Wednesday, August 20, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 165



কাঁটাকম্পাস পর্ব-০১

0

#কাঁটাকম্পাস
#আরশিয়া_জান্নাত

“দেখুন আমি সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি। এই বিয়েতে আমার মত ছিল না, বলতে গেলে অনেক টা বাধ্য হয়েই আমি আপনাকে বিয়ে করেছি। এই বিয়ে আমি মানি না। আপনি আমার কাছে সামাজিকভাবে স্ত্রীর মর্যাদা পেলেও ব্যক্তিগতভাবে সেটা পাবেন না….”

কথাগুলো বলেই শ্বাস ফেলল জাওয়াদ। তার কথা শুনে ঘোমটা তুলে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো আরওয়া। রূঢ় কন্ঠে বলে উঠলো, আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন? এই যুগে এসে আদিম যুগের কিচ্ছা শোনাচ্ছেন? এখন জোর করে মেয়েদের ই বিয়ে হয়না আর আপনার মতো ধামড়া লোকের বিয়ে হয়ে গেল? এটা বললেই আমি বিশ্বাস করবো?

বিশ্বাস করা না করা আপনার বিষয়। আমি আমার কথা জানিয়ে রাখলাম ব্যস!

আপনার ঘোড়ার ডিমের মনগড়া কথা শুনতে আমার বয়েই গেছে!

আপনার এটা মানতে সমস্যা হলে বলে দিন ডিভোর্স দিয়ে দিবো। এই বিয়েটা এমনিতেও বেশিদিন টেকার কথা না

ওয়েট এ মিনিট! আপনার মাথায় কি সমস্যা আছে? আমার বাবা এতো টাকা খরচা করে অনুষ্ঠান করলো, আপনার বাড়ির শ’খানেক বরযাত্রী খাওয়ালো। আর আমি আপনার মতো আহাম্মকের কথা শুনে সেসব জলে ভাসিয়ে দিবো? তাছাড়া বিয়ের মাত্র কয়েকঘন্টায় ডিভোর্স দেওয়ার মুরোদ যার আছে সে কবুল বলতে অস্বীকার করার মুরোদ রাখেনি কেন?

আপনি হাইপার হয়ে গেছেন। আপনাকে দেখে যতোটা নম্রভদ্র মনে হয়েছিল আপনার ব্যবহার ততোটাই খারাপ!

হাহাহা আপনি বোধহয় বাংলা সিনেমা বেশি দেখতেন। তাই ভেবেছেন রাজ্জাকের মতো এসে বলবেন এই বিয়ে আমি মানি না আর আমি নম্রভদ্র শাবানার মতো চুপচাপ সেটা মেনে নিয়ে মনের দুঃখে গান গাইবো, আমি রজনীগন্ধা ফুলের মতো গন্ধ বিলিয়ে যাই??

স্যরি?

ইউ শুড বি স্যরি!

আপনার সঙ্গে কথা বলাই ভুল আসলে!

এই দাঁড়ান কোথায় যাচ্ছেন?

যেখানেই যাচ্ছি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নই!

আলবাৎ বাধ্য। এই ঘর ছেড়ে এক পাও যদি এগোন আমি চিৎকার করে পুরো বাড়ির লোক একত্রিত করবো। আমার গলা সম্পর্কে আপনার আইডিয়া নেই, প্যারেড কমান্ডার হিসেবে ৩বার মেডেল জিতেছি।

জাওয়াদ দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। ঘরভর্তি মেহমানদের সামনে মানসম্মান নষ্ট করার দুঃসাহস ওর নেই। তাছাড়া ওর দাদা সাহেব যদি জানতে পারে ওকে আস্ত রাখবেনা। তাই সে চুপচাপ চেয়ারে বসে পড়লো।

আরওয়া চারদিকে চেয়ে বলল, আহারে স্টার জলসার মতো এ ঘরে সোফা নেই যে বেচারা ঘুমাবে! ইশ আগেই বুদ্ধি করে সেটা যোগাড় রাখতেন, কি যে করেন না আপনি।

জাওয়াদ অগ্নিদৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। আরওয়া সেটা তোয়াক্কাই করলো না। বিছানা ছেড়ে উঠে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে গয়না খুলতে খুলতে বলল, দাদীজান অযথাই কত কি শিখিয়ে দিলো। সে যদি জানতো তার নাতজামাই বাসরঘরে ঢুকে সালাম দেওয়ার বদলে বিয়ে মানিনা বলবে তবে হয়তো অন্য কিছু শিখিয়ে দিতো। আহা এতো টাকার মেকাপ ওয়েস্ট গেল…

জাওয়াদ মনে মনে ভাবতে লাগলো এই মেয়ে এতো হিসাবী? সবকিছু টাকা দিয়ে হিসাব করছে। এ কেমন মেয়েরে বাবা?!

এবার বলি তাদের পরিচয় টা। ফারাজ খন্দকার জাওয়াদ পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ফ্যামিলি বিজনেসে তার মোটেও আগ্রহ না থাকলেও দাদার আদেশে জয়েন করেছে বছরখানেক আগে। ২ভাই আর একবোনের মধ্যে জাওয়াদ বড়, বড় ছেলেমেয়েরা স্বভাবতই বোকা হয়। তার উপর কড়াশাসন পেলে তো কথাই নেই! জাওয়াদের দাদা জোবায়ের খন্দকার বেশ রাগী ও বিচক্ষণ মানুষ। তার কথার বাইরে কথা বলবে এমন কেউ এই পরিবারে নেই। তিনি যদি বলেন সূর্য পশ্চিম দিকে উঠে, সবাইকে সেটাই মানতে হবে। উনার তিন ছেলে আর ২মেয়ের মধ্যে জাওয়াদের বাবা জহির রায়হান ঠিক তার উল্টো চরিত্রের। হাসিখুশি প্রাণবন্ত লোকটা কিভাবে এমন বদমেজাজি লোকের ছেলে হলো এ নিয়ে জাওয়াদের মতো অনেকের মনে প্রশ্ন।
তবে এমন একগুঁয়ে দাদার নাতি হবার সাইড ইফেক্ট হলো নিজের মতামত রাখা তো দূর মতামত ভাবাটাও ওদের কাছে দুঃসাহসিকতা। যে ছেলের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দাদার মতের বাইরে কিছু ই ঘটেনি, তার বিয়েটা নিজের মর্জিতে হবে এ ভাবা বিলাসীতা বৈ কিছুই না।তবুও সে চেষ্টা করেছিল বিয়ের আগে একবার হলেও কথাটা পাত্রীর কানে তুলতে। কিন্তু নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে সেটা আর হয়ে উঠেনি। বহুকষ্টে যা একটু প্রকাশ করলো আরওয়ার রিয়েকশন দেখে ভেতরটা ভীষণ তেতো হয়ে উঠলো বটে! নাহ এই জীবনে ও আর সুখী হবে না…

আয়েশা সিদ্দীকা আরওয়া বাবা মায়ের অতি আদরের সন্তান। সে বেশ‌ চঞ্চল ও স্বাধীনচেতা মেয়ে। পড়াশোনা থেকে শুরু করে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সে নিজের মর্জিমতোন চলেছে। জীবনটা তার কাছে একটা এক্সপেরিমেন্ট ব্যতীত কিছুই না। এই জীবনকে অযথা ওয়েস্ট করার মানেই হয় না। সে চায় জীবনটা উপভোগ করতে, এডভেঞ্চারিং ঘটনায় মুখোরিত রাখতে। তার দাদীজান করিমুন্নেসা নাতনির উচ্ছাসিত জোয়ারে লাগাম টানতেই বিয়ের ব্যবস্থা করেন। এতে অবশ্য তার দ্বিমত ছিল না। বিয়ে মানে আরেক এডভেঞ্চারিং ঘটনা। এর প্রতিটি পরতে পরতে আছে রোমহর্ষক ঘটনাবলি। তাই অনেক উৎসাহ নিয়েই সে বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।


বিয়ের ভারি সাজ ঘষেমেজে তুলে লাগেজ থেকে কাপড় বের করে আরওয়া ওয়াশরুমে গেল ড্রেস চেঞ্জ করতে। বেরিয়ে দেখে জাওয়াদ সেই আগের মতোই হেড ডাউন করে চেয়ারে বসে আছে। আরওয়া তুড়ি বাজিয়ে বললো, ও হ্যালো সারারাত এভাবে বসে ঘুমানোর প্ল্যান করেছেন নাকি?

জাওয়াদ মাথা তুলে বললো, আপনার সমস্যা কি? আপনার কাজ আপনি করুন না, আমাকে অযথা বিরক্ত করছেন কেন?

ওমা আপনাকে বিরক্ত করবো না তো কাকে করবো? দশটা না পাঁচটা না একটামাত্র স্বামী!

দেখুন মিস আরওয়া আপনি অযথাই এসব করছেন, জোর করে কিছু হয় না। আমি আপনাকে ভালোবাসতে পারবো না। আমার মনে আপনার জন্য কোনো অনুভূতি নেই। আপনাকে আমি নিজের স্ত্রী ভাবতে পারছিনা..

কেন পারছেন না? আপনি কি পুরুষ নন নাকি মনে মনে নিজেকে শরীফা ভাবেন?

মানে কি! আমি কখন বললাম আমি পুরুষ নই?

না মানে বিয়ের রাতে এমন সুন্দরী বউকে যে উপেক্ষা করে সে হয় মহাপুরুষ নাহয় নাপুরুষ!
আই মিন হি…..

স্টপ ইট! আপনার মাইন্ড এতো চিপ মাই গড!

উফ কান গেল আমার, আরে মিয়া চিল্লাইয়া কি মার্কেট ফাওন যাইবো? খামোখা চিল্লাইয়েন না তো।

আপনি ঘুমাতে যান তো। আপনার সঙ্গে কথা বলে আমার মাথা ব্যথা করতেছে। অসহ্যকর!

আরওয়া হাই তুলে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, মাথা ব্যথা তো করবেই। যেসব আজেবাজে বুদ্ধি নিয়ে ঘুরেন ব্রেইন বেচারা হাইপার না হয়ে থাকবে কিভাবে?

জাওয়াদ ক্রুর দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো। যেন সে পারলে চোখ দিয়েই এই মেয়েকে ভষ্ম করে দিবে। আরওয়া চেয়ার টেনে বসে কৌতুহলী গলায় বললো, আচ্ছা একটা কথা বলুন আপনার লাভ এফেয়ার আছে? বিয়ে মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন কেন?

আমি আমার ব্যক্তিগত কথা শেয়ার করতে পছন্দ করি না।

আরেব্বাস! আপনি দেখি ভালোই বেকুব। বিয়ে মানে বোঝেন নাকি আন্দাজে কবুল বলেই খালাস? আমাকে যদি না বলেন আমি বুঝবো কিভাবে?

আপনি আমাকে সেই কখন থেকে যা তা বলছেন। আপনার কি মিনিমাম ভদ্রতা জানা নেই?

জানা তো অনেক কিছুই ছিল। আপনার বেলা সেসব প্রয়োগ করা ওয়েস্ট ছাড়া কিছুই না। এমনিতেই আমার অনেক অপচয় হয়ে গেছে, আর খরচ করতে সাহস পাচ্ছি না।

জাওয়াদ উঠে বললো, ওকে ফাইন। আপনার যা ইচ্ছে করুন হু কেয়ার্স।

আরওয়া বিছানায় সাজানো ফুলগুলোর দিকে চেয়ে আফসোস করে বললো, আহারে আমার বিয়ের ফুলগুলো…


পরদিন সকালে নাশতা খাওয়ার পর জোবায়ের সাহেব বাজার থেকে বিশাল বড় একটা রুই মাছ কিনে আনলেন। রেওয়াজ অনুযায়ী নতুন বৌকে এই মাছ কাটতে হবে। আরওয়া বড়বড় চোখ করে মাছটার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে তার দাদীশাশুড়ি সালমা বেগম বললেন, নাতবৌ মাছ দেইখা ডরাইছো? ভয় পাইও না তুমি খালি মাছোর মুড়োডা কুটবা, তোমার শাশুড়ি তোমারে সাহায্য করবো।

আরওয়া মনে মনে বলল, এই মাছ কুটতে গেলে বটি না ভাঙলেই হয়! এতো বড় মাছ আমি আলগাবো কেমনে….

ওর অবস্থা দেখে জাওয়াদের ঠোঁটের কোণে পৈশাচিক হাসি ফুটে উঠলো। একদম ঠিক হয়েছে, এবার মাছ কুটতে না পেরে লজ্জায় পড়ুক ঝগড়ুটে টা। সবার সামনে ভালোই জব্দ হবে।

আরওয়া জাওয়াদের চেহারা দেখে রাগে গা টা জ্বলে গেল। এই ব্যাটা নিশ্চয়ই মনে মনে ভীষণ খুশি হয়েছে। কোনো ব্যাপার না মনু আমিও তোমারে দেখাবো আরওয়া কোন চিজ। মাছ কাটা কোনো ব্যাপার হলো!

শাড়ি সামলে মাছ কুটতে বসতেই সবাই তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। এদের মধ্যে কেউ কেউ ফোনে ভিডিও করতে শুরু করেছে।আরওয়া মনে মনে দোয়াদূরুদ পড়ে মাছটা দুই হাতে তুললো। দাদাশ্বশুড়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, বাজারে সবচেয়ে বড় মাছটাই আপনার আনতে হলো দাদাসাহেব?
তারপর সেটা ধীরে ধীরে কাটা শেষ করলো শাশুড়ির সাহায্যে। সবাই বেশ হৈ হুল্লোড় করে পরিবেশ টা উৎসবমুখর করে তুলেছে।আরওয়া বিজয়ের হাসি দিয়ে মাছ কুটে উঠলো। জাওয়াদ মুখ পাংশু করে সরে গেল।

চলবে….

কনে দেখা আলো পর্ব-২৭ এবং শেষ পর্ব

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_সাতাশ_শেষ_পর্ব

পুলিশ স্টেশনে পা দিয়েই মনে হলো, মাছের হাট বসেছে। কে কাকে ধমকাচ্ছে, কে কাকে সাপের পাঁচ পা দেখাচ্ছে… কিছুই পরিষ্কার না। রেজা আর দুজন স্টাফ তাদের সামলাতে ব্যর্থ হয়ে অন্য কাজে মন দিয়েছে। জামান শিকদার একবার হাজত সেল দুটোতে নজর দিয়ে নিজের রুমে গিয়ে বসল। আজ খুব কর্মব্যস্ত একটা দিন গিয়েছে। রাতটাও যাবে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু একেবারে একটু ঘুমাতে না পারলে কালকের দিনটা সামাল দেওয়া যাবে না। বোঝাই যাচ্ছে আগামিকাল আরেকটা বিগ ডে আসতে চলেছে। সম্ভবত এতদিনের সব অজানা প্রশ্নের উত্তরগুলো আগামিকালই পাওয়া যাবে।

রেজাকে রুমে ডেকে জামান শিকদার বলল, ‘চেয়ারম্যান সাহেবকে যে খবর দিতে বললাম! দাওনি?’
রেজা নিজের ব্যর্থতাকে চাপা না দিয়ে ক্ষেদের সঙ্গে বলল, ‘স্যার বলছিলাম তো! চেয়ারম্যান সাহেব বইলা পাঠাইছেন তিনি আজ এত রাইতে পুলিশ স্টেশনে যাইতে পারবেন না। তার ছেলেরে পুলিশ যা যা জিজ্ঞেস করব করুক। তিনি এইসবের মধ্যে নাই!’
‘রেজা! তুমি পুলিশের চাকরিতে টিকবে কীভাবে আমি বুঝতে পারছি না! আমি কি তোমাকে পাশের বাসার খালাম্মাকে একটু ডেকে আনতে বলেছি? তুমি চেয়ারম্যান সাহেবকে গিয়ে বলবে… আপনাকে পুলিশস্টেশনে যেতে হবে! এটা শোনার পরে সে তোমার কথা না শুনে থাকে কীভাবে?’
রেজা গাঁইগুই করতে থাকে। জামান শিকদার আর কিছু বলে না। রেজার অক্ষমতা যে সে বুঝতে পারছে না তা তো নয়। এসব থানা ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানরা সামান্য কনস্টেবলের কথাতে নড়ে চড়ে না। সে নিজে গেলেও আজ চেয়ারম্যানকে আনতে পারত কী না বলা মুশকিল। আর এনে এখন তাকে কীই বা খাতিরদারি করা হবে? তার চাইতে বরং আগামিকালই আসুক। কমিশনার সাহেব এলে না এসে কে কোথায় থাকে দেখা যাবে!
প্রসঙ্গ পাল্টে জামান শিকদার বলল, ‘রেজা, শোনো আজকের রাতটা আমাদের স্টেশনেই কাটাতে হবে। তুমি আর আমি পালাক্রমে রাত জাগব। একটু ঘুমিয়ে নিলাম ফাঁকে ফাঁকে। কিন্তু পুরো রাত পুরো ঘুমে কাটানো যাবে না। ভয়ানক সব অপরাধীদের আসর বসেছে।
আচ্ছা একটা কথা এই বাবুলের কেসটা কী বলো দেখি? আমি তো তাকে এতদিন চেয়ারম্যান সাহেবের ডান হাত বলেই জানতাম! সে হঠাৎ চেয়ারম্যানের ছেলের বিপক্ষে অবস্থান নিলো কেন বুঝতে পারছি না! আর চেয়ারম্যানের ভাইয়ের খুনির সঙ্গে তার এত মিলমিশ হলো কেমন করে?’
‘আমিও তো এই কথাই ভাবতাছি স্যার! শমসেররে সবাই এত আঁতিপাঁতি কইরা খুঁজল। চেয়ারম্যান খুঁজল তার লোকজন খুঁজল! আর এইদিকে দেখা যাইতাছে সরিষার মইধ্যেই ভূত!’
‘কিছু বলেছে বাবুল? মানে হাজতে ঢোকানোর পরে মুখ খুলেছে কিছু বলার জন্য?’
‘না স্যার সে তো এমনিতেই কথাবার্তা তেমন একটা কয় না। আর আইজ তো মুখে একেবারে কুলুপ আঁটছে!’
‘আচ্ছা থাক। যে যা বলার আগামিকালই বলুক!’

পরিকল্পনামাফিক কেউ ঘুমে কেউ জেগে, সবাই এভাবে ডিউটি করেই রাতটা কাটিয়ে দিলো তারা। সকাল থেকেই শুরু হয়ে গেল অন্যরকম তোড়জোড়। ইতোমধ্যে কমিশনার সাহেব টেলিফোনে জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি অন দ্য ওয়ে! এসপি সাহেবও রওয়ানা দিয়েছেন। সম্ভবত তারা দুজনে একই সঙ্গে কদমপুর পুলিশ স্টেশনে এসে কদম রাখবেন। বসের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এতদিন অনেক লাভ খেয়েছেন এসপি সাহেব। সেই লাভের গুড় এবারে বুঝি পিঁপড়ার পেটে যায়! তাই যতটা সম্ভব কমপেনসেট করার চেষ্টায় আছেন তিনি।
রওয়ানা দেওয়ার আগে এসপি একবার জামান শিকদারের মোবাইলে ফোন দিয়েছিলেন। সেই ফোন ধরে কিছু গালিগালাজ হজম করতে হয়েছে জামান শিকদারকে। ঔষধ মনে করে সেগুলোকে গিলে নিয়েছে সে। এভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেলে ঘোড়া তো একটু মাইন্ড করবেই! চিবিয়ে চিবিয়ে এসপি সাহেব বলেছেন,
‘চাকরির কত বছর হলো? জয়েন করেই হিরো হওয়ার শখ হয়েছে? আমাকে জানালেই পারতা! হিরো বানায়ে দিতাম! আমাকে রিপোর্ট না করে সোজা একেবারে কমিশনার অফিসে জানায়ে বসে আছ? তোমার আগে কত ওসি এলো গেল, তারা কেউ হিরো হয়ে যেতে পারল না… তুমি ধরেই নিয়েছ স্ট্রাটেজি পাল্টে হিরো হয়ে যাবে?’
জামান শিকদার একটা কথারও কোনো উত্তর দেয়নি। উত্তর যে তার কাছে ছিল না এমন তো নয়! সে বলতে পারত, ‘আপনি যদি আপনার কাজটুকু ঠিকঠাকমতো করতেন তাহলে কোনোকিছুই পাল্টাতে হতো না স্যার!’ কিন্তু অধস্তন অফিসারের উচিত কথা বলারও অনুমতি নেই। এটাই মুশকিল!

কমিশনার সাহেব এবং এসপি সাহেব আসার আগেই জামান শিকদারের একবার ভেতরের ঘটনাটা জানার ইচ্ছে হচ্ছিল। তারা আসার পরে তো জবানবন্দি আকারেই সবকিছু শোনা হবে। কিন্তু আন অফিসিয়ালি ঘটনা জানার একটা মজা আছে।
শমসের আর বাবুলকে যে হাজতসেলে ঢোকানো হয়েছিল, সেটার সামনে গিয়ে হাজির হলো জামান শিকদার। বাবুল মেঝেতে শুয়ে ঘুমাচ্ছিল। কিন্তু শমসের ছেলেটা ঘুমহীন চোখে ঠাঁয় বসে ছিল। জামান শিকদার গিয়ে সেলে একটা ঠোকা দিতেই দুজনেই সচকিত হয়ে উঠল। বাবুল শোয়া থেকে উঠে বসল। পরিষ্কার চোখ মেলে সে জামান শিকদারের চোখের দিকে তাকাল। এই ছেলেটার চোখের মধ্যে কী জানি একটা আছে। যতবার এর দিকে তাকিয়েছে, জামান শিকদারের অস্বস্তি কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ছেলেটা যেন একেবারে ভেতর অব্দি দেখে নেয়।
সেই অস্বস্তি কাটাতেই যেন জামান শিকদারও এবারে তার চোখের দিকে সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘তারপর ঘটনা কী বলো দেখি বাবুল, তুমি তো চেয়ারম্যানের দলের লোক। তুমি তার ছেলের পিছে লাগলা কেন?’

বাবুল স্পষ্ট গলায় উত্তর দিলো, ‘চেয়ারম্যান সাব বেবাক কিছু জাইনাও আমারে দিয়া তার পোলার তাঁবেদারি করাইতে চাইছিল। কিন্তু আমি বাবুইল্যা কারো বাপেরডা খাই না। চেয়ারম্যানরে ভালা মনে কইরা তার হুকুম মানতাম। কিন্তু যেইদিন দ্যাখলাম চেয়ারম্যান আসল ঘটনা জাইনা শুইনা নিজের রক্তের মান বাঁচাইতাছে, সেইদিন আর চুপ থাকিনি! যা করা ঠিক মনে হইছে তাই করছি!’
‘কী করছে চেয়ারম্যান? কী জেনে গেছিল?’
‘জাইনা গেছিল তার ভাইয়েরে আসলে কেডায় মারছে!’
‘এই শমসের মারেনি চেয়ারম্যানের ভাইকে?’
‘জে না! শমসের মারব কী! শমসের তো তার পোলা আছিল। পোলা বাপেরে মারব ক্যান?’
এই কথায় ঘরে যেন বাজ পড়ল। শমসের হতবুদ্ধি হয়ে বাবুলের মুখের দিকে তাকাল। তার মুখভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, এই সত্যটা তার অজানা ছিল। বাবুল সেদিকে তাকিয়ে কৈফিয়তের সুরে বলে, ‘হ, আমি এই কথা তর কাছ থেইকা লুকাইছিলাম। কারণ আমার কাছে মনে হইছিল, এইডা জানবার পারলে তুই আব্দুল রফিক সাহেবরে ভুল বুইঝা চইলা যাইবি! আমি এইসব ম্যালা আগে থেইকাই জানি।’

শমশের কাঁপা কাঁপা গলায় বলে, ‘কী জানেন আপনে? তিনি আমার বাপ হইতে যাবেন ক্যান? তিনি আমার বাপ হইলে আমি জানতাম না? আমার মায়ে আমারে মিছা কতা কইত?’
‘তর মায়ের কুনো দোষ আছিল না শমসের। তর মায়েরও দোষ আছিল না, আব্দুল রফিক সাহেবেরও কুনো দোষ আছিল না। তিনি তর মায়েরে বিয়া করছিলেন। বাড়িত আইসা ভাইয়ের কাছে বিয়ার কথাও কইছিলেন। তখন চেয়ারম্যান সাব কইছিলেন, ‘শহরে কারে না কারে বিয়া কইরা আইছস। অখনই এই বিয়ার কথা কাউরে কওনের দরকার নাই।’ ক্যান বিয়ার কথা কইতে নিষেধ করছিলেন এইডা সোজা সরল আব্দুল রফিক সাব বুঝতে পারেন নাই। চেয়ারম্যানের মগজে তখন সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার চিন্তা আছিল। কারণ তার বাপে উইল কইরা গেছিল যদি তার ছোট পোলা বিয়া করে তাইলে সম্পত্তি সমান দুইভাগে ভাগ হইব। কিন্তু যদি বিয়া না করে তাইলে বেশিরভাগ সম্পত্তিই পাইব আব্দুল লতিফ মানে আমাগো চেয়ারম্যান সাব!’

জামান শিকদার এবারে প্রশ্ন করল, ‘এমন অদ্ভুত শর্তের কারণ কী?’
‘কারণ হইতাছে, আব্দুল রফিক সাব তার বাপে বাঁইচা থাকতে বিয়া করবার চান নাই। তাই পোলারে বিয়া দেওনের লাইগা তার বাপে এই বুদ্ধি কইরা গেছিলেন। আর এদিকে চেয়ারম্যান সাবের ঘরে দুই পোলা। বড় পোলার বড় সংসার। ম্যালা পুষ্যি। এত লোকের দেখভালের ভার চেয়ারম্যানের ওপর। তাই ভাই বিয়া করেনি এইটাতে চেয়ারম্যান সাব খুশিই আছিলেন।
কিন্তু যেইদিন আব্দুল রফিক সাব বিয়ার কথা ভাইয়ের কাছ কইয়া দিলেন সেইদিন তার মাথায় আকাশ ভাইঙ্গা পড়ল। ভাইরে উল্টাপাল্টা বুঝাইলেন যে অখন যদি তার বিয়ার কথা গেরামের লোকে জানতে পারে তাইলে তারা তার বউরে মন্দ কইব। নানান হাবিজাবি বুঝ দিয়া তার মাথায় একেবারে সিল মাইরা দিলেন। আব্দুল রফিক সাব শহরে গিয়া বউরে কইলেন তাগো বিয়ার কথা গোপন রাখতে। শমসেরের মায়ে সেই কথা রাখতেই শমসেরের কাছেও কুনোদিন তার বাপের পরিচয় দ্যায়নি।
কিন্তু যেইদিন শমসেরের মায়ে অসুখে মইরা গ্যালো, শমসেরের মাথার ওপরে কুনো ছায়া থাকল না সেইদিন তিনি শমসেররে গেরামে আইনা নিজের ব্যবসার কামে লাগাইয়া দিলেন।’

জামান শিকদার আবার মাঝখানে প্রশ্ন করল, ‘তুমি এতকিছু কীভাবে জানলা?’
‘তাগো দুইভাইয়ের মইধ্যে মাঝে মাঝেই বড় বড় ঝগড়া বাঁধত। সেই ঝগড়ার সময় সেই জায়গায় কেউ থাকত না। কিন্তু চেয়ারম্যান সাব আমারে কাছ ছাড়া করতেন না। তার ভয় আছিল, ছোট ভাইরে ভুজুং ভাজুং বুঝাইয়া রাখছেন এদ্দিন। কুনদিন জানি ছোট ভাই বেবাক কিছুর শোধ তুলে!’
‘খুনটাও কি তাহলে চেয়ারম্যান সাহেবই করিয়েছিল?’ জামান শিকদার উত্তেজনা অনুভব করে।
‘জে না। খুন খারাবি চেয়ারম্যান করেনি। চেয়ারম্যান সাব সম্পত্তির বেলায় পাই পাই হিসাব করলেও তার অন্য দোষ আছিল না। ভাইরে তিনি ভালাও বাসতেন। ভাই মইরা যাওনের পরে বহুত কান্নাকাটি করছেন। এইসব মিছা আছিল না। কিন্তু যেইদিন তিনি সত্যটা জানতে পারছেন সেইদিন তিনি অপরাধীরে পুলিশের কাছে ধরায় দ্যান নাই। উল্টা সেইডারে চাপা দেওনের লাইগা শমসেরের খোঁজ করাইছেন। পুলিশের কাছে শমসেরের নামে বারবার নালিশ দিছেন! এইডা জানতে পাইরা আমি গোপনে দল বদলাইছি। চেয়ারম্যানের লগে থাইকা বেবাক কিছু জাইনা নিয়া শমসেররে জিন্দা রাখছি। ওরে ছাইড়া দিলে চেয়ারম্যান সাব ওরে পুলিশে ধরায় দিত। আমি সেইডা হইতে দেই নাই!’
‘তাহলে কে খুন করেছে আব্দুল লতিফকে?’
‘কেডায় আবার? ঐ বজ্জাত রুবেল… চেয়ারম্যানের ছোট পোলা!’
‘রুবেল খুন করেছে? কে এই ঘটনার সাক্ষী?’
‘ঐ বাড়ির বেবাকেই সাক্ষী! চেয়ারম্যানের শালা মুজিবর গোপনে গোপনে রুবেলের লগে কাম করত। এই খুনের বেবাক আলামত সেই সরাইছে! চেয়ারম্যান সাব এইসবের ব্যাপারে জানত না। বাড়ির বেবাকে তার কাছ থেইকা চাইপা গ্যাছিল। সে জানছে পরে। তদ্দিনে রুবেল সব আলামত গায়েব কইরা দিয়া ব্যবসা বাণিজ্য নিয়া জাঁকাইয়া বইছে। চেয়ারম্যান সাব কিছু করবার গ্যালে রুবেলই নিজের বাপরে শ্যাষ কইরা দিত! এক নাম্বারের হারামজাদা বদ ঐ ছোড়া! মাইয়ামানুষের নেশায় কাড়ি কাড়ি ট্যাকা নষ্ট করে। গঞ্জে গিয়া বেশ্যা মাগিগো পেছনে খরচ কইরা আসে! তাও বিয়া করে না!’
‘রুবেল কেন তার চাচাকে খুন করেছে?’
‘যেইদিন জানতে পারছে চাচা বিয়া করছে আর তার একজন পোলা আছে, সেইদিন থেইকাই তার মাথা খারাপ হইয়া গেছিল। তয় শমসেরই যে সেই পোলা এইডা সে জানত না। জানলে হয়ত শমসেররেও মাইরা ফেলত। আর আরেকটা কারণে সে তার চাচারে সহ্য করতে পারত না!
‘কী সেই কারণ?’
‘আব্দুল রফিক আগর গাছের ব্যাপারটা জাইনা গেছিলেন। এইটা জাইনা তিনি ভাইয়ের কাছে বিচার দিতে আইছিলেন। কিন্তু সেইদিন চেয়ারম্যান সাব বাড়িত ছিলেন না। রুবেল জানতে পাইরা চাচারে গুলি করে। আর মুজিবর সেই বন্দুক নিয়া গিয়া লুকাইয়া ফ্যালে! পরে শমসের আইসা দেখে তার মনিব মাটিতে পইড়া আছে। তখন সবাই মিইলা রটাইয়া দেয় যে শমসের খুন করছে। প্রত্থমে চেয়ারম্যান সাবও এইটাই বিশ্বাস করছিলেন। পরে তিনি সত্যিটা জানতে পারছেন।’
‘আর আগরগাছের ব্যাপারটা কি চেয়ারম্যান জানতেন?’
‘হ এইটাও তিনি জানতেন। রুবেলের লাইগা তিনি কিছু করতেও পারতেন না!’
অর্থাৎ ছেলের জন্য তার হাত পা বাঁধা ছিল?’
‘হ! সেইটাই কারণ!’
বাবুল থামে। পাশে নিথর হয়ে বসে থাকে শমসের। তার চোখ দিয়ে হয়ত নিজের অজান্তেই গড়িয়ে পড়তে থাকে অশ্রু। এমনই অভাগা এক সন্তান সে, নিজের পিতার সাথে দিনরাত থেকেও তাকে পিতা বলে ডাকার সৌভাগ্য হয়নি তার!

চাঞ্চল্যকর এত খবর জানার পরে জামান শিকদার রীতিমত রোমাঞ্চিত হয়ে বসে থাকে। সব নাটের গুরু তাহলে রুবেল!
অন্য সেলটির দিকে আলগোছে একবার নজর বুলায় জামান শিকদার। রুবেল পায়ের ওপরে পা তুলে চোখ দুটো বুজে আধাশোয়া হয়ে আছে। অপরাধের ছিটাফোঁটা গ্লানিও তার চোখেমুখে নাই। জামান শিকদারের পুরো শরীর রি রি করে উঠল। একেই বুঝি বলে জাত অপরাধী! অপরাধ করবে কিন্তু তার আঁচ লাগবে না শরীরে!

জামান শিকদার বাবুলকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘যা কিছু বললে এইসব জবানবন্দি দিতে পারবে তো কোর্টে? ভয় পাবে না তো?’
বাবুল বাঁকা হাসি হাসে। বলে, ‘ভয় আমি পাই না ওসি সাব! ভয় পাইলে চেয়ারম্যানের কোলের মধ্যেই সান্ধাইয়া থাকতাম! আপনে নিশ্চিত থাকতে পারেন! বাঁইচা যদি থাকি, কোর্টে আমারে পাইবেন।’
বাবুলের চোখের দৃষ্টি এখনো একদম স্থির। জামান শিকদার নিজের অজান্তেই চোখ সরিয়ে নিলো।

জামান শিকদারের অনুমানই ঠিক হলো। প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে কমিশনার সাহেব এলেন। এসপি সাহেব এলেন তার প্রায় সাথে সাথেই। দেখে মনে হতে পারে, তিনি বুঝি রাস্তায় কোথাও ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন। কমিশনার সাহেবের গাড়ির দেখা পেয়ে আস্তে ধীরে পিছে পিছে এসেছেন। চেয়ারম্যান সাহেবও তার আগমনের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশস্টেশনে চলে এলেন। তাদের মধ্যে যে পারষ্পারিক ভালো বোঝাপড়া আছে, সেটা আবারো নিজেরাই প্রমাণ করে দিলেন।
জামান শিকদার কমিশনারের কাছে পুরো ঘটনার আদ্যোপান্ত রিপোর্ট করলেন। একেবারে শুরু থেকে যা যা ঘটেছে সবকিছুই খুলে বললেন। চেয়ারম্যান সাহেব এবং তার শ্যালক মুজিবরের বিরুদ্ধেও চার্জশীট দেওয়া হলো। কমিশনারের নির্দেশে দুজনকেই হাজতে ঢোকানো হলো।
আগরগাছের সন্ধানে পশ্চিমের জঙ্গল পরিদর্শন করে আসা হলো। সেই এলাকার আগরগাছ যে এতদিন ধরে কেটে ফেলা হচ্ছে, এই ব্যাপারে এতদিনেও কেন কোনোরকম রিপোর্ট তার কাছে আসেনি…এটা জানতে চেয়ে কমিশনার সাহেব এসপির কাছে মৌখিক কারণ তলব করলেন। জানিয়ে দিলেন শিগগিরই তার কাছে লিখিত শোকজ নোটিশ চলে যাবে।
শুরু থেকেই সবকিছু নিজের দখলে নেওয়ার একটা জোর প্রচেষ্টা ছিল এসপি সাহেবের। কিন্তু পরিস্থিতি যে অনেক আগেই তার হাতের মুঠো গলে বেরিয়ে গেছে, এটা শেষমেশ হাড়ে হাড়ে টের পেলেন। কমিশনার সাহেব তার সঙ্গে ঠিকমত কথা পর্যন্ত বললেন না।
চেয়ারম্যানের শ্যালক মুজিবরের মাধ্যমে মার্ডার উয়েপনও খুঁজে বের করা হলো। মুজিবরের বিরুদ্ধে হত্যার আলামত গায়েব, অপহরণসহ একাধিক অভিযোগ। জামান শিকদার বাদি হয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করল। শমসেরকে আপাতত পুলিশ কাস্টডিতে রাখা হলো। জামান শিকদার তাকে আশ্বস্ত করল সে নিজে উদ্যোগী হয়ে তার জন্য ভালো উকিলের ব্যবস্থা করবে। আর তাছাড়া মার্ডার উয়েপন যখন খুঁজে পাওয়া গেছে তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ করতে সময় লাগবে না।
সবকিছু শেষ হতে হতে বিকেল গড়ালো। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত জামান শিকদার সন্ধ্যায় নিজের আস্তানায় যাওয়ার সুযোগ পেল। সবকিছু যে এত ভালোভাবে সামাল দেওয়া গেছে, এটাই দিন শেষের পরিতৃপ্তি!

পরিশিষ্ট
ফুলি আর ফুলির মা হাসুবিবি অনেকক্ষণ ধরে সুফিয়াদের ঘরের দাওয়ায় বসে আছে। ফুলির কোলে তার সন্তান। সুফিয়া আর জুলেখা কচু শাক তুলে আনতে বাড়ির পাশের ক্ষেতে গেছে। সুফিয়ার মা চুলায় তরকারি বসিয়ে মশলা পিষছে। বাড়িতে আগত দুজনের দিকে তার বিশেষ মনোযোগ নাই। ফুলির মা বারকয়েক ডাকাডাকি করে এখন বসে আছে জুলেখার জন্য। সে এলে যদি কথাবার্তা একটু আগায়!

হনুফা বেগমের মন এখন আগের চাইতে অনেক শান্ত। মাথাটাও বেশ ঠাণ্ডা আছে। কয়েক মাস আগে যেদিন পুলিশের বড় অফিসারেরা তার বাড়িতে এসে সুফিয়ার মাথায় হাত দিয়ে বলেছে, ‘তোমার সাহসের কাছে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট কৃতজ্ঞ’… সেদিন গর্বে হনুফা বেগমের বুক ভরে উঠেছে। বড় অফিসারেরা যাওয়ার আগে তাকে বারবার করে বলে গিয়েছে, ‘মেয়েকে পড়ালেখা করাবেন। আপনার মেয়ে বড় হয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। দুম করে বিয়েশাদী দিয়ে ফেলেন না। মেয়েকে বোঝা না বানিয়ে সম্পদ করে গড়ে তুলুন।’
এত কঠিন কঠিন কথাবার্তা সব সে ভালোমত বুঝতে পারেনি। কিন্তু এটুকু বুঝেছে যে সুফিয়ার বুদ্ধি আর সাহসের সবাই খুব প্রশংসা করেছে। বিয়ে না দিয়ে পড়ালেখা করাতে বলেছে।
হনুফা বেগম সুফিয়ার জন্য পাত্র খোঁজা বন্ধ করেছে। ওসি সাব মাঝে মাঝে এসে খোঁজ নিয়ে যায়। বলে, ‘মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজতে হবে না আপনার। আপনার মেয়ের জন্যই পাত্রের বাবা লাইন দিবে একদিন!’

জুলেখার প্রতিও তার মনটা নরম হয়েছে এখন। সুফিয়া তাকে অনেক বুঝিয়েছে। সুফিয়ার বাবাও কম বোঝায়নি। হনুফা বেগম বুঝিয়েছে নিজের মনকে। তাই তো! জুলেখার তো কিছুই নাই! সে তো একটুখানি ভালোবাসার কাঙ্গাল। সে কেন তাদের পর মনে করবে? সুফিয়া এত ভালোবাসে জুলেখাকে! জুলেখার ভালোবাসার গুণেই তো এমন ভালোবাসা পেয়েছে সে। এতদিন পরে এসে হনুফা বেগম আর জুলেখার সম্পর্কটা একটু সহজ হয়েছে।

হাসুবিবি উশখুশ করতে করতে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘হনুফা বু, জুলেখা গো কি দেরি হইব?’
হনুফা বেগম ভাতের মাড় গালতে গালতে অন্যদিকে তাকিয়ে উত্তর দেয়, ‘কইবার পারি না!’
হাসুবিবি আবার কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল এবারে হনুফা বেগম নিজে থেকেই বলে, ‘আপনে এমুন কইরা বারবার আইসেন না। আমরা কিছু করবার পারুম না। আমার সুফিয়ারে আপনের জামাই উঠাই নিয়া গেছিল। এইটা তো ভুল না। জুলেখা নিজে সাক্ষী দিছে। আপনে তো আমার কথা বিশ্বাস না করেন, জুলেখার কথা তো করেন। তাইলে বারবার আইসা কী করবার চাইতাছেন কন তো?’
‘হনুফাবু, আমার নাতিনটা কেবল হইল। বাপের চেহারাটাও দেখে নাই। অখন যদি জেল হইয়া যায়… আল্লাহয় জানে কবে বাইরাইতে পারব। আপনেরা এই কেস যদি তুইলা নিতেন…’
‘ক্যা কেস তুলুম ক্যা? আমার মাইয়ার যে পেরেশানিটা হইছে সেইডা কিছু না? আর কেস তো পুলিশ করছে! আমরা তো করি নাই!’
আরো দুই চার কথার পরে নিরাশ হয়েই হাসুবিবি আর ফুলি তাদের বাড়ির পথ ধরল। সামনের অনিশ্চিত পথ কীভাবে পাড়ি দিবে এই চিন্তায় মা মেয়ে দুজনেই উদ্বিগ্ন।

জামান শিকদার ইদানিং প্রায়ই এটা সেটা কাজে সুফিয়াদের গ্রামে আসা যাওয়া করে। গ্রামে নাকি ইদানিং চোর ডাকাতের উপদ্রব বেড়ে গেছে। তাই পুলিশের ঘন ঘন এসব জায়গা ঘুরে গেলে ভালো। এতে সবাই একটু টাইট থাকে।
গাড়ি নিয়ে ফেরার পথে জামান শিকদার দেখতে পেল, দূরে সুফিয়া আর তার বোন জুলেখা শাক তুলছে। মোতালেবকে গাড়ি দাঁড় করাতে বলে জামান শিকদার গাড়ি থেকে নেমে এলো। সুফিয়া মুখ তুলে জামান শিকদারকে এগিয়ে আসতে দেখেই এক গাল হেসে বোনের কনুইয়ে একটা খোঁচা দিলো। জুলেখা সামনে তাকিয়ে ওসি সাহেবকে দেখেই অপ্রস্তুত হয়ে মাথায় কাপড় দিতে গেল। জামান শিকদার সেদিকে এক নজর তাকিয়ে সুফিয়াকে বলল, ‘কী স্কুল নাই? শাক তুলছ বসে বসে?’
‘ইশকুল আইজ বন্ধ। আপনে এইদিকে কই আইছিলেন?’
‘আসছিলাম। একটু কাজ ছিল। তা… সুফিয়া তোমার বোন কি কারো সঙ্গে কথা বলে না?’
‘কয় না আবার? তয় অখন আমি থাকলে কইব না। আমি এট্টু ঐদিকের শাক তুইলা আনি। ও বু, কথা কও!’

জুলেখাকে চরম বিপদে ফেলে সুফিয়া সত্যি সত্যিই একটু দূরের ক্ষেতের দিকে এগিয়ে গেল।
জামান শিকদার জুলেখাকে বলল, ‘সেদিন তো অনেক কথা বলেছিলে। এখন এত লজ্জা পাও কেন?’
জুলেখা অধোমুখী হলো। জামান শিকদার মনে মনে ঠিক করে, এবারে মাকে একবার কদমপুর থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে যাবে। মাও অনেকদিন ধরে তাড়া দেয়। তারও বয়স ঘোড়দৌড় লাগিয়েছে। এবারে দুটোকেই বাগে আনতে হবে।
জুলেখার রঙটা একটু চাপা। কিন্তু সেই নিয়ে চিন্তা নেই জামান শিকদারের। কোনো এক কনে দেখা আলোতে যে অপূর্ব আলোকচ্ছটা এসে পড়েছিল জুলেখার মুখে, তা যেন তার ভেতরের সৌন্দর্যটাকেও তার কাছে দৃশ্যমান করে তুলেছে। বাইরের এই চাপা রঙের আড়ালে চাপা পড়া সেই সোনারঙ্গা মুখ জামান শিকদারের মানসপটে আঁকা হয়ে গিয়েছে।

ওদিকে বসে বসে দিনে দুপুরে মশার কামড় খাচ্ছিল মোতালেব। পথচলতি এক পথিক পুলিশের গাড়িকে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘কী হইছে? পুলিশ আইছে ক্যান?’
মোতাবেল বিরক্ত মুখে বলে, ‘তুমাগো গেরামে নাকি চোরের উৎপাতে টেকা যাইতাছে না! এত চোর কই থেইকা পয়দা হইল? ওসি সাব তো চোররে ডর দেখাইতেই রোজ আইতাছেন!’
পথিক কিছু বুঝতে না পেরে হাঁ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চোর মনে হয় ওসি সাবের নিজেগো লোক! আমরা তো কিছু ট্যার পাইলাম না!’
পথিক ফোকলা দাঁতে হেসে নিজের পথ ধরে। মোতালেব গাল চুলকাতে চুলকাতে বলে, ‘আমিও তাই কই! সেইডাই হইব!’

(সমাপ্ত)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-২৬

0

#কনে_দেখা_আলো
#উপন্যাস
#পর্ব_ছাব্বিশ

জামান শিকদার আর রেজা বাঁকটা পার হয়েই তিনজন মানুষের মুখোমুখি হলো। তাদের মধ্যে একজন ধোপদুরস্ত পোশাক আশাকে। তার মুখ দেখা যাচ্ছে না। মুখটা তাদের থেকে পেছন ফিরে রয়েছে। কিন্তু যে দুজনের সঙ্গে সে ধস্তাধস্তি করছে তাদের মধ্যে একজনকে জামান শিকদার চেনে। চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফের একান্ত সহকারী বাবুল। সে এখানে কেন বোঝা যাচ্ছে না! আরেকজনকে জামান শিকদার আগে কখনো দেখেনি। চুল জামাকাপড় উসকোখুসকো। চোখমুখ ভালো বোঝা না গেলেও তাকে একেবারে রাস্তার ছেলে বলে মনে হয় না।
তারা দুজনেই অন্যজনের হাত থেকে পিস্তলটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যেকোনো মুহূর্তেই একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে! মুখ আড়ালে থাকা মানুষটি সাপের মতো হিসহিস করে বলছে, ‘বাবুইল্যা তর এত বড় সাহস! যেই পাত্রে খাস সেই পাত্রেই থুতু দিস! তর কইলজা ছিড়া ফেলুম টান মাইরা! হারামজাদা শুয়োর!’

একটু দূরে সুফিয়া বসে আছে। তার বেশবাস একটু অসংলগ্ন। চোখেমুখে ক্লান্তি আর ভীতির ছাপ স্পষ্ট। সাহসী মেয়েটা একদিনের আধা বেলাতেই কেমন চুপসে গেছে! বিস্ফোরিত চোখে সে এখন এসব কাণ্ডকারখানা দেখছে। আচমকা ভোজবাজির মতো শমসের আর অপরিচিত একজন মানুষ গুদামে ঢুকে পড়েছে। তারা দুজন জানালা গলে ঢুকল নাকি ছাদ ভেঙে মাটিতে পড়ল সুফিয়া জানে না। শুধু মনে হলো তারা যেন সাঁই করে ছুটে এসে তার সামনের ঐ খারাপ মানুষটার ঘাড়ের ওপরে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়ল!
জামান শিকদার শূন্যে গুলি ছুঁড়ে আওয়াজ তোলে, ‘হাতে থাকা অস্ত্র মাটিতে ফেলে দাও নইলে পায়ে গুলি খাবা! কুইক!’ পাশ থেকে রেজা বলে ফিসফিস করে বলে ওঠে, ‘স্যার আগে সুফিয়াকে সরাতে হতো না?’
‘না! এখন সুফিয়ার কাছে গেলে হামলাকারী আরো মরিয়া হয়ে উঠবে। গুলিও করে বসতে পারে! তুমি ওর দিকে না তাকিয়ে সামনে দেখো!’ জামান শিকদারও ফিসফিস করে বলল। রেজার অপটু আচার আচরণে তাকে বেশ ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে।
জামান শিকদার গুনতে শুরু করে। ‘ওয়ান টু থ্রি …’ তিন গোণার পরপরই অস্ত্রধারী অস্ত্র ফেলে দিয়ে হাত ওপরে তুলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তারপর ধীরে ধীরে পেছনে ঘোরে, একেবারে জামান শিকদারের মুখোমুখি!

অন্তরালে থাকা মানুষটার মুখ দেখেই চমকে ওঠে জামান শিকদার! হাতে ধরে রাখা পিস্তলটা পড়েই যাচ্ছিল আরেকটু হলে!
এ কী! এ যে চেয়ারম্যানের ছোটছেলে রুবেল! এই এতসব কারবার….. সুফিয়া অপহরণ, জঙ্গলের আগরগাছ কেটে ফেলা, বাইরে পাচার করা সব তাহলে রুবেলের কাজ? কিন্তু বাবুল তাহলে কী করছে এখানে? সে দেখা যাচ্ছে রুবেলকে আটকানোর চেষ্টা করছে। তাহলে কি চেয়ারম্যান সাহেব সব আগে থেকেই জানত এবং তিনিই বাবুলকে পাঠিয়ে দিয়েছেন রুবেলকে আটকানোর জন্য? তাহলে তিনি সেটা জামান শিকদারদের কাছে স্বীকার করলেন না কেন? হয়ত সম্মান হারানোর ভয়ে স্বীকার করেননি!
‘রুবেল! আপনি? এই আড়ত আপনার দখলে? ওহ হ্যাঁ… মনে পড়েছে… তাই তো বলেছিলেন একদিন! আড়ত আপনে সামলান। তা এই আড়তে কাপড় কই? আপনার চাচার না কাপড়ের ব্যবসা ছিল? কাপড়ের ব্যবসা তুলে দিয়ে এখন কি তাহলে আগরকাঠের ব্যবসা শুরু করেছেন?’

রুবেল অগ্নিদৃষ্টিতে জামান শিকদারের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দিয়ে আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। সাপের মতো হিসহিসে গলায় বলল, ‘কাজটা ঠিক করলেন না আপনে ওসি সাব! আমার হাত কত দূর পর্যন্ত যাইতে পারে, আপনি এখনো টের পাননি! চাকরি তো খোয়াবেনই, মান সম্মান নিয়ে আর বাড়ি ফিরতে পারবেন না!’
‘ওহ হ্যাঁ একটু আগে আরেকজনও এই কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন। আপনার একজন মাসতুতো ভাই। আমার চাকরি আর মান সম্মান নিয়ে কত চিন্তা আপনাদের! মনের মধ্যে নানারকম কৌতূহল হচ্ছে। আপনার বাবার এই খাস খেদমতদার বাবুল আপনাকে আটকাচ্ছিল কেন? আর বাবুলের সঙ্গে এইটা কে? একে তো আগে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না!’
‘আগে দেখবেন কীভাবে? আসল কাজ না করে এদিক ওদিকের কাজ করে বেড়ালে যা হয়! এই শালা বাবুলই তো হারামিটা করেছে! এই হারামির জন্যই আমার এতদিনের এত সূক্ষ্ণ হিসাবনিকাশ সব বানচাল হওয়ার দশা! বাবার চাকরি করে তার চোখে ধুলা দিয়ে এটা মীরজাফরগিরি করেছে! আর এই ছেলেকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে আপনার? হবেই তো! এই হচ্ছে আমরা চাচার খুনি শমসের! নেন এ্যারেস্ট করেন। এ খোলা হাওয়ায় ঘুরে বেড়াবে আর আমি আটক হব, এতটা আশা করলেন কীভাবে?’

রুবেলের একদম শেষ কথাগুলো জামান শিকদার শুনতে পায়নি। শমসেরের নাম শুনেই চমকে উঠেছে। এই সেই খুনি শমসের! এ এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল? এখন এখানে কোথা থেকে এসে হাজির হলো? উফ সব জট পাকায়ে যাচ্ছে! জামান শিকদার আর চিন্তা করার দিকে গেল না। রেজাকে নির্দেশ দিলো, ‘সব কয়টাকে ধরে গাড়িতে তোলো। সবাইকে! এই গুদামের একজন বান্দাও যেন কোথাও লুকিয়ে না থাকে। বাবুল আর শমসেরকেও গাড়িতে ওঠাও। পুলিশস্টেশনে গিয়ে তাদের বক্তব্য শুনব। গুদাম সিল করে দাও। দ্রুত সবাইকে কাজে নামতে বলো! কুইক!’

সবাইকে গাড়িতে ওঠানোর পরে জামান শিকদার সুফিয়ার কাছে গেল। সস্নেহে কোমল গলায় বলল, ‘সুফিয়া, ভয় পাওনি তো? আমাদের একটু দেরি হয়ে গেছিল। তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি তো সুফিয়া?’
সুফিয়া আচমকা স্থানকাল ভুলে ভ্যা করে কেঁদে দিলো। তার কান্না দেখে জামান শিকদার একটু ভয় পেয়ে গেল। তবে কি তারা পৌঁছাতে বেশিই দেরি করে ফেলেছে? সুফিয়ার কি ক্ষতি করেছে কোনো?’
‘সুফিয়া কী হলো কাঁদছ কেন? আরে বলো আমাকে! সবকিছু খুলে বলো!’
‘না সাব আমার কিছু করতে পারেনি। কিন্তু আর বেশি দেরি হইলে কী হইত জানি না…’
‘ওহ তাই বলো!’ জামান শিকদার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

পুলিশষ্টেশনে পৌছার পরে সুফিয়াকে রেখে আসার জন্য কয়েকজন পুলিশকে নির্দেশ দিতে গিয়েও জামান শিকদার থামল। কারো ভরসাতেই সুফিয়াকে পাঠানো ঠিক হবে না। সে নিজে গিয়েই তাকে রেখে আসবে। এই আমানত আগে ঠিকমত যথাস্থানে পৌঁছে দিতে হবে। তারপর অন্য কাজ।
গুদামে যাদেরকে পাওয়া গিয়েছিল সবাইকেই হাজতে ঢোকানো হলো। শমশের আর বাবুলকে আলাদা একটা ছোট কামরার হাজতে ঢোকানো হলো। রুবেল যেরকম বিষ নজরে বাবুল আর শমসেরের দিকে তাকাচ্ছিল, তাতে জামান শিকদার আশংকা করল রাতেই কিছু না একটা অঘটন ঘটে যায়।
রুবেল আর তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে একই কামরার হাজতে কনস্টেবল শরফুদ্দিনেরও ঠাই হলো। তাকে হাজতে ঢুকিয়ে রেজা একটু ভয়ে ভয়ে টিপ্পনী কাটল। ‘স্যার কী কামডা করলেন যে নিজেগো হাজতে নিজেরই ঢুকতে হইল!’
শরফুদ্দিন খেঁকিয়ে উঠল, ‘ঐ হারামজাদা নিজের কাম কর চুপচাপ! বেশি পিন মারলে এইখান থেইকাই তর গলা চাইপা ধরুম! তর বাপে আইসাও ছুটাইতে পারব না!’
রেজা সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে চুপ মেরে গেল। যেরকম বেপরোয়া লোক কিছুই বলা যায় না! একে না ঘাঁটানোই ভালো!
জামান শিকদার সুফিয়াকে রেখে আসার জন্য রওয়ানা দেওয়ার আগে বলল, ‘রেজা, কাউকে দিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবকে আজ আমাদের গরীবালয়ে ডেকে পাঠাও। বলো তার সুপুত্র আজ আমাদের অতিথিশালায় রাত কাটাবেন। তিনিও চাইলে ছেলেকে সঙ্গ দিতে পারেন!’

সুফিয়াকে তার বাড়িতে নামিয়ে দিতেই সেখানে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের অবতারণা হলো। সুফিয়ার মা-বাবা ছুটে এসে মেয়েকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। সেই সঙ্গে বিলাপ আর প্রলাপের মাতম চলল কিছুক্ষণ। আশেপাশে কে দাঁড়িয়ে আছে না আছে সেটা নিয়ে তার কিছুমাত্র মাথাব্যথা নেই। অবিশ্রান্ত মুখের কথা তার শেষ হতে চায় না, ‘ওহ আল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌ গো না জানি আমার মাইয়াটার ওপর দিয়া কত ঝড় গ্যাছে গো আল্লাহ্‌! কুন হারামজাদা আভাগীর পুত আমার মাইয়ার এমুন সর্বনাশ করল গো আল্লাহ তারে তুমি ছাইড়া দিয়ো না আল্লাহ্‌! তার চৌদ্দ গুষ্ঠিরে তুমি বিনাশ কইরা দিয়ো!…’
নেয়ামত উল্লাহ বউকে এই অবস্থাতেও তিরস্কার করে, ‘চুপ করো হনুফা! মুখ দিয়া কি কুনো ভালা কথা আসে না তুমার? সবসময় মাইনষেরে গালাগালি আর অভিশাপ দেওয়া!’
হনুফা বেগম এবারে আর স্বামীর কথায় চুপ করে না। উল্টা ঝাঁঝের সঙ্গে বলে, ‘হ আপনে তো কইবেনই এই কথা! আমার মাইয়ার কিছু হইলে আপনের কী! আপনের বড় মাইয়া ঠিক থাকলেই আপনে ঠিক! ছুডো মাইয়ার যদি ভালা চাইতেন, তাইলে আইজ এই দিন আমার দেখোন লাগত না! আমার মাইয়াডার উপর দিয়া না জানি কী ঝড় গ্যাছে!…’

জামান শিকদার পুলিশ হয়েও এমন পরিস্থিতিগুলো সাধারণত এড়িয়ে চলেন। ভিক্টিমের পরিবার আবেগের কারণে এমন এমন কাজ করে ফেলে যে, তাদের থামানো যায় না। পুলিশ কেন আগে কিছু করতে পারল না, এমন অভিযোগও প্রায়ই শুনতে হয়।
সুফিয়া বিরক্ত হয়ে মাকে বলল, ‘আহ মা থামো তো! না জাইনা শুইনা কী না কী কইতাছ! আমি ঠিক আছি। আমার কুনো ক্ষতি হয়নি!’
এই কথাতেও হনুফা বেগম থামতে পারেন না। বাইরের মানুষের সামনেই সুফিয়ার শরীরে হাত দিতে দিতে বলেন, ‘তুই হাছা কইতাছ আমার কিরা কাইটা ক! মায়েরে বুঝ দেওয়নের চেষ্টা করবি না!’
এবারে সুফিয়াও বিব্রত। ‘মা, কী করতাছ? ওসি সাব আইছেন। খাড়াইয়া আছেন। একটু বইতে দাও। আইজ তেনারা না থাকলে জানি না কী হইত! বুবু কই বুবু?’
শেষের কথাতে হনুফা বেগমের মুখে যেন কালি লেপে দেয় কেউ! এত কিছু ঘটে যাওয়ার পরেও বুবুর নামটা মাথা থেকে সরে না! চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘হ ওখনো তোমার বুবু বুবু করোন লাগে! এত কিছু হইয়া গ্যালো তোমার বুবু কী করছে তোমার লাইগা? বইসা বইসা মজা দ্যাখছে আর কান্দনের নাটক করছে! আর তুমি আইসাই বুবু কই… বুবু কই! রামগাধি হইছে একটা!’

জুলেখা ঘরের এক কোণে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। সুফিয়া আসার কথা জানতে পেরেই সে তার ঘর থেকে ছুটে এসেছে। দূর থেকে সুফিয়াকে দেখতে পেয়ে তার চোখের পানি আর বাঁধ মানেনি। নতুন করে তাতে যেন বান ডেকেছে। সুফিয়ার কোনো ক্ষতি হয়নি শুনে সে মনে মনে বারবার আল্লাহ্‌র শোকরিয়া আদায় করছে। কিন্তু এখন যেন সুফিয়ার সঙ্গে তার যোজন যোজন দূরত্ব। ঐটুকু পথ সে কীভাবে অতিক্রম করে বোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, জানে না। তার ওপরে সৎ মায়ের অকথা কুকথা তো আছেই! বোনের মুখের নিজের নাম শুনে ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে। অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করে ঘরের কোণে লুকিয়ে থাকে জুলেখা।
জামান শিকদার সুফিয়ার মায়ের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে, এখানে একটা ‘গল্প’ আছে। কিন্তু সেই গল্পের মধ্যে বাহিরের একজন হয়ে সে ঢুকতে পারে না। সম্ভবত সুফিয়া আর তার বোন দুই মায়ের মেয়ে। সেই জন্যই বড় মেয়ের প্রতি এত বিতৃষ্ণা সুফিয়ার মায়ের। আবার ওদিকে বোনের প্রতি সুফিয়ার ভালোবাসা সজীব। সেই বোনের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েই সুফিয়াকে অপহরণ করা হয়েছে। সৎ বোনের প্রতি সুফিয়ার এই ভালোবাসায় হনুফা বেগমের সেজন্যই এত তীব্র বিরাগ!

জামান শিকদার পুলিশস্টেশনে ফেরার তাগিদ অনুভব করে। সেখানে আজ কী সার্কাস অপেক্ষা করে আছে কে জানে! কিন্তু এখানেও মনে হচ্ছে পারিবারিক সংঘাত আসন্ন। জামান শিকদার একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘দেখুন আমি এর মধ্যে কথা বলতে চাচ্ছি না। এটা আপনাদের পারিবারিক ব্যাপার। তবে সুফিয়ার ব্যাপারে আমরা হয়ত জানতে জানতে অনেক দেরি হয়ে যেত যদি সুফিয়ার বড় বোন আমাদের পুলিশ স্টেশনে না আসতেন। আর আজকের দিনটা পার হয়ে গেলে কী হতো, বলা মুশকিল। হয়ত সুফিয়ার অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। তাই না জেনে… ’
হনুফা বেগমের কথা আজ যেন থামবেই না। সে এই কথার মাঝখানেই বলে উঠল, ‘হ গ্যাছে ভালা করছে। আকাম নিজে করাইয়া নিজেই গ্যাছে পুলিশে খবর দিতে!’
‘এত নিশ্চিত হয়ে আপনি কীভাবে বলছেন এসব? যাই হোক… আমি আর কথা না বাড়াই। নেয়ামত সাহেব, মেয়েদের যত্ন নিবেন। তাদের খোঁজখবর রাখবেন। আশাকরি এমন ঘটনা আর কখনো ঘটবে না। আর সুফিয়া এরপর থেকে সাবধানে চলাফেরা করবে। মন দিয়ে পড়াশুনা করবে, আর শোনো বনে জঙ্গলে কম ঘুরাঘুরি করবে!’ বলেই জামান শিকদার একটু ঘরের দিকে চোখ তুলে তাকায়। তার দৃষ্টি যেন কাউকে খুঁজে ফেরে। সুফিয়া সেটা বুঝতে পেরে জোরে ডাক দেয়, ‘জুলেখাবু, ওসি সাব তোমারে বুলায়!’
জামান শিকদার ভ্রু কুঞ্চিত করে সুফিয়ার দিকে তাকায়। এই মেয়েটা একেবারে দিনদুনিয়ার নিয়ম মানে না। এইমাত্র কী ঘোর বিপদ কাটিয়ে এলো সেটা সে একেবারেই ভুলে বসে আছে!
কিন্তু তার ডাকাডাকিতেও কেউ আসে না। একটু যেন নিরাশ হয়েই জামান শিকদার নিজের পথ দেখে। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-২৪+২৫

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_চব্বিশ

(আজকের পর্বের কিছু বর্ণনা একটু অস্বস্তিকর। তবে আমি ১৮+ ট্যাগ লাগাচ্ছি না। কারণ ১৮ বছর বয়সের নিচের কেউ পড়ছে বলে আশা করছি না। আর অল্পবয়সী মেয়েদের কিছু ব্যাপারে সতর্ক থাকারও দরকার আছে। তারা পড়লে ক্ষতির কিছু নাই। উত্তেজনা সৃষ্টিতে রগরগে বর্ণনা আমি কখনোই দিই না।)

‘কই দেখি তো কেমুন তেজি মুরগি ধইরা নিয়া আইছস? খুব নাকি তেজ মাইয়ার! মাইয়া মাইনষের তেজ না থাকলে কি মানায় নাকি? দেখি দেখি… ঘোমটা খোলো… ঘোমটা খোলো… দেখি গো! ওহহো! ঘোমটাই তো নাই! এইডা কেমুন কথা হইল? ঐ তরা একটা ঘোমটার ব্যবস্থা করবার পারিস নাই? এইরাম কইরা শুভদৃষ্টি হইল?’
ওস্তাদের কথা শুনে তার আস্তানার বিশেষ আয়োজনে উপস্থিত সবাই খুব একচোট হেসে নিলো। মাঝে মাঝে ওস্তাদ এমন মজার মজার সব কথা বলে!

জ্ঞান ফেরার পর থেকে সুফিয়া নিজেকে এখানে আবিষ্কার করছে। জায়গাটা বেশ বড়সড়। চারপাশে গাদাগাদি করে অনেক গাছের খণ্ড স্তূপ করে রাখা। কিছু জায়গায় সেগুলো দিয়ে সিঁড়ির মতো তৈরি করা হয়েছে। সেই সিঁড়ি নানাকাজে ব্যবহার হচ্ছে। ওপরে টিনের ছাদ। সিলিঙয়ের ওপর থেকে দড়ির মতো কিছু জিনিস দিয়ে বড় বড় বাল্ব ঝোলানো আছে। এরপর প্রায় নয় দশটা কী তারও বেশি বাল্ব পুরো ঘরটাতে। সেগুলোর আলোয় জায়গাটা যথেষ্ট আলোকিত। পায়ের নিচে কাদামাটি। কিছু জায়গা শুকনোও আছে। চারপাশের প্রশস্ততা দেখে বোঝা যায়, এটা কিছুতেই লোকজনের চোখের আড়ালে থাকার মতো কোনো জায়গা না। কিন্তু সুফিয়া এরকম জায়গা কোথাও দেখেছে বলে মনে করতে পারল না।
জ্ঞান ফেরার পরে বেশ অনেকটা সময় সুফিয়ার মাথাটা ঝিম মেরে ছিল। চোখের সামনে তখনো সর্ষে ফুল দেখছে সে। চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। সুফিয়া চেঁচামেচি না করে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখছিল। সে এখানে এলো কেমন করে? এখন কয়টা বাজে? এই বিশাল জায়গাটা আলোকিত হয়ে থাকলেও জানালার ফাঁক দিয়ে বাইরের ঘুটঘুটে অন্ধকার ঠিকই চোখে পড়ছে। তার মানে এখন রাত! এত রাতে সে এখানে কীভাবে এসেছে?

ধীরে ধীরে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল। সুফিয়া আজ গিয়েছিল তার বান্ধবী ফুলির বাসায়। সে একা যায়নি, জুলেখাবুও গিয়েছিল। ফুলির জামাইয়ের ছাগলামি আর ফুলির সেই ছাগল জামাইকে নিয়ে আদিখ্যেতা দেখতে দেখতে মনে মনে ভাবছিল, জীবনে কোনোদিনও বিয়ে করবে না। আসার পথে জুলেখাবুকে সেই কথাটাই বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এমন সময় … কী জানি একটা হলো! আচমকা কী একটা যেন ছুটে এলো তার দিকে… তারপর… আর কিছু মনে নাই। জ্ঞান ফেরার পরে দেখছে সে এখানে!
তাহলে কি কেউ তাকে উঠিয়ে এনেছে? কী জন্যে উঠিয়ে এনেছে? খারাপ উদ্দেশ্যে? কী সর্বনাশের কথা!

যে জায়গাটা দিয়ে তারা আসছিল সেই বিলের কাছে এর আগেও এরকম ঘটনা ঘটেছে। জুলেখাবু কখনোই ঐ রাস্তা দিয়ে রাতে কোথায় যাওয়া আসা করতে চায় না। সুফিয়াই তাকে আশ্বাস দেয়, ‘তুমার খালি আজাইরা ভয় বু! এইডা আমাগো গেরাম! এইখানে আমাগো ক্ষতি করব এইরাম কেউ আছে নাকি?’
কিন্তু বোঝা যাচ্ছে, তার ধারণাটা ঠিক ছিল না। ক্ষতি করার মানুষ কখন কোথা থেকে এসে যে হাজির হয়ে যায়, কেউ বলতে পারে না!
জ্ঞান ফেরার পরে সে ভয়ে ভয়ে নিজের শরীরের দিকে তাকায়। কেউ কি এর মধ্যেই তার ক্ষতি করে গেছে? মন আশ্বস্ত করে, সে ঠিক আছে। কিন্তু কতক্ষণ ঠিক থাকবে কে জানে! জীবনে ভয়ডর শব্দগুলোর সাথে ওর সেভাবে আলাপ পরিচয় ছিল না। একা একা জঙ্গলে বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছে। দেউ, বুনো জন্তু এমনকি মানুষ… কাউকেই ভয় করেনি কখনো। কেউ ‘ভয় পাস না?’ বললে ওর হাসি পেত। মাঝে মাঝে বিরক্তও লাগত। ভয় কীভাবে পায় কে জানে! মানুষ এই ভয়ের কথা ছাড়া আর কিছুই কেন জিজ্ঞেস করতে পারে না কতদিন ভেবেছে সুফিয়া!
কিন্তু এই প্রথম সে বুঝতে পারছে ভয় কাকে বলে! ভয় মনের মধ্যে কীভাবে ঘুরপাক পায়! কেমন করেই বা সেটা ছড়িয়ে পড়ে!

কয়েকটা ষণ্ডামতো চেহারার লোক ঘরের মধ্যে আছে। সংখ্যায় তিন চারজন হবে। সকলেই এক দৃষ্টিতে তাকে দেখছে। চোখের দৃষ্টি কেমন জানি অস্পষ্ট। সেখানে খারাপ কিছু আছে হয়ত, কিন্তু সেটা খুব বেশি স্পষ্ট না। লোকগুলোকে দেখতে দেখতে নিজের হাতের দিকে তাকালো সুফিয়া। কী আশ্চর্য! ওর হাতদুটো খুলে রাখা। শরীরের কোথাও কোনো বাঁধন নাই। যারা ওকে আটকে রেখেছে, তারা হয়ত ভালোমতোই জানে, এখান থেকে সে কিছুতেই পালাতে পারবে না। তাই আলাদা ব্যবস্থা নেয়নি।
সুফিয়াকে নিজের হাতের দিকে তাকাতে দেখে লোকগুলোর একজন বলে, ‘ঐ ব্যাটা ছেমড়ির হাত খুইলা রাখছস ক্যা?’
‘ওস্তাদ বান্ধতে মানা করছে। খুইলা থুইলেই কী না থুইলেই কী! ওর এই দুইনার খেল খতম! নড়ন চড়ন হাউশ মাউশ বেবাক শ্যাষ!’
সুফিয়ার পিঠের ওপর দিয়ে কুল কুল করে কীসের যেন শীতল ধারা নেমে গেল। কী বলছে এরা? কী বোঝাতে চাইছে? ওকে কি মেরে ফেলবে? কিন্তু কেন?
‘ছেমড়ি কী করছে?’
‘বহুত গ্যাঞ্জাম করছে। আমাগো রুটিরুজির দিকে হাত বাড়াইছে! এমুন সাহস ছেমড়ির! পুলিশরে গিয়া কইয়া দিছে আমরা আগরগাছ কাটতাছি!’
‘জানল ক্যামনে? আগরগাছের কথা তো গেরামের মানুষে জানে না!’
‘কী জানি! ছেমড়ি মনে হয় জাদুটোনা জানে!’

ওহ আচ্ছা! এই লোকগুলোই তাহলে আগরগাছ কেটে আনে। কেটে এনে এখানে স্তূপ করে রাখে। পরে অন্য জায়গায় পাচার করে। কিন্তু এদের মাথা কে? এত বড় জায়গা এরা গ্রামের মধ্যে কীভাবে জোগাড় করল? অবশ্য গ্রামে জায়গা জোগাড় করা তো কোনো ব্যাপার না! কিন্তু যেটা ব্যাপার তা হলো, এদের এই জায়গার কথা আগে কেউ জানেনি কেন?
ভয় ভুলে থাকার জন্য সুফিয়া নানাভাবে মাথাটাকে খেলানোর চেষ্টা করে। লোকগুলোর কথাই ঠিক। সে এখান থেকে হাজার চেষ্টা করলেও পালাতে পারবে না। এই বিশাল জায়গার চারপাশে এদের লোকজন ছড়িয়ে আছে। এত বড় ব্যবসা ফেঁদে রেখেছে, এটা নিশ্চয়ই এই মাত্র তিন চারজনের কাজ না!
বেশিদূর ভাবতে পারল না, তার আগেই বাইরে গাড়ির আওয়াজ শোনা গেল। আর তার পরপরই ‘দেখি তো কেমন তেজি মুরগি’ বলতে বলতে এই লোক এসে হাজির হয়েছে।

ভয়ে সুফিয়ার গলা পুরোপুরি শুকিয়ে এসেছে। লোক না বলে ছেলে বললেই ভালো হয়। ছেলেটা দেখতে শুনতে ভদ্রঘরেরই মনে হচ্ছে। অথচ কী নোংরা ভাষায় কথা বলছে! কী বিশ্রী চোখে ওর দিকে তাকাচ্ছে!
ছেলেটা কি এখন ওর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়বে? কী করবে সুফিয়া তখন? বিনা বাঁধায় নিজেকে এর হাতে ছেড়ে দিবে? না না এটা কেমন করে হয়! প্রাণপনে ভাবতে চেষ্টা করে সুফিয়া। কিছুই কি নাই? নিজেকে একটুখানি বাঁচানোর কোনো হাতিয়ার?
কোমরের কাছে হাত দিয়ে কী যেন বাধে তার হাতে। বড় সেফটিপিন! শাড়ি সামলে রাখতে পারে না দেখে জুলেখাবু জোর করে ওর শাড়িতে সেফটিপিন গুঁজে দিয়ে শক্ত করে আটকে দেয়। ছোট সেফটিপিন খুলে আসে দেখে নিজে হাটে গিয়ে বড় দেখে সেফটিপিন কিনে এনেছে জুলেখা।
মিশমিশে অন্ধকারে সেই সেফটিপিনটাকেই মনে হয় একমাত্র আলোর দিশা। সুফিয়া আলগোছে সেফটিপিনটাকে খুলে নিজের হাতের মুঠোয় লুকিয়ে রাখে।

‘কী গো মাইয়া কথা কও না ক্যান? রাগ করছ? ওহ হো, এত লোকের মইধ্যেখানে ভয় পাইতাছ? ঐ ব্যাটারা রাম শাম যদু মধু… যারা যারা আছোস সব বিদায় হ এইখান থেইকা! দেখতাছোস না আমি একটা তেজি মুরগির লগে ইশক করতাছি? তরা চোখ দিয়া বইসা থাকলে কি তেজি মুরগিরে পোষ মানাইতে পারুম? ঘাড় ঘুরাইয়া উড়ান দিব না? আর শোন, কনস্টেবল শরফুদ্দিন ব্যাটা আইতে পারে। হারামজাদার তেজি মুরগির ঝাল মাংস খাওনের শখ হইছে। আইলে কইবি খাঁড়ায় থাকতে। আগে আমি তো খাইয়া লই!’
একটা হাসির হিল্লোল তুলে অন্য লোকগুলো বিদায় নিলো। হয়ত আশেপাশেই অবস্থান নিলো। একবারে তো চলে যাওয়ার কথা না!
কনস্টেবল শরফুদ্দিনের নাম শুনেই সুফিয়ার মাথায় হাজার বিদ্যুতের ভোল্ট চলে গেল। পুলিশস্টেশনে গিয়ে শরফুদ্দিনকে দেখার পর থেকেই তার বারবার মনে হচ্ছিল, এই লোকটা সুবিধার না। কেমন করে জানি তাকায়, কেমন জঘন্য ভাষায় কথা বলে! শরফুদ্দিনের ভাবসাব দেখে সুফিয়ার মনে হচ্ছিল, সে পুলিশকে খবরটা দিয়েছে দেখে শরফুদ্দিন কেমন জানি সেটাকে ভালোভাবে নেয়নি! এই সহজ ব্যাপারটা সুফিয়ার মতো একটা এলেবেলে গ্রামের মেয়ে বুঝতে পারল, আর ওসি সাহেব বুঝতে পারল না? সুফিয়ার দুঃখে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন আর এসব ভেবে কী হবে? সবকিছুই তো শেষ হয়ে যাবে এই হয়ত আর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই!

ছেলেটা এগিয়ে এসেছে খুব কাছে। সুফিয়া তার নিঃশ্বাসের গন্ধ পাচ্ছে। ওয়াক থু! গন্ধে বমি এসে যাচ্ছে তার! ছেলেটা মদ খায়! সুন্দর পোশাক পরা একটা ছেলে। অথচ কী বদখত স্বভাব!
‘কী গো মাইয়া! আমার তেজি মুরগি! দূরে দূরে সইরা থাইকা কি বাঁচতে পারবা? আইজ তুমারে এট্টু আদর সোহাগ কইরা দিই। জীবনে আর পাও কী না পাও…’
খুব কাছে থেকেই মিলিত হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। সেই সঙ্গে অশ্লীল কিছু কথাবার্তা। ‘ওস্তাদ, মাল নতুন। একটু আস্তে কইরেন যা করোনের! খিক খিক খিক…’
‘এ্যাই চুপ থাক শালারা! খালি ডিস্টার্ব করোস কামের সময়! আসল কাম এই লড়কী কইরা দিলো, আর তরা বইসা বইসা দুদু খাইলি!’
ছেলেটা আরো কাছে এগিয়ে আসছে। এবারে তার হাতদুটোও ক্ষিপ্রগতিতে ওঠানামা করতে শুরু করেছে সুফিয়ার শরীরে। সুফিয়া তার হাতে শক্ত করে চেপে ধরে আছে সেফটিপিনটা। সুফিয়ার চোখের দৃষ্টি সরাসরি ছেলেটার চোখের দিকে। নিজেকে বাঁচাতে হয়ত পারবে না, কিন্তু এই শয়তানের কোনো ক্ষতি না করে সে নিজের এতটুকু ক্ষতি হতে দিবে না!

নিজেকে বাঁচানোর ক্ষীণ আশা থেকেই সে আচমকা একটু বুদ্ধি করল। ছেলেটার মনোযোগ একটু অন্যদিকে সরানোর ইচ্ছে নিয়ে বলল, ‘শরফুদ্দিন বইলা কার কথা কইতাছিলেন? পুলিশে চাকরি করে?’
ছেলেটা একটু যেন থামল। কৌতুকপূর্ণ চোখে তাকালো সুফিয়ার দিকে। চেহারাতে একটা বিস্ময়সূচক হাসি ঝুলিয়ে রেখে বলল, ‘বাব্বাহ তুমি তো মাইয়া আসলেই তেজি মুরগি! এইরকম অবস্থায়ও মাথা খ্যালতাছে! হাহা হা… নাহ তুমারে আর দশটা মাইয়ার মতো একইরকম ভাবে ট্রিট করোন যাইব না! তুমি হইলা গিয়া স্পেশাল জিনিস! তুমারে আলাদা মশলা দিয়া রান্ধতে হইব! খাঁড়াও, তুমারে আগে এই জায়গা থেইকা ভালা কুনো জায়গায় নিয়া যাওনের ব্যবস্থা করি। শাড়িকাপড়ও তো ময়লা হইয়া আছে! অবশ্য কাপড়চোপড়ের আর দরকার কী ওহন! হি হি হি… যাই হোক তাও তুমারে একটু আলাদা খাতির দেওন দরকার! খাঁড়াও আইতাছি…’
বলেই ছেলেটা সরে গেল সুফিয়ার কাছ থেকে। এক ঝলক মুক্ত বাতাসে আবার নাক টেনে শ্বাস নিলো সুফিয়া। আহ! কিছুটা সময় পাওয়া গেছে। একটু একটু করে আরেকটু সময় পেলে যদি কিছু হয়? কেউ কি ওকে বাঁচাতে আসবে না? ওসি জামান শিকদার? কেউ কি তাকে একটু খবর দেয়নি? জুলেখাবুরে তো এই নামটা বলেছিল সে! বুবু কি ভুলে গেছে নাকি মনে আছে? মনে থাকলে বুবু জান দিয়ে হলেও তাকে খবর দিবে এটা জানে সুফিয়া!
কেন যেন আরেকজন মানুষের কথাও মনে পড়ছে। কিন্তু সেই মানুষটার পক্ষে তো আর এখানে আসতে পারা সম্ভব না। কে তাকে খবর দিবে? আর দিলেই বা কী? তার নিজের জান নিয়েই টানাটানি! সে কীভাবে তাকে বাঁচাতে আসবে?

পুলিশের গাড়ি জুলেখাকে তাদের গাঁয়ে নামিয়ে দিয়েই দ্রুত আবার পুলিশস্টেশনে ফিরে গেল।
বাড়ির কাছাকাছি এসে জুলেখার পা আর চলতে চাইছে না। তাদের বাড়ির উঠান থেকে একটা হট্টগোল শোনা যাচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে প্রচুর মানুষ এসে ভিড় করেছে সেখানে। তার সৎ মায়ের চিৎকার আর বিলাপ এতদূর থেকেই কানে ভেসে আসছে। জুলেখা ভয়ার্তচোখে বাবার দিকে তাকালো। নেয়ামত উল্লাহ নিজেও শক্ত সমর্থ মানুষ না। শক্ত মানুষ হলে নিজের চোখের সামনে তার ভালোমানুষ অসহায় মেয়েটার ওপরে তার স্ত্রীর এত অত্যাচার সে দেখেও না দেখার ভান করে পড়ে থাকত না। কীসের জানি একটা অজানা আতঙ্ক তাকে তার সঠিক কাজটা করতে দিত না কখনো।
কিন্তু আজ পুলিশ স্টেশনে জুলেখার আত্মবিশ্বাস আর সাহস দেখে নেয়ামত উল্লাহর মনের মধ্যে এক অন্যরকম সাহসের জোয়ার এসেছে। এরকম পরিস্থিতিতেও জুলেখা এত শক্ত থাকতে পারল কেমন করে? যে মেয়ে একটা চড় খেয়ে আরেক গাল বাড়িয়ে দেয়, সেই মেয়ে কেমন কনস্টেবলের সামনে নিজের জেদ বজায় রাখল!

নেয়ামত উল্লাহ জুলেখার হাতটা ধরে বলল ‘তুই আয় আমার লগে। একদম ভয় পাইবি না। তর বাপজান আছে। কেউ তরে কিছু কইতে পারব না!’
জুলেখা তার বাবার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা আশ্বাস পেল। মনে হলো, বাপজান যা বলছে তা ভুল বলছে না। আজ সত্যিই কেউ সত্যিই তার কিছু করতে পারবে না!

বাপ মেয়েকে একা একা আসতে দেখে হনুফা বেগম সাপের মতো হিসহিস করে উঠল, ‘আইছে! ঐ যে আইছে! আমার মাইয়াডারে কাগো হাতে জানি তুইলা দিয়া হারামজাদি মাগি শ্যাওড়া গাছের পেত্নি আইছে দ্যাখো! মাগি আমার মাইয়ারে বেইচা দিছে। ওর শাড়ির কোঁচড় খুঁইজা দ্যাখো! টাকার বাণ্ডিল খুঁইজা পাইবা…’
‘চুপ করো হনুফা! খবরদার আমার মাইয়ারে যদি আরেকটা খারাপ কথা কইছ তাইলে আইজ এই বাড়িত থেইকা আমি তুমারে খেদাই দিমু! মুখে যা না তাই কইবা আর সবাই দিনের পর দিন মুখ বুইজা সইব … কী ভাবছ তুমি? এ্যাঁ? জানো আমার মাইয়াডা আইজ সুফিয়ারে বাঁচনের লাইগা কী কী করছে? আন্ধা মাইয়ামানুষ! তুমার চক্ষে তো আল্লাহ্‌য় জন্ম পট্টি লাগাইয়া দিছে! তুমি কিছু দ্যাখবা ক্যামনে?’

স্বামীর মুখে এসব কথা শুনে হনুফা বেগম রা করতে ভুলে গেল কিছুক্ষণের জন্য। তারপর আচমকা হাত পা ছড়িয়ে গগনবিদারী চিৎকারে কান্নাকাটি জুড়ে দিলো।
যারা এতক্ষণ উঠানে দাঁড়িয়ে হনুফাকে নানারকম বুদ্ধি পরামর্শ দিচ্ছিল আর তার মুখের অকথা কুকথা শুনে হু হা করে সায় দিচ্ছিল, তারা এবারে একটু দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ল। থাকবে নাকি চলে যাবে, ঠিক যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না তারা!
তাদেরকে উদ্দেশ্য করে নেয়ামত উল্লাহ বলল, ‘আপনাগো ছেনেমা শ্যাষ হইছে? এইবার যার যার বাড়িত গিয়া ঘুম দ্যান!’
এই কথার পরে আর থাকা যায় না। যেতে যেতে কেউ কেউ মন্তব্য করল, ‘মাইয়ার শোকে জুলেখার বাপের মাথাডাও খারাপ হইয়া গ্যাছে!’ (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_পঁচিশ

ওসি জামান শিকদার তার জিপে উঠতে উঠতে রেজাকে বলল, ‘কে ফোন করেছে? কী বলেছে বলো দেখি!’
‘স্যার নাম পরিচয় দ্যায় নাই। খালি বলছে… আপনারা আব্দুল রফিক সাহেবের গুদামের দিকে যান। সব প্রশ্নের জবাব পাইবেন!’
‘আব্দুল রফিকের গুদাম? মানে কাপড়ের গুদাম?’
‘তা বলতে পারি না স্যার!’
‘কেন বলতে পারবা না? আব্দুল রফিক তো বারোয়ারি ব্যবসা করত না। কাপড়ের ব্যবসা করত বলেই জানি। সেখানে তো কাপড়ই থাকার কথা! আর কে না কে ফোন করল, তুমি নাম শুনবা না?’
‘স্যার সে বলল তার পরিচয় জানোনের চাইতে এখন আমাদের সেই গুদামে যাওয়াটা বেশি জরুরি। আর বেশি কথা বলতে পারি নাই স্যার। লাইনটা কাইটা দিছে এই কথার পরপরই।’
‘এক কাজ করো। তার নাম্বারটা সেভ করে রাখো। আর একবার ফোন দাও তো সেই নাম্বারে। দেখা যাক, আরেকটু কথা বলা যায় কী না!’

কনস্টেবল রেজা একটু যেন অনিচ্ছা নিয়েই সেই অচেনা নাম্বারে ফোন দিলো। নাম্বারটা বন্ধ দেখাচ্ছে। সে প্রথমবার কথা বলেই বুঝতে পেরেছে লোকটা তার নাম পরিচয় দিতে ইচ্ছুক না। ওসি সাহেব কেন যে শুধু শুধু এটার পেছনেই পড়ে আছেন কে জানে! তার চেয়ে বরং সুফিয়ার সন্ধানে দ্রুত যাওয়া দরকার। লোকটা সেই কথা বারবার বলে দিয়েছে। বলেছে, ‘দেরি করলে ক্ষতি হইয়া যাইতে পারে! পরে সবকিছুই পাওন যাইব, এই ক্ষতি পুরাইব না!’
গাড়ি চলতে শুরু করেছে। আব্দুল রফিকের গুদামটা কনস্টেবল রেজা ভালোমতোই চেনে। জামান শিকদারও খুনের তদন্ত শুরু করার পরে একবার মাত্র গিয়েছিল। চারপাশে অনেক গাছ গাছড়া আছে। জায়গাটা গ্রামের একটু নির্জন কোণেই। সুফিয়াকে কি এইখানেই রাখা হয়েছে? জামান শিকদার বলল, ‘কিন্তু রেজা আমরা কি একটু রিস্ক নিয়ে ফেলছি না?’
‘বুঝলাম না স্যার!’
‘সুফিয়াকে যদি এখানে রাখা হয়, তাহলে এখানে সশস্ত্র পাহারাদারও থাকতে পারে। যদিও পুলিশের দিকে গুলি ছোঁড়ার মতো সাহস পাবে না কেউ। নাটক সিনেমা হলে পেত। কিন্তু তারপরেও আরো কয়েকজনকে সঙ্গে আনা গেলে ভালো হতো!’
‘স্যার আপনি ফোন কইরা দ্যান। যারা স্টেশনে আছে, জিপ নিয়া চইলা আসুক।’

আরেকটা জিপ নিয়ে কয়েকজন পুলিশকে আসতে বলে ফোনটা রাখতে না রাখতেই একটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল জামান শিকদারের। আব্দুল রফিকের গুদামের কাছাকাছি চলে এসেছে তারা। যদিও আশেপাশের অন্ধকারে সবকিছু ভালোমত ঠাহর হয় না, কিন্তু এই জিনিসটা চিনতে ভুল হলো না তার। গুদামের সামনে একটা পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে। আর সেই গাড়ির দরজা ধরে শরীরের অর্ধেকটা বাইরে আর অর্ধেকটা ভেতরে রেখে খুব কায়দামতো দাঁড়িয়ে আছে তারই একান্ত বিশ্বস্ত কনস্টেবল শরফুদ্দিন!
জামান শিকদার রেজাকে ইশারা করল, ‘সামনে তাকাও। দেখো আমাদের একজন স্বজাতি আমাদের কত আগেই পৌঁছে গেছে! তুমি আর আমি লেট লতিফই হয়ে থাকলাম রেজা!’
রেজা সামনে তাকিয়ে চোখ পিট পিট করে বলল, ‘স্যার! দ্যাখছেন কাণ্ড! শরফুদ্দিন ভাই আগেই আইসা হাজির!’
‘হুম তাই তো বলছি! কী মনে হয় তোমার সে কি সব ক্রেডিট একা একাই নিয়ে যেতে চলে এসেছে নাকি তার মতলব ভিন্ন কিছু?’
‘শেষেরটাই তো মনে হইতাছে স্যার!’

জামান শিকদার জিপটাকে অন্ধকারে আড়াল করতে বলে গাড়িতে বসে বসে সামনের দিকে চোখ লাগিয়ে রাখে। পুলিশের অন্য গাড়িটা চলে এলেই তারা নেমে পড়বে। রেজাকে একটু উশখুশ করতে দেখে জামান শিকদার জিজ্ঞেস করে, ‘কী ব্যাপার রেজা? তুমি এমন অস্থির হয়ে আছ কেন?’
‘স্যার মাইয়াটার জন্য ভয় করতাছে। ওর কোনো ক্ষতি না হয়!’
‘তোমার চেয়ে আমার টেনশন কিছু কম না রেজা। সুফিয়া মেয়েটাকে আমি খুব স্নেহ করি। খুব সাহসী একটা মেয়ে। এমন মেয়ে হরহামেশা দেখা যায় না। আমাদের ছোটবেলায় ক্লাস ফাইভে একটা গল্প ছিল, নাম ‘বুদ্ধিমতী’। সেখানে গ্রামের একটা কিশোরীর গল্প বলা হয়েছিল। শহর থেকে আসা একটা দলকে মেয়েটি কীভাবে তার বুদ্ধিমত্তার জাদু দেখিয়ে তাক লাগিয়ে ফেলে, সেটি নিয়েই গল্প। আমরা ছোটবেলায় খুব আনন্দ নিয়ে গল্পটি পড়েছিলাম।
সুফিয়ার বুদ্ধিমত্তাও সেই কিশোরীর চাইতে কোনো অংশে কম না। বরং বেশি। আর যে সাহসের সে পরিচয় দিয়েছে, তা রীতিমত অবিশ্বাস্য। এই মেয়ের কোনোরকম ক্ষতি হলে আমি কোনোদিন নিজেকে ক্ষমা করতে পারব না। তুমি মনে মনে কুড়ি পর্যন্ত গোনো। এর মধ্যেই আমাদের অন্য গাড়িটা চলে আসবে।’ রেজার মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্যই জামান শিকদার তার কথাকে লম্বা করে।

রেজা সত্যি সত্যি চোখ বন্ধ করে ওসি স্যারের কথামত গুনতে শুরু করে। বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা টেনশন হচ্ছে। তারা এখানে চুপচাপ অপেক্ষা করছে, আর ওদিকে না জানি একটা বাচ্চা মেয়ের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে যাচ্ছে! পুলিশের চাকরি করতে এসে দেখতে হয় মাঝে মাঝে, পুরুষ মাঝে মাঝে নারীর প্রতি কত পৈশাচিক আচরণ করে! একটা বাচ্চা মেয়ে থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ এদের হাত থেকে রেহাই পায় না।
রেজার চাকরির অভিজ্ঞতা বেশিদিনের না। মনটা এখনো নরম। এই চাকরিতে যেসব ব্যাপারস্যাপার সে নিয়মিত দেখছে, হয়ত বেশিদিন চাকরিটা করতে পারবে না। মাঝে মাঝেই ভাবে, ঢাকায় গিয়ে অন্যকিছু করা যায় কী না চেষ্টা করে দেখবে। কিন্তু এই কাজটা সাহস করে করা মুশকিল। কথায় আছে, ‘হাতের লক্ষ্মীকে পায়ে ঠেলতে নেই।’ রেডিমেড একটা চাকরি হুট করে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবে কেউই সম্মতি দিবে না।

সত্যি সত্যিই কুড়ি গোণার আগেই পুলিশের আরেকটা গাড়ি এসে হাজির হয়। জামান শিকদার তার ড্রাইভার মোতালেবকে বলে, ‘সামনে আগাও। একেবারে সোজা গুদামঘরের দরজার কাছে গিয়ে গাড়ি থামাবে!’
মোতালেব এই এ্যাডভেঞ্চারে উত্তেজিত। সে অত্যুৎসাহে বলল, ‘স্যার, দরজার ভিতর দিয়া গুদামের ভেতরে গাড়ি সান্ধাইয়া দেই?’
‘না ঠিক আছে। অত দরকার নাই। তাছাড়া শরফুদ্দিন স্যারের সঙ্গে একটু দেখা করবা না? আমরা ভেতরে ঢুকে গেলেই সে একটু পরে এসে পুরো অভিযানের ক্রেডিটটা নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিবে!’

কথামত মোতালেব এক টানে জিপ এনে দাঁড় করায় আব্দুল রফিকের গুদামের সামনে।
সাঁই করে দরজা খুলে নেমে আসে জামান শিকদার ও কনস্টেবল রেজা। শরফুদ্দিন তখন একটু পরের ঝাল ঝাল তেজি মুরগির মাংস খাওয়ার আশায় মশগুল হয়ে আছে। আচমকা ওসি স্যারের গাড়িকে সামনে আসতে দেখে সে একেবারে ভূত দেখার মতো চমকে যায়। তৎক্ষণাৎ টান টান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট ঠুকে বলে, ‘স্যার, আপনে ছুটি দিলেন কিন্তু বাড়িতে গেলাম না। খবর পাইলাম সুফিয়ারে নিয়া আইছে এইখানে। তাই দেরি না কইরা চইলা আইছি!’
জামান শিকদার পাথরের মতো মুখ করে শরফুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে রেজাকে নির্দেশ দিলো, ‘একে হাতকড়া পরিয়ে গাড়ির সঙ্গে বেঁধে রাখো। সাবধান, কিছুতেই যেন ছুটতে না পারে! এ যদি ছুটে তো তোমার হাতেও হাতকড়া পরাব রেজা। কথাটা যেন মনে থাকে!’

শরফুদ্দিন কিছু বোঝার আগেই রেজা তার ওসি স্যারের নির্দেশ পালন করে ফেলে। শরফুদ্দিন ঘটনা কী ঘটছে বোঝামাত্রই হইচই শুরু করে দেয়, ‘স্যার, কাজটা কইলাম ঠিক করলেন না! নিজের ভালা যদি চান, তাইলে আমার হাতকড়া খুইলা দ্যান! আপনের চাকরি তো যাইবই, জান নিয়া টানাটানি পইড়া যাইব স্যার… ঐ শালা মাদারচোত রেজার বাচ্চা, আস্তে কইরা বান্ধ! ওসির লগে থাইকা খুব হিরোগিরি দ্যাখাইতাছোস তাই না? ইন্সপেক্টর সিনহাম! থু মারি তোগো সিনহামের মুখে! দুই পয়সার ওসি! কার লগে লাগতে আইছে হুঁশ পাইতাছে না!’
রেজা হাতকড়া বাঁধতে বাঁধতে বলল, ‘স্যার অখনো সময় আছে ওসি স্যারের পা ধইরা বইসা পড়েন। চাকরিটা বাঁচলেও বাঁচতে পারে! আইজকার পরে আর কোনো আশাই থাকব না স্যার!’
‘চুপ শালা মাদারচোত আমারে চাকরি বাঁচানের বুদ্ধি দ্যায়…’

ফোর্স নিয়ে গুদামে প্রবেশ করল জামান শিকদার। তার অনুমানই ঠিক হয়েছে। গুদামে উপস্থিত একজন মানুষও তাদেরকে ঠেকাতে এগিয়ে এলো না। জামান শিকদার তবু একটু ভয় জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করল। ফাঁকা গুলি ছুড়ল দুই তিনটা। তারপর ভারি গমগমে গলায় বলল, ‘খবরদার কেউ যদি সামনে এগিয়ে আসার চেষ্টা করে, তার লাশ ফেলে দিব একেবারে! তোদের ওস্তাদ কই? সামনে আসতে বল!’

ওদিকে সুফিয়ার বুদ্ধিতে তার ইজ্জতে হামলা করতে এগিয়ে আসা ছেলেটা কিছু সময়ের বিরতি দিয়েছে তাকে। সুফিয়ার সাহস দেখে তার মনে হয়েছে, মেয়েটাকে এই গুদামে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু বাসায় নিয়ে গেলেও তো বিপদ! বাপ খ্যাঁচ খ্যাঁচ করবে। মা যেখানকার জিনিস সেখানে রেখে আসতে বলবে। বিয়েশাদী সময়মত না করার এই এক মুশকিল। চরিত্রটা ঠিক রাখা মুশকিল হয়ে যায়।

এতদিন যাদের সঙ্গে আপোষে এসব কাজ করেছে তারা সব মন্দ পাড়ার মেয়ে। নিজেরাই আগ বাড়িয়ে ছেনালি করে। কিন্তু আজকের মেয়েটা তাদের মধ্যে অন্যরকম। যদিও এই মেয়ের ওপরে শুরুতে খুব রাগ হয়েছিল। মনে হয়েছিল দেখামাত্রই নোংরা করে ছুঁড়ে ফেলে দিবে। তারপর কত পুলিশের কাছে যাইতে মন চায় যাক! কিন্তু মেয়েটার সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলেই মনে হচ্ছে এর এরকম অনাদর করাটা উচিত হচ্ছে না।
ফোন করে সুফিয়ার জন্য ভালো শাড়ি কাপড় আনা হচ্ছে। সুফিয়ার কাছাকাছিই বসে আছে সে। টেলিফোনে কাকে যেন নির্দেশ দিয়ে বলছে, ‘বাজারের বেস্ট শাড়িটা লাগব আমার! হ বেস্ট জিনিসের গায়ে বেস্ট কাপড়। সেন্ট ফেন্ট আছে নাকি তুমার দোকানে? না থাকলে আশেপাশের দোকানে খোঁজ করো মিয়া। চাই চাই আইজই চাই!
আচমকা জামান শিকদারের গমগমে আওয়াজ কানে আসতেই ফোন ফেলে দিয়ে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়াল সে। হারামজাদা ওসি! এই জায়গার খোঁজ পেল কেমন করে? পকেট থেকে নিজের পিস্তলটা বের করে সে। লাইসেন্স আছে এটার। বেশি তেড়িবেড়ি করলে একেবারে সোজা ঠুকে দিবে! লোড করা আছে!

ওদিকে ওসির গলার আওয়াজ কানে আসতেই খুশিতে মুখচোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সুফিয়ার। এতক্ষণ সে সব আশাভরসা ছেড়ে দিয়ে বসেছিল। অসভ্য ইতর ছেলেটা তাকে তারিয়ে তারিয়ে দেখছে। মুখ দিয়ে বাজে সব ভঙ্গি করছে। সুফিয়া ধরেই নিয়েছে, এই জীবন যদি টিকেও যায়, কাউকেই এই মুখ আর দেখাতে পারবে না সে। জুলেখাবু, বাবা, মা… সবার কথা মনে পড়ছিল। এই মানুষগুলোর সামনে কি আর কোনোদিন সে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে? জুলেখাবু কত আগলে রেখেছে তাকে সবসময়! সেই বু যখন জানবে…
ভাবতে ভাবতেই আওয়াজটা কানে আসে। পর পর কয়েকবার গুলির আওয়াজ। এসেছে! ওসি সাব এসেছে! তাকে বাঁচাতে চলে এসেছে! এই বাজে ছেলেটার হাত থেকে ঠিক তাকে বাঁচিয়ে ফেলবে ওসি সাব! আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতায় চোখ বুজে আসে সুফিয়ার।

ততক্ষণে ছেলেটা ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিশানা তাক করছে। সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে কটমট করে বলল, ‘এ্যাই মাইয়া খবরদার যদি এদিক সেদিক দৌড় দিছ, এক্কেরে গুলি কইরা দিমু বুঝবার পারছ? যেইখানে আছ সেইখানেই বইসা থাকো! এট্টুও নড়বা না কইলাম!’
সুফিয়া কিছু বলল না। মনে মনে বলল, ‘হ আমি বইসাই আছি। আপনে খাড়াইয়া থাকেন অখন! দেখি আপনের পায়ে কেমুন জোর!’

ছেলেটা একটা বড় থামের আড়ালে গিয়ে লুকালো। জামান শিকদারের গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। ‘দেখো, তুমি বা তোমরা যারাই হও এভাবে লুকোচুরি খেলে লাভ হবে না কিছুই। পুলিশ তোমাদের গুদাম ঘিরে ফেলেছে। পালানোর রাস্তা নাই। শুধু শুধু গোলাগুলি করলে সময়ই নষ্ট হবে! বের হয়ে আসো! মেয়েটিকে কোথায় লুকিয়ে রেখেছ, আমাদের হাতে সোপর্দ করে দাও। খবরদার ওর কোনোরকম ক্ষতি করার চেষ্টা করলে এই গুদাম একেবারে উড়িয়ে দিব!’

ততক্ষণে শরফুদ্দিনের হাতে হাতকড়া পরিয়ে হাতকড়ার এক প্রান্ত গাড়ির হাতলের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হয়েছে। রেজা সেই কাজ শেষ করে জামান শিকদারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার ভীষণ একটা থ্রিলিং ফিল হচ্ছে। একেবারে সিনেমাতে যেমন গুণ্ডাদের আস্তানাতে গিয়ে নায়ক গোলাগুলি করে নায়িকাকে উদ্ধার করে এটাও অনেকটা সেইরকম ব্যাপার।
শুধু সমস্যা হচ্ছে প্রতিপক্ষ একটু বেশি ম্যান্দামারা। তারা গোলাগুলি করার হ্যাপাতে যাচ্ছে না। আর সুফিয়া মেয়েটাকেও জামান শিকদারের নায়িকা বলার কোনো সুযোগ নাই। নেহায়েত বাচ্চা একটা মেয়ে। স্যারও তাকে বিশেষ স্নেহ করেন!

কনস্টেবল রেজার এসব ফ্যান্টাসি ভাবনার মাঝেই হঠাৎ গুম করে গর্জে উঠল পিস্তল। রেজা চকিতে জামান শিকদারের দিকে তাকায়। না এটা তার পিস্তলের আওয়াজ না, এসেছে সামনে থেকে। ফাঁকা আওয়াজ, কিন্তু সতর্কতার জন্য এর বেশি আওয়াজের দরকার পড়ে না।
জামান শিকদার আর রেজা গুদামের দুই প্রান্তে অবস্থান নিলো। জামান শিকদার বলল, ‘এসব করে লাভ হবে না। আমি আমার ফোর্সকে ভেতরে ঢুকতে বললেই কিন্তু বের হয়ে আসতে হবে। খামাখা সময় নষ্ট করা ঠিক হচ্ছে কি?’
এবারে ছেলেটা কথা বলল, ‘ওসি, তোমার দলবল নিয়া চইলা যাও। আমার কথা না শুনলে কিন্তু ভালা কিছু হইব না। শুধু শুধু এই মাইয়াটার বেঘোরে জানটা যাইব! আমি কিছুতেই ধরা দিমু না। তুমি খবরদার আর এক পা আগাইবা না!’

গলাটা চেনা চেনা লাগছে। কিন্তু এখন সেটা নিয়ে ভাবার সময় নাই। জামান শিকদারের ভ্রু কুঁচকে গেল। এ কী জ্বালাতন! এখন এই একজনকে ধরতেই কি গোলাগুলি করতে হবে নাকি? নাটের গুরু তো একটাকেই মনে হচ্ছে। জামান শিকদার রেজাকে নিজের কাছে ডেকে আস্তে আস্তে বলল, ‘তুমি একটু বুদ্ধি করে পেছনে কোনো রাস্তা আছে নাকি দেখতে পারবে?’
‘স্যার দেখতে যাইতে পারি। কিন্তু আপনে তো তাইলে এইখানে একা হইয়া যাইবেন!’
‘আমি সামলাতে পারব। চিন্তা করো না!’
‘স্যার গুদামে কিন্তু জনা সাতেক লোক আছে। হঠাৎ কইরা এরা আক্রমণ কইরা বসলে…’
‘পুলিশকে কিছু করতে পারবে না, ভয় পেয়ো না অযথা!’
‘এ্যাদের মতিগতি উলটাইয়া যাইতে সময় লাগব না স্যার। আর শরফুদ্দিন ভাই ঐখান থেইকা কী কলকাঠি নাড়ব কে জানে! মানুষের মাথায় শয়তানি বুদ্ধি থাকলে শয়তানে কখন কী লাড়াচাড়া দেয় কে কইতে পারে স্যার!’
‘হুম… কথা তো এমনিতে ভুল বলোনি… আরে! ঐটা কীসের আওয়াজ হলো?’ আচমকা একটা ধরপাকড়ের আওয়াজ শোনা যেতে লাগল ঠিক তাদের সামনে থেকে… যেখান থেকে একটু আগে ঐ কণ্ঠস্বরটা ভেসে আসছিল!
জামান শিকদার তার কনস্টেবলকে বলল, ‘এখন আর অপেক্ষা করার সুযোগ নাই রেজা! ওপাশে যে আছে সে কারো সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছে। চলো দ্রুত আগানো যাক!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-২২+২৩

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_বাইশ

শরফুদ্দিনের এসব কথাবার্তা শোনার সময় কিংবা ইচ্ছা কোনোটাই জুলেখার নাই। সে বুঝতে পারছে এই লোকটা সেই ওসি না। যে ওসির কথা সুফিয়া তাকে বলেছিল, জুলেখা তাকে এক নজর ভালোভাবেই দেখেছে। দেখতে শুনতে তাগড়া, লম্বা। এই দুজনকে দেখে তো পুলিশই মনে হয় না! কিন্তু ওসি সাহেবকে দেখলেই মনে শ্রদ্ধা জাগে। জুলেখা নিজেকে সংযত করে গুছিয়ে বলল, ‘আমি ওসি সাহেবের কাছে আইছি। আমার বইনরে…’ কথাটা বলতে গিয়েই থেমে গেল জুলেখা। মনে হলো, সে এই লোকের কাছে কেন বলছে?
‘হ্যাঁ তোমার বইনরে… কী হইছে কথা শেষ করো মাইয়া। কী হইছে তুমার বইনের?’
‘আমি আপনেরে কমু না। ওসি সাহেবরে কমু!’ জুলেখা ঘাড় শক্ত করে কথাটা বলল, একদম সুফিয়ার মতো। নেয়ামত উল্লাহ অবাক চোখে জুলেখার দিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের সাদাসিধা মেয়েটাকে আজ একেবারেই অপরিচিত লাগছে তার কাছে!
‘ঐ যে আরেকজন আইছে দেখো! এক রামে রক্ষা নাই, তার সুগ্রীব দোসর! সকাল থেইকা এক মাইয়ার শুভ আগমনে আজ অখন অব্দি ঘরে যাইবার পারলাম না। অখন আবার আরেকজন আইসা ওসি সাবেরে খুঁজতাছে। বেবাক কিছু কি ওসি সাবই সামলাইব? আমাগোরেও দুই চারটা কামকাইজ দিয়েন। নইলে তো বইসা বইসা হয়রান হইয়া যামুগা!’ শরফুদ্দিন মনের ক্ষেদ একেবারে গোড়াসহ উপড়ে দিলো!

‘কে বসে বসে হয়রান হয়ে যাচ্ছে শরফুদ্দিন? তুমি? এদিকে আমি তো কাজের চাপে ডেস্ক থেকে মুখই তুলতে পারছি না!’ বলতে বলতে ওসি জামান শিকদার তার পাশের রুমে প্রবেশ করে।
ঘড়িতে বাজে সাড়ে সাতটা। এমন কিছু আহামরি রাত না। কিন্তু গ্রামদেশে এই সময়েই বাইরে শেয়াল ডাকতে শুরু করে। চারপাশে নিশুতি নেমে আসে। এই শুনশান নীরবতায় আশেপাশের অল্প একটু শব্দও বড় করে শোনা যায়। শরফুদ্দিন কোনো একটা মেয়ের সাথে বেশ তেজ দেখিয়ে কথা বলছে, এটা নিজের রুমে বসেই শুনতে পেয়েছে জামান শিকদার। এত রাতে মেয়ে এলো কোথা থেকে?
পাশের রুমে এসে একটু বিস্ময়ের ধাক্কা লাগল জামান শিকদারের। একটা তেইশ চব্বিশ বছর বয়সী তরুণী আর মাঝবয়সী একজন লোক এই সময়ে পুলিশস্টেশনে! মেয়েটার বেশবাস আলুথালু। শাড়িতে ছোপ ছোপ কাদামাটি লেগে আছে। মাথার এক ঢাল চুল খোঁপার বাধনে বাঁধা ছিল হয়ত। সেগুলো খোঁপা খুলে এলোমেলো ছড়িয়ে আছে পিঠময়। কিছু কপালের কাছাকাছি এসে লুটোপুটি খাচ্ছে। মেয়েটার চোখেমুখে গাঢ় বেদনার ছায়া। দেখে বোঝা যাচ্ছে খুব ভয়ানক কিছু একটা অঘটন ঘটে গেছে তার জীবনে! লোকটার অবস্থাও বেশি সুবিধার না।
কিন্তু এতকিছুর পরেও যে কথাটা জামান শিকদারের খুব তীব্রভাবে মনে হলো তা হচ্ছে মেয়েটাকে সে যেন কোথায় দেখেছে! ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু দেখেছে খুব কাছাকাছি সময়েই!

‘কী ব্যাপার? কী হয়েছে? শরফুদ্দিন কী বলছিলে তুমি?’
‘স্যার দেখেন না, আমি এই মেয়েটাকে বলছি তার কমপ্লেইন কী সেটা বলতে। লিখে নিব। কিন্তু সে আমাকে হাইকোর্ট দেখাচ্ছে। বলছে যে…’ শরফুদ্দিন বলতে বলতে থেমে গেল। জুলেখা ওসি সাহেবকে আসতে দেখেই হড়বড়িয়ে কথা বলতে শুরু করেছে।
‘ওসি সাব, আপনে আমার বইনরে খুঁইজা দ্যান! আমার বইনরে তুইলা নিয়া গ্যাছে ওসি সাব!’ জুলেখা কাঁদতে কাঁদতে বলল।
‘আপনার বোন? কী হয়েছে আপনার বোনের? নাম কী? মিসিং কেস? কাউকে সন্দেহ করছেন?’
‘ওসি সাব ওরে আপনে চেনেন। আইজও সে আপনের লগে দেখা করছিল। আমার বইনের নাম সুফিয়া! ওরে দুইজন মানুষ জোর কইরা নাকের কাছে কী জানি গুইজা দিয়া অজ্ঞান কইরা নিয়া গ্যাছে!’
‘সুফিয়াকে তুলে নিয়ে গেছে? সর্বনাশ! আপনে সুফিয়ার বোন? কখন ঘটল এই ঘটনা?’ জামান শিকদারের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। সুফিয়া নিজের জীবনের অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে পুলিশকে সাহায্য করেছে। তাকে আরো ভালোমতো নিরাপত্তা দেওয়া উচিত ছিল। নিজের ওপরে ভীষণ রাগ লাগছে জামান শিকদারের।

ওদিকে ঘটনা শুনে তো শরফুদ্দিনের ইচ্ছে করছে এক পাক নেচেই নেয়! একেই বলে, ওস্তাদের মার শেষ রাতে! খুব হিরোগিরি দেখানোর সাধ হয়েছিল না? দুই টাকার এক ছেমড়ি! পুঁটি মাছ হয়ে রুই কাতলের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে এসেছে!
আর ওসিরও খুব জেমস বন্ড সাজার শখ হইছিল! দ্যাখ এইবার ব্যাটা! কত ধানে কত চাল!

জামান শিকদার শশব্যস্ত হয়ে বলে ওঠে, ‘আপনারা দুজন আমার রুমে আসেন। রেজা শরফুদ্দিন তোমরা আজ পুলিশ স্টেশন থেকে বের হবে না। দরকার হলে বাসায় জানিয়ে দাও যে আজকে ফিরতে পারবে না। খাওয়া দাওয়া ঘুম সব এখানেই সারতে হবে। আজকে আমাদের রাতেও অপারেশনে যেতে হবে!
এই নতুন হুকুম শুনে শরফুদ্দিনের মুখের ভাবখানা যা হলো, তা দেখার মতো! মনে হচ্ছে কেউ বুঝি তাকে জোর করে নিমপাতার বড়া খাইয়ে দিয়েছে। মনে মনে প্রচণ্ড মুখ খারাপ করে সে জামান শিকদারকে একটা গালি দিলো। সেই গালি শুনলে আশেপাশে মশামাছিও বসতে চাইত না।

জুলেখা আর নেয়ামত উল্লাহকে নিজের রুমে বসিয়ে জামান শিকদার তাদের একটু ধাতস্থ হয়ে নেওয়ার সময় দিলো। মেয়েটাকে সে এবারে চিনতে পেরেছে। সুফিয়াকে সেই প্রথম দিন যখন তাদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়েছিল, তখন কিছু দূরেই তার এই বোনটি এসে দাঁড়িয়েছিল। লাউয়ের মাচান থেকে লাউ তুলছিল। কিন্তু সেদিনের স্নিগ্ধ মায়াময় মুখটাতে আজ মলিনতার রাজত্ব। দেখে বোঝাই যাচ্ছে অনেক বড় ঝড় বয়ে গেছে মেয়েটার ওপর দিয়ে।
জামান শিকদার কোমল গলায় বলল, ‘আমাকে প্রথম থেকে খুলে বলেন তো কী হয়েছে। কোনো কিছু বাদ দিবেন না। ছোট থেকে ছোট ব্যাপারও উল্লেখ করবেন। বুঝতেই পারছেন সবকিছুই জানা জরুরি।’
জুলেখা বিকেলে সুফিয়ার বাড়িতে ফেরার পর থেকে যা যা ঘটেছে সবকিছুই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে গেল। ফুলিদের বাড়িতে গিয়ে যা যা ঘটেছে সবকিছু বিস্তারিতভাবে বলল। বলার সময় ইচ্ছে করেই ফুলির স্বামীর কথা বারবার বলল। আর আচার আচরণের বিস্তারিত বর্ণনা দিলো। জুলেখার বাবা নেয়ামত উল্লাহ হাঁ করে সব কিছু শুনছিল। জুলেখার আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় মনোভাব দেখে আজ অবাক না হয়ে পারছে না নেয়ামত উল্লাহ। তার মেয়েটার মাঝের এত আত্মবিশ্বাস এতদিন কোথায় লুকিয়ে ছিল?

জামান শিকদার একটাও কথা না বলে সবকিছু খুব মন দিয়ে শুনল। ফুলির স্বামীর কথা শোনার সময় ভ্রু কুঁচকে দুই একবার জুলেখার মুখের দিকেও তাকাল। জুলেখা যখন তার দুই পায়ে দুই রঙের মোজার কথা বলছিল তখন অবাক না হয়ে পারেনি। মেয়েটা দেখা যাচ্ছে অনেক কিছু খেয়াল করে! বিবরণ শেষ হওয়ার পরে জামান শিকদার জিজ্ঞেস করল, ‘অর্থাৎ দুজন লোকেরই মুখ কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। আর কিছু কি খেয়াল করেছেন? কাউকেই চিনতে পারেননি?’
জুলেখা একটু ভেবে নিয়ে শান্তমুখে বলল, ‘চিনছি ওসি সাব। একজনরে চিনবার পারছি!’
‘ভেরি গুড! কে সে? বলুন!’
‘তার দুই পায়ে ছিল দুই রঙের মোজা! এইডাই খেয়াল করছি!’
‘হোয়াট? তার মানে… তার মানে আপনি বলতে চাইছেন ফুলির স্বামী ছিল দুজনের একজন?’
‘জি ওসি সাব। একজন ফুলির স্বামীই ছিল।’

নেয়ামত উল্লাহর মুখ এখন পুরোপুরি হাঁ! জামান শিকদার জুলেখাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু আপনি এতটা নিশ্চিত হয়ে কীভাবে বলতে পারছেন? দুই পায়ে দুই রঙের মোজা তো অনেকেই পরে! এটা খুব আনকমন ব্যাপার না। মাঝে মাঝে হাতের কাছে খুঁজে না পেলে আমিও এই কাজ করে ফেলি!
শুধু এটা দেখেই কি একজনকে পুরোপুরি সনাক্ত করা সম্ভব? আর তাছাড়া ঘটনা যখন ঘটেছে তখন চারপাশে অন্ধকার। গ্রামের অন্ধকার মানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঐ অন্ধকারে আপনি এত নিখুঁতভাবে কীভাবে দেখতে পেলেন?’
‘আমি ভুল দেখিনি ওসি সাব। এই গরমের মইধ্যে গেরামের মানুষ মোজা পরে না। ফুলির স্বামীর এক পায়ে ছিল কালা আরেক পায়ে লাল চকরাবকরা মোজা। অন্ধকার ছিল এই কথা ঠিক, কিন্তু একবার বিদ্যুতের আলো চমকাইছিল। আমি সেই আলোতে পরিষ্কার দ্যাখছি। আমার দেখার মইধ্যে এট্টুও ভুল নাই!’
‘হুম… ঠিক আছে। আপনি যখন এত নিশ্চিতভাবে বলছেন… তাহলে এই ক্লু ধরেই আমাদের এগুতে হবে। আপনি চিন্তা করবেন না। সুফিয়াকে আমি খুব স্নেহ করি। ও আমাদের অনেক বড় উপকার করে দিয়েছে। ওকে খুঁজে বের করা আমাদের জন্য অবশ্য কর্তব্য!’
এবারে নেয়ামত উল্লাহ মুখ খুলল, ‘হুজুর, বেশি দেরি হইয়া গ্যালে আমার মাইয়াটার সর্বনাশ হইয়া যাইব! গাঁও গেরামের মানুষ ভালা না হুজুর!’
জুলেখা আঁচলে মুখ চাপা দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগল।

জামান শিকদার ব্যথিতমনে বলল, ‘পুলিশের চাকরি করি। খারাপ মানুষজন নিয়েই কাজ কারবার। শুধু গ্রাম কেন, খারাপ মানুষ সব জায়গায় ছড়িয়ে আছে। তবে আশার কথা হলো, এর মাঝে ভালো মানুষের সংখ্যাও একেবারে কম না!
কিন্তু থাক সেসব কথা। আপনেরা এখন বাড়িতে যান। আপনাদের অনেকটা পথ যেতে হবে। নিরাপত্তা কিন্তু আপনাদেরও দরকার। কারণ সুফিয়াকে যে বা যারা উঠিয়েছে, সুযোগ পেলে তারা আপনাদেরও ক্ষতি করতে পারে। ভ্যান নিয়ে এসেছেন কি? ফেরত পাঠিয়ে দিন। আমি বলে দিচ্ছি। আমার একজন স্টাফ আপনাদের বাড়িতে রেখে আসবে। ভ্যানওয়ালার টাকা দিয়ে দিবে চিন্তা করবেন না। আপনারা না যাওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের কাজ শুরু করতে পারব না। সুফিয়াকে খোঁজার কাজ শুরু করা দরকার! দেরি করলে বিপদ হতে পারে!’

জুলেখা আর তার বাবাকে পাঠিয়ে দিয়ে জামান শিকদার পাশের রুমে আসে। এসেই দেখতে পায় শরফুদ্দিন কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। সুফিয়াকে তুলে নিয়ে গিয়েছে শোনার পর থেকেই মেজাজটা খিচড়ে ছিল, এটা দেখে ধৈর্য ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ল। বোঝাই যাচ্ছে, অপরাধীদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে যাচ্ছে শরফুদ্দিন। তবু জামান শিকদার তার কিছুই করতে পারছে না। কারণ প্রমাণ নাই। এই লোকটার ফোন সিজ করলেই অনেক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসবে। কিন্তু প্রমাণের অভাবে সেটাও করা যাচ্ছে না।
জামান শিকদারের অনুমান ভুল না। কনস্টেবল শরফুদ্দিন তখন জায়গামতই ফোন দিয়েছে। হাসিতে উজ্জ্বল মুখখানা সে কিছুতেই গোপন করে রাখতে পারছে না।
‘স্যার, ঘটনা তো ঘইটা গ্যাছে! ওহ যা দেখাইলেন! ঐ বদ ছেমড়িরে ধইরা আচ্ছামতন এখন একটা ডলা দিয়া দ্যান। হিরোগিরি এক ডলানিতেই ছুইটা যাইব!’
‘হ, যেই কাজ আপনের করার কথা ছিল সেইটা আমার লোকজন দিয়া করাইতে হইল। এইটাই আফসোস। তা, ডলা দেওয়ার ভাগ চাও নাকি? আইসা পড়ো মিয়া!’
শরফুদ্দিন লাজুক হাসি দিয়ে বলে, ‘স্যার সেই ইচ্ছা যে একদম করতাছে না এইটা বলবার পারি না! কিন্তু শালার ওসি খুব জ্বালাইতাছে! অখনো বইসা বইসা মশামাছি মারতাছি। এইবার এই ওসির কিছু একটা করোন লাগব স্যার! অধমের আর্জি!’
‘হুম সেই ব্যবস্থাও হইয়া যাইব! আচ্ছা রাখি এখন। যাই গিয়া দেইখা আসি কেমুন মাল ধইরা নিয়া আইলো। ঝিম ধরা মুরগির মাংসে মজা নাই! আইজ তেজি মুরগির ঝাল ঝাল তরকারি খামু! তুমিও আইসা পড়ো মিয়া। একা একা ভাল্লাগে না!’

জামান শিকদার কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শরফুদ্দিনের এই ফুর্তি দেখল। তারপর উপস্থিত সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলল, ‘শরফুদ্দিন তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। তুমি বরং এক কাজ করো। আজ তুমি তোমার বাড়িতে চলে যাও। আমি আর রেজাই আজকের বাকি কাজ সামলাতে পারব।’
শরফুদ্দিনের চোখেমুখে একটা বিস্ময়ের ছাপ ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেল। ব্যাটা যখন নিজে থেকেই চলে যেতে বলছে তখন সে আর বেশি বেশি কাজ দেখাতে যাবে কোন দুঃখে? মনে মনে ভাবে শরফুদ্দিন… ভালোই হলো! এই চান্সে ঝাল মুরগির মাংস একটু চেখে আসা যাবে!
তবু এত সহজে রাজি হয়ে গেলে আবার সন্দেহ করে বসে যদি? এই ভেবে চেহারায় একটা মলিন ভাব ফুটিয়ে তুলে শরফুদ্দিন বলল, ‘স্যার কী বলেন! এত কাজ আপনে একা সামলাইবার পারবেন? অখন তো আবার সুফিয়ারে খুঁজতে যাওন লাগব! কই না কই নিয়া গ্যাছে মাইয়াটারে!’
জামান শিকদার মনে মনে বলল, ‘হুম সেজন্যই তো তোমাকে একটু ঘুরেফিরে দেখে আসার জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছি!’ মুখে বলল, ‘আরে এত চিন্তা করো না। ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি যাও বাড়ি গিয়ে রেস্ট নাও, ঠিক আছে?’

‘আচ্ছা স্যার আপনে যখন এত কইরা বলতাছেন…’ (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_তেইশ

শরফুদ্দিন বের হয়ে যাওয়ার প্রায় দশ পনের মিনিট পরে জামান শিকদার কনস্টেবল রেজাকে নিজের রুমে ডেকে পাঠাল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে দুজনে মিলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলো।
বাইরে আবার বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। আর বেশি দেরি করলে ঝড় বৃষ্টির মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। জামান শিকদার রেজাকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘তাহলে বুঝতে পেরেছ আমাদের প্ল্যানটা কী হবে? কোথা থেকে শুরু করা হবে?’
‘জি স্যার, আমি বুঝছি। আমার পাশে বইসাই সে জোরে জোরে কথা বলতাছিল। পাশাপাশি বসি স্যার। তারে না জানাইয়া আপনার রুমে গেলে সে রাগ করে, প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতে থাকে।’
‘তোমাকে দলে ভিড়াইতে চায়নি কখনো? নাকি দলে ভিড়েই আছ? আমি জানি না!’ জামান শিকদার একটু খোঁচা মেরে শেষের কথাটুকু বলল।
‘স্যার, আমি বিয়েশাদী করিনি। মা-বাবা থাকে শহরে। দায়ে পড়ে এইখানে পইড়া আছি। আমার খুব বেশি উঁচুতে ওঠার সাধ নাই স্যার। বাবা আসার আগে মাথায় হাত দিয়ে শপথ করায় নিছিল, নিজের ইমান যাতে বিক্রি না করি। আপনে চিন্তা কইরেন না স্যার। আমি শরফুদ্দিনের রাস্তায় হাঁটিনি।’
‘হুম আচ্ছা বিশ্বাস করলাম। চলো এবারে রওয়ানা দেওয়া যাক!’

জামান শিকদার কনস্টেবল রেজাকে নিয়ে চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফের বাড়িতেই হাজির হলো।
চেয়ারম্যান সাহেব তখন সবে রাতের খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটু টেলিভিশন দেখতে বসেছে। এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিদ্যুতের অবস্থা একসময় বড়ই বেহাল ছিল। বিদ্যুৎ মাঝে মাঝে যেত না, মাঝে মাঝে আসত। কিন্তু পল্লী বিদ্যুৎ আসার পর থেকে পরিস্থিতি কিছুটা সহনীয়। অনেকের বাসাতেই এখন টেলিভিশন আছে। বর্ডার এলাকা হওয়ায় পাশের দেশের অনেক চ্যানেল ডিশ এণ্টিনা ছাড়াই চলে আসে। ওই দেশে নাকি এই দেশের টিভির চ্যানেল চলতে পারে না। কিন্তু এই দেশের দেশপ্রেমী জনতার সেটাতে কিচ্ছু আসে যায় না।
বাড়ির মহিলারা কেউ ঘরের ভেতরে কেউবা পর্দার আড়াল থেকে টিভিতে চোখ সেঁটে বসে আছে। স্টার জলসাতে চলছে প্রতিদিনের জনপ্রিয় সিরিয়াল। এই সিরিয়াল দেখতে প্রতিদিনই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই ঘরের কাজকর্ম সারা হয়ে যায়। কাউকে কিছুই বলার দরকার পড়ে না। আব্দুল লতিফ টিভি ছেড়ে দিয়ে একটা গড়গড়া হাতে নিয়ে বসেছে।
ক্লাইম্যাক্সের জায়গাতে এসে যখন ঘরের মধ্যে তুমুল উত্তেজনা, একেকজন একেক কথা বলছে এরপরে কাহিনী কোনদিকে যাবে… ঠিক এমন সময়েই বাইরের সদর দরজায় জোরে ধাক্কার আওয়াজ শোনা গেল। সেই সঙ্গে একটা ভারি গলার আওয়াজ, ‘চেয়ারম্যান সাহেব কি বাড়িতে আছেন?’

এমন উত্তেজনাকর মুহূর্তে এই বহিরাগত যন্ত্রণাতে সবাই প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। চেয়ারম্যান সাহেবের বউ বিরক্তমুখে বলল, ‘তুমার লোকজনেরা আইজকাল রাইতেও ডাকাডাকি শুরু করছে! কইয়া দাও অখন যাইতে পারবা না! ইস! চিল্লানির জ্বালায় কিছুই শুনবার পারলাম না! দুরু!’
আব্দুল লতিফ কিন্তু আওয়াজ শুনেই সচকিত হয়ে উঠেছে। এটা তো তার লোকজনের হাঁকডাক বলে মনে হচ্ছে না। আর তাদের এত সাহস নেই যে তাকে ‘চেয়ারম্যান সাহেব কি বাড়িত আছেন?’ এই প্রশ্ন করে। স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে আব্দুল লতিফ মৃদু ধমকের সুরে বলল, ‘না বুইঝা কথা কওয়া তুমাগো মাইয়া মাইনষের একটা স্বভাব! আওয়াজ শুইনা বুঝতাছ না, বাইরের কেউ আইছে? আমার লোকজন এত রাতে এইরম কইরা দরজা ধাক্কায় শুনছ কুনোদিন?’
চেয়ারম্যানের বউ টিভির দিকে চোখ সেঁটে রেখেই চিন্তিত মুখে বলল, ‘তাইলে কেডায় আইল এত রাইতে?’
‘তুমরা ভেতর ঘরে যাও। আইজ টিভি দেখন বন্ধ!’ বলে টিভি অফ করে দিলো আব্দুল লতিফ। এত রাতে কী অজানা বিপদাপদ হলো, এই নিয়ে কারো মাথাব্যথা নাই। কিন্তু সিরিয়ালের বাকি অংশ দেখতে না পারার দুঃখে সবার যেন জান আটকায়ে গেল। বুক ভাঙা কষ্ট নিয়ে সবাই ভেতরের ঘরের দিকে পা বাড়াল।

একটু পরে আব্দুল লতিফের সাগরেদ মোস্তাক এসে খবর দিলো, ‘হুজুর ওসি সাব আইছে!’
আব্দুল লতিফের ভ্রু কুঁচকে গেল। এই অসময়ে ওসি সাহেব তার বাড়িতে কেন? তাকে না জানিয়ে পশ্চিমের জংগলের অভিযানের কথা তার কানে এসেছে। এটা শোনার পর থেকেই সারাদিন হপ হয়ে ছিল মেজাজ। যে ওসি সাহেব তাকে ছাড়া একটা গাছের পাতাতেও হাত দেয় না, তার হঠাৎ এই একা একা অভিযানের খবরে খুশি হওয়ার কোনোই কারণ নাই।
আব্দুল লতিফ বলল, ‘বৈঠকঘরে নিয়া বসা। যাইতাছি আমি। আর শোন… বাবুলরে এট্টু খবর দে!’
‘বাবুল ভাই কনে জানি গ্যাছে। কিছু কইয়া যায়নি!’
‘হারামজাদা এইসময়ে কনে গেল আবার? আচ্ছা ঠিক আছে তুই গিয়া ক, আমি আইতাছি। অপেক্ষা করবার ক!’

ওসি জামান শিকদার ধৈর্য ধরে বৈঠকখানায় অপেক্ষা করছে। অপেক্ষা করার কথা বলার পরেও কুড়ি মিনিট পার হয়ে গেছে। আব্দুল লতিফের দেখা মেলেনি এখনো। অথচ এখন একেকটি মিনিট সোনার চেয়েও দামি। জামান শিকদার বারবার ঘড়ি দেখতে লাগল। একসময় ধৈর্যর বাঁধ পুরোপুরি ভেঙে যাওয়ার পরে সে তার কনস্টেবল সহ বাইরে উঠানে বেরিয়ে এসে ডাকতে শুরু করে, ‘চেয়ারম্যান সাহেব কি ঘুমায়ে পড়লেন নাকি? দেখুন আপনি সহযোগিতা না করলে কিন্তু আমাদের হাতে অন্য উপায়ও আছে!’
এবারে ভেতর ঘর থেকে আব্দুল লতিফ বেরিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘কী ব্যাপার ওসি সাব? আপনারে খুব পেরেশান লাগতাছে! কইছি তো এট্টু অপেক্ষা করেন। আপনের দেখি আইজকাল ধৈর্য এক্কেবারে নাই হইয়া গ্যাছে!’
জামান শিকদার খোঁচাটা গায়ে না মেখে বলল, ‘আমার ধৈর্য কমেনি চেয়ারম্যান সাহেব! তবে মনে হচ্ছে আপনি শুধু শুধু আমার ধৈর্যর পরীক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করছেন!’
‘আমি আপনার ধৈর্যর পরীক্ষা নিতাছি নাকি আপনে আমার ধৈর্য পরীক্ষা করতাছেন সেই আলাপ তো অখনো তুলিই নাই! যাই হউক, ভ্যাদা প্যাঁচাল না পাইড়া আসল কথা কন। হঠাৎ কী মনে কইরা আমার বাড়িত আপনের পা পড়ল? আপনে তো আমার এলাকার বনে জঙ্গলের বড় বড় খবর একা একাই পাইয়া যাইতাছেন! এলাকার চেয়ারম্যানেরেও জানানের দরকার মনে করতাছেন না!’
চেয়ারম্যানের গলার তীব্র শ্লেষ একেবারেই লুকিয়ে রইল না। জামান শিকদারও আজ একেবারে মরিয়া। এই শ্লেষের কারণ যাই হোক, সে আজ দমবার পাত্র না। স্পষ্ট ভাষাতেই চেয়ারম্যানের শ্লেষভরা উক্তির জবাব দিলো সে।

‘ঘটনা যখন আপনের বাড়ির আশেপাশেই তখন তো রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টাই এইখানে টহল দেওয়ার দরকার ছিল চেয়ারম্যান সাহেব! আমরা তো এতদিন শুধু শুধুই এদিক ওদিকে ঘুরে বেকার সময় নষ্ট করলাম! আর বনে জঙ্গলে কীসের বড় খবর লুকিয়ে ছিল, সেটা কি আমার চাইতে আপনি কম জানতেন নাকি?’
‘কী কইতে চান ওসি সাব, খোলাসা কইরা কন! লন বৈঠকখানায় বইসা আলাপ করি!’
‘আজকে আর বসার ইচ্ছা নাই চেয়ারম্যান সাহেব। সময়ও নাই। আপনি শুধু এটুকু জানিয়ে আমাকে উপকৃত করেন যে আপনার বাড়ির আশ্রিত আপনার শালা মুজিবর এখন কোথায়?’
‘মুজিবর কোথায় এই খবর লইতে বাড়ি চইলা আইছেন? এইটা তো কাউরে পাঠায় দিলেই জানবার পারতেন! একেবারে দলবল নিয়া এইরাম কইরা হুলুস্থুল করোনের কী দরকার আছিল? মুজিবর আইজ ওর শ্বশুরবাড়ি নোয়াহাটি গ্যাছে।’
‘জি সেটা আমি জানি। আমি শুধু জানতে চাচ্ছি, এরপরে সে কোথায় গেছে?’
‘তার মানে? এরপর সে ঐখান থেইকা কই যাইব আমারে কি জানাইয়া গ্যাছে নাকি? কী জিগাইতাছেন এইসব?’
‘সে তো আপনার কথামতোই চলে বলে জানি চেয়ারম্যান সাহেব! আপনি খামাখা এত উত্তেজিত হচ্ছেন কেন?’
‘উত্তেজিত হমু না? আরে! রাত বিরাতে আইসা কী শুরু করলেন আপনে?’
‘আপনে বলতে চাচ্ছেন সে এখন কোথায় এটা আপনে জানেন না?’
‘আরে কী আপদ! এক কথা কয়বার কমু?’
এমন সময় কনস্টেবল রেজার নাম্বারে অপরিচিত নাম্বার থেকে একটা ফোন আসে। সে ফোনে কথা বলে জামান শিকদারকে এসে বলে, ‘স্যার সন্ধান মনে হইতাছে পাওয়া গ্যাছে! আমাদের এখন এইখান থেইকা যাইতে হইব!’
‘কীভাবে সন্ধান পেলে?’
‘যাইতে যাইতে বলি স্যার। দেরি না করার জন্য বলতেছে!’
‘আচ্ছা চলো তাহলে!’
চেয়ারম্যানের বাড়ি থেকে বের হওয়ার মুখে জামান শিকদার একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে খুবই ক্যাজুয়ালি বলল, ‘আপনাদের সিরিয়াল দেখা নষ্ট করার জন্য দুঃখিত চেয়ারম্যান সাহেব। কী করব, যার কাছে যেটা বেশি জরুরি তাকে তো সেটা নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হয়!’
পুলিশ চলে যেতে আব্দুল লতিফ মোস্তাককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ওসির দ্যাখতাছি খুব চর্বি বাড়ছে! ঐ হারামজাদা বাবুল কই সান্ধাইছে এইসময়? খুঁইজা নিয়া আয়! ফোন দে হারামজাদারে!’
মোস্তাক চিন্তিতমুখে বলে, ‘বাবুল ভাই তো ফোন ধরতাছে না! ফোন মনে হয় বন্ধ কইরা থুইছে!’
‘ফোন বন্ধ কইরা থুইয়া বাইরে ঘুরতে গ্যাছে! হারামজাদার এত সাহস! বেবাকের পাঙ্খা দেখি লম্বা হইয়া গ্যাছে! সব কয়টার পাঙ্খা একলগে কাইটা দেওন লাগব! আসুক আইজগা!’

ওদিকে জঙ্গলের মধ্যে শমসের তখন ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে। খুব কাছেই একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। পায়ের আওয়াজ, এগিয়ে আসছে এই দিকেই।
আজ একটু সকাল সকালই চোখের পাতা বুজে এসেছিল তার। জঙ্গলে থাকতে থাকতে এখন নিজেকে তার বুনোমানব মনে হতে শুরু করেছে। বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, বুনো গাছপালা পশুপাখির সাথে জড়ামড়ি করে বাস করতে করতে নিজেকে আর মানুষই মনে হয় না ইদানিং।
শমসের মনস্থির করে ফেলেছে তার শুভাকাঙ্ক্ষী লোকটি এর পরদিন এলেই তাকে বলবে, সে আর লুকিয়ে থাকতে পারবে না। পুলিশের কাছে ধরা দিতে হয় দিবে। বিনাদোষে যদি প্রাণ দিতে হয় সেটাও দিবে! মা নাই বাবা নাই, চালচুলো কিছুই নাই… তার বেঁচে থাকার জন্য কীসের এত দায়? এভাবে মানুষের শরীর নিয়ে বুনোমানব হয়ে বেঁচে থাকতে সে আর পারবে না!
কিন্তু আজ বেশ অনেকদিন হয়ে গেল সেই লোকটা আসছে না। কী ঝামেলা হলো কে জানে! আর দুইদিন দেখবে শমসের। তারপরেই বের হয়ে আসবে!

পায়ের আওয়াজটা এদিকেই এগিয়ে আসছে। শমসের অন্ধকারে পালায়ে যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনেনি। আজ প্রায় তিনমাসের ওপরে সে এই ভাঙা মন্দিরে আশ্রয় নিয়েছে। কেউ তো এদিকটাতে দিনের বেলাতেই আসে না। এই রাতে কে আসছে এদিকে?’
দরজার আছে এসে পায়ের আওয়াজ থেমে গেল। শমসের অন্ধকারে নিজেকে প্রায় মিশিয়ে ফেলেছে। একটা শক্তিশালী আলোর উৎস থেকে তীক্ষ্ণ আলোর রেখা ছুটে আসছে। অন্ধকারে অজানা আতঙ্কের মুখোমুখি হয়ে শমসের বহু কষ্টে সামনে তাকালো। এরপরেই পরিচিত গলার আওয়াজটা শোনা গেল।
‘শমসের আছিস নাকি? ভয় পাইছস নাকি? দুরু ব্যাটা! তুই না বাঘের বাচ্চা! এট্টুকুতেই ডরাই গেলি? বাইর হ!’
শমসেরের জানে যেন পানি এলো। যার কথা ভাবছিল, সেই এসেছে। একেবারে সময়মত এসেছে। আর দুইদিন দেরি হলেই কিছু একটা হয়ে যেত! এতদিনের চাপা ক্ষোভগুলো একবারে উগড়ে দিলো শমসের।
‘আপনে আইছেন? এদ্দিন পরে আইলেন এইবার? দুইদিন দেরি করলেই এইবারে আর আপনের আওন লাগত না। আমিই যাইতাম আপনের কাছে! পুলিশের কাছে গিয়া সব কথা খুইলা কইতাম! তা আপনে দিন থাকতে রাইতে আইছেন ক্যান?’
টর্চটা জ্বালিয়ে রেখেই এগিয়ে আসে লোকটা। শমসেরের বিক্ষুব্ধ ভাবসাব দেখে প্রশ্রয়ের হাসি হেসে বলে, ‘তর পলাইয়া থাকোনের দিন ফুরাইছে। ল চল এইবার, আমার লগে চল!’
‘কই যামু?’
‘পুলিশ ইস্টেশন!’
‘আপনে কি আমারে পুলিশে ধরাইয়া দিবার আইছেন?’
‘ক্যা? দুইদিন পরে আইলে তুই নিজেই তো গিয়া পুলিশের কাছে ধরা দিতি! এইমাত্র না কইলি!
শমসের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। লোকটার মুখ হাসি হাসি। শমসেরকে ধোঁকা খাওয়াতে পেরে যেন খুব জিতেছে এমনভাবে বলে, ‘শুইয়া থাকোনের টাইম নাই। উইঠা পড়। পুলিশের কাছে যাওন লাগব। সুফিয়ারে ধইরা নিয়া গ্যাছে!’
হঠাৎ যেন বজ্রপাত হলো সেই ছোট্ট ভাঙা মন্দিরটাতে। শমসের বিস্ময়ভরা কণ্ঠে বলল, ‘সুফিয়ারে ধরছে? কেডায়? ও তো পুলিশের কাজেই সাহায্য করছে! আমিই ওরে আগরগাছের সন্ধান কইয়া দিছি!’
‘হ সেইডা আমি ঠিকই বুঝছি! তর কওন লাগব না! সুফিয়ারে পুলিশ ধরেনি, যারা এই আগরগাছ কাইটা দেশের সম্পদ বাইরে পাচার করতাছে তারাই ধরছে! প্রতিশোধ নিবার চায়! মাইয়াটার রস চিপা ছিবড়া বানাইয়া ফালাইয়া দিব। ব্যস! মাইয়ার জীবন শ্যাষ! প্রতিশোধ নিতে আর কী লাগে?’
শমসেরের গা বেয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল। তার জন্যই সুফিয়া এরকম বিপদে পড়ল! এটা সে কী করল?’

‘কিরে বইয়া থাকবি অহনো নাকি পুলিশের কাছে যাবি?’
‘কিন্তু পুলিশরে গিয়া কী কমু? আমি তো জানি না এই কাম কারা করতাছে। আপনে জানেন, কিন্তু আপনে তো সামনে আইবেন না!’
এত কিছু তরে চিন্তা করবার কইছি? যাইবার কইছি ল চল। একবারে যাইতাছোস। যা যা নেওন লাগব নিয়া নে!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-২০+২১

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_কুড়ি

‘কই?’ এইবারে কিন্তু মুজিবরের সহকারী লোকটা ধমক দিলো না। কারণ চোখ দুটো পিট পিট করে সেও তখন সুফিয়া আর তার বোনকে চিনে ফেলেছে। না চেনার কারণই নেই!

আজ যখন থেকে সে এই কাজের জন্য নির্দেশপ্রাপ্ত হয়েছে, তখন থেকেই সুফিয়ার বাড়ির সঙ্গেই সে একরকম সেঁটে আছে। এই মেয়ে বাড়িতে এসেছে ম্যালা বেলা করে। পুলিশের গাড়ি তাকে তার বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূরে নামিয়ে দিয়ে গেছে। একেবারে ভিআইপি ব্যবস্থা। নামিয়ে দিয়েই গাড়ি হাঁকিয়ে ওসি চলে গেছে। তখনই আরাম করে সে তার কাজ করে ফেলতে পারত। খামাখা এত বেলা অব্দি বসে থাকার কোনো দরকারই ছিল না। কিন্তু দিনের বেলা কাজ করার হুকুম ছিল না। আর তাছাড়া একাও কাজ করার ব্যাপারে নিষেধ করা আছে। তাকে বটগাছের নিচের বাঁশের বেঞ্চিতে বসে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়েছে। সেটাই সে করছিল। যথাসময়েই এই বান্দা হাজির হয়েছে।

‘হ! আপনে তো ঠিকই কইছেন এইবার! এইডা তো ঐ মাইয়াই! লগে এইডা তার বইন! দুইজনে কই গেছিল?’
মুজিবরের গলা চুলকাতে লাগল। ফস করে বলে দিতে ইচ্ছে করছিল, ‘আমার শ্বশুরবাড়িতেই গেছিল! এতক্ষণ আমি এগো লগে গপসপ করতাছিলাম!’ কিন্তু এইবারেও সে নিজেকে বহুকষ্টে সম্বরণ করে ফেলল।

‘লন কাজে নাইমা পড়ি। আবার কইতাছি বেশি কাম করবার যাইবেন না! আপনে গিয়া মাইয়ার হাত দুইডা পিছমোড়া কইরা চাইপা ধরবেন। আমি তার নাকের কাছে রুমাল ধরুম। ব্যস! আর কিচ্ছু করোন লাগব না! বহুত তেজি মাইয়া। হাত দুইটা বাইন্ধা না লইলে ফসকাইয়া যাইতে পারে! আপনের মুখচোখ বান্ধছেন তো ঠিকমত? হ ঠিক আছে। আপনেরে জানি কেউ চিনবার না পারে।’
মুজিবর যেতে যেতেই বলল, ‘আর মাইয়াডার বইন? ও যদি চিৎকার মারে?’
‘মারলে মারব! এই শুনশান জায়গায় ওর চিৎকার শুইনা কেউ আইব না! আচ্ছা… ঠিক আছে। কইতাছেন যখন! মাইডারে অজ্ঞান কইরা ওর বইনের একটা ব্যবস্থা করোন যায় কী না দেখন লাগব!’

দুজনের কাছাকাছি চলে আসতেই মুজিবরের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। এমনিতে যতই মুখে মুখে হাতিঘোড়া মারুক না কেন, সাহস করে সে একটা তেলাপোকাও মারতে পারে না। তবে শয়তানি বুদ্ধিতে তার জুড়ি মেলা ভার।
এদিকে হঠাৎ সোজাসুজি দুজন মানুষকে নিজেদের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে জুলেখার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সজাগ হয়ে ওঠে। সুফিয়াকে হাতের কনুই দিয়ে একটা গুঁতা মারতে যাবে ঠিক এমন সময় প্রায় চিতাবাঘের গতিতে মুজিবরের সঙ্গের লোকটা সুফিয়ার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুজিবর পৌঁছানোর আগেই সে সুফিয়ার নাকের কাছে ক্লোরোফর্ম মাখানো রুমাল স্পর্শ করিয়ে দেয়। প্রায় সাথে সাথেই অচেতন হয়ে পড়ে সুফিয়া। লোকটা এক মুহূর্ত দেরি না করে সুফিয়ার হাল্কা পাতলা অচেতন শরীরটাকে দুই হাত দিয়ে নিজের ঘাড়ের ওপরে উঠিয়ে ফেলে।

কয়েকটা মুহূর্তেই এত সব ঘটনা ঘটে যায়। জুলেখা একটা চিৎকার করারও সময় পায় না। এদিকে মুজিবরও তার সঙ্গীর ক্ষিপ্রতায় বাকরুদ্ধ। বাক ফিরে পেতেই সে দেখে জুলেখা চিৎকার দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখনই সে এক মুহূর্তও আর অপেক্ষা না করে নিজের সামান্য ভূমিকাটুকু পালন করে ফেলে। চট করে এগিয়ে গিয়ে জুলেখার মুখে হাত চাপা দেয়। তারপর ধীরে সুস্থে একখণ্ড রশি দিয়ে জুলেখার হাত বেঁধে ফেলার চেষ্টা করে।

সুফিয়াকে নিয়ে লোকটা তখন বেশ কিছুটা দূরে চলে গিয়েছিল। পেছন ফিরে মুজিবরের কায়দা কসরত দেখে সে মহা বিরক্ত হয়। হাতে ধরে রাখা ক্লোরোফর্মের রুমালটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারে মুজিবরের দিকে। এদিকে জুলেখার হাত বাঁধতে গিয়ে সে তুমুল বাঁধার মুখোমুখি হয়। এক পর্যায়ে বুঝতে পারে, কাজটা তার দ্বারা করা সম্ভব নয়। নিজের বোনকে এভাবে ভয়ানক বিপদে পড়তে দেখে জুলেখার শরীরে যেন অসুর এসে ভর করেছে। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে মুজিবরের মোকাবেলা করে চলেছিল।

সঙ্গীর ছুঁড়ে দেওয়া রুমালটা পেয়ে মুজিবর হঠাৎ যেন দিশা খুঁজে পায়। দেই দলা পাকানো রুমালটা মাটি থেকে তুলে নিয়ে সে মেলে ধরে জুলেখার নাক বরাবর।
এদিকে বিকেল থেকেই আবহাওয়াটা ছিল একটু কেমন জানি গুমোট। ফুলিদের বাসা থেকে ওরা দুই বোন যখন বের হয়েছে, আকাশ তখন ঘন কালো হয়ে বৃষ্টি ঝরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। জুলেখা অচেতন হয়ে ওঠার আগ মুহূর্তে আকাশে হঠাৎ বুঝি একটু বিদ্যুৎ খেলে যায়। সেই হাল্কা বিদ্যুৎ শিখায় হঠাৎ আগত এই দস্যুদের হাত থেকে বাঁচতে মরিয়া জুলেখার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা পড়ে একটা পরিচিত দৃশ্য। তাকে আক্রমণকারী লোকটার দুই পায়ে দুই রঙের মোজা! একটা কালো আর একটা লাল চকরাবকরা!

কোথায় যেন দেখেছে দৃশ্যটা? ভাবতে ভাবতেই নিয়তির হাতে নিজেকে ছেড়ে দেয় জুলেখা। নিয়তিও শেষ মুহূর্তে তাকে মনে করিয়ে দেয় দৃশ্যটা সে কোথায় দেখেছে! একটু আগে ফুলির জামাইয়ের অদ্ভুত সাজপোশাক দেখে মনে মনে হাসি চাপাচ্ছিল সে। কিন্তু সেই দৃশ্য এখানে কেন? কী আশ্চর্য!

জুলেখা অচেতন হয়ে পড়তেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচে মুজিবর। বাপরে! গ্রামের একটা মেয়ের শরীরে এত জোর! কোথায় পায় এত জোর?
সামনে থেকে সুফিয়াকে বহনকারী লোকটা হাঁক ছাড়ে, ‘কী জ্ঞান হারাইছে নাকি অখনো চাইয়া আছে আপনের দিকে? একটা মাইয়া মাইনষেরে শায়েস্তা করতে এত সময় লাগে, আচ্ছা পুরুষ মানুষ আপনে! এইবার হ্যারে ছাইড়া জলদি জলদি চইলা আসেন। অনেকটা পথ যাওন লাগব। পথের মধ্যে মানুষজন পিছে লাগলে কিন্তু দৌড় মারোন লাগব! পারবেন দৌড়াইতে?’

মুজিবেরের বুকে চাপ দিচ্ছিল অনেকক্ষণ থেকেই। একটু আগেই সে শ্বশুরবাড়িতে ভুরিভোজ করে এসেছে। এখন যদি এই ভরা পেট নিয়ে দৌড় দিতে হয় তাহলে তো সে দম আটকে মরেই পড়ে থাকবে। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, ‘ও ভাই, একটা ভ্যানগাড়ির ব্যবস্থা করোন যায় না?’
‘হ যায়! তারপর সেই ভ্যানআলা আপনেরে খাতির কইরা পুলিশের কাছে ধরাইয়া দিয়া আইব। কন রাজি?’
‘কিন্তু এতখানি পথ এই মাইয়াডারে এমুন কইরা নিয়া যাইতে পারবেন? আপনে নিজেই তো কাহিল হইয়া যাইবেন!’

‘আমার চিন্তা ছাইড়া দেন। আপনের মতো আরাম আয়েশে দিন কাটানের কপাল লইয়া তো আসি নাই! অখন কথা বাদ দিয়া জলদি জলদি পা চালান! নইলে কইলাম বিপদ আইতে সময় লাগব না! তাছাড়া ঝড়বৃষ্টিও আইতাছে।’ কথাটা বলেই লোকটা প্রায় দৌড়াতে শুরু করল। এত বড় একটা বোঝা যে সে কাঁধে নিয়ে চলছে, এটা তাকে দেখে এখন আর বোঝারই উপায় নাই! তার পিছে পিছে তাল রাখতে গিয়ে মুজিবর তৃষ্ণার্ত কুকুরের মতো হাঁপাতে লাগল। মনে হচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা বুঝি ছিটকেই চলে আসবে বাইরে।

ওদিকে সন্ধ্যা হয়েছে সেই কখন, অথচ জুলেখা আর সুফিয়া এখনো বাসায় আসছে না দেখে হনুফা বেগমের এতক্ষণে টনক নড়েছে। জুলেখা না ফেরে না ফিরুক, পোড়ারমুখী বিলের কাছের বটগাছটার সাথে দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ুক! পোড়ারমুখী পাতিলের কালির জন্য তার চাঁদবরণী মেয়েটার বিয়ে হচ্ছে না! কবে যে ঐটারে বিদায় করতে পারবে!
দুপুরের পর থেকেই প্রচণ্ড গরম পড়েছিল। সন্ধ্যার পর থেকে মেঘ করে বৃষ্টি নেমেছে। এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যেও মেয়েটা এখনো ফিরল না দেখে হনুফা বেগম একটু অস্থিরই হয়ে পড়ল। কিন্তু এই রাতের বেলা বৃষ্টির মধ্যে সে একা মেয়েমানুষ কোথায় গিয়ে খোঁজ খবর করবে? আচ্ছা বিপদে পড়া গেল তো!

ভাগ্য ভালো একটু পরেই সুফিয়া জুলেখার বাবা নেয়ামত উল্লাহ ভিজতে ভিজতে বাড়িতে এলো। বাড়ির উঠানে পা দিয়েই সে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি জুড়ে দিলো, ‘জুলেখা… ও মা জুলেখা… আমার হাতের জিনিসগুলান একটু ধর দেখি মা। এট্টু চাউল ডাউল আনছিলাম, বেবাক সদাইপাতি বৃষ্টিতে ভিইজা গ্যালো! যেমুন গরমডা পড়ছিল, তেমুনই বৃষ্টি নামছে! জুলেখা, ও মা আইলি না অখনো?’

বউকে কখনো এভাবে ডাকাডাকি করে না নেয়ামত উল্লাহ। তার বদমেজাজি বউ কখন কোন কথায় কী প্রতিক্রিয়া দেখায়, বলা মুশকিল। সুফিয়ার মেজাজ মর্জিরও ঠিকঠিকানা নাই। এই ঝড় তো এই মেঘ! আর সে নিজেই তো একটা দমকা বাতাস। কখন বাড়িতে থাকে কক্ষন থাকে না কেউ তার খবর জানে না! মেয়েটাকে নিয়ে মাঝে মাঝে খুব চিন্তা হয় নেয়ামত উল্লাহর।

চিন্তার কথাটা সে কারো কাছে বলে না। মুখে না বললেও সুফিয়ার ডানপিটে স্বভাবটাকে তার খুব ভয় লাগে। এমন মেয়েরা পদে পদে বিপদে পড়ে। সমাজ এদেরকে সোজা চোখে দেখে না। এটা সেটা ঘটনা ঘটিয়ে এরা এদের জীবনের পথটাকে নিজেরাই জটিল করে তোলে।
বাড়িতে শুধু জুলেখার সঙ্গেই নেয়ামত উল্লাহ দুই দণ্ড কথা বলে আরাম পায়। তার শ্যামলছায়ার মতো নরমশরম মেয়েটা যেন তীব্র দাবদাহ শেষে এক পশলা বৃষ্টি। সৎ মায়ের সংসারে মেয়েটা এক কণাও শান্তি পায় না, তবু মুখের হাসি কখনো তার ফুরায় না!

‘কারে ডাকতাছেন? আপনের আদরের দুলালী আইজ অহনতুরী বাড়িত আসেনি। দুপুরে এট্টু বাইরে থেইকা আইসা দেখি ঘরদোর খুইলা রাইখা আপনের আদরের কন্যা পাড়া বেড়াইতে গ্যাছে। গ্যাছে ভালা কথা! গ্যাছে তো গ্যাছেই! ফেরার আর নামগন্ধ নাই!’
‘জুলেখা ওহনতরি বাড়িত আসে নাই? কী কও? এমুন তো জুলেখা কখনোই করে না! সুফিয়া আছে নাকি বাড়িত?’
‘নাহ! সুফিয়ারে মনে হয় ফুসলাইয়া ফাসলাইয়া আপনের বড় মাইয়া লগে নিয়া গ্যাছে। আমার মাইয়াডা তো বোকার হদ্দ। যে যেমুন কইরা চালায় সেও আগপাশ ভাবনা চিন্তা না কইরা সেই রাস্তাতেই চলে!’

নেয়ামত উল্লাহ কিছু বলল না। সব কথার জবাব দিতে নাই। কিন্তু মেয়েদুটো এই ঝড় বাদলের রাতে এখনো বাড়ির বাইরে আছে, এই কথা শুনে তার ভালো লাগল না। মনের মধ্যে কীসের যেন কুডাক ডাকতে লাগল। হনুফা বেগমের মনে তো সবসময় মন্দ ভাবনা ঘোরে! মাতৃত্বের স্বাভাবিক অনুভূতিটুকুও তার কাজ করে না সবসময়। যদি করত তাহলে সে বুঝতে পারত মেয়েদের এত রাতে বাড়ি না ফেরাটা কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়!

সদাইপাতিগুলো নিজেই বারান্দার চৌকিতে রেখে দিয়ে নেয়ামত উল্লাহ ছাতাটা নিয়ে আবার বাইরে যেতে উদ্যত হলো। স্বামী যে তাকে ঘরসংসারের কাজকর্মের ব্যাপারে কিছুই বলে টলে না, এটা হনুফা বিবি ঠিকই বুঝতে পারে। সব কাজের জন্যই মেয়েকে খোঁজে কিন্তু বউকে না। হনুফার বুকের ভেতরটা দিনরাত জ্বলতে থাকে। এই সংসারের সবার প্রতিই তার অজস্র ক্ষোভ জমে আছে। মনে হয়, সবাই মিলেই যেন তার জীবনটাকে নরক বানিয়ে ছেড়েছে। এখন তার মেয়েটাকেও কেউ ভালো একটা জীবন উপভোগ করতে দিবে না। এত সুন্দর দেখতে তার মেয়েটা! ওর তো রাজরানী হওয়ার কপাল ছিল! কিন্তু এই লোকের পাল্লায় পড়ে ঠিকই তার মেয়েটারও জীবন ধ্যাদ্ধেরে গোবিন্দপুর হয়ে যাবে! এ্যাহ বড় মেয়ের বিয়ে না দিয়ে ছোট মেয়েকে বিয়ে দিবে না! বড় মেয়ের ঐ বদন দেখেই তো লোকে পালায়! তার আবার বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখে!
নেয়ামত উল্লাহকে আবার বেরুতে দেখে পেছন থেকে হনুফা বেগম বলে ওঠে, ‘কী হইছে আবার কই যাইতাছ?’
‘মাইয়া দুইটা কই গ্যালো এট্টু দ্যাখতে হইব না?’

নেয়ামত উল্লাহ বাড়ির বাইরে পা দিতে পারল না, তার আগেই পাড়ার এক ছেলে এসে খবর দিলো, জুলেখা বিলের মাঠটার পাশে অচেতন হয়ে পড়ে ছিল। কে একজন দেখতে পেয়ে তাকে উঠে বসিয়েছে। হুঁশ ফিরতেই সে প্রথমেই যে কথা বলেছে তা হলো, ‘সুফিয়ারে উঠাইয়া নিয়া গ্যাছে! ওরে কেউ বাঁচাও! আমার বোনটারে বাঁচাও!’
এই কথা শুনে হন্তদন্ত হয়ে ছাতা ফেলেই নেয়ামত উল্লাহ ছুট লাগাল। পেছনে হনুফা বেগম তখনো যেন কথাটা ঠিকমতো আত্মস্থ করে উঠতে পারেনি।
ভালোমত বোঝার পরে সে হাত পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করে চেঁচাতে শুরু করল, ‘ওহ আল্লাহ! এইডা আমি কী শুনলাম গো আল্লাহ! হায় আল্লাহ! তুমি আমারে এই খবর শোনানোর আগে ক্যান উঠাইয়া নিলা না? আমার সুফিয়ার কেডায় এমুন ক্ষতি করল আল্লাহ!’

বলতে বলতে হঠাৎ সে সোজা হয়ে বসে। তারপর কী যেন খেলে যায় তার মাথার মধ্যে। আচমকা সুর পরিবর্তন করে এবারে সে বলতে শুরু করে, ‘বুঝছি আমি বেবাক কিছু বুঝছি! এই সবই হইতাছে ঐ হারামজাদি জুলেখার কারসাজি। প্রত্থমে ফুসলাইয়া ফাসলাইয়া আমার মাইয়াডারে বাড়ির বাইর করছে তারপর কাউরে তার পিছে লাগাইয়া দিছে! হ এইবার বুঝছি আমি! ও আল্লাহ তুমি এইডার বিচার কইরো! ঐ হারামজাদি জানি আইজকা বাড়িত না আইবার পারে! আইজ ঐখানেই জানি ওর দুনিয়ার লীলাখেলা শ্যাষ হয়…!’
অবিরাম অভিশাপবর্ষণে বুঝি তখন প্রকৃতিও স্তব্ধ হয়ে থমথমে মুখে এই মাঝবয়সী কটুভাষিণী মহিলার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_একুশ

‘ও মা, মারে কী হইছে? তুই এইভাবে পইড়া আছশ ক্যা? সুফিয়া কই রে মা?’
‘বাজান, বাজান গো… সর্বনাশ হইয়া গ্যাছে! এইডা কী হইল বাজান? আমি লগে থাইকাও কিছুই করবার পারলাম না! আমার চোখের সামনে দিয়াই সুফিয়ারে তুইলা নিয়া গ্যালো! আমি চাইয়া চাইয়া দ্যাখলাম খালি!’

বৃষ্টি যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ করেই থেমে গেছে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ভয়ানক পরিস্থিতিতে মানুষের পাশাপাশি প্রকৃতিও যেন শোকস্তব্ধ হয়ে পড়েছে।
এই কদমপুর নোয়াহাটি সহ আশেপাশের গ্রামের মানুষদের জীবনে আগে কখনোই এমন ঘন ঘন বিপদ আপদ আসেনি। কিন্তু এখন প্রায়ই খুন, ধর্ষণ, অপহরণ… এসব ঘটনার কথা শোনা যায়। গ্রামে বুঝি সর্বনাশা কোনো প্রেতাত্মা এসে ভর করেছে!
এক কান দুই কান করতে করতে একসময় গ্রামের সবাই প্রায় জেনে গেল যে, জুলেখা আর সুফিয়াকে অচেতন করে দুজন লোক সুফিয়াকে তুলে নিয়ে গেছে আর জুলেখাকে ফেলে গেছে। মুহূর্তের মধ্যেই সেই বিলের পাশের জায়গাটা অনেক মানুষের কলরবে মুখরিত হয়ে উঠল। একেকজন একেকরকম কথা বলতে লাগল। সম্ভাব্যতা অসম্ভাব্যতাকে মিলিয়ে মিশিয়ে কল্পনাতেই সবাই যেন ঘটনার আদ্যোপান্ত বুঝে গেল!
দুই একজন বলল, ‘খারাপ কাজের লাইগা নিলে তো দুইজনরেই নেওনের কথা! জুলেখারে ফালাইয়া যাইব ক্যান?’
এর ব্যাখ্যাও কারো কারো কাছে প্রস্তুতই ছিল। ‘হয়ত জুলেখা কালা বইলাই তারে নেয়নি! সুফিয়ারে ধলা দেইখা নিয়া গ্যাছে!’
কেউ কেউ একটু অন্যরকম ব্যাখ্যাও দিলো। একটু আগেই তাদের অনেকে সুফিয়ার মায়ের শাপ শাপান্ত বিলাপ প্রলাপ শুনেই এদিকে এসেছে। তারা সেই কথার সুরে সুর মিলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল, ‘সৎ মায়ের অত্যাচারে জান পেরেশান হইয়া আছিল। বিয়াও হইতাছিল না ম্যালাদিন ধইরা। কে জানে, মাইনষের মন! হিংসা থেইকাই এই কাম করাইছে কী না কেডায় কইতে পারব?’

ভাগ্য ভালো, এই শেষোক্ত বক্তব্য দেওয়া মানুষগুলো সংখ্যায় খুব বেশি নয়। তাদের কথাকে অনেকেই ধর্তব্যের মধ্যেই গণ্য করল না। জূলেখা ওইরকম মেয়েই নয়। হনুফা বেগম যা বলে বলুক, জুলেখা নিজের জান দিয়ে হলেও বোনকে রক্ষা করতে চাইবে। হয়ত ঘটনা এসবের কোনোটাই না। সুফিয়ার যে ডানপিটে স্বভাব! অনেকেই তাকে ভেতরে ভেতরে সহ্য করতে পারে না। কে জানে কার কোন পাকা ধানের গোলায় ঐ মেয়ে আগুন দিয়েছে!

জুলেখা তখনো মাটিতে বসে আহাজারি করছিল। নেয়ামত উল্লাহও মেয়ের পাশে বসে বুক চাপড়াচ্ছে। দৃশ্যটা সহ্য করার মতো নয়। গ্রামের দুই একজন মুরুব্বি এবারে এগিয়ে এসে বলল, ‘নেয়ামত উল্লাহ, উঠো। এইভাবে বইয়া বইয়া কান্নাকাটি কইরা কিছু হইব না। মাইয়ারে খুঁইজা বাইর করোন লাগব। মা জুলেখা, তুমি কি কাউরে দ্যাখবার পারছ? চিনছ কাউরে? এই কাম কি আমাগো গেরামের কারো নাকি অন্য কেউ এইডার পিছে আছে?’
জুলেখার মনে বিদ্যুতঝলকের মতোই সবকিছু ঝিলিক দিয়ে উঠল। এই কাজ যে করেছে, সে তাকে চিনেছে। ঐ তো সামনেই ফুলির বাবা আফসার খালুজানও দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে তার জামাইয়ের নাম ভুলেও উচ্চারণ করা যাবে না। চরম বিপদের মাঝেও কে যেন জুলেখার কানে কানে এসে বুদ্ধি দিয়ে গেল, ‘যা করার ভাইবাচিন্তা করোন লাগব। এইখানে বেফাঁস কিছু কইলে ঝামেলা বাড়তে পারে!’
কাঁদতে কাঁদতে জুলেখা বলল, ‘আমি কাউরেই চিনি নাই। তারা মুখ বাইন্ধা আইছিল। চেনোন যায়নি!’
‘ওহ তাইলে তো পুলিশের কাছে যাওন ছাড়া উপায় নাই! নেয়ামত উল্লাহ খামাখা আর এইখানে বইসা কান্দাকাটি কইরা সময় নষ্ট কইরো না। একটা ভ্যান লইয়া পুলিশ ইস্টেশনের দিকে রওয়ানা দাও। শুনছি আমাগো নতুন ওসি সাব নাকি ভালামানুষ। তিনি কিছু করলেও করবার পারেন!’

পুলিশের কথায় নেয়ামত উল্লাহর মনে কোনো আশা জাগল না, কিন্তু জুলেখার মনে আবার বিদ্যুতের ঝটকা লাগল। সুফিয়া তাদের থানায় নতুন ওসি সাহেবের কথা বলছিল। খুব নাকি ভালো মানুষ। সুফিয়াকে তিনি চেনেনও ভালোমত। একবার সেখানে গেলে ক্ষতির তো কিছু নাই, লাভ হলেও হতে পারে।
জুলেখা চোখের পানি মুছে বাবাকে বলল, ‘বাজান লও, পুলিশ ইস্টেশনেই চলো। সন্ধ্যা হইয়া গ্যাছে। বেশি দেরি হইলে ওসি সাবের লগে দেখা করোন যাইব না। একটা ভ্যান লইতে হইব।’
‘পুলিশের কাছে যাবি মা? আমাগো তো কপাল পুড়ছেই! অখন দশজনে জানাজানি হইব হুদাই!’
‘বাজান, কী কইতাছ এইসব? তুমার কাছে সুফিয়া বড় হইল নাকি ঐ দশজন বড় হইল? সুফিয়ারে বাঁচাইতে হইব। না জানি কী বিপদের মধ্যে পড়ছে আমার বইন! আর তুমি লোক জানাজানির ভয় করতাছ বাজান!’ বলতে বলতে জুলেখা আবার কান্নায় ভেঙে পড়ল।

গ্রামে সন্ধ্যা নামে ঝুপ করে। সন্ধ্যা নামা মানেই দিন ফুরিয়ে যাওয়া। রাতের আলাদা কোনো আয়োজন থাকে না গ্রামে। শহরের মতো এখানে স্ট্রিটলাইটের বাহারি সজ্জা নেই। দোকানপাট নানা পসরা সাজিয়ে আলোকিত হয়ে ওঠে না। রাস্তাঘাটেও লোক চলাচল থাকে না বললেই চলে। শুধু নিতান্তই ঠ্যাকায় পড়ে যাদের পথে নামতে হয়, তাদের কথা আলাদা। তাই এখানকার পুলিশস্টেশনগুলোতেও লোকজন কুচে বসা মুরগির মতো ঝিমাতে থাকে। কদাচিৎ কেউ নালিশ জানাতে গেলে তাদের চোখ ডলে ঝিমুনি কাটিয়ে কাজে নামতে হয়। বিরক্তির ছাপ ফুটে ওঠে মুখেচোখে।
তাই জুলেখার তাড়া খেয়ে হতাশা নিয়েই নেয়ামত উল্লাহ উঠে দাঁড়ায়। উৎসুক জনতা উপচে পড়ছে তাদের চারপাশে। ভ্যানের ব্যবস্থা হয়ে যায় সাথে সাথেই। বাপ মেয়ে যাত্রা শুরু করে অনিশ্চিতের পথে।

নিকষ কালো অন্ধকারে পথঘাট চেনা যায় না। ভ্যানওয়ালা অভ্যস্ত চেনা পথে তার বাহন হাঁকিয়ে চলে। একটা পাঁচ ব্যাটারির ছোট টর্চ হেডলাইটের মতো ভ্যানের সামনে তাক করে লাগানো আছে। সেটার আলোতেই সে এই নিকষ কালো আঁধারেই দিব্যি সরসরিয়ে পথ চলতে থাকে।
ভ্যানওয়ালা ভ্যান চালাতে চালাতে উশখুশ করতে থাকে। তার ঘটনার বিস্তারিত সবকিছু জানতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু ভ্যানে বসা দুজন মানুষের কারো মুখেই কথা নাই। থেকে থেকে জুলেখার দিক থেকে একটা হিঁচকি ওঠার মতো আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তার মনে তখন ঝড় উঠেছে। সেই ঝড়ের তাণ্ডবে তার মনের ভেতরের সবকিছু চুরমার হয়ে যাচ্ছে।
গত দুইদিন ধরেই জুলেখা বায়না করছিল ফুলিকে দেখতে যাওয়ার জন্য। সুফিয়াই কী নিয়ে যেন ভীষণ ব্যস্ত ছিল। সময় দিতে পারছিল না। আজ যদিও সুফিয়াই নিজে থেকে ফুলিদের বাসায় ঘুরে আসতে চেয়েছে, কিন্তু সেটাও জুলেখার আবদার মেটাতেই। ফুলিদের বাড়িতে না গেলে হয়ত তার বোনটার আজ এই ভয়ানক বিপদ হতো না! সবকিছু জুলেখার দোষেই হলো!

আজ বিকেলের পর থেকে যা যা ঘটেছে, সেগুলো মনের মধ্যে ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ঘটে যাচ্ছিল।
সুফিয়ার ভেতরে কীসের যেন একটা খৈ ফুটছিল কিছুদিন ধরে। জন্মের পর থেকেই একরকম তার হাতেই মানুষ, জুলেখা সুফিয়ার ভেতরটা স্বচ্ছ কাঁচের মতোই পড়তে পারত একসময়। যে কথা সুফিয়া বলত আর যে কথা গোপন রাখত, জুলেখা তার সবটুকুই পড়ে ফেলত গড়গড়িয়ে। সুফিয়া এই নিয়ে কতদিন অনুযোগ জানিয়ে বলেছে, ‘ও বু, তুমি ক্যামনে সবকিছু আগে থেইকা বুইঝা ফালাও?’
অথচ গত বেশ কিছুদিন ধরেই সে তার আদরের বোনটাকে একেবারেই যেন চিনতে পারছিল না। এই বোন যেন জুলেখার সেই চিরচেনা বোনই না! আজ বিকেলে ফুলিদের বাড়িতে যেতে যেতে সে বলেছিল, ‘বুবু, তুমারে বেবাক কথা খুইলা কমু। আমারে আর দুইটা দিন সময় দাও! তুমার বোনে কুনো খারাপ কিছু করতাছে না!’ কিন্তু কিছু বলারই তো সময় পেল না তার বোনটা! তার
আগেই তো কী থেকে কী হয়ে গেল…

এদিকে জুলেখার মনে বারবার ভেসে উঠছিল সেই দুই পায়ে দুই রঙের মোজার ছবি! দুজন লোকের একজন কি তাহলে ফুলির স্বামীই ছিল? জুলেখার মন ভুল হতেই পারে না। ফুলির স্বামী মুজিবরের চোখেমুখে সে যে ছাপ দেখেছে সেটা তাকে স্বস্তি পেতে দেয়নি। কেন জানি মনে হচ্ছিল, ফুলি সুখি হতে পারেনি। নিজের মাকে বাইরের দুজন মানুষের সামনে এভাবে বারবার হেনস্থা করা, স্বামীকে এটা সেটা তুলে দেওয়ার জন্য তাড়া লাগানো, সময়মত খাবার না দিতে পারার জন্য খোঁটা দেওয়া… এসব কিছুতেই একজন সুখি মেয়ের আচরণ হতে পারে না। যত স্বামীপাগলা মেয়েই হোক, মাকে এভাবে অপদস্থ করার মধ্য দিয়ে ফুলি যেন নিজের ভেতরের অসুখী ব্যক্তিটাকেই বারবার সামনে বের করে ফেলছিল।
জুলেখা গ্রামের মেয়ে হলেও মানুষের মনের এইসব ভাবগতিক ভালোই বুঝতে পারে। হয়ত দুঃখের সাথেই জীবন গড়ে নিয়েছে দেখে দুঃখ তাকে মানুষ চিনতে শিখিয়েছে।

‘বাজান, মায়ে শুনছে? সুফিয়ার কথা?’
‘হ মা, শুনছে।’
‘মায়ে কি আমারে দোষ দিতাছে বাজান?’
‘তর মায়ের কথা ছাইড়া দে মা! তুই কি কুনোদিন তর মায়ের কথা নিয়া পইড়া ছিলি যে আজ থাকবি? তার মাথাটা কুনোকালেই ঠিক আছিল না!’
জুলেখা যেন সেই কথা শুনতেই পায়নি এমনভাবে বলল, ‘বাজান তুমি কি আমারে দোষ দিতাছ? তুমিও কি আমারে অবিশ্বাস করো বাজান? তুমি কি এইডা মনে করো যে আমি ইচ্ছা কইরা সুফিয়ারে ধরাইয়া দিছি?’
‘এইডা কী কইতাছোস মা? আমি মইরা গ্যালেও এই কথা বিশ্বাস করুম না! তর জান দিয়া হইলেও সুফিয়ারে তুই বাঁচানোর চেষ্টা করতি!’
‘কিন্তু মাইনষে সেইটা মানব না বাজান! সক্কলে মনে করতাছে আমিই সুফিয়ারে ধরাইয়া দিছি! আমি হইলাম গিয়া সৎ বোন! আমি কি ওর ভালা চাইতে পারি? আমি সুফিয়ার কেউ না!’ জুলেখা আর পারল না। ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল। নেয়ামত উল্লাহ সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পায় না। জুলেখার দিকে সরে এসে তার মাথায় হাত দেয়। ভিড়ের মধ্যে দুই একজন লোকের এমন উতপটাং কথাবার্তা তার কানেও এসেছে। মানুষ কারো ক্ষতে মলম দিতে না পারুক, সেই ক্ষতটাকে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করতে পারে ভালোমত!

প্রায় আধাঘণ্টা পর পুলিশস্টেশনের গেটের সামনে ভ্যানগাড়ি এসে দাঁড়াল। গেটে প্রায় ঘুমন্ত একজন চৌকিদার বসে বসে ঢুলছিল। নেয়ামত উল্লাহ তাকে কিছু বলতে যাবে এমন সময় জুলেখা হনহন করে কোনোদিকে না তাকিয়েই ভেতরে ঢুকে গেল।
কনস্টবেল রেজা এবং শরফুদ্দিন দুজনেই তখনো নিজেদের ডেস্কে বসে কাজ করছিল। ওসি নিজেও আজ সারাদিন কাজ করেছে, তাদেরকেও নিজেদের ডেস্ক থেকে সরতে দেয়নি। শোনা যাচ্ছে আগামিকাল নাকি কমিশনার সাহেব এখানে আসবেন। কমিশনার আসা মানে এসপি সাহেব তো আসবেনই! পুরো পুলিশস্টেশনে সেটারই আয়োজন চলছে, তবে গোপনে গোপনে।
সারাদিন ধরে পুলিশস্টেশনের ফাইলপত্র ঘাটাঘাটি চলেছে। সবকিছু আপডেট আছে কী না জানার জন্য দশ বিশ বছর এবং তারও আগের ফাইল প্রায় গর্ত থেকে টেনে বের করা হচ্ছে। ওসি সাহেব নিজে যেহেতু হাত লাগিয়ে সব কাজ করছে, কাজেই তাদেরও হাত গুটিয়ে বসে থাকার উপায় নাই। কনস্টেবল রেজা চুপচাপ নিজের কাজ করে গেছে সারাদিন। কিন্তু শরফুদ্দিন ভেতরে ভেতরে ফুঁসে মরছিল। ওসি সাহেব যে আজ সারাদিন তার সঙ্গে শুধু বিদ্রূপ আর কটাক্ষই করে গেছে তাই নয়, অন্য স্টাফদের সামনে রীতিমত তাকে হেয় করেছে।
শরফুদ্দিনের আর তর সইছে না। খুব তাড়াতাড়ি সে এসবের শেষ দেখতে চায়। তারপর এই ওসি হারামজাদাকে সে এমন ঘোল খাওয়াবে যে আজীবন সেটাকে যেন শ্রদ্ধার সঙ্গে মনে রাখতে পারে। যতই কমিশনার আসুক আর তার বাপ আসুক, কেউই কিছু করতে পারবে না। এসপি সাহেব জায়গামত কলকাঠি ধরে টান দিলেই সব একদিনে সোজা হয়ে যাবে! জামান শিকদার টের পায়নি সে কার সঙ্গে খেলতে এসেছে!
শরফুদ্দিন মনে মনে নীলনকশা আঁকতে থাকে। ফাঁদে পা পড়ামাত্রই ওসিকে নিয়ে সে কী করবে, কেমন হিল্লি দিল্লি ঘুরাবে সেটা ভেবেই তার অশান্ত মনটা ফুরফুরে হয়ে ওঠে।

‘আরে আরে…! কেডা আপনে? এমুন কইরা পুলিশ ইস্টিশনে ঢুইকা পড়তাছেন ক্যান?’
আচমকা একটা শব্দ শুনে শরফুদ্দিন আর রেজা হকচকিয়ে সামনে তাকিয়েই দেখতে পায় একজন তরুণী আলুথালু বেশে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং তার পেছনে পেছনে স্টেশনের গার্ড লাঠি হাতে নিয়ে মেয়েটিকে আটকানোর চেষ্টা করছে। পেছনে একজন মাঝবয়সী মানুষকে দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত মেয়েটির বাবা।
‘আরে! এ কী! পুলিশষ্টেশন কি চিড়িয়াখানা হইয়া গেল নাকি? যখন তখন যার ইচ্ছা সেই ঢুইকা পড়ে! মকবুল ঐ ব্যাটা মকবুল, বইসা বইসা ঘুমাইতাছিলি তাই না? আরেকজন আইসা পড়ছে! সকালের একজনের ঝাল অহনো চিপা চিপা বাইর হইতাছে! নতুন আরেকজন আইসা হাজির হইল!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-১৮+১৯

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_আঠার

সুফিয়া আর জুলেখা যখন ফুলিদের বাড়িতে পা দিলো, তখন ওদের বাড়িতে বেশ একটা সাজ সাজ রব। ফুলির মা হাসুবিবি রান্নাঘরে হিমশিম খাচ্ছে। তার দুই তিনজন সহকারীও তার সঙ্গে পেরে উঠছে না। তাদেরকে আশেপাশের বাড়ি থেকে বলে কয়ে আনা হয়েছে। নইলে হাসুবিবির একার পক্ষে আজ এই অল্পসময়ে এত কিছুর ব্যবস্থা করা কিছুতেই সম্ভব হতো না।

তরকারির হাঁড়ি চুলা থেকে নামিয়েই বাটিতে বাটিতে পরিবেশন চলছে। সেই বাটিগুলো আবার কয়েকদফা ভালোমত দেখেশুনে নেওয়া হচ্ছে সেগুলোতে কোনো ময়লা লেগে আছে কী না। দেখে শুনে মনমতো হওয়ার পরেই সেসব বাটিতে তরকারী ঢালা হচ্ছে।
এই হুলুস্থুল আয়োজন দেখে দুই বোনের আর বুঝতে বাকি রইল না বাড়িতে বিশেষ কোনো মেহমান এসেছে। জুলেখাদের দেখে হাসু বিবি একবার মুখ তুলেই সহাস্যে বলে উঠল, ‘ওহ আল্লাহ! তরা দুই বুইনে বাইছা বাইছা আইজকার দিনটাই খুঁইজা পাইলি আওনের লাইগা? কদ্দিন মনে মনে কইছি, জুলেখা আর সুফিয়া একবার একটু ভুলকি মাইরাও আমগো বাড়িত আহে না! তোগো মা তো ঠিকই একদিন আইছিল। তরা আইবার পারিস নাই?’

জুলেখা কর্মনিপুণা মানুষ বলেই হয়ত কোথাও কেউ কাজে হিমশিম খাচ্ছে দেখলে তার সঙ্গে হাত না মিলিয়ে থাকতে পারে না। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা চুলা থেকে তরকারির কড়াইটা নামাতে যাচ্ছিল হাসুবিবি। জুলেখা একরকম ছোঁ মেরে তার হাত থেকে লুচনি নিয়ে বলল, ‘সইরা বসো খালা। আমি নামাইতাছি। ঘাইমা তো এক্কেরে জবজব করতাছো!’

হাসু বিবি জুলেখার এই আন্তরিকতায় মনে মনে খুব খুশি হলো। মেয়েটা এমনই মায়াকাড়া, একে কেউ ভালো না বেসে থাকতেই পারে না! তবু মুখে বলল, ‘ও মা, তরা আইছস এট্টু গপসপ করোনের লাইগা! তুই ক্যান আমার কাম কইরা দিবি রে মা?’
জুলেখা সেই কথার উত্তর দেওয়ার দরকার মনে করল না। সুফিয়া উঠানে দাঁড়িয়ে উশখুশ করছিল। তার জুলেখার মতো এত কাজকর্ম করার শখ নাই। বুবুর এই আদিখ্যেতা দেখে সে মনে মনে ফুঁসতে লাগল। সব জায়গায় আগ বাড়িয়ে কাজ কাঁধে নেয়। কেন বাবা, এখানেও তাকে কাজ করতে হবে কেন? নিজের বাবার বাড়িতে দিনরাত ঝি গিরি করেও কি পোষাচ্ছে না?

জুলেখা ভাতের মাড় গালতে গালতে বলল, ‘কিন্তু খালা, তুমি এমুন রাজভোগের জোগাড়যন্ত্র করবার লাগছ কিয়ের লাইগা? কেউ আইছে নাকি?’
হাসু বিবি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আর কীই বা আয়োজন করবার পারছি! জামাই আইজ কদ্দিন পরে আইলো! এট্টু ভালামন্দ খাওয়াইবার না পারলে কি হয়? তাও গরীব মানুষ, সাধ্য কতটুকুন আমাগো!’
‘দুরু খালা কী কও? ম্যালা কিছু করছ! তা ফুলির জামাই কি কয়দিন থাকব?’
‘আরে না! আইজ সকালে আইছিল। এট্টু পরেই চইলা যাইব। ভাত দিতে দিতে দুপুর গড়াইছে আমার!’

ওদিকে সুফিয়ার মনের মধ্যে চিলিক দিয়ে উঠেছে ফুলির জামাই আসার কথা শুনে। সে তো মনে মনে এই ইচ্ছা নিয়েই এসেছে যে ফুলির কাছ থেকে তার স্বামীর ব্যাপারে একটু খোঁজখবর করবে। শ্বশুরবাড়ির কথা ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করবে। ফুলিটা এমন গাধী! একটু ভালোমত চেপে ধরলেই গড় গড় করে পেটের কথা সব বের করে ফেলবে! আর এদিকে তো দেখা যাচ্ছে, ফুলির জামাইও এখানেই মজুদ আছে। ভালোই হলো। একেবারে সোনায় সোহাগা!

সুফিয়া হাসুবিবিকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘ও খালা, ফুলির লগে কি এট্টু দেখা করবার পারুম?’
‘ও মা ক্যান পারবি না? ওই তো ঘরেই বইয়া আছে। জামাইও আছে। যা না দেখা কইরা আয়! তুই হইতাছস ফুলির ইশকুলের বান্ধবী। ছোটবেলার সই। তুই লজ্জা করছ ক্যান?’
সুফিয়া তবু একটু দোনোমোনো করতে লাগল। সে অবিবাহিত একটি মেয়ে। নারী পুরুষের প্রেম ভালোবাসার মুহূর্তগুলোতে বাইরের কেউ এসে পড়লে তারা নাকি খুব বিরক্ত হয়। জামাই বউ দুইজনেই ঘরের মধ্যে খিল এঁটে বসে আছে। প্রেমালাপ করছে কী না কে জানে! এই অবস্থায় সে ভেতরে ঢোকে কীভাবে?

জুলেখা কাজ করতে করতে সুফিয়ার দিকে আড়চোখে তাকাল। সুফিয়ার ইতস্তত মুখের ভাব দেখে তার খুব মজা লাগল। যাক, দুদ্দাড় উতপটাং কাজে অভ্যস্ত তার বোনের তবে একটু হলেও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। দুম করে ফুলির ঘরে ঢুকতে সে সঙ্কোচ বোধ করছে। জুলেখা একটু সহজ করার জন্য বলল, ‘ও সুফিয়া, তুই উঠান থেইকা ফুলির নাম ধইরা ডাক দে না! ফুলি বাড়াইয়া আইব তাইলে!’
ভালো বুদ্ধি! সুফিয়া নিজের মাথায় মনে মনে একটা রাম চাপাটি দিলো। তার বুবুটার এমনিতে বুদ্ধিশুদ্ধি না থাকলে কী হবে, এইসব ঘরসংসারের বুদ্ধিতে মাথাটা একেবারে গিজগিজ করছে!

সুফিয়া একটু এগিয়ে গিয়ে জুলেখার কথামতো চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল। জামাই বউ শুধু যে ঘরের মধ্যেই ঢুকে বসে আছে তাই না, বেহায়ার মতো মায়ের উপস্থিতিতে ঘরের দরজাটাও বন্ধ করে দিয়েছে! ছাগল মার্কা মানুষ হলে যা হয়! বিয়ের পরে একেবারে লাজ শরমের মাথা খেয়ে ফেলতে হয় যেন!

সুফিয়ার হাঁকডাকে ঘরের দোর দুম করে খুলে গেল। তারপর সুফিয়াকে দেখেই ফুলির মুখে এক পশলা বৃষ্টির মতোই হাসি খেলে গেল। ইয়া বড় পেট নিয়ে সে থপ থপ করে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘ওরে আল্লাহ! সুফিয়া তুই আইছস! কতদিন মায়েরে কইছি, ও মা আমি এট্টু সুফিয়ার লগে দ্যাখা কইরা আসি। ঐ ছেমড়ি তো আমার কাছে আসোনের সময়ই পায় না! আমিই গিয়া দ্যাখা দিয়া আসি! আইছস তো ম্যালা ভালা দিনে আইছস। তর দুলাভাই আইছে। আয় তর লগে আলাপ করাইয়া দেই!’

সুফিয়া মনে মনে বলল, ‘হ, এইবার একটা ভালা কথা কইছস!’ মুখে বলল, ‘আলাপ তো করুমই, কিন্তু তার আগে তরে এট্টু দেইখা লই। মা গো মা, এত্ত বড় প্যাট বানাইছস! এই প্যাট নিয়া হাঁটাচলাও তো করবার পারতাছস না! এইডা আর কিছুদিন পরে বানাইলে কি ম্যালা ক্ষতি হইয়া যাইত নাকি?’
ফুলি লাজনম্র মুখে বলল, ‘আমি তো আর কয়েকডা দিন পরেই চাইছিলাম লইতে। তেনার তো সবুর সইল না!’
সুফিয়া মনে মনে আরেকবার বলল, ‘বেহায়া ছেমড়ি!’

ফুলির স্বামী মুজিবর চিকনা পটকা গোছের একজন মানুষ। মাথার চুলগুলো বিশেষ কায়দায় ব্যাক ব্রাশ করা। গায়ে একটা ফুলতোলা সুতির পাঞ্জাবি। সেই পাঞ্জাবির গলার কাছে একটা সানগ্লাস ঝুলিয়ে রাখা। ফুলি সুফিয়াকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই সে পকেট থেকে একটা চিরুনি বের করে চুলগুলো একবার আঁচড়ে নিলো। সানগ্লাসটাকে শুধু শুধু গলার কাছ থেকে নামিয়ে একবার ভাপ দিয়ে মুছে নিলো। তারপর একটা বিশেষ এঙ্গেলে বউয়ের বান্ধবীর দিকে তাকিয়ে নিজের বউকে বলল, ‘কেডা?’
‘আমার বান্ধবী সুফিয়া। ওর কথা তুমারে আগেই কইছি। মনে কইরা দ্যাখো। মাগো মা! এমুন অংকের বেরেন! তুমি যদি দ্যাখতা!’
ফুলির স্বামী মুখেচোখে ব্যাপক ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আইচ্ছা অংকে ভালা? ঠিক আছে, আলাপ পরিচয় করি আগে। এরপর আমি অংকের পরীক্ষা লমু। দেখুম তুমার বান্ধবী অংকে কেমুন ভালা!’

ফুলি এই কথা শুনে পরম প্রশান্তি নিয়ে সুফিয়ার দিকে চাইল। ভাবখানা এই, ‘আমার জামাইয়ের পরীক্ষায় পাশ না করলে তরে কইলাম আমি আর গোণায় ধরুম না!’
ওদিকে সুফিয়া ফুলির জামাইয়ের ভাবসাব দেখে হাসি ঠেকায়ে রাখতে পারছে না। মনে মনে বলল, ‘ব্যাটা গাড়ল! আইছে আমার পরীক্ষা নিবার! হুহ! ক্লাস থ্রি পাশ করছে বইলাই তো মনে হয় না, হেয় নাকি আমার অংকের পরীক্ষা নিব!’

সুফিয়া ওসব কথার পাশ কাটিয়ে ফুলির স্বামীর সঙ্গে অন্য আলাপ দিয়ে ভাব জমাল।
‘দুলাভাই, আপনেরে সেই বিয়ার সময়ে দেখছিলাম, আর এই আবার আইলেন! মাঝে মাঝে এট্টু শ্বশুরবাড়িতে আইলে না আমরাও চেয়ারম্যানের বাড়ির লোকের দেখা সাক্ষাত পাই!’
মুজিবর এই কথা শুনে কিছু বলল না। শুধু তার ভাবসাব আরেকটু বেড়ে গেল। ফুলি পাশ থেকে উত্তর দিলো, ‘তুই চেনোস চেয়ারম্যানরে?’
ফুলি গাল উল্টিয়ে বলল, ‘চেয়ারম্যানরে কেডায় চেনে না? তিনি আমাগো মাথার ওপরে ছায়া হইয়া আছেন! দুলাভাই… চেয়ারম্যানগো ম্যালা খাটাখাটনি করোন লাগে তাই না? তারা নাকি দম ফেলনেরই ফুরসত পায় না!’ সুফিয়া একটু কৌশলি হওয়ার চেষ্টা করল।

এবারে ফুলির স্বামী মুজিবর কথা বলল। ‘চেয়ারম্যানের আসল কামকাজ তো তার লগের লোকজনরাই কইরা ফালায়। এই যেমন আমারে তিনি খুব ভালাবাসেন। তার বেবাক রকম আসল আসল কামকাজ আমি কইরা দেই। ফাই ফরমাশ আর ছুটকা মুটকা কামকাজ করোনের লাইগা আলাদা লোকজন আছে।’

‘ওহ! তাই কন। আমি তো চিন্তা কইরাই কূল পাইতাম না তিনি একা মানুষ এতদিকে ক্যামনে সামলান! আচ্ছা… একটা কথা। তেনার ভাই নাকি খুন হইছেন?’
আবার ফুলিই প্রথম কথা বলল, ‘তুই এইডা কার কাছ থেইকা শুনছস? ওহ… আচ্ছা মনে পড়ছে। সেইদিন হনুফা চাচি আইছিল। চাচিরে আমিই কইছি। হ… ভালামানুষ আছিল!’

মুজিবর গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, ‘আশেপাশে আজেবাজে মানুষজন থুইলে খুন তো হইবই!’
‘কার কথা কইতাছেন দুলাভাই?’ সুফিয়া সূত্রের সন্ধান পেয়ে উৎসুক হয়ে ওঠে।
‘কার কথা আবার? যেই ছেমড়া খুন করছে! ঐ যে শমসের। পুলিশ তো তারে গরু খোঁজা খুঁজতাছে সেই কবে থাইকা। হারামজাদা কই যে পলাইয়া আছে!’
‘ঐ ছেমড়া খুন করল ক্যান?’

‘ক্যান আবার? হয়ত লেনদেন লইয়া বচসা লাগছিল। দুলাভাইয়ের ভাইয়ের মাথাডা তো তার ঐ সাগরেদেই চিবাইতাছিল। খুন কইরা পলাইয়া গ্যাছে হারামজাদা!’
‘আপনের কী মনে হয়? কই পলাইতে পারে? পুলিশ এত খুঁইজাও পাইতাছে না!’
‘দুরু সুফিয়া… কী সব ঘোড়ার ডিমের প্যাঁচাল জুড়লি! কদ্দিন পরে তরে দ্যাখলাম! ইট্টু তর ইশকুলের গপসপ কর। আমি কেমুন সংসার করতাছি হেইডাও তো জিগাইলি না! আর তর দুলাভাইয়ের লগে গপ করন লাগব না।’ আবারও ফুলি কথার মাঝখানে বাগড়া দিলো। সুফিয়া মনে মনে খিঁচে একটা গালি দিলো ফুলিকে।

‘গাধি ছেমড়ি মাঝখানে না সান্ধাইলে মন ভরে না! তর সংসারের খবর জানোনের লাইগা ত আমার ঘুম আইতাছে না!’ মুখে কিছু বলতে পারল না। সমাজে বাস করার এই হচ্ছে ঝামেলা। শুধু একটা হাসি দিয়ে মুজিবরের দিকে তাকালো। মুজিবর একটা অবজ্ঞার হাসি দিয়ে বলল, ‘হ ফুলি তো ঠিকই কইছে! তোমরা দুই সই ঘর সংসার সেলাই ফোঁড়াই রান্নাবান্না এইসব নিয়া গল্প করবা। অংক খুন এইগুলান ভারি ভারি জিনিস তোমাগো পাতলা মাথায় ঢুকাইলে তো দুইদিনেই পাগল হইয়া যাইবা! হাহ হা হা…’

ওদিকে হাসুবিবি তখন জামাইকে খেতে বসানোর জন্য জোর হাতে কাজ করে যাচ্ছে। সঙ্গে জুলেখাও সমানতালে কাজ করছে। হনুফা বিবির এবারে একটু অপরাধবোধ হলো। বলল, ‘তোরা আইছস দুইটা কথা কওনের লাইগা। আমি তরে কামে লাগাইয়া দিছি!’
‘খালা আপনে আমারে কই কামে লাগাইছেন? আমি নিজেই তো করতাছি!’
‘জুলেখা তর মায়ে আইছিল সেইদিন। দুনিয়ার এইদিক সেইদিকের প্যাঁচাল! সুফিয়ার লাইগা চেয়ারম্যানের ছোট পোলার খোঁজ করতাছে! ঐদিকে তুই যে অখনো বিয়ার মাইয়া বইসা আছোস সেইডা দেখে না?’

জুলেখা কাজ করতে করতে বলল, ‘খালা আমার লাইগা কি সুফিয়ার বিয়া আটকাইয়া থোওন লাগব? আমি হইলাম পাতিলের কালি! আমারে কেডায় বিয়া করব? কিন্তু সুফিয়া কত সুন্দর দ্যাখতে। কত ভালা ভালা প্রস্তাব আসে ওর! আমার বিয়ার লাইগা তো ম্যালাদিনই দ্যাখছে! আর কত?’
‘তুই পাতিলের কালি? নিজেই নিজেরে নাম দিয়া দিলি? গায়ের রঙখান এট্টু মাজা, এইডারে পাতিলের কালি কয় নাকি? আর তর মুখের ছিরি ছাঁদ কি কম সুন্দোর? তর মায়েও দ্যাখতে এইরাম সুন্দোর আছিল। তর তো মনে নাই অখন। আমরা দ্যাখছি। মনে আছে!’

মায়ের কথায় জুলেখার মনে কুল কুল নদীর সেই কলতানটা আবার ভেসে এলো যেন। আহারে! মা! কতদিন ঐ প্রিয় মুখটা দেখেনি সে!
তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে জুলেখা বলল, ‘হ খালা! আপনে আমারে ভালা পান এর লাইগা সুন্দোর দ্যাখেন। আপনের চোখ দিয়া দ্যাখলে কবেই আমার বিয়াশাদী হইয়া…’

‘ও মা ওর নাকি দেরি হইয়া যাইতাছে! খাওন দিবা না?’ ফুলি বারান্দা থেকে হাঁক দিলো। হাসুবিবি শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘এই যে মা, অক্ষুনি দিতাছি!’ বলেই জুলেখার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ও মা আমারে আরেকটু আগাইয়া পাড়াইয়া দে! তুই না থাকলে আইজ তো খাওনই দিবার পারতাম না! ও মা, তুই আর সুফিয়া কিন্তু আজ এইখান থেইকা খাইয়া যাইবি! না খাইয়া যাইবার পারবি না!’
‘মায়ে তো চিন্তা করব খালা!’
‘হ! তর মায়ের তো তর চিন্তায় ঘুমই আহে না…’ (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_উনিশ

খাবার টেবিলে বসে ফুলির স্বামী আর অন্যদিকে তাকিয়ে সময় নষ্ট করল না। সামনে পরিবেশিত খাবার আর তার হাত এবং মুখ, এই তিনটি জিনিস ছাড়া তখন সে কাউকেই চেনে না!
মুজিবরকে খেতে বসিয়ে তার শাশুড়ি, বউ, জুলেখা আর সুফিয়া প্রত্যেকেই তদারকিতে নেমে পড়ল। ফুলি একপাশে বসে নিজের ঐ হাঁসফাঁস শরীর নিয়েই পাখা ঘুরিয়ে যেতে লাগল। শাশুড়ি একের পর এক আইটেম জামাই বাবাজির সামনে পরিবেশন করে যেতে লাগল। সুফিয়া আর জুলেখা একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই তামাশা দেখতে লাগল। মাঝে মাঝে জুলেখা হাসুবিবিকে এটা সেটা এগিয়ে দিয়ে সাহায্য করতে লাগল।

যেভাবে হাপুস হুপুস করে ফুলির বর খেতে লাগল, দেখে সুফিয়া কিছুতেই নিজের হাসি সামাল দিতে পারছিল না। জুলেখা বারকয়েক সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে ইশারায় হাসতে বারণ করেছে। বারণ করেছে ঠিকই, কিন্তু নিজে মুখ নিচু করে আঁচলের নিচে হাসি চাপা দিয়েছে। ছেলেটা সত্যিই একেবারে হাভাতের মতো খাচ্ছে। আরে খাওয়াদাওয়া তো পালায়ে যাচ্ছে না! একটু আস্তে আস্তে খা! দেখে মনে হচ্ছে যেন কতদিন ভালোমন্দ কিছু খায়নি!
ওদিকে সুফিয়া মনে মনে ভাবছে, ‘আহারে চেয়ারম্যান সাবের এসিস্টেন্টের খাওয়ন দেখো! চেয়ারম্যান হ্যারে ছাড়া নড়বার পারে না, আর ঐদিকে বেচারারে না খাওয়াইয়া রাখে! ইশ রে!’

ঐদিকে ফুলি ক্রমাগত তার মাকে বলতে লাগল, ‘ও মা, থোড়ের বড়া মোটে দুইটা দিলা ক্যান? আরো দুইটা দাও না? আর কে খাইব? … ডাউল পরে দাও! তরকারি না দিয়াই আগে ডাউল দিলা? খাওনডাই ত নষ্ট কইরা দিলা!’
সুফিয়া আরেকবার মনে মনে ফুলিকে ‘গাধী’ বলে সম্বোধন করে বলল, ‘বিয়ার আগে যেইটুক বুদ্ধি আছিল বিয়ার পরে সেইডাও গ্যাছে! আগে ছিল ছাগলী, অখন হইছে গাধী!’

জুলেখা এর আগে ফুলির স্বামীকে দেখেনি। সে একটু দূর থেকে ভালো করে তাকেই দেখছিল। কিন্তু কেন জানি, ছেলেটাকে দেখে জুলেখার কিছুতেই ভালো লাগল না। মেয়েদের একটা তৃতীয় নয়ন থাকে। সেই নয়নে যা ধরা পড়ে, তা অন্য দুই চোখ দেখতে পায় না।
বেচারা হাসু খালা গরমে ঘেমে নেয়ে এতক্ষণ ধরে জামাইয়ের জন্য রান্নাবান্না করেছে। অথচ ছেলেটা খেতে বসে একবারের জন্যও বলল না, ‘আম্মা আপনে এই গরমে খাড়াইয়া আছেন ক্যান? আপনেও আমার লগে খাইতে বসেন!’ খেতে বসতে না বলুক, বসতে তো বলতে পারে! আর ফুলিও বিয়ের পরে কেমন জামাইপাগলা হয়ে গেছে। জামাইকে ঠেসে ঠেসে খাওয়ানোর দিকেই তার পুরো মনোযোগ। মায়ের দিকে ভ্রুক্ষেপও করছে না!
জুলেখা ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তার বিয়েশাদী হয়নি অথবা হবেও না কোনোদিন, আর তার মাও বেঁচে নেই। কিন্তু স্বামীর জন্য যদি মায়ের সঙ্গে এরকম আচরণ করতে হতো, তাহলে সে ইচ্ছে করেই বিয়ে করতে চাইত না কখনো।

মুজিবর খেতে খেতে কয়েকবার নিজের ঘড়ি উল্টিয়ে দেখেছে। হাসুবিবি এটা দেখে বলে ফেলল, ‘বাবার কি কুনো তাড়া আছে কুনোখানে যাওনের? এট্টু আরাম কইরা আস্তেধীরে খাও বাবা। বেশি জোরে খাইলে এই গরমে খাওনদাওন হজম হইবার চাইব না!’
মুজিবর মুখচোখে একটা অবজ্ঞার ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, ‘আমার তো আম্মা বইসা থাকোনের কুনো উপায় নাই! চেয়ারম্যান সাব আমারে আবার চক্ষে হারান। দুই তিনজন আকাইম্মার ঢেঁকী আছে তার দুনোধারে। একটা করতে কইলে আরেকটা কইরা বইসা থাকে। তাগো ভরসায় কি তিনি থাকতে পারেন? খাওন দিতে দিতে এট্টু বেশি দেরি কইরা ফালাইছেন আম্মা! অখন খাইয়া দাইয়া রওয়ানা দিতে দিতে আন্ধার হইয়া যাইব!’

হাসুবিবির মুখ কালো হয়ে যায়। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে জুলেখার নিজের চোখেই প্রায় পানি চলে আসে। কেমন অপদার্থ জামাই! এইভাবে শাশুড়িকে বলে!
ফুলি গাল ফুলিয়ে বলে, ‘আমি মায়েরে সেই কুন বিয়ান বেলা থেইকা কইছি, জলদি জলদি পাকসাফের ব্যবস্থা করতে! মায়ের বেবাক কাজেই খালি ঢিলাঢালা দেওয়া!’

সুফিয়া এই দৃশ্য দেখে আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে কোথায় আছে, তার পরিচয় কী… সব কথাই সে নিমেষেই ভুলে গেল। সাপের মতো ফোঁস করে বলে উঠল, ‘খালার কি দশটা হাত নাকি ফুলি? তুই নিজে তো ইয়াব্বড় একখান পেট বানাইয়া বইসা আছোস! বেবাক কাম খালার একা করোন লাগছে! কইলেই কি সাথে সাথে খাওন রেডি কইরা ফালান যায়? আর দুলাভাই… একদিন না হয় চেয়ারম্যান সাব আপনারে ছাড়াই কাম চালাইয়া লইল। এট্টু শ্বশুরবাড়ির আলোবাতাস ভালা কইরা খাইয়া যান!’

মুজিবর এই কথা শুনে ভ্রুটাকে সরু করে সুফিয়ার দিকে তাকাল। মনে মনে ভাবল, এই ছেমড়ি তো বহুত সেয়ানা! সব কিছুতেই বাঁও হাত সান্ধাইয়া দেয়!
ফুলির চোখেও অবাক চাহনি। বান্ধবীর এই জায়গায় হস্তক্ষেপ তার একেবারেই ভালো লাগল না। হাসুবিবিও একটু অপ্রস্তুত হয়ে কথাটাকে সেখানেই চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল। আর জুলেখা কটমট করে সুফিয়ার দিকে তাকাল। সেই চাহনির অর্থ হচ্ছে, ‘তুই খালি বাড়িত চ! তরে আমি আইজ দেখুমনে! বেবাক কথার লগে কথা কওয়া তর ছুটাইতাছি!’
মুজিবর কিন্তু চাহনি দিয়েই ক্ষ্যান্ত হলো না। একটা তীব্র শ্লেষভরা গলায় বলল, ‘আদার ব্যাপারীর কি জাহাজের খবরাখবর রাখলে চলে? তার আদা লইয়াই খুশি থাকোন ভালা গো শালি! বুঝলা?’

এসব কথাবার্তার মধ্যেই জুলেখার চোখ পড়ে যায় মুজিবরের পায়ের দিকে। এই প্রচণ্ড গরমে সে মোজা পরে বসে আছে। তাও আবার দুই পায়ে দুই মোজা। এক পায়ে কালো আরেক পায়ে লাল চকরাবকরা নকশার মোজা। জুলেখার হঠাৎ সুফিয়ার রোগ ধরল। বহু কষ্টে হাসি সামলাতে গিয়ে সে বারকয়েক হিঁচকি তুলে ফেলল। সুফিয়া কাছে এসে মাথায় থাবাড় দিয়ে বলল, ‘আরে কী হইল? হিঁচকি শুরু হইল ক্যান? ও বু!’

খাওয়া দাওয়ার পাঠ চুকতে চুকতে বিকেল গড়ালো। হাসু বিবি এই অসময়ে সুফিয়া আর জুলেখাকেও জোর করে খাইয়ে দিলো।
ঐদিকে এত হম্বিতম্বি আর কাজের ব্যস্ততা দেখিয়েও ফুলির স্বামী কিন্তু যাওয়ার নাম মুখে নিলো না। সে বেশ আয়েশ করে তাকিয়ায় হেলান দিয়ে শাশুড়ির সাজিয়ে দেওয়া পান মুখে দিয়ে চিবুতে লাগল। সুফিয়ার মুখ চুলকাতে লাগল। বোনের বজ্রচাহনি উপেক্ষা করেই সে বলল, ‘ও দুলাভাই, আপনের চেয়ারম্যানে মনে হয় অখন দিনদুনিয়া আন্ধার দ্যাখতাছে!’
মুজিবর কিছু বুঝতে না পেরে ভ্যাবলার মতো তাকালো। সুফিয়া যোগ করল, ‘এই যে আপনে অখনো যাইতে পারেন নাই!’
জুলেখা একটা রাম চিমটি কাটল সুফিয়ার কোমরে। সুফিয়া চেঁচিয়ে উঠল… ওহ মাগো!

সুফিয়ার খোঁচা খেয়েই হোক অথবা অন্য যে কারণেই হোক, মুজিবর এরপর আর না উঠে পারল না। ফুলির মুখচোখ অন্ধকার হলো। না থাকতে পেরে হাসুবিবিও বলে ফেলল, ‘মা সুফিয়া, বেবাক কথায় মুখ নাড়াইতে হয় না। দুইদিন পরে তরও বিয়াশাদী হইব। এইগুলান না বুঝলে শ্বশুরবাড়িতে তিষ্টাইতে পারবি না মা! দুনিয়া এত সোজা না!’
সুফিয়া এই কথারও উত্তর দিলো। ‘হ হেইডা ত জুলেখাবুরে দেইখা রোইজই বুঝতাছি! শ্বশুরবাড়ি লাগব না, নিজের মায়ে না থাকলেই দুনিয়ার কেউই চেনে না!’
উপস্থিত সকলেই বুঝতে পারল, যাকে তারা নাদান মনে করে দিন দুনিয়ার জ্ঞান দিচ্ছেন সে তাদের কারো চাইতে কোনোকিছুই কম বোঝে না। বরং সবার চাইতে আরো কয়েক কাঠি বেশি বোঝে!

মুজিবর চলে যাওয়ার পরে হাসুবিবি সুফিয়া আর জুলেখাকে যেতে দিতে চাইল না। জুলেখার মায়ের সঙ্গে হাসু বিবির অনেক সখ্য ছিল একসময়। তার মেয়েটাকেও হাসু বিবি খুব স্নেহ করে। সৎ মায়ের সংসারে জুলেখার যে অনাদর হয়, কমবেশি গ্রামের সবাই তা জানে। আর জুলেখার মায়ের বন্ধু হওয়ার কারণে হাসুবিবির তার প্রতি আলাদা একটা পক্ষপাতিত্ব কাজ করে। জুলেখাকে বারবার থাকার জন্য অনুরোধ করতে থাকে হাসুবিবি।
‘ও জুলেখা আইজ কদ্দিন পরে আইলি আমারে দ্যাখতে! তর মায়ে বাঁইচা থাকলে কি এদ্দিন পরে আইতি? তর লগে কত গল্প করবার মন চায়। আইজ এমুন সময়ে আইলি যে দুইডা কথাও ভালামত কইবার পারলাম না! আরেকটু থাক না! এট্টু পরে যাইস!’
‘নাগো চাচি! ম্যালা দেরি হইয়া গ্যাছে। মায়ে এতক্ষণ বাড়িত চইলা আইছে। আমাগো না দেইখা অস্থির হইয়া যাইব!’
‘তর মায়ের কথা থুইয়া দে! বেবাকই তার মন মর্জি!’

শেষমেশ আরো প্রায় কুড়ি মিনিট পরে জুলেখা আর সুফিয়া ছাড়া পেল। যাওয়ার আগে হাসু বিবি কিছু পিঠাও বেঁধে দিলো তাদেরকে। জুলেখাকে কানে কানে বলল, ‘তুই এট্টু আলাদা কইরা খাইশ! বেবাকটাই সৎ মায়েরে খাওয়াস না!’
জুলেখার মুখ চাপা হাসিতে উদ্ভাসিত হলো। মা চলে গেছে ঠিকই, কিন্তু মা নিজের বন্ধুর কাছে কিছুটা স্নেহের পরশ তার জন্য ছেড়ে গেছে।

এদিকে মুজিবর যেতে যেতেই একটা ফোন পেল। ফোনদাতার নাম দেখেই তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। এই সময়ে ইনার ফোন! কোনো দুঃসংবাদ নয় তো? দুঃসংবাদ তো আর কারো না, তার নিজেরই দুঃসংবাদ হয়ত! পরের বাড়িতে আশ্রিত থাকে। পান থেকে চুন খসার ভয় করে সারাক্ষণ। কোথায় যে কখন ভুলভাল হয়ে যায় কে জানে!
‘এই যে কেমুন আছেন আপনে?’
‘হ ভালা আছি! আপনে হঠাৎ আমারে ফোন দিছেন এই সময়ে?’
‘জি দিছি। আপনে কোথায় এখন? বাড়িত আছেন নাকি শশুরবাড়িত হাওয়া খাইতে গ্যাছেন?’
‘এট্টু আইছিলাম আর কী বউয়ের বাড়ি, নোয়াহাটি। অখনই ফিরতাছি!’

‘আইচ্ছা তাইলে তো ভালা সময়েই ফোন দিছি। শুনেন, আপনে যে অখন আপনার শ্বশুরবাড়িতে মণ্ডা মিঠাই খাইতাছেন সেইডা আমি ভালা কইরাই জানি। হের লাইগাই আমার একজন লোকেরে আপনার শ্বশুরবাড়ির কাছাকাছি দাঁড় করাইয়া রাখছি। সে দাঁড়াইয়া আছে আপনার শ্বশুরবাড়ি থেইকা এট্টু দূরে বিলের পাশে যে বট গাছটা আছে, সেইটার নিচে। আপনে তো খুব করিতকর্মা মানুষ, তাই এই কাজ একা আপনের দ্বারা নাও হইবার পারে!’
‘জি কী করতে হইব একবার খালি কইয়া দ্যাখেন! জান দিয়া করুম!’
‘আপনের জান দিয়া আমার কী কাম? ঐটা নিজের কাছেই থুইয়া দ্যান। আপনার শ্বশুরবাড়ির গ্রামে একডা মাইয়া আছে, নাম হইতাছে সুফিয়া। এই মাইয়াডারে তুইলা আনোন লাগব! মাইয়ার খুব লম্বা পাখনা গজাইছে!’

নামটা শোনামাত্রই মুজিবরের মনের মধ্যে বিরাট একটা বজ্রপাত হলো। সুফিয়া! তার বউ ফুলির ঐ বাচাল বান্ধবী! কী করছে এই মাইয়া? গ্রামে এত মানুষ থাকতে এই মাইয়ারে ক্যান উঠানোর দরকার পড়ল!
‘কী খুব চিন্তায় পইড়া গ্যালেন মনে হইতাছে! এই মাইয়া কী করছে এইটা জানলে আপনের পিলা চমকাইয়া যাইব! বহুত ঘাউড়া মাইয়া! আপনের বউয়ের বান্ধবী! বেবাক খবর নিছি আমি। বেশি দেরি কইরা কামে ডিসটার্ব কইরেন না। যদি বেশিদূর চইলা গিয়া থাকেন তাইলে আবার উল্টা ঘুরানি দ্যান। আমার লোকরে খুঁইজা বাইর কইরা নিজের কাম শ্যাষ করেন!’
মুজিবর ফোন রেখে দিয়েই সত্যি সত্যি উল্টা হাঁটা দিলো। নির্দেশ মোতাবেক কাজ না করলে তার নিজেরই অস্তিত্ব নাই হয়ে যাবে। দুইটা হুকুম তালিম করেই তো ঘাড়টা এখনো একটু শক্ত রেখেছে। নইলে এই ফুটানি কবেই ফুটা গ্যাস বেলুন হয়ে ফুস হয়ে যেত!

যেতে যেতে সুফিয়ার কথাই ভাবছিল মুজিবর। এত কামিয়াব মেয়ে যে এত হাই লেভেলে তার খবর পৌঁছে যায়! কী করেছে শুনলে নাকি পিলে চমকে যাবে! আর মুজিবর কী না এই মেয়েকে অবজ্ঞা করছিল!
বটগাছের কাছাকাছি যেতেই লোকটা বেরিয়ে এলো। চোখেমুখে একটা বড় কাপড়কে মাফলারের মতো করে পেঁচিয়ে ঢেকে রেখেছে। চেহারা বোঝার কোনোই উপায় নাই। কাছাকাছি আসতেই মুজিবর বলল, ‘ভাই আপনে কি আমার চেনা পরিচিত?’
লোকটা রোবটের মতো গলায় বলল, ‘সেইটা দিয়া কী করবেন? শশুরবাড়িত নিয়া জিয়াফত খাওয়াইবেন? কাম বুইঝা লইছেন না? হুম… লন এইবার হাঁটা দ্যান! ওহ আচ্ছা… খাড়ান! এই কাপড়টা দিয়া নিজের মুখ চোখ ভালামতো ঢাইকা নেন! খবরদার চেহারা যাতে এট্টুও না বোঝান যায়।’

মুজিবর নির্দেশ পালন করল। লোকটা বলল, ‘লন এইবার মাইয়ার বাড়ির দিকে যাই। আমি যেমুন যেমুন বলুম সেই রকম কইরা কাম করবেন। বেশি কাম করবার যাইয়েন না!’
মুজিবর মিনমিন করে বলল, ‘কিন্তু আমি তো মাইয়ার বাড়ি চিনি না! মানে সুফিয়ার বাড়ি!’
‘এই যে একটা বেশি কথা কইয়া ফালাইলেন! আমি কইছি না, বেশি কথা কইবেন না? মাইয়ার বাড়ি আপনারে চিনতে হইব এইটা কইছি আমি? আপনে খালি আমার পিছে পিছে আসেন!’

মুজিবর আর কিছু বলল না। একটু আগেই যে সুফিয়া ফুলিদের বাড়িতে এসেছিল এবং সম্ভবত এখনো সেই বাড়িতেই আছে, এই কথাটাও চেপে গেল। এই ব্যাটা যখন এত সবজান্তার ভাব দেখাচ্ছে তখন সেই তাকে খুঁজে বের করুক!
ভাগ্য ভালোই বলতে হবে। তারা যখন বটগাছের সীমানা ছাড়িয়ে ক্ষেতের আলে গিয়ে নেমেছে, তখনই দেখতে পেল শুনশান পথ দিয়ে দুটো মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। দেখামাত্রই মুজিবর চিনে ফেলল তারা কারা। নির্দেশ অমান্য করে আবার সে বলে উঠল, ‘ঐ যে সুফিয়া! লগে ওর বইনও আছে!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-১৬+১৭

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_ষোল

নিতান্ত অনিচ্ছাতে গাড়ির পেছনের সিটে উঠেই সামনে সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা বিষদৃষ্টি দিলো শরফুদ্দিন। তার মোবাইলের মেসেঞ্জারে একটা নতুন মেসেজ এসেছে এইমাত্র। খুলে দেখতে যাবে এমন সময় গাড়ির দরজা খুলে জামান শিকদার গাড়িতে উঠল। তার দৃষ্টি সোজাসুজি শরফুদ্দিনের দিকে নিবদ্ধ। শরফুদ্দিন ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে গেল। চট করে মোবাইলটাকে সরিয়ে ফেলল। তারপর চিন্তামগ্ন চোখে পথের দিকে তাকিয়ে রইল। জামান শিকদার বারকয়েক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘শরীর খারাপ লাগছে নাকি শরফুদ্দিন?’
‘ক…কই… না তো স্যার!’
‘শরফুদ্দিন… কী যে এত ভাবনা তার সারাটা রাতদিন!’ ছন্দে ছন্দে মিলিয়ে জামান শিকদার একা একাই একটু হাসল। শরফুদ্দিনের মুখের ভাবে কোনো পরিবর্তন দেখা দিলো না। পথে খুব বেশি কথাবার্তা হলো না। জামান শিকদার, সুফিয়া, শরফুদ্দিন এমনকি মোতালেব… কারো মুখেই কথা নাই। সবাই যেন রুদ্ধশ্বাসে কিছু একটা দুরূহ আবিষ্কারের নেশায় উর্ধগতিতে ছুটে চলেছে।

জঙ্গলের কাছাকাছি এসে বেশ কিছুটা দূরেই তারা সবাই গাড়ি থেকে নামল। ততক্ষণে পেছনের গাড়িটাও চলে এসেছে। সামনে সশস্ত্র পুলিশদের রেখে তারা তিনজন পেছনে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে লাগল। তার অবশ্য দরকার ছিল না তেমন। শুনশান নিস্তব্ধ জঙ্গলে কোনো জনমানবের অস্তিত্ব নেই। শুধু নাম না জানা পাখিরা মাঝে মাঝে অশ্রুত ভাষায় ডাক দিয়ে সবাইকে যেন জানিয়ে যাচ্ছে জঙ্গল পুরোপুরি নিঃসঙ্গ নয়। হঠাৎ কখনো দূর থেকে ভেসে আসছে বিচিত্র প্রাণীর আওয়াজ।

জামান শিকদার একবারের জন্যও শরফুদ্দিনের ওপর থেকে চোখ সরাচ্ছে না। শরফুদ্দিনের মুখে যেন অমাবস্যা নেমেছে। থপ থপ করে পা ফেলে নিতান্ত অনিচ্ছাতে সে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। জামান শিকদারের কেন জানি বারবার মনে হচ্ছে, তার ওপর থেকে চোখটা একবারের জন্য সরিয়ে নিলেই এই লোক কিছু একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে।
মাঝামাঝি আসার পরে জামান শিকদার সুফিয়াকে বলল, ‘তুমি সেই জায়গাটা চেনো তো? নিয়ে যেতে পারবে কি আমাদের?’
‘হ স্যার আমি চিনি তো! চিন্তা কইরেন না! আমি এই জায়গায় প্রায়ই আসি! আসেন আমার লগে লগে!’ এভাবেই পুলিশকে নির্দেশনা দিয়ে সুফিয়া তার সঙ্গে নিয়ে যেতে লাগল। ব্যাপারটাতে সে যে কী মজা পাচ্ছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। পুলিশ তার নির্দেশে হেঁটেছে, এই গল্প কাউকে না শোনানো পর্যন্ত সে পেট ফুলে মরেই যাবে!

মন্দিরের কাছাকাছি আসার পরে জামান শিকদার বলল, ‘একবার মন্দিরটা ঘুরে যাই। এই মন্দিরের অনেক গল্প শুনেছি। এত কাছে যখন এসেই পড়েছি, তখন একবার ঘুরে না গেলে কেমন দেখায়! চেয়ারম্যান সাহেব বলছিল যে মন্দির নাকি সংস্কার করাবে। দেখে আসি তো, সংস্কারের পর্যায়ে কিছু আছে কী না!’
সুফিয়ার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। সে যে আজ আসছে এই খবর শমসের জানে না। বলেছে সময় সুযোগ করে পুলিশকে নিয়ে আসবে। কিন্তু কবে আনবে সেটা তো বলা হয়নি! শমসের যদি সাবধান হওয়ার সময় না পায়? সুফিয়া শশব্যস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘না না অখন ঐদিকে যাওনের দরকার নাই। মন্দিরে গ্যালে দেরি হইয়া যাইব! আগে যেইখানে যাইতাছি সেইখানেই চলেন!’
শরফুদ্দিন মুখ ঝামটা দিয়ে উঠল, ‘ঐ মাইয়া চুপ থাকো! তুমার কথামত সব হইব নাকি? স্যার মন্দিরে যাইবেন ঠিক করছেন যখন…’
জামান শিকদার হাত নাড়িয়ে বোঝাল, থাক আজ আর মন্দিরে যাওয়ার দরকার নাই! একটু অবাক হলেও সুফিয়ার কথায় জামান শিকদার আপত্তি করল না। আজ তিনি বিনা প্রতিবাদে সুফিয়াকে টিম লিডার মেনে নিয়েছেন। দেখাই যাক না মেয়েটা তাদেরকে শেষমেষ কী দেখায়!

একসময় তারা চলে আসে সেই জায়গাটার কাছে। একপাশে ছোট্ট একটা ঝর্ণা। সেখান থেকে তির তির করে জলধারা নেমে আসছে। কাঁচের মতো স্বচ্ছ পানি! ঝর্ণার ঠিক বিপরীতদিকে বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে সারি সারি লম্বা সব গাছ।
এই সেই আগর গাছ! আজকেই ইন্টারনেটে এই গাছের অসংখ্য ছবি দেখেছে জামান শিকদার। এই গাছের পাতার একটা অন্যরকম বিশেষত্ব আছে, দেখলেই চেনা যায়। ইতোমধ্যেই এই গাছের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানা হয়ে গেছে তার। কাজেই গাছটাকে সে নিখুঁতভাবেই চিনতে পারল। আশ্চর্য না হয়ে উপায় নাই। দেখে মনে হয় কেউ বুঝি এখানে পরিকল্পিতভাবেই আগরগাছ চাষ করেছে। যদিও পাশাপাশি অন্য গাছপালাও আছে। কিন্তু আগরগাছের আধিক্যই বেশি চোখে পড়ে।
কিছু কিছু গাছ কাণ্ডের অংশ থেকে কেটে ফেলা। নিচে কিছু কাটা খণ্ডও পড়ে থাকতে দেখা গেল। ঠিক সুফিয়া যেমনটি বলেছে। আর তার চাইতেও বড় কথা, গাছগুলোতে পেরেক ঠুকে রাখা আছে। অর্থাৎ কেউ অথবা কারা এই গাছ সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই এভাবে পেরেক মেরে গাছে কৃত্রিম ক্ষত তৈরি করার চেষ্টা করেছে। আগর কাঠের ব্যবহার এবং উৎপাদন প্রসেস তাদের কাছে অজানা নয়।

‘ওহ মাই গড! এ কী কাণ্ড!’ জামান শিকদারের গলায় নিখাদ বিস্ময়। তারপর শরফুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই যে শরফুদ্দিন! একটু আগেই বলছিলে না আমরা এখানে বসে বসে ঘুমাই না! দেখো… দেখো একবার! পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে তাদের এরিয়ার দামি আগরগাছ কেটে নিয়ে চলে যাচ্ছে। আর তুমি বলছ পুলিশ এখানে বসে বসে ঘুমায় না!’

সুফিয়া আগেই এই গাছ সম্পর্কে ভালোমত জেনে নিয়েছে শমসেরের কাছে। তবু সে একটু অজ্ঞের ভান ধরে বলল, ‘কীসের গাছ কইলেন ওসি সাব?’
জামান শিকদার উত্তর দেওয়ার আগেই শরফুদ্দিন হঠাৎ খ্যাঁক করে বলে উঠল, ‘ঐ মাইয়া, তুমার তা দিয়া কিয়ের কাম? গাছের সন্ধান দিছ অখন বাড়িত যাও। সকল কিছু তুমার না জানলেও চলব!’
সুফিয়া রাগত চোখে কনস্টেবল শরফুদ্দিনের দিকে তাকাল। শরফুদ্দিনের চোখেমুখে কিসের যেন চাপা উষ্মা। তার অন্দরমহলের ফোঁসফোঁসানি কিছুতেই থামতে চাইছে না। ইচ্ছে করছে এই মহা ত্যাঁদড় মেয়েটাকে বাগে পেলে একেবারে আচ্ছামতোন এর ঝাল ছুটিয়ে দিত! এ্যাহ! হিরো হওয়ার শখ হইছে! মহিলা হিরো! এই মেয়ে হিরোগিরি যদি না ছুটাইতে পারে তাহলে সে কুকুরের গলায় মালা দিবে!

জামান শিকদার অবাক হয়ে শরফুদ্দিনের দিকে তাকাল। প্রচণ্ড জোরের সঙ্গে বলে উঠল, ‘শরফুদ্দিন সাবধানে কথা বলো। আমার সামনে দাঁড়াইয়া তুমি এই মেয়ের সঙ্গে কীভাবে এই ভাষায় কথা বলতে পারো? তোমার নিজের যে কাজ করার কথা ছিল, সেই কাজ এই মেয়ে করে দিয়েছে বলেই এত রাগ? ক্রেডিট নিতে পারলা সেই ক্ষোভ এর ওপরে ঝাড়ছ? নাকি ঘটনা অন্যকিছু? খবরদার বলছি আর কখনো যদি ওর সঙ্গে এমন ভাষায় কথা বলতে শুনেছি তাহলে কিন্তু আমার মতো খারাপ আর কাউকে হতে দেখবা না তুমি, বুঝেছ?’
জামান শিকদারের এই হুমকিতে কাজ হলো। হাজার হলেও ওসি তার বস। শরফুদ্দিন নিজের রাগকে বশ করে ফেলল। কিন্তু কেন জানি তার ভেতরের আগ্নেয়গিরি আজ কিছুতেই ঠাণ্ডা হতে চাইছে না! ফোঁস ফোঁস করে গর্জন করেই চলেছে। পুলিশের চাকরি করে যে ফুটো পয়সা বেতন পাওয়া যায়, তা দিয়ে বউয়ের কসমেটিক্স কেনারই টাকা হয় না। দুটো উপরি রোজগারের এমন ফুরফুরে মসৃণ রাস্তাটাতে এক পুঁচকে মেয়ে এসে গর্ত খুঁড়ে দিয়ে গেল! এই জ্বালা কীভাবে এত সহজে জুড়ায়?

জায়গাটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ শেষে জামান শিকদার তার স্টাফদের জায়গাটা ঘিরে দিতে বলল। বড় কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে তাকে একবার হেড অফিসে জানাতে হবে। অফিসিয়ালি তাদের হেল্প চাইতে হতে পারে।

ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল, আগের ওসি আব্দুস সোবহান সাহেবের পরিণতির কথা। এই হেড অফিসে খবর দিতে গিয়েই তাকে বদলি হতে হয়েছে। বর্তমান এসপি সাহেবের সম্পর্কে নানান কথাবার্তা শোনা যায়। সবই উড়ো খবর, কিন্তু উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। ডিপার্টমেন্টে সবার মুখে মুখেই ঘোরে। এসপি লোকটা খুব সুবিধাবাদী মানুষ। নৈতিকতার ধার ধারে না। প্রায়ই পরিবার নিয়ে বিদেশ সফরে যায়। তাও আবার আশেপাশের দেশগুলোতে না, একেবারে ইউরোপ আমেরিকা। তার অবস্থানে থেকে এত ঘন ঘন বিদেশ সফরে যাওয়া সহজ ব্যাপার না। পয়সাপাতির প্রশ্ন তো আছেই, কিন্তু ব্যক্তিগত কাজে বিদেশ সফরের জন্য তার জিও ম্যানেজ করাই কঠিন হওয়ার কথা। কিন্তু লোকটার হাত যে অনেকদূর অব্দি লম্বা, সেটা এতদিনে সবাই বুঝতে পেরে গেছে।

জামান শিকদার দ্রুত চিন্তা করছে তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হওয়া উচিত। একদিক দিয়ে না হলে আরেকদিক দিয়ে এগুতে হবে। কিন্তু আব্দুস সোবহান সাহেবের পরিণতি কিছুতেই বরণ করা যাবে না। সবাই হেরে গেলে এসব দুষ্টচক্রের সাথে লড়বে কারা? বাচ্চা একটা মেয়ে এতদূর পথ দেখিয়ে দিলো, তারা পুলিশের চাকরি করে হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? কিছুতেই নয়!

সুফিয়াকে তার বাড়ির কাছাকাছি নামিয়ে দিয়ে জামান শিকদার পুলিশস্টেশনে ফেরার জন্য গাড়ি ঘোরানোর নির্দেশ দিলো। সুফিয়া কয়েক মুহূর্ত ইতঃস্তত করে বলল, ‘আপনারে একটা কথা কওনের ছিল। তয় সকলের সামনে কথাটা কই নাই। এইটাও খুব জরুরি একটা কথা।’
জামান শিকদার একটু তাড়াহুড়ার মধ্যে ছিল। তার এখন অনেক কাজ পড়ে আছে। দেরি করার উপায় নেই। তাই সুফিয়ার কথাটাকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ বলো সুফিয়া কী কথা?’
‘আইজ অনেকজন লগে ছিল তাই আপনারে বলিনি। আমাগো আরেকবার জঙ্গলে যাওনের দরকার আছে।’
‘হ্যাঁ জঙ্গলে তো এখন প্রতিদিনই যেতে হবে! তবে তোমার আর না গেলেও চলবে সুফিয়া। তুমি এখন বাড়িতে থাকো আর মন দিয়ে পড়ালেখা করো। এসবের মধ্যে তোমার আর ঢোকা উচিত হবে না। চারপাশে অনেক দুষ্ট লোকজন ঘোরাফেরা করে। আমরা পুলিশ, এদের নিয়েই আমাদের থাকতে হয়। তুমি বাচ্চা একটা মেয়ে। তুমি এসবের সঙ্গে সামলে চলতে পারবে না!’
‘আমি আর ঢুকুম না। তয় এই ব্যাপারটা আপনারে আমার কইতেই হইব। এইটা শুনলে আপনে…’

কথার মাঝখানেই জামান শিকদারের ফোন বেজে উঠল। ওসি আব্দুস সোবহান সাহেবের ফোন। জামান শিকদার ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে উত্তেজিত আব্দুস সোবহান বলল, ‘হ্যালো জামান সাহেব, আপনেরা তো আগর গাছ কাটার নমুনা সংগ্রহ করে ফেলেছেন শুনলাম! আপনার কনস্টেবল রেজা আমাকে ফোন দিয়েছিল। সে খুবই উত্তেজিত হয়ে আছে। অবশ্য উত্তেজিত হওয়ারই কথা! অনেক অনেক অভিনন্দন আমার তরফ থেকে। এখন কিন্তু সামনে খুব সাবধানে পা ফেলতে হবে। শত্রু কিন্তু দুর্বল না!’

জামান শিকদার মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। এই খবরটা এখনই এদিকে সেদিকে চাওড় হয়ে যাক এটা সে চাইছিল না। তার স্টাফদের মধ্যে আরেকটু বিচক্ষণতা থাকলে ভালো হতো। আগের ওসিকে বলার আগেও তার একটা পারমিশন নিয়ে নেওয়ার দরকার ছিল। জামান শিকদার নিজেই তো তাকে ফোন দিত! ওসির অনুমতির তোয়াক্কা না করেই তার কনস্টেবল নিজেই ফোন দিয়ে বসেছে! গাড়ল লোকজন সব!

সোবহান সাহেব ওপাশে অপেক্ষা করছে। তার পরামর্শ মোতাবেকই কাজ শুরু হয়েছে। এটাও ভুলে যাওয়া যায় না। জামান শিকদার আন্তরিক গলাতে বলল, ‘হ্যাঁ সোবহান সাহেব, আপনার অনুমানই মিলে গেল। এখন এটা দিয়েই কাজ শুরু করছি। দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়!’
‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের খুনের সঙ্গে এবারে একটা ব্রিজ তৈরি করতে পারবেন।’
‘পলাতক খুনির সাক্ষাত এখনো পাইনি। দেখা যাক!’
‘অল দ্য বেস্ট!’
কথাতে তন্ময় হয়ে কখন যে জামান শিকদার গাড়িতে চড়ে বসেছে আর মোতালেবও গাড়ি ছুটিয়ে দিয়েছে, তা তার খেয়ালই নেই। সুফিয়া যে একটা কথা শুরু করেছিল, এটা ফোনালাপে বেমালুম ভুলেই গিয়েছে জামান শিকদার। গাড়ি বেশ কিছুদূর আসার পরে জামান শিকদারের সেই কথা মনে পড়ল। মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করতে করতে বলল, ‘আহহা! মেয়েটা কী জানি বলতে শুরু করল, না শুনেই তো চলে এলাম!’
‘গাড়ি ঘুরাব স্যার?’ মোতালেব জানতে চাইল।
‘না থাক। পরে জেনে নিব। তেমন জরুরি কিছু নয় হয়ত!’

ওদিকে সুফিয়া তখন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে আছে দূরে চলে যাওয়া গাড়িটার দিকে। ওসি সাহেব তার কথাটাই শুনল না! ওহ এখন নিজেদের কাজ হয়ে গেছে দেখে আর তাকে চেনে না! সে খোঁজ না দিলে জীবনেও ঐ গাছ কাটার খবর জানতে পারত না! এখন সে মুখ বন্ধ করেই বসে থাকবে। দেখা যাক, পুলিশ শমসেরকে কীভাবে খুঁজে বের করে! শমসরেকে এবারে ধরা দিতেই হবে! নইলে অনেক কিছু সামনে আসার পথ পাবে না। (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_সতের

পুলিশস্টেশনে ফিরে আগে একটা লম্বা দম নিয়ে নিলো জামান শিকদার। তারপর অনেক ভাবনাচিন্তা করে ঢাকা পুলিশ কমিশনারের অফিসে ফোন দিলো। নিজের পরিচয় দিয়ে সরাসরি পুলিশ কমিশনারের কাছে সে সব কিছু খুলে বলল। একটু একটু ভয় যে করছিল না, এমন নয়। এভাবে ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খাওয়াটাকে কেউই ভালো চোখে দেখে না। কমিশনার সাহেবও জানতে চাইলেন।

‘তুমি তোমার এসপি কে ফোন না করে সরাসরি এখানে কেন যোগাযোগ করেছ?’
‘স্যার আমি নিতান্তই বিপদে পড়ে এই কাজ করেছি। আমার এই অপরাধ ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখলে কৃতজ্ঞ হব স্যার। আমি যে ঝামেলার খোঁজ পেয়েছি ঠিক একই জিনিস আমার আগের ওসিও জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু এসপি স্যার সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েও এগিয়ে আসেননি। আমি তাই এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হলাম স্যার!’
‘হুম, বেশ সাহসী অফিসার তুমি। ডিপার্টমেন্ট তোমার মতো অফিসারদের ওন করে।’
‘থ্যাংক ইউ স্যার!’
‘আমি দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি। তুমি স্থানীয়দের মধ্যে কারা এটার সঙ্গে জড়িত আছে, তা খুঁজে বের করো। ইটস এ্যান অর্ডার!’
‘স্যার!’

ফোন রেখে দিয়েই কাজে নেমে পড়ল জামান শিকদার। এখন আর নিঃশ্বাস ফেলার সময় নাই। জঙ্গলে গিয়ে মোবাইলে কিছু ছবি তুলে আনা হয়েছে। সেগুলোকে পিসিতে ট্রান্সফার করে দ্রুত হাতে কয়েকটার প্রিন্ট বের করে নিলো। কালার প্রিন্টারে প্রিন্ট করায় প্রতিটা ছবি একেবারে ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে। এইরকম অজ থানায় কালার প্রিন্টারের ব্যবস্থা থাকবে এটা আশা করেনি জামান শিকদার। যে ওসি সাহেবই কেনার ব্যবস্থা করে থাকুন, তাকে মনে মনে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দিলো সে।

এদিকে কনস্টেবল শরফুদ্দিনও তার জায়গাতে স্থির বসে নাই। পুলিশস্টেশনে পা দিয়েই নিজের মেসেজ চেক করেছে সবার আগে। প্রায় দুই ঘণ্টা আগের মেসেজ। পরপর পাঁচটা।
‘কী কইলি? পুলিশে আগরগাছের সন্ধান পাইছে? কে দিছে এই সংবাদ?’
পনের সেকেন্ড পরেই পরের মেসেজ, ‘ওই ব্যাটা! খবর দিয়া গায়েব হইলি ক্যান? জানা শিগগির। পুলিশ ক্যামনে খবর পাইল?’
এর দশ সেকেন্ড পরে মেসেজ। ‘শরফুদ্দিন মিয়া তুমি আমার লগে খেল খেললা না তো? ভাবছ এই খবর পাইয়াই আমি গাছ কাটা ঠেকাইতে ছুট দিমু আর তুমি আমারে পুলিশ দিয়া গ্রেফতার করাইবা! অত বোকা পাওনি আমারে! এইটা যদি খেল হয়, তাইলে আমি তোমার লগে হাডুডু খেলুম!’
সাত সেকেন্ড পরে মেসেজ। ‘কীরে তর এত সাহস… কথা কস না!’
এবারে পাঁচ সেকেন্ড পরে, ‘তুই কি মরছস? ঐ ব্যাটা শরফুদ্দিন!’

শরফুদ্দিনের গা কাঁপতে লাগল। তাড়াতাড়ি ফোন তুলে নির্দিষ্ট নাম্বারে ডায়াল করল। ওপাশ থেকে বেশ কিছুটা সময় ধরে হম্বিতম্বি চলল। শরফুদ্দিন একটা কথা বলারও সুযোগ পেল না। একবার শুধু ‘স্যার আমি একটু খুলে বলি…’ বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওপাশের মুখ খারাপ করা গালি শুনে আর কোনো কথা বলার চেষ্টা করেনি। অনেকটা সময় ধমকাধমকি চলার পরে পরিস্থিতি কিছুটা ঠাণ্ডা হলে শরফুদ্দিন কথা বলার সুযোগ পেল।
‘স্যার, ওসি আমারে তার গাড়িতে উঠাইয়া নিছিল। আমি ফোন চেক করতে পারি নাই। চেক করলে ধরা পইড়া যাইতাম! ব্যাটা এমনিতেই আমারে সন্দেহ করছে মনে হইছে। আপনারেও তাইলে…’

‘তোর ওসির হঠাৎ এমন বুদ্ধি খুলল ক্যামনে? ব্যাটা তো গ্রামে আইসা হাওয়া খাইয়া বেড়াইতাছিল। হঠাৎ এমন জেমস বণ্ড হইয়া গ্যালো ক্যামনে?’
স্যার, একটা তের চৌদ্দ বছরের মাইয়া গাছ কাটার খবর দিছে… জি স্যার, এই গ্রামেরই মাইয়া, নাম সুফিয়া।’
‘তের চৌদ্দ বছরের গ্রামের মাইয়ার এত সাহস যে আমার কামে বাম হাত ঢুকাইয়া দ্যায়! আইচ্ছা! দ্যাখতাছি! আর শুইনা রাখো শরফুদ্দিন, তুমার পুলিশ ডিপার্টমেন্ট যদি আমার ব্যবসার লালবাতি জ্বালাইবার চিন্তাও মাথায় আনে তাইলে আমি কিন্তু কাউরে ছাড়ুম না! তোমার চাকরি যাইব সবার আগে, মাথায় রাইখো!’
‘সেইডা কখনোই হইব না স্যার! আমি আপনেরে কথা দিতাছি!’
‘হ, কথা যাতে ঠিক থাকে মনে রাইখো!’

এইভাবে তুই আপনি জগাখিচুড়ি সম্বোধনে ওপাশ থেকে অগণিত গালিগালাজ ধমকাধমকির তুফান ছুটিয়ে ফোন রাখা হলো। এপাশে কনস্টেবল শরফুদ্দিন ফোন রেখে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে বসে পড়ল। তার মাথায় এখন হাজার চিন্তা। কিছুতেই ওসি জামান শিকদারকে এর চাইতে এক কদম বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। যা করার এখনই করতে হবে। এসপি সাহেবকে সবার আগে খবরটা দেওয়া দরকার। ফোনটা তুলতে যাবে এমন সময় পিওন এসে খবর দিলো, ‘স্যার ওসি স্যার আপনারে বুলায়।’
মনে মনে মুখ খারাপ করে একটা গালি দিলো শরফুদ্দিন। হারামজাদা ওসি মনে হচ্ছে তাকে চোখে হারাচ্ছে। দুই দণ্ড তিষ্টাতে দিচ্ছে না! মুখে বলল, ‘আসতাছি গিয়া ক!’
পিওন তবু নড়ল না। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বলল, ‘স্যার অক্ষুণি যাইতে কইছে!’
‘যা ভাগ হারামজাদা! কইলাম না যাইতাছি! কথা কানে যায় না?’
অনিচ্ছাসত্ত্বেও পিওনকে এবারে সরতে হলো। এই কনস্টেবলের কীসের জানি একটা গরম আছে। সেই গরমের হদিস কারো জানা নেই। কিন্তু গরমের তাপ সবাই টের পায়। পিওন যেতে যেতে ভাবল, ‘ব্যাটা এইবার পড়ছে মাইনকার চিপায়! এইবার জুদি তেল ছুটে!’

পিওন যাওয়ার পরে এসপি সাহেবকে একটা ফোন দেওয়ার জন্য ফোনটা তুলতে গিয়েও কী মনে করে রেখে দিলো শরফুদ্দিন। থাক, এত বেশি বাড়াবাড়ি করার দরকার নাই। ওসির ফোঁসফাঁশ লম্ফঝম্ফ এমনিতেই থেমে যাবে। শুধু শুধু নিজেকে সন্দেহের তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়ার দরকার নাই।

ওসির রুমে গিয়ে শরফুদ্দিন দেখতে পেল, চারপাশে ফাইলপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। জামান শিকদার একটা ডায়েরিতে কী যেন নোট করছে। সে রুমে ঢুকতেই বলল, ‘এই যে শরফুদ্দিন! এখান থেকে এখানে আসতেও তোমার এত সময় লাগে? সময় অনেক মূল্যবান, বুঝেছ? শোনো আমি কিছু ছবি প্রিন্ট করেছি। তুমি এই ছবিগুলো দ্রুত ঢাকা কমিশনারের অফিসে ফ্যাক্স করে পাঠাও। আমি মেইলে পাঠিয়েছি। তবু ফ্যাক্সেও পাঠায়ে দাও।’ কথাটা বলেই জামান শিকদার একটু বাঁকাচোখে শরফুদ্দিনের মুখচোখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করতে লাগল।

মোবাইল ইন্টারনেটের এই যুগে ফ্যাক্স মেশিন এখন কেউই তেমন একটা ব্যবহার করে না। ছবি ইতোমধ্যেই কমিশনার অফিসে চলে গেছে। তবু শরফুদ্দিনকে ডেকে এনে এই কাজ করানোর পেছনে জামান শিকদারের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। সে শরফুদ্দিনকে চোখের আড়াল করতে চাইছে না। পুরো ব্যাপারটিতে তার এই কনস্টেবলের জড়িত থাকার প্রমাণ এখন শুধু সময়ের অপেক্ষা। ঘরের শত্রু বিভীষণদের জন্যই সবসময় এমন দ্রুতগতিতে আগুন লাগে! নইলে বাইরের শত্রু কি এত সহজে ভেতরে আঁচড় বসাতে পারে? তবু প্রমাণ পাওয়ার আগে কিছুই করা যাবে না।

শরফুদ্দিন অবিশ্বাসীর চোখে জামান শিকদারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এসপি স্যারকে না জানিয়ে সরাসরি কমিশনারের কাছে অভিযোগ প্রেরণ! এমনকি গাছ কাটার ছবিও সেখানে চলে গেছে! জামান শিকদার তো দেখা যাচ্ছে একেবারে কাছা বেঁধে লেগেছে। সর্বনাশ!
এই ভীষণ পরিস্থিতির মাঝেই প্রচণ্ড বেরসিকের মতোই শরফুদ্দিনের মোবাইলটা বেজে উঠল। চট করে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে শরফুদ্দিনের শরীরে ঘাম ছুটে গেল। এসপি স্যার ফোন দিয়েছে!

এক ফাঁকে জামান শিকদারও শরফুদ্দিনের ফোনের ইনকামিং কলের দিকে চকিতে দৃষ্টিপাত করে ফেলেছে। ফোনদাতার নামটাও নজর এড়ায়নি তার। জামান শিকদারের মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটে উঠল। শরফুদ্দিন ফোন রিসিভ করতে ইতস্তত করছে দেখে হাসিমুখে বলল, ‘সে কী ফোন ধরছ না কেন? এসপি স্যার ফোন দিয়েছেন দেখছি! এসপি স্যার সরাসরি তোমাকে ফোন দেন নাকি? খুব ভালো তো! ধরো ধরো ফোনটা ধরো!’

শরফুদ্দিনের তবু ফোন ধরার উপায় নাই। সে কাতরস্বরে বলল, ‘স্যার মনে হয় আপনারে ফোন দিতে গিয়া আমারে দিয়া ফেলছে। আপনে কথা বলবেন স্যার?’
‘না অবশ্যই না! আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে উনি আমার ফোনেই ফোন দিবেন। এত বড় ভুল যদি উনার মতো অফিসার করে বসেন তাহলে তো ডিপার্টমেন্টের লালবাতি জ্বলে যাবে! তোমার ফোন তুমিই ধরো শরফুদ্দিন!’
শরফুদ্দিন সাত পাঁচ চিন্তা করে কূল কিনারা না পেয়ে ধুম করে ফোনটা কেটেই দিলো। সেটা দেখে জামান শিকদার হাসতে হাসতে বলল, ‘আহা আমার জন্য কথাটা বলা হলো না তোমার! চিন্তা নাই, আবার ফোন করবে নিশ্চয়ই। এবারে ধরো কিন্তু!’

***

ওসি স্যার তার কথা না শুনেই গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেছে এই রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলো সুফিয়া।
জুলেখা বাড়ির কাজকর্ম শেষ করে একটা কাঁথা নিয়ে বসেছে। সুফিয়াকে আসতে দেখে গাল ভারি করে বলল, ‘মহারানী আইছেন! আইজ বলে তুই ইশকুলে যাস নাই?’
সুফিয়া ভেতর ভেতর চমকে উঠল। সে যে আজ স্কুল ফাঁকি দিয়ে পুলিশস্টেশনে গিয়েছিল এটা তো তার বুবুর জানার কথা না! কে এই খবর দিলো?
জুলেখা আন্দাজে একটা ঢিল মেরেছিল। সেই ঢিলের আন্দোলনে যে সুফিয়ার মুখেচোখে এমন ঢেউ উঠবে এটা সে আশাই করেনি। সুফিয়ার মুখ দেখে জুলেখার বুঝতে বাকি রইল না, সুফিয়া সত্যি সত্যিই এই কাজ করেছে! জুলেখা স্তম্ভিত হয়ে কাঁথা ফেলে বসে রইল। সুফিয়ার মতিগতি তার একদম ভালো ঠেকছে না। এতদিন পড়ালেখা নিয়ে মেতে ছিল তা একরকম বেশ ভালোই ছিল। কিন্তু হঠাৎ জঙ্গলের প্রতি তার কীসের এত মমতা জন্মাল যে প্রতিদিন সেখানে একা একা ঘুরতে যায়?

সুফিয়া আজকে আর লুকালো না। সে গম্ভীর মুখে বলল, ‘বুবু তুমার লগে আমার কথা আছে! আমি তুমারে বেবাক কথা খুইলা বলুম। শুনলে তুমি বুঝতে পারবা, তুমার বইনে কুনো খারাপ কাম করেনি। সে যা করছে ভালা কামই করছে!’
‘গেরামে আর কেউ নাই এই ভালা কাম করোনের লাইগা? তুইই একমাত্র মানুষ আছিলি? ইশকুল ফাঁকি দিয়া তুই কুন রাজকার্জ করবার গেছিলি ক আমারে!’
‘তার আগে কও তুমার না একটা কাম আছে? ভুইলা গেছ? তুমি না ফুলিরে দেইখা আইতে চাইছিলা? লও আইজ ঘুইরা আসি!’

‘তুই কথাডা ঘুরাইয়া নিলি তাই না? ফুলিরে দ্যাখবার যাওনের তোর জানি কত হাউশ আমি কি কিছু জানি না? এদ্দিন কইয়া কইয়া নিবার পারি নাই আইজ হঠাৎ মহারাণী নিজেই যাওনের লাইগা প্রস্তুত!’
একটু ইতস্তত করে সুফিয়া বলেই ফেলল। ‘কদমপুর থানায় নতুন একজন ওসি আইছেন। নাম জামান শিকদার। খুব ভালা মানুষ। উনার লগে আমার ভালা আলাপ পরিচয় হইছে। আইজ উনি আমারে লইয়া গেছিলেন। লগে আরো পুলিশের লোকজন আছিল। সেই জঙ্গলে একটা অপকর্ম চলতাছে। এইসব ভূত দেউয়ের যেই গল্প মাইনষের মুখে মুখে ঘুইরা বেড়াইতাছে, বেবাক গল্প ফাউল বুঝলা? জঙ্গলের আসল দেউ হইতাছে মানুষ! আর হেই মানুষ জঙ্গলে থাকে না, থাকে আমাগো আশেপাশেই। মানে এই গ্রামেই। তারা মাইনষের মইধ্যে নকল দেউয়ের ভয় ঢুকাইয়া দিয়া দ্যাশের ক্ষতি করতাছে!’

জুলেখা বোকার মতো নিস্পন্দ চেয়ে থাকে সুফিয়ার দিকে। তার সেদিনের সেই এক রত্তি বোনটা এসব কী বলছে? এত বুঝ তার মধ্যে কীভাবে এলো? জুলেখা বিড়বিড় করে বলে, ‘তুই কী কইতাছস আমি কিছুই বুঝবার পারতাছি না!’
‘বুঝন লাগব না। সময় আইলে নিজেই বুঝবা। অখন কও, বুবু তুমি যাইবা নাকি! ফুলির লগে আমার একডা কাম আছে। তুমি লগে গেলে ভালা হইত!’
‘ফুলির লগে আবার কিয়ের কাম?’
‘আছে একটা কাম। তুমার বেশি বুঝনের কাম নাই বু!’
সুফিয়ার কাজ কারবার জুলেখার কাছে এমনিতেই দুর্বোধ্য লাগে। গত কয়েকদিন ধরে সে যেন সুফিয়াকে চিনতেই পারছে না! তবু সুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে জুলেখা না করতে পারল না। কাঁথাটা ভাঁজ করে সে তৈরি হতে গেল। তাদের মা হনুফা বিবি দুপুরের নিয়মিত কাজ পাড়া বেড়াতে গেছে।

জুলেখা আর সুফিয়াও আজ ফুলিকে দেখতে তাদের বাড়িতে গেল। (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে_দেখা_আলো পর্ব-১৪+১৫

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_চৌদ্দ

‘তুমি কি বাইরে গিয়া বইলা দিবা আমার কথা?’ শমসের একটু দ্বিধা নিয়েই প্রশ্নটা করল।
সুফিয়াও দ্বিধায় আছে। তবে এই ছেলেটাকে তার শুরু থেকেই ধান্দাবাজ মনে হচ্ছে না। কেন জানি মনে হচ্ছে একে কেউ ফাসিয়েছে। কে ফাসাল? এটা আগে জানতে হবে। শমসেরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সুফিয়া তাকে অন্য কথা জিজ্ঞেস করল।
‘আপনের কুনো শত্রু আছিল যে আপনের নামে মিথ্যা কথা কইতে পারে?’
‘আমি তো সেইরকম কুনো শত্রুর কথা জানি না। তয় ছিল হয়ত! আমার শত্রু না হইলেও আমার মনিবের যে ম্যালা লোকেই শত্রু আছিল এইটা আমি ভালা কইরাই জানি!’
‘আপনে এইখানে একা একা থাকেন… আপনেরে জিনিসপাতি কে আইনা দেয়? মন্দিরের মইধ্যে তো ম্যালা জিনিসপাতি আছে!’
‘দেয় একজন। তার নাম তুমার কাছে কওন যাইব না। তার নিষেধ আছে।’
‘ওহ আইচ্ছা। অখন আপনে কন আমি আপনের কী কামে লাগতে পারি!’ সুফিয়া পাকা চুক্তিবাজের মতো বলল।
‘তুমি এট্টু আগে পুলিশের কথা কইতাছিলা। তুমি কি সত্যি সত্যি পুলিশের কাছে যাইতে পারবা?’
সুফিয়া সঙ্গে সঙ্গে ঘাড় কাত করে জানায় যে সে তা পারবে। শুনে শমসের বলে, ‘আইচ্ছা তাইলে পুলিশের কাছে একটা খবর দিতে হইব। কইবা যে, জঙ্গলের যেই সাইডে ঝর্ণা আছে… মানে জঙ্গলের পূর্ব পাশে… সেই খানে দামি আগর গাছ আছে। এই গাছ ম্যালা দামি। এই জঙ্গলে একটা বড় জায়গা জুইড়া এই আগর কাঠের গাছ আছে। তুমি কি জানো এই আগর গাছের দাম কেমুন? তুমার কইলাম জানার কথা না!’
‘দাম কেমুন?’
‘প্রতি কেজি কাঠ বিক্রি হয় প্রায় তিন চার লাখ টাকায়!’
শুনে সুফিয়ার চোয়াল ঝুলে পড়ার অবস্থা হলো। এত দাম? সে বলল, ‘আপনে এই গাছের কথা ক্যামনে জানলেন? আর কী হইছে সেই গাছের?’
‘এই গাছগুলান এই এলাকার সম্পদ, দ্যাশের সম্পদ। কিন্তু সেই সম্পদ বিদেশে পাচার হইতাছে। আমাগো দেশের বর্ডার দিয়া রাইতের বেলা অন্যদেশে চইলা যাইতাছে।’
সুফিয়ার মনে পড়ল, কথা প্রসঙ্গে সে জামান শিকদারের কাছে ঝড়ে বক মারার মতো এই গাছ কেটে ফেলার কথাই বলেছিল। সেই কথাই এভাবে ফলে গেল! সে বলল, ‘আপনে জানেন গাছ কেডায় কাটে?’
‘আমি জানি না। আমারে একজন কইছে। কিন্তু সে পুলিশের কাছে যাইব না। তার অসুবিধা আছে। কীয়ের অসুবিধা সেইটা আমারে জিগাইও না। কইতে পারুম না। গাছ রাইতের বেলা কাটতে আসে। আমি লোকজনের আওয়াজ পাইছি। কিন্তু বাইর হই নাই। আমি বাইর হইলে আমার বিপদ হইব। কেউ আমার কথা বিশ্বাস করব না। আমারে ধইরা নিয়া যাইব! তুমি তো জঙ্গলে মাঝে মইধ্যে আসো, ঘুরাফিরা করো। পুলিশের কাছে গিয়া কইবা, তুমি গাছ কাটতে দ্যাখছ।’
‘তারপর পুলিশ যদি আমারে সেই জায়গা দেখাইয়া দিবার কয়?’
‘দেখাইয়া দিবা! চলো আমি তুমারে দেখাইয়া দেই। একবার দ্যাখলেই চিনতে পারবা।’

এরপর শমসের সুফিয়াকে নিয়ে গেল সেই আগরগাছে ঘেরা জায়গাটার কাছে। এত দামি গাছ এখানে এভাবে সারি সারি লাগানো আছে দেখলে তাজ্জব হয়ে যেতে হয়। মনে হয় কেউ বুঝি পরিকল্পনা করে গাছগুলো লাগিয়েছে। আশেপাশে অন্য গাছপালাও আছে। সুফিয়া এই দামি গাছের কথা জীবনে প্রথমবার শুনল। লম্বা গাছটা তেমন একটা মোটা না। ইউক্যালিপটাস গাছ দেখেছে সুফিয়া। দেখতে অনেকটা সেই গাছের মতো। গাছের পাতাগুলো তেজপাতার মতো। অবাক হয়ে গাছগুলো দেখতে দেখতে সুফিয়া জিজ্ঞেস করল,
‘কী কামে লাগে এই গাছ? আর গাছে এত ছিদ্র করছে ক্যান? পেরেক মাইরা থুইছে অনেক গাছে! এগুলান কীসের লাইগা?’
‘আগর গাছ ম্যালা কামে লাগে। আগর তেল দিয়া সাজগোজের জিনিসপাতি বানান যায়। আতর হয় এই তেল দিয়া। আগরবাতি দ্যাখছ না? সেইটাও এই গাছের কাঠ দিয়া হয়। ছিদ্র করছে কারণ এই ছিদ্র করা হইলে গাছে ক্ষত হয়। সেই জায়গাডা কালো হইয়া গেলে তখন সেই কাঠ কাইটা নিয়া যায়। ঐ কালো কাঠ দিয়াই আগর তেল হয়। নানারকম পদ্ধতি আছে তেল করোনের।’
সুফিয়া অবাক হয়ে শুনল। ছেলেটার জ্ঞানের পরিধি দেখেও অবাক হলো। নিখাদ বিস্ময়েই বলে উঠল, ‘আপনে তো ম্যালা কিছু জানেন! এত কিছু জানেন আর গাছ কেডা কাইটা নিতাছে এইটা জানেন না?’
শমসের একটু কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, ‘এক্কেরে কিছু জানি না কইলে ভুল হইব। তয় পুরাপুরি নিশ্চিত না।’
‘তাইলে আগে এইটা বাইর করেন এই গাছ কারা কাটতাছে। কারণ আমি যদি পুলিশরে খবর দেই তাইলে পুলিশ আইসা সবার আগে আপনারে ধরব। আর আপনে যদি কইবার পারেন যে গাছ কারা কাটতাছে তাইলে পুলিশ আপনেরে ধরলেও আপনে বাঁচতে পারেন!’

শমসের মনে মনে স্বীকার করল, এই তের চৌদ্দ বছরের মেয়েটি প্রখর বুদ্ধিমতী। তবে সে যা বলছে পুরোটা বুঝে বলছে না। শমসের গাছ কারা কাটছে এটা বলে দিলেও পুলিশ তাকে ছাড়বে না। কারণ পুলিশ তাকে ছাড়লেও চেয়ারম্যান সাহেব তাকে ছাড়বে না। এখানে মহা ঘাঁপলা আছে। এত কথা একে বুঝিয়ে বলা সম্ভব না। তাই শমসের সংক্ষেপেই বলল, ‘আমি পলাইতে পারুম, তুমি আমার চিন্তা বাদ দাও। তুমি খালি আমারে এইটা কইয়া যাও পুলিশরে খবর দিবা কুনদিন? আইজ দিবার পারবা?’
‘হ পারুম! কিন্তু গাছ কে কাটতাছে সেইডা তো আপনে জানেন না!’
শমসের চিন্তায় পড়ল। গাছ কে কাটছে এই খবর একজন জানে। কিন্তু সে এখন কিছুতেই মুখ খুলবে না। তার সঙ্গে একবার পরামর্শ করে নেওয়া দরকার।
‘আচ্ছা তুমি তাইলে পুলিশরে খালি এইটা কইয়ো, তুমি জঙ্গলের এক জায়গায় কাটা গাছের খণ্ড দ্যাখছ। ব্যস! বাকি কাম পুলিশের!’
সুফিয়া আর কিছু বলল না। এটাই ঠিক আছে। তার এত বেশি কথা পুলিশ শুনবে কেন? সে শুধু গিয়ে বলে আসবে যে, সে জঙ্গলে কাটা গাছ দেখেছে। কেউ এই জঙ্গলের গাছ কাটছে।
তবে তার এই ছেলেটার জন্য এখন চিন্তা হচ্ছে। সে যদি ধরা পড়ে যায়? ছেলেটা কি সত্যিই খুন করেনি নাকি তাকে মিথ্যা কথা বলছে? চোখমুখ দেখেই কি সবসময় মানুষ চেনা যায়?

ওদিকে পুলিশস্টেশনে বসে জামান শিকদার পুরনো ফাইলপত্রগুলো ঘাটাঘাটি করছিল। এলাকার যত চোর ছ্যাঁচড় আছে, তাদের নামে যতরকম কেস আছে সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে দেখছিল সে। আগের ওসি সাহেবের সঙ্গে কথা বলার আগে একবার ফাইলগুলোতে নজর বুলানো দরকার।
দেখতে দেখতেই একটা ফাইল দেখে একটু থমকাল জামান শিকদার। আপাতদৃষ্টিতে সেরকম কোনো বিশেষ ফাইল না। তবু রেকর্ডে যেটুকু তথ্য দেওয়া আছে সেটা যেন অসমাপ্ত। ফাইলে একজন গ্রাম্য ব্যক্তির ছবি। তাকে চোরাচালানের অপরাধে ধরা হয়েছিল। সামান্য কিছু জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল তার কাছ থেকে। এখন যেসব গ্রামবাসী এটা সেটা জিনিস বর্ডারের ওপারে পার করে দেয়, সেরকমই কিছু মামুলী জিনিস। কিন্তু যে জিনিসটা দেখে ফাইলে চোখ আটকে যায়, তা হলো লোকটা জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে হার্ট এ্যাটাকে মারা যায়। ফাইলটা সেখানেই ক্লোজ করা। আরেকটা রহস্যময় ব্যাপার হচ্ছে ফাইলের শেষে লাল কালিতে একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকা আছে। ব্যস এতটুকুই! ঐ প্রশ্নবোধক চিহ্নটা দেখে কী যেন মনে হয়। এই চিহ্নটা কেন আঁকা হয়েছে সেখানে?
ফাইলের তারিখ দেখল জামান শিকদার। আগের ওসি সাহেবের মেয়াদেই ফাইলটা ওপেন করা হয়েছিল। ছোটখাট চোর ছ্যাঁচড়দের ধরার পরে যে এরকম ফাইল রাখা হয় সেটাও জামান শিকদারের কাছে নতুন। এই লোকটার কাছে তো এমন কিছু আহামরি জিনিসও ছিল না! তাহলে এই ফাইল তৈরির পেছনে কারণ কী!
অন্যান্য কাগজপত্র ঘেঁটে রহস্যজনক কিছুই তেমন পাওয়া গেল না। জামান শিকদার একটু দোনোমোনো করতে করতে ওসি আব্দুস সোবহান সাহেবকে ফোনটা দিয়েই ফেলল।
‘হ্যালো সোবহান ভাই, আমি কদমপুর থানার ওসি জামান শিকদার বলছি। ভালো আছেন?’
‘ওহ… জি আলহামদুলিল্লাহ ভাই ভালোই আছি এখন বলতে পারেন। তা আমাকে কেন স্মরণ করলেন জামান সাহেব?’
জামান শিকদার প্রশ্ন করতে একটু ইতস্তত করছিল। কাউকে এমন প্রশ্ন করা যথেষ্ট বিব্রতকর। তবু চোখ কান বন্ধ করে প্রশ্নটা করতেই হলো। ‘সোবহান সাহেব, আমার প্রশ্নটা শুনে দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না। খুব বিপদে পড়েই আপনাকে এই আপত্তিকর প্রশ্নটা করছি।’
‘কী ব্যাপার বলুন তো? এত দ্বিধা রাখবেন না মনে। যা জানতে চাইছেন খোলামনেই জিজ্ঞেস করুন। আমি আসলে মনে মনে আপনার ফোনের অপেক্ষাতেই ছিলাম এতদিন। ফোনটা আসছিল না দেখেই অবাক হচ্ছিলাম!’
জামান শিকদার মনে মনে অবাক হলো। ফোনের অপেক্ষাতে ছিলেন? তার মানে তিনি জানতেনই যে জামান শিকদার এই বিপদে পড়বেই!
‘ভাই আপনাকে এখান থেকে বদলী করা হয়েছিল কেন?’
‘আসল কারণটা তো আমার জানার কথা নয় ভাই! যেটুকু ওপরওয়ালা জানিয়েছে সেটুকুই জানতে পেরেছি। হেড অফিস থেকে এসপি স্যার জানিয়েছিলেন যে, আমার প্রগ্রেস ফ্রুটফুল না। আমার চাকরিকালীন সময়ে নাকি ঐ অঞ্চলে চুরি ডাকাতি খুন চোরাচালান এসব বেড়ে গেছে। অথচ আমার রেকর্ড মোটেও তা বলেনি। চুরি ডাকাতির ঘটনা তো ঘটেইনি। চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের খুন হয়েছিল, কিন্তু সেটাতে আমি হাত দেওয়ার আগেই তো আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো!’

জামান শিকদার নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘আপনি নাকি কিছু একটা জানতে পেরে হেড অফিসে যোগাযোগ করেছিলেন! কী সেটা বলা যাবে?’
‘নিশ্চয়ই বলব ভাই। দেখেন আপনি কিছু করতে পারেন কী না। কোথা থেকে যে বাঁধা আসছে তা জানার আগেই তো সরিয়ে দিলো। আপনি কাজ শুরু করলে একটু সাবধানে গোপনে কাজ করবেন, যেন কেউ কিছু জানতে না পারে। আরেকটা কথা, চেয়ারম্যান সাহেবকে খবরদার এই ব্যাপারে কিছু বলবেন না!’
জামান শিকদারের মাথায় বাজ পড়ল। প্রথমেই এই সাবধানবাণী! অথচ সে কী না সবার আগে উনার সঙ্গেই পরামর্শ করতে যেত!
‘আমি একটা অদ্ভুত কথা জানতে পেরেছিলাম ভাই। জানি না সত্যতা কতটুকু। একদিন কদমপুর থানায় একটা ছিঁচকে পাচারকারী ধরা পড়ে। এটা সেটা ওপাড়ে চালান করে। তাকে ধরে দুই একটা উত্তম মধ্যম দিয়ে কথা বের করার জন্য আমার এক কনস্টেবলকে লাগাই। সে অল্প কিছুসময় পরে এসেই বলে, লোকটা নাকি অসুস্থ বোধ করছে। আমি তাড়াতাড়ি সেখানে যাই। দেখি সে ছটফট করছে। বারবার নিজের এক বাহু দেখিয়ে বলছিল, ‘বিষ দিছে! বাঁচুম না!’
আমি বারবার জিজ্ঞেস করি, সে আর কিছুই বলতে পারে না। শুধু হাত দিয়ে নিজের লুঙ্গির নিচে কী যেন দেখাচ্ছিল। পরপরই মুখে ফেনা উঠে লোকটা মারা যায়।
আমরা তার লুঙ্গির নিচটা পরীক্ষা করে সেখানে একটা পকেট মতো জায়গা দেখতে পাই। পকেটটা সেলাই করা ছিল। সেই পকেটের মধ্যে থেকে বের করা হয় এক খণ্ড কাঠের টুকরা। কালো হয়ে যাওয়া কাঠের টুকরা। নাকের কাছে নিয়ে পরখ করতেই চমকে উঠি। আগর কাঠ! তার মানে লোকটা আগর কাঠের স্যাম্পল দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। টুকটাক চোরাচালানের জিনিসপাতি সব আসলে চোখকে ফাঁকি দেওয়া। আসল জিনিস ওটাই ছিল!’
জামান শিকদার রুদ্ধশ্বাসে শুনতে থাকে। আব্দুস সোবহান বলে যেতে থাকে, ‘আমি ব্যাপারটা জানিয়ে হেড অফিসে ফোন করি। সেখান থেকে আমাকে জানানো হয় অল্পসময়ের মধ্যেই তারা ফোর্স নিয়ে এসে দেখে যাবে। কিন্তু বেশ অনেকটা সময় পার হওয়ার পরেও যখন কেউ আসে না, তখন আমি সদরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। পথেই বদলির ফোন পাই।’

জামান শিকদার সব কথা শুনে স্থবির হয়ে বসে থাকে কিছুটা সময়। আব্দুস সোবহান বলে, ‘আপনি খোঁজ নেন, সেখানে আগর গাছ আছে কী না। আপাতত এটাই আপনার প্রধান কাজ। একটা দিয়ে কাজ শুরু করেন। আমার কেন জানি মনে হয়, এটা ধরে টান দিলেই চেয়ারম্যান সাহেবের ভাইয়ের খুনিকেও পেয়ে যাবেন!’
ফোন রেখে জামান শিকদার গভীর ভাবনায় ডুবে যায়। ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে পিওনের হাঁকে।
‘স্যার একটা মাইয়া আপনার লগে দেখা করতে চায়। নাম কইতাছে সুফিয়া। ভেতরে নিয়া আসুম?’
জামান শিকদার অবাক হয়। সেদিনের সেই মেয়েটা! আজ কী হয়েছে তার? পিওনকে বলল, ‘নিয়ে এসো!’ (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_পনের

চেয়ারম্যান আবদুল লতিফ আজ একটু খোশমেজাজে আছে।
ভাইয়ের মৃত্যুর পর থেকে নানা কারণে তার মনমেজাজ ভালো থাকে না। সব মন খারাপের কারণ সবার কাছে বলাও যায় না। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য তিনি যে একটু বিশেষভাবে শোক করবেন, সেটাও করবার উপায় নাই। মানুষের নজর এত খারাপ! ওপরে ওপরে কেউ কিছু না বললেও লোকে আড়ালে কী বলে বেড়ায়, সেটা ভালোই জানা আছে তার। কিছু কিছু কথা তো তার সাগরেদ মোস্তাকই তাকে বলেছে। অবশ্য সে বেশি কথা বলে। তার সব কথাকে আব্দুল লতিফ তেমন গুরুত্ব দেয় না। ছেলেটা এমনিতে কাজের আছে। দরকারে জান দিয়ে দিতে পারে। শুধু এই অহেতুক প্যাঁচালটা একটু হজম করে নিতে হয়, এই যা!
‘হুজুর, মাইনষে কইতাছে আপনে নাকি ভাইয়েরে হিংসা করতেন। তার ব্যবসা বাণিজ্যের দিকে আপনের নজর পড়ছিল! বেবাক কিছু দখল করোনের পাঁয়তারা করতাছিলেন!’
‘কুন হালায় এই কথা কইছে ব্যাডারে আমার সামনে নিয়া আয়! আমার ভাইয়ের কিয়ের হাতিঘোড়া ব্যবসা আছিল যে আমি হেইডার পিছে লাগুম!’
‘মাইনষে আরো কয়, আপনে নাকি নিজে লোক লাগাইয়া ভাইরে মারছেন! আমি না হুজুর… মাইনষে কয়।’
‘হারামজাদা তুই যাইবি আমারা এনে থেইকা? আমার তো মন কইতাছে এইগুলান কথা তুইই কইয়া বেড়াস!’
‘মায়ের কিরা হুজুর! আমু কমু কুন সাহসে? মাইনষে কইয়া বেড়ায়!’

আজ আব্দুল লতিফের মেজাজ ভালো আছে কারণ তিনি তার ছোটপুত্রের কাজকর্মের দিকে মনোযোগ দেখে খুব খুশি হয়েছেন। আপাতত রুবেলকে তিনি তার ছোটভাইয়ের ব্যবসাটাই দেখতে বলেছেন। লোকে যা বলে বলুক, ভাইয়ের যেহেতু কোনো ওয়ারিশ নাই তার ফেলে রেখে যাওয়া ব্যবসাবাণিজ্য তো তাদেরকেই দেখতে হবে! সেগুলো তো আর নিলামে চড়িয়ে দিতে পারেন না!
রুবেলকে দায়িত্ব দিয়ে আব্দুল লতিফের বেশ একটু চিন্তাই ছিল। এসব কাজ বুঝে উঠতেও তো সময় লাগে! কিন্তু রুবেল দেখা যাচ্ছে খুব দ্রুতই সবকিছু শিখে ফেলেছে। ঢাকা থেকে পাইকারি দরে কাপড় কিনে আনা থেকে শুরু করে দোকানে মালামাল বুঝে দেওয়া, ভালো সেলসম্যান রাখা… সবকিছুই সে একা হাতে সামলাচ্ছে। আগে শমসের ছেলেটা এসব দিক দেখত। কিন্তু সে তো তার অন্নদাতাকে খুন করে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় যে পালিয়ে আছে হারামজাদা! এখন পর্যন্ত তার টিকিটারও খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। খোঁজ তো কম করলেন না! কিন্তু ব্যাটা কেমন জানি ভোজবাজির মতো মিলিয়ে গেছে!
শমসের ছেলেটাকে তার এমনিতে খারাপ মনে হয়নি কখনো। কথা কম বলত। কিন্তু সেটা তো কোনো দোষের কিছু না। এভাবে খুন করে পালিয়ে যাওয়ার মতো ধূর্ত ধান্দাবাজ মনে হয়নি তাকে। আর আব্দুল রফিকের সঙ্গে তার কীসের এত গ্যাঞ্জাম চলছিল সেটাও এখন আর জানার উপায় নাই। কদমপুর থানায় ওসিগুলাও আসে সব একেবারে ম্যান্দামারা। কেউ যে কেস হাতে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সাথে সমাধান করবে এত বড় এলেম কারো নাই। যা করার তাকেই অর্থাৎ এই আব্দুল লতিফ শর্মাকেই করতে হবে!

চারপাশের হাল হকিকত জানার জন্য আব্দুল লতিফ বাবুলকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। চেয়ারম্যানের দশ দিকে খোঁজখবর রাখতে হয়। কিন্তু দশ দিকে তার নিজের যাওয়ার উপায় নাই। তাই খুব বিশ্বস্ত একজন লোক দরকার। তার শ্যালক মুজিবর বেশ কিছুদিন আশেপাশে ঘুরঘুর করেছে। কাজকাম কিছু করে না। মোসাহেবি করে আখের গোছাতে চায়। নজর পড়ে আছে শুধু নিজের ফায়দার দিকে। সিয়ানা ভাব দেখায়, কিন্তু কাজ দিয়ে ভরসা পাওয়া যায় না। আব্দুল লতিফ মুজিবরকেও দলে রেখেছে ঠিকই, কিন্তু সব কাজে তাকে লাগায় না। তার একান্ত বিশ্বস্ত ডান হাত হিসেবে বাবুল একেবারে ঠিকঠাক। মুখ দেখে মনের মতিগতি কারো বোঝার উপায় নাই। কিন্তু সে ঠিকই সময়মত আসল কাজ হাসিল করে ফেলে।
বাবুলকে খোঁজ করতেই সে সামনে এসে দাঁড়াল। আব্দুল লতিফ এক নজর তাকে দেখে নিয়ে বেজার মুখে বলল, ‘আইজকাল দ্যাখতাছি তর খুব ত্যাল বাড়ছে! না ডাকলে দ্যাখাই পাওন যায় না!’
বাবুলের মুখে জবান নাই। একটা শলার কাঠি দিয়ে সে তার দাঁত খোঁচাচ্ছে। অন্য কেউ এরকম ভাব নিয়ে সামনে দাঁড়ালে আব্দুল লতিফ চড় মেরে তার দাঁত তুলে ফেলত। কিন্তু বাবুলের কথা আলাদা। সে বিশেষ ভাবে থাকে। দরকার ছাড়া মুখের বাক্য খরচ করে না।
‘কী হইছে কথা কছ না ক্যা?’
‘না জিগাইলে কী কমু? জিগান কিছু!’
‘অত ভাব নিছ না সবসময় বুঝলি? অত ভাব নিছ না! জঙ্গলে গেছিলি? নাকি হেই যে ভয় পাইয়া ফিরা আইলি আর উঁকি দ্যাছ নাই?’
‘গেছিলাম।’
‘মোস্তাকরে লছ নাই তো?’
‘না!’
‘হুম। কী দ্যাখলি?’
‘টুকরা ফালাইয়া থুইয়া আইছে।’
‘কছ কী? ধরা খাইব তো! তুই কিছু করছ নাই? সরাস নাই?’
‘নাহ টাইম পাই নাই।’
‘ক্যা টাইম পাইবি না ক্যা?’
‘জোরে চাপছিল কী করুম?’
‘কী চাপছিল?’
‘দুই নাম্বার!’
‘ধুর শালা! হারামজাদা খবিস। জঙ্গলে বইয়া যাইতে পারছ নাই? এইডার লাইগা চইলা আইছস!’
বাবুল এই কথার উত্তর দিলো না। মন দিয়ে আবার শলা চিবাতে লাগল। যেন তার যতটুকু বলার ছিল, বলা হয়ে গেছে। এখন চেয়ারম্যান বকাবকি গালাগালি যা খুশি করুক, তার জানার দরকার নাই!

ওদিকে সুফিয়া পুলিশ স্টেশনে যেতে যেতে বারবার এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছিল। কেউ যদি তাকে পুলিশস্টেশনের দিকে যেতে দেখে তাহলে বিপদের ওপরে বিপদ। প্রশ্নবাণে ছারখার করে মারবে। তার চাইতেও বড় কথা, খবর তার মায়ের কাছে নিমেষেই সাপ্লাই হয়ে যাবে। তাছাড়া জঙ্গলের ছেলেটা তাকে একটু গোপনে কাজ করতে বলেছে। বেশি জানাজানি হয়ে গেলে আসল লোকেরা সাবধান হয়ে যাবে।
ছেলেটার নাম জানা হয়নি। অবশ্য জানতে চাইলেও বলত বলে মনে হয় না। ছেলেটাকে দেখেশুনে ভালো ঘরের ছেলে বলেই মনে হয়। বয়স কম হলেও ছেলেদের চোখের দৃষ্টির স্বচ্ছতা মাপার জ্ঞান সুফিয়ার ভালোই আছে। এই ছেলেটার চোখের দৃষ্টি স্বচ্ছ। সেখানে কোনো অস্বচ্ছতার দেখা পায়নি সে।

পুলিশ স্টেশনের মূল ফটকেই সুফিয়াকে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হলো। কনস্টেবল গোছের একটা লোক তো কিছুতেই তাকে ঢুকতে দিবে না। একেবারে সিনা তাক করে তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, ‘এ্যাই মাইয়া, তুমি হন হন কইরা কই ঢুকতাছ? এইটা কি তোমার কাছে হাটবাজার মনে হইতাছে নাকি? বাজার করতে আসছ? এইটা হইতাছে পুলিশ ষ্টেশন। এইখানে লোকে আসে হয় গ্রেফতার হইতে নয় কাউরে গ্রেফতার করাইতে। তুমি কী করাইতে আসছ?’
‘ওসি সাব আছেন? উনার লগে দেখা করতে আইছি। আমার নাম সুফিয়া।’
‘আরেব্বাবা! সোজা একেবারে ওসি সাহেবের লগে দেখা করার আর্জি নিয়া আসছ? কী উদ্দেশ্য? খুইলা বলো। আগে সবকিছু এইখানে বলবা তারপর ওসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে পারবা কী না ভাইবা দেখা হইব।’
‘ক্যান? আপনারে কমু ক্যান? ওসি সাব আমারে চেনেন। আমার নাম কইলেই হইব। আপনে গিয়া কন নোয়াহাটি গ্রামের সুফিয়া দেখা করবার চায়। খামাখা আপনে নিজেরও সময় নষ্ট করতাছেন, আমারও!’
কনস্টেবলের চোয়াল ঝুলে পড়ার জোগাড় হলো। সুফিয়ার প্রস্তাবে তো সে রাজি হলোই না, উপরন্তু জিজ্ঞাসাবাদের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে দিলো। সুফিয়া বহু কষ্টে বিরক্তি চাপতে চাপতে চিন্তা করতে লাগল, ‘খালি একবার ওসি সাবের কাছে যাইয়া লই, তুমার হালুয়া আমি টাইট করুম! খাড়াও! ব্যাটা পুলিশে চাকরি করতাছ দেইখা আমারে হাইকোর্ট দেখাইতাছ!’

অল্পসময়েই পুলিশস্টেশনে বেশ একটা চাঞ্চল্যকর পরিবেশ সৃষ্টি হলো। কেউ কেউ কনস্টেবলের পক্ষ নিলো, কেউ সুফিয়ার পক্ষ। তবে এই পক্ষপাতিত্ব গোপনে গোপনে চলল। ওপরে সবাই তাদের সরস বাকবিতণ্ডায় তেল পানি দিয়ে যেতে লাগল।
ওসি জামান শিকদারের পিওন এই দৃশ্য দেখে তার কাছে গিয়ে খবর দিতেই ঘটনার মোড় ঘুরে গেল। পিওন একটু পরে এসে সুফিয়াকে বলল, ‘স্যার আপনারে ভেতরে বুলাইছে।’
কনস্টেবলের এতে খুব অপমানবোধ হলো। সে ঘাড় শক্ত করে পিওনের দিকে একটা কড়া দৃষ্টি ফেলে বলল, ‘স্যারে বুলায় মানে? স্যার জানল ক্যামনে এই মেয়ের কথা? স্যারের রুমে কি সিসি ক্যামেরা লাগাইছে নাকি?’
পিওনের মুখেও জবাব এসে গেল, ‘আপনেরা এত জোরে চিল্লাচিল্লি করতাছেন আর স্যারের কানে কিছু যাইব না?’
‘খুব কথা শিখছ তুমি তাই না? স্যারের কানে গিয়া তুমিই যে খবরটা লাগাই দিছ সেইটা কি আমি বুঝবার পারি নাই? কনস্টেবল আমি নাকি তুমি?’
‘আপনে। এইবারে মাইয়াটারে যাইবার দ্যান। স্যার অপেক্ষা করতাছে!’
কনস্টেবলের কটমট দৃষ্টিকে বেমালুম পাত্তা না দিয়ে সুফিয়া গটগট করে পিওনের পিছে পিছে রওয়ানা দিলো। যাওয়ার আগে এমন একটা ভাব করল যেন ছোটখাট একটা যুদ্ধ জয় করে ফেলেছে!

জামান শিকদার সুফিয়াকে উষ্ণ অভিবাদন জানিয়ে বলল, ‘আরে সুফিয়া! তুমি দেখি রাস্তা খুঁজে ঠিকই পুলিশ স্টেশনে চলে এসেছ! কোনো কাজে এসেছ? কাজে না এলে আমি আজ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারব না। আগেই বলে দিলাম। একটা জরুরী কাজে আটকে গেছি।’
সুফিয়াকে ওসি সাহেবের ঘরে পৌঁছে দিয়ে পিওন সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। সুফিয়া বারদুয়েক তার দিকে তাকিয়ে ইতস্তত করছে দেখে জামান শিকদার পিওনকে বলল, ‘বারেক, তুমি একটু বাইরে যাও।’ পিওন চলে যেতেই সুফিয়া বলল, ‘স্যার আমিও জরুরি কামেই আইছি। আপনে কইছিলেন কুনো সমস্যা হইলেই জানি আপনারে জানাই!’
‘কোনো সমস্যা হয়েছে নাকি?’ কথা বলতে বলতেও জামান শিকদার ফাইলপত্র থেকে মুখ সরাচ্ছিল না। এখন একটা মুহূর্তও এক ঘণ্টার চাইতে দামি মনে হচ্ছে তার কাছে। যেন রহস্য খোলার ছোট্ট একটা চাবি তার হাতে চলে এসেছে। এখন এই ছোট্ট চাবিটাকে সম্ভাব্য সব তালাতে এখনই তাকে লাগিয়ে লাগিয়ে দেখতে হবে। দেরি হয়ে গেলেই চাবির ডেট এক্সপায়ার্ড হয়ে যাবে!
‘স্যার, আমি গতকালও জঙ্গলে গেছিলাম। সেইখানে আমি একটা জিনিস দ্যাখছি!’
‘কী জিনিস? আর আমার নিষেধ করার পরেও তুমি আবার সেই জঙ্গলে একা একা ঢুকেছিলে? তুমি তো মেয়ে বিপদে না পড়ে ছাড়বেই না দেখছি!’
‘স্যার আমার বিপদের কথা পরে চিন্তা কইরেন। আগে কী দ্যাখছি সেইটা কইয়া নেই। আমি জঙ্গলের একটা জায়গায় ম্যালা কাঠের খণ্ড পইড়া থাকতে দ্যাখছি!’

জামান শিকদার রীতিমত চমকে উঠল। আরেকটু হলে তার হাত থেকে ফাইল পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে এলো, ‘কী… কী দেখেছ? কাঠের খণ্ড? মানে গাছ কেটেছে? কী গাছ?’
‘ঠিক কইবার পারি না স্যার। তয় সেই গাছে ম্যালা পেরেক ঠুইকা রাখা আছে। দেইখা মনে হয়, কেউ বুঝি ইচ্ছা কইরা পেরেকগুলানরে গাছের সঙ্গে ঠুইকা রাখছে!’
‘আগর কাঠ!’ নিজের অজান্তেই জামান শিকদারের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো। একটু আগেই সে মোবাইলে ‘আগর কাঠ’ লিখে সার্চ দিয়েছিল। আগর কাঠকে ব্যবহারের উপযোগী বানানোর জন্য যে কষ্টসাধ্য প্রক্রিয়া গাছের ওপরে চালানো হয় সেটাই বিস্তারিত পড়ছিল এতক্ষণ। গাছ যখন ইনফেক্টেড হয়ে কালোরঙের হয়, তখনই সেই গাছ দামী হয়ে ওঠে। আর এর দাম রীতিমত আকাশছোঁয়া। তাহলে কি সুফিয়াও সেই গাছের কথাই বলতে এসেছে যার ব্যাপারে আব্দুস সোবহান সাহেব বলছিলেন? কদমপুরের জঙ্গলে কি সত্যিই তাহলে আগর গাছ আছে? এত দামি গাছ! সেই গাছ চুরি হয়ে যাচ্ছে পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই?

জামান শিকদার আর অযথা কথা বলে সমস্য নষ্ট করতে গেল না। সোজাসুজি জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি আমাকে সেই জায়গাটাতে নিয়ে যেতে পারবা? মনে আছে তোমার জায়গাটা কোথায়?’
‘হ পারুম।’
‘গুড! চলো তাহলে। এক্ষুণি যেতে হবে!’
সুফিয়াকে নিয়ে বের হয়ে আসতে আসতে জামান শিকদার তার দুজন কনস্টেবলকেও গাড়ি নিয়ে বের হতে বলল। গন্তব্য কদমপুরের পশ্চিমের জঙ্গল। প্রতিটা চোখে জ্বলজ্বল করে থাকা জিজ্ঞাসাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে জামান শিকদার বলল, ‘আপনারা সবাই আমার গাড়িকে ফলো করতে করতে আসুন। রাস্তায় কারো সঙ্গে কোনোরকম কথাবার্তা বলবেন না!’

সুফিয়াকে একটু আগে যে কনস্টেবল জিজ্ঞাসাবাদ করছিল সে মিনমিন করতে করতে বলল, ‘স্যার, সবাই চইলা গ্যালে তো পুলিশ স্টেশনে কেউ থাকব না। রেজা আপনার লগে যাক, আমি না হয় এইখানেই থাকি!’
‘শরফুদ্দিন সাহেব, আপনি কি সবকিছু একটু বেশিই বোঝেন? আমি যা করতে বলছি আপনি তাই করবেন। অযথা প্রশ্ন করে আপনি আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?’

কনস্টেবল শরফুদ্দিনের মনে হলো, কেউ বুঝি তাকে চিরতার শরবত খাইয়ে দিয়েছে। সুফিয়া মেয়েটাও তার দিকে কেমন বিদ্রূপের চোখে তাকিয়ে মজা দেখছে। একটা সামান্য গ্রামের মেয়ের সামনে স্যার তাকে এভাবে না বললেই পারত! শরফুদ্দিন মনে মনে বলল… ‘এই হিসাব আলাদা তোলা থাকল স্যার! হিসাব হইব পইপই কইরা!’

ঠিক হয়েছিল ওসি জামান শিকদারের গাড়িতে সুফিয়া উঠবে, আর আরেকটি গাড়িতে উঠবে তার দুই কনস্টেবল শরফুদ্দিন আর রেজা। কয়েকজন সাধারণ পুলিশকেও তাদের গাড়িতে ওঠানো হবে। এত জন ফোর্স না নিয়ে গেলেও হয়ত হয়, কিন্তু শুরুতেই সতর্ক হয়ে গেলে ভালো হয়। কারণ বলা যায় না, যারা গাছ কাটছে তারা হয়ত এত নিষ্কণ্টক করে রাখেনি জায়গাটাকে!
কনস্টেবল রেজা ওসি স্যারের নির্দেশনা পাওয়ামাত্রই গাড়িতে গিয়ে উঠেছে। কিন্তু শরফুদ্দিন তখনো ইতস্তত করছে, যেন কিছু একটার জন্য সে অপেক্ষা করছে। মাঝে মাঝে নিজের মোবাইলের দিকে তাকাচ্ছে। গ্রামদেশে নেটওয়ার্ক ভালো আসে না। একটু পর পর সে তার ফোনটাকে নিয়ে কিছু দূরে চলে গিয়ে নেটওয়ার্ক চেক করছে।
জামান শিকদার সুফিয়াকে গাড়িতে উঠতে বলে শরফুদ্দিনের হাবভাব দেখতে লাগল। তিনি যে দূর থেকে তাকে লক্ষ করছেন, এই ব্যাপারে শরফুদ্দিনের কোনো খেয়াল নেই। তাকে দেখে কেমন একটু চিন্তিত মনে হচ্ছে।

মিনিট দুয়েক এই হাবভাব দেখার পরে জামান শিকদার সুফিয়াকে গাড়ি থেকে নেমে সামনে ড্রাইভারের পাশে বসতে বলল। তারপর শরফুদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘এই যে শরফুদ্দিন, তুমি এসে এই গাড়িতে বসো। পেছনের সিটে বসো। আমি আর তুমি পেছনে বসি, সুফিয়া সামনে বসুক।’
শরফুদ্দিনকে দেখে মনে হচ্ছে, সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। ওসি স্যার তাকে তার গাড়িতে উঠতে বলছেন! কিন্তু কেন? ওসি স্যারের গাড়িতে উঠলে সে তার কাজ অর্থাৎ মেসেজ চালাচালিটা করবে কীভাবে?
জামান শিকদার তাড়া লাগায়, ‘কী হলো কথা শুনতে পাওনি? ঝটপট আমার গাড়ির পেছনের সিটে গিয়ে বসো!’
‘ইয়ে মানে স্যার… আপনার পাশে! সেইটা কি ভালো দেখায়?’
‘কেন? ভালো দেখায় না কেন? তুমি কি আমার পাশে আগে কখনো বসোনি নাকি? মনে হচ্ছে আজকেই নতুন বসছ!’
এরপরে কথা চলে না। শরফুদ্দিন তবুও গাইগুঁই করছে দেখে জামান শিকদার এবারে গম্ভীর গলায় বলল, ‘কী ব্যাপার শরফুদ্দীন, তুমি দেখছি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছ! ঘটনা কী একটু খুলে বলবা?’
‘স্যার, আমার একটা কথা। কোথাকার কে না কে… একটা আকাইম্মা গ্রামের মাইয়া আইসা আপনারে বলল আর আপনে তার কথা শুইনা একেবারে ফোর্স নিয়া জঙ্গলে যাইতাছেন! এইটা কি একটা কথা হইল স্যার? আমরা পুলিশরা কি এইখানে বইসা বইসা ঘুমাইতাছি? এইরকম কিছু যদি হইত, তাইলে কি আমরা এদ্দিনে খবর পাইতাম না?’
জামান শিকদার তীক্ষ্ণচোখে শরফুদ্দিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘আমরা তো এতদিন ধরে ঘুমের মধ্যেই আছি! তবে তুমি মনে হচ্ছে এতদিন ধরে জেগে জেগে ঘুমাচ্ছিলা! আশেপাশে মশামাছি এসে আমাদের ঘুমে ডিসটার্ব করে কী না সেই পাহারায় ছিলা!’
‘বু… বুঝলাম না স্যার!’
‘কিছু বোঝার দরকার নাই। গাড়িতে ওঠো। খবরদার আর একটা কথাও যাতে খরচ না করতে হয়!’ (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী

কনে দেখা আলো পর্ব-১২+১৩

0

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_বার

নিজের ডেরায় ঢুকে হাঁপাতে থাকে শমসের। একটুর জন্য বেঁচে গিয়েছে আজ। আরেকটু হলেই মেয়েটা তাকে ধরে ফেলেছিল প্রায়। জঙ্গল থেকে বিদায় হয়েছে নিশ্চিত হওয়ার পরেই সে নিজের ডেরায় ঢুকেছে।
হ্যাঁ, আজ প্রায় তিনমাস যাবত এই জীর্ণশীর্ণ ভাঙাচোরা মন্দিরটাই তার ডেরা। সামনে ইয়াবড় জিভ বের করে রাখা প্রায় প্রমাণ সাইজের এক কালীমূর্তি। এক হাত কনুই থেকে খসে পড়া। তবু খড়গ ধরা হাতটি এখনো অক্ষত। মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন সেই খড়গ ধরা হাতের দিকে তাকালে যেকোনো দুর্বলচিত্ত মানুষের সেখানেই ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যাওয়ার কথা। প্রথমদিকে তারও যে একটু আধটু ভয় ভয় লাগত না, একথা গলায় জোর দিয়ে বলতে পারে না। কিন্তু সেটাকে পাত্তা দেওয়ারও বান্দা সে নয়।
নীরব নির্জন জঙ্গলে রাত বিরেতে কতরকম যে শব্দ হয়! পাতার শনশন… মর্মর! বিজাতীয় কোনো পাখির বিচিত্র সুর, বন্যপ্রাণীর গা হিম করা চিৎকার! মাঝে মাঝে মাটির ওপর দিয়ে কী যেন হেঁটে যায় বুকে ভর করে। প্রথমদিকে যখন ঘুম আসতে চাইত না, তখন মাদুরে শুয়ে শুয়ে এসব আওয়াজ শুনে রাত কাবার করে দিত সে।

শমসেরকে নতুন জীবন দেওয়া ‘শুভাকাঙ্ক্ষী’ লোকটি তাকে এখানে রেখে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কীরে ছ্যাড়া, থাকবার পারি তো এইখানে? ভয়ে মইরা পইড়া থাকিস না য্যান!’
আজীবন কম কথা বলা শমসের সেদিনও খুব বেশি কথা বলেনি। শুধু একবার জিজ্ঞেস না করে পারেনি, ‘আপনে আমারে বাঁচাইবার চাইতাছেন ক্যান?’
‘কারণ তর লগে আমার পীরিত হইছে বুঝছস? বাঁচাইবার চাইতাছেন ক্যান! এ্যাহ! এইডা জাইনা তর কিয়ের কাম? বাঁইচা থাকনের চেষ্টা করিস। মূর্তি দেইখা ভয় খাওনের কিছু নাই। যে যাই কউক, এই মাটির মূর্তি তর কুনো ক্ষতি করব না!’
শমসের আর কিছুই জিজ্ঞেস করেনি।

লোকটি যাওয়ার আগে নিজেই বলে গিয়েছিল, ‘আমি আসুম মাঝে মইধ্যে। কিছু শুকনা খাবার দিয়া গ্যালাম। এইডা দিয়া দিন চারেক পার কইরা দে। এই জঙ্গলের এক মাথায় একটা ছোট পাহাড় আছে। সেই পাহাড়ে ছোট মতন একটা ঝর্ণা আছে। সেইখান থেইকা পানি আইনা খাইতে পারবি। আমি অখন যাই। এইখানে আমার বেশিক্ষণ থাকা নিরাপদ না। তুইও একটু চোখকান খুইলা রাখিস কয়েকটা দিন! কুনো অন্যরকম আওয়াজ পাইলে এদিক সেদিকে গা ঢাকা দিস। বুঝছস? বুইঝা শুইনা চলোন লাগব!’
কথাগুলো বলেই সে চলে যেতে উদ্যত হয়েছিল। তারপর কী মনে করে পেছন ফিরে বলেছিল, ‘তরে বাঁচাইয়া রাখতাছি বেবাকের লাইগা। এইডা পরে বুঝবি। তুই বাঁইচা থাকলে ম্যালা মাইনষে বাঁচব! এই গেরামডাও বাঁইচা যাইব।’

কথাগুলো ভীষণ হেঁয়ালির মতো মনে হয়েছিল শমসেরের কাছে। তার এই ঠুনকো জীবনটা কীভাবে অনেক মানুষের জন্য এত দামি, এই ভীষণ কঠিন ধাঁধা সে সমাধান করতে পারেনি। অবশ্য খুব বেশি মাথাও ঘামায়নি এটা নিয়ে। গত কয়েকদিনে তার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই বারবার ঘুরেফিরে মনে পড়েছে আর একে একে ছেঁড়া সুতো জোড়া দিয়ে কিছু একটা বানানোর চেষ্টা করে গেছে শমসের।

জীবনটা তার কোনোদিনই সরল ছিল না। সংগ্রাম করেই বাঁচতে শিখেছে সে আজীবন।
মা মরে গেল হুট করে। অভাবে, কষ্টেশিষ্টে দিনগুলো চলেই যাচ্ছিল তাদের মা-ছেলের। মাঝে মাঝে ওদের একচালা বস্তির টিনের ঘরটাতে মাংসের সুবাস ভেসে আসত। প্রাণ ভরে সেই সুবাস নাকে টেনে নিতে নিতে সে অবাক হয়ে দেখত, মা কেরোসিনের চুলায় গরুর মাংস চড়িয়েছে। একটা পাত্রে পোলাওয়ের চাল ধুয়ে রাখা। শমসের অবাক হয়ে মাকে বলত, ‘ও মা, এগুলান কই পাইছ?’
মা কিছু না বলে মিটিমিটি হাসত। খাওয়ার সময় জোর করে ওর পাতে আরো দুটো মাংসের খণ্ড দিতে দিতে বলত, ‘ভালা কইরা খা। উনি কদ্দিন পরে আইসা বাজারঘাট কইরা দিলেন। আবার কোনদিন আইবার পারবেন কেডায় জানে!’
এই উনি মানে যে কে, এটা বুঝেছে বুদ্ধি হওয়ার পরে। আব্দুল রফিক সাহেব মাসে দুই মাসে তাদের হতদরিদ্র সেই ঘরটাতে পায়ের ধূলি দিত। সেদিন তাদের বাড়িতে ভালোমন্দ রান্না হতো। মা তাকে খেয়ে যাওয়ার জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করত। মাঝে মাঝে তিনি খেতে বসতেন, মাঝে মাঝে বসতেন না। সেই দিনের পরেও আরো দশ বারোদিন তাদের কোনো অভাব থাকত না। বাসায় ভালো রান্নাবান্না হতো। মায়ের চোখেমুখে হাসি আনন্দ ঝিলমিল করত।

দিনে দিনে বস্তিতে নানারকম অকথা কুকথা ভেসে বেড়াতে লাগল। কেউ কেউ তাকে পথেঘাটে দেখে নোংরা ইঙ্গিত করে বলত, ‘কীরে ছ্যাড়া, তর মায়ের ভাতার আইছে?’ বলেই অশ্লীল একটা হাসি দিত। পাশ থেকে কেউবা টিপ্পনী কেটে বলত, ‘ভাতার কস ক্যা? ক নাগর! খিক খিক খিক!’
কিশোর শমসের ভোঁস ভোঁস করে ফুঁসত এসব কথা শুনে। মাকে গিয়ে বলত, ‘আমি কামাই কইরা তুমারে খাওয়ামু। তুমি হেই ব্যাডারে আর বাড়িত আইবার দিবা না। যদি দাও, আমি কইলাম গলায় দড়ি দিয়া মরুম!’
ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড জেদি শমসেরের যেই কথা সেই কাজ। মায়ে তার এই হুমকি শুনে কেঁদে বুক ভাসিয়ে বলত, ‘আচ্ছা বাপ, তর কথাই থাকব। আমি না কইরা দিমু। তুই কিছু করিস না বাপ আমার। আর একটা কথা জাইনা রাখ, তর মায়ে কুনো খারাপ কাম করেনি। তোরে যারা খারাপ কথা কইছে, বেবাকে মিছা কথা কইছে!’

ফ্ল্যাশব্যাকের মতো ঘটনাগুলো ভেসে উঠতে থাকে মনের পর্দায়। মায়ে ছেলের দিনগুলো হাসি আনন্দ দুঃখ কষ্টে কেটেই যাচ্ছিল একরকম।
শমসের বড় হলো। আব্দুল রফিক কিন্তু এতকিছুর পরেও তাদের বাড়িতে ঠিকই আসত। ততদিনে শমসের বুঝতে পেরেছে, যারা আজেবাজে কথা বলে তারা না জেনেই বলে। আব্দুল রফিক আর তার মায়ের মধ্যে এমন কোনো খারাপ সম্পর্ক নাই যার জন্য তার মাকে এমন অপবাদ দেওয়া যায়। যে সম্পর্ক ছিল সেটা ছিল পুরোপুরি মানবতার। মানবতার খাতিরেই আবদুল রফিক তাদের বাড়িতে আসত। তাদেরকে সাহায্য করত। কারণ শমসেরের নানা একসময় তাকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। তিনি না থাকলে হয়ত আব্দুল রফিক এতে সহজে কাপড়ের ব্যবসার নাড়ি নক্ষত্র বুঝতে পারতেন না।

কাপড়ের ব্যবসার কাজে অনেক আগে থেকেই শহরে আসা যাওয়া ছিল আব্দুল রফিকের। শমসের তখনো জন্মায়নি। তার নানা মোরশেদুল রহিম তখন বেঁচে ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে শমসেরদের অবস্থা এত খারাপ ছিল না। মোরশেদুল করিম ছিলেন পাইকারি কাপড়ের বিক্রেতা। ঢাকার গাউসিয়াতে তিনি একটা কাপড়ের দোকানের কর্মচারি ছিলেন। দোকানের জন্য তিনি প্রত্যন্ত এলাকা থেকে খুচরা দরে কাপড় কিনে আনতেন। আব্দুল রফিক ঢাকায় কাপড় কিনতে এসে তার সঙ্গে পরিচিত হয়। কাজের প্রয়োজনে তাকে মোরশেদুল করিমের বাসাতেও আসতে হয়। সেই আসা যাওয়া থেকেই শমসেরের মাও তাকে চিনত।
মোরশেদুল করিম মারা যাওয়ার পরে শমশেরের মা মোটামুটি পানিতে পড়ে যায়। বাপের চাকরিটা তো আর মেয়ের করার উপায় ছিল না। সেটা খাটাখাটুনির কাজ। দুর দূরান্তে যাওয়া আসা করতে হয়। মহিলা মানুষের জন্য ম্যালা ঝক্কির কাজ। জমানো সামান্য যেটুকু টাকা ছিল, সেটাও তখন তলানিতে ঠেকেছে। আর তারচেয়ে বড় বিপদের কথা হলো এই, ততদিনে শমসের দুনিয়াতে এসে গেছে।

মায়ের কাছে নিজের বাবার কথা জানতে চেয়ে সদুত্তর পায়নি শমসের। তার বাবা নাকি বউ বাচ্চাকে রেখে বিদেশে গিয়েছিল। সেখান থেকে আর ফেরেনি। হয়ত সেখানে নতুন সংসার শুরু করেছে তার বাবা।
শমসেরের মন এটুকু উত্তরে সন্তুষ্ট হয়নি। বাবার নাম পরিচয় আর কোন দেশে সে গিয়েছে, এসব ভালোমত জানা থাকলে যে করেই হোক সে তার বাবার খোঁজ সে বের করেই ছাড়ত! কিন্তু এসবের কোনো কিছুই তার বোকাসোকা মায়ের জানা ছিল না।
মোরশেদুল করিমের মেয়ে আর নাতির দুঃসময়ে আব্দুল রফিক সহৃদয়তার হাত বাড়িয়ে দেয়। সেই হাতে কোনো পাপ ছিল না। একদিন নিজের পাশে বসিয়ে আব্দুল রফিক তাকে সবকিছু খুলে বলে। এটা জানার পরে শমসেরের মনেও আর কোনো দ্বিধা থাকে না।

কিন্তু ভাগ্য যাকে জন্মদুঃখী করে দুনিয়ায় ছেড়ে দিয়েছে, সে কীভাবে এত সহজে সুখের সন্ধান পাবে? বটগাছের মতো ছায়াদাতা মানুষটিই শিকড় উপড়ে চলে গেল!
আব্দুল রফিক তাকে গ্রামে নিয়ে এসে নিজের ব্যবসার কাজে লাগিয়ে দিয়েছিল। ভালোই চলছিল সবকিছু। আব্দুল রফিক শহর থেকে মালামাল নিয়ে আসত। তাকে সবসময় সঙ্গে করে নিয়ে যেত। গ্রামে আব্দুল রফিক আর আব্দুল লতিফ এই দুই ভাইয়ের ভালো দাপট আর প্রভাব প্রতিপত্তি। সেই প্রভাবে শমসেরও মাথা উঁচু করে চলত। সে বেশি একটা কথাবার্তা বলত না। কারো সাথে মিশত টিশত না। কেউ মিশতে এলে অন্যদিকে রাস্তা মাপত। এতকিছুর পরেও কেউ থাকে ঘাঁটাতে আসত না। কিন্তু ভাগ্যের ফের! কী থেকে কী হয়ে গেল!
হয়ত পুলিশের হাতে এতদিনে তার ভবলীলাই সাঙ্গ হয়ে যেত। কিন্তু আবারও এক অপ্রত্যাশিত ‘রক্ষাকবচ’ তাকে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরিয়ে আনল। হয়ত তার অপাপবিদ্ধা জন্মদুঃখী মায়েরই কোনো পুণ্যের প্রতিদান হবে! সৃষ্টিকর্তা বারবার শতেক উছিলায় তাকে নতুন জীবন দান করে চলেছেন!

তিন মাস এই জঙ্গলের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে নিয়ে প্রায় অভ্যস্তই হয়ে পড়েছে এতদিনে। তার সেই শুভাকাঙ্ক্ষী লোকটি মাঝে মাঝে দরকারি জিনিসপত্র দিয়ে যায়। খুবই অল্প আয়োজনে নিজের বেঁচে থাকার ব্যবস্থাটা সে করে ফেলে। সে কথা দিয়েছে, আর কিছুদিন পরে সুযোগমত এখানে থেকে সরিয়ে ফেলবে তাকে। কিন্তু শমসের ভরসা পায় না, সরালে কোথায়ই বা সরাবে! সেখানেও তো আবার সেই পলাতক জীবনই যাপন করতে হবে! এর চাইতে পুলিশের হাতে ধরা দিয়ে সব সত্যি সত্যি বলে দিলেই বুঝি ল্যাঠা চুকে যায়!

একদিন সে তার শুভাকাঙ্ক্ষীকে এই কথা বলেও ফেলেছিল। দুই পলক স্থিরচোখে তাকিয়ে থেকে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠতে দেখেছিল লোকটার মুখে। ঠোঁটটাকে ঈষৎ বাঁকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিল, ‘পুলিশ তরে এ্যারপরে জামাই আদরে পোলাও মাংস খাওয়াইত। মখমলের বিছানায় আরাম কইরা শুয়াইত!’
‘আপনে জানেন না কী হইছে? ছিলেন না ঐদিন?’
‘হ জানি! বেবাক না দ্যাখলেও যেটুকুন দ্যাখছি তাতে যা বুঝনের বুইঝালাইছি! কিন্তু আমি বুঝলে আর দশজন বুঝলেও কিচ্ছু যাইব আইব না, বুঝলা চান্দু? খামাখা ভাবের কথা না কইয়া য্যামনে কইতাছি ত্যামনে থাক। বেশি তেড়িবেড়ি করলে তুইও মরবি, গেরামের লোকেও মরব!’
আবার শমসেরের মনে প্রশ্ন জাগে, সে মরলে কেন গ্রামের লোকেও মরবে? কিন্তু আর কিচ্ছুই বলে না সে।

অন্য বিপদ ছিল না তেমন একটা। জঙ্গলের অপবাদের কারণেই এখানে গ্রামের লোকজন তেমন একটা আসে টাসে না।
কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে উটকো এক বিপদ এসে হাজির হয়েছে। জঙ্গলে একা একা একটা মেয়ে ঘুরে বেড়ায়। সে এই গাছ সেই গাছের ডাল ধরে ঝাঁকায়, ফলমূল পেড়ে জামার কোঁচড়ে ভরে। পাখির ডাক শুনলে থমকে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে সেটা শোনে। মনে হয় জঙ্গলের এই থমথমে পরিবেশ মেয়েটা যেন খুব উপভোগ করছে।
দৃশ্যটা এতটাই অদ্ভুত যে, কয়েক মুহূর্তের জন্য ধন্দে পড়ে গিয়েছিল শমসের। ফাঁকা জঙ্গলে কি সত্যি সত্যিই কিছু থাকে নাকি? এই মেয়ে কি ভাবে বাস্তবের কেউ হবে? দেখেশুনে চৌদ্দ পনের বছরের বেশি মনে হয় না বয়স। এত অল্প বয়সের একটা মেয়ের এত সাহস হয় কেমন করে?

শমসের মেয়েটাকে দেখামাত্রই একটা ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। যদিও তার বিশ্বাস ছিল, মেয়েটা কিছুতেই মন্দিরের মধ্যে ঢোকার সাহস পাবে না, তবু ঝোপঝাড়কেই বেশি নিরাপদ মনে হয়েছিল তার কাছে। তারপর মেয়েটা যখন তার বিশ্বাসকে ঠ্যাঙা দেখিয়ে মন্দিরের ভেতরে উঁকি দিয়েছিল, বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছে শমসের।
এরপরেও আরো বেশ কয়েকদিন মেয়েটা এসেছে। প্রতিবারই তাকে চটজলদি ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকতে হয়েছে। একদিন তো এক ঝোঁপের ভেতরে কী একটা পোকা যেন কামড়ে দিয়েছিল। বিষ ছিল সম্ভবত তার কামড়ে। অনেকক্ষণ ধরে জায়গাটা জ্বলছিল।

দাঁতে দাঁত চেপে সেই জুলুনি হজম করতে করতে শাপশাপান্ত করেছে মেয়েটাকে। বজ্জাত ছুড়ি! ঘোরাঘুরি করার আর জায়গা খুঁজে পায়নি!
একদিন সে সম্ভবত তার বড়বোনকে সঙ্গে নিয়ে এসেছিল। সেদিনও নিজেকে আড়াল করতে কম ফ্যাসাদে পড়তে হয়নি শমসেরকে। আর আজকে তো সব সাবধানতাই প্রায় ধ্বসে যাচ্ছিল। একবার মনে হচ্ছিল, মেয়েটা বুঝি তাকে দেখেই ফেলেছে। খুব অল্প সময়ের জন্য একবার মনে হয়েছিল, মেয়েটা যেন তার দিকে তাকিয়েছে। যদিও তা খুব সামান্য কয়েক মুহূর্তের ব্যাপার ছিল। এরপরেই শমসের দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়েছিল। মনে মনে ঠিক করেছিল, এর পরেরবার মেয়েটা এলে সে তার মুখোমুখি হবে। একটা বাচ্চা মেয়েকেও যদি ভয় পেতে হয়, তাহলে এই জীবন বাঁচিয়ে রেখেই বা কী হবে? (ক্রমশ)

#উপন্যাস
#কনে_দেখা_আলো
#পর্ব_তের

ওদিকে সুফিয়া তখন বাড়িতে বড়বোনের প্রশ্নবাণে জর্জরিত হচ্ছে। সুফিয়ার মনটা আজ বেজায় খুশি। জুলেখার হম্বিতম্বি তার কানে ঠিকমত ঢুকছেই না যেন। মনে মনে সে বারবার সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে, আর বলছে… ‘আল্লাহ্‌ আমার মনের মইধ্যে যেই খোয়াব জাগছে, সেইডাই জানি সত্য হয়! অন্যকিছু জানি না হয় আল্লাহ্‌! তুমি দেইখো! আমার মায়ে জানি কুনো প্যাঁচ লাগাইবার না পারে!’
জুলেখা ওদিকে ভাতের মাড় গালতে গালতে সুফিয়ার ভাবভঙ্গি দেখছিল। এত খুশি হওয়ার মতো কী হয়েছে আজকে, এটা সে মোটেও বুঝতে পারছে না। পুলিশের জিপে উঠতে পেরেই এত খুশি! নাকি পুলিশের সঙ্গে বেশি খাতির হয়ে গেছে? ভাব তো ভালো ঠেকছে না এই মেয়ের! সে আপনমনে গজগজ করতে থাকে।
‘এমুন ডানপিটা স্বভাব হইছে! পুলিশের লগেও খাতির হইয়া গ্যাছে! পুলিশের গাড়িত কইরা পাড়া ঘুইরা বেড়ায়! মাইনষে দ্যাখলে কী কইত? কেউ একটা খারাপ কথা রটাইয়া দিলে তর আর বিয়াশাদী কিছু হইত? গ্যাছশ ইশকুলে! ইশকুল থেইকা সিধা বাড়িত আইবি। তুই কীয়ের মইধ্যে গিয়া সান্ধাইছস?’
সুফিয়া হঠাৎ তার বুবুর গলা ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে বলে, ‘আমার বিয়া হইব কী না হইব, সেই চিন্তা কইর না বু! তয় তুমার একটা ব্যবস্থা খুব শিগগিরই হইয়া যাইব!’
জুলেখা সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে ভ্রুদুটো কুঁচকে বলে, ‘হ! গায়েবি সংবাদ পাইছস তো তুই! এইসব আলগা ফুটানি তর কাছেই থুইয়া আমারে সিধা সিধা ক আইজও কি তুই ঐ অলুক্ষুণা জঙ্গলে গেছিলি? কেডায় আছে ঐখানে তর? ভাতারের খোঁজ পাইছস? আর আইজ না তোরে এট্টু জলদি আইতে কইছিলাম! ফুলিরে একবার দ্যাখবার যাইতে চাইছিলাম ভুইলা গেছস?’

জুলেখা আজ সত্যিই রেগেছে বুঝতে পারল সুফিয়া। অযথা আর বোনের রাগ না বাড়িয়ে সে মিথ্যা কথা বলল। ‘হেইডা আমি ভুলি নাই বু! মনে আছিল। জলদিই ইশকুল থেইকা রওয়ানা দিছিলাম। আর তুমি কী ভাবছ যে আমি রোইজ ঐ জঙ্গল দিয়া ঘুইরা আসি? রাস্তায় দেখি ঐ পুলিশ ব্যাটা গাড়ি লইয়া বাইর হইছে। আমারে কইল, হামিদ মিয়ার বাড়িটা কই হেইডা খুঁইজা দিতে।’
মিথ্যা বলতে বলতে একটু বেশিই বলা হয়ে গেল। তবু সুফিয়ার গলা কাঁপল না। হামিদ মিয়া এই অঞ্চলের একজন বড় জুয়ারি। প্রতিবছর মেলাতে সে জুয়া খেলে অনেক টাকাপয়সা কামাই করে। সেই টাকা দিয়ে মদ তাড়ি মেয়েমানুষ… যাবতীয় নেশার রসদ জোগায় সে। হামিদ মিয়ার অত্যাচারে গাঁয়ের লোকজন অতিষ্ঠ। পড়ালেখা জানা লোকজন তাকে দেখলে রাস্তা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে যায়। মেয়েরা সহজে তার সামনে পড়তে চায় না।

সুফিয়ার কথা শুনে জুলেখা হাঁ করে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সুফিয়া বুঝতে পারল, কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরিয়ে গেছে। ছোটখাট জ্বরকে তাড়াতে গিয়ে টাইফয়েড বেঁধে গেছে। জুলেখা কোনোমতে বলল, ‘তুই ঐ জুয়াড়ি মাইয়াবাজ নেশাখোর হামিদের বাড়ি দেখাইয়া আইছস পুলিশরে? আল্লাহ্‌! কী হইব এই ছেমড়ির! অখন যদি হামিদ মিয়ারে পুলিশ গিয়া ধরে আর একবার যদি সে জানবার পারে যে, তুই হ্যারে ধরাইয়া দিছস, তাইলে ওই ব্যাটা জেল হাজত থেইকা ছুটা পাইয়া তর কী হইব জানশ কিছু?’
সুফিয়া তবুও নির্বিকার। হঠাৎ জুলেখার মতিভ্রম হলো। যা সে কখনো করে না, আজ সেটাই করে বসল। সুফিয়ার কানটা ধরে চেঁচিয়ে উঠল, ‘মায়ে ঠিকই কয়। তরও বিয়া হইব না কুনোদিন। তুই বেবাকেরে জ্বালাইয়া পুড়াইয়া মারোনের লাইগাই পয়দা হইছস!’
সুফিয়ার মা হনুফা বিবি অসময়ে একটু শুয়েছিল। চোখের পাতাটাও ধরে এসেছিল তার। এই চেঁচামেচিতে সে বিছানা থেকেই চেঁচিয়ে উঠল, ‘ঐ জুলেখা কী হইছে তর? সারাদিন খাটাখাটনি কইরা এট্টু বিছানায় কাইত হইছি কী হইনি, তোগো ফূর্তি লাগছে তাই না? তুই চিল্লাস ক্যা? কী হইছে? বাড়িত কি ডাকাইত পড়ছে?’
সুফিয়া হাত জোড় করে মিনতি জানায় মাকে কিছু না বলার জন্য। জুলেখা ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলে, ‘আইজকার মতো বাঁইচা গেলি তুই! কিন্তু এ্যারপর জুদি এইটা নিয়ে কিছু হয়, আমি বেবাক কিছু মায়েরে কইয়া দিমু… এই কইলাম!’

যেদিন এসব ঘটনা ঘটল তার দুইদিন পরেই সুফিয়া আবার সেই পশ্চিমের জঙ্গলে পা দিলো।
সেদিন সে যে জিনিস আবিষ্কার করেছে, সেটার ফিরিস্তি উদ্ধার না করে সে কিছুতেই পিছু হঠবে না! তাকে জানতেই হবে, জঙ্গলে মন্দিরের ভেতরে কোন আল্লাহ্‌র বান্দা ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে! আর কী উদ্দেশ্যেই বা সে সেখানে আশ্রয় নিয়েছে!
জঙ্গলে ঢুকে সুফিয়া আজ একটু সতর্ক হলো। যে ছেলেটিকে সেদিন সে দেখেছে, সে খুব চালাক। নিজেকে অন্যের চোখ থেকে বাঁচিয়ে রাখার কৌশল সে বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছে। সুফিয়া আজকে তাই পা টিপে টিপে মন্দিরের দিকে রওয়ানা দিলো। ভেতরে একটু উঁকি মেরে দেখল কেউ নেই সেখানে। চকিতে এদিকে ওদিকে তাকিয়ে সে সুড়ুত করে একটা ঝোঁপের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। কীসের ঝোঁপ কে জানে! গা টা কেমন কুট কুট করছে। কিন্তু সেদিকে তার ভ্রুক্ষেপ করারও সময় নেই। আজ আর ব্যাটাকে হাতেনাতে না ধরে কিছুতেই ছাড়ছে না সে। বারেবারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান? এবারে ধান খাওয়ার মজা দেখাবে সুফিয়া!

‘ঐখান থেইকা উইঠা আসো! ঐটা বিছুটি পাতার গাছ। একটু পরে চুলকানির চোটে মা-বাপের নাম ভুইলা যাইবা!’
চমকে পেছন ফিরে তাকিয়েই একেবারে জমে গেল সুফিয়া। সেদিনের সেই ছেলেটা ঠিক তার পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে। আজকে আর তাকে দেখে কেটে পড়ার নামগন্ধ করছে না। এক জায়গাতে দাঁড়িয়ে থেকে স্থিরচোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিতে একটু যেন বিরক্তি আর একইসাথে কৌতূহল। সুফিয়া চরম অস্বস্তি নিয়ে ঝোঁপের আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। শরীরের কুটকুটানি ভীষণ বেড়েছে। নানা অজায়গা কুজায়গায় চুলকাচ্ছে এখন। অথচ সামনে একটা জলজ্যান্ত ছেলে দাঁড়িয়ে। এর সামনে চুলকাবে কীভাবে? কী ভীষণ ঝামেলার মধ্যে পড়া গেল!

‘দুইদিন পরে পরেই জঙ্গলের হাওয়া খাইতে আসো। কামকাইজ নাই? নাকি ঘুইরা বেড়ানিই একমাত্র কাম?’
সুফিয়া এঁকেবেঁকে শরীরের চুলকানি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলে, ‘জঙ্গল কি কারো বাপের সম্পত্তি নাকি? আমি ঘুইরা বেড়াইলে কার কী? আর আপনে এই ভাঙ্গা মন্দিরের মইধ্যে যে পইড়া আছেন, সেইডাতে কুনো অসুবিধা নাই? আমি যদি মাইনষেরে কইয়া দেই? যদি… যদি পুলিশের কাছে কইয়া দেই? আপনে নিশ্চয়ই কুনো কুকীর্তি কইরা জঙ্গলে সান্ধাইয়া আছেন!’
সেদিন জামান শিকদারের সঙ্গে আলাপ হওয়ার পর থেকে সুফিয়া খুব ভাবে আছে। এমনিতেই সে কাউকে বিশেষ একটা পাত্তা ফাত্তা দেয় না, এখন তো কারো এতটুকু তেড়িবেড়ি দেখলেই তাকে পুলিশস্টেশনের হাওয়া খাইয়ে আনতে ইচ্ছে করে। পুলিশের বড় অফিসারের সঙ্গে তার এখন কত খাতির!

শমসের মনে মনে একটু থমকাল। এই মেয়ে দেখা যাচ্ছে মহা সেয়ানা! তাকে পুলিশের হুমকি দেখায়! বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া দেখে অবশ্য মনে হচ্ছে না যে, তাকে চিনতে পেরেছে। তবু শমসের কথার গতি বদলাল। যত যাই হোক, এর কাছে নিজের দুর্বলতাও কিছুতেই প্রকাশ করা যাবে না।
‘পুলিশরে গিয়ে খবর দেওনের ভয় দেখাইতাছ? দিলে দাও গা! আমি কি চোর ডাকাত নাকি যে পুলিশের নাম শুনলেই ভড়কাইয়া যামু? তুমি কী উদ্দেশ্যে দুইদিন পরে পরে এইখানে ঘুইরা যাও আগে সেইটা কও!’
দুজনে এভাবেই বেশ অনেকটা সময় নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডা চালাল। স্বল্পভাষী শমসেরের মুখে আজ যেন কথার খই ফুটেছে। দিনের পর দিন নির্জন জনমানবহীন জঙ্গলে পড়ে থাকতে থাকতে সে একজন সঙ্গীর অভাব বোধ করে, যার সঙ্গে দুই দণ্ড বসে কথা বলা যায়। সুখ দুঃখের অনুভূতি জানানো যায়। যে তাকে এখানে গা ঢাকা দেওয়ার জন্য রেখে গেছে, তার সঙ্গে একটার বেশি দুইটা কথা বললেই আর কিছু বলার থাকে না। সম্ভবত সেই লোকটাও বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। কিন্তু এই মেয়ের মধ্যে প্রাণ আছে। এর সঙ্গে ইচ্ছামত কথা বলা যায়।

বেশ কিছুক্ষণ এভাবে তর্কাতর্কি করার পরে দুজনেই বুঝতে পারল, তারা কেউ কারো শত্রু না। বরং ঝগড়া না করে দুজনেই দুজনের কিছুটা কাজে লাগতে পারে।
শমসের বলল, ‘তুমি কি কদমপুরের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফরে চিনো?’
‘হ চিনুম না ক্যা? আমার সই ফুলির তো ওগো বাড়িত বিয়া হইছে। চেয়ারম্যানের শালার লগে। কামকাইজ কিছু করে না। দুলাভাইয়ের ঘাড়ে বইসা বইসা খায়।’ সুফিয়া অল্পসময়ের মধ্যেই খুব সহজ হয়ে গেছে শমসেরের সঙ্গে। মনে হচ্ছে ছেলেটা বদটাইপের কেউ না। যদিও তার এভাবে লুকিয়ে থাকার রহস্য এখনো বোঝা যাচ্ছে না!
শমসের চিনতে পারল ফুলিকে। ফুলির স্বামীকে তো সে ভালোভাবেই চেনে! ছেলেটা শুধু অকর্মা না, একটু ফিচেল স্বভাবেরও বটে। নিজের অকর্মা স্বভাব ঢাকার জন্যই চেয়ারম্যানের তেলবাজি করে বেড়ায় দিনরাত।
‘সেই চেয়ারম্যানের ভাই আব্দুল রফিক সাহেবরে চিনতা?’
‘নাহ তেনারে তো চিনি না! ক্যান তার কী হইছে?’
কথাটা শুনে শমসের একটু আশ্বস্ত হলো। যাক, বোঝা যাচ্ছে মেয়েটা আশেপাশের খবর তেমন একটা রাখে না। শমসের আর বেশি কিছু বলতে গেল না। মেয়েটাকে আরেকটু ভালোমত বোঝা দরকার। প্রথমদিনেই বেশি কথা বলে ফেললে তার বিপদ হতে পারে। এটুকু বলেছে শুনলেই হয়ত তার সেই শুভাকাঙ্ক্ষী লোকটা বিরাট রাগ করবে। এমন কাজ শমসের নিজেও কখনো করে না। তবু কেন জানি মেয়েটাকে তার সবকিছু খুলে বলতে ইচ্ছা করছে।

‘আপনে জঙ্গলে ক্যান থাকতাছেন? তাও আবার এই ভাঙ্গা মন্দিরে? ভূতের ভয় না করলেন, সাপখোপে কামড়াইলে কী করবেন?’
‘কী আর করুম? মরুম। তয় চিন্তা নাই। মন্দিরের চারপাশে কার্বলিক এসিডের বোতল রাখন আছে। সাপ মন্দিরে ঢুকব না।’
‘আপনে ক্যান ঢুকছেন?’ সুফিয়া নাছোড়বান্দা। এই ছেলের উদ্দেশ্য তাকে জানতেই হবে! শমসেরও আর পারল না। বলেই ফেলল মুখচোখ শক্ত করে।
‘আমি পলাইয়া আছি!’
‘ক্যান? কী করছেন আপনে?’
‘সক্কলে কয় খুন করছি। হের লাইগা পলাইয়া আছি!’
‘খুন? ও আল্লাহ্‌! কারে খুন করছেন?’
‘চেয়ারম্যানের ভাই আব্দুল রফিকরে!’
‘কী! ও আল্লাহ্‌!’ সুফিয়ার মুখচোখের রঙ এবারে একটু ফ্যাকাসে দেখাল। শেষমেশ সে কী না খুনির কবলে পড়ল! এখন যদি এখান থেকে পালাতে না পারে? এই ছেলে যদি আজকে তাকেও মেরে ফেলে? আর মেরে ফেলার আগে যদি… সুফিয়া আর ভাবতে পারল না। হঠাৎ এই প্রচণ্ড গরমেও তার কেমন শীত শীত লাগতে লাগল।

সুফিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে শমসের কিছু একটা বুঝতে পারল। বলল, ‘তুমি কি ভয় পাইলা নাকি? এট্টু আগেই না খুব সাহস দ্যাখাইতাছিলা!’
‘আপনে মানুষ খুন করছেন!’
‘আমি কি কইছি আমি খুন করছি?’
‘এট্টু আগেই না কইলেন!’
‘মাইনষে কয় খুন করছি। আমি তো কই নাই আমি খুন করছি! আব্দুল রফিক সাহেবরে আমি খুন করুম ক্যা? তিনি না থাকলে কি আমি এই গ্রামে থাকবার পারতাম? বেবাকে আমারে এত তোয়াজ কইরা চলত? আর আমি বন্দুক পামু কই থেইকা?’
‘তাইলে কে খুন করছে?’
‘সেইটা যদি জানতাম তাইলে কি আমি এইখানে চোরের লাগান বইসা থাকতাম? সেই ব্যাডারে আমি পানির মইধ্যে চুবাইয়া মারতাম না?’
সুফিয়া ধন্দে পড়ে গেল। এই খুনের কথা সে ঝাপসা মতো শুনেছে কোথায় যেন… এবারে মনে পড়ল। আসলে পাশের গ্রামের কথা, তাই খুব বেশি মন দেয়নি খবরটাতে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে অনেক বড় একটা রহস্যে জড়ায়ে গেল! যেন আল্লাহ্‌ ইচ্ছা করেই তাকে এই রহস্যের মধ্যে এনে ঢুকিয়ে দিলো! (ক্রমশ)

#ফাহ্‌মিদা_বারী