশাহীন পথ এগিয়ে যাওয়া উচিৎ। কেননা আশা নিয়ে কাজ করলে দেখা যাবে সেই আশা নিপূরণ হয়ে রইল। তপ্তশ্বাস ফেলে বোনের পাশেই হেলান দিয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে সে।

চলবে…..

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৬

“এ মেয়ে সেই কখন থেকে বলছি রেডি হয়ে নাও। হচ্ছো না কেনো? কথা কি কানে যায় না?”

শারফানের রাগী কণ্ঠে কেঁপে উঠলাম। বাড়ির কেউই আমার কথা শুনতে রাজি নয়। সবাই গম্ভীর গলায় কথা বলছেন। শারফান তো প্রয়োজন ছাড়া কথাই বলছেন না। আমার কি করা উচিৎ বোঝে উঠতে পারছি না। শাহানাও এখন মুখ ফিরিয়ে থাকে। সবার কাছে একপ্রকার অবহেলার পাত্রী হিসেবে নিজের অবস্থান খেয়াল করে চলেছি। আচমকা শক্তপোক্ত হাতের স্পর্শে চমকে তাকালাম।

“কানে যায় না প্যাকেটে রাখা ড্রেস পরে রেডি হয়ে আসতে বলছি কতক্ষণ হচ্ছে কথাটা বলেছি? নাকি তুমি চাও আমি তোমায় পরিয়ে দিয়ে বাপের বাড়ি রেখে আসি?”

কলিজা মোচড়ে উঠল। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

“কি কি বলছেন? আপআপআপনি কি আমায় দাদুরবাড়ি রেখে আসতে চাইছেন?”

“নাহলে বরযাত্রীর দায়িত্ব পালন করব কেমনে? এত মাস ধরে তোমার ন্যাকামি অনেক সহ্য করেছি। এবার তোমায় সহি নিয়তে রেখে আসতে চাই।”

নিজের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না। শারফানকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলাম। গলায় কথা আঁটকে আসছে। তবুও কষ্টে নাক ফ্যাঁস ফ্যাঁস করে বললাম।

“আর কখনো আপনার সাথে বেয়াদবি করব না। আমি যা করতাম শুধু আপনার কাছাকাছি আসার জন্যে করতাম। তার চেয়ে আর কিছু নয়। আমাকে প্লিজ পাঠিয়ে দিয়েন না। আপনাকে খুব ভালোবাসি আমি শারফান‌। আপনার সাথে জীবনের শেষটুকু কাটাতে চাই। আমার সত্যি বিশ্বাস করেন কোনো ইনটেশন ছিল না শাহানাকে চ’ড় দেওয়ার। সেটা পরিস্থিতির প্রতিক্রিয়ায় আমি হুট করে বেসামাল হয়ে কাজটি করে ফেলেছি। আপনি চাইলে আমি শাহানার পা ধরে ক্ষমা চাইবো তবুও প্লিজ আমাকে পাঠিয়ে দিয়েন না। আপনাকে ছাড়া এক মুহূর্ত থাকতেও আমার দম আটকে আসে।”

শারফান কে নিশ্চুপ দেখে তার চোখের দিকে তাকালাম। সে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে বলে,

“এসব কথা তোমার চ’ড় দেওয়ার আগে ভাবা উচিত ছিল।”

কথাটা বলে আমার হাত সরিয়ে প্যাকেট হাতে ধরিয়ে দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। উদাসীন মুখখানা নিয়ে অনুভূতি শূন্য হয়ে স্বামীর দেওয়া পোশাক পরে বের হলাম। শাহানা কে রুমে বসা দেখে ফুঁপিয়ে বললাম।

“বোন তুমি আমায় ক্ষমা করে দাও। প্লিজ তোমার ভাইয়াকে বোঝাও না। আমাকে বাপের বাড়ি না রেখে আসার জন্য। আমি তোমাদের খুব ভালোবাসি। তোমাকে আমি ইচ্ছে করে চ’ড় দেয়নি বিশ্বাস করো বোন। ঐ সময় মিমলি গর্ভবতী অবস্থায় গরম পানি চুলায় বসাছিল। তার উপর গরম পাতিল রাখা ছিল চুলার উপর অথচ গ্যাস কবে নিভে গেলো তুমি জানলেই না। এতে মিমলি ঘ্রাণ না পেলেও আমি পেয়েছি। তাইত হতদন্ত হয়ে ছুটে এসে মিমলিকে থামিয়ে দরজা জানালা খুলে ঘ্রাণ দূর করার প্রয়াস করে দেয়। তখনি তোমাকে ফোন নিয়ে ব্যস্ত দেখে রাগে কাজটা করেছি। সত্যি বোন আমার তোমাকে হার্ট করার ইচ্ছে ছিল না।”

শাহানাও শারফানের মত মুখ ফিরিয়ে বলে,

“দেখেন ভাবী আমি এখানে ভাইয়ের কথায় এসেছি। আপনায় নাকি সাজহীন কলিগদের কাছে প্রদর্শন করতে পারছেন না। ভাইয়ার কলিগগণ আপনাকে দেখতে চাইছেন। তাই বাধ্য হয়ে ভাইয়া এত কিছু করছেন। এবার প্লিজ আপনি আয়নার সামনে বসে যান। আপনাকে সাজিয়ে দিয়ে আমার বের হতে হবে।”

উদাসীন হয়ে শাহানার কথায় সাড়া দিয়ে নির্লিপ্ত হয়ে বসে পড়লাম ড্রেসিং টেবিলের সামনে। শাহানা তার ভাবীর অগোচরে মিটমিটে হাসল। সর্তকতার সাথে সে তার ভাবীকে সাজিয়ে দিতে লাগল। দরজার বাহিরে থেকে শারফান সবটা শুনেছে পরখও করেছে। তার পেছনে জয়নাল মিয়া ছেলের মাথায় চাপড় মেরে বললেন।

“দেখলি তো বউমার কোনো ভুল নেই। আর তুই এতটা কষ্ট দিয়ে সাজতে বসাইলি কেন? সোজাসাপ্টা বললেই পারতি। এহন দেখ মাইয়াটা কেমনে উদাস হয়ে আছে।”

“আহ্ আব্বু আম্মুর প্ল্যানিং এটা। দেখবে যখন বাড়ির সবাইকে চোখের সামনে দেখবে তখন তোমার বউমা কতটা হেসে খেলে উঠে। এখনকার জন্যে কষ্ট পাক। আমিও কি কম পেয়েছি নাকি? ব্যস আজকের রাতেই আমাদের স্বপ্ন পূরণ হবে।”

জয়নাল মিয়া শুকনো কাশি দিয়ে চলে গেলেন। শেরহাজ কে ইশারায় সব ঠিক করে নিতে বলে। মিমলিও ব্যস্ত সবকিছুতে তোড়জড় লাগাতে। তার বড় ভাবীর পুনরায় বিয়ে হচ্ছে। এর খুশিতে পুরো বাড়িতে আজ আমেজ বসবে।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)শাহানা সাজিয়ে দিলো প্রায় একঘণ্টা লেগেছে। মনমতো সে তার ভাবীকে সাজাতে পেরে অত্যাধিক খুশি। সময় বিলম্ব না করে ভাবীকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,

“নিজেকে দেখে ভাব নিতে হবে না। আমার সাজানোর হাত সুন্দর তাই আপনাকে এতটা সুন্দর লাগছে মাশাআল্লাহ। আবার ভাবিয়েন না নজর দিচ্ছি।”

শাহানার দিকে ছলছল নজরে তাকালাম। যা দেখে শাহানা মনেমনে ভয় পেলো। খুব কষ্ট করে সময় নিয়ে সাজিয়েছে সে তার ভাবীকে। এখন যদি তার ভাবী কান্না করে দেয়। তার কষ্টের ফলাফল একেবারে নষ্ট,বৃথা যাবে। তাইত কিছুটা রেগেই বলে ফেলল।

“ভাবীইই আপনি নিজে অলস হতে পারেন আমি নয়। দেখছেন না আমি সাজিয়েছি। সেই সাজানোর মধ্যে কেনো আপনি কান্না করে মুখটা নষ্ট করার চেষ্টা করছেন? ওওওও ভাইয়ার কলিগদের সামনে বলার জন্য আমি ননাস হিসেবে খুব খারাপ। সরি টু সে ভাবী এতে আপনারই দোষ হবে। আমি কষ্ট করে সাজিয়েছি সেটা আমি বললেই ভাইয়ারা বিশ্বাস করবেন। আর আপনি কয়েক মাসের আসা এক মেয়ের কথায় কেউ বিশ্বাস করবে না। সো প্লিজ ডোন্ট ক্রাই। আর শক্তি নেই আপনাকে সময় নিয়ে সাজানোর। যা সাজিয়েছি তাতেই যথেষ্ট।”

শাহানা কথা শেষ করে ধুপধাপ পা ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। শারফান খেয়াল করেই বোনের কাছে গিয়ে তার পিঠে ধুপধাপ কয়টা লাগিয়ে দিলো। শাহানা ‘উহহহ আহ’ করে পিঠ মালিশ করতে থেকে বড় ভাইয়ের দিকে তাকায়‌।‌ শারফান রাগী কণ্ঠে বলে,

“ঐ আমার বউকে উল্টা পাল্টা কথা শুনালি কেন? তোর কত সাহস আমার বউকে কান্না করাস। তোকে তো সাত তলা থেকে নিচে ফেলে দেবো বেয়াদব। যা এখনি ক্ষমা চেয়ে খাইয়ে দেয়।”

“উফফ ভাইয়া এখন না বকলে ভাবী কান্না করে মুখের সাজ নষ্ট করে ফেলতেন। এতে আবার সাজাতে গিয়ে সময় নষ্ট হতো সাথে তোমার বিয়ের সময়তেও দেরি হতো। এখন ভাবী একেবারে প্রস্তুত। তুমি শেরহাজ ভাইয়াকে গাড়ি দিয়ে পাঠিয়ে দাও। আমিও বেরিয়ে যাচ্ছি। রিসোর্ট এ গিয়েই সেজে নেবো আমি। ওখানে আমার ফ্রেন্ডস আসছে ওরা সাজাই দেবে। আমি আব্বুকে নিয়ে চলে যাচ্ছি টাটা।”

কথা শেষ করে শাহানা দ্রুত পালিয়ে গেলো। কেননা তার বড় ভাই যে রেগে আছে বোম ব্লাস্ট হতে সময় লাগবে না। শারফান তপ্ত শ্বাস ফেলে রুমের দিকে অগ্রসর হলো। আমি আলমারি খুলে সুটকেসে বের করে কাপড় ভরে নিচ্ছি। আর থাকব না এ বাড়িতে। সামান্য ভুলের জন্য সবার কাছ থেকে অপমান সহ্য করা সহজ কি? কান্না করতে পারছি না শাহানার অপমানে। শারফান রুমে এসে নিজের বউকে সুটকেস গুছাতে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো। বিস্মিত গলায় বলে,

“এই এই মেয়ে সুটকেস কেন গুছিয়ে নিচ্ছো? কোথাও যাবে নাকি?”

“হ্যা আপনাকে আর আপনার পরিবার কে ছেড়ে বাপের বাড়ি চলে যাচ্ছি।”

“কেনো কারণটাও বলে দাও?”

রেগে জেদে চিৎকার করে বললাম।

“এই ফাজিল চুপ থাকেন। একে তো কথা পুরো না শুনে আমায় পাত্তা দিচ্ছেন না। তার উপর আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আপনার অভিমান ভাঙাতে চেষ্টা করছি। সেখানে আপনার ভাব দেখি বেড়েই যাচ্ছে। কোথায় ক্ষমা করে পুরো কথা শুনবেন তা না করেই দুনিয়ার সম্মান রক্ষার্থে সাজাতে বললেন শাহানা কে। ঠিকাছে আপনার সম্মানের ব্যাপার যেহেতু সেহেতু সেজে গুজে নিজেকে আপনার কলিগদের কাছে মূর্তির মত পরিচয় দেবো। কিন্তু আমার রগ যদি ফুলে গেছে তবে আপনাদের সবাইকেই ঝাড়ুর বা*রি মেরে একেবারে আলুভর্তা বানিয়ে ফেলল।”

“ব্যস বউ হয়েছে আরেকটু বললে এখন আমার শরীরটা এম্বুলেন্স নিয়ে টানাটানি করতে হবে। আসো যাই। তারপর যেখানে মন চাই সেখানে চলে যেও। আপাতত ভালো স্ত্রীর আবেশে নিজেকে সামলে নাও।”

শারফান ঢোক গিলে কথা শেষ করেই সুরসুর করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। দাঁতে দাঁত চেপে তার পিছু নিয়ে চলে গেলাম। তার গাড়িতে গিয়ে বসলাম। কিন্তু যাওয়ার সময় বাড়িতে কাউকে নজরে পড়েনি। সবাই ব্যস্ত ভেবে ওতটা ঘাঁটলাম না। গাড়িতে নিশ্চুপ শারফানের দিকে নজর দিলাম। লোকটাকে আজ অন্যরকম সুন্দর লাগছে। গালের খোঁচা দাড়ি কিছুটা বেড়েছে। মুখটা একেবারে উজ্জ্বল হয়ে আছে যেনো আজ তার জয়বিলাস। পরণের দিকে তাকাতেই চমকে গেলাম। লোকটার গায়ে শেরওয়ানি কেনো? পরক্ষণে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি, ‘একি আমার গায়ে লাল শাড়ি শারফানের গায়ে শেরওয়ানি তবে কি আমার যা এখন মনে হচ্ছে সেটাই হতে চলেছে?’ মনের ভাবনা আর প্রকাশ না করে থাকতে পারলাম না। শারফানের কলার ধরে ঠোঁটের কাছে এনে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম।

“আপনি কি আমায় আজ বিয়ে করছেন?”

শারফান ভেতরে চমকে গেলেও প্রকাশ্যে আনল না বরং বাঁকা হেসে বলে,

“তোমার শাস্তি দিতে নিয়ে যাচ্ছি। আজ আমার দ্বিতীয় বিয়ে হবে আর তুমি হবে দর্শক। তোমার কাছাকাছি থেকেই আমার বিয়ে হবে। মনে আছে সেদিন তোমার পায়ের চরণ বাড়িতে পরার পর রুমে আবদ্ধ অবস্থায় তুমি কষ্টের তিক্ত বাণী শুনিয়েছিলে। সেই একইভাবে আজ তোমাকে বলছি। তুমিও আজ আমার বিয়ে দেখবে এই নিজ চোখে নিজ হাতেই আমায় বিয়ের স্থানে আসনপ্রাপ্ত করাবে।”

শারফান খুব গম্ভীর ভঙ্গিমায় আমার হাত ছাড়িয়ে কলার ঠিক করে বসল। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে শব্দহীন জোরালো শ্বাস ছাড়লো। আমি স্তদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। ভাবছি এই আমি কাকে দেখছি? লোকটা সামান্য এক ভুলের উপর জেদ লাগিয়ে আমার জন্য সতীন আনার ব্যবস্থা করবে। রাগের ফুলকি বেড়েই যাচ্ছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে আড়চোখে পরপর শারফানকে দেখছি। শারফান স্থীর হয়ে বসে থাকতে পারছে না। সে জানে তার বউয়ের ধারালো চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেই সে ধরা পড়ে কাঠ হয়ে পড়বে। যার কারণে সে যথাসম্ভব নিজেকে ফোনে নাহয় জানালার বাহিরে তাকাচ্ছে। বউয়ের হাতে ঝাড়ুপেটা তার কপালে লিখিত রয়েছে সেটা সে ভালোই বুঝতে পেরেছে। ঢোক গিলে ফোনে সময় দেখছে সে। চোখজোড়া সরু করে বললাম।

“দ্বিতীয় বিয়ে যে করছেন কাকে করছেন একটু শুনি?”

“আআআমার কলেজের এক শিক্ষিকাকে করছি।”

“ওহহ রিয়েলি সো নাম কি তার?”

“নাম নাম ওহ হ্যা ফারজানা।”

“জি আমার নাম না ঐ সতীনের নাম জিজ্ঞেস করতেছি। ভয়ে কি আমার নামই আপনার মুখে আসতেছে নাকি এমনি ফট করে ভুলে বলছেন।”

“আরে ধুর মনের ভুলে বলে ফেলেছি। মেয়েটার নাম মনিকা।”

“কোন গ্রহের মনিকা? কোথার থেকে ডিগ্রি পাস করছে সে? কবে থেকে চলছে আপনাদের রিলেশনশিপ? কবে জয়েন হয়েছিল কলেজে? কবে আপনারা মিট করছেন? হেই কোনো রুমডেটও করছেন নাকি? কবে তার বাপ-মায়ের কাছেও হাত পাতলেন মেয়ের নামে? সবগুলোর উত্তর কি আপনি দেবেন? না আমি আপনার কুণ্ডলী পাকানো কথা পেটের উপর আক্রমণ করে বের করবো?”

শারফান এর ইচ্ছে করছে গাড়ি থেকে লাফ মেরে নিজেকে শেষ করে ফেলতে। মেয়েটা একবিন্দু পরিমাণ ছাড় দিচ্ছে না। ধরেছে কি একেবারে ধরার মত ধরা ধরেছে। না ছাড়ছে, না যেতে দিচ্ছে মাথাটা বোধহয় আজকেই পাগল বানিয়ে ছাড়বে। শারফান ঠোঁট কামড়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বলে,

“দেখো এই শারফান মারুফ কারো কাছে কৈফিয়ত….।”

“আপনি দিতে বাধ্য জানি। তাই বাধ্যতামূলক জিজ্ঞেস করছি মেয়েটার বায়োডাটা দেন। আচ্ছা বায়োডাটা ভালোবাসার দায়ে দিচ্ছেন না বুঝতে পারছি। এক কাজ করেন রাতবিরেতে প্রেম তো নিশ্চয় করছেন দেখি আপনার‌ ফোন দেন। কতটা প্রেমের পিরিতি মারছেন বের করি।”

“ইশ্ মেয়েটাকে যত সারপ্রাইজ দিতে চাইছি তত সারপ্রাইজ নষ্ট করার জন্য উতলা হয়ে যাচ্ছে মেয়েট। পাগলী একটা জুটেছে আমার কপালে। উফফ আল্লাহ প্লিজ হেল্প।”

*আমি আমার ফোন কাউ…।”

শারফানের অর্ধ কথার মাঝেই ফোনটা নিয়ে লক খুলে ফেললাম। ফোন ঘেঁটে ঘেঁটে কোনো সন্দেহজনক বিষয় না পেয়ে সুরু দৃষ্টিতে শারফানের দিকে তাকালাম। লোকটা আমার থেকে কিছু তো লুকাচ্ছে। শারফান কে আর বেশি কিছু বলে বিরক্ত করলাম না। ফোন দিয়ে দিলাম।
শারফান রিসোর্টে যাওয়ার পূর্বে রাস্তায় গাড়ি থামালো। মিষ্টির দোকানে যেয়ে কয়েক প্যাকেট মিষ্টি কিনে এসে গাড়িতে উঁকি দিতেই দেখল তার বউ গাড়িতে নেই। শারফানের বুক কেঁপে উঠল। সে আশপাশে নজর রাখতেই খেয়াল করল তার বউ ফারজানা দৌড়ে কোথাও ছুটছে। উচ্চস্বরে ডেকে পিছু নিলো শারফান। অন্যথায় আমি দৌড়ে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়ানো বাচ্চাকে ধরে রাস্তা পার হতে গিয়েই আটকে পড়লাম। কেননা শাড়ির আঁচল পাথরে আটকে গিয়েছে। পেছন দিক দিয়ে বড় ট্রাক দ্রুতগতিতে ধেয়ে আসছে। পাঁচ/ছয় বছরের ছোট বাচ্চাটি আমার কোলে লাগাতার কান্না করে চলেছে। বিপদে পড়লে মানুষ দিকবিদিক ভুলে যায় বলে না আমার সাথেও তেমনটা হয়েছে। শারফান এসে দেখল তার বউ এক বাচ্চাকে নিয়ে রাস্তায় আটকে পড়েছে। ট্রাককে খেয়াল করতেই উচ্চস্বরে ‘ফারজানা’ বলে ডেকে উঠে। আমি ছলছল চোখে চেয়ে শারফানকে আসতে বারণ করলাম। সে শুনল না ছুটে আমার কাছে এসে পাথর থেকে আঁচল সরিয়ে ধাক্কা দেয়। আমি পড়ে যেতে নিয়েও হাতে তার শেরওয়ানির অংশ ধরে রেখে ছিলাম। কিন্তু যা দেখলাম জোরেসরে ‘শারফান’ বলে ধপ করে বসে পড়লাম।

চলবে……

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-১৩+১৪

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৩

“এ মেয়ে নাও ফোনে তোমার নাম সেট করো, অধিকার খাটাও, নিজের তরফদারি করো। তবুও মুখ ফুটে আমার সাথে কথা তো বলো। একদম চুপ করে থাকলে তোমার চুপের ঠেলায় আমার ডায়রিয়া হয়ে যাবে। এই নাও ধরো আমাদের ফোন। যখন ইচ্ছে চালাইও। কিন্তু মুখ লটকিয়ে রাখিও না। তুমি কথা না বললে আম্মুও কথা বলবে না। এই মেয়ে শুনতেছো কি বলছি? কি গো মরেটরে গেলা নাকি?”

বউয়ের বাহুডোরে মৃদু স্পর্শ করে নেড়ে দেখল শারফান। আমি ঘাপটি মেরে শুয়ে আছি। এসি চলছে ঠান্ডাও লাগছে। তবুও কাঁথা শরীরে জড়ায়নি। স্বামীর মুখ থেকে পাগলাটে কথাবার্তা শুনে ভেতরটা আনন্দে ফেটে যাচ্ছে। শারফানের হঠাৎ ঐ ছেলের কথা মনে পড়ে গেলো। দাঁত কিড়মিড়িয়ে তৎক্ষণাৎ জাপ্টে ধরল বউকে। হতভম্ব হয়ে গেলাম। লোকটা এভাবে পেঁচিয়ে নেবে ভাবতেই পারিনী। শরীর জুড়ে কাঁপন ধরল মত অবস্থা। ঢোক গিলে তার হাত সরানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু তিনি ছাড়ছেই না। বিধেয় আমিও ন্যাকামি করে বললাম।

“এখন কেন আমায় চেপে ধরে রাখছেন? যাইতাছেন না কেন আপনার জারিফা নামক ভূতের কাছে? ওহ ঐটা তো আবার আমার ছোট দেবরানী হয়ে গেলো। ইশ্ স্বামী আপনার মত আনলাকি আর দুটো নেই। বউ পেয়েছিলে তারেও হারালে , প্রাক্তন পেয়েছিলে সেটাও বের হলো বহুরুপী। বলি তাই কি এখন আমায় প্রয়োজন মনে করছেন?”

“বউ আমার তার কাছে যাওয়া তাকে স্পর্শ করার পূর্ণ অধিকার আমার আছে। আর ভালোই ভালোই সবটি ভুলে মানিয়ে নাও তবেই দেখো না কেমনে তোমাতে মজে থাকি।”

রাগে শরীর জ্বলছে উঠল তার কথায়। ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিলাম তাকে। সে পিছিয়ে গেলো কিছুটা। তবে বিছানায় ছিল। ক্রন্দন প্রায় চোখ নিয়ে বললাম।

“পুতুল পেয়েছেন হ্যা? যখন খুশি কাছে আসবেন যখন খুশি দূরছাই করবেন। আপনার কাছে কেনো এসেছি জানেন? কারণ দূরে থেকে কষ্ট দেওয়ার চেয়ে কাছে থেকে কষ্ট দেওয়ার মজাই আলাদা। এই রুম এই বাড়ির ভেতরে আমার আনাগোনা চলবে। তবে আপনার আর আমার সম্পর্কের গভীরতা কেমন চলবে জানেন? বলছি মন দিয়ে শুনেন। বউকে কাছের থেকে দেখবেন, তবে ছুঁতে পারবেন না। বউয়ের হাতের রান্না খাবেন তবে ছুঁয়ে প্রশংসা করতে পারবেন না। বউয়ের ইস্ত্রি করা জামা কাপড় পরতে পারবেন কিন্তু সেখানে পাবেন না কোনো মায়া। বউয়ের গোছানো সব জিনিস হাতের নাগালে পাবেন তবে বউকে কাছে ডেকে জিনিসটা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারবেন না। সর্বশেষে বউকে একই ছাদের নিচে একই বিছানায় এক সাথে পাবেন তবে বুকে জড়িয়ে ধরার মত দুঃসাহসিকতা দেখাতে পারবেন না।”

কথাগুলো তিক্ত শুনালেও আমার কিছু করার ছিল না। বিয়ের পর থেকে তিনি আমায় অবহেলার পাত্রে বসিয়ে দিয়ে ছিলেন। এখন সেই তিনি কাউকে না পেয়ে আমায় দয়ার নজরে দেখে কাছে পেতে চাইছেন তা হতে দেবো না। রাগ আমারও আছে। শারফান স্বাভাবিক চোখেই চেয়ে রইল। মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়। আলমারির কাছে গিয়ে আলমারির দরজা খুলে ভেতরে থেকে কোলবালিশ বের করে। বিছানায় বর্ডারের মত রেখে সন্তপর্ণে বসে বিছানায় হেলান দিলো। তার কার্যসিধি দেখতে থাকলাম। শারফান ফোনের ওয়াল পেপারে তার সুতি থ্রিপিচ পরা একটি হাসির ছবি লাগিয়েছে দেখে অবাক। আগে তো সেই জায়গায় জারিফার ছবি ছিল। তবে পরিবর্তন করলেন কবে তিনি? শারফান ফোনের কাজ সেরে সেটি আমার কাছে এগিয়ে রাখল। নিজের মত উঠে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমার কষ্ট হচ্ছে। যতই স্বামীকে নিয়ে রাগ জেদ দেখাই না কেনো মনের মধ্যে তাকে নিয়ে বুনা স্বপ্নের সুতোর গভীরতা খুব প্রখর। ফোনটি হাতে নিয়ে চালু করতেই ভেসে উঠল স্বামী আর আমার দুজনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকার ছবি। আরে এটা কে তুলে ছিলো? এমন ছবি তো শারফান উঠায়নি। তবে কি শাহানা? হতে পারে ভেবে পুরো ফোন ঘেঁটে জারিফার কোনো চিহ্নটুকু পেলাম। হঠাৎ কারো গম্ভীর গলায় চট করে ফোনটি রেখে দিলাম। তিনি হালকা কেশে ভাতের থালা হাতে নিয়ে এসে বিছানায় বসল। থালায় সুন্দর করে তরকারির সাথে ভাত রাখা। শারফান মেখে এক লোকমা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলো। থমথমে চেহারা নিয়ে তাকালাম। শারফান মুচকি হেসে বলে,

“ঝগড়া বলো, অভিমান বলো সবটা আমার সাথেই করো। এমন কি এই বাড়ির ভেতর থেকেই করো। তাতেই আমি খুশি থাকব। তবে আমার কর্তব্য হতে আমি পিছু হবো না। বউকে নিজ হাতে খাওয়ে দেওয়া স্বামীর জন্য সুন্নাত। তা থেকে তুমি আমায় বিরত রাখতে পারবে না জানেমান।”

শেষ শব্দটা শুনে পুরো শরীর জুড়ে লাজুকতা ভর করল। মাথা নুইয়ে অন্যদিক তাকিয়ে রইলাম। হঠাৎ গালে ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে মুখ হা করে তার দিকে তাকাতেই মুখের ভেতর ভাতের লোকমা পুরে দিলো শারফান। সে বাঁকা হেসে বলে,

“আরো মুখ ফিরিয়ে নাও। আমার জন্য তো লাভে লাভ। একের পর এক চুমু দিয়ে তোমার গাল আর গাল রাখব না। টমেটো সস বানিয়ে দেবো ইয়াম্মমিইই।”

জ্বিভ বুলিয়ে ইশারা করল শারফান। তৎক্ষণাৎ ইতস্তত হয়ে খেতে লাগলাম। লোকটার উপর বিশ্বাস নেই সত্যিতে আমার গালে হামলা চালাবে। শারফান মনেমনে হাসল। সে ভেবেই নিলো তার আজ থেকে মিশন একটাই। ‘মিশন একটা বউ পটানো’। আমার খাওয়া হয়ে যাওয়ায় মাথা নেড়ে ‘হয়ছে’ বললাম। শারফান নিজের মত স্বাদ নিয়ে খেয়ে নিলো। হাতের আঙ্গুল চেটেপুটে খেয়ে বলে,

“আজকে ফাস্ট ডে তাই নিজ হাতে খাওয়ালাম পরের বার তুমি আমাকে খাওয়াবে।”

বলেই শারফান চুমুর ইশারা করল। করেই দাঁড়িয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমি আর রুমে বসে থাকতে পারলাম না। লোকটার এতটা অধঃপতন হয়েছে। ভয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। কেননা লোকটা সামনে পেলে দুষ্টুমি করতে উদ্যত হতো। শারফান রান্নাঘরে এসেছে থালাটা ধুয়ে নিতে। থালাটা রেখে খেয়াল করল তার বউ চুরিচুপে শাহানার রুমে যাচ্ছে। যা দেখে হেসে উঠল শারফান। শেরহাজ সবে মাত্র বাড়ির ভেতরে এসেছে। শারফান কে একলা হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তার নিকট এগালো। ছোট ভাইকে দেখে শারফান নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। মৃদু হেসে বলে,

“টিউশনি করে এসেছিস খেয়ে নেয়। রান্না করা আছে। তোর ভাবীর সাথেও দেখা করিস।”

শেরহাজ খুশি হয়ে শারফান কে জড়িয়ে বলে,

“সত্যি ভাই ভাবী ফিরে এসেছেন?”

পরক্ষণে তার মুখে কালো মেঘের ছায়া আনাগোনা হলো। মাথা নুইয়ে বলে,

“আমি কোন মুখে ভাবীর কাছে ক্ষমা চাইবো বলো? তুমি একটু আগে ভাবীকে বুঝিয়ে পুরো ঘটনা বলিও। তাহলে আমি সাহস পাবো।”

শারফান তার ছোট ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

“চিন্তে করিস না। তোর ভাবী এখন শাহানার রুমে। সেই সবটা খুলে বলবে। যা ফ্রেশ হয়ে নেয়। দীর্ঘ তিন ঘণ্টায় তোর শার্টের থেকে ঘামের দুর্গন্ধ আসতেছে। বলেছিলাম রাস্তাঘাটে না হেঁটে রিকশা করেই চলে আসতেছে না হয় টেম্পু করে। তুই তো আমার কথা শুনিসই না।”

বড় ভাইয়ের কথায় শেরহাজ লাজুক হেসে বলে,

“এখন থেকে মেনে চলতে হবে তো ভাইয়া। তোমার ছোটু আরেক ছোটুর বাপ হতে চলেছে।”

শারফান ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে আসলে ঠিক শুনেছে কিনা বোঝার দায়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। শেরহাজের কথার অর্থ বুঝতে পেরেই চিল্লিয়ে বলে,

“কিই তুই তুই তুই তুততততুই আরেক ছোটুর বাপ?”

শারফান তার ছোট ভাইয়ের গায়ের চারপাশ ঘূর্ণন দিয়ে তাজ্জব বনে গেল। ধপ করে রান্নাঘরে থাকা চেয়ারে বসে বলে,

“এই বেয়াদব তোর বয়স কত-রে? এত বড় কাম করতে তোর বিবেকে ভাবিস নাই একবারও ঐ ছোট মেয়ে এত বড় বোঝা বহন করতে পারবে কিনা?”

“আরে ভাই বয়সের কি যায় আসে? আমি তোমার চেয়ে গুনে গুনে চার বছরের ছোট। অর্নাসের আর একবছর আছে। তাতে কি যায়? বাপ হচ্ছি এতেই খুশি। তোমার আগে আমিই চক্কা মেরে দিলাম ভাইয়া।”

শেরহাজ দুষ্টুমির চটে দাঁত কেলিয়ে হাসল। শারফান দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,

“বেয়াদব কোথাকার। মেয়েটার বয়স তোর ভাবী চেয়ে একবছর কম। আর এক বছর অপেক্ষা করতি। তা না করেই তোর থেকে তোর কাম সারতে হলো?”

“উফ ভাইয়া ঝগড়া লাগাছো কেন? সে রাতে ঐ মিমলিকে তোমার রুমে ঢুকতে দেখে মাথা পাগলায় গেছিলো। ঠিক ভুল কি আর খেয়াল করছিলাম নাকি যতসব!”

শারফান উদাস হয়ে বলে,

“হায় কপাল দেখলা আম্মু তোমার ছোট ছেলেও বাপ হয়ে যাবে। আর এদিকে আমার বিয়ের পাঁচ মাস অতিক্রম হবে। এখনো আদর করার সুযোগ শুদ্ধ পেলাম না। মেয়েটা একটা চিজ। একেবারে ধানি লঙ্কা। রুমের ভেতর খোঁটা মারতে মারতে আমার ব্রেনলুজ করে দিচ্ছে। যেনো আমি ইচ্ছে করেই দোষগুলো করে ছিলাম।”

শেরহাজ শয়তানি হেসে বলে,

“ভাইয়া তোমাকে একেবারে ফকিরবাবার মত লাগছে। বাহিরে একটা থালা নিয়ে বসায় দিলে মাসে শতখানেক কামাই করতে পারবা। ওহ না এরুপে পীর বাবার মতও লাগছো। পীরগিরি করতে বসে যাও। এটাই বেস্ট হবে। বউকে বশ করে ছয় চক্কা মেরে জ্ঞান ফিরিয়ে বলবা, শেষ তুমি জিতলে। এত চিন্তা করিও না ভাই চলো তোমাকে পীরগিরির ট্রেনিং দেয়।”

শেরহাজের ফাজলামি শারফান ভালোই ধরতে পেরেছে। রাগে তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে শেরহাজকে ধাওয়া করতে লাগল। শেরহাজও মা*ই*রের ভয়ে এদিক ওদিক ছুটছে। উপায়ন্তর না পেয়ে শাহানার রুমের ভেতর ঢুকে পড়ল। চমকে গেলাম দুভাইয়ের কাণ্ডে। দুজনে একে অপরকে ধাওয়া কেন করছে বুঝছি না। এতক্ষণ যাবত শাহানার কাছ থেকে জারিফার বহু রুপীর কাহিনি শুনেছি। সে যে আমার ছোট ননদীনি বুঝতে পারলাম। তবে ননদীনি আর ধরা যাবে না দেখতে গেলে জারিয়া ওরফে মিমলি এখন আমার দেবরানী। শেরহাজ কৌশলে শারফান কে জোরেসরে ধাক্কা মারল। তাতে শারফান হোঁচট খেয়ে বিছানায় আমার উপর পড়ে যায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)থমকে গেলাম আমি। কি হলো এটা? শারফানও হতবাক। শেরহাজ আপনমনে ‘ইয়েস’ বলে শাহানাকে ইশারা করে রুম থেকে বের করিয়ে আনল। আমার হাত কাঁপছে। লোকটার শরীরের থেকে লাক্সের ঘ্রাণ আসছে। বোধহয় গোসল করেছে। আফিমের ন্যায় আমার শরীরে উত্তেজনার সৃষ্টি হচ্ছে। এত মাস স্বামী সোহাগ হতে বঞ্চিত। তার উপর স্বামীর কাছ থেকে প্রেমের অনুভূতি পাওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমায় জর্জরিত করে দিচ্ছিল। আজ এতটা কাছে লোকটার আগমনে আমি নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ব। ঢোক গিলে তার চোখের থেকে চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে বললাম।

“দদদেখুন উঠে পড়েন‌। আমি যেতে চাই।”

শারফান এর কথাটা পছন্দ হলো না। সে আয়েশ করে নিজের শরীরের ভর ফেলে বলে,

“কোথায় যেতে চাও সেটাও বলে দাও জানেমান। বুকে নাকি অন্য কোথাও?”

বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম।

“ছিঃ কি বলছেন কোথায় যেতে চাইবো? বলছি সরেন।”

“উহুম দেখছি আমার বউ খুব নির্লজ্জ। আমি বলেছি কোথায় যেতে চাও। সে ছিঃ ছাঃ করে অন্যকিছু বুঝে নিয়েছে। আচ্ছা অন্যকিছু কি বুঝেছো একটু বলবে জানেমান?”

কথার পরেই চোখ টিপ মারল শারফান। লজ্জায় আমতা আমতা করে চট করে ধাক্কা মারলাম তাকে। লোকটা উবুর হয়ে অন্যপাশে শুয়ে গেলো। আমিও নিজেকে ঠিক করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলাম। তার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম।

“একদম গলানোর চেষ্টা করবেন না। আমি আপনার কাছে কোনো ভাবেও ধরা দেবো না বুঝলেন?”

শারফান বাঁকা হেসে বলে, ‘তবে এসে দেখাই!”

চমকে সুরসুর করে রুমের দরজা খুলে বেরিয়ে গেলাম। ছিঃ চরম অসভ্য হয়েছে স্বামী তার।

চলবে…….

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১৪

“এই জামাই এতো পালাই পালাই করছো কেনো হ্যাঁ? ভয় পাচ্ছেন কেনো? দুনিয়ার যে কোণেই লুকিয়ে থাকেন না কেন আজ আপনার দুর্ভাগ্য স্বচক্ষে দেখিয়ে দিচ্ছি। আমি আপনার প্রাক্তন হয় তাই না! কলিগদের সাথে এসবনি কথা বলেন?”

জয়নাল মিয়া শুনেই চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে চুপটি করে বসে গেলেন খাবার টেবিলে চেয়ার টেনে। শাহানাকেও চুপ করে খাওয়ার জন্য ইঙ্গিত দিলেন। আমি ঝাড়ু হাতে নিয়ে রুমের ভেতর ডাইনি রুপে দাঁড়িয়ে আছি। স্বামী আমার অথচ বাহিরে আমায় নিয়ে ঠাট্টা মশকারী মারে সাহসের শেষ নেই তার। অন্যদিকে আলমারির ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে শারফান। নিজেই কপাল চাপড়ে নিজেকে গালি দিচ্ছে বেচারা। আনমনে বিড়বিড় করে বলে,

“ধ্যাঁত মাইলের পুলা পাইন কোন কুলক্ষণে তাদের কে হেল্প করতে এনে ছিলাম। গাধার দলবল একেবারে আমার বিয়ের বারোটা বাজিয়ে রফাদফা করে দিলো।”

শারফান উদাস হয়ে ভাবান্তর হলো। তার বউয়ের আগমনের আজ গুনে গুনে এক সপ্তাহ অতিক্রম হয়েছে। সে না পারল বউকে মানাতে, না পারল বউকে আদরে জাপটে নিতে। রাতবিরেতে হাত-পা ছুড়াছুড়ি করে এক প্রকারে কাবাডি খেলে মেয়েটা। যার কারণে সে বিরক্ত হয়ে নিজেই বর্ডার বানিয়ে একপাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমাই। আজ ভেবে ছিলো তার লেংটা কালের কলিগ দুটো-রে দিয়ে বউকে পটিয়ে নিবে। দ্বিতীয় বার বউকে আপন করার সুযোগের রাস্তা গড়বে। হলো তার পুরোটা উল্টো। কলিগ দুটোর মধ্যে একজন হলো ফারেজ আরেকজন আরফ। এতটা ফাজিল ছিল তারা ফারজানা কে দেখেই উচ্চস্বরে ফারেজ বলতে লাগল।

“ওওওও তাহলে এই চলছে তোর মনে শারফান। তুই আমাদের গুণবতী ভাবী কে রেখে কিনা অন্য মেয়েকে খোঁজার কথা বলিস। ছিঃ ছিঃ বিবেক দিয়ে ভাববি না। তোর বউ আছে কোথায় তারে দ্বিতীয় বিয়ে করবি। উল্টো তা না করে অন্য মেয়েকে বিয়ে।”

আরফ ফারেজের সাথে তাল মিলিয়ে বলে,

“ছিঃ শারফান তুই আর্দশ শিক্ষক হতে পারলি কিন্তু একজন আর্দশ জামাই হতে গিয়েও পারলি না। এই নিয়ে তোর জীবনের শিক্ষাই বৃথা-রে বন্ধু। তোর দ্বারা আসলেই ভাবীকে বিয়ে করা উচিৎ হয়নি।”

শারফান দু’বন্ধুর পল্টি খাওয়া দেখে হতভম্ব হয়ে গেলো। চট করে পিছন ফেরে দেখল তার বউ অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলে,

“যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়‌। আরে গাধার দল তোরা এতকিছু বলে তো ফেললি এবার তোদের ভাবীর হাত থেকে আমিও তোদেরকে রক্ষে করতে পারবো না।”

শারফানকে বিড়বিড় করতে দেখে আরফ আর ফারেজ তার পাশে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

“কি হলো চুপ মারলি কেনো?”

“হাহাহাহা কারণ বাঁশ খালি আমি একলা খাবো না তোরাও খাবি। ওয়েট এন্ড সি।”

বলেই শারফান ঘাপটি মেরে এককোণে ইতস্তত মুখ করে দাঁড়াল। ফারজানা এগিয়ে নম্র গলায় তার স্বামীর বন্ধু দুটোকে বলে,

“আপনারা কি শারফানের ছোটবেলার ফ্রেন্ডস?”

শারফান পেছন থেকে না না করে ইশারা করছে। তার মানে না বলতে ইঙ্গিত করছে। গাধা দুটো মশকারী ভেবে ‘জ্বি ভাবী’ উচ্চস্বরে বলে। শারফান শুনে কপাল চাপড়ালো। ফারজানা দেখে বলে,

“ওহহ তাহলে একটু দাঁড়ান দুজনে।”

এই বলে ফারজানা কোথায় যেনো গেলো। তারা যেদিক দাঁড়ায় আছে সেদিকটা খোলামেলা ঘাসে ঘেরা স্থান‌। এ জায়গাকে ঘুরন্ত স্থান বলে। এখানে পর্যটক গণ এসে ঘুরতে মজা পান। মূলত শারফান তার বউকে পুনরায় বিয়ে করার জন্য প্লানিং করতেই তার কলিগ দুটোকে ডেকে ছিল। অথচ এরাই তার বউকে মেসেজ করে এই জায়গার ঠিকানা দিলো। যা মাত্রই ফোন বের করে ফারেজ দেখালো। আরফ হেসে কুটিকুটি অবস্থা তার। তারা বেচারা জানেও না কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সাথে কি হতে চলেছে?
আচমকা আরফ ‘আহহহ’ করে চিল্লিয়ে উঠল। তাকে ঝাড়ু দিয়ে বারি লাগাচ্ছে শারফানের বউ। বেচারা ভয়ে গাছের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। তার কলিগ দুটো মাইর খেয়ে ভয়ে সুরসুর করে পালালো। শারফানকে আর পায় কে? সেও ছুটে বাড়ির দিকে গেল। তার বউ পেছন থেকে চিল্লিয়ে থামতে বলছে। কিন্তু সে থামল না। সবার কাছেই তার প্রাণ সবচেয়ে প্রিয়। ভাবনা থেকে ফিরল যখন খেয়াল করল। রুম থেকে কোনো ধরনের সাড়া শব্দ আসছে না।। ঢোক গিলে আস্তে ধীরে আলমারির ফাঁকা গর্ত দিয়ে চোখ দিলো। দেখল তার বউ চুপ করে ঝাড়ু হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুমের দরজার দিকে। এপাশ ওপাশ তাকাচ্ছি। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম।

“ঐ জামাইয়ের বাচ্চা শুনতে পাচ্ছেন না? গত কয়েকদিন আগেও প্রেমের বড়বড় বাণী শুনালেন রোমান্সের র বোঝার ক্ষমতা হয়েছে বললেন। এখন কোথায় আপনার রোমান্সের বয়াম হুম? ঢেঁড়স হয়ছেন একেবারে। আজ ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়ে বুঝাবো দ্বিতীয় বিয়ের অর্থ কি?”

শারফান মুখ বাঁকিয়ে কপাল চাপড়ে কণ্ঠ নিম্ন করে বলে,

“জানেমান বিয়েটা আমি তোমাকে করব বলেছিলাম। কিন্তু ঐ ফাজিলের ড্রাম দুটো ইচ্ছে করে আমায় ফাঁসিয়েছে। বিশ্বাস করো তোমার জামাই একেবারে দুধে ধুঁয়া তুলসী পাতা। এইটুকুন পরিমাণ দোষত্রুটি নেই তার মধ্যে। ইনসেন্টের উপর পিএইচডি করছেরে বউ।”

চট করে আলমারির দরজা খুলে গেলো। বউকে সামনে দেখে তার বুক ছ্যাঁত করে উঠল। দুহাত ধরে দরজা খুলে উড়নচণ্ডী রুপে তাকিয়ে রইলাম। শারফান আমতা আমতা করে বলে,

“আমার সোনা আমার মনু তুমি তোমার জামাইকে মারলে তোমার শ্বাশুড়ি রাগ করবে বলছেন।”

“ওহ আচ্ছা তাই আর কি কি বলছেন আমার শ্বাশুড়ি আম্মা একটু শুনি?”

শারফান ঢোক এদিক ওদিক দৃষ্টি বুলিয়ে ক্যাবলামার্কা হাসি দিয়ে বউয়ের বগলের নিচ থেকে বের হয়ে বিছানার নিকট দৌড় দিল। স্বামীর কাণ্ডে তার আগুপিছু দৌড়াচ্ছি। রুমের মধ্যে যেনো টনেডো বয়ে যাচ্ছে। শারফানকে থামতে বলছি কিন্তু সে থামছেই না। শারফানও মনে মনে শয়তানি পরিকল্পনা করে রেখেছে। সে কৌশলে দৌড়ের মাঝেই রুমের দরজা আঁটকে দিলো। এবার সে হুট করে একদিকে দাঁড়িয়ে গেল। শারফানকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতে দেখে হোঁচট খেয়ে তার বুকের উপর ঢলে পড়লাম। সে দিগ্বিদিক না ভেবে আমার নাকে জোরে সরে কামড়ে দিলো। ‘আহহহহ’ শারফান এর গাল সরিয়ে চেঁচিয়ে বললাম।

“এই খব্বিশ বেডা আমার নাক কামড়ে দিলেন কেনো! ছিঃ এখন এই লালে ভরা দাগ নিয়ে আমার শ্বশুর ননদীর সামনে যাবো কেমনে? দেবরও তার বউয়ের সাথে ডাইনিং রুমে আছে। ছিঃ বেশরম স্বামী একটা। অন্যকিছু ও করতে পারতেন। এই কি করলেন?”

শারফান লাজুক ভঙ্গি ধরে বলে,

“সত্যি পুনরায় বিয়ে করার আগে বাসর করতে দেবে?”

কথার ছলে সে তার বউয়ের থ্রিপিচ এর উড়নার সেফটিপিনে হাত লাগিয়ে খুলতে নিলো। দেখেই মেজাজ বিগড়ে গেলো। তার হাতে চাপড় মেরে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখ ঝামটা দিয়ে বললাম।

“হাহ্ আইছে নবাবজাদার বাণী। বিয়ে হওয়ার আগেই দুনিয়ার বদচিন্তা সব মাথায় নিয়ে ঘুরে। খবরদার যদি বিয়ে করার আগে আমায় টার্চ করেছেন তো। সামনের সপ্তাহে ননদীর পরীক্ষা। তার পরীক্ষায় ধ্যান দিন।”

“এ্যাহ শাহানার সামনে পরীক্ষা তোমাকে কে বলল? উল্টো তোমার এনা সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা আরম্ভ হবে। ও ম্যাডাম আপনি হয়ত পরিস্থিতির পরিক্রমায় মাসের গণনা করতে ভুলে গিয়েছেন। আপনি ছিলেন না যে মাসে সে মাসেই শাহানার পরীক্ষা আরম্ভ হয়ে শেষ হয়ে গিয়ে ছিল। শ্বশুরবাড়ির খবরাখবর তো রাখতেন না আপনি। দুনিয়ার পরছেলের কোলে ঘরে পড়া ছাড়া। কি যেনো নাম? ওহহ মির্জা তাই না?”

শারফানের কথায় হকচকিয়ে গেলাম।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)আসলেই আমার মাসের আর শ্বশুরবাড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনার খেয়াল ছিল না। কবে শাহানার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো জানলামই না। পরক্ষণে নিজের গাফিলতির জন্য অনুশোচনা হলো‌। মাথা নুইয়ে বললাম।

“আপনার সাথে বিচ্ছেদের পর আমার সবকিছুই বিতৃষ্ণা লাগছিল। হয়ত সে কারণেই আমি জানার প্রয়োজন বোধ করেনি এই বাড়িতে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেই ব্যাপারে। আচ্ছা তার মানে সামনে আমার পরীক্ষা? ইয়া আল্লাহ সামনের সপ্তাহেই তো পরীক্ষা। ইশ্ দাদুরবাড়ি গিয়ে পড়ায় আন্ডা পাবার ব্যবস্থা করেছি। বইয়ে হাতই দেয়নি।”

“তাইত বলি তোমার সুটকেস ঘেঁটে কাপড় গুছিয়ে রাখার মাঝে বিন্দুমাত্র ধুলাবালি পায়নি। অথচ বইগুলোর দিকে যখন চোখ পড়লো। সঙ্গে সঙ্গেই বইগুলোর আত্মার মাগফেরাত কামনা করলাম। ভেতরে কখনো খুলে দেখেছো কিনা সন্দেহ ! একজন পরীক্ষার্থীর বইয়ে কোনো মার্কারের দাগ নেই। নিশ্চিত সেই পরীক্ষার্থী একজন মুলা।”

“এই আপনি খোঁটা মা*রা বন্ধ করেন তো। কোথায় কলেজের মাস্টার্স হয়ে আমায় পরীক্ষার জন্য হেল্প করবেন তা না করে খোঁটা দিচ্ছেন। এখনি বইয়ে সবকিছু সাজেশন দেন।”

“হাহ্ বকেও আবার সাজেশন ও চাই। দিতাম না যাও ভাগো।”

আমি হাতে সেফটিপিন খুলে তার দিকে নিশানা করলাম। সঙ্গে সঙ্গে শারফান বাংলা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান বই নিয়ে বসে দাগানো আরম্ভ করে। আমি দেখে মুচকি হাসলাম। নম্র গলায় বললাম।

“মির্জা আমার ফুপাতো ভাই‌। তার সাথে আমার কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিল না। সেদিন কলে শুধু আপনাকে জ্বালাতন করতেই ওসব কথা বলে ছিলাম। এর বেশি কিছু নয় কসম।”

বলেই রুম থেকে লজ্জায় ছুটে বেরিয়ে গেলাম। শারফান বইয়ে দাগানোর মাঝেই প্রাণমেলে হাসল। শেরহাজ ভাবীকে চলে যেতে দেখে রুমে উঁকি দিয়ে ভাইয়ের হাসি দেখলো। সেও মৃদু হাসল। আনমনে হেঁটে নিজের রুমে চলে আসল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল মিমলির উদাসীন মুখখানা। জানালার ধারে বসে পেটে হাত রেখে আছে। শেরহাজ মনে মনে ভাবল।

“না আর কষ্ট না দেয়। সবাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতেই তৎপর হয়েছে। সেখানে আমি কেনোই বা নিজ স্ত্রীকে কষ্ট দেবো। তার চেয়েও বড় কথা এই স্ত্রীর গর্ভে তার সন্তানের আগমন ঘটবে। বাবা-মায়ের মধ্যকার দ্বন্দ্বের মাঝে নিষ্পাপ বাচ্চার কি দোষ? তার মাও তো ক্ষমা চেয়ে সোহাগ পেতে চেয়েছে বারবার। আমিই তো জেদ দেখিয়ে ধমকেছি, দূরে ঠেলেছি। আমি জানি মিমলির ধারণা আমি তার প্রেগন্যান্সির ব্যাপারে জানি না। কিন্তু এ যে মিথ্যা ধারণা।”

শেরহাজ ধীরস্থির পায়ে গিয়ে মিমলিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। হঠাৎ গরম হাতের স্পর্শে মিমলি কেঁপে উঠল। আজ কত মাস পর যেয়ে সে তার স্বামীর স্পর্শ পেয়েছে ভেবে কুল পাচ্ছে না মিমলি। তবুও ঘোরে ধরেছে ভেবে নিজেই ছাড়ানোর জন্য হাতজোড়া খোলার চেষ্টা করে। শেরহাজ ফিসফিসিয়ে বলে,

“বাবুর আম্মুকে কিছুটা সোহাগ দেওয়া যাবে কি?”

কথাটা শুনে মিমলি থমাকানো দৃষ্টিতে পিছনে তাকালো। শেরহাজ স্বাভাবিক ভাবে তাকিয়ে মিমলিকে ছেড়ে দিলো। সন্তপর্ণে দরজা লাগিয়ে মিমলিকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় রাখল। মিমলি ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে। এতো কিছুক্ষণ বাদেই চোখ থেকে পানি টপকে পড়তে লাগল। যখন শেরহাজ গভীর স্পর্শ করতে হাত ছুঁয়ে দিলো। মিমলির চোখের জলের স্পর্শে শেরহাজ ফিসফিসিয়ে বলে,

“ওতো ভেবো না আমার বাবুর আম্মু। চুপটি করে আরামে বাবুর আব্বুকে জড়িয়ে নাও।”

মিমলি খুশিতে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলো। আজ থেকে তার সুখের দিনের গণনা আরম্ভ। তবে তা কতদিন টিকবে সেটা একমাত্র রবই ভালো জানেন!
সন্ধ্যা হওয়ায় নামাজ পড়ে পড়ার টেবিলে চেয়ার নিয়ে বসে বই ঘাঁটছি। তীব্র গরম থেকে ঘার্মাক্ত শরীরে হাতে খাতার বান্ডিল নিয়ে শারফান বাড়িতে ফিরেছে। আজ এইচএসসি ব্যাচের এডমিট কার্ড দিয়ে সব আদেশাধীন করে , নবম শ্রেণীর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার খাতা নিয়ে আনল। বাংলা আর ইংরেজি মিডিয়াম মিলে প্রায় ষাটটা খাতা। সে যেহেতু রসায়ন বিভাগের প্রশিক্ষক সেহেতু তার পক্ষের খাতাগুলো অন্যদের তুলনায় বেশিই। শারফানকে ক্লান্ত হয়ে সোফায় বসতে দেখে চট করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলাম। শরবত আর নাস্তা বানিয়ে রুমে এসে দেখি শারফান নেই। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ পেয়ে বুঝলাম লোকটা গোসল করছেন। তাই স্বামীর জন্য কাপড় বের করে বিছানায় রেখে পুনরায় পড়তে বসলাম। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে স্বাভাবিক গলায় বললাম।

“আপনার জন্য শরবত আর নাস্তা রেখেছি খেয়ে নিন ভালো লাগবে।”

কথার মাঝে খেয়াল করলাম ঘাড়ের উপর ঠান্ডা পানির ফোঁটা পড়ছে। ঢোক গিললাম লোকটা আমার এতটা কাছে কেনো? চেয়ারটা টেনে শারফান তার মুখোমুখি এনে আমায় চেয়ারে আটকে নিলো। গলায় স্বর নিম্ন হতে নিম্নতর হয়ে যাচ্ছে। শারফান মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলে,

“ইউ আর লুকিং টু ইয়াম্মি জানেমান। আই ওয়ানা ইট ইউ ওয়ানডে। নাউ আই উইল গিভ ইউ মাই লাভবাইট।”

চলবে…..

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-১২

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১২ (আগমন)

রুমের বাহির থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনে শেরহাজ এর ঘুম ভেঙ্গে গেল। তৎক্ষণাৎ উঠে বসে সে। বিছানায় তাকিয়ে দেখল মিমলি বাচ্চাদের মত তার হাত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। বিয়ে ছাড়া যা না হওয়ার কথা তা হয়েই গেলো শেষমেশ। সে পারেনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে। তবে পরিস্থিতি হাতের নাগালে রাখতে সে চটজলদি উঠে পড়ে। মিমলির ঘুম তখনো কাঁচা হয়ে থাকায় ঘুম ভেঙ্গে উঠতে পারেনি। একলা শেরহাজ গোসল সেরে জামা পরে রুম থেকে বের হতেই চাচীর ক্রন্দররত মুখশ্রী দেখতে পেল। যা একেবারে ন্যাকামি বৈকি আর কিছু নয়। সে ধীরপায়ে হেঁটে সোফার রুমে চলে এলো। যেখানে খুট খুট করে কাঁদছেন মিসেস জাহানারা। জয়নাল মিয়া মাথায় হাত ঠেকিয়ে বসে আছেন। শাহানা শারফান এর কাছে বসে কাঁধে হাত রেখে কি যেনো বলছে। শেরহাজ পরিস্থিতি কি হতে পারে বুঝে ফেলেছে। তাই তপ্তশ্বাস ফেলে নিজের ভুল স্বীকার করতে সকলের দৃষ্টিকার্ষণে গলা ঝাড়ে। এতে সবাই তার দিকে স্বাভাবিক চোখে তাকিয়ে পুনরায় চোখ ফিরিয়ে নেয়। শেরহাজ এর গলা কাঁপছে তবুও সে সত্য বলবে। মিমলিকে সে প্রাণে ভালোবাসে। তার সংসার পাতানোর খবর শুনে নেশাকে সঙ্গি করে ছিল। এখন আসল সময় ভেবেই সে বলে,

“জারিফা ওরফে মিমলি আমার রুমে ছিল পুরো রাত শায়িত অবস্থায় একত্রিত ছিলাম আমরা।”

সকলের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটল মত অবস্থা। শাহানা শুনেই দৌড়ে শেরহাজ ভাইয়ের রুমে ছুটে। দরজা খুলে একপলক তাকিয়ে চট করে দরজা বন্ধ করে দিল। স্তদ্ধ হয়ে সে সোফার রুমে এসে মাথা নাড়ল। মিসেস জাহানারার কান্না থেমে গেলো। তার পরিকল্পনা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেল বিধেয় তিনি থমকে মাটিতে কপাল চাপড়ে বসে পড়লেন। শারফান রাগে গিয়ে শেরহাজ এর গালে চ’ড় লাগায়। মিমলি ভয়ে কাঁদছে। সে তখনি জেগে গিয়ে ছিল যখন শাহানা রুমে দেখতে এসেছিল। এমুহুর্তে শেরহাজ চ’ড় খেয়েছে যার শব্দে সে আর বসে রইল না। কোনোমতে ফ্রেশ হয়ে থ্রিপিচ পরে রুমের বাহিরে ছুটে এসে দেখল শারফান শেরহাজকে বে*ল্ট দিয়ে আঘাত করছে। শেরহাজ নির্লিপ্ত রুপে আঘাত সহে নিচ্ছে। মিমলি কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে শেরহাজকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে। শারফান এর হাত থেমে যায়। মিমলি কাঁপা গলায় বলে,

“শেরহাজ ভাইয়া আমি মিমলি আপনার ছোট চাচাতো বোন। আমি কোনো জারিফা বা আপনার প্রাক্তন প্রেমিকা নয়। আমার মায়ের কুবুদ্ধির শিকার হয়েই আমার কালো রুপের বদলে এই রুপ ধারণ করেছি। আমি সত্যিতেই জারিফা নয়‌ এমনকি জারিফা কে জানতামও না। মা আমাকে জারিফার বেশভূষা শিখিয়ে পড়িয়ে আপনার সংসারে ফাটল ধরাতে নিয়ে এসেছিল। যাতে সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ আমার দ্বারা হাতাতে পারেন। বিশ্বাস করেন ভাইয়া আপনাকে আমি একতরফা আবেগে মোহ ভেবে ভালোলাগার দায়ে এসব করেছি। কিন্তু আমার আসল ভালোবাসা হলো শেরহাজ। সে ছাড়া আর কেউ নয়। সেই ছোট থেকে আমি শেরহাজ এর সাথে খেলেছি,পরেছি। তার পরিবর্তে আপনাকে আমি শুধুই মোহ ভেবেছি বৈকি আর কিছু নয়। আর গতরাতে মা আপনার খাবারে নেশার ওষুধ মিশিয়ে আমার সাথে এক রুমে বন্দি করে দিনে কুৎসিত ঘটনা রটাতে চেয়েছিল। তাই কৌশলে আমার খাবারেও মিশিয়ে দেয়। যাতে আমি অস্বীকার না করতে পারি। তবে ভাগ্যের পরিহাসে আমি আপনার সাথে নয় শেরহাজের কাছে ছিলাম‌। তাকে আর আঘাত করিয়েন না ভাইয়া প্লিজ। আমার আর আমার মায়ের দোষের শাস্তি শেরহাজকে দিয়েন না। সে কোনো নেশায় আসক্ত নয় সে তো আমার কারণে নেশাকে নিজের জীবনে জড়িয়ে ছিল। মায়ের বুদ্ধি ছিল আপনাদের সবাইকে আমার মিথ্যা সংসার পাতানোর কথা বলে জারিফা নামক এই আমি কে এই বাড়িতে আনা। সেই সবের ভিত্তিতে দেখলে মা আর আমি দোষী ভাইয়া। শেরহাজ নয়। তাকে রিহ্যাবেও পাঠিয়েন না প্লিজ।”

শারফান ধপ করে বসে গেলো। তার দ্বারা কত বড় ভুল যে ঘটে গেল সে ঠিক উপলদ্ধি করতে পারছে। তার বউ তার ফারজানা কোনো রুপ দোষ না করেও দোষের সাব্যস্ত হয়ে বাড়ি ছাড়ল। সেও বোকামি করে তাকে ফেরাইনি। তবে কি তার আম্মু সে কারণেই নারাজ হয়ে তার সঙ্গে দেখা দিচ্ছে না? হ্যা এটাই কারণ বোধ হয়। সে উত্তেজিত হয়ে গেলো। তৎক্ষণাৎ শাহানা কে বলে,

“এখনি শেরহাজের রুম সাজিয়ে নেয়। তোর ছোট ভাবী কে বরণ করার জন্য প্রস্ততি নেহ্। ঠিক সন্ধ্যা সাতটায় বিয়ের কার্য সম্পন্ন করা হবে।”

শেরহাজ উৎফুল্ল হলেও ভেতরে মিমলির জন্য চেপে রাখা রাগ কে নিয়ন্ত্রন করে নিলো। কারণ বিয়ের পরই সে চরম শাস্তি দিতে পারবে মিমলিকে। নাহলে অনাধিকার বলে গণ্য হবে ব্যাপারটা। মিমলির খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো। মায়ের কাছে যেতে নিলেই তার গালে বড়জোর চ’ড় পরে। তিনি হিংস্র হয়ে পুনরায় আঘাত করতে চাইলে শেরহাজ ধরে তাকে জড়িয়ে নেয়। মিসেস জাহানারা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে চুপ করে তাকিয়ে রইল। জয়নাল মিয়া মনযোগ দিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করে বলে,

“জাহানারা তোমাকে এই বাড়ি থেকে ত্যাজ্য করা হলো। এই বংশের যে বউয়ের অধিকার নিয়ে আমার ছোট ভাইয়ের হাত ধরে এসেছিলে। সেই বংশের অঙ্গীকার করে বলছি তোমার অধিকার আজ থেকে ছিন্ন করা হলো।”

মিসেস জাহানারার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল মত অবস্থা। তিনি তৎক্ষণাৎ বড় ভাইয়ের সমান জায়ের পা ধরে ক্ষমা চেয়ে কাঁদতে লাগলেন। কারণ আজ যদি তিনি অধিকার থেকে ত্যাজ্য হয়ে স্বামীর বাড়ি ফেরে তবে তার স্বামীও তাকে তালাক দেবে। সে তার স্বামীকে ভালোই চেনে। তাই কেঁদেকেটে হলেও বড় ভাইকে মানানোর চেষ্টা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি সবাইকে আদেশ করলেন।

“জাহানারা আর মিমলির দোষ দেখে দুজনকে শাস্তি স্বরুপ পর করা হচ্ছে। তোমরা এ বাড়িতে থাকলেও প্রাপ্য সম্মান আর মর্যাদা ছাড়াই থাকবে। তবে দেখতে গেলে মিমলি এ বাড়ির ছোট বউ হবে তাই তাকে বউরুপে বরণ করা হলেও তার পদবী হবে পরের মেয়ের মত। কারণ সে দোষী।”

জয়নাল মিয়ার কথায় শারফানরা অমত করল না। শেরহাজ কে মিমলি ধরতে চাইলেও সে স্বেচ্ছায় উঠে দাঁড়ায়। তার নিকট এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আমার ভালোবাসায় লা*থি মে*রে আবেগের কাছে ছুটে ছিলি না। এবার বুঝবি ভালোবাসা পেয়েও অবহেলিত হওয়ার পরিণতি কেমন? হারিয়ে পাওয়া ভালোবাসার চেয়েও কষ্টকর পেয়ে হারানোর। তুইও এই কষ্টে ভোগে যাবি প্রতিদিন। বউ হলেও তুই নামেমাত্র বউ রইবি মিমলি। নামেমাত্র বউ। এই শাহানা বোন আমায় একটু ব্যান্ডেজ করতে আয়।”

মিমলি ফুঁপাচ্ছে তার কিছু যায় আসে না সবাই কি বলেছে না বলেছে তাতে। তার কষ্ট হচ্ছে শেরহাজের আঘাত দেখে। সে চেয়েও পারছে না তাকে স্পর্শ করতে। অধিকার পেয়েও হারিয়ে ফেলল। সেই থেকে বিয়ের দিনকার সময়ে সবাই কৃত্রিম হাসি দিলেও তার মায়ের মন কিছুটা হলেও নরম হয়ে ছিল। নিজের মেয়েকে জায়ের বড় ছেলের সাথে না হোক অন্তত ছোট ছেলের সাথে তো বিয়ে করাতে পারলেন। মিমলি উদাস হয়ে অপলক তাকিয়ে থাকে তার আপন পুরুষের দিকে। শেরহাজ বিয়ের শেরওয়ানি পরে তার পাশে বরবেশে বসে আছে। এর চেয়ে খুশির দৃশ্য আর কি হতে পারে তার জন্য? লোকটা ভালোবেসে হোক বা ঘৃণা করে হোক। একরাতের বিনিময়ে আজম্মের সুখ তার পায়ের নিচে এগিয়ে দিচ্ছে। থাক না তার কাছ থেকে ভালোবাসা পেতে বিলম্ব হোক। তবুও সে কাছে থাকুক আজম্ম। মিমলি তার চোখের কোণে জমা পানি মুছে নিলো। শাহানা আড়চোখে খেয়াল করেছে। তারও মনে হয় ছোট ভাবীকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু কোথাও একটা ‘রা’ থেকে যায়। তপ্ত শ্বাস ফেলে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে নিলো। বিয়ের সময় আরম্ভ হতেই শারফান ভাইকে ইঙ্গিত দিলো। শারফানও অতি চালাকের সহিতে শাহানার কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলে,

“শোন মিমলির সাথে শেরহাজের সাথে আমারও ছবি উঠবে। সবগুলোতে আলাদা করে ক্রোপ করে আমাকে দিস। তোর ভাবীকে ও একটু জ্বালাবো। কম কষ্ট পায়নি তার থেকে। এমনিতে বাঘিনী আমার তার উপর সেরা সেয়ানা। আমায় ডোজ লাগাতে চেয়েছিল। একবার কাছে পায় দুমড়ে মুচড়ে ধরে ফেলব।”

“আহুম আহুম ভাই আমি তোর বোন।”

শারফান থতমত খেলো। আবেগের চটে বোনকে কি সব বলে ফেলল। বিব্রতবোধ লুকিয়ে বলে,

“এই কথা কম কাজে মন দেয়।”

তাদের কথা শুনে মিমলির মনে একরাশ আশার সঞ্চার হলো। তার ধারণা ফারজানা অর্থাৎ তার বড় ভাবী এলেই হয়ত সেও সুখের দিন দেখতে পাবে। শারফানকে হাসতে দেখে শেরহাজের মনে একটু হলেও অনুশোচনা বোধ কমেছে। ছোট ভাইকে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে বলে,

“এবারের মত মাফ করলাম। যদি তোর নেশা না ছাড়িস তবে রিহ্যাবে তোর জন্য সিট বুকিং দেবো।”

“না ভাই না প্লিজ বিয়ে হচ্ছে আমার। আর নেশাপানির দরকার ফরকার নাই। সব নেশাপানি দূর করার দায়িত্ব এখন থেকে এই মেয়ের।”

কিছুটা উঁচু গলায় বলে ফেলে শেরহাজ। যা শুনে লজ্জায় মিইয়ে গেল মিমলি। শাহানা সিটি বাজিয়ে তাল দিলো। মিসেস জাহানারা দেখে রইলেন। কাজী বিয়ে পড়ানো আরম্ভ করেন।‌ এই ফাঁকে ইতিমধ্যে শাহানার কাছ থেকে পাওয়া ছবিগুলো চটজলদি নিজের বউয়ের নাম্বারে পাঠিয়ে দেয়। শয়তানি হেসে বলে,

“আপ আইয়ে গা মাজা।”

বিয়ের পর থেকে বাসররাত্রিতেই শেরহাজ মিমলিকে পর করে দিলো। স্বামী সোহাগ বেচারির কপালে টিকল না। সে রাতে একই ছাদের নিচে দুজন শুয়ে ছিল আলাদা ঘরে। দিনকাল পেড়িয়ে যেতে লাগল। শেরহাজ সহ বাড়ির সবার কাছ থেকে হেয়ো পেয়ে মিমলি হাঁফিয়ে উঠতে লাগে। মাসের শেষ দিকে হঠাৎ তার বমি হতে লাগল। এতে মিমলি ওত ধ্যান দেয়নি। কিন্তু নতুন মাস আরম্ভ হতেই খেয়াল করে তার পিরিয়ড মিস গিয়েছে। ঢোক গিলল সে। তার কাজের মাঝে হাঁফিয়ে উঠা, অনাকাঙ্ক্ষিত সময়ে বমির ভাব আসা, পিরিয়ডের দিন মিস যাওয়া সবটা এখন আয়ত্তে নিয়ে তার ধারণা একদিকে ইঙ্গিত করছে। মিমলি সময় ব্যয় করল না। তৎক্ষণাৎ সকলের অগোচরে বাহিরে গিয়ে ফার্মেসি থেকে প্রেগন্যান্সি কিট নিয়ে এলো।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)নিজেকে ধাতস্থ করে পরীক্ষা করে দেখে। মিনিট দুয়েক পর যা দেখল তার চোখজোড়া বড় হয়ে গেলো। কিটে দুদাগ ভেসে উঠেছে। তার হাত কাঁপছে। এবার মিমলির মনে হলো সে’রাতে পিল খাওয়া হয়নি তার। তবেই কি সে’রাতের বিনিময়ে তার গর্ভে? ফুঁপিয়ে উঠে মিমলি। কাকে বলবে এ কথা? নিজের স্বামীও তাকে অবহেলার চোখে দেখে, ননদী,জা আর শ্বশুরও তাকে তার মায়ের কারণে দূর দূর করে ঠেলে দেয়। মিমলি কিছুটা সময় কান্না করে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ভেবে রাখল আজ রাতে সে শেরহাজ কে জানাবে। যাতে তাকে আর অবহেলার চোখে না দেখুক।
হঠাৎ ওয়াশরুমের দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো মিমলি। দরজা খুলতেই শেরহাজ রাগে ধমকে দিলো।

“এই মেয়ে সময়ের কোনো চিন্তে নেই? আমার ভার্সিটির ক্লাস আছে বুঝছো তোমার মত এখানে বসে বসে চক্রান্ত করি না। ক্লাসের সাথে টিউশনিও করাতে হয় আমার। রাতবিরেতে জবের এপ্লাই করে জবের খোঁজ লাগাতে হয়।”

মিমলি ঠোঁট কামড়ে ‘সরি’ বলে শেরহাজ কে জায়গা করে দিলো। মিমলির পাশ কেটে শেরহাজ বাহিরের পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মিমলির তখনি মনে পড়ল প্রেগন্যান্সি কিটটা বেসিনের উপর রেখে এসেছে সে। মাথায় হাত চেপে ভয়ে ভীতি হয়ে গেলো। কোনো ভাবে শেরহাজ জানতে পেরে ক্ষতি করতে চাইলে অথবা মেনে না নিলে? মিমলি জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে গেলো।
বিশ মিনিট পর শেরহাজ মুখ মুছতে মুছতে বের হলো। মিমলি অধীর আগ্রহে তাকিয়ে রইল। এই বুঝি লোকটা তাকে খুশিতে জড়িয়ে ধরবে। না তা হলো না শেরহাজ ধমকে বলে,

“এই মেয়ে স্বামীর সেবা করতেও জানিস না দেখছি। বাহিরে যাবো মিষ্টি নিয়ে আয়।”

মিমলি মুখ কালো করে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। কিছুক্ষণ পরই রসমোল্লাই বাটি করে এনে এগিয়ে দিলো শেরহাজের নিকট। সে বিরক্তকর গলায় বলে,

“মেয়েটার মাথায় বুদ্ধিসুদ্ধি নেই দেখছি। আমার হাতে কত কাজ চোখে পড়ছে না তোর? নিজ হাতে খাওয়ালে কি ফোস্কা পড়বে বেয়াদব কোনখানা।”

মিমলি অবাক চোখে তাকালো। শেরহাজ তার মনমতো কাজ করে যাচ্ছে। মিমলির ভয়ের চেয়েও বেশি অনুভূতির জোয়ারে দুল খাচ্ছে। তার স্বামী তার হাত থেকে খেতে চাইছে। কাজের বিনিময়ে হোক লোকটা খাবে সেই খুশিতে বিনা দ্বিধায় মুখের দিকে এগিয়ে দিলো। শেরহাজ খেয়ে বাটি থেকে দু-তিন চামচ করে মিমলিকেও খাওয়ে দিলো। সে শুধু অবাক চোখে দেখে গেলো। শেরহাজ গম্ভীর গলায় বলে,

“খাওয়ে দিছি বলে ভেবো না ভালোবেসে মাফ করেছি। তুমি আমার উপরে কর্তব্যরত তাই স্বামী হিসেবে খাওয়ে দিলাম।”

মিমলির খুশিতে ভাটা পড়ল কথাগুলো শুনে। মাথা নুয়ে নিলো। বাটি নিয়ে সরে যেতে গেলেই আচমকা তার পা কিছু একটার মাঝে লেগে হোঁচট খেতে গেলো। শেরহাজ তৎক্ষণাৎ তাকে ধরে ফেলে। রাগে তাকে দাঁড় করিয়ে বলে,

“এ মেয়ে ধ্যান কোথায় তাকে হ্যা? চোখ কি কপালে উঠিয়ে রেখেছিস? যা বিছানায় গিয়ে ঘুমা। সারাদিন ঢেং ঢেং করা ছাড়া কাজ নাই আর।”

মিমলি মুখ চেপে কাঁদতে লাগল। চুপটি করে বিছানায় গিয়ে কাঁথা মোড়ে শুয়ে পড়ল। আড়চোখে দেখে শেরহাজ বেরিয়ে গিয়েছে। তেমনি দিন যেতে লাগল।

বর্তমান,

“শারফানের বাচ্চা এই শারফানের বাচ্চা কোথায় রে তুই? হে এই শারফানের বাচ্চা কোথায় লুকিয়ে আছিস আজ তুই বাহিরে আসবি না হয় আজ তোকে খুঁজে পেলে জ্যান্ত চিবিয়ে ফেলব বেয়াদব।”

জয়নাল মিয়া দেখেই সুর সুর করে এককোণে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমার রাগে শরীর কাঁপছে। যেই থেকে ছবিগুলো দেখেছি সেই থেকে মাথার রগে টান পড়েছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বললাম।

“ঐ স্বামীর ঘরে স্বামী বাহিরে আসবি না আমি আসবো?”

শারফান ভাবছে যাবে কেমনে? বউ যে বাঘিনী রুপে এসেছে সামনে পেলে সত্যিতে চর্বণ করে ফেলবে। ফোন বের করে তৎক্ষণাৎ শাহানা কে মেসেজ করে। শাহানাও ভয়ে গুটিয়ে আছে। ভাইয়ের মেসেজ দেখে ঢোক গিলে বলে,

“ভাভাভাবী ভাইয়া কলেজে গেছে। এখন আসবে না।”

কথাটা শুনে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নিলাম। ইশ সামনে শ্বশুর আব্বু দাঁড়ানো আছে খেয়ালই করিনি। তৎক্ষণাৎ শ্বশুরআব্বুকে সালাম করলাম। শাহানা কে জড়িয়ে ধরে কুশল আদায় করতেই নজর গিয়ে পড়ল জারিফার উপর। তার পরণে মেরুন রঙের শাড়ি, গলায়,কানে,হাতে সোনার সেট পুরোদমে বাঙালি বউয়ের সাজে দাঁড়িয়ে আছে। শরীরের রাগ পুনরায় বেসামাল হতে লাগল। শাহানা খেয়াল করতেই তৎক্ষণাৎ আমায় জড়িয়ে বলে,

“ভাবী এটা তোমার ছোট দেবরানী।”

কথাটা আমার কানে যেতেই বিস্ময় নজরে জারিফার দিকে তাকালাম‌। আচমকা ‘কি’ উঁচু গলায় বলে তাকালাম শাহানার দিকে।

চলবে…….
(অতীত শেষ বর্তমান শুরু)

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-১০+১১

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১০ (চমক)

আজ শারফান পুরো বাড়ি ডেকোরেশন করেছে। তার বউ রেগে জেদে হলেও শ্বশুরবাড়িতে ফিরে আসছে সেটাই ঢের তার কাছে। শাহানাকে দিয়ে তার নিজের রুমটাকে বাসররুমের মত সাজিয়ে দেওয়ার জন্য নানান রঙিন ফুল সংগ্রহ করে আনিয়েছে। জারিফা(মিমলি)এককোণে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। তার একটাই আফসোস সে কেনো অসৎ উদ্দেশ্যে লিপ্ত ছিলো? সে যদি তার পক্ষ থেকে সৎ থাকতো তবে তারও সুন্দর এক সংসার হতো। চোখের কোণে জমে আসা পানি হাত দিয়ে মুছে ছুটে রুমে চলে আসল সে। পেটে হাত চেপে ফুঁপিয়ে উঠলো। তার অনাগত সন্তানের কথা কাকে জানাবে? নববধু হয়েও যেখানে কারো কাছে পাত্তা পেলো না , সেখানে তার অনাগত সন্তানের কথা শুনে যদি এবরশন করতে বলে! ভেবেই জারিফা(মিমলি)ভয়ে গুটিয়ে গেলো। আচমকা দরজায় টোকা পড়ার কারণে চোখমুখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করেই দরজার দিকে ফিরল। শাহানা কে গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও খুশি হলো সে। সম্পর্কে ননদ তাই আপনত্ব পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তারও ঢের। শাহানার নিকট গিয়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে চেয়েও থামিয়ে দিলো তাকে। জারিফার(মিমলির)মুখ কালো হয়ে গেলো। চুপটি করে তাকিয়ে রইল। শাহানা খুব বিরক্তের সহিতে হাতে থাকা বড় আকারের রুপার থালি জারিফার(মিমলির)নিকট এগিয়ে দেয়। জারিফা খুশি হয়ে থালিটি গ্রহণ করে বলে,

“আরে শাহানা এসবের…।”

“অশুভ মুখ দিয়ে কোনো কথা বের না করলে খুশি হবো ভাবী। তোমাকে ভাবী ডাকতেও না মুখে আটকে যায়। ঘৃণা করতে মন চাই তবে পারি না। কারণ তুমি এখন সম্পর্কে আমার ছোট ভাবী। না চাইলেও তোমায় সহ্য করা এ বাড়ির লোকদের দায়িত্ব আর কর্তব্য। এইসব আমার প্রিয় ভাবী ফিরে আসার খুশিতে ভাইয়া সবার জন্য আনিয়েছেন। দয়া করে বাড়িতে ভাবী থাকাকালীন কোনো সিনক্রিয়েট না করার অনুরোধ রইল। ভাবী এলে সবাই বরণ করতে চলে যাবে। তুমিও তৈরি হয়ে থেকো।”

শাহানা মুখ ফিরিয়ে জারিফার(মিমলির)রুমের ভেতর না ঢুকেই চলে গেলো। তার চোখ ছলছল করছে। সে হাতে থাকা থালির উপর তাকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসল। সবকিছু কেমন বিতৃষ্ণা লাগছে তার নিকট। কেনো এমন হলো তার সঙ্গে? তার মায়ের পাপ কেনো তার ভোগতে হচ্ছে। ওহ সেও তো কম লোভী ছিল না। তবে সেই লোভ তো #এক_মুঠো_সুখপ্রণয় এর জন্য ছিল। জারিফা(মিমলি)দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। চোখ বুজে নিলো। অতীতে ডুব দিলো। তার আসল পরিচয়ই হলো মিমলি।

অতীত,

শারফানের পায়ে ধরে হাজার ক্ষমা চাইলেও সে তার ভাই শেরহাজ কে ক্ষমা করল না। শেরহাজ খুব অনুতপ্ত। বাড়ির পরিবেশ গম্ভীর দেখে মিসেস জাহানারা তৎক্ষণাৎ পরিকল্পনা বদলে নিলেন। তিনি চটজলদি শারফান এর রুম পরিষ্কার করে দিলেন। জারিফাকেও স্বাভাবিক রুপে যেতে বললেন। সে গেলেও শারফান অদেখা করে রুমে চলে যায়।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) সেদিন পর থেকে প্রায় কয়েকবার শারফানের সামনে ঘুরঘুর করেও লাভ হতো না। শারফান হয় অফিসে নাহয় রুমে থাকতো। মিমলি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো শারফানের জন্য। যদি একবার দেখা পায় সেই ভেবে। কিন্তু ফলাফল শূন্য রয়ে যেতো। তার জন্য রাতবিরেতে মিসেস জাহানারার কোল চেপে কান্না করেছে মেয়েটি। এতে বেশ বিরক্ত বোধ করতেন তিনি। কারণ তিনি মেয়ের মত ততটা আবেগি নোন। মেয়ে যে তার ছোট থেকেই আবেগি তা নিয়ে তিনি অবগত। কৃষ্ণকুমারী মেয়ের কপাল বলে কথা! রাজপুত্র দেখে প্রেমে পড়লেও তাকে সহজে হাতানো যায় না দেখেই নিজের মেয়ের সেই কৃষ্ণকুমারী রুপের বদলে সুন্দর চেহারার আদল জোগাড় করে দিলেন। এই রুপসী রুপ আর সুন্দর নামের মালিক সেই মৃত জারিফা হলেও তার পূর্ববর্তী নারীর আদল আর নাম শুনলে লোকজনের চেহারায় মেঘ ছেয়ে যেতো। এমতা তার নিজ স্বামীও। তিনিও মেয়ের কৃষ্ণকুমারী রুপের কারণে তার কাছ থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন। স্বামীর কাছ থেকে নিজেদের মেয়ের প্রতি উদাসীনতা দেখে তিনিও উম্মাদে পরিণত হলেন। মেয়েকে সুন্দরীতমা বানিয়েই ছাড়বেন বলে পণ করে নিলেন। স্বামীর কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে ঋণ নিয়ে মেয়েকে নতুন রুপ দেন। অতঃপর তার মেয়ে যার নাম ছিল মিমলি। সেই আজ নতুন চরিত্রের বেশে এই বাড়িতে অবস্থান করছে। সেসব ভেবে তিনি পৈশাচিক হেসে মেয়ের মাথায় আলগোছে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। থাক কিছু দিনের আবেগ তারপরই সব তার মেয়ের হাতের মুঠোয় থাকবে। মেয়েকে সাড়া দিয়ে ঘুমে পাড়ি দিলেন তিনি।

সকাল ১১টা,
শেরহাজ তার ভাবীর কাছে ফোন দিচ্ছে । তবে কল উঠায়নি দেখে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। শারফানও কম পুড়েনি। রাত হলেই তার বুকের মাঝে খালি খালি লাগতো। মাকে সাথে দেখতে পেলেও তিনি তার সাথে কথা বলতেন না‌। এ নিয়ে হাজার বার প্রশ্ন করে ছিল মাকে। তবে তিনি জবাব দেননি। এর কারণ অবশ্য বাবার কাছে জানতে পারবে ভেবে বাবার কাছে ছুটে যায়। জনাব জয়নাল নিজের স্ত্রীর কবরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছেন। আজ অনেকদিন পর তিনি এসেছেন। এতদিন যাবত বাড়িতে ফারজানা ছিলো বলে মনে হত তার স্ত্রীর গুণ নিয়ে আরেক রুপে যমীনে এসেছিল মেয়েটা। শাহানার মত তাকেও তিনি মেয়ের চোখে স্নেহ করে গেছেন। সে নেই, বাড়িটার মাঝে শান্তিও নেই। হঠাৎ পাশে কারো আহাট পেয়ে তিনি মুচকি হেসে বলেন,

“বাপ এভাবে পায়ে পা না মুচড়ে কি বলতে চাইছিস বলে ফেল!”

“আব্বু তুমি বুঝলে কেমনে এটা আমি?”

জয়নাল মিয়া স্বাভাবিক নয়নে চেয়ে ছেলের কাঁধে হাত বুলিয়ে বলেন,

“তুই আমার রক্ত , পারিবারিক দ্বন্দ্বের মাঝে তোর জন্ম। তোকে ঘিরে তোর মায়ের হাজারো স্বপ্ন ছিল। সেই স্বপ্নের মধ্যে আমি ছিলাম রাজা আর তোর মা রাণী। তুই হলি সর্বপ্রথম রাজপুত্র। তোকে আমরা দুজনেই দূর থেকে অনুভব করতাম।”

শারফান এর শুনে কি হলো কে জানে! সে সোজা তার বাবাকে জড়িয়ে ধরল। চুপ করে দুজনে দাঁড়িয়ে রইল‌। সে হঠাৎ করেই কাঁপা গলায় বলে,

“আব্বু আম্মু আজকাল মুখ লটকিয়ে রাখছে কেনো? আমার সাথে কথাও বলছে না। আমি ডাকলে মুখ ফিরিয়ে রাখছে। যেনো আমি কোনো বড় অপরাধ করে ফেলেছি।”

জয়নাল মিয়া মনযোগ সহকারে ছেলের কথা শুনলেন। তিনি ছেলেকে বোঝালেন এই বলে,

“তোর মা তোর সাথে রাগ করেছে। কারণ তুই তোর বউকে চলে যেতে দিয়েছিস। এটা তো ঠিক ছিল না। তোর উচিৎ ছিল তাকে মানিয়ে নিয়ে আসা। তুই কি করলি উল্টো পরের কোন এক মেয়েকে ধরে নিজের বউয়ের সাথেই পরের মত ব্যবহার করলি তা কি ঠিক হলো? তোর আম্মু এই কারণেই রেগে আছে।”

বাবার কথায় সে ঠিক ধরলেও মনটা উদাস হয়ে গেলো তার। সে মাথা নেড়ে তৎক্ষণাৎ গাড়িতে গিয়ে বসল। বাড়িতে এখন আর তার মন টিকবে না। কারণ যেখানে প্রণয় ভাগকারী ব্যক্তিটিই নেই সেখানে সুখ প্রণয় কি পাওয়া সম্ভব? সে গাড়ির ভেতর থেকে জানালার বাহিরে তার বাবার দিকে তাকিয়ে রইল। তার বাবার সুখপ্রণয় বুঝি এ স্থান? হুম হয়তবা এ স্থানই। কেননা তার মা যে সেই সামনের কবরে সুখনিদ্রায় শায়িত অবস্থায় আছেন। মনের উদাসীনতা লুকিয়ে সে ড্রাইভার আঙ্কেল কে কলেজের দিকে গাড়ি ঘুরাতে বলল। শাহানার এসএসসি পরীক্ষা সামনে। তার পরের এক মাস পরেই এইচএসসি পরীক্ষা। সব মিলিয়ে তার কাঁধে খুব চাপ। পরীক্ষার হলে কাকে কখন ডিউটি দিতে হবে, কোন কক্ষে কত রোল পর্যন্ত ছাত্র ছাত্রী বসবে এসব নির্ধারণের দায়িত্ব তার উপরে। ড্রাইভার মালিকের ছেলের কথামত গাড়ি কলেজের রাস্তায় নিলো। শারফানের গাড়ির যাওয়ার দিকে নির্লিপ্ত চোখে তাকিয়ে রইল মিমলি। (গল্পের সুবিধার্থে আসল নামটিই ব্যবহার করছি)
উদাসী গলায় গেয়ে উঠে।

“আপনি আমার মোহ বৈকি কিছু নয়।”

হঠাৎ কারো সাথে ধাক্কা লাগায় মিমলি পড়তে গিয়েও পড়ল না। রেগে পিছু ফিরতেই শেরহাজকে দেখে চুপ হয়ে গেলো। শেরহাজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জারিফা নামক ব্যক্তির আপাতমস্তক পরখ করে। এতে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায় মিমলি। কোনো রূপ কথা না বলেই শেরহাজ কে পাশ কাটিয়ে দৌড়ে রান্নাঘরে নিজের মায়ের কাছে চলে গেলো‌। রান্নাঘরের ভেতর ঢুকে জোরে জোরে হাঁফাতে লাগল। একটুর জন্য ধরা খেয়ে যেতো সে। মিমলি কে হাঁফাতে দেখে তার মা মিসেস জাহানারা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করেন।

“কি হলো এভাবে হাঁফিয়ে উঠলি কেন?”

“আম…আম্মু শেরহাজ ভাইয়ের নজর থেকে পালিয়ে এসেছি।”

তিনি চমকে গেলেন। হাতের কাজ রেখে মেয়েকে চেপে ধরে রুমে টেনে নিয়ে গেলেন। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে আপাতমস্তক চোখ বুলিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেললেন। ঢোক গিলে বলেন,

“দেখ সাবধানে থাকিস শেরহাজের নজর থেকে। শেরহাজ মোটেও শারফানের মতো নয়। দুই ভাই একেক প্রকৃতির। সে যদি একটুও তোর ব্যাপারে আঁচ করতে পারে। তবে আমাদের পরিকল্পনা কখনো সফল হবে না।”

মিমলির মন পুনরায় খারাপ হয়ে গেলো। সে জানে তার মা কেনো শারফানের প্রতি অধিক আগ্রহ পোষণ করে। সম্পত্তির অর্ধেক ভাগ শেরহাজ আর শাহানা পাবে। বাকি অর্ধেকের সঙ্গে জয়নাল মিয়ার জমিজমার দলিলাদি পাবে শারফান। সেক্ষেত্রে দেখা গেলে শারফানের হক সবগুলোতে বেশি। মিমলি জানে তার মন চাইলেও সে সাড়া দিতে পারবে না। একদিক থেকে তার কাছে মনে হয় সে শারফানকে ভালোবাসে। তবে শেরহাজ কে দেখলে তার অনুভূতির মধ্যে উম্মাদের ন্যায় জোয়ার উঠে। তখন সে দোটানায় ভোগে।শেরহাজ এর ভালোবাসা তখন তার কাছে একতরফা ভালোবাসা মনে হয়। এ কথা ভাবলেও সে বেসামাল হয়ে পড়ে। মিসেস জাহানারা মেয়ের চোখমুখে শেরহাজের প্রতি ভাবান্তর হচ্ছে দেখে তৎক্ষণাৎ মেয়ের গাল চেপে ধরে বলেন,

“দেখ মা তোর মন মাঝারে খালি শারফানের নাম হবে বুঝেছিস কি নাম? শারফান। ভুলে যাহ্ শেরহাজের সাথে তোর কৈশোরকালীন সম্পর্কের কথা। আমিও শারফানের বিয়ের আগে সবাইকে জানিয়েছি তোর সংসার অন্যত্রে পেতেছে। তুই আমার সাথে রাগ করে বিদেশে গিয়ে অন্যত্রে বিয়ে করে সেখানেই স্যাটেল হয়ে গেলি। এতে অবশ্য শেরহাজ তোর প্রতি আগ্রহ হারিয়ে সামনে আগাবে।”

মায়ের কথায় বুকটা ধুকপুক করে উঠল মিমলির। সে কি তবে সহ্য করতে পারবে শেরহাজের সাথে অন্য কারো বন্ধনী! সে আর ভাবতে পারছে না দুদিকের জোয়ারে ফেঁসে গেছে। কথাবার্তা হীন পরণে বাদামী কটি জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি হতে। মিসেস জাহানারার শত ডাকেও থামেনি সে। তিনিও অধিকান্তু আগ্রহ দেখালেন না। নিজ কাজে লেগে পড়তে গেলে তার স্বামী কল দিয়ে বসেন। তিনিও ফোন চেপে চোরা গলায় বলেন,

“এই মিমলির বাবা ফোন করছো কেনো? আরো কাপুরুষ নামক শব্দ শুনে গালি খেতে চাও? না খেতে চাইলে চুপচাপ যেখানে পড়ে আছো সেখানে পড়ে থাকো। আমি আমার উদ্দেশ্য হাসিল না করা পর্যন্ত এ বাড়ি থেকে যাচ্ছি না। ভাগ্যিস সেরাতে ফিরে গেলেও ভাইয়া পুনরায় আমায় ডেকে পাঠিয়ে ছিলো। তিনি তো মোটেও আমার পরিকল্পনা ধরতে পারেননি। এতেই আমি বেশ খুশি। ভেবে ছিলেন আমি শারফানের উপর রেগে চলে গিয়ে ছিলাম। বোকা ভাই যে তোমার। কি ভাবে কে জানে? থাক এখন বেশি কথা বলতে পারবো না। আগে মেয়েকে শারফানের কাছে লেলিয়ে দেয় তারপর তোমাকে ডাকবো। তখন তুমিও বলবে আসল কাপুরুষ কে? আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিও ভাইয়া কে আপনার ছেলে হলো বড় কাপুরুষ। বউ থাকতেও অন্য মেয়ের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলে। হা হাহা।”

মিসেস জাহানারার কথায় তার স্বামী মিয়াজ মিয়া খুশি হলেন বটে। ভাইয়ের উপর প্রতিশোধ নেওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার বহু বছর পূর্বের। বউ-বাচ্চা কে দিয়ে যদি সেই শোধ তোলা যায় তবে ক্ষতি কোথায়? তিনিও হেসে বলেন,

“তাহলে কখন লেলিয়ে দেওয়ার জন্যে পাঠাবে আমার ভাইয়ের ছেলে শারফানের কাছে?”

“আজকেই কিছু একটা করবো।‌ সেরাতে শেরহাজকে হাতেনাতে ধরেছে শারফান। শেরহাজ নাকি হোস্টেলে থেকে খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মেশে নেশাপানি খাওয়ায় মত্ত থাকতো। যার কারণে তার নেশাপানিতে আসক্তি জুড়ে বসে। তাইত ভাইয়ের কাছ থেকে দিনকে দিন টাকা চেয়ে বসত। অথচ জানো তাকে দেখলে একেবারে সুস্থ সবল যুবক মনে হয়। দেখো ভেতরে কেমন আসক্তি নিয়ে বসে আছে। গোপন কথা শুনবে? নিজ ভাইকে চ’ড় মেরেছে শারফান। তাও তার বউয়ের জন্য। কারণ শেরহাজ নাকি একরাতে নেশা পানি খেয়ে মাতাল ছিলো। তখন তার সামনে ফারজানা ছিল।”

“ফারজানা কে?”
ভ্রু কুঁচকে মিয়াজ মিয়া জিজ্ঞেস করলেন। মিসেস জাহানারা কপাল চাপড়ে বলেন,

“উফ মিমলির বাবা আর কে হবে? তোমার বড় ভাইয়ের বাড়ির বড় বউমা! শেরহাজ তার উপর নজরবন্দি করায় কোমরে নাকি অশ্লীল ভাবে হাত লাগাইছিল। আরেকবার বলে কোমরে হাত লাগাইতে উদ্যত হয়েও ধরতে পারেনি। কারণ শারফান এসে ফারজানাকে চ’ড় দিয়ে ছিল। সেবার ফারজানা কে চ’ড় দিলেও পরের বার মাইর খেয়েছে শেরহাজ নিজে। নেশা পানি খেলে তার হুঁশ থাকে না। এখন দেখো ছেলে মাতাল অবস্থায় অবশ্য কোনো মেয়ে সামনে থাকলে বদমাইশি করতে চাইবেই। এতে কি? দোষ কার? শারফানের ভাই শেরহাজের। ইশ্ ছেলেটার জন্য খারাপও লাগছে। শারফান তাকে আজ বাদে কাল রিহ্যাবে পাঠিয়ে দেবে। এতে যদি ছেলেটা শোধরে যায়। হাস্যকর ব্যাপার কি জানো? এতে আমার সুবিধাই বেশি শারফানের অতি কাছে মিমলিকে পাঠাতে কোনো বাঁধা ধরা থাকবে না।”

মিয়াজ মিয়া শুনেই পৈশাচিক আনন্দে নিজ বউয়ের কুটিল পরিকল্পনায় ‘বাহ বাহ’ দিলেন। মিসেস জাহানারা এ পর্যায় কথা থামিয়ে বিদায় দিয়ে রেখে দিলেন ফোন। তখনি তিনি অনুভব করলেন রুমের বাহির থেকে কারো আহাট সরে যাওয়ার। তৎক্ষণাৎ সেদিক গিয়ে দেখলেন কেউ নেই। মনের ভ্রম ভেবে ছাড় দিলেন। ছায়াটা তার মাথা চেপে সোজা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো।

চলবে…..

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_১১ (অভিমান)

শেরহাজ অনর্গল নেশাপানি খেয়ে মাতাল হয়ে ক্লাবে টলছে। সঙ্গহীন হওয়ায় সেখানে আর বসে রইল না। রাস্তায় একা বেরিয়ে হাঁটছে আর মাতলামি করে উচ্চস্বরে গান গেয়ে যাচ্ছে। নির্জনে সে দুঃখ বিলাস করছে। সেই রাস্তা দিয়ে হাতে কিছু ফলমূল নিয়ে মিমলি বাড়ির দিকে যাচ্ছিল। শেরহাজকে দেখে থমকে দাঁড়ালো। তার চোখমুখ অসহায় হয়ে পড়ল শেরহাজের করুণ অবস্থা দেখে। তৎক্ষণাৎ তার নিকট ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল। শেরহাজ মাতাল হওয়ায় চোখে ঝাপসা দেখছে। তবে জারিফার পরিবর্তে মিমলিকে দেখে চমৎকার হাসি দিয়ে তার কোমর চেপে গালে হাত বুলিয়ে বলতে লাগে।

“আরে মাই মিমলি ডার্লিং তুমি কবে ফিরে আসলে? কেমন কাটলো তোমার সংসার ফরেইনে? আরে বেইমান মেয়ে তুই একটা। শৈশবে তোকে কতই না ভালোবাসা আদর যত্ম দিতাম। সেই তুই আমার ত্যাগ ভালোবাসা ভুলে আমার বড় ভাইয়ের দিকে নজর দিলি ছিঃ। তোর থেকে বে*শ্যা মাইয়া বহুত ভালোরে। তারা অন্তত হৃদয়ে আঘাত করে না। তুই তো সোজা আমার হৃদয়ে ব*ন্দু*ক চালিয়ে দিলি। এবার বল তুই কি কখনো অনুভব করিসনি তোর শেরহাজ ভাই তোকে কতটা ভালোবাসে? তোকে যখন শারফান ভাই বকে ধমকে কাঠফাঁটা রোদ বল, শ্রাবণের বৃষ্টি বল, অন্ধকার রুম বল যেখানে ইচ্ছে দাঁড় করিয়ে চলে যেতো। তখন তোর অঝোরে কান্নার সাক্ষরিত সঙ্গী কে ছিলো? এই আমি শেরহাজ মারুফ ছিলাম। তোকে আদরে গালে চুমু খাওয়ার লোভে কত শত আইসক্রিম চকলেটও দিয়েছি। সেই তুই কিনা ছিঃ ছিঃ কেন রে মিমলি আমায় কেন একটুও ভালোবাসলি না। কারে বোঝাব আমি এসব নেশাপানির আরম্ভের জন্য দায়ী একমাত্র তুই। জানিস কেনো? তুই আমাকে আগলে না নিয়ে বিদেশে সংসার পাতলি। এর চেয়ে কষ্টের কারণ কি হতে পারে আমার জন্য? সেই আবার জানলাম এসব মিথ্যে। তুই তো তোর কালো রুপ বর্জন করে রুপসী রুপ নিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে যাচ্ছিস তাও কার কাছে সেই শারফান ভাইয়ের কাছে। লাভ কি হলো? কিছু না হাহাহা।”

শেরহাজের হাসিতে বিস্বাদের রুপ ফুটে উঠেছে। ছেলেটা আসলেই তার বিরহে উম্মাদ হয়েছে। ভেবেই মিমলি কান্না করে দিলো। শেরহাজ সন্তপর্ণে তাকে ছেড়ে খানিক দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। তাচ্ছিল্যের হেসে বলে,

“দেখ সেই তুই আবারো শারফান ভাইয়ের কারণে কাঁদছিস। কিন্তু এই আমি আজ তোর কাছে নয় একপ্রকার দূরত্বে আছি। না পারছি তোকে আগলে নিতে, না পারছি তোকে ভুলতে। এই যাহ্ তো তোর এই রুপ ধাঁধানো রঙ আমার সহ্য হচ্ছে না। আমার কৃষ্ণরাণীর কাছে তোর এ রুপ হলো শূন্য বুঝলি শূন্য! তার ঐ কৃষ্ণরুপের প্রতি আমার খুব লোভ। তার ঐ চোখের মায়ায় আমি ডুবে মরেছি বারংবার। জানিস তোর পাঁচবছর বয়সে তোর প্রথম হাত ছুঁয়ে কি বলে ছিলাম?
বলে ছিলাম এই কৃষ্ণরুপী হওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে শোকরিয়া। পরপুরুষের মনে কখনো তোকে নিয়ে আগ্রহ জমানো তো দূর একবিন্দু পরিমাণ ভালোবাসার ফুলও ফুটবে না। কেননা সেই ফুল সেই আগ্রহ যে আমার মনের হৃদয়ের খোড়াক হয়ে গিয়েছিল। খুব অপেক্ষা করছিলাম তোর বড় হওয়ার। তোর বাবা-মা তোকে ছিনিয়ে নিয়ে তো গেলো। ফিরিয়ে আনলো বিধ্বংসী রুপ নিয়ে। যাক গে তুই আমার কেউ না। তুই হলি বহুরুপীইইই।”

বলেই শেরহাজ জ্ঞান হারাতে বসল। মিমলি দেখেই কান্না থামিয়ে তাকে বুকে আগলে নিলো। সে পুরো দিন সঙ্গহীন কাটিয়ে নিজের আসল প্রেম কে খোঁজে পেয়েছে। সে পেয়েছে তার অন্ধকার রুপের আসল আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মত প্রেমিক পুরুষ। অথচ সেই আজ তার কাছে অবহেলিত হচ্ছে। ঐ যে একটা কথা আছে না ,
‘অতি বাড় বেড়ো না,ঝরে পড়ে যাবে।’ আজ মিমলি অনুভব করছে তার রুপের বিস্বাদ গ্রস্থের অন্ধত্বে যেমন তার প্রেমিক পুরুষের সান্নিধ্য হারিয়েছে ঠিক তেমনি ভালোবাসাও হারিয়েছে। মিমলি কান্না করল না আর।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)শেরহাজকে বহু কষ্টে ধরে পাশেই এক টিনের ভাঙা ছাউনি আছে সেখানে শুয়ে দিলো। সুঠামদেহী পুরুষকে কি আর এইটুকুন মেয়ের বহন করা সহজ? বিধেয় সে ফোন বের করে ড্রাইভার কে শেরহাজের ব্যাপারে বলে। কারণ সে জানে ঐ বাড়ির কেউই তাকে দেখতে পারেনা। ইশ্ সে যদি জারিফার পরিবর্তে মিমলির রুপে থাকতো তবে সবাই কতই না আদর যত্ন করতো। স্বেচ্ছায় হারিয়েছে তা কি আর ফেরানো সম্ভব? দীর্ঘশ্বাস ফেলে শেরহাজের দিকে তাকিয়ে রইল। আচমকা তার মনে নিষিদ্ধ কাজের ইঙ্গিত দিলো। ধীর পায়ে গিয়ে শেরহাজের কোমরের দিক বসল। তার চেহারার জ্বলকে শৈশবের বাচ্চামি মনে ধরে রেখে মনোমুগ্ধের ন্যায় শেরহাজের গালে চুমু দিলো। এ প্রথমবার সে কোনো কিছুর লোভ বিহীন ছেলেটার গালে চুমু দিয়েছে। মিমলি লাজুক হেসে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণ পর ড্রাইভার হাঁক সেরে ডাকল। মিমলি ড্রাইভার কে সাথে নিয়ে শেরহাজকে ধরে নিয়ে বাড়িতে ফিরল। মিসেস জাহানারা অবশ্য বিরক্ত প্রকাশ করেছেন মেয়ের কাজে। কারণ নেশা পানি খেয়ে মাতাল অবস্থায় মরেটরে গেলে তাদের জন্য সুখবর হতো। মেয়ের বোকামির জন্য ভেজায় বিরক্ত হয়ে রুমে চলে গেলেন। তবে যাওয়ার পূর্বে মেয়েকে ইশারায় রুমে ডেকে গেলেন। মিমলি চুপটি করে বাড়ির কাজের ছেলেকে শেরহাজের কাপড় পাল্টে ফ্রেশ করিয়ে শুয়ে দিতে বলে সে গেলো মায়ের রুমে। সেখানে মায়ের হাতে ফারজানার শাড়ি-জুয়েলারি দেখে ঢোক গিলল। সে মুখ ফুটে বলতেও পারছে না। মায়ের হাতে মাইর খাওয়ার ভয়ে। ছোটবেলায় শেরহাজের অতি কাছাকাছি যাওয়ার কারণে আড়ালে কত যে মাইর খেয়েছে তার হিসেব নেই। মিসেস জাহানারা শক্ত গলায় বলেন,

“আজ শারফান রাত করে আসবে। তুই খেয়ে নেহ্। সে খিদে পেটে আসলেই ফারজানার মত আচরণ করে তাকে খাওয়ার জন্যে ডাকবি। আমি ততক্ষণে শারফানের খাওয়ায় নেশার ওষুধ মিশিয়ে দেবো। এতে অবশ্য ছেলেটা মাতাল হয়ে তোকে দেখে ফারজানা ভাববে। সেই থেকে তোরে কাছে পেতে চাইবে। দেখ আজকের রাতে সুযোগ পাবি পরের বার এই সুবর্ণ সুযোগ পাবি না।”

মায়ের কথায় বাধ্য হয়ে মাথা নাড়ল সে। খেয়েদেয়ে তৈরি হয়ে শারফানের অপেক্ষা করতে লাগল। যা তার মাকে দেখানোর জন্য। তার মন তো পড়ে রয়েছে শেরহাজের কাছে। ছেলেটা যে ঘুমিয়ে ছিল পরে উঠেছে কিনাও জানে না সে। তার মা একপ্রকারে তার উপর নজরদারি চালিয়ে বসেছে।

ঘড়িতে এখন রাত একটা।
শারফান সবেই কলেজের মিটিং শেষ করে এসেছে। খিদে পেটে হওয়ায় একগ্লাস পানি খেয়ে টিভির রুমে বসল। ভাবছে আসার পথে নতুন সিম কিনেছে। সেটা লাগিয়ে বউয়ের কাছে একবার ফোন দিয়ে তার কণ্ঠস্বর শুনবে। এতেও যদি তার মন একটু হলেও হালকা হয়! সিম বের করে ফোনে নতুন সিম লাগিয়ে কল চাপল ফারজানার নাম্বারে। মিমলি এসে শারফানের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কার্যকলাপ পরখ করছে। এদিকে ফারজানা মির্জার সাথে হাসিমজায় ব্যস্ত। আচমকা কল আসায় না দেখেই কল রিসিভ করে নিলো। তখন মির্জাও লাজুক স্বরে বলে উঠে।

“এই ফারজানা আমায় তোমার কেমন লাগেরে?”

শারফান এর কান গরম হয়ে গেলো। সে ভুল শুনল নাকি ঠিক বোঝার জন্য রুদ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে।

“এই মেয়ে ছেলেটা কে এখনি বলো!”

থমথমে চেহারা নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে নজর দেয়। আননোন নাম্বার দেখেই বাঁকা হাসে। ফোন কানে চেপে রেখেই শারফানকে শুনিয়ে শুনিয়ে ন্যাকামি গলায় মির্জা কে বলে,

“তুই জানিস তোকে দেখলে আমার ক্রাশ খেতে মন চাই, একেবারে শাকিবের মত রসিক ছেলে তুই। তোর বাহুডোরা দেখলে তো মেয়েরা টাস্কি খায় পরেইইইই যাবে। আহ আমার তো ইচ্ছে করছে তোর বুকের উপর ঢলে পড়ি।”

দাঁতে দাঁত চেপে শারফান বলে,

“পরপুরুষের শরীরের উপর পড়তে খুব ইচ্ছে করছে না বউ? কই কখনো আমার উপর তো ঢলে পড়তে চাওনি। ঝগড়া ছাড়া একটু হাসি মুখে কথা বলেছো কিনা সন্দেহ । তার উপর রোমান্সের জন্য লাফাতে। ছিঃ।”

মুখ ফুলিয়ে মির্জাকে বলেই দিলো।

“উফফ তুই রোমান্টিকও বেডা।”

কি বলল সে নিজেই বোকা বনে গেল। মুখ চেপে ধরে জিভ কামড়ে রুমে চলে যায়। শারফান কথাটা শুনেই রেগে বলে,

“ঐ বা*স্টার্ডকে তো আমি জানে মেরে ফেলবো। আমার বউয়ের সাথে রোমান্টিক হবে। না আমি তা হতেই দেবো না। ওর সাহস কত বড় তোমার কাছে রোমান্টিক হয়? এই মেয়ে কথা বলছো না কেনো?”

শারফান অপর পাশ থেকে কোনো রুপ জবাব না পেয়ে ‘হ্যালো হ্যালো বউ লাইনে আসো! এই বউ?’
টুটুটু শব্দ হওয়ায় ভ্রু কুঁচকে দেখল তার কল দিয়েছে মেয়েটা। রেগে গিয়ে ফোনটা পকেটে পুরে রুমে যেতে গেলেই সামনে জারিফা কে দেখে থমকে দাঁড়ালো। মেয়ের পরণে তার বউয়ের শাড়ি দেখে রাগ আকাশচুম্বী হলো তার। তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে উচ্চস্বরে বলে,

“এই মেয়ে আমার বউয়ের শাড়ি পরেছিস কেন? তোর কি মাইর খাওয়ার শখ জেগেছে? আমার বউয়ের শাড়ি খুলে আমার রুমে রেখে আয় যাহ্। নাহলে আজ এই পানির গ্লাস দিয়ে তোর মাথা ফাটিয়ে দেবো।”

মিমলি ভয়ে তৎক্ষণাৎ গিয়ে শাড়ি পাল্টে থ্রিপিচ পরে এলো। শাড়িটি কাঁপা হাতে শারফানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ছোঁ মেরে শাড়িটি নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হতেই মিমলি অসহায় গলায় বলে,

“ভাইয়া ভাত খেয়ে ঘুমাতে যান।”

শারফানের অবশ্য খিদে লেগেছে খুব। তাই ‘হুম’ শব্দ করে রুমে গেলো ফ্রেশ হতে। মিসেস জাহানারা মেয়ের ভয়ার্ত রুপ দেখে ইশারায় ভাত খাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন। সেও মায়ের ইশারা বুঝে ভাত খেতে বলেছে। মিসেস জাহানারা শারফানের পাতে নেশার ওষুধ দিয়েও ক্ষান্ত হোননি মেয়ের পাতেও হালকা করে ঢেলে দিলেন। দুজন নেশায় মত্ত হয়ে একরুমে আবদ্ধ হলেই দিনের বেলা তিনি নিজের কাজ আরম্ভ করতে পারবেন। মিমলি ভেবেছে শারফান এর পাতেই শুধু নেশা মিশিয়েছে তার পাতে নয়। সে শারফান কে খাওয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে শেরহাজের কাছে চলে যাবে ভেবেই শেরহাজের রুমের দিকে তাকিয়ে রইল। মিসেস জাহানারা পৈশাচিক হেসে মেয়ের মনোভাব বুঝতে পেরেই নেশার ওষুধ মেয়েকেও দিয়েছেন।
তিনি ইশারায় হয়েছে বুঝিয়ে নিজ রুমে চলে গেলেন। শারফান মুখ হাত ধুয়ে মুছে খেতে বসল। খাওয়ায় অন্যরকম স্বাদ পেলেও পাত্তা দিলো খিদার চটে। খাবারে অন্যরকম স্বাদ পেয়ে মিমলিও কিছুটা অবাক হয়েছে। তবুও শারফানকে প্রশ্ন করতে না দেখে ভাবল তার মনের ভুল বিধেয় সেও খেতে থাকল। খাওয়া শেষ হতেই শারফানের নিজের কাছে মাতাল মনে হচ্ছিল। হাত ধুয়ে টলতে টলতে নিজের রুমে গিয়ে দরজা না আটকে শুয়ে পড়ল। মিমলিও হাত ধুয়ে অনুভব করছে তার শরীর টলছে। চোখে ঝাপসা দেখায় তার রুম কোনটা খুঁজে পাচ্ছে না। হাতড়ে হাতড়ে ভুশবশত শারফান এর রুমের দরজা খুলতে নিলেই অন্ধকারে তার হাত অন্য কেউ চেপে ধরে তার রুমে ঢুকিয়ে শারফানের দরজা আটকে দিলো। সেই সঙ্গে মিমলিকে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে দরজা আটকে নিজের শার্ট খুলে ফেলে দিলো। মিমলি চোখের সামনে শেরহাজকে উদাম বুকে দেখে উত্তেজনা অনুভব করে। সেও তার গলার থেকে উড়না সরিয়ে বিছানায় পায়ে ভর করে বসে শেরহাজের ঘাঁড় ধরে নিজের দিকে টানল। নেশার ওষুধের কারণে দুজনে শরীরে কাম উত্তেজনা ছড়িয়ে গেছে। শেরহাজ আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল না। মিমলির কামিজের চেন খুলে তার উপর ভর করে শুয়ে গেলো। দুজনের ঠোঁট আবদ্ধ হয়ে গেলো। শেরহাজ এর মাথায় মিমলির কাছ থেকে ভালোবাসা পাওয়ার লোভে উম্মাদ হয়ে উঠেছে। মেয়েটা যতই কষ্ট দিক তার ভাগ সে অন্য কারো সাথে সইতে পারবে না। উহুম পারবে না বলেই শারফান ভাইয়ের রুমে মেয়েটাকে যেতে দেখেই রেগে নিজেই চেপে ধরে নিয়ে আসে। এই মেয়ে শুধু তার মানে তারই।

চলবে…….

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-০৯

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৯

“জানেন শারফান আপনি যতই আমায় কল দেন না কেনো! এতো সহজে আমায় হাতের নাগালে পাবেন না। যে দূরত্বের সূচনা আমি করেছি এর ইতিও আমি টানব। তবে যে ভুল আপনি স্বেচ্ছায় বউ থাকতেও করেছেন সেই ভুলের মাশুল আপনাকে দিতেই হবে।”

আপনমনে শারফান এর ছবির দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললাম। পেছনে যে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল খেয়াল করিনী। ‘আহেম আহেম’ গলা ঝেড়ে নেওয়ায় আমি চোখ মুছে পিটপিট করে তাকালাম। ফুপাতো ভাই মির্জা কে দেখে বিরক্তির চোটে মুখ ফসকে ‘চ’ বের হতে গিয়েও নিয়ন্ত্রণ করে নিলাম। ছেলেটা ফোকলা দাঁতের হাসি দিয়ে বলে,

“কি জুনিয়র সাহেবা পরীক্ষার প্রিপারেশন কেমন! আচ্ছা তুমি পরীক্ষা দেবে কোথায়? তোমার শ্বশুরবাড়িতে নাকি বাপের বাড়িতে। না আমি জানতে চেয়ে ছিলাম তোমার যাওয়া আসার….।”

“আমি জানাতে ইচ্ছুক নয়।”

মির্জার মুখটা ভোঁতা হয়ে গেলো। আসছে থেকে মেয়েটা তার সাথে গম্ভীর গলায় কথা বলছে। মেয়েটার হৃদয়ে প্রেমের অনুভূতি বলতে কি কিছু নেই তাই বুঝে পাচ্ছে না সে। তবুও নিজের ভাবভঙ্গি বজায় রেখে মেয়েটার দিকে ঘুরে তাকাতেই অবাক। মেয়েটা সামনে থেকেই উধাও। মির্জা মুখ ভেঙিয়ে বলে,

“ধ‌্যাঁত ফালতু মেয়ে একখান। মুখে তিতা রস খেয়ে বড় হয়েছিল মনে হয়। কথার সময় সব তিতামার্কা কথার ঝুলি পড়ে।”

“কিরে নাতী একলা দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছিস কেন? জ্বীনে টিনে ধরল নাকি-রে তোরে আবার?”

“বাড়ির ভেতর আটাময়দা সুন্দরী কি কম পড়ছে যে এখন জ্বীন-টীন ও দেখতে হবে। ঐ আটাময়দা ওয়ালীদের দেখলেই হবে জ্বীনের তাড়নায় বেহুঁশ হয়ে পড়ে থাকবো।”

নানা ‘হু হু’ করে হেসে দিলো মির্জার কথায়। ছেলেটার নাম মির্জা ফখরুল। তিনি মনে মনে ছেলেটার উপর সন্তুষ্ট। সেদিন ছেলেটাও তার নাতীন এর সাথে এক ট্রেনে এসেছে শুনে স্বস্তি অনুভব করে ছিলেন। ছেলেটার সাথে না এলে পুরো সময় তিনি চিন্তায় বিভোর থাকতেন। তার নাতনীর সম্পর্কে ফুপাতো ভাই হয়। ছেলেটা হাস্যরসক স্বভাবের হওয়ায় তিনি খুব পছন্দ করেন। তার নাতীনও বিগত একমাস ধরে অস্বাভাবিক ব্যবহার করছে। তার কারণ কি সেটাও জানাচ্ছে না মেয়েটা! মির্জা কে নানার সাথে দেখে মুখ ফুলিয়ে বললাম।

“নানু আপনি এখানে রোদে দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? নিশ্চয়ই এই ভাইয়া দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এই ভাই আপনার আক্কেল জ্ঞান নেই ? মুরব্বি লোককে এভাবে কাঠফাঁটা রোদে দাঁড় করিয়ে রেখছেন। কোথায় আপনার বলা উচিৎ আসেন নানা ভেতরে এসির নিচে গিয়ে বসি। সেই আপনি নানাকে কষ্টে রেখে খেজুরে আলাপ করছেন।”

মির্জার মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো। বেচারা এই মেয়েটার সামনে বারবার অপদস্থ হয়ে যাচ্ছে। মেয়েটাও একবার ধরলে সহজে ছাড় দেয় না। একের পর এক কথা দিয়েই নাজেহাল অবস্থা বানিয়ে দেয়। সে না পারতে নানার সামনে মাটিতে বসে পড়ল। নানার পা ধরে বলে,

“ও নানা আপনার মেয়ে কি তার মেয়ের জন্মের সময় মধু খাওয়ায় নেই। গণহারে অপমান করেই যাচ্ছে। আরেকটু বললে এখানেই আমার মরণ হবে। তার দায়ী হবে এই মেয়েটা। চুরেল কোথাকার।”

মাথা ধরে গেলো। ছেলেটা আমায় চুরেল বলল। এত সাহস দাঁতে দাঁত চেপে বললাম।

“আরেকবার বলে দেখান তো। চুরেলের গোষ্ঠীদের কাছে পাঠিয়ে দেবো আপনাকে হারামী কোনখান। আসেন নানা এখানে পাগল ছাগলের সাথে দাঁড়িয়ে কালো হওয়ার ইচ্ছে আমাদের নেই।”

নানাকে ধরে নিজের রুমে নিয়ে এলাম। দরজা বন্ধ করে ইতস্তত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। নানা এতক্ষণ ধরে আমার ভাবভঙ্গি পরখ করছিলেন। তা আমি বেশ বুঝতে পেরেছি। তবুও এখন আমার সত্য জানতে হবে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করলাম।

“নানু আপনি কি শারফান এর সাথে কথা বলেছেন?”

নানা মুখ ফুলানোর ভান ধরে অন্যদিকে ফিরে তাকান। অপরাধী মুখ করে নানার হাত ধরে বললাম।

“আইম সরি নানু। আমি চাই নাই তুমি জেল থেকে বেড়িয়ে আমার সংসারের টানাপোড়েন সম্পর্কে অবগত হয়। এতে তোমার মন মস্তিষ্কে শারফানের প্রতি বিদ্রুপ মনোভাব জাগ্রত হতো। কিন্তু বিশ্বাস করো নানু তিনি ওমন পুরুষ নয়। আমিও তাকে ছেড়ে দেয়নি। শুধু কয়েকদিনের দূরত্ব তারপর সব মিটে….।”

“যাবে না সব মিটে।”

নানার কথায় থমকে গেলাম। অবাক করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম।

“মানে কি বোঝাচ্ছেন আপনি নানু?”

“যা শুনেছো তাই। শারফানের দোষ সে তোমায় বিয়ে করেও নিজ স্ত্রীর সামনে পরনারীর কথা তুলেছে। এখন সেই পরনারী তোমার সংসারে এসেছে তাও কোনো রুপ ভুলত্রুটি ছাড়া। নিশ্চয় এর পেছনে কারণ আছে। জারিফা মা’রা গেছে সেটা আমরা সবাই জানি। তার জীবিত হওয়ার কোনো রাস্তা নেই। তাকে এই নিজ হাতে তোমার বাবা সহ মিলে কবর দিয়েছি। তাই আমার মনে হচ্ছে এখানে কারসাজি করেছে তোমার চাচী শ্বাশুড়ি।”

“নানু তোমার কথায় আমিও একমত। জারিফা বেঁচে নেই। এটা নিশ্চয় কোনো বহুরুপী। যে কিনা জারিফার সম্বন্ধে সব জেনেশুনে আমার সংসারে জোরপূর্বক ঢুকতে চাইছে। তবে তুমি চিন্তা করো না নানু। এর ব্যবস্থা স্বয়ং তোমার নাতজামাই করবে। আমার বিশ্বাস এতদিনে তিনি আমার বিরহে জ্বলে পুড়ে ছারখার হচ্ছেন।”

“এই না হলো নাতজামাইয়ের আর্দশ অর্ধাঙ্গীনি। কিন্তু আমার মনে এখনো একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার জেল থেকে রেহাইয়ের ব্যবস্থা করলে কেমনে তুমি?”

“আসলে নানু আমার আব্বুর কিছু মেনশনের টাকা ছিল। সেগুলো আর হাতের সোনার বালা বিক্রি করে জোগাড় করেছি। তোমার নাতজামাই কে এসবে জড়ায়নি। কারণ তার আর আমার সম্পর্কের গভীরতা তখনো মজবুত ছিল না। তাইত চাচীর মুখের কথায় বিশ্বাস করে তিনি আমায় বেরিয়ে যাবার সময় থামালেনও না। অন্তত বিশ্বাস করে তো দেখতে পারতেন তিনি। চাচীর কথায় কি সত্যতা ধরা যাবে? যাক গে নানু এসব বাদ দাও। আমি শুধু সময়ের অপেক্ষা করছি। তোমার কয়েকদিন দাদুর বাড়িই থাকতে হবে। যতদিন না ঐ গ্রামে তোমার ভিটেমাটিতে বাড়ি গড়ে উঠে। আমি টাকা দিয়েছি। মিস্ত্রিরা কাল থেকে কাজে লেগে পড়বে। ইট-সিমেন্ট এর টাকা বারতি তোমার ব্যাংক একাউন্টে আছে। শেষ হলে বলিও আব্বুর ব্যাংকের জমানো টাকা থেকে ট্রান্সফার করিয়ে তোমাকে দেবো।”

“সব বুঝলাম তাহলে তোমার এখানে আসার কারণ কি শুধু আমি?”

“আরে নানু তোমাকে মনে পড়ছিল অনেকদিন ধরে। তার চেয়ে বড় কথা তোমাকে রেহাই দেবে শুনে আমার শ্বশুরবাড়িতে মন টিকছিল না। না পারতে কুসমা আপার হাতে টাকা দেওয়ার পর থেকে একেবারে মনস্থির করে রেখেছিলাম তোমার সাথে দেখা করবো। তার মাঝে শারফান কে দূরত্বের মজা কড়ায়গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবো। স্বামীকে যতদিন আমার পেছনে নাকে দড়ি দিয়ে না ঘুরাচ্ছি ততদিন আমি শ্বশুরবাড়ি ফিরছি না। দরকার হলে এইচএসসি পরীক্ষা হোস্টেলে থেকে দেবো। তার চেয়ে বড় কথা সামনের সপ্তাহ থেকে শাহানার পরীক্ষা শুরু তার একমাস পর আমার পরীক্ষা। ওর পরীক্ষার মাঝে শারফান বাড়িতে না থাকায় শ্বশুরবাড়ি ঘুরে আসবো।”

“তুমি আর তোমার শ্বশুরবাড়ি তোমরাই জানো রে বাবা। ছাড়ো এসব আমার শারফানের সাথে কথা হয়নি। কথা হয়েছে তোর শ্বশুরের সাথে। সেই আমাকে বিয়ের দিন থেকে শুরু করে সব কথা কাহিনীর মত শুনিয়েছে। এখন তোমরা স্বামী স্ত্রী। তোমাদের মধ্যকার ঝগড়ার মাঝে আমরা নেই বাবা।”

নানার মুখভঙ্গি দেখে না হেসে পারলাম না।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)আচমকা ফোন আসায় আমি কল রিসিভ করে ‘হ্যালো আসসালামুয়ালাইকুম বললাম।’ নানা এই ফাঁকে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। কলের অপর পাশ থেকে কোনো রুপ সাড়া না পেয়ে পুনরায় শব্দ করলাম। তাও নিরুত্তর। এবার রুক্ষ গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

“আল্লাহ্ জানেন কোন বদ*মাইশ।”

কোনো রুপ সাড়াশব্দ না পেয়ে কট করে কল কেটে দিলাম। ফোনের স্ক্রিনে শাহানার নাম্বার খেয়ালই করেনি। জিভ কামড়ে বিড়বিড় করে বললাম।

“আপনিও কম চালাক নয় শারফান মিয়া। নিজের ফোনে না পেয়ে শেষমেশ আমার ননদীনির ফোন দিয়ে কল। বাহ্ ভালোই উন্নতি হয়েছে আমার স্বামীর। স্ত্রীর বিরহে লোকটা তবে চালাক হতে শুরু করেছে। নট ব্যাড।”

পুনরায় শাহানার কল এলো। এবার রিসিভ করে চুপ করে থাকব ভাবছি। যেই ভাবনা সেই কাজ। কল রিসিভ করে চুপ থাকতে গিয়েও পারলাম না। শাহানার কণ্ঠ শোনা গেলো। মনের এতক্ষণের ভাবনা সবটা ভাববিলাশ মনে হলো। মন উদাস হলেও মৃদু হেসে বললাম।

“কেমন আছো ননদীনি? আব্বু কেমন আছেন? তোমার ভাই দুটা কি করছে? নিশ্চয় তোমার বড়ভাই ঐ জারিফার বাচ্চা কে বিয়ে করছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ আমরা ভালো আছি ভাবী। তবে একটা গুড নাকি ব্যাড নিউজ আমি নিজেও জানি না। তবে তুমি শুনে চরম অবাক হবে।”

শাহানার কথাগুলো কোনো আশংকার দিকে ইঙ্গিত করছে। ঢোক গিলে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

“কি কি হয়েছে শাহানা তুমি এমনে কথা কেনো বলছো কিছু হয়েছে?”

শাহানার ভয় করছে। সে একপলক ড্রয়িংরুমে বসা তার ভাই আর বাবার দিকে তাকালো। তারা কত উল্লাসী হয়ে কথা বলছে। জারিফা মাঝে বসে আছে। নববধুর ন্যায় লজ্জা পাচ্ছে। এই লজ্জায় পড়ার কথা তো তার ভাবীর ছিল এই নির্লজ্জ মেয়েটার নয়। আচমকা মিসেস জাহানারা আহ্লাদী গলায় ‘শাহানা মা চলে আয় তোর ভাবীর খাওনের সময় হয়ছে।’ সে ভয়ে চটজলদি ফোনের মাইক্রো সাইড চেপে ধরল। কিন্তু ফোনের অপর পাশে আমি কথাটা শুনে থমকে গেলাম। একমাস হলো শ্বশুরবাড়ি থেকে দূরে! এর মাঝে বিয়েও তবে হয়ে গেলো? শারফান আমায় রেখে, আমার অনুমতি ব্যতীত দ্বিতীয় বিয়ে করলো কেমনে? আমার হাত কাঁপছে। মনে হচ্ছে এখনি ফোনটা নিচে মাটিতে পড়ে ভেঙ্গে পড়বে। চোখজোড়া টলমল করছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে বিড়বিড় করে আওড়ে যাচ্ছি।
‘সব মিথ্যা আমি জানি শারফান আমাকে ভালোবাসে। সে আমায় ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবে না। আমি জানি। একমাসের মধ্যে তেমন কিছু ঘটার মত অবশ্যই কোনো বিশেষ কারণ নেই।”

আবুল তাবুল বকে নিজেকে শান্ত্বনা দিচ্ছি। ফোন চেপে রেখেই শাহানা কে ধমক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“বোন তাড়াতাড়ি বল তোর ভাবী কে হয়েছে আর আমিই তো ভাবী। আমি ছাড়া আর কে ঐ বাড়ির বউ হয়েছে।”

“আর কার হবে ভাবী? ভাইয়ের বউ।”

চিৎকার করে না বলে ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। মাথা চেপে ‘শারফান’ কে উদ্দেশ্য করে মনের তীব্র বেদনা দ্বারা নিজের মনের বিতৃষ্ণা প্রকাশ করছি। লোকটা সত্যিই অন্য কাউকে মন দিয়েছিল বলে বউয়ের উপর তার কোনো মায়া টান হয়নি। নানা ভাত-তরকারির থালা নিয়ে রুমে এসে আমায় দেখে অবাক। হতদন্ত হয়ে ছুটে এসে আমায় বুকে আগলে নিলেন। আমি কান্নার চটে কথা বলতে পারছি না।লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)নানা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন আমার শান্ত হওয়ার। নিরবে ফুপাঁচ্ছি। অতঃপর নিরব গেলাম। বেখেয়ালে টলছি।
হুট করে ফোনের নোটিফিকেশনের শব্দ হলো। নানা আমায় শুয়ে দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে খুলতে চাইলেন পারলেন না। আমি নিভু নিভু চোখ খুলে উঠে বসলাম। নানা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললেন।

“এই নানুভাই উঠলি কেনো? এই না ঘুমিয়ে পড়তে নিছিলি।”

আমি নিশ্চুপে নানার হাত থেকে ফোন নিয়ে নোটিফিকেশন চালু করলাম। এতে বিয়ের ছবি পাঠানো হয়েছে অচেনা নাম্বার থেকে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে বিয়েটা শারফানের। তিনি সামনে মুখ করে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে ভালোবাসেন। জারিফার পরণে লাল বেনারসী শাড়ি জড়ানো দেখেই মাথাটা ধরে গেলো। লোকটা আমায় পুতুল পেয়েছে? এই লোককে তো আর ছাড়ছি না। একমাসে কথাবার্তাহীন বিয়ে অব্দি করে নিলো। আজ তার একদিন কি আমার একদিন!
দাঁত কিড়মিড়িয়ে স্যোশাল সাইডে এসে শারফান আইডি আনব্লক করে রেকর্ডিং পাঠাতে তৎপর হলাম।

“জামাই তুই আমাকে চিনস নাই। মেয়ে আমি এইটুকুন হলেও আমার কথার ঝাঁজ আর ঝাড়ুপেটার ঝাঁজ কেমন তা জানস না। আমায় রেখে বিয়ে করেছিস না। আসতেছি আমি। অপেক্ষা কর তুই। আজীবনের জন্য তোর বিয়ে করার শখ মেটাতে এই ফারজানা মারুফ ফিরছে। ভেবেছিস পার পাবি তাই না? বুঝবি এবার আমি কি চিজ।

চলবে…..

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-০৮

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৮

“এ নাও তোমার নতুন ফোন। আর কখনো আমার ফোনে হাত লাগাবে না। পাসওয়ার্ড যা দিয়েছো চেঞ্জ করে দাও। রোজ রোজ তোমার ন্যাকামি আমার সহ্য হয় না। ফোন রেখে কলেজে গিয়ে পড়ানোর সময় লজ্জার সম্মুখীন হতে হয়। কলিগগণ ফোনে না পেয়ে জরুরি বার্তা বলতে না পারায় অসন্তোষ বোধ করেন। পরের বার থেকে নিজের ফোন নিয়ে বসে থেকো আমাকে রেহাই দাও।”

“রেহাই দিলে আমায় ছাড়া থাকতে পারবেন?”

কথাটায় কি ছিল জানে না শারফান। তবে তার বুক কেঁপে উঠে ছিল। সাময়িক সময়ের যন্ত্রণা ভেবে রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেলো। আমি নতুন ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে বেদনার হাসি দিলাম। ফোন পেলেও সেই হাসিটুকু মুখে ফুটল না যা ফুটে উঠার কথা ছিল।

‘পিপ পিপ’ হর্নের তীব্র শব্দে অতীত থেকে বেরিয়ে এলাম। চোখ খুলে দেখলাম ড্রাইভার আঙ্কেল রেল স্টেশন এর গেইটের সামনে এসে গাড়ি থামিয়েছেন। চোখ কুঁচলে জিজ্ঞেস করলাম।

“কতক্ষণে এলাম আমরা?”

“দু’ঘণ্টা হবে আপা। আচ্ছা আপা আপনি সত্যিই চলে যাইতাছেন?”

কথাটার জবাব দিলাম না। মুচকি এক হাসি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। ড্রাইভার আঙ্কেল কে নাস্তা-পানির টাকা দিয়ে টিকেট কাউন্টারে এসে টিকেট কাটলাম। তবে নিজ গ্রামের নয় অন্য গ্রামের। অঞ্জয়পুর গ্রাম কে সেই কবে বিদেয় জানিয়েছি। সেখানে যাওয়ার আর কোনো ভাবনা নেই। এবার গন্তব্য হবে দোলনপাড়া। যেখানে দাদার ভিটে অবস্থিত। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)টিকেট নিয়ে ট্রেনের ভেতর গিয়ে বসে পড়লাম। যা গরম পড়ছে না। এসি ট্রেন ভাড়া করেছি নিজের জন্য। কিন্তু বুকিং এ একজন ছেলেও আছে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে। নিজেকে সামলে বসে পড়লাম জানালার পাশে । সিটে মাথা ঠেকিয়ে ফোনের ওয়ালপেপারের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘুমন্ত শারফান এর বাচ্চাময় চেহারা। মুখটা স্বল্প আকারে হা করা। দেখে কিউটের ডিব্বা মনে হচ্ছে। তার ঘুমের ফায়দা যে কত বার তুলে ছিলাম। আচমকা কারো গলার ‘উহুম উহুম’ শব্দে পাশ ফিরে তাকালাম। মাথায় টুপি ,চোখে সানগ্লাস, পরণে বড়জড় কটি পরিহিত এক যুবক। দেখে চেনার জো নেই কে সে? চোখ ফিরিয়ে সিটে মাথা হেলিয়ে দিলাম। লোকটা সন্তপর্ণে আমার পাশের সিটে গা হেলিয়ে দিলো। যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে আমি বসেছি। লোকটা চিকন গলার স্বরে জিজ্ঞেস করে।

“আপনি কই যাচ্ছেন?”

“বলতে ইচ্ছুক নয়।”

ব্যস পুরো গন্তব্যে মুখিয়ে ছিলাম। লোকটা বিরক্ত করলেও জবাব দেয়নি। মনমাঝারে স্বামীকে ছেড়ে আসার কষ্ট যে কি পরিমাণ বেদনার্ত তা এক স্ত্রীই বুঝে। দীর্ঘ চার ঘণ্টা সফরের পর বুক ভরা শ্বাস ফেললাম। ফোন বন্ধ রেখেছি প্রায় ছয়-সাত ঘণ্টা। সেই তখন গাড়িতে বসা অবস্থায় বন্ধ করে ছিলাম। এখন না চাইতেও ফোন চালু করতে হবে। নানাকে খবর পাঠিয়ে দাদার ভিটায় ফিরতে হবে। তারা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে শুনেই মনটা উৎফুল্ল। এ কি শারফান এর এতগুলো আননোন মিস কল কেনো? পুনরায় কল বেজে উঠল! ধরব কিনা ভাবছি। মনে পাথর রেখে ব্ল্যাক লিস্টে নাম্বারটা ফেলে দিলাম। এই আননোন নাম্বার আমার স্বামীর তা আমার বেশ বোঝা হয়ে গিয়েছে। নিশ্চুপে কুসমা আপার নাম্বারে কল চাপলাম। সে রিসিভ করে বলে,

“আপা আপনার কথা মত আমরা দোলনপাড়া গ্রামেই আইসা পড় ছিলাম। ঐ গ্রামে পুড়া বাড়ি ছাড়া আর কিছু নেই আপা।”

“ঠিকাছে নানা কোথায়?”

“আপা নানা খাইয়া ঘুমাচ্ছে। আপনাকে এক পোলা তার সঙ্গে আনবো কইছে। সে নাকি আপনাকে চিনছে। পোলাডা আপনার ফুফাতো ভাই হয় হুনছি।”

“বুঝছি কল রাখছি বাসায় এসে কথা হবে।”

কুসমা আপা ‘আচ্ছা’ বলে কল কেটে দিলো। আমি এপাশ ওপাশ নজর বুলিয়ে ছেলেটা কে খোঁজছি। হঠাৎ কেউ কাঁধে হাত রাখাই পেছনে ফিরে তাকালাম। স্বাভাবিক চোখের নয়নে তাকিয়ে আছি। ছেলেটা উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠে।

“ওয়াও হোয়াট এ্যা প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ। আপনিই আমার সিট পার্টনার ছিলেন। এখন দেখি আমার মামাতো বোন। আগে বললেই পারতেন। আপনার সাথে পুরো গন্তব্যে গল্পে মজে থাকতে পারতাম।”

ছেলেটা আমার অতি নিকটে এসে ন্যাকামি করে কথাগুলো বলে। তাতে আমার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। তপ্তশ্বাস ফেলে বললাম।

“আইম নট ইন্টারেস্টেড।”

ছেলেটার মুখ ভোঁতা হয়ে গেলো। সে আমতা আমতা করে কথা বাড়াতে নেওয়ার পূর্বেই রুদ্ধ গলায় বললাম।

“দেখেন বাসায় নিয়ে চলেন। আমার শরীর খারাপ লাগছে।”

“আচ্ছা চলেন জুনিয়র সাহেবা।”

কথাটা শুনে চোখ রাঙাতেই লোকটা সুরসুর করে গাড়ি ভাড়া করতে স্টেশনের বাহিরে গেলো। আমিও তার পিছু এগিয়ে গেলাম। সে কথা বলে এক লোককে ভাড়া করে। দু’জনে এক সিটে বসব তা নিয়ে ইতস্তত বোধ করছি দেখে ছেলেটা স্বেচ্ছায় বলে,

“আমি সামনে বসছি আপনি পেছনে বসুন। ওতটাও খারাপ নয় আমি।”

ছেলেটার কথায় স্বস্তি পেলাম। সন্তপর্ণে বসে গেলাম। ছেলেটা হাঁসফাঁস করছে কেনো করছে তাও বুঝতে পারছি। কিন্তু আমার মন তো সেই শারফান এর কাছে পড়ে আছে। ফোন বের করে শারফান এর ছবি ঘাঁটতে লাগলাম। ছেলেটা ব্যাক মিরর দিয়ে দেখে ভ্রু কুঁচকালো। বিড়বিড় করে আপনমনে বলে,

“মেয়েটা জুনিয়র তবে এটিটিউট আকাশচুম্বী উফফ।”

তার ফোন বেজে উঠল। সে ফোন কল ধরে ‘হ্যালো’ বলতেই অপরপাশ থেকে কে কথা বলল বুঝতে পারলাম না। ছেলেটা নিজমনে কথা বলে চলেছে। আমি গাড়ির বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছি। কুসমা আপা বার্তা পাঠালো। ‘কতদূর এসেছি’ জানতে চাওয়ায় বার্তা পাঠিয়ে লিখলাম,

“আসছি ছেলেটা সঙ্গে আছে।”
অপরপাশে থেকে আর কোনো সাড়া পেলাম না। গাড়ি থামার শব্দে অবাক হয়ে বললাম।

“এত জলদি চলে এলাম?”

“জ্বি জুনিয়র সাহেবা বেরিয়ে আপনার পদচারণ বাড়ির চৌকাঠে ফেলুন।”

ছেলেটার ন্যাকামি শুনতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। রেগে মুখ খুলার আগেই সে সুরসুর করে পালালো। ভেতরে ঢুকতেই সকলে এসে বরণ করতে ভীড় জমালো। খুশি হলাম তবে একজনের কণ্ঠে স্বামীর কথা জিজ্ঞেস করে। নানাকে দেখে নিরুত্তর ভঙ্গিমায় এড়িয়ে কান্না করে জড়িয়ে ধরলাম। নানা দেখে অবাক হয়েছে বটে। কিন্তু আমি চাই না স্বামীর নামে কারো মুখে কটু শব্দ শুনতে।

____
দুসপ্তাহ পর….
ফারজানার যাওয়ার পর থেকে বাড়িটা নিস্তদ্ধ হয়ে পড়েছে। আগের মত সেই কোলাহল নেই। এতে অবশ্য ফায়দা উঠিয়েছে জারিফা আর মিসেস জাহানারা। তবে পরখ করেও বলেনি ফারজানার শ্বশুর নির্লিপ্ত। তিনি আসলে মুখ খুলতে গেলে তার বাচ্চাদের ক্ষতি করে দেওয়ার আশংকায় ভয়ে জরাজীর্ণ। জারিফা আজ অন্যরকম মনোভাব পোষণ করছে দুপুরের খাবারের সময়। মিসেস জাহানারা ও তাল মিলিয়ে শারফান কে বুলাছিল। জনাব জয়নালের কাছে বিষয়টা খটকা লাগছে। তবে প্রেসার ফল হবে ভেবে চিন্তাধারা অব্যাহত রাখলেন।
রাত প্রায় বারোটা,
জারিফা আজ ফারজানার শাড়ি পরেছে। সে আজ আবেদনময়ী রুপে শারফান এর সামনে যাবে। মিসেস জাহানারা শারফান এর রুমে ‘ক্যান্ডেল লাইট’ ডিনারের ডেকোরেশন করে সবে মাত্র জারিফার রুমে এলেন। জারিফাকে ধরে বিছানায় বসিয়ে নিজের কাজল থেকে এক টুকরো কাজল তার ঘাঁড়ের পাশে দিয়ে বলেন,

“বাহ্ মাশাআল্লাহ আজ আমার মাকে কোনো পরীর চেয়ে কম মনে হচ্ছে না। দেখব শারফান কেমনে তোর কাছ থেকে দূরে থাকে?”

“হ্যা মা শারফান ভাইয়াকে ছোট থেকে পছন্দ করতাম। কিন্তু বড় আব্বু শারফানের জন্যে কোথাকার কোন ছোট-জাত কে পছন্দ করে কথাবার্তা ছাড়াই বিয়ে দিয়ে ফেলল। আমার তো সেদিন থেকে মাথায় ঘুরছিল কেমনে শারফান এর জীবনে ঢুকে মেয়েটা কে বের করবো? তাইত নিজের কালো রুপ ছেড়ে এই আবেদনময়ী রুপ কে আবরণ করে ফেললাম। জানো মা সেদিন জারিফার ছবি তুমি জোগাড় না করলে কখনো আমি শারফান এর নিকটে আসতে পারতাম না। এই জারিফার রুপই পারে আমায় শারফান এর কাছাকাছি যেতে।”

“হ্যা আমার মা তুই আর ভাবিস না। এই তোর বড় আব্বুর সম্পত্তি থেকে শুরু করে সবকিছুতে এখন তোরই অধিকার বিরাজ করবে। ঐ মেয়ের নামে শারফান এর কানে অনেক বিষ ঢুকিয়েছি। আমার লাগছে শারফান বাবার অন্তরে ঐ মেয়ের জন্য ঘৃণা ছাড়া আর কিছুই নেই।”

“এমনটাই যেনো হয় মা।”

বাড়ির গেইট খোলার শব্দে মিসেস জাহানারা বিছানায় জারিফাকে বসে থাকতে বলে নিজে চলে গেলেন। তিনি আজ নিজ হাতে রান্না করেছেন। শারফান কে খাবারের মাঝে নেশার ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ে রুমে পাঠিয়ে দিবে সেই পরিকল্পনা নিয়ে তিনি পৈশাচিক হাসি দিলেন। শারফান আর শেরহাজ একসঙ্গে বাসায় এসেছে। শেরহাজ এর চোখজোড়া ভিজে আছে। কেনো তা বোঝা দায়। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)শাহানা দরজার পাশ থেকে সরে দু ভাইকে ঢুকতে দিলো। দু’জনের চোখজোড়া রক্তিম লাল হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কান্না করেছে দু’জনে। শাহানা দুভাইকে বসতে বলে ঠান্ডা জল এনে দিলো। দুজনে খেয়ে নেয়। শেরহাজ কাঁপা হাতে শারফান এর হাত ধরে কাঁপা গলায় বলে,

“আইম সরি ভাইয়া। রিয়েলি সরি।”

শারফান চুপ করে রইল। সে তার হাতের উপর থেকে ছোট ভাইয়ের হাত ছড়িয়ে বলে,

“মাত্র দু’দিন তুই বাসার খাবার যত ইচ্ছে খেয়ে নেহ্। দু’দিন পর তোকে রিহাবে নেওয়া হবে।”

শেরহাজ চিৎকার করে কান্না করে বড় ভাইয়ের পা চেপে ধরে বলে,

“ভাইয়া প্লিজ আমি রিহ্যাবে থাকতে পারব না। এতটা অবিচার আমার সাথে করো না ভাইয়া। মাফ করে দাও প্লিজ ভাইয়া।”

“এই কথা তোর নেশায় জোড়ানোর আগে ভেবে নেওয়া উচিৎ ছিলো। নেশা করে তুই তোর ভাবীর সাথে ছিঃ আমার তোকে নিজের ভাই বলতেও ঘৃণা লাগছে। আরে তোর ভাবী পরের মেয়ে বুঝলাম কিন্তু তোর যে নিজের বোন আছে। সেই কথা তো তোর ভাবা উচিত ছিলো।”

শেরহাজ কাঁদছে। শাহানা শুনে হতভম্ব তার মেজো ভাই কিনা নেশায় আসক্ত। সে আর ভাইদের মাঝে নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। দৌড়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগালো। তার চোখজোড়াও ভিজে গিয়েছে। নিজেকে সামলাতে ফোন নিয়ে ভাবীর কাছে কল দিতে গিয়েও থেমে গেল। ভাবল,
‘না ভাবী বাড়ি গিয়েছেন সপ্তাহ দুয়েক হবে। ব্যস্ত থাকবেন হয়ত। ইশ্ ভাবী গেলেন বাড়ির সুখসমৃদ্ধি ও হারিয়ে গেলো।’

পরক্ষণে তার মস্তিষ্কে ভেসে উঠে ভাবীর দেওয়া চিরকুটের দৃশ্য। সে ভুলেই গিয়েছিল চিরকুট এর ব্যাপারটা। ভাবী চলে যাবে এ আশা করেনি সে। তাইত কান্না কষ্টের মাঝে চিরকুট দেখার সময় পায়নি। তার পরণের জিন্স হাতড়ে খুঁজে দেখে সেখানে চিরকুটটি নেই। না পেয়ে সে হুলুস্থুল হয়ে রুমের মধ্যে খুঁজে বেড়ায়। জিনিসপত্র এলোমেলো করে না পেয়ে মাথায় হাত চেপে ধরে বসে পড়ে।

“আল্লাহ আমি ভাবীর দেওয়া চিরকুটটা কোথায় রাখছিলাম? কোথায় হারিয়েছি সেটা আল্লাহ?”

বিড়বিড় করে কপাল চাপড়ে তার নজর পড়ল ছোট বালতিতে। সেখানে আধোয়া কাপড় রাখা। উপরে জিন্স দেখে তার মনে পড়ল সে এই জিন্স পরে ছিল তার ভাবী যাওয়ার সময়। খুশি হয়ে আধোয়া বালতি থেকে জিন্সটা নিয়ে পুরো জিন্সের পকেট হাতড়ে চিরকুটটা পেয়ে যায়। উৎফুল্ল হয়ে চিরকুট খুলে ভেতরের লিখা পড়তেই আনন্দে লাফিয়ে উঠল। কেননা সেখানে ফারজানা লিখে ছিল,

“ভালোবাসায় গুরুত্ব যেমন দরকার, দূরত্ব তেমনি আবশ্য।তোমার পাগলা ভাইয়াকে দু’মাসের জন্য দেখে রেখো ননদীনি। আই হোপ তারও দরকার হবে না। কোজ হি ইজ অলরেডি মিসিং মি।”
পাশেই চোখ টিপ দেওয়া ইমেজ আঁকা।

শাহানা নিজের আনন্দ চেপে রাখতে না পেরে লাফাতে লাগল। আনমনে বলে উঠে।

“ইয়েস ইয়েস এই না হলো আমার ভাবী। আমি জানতাম ভাবী কখনো ভাইয়া কে একা করে যাবেন না। নিশ্চয় এর পেছনে কোনো কারণ আছে বলেই তিনি নিজের বাড়ি গিয়েছেন। উফফ কত খুশি লাগছে।”

হঠাৎ দরজায় টোকা পড়ায় শাহানা ঘাবড়ে গেলো। সে তার পুরো রুমের দিকে চোখ বুলিয়ে নিজেই ‘ইয়ু’ বলে দরজার কাছে গিয়ে বলে,

“আমার রুম অগুছালো। এখন এসো না কেউ।”

“এই মেয়ে নিজের বাপকে রুমে আসতে মানা করছিস। ওমন কত তোদের অগুছালো রুম সাফসুতরো করছি জানিস তুই? দরজা খুলে দেয় এখনি। আমিও একলা বসে হাঁফিয়ে গেছি। বউমাও নেই যে গল্প করব।”

বাবার কথা শুনে সময় বিলম্ব না করে দরজা খুলে দিলো। বাবাকে ভেতরে নিয়ে চিরকুট এর কথা শুনিয়ে দেয়। বাপ-মেয়ে তো মহাখুশি। একসাথে কাজে লেগে পড়ে।

চলবে…….

এক মুঠো সুখপ্রণয় পর্ব-০৭

0

#এক_মুঠো_সুখপ্রণয়
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
#পর্ব_০৭

“আপনার সাথে কেনো বেহায়াপনা করতাম জানেন? কারণ একমাত্র আপনিই ছিলেন আমার জন্যে পবিত্র পুরুষ। সেই আপনার মনে পরনারীর আক্ষেপ থাকলেও আমার কিছু যাই আসতো না। আমি জীবনে শুধু এটাই চেয়ে ছিলাম আপনি আমার হয়ে থাকুন। অতীত নাহয় এককোণে আবদ্ধ থাকবে। আপনার বর্তমান আর ভবিষ্যত হতে চেয়েছি। কিন্তু আপনি সেই জারিফার মধ্যে মজে ছিলেন। আচ্ছা বিগত দু’মাসেও কি আমি আপনার মনে জায়গা করতে পারিনি? এতো এতো খুনসুটির পেছনে কি তবে বাধ্যকতা দায় ছিল? আপনার কাছে আমাকে বেহায়া মেয়ে হতো তাই না? আচ্ছা বলেন তো স্ত্রী স্বামীর কাছেই তো সব প্রকাশ করে। আমিও করতাম এতে বেহায়াপনার কি আছে? আমি আত্মসম্মানি নয় সেটাই কারণ ছিল? এবার হারে হারে বুঝবেন এক মেয়ের আত্মসম্মানবোধ কতটা প্রখর। যে মেয়ে অধিক ভালোবাসতে জানে, সে মেয়ে অধিকের চেয়েও বেশি ঘৃণা করতে পারে। আপনার জারিফা আপনাকে মোবারকবাত। দুজনের নরকের জীবন দুঃখের হোক। ভাববেন না সুখের দয়া করব। সতীনকে আশীর্বাদ করার মত মেয়ে আমি নয়। পরদিকে সতীন যদি আবার হয় বহুরুপী।আপনার জীবন আমার সাথেই স্বর্গের ছিল সেটা আপনি এখন বুঝবেন না। আমার #এক_মুঠো_সুখপ্রণয় এর জন্য আপনি আক্ষেপ করবেন, তড়ফাবেন, কাঁদবেন। তবে আমার কাছ থেকে সুখপ্রণয় আপনি অন্যের বক্ষে কখনো পাবেন না। যাই আল্লাহ হাফেজ।”

কথার ঝুলি বুঝি শেষ। হ্যাঁ শেষ। আর কোনো পিছুটান নেই আমার। নিজের ব্যাগ নিয়ে বাহিরের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছি। সামনে রক্তিম জল ভরা চোখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন শ্বশুর আব্বু আর শাহানা। মুখ গম্ভীর করে শেরহাজ এক কোণায় দাঁড়িয়ে রইল। হয়ত ভদ্রতার খাতিরে বিদায় দিতে এসেছে। তার চোখে আমার জন্য ক্রোধ স্পষ্ট প্রতীয়মান। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে শ্বশুর আব্বুর সালাম নিয়ে বললাম।

“আব্বু ওষুধ নিতে কখনো অবহেলা করবেন না। আপনার কিছু হলে আপনার সন্তানরা অসহায় হয়ে পড়বে। আমি চলে যাচ্ছি তার মানে এই নয় আপনি আর শাহানা আমায় ভুলে যাবেন। আপনাদের আমার কথা মনে পড়লে দেখা করতে চলে আসবেন।”

কথাটা বলে সবার চোখের আড়ালে শাহানাকে জড়িয়ে ধরলাম। তার হাতে একটি চিরকুট গুঁজে দিলাম। মাথায় হাত বুলিয়ে বললাম।

“ইন শা আল্লাহ তোমার আগাম জীবন সুখের হোক। আব্বুর খেয়াল রেখো। ভাইদের দিকে নজর দিও। আর সর্বশেষ নিজের যত্ন নিও। আল্লাহ চাইলে কোনো একদিন দেখা হবে।”

“ইন শা আল্লাহ ভাবী। আপনাকে খুব মনে পড়বে। আপনার রান্নার স্বাদ পেয়ে মায়ের রান্নার স্বাদ পেয়েছিলাম। এই স্বাদ আর কেউ দিতেও পারবে না।”

কথাটা রুক্ষ গলায় জারিফার দিকে তাকিয়ে বলে সে। জারিফাকে চাচী শ্বাশুড়ি ব্যান্ডেজ করে নিয়ে এসেছে। শারফান মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছেন। জারিফা গিয়ে তার বাহু আঁকড়ে ধরল। শরীরের রক্ত টগবগে উঠল আমার। তবুও নিয়ন্ত্রণ করে নিলাম। আজ সব পরিস্থিতি আমার হাতের বাহিরে। চোখ বুজে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে জারিফা আর শারফান এর নিকট এগিয়ে গেলাম। শারফান কে একপলক দেখে জারিফার দিকে অগ্নি দৃষ্টি দিয়ে বললাম।

“অন্যের স্বামী কে যতই নিজের কাছে টানার চেষ্টা করিস না কেনো সেই পুরুষ কখনো তোর হবার নয়। তুই যে বহুরুপী। তা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। তাই নিজের রাস্তা মাপার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকিস। নাহলে শাস্তি আমার দিতে হবে না। তোর পাশে দাঁড়ানো এই লোকটাই মারাত্মক ভয়ানক লোক। সত্য জানলে তোর জীবন নরক বানিয়ে দিবে।”

শেষের কথাগুলো জারিফার কানে কানে বলে বাঁকা হাসি দিয়ে চোখ টিপ মারলাম। জারিফার সহ্য হলো না। তাই মুখে ব্যথা নিয়ে বলে,

“যাহ্ তো যাহ্ সংসার ছাড়ার কারণে পাগল হয়ে গিয়েছিস।”

আমি তার থেকে মুখ ফিরিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসলাম। তার দিকে ঘুরে বললাম।

“নিজেকেই জিজ্ঞেস করে নেহ্ নিজের এই বিধ্বস্ত রুপ দেওয়ার মালিকের কথা।”

মুখ ঝামটা মে*রে ব্যাগ সমেত গাড়িতে উঠে বসলাম। গাড়ির জানালা কাঁচ নামিয়ে শাহানার দিকে তাকালাম। চোখের ইশারায় চিরকুটটি যত্নে রাখতে ইঙ্গিত দিলাম। সেও চোখের ইশারায় আশ্বাস্ত করল। মিটি হাসি দিয়ে নিজের সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ভাবা যায় কারো বিচ্ছেদ হলে মানুষ হাসে? সবাই তো কান্না করে। তবে আমি হাসছি। আসলেই আমি হেসে সংসার ছাড়ছি। গাড়ি ছুটতে লাগল। সংসারের রাস্তা পেরিয়ে যেতেই আপনাআপনি আমার চোখ হতে পানি গড়ালো। মৃদু হেসে চোখের জল মুছে নিলাম। বিড়বিড় করে বললাম।

“আপনি নিশ্চয় খুব খুশি শারফান। আমি ছেড়ে যাচ্ছি। তার মানে এই নয় আমার সংসারে ডাইনির আগমনে নিজের সংসার, নিজের স্বামীর জীবন তছনছ হতে দেবো। সাময়িক সময়ের উল্লাস আপনাদের। তারপর আমার পালা…আপনাকে জয়ের উল্লাসের শুভেচ্ছা চাচী। আপনার একতরফা আক্রমণ আমার উপর মারাত্মক ভাবে ফলল। তবে আমি আল্লাহ বিশ্বাসী। উনি চাইলে নিশ্চয় অন্তিম ফলাফল সুখময় করে দেবেন আমার জন্য।”

হঠাৎ মোবাইলের স্ক্রিনে শারফান এর কল ভেসে উঠল। দেখেও অদেখা করে নাম্বারটি ব্ল্যাক লিস্টে ফেলে দিলাম। সব সোশাল সাইড থেকে শারফান নামক ব্যক্তিকে দূরে সরিয়ে দিলাম। শাহানা একমাত্র বোন হিসেবে ঠাঁই রইবে। মোবাইলটি বন্ধ করে চোখ বুজে নিলাম। অতীত হাতড়ে দুমাস আগের ঘটনা মনে করছি।

অতীত,
শারফান মোবাইল হাতে নিয়ে চালাতে গিয়ে পাসওয়ার্ড দেখে তার মাথা ধরে গেলো। দিনকে দিন তার মোবাইলের উপর কব্জা বসিয়ে রেখেছি আমি। পাসওয়ার্ড মুখে বললেও লোকটা ধরতে পারে না। উল্টো ছ্যাঁত করে উঠে। নাহয় লজ্জা পেয়ে রুমের বাহিরে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে মোবাইলের লক খুলে রাখতে। ইশ্ কি মজা পেতাম। স্বামীর কাছ থেকে ইনিয়ে বিনিয়ে এ নিয়ে প্রায় অনেকবার চুমু খেয়েছি গালে। তা আমার স্বামী জোরপূর্বক দিতো বোঝা যেতো। স্বেচ্ছায় দিলে অবশ্য ভালোবাসার অনুভূতি পেতাম। যে অনুভূতির জন্য আমার শত প্রার্থনা আল্লাহর কাছে। আমি উন্মাদের মত মোবাইল নিয়ে এদিক ওদিক ছুটে স্বামীকে ধাওয়া করতাম। সেও এসে বলতো।

“ব্যস দেখো ফারজানা আমার মোবাইলের পাসওয়ার্ড বলো। নাহলে চ’ড় খাবা বলে দিলাম।”

“ওকে জামাই আমাকে উম্মাহ দাও।”

শারফান থেমে করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিড়বিড় করে নিজের সাথেই কি যেনো বলতো। আমি দেখে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলাম।

“এই একলা কি বিড়বিড় করছেন?”

“এই মেয়ে একলা কোথায় আমার সাথে আমার আম্মু আছে বুঝলে?”

“ওহ আমার শ্বাশুড়ি মা সঙ্গে আছে আপনার? একটু জিজ্ঞেস করেন তো আমাকে আম্মুর পছন্দ হয়েছে কিনা?”

বলেই লাজুক হেসে মুখে হাত চেপে ধরলাম। শারফানও আমার কথামত জিজ্ঞেস করে। আমি অবাক লোকটার বয়স এখন ছাব্বিশ চলছে। বার্থ সার্টিফিকেট দেখে জেনে ছিলাম। সেই তরুণ যুবকের এই কি দশা? তার বিড়বিড় করে কথা বলাটা আমার মনে খটকা দিতো। শারফান এর ডাকে ধ্যান ফিরলো। সে বলে,

“আম্মু বলছে পছন্দ হয়ছে কিন্তু আমার সাথে দুষ্টুমি করতে মানা করছেন। তাই এখনি পাসওয়ার্ড খুলে দাও।”

“ওহ শ্বাশুড়ি আম্মু বলেছেন আর কি দুষ্টুমি করতে পারি বলুন? এই নেন আপনার ঢেঁড়স মার্কা ফোন। সেই ঘুরে ফিরে আমার কাছে এসেই ফোন চালাবেন। হিহিহি। আমার নিজের ফোন নেই তাতে কি? আপনার যা তাই আমার স্বোয়ামী জি।”

কথার ছলে শারফান এর ঠোঁটে আলতো স্পর্শ দিয়ে রুম থেকে পালালাম। গন্তব্য শ্বশুর আব্বুর রুম। রুমের সামনে এসে মাথায় ঘোমটা টেনে দরজায় টোকা দিলাম। জয়নাল মিয়া ভেতর থেকে উচ্চ আওয়াজে আসতে বললেন। আমি ধীর পায়ে হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করলাম। দেখি শ্বশুর আব্বু এক মহিলার ফ্রেম হাতে নিয়ে বসে আছেন। আমাকে দেখে চোখের জল মুছে বসতে বললেন। আমি নম্র গলায় জিজ্ঞেস করলাম।

“আব্বু ইনি আমার শ্বাশুড়ি?”

“হুম তোমার শ্বাশুড়ি সুন্দরী ছিলো অনেক। তাকে বিয়ের আগে কনে দেখতে যাওয়ার সময় দেখেই প্রেমানুভূতি জাগ্রত হয়ে ছিল। সেই তাকে শুরু তাকে দিয়েই শেষ হবার ইচ্ছা আছে। মেয়েটা না খুব নাজুক ছিল। আমার ব্যথা সহ্য করতো না। অথচ সেই মেয়েটা শ্বশুর বাড়ির নানান অত্যাচার সহ্য করে রাতবিরেতে স্বামীর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতো। আমি অসহায় বাধ্যগত সন্তান ছিলাম বলে মুখ ফুটে বাবা-মায়ের মুখের উপর কথা বলতে পারতাম না। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)এতে অবশ্য তোমার শ্বাশুড়ির কোনো আক্ষেপ ছিল না। তবুও চাইতো আমি কিছু বলি। বলিনী কখনো। তেমনি সংসারের পুরো দায়িত্ব সে বড় বউ হিসেবে নিয়ে পালন করে বেড়াতো। তার পর তো ছোট ভাইয়ের বিয়ে হয় জাহানারার সাথে। তাকে ধনীবিত্ত দেখে মায়ের লোভ জেগে উঠে। আমার বউকে দিয়ে আরো খাটিয়ে নিতো‌। আর কত সহ্য করতাম? আমি তখন এক ছেলের বাবা। শারফান তার মায়ের উপর হওয়া নির্যাতন দেখেছে স্বচক্ষে। তাই সে কখনো মেয়েদের উপর জুলুম করার সাহস পায়নি। তুমি বলতে পারবে মা? সে কখনো অকারণে তোমাকে মেরে ছিলো কিনা? উহুম মারেনি মারলেও অবশ্য তার পেছনে কারণ থাকবে। কিন্তু যখন তোমার শ্বাশুড়ির পেটে শেরহাজ এলো। তখন মা জাহানারার পক্ষপাতীত্ব করে খুব কাজ দিতো। যা আমার সহ্যসীমা লঙ্ঘন করে ছিল। নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে নিজের বউকে নিয়ে অন্যত্রে চলে এলাম। এতে অবশ্য উপকৃত হয়ে ছিলাম আল্লাহর দরবারে। কারণ বাবা মা জাহানারার কাছে ভালো ছিল না। তারা বুঝতে পেরেছিল আসল হীরে কে? তবে দেরি হয়ে গেছিল তখন। আমরা দেশ ছেড়ে ইউকে চলে গিয়ে ছিলাম। সেখানে থেকে আমি আমাদের এ বাড়ির আয়োজন করি, বসতভিটে গড়লাম। শেরহাজ এর জন্মের কয়েকবছর পর শাহানা হলো। ইউকেতে জন্ম হলেও বাবা-মায়ের আর্তনাদের টানে ফিরে আসি। এসে জানলাম তারা মারা গিয়েছে একমাস হবে। আমার কুলাঙ্গার ভাই আমায় জানানোর প্রয়োজন অব্দি মনে করেনি। বাবা-মায়ের কবরে গিয়ে খুব কাদঁলাম। তোমার শ্বাশুড়ির সাথে সুখের দিন পেলেও সময়সীমা সীমিত ছিল জানতাম না। আস্তেধীরে আমার ছেলেমেয়ে বড় হলো। তোমার শ্বাশুড়ি গর্ব হলেও মাঝরাতে নামাজে কাঁদতো। আমায় কিছু বলতো না। হঠাৎ একরাতে সে আমার বুকে মাথা রেখে বলে ছিল।

“ওগো আমার বাচ্চাদের জন্য আমার মতই বউমা এনো। যাতে সংসারটা স্বর্গের হোক। আমি চাই না আমার শ্বাশুড়ির মত তারাও বউ হিসেবে অনাদারে থাকে। শারফান এর জন্য নববধূ এনো যে কিনা পুরো বাড়ির খেয়াল রাখবে।”

আমি সেরাতে তোমার শ্বাশুড়ির কথায় খুব ব্যথিত হয়ে ছিলাম। কেনো সে কান্না করে এসব বলছে পরখ করতে পারছিলাম না। হাসপাতালে নিতে চাইলে যেতো না। জোর করলে কান্না করে বাড়ি মাথায় তুলতো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)কি করব সেরাত খুব ভয়ে কেটে ছিল। জানো মা সকালে যখন দেখি তোমার শ্বাশুড়ির শরীর ঠান্ডা বিশ্বাস করো আমিও তখনি মারা যেতাম। ছেলেমেয়েদের ডাকে ধ্যান ফিরে চটজলদি তোমার শ্বাশুড়ির চেকআপ করিয়ে জানলাম সে নাকি রাতের তিনটায় পরলোকগমন করে ছিল।”

কথার মাঝে চশমা খুলে চোখের পানি মুছলেন শ্বশুর আব্বু। আমারও চোখ ভিজে গেলো। তিনি তপ্ত শ্বাস ফেলে বলেন,

“তখন থেকে শারফান বিড়বিড় করে নিজের সাথেই কথা বলতে লাগল। জিজ্ঞেস করলে বলতো মায়ের সাথে কথা বলি। অথচ ছেলেটা শারীরিক ভাবে পুরোদমে সুস্থ ছিল। ডক্টর কে জানানোর পর তিনি বলে ছিল আপনার ছেলে মায়ের উপর হওয়া নির্মম অত্যাচার স্বচক্ষে দেখেছিল, সে যখন খাওয়ার জন্য কাঁদতো তখনো তার দাদু ধমকে চুপ করাতো। এসবের কারণে সে মনেমনে মাকে কল্পনা করে সঙ্গহীন কথা বলতো। এতে মানুষের ক্ষতি হয় না। এক ধরনের মেন্টালি ফোবিয়া বলতে পারেন। আপনার ছেলের মা আপনার ছেলেকে রক্ষা করে তাকে আশ্বস্ত করে তিনি তার সাথে আছেন। যার কারণে আপনার ছেলে হয়ত আজ অব্দি কোনো অসৎ কদম উঠায়নি। সেই থেকে ছেলেকে মানুষ করলাম। তবে তার মায়ের সাথে কথা বলার অভ্যাস চলমান ছিল। শাহানা শেরহাজ আর শাহানাকে মায়ের কথা শুনাতো। তারাও শুনে খুশি হতো। তুমি জানতে না তাই তোমাকে বলে আজ মনটা হালকা করলাম। একটু কষ্ট করে আমার জন্য চা পাঠিয়ে দিও মা।”

আমি সব জেনে খুশি হয়েছি। যাক স্বামীকে সান্নিধ্যে পাওয়ার আরেক ধাপ হাতে পেলাম। রুমে গিয়ে বললাম।

“শ্বাশুড়ি আম্মা জানেন আপনার ছেলে হলো বদ*মাইশ। অন্য মেয়ের দিকে মজে আছে। আমি কি সুন্দরী না আম্মা?”

“এই আমার আম্মুর কাছে অভিযোগ দিচ্ছো কেনো?”

“আপনি যেমন দেন তেমন। তাই না আম্মু একে বারে ভালো কাজ করেছি না? দেখলেন আম্মু হ্যা বলেছেন।”

“কি আম্মু তুমি এখন এই মেয়ের পক্ষপাতীত্ব করছো। এটা কিন্তু ঠিক না আম্মু। আমি তোমার ছেলে। হ্যা জানি পরের মেয়ে আর আমার বউ তাই বলে মাথায় চড়বে নাকি? না দেবো না একে আমার ফোন। আজই নতুন ফোন কিনে আনবো।”

রেগেমেগে শারফান বেরিয়ে গেলো। হ্যাবলার মত খালি তাকিয়ে রইলাম। কি হলো ব্যাপারটা লোকটা চলে গেলো তাও আবার নতুন ফোন কিনতে?
মনটা উদাস হয়ে গেলো। নতুন ফোন কিনলে যে তাকে জ্বালাতে পারব না।
বিড়বিড় করে বললাম।

“ওওওও শ্বাশুড়ি আম্মা আমার জামাইটার মাথায় বুদ্ধি দাও । আমার মত বউ পেয়েও অবহেলা করে লোকটা।”

চলবে….