Saturday, June 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1586



অনুভূতির অন্তরালে পর্ব-০৩

0

#অনুভূতির_অন্তরালে
#পর্ব:৩
#Devjani

হঠাৎ রোদ্দুর ভাইয়ার কি হলো কে জানে?মাঝ রাস্তায় গাড়িটা থামিয়ে রাগী দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আচ্ছা আমি কি কোনো রাগার মতো কথা বলেছি?কথায় কথায় এত রেগে যায় কেন উনি?ভয় লাগে তো! উনি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,আমি তোর স্যার হই।ভাইয়া না।আর তুইবা আমার কোন সম্পর্কের বোন হোস বলতো।লাস্টের কথাটা একটু শান্ত কন্ঠে বললেন তিনি।

— ইয়ে মানে,স্যার তো শুধু কলেজে।তাই না ভাইয়া?
বলার সাথে সাথে আবার ওনার অগ্নি দৃষ্টি দেখে ফ্যাকাসে হেসে বললাম, মানে স্যার। আচ্ছা স্যার বলব।এখন তো চলুন। আম্মু টেনশন করছে।দেখুন কল করছে।
— তো ধরছিস না কেন?
— ফোনে তো চার্জ নেই।বন্ধ হয়ে গেছে।
— তাহলে বুঝছিস কিভাবে আন্টি ফোন করছে?
— আরে,,,,,,,ঐটা হলো মনের কানেকশন।মনের মাধ্যমে বুঝতে পারছি।সবার সাথেই তো আমার মনের কানেকশন আছে।
— ওহ্,ভালো!সবার মনের সাথেই আছে। শুধু আমার মনের সাথেই তোর কানেকশন নেই।থাকলে হয়ত,,,,,,,,,,,
— অ্যাহ?
— কিছু না গাধী!
বলে উনি গাড়ি চালানো শুরু করলো। বুঝলাম না হঠাৎ গাধীর কি করলাম?ওহ্!আমি তো ভুলেই গেছি ওনার কাছে আমি বরাবরই গাধী। কিন্তু উনি!নিজেকে কি মনে করে।

রোদ্দুর ভাইয়া ওনাদের এ্যাপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,গাড়ি থেকে নাম আরু।নয়তো ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিব।
— এটা কি ধরনের কথা হুম?আমি আপনার গাড়িতে উঠিনি।আপনি উঠিয়েছে।আমাকে আমার জায়গায় পৌঁছে দিন।নয়তো আমিও নামছি না।
— শুনবি না আমার কথা?
— না।
— ভেবে দেখ পরীক্ষায় নম্বর কম দিব।ভালো হবে না?
— আপনি?
— তোর স্যার!
কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। রোদ্দুর ভাইয়াদের এ্যাপার্টমেন্টের পাশের এ্যাপার্টমেন্টে আমরা থাকি। কিন্তু আমার প্রবলেম সেটা নি। প্রবলেম হলো রোদ্দুর ভাইয়ার পোষা ভাইয়ার পোষা কুকুর টাইগার।।আমার সাথে তার কিসে শত্রুতা কে জানে!আমাকে দেখলেই ঘেউ ঘেউ শব্দে ভয় দেখানো শুরু করে।আর এই কুকুর নামক প্রাণীটাকে আমি বরাবরই ভীষণ ভয় পাই।
আমি নামার সাথে সাথে কুকুরটা হাজির।সাথে তার বিখ্যাত ডাকটা তো আছেই। কুকুরট কে দেখেই ভয়ে আবার গাড়ির ভেতরে ঢুকে বসে পড়লাম। রোদ্দুর ভাইয়া ছোট ছোট চোখ করে তাকালেন।
— আবার কি হলো?আমার গাড়ি থেকে নামতে ইচ্ছে করছে না বুঝি?
— আরে আপনার কুকুর।
— থাপ্পড় দিব কুকুর বলবি তো। টাইগার বলবি টাইগার!
— ওই আরকি একই তো হলো। আপনার কুকুরটাকে থুক্কু টাইগারকে একটু সরান না।ভয় লাগে তো।
— ঢং করার জায়গা পাস না?
— সত্যি বলছি ভয় লাগে।
— আচ্ছা তুই নাম দেখছি তোর কেমন ভয় লাগে!

রোদ্দুর ভাইয়া এই কথা বলেই গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমি বসে আছি। কুকুরটা আমির সাইডে।আগে ভাইয়া তাড়াবে তারপর নামব। কিন্তু ভাইয়া তাড়ানোর পরিবর্তে মাথা হাত দিয়ে আদর করা শুরু করলো। রোদ্দুর ভাইয়ার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাড়ানোর ইচ্ছে নেই। কিভাবে থাকবে!সবসময় তো আমাকে বিপদে ফেলার চিন্তায় থাকে।
ভাইয়া আর কুকুর ব্যস্ত এই সুযোগে তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে পেছনে ঘুরতে কুকুরের ডাক।কুকুরটা চারদিকে গর্জন করতে করতে ঘুরছে।ভয়ে রোদ্দুর ভাইয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কিন্তু এই রোদ্দুর ভাইয়া ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে।মনে হচ্ছে ব্যাপারটা তার কাছে খুবই আনন্দের।আমি যে ভয় পাচ্ছি সেদিকে তার কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই।ভাইয়াকে হালকা ধাক্কা দিলাম।
— ভাইয়া কিছু করেন না।
ভাইয়া উল্টো রাগী গলায় বলল,আবার ভাইয়া!
— সরি,স্যার!এটাকে তাড়ান না। বাসায় যাব তো। আম্মু বকা দিবে।দেরী হয়ে যাচ্ছে।
— তোকে আন্টি বকা দিলে আমার কি!
বলে তিনি কুকুরটার সামনে গিয়ে বসে।বলে,নো টাইগার।গাধার পেছনে দৌড়ানো ভালো না।
আমি প্রতিবাদ করে বলে উঠি,আপনি আমাকে শুধু শুধু গাধা বলেন কেন?

— আমি তো গাধা বলেছি।আমি জাস্ট ওকে শিখাচ্ছিলাম গাধার পাছনে না দৌড়াতে।বাই দা ওয়ে, তুমি কি নিজেকে গাধা মনে করো নাকি?
— আপনি তো আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলেছেন তাই না?
— তুই যা ভাববি।আমি ওকে দৌড়াতে নিষেধ করেছি।ওকি তোর পিছনে দৌড়াচ্ছিল নাকি। হুম?
— কিন্তু,,,,,,
— এই তুই কি আমার সাথে ঝগড়া করবি নাকি।

এই মানুষটার সাথে কথা বলা মানে ঝগড়া করা।তাই কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বাসার দিকে এগোতে থাকলাম।

☆☆☆

— শোনেন না,,,আমাকে একটু বাসায় পৌঁছে দেবেন?
— তোমাকে ইম্পসিবল।তোমার জন্য আরাদ্ধা চলে গেছে।বসে থাকো এখানে।রাগী গলায় বলে শ্রেয়ান।
— সরি।আপনি আরুর পিছনে এত লেগে থাকেন কেন?
— আমার ইচ্ছা তোমাকে কেন বলব?তোমার কি?
— আমার ব্যাপারটা ভালো লাগে না।
— তো আমি কি করব?বলে শ্রেয়ান উল্টোদিকে হাঁটা শুরু করে।
অদ্রির উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার। সেই সাথে আরাদ্ধার উপরও। ভেবেছিল আজকে আরাদ্ধাকে তার মায়ের সাথে দেখা করাবে। কিন্তু কখন আরাদ্ধা চলে গেছে টেরই পায় নি।

অদ্রি শ্রেয়ানের পিছন পিছন ছুটে আসে।শ্রেয়ানের সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে থাকে।আড় চোখে একবার দেখে নেয়।শ্রেয়ানের চোখেমুখে আজকাল ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট।সহজে হাসে না।অথচ আগে সবসময় হাসিখুশি থাকতো। প্রিয় মানুষটার এ অবস্থাতে অদ্রির খারাপ লাগছে। কিন্তু যার জন্য খারাপ লাগছে সে কি বুঝতে পারছে না?
শ্রেয়ান ওর গাড়ির সামনে গিয়ে অদ্রিকে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে, তুমি কি সত্যিই একা যেতে পারবে না?

অদ্রি গলা ঝেড়ে বলে,পারব।আমি আসি।
কথাটা বলে অদ্রি পেছনে ঘুরতেই হাতে টান পড়ে।
শ্রেয়ান বলে, তুমি যেতে পারো।আমার সমস্যা নেই।
অদ্রি একটু ভাব দেখিয়ে বলে, আমি যেতে পারব।আপনাকে এত ভাবতে হবে না।হাত ছাড়ুন।
— বললাম তো,আমার সাথে চল।আর যদি না যাও তাহলে,,,,,,
— তাহলে?
— আমি চলে যাচ্ছি।ওকে?
— এই না না।চলুন।
অদ্রি শ্রেয়ানকে এক পলক দেখে নেয়।আর কথা বাড়াল না। চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসে।

☆☆☆

ঘড়ির কাঁটায় সন্ধ্যা ছয়টা বাজছে।বইয়ের পাতায় বিরক্তি নিয়ে মুখ গুজে বসে আছে আরাদ্ধা।সামনে বসে আছে রোদ্দুর।তাকে হার্ট সম্পর্কে বোঝাচ্ছে। বাজেভাবে ফেঁসে গেছে সে।বাসায় এসে শুধু বলেছিল নতুন স্যার রোদ্দুর আর বিকেলের দিকে বলেছিল পড়ি বুঝতে পারছে না।ব্যস এতটুকুই!
সন্ধ্যায় তার মা জোর করে তাকে রোদ্দুরের কাছে পড়তে পাঠিয়েছে।
এতক্ষণ পড়ায় মনোযোগ থাকলেও এই মুহূর্তে রোদ্দুরের পড়ার প্রতি তার মনোযোগ নেই। রোদ্দুরের পড়ার টেবিলের উপর রাখা স্টেথোস্কোপটা তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করছে।
রোদ্দুর আরাদ্ধাকে প্রশ্ন করে, কোনো কিছুতে আর সমস্যা আছে?কি বলেছি বুঝেছিস?
আরাদ্ধা হঠাৎ মুখ ফসকে বলে ফেলে,স্টেথোস্কোপটা দিয়ে আপনার হার্টবিটটা চেক করি?
— কীহহ? রোদ্দুর শান্ত কন্ঠে আরাদ্ধির দিকে তাকায়।
আরাদ্ধা ঠোঁট উল্টায়।বলে,এই বিষয়টা এখনো বুঝি না।তাতে কি!একটু দেখ।প্লিজ!
রোদ্দুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।আরাদ্ধা ভাবছে রোদ্দুর হয়ত এখন তাকে বকা দিবে। মুখ দেখে তাই মনে হচ্ছে।আবার নাও দিতে পারে।বকার মতো কোনো কথা তো বলেনি।কিন্তু কখন যে এই মানুষটা শান্ত থাকে আর কখন রেগে যায় বুঝতে পারে না সে। রোদ্দুর চরিত্রটা সবসময়ই তার কাছে রহস্যজনক।

চলবে,

অনুভূতির অন্তরালে পর্ব-০২

0

#অনুভূতির_অন্তরালে
#পর্ব:২
#Devjani

অদ্রির কথায় পাশে তাকাতেই মেজাজটা ধপ করে গরম হয়ে গেল।মার্জিয়া লুচুটা পেছনের সিটে দেওয়ালে হেলে দাঁড়িয়ে আছে। তাতে আমার কোনো প্রবলেম নেই। আমার প্রবলেম হলো ওর চোখ দুটো নিয়ে।ড্যাবড্যাব করে রোদ্দুর ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।এই মেয়ের কি লজ্জা সরম নেই নাকি! ইচ্ছে করছে গিয়ে চুলের মুঠি ধরে বলি,স্যার হয় তোর।এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? স্যারের চোখে দেখ,লুচু।

কিন্তু দুর্ভাগ্য যে সেটা আমি বলতে পারবো না। কারণ যার দিকে তাকাচ্ছে তারই তো কোনো মাথাব্যথা নেই। তাছাড়া মার্জিয়ার সাথে আমার শেষ কথা হয়েছে দুই বছর আগে।তাও ঝগড়ার মাধ্যমে।ও সম্পর্কে আমার মামাতো বোন হয়।জানি না কেন ও আমাকে সহ্য করতে পারে না। শেষবার যখন ও আমাদের বাসায় এসেছিল তারপর থেকেই আমার কিউট দাদিটা ভিলেন দাদিতে পরিণত হয়েছে।আর এই রোদ্দুর ভাইয়াও কেমন‌ মানুষ!আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে বকা দিল আর মার্জিয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওনাকে দেখে যাচ্ছে সেদিকে দেখি কোনো খেয়ালই নেই।

আমার ভাবনার মাঝেই রোদ্দুর ভাইয়া হেঁটে হেঁটে মার্জিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়াল।বুকে হাত গুজে জিজ্ঞেস করে, দাঁড়িয়ে আছো কেন?
আমার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে,ওকে বকা দিয়েছি শুনোনি?
— সরিইই স্যাএএর!
মার্জিয়ার দাঁড়ানোর স্টাইল এই মুহূর্তে ঝড়ে নেতিয়ে পড়া গাছের মতো লাগছে। ক্লাসের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
— সিট ডাউন।
— এক্সকিউজ মি স্যার আপনার নামটা কি বলেছেন?
রোদ্দুর ভাইয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মার্জিয়ার দিকে তাকালো।মার্জিয়া শুকনো ঢোক গিলে বলে,আমার নাম ম্যারি!

আল্লাহ্,এই মেয়ে বলে কি!মার্জিয়া থেকে ম্যারি!তাহলে আমার নামও আরাদ্ধা থেকে এ্যারি।এ্যারি,,,,,উহুম সুন্দর নাই নামটা।আরাদ্ধাই সুন্দর!

রোদ্দুর ভাইয়া রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,আমি কি তোমার নাম জানতে চেয়েছি? অদ্ভুত!
— আহলে স্যার,,,,
রোদ্দুর ভাইয়া ওকে বলতে না দিয়ে রাগী গলায় বলে, তোমার বেয়াদবি অনেকক্ষন ধরে দেখছি। সুমাইয়া তো ভালো মেয়ে। তুমি ওর বোন এমন হও কি করে!
মার্জিয়া ভীত কন্ঠে বলে,আপনি সুমু আপুকে চিনেন?
— আমার ফ্রেন্ড হয় ও,চিনবো না?
— ওহ্ আচ্ছা!বলে ও চুপচাপ বসে গেল।

রোদ্দুর ভাইয়া বই নিয়ে পড়ানো শুরু করল। যদিও ওনার পড়ার দিকে আমার কোনো মনোযোগ নেই। অদ্রির সাথে রোদ্দুর ভাইয়ার চোখ এড়িয়ে দুষ্টুমি করছি।

☆☆☆

অদ্রির সাথে ক্যান্টিনে বসে কথা বলেছি।কথা বলছি বললে ভুল হবে।বলা যায় তর্ক-বিতর্ক করছি।টপিকটা রোদ্দুর ভাইয়া। অদ্রির মতে,আমার রোদ্দুর ভাইয়াকে ভাইয়া নয় স্যার বলে ডাকা উচিত। কিন্তু এত বছরের অভ্যাস ফেলে হুট করে স্যার শব্দটা মুখে আসে না।ভাইয়া শব্দটাই বেরিয়ে যায়।

হঠাৎ কোথা থেকে শ্রেয়ান ভাইয়া এসে হাত টেনে ধরল। গম্ভীর গলায় বলল,তুই আমাকে এভোয়েড করছিস?
শ্রেয়ান ভাইয়ার এমন অদ্ভুত কথায় ওনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম।তবে কিছু বলার আগেই অদ্রি বলে,ও আপনাকে কেন এভোয়েড করবে?ও এভোয়েড করার কে হুম?
শ্রেয়ান ভাইয়া বিরক্তি সহকারে বলে,কাকে বললাম আর কে উত্তর দিচ্ছে!এই তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি?
— আমাকে জিজ্ঞেস করেননি কিন্তু আমি উত্তর দিয়েছি।
— একদম না।আমার আর মোহনের মাঝখানে তুমি কথা বলবে না।
শ্রেয়ান ভাইয়ার এমন কথা শুনে আমি আর অদ্রি একসাথে বলে উঠলাম,মোহন,,,,,,!
— ইয়ে মানে,,,,এমনে আরাদ্ধাকে ডাকলাম আরকি। কেন নামটা সুন্দর না?
আমি ছোট ছোট চোখ করে বললাম,আপনি আমাকে ছেলের নাম ধরে ডাকলেন কেন?
— কিছু না।চল আমার সাথে।
— কোথায়?
— কৈফিয়ত দিতে আমী রাজি নই।যেতে বলেছি যখন যাবে।
— পাগল নাকি আপনি?আপনি বললেই আমাকে আপনার সাথে যেতে হবে নাকি। আচ্ছা আপনি আমার সাথে এমন করেন কেন?আমি তো আপনাকে চিনিও না।
অদ্রি মুখ বেঁকিয়ে বলে, খারাপ লোক তো তাই।
শ্রেয়ান ভাইয়া রেগে গিয়ে বলে,এইযে মিস অদ্রিজা আমাদের মাঝখানে কথা বলবেন না।আর ম,,সরি আরাদ্ধা আপনার সাথে কেন এমন করি জানেন,আমি আপনাকে ধরে নিয়ে একজনের কাছে বিক্রি করে দেব। হয়েছে?এবার চল।

আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি।শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা আগামাথা কোনোটাই আমার বোধগম্য হলো না।চোখ বাঁকিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি রোদ্দুর ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বুঝলাম না এসব কি হচ্ছে আমার সাথে!

অদ্রিকে ইশারায় কিছু একটা করতে বললাম।নাহলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাব না। রোদ্দুর ভাইয়ার উপর বিশ্বাস নাই। আম্মুর কাছে যদি উল্টাপাল্টা কিছু লাগিয়ে দেয়,তখন আবার বকা গুলো আমাকেই শুনতে হবে।
অদ্রি গিয়ে শ্রেয়ান ভাইয়ার কলার চেপে ধরে। চেঁচিয়ে বলে, অনেকক্ষন ধরে আপনার বাজে বকবক সহ্য করছি।আর,,,,,
— গলা নিচে।শ্রেয়ান চৌধুরীর সাথে এভাবে কথা কেউ বলে না।বাই দা ওয়ে,এই ডায়লোগগুলো কি সিরিয়াল থেকে শিখেছো নাকি, হুম?শ্রেয়ান ভাইয়া কথাটা বলে মুখ টিপে হাসল।

অদ্রি যেই উদ্যম নিয়ে কথা বলতে গিয়েছিল।শ্রেয়ান ভাইয়ার কথা শুনে মুহূর্তে চুপসে গেল।আমি ততক্ষণে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে এসেছি। আব্বু গাড়ি দিয়ে করিম চাচাকে পাঠিয়েছে।

এদিকে আম্মু কল দিয়েই যাচ্ছে।একটু লেট হয়ে গেছে আজকে।বুঝি না আমাকে নিয়ে এত টেনশন করার কি আছে।আমি তো আর ছোট নই। যথেষ্ট বড় হয়েছি আমি। আম্মুর এই টেনশনের জন্য আজ পর্যন্ত বন্ধুদের সাথে দূরে কোথাও ঘুরতে যাইনি। অথচ সবাই কি সুন্দর ঘুরতে যায়!

আম্মুকে মেসেজ করে দিলাম,আমি আসছি।
গাড়ির দরজা খুলতে যাব এমন সময় কোথা থেকে রোদ্দুর ভাইয়া এসে হাত চেপে ধরলো।করিম চাচাকে উদ্দেশ্য করে বলল,আপনি চলে যান।আমি ওকে নিয়ে আসছি।
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি। রোদ্দুর ভাইয়ার বলতে দেরি করিম চাচার যেতে দেরি নেই।
আহ্!মালিক আমি নাকি রোদ্দুর ভাইয়া? রোদ্দুর ভাইয়া বলল আর চাচা চলে গেল!আমাকে জিজ্ঞেসও করল না!
রোদ্দুর ভাইয়া রাগী গলায় বলে,আন্টি জানে?
— কি জানবে?
— তুই কলেজে এসে এসব করিস?
— কি করেছি আমি।
— সাধু সাজছিস। চেঁচিয়ে বলল রোদ্দুর ভাইয়া।ওই ছেলেটা কে হুম?
— কোন ছেলেটা?
রোদ্দুর ভাইয়ার গরম দৃষ্টি দেখে আমি ফ্যাকাসে হেসে বললাম, ওহ্!ইয়ে,,,ও হলো শ্রেয়ান।মানে শ্রেয়ান ভাইয়া।আমার সিনিয়র।বাবা বিজনেসম্যান।মা টিচার।বোন আছে একটা।
— শাট আপ!এত কিছু জানতে চেয়েছি?যা গিয়ে গাড়িতে উঠে বোস।
— হুম।
চুপচাপ গিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম। বিরক্তিকর! নিজের গাড়ি রেখে অন্যের গাড়িতে ওঠা বরাবরই আমার পছন্দ না।
রোদ্দুর ভাইয়ার গাড়িতে উঠতে আমি বেশ ভয় পাই।কারণ উনি অনেক স্প্রিডে গাড়ি চালান।এই পর্যন্ত ওনার গাড়িতে দুইবার উঠেছি। প্রথমবার উঠেই বুঝতে পেরেছিলাম ওনার গাড়িতে উঠলে যেকোনো সময় আমার লাইফ ওনার সাথে সাথে দি ইন্ড হয়ে যেতে পারে।এরপর অনেক বার উনি বলা সত্ত্বেও উঠিনি। কিন্তু আজকে এই করিম চাচার জন্য উঠতে হলো।এখন যদি রোদ্দুর ভাইয়ার সাথে না যাই তাহলে আবার বাসায় পৌঁছাতে আরও দেরি হবে।আজকে বাসায় গিয়ে করিম চাচার নামে আব্বুর কাছে বিচার দিব।আমাকে একবার জিজ্ঞেস না করে কি সুন্দর চলে গেলেন।
— আরু?
— হ্যাঁ?
— শ্রেয়ান তোর কেমন ভাই হয়?শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন উনি।
— ভাই।আপনি যেমন ভাই তেমনি আরকি।
শুধু এতটুকুই বলেছি। আল্লাহ্ জানে কি ভুল বলেছি! উনি রেগে গিয়ে বলে, থাপ্পড় দিব আরেকবার ভাই বললে।আমি তোর কোন সম্পর্কের ভাই রে?
— আজব! ছোটবেলা থেকেই ভাইয়া ডেকে আসছি।আর এখন আপনি আপনার পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন করছেন?
হঠাৎ রোদ্দুর ভাইয়ার কি হলো কে জানে?মাঝ রাস্তায় গাড়িটা থামিয়ে,,,,,,,

চলবে,

অনুভূতির অন্তরালে পর্ব-০১

0

#অনুভূতির_অন্তরালে
#পর্ব:১
#Devjani

“– পরের মেয়ে পরের মেয়েই হয়।এতো আদিক্ষেতা করার কি আছে। যত্তসব!রেজাল্টাই তো বের হবে।কি অবস্থা হবে আমার জানা আছে।এত অভিনয় করার কি হয়েছে?
দাদির এরূপ কথা শুনে খারাপ লাগলো।এটা প্রায়ই বলে দাদি। কারণ আমি আমার বাবা মায়ের এডোপ্টেড চাইল্ড।অন্যান্য দিন হলে কেঁদে দিতাম।আজ দিচ্ছিনা কারণ ভীষণ টেনশনে আছি। এইচএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট দিবে আজ।দোয়া করছি যেন অল সাবজেক্টে এ প্লাস পাই।

সাধারণত রেজাল্টের ব্যাপারে আমি বরাবরই রিল্যাক্স থাকি। কিন্তু এখন এই ব্যাপারটায় আমি ভীষণ সিরিয়াস। কারণ ওই ডেভিল মার্কা লোক রোদ্দুর রেজওয়ান!ওনাকে দেখাতে চাই আমিও কোনো অংশে কম না।

ওনার জন্য গত একমাস ধরে আম্মুর কাছে বকা খেয়ে আসছি। আম্মুর মতে, উনি এত ভালো স্টুডেন্ট আমি কেন নই?
আজব!আমি জানি আমি ভালো স্টুডেন্ট না।আবার খারাপও না। স্কুলে সবসময় আমার রোল এক থেকে দশের মধ্যে থাকে। কিন্তু আম্মু সবসময় তার বান্ধবীর ছেলে ওই রোদ্দুর ভাইয়ার সাথে আমার কম্পেয়ার করতে থাকে।
ব্যাপারটা আমার একদম পছন্দ নয়।এমনেও রোদ্দুর ভাইয়া আমার থেকে কয়েকবছরের বড়। এক্ষেত্রে ওনার সাথে আমার কম্পেয়ার করে কি লাভ!এই ব্যাপারটাই আম্মু বুঝে না। এই জন্য আমিও কিছুদিন আগেই বলে দিয়েছি সব বিষয়ে এ প্লাস না পেলে মেডিকেল পড়ব না।এটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জ। কারণ আমি একজন ডাক্তার হতে চাই।

তাছাড়া এমনেও রোদ্দুর ভাইয়াকে আমার ভালো লাগে না।এই পর্যন্ত যতবার ওনার সাথে আমার দেখা হয়েছে ঝগড়া ,কথা কাটাকাটি ছাড়া কিছুই হয় নি।আই হেইট দিস গায়!

তবে ভালো রেজাল্টের ব্যাপারটা আরও আগে বললেই পারতো। তাহলে পরীক্ষার আগে আরও ভালো করে পড়তাম।

হঠাৎ কলিংবেল বাজতেই আম্মু গিয়ে দরজা খুলে দিল। আব্বু এসেছে।দৌড়ে গিয়ে বললাম, আব্বু আমার রেজাল্ট,,,,
— বের করনি? আচ্ছা সমস্যা নেই আমি বের করে দিচ্ছি।

আব্বু গিয়ে সোফায় বসল। কিছুক্ষণ ফোন ঘেটে বলল,জেনে গেছি!
সাথে সাথে আম্মু জিজ্ঞেস করে, মোহনের রেজাল্ট কেমন হয়েছে?
— ৪.৮৫।
রেজাল্ট শুনে পুরোপুরি চুপসে গেলাম।হায়,কি ভাবলাম আর কি হলো!
— বললাম না দেখবি তোরা! পড়াশোনাও করে না। সারাদিন ফোনের উপর থাকে।ওর কি আর আমাদের মান সম্মান নিয়ে এত মাথাব্যথা আছে?

আব্বু ইশারায় দাদিকে চুপ করতে বলল।হয়ত আমার সামনে আসল পরিচয় তুলতে চায় না।তাতে কি!আমি তো জানি সত্যিটা জানি।আমি এডোপ্টেড।তবে এতে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই।

দাদির কথায় পাত্তা না দিয়ে আম্মুর দিকে তাকালাম। আম্মু মন খারাপ করে কিচেনের দিকে চলে গেল। কান্না আসছে।সব সাবজেক্টে এ প্লাস পাব ভাবছিলাম।তবে রেজাল্ট যাই হোক না কেন মেডিকেলে তো আমি পড়বই।হুহ!
নিরর্থক বিষয়ের জন্য স্বপ্ন নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।
আব্বুকে বললাম, আমি মেডিকেলে পড়বই।একজন ডাক্তার হবো। তুমি আবেদন কর।
কথাটা বলে আম্মুর খোঁজে কিচেনের দিকে গেলাম। আম্মু কাজ করছে। মুখে মন খারাপের ছাপ স্পষ্ট। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলাম। সাথে সাথে আম্মু রাগী গলায় বলল,ছাড় আমাকে!করিস না পড়াশোনা।ছেড়ে দে সব।কি রেজাল্ট করেছিস!

— আম্মু,সরি! পরের বার থেকে ভালো করে পড়ব।প্রমিস!

— এই এক কথা শুনে আসছি সেই কবে থেকে। মুখস্থ হয়ে গেছে।

— আম্মু আব্বুকে বলেছি মেডিকেলে আবেদন করতে বলেছি।আই প্রমিস, চান্স পেয়ে একজন ভালো ডাক্তার হয়ে দেখাব।

— তোর এইসব ফালতু প্রমিস আমাকে দেখাবি না।তুই কি কি করতে পারিস জানা আছে আমার। রোদ্দুরের কাছ থেকে কিছু শিখতে পারিস না!

আম্মুর মুখে রোদ্দুর ভাইয়ার কথা শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।তেজ দেখিয়ে বললাম,এই আম্মু একদম রোদ্দুর রোদ্দুর করবা না।আমিও মেডিকেলে চান্স পেয়ে দেখাব। আমিও কোনো অংশে কম নই।হুহ!”

— আরু,,,,, তাড়াতাড়ি কর।তোর আব্বু নিচে গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে।
মায়ের ডাকে ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম।আহ্! শেষ পর্যন্ত মেডিকেলে চান্স পেয়েই গেলাম। আমিও কোনো অংশে কম নই।হুহ!
আরাদ্ধা কায়নাত আমি।কম হই কি করে!

চুলগুলো ঠিক করে এ্যাপ্রোনটা পড়ে নিলাম। আয়নায় নিজেকে একবার দেখে নিলাম।ইসস,,, নিজেকে কেমন ডাক্তার ডাক্তার লাগে!

তাড়াতাড়ি এ্যাপার্টম্যান্টের নিচে গেলাম। আব্বু পেছনের ছিটে বসে পত্রিকা পড়ছে।আর ড্রাইভিং সিটে করিম চাচা। গিয়ে আব্বুর পাশে বসে পড়লাম।আজ একটু তাড়াতাড়িই যাচ্ছি। নতুন একজন স্যার আসবে।লেট না করাই ভালো।
আব্বু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল,গুড মর্নিং মাই প্রিন্সেস!
— গুড মর্নিং, আব্বু!
— পড়াশোনা কেমন চলছে?
— ভালো।
— ভেরি গুড।
আব্বুর সাথে কথা বলতে বলতে কলেজের সামনে চলে এলাম।
গাড়ি থেকে নামতেই অদ্রি এসে হাজির।আমাকে দেখে মুখ টিপে হাসল।বলল,রানী সাহেবা আজকে এত তাড়াতাড়ি!এম আই ড্রিমিং?

আমিও অদ্রির হাসির প্রত্যুত্তরে হাসলাম।
— ঐ আরকি আমি,,,,
হঠাৎ একটা কালো রঙের গাড়ি ধূলা উড়িয়ে সামনে এসে দাঁড়ালো। কথাটা শেষও করতে পারলাম না ধূলা উড়ার জন্য।অসহ্য!

অদ্রি আমাকে টেনে একসাইডে নিয়ে গেল।তবে ওর চোখগুলো গাড়ির উপর স্থির রাখল।আমিও ওর সাথে তাল মিলিয়ে চোখগুলো সেখানে রাখলাম।

গাড়ি থেকে একটা ছেলে নেমে এলো। সাদা শার্টের উপর কালো ব্লেজার আর জিন্স।মুখ দেখার উপায় নেই। কালো মাস্ক লাগানো মুখে।তবে ওনার মাস্কের উপর দৃশ্যমান কপাল দেখে বোঝা যাচ্ছে উনি অনেক ফর্সা।
উনি নেমে চারপাশে একবার দেখে নিল।কেমন একটা লজ্জা লাগায় চোখ নামিয়ে ফেললাম। কিন্তু আশেপাশে তাকিয়ে দেখি শুধু আমি বা অদ্রিই না, সবাই ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে ওনার দিকে।আর একটু হলে হয়ত চোখগুলোই বেরিয়ে আসবে।
পাশে তাকিয়ে দেখি শ্রেয়ান ভাইয়া আমার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
রোদ্দুর ভাইয়া সম্পর্কে যাই বলি না কেন বাস্তবে ওনাকে ভীষণ ভয় পাই।উনি অত্যন্ত বদমেজাজি,রাগী ধরনের লোক।এই ওনার পর যদি আর কাউকে ভয় পাই সে হলো এই শ্রেয়ান ভাইয়া।সবসময় রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। মাঝে মাঝে বকাও দেয়।

অদ্রিকে টেনে ক্লাসে চলে এলাম।সবাই কথা বলছে।একটু পর ক্লাস শুরু হবে।
তাই আমি বই খুলে পড়তে বসলাম।আম্মুকে প্রমিস করেছি,সবসময় ভালো রেজাল্ট করার চেষ্টা করব সবসময়।

টানা ১০মিনিট পড়ার পর কারো পায়ের আওয়াজ শুনলাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই দাঁড়িয়ে আছে।আমিও দাঁড়িয়ে গেলাম। কিন্তু সামনে তাকাতেই আমি পুরোপুরি শক খেলাম।

— হ্যালো! আই এম ডাঃ রোদ্দুর রেজওয়ান।এন্ড ফ্রম নাও অন আই এম ইওর নিউ টিচার।

আল্লাহ্!আমার সামনে রোদ্দুর ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।তাও টিচার হয়ে!ইজ ইট ট্রু?স্বপ্ন দেখেছি না তো!ওনার পোশাকটা দেখে একটু আগের ছেলেটার কথা মনে পড়ে গেল।তার মানে ওই সময়ের ওই ছেলেটা রোদ্দুর ভাইয়া!

রোদ্দুর ভাইয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে আছি।আগে প্রায়ই দেখা হতো কিন্তু লন্ডন যাওয়ার পর আজ প্রায় পাঁচ বছর পর ওনাকে দেখছি।

হঠাৎ উনি আমার দিকে তাকিয়ে জোরে ধমক দিল। বুঝলাম না কি হলো! আশেপাশে তাকিয়ে দেখি সবাই বসে আছে। শুধু আমিই দাঁড়িয়ে আছি।ওনার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।একটু মেকি হাসি দিয়ে বসে পড়লাম।হায় কপাল,উনি এখন আমার টিচার!না জানি ভাগ্যে কি কি আছে, আল্লাহ্!
হঠাৎ অদ্রির দিকে তাকিয়ে দেখি ও মুখ টিপে হাসছে। ভ্রু কুঁচকে তাকালাম ওর দিকে। ইশারায় হাসার কারণ জিজ্ঞেস করলাম।ও পাশে তাকাতে বলল।
অদ্রির কথায় পাশে তাকাতেই মেজাজটা ধপ করে গরম হয়ে গেল।

(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।কেমন হয়েছে জানাবেন।)

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২৪ (অন্তিম পর্ব)
#Munni_Akter_Priya
.
.
বিয়ের এক সপ্তাহ্ পাড় হয়ে গিয়েছে। সব মেহমানের আসা যাওয়াও শেষ। তাই ফাহাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোথাও একটু ঘুরতে যাওয়া উচিৎ। হানিমুনের জন্য জায়গা ঠিক করেছে ব্যাংকক। কিন্তু আপাতত এখন ঘুরতে যাবে কক্সবাজার। সাথে যাবে পৃথা আর ওর হাজবেন্ড আকাশ। সব গোছগাছ করাও শেষ। রাতের বাসে রওনা দিবে।

ফাহাদ রুমে বসে পাব্জি খেলছিল। প্রিয়া শ্বাশুরীর সাথে টুকটাক গল্প করে রুমে আসে। ফাহাদের সেদিকে দৃষ্টি নেই। গেমস খেলায় ব্যস্ত। প্রিয়া গিয়ে ফাহাদের সামনে বসলো তবুও কোনো ভাবান্তর নেই। প্রিয়া বিড়বিড় করে বলে,
“অদ্ভুত! বিরক্তিকর! কি আছে এই গেমের মধ্যে যে বউয়ের দিকেও খেয়াল নেই। ধুর!”
প্রিয়া উঠে দরজা পর্যন্ত আসতেই ফাহাদ প্রিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে প্রিয়া।
“ছাড়ো! ছাড়ো বলছি। তুমি তোমার গেমস নিয়েই থাকো।”
“আরে রাগ করছো কেন? তুমি যখন রুমে প্রবেশ করেছো তখনই আমি পাব্জি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছি।”
“তাহলে ফোন নিয়ে কি করছিলে?”
“দেখবে?”
“হু।”
“দাঁড়াও।”
ফাহাদ ফোন বের করে একটা ভিডিও অন করে। যেখানে প্রিয়া বিড়বিড় করে একাই কথা বলছে। ভিডিও টা দেখে ফাহাদকে খামচি দেয়।
“কি করছো এটা হ্যাঁ?”
“তোমার এক্সপ্রেশন ভিডিও করে রাখলাম হাহাহা।”
দুমদাম কয়েকটা কিল বসাতেই শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ফাহাদ।
.
.
রাত নয়টায় বাস ছাড়ে। জানালার ধারে বসে আছে প্রিয়া। ফাহাদের কাঁধে মাথা রাখে। জানালা দিয়ে হিমেল বাতাস বয়ে আসছে। প্রিয়ার এক হাত মুঠোবন্দি করে ফাহাদ চুমু খেয়ে বলে,
“জানো যখন আমরা অফিস থেকে ট্যুরে গিয়েছিলাম তুমি পৃথার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছিলে। আমার তখন খুব ইচ্ছে হয়েছিল তোমার পাশে বসে তোমার মাথাটা আমার কাঁধে রাখতে। আর তাই পৃথাকে সরিয়ে বসিয়েছিলাম। দেখো ছবিগুলো এখনো আছে।”
“তুমি আমায় এত ভালোবাসলে কেন বলো তো?”
“কারণ জানতে চাইছো?”
“হু।”
“তুমি আমায় কেন ভালোবাসো?”
“কারণ ছাড়াই। কোনো কারণ নেই।”
“আমিও ঠিক কোনো কারণ ছাড়াই ভালোবাসি। কারণ নিয়ে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাতে থাকে স্বার্থ। আমি নিঃশ্বার্থভাবে ভালোবাসি তোমায়।”
“নিজেকে অনেক ভাগ্যবতী মনে হয় তোমাকে পেয়ে।”
“আর আমি ভাগ্যবান তোমায় পেয়ে।”
ফাহাদের কাঁধে মাথা রেখেই প্রিয়া ঘুমিয়ে পড়ে। আর ফাহাদ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে তার হোয়াইট ফেইরিকে।

ভোরে ওরা কক্সবাজার পৌঁছায়। আগে একটা হোটেলে ওঠে। প্রিয়া আর ফাহাদের পাশের রুমে পৃথা আর আকাশ। প্রিয়া ফ্রেশ হয়েই শুয়ে পড়ে। ফাহাদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে একটুখানি সময়ে ঘুমিয়েও পড়েছে। ডাকতে গিয়েও ডাকলো না। ভাবলো ঘুমাক একটু!

১০টার দিকে খাওয়া-দাওয়া করে বীচে যায়। পানি দেখেই প্রিয়া লাফাতে থাকে। পৃথা আর প্রিয়া দুজনে দৌঁড়ে পানিতে চলে যায়। হাত ধরে দুজনেই ইচ্ছেমত লাফাচ্ছে। হাসছে। আকাশ আর ফাহাদ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সবাই মিলে অনেকটা সময় পানিতে কাটায়। প্রিয়া আর পৃথা তো কিছুতেই যেতে চাচ্ছেনা পানি থেকে। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুজিয়ে হোটেলে নিয়ে এসেছে।
বীচ থেকে আসার পরই ফাহাদ কিছুটা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই দুপুরের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। বিকেলের দিকে প্রিয়াকে নিয়ে বীচে যায়। কারণ সূর্যাস্ত একদম মিস করা যাবেনা।
সূর্যাস্তের সময় ফটোশ্যুট করছিলো ওরা। এরমধ্যে ফাহাদ বললো,
“তুমি পৃথা আর আকাশের সাথেই থেকো। আমি আসছি।”
“কোথায় যাচ্ছো?”
ফাহাদ যেতে যেতেই বললো,
“আসছি ৫ মিনিট।”
পৃথা আর আকাশ একসাথে সময় কাটাচ্ছিল বলে আর ওদের ডিস্টার্ব করেনি। ফুলকে ফোন দিলো কথা বলার জন্য। ফুল ফোন রিসিভ করে বলে,
“আমার কিউট ভাবীর তাহলে আমার কথা মনে পড়লো?”
“এত সুইট ননোদকে কি আর ভোলা যায়?”
“হু কত যে মনে রেখেছো! সারাদিন পর এখন কল করলে।”
“বাব্বাহ্! আমার সুইটি রাগ করেছে?”
“অনেক রাগ করেছি।”
“আচ্ছা কি করলে রাগ ভাঙ্গবে?”
“উমমমমমম!!! আসার সময় অনেকগুলো আচার আর বাদাম নিয়ে আসবা ওকে?”
“আচ্ছা। সাথে আরো অনেক কিছুই নিয়ে আসবো।”
“আমার লক্ষী ভাবী।”
“বাবা-মা কেমন আছে?”
“ভালো আছে।”
“মা কোথায়?”
“মা তো, মায়ের ঘরে। ও ভাবী তুমি কি এখন বীচে?”
“হ্যাঁ। কেন?”
“আমি হোয়াটসএপে ভিডিও কল দিচ্ছি তুমি আমাকে সানসেট দেখাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ!”
“আচ্ছা পাগলী।”
ভিডিওকলে সানসেটসহ আশেপাশের বিভিন্নদৃশ্য দেখাচ্ছিল। ব্যাক ক্যামেরায় একজনের মুখ দেখে প্রিয়া থমকে যায়। এই আবছা আলোতেও মুখটা স্পষ্ট দেখছে প্রিয়া। শিহাব! এতবছর পর শিহাবকে দেখে চিনতে এতটুকুও কষ্ট হলো না। ভিডিওকলে ফুল অনেক কথাই বলছে কিন্তু প্রিয়ার কানে কোনো কথা যাচ্ছেনা। শিহাব প্রিয়ার দিকেই এগিয়ে আসছে। প্রিয়ার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা গলায় ফুলকে বললো,
“ফুল আমি হোটেলে গিয়ে তোমায় কল দিচ্ছি।”
“ওকে ভাবী।”
প্রিয়া ফোন কেটে দিয়েই হোটেলের পথে যায়। পেছন পেছন শিহাবও আসে। পেছন থেকে ডাক দেয়,
“প্রিয়া দাঁড়াও প্লিজ। একটাবার দাঁড়াও।”
শিহাব দৌঁড়ে প্রিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। একটু ঝুঁকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,
“প্লিজ কিছু কথা বলবো!”
প্রিয়া এবার ভালো করে দেখছে শিহাবকে। আগের মতই আছে। কিন্তু চেহারায় লাবণ্য নেই আগের মত।
“কথা বলবে না প্রিয়া?”
“তোমার সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছে নেই আমার।”
“এটাই স্বাভাবিক। তবুও একটু সময় দাও প্লিজ।”
“সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আমাকে যেতে হবে।”
“তাহলে কাল সকালে? প্লিজ?”
“ভেবে দেখবো।”
“ভেবে নয়। একটাবার প্লিজ!!!”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“কাল সকাল ছয়টায় আমি এখানেই অপেক্ষা করবো।”
“আসছি আমি।”
.
রাতে আর ঘুম আসলো না প্রিয়ার। জেগে জেগে ফাহাদকে দেখলো। ফাহাদের গালে হাত বুলিয়ে মনে মনে বললো,
“স্যরি ফাহাদ। তোমাকে না জানিয়েই যাচ্ছি। আমার অনেক কিছু বলার আছে শিহাবকে।”

সকাল সকাল ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে পড়ে প্রিয়া। বীচে গিয়ে দেখে শিহাব দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়াকে আসতে দেখেই শিহাব এগিয়ে আসে। হাসি হাসি মুখে বলে,
“গুড মর্নিং।”
“মর্নিং।”
“কেমন আছো?”
প্রিয়া একবার ফাহাদের দিকে তাকিয়ে চুপ করে রইলো। অনেকক্ষণ পর বললো,
“ভাগ্য আমাদের কোথায় নিয়ে আসে তাই না শিহাব? একটা সময় ছিল যখন আমি তোমার জন্য পাগল ছিলাম। একটা বার দেখা করার জন্য কত অনুনয়বিনয় করতাম। কিন্তু তখন তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাওনি। আর আজ! আজ শত রিকোয়েস্ট করে তুমি আমায় দেখা করাতে রাজি করিয়েছো।”
শিহাব মাথা নিচু করে আছে। প্রিয়া বললো,
“এতগুলো বছর তোমার থেকে, তোমার স্মৃতি থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। কিন্তু মন কেন জানি চাইতো একটাবার তোমার সাথে দেখা হোক। শুধু একটাবার। তোমাকে আমার অনেক প্রশ্ন করার আছে। যেগুলোর উত্তর তুমি আমায় দাওনি তখন। এখন কি দিবে সেগুলোর উত্তর? কেন করেছিলে আমার সাথে এমন? কেন ঠকিয়েছিলে আমায়?”
“তোমার কোনো প্রশ্নের উত্তর নেই আমার কাছে প্রিয়া। কিন্তু আমি জানি আমি তোমার প্রতি অন্যায় করেছি। কাউকে ঠকিয়ে যে কেউ সুখী হতে পারেনা সেটা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রকৃতি কিছুই ভুলেনি। কঠিন শাস্তি দিয়েছে আমায়।”
প্রিয়া একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে বললো,
“তোমার বউ কেমন আছে?”
শিহাবের চোখগুলো ছলছল হয়ে গেলো। গলা ধরে এসেছে।
“অনেক কিছু হয়ে গিয়েছে এরমধ্যে। আমি তোমায় ঠকিয়ে ঠিক করিনি।”
“কি হয়েছে?”
“আমার বিয়ের পর খুব ভালোমতই সময়গুলো কাটছিল। হাসাহাসি, সুখ সবই ছিল। বিয়ের ছয় মাস পর একদিন সংবাদ পেলাম আমার ওয়াইফ প্রেগন্যান্ট। এত আনন্দের মধ্যেও আরেকটা আনন্দের খবর এলো। আরো বেশি ভালোবেসে ফেললাম ওকে।”
“নাম কি তোমার ওয়াইফের?”
“শোভা।”
“বাহ্! নামেরও তো খুব মিল। কোথায় সে? হোটেলে রেখে আসছো?”
“না।”
“তাহলে?”
“শোভা যখন তিন মাসের প্রেগন্যান্ট তখন বাথরুমে পা পিছলে পড়ে যায়। বাচ্চাটাকে বাঁচানো যায়নি। এরপর শোভা অনেক ভেঙ্গে পড়ে। কারো সাথেই কোনো কথা বলেনা। এমনকি আমার সাথেও না। তখন ডক্টর আর বাড়ির সবাই বললো শোভাকে নিয়ে যেন রাজশাহী থেকে ঢাকায় চলে আসি। ব্যস্ত শহরে ঘুরলে ফিরলে মনটা ভালো হয়ে যাবে। আমিও তাই করলাম। ঢাকায় একটা ফ্লাট ভাড়া করলাম। অফিস থেকে এসে যতটা সময় পেতাম ওকে দিতাম। সত্যি বলতে অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম ওকে। সময় পেলেই ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হতাম। একটা সময়ে ও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে থাকে। ভাবলাম আবারও আগের মত হ্যাপী হবো আমরা। কিন্তু এমনটা হলো না। পাশের ফ্লাটের এক ছেলের সাথে শোভার সম্পর্ক হয়। দুইমাস পরই ছেলেটার সাথে ও পালিয়ে যায়। যাওয়ার আগে চিঠি লিখে যায়। যেটায় লিখা ছিল, ‘শিহাব আমি আর তোমার সাথে সম্পর্কটা রাখতে পারবো না। আমি দিদারকে ভালোবাসি। আর ওর হাত ধরেই বের হলাম। আমি তোমার সাথে হ্যাপী নই। আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করো না প্লিজ। আর আমায় ডিভোর্স দিয়ে মুক্তি দিয়ো।”
কথাগুলো বলেই শিহাব কাঁদছে। দ্বিতীয়বারের মত শিহাবকে কাঁদতে দেখছে প্রিয়া। আগেরবার কেঁদেছিল প্রিয়ার জন্যই। তবে সেটা ছিল অভিনয় মাত্র। কিন্তু এই কান্নাটা অভিনয় নয়। শিহাবের জন্য একটুও খারাপ লাগছেনা প্রিয়ার। রাস্তার একজন পথচারীও যদি প্রিয়াকে এই কথাগুলো বলতো তাহলে প্রিয়া শিওর যে কষ্টে কেঁদেই ফেলতো। কিন্তু এখন একটুও কষ্ট হচ্ছেনা। প্রিয়া কি বলবে বা বলা উচিত বুঝতে পারছেনা। শিহাব নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও প্রিয়া। আমি জানি এইসব হয়েছে শুধু তোমাকে ঠকানোর জন্য।”
প্রিয়া তখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। এবার শিহাব প্রিয়ার হাত ধরে বললো,
“আমায় ক্ষমা করে দাও প্লিজ। আরেকটাবার কি আমায় ক্ষমা করে সব আগের মত করা যায় না? একটা সুযোগ আমাকে দাও। পৃথিবীর সব ভালোবাসা তোমায় দিবো। শুধু একটাবার সুযোগ দাও। আমি জানি তুমিও আমায় এখনো ভালোবাসো।”
প্রিয়া শিহাবের থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো। ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যর হাসি।
“আমাকে টাচ করার কোনো রাইট নেই তোমার শিহাব। আর আমি তোমায় সুযোগ দিবো মানে কি? তুমি কি জানো আমি বিবাহিত? আদারওয়াইজ তুমি ভুল জানো। আমি তোমাকে ভালোবাসিনা। একটা প্রতারক কখনোই আমার ভালোবাসার যোগ্য না।”
“তুমি ম্যারিড?”
“কেন বিশ্বাস হচ্ছেনা? তুমি কি ভেবেছিলে আমি তোমার অপেক্ষায় পাগল বনে যাবো? হ্যাঁ সত্যিই পাগল হতাম যদি তোমার ভালোবাসাটা সত্যি হতো। কিন্তু তুমি তো আমায় ঠকিয়েছো। পরিস্থিতির উপর দোষ চাপিয়ে খুব সুন্দর করে আমায় ঠকিয়েছো। আর আমি যদি বিবাহিত নাও হতাম না তবুও আমি তোমার জীবনে কখনোই ফিরে যেতাম না। কখনো না।”
শিহাবের চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। প্রিয়া কিছুক্ষণ দম নিলো। এরপর ঠান্ডা গলায় বললো,
“তুমি যেদিন বিয়ের আনন্দে শামিল সেদিন আমি বাবার লাশ জড়িয়ে ধরে কাঁদি!”
“লাশ!! তোমার বা…বা….”
“আমার বাবা বেঁচে নেই শিহাব। এরজন্য আমিই দায়ী। কিভাবে জানো? কারণ আমি তোমার মত একটা প্রতারককে ভালোবেসেছিলাম। যার শাস্তি পেলো আমার বাবা। আমাদের একা করে দিয়ে ওপারে চলে গেলো।”
“কি…কিভাবে হলো এ…সব?”
“তোমার গায়ে হলুদের রাতে আমি তখন পাগল প্রায়। আবেগের বসে সুইসাইড করতে যাই। বাবা ছিল হার্টের রোগী। আমাকে ওভাবে ঝুলন্ত অবস্থায় দেখে সহ্য করতে পারেনি। হার্ট এ্যাটাক করে মারা যায়। আমিতো ঠিকই বেঁচে গেলাম কিন্তু মেরে ফেললাম আমার বাবাকে। তুমি যেদিন আনন্দে সেজেগুজে বিয়ে করতে যাও সেদিন আমি বাবার লাশ বুকে জড়িয়ে কেঁদেছি। তুমি যেইরাতে শোভার সাথে ঘনিষ্ঠ মুহুর্ত কাটাও আমি সেই রাতে বাবার ছবি বুকে নিয়ে কেঁদেছি। আস্তে আস্তে সবার থেকে নিজেকে আড়াল করে নেই। বাবার মৃত্যুর জন্য আমি এখনও নিজেকেই দায়ী মনে করি। বিশ্বাস জিনিসটা হারিয়ে ফেলি। সবার ধারণা ছিল হয়তো বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবো আগের মত। বিয়ে করার মত কোনো মানসিকতা আমার ছিলনা। শুধুমাত্র সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রাজি হই। কিন্তু বিধিবাম সেও আমায় ঠকায়। নাম তার মৃন্ময়। একটা সময় তোমার মতই ভালোবাসায় দেখায় আমায়। অভিনয়যুক্ত ভালোবাসা। বিশ্বাস করতে শুরু করি আবার। গায়ে হলুদের রাতে সে আমার পায়ে ধরে বলে আমায় বিয়ে করতে পারবেনা তার এক্স গার্লফ্রেন্ডের জন্য। আটকাইনি তাকে। পরে সে উপলব্ধি করলো সে এখনো আমায় ভালোবাসে। যেমনটা এখন তুমি উপলব্ধি করছো। তোমাদের কাছে ভালোবাসা মানেই তো পুতুলখেলা। মৃন্ময়কে আমি এক্সেপ্ট করতে পারিনি। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিলো। তার খালাতো ভাইয়ের সাথেই আমার বিয়ে হয়। মানুষটা আমাকে পাগলের মত ভালোবাসে।”
“আর তুমি?”
“আমি তাকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসি। কেন জানো? কারণ তার ভালোবাসায় বিন্দুমাত্র অভিনয়ের ছোঁয়া নেই। যেখানে তোমার ভালোবাসা ছিল সবটাই নাটক।
তোমার বিয়ের পর আমি সবই জানতে পারি। তুমি আমার আগেও বেশ কয়েকজনের সাথে টাইমপাস করেছো। তারাও ছিল তোমার লেভেলের। তাই হয়তো তোমায় ভুলতে পেরেছিল। আমাকে যখন থেকে তুমি ইগনোর করা শুরু করো তখন আসলে তোমার পরিবার থেকে কোনো চাপ আসেনি। তুমি নতুন রিলেশনে জড়িয়েছিলে। আর সবেচেয়েও মজার বিষয় ছিল আমার জন্য এটা যে, তোমার বিয়ে আরো আগেই ঠিক হয়েছিল শোভার সাথে। আমি ছিলাম তোমার টাইমপাস। কিন্তু আমার ভালোবাসা ছিলে তুমি। আমার পরে যার সাথে রিলেশনে গিয়েছো তার সাথে এক সপ্তাহ্ এর মত রিলেশন ছিল তাই না? এরপর শোভাকে বিয়ে করো। বিয়ের আগেও আমার কাছে কতই না নাটক করেছো। তুমি বলেছিলে তোমার পরিবারের সবাই জানে আমার কথা। কিন্তু সত্যিটা হলো কেউই জানতো না আমার কথা। শুধুমাত্র ঢাকার তোমার সেই বন্ধুগুলো বাদে। তুমি বলেছিলে তোমার পরিবার আমায় মানবেনা। আমি ঢাকা শহরের মেয়ে বলে। সত্যিটা হলো তুমি বাড়িতে বিয়ের বিষয়ে আমার কথা জানাওনি। আমার বন্ধুরা যখন আমায় ছেড়ে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলো তোমার কাছে। তুমি বলেছিলে আমার আর্থিক অবস্থা ভালো না। তাই তোমার পরিবার মানবেনা কখনো। ভাবতে পারছো কতটা নিচু তোমার মন? তোমার কাছে টাকা-পয়সা, বাড়িঘর ছিল ভালোবাসা। আমি নই! বিয়েও করেছো বড়লোকের মেয়েকে। কি পেলে? থাকলো সে তোমার? আসলে কি বলো তো শিহাব, ভালোবাসা কি তুমি জানোইনা। তুমি জাস্ট একটা মোহে আকৃষ্ট হও। আমি ভাবতাম আমি তোমার যোগ্য নই। কিন্তু সত্যটা হলো তুমি আমার যোগ্য নও। আমার ভালোবাসার তো নও’ই। আমি তোমায় অভিশাপ দেইনি। হয়তো আমার মায়ের চোখের পানি নয়তো আমার চোখের পানিই তোমার জন্য অভিশাপরূপ ছিল। যে কারণে সব পেয়েও তুমি হারিয়েছো।
আসলে একটা কথা আমি সবসময়ই মানি। আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে। যে মানুষ বিয়ের আগে ঠকাতে পারে, সে বিয়ের পরও ঠকাতে পারে। এজন্যই হয়তো আল্লাহ্ তোমার সাথে আমার জোড়া বানায়নি। তুমি চলে গিয়েছো বলেই আমি সত্যিকারের ভালোবাসার দেখা পেয়েছি। আমার ফাহাদকে পেয়েছি। যার চোখে আছে আমাকে হারানোর ভয়। যার মনে আছে আমার জন্য সীমাহীন ভালোবাসা।
অহংকার নয়, একটা কথা বলি। ফাহাদ কিন্তু তোমার চেয়ে অনেক অনেক বড়লোক। তবুও সে এই গরীব মেয়েটার জন্যই পাগল হয়েছে। অপরিসীম ভালোবেসে বিয়ে করেছে। সে টাকা-পয়সা, বাড়িঘর দেখেনি। সে সঠিক মানুষ দেখেছে। ঠিক তেমনই তুমি ছিলে আমার জীবনে ভুল মানুষ। যার খেসারত আমাকে অনেকভাবে, অনেক সময় ধরে দিতে হয়েছে। আর আল্লাহ্ তারপরই পাঠালেন আমার জীবনে ফাহাদকে। প্রকৃতি তার প্রতিশোধ নিবেই। আজ বা কাল! নিয়েছেও। প্রকৃতি তোমায় দিয়েছে শাস্তি আর আমায় দিয়েছে আমার ভালোবাসা।”

সূর্যোদয় হয়েছে চারদিকে সূর্যের রক্তিম আভা। প্রিয়ার দৃষ্টি সেখানেই। শিহাবের দিকে তাকাতেই দেখলো শিহাবের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে।
“তুমি অনুতপ্ত কি’না আমি জানিনা শিহাব। তবে তোমাকে একটা কথাই বলবো, আর কাউকে আমার মত ঠকিয়ো না প্লিজ। আর হ্যাঁ থ্যাঙ্কিউ ফাহাদের মত একজন সঠিক মানুষকে আমার জীবনে আসার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। তুমি চলে না গেলে আমাকে আরো বেশিই পস্তাতে হতো। আমি অনেক অনেক অনেক বেশিই খুশি যে আল্লাহ্ ফাহাদকে আমার জীবনে পাঠিয়েছে।
ভালো থেকো। আর পিছু ডেকো না আমায়।”
প্রিয়া উল্টোপথে হাঁটা শুরু করলো। একবারের জন্য পিছু ফিরে তাকালো না।
হোটেলে গিয়ে দেখলো ফাহাদ বিছানায় নেই। ব্যালকোনিতে গিয়ে পেয়ে গেলো।
“এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলে যে?”
কফিতে চুমুক দিয়ে ফাহাদ পিছনে ঘুরে বললো,
“হুম। কফি খাবে?”
“না।”
“দেখো আকাশটা কত্ত সুন্দর পরিষ্কার লাগছে। মনে হচ্ছে সব মেঘ কেটে গিয়ে শান্তিতে ভাসছে।”
“ঘুম থেকে উঠে আমায় দেখোনি। এখন যখন আসলাম জিজ্ঞেস করলে না কেন কোথায় গিয়েছিলাম?”
“তুমি আমার স্বাধীন ভালোবাসা। সবকিছুর জন্যই কি কৈফিয়ত চাইতে হবে? তাছাড়া আমি তো জানি তুমি কোথায় গিয়েছিলে।”
প্রিয়া অবাক হয়ে বললো,
“জানো?”
“হু। শিহাবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলে তাইনা?”
“আসলে….”
প্রিয়াকে থামিয়ে দিয়ে ফাহাদ বললো,
“আমি কোনো কারণ জানতে চাইনা।”
রুমে ঢুকে একটা শার্ট নিয়ে বাহিরে চলে গেলো ফাহাদ। প্রিয়া এতবার পিছু ডাকা সত্ত্বেও শুনলো না। খুব ভয় করছে। ফাহাদ কি ভুল বুঝলো! ছেড়ে দিবে কি ভুল বুঝে। উপায় না দেখে ফোন করে। রুমের মধ্যেই ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা রুমেই রেখে গেছে। আকাশকে যে বলবে সেটাও পারছেনা! অযথাই ওদের টেনশনে ফেলবে আর ওদের মুহুর্তগুলোকে নষ্ট করতে ইচ্ছে হলো না প্রিয়ার। তাই অপেক্ষা করতে লাগলো। সকাল পেড়িয়ে দুপুর! দুপুর পেরিয়ে বিকাল! বিকাল পেরিয়ে সন্ধ্যা! এখনো ফাহাদের আসার কোনো নাম নেই। টেনশনে মাথা কাজ করছেনা প্রিয়া। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খারাপ।
রাতঃ ১০টা
ফ্লোরে শুয়ে শুয়ে কাঁদছে প্রিয়া। তখন দরজা খোলার আওয়াজে উঠে বসে। ফাহাদকে দেখে দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“কোথায় গিয়েছিলে তুমি? জানো কত টেনশন হচ্ছিলো? কেন আমাকে একা করে চলে যাচ্ছিলে? আমায় ভুল বুঝোনা প্লিজ!!!”
ফাহাদ চুপচাপ নিজ থেকে প্রিয়াকে ছাড়িয়ে নেয়। ফাহাদের হাতে কিছু প্যাকেট ছিল। সেগুলো বিছানায় রাখতে রাখতে বললো,
“ফ্রেশ হয়ে নাও।”
“তুমি আমার ওপর রেগে আছো। আমার কথাটা শুনো ফাহাদ।”
কিছু না বলে ফাহাদ প্রিয়াকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। শাওয়ার ছেড়ে দেয়। প্রিয়া হাজার কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা। গোসল শেষে ফাহাদ বেরিয়ে যায়। প্রিয়া চেঞ্জ করে বের হয়। কাঁদতে কাঁদতে বলে,
“আমার কথা শোনো প্লিজ।”
“চুপ করে থাকো।”
প্যাকেট থেকে একটা সাদা শাড়ি বের করে ফাহাদ। নিজ হাতে প্রিয়াকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। নিজে চুল আঁচড়ে দেয়। মুখে হালকা ফেস পাওডার দিয়ে দেয়। চোখে কাল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে দেয়। কপালে সাদা পাথরের একটা টিপ পড়িয়ে দেয়। দুই হাত ভর্তি খাঁজকাটা কাঁচের চুরি পড়িয়ে দেয়।
প্রিয়ার কোনো কথাই শুনছেনা। ভুল ভাঙ্গানোরও কোনো সুযোগ দিচ্ছেনা।
প্রিয়াকে রেডি করিয়ে ফাহাদ গোসল করতে যায়। অভিমানে, কষ্টে বুক ফেঁটে কান্না আসছে প্রিয়ার। বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকে।
.
ফাহাদ গোসল করে একটা সাদা পাঞ্জাবি পড়ে। হাতা ফোল্ড করে নেয়। দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে খালি গলায় গান ধরে,
“কেনো ভাবো ছেড়ে যাবো তোমায়?
ছেড়ে গেলে তোমায় পাবো কোথায়!
তোমাকে নিয়ে জীবন, আর জীবন তো হয়না দু’বার….
তুমি আমার বসুন্ধরা, তুমি আমার বাঁচামরা,
তুমি আমার রঙিন আশা, তুমি আমার ভালোবাসা!!”
গান শুনেই প্রিয়া বালিশ থেকে মুখ উঠিয়ে শোয়া থেকে বসে। ফাহাদ তখন মুচকি হেসে দুই হাত প্রসারিত করে দেয়। প্রিয়া দৌঁড়ে এসে ফাহাদের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফাহাদও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখেই আনন্দের অশ্রু। এতক্ষণে ফাহাদের বুকটা শান্তি হলো প্রিয়াকে বুকে নিয়ে।
“কাঁদছো কেন পাগলী? আমি তোমায় কি করে ভুল বুঝি বলোতো? আমি তো জানি আমার পরীটা আমায় কত্ত ভালোবাসে। আমি কালই তোমায় শিহাবের সাথে কথা বলতে দেখেছি। যদিও আমি জানতাম না ঐটা শিহাব। তবে আমার মন বলছিল ঐটাই শিহাব। আমিও চাইতাম একটাবার তোমার ওরসাথে দেখা হোক। ও দেখুক তুমি কতটা ভালো আছো। আমার বিশ্বাস আছে তোমার প্রতি। তাই তোমায় কোনো প্রশ্ন করিনি।”
“তাহলে এতটা সময় কেন কষ্ট দিয়েছো?”
“এতদিন পর এক্সের সাথে দেখা। ওর অবস্থা জেনে বা ওকে দেখে তোমার খারাপ লাগতে পারে। তাই কিছুটা সময় আমি দূরে ছিলাম। যাতে তোমার মন শুধু আমার দিকেই থাকে। তাছাড়া দুজনই দুজনের প্রতি ভালোবাসার টান উপলব্ধি করতে পারলাম। আমার যে কি কষ্ট হচ্ছিল তোমায় ছাড়া থাকতে। আমি কখনো তোমায় ছাড়তে পারবো না। তোমাকে ছাড়া থাকলে আমি দম আটকেই মরে যাবো।”
“আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না ফাহাদ। ভালোবাসি ভালোবাসি।”
“ভালোবাসি আমার পাগলীটা।”
দুজনই চুপ করে রইলো কিছুক্ষণ। ফাহাদ বললো,
“প্রিয়া!”
“হু।”
“চাই।”
“কি?”
“আদর।”
“নির্লজ্জ!”
“বুকে লাগে তো! আর নির্লজ্জ যখন বললে তখন নির্লজ্জের কাজটা করেই ফেলি। কি বলো?”
“একদম না।”
“তুমি না বললেও আমি শুনছিনা।”
প্রিয়াকে পাঁজাকোলা করে বিছানায় নিয়ে যায়। টেবিল ল্যাম্প অফ করে দেয়। প্রিয়াকে একটানে নিজের বাহুদ্বরে আবদ্ধ করে। শাড়ির কু্ঁচি খুলে ফেলে। প্রিয়ার ঠোঁট নিজের ঠোঁটের দখলে নিয়ে নেয়। সূচনা হয় আরো একটি ভালোবাসাময় রাত!

আমরা সবাই সবার ভুল বুঝতে পারি। কিন্তু অনেক দেড়িতে। ততদিনে অপর মানুষটা হয়তো ভুলেই যায় কি ঘটেছিল তার জীবনে। ঠকিয়ে কেউই সুখী হতে পারেনা। রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলতে একটা কথা আছে। প্রকৃতি কখনো তার প্রতিশোধ নিতে ভোলে না। মৃন্ময়ের একটা ভুলে প্রিয়ার জীবন কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল। যার ফলস্বরূপ প্রিয়াকে হারাতে হলো। চোখের সামনে ভালোবাসার মানুষটিকে ভাইয়ের বউ হিসেবে সহ্য করতে না পেরে পাড়ি জমালো বিদেশের মাটিতে। শিহাব তার কর্মের ফল পেলো প্রতিটা পদে পদে। জীবনে সুখের দেখা পেয়েও হারালো। কাউকে কাঁদিয়ে, ঠকিয়ে সুখী হওয়া বড্ড কঠিন।
অপরদিকে প্রিয়া ঠকে গিয়েও জিতে গেলো। উপহারস্বরূপ পেলো ফাহাদের মত একজন সঠিক মানুষকে। দুজনের প্রতি দুজনের আছে অফুরন্ত ভালোবাসা। সময় পেলেই একে অপরকে বলে, “তুমি আমার ভালোবাসা।”
(সমাপ্ত)

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-২৩

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২৩
#Munni_Akter_Priya
.
.
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দুলাভাই ফাহাদকে বলে,
“বুঝলা ফাহাদ, বিড়ালের মত ম্যাউ ম্যাউ করার আগেই বাসরঘরে বিড়াল মেরে ফেলো।”
ফাহাদ কি বললো শোনা গেলো না। প্রিয়া আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করছে। দুলাভাই আবার বলে,
“হাইসো না মিয়া। আমার শালিকারে তো চিনো না। এমন নাকানিচুবানি খাওয়াইবো টেরও পাইবা না।”
দুলাভাইর সাথে সাথে আকাশসহ আরো অনেকেই হোহো করে হেসে দিলো। শুধুমাত্র মৃন্ময়ই চুপ করে আছে। ওর এসবের ভেতর একদম থাকার ইচ্ছে ছিলনা। সবার জোড়াজুড়িতেই বাসরঘরের সামনে আসা। মৃন্ময়কে বেশ ভালো করেই দেখছে ফাহাদ। ফাহাদ ভাবে, কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। সবাই চলে যাওয়ার পর ফাহাদ রুমে ঢোকে। প্রিয়া তখন দরজার আড়ালে ছিল। আচমকা প্রিয়াকে দেখে ভয় পেয়ে যায়।
“ওমা গোওওও!”
প্রিয়া ফাহাদের মুখ চেপে ধরে বলে,
“চুপ! এভাবে চেঁচাচ্ছো কেন? আমি কি চোর না ডাকাত?”
প্রিয়ার হাত সরিয়ে ফাহাদ বলে,
“তুমি এখানে কেন?”
“শুনছিলাম।”
“কি?”
“তোমাদের কথা। দুলাভাই বিড়াল মারার কথা বললো কেন? নিরীহ বিড়ালের দোষ কি?”
ফাহাদ মিটমিট করে হাসছে।
“উত্তর না দিয়ে এমন চোরের মত হাসছো কেন?”
“চোররা এভাবে হাসে?”
“এটাকে চোরামি হাসিই বলে।”
“আর কত রকম হাসি আছে?”
“কথা ঘুরাচ্ছো কেন?”
“কখন কথা ঘুরালাম?”
“বিড়াল মারার কথায় ছিলাম আমরা।”
“ওহ আচ্ছা। বিড়ালের তো অনেক দোষ। কোনটা রেখে কোনটা বলবো?”
“যেগুলো মেইন সেগুলোই বলো।”
“আচ্ছা বলছি। আসো।”
ফাহাদ প্রিয়াকে টেনে ড্রেসিংটেবিলের সামনে নিয়ে যায়। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“জানো বিড়ালটাকে না আমার মারতে ইচ্ছে করেনা।”
“তাহলে মেরো না।”
“মারবোই তো না। এত কিউট বিড়াল কেউ মারতে নাকি?”
“কোথায় সেই বিড়াল? আমিও দেখবো।”
“দেখবে?”
“হ্যাঁ।”
“শিওর?”
“পাক্কা শিওর।”
“আচ্ছা। আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখো লাল লেহেঙ্গা পড়া মেয়েটাই বিড়াল।”
প্রিয়া চোখগুলো বড় বড় করে বলে,
“কিহ্? আমি বিড়াল?”
ফাহাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েই পিঠে কয়েক দফা কিল বসিয়ে দিলো। ফাহাদ মার খেয়ে বলে,
“দুলাভাই ঠিকই বলেছিল। এজন্যই বাসর রাতে আগে বিড়াল মারা উচিত। এখন বিড়ালের হাতেই আমায় মার খেতে হচ্ছে?”
“আরো মার খাওয়ার ইচ্ছে আছে?”
“না, না। আমি আর তোমার ধারেকাছেও ঘেষছি না। আমি শুতে গেলাম।”
ফাহাদ বিছানার একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো। পিছু পিছু প্রিয়াও গেলো। প্রিয়াকে দেখে ফাহাদ অন্যপাশে ঘুরে শুলো। আর মিটিমিটি হাসে। পেছন থেকে প্রিয়া বলে,
“তোমার কি খুব লেগেছে?”
ফাহাদ চুপ।
“কথা বলছো না কেন?”
ফাহাদ কথা বলছে না দেখে প্রিয়াও বিছানায় উঠে গেলো। ফাহাদের দুই হাতের মাঝখান দিয়ে একদম মুখোমুখি বালিশে মাথা রাখলো প্রিয়া। ফাহাদ একবার তাকিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলে। প্রিয়া ফাহাদের গালে হাত রেখে বলে,
“রাগ করেছো?”
“আমি রাগ করলেই কার কি আসে যায় তাতে?”
“অনেক কিছু আসে যায়।”
“সরো।”
“না সরবো না।”
প্রিয়া এক হাত-পা ফাহাদের ওপর দিয়ে জাপটে ধরে শুয়ে রইলো। ফাহাদ আর তখন রাগের অভিনয় করে থাকতে পারলো না। চট করে প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে হেসে দিলো।
“রাগ শেষ?”
“আমি কি সত্যি রাগ করেছিলাম নাকি?”
“তাহলে কি মিথ্যা রাগ করেছিলে?”
“হ্যাঁ। যাতে তুমি নিজ থেকেই কাছে আসো।”
“কি ফাজিল!!”
ফাহাদ প্রিয়াকে ধরে উঠে বসায়।
“আচ্ছা প্রিয়া একটা জিনিস খেয়াল করেছো?”
“কি?”
“তোমাকে এত এত গয়না দিয়েছি। কিন্তু একটা জিনিস দেইনি।”
“কি?”
“ভেবে দেখো তো কি!”
“আমি তো কোনো কিছুর কমতি দেখছি না।”
“পা দাও।”
“মানে?”
“আরে দাও না।”
প্রিয়া পা এগিয়ে দিলো।
“এখন দেখেছো কিসের কমতি?”
“নূপুর!!”
“হ্যাঁ।
ফাহাদ বিছানা থেকে নেমে হাঁটু গেড়ে বসে। প্রিয়ার পা ফাহাদের হাঁটুর ওপর রাখে। খুব যত্নসহকারে নূপুরগুলো পড়িয়ে দেয়। নূপুরের সৌন্দর্যে প্রিয়া বিষ্মিত হয়। ফাহাদ আলতো করে প্রিয়ার পায়ে চুমু খায়। প্রিয়া শিউরে উঠে পা সরিয়ে নেয়। ফাহাদ প্রিয়ার পাশে বসে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়ার ঘাড়ে মুখ ডোবায়।
“ফাহাদ!”
“হু।”
“আমার না আনইজি লাগছে।”
সাথে সাথে ফাহাদ প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলে,
“স্যরি।”
“স্যরি কেন?”
“তোমার আনইজি লাগবে এমন কিছু করা ঠিক হবেনা।”
“আরে আমি বলতে চেয়েছি, এই ভারী ড্রেসে আমার আনইজি লাগছে। ড্রেসটা চেঞ্জ করা দরকার।”
“তোমার লাগেজ তো ফুলের ঘরে মেবি। দাঁড়াও আমি নিয়ে আসি।”
“না, না। লাগবে না।”
“তোমার না আনইজি লাগছে?”
“হ্যাঁ। তো?”
“তো ড্রেস চেঞ্জ করবে না?”
“করবো তো। তোমার কোনো ড্রেস দাও।”
“আমার ড্রেস তোমার গায়ে লাগবে।”
“না তো! তুমি যেই মোটা।”
“আমি একটুও মোটা নই। আমি একদম ফিট।”
“কচু। এখন তোমার একটা লুঙ্গি আর শার্ট দাও।”
“তুমি লুঙ্গি পড়বে?”
“হ্যাঁ পড়বো। দাও।”
ফাহাদ একটা লুঙ্গি আর শার্ট এগিয়ে দেয় প্রিয়ার দিকে।
“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? আমার চেঞ্জ করা দেখবে?”
“দেখলে কি হয়েছে?”
প্রিয়া চোখ গরম করে তাকায়। ফাহাদ,
“যাচ্ছি যাচ্ছি।”
বলে ব্যালকোনিতে চলে যায়।
প্রিয়া লাইট নিভিয়ে দিয়ে ডিম লাইট জ্বালিয়ে দেয়। শার্ট পড়তে পারলেও লুঙ্গিটা কিছুতেই পড়তে পারছেনা। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়ে।
ফাহাদ ব্যালকোনি থেকে বলে,
“হয়েছে তোমার?”
“না, ফাহাদ।”
“আমি কি রুমে আসবো?”
“আসো।”
ফাহাদ রুমে এসে দেখে লুঙ্গি হাতে নিয়ে প্রিয়া বসে আছে হতাশ মুখে। শার্ট’টা হাঁটুর এক ইঞ্চি উপরে ছুঁই ছুঁই করছে। এভাবে দেখে ফাহাদের ঘোর লেগে যায়। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,
“লুঙ্গি পড়ছো না কেন?”
“পারছিনা তো। এত প্যাঁচের জিনিস পড়ো কিভাবে তোমরা?”
ফাহাদ হো হো করে হেসে দিলো। প্রিয়া বিরক্ত নিয়ে বললো,
“এত হেসো না তো। পারলে লুঙ্গিটা পড়িয়ে দাও।”
“আমি পড়িয়ে দিবো?”
“এমন একটা ভাব ধরছো যেন আমি পরপুরুষকে বলেছি। দাও দাও পড়িয়ে দাও।”
“আচ্ছা উঠে দাঁড়াও।”
প্রিয়াকে এমন অবস্থায় দেখে ফাহাদের মাথা ঘুরে ওঠে। কত স্বপ্নই দেখেছে প্রিয়াকে বউ করার। কিন্তু এত কাছে এসেও ফাহাদের সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। লুঙ্গি পড়ানো শেষে প্রিয়া ড্রেসিংটেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে নিজেকে দেখছে। ফাহাদের দৃষ্টি তখন প্রিয়ার ওপর। কত হাসিখুশি একটা মেয়ে। ফাহাদ আস্তে আস্তে প্রিয়ার দিকে এগিয়ে যায়। প্রিয়া ফাহাদের দিকে ঘুরে বলে,
“দেখো তো আমায় কেমন লাগছে!”
ফাহাদ প্রিয়ার মুখের ওপর আলতো করে হাত রাখলো। পাজকোলে করে বিছানায় নিয়ে যায়। প্রিয়ার তখন দম যায় যায় অবস্থা। ফাহাদ যতই কাছে যাচ্ছে প্রিয়ার নিঃশ্বাস ততই ভারী হচ্ছে। একটা সময় এতটা কাছাকাছি এসে পড়ে যে দুজনের নিঃশ্বাস একত্রে মিসে যাচ্ছে। প্রিয়ার চুলগুলো হাতখোঁপা করা ছিল। বাম হাতে খোঁপাটা খুলে দেয় ফাহাদ। চুলে মুখ ডুবিয়ে ঘ্রাণ নিতে থাকে। মাতাল করা ঘ্রাণ। বাম হাত প্রিয়ার ঘাড়ে রেখে কপালে, গালে, ঠোঁটে, গলায় আলতো করে চুমু খায়। এরপর ঘাড়ে গভীর চুমু এঁকে দেয়। প্রিয়ার অবাধ্য হাত তখন ফাহাদের শার্ট আঁকড়ে ধরে। ফাহাদ এক হাতে প্রিয়ার শার্টের বোঁতামগুলো খুলে ফেলে।
একটা সময় দুজনই হারিয়ে যায় ভালোবাসার অসীম সীমায়। যেখানে কেউ আটকানোর নেই, কেউ বাঁধা দেওয়ার নেই। একটি ভালোবাসা সম্পূর্ণ পূর্ণতা পেতে মোহিত হয়ে ওঠেছে একে অপরের ভালোবাসায়।
.
.
সকাল সকাল গোসল করে ফ্রেশ হয়ে নেয় প্রিয়া। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখে সবাই কাজে ব্যস্ত। বৌভাতের আয়োজনের ব্যবস্থা করছে। প্রিয়া শ্বাশুরীর দিকে এগিয়ে যায়। শ্বাশুরী মা তখন মৃন্ময়ের সাথে কথা বলছো। কিছু একটা নিয়ে শ্বাশুরী-মা খুব বকছে মৃন্ময়কে। মৃন্ময় প্রিয়াকে দেখে থমকে যায়। কালো জর্জেট একটা শাড়ি পড়েছে প্রিয়া। হাতে ম্যাচিং করা কালো চুড়ি। নাকে সাদা পাথরের ছোট্ট একটা নাকফুল। লম্বা চুলগুলো থেকে পানির ফোঁটা পড়ছে। পায়ের নূপুরগুলোর শব্দ কানে বাজছে। মাথায় কাপড় দেওয়া। একদম স্নিগ্ধ লাগছে। মৃন্ময়ের কষ্ট যেন বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রিয়া এগিয়ে গিয়ে শ্বাশুরীকে সালাম করে। তিনি বলেন,
“আরে তুমি এত সকালে ঘুম থেকে ওঠেছো কেন?”
“আমি তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে ওঠি সবসময়।”
“এখন থেকে এত তাড়াতাড়ি ওঠার দরকার নেই। বাড়ির সব কাজ করার জন্য মানুষ আছে।”
“আচ্ছা আমি তাহলে ফুলের কাছে যাই?”
“দেখো গিয়ে ঘুমাচ্ছে হয়তো। পারলে একটু ওকেই ঘুম থেকে তোলো। খুব ঘুমকাতুরে হয়েছে।”
মৃন্ময় প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ সরছেনা। প্রিয়া এখন সম্পূর্ণই অন্য একজনের। সেই অন্য একজনটা আর কেউ নয়। নিজেরই ভাই ফাহাদ। মৃন্ময় আজই এখান থেকে চলে যেতে চাইছে। এভাবে প্রিয়াকে দেখতে পারছেনা। নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। এটা নিয়েই সকাল সকাল খালামনির সাথে কথা কাটাকাটি হচ্ছে। মৃন্ময়ের মা এসে তার বোনকে বোঝায় যাতে মৃন্ময়কে যেতে দেয়। কারণ তিনি তো মা। নিজের ছেলের কষ্টটা তিনি বুঝতে পারছেন।
প্রিয়া ফুলের রুমে গিয়ে দেখে ফুল ঘুমাচ্ছে। দুই/তিন বার ডাকতেই ফুল ঘুম থেকে ওঠে যায়। প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“ভাবী তুমি!!! তাই তো বলি এত তাড়াতাড়ি আমার ঘুম ভাঙ্গলো কিভাবে।”
“আমি ডেকেছি বলে ঘুম ভেঙ্গেছে?”
“হুম। কারণ তুমি তো যাদু জানো।”
ফাহাদ শার্টের হাত ফোল্ড করতে করতে ফুলের রুমে ঢুকে বলে,
“এখানে ননোদকে আদর করে ঘুম ভাঙ্গানো হচ্ছে! অথচ আমার বেলায় আদর নেই?”
ফুল বলে,
“ভাইয়া তুমি এত হিংসুটে কেন বলো তো?”
“সত্যি বললে তো হিংসুক হবোই। আমাকে একটু চুমুটুমু দিয়ে ঘুম ভাঙ্গালে তোর ভাবীর মহাভারত কি অশুদ্ধ হয়ে যেত রে?”
“তুমি না দিনদিন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছো ভাইয়া।”
“তোর ভাবীও তাই বলে। তুই তো দেখছি তোর ভাবীর মত হবি।”
“তাও ভালো। তোমার মত তো হবো না।”
“কি বললি?”
ফুল প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। প্রিয়া আড়চোখে ফাহাদকে দেখছে। লজ্জায় ভালো করে তাকাতে পারছেনা। ফাহাদও কালো কালার শার্ট পড়েছে। চুলগুলো স্পাই করেছে। দেয়ালের সাথে এক পা তুলে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া লাজুক লাজুক মুখে বলে,
“ওভাবে কি দেখছো?”
“আমার লজ্জাবতী বউকে দেখছি। কালকে কি ডোজ বেশি হয়ে গেছিল?”
“ফাজিল, কুত্তা।”
প্রিয়া দৌঁড় দিতে নিলেই ফাহাদ হাত ধরে ফেলে। জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে থাকে। ফুল তখন ওয়াশরুম থেকে বের হয়।
“এহেম!! এহেম!!”
প্রিয়া ফাহাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌঁড়ে চলে যায়……

চলবে….

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-২২

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২২
#Munni_Akter_Priya
.
.
মৃন্ময়ের দেশে আসার কোনো ইচ্ছেই ছিল না। একদিকে ফাহাদ মৃন্ময়ের ভাই আর সবেচেয়ে কাছের বন্ধু। আর অন্যদিকে দেশে গেলে প্রিয়ার একাকিত্ব! সব মিলিয়ে খুব প্যারায় আছে। ফাহাদও সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে, যেভাবেই হোক মৃন্ময়কে আসতেই হবে। তাই অগত্যা মৃন্ময়কে রাজি হতে হয়। গায়ে হলুদের রাতে ফ্লাইটে ওঠে মৃন্ময়। বিয়ের দিন সকালেই পৌঁছে যাবে।
.
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক দুলে দুলে নিজেকে দেখছে প্রিয়া। এভাবে দেখার কারণও আছে। ছোট থেকেই প্রিয়ার খুব শখ বউ সাজার। একবার প্রিয়া ছোট ভাইয়ার সাথে, ভাইয়ার বন্ধুর বড় ভাইয়ের বিয়ের বৌভাতের দাওয়াত খেতে যায়। তখন বউ এর দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে ছিল। ছোট ভাইয়া ধাক্কা দিয়ে বলেছিল,
“কিরে কি দেখছিস এভাবে?”
“ভাইয়া ঐটা কি বউ?”
“হ্যাঁ।”
“ভাইয়া আমিও বউ সাজবো। ও ভাইয়া আমিও বউ সাজবো।”
প্রিয়া প্রায় চেঁচামেচি করেই কথাটা বলে। চারপাশের লোকজন তখন প্রিয়ার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। ছয় বছর বয়সী একটা মেয়ে! সে কিনা বউ সাজতে চাইছে। ভারী মজার বিষয়। কেউ কেউ আবার এই কান্ড দেখে হাসছেও। ছোট ভাইয়া কিছুতেই প্রিয়াকে শান্ত করতে পারছিলো না। তখন যার বিয়ে সে বললো,
“তুমি বউ সাজবে?”
“হ্যাঁ। আমি ঐ মেয়েটার মত বউ সাজবো।”
“কিন্তু বউ সাজলে তো বিয়ে করতে হয়।”
“তাহলে আমিও বিয়ে করবো।”
উপস্থিত সকলে হেসে দিলো। সেও হেসে বললো,
“তুমি বর কোথায় পাবে?”
“তুমি কি হও ঐ বউটার?”
“আমিই তো ওর বর।”
“তাহলে তুমি আমারও বর হবে। ও বড় বউ আর আমি ছোট বউ।”
প্রিয়ার এই কথা শুনে সকলের সে কি হাসি। দম ফাঁটিয়ে হেসেছিল সবাই।

কথাগুলো ভেবেই আয়নার দিকে তাকিয়ে হাসলো প্রিয়া। কি কান্ডটাই না করেছিল সেদিন। সবাই তো এখনো ক্ষেপায় প্রিয়াকে। বিশেষ করে ঐ ভাইয়াটা। দেখা হলেই সবসময় বলতো,
“কি গো ছোট বউ আমায় মনে আছে?”
তখন যে প্রিয়া কি লজ্জা পেতো।
আজ প্রিয়াও বউ সেজেছে। লাল টুকটুকে বউ। ঘেরওয়ালা লাল লেহেঙ্গা পড়েছে। পাথরের গলার হার, কানের দুল, টিকলি, আর নাকে নোলক পড়েছে। দুই হাত মেহেদীর রঙে আবির্ভূত। দুই হাত ভর্তি লাল চুড়ি। হাত নাড়ালেই সেগুলো রিনিকঝিনিক আওয়াজ করছে। আওয়াজটা শুনতে বেশ লাগছে প্রিয়ার। চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা। তাতে আবার অনেকগুলো গোলাপ গুঁজে দেওয়া। ব্রাইডাল সাজ। গাঢ় কাজলে চোখগুলো টানা টানা লাগছে। নিজেকে বউ সাজে দেখে নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে যাচ্ছে। প্রিয়া যেমনভাবে বউ সাজতে চেয়েছিল তেমনভাবেই সাজানো হয়েছে। ফাহাদ বলেছিল বিয়ের সব কিছু, এমনকি অর্নামেন্টসও ফাহাদ নিজে পছন্দ করেছে। আর পার্লারের লোকও ফাহাদই ঠিক করে দিয়েছে। প্রিয়া আপনমনেই ভাবে,
“ফাহাদ আমার পছন্দ জানলো কিভাবে? ও কি মন পড়তে পারে? নাকি ওর আর আমার চয়েজ এক? তাই বলে এত মিল? অদ্ভুত!”
আঙ্গুল কামড়ে কিছুক্ষণ কথাগুলো ভাবলো। এরপর আবার নিজেই বললো,
“ধুর ছাই! যাই হোক, মানুষটা আমার মনের মত সাজিয়েছে এটাই তো অনেক।”
এতক্ষণে আয়নায় লক্ষ করলো পেছনে মা, লামিয়া, পৃথা দাঁড়িয়ে মিটমিট করে হাসছে। ওদের এভাবে হাসতে দেখে প্রিয়া লজ্জা পেয়ে যায়। মা প্রিয়ার দিকে এগিয়ে এসে প্রিয়া দুইগালে চুমু খায়।
“আমার মেয়েটাকে কি সুন্দর লাগছে! মনে হচ্ছে চোখের সামনে লাল টুকটুকে একটা পরী দাঁড়িয়ে আছে। আজ যদি তোর বাবা থাকতেন, তাহলে দেখতি কত খুশি হত সে। দুচোখ ভরে দেখতো তার ছোট্ট পরীকে।”
মায়ের চোখে পানি স্পষ্ট। প্রিয়ার নিজের বুকেও মোচর দিয়ে ওঠে। মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। মা তৎক্ষণাৎ প্রিয়ার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলেন,
“খবরদার! আজ আর কোনো কান্না নয়। আমার মেয়েকে দেখতে পঁচা লাগবে এটা আমি চাইনা। তুই ওদের সাথে বাহিরে আয়। আমি দেখি সবাই রেডি হলো কি’না।”
“মা, ভাবীরা আসেনি?”
“না।”
প্রিয়ার মুখটা মলিন হয়ে গেলো। প্রিয়া ভেবেছে অন্তত আজ বিয়ের দিনে ভাবীরা আসবে। ননোদের বিয়ে অথচ দুই ভাবীর এক ভাবীও থাকবেনা। এত খুশির মুহুর্তেও তাদের পাশে পাবেনা। তারা অন্যায় করেছে করুক, আজকে যদি একবার আসতো প্রিয়া সব ভুলে যেত সব। আজ প্রিয়া ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পেতে চলেছে। তাই সবার ওপর মান-অভিমানের ভ্যানিশ করে দিতো। মা হেসে বলেন,
“আসেনি এখনো। তবে আসবে।”
প্রিয়া খুশি হয়ে বলে,
“সত্যিই আসবে?”
“হ্যাঁ।”
“কখন আসবে কখন?”
“ওরা সরাসরি কমিউনিটি সেন্টারে আসবে।”
“আচ্ছা।”
মা চলে যাওয়ার পর লামিয়া এগিয়ে আসলো। প্রিয়া দুলেদুলে বলে,
“আপু, আমায় কেমন লাগছেরে?”
“শাঁকচুন্নির মত।”
প্রিয়া মুখটা গোমড়া করে বলে,
“আপু!!! অন্তত আজ সত্যি বল।”
“সত্যিই তো বললাম।”
“রাখ তোর সত্যি। ভেবেছিলাম তোর যদি ছেলে হয় তাহলে আমার মেয়ের সাথে বিয়ে দিবো। কিন্তু এখন ডিসিশন চেঞ্জ। এমন হিংসুক বেয়াইন আমার চাইনা।”
“এখনো বিয়ে হলো না, কিছু হলো না আর তুই বাচ্চার বিয়ে পর্যন্ত চলে গেছিস?”
“ভাবতে কি কিছু করা লাগে নাকি।”
“ফাজিল।”
প্রিয়ার দুলাভাই দ্রুতবেগে রুমে প্রবেশ করলেন।
“কই কই আমার জানের টুকরাটা কই।”
দুলাভাই প্রিয়াকে আদর করে জানের টুকরা বলে ডাকে। এর ঘোর প্রতিবাদ জানায় একদিন লামিয়া। তখন দুলাভাই বলেছিল,
“তুমি তো আমার জান। আর শালিকা আমার জানের টুকরা। ভালো তো আমি তোমাকেই বেশি বাসি।”
লামিয়া মুখে কিছু না বললেও মনে মনে হেসেছিল।
দুলাভাইকে দেখে প্রিয়া আহ্লাদী স্বরে বললো,
“সুইটহার্ট দুলাভাই দেখেন না আপনার বউ কেমন হিংসা করে আমাকে।”
“কি? লামিয়া হিংসা করে তোমাকে? আমার জানের টুকরাকে হিংসা করে? এত্তবড় সাহস। কই কই সেই হিংসুক মহিলা?”
“ঐতো আপনার পিছনে।”
দুলাভাই পিছন ফিরে তাকাতেই ফাঁকা একটা ঢোক গিলে। লামিয়া কোমড়ে হাত রেখে চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে। দুলাভাই একটু কেশে লামিয়াকে বলে,
“ও আমার লামু জান এমনে তাকাও ক্যান বাবু? ওপস স্যরি! এখন তো তুমি হবু বাবুর মা।”
“একটু আগে কি বলছো? আমি মহিলা?”
“ছিহ্। এটা বললাম নাকি আমি? কখন বললাম? এই জানের টুকরা আমি কি এটা বলেছি?”
“দুলাভাই এটা কি হলো? বাঘের মত গর্জন করে এখন বিড়ালের মত ম্যাউ ম্যাউ করছেন?”
তিনি হতাশ গলায় বলেন,
“জানের টুকরা রে, দিনশেষে তো একরুমেই থাকতে হয়। তখন যদি খুন্তির স্বাদ নিতে পারতে তাহলে বুঝতা এমন ম্যাউ ম্যাউ কেন করছি!”
দুলাভাইর কথা শুনে প্রিয়া আর পৃথা হাসতে হাসতে সোফায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। দুলাভাই বলেন,
“হাসো হাসো। সত্যি বললে তো হাসবাই। তোমার বান্ধবী পৃথাকে জিজ্ঞেস করে দেখো ওর জামাইরেও এমনেই হাদানি-পাদানি দিয়ে রাখে। ওর কথাই বা কি বলছি আর! আজ বিয়েটা হোক। বেচারা ফাহাদেরও এই অবস্থাই হবে। তোমরা বউরা তো বাড়িতে একেকজন প্রেসিডেন্ট!”
ওরা এখনো হেসেই চলেছে।
“হাসি শেষ হয়েছে আমার জানের টুকরা? চলো তাড়াতাড়ি। কমিউনিটি সেন্টারে বরের আগে পৌঁছাতে হবে। ভাইয়ারা তাড়া দিচ্ছে।”
প্রিয়া কোনো রকমে হাসি থামিয়ে বলে,
“চলেন।”
রুমের বাহিরে যেতেই বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া প্রিয়াকে বুকে জড়িয়ে নেয় পরম আদরে। পাশ থেকে ঐ ভাইয়াটা মানে যাকে প্রিয়া বর হওয়ার কথা বলেছিল। সে বলে,
“ছোট বউ আমায় রেখেই অন্য কাউকে বিয়ে করবে?”
প্রিয়ার মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায়।
গাড়িতে পৃথা আর প্রিয়া পাশাপাশি বসেছে। হঠাৎ পৃথাকে খোঁচা মেরে প্রিয়া বলে,
“ঐ আর কতক্ষণে পৌঁছাবো?”
“বেশি সময় লাগবে না। কেন?”
“কেন আবার কি? ফাহাদকে জামাই সেজে কেমন লাগছে দেখবো না?”
“এত পাগল হচ্ছিস কেন?”
“তোর বিয়ের সময় তুই মনে হয় হসনি?”
“তোর মত এত না।”
“চুপ কর! ঝগরা করবিনা ঝগরুটে।”
“হুহ। ভিডিও কল দিয়ে দেখলেই তো হয়।”
“নারে। সেটা হবেনা।”
“কেন?”
“গায়ে হলুদের রাতেই বলে দিয়েছি বিয়ের সাজে সরাসরি দেখবো। কোনো ভিডিও কল হবেনা, এমনকি কোনো ছবিও শেয়ার করা হবেনা।”
“তাহলে আরকি! একটু তো ওয়েট করতেই হবে।”
“হুম। আকাশ ভাইয়া কোথায়?”
“তোর ভাইয়াদের সাথে আছে।”
“ওহ্।”
.
.
কমিউনিটি সেন্টারে পৌঁছেই ভাবীদের দেখতে পায়। প্রিয়াকে দেখে তারা হাসি হাসি মুখে এগিয়ে আসে।
“তোমাকে কি সুন্দর লাগছে প্রিয়ু।”
“এত সুন্দর ননোদিনীকে তোমরা কষ্ট দাও কিভাবে?”
প্রিয়ার কথাটা শুনে ভাবীদের মুখ মলিন হয়ে যায়। প্রিয়া দুই ভাবীর হাত ধরে বলে,
“ভাবী যা হওয়ার হয়েছে ভুলে যাও প্লিজ। মনের মধ্যে আর কোনো ক্ষোভ রেখো না। রামিম সেদিন ওরকম বিহেভ না করলে এত ঘটনা ঘটতো না। কিন্তু দেখো, রামিমও বিয়ে করেছে অন্য কাউকে। আমিও আমার ভালোবাসার মানুষটিকে বিয়ে করছি। তাহলে আর কিসের রাগ অভিমান থাকবে বলো? আর আমার ওপর যদি রাগ অভিমান থাকেও তাহলে কোনো সমস্যা নেই। আমি তো পরের ঘরে চলেই যাবো। আমাকে তোমাদের সহ্য করতে হবেনা। তোমরা শুধু ভাইয়াদের নিয়ে মায়ের সাথে এক বাড়িতে থাকো প্লিজ। আমি চলে আসাতে আমার মা যে বড্ড একা হয়ে যাবে গো। আবার আগের মত সবাই এক হয়ে যাও। নাতি-নাতনিদের নিয়ে মায়ের সময় কেটে যাবে। আমার মাকে তোমরা কেউ কষ্ট দিয়ো না গো। যদি মাকে বোঝা মনে হয় কোনোদিন এক সেকেন্ডের জন্যও তাহলে সাথে সাথে আমাকে ফোন দিবে। আমার জান্নাতকে আমি আমার কাছে এনে রাখবো। তবুও অবহেলা করো না মাকে।”
“তুমি কি আমাদের এতই খারাপ ভাবো প্রিয়ু? আমরা এখন থেকে সবাই একসাথে থাকবো আগের মত। মায়ের কোনো অবহেলা হবেনা। মাথায় তুলে রাখবো দেখো। আর তোমার প্রতিও আমাদের কোনো রাগ নেই। দোষ করলে আমরা করেছি। তুমি তো কোনো দোষ করোনি। উল্টো আমরাই ক্ষমার অযোগ্য।”
“তোমাদের ওপর কোনো রাগ নেই আমার ভাবী। এইযে তোমরা সব রাগ অভিমান ভুলে আমার বিয়েতে এসেছো, একসাথে থাকবে বলেছো এটাই আমার বিয়ের বড় গিফ্ট। আর কিচ্ছু চাইনা তোমাদের থেকে।”
“পাগলী বোন।”
বড় ভাইয়ার দুই বাচ্চা আর ছোট ভাইয়ার এক বাচ্চা মোট তিনজনে মিলে প্রিয়ার লেহেঙ্গা ধরে টানছে। প্রিয়া নিচে তাকিয়ে দেখে তিন বিচ্ছুকে। লেহেঙ্গা ধরে বলে,
“আব্বু, আম্মু আমার লেহেঙ্গা এভাবে টানলে তো খুলে যাবে। তখন তো লজ্জা পাবো ফুপি।”
ছোট ভাইয়ার ছেলেটা তুতলিয়ে তুতলিয়ে বলে,
“ও পুপি, পুপি তুমালে ছুন্দল নাগতাছে। আছো ছুবি তুলবো।”
“আমার বাবাটা ছবি তুলবে?”
“আমলা ছুবাই ছুবি তুলবো।”
“আচ্ছা চলো ফটোগ্রাফারকে বলি আমাদের চারজনের সুন্দর করে ছবি তুলে দিতে। ঠিক আছে?”
“আচ্চা।”
প্রিয়া তিন পিচ্চিকে নিয়ে বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলতে ব্যস্ত। ঐদিকে বরযাত্রী এসে পড়েছে সে খেয়ালই নাই। সবাই বরের কাছে এগিয়ে গিয়েছে। পৃথাসহ প্রিয়ার স্কুল ও কলেজের বন্ধু-বান্ধবীরা গেট ধরে টাকা দাবি করেছে। খুব হৈচৈ হচ্ছে। পিচ্চিগুলা শব্দ শুনে বলে,
“মনে হয় বর এসেছে। এই চল চল বর দেখি।”
ফটোগ্রাফার বলে,
“ম্যাম আপনি দাঁড়ান, কিছু সিঙ্গেল ছবি তু্লি আপনার।”
“ঠিক আছে।”

গেটের সব ঝামেলা চুকিয়ে বরযাত্রীরা ভেতরে প্রবেশ করে। ফাহাদ ভেতরে গিয়ে থমকে যায় প্রিয়াকে দেখে। প্রিয়া তখন ছবি তোলায় ব্যস্ত। চোখ ধাধিয়ে যাচ্ছে ফাহাদের। বউ সাজে কাউকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে! শুধু একজোড়া চোখ নয়! দুইজোড়া চোখ প্রিয়ার ওপর স্থির। একজোড়া ফাহাদের আর অন্যজোরা মৃন্ময়ের। মৃন্ময়ের দৃষ্টি ভরা অবাক, কৌতুহল আর সেই সাথে বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করা। মৃন্ময় মনে মনে ভাবে,
“আমি কি ঠিক দেখছি! প্রিয়া এখানে! তাও বউ সাজে!”
কয়েকজন ফাহাদকে নিয়ে বসায়। মৃন্ময় তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। পা চলছে না ওর। মনে হচ্ছে মাটি কামড় দিয়ে ধরে রেখেছে। ছবি তোলা শেষে প্রিয়া ফাহাদের দিকে তাকিয়ে হা হয়ে যায়। লাল খয়েরী সেরোয়ানিতে অপূর্ব লাগছে ফাহাদকে। বাম হাতে একটা কালো ঘড়ি। মাথায় পাগড়ী নেই। পাগড়ীটা পড়ে আছে পাশের একজন ছেলে। সম্ভবত ফাহাদের বন্ধু হবে। পৃথা এসে প্রিয়াকে ফাহাদের পাশে বসায়। আড়চোখে ফাহাদকে দেখছে প্রিয়া। লাজুক লাজুক চোখে তাকায় বারবার। হুট করেই সামনে দৃষ্টি যায়। প্রিয়ার হাসি বিলীন হয়ে যায়। মৃন্ময় এখানে কেন?
তখনই ফাহাদ ইশারায় মৃন্ময়কে ডাকে,
“এদিকে আয় মৃন্ময়। ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?”
প্রিয়া ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কে উনি?”
“আমার ভাই।”
“আমি তো জানতাম তুমি একাই আর ফুল।”
“আরে ও আমার খালাতো ভাই। এতদিন বাহিরে ছিল। আমার বিয়েতে এসেছে।”
“ওহ্।”
প্রিয়ার মনে এবার ভয় ঢুকে যায়। মৃন্ময় ফাহাদের ভাই! ফাহাদ যদি জানতে পারে মৃন্ময় প্রিয়াকে ভালোবাসে তাহলে! তাহলে কি হবে? ভাইয়ের জন্য ত্যাগ করবে? আবার স্বপ্ন ভেঙ্গে যাবে! ভয়ে ঘেমে যাচ্ছে প্রিয়া। ফাহাদ প্রিয়াকে ঘামতে দেখে বলে,
“আর ইউ ওকে?”
“ইয়াহ্।”
প্রিয়ার বান্ধবীরা সব দৌড়ে আসে। ফাহাদকে টেনে নিয়ে বলে,
“চলেন দুলাভাই ছবি তুলবো।”
প্রিয়ার কিচ্ছু ভালো লাগছেনা। চারপাশে চোখ বুলায় প্রিয়া। সকলের এত হাসিখুশি মুহুর্ত কি নিমিষেই শেষ হয়ে যাবে? মৃন্ময় ধীরে ধীরে প্রিয়ার দিকে এগিয়ে আসে। তখনই ফুল এসে প্রিয়াকে নিয়ে যায় ছবি তোলার জন্য। প্রিয়ার হাসি আসছেনা। মুখে জোরপূর্বক কৃত্রিম হাসি ফুঁটিয়ে ছবি তুলছে। বিষয়টা খেয়াল করেছে ফাহাদ। সবার চোখের আড়ালে নিয়ে যায় প্রিয়াকে।
“কি হয়েছে তোমার প্রিয়া? এমন ভীত দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?”
আচমকা ফাহাদকে জড়িয়ে ধরে প্রিয়া।
“তুমি আমায় ঠকাবেনা তো ফাহাদ? আমায় ছেড়ে যাবেনা তো?”
“রিলাক্স! কি হয়েছে আমায় বলো।”
“মৃ…ন্ম…য়!!”
“মৃন্ময় কি?”
প্রিয়া চুপ করে আছে।
ফাহাদ বললো,
“আমি বিয়েটা করবো না।”
প্রিয়ার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
“বিয়ে করবেনা মানে?”
“আমি বিয়েটা করবোনা! এটাই বলবো ভেবেছিলে?”
ফাহাদের কথার কিছুই বুঝতেই পারছেনা প্রিয়া। হ্যাঁচকা টান দিয়ে প্রিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে আসে। চোখে চোখ রেখে বলে,
“আমি সব জানি। মৃন্ময়ের সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। মৃন্ময় রিমির জন্য বিয়েটাও ভেঙ্গে দেয়। এরপর মৃন্ময় তোমাকে ভালোবেসে ফেলে। সব জেনেশুনেই আমি এতদূর এগিয়েছি।”
“তুমি সব জানতে? সব জেনেও বিয়ে করছো?”
“লিসেন প্রিয়া, আমি এতটা মহৎ নই যে নিজের ভালোবাসাকে ভাইয়ের হাতে তুলে দিবো। হ্যাঁ দিতাম হয়তো, যদি তুমি মৃন্ময়কে ভালোবাসতে। আমি এটাও জানতাম যে তুমি মৃন্ময়কে ভালোবাসতে না। শুধুমাত্র পরিবারের কথা ভেবে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলে। আস্তে আস্তে তুমি মৃন্ময়কে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলে তখনই মৃন্ময় তোমায় ঠকায়।”
“তুমি এসব কি করে জানো?”
“ছোট ভাইয়া বলেছে।”
“আর মৃন্ময় যে আমাকে ভালোবাসে এটা কিভাবে জেনেছো?”
“যেদিন মৃন্ময় প্রথম তোমাকে অফিসের এলাকায় দেখে। ঐদিন সন্ধ্যায় আমি আর মৃন্ময় রেষ্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলাম। তোমার পিছু যখন আমরা নিই তখন তোমায় পেছন থেকে দেখেই চিনেছিলাম। বিশ্বাস করো তখন এত কষ্ট হয়েছিল এটা ভেবে যে মৃন্ময় আর আমার ভালোবাসার মানুষটা একজনই। অনেকবার ভেবেছিলাম সরে যাবো। কিন্তু মন বললো এই ভুল করিস না। তখন আমি সব ইনরফরমেশন নিতে লাগলাম। এরপর যখন তোমার ভাইয়ার সাথে পরিচয় হয় ভাইয়াকে সব খুলে বললাম। পরে ভাইয়া সব বলেছে।”
“তাহলে আমার প্রথম অতীতের কথাও তুমি জানতে? এজন্যই আমার কথাগুলো তখন শুনোনি?”
“হ্যাঁ জানতাম। কিন্তু ঐগুলা ভাইয়া বলেনি। তোমার ডায়েরী পড়ে জেনেছি। প্রথম যেদিন তোমার ঘরে নানীর সাথে বসে গল্প করি সেদিনই টেবিলে তোমার ডায়েরী পাই এবং লুকিয়ে নিয়ে আসি বাসায়। বিশ্বাস করো এত কেঁদেছি ডায়েরীটা পড়ে যা বলে বোঝাতে পারবো না। আর ডায়েরীটা পড়ার পর থেকেই তোমার প্রতি ভালোবাসা কয়েকশ গুণ বেড়ে যায়। মনে মনে এটাই প্রতিজ্ঞা নেই, তোমাকে কিছুতেই হারাতে দিবো না। কি করে ছাড়বো বলো? ভালোবাসি তো খুব।”
প্রিয়া ফাহাদের বুকে মাথা রেখে নিঃশব্দে কাঁদে। সকল ভয় দূর হয়ে গেছে। আসলে সবাই এক হয়না। ভুল মানুষের মাঝেও একজন সঠিক মানুষ আসে আমাদের জীবনে। হয়তো আমরা চিনিনা নয়তো দেড়িতে চিনি। আর ফাহাদ সেই সঠিক মানুষটাই।
.
ফাহাদের সাথে প্রিয়ার বিয়েটা খুব সুন্দরভাবে মিটে যায়। ধুমধাম করে বিয়ে হয়। কোনোকিছুরই কমতি ছিল না বিয়ের আয়োজনে। সবাই যখন খাওয়া-দাওয়ায় ব্যস্ত তখন মৃন্ময় প্রিয়ার কাছে আসে।
“প্রকৃতি কতটা নিষ্ঠুর প্রতিশোধ নেয় তাইনা প্রিয়া?”
প্রিয়া মৃন্ময়ের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকায়।
মৃন্ময়ের চোখমুখ লাল হয়ে আছে। না পাওয়ার কষ্টটা ভেতরে পুড়ে ছাই করে দিচ্ছে। মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। কোনোরকমে বললো,
“শুধুমাত্র একটা ভুল আমার জীবনটাকে এলোমেলো করে দিলো। সেদিন যদি রিমির কথায় গলে ঐ ভুলটা না করতাম তাহলে তোমায় পেতাম। তুমি আমার বউ হতে। কিন্তু প্রকৃতি কি প্রতিশোধটাই নিলো দেখো! তোমাকে ভাইয়ের বউ বানিয়ে দিলো। অন্য কাউকে বিয়ে করলেও হয়তো সহ্য করতে পারতাম কিন্তু এই কষ্টটা অসহনীয় প্রিয়া। প্রকৃতির প্রতিশোধ খুব কঠিন খুব।”
“মিষ্টার মৃন্ময়, একটা সঠিক সিদ্ধান্ত জীবনকে যেমন সুন্দর করতে পারে তেমনি একটি ভুল সিদ্ধান্ত জীবনকে শেষও করতে পারে। তাছাড়া আমার যা বলার সেদিনই বলে দিয়েছি। আজ আর নতুন করে কিছু বলার নেই। আমার ভালোবাসার মানুষটা ফাহাদ’ই।”
“না পাওয়ার কষ্ট সহ্য করা যায়। কিন্তু পেয়েও হারানোর কষ্ট সহ্য করা যায়না।”
“আমি মনে করি, আল্লাহ্ যা করে ভালোর জন্যই করে।”
প্রিয়া আর কথা বাড়ায় না। সামনের দিকে এগিয়ে যায়। প্রিয়ার যাওয়ার দিকে একরাশ আফসোস নিয়ে তাকিয়ে থাকে মৃন্ময়।

প্রিয়াকে একটা চেয়ারে টেনে বসায় দুলাভাই।
“বসো বসো, নিজের বিয়েতে নিজেই খাবেনা?”
বলেই এক লোকমা বিরিয়ানি প্রিয়ার মুখে তুলে দিলো। আর ছোট ভাইয়া সেই মুহুর্তের ছবি তুলে নিলো। জন্মদিনে পঁচাতে কাজে লাগবে পরে….

চলবে……

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-২১

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২১
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
প্রিয়া অফিসে গিয়েই ফাহাদের কাছে যায়। কিন্তু ফাহাদ প্রিয়াকে দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। ফাহাদের এমন ব্যবহারে প্রিয়া অবাক হয়। চোখ পিটপিট করে ফাহাদের দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার দিকে তাকাচ্ছেন না কেন?”
ফাহাদ হাতের কলমটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলে,
“তুমি কি রাণী ভিক্টোরিয়া? তোমাকে এত দেখার কি আছে বুঝলাম না।”
“ফাহাইদ্দা!!!!”
প্রিয়া তেড়ে যায় ফাহাদের কাছে। দু’হাত দিয়ে গলা চেপে ধরে বলে,
“আমি কি? কি আমি বলেন?”
প্রিয়ার হাত সরিয়ে ফাহাদ কাঁশতে কাঁশতে বলে,
“বাবারে! বউ তো নয় যেন অগ্নিকন্যা!”
“জেনেশুনে আগুনে পা রাখলেন কেন শুনি?”
ফাহাদ প্রিয়াকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কোলে বসায়।
“আরে আরে কি করছেন?”
“চুপ! তোমার ভালোবাসার আগুণে পুড়তে চাই। তাই জেনেশুনেই ভালোবেসেছি।”
“পুড়ে যদি ছাই হয়ে যান?”
“কবি বলেছেন, ‘যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন!”
“ঢং।”
“আমি কি সবার সাথে ঢং করি?”
“আমি কি জানি?”
“কে জানে?”
“আপনি জানেন।”
“আচ্ছা শুনো।”
“কি?”
“একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“কি সারপ্রাইজ?”
“বলে দিলে কি সেটা সারপ্রাইজ থাকবে নাকি পাগলি!”
“তাও তো ঠিক।”
“হুম। চলো।”
“কোথায়?”
“সারপ্রাইজ দেখবে না? নাকি কোলেই বসে থাকবে? শুধু তুমি কোলে থাকলেই হবে? একটা বাবুও আনি চলো।”
“নির্লজ্জ।”
ফাহাদ হাসলো। প্রিয়ার চোখ ধরে বাহিরে নিয়ে যাচ্ছে।
“আরে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“চলো তো তুমি।”
এক জায়গায় স্থির দাঁড়িয়ে প্রিয়ার চোখ ছেড়ে দিলো। সবকিছুই কেমন যেন ঝাপসা লাগছে। চোখ কচলিয়ে সামনে তাকাতেই প্রিয়া হা হয়ে যায়। পৃথা এসেছে! পৃথা প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।
“তোর হানিমুন শেষ পৃথা?”
“সারা বছর কি হানিমুনই করে যাবো?”
“যাহ্ ফাজিল। তুই যে আজ থেকেই
অফিসে জয়েন করবি। বলিসনি তো।”
“তোকে কেন বলবো? তুই কি আমায় সব বলিস?”
“আমি আবার কি লুকালাম?”
“ডুবে ডুবে জল খাও আর এখন বলো কি লুকালাম?”
পৃথার ইঙ্গিত বুঝতে পারে প্রিয়া। কান চুলকে বলে,
“আসলে…মানে..কি বলতো আমি না তোর হানিমুনের সময় নষ্ট করতে চাইনি তো তাই ফোনে বলিনি। বাট আমি ভেবেছিলাম পরে তোকে বলবো পাক্কা।”
“হয়েছে হয়েছে তোকে আর বলতে হবেনা। স্যার আমায় সব বলেছে।”
“রাগ করেনা আমার পৃথা সোনা!”
“যা সর। আগে বল বিয়ে কবে করছিস?”
বিয়ের কথা শুনতেই প্রিয়ার মুখটা মলিন হয়ে যায়। যতদিন’না ফাহাদের বাবা মেনে নিবে ততদিন তো বিয়েও করতে পারবেনা। পৃথা হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
“এমন চুপসে গেলি কেন?”
“হ্যাঁ? খুব শিঘ্রয়ই করবো বিয়ে।”
কথার মাঝে প্যাঁচ কেটে ফাহাদ বলে,
“আমি বুড়ো হয়ে গেলে তখন বিয়ে করবে?”
“হ্যাঁ করবো। তখন আপনি হবেন আমার বুড়ো বর।”
সবাই প্রিয়ার কথায় হেসে ফেললো।
.
প্রতিদিনই ফাহাদ প্রিয়াকে বাড়িতে এগিয়ে দেয়। কিন্তু আজ আর্জেন্ট কাজ থাকায় অফিসের একটা গাড়িতে ওঠিয়ে দিলো। আজ অফিসও ছুটি হয়েছে দেড়ি করে। মাঝ রাস্তায় হুট করেই গাড়ি খারাপ হয়ে যায়। বিপদের ওপর বিপদ। হাত ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ১১:৩৯ বাজে। এতরাতে তো গাড়ি পাওয়াও মুশকিল। ড্রাইভার বাহির থেকে বলে,
“ম্যাম গাড়ির ইঞ্জিন খারাপ হয়ে গেছে।”
“তাহলে এখন কি হবে?”
“আপনি গাড়িতে বসেন। আমি দেখি কোনো গাড়ি পাই কি না।”
“ঠিক আছে।”
প্রিয়া ফাহাদকে ফোন দিলো। কিন্তু ফোন সুইচড অফ। অদ্ভুত তো! আজ হচ্ছে কি এসব। এভাবে গাড়িতে বসে থাকতেও বোরিং লাগছে। আবার ভয়ে বেরও হতে পারছেনা। বলা তো যায়না মানুষরূপী পশু আবার কখন ঝাঁপিয়ে পড়ে। এত সময় ধরেও কোনো গাড়ির হদিস পেলো না। কিছুক্ষণ পরই কিছু লোক হুড়মুড়িয়ে গাড়ির কাছে এলো। প্রিয়াকে টেনে-হিঁচড়ে গাড়ি থেকে বের করলো। কারোরই মুখ দেখতে পারছেনা। কারণ সবারই মুখ কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা। একজন লোক প্রিয়ার নাকের কাছে কিছু একটা চেপে ধরতেই প্রিয়া সেন্সলেস হয়ে যায়।
যখন জ্ঞান ফিরে তখন প্রিয়াকে একটা চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারপাশে তাকিয়ে দেখে ওরা রাস্তায় আছে। দুপাশেই বড় ঘন জঙ্গল। এখানে মেরে ফেলে রাখলেও কেউ টেরই পাবেনা। একদম মানবশূন্য জায়গা। প্রিয়া ফাঁকা ঢোক গিললো। তবে কি আজই জীবনের শেষ দিন! প্রিয়ার সামনে একজন চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। হাতে ছুড়ি। প্রিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
“ক…কে… আ…আপ…নি?”
লোকটি উত্তরে কিছু না বলে মুখের কালো কাপড়টা সরিয়ে ফেলে। প্রিয়া পুরো শকড হয়ে যায়।
“আপনি!!!!!”
লোকটা অট্টহাসিতে মেতে ওঠে। প্রিয়া ভয় পেয়ে যায়। লোকটি আর কেউ নয়। ফাহাদের বাবা।
“আঙ্কেল আপনি? আপনি এটা করেছেন? কিডন্যাপ করেছেন আমায়?”
“এছাড়া তো আমার আর কিছুই করার ছিলনা মামণী। সেদিন তো ভালোভাবেই তোমায় বোঝালাম। কিন্তু তুমি তো বুঝলেনা। তাই আরকি! বাধ্য হলাম।”
“ছিহ্ আঙ্কেল! এসব করে কি লাভ? ফাহাদের লাইফ থেকে আমায় সরানোর জন্য এতকিছু?”
“ঐ কে আছিস? একে নিয়ে যা তো। আর কাজটা জলদি সেড়ে ফেল।”
প্রিয়া এবার প্রচন্ড ভয় পেয়ে যায়। কি করার কথা বলছেন উনি। একটা লোক এসে প্রিয়ার হাত পায়ের বাঁধণ খুলে প্রিয়াকে টেনে নিয়ে যায় জঙ্গলের দিকে। প্রিয়া লোকটার সাথে ধস্তাধস্তি করেও পারছেনা। মনে মনে আল্লাহ্ কে ডেকে যাচ্ছে। আল্লাহ্ ছাড়া আর কেউই এখন বাঁচাতে পারবেনা। প্রিয়া আর্তনাদ করে বলে,
“কি ক্ষতি করেছি আমি আপনাদের? কেন আমার ক্ষতি করছেন?”
জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে প্রিয়াকে ছেড়ে দিলো। ঘুটঘুটে অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা। প্রিয়া ভাবে, এই সুযোগ। যেভাবেই হোক এই অন্ধকারেই পালাতে হবে। প্রিয়া দৌড় দিতে গেলে কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে পড়ে যায়। আর তখনই সাথে সাথে চারদিকে লাইট জ্বলে ওঠে। ঝাড়বাতিতে চারপাশ আলোকিত হয়ে ওঠেছে। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ফাহাদ প্রিয়াকে ধরে রেখেছে। ভূত দেখার মত ভয়ে চিৎকার দিয়ে ওঠে প্রিয়া। চারপাশ থেকে অনেকের স্বরে ভেসে আসে,
“হ্যাপি বার্থডে টু ইউ প্রিয়া। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ।”
প্রিয়া এবার চারপাশে তাকায়। ফাহাদের বাবা-মা, ফুল, প্রিয়ার মা, ভাইয়ারা, পৃথা,আকাশ সবাই উপস্থিত। প্রিয়া যেন কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। সবাই জোরে জোরে হেসে বললো,
“সারপ্রাইজ!!!”
প্রিয়া কেঁদে দিলো। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
“এটা কেমন সারপ্রাইজ? আর একটু হলেই তো আমি ভয়ে মরে যেতাম।”
ফাহাদ চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,
“তোমার ছোট ভাইয়ার কাছে শুনেছিলাম, তুমি নাকি সারপ্রাইজ পেতে পছন্দ করো? আর তাই তো তোমার জন্মদিনে এই ছোট্ট সারপ্রাইজ?”
“এটা সারপ্রাইজ? একটু হলেই তো মরতাম। তখন আমার জন্মদিন আর মৃত্যুবার্ষিকী একসাথেই পালন করতেন।”
“চুপ পাগলী। আমি ছিলাম তো।”
“হ্যাঁ। এজন্যই তো ভয় পেয়েছিলাম।”
“কিহ্?”
“চিল্লান ক্যান? ভয় তো আপনারাই দেখিয়েছেন তাহলে দোষ আপনার না?”
“এই আইডিয়া কিন্তু আমার না। ফুলের আইডিয়া এটা।”
চোখ কচলাতে কচলাতে প্রিয়া ফুলের দিকে তাকালো।
“কাজটা ভালো করোনি ননোদিনী। তোমার জন্মদিনে যদি তোমায় নাকানিচুবানি না খাইয়েছি তো আমিও তোমার ভাবী নই হুহ।”
ফুল প্রিয়াকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“স্যরি ভাবী। এই নাও তোমায় একটা কিসি দিয়ে দিলাম। তবুও রাগ করো না প্লিজ। আর আমি তো শুধু আইডিয়া দিয়েছিলাম। কাজে তো লাগিয়েছে বাবা আর ভাইয়া।”
বাবা কথাটা শুনে প্রিয়া থমকে যায়। ভয়ের কারণে এতক্ষণে খেয়ালই ছিলনা ফাহাদের বাবা এখানে। তাও আবার সবার সাথে মিলে প্রিয়াকে সারপ্রাইজ দিলো! হোক ভয়ংকর সারপ্রাইজ তবুও! প্রিয়া ফাহাদের বাবার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তিনি তাড়াহুড়োয় বললেন,
“আমার কোনো দোষ নেই মা। আমি প্রথমে ওদের প্রস্তাবে রাজি ছিলাম না। ওরা জোর করে আমাকে দিয়ে এটা করিয়েছে। বিশ্বাস করো আম্মু।”
সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রিয়া তাকে জড়িয়ে ধরে। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনিও চমকে যান। প্রিয়ার মাথায় তিনি হাত বুলিয়ে দিলেন। প্রিয়াকে কাঁদতে দেখে বললেন,
“বাবা হই না আমি? এবারের মত ক্ষমা করে দাও। আর কখনো ওদের কথা শুনবো না।”
কান্নারত অবস্থায় প্রিয়া বললো,
“আপনি যদি আমার প্রতিটা সারপ্রাইজে থাকেন তাহলে আমি হাজারও ভয়ংকর সারপ্রাইজ পেতে চাই বাবা। আমার বার্থডের বড় সারপ্রাইজ’ই তো আপনি বাবা। আমি ভাবতেও পারিনি এত সহজে আপনি আমায় মেনে নিবেন।”
“তোমার কথাগুলো সেদিন আমার মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমি সেদিনই বুঝেছিলাম এই মেয়ে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়। এটা তো সাক্ষাৎ মায়াবিনী। তোমাকে হারাতে দেওয়া যাবেনা। আমার ফাহাদ সঠিক মানুষকেই জীবনসঙ্গিনী হিসেবে বেছে নিয়েছে। জীবনে বেঁচে থাকার জন্য টাকা পয়সার প্রয়োজন আছে। কিন্তু মনের শান্তির জন্য ভালোবাসা প্রয়োজন। যেটা তোমার চোখে দেখেছিলাম। ঐদিন বাড়িতে গিয়েই আমি বলে দেই আমি রাজি। তারপর তুমি অফিসে থাকা-কালীন তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই। যেটা ফাহাদও জানতো না শুধু ফাহাদের মা ছাড়া। কাল যখন ফাহাদ ফুলের সাথে ডিসাইড করছিল কিভাবে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবে তখনই আমি ওদের সবটা জানাই। আর আমিও সারপ্রাইজ দিতে অংশগ্রহণ করি।”
প্রিয়ার চোখের পানি আজ বাঁধা মানছেনা। এটা সুখের অশ্রু। সত্যিই মানুষের সব সময়টা খারাপ যায়না। একটা সময় সুখ ঠিকই হাতছানি দেয়।
কেক কাটার জন্য এগিয়ে যেতেই দেখে মায়ের চোখে পানি। এই মানুষটার চোখে প্রিয়ার সব মুহুর্তেই পানি থাকবে। তবে প্রিয়া জানে মায়ের চোখের পানিও আনন্দের। প্রিয়া মায়ের কপালে একটা চুমু খেলো। কেক কাটার পর সবাই মিলে কিছুটা সময় কাটালো। তারপর যে যার মত শুয়ে পড়লো। ওরা যেই বাগানে গিয়েছিল তার পাশেই ফাহাদদের বাংলো বাড়ি। এখানেই সব আয়োজন করা হয়েছে। রাত দুইটা বাজে। বাংলো বাড়িতে সুন্দর একটা ফুলের বাগান আছে। তার পাশেই ছোট্ট একটা পুকুর। পুকুর আর ফুলের বাগানের মাঝামাঝি একটা দোলনা। ফাহাদ আর প্রিয়া পাশাপাশি দোলনায় বসে আছে। আজও আকাশে থালার মতন সম্পূর্ণ একটা চাঁদ ওঠেছে। সাথে তো অজস্র তারা আছেই। প্রিয়া আকাশের দিকে তাকিয়েই বললো,
“একটা কথা বলি?”
“বলো।”
“আপনার কোলে একটু মাথা রাখি?”
“না।”
প্রিয়া অবাক হয়ে ফাহাদের দিকে তাকালো।
“না কেন?”
“কারণ আমি তোমার ওপর রেগে আছি।”
“কি করেছি আমি?”
“এক. তুমি এখনো আমায় আপনি করে ডাকো। দুই.বার্থডেতে কোনো গিফ্ট পেলাম না।”
“প্রথমত আমার তুমি ডাকতে লজ্জা লাগে। তবে চেষ্টা করবো। আর দুই, বার্থডে তো আমার ছিল তাহলে আমি গিফ্ট দিবো কেন?”
“এত কষ্ট করে সবকিছুর আয়োজন করেছি। আমি তো একটা গিফ্ট পাই’ই।”
“আচ্ছা কি গিফ্ট চান?”
“আবার আপনি?”
“আচ্ছা কি গিফ্ট চাও?”
ফাহাদ প্রিয়ার মুখের কাছে নিজের মুখটা এগিয়ে নিয়ে বললো,
“চুমু।”
“ধুর।”
“ধুর না। আমি আমার গিফ্ট চাই।”
“আমি পারবোনা।”
“যাও তোমার পারতে হবেনা।”
ফাহাদ অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইলো। প্রিয়া ফাহাদের গালে হাত রেখে বললো,
“ঠিক আছে দিচ্ছি। তবে একটাই।”
গালের কাছে ঠোঁট এগিয়ে নিতেই ফাহাদ বললো,
“এই দাঁড়াও দাঁড়াও। গালে দিচ্ছো কেন?”
“তাহলে কোথায় দিবো?”
“ঠোঁটে।”
“না, না, না। আমি পারবোনা এটা।”
“পারতে হবে।”
“না।”
“হ্যাঁ।”
“না।”
“ওকে যাও। লাগবেনা।”
ফাহাদ মুখ গোমড়া করে বসে রইলো প্রিয়ার খুব আনইজি লাগছে। মুখটা মলিন করে বললো,
“দিচ্ছি।”
অনেক কষ্টে নিজের মধ্যে সব জড়তা কাটিয়ে নিজের ওষ্ঠদ্বয় ফাহাদের ওষ্ঠদ্বয়ের কাছে এগিয়ে নিতেই ফাহাদ প্রিয়ার ঠোঁটে আঙ্গুল রাখলো। প্রিয়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ হেসে বললো,
“আজ নয়। বাসররাতের জন্য সব তোলা রইলো। তোমার আনইজি লাগবে এমন কিছুই আমি চাইনা।”
প্রিয়ার চোখে পানি চিকচিক করছে।
মনে মনে বলছে,
“এই মানুষটা আমায় এত বুঝে কিভাবে।”
ফাহাদ প্রিয়ার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
“এখন থেকে শুধু তুমি করে ডেকো।”
প্রিয়া ফাহাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ বললো,
“কোলে মাথা রাখবে না?”
প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে ফাহাদের কোলে মাথা রাখে। পুরো বিস্তৃত আকাশটা এখন প্রিয়ার সামনে। আকাশ সমান সুখ যেন আল্লাহ্ প্রিয়ার আঁচলে ঢেলে দিয়েছে। ফাহাদ প্রিয়ার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে। ফাহাদের এক হাত প্রিয়া নিজের হাতের মুঠোয় নেয়। হাতে চুমু খেয়ে বলে,
“আমার সেই অতীতের পর আমি কাউকেই ভালোবাসতে পারিনি। চেষ্টাও করিনি কখনো। পরীক্ষা শেষে জব নিয়েছিলাম আর পাশাপাশি অনার্সে ভর্তি হই। সাত মাস চাকরী করার পর সবাই মিলে ভালো ছেলে দেখে আপুর বিয়ে দেই। আল্লাহ্ এর রহমতে আমার আপু অনেক সুখী হয়। আমার দুলাভাই অনেক ভালো একটা মানুষ। দুই ভাইয়া-ভাবিও তখন আমাদের সাথে থাকতো। সবার জীবনেই সুখ ফিরে আসে। শুধু সুখের দেখা মেলেনি আমার। অনেক প্রপোজাল পেয়েছিলাম কিন্তু আমার মন কাউকেই সায় দেয়নি। আমার শুধু মনে হতো এরা কেউই আমার জন্য নয়। এত অবিশ্বাসের মাঝেও আমার মন আপনার ভালোবাসার ডাকে সায় দিলো। আমি যতবার আপনার থেকে দূরে সরে যেতে চেয়েছি আমার মন ততবারই আপনার কাছে গিয়েছে। বারবার বলেছে একে বিশ্বাস করা যায়। সত্যি বলছি, না চাইতেও খুব বেশিই ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”
“বিশ্বাসের সম্পূর্ণ মর্যাদা রাখবো আমি। এতবেশি ভালোবাসবো যে, অতীতের কথা মনে পড়লে তুমি হাসবে।”
“একটা গান শোনাবেন?”
“আগে তুমি করে বলো।”
“একটা গান শোনাও।”
ফাহাদ হেসে গান ধরলো।
“অনেক সাধনার পরে আমি পেলাম তোমার মন,

পেলাম খুঁজে এ ভূবনে আমার আপনজন।
তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয়া আমাকে,,
আমি ভালোবাসি ভালোবাসি ভালোবাসি তোমাকে।”
“এই গানে তো প্রিয় বলে, তুমি প্রিয়া বললে কেন?”
“গানটা তো আমি আমার প্রিয়াকে ডেডিকেটেড করেছি তাই প্রিয়া বলেছি। গানের প্রত্যেকটা কথার সাথেই আমার মনের কথা একদম মিল আছে।”
“পাগল।”
“হুম। তোমার পাগল।”
.
.
অবেশেষে প্রিয়া আর ফাহাদের বিয়ের দিন এসে পড়ে। অনেক সাধনার পর ফাহাদ আর প্রিয়া ভালোবাসার মানুষকে পেতে চলেছে। আজ ওদের গায়ে হলুদ। গাঢ় হলুদ শাড়ি পড়েছে প্রিয়া। সাথে ফুলের গয়না। ফুলের ঘ্রাণে প্রিয়ার শরীর মো মো করছে। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরুর আগেই ফাহাদ ফোন দেয়। প্রিয়ার বুকটা ধক করে ওঠে। আগের গায়ে হলুদের কথা মনে পড়ে যায়। ফাহাদও কি মৃন্ময়ের মত একই কাজ করবে নাকি। অনেক চিন্তাভাবনার পর প্রিয়া ফোন রিসিভড করে। ওপাশ থেকে ফাহাদ বলে,
“ও বউ, বউ তুমি ফোন ধরো না কেন?”
ফাহাদের কথার ভঙ্গিতে প্রিয়ার জানে পানি ফিরে আসে।
“একটু পর গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শুরু হবে। আর আপনি এখন ফোন দিয়ে ঢং শুরু করেছেন?”
“আমার বউয়ের গায়ে হলুদ। আমি একশোবার ফোন দিবো। আর আমি কি তোমার পর? এখনো আপনি আপনি করে বলো কেন?
“কেন ফোন করেছো?”
“ইশ! তুমি করে বললে কি মিষ্টি লাগে।”
“এত মিষ্টি ভালো না। ডায়াবেটিস হবে।”
“হলে তোমার জামাইর হবে। আমার কি?”
“উফফ আল্লাহ্! তোমার কি তাই না? তাই তো তোমার কি! বিয়ে তো আমি পাশের বাড়ির কুদ্দুসকে করবো।”
“আমি থাকতে কুদ্দুস কেন বউ?”
“কেন ফোন দিছো বলবা নাকি রেখে দিবো?”
“রাগ করেনা বউটা আমার। কাল তো বিয়ে হয়েই যাবে। তাই বিয়ের আগে দুষ্টুমিষ্টি প্রেম করে নিচ্ছি।”
“হয়েছে প্রেম করা?”
“না। ভিডিও কলে আসো। তোমায় দেখবো।”
“পারবোনা এখন।”
“আমার বউ গায়ে হলুদে কেমন করে সেজেছে আমি দেখবো না? এত্ত মানুষ দেখবে আর আমি দেখলেই দোষ? তাড়াতাড়ি ইমোতে আসো।”
“ইমোতে আসবো কেন? আমার স্বামী কি বিদেশ থাকে নাকি?”
“ইমোতে আসার সাথে স্বামী বিদেশ থাকার কি সম্পর্ক?”
“আমার ওমোনি লাগে ইমোতে কথা বললে। সবাই বলে ইমোর আরেক নাম নাকি স্বামী বিদেশ এপস!”
প্রিয়ার কথা শুনে ফাহাদ হো হো করে হেসে দিলো।
“আমার বউ দেখি একটা বাচ্চা। সমস্যা নেই আদর-ভালোবাসায় বড় হয়ে যাবে। এখন তাহলে হোয়াটসএপে আসো।”
“আসতেই হবে?”
“হু। আমার পরীটাকে দেখবো।”
“ঠিক আছে।”
প্রিয়া ডাটা কানেক্ট করে হোয়াটসএপে যায়। ফাহাদ ভিডিও কল দেয়। প্রিয়া তো লজ্জায় তাকাতেই পারছেনা। আর ঐদিকে ফাহাদ চোখ সরাতেই পারছেনা। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে প্রিয়ার দিকে…

চলবে……

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-২০

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_২০
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
প্রিয়ার অঝোর চোখের পানি শিহাবের হৃদয় স্পর্শ করতে পারছেনা। শিহাব কিছুই ক্লিয়ার করে বলছেনা। সবকিছুই রাহার সাথে শেয়ার করে ফোন দিয়ে। সব শুনে রাহা বেশ রেগে যায়। এমন করার তো কোনো মানে নেই। কিছু তো একটা ক্লিয়ার করে বলতে পারে। প্রিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে চলেছে। ফোনের ওপাশ থেকে রাহা বললো,
“একটা সময় আমরা যখন কষ্টে কাঁদতাম তখন তুই আমাদের বুঝাতি। হাসাতি। আর আজ এভাবে ভেঙ্গে পড়ছিস তুই? তুই না অনেক শক্ত মনের মেয়ে? এভাবে কাঁদিস না প্লিজ। আমারও এমন একটা সময় যে, তোর কাছে গিয়ে যে তোকে বুকে জড়িয়ে নিবো সেটাও পারছিনা। আমার শ্বাশুরী খুব অসুস্থ।”
প্রিয়া কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিনা রাহা।”
“শোন, তুই আজ ফোন দিয়ে ক্লিয়ারলি জিজ্ঞেস করবি, সে কি চায়। হয় সারাজীবনের মত একসাথে থাকবে নয়তো ছেড়ে দিবে। এভাবে ঝুলিয়ে রাখার তো কোনো মানে হয়না।”
“হুম।”
রাহা আরো অনেক কিছু বুঝালো। প্রিয়াও সিদ্ধান্ত নিলো যা হবার আজ হবেই। ফোনের ওপর ফোন দিতে থাকে কিন্তু রিসিভড করেনা শিহাব। সাথে ম্যাসেজও দেয়,
“প্লিজ শিহাব ফোনটা ধরো। তোমার সাথে ইম্পোর্ট্যান্ট কথা আছে।”
ম্যাসেজ সীন করে কিন্তু রিপলাই করেনা। প্রিয়া আরো ম্যাসেজ দেয় সাথে ফোনও দিতে থাকে। প্রিয়া ভেবে পায়না, যে ছেলে প্রিয়ার একটা ফোনকলের আশায় চাতকপাখির মত বসে থাকতো সেই ছেলে এখন পুরো দমে প্রিয়াকে ইগনোর করছে। তবে কি শিহাবের ভালোবাসা পুরোটাই নাটক ছিল। ভাবতে পারছেনা প্রিয়া। ওপাশ থেকে শিহাবের রিপলে আসে,
“আমি অফিসে ব্যস্ত আছি।”
“শুধু একটাবার কথা বলবো।”
অবশেষে শিহাব কল ধরে।
“তুমি এমন কেন করছো শিহাব? আমায় নিয়ে যেই সমস্যা সেটা তো আমি সমাধান করেই দিলাম। আমি পড়বোনা। তাহলে আর কিসের সমস্যা বলো? কেন ইগনোর করছো আমায়?”
“আমি বুঝতেছিনা আমি কি করবো।”
“এরকম ভাবলেশহীন উত্তর দিয়ো না শিহাব। তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না। প্লিজ আমায় ছেড়ে যেয়ো না। কেন বুঝো না আমি তোমায় কতটা ভালোবাসি।”
কথাগুলো বলতে বলতেই প্রিয়া কেঁদে দেয়।
“কান্না করো না প্লিজ। আমি দেখি কি করতে পারি।”
“তোমার কথা সব ছন্নছাড়া। তুমি সত্যিই আমায় ভালোবাসো তো? নাকি সবটা নাটক ছিলো?”
“ভালোবাসি আমি।”
“কেমন ভালোবাসা এটা? যেখানে দিনের পর দিন তুমি আমায় কষ্ট দিচ্ছো। ইগনোর করছো।”
“কি করবো আমি জানিনা।”
“সেই এক কথা। ভালোবাসি অনেক শিহাব।”
“আমি পরে ফোন দিচ্ছি। বস আসতেছে।”
শিহাব ফোনটা রেখে দিলো। প্রিয়া ফ্লোরে বসেই জোরে জোরে কান্না শুরু করলো। বাড়িতে কেউ নেই। লামিয়া আর মা ওর নানির বাসায় গেছে। বাবা অফিসে। পুরো বাড়িতে প্রিয়া একা। কষ্টে দম আটকে আসছে প্রিয়ার। আবারও ডায়াল করে শিহাবের নাম্বারে। এবার কল ওয়েটিং। কষ্টে বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিলো। শিহাবের বন্ধুকে ফোন দিয়েও কিছুই জানতে পারেনা প্রিয়া। অসহায় হয়ে পড়ে। শেষমেশ শিহাবকে ম্যাসেজ করে,
“অনেক হয়েছে এই অবহেলা। আজ ক্লিয়ার করে একটা কথা বলো তুমি কি চাও? আমাকে কি তুমি সত্যিই ভালোবাসো? ভালোবাসলে ভালোবেসে হাতটা ধরো নয়তো ছেড়ে দাও। তবুও এভাবে কষ্ট দিয়ো না প্লিজ। আমাকে যদি তোমার আর ভালো না লাগে তাহলে সেটা সোজাসুজি বলে দাও। বিশ্বাস করো একটুও কষ্ট পাবো না। যতটা কষ্ট পাচ্ছি তোমার এহেন আচরণে।”
ম্যাসেজটা সেন্ড করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে চোখের পানি ঝড়ায়। প্রিয়ার বিশ্বাস শিহাব প্রিয়াকে ভালোবাসে, চায়। শিহাব নিশ্চয়ই প্রিয়াকে ছেড়ে দিবেনা। ফোনের ম্যাসেজ টোন বেজে ওঠে। শিহাবের ম্যাসেজ। প্রিয়া তাড়াতাড়ি ম্যাসেজটা ওপেন করে। ম্যাসেজ দেখে প্রিয়ার সব বিশ্বাস মুহুর্তেই ভেঙ্গে যায়। বিশ্বাসই করতে পারছেনা। ম্যাসেজটা ছিল,
“আমায় তুমি ক্ষমা করে দিয়ো প্রিয়া। আমার কিছুই করার নেই। আমি আমার বাবা-মাকে কষ্ট দিতে পারবোনা। আমি নিরুপায়। ভালো থেকো।”
প্রিয়া সাথে সাথে শিহাবকে ফোন দেয়। নাম্বার ব্যস্ত। যতবার ফোন দেয় একই কথা। তার মানে নাম্বারটা ব্লাকলিস্টে ফেলেছে। ম্যাসেজ টাইপ করার মতও শক্তি পাচ্ছেনা প্রিয়া। ফেসবুকে লগিন করে দেখে সব আইডি ব্লক করে দিয়েছে। এমনকি হোয়াটসএপ এবং ইমো থেকেও। সকল প্রকার যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে শিহাব। কি করে করতে পারলো এটা শিহাব। প্রিয়া এবার চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। এভাবে হারিয়ে যাবে শিহাব, এভাবে ঠকাতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছেনা প্রিয়ার। ঐসময়েই প্রিয়ার মা ফিরে আসে। প্রিয়াকে এভাবে কাঁদতে দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান। দৌঁড়ে মেয়ের কাছে এসে জড়িয়ে ধরে।
“কি হয়েছে মা? এভাবে কাঁদছিস কেন?”
প্রিয়া কান্নার জন্য কথা বলতে পারছেনা। কান্নার শব্দে পাশের ফ্লাট থেকেও লোকজন এসে পড়েছে। মা কোনোরকমে তাদের বুঝ দিলো অন্য কথা বলে। তারা চলে যেতেই মা বললো,
“শিহাবের সাথে কিছু হয়েছে?”
কান্নারত অবস্থায় বললো,
“শিহাব আমায় ঠকিয়েছে মা। শিহাব আমায় ঠকিয়েছে। ও আমায় বিয়ে করবেনা। ওর বাবা-মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে।”
প্রিয়ার মা স্তব্ধ হয়ে যায়। যেই ছেলে এত ভালোবাসতো সে কি করে এটা করতে পারে। তাহলে কি সবটাই নাটক ছিল। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তিনি কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারেনি। মেয়ের সাথে সাথে কান্না করেন। মেয়েকে বুঝানোর মত মানসিক অবস্থাও তার নেই। এদিকে প্রিয়ার প্রায় পাগল পাগল অবস্থা। কাঁদতে কাঁদতে অবস্থা খুবই খারাপ। প্রিয়াকে একদমই সামলানো যাচ্ছেনা। ঐমুহুর্তেই লামিয়াকে ফোন দেয় মা। তখনই নানু, খালামনিরা আর লামিয়া ছুটে আসে। প্রিয়ার অবস্থা দেখে কেউই চোখের পানি আটকাতে পারেনি। এভাবে কেউ ভালোবাসতে পারে সেটা প্রিয়াকে না দেখলে কেউ জানতোই না। প্রিয়ার কান্নায় মনে হচ্ছে আকাশ-পাতাল এক হয়ে যাচ্ছে।
সেরাতে আর প্রিয়াকে জোর করেও খাওয়াতে পারেনি কেউ। কি করে খাবে প্রিয়া, ভালোবাসার মানুষটার কাছে যে খুব জঘন্যভাবে ঠকেছে। শিহাব ঠকিয়েছে এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা প্রিয়া। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদছে । পাশেই নানু আর লামিয়া আপু বসে নিরবে কাঁদছে। প্রিয়া প্রচুর হার্ট হয়েছে। কখন কি পাগলামি করে বসে বলা যায়না। হয়তো নিজেরই কোনো ক্ষতি করে ফেলবে। তাই কেউ প্রিয়াকে একা ছাড়েনি। সেদিনই প্রিয়ার বাবা সব জানতে পারেন। কিন্তু আদরের মেয়েকে কিছুই বলেনি। সারারাত ঐদিন কেউই ঘুমায়নি।
.
দিন যায় দিন আসে। প্রিয়ার খারাপ সময়গুলো আর যায়না। প্রিয়ার সবেচেয়ে বড় সাপোর্ট হয়ে দাঁড়ায় ওর মা। তারপর পরিবার। এই সময়টাতে মানসিক সাপোর্ট সবচেয়ে বেশিই দরকার। ওর ফ্রেন্ডসরাও ওকে প্রচুর সাপোর্ট করে। কিন্তু যে যাই বলুক না কেন, প্রিয়ার অবাধ্য মন সেটা মানতে নারাজ। শিহাবের শূন্যতা কুঁড়েকুঁড়ে খায় প্রিয়া। সবার এত বোঝানো কথাও প্রিয়ার মনকে ধরে রাখতে পারেনা। এদিকে মা প্রতিদিনই কাঁদে। চোখের সামনে মেয়ের এমন অবস্থা সহ্য করতে পারবেনা কোনো মা’ই। কারো সাথেই কথা বলেনা প্রিয়া। নামাজে বসে শুধু চোখের পানিই ফেলে। এত কষ্ট কেন ভালোবাসায়। কেন এত বিরহ! টেষ্ট পরীক্ষাও চলে আসে। এমন মানসিক অবস্থায় পরীক্ষা দেওয়া কঠিন। কোনো প্রিপারেশনই নেই। কিন্তু পরিবারের দিকে তাকিয়ে পরীক্ষা দেয়। নিজের কষ্টগুলোকে লুকিয়ে সবার সাথেই হেসে কথা বলার চেষ্টা করে। বুকের ভেতর পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও মুখে মিথ্যা হাসি ফোঁটাতে ভুলেনি প্রিয়া।
প্রিয়া ভাবে, নিজের কষ্টের জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। মাকে কাঁদাচ্ছে। ঠকিয়েছে শিহাব অথচ কষ্ট পাচ্ছে প্রিয়া আর ওর পরিবার! প্রিয়া সিদ্ধান্ত নিলো যত কষ্টই হোক আর কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবেনা। তাই বুকের কষ্টগুলো বুকে রেখেই সবার সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। নিঁখুত ভালো থাকার অভিনয় কেউ ধরতেও পারেনা। কিন্তু রাত হলেই কষ্টগুলো আর আটকে থাকতে চাইতো না। চোখের পানি হয়ে বেড়িয়ে আসতো। এমন কোনো রাত নেই যে রাতে ও কাঁদেনি।
.
.
আর মাত্র একমাস বাকি আছে প্রিয়ার এইচ.এস.সি পরীক্ষার। মাঝখানে অনেকগুলো দিন অতিবাহিত হয়ে যায় শিহাবের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে। এক ঘন্টা যে মানুষটার সাথে কথা না বলে থাকতে পারতো না সেই মানুষটার সাথে এখন কথা না বলেই সময় কেটে যায়। প্রিয়ার ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। মানুষ বদলাতে সত্যিই সময় লাগেনা। গিরগিটিও মানুষের কাছে নিঃসন্দেহে হার মানবে। শিহাবের বন্ধু খবর দিলো মার্চের ১৫ তারিখে শিহাবের বিয়ে। শিহাবের বিয়ে শুনে প্রিয়ার বুক মোচর দিয়ে ওঠলো। মানতেই পারছেনা কথাটা। আজ ১১ তারিখ। তাহলে আর চারদিন বাকি ওর বিয়ের! অসহনীয় ব্যথা হচ্ছে বুকে। আবার পাগলামি শুরু হয়ে যায়। যেই স্বপ্নগুলো প্রিয়াকে দেখাতো সেই স্বপ্নগুলো অন্য কাউকে নিয়ে পূরণ করবে! আবার সেই আগের মত কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। এবারের কষ্টটা আরো বেশি। নিজের ভালোবাসার মানুষকে অন্য কারো সাথে কেউই সহ্য করতে পারেনা। সেখানে প্রিয়া পাগলের মত ভালোবাসে শিহাবকে। প্রিয়ার কান্না মা কিছুতেই সহ্য করতে পারেনা। তিনি আর্তনাদ করে কাঁদতে কাঁদতে বলেন,
“আল্লাহ্ আমার মেয়েটারে আর কত কষ্ট দিবা? ঐ ছেলে তো দিব্যি সুখে আছে। তাহলে আমার মেয়েটারে ক্যান এভাবে কষ্ট দিচ্ছো। ওরে কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা দাও আল্লাহ্। ওর সব কষ্ট তুমি আমায় দাও। তবুও আমার মেয়েটাকে আর কাঁদাইয়ো না।”
.
চৌদ্দ তারিখ গায়ে হলুদের দিন শিহাব প্রিয়াকে ফোন দেয়।
“হ্যালো।”
“ভালো আছেন?”
শিহাবের মুখে আপনি ডাক শুনে তাচ্ছিল্যর হাসি হাসলো প্রিয়া। উত্তরে বললো,
“যেমন রেখেছো।”
“আমি জানি তোমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু কি করতাম বলো? আমার যে কিছুই করার নেই।”
“আজ তোমার গায়ে হলুদ না?”
“হুম।”
“খুব আনন্দ হচ্ছে তাইনা?”
“আমি জানি আমার কেমন লাগছে।”
“মিথ্যা নাটক আর করো না প্লিজ। তুমি অনেক খুশি আমি জানি, অথচ আমার সামনে এমন ভাব ধরছো যে তুমি আমাকেই ভালোবাসো। কেন ঠকালে আমায় শিহাব? কি দোষ ছিল আমার?”
“আমি তোমায় ঠকাইনি। আমি পরিস্থিতির স্বীকার।”
“হাহ্! নিজের দোষগুলো আর পরিস্থিতির ওপর চাপিয়ে দিয়ো না। তোমার বউ নিশ্চয়ই অনেক সুন্দর?”
“জানিনা।”
“বলো না। আমিই তো।”
প্রিয়া নিঃশব্দে কাঁদছে। শিহাব সেটা বুঝতে পারছে। প্রিয়ার কথা গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বললো,
“তোমার অনেক কিছুই করার ছিল শিহাব। তুমি করোনি কারণ তুমি তো আমায় কখনো ভালোইবাসিনি। এভাবে না ঠকালেও হয়তো পারতে। যেই স্বপ্নগুলো তুমি আমায় দেখিয়েছিলে সেই স্বপ্নগুলো কাল থেকে অন্য একটা মেয়ের সাথে পূরণ করবে। যেখানে আমার বউ সাজার কথা ছিল সেখানে অন্য একটা মেয়ে বউ সাজবে। যেই রাতটাকে ঘিরে আমাদের দুজনের স্বপ্ন ছিল সেই রাতের স্বপ্ন অন্য একটা মেয়ে পূরণ করবে। তোমার যেই হাতের স্পর্শ আমার পাওয়ার কথা ছিল সেই স্পর্শে অন্য মেয়ে মোহিত হবে। তবুও বলবো তুমি সুখী হও। আল্লাহ্ তোমাকে অনেক সুখী করুক। ভালো থেকো আমার ভালোবাসা।”
প্রিয়া ফোন কেঁটে বন্ধ করে দেয়। শব্দ করে কাঁদতে থাকে। আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছেনা। একদম না। যেই জীবনে শিহাব নেই সেই জীবন রেখে কি হবে!
মাথার ওপর সিলিং ফ্যানটা ঘুরছে। একবার বিবেকে তাড়া দেয়, শিহাবের জন্য নিজের পরিবারকে কষ্ট দিবে! আবেগে বলে, বেঁচে থাকতে শিহাব অন্য কারো হবে এটা কিছুতেই মানতে পারবেনা। আবেগের তাড়নায় আর কষ্টে মায়ের একটা কাপড় নিয়ে ফ্যানের সাথে বাঁধে। গলায় কাপড় পেঁচিয়ে পায়ের নিচ থেকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে টুলটা সরিয়ে দেয়। তখনই রুমে প্রবেশ করে প্রিয়ার বাবা আর লামিয়া। নিজের চোখে মেয়েকে এভাবে ঝুলে থাকতে দেখে তার শ্বাস রুদ্ধ হয়ে যায়। লামিয়া সাথে সাথে চিৎকার দেয়। প্রিয়ার মা, খালামনি, নানুরা দৌঁড়ে আসে।…..
.
প্রিয়া অতীত থেকে ফিরে আসে।
সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায়। অতীতের কষ্ট এখন প্রিয়ার গলা চেপে ধরেছে। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। একটু পানি খাওয়া দরকার। ঘরে ওয়াটার বোতলে পানি নেই। তাই ভেতরের রুমে যেতে হবে। দরজা খুলতেই দেখে ফাহাদ দরজার পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ভোর চারটা বাজে। একটুপরই মা রান্না করতে উঠবে। আর উনি এখানে ঘুমাচ্ছে।
“এইযে শুনছেন!”
এক ডাকেই ফাহাদ ধড়ফড়িয়ে ওঠে। প্রিয়ার দুই বাহু ঝাঁকিয়ে বলে,
“এই তুমি এভাবে চলে আসলে কেন? কি হয়েছে বলো? আমি কত ভয় পেয়েছি জানো?”
প্রিয়া ফাহাদের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ধূসর বাদামি চোখগুলো ভয়ের জানান দিচ্ছে। আচ্ছা সব ছেলেই কি এক? ফাহাদও কি কখনো ঠকাতে পারে? ভয় পেয়ে কি নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছি? সত্যিই কি ভালোবাসা বলতে কিছু আছে? প্রিয়াকে আলতো করে ধাক্কা দেয় ফাহাদ।
“কি ভাবছো?”
“কিছুনা। বাড়ি যাবেন না?”
“তাড়িয়ে দিচ্ছো?”
“মোটেও না।”
“বিয়েটা শুধু আগে করি তারপর দেখিয়ো পুরো শ্বশুরবাড়িটা কিভাবে দখল করে নিই হুহ। তখন তুমি তোমার শ্বশুরবাড়ি থাকবে আর আমি আমার শ্বশুরবাড়ি।”
ফাহাদের কথা শুনে প্রিয়া হেসে দেয়।
“ইশ! এভাবে হেসো না গো। বুকে লাগে আমার।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলেন এগিয়ে দেই।”
মেইন দরজা পর্যন্ত যেতেই ফাহাদ থেমে যায়।
“আর যেতে হবেনা। রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”
“হুম।”
ফাহাদ দু পা এগিয়ে আবার ফিরে আসে।
“কিছু বলবেন?”
“একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
“শিওর।”
“অতীতের মানুষটাকে এখনো ভালোবাসো?”
“না।”
“তবে কি ঘৃণা করো?”
“তাও না।”
“তাহলে?”
“তাকে আমি ভালোওবাসিনা। ঘৃণাও করিনা। তার প্রতি আমার সব অনুভূতি ফিকে হয়ে গিয়েছে।”
“তার ওপর রাগ হয়না?”
“না।”
“কেন? আমি হলে তো মেরেই ফেলতাম।”
“রাগ করবো কেন? আর আমি মারারই বা কে? যার যার শাস্তি সে সে পাবে। রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলতে একটা কথা আছে জানেন তো?”
“হুম।”
“এটাই যথেষ্ট আমার জন্য।”
ফাহাদ প্রিয়ার গালে হাত রেখে বললো,
“অতীতগুলোকে আর হাতছানি দিতে দিয়ো না। অনেক বেশিই ভালোবাসি তোমাকে।”

চলবে……

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-১৯

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
ফাহাদ প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে বেমালুম ঘুমাচ্ছে। প্রিয়া হেসে দিলো। কাকে শোনাচ্ছে তার অতীতের কথা। প্রিয়া ফাহাদের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডাকলো,
“শুনছেন?”
ফাহাদের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেলো না। প্রিয়া আবার ডাকলো,
“আপনি ঘুমাচ্ছেন?”
ফাহাদ এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“না, না তুমি বলো। আমি শুনছি।”
“আপনার ঘুম পেয়েছে। আপনি বাড়ি যান।”
“না। আমি তোমার কাছেই থাকবো। তুমি বলো।”
“খুব বেশি ঘুম পেলে ভাইয়ার রুমে গিয়ে ঘুমান।”
ফাহাদ এবারও কোনো সাড়াশব্দ করলো না। আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়া আর ডাকলো না। ঘুমাক। আজ এমনিতেও প্রিয়ার আর ঘুম আসবেনা। পুরনো ক্ষত যে জেগে ওঠেছে। কিন্তু যাকে শোনানোর জন্য এত আয়োজন সেই তো গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আচ্ছা ফাহাদ কেন ওর অতীত শুনতে চায় না? কেন সিরিয়াস হয়না? এর উত্তর ভেবে পায়না প্রিয়া। ছাদের রেলিং-এর কাছে লম্বা সরু একটা বেঞ্চ পাতা আছে। ওটার ওপরই প্রিয়া বসে আছে। আর ফাহাদ প্রিয়ার কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। প্রিয়া রেলিং-এ মাথা ঠেকিয়ে আকাশ পানে তাকায়। বুকটা মোচর দিয়ে ওঠে। বিশাল চাঁদ আকাশে আর অজস্র তারা। কতই না স্বপ্ন বুনেছিল শিহাবের সাথে আকাশের চাঁদ আর তারা দেখতে দেখতে। কত ভালোবাসা ছিল একটা সময় দুজনের মধ্যে। সব শেষ হয়ে গেলো।

আকাশের দিকে তাকিয়েই প্রিয়া আবার অতীতে ফিরে যায়।

শিহাবের ওমন পাগলামিকে বেশিদিন এড়িয়ে যেতে পারেনি প্রিয়া। সারাক্ষণ পিছে ঘুরঘুর করা, ওর ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও প্রিয়ার জন্য কলেজের সামনে অপেক্ষা করা এসব খুব ভাবাতো প্রিয়াকে। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। কিন্তু হয়েছিল। এমনটাই হয়েছিল।
রাত থেকে প্রিয়ার খুব জ্বর। গা পুড়ে যাচ্ছিলো জ্বরে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়ে ওষুধও আনে। পরেরদিন আর জ্বর নিয়ে কলেজে যেতে দেয়নি প্রিয়ার মা। সেদিন সারাদিন ছটফট করেছে শিহাব। প্রিয়াকে একটা নজর দেখার জন্য উন্মাদ হয়ে যায়। কারো কাছেই প্রিয়ার কোনো ইনরফরমেশন পায়না। প্রিয়ার বাড়ির এড্রেসও জানেনা শিহাব। পরক্ষণেই শিহাবের মনে হলো সুমার কাছে তো প্রিয়ার নাম্বার আছে। ওর নাম্বারটা নিলেই তো পারে। শিহাব তাড়াতাড়ি সুমাকে কল দেয়।
“হ্যালো শিহাব ভাইয়া।”
“একটা হেল্প করবে?”
“কি?”
“প্রিয়ার নাম্বারটা দিবে প্লিজ?”
“ইশ! ভাইয়া রিহান আমার ফোন থেকে প্রিয়া আপুর নাম্বার ডিলিট করে দিয়েছে। স্যরি ভাইয়া।”
শিহাবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ফোন কেটে দিয়ে চুপ করে বসে রইলো। রিহানের ওপর রাগ হতে লাগলো।
“রিহান! রিহান! হ্যাঁ রিহানের থেকেই তো প্রিয়ার বাড়ির এড্রেসটা নিতে পারি।”
যেই ভাবা সেই কাজ। রিহানের থেকে এড্রেস আর ফোন নাম্বার নিয়েই বাইক নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে।
বাহিরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। সকাল থেকেই বৃষ্টি হচ্ছে। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে এই জ্বর নিয়েও বৃষ্টিতে ভেজার জন্য মায়ের কাছে বায়না ধরেছে প্রিয়া। মা তো এক কথায় বারণ করে দিয়েছে। শুধু তাই নয়। বাহির থেকে তালা দিয়ে রেখেছে। এই মেয়েকে দিয়ে একদম বিশ্বাস নেই। কখন জানি ফুড়ুৎ করে ছাদে চলে যাবে। মন খারাপ করে প্রিয়া বিছানায় শুয়ে রইলো। জ্বর তো অনেকটাই কমে গিয়েছে। একটু ভিজলে এমন কি ক্ষতি হবে? ঐদিকে বৃষ্টির প্রতিটা ফোঁটা প্রিয়াকে আহ্বান করছে। আর পারছেনা প্রিয়া। বারান্দার দরজা খুলে বারান্দায় চলে গেলো। বৃষ্টির পানি এসে বারান্দার ফ্লোর ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। বাহিরে প্রচন্ড বাতাসও বইছে। বারান্দার গ্রিল ধরে চোখ বন্ধ করে বৃষ্টির স্বাদ নিচ্ছে। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ে প্রিয়ার চোখমুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। আচমকা চোখ খুলে তাকাতেই প্রিয়া ভয় পেয়ে যায়। রাতের বেলায় বাড়ির সামনে ভূত আসলো নাকি! প্রিয়া ভালো করে তাকিয়ে দেখলো নিচে শিহাব দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে আর কি যেন বলছে। কথা শোনা যাচ্ছেনা তবে শিহাবকে ল্যামপোস্টের আলোয় দেখা যাচ্ছে। প্রিয়া মনে মনে ভাবে,
“এই ছেলেকি পাগল নাকি! আমার বাড়ির সামনে কি করছে? তাও আবার বৃষ্টির মধ্যে।”
শিহাব হাতের ইশারায় কি যেন বুঝাচ্ছে। প্রিয়া ঠিক বুঝতে পারলো না। ভালো করে হাতের ইশারা লক্ষ করতেই বুঝতে পারলো শিহাব ফোনের কথা বলছে। প্রিয়া তৎক্ষণাৎ রুমে এসে ফোন খুঁজতে লাগলো।
“কাজের সময় কোথায় যে যায় ফোন।”
সারা বিছানা খোঁজার পর ফোন পেলো। ৩৮টা মিসডকল। তাও আননোন নাম্বার থেকে। নিশ্চয়ই শিহাব কল করেছে। প্রিয়া অবাক হলো। বাড়ির লোকজন ছাড়া আর গুটি কয়েক ফ্রেন্ডস ছাড়া কেউ প্রিয়াকে ফোন দেয়না। এতবার তো নয়’ই। প্রিয়ার মনে কেমন জানি ভালোলাগা শুরু করে। ভাবনার ঘোর কাটার আগেই শিহাব আবার ফোন দেয়। রিসিভ করবে নাকি করবেনা ভেবে রিসিভড করেই ফেললো। প্রিয়া চুপ করে আছে। হার্টবিট কেমন যেন বেড়ে যাচ্ছে। ওপাশ থেকে শিহাব বললো,
“প্রিয়া।”
প্রিয়া চুপ।
“প্রিয়া শুনছো? হ্যালো….হ্যালো। শুনছো তুমি?”
“হ্যাঁ শুনছি।”
“তুমি এত স্বার্থপর কেনো প্রিয়া?”
“কি করেছি আমি?”
“আজ কলেজে কেন এলেনা? জানো কত কষ্ট হচ্ছিলো আজ তোমায় না দেখতে পেয়ে। মনে হচ্ছিলো দম আটকে মরেই যাবো।”
“একদিন কলেজ যাইনি তাতেই এই অবস্থা?”
“একদিন কি কথা? আমি এক সেকেন্ডও তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না। অনেক ভালোবাসি তোমায়।”
“কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসিনা।”।
“তোমার বাসতে হবেনা। আমি একাই ভালোবাসবো।”
“পাগলামো বাদ দিয়ে এখন বাসায় যান।”
“না। তুমি বারান্দায় আসো তোমাকে দেখবো।”
“পারবোনা।”
“কেন?”
“আমি তো আপনাকে ভালোবাসিনা। তাহলে কেন শুনবো আপনার কথা?”
“তুমি কি আমায় সত্যিই ভালোবাসো না প্রিয়া?”
“না।”
“আচ্ছা বেশ। আজ আমি সারারাত তোমার বাড়ির সামনে বৃষ্টিতে ভিজবো।”
প্রিয়াকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শিহাব ফোনটা কেটে দেয়। প্রিয়া কলব্যাক করে কিন্তু শিহাব রিসিভড করেনা। প্রিয়া বারান্দায় গিয়ে হাতের ইশারায় চলে যেতে বলে কিন্তু শিহাব সেকথার পাত্তা না দিয়ে অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়া রাগে গজগজ করতে করতে রুমে এসে পড়ে। কাঁথা গায়ে জড়াতে জড়াতে আপনমনেই বলে,
“যা ইচ্ছে করুক আমার কি তাতে! যখন ঠান্ডা লাগবে তখন একাই চলে যাবে। এসব উটকো ঝামেলায় একদম জড়ানো যাবে না। সেঁধে সেঁধে বাঁশ খাওয়ার কোনো মানেই হয়না।”
.
সকালবেলা ঘুম ভাঙ্গতেই প্রিয়া আড়মোড়া ভাঙ্গলো। রাতের কথা মনে পড়ায় দৌঁড়ে বারান্দায় গেলো কিন্তু শিহাবকে দেখতে পেলো না। আজ অনেকটাই সুস্থ প্রিয়া। তাই মায়ের বারণ না শুনেই প্রিয়া কলেজে গেলো। কলেজে গিয়েই প্রিয়া চমকে গেলো। আজ কোথাও শিহাবকে দেখতে পেলো না। প্রিয়ার তো খুশি হওয়ার কথা কিন্তু মনের এক কোণায় কোথাও যেন শূন্যতা বিরাজ করছে। তবে কি প্রিয়া শিহাবকে ভালোবেসে ফেলেছে! কলেজ ছুটির পর শিহাবের বন্ধু প্রিয়ার কাছে যায়।
প্রিয়াই বললো,
“কি খবর মামু?”
“দেখো মজা কিন্তু পরেও করতে পারবা। এখন আমার সাথে চলো।”
“কোথায় যাবো?”
“শিহাবের ম্যাসে।”
“না।”
“শিহাব অনেক অসুস্থ।”
শিহাব অসুস্থ শুনে প্রিয়ার মনটা খারাপ হয়ে যায়।
“কি হয়েছে?”
“কাল সারারাত তোমার বাড়ির সামনে বৃষ্টিতে ভিজছে। ফোন দিয়া জিজ্ঞেস করতেই বললো তোমার বাড়ির সামনে। ভোরে গিয়া দেখি ও সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে। পরে সবাই মিলে ও নিয়া আসি। এখন অনেক জ্বর। বারবার খালি তোমার নাম নিতাছে।”
প্রিয়া আর কোনোকিছু না ভেবেই রাজি হয়ে যায়। হাজার হোক, ওর জন্যই তো শিহাব আজ অসুস্থ।
ছোট্ট একটা ম্যাসের সামনে এসে দাঁড়ায় ওরা। প্রিয়া বাড়িটা দেখে থমকে যায়। ব্যাচেলর বাড়ি। সব ছেলে মানুষ। প্রিয়ার কি যাওয়া ঠিক হবে? যদি কোনো ক্ষতি করে ফেলে! ছেলেদের দিয়ে তো একদম ভরসা নেই। প্রিয়াকে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটা বললো,
“কি হইলো? আসো। তুমি কি ভয় পাইতাছো? ভিতরে আমার গার্লফ্রেড আর ওর কয়েকটা বান্ধবীও আছে। ভয়ের কিছু নাই।”
বলতে বলতেই দরজার সামনে কয়েকটা মেয়ে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়া সস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো। যেতে যেতে বললো,
“উনি ম্যাসে থাকে কেন?”
“ওর বাবা-মা, ভাই-ভাবি সবাই রাজশাহী থাকে। ও এখানে পড়াশোনা করে। পরীক্ষাটা শেষ হলেই জব নিবে। আগে অবশ্য জব করতো। কিন্তু কয়েকদিন পর পরীক্ষা তো তাই ছাইড়া দিছে।”
“ওহ।”
ভিতরে গিয়ে দেখলো ছোট্ট একটা খাট পাতা আছে। খাটের পাশেই পড়ার টেবিল। জামা-কাপড় রাখার জন্য একটা ছোট্ট ট্রলি আর মাথার ওপর একটা সিলিং ফ্যান। ঘরটা বেশ পরিপাটিই বলা চলে। শিহাব বিছানায় শুয়ে আছে। প্রিয়া রুমে যেতেই সবাই বেড়িয়ে গেলো। প্রিয়ার খুব ভয় করছিল। এভাবে একা ঘরে, শিহাবের সাথে। যদি কোনো অঘটন ঘটে প্রিয়া তো মরেই যাবে। প্রিয়া মনে মনে বললো,
“নো প্রিয়া নো! তুই না ব্রেফগার্ল? এভাবে ভয় পেলে চলবে? ভয়কে জয় করতে হবে।”
প্রিয়া আস্তে করে ডাকলো শিহাবকে। শিহাব চোখ মেলে প্রিয়াকে দেখে খুশি হয়ে বললো,
“তুমি এসেছো?”
“হু। কিন্তু এগুলা কেমন পাগলামি বলেন তো? এভাবে নিজের ক্ষতি করার কোনো মানে হয়?”
“তুমি শুধু আমায় একটাবার ভালোবাসো প্রিয়া।”
“ভালোবাসা কি জোর করলেই হয়? আমার ভালোবাসা আসেনা। পেইন ভালোলাগে না। কষ্ট সহ্য করতে পারিনা একদম।”
“আমি তোমায় একটুও কষ্ট দিবো না।”
“ওটা আমার বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডরাও বলতো। তারপরও দেখতাম আমার বান্ধবীরা কাঁদে। আমি বাবা এসব সহ্য করতে পারবো না।”
শিহাব হাসলো। বললো,
“বেশ। তবে আমরা বন্ধু হই?”
“বন্ধু হতে আমার কোনো অসুবিধা নেই।”
তখন থেকেই শিহাব আর প্রিয়া বন্ধু। একসাথে কলেজে যাওয়া, বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া, কলেজ ক্যাম্পাসে আড্ডা দেওয়া, একসাথে কফি খাওয়া, ফুসকা খাওয়া সবকিছু জুড়েই শুধু শিহাব জড়িয়ে গেলো। কে যেন বলেছিল, একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনোই বন্ধু হতে পারেনা। এদের মধ্যে যেকোনো একজন তো প্রেমে পড়বেই। শিহাব তো আগে থেকেই প্রিয়াকে ভালোবাসে। এবার প্রিয়াও ভালোবেসে ফেলে শিহাবকে। শিহাব ইচ্ছে করেই ফ্রেন্ডশিপ করেছিল যাতে ভালোবাসার একটা সুযোগ পায়। হলোও তাই। শিহাব পরীক্ষার জন্য খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ে পড়াশোনা নিয়ে। এখন আর তেমন সময় দিতে পারেনা প্রিয়াকে। তখন থেকেই প্রিয়া উপলব্ধি করতে পারে যে প্রিয়াও শিহাবকে ভালোবেসে ফেলেছে। দুজনের ভালোবেসে একসাথে পথচলার শুরুটা তখন থেকেই। এই ভালোবাসাটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় প্রিয়ার জীবনে।
.
.
শিহাবের পরীক্ষা শেষ। ভালো একটা চাকরীও করছে এখন। প্রতি শুক্রবারটা প্রিয়ার জন্য বরাদ্দ রাখে শিহাব। শুক্রবারে প্রিয়া তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে ওঠে। গোসল হয়ে রেডি হতে হবে। ঘুমঘুম চোখে ওয়াশরুমে এগিয়ে যাচ্ছিলো প্রিয়া। পেছন থেকে প্রিয়ার মেজ খালামনি বললো,
“প্রেমে ট্রেমে পড়লি নাকি?”
খালামনির কথা শুনে প্রিয়ার ঘুম উধাও। ফাঁকা একটা ঢোক গিলে বললো,
“এমন মনে হলো কেন?”
“ফেসওয়াশ মনে করে স্নো নিয়ে যাচ্ছিস ওয়াশরুমে। প্লাজুর বদলে তোর মায়ের পেটিকোট নিয়ে যাচ্ছিস। কাহিনী কি হুম?”
প্রিয়া হাতের দিকে লক্ষ করে দেখলো আসলেই সে মায়ের পেটিকোট আর স্নো নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়া জিভ কাটলো।
“ঘুমে উলটপালট হয়ে গেছে।”
“ঘুমে উলটপালট? প্রতি শুক্রবারে কোথায় যাওয়া হয়?”
এতক্ষণ শুধু মেজ খালামনি চেপে ধরলেও এখন যোগ দিয়েছে লামিয়া, মা, নানু আর ছোটখালামনি। মাঝখানে প্রিয়া একদম চ্যাপা শুটকি হয়ে যাচ্ছে। ওদের সবার সাথেই প্রিয়া অনেক ফ্রি। সব কথাই ওদের শেয়ার করে। কিন্তু ভালোবাসার কথা কিভাবে শেয়ার করবে? ইশ, কি লজ্জা! কিন্তু ওরাও নাছোড়বান্দা। কিছুতেই না শুনে ছাড়বেনা। শেষমেশ সব লজ্জাশরম কাটিয়ে প্রিয়া সব বললো। সবাই তো খুশিতে গদগদ। প্রিয়ার মা বললো,
“আগে ছেলের ছবি দেখা। ছেলে ভালো তো?”
প্রিয়া ফোন থেকে ছবি বের করে দেখালো।
“মাশআল্লাহ্। এটা তো পুরা নায়ক। কিন্তু মা, যাই করিস না করিস একটু সাবধান থাকিস। আজকালকের ছেলেদের দিয়ে বিশ্বাস নেই। দুইদিন প্রেম করবে তারপর উধাও।”
“মা শিহাব ওরকম নয়। আমি ওকে তোমাদের সাথে কথা বলিয়ে দিবো।”
“আচ্ছা। তাহলে আজই আসতে বল।”
“আজ?”
“হু।”
প্রিয়া ফোন করে শিহাবকে সব বললো। শিহাবের তো ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
“প্রিয়া তুমি ঠিক বলছো? তোমার বাড়িতে আমার কথা জানিয়েছো?”
“হ্যাঁ। তুমি না সেদিন বললে যে, তোমার বাড়িতে আমার কথা বলেছো? তারাও তো রাজি। এখন আমার পরিবারও রাজি। এখন তো আমাদের বিয়েতে কোনো সমস্যাই হবেনা।”
“হুম।”
“তুমি তাড়াডাড়ি বাসায় আসো।”
“আমার ভয় করছে। সাথে লজ্জাও লাগছে।”
“আরে, আমি আছি তো। তাড়াতাড়ি আসো তুমি।”
প্রিয়া ফোন রেখে দিলো। আধঘণ্টার মধ্যেই শিহাব বাড়িতে আসে। বাড়ির সবাই খুব পছন্দ করে।
সেদিন বাইকে করে ঘুরতে যায় শিহাব আর প্রিয়া। গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিলো দেখে একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় নেয় ওরা। মেঘে মেঘে কালো হয়ে আছে আকাশ। একটু পরপর বিদ্যুৎ চমকায়। প্রিয়া ভয় পেয়ে শিহাবের হাত জড়িয়ে ধরে। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে শিহাব একটা দুষ্টু হাসি দেয়। প্রিয়ার অনেক কাছে এগিয়ে যায় শিহাব। ঘোরের মধ্যে চলে যায়। প্রিয়ার ঠোঁটে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। প্রিয়া কেঁপে ওঠে। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে। একসময় প্রিয়া লজ্জা পেয়ে শিহাবকে জড়িয়ে ধরে। চোখের কোণা বেয়ে পানি ঝড়ে পড়ে প্রিয়ার। শিহাব প্রিয়ার হাত ধরে বলে,
“আমায় কখনো ঠকিয়ো না প্লিজ। খুব বেশিই ভালোবাসি তোমাকে। আমার চেয়ে বেশি তোমায় কেউ ভালোবাসতে পারবেনা।”
“কখনো ঠকাবো না।”
“ছেড়ে যাবে না তো কখনো?”
“না।”
“আমার খুব ভয় করে প্রিয়া। ছেড়ে যেয়ো না আমায়।”
কাঁদতে কাঁদতেই ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে আসে প্রিয়া। প্রিয়ার চোখের পানি গাল বেয়ে ফাহাদের মুখে পড়ে। ফাহাদ তৎক্ষণাৎ উঠে বসে। দেখে প্রিয়া চোখ বন্ধ করে কাঁদছে। প্রিয়ার বাহুতে ধরে ফাহাদ হালকা ধাক্কা দেয়। প্রিয়া চোখ মেলে তাকায়।
“কি হয়েছে তোমার? কাঁদছো কেন?”
“কই?”
“চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। আবার বলছো কই?”
প্রিয়া চোখে হাত দিয়ে দেখে আসলেই সে কাঁদছে। পুরনো ক্ষত কেন এত পোড়ায় প্রিয়াকে।
“কি হলো?”
“কিছুনা। এমনিই চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।”
“কি লুকাচ্ছো বলো তো?”
“লুকানোর মত কিছুই নেই।”
ফাহাদ প্রিয়ার গালে হাত রেখে বললো,
“অতীতের স্মৃতিগুলো মনে পড়েছে?”
প্রিয়া আর সেখানে বসলো না। এক ছুটে নিজের ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। হুট করেই কেন এত কষ্ট হচ্ছে। কেন মনে পড়ছে ওর কথা। তবে কি অতীত আবার ফিরে আসছে। কেন হলো এমন কেন! প্রিয়া মুখে হাত দিয়ে কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে একসময় প্রিয়া ক্লান্ত হয়ে যায়। চোখ বন্ধ করে ভাবে এত ভালোবাসার মানুষটা কি করে এমন পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল।..
সময়টা প্রিয়ার এইচএসসি এর টেষ্ট পরীক্ষার মাত্র পাঁচদিন আগের। মাঝখানে এত্তগুলো সময়, দিন, সপ্তাহ্, মাস পেড়িয়ে যায় শিহাব আর প্রিয়ার ভালোবাসায়। শিহাবের প্রচন্ড ইগো ছিল আর প্রিয়ার ছিল প্রচুর রাগ। কিন্তু ভালোবাসার কমতি ছিলনা কারোরই। কোনো আড্ডায় প্রিয়া থাকলেই সেখানে গর্ব করে বলতো শিহাবের কথা। কিন্তু হঠাৎ ভূমিকম্পের ন্যায় সব বদলে গেলো। ভূমিকম্প যেমন কোনো সংকেত দিয়ে আসেনা শিহাবের পাল্টে যাওয়াটাও ঠিক তেমন ছিল। আগের মত তো কথা বলেই না। দেখাও করেনা। যতটুকু কথা হয়, শুধু ঝগড়া হয় আর না হয় শিহাব চুপ করে থাকে। প্রিয়া ভেবে পায়না শিহাবের এমন পরিবর্তনের কারণ। তিনদিন এভাবেই কেটে যায়। যেখানে ঝগড়া করে শিহাব এক ঘন্টাই থাকতে পারতো না সেখানে তিনদিন প্রিয়ার সাথে কথা না বলেই থাকছে। প্রিয়াকে ইগনোর করছে। শিহাবের এমন আচরণ প্রিয়া কিছুতেই মেনে নিতে পারেনা। একা একাই কেঁদেকেটে বুক ভাসায়। ঠিকমত খায়না, গোসল করেনা। একদম পাগল প্রায় অবস্থা। কলেজে গিয়েও কাঁদতে থাকে। প্রিয়া ফোন দিলেই কেটে দিয়ে ম্যাসেজ দেয়, “আমি বিজি আছি।” অথচ পরে আবার কল দিলে দেখে শিহাবের নাম্বার ওয়েটিং। অবাক হয় প্রিয়া। এই কি সেই ভালোবাসার মানুষটা? যাকে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসতো?
কলেজে গিয়ে মনমরা হয়ে বসে আছে। বারবার ফোনে ট্রাই করছে শিহাবকে বাট নো রেসপন্স। ম্যাসেজেরও কোনো রিপলে নেই। স্যারের কোনো লেকচারও মাথায় ঢুকছে না। ম্যাসেঞ্জারে গিয়ে শিহাবকে একটিভ পায়। ম্যাসেজ করে,
“কেমন আছো তুমি?”
সীন করেনা ম্যাসেজ।
“জান কথা বলো না কেন? কি করেছি আমি? কেন এমন করছো আমার সাথে?”
আকুতি-মিনতি করে একটাবার কথা বলতে চায় প্রিয়া। শিহাব রিপলে করে,
“চেষ্টা করবো।”
“প্লিজ জান একটাবার কথা বলো আমার সাথে।”
টিফিন টাইমে ফাঁকা ক্লাসে গিয়ে ফোন দেয় প্রিয়া। বারবার ট্রাই করেও লাভ হচ্ছে না। প্রিয়া জোরে আর্তনাদ করে কেঁদে ওঠে। অনেকবার ট্রাই করার পর শিহাব ফোন রিসিভড করে বলে,
“বলো।”
“আমার সাথে এমন কেন করছো?”
শিহাব চুপ।
“প্লিজ কিছু বলো।”
“আমি একটু সমস্যায় আছি প্রিয়া।”
“কেমন সমস্যা যেটা আমাকে বলা যায় না?”
“তোমাকে বললে তুমি কষ্ট পাবে।”
“কষ্ট তো তুমি এখনও কম দিচ্ছো না।”
“বাড়ি থেকে আমার বিয়ের কথা বলছে।”
প্রিয়ার বুকে মোচর দিয়ে ওঠে। বিয়ের কথা!
“তো এখানে সমস্যার কি আছে? তুমি না বলেছিলে তোমার বাড়ির সবাই জানে আমার কথা? মেনেও নাকি নিয়েছে।”
” তখন মেনে নিয়েছিল এখন নিচ্ছে না। বাবা অন্য জায়গায় মেয়ে দেখতে চাইছে। আমার মাথা কাজ করছে না।”
“এসব তুমি কি বলছো শিহাব? তুমি কি জানো তুমি কি বলছো? কেন মেনে নিবে না তারা?”
“শহরের মেয়ে তাদের পছন্দ না। এখন বিয়ে করলে তো তুমি পড়াশোনা করবে বিয়ের পরও তারা সেটা মানবে না।”
প্রিয়া কোনো কিছু না ভেবেই বলে ফেললো,
“আমি করবো না। আমি পড়াশোনা করবো না। তোমার জন্য আমি আমার স্বপ্ন স্যাক্রিফাইজ করতে রাজি আছি। তবুও প্লিজ আমায় ছেড়ে যেয়ো না।”
“দেখছি।”
“দেখছি? এরপরও তুমি বলছো দেখছি?”
প্রিয়া ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ওপাশ থেকে শিহাব ফোন কেটে দেয়……

চলবে….

তুমি আমার ভালোবাসা পর্ব-১৮

0

#তুমি_আমার_ভালোবাসা
#পর্ব_১৮
#লেখিকা_Munni_Akter_Priya
.
.
শিহাব হুট করেই মাটিতে বসে হাত জোর করে বললো,
“বাবু ডাকো, জান ডাকো, জামাই ডাকো তবুও প্লিজ আঙ্কেল ডেকো না।”
“আরে আমি কাকে কি ডাকবো সেটা তো আমার বিষয়।”
শিহাব উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“তাই বলে আঙ্কেল ডাকবে? ভাইয়া বললেও তো একটা কথা ছিল। অন্তত সাইয়্যা হওয়ার একটা আশা থাকে।”
“এজন্যই প্রথম থেকে রাস্তাটা বন্ধ করে দিলাম। আপনার ধান্দা আমি বুঝিনি ভেবেছেন? আপনাদের মত ছেলেদের আমি হারে হারে চিনি। আজ ভালোবাসার নাটক করবেন দুইদিন পরই সেই ভালোবাসা ফুড়ুৎ!”
“বাব্বাহ্! এতকিছু জানো তুমি?”
“আরো অনেক কিছুই জানি।”
“তা কি কি জানো একটু শুনি?”
“আপনাকে বলতে আমি ইচ্ছুক নই আঙ্কেল।”
“উফফ! আবার আঙ্কেল!”
“শুনুন আঙ্কেল, আপনার এইসব সাঙ্গপাঙ্গদের দিয়ে হুটহাট ডেকে পাঠাবেন না।”
কথাগুলো বলেই প্রিয়া গটগট করে হেঁটে চলে গেলো। শিহাবের বন্ধুরা সব হা করে তাকিয়ে আছে।
“দোস্ত, মেয়ে তো নয় এটা পুরা ঝাল মরিচ!”
শিহাব ভাবলেশহীনভাবে বললো,
“সেটাই তো দেখছি রে।”
.
ইদানীং রিহান ছেলেটা প্রিয়াকে খুব জ্বালাচ্ছে। রিহান প্রিয়ার এক ব্যাচ সিনিয়র। একই স্কুলে পড়ার সুবাদে ওরা পরিচিত। প্রিয়া যখন এইটে পড়ে তখন থেকেই রিহান প্রিয়াকে পছন্দ করে। ছয় মাস প্রচুর পিছন পিছন ঘুরেছে কিন্তু একদম পাত্তা পায়নি। এরপর রিহান এস.এস.সি পরীক্ষা শেষে কলেজে গিয়ে রিলেশনে যায়। এইসব খবরই প্রিয়ার কানে আসতো। প্রিয়া বড় বাঁচা বেঁচে যায় মনে মনে। এরমধ্যে রিহানের সাথে আর প্রিয়ার দেখা হয়নি। সবই তো ভালোই চলছিল। ঐদিন হুট করে কলেজে যাওয়ার সময় রিহানের সাথে দেখা হয়ে যায়। রিহানের পাগলামি তখন থেকেই। এরমধ্যে শুনেছিল রিহানের নাকি ব্রেকাপও হয়েছে কিন্তু খবর কতটা সত্যি সেটা জানেনা প্রিয়া। যাই হোক, প্রিয়ার জানার কোনো আগ্রহও নেই। ঐদিন দেখা হওয়ার পর থেকেই রিহান খুব জ্বালাচ্ছে প্রিয়াকে। হুটহাট করে ফোন দিচ্ছে, বাড়ির সামনে আসছে। কতগুলো নাম্বার যে ব্লাকলিস্টে ফেলেছে তার কোনো হিসেব নেই। পুরনো প্রেম জেগে ওঠেছে।
সন্ধ্যার সময় প্রিয়া একটু পড়তে বসেছিল তখনই আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। প্রিয়া শিওর হয়ে যায় যে এটা রিহানেরই কাজ। আজ একটা রামধোলাই দিবেই দিবে। ফোন রিসিভড করেই প্রিয়া বললো,
“হারামজাদা আবার ফোন করছিস? ঐ তোর কি কোনো লজ্জাশরম নাই নাকি? এতগুলো নাম্বার ব্লক করেছি এরপরও অন্য নাম্বার থেকে ফোন করেছিস?”
ওপাশ থেকে একটা মেয়ে কণ্ঠ ভেসে আসলো,
“আপু আমি তো আজই তোমাকে প্রথম কল দিলাম।”
প্রিয়া এবার থতমত খেয়ে বললো,
“কে তুমি?”
“আমি সুমা।”
“কোন সুমা? কোথাকার সুমা? আমি কি চিনি?”
মেয়েটা কোনো উত্তর না দিয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“রিহানের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?”
প্রিয়ার মাথা এবার রাগে ফেঁটে যাচ্ছে। কোনো সম্পর্কে না জড়িয়েও একটা অপরিচিত মেয়ের কাছে শুনতে হচ্ছে কি সম্পর্ক! এরচেয়েও অপমানের কিছু হয়না প্রিয়ার কাছে। নিজের রাগকে সংযত করে প্রিয়া বললো,
“আগে তোমার পরিচয় দাও। তারপর আমি সব বলছি।”
“আমি রিহানের গার্লফ্রেন্ড।”
“কিহ্? তুমি ছেচ্চড়টার গার্লফ্রেন্ড? অথচ ঐ ছেচ্রা কাল পর্যন্তও নিজেকে সিঙ্গেল বলতে বলতে মুখ দিয়ে ফ্যানা তুলে ফেলেছিল।”
“আমি জানি আপু। এটা নিয়ে ওর সাথে আমার খুব ঝগরাও হয়েছে।”
“তুমি কোন কচুটা জানো? জানলে হুট করেই এই প্রশ্ন কেন করলে যে রিহানের সাথে আমার কি সম্পর্ক? কেমন ছেলেকে ভালোবাসো যার চরিত্র খারাপ! একটা পাগলকে নিয়ে সারাজীবন থাকা যায় কিন্তু চরিত্রহীন কাউকে নিয়ে থাকা যায়না।”
“আমি বুঝতে পারছি ওর ওপর তোমার অনেক রাগ। আমি ওকে অনেকবার তোমার কথা জিজ্ঞেস করেছি। কিন্তু বলেনি। এটাও বলেছি যে, ও যদি তোমাকে চায় আমি নিজেই তোমাকে ওর হাতে তুলে দিবো।”
“হোয়াট দ্যা…. তুমি কে আমাকে ওর হাতে তুলে দেওয়ার? তোমার কি মনে হয় আমি রিহানকে ভালোবাসি? নো ওয়ে। এমন ক্যারেক্টারলেস ছেলে কখনো প্রিয়ার ভালোবাসা ডিজার্ভ করেনা। আদারওয়াইজ আমি আগে রিহানকে ভালো না বাসলেও ভালো মানুষ ভাবতাম। কিন্তু এখন তো দেখছি সে একটা চরিত্রহীন ছেলে। গার্লফ্রেন্ড থাকতেও অন্য মেয়ের প্রতি যার ভালোবাসা জন্মায় সে নিঃসন্দেহে একজন খারাপ লোক। আর তুমি আগে কেন যোগাযোগ করোনি আমার সাথে? তাহলে সামনে থেকে ছেচ্রাটাকে একটা উচিত শিক্ষা দিতাম।”
“আসলে অনেক ট্রাই করেছি কিন্তু পাইনি। আমার ভাইয়াকে বলেছিলাম তোমার কথা। ভাইয়া ওর বন্ধুদেরও বলেছে। তারা আপনার কলেজেই অনার্স ফাইনাল ইয়ারের স্টুডেন্ট। বলেছে যে কয়েকদিনের মধ্যেই খুঁজে জানাবে। কিন্তু তার আগেই আমি রিহানের ফোন নিয়ে তোমার নাম্বার নিই।”
“খুব ভালো করেছো। যার সাথে জীবন জড়িয়েছো তাকে বলিয়ো শুধু তোমাতেই যেন মত্ত থাকে। আর পার্সোনালি একটা কথা বলি তোমায়। আমি রিহানকে ঘৃণা করি, খুব বেশি ঘৃণা করি।”
ঠুস করে লাইনটা কেটে কেলো। কি হলো? টাকা শেষ নাকি ফোন রেখে দিলো? ফোনটা হাতে নিয়ে খেয়াল করলো ফোন বন্ধ হয়ে গেছে। শিট! প্রিয়া ফোনটা চার্জে বসিয়ে পড়তে বসলো।

পড়া শেষ করে সবার সাথে রাতের খাবার খেতে বসলো। প্রিয়াদের বাড়িতে অত বিলাসিতা নেই। কিন্তু মনের সুখটাই তো আসল। যেটা ওদের মধ্যে ছিল। দুই ভাইয়া বউ নিয়ে অন্য জায়গায় থাকে কাজের সুবাদে। এখানে শুধু প্রিয়ার বড় বোন লামিয়া, বাবা-মা আর প্রিয়া থাকে। লামিয়া পড়াশোনার পাশাপাশি হাসপাতালে রিসিপশনে জব করে। মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খেতে বসেছে ওরা। রাতের খাবারের মেন্যুতে ছিল ইলিশ মাছ ভাজা, আলু ভর্তা আর ডিমের তরকারি। ডিমের তরকারি দিয়ে ভাত মাখতে মাখতে প্রিয়া বললো,
“বুঝলে মা, ভাবছি কয়েকটা মুরগী পালবো।”
“হঠাৎ এই ভাবনা কেন?”
“এইযে ডিম রান্না করো। এই ডিম কেনার টাকাটা বেঁচে যাবে।”
লামিয়া বললো,
“এত উন্নতির কথা কবে থেকে ভাবা শুরু করলি?”
“যবে থেকে তোকে বিদায় করার ভূত মাথায় এসেছে।”
“আমি কি তোর পাকা ধানে মই দিয়েছি যে আমায় বিদায় করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিস?”
“আমার ধানের ক্ষেত থাকলে তো মই দিবি। কথা তো ওটা নয়, তোর বিয়ের জন্য ডিম বিক্রির টাকা জমিয়ে তোকে বিয়ে দিবো।”
“তোর খুব বেশি তাড়া থাকলে তুই বিদায় হ।”
“তুই কি এখন বিয়ে করবি না আপু?”
“না।”
“না করলে না করবি। সেটা তোর ব্যাপার। কিন্তু আমার ইচ্ছে আছে আমি একটা ডিমের দোকান খুলবো। যেই দোকানে শুধু ডিম বিক্রি হবে। দোকানের নাম কি দিবো জানিস?”
“কি?”
“লামিয়ার ডিম ষ্টোর। শত হোক, তুই আমার বড় বোন। তোর প্রতি তো আমার আলাদা একটা টান আছে বুঝিস না।”
লামিয়া জোরে একটা ধমক দিয়ে বললো,
“ঐ লামিয়ার ডিম ষ্টোর মানে কি রে হ্যাঁ? ডিম কি আমি পারবো নাকি?”
“আমি এটা কখন বললাম?”
“নামটা তো তেমনই শোনায়।”
“দেখেছিস তোর থিংকিং কতটা নিচু? আচ্ছা তোর পুরো নাম যেন কি? লামিয়া ইসলাম মীম তাই না? হোল স্কুল-কলেজ লাইফে তো তোকে সবাই ডিম বলেই ডাকতো। ডিম থেকেই তো ছানার জন্ম। ছানা থেকে বড় মুরগী। আর তুই তো এখন বড় হয়েছিস। তাহলে লামিয়ার ডিম ষ্টোর নামটা কোন দিক দিয়ে খারাপ রে?”
লামিয়া দাঁত কটমট করে তাকিয়ে আছে। প্রিয়া খাওয়া শেষে তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“আজকাল কারো ভালো চাইতে নেই। দুনিয়ায় ভালো মানুষের কদর কেউ করেনা কখনো। একদিন বুঝবি।”
“যা ভাগ।”

প্রিয়া ঘরে গিয়ে মোবাইল নিয়ে সোজা বারান্দায় গেলো। কানে হেডফোন গুঁজে প্লে লিস্ট থেকে নিজের ফেভারিট গানগুলো শুনতে লাগলো। এরমধ্যে একটা গান একটু বেশিই ভালো লাগে প্রিয়ার। প্রিয়া সবসময় মাঝখান থেকেই শোনে গানটার।
“চুরাবালির পিছুটানে, বুঝিনা এই ভাষার মানে
অশান্ত মন, কি উচাটন খোদা জানে!
ঘরের কাজে, সকাল সাঝে
জিওমিতির ভাঁজে ভাঁজে,,
কিসের ছায়া, এ কোন মায়া
বুঝি না যে..!”
গানটা শুনতে শুনতে প্রিয়া ভাবে জীবন কি অদ্ভুত। একটু ভুল বুঝাবুঝি জীবন শেষ করে দিতেও দ্বিধাবোধ করেনা। যেটা এই “বখাটে” শর্টফিল্ম দেখলেই বোঝা যায়।
রাত একটা পর্যন্ত বারান্দায় বসে বসে গান শোনে প্রিয়া। এরপর ঘুমাতে চলে যায়। লামিয়া একটা শোয়ার বালিশ বুকে জড়িয়ে অন্যপাশ হয়ে ঘুমিয়ে আছে। প্রিয়া গিয়ে পেছন থেকে লামিয়াকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে। প্রিয়ার এক হাত, এক পা লামিয়ার ওপর। সারাদিনে যত ঝগড়াঝাঁটি যাই হয়ে যাক না কেন রাতে কেউই কাউকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। বিশেষ করে প্রিয়া। যতই মুখে বলুক তোকে বিয়ে দিয়ে বিদায় করবো কিন্তু মনে মনে চায় বোন সারাজীবন ওদের কাছে থাকুক। সুন্দর এসব ভাবনা নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে প্রিয়া।
.
.
সকালঃ ৯:১১ মিনিট
ঘুমঘুম চোখে মোবাইলে টাইম দেখেই প্রিয়া ধড়ফড়িয়ে বিছানায় বসে। দশটায় প্রিয়ার ক্লাস শুরু। তাও প্রথমেই ইংলিশ ক্লাস। এই ক্লাসে লেট করা মানে ম্যামের ক্লাসে পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকা। উফফ! আর ভাবতে পারছেনা প্রিয়া। কখন রেডি হবে আর কখন খাবে। আজ তো কপালে শনির দশা আছেই। আপুর ওপর খুব বেশিই রাগ হচ্ছে প্রিয়ার। ইচ্ছে করে ডাক দেয়নি। রাতের শোধটা এভাবে নিলো। প্রিয়া মনে মনে একশো টা গালি দিয়ে ফেলেছে। ঝটপট প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে কলেজের ইউনিফর্ম পড়ে নেয়। আজ হিজাব বাঁধার একদম সময় নেই। তাই সাদা জর্জেট ওড়নাটা গলায় সুন্দর করে পেঁচিয়ে নেয়। লম্বা চুলগুলো একটা ঝুটি করে। বাহিরে প্রচুর ধুলাবালি থাকায় একটা মাস্ক পড়ে নেয়। এরপর না খেয়েই ব্যাগ নিয়ে দৌড় দেয়। মাঝ রাস্তায় পথ আটকে ধরে শিহাব ও ওর বন্ধুরা। প্রিয়ার মেজাজটা বিগড়ে যায়। এদের কি এখনই আসতে হলো! প্রিয়া ওদের সাইড কাটিয়ে চলে যাওয়া ধরলে শিহাবের বন্ধু পথ আঁটকে বলে,
“আরে দাঁড়াও মামণী! এত তাড়া কিসের?”
প্রিয়া কিছু বললো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখছে। শিহাব চুলগুলো হাত দিয়ে ঠিক করতে করতে বললো,
“রিহানের সাথে কিসের ইটিশপিটিশ চলছে হ্যাঁ? আমাদের ছোট বোনের বয়ফ্রেন্ড হয় রিহান। কয়েকদিন পর ওদের বিয়ে জানো? আর ওর পিছনে ঘুরঘুর করছো?”
প্রিয়া এতক্ষণে বুঝলো ওদের আসার কারণটা অন্য অর্থাৎ রিহানঘটিত। সুমা বলেছিল ওর ভাইয়াকে আমায় খোঁজার কথা। মেয়েটার সাথে কথা বলে একবারের জন্যও মনে হয়নি থ্রেড দিতে বলেছে। কিন্তু এইগুলো একটু বেশিই লাফাচ্ছে মনে হয়।
শিহাব এবার ধমক দিয়ে বললো,
“চুপ করে আছো কেন? বোবা? কথা বলতে পারোনা? আর মুখে মাস্ক লাগিয়ে ঘুরছো কেন? খুলো বলছি এক্ষুণী মাস্ক খুলো।”
পাশ থেকে শিহাবের বন্ধু বললো,
“দোস্ত মামনী মনে হয় ব্রান্ডের লিপস্টিক ইউজ করেছে তাই মাস্ক দিয়ে ঢেকে রেখেছে।”
“আরে তাহলে ঢাকবে কেন? সবাইকে তো দেখানো উচিত।”
এবার প্রিয়া ক্ষিপ্ত গলায় বললো,
“জ্বী আঙ্কেল ঠিক বলেছেন। আমি ব্রান্ডের লিপস্টিক ইউজ করেছি। আপনি দিবেন ঠোঁটে? লাগিয়ে দিবো? আমি ব্যাগে করে নিয়ে এসেছি।”
প্রিয়ার এমন কথায় সকলে হকচকিয়ে গেলো। শিহাব ধমক দিয়ে বললো,
“এই মেয়ে এত্ত সাহস তোমার? দেখি মুখটা দেখাও দেখি। মাস্ক খুলো।”
“মাস্ক আমি খুলতেই পারি। কিন্তু নিজেকে সামলানোর ক্ষমতা আছে তো?”
“কেন? তুমি কি কুইন এলিজাবেথ?”
“তা নই। তবে আপনার মাথা ঘুরানোর কথা। কাকে থ্রেড করতে আসছেন দেখেন।”
বলেই প্রিয়া একটানে মাস্কটা খুলে ফেললো। শিহাব লাফ দিয়ে বাইকে বসে পড়লো।
“লা হাওলা কুয়াতা ইল্লা বিল্লাহিল আলিউর আজিম।”
“কি হলো আঙ্কেল? ভয় পেলেন?”
“ছিহ্ এসব কি বলো! আর ঐ সোহানের বারোটা আমি বাজাচ্ছি। আমাকে দিয়েই আমার হবু বউকে থ্রেট দেওয়ানো।”
“আঙ্কেল…”
শিহাব বুকের বামপাশে হাত রেখে বললো,
“উফফ আল্লাহ্। বুকে মোচর দেয়। প্লিজ আঙ্কেল ডেকো না। হার্টএটাক করে মরেই যাবো।”
“বেশ! তবে মামা ডাকি কেমন?”
” এভাবে আহত-নিহত কেন করছো প্রিয়া?”
“আমি কি করলাম মামু?”
“শেষ আমি শেষ! ওরে তোরা কে কই আছিস আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল। পোস্টমর্টেম করতে হবে। তখন রিপোর্টে স্পষ্ট আসবে “প্রিয়ার কথার আঘাতে শিহাবের মৃত্যু।” বিয়ের আগেই বিধবা হবে তখন বুঝবে মজা।”
“পাগল।”
বলেই প্রিয়া কলেজে চলে গেলো।…

চলবে….