এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না রুশার। ব্রিজে প্রায় দেড় ঘন্টা সময় কাটিয়ে রাত আটটায় বাসায় ফেরে সে। অবশ্য ভাগ্য ভালো থাকায় বাবা ফেরার আগেই সে ফিরে আসে। রাস্তায় নানান চিন্তায় হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো রুশার। বার বার মা’কে ফোন করে জেনেছে বাবা ফিরেছে কি-না? ভাগ্যের কথা বলা যায় না। যদি বাসায় ফিরে দেখে বাবা ড্রইংরুমে কাগজ হাতে বসে আছে। তখন প্রশ্ন করবে। কী উত্তর দিবে তা মনে মনে সাজিয়ে নিয়েছে রুশা। রিকশায় ফায়াজ নিজ অধিকারে রুশার হাত ধরে। রুশা তেমন বাধা দেয়নি। ফায়াজ হাত ধরেই চমকে ওঠে।
হাত ঠান্ডা দেখে রুশাকে সে জিজ্ঞেস করে,
“শরীর খারাপ লাগছে না-কি রুশা?”
“নাহ।”
“হাত তো একদম বরফ হয়ে আছে।”
“এমনি হয়তো হয়েছে।”
“মানুষ যখন অতিরিক্ত টেনশন করে কিংবা অসুস্থ হয় তখন তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসে।”
“ওহ।”
“কী ওহ? বলো কী হয়েছে?”
“একটু চিন্তা হচ্ছে। যদি ফিরে দেখি আব্বু চলে আসছে।”
ফায়াজ কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু বলেনি।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফায়াজের কথাগুলো ভাবছে রুশা। ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে ফায়াজের বলা কথাগুলো রুশার কানে লাগছে। মন ভাবছে, সত্যিই কি সেদিন স্যারের কোনো রাস্তা ছিলো না? সত্যিই কি স্যার সেদিন সব ভুলে গিয়ে আমাকে আপন করতে পারতো না? প্রথমবারের আঘাত ভুলে গিয়ে একবার অন্তত আমার হাতটা ধরেই দেখতো? আমি তো তার ক্যারিয়ার দেখে তাকে ভালোবাসিনি। আমার মনটা অকারণেই তাকে ভালোবেসেছিলো। আমি শুধু তাকে ভালোবেসেছিলাম। তখন তো আমি ক্যারিয়ার কী তা-ও জানতাম না। কিন্তু তার দেওয়া কষ্টগুলো আমায় হুট করেই কত কিছু বুঝতে শিখিয়ে দিলো। কত দ্রুত আমায় বড় করে দিলো। আচ্ছা, আমি কি খুব বেশিই বড় হয়ে গেছি?
ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে। আপাতত রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না। ভাবনাতে ডুবে থাকতেই বেশি ভালো লাগছে তার। ভাবছে, স্যার আমায় নিয়ে কী ভাবছে এখন? আমারই বা কী করা উচিত? আমি মানুষটাকে ভালোবাসি। হ্যাঁ ভীষণ ভালোবাসি। আমার এই ভালোবাসাটাই আমায় ভীষণ দুর্বল করে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে আমি ভেবে পাই না এই দুনিয়ায় কি আর কোনো পুরুষ ছিলো না। আমার ভালোবাসা স্যারের উপরেই কেন পড়তে হলো? আমার কেন স্যারকেই ভালোবাসতে হলো। লোকটার মাঝে কী এমন দেখেছিলাম উপরওয়ালা-ই ভালো জানেন।
দুটো বছর। বিগত দুটো বছর অসহ্য যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমায়। যদি তিনি এতটুকুও বুঝতেন আমায়?
ফোনটা অনবরত ভাইব্রেট হচ্ছে। এবার বিরক্ত লাগছে রুশার।
“কে এতবার ফোন করে। দেখছে রিসিভ হচ্ছে না, তবুও ফোন করতে হবে কেন?”
বলতে বলতে ফোন হাতে নিয়ে দেখে ফায়াজ ফোন করেছে। সাটার ডাউন করে দেখে প্রায় তিন টা মিসড কল উঠে আছে তার ফোনে। রুশা ফোন রিসিভ করে কানে নেয়।
“হ্যালো।”
“ঘুমিয়ে গেছ?”
“নাহ।”
“রুশা, টিচিং প্রফেশনালে থেকে থেকে সরাসরি কথা বলা অভ্যাস হয়ে গেছে আমার। তাই ইনিয়েবিনিয়ে কথা বলতে পারি না। সরাসরিই বলি, আমায় বিয়ে করবে?”
কথাটা শুনে মনে হলো যেন ৪৪০ ভোল্টেজের কারেন্ট লাগে রুশার শরীরে। রুশাকে কিছু বলতে না দিয়ে ফায়াজ আবারও বলে,
“রুশা, বলো কিছু? বিয়ে করবে আমায়? আমি আমার তরফ থেকে কোনো সাফাই দিবো না। শুধু তুমি মনকে জিজ্ঞেস করো। থাকবে আমার সাথে? দুই বছর আগে যেই আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তোমায়। সেই আমিই বলছি তোমায়, থাকবে সারাজীবন আমার হয়ে? কথা দিচ্ছি পুরোটা না হলেও তোমার অর্ধেকের বেশি কষ্ট আমি আমার করে নিবো। এতটাই ভালোবাসা দিবো যে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার হাতটা ছাড়বো না। আমি ফোনটা রাখছি। তুমি আমায় তোমার ভাবনা জানাতে পারো। ধীরে সুস্থে। কোনো তাড়া নেই। তবে রুশা, আমার মনে হচ্ছে আমি তোমায় ছাড়া থাকতে পারবো না। ভালোবেসে ফেলেছি তোমায়। কতটা ভালোবাসি তা জানি না। তবে ভালোবাসি।”
ফায়াজ ফোন রেখে দেয়। রুশার দু’চোখ পেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। অশ্রুগুলো কি তবে আনন্দের?
ব্রিজের এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুশা আর ফায়াজ। আজ অনেকদিন পর রুশা প্রাণ ভরে নিশ্বাস নিতে পারছে। মনে হচ্ছে, শরীরে যতটা অসুস্থ ভাব ছিলো সব উধাও হয়ে গেছে।
দু’জন মানুষ। যারা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চলছে গভীর নিস্তব্ধতা। রুশার চোখ জোড়া দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। আর ফায়াজের দৃষ্টি রুশাকে দেখছে। নিস্তব্ধতা সব সময় ভালো লাগে না। ফায়াজ বলে,
“রুশা, কিছু বলছো না যে?”
ফায়াজের প্রশ্নে হালকা নড়ে ওঠে রুশা।
“কথা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি বলুন। কেন দেখা করতে বলেছিলেন।”
“কিছু কথা বলার আছে।”
“আচ্ছা। শুনছি আমি। আপনি বলুন।”
“তার আগে একটা প্রশ্নের উত্তর দেও তো।”
“আপনি প্রশ্ন করুন। উত্তর জানা থাকলে অবশ্যই দেবো।”
ফায়াজ একটু ইতস্তত বোধ করে। কিন্তু তবুও তাকে এই প্রশ্নটা করতে হবে।
“ফুয়াদ ছেলেটার সাথে তোমার আন্ডারস্ট্যান্ডিং কেমন?”
ফায়াজের কথার ধাচ দেখে রুশা চমকে যায়। এই মুহুর্তে ফায়াজকে দেখে রুশার হাসি পাচ্ছে আবার হাসতে ভালোও লাগছে না। কথায় আছে, নারী মন সন্দেহবাতিক। কিন্তু আজ রুশা বুঝতে পারছে শুধু নারী মন-ই নয়, পুরুষ মনও সন্দেহবাতিক। ফায়াজ এখানে চালাকি করেছে। সে হয়তো ভেবেছে রুশাকে সরাসরি প্রশ্ন করার চাইতে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করাটাই বেশি শ্রেয়। রুশারও কথা ঘোরাতে ভালো লাগে না। তাই সরাসরিই বলে,
“ফুয়াদ আমার ক্লাসমেট। অনলি ক্লাসমেট। আন্ডারস্ট্যান্ডিং শব্দটা ব্যবহার না করে যা সন্দেহ করেছিলেন সেটাই বলতে পারতেন। যে, তার সাথে আমার কী সম্পর্ক অথবা কেন সে আমার সাথে এত কথা বলে। কিংবা আপনার চোখ বার বার আমাদের একত্রেই দেখেছে কেন, আরও কিছু।”
রুশা যে তার চালাকি ধরতে পেরেছে তা বুঝতে পেরে লজ্জিত হয় ফায়াজ। তবুও তার আপত্তি লাগছে না। কারণ সে ভুল কিছু করেনি। সে শুধু জানতে চেয়েছে। এর বেশি কিছু না।
“সবটা যখন বুঝতেই পেরেছো, তবে বলে ফেলো।”
“ওই যে বললাম। শুধু ক্লাসমেট। এর অতিরিক্ত কিছুই না।”
“ফুয়াদ তোমায় পছন্দ করে।”
“করতেই পারে। সে যে আমায় পছন্দ করে সেটা আমিও জানি। তবে সে তো আর এটা জানে না, যে আমার মনে কী চলে।”
“কী চলে তোমার মনে।”
“না বলি।”
পাশ দিয়ে ঝালবুট যাচ্ছিলো। রুশার জন্য নেবে কি-না ভাবছে। খাবে কি-না সেটাও প্রশ্ন।
“ঝালবুট খাবে?”
“নাহ। ইচ্ছে করছে না।”
“ফুচকা খাবে?”
“নাহ।”
“ফুচকা তো তোমার খুব প্রিয়। তাহলে খাও না কেন?”
“কত কিছুই তো আমার প্রিয় ছিলো। সব কিছু কি আর ধরে রাখতে পেরেছি?”
ফায়াজ আবারও দমে যায় রুশার কথায়। মেয়েটা কিছুক্ষণ পর পর এমন একেকটা কথা বলে যা সহ্য করার মতো না। পর মুহুর্তে আবার ভাবনায় আসে থাক, কথাগুলো তার কষ্টের থেকে কম কিছুই।
রুশাকে দেখছে ফায়াজ। রুশাও বুঝতে পারছে পাশে থাকা লোকটার নজর তার দিকেই। কেন যেন সংকোচ হচ্ছে। এভাবে এক নজরে তাকিয়ে থাকাটা রুশা নিতে পারে না। তাও যদি সেই নজর ফায়াজের হয়।
উপরওয়ালার কাছে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে, আমায় নিয়ে আর কত খেলা হবে? আমায় নিয়ে আর কত হাসি ঠাট্টা হবে? আমার ভাবনা গুলোর সাথে আর কত নড়চড় করা হবে? সে যখন আমায় আগুনে ফেলে চলে গেল, তবে তাকে আবারও কেন পাঠানো হলো। আগুন নেভানোর জন্য নাকি সেই আগুনে আরও ঘি ঢেলে আগুনের তাপ বাড়ানোর জন্য। আমার মনে কষ্ট নামের ফোঁড়ায় পাক ধরতে না ধরতেই তার উপর বিষফোঁড়া তৈরির জন্যই কি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা? আর কত কাঁদতে দেখলে তোমার মন গলবে আল্লাহ।
কিছু কথা রুশার জানা প্রয়োজন। এতে রুশার ভালো হবে কি-না তা জানা নেই তবে সে নিজে মানসিক শান্তি পাবে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে ফায়াজের। কথাগুলোর প্রতি কঠিন জোর দিতে হচ্ছে তাকে। হয়তো এটাই সময়, সব কিছু বলার। গলায় খাকাড়ি দিয়ে ফায়াজ বলতে শুরু করে,
“অভিমান অনেক জমিয়ে রেখেছো নিজের ভেতরে। তাই নিজে ভালো নেই তুমি। রুশা, কিছু কথা ছিলো, যা চাইলেও তখন বলতে পারিনি। আর না পেরেছি তোমার কথা শুনে তোমার সরলতার সুযোগ নিতে। চাইলেই পারতাম রুশা, বিশ্বাস করো চাইলেই পারতাম তোমাকে ব্যবহার করতে। কিন্তু জড়তা কাজ করছিলো ভীষণ এবং সেই সাথে অসহ্য যন্ত্রণার মধ্যে ছিলাম। রুশা, ভালোবাসা অনেকের জীবনে সুখ নিয়ে আসে। আবার অনেকের জীবনে অভিশাপ। ভালোবাসার মানুষ অনেক সময় জীবনে ফেরেশতা হয়ে আসে, আবার অনেক সময় জীবনে ধ্বংসের কারণ হয়ে আসে। আমার জীবনে তোমার আগে অন্য একজন ছিলো।”
বাকি সব কথা উড়িয়ে দিলেও এই কথাটায় আটকে যায় রুশা। অন্য একজন ছিলো! তার মানে এইজন্যই তার স্যার তাকে বার বার রিফিউজ করেছে। ফায়াজকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুশা বলে ওঠে,
“এটা আপনি দুই বছর পর বলছেন আমায়?”
এবার ফায়াজ একটু বিরক্ত হয়। তার কথার মাঝে কেউ কথা বললে তার অসম্ভব মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। তবুও নিজের মেজাজ কন্ট্রোল করে বলে,
“রুশা, আগে কথা বলার সুযোগ দাও। আমি শেষ করি আগে? এরপর না হয় তুমি বলো।”
ফায়াজের কথা বলার ভঙ্গিমা দেখে রুশা চুপ হয়ে যায়। ফায়াজ আবারও বলে,
“লাস্ট সেমিস্টারে তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়। কাকতালীয় ভাবেই আমাদের যোগাযোগ হয়। এরপর থেকে কথা বলতে বলতে আমাদের সম্পর্কের শুরু। আমি ভীষণ রকম চেয়েছিলাম তাকে। তার মাঝেও কোনো কিছুর কমতি ছিলো না। তবে আমার বিশ্বাসে খুঁত ছিলো। আমায় যে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ করে রেখেছিলো সে। আমি বুঝতেই পারিনি। রুশা, ক্যারিয়ার যদি কারো কাছ থেকে তার ভালোবাসা কেড়ে নেয় তখন বলো তো কেমন কষ্ট লাগে। আমারও লেগেছিলো। যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলো, ‘সামান্য টিউশনি করে আমার চাহিদা পূরণ করার ক্ষমতা তোমার নেই ফায়াজ। আমি আর আবেগ ধরে রাখতে চাই না। নিজেকে গুছিয়ে নাও।’ ভাবতে পারো রুশা, নিজেকে তখন কতটা কষ্টে দমিয়ে রাখতে হয়েছে আমায়। তবুও টিউশনি করেছি, রাত জেগে পড়াশোনা করেছি, বি সি এস দিয়েছি। কারণ টিচিং প্রফেশন আমার বাবার খুব পছন্দের। যেখানে কোনো দুর্নীতি নেই। তখন রিলেশন, ভালোবাসা, প্রেমিকা, আবেগ আর কিছু চাইনি। শুধু চেয়েছি একটা ক্যারিয়ার। কিন্তু বুঝিনি রুশা, সে ব্যতীত অন্য কেউও থাকতে পারে যে আমায় মনে প্রাণে চাইতে পারে। বুঝিনি, ক্যারিয়ারের নেশায় মত্ত্ব হয়ে কাউকে জীবন্ত লাশ বানিয়ে দিয়েছি। বুঝিনি, আমার কারণে একটা হাস্যজ্বল প্রাণচঞ্চল কিশোরী খুব সহজেই ভেতর ভেতর আগুনে দগ্ধে শেষ হয়ে গেছে। রুশা, আমি তোমার খোঁজ খবর রাখতাম। তবে শুধুই তোমার পড়াশোনার। আমি বুঝতেই পারিনি নিজেকে এইভাবে শেষ করে দিয়েছো তুমি। তোমায় যখন ভার্সিটিতে দেখেছি কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছি। কিন্তু, আগের রুশাকে না পেয়ে আমি মরমে মরে গেছি৷ উপলব্ধি করতে পারার পর থেকে কাছে চাইতাম। কিন্তু তখন এটা হতো পৈশাচিক কর্মকাণ্ডের একটা অংশ। আমি যেমন তোমায় ফিরিয়ে দিয়েছি, তেমন তোমায় জিতে নিতে চেয়েছি রুশা। তেমন তোমায় জিতে নিতে চেয়েছি।”
রুশার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। মুখে শব্দ নেই। কিন্তু চোখে পানির স্রোত বয়ে চলছে। ফায়াজ রুশার মুখের দিকে তাকিয়ে। হাতটা কোনো ক্রমেই তার স্থির থাকছে না। চট করেই সে রুশার গালে হাত দেয়। পরম যত্নে চোখের পানিগুলো মুছে দেয়।
“রুশা, কেঁদো না। আর কত কাঁদবে? যদি বলি, তোমার সমস্ত কান্নাগুলো আমায় দিয়ে দাও। দেবে আমায়? যদি বলি ভেতরে যত আগুন পুষিয়ে রেখেছো, তাতে আমি ভালোবাসার অমৃত ঢেলে দেবো। সেই অধিকার দেবে আমায়?”
রুশা চুপচাপ শুধু শুনছে ফায়াজের কথাগুলো। মুখে কথা আসছে না। শুধু বুকের মধ্যে তোলপাড় করছে। সব ভেঙে চুড়ে যাচ্ছে।
আজ তিন দিন ধরে বিছানায় শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে গেছে রুশা। সেদিন রাতে শাহীন ভাইয়ার প্রাইভেট কার দিয়ে রুশাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়া হয়। এই তিন দিনে আশরাফ এবং নাসরিন রুশাকে অন্তত চার থেকে পাঁচ জন ভালো ডক্টর দেখিয়েছেন।
রুশা এর আগে কখনো সেন্সলেস হয়নি। সেদিনই হুট করে কেন এইভাবে পড়ে গেল। এটাই মাথায় আসছিলো না তাদের। তবে ডক্টরদের একই কথা, রুশা প্রচুর চিন্তিত থাকে। তার মস্তিষ্কে সব সময় দ্রুত গতিতে রক্ত সঞ্চালন হয়। এর ফলে তার মস্তিষ্কে চাপ পড়ে। এই কারণেই বিপি হাই হয়ে যায়। এই বয়সে বিপি হাই থাকায় প্রায় সব ডক্টররাই অবাক হয়ে গেছে। মেডিসিন দিলেও তারা একটা কথাই বলেছেন, রুশাকে সব সময় হাসি-খুশি থাকতে হবে। বেশি টেনশন করা যাবে না। বিপি হাই হতে দেওয়া যাবে না। নিয়মিত খাবার খেতে হবে। আর কিছুদিন রেস্টে থাকতে হবে।
আশরাফ অফিস থেকে এসেই মেয়ের মাথার পাশে বসে থাকেন। বাকি সময়টা নাসরিন আর রাইসুল দেখে রাখে রুশাকে। মাঝে একদিন রিমি এসে দেখে গেছে। গতকাল থেকে রুশা ঘুমাচ্ছে প্রচুর। তাকে জোর করে ঘুম থেকে তোলা হয় শুধু কয়টা ভাত আর মেডিসিন খাওয়ানোর জন্য। বেঘোরে ঘুমানোর পর রুশা আজ বিকেলে থেকেই সজাগ। তার বিছানার পাশে ফল, জুস সব কিছু দিয়ে ভরপুর করে রাখা হয়েছে।
খাবারে রুশার অরুচি। তবুও বাধ্য হয়েই তাকে খেতে হয়। এই তিন দিন মোবাইলের সাথে তার যোগাযোগ নেই বললেই চলে। রুশা ভাবে, আচ্ছা মোবাইলটা কোথায়? তার যতটুকু মনে পড়ে ফায়াজের কাছ থেকে আসার পর বুকে ব্যথা হচ্ছিলো তার। কোনো দিক না পেয়ে সে তার খালামনির ঘরে চলে যায়। আর সেখানে যাওয়ার পর মাথাটা এমনভাবে ঘুরে যায় যে সামনে অন্ধকার নেমে আসে। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার। ততক্ষণ পর্যন্ত তার হাতেই ছিলো মোবাইলটা। এখন কোথায়?
“আম্মু, এই আম্মু?”
মেয়ের ডাকে নাসরিন দ্রুত মেয়ের ঘরে আসে।
“হ্যাঁ বল।”
“আম্মু, আমার ফোনটা কোথায়?”
“লাগবে?”
“হ্যাঁ। একটু দাও তো।”
নাসরিন মেয়ের হাতে ফোন দিয়ে গ্লাসে জুস ঢেলে মেয়েকে খাইয়ে দেন।
“আমার ওজন এই তিন দিনে প্রায় পনেরো কেজি বেড়ে গেছে আম্মু।”
“হ্যাঁ, আপনাকে তো বলেছে। খা এটা।”
রুশা চুপচাপ জুসটা খেয়ে নেয়। নাসরিন রান্নাঘরে চলে গেলে রুশা মোবাইলটা ওপেন করে। ওয়াইফাই কানেকশন দিতেই মেসেঞ্জারে টুং-টাং শব্দ শুরু হয়। মেসেঞ্জারে গিয়ে দেখে ফুয়াদ প্রায় ২৫+ মেসেজ দিয়েছে। রিমির মেসেজও আছে কিছু। ডিপার্টমেন্টের গ্রুপে মেসেজ। এক এক করে রুশা সব কিছু চেক করে।
মোবাইলের দিকে তাকিয়ে থাকা অবস্থায় একটা আন-নোন নাম্বার থেকে ফোন আসে। মনে হচ্ছিলো কেউ একজন তার ফোন ওপেন হবার অপেক্ষায় ছিলো। রুশা ফোন রিসিভ করে কানে নেয়।
“হ্যালো, কে বলছেন?”
ফোনের ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই রুশা আবারও বলে,
“কে বলছেন?”
এবার ওপাশ থেকে গলা খাকাড়ি দেওয়ার শব্দ তার কানে আসে। সঙ্গে সঙ্গে তার বুকটা ধক করে ওঠে। কন্ঠস্বরটা হুবুহু ফায়াজের মতো। ফায়াজ নয়তো? নিম্ন কন্ঠে আবারও বলে ওঠে,
“হ্যালো, কে বলছেন?”
অপেক্ষায় আছে উত্তরের। তার সেই অপেক্ষাকে অবসর দিয়ে জবাব আসে,
“কেমন আছো রুশা?”
এবার সন্দেহ নেই। এ যে ফায়াজ। কিন্তু সে তার নাম্বার পেয়েছে কোথায়? কে দিতে পারে তাকে নাম্বার? ফোন কেটে দেওয়ার জন্য ফোন কান থেকে নামাতে যাবে এমন সময় ফায়াজ বলে,
“রুশা স্টপ। লাইন কাটবে না একদম।”
আশ্চর্য! সে বুঝলো কী করে যে লাইন কাটবে এখন। ফোন কানেই আছে তার। ফায়াজ বলার পর আর ফোনটা নামায়নি সে। ফায়াজ বললো,
“রুশা, কেমন আছো?”
“ভালো আছি।”
ফায়াজ কথা খুঁজে পাচ্ছে না। খুব কায়দা করে সে রুশার নাম্বার জোগাড় করেছে কথা বলবে বলে। কিন্তু এখন কথা খুঁজে পাচ্ছে না।
এরই মধ্যে রুশা বলে,
“রাখছি।”
“রুশা, শোন।”
রুশা আবারও ভড়কে যায়।
“জি বলেন।”
“দেখা করবে একবার?”
“কোন প্রয়োজনে?”
“সব কিছু কি প্রয়োজন বুঝে হয়?”
“অবশ্যই প্রয়োজন বুঝে হয়। আপনি আমার স্যার ছিলেন। এখন আবার ভার্সিটির লেকচারার। এখনো আপনি আমার স্যার। আমার জানা মতে, একজন স্যারের সঙ্গে তার ছাত্রীর যোগাযোগ একমাত্র প্রয়োজনেই সীমাবদ্ধ। এটা আপনিই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। মনে আছে তো?”
প্রতিটা কথা তীরের মতো বিঁধছে ফায়াজের শরীরে। যেন রুশা তীর ছুড়ে মারছে তাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ফায়াজ আবার বলে,
“দেখা করবে কি-না?”
“আমি অসুস্থ। আজ তিন দিন বিছানা থেকে একমাত্র ওয়াসরুমে যাওয়া ছাড়া নিজেদের ড্রইংরুমটাও দেখিনি। আর আপনি বলছেন দেখা করার কথা।”
“আচ্ছা, দেখা করতে হবে না। ভালো থাকো।”
ফায়াজ নিজেই ফোন রেখে দেয়। রুশার জবাবের অপেক্ষা না করেই কিংবা রুশাকে কিছু বলতে না দিয়েই ফোন রেখে দেয়। কথা হচ্ছে, দেখা করতে না চাওয়াটায় কি তার ইগোতে লেগেছে নাকি সে কষ্ট পেয়েছে? যদি ইগোতে লেগে যায় সেটা ভিন্ন যদি কষ্ট পায় সেটা? হু হু করছে বুকের ভেতরটা? সে কি কিছু বলতে চায়? দেখা করাটা কি উচিত? সাথে সাথে কল ব্যাক করে রুশা।
দুইবার ফোন বেজে যায় কিন্তু কেউ ফোন রিসিভ করেনি। রুশা তৃতীয় বার ফোন করবে না করবে না করেও করে। এবার ফোন রিসিভ হয়।
“হ্যাঁ রুশা বলো।”
“ফোন রিসিভ করলেন না যে।”
“আমি স্টাডিরুমে গিয়েছিলাম একটু। এসে দেখি দুইটা মিসড কল উঠে আছে। কল ব্যাক করতে তোমার নাম্বারে গিয়েছি এর মাঝেই আবার ফোন করলে।”
“ওহ।”
“কিছু বলবে?”
“তখন এইভাবে ফোন রেখে দিলেন।”
“তুমি দেখা করবে না। জোর করি কীভাবে? তাই রেখে দিলাম।”
কন্ঠস্বরটা ভার ভার লাগছে। সে ঠিক ধরেছে, তার স্যার কষ্ট পেয়েছে।
“আপনি আজ ভার্সিটি যান নি।”
“আজ তেমন ক্লাস নেই। তাই যাইনি।”
“ওহ।”
“আর কিছু বলবে?”
কী উত্তর দেবে ভাবছে রুশা। এদিকে রুশার নিস্তব্ধতা ফায়াজকে পোড়াচ্ছে।
“রুশা, তুমি কি কিছু বলবে?”
ফায়াজের প্রশ্নের জবাবে রুশা বলে,
“কোথায় দেখা করতে চান?”
কথাটা শুনে ফায়াজের কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠে। মনে হচ্ছিলো হার্ট-বিট বেড়ে যাচ্ছে তার। রুশা কি তবে দেখা করার জন্য রাজি হয়েছে? আর এটা বলার জন্যই কি তবে ফোন করেছে? সাথে সাথে জবাব দেয়,
“রুশা, দেখা করতে চাইছো?”
“কোথায় আসতে হবে?”
“কোথাও আসতে হবে না। তুমি বিকেলে রেডি থেকো। আমিই আসবো তোমার বাসার সামনে।”
“আপনি আসবেন?”
“হ্যাঁ। আমিই আসবো।”
“আচ্ছা।”
“সাড়ে চারটা কিংবা পাঁচটা নাগাদ আমি আসবো।”
“আচ্ছা।”
ফায়াজ ফোন রেখে দেয়। সে নিজে আসবে তাকে নিতে। এটা ভাবতে পারছে না রুশা। বেশ অবাক লাগছে বিষয়টা। ফায়াজের কষ্টটা সে সহজেই ধরতে পেরেছে। এখন মা’কে ম্যানেজ করতে হবে। নয়তো কী করে যাবে সে? মা যেহেতু সবই জানে। এখন মা’কেই বলা উচিত। কিন্তু তার চিন্তা, মা কি তাকে যেতে দেবে বাহিরে? কেন জানি মনে হচ্ছে তার শরীরে এখন আর কোনো অসুখ নেই। মুহুর্তেই শরীরটা পাতলা লাগছে তার কাছে।
বিকেল চারটা বেজে বিশ মিনিট। রুশা নিজের চুল নিয়ে বিপদে পড়েছে। এই তিনদিনে চুলগুলো কেমন তেল চিটচিটে হয়েছিলো। দুপুরে মা’কে বলে শ্যাম্পু করিয়েছে। এখন কীভাবে বাঁধবে সেটাই ভাবছে রুশা। নাসরিন পাশে বসে আছে।
“আম্মু, চুলগুলো?”
“ছেড়ে রাখ। তোকে ছাড়া চুলে ভালো লাগে।”
“আচ্ছা।”
নাসরিন প্রথমে না করেছিলেন। কয়েক দফায় না করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে চিন্তা করলেন একটু নরম হয়ে দেখাই যাক না মেয়েটা তার ভালো থাকে কি-না। কারণ, আর কেউ না জানুক তিনি অন্তত জানেন তার মেয়ের মনে শুধুমাত্র একজনেরই বসবাস। কিন্তু মেজাজ খারাপ হচ্ছে ওই ছেলেটার ওপর। আগেই সে তার মেয়েটাকে অনেক দুঃখ দিয়েছে। এতটাই দুঃখ দিয়েছে যে তিনি নিজে মা হয়ে নিজের মেয়ের আচরণগুলোর সাথে অপরিচিত হয়ে গেছেন। এখন আবার কেন দেখা করতে চায়? যত্তসব আদিক্ষ্যাতা দেখায়। মেয়েটাও হয়েছে গাধা। যে এত দুঃখ গুলো তার ডাকেই সাড়া দিচ্ছে। ওই ছেলের জায়গায় যদি আশরাফ হতো, তাহলে আশরাফের কপালে খারাপি ছিলো বহুত।
“আম্মু, কী ভাবছো?”
মেয়ের ডাকে ধ্যান ভাঙে নাসরিনের।
“ভাবছি, ফায়াজের জায়গায় তোর বাবা হলে আর আমি তোর জায়গায় হলে তোর বাবার কপালে খারাপি ছিলো। আমি জীবনেও তোর মতো দেখা করতে যেতাম না।”
হালকা হাসে রুশা।
“কেন যেতে না? আমার আব্বু তো প্রচুর হ্যান্ডসাম। তুমিও না করতে পারতে না।”
“একটা কাজ করবি?”
“কী?”
“ইচ্ছামতো খেয়ে আসবি। মিনিমাম বিল করবি ২০০০/৩০০০ টাকা। এরপর একশো কথা শুনাবি।”
রুশা যেন আকাশ থেকে পড়ে। তার মা তাকে এসব কী শিখিয়ে দিচ্ছে?
“আম্মু! তুমি এইসব কী বললে?”
“ঠিকই তো বললাম।”
“আমায় দেখে মনে হয় আমি ৩০০০ টাকার খাবার খেতে পারবো? আর কথা যা শোনানোর তা তো শুনিয়েই দিলাম সেদিন।”
“তুই না খেলে আমার আর রাইসুলের জন্য নিয়ে আসিস।”
“আম্মু!”
নাসরিন হেসে দেয়। মায়ের মুখে হাসি দেখে রুশাও হাসে তবে আগের মতো সেই প্রাণখোলা হাসি আর আসে না তার। নাসরিন মনে মনে বলে, হাস না রে মা। আগের মতো প্রাণ খুলে হাস। তোর হাসিটা দেখার জন্য কলিজা আমার শুকিয়ে গেছে। একটু হাস না মা।
রাইসুল এসে বোনকে রেডি হতে দেখে বলে,
“এই তুমি যাচ্ছো কোথায়? আম্মু, আপু কোথায় যাচ্ছে? আমি এক্ষুনি আব্বুকে ফোন করে বলে দিচ্ছি আপু বাহিরে যাচ্ছে আর তুমি কিছু বলছো না আপুকে।”
নাসরিন ঠোঁট কামড়ে হুড়োহুড়ি করে ছেলের হাত শক্ত করে ধরে।
“এই আব্বুর চামচা, সবই কি আব্বুকে বলতে হয়? ফাযিল ছেলে। তোকে খাওয়াই আমি, পড়াই আমি। আর তুই আব্বু আব্বু করিস কেন রে?”
“তুমি খাওয়াও ঠিকাছে, পড়াও ঠিকাছে কিন্তু টাকা তো দেয় আব্বু।”
নাসরিন ভাবে এইটুকুন ছেলে এত পাকনা কথা বলে কীভাবে? রুশা রাইসুলকে বলে,
“আসার সময় তোর জন্য বার্গার নিয়ে আসবো তা-ও আবার চিকেনওয়ালা বার্গার। কিন্তু শর্ত একটাই আব্বুকে কিছু বলতে পারবি না।”
“ঘুষ দিচ্ছো নাকি। আমি সচেতন নাগরিক। দুর্নীতি করি না।”
নাসরিন বলে,
“আসছে আমার সচেতন নাগরিক। তুই যে আমার পার্স থেকে দশ/বিশ টাকা লুকিয়ে নেস। সেটা দুর্নীতি না?”
রাইসুল ধরা পড়ে গিয়ে চুপ হয়ে গেছে। এখন আর উপায় নেই। এরা যা বলে তা-ই করতে হবে।
“ওকে ওকে। বলবো না যাও। তবে সাথে একটা কোকা কোলা আনবা। নয়তো খবর আছে।”
রুশাও সহমত পোষণ করে।
রিকশায় অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে আছে রুশা। ফায়াজ তার পাশেই বসা। হাতের উপরের অংশটা ফায়াজের বাহুর সঙ্গে মিশছে বার বার। জড়তা হচ্ছে। একই রিকশায় পাশাপাশি তারা দু’জন। ফায়াজ রুশার দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। মেয়েটার মুখটা মলিন হয়ে আছে। হাসিটা যেন কতদূরে হারিয়ে গেছে। খুঁজে আনতে অনেক সময় লাগবে। কিছুই বলতে পারছে না মেয়েটা। তার উপর অসুস্থতা। আরও কাবু করে ফেলেছে মেয়েটাকে।
সংকোচ হচ্ছে ফায়াজের রুশার সাথে কথা বলতে। তবুও কথা বলতে ইচ্ছে করছে। খুব ইচ্ছে করছে। হাতটা ছুঁয়ে দেখতে পারলে ভালো হতো। ছোঁবে নাকি একবার?
“রুশা, কোথায় যেতে মন চাইছে?”
নীরবতা ভেঙে রুশা জবাব দেয়,
“পোস্তগোলা ব্রিজের ওপর।”
“সেখানে যেতে চাও?”
“হ্যাঁ।”
ফায়াজ রিকশাওয়ালা মামাকে বলে,
“মামা পোস্তগোলা ব্রিজে নিয়ে চলেন।”
রিকশাওয়ালা মামা বেশ রসিক মানুষ। একবার পেছনে তাকিয়ে ফায়াজের দিকে মুচকি হাসি দিয়ে চোখের ইশারায় হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়েন তিনি। পানের পিক ফেলতে ফেলতে বলেন,
“আন্নেগো দুইজনরে ভালোই লাগতাছে। তয় আম্মাজানে কি রাগ করছেনি?”
ফায়াজ মুচকি হেসে রুশার দিকে তাকায়। আর রুশা তাকায় ফায়াজের দিকে। ফায়াজ হাসি থামিয়ে বলে,
“আপনার আম্মাজান আমার সাথে রেগে আছেন মামা।”
রিকশাওয়ালা মামা বললেন,
“কিলিগা গো আম্মাজান রাইগা আছেন? রাইগেন না আম্মাজান। জামাইর লগে রাইগা থাওন ভালা দেহায় না। কত্ত সোন্দর রাজপুত্রের লাহান চেহারা আপনের জামাইর।”
এবার দু’জনেই অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে রিকশাচালকের দিকে। কী বললেন তিনি? এখনো কিছুই হলো না, আর তিনি একেবারে তাদের দু’জনকে স্বামী-স্ত্রী বানিয়ে দিলেন। ফায়াজ বলে,
“মামা একটু তাড়াতাড়ি চালান।”
“আইচ্ছা বাজান, আইচ্ছা।”
রিকশাওয়ালা আপন মনে রিকশা চালাচ্ছে। ফায়াজ রুশার উদ্দেশ্যে বলে,
“হঠাৎ ব্রিজে যেতে চাচ্ছো? আমি চাচ্ছিলাম কাছে-পিঠে কোথাও একটা জায়গায় বসতে। তোমার শরীরের অবস্থাটাও তো তেমন ভালো না।”
“নাহ। আজ ব্রিজেই যাই।”
“খোলামেলা আকাশ দেখবে?”
“হ্যাঁ। আর সেই আকাশে কিছু দুঃখ নিলাম করবো। যেখানে দুঃখগুলোকে সুখ বলে মনে হবে। কান্নাগুলোকে হাসি বলে মনে হবে। যেখানে আমার আমিটাকে একটা অবয়ব বলে মনে হবে।”
মন্ত্রমুগ্ধের মতো রুশার কথাগুলো শুনছে ফায়াজ। যেন মনে হচ্ছে, তার কানের কাছে কেউ গুন গুন করে গান গাইছে। মেয়েটার কন্ঠস্বরে একটু পরিবর্তন এসেছে।
“তোমার কথাগুলো আজকাল ভালো লাগে রুশা। আর কি নিলাম করতে চাও?”
“কিছু জমাট বাঁধা কষ্ট আছে, সেইগুলোও ফুরুৎ করে উড়িয়ে দেবো।”
ফায়াজ মুচকি হেসে রুশার কথা বলার ঢং দেখছে। মলিন চাহনির এই ঢংটা সোজা গিয়ে ফায়াজের বুকে লাগছে।
খালামনিকে বলে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি বের করায় রুশা। কিছুক্ষণ চুপ করে ডাইনিং টেবিলে বসে থাকে সে। খারাপ লাগছে ভীষণ তার। পুরো এক বোতল ঠান্ডা পানি একটু একটু খাচ্ছে রুশা।
নাসরিন ডাইনিংরুমে এসে মেয়েকে দেখতে পান। দ্রুত পায়ে গিয়ে মেয়ের পাশে বসে। তিনি কিছু বলার আগেই রুশা তার রক্ত লাল।চোখ নিয়ে তার দিকে তাকায়। আর তিনিও মুহুর্তের মধ্যেই বুঝে যান। ঘটনা যা হবার ঘটে গেছে।
তিনি মেয়েকে বললেন,
“বাসায় চলে যাই। চল।”
রুশার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। তবুও সে বললো,
“খালামনি কী ভাববে? শাহীন ভাইয়া আর ভাবী তারা কী ভাববেন?”
“এই বিপদ যে এখানে উপস্থিত হবে তা কে জানতো?”
“বাদ দাও। তুমি যাও। না হয় সন্দেহ করবে সবাই। ইজি থাকো।”
“তোকে দেখে তো মনে হচ্ছে শরীর খারাপ লাগছে তোর।”
“সমস্যা নাই। আমি একটু বসি এখানে। ধীরে ধীরে ভালো লাগবে। যাও তুমি।”
রুশা মা’কে কোনো রকম বুঝিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দেয়। রুশা বরাবরই তার ভাগ্যকে দোষ দেয়। তার ভাগ্যের মতো নাকি এত খারাপ ভাগ্য আর কারো নেই। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। আপন মনে বলে যাচ্ছে সে, আমার কপালে কি শান্তি নেই? মানে কীভাবে একটার পর একটা খারাপ পরিস্থিতিতে আমায় ফালানো যায় সেই ব্যবস্থাই করা হয়। সব খারাপ পরিস্থিতি কি আমার জন্যই নির্ধারণ করা হয়েছে নাকি?
খুব আনন্দের সাথে শাহীন এবং ওয়াজিফার ছেলের জন্মদিন পালন হয়। কেক কাটার পর্ব শেষ হয়। সবার নজর যখন টেবিলে রাখা কেকের দিকে, ফায়াজের নজর তখন রুশার দিকে। রুশা না তাকিয়েও বুঝতে পারছে ফায়াজের চোখ তাকে দেখছে। এই মুহুর্তটা খুবই অস্বস্তিকর। কেউ যদি সামনা-সামনি এইভাবে নজর দিয়ে তাকিয়ে থাকে তাহলে মনে হয় যেন সব কিছুই থেমে যাচ্ছে। বিরক্তিকর একটা মুহুর্ত। কেক কাটার পরে রুশা সেখান থেকে সরে যায়। তার একটাই চাওয়া যতক্ষণ ফায়াজ এখানে আছে ততক্ষণ পর্যন্ত সে লুকিয়ে থাকতে চায়। আর ফায়াজও যেন তাকে না দেখতে পায়। ফ্ল্যাটের পশ্চিম দিকে একটা ছোট বারান্দা আছে। রুশা তার মা আর খালামনিকে বলে সেই বারান্দায় চলে যায়। সবাই ভেতরে খাওয়া দাওয়া আর কথাবার্তায় ব্যস্ত। এখানে আপাতত কেউ আসবে না। রুশা বারান্দার দরজাটা হালকা টেনে চুপচাপ এখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। ভাবছে, বাঁচা গেল। এখানে অন্তত একান্তে কিছুটা সময় স্বস্তির নিঃশ্বাসটুকুন ফেলতে পারবো। এমন ভাবে তাকাচ্ছিলো মনে হচ্ছিলো যেন চোখ জোড়া দিয়েই আমায় গিলে খেয়ে নেবে। অতি আশ্চর্যজনক!
ঘাড়টা উঁচু করে কিছুক্ষণ উপরের দিকে তাকিয়ে আছে রুশা। আজ আকাশে অনেকগুলো তারা উঠেছে। কিন্তু চাঁদটা মেঘে ঢেকে আছে। কিছুতেই মেঘ থেকে বের হচ্ছে না। হয়তো চাঁদেরও মন খারাপ। নয়তো সে-ও চায় তার মতো আড়ালে আবডালে থাকতে।
তবে মেঘের আড়ালে থেকেও কিন্তু চাঁদকে অপূর্ব লাগছে। এক ফালি আলো তো ছড়াচ্ছে তার চারপাশে সে। এটাই বা কম কিসে।
নাহ, অনেকক্ষণ হলো এখানে এসেছে সে। এবার ভেতরে গিয়ে পরিস্থিতি দেখা উচিত। রুশা ভেতরে যাবে বলে পেছনে ঘুরতেই একটা হাত তার শাড়ির ভাজে থাকা উন্মুক্ত কোমর আঁকড়ে ধরে। রুশা কেঁপে ওঠে।
“কেহ!”
কাঁপা কন্ঠে বার বার প্রশ্ন করছে সে। কিন্তু অপরপাশ থেকে উত্তর না এসে যেন কোমরটা আরও শক্ত করে ধরে আছে কেউ। রুশা তাকাতেই আৎকে উঠে। অবয়ব দেখেই বুঝে গেছে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আর কেউ নয়। এ যে ফায়াজ দাঁড়িয়ে আছে। রুশা প্রাণপণে চেষ্টা করছে ফায়াজের হাতটা সরানোর জন্য। কিন্তু পারছে না। চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করে,
“কী হচ্ছে? আমায় ছাড়ুন।”
ফায়াজ এক ধাক্কায় রুশাকে আবারও বারান্দায় নিয়ে যায়। দেওয়ালের সাথে মিশিয়ে দেয় রুশাকে।
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”
“আমার জানা মতে আপনার কোনো কথা নেই আমার সাথে।”
“কী হয়েছে রুশা? এমন করছো কেন?”
“আপনি কোন সাহসে আমার কোমরে হাত রাখেন? কোন অধিকারে রাখেন?”
“হাত রাখতে বুঝি সাহস এবং অধিকার লাগে?”
“আলবাত লাগে। অবশ্যই লাগে। এভাবে হুটহাট আমায় ছোঁবেন না। আমার অস্বস্তি হয়।”
“লাইক সিরিয়াসলি রুশা! তোমার অস্বস্তি হয়?”
“হ্যাঁ।”
“যাকে ভালোবাসো তার ছোঁয়ায় অস্বস্তি লাগে?”
“ভালোবাসা…! আপনার মুখে ভালোবাসা? আমি কি সঠিক শুনছি? এ তো দেখছি ভূতের মুখে রাম নাম। ফায়াজ কারিমের মুখে ভালোবাসার কথা।”
“ফাইযলামি করছো কেন রুশা?”
“না আপনি আমার ভাই, না আপনি আমার হাই, না-ই আপনি আমার বন্ধু। আপনার সাথে ফাইজলামি করার সম্পর্কও আমার নেই। সো এইসব বন্ধ করুন আর আমায় যেতে দিন।”
“দাঁড়াও এখানে। আমার কথা আছে তোমার সাথে?”
“আমি শুনতে ইচ্ছুক নই।”
“কেন, ভালোবাসা কমে গেছে নাকি?”
এতক্ষণ কোনো কথা না লাগলেও ফায়াজের এই কথাটা রুশার গায়ে লাগে। হ্যাঁ, খুব গায়ে লাগে। তার মনে হচ্ছে, ভালোবাসা কমে গেছে নাকি কথাটা দ্বারা ফায়াজ তাকে টন্ট করেছে। বিদ্রুপ করেছে। খুব বিদ্রুপ করেছে। ফায়াজ বোঝে ভালোবাসা কেমন হয়? সে তো ভালোবাসা কী জিনিস বোঝেই না। সে এই কথা কীভাবে বলে? নিজেকে দমিয়ে রাখার অদম্য ইচ্ছাটা রুশা আর ধরে রাখতে পারলো না। সাথে সাথে জবাব দেয়,
“ভালোবাসা মানে বোঝেন আপনি? ভালোবাসা নামক অনুভূতি আছে আপনার মাঝে? কোন যুক্তিতে প্রশ্নটা ছুড়ে মারলেন আমার দিকে? ভালোবাসা কমে গেছে নাকি? আপনার কাছে সব কিছুই মজা লাগে? এই যে মিস্টার ফায়াজ সাহেব, আপনি হবেন আমার স্যার তবে সেটা ভার্সিটিতে। আপনি ছিলেন আমার স্যার, তবে সেটা দু’বছর আগের অতীত। কী জানতে চান, ভালোবাসি কিনা? ভালোবাসা আগের মতো আছে কি-না? তাহলে শুনুন, আপনার এই প্রশ্নের উত্তরে একটা কথাও বলতে বাধ্য নই আমি। বুঝেছেন আপনি? আশা করি বুঝেছেন। এবার আমার পথটা ছাড়ুন।”
ফায়াজ চুপচাপ রুশার কথা শুনছে। রুশার কন্ঠস্বরই বলে দিচ্ছে তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। চোখে পানি জমেছে। হয়তো পলক পড়লেই গড়িয়ে পড়বে পানিগুলোও। ফায়াজ এখনো ছাড়েনি রুশাকে। রুশা আবারও বলে,
“ভালোবাসলেই যে কথা বলতে হবে কিংবা কথা শুনতে হবে এমন কোনো আইন নিশ্চয়ই জারি করা হয়নি। ভালো তো ভীষণ বেসেছিলাম। কিন্তু বিনিময়ে পেলাম কী? সেই আবেগপ্রবণ, প্রাণচাঞ্চল্য রুশাকে মুহুর্তেই বড় করে দেওয়া হলো। তার কোমল হৃদয়ে ভালোবাসার যেই বীজ বপন করা হয়েছিলো সেই বীজ মাটি খুঁড়ে বের করে দিয়ে সেখানে আস্ত একটা বটগাছ বপন করা হলো। সেদিনের সেই ছোট্ট রুশা মুহুর্তেই বড় হয়ে গেল। ভালোবাসা যে এইভাবে কাউকে বড় করে দেয় আমি জানতাম না। ভালো তো ভীষণ বেসেছিলাম, কিন্তু বিনিময়ে কী পেলাম? রোজ রোজ রিফিউজ। এরপর শেষে আমার মা’য়ের কাছে বিচার দিয়ে মাঝ পথে পড়ানো বন্ধ করে দেওয়া। আরে এতটাই কি বিরক্ত করে ফেলেছিলাম নাকি আমি আপনাকে? আপনি আমায় যেমন দেখতে চেয়েছিলেন আমি এখন তেমনটাই হয়ে গেছি। আশা করি এরপর আমায় আপনি যত দেখবেন ততটাই অবাক হবেন সাথে খুশিও হবেন।”
এবারের কথাগুলো ফায়াজের লেগেছে। হ্যাঁ, রুশার বলা এবারের কথাগুলো ফায়াজের বুকে গিয়ে লেগেছে। রুশা একদম কাট-টু-কাট জবাব দিয়ে দিয়েছে। কোমরে থাকা হাতটা সরিয়ে রুশা সামনে পা বাড়াতে নিলে ফায়াজ বলে,
“ভালোবেসেছিলাম রুশা? ভালোবেসেছিলাম? তার মানে এখন আর সেই ভালোবাসা নেই?”
রুশা তৃতীয় বারের মতো আবারও অবাক হলো। ফায়াজ এখনো এই প্রশ্ন করে। রুশা হালকা হেসে জবাব দেয়,
“আফসোস ফায়াজ সাহেব, আপনি এখনো আমায় এই প্রশ্ন করছেন? আফসোস ফায়াজ সাহেব, আপনি এখনো বুঝেনই না ভালোবাসা কী? আফসোস ফায়াজ সাহেব, যদি দেখাতে সক্ষম হতাম কতটা ভালোবাসি।”
রুশা আর এক সেকেন্ডও সেখানে দাঁড়ায়নি। যদি দেখাতে সক্ষম হতাম কতটা ভালোবাসি– কথাটা ফায়াজের কানে বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দের মতো বেজে ওঠে। বুকের ভেতরটা যেন তার হিম শীতল হয়ে যায়। রুশা কী বলে গেল? মানে তার মনে যেই দ্বিধাটা ছিলো তা এখন আর কাজ করছে না। তবে, রুশা তাকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, রুশা তাকে ভালোবাসে। না চাইতেও চোখে পানি জমেছে তার।
ফায়াজ দ্রুত পায়ে ড্রইংরুমের দিকে যায় এই আশায় যে, রুশাকে হয়তো সেখানেই পাওয়া যাবে।
নাসরিন অনেকক্ষণ যাবত মেয়েকে দেখছেন না। পশ্চিম দিকের বারান্দায় দেখে এসেছেন, সেখানে কেউই নেই। পুরো বাসা ভর্তি মেহমান। কোথায় মুখ শুকনো করে বসে আছে মেয়েটা? ভাবতেই নাসরিনের শরীরে কাটা দিচ্ছে।
ওয়াজিফা নাসরিনকে বললো,
“খালামনি, আপনি এখানে বসে আছেন যে, খাবার খাবেন না?”
“এই তো ওয়াজিফা। তোমাকেই খুঁজছিলাম মা।”
“কী হয়েছে খালামনি?”
“ওয়াজিফা, রুশাকে দেখেছো?”
“মায়ের কাছে শুনলাম বারান্দায় গেছে।”
“নেই তো সেখানে মা।”
“তাহলে কোথায় যাবে? আচ্ছা খালামনি, আপনি বসেন এখানে, আমি দেখছি?”
নাসরিনকে বসিয়ে রেখে ওয়াজিফা এই ঘর ওই ঘর খোঁজা শুরু করে। সব ঘর খোঁজা শেষ। এখন বাকি তাহমিনা বেগম মানে তার শাশুড়ি মায়ের ঘরখানা। ওয়াজিফা সেই ঘরে যায়।
“শাহীন, দ্রুত মায়ের ঘরে আসো। রুশা সেখানে সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছে?”
ওয়াজিফার কথা শুনে উপস্থিত সবাই যেন থমকে যায়। নাসরিন এদিক সেদিক না তাকিয়ে দৌড়ে যায় তাহমিনা বেগমের ঘরে। ফায়াজ যেন জমে গেছে কথাটা শোনার পর। তাহমিনা বেগম সব ফেলে রেখে তার নিজের ঘরে যান। সবার এক প্রশ্ন একটু আগেও তো ভালো ছিলো মেয়েটা। হঠাৎ কী হলো?
ফায়াজও দ্রুত সেই ঘরের দিকে পা বাড়ায়। ততক্ষণে ফায়াজের মা বোনও সেই ঘরে উপস্থিত হয়। ফায়াজ যেতে যেতে শাহীন রুশাকে খাটে শুইয়ে দেয়। নাসরিন কান্নায় ভেঙে পড়েন। ফোনে আবল তাবল বলছেন নিজের স্বামীকে। পুরো শরীর কাঁপছে তার। তিনি এই ভয়টাই পাচ্ছিলেন। কখন জানি একটা বিপদ হয়। মায়ের মন, আগেই সংকেত দিয়ে রেখেছে।
ফায়াজের মা তাকিয়ে আছেন রুশার দিকে। মনে মনে বলছেন, আহা! কী মায়াভরা চাহনি মেয়েটার! কী অপূর্ব লাগছে! কিছুক্ষণ আগেও দেখলাম হাঁটা-চলা করছে। হঠাৎ কী হলো মেয়েটার?
মা’কে এইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারহানা বলে,
“এইভাবে তাকিয়ে আছো কেন মা?”
“দেখ না, মেয়েটাকে কত মায়াবী লাগছে। ঠোঁট জোড়া দেখ। যেন পুতুলের ঠোঁটের মতো। মনে হচ্ছে ঘুমিয়ে আছে।”
“মেয়েটা সেন্সলেস হয়ে গেছে মা। আর তুমি তার রুপের বর্ণনা করছো।”
“ঘুমন্ত অবস্থায় যে নারীকে সব থেকে বেশি সুন্দর লাগে, সে নারী সত্যিই সুন্দর।”
“এ্যা।”
“এ্যা নয়, হ্যাঁ। ভাবছি তোর কাকি বলে ফায়াজের জন্য এই মেয়ের সম্বন্ধ চাইবো।”
এইবার ফারহানার চোখ কপালে উঠে যায়। একটা মানুষ অসুস্থ আর তার মা সেই অসুস্থ মানুষটাকে ছেলের বউ হিসেবে কল্পনা করছে।
“মা, তোমার মাথা ঠিকাছে তোমার? কী সব বলছো? হায়রে মা, ভাইয়ার বিয়ের ভূত কবে নামবে তোমার মাথা থেকে? মেয়েটা অসুস্থ আর তুমি তাকে ছেলের বউ বানাবে। ভাগ্যিস কেউ শোনেনি। নয়তো বারোটা বাজাতো।”
মেয়ের কথা শুনে তিনিও একটু চুপ হয়ে যায়। ফায়াজ তাকিয়ে আছে রুশার দিকে। মেয়েটা তার সামনে থেকে চলে গেল। কিন্তু এখানে এসে এইভাবে সেন্সলেস হবে। তা ভাবেনি সে। ব্যথা হচ্ছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে তার। চাপা ব্যথা। ইচ্ছে করছে সবাইলে ডিঙিয়ে রুশাকে নিজের বুকে চেপে ধরতে। ইচ্ছে করছে রুশার শরীরে নিজের শরীরের সবটুকু উষ্ণতা ঢেলে দিতে। ইচ্ছে করছে রুশামে অজস্র চুমু দিয়ে ঘুম থেকে ডেকে তুলতে। মুহুর্তেই ভাবছে, কী হয়েছে রুশার? এইভাবে সেন্সলেস হওয়ার কারণ কী হতে পারে? ওর এই অসুস্থতা আমি নই তো?
ফায়াজ ক্লাসে এলে রুশার মাথা নিচু হয়েই থাকে। আজও ব্যতিক্রম কিছু হয়নি। ফায়াজ ক্লাসে এসেছে প্রায় ২৫ মিনিট পার হয়ে গেছে। এই ২৫ মিনিটে একবারও রুশার মাথা উঁচু হয়নি। ফায়াজের খুব অস্বস্তি হচ্ছিলো। সে চেয়েছিলো রুশা একবার অন্তত তার দিকে তাকাক। কিন্তু নাহ, রুশা তাকে দেখছে না। ফায়াজ সাথে সাথে বুদ্ধি করে এক চ্যাপ্টারের দশটা সূত্র সবাইকে দেখতে বলে। তার উদ্দেশ্য ছিলো সে রুশাকেও জিজ্ঞাসা করবে। তখন রুশা না তাকিয়ে থাকতে পারবে না।
৫ মিনিট পর ফায়াজ পড়া জিজ্ঞেস করা শুরু করে। ৬ জনকে জিজ্ঞেস করার পরেই সে রুশা বলে ডেকে ওঠে। ফায়াজের কন্ঠে নিজের নামটা শুনেই বুকটা ধক করে ওঠে রুশার। এদিকে ক্লাসের অনেকেই এদিক সেদিক তাকাচ্ছে। কে রুশা? কারণ, অনেকেই জানে রুশাকে রুশা নামে চিনে না। শুধু রিমি আর ফুয়াদ ছাড়া বাকি কয়েকজন তাকে তনিমা আফরোজ নামেই জানে।
রুশা সংকোচ নিয়েই দাঁড়ায়। রুশা দাঁড়িয়ে যাওয়ার পর হালকা গুন গুন হয় চারপাশে। গুন গুন করে একে অপরকে প্রশ্ন করছে স্যার কীভাবে তনিমা আফরোজের শর্ট নেইম জানে? তারা কি পূর্ব পরিচিত নাকি? বর্তমান যুগের ছেলে-মেয়েরা অত্যন্ত স্মার্ট। শুধু স্মার্ট না এরা ওভার স্মার্ট। কিছু একটা আন্দাজ করতে পারলে এর শেষ অবধি দৌড়ায়।
ফায়াজ নির্দ্বিধায় রুশার দিকে তাকিয়ে আছে। রুশার মাথা তখনও নিচু। ফুয়াদ পেছন থেকে রুশাকে দেখছে।। ভাবছে রুশা মাথা নিচু করে আছে কেন? ফায়াজ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে প্রশ্ন করে,
“এনিথিং রং রুশা?”
স্যারের এনিথিং রং কথাটা শুনে রুশা সেই পুরনো দিনে ফিরে যায়। একবার স্যার তার পাশে বসে এই প্রশ্নটাই করেছিলেন তাকে। উত্তরে সে বলেছিলো, নাথিং। আজও অন্যরকম কিছু হয়নি। জবাবে বলে,
“নাথিং।”
“বেঞ্চে কি কিছু আছে?”
“নাহ স্যার।”
“ওকে, লুক এট মি।”
রুশা ফায়াজের চালাকি ধরে ফেলে। সে বুঝে গেছে এইসব পড়া জিজ্ঞেস করা শুধুই ছক মাত্র। স্যার গেইম খেলেছে। রুশা এবারও তাকায়নি। ফায়াজ আবারও বলে,
“রুশা, লুক এট মি।”
রুশা আর না তাকিয়ে থাকতে পারেনি। ফায়াজ ক্লাসের মধ্যে এমন করবে সে ভাবেনি। ফায়াজ রুশাকে পড়া জিজ্ঞেস করছে। রুশা জবাব দিচ্ছে। নিজেকে যতটা পারছে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু ভেতরে উথাল-পাতাল ঢেউ দুলছে। রুশা এবং বাকি সবার মনে হচ্ছে স্যার তাকেই বেশি প্রশ্ন করছে।
ক্লাস শেষে রুশা বের হলেই ফুয়াদ তাকে আটকায়।
“রুশা, বাসায় চলে যাবে?”
“হ্যাঁ। থেকে কী করবো?”
“চলো, কোথাও বসি।”
“নাহ ফুয়াদ। বাসায় যেতে হবে। অন্য আরেকদিন বসবো।”
“তোমার কি মন খারাপ?”
“নাহ, আমি ঠিক আছি।”
রুশার আসলেই ভালো লাগছে না কিছু। সে বাসায় যেতে চাচ্ছে। তাই দ্রুত গতিতে পা ফেলছে। ফুয়াদ আবারও প্রশ্ন করে,
“ফায়াজ স্যার কি তোমার পূর্ব পরিচিত?”
প্রশ্নটা শুনে পা জোড়া থেমে যায় রুশার। যা সন্দেহ করেছিলো, তাই-ই হলো। ফায়াজ সবার মনে সন্দেহের বীজ বপন করে দিয়েছে।
ফুয়াদ আবার জিজ্ঞেস করে,
“কী হলো, বললে না যে?”
“কী বলবো?”
“ফায়াজ স্যার কি তোমার পূর্ব পরিচিত?”
“হঠাৎ এই প্রশ্ন?”
“ক্লাসে তোমার শর্ট নাম ধরে ডাকলেন। আসলে সবাই তো তোমার নাম তনিমা আফরোজ জানে।”
“সবাই জানে। তুমি তো রুশা জানো।”
“তুমি বলেছো বিধায় জানি।”
“তাহলে ভাবতে কেন পারছো না। হয়তো আমার নামের শর্ট ফ্রমটা উনার কানে গিয়েছে। তাই ডেকেছেন। নাম ধরে ডাকা আহামরি কিছু না। তাই না? এ নিয়ে এত কানা-কানি, মাতা-মাতির কিছু আছে বলেও আমার মনে হচ্ছে না।”
“তুমি রেগে যাচ্ছো কেন?”
“রাগার মতো কথা বললে। তাই রাগলাম।”
“আচ্ছা স্যরি।”
“আসছি আমি।”
ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে রাস্তায় হাঁটছে রুশা। মনে মনে বলছে, কাজটা তিনি একদম ঠিক করেননি। আদিক্ষেতা করে রুশা না বললেও পারতেন। অহেতুক সবার মনে সন্দেহ তৈরি করে দিলেন। চাইছেন কী উনি এখন? সমস্যা কী উনার এখন? বিরক্ত করার মানুষ তো উনি নন। তবে এমন কেন করছেন?
পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়………
#স্যার
#পর্ব_১৬
লেখনীতে — আফরোজা আক্তার
রুশার অস্বস্তি হচ্ছে। এতক্ষণ এক টানা এক জায়গায় থাকতে তার ভালো লাগে না। নেহাৎ মা জোর করলেন। সেইজন্যই আসা। সং সেজে বসে থাকতে অসহ্য লাগে তার কাছে।
নাসরিন তার দুঃসম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাড়ি বিকেলে বেড়াতে এসেছেন। এখানে একটা জন্মদিনের অনুষ্ঠান আছে। রুশাকে কয়েকবার আসতে বলা হয়েছিলো কিন্তু সে রাজি হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে মায়ের গোমড়া মুখ দেখে রাজি হতে বাধ্য হয়। কালো রঙের শাড়িটায় রুশাকে বেশ মানিয়েছে। শাড়ি পরতে চায়নি সে। তবুও মায়ের জন্য পরতে হলো। মা শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে তাকে। তাই আর না করেনি।
এইসব অনুষ্ঠানে সাধারণত একটা গ্যাং থাকে। যার নাম আন্টি গ্যাং। যারা অন্যদের নিয়ে সমালোচনায় ব্যস্ত থাকে। রুশার কাছে এইসব বিরক্ত লাগে। কার মেয়ের বিয়ে হয়েছে, কার মেয়ে পালিয়ে গেছে, কার মেয়ের জামাই কেমন, কার মেয়ে অনেক রাজার হাওলাতে আছে এইসবই তাদের মূল আলোচ্য বিষয়।
রুশা মা-ও তাদের সাথেই বসে আছেন। রুশা আরেক পাশের সোফায় বসা। একজন ভদ্রমহিলা নাসরিনকে বললেন,
“আপা, মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে। বিয়ে দিবেন না?”
নাসরিন জবাব দেয়,
“ভাবী, আপনাদের চোখে বড় হয়েছে। কিন্তু আমার মেয়ে এখনো ছোট। সবে অনার্স ফার্স্ট ইয়ার।”
“কী যে বলেন না ভাবী, মেয়েদের এস এস সি শেষ হলেই বিয়ে দেওয়া ভালো।”
“কেন, ভালো কেন?”
“তাড়াতাড়ি সংসার বোঝে। বাচ্চা কাচ্চাও তাড়াতাড়ি হয়।”
“ভাবী, আমার বিয়ে হয়েছে মাস্টার্স শেষ করার পরে। এরপর বিয়ে। বিয়ের অনেক বছর পর রুশা হয়। এখন আপনার কথা ধরলে তো বলতে হয়, আমি এখনো সংসার বুঝি নাই।”
ভদ্রমহিলা তীর ঠিকঠাক লাগাতে পারছেন না। তাই তিনি চুপচাপ হয়ে যান৷ নাসরিন আরেকজনকে বলেন,
“আমার মেয়ে তো বলেই দিয়েছে, সে বিয়ে পরে করবে। আমার আর তার বাবারও একই সিদ্ধান্ত। আগে মেয়ের পড়ালেখা শেষ হবে। এরপর চাকরি করবে। তারপরই বিয়ে।”
“এটাই ভালো ভাবী।” অন্য একজন ভদ্রমহিলা জবাব দেন৷
রুশা ওই মহিলার মুখ দেখছে। ঠোঁট বাকিয়ে মুচকি হাসে সে। মহিলা বেশ ভালো অপদস্ত হয়েছে। যা অন্য সবাই এবং তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছেন।
বাসায় ধীরে ধীরে অনেক মানুষের আগমন ঘটছে। যার বাসায় তারা এসেছে মানে তাহমিনা বেগমের বাসায়, তিনি এসে নাসরিনকে বললেন,
“নাসরিন, বোন বসে আছিস। সমস্যা হচ্ছে কোনো?”
“আরেহ না। ঠিকাছি আমরা।”
“আসলেই আমার ননস আসবেন। সাথে ননসের বড় জা আর তার ছেলেমেয়ে আসবে। আমি দাওয়াত করেছি তাদের। কখনো আসেনি আমার বাসায়। তারা আসলেই আমরা অনুষ্ঠান শুরু করবো।”
তাহমিনা বেগম খুব আনন্দিত। তার ছেলের ঘরের নাতির প্রথম জন্মদিন। তাই বেশ জাকিয়ে অনুষ্ঠান হচ্ছে। নাতিকে কোলে নিয়ে ঘুরছেন। গুলুমুলু একটা বাবু। রুশার দিকে পিট পিট করে তাকিয়ে আছে। তাহমিনা বেগম রুশাকে দেখে হাসি মুখে বললেন,
“আমাদের রুশামনি দেখি বড় হয়ে গেছে। এবার বিয়ে শাদী দিয়ে দিবো।”
রুশা হালকা হাসি দেয়। তাহমিনা বেগম আবারও বললেন,
“এই রুশা, আমার নাতি তোর দিকে কীভাবে তাকিয়ে আছে দেখছিস। ফুপিকে ঠিক চিনতে পারছে।”
রুশা বলে,
“তোমার নাতি বড় হয়ে ফ্লার্টবাজ ছেলে হবে। তার চোখেই লেগে আছে, সে হাজার নারী নাচাবে।”
“যাহ। কী সব বলস। আমার নাতি লাখে একটা হবে।”
“লাখে না খালামনি, বলো কোটিতে একটা হবে।”
“যাহ ফাযিল।”
রুশা হাসি মুখে বাবুকে কোলে তুলে নেয়। সোফায় বসে বাবুকে আদর করছে। বাবুটাও চুপচাপ রুশার আদর খাচ্ছে।
এমন সময় তারা সবাই চলে এলেন। তাহমিনা বেগমের ননস এবং তার বড় জা একত্রে বসার ঘরে ঢুকলেন। সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষ হয়। নাসরিনকে ওই মহিলা আগে থেকেই চিনেন। তাই খুব খাতির হয়ে যায়। তাদের সাথে একটা মেয়েও আছে। রুশার চেয়েও বড় মেয়েটা। আশেপাশে তাকিয়ে তাহমিনা বেগম বললেন,
“ছেলে কই? ও আসলো না?”
জবাবে ওই মেয়েটা বললো,
“ভাইয়ার নাকি ভালো লাগে না আন্টি। তাই আমাদের নামিয়ে দিয়ে গেল। সে আসবে না। তার না-কি খুব কাজ।”
“এটা কোনো কথা?”
খানিক বাদেই কেউ একজন দরজার কাছে এসে দাঁড়ায়। সেখান থেকেই আওয়াজ দেয়,
“ফারহানা?”
সবার নজর দরজার দিকে যায়। সোফায় বসে থাকা মেয়েটা দৌড়ে দরজার কাছে যায়।
“কী ব্যাপার! তুমি না বললা আসবা না? এখন দেখি চলে আসলা।”
“চড় খাবি। মা পার্স ফেলে আসছে। সেটা দিতে আসছি।”
তাহমিনা বেগম হাসি মুখে দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
“ফায়াজ, কত্তদিন পরে আসলা তুমি। ভেতরে আসো।”
“আন্টি আরেকদিন আসবো। আজ যাই।”
“খবরদার যেতে পারবা না। শাহীন শুনলে রাগ করবে। তুমি তার ছেলের জন্মদিনে এসেও চলে যাচ্ছো।”
“আন্টি, মা, কাকি, আর এই ফাযিলটা তো এসেছে। আপনি শাহীন ভাইকে বলবেন। আমি পরে একদিন আসবো।”
ফায়াজের মা উঠে এসে বলেন,
“এত করে বলছে যখন থেকে যা। অন্তত কেক কাটা পর্যন্ত ওয়েট কর। এরপর না হয় চলে যাস। আর তাছাড়া কালকে তো কলেজও নেই।”
ফায়াজের কাকি রোকসানা বেগমও বলেন,
“এই ফায়াজ, এখানে আয়। বোস এখানে। কেক কাটার পর চলে যাস।”
সবার কথা উপেক্ষা করতে পারেনি ফায়াজ। ভেতরে যেতে বাধ্য হয় সে। নাসরিন বেগম প্রথমে বুঝতে পারেননি। ফায়াজ নামটা চেনা চেনা লাগলেও প্রথমে গায়ে মাখেননি। কিন্তু যখনই ফায়াজ বসার ঘরে এসে সবাইকে সালাম দেয় তখনই নাসরিন শিওর হোন এই সেই ফায়াজ যাকে দুই বছর আগে নিজের মেয়ের পরিসংখ্যান টিচার হিসেবে রাখা হয়েছিলো। নাসরিনের হুট করে আগের সব কথা মনে পড়ে যায়।
একই ভাবে নাসরিনকে দেখে ফায়াজও ভড়কে যায়। কিন্তু মুখে কিছু বলেনি।
এদিকে মহিলা সবাইকে ভেতরে যাওয়ার কথা বললে সবাই ভেতরে চলে যায়। ফায়াজ আশেপাশে দেখছে। রুশার মা যখন এসেছে নিশ্চয়ই রুশাও এসেছে। কিন্তু কোথায় রুশা।
এরই মধ্যে তাহমিনা বেগমের ছেলে শাহীন এসে বসার ঘরে উপস্থিত হয়। ফায়াজকে দেখেই হ্যান্ডসেক করে। হাসি মুখে কথা শুরু করে। এক এক করে শাহীনের কিছু কলিগ আসা শুরু করে। শাহীন তাদের সময় দেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে ফায়াজ আশেপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। কোথাও রুশাকে দেখা যায় কি-না।
নাসরিন তার মেয়েকে খুঁজছেন। মেয়েকে নিজের কাছে বসিয়ে রাখা প্রয়োজন। ও ঘরে যেতে দেওয়া যাবে না। মনে মনে সময়কে গালমন্দ করতে ব্যস্ত তিনি। আর সময় পেলো না ফায়াজ এখানে আসার। এমন হলে রুশাকে না আনা-ই উচিত ছিলো।
নাসরিন রুশাকে দেখতে না পেয়ে তাহমিনা বেগমকে বললেন,
“রুশা কোথায় আপা?”
“রুশা তো বউয়ের ঘরে। নাতিকে কোলে করে সেখানে বসে আছে। বউয়ের অন্য বোনরাও এসেছে।”
“ওহ।”
এত মানুষের মধ্যখান থেকে মেয়েকে ডেকে এনে পাশে বসিয়ে রাখাটাও অদ্ভুত দেখাবে। কী করবেন তিনি এখন? রুশা যদি ফায়াজকে দেখে ফেলে পুরো অনুষ্ঠানে তার মেয়ে বিমর্ষ মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াবে যা তার সহ্য হবে না। নাসরিনকে একটু চিন্তিত দেখে তাহমিনা বেগমের ননস রোকসানা বেগম বললেন,
“নাসরিন আপা, আপনাকে এত চিন্তিত দেখা যাচ্ছে কেন? কিছু হয়েছে?”
নাসরিন কথা ঘোরাতে চেয়েও পারছেন না।
“আসলে আপা, মেয়েটাকে দেখছি না তো। তাই আর কি।”
“মেয়ে আছে তো ঘরেই। চিন্তা করবেন না।”
রোকসানা বেগম তার বড় জা মানে ফায়াজের মা’য়ের সাথে নাসরিনের পরিচয় করিয়ে দেন। নাসরিন এতক্ষণে বুঝে গেছে যে ইনি ফায়াজের মা। ইচ্ছা হচ্ছে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্ত্য সব ইচ্ছাকে সব সময় উষ্কানি দিতে নেই। নাসরিন চুপ করে আছেন। হাসতে না চেয়েও জোর করে হাসছেন। আর সবার সঙ্গে কথা বলছেন।
রুশার খালাতো ভাই শাহীন ভাইয়ার বউ অনেক মিশুক একজন মানুষ। শাহীন ভাইয়াও মানুষ ভালো। হাসি হাসি মুখ তাদের। সবার সাথেই হাসি মুখে কথা বলেন। ভালোবেসে বিয়ে করেছে তারা। তাদের বিয়েটাও অদ্ভুত ভাবেই হয়েছে। তখন রুশার এইচ এস সি এক্সাম। পরীক্ষা আর ব্যক্তিগত জীবনে নিয়ে রুশার তখন আশেপাশে তাকানোর সময় নেই। পরে মায়ের কাছ থেকে শুনেছে তাদের বিয়ে নাকি রাত একটায় হয়েছে। বিয়ে হবার পরেই নাকি তারা দু’জন পুরো দুই ঘন্টা মানে রাত তিন টা পর্যন্ত গাড়ি দিয়ে ঘুরেছে। কেউ মানা করেনি। এটা না-কি তাদের ইচ্ছা ছিলো। কিছু কিছু ভালোবাসার সম্পর্ক খুব অদ্ভুত হয়। সেখানে সব অদ্ভুত চিন্তাভাবনার উদয় ঘটে।
শাহীন ভাইয়ার বউ ওয়াজিফা রুশাকে বললো,
“রুশা, বাবুকে তোমার ভাইয়ার কাছে দিয়ে আসো না একটু। আমিই যেতাম, তবে দেখছোই তো একটু রেডি হচ্ছি।”
“ভাবী, বাবু আমার কোলেই থাক না। ভাইয়া তো বাহিরে।”
“নাহ, তোমার ভাইয়া বসার ঘরে। তার কলিগরা এসেছে। তারা বাবুকে দেখতে চাইছে। মা হয়তো অন্য ঘরে ব্যস্ত। যাও না ভাই, একটু দিয়ে আসো।”
“আচ্ছা ভাবী।”
বাবুকে তুলতুক করতে করতে রুশা হাঁটা শুরু করে ড্রইংরুমের দিকে। যেতে যেতে রুশা বাবুর সাথে কথা বলে,
“এই ছেলে, বড় হয়ে একদম মেয়ে নাচাবি না। যে ভালোবাসতে চাইবে তাকেই ভালোবাসবি।
বুঝলি গুপলু সোনা।”
বাবুটা রুশার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। সে বুঝে না রুশা তাকে কী পরামর্শ দিচ্ছে।
বসার ঘরে এদিক সেদিক না তাকিয়ে রুশা য়ার শাহীন ভাইয়াকে বলে,
“ভাইয়া, তোমার ছেলেকে নাও।”
রুশার কন্ঠস্বর অতি সূক্ষ্মভাবে ফায়াজের কানে গিয়ে লাগে। ফায়াজ সঙ্গে সঙ্গে এদিক ঘুরে দাঁড়ায়৷ ফায়াজকে এই মুহুর্তে এইখানে নিজের সামনে দেখে রুশা যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। তার ভাবনাতেও ছিলো না যে ফায়াজকে এখানে সে দেখবে।
শাহীন ভাইয়া রুশাকে বললেন,
“রুশা এখানে আসো। তোমার সাথে আমার কলিগদের পরিচয় করিয়ে দেই।”
রুশার মনে হচ্ছিলো সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে এক্ষুনি। বুকে ব্যথা করছে তার। চিন চিন ব্যথা, যা সরাসরি কলিজায় গিয়ে আঘাত করছে।
“ভাইয়া, আমি ভেতরে যাচ্ছি।”
এই বলে রুশা দ্রুত পায়ে ভেতরে চলে যায়।
ওদিকে রুশাকে আরও একবার শাড়ি পরা অবস্থায় দেখে ফায়াজ যেন নজর সরাতে পারেনি। রুশা যতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে ছিলো ফায়াজের নজর ততক্ষণই রুশাকে দেখছিলো। শেষে রুশাকে অসুস্থ বলে মনে হয় তার। সে বোঝে, রুশার এই সমস্যার কারণ সে নিজেই। কবে সে রুশার এই অসুস্থতা কাটাতে পারবে? কবে সে রুশার এই মলিন মুখে আগের সেই মিষ্টি হাসি ফোটাতে পারবে? খুব বেশি দেরি যেন না হয়ে যায়।
এক সপ্তাহ পর।
খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। আশরাফ এক মনে খাচ্ছেন এমনটাও না। নাসরিনও যে খাচ্ছেন তেমনটাও না। তবে রুশা চুপচাপ খাচ্ছে। কোনো সারা-শব্দ ছাড়া সে খাচ্ছে। মূলত আশরাফ মেয়ের আচরণ নিয়ে খুব চিন্তিত। তার এই চিন্তার উদ্ভব ঘটেছে গতকাল থেকে। গতকাল অফিস থেকে এসেই তিনি অত্যন্ত মানসিক চাপে ছিলেন। সেই সাথে নাসরিনও। তাদের দু’জনের নজরই রুশার দিকে। রাইসুল পাশে বসে আছে। কিন্তু রুশা তার সাথেও তেমন কথা বলছে না। ছোট ভাইটার মনটা যে আকুলিবিকুলি করে বোনের সাথে কথা বলার জন্য সেটা রুশা বোঝে না।
গতকাল অফিসে একটা খারাপ খবর শুনেছে আশরাফ। সেই থেকে তিনি স্তব্ধ হয়ে আছেন। বাসায় আসার পর বার কয়েক জোরাজোরি করার পর তিনি নাসরিনকে ঘটনা খুলে বলেন। তার কলিগ করিম সাহেবের মেয়ে গত পরশু রাত সুইসাইড করেছে। এমন ভাবেই নিজেকে শেষ করেছে যে ডক্টর কোনো উপায় বের করতে পারেনি তাকে বাঁচানোর।
সুইসাইডের কারণ জিজ্ঞেস করলে জানা যায়, মেয়েটা নাকি প্রচুর ডিপ্রেশনে ছিলো। নিজের বাবা-মা কারো সাথেই তেমন ভালো কানেকশন ছিলো না। যেমন রুশার সাথে তাদের তেমন কানেকশন নেই। মেয়েটা নাকি সবার কাছ থেকেই দূরে দূরে থাকতো। যেমন রুশা থাকে। আশরাফ আর নাসরিন যেন, কলিগ করিম সাহেবের মেয়ের মধ্যে নিজেদের মেয়ে রুশাকে খুঁজে পাচ্ছেন। সেই থেকেই দু’জন খুব চিন্তায় আছেন মেয়েকে নিয়ে।
আশরাফ সাহেব ভাবছেন তিনি মেয়েকে যতটা সম্ভব চোখে চোখে রাখবেন। নাসরিন ভাবছেন তিনি যতটা পারেন মেয়ের সঙ্গে গল্পে মেতে থাকবেন। রুশা তাদের বয়সকালের প্রথম সন্তান। আল্লাহ না করুক রুশার কিছু হয়ে গেলে তারা দু’জনেই পাগল হয়ে যাবে।
খেতে খেতে রুশার নজর যায় তার বাবা-মায়ের ওপর। তাদের দু’জনকেই কেমন যেন ভীত লাগছে। রুশা খাবার গিলে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে? এইভাবে তাকিয়ে আছো যে তোমরা?”
মেয়ের প্রশ্ন শুনে একটু ভড়কে যায় আশরাফ এবং নাসরিন। আশরাফ হালকা হেসে জবাব দেয়,
“তুমি অনেকদিন পর তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছো। দেখে খুব ভালো লাগছে মামুনি।”
উত্তরটা নিতান্তই অযুক্তিযুক্ত লাগছে রুশার কাছে। অন্তত তার বাবার কাছ থেকে এমন সব কথা আশা করাও বোকামি। রুশা বলল,
“কী হয়েছে আব্বু? কোনো সমস্যা?”
“নাহ মামুনি। কোনো সমস্যা নেই।”
নাসরিন বলল,
“রুশা, তুই ঠিক আছিস তো মা?”
মায়ের প্রশ্নে একটু অবাক হয় রুশা। হঠাৎ এই প্রশ্ন করলো কেন তার মা?
“আমার কী হবে আম্মু?”
নাসরিনেরও এক পর্যায়ে মনে হতে লাগলো প্রশ্নগুলো অহেতুক। বাবা-মায়ের কাছ থেকে নীরবতা পেয়ে রুশা বলে,
“নিজেকে শেষ করে দেওয়ার পক্ষে আমি নই আব্বু। গতকাল রাতে কিচেন রুমে যাওয়ার সময় তোমার আর আম্মুর কথা শুনেছি আমি। এত চিন্তা কোরো না আমায় নিয়ে। তোমার মেয়ে দগ্ধে দগ্ধে মরবে তবুও নিজেকে শেষ করবে না। কারণ, জীবন তো একটাই আব্বু। আখিরাত বলেও একটা স্থান আছে। সেখানেও জবাব দিতে হবে। আমাদের এই জীবনের ওপর আমাদের কোনো অধিকার নেই। যে জীবন দান করেছেন একমাত্র তারই অধিকার আছে এই জীবন নিয়ে খেলা করার। এইসব আমায় দিয়ে কখনো হবে না আব্বু। যদি হতো আমি সেদিনই শেষ হয়ে যেতাম যেদিন আম্মুর হাতটা আমার গাল অবধি উঠেছিলো। দু’জনকেই বলছি আমি ঠিক আছি। তবে কিছু কথা অস্বীকার করবো না। হ্যাঁ, ভেতরে কষ্ট আছে। এমন অনেক রাত কেটেছে আমার না ঘুমিয়ে। আমি আমার আমিকে অনেক প্রশ্ন করেও উত্তর খুঁজে পাইনি। বাবা হয়ে তুমিও সবটা মায়ের হাতেই তুলে দিয়েছো। একবার এসে প্রশ্ন করোনি যে কী হচ্ছে আমার জীবনে? যা দেখার তোমার স্ত্রী মানে আমার মা দেখেছে। এমন অনেক রাত যায় আমি ঘুমাই না। এমন অনেক বেলা কাটে আমার খেতে ইচ্ছে করে না। আমি অনুভূতি পাই না আব্বু। আমি অনুভব করার শক্তিটাও পাই না আব্বু।”
রুশার চোখে পানি এসে জমাট হয়েছে কিন্তু চোখ বেয়ে পড়ছে না। নাসরিনের গলা ধরে আসছে মেয়ের কথায়। আশরাফের কলিজায় কে যেন ছুড়ি চালাচ্ছে। রুশা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
“অপরাধ করেছি একটা। অনেক বড় অপরাধ। অকপটে বলতে লজ্জা করছে না আমার। আমার অপরাধ ছিলো আমি ভালোবেসেছিলাম। আমার ভালোবাসা উপেক্ষা করে যে মানুষটা দুই বছর আগে চলে গেল সেই মানুষটা এখনো আমার মনেই রয়ে গেছে। আমি কেন তাকে ভুলতে পারছি না। এর উত্তর নেই আমার কাছে। আমি খুব যত্ন করে আমার ভালোবাসা লালন করছি আমার এই মনে। আমার এখন মনে হয়, আমি দুই বছর আগেই অনেকেটা বড় হয়ে গিয়েছিলাম। আর এখন আরও বড় হয়েছি। সব কিছুই বুঝি।”
রুশার গলা বন্ধ হয়ে আসছে। কান্নারা এসে ভিড় জমাতে শুরু করেছে গলায়। রুশা সামনে থাকা গ্লাসের পানিগুলো খেয়ে নেয়। এরপর আবারও বলা শুরু করে,
“যেই মানুষটা আমার সরল মনের ভালোবাসা উপেক্ষা করে চলে গেল। আজ দুই বছর পর আমি কিনা সেই ভার্সিটিতেই এডমিশন নিলাম যেখানে মানুষটা পরিসংখ্যানের লেকচারার! লাইক সিরিয়াসলি! এখন বুঝতেছি জীবন আমায় নিয়ে জুয়া খেলছে। দারুণ খেলায় মত্ত্ব সে।”
ফায়াজের অবস্থানের কথা শুনে মাথায় বাজ পড়ে আশরাফ আর নাসরিনের। আশরাফ এখন বুঝতে পারছে সেদিন কেন তার মেয়ে ভার্সিটি বদলানোর কথা বলেছিলো।
“ভয় পেয়ো না। এবার আর তার ক্যারিয়ার এবং তোমাদের মান সম্মানে কোনো আঘাত আসবে না। কারণ, আমি যে ভেতরগত ভাবেই মরে গেছি অনেক আগে।”
গ্লাসে থাকা বাকি পানিটুকুন শেষ করে রুশা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
“আসছি আমি। আর আব্বু, আমায় নিয়ে এইসব দুঃশ্চিন্তা বন্ধ করো। তোমার মামুনি দিন শেষে তোমাদের সাথেই থাকবে। এটা তোমার মামুনির ওয়াদা।”
রুশা বের হয়ে যায়। আশরাফ এবং নাসরিন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছেন। তা-ও ভালো, মেয়ে আজ তার ভেতরের কিছু কষ্ট তাদের সাথে শেয়ার করে গেছে। মেয়েটা হয়তো এখন মোটামুটি ভালো থাকতে পারবে। আশরাফ মনে মনে ভাবছেন, একবার কি ফায়াজের সাথে দেখা করবেন তিনি? কথা বলা প্রয়োজন। আবার ভাবছেন, যদি পাত্তা না পান। তখন আরও অপমানজনক ব্যাপার হবে।
ক্যাম্পাসে এসে শান্তি পাচ্ছে না রুশা। মনটা খচখচ করছে তার। কিন্তু কারণ জানা নেই। ইদানীং কলিজার নিচে বড্ড ব্যথা হয়। ডক্টর দেখাবে কি-না ভাবছে। সে বোঝে বাসার পরিবেশটাও ভালো নেই। হয়তো তার জন্যই। বাবা-মা প্রতিনিয়ত তাকে নিয়ে ভয়ে আছেন। তাদের ভয়টাও অগ্রাহ্য করার উপায় নেই। তারা ভাবেন, মেয়ে যদি কিছু করে বসে। রুশা ভাবছে আর মলিন হাসি দিচ্ছে।
ফুয়াদ এসে পাশে বসে তার। মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে রুশাকে। রুশার মলিন মুখের এই হাসিটা তার বেশ পছন্দের। যেন সহস্র বছর বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা।
“রুশা, তোমায় একটা প্রশ্ন করি?”
“হ্যাঁ, করো।”
“তোমার এত চুপচাপ থাকার কারণ কী?”
“আমি চুপচাপ থাকতে পছন্দ করি।”
“তোমার একটা ছবি তুলি?”
“নাহ। আমার পছন্দ না।”
ফুয়াদ আর জোর করেনি। বিগত একমাসের উপর হবে তারা এক সাথে ক্লাস করে। মনের কথাটুকু এখনো বলতে পারছে না ফুয়াদ। শুধু এটা ভেবেই যে শোনার পর রুশা বন্ধুত্বটুকু আবার শেষ না করে দেয়। এমন সময় উপস্থিত হয় রিমি। এই রিমিটা সব সময় ভুল সময়ে এসে পড়ে এমনটাই ফুয়াদ ভাবে। কিন্তু কে জানতো, এই রিমিই সঠিক সময়ে এসে উপস্থিত হচ্ছে প্রতি মুহুর্তে।
দূর থেকে পুরো বিষয়টি লক্ষ করে ফায়াজ। এই ফুয়াদ ছেলেটাকে তার পছন্দ হচ্ছে না। কেন পছন্দ হচ্ছে না এর বিশেষ কোনো কারণ নেই। অন্যদের চোখে ফুয়াদ যথেষ্ট ভদ্র একটা ছেলে। ক্লাসেও মনোযোগী। কোনো রকম বেয়াদবিও করে না। তাহলে তার কেন ভালো না? এর কারণ কি তবে রুশা? রুশার আশেপাশে থাকে বলেই কি তার ফুয়াদকে ভালো লাগে না? আচ্ছা, রুশাও কি পছন্দ করে ফুয়াদকে? করতেই পারে। এখানে দোষের কিছু নেই। ফুয়াদ তার ক্লাসমেট। মিলেও ভালো। রুশার সাথে তার বয়সের ফারাকটা অনেক। সেই তুলনায় ফুয়াদ বেশ হ্যান্ডসাম। রুশার পছন্দ হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার কেন খারাপ লাগছে?
স্পোর্টস ডে’র কথা মনে পড়ে যায় তার। সেদিন ওই কক্ষে রুশা তাকে যা যা বলল। রুশা কি তাকেই ভালোবাসে এখনো? মাথায় কিছুই আসছে না ফায়াজের। দোটানায় পড়ে গেছে মানুষটা। তার যে রুশাকে মনে ধরেছে। এখন কী করবে সে? কী করে ফেরাবে আগের রুশাকে? কী করলে রুশা আবারও হাসবে আগের মতো করে? এত এত প্রশ্ন, উত্তর কোথায় মিলবে?
কক্ষ নং ২১৩।
রুশা সবার আড়ালে এখানে এসেছে। মা’য়ের ওপর খুব বেশি না হলেও একটু অভিমান জন্ম নিয়েছে এই মুহুর্তে। শাড়িতে ঠিক মতো পিন দেয়নি বোধ হয়। না হয় খুলে গেল কী করে? রিমিকে খুঁজেছে অনেকক্ষণ। পরে দেখতে পায়, রিমি ফুয়াদের সঙ্গে ডিপার্টমেন্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। সেখান থেকে তাকে ডাকা উচিত হবে না। আবার মাঠ থেকে ডিপার্টমেন্টে যেতেও সময় লেগে যাবে। হাতের কাছেই প্রথম ভবন। সেখানেই দ্রুত উঠে যায় সে। সব ক্লাসেই দু’জন, একজন স্টুডেন্ট বসা। কোনো কোনো টায় স্টুডেন্টরা দল পাকিয়ে বসে আছে। খুঁজতে খুঁজতে ২১৩ নং কক্ষটাই তার চোখে পড়েছে।
একদম কাঁধ থেকে খুলে গেছে শাড়িটা। পেছনে হাত দিতে গিয়ে দেখে ইনারটাও হালকা বের হয়েছে। ভাগ্যিস কেউ লক্ষ করেনি তার দিকে। রিমি থাকলেই হতো। মেয়েটা ওইখানে ফুয়াদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছে।
“ধুর, একে তো গরম। তার ওপর শাড়ি খুলেছে। আম্মু আজকে কী পিন মেরেছে। আম্মুই জানে।”
বক বক করছে আর এদিক সেদিক তাকাচ্ছে কেউ এসে পড়ে কি-না। দরজার চিপার মধ্যে এইভাবে দাঁড়িয়ে শাড়ি ঠিক করা যায়? প্রচন্ড বিরক্ত রুশা। আর কখনো ভার্সিটিতে সে শাড়ি পড়ে আসবে না। এটাই তার শেষ কথা।
হঠাৎ কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখলে সে আৎকে উঠে। এখানে কারো আসার কথা না। কোনো বাজে ছেলে না তো? চট করেই পেছনে তাকায় রুশা। চোখে অন্ধকার দেখছে সে। এ কাকে দেখছে? স্যার যে তার সাথে তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। রুশার ভেতরে আবারও ঝড় উঠেছে। আবারও হাত-পা কাঁপছে। কণ্ঠনালী আবারও শুকিয়ে যাচ্ছে। স্যার জানে কীভাবে সে এখানে?
ফায়াজ চাপা স্বরে বলে,
“কীভাবে শাড়িতে পিন পরেছো যে পিন খুলে যায়। এখনো কি আগের মতোই এমন ছোটাছুটি করো নাকি?”
রুশা তার কথায় বুঝতে পারছে যে সে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছে যে শাড়ির পিন খুলে গেছে। রুশা চাইছে না কথা বলতে। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে। কেমন যেন তীব্র অভিমান মুহুর্তেই ভর করছে মনে। কিন্তু এই অভিমানের কোনো দাম নেই। সে ভালোবাসে। তবে ভালোবাসলেই যে কথা বলতে হবে তা নয়। রুশা মুখে কাঠিন্য এনে নজর অন্যদিকে নেয়।
ফায়াজ রুশাকে ঘুরিয়ে দিয়ে দাঁড় করায়। স্লিভস টান টান করে ভেতরের ইনার সহ শাড়িতে পিন মারে। পিন মারার সময় ইচ্ছে করেই সে রুশার কাঁধে সরু ধারালো পিনের মাথা দিয়ে খোঁচা দেয়। তার ইনটেনশন রুশাকে ব্যথা দেওয়া ছিলো না। রুশা যাতে তার সাথে কথা বলে সেই ইনটেনশন ছিলো। কিন্তু রুশা পিনের খোঁচা অনুভব করার সঙ্গে সঙ্গে নিজের দাঁত-মুখ এক করে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। ব্যথাটা হজম করে নেয়। তবুও কিছু বলে না।
নারী-পুরুষ একত্রে থাকলে শয়তান ধোঁকা দেয়। এটা সত্যি কথা। ফায়াজের ইচ্ছে করছে রুশাকে জড়িয়ে ধরে দুই বছর আগে করা সকল অন্যায়ের জন্য ক্ষমা চাইতে। ইচ্ছে করছে রুশার এক জোড়া মলিন শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁটে নিজের শীতল ভেজা ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে। ইচ্ছে করছে রুশার শাড়ির ভাজে থাকা উন্মুক্ত কোমরে নিজের ঠান্ডা হাত রাখতে। পারফিউমের ঘ্রাণটা তার নাকে আসছে। খুব গাঢ় ভাবেই আসছে। ইচ্ছে করছে রুশার খোলা ঘাড়ে নাক ডোবাতে।
কিন্তু সব ইচ্ছাকে সব সময় বাস্তবে ফলাতে নেই। আর তার পক্ষে তো একেবারেই না। কারণ, রুশা যখন বার বার, বার বার তার সরল মনের ভালোবাসা তুলে ধরেছিলো সে-ও তখন বার বার, বার বার রুশাকে রিফিউজ করে গেছে। তাই, এখন আর তার এইসব ইচ্ছে করা সাজে না। বড্ড বেমানান তার এই ইচ্ছেগুলো।
শাড়ির আঁচল ঠিক করে ছোট্ট একটা ধন্যবাদ বলে রুশা দরজার চিপা থেকে বের হতে নিলে ফায়াজ তার হাতটা ধরে নেয়।
“কিছু কথা আছে আমার। শুনে যাও।”
শান্ত নজরে তাকায় সে স্যারের চক্ষুপাণে।
“আর তো কোনো কথা থাকার কথা না। এখনো কিছু কথা রয়ে গেছে?”
“টন্ট কোরো না আমায়। বিরক্ত লাগে।”
“দয়া করে হাতটা ছাড়ুন। নিউ ফার্স্ট ইয়ারের স্টুডেন্টের সাথে দরজার চিপায় স্যার। জানা-জানি হলে আমার মান-সম্মানের সাথে সাথে আপনার ক্যারিয়ারে দাগ লাগবে। আপনার কাছে সবার উর্ধ্বে হচ্ছে আপনার ক্যারিয়ার। হাতটা ছাড়ুন।”
“পিঞ্চ করে কথাগুলো বলছো। তাই তো?”
“আমায় সাহায্য করেছেন এর জন্য ধন্যবাদ। এবার হাতটা ছাড়ুন।”
“যদি না ছাড়ি। কী করবে? চেঁচাবে? না-কি লোক জোরো করবে?”
রুশার ভেতরটা গলতে শুরু করছে। দম বন্ধ লাগছে। চোখে হয়তো পানিও চলে আসছে। কিন্ত সে মনে প্রাণে চাইছে যাতে তার চোখে পানি না আসে।
“এই মুহুর্তে যদি আমি দম বন্ধ হয়ে মরে যাই। এর দায় কে নেবে? আপনি নেবেন?”
“মানে?”
“আপনাকে দেখলে এখন আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। আমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি না। আমার উন্মাদের মতো লাগে। দু’বছর আগে ঘটে যাওয়া প্রতিটা স্মৃতি গভীর ভাবে আমার মনে পড়ে। তখন নিজেকে রাস্তার পাগল কুকুরের চাইতেও খারাপ মনে হয়। এইযে এই মুহুর্তে, আমার নিঃশ্বাসটা মনে হয় আমার কলিজার গোড়ায় আটকে আছে। আমার কষ্ট হচ্ছে। দেখছেন না আমি ঘামছি। আমায় ছেড়ে দিন প্লিজ। প্লিজ আমায় যেতে দিন।”
রুশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে ফায়াজ। সত্যিই রুশা ঘামছে। কপালে, গলায়, নাকের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চোখ জোড়া লাল হয়ে আছে। নিঃশ্বাস পড়ছে ঘন ঘন। ফায়াজ রুশার হাতটা ছেড়ে দেয়। সাথে সাথে রুশা তার চোখ জোড়া আবারও বন্ধ করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
ফায়াজ প্রশ্ন করে,
“এতটা বদলে গেলে কেন?”
রুশা চলে যাওয়ার আগে উত্তর দেয়,
“ভেঙে যাওয়া মন নিয়ে কখনো একটা মানুষ ভালো থাকতে পারে না। আমিও ভালো নেই। আবার ভালোই আছি। বদলে গেছি কি-না জানি না। তবে ভেতরটা মরে গেছে। আসছি।”
রুশা দৌড়ে কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। চিন চিনে একটা ব্যথা নিয়ে ফায়াজ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
রাত প্রায় সোয়া বারোটা।
নিজের ঘরে পায়চারি করছে ফায়াজ। দুপুরে বলা রুশার কথাগুলো মস্তিষ্কে ঘোরাঘুরি করছে। মেয়েটা সত্যিই আর আগের মতো নেই। সে কি তবে নিজের দুঃখ ভুলতে গিয়ে একটা বাচ্চা মেয়ের মনে অনেক বড় আঘাত করে ফেলেছে? যেই আঘাত সহ্য করতে না পেরে মেয়েটা নিজেকেই পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু সেই সময়ে তারও যে হাত-পা বাঁধা ছিলো। হুট করে একটা নতুন সম্পর্কে জড়াতে চায়নি সে। তাও উনিশ বছর বয়সের একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে। তাছাড়া সে নিজেই তখন বড় ধরনের এক ধাক্কা খেয়েছে।
দরজায় কড়া পড়ার শব্দে পেছনে তাকায় ফায়াজ। ছোট বোন ফারহানা দাঁড়িয়ে আছে দরজায়। বোনের সঙ্গে ফায়াজের দারুণ মিল। একা থাকলে এবং কাজ না থাকলে দু’জন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটায়। বোনের সব কথা সে জানে তার সব কথা বোন জানে। ফারহানা এবার থার্ড ইয়ার স্টুডেন্ট। বাসায় বাবা-মা, বোন আর সে। চারজনের ছোট একটা পরিবার ফায়াজের। ফারহানাকে দেখে ফায়াজের রুশাকে মনে পড়ছে আবারও। তার এই ছোট পরিবারে ওই ছোট্ট রুশাটা যদি আসতো তবে হেসে খেলেই থাকতো। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হচ্ছে এখন।
“কী ব্যাপার লেকচারার ভাই আমার! এত রাতেও পায়চারি? কারণ কী?”
“ঘুমাস নি তুই?”
“ম্যাথ শেষ করলাম মাত্র। বার বার বলেছিলাম, ভাইয়া ম্যাথ নিয়ে পড়বো না। সে-ই জোর করে আমায় ম্যাথে ভর্তি করেছো।”
“সমস্যাগুলো আমায় দেখালেই পারিস।”
“আগে নিজের সমস্যা শেষ করো। পরে আমার ম্যাথের সমস্যা দেখিও।”
“মানে?”
“হয়েছে কী? মুড অফ কেন?”
ফারহানা রুশার কথা জানে আগে থেকেই। তবে কখনো দেখেনি। বোনের কাছে বাকি সব খুলে ভলে ফায়াজ। ফারহানার এবার নিজের ভাইয়ের প্রতি বিরক্ত লাগছে।
“তোমরা পুরুষ মানুষ এমন কেন? যখন সে চেয়েছে তুমি মুনতাহার শোকে কাতর থেকে তাকে রিফিউজ করলা। আর এখন…! দ্বিতীয় কথা আর কি কোনো ভার্সিটি ছিলো না শহরে। ওই মেয়ের এই ভার্সিটিতেই ভর্তি হতে হলো। বেচারি ফেঁসে গেছে।”
“প্রাণবন্ত মেয়েটা আজ একেবারেই নিষ্প্রাণ হয়ে গেছে।”
“পরিসংখ্যানের ওই সূত্র ছাড়া তোমার মাথায় কিছু আছে বলে আমার তো মনে হয় না। এখন কী করবা? কিছু ঠিক করেছো?”
“বুঝতে পারছি না।”
“এক কাজ করো। এত দ্রুত সব কিছু করতে যেয়ো না। না হয় ওই মেয়ে এতসব ট্রমা নিতে পারবে না। আরও কিছুদিন সময় দাও।”
বোন তার নিজের মতো করে যতটা পেরেছে বলে গেছে। বাকিটা ফায়াজের ওপর নির্ভর করে।
মোবাইল হাতে নিয়ে রুশার ফেসবুক টাইমলাইন ঘুরছে ফায়াজ। তেমন কিছুই নেই টাইমলাইনে। মাঝে মাঝে দুই একটা গান শেয়ার করে। আর প্রোফাইল পিকচারটা চেঞ্জ করা। প্রোফাইল পিকচারটায় ক্লিক করলে দেখতে পায়, মিষ্টি একটা মেয়ে শাড়ি পরে খোঁপায় গাজরা দিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি তাহার বহুদূরে। ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসির ভাজে যে সহজেই কান্না লুকিয়ে রেখেছে।
রুশাকে এবং নিজেকে আরও কিছু সময় দিবে সে। হ্যাঁ আরও কিছু সময় দেবে।
খাবার টেবিলে নীরবতা। টেবিলে চার জন মানুষ বসা আছে। অথচ কারো মুখে কোনো কথা নেই। দশ বছরের রাইসুলও তেমন কথা বলে না। আসরাফ খাচ্ছেন কম মেয়েকে দেখছেন বেশি। কেমন যেন শীতল হয়ে গেছে তার চঞ্চলা মেয়েটা। বিগত দুই বছর আগে মেয়ের একটা সমস্যা নিয়ে তার সাথে কথা বলেছিলেন তার স্ত্রী নাসরিন। বাবা হয়ে মেয়ের সাথে ওইসব ব্যাপারে কথা বলতেও ইতস্তত লাগে আশরাফের। তাই সব ভার তিনি স্ত্রীকেই দিয়েছিলেন। কিন্তু নাসরিনকে কোনো কষ্ট করতে হয়নি। কেউ একজন চলে যাওয়ার পর থেকেই তার মেয়ে বদলে গেছে। গভীর রাতে নাসরিন তার বুকে মাথা রেখে চোখের পানি ফেলেন। কেন যেন তখন নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয়। মনে হয় তিনি পৃথিবীর সব থেকে ব্যর্থ বাবা এবং ব্যর্থ স্বামী।
মেয়ের আড়ালে নাসরিন তার স্বামীকে হালকা খোঁচা মেরে দিয়েছেন। আশরাফ ছোট নিঃশ্বাস ফেলেন। মাথা তুলে মেয়ের দিকে তাকান তিনি। প্লেটে খাবার যেভাবে দেওয়া হয়েছে সেইভাবেই আছে। একটা খাবারও বিগত দশ মিনিটেও পেটে যায়নি রুশার। এইভাবে থাকতে থাকতে তার মেয়ে হয় পাগল হয়ে যাবে নয় মরে যাবে। এটা ভেবেই আশরাফ আর নাসরিনের যত ভয়।
পানি খেয়ে তিনি কথা বলার জন্য প্রস্তুত হোন। আজ-কাল মেয়ের সাথে কথা বলতে গেলে তাকেও প্রস্তুতি নিতে হয়।
“রুশা!”
“জ্বি।”
“পায়ের ব্যথা কেমন হয়েছে মামুনি।”
“একটু একটু আছে। সেড়ে যাবে।”
“মেডিসিন নিচ্ছো তো মামুনি?”
“হ্যাঁ।”
“আগামীকাল তো শুক্রবার। তোমার সাত্তার আংকেলের বাসায় দাওয়াত আছে। তুমি যাবে?”
“নাহ আব্বু। আমার ইচ্ছে নেই যাওয়ার।”
“চলো না মামুনি। গেলে ভালো লাগবে।”
“যেখানে যেতেই ইচ্ছে করছে না। সেখানে গেলে ভালো কীভাবে হবে তা বুঝতে পারছি না আব্বু।”
আশরাফ আর কোনো কথা বলেনি। ইদানীং তিনিও কথা বলা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তা মেয়ের সাথে। মেয়েও চুপচাপ থাকে তাদের সাথে। তারাও চুপচাপ থাকে মেয়ের সাথে। প্রায় পাঁচ মিনিট পর রুশা বলে,
“আব্বু, একটা কথা বলার ছিলো। বলবো?”
খুশিতে আশরাফ এবং নাসরিনের চোখ জ্বলে ওঠে। মেয়ে আজ অনেকদিন পর নিজ থেকে কিছু বলতে চেয়েছে। আশরাফ এক মিনিট অপেক্ষা না করেই বললেন,
“হ্যাঁ, বলো মামুনি।”
“আব্বু, এই ভার্সিটিটা বদলানোর কোনো ব্যবস্থা আছে?”
রুশার কথায় বেশ বড়সড় ধাক্কা খায় আশরাফ। এখন ভার্সিটি বদল? কীভাবে কী! তারা স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই অবাক।
“ভার্সিটি বদলানোর ব্যবস্থা বলতে?”
“মানে আমি ভার্সিটি চেঞ্জ করতে চাচ্ছিলাম।”
“কেন মামুনি? এই ভার্সিটিটা তো অনেক ভালো।”
“আসলে আমার ভালো লাগছে না।”
“হুট করে এইভাবে বদলানোর তো ব্যবস্থা নেই। নেক্সট ইয়ার ছাড়া কিছু করাও যাবে না। তাতেও সমস্যা। তোমার ইয়ার লস হবে। কী হয়েছে রুশা? বাবাকে বলো। কোনো সমস্যা? ভার্সিটিতে কেউ কিছু বলেছে?”
রুশা প্লেটে খাবার নাড়াচাড়া করছে। কিছুই বলতে পারছে না। ভেতরের আগুন কাউকে দেখানোর নয়।
“নাহ। কোনো সমস্যা হয়নি। সব ঠিক আছে।”
রাতে শুয়ে আছে রুশা। কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। কাব্যিক টাইপ কিছু। নিজেকে কবি বানাতেও ইদানীং ইচ্ছা জাগে রুশার। অদ্ভুত ইচ্ছা সব। ভাবছে আচ্ছা মন ভেঙে যাওয়া মানুষগুলোই কি তবে কবি হতে পারে?
সে-ও কয়েকবার কিছু লিখতে চেয়েছিলো কিন্তু পারেনি। তার মনে হয়, তার মাথায় কেবল পরিসংখ্যানের ওই কঠিন কঠিন সূত্র ছাড়া আর কিছুই নেই। কাব্যিকতার ক টাও ধারে কাছে নেই। কাব্যিকতা তো দূরে থাক।
সাউন্ড সিস্টেমে রবীন্দ্র সংগীত শুনতে মন চাইছে। ঘড়িতে নজর দেয়। এগারোটা বেজে বিশ মিনিট। এখন সাউন্ড সিস্টেমে গান শুনলে বাবা-মা কি তাকে বকবে? অবশ্য এই দুই বছরে বকা কি জিনিস তা রুশা ভুলে গেছে।
সাত-পাঁচ না ভেবেই রুশা সাউন্ড সিস্টেমে গান প্লে করে। আমারও পরাণ যাহা চায়, তুমি তাই, তুমি তাই গো। আমারও পরাণ যাহা চায়। তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের-ও সন্ধ্যানে যাও, আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়ও মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো। আমারও পরাণ যাহা চায়। তুমি তাই, তুমি তাই গো। আমারও পরাণ যাহা চায়।
গান শুনছে আর গ্যালারি দেখছে রুশা। তাতে আলাদা একটা ফোল্ডার সেভ আছে। যার নাম স্যার নামে রাখা হয়েছে। গ্যালারিতে ফায়াজের প্রায় ৫০+ ছবি সেভ করা। দুই বছর আগে রুশা ফেসবুক থেকে ছবি গুলো নামিয়ে রেখেছিলো। এখন অবশ্য আগের থেকে একটু পরিবর্তন হয়েছেন। টিচার বলে কথা। শুধু টিচার না, রীতিমতো লেকচারার।
গানের সাথে নিজেকে মেলাচ্ছে রুশা। আসলেই কি তাই? স্যার কি তবে সুখের জন্য তাকে ছেড়েছিলো? হৃদয় মাঝে তো সে তার স্যারকেই ধারণ করে রেখেছে এখনো। হয়তো আজীবন রাখবে।
সাউন্ড সিস্টেমে পরবর্তী গান প্লে হয়েছে। আমি চিরতরে দূরে চলে যাবো, তবু আমারে দেবো না ভুলিতে। বাতাস হইয়া জড়াইবো কেশ, বেনী যাবে যবে খুলিতে। আমারে দেবো না ভুলিতে।
এই গানের সাথেও মিল পাচ্ছে সে নিজের। স্যার হারিয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু সে তাকে ভুলতে পারছে না। সত্যিই ভুলতে পারছে না। হয়তো কখনো পারবেও না।
দু’চোখের কোণ বেয়ে পানি গড়াচ্ছে। ঠোঁট জোড়া কাঁপছে ভীষণ। কিন্তু উপায় নেই তার। জোরে কান্না করার কোনো জায়গা নেই। আজ অনেকদিন পর তার চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। ইমোশন জিনিসটা খুব খারাপ। ভেতরটাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়। কিন্তু বোঝার অবকাশ নেই।
পনেরো দিন পর।
আজ ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান। শাড়ি পরে যেতে হবে। রুশা শাড়ি পরতে পারে না। কিন্তু তার শাড়ির অভাব নেই। চোখে যেই শাড়িই ভালো লাগে সেইটাই কেনে। কিন্তু পরা আর হয় না। নিজের পছন্দের ওপর খুব একটা ভরসা নেই তার। সে শুধু মানুষ হিসেবে তার স্যারকেই পছন্দ করেছিলো। মা’কে বলায় মা এসে সব থেকে সুন্দর শাড়িটা বাছাই করে দেয় তাকে। নাসরিন বেশ ভালো মর্ডান চিন্তাভাবনার মানুষ। নাসরিনের মতো হয়েছে মেয়েটা। আশরাফ মাঝে মাঝে রুশার মাঝে নাসরিনের আদল খুঁজে পান। তবে দু’জনের চরিত্র আলাদা। নাসরিন রুশাকে শাড়ি পরিয়ে দেয়।
“খোঁপা করে দেই? নাকি চুল ছাড়া রাখবি?”
“ছাড়া রাখবো না আম্মু। গরম লাগবে পরে। এমনিতেই গরম লাগছে।”
“গরম লাগার তো কথা না। শাড়িটা তো নরমালই।”
“কী জানি, হয়তো আমারই গরম লাগছে।”
“খোঁপা করবি?”
“দাও তাহলে খোঁপা করে।”
“তোর বাবা তো আজ বাসায় আছে। বাহিরে পাঠাই। একটা বেলীফুলের মালা নিয়ে আসুক। তোর তো বেলীফুলের মালা খুব পছন্দের। খোঁপায় পরবি।”
“নাহ আম্মু। ওসবের প্রয়োজন নেই। ওইখানে আর্টিফিশিয়ালের সাদা গাজরা রাখা আছে। ওইবার নিউমার্কেট থেকে কিনে দিয়েছিলে। সেটাই পরিয়ে দাও।”
“আচ্ছা।”
নাসরিন মেয়ের চুল বেঁধে দেন। রুশা সেখানেই বসে হালকা সাজতে শুরু করে। যদিও সাজ তার ততটা ভালো লাগে না। তবুও সাজতে হয় মাঝে মাঝে। সে বিশ্বাস করে, মনের কষ্টকে ঢাকতে সাজটা বেশ জরুরী। সাজের ভাজে কষ্ট লুকানোর মজাই আলাদা। সম্পূর্ণ সাজ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত নাসরিন মেয়ের বিছানায় বসে আছেন। মেয়েকে দেখছেন। কী যে অপূর্ব লাগছে তার মেয়েটাকে! সেই ছোট্ট রুশা আজ ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। একদিন পরের বাড়ি পাঠাতে হবে। কিন্তু মেয়ে কি তার পরের বাড়ি গিয়ে ভালো থাকতে পারবে? মেয়ের মনে যে একজনই বাস করছে।
“মা, চোখে কাজল দিবো? নাকি খালি থাকবে।”
“কালো কাজলটা দে। সুন্দর লাগবে।”
“আচ্ছা।”
চোখটাকে ন্যুড কালারের প্যালেট দিয়ে সাজিয়েছে বলে অপূর্ব লাগছে। মাসকারা দিয়ে ল্যাশগুলো টানা টানা করায় আরও ভালো লাগছে। নাসরিন কয়বার যে মনে মনে মাশা-আল্লাহ বলেছেন এর ইয়ত্তা নেই।
সাজ সম্পূর্ণ। রুশা উঠে দাঁড়ায়। শাড়ি পরাতে তাকে লম্বা লাগছে নাকি সে এমনিতেই লম্বা এটা ভাবছে। নাকি আয়নার দোষ? তাও ভাবছে সে। ঘড়িতে সময় দেখছে রুশা। তাদের দশটায় যেতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন নয় টা বেজে পঞ্চাশ মিনিট। একটু দেরি হবে।
রিমিকে ফোন করে রুশা। রিমি ফোন রিসিভ করে কানে নেয়৷ রুশা বাসায় বসে বুঝে গেছে রিমি এখন ভার্সিটিতে। আশেপাশে অন্যান্যদের বক বক শোনা যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে তার মাথা ধরে গেছে।
“হ্যালো রিমি, তুই কি ভার্সিটি চলে গেছিস?”
“হ্যাঁ। তুই কখন আসবি। রেডি হয়েছিস। সানজিদা তো চলে এসেছে। ওকে যা সুন্দর লাগছে! আমি তোকে দেখার অপেক্ষায় আছি।”
“আমি এখনো বাসায়। একটু পর বের হবো।”
“তাড়াতাড়ি কর। কখন আসবি। সব জায়গায় দেরি করে।”
রুশা ফোন রেখে মায়ের দিকে তাকায়।
“স্লিপার না হিল?”
“কোনটায় তুই কমফোর্ট ফিল করিস?”
“দুটোতেই। তবে পায়ে যে ব্যথা।”
“স্লিপার ভালো লাগবে না। হিলটা ট্রাই কর।”
“আচ্ছা। আব্বুকে বলো আমি বের হবো।”
“তোর আব্বুও হয়তো রেডি। আয়।”
কোনো কারণে আশরাফের অফিস আজ ছুটি। রুশা ভেবেছে বাবার সাথেই যেতে পারবে। সেই অনুযায়ী গতকাল রাতে বাবাকে বলে রেখেছে।
মেয়েকে নিয়ে আশরাফ রওনা দিয়েছেন ভার্সিটির পথে। রিকশায় মেয়ে চুপচাপ বসে আছে। আশরাফের মন চাইছে কথা বলতে। মেয়েটাকে তার ভালো লাগে। খুব ভালো লাগে। অফিসের সবাই যখন রুশাকে নিয়ে প্রশংসা করেন তখন নিজেকে বাবা হিসেবে খুব গর্বিত লাগে সেই সাথে মনটা আনন্দিত লাগে।
“খুব গরম পড়ছে। তাই না মামুনি?”
“হ্যাঁ আব্বু।”
“ঠান্ডা কিছু কিনে দেই?”
“নাহ, লাগবে না।”
“টাকা আছে সাথে?”
“আছে।”
“কত আছে?”
“গুনে দেখিনি।”
আশরাফ ওয়ালেট থেকে পাঁচ’শ টাকার একটা নোট বের করে বললেন,
“এটা রাখো। খরচ কোরো৷”
“আমার লাগলে আমি চেয়ে নিবো আব্বু। এখন দিয়ো না প্লিজ।”
আশরাফ আর কিছু বলেনি। টাকাটা ওয়ালেটে রেখে দিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ে। জ্যামের কারণে বিশ মিনিট পর রিকশা এসে ভার্সিটির সামনে দাঁড়ায়।
“দেরি হয়ে গেল। তাই না মামুনি?”
“সমস্যা নেই। আমি ম্যানেজ করে নিবো। তুমি আসবে ভেতরে?”
“নাহ। তুমি ভেতরে যাও। সময় মতো বাসায় চলে যেয়ো। নয়তো আব্বুকে ফোন কোরো।”
“আচ্ছা।”
রুশা ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। পেছন থেকে হুবুহু নাসরিনের মতো লাগছে মেয়েকে। নাসরিনের হাঁটাও এমন ধীর গতির। আশরাফ রিকশা ঘুরিয়ে দিতে বলেন। বাসায় যাবেন তিনি এখন।
অডিটোরিয়ামের সামনে যেতেই সবার নজর পড়ে রুশার দিকে। মেয়েদের নজর রুশার শাড়ি আর সাজের ওপর। ছেলেদের নজর রুশার সৌন্দর্যের ওপর। সবুজ রঙের সিল্ক শাড়িতে অপূর্ব লাগছে রুশাকে। এত সিম্পল সাজ অথচ এত অপূর্ব।
রুশার একবার অস্বস্তি হচ্ছিলো আবার হচ্ছিলোও না। নিজের ব্যাপারে অস্বস্তি হলে অন্যরা সুযোগ পেয়ে যায়। তাই যতটা পারা যায় নিজেকে কমফোর্ট জোনে রাখা। কয়েক কদম দিতেই রিমি দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে রুশাকে। রুশাও মিষ্টি হাসি দেয়।
“ইশ! আমি কেন ছেলে হলাম না?”
“হলে কী করতি?”
“তোকে নিয়ে পালিয়ে যেতাম।”
“আশরাফ সাহেব থানা পুলিশ এক করে প্যাদানী খাওয়াতো।”
রুশার কথায় রিমি খিল খিল শব্দ করে হাসে। এর মধ্যেই স্পোর্টস টিচার এসে রুশাকে নিয়ে যায়। সেখানে সানজিদা নামের মেয়েটিও ছিলো। স্পোর্টস স্যার রুশাকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। রুশাও মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হ্যাঁসূচক ইশারা করছে।
রুশার এই মাসুম চেহারাটা দূর থেকে লক্ষ করছে একজন। কাছে গিয়ে গাল দুটো টেনে দিয়ে বলতে ইচ্ছে করছে, এই মেয়ে তুমি এত সুন্দর আর ইনোসেন্ট কেন? কিন্তু উপায় নেই।এমন করলে চড় থাপ্পড় খাওয়ার চাঞ্চ বেশি। মনে প্রশ্ন জাগে, রুশার হাত তার গাল অবধি উঠবে তো? মনে তো হয় না। আপাতত দুটো ছবি তুলতে নিশ্চয়ই না করবে না সে। ধীর পায়ে রুশার পেছন দিকে গিয়ে দাঁড়ায় সে। এক হাত দিয়ে রুশার কাঁধে স্পর্শ করলে রুশা পেছনে তাকায়। ফুয়াদকে দেখে হালকা হেসে বলে,
“কী ব্যাপার! তুমি এখানে?”
এই পনেরো দিনে ফুয়াদ আর রুশার সম্বোধন তুমিতে এসেছে। রুশার চোখে ফুয়াদ শুধু একজন বন্ধু। কিন্তু রুশা জানে না ফুয়াদের চোখে রুশা কী? রুশা আর ফুয়াদকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রিমিও এসে দাঁড়ায় সেখানে। রিমির সাথেও ফুয়াদের বন্ধুত্বসুলভ সম্পর্ক। রিমিকে দেখে একটু নারাজ হয় ফুয়াদ। সে চেয়েছিলো একা কথা বলবে রুশার সাথে। কিন্তু তা হলো না।
“আসো তোমার দুটো ছবি তুলি। তোমায় আজ দারুণ লাগছে।”
“ছবি তুলতে ভালো লাগছে না। পরে তুলি?”
রিমি তখন বলে,
“ফুয়াদ, আমার কয়েকটা ছবি তুলে দাও।”
মুখের ওপর না করতে পারে বা ফুয়াদ। তাই ব্যথিত মনে সে রিমির ছবি তুলে দেয়।
এরই মাঝে মেয়েদের নজর পড়ে অন্য আরেকজনের ওপর। সবুজ রঙের পাঞ্জাবিটা তাকে দারুণ মানিয়েছে। স্যারের ওপর ক্রাশ খাওয়া ন্যাকি মেয়েগুলোর অবস্থা দেখে হেসে খুন হওয়ার মতো অবস্থা। এমন ব্যাচেলর স্যার থাকলে কোন ফিমেল স্টুডেন্ট ক্রাশ না খাবে। ফায়াজ আজ পাঞ্জাবি পরে এসেছে। যেহেতু অনুষ্ঠান, তাই একটু ফিটফাট হওয়ার চেষ্টা। এমনিতেও সে ফিটফাট। আজকে একটু বেশিই ফিটফাট হয়েছে মনে হচ্ছে। তার ধারণার বাহিরে ছিলো যে তার পোশাকের রঙের সাথে অন্য একজনের শাড়ির রঙটা হুবুহু মিলে যাবে। স্টেজে এসেই সে রুশাকে দেখতে পায়। পুরো হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে রুশার দিকে। অদ্ভুত ভালো লাগা কাজ করছিলো ওই মুহুর্তে তার মনের মধ্যে। রুশা চুপচাপ এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। সে এখনো এদিকে তাকায়নি। তাকালে হয়তো লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলতো। নয়তো তার নজর এড়িয়ে যাওয়ার জন্য এখান থেকে সরে পড়তো।
এগারোটায় প্রধান অতিথির আগমন ঘটে। সবাই তাকে ফুলের বৃষ্টি দিয়ে বরণ করে। ভার্সিটির গেইট থেকে স্টেজ পর্যন্ত ফুলের বর্ষণ হয়। প্রিন্সিপাল স্যার সহ প্রতি ডিপার্টমেন্টের স্যাররা সবাই প্রধান অতিথির সাথে কথা বলেন। এরপর তাদের আসন গ্রহণ করার জন্য বলা হয়। প্রথমেই ব্যাচ পরানো হবে। মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, ফার্স্ট ইয়ার থেকে দু’জন এসে ব্যাচ পরাবেন। কথানুযায়ী সানজিদা শারমিন নামের মেয়েটি প্রধান অতিথির বাম পাশ থেকে ব্যাচ পরানো শুরু করে। আর রুশা প্রধান অতিথিকে দিয়েই শুরু করে।
এখানে হাসতেই হবে৷ না চাইতেও হাসতে হবে তাকে। মলিন হাসি দিয়ে রুশা সালাম দেয়। প্রধান অতিথিও সালাম গ্রহণ করেন। নাম জিজ্ঞেস করেন।
“নাম কী?”
“তনিমা আফরোজ।”
“গড ব্লেস ইউ।”
“থ্যাংক ইউ স্যার।”
ডান পাশ থেকে এক এক করে সব স্যারদের ব্যাচ পরানো শুরু করে রুশা। প্রত্যেককে একবার করে সালাম দিয়ে ব্যাচ পরাচ্ছে রুশা। পা জোড়া একজনের সামনে এসেই স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্যামেরায় ছবি তোলা হচ্ছে। রুশা এই মুহুর্তে তার স্যার অর্থাৎ ফায়াজের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাত-পা অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার। কলিজায় কামড় পড়ছে অনবরত। কণ্ঠনালী ধরে আসছে। পানির পিপাসা পেয়েছে। হাত তার ফায়াজের বুক অবধি উঠছে না। ফায়াজ তাকিয়ে আছে রুশার দিকে। চাপা স্বরে বলছে,
“মনকে শক্ত করে ব্যাচটা পরাও। সবাই তাকিয়ে দেখছে।”
রুশা যেন তার কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত-পা কাঁপছে তার। কাঁপা হাতে ফায়াজের বুক পকেটের পাশে হাত রাখে রুশা। ফায়াজ লক্ষ করছে রুশার হাত কাঁপছে। ফায়াজের বুকের বাম পাশের জায়গাটা হাত রুশার। ফায়াজ আড় চোখে চারপাশটা দেখছে। একটা সময় ফায়াজ সুযোগ বুঝে বলে,
“বুকের বাম পাশে হাত রেখেছো। বুঝে শুনে ব্যাচ পরাও। ভয় হচ্ছে এখন। কাঁপা হাতে ব্যাচ পরাতে গিয়ে পিনটাই না আমার বুকে বসিয়ে দাও। পরে আমার থেকে যন্ত্রণাটা তোমারই বেশি হবে। সহ্য করতে কষ্ট হয়ে যাবে তোমার।”
রুশার নিশ্বাস ভারী হচ্ছে। সে চাইছে এই ব্যাচ পরানোর কাজটা যত তাড়াতাড়ি শেষ করা যায়। কোনো রকম স্টেজ থেকে নামতে পারলে সে বাঁচে। ফায়াজের সামনে থাকাটা তার জন্য অত্যন্ত যন্ত্রণার। যা সে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
সিঁড়ি বেয়ে দু’জনেই উপরে উঠে যাচ্ছে। রিমি একটু বিরক্ত রুশার প্রতি। তার বিরক্তের যথার্থ কারণ আছে। সে রুশার বদলানোতে বিরক্ত। রুশার চুপ হয়ে যাওয়াতে বিরক্ত। রুশার কথায় কথায় খিল খিল করে না হাসাতে বিরক্ত। আর আজকে চরম বিরক্ত হয়েছে রুশার ফুচকা না খাওয়া নিয়ে। কোন মেয়ে ফুচকা না খায়। কার না ফুচকা পছন্দ। রুশাকে বার বার বলেও ফুচকা খাওয়াতে পারেনি রিমি।
রুশার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিলো। তাই থেমে থেমে হাঁটছে সে। উপরে উঠে খানিকটা সময় দাঁড়িয়ে পড়ে রুশা। রিমি এটাতেও বিরক্ত তবে মুখে কিছু বলেনি। শুধু নরমাল প্রশ্ন করে,
“দাঁড়িয়ে গেলি যে? ক্লাসে যাবি না?”
“যাবো। একটু জিড়িয়ে নেই। পা টা টন টন করছে।”
“ওহ।”
রুশা রিমির মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মলিম হাসি দিচ্ছে সে। সে-ও জানে, রিমি তার উপর খুব বিরক্ত। আর সে এটাও জানে রিমির বিরক্ত হওয়ার কারণ কী?
“খুব বিরক্ত হয়ে আছিস মনে হচ্ছে?”
রুশার প্রশ্নে রিমি মুখ তুলে তাকায়। রুশার চেহারা দেখে রিমিরই কেঁদে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে এই মুহুর্তে। কত্ত সুন্দর রুশা। কিন্তু কোথাও যেন যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। বিশেষ করে রুশার চোখ জোড়া। মনে হচ্ছে, পলক পড়ার সাথে সাথে গড়িয়ে পড়বে পানি। প্রশ্নটাও এমন ভাবে করেছে মনে হচ্ছে রুশার একপাশ কোথাও যেন তলিয়ে গেছে।
“বিরক্ত কেন হবো? বিরক্ত হইনি।”
“মিথ্যা বলিস কেন? তুমি বিরক্ত আমার উপর।”
রিমি আর চুপ থাকতে পারেনি। সরাসরি প্রশ্ন করে,
“কেন এমন চুপসে গেছিস? তোকে এইভাবে দেখতে আর ভালো লাগে না। এইভাবে আর কত? একটা মানুষ আর কত গুমোট হয়ে থাকতে পারে। বলতে পারিস?”
রুশা মলিন হাসি দিয়ে বলে ওঠে,
“আমি গুমোট কোথায় হলাম। আর চুপসেই বা গেলাম কবে। তোর ভুল ধারণা এইসব।”
“আমার ভুল ধারণা? লাইক সিরিয়াসলি!”
“হ্যাঁ।”
“ফুচকা কেন খেলি না। যে রুশা কলেজ মাঠে ফুচকাওয়ালাকে দাঁড় করিয়ে ইচ্ছামতো ফুচকা খেয়েছে সেই রুশা আজ ফুচকার দিকে ফিরেও তাকায় না। কেন? কোথায় সমস্যা তোর? কোথাও একত্রে বসিস না। কারো সাথে কথাও ঠিকমতো বলিস না। ক্লাসের অন্যান্য মেয়েরা অলরেডি গসিপ করা শুরু করে দিয়েছে। তুই নাকি একঘেয়ে টাইপ মেয়ে। আলাদা থাকিস সব সময়। এইসব কী রুশা।”
“তারা আমায় দেখলোই একদিন। এরমধ্যে গসিপ শুরু করে দিয়েছে?”
“গসিপ করার জন্য একদিনের প্রয়োজন হয় না, এক মিনিট-ই যথেষ্ট।”
“আচ্ছা।”
“কী আচ্ছা! রুশা, তুই এইভাবে থাকিস না প্লিজ। দম বন্ধ হয়ে নয়তো স্ট্রোক করে মরে যাবি। কোনদিন ঘুম থেকে উঠে শুনবো তুই মরে গেছিস।”
“সেদিন কিন্তু নিজ হাতে আমায় শেষ সাজা সাজিয়ে দিতে হবে তোকে। এই বলে দিয়ে গেলাম আমি।”
রুশার কথা শুনে কলিজা মোচড় দেয় রিমির। সে কি একটু বেশি বলে ফেলেছে? না না একটু বেশি না, অনেকখানি বেশি বলে ফেলেছে। তার জন্যই রুশা এমন কথা বলেছে। রিমি খুব লজ্জিত তার কথার জন্য।
“স্যরি রুশা।”
“কিসের জন্য স্যরি?”
“এইভাবে বলতে চাইনি। কিন্তু তোকে এইভাবে দেখে আমি খুব অস্বস্তি বোধ করি। আমার সব থেকে কাছের বান্ধবীটা এইভাবে গুমরে গুমরে থাকবে এটা আমি মানতে পারি না। বিশ্বাস কর।”
“রিমি, আমার কী মনে হয় জানিস? আমার মনে হয় আমার মনে পঁচন ধরেছে। ধীরে ধীরে গন্ধ বের হবে। আস্তে আস্তে সেখানে পোকামাকড় বাসা বাঁধবে।”
“রুশা!”
“হ্যাঁ। তা ছাড়া আর কী হতে পারে? আমি কেন হাসতে পারি না। আমি কেন কাঁদতে পারি না। আমি কেন অনুভব করতে পারি না। আমার কোনো অভিযোগ নেই কেন? আমার কারো প্রতি অভিমান হয় না কেন? আমি কেন খাবারে স্বাদ পাই না। গতকাল মা’কে প্রশ্ন করেছিলাম। মা শুনে বলে, খিচুড়ি করে রান্না করি, খাবি?”
রুশার কথার পরিপ্রেক্ষিতে রিমি কী বলবে বুঝতে পারছে না তাই সে চুপ করেই আছে।
রুশা দো-তলা থেকে নিচে ক্যাম্পাসের মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি তার বরাবরের মতো শান্ত হয়ে আছে। রিমিরও ভালো লাগছে না।
“চল ক্লাসে যাই।”
“রিমি, তোর স্যারের কথা মনে আছে?”
রুশার মুখে স্যারের কথা শুনে রিমির মেজাজ আরও অনেক খারাপ হয়।
“বালের স্যার কথা বলস কেন? ওই লোকটা চরম বেয়াদব আর অসভ্য। তার জন্যই আজ তোর এই অবস্থা। যদিও আমি তাকে কখনো দেখিনি। কিন্তু, আই হেইট হিম। ইয়েস, আই হেইট হিম।”
“যদি কখনো সে তোর সামনে এসে দাঁড়ায়। যদি কখনো বলে, আমিই রুশার সেই স্যার। তখন কী করবি তুই?”
“বড় ছোট জ্ঞান করবো না। ইচ্ছামতো কথা শোনাবো। ওই লোক গেছে তো গেছে, তোকে একেবারে শেষ করে দিয়ে গেছে।”
“তার কি আদৌ কোনো অপরাধ আছে?”
“আলবাত আছে। সে চাইলেই পারতো তোকে সময় দিতে।”
“আবার সে চাইলেই পারতো আমার সরলতার সুযোগ নিতে। কিন্তু…!”
“এখনো সে তোর চোখে ভালো?”
“ভালো না, তবে খারাপও না। শুধু বুঝতে পারেনি। আমায় যদি খানিকটা বুঝতো। তাহলেও হতো।”
“আমি ওই বদ লোকের কথা শুনতেই চাই না। আমি এতটুকুই বুঝি ওই লোক তোকে শেষ করে দিয়ে গেছে।”
রুশা মুচকি হেসে বলে,
“চল, ক্লাসে যাই। কষ্ট হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকতে।”
রিমি রুশাকে নিয়ে ক্লাসের দিকে রওনা হয়। এই এতক্ষণ যাবত তাদের কথোপকথনগুলো ফায়াজ সিঁড়ির কোণায় দাঁড়িয়ে থেকে শুনে নেয়। প্রতিটা কথাই ফায়াজের কানে আসে। রুশা যখন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেছে ফায়াজও তখন পেছন পেছন সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে নেয়। তিন সিঁড়ি উপরে উঠেই সে রুশাকে দেখতে পায়। সাথে রিমিকেও। তাই সে দাঁড়িয়ে যায়।
রুশার প্রতিটা কথা ফায়াজ শ্রবণ করে। প্রতিটা শব্দ তার কানে যাচ্ছিলো আর সে অবাক হচ্ছিলো। সে রুশাকে কেমন বানিয়ে দিচ্ছে। কতটা নিষ্প্রাণ করে দিয়েছে সে রুশাকে। কিন্তু তার হাতেও যে কিছুই করার ছিলো না তখন। তাকে যে তখন রাশ টেনে ধরতে হয়েছিলো। মুনতাহার দেওয়া যন্ত্রণা গুলো তাকেও যে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে। ক্যারিয়ার বিল্ড-আপ করার নেশা তাকে এতটাই চেপে ধরেছিলো যে একটা বাচ্চা মেয়ের সরল মনের সরল অনুভূতিগুলোও তখন তার কাছে বিষের মতো লেগেছিলো।
চাপা নিঃশ্বাস ফেলে ফায়াজ ডিপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যায়।
রুশা ক্লাসে গিয়ে বসে। আর তিন দিন পর ক্লাসে আসায় সবাই যেন তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে আছে। যেন সে অন্য গ্রহের প্রাণী। কয়েকজন এসে জিজ্ঞেস করেছে পায়ে কী হয়েছে।
মাঝের সারির পঞ্চম বেঞ্চে বসে থাকা ছেলেটা তাকিয়ে দেখছে রুশাকে। মন্দ লাগছে না মেয়েটাকে দেখতে। মনে ধরেছে খুব। কথা বলা যেতেই পারে। আফটার-অল ক্লাসমেট বলে কথা।
ফুয়াদ নিজের জায়গা ছেড়ে রুশার পেছনের সিটে বসে। রুশা তখন চুপচাপ মোবাইল দেখছে। রিমি কথা বলছে অন্যজনের সাথে। ফুয়াদের মনটা খচখচ করছে রুশার সাথে কথা বলার জন্য।
“এক্সকিউজ মি?”
কারো কথা শুনে রুশা ঘাড়টা সামান্য ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়। রুশাকে দেখে ফুয়াদ হালকা হেসে বলে,
“পরিচয় হতে এলাম। যেহেতু ক্লাসমেট আমরা। পরিচয় হওয়া যেতেই পারে।”
রুশাও হালকা হেসে বলে,
“আমার নাম রুশা। ভালো নাম তনিমা আফরোজ।”
“আমার নাম ফুয়াদ। ভালো নাম আবদুল আহসান।”
“সুন্দর নাম।”
“ধন্যবাদ। আপনাকে প্রথম দিন দেখেছিলাম। এরপর আর আসেননি।”
“প্রথম দিনই ছোট একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয় আমার। পায়ে ব্যথা পেয়েছিলাম খানিকটা। তাই রেস্টে ছিলাম।”
“এখনো তো মনে হয় ব্যথা আছে। খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটছিলেন দেখলাম।”
“হ্যাঁ একটু-আধটু আছে।”
“কথা বলছি। বিরক্ত হচ্ছেন না তো।”
“একদমই না। আপনি তো বিরক্ত হওয়ার মতো কিছু বলছেন না। তাহলে রাগ করবো কেন?”
“আপনাকে দেখতে এতটা বিষন্ন লাগছে কেন? “আমার তো তা মনে হচ্ছে না।”
কথার এক পর্যায়ে ক্লাসে স্যার চলে আসে। তাই আর কথা বেশি বলতে পারেনি ফুয়াদ। ইচ্ছে করছিলো রুশার পাশে গিয়ে বসতে। কিন্তু উপায় নেই। রুশা যেই বেঞ্চে বসেছে সেখানে আর জায়গা নেই।
পুরো পঁয়তাল্লিশ মিনিট ক্লাস শেষে স্যার চলে যাওয়ার আগে ঘোষণা করেন,
“তনিমা আফরোজ আর সানজিদা শারমিন এই দু’জন দাঁড়িয়ে যাও।”
নিজের নাম শুনে রুশা দাঁড়ায়। স্যার তখন বলেন,
“তোমাদের দু’জনকে সিলেক্ট করা হয়েছে। সামনে অ্যানুয়েল স্পোর্টস এর অনুষ্ঠানে তোমরা দু’জন প্রধান অতিথি সহ বাকি স্যারদের ব্যাচ পরাবে। সানজিদা শারমিন প্রধান অতিথির বাম পাশের সব স্যারদের পরাবে এবং তনিমা আফরোজ, তুমি প্রধান অতিথি সহ তার ডান পাশের সমস্ত টিচারদের ব্যাচ পরাবে। এবারের ফার্স্ট ইয়ারদের থেকে তোমাদের বাছাই করা হয়েছে। কোনো গন্ডগোল করা চলবে না।”
রুশা অবাক হয়ে ভাবে এত স্টুডেন্ট থাকতে রুশাকেই কেন বাছাই করা হলো? অন্য কোনো কারণ নেই তো।
সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে যাবে এমন সময় হাতে থাকা পরিসংখ্যান বইটা পড়ে যায়। হয়তো তাড়াহুড়োতেই এমন হয়েছে। ক্লাস থেকে কোনো রকম বের হয়ে দ্রুত পায়ে নেমে যাওয়ার সময় এমন অঘটন ঘটলো। ক্লাসে ফায়াজ তাকে দেখেছে। বাম পাশের চার বেঞ্চ পর যখন ফায়াজ নাম জিজ্ঞেস করলো, দু’জনের পর রুশা দাঁড়ায়। কে জানে ফায়াজের মনে তখন রুশাকে দেখে ধাক্কা লেগেছিলো কি-না? যেমনটা রুশার লেগেছিলো ফায়াজকে দেখে।
রুশাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফায়াজের চেহারায় পরিবর্তন আসেনি। এটা লক্ষ করেছে রুশা। তবে অস্বস্তি হচ্ছিলো তার। ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছিলো ফায়াজের সামনে থাকতে। ভেতরটা লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছিলো। তবে অবাক করার মতো একটা কান্ড ঘটেছে। আর সেটা ছিলো, ফায়াজ তার নাম জিজ্ঞেস করেনি৷ নাম না জিজ্ঞেস করেই বলেছিলো, জিপিএ ফোর পয়েন্ট এইট জিরো? উত্তরে রুশা জ্বি ছাড়া আর কিছুই বলেনি। ফায়াজ নেক্সট উচ্চারণ করলে রুশা বসে যায়। মনের মধ্যে তুফান উঠেছে, স্যার তার পয়েন্ট জানে কীভাবে? কে বলেছে? নাকি স্যার তার খোঁজ রেখেছে? এত কিছুর পর নিশ্চয়ই খোঁজ রাখবেন না আর। তবে কে বলতে পারে? মিম আপু নয়তো? বলতেই পারে, আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। তার সাথে তো আবার স্যারের গলায় গলায় ভাব ছিলো। এখনো আছে কি-না, কে জানে?
বইটা তড়িঘড়ি করে তুলে সামনে পা বাড়াতেই ফায়াজকে দেখতে পায় রুশা। আবারও সব কিছু এলোমেলো হচ্ছে তার। নাহ, সব কিছু এলোমেলো হতে দেওয়া যাবে না। সে ভালোবাসে। হ্যাঁ, সে ভালোবাসে। তার ভালোবাসা বড্ড যত্ন করে বানানো। বহুত কষ্টে আগলে রাখা ভালোবাসা তার। না হোক মানুষটা তার। তাকে নিজেকে বশে রাখতে হবে। নয়তো আবারও এলোমেলো হয়ে যাবে সব কিছু। মানুষটা খুব ব্যক্তিগত।। হ্যাঁ, এই মানুষটা তার খুব ব্যক্তিগত। এই ব্যক্তিগত মানুষটাকে সে তার হৃদ মাঝারে রেখে দিয়েছে। কোনো এক লুকানো জায়গায়। অতি যত্নে। পরম আদরে।
এমন ভাবে পা বাড়াচ্ছিলো যেন মনে হচ্ছে সে চোর। কিছু চুরি করে ধরা পড়ার ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছে। ফায়াজ তখনই আরেকজন স্যারের সাথে কথা সেরে একা হয়েছে। রুশা পাশ কাটিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় হোঁচট খায়। ভাগ্যিস সামনে দেওয়াল থাকায় দু’হাত দিয়ে দেওয়াল আঁকড়ে ধরে। ফায়াজের সামনেই ঘটনাটা ঘটেছে। কী বলবে, বুঝতে পারছে না সে। তবে ভাবছে, এত সুন্দর ফ্রেশ জায়গায় রুশা হোঁচট খেল কী করে? মেয়েটা কি তবে আজও আগের মতোই আছে? সেই চঞ্চল, সেই দুষ্টু বুদ্ধিওয়ালি। তবে দেখে তো এমন মনে হচ্ছে না। কেমন যেন চুপসে যাওয়া এক জীবন্ত প্রাণীর মতো লাগছে তাকে। উপরটা ঠিকঠাক তবে ভেতরটা মরা।
ফায়াজের খুব জানতে ইচ্ছে হচ্ছে রুশা ব্যথা পেয়েছে কি-না? অন্য কিছু না হোক, অন্তত মানুষ হিসেবে মানবিকতার দিক থেকে প্রশ্ন করা যেতেই পারে।
“ব্যথা পেয়েছো?”
বুকে ঝড় উঠেছে। প্রশ্নের উত্তর নেই। যেই ব্যথা অতীত তাকে দিয়েছে সেই ব্যথার কাছে এই ব্যথা কিছুই না।
“আমি ঠিকাছি।” বলেই রুশা সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়।
রাস্তার পাশে ফুটপাতের ওপর দিয়ে হাঁটছে রুশা। কেন এই ভার্সিটিতে এডমিশন নিলো সে? কেন আবারও দেখা হলো তাদের? কেন আবারও স্মৃতি গুলো মনে পড়ছে? ভালোবাসা এমন অদ্ভুত কেন হয়? এ এমন একটা অনুভূতি যা এক দিনেই আঁকড়ে ধরে। আবার এ এমন একটা অনুভূতি যা শত কিংবা সহস্র বছরেও আঁকড়ে ধরতে পারে না।
সে কি এখনো সিঙ্গেল? বিয়ে করেছে? বাচ্চা আছে? মন বলছে, কী সব স্টুপিড চিন্তাভাবনা করছিস রুশা? দুই বছরে কেউ বাচ্চার বাপ হয়? যদি হয়, হয়তো বিয়ে হয়েছে। অন্যদিকে মস্তিষ্ক বলছে, ইচ্ছা থাকলে এক সপ্তাহে বাচ্চার প্ল্যান করা যায় আর এখানে তো দুই বছর। এক বছরে বারো মাস তাহলে দুই বছরে বারো যোগ বারো সমান সমান চব্বিস মাস। বাচ্চা হতে সর্বোচ্চ নয় মাস। বেশ অনেক সময়। বাচ্চার বাপ হতে নিশ্চয়ই নয় মাসের অধিক সময় লাগে না?
কখন যে ফুটপাত থেকে নিচে নেমে রাস্তায় চলে এসেছে খেয়াল নেই রুশার। উল্টো সাইড থেকে অটোরিকশা হর্ণ দিতে দিতেও রুশা সরার সুযোগ পায়নি। সাথে সাথে পায়ের পাতার ওপর চালিয়ে দেয় রিকশা। রুশা সাথে সাথে রাস্তায় বসে পড়ে।
“মা গো।” বলে চেঁচিয়ে ওঠে।
আশেপাশের লোকজন দৌড়ে আসে। রিকশাওয়ালা রিকশা থামায়। এক্ষেত্রে রিকশাওয়ালার দোষ নেই। দোষটা রুশারই। সে মেইন রোডে নেমেছে। ভাগ্য ভালো অটোরিকশা ছিলো। সি এন জি কিংবা প্রাইভেট কার অথবা বাস হলে আজকে একেবারে পিষিয়ে রেখে যেতো।
রিকশাওয়ালা বেশ চোটপাট করছে। রুশা তখন পা চেপে ধরে বসে আছে রাস্তায়।
“ওই মাইয়া, চোখে দেহো না। মরনের এত শখ ক্যান? আজাইরা পাগল ছাগল মানুষ। আমার রিকশার তলেই আইয়া পড়ে।”
আশেপাশের লোকজন রুশার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। সাধারণত এমন দুর্ঘটনায় ভিক্টিম বেশ চোটপাট করে। কিন্তু এখানে ঘটনা উলটো৷ ভিক্টিম চুপচাপ বসে আছে। উলটো রিকশাওয়ালা কথা শোনাচ্ছে। এমতাবস্থায় এক ভদ্রলোক বলেন,
“মা, ব্যথা বেশি পাইছো?”
“নাহ, আমায় একটা রিকশা ধরে দেন আংকেল।”
“আচ্ছা, আসো উঠো দেখি।”
কয়েকজন মিলে রিকশাওয়ালাকে চুপ করিয়ে পাঠিয়ে দেয়।
আরেকটা রিকশা ধরে রুশাও বাসায় রওনা হয়। উপরওয়ালা আজ সাথে ছিলেন, নয়তো আজ হয়তো শেষ দিন হতো তার জীবনে। বিপদ কানের নিচ দিয়ে গেল। পায়ের দিকে নজর দেয় রুশা। অসম্ভব রকম ফুলে আছে বাম পা টা। ইশ! লাল হয়ে আছে। ছিলে গেছে বেশ খানিকটা। এই পা এখন কয়েকদিন তাকে ভোগাবে। খুব ভোগাবে।
আজ তিন দিন পার হয়ে গেছে।
এর মধ্যে দু’দিন ফায়াজের ক্লাস ছিলো। ফায়াজ ক্লাসে এসেছে ঠিকই। কিন্তু তার নজর রুশাকে খুঁজেছে। এই খোঁজার কারণ কী? নাকি অকারণেই খুঁজছে এই নজর রুশাকে। ফায়াজ পড়াচ্ছে ঠিকই। কিন্তু তার পড়া গুলো খাপ ছাড়া লাগছে। এগুচ্ছে না ঠিকঠাক মতো। স্টুডেন্টরাও একটু কাচুমাচু করছে। স্যার পড়াচ্ছেন কী?
প্রথম দিন রুশার সাথে রিমিকে দেখেছিলো ফায়াজ। হয়তো বেশ ভালো সম্পর্ক তাদের দু’জনের। কারণ পুরো ক্লাসেই রিমি রুশার সাথে কথা বলছিলো। ভালো সম্পর্কগুলো খুব সহজেই মানুষের চোখে পড়ে। এক্ষেত্রেও বিপরীত কিছু নেই। কিন্তু ফায়াজ তো এই মেয়েকে চিনেই না। শুধু নামটুকুই জানে, রিমি। সেদিন নাম বলেছিলো। আর গতকাল পড়া জিজ্ঞেস করায় পেরেছিলো। ব্যাস এইটুকুই। চেনা নেই জানা নেই হুট করে তাকে রুশার কথা জিজ্ঞেস করা উচিত হবে তো? বাই এনি চাঞ্চ যদি রিউমার ছড়িয়ে দেয়। তবে ক্যারিয়ার শেষ। কিন্তু রুশার অনুপস্থিতিটাও তাকে তীর ছুঁড়ে মারছে। কিন্তু কেন? এর উত্তর নেই।
ক্লাস শেষে রিমি বের হলে ফায়াজ রিমিকে দাঁড় করায়।
“এক্সকিউজ মি, মিস রিমি?”
স্যারের ডাকে রিমি দাঁড়িয়ে যায়। কন্ঠস্বরটা একটু ভারী কিন্তু শুনতে বেশ। সহজেই কানে লাগার মতো। রিমি সালাম দেয়। ফায়াজও সালাম নেয়। স্যারকে বেশ ভদ্র মনে হচ্ছিলো রিমির কাছে। কত্ত সুন্দর করে ডাকলেন। ফায়াজ প্রশ্ন করে,
“ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, ক্যান আই আস্ক ইউ আ কোশ্চেন?”
রিমি জবাব দেয়,
“শিওর স্যার। প্লিজ।”
“হয়ার ইজ রুশা?”
স্যারের মুখে রুশার নাম শুনে বেশ অবাক হয় রিমি। পরিসংখ্যানের অংকের সূত্র ধরে ফলাফল মেলানোর মতো এই ফলাফল মেলাতে ব্যস্ত রিমি। উত্তর দেবে কী? স্যার রুশাকে চেনে? সেদিনও নাম জিজ্ঞেস না করে রুশার পয়েন্ট বলে দিলো। স্যারকে দেখে রুশার ওমন করাটা। এখন আবার আলাদাভাবে দাঁড় করিয়ে রুশা কোথায় জিজ্ঞেস করা। কেমন জানি গোলমেলে লাগছে সবটা। রিমিকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফায়াজ আবারও প্রশ্ন করে,
“রিমি, রুশা কোথায়?”
স্যারের প্রশ্নের জবাবে রিমি বলে,
“রুশা একটু অসুস্থ। সেদিন বাসায় ফেরার পথে ছোট-খাটো একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।”
অ্যাক্সিডেন্টের কথা শুনে ফায়াজের বুকটা ধক করে ওঠে। এক সেকেন্ড সময় না নিয়ে পরবর্তী প্রশ্ন করে,
“অ্যাক্সিডেন্ট! কীভাবে? কোথায় আছে এখন? কী অবস্থা এখন?”
“স্যার, রুশা ভালো আছে। একটা অটোরিকশা তার রিকশা রুশার পায়ের ওপর তুলে দেয়৷ ওরও খেয়াল ছিলো না। আনমনে হাঁটছিলো হয়তো। বাম পা টা ফুলে গেছে। আর সাইড থেকে খানিকটা ছিলে গেছে। তাই দু’দিন রেস্ট নিচ্ছে। আগামীকাল হয়তো আসবে।”
নিশ্চিন্ত হতে পারছে না ফায়াজ। ভেতরে কী যেন চুরমার হচ্ছে। কিন্তু কী চুরমার হচ্ছে, তা বুঝতেছে না সে। রিমি সালাম দিয়ে চলে যায়। ফায়াজ এসে অফিস রুমে বসে। বাকি স্যাররা হয়তো ক্লাস নিতে গেছে। গোটা অফিস রুমে সে একা।
ভাবছে রুশার কথা। দুই বছরে কতখানি বদলে গেছে মেয়েটা। কথাও বোধ হয় খুব কম বলে। চোখ জোড়া আগের থেকে অনেক গভীর হয়েছে। বিয়ে হয়েছে বলে তো মনে হচ্ছে না। আচ্ছা, রুশা কী কোনো রিলেশনে আছে? কোনো নতুন সম্পর্কে পা রেখেছে? আগে যেমন ভালোবাসি ভালোবাসি বলে পাগল করে তুলতো এখনো কি আগের মতোই ভালোবাসে? নাকি আমার দেওয়া ব্যথাগুলোতে মলম লাগিয়ে নিজে ভালো থাকার উপায় খুঁজে নিয়েছে?
দুটো বছর। হ্যাঁ, দু দুটো বছর পর তাকে সেদিন দেখার পর ভেতরটা নড়ে উঠেছে। রাতের ঘুমটাও ঠিকঠাক মতো হলো না। দূরত্ব এতটাই করে দিয়েছিলাম যে খুঁজেও পায়নি আমায়। তবে কেন এই দুটো বছর পর তার এখানেই আসতে হলো? ক্যারিয়ার সাজাতে ব্যস্ত ২৯ বছরের ছেলেটা আজ ক্যারিয়ার সাজিয়ে ৩১ বছরের সুদর্শন পুরুষ হয়েছে। সেদিনের সেই অবুঝ ১৯ বছরের মেয়েটি আজ ২১ এ পা রেখেছে। হয়তো অনেক কিছু বুঝতে শিখেছে। মন কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছে আজ চারটা দিন। এই আচরণের কারণ কী হতে পারে? সেই ১৯ বছরের মেয়েটি না তো?
সেদিন সম্পর্ক নামক শব্দটা আর ভালোবাসা নামক শব্দটাকে ঘেন্না লাগতো। কিন্তু আজ কেন যেন ভালোবাসা নামক শব্দটাকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। ভালোবেসে বড় ধাক্কা খাওয়া সেদিনের সেই ছেলেটা এতদিন পর ভালোবাসাকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। বয়স বাড়ছে, কিন্তু মন যেন অবুঝ হচ্ছে।
মোবাইল হাতে নিয়ে ফেসবুক লগ ইন করে ফায়াজ। রুশার ফেসবুক আইডি টার নাম এখনো মনে আছে তার। তনিমা আফরোজ রুশা। সার্চ করতেই একদম প্রথমেই একটা আইডি চলে আসে। প্রোফাইল পিকচারটা বেশ সুন্দর। লাল ড্রেস পরা। কাঁধে চাদর জড়ানো। গালে হাত দিয়ে বসে আছে। চোখ জোড়া একদম শান্ত এবং শীতল। আজ প্রায় বহুদিন পর রুশার আইডি ঘুরছে সে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার নেশায় তখন এতটাই মগ্ন ছিলো যে সব বাদ দিয়েছিলো জীবন থেকে। কিন্তু এখন সব কিছুকেই জড়াতে ইচ্ছে করে।
“ফায়াজ সাহেব, ক্লাস নেই আর?”
পেছন থেকে ডিপার্টমেন্ট হ্যাড মোস্তাফিজ স্যার বলে উঠলেন। ফায়াজ দ্রুত মোবাইলের স্ক্রিন-লাইট অফ করে দেয়। হালকা হাসি দিয়ে মাথা নাড়ে।
“আজ আর নেই। বাসায় চলে যাবো ভাবছি।”
“ওহ আচ্ছা। তা চা দিতে বলি?”
“নাহ স্যার। লাগবে না।”
“চিন্তিত লাগছে কেন? কিছু হয়েছে?”
“নাহ স্যার।”
“সামনের মাসে তো অ্যানুয়েল স্পোর্টস এর অনুষ্ঠান। আমাদের ডিপার্টমেন্ট থেকে ফার্স্ট ইয়ার থেকে দুটো স্টুডেন্ট বাছাই করবেন। তারা প্রধান অতিথিকে এবং বাকি টিচারদের ব্যাচ পরাবে।”
“জি আচ্ছা, স্যার।”
“চা খান। দিতে বলি?”
“নাহ স্যার। আজ আর খাবো না।”
হাঁটতে একটু কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু তবুও হাঁটছে রুশা। ব্যথাগুলোকে বিশ্রাম দেওয়া প্রয়োজন। নয়তো এরাও তাকে কষ্ট দেবে। রুশা তার জীবন থেকে কষ্টগুলোকে একটু একটু করে দূর করতে চায়।
নাসরিন এসে মেয়ের পাশে দাঁড়ায়।
“ঘুমাস নি?”
মায়ের প্রশ্নে মুখ তুলে তাকায় সে মায়ের দিকে।
“হাঁটার চেষ্টা করছি। ভাবছি কাল ভার্সিটি যাবো।”
“এই পা নিয়ে?”
“ক্যাম্পাস অবধি আব্বু এগিয়ে দেবে। সমস্যা হবে না।”
“বাড়ি ফিরবি কী করে?”
“রিমি থাকবে তো।”
নাসরিন তাকিয়ে আছে মেয়ের দিকে। তার মেয়েটা বদলে গেছে। আগের মতো ছোটাছুটি করে না। বেশি কথা বলে না। তার কোলে মাথা রাখে না। ছুটির দিন গুলোতে নিজের ঘরে সাউন্ড সিস্টেমে রবীন্দ্র সংগীত শোনে। আর বাকিদিন গুলোতে পড়াশোনা। না কোথাও বেড়াতে যায়। না কোথাও বসে কথা বলে। নাসরিন জানে, মেয়ের মনে এখনো সেই মানুষটাই বসবাস করছে। মাঝে মাঝে মেয়ের শান্ত মুখটা দেখলে বুকটা ছ্যাত করে ওঠে।
একজন স্যার। যেই স্যারের জন্য তার মেয়ে এতটা বদলে গেল। কে জানে মেয়ের কপালে কী আছে?
নাসরিন কিছু না বলে চলে যেতে নিলে রুশা বলে,
“আম্মু, কোনো কিছুতে অনুভূতি পাই না কেন গো? খাবারেও স্বাদ লাগে না। রুচি নষ্ট হয়ে গেল নাকি কে জানে?”
মেয়ের কথা শুনে কলিজাটা নড়ে ওঠে নাসরিনের।
“খিচুড়ি করি কালকে? খাবি?”
“নাহ থাক। যাও ঘুমাও গিয়ে।”
নাসরিন আর কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। রুশা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। আজ আকাশে চাঁদ উঠেনি। তবে কি আজ আকাশেরও মন খারাপ?