Wednesday, August 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 166



কনে_দেখা_আলো পর্ব-১১

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_এগার

মুখ কাঁচুমাচু করে অগত্যা সুফিয়াকে পুলিশের জিপে উঠতে হলো। জামান শিকদার সামনে বসে বলল, ‘তুমি ডিরেকশন দিয়ে নিয়ে যাও। তোমাকে বাসায় রেখে তারপর আমরা আমাদের কাজে যাব।’
সুফিয়া মুখ লটকে বসে থাকল। আজ আর নিস্তার নাই! হয়ত তার এই জঙ্গলে ঘোরাঘুরির আজ থেকেই ইতি ঘটে যাবে। মা শুধু যদি একবার জানতে পারে যে সে একা একা যখন তখন জঙ্গলে গিয়ে ঘোরাঘুরি করে, তাহলে হয়ত তার পড়ালেখাও বন্ধ করে দিতে পারে। এটা করতে মাকে খুব বেশি কষ্ট করতে হবে না। খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিয়ে বলবে, ‘হয় সুফিয়া ইশকুল যাওন বন্ধ করব, নয় আমি না খাইয়া মরুম। যেইটা তোমাগো ইচ্ছা সেইডাই হইব!’
ব্যস, এই কথা শুনেই বাবা অস্থির হয়ে যাবে। সুফিয়াকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলবে… ‘মারে পড়ালেখা না করলে কি আর মইরা যাবি রে মা? কিন্তু মা হারাইলে আর কই পাবি?…’
**
‘তুমি কোন ক্লাসে পড় খুকি?’
‘ক্লাস সেভেনে। কিন্তু আপনে আমারে খুকি কইতাছেন ক্যান? আমি কি খুকি নাকি? বড় হইছি না?’
‘বাহ হাইস্কুলে পড়ো? তাহলে তো বড়ই হয়েছ! খুকি বলা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু হাইস্কুল… সেটা তো এই গাঁয়ে না। এই গাঁ থেকেও আরো কয়েক ক্রোশ পথ। এত দূরে পড়তে যাও? এই গাঁয়ের আর কোনো মেয়ে পড়ে ঐ স্কুলে?’
‘নাহ, আর কেউ পড়ে না। কারো পড়তে ভালা লাগে না। সক্কলের খালি বিয়া করতে ভালা লাগে!’
জামান শিকদারের মুখে হাসি খেলে গেল। মেয়েটা দেখা যাচ্ছে বেশ রসিকা। জামান শিকদারও রসিকতা করে বলল, ‘তোমার কি বিয়ে করার ইচ্ছা নাই?’
‘না নাই। আমি পড়ুম। ম্যালাদূর পড়ুম। ইশকুল পাশ দিয়া কলেজ যামু তারপর ইউনিভার্সিটি।’
‘বাহ বেশ তো। খুব ভালো কথা! পড়াশুনা করার ইচ্ছা থাকলে কেন পড়বা না?’
সুফিয়া একটু বেজার মুখে বলল, ‘মা পড়বার দিবার চায় না। খালি আমার লাইগা পাত্র খোঁজে। ভালা পাত্র পাইলেই জোর কইরা বিয়া দিয়া দিব।’
‘নাহ তুমি ঠেকাবা। জোর করে কোনো কাজ করলে সেই কাজ কখনোই ভালো হয় না। যা করবা মন থেকে করবা। তা… তোমার কোন বিষয় পড়তে বেশি ভালো লাগে?’
‘অংক। অংকের মতন মজার আর কিছুই নাই!’

জামান শিকদার চমৎকৃত হলো। মেয়েটার বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ দেখে বোঝা গেল, সে যা বলছে মন থেকেই বলছে। বুদ্ধিমতী মেয়ে। এবারে একটু প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে তিনি জানতে চাইলেন, ‘আচ্ছা তুমি যে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াচ্ছিলে, সেখানে কিছু দেখতে পাওনি?’
সুফিয়ার একবার মনে হলো, সে আজকে যা দেখেছে সেটার কথাই হয়ত ইনি জিজ্ঞেস করছেন। কিন্তু ভুল ভাঙল পরের প্রশ্নে।
‘মানে, কেউ কেউ বলে সেখানে নাকি অশুভ কিছু আছে! জঙ্গলে কেউ গেলে তাকে ভয় দেখায়। তুমি ভয় পাওনি?’
‘ওহ আপনেও এইডা বিশ্বাস করেন? হায় আল্লাহ্‌!’ সুফিয়া সবিস্ময়ে বলল।
‘কেন? বিশ্বাস করার কথা না?’
‘আরে দূর! জঙ্গলে দেউ আছে, এইডা তো লোকে গপ্পো বানাইছে যাতে কেউ জঙ্গলে না যায়!’
জামান শিকদার সুফিয়ার বুদ্ধিমত্তা ও সাহসে আরো একবার চমৎকৃত হলো। এই দিকটা তো ভেবে দেখা হয়নি! মেয়েটা তো খুব দামি একটা পয়েন্ট বের করেছে চিন্তা করে! আরেকটু বাজিয়ে নেওয়ার জন্য জামান শিকদার জিজ্ঞেস করল, ‘কেন কেন? এই কথা কেন বলছ? জঙ্গলে অন্যরা গেলে কার কীসের ক্ষতি?’
‘ক্ষতি তো আছেই! জঙ্গলে এত গাছ! কত ফলপাকুড়! আমাগো ইশকুলের মাস্টার সাব কইছে, গাছের ম্যালা দাম। গাছ তো আমাগো জীবন বাঁচায় এইডা ঠিক আছে, কিন্তু গাছ দিয়া ম্যালাকিছু বানানও যায়! কে কইবার পারে, ঐ জঙ্গলের গাছগুলান কাটনের লাইগা কেউ এই ভুয়া কথা কইতাছে কী না!’
জামান শিকদার কয়েক সেকেন্ডের জন্য বিহ্বল হয়ে গেল। মোতালেবও গাড়ি চালাতে চালাতে চকিতে একবার সুফিয়ার মুখের দিকে তাকাল। এই এত বুদ্ধিমতী মেয়েটাকে একবার না দেখে নিলেই যেন নয়!

‘সুফিয়া, তুমি একটা কথা বলো তো আমাকে। তুমি তো মনে হচ্ছে এর আগেও জঙ্গলে গিয়েছ। তুমি কি জঙ্গলে সেরকম কিছু দেখতে পেয়েছ?’
সুফিয়ার একবার মনে হলো, মন্দিরে মানুষ থাকার যে প্রমাণ সে আজকে আবিষ্কার করেছে সেটা এই পুলিশ স্যারকে বলে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে নিজেকে সামলে নিলো। না ওটা আগেই বলা যাবে না। আগে সে পুরো জিনিসটা নিজে খুঁজে বের করবে তারপর যা করার করবে।
‘ন…না আমি কিছু দেখি নাই। কিন্তু ধরেন এমুন তো হইবার পারে তাই না?’
জামান শিকদারের কাছে একবার মনে হলো, মেয়েটা কিছু একটা গোপন করল তার কাছে। খুব খুব বুদ্ধিমতী এই মেয়ে। একে একটু চোখে চোখে রাখা দরকার, মনে মনে ভাবল জামান শিকদার।

সুফিয়াদের বাসার কাছাকাছি চলে এসেছিল তারা। সুফিয়া এবারে মিনতি জানাল, ‘স্যার আমি এইখানে নাইমা যাই? আমার মায়ে আমারে পুলিশের গাড়িতে দ্যাখলে আমার পড়ালেখা বন্ধ কইরা দিব!’
‘তাই? কিন্তু আমি তো তাদেরকে একটু সাবধান করে যেতে চাচ্ছিলাম। তোমাকে যাতে একটু চোখে চোখে রাখেন তারা। এভাবে একা একা বনে জঙ্গলে ঘুরঘুর করলে কখন কোন বিপদে পড়বা জানো?’
‘না না না স্যার। আপনি হেইডা করলে আমার পড়ালেখা এইখানেই শ্যাষ! মায়েরে আর কিছুই বুঝান যাইব না!’
‘আচ্ছা… ঠিক আছে। তুমি খুব বুদ্ধিমতী একটি মেয়ে, তাই তোমাকে নিশ্চয়ই বেশিকিছু বলার দরকার নেই। তুমি জানো না মেয়েদের কতরকম খারাপ শত্রু থাকে?’
সুফিয়া মাথা উপর নিচে নামায়, অর্থাৎ সে জানে।
‘সেই শত্রুদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে চলা খুব কঠিন। এজন্য খুব সাবধানে চলাফেরা করতে হয় বুঝেছ? আর কখনো এভাবে একা একা বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়ো না। মনে থাকবে তো?’
সুফিয়া এবারে ঘাড়সমেত মাথাটাকে একপাশে হেলিয়ে দেয়। জামান শিকদার হাসতে হাসতে বলে, ‘শুধু মাথা নাড়ালেই চলবে না। কথাগুলো মাথায় ভালোমতো ঢুকিয়ে নিতে হবে। আচ্ছা তুমি এখানেই নেমে পড়ো তাহলে। কোনো দরকার হলে পুলিশষ্টেশনের দরজা খোলা। আর মন দিয়ে পড়ালেখা কোরো। তুমি চাইলে অবশ্যই একদিন ইউনিভার্সিটিতে যেতে পারবে। তোমার অনেক সাহস। কে জানে হয়ত একদিন তুমি আমার কলিগও হয়ে যেতে পারো! অবশ্য আমি হয়ত ততদিনে রিটায়ারমেন্টে চলে যাব!’
সুফিয়া উজ্জ্বল মুখে তাকিয়ে থাকে। তার কাছে এত ভালো লাগে কথাগুলো শুনে! সত্যি সত্যিই যদি সে পুলিশ হতে পারত! সব চোর ছ্যাঁচড়ের দলকে ঠেঙিয়ে সোজা করে দিত!

জামান শিকদার মোতালেবকে গাড়ি ঘুরাতে বলে। বিকেলের আলো প্রায় ফুরিয়ে আসছে। এখন আর জঙ্গলের দিকে গিয়ে কাজ নেই। আগামিকাল সময় করে একবার আসতে হবে।
গাড়ির মুখ ঘুরতে গাড়িতে উঠতে যায় জামান শিকদার। একবার পেছন ফিরে তাকায়। সুফিয়া তখনো সেখানে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখেচোখে অদ্ভুত প্রশান্তি। সুফিয়ার পেছনে বেশ খানিকটা দূরে একটা লতানো গাছের মাচান দেওয়া জায়গা চোখে পড়ল তার। সেখানে শাড়িপরা একটা মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। দূরত্বটা অনেক বেশি না। মেয়েটাকে পরিষ্কারই দেখা যাচ্ছে।
গাড়িতে ওঠার জন্য এক পা বাড়িয়েছিল জামান শিকদার। পা টা নিজের অজান্তেই মাটিতে নেমে এলো। মেয়েটাও স্থিরচোখে এদিকেই তাকিয়ে আছে। সেই মুখে একটু বুঝি বিভ্রান্তের চাহনি।
মেয়েটার এক মাথা এলোচুল কোমর ছাপিয়ে নিচে নেমে এসেছে। পরনের কাঁঠালিচাপা রঙের শাড়ির আঁচলটা কোমরে গোঁজা। মেয়েটার হাতে একটা কাস্তে মতো কিছু। এই শেষ বিকেলে সে লাউ তুলতে এসেছে।

জামান শিকদারের চোখের দৃষ্টি অনুসরণ করে এবারে সুফিয়াও তাকালো পেছন দিকে। একটু ভয়ে ভয়েই তাকিয়েছিল সে। মনে হয়েছিল পেছন ফিরেই বুঝি মাকে দেখতে পাবে। কিন্তু পেছনে লাউয়ের মাচানের নিচে বোন জুলেখাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুফিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। সামনে তাকিয়ে পুলিশ অফিসার জামান শিকদারের চোখেমুখেও একটা আগ্রহী ছাপ দেখে সুফিয়ার মনে বিদ্যুৎ চমকালো। শেষ বিকেলের অবশিষ্ট রক্তিমাভাটুকুকে সে মনে মনে ধন্যবাদ জানাল।
‘আমার বুবু। লাউ পাড়তাছে মনে হয়। বুবু রোজ রাইতে রান্না করে। দিনের বেলায় ঘরের কামকাজ করে আর রাইতে রান্না করে। বুবুর খালি সব উল্টাপাল্টা কাম!’
‘উম…হুউম… ওহ আচ্ছা… ঠিক আছে খুকি। চলি তাহলে! ভালো থেকো!’

চেষ্টা করেও নিজের অন্যমনস্কতাকে এড়াতে পারল না জামান শিকদার। পুলিশ হয়েও সে আজ চোরের মতো এক বুদ্ধিমতী বালিকার কাছে ধরা পড়ে গেছে। ছি ছি! কী ভীষণ লজ্জার কথা!
স্নিগ্ধ মায়াময় এক সাধারণ গ্রাম্য নারীকে দেখে এতটা উতলা হওয়া সত্যিই বাড়াবাড়ি! মনে মনে নিজেকে খুব একচোট ধমকাল জামান শিকদার।

সুফিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে লাফিয়ে লাফিয়ে অতিক্রম করল তার আর জুলেখার মাঝের দূরত্বটুকু। কাছাকাছি চলে আসতেই জুলেখা হাঁক দিলো তাকে, ‘সুফিয়া… ঐ সুফিয়া তুই আইজকা আবার কই গেছিলি? আর তোরে পুলিশ ধরছিল ক্যান? কী করছিস তুই? জুলেখার মুখেচোখে উদ্বেগ আর আশঙ্কা। তার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছে সুফিয়া নির্ঘাত একটা কোনো অঘটন ঘটিয়েছে।
সুফিয়া হাসতে হাসতে বলল, ‘পুলিশ আমারে ধরে নাই গো বু! পুলিশ তো আমারে খাতির কইরা বাড়িত নামাইয়া দিয়া গ্যালো! ইস্পেশাল খাতির কইরা! তয় অহন বুঝতাছি এই খাতিরের দরকার আছিল। মনে হইতাছে সামনে আরো ম্যালা খাতির পামু!’
জুলেখা এই হেঁয়ালিভরা কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে বলল, ‘কী কইতাছস খুইলা ক! এত ধুঁয়া দিয়া কথা কইলে বুঝুম ক্যামনে?’
‘বুঝন লাগব না তুমার! লও বাড়িত চল। আর আল্লাহ্‌র দোহাই লাগে, মুখডারে একটু চাইপা রাইখ। মায়ে য্যান কিছুই জানবার না পারে!’
তারপর জুলেখার দিকে তাকিয়ে চাপাহাসিতে উদ্ভাসিত মুখে বলল, ‘বুবু আল্লাহ্‌য় আজ বেবাক কিছু মিলাইয়া দিছে। তুমি কী সুন্দর কাঁঠালিচাঁপা শাড়িটা পিন্ধছ! এক্কেরে সিনেমার সিনের লাগান ঠিক সময়মত মাচানের কাছে গ্যাছ! আমার যে কী খুশি লাগতাছে বু!’
জুলেখা বোনের কথায় ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তরে কি আজ হাছাই ভূতে ধরছে? এগুলান কী কইতাছস?’
‘ভূতে না বু! খুশিতে ধরছে! আইজ আমার বুয়ের প্রত্থম দ্যাখা হইয়া গ্যালো। খাড়াও, পাকা দ্যাখাটাও জলদি জলদিই করাইয়া দিমু!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-১০

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_দশ

এই গল্প ইতোমধ্যেই জামান শিকদার একাধিকবার শুনেছে। তবু শান্তমুখে আরেকবার শুনল। তারপর বলল, ‘তবু বলা তো যায় না। হয়ত বেশভূষা পাল্টে ভিড়ে মিশে গেছে। একবার শহরে চলে গেলেই কিন্তু ওকে ধরা খুব সহজ কাজ হবে না।’
‘এইটা আপনি কী কথা কইলেন ওসি সাব? আপনাগো জেলা সদরের হেড কোয়ার্টারে শমসেরের ছবি দিয়া দিলে তারা সেই ছবি রাস্তাঘাটে লটকাইয়া রাখব না? অপরাধী কি এক জায়গায় সান্ধাইয়া থাকে? যেমনে পারেন, শমসেররে কইলাম ধরোনই লাগব ওসি সাব!’
‘সেই চেষ্টায় কি ত্রুটি রেখেছি কোনো? আর ছবিও জেলা সদরে ঝুলানো হয়েছে। শমসেরকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না!’

চেয়ারম্যান সাহেবকে বিদায় দিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে জামান শিকদারের চোখ চেয়ারম্যানের সাগরেদ বাবুলের ওপরে আটকে গেল। এই ছেলেটার মধ্যে কী যেন একটা আছে! চোখের দিকে তাকালে স্বস্তিবোধ হয় না। কেমন জানি অস্বস্তি লাগে। ছেলেটা কেমন এক দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একবারের জন্যও চোখ সরাল না।
অস্বস্তিটাকে জিইয়ে রেখেই জিপে চড়ে বসল জামান শিকদার। চেয়ারম্যান সাহেব কী যেন বলছিল, তার সাগরেদ দুজন আজকে নাকি জঙ্গলে গিয়ে ভয় পেয়েছে! একবার যাবে নাকি ঐদিকটায়? ঘুরেই আসা যাক! দেখা যাক ঘটনা আসলে কী!
ড্রাইভারকে পশ্চিমের জঙ্গলের নাম বলতেই সে মনে হয় একটু যেন সিঁটিয়ে গেল। মনে মনে কয়েকবার দোয়া দরূদ পড়ে নিলো। এই ওসি সাহেবের ডিউটি করে এমনিতে আরাম আছে। মেজাজ পানির মতো। সবসময় হেসে হেসে কথা বলে। ধমকাধমকি একেবারেই করে না। কিন্তু সমস্যা একটাই। ভয়ডর একটু বেশিই কম। এইসব জঙ্গলের গল্পটল্প তিনি বিশ্বাস করেন না। প্রথমদিকে সে সত্য মিথ্যা বানিয়ে একটা জমজমাট গল্প ফেঁদেছিল। ওসি সাহেব মুখ ভেটকে বলেছে, ‘তুমি নিজের চোখে দেখেছ এসব? নাকি পুরোটাই এর কাছ থেকে এক খাবলা ওর কাছ থেকে দুই খাবলা… এভাবেই মেরে দিলে?’
ড্রাইভার সেদিনই বুঝে গিয়েছিল, এর কাছে বেশি গুলগাপ্পি মারা যাবে না।

আগের ওসি সাহেব লোকটাও খারাপ ছিল না। এমনিতে একেবারে শান্ত গাইয়ের মতো মানুষ ছিল। কিন্তু একদিন কী জানি একটা বিষয় নিয়ে খুব উত্তেজিত ছিল। হেড অফিসেও সম্ভবত, কিছু একটা জানিয়েছিল। ওখান থেকে যখন সাড়াশব্দ আসছিল না তখন নিজেই হেড অফিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু পথেই তার কাছে ফোন আসে যে, তাকে বদলি করা হয়েছে। বদলির আদেশ সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হয়ে গেছে। অনতিবিলম্বেই তাকে ভোলায় চলে যেতে হবে।
কর্তার ইচ্ছাতেই কর্ম। কী যে হয়েছিল কেউই তা জানতে পারেনি। তিনিও কাউকে বলে যাওয়ার সময় পাননি। সেইদিন রাতেই তাকে এখানকার পাঠ চুকিয়ে দিয়ে ভোলায় রওয়ানা দিতে হয়।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল সবে নামি নামি করছে। গ্রীষ্মের তপ্ত দাবদাহ এইমাত্র যেন একটু শীতল হয়েছে। চোখে সানগ্লাসটা জড়াতে গিয়েও পকেটে রেখে দিলো জামান শিকদার। এই প্রকৃতিকে দেখতে হয় খোলা চোখে, সবরকম রঙিন আবরণ থেকে নিজেকে মুক্ত করে।
দুইপাশের দিগন্তবিস্তৃত ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে যেতে যেতে জামান শিকদার আরেকবার ভাবনার জালে জড়িয়ে গেল। যেভাবে একটার পরে একটা প্যাঁচ লাগতে শুরু করেছে এখানে, মনে হচ্ছে তাকেও বুঝি আগেরজনের মতো অন্য কোথাও বদলি হতে হবে। আগের জন যে ঠিক কী কারণে বদলি হয়েছিল এটা তাদের পুলিশ স্টেশনের কেউই ভালোমত বলতে পারে না। একজন একটা বলে তো আরেকজন আরেকটা। শুনে বোঝা যায়, আসল কারণ কেউ জানে না।
কথাটা মনে হতেই জামান শিকদার আরেকবার ভাবল, তার নিজের একবার আগের ওসি সাহেবের সঙ্গে ফোনে আলাপ করা দরকার। হয়ত লাভের লাভ কিছুই হবে না। তবু বলা যায় না, পাইলেও অমূল্য রতন পাওয়া যেতে পারে।

যেতে যেতে ড্রাইভারের সঙ্গে গল্প শুরু করল জামান শিকদার। তার ড্রাইভারটাও গল্প করতে ভালোবাসে। তবে জামান শিকদার নিজেই তাকে একটু দমিয়ে রাখে। খুব বেশি পটরপটর করতে দেয় না। কারণ বেশি গল্প করার চান্স দিলে সে দিনেই চাঁদ তারা দেখিয়ে দিতে পারবে। এমনই কামিয়াব গল্পবাজ!
‘মোতালেব, একটা কথা বলো দেখি!’
‘জি স্যার কী কথা?’
‘তোমার আগের স্যার কেমন ছিলেন?’
‘আগের ওসি সাব? খুব ভালামানুষ আছিলেন স্যার। একেবারে মাটির মানুষ। গাইয়ের মতো। সবাইরেই অনেক সম্মান করতেন। স্যার যেদিন চইলা গ্যালেন সবাই তার বাসায় গেছিল। সক্কলের মন খারাপ আছিল!’
‘চলে গেছিলেন কেন এই ব্যাপারে কিছু জানো?’
‘কী একটা জানি খবর পাইয়া স্যার খুব টেনশনে আছিলেন। হেড অফিসে ফোন দিছিলেন। তারপর আমারে নিয়া হেড অফিসের দিকেই রওয়ানা দিছিলেন। রাস্তাতেই তো বদলি হওনের ফোনটা পাইলেন…’
‘হুম! কী নিয়ে টেনশনে ছিলেন এটা জানো না?’
‘না স্যার। এইটা জানবার পারি নাই!’
জামান শিকদার চুপ করে গেল। বোঝাই যাচ্ছে এখানে একটা ভালোরকম ‘কিন্তু’ আছে। সেই কিন্তুটা যে কী, এটাই বোঝা যাচ্ছে না!

জঙ্গলের কাছাকাছি আসতেই একটু দূর থেকে একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। স্কুল পোষাক পরা একটি মেয়ে জঙ্গলের ভেতর থেকে বের হয়ে আসছে। মেয়েটার লম্বা চুলগুলো দুই বেণীতে আটকে রাখা। জামান শিকদারের চোখ গোল গোল হয়ে গেল। যা দেখছেন, ঠিক দেখছেন তো? দুইটা মর্দা জোয়ান আজ ভয় পেয়ে জঙ্গল থেকে পালিয়ে এসেছে, সেখানে বাচ্চা একটা মেয়ে সেই জঙ্গলে একা একা কী করছে? ব্যাপারটা তো দেখতে হবে! ড্রাইভারকে চটজলদি গাড়ি থামানোর নির্দেশ দিলো জামান শিকদার।
‘এ্যাই এ্যাই … মোতালেব… গাড়ি থামাও শিগগির। ঐ যে একটা মেয়ে বের হয়ে আসতেছে না জঙ্গল থেকে? দেখো দেখি! আমি কি ভুল দেখতেছি?’
মোতালেব সামনে তাকিয়ে জমে গেল। বাপরে বাপ! এই জঙ্গলে কেউ ঢোকার সাহস পায় না। এই মেয়ে একা একা ঢুকল কোন সাহসে? সে কি আসলেই মানুষ নাকি…! মোতালেবের মুখ দিয়ে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এলো, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…’
জামান শিকদার সেটা শুনে হাসতে হাসতে বলল, ‘কালেমা পড়ছ ভালো কথা। কিন্তু এখন আবার গাড়ি ফেলে ছুট দিও না যেন বুঝলা? তুমি গাড়িতে বসে থাকো। আমি আসছি। খবরদার গাড়ি নিয়েও কিন্তু ছুট দেওয়া যাবে না। পুলিশের চাকরি করে এত বীর বাহাদুর হলে চলে না!’

জামান শিকদার গাড়ি থেকে নেমে জঙ্গলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বেশ কিছুটা কাছাকাছি যাওয়ার পরে বুঝতে পারল, দেউ পেত্নি কিচ্ছু না। একেবারে সাদাসিধা গ্রামের একটা মেয়ে। একদম জীবন্ত, চলৎশক্তিসম্পন্ন। ততক্ষণে মেয়েটাও তাকে দেখে ফেলেছে। সম্ভবত পুলিশের পোশাক পরা দেখেই চোখ বড় বড় করে তাকে দেখছে। কাছাকাছি হওয়ার পরে জামান শিকদার গম্ভীর গলায় বলল, ‘এ্যাই মেয়ে, তুমি কে? এই বিকাল বেলায় একা একা জঙ্গলে এসেছ কেন? ভয়ডর নাই?’
সুফিয়া তখনো অবিশ্বাসীর চোখে পুলিশকে দেখছে। তার মুখে কথা যোগাচ্ছে না। একটু আগেই সে জঙ্গলের মধ্যে জ্যান্ত একজন মানুষ দেখেছে। কোনো ভুল নাই। ওটা মানুষ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। যদিও তার বোন জুলেখা থাকলে বলত, এটা নিশ্চয়ই মানুষের বেশ ধরে কোনো দেউ। কিন্তু সুফিয়া তীক্ষ্ণচোখে মানুষটার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে ছিল। মানুষটাও তাকে দেখেছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ড। তারপরেই সে পাঁই করে ঘুরে নিমেষেই কই যেন হাওয়া হয়ে গেল। একেবারে অল্প কয়েক সেকেন্ডেই হাওয়া। এত দ্রুত তাকে সরে যেতে দেখে সুফিয়ার প্রথম একটু ভয় লেগেছিল। কিন্তু সেটা খুব বেশি সময়ের জন্য না। একটু পরেই ভয় পাওয়ার জন্য সে নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিচ্ছিল।

মানুষটা গায়েব হওয়ার পরে সুফিয়া সেখান থেকে সরে আসেনি। আশেপাশে তন্ন তন্ন করে তাকে খুঁজেছে। মন্দিরের মধ্যে ঢুকে দেখেছে। সেখানে ঢুকে যা দেখেছে তাতে আর সন্দেহ থাকেনি যে, ওখানে একটা মানুষই থাকে।
জায়গাটা আগের চাইতে আরো বেশি সাফসুতরা করে রাখা। একপাশে একটা মাদুর বিছানো, তার এক মাথায় একটা তেল চিটচিটে বালিশ। ঘরে একটা বোটকা গন্ধ। গন্ধটা পুরনো ভবন বা ভাঙাচোরা মন্দিরের ভেতর থেকে আসা স্বাভাবিক গন্ধ না। এটা যেন কোনো মানুষের শরীরের গন্ধ! হয়ত সেই মানুষটা নিয়মিত গোসল করে না, তাই এমন বোটকা গন্ধ শরীরে।
ঘরের একপাশে একটা টুল জাতীয় বস্তুর ওপরে একটা খুব সাধারণ পানির জগ আর মেলামাইনের গ্লাস। এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিত্য ব্যবহার্য টুকিটাকি, যা প্রমাণ করে কেউ একজন এখানে আস্তানা গেঁড়েছে।

সুফিয়া নতুন কিছু আবিষ্কারের নেশায় উত্তেজিত হয়ে ওঠে। হয়ত আরো কিছুটা সময় সে সেখানে থাকত। কিন্তু হুট করে মনে পড়ে যায়, আজ জুলেখাবু তাকে নিয়ে ফুলিকে দেখতে যাবে। ফুলি তার সহপাঠী ছিল। বিয়েশাদি করে পেট বাঁধায়ে বসে আছে। সুফিয়ার মোটেও ইচ্ছা নেই, সেই পেটরা বান্ধবীকে দেখতে যাওয়ার। অকর্মার ঢেঁকি সব। কাজের মধ্যে কাজ হচ্ছে বিয়ে শাদি করে বাচ্চাকাচ্চা পয়দা করা। আর যেন মানুষের কোনো কাজ নেই!
তবু বুবুর মুখ চেয়েই সে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। রহস্যটা উদ্ঘাটন করা গেল না। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো, এখানে কে থাকে… কেন থাকে এটা সে বের করেই ছাড়বে! আর বের না করা পর্যন্ত এই কথা সে কারো কাছে গল্প করবে না, বুবুর কাছেও না।

কিন্তু জঙ্গল থেকে বের হয়েই এ আবার কোন উটকো বিপদ? পুলিশ এখানে কী করছে? এই তো এখন শুরু করবে দুনিয়ার প্রশ্ন! আর যদি ওকে ধরে নিয়ে যায়? একা একা জঙ্গলে কোন মতলবে ঢুকেছে, এসব নিয়ে যদি অহেতুক হয়রানি করে?
ঝট করে সব চিন্তাভাবনা মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দিলো সুফিয়া। সে তো কোনো অন্যায় করেনি! শুধু শুধু হয়রানি করতে চাইলেই হলো? পুলিশ হইছে বলেই কি মাথা কিনে নিছে নাকি?

‘এ্যাই মেয়ে তুমি কে? কথা বলছ না কেন? কথা বলতে পারো না?’
‘পারুম না ক্যান? আমার নাম সুফিয়া!’
‘হুম সুফিয়া, তুমি একা একা জঙ্গলে কী করতে এসেছ? জঙ্গলের ভেতরে যে কালী মূর্তি ইয়াব্বড় জিভ বের করে বসে আছে, দেখোনি সেটা?’
‘হ দ্যাখছি তো! ভাঙা মূর্তি। ডান হাত ভাইঙ্গা গ্যাছে!’
‘ডান হাত ভেঙ্গেছে বলে কি তোমাকে ধরতে পারত না নাকি? যদি খপ করে ধরে কপ করে বলি দিয়ে দিত? তুমি জানো না, এখানে আগে নরবলি হতো?’

সুফিয়া হঠাৎ ফিক করে হেসে দেয়। সে বুঝতে পারে, এই পুলিশটা তার সঙ্গে ইয়ার্কি করছে। তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনো মতলব নেই তার। থাকলে এসব কথা বলতই না!
‘কী হলো খুকি! তুমি হাসছ কেন? স্কুল ফাঁকি দিয়ে জঙ্গলে ঘুরতে এসেছ? আচ্ছা সাহস তো তোমার! কী করতে এসেছ বললে না তো!’
জঙ্গলে কেউ থাকে এই কথাকে বেমালুম পাশ কাটিয়ে সুফিয়া অন্য কথা বলল। ‘জঙ্গলে ম্যালা ফলপাকুড়। গাছে ধইরা পাইকা থাকে। মাটিতে পইড়া থাকে, খাওনের কেউ নাই! ঐগুলান পাড়তে গেছিলাম।’
বলতে বলতে নিজের জামার কোঁচড় দেখাল সুফিয়া। জঙ্গলে মাঝে মাঝে এমনি এমনি ঘুরে বেড়াতে কী যে ভালো লাগে তার, এই কথাও আগাগোড়া চেপে গেল। দরকার নাই ও কথা বলার। তাহলে হয়ত এই পুলিশ তাকে পাগল মনে করবে।
জামান শিকদার সুফিয়ার জামার কোঁচড়ে কিছু ফলমূল দেখতে পেল। আচ্ছা ক্ষ্যাপাটে মেয়ে তো এ! ভয়ের অস্তিত্ব নাই! ফলমূল খেতে জঙ্গলে চলে এসেছে। দেখতে শুনতে ফুটফুটে একটা কিশোরী মেয়ে। ভূতপ্রেতের ভয় না থাকুক, অন্য জিনিসের তো ভয় আছে! সেই সম্পর্কে সম্ভবত এর কোনো ধারণাই নেই। এর মা-বাবাকে সতর্ক করে দেওয়াটা জরুরি। দিনকাল খুবই খারাপ। আজকাল গ্রাম কিংবা শহর কোথাও মেয়েরা নিরাপদ নয়। আট থেকে আশি বছরের কেউই নিস্তার পায় না নারীলিপ্সু পিশাচগুলোর হাত থেকে। একটা নারী শরীর থাকলেই যেন শুধু হয়!

জামান শিকদার বলল, ‘এখন তো বাসায় যাচ্ছ তাই না? নাকি এ্যাডভেঞ্চার এখনো বাকি আছে?’
সুফিয়া আবার ফিক করে হেসে বলল, ‘হ অখন বাসায় যামু।’
‘হুম বেশ, চলো আমি তোমাকে পৌঁছে দিয়ে আসি’
সুফিয়া একেবারে না না করে উঠে বলল, ‘আমি একা যাইতে পারুম। নিয়া যাইতে হইব না!’
‘উঁহু, তোমাকে একা রেখে যাওয়া যাবে না। গাড়িতে উঠতে তোমাকে হবেই। আমার একটা দায়িত্ব আছে বুঝলে? ভয় নাই, আমি তোমাকে পুলিশস্টেশনে নিয়ে যাব না!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৯

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_নয়

চেয়ারম্যান আবদুল লতিফের সামনে তার দুই সাগরেদ বাবুল আর মোস্তাক দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের মাথাই হেঁট করা। থেকে থেকে শুধু মোস্তাক একটু মাথা তুলে কিছু একটা বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আর পরমুহূর্তেই চেয়ারম্যান সাহেবের ধমক খেয়ে ধুপ করে মাথা নিচু করে ফেলছে।
আজকে চেয়ারম্যান সাহেব তাদেরকে পশ্চিমের জঙ্গলের মধ্যে থেকে একবার ঘুরে আসতে বলেছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে কালীমন্দিরের হাল অবস্থা দেখে আসা। আব্দুল লতিফ সাহেব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এলাকার উন্নয়নের জন্য কিছু বিশেষ কাজকর্ম করবে। আশেপাশের দু’দশটা গ্রামকে দেখিয়ে দেওয়া দরকার যে কদমপুর গ্রামের চেয়ারম্যান শুধু গ্রামের উন্নতির জন্যই মাথা ঘামায় না, বরং এখানকার প্রাচীন ঐতিহ্যগুলোও রক্ষা করার কাজে মনোযোগী।
সেইজন্যই তিনি কালীমন্দির সংস্কারের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এত বছরের পুরনো একটা মন্দির, এভাবে সংস্কারের অভাবে সাপখোপের আখড়া হবে? এটা ভালো দেখায় না। তাই তিনি নিজেই এবার জঙ্গলের প্রাইভেসি নষ্ট করার কাজে নেমেছেন।

চেয়ারম্যান সাহেবের এই সিদ্ধান্তে গ্রামের মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগের প্রতিক্রিয়াই এই কাজের বিপক্ষে। এলাকার হিন্দু জনবসতি কমতে কমতে এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। যে অল্প কয়েক ঘর হিন্দু পরিবার আছে, তাদের কাছে ঐ জঙ্গলে ঢুকে পূজা অর্চনা করার সাহস হবে বলে মনে হয় না। আর তাছাড়া এসব মন্দিরের জন্য পুরোহিতের ব্যবস্থা করতে হয়। সেই পুরোহিতের আবার মাসোহারার ব্যবস্থা করতে হয়। গাঁয়ের লোক যদি পূজাই না করে, তাহলে শুধু শুধু এসব কাজ করে কী হবে?
তাছাড়া মন্দিরের নামে যেসব গল্পগাঁথা চালু আছে, সেগুলোও তো কম ভীতিকর না। একসময়ের রক্তপিপাসু বিগ্রহ আবার যদি জেগে ওঠে?
চেয়ারম্যানের কানে গাঁয়ের লোকজনের এসব কথা ভেসে আসতেই তিনি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তার চ্যালা চামুণ্ডাদের ধরে এনে বলেছেন, ‘এইসব কথা কারা হয় এক এক কইরা নিয়া আইবা আমার কাছে। সব কয়টার তেল কমাইয়া দিতে হইব। মুসলমানের পোলা হইয়া বিশ্বাস করে যে বিগ্রহ জাগ্রত হইব! এইসব কথা বিশ্বাস করলে ঈমান থাকব?’

এরকম অবস্থার মধ্যেই তিনি তার দুই একান্ত সাগরেদকে মন্দিরের হাল হকিকত দেখে আসার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই দুইজন ফিরে এসেছে কাঁপতে কাঁপতে। তাদের মুখে সব কথা শুনে আব্দুল লতিফের মাথার তালু থেকে পায়ের পাতা অব্দি জ্বলে গেছে। মোস্তাক থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলেছে, ‘হুজুর, ঐখানে কুনো কাম করা যাইব না! আমরা গেছিলাম। বেশিদূর যাইবার পারি নাই! আমি এক্কেরে হাচা কথা কইতাছি হুজুর! বাবুল ভাইও দ্যাখছে! বাবূল ভাই, আপনেও হুজুররে কন কী দ্যাখছেন!’
বাবুল মোস্তাকের কথায় সাড়া না দিয়ে বলল, ‘আগে তুই কইয়া নে। আমি পরে কমু!’
আব্দুল লতিফ এবারে হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘অই হারামজাদা বাইনচোতের দল! কী দ্যাখছস কস না ক্যা? মারুম নাকি এক থাবড়া?’
মোস্তাক এবারে মিন মিন করে বলে, ‘হুজুর, ঐ জঙ্গলে দেউ আছে। আমি নিজের কানে আওয়াজ পাইছি। কেমুন জানি গায়েবি আওয়াজ। মন্দিরের কাছে যাইবার পারি নাই। হের আগেই কিয়ের জানি ধুঁয়া আইসা পথঘাট আন্ধার কইরা দিছে। মায়ের কিরা। হাচা কইতাছি হুজুর!’ মোস্তাক এবারে প্রায় কেঁদেই ফেলে।
আব্দুল লতিফ এবারে বাবুলের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘কীরে তুইও কি দ্যাখছশ কিছু? নাকি বেবাক কিছু এই মোস্তাকেই দ্যাখছে?’
বাবুল মাঝবয়সী গাট্টাগোট্টা লোক। চোখের দৃষ্টি আর মগজের তাপমাত্রা স্থির রাখতে পারা তার একটা বিশেষ গুণ। কোনো পরিস্থিতিতেই সে মাথা গরম করে না। হুটহাট কোনো কথা বলে না। আর তার চাইতেও বড় কথা, সে সহজে ভয় পায় না। আব্দুল লতিফ তার এই সাগরেদকে বিশেষ পছন্দ করে। তবে সেটা তিনি বুঝতে দেন না। পক্ষপাতিত্ব বেশি বুঝে গেলে মাথায় চড়ে বসে থাকবে। তখন কিছুতেই মাথা থেকে নামানো যাবে না।

বাবুল মুখ তুলে আব্দুল লতিফের দিকে স্থিরচোখে তাকিয়ে অকম্পিত স্বরে বলে, ‘আমি কুনো আওয়াজ শুনি নাই। তয় কেমুন জানি একটা ধুঁয়া দ্যাখছি। আমরা যখন মন্দিরের দিকে যাইতাছিলাম তখন ধুঁয়ায় চারপাশ ঢাইকা গেছিল।’
আব্দুল লতিফ ভেতরে ভেতরে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল। তবে ওপরে সেটা প্রকাশ না করে বলল, ‘এ্যাহ দুই বীর পালোয়ানরে পাঠাইছি আমি! এদ্দিন কি জঙ্গলে কেডাও যায়নি নাকি? তোগো এই ধুঁয়ার গপ তো কারো মুখ থেইকা শুনলাম না!’
‘জঙ্গলে কেডায় যাইব হুজুর? মাইনষের জানের মায়া কম আছেনি?’ পাশ থেকে আবারও মোস্তাক বলে ওঠে।

আব্দুল লতিফ চুপ করে কী যেন চিন্তা করতে থাকে। আপন মনেই বিড় বিড় করে বলতে থাকে, ‘মন্দির দ্যাখতে তো কতজনেই গ্যাছে! হ্যারা তাইলে কিছু দ্যাখল না ক্যা? এইডা আবার নতুন কী কথা শুনলাম… বানাইয়া বুনাইয়া কোইতাছে না তো?’
‘হুজুর কিছু কইলেন?’ যথারীতি বক্তা আবারও সেই মোস্তাক!
‘জি না জনাব, আপনাগো কিছু কই নাই। আপনারা এইবার আসতে পারেন। বুঝছি আমি আমারে অন্য রাস্তা দ্যাখতে হইব। একটা খবর আইনা দিবেন… হেইডাও পারলেন না!’

‘কী খবর চেয়ারম্যান সাহেব… এই ভরদুপুরে কীসের মিটিং করছেন?’ কথা বলতে বলতে চেয়ারম্যানের বাড়ির বৈঠকখানার সামনে জীপ থামিয়ে ওসি জামান শিকদার সেখান থেকে নামল। চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ বৈঠকখানার সামনের বারান্দায় বসে দুই সাগরেদের বক্তব্য শুনছিল। জামান শিকদারকে আসতে দেখে সহাস্য অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘আরে ওসি সাব যে! কী মনে কইরা গরীবের ঘরে পদধূলি দিলেন! আমার কী সৌভাগ্য!’
‘আমি আপনার ঘরে এলেই আপনার এত সৌভাগ্যের কারণ নেই চেয়ারম্যান সাহেব। এসেছিলাম একটা কাজ নিয়েই। সেইসঙ্গে একটু গল্পগুজব করারও ইচ্ছা। ভাবলাম ম্যালা দিন দেখা হয়নি। একটু দেখা করে আসি।’
‘বহুত খুশি হইছি ওসি সাব। আপনে যে গল্প করার লাইগা আমারে যোগ্য মনে করছেন এইটা আমার সৌভাগ্য নয় তো কী!’
‘কীসের সভা বসিয়েছেন বললেন না তো?’
‘আর বইলেন না ওসি সাব। ভাবলাম গ্রামের একটু উন্নতি করি। ম্যালাদিন ধইরা জঙ্গলডা এইভাবে পইড়া আছে। হেইডার দিকে একটু নজর দেই। কালী মন্দিরটারে কিছু করোন যায় কী না সেইটাও দেখি। এই দুইজনরে পাঠাইছিলাম, মন্দিরের অবস্থা অখন কতটা খারাপ হইছে হেইডা দেখোনের লাইগা। এরা ফিরা আইসা আমারে দেউয়ের ভয় দ্যাখাইতাছে। জঙ্গলে নাকি দেউ থাকে। বুঝছেন অবস্থা? গাঁয়ের মাইনষে আবোলতাবোল বকে, এ্যারাও সেই তালে তাল দিছে!’
‘মন্দিরের সংস্কার করবেন? ভালো তো! গাঁয়ের একটা সম্পদ। এভাবে ভাঙাচোরা ফেলে রাখাটা তো ঠিক না। বলা যায় না, মন্দিরে আবার হিন্দুরা পূজা করতেও আসতে পারে। তাহলে তো এত বড় জঙ্গলটা এভাবে পড়ে থাকবে না।’
‘আর বইলেন না! মাইনষে কি একটা ভালো কাম করবার দেয় নাকি? মন্দির নাকি সংস্কার করলে দেবী জাগ্রত হইয়া যাইব! বুঝছেন অবস্থা! এই ধুঁয়া তুইলা কাম বন্ধ করবার চায়। আবার আইজ এ্যারা দুইজন নাকি জঙ্গলে কিয়ের একটা ধুঁয়া দেইখা আইছে। সেইডারই ফিরিস্তি শুনতাছি। আমার তো আর কামকাইজ নাই। ভূত দেউ লইয়াই আছি!’

জামান শিকদার এই কথায় খুব একচোট হাসল। তারপর বলল, ‘কিন্তু আপনে তো নিজেই জঙ্গলের নীরবতা ভঙ্গ করার পক্ষে ছিলেন না! এখন হঠাৎ মত বদলালেন কেন?’
‘এমনেই! হঠাৎই খেয়াল আইল বলতে পারেন! সারাজীবন কি মাইনষের মন একরকম থাকে ওসি সাব? আপনিই কন!’
‘হুম মনের তো চাওয়ার কোনো শেষ নাই! খেয়াল এলে তো এমনিতে খারাপ না! কিন্তু গাঁয়ের লোকজনের এত আপত্তি আছে যেখানে…’
‘আরে রাখেন তাগো কথা! কিছু একটা গুজব ছড়াইতে পারলেই এগো শান্তি…ফাউল পাবলিক সব!’ আব্দুল লতিফ জামান শিকদারের কথাকে মশামাছির মতোই উড়িয়ে দিলো। তারপর বলল, ‘আপনে নাকি কী কামে আইছেন কইলেন? কীয়ের কাম?’
‘ওহ তাইতো! গল্পে গল্পে আসল কথাই ভুলতে বসেছিলাম! আজ পুলিশস্টেশনে আমার এক হাবিলদার একজনকে ধরে নিয়ে এসেছে…’ জামান শিকদার পুরো ঘটনা আদ্যোপান্ত খুলে বলল। তারপর বলল, ‘আপনে কি এই ব্যাপারে কোনো সাহায্য করতে পারবেন? এরকম কাজ কারা করতে পারে বলে আপনার কাছে মনে হয়? এই গাঁয়ে অথবা আশেপাশের গাঁয়ে এরকম অস্ত্রশস্ত্রের কারবার কেউ করে কী না। অথবা আপনি কাউকে সন্দেহ করেন কী না!’
আব্দুল লতিফ ভীষণ চিন্তিত গলায় উত্তর দিলো, ‘এইটা কী শোনাইলেন ওসি সাব! আমাগো গ্রামে এইরকম অস্ত্রশস্ত্রের চোরাকারবারি করার মতো কেউ আছে বইলা তো আমার জানা নাই! আশেপাশের গাঁয়ে থাকলেও জানা যাইত। আমরা তো এই এলাকারে নিরাপদ এলাকা বইলাই জানি। এইখানে কেউ এমুন কাজ…’ আব্দুল লতিফের কপালে চিন্তার গাঢ় ভাঁজ ফুটে উঠল।
‘চোরাকারবার কী না সেটা এখনো বলতে পারছি না! তবে আমাদের চোখ কান খুলে রেখেই কাজ করতে হবে। তার মানে…আপনি এরকম কারো ব্যাপারে কিছু জানেন না?’
‘জি না ওসি সাব। আপনি যা শোনাইলেন সেইটা তো আমার বুদ্ধি বিবেচনারে এক্কেরে ঠাশকি খাওয়াইয়া দিলো। আমি আইজ থেইকাই এই ব্যাপারে আমার মতন কইরা খোঁজ খবর করুম। কিছু পাইলে আপনারে অবশ্যই জানাইমু।’
‘অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনার সহযোগিতা পাব আশা রাখি।’

আব্দুল লতিফ হঠাৎ একটা ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘আমার ভাইয়ের খুনের কিছু হদিস করবার পারলেন ওসি সাব? ম্যালাদিন তো হইয়া গেল! একটা দুই রত্তি পোলা এমুন কইরা বেবাকের চক্ষে ফাঁকি দিয়া পলাইয়া গ্যালো!’
জামান শিকদারের মুখে কালো ছায়া পড়ল। সে জানত, এই প্রসঙ্গ একবার না একবার উঠবেই। সেটাই স্বাভাবিক। একজন পলাতক ছেলে, সে আবার চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের খুনি…তাকে খুঁজে পেতে বের করতে এত তো ঝকমারি হওয়ার কথা না! তবু কেন যে ছেলেটার কোনোরকম হদিস পাওয়া যাচ্ছে না… কে বলতে পারে!
‘বুঝছি ওসি সাব। আপনের মুখ দেইখাই বুঝছি আপনে অখনো কুনো কূলকিনারা করবার পারেন নাই! আমার আসলে মুখ দ্যাখানের কুনো যোগ্যতা নাই! আমি বালের চেয়ারম্যান হইছি! নিজের ভাইয়ের খুনিরে যে ধরবার পারে না, হের চেয়ারম্যান হওনের কুনো যোগ্যতা নাই!’
জামান শিকদার সান্ত্বনা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘অপরাধী ধরা তো আপনার কাজ না চেয়ারম্যান সাহেব! ঐটা আমাদের পুলিশের কাজ। আমরাই আপনার ভাইয়ের খুনিরে এখন পর্যন্ত ধরতে পারি নাই, এইটা আমাদের অযোগ্যতা। কী জানি… আমাকেও হয়ত এবার আপনাদের এলাকা থেকে চলে যেতে হবে। সামান্য একটা কেসের কোনো সুরাহা করতে পারলাম না। ছোট একটা গ্রাম। অল্পবয়সী একটা ছেলে। গাঁয়ের সবাই তাকে মোটামুটি চেনে… অথচ তাকে খুঁজে পাচ্ছি না! আচ্ছা… এমন নয় তো, সে হয়ত প্রথমেই শহরে পালিয়ে গেছে?’

‘সেইডা হওনের সম্ভাবনা কম ওসি সাব। আমার ভাই যেইদিন খুন হয়, সেইদিন খবর পাইয়াই আমি বাড়িত ছুইটা আসি। সন্ধ্যা হইয়া গ্যাছিল। আইসা দেখি, আমার ভাই উঠানের মেঝেতে পইড়া আছে। ম্যালাখানি জায়গা জুইড়া তাজা রক্ত। উঠানের এক কোণায় বাড়ির মাইয়ারা কানতাছে। তাগো কাছেই শুনছি, শমশেরের লগে রফিকের কী নিয়া জানি খুব কথা কাটাকাটি হইছে। শমশের আমার ভাইরে গালি দিয়া কইছে, ‘আপনারে দুনিয়া থেইকাই সরায় দিমু! তারপর দেহি কে আমারে ধমকাধমকি করে…’ এইটা কইয়া রফিকের বুক বরাবর গুলি চালায় শমসের। এক গুলিতেই জান চইলা গ্যাছে আমার ভাইয়ের।

গুলি চালাইয়াই শমসের পলাইয়া গ্যাছে। ওরে আর কেউ দেখেনি! আমি সঙ্গে সঙ্গেই চার রাস্তার মোড়ে ছুইটা গেছি। আমার লোকজন বেবাকেই আমার লগে গেছিল। সেইখানে এমুন একটা মানুষ নাই যারে আমি জিগাইনি… আমার লোকে জিগাইনি। আমাগো অবস্থা তখন বুঝবার পারতাছেন? পুরাই পাগলের লাগান হইয়া আছি! চেয়ারম্যানের বাড়িত আইসা তার ভাইয়েরে খুন কইরা পলাইয়া গ্যাছে! ওরে আমি তখন কুত্তা খুঁজা খুঁজছি। হাতের কাছে পাইলে ওরে আমি খুন করতাম!
জাগো কাছে জিগাইছি তারা কেউই শমসেররে ওই জায়গা দিয়া কুনোখানে যাইতে দেখেনি। গাড়িতে চড়তে দেখেনি। চার রাস্তার মোড় দিয়াই শহরে যাওনের গাড়ি ছাড়ে।’ চলবে

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৮

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_আট

গ্রামের রাস্তায় জিপ নিয়ে চলাচল করা বড় হুজ্জোত। এবড়োথেবড়ো মাটির রাস্তা। জায়গায় জায়গায় খানাখন্দ। বেশিরভাগ পথই আবার সরু। বর্ষাকাল শেষে সেই পথের অবস্থা হয়েছে দুর্বিষহ। তার ওপরে সামনে থেকে যদি কোনো ভ্যান বা গরুরগাড়ি আসে তাহলে তো হয়েই গেল! সারাদিনেও আর গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হয় না।
আজকেও পথের অবস্থা দেখে জামান শিকদার বিরক্তির চুড়ান্ত হলো। একবার ইচ্ছে করল গাড়ি থেকে নেমে হাঁটা দেয়। জিপগাড়ির আগেই পৌছাতে পারবে!
ড্রাইভার একটা খন্দের মধ্যে পড়ে হা পিত্যেশ করছিল। জামান শিকদার বিরক্ত মুখে দরজা খুলতে যেতেই সামনে থেকে আসা গাড়িটাকে দেখতে পেল। আরেকটি মোটর গাড়ি এই রাস্তাতে উঠে এসেছে। এখন খন্দ থেকে বের হতে পারলেও এই গাড়িকে রাস্তা দিতে গিয়ে আবার আরেক খন্দে পড়তে হবে। এই পাড়াগাঁয়ে একজন বান্দাই মোটরগাড়ি হাঁকাতে পারে। তিনি হচ্ছেন চেয়ারম্যান স্বয়ং। মনে মনে খুশিই হলো জামান শিকদার। অত দূরে আর যেতে হলো না। রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল!

জামান শিকদার গাড়ি থেকে বের হতেই ওপাশের জনও গাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলো।
না, চেয়ারম্যান না। এ হচ্ছে চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে রুবেল। বছর পঁচিশ ছাব্বিশেক বয়স হবে। চেয়ারম্যানের ডান হাত। ভাইয়ের মৃত্যুর পরে চেয়ারম্যানের যাবতীয় ব্যবসা বাণিজ্য এখন এই রুবেলের মাধ্যমেই পরিচালিত হয়। অল্প বয়সেই বিশাল দায়িত্বের বোঝা কাঁধে আসাতে ছেলেটা খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। খুব একটা কথাবার্তা বলে না। এর আগে যতবার দেখা হয়েছে সালাম দিয়েই সরে পড়েছে। আজ কিন্তু রুবেল তাকে দেখে সরে গেল না। হাসিমুখে সালাম দিয়ে বলল, ‘আরে ওসি সাহেব, আপনি? বাবার কাছে আসছিলেন নাকি?’

জামান শিকদার পূর্ণচোখে রুবেলের দিকে তাকাল। ছেলেটাকে হাসলে তো বেশ সুন্দর লাগে! সবসময় মুখ গোমড়া করে রাখে দেখে আজ আরো বেশি ভালো দেখাচ্ছে। পরনে মেরুন রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর জিন্স। মাথার চুল উস্কোখুস্কো। ছেলেটা ভালোই লম্বা হবে। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামলা। বেশ সুদর্শন ছেলে বলতে হবে। এই কিছুদিন আগেও চেয়ারম্যান সাহেব এই ছেলের বিয়ের ব্যাপারে তার সাথে কথা বলছিল।

‘বুঝলেন জামান সাহেব…ছোট ছেলেটারও তো ভালোই বয়স হইলো। একটা বিয়াশাদী দেওয়ন দরকার। সময়ের কাম সময়ে না করালে ম্যালা অনর্থ হয় বুঝলেন তো? আপনার কাছে কি কোনো ভালা মাইয়ার সন্ধান আছে?’
জামান শিকদার মুচকি হেসেছিল। সেই হাসি দেখেই চেয়ারম্যান সাহেবের টনক নড়ে গিয়েছিল। হৈ হৈ করে বলেছিল, ‘আরে! আমিও যে বেয়াক্কল! মায়ের কাছে নানীবাড়ির গল্প করবার বইছি! আপনি নিজেও তো অখনো বিয়াশাদী না কইরা বইসা আছেন! আপনার তুলনায় তো আমার ছেলেটা অনেক কম বয়সীই হইব!’

লজ্জা পেয়েছিল জামান শিকদার। মেঘে মেঘে বেলা যে ভালোই হয়ে গেছে, এই কথা উঠতে বসতে অনেকেই মনে করিয়ে দেয়। আজ চেয়ারম্যান সাহেবও সেই কথাই তুলল! আসলে করি করব করছি করে করেও বিয়েটা করা হয়ে উঠল না আজতক। অথচ বিয়ের পাত্র হিসেবে সে নিজেও কম আকর্ষণীয় নয়। আজ থেকে পাঁচ ছয় বছর আগে তো যথেষ্ট সুদর্শন ছিল! এখনও কেউ তাকে কুদর্শন কিছু বলবে না। কিন্তু বয়স কি আর বসে থাকার জিনিস? সে তার নিজের রাস্তায় ঠিকই চলতে থাকে। মাথা ভর্তি ঘন কালো চুলগুলোতে এখন হেমন্তের ধুসরিমা লাগি লাগি করছে। কিছু চুল রণে ভঙ্গ দিয়ে ময়দান ফাঁকা করার ফন্দিফিকির করছে। কিন্তু এখনও যতগুলো অবশিষ্ট আছে, তারাও দলগতভাবে বেশ ঘনত্ব নিয়েই বাস করছে।
সামনে দাঁড়ানো এই সুদর্শন যুবকের মতো এতটা না হলেও এখনও তিনি বেশ যোগ্য পাত্রই বলতে হবে। বয়স এই নভেম্বরে পঁয়ত্রিশ হবে। বিয়ের বয়স এখনও একেবারে চলে যায়নি। দেশের বাড়ি থেকে মা নিত্যই তাগাদা দিয়ে চলেছে। ‘ও বাজান, এইবার একটা বিয়াশাদী কিছু কর! আমি নাতিনাতনীর মুখ দেইখা মরি!’
বিয়ের কথা একেবারেই যে মাথায় আসেনি কখনও তা নয়। কিন্তু কেন যেন শুভ কাজটা করা হয়ে উঠছে না। বিয়েশাদী নাকি ভাগ্যের ব্যাপার। তিনি হয়ত এখনও ভাগ্যের গ্রীন সিগন্যাল পাননি!

রুবেল এখনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে দেখে সচকিত হয়ে উঠল জামান শিকদার। নিজেও মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আরে এই যে ছোট সাহেব! কোথায় চললেন আপনি? হ্যাঁ আমি তো আপনার বাবার কাছেই যাচ্ছিলাম। উনি বাড়িতে আছেন তো? নাকি কোথাও গিয়েছেন?’
‘বাবাকে তো বাড়িতেই দেখলাম! কোনো দরকার?’
‘আঁ…তা একটু দরকার ছিল বটে! সেটা উনার সাথেই আলাপ করি। আপনি কোথায় চললেন?’
‘যাচ্ছিলাম একটু চাচার আড়তে। বোঝেনই তো, চাচা নাই…এখন সবকিছু বাবাকেই দেখেশুনে রাখতে হচ্ছে। দুদিন ধরে বাবার একটু ঠান্ডা লেগেছে। তাই বাড়ির বাইরে তেমন একটা যাচ্ছে টাচ্ছে না। এই ফাঁকেই নাকি দুজন কর্মচারীর মধ্যে গ্যাঞ্জাম লেগেছে। বাবা আমাকে পাঠালো মিটমাট করে দেওয়ার জন্য। চাচার এইসব আড়ত আর কাপড়ের দোকানের কী যে করব আমরা সেটাই ভাবছি। নিজেদের কাজকর্ম সামলেই সময় বের করতে পারি না! এর মধ্যে আরও কত উটকো উপদ্রব!’

জামান শিকদার মুগ্ধতা নিয়েই রুবেলের কথা শুনছিল। ছেলেটা পড়ালেখা তেমন একটা করেনি। তবু কথাবার্তায় একেবারে চোশত! গেঁয়ো ভাষায় কথা বলে না। একেবারে শুদ্ধ বাংলা বলছে। আর খুব স্মার্ট তার কথা বলার ভঙ্গিটা। এই ছেলে পড়ালেখা কেন করেনি কে জানে!
পড়ালেখা করতে চাইলে তো বাধা দেওয়ার কেউ ছিল না। কিন্তু নিজের চেয়ে বড় বাধা আর কে আছে সংসারে? গ্রামের ছেলে। যদিও বাপে চেয়ারম্যান, কিন্তু অল্পবয়স থেকেই টাকা পয়সা দেখেশুনে বড় হতে গিয়ে হয়ত পড়ালেখার দিকে আর মন দিতে ইচ্ছে করেনি। সদরের একটা কলেজ থেকে নাকি আইএ পাশ করেছে। তবে লোক মারফত খবর আছে যে, সেই বছর নকলের সুবিশেষ সুবিধা পাওয়া গিয়েছিল। একদিন ক্লাস না করেও চেয়ারম্যানের ছেলের পাশাপাশি তার সকল সাঙ্গপাঙ্গ সদলবলে সেই বছর পাশ করে গেছে। একেবারে চরম ঔদার্য যাকে বলে!
এসবই শোনা কথা অবশ্য। তবে নানারকম উৎস থেকে আসা এইসব খবর ভুয়া হওয়ার সম্ভাবনা খুবই সামান্য।

রুবেল চলে যেতেই জামান শিকদার আবার নিজের জিপে উঠে বসল। বিরক্তিকে জয় করে একটা সিগারেট ধরাল। মাথাটা মাঝে মাঝে জট পাকিয়ে যায়। একটু সিগারেট খেয়ে মাথাটাকে ক্লিয়ার রাখা প্রয়োজন।
আব্দুল রফিকের কোনো উত্তরাধিকারি নেই। তার ভাই আর দুই ভাস্তেই তার যাবতীয় সয়সম্মত্তির উত্তরাধিকারি এখন। ধানচালের ব্যবসা করেছে। সেই সাথে কয়েক গ্রাম মিলিয়ে প্রায় একচেটিয়াভাবেই পাইকারি কাপড়ের ব্যবসা করেছে। টাকা কড়ি কম কিছু কামায়নি জীবনে। শমসের ছেলেটাকে নাকি নিজের হাতে কাজ শিখিয়েছিল। ছেলেটা ব্যবসাও বুঝত ভালোই। এসবও অনেকটা শোনা কথাই। তবে যেখানে এরাই মূল সাক্ষী সাবুদ সেখানে শোনা কথার ওপরেই আস্থা রাখা ছাড়া উপায় কী?

শমসের ছেলেটা এই ব্যবসার ভাগ নেওয়ার জন্যই আব্দুল রফিককে খুন করেনি তো? কারণ সে জানত, যতই তার মালিক তাকে স্নেহ করুক না কেন…সম্পত্তির অংশীদার কখনোই বানাবে না তাকে। সেখান থেকেই হয়ত বিবাদের সূচনা…আর তারপর খুন।
যেতে যেতে পথের দু’পাশের অবারিত ক্ষেতের শোভা উপভোগ করছিল জামান শিকদার। পাকা গমের অপূর্ব হলুদ রঙে চোখে ধাঁধা লেগে যায়। কে যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে পুরোটা ক্ষেত জুড়ে। জামান শিকদার নিজেও গ্রামেরই ছেলে। স্কুল পর্যন্ত গাঁয়েই পড়ালেখা করেছে। তারপর শহরে গিয়ে আইএ বিএ পাশ করে ভাগ্যের জোরে সরকারী চাকরিটা পেয়ে গেছে।

আজ মনে তার মিশ্র অনুভূতির জোয়ার নেমেছে। একটু আগেই আব্দুল রফিকের খুনের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল জামান শিকদার। এখন আবার হুট করেই পুরনো চাপা দুঃখবোধটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। জীবনের রঙিন বসন্তগুলো এলোমেলো দমকা বাতাসের মতোই দ্রুতলয়ে বয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে শীত এসে যাবে। জরার কবলে পড়বে সবুজ অরণ্য। সময় কি থেমে থাকবে কোনোকিছুর জন্য? এখনও মা আছে বলে কাজ থেকে অবসর মিললে বাড়ি যাওয়ার তাড়া অনুভব করে। যেদিন সেই আশ্রয়টুকুও নাই হয়ে যাবে, সেদিন কোথায় যাবে সে? কাজ আর বিশ্রাম এই দুইয়ের মধ্যেই বেঁধে নিয়েছে জীবনের সমস্ত আলাপন। কিন্তু ঘর মন সংসার ঘরণী…এসব কি আজীবন অধরাই থেকে যাবে জীবনে?

এখন অব্দি বিয়ে না করার পেছনে অনেকগুলো কারণ দায়ী। নিজের মাকে আকারে ইঙ্গিতে নানাভাবে বুঝিয়েছে, তার জন্য মেয়ে পছন্দ করতে। কারণ কত জায়গায় কত মেয়েই তো দেখা হলো! কাউকেই কেন যেন মনে ধরে না তার!
আজকালকার মেয়েগুলো বড় নখরাবাজ! কী গ্রাম কী শহর… হিন্দি সিনেমা আর ডিশের কল্যাণে মেয়েগুলোর মধ্যে থেকে সভ্যতা ভব্যতা কেমন জানি নাই হয়ে গেছে। এত ছোট ছোট সালোয়ার কামিজ পরে আর এত রঙ ঢং করে চুল বাঁধে, চোখেমুখে হাবিজাবি কত রঙ লাগায়…যে তার একেবারে অভক্তি ধরে যায় দেখে!

বাঙালি সতেজ কমনীয়তা সে খুঁজে পায় না কোনো নারীর মধ্যেই। কোনো নারীকে দেখেই আজ অব্দি মনে হয়নি একদম ভোরের শিশিরের মতো পবিত্র, অস্পর্শা… প্রথম ছোঁয়াটুকু পেলেই যে টুপ করে ঝরে পড়ে যাবে! অথবা লাজনম্র লজ্জাবতীর মতো সঙ্কোচে কুঁকড়ে যাবে নিজেকে দ্রুত সামলাতে সামলাতে!
সেই সতেজ স্নিগ্ধ নারী কি কোথাও অপেক্ষা করে আছে তার জন্য? নাকি একটা জীবন পারই হয়ে যাবে তার পথের পানে তাকিয়ে তাকিয়ে? (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৭

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_সাত

মানুষের এসব অন্ধ বিশ্বাসের শেকড় অনেক শক্ত হয়। এটা জানে বলেই চুপ করে থেকেছে জামান শিকদার সাহেব। চাকরিজীবনে নয়, তার নিজের ব্যক্তিগত জীবনে এমন একটি অভিজ্ঞতা আছে।
তখন জামান শিকদার কলেজে পড়ে। মফঃস্বল শহরের একটি কলেজ। তারা তিন বন্ধু হোস্টেলের একটা রুম শেয়ার করে থাকত। তিন বন্ধুতে দিনমান পড়াশুনা আড্ডাবাজি আর এটা সেটা মৌজমাস্তি করেই মজারসে দিন পার করত। মা-বাবাকে ছেড়ে প্রথম বাইরে থাকতে এসে তাদের তিনজনেরই কিছুটা পাখনাও গজিয়ে গিয়েছিল। প্রথমদিকে মাসে কদাচিত একটা সিনেমা দেখতে যেত দূরের সিনেমা হলে। হোস্টেলে ফিরে হোস্টেল সুপারকে কী কৈফিয়ত দিবে, সেটার ফর্দ বানানো চলত দু’দিন আগে থেকে। তারপরও ধরা পড়ে গেলে শাস্তি জুটত বিস্তর। সেসব দিনের কথা মনে পড়লে এখনও স্মৃতিকাতর হয়ে ওঠে জামান শিকদার।

সেই হোস্টেলে থাকাকালীন সময়েই তারা একটি গুঞ্জন শুনতে পেয়েছিল। এক কান দু’কান হয়ে সেই গুঞ্জন ছড়িয়ে গিয়েছিল পুরো হোস্টেলে। এল শেপড হোস্টেলটার পেছনের ফাঁকা জায়গাটায় আম জাম নারকেল তেঁতুল এসব নানারকম ফল ফলারীর গাছ ছিল। গাছের ফল ছাত্রদের জন্যও বরাদ্দ ছিল। হোস্টেল সুপার এসব ব্যাপারে অনুদার ছিলেন না। হোস্টেলের বাথরুমগুলোর অবস্থান ছিল পেছন দিকটায়। সেটার জানালা দিয়ে এই গাছগুলো চোখে পড়ত।
একদিন বেশ অনেক রাতে বাথরুমে গিয়ে এক ছেলে ভীষণ ভয় পেল। ভয়ের চোটে তার মুখ দিয়ে গোঙানির মতো আওয়াজ বেরুতে লাগল। ভাগ্য ভালো যে, হোস্টেলের চৌকিদারের নজরে পড়ে বিষয়টা। সে ধরাধরি করে ছেলেটাকে তার রুমে পৌঁছে দিয়ে যায়। ছেলেটা অল্প সুস্থ হওয়ার পরে বলে, সে নাকি তেঁতুলগাছের ডালে বসে একজনকে দোল খেতে দেখেছে। লম্বা চুলের সুন্দরী একটা মেয়ে। জোরে জোরে দোল খেতে খেতে মেয়েটা গুনগুন সুরে গান করছিল।

প্রথম প্রথম দু’একজন এটাকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কেউ কেউ হাসাহাসি করেছিল। ছেলেটাকে নিয়ে ব্যঙ্গ রসাত্মক সব গল্প বলছিল। কিন্তু দিনে দিনে পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করল। আরও দু’একজনও নাকি একই দৃশ্য দেখে ফেলল। আর প্রত্যেকেই প্রায় মাঝরাতের দিকেই এই দৃশ্য দেখতে শুরু করল। একটু বেশি রাত জেগে যেসব ছেলেরা পড়ত, তারা আর কেউ বেশি রাতে বাথরুমে যেতে সাহস করত না।
জামান শিকদার ভিতু ছিল না কোনো দিনই। তাই এসব কানকথাকে কখনোই পাত্তা দেয়নি সে। হোস্টেলের ছেলেপুলের এই কুসংস্কার আর অযথা ভীতিকে দূর করার জন্য মাঝরাত্তিরে উঠে বাথরুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখেছে। এটা নিয়ে হাসিতামাশা করে বিষয়টাকে হাল্কা করারও চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসবের ফলাফল হয়েছে শূন্য। মাঝখান থেকে অনেকেই তাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে। তাদের রুমের ভীতুর ডিম মানিকের সাথেও একদিন সেই দোল খাওয়া পেত্নির দেখা হয়ে গেল। একদিন কিছুটা কাকতালীয়ভাবেই রাতের বেলা তাদের রুমের বাল্বটা খুব শব্দ করে বার্স্ট করলো। ঝড় নাই বাতাস নাই, আরেকদিন এক রুমমেটের টেবিল ল্যাম্পটা ঠাস করে নিচে পড়ে গেল।

মানিকের স্থির বিশ্বাস জন্মে গেল, এই রুমের দিকে কারো বদনজর পড়েছে। সেখান থেকেই এমনটা হচ্ছে। জামান বাদে অন্য রুমমেটরা তেমন উচ্চবাচ্য করলো না। কিন্তু জামানের কেমন যেন রোখ চেপে গেল। তাকে যেন প্রমাণ করতেই হবে, ঐসব পেত্নি ফেত্নি সব ফালতু কথা। হয়ত কেউ ইচ্ছাকৃত ভাবে ছেলেদের ভয় দেখাচ্ছে। কোনো উদ্দেশ্য হাসিলের ফন্দিও হতে পারে। মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বন্ধুদের একরকম জোর খাটিয়েই বাথরুমের কাছে নিয়ে যেতে চাইত জামান শিকদার। এইসব বাড়াবাড়ি করার জন্য মানিক একসময় রুমই ছেড়ে দিলো। অন্য দুজন রুমমেটও তার সাথে খুব বেশি কথাবার্তা বলত না আর। ইচ্ছে করেই সব কাজে এড়িয়ে চলতে শুরু করল। কলেজে পড়ার বাকি সময়টা একরকম একঘরে হয়েই থাকতে হয়েছে তাকে।
মানুষের অন্ধবিশ্বাসের জোরটা সেদিনই প্রথম অনুভব করেছিল জামান শিকদার। কিছু কিছু জিনিস মানুষ চোখ বন্ধ করে মেনে নিতে ভালোবাসে।

এই এলাকাটি বর্ডার অঞ্চলে পড়েছে। ওপাশেই পার্শবর্তী দেশের সীমানা। তাই এমনিতে বড় কোনো খুন খারাপি বা এই জাতীয় ঘটনার ব্যস্ততা না থাকলেও পাচার সংক্রান্ত কিছু কেস আসে থানায়। কাপড়চোপড়, ফসলাদি, মশলাপাতি এমনকি বাসনকোসন… সবকিছুই দুই দেশের মধ্যে পাচার চলে। মাঝে মাঝেই ছুটকো ছাটকা লোকজনদের ধরে নিয়ে আসে থানার হাবিলদার। তাদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। লুকোছাপাও কিছু করে না। দু’চারটা কিল ঘুষি গায়ে পড়তেই গড় গড় করে সবকিছু উগরিয়ে দেয়। সামান্য কিছু টুপাইস কামানোর জন্য দেশের পণ্য পাশের দেশে পাচার করছে। লেনদেনে মূল্য পরিশোধ হওয়ার পরে অল্প কিছু টাকাই জমা হয় পাচারকারীর ঝুলিতে। নিজেদের অন্য কাজের পাশাপাশি এই কাজ তারা দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে দিনের পর দিন। কথা শুনলে বোঝা যায়, চড় থাপ্পড়ের তোয়াক্কা তারা করে না। ওসব কিছু গায়ে পড়লেও তেমন কিছু আসে যায় না। থানা পুলিশ আছে নিজেদের জায়গায়, আর তারা তাদের জায়গায়।
জামান শিকদার বুঝেছে, এদের ঠেকাতে গেলে যে টহল পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে তা সে এই সামান্য লটবহরে সামাল দিতে পারবে না। আর তাছাড়া সামান্য কুলি মজুর শ্রেণীর লোকজন এরা। খুব বেশিকিছু করার সাধ্য এদের নেই। দুই দেশের মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে সামান্যকিছু এদিক সেদিক করে মাত্র। কিন্তু যদিও তা অবৈধ, একটু আধটু শাসন না করলে একেবারে মাথায় চড়ে বসে থাকে।

সেইরকম একজনকে আজ শাসন করতে গিয়েই বেশ বড়সড় চমকের দেখা পেয়েছে জামান শিকদার।
একহারা গড়নের সাদাসিধে দেখতে লোকটাকে ধরে এনেছিল এক হাবিলদারই। হাতে বড়সড় ব্যাগ দেখতে পেয়েই দাবড়ানি দেয়। লোকটা কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। ব্যাগ হাতে সন্দেহজনকভাবে কাউকে দেখতে পেলেই পুলিশের লোক একটা দাবড়ানি দিবে, এটা তারা জানেই। ধরা পড়লে মালপাত্তি কিছু খোয়াতে হবে এটাও ভালোমতই জানা আছে তাদের।
কিন্তু এই লোকটা দাবড়ানি খেয়ে কেমন যেন হতচকিত চোখে তাকাচ্ছিল। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সে কিছু একটা লুকাতে চাইছে। অথচ অভিজ্ঞতা থেকে হাবিলদার জানে যে, এরা ধরা পড়েও বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না। জানেই যে, কিছু কিল থাপ্পড় আর কিছু আক্কেল সেলামী…ব্যস! এর বেশি কিছুই হবে না। কিন্তু এর ভাবভঙ্গি এমন দেখাচ্ছে কেন?

সন্দেহ হতেই লোকটাকে জেরা করা শুরু করে হাবিলদার। জেরার এক পর্যায়ে অত্যন্ত ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে লোকটা পালানোরও চেষ্টা করে। ফলে আরও শক্ত করে চেপে ধরা হয় তাকে। সাথের পোঁটলা খুলে ভালোমত দেখতে গিয়েই বড়সড় হোঁচট খায় পুলিশের হাবিলদার। পোঁটলার মধ্যে থেকে উঁকি মারছে একটা পিস্তল। সাথে কিছু গোলাবারুদ। সেগুলো অবশ্য ঢেকে রাখা হয়েছে নানারকম আচার চাটনি এসবের প্যাকেট দিয়ে।
লোকটাকে ধরে আনা হয় থানায়। রাস্তায় সে অনেকবার হাবিলদারের পায়ে পড়ার চেষ্টা করে। নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করে যে, কেউ তার পোঁটলায় এইসব জিনিস ভরে দিয়েছে। এগুলো মোটেও তার জিনিস নয়। সে সীমানার এই পাড় থেকে পাশের দেশের আচার চাটনি এসব জোগাড় করে। বিনিময়ে সেও এমন কিছু খাবার দাবারের জিনিস ঐ পাড়ে চালান করে। কিন্তু আজকে পোঁটলা খুলে সে হতভম্ব হয়ে গেছে। তার পোঁটলায় এসব পিস্তল গোলাবারুদ কই থেকে এলো সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না। হয়ত কেউ ভুল করে এসব ভরে দিয়েছে।
এমন আজগুবি ব্যাখ্যায় হাবিলদারের মন ভরবে না জানা কথা। সে থানায় ফিরে লোকটাকে আচ্ছামতন উত্তমমধ্যম দেওয়ার ফন্দিফিকির শুরু করে। ওসি স্যারকেও দেখানো দরকার জিনিসটা।

ওসি জামান শিকদার নিজেও হতভম্ব হয়ে পড়ল এই বস্তু দেখে। এই থানায় আসার পরে আজকেই প্রথম এমন চাঞ্চল্যকর জিনিস ধরা পড়ল। সে বেশ বুঝতে পারল, তার একার সিদ্ধান্তে এটার কোনো সমাধানে আসা যাবে না। আর ধরা পড়া লোকটাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে সত্যিই খুব ভয় পেয়েছে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে না, লোকটা মিথ্যে বলছে। হয়ত সত্যিই জিনিস অদলবদল হয়ে গেছে। একজনের জিনিস ভুল করে তার সাথে চলে এসেছে।
হাবিলদার কিন্তু এত সহজ ব্যাখ্যা মানতে চায় না। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে, ‘স্যার আপনে সিধা লোক তাই বুঝবার পারতাছেন না। এই শালারা দুনিয়ার বজ্জাত! এমন ভাব ধরে থাকে যে, দেখে মনে হয় ভাজামাছ উলটে খেতে পারবে না। এখান থেকে বের হলেই দেখবেন অন্য চেহারা। ড্যাং ড্যাং করে মানুষের কাছে গল্প ছুটাবে যে পুলিশ আমার টিকিও ছুঁইতে পারেনি! আমি এরে একটু খাতিরদারি করি। কষে জায়গামত দুইটা বাড়ি পড়লেই হুড়মুড় করে সব উগরায়ে দিবে! বাড়ি স্টার্ট করব স্যার?’

অহেতুক মারধর করা জামান শিকদারের পছন্দ না। আর লোকটাকে তার মোটেও এমন ধুরন্ধর বলে মনে হচ্ছে না! হাবিলদার যতই তাকে সিধালোক বলে আলগা তোয়াজ করুক না কেন, সে মানুষটা বাস্তবে মোটেও সিধেসাধা নয়। যেখানে ছড়ি তোলার দরকার, সেখানে সে খাতির করে না। কিন্তু এই লোক প্রথম থেকেই ভয়ে সেঁধিয়ে আছে। একে আরও মারধর করলে বলা যায় না, হিতে বিপরীত হতে পারে।
জামান শিকদার হাবিলদারকে মৃদু ধমক দিয়ে নিজেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করল। লোকটাকে চেয়ারে বসাল। এতে সে আরও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কিন্তু ভয়ে ভয়ে বসলোও। জামান শিকদার জিজ্ঞাসা করল,
‘এসব কাজ করো কেন?’
‘ভুল হয়ে গেছে হুজুর! পেটের দায়ে করি। খেতিবাড়ি করে সংসার চলে না। একদিন খাইলে দুইদিন উপোশ দেওয়ন লাগে! এই করে অল্প দু’এক টাকা হাতে আসে হুজুর। দুর্দিনে বউ পোলাপান লইয়া না খাইয়ে মরতাম নাইলে!’
‘হুম! কী পাচার করো? ঠিক করে বলো। তোমার কোনো ভয় নাই।’
‘ডাল, বিড়ি, আচার, আনাজ…এইসবই অইপাড়ে দেই হুজুর। আল্লাহর কসম লাগে…আমি এইগুলান কুনোদিনই আনা নেওয়া করিনি হুজুর!’ বলেই তো ভীতচকিত চোখে নিজের পোঁটলার দিকে তাকায়।
‘হুম…করোনি তাহলে তোমার পোঁটলার মধ্যে এইসব কোথায় থেকে এলো? যার সাথে লেনদেন হইছে সে তো তোমার চেনা তাই না? সে এগুলো এমনি এমনি দিয়ে দিলো তোমার পোঁটলায়? দেখো…সত্যি কথা বলো যদি বাঁচতে চাও!’
লোকটা আর ধরে রাখতে পারলো না নিজেকে। এই পর্যায়ে এসে আবার হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল।

জামান শিকদার লোকটাকে হাজতে ঢোকাতে বলে একটু বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
ভালো করে না জেনেশুনে একে ছাড়া যাবে না। সাথে অস্ত্র পাওয়া গেছে। কে জানে কোনো চক্র ফক্র আছে নাকি এর পেছনে। মনে মনে প্রমাদ গুনল জামান শিকদার। কোথায় একটু আরামে দিন কাটাবে মনে করছিল, এখন যদি কোনো চক্রের কারসাজি প্রমাণিত হয়, ব্যস তাহলেই হয়ে গেল! কোথাকার জল গিয়ে কোথায় দাঁড়াবে কে জানে! শান্তির ঘুম হারাম হয়ে যাবে চিরদিনের জন্য!
টুপিটা মাথায় গলিয়ে নিজের জিপগাড়িটাতে চেপে বসলো জামান শিকদার। একবার চেয়ারম্যান সাহেবের সাথেও বিষয়টা নিয়ে আলাপ করে আসা যেতে পারে। যদিও এসব পুলিশের ভেতরের কথা, কিন্তু চেয়ারম্যান লোকটাকে তার বটগাছের মতো আস্থাশীল মনে হয়। এমন পাণ্ডব বিবর্জিত জায়গায় আস্থার সাথে দুটো কথা বলার জন্য এই একটা লোকই আছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের সাথে তেমন একটা পরিচয় ছিল না জামান শিকদারের। তবে সেই লোকটাও নাকি তার সহচর শমসেরের মতো চুপচাপ গোছেরই ছিল। নিজের কাজ ছাড়া কিছুই বুঝত না। চালডালের আড়তটা তিনিই সামলাতেন। শহর থেকে কাপড় এনে পাইকারী ব্যবসার মূল অংশীদার ছিল সে। এছাড়া আরও নানারকম ব্যবসা তারা দু’ভাই মিলে সামাল দিত। বাইরের লোকের বিশেষ কিছু প্রয়োজন ছিল না। এমন শক্তিশালী অংশীদারকে এরকম দুঃখজনকভাবে হারিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবও পুরোপুরি মুষড়ে পড়েছে।

কিন্তু তবুও এলাকার চেয়ারম্যান বলে কথা! গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে কাজে নেমে পড়তে হয়েছে তাকে। তিনি হয়ত এই অস্ত্র পাচারের ব্যাপারে কিছু একটা দিক নির্দেশনা দিতে পারবেন। তার এলাকার মধ্যে এমন ঘটনা ঘটছে, এটা তার এখতিয়ারে থাকা প্রয়োজন। আগেই জেলার এসপি সাহেবের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে না জামান শিকদার। এসপি সাহেব একবার এসবে ঢুকে পড়লেই খানাপিনা ঘুম সব একেবারে হারাম করে দিবে। নিজেরা দূরে বসে খালি হুকুম চালাবে, মাসে দুইমাসে একবার ভিজিট করবে। তাদের জন্য মাটন মুরগির ব্যবস্থা করতে হবে তাকেই। আবার এদিকে তাদের হুকুম মোতাবেক লম্ফঝম্ফ করে নাভিশ্বাসও উঠবে তার নিজের। যত্ত সব! (ক্রমশ)

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৬

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_ছয়

কদমপুর থানার ওসি জামান সিকদার মাস তিনেক হলো এই থানায় বদলি হয়ে এসেছে। এসেই এক মারাত্মক জটিল কেসে জড়িয়ে পড়েছেন তিনি। সেই কেসে এত ডালপালা আর এত প্যাঁচগোচ যে মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে এখানে না এলেই বুঝি ভালো ছিল।
এমনিতেই পুলিশের চাকরি করতে তার তেমন একটা ভালো লাগে না। নেহায়েত পেটের দায়ে করতে হয় বলেই করা। ঠিকমত কেসের সুরাহা না করতে পারলে পাবলিকের কাছে হেনস্থা হতে হয়। আড়ালে আবডালে প্রচুর গালমন্দ হজম করতে হয়। সেসব গালমন্দ যে পুলিশের কান অব্দিও চলে আসে, পাবলিক অনেক সময়েই তার খবর রাখে না। আবার সবসময় বেশি মন লাগিয়ে বসে থাকলেও কিছু করা যায় না। ওপরওয়ালার চাপ থাকে। কেউকেটা কেউ জড়িত থাকলে তো হয়েই গেল! কেস থেকে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হয়।

জামান সিকদারের বয়স বেশি না। এখনো পঁয়ত্রিশ পুরো হয়নি। একেবারে ফুরফুরে মেজাজে ঘুরেফিরে বেড়ানোর বয়স না এটা। আবার ‘সব দেখে ফেলেছি’ বলার জন্যও বয়সটা ঠিক যুতসই নয়। কাজ নিয়ে মেতে থাকলে ঠিক আছে। নইলে গায়ে আরামের মেদ জমতেও সময় লাগে না। খুব বেশি অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে না হলে আরাম আয়েশের অভ্যাস হয়ে যায় এই বয়সে। তার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। এতদিন বেশ আয়েশে আয়েশেই দিন কেটেছে। তাই খুব বেশি ঝামেলা দেখলে এখন মাথার মধ্যে চিড়বিড় করে। ইচ্ছে করে দূরে কোথাও গিয়ে আরাম করে ঘুম দিতে। ইদানিং তার ভয় হচ্ছে, অবস্থা এইরকম চলতে থাকলে পুলিশ ডিপার্টমেন্টেই বুঝি আর চাকরি করা হয়ে উঠবে না।

তার এই আরাম আয়েশের অভ্যস্ততার পেছনে দায়ী আগের দুটো পোস্টিং। পুলিশের চাকরিতে ঢুকেই একটা ভাব থাকে যে, কিছু করে ফাটিয়ে ফেলে দিব। দেশ থেকে অন্যায় দুর্নীতির মূলোৎপাটন করে ছাড়ব। দু’দিন যেতে না যেতেই সেই ভাববোধে আগাছা জন্মাতে শুরু করে। দু’দশটা চোর বাটপারের গায়ে চড় থাপ্পর মারার পরেই মূলোৎপাটন করার ইচ্ছেটা আস্তে আস্তে ভেতরেই শুকিয়ে যায়।

এর আগে পোস্টিং ছিল মোটামুটি শান্ত এলেবেলে গোছের দুটি থানাতে। নানা জাতের চোর ছ্যাঁচড় নিয়ে বেশ ভালোই অভিজ্ঞতা হয়েছে সেসব জায়গায়। ছিঁচকে চোর, সিঁধেল চোর, তেলা চোর, লম্বু চোর, বাট্টু চোর…চোরেদের স্বর্গরাজ্য ছিল যাকে বলে। কিছুদিন যেতে না যেতেই তিনি চোর ধরাতে বেশ পারদর্শী হয়ে উঠলেন। আর প্রথম দিকে কাজটাতে বেশ একটা থ্রিল থ্রিল ভাবও জাগত। তারপরে যত দিন যেতে লাগল, তত আগ্রহে ভাটা পড়তে শুরু করল। একপর্যায়ে এমন অবস্থা দাঁড়াল, কোথাও চুরির খবর শুনলেও তিনি আর নড়তেন না। তার কনস্টেবলকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে পত্রপত্রিকা পড়ায় মন দিতেন।
পর পর দুটি থানাতেই একই রকম অভিজ্ঞতা হওয়ার পরে জামান শিকদার ধরেই নিয়েছিল যে, চাকরি জীবনটা বুঝি এভাবেই কেটে যাবে। চোর বাটপার ধরা ছাড়া পুলিশ ডিপার্টমেন্টের আর বুঝি তেমন কোনও কাজ নেই।

কিন্তু এই কদমপুর থানাতে বদলি হয়ে এসেই বেশ অন্যরকম অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে তাকে। তিনি আসার অল্প কিছুদিন আগেই ঘটনা ঘটেছে। আগের জনকে এই ঘটনার জন্যই চলে যেতে হয়েছে কী না বলা মুশকিল। তার সঙ্গে একবার সময় করে যোগাযোগ করা দরকার। বলা যায় না, কোনো সূত্র পেলেও পেয়ে যেতে পারেন। ঝামেলার জন্য সেটাও করতে পারছেন না। তাই গোড়া থেকেই তাকে মাঠে নামতে হয়েছে।
এই কেসের আগামাথা এখনো ভালোমত বুঝেই উঠতে পারছেন না তিনি। খুন হয়েছে কদমপুরের চেয়ারম্যানের সহকারী কাম ছোটভাই আব্দুল রফিক, আর খুনের দায়ে পলাতক হয়ে আছে সেই ভাইয়ের সাগরেদ শমসের, যে নাকি ছিল তার ডান হাত। খুনের দিন সকালে চেয়ারম্যানের ভাই আর তার সাগরেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়েছে। এই ঘটনার সাক্ষী আছে চেয়ারম্যানের বাড়ির সবাই।

অথচ বাড়ির কাজের লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় জানা গেছে, আব্দুল রফিক সাহেব এমনিতে সচরাচর তার সাগরেদকে নিয়ে ভাইয়ের বাসায় তেমন একটা আসা যাওয়া করতেন না। তার সাগরেদটি নাকি খুব চুপচাপ প্রকৃতির ছেলে ছিল। প্রচণ্ড ঠান্ডা স্বভাবের। তাকে কেউ জোরে কথা বলা তো দূর, বেশি একটা কথাই বলতে শোনেনি কখনো। আব্দুল রফিক সাহেব তাকে যা কিছু বলতেন, সে চুপ করে মাথা নীচু করে শুধু শুনে যেত। এইরকম ঠান্ডা প্রকৃতির প্রভু ভক্ত একটা ছেলে কেন আচমকা তার প্রভুকে খুন করে পালিয়ে যাবে বিষয়টা খুব বেশি পরিষ্কার নয়।

আবার চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ তার ছেলেদের চেয়ে ভাইকেই বেশি বিশ্বাস করতেন। নিজের ছেলেদেরকে ব্যবসার অংশীদার না বানিয়ে তিনি তার ভাইকেই বেশি যোগ্য মনে করেছিলেন। যদিও তার দু’ছেলেই পরিণত বয়সের। চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফের বক্তব্য অবশ্য পরিষ্কার। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, ভাইয়ের ব্যবসায়িক বুদ্ধির ওপরে তার আস্থা অনেক বেশি ছিল।

তার বড় ছেলে অকর্মন্য প্রকৃতির। সে কাজকর্ম তেমন কিছু একটা করে না। বসে বসে বাবার টাকা ভোগ করে আসছে এতদিন। মাদক আর মেয়েমানুষের নেশাও আছে তার। সেই নেশার জোগানও তার বাবার টাকা থেকেই হয়ে আসছে। ছেলের মতি ফেরানোর আশায় চেয়ারম্যান সাহেব তার বিয়েও দিয়েছেন। কিন্তু ছেলের মতি তাতে ফেরেনি। সে এখনো মদ, মেয়েমানুষ এসব নিয়েই মেতে আছে। লাভের মধ্যে লাভ হয়েছে এই, ছেলের বউ আর সন্তানদের দায়িত্বও চেয়ারম্যানেরই ঘাড়ে এসে জুটেছে। ছেলের শ্বশুরবাড়ির লোকজন ছেলের চরিত্র নিয়ে নানারকম বদনাম আর কানাঘুষা করছে। এতে আগামি ইলেকশনে নিজের দলে কিছু শত্রু জড়ো হওয়াও বিচিত্র ব্যাপার না!

ছোট ছেলে তুলনামূলকভাবে কিছুটা সুমতি সম্পন্ন। অল্প বিস্তর লেখাপড়াও করেছে সে। তবে তার ওপরেও আব্দুল লতিফ সাহেবের তেমন আস্থা নেই। লেখাপড়া করার সময়ে তারও কিছু অসৎসঙ্গ লাভ হয়েছে। কাজেই তার ওপরে ব্যবসার দায়ভার চাপিয়ে দেওয়া সম্পূর্ণ ঝুঁকিমুক্ত ছিল না। আর তাছাড়া ব্যবসার কাজে কিছুটা অভিজ্ঞতা আর বয়সের প্রয়োজন আছে যা তার ছোট ছেলের এখনো হয়নি বলে মনে করেন তিনি। ব্যবসার কাজে সে এখনো আনাড়িই বলা চলে। এখন ঠেকায় পড়ে একটু আধটু শিখছে। কিন্তু দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য সে এখনো উপযুক্ত হয়ে ওঠেনি। তাই চেয়ারম্যান সাহেব ভাই আব্দুল রফিককেই এই ব্যাপারে সুযোগ্য সহকারী হিসেবে মনে করতেন।

দুই ভাই একই বাড়িতে থাকতেন না। আব্দুল রফিক ভাইয়ের বাড়ি থেকে কিছু দূরে বাড়ি বানিয়েছিলেন। তিনি বিয়ে থা কিছু করেননি। এক ঠিকা ঝি তার রান্নাবান্না আর বাসার কাজকর্ম করে দিত। শমসেরকে তিনি কাছে কাছেই রাখতেন। সেই বাড়িতেই শমসের আর তিনি অনেকটা নিঃসঙ্গ একাকী জীবন যাপন করতেন। কাজেই শমসেরের সাথে যদি আব্দুল রফিক সাহেবের কিছু একটা ঝামেলা হয়েও থাকে, তাহলে সেই বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যেই সেটা হতে পারত। ভাইয়ের বাড়িতে নিজেদের ঝামেলা বয়ে আনার তো কোনো দরকার ছিল না!

খুন যে বন্দুক দিয়ে করা হয়েছে, সেটাকেও অকুস্থলে পাওয়া যায়নি। সেটা পাওয়া গেলেও হয়ত কেসের কিছু একটা সূত্র পাওয়া গেলেও যেতে পারত। অন্তত বলা যেত যে মার্ডার উইপেন মিলে গেছে। আসামিকেও দ্রুতই ধরে ফেলা হবে। আব্দুল লতিফের বাড়ির লোকজন বলছে, বন্দুক নিয়েই গা ঢাকা দিয়েছে শমসের। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রত্যেকে এতটাই বিমূঢ় হয়ে গেছে যে, তার পিছু ধাওয়া করার চিন্তাটাও সময়মত মাথায় আসেনি কারো!

শমসেরকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে চেয়ারম্যান সাহেব সব ধরনের সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়েছেন। সহযোগিতা করেছেনও তিনি। সম্ভাব্য সব জায়গার হদিস দিয়েছেন যেখানে শমসেরের দেখা মিলতে পারে। কিন্তু আজব এক ভোজবাজির মতোই গায়েব হয়ে গিয়েছে ছেলেটা। আশেপাশের গ্রামের কেউই তার কোনোরকম সন্ধান দিতে পারেনি। অবশ্য জামান সিকদারও একেবারে জান বাজি করে ছেলেটার পিছু নেয়নি। ওপর থেকে চাপ নেই। গ্রামের লোকজনেরও কিছুই আসে যায় না খুনি ধরা পড়ল কী পড়ল না সেটা নিয়ে। আব্দুল লতিফ সাহেব একা আর কয়দিন ভাইয়ের খুনির পিছে লেগে থাকবেন? তার তো অন্য কাজকর্ম আছে! হাত গুটিয়ে তো দিনের পর দিন বসে থাকা যায় না!
খুনের জোরালো কোনো মোটিভও খুঁজে পাওয়া যায়নি। শমসের ছেলেটা নীরব প্রভুভক্ত হিসেবেই পরিচিত ছিল। হঠাৎ কী এমন ঘটনা ঘটল যে একেবারে খুন করে বসল! হয়ত ক্ষনিকের মাথা গরম থেকেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। চালচুলোহীন ছেলে। কারো সাথে তেমন একটা মিশত টিশত না। আব্দুল রফিকই তার মা-বাপ ছিল। আগেপিছে কেউ নেই যে তার সূত্র ধরে ওর কাছাকাছি যাওয়া যাবে। এক মা ছিল, সেও মরে গেছে। আত্মীয় স্বজন কারো খোঁজ জানা নেই। হারিয়ে গেলে কারো কিছু আসবে যাবে না। কাজেই এমন একটা ছেলেকে খুঁজে বের করা খুব বেশি সহজ কাজ না। তাছাড়া এসব প্রত্যন্ত অঞ্চলের অপ্রতুল সুযোগসুবিধাও একটা কারণ। একটা পুলিশস্টেশন নামেমাত্র আছে এই যা! লোকবল নাই, কিছু নাই। কাজেই শুধু শুধু এই ছেলের পেছনে ঘুরে নিজের আয়ুক্ষয় করাটাকে বিশেষ সুবিবেচনার কাজ মনে হয়নি জামান শিকদারের।

এছাড়া এখানে শুরু থেকেই কিছু ব্যাপারে রহস্যের সন্ধান পেয়েছেন তিনি। এখানে কিছু একটা আছে, অশুভ কিছু। আর পুরো অঞ্চলে তার একটা অশুভ ছায়া আছে।
এই কদমপুর আর তার পাশের গ্রাম নোয়াহাটিকে জুড়ে আছে প্রায় দুইশত একরের এক বিশাল জঙ্গল। দুই গ্রামের মানুষের মনে এই জঙ্গলকে ঘিরে অনেক আজব গল্পগাঁথা প্রচলিত আছে। সন্ধ্যার পরে কেউই এই জঙ্গলের আশপাশ দিয়ে যাওয়া আসা করে না। কোনকালে এক কালীমূর্তির বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল এখানে। এলাকার হিন্দুদের বিশ্বাস, সেই বিগ্রহ অতি জাগ্রত। একসময় তাকে নরবলি দিতে হতো। নির্দিষ্ট সময় পরে পরে নরবলি দেওয়া না হলে বিগ্রহ অসন্তুষ্ট হতো। সেই নরবলি প্রথা কালের বিবর্তনে উঠে গেছে ঠিকই, কিন্তু বিগ্রহ তার নিজস্ব মৌনতায় বাগড়া দেওয়া পছন্দ করে না। তাই এই জঙ্গল আর তার আশেপাশের নিস্তরঙ্গতাকে কেউ ঘাঁটাতে যায় না।
হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রোত্থিত এই বিশ্বাস কীভাবে কীভাবে যেন অন্যদের মগজেও আমূল গেঁথে গেছে। এই থানাতে বদলি হয়ে আসার পরে থেকেই জামান শিকদার সাহেব এসব গল্পগাঁথা শুনে আসছেন। এসব গল্প একবার চালু হয়ে গেলে মানুষের মগজটাকে একেবারে আচ্ছামতন ওয়াশ করে ফেলে। কিছুতেই মাথা থেকে তাড়ানো যায় না। মানুষ কেন যেন এইসব গল্পগাঁথাকে খুব সহজেই বিশ্বাস করে ফেলে। সত্যি মিথ্যা যাচাই করারও প্রয়োজন দেখে না। হুট করে এসবের বিপক্ষে কিছু বলতে গেলে উলটে তাদের বিরাগভাজন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

এমনকি এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবও এই গল্পগাঁথাকে বিশেষ পাত্তা দিয়ে থাকেন। এখানে আসার পর তিনি নিজে অনেক সময় নিয়ে ভেঙ্গেচুরে এই জঙ্গলের রহস্যময়তার গল্প করেছেন। এমন একটা রহস্যময় জঙ্গল যে এই এলাকাতে আছে, এটাতে ভেতরে ভেতরে কেমন একটা গোপন গর্বের ছায়াও ফুটে উঠতে দেখেছে তার মুখেচোখে।

যেন প্রকৃতি অনেক দয়াপরবশ হয়েই তার রহস্যময়তা দেখানোর জন্য এই জায়গাটাকেই বেছে নিয়েছে। এখানকার মানুষদেরও সেই রহস্যের মর্যাদা রক্ষা করে চলাটা দায়িত্ব! আর সবাই সেটাই করে থাকে। বিনা দরকারে কেউ এর রহস্যময়টাকে ভাঙতে যায় না। জঙ্গল পড়ে আছে নিজের আভিজাত্য নিয়ে।
জামান শিকদার বুদ্ধি খরচ করে চুপ থাকাটাকেই নিরাপদ ভেবেছে। নতুন জায়গায় এসে জনবিশ্বাসে আঘাত দিয়ে শত্রু বৃদ্ধি করাটাকে বুদ্ধিমানের কাজ মনে হয়নি তার কাছে। (ক্রমশ)

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৫

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_পাঁচ

মনের কুচিন্তা দূরে সরিয়ে রেখে সে মিহি গলায় ফুলিকে জিজ্ঞেস করলো, ‘ও মা ফুলি…তর শশুর বাড়িত কেডা কেডা আছে? শাশুড়ি আছেনি?’
এসব গল্প তার মোটামুটি মুখস্থ। বহুবার বহুরকম জিজ্ঞাসাবাদ করে আর দিনমান চোখকান খুলে রেখে প্রায় সবকিছুই এখন হনুফার নখদর্পণে। ফুলির যে শশুর শাশুড়ি কেউ নেই, সে যে তার ননাস-নন্দাই এর বাড়িতে একরকম আশ্রিতের মতো আছে… এগুলো খুব ভালোমতই জানে হনুফা বেগম। তবু এসব কথা বার বার জিজ্ঞেস করে সে ফুলিকে তার অবস্থানটা প্রতিবার মনে করিয়ে দিতে চায়। চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রিত থাকা আর সেই বাড়ির বউ হয়ে যাওয়া যে এক জিনিস নয় এটা বোঝানোই তার উদ্দেশ্য।
ফুলি বিরস মুখে উত্তর দিল, ‘চাচি এক কতা আর কত জিগাইবেন? আপনে তো জানেনই আমার শশুর শাশুড়ি কেউ বাঁইচা নাই। আমার ননাস আর নন্দাই আমাগো থাকবার দিছে। আর কী জিগাইবেন তাড়াতাড়ি জিগান। ঘরেত গিয়া শুইয়া থাকমু।’

হনুফা বেগম খানিক অপ্রস্তুত হলো। এক কথা বারে বারে বলাটা আসলেই ভুল হয়ে গেছে। মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। তার চাই খবর। আর এই খবরের মাধ্যম বানাতে হবে ফুলিকে। তাই ফুলিকে রাগালে চলবে না।
যেন খুব ভুল হয়ে গেছে এমনভাবে হনুফা বেগম তাড়াতাড়ি বলল, ‘ওহ হো, তাই তো! আইজকাল সগল কথা আর মনে থাকে না। সকালে শুনলে বিকালে ভুইলা যাই…তা ফুলি, চেয়ারম্যানের ছুডো পোলার বয়স কত? কামকাইজ কিছু করে?’
ফুলি আর হাসুবিবি চোখ চাওয়াচাওয়ি করলো। এতক্ষণে তারা আসল ব্যাপারটা বুঝতে পারলো। মনে মনে হাসুবিবি স্বীকার না করে পারল না, হনুফা বেগমের জেদ আছে বটে। একবার যা সে ধরে একেবারে কচ্ছপের কামড় দিয়েই ধরে।

ফুলি গলা নামিয়ে বলল, ‘চেয়ারম্যানের পোলার কি বইয়া থাকলে চলে চাচি? কাইমকাজ করে। তয়…’
কিছু একটা বলতে গিয়েও ফুলি থেমে গেল। হনুফা বেগম টের পেল, মায়ের ইশারাতেই কথা থামিয়ে দিয়েছে ফুলি। কিন্তু হনুফা বেগমের তো সব খবর জানা চাইই চাই! এই মাঝপথে থেমে থাকলে তো তার চলবে না! ব্যগ্র উৎসুক কণ্ঠে সে বলল, ‘তয় কী? পোলা দ্যাখতে শুনতে ভালা না?’
‘না না…দ্যাখতে শুনতে তো ভালাই। তয় তাগো বাড়িত একটা ক্যাচাল বাঁধছে।’
ফুলি কথাটা বলে ফেলেই ভয়ে ভয়ে তার মা হাসুবিবির মুখের দিকে তাকায়। হাসুবিবি যতই আকারে ইঙ্গিতে মেয়েকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, মেয়ে তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। আর এদিকে হনুফা বেগম তো গল্পের সুতা ঠিকঠাকমত ধরে ফেলেছে। এবারে কি আর সে সুতা ছাড়ে? আস্তে আস্তে সেই সুতাকে নিজের দিকে টানতে থাকে হনুফা।
‘কী ক্যাঁচাল বাঁধছে?’
ফুলি বুঝল, আর থেমে থাকার চেষ্টা করে লাভ নেই। সেও ভুলে মুখ খুলে ফেলেছে আর এখন হনুফা চাচিও তার সেই খোলা মুখ থেকে পুরো কথা বের করে তবেই ছাড়বে।

মিনমিনিয়ে ফুলি যা বললো তার অর্থ এই, চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ আর তার ভাই আব্দুল রফিক দুজনে মিলে এটা সেটা নানারকম ব্যবসা করে আসছিল এতদিন। তাদের টাকা পয়সার মূল জোগান এই ব্যবসা থেকেই আসতো। চেয়ারম্যানের সব ব্যবসাতেই সমান অংশীদার ছিল তার এই ভাই।
চেয়ারম্যানের ভাই আব্দুল রফিকের একজন সাগরেদ ছিল শমসের নামে, যে চব্বিশ ঘণ্টা তার সাথে সাথেই থাকতো। এই ছেলেটাকে যে আব্দুল রফিক কোথা থেকে এনেছিল তা ঠিকমত কেউ বলতে পারত না। কারণ ছেলেটি সবসময় চুপচাপ থাকত। কেউ কেউ বলত সে নাকি লেখাপড়া জানা ছেলে। শহরে পড়ালেখাও করেছে। দেখতে শুনতে বেশ ভালো। যেটুকু কথা বলত শুদ্ধ ভাষায় বলত। লোকমুখে চালু আছে যে, ছেলেটা তার মায়ের সঙ্গে শহরে থাকত। তার পড়ালেখার খরচ নাকি আব্দুল লতিফই যোগাত। এটা একটা রহস্য বটে। কেন তিনি এই ছেলের পড়ালেখার খরচ যোগাবেন, এটা মানুষের মাথায় আসেনি। কেউ কেউ বলত, ভেতরে হয়ত কোনো গল্প আছে। কারণ ছেলেটার বাপের কথা জানা যায়নি। আবার কেউ কেউ বলত, বড়লোকের খেয়াল। হয়ত দেখে কখনো ভালো লেগেছে। নিজের ছেলের মতো দেখভাল করেছে। তবে মানুষজন দুই নাম্বারির গল্প পেলেই তা বেশি শুঁকে দেখে। তাই প্রথম ধারণাটাকেই তাদের কাছে সঠিক বলে মনে হয়।
ছেলেটার মা অসুখে ভুগে মারা যাওয়ার পরে আব্দুল রফিক তাকে গ্রামে নিয়ে এসেছে। তার সাথে থেকে ব্যবসা বাণিজ্যের কাজকর্ম শেখার জন্য।
বছরখানেক আগে আব্দুল রফিকের সাথে তার এই সাগরেদের কী নিয়ে যেন প্রচণ্ড বাকবিতণ্ডা হয়। সেই ছেলেটি তাকে একপর্যায়ে খুন করে পালিয়ে যায়। তাকে ধরার জন্য চেয়ারম্যান পুরষ্কার ঘোষণা করেছে। যে সেই শমসের ছেলেটাকে ধরে আনতে পারবে সে মোটা অঙ্কের অর্থ পুরষ্কার পাবে। পুলিশও তাকে হন্য হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

হনুফা বেগম এই ক্যাঁচালের বিবরণে খুব বেশি আহ্লাদিত হলো না। সে এসব জেনে কী করবে? কোথাকার চালচুলোহীন এক ছেলে চেয়ারম্যানের ভাইকে মেরে পালিয়েছে। সেই খবর দিয়ে তার কী? কিছুটা অসহিষ্ণু গলায় হনুফা জিজ্ঞেস করল, ‘হেই পোলায় যদি খুন করে তাইলে আইজ না হোক কাইল ধরা তো পড়বোই। পলাইয়া কই যাইব? এই ক্যাঁচালও বেশি দিন টিকব না। কিন্তু… চেয়ারম্যান সাব ভাইয়ের লাইগা বেবাক কামকাইজ বন্ধ কইরা বইয়া থাগব ক্যা? হ্যায় কি তার পোলার লাইগা মাইয়া খোঁজ করে না? বিয়াশাদি দেওন লাগব না?’
হাসুবিবির এই পর্যায়ে খুব হাসি পেয়ে গেল। সে মুখ লুকিয়ে হাসতে গিয়ে বিষম খেলো। বিষয়টা হনুফা বেগমের কাছে গোপন রইল না। ভেতরে ভেতরে একটু অপমানিত বোধ করলেও সে তা হজম করে নিল। যত পারে হেসে নিক। চেয়ারম্যানের পোষ্যর সাথে বিয়ে দিয়েই এত ফুটানি দেখাচ্ছে! তার সুফিয়ার সাথে আগে চেয়ারম্যানের ছেলের বিয়েটা হোক না! তারপরে দেখবে, কে কত হাসতে পারে!

ফুলিদের বাড়ি থেকে বের হতে হতে হনুফা বেগমের বেশ দেরিই হয়ে গেল। পশ্চিমের পাড়া থেকে তাদের পাড়ায় যেতে ভালোই সময় লাগে। তার ওপরে যেতে হয় পশ্চিমের জঙ্গলের পাশ দিয়ে। এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেমন যেন সারা শরীর হিম হয়ে যায় হনুফা বেগমের। বিয়ের পরে থেকেই সে এই জঙ্গলের নানারকম গল্প শুনে এসেছে।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে, এই জঙ্গলে যে কালি মুর্তি আছে সেটা নাকি এখনো জাগ্রত। আগে তাকে নরবলি দিয়ে শান্ত রাখতে হতো। নিয়মিত নরবলি না হলে সে অশান্ত হয়ে গাঁয়ে নানা অনর্থ ঘটাত। কখনো কারো ওপরে ভর করেও সে তার অপশক্তির প্রয়োগ করত।
সবই শোনা গল্প। তবু শুনলেই কেমন যেন গা ঝিম ঝিম করে। এই জঙ্গলের পাশ দিয়ে রাত বিরেতে কেউই বলতে গেলে তেমন একটা আসা যাওয়া করে না। নীরব নিস্তব্ধ জঙ্গলটা যেন জুজুবুড়ির মতো পুরো গাঁয়ের মানুষকে বশ করে রেখেছে। হনুফা বেগমের ভীষণ ভয় ভয় করতে লাগল। গল্পে গল্পে যে এতটা দেরি হয়ে গেছে, সে একেবারেই বুঝতে পারেনি।

যখন জঙ্গলের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, তখন একটা বিচিত্র জিনিস তার চোখে পড়ল।
অবিকল সুফিয়া আর জুলেখার মতো বেশবাসের দুজন মেয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে গল্প করতে করতে সেই জঙ্গলের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে। দুজনের পরনেই শাড়ি। আর তাদের দেহের আকার আকৃতি সব কিছুই হুবহু সুফিয়া আর জুলেখার মতো। কিন্তু এই ভর সন্ধ্যায় জঙ্গলের ভেতর থেকে তাদের দু’জনের বেরিয়ে আসা রীতিমত অসম্ভব ব্যাপার। এ কিছুতেই সত্য হতে পারে না।
মুহূর্তেই হনুফা বেগমের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে গেল। এ নিশ্চয়ই কোনো অশুভ ছায়া, সুফিয়া আর জুলেখার বেশ ধরে এসে তাকে ভয় দেখাচ্ছে। অথবা আরো খারাপ কোনোকিছু। পরিচিত কারো বেশ ধরে এভাবে দেখা দেওয়ার একটাই মানে দাঁড়াতে পারে। অশুভ কোনো কিছুর নজর পড়েছে হনুফার দিকে। তাকে কাছে টেনে নিয়ে যাওয়ার জন্যই এই বেশ ধরেছে সে!
হনুফা বেগম চোখ বন্ধ করে সেখানেই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ছোটবেলা থেকে যত দোয়া দরুদ মুখস্থ করেছে, সব মনে মনে আওড়ে যেতে লাগল। এক পাও সামনে এগুতে পারল না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল, যদি একবার এই বিপদ থেকে রেহাই পায়, তাহলে জীবনে আর কোনোদিন কারো পিছে লাগবে না। এখন থেকে জুলেখাকে মায়ের নজরে দেখবে। ফুলির দিকে হিংসার নজর লাগাবে না। যত ভালো ভালো কাজ আছে, এখন থেকে সব সে করবে। শুধু একবার এই অশুভ বস্তুর ছায়া তার সামনে থেকে যেন সরে যায়।
দীর্ঘসময় পরে সভয়ে চোখ খুলে পিটপিট করে এদিক সেদিকে চাইল। এবার আর সামনে কাউকে দেখতে পেল না।
আর এক মুহূর্ত দেরি না করে হনুফা বেগম প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতেই পশ্চিমের পাড়া ছাড়িয়ে এলো। আগের প্রতিজ্ঞার কথা এর মধ্যেই সে একটু একটু ভুলেই গেছে। নতুন করে আরেকটা প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনোদিন বিকেলের পরে সেই জঙ্গলের পাশ দিয়ে আসবে না।
আজ বলতে গেলে একটুর জন্যই সে প্রাণে বেঁচে গেছে। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০৪

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_চার

দিনের বেলা ঘুমানোর অভ্যাস নেই হনুফা বেগমের।
দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে সে গিয়েছিল পশ্চিমের পাড়ায় বেড়াতে। সেখানে হাসুবিবির মেয়ে ফুলি পোয়াতি হয়েছে। সে তার বাপের বাড়ি নাইওর এসেছে। ফুলির অনেক বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে। ওদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাহেবের শ্যালকের সাথে বিয়ে হয়েছে ফুলির।
ফুলির বাপ সামান্য মুদি দোকানদার। সে এত বড় ঘরে মেয়ের বিয়ে দিতে পেরে একেবারে বর্তে গেছে। খুশিতে সারা গাঁ দাওয়াত দিয়েছিল নিয়াজ উদ্দীন। মেয়ের এই অপ্রত্যাশিত সৌভাগ্য সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিল না। তাদের গ্রামের বড় আড়তদার রফিক উদ্দীন সেই বিয়ের দাওয়াতে এসে ফুলিকে গলার আর কানের সোনার সেট উপহার দিয়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব তার বন্ধু মানুষ। তার শ্যালক বউকে কি যেমন তেমন উপহার দেওয়া যায়?

ফুলির এত ভালো ঘরে সন্মন্ধ আসায় হনুফা বেগম স্বামীর সাথে গাল ফুলিয়ে বসে ছিল। তিনদিন ভাত খায়নি সে। তার মেয়ে সুফিয়া আর ফুলি প্রায় পিঠাপিঠি বয়সের। সুফিয়ার বয়স কয়েকমাস বেশিই হবে। ফুলি দেখতে এমন কিছু আহামরি নয়। পাশাপাশি দাঁড় করালে সুফিয়াকেই বেশি ধলা দেখায়। অথচ ফুলির কত বড় ঘরে বিয়ে হয়ে গেল। আর এদিকে সুফিয়ার বিয়ে নিয়ে তার বাপ নেয়ামত উল্লাহর কোনো মাথাব্যথাই নেই। নেয়ামত উল্লাহ বউকে অনেক কিছু বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঠান্ডা করার চেষ্টা করেছে।
‘ফুলির তো বিয়া হইছে চেয়ারম্যানের শালার লগে। চেয়ারম্যানের পোলার লগে তো আর হয়নি! হের শালা তিনবার মেট্রিক পরীক্ষায় ফেল করছে। দুলাভাইয়ের বাড়িত থাইকা খায় দায়। কাম কাইজ কিছুই করে না। তুমি কি হের লগে তুমার মাইয়ার বিয়া দিতা? তুমার মাইয়ার মাথায় এত বুদ্ধি!’
হনুফা বেগম মুখ ঝাংটানি দিয়ে বলে, ‘রাখেন আপনার বুদ্ধি! ঐ বুদ্ধি ধুইয়া কি হেই পানি খাইবোনি? ভালা বিয়া না হইলে ঐ বুদ্ধি কুনো কামেই আইবো না!’

নেয়ামত উল্লাহ্‌ আর জুলেখার প্রসঙ্গ টানে না। এই সময়ে জুলেখার কথা শুনলেই হনুফা বেগম রাগে উন্মাদ হয়ে যাবে। জুলেখার বিয়ের জন্য আর একদিনও অপেক্ষা করতে রাজি নয় হনুফা। ঐ কালো মেয়ের জন্য তার সুফিয়ার এত ভালো ভালো প্রস্তাব সব ফসকে গেছে। ভালো ছেলে কি এত দিন অপেক্ষা করে নাকি? তাদের জন্য মেয়ের বাপেরা সব লাইন দিয়ে রাখে। এক জায়গায় না হলেই আরেক জায়গায় ঠিকঠাক হয়ে যেতে সময় লাগে না।
হনুফা বেগমও এত সহজে হাল ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী নয়। বড় ঘরে সে তার মেয়ের বিয়ে দিয়েই ছাড়বে! এজন্য যত কাঠখড় পোড়ানোর প্রয়োজন হয়, সে পোড়াতে রাজি আছে। তবু যেনতেন ভাবে মেয়ের বিয়ে দিবে না। নিজের বাপে তাকে দোজবরে বিয়ে দিয়ে দায়িত্ব চুকিয়ে দিয়েছে। সে তার মেয়েকে রাজার ঘরে বিয়ে দিয়ে এর প্রতিশোধ নেবে।

ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ সাহেবের দুই ছেলে। বড় ছেলের বিয়ে হয়ে গেছে। আর ছোটটা এখনো অবিবাহিত। হনুফা বেগমের মনে মনে তীব্র ইচ্ছা, চেয়ারম্যানের এই ছোট ছেলের সাথে তার মেয়ে সুফিয়ার বিয়ে দেওয়ার। তার মেয়ের মতো গায়ের রঙ ক’জন মেয়ের আছে? সুফিয়াকে যে ই একবার দেখে, সেই তাকে পছন্দ করে ফেলে। তার স্বামী সামান্য কাঠমিস্ত্রী, এটাই যা একটু বাধা। তবু একবার যদি চেয়ারম্যানের ছেলে তার মেয়েকে পছন্দ করে ফেলে তাহলেই কাজ হয়ে যাবে, এই ব্যাপারে হনুফা মোটামুটি নিশ্চিত।
ফুলির বাপের বাড়ি নাইওর আসার খবর পেয়ে সেজন্যই হনুফা বেগম তাড়াতাড়ি তাকে দেখতে এসেছে। খালি হাতে আসেনি, একটু পায়েস রান্না করে নিয়ে এসেছে। ফুলিকে হাতে রাখা দরকার। সে চেয়ারম্যানের শ্যালক বউ। থাকেও ঐ বাড়িতেই। কাজেই ফুলিকে সন্তুষ্ট রেখে এগুতে পারলে অর্ধেক কাজ হয়ে যায়।

ফুলির মা হাসুবিবি কুমড়োর বিচি ছাড়িয়ে কুচোচ্ছিল। তার মেয়ে ফুলি কুমড়ো ডালের বড়ি খেতে খুব ভালোবাসে। রুই মাছের পাতলা ঝোলের সাথে কুমড়ো বড়ি আর টমেটো শিম নতুন আলুর তরকারি। বাপের বাড়িতে পা দিয়েই সে মায়ের কাছে কুমড়ো বড়ি খাওয়ার আবদার করেছে।
হনুফা বেগমকে আসতে দেখেই হাসুবিবি মনে মনে বিরক্তি গোপন করলো। মেয়েটাকে এখন আর শান্তিতে তিষ্টোতে দেবে না। এসেই দুনিয়ার হাজার প্যাঁচাল আর প্রশ্ন দিয়ে ছ্যাড়াব্যাড়া করে মারবে। আলগা আদরের বান ডাকবে। অথচ ফুলির বিয়ে ঠিক হওয়ার পরে থেকেই হনুফা বেগমের মনের সুখ উধাও হয়ে গেছে। এটা সে গোপন করার চেষ্টা করলেও শেষ পর্যন্ত আর গোপন থাকেনি। হনুফা বেগম এই বিয়েতে ভাংচিও দিতে চেয়েছিল। ফুলির স্বভাব চরিত্র ভালো না, দেখতে অসুন্দর এমন নানারকম কথা সে প্রচার করে বেড়াত।
তার মেয়েটার সুখ দুইচোখে দেখতে পারে না এই হনুফা। ফুলির এত বড় ঘরে বিয়ে হয়েছে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আজ মেয়েটা পোয়াতি হয়ে বাপের বাড়ি এসেছে। না জানি এখন আবার সে কোন মতলবে এই বাড়িতে এসেছে!

হনুফা বেগম আড়চোখে একবার ঘরের ভেতরে উঁকি দিয়ে একগাল হাসি নিয়ে এগিয়ে গেল হাসুবিবির দিকে।
‘ও বু, ডাইলের বড়ি বানাইবা নি?’
‘হুম। তুমি এই অসময়ে, কী ব্যাপার? কুনো কামে আইছ?’
‘শুনলাম ফুলি আইছে, তাই দ্যাখবার আইলাম।’
হাসুবিবি মনে মনে টিটকারি মারলো, ‘দ্যাখবার আইলা…নাকি অন্য কুনো মতলবে আইলা!’
মুখে বললো, ‘ভালা করছো। তুমার মাইয়াগো খবর কী? বিয়া শাদি ঠিকঠাক হইলো কিছু?’

এই প্রশ্নে হনুফা বেগমের মুখ কালো হয়ে গেল। প্রশ্নটা ঠিক প্রশ্ন বলে মনে হলো না। একটু যেন খোঁচা মারার মতো মনে হলো। তবে এখন তপ্ত হলে চলবে না। এখন সে যথাসম্ভব ভাব বজায় রেখে চলতে চায়। মুখটাতে কষ্টের ছায়া ফুটিয়ে তুলে বললো, ‘নাগো বু, বিয়া ঠিক হইলে তো জানবারই পারতা! আমার মাইয়ার বিয়া তো আমি আইজই দিবার পারি। ঐ যে পোড়ারমুখি হাড় জ্বালানী আমার মাইয়ার সুখের পথে কাঁটা…খাড়াইয়া আছে না? হ্যারে আগে বিয়া না দিয়া তো আর মাইয়ার বিয়া দিবার পারি না!’
হাসুবিবির জুলেখার মায়ের কথা মনে পড়লো। জুলেখার মাকে এই গ্রামের সবাই খুব পছন্দ করতো। একেবারে পানির মতো ঠান্ডা নিরীহ প্রকৃতির এক মানুষ ছিল সে। তার মেয়েটাও হয়েছে পুরোপুরি মায়ের মতোই। অথচ এমনই দুর্ভাগ্য! পড়েছে কী না হনুফা বেগমের মতো এক খাণ্ডারনীর কবলে! ঐ মেয়েটার কপালে আর সুখ জুটবে কী না কে জানে!
হনুফা বেগম উশখুশ করে বলে, ‘ও বু, ফুলির শশুরবাড়ির মাইনষে কেমুন? ফুলিরে কি আদর যত্ন করে?’
‘ফুলি তো কয় করে। সুময়মতো বাপের বাড়ি নাইওর আইবার দিছে। হগগলে তো আর দেয় না! তাই না? কী কও তুমি?’
‘হ, তা তো ঠিকই!’
তারপরে উচ্ছ্বাসমাখা গলায় বলে, ‘ফুলির লাইগা এট্টু পায়েস আনছিলাম। তুমার মাইয়া না পায়েস খাইতে ভালাবাসে…কইছিলা একদিন!’
কবে এই কথা বলেছিল সে, তা হাসুবিবির মনে পড়লো না। তবে সে পায়েসের ডিব্বাটা হাত বাড়িয়ে নিল। যার যা কিছুই মতলব থাকুক না কেন, ভালোবাসার সামান্যতম নিদর্শনও পায়ে দলতে নেই। এটা সে তার নিজের জীবন দিয়ে টের পেয়েছে। ফুলিকে ডাক দিয়ে বললো, ‘ও ফুলি, মা এট্টু উঠানে আইয়া বয়। তর হনুফা চাচি আইছে। পায়েস আনছে তর লাইগা।’

মায়ের ডাক শুনে ফুলি বহুকষ্টে শরীরটাকে একরকম টেনে হিঁচড়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। গর্ভবতী হয়ে সে বেশ মোটা হয়েছে। দিনরাত শুধু খেতে ইচ্ছে করে। অনেকে নাকি এই সময়ে একেবারেই খেতে পারে না। রুচি কমে যায়। তার হয়েছে উলটো। রুচি যেন ধাই ধাই করে বেড়ে গিয়েছে। হাতের কাছে খাবার দাবার কিছু না থাকলে গাছের পাতা ছিঁড়ে কচ কচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।
হনুফা চাচিকে দেখে সেও মনে মনে শঙ্কিত হলো। মতলব ছাড়া হনুফা চাচির তার কাছে আসার কথা নয়। এই মহিলার কারণে শশুর বাড়িতে প্রথম দিকে সে ভালোই হুজ্জোত সামলিয়েছে। তার স্বভাব চরিত্র নিয়ে কম আজেবাজে কথা রটায়নি এই হনুফা চাচি। সেটার কারণও তাদের গ্রামের সবাই জানত। কিন্তু শশুরবাড়ির লোকজনেরা কি এতকিছু জানে? নাকি বোঝে? তাই তারা প্রথমদিকে ফুলিকে খুব চোখে চোখে রাখত। সবকিছুতে সন্দেহ করত।

ফুলি আর হনুফা চাচির মেয়ে সুফিয়া ছোটবেলা থেকে একসাথেই বড় হয়েছে। দুই সখী ছিল তারা। তবে নয় দশ বছর বয়স হওয়ার পরে থেকেই দুজনের পথ অনেকটা অন্যরকম হয়ে গেছে।
ফুলি মোটেও লেখাপড়া করতে চাইত না। আর সুফিয়া ছোটবেলা থেকেই পড়ালেখায় খুব ভালো। গ্রামের মেয়ে যে অঙ্কে এত ভালো হতে পারে, তা সুফিয়াকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করত না। যেকোন অঙ্কই সে ঘসঘস করে কষে ফেলে। কীভাবে এত অঙ্ক পারে এই প্রশ্ন করলে সুফিয়া বলত, ‘আমি কচু শাক খাইতে ভালাবাসি। তাই অঙ্কের মাথা ভালা। হি হি হি…’
একসময় ওদেরও বিশ্বাস জন্মে গেল, নিশ্চয়ই এটাই তবে কারণ! কচুশাক খাওয়ার কারণেই সুফিয়া এত ভালো অঙ্ক পারে।
ওদের অঙ্কের স্যার তো বলতেনই সেই কথা, ‘তরা সবাই সুফিয়ার কাছে অঙ্ক শিখবি। আর ওর মতো কচুশাক খাইবি!’
সুফিয়ার অনেক পড়ালেখা করার ইচ্ছা। সে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তে চায়। বড় চাকরি বাকরি করতে চায়। ফুলি জানে, সুফিয়া যা বলছে তা সে করে ছাড়বেই। ওর মতো জেদি মেয়ের পক্ষে সবই সম্ভব।
ওরা গ্রামের মেয়েরা যেসব ভাবনা চিন্তা নিয়ে মেতে থাকে, সুফিয়াকে সেগুলো একেবারেই আকর্ষণ করে না। বিয়েশাদি নিয়ে সুফিয়ার নিজের যে কোনোরকমের মাথাব্যথাই নেই, এটা ফুলি ভালোমতই জানে। ভালো কোনো প্রস্তাব এলেও সুফিয়াকে কিছুতেই বিয়েতে রাজি করানো যাবে না। অথচ সুফিয়ার মা, মেয়ের বিয়ে দেওয়ার জন্য রীতিমত অস্থির হয়ে উঠেছে। অন্যের ভালো বিয়ে হতে দেখলেই ঝামেলা পাকানোর তালে থাকে।

হনুফা বেগমকে দেখে বিরক্ত হলেও পায়েশ দেখে খুবই খুশি হয়ে উঠল ফুলি। অন্যসময় পায়েশ দেখলে সে ছুঁয়ে দেখত কী না সন্দেহ। কারণ দুধের কোনো খাবার সে একেবারেই পছন্দ করে না। কিন্তু এখনকার কথা আলাদা। আগে যা কখনো খেতেই পারত না, এখন সেইসব খাবারদাবারই অমৃতের মতো লাগছে! পেটে কি রাক্ষস বেড়ে উঠছে কী না কে জানে!
ফুলি চামচ না এনে হাত দিয়েই হাপুসহুপুস করে পায়েশ খেতে শুরু করে দিল।
হাসুবিবি মেয়ের এই আদেখলাপনায় একটু বিরক্ত হলো। মেয়েটা কেমন যেন হাভাতের মতো করে খাচ্ছে। এত বেশি খেতে থাকলে তো পেটের বাচ্চা বেশি বড় হয়ে যাবে। শেষে প্রসবে কষ্ট হবে। অবশ্য এখন তো ঘরে ঘরে যেসব স্বাস্থ্যকর্মীরা আসে, তারা ভিন্ন কথা বলে। এসময় নাকি যত খাওয়া যায়, ততই গর্ভের বাচ্চার জন্য ভালো। অথচ তাদের মা- শাশুড়িরা তো তাদের বাচ্চা বড় হওয়ার ভয়ে ঠিকমত খেতেই দিতে চাইত না। দিনকাল বদলে গেছে। তারা যা বিশ্বাস করত, এখন সেসব আর ধোপে টেকে না!

ফুলির খাওয়াতে তার আপত্তি নেই। কিন্তু যেভাবে ফেলেছেড়ে খাচ্ছে মেয়েটা, দেখতে কেমন যেন অরুচিকর লাগছে। আর খাচ্ছে তো খাচ্ছে…সেটাও আবার হনুফা বেগমের সামনে! এটা নিয়ে সে আবার কী কথা বলে বেড়াবে বাইরে, কে বলতে পারে!
হাসুবিবি মেয়েকে মৃদু ভৎসনা মাখা গলায় বলল, ‘ঐ ফুলি আইস্তে খা। এমনে খাস ক্যা?’
হনুফা বেগম গলায় আলগা কপট স্নেহের ঢেউ তুলে বলল, ‘আহা, খাউক না বু। অহনই তো খাইব! আমরা খাইছি না এই সুমোয়ে! কয় মাস হইলো বু?’
‘ছয় মাসে পড়ছে।’
হনুফা বেগম সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল ফুলির পেটের দিকে। এই পেটকে তো ছয় মাসের পেট বলে মনে হচ্ছে না! দেখে মনে হচ্ছে সামনের মাসেই বিয়োবে। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে দেখা আলো পর্ব-০৩

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_তিন

সুফিয়ার মা হনুফা বেগম ছোটখাট চেহারার একজন মানুষ। বয়স চৌত্রিশ পঁয়ত্রিশের আশেপাশে। তার বেশি হবে না। সুফিয়ার যখন জন্ম হয়, তখন সে আঠারো কী উনিশের এক অল্পবয়সী মেয়ে।
তার বাপের বাড়িতে ছিল মেয়ে সন্তানের ছড়াছড়ি। বাপ চাচা এক বাড়িতেই থাকতো। হাঁড়ি আলাদা করেনি কখনো। চাচার আবার ছিল দুইটা সংসার। সেই দুই সংসারে নয়টি মেয়ে সন্তান জন্মেছিল। দুই স্ত্রীর একজনও তাকে একটি পুত্র সন্তানের মুখ দেখাতে পারেনি। এই পুত্র সন্তান পাওয়ার আশাতেই চাচা দ্বিতীয় বিয়ে করেছিল। আর সেদিক দিয়ে হনুফা বেগমের বাবার অবস্থাও খুব বেশি ভালো ছিল না। তার ঘরে ছিল পাঁচ মেয়ে এক ছেলে। অর্থাৎ পুরো বাড়িতে ছিল মাত্র একজন ছেলে।
সেই একমাত্র ছেলে অর্থাৎ হনুফা বেগমের ভাইয়ের আদর আহলাদের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। রাজপুত্রের মতো আদরে বড় হচ্ছিলো সে। পরিবারের একমাত্র চেরাগ। এই চেরাগের কিছু হলে পরিবারটি অন্ধকারে ডুবে যাবে। আলো দেখানোরই কেউ থাকবে না।

আর অন্যদিকে মেয়েদের অবস্থা ছিল সেইরকমই নিদারুণ। পঙ্গপালের মতো এতগুলো মেয়েকে জন্ম দিতে গিয়ে বাড়ির বউদের দুর্দশাও কিছু কম ছিল না। একে তো শরীর স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল, তার ওপরে মনে ছিল না শান্তি। দিনরাত স্বামী- স্ত্রী, জায়ে জায়ে খিটিমিটি লেগে থাকতো। সংসারের শান্তি বলে কিছু ছিল না।
স্বামীদের কাছে দুই বউয়েরই মান-সম্মান বলতে কিছুই ছিল না। সামান্য কিছু হলেই তাদের খোঁটা দেওয়া হতো এই বলে, ‘আর কী পারবা, পারবা তো খালি গণ্ডায় গণ্ডায় মাইয়া বিয়াইতে! ঐ এক কাম করবার লাইগাই তো আইছো!’
আসলে তাদের স্বামীদেরও দোষ দেওয়া যায় না। কীভাবে কোনদিক দিয়ে এতগুলো মেয়েকে তারা পার করবে, সেই চিন্তাতে দুইভাইয়ের কারোরই রাতে ঘুম আসতো না।

হনুফা বেগমদের বাড়ির অবস্থা এমনিতে খারাপ ছিল না। তার বাবা ছিল মাছের ব্যবসায়ী, চাচাও এটা সেটার খুচরো ব্যবসা করত। কিন্তু এতগুলো মেয়েকে পার করতে গিয়ে তাদের অবস্থা হয়ে পড়েছিল বেহাল। গ্রামদেশে যৌতুক ছাড়া মেয়েদের বিয়ে দেওয়া যায় না। তার ওপরে সবগুলো মেয়েই আবার ছিল পিঠেপিঠি। একজনের বিয়ে দিয়ে আরেকজনকে যে বেশ কিছুদিন বসিয়ে রাখবে তার উপায় ছিল না কোনো। ফলে তারা একরকম চোখ কান বন্ধ করে যেমন তেমন করেই সবগুলো মেয়েকে পার করেছে।
হনুফা’র বড় দু’বোনের বিয়ে হয়েছিল এক ভ্যানচালক আর এক রাজমিস্ত্রির সাথে। সেই দুই বিয়ে দিতেও হনুফার বাবাকে মোটা অঙ্কের যৌতুক গুনতে হয়েছে। তার ওপরে ছিল আরো তিন মেয়ের চিন্তা। অবশ্য তার মনে আশার আলো ছিল। মনে মনে দিন গুনছিল কবে ছেলের বিয়ে দিতে পারবে। এক ছেলের বিয়ে দিয়ে আগের সব ক্ষয় ক্ষতি পুষিয়ে দেবে, এমনটাই ইচ্ছে ছিল তার। হনুফার বিয়ে দিতে গিয়ে দেখা গেল, হাতের টাকা পয়সা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আর তার ভাইয়ের অবস্থা তো আরো করুণ। এদিকে মেয়ের বিয়ের বয়সও যায় যায়। হনুফার বাবা চিন্তা করে দেখলো, হনুফার বিয়ে দিতে আর বেশি দেরি করলে মহা প্যাঁচে পড়ে যাবে। কারণ দুই বছরের ছোট আরেকজন ইতিমধ্যেই সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে আছে।

সেই কঠিন সময়েই পাশের গ্রামের নেয়ামত উল্লাহর খোঁজ পেয়ে গেল হনুফার বাবা। একেবারে আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো।
অল্প কিছুদিন হলো নেয়ামত উল্লাহর বউ মরেছে। সেই ঘরে বছর সাতেকের একটা মেয়েও আছে। এটুকু বাদে আর সবকিছুই ভালো। নেয়ামত কাঠের কাজ করে। কাঠ কেটে নানারকম আসবাবপত্র তৈরি করে। রোজগার পাতি বেশ ভালো। কারণ তার গ্রামে সে ছাড়া আর কোনো কাঠের মিস্ত্রী নেই। এসব বাদেও আরো ভালো খবর হচ্ছে, নেয়ামত উল্লাহ কোনো যৌতুক চায় না। সে শুধু তার মা মরা মেয়েটার দেখাশোনার জন্য বিয়ে করতে আগ্রহী।
হনুফার বাবা দোটানায় পড়ে গেল। একে তো ছেলে দোজবর, তার ওপরে ছোট বাচ্চাও আছে। বিষয়টাতে তার মনের মধ্যে যে একটু খুঁতখুঁত করছিল না তা নয়। কিন্তু যৌতুকবিহীন বিয়ের এত বড় সুযোগটা হাতাছাড়া করতেও তার মন সায় দিচ্ছিলো না।
প্রস্তাবটা বাড়িতে আনতেই হনুফা আর তার মা দুজনেই মহা গ্যাঞ্জাম শুরু করে দিল। হনুফা পুরোপুরি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিল। গলায় ফাঁস দিয়ে মরারও হুমকি দিল। হনুফার মা চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুললো,
‘এদ্দিন ম্যালা কিছু কইছেন, কানে তুলিনি। মাইয়া বিয়াইছি, মহা পাপ করছি। আইজ না কইয়া যামু না। আমার মাইয়াটারে পানিত ভাসাইয়া দিবেন? দুজবরে বিয়া দিবেন?’

হনুফার বাবা ভীষণ বিরক্ত হলো। মেয়েমানুষ না জেনেবুঝে বেশি কথা বলে। তারা শুধু আগাটাই দেখে লাফালাফি করে। গোড়ার মিষ্টিটা কখনো এদের চোখে পড়ে না। তবু মাথা ঠান্ডা রেখে শান্তভাবে স্ত্রী কন্যাকে বোঝাতে থাকে সে।
‘দ্যাখো হনুফার মা, হনুফা কি আমার মাইয়া না? দুজবরে বিয়া দিলেই কি পানিত ফালাইয়া দ্যাওয়া হয়? তুমার বড় দুই মাইয়ারে ভ্যানআলা আর রাজমিস্ত্রীর লগে বিয়া দিলাম। তাগো আয় রোজগার ভালা না। তখন ত কিছু কইলা না! খালি দুজবর হইলেই খারাপ হইয়া গেল! আমি খুঁজ নিছি। নেয়ামত পোলাডা বড় ভালা। এক ট্যাকাও যৌতুক চায় না। বয়সও তেমুন বেশি না। আজেবাজে নেশা করে না। স্বভাব চরিত্র বড় ভালা। খালি তার মা মরা মাইয়াটারে একটু দেইখা শুইনা রাখবো এমুন একটা বউ চায়। চাওয়াটা তো খুব বেশি না, তাই না? অহন চিল্লাচিল্লি বন্ধ কইরা মাইয়ারে বুঝাও।’
হনুফা বেগম কম হুজ্জোত করেনি সেদিন। দড়ি কলস নিয়ে পুকুরে ঝাঁপও দিয়েছিল। লোকজন দিয়ে তাকে পানি থেকে ওঠানোর পরেও তার ফোঁসফাঁস কমেনি। তার ঐ এক কথা, সে মরবে তবু নেয়ামত উল্লাহকে কিছুতেই বিয়ে করবে না! একে তো দোজবর, তার ওপরে সতিনের মেয়েকে দেখতে হবে। তার বোনদের গরীবের বাড়িতে বিয়ে হলেও এসব ঝামেলা তো কারো ছিল না! সব ঝামেলা কেন তার ঘাড়েই এসে পড়বে?

শেষমেষ অবশ্য তার সব প্রতিরোধই ব্যর্থ হয়েছিল। আসলে তার বাবার আর ক্ষমতাও ছিল না। মোটা অঙ্কের যৌতুক দিয়ে অবিবাহিত কাউকে খুঁজে নিয়ে আসা তার দরিদ্র পিতার পক্ষে সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়েই নেয়ামত উল্লাহকে বিয়ে করে হনুফা বেগম। এই মেনে নেওয়া সমঝোতার জীবনে তার আক্ষেপের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না।
এমনিতে তার স্বামী নেয়ামত উল্লাহ নিতান্তই সাদাসিধা গোবেচারা প্রকৃতির মানুষ। মেয়েটাও শান্ত বাছুরছানা ধাঁচের। নিজে থেকেই বাড়ির সব কাজে হাত লাগায়। সৎ মায়ের মন রক্ষা করে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু হনুফা বেগমের তাতে মন ভরে না। নিজেকে তার বড় প্রতারিত মনে হয়। সে তো দেখতে তার অন্য বোনদের চেয়ে কিছু কম সুন্দর ছিল না! তাহলে তার ভাগ্যই এমন ফুটো হবে কেন?

এদিকে নেয়ামত উল্লাহর মনেও সুখ ছিল না। যে উদ্দেশ্য নিয়ে সে বিয়ে করেছিল, তা পুরোপুরিই মাঠে মারা গেছে। নতুন বউ তার মেয়ে জুলেখাকে দু’চোখে দেখতে পারে না। কচি মেয়েটা সৎ মায়ের মন জয় করার জন্য সব কাজের ভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। তবু সৎ মায়ের মন পায় না সে।
নেয়ামত উল্লাহ নিজেও হনুফা বেগমের সামনে মেয়েটাকে একটু আদর করতে পারে না। জুলেখার সাথে একটু নরম সুরে কথা বললেও হনুফা বেগম হিসহিসিয়ে ওঠে, ‘বাপ-বেটির সোহাগ দেখবার লাইগাই তো আইছি এই বাড়িত। আমি দুনিয়ার কামকাইজ কইরা মরি। আর তুমরা বইয়া বইয়া হাউশ করো!’

অবাক লাগে নেয়ামতের। মেয়ে মানুষ নাকি মায়ের জাত। তাহলে মায়ের জাত এক নারী কীভাবে সাত বছরের এক শিশুর প্রতি এতটা নির্দয় হতে পারে? মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। কী করতে গিয়ে কী হয়ে গেল!
জুলেখার মা’র সাথে কাটানো সেই নয়টি বছর ঘুরে ফিরেই তার মনের মধ্যে ফিরে ফিরে আসে। তার প্রথম বউটি ছিল খুব নরম সরম, বোকা সোকা। একেবারে জুলেখার মতোই। সাত চড় দিলেও রা করতো কী না সন্দেহ। অবশ্য চড় মারার মতো মানুষ কখনোই ছিল না নেয়ামত। সে তার বউকে মাথায় তুলেই রেখেছিল। এক সন্তানকে নিয়ে সংসারে তার কোনোরকম অশান্তি ছিল না। তবু কীসের এক সামান্য জ্বরে তার শান্তশিষ্ট ভালোমানুষ বউটি পরপারে চলে গেল।
মেয়ে আর মেয়ের বাপের খাওয়া দাওয়ার অসুবিধা হবে ভেবে তার বউ কখনো বাপের বাড়িতে পর্যন্ত যেতে চাইত না। অথচ সেই মেয়ে আর স্বামীকে এভাবে একলা অসহায় রেখে সে কোন অজানা দুনিয়ায় একা একা পাড়ি জমালো!

নেয়ামত নিজের কথা ভাবেনি কোনোদিন। সে সামান্য কিছু একটু পেলেই খুশিমনে খেয়ে নেয়। একটুখানি ভাত ডাল তরকারি সে নিজেই রান্না করে নিতে পারে। শরীরের জৈবিক চাহিদাও কখনোই খুব বড় কিছু হয়ে সামনে আসেনি তার। শুধু মেয়েটাকে নিয়েই মনোকষ্টে ভুগতো সে। কতই বা বয়স তার মেয়েটার! এই বয়সে মায়ের কথা মনে পড়লে দুনিয়া দু’ভাগ হয়ে যায়। ইচ্ছে করে মায়ের হাতে মাখা গ্রাস খেয়ে, মায়ের কোলে শুয়ে শুয়ে গল্প শুনতে।
তার প্রথম বউটি ছিল কালো। কিন্তু ভারী মায়াকাড়া মুখের গড়ন। জুলেখার মুখটিতে যেন তার মায়ের মুখখানাই কেটে বসানো হয়েছে। সেই মুখের দিকে চেয়ে নেয়ামত উল্লাহর বুকটা হু হু করে উঠতো। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল মনে, এমন মায়াকাড়া শিশুকে কোনো নারীই না ভালোবেসে পারবে না। সে বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজতে শুরু করে আবার। বিয়ে করে জুলেখার জন্য নতুন মা আনবে।
সবকিছুই হলো, শুধু জুলেখার মা হয়ে কেউ এলো না এই বাড়িতে। অভাগিনী মা’হারা জুলেখা আর কোনোদিনই মায়ের আদর ফিরে পেল না।

মাঝখান থেকে লাভের মধ্যে এই লাভ হলো, নেয়ামত এখন জুলেখার জন্য একটা টাকাও খরচ করতে পারে না। আগে জুলেখাকে সে শখ করে কিছু একটা কিনে দিতে পারতো। এখন প্রতিটি পাই পয়সার হিসাব বউ হনুফার কাছে জমা রাখতে হয়। কোন টাকা কীভাবে খরচ হচ্ছে সবকিছুরই কড়ায় গণ্ডায় হিসাব রাখে হনুফা।
বিয়ের পরের বছর সুফিয়ার জন্মের পরে থেকে হনুফা বেগমের এই হিসাব নিকাশ কয়েকগুণ বেড়েছে। নারীজাতি মায়ের জাত ঠিকই, তবে সব শিশুর জন্য সে মা নয়। যে নারী জুলেখাকে নিজের সন্তান ভাবা তো দূর সামান্য স্নেহ দিতেও নারাজ, সেই নারীই সুফিয়ার জন্য স্নেহের সাগর। তবে হনুফার মেজাজের হালচাল এতটা খারাপ হতে শুরু করেছে সুফিয়ার জন্মের তিন চার বছর পরে থেকে। এর আগে হনুফা রাগী প্রকৃতির থাকলেও এতটা বদমেজাজী ছিল না।

সুফিয়ার যখন তিন কী চার বছর বয়স, তখন হনুফার একদিন প্রচণ্ড পেটে ব্যথা আরম্ভ হয়। সেই সাথে তীব্র রক্তপাত। তাড়াতাড়ি সদরের হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করাতে হয় হনুফাকে।
সুফিয়ার দেখাশোনার ভার ছিল জুলেখার ওপরেই। সুফিয়াকে খাওয়ানো, গোছল করানো, কোলে পিঠে রাখা…সব কাজই সেই একরত্তি জুলেখাই করতো। এতে তার মোটেও আপত্তি ছিল না। বরং সে এতে ভীষণ আনন্দিত ছিল। সুফিয়া তার কাছে ছিল এক জ্যন্ত পুতুল। এগারো বছরের জুলেখা সেই তিন বছরের জ্যন্ত পুতুল দিয়ে দিনরাত খেলায় মেতে থাকতো।
কঠিন অসুখ ধরা পড়ে হনুফার। শরীরের একটা অঙ্গ ফেলে দিতে হয়। গর্ভাশয়…যা না থাকলে কোনো মেয়ে মা হতে পারে না কখনো।

হনুফার খুব শখ ছিল পুত্র সন্তানের জননী হওয়ার। যে মেয়ে সন্তান হয়ে জন্মানোর কারণে তাকে তার বাবার বাড়িতে এত অবজ্ঞার শিকার হতে হয়েছে, সেই মেয়ে সন্তানই যে পুত্রের জন্ম দেয়, সেটা তার সবাইকে দেখিয়ে দেওয়ার সাধ ছিল। ছেলে কোলে নিয়ে বাপের বাড়ি নাইওর যাওয়ার সুপ্ত বাসনা ছিল তার মনে।
আর তাছাড়া, মনে মনে একটা তীব্র ভয়ও কাজ করতো হনুফার। জুলেখার প্রতি নেয়ামত উল্লাহর চোরা টানটা সে ঠিকই বুঝতে পারতো। ঐ কালো মেয়েকে পরের বাড়ি পার করতে গিয়ে যদি সব জমানো টাকা পয়সা শেষ করে ফেলে তার স্বামী… এই ভয় তাকে শান্তি পেতে দিত না কখনো।
হনুফার স্বামী তার সামনে মেয়েকে আহলাদ দেখায় না ঠিকই, কিন্তু ভেতরে ভেতরে জুলেখার প্রতিই যে টানটা তার বেশি এটা হনুফা ভালোই টের পায়। তার নিজের একটা ছেলে থাকলে আর চিন্তা ছিল না। সবকিছুর মালিক হতো সেই ছেলে। কিন্তু সে নিজেও তো এক মেয়ে সন্তানেরই জননী। সেই মেয়ে যে সবকিছুর বেশি ভাগ পাবে, এমনটা কি আর হতে দেবে হনুফার স্বামী?

আর কখনোই মা হতে পারবে না, এই সত্যিটাকে বুঝতে পারার পর থেকেই হনুফা একেবারে অন্যরকম হয়ে গেছে। সে যেন এখন এক হিংস্র বাঘিনী যে প্রতি মুহূর্তে তার বাচ্চাকে বাঁচানোর চিন্তায় ব্যগ্র হয়ে আছে।
যার জন্য এতকিছু সেই সুফিয়া কিন্তু মোটেও তার মায়ের ধাঁচ পায়নি। সে হয়েছে একেবারে দুনিয়ার অন্যরকম। কারো সাথেই তার আচার আচরণে মিল নেই। ডাকাবুকো, ভয় ডর নাই বললেই চলে। মায়ের শাসনের সে ভয় করে না। আবার বাবার স্নেহেরও সে কাঙ্গাল নয়। প্রচণ্ড জেদি, একরোখা…আবার সেই সাথে চরম প্রতিবাদী। অথচ কারো প্রতি মায়াদয়াও কিছু কম নেই তার মনে। একেবারেই বিপরীতমূখী চরিত্রের এক মানুষ এই সুফিয়া।
ছোটবেলা থেকে যে সৎবোন তাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে, তার প্রতি মায়ের দুর্ব্যবহারে সে বোনের প্রতি আরো প্রগাঢ় মমতা বোধ করে। অসহায় ভালোমানুষ বোনটাকে সে সবকিছু থেকে আগলিয়ে রাখে, যেমন ভাবে বোন তাকে তার ছোটবেলায় আগলে রেখেছে। নেয়ামত উল্লাহ দূর থেকে দুই বোনের মাখামাখি ভরা ভালবাসা দেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। মনে মনে ভাবে,
‘পোড়াকপালী! তাও তো কিছু একটা ভাগ্য নিয়া আইছিলি! সৎবুইনের ভালোবাসা পাওয়া থাইকা আল্লাহ্‌ তোরে ফিরাইয়া রাখেনি।’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-০২

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_দুই

তেমনই এক ঘটনা গত বছর ঘটেছিল, গ্রামের কৃষক হাফিজুদ্দিনের মেয়ে রেহানার সাথে।
ঘটনা যে কবে ঘটেছিল আর কীই বা ঘটেছিল কেউই আগেভাগে কিছু জানতেও পারেনি। সবকিছুই চলছিল ঠিকঠাক। জানতে পারলো সেদিন, যেদিন সামনে এলো যে রেহানা অন্তঃসত্তা। তারপরে একে একে বেরিয়ে এলো সেদিন কী কী ঘটেছিল তার সাথে। ধর্ষিতা হওয়ার পরেও বাঁচতে পেরেছিল রেহানা। কতই বা বয়স তার! কতটুকুই সে দেখেছে জীবনের! এত তাড়াতাড়ি কেন অন্যের পাপে সে তার জীবনাবসান ঘটাবে?
কিন্তু ঘটনা সামনে আসার পরের লজ্জা সে আর নিতে পারেনি। গাঁয়ের লোক হাজার অকথা কুকথা শুনিয়ে তার জীবন জেরবার করে দিয়েছে। যারা তাকে ধর্ষণ করেছে, তাদের শাস্তি দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি তারা। কিন্তু সব দোষ রেহানার দুর্বল কাঁধে চাপাতে বিন্দুমাত্র পিছপা হয়নি। লজ্জায় অপমানে রেহানারও আর বাঁচা হয়নি। ক্ষেতের মাঝখানে এক বড় আমগাছের ডালের সাথে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছে সে।
সেই গাছটি দাঁড়িয়ে আছে ওদের গ্রামের একেবারে মাঝখানে। সেই রাস্তা দিয়েই গ্রামের প্রতিটি মানুষ আসা যাওয়া করে। রেহানা প্রতিটি চোখের সামনে নিজেকে ঝুলিয়ে রেখে সবাইকে অপরাধী বানিয়ে গেছে।
অল্প কিছুদিন এটা নিয়ে গ্রামে একটা হৈ চৈ হয়েছিল ঠিকই। কিন্তু ধামাচাপা পড়ে যেতেও সময় লাগেনি। প্রতিদিন কত অজস্র ঘটনা ঘটে! একটা ঘটনা নিয়ে বসে থাকলে তো আর দিন চলে না। মানুষ তাই কোনোকিছুই বেশিদিন মনে রাখতে চায় না। শুধু যার যায়, একা একা তাকেই সে শোক সারাজীবন বয়ে বেড়াতে হয়।

এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কুলক্ষণের মতোই সেই ঘটনাটি মনে পড়ে গেল জুলেখার। রাগ রাগ চোখে সুফিয়ার দিকে তাকালো সে। সুফিয়ার ভাবভঙ্গি কিন্তু নির্বিকার। উদাসীন দৃষ্টি মেলে চারপাশে দেখতে দেখতে হাঁটছে সে। গুনগুন করে আবার কীসের যেন সুরও ভাঁজছে। তাকে একটা কিছু বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো জুলেখা। তার নিজের ভয়টা আর সুফিয়ার মধ্যে ঢুকিয়ে দিতে মন চাইলো না।
আজ সকাল থেকেই জুলেখাকে বলে রেখেছিল সুফিয়া। ‘বুবু, আইজ একবার পশ্চিমের ঝাড়ের ঐদিকটায় যামু। তুমি আর আমি। ঐদিকটাত না ম্যালা লটকন, করমচা ধইরা আছে। এই এত্ত এত্ত! ঝোপের মইধ্যে। কেউ জানেও না!’
সুফিয়ার কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকিয়েছিল জুলেখা।
সুফিয়া জানে, বুবু তার কোনো কথাই ঠেলতে পারবে না। তার ছেলেমানুষি আহলাদ গুলো সবসময়ই আলাদা প্রশ্রয় পায় জুলেখার কাছে। সুফিয়ার জন্য তার মনের ভেতরে কুলকুল বয়ে চলা শীতল পানির ধারাটা কখনোই শুষ্ক হয় না। জুলেখার কাছে পুরো পৃথিবী যদি দাঁড়িয়ে থাকে একদিকে, তবে সুফিয়া আরেকদিকে।
আর কেউ তো জুলেখার খাওয়ার সময় কাছে এসে কখনো জিজ্ঞেস করে না,
‘ও বুবু, এক টুকরা মাছ আইনা দিই? চিন্তা কইরো না, পাতিল থাইকা আনুম না। আমি রাইখা দিছি, তুমার লাইগা!’
জুলেখার হাজার নিষেধেও সুফিয়া কথা শোনে না। তার আদরের বুবুকে সে সবসময় চোখে চোখে রাখে। তার মা, বুবুকে দু চক্ষে দেখতে পারে না। দিনরাত গালমন্দ করে। পান থেকে চুন খসার জো নেই। সারাদিন ঘরের সব কাজ বুবুকে দিয়ে করিয়ে নিয়েও মায়ের শান্তি হয় না কোনো। কীসের যেন তীব্র আক্রোশে জ্বলে পুড়ে মরে সারাক্ষণ।

মায়ের বকাঝকার মাঝপথে সুফিয়া বেমক্কা কিছু একটা বলে বসে বোনকে বাঁচিয়ে দেয়। এমনটা সে অনেকদিন করেছে। প্রথমদিকে সুফিয়ার মা মেয়ের এই চালাকি ধরতে পারতো না। এখন জুলেখাকে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই তার মা সুফিয়াকে সাবধান করে দেয়, ‘খবরদার কইছি, কতার মাইঝখানে যদি সান্ধাইছোস তয় ভুইলা যামু তুই আমার প্যাটের মাইয়া!’
সাবধান বাণীতে বিশেষ একটা কাজ হয় না। সুফিয়া নিত্য নতুন ফন্দি এঁটে তার মাকে ভালোমতই পরাস্ত করে ফেলে। তার মাকে সে মোটেও সুবিধা করতে দেয় না।
জুলেখা তার বোনের এইসব ছলচাতুরি বুঝতে পেরে মুখ টিপে হাসে। সৎ মায়ের বকাঝকা তখন আর একটুও গায়ে লাগে না। সেই মুখ টিপে হাসি দেখে তার সৎ মায়ের গনগনে রাগ আরো তেতে ওঠে। ঝাঁঝিয়ে ওঠে দ্বিগুণ ক্ষোভে, ‘পোড়ারমুখী! নিজের মায়েরে খাইছস, আমার সংসারের শান্তি নষ্ট করছস…ওহন আইছস আমার মাইয়ার জীবন নষ্ট করতে! আমার নিজের প্যাটের মাইয়ারে তাবিজ করছস! তুই কী ভাবছোস আমি বুঝি না কিছু?’
এমন সময়ে সুফিয়া কঁকিয়ে ওঠে, ‘ও মা গো, ওরে আল্লাহ গো! প্যাট ব্যথায় মইরা গ্যালাম। মনে হয়, তাবিজের আছর। গ্যালাম গা প্যাট ব্যথায় শ্যাষ হইয়া গ্যালাম। ও বু, তাবিজ করছো যহন…অহন শ্যাক দিয়া ব্যথা ভালা কইরা দাও। ওরে বাবারে…মইরা গ্যালাম…
মুহূর্তেই থেমে যায় সৎ মায়ের মুখের মেশিন। সাথে সাথে ব্যস্ত হয়ে ওঠে মেয়ের শুশ্রুষায়,
‘কী হইছে রে মা, প্যাট কি হাছাই বেশি ব্যতা করতাছে?’
‘হাছা না তো কি মিছা কতা কইলাম? শ্যাক দিবার কও। খাড়াইয়া থাগবার পারতাছি না!’
জুলেখার দিকে তাকিয়ে আবার চিৎকার দেয় তার সৎ মা, ‘ওহনো খাড়াইয়া আছোস? হুনলি না?’

ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুক্ষণের জন্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছিল জুলেখা। বোকার মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিল, সত্যি সত্যিই কি সে কোনো জাদুটোনা করলো নাকি সুফিয়ার ওপরে?
সৎ মায়ের ধমক শুনে বোনের দিকে চাইতেই জুলেখা এক মুহূর্তেই সব বুঝে গেল। পটপটিয়ে বার কয়েক চোখ মেরে সুফিয়া মটকা মেরে মেঝেতে পড়ে রইলো। জুলেখা প্রাণপনে হাসি চেপে হারিকেন জ্বালাতে যায় স্যাক দেবার জন্য। ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে তার হাসি একান ওকান হয়। কী পাজি মেয়েরে বাবা! পেটে পেটে এত বুদ্ধি!
সেই বোন কিছু একটা আবদার জানালে যত দুঃসাধ্যই হোক, জুলেখার তা রাখা চাইই চাই। যদিও কপট শাসন টুকুও করতে হয়।

অত দূরে যাওয়ার প্রস্তাবে সে মাথা নেড়ে বলেছিল, ‘খ্যাপছোস তুই? ওদ্দুরে যাবি! আর ঐ জঙ্গলে? তুই জানস না সেই জঙ্গলের গপ! কেউ যায় হেইখানে? মায়ে জানবার পারলে দুইজনের কারোরই হাড়হাড্ডি আস্ত থুইবো না!’
‘মাইনষে যায় না আজাইরা ডরে। তুমি ডরাও এইসব হুদার গপে? আরে মায়ে জানবার পারলে তো!’ তারপরেই ঠোঁট ফুলিয়ে বলেছিল, ‘তুমি যাইবা নাকি কও! নাইলে কইলাম আমি একাই যামু!’
এরপরে আর ওজর আপত্তি চলে না। কারণ, জুলেখা জানে সে রাজি না হলে সুফিয়া সত্যি সত্যিই একা একাই চলে যাবে। এই মেয়ে যেন কেমন হয়েছে! ভয়ডর বলে কিচ্ছু নেই। আর ভীষণ জেদ। যা করতে চায় আজ হোক অথবা কাল, সেটা সে করেই ছাড়ে। পড়াশুনা করে, মাথার বুদ্ধিশুদ্ধিও পরিষ্কার। বাড়ির আর কেউ তার সাথে বুদ্ধিতে এঁটে উঠতে পারে না।
এটা ওটা নানান কথা বলে সুফিয়া তার বোনকে বুঝিয়েই ছাড়ে যে, জঙ্গলে মোটেও ভয়ের কিছু নেই। এগুলো সব গাঁয়ের লোকের মিথ্যে কুসংস্কার। জুলেখা বোকা সোকা নরম মনের মেয়ে। সুফিয়ার যুক্তির কাছে সে অতি সহজেই পরাস্ত হয়।

তাই দুপুরের একটু পরেই দু’বোনে চলে এসেছিল পশ্চিমের ঝাড়ে।
ঘন ঝোপঝাড় আর বড় বড় গাছ গাছালিতে ঢাকা এই জায়গাটি তাদের গ্রামের একেবারে শেষ মাথায়। অনেক গাছপালা থাকা সত্ত্বেও এদিকটাতে কেউ তেমন একটা আসে না। সাপ খোপের আখড়া জায়গাটা।
জঙ্গলের ভেতরে অনেক পুরনো একটা কালী মন্দির আছে। সেখানে একটা বিগ্রহও বসানো আছে। কেউ অবশ্য এখন আর পুজো আর্চা করতে আসে না। ছোট বাচ্চাদের মধ্যে এদিকটাতে ভূতের গল্পও চালু আছে। সেজন্যই চোর ছ্যাচড় ছাড়া এই ঘন জঙ্গলে কারোরই পায়ের ছাপ পড়ে না বলতে গেলে।
ঘন জঙ্গল ছেয়ে আছে নানারকম গাছপালায়। ফলের গাছই যে আছে কত রকম! সেসব গাছে ফল ধরে পেকে টসটসে হয়ে থাকে। পাখি খেয়ে শেষ করতে পারে না। বাদুড়, কাঠবেড়ালী, বানর…সবাই মিলেমিশে খায়। নীচে পড়ে থাকে এত্ত এত্ত। তবু কেউ সেসব ফল ছিঁড়তে আসে না। কালী মন্দিরটাকে লোকে খুব ভয় পায়। এক কালে নাকি এখানে নরবলি হতো।

সেসব অবশ্য অনেক পুরনো কথা। গাঁয়ের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে মুখে প্রচলিত সেসব গল্পগাঁথা শুনে শুনে বড় হয়ে ওঠা তরুণ, প্রৌঢ়রাও আর এই পথ তেমন একটা মাড়ায় না। শীত গ্রীষ্ম বর্ষা ফাগুন সব ঋতুতেই এই ঘন জঙ্গল পড়ে থাকে একা একা…তার অদ্ভুত রহস্যময়তাকে সঙ্গী করে।
সুফিয়ার কথা শুনে জুলেখা এসেছে ঠিকই, কিন্তু জঙ্গলে পা দিয়েই তার বুক দুরুদুরু কাঁপতে শুরু করে দিল। ছোটবেলা থেকেই এই কালীমন্দিরের কত যে গল্পগাঁথা শুনেছে সে! প্রতি ছ’মাসে নাকি এই মন্দিরে একটা করে নরবলি না হলে গাঁয়ের লোক শান্তিতে থাকতে পারতো না। একটা কিছু না কিছু অনর্থ লেগেই থাকতো গ্রামে। প্রচলিত আছে, সেই কালী নাকি এখনো জাগ্রত। দীর্ঘদিন নরমুণ্ডু না পাওয়ার আক্রোশ সে এখনো ভোলেনি। সেই জঙ্গলের ভেতরে কাউকে দেখতে পেলে এখনো সে যেকোন সময় তার বিধ্বংসী রূপ নিয়ে দেখা দিতে পারে।

কালের পরিক্রমায় গাঁয়ে হিন্দু বসতি কমে গিয়েছে। দেশভাগের পরে অনেক হিন্দুই বাক্স পেঁটরা নিয়ে পার্শবর্তী দেশে চলে গিয়েছে। এখন দু’একটি বাদে গাঁয়ে আর কোনো হিন্দু বাড়ি নেই বললেই চলে। ধর্মীয় বিশ্বাসের সেই জায়গাটা হারিয়ে গেলেও গল্পগুলো এখনো লোকের মুখে মুখে ফেরে। শোনা সেসব গল্পের সত্য মিথ্যা যাচাই করে দেখবার মতো সাহসী লোকের গাঁয়ে বড়ই অভাব। কেউই সেই জঙ্গলে যাওয়ার তেমন একটা প্রয়োজন দেখে না।
জুলেখা একবার ভেবেছিল ফিরে যাবে। দরকার নেই এই জঙ্গলের ভেতরে ঢোকার। ওরা দু’বোন হারিয়ে গেলে কেউ কোনদিন জানতেও পারবে না। বার কয়েক ঢোক গিলে সুফিয়াকে বলেছিলও সে, ‘ও সুফিয়া, চল চইলা যাই বইন। কাইজ নাই এই জঙ্গলে ঢুইকা!’
সুফিয়ার চোখেমুখে তখন ঝিকমিক করছে কৌতুহল আর আগ্রহ। ফিরে যাওয়ার জন্য সে মোটেও আসেনি। জুলেখার কথায় তাই কটমট চোখে তাকিয়ে বলেছে, ‘তুমি কেমুন মানুষ গো বুবু! আজাইরা ভয় পাও। গাঁয়ের মাইনষের আক্কেল বুদ্ধি কম, তাই এমুন জায়গায় পা দেয় না। দেখছো কত ফল পাকুড় ধইরা আছে! আইজ আঁচল বাইন্ধা লইয়া যামু।’
তা অবশ্য ভুল কথা নয়। ফলফলারী ধরে আছে প্রচুর। গাছগুলো ফলের ভারে একেবারে নুয়ে পড়েছে। লটকন, করমচা, জলপাই, চালতা, পেয়ারা, বাতাবী লেবু…কীসের গাছ নেই এখানে? সুফিয়া চুক চুক করে বললো, ‘বেজায় ভুল হইয়া গ্যাছে! একটা থইলা নিয়া আসোন লাগতো! খালি কোঁচড়ে ভইরা কয়টা লইয়া যামু?’
জুলেখার ভয় তখনো কাটতে চায় না। অন্য ভয় না থাকুক, সাপ খোপ যে এই জঙ্গলে অগুনতি আছে তা তো আর বলে দিতে হয় না। ফল পাড়তে এসে শেষমেষ বেঘোরে প্রাণটা না যায়! আর তাছাড়া আসল ভয় তো আছেই! তার সৎ মা’র ভয়। দুইবোনের এই পশ্চিমের ঝাড়ে এসে ফল পাড়ার খবর বাড়িতে চাওড় হলেই আর দেখতে হবে না। তারা যদি সুস্থ শরীরে সব হাত পা অক্ষত রেখে ফিরতেও পারে, তবু বাড়িতে গিয়ে কী জবাব দেবে কে জানে! খড়গটা তো এসে পড়বে জুলেখার ঘাড়েই।
তবু জঙ্গলের ভেতরে এমন শুনশান নিস্তব্ধতার মাঝে এসে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম একটা ভালোলাগা এসেও আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল জুলেখার মনকে। কত সারি সারি গাছ এখানে! কী লম্বা সেসব গাছের ডালপালা! যেন আকাশ ছুঁতে চায়। সেসব গাছের ফাঁক গলে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে শেষ বিকেলের আলো।

যদি সত্যিই এখানে ভয়ের কিছু না থাকে, তাহলে গাঁয়ের লোক এমন একটা গাছগাছালি ভর্তি জঙ্গল পেয়েও কেন এভাবে ফেলে রেখেছে? কেন সেটাকে নিজেদের কাজে লাগাচ্ছে না? এসব গাছের খুচরো ডালপালা আর ফলফলারি বিক্রি করেই তো কত লোকের ভাগ্য খুলে যেতে পারে! স্রেফ ভয়ের কারণেই এমন একটা জায়গাকে সবাই দূরে সরিয়ে রেখেছে? গ্রাম্য কুসংস্কার বড় সাংঘাতিক বস্তু। একবার যদি এটা ছড়াতে থাকে, তাহলে তার গতি রোধ করা সত্যিই মুশকিল।
বনে ঘুরতে গিয়ে দুজন ক্লান্ত হয়ে পড়লো। বন জঙ্গলের পথঘাট তো আর ঘাসে ঢাকা মসৃণ নয়! গাছ গাছালির কাঁটাওয়ালা ডাল আর ইট পাথর কাঁকড় নুড়িতে চারপাশ ভরা। দু’বোনের কারোর পায়েই স্যাণ্ডেল নেই। গ্রামের পথঘাটে তারা খালি পায়েই চলাফেরা করে। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দু’জনেরই পায়ের নীচটা কেটে ছিঁড়ে একসা হলো।
গাছ থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে ফল পাকুড় পেড়ে আর ইচ্ছেমত কোঁচড় বোঝাই করতে গিয়ে শরীরের শক্তিও প্রায় ফুরিয়ে গেল। সুফিয়া গাছের নীচে বসে পড়লো হাত পা ছড়িয়ে। জুলেখা ততক্ষণে ভয়কে জয় করে জঙ্গলের সৌন্দর্য আস্বাদনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পাতার ফাঁক গলে শেষ বিকেলের আলো এসে তখন ঘিরে নিয়েছে চারপাশ। সেই অপূর্ব দৃশ্যটা তখনই চোখে পড়ে যায় জুলেখার।

জঙ্গলের শেষপ্রান্তে এসে সে দেখতে পায়, সামনে ধু ধু ফসলের মাঠ। সোনা রঙা ফসলের চাদরে মুড়ে আছে পুরোটা মাঠ। পশ্চিমের আকাশে টকটকে লাল সূর্যটা নেমে এসেছে অনেকটা নীচে। চারদিকে মায়াবী শেষ বিকেলের স্নেহভরা আলোর আলিঙ্গন।
এই আলোর পরশ পেলেই জুলেখার মনে হয় যেন মা এসে ছুঁয়ে দিয়ে গেল তাকে। চোখেমুখে সে যেন মায়ের আদরমাখা পরশকে অনুভব করতে পারে।
জঙ্গল থেকে বেরিয়েই সব দুর্ভাবনা পালা করে ছেঁকে ধরছিল জুলেখাকে। আজ বোনের সাথে সাথে ওকেও বুঝি ভূতে পেয়েছিল। এখন ভালোয় ভালোয় বাড়ি ফিরতে পারলে হয়! চোখ কান খোলা রেখে সামনে পেছনে ডানে বাঁয়ে দেখতে দেখতে দ্রুত পায়ে হাঁটছিল সে। দু’বোনের কোঁচড় ভরা লটকন, জলপাই, জামরুল আর করমচা। সেগুলো সামলে নিয়ে দ্রুতপায়ে হাঁটতে বেশ ভালোই বেগ পেতে হচ্ছিলো ওদের। হঠাৎ কী মনে হতেই জুলেখা সন্দেহসূচক চোখে তাকায় সুফিয়ার দিকে। রাগ রাগ গলায় জিজ্ঞেস করে, ‘হাছা কইরা ক দেখি, তুই এইহানে আগেও আইছস ঠিক না?’
সুফিয়া ধরা পড়া গলায় তোতলাতে তোতলাতে বলে, ‘এ…এইটা তু…তুমার ক্যান মনে হইলো?’
‘এইটা আমার এইজন্যিই মনে হইলো যে, বাইরে থ্যাইক্যা এই জঙ্গলের ফলপাকুড় দ্যাখন যায় না। তুই আইজ বাড়িত চল। একা একা এই জঙ্গলে তুই কুন সাহসে আশোস হেইডা আমার জানতে হইবো।’

সুফিয়া মনে মনে প্রমাদ গুনলো। ভয় জিনিসটা তার চিরদিনই কম। কোথা থেকে যে সে এত সাহস পায় নিজেও জানে না। প্রকৃতির সান্নিধ্য তার সবসময়ই বড় ভালো লাগে। যাকে বলে গেছো মেয়ে, সুফিয়া ঠিক তাই। গাছে চড়তে তার খুব ভালো লাগে। সাপ খোপের ভয়ও তেমন একটা করে না।
ওদের স্কুলে ক্লাসরুমের ভেতরে একবার একটা সাপ ঢুকে পড়েছিল। শঙ্খচূড় সাপ! স্কুলের চারপাশে যে ঝোপঝাড় আছে তা থেকেই চলে এসেছে হয়ত। গরমের দিনে অনেকসময়ই সাপ গর্ত থেকে বেরিয়ে আসে। সাপটি ক্লাসরুমে ঢুকে শান্তভাবে জানালার কাছে কুণ্ডলী পাকিয়ে ছিল। ছেলেপুলের সে কী ভয়! এক মেয়ের তো ভয়ে মুখ দিয়ে ফেনা উঠতে শুরু করে দিল। সুফিয়া ভেবে পায় না এত ভীতু কেন চারপাশের সবাই? গ্রামের ছেলেমেয়ের এত ভীতু হলে চলে?

একটা ছেলেকে সাথে নিয়ে সুফিয়া নিজে লাঠি দিয়ে সেই সাপ ধরেছে। তারপরে বাইরে গিয়ে আবার ঝোপের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছে। স্কুলের সবাই সুফিয়ার সাহসে রীতিমত বিস্মিত হয়ে গিয়েছে। এরপরে থেকে সব ক্লাসরুমে কার্বলিক এসিডের বোতল রেখে দেওয়া হয়েছে, যাতে আশেপাশে সাপ ভিড়তে না পারে।
সুফিয়া এই জঙ্গল নিয়ে গাঁয়ের লোকের ওসব উদ্ভট গল্পগাঁথায় কখনোই বিশ্বাস করেনি। একা একা অনেকদিন সে এই জঙ্গলে এসেছে। ফলমূল পেড়ে খেয়েছে। নির্জন জঙ্গলে একা একা ঘুরে ঘুরে দেখেছে সবকিছু। এমনকি সেই কালী মন্দিরেও উঁকি মেরে দেখেছে সে। রহস্যের কিছুই খুঁজে পায়নি।
পুরনো এক কালীমূর্তি ইয়াবড় জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছে। সময়ের আঁচড়ে মূর্তির গায়ে অনেক চড়াই উতরাই। মূর্তির এক হাতের অনেকটা অংশ ভাঙ্গা। তবে একটা জিনিস দেখে সে খানিকটা অবাক না হয়ে পারেনি। মন্দিরের ভেতরটা কিন্তু বেশ সাফসুতরো। দেখে মনে হয়, কেউ বুঝি সেটাকে নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখে। এই ব্যাপারটা সুফিয়ার মনের মধ্যে একটা খটকা লাগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওর যুক্তিবাদী মন কোনো লোকগড়া মতামতকে মানতে নারাজ। নিশ্চয়ই কেউ এই মন্দিরে থাকে। কে থাকে, কেন থাকে সেটা জানার চেষ্টাও করেছে আরো কয়েকদিন এসে। বের করতে পারেনি। কাউকেই চোখে পড়েনি তার।

কিন্তু সেসব কথা এখন জুলেখাকে বলা যাবে না। পরে একসময় আস্তে ধীরে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বলতে হবে। এই মুহূর্তে বোনকে বুঝ মানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সুফিয়া।
‘ও বু, সেইসব কথা পরে হইবো। আগে চলো, বাড়িত যাই। মায়ে মনে হয় লাঠি নিয়া খাড়াইয়া আছে!’
‘হ, হেইডা ত ঠিকই! তয় হেই লাঠি ত আমার মাথায় ভাঙবো, তুমার ত চুলের আগাও ছুঁইবার পারবো না!’
‘ওমা, আমি থাকতে তুমার মাথায় কেডা লাঠি ভাঙবো! দ্যাখবোনি হুহহ!’
গল্পকথা আর নিজেদের ভেতরের উত্তেজনায় দুজনের কেউই জানতে পারলো না, পেছন থেকে একজোড়া সাবধানী উৎসুক চোখ এক উঁচু গাছের ডাল থেকে তাকিয়ে আছে তাদেরই দিকে।

যত দ্রুত পারা যায়, পা চালাতে লাগলো দু’বোন। প্রায় দশমিনিটের মতো দুজনের কেউই আর একটাও কথা বললো না। যখন খোলা মাঠটা ছাড়িয়ে গ্রামের সীমানায় ভালোমত পৌঁছে গেল, তখন মুখ খুললো সুফিয়া।
‘ও বুবু, একটা কথা কইতাম!’
‘ক, তর মুখ কেডা চিপা ধরছে?’
‘না মানে, রাগ করবা না কও আগে!’
জুলেখা পা থামিয়ে দিয়ে আগুন চোখে তাকালো সুফিয়ার দিকে। রাগী গলায় বললো,
‘আবার কী চাস তুই? সক্কাল বেলায় এক হাউশ কইরা বইলি। সেই হাউশ মিটাইবার গিয়া ওহনতরি বাড়িত যাইবার পারলাম না! এই মাইঝ রাস্তায় আবার নতুন কী চ্যারা মাথার মইধ্যে কামড়াইতাছে তর?’
‘তুমি কিছু না শুইনাই মায়ের লাগান মেশিন চালাইয়া দিলা বুবু? আগে শুনো কী কই! দ্যাখলা ত পশ্চিমের জঙ্গলটা। এক্কেরে সুন্দোর, কোনো জিন ভূত কিচ্ছু নাই! তাইলে এই গেরামের মাইনষে কীয়ের লাইগ্যা এত ডরায় বু?
জুলেখা মাথা নেড়ে অনিশ্চিত গলায় বললো, ‘হেইডা আমি কেমনে কমু? আছে হয়ত কিছু একটা…হেই লাইগাই ডরায়।’
‘তুমি দ্যাখলা?’
‘না দ্যাখি নাই। তয় বেবাক জিনিস কী এক সময়েই দ্যাখন যায়? কুনো সময় যায় কুনো সময় যায় না।’
সুফিয়া অস্থিরভাবে মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, ‘উহ্‌ বুবু! আবার হেই এক প্যাঁচাল…আছে একটা কিছু! তুমার কি এত্ত বয়সেও আক্কেল হয় নাই বুবু? এগুলান সব মাইনষের চাল…কেউ যাতে হেই জঙ্গলে ঢুকবার না পারে এর লাইগাই এইসব গপ চালু কইরা দিছে। আমার মনে কয়, ঐ জঙ্গলের মইধ্যে কেউ থাহে!’

জুলেখা হাঁটার গতি থামিয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। যত দিন যাচ্ছে সুফিয়া যেন আরো রহস্যময়ী হয়ে উঠছে। কীসের এক জঙ্গল, কেউ যেখানে আসা যাওয়াই করে না.. সেই জঙ্গলে কেন লোকে আসা যাওয়া করে না, এটা জানার জন্য এই মেয়ের এত কীসের উদ্বেগ? আর এই মেয়ের ভয়ডর একেবারেই নাই হয়ে গেল কেন? গ্রামদেশের অল্পবয়সী মেয়ের ভূত জীনের ভয় থাকবে না, এটা কেমন কথা?
জুলেখা মনে মনে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলো। বেশি ডাকাবুকো মেয়েদের কেউ বিয়ে করতে চায় না। শেষে তার সৎ মায়ের আশঙ্কাই না সত্যি হয়! সুফিয়ারও যদি তার মতো পোড়া কপাল হয়? নাহ্‌, এই মেয়ে বেশি বাড়ছে! একে খুব তাড়াতাড়িই সাইজ করতে হবে।
জুলেখা আবার পা চালাতে চালাতে বললো, ‘তরে কেডায় কইলো কেউ থাহে?’
সুফিয়া সতর্ক হলো। আপাতত সবকিছু খুলে বলার দরকার নেই। পরে আস্তে আস্তে বলবে। তাই কথাটা হাল্কা করে দিয়ে বললো, ‘এমনি, আমার মনে হইলো।’
‘দ্যাখ সুফিয়া, এইসব আজাইরা চিন্তা ভাবনা না করনই ভালা বুঝলি? বেশি চিন্তা করলে তরও আমার লাগান কপাল পুড়বো কইলাম!’
‘আচ্ছা বুবু, তুমিও কি মায়ের লাগান এইডা মনে কর যে তুমার কপাল পুড়া?’
‘মনে করুম না ক্যা? এতখানি বয়স হইলো…ওহনো বাপের কান্ধে চইড়া আছি। নিজের সংসার হইলো না…পোলাপান হইলো না…আমার ত কপাল পুড়াই! পাতিলের কালির লাগান পুড়া!’
‘আমার হেইডা মনে হয় না বুবু। দ্যাইখো তুমি, তুমার কপাল একটুও পুড়া না। আর খালি বিয়া হইলো না বইলাই কপাল পুড়া হইবো ক্যা…’

সুফিয়ার কথা শুনতে শুনতে জুলেখা সামনের সম্ভাব্য বিপদের কথাই ভুলে গেল। সুফিয়া নানারকম যুক্তি তর্ক দিয়ে তাকে বোঝাতে লাগলো যে, নিজেকে পোড়াকপালী ভাবার কোনো কারণই নেই। কারণ, জীবনে কার কী ঘটবে কেউ বলতে পারে না।
জুলেখা মুখ টিপে হাসতে লাগলো। তার একটুও মনে থাকলো না যে, বাড়িতে গিয়েই কী ভীষণ জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হবে! সেটার জন্য কোনো প্রস্তুতি তাদের আদৌ আছে কী না।
সব ভাবনা চিন্তা ভুলে সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে থাকা নিস্তব্ধ গ্রামের পথে দুই বোন গল্প করতে করতে হেঁটে চললো।
যখন তারা বাড়িতে পৌঁছলো, পশ্চিম আকাশের শেষ লালিমাটুকুও তখন পুরোপুরি মুছে গিয়েছে। (ক্রমশ)