Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 146



আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-২০+২১+২২

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(২০)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৪৬)
নিজরুমে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে নিজের নাকের সাথে বরফের থলি চেপে ধরে আছে রাজিবুল। মুখশ্রী জুড়ে রাগের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। তার চারপাশে বসে আছে রফিকুল, ঊর্মিলা, শেফালি ও রাহেলা বেগম। রাজিবুল রাগী স্বরে বললো….

—“তোমরা এতোজন মানুষ থাকতেও রিজওয়ান আমাকে পর পর ২দিন আ*ঘা*ত করতে পারলো। তোমাদের যদি আমি আমার বিপদের সময়েই পাশে না পাই তাহলে তোমাদের মতো প্রিয়জন আমার কাছে থাকা না থাকা তো সমান। আ*ঘা*ত পাওয়ার পর সেই আ*ঘা*তে*র জ্বা*লা বাড়াতেই যে তোমরা আমার কাছে থাকো সেটাও বুঝতে আমার বাকি নেই।”

রফিকুল বললো….
—“দেখ ভাই, তুই আমাদের ভুল বুঝছিস।”

—“আমি ভুল কিছুই বুঝছি না। আজ এই মুহূর্ত থেকে তোর আর আম্মার রাস্তা আলাদা আর আমার রাস্তা আলাদা। আমার কোনো পরিকল্পনায় আমি তোদের সঙ্গ পেতে চাই না। এক্ষুণি আমার রুম থেকে বেড়িয়ে যাবি তোরা সবাই। আম্মা আপনিও যান।”

রাহেলা বেগম কোনো প্রতিত্তুর না করে নিরবে রাজিবুলের কথা মেনে নিয়ে স্থান ত্যগ করলেন। রাজিবুলের এমন আচারণ ঊর্মিলার মোটেও পছন্দ হয় নি। তাই সে রফিকুলকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাহিরে চলে যায়। শেফালি শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো….

—“রাগের মাথায় অতিরিক্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে বলে মনে হচ্ছে না তোমার!”

রাজিবুল শেফালির দিকে ক্ষি*প্ত নজরে তাকিয়ে বললো…

—“এই সিদ্ধান্ত আমার আরো আগেই নেওয়া উচিত ছিলো। এখন ওদের কাউকে নিয়ে আমার কাছে সাফাই গাইতে আসবে না তুমি। তাহলে কিন্তু ফল মোটেও ভালো হবে না বলে দিলাম।”

শেফালি আর কিছু না বলে বসা থেকে উঠে রুমের বাহিরে চলে যায়। রাজিবুল নিজমনে বিরবিরিয়ে বললো…

—“খুব শীঘ্রই তোর নাম ও নিশান এই পৃথিবীর বুক থেকে চিরতরের জন্য মুছে ফেলার ব্যবস্থা করবো আমি রিজওয়ান। এই রাজিবুলের শরীরে আ*ঘা*ত করার ফল কতোটা ভ*য়া*ব*হ হতে পারে তা সময় তোকে বুঝিয়ে দিবে।”

(৪৭)
আজ শুক্রবার…..
আরহামের বাসায় দুপুরবেলার দাওয়াত উপলক্ষে রিজওয়ান আর মেহরিন তৈরি হয়ে নিচে আসতেই রুমির সাথে দেখা হয়ে যায় ওদের। আঙিনায় তখন ৪র্থ কোনো ব্যক্তি উপস্থিত ছিলো না। মেহরিন রুমির সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো….

—“কি ব্যপার রুমি, তুমি এই সময়ে এখানে দাঁড়িয়ে আছো যে!”

—“ভাবী তোমরা দু’জনেই বাহিরে যাচ্ছো মনে হচ্ছে!”

—“হ্যা, তোমার ভাইয়ার বস তার বাসায় দাওয়াত দিয়েছেন আজ আমাদের। সেখানেই যাচ্ছি।”

—“ভাবী বাড়িতে আজ ওরা সবাই আছে। তোমাদের অবর্তমানে আমার সাথে ওরা যদি কোনো খারাপ আচারণ করে বা বড় ভাইয়া রিজওয়ান ভাইয়ের মা*ই*রের ব*দ*লা নিতে আমাকে আঘাত করে তখন কি হবে! আমার যে ভিষণ ভ*য় করছে।”

রুমির মুখে এরূপ কথা শুনে রিজওয়ান ওর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে বললো…

—“আমরা না আসা পর্যন্ত পুরো সময়টা তুই আমাদের রুমে থাকতে পারিস। আর হ্যা রুমের দরজা ভিতর থেকে আটকে দিস। ওরা কেউ আমাদের রুমে যাবে না। তোকে খুজতে তোর রুমে গিয়েও তোকে না পেলে বুঝবে তুই বাড়িতে নেই। তুই কোনো অ*ন্যা*য় করিস নি। তাই তোর ওদের ভ*য় পাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসছে না।”

রিজওয়ানের কথায় রুমি কিছুটা সন্তুষ্ট বোধ করে। অতঃপর সে নিরবে সিঁড়ি বেয়ে উপরে রিজওয়ানদের রুমের ভিতরে প্রবেশ করে দরজা ভিতর থেকে আটকে দেয়। রিজওয়ান আর মেহরিন পুরো দৃশ্যটা দেখে বাসা থেকে বের হয়।

বাসার সামনেই ওদের নিয়ে যাওয়ার জন্য পূর্ব থেকেই গাড়ি দাঁড় করানো ছিলো। রিজওয়ান ও মেহরিন গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি তার আপন গতিতে চলতে শুরু করে। প্রায় ৪৫ মিনিট পর গাড়িটি চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট পেরিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। মেহরিনের সিটের পাশের জানালা খোলা থাকায় সে বাহিরের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। গাড়িটি চলছে যেই রাস্তা দিয়ে তার দু’পাশে রং-বেরঙের ফুলের গাছ লাগানো রয়েছে। ফুলগুলো নিজ নিজ রূপে সজ্জিত হয়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে মনখুলে হাসছে যেনো। কিয়ৎক্ষণ পর গাড়ি থেমে গেলে মেহরিন আর রিজওয়ান গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। এই অল্প সময়েই বাহ্যিক পরিবেশটা মেহরিনকে মুগ্ধ করে দিয়েছে। রিজওয়ান আর মেহরিনের আসার খবর পেয়ে আরহাম ও আমজাদ নিজরুম থেকে বেড়িয়ে মূল দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। আরহাম হাসিমুখে বললো…

—“রিজওয়ান সাহেব, আপনি আমার দাওয়াত কবুল করেছেন দেখে ভিষণ ভালো লাগলো। ভিতরে আসুন আপনারা।”

আমজাদ হাসিমুখে বললেন…
—“তোমাদের দু’জনের সাথে পুনরায় সাক্ষাৎ করার ভিষণ ইচ্ছে ছিলো আমার। কিন্তু ব্যস্ততার জন্য সময় করে উঠতে পারি নি। তোমাদের এখানে আসার বিষয়ে আরহাম আমাকে পূর্ব থেকে অবগতও করে নি। ওর তরফ থেকে পাওয়া এই সারপ্রাইজটি আমার কাছে বিশেষ হয়ে থাকবে সবসময়।”

মেহরিন আর রিজওয়ান হাসিমুখে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। অতঃপর ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে পরে ওরা সবাই। মেহরিন বললো……

—“চাচা, আরফাকে দেখছি না যে! ও কোথায়? ওকেও ডাকুন। মেয়েটা ভাড়ি মিষ্টি। ১ম দিন ওর সাথে ঠিকভাবে কথাও বলা হয় নি আমাদের।”

আমজাদ কিছু বলার পূর্বেই আরহাম বললো…..
—“আরফা ওর রুমে আছে। আর ওকে এখানে না আনাই ভালো।”

মেহরিনের হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রীতে মলিনতার ছাপ স্পষ্ট হয়। প্রথম দিন আমজাদ তাদের আরফার সাথে আরহামের করে যাওয়া আচারণ সম্পর্কে অবগত করেছিলো। সেই কারণেই যে তিনি এখন এখানে আরফাকে উপস্থিত করতে চাচ্ছেন না তা মেহরিনের বুঝতে বাকি রয় না।

(৪৮)
নিজরুমে বিছানায় বসে আছে আরফা। আজও তার হাতে তার মা সানজিদের ছবি রাখা। আরফার দৃষ্টি তার মায়ের ছবির উপরেই স্থির। আরফা ওর মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো….

—“আর কিছুসময়ের-ই অপেক্ষা মাম্মাম। তারপর তোমাকে বাবাইয়ের কাছে ফিরিয়ে দিয়ে তোমার জায়গায় আমি স্টার হয়ে যাবো। মাম্মাম তুমি বাবাইকে পেয়ে আমাকে ভুলে যেও না যেনো। বাবাইকে বলিও আমি তোমাকে আর বাবাই অনেক ভালোবাসি। আমি যখন স্টার হয়ে যাবো প্রতিরাতে আমাকে দেখার জন্য তোমরা ছাদে এসো কিন্তু। তোমাদের একসাথে খুশি খুশি সময় কাটাতে দেখে তখন আমার কি যে আনন্দ হবে।”

আরফা হাসতে হাসতে কথাগুলো বলছিলো তবুও ওর দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছিলো।

(৪৯)
দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে বাগানের মাঝ বরাবর থাকা বসার স্থানে বসে আছে রিজওয়ান, মেহরিন, আরহাম ও আমজাদ। গল্পের মাঝে থাকা অবস্থাতেও মেহরিনের মন আজ আরফার জন্য অজানা কারণে টানছে ভিষণ ভাবে। আসার পর থেকে এখন পর্যন্ত একপলকের জন্যও সে আরফাকে দেখতে পায় নি। বেশ কিছুটা সময় এভাবেই পেরিয়ে যায়। হঠাৎ আরফার ‘বাবাই’ বলে ডাকার আওয়াজ ভেসে আসলে ওদের সকলের দৃষ্টি যায় তিন তলার বেলকনির কার্ণিশে দাঁড়িয়ে থাকা আরফার দিকে। এই প্রথম আরফার কন্ঠে আরহাম ‘বাবাই’ ডাক শুনতে পেলো। সকলে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে বেলকনির নিচে এসে দাঁড়ায়। আমজাদ বললেন…..

—“দিদিভাই, ওখান থেকে সরে দাঁড়াও তুমি। ঐ জায়গাটা ভিষণ পিচ্ছিল। একটু এদিক-সেদিক হলে পরে যাবে। পিছিয়ে যাও দিদিভাই।”

আমজাদের কথা আরফার কান পর্যন্ত পৌঁছালেও ওর উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না তা। আরফা হাসিমুখে বললো…..

—“বাবাই, তুমি মাম্মামকে অনেক ভালোবাসো আমি জানি। কিন্তু মাম্মামের স্টার হয়ে যাওয়ার জন্য তুমি আমাকে দায়ী করো এ কারণে আমার ভিষণ কষ্ট হয় জানো!”

মেহরিন বললো….
—“আরফা, সোনা মামনি তুমি পিছিয়ে যাও। তোমার বাবাই জানে তুমি দায়ী নও তোমার মাম্মামের স্টার হয়ে যাওয়ার জন্য। তুমি পরে যাবে মা, পিছিয়ে যাও।”

মেহরিনের কথাও আরফার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে না। আরফা বললো….

—“স্কুলে যাওয়ার পর আমার ফ্রেন্ডসের বাবাই ও মাম্মাদের দেখি তারা ওদের কোলে নিয়ে অনেক আদর করে। কিন্তু আমি তো কখনও আমার মাম্মামের আদর পাই নি। আর না কখনও তোমার আদর পেয়েছি বাবাই। জানো বাবাই আমি আল্লাহর কাছেও প্রার্থনা করেছিলাম যেনো তিনি আমার জন্য তোমার মনে একটু হলেও ভালোবাসার সৃষ্টি করেন। কিন্তু তুমি যেমন আমাকে পঁচা বেবি মনে করো তেমনি আল্লাহও আমাকে পঁচা বেবি মনে করেন। তাই তো তিনি আমার প্রার্থনা কবুল করেন নি।”

মেহরিন রিজওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“তুমি উপরে যাও। আরফাকে ওখান থেকে সরিয়ে নাও। ও ছোট মানুষ। ওর মনে বাজে ভাবে ইফেক্ট করেছে ওর বাবাইয়ের এই দূরত্ব ও খারাপ আচারণ। ও খারাপ কিছু করে ফেলতে পারে। যাও গিয়ে আটকাও ওকে।”

—“হ্যা, হ্যা আমি যাচ্ছি।”

এই বলে রিজওয়ান আরফার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ির ভিতরে যেতে দৌড় দেয়। মেহরিন আরফাকে বললো….

—“আরফা, মামনি পিছিয়ে যাও। এমন ভাবে কর্নিশে এসে দাঁড়াতে হয় না। আমরা তোমার বাবাইকে খুব করে বকা দিবো। দেখবে এখন থেকে তোমার বাবাই তোমাকে অনেক আদর করবে।”

আরহাম শক্ত পাথরের ন্যয় দাঁড়িয়ে আছে। বোধশক্তি যেনো হারিয়ে ফেলেছে সে। তার ৫ বছর বয়সে মেয়ের মুখে এতো কঠিন কঠিন কথা শুনে সে কি রিয়েক্ট করবে বুঝে উঠতে পারছে না যেনো। আরফা আবারও বললো…

—“না, না তোমরা কেউ বাবাইকে বকা দিও না। দাদু বাবাইকে অনেক বার বকা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বাবাই তার কথা শুনেন নি কখনও। আমি জানি বাবাই মাম্মামকে আবারও নিজের কাছে ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত খুশি হবেন না। জানো বাবাই, আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি। তাই মাম্মামকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবো আজ। মাম্মাম এর জায়গায় আমি স্টার হয়ে গেলে তো আল্লাহ মাম্মামকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবেন। তখন মাম্মামের সাথে তুমি অনেক খুশি থাকতে পারবে। আর কখনও মাম্মামকে বাবু নিতে দিও না। তাহলে সেই বাবুকে আনতে গিয়ে মাম্মাম আবারও স্টার হয়ে গেলে তাকেও তুমি আমার মতো দায়ী করবে। সব বাবু তো আমার মতো তোমার খুশির কথা ভেবে স্টার হয়ে মাম্মামকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিবে না।”

ছোট্ট আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে মেহরিনের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদছেন আমজাদ চৌধুরী নিজেও। আরফা আবারও বললো…

—“মিষ্টি আন্টি, মিষ্টি আঙ্কেল দরজার ধাক্কাচ্ছেন। আজ দরজা ধাক্কিয়ে তো কোনো লাভ হবে না।”

পরক্ষণেই আরফা আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললো….
—“মাম্মাম…বাবাইয়ের কাছে আসার জন্য তুমি তৈরি তো! আমি কিন্তু তোমার জায়গায় স্টার হওয়ার জন্য তৈরি।”

এই বলে আরফা খিলখিলিয়ে হাসতে শুরু করে। মেহরিন ও আমজাদ কিছু বলতে নিবে তার পূর্বেই আরফা ওদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিন তলা থেকে লাফ দেয়। চোখের পলকে আরফার ছোট্ট দেহটা ওদের পায়ের কাছে এসে মুখ থু*ব*রে পরে। মেহরিন ‘আরফা’ বলে ও আমজাদ ‘দিদিভাই’ বলে চিৎকার করে উঠে। ওদের পিছনেই আরহাম দু’হাটু ভাঁজ করে মাটির উপর ধপ করে বসে পরে। ইতিমধ্যে দরজা ভেঙে বেলকনিতে এসে দাঁড়ায় রিজওয়ান। নিচের দিকে তাকাতেই আরফার নিথর দেহটা সে দেখতে পায়। বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে ওর।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…..

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(২১)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৫০)
হাসপাতালে অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে থাকা বসার স্থানে চিন্তিও ও ভ*য়া*র্ত মুখশ্রী নিয়ে বসে আছে আমজাদ, মেহরিন ও রিজওয়ান। তাদের থেকে কয়েকহাত দূরে দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। আরহামের পরণে থাকা সাদা শার্টটা র*ক্তে রঙিন হয়ে আছে। আরহামের ফর্সা হাত জোড়াও র*ক্তে মেখে আছে। জায়গায় জায়গায় লেগে থাকা র*ক্তগুলো সব শুকিয়ে গিয়ে হালকা কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। অধিক উঁচু থেকে লাফ দেওয়ায় ছোট্ট আরফার মুখের একপাশ প্রায় থে*ত*লে গিয়েছিলো। মাথা ফেঁ*টে অত্যাধিক ব্লেডিং ও হয়েছিলো। হাসপাতালে আনার পথে অনেক চেষ্টা করেও ব্লেডিং বন্ধ করতে পারে নি কেউ।

প্রায় চার ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের বাহিরে দরজার উপর জ্বলতে থাকা বাতিটা নিভে যায় ও ভিতর থেকে একজন পুরুষ ডাক্তার গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বেড়িয়ে আসেন। আমজাদ, মেহরিন ও রিজওয়ান বসা থেকে উঠে ডাক্তারের সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। আমজাদ বললেন….

—“আমার ছোট্ট দিদিভাই এখন কেমন আছে ডাক্তার সাহেব!”

উপস্থিত সবাই আমজাদের করা প্রশ্নের উত্তর শোনার জন্য অপেক্ষা করছে। ডাক্তার সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন….

—“বাচ্চার অবস্থা ভালো না। মুখের যে পাশ থে*ত*লে গিয়েছে সে পাশ আবারও আগের মতো ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ৫% ও নেই। শরীরের বিভিন্ন জায়গার হাড়ের জোড়া আলাদা হয়ে গিয়েছে। মেরুদন্ডের হাড় ও ভেঙে গিয়েছে কয়েকটা। মাথার অনেকটা জায়গা ফেঁ*টে যাওয়ায় ১৫টা সেলাই দেওয়া হয়েছে সেখানে। বাচ্চাটি যে কোমায় চলে গিয়েছে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই আমার। আমরা আমাদের তরফ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে। এবার ওর সুস্থতা নির্ভর করতেছে আল্লাহ তায়ালার উপর। এতো মেজর আ*ঘা*ত পেয়েও বেঁচে যাওয়ার ক্ষমতা খুব কম মানুষেরই থাকে। এতো ছোট বাচ্চার ক্ষেত্রে বিষয়টা মিরাক্কেল ই বলা যায়।তাই আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন, দোয়া করুন ওর জন্য।”

আমজাদ বললেন….
—“ডাক্তার সাহেব আমরা কি দিদিভাইকে দেখতে পারি!”

—“একটু পর ওকে কেবিনে সিফট করা হবে। যেহেতু ওর অবস্থা এখনও চিন্তার বাহিরে নয় তাই আগামী ৪৮ ঘন্টা আপনাদের ওর থেকে দূরে থাকতে হবে। তারপর আমরা ওর অবস্থা দেখে আপনাদের দেখা করার পারমিশন দিতে পারবো।”

এই বলে ডাক্তার স্থান ত্যগ করলেন। আমজাদ তার দু’চোখ দিয়ে নোনাজল ফেলতে ফেলতে বললেন…

—“আমার ছোট্ট ফুলটা এতো য*ন্ত্র*ণা কিভাবে সহ্য করছে! আল্লাহ আপনি আমার দিদিভাইকে সুস্থ করে দিন। ওর য*ন্ত্র*ণা গুলো নির্মূল করে দিন।”

আগের স্থানেই দাঁড়িয়ে ওদের সম্পূর্ণ কথপোকথন নিরবে শুনলো আরহাম। পরক্ষণেই সে সেই স্থান থেকে সামনের দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করে। উঠতে উঠতে সোজা হাসপাতালের ছাদে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে দৃষ্টি স্থির করে আরহাম৷ সারাদিন ধরে মাথা চাড়া দিয়ে থাকা সূর্য অনেক আগেই পশ্চিমাকাশে ডুবে গিয়ে রাতের জানান দিয়েছে। তার বিপরীত পার্শে থালার মতো বিশালাকার চাঁদ যেনো খিলখিলিয়ে হাসছে। হালকা কালচে বর্ণ ধারণ করা সম্পূর্ণ আকাশজুড়ে আজ তারারা মেলা বসায় নি। দূর দূরান্তে কেবল হাতে গোণা ২-৪ টা তারার দেখা মিলছে। আরহাম চাঁদের প্রায় সংস্পর্শে থাকা সবথেকে উজ্জ্বল ও বড় তারাটির দিকে তাকিয়ে বললো….

—“আরফা তোমাকেই ওর মা মনে করে এসেছে সবসময়। আমিও তোমাকে আজ আমার প্রিয়তমা স্ত্রীর স্থানে বসাচ্ছি। তুমি তো জানতে সানজিদ আমি তোমাকে কতো বেশি ভালোবাসতাম এখনও কতো বেশি ভালোবাসি। প্রথম বার যখন প্রেগন্যান্সির ৬মাস চলাকালীন আমাদের বাচ্চাটা মা*রা গেলো তখন অত্যাধিক ব্লে*ডিং হওয়ায় ডাক্তার তোমাকে ২য় বার প্রেগন্যন্সির রি*স্ক নিতে নিষেধ করেছিলেন। কারণ প্রথমবার তোমাকে অনেক চেষ্টার পর আল্লাহর রহমতে তারা বাঁচাতে পেরেছিলেন। ২য় বার আর তিনি সহায়ক নাও হতে পারেন। আকস্মিক বাচ্চা ন*ষ্ট হওয়ায় তোমার শারিরীক অবস্থা যেমন খারাপ ছিলো তেমনি তুমি মানসিক ভাবেও ভে*ঙে পড়েছিলে। অনেক বার অনেক ভাবে তোমাকে সুস্থ, স্বাভাবিক করার চেষ্টা আমি করেছিলাম কিন্তু কখনও আমার চেষ্টা গুলো তোমার ভিতর ভালো পরিবর্তন আনতে পারে নি। এরপর তুমি আমাকে না জানিয়েই ২য় বার প্রেগন্যান্ট হওয়ার চিন্তাধারা স্থির করেছিলে। সেদিন রাতে তোমার ধারনা সম্পর্কে আমি কল্পনাও করতে পারি নি। তোমার স্বাভাবিক রূপ আমাকে তোমার প্রতি এতোটাই আকৃষ্ট করে ফেলেছিলো যে সমস্ত বাঁধ-দ*ন্দ পেরিয়ে তোমাতে মিলিত হয়েছিলাম আমি। কয়েকমাস পর তোমার শারিরীক পরিবর্তন আমার মনে সন্দেহের সৃষ্টি করলে তোমাকে জোরপূর্বক ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই আর জানতে পারি তোমার গর্ভে আমাদের সন্তানের বয়স তখন ৪মাস হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার আমার সাথে ভিষন রাগারাগি করলেন। কারণ কয়েকমাস আগেই তোমার উপর দিয়ে এতো বড় একটা ঝ*ড় গিয়েছে। যার প্রভাব এখনও তোমার শরীর কাটিয়ে উঠতে পারে নি। এর ভিতরেই তুমি ২য় বার প্রেগন্যান্ট হয়েছো। এখন এই বাচ্চাকে বহন করতে গিয়ে তোমার শারিরীক অবস্থার যে আরো অব*নতি ঘটবে সে বিষয়েও ডাক্তার আমাকে অবগত করেছিলেন। আর শেষ মূহূর্তে গিয়ে ডেলিভারির সময়ে বাচ্চা ও মা দু’জনকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। যদি বাচ্চাকে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয় তবে মা মা*রা যাবে। আর যদি মা’কে বাঁচানোর চেষ্টা করা হয় তাহলে বাচ্চা তো মারা যাবেই পাশাপাশি তুমি আজীবনের জন্য মা হওয়ার ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলবে। ঐ মুহূর্তটা যে আমার জন্য কতোটা য*ন্ত্র*ণা দায়ক ছিলো তা আমি কখনও কাউকে ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারি নি। টানাপোড়া মুহূর্ত নিয়ে আরো ৬মাস কাটিয়ে উঠলে তুমি। তোমার চেহারার সমস্ত উজ্জ্বলতা কোথায় যেনো ঢাকা পরে গিয়েছিলো। অতিরিক্ত ব*মির কারণে ও না খেয়ে বেশিরভাগ সময় পার করার জন্য তোমার ওজন ৫৫ থেকে ৪০ এ নেমেছিলো। তোমাকে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকানোর পূর্বে ডাক্তার যখন আমাকে বলেছিলো বাচ্চা নয়তো মা যেকোনো একজনকে বাঁচানোর সিদ্ধান্ত নিতে তখন নিজের বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে আমি তোমাকে বাঁচাতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার সাথে বি*শ্বা*স*ঘা*ত*কতা করেছিলে সেদিন। আমার কথা না ভেবে বাচ্চার কথা ভেবেছিলে। তাই তো ডাক্তারকে আমার জানানো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করেছিলে। ঘন্টাখানেক পর অপারেশন থিয়েটারের ভিতর থেকে যখন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে এসেছিলো তখন পুরো দুনিয়া যেনো আমার কাছে থ*ম*কে গিয়েছিলো। আমার আর বুঝতে বাকি ছিলো না এ পৃথিবী থেকে তুমি স্বা*র্থ*পরের মতো চিরতরের জন্য বিদায় নিয়েছো। সেদিন বাচ্চাকে গ্রহন করার মতো মানসিকতা আমার ছিলো না। আমি হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে গিয়েছিলাম। পরেরদিন তোমার দা*ফ*ন কার্য সম্পন্ন করার পর বাবা যখন আমার দিকে আমাদের ছোট্ট মেয়েটাকে তুলে দিতে ধরেছিলো তখন তোমার মুখশ্রী আমার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিলো। এই বাচ্চার জন্যই তো তুমি আমাকে ছাড়তেও দু’বার ভাবো নি। তোমার মৃ*ত্যু*র জন্য আমার ওকেই দায়ী মনে হয়েছিলো। এরপর থেকে কখনও আমি আরফার দিকে পিতৃনজরে তাকাই নি, ওকে পিতৃস্নেহ থেকে বন্ঞ্চিত করেছিলাম। ওকে কখনও আর পাঁচ বাচ্চার বাবার মতো কোলে নিয়ে বাবার আদর দেই নি। আমার এই অবহেলা, অ*যত্ন যে আমাদের মাত্র ৫ বছর বয়সী মেয়েটার উপর এতো বড় প্রভাব ফেলতে পারবে কখনও ভাবি নি। কখনও এমন ভাবে চিন্তাও করি নি ঐ নিষ্পাপ বাচ্চাটির আসলেই কি কোনো দো*ষ আছে বা ছিলো! ওকে তো আমরাই পৃথিবীতে এনেছি। তাহলে আমাদের বি*চ্ছে*দ এর জন্য ঐ নিষ্পাপ প্রাণটাকে কেনো আমি দায়ী করে আসছি সবসময়! ও তো নিজ থেকে বলে নি তোমরা আমাকে পৃথিবীতে আনো। ৫ বছরের একজন বাচ্চার মনে আমার আচারণ ঠিক কতোটা বা*জে ভাবে প্রভাব ফেললে সে আমার কাছে তোমাকে ফিরিয়ে দিতে নিজে তোমার স্থান নিতে চায়! আজ আমাদের মেয়ের এই করুণ পরিণতির জন্য যে আমিই দায়ী সে কথা অস্বীকার করার মতো নয়। তুমি তো আমার উপরে ভরসা করেই ওকে পৃথিবীতে রেখে নিজে চলে গিয়েছিলে। আমি তোমার সেই ভরসা রাখতে পারি নি। আমার আজ নিজেকে মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতেও ঘৃ*ণা হচ্ছে। ভিষণ ঘৃ*ণা হচ্ছে নিজের প্রতি।”

এই বলে আরহাম হাঁটু ভে*ঙে ছাদের উপর বসে পড়ে। আজ আরহামের দু’চোখ আর বাঁধ মানছে না। অঝোর ধারায় দু’চোখ বেয়ে নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। আকাশে থাকা চাঁদটা কালো মেঘের আড়ালে ঢাকা পরে গিয়েছে। মুহূর্তের মধ্যেই মুশল ধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু হয়। আজ আরহামের কান্নার সাথে পাল্লা দিয়ে যেনো আকাশ ও কাঁদছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(২২)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৫১)
২দিন পর……
আজ ৪৮ ঘন্টা পেরিয়ে গিয়েছে। ডাক্তার আরফার সাথে সাক্ষাৎ এর পারমিশন দিয়েছেন আমজাদ ও আরহাম। তবে এ’ও বলে সতর্ক করেছেন তারা যেনো আরফার পাশে বসে উচ্চস্বরে কথা না বলে৷ আরফা কোমায় চলে যাওয়ায় ওর সর্বশরীর পাথর মূর্তির ন্যয় স্থির হয়ে রইলেও ওর ব্রেইন স্বাভাবিক সময়ের মতোই কাজ করছে। তাই এমন কোনো বিষয় নিয়েও ওর পাশে বসে কথা যেনো না বলে তারা যার প্রভাব ওর ব্রেইনে পৌঁছে বা*জে অবস্থা হয়। আরফার কেবিনের বাহিরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আরহাম। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আমজাদ ভিতরে গিয়েছেন তার ছোট্ট ফুলকে একপলক দেখার জন্য গত দু’দিন ভিষণ ছটফট করেছেন তিনি। কেটে যায় আরো কিছু সময়। আমজাদ চোখ মুছতে মুছতে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে বললেন…..

—“দিদিভাইয়ের এই অবস্থা আমি সহ্য করতে পারছি না রে বাবা, আমার দিদিভাইকে তুই আগের মতো সুস্থ করে তুলে আমার কাছে ফিরিয়ে দে।”

আরহাম আমজাদের দিকে অনুশোচনার চাহুনি স্থির করে রেখেছে। ওর দু’চোখ গত দু’দিন এক সেকেন্ড এর জন্যও বুঁজে নি। হালকা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে কালচে মনির চারপাশে। আমজাদ আরহামের কাঁধে হাত রেখে বললেন….

—“ভিতরে যা।”

অতঃপর আমজাদ সেখানে রাখা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আরহাম নিঃশব্দে কেবিনের দরজা ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করে। কেবিনের মাঝ বরাবর একটা মাঝারি সাইজের বেডের উপর শরীরে যান্ত্রিক লাইনের ছড়াছড়ি রেখে দু’চোখ বুঁজে স্থির হয়ে শুয়ে আছে ছোট্ট আরফা। আরহাম ধীরপায়ে একটু একটু করে ওর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মেয়ের যতো কাছে এগিয়ে যাচ্ছে সে ততোই মেয়ের ক*রু*ণ অবস্থা স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছে আরহাম। ওর বুকের ভিতরটা যেনো অনুশোচনার আ*গু*নে জ্ব*লে-পু*ড়ে দ*গ্ধ হয়ে যাচ্ছে। আরহাম আরফার হাতের ডান পার্শে রাখা চেয়ারটি টেনে সেখানে বসে৷ ওর ডান পার্শের মুখশ্রী সম্পূর্ণ ঠিক আছে। বাম পাশ টা ব্য*ন্ডে*জ দিয়ে মোড়ানো। আরহাম ওর কাপান্বিত হাত দ্বারা আরফার ছোট্ট হাতটা স্পর্শ করলো। আরফার জন্মের পর এই প্রথম আরহাম স্বইচ্ছায় আরফাকে স্পর্শ করলো। আরহামের দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় নোনাজল গড়িয়ে পড়ছে। আরহাম বললো…..

—“বাবাইয়ের প্রতি তোমার অনেক রাগ, অভিমান জমে আছে তাই না মা! বাবাই তোমাকে কখনও একটুও আদর করে নি, একটুও ভালোবাসে নি। শুধু সীমাহীন অবহেলা আর কষ্টই দিয়ে গিয়েছে। তোমার কোনো দো*ষ না থাকা সত্বেও তোমাকে তোমার মাম্মামের মৃ*ত্যু*র জন্য দায়ী করেছে সবসময়। তোমার এই পুতুলের মতো মুখটা ন*ষ্ট হয়ে যাওয়ার জন্য তো বাবাই-ই দায়ী। তোমার বাবাই ভিষণ পঁ*চা, অ*মানুষ একটা। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠে তোমার বাবাইকে অনেক বকা দিও তো। কিন্তু এভাবে নিরব হয়ে বিছানায় পরে থেকে বাবাইয়ের বুকের ভিতরটা য*ন্ত্র*ণা*য় ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দিও না। তোমার বাবাই বুঝে গিয়েছে সে কতো বড় অন্যায় করেছে তোমার সাথে। তাকে ক্ষমা করে দাও তুমি মা।”

আরহাম কথাগুলো বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েছে। আরফা সুস্থ, স্বাভাবিক থাকলে হয়তো এতোক্ষণে নিজের ছোট্ট দুটো হাত দিয়ে খুব যত্ন নিয়ে নিজের বাবাইয়ের দু’চোখের পানিগুলো মুছে দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে বসে থাকতো।

(৫২)
দুপুরবেলা……..
ডান হাতে ব্যন্ডেজ করা অবস্থায় বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে ঊর্মিলা উচ্চস্বরে নিজের শ্বাশুড়ি মা’কে ডাকতে শুরু করে। কিয়ৎক্ষণ পর রাহেলা, শেফালি ও রুমি নিজরুম থেকে বেড়িয়ে আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। রাহেলা বললেন….

—“কি হয়েছে বউমা! এই ভর দুপুরবেলা এতো চিৎকার চেচামেচি করছো কেনো?”

শেফালির দৃষ্টি ঊর্মিলার হাতের উপর পড়তেই সে ঊর্মিলার কাছে গিয়ে চিন্তিত স্বরে বললো…..

—“এ’কি মেজো! তোর হাতে কি হয়েছে? ব্যন্ডেজ করা কেনো? আর তুই তো ঊষাকে স্কুল থেকে আনার জন্য গিয়েছিলি। ঊষা কোথায়? ওকে দেখছি না তো তোর সাথে।”

ঊর্মিলার এতোসময় ধরে আটকে রাখা কান্নাগুলো এবার বাঁধ অতিক্রম করে ফেলে। ঊর্মিলা কান্না করতে করতে বললো….

—“ভাবী…অনেক বড় বি*প*দ হয়ে গিয়েছে।”

ঊর্মিলার মুখে বিপদ শব্দটা শোনামাত্র ভরকে যান রাহেলা। তিনিও ঊর্মিলার কাছে এগিয়ে এসে বললেন….

—“বি*প*দ! কি বি*প*দ হয়েছে? আমার ঊষা দিদিভাইয়ের কিছু হয় নি তো?”

—“মা আজ হয়তো আপনি আর আপনার নাতনীকে জীবিত অবস্থায় দেখতে পারতেন না।”

—“কি সব যা তা বলছো তুমি মেজো বউ মা? মুখে কি একেবারেই লাগামহীন হয়ে গিয়েছে নাকি!”

—“আমি সত্যি বলছি মা। আজ ঊষাকে স্কুল থেকে আনার সময় আমার ফোনে একটা কল এসেছিলো। কথা বলার ব্যস্ততায় কখন থেকে আমার হাত থেকে ঊষার হাত ছুটে গিয়েছিলো বুঝতে পারি নি। কিয়ৎক্ষণ পরই কোথায় থেকে যেনো আল্লাহর পাঠানো উছিলার মতো রিজওয়ান আর মেহরিন এসে ঊষাকে গাড়ির নিচে পড়া থেকে বাঁচিয়ে নিয়েছে। ঊষাকে বাঁচাতে গিয়ে মেহরিন ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায় বা*জে ভাবে আ*ঘা*ত পেয়েছে। মূহূর্তের মধ্যেই সেখানে লোকজনে ভরপুর হয়ে যায়। ভিড় ঠেলে ভিতরে প্রবেশ করতে গিয়ে ধা*ক্কা লেগে রাস্তায় পরে গিয়ে আমার হাতের চামড়া উঠে গিয়েছে। পরে আমরা সবাই মেহরিনকে নিয়ে হাসপাতালে যাই। আমার ক্ষ*ত স্থানে ব্য*ন্ডে*জ করে দেওয়া মাত্র আমি বাড়িতে চলে আসি আপনাদের খবর দেওয়ার জন্য। মেহরিন হাসপাতালে ভর্তি আছে। ওর কাছে রিজওয়ান আর ঊষাও আছে।”

মেহরিন আ*ঘা*ত পেয়েছে শুনে রাহেলার মুখে কিন্ঞ্চিত পরিমাণও খারাপ লাগার ছাপ ফুটে উঠে না। সে স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো….

—“ঐ দুই আ*প*দ ম*রে যাক কিংবা জা*হা*ন্না*মে যাক তাতে আমার কি হ্যা! এমন ভাবে কান্নাকাটি করে পুরো ঘটনা বললে যেনো কি না কি হয়ে গিয়েছে। দুপুরবেলা খাওয়া শেষ করে মাত্রই বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছিলাম। চোখ লাগতে না লাগতেই চেচামেচি করে পুরো বাড়ি একেবারে মাথায় তুলে ফেলেছো তুমি। শুনো বউমারা, ওদের দু’জনকে নিয়ে এতো আ*দি*খ্যে*তা করো না তোমরা। মেজো বউমা তোমার কি কখনই আক্কেল জ্ঞান হবে না! শ*ত্রু*দের কাছে যে নিজের একমাত্র মেয়েকে রেখে এসেছো ওরা যদি আমার দিদিভাইয়ের কোনো ক্ষ*তি করে তাহলে কিন্তু তোমাকেও আমি ছেড়ে কথা বলবো না বলে দিলাম।”

এই বলে রাহেলা নিজরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালেন। উপস্থিত ওরা তিনজন রাহেলার যাওয়ার পানে তাকিয়ে হয়তো এটাই চিন্তা করে যে, যাদের জন্য আজ এ বাড়ির সবথেকে ছোট সদস্যটির প্রাণ বাঁচলো তারাই কি ওদের আড়ালে ওর ক্ষ*তি করবে। শেফালি একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…..

—“মেজো! আমাদের এক্ষুণি হাসপাতালে যাওয়া উচিত। মেহরিন এর সাথে আমরা কম রেষারেষি করি নি। তবুও আজ ও তোর মেয়ের প্রাণ বাঁচাতে নিজের প্রাণকে ঝুঁ*কি*র সম্মুখীন করতে দু’বার ভাবে নি। ও চাইলেই পারতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তোর মেয়েকে গাড়ির নিচে পি*ষে যেতে দেখে মজা নিতে। কিন্তু ও তা করে নি। এবার আমাদেরও এই খা*রা*প মানুষের খো*ল*স ত্যগ করে ভালো হওয়ার চেষ্টা করা উচিত।”

ঊর্মিলা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। রুমি ওদের দু’জনের চিন্তাধারা পরিবর্তন হতে দেখে মনে মনে খুশি হয়। অতঃপর ওরা তিনজন একসাথে মেহরিনকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে।

(৫৩)
পরেরদিন সকালবেলা……
শেফালি, ঊর্মিলা, রুমি, রিজওয়ান ও ঊষা মেহরিনকে নিয়ে একসাথে বাড়িতে ফিরে। গতকাল দুপুর বেলা মেহরিনকে দেখার জন্য ওরা তিনজন হাসপাতালে যাওয়ার পর আর বাড়িতে ফেরে নি। আঙিনায় দাঁড়িয়ে রাগী মুখশ্রী নিয়ে পায়চারি করছে রাজিবুল। সেইসময় ওদের সবাইকে বাসায় ফিরতে দেখে রাগে গজগজ করতে করতে শেফালির সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো…..

—“তোমার এতো সাহস হলো কি করে আমার পারমিশন না নিয়ে আমারই শত্রুদের কাছে গিয়ে তাদের সমবেদনা জানানোর ও সেখানেই রাত কাটানোর! অনেকদিন ধরেই তোমার অত্যাধিক বার সহ্য করে যাচ্ছিলাম আমি। কিন্তু আজ তুমি তোমার সব বাঁধা অতিক্রম করে ফেলেছো। আজ তোমাকে তোমার এই কাজের জন্য শা*স্তি পেতেই হবে।”

এই বলে যেই না রাজিবুল শেফালিকে মা*রা*র জন্য উদ্যত হয়েছে ওমনি সময় রিজওয়ান রাজিবুলের হাত ধরে তা ওর পিঠের পিছনে নিয়ে গিয়ে অনেকটা মু*চ*ড়ে ফেলার মতো করে। রিজওয়ান এবারেরও আকস্মিক আ*ক্র*ম*ণ রাজিবুলকে ঘা*য়ে*ল করে ফেলে। সে ব্য*থা*য় ছুটার চেষ্টা করে। রিজওয়ান রাগী স্বরে বললো…..

—“ঘরের মেয়ে ও বউয়ের গায়ে হাত তোলার মতো কাপুরুষত্বতা করা ছাড়া তো তোর দ্বারা কখনও কোনো প্রশংসার যোগ্য কাজ করা সম্ভব হতে দেখলাম। আগের মা*ই*র গুলোর কথা ভুলে গিয়েছিস নাকি! নাকের ব্য*ন্ডে*জ টা তো এখনও খুলিস নি দেখছি। ক্ষ*ত শুখায় নি নিশ্চয়ই এখনও! হাত-পা খুঁ*ই*য়ে ল্যং*ড়া হয়ে আজীবন বিছানায় পরে থাকার শখ না থাকলে আমার ভাবীর শরীরে ভুলেও একটা ফুলের টোকা দেওয়ার চেষ্টা করিস না।”

এই বলে রিজওয়ান রাজিবুলের হাত ছেড়ে দিয়ে স্বজোরে একটা ধা*ক্কা দেয় ওকে। ধা*ক্কার বেগ সামলাতে গিয়ে রাজিবুল আঙিনার মেঝের উপর পড়তে গিয়েও পড়ে না। অন্যহাত দিয়ে নিজের ডানহাত বুলাতে বুলাতে স্থান ত্যগ করে সে। শেফালি আর ঊর্মিলা রিজওয়ানের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। আজ রাজিবুলকে এমন ভাবে শা*য়ে*স্তা করায় শেফালির মাঝে একটুও খারাপ লাগা কাজ করছে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………..

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১৭+১৮+১৯

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৭)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৩৭)
রাতেরবেলা…..
রুমি নিজরুমে এসে বিছানায় স্থির হয়ে বসে নিরবে নিজের দু’চোখ দিয়ে নোনাজল বিসর্জন দিচ্ছে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমি দু’হাতে নিজের দু’চোখের পানি মুছে বললো….

—“যে পরিবার আমার সুখকে কু*র*বা*নি দিয়ে নিজেদের সুখের পরিমাণ বাড়াতে চায় সেই পরিবারের সাথে থাকার কোনো প্রশ্নই আসে না। সেই পরিবারের সম্মানের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের মূল্যবান সময় গুলোও নষ্ট করার কোনো মানে হয় না। আমি কালই জিহাদের সাথে দেখা করবো। আর আমাদের সম্পর্ক নিয়ে হয়তো ভালো নয়তো খারাপ যেকোনো একটা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবো।”

(৩৮)
মেহরিনের বিছানা ঠিক করা শেষ হয়েছে দেখে রিজওয়ান বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে ওর বস আরহাম চৌধুরীর দেওয়া গিফট এর ব্যগটা হাতে নিয়ে মেহরিনের কাছে এসে ওর মুখোমুখি বসে দুপুরের পর অফিসে হওয়া সম্পূর্ণ ঘটনার কথা খুলে বললো। অতঃপর গিফট প্যকেটটি খুলতেই ভিতর থেকে হাজার টাকার দু’টো বান্ডিল আর একটা এন্ড্রয়েড ফোনের বক্স বের করে। মেহরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো….

—“তোমার এমন একটা ফোন কেনার অনেক শখ ছিলো বাবা তোমাকে দিতে চাইলেও সেই সময়ের পরিস্থিতি এমনই ছিলো যে তুমি চেয়েও নিজের শখ পূরণ করতে পারো নি। অথচ এখন দেখো, তুমি সব ভুলে নতুন করে নিজের জীবন শুরু করেছিলে আর একটু একটু করে তোমার অপূর্ণ থাকা শখগুলো পূরণ হতে শুরু করেছে। এতে কি বুঝা যায় জানো! আল্লাহ আমাদের সবাইকে ঠিকই কঠিন ও খারাপ পরিস্থিতির সম্মুখীন করান কিন্তু কখনও এতোটা হতাশ করেন না যে আমরা তাঁকে ভুলে যাই বা তাঁর ইবাদত পালন করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়ি। আমাদের ইমান পরীক্ষা করেন তিনি কঠিন ও খারাপ পরিস্থিতিতে ফেলে। আর আমাদের সহ্য ক্ষমতা ল*ঙ্ঘ*ন হওয়ার পূর্বেই তিনি সব সমস্যা দূর করে ভালো সময় এনে দেন। তাই আমাদের উচিত জীবনের প্রতিটি ক্ষণে তার উপর অগাধ ভরসা রাখা।”

রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“হুম ঠিক বলেছো বউ। এতোদিন একটা ফোনের অভাবে বাবাকে সব সত্য সম্পর্কে অবগত করতে পারি নি। ভেবে রেখেছিলাম ১ম মাসের বেতনটা হাতে পেলে সর্বপ্রথম একটা ফোন কিনবো। কিন্তু আল্লাহ আমাকে ততোদিন অপেক্ষা করালেন না।”

মেহরিন শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো….
—“বাবা কি তোমার কথা বিশ্বাস করবেন? আমরা মাত্র দু’জন আর ওরা ৬জন। ওদের দল যে ভিষণ ভাড়ি। এমন না হয় যেনো মিথ্যার জোরে সত্য মাটির নিচে চাপা পরে যায়।”

রিজওয়ান মেহরিনের দু’গালের উপর নিজের দু’হাত আলতো ভাবে রেখে বললো….
—“মি*থ্যা*র দল যতোই ভাড়ি হোক না কেনো তা কখনও সত্যকে মাটির নিচে চাপা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না বউ। সত্য একাই একশত জনের শক্তির সমতুল্য। আমি আগামীকালই বাবাকে সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবগত করবো। এরপর তার নিটক যেটা ঠিক মনে হবে সেটাই হবে। বাবা যদি একটু গভীর ভাবে চিন্তা করেন ও যাচাই করেন তাহলে কারা সত্য বলছে আর কারা মিথ্যা তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারবেন।”

—“হুম দেখা যাক কি হয়। সম্পূর্ণ ভরসা এখন আল্লাহর উপর। তিনি যা লিখে রেখেছেন তাই হবে ইনশাআল্লাহ।”

—“ওহ হ্যা, বউ তোমাকে তো আরো একটা কথা বলার ছিলো আমার এসব কথার তালে স্মরণ হারা হয়ে গিয়েছিলো।”

—“কি কথা?”

—“আরহাম স্যার শুক্রবার দুপুরবেলা তোমাকে নিয়ে আমায় তার বাসায় যেতে বলেছেন৷ তিনি নিজ থেকে আমাদের দুপুরের খাবার একসাথে খাওয়ার জন্য দাওয়াত করেছেন৷ আমি তার এমন ভাবে বলা কথায় না করতে পারি নি।”

মেহরিন হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে আমরা যাবো।”

(৩৯)
পরেরদিন সকালবেলা……
অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে আরহাম ড্রয়িংরুমে আসতেই ওর সম্মুখে এসে দাঁড়ায় আরফা। আরহাম কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পরে এমন ভাবে আরফার উপস্থিতিতে। আরহাম আরফার উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করতেই আরফা বললো….

—“জানেন আমি দাদুর কাছে নামাজ পড়া শিখে নিয়েছি। নামাজ শেষে আমি আল্লাহর কাছে একটা সিক্রেট দোয়া করেছিলাম। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছে কি না সেটাই দেখতে আজ আপনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। এখন আমি চোখ বন্ধ করছি কেমন!”

এই বলে আরফা চোখ বন্ধ করে ফেলে। ছোট্ট আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে আর এমন কাজে আরহাম অত্যন্ত অবাক হয় ঠিকই। কিন্তু পরমুহূর্তেই আরহাম আরফার প্রতি ভালো কোনো রিয়াকশন প্রকাশ করার পূর্বেই ওর চোখের সামনে সানজিদ এর মুখশ্রী ভেসে উঠে। যার ফলে আরহাম বরাবরের মতোই আরফার পাশ কাটিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। কিয়ৎক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকার পরেও কোনো রকম রিয়াকশন বুঝতে না পেরে অস্থির হয়ে আরফা চোখ মেলে সামনে তাকায়। আরহাম নেই। আরফা একনজরে নিজের চারপাশ দেখে নেয় নাহ্ আরহাম নেই। সেইসময় বাহির থেকে গাড়ির হর্ণ বাজার শব্দ আরফার কর্ণপাত হতেই আরফার সম্পূর্ণ মুখশ্রী একরাশ কালো মেঘে ঢেকে যায়। আরফা বুঝতে পারে বরাবরের মতোই ওর বাবাই ওকে এড়িয়ে চলে গিয়েছে। আরফা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ি বেয়ে সোজা ছাদে চলে আসে। ছাদের এক কোনে হাঁটু ভাজ করে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে অভিমানী স্বরে বললো….

—“দাদু তো বলেছিলো আল্লাহ সব বেবিসদের প্রার্থনা খুব তাড়াতাড়ি কবুল করে নেন। আমি তো আল্লাহর কাছে খুব করে চেয়েছিলাম বাবাই যেনো আমাকে একটু আদর করেন। একটু সময়ের জন্য কোলে নেন। তবে কি বাকি বাকি বেবিসদের মতো আমি ভালো না! বাবাই যেমন আমাকে পঁচা মনে করেন আল্লাহও তেমন-ই আমাকে পঁচা মনে করেন। তাই তিনি আমার দোয়া কবুল করেন নি! মাম্মাম এখন দিন হয়ে গিয়েছে তাই আমি তোমাকে দেখতে পারছি না। কিন্তু আমাকে তো তুমি সবসময় দেখতে পাও। আমার কথাও তুমি সবসময় শুনতে পাও। মাম্মাম তুমি বাবাইকে বলে দিও আমি তোমাকে আর বাবাইকে দু’জনকেই অনেক ভালোবাসি। কিন্তু জানো মাম্মাম বাবাই শুধু তোমাকে ভালোবাসে। আমাকে একটুও নয়। আমি এখন থেকে আল্লাহর কাছে এই দোয়া করবো যেনো আল্লাহ আমাকে খুব তাড়াতাড়ি স্টার বানিয়ে দেন আর তোমাকে আবারও বাবাইয়ের কাছে ফিরিয়ে দেন। আমিও তখন আকাশে বসে তোমাদের একসাথে হাসি-খুশি থাকতে দেখবো।”

কথাগুলো বলতে বলতেই ছোট্ট আরফার দু’চোখ নোনা জল দ্বারা ভিজে গিয়েছে। আরফা আকাশ থেকে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে দু’হাঁটুর মাঝে মুখ গুঁজে ওভাবেই বসে রয়।

(৪০)
কলেজের যাওয়ার জন্য নিজ রুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরি হচ্ছে রুমি। সেইসময় রুমির মা রাহেলা ওর রুমে প্রবেশ করে। আয়নায় নিজের মায়ের প্রতিচ্ছবি দেখে রুমির বুঝতে বাকি রয় না তার মা এখন তাঁকে কি বলার জন্য এখানে এসেছেন। সবকিছু জেনেও নিরব আর স্বাভাবিক রয় রুমি। রাহেলা নিজের মুখে হাসি বজায় রেখে বিছানায় বসতে বসতে বললেন…..

—“রুমি মা..আমার পাশে এসে বোস তো। তোর সাথে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলার আছে।”

রুমি কোনোরূপ প্রশ্ন না করে নিরব হয়ে ওর মায়ের সম্মুখপানে এসে বসে। রুমির মুখে লেগে আছে স্মিত হাসির রেখা। রাহেলা আবারও বললেন….

—“শোন মা..সব মেয়েদেরই একদিন না একদিন বাবার বাড়ির মায়া ত্যগ করে নিজের আসল বাড়ি অর্থাৎ শ্বশুড় বাড়িতে চলে যেতে হয়। আর আমৃত্যু পর্যন্ত সেখানে থাকতে হয়। আমাদের সময় মেয়েদের বয়স ১০ পেরোলেই পাড়া-পড়শী ও বাড়ির সকল গুরুজনদের নজরে সে বিয়ের জন্য যোগ্য হয়ে যেতো। আর তোর বয়স ১৭ তে পরেছে আরো বেশ কয়েকমাস আগেই। তাই আমার নজরেও বিয়ের উপযুক্ত বয়স তোর হয়ে গিয়েছে। অনেকদিন থেকেই বিভিন্ন আত্মীয়, পাড়া-পড়শীর থেকে অনেক ছেলের সম্বন্ধই আমার কান পর্যন্ত পৌঁছে ছিলো। কিন্তু কখনও কোনো সম্বন্ধ নিয়ে এতো গভীর ভাবে ভেবে দেখি নি। এবার তোর বড় ভাই যে সম্বন্ধটা নিয়ে এসেছে তা নিয়ে আমি না ভেবে পারলাম না। এতো ভালো ছেলে সহজে কি পাওয়া যায় বল! টাকা-পয়সা, বাড়ি, সয়-সম্পত্তি, সম্মান কোনো কিছুর অভাব নেই তার। হ্যা হতে পারে ছেলেটার একটু বয়স বেশি। চেহেরার উজ্জ্বলতা কিছুটা ঢাকা পড়ে গিয়েছে। স্ত্রী মা*রা গিয়েছে আর সে পক্ষের দুই সন্তান ও আছে। কিন্তু এসব কিছুই ঢাকা পরে যাচ্ছে তার অর্থের সামনে। একটা কথা কি জানিস মা! স্বামী হিসেবে পুরুষ মানুষদের একটু বেশি বয়স হওয়া ভালো। কারণ তারা তাদের স্ত্রীকে অনেক বেশি ভালোবাসেন আর তাদের চাওয়া-পাওয়া গুলোর গুরুত্ব বেশি দেন। আর রাজিবুল তো বলেছিলোই যে বাচ্চাদের নিয়ে তোর সমস্যা হলে বিয়ের পর কৌশলে নিজের সংসার থেকে ওদের সরিয়ে ফেলতে পারবি তুই। রাণীর মতো সেই সংসারে রাজত্ব করতে পারবি। সবকিছু চিন্তা করার পর এই সম্বন্ধে আমার মন খুব ভালো ভাবেই বসে গিয়েছে রে মা। তুই ও আর দ্বিমত করিস না। আমি বা তোর ভাইয়েরা কেউই তোর খারাপ চাই না। তুই সুখে থাকবি এটাই সর্বপ্রথম চিন্তা করি।”

রাহেলার বলা প্রতিটি শব্দ এই মুহূর্তে রুমির নিকট বি*ষে*র থেকে বি*ষা*ক্ত মনে হচ্ছিলো। যা ওর বুকের ভিতরটা খুব যত্ন নিয়ে ক্ষ*ত-বি*ক্ষ*ত করে দিতে সক্ষম হলো। রুমি মনে মনে কেবল একটি বাক্য আওরালো…..

—“মা! মা জাতি তো এমন হওয়ার কথা না!”

চলবে ইনশাআল্লাহ…………

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৮)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৪১)
কলেজের কথা বলে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে রুমি জিহাদের সাথে দেখা করার উদ্দেশ্যে পার্কে এসেছে। পার্কের ভিতর একটা বেন্ঞ্চে বসে জিহাদের আসার অপেক্ষা করছে রুমি। কিয়ৎক্ষণ পর জিহাদকে পার্কের মূল দরজা পেরিয়ে নিজের দিকে অগ্রসর হতে দেখে রুমি। জিহাদ রুমির পাশে এসে বসে বললো…..

—“হঠাৎ কি হলো তোমার রুমি! দেখা করার জন্য এতো জরুরী তলব কেনো?”

রুমি শান্ত স্বরে বললো….
—“বড় ভাইয়া আমার জন্য একটা বিয়ের সম্বন্ধ এনেছে জিহাদ।”

জিহাদ ভাবলেশহীন কন্ঠে বললো….
—“তো এর জন্য এমন উদাস হওয়ার কি আছে!”

রুমি শব্দ করে একবার নিশ্চিত ফেলে বললো….
—“আমার জন্য আনা সেই সম্বন্ধে লোকটির বয়স আমার বয়সের দ্বীগুণেরও বেশি। আর লোকটির আগের একবার বিয়ে হয়েছিলো। প্রথম স্ত্রী মারা গিয়েছেন। প্রথম পক্ষের একজন ছেলে সন্তান ও একজন মেয়ে সন্তান আছে। ছেলে সন্তানের বয়স ১২ বছর আর মেয়েটার বয়স খেয়াল নেই।”

রুমির মুখে সম্বন্ধের বর্ণনা শুনে জিহাদ শব্দ করে হেসে উঠে বললো….
—“শেষ পর্যন্ত তোমার ভাই কি না তোমার জন্য বাচ্চাসমেত বুড়ো পুরুষ খুঁজে আনলেন! তো তুমি কি বললে? না করে দিয়েছো নিশ্চয়ই!”

—“হুম প্রথমদিন-ই শোনামাত্র না করে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরিস্থিতি আমাকে আমার প্রিয়জনদের আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে।”

—“মানে!”

—“আমার জন্য আনা সম্বন্ধের পুরুষ লোকটি বড় ভাইয়ার অফিসের ম্যনেজার হন। তাঁর আর্থিক অবস্থা নাকি অনেক ভালো। সয়-সম্পত্তির কোনো অভাব নেই। বড় ভাইয়া অফিসে নিজের জায়গা আরো মজবুত করার জন্য আমাকে তার আনা সম্বন্ধে রাজি করাতে উঠে পরে লেগেছেন। আজ সকালে আম্মাও আমাকে অনেক বুঝ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। যেনো আমি রাজি হয়ে যাই। তাদের এই রূপ আমার ভিতরটা জ্বা*লি*য়ে পু*ড়ি*য়ে শেষ করে দিচ্ছে জিহাদ। এভাবে চলতে থাকলে আমি নিশ্চিত কোনো অ*ঘটন ঘটিয়ে ফেলবো।”

রুমির মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে জিহাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ স্পষ্ট হয়। কিয়ৎক্ষণ যাবৎ পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে পুরো পরিবেশ জুড়ে। কিয়ৎক্ষণ পর জিহাদ বললো….

—“কিন্তু আমার অবস্থাও তো এখন এমন নয় যে আমি তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে পারবো। সবে পড়াশোনার গন্ডি পেরিয়ে জীবনে কিছু করার চিন্তা ভাবনা করছিলাম। ব্যবসা কিংবা চাকরি যেকোনো একটাতেও যদি ফোকাস করি তা দ্বারা নিজের জীবনকে গুছিয়ে নিতেও আমার যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন।”

রুমি মলিন স্বরে বললো….
—“নিজের মা-ভাই যেখানে আমার সুখের কথা চিন্তা করছে না সেখানে আমি তাদের সাথে ল*ড়া*ই করে কতোদিন আর টিকতে পারবো জিহাদ! যদি সবকিছু হাতের বাহিরে চলে যায় আর তুমি সময়ের ভিতর কিছু করতে না পারো তাহলে আমার আ*ত্ম*হ*ত্যা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। আমি ম*রে যাবো কিন্তু তুমি ব্যতিত ২য় কোনো পুরুষের হতে পারবো না।”

রুমির এরূপ কথায় জিহাদের বুকের ভিতরটা যেনো মো*চ*র দিয়ে উঠে। ভাগ্য তাদের এতো তাড়াতাড়ি এমন কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন করতে পারে তা ভাবতেও পারে নি জিহাদ।

(৪২)
রাতেরবেলা…..
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষ করে আঙিনার মাঝ বরাবর গোল হয়ে চেয়ারে বসে আছে রাহেলা, রাজিবুল, শেফালি, রফিকুল, ঊর্মিলা। রাহেলা পাশেই মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুমি। সেইসময় রাজিবুল বললো…..

—“আম্মা…তোমার মেয়ে কি আমার আনা সম্বন্ধে সম্মতি জানিয়েছে! ম্যনেজার সাহেবকে আমি বলে দিয়েছিলাম তার জন্য যোগ্য মেয়ের সন্ধান আমি করে ফেলেছি। মেয়েটি কে তা জানার জন্য তিনি ভিষণ তাড়া দিচ্ছেন।”

রাহেলা রুমির দিকে একপলক তাকিয়ে পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বললেন….
—“রুমি এখনও আমাকে এ বিষয়ে কোনো মতামত জানায় নি রে বা’জান।”

রাহেলার এমন উত্তরে রাজিবুলের চেহারায় অসন্তুষ্ট ভাব স্পষ্ট হয়। রাজিবুল রুমির দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো….

—“রুমি..কি সমস্যা তোর হ্যা! সম্মতি জানাতে অহেতুক এতো সময় কেনো নিচ্ছিস তুই?”

রুমি আর চুপ না থেকে জোর গলায় বললো….
—“আমি তো প্রথম দিনই বলে দিয়েছি তোমাদের সবাইকে বড় ভাইয়া যে আমি ঐ লোককে বিয়ে করতে একদম-ই ইচ্ছুক নই। আর আমি এখন নিজের বিয়ে নিয়ে কোনো চিন্তা-ভাবনাই করছি না। আমার সময়ের প্রয়োজন। আমি অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চাই। নিজের পায়ে দাঁড়াতে চাই।”

রাজিবুল ধমকের স্বরে বললো….
—“আরে রাখ তোর পড়াশোনা। তুই মেয়ে মানুষ। পরের বাড়ির সম্পত্তি। আমাদের ভাগের টাকা খরচ করে তোকে এতো পড়াশোনা করিয়ে বড় জায়গায় চাকরি নিয়ে দিতে যাবো কেন আমরা! বিয়ের পর তো সেই চাকরি থেকে পাওয়া টাকা তুই আমাদের হাতে তুলে দিবি না।”

রাজিবুলের তালে তাল মিলিয়ে রফিকুল বললো….
—“বড় ভাইয়া একদম ঠিক বলেছে। তোকে পড়াশোনা করাতে গিয়ে এ যাবতে যে অর্থ গুলো ব্যয় হয়েছে সেই ক্ষতিই তো আমাদের কখনও পূরণ হবে না। আর তুই কি না অনেক দূর পর্যন্ত পড়াশোনা করার কথা বলছিস!”

রুমি নিজের দুই ভাইয়ের এমন তি*ক্ত কথা হজম করতে না পেরে তেজী স্বরে বললো…..

—“তোমরা হয়তো ভুলে যাচ্ছো আমি তোমাদের টাকা দিয়ে পড়াশোনা করি না। আমি জনাব. শরীফ সাহেবের একমাত্র মেয়ে। জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত আমার পিছনে হওয়া যাবতীয় খরচ তিনি একা হাতেই সামলে এসেছেন। রিজওয়ান ভাই সেদিন কি বলেছিলো ভুলে গিয়েছো নাকি তোমরা! আমি সেদিন এখানে উপস্থিত না থাকলেও আম্মার থেকে সম্পূর্ণ ঘটনাই শুনেছিলাম। এই বংশের উত্তরাধিকার সূত্রে কেবল আমি আর রিজওয়ান ভাই-ই যাবতীয় সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার অধিকার রাখি। তোমরা দু’জন এই বংশের উত্তরাধিকার নও। তাই আমার পড়াশোনা বন্ধ করতে চাওয়ার কথা বলারও কোনো অধিকার তোমাদের নেই বুঝলে!”

রুমির মুখে এরূপ কথা শুনে রফিকুল আর রাজিবুলের সর্বশরীরের র*ক্ত যেনো টগবগ করে ফু*ট*তে শুরু করেছে। রফিকুল নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারলেও রাজিবুল পারে না। সে বসা থেকে উঠে অত্যন্ত রাগ নিয়ে রুমির দিকে তে*ড়ে এসে সকলের সামনেই ভিষণ শক্ত ভাবে ওর গলাটা একহাত দিয়ে চে*পে ধরে গোল বৈঠকখানার মাঝবরাবর টেনে আনে। উপস্থিত বাকিদের চোখে-মুখে ভ*য় ও হ*ত*ভ*ম্ব*তার ছাপ স্পষ্ট হয়। সকলেই যেনো মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ করার ভাষা হারিয়ে ফেলে। এদিকে রুমি নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য হাত-পা ছুঁ*ড়*তে শুরু করেছে। রাজিবুল অত্যন্ত রাগী স্বরে বললো…..

—“আমাকে আমার জায়গা চেনাচ্ছিস তুই! হাঁটুর বয়সী মেয়ে হয়ে আমার মুখে মুখে এতো বড় কথা বলার সাহস দেখিয়েছিস। আজ তোকে মে*রে*ই ফেল……!”

রাজিবুল পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই ঝড়ের বেগে একটা লা*থি ওর পেটের বাম পার্শে এসে পড়লে রুমির গলা ছেড়ে গিয়ে সে কয়েকহাত দূরে মেঝেতে ছিঁ*টকে পরে যায়। তাল সামলাতে না পেরে রুমিও মেঝেতে পরে গিয়েছে। রাজিবুল অত্যন্ত ব্যথায় কুঁ*ক*ড়ে যায়। আকস্মিক এমন কিছু হওয়ায় উপস্থিত সকলেই ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে ওদের সামনে রিজওয়ান রাগে হালকা লাল বর্ণ ধারণ করা মুখশ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিচ থেকে উচ্চশব্দে কথা বলার আওয়াজ শুনতে পেয়ে এতোক্ষণে মেহরিন ও সেখানে উপস্থিত হয়েছে। মেহরিন পরিস্থিতি হালকা ভাবে আঁচ করতে পারে। রুমিকে মেঝেতে পরে থাকতে দেখে মেহরিন রুমির কাছে এসে ওকে ধরে ডাইনিং রুমে এনে সেখানে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে ওর দিলে এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দেয়। কাঁদতে কাঁদতে রুমির দু’চোখ ফুলে লাল বর্ণ ধারণ করতে শুরু হয়েছে। রিজওয়ান দ্রুতকদমে রাজিবুলের নিকট এগিয়ে গিয়ে ওকে টেনে দাঁড় করিয়ে ওর নাক বরাবর পর পর কয়েকটা ঘু*ষি প্রয়োগ করে। রাজিবুল নাক ফে*টে র*ক্ত ঝড়তে শুরু হয়েছে। উপস্থিত কেউই রাজিবুলকে রিজওয়ানের হাত থেকে বাঁচাতে এগোনোর সাহস করে উঠতে পারছে না। পরমুহূর্তেই রিজওয়ান ওর দু’হাত দিয়ে শক্ত ভাবে রাজিবুলের শার্টের কলার্ট চেপে ধরে বললো…..

—“তোর সাহস কি করে হলো আমার বোনের গলা চে*পে ধরার! মাতৃসূত্রে তুই ওর বড় ভাই হতে পারিস কিন্তু পিতৃসূত্রে আমিও তোর বড় ভাই হই। রুমি হাজার অন্যায় করলেও এমন ভাবে ওর গায়ে হাত দেওয়ার অধিকার তোর নেই। আমার বোনকে মে*রে ফেলতে চাস তুই! এতো বড় সাহস তোর! আমি চাইলে এক্ষুণি তোকে মে*রে এই আঙিনার ২০ ফুট নিচে দা*ফ*ন করিয়ে দিতে পারবো। শুধুমাত্র বাবার সামনে তোদের আসল রূপটা দেখানোর জন্য আমি এমন কিছু করি নি এখনও। আজ যা করেছিস পরবর্তীতে ভুলেও এমন কিছু করার চিন্তাও করিস না। তখন আমি কারোর পরোয়া করবো না। সোজা মে*রে মাটির নিচে গে*ড়ে দিবো।”

এই বলে রিজওয়ান স্বজোরে একটা ধাক্কা দেয় রাজিবুলকে। রাজিবুল এবারও কয়েকহাত দূরে মেঝের উপর পরে গিয়ে সেন্স হারিয়ে ফেলে। পরমুহূর্তেই রিজওয়ান রাহেলা আর রফিকুলে সামনে এসে দাঁড়ায়। রফিকুল পরপর কয়েকবার শুকনো ঢো*ক গিলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। রিজওয়ান তেজি স্বরে বললো…..

—“আমার বোনকে বিয়ে দেওয়ার জন্য যে বা যারা জোর জ*ব*র দ*স্তি করার চেষ্টা করবে তাদের পরিণতিও ভিষণ ভ*য়া*বহ হবে মনে রাখবেন সবাই। আপনাদের মতো অ*মানুষদের সুখের ব*লি আমার বোনকে চ*ড়*তে দিবো না আমি।”

এই বলে রিজওয়ান সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজরুমে চলে যায়। রিজওয়ান চলে যেতেই ওরা সবাই বসা থেকে উঠে ছুটে যায় রাজিবুলের কাছে। দূর থেকে রুমি ওদের দিকে ঘৃ*ণা ভরা দৃষ্টি নি*ক্ষে*প করে মনে মনে বললো……

—“কে আমার আপন আর কে আমার পর আজ তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে সক্ষম হলাম আমি।”

রুমির পাশেই মেহরিন নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো কেবল।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৯)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৪৩)
রাহেলা, রফিকুল, শেফালি, ঊর্মিলা অচেতন রাজিবুলের চেতনা ফেরানোর কাজে ব্যস্ত আছে। মেহরিন রুমিকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“তুমি তোমার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো রুমি। ওদের বিষয় ওদেরকেই সামলাতে দাও। আর বিয়ের বিষয়ে কোনো চিন্তা করো না। পুরো দুনিয়া তোমার বিরুদ্ধে চলে গেলেও তোমার রিজওয়ান ভাই আর আমাকে সবসময় পাশে পাবে তুমি।”

এই বলে মেহরিন সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজরুমে চলে যায়। রুমি ছলছল দৃষ্টি নিয়ে মেহরিনের যাওয়ার পানে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর নিজের মা-ভাই-ভাবীদের দিকে দৃষ্টি স্থির করে মনে মনে বললো….

—“অ*ন্যায় কারীর পরিণতি এমন-ই হয়। যা হয়েছে বেশ হয়েছে।”

এই বলে রুমি বসা থেকে উঠে ওদের সবার পাশ কাটিয়ে নিজরুমে চলে যায়। ঊর্মিলা একপলক রুমিকে দেখে আবার বাকিদের উপর দৃষ্টি স্থির করে। শেফালি অস্থির কন্ঠে বললো….

—“আম্মা…ওর নাক থেকে রক্ত পড়া তো বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিন্তু ওর চেতনা কেনো ফিরছে না। ওকে কি হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে!”

শেফালির মুখে এরূপ কথা শুনে ঊর্মিলা মনে মনে বললো….

—“হুম হুম আমার স্বামীর পকেট থেকে টাকা খ*সানোর জন্যই এখন নিজের স্বামীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা উঠাচ্ছে চতুর মহিলা। ভেবেছি আমি বুঝবো না। তুমি শেফালি যদি চলো ডালে ডালে আমি ঊর্মিলাও চলবো তেমন পাতায় পাতায়।”

এই বলে ঊর্মিলা নিজের ডান হাতের কনুই দিয়ে রফিকুলের পেটের একপার্শে পরপর কয়েকবার গুঁ*তো দেয়। রফিকুল কিন্ঞ্চিত ব্য*থায় চোখ-মুখ হালকা কুঁ*চ*কে নিয়ে ঊর্মিলাকে কিছু বলতে নিয়ে ঊর্মিলা ইশারায় রফিকুলকে নিরব থেকে ওদের থেকে দূরে সরে আসতে বলে। অতঃপর ঊর্মিলা বসা থেকে উঠে ওদের সবার থেকে কয়েকহাত দূরে এসে দাঁড়ায়। রফিকুলও ঊর্মিলার পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“কি হলো..এভাবে ডাকার মানে কি?”

—“শুনলে না তোমার বড় ভাবী কি বললো! তোমার ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা তুলেছে।”

—“হুম, এতে কি হয়েছে।”

—“কি হয়েছে মানে! তোমার মাথায় কি বুদ্ধি বলতে কোনো কিছু আছে আদেও?”

—“আহহ ঊর্মিলা, এতো ভনিতা না করে যা বলার সরাসরি বলো তো৷”

—“বলি আমাদের এলাকায় আশেপাশে কোনো হাসপাতাল আছে কি?”

—“না, নেই তো।”

—“হুম নেই। হাসপাতাল সব শহরে অবস্থিত। আমাদের এখান থেকে শহরে যেতে প্রতিজনের ৫০ টাকা করে ভাড়া লাগে। এখন তোমার ভাইকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তোমার মা সম্মতি জানালে এতোগুলো মানুষের যাওয়ার ভাড়া থেকে শুরু করে, হাসপাতালে ডাক্তার দেখানোর খরচা ও ঔষধ কেনার খরচা সব তো তোমার পকেট থেকেই দিতে হবে। তোমার ভাবী, মা তো তখন সুযোগ পেয়ে অসহায় হওয়ার নাটক করবে। খামোখা তুমি এতো টাকা ব্যয় করতে যাবে কেনো শুনি?”

ঊর্মিলার বলা কথাগুলো বুঝতে পেরে রফিকুল বললো….
—“হুম এভাবে তো ভেবে দেখি নি বিষয়টা।”

—“তা ভাববে কেনো? ভাবার জন্য তো মাথায় সামান্যতম বুদ্ধি বলতে কিছু থাকতে হবে।”

—“আহহা ঊর্মি, আবার শুরু করো না তো তুমি।”

—“শুনো, তোমার মা আর ভাবীকে যেভাবেই হোক বুঝায় বলো যে বড় ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। র*ক্ত পড়া যেহেতু বন্ধ হয়েছে সেহেতু আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। মা*ই*রের ধ*ক*ল*টা একটু পর কে*টে গেলে আপনা-আপনিই ওনার চেতনা ফিরে আসবে। আর যদি ওনারা একান্তই না মানে তাহলে এই আমি বলে দিচ্ছি তুমি ওদের সাথে এক পা ও বাহিরের দিকে বের করবে না। নয়তো তোমার একদিন হবে আর আমার যতোদিন লাগে।”

এই বলে ঊর্মিলা রফিকুলের কাছে থেকে সরে রাহেলা আর শেফালির পাশে এসে বসে। রফিকুলের কপালে কয়েকটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ইতিমধ্যেই। কিয়ৎক্ষণ নিরব হয়ে ভাবার পর রফিকুল ঊর্মিলার কথানুযায়ী ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“আম্মা…ভাবী! তোমরা শান্ত হও। এতোটা অস্থির হওয়ার মতো আহামরি বিষয় এখানে হয় নি। বড় ভাই ভাড়ি শরীরের মানুষ। আকস্মিক মা*ই*রের ধ*ক*ল নিতে পারেন নি জন্যই এখনও তার চেতনা ফিরছে না। এতোসময় ধরে এভাবে তাঁকে শুধু মেঝের উপর শুইয়ে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না। সবাই আমাকে সাহায্য করো বড় ভাইকে রুমে নিয়ে যেতে।”

বাকিরা আর কথা না বাড়িয়ে রফিকুলকে সাহায্য করে রাজিবুলকে মেঝে থেকে উঠিয়ে রুমে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

(৪৪)
মেহরিন রুমে প্রবেশ করতেই দেখে রিজওয়ান এখন অফিসের পোশাক পরিবর্তন করে নি। বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে কপালের উপর একহাত ভাঁজ করে দু’চোখ বুঁজে আধশোয়া হয়ে আছে সে। মেহরিন রিজওয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কপালের উপর রাখা হাতের উপর নিজের শীতল হাত রাখতেই রিজওয়ান হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসে মেহরিনের উপর নিজের শান্ত দৃষ্টি স্থির করে। মেহরিন কিয়ৎক্ষণ পূর্বে নিচে ঘটে যাওয়া ঘটনা সম্পর্কে কোনো কথা না উঠিয়ে বললো….

—“কি হয়েছে তোমার! কেমন বিষন্ন লাগছে তোমাকে দেখতে। কোনো বিষয় নিয়ে কি চিন্তিত তুমি?”

রিজওয়ান শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো….

—“অফিসে যাওয়ার পর অনেক খোঁজা-খুঁজি করে বাবার ফোন নাম্বারটা জোগার করেছিলাম আমি। কিন্তু ফোন দেওয়ার পর বারংবার ফোন বন্ধ দেখিয়েছে। ঐ নাম্বার দিয়ে অনলাইন সাইডে বিভিন্ন একাউন্ট ও খোলা আছে তার। কিন্তু সেখান দিয়ে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। ৩দিন আগে সব জায়গা থেকে অনলাইন এ এক্টিভ ছিলেন তিনি। বাবাকে সব সত্য সম্পর্কে অবগত না করা পর্যন্ত আমি স্বস্তি পাচ্ছি না মেহরিন। বাবার সাথে যোগাযোগ করতে না পারলে কিভাবে এই কাজটা সম্পন্ন করবো আমি! বাবার কোনো সমস্যা হলো কি না এ নিয়েও চিন্তা হচ্ছে আমার।”

রিজওয়ানের এরূপ কথাগুলো শুনে মেহরিনের চেহারা জুড়েও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। মেহরিন নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো….

—“এভাবে দু*শ্চিন্তা করো না তুমি। হয়তো বাহ্যিক কাজে বাবা অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন যার দরুন ফোন বন্ধ করে রেখেছেন আর নিজের অনলাইন একাউন্ট গুলোতেও এক্টিভ হতে পারছেন না। ব্যস্ততা শেষ হলে নিশ্চয়ই তিনি তোমার সব কল, অনলাইন সাইডে যোগাযোগ করার চেষ্টা গুলোকে দেখবেন। ততোদিন অপেক্ষা করা ছাড়া আমাদের আর করার কিছু নেই। ধৈর্য রাখো। আল্লাহ আছেন আমাদের পাশে। তিনি যা করবেন নিশ্চয়ই তাতে আমাদের ভালোটাই হবে।”

মেহরিনের কথায় রিজওয়ান পূর্বের থেকে কিছুটা শান্ত হয়। কিয়ৎক্ষণ সম্পূর্ণ পরিবেশ জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে। কিয়ৎক্ষণ পর রিজওয়ান বললো…

—“রাজিবুলের আনা ওমন সম্বন্ধ মেনে নেওয়া সম্ভব না এটা আমি বুঝতে পারছিই। কিন্তু রুমির বিয়েতে না করার পিছনে আরো অন্য কোনো কারণ আছে বলে মনে হচ্ছে না তোমার মেহরিন!”

রিজওয়ানের কথার ধরণে মেহরিন বুঝতে পারে সে রুমিকে সন্দেহ করছে। মেহরিন এবার মনঃস্থির করে সে রিজওয়ানকে রুমির সব সত্য সম্পর্কে অবগত করবে। নয়তো দিনকে দিন পরিস্থিতি আরো খা*রা*প পর্যায়ে চলে যেতে পারে। পরমুহূর্তেই মেহরিন বললো….

—“রুমি একজন ছেলেকে ভালোবাসে রিজওয়ান।”

মেহরিনের মুখে এরূপ কথা শুনে রিজওয়ান অবাক হয় না। রিজওয়ান স্মিত হাসি দিয়ে বললো….

—“কে সেই ছেলে?”

—“আমাদের এলাকার চেয়ারম্যান সাহেবের একমাত্র ছেলে জিহাদ।”

—“জিহাদ ছেলেটা খারাপ না। যথেষ্ট ভদ্র। এখনও বাহিরে কোথাও দেখা হলে সালাম দিয়ে সম্মানের সহিত কথা বলে। কিন্তু মূল সমস্যা চেয়ারম্যান সাহেবকে নিয়েই। লোকটা মোটেও সুবিধার নয়। অর্থবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের দু’নজরে দেখেন সবসময়। এছাড়াও ওনার অ*ন্যায়, অ*বৈধ কাজের তো হিসাব নেই। আমাদের বাড়ির মেয়ের সাথে উনি ওনার একমাত্র ছেলের বিয়ে দিতে সম্মতি জানাবেন কি না এ নিয়ে চিন্তিত আমি।”

—“এই বিষয়টা আমিও চিন্তা করেছিলাম। কিন্তু রুমির আচারণ দেখে আমি যা বুঝেছি সে এই সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসবে না। তুমি বরং জিহাদের সাথে একাকী এই বিষয়ে কথা বলো একবার। সে কি বলে শুনো। তারপর যা করা দরকার মনে হবে তাই করবো আমরা।”

—“হুম ঠিক বলেছো। আমি আগামীকাল-ই জিহাদের সাথে দেখা করবো।”

(৪৫)
আরফা নিজরুমে বিছানায় বসে নিজের মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…..

—“মাম্মাম জানো..তোমার ছবিতে হাত বুলিয়ে দি যখন তখন মনে হয় আমি তোমার শরীর স্পর্শ করছি। মনে হয় তুমি আমার কাছেই আছো। মাম্মাম তুমি একদম আফসেট হইও না। খুব তাড়াতাড়ি আমি তোমার জায়গায় স্টার হয়ে গিয়ে তোমাকে বাবাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো।”

আরহাম মাত্রই অফিস থেকে বাসায় ফিরেছে। আরফার রুম পেরিয়েই আরহামকে তার নিজের রুমে যেতে হয়। সেইসময় আরফার কন্ঠে এরূপ কথাগুলো শুনে অজান্তেই আরহামের বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। ছোট্ট আরফা যে এটা বুঝে না, কেউ যদি মারা যায় তাঁকে আর কখনও ফিরিয়ে আনা যায় না। একজন জিবীত মানুষের বদলে আরেকজন মৃত্যু মানুষকে ফিরিয়ে আনার মতো অসম্ভব শক্তি আল্লাহ কাওকে দেন নি। আরহাম ওভাবেই স্থির হয়ে আরফার রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়। কিয়ৎক্ষণ পর আরহাম আর না পেরে নিজরুমে চলে যায়। আরফা ওর বাবার উপস্থিতি বুঝতে পারে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১৫+১৬

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৫)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৩১)
নিজরুমে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে ঊর্মিলা আর রফিকুল। ঊর্মিলা বললো…..

—“বড় ভাইয়ের মতো চালাক-চতুর কবে হবে তুমি শুনি?”

আকস্মিক ঊর্মিলার এমন প্রশ্নে রফিকুল ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে বললো….

—“কেনো বড় ভাই আবার কি এমন চালাকির কাজ করলো?”

—“চোখ থাকতেও অন্ধের মতো চলাফেরা করো তো তুমি, তোমার থেকে এমন প্রশ্নই আশা করা যায়।”

—“আরে হয়েছে টা কি সরাসরি বলো তো। আজাইরা কথা বলে কানের মাথা খেও না।”

—“হ্যা, এখন আমার কথা তো আজাইরাই মনে হবে। ঘরের বউ পুরাতন হয়ে গেছে না! একটা বাচ্চা হলে কি আর সেই বউয়ের প্রতি কোনো টান কাজ করে? তখন তো মন আরো ফুরফুরে হয়ে যায়। হাঁটুর বয়সী মেয়েদের দেখলে ছলাৎ ছলাৎ করে।”

—“কথার কি ধরণ, ছিহ্।”

ঊর্মিলা একবার মুখ বাঁকিয়ে বললো…….
—“তোমার বড় ভাই নিজেদের ভবিষ্যত উজ্জ্বল করার জন্য উপযুক্ত রাস্তা দেখে নিয়েছে তা কি দেখছো না! বাহিরের সম্পত্তিও পাবে ১৬ আনা আবার তোমার এই বোকা বোকা চাল-চলনের জন্য একদিন ঘরের সব সম্পত্তিও নিজের নামে লিখে নিবে। তখন রিজওয়ান বা ওর বউও কিছু করে উঠতে পারবে না। আমাদের সবাইকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে নিজের বউ-বাচ্চাকে নিয়ে রাজত্ব করবে।”

—“তোমার মাথায় এমন উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা গুলো আসে কি করে আমাকে একটু বুঝিয়ে বলবে ঊর্মি!”

—“আমি কোনো উদ্ভট চিন্তা-ভাবনা করি নি। সকালে খেতে বসে তোমার ভাই যে তোমাদের একমাত্র বোনের জন্য এমন একটা সম্বন্ধ আনার কথা বললো সে বিষয়ে কি একটা বার ও ভেবে দেখেছিলে! এমন সম্বন্ধ আনার পিছনে তার কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে! তখন তো তোমার মুখশ্রী জুড়ে খুশির শেষ ছিলো না বোনের বিয়ে হবে ভেবে।”

—“উদ্দেশ্য! এখানে আবার উদ্দেশ্য কি থাকতে পারে?”

ঊর্মিলা ওর কপালে একবার চাপর দিয়ে আফসোসের স্বরে বললো….
—“ইয়া আল্লাহ, এ আমি কোন গ*র্ধ*ভকে ভালোবেসে বিয়ে করতে গেলাম!”

—“আমাকে অসম্মান না করে কখনও একটা বিষয় নিয়ে কথা পরিষ্কার ভাবে শেষ করতে পারো না তুমি তাই না!”

ঊর্মিলা শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো….
—“ঊর্মি-ঊর্মি-ঊর্মি…ঠান্ডা হ। এখন নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিবাদ করার সময় না।”

অতঃপর ঊর্মিলা আবার বললো….
—“তোমার ভাই আর তোমার আয়ের অবস্থা প্রায় একই। যদি শ্বশুড়মশাই খরচ না দিতেন তাহলে সত্যিই যে আমাদের জীবন এতোটা স্বচ্ছল ভাবে কাটতো না এ কথা আমি কখনও অস্বীকার করবো না। শ্বশুড় মশাই তো আমৃত্যু পর্যন্ত কষ্ট করে টাকা রোজগার করবেন না। আর এই বংশের আসল উত্তরাধিকার যে রিজওয়ান এ কথাও অস্বীকার করার জোঁ আমাদের নেই। সেই হিসাবে রিজওয়ান তোমার আর বড় ভাইয়ের থেকে কয়েকগুন বেশি সম্পত্তির ভাগ পাবে। সবদিক চিন্তা করেই তোমার বড় ভাই নিজের লাভের জন্য রুমির জন্য এমন একটা বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে এসেছেন। রুমির জন্য আনা সম্বন্ধে ঐ লোকের বয়স রুমির বয়সের দ্বিগুণের থেকেও বেশি। আবার তার দু’জন সন্তানও আছে। সয়-সম্পত্তির নাকি অভাব নেই। আবার বড় ভাইয়ের অফিসের ম্যনেজার ও উনি। রুমি বিয়ে সত্যিই ওখানে হলে অফিসের দিক থেকেও বড় ভাই লাভবান হবেন আবার ওনার যে বুদ্ধি! তা খাঁটিয়ে রুমির শ্বশুর বাড়ির সব সম্পত্তি নিজের নামে কিভাবে লিখে নিবেন কেউ বুঝতেও পারবে না। উনি সবদিক থেকে লাভবান হয়ে যাবেন। আর আমরা বসে বসে বুড়ো আঙুল চুষে খাবো।”

ঊর্মিলার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে রফিকুলের কপালে চিন্তার কয়েকটা ভাঁজ স্পষ্ট হয়। কিয়ৎক্ষণ পর ঊর্মিলা আবারও বললো….

—“বাহির দিক থেকে লাভবান হতে পারো কিন্তু ভিতর দিক থেকে হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। একেবারে তো হাল ছেড়ে বসে থাকা যাবে না।”

রফিকুল ঊর্মিলার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি স্থির করলে ঊর্মিলা বললো…..

—“শ্বশুড় মশাই একেবারের জন্য দেশে ফিরে আসলে খুব বেশি দেড়ি করবেন না নিজের অর্জিত অর্থ ও সয়-সম্পত্তি সবার মাঝে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে দিতে। তার এই কাজ করার পূর্বেই তোমাকে এমন কোনো পরিকল্পনা সাজাতে হবে যেনো সব সম্পত্তি তুমি কেবল নিজের নামে লিখে নিতে পারো। বাকিরা শত চেষ্টা করেও যেনো এই সম্পত্তিতে ভাগ বসাতে না পারে।”

—“হুম তুমি ঠিক বলেছো। আমি ভাবছি এই বিষয়ে। তুমি কোনো চিন্তা করো না।”

রফিকুলের মুখে এরূপ কথা শুনে উর্মিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসে।

(৩২)
পরেরদিন সকালে….
রুমির রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই শেফালি দেখলো রুমি কোথাও যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। শেফালি শান্ত স্বরে বললো….

—“কোথায় যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছো রুমি?”

শেফালির কন্ঠে এমন প্রশ্ন রুমির কর্ণপাত হতেই ওর মুখশ্রী জুড়ে একরাশ বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট হয়। রুমি বিরক্তির স্বরে বললো….

—“ক’টা বাজে এখন? এই সময় আমি কোথায় যেতে পারি জানো না তুমি? আমার কি রসের শত শত বন্ধু-বান্ধব আছে যে তাদের বাড়িতে ঘুরতে যেতে পারবো!”

রুমির মুখে এমন ত্যড়া প্রতিত্তুর শুনেও তা শেফালি হজম করে নেয় অনায়াসেই। কেনো জানি না এখন আর আগের মতো কথায় কথায় মুখ লাগিয়ে কারোর সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে হয় না ওর। অল্পতেই সমাধান হয়ে যাক এমনটা ভাবে সে। শেফালি ছোট্ট করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো…..

—“তোমার ভাইয়ের আনা তোমার জন্য গতকালের সেই সম্বন্ধের জন্য ওর পাশাপাশি আমার উপরেও রেগে আছো তুমি তাই না রুমি!”

রুমি শেষ বারের মতো নিজেকে আয়নায় আরেকবার দেখে নিয়ে শেফালির দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে বললো….

—“সকাল সকাল এই আজাইরা বিষয়ে কথা বলার কোনো ইচ্ছে আমার নেই বড় ভাবী। আজ আমার মনটা গতকালের তুলনায় অনেকটা ভালো আছে তাই কলেজের যাওয়ার কথা চিন্তা করেছি, এই শেষ মূহূর্তে এসে আমি চাই না এই বিষয়ে কথা বলে তুমি আমার যাওয়ার সম্পূর্ণ ইচ্ছে মাটি করে দাও।”

এই বলে রুমি শেফালিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বিছানা থেকে নিজের হাত ব্যগটা নিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি দরজার একপার্শে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রুমির যাওয়ার পানে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।

(৩৩)
নিজরুমে দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের ড্রয়ার খুলে নিজের ফোনটা বের করে তা নিয়ে বিছানায় এসে বসেন রাহেলা বেগম। তার দৃষ্টি এখন বিছানার উপর রাখার তারই মোবাইলের উপর স্থির। পরক্ষণেই রুমের ভিতরে দেওয়ালে টাঙানো ঘড়িটার দিকে তাকাতেই দেখলেন ঘড়িতে তখন ১১টা বেজে ৫মিনিট। কিয়ৎক্ষণ যেতে না যেতেই রাহেলার ফোন বেজে উঠে। রাহেলার স্বামী শরীফ সাহেব ফোন করেছেন। রাহেলা বেগমের ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। পরক্ষণেই হাসি থামিয়ে টেবিলের উপর থাকা পানির বাটি থেকে স্বল্প পরিমাণ পানি নিয়ে নিজের চোখ ভিজান তিনি। যেনো তাঁকে দেখে মনে হয় তিনি এতোসময় ধরে কান্না করছিলেন। মুখশ্রীর ভাব ও তেমন করলেন তিনি। অতঃপর শরীফ সাহেবের কল রিসিভ করেই তাঁকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তিনি ন্য*কা কান্নার নাটক করতে করতে বললেন……

—“ওগো…আমার সব শেষ হয়ে গেলো গো। আমি এবার কি নিয়ে বাঁচবো। এমন দিন দেখার আগে আমার মরণ কেনো হলো না!”

রাহেলার মুখে আকস্মিক এমন কথা শুনে শরীফ সাহেব ভরকে যান। দ্রুততার স্বরে তিনি বললেন….

—“রাহেলা..কি হয়েছে তোমার? এভাবে কান্না করছো কেনো? আমার ছেলে-মেয়েরা সবাই সুস্থ আছে তো? বউমারা-বাচ্চারা ওদের কিছু হয় নি তো?”

—“সবাই সুস্থ আছে। কিন্তু আজ আমাকে আমারই এক ছেলের মুখে শুনতে হলো এতো বছরের চেষ্টায় সাজানো এই সংসার নাকি আমার না। আমি, আমার দুই – ছেলে – বউমারা আমরা সবাই নাকি এই সংসারের আগাছা। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের সবাইকে এ বাড়ি থেকে চিরতরের জন্য বের করে দেওয়া হবে।”

শরীফ সাহেব অত্যন্ত অবাক স্বরে বললেন….
—“কি বলছো কি তুমি এসব রাহেলা! রিজওয়ান তোমাদের এমন কথা বলেছে?”

—“শুধু এতোটুকুই না। আরো অনেক কথা বলেছে সে আমাদের। আর এটা নতুন কিছু না। তোমার অবর্তমানে আমরা সবাই এখানে কিভাবে দিন পার করছি আমরা জানি। সবসময় রাজিবুল আর রফিকুলকে এটা বলে খোঁটা দেয় সে যে, ওদের দুজনের জন্মদাতা পিতা তুমি নও। তাই এই বাড়ির সব সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকার সে নিজে। আর রইলো রুমির কথা। খুব তাড়াতাড়ি ওকে দায়সারা ভাবে বিয়ে দিয়ে এ বাড়ি ছাড়া করার ব্যবস্থা করবে রিজওয়ান। তারপর আমাদেরও এ বাড়ি থেকে বের করে দিবে সে। এতোদিন সংসারে অশান্তি হবে ভেবে আমরা সবাই সব অন্যায়-অবিচার মুখ বুঝে সহ্য করে গিয়েছিলাম। তোমার কাছে কখনও এসব নিয়ে কোনো অভিযোগ করি নি কেউ। কিন্তু এবার সব সহ্যের সীমা অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। তাই সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে তোমাকে অবগত না করে পারলাম না। আমার মন আর আমার সৃষ্টিকর্তা খুব ভালোভাবেই জানে আমি বা আমার ছেলে-মেয়েরা আসলে কেমন। আমরা সবাই সেই শুরু থেকে রিজওয়ানকে আপন করে নেওয়ার চেষ্টা করে এসেছি। কিন্তু রিজওয়ান না কখনও আমাকে তার মায়ের স্থানে বসিয়ে সম্মান দিয়েছে আর না আমার ছেলে-মেয়েদের নিজের ভাই-বোন মনে করে শ্রদ্ধা-স্নেহ করেছে। সবকিছু হাতের বাহিরে চলে যাওয়ার আগে তুমি দেশে চলে এসো। আমাদের সাথে হওয়া এই অন্যায়ের সুবিচার পাওয়ার আশায় মুখর হয়ে বসে আছি আমরা।”

রাহেলার বলা সম্পূর্ণ কথা গুলো শুনে শরীফ সাহেবের মুখশ্রী জুড়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। তিনি যেনো কিছুতেই নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার ও তার প্রথম স্ত্রীর ভালোবাসার চিহ্ন রিজওয়ান এতোটা নিম্ন মানসিকতার হতে পারে তা তিনি ভাবতেও পারছেন না। শরীফ সাহেব কিছু না বলে কল কেটে দিলেন। কল কেটে গিয়েছে বুঝে রাহেলা শাড়ির আঁচল টেনে নিজের চোখে-মুখে লেগে থাকা পানি গুলো মুছতে মুছতে বললেন…..

—“সঠিক সময় সঠিক স্থানে বিষমন্ত্র উগলে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করে দিলাম। এখন কিছুটা নিশ্চিন্ত লাগছে।”

এই বলে রাহেলা নিঃশব্দে হাসতে থাকেন।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………..

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৬)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(৩৪)
বিকেলবেলা…..
আমজাদ চৌধুরী নিজরুমে হেলানো চেয়ারে শরীর এলিয়ে বসে আছেন আর বই পড়ছেন। সেইসময় আরফা ওর বুকের সাথে একহাত দিয়ে ছোট্ট একটা টেডি জড়িয়ে নিয়ে আমজাদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“দাদু..দাদু..শুনো একটু আমার কথা।”

আরফার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমজাদ সোজা হয়ে বসে হাত থাকা বইটা বন্ধ করে পাশের ছোট্ট টেবিলের উপর রাখতে রাখতে আদুরে স্বরে বললেন….

—“আরে আমার দিদিভাই এসেছে যে, কি বলতে চাও তুমি আমায় দিদিভাই?”

আরফা বললো….
—“দাদু তুমি আমাকে নামাজ কিভাবে পড়তে হয় তা শিখিয়ে দিবে! আমি নামাজ পড়তে চাই।”

ছোট্ট আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে আমজাদ কিছুটা অবাক হলেন। মাত্র ৫ বছর বয়সের বাচ্চা নামাজি শিক্ষা নিতে চাচ্ছে এতো আগ্রহের সাথে! আমজাদ হাসিমুখে বললেন….

—“এ তো অনেক ভালো কথা দিদিভাই। আমি অবশ্যই তোমাকে শিখাবো কিভাবে নামাজ আদায় করতে হয়। আর নামাজে থাকাকালীন কোন কোন সূরা গুলো পড়া তোমার জন্য সুবিধাজনক হবে সেগুলোও মুখস্থ করতে সহোযোগিতা করবো। একটু পর আছরের আজান দিবে। তখন তোমাকে শিখিয়ে দিবো কেমন!”

—“ঠিক আছে দাদু।”

এই বলে আরফা গুটি গুটি পায়ে আমজাদের রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। আমজাদ নিরব হয়ে আরফার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রন।

(৩৫)
অফিসে নিজ টেবিলে বসে আছে রিজওয়ান। এখন ১৫মিনিটের ব্রেক টাইম পেয়েছে সে। চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে মনে মনে চিন্তা করছে সে তার ‘বাবাকে সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে কিভাবে অবগত করা উচিত হবে’। কিয়ৎক্ষণ পর রিজওয়ানকে হাতের বাম পার্শে ওদের অফিসের অনেক পুরোনো মধ্যবয়সের একজন পুরুষ পিওন এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললেন….

—“ছোট স্যার আপনাকে তার কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছেন এক্ষুণি।”

রিজওয়ান সোজা হয়ে বসে বললো…
—“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।”

পিওন স্থান ত্যগ করা মাত্র রিজওয়ান ও আরহাম চৌধুরীর কেবিনে যাওয়ার উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে। কিয়ৎক্ষণ পর আরহামের কেবিনের দরজার সামনে এসে দাড়িয়ে নক করে ভিতরে যাওয়ার অনুমতি চাইলে আরহামের অনুমতি পেয়ে রিজওয়ান তার কেবিনে প্রবেশ করে শান্ত স্বরে বললো….

—“স্যার..আপনি আমাকে ডেকেছিলেন?”

আরহাম শান্ত স্বরে বললো….
—“জ্বি, বসুন এখানে।”

রিজওয়ান বিনাবাক্যে আরহামের সম্মুখপানে রাখা চেয়ারটি টেনে সেখানে বসে। পরক্ষনেই আরহাম বললো…

—“অফিসে জয়েন হয়েছেন পর আমার নানান ব্যস্ততার কারণে আপনার সাথে পারসোনালি কথা বলা হয় নি এখনও। বাবার থেকে শুনেছিলাম অনেক আগেই। আপনার জন্য আমার বাবার প্রাণ রক্ষা হয়েছিলো। আপনার কাছে সেই সূত্রে আমি ঋণী হয়ে আছি। আমার জীবনে আমার বাবার মূল্য অনেক বেশি। তাঁকে আমি অনেক ভালোবাসি। তিনি ছাড়া আমার আপন বলতে এ পৃথিবীতে ২য় কেউ নেই।”

আরহামের মুখে এরূপ কথা শুনে রিজওয়ানের মনে পরে প্রথম পরিচয়ের দিন আমজাদের বলা কথাগুলো। আমজাদের সাথে থাকা সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি আরফাকে আরহাম আজও নিজের মেয়ে বলে মেনে নেন নি তা আজ আরো পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারলো রিজওয়ান। নিজের ভিতরে দলা পেকে আসা কিছু প্রশ্নগুলোকে আর বের হতে দিলো না সে। শব্দ করে কেবল একবার নিঃশ্বাস ফেললো রিজওয়ান। কিয়ৎক্ষণ পর আরহাম আবারও বললো….

—“বাবা খুশি হয়ে আপনাকে আমাদের কোম্পানিতে চাকরি দিয়েছেন। এই কাজের পাশাপাশি তিনি আমাকে কড়া শব্দে বলে দিয়েছেন আমি যেনো আপনাকে কোম্পানি থেকে সবরকম সুযোগ সুবিধা দেই।”

এই বলে আরহাম ওর হাতের ডান পার্শে থাকা টেবিলের ড্রয়ার খুলে একটা সপিং ব্যগ বের করে রিজওয়ানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো….

—“এই ব্যগটিতে আপনার জন্য একটি এনড্রয়েড ফোন আর ২ মাসের বেতন রাখা আছে।”

আরহামের এরূপ কথা শুনে রিজওয়ান কিছুটা অবাক হয়। রিজওয়ান শান্ত স্বরে বললো….

—“স্যার আপনারা আমায় এতো বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছেন। সেদিন বড় স্যারের প্রাণ আল্লাহ তায়ালার রহমতে বেঁচে গিয়েছে। আমি তো উছিলা ছিলাম মাত্র। তাই মানবিকতার খাতিরে যতোটুকু করা যায় করেছিলাম।”

—“আপনার করা উপকারের ফলসরূপ এই সুযোগ-সুবিধা গুলো পাচ্ছেন আপনি। যদি এগুলো গ্রহন না করেন তাহলে বাবার কড়া জবাবের সম্মুখীন হতে হবে আমায়। যা আমি চাই না। তাই না করবেন না।”

অতঃপর রিজওয়ান বাধ্য হয়ে আরহামের দেওয়া উপহার সামগ্রীগুলো গ্রহন করে। আরহাম আবারও বললো….

—“সামনের শুক্রবারে আপনার স্ত্রীকে নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেন। দুপুরের খাবার একসাথে খাবো৷ এই দাওয়াত আমার তরফ থেকে। আর এ বিষয়ে আমি কোনো নারাজ বাক্য শুনতে রাজি নই। নিঃশব্দে মেনে নিন। মন থেকে খুশি হবো।”

রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে স্যার।”

অতঃপর রিজওয়ান বসা অবস্থা থেকে উঠে আরহামের কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে।

(৩৬)
রাতের বেলা,
রাজিবুল বিছানায় শুয়ে আছে আর শেফালি রাজিবুলের মাথার পাশে বসে ওর মাথায় তেল মালিশ করে দিচ্ছে। রাজিবুল বললো…

—“রুমির সাথে আমার আনা সম্বন্ধের বিষয়ে কথা বলেছিলে?”

শেফালি শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো…
—“সকালে গিয়েছিলাম রুমির সাথে কথা বলতে। কিন্তু সে আমার সাথে খামোখাই উগ্র আচারণ করলো। আর বললো আমি যেনো এই সম্বন্ধ নিয়ে ওর সাথে কথা বলে ওর মুড নষ্ট করে না দেই।”

শেফালির মুখে এরূপ কথা শুনে রাজিবুলের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে চট করে শোয়া থেকে উঠে বসে রাগী স্বরে বললো….

—“তোমাকে সামান্য একটা কাজ দিয়েছিলাম আর তুমি সেটা করতে পারলে না! কোথায় আগে তো কখনও রুমি তোমার সাথে উগ্র আচারণ করার সাহস পেতো না! যদিও উঁচু গলায় একটা কথা বলতে আসতো তখন তুমি ওর মুখ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কথা ওকে শুনিয়ে দিতে। আমি তোমার ভিতর আমার পুরোনো শেফালিকে খুঁজে পাই না এখন। সেদিনের পর থেকে কেনো নিজেকে এতোটা পরিবর্তন করে ফেললে তুমি? যদি সময় থাকতে নিজেকে পূর্বের ন্যয় করতে না পারো তাহলে সম্পর্কের ১০ বছরের মাথায় এসে এই সম্পর্ক নিয়ে আমার ২য় বার ভাবতে হবে।”

এই বলে রাজিবুল বিছানা থেকে নেমে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি নিরব হয়ে রাজিবুলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। নিজ রুম থেকে বেড়িয়ে রাজিবুল সোজা ওর মা রাহেলা বেগম এর রুমে আসে। রাহেলা বিছানায় আয়েশী ভঙ্গীতে বসে পান চিবুচ্ছিলেন। সেইসময় রাজিবুলকে গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে নিজ রুমে প্রবেশ করতে দেখে রাহেলা বললেন….

—“আরে আমার বড় বা’জানের মুখটা এমন গম্ভীর হয়ে আছে কেনো? কি হয়েছে বা’জান! আমার পাশে এসে বোস বাবা।”

রাজিবুল ওর মায়ের পাশে এসে বসে বললো….
—“মা তুমি আমাকে ভালোবাসো তো?”

রাহেলা অবাক স্বরে বললেন….
—“হঠাৎ এমন প্রশ্ন করছিস কেনো বাবা?”

—“উল্টো প্রশ্ন না করে যা জিজ্ঞাসা করলাম তার উত্তর দাও।”

—“এটা আবার জিজ্ঞাসা করতে হয় রে! তুই, রফিকুল আর রুমি তোরা তিনজন-ই তো আমার কলিজার টুকরো। তোদের তিনজনকে ঘিরেই তো আমার সকল ভালোবাসা।”

—“আমার কারণে তুমি প্রথম ‘মা’ ডাক শুনতে পেরেছিলে সেই সূত্রে তোমার নিকট আমার হক রফিকুল আর রুমির থেকে বেশি হওয়া উচিত নয় কি!”

—“কি হইছে তোর বা’জান? এমন এমন কথা বলছিস কেনো তুই?”

—“যদি তুমি তোমার বড় সন্তানকে হারাতে না চাও আর তার ভালো হোক এমনটা চাও তাহলে রুমির জন্য
আমার আনা সম্বন্ধে ওকে সম্মতি জানাতে বাধ্য করিও।”

—“রাজিবুল! কি বলছিস তুই এসব? রুমি তোদের একমাত্র ছোট বোন। নিজের ভালোর জন্য তুই বোনকে কু*র*বানি দিতে চাচ্ছিস কি করে?”

রাজিবুল তেজী স্বরে বললো….
—“ভুলে যেও না মা রুমির শরীরে আমার বাবার রক্ত বইছে না। তুমি কেবল ওকে পেটেই ধরেছিলে। আমাদের নাড়ির টান একই হতে পারে কিন্তু আমাদের পৈতৃক সূত্র আলাদা। তাই নিজের ভালোর জন্য রুমিকে কু*র*বানি দিতে চাওয়া অ*ন্যায় কিছু নয়।”

—“রাজিবুল বাপ আমার! মাথা ঠান্ডা কর। এসব চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল তুই। আমার কাছে তুই, রফিকুল এর থেকে রুমির গুরুত্ব কোনো অংশে কম না। আমি চাই তোরা তিন জন-ই ভালো থাক, সুখে-শান্তিতে থাক। এক সন্তানের সুখের জন্য আমি মা হয়ে আরেক সন্তানকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ের জন্য জো*র-জ*ব*রদ*স্তি করতে পারবো না।”

রাজিবুল বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রাগে হিসহিসিয়ে বললো….
—“যদি তুমি আমার কথা না শুনো তাহলে তোমার বৃদ্ধ বয়সে তুমি তোমার পাশে আমাকে পাবে না। তোমার মৃত্যুর সময় তোমার মুখে পানি দেওয়ার জন্য তোমার ছোট ছেলে, মেয়ে কেউ থাকবে না। এই কথাটা মনে রেখো।”

এই বলে রাজিবুল রাহেলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহনিয়ে তার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। এতোসময় ধরে রাহেলার রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে রুমি ওদের দু’জনের সম্পূর্ণ কথপোকথন শুনেছে। রাজিবুল বেড়োনোর পূর্বেই সে সাবধানে স্থান ত্যগ করেছিলো। রুমির দু’চোখ বেয়ে কেবল অঝোর ধারায় অশ্রু গড়ে পড়ছে। ভাগ্য তাকে এ কোন মোড়ে এনে দাঁড় করালো। বাবা সমতুল্য বড় ভাই কিনা নিজের সুখের কথা চিন্তা করে তার সুখকে কু*র*বা*নি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেছে! রুমির কানে কেবল সেই সময়ের কথা গুলো বাজছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………..

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১৩+১৪

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৩)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২৫)
মেহরিন কিছুটা আনমনা ভাব নিয়ে খাবারের ট্রেটা হাতে রাখা অবস্থায় নিজেদের রুমে প্রবেশ করে বিছানার পাশে থাকা টেবিলের সম্মুখে এসে স্থির হয়ে দাঁড়ায়। কিয়ৎক্ষণ পর কাঁধে কারোর স্পর্শে কিন্ঞ্চিত ভ*র*কে উঠে মেহরিন পিছন ফিরতেই রিজওয়ানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট্ট করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে। রিজওয়ান বললো….

—“কখন থেকে তোমাকে ডেকে যাচ্ছি শুনছোই না তুমি। কোন চিন্তায় এতো গভীর ভাবে ডুবে আছো মেহরিন!”

রুমির বিষয়টা মেহরিন এখন-ই রিজওয়ানকে বলবে নাকি বলবে না সেই বিষয়ে ওর মন ভিষণ ভাবে খচখচ করছে। অতঃপর মেহরিন এই বিষয়ে ভাবার জন্য নিজেকে কিছুটা সময় দিতে আপাত পরিস্থিতি সামলাতে বললো….

—“ভাবছিলাম এই সংসারটা তো আমার, বড় ভাবী, মেজো ভাবীর আমাদের সবারই। আমরা একে-অপরের সাথে রে*ষা-রে*ষি না করে যদি মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করি তাহলে কি হয় না! মানছি বড় ভাবী, মেজো ভাবী বিগত সময় গুলোতে আমাদের দু’জনের সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছেন, ক*টু ও ক*ষ্ট দায়ক কথা শুনিয়েছেন কিন্তু আমরাও যদি এখন তাদের সাথে তাদের মতো আচার-ব্যবহার করি তাহলে আমাদের আর তাদের মধ্যে তো কোনো পার্থক্য থাকবে না বলো! তোমার নতুন চাকরি হয়েছে দিনের পুরো সময়টা এমনকি রাতের প্রথম ভাগও তোমাকে কাজের জন্য বাহিরে থাকতে হবে প্রতিদিন। কিন্তু আমাকে তো ২৪টা ঘন্টাই এই বাড়ির ভিতরেই থাকতে হবে। এই বাড়িতে বসবাসরত বাকি মানুষগুলোর সম্মুখেও দাঁড়াতে হবে। সারাজীবন কি এভাবেই তাদের সাথে আমরা আমাদের সাথে তারা রে*ষা-রে*ষি করেই কাটিয়ে দিবো বলো?”

মেহরিনের বলা কথাগুলো রিজওয়ান নিরব হয়ে শুনে। কিয়ৎক্ষণ পর মেহরিন আবারও বললো….

—“বাবার বয়স হয়েছে। কিছুদিন পর এমনিও তিনি নিজ থেকেই দেশে একেবারের জন্য চলে আসবেন। বাড়ির মানুষগুলোর আসল চেহারা সম্পর্কে তিনি অবগত নন। হুট করে সবকিছু জানতে পেরে যদি তার বড় কোনো ক্ষ*তি হয়ে যায় তখন কি হবে? যদি তিনি দেশে ফেরার আগেই কিংবা তাকে সবার সম্পর্কে সব সত্য জানানোর পূর্বেই আমাদের মিলেমিশে চলার চেষ্টার ফলসরূপ পরিবারের সবার চিন্তা-ভাবনা, আচার-আচরণ পরিবর্তন হয় তাহলে কি খুব খারাপ হবে!”

রিজওয়ান মেহরিনের দু’কাঁধে নিজের দু’হাত রেখে বললো…
—“তোমার মতো এতো সহজ ভাবে যদি ওরা সবাই চিন্তা করতো মেহরিন তাহলে ওরা নিজ থেকেই অতীতে নিজেদের করা কাজের জন্য মনে মনে অনুশোচনা করতো, লজ্জা বোধ করতো। বিগত দুইদিন ধরে আমি ওদের প্রত্যেকের চেহারায় আমাদের জন্য কেবল রাগ-ক্ষো*ভ ব্যতিত কিছুই দেখি নি। বি*ষা*ক্ত সা*প দের শত চেষ্টা করেও নিজেদের বশে আনানো যায় না। তারা কেবল আমাদের দেখানোর জন্য নিজেদের বশীভূত বলে দাবী করে। কিন্তু তাদের নিজস্ব সময় ও সুযোগ হলে তারা আমাদের নিজেদের শরীর দ্বারা পিষ্ট করে বি*ষ দাঁত অবশ্যই বসিয়ে দিবে। তবে তুমি নমনীয় হয়ে চলতে চাইছো যখন তখন চলতে পারো। কিন্তু নমনীয় হতে ধরে এসব বি*ষ ধর সা*প*দের আর কখনও নিজের মাথায় ছো*ব*ল দেওয়ার মতো সুযোগ দিও না। রইলো বাবার কথা! তাকে একদিন না একদিন সব সত্য সম্পর্কে অবগত হতেই হবে। আর এই সত্য জানানোর জন্য আমরা যদি অধিক সময় নিয়ে ফেলি তাহলে আমাদের চারপাশে থাকা বি*ষ ধর সা*পে*রা তাদের বি*ষা*ক্ত চিন্তা-ধারা দ্বারা বাবার মন ও মস্তিষ্ক দখল করে নিবে। তাই আমি খুব শীঘ্রই আমার মতো করে বাবাকে সম্পূর্ণ সত্য সম্পর্কে অবগত করার যথাযথ চেষ্টা করবো।”

রিজওয়ানের বলা প্রতিটি কথার মানে মেহরিন খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারে। অতঃপর মেহরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো….

—“কথা শুনে কিংবা বলে তো তোমার পেটের ক্ষুধা নিবারণ হবে না। খাবার গুলোও মনে হয় ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। একটু অপেক্ষা করো আমি আবার খাবারগুলো আবার গরম করে নিয়ে আনতেছি।”

এই বলে মেহরিন খাবারের ট্রে টা নিতে টেবিলের দিকে অগ্রসর হতেই রিজওয়ান মেহরিনের হাত ধরে ওকে নিজের কিছুটা কাছে টেনে নিয়ে বললো…

—“আর নতুন করে খাবার গরম করতে হবে না তোমায়। একটু ঠান্ডা হলেও সমস্যা নেই। তুমি আমায় নিজ হাতে খাইয়ে দাও যদি তাহলে এই খাবার-ই আমার কাছে অতুলনীয় স্বাদের হয়ে যাবে।”

রিজওয়ানের এরূপ কথা শুনে মেহরিনের ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। মেহরিন হাসিমুখে বললো…

—“ঠিক আছে, বসো তুমি। আমি নিজ হাতে তোমায় খাবার খাওয়াবো আজ।”

অতঃপর রিজওয়ান বিছানায় গিয়ে বসে। মেহরিন টেবিলের উপর থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে রিজওয়ানের সম্মুখে বিছানায় বসে খুবই যত্নসহকারে ওকে খাইয়ে দেয়। সম্পূর্ণ খাবার খাওয়া শেষ হতেই রিজওয়ান বললো….

—“অনেকদিন পর এতোটা তৃপ্তি নিয়ে খাবার খেলাম বউ।”

মেহরিন হাসিমুখে হাত ধুয়ে নিজের আঁচল দিয়ে রিজওয়ানের মুখ মুছে দেয়।

(২৬)
পরেরদিন সকালবেলা…….
রিজওয়ান আর মেহরিন ব্যতিত সবাই ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে। সেই সময় রাজিবুল বললো….

—“নানান ঝামেলায় তোমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে জানানোর কথা স্মরণহারা হয়ে গিয়েছিলো আমার।”

রাহেলা খাবার খেতে খেতে বললেন….
—“কি বিষয়?”

উপস্থিত বাকিদের মাঝেও রাজিবুলের থেকে সেই বিষয় সম্পর্কে জানার জন্য যে কৌতুহল কাজ করছে তার ছাপ তাদের সকলের চেহারায় স্পষ্ট ফুটে আছে। কিয়ৎক্ষণ পর রাজিবুল বললো….

—“আমার অফিসের ম্যনেজার স্যারের স্ত্রী ১মাস আগে হার্ট অ্যা*টাক করে মা*রা গিয়েছিলেন। তার একজন ১২ বছর বয়সী ছেলে আর ৪ বছর বয়সী একজন মেয়ে আছে। আকস্মিক ভাবে স্যারের স্ত্রী মা*রা যাওয়ায় তার এবং তার সন্তানদের অবস্থা বেহাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতকাল তিনি আমাকে পারসোনালি ডেকে বললেন এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার জন্য তার একজন সঙ্গী প্রয়োজন। অফিস, সংসার, বাচ্চাদের একসাথে তার একার পক্ষে সামলানো অসম্ভব হয়ে উঠছে। ম্যনেজার সাহেবের বয়স একটু বেশি হলেও তার মানসিকতা অনেক ভালো। দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ তিনি ঐ কোম্পানিতে চাকরি করছেন। আমি তো তাঁকে বিগত ৫বছর থেকেই চিনি। তার সাথে সকল কাজে উঠাবসা আমার। দুই-তিনবার ওনার বাড়িতেও গিয়েছিলাম আমি। বিশাল বড় বাড়ি ওনার। জায়গা-জমির ও অভাব নেই। ম্যনেজার সাহেবের কথার ধরনে যখন আমি বুঝতে পারলাম তিনি ২য় বার বিবাহ বন্ধনে আবব্ধ হতে চাচ্ছেন তখন তার জন্য মেয়ের খেয়ালে আমার রুমির কথার স্মরণ হয়েছিলো।”

রাজিবুলের মুখে এরূপ কথা শোনার পর রুমি অত্যন্ত অবাক হয়ে রাজিবুলের দিকে তাকায়। ওর হাতে থাকা খাবার প্লেটে পরে যায়। রফিকুল হাসিমুখে বললো….

—“আমাদের ছোট্ট বোনটা যে বিয়ের বয়সী হয়ে গিয়েছে সে কথা আমার খেয়াল হারাই হয়ে গিয়েছিলো।”

—“আম্মা তুমি বলো যদি তাহলে আমি ম্যনেজার সাহেবকে বলতে পারি আমাদের রুমিকে দেখতে আসার জন্য। তারপর সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে খুব তাড়াতাড়ি রুমির বিবাহ কার্য সম্পন্ন……!”

রাজিবুল পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই রুমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে বললো….

—“বড় ভাইয়া তুমি এমন লোকের সাথে আমার বিয়ের কথা ভাবতে পারলে কি করে? আর মেজো ভাইয়া তুইও কি করে বড় ভাইয়ার কথার তালে তাল মিলাচ্ছিস?”

রাজিবুল বললো……
—“রুমি! তুই এভাবে রিয়েক্ট কেনো করছিস? আমার আনা সম্বন্ধে সমস্যা কি তোর?”

—“সমস্যা কি সেটা আবার আমাকে জিজ্ঞাসা করছো তুমি? বাবার বয়সী একজন লোকের সাথে আমার বিয়ের বিষয়ে কথা বলছো আবার তার কিনা ১২ ও ৪ বছরের দু-দু’টো ছেলে-মেয়েও আছে। এসব জানার পরেও কি করে তুমি আমার জন্য ঐ লোকের সম্বন্ধ আনতে পারলে বলো?”

—“বাবার বয়সী কি করে হলেন উনি? তোর আর আমার বাবার বয়স ৫৫ বছরের অধিক। আর ওনার বয়স তো ৪০ এ পড়েছে কেবল। আর পুরুষ মানুষের বয়স দেখে বিচার করা হয় না। পুরুষ মানুষ ৮০ বছর বয়সেও বিয়ে করার যোগ্যতা রাখেন। রইলো ওনার ছেলে-মেয়ের কথা। আগে এই সম্বন্ধ চূড়ান্ত হোক। তারপর যখন তুই বিয়ে করে ওনার বাড়ি যাবি তখন আমাদের মায়ের মতো ঐ সংসার নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিবি। ছেলে-মেয়ে দু’টো বেশি জ্বালাতন করলে ওদের বিরুদ্ধে বড়-সড় একটা কাহিনী রটাবি তারপর তোর সংসার থেকে আগাছা পরিষ্কার করতে যা ব্যবস্থা করার ম্যনেজার সাহেব নিজেই করবে। একটা বার ঠান্ডা মাথায় চিন্তা কর ওতো বড় বাড়ি, সয়-সম্পত্তির মালকিন তুই হবি। তোর রাজত্ব চলবে সেখানে।”

রুমি রাগী স্বরে বললো…..
—“কোনো সয়-সম্পত্তির মালিকানা কিংবা রাজত্বের শখ নেই আমার বড় ভাইয়া। আমি পরিষ্কার ভাবে তোমাদের সবাইকে বলে দিচ্ছি এই মুহূর্তে আমি কোনো বৈবাহিক সম্বন্ধে আবব্ধ হতে ইচ্ছুক নই।”

এই বলে রুমি দ্রুত কদমে ডায়নিং স্থান ত্যগ করে নিজ রুমে চলে যায়। উপস্থিত বাকিরা এক দৃষ্টিতে রুমির যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। এতোসময় ধরে দোতালার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ওদের সবার সব কথপোকথন মেহরিন শুনে শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে। রুমির এই মুহূর্তে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ সম্পর্কে কেবল মেহরিন-ই অবগত।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১৪)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২৭)
রুমি নিজরুমে এসে পায়চারি করতে করতে রাগী স্বরে বললো….

—“এক নাড়ির সম্পর্ক হয়েও বড় ভাইয়া আমার সাথে এতো বড় অ*ন্যা*য় করার কথা চিন্তা করতে পারলো কি করে! মায়ের সাথে আমার তুলনা করছে। মায়ের মতো তো আমি ডিভোর্সি, সন্তান সমেত মহিলা হয়ে নিজের বাবার বাড়িতে পরে নেই তাই নিজের থেকে দ্বিগুণ বেশি বয়সের বউ মারা যাওয়া, দুই সন্তান ওয়ালা পুরুষকে বিয়ে করতে হবে! আমি একজন অবিবাহিত মেয়ে। যথেষ্ট সুন্দরীও। তাহলে আমাকে কেনো এমন পরিস্থিতির সম্মুখে দাঁড়ালো করালো সে? যেভাবেই হোক জিহাদের সাথে আমাকে দেখা করতে হবে। ওর সাথে এই বিষয়ে কথা বলাটাও জরুরী। যদি পরিস্থিতি আমার হাতের বাহিরে চলে যায় তখন কি হবে?”

রুমির ভাবনায় ছেদ ঘটে দরজায় কারোর কড়া নাড়ার শব্দে। রুমি দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে দরজার সামনে মেহরিন দাঁড়িয়ে আছে। এই অসময়ে মেহরিনের উপস্থিতি রুমিকে অবাক করে। রুমি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো….

—“কি চাই তোমার? কেনো এসেছো এখানে?”

মেহরিন নিজের মুখশ্রী জুরে শান্ত ভাব স্পষ্ট রেখে রুমির রুমের ভিতরে প্রবেশ করে দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ করে দেয়। মেহরিনের এরূপ কাজ রুমির অবাকের মাত্রা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। মেহরিন রুমির সম্মুখপানে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“বিয়ের জন্য সরাসরি না করে দিলে যে! আমি যতোদূর তাদের চিনি উপযুক্ত কোনো কারণ না তুলে ধরা পর্যন্ত তারা এই বিয়ের কথা থেকে পিছু হটবে না।”

—“আমার বিষয় নিয়ে তোমাকে মাথা ঘামাতে বলি নি তো। এই বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙার জন্য আমার যা যা করনীয় করা দরকার আমি তা অবশ্যই করবো। তোমায় কোনো জ্ঞান ও দিতে হবে না। আমার রুম থেকে বেড়িয়ে যাও তুমি। আমি একা থাকতে চাই এখন।”

—“শুধু এই একটা সম্বন্ধই ভাঙতে চাও তুমি নাকি এরপর যতো সম্বন্ধ আসবে সবই ভাঙতে উঠে পরে লাগবে?”

মেহরিনের এরূপ প্রশ্নে রুমি ভ*র*কে উঠে। রুমি তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো….

—“মানে! কি বলতে চাইছো তুমি?”

—“তোমার বিয়ের বয়স হয়েছে। তাই এখন একের পর এক অনেক সম্বন্ধই আসতে শুরু করবে। এই সম্বন্ধ না হয় যেকোনো ভাবে ভাঙতে সম্পন্ন হলে তুমি কিন্তু এরপর কি করবে? বারবার কি তোমার অজুহাত কাজে দিবে?”

রুমি মেহরিনের সম্মুখপান থেকে সরে অন্যত্র এসে দাড়িয়ে বললো….
—“এই তুমি যাও তো আমার রুম থেকে। অহেতুক প্রশ্ন করে আমার মাথা ব্যথা ধরিয়ে দিও না।”

মেহরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“যার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ ভাঙার চেষ্টা তোমার তাঁকে আগে পরোক করে দেখো। সে কি আদেও তোমার যোগ্য? যখন পরিস্থিতি তোমার হাতের বাহিরে চলে যাবে তখন সে কি তোমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে শক্ত করে তোমার হাতটা ধরার ক্ষমতা রাখতে পারবে! সময় থাকতে এটাও যাচাই করে নিও। নয়তো একূল-অকূল দু’কূলই হারিয়ে পথভ্রষ্ট পথিকের মতো ঘুরে বেড়াতে হবে তোমায়।”

রুমি মেহরিনের কথার ধরণে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারে যে মেহরিন ওর সাথে জিহাদের সম্পর্কের বিষয়ে অবগত হয়ে গিয়েছে। রুমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয় কেবল। মেহরিন আবারও বললো….

—“চেয়ারম্যনের মতো নি*কৃ*ষ্ট, ব*র্ব*র ও নিম্ন মানসিকতার মানুষ এই এলাকায় আর দ্বিতীয় কেউ আছে বলে আমার জানা নেই। তিনি ২৪ ঘন্টা ধরেই কেবল তার সামান্য ক্ষমতার বরই করে বেড়ান সাড়া গ্রামজুরে। তার মতো মানুষ এই পরিবারের মেয়েকে নিজের একমাত্র ছেলের বউ বানিয়ে ঘরে উঠাবেন কি আদেও? এই প্রশ্নটাও জিহাদ ভাইকে করে দেখিও। তার উত্তরের মাঝেও অনেক কিছু খুঁজে পাবে তুমি। যা হয়তো তোমাকে ভরসা দিবে নয়তো তোমার সব ভরসা ভে*ঙে চূ*র*মার করে দিবে।”

এই বলে মেহরিন রুমির রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। রুমি ধপ করে বিছানায় বসে পরে। মেহরিনের বলে যাওয়া প্রতিটা শব্দ রুমির কানে বাজছে এখনও।

(২৮)
নিজ রুমে বিছানায় একলা বসে আরফা ওর মায়ের ছবিতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…..

—“মাম্মাম, তোমার স্টার হয়ে যাওয়ার জন্য বাবাই সবসময় আমাকে কেনো দোষ দেন? জানো মাম্মাম বাবাই আমাকে কখনও নিজের কোলে বসিয়ে আদর করেন না। আমার স্কুলে আমার ফ্রেন্ডসদের বাবাইরা আমার সামনে তাদের কোলে তুলে নিয়ে কত্তো আদর করে। সেসব দেখে আমার ভিষণ কান্না পায়। মাম্মাম তুমি আকাশ থেকে নেমে আবার আমার কাছে চলে এসো না। আমি তোমাকে বাবাইয়ের কাছে দিয়ে বলবো, দেখো বাবাই তোমার জন্য আমি আমার মাম্মামকে আবার ফিরিয়ে এনেছি। এখন একটু আমাকে কোলে নিয়ে আদর দাও না!”

কথা গুলো বলতে বলতেই ছোট্ট আরফার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু ঝড়তে শুরু হয়। আরফা দু’হাতে নিজের চোখের পানি মুছে নিজের মায়ের ছবিটা যত্ন সহকারে বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে বিছানা থেকে নেমে জানালার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে দূর আকাশে দৃষ্টি স্থির করে।

(২৯)
রাতের বেলা,
শেফালি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বিনুনি করছে। সেইসময় রাজিবুল শান্ত স্বরে বললো….

—“শেফালি, তুমি আগামীকাল রুমির সাথে আমার আনা সম্বন্ধের বিষয়ে কথা বলো। আর যেভাবেই হোক ওকে রাজি করানোর চেষ্টা করো।”

—“সকালে শুনলে না রুমি কি বললো? এই লোককে বিয়ে করতে চায় না সে। আমি বুঝালেই সে বুঝে যাবে এতো সহজ-সরল মেয়ে রুমি নয় তা তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো।”

—“রুমিকে বুঝতে হবে। আর এই বিয়ে করার জন্য ওকে রাজি হতেই হবে। তুমি তোমার সবটুকু দিয়ে ওকে রাজি করানোর চেষ্টা করবে। তুমি ব্যর্থ হলে আমি মা’কে বলবো কাজটা যেভাবেই হোক তিনি যেনো সম্পন্ন করেন।”

—“এই সম্বন্ধের পিছনে তুমি এতো মরিয়া হয়ে পড়লে কেনো বলোতো রাজিব!”

রাজিবুল বসা অবস্থা থেকে উঠে শেফালির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বাঁ*কা হেসে বললো….
—“ম্যনেজার সাহেবের সাথে রুমি বিয়ের সম্বন্ধ পাঁকা হলে আমাদের জন্য সেটা অনেক ভালো হবে।”

—“ভালো! কিভাবে হবে শুনি?”

—“আমাদের অফিসের বস ম্যনেজার সাহেবকে অনেক সম্মান করেন। মাসের পর মাস অফিসের সম্পূর্ণ দায়ভার তার উপর দিয়ে বস নিশ্চিন্ত মনে বিদেশ ভ্রমণ করে আসেন। এই কয়েক বছরে আমি ম্যনেজার সাহেবের অনেকটা ক্লোজ হতে পেরেছি। যদি রুমির সাথে ম্যনেজার সাহেবের বিয়ে হয় তাহলে আমাদের মাঝের বন্ধন টা আরো মজবুত হবে। তখন আমি ম্যনেজার সাহেবকে অনায়াসেই আমার প্রমোশনের বিষয় নিয়ে বসের সাথে কথা বলাতে পারবো। আর এভাবে প্রমোশনের পর প্রমোশন মিললে আমাদের ঘর টাকা দিয়ে থৈ থৈ করবে।”

শেফালি কোনো প্রতিত্তুর না করে আয়নায় রাজিবুলের
প্রতিচ্ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।

(৩০)
মেহরিন যত্নসহকারে রিজওয়ানকে নিজ হাতে খাবার উঠিয়ে খাওয়াতে খাওয়াতে সকালে রুমির জন্য রাজিবুলের আনা বিয়ের সম্বন্ধের কথা জানায়। রুমি রাজি নয় সে কথাও জানায়। জিহাদের বিষয়টা কেবল গোপন রাখে। রিজওয়ান বললো…..

—“বড় ভাইয়া রুমির জন্য এমন সম্বন্ধ কেনো এনেছেন তা বুঝতে বাকি নেই আমার।”

মেহরিন রিজওয়ানের দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। রিজওয়ান আবারও বললো……

—“নিজ কর্মস্থানে নিজের জায়গা আরো উচ্চে নিয়ে যেতেই এই চিন্তা তার। নিজের স্বা*র্থ হা*সি*লের জন্য নিজের ছোট বোনকে কু*র*বা*নি দিতেও যে দু’বার ভাববে না ওরা দুই ভাই সেটাও জানি আমি। কিন্তু রুমির শরীরে তো কেবল ওদের দু’জনের র*ক্ত বইছে না। আমার র*ক্তও বইছে। রুমির ভালো-ম*ন্দ চিন্তা করার অধিকার যেমন ওদের দু’জনের আছে তেমনই আমারও আছে। রুমি যদি শেষ পর্যন্ত এই সম্বন্ধে রাজি না থাকে তাহলে ওদের আমি রুমির উপর জোর খা*টাতে দিবো না কিছুতেই।”

রিজওয়ানের এরূপ কথা শুনে মেহরিনের ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১১+১২

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১১)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২২)
মেহরিনের ডাকাডাকি চিৎকারে বাড়ির বাকি সদস্যরা ড্রয়িংরুমে উপস্থিত হয়। রাহেলা আর রুমিও এসেছে আবারও। রুমির চেহারায় বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। রুমি বিরবিরিয়ে বললো….

—“মায়ের হাতে থা*প্প*ড় খেয়েছে না, এখন অতিরিক্ত যত্ন পাওয়ার জন্য অজ্ঞান হওয়ার নাটক করছে। তোমাকে আমি চিনি না মনে করেছো মেজো ভাবী! ভুলেও আমি এখন তোমার ধারের কাছে ঘেঁষতে যাবো না।”

মেহরিন শেফালির দিকে তাকিয়ে বললো….
—“বড় ভাবী..মেজো ভাবী জ্ঞান ফেরানোটা জরুরী। মেঝের উপর এভাবে রাখা ঠিক হবে না। তাকে ধরো। রুমে নিয়ে যেতে হবে।”

মেহরিনের কথানুযায়ী শেফালি ঊর্মিলার শরীরের উপরিভাগ ধরে আর মেহরিন নিচেরভাগ ধরে উঠিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। অজ্ঞান হওয়ার পর সর্বশরীরের ভার ঊর্মিলা ছেড়ে দিয়েছে। স্বাভাবিক এর তুলনায় ওজন যেনো বেড়ে গিয়েছে। মেহরিন আর শেফালির দু’জনের ঊর্মিলাকে নিয়ে যেতে ভিষণ বেগ পেতে হচ্ছে। রাহেলা ওদের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে দাঁড়িয়ে আছে কেবল। রুমি একবার ভেং*চি কেটে শেফালি, ঊর্মিলা আর মেহরিনের পাশ কাটিয়ে আগে আগে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। শেফালি রুমির এরূপ কাজে যথেষ্ট অবাক হয়। আজ ঊর্মিলার দূ*র্সময়ে রুমি বা রাহেলা কেউই ওর পাশে দাঁড়ালো না কাল যদি শেফালির নিজের কোনো বি*প*দ হয় তখনও যে তারা এভাবেই মুখ ফিরিয়ে নিবে না তারও তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। শেফালি একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাত্র। কিয়ৎক্ষণ পর শেফালি আর মেহরিন ঊর্মিলাকে তার নিজরুমে এনে বিছানায় শুইয়ে দেয়। মেহরিন দ্রুততার স্বরে বললো….

—“বড় ভাবী তুমি মেজো ভাবীর কাছেই বসে থাকো আমি এক গ্লাস পানি আর একটা চামচ নিয়ে এক্ষুণি আসছি।”

এই বলে মেহরিন ঊর্মিলার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালি মেহরিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে বললো…

—“জীবনে দূ*র্সময় না আসলে কে আপন কে পর তা বুঝতে পারার যায় না। ছোট…যেই মেহরিনের সাথে আমি আর তুমি সবসময় যাচ্ছে নয় তাই ব্যবহার করেছিলাম, ছোট-বড় কতো অপমান মূলক কথা শুনিয়েছিলাম সেই মেহরিন-ই তোমার বি*প*দের সময়ে পাশে এসে দাঁড়ালো।”

শেফালির কথা শেষ হতে না হতেই মেহরিন গ্লাসে করে পানি আর চামচ নিয়ে আবারও ঊর্মিলার রুমে প্রবেশ করে ওর মাথার অন্যপার্শে বসে ওর চোখ-মুখে পানির ছিটা দিতে শুরু করে। মেহরিন পানির গ্লাসটা শেফালির হাতে দিয়ে ঊর্মিলার মুখ খুলতেই দেখে দাঁতের সাথে দাঁত ভিষণ শক্ত ভাবে বসে আছে। মেহরিন বললো….

—“বড় ভাবী, আমি এই চামচের সাহায্যে মেজো ভাবীর বসে যাওয়া দাঁত খোলার চেষ্টা করছি। তুমি একটু পর পর মেজো ভাবীর চোখে-মুখে পানির ছিটে দিতে থেকো।”

অতঃপর মেহরিন ওর কাজ শুরু করে, শেফালিও মেহরিনের কথানুযায়ী কাজ করে। বেশকিছু সময় ধরে চেষ্টা করার পর অবশেষে ঊর্মিলার সেন্স ফিরে। সেন্স ফেরা মাত্র সে কাশতে শুরু করে। মেহরিন দু’হাতে ঊর্মিলাকে ধরে উঠে বসতে সাহায্য করে। মিনিট দু’য়েক পর ঊর্মিলা তুলনামূলকভাবে স্বাভাবিক হয়ে যায়। নিজের পাশে শেফালি আর মেহরিনকে দেখে ঊর্মিলা অনুশোচনা বোধের কারণে নিজের মাথা নুইয়ে ফেলে। মেহরিন আবারও বললো….

—“মেজো ভাবী…তুমি বিশ্রাম করো। আমি তোমার জন্য কিছু খাবার বানিয়ে আনছি। বড় ভাবী আছে তোমার পাশেই।”

এই বলে মেহরিন বিছানা থেকে নেমে ঊর্মিলার রুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে চলে আসে। ঊর্মিলা শেফালির দিকে তাকিয়ে বললো….

—“বড় ভাবী…আমাকে ক্ষমা করে দিও তুমি। সকালে আমি তোমার সাথে অকারণেই ঝ*গ*ড়া করেছিলাম। আম্মার কাছে বানিয়ে, বাড়িয়ে মি*থ্যে বলেছিলাম। আমি আমার আচারণ ও কাজের জন্য ভিষণ ভাবে লজ্জিত। সবকিছু ভুলে তুমি আর মেহরিন আমার এই দূ*র্সময়ে যে এভাবে পাশে এসে দাঁড়াবে আমি ভাবতেও পারি নি।”

ঊর্মিলাকে এই প্রথম এতো নম্রস্বরে কথা বলতে দেখে শেফালির বুকের ভিতরে এক অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতে শুরু করে। কিয়ৎক্ষণ নিরব থাকার পর শেফালি বললো….

—“সেসব কথা ছাড়ো, আগে বলো হুট করেই এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেলে কি করে তুমি! আম্মা বা রুমির সাথে কি কোনো ঝামেলা হয়েছে তোমার ছোট?”

ঊর্মিলা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পুরো ঘটনা খোলাশা করে তুলে ধরলো শেফালির সামনে। অতঃপর বললো….

—“আমার কথাগুলো বিশ্বাস করা হয়তো তোমার জন্য ক*ষ্ট*কর হবে। এবারও মি*থ্যা, বানোয়াট কথা বলছি এমন মনে হবে। কিন্তু আমি এখন একটা শব্দ ও মি*থ্যা বলি নি মেজো ভাবী।”

ঊর্মিলার মুখে সম্পূর্ণ কথাগুলো শুনে শেফালি যেনো কয়েক সেকেন্ডের জন্য বাক*রুদ্ধ হয়ে যায়। ঊর্মিলা আর শেফালির মাঝের নিরবতার দেওয়াল ভেঙে শেহতাজ আর ঊষা রুমে প্রবেশ করে বিছানায় উঠে বসে। ঊষা ওর মায়ের একেবারে সংস্পর্শে এসে নিজের ছোট্ট হাতজোড়া দিয়ে তার হাত ধরে বললো….

—“আম্মু তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে বলো আমায়। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করে দিবো। দেখবে তোমার সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।”

ঊষার মুখে এরূপ কথা শুনে ঊর্মিলার দু’চোখ ছলছল করে উঠে। ঊর্মিলা বললো…

—“এখন আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না মামনি। আল্লাহর কাছে দোয়া করলে তিনি অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করে দেয় এইটা তোমাকে কে শিখিয়েছে মা!”

ঊষা হাসিমুখে বললো…
—“ছোট্ট চাচী শিখেয়েছে। ছোট্ট চাচী তো আমাকে আর ভাইয়াকে অনেক কিছু শিখান প্রতিদিন।”

ঊর্মিলা শেফালির দিকে একপলক দেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাত্র। কিয়ৎক্ষণ পর মেহরিন একটা ট্রে হাতে নিয়ে ঊর্মিলার রুমে প্রবেশ করে। মেহরিনকে আসতে দেখে শেফালি ঊর্মিলার পাশ থেকে উঠে অন্যপাশে গিয়ে বসে। মেহরিন শেফালির পূর্বের স্থানে বসে বললো….

—“মেজো ভাবী, আপাতত তোমার জন্য কয়েক প্রকার সবজি দিয়ে এই পাতলা ঝোল বানিয়ে এনেছি। এটুকু খেতে পারলে তোমার শারীরিক দূর্বলতা অনেকটা কেটে যাবে।”

ঊর্মিলা নিঃশব্দে মেহরিনের কথা মেনে নিয়ে খেতে শুরু করে। ঊষা, শেহতাজ এমনকি শেফালিও গভীর দৃষ্টি নিয়ে ঊর্মিলাকে খেতে দেখছে। মেহরিন বিষয়টা লক্ষ্য করে বললো…

—“তোমাদের কি ক্ষুধা পেয়েছে!”

শেফালি নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিরব রয়। ঊষা শেহতাজের দিকে একপলক দেখে উপরনিচ মাথা নাড়ায়। মেহরিন শেহতাজের দিকে তাকালে শেহতাজ মাথা নুইয়ে ফেলে। ভালো-মন্দ বোঝার সামান্যতম বুদ্ধি ওর হয়েছে। মেহরিন ওদের নিরবতার ভাষা বুঝতে পেরে বললো….

—“তোমরা কিছুসময় অপেক্ষা করো আমি তোমাদের জন্য চটজলদি কিছু বানিয়ে আনা চেষ্টা করছি।”

এই বলে মেহরিন আবারও রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। অতিরিক্ত ক্ষুধার কারণে ঊর্মিলার এতোসময় ধরে যেনো এসবের প্রতি কোনো খেয়াল ই ছিলো না। সে দ্রুত পারছে নিজের হাতে থাকা বাটিতে রাখা খাবার গুলো শেষ করছে। শেফালি এখনও নিরব হয়েই বসে রয়।

(১২)
রাতের বেলা….
নিজরুমে আয়নার সামনে বসে শেফালি নিজের চুল চিরুনি করছে। সেইসময় রাজিবুল ক্লান্ত মুখশ্রী নিয়ে রুমে প্রবেশ করে আলনার কর্ণারে কাঁধের ব্যগটা রেখে বিছানায় এসে বসে পরণের শার্ট খুলতে শুরু করে। শেফালি বললো….

—“আমরা মানুষ চিনতে বড্ড ভুল করেছি জানো!”

শেফালির মুখে হঠাৎ এমন কথা শুনে রাজিবুল বেশ অবাক হয়ে যায়। রাজিবুল শেফালির দিকে তাকিয়ে অবাক স্বরে বললো…

—“রাতে-বিরাতে উল্টো-পাল্টা কিছু খেয়েছো নাকি তুমি শেফালি!”

—“আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আর স্বাভাবিক আছি। আজ আসলে কে আমাদের আপন আর কে আমাদের পর তা একটু হলেও বুঝতে পেরেছি আমি।”

—“এতো হেয়ালি না করে কি হয়েছে সেটা খোলাসা করে বলো তো।”

অতঃপর শেফালি দুপুরের পর ঘটে যাওয়া সকল ঘটনা রাজিবুলকে খোলাসা করে বলে। সম্পূর্ণ ঘটনা শোনার পর রাজিবুল কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে হুট করেই শব্দ করে হাসতে শুরু করে। রাজিবুলের হাসির শব্দ শুনতে পেয়ে শেফালি ওর দিকে ঘুরে বসে বললো…

—“হাসছো কেনো এভাবে?”

রাজিবুল হাসি থামিয়ে বললো…
—“এ আমি কোন শেফালিকে দেখছি! আজ সকালেই যেই শেফালিকে রেখে আমি অফিসে গেলাম তুমি আদেও সে! মাত্র কয়েক ঘন্টার ভিতরে একটা মানুষের ভিতর এতোটা পরিবর্তন হতে পারে কি করে?”

—“আমি শুধু স্বার্থ বুঝে পাশে থাকা মানুষ আর নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে থাকা মানুষের মাঝে পার্থক্যটা দেখাতে চাইছি তোমায় রাজিব।”

—“তোমার চোখে ইতিমধ্যেই একটা পর্দা পড়তে শুরু করেছে বুঝলে! তুমি নিজের চিন্তা-বুদ্ধি করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছো।”

—“তেমন কিছুই না।”

—“মেহরিন আর ওর স্বামীই আসল মুখোশধারী এটা বুঝতে শিখো।”

—“এভাবে বলো না। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করা উচিত আমাদের।”

—“ভুলে যেও না শেফালি, রিজওয়ান আমার শরীরে হাত উঠানোর ও আমাকে অপমানমূলক কথা শোনানোর সাহস করেছিলো। আমি বা আমার ভাই যে এ বাড়ির বংশধর নই এমনটাও বলেছিলো সে। হুট করেই আমাদের সাথে দুর্বব্যহার করে আবার হুট করেই আমাদের প্রতি সহানুভূতি আচারণের শেষ থাকে না ওদের। এরা মুখোশধারী নয়তো কারা মুখোশধারী হবে শুনি! আমাদের দল ভাড়ি আর ওরা মাত্র দু’জন তাই আমাদের সাথে ভালোমানুষি আচারণ দেখিয়ে আমাদের মনে দূর্বলতার জায়গা করে নিতে চাইছে ওরা। এরপর সুযোগ বুঝে আমাদের পিঠে ছু*ড়ি ঢুকিয়ে প্র*তা*রণা করতেও দু’বার ভাববে না বুঝলে! আর তুমি ঊর্মিলার বলা কথাগুলোই বা বিশ্বাস করে নিলে কি করে? ও তো একটা নাটক*বা*জ স্বভাবের মেয়ে। হয় যদি ১ শতাংশ তা নিজের মতো করে বাড়িয়ে আরো ৯৯ শতাংশ করে তুলে ধরবে। যেনো সে ধোঁয়া তুলসি পাতার মতো স্বচ্ছ আর বাকিরা ওর খুব খারাপ। আম্মা আর রুমির প্রতি আমার শতভাগ বিশ্বাস আছে। আম্মা তোমার বা ঊর্মিলার সাথে অকারণে কোনোরূপ খারাপ আচারণ করবেন না আমি জানি। তাই কে আসলে আমাদের আপন আর কে আমাদের পর তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে যেও না। আম্মা, রুমি আর রফিকুল ই আমাদের আসল আপন মানুষ ছিলো, আছে ওরাই সারাজীবন থাকবে।”

এই বলে রাজিবুল ওয়াশরুমে চলে যায়। শেফালি নিরব হয়ে রাজিবুলের বলে যাওয়া কথাগুলো ভাবে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১২)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২৪)
রাতের বেলা…..
আঙিনায় এপাশ থেকে ওপাশ তো ওপাশ থেকে এপাশ পায়চারি করতে করতে বারবার মূল দরজার দিকে নিজের অস্থির দৃষ্টি নিক্ষেপ করছে মেহরিন। কিয়ৎক্ষণ পর ডায়নিং টেবিলের সম্মুখে থাকা দেওয়ালের উপর রাখা ঘড়ির দিকে দৃষ্টি যায় মেহরিনের। ঘড়িতে তখন ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট। রিজওয়ানের অফিসে আজই প্রথম দিন ছিলো। আজই এতো দেড়ি হচ্ছে কেনো ওর বাড়ি ফিরতে সে বিষয়ে চিন্তা করে কুলিয়ে উঠতে পারছে না মেহরিন। মেহরিনের চিন্তার ঘোর কাটে মূল দরজা থেকে ভেসে আসা রিজওয়ানের ডাকে। মেহরিন দ্রুততার সাথে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে ওকে সুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট্ট করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে। অতঃপর রিজওয়ানের কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর কাঁধে থাকা ব্যগটা নিজ হাতে নিয়ে বললো….

—“প্রথম দিন-ই এতো দেড়ি হলো যে! কাজের কি খুব চাপ পড়েছে তোমার উপর?”

রিজওয়ান মেহরিনের দিকে একপলক তাকিয়ে স্বচ্ছ হাসি দিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে হতে বললো….

—“কাজ তো আজ থেকে শুরু হলো মাত্র। রোজই এমন দেড়ি হবে বাড়ি ফিরতে। আমজাদ চাচা বলেছেন কাজের প্রতি আমি যতো বেশি গুরুত্ব দিবো, যতোবেশি দক্ষতা অর্জন করবো আর আমার কাজ দ্বারা কোম্পানির যতো বেশি লাভ হবে আমার পদ ততোই দ্রুত উপরের দিকে যাবে।”

মেহরিন রিজওয়ানের সাথে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে কৌতুহলের স্বরে প্রশ্ন করলো….
—“কি কাজ করতে হয় সেখানে তোমায়?”

—“অফিসে আমার মতো আরো ৩শ কর্মচারী আছে জানো। তাদের সবাইকে মোট ২০টা গ্রুপে ভাগ করে কাজ বুঝিয়ে দিয়েছেন স্যার। আমার কাজ এতোটা কঠিন না কিন্তু এই ২০টা গ্রুপের তৈরিকৃত ৪০টা হাতে কলমে লেখা ইংরেজি শব্দের চিঠি আমাকে একস্থানে বসে কম্পিউটারে টাইপ করে বিভিন্ন জায়গায় মেইল করে দিতে হয়। আমি যাওয়ার পর আমজাদ চাচা আমার সব সার্টিফিকেট গুলো চেক করে আমাকে একজন দক্ষ কর্মচারীর আন্ডারে দিয়ে কিভাবে কম্পিউটারে টাইপ করতে হয় আর কিভাবে মেইল করতে হয় সেইসব শিখিয়ে দিয়েছেন। আজ নতুন তো তাই সব কাজ শিখে উঠতে উঠতে লম্বা সময় লেগে গিয়েছিলো আমার। তবে কাজ করতে আমার ভিষণ ভালো লাগছিলো জানো! নিজেকে কেমন স্বাধীন লাগছিলো।”

মেহরিন মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে এতোসময় ধরে বলা ওর সব কথা শুনলো। কথা বলতে বলতেই রিজওয়ান মেহরিনকে নিয়ে নিজরুমে চলে এসেছে। রিজওয়ান মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বললো…

—“বউ আমার না ভিষণ ক্ষুধা লেগেছে। খেতে দিবে একটু!”

রিজওয়ানের মুখে এরূপ কথা শুনে মেহরিনের হুস ফিরে। কথার তালে সে খেয়াল হারা হয়ে গিয়েছিলো যে রিজওয়ানকে খেতে দিতে হবে। মেহরিন বললো…

—“তুমি হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরিবর্তন করে নাও আমি এক্ষুণি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি।”

এই বলে মেহরিন দ্রুত কদমে রুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে শুরু করে। মেহরিন রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই দেখলো রুমি একটা টিফিন বাটিতে খাবার উঠাচ্ছে। এতো রাতে রুমিকে এমন কাজ করতে দেখে মেহরিন কিছুটা অবাক হয়। পরক্ষণেই মেহরিন কোনো সাড়াশব্দ না করে আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে পরে রুমি কি করে তা দেখার উদ্দেশ্যে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমি টিফিন বাটিটা হাতে নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে চারপাশ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে ধীর কদমে মূল দরজার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। মেহরিন আড়াল থেকে বেড়িয়ে নিজমনে বললো…

—“এতোরাতে রুমি বাটিতে খাবার উঠিয়ে নিয়ে বাহিরে যাচ্ছে কার জন্য? দেখতে হচ্ছে তো বিষয়টা।”

এই বলে মেহরিন রুমির থেকে যথাযথ দুরত্ব বজায় রেখে ওকে অনুসরণ করে সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে এসে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পরে মেহরিন। আড়াল থেকে সামনের দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করে রুমির সম্মুখপানে একজন ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। আবছা আলোয় ছেলেটার চেহারা মেহরিন স্পষ্ট ভাবে দেখতে পারছে না। ওদের থেকে মেহরিনের দূরত্ব ততোটা বেশি না হওয়ায় ওদের দু’জনের কথপোকথন মেহরিনের কান এড়াতে পারে না। রুমি ছেলেটিকে উদ্দেশ্য করে বললো…

—“আমার হাতে রান্না করা মাছের ভুনো খাওয়ার জন্য তো ভিষণ জেদ নিয়ে বসেছিলে তুমি। আর তোমার জেদ পূরণ করতে আজ আমায় রান্না করতে হয়েছে। খেয়ে জানিও কেমন হয়েছে।”

—“ঠিক আছে।”

—“এভাবে আর জেদ করবে না আমার হাতের রান্না করা খাবার খাওয়ার জন্য। বাড়ির সবার আড়ালে বাটি ভরে তোমার জন্য খাবার নিয়ে বাহিরে আসাটা আমার জন্য কতোটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায় তা এবার থেকে বুঝতে শিখো।”

—“সবসময় তো বলি না, মাসে একদিন বলি তাতেও তোমার এতো বাহানা দেখাতে হয় রুমি!”

—“আমার যে সমস্যা তা বুঝতে চাও না কেনো তুমি জিহাদ!”

জিহাদ নামটা শোনামাত্রই মেহরিনের হাত অটোমেটিক মুখের উপর চলে আসে। জিহাদ যে তাদের গ্রামের চেয়ারম্যান এর ছেলে। চেয়ারম্যান লোকটা ভিষণ ই ব*র্বর স্বভাবের। নিজের সামান্য ক্ষমতা আর আয় এর জন্য অহং*কারে মাটিতে যেনো তার পা পড়ে না। গ্রামের কৃষকদের উপর ও অ*ত্যা*চার করে। চড়া সু*দে গরীব চাষিদের টাকা ধার দেয়। পরবর্তী সেই টাকা শোধ করতে না পারলে সেসব চাষীদের সকল সয়-সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়ে তাদের সর্বস্ব হারা করে দেয়। তারই ছেলের সাথে রুমি গোপনে সম্পর্কে জড়িয়েছে বুঝতে পেরে মেহরিনের মুখশ্রী জুড়ে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট হয়। পরক্ষণেই জিহাদের কথা কানে পড়তেই মেহরিন আবারও ওদের দিকে লক্ষ্য করে…..

—“আমার বাড়িতে প্রতিবেলায় ভালো ভালো খাবারের অভাব হয় না। যখন যেটা খাওয়ার জন্য ইচ্ছে পোষণ করি তখন সেটাই পাই আমি। কিন্তু আমার কাছে তোমার হাতের রান্না করা খাবারের মূল্য অনেক বেশি। এই খাবার খেয়ে আমি যতোটা তৃপ্তি পাই তা ওসব খেয়ে পাই না বুঝলে! তাই আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। প্রতিমাসে এই একদিন করে তুমি আমাকে তোমার নিজ হাতের রান্না করা খাবার দিবে যেভাবে পারো।”

জিহাদের জেদের সামনে হার মানতে হয় রুমিকে। রুমি একবার শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে বললো….

—“ঠিক আছে আমি চেষ্টা করবো। কিন্তু এভাবে আর বেশিদিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তুমি আমার কথা তোমার বাড়িতে কবে বলবে জিহাদ!”

—“কয়েকদিন পর আমি শহরে যাবো। বাবা তার পরিচিত একজন লোকের সাথে কথা বলে আমার জন্য উচ্চপদে চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সেখানে জয়েন হওয়ার জন্য চূড়ান্ত চিঠি এসেছে আমার কাছে। চাকরিতে জয়েন হই। এরপর নিজের কাজটা ভালো ভাবে বুঝে নেয়া হয়ে গেলেই তোমার কথা আমার বাড়িতে জানিয়ে দিবো আমি।”

—“ঠিক আছে, এখন বাড়িতে যাও। আমাকেও যেতে হবে। এতোরাতেও সদরদরজা খোলা রয়েছে কেও দেখে দরজা আটকে দিলে সারারাত আমাকে বাড়ির বাহিরেই কাটিয়ে দিতে হবে।”

ওদের কথপোকথন ফুরিয়ে এসেছে বুঝে মেহরিন আড়াল থেকে বেড়িয়ে বাড়ির ভিতরে আগে চলে আসে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমি ও বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে মূল দরজা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে বললো…

—“যাক বাবা, এই সময়ে কেও আর এদিকে আসে নি বেঁচে গেলাম।”

এই বলে রুমি যেই না সামনের দিকে ঘুরে তক্ষুনি মেহরিনকে রান্নাঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বেশ ঘা*ব*ড়ে যায়। রুমি শুকনো ঢোক গিলে কোনো রকমে নিজেকে সামলে নিয়ে নিজরুমের দিকে হাঁটতে শুরু করে। মেহরিন নিরব রয়। এটা সঠিক সময় নয় রুমির সাথে এসব বিষয়ে কথা বলার। অতঃপর মেহরিন নিজ চেহারায় স্বাভাবিক ভাব স্পষ্ট রেখে রান্নাঘরের ভিতরে প্রবেশ করে রিজওয়ানের জন্য প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে নিজরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-১০

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(১০)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(২০)
মেহরিন রিজওয়ানের শার্টের কলার্ট ঠিক করে দিতে দিতে বললো….

—“সাবধানে যেও। অপরিচিত জায়গা, অপরিচিত মানুষজন সবাই। ভয় পাবে না একদম। এসব বড় জায়গায় নিজেকে নিশ্চিন্ত ও আত্মবিশ্বাসী হিসেবে তুলে ধরতে হয় সবসময়।”

রিজওয়ান মেহরিনের দুই কাঁধের উপর দুইহাত রেখে ওর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললো….

—“আমার বউ যে এতোকিছু জানে আর এতো সুন্দর ভাবে বুঝাতে পারে তা তো আমার আগে জানা ছিলো না।”

মেহরিন হাসিমুখে বললো….
—“হয়েছে এখন বউয়ের প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ হয়ে থাকলে আজ আর কাজে যাওয়া হবে না।”

—“একটাই তো বউ আমার তার প্রশংসায় পন্ঞ্চমুখ না হয়ে কি পারা যায়!”

মেহরিন বললো…
—“এই সরো তো তুমি। আর যাও এখন কাজের উদ্দেশ্যে।”

রিজওয়ান মেহরিনের এমন কথায় কিছুটা অভিমানী স্বরে বললো…
—“কাজ হতে না হতেই বউ তুমি আমাকে পর করে দিচ্ছো!”

মেহরিন চোখ ছোট ছোট করে রিজওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“তুমি যাবে এখন!”

রিজওয়ান মেহরিনের কাছে থেকে সরে এসে বিছানার উপর থেকে নিজের সার্টিফিকেট রাখা ব্যগটা কাঁধে নিয়ে যেই না যেতে নিবে ওমনি সময় মেহরিন পিছন থেকে রিজওয়ানের হাত ধরে ওকে থামিয়ে দেয়। রিজওয়ান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই বললো…

—“কি হলো এখন আবার আটকাচ্ছো কেনো? এই তো যাওয়ার জন্য ভিষণ তাড়া দিচ্ছিলে।”

মেহরিন রিজওয়ানের অভিমানের স্বরে বলা কথার ভাঁজ বুঝতে পেরে রিজওয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ওর দু’গালে দু’হাত রেখে পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে নিজের উচ্চতা খানিকটুকু বাড়িয়ে রিজওয়ানের কপালে একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়। মেহরিনের এরূপ কাজে রিজওয়ানের ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠে। রিজওয়ান একহাতে মেহরিনের কমোর জড়িয়ে ধরে নিজের বুকের সাথে ওকে মিশিয়ে নিয়ে অন্যহাত দিয়ে নিজের ঠোঁট স্পর্শ করে বললো…..

—“এখানে দাও নচেৎ এই অভিমানের মেঘ মনের আকাশ থেকে বিদায় নিবে না।”

রিজওয়ানের এরূপ কথায় মেহরিন লজ্জায় নুইয়ে যায়। রিজওয়ান মেহরিনকে লজ্জায় নুইয়ে যেতে দেখে বললো….

—“এভাবে লজ্জা পেলে তো আজ সত্যি সত্যিই আমার কাজে যাওয়া হবে না বউ।”

মেহরিন আরো কিছুটা লজ্জা পেয়ে রিজওয়ানের বুকে আলতো ধা*ক্কা প্রয়োগ করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বললো….

—“ছাড়ো আমায়, দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার।”

—“একটু দেড়ি তুমি করিয়েছো আরেকটু দেড়ি আমি স্বইচ্ছায় করবো। দো*ষের কিছু নেই এতে।”

এই বলে রিজওয়ান মেহরিনের থুতনি স্পর্শ করে ওর নুইয়ে থাকা মুখশ্রী কিছুটা তুলে ধরে ওর ঠোঁটের ভাঁজে নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দেয়। মেহরিন রিজওয়ানের আকস্মিক এমন কাজে দু’চোখ শক্ত ভাবে বুঁজে ফেলে। কিয়ৎক্ষণ ওরা দু’জনে একে-অপরের মাঝে ডুবে থাকার পর রিজওয়ান হাসিমুখে মেহরিনকে ছেড়ে দেয়। মেহরিন রিজওয়ানের সামনে থেকে সরে এসে বিছানার এক পার্শের স্ট্যন্ড ধরে দাঁড়িয়ে স্বাভাবিক এর থেকে কিছুটা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। মেহরিনের ঠোঁটে লজ্জামিশ্রিত হাসির রেখা ফুটে আছে। রিজওয়ান হাসিমুখে দরজার দিকে যেতে যেতে বললো….

—“বউয়ের ভালোবাসায় মনে অফুরন্ত শান্তি নিয়ে কেবল ভাগ্যবান পুরুষরাই ঘরের বাহিরে যেতে পারে। আজ নিজেকেও সেই ভাগ্যবান পুরুষদের মাঝে একজন বলে মনে হচ্ছে।”

রিজওয়ানের এরূপ কথা বলা শেষ হওয়া মাত্র মেহরিন ঘুরে দরজার দিকে তাকাতেই দেখে রিজওয়ান ইতিমধ্যে চলে গিয়েছে। মেহরিন দ্রুত পায়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাতেই দেখে রিজওয়ান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছে। অতঃপর মেহরিন রুম থেকে বেড়িয়ে বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়ায়। বিয়ের পর আজই প্রথম মেহরিনের হয়তো পুরো একটা দিন-ই রিজওয়ানকে না দেখে তার সাথে কথা না বলে কাটবে। রিজওয়ান সিঁড়ি বেয়ে নেমে মূল দরজা পেরিয়ে বাহিরে চলে যায়। রিজওয়ান চোখের আড়াল হলে মেহরিন নিজেই নিজের মনকে আশ্বস্ত করে এই বলে যে, এখন তো এই সামান্য সময়ের দুরত্বের সাথে তাঁকে মানিয়ে নিতে হবেই। এই দুরত্বই খুব শীঘ্রই তাদের জীবনে ভালো সময় ডেকে আনবে।

(২১)
দুপুর ১টা…..
ঊর্মিলা ঊষাকে নিয়ে ঢলতে ঢলতে গরমে হাস-ফাঁস করতে করতে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করে। ঊষা দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়। ঊর্মিলা কোনোরকমে হেঁটে ডাইনিং রুমে এসে চেয়ারের সাথে শরীর এলিয়ে বসে পরে। সকালে জায়ে জায়ে ঝ*গড়া বি*বাদ করায় রান্নাও শেষ করতে পারে নি দু’জনের একজনও। সকাল থেকে খালি পেটে থাকায় শরীর আরো বেশি দূর্বল লাগছে ঊর্মিলার। এক গ্লাস পানি ঢেলে খাওয়ার মতো শক্তি যেনো ওর হচ্ছে না। কিন্তু পানি খাওয়ার প্রয়োজন মনে করছে খুব। পরিবেশ পরিস্থিতি এখন আর আগের মতো নেই যে যেকোনো কাজের জন্য মেহরিনকে হুকুম করতে পারবে নির্দ্বিধায়। ঊর্মিলার ভাবনায় ছেদ ঘটে ডাইনিং এ রুমির আগমনে। ঊর্মিলা ওভাবেই বসে থেকে বললো…

—“রুমি…আমাকে একটু লেবুর শরবত করে দাও তো। ভিষণ পিপাসা পেয়েছে। আর ক্লান্তও লাগছে।”

ঊর্মিলার এরূপ কথা শুনে রুমি তেজী স্বরে বললো….
—“আমাকে কি তোমার ব্যক্তিগত কাজের মেয়ে মনে করো নাকি যে এভাবে হুকুম করছো!”

রুমির এরূপ কথায় ঊর্মিলার ক্লান্ত ভাব মুহূর্তেই যেনো বিরক্তি ভাবে রূপ নিলো। ঊর্মিলা বিরক্তির স্বরে বললো..

—“যদি তোমাকে আমি আমার ব্যক্তিগত কাজের মেয়েই ভাবতাম তাহলে শুধু লেবুর শরবত করে দিতে বলতাম না। পাশাপাশি আমার হাত-পা ও টিপে দেওয়ার হুকুম দিতাম।”

রুমি উচ্চস্বরে বললো…
—“সকালে তো সামান্য রান্না করতে বলা হয়েছিলো তোমাদের দুই বউকে। সেই কাজটুকুও তো করতে পারো নি। সকাল সকাল সকলকে না খেয়ে বাহিরে যেতে হয়েছে। এখন কি সামান্য কাজ করে বাহির থেকে এসেছো তাতেই আমাকে হুকুম করছো শরবত বানিয়ে দেওয়ার জন্য! যত্তোসব বড়লোকি চাল-চলন। চলো তো আমার বাবার টাকায়। নিজের স্বামীর এতো মুরদ আছে নাকি যে নিজের টাকায় তোমার জন্য কাজের মেয়ের খরচ বহন করতে পারবে!”

রুমির এরূপ কথায় ঊর্মিলার রাগে সর্বশরীর জ্বলে উঠে যেনো। ঊর্মিলা অত্যন্ত রাগ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমির সম্মুখপানে এসে দাঁড়িয়ে যেই না রুমিকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছে সেইসময় রাহেলার কন্ঠে ‘মেজো বউমা’ শব্দটি শোনামাত্র সে থেমে যায়। কয়েক সেকেন্ডের জন্য পুরো পরিবেশে থমথমে ভাব বিরাজমান হয়। ঊর্মিলা অনেক কষ্টে নিজের রাগকে দ*মি*য়ে হাত নামিয়ে নেয়। রাহেলা দ্রুত কদমে ওদের কাছে এসে দাঁড়িয়ে রাগী দৃষ্টি নিয়ে একবার রুমিকে দেখে পরপরই নিজের দৃষ্টি ঊর্মিলার উপর স্থির করে বললেন….

—“তোমার এতো বড় সাহস তুমি আমার মেয়ের শরীরে হাত উঠানোর জন্য উদ্যত হয়েছো!”

রাহেলাকে ঊর্মিলার উপর রেগে যেতে দেখে সেই রাগের আগুনের মাত্রা বাড়াতে রুমি নিজের মুখ দিয়ে ঘি এর গোলার মতো কথা ছুঁ*ড়ার নিয়ত নিয়ে বললো….

—“দেখো আম্মা দেখো, তোমার গোছানো সংসারের এ কেমন হাল হয়েছো দেখো। একবার তোমার সৎ ছেলে আমাকে মারলো এখন আবার তোমার নিজের ছেলের বউও আমাকে মা*রার জন্য উদ্যত হলো। এ বাড়িতে যে আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে তা সবাই আমাকে খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিচ্ছে। তুমি আমার জন্য ছেলে দেখা শুরু করো মা। এ বাড়িতে আমার বিন্দুমাত্র সম্মান অবিশিষ্ট নেই। আমি আর থাকতে চাই না এ বাড়িতে।”

এই বলে রুমি ন্যকা স্বরে কাঁদতে শুরু করে। ঊর্মিলা রুমির এমন কাজে অবাক না হয়ে পারে না। সামান্য লেবুর শরবত করতে বলায় সেই সামান্য বিষয়টাকে টেনে কতোই না বিশাল বানাচ্ছে সে। ঊর্মিলা কিছু বলতে নিবে সেইসময় রাহেলা অত্যন্ত রাগ নিয়ে ঊর্মিলার গালে একটা থা*প্প*ড় দিয়ে বসেন। রাহেলার আকস্মিক এমন কাজে ঊর্মিলা স্তব্ধ হয়ে যায়। থা*প্প*ড় খাওয়া গালের উপর একহাত রেখে নিজের দৃষ্টি মেঝের উপর স্থির করে রাখে সে। রাহেলা রাগী স্বরে বললেন….

—“যে প্রাণী যেই ভাষায় কথা বললে বুঝে তার জন্য সেই ভাষাই প্রয়োগ করা উচিত। পর কখনও আপন হয় না। এই কথাটা চিরন্তন সত্য। ছেলের বউরা কখনও নিজের মেয়ের জায়গা নিতে পারে না। তোমাকে আর শেফালিকে আমি রুমির থেকে কম আপন মনে করি নি কখনও। কিন্তু তোমরা যে আসলে আপন হওয়ার যোগ্য-ই নও তা খুব ভালো ভাবেই বুঝিয়ে দিয়েছো। আর কখনও যদি তোমার বা শেফালির জন্য আমার মেয়ের চোখে পানি এসেছে তখন তোমাদের আমি আমার সংসার থেকে চিরতরের জন্য আলাদা করে দিবো। কথাটা ভালোভাবে মাথায় ঢুকিয়ে নাও।”

এই বলে রাহেলা দ্রুত কদমে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। রুমি ও মায়ের পিছন পিছন যেতে যেতে ঘাড় বাঁকিয়ে ঊর্মিলার নিস্তব্ধ মুখশ্রী দেখে একহাতে নিজের চোখের কর্নিশে মাত্র জমা অশ্রুকণাগুলো মুছো ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে। ওরা দু’জনে চলে যাওয়ার পরও কিয়ৎক্ষণ ধরে ঊর্মিলা আগের ন্যয় ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। অতিরিক্ত গরম, না খেয়ে অর্ধেক বেলা পার করার পাশাপাশি রাহেলার দেওয়া থা*প্প*ড়ে*র রেশ উর্মিলা নিতে পারে না। মেহরিন নিজরুম থেকে বেড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামছিলো। সেইসময় সে ঊর্মিলাকে ধপ করে মেঝের উপর পরে যেতে দেখে। মেহরিন ‘মেজো ভাবী’ বলে উচ্চস্বরে ডেকে দ্রুত কদমে সিঁড়ি বেয়ে নিচে এসে ঊর্মিলার পাশে বসে পরে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…..

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৯

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৯)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(১৮)
রাতের বেলা…
রাহেলা বেগম এর রুমে একত্র হয়েছে তার দুই ছেলে-বউমা ও মেয়ে রুমি। ঊর্মিলা রাগী স্বরে বললো….

—“আম্মা..আপনারা তো জানেন-ই না আজ সন্ধ্যার একটু আগে আপনার সৎ ছেলে-বউমাকে কারা যেনো বিশালাকার চার চাকার গাড়ি করে বাড়ির মূল দরজার সামনে নামিয়ে দিয়ে গিয়েছে। এ বিষয়ে আমি আর ভাবী ওদের প্রশ্নও করেছিলাম। কিন্তু রিজওয়ানের প্রতিত্তুরে কেবল অ*প*মা*নিত বোধ-ই হয়েছে আমাদের। এসব তো আর সহ্য করা যাচ্ছে না। কি ভাবে ওদের দমন করা যায় সেটা বলুন।”

শেফালি বললো…..
—“এবার ওদের ঠিক এমন ভাবে দমন করতে হবে যেনো এ বাড়ি থেকে ওদের চিরতরের জন্য বের হয়ে যেতে হয়। গলা উঁচিয়ে রিজওয়ানের নিজেকে এবাড়ির বংশধর হিসেবে দাবি করা ঘুঁ*চে যাবে।”

রাজিবুল রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে বললো….
—“সকালের অ*প*মা*ন আমি এখনও ভুলি নি আম্মা। আমার সর্বশরীরের র*ক্ত ট*গ-ব*গ করে ফুঁ*ট*তে*ছে। ঐ রিজওয়ানকে মা*র*তে মা*র*তে এ বাড়ি ছাড়া না করা পর্যন্ত আমার শান্তি হবে না।”

রুমি বললো….
—“এই ১৭ বছর বয়সে তুমি বা আমার ভাইয়েরা কখনও আমার শরীরে একটা ফুল দিয়েও টোকা দাও নি আর তোমার সৎ ছেলে সকলের সামনে আমাকে থা*প্প*ড় দিয়েছিলো আম্মা। ছোট-বড় অনেক অ*প*মা*ন মূলক কথাও শুনিয়েছিলো। তখন তো তোমার সৎ ছেলে-বউকে শা*য়ে*স্তা করার কথা বলে আমাকে শান্তনা দিয়েছিলে তাহলে এখনও চুপচাপ বসে আছো কেন তুমি আম্মা! কিভাবে আমাদের সবার র*ক্ত শীতল করবে তুমি শুনি।”

রফিকুল ব্যতিত ওদের সকলের বলা কথা গুলো শোনার কিয়ৎক্ষণ পর রাহেলা বেগম বললেন….

—“রিজওয়ান কিছু করার পূর্বেই আমি তোদের বাবাকে দেশে আসতে বলবো ভাবছি। তারপর নিজেদের মতো করে সামনা-সামনি তাঁর কান রিজওয়ান আর বউয়ের বিরুদ্ধে বি*ষ মন্ত্র ভরে দিবো৷ কাজটা এমন ভাবে সম্পন্ন করবো যেনো শরীফ সাহেব আমাদের কথা বিশ্বাস করতে দু’বার না ভাবেন।”

রফিকুল ভাবুক স্বরে বললো….
—“কিন্তু তুমি বাবাকে কি বলে দেশে আসার জন্য বাধ্য করবে আম্মা!”

রাহেলা বাঁকা হেসে বললেন….
—“সে বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাক তোরা। যা করার আমি একাই করবো।”

(১৯)
সকালবেলা…….
রাহেলা নিজরুম থেকে বেড়িয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করতেই দেখলেন মেহরিন উনুনের পাশে বসে রুটি বেলতেছে। রাহেলা ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁচকে নিয়ে রান্নাঘরের ভিতরে প্রবেশ করে মেহরিনের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন….

—“আমার অনুমতি না নিয়েই সকাল সকাল উনুন বন্ধ করে রুটি বানানোর সাহস কি করে হলো তোমার? তোমার মনে হচ্ছে না কি তুমি আর তোমার স্বামী অনেক বেশিই বাড়াবাড়ি করতেছো সব বিষয়ে!”

রাহেলার এরূপ কথাগুলো মেহরিনের উপর যে খুব একটা প্রভাব ফেলতে পারলো না তা মেহরিনের হাতের কাজ বন্ধ করতে না দেখেই বুঝতে পেরেছেন রাহেলা। মেহরিনের এই শান্তরূপ রাহেলার রাগের পরিমাণ কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয় যেনো। পরক্ষণেই রাহেলা রাগ নিয়ে মেহরিনের সামনে কিছুটা ঝুঁকে পিড়ার উপর থাকা রুটিটা ধরতে নিলে মেহরিন রাহেলার হাত ধরে বাঁধা প্রদান করে। অতঃপর রাহেলার দিকে তাকিয়ে মেহরিন শান্ত স্বরে বললো….

—“সকাল সকাল সামান্য বিষয়কে কেনো টেনে বড় করার চেষ্টা করছেন আপনি আম্মা! আমার স্বামী আলুর পরোটা খেতে চেয়েছে তাই শুধু ওর জন্যই অল্প পরিমাণে তৈরি করছি আমি। এতে তো আপনার কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আর রইলো আপনার থেকে অনুমতি নিয়ে কাজ শুরু করার বিষয়! আচ্ছা আপনার থেকে আমাকে অনুমতি নিতে হবেই বা কেনো? আপনি যেমন এই সংসারের বউ আমিও তো তেমনই এই সংসারের বউ। আপনার অধিকারের জায়গার পরিমাণ যতোটুকু আমারও ততোটুকুই। আমার স্বামীকে আপনি হয়তো আপনার বাকি ছেলের মতো আপন ভাবেন না কিন্তু এ বাড়ির মূল কর্তা আমার শ্বশুড় মশাই তো ভাবেন! তার দেওয়া অর্থ দিয়েই তো সংসারের সব খরচ মিটে। তাহলে এই টাকা দিয়ে আপনার বাকি দুই ছেলে-বউমা’রা নিজেদের মর্জি মতো খরচ করে চলতে পারলে আমি আর আমার স্বামী কেনো পারবো না! এখন থেকে নিজের হাত ও মুখ নিয়ন্ত্রণে রেখে চলতে শিখুন। নয়তো হাত-মুখ তাদের নিজ নিজ জায়গায় নাও থাকতে পারে।”

এই বলে মেহরিন ঝা*ট*কা মে*রে রাহেলার হাত ছেড়ে দিয়ে আবারও নিজের কাজে মনোনিবেশ করে। মেহরিনের বলা প্রতিটা শব্দ যেনো রাহেলার মস্তিষ্কে গিয়ে সূচের মতো ফুঁ*টে*ছে। যেই মেয়ে দু’দিন আগেও চোখ তুলে তাকানোর সাহস করতো না আজ সেই মেয়েই মুখ বন্ধ করে দেওয়ার মতো কঠিন জবাব দিলো। রাহেলার সম্পূর্ণ মুখশ্রী অ*প*মা*নে থমথমে হয়ে গিয়েছে। তিনি আর কোনো কথা না বলে হনহনিয়ে রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে গেলেন। বিয়ের পর এই প্রথম শ্বাশুড়ির মুখের উপর প্রতিবাদ মূলক প্রতিত্তুর করার পর মেহরিনের বুকের ভিতরটা যেনো অনেকটা হালকা হয়ে যায়। কাজ করতে করতেই মেহরিনের রিজওয়ানের কথা মনে পড়ে। রিজওয়ান-ই মেহরিনকে বলেছিলো ওর আড়ালে অ*ন্যা*য় হলে যেনো মেহরিন তা মুখ বুঁজে তা সহ্য না করে। প্রতিবাদ করার সাহস যখন রিজওয়ান নিজে দেখাতে একবার শুরু করেছে তখন তার স্ত্রী হিসেবে মেহরিনকেও নিজের ভিতর সেই সমপরিমাণ সাহস রাখতে হবে। মেহরিন আজ ওর স্বামীর কথা রাখতে পেরেছে।
.
.
.
.
অফিসের পোশাক পরিধান করে রাজিবুল ও রফিকুল ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। এছাড়াও মেহরিন আর রিজওয়ান ব্যতিত বাকিরাও উপস্থিত আছে। রাজিবুল নিজের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একপলক তাকাতেই দেখলো ঘড়িতে তখন সময় ৮টা বেজে ৩০ মিনিট। রাজিবুল উচ্চস্বরে শেফালি আর ঊর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“এখনও রান্না শেষ হলো না তোমাদের! আজ কি অফিসে ৯টার জায়গায় ১২ টার সময় যাবো আমি শেফালি!”

রাজিবুলের তালে তাল মিলিয়ে রফিকুল ও বললো….
—“ঊর্মিলা আমারও অফিসের জন্য দেড়ি হয়ে যাচ্ছে তো। রান্না যতোটুকু শেষ করতে পেরেছো তা-ই নিয়ে এসো।”

শেহতাজ ঊষার দিকে কিছুটা ঝুঁকে বললো…
—“আমি তো চাচ্ছি মা’য়ের আর বড় মা’য়ের রান্না শেষ হতে আরো বেশি সময় লাগুক। তাহলে আজ আর আমাকে কষ্ট করে স্কুলেও যেতে হবে না আর পরীক্ষাও দিতে হবে না।”

ছোট্ট ঊষা শেহতাজের বলা পুরো কথাগুলোর মানে বুঝতে না পেরে চোখের আকৃতি বড় বড় রেখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে মাত্র। রুমি রাহেলাকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“মা..আজ কলেজে আমার গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। ভাবীরা রান্না শেষ করতে এতো সময় লাগালে আমার বাস-ই মিস হয়ে যাবে। তখন আমি কলেজ এই তো যেতে পারবো না।”

রাহেলা ওদের সবার কথা আর অস্থিরতা নিতে না পেরে চেয়ার ছেড়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করলেন। রাহেলা রান্নাঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়াতেই শেফালি আর ঊর্মিলাকে কথা কাটাকাটি করতে দেখে অত্যন্ত অবাক হয়ে গেলেন। রান্নাঘরে মাটির একটাই চুলো বসানো রয়েছে। একসাথে কেবল একটা কিছুই রান্না করা সম্ভব সেখানে। আর শেফালি ঊর্মিলাকে বলছে ‘সে আগে নিজের স্বামী-সন্তানের জন্য রান্না শেষ করবে’ আর ঊর্মিলাও শেফালিকে একই কথার পুনরাবৃত্তি করে শুনাচ্ছে। রাহেলা নিজের শাড়ির কুঁচি গুলো একহাতে জড়ো করে ধরে লম্বা কদম ফেলে শেফালি আর ঊর্মিলার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ধমকের স্বরে বললেন…..

—“থামো তোমরা।”

রাহেলা বেগমের ধমকে ওরা দু’জনেই চুপ হয়ে যায়। পরক্ষণেই রাহেলা লক্ষ্য করলেন উনুন এখনও ধরানোই হয় নি আর মেঝের উপরেও দু’টো বড় বোলে কাঁচা সবজি গুলো অসমান ভাবে কেটে রাখা রয়েছে। এমনটা দেখে রাহেলা বুঝতে পারলেন এখন পর্যন্ত তার দুই বউমা রান্নার ‘র’ ও শুরু করে নি। অতঃপর রাহেলা ওদের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত পি*ষে বললেন….

—“দেড় ঘন্টা হলো তোমরা দু’জনে রান্নাঘরে প্রবেশ করেছিলে আর এখনও পর্যন্ত একটা কিছুও রান্না করতে পারো নি! ওদিকে আমার ছেলেরা, নাতী-নাতনী, মেয়েটা তাদের কাজের স্থানে যাওয়ার জন্য তাড়া দিচ্ছে আর তোমরা একে-অপরের সাথে সমান তালে ঝগড়া করছো?”

ঊর্মিলা কিছুটা ন্যকা ভাব নিয়ে বললো….
—“আম্মা..এখানে আমার কোনো দো*ষ নেই। আমি সবজি সব কা*টা-কা*টি শেষ করে যেই মাত্র রান্না উঠাতে যাবো ঠিক করলাম ওমনি সময় ভাবী উনুনের সামনে বসে নিজের কা*টা-কা*টি করে যেতে লেগেছিলেন। আমি তাকে সরতে বললে তিনি বললেন তিনি-ই আগে রান্না করবেন তারপর আমি করার সুযোগ পাবো। আর এতোসময় আমাকে অপেক্ষা করতে হবে।”

ঊর্মিলার এরূপ কথা শুনে শেফালি রাগী স্বরে বললো….
—“ছোট..তুমি তো দেখছি ভাড়ি কু*চু*টে মনের মানুষ। নয়তো নিজের করা কাজের ভাড় কি এভাবে অবলিলায় আমার উপর চাপাতে পারতে!”

শেফালির এরূপ কথা শুনে ঊর্মিলার মুখ কিছুটা শুকনো বর্ণ ধারণ করে বটে তবুও সে আমতা স্বরে বললো….

—“দেখো ভাবী…এখন মায়ের সামনে একদম ভালো সাজার চেষ্টা করো না তুমি৷”

—“ভালো সাজার চেষ্টা আমি না তুমি নিজে করছো। সবজি কাটা-কাটি প্রথমে আমার শেষ হয়েছিলো আর উনুন বন্ধ করে তুমি সেখানে বসেছিলে।”

ঊর্মিলা আবারও কিছু বলতে নিবে সেইসময় রাহেলা অত্যন্ত রাগ নিয়ে ধমকের স্বরে ওদের দু’জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“চুপ…একদম চুপ। আর একটা শব্দ ও যদি তোমরা দু’জনে একে-অপরের মুখ থেকে করেছো তবে তোমাদের মুখ আমি সুঁই-সুতো দিয়ে সারাজীবনের জন্য সেলাই করে দিবো বলে দিলাম।”

এবার শেফালি আর ঊর্মিলা কিছুটা ভ*য় পেয়ে একেবারেই নিরব হয়ে যায়। রাহেলা আবারও বললেন…

—“বিয়ে হয়ে দু’জনে এ বাড়িতে এসেছো পর থেকে নিজেদের আরাম-আয়েশ এর কথা চিন্তা করে স্বামীর রোজগার কম জেনেও শ্বশুড়ের টাকায় কাজের মেয়ে রেখেছিলে। তাদের দিয়েই সংসারের যাবতীয় কাজ করিয়ে নিতে। এরপর যখন রিজওয়ান বউ নিয়ে আসলো তখন সব কাজের লোকদের কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে ওর একার উপরেই সংসারের যাবতীয় কাজ সামলানোর দায়ভার বর্তে দিয়েছিলে। দু’দিন হলো না রিজওয়ান নিজের বউকে সংসারের বাড়তি কাজ-কর্ম থেকে গুটিয়ে নিয়েছে আর তোমরা যাদের কিনা সারাক্ষণ গলায় গলায় ভাব থাকে তারা একবেলার রান্না করতে এসে এ আগে করবে তো ও পরে করবে করে করে তর্ক-ঝগড়া করছো! এ বাড়িতে কখনও আমার পরিবারের কোনো সদস্যকে বাহিরে যাওয়ার সময় খালি পেটে যেতে হয় নি। আজ শুধু মাত্র তোমাদের দু’জনের জন্য বাড়ির পুরুষ সদস্যরা, বাচ্চারা, আমার মেয়েটাকেও না খেয়ে বাহিরে যেতে হবে। নিজের স্বামী-সন্তান আর বাড়ির দু’জন সদস্যের জন্য একবেলার খাবার রান্না করতে পারো না সংসারের কেমন বউ তোমরা একটাবার চিন্তা করে দেখো।”

এই বলে রাহেলা রাগে হনহনিয়ে স্থান ত্যগ করলেন। শেফালি আর ঊর্মিলা একে-অপরের মুখশ্রী পানে একপলক তাকিয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। রাহেলা আবার ডাইনিং রুমে আসতেই দেখলেন সেখানে কেউ ই নেই। ওরা সকলেই যে আর অপেক্ষা করতে না পেরে বি*র*ক্তি নিয়ে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে তা বুঝতে রাহেলার আর বাকি থাকে না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……….

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৮

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৮)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(১৪)
পশ্চিমাকাশে ক্লান্ত সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়তে পড়তে সন্ধ্যা হওয়ার জানান দিচ্ছে। আমজাদ বললেন….

—“সন্ধ্যা হয়ে আসছে। বাড়ি ফিরতে হবে তো তোমাদের নিশ্চয়ই।”

মেহরিন শান্ত স্বরে বললো…
—“জ্বি চাচা।”

আমজাদ তৎক্ষনাৎ একজন গার্ডসকে ডাকলেন। গার্ডসটি তার সামনে এসে দাঁড়ানো মাত্রই আমজাদ বললেন…

—“মেহরিন মা আর রিজওয়ান বাবাকে গাড়ি করে ওদের বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে এসো। আমি আরফাকে নিয়ে এখানেই বসছি আরো কিছুসময়।”

রিজওয়ান বললো…
—“চাচা, এই পার্ক থেকে আমাদের বাড়ি যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না। হেঁটেই যেতে পারবো না। আপনার শরীর ভালো না। এখানে বসে আর অপেক্ষা করতে হবে না আপনাকে।”

—“গুরুজনরা কিছু বললে সেটা হাসিমুখে মেনে নিতে হয় বাবা।”

—“কিন্তু চাচা..!”

—“কোনো কিন্তু নয়। আচ্ছা তোমাদের যখন আমার শরীর নিয়ে এতো দুশ্চিন্তা হচ্ছে তখন আমরাও যাবো তোমাদের সাথে। তোমাদের বাসায় নামিয়ে দিয়ে নিজ বাসায় চলে যাবো। তাহলে তো কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না!”

আমজাদের এরূপ কথায় মেহরিন আর রিজওয়ান এবার আগের তুলনায় কিছুটা সন্তুষ্ট বোধ করে। অতঃপর ওরা সবাই পার্ক থেকে বেড়িয়ে গাড়িতে উঠে বসে। ওদের পিছনের গাড়িতে গার্ডসরা আছে। মিনিট ১৫ এর ভিতরেই গাড়িটি রিজওয়ানের বাড়ির মেইন গেইটের সামনে ব্রেক কষে। রিজওয়ান আর মেহরিন হাসিমুখে আমজাদ আর আরফার থেকে বিদায় নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। অতঃপর আমজাদ ও তাঁর গার্ডসদের গাড়িও তাদের নিজ গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।

ছাদ থেকে নিজেদের শুকনো ও আধভেঁজা কাপড়গুলো উঠাচ্ছিলো শেফালি আর ঊর্মিলা। তাই এতোসময় ধরে পুরো বিষয়টাই লক্ষ্য করেছে ওরা। ঊর্মিলা শেফালির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো….

—“ভাবী, এতো বড় গাড়ি করে ওদের দু’জনকে বাড়ির সামনে কে নামিয়ে দিয়ে গেলো বলো তো! এমন তো এর আগে কখনও হতে দেখি নি।”

শেফালি ভাবুক স্বরে বললো….
—“আমিও তো সেটাই ভাবছি। চল নিচে যাই। তাহলেই জানতে পারবো।”

—“এখন ওদের ভাব যেই পরিমাণে বেড়ে গিয়েছে তোমার মনে হয় আমাদের বলবে ওরা!”

শেফালি একপলক ঊর্মিলাকে দেখে কোনো প্রতিত্তুর না করে পরপরই নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সামনের দিকে হাটা ধরে।

(১৫)
চৌধুরী মেনশনের মূল গেইট দিয়ে আমজাদ চৌধুরীর গাড়ি ভিতরে প্রবেশ করে। কাঙ্ক্ষিত স্থানে গাড়ি থামানো মাত্র আরফাকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামেন আমজাদ। অতঃপর ছোট্ট আরফার হাত ধরে মূল দরজা ভেদ করে ভিতরে প্রবেশ করতেই ড্রয়িং প্লেসে সোফায় আরহামকে বসে থাকতে দেখে আমজাদ একজন মহিলা সার্ভেন্টকে ইশারা করেন। মহিলা সার্ভেন্টটি আরফাকে নিয়ে ওর রুমের উদ্দেশ্যে চলে যায়। ৩০ বছর বয়সী আরহামের দৃষ্টি তার হাতে থাকা ফাইলের উপরেই সীমাবদ্ধ দেখে আমজাদ লম্বা করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে আরহামের পাশে এসে বসে শান্ত স্বরে বললেন….

—“নিজের দায়িত্ব থেকে আর কতো কাল নিজেকে দূরে রাখবে তুমি আরহাম!”

নিজের দৃষ্টি ফাইলের উপরেই স্থির রেখে আরহাম বললো…
—“আমার কোন দায়িত্ব থেকে নিজেকে দূরে রাখার কথা বলছেন আপনি বাবা?”

—“আমার কথার মানে যে তুমি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছো তা বুঝতে আমার এতোটুকুও সমস্যা হচ্ছে না আরহাম।”

—“অহেতুক, অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে আমার সাথে কথা বলতে না আসার কথা আপনাকে আমি বহুবার বলেছি। আপনি আমার কথা শুনলেই পারেন।”

—“আরফা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে। ভালো-মন্দের মাঝে পার্থক্য বুঝতে শিখছে। ওর ছোট্ট মনে তোমার এমন আচারণের কেমন প্রভাব পড়তে পারে সে সম্পর্কে একটা বারও চিন্তা করে দেখেছিলে তুমি?”

—“আপনার আদরের নাতনী দুনিয়াতে আসা মাত্র-ই আমার প্রিয়তমা স্ত্রীকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছিলো। ওর দিকে যখনই তাকাই আমার সানজিদের মুখশ্রী ভেসে উঠে চোখের সামনে। কতোটা য*ন্ত্র*ণা সহ্য করে ওকে পৃথিবীতে এনেছিলো সানজিদ ভুলে গিয়েছেন? তার প্রতিদান সরূপ আপনার নাতনী ওকে কি দিয়েছে? মৃত্যু! আমার স্ত্রীর মৃ*ত্যু*র কারণ যেই সন্তান তার প্রতি বিন্দুমাত্র স্নেহ দেখানোর ইচ্ছে আমার নেই আর না কখনও জাগবে।”

—“ঐ নিষ্পাপ প্রাণটাকে বউমার মৃ*ত্যু*র জন্য আর কতো দিন দো*ষা র…..!”

আমজাদ পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই আরহাম ‘ব্যস’ বলে শব্দ করে নিজের হাতে থাকা ফাইলটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন….

—“এ বিষয়ে যদি আর একটা শব্দ ও আপনি বলেছেন তবে আমার থেকে খারাপ আর কেও হবে না শেষবারের জন্য বলে দিলাম।”

এই বলে আরহাম দ্রুততার সাথে নিজরুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরেন। আমজাদ আরহামের যাওয়ার পানে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রন কেবল।

(১৬)
রিজওয়ান আর মেহরিন নিজরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠা মাত্র ওদের সামনে শেফালি আর ঊর্মিলা এসে দাঁড়ায়। রিজওয়ান আর মেহরিন ওদের পাশ কাটিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলে ঊর্মিলা হাত মেলে ওদের রাস্তা আটকায়। রিজওয়ান শান্ত স্বরে বললো….

—“কোনো সমস্যা?”

ঊর্মিলা বললো….
—“এ বাড়ির আশেপাশেও এর আগে কখনও চার চাকার গাড়ি আসতে দেখি নি। আজ হঠাৎ তোমরা দু’জনে বাহিরে গিয়ে কি এমন রাজকার্য উদ্ধার করলে শুনি, যে এতো বড় বড় দু-দু’টো গাড়ি বাড়ির সামনে পর্যন্ত এসে তোমাদের নামিয়ে দিয়ে গেলো!”

রিজওয়ান স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো….
—“সে বিষয়ে তোমাদের কিছু বলার প্রয়োজন আমরা মনে করছি না। রাস্তা আটকে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করে উভয়ের সময় নষ্ট করো না।”

রিজওয়ানের এমন প্রতিত্তুরে ঊর্মিলা রাগে দাঁতের সাথে দাঁত খিঁ*চে ধরে কেবল। শেফালি বললো…

—“পিপীলিকার পাখা গজায় ম*রি*বা*র তরে এই কথাটার বাস্তব প্রমাণ খুব শীঘ্রই পেতে যাচ্ছি আমরা।”

রিজওয়ান শেফালির দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো…

—“সঠিক সময়ে সঠিক প্রবাদ বাক্য বলার জন্য তোমাকে বাহবা না দিয়ে পারছি না বড় ভাবী।”

এই বলে রিজওয়ান আর ওদের কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মেহরিনের হাত ধরে ওদের পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দরজা আটকে দেয়।
ঊর্মিলা রাগে গজগজ করতে করতে বললো….

—“দেখলে ভাবী দেখলে! বলেছিলাম না এদের ভাব এখন আকাশ ছুঁই হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি কথার পিঠে কথা বলে আমাদের মুখ ই বন্ধ করে দিচ্ছে এরা।”

—“দেখছি ছোট সবই দেখছি।”

(১৭)
নিজরুমে এসে রিজওয়ান আর মেহরিন ফ্রেশ করে বাহিরের পোশাক পরিবর্তন করে ঘরের পোশাক পরিধান করে নেয়। মেহরিন শান্ত স্বরে বললো….

—“আগামীকাল সকাল ১০ টায় আমজাদ চাচা যে তোমাকে তার কোম্পানিতে ডেকে পাঠালেন এ বিষয়ে কি সিদ্ধান্ত নিলে তুমি?”

—“আল্লাহ তায়ালা আমাদের দিকে তার অসীম রহমতের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আমজাদ চাচা আমাদের দুর্দিন শেষ করে সুদিন দেখানোর জন্য আল্লাহর পাঠানো উছিলা। তাই আমি আগামীকাল চৌধুরী গ্রুপ অফ লিমিটেড এ অবশ্যই যাবো। আমার একটা চাকরি ওদের সবার বিরুদ্ধে মো*কা*বি*লা করার জন্য শক্ত-পোক্ত অ*স্ত্রে*র মতো কাজ করবে।”

—“হুম ঠিক বলেছো। আচ্ছা তুমি তোমার সব কাগজ-পত্র একত্র করে নাও। আমি গিয়ে শেহতাজ আর ঊষাকে পড়িয়ে আসি। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ওদের পড়ানোর কথা ছিলো। ওদের বাবা-মায়ের জন্য আমাদের দিক থেকে ওদের পড়াশোনায় কোনো খারাপ প্রভাব পড়ুক এমনটা আমি চাই না।”

—“হুম যাও। তবে ওরা যদি আমার আড়ালে তোমাকে একটাও ক*ষ্ট দায়ক কথা শোনায় তবে তুমি চুপ থাকবে না মেহরিন। অবশ্যই প্রতিটি কথার পিঠে উপযুক্ত প্রতিত্তুর করবে। আমি চাই না তুমি দূর্বল হও ওদের সামনে।”

মেহরিন হাসিমুখে ‘আচ্ছা’ সূচক জবাব দিয়ে রুম থেকে বের হয়। রিজওয়ান মেহরিনের যাওয়ার পানে কিছুসময় তাকিয়ে থাকার পর বিছানা থেকে নেমে আলমারীর কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলমারি খুলে বিগত বছর গুলো ধরে নিজের অনেক ক*ষ্টে অর্জিত মার্কসিট ও সার্টিফিকেট গুলো বের করে সেগুলো নিয়ে আবারও বিছানায় এসে বসে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……..

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৭

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৭)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(১৩)
রিজওয়ান আর মেহরিন ছুটে সেই বৃদ্ধলোকটির পাশে এসে দাঁড়াতেই দেখলো লোকটি নিজের বুকের বাম পার্শে একহাত চেপে ধরে চোখ বুঁজে মৃদু ভাবে কাঁপছেন আর জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছেন। আর অন্যহাত দিয়ে এখনও নিজের নাতনীর হাত ধরে রেখেছেন। ছোট্ট বাচ্চাটি ‘দাদু দাদু’ বলে কান্না করে যাচ্ছে কেবল। মেহরিন আর রিজওয়ান বৃদ্ধলোকটির হাতের দু’পাশে আলগা হয়ে বসতেই মেহরিন দ্রুততার স্বরে বললো….

—“শুনো..তুমি তোমার দু’হাত চাচার বুকের উপর রেখে জোড়ে জোড়ে চাপ দাও। আমার মনে হচ্ছে চাচার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। এভাবে চাপ প্রয়োগ করলে তার বুকের ভিতরটা হালকা হয়ে আসবে আশা করা যায়।”

রিজওয়ান অবাক দৃষ্টি নিয়ে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরিন রিজওয়ানকে এখনও বসে থাকতে দেখে বললো…

—“কি হলো! চাপ দাও।”

রিজওয়ান আর দেড়ি না করে মেহরিনের কথা অনুযায়ী বৃদ্ধ লোকটির বুকের উপর পর পর কয়েকবার চাপ প্রয়োগ করে। মেহরিন আবারও বললো….

—“থেমে যাও ৫ বার হয়েছে। ৫ বার করে চাপ প্রয়োগ করে কিছুসময়ের জন্য থেমে যেতে হবে। তারপর আবার ৫ বার চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এভাবে ততোক্ষণ করতে হবে যতোক্ষণ পর্যন্ত না চাচার নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা স্বাভাবিক হচ্ছে।”

রিজওয়ান মেহরিনের কথা অনুযায়ী কাজ করতে থাকে। এভাবে মিনিট ২ করার পর বৃদ্ধ লোকটি একবার লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে জোরে জোরে কাঁশতে শুরু করেন। মেহরিন বললো….

—“শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। আমাদের চেষ্টা সফল হয়েছে। আর কিছু করতে হবে না তোমাকে। চাচা একটুপরই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আসার সময় পার্কের বাহিরে একটা ছোট্ট ভাতের হোটেল দেখেছিলাম। সেখানে থেকে এক গ্লাস পানি নিয়ে এসো। চাচাকে একটু পানি খাওয়াতে হবে।”

রিজওয়ান তৎক্ষণাৎ বসা অবস্থা থেকে উঠে পানি আনার জন্য পার্কের ভিতরে ও বাহিরে যায় সেই মূল দরজার দিকে যেতে শুরু করে। মেহরিন বৃদ্ধ লোকটি ধরে বসতে সাহায্য করে। নিজের দাদুকে আগের থেকে অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যেতে দেখে বাচ্চা মেয়েটিও কান্না থামিয়ে দেয়। বৃদ্ধ লোকটি চোখ মেলে তাকাতেই নিজের একপার্শে নাতনিকে আর অন্যপার্শে মেহরিনকে বসে থাকতে দেখে বললেন….

—“কে তুমি মা! আমার এই দু*র্সময়ে এভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়ালে। তুমি না থাকলে আজ আমার হয়তো আর জিবীত অবস্থায় বাসায় ফেরা হতো না।”

মেহরিন স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“আমার নাম মেহরিন চাচা। আমি অতি সাধারণ একজন মেয়ে। এভাবে বলবেন না আপনি। প্রাণীকূলের হায়াত-মউত ঠিক করা সবই আল্লাহর উপর। আমি আর আমার স্বামী আপনার কাছে আজ উছিলা হয়ে এসেছিলাম মাত্র। তাই সৃষ্টিকর্তা ও রহমত বর্ষণ কারী ঐ আল্লাহ তায়ালার শুকুর আদায় করুন।”

—“হ্যা হ্যা তা সঠিক বলেছো তুমি মা। তোমার স্বামীকে তো দেখছি না। কোথায় সে?”

—“আপনার জন্য পানি আনতে পার্কের বাহিরে গিয়েছে। এসে পড়বে এক্ষুণি।”

মেহরিনের কথা শেষ হতে না হতেই ওরা লক্ষ্য করে সামনে থেকক ওদের দিকে বিশাল দেহের কালো পোশাকধারী ও হাতে একটা করে বিশালাকার ব*ন্দু*ক নিয়ে কয়েকজন গার্ডস দৌড়ে আসছে। মেহরিন তাদের চিনতে না পারায় বৃদ্ধ লোকটি ও বাচ্চা মেয়েটির সামনে এসে দু’হাতে পিছন থেকে তাদের ঘিরে ধরে বললো….

—“চাচা, আপনি ভ*য় পাবেন না আমি থাকতে এই গু*ন্ডা গুলো আপনাদের কোনো ক্ষ*তি করতে পারবে না।”

মেহরিনের কথা শেষ হতেই গার্ডসরা মেহরিনের সম্মুখপানে এসে দাঁড়িয়ে পরে। মেহরিন গার্ডসদের উদ্দেশ্য করে উচ্চস্বরে বললো….

—“লজ্জা করে না আপনাদের একজন বৃদ্ধ লোক ও তার সাথে একজন ছোট বাচ্চা এবং একজন মেয়ে মানুষকে দেখে তাদের উপর হা*ম*লা করতে! কা*পুরুষের দলেরা। শরীর স্বাস্থ্য তো যথেষ্ট ভালো। গু*ন্ডা*মি না করে, ব*ন্দু*ক দেখিয়ে সাধারাণ মানুষদের ভ*য় না দেখিয়ে ভালো কোথাও গিয়ে নিজেদের শ্রম ব্যয় করে টাকা রোজগার করলেই তো পারেন।”

মেহরিনের মুখে এরূপ কথা গুলো শুনে গার্ডসরা আ*হা*ম্ম*কি দৃষ্টি নিয়ে একে-অপরকে দেখে কেবল। মেহরিনের পিছন থেকে বৃদ্ধ লোকটি আর বাচ্চা মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গেই শব্দ করে হেসে উঠে। ওদের হাসির শব্দ শুনে মেহরিন ওদের সামনে থেকে সরে একপার্শে এসে বসে অবাক দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়। বৃদ্ধ লোকটি হাসিমুখে বললেন….

—“ভ*য় পেও না ওরা। ওরা কেও খা*রা*প লোক কিংবা গু*ন্ডা না। ওদের সবাইকে আমাকে আর আমার নাতনিকে সমস্ত বি*প*দ-আ*প*দ থেকে রক্ষা করার জন্য গার্ডস হিসেবে নিয়োজিত করেছে আমার বড় ছেলে। পার্কে প্রবেশ করার পূর্বে ওদের পার্কের বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখে আমি আমার নাতনীকে নিয়ে ভিতরে এসেছিলাম। অনেক সময় হয়ে গেলো আমরা না ফেরায় ওরা চি*ন্তি*ত হয়েই এখানে চলে এসেছে।”

বৃদ্ধ লোকটির এরূপ কথা শুনে মেহরিন নিজের আচারণ ও কথার ধরণের জন্য কিছুটা লজ্জাবোধ করে। গার্ডসরা বৃদ্ধ লোকটিকে ধরে সেখানেই বসার জায়গায় বসিয়ে দেয়। সেইসময় রিজওয়ান একটা কাঁচের গ্লাসে করে পানি নিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়ায়। গার্ডসদের দেখে সেও কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবাক হয়। মেহরিন রিজওয়ানের হাত থেকে পানির গ্লাসটি নিয়ে বৃদ্ধ লোকটিকে দিলে তিনি হাসিমুখে গ্লাসে থাকা সবটুকু পানি পান করে নেন। পরক্ষণেই বৃদ্ধ লোকটি বললেন…

—“ও-ই তাহলে তোমার স্বামী মেহরিন মা!”

—“জ্বি চাচা।”

—“নাম কি তোমার বাবা! কি কাজ করো?”

রিজওয়ান একপলক মেহরিনের দিকে তাকিয়ে পরপরই নিজের দৃষ্টি বৃদ্ধ লোকটির উপর স্থির করে বললো….

—“আমার নাম রিজওয়ান ইয়াসীর। আমি আপাতত বেকার, চাচা।”

রিজওয়ানের মুখে ‘বেকার’ শব্দটি শুনে বৃদ্ধ লোকটির ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁ*চ*কে আসে। পরক্ষণেই তিনি শান্ত স্বরে গার্ডসদের উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“তোমরা আপাতত আমাদের থেকে দূরত্ব রেখে দাঁড়াও। কোনো প্রয়োজন হলে আমি ডেকে নিবো।”

অতঃপর গার্ডসরাও বিনাবাক্যে ওদের থেকে কয়েক হাত দূরে গিয়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে পড়ে। বৃদ্ধ লোকটি রিজওয়ানের উদ্দেশ্যে বললেন…

—“মেহরিন মা’য়ের পাশে বসো তুমি বাবা।”

রিজওয়ান ও নিঃশব্দে মেহরিনের পাশে বসে পড়ে। বৃদ্ধ লোকটি আবারও বললেন….

—“আমার নাম আমজাদ চৌধুরী। এই শহরের সবথেকে বড় কোম্পানি চৌধুরী গ্রুপ অফ লিমিটেড এর প্রতিষ্ঠাতা আমি। তবে এখন কোম্পানি সামলানোর সব দায়িত্ব আমার একমাত্র ছেলে আরহাম চৌধুরীর উপর দিয়ে আমি অবসর নিয়েছি। ও আমার একমাত্র নাতনী আরফা। আরফার মা সানজিদ ওকে জন্ম দেওয়ার পর পরই আল্লাহর ইচ্ছেতে জান্নাতে চলে গিয়েছেন দীর্ঘ ৫বছর হলো। এরপর-ই আরহাম অনেকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলো। বউমার স্মৃতি মনে করা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে ২৪ ঘন্টার ভিতর ১৮ঘন্টার বেশি সময় ধরে নিজেকে বাহ্যিক কাজের মাঝে ব্যস্ত রাখতে শুরু করে। বাবা হওয়ার খাতিরে আরফার ২৪ ঘন্টা দেখাশোনার জন্য কয়েকজন মহিলা সার্ভেন্ট রেখেছে মাত্র। কিন্তু আরহাম যে এখনও আরফাকে মন থেকে গ্রহন করে নি তা বুঝতে আমার বাকি নেই। শত ব্যস্ততার মাঝে নিজেকে রেখে আরফার হক থেকে ওকে বন্ঞ্চিত করে এসেছে বিগত বছর গুলো ধরে। ও মনে করে সানজিদের মৃ*ত্যু*র জন্য আমার নিষ্পাপ নাতনী আরফা দায়ী। যতোবার আরহামের সাথে এ বিষয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম প্রতিবারই ও আমাকে এক বুক হতাশা দিয়েছে মাত্র। জানি না ওর ভিতরে কাজ করা এই ভু*ল ধারণা কবে ভা*ঙ*বে। বাহ্যিক কাজ থেকে অবসরে আসার পর নাতনীর পিছনেই পুরো সময় ব্যয় করি আমি। প্রায় সময়ই এই পার্কে হাঁটতে আসি আরফার সাথে। আজও এসেছিলাম৷ এরপর যা হলো তা নিয়ে আর কি বলবো! সবকিছুর পরে আমাকে কেবল একটা বিষয়-ই ভাবায়, তা হলো ‘আমার অবর্তমানে আমার নাতনীটার কি হবে!’ বাবার অ*ব*হে*লায় বড় হতে হতে নিজেকে একলা মনে করতে শুরু করবে হয়তো!”

এই বলে আমজাদ একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। আরফা ফ্যল ফ্যল দৃষ্টি নিয়ে নিজের দাদুর মুখশ্রী পানে চেয়ে আছে। দাদুর বলা এই কঠিন কথাগুলোর বেশিরভাগ কথার মানেই হয়তো সে বুঝে উঠতে পারে নি। আরফার এই চাহুনি মেহরিনের হৃদয়ে গিয়ে ধাঁ*রা*লো সুঁ*চে*র মতো বিঁ*ধে। কিয়ৎক্ষণ পর আমজাদ আবারও বললেন…..

—“আল্লাহর রহমতের জন্য ও আমাকে এই কঠিন বি*প*দ থেকে রক্ষা করার জন্য তোমাদের দু’জনকে আমার নিকট উছিলা হিসেবে পাঠানোর জন্য আমি তার লক্ষ্য-কোটি শুকরিয়া আদায় করছি। তোমাদের এই উপকারের মূল্য আমি কোনো কিছুর বিনিময়েই শোধ করতে পারবো না জানি তবুও আমি আমার সাধ্যের ভিতর থাকা এমন কিছু করে তোমাদের দুঃসময়ে তোমাদের পাশে দাঁড়াতে চাই। এ নিয়ে আমি তোমাদের থেকে দ্বিমত শুনবো না।”

রিজওয়ান আর মেহরিন অবাক দৃষ্টি নিয়ে আমজাদের মুখশ্রী পানে তাকিয়ে রয়। আমজাদ শান্ত স্বরে বললেন….

—“আমি জানি মধ্যবিত্ত পরিবারে একজন প্রাপ্ত বয়সের বেকার ছেলে থাকলে তার উপর দিয়ে কতোটা মানসিক ধ*ক*ল যায়। পরিবার, সমাজ দুই-ই তাঁকে ছোট নজরে দেখে সবসময়। এর উপর তুমি বিবাহিত। তোমার উপর মেহরিন মা’য়ের সম্পূর্ণ দায়ভার ব*র্তে*ছে৷ হয়তো এখনও তোমার বাবা কিংবা ভাই তোমাদের খরচ বহন করছেন কিন্তু তারা তো আজীবন তোমাদের খরচ বহন করবেন না। এই সময়টা তোমাদের দু’জনের জন্যই দুঃসময়। তাই আগামীকাল সকাল ১০ টার ভিতর তোমার সি.ভি নিয়ে চৌধুরী গ্রুপ অফ লিমিটেড এ উপস্থিত হবে তুমি রিজওয়ান। আমিও থাকবো সেখানে আগামীকাল। রিসেপশনে তোমার কথা আমি পূর্ব থেকেই বলে রাখবো। তুমি শুধু তোমার নামটা বলবে তাহলেই তারা তোমাকে আমার নিকট পৌঁছাতে সহযোগিতা করবে। তারপর তোমার যোগ্যতা যাচাই করে তোমাকে আমি আমার কোম্পানিতে চাকরির ব্যবস্থা করে দিবো ইনশাআল্লাহ।”

আমজাদের এরূপ কথা শুনে মেহরিনের দু’চোখ খুশির নোনাজলে টইটম্বুর হয়ে উঠে। উপকারের এতো বড় প্রতিদান যে তারা পাবে এমনটা কল্পনাও করে নি ওরা। রিজওয়ান মাথা নুইয়ে রেখেছে। প্রতিত্তুরে কিছু বলার ভাষা যেনো ওরা হারিয়ে ফেলেছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ……

আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ পর্ব-০৬

0

#আমি_তোমারি_সনে_বেঁধেছি_আমারো_পরাণ💙(৬)
#Maisha_Jannat_Nura(লেখিকা)

(১০)
নিজের রুমে এসে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে রুমি শব্দ করে কান্না করছে। সেইসময় রাহেলা আর ঊর্মিলা রুমির রুমে প্রবেশ করে রুমির পাশে এসে বসেন। রাহেলা বললেন…

—“রুমি..মা আমার, এভাবে কান্না করিস না। শরীর খারাপ করবে তোর।”

রুমি কান্না করতে করতে বললো…
—“তুমি আর ভাবীরা তো ওখানে উপস্থিত ছিলেই মা। যখন তোমার সতীনের ছেলে আমাকে থা*প্প*ড় দিলো আবার এতো বড় বড় কথা শুনালো তখন কিছু বললে না তো? চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে আমাকে অ*প*মা*নিত হতে দেখেছো তোমরা। আর এখন এসেছো শান্তনামূলক বাক্য শুনাতে! দরকার নেই আমার তোমাদের কোনো শান্তনার। চলে যাও তোমরা আমার রুম থেকে। আমাকে একা থাকতে দাও তোমরা। চলে যাও।”

রাহেলা রাগে ক্ষি*প্ত হয়ে বললেন….
—“আমার ফুলের মতো সুন্দর মেয়ের শরীরে হাত উঠিয়েছে ঐ জা*লি*ম। সকালে আমার কলিজার টুকরা বড় ছেলেকে আ*ঘা*ত করেছিলো। আবার বড় বড় কথাও শুনিয়েছিলো আমাদের সবাইকে। এই সবকিছু যে আমরা এমনি এমনিই মুখ বুঝে সহ্য করবো এমনটা তুই ভাবিস না মা। রিজওয়ান আর ওর বউয়ের হঠাৎ উদয় হওয়া এই সাহসিকতার আর চাপার জোড়ের ফল যে ওদের জন্য কতোটা ভ*য়া*বহ হতে চলেছে তা ওরা কল্পনাও করতে পারবে না। আজ তোর মেজো ভাইয়াকে বাসায় ফিরতে দে। বড় খোকার মন-মানসিকতাও একটু ভালো হোক। তারপর সবাই মিলে একত্রে বসবো আমরা এর একটা উপযুক্ত বি*হী*ত করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে।”

রুমি শোয়া অবস্থা থেকে উঠে নিজের মা’কে জড়িয়ে ধরে।

(১১)
মেহরিনের কোলের উপর মাথা রেখে চোখ বুঁজে শুয়ে আছে রিজওয়ান। মেহরিন রিজওয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো…

—“বাবা কি সত্যিই দেশে ফিরবেন?”

রিজওয়ান চোখ মেলে মেহরিনের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“হুম আসতে তো হবেই বাবাকে দেশে। কিন্তু তার আগে যে ভাবেই হোক আমাকে একটা চাকরিতে যোগদান করতে হবে। দেখি আরো নতুন কয়েক জায়গায় আবেদন করার জন্য বের হবো আগামীকাল।”

—“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো। অ*ন্যা*য়ের প্রতিবাদ করার মতো সাহস যেমন তিনি জুগিয়ে দিয়েছেন তেমনি তোমার কোনো না কোনো জায়গায় চাকরিই মিলিয়ে দিবেন তিনি।”

—“ফি আমানিল্লাহ….বউ।”

—“আজ আমাকে নিয়ে একটু বাহিরে যাবে!”

—“কেনো?”

—“বাড়ি থেকে কিছুটা সামনে নাকি একটা ছোট্ট পার্ক আছে শেহতাজের থেকে শুনেছিলাম। ওখানে গিয়ে তুমি আমি হাত ধরে কিছুসময় হাঁটাহাঁটি করবো। বেন্ঞ্চে বসে থাকবো। আমার কোলে এভাবে মাথা রেখে শুয়ে থেকো তুমি। আমি তোমার সাথে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে চাই কিছুসময়।”

রিজওয়ান হাসিমুখে বললো….
—“ঠিক আছে, বিকেলবেলা তুমি আর আমি মিলে যাবো সেখানে।”

বিকেলবেলা….
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছেন রাহেলা, ঊর্মিলা আর শেফালি। সেইসময় রিজওয়ান আর মেহরিন সুন্দর, মার্জিত পোশাক পড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতে দেখে ওদের তিনজনের ভ্রু কিন্ঞ্চিত কুঁ*চ*কে যায়। ওরা নিচে আসতেই ঊর্মিলা বললো….

—“দুপুরের রোদ পড়তে না পড়তেই কোথায় যাওয়া হচ্ছে শুনি!”

রিজওয়ান শান্ত স্বরে বললো….
—“বাহিরের পোশাক পড়ে আছি দু’জনেই মানে বাহিরেই যাবো। এতোটুকু বিষয় বুঝতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না তোমার মেজো ভাবী!”

ঊর্মিলা দাঁতে দাঁত চেপে রিজওয়ানের ত্য*ড়া জবাব হজম করে নেয়। শেফালি বললো….

—“সংসারের কাজ করা থেকে নিজের বউকে ছাড়িয়ে নিলে ভালো কথা। কিন্তু তোমার বউ যে প্রতিদিন বিকাল করে আমার ছেলে আর ঊর্মিলার মেয়েকে পড়াশোনা করায় সে কথা কি সে ভুলে গিয়েছে! নাকি ওদের পড়ানোও ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তও ছেড়ে দিতে বলেছো তুমি তোমার বউকে?”

রিজওয়ান শেফালির দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে বললো…
—“শেহতাজ আর ঊষা আমার ভাতিজা-ভাতিজি হয়। ঐ নিষ্পাপ প্রাণ দু’টো কখনও আমাকে বা আমার স্ত্রীকে ক*ষ্ট দেয় নি। নিজেদের ছোট্ট মন খুলে যতোটুকু পেরেছে প্রকৃত, স্বা*র্থ*হীন ভালোবাসা উজার করে দিয়েছে। মেহরিন আগেও যেমন ওদের পড়াশোনা করাতো ভবিষ্যতেও করাবে৷ আজ একটু সময়ের অনিয়ম হয়ে যাবে। আমরা যেহেতু বাহিরে যাচ্ছি তাই বাহির থেকে আসার পর সন্ধ্যায় ওদের পড়াতে যাবে মেহরিন।”

শেফালি তেজি স্বরে বললো….
—“তোমাদের বাহিরে গিয়ে ফু*র্তী করার জন্য আমাদের ছেলে-মেয়ের পড়াশোনার সময়ের অনিয়ম করাতে হবে নাকি? ওসব তো হবে না। প্রতিদিন বিকেল বেলা তোমার বউ আমাদের ছেলে-মেয়েকে যেমন পড়াতো আজও তেমনই পড়াবে। দরকার পড়লে তোমরা রাতে বাহিরে যাবে।”

রিজওয়ান শান্ত স্বরেই বললো….
—“তোমরা তোমাদের ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করানোর জন্য তোমরা আমার স্ত্রীকে বেতন দাও না যে তোমাদের হুকুম পালন করতে সে বাধ্য থাকবে। তাই প্রতিটা কথা বলার পূর্বে ভেবে-চিন্তে কথা বলিও।”

এই বলে রিজওয়ান ওদের আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে মেহরিনের হাত ধরে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। ঊর্মিলা বললো….

—“দেখেছেন মা দেখেছেন! কেমন বার বেড়েছে এরা দু’জনে। বিশেষ করে রিজওয়ান। ওর চাপার জোড়েই ওর বউ ও সাহস পাচ্ছে। খুব তাড়াতাড়ি এদের একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা না করলে চলবে না। হুট করেই যদি রিজওয়ানের কথায় বাবা দেশে চলে আসেন আর তার কানে রিজওয়ান আমাদের করা যাবতীয় কর্মকাণ্ডের কথা তুলে দেয় তাহলে তো সব শেষ হয়ে যাবে। এ বাড়িতে আমাদের রাজত্বের দিন ফুরিয়ে যাবে। রিজওয়ানই যে এ বাড়ির আসল বংশধর এ কথা তো মি*থ্যে না। তাই ওর জোর আমাদের থেকে যথেষ্ট বেশি।”

রাহেলা বললেন….
—“এসব ভেবে দু*শ্চি*ন্তা করো না মেজো বউমা। রিজওয়ান যতোই এ বাড়ির আসল বংশধর হোক না কেনো আগে যেমন এ বাড়িতে আমাদের রাজত্ব চলতো ভবিষ্যতেও তেমন চলবে। ওদের অতিরিক্ত বারের জন্য ওদের পিঠে গজানো পাখা জোড়া কে*টে ফেলবো খুব তাড়াতাড়ি।”

(১২)
বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর রিজওয়ান আর মেহরিন একে-অপরের হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেই পার্কের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এখানে ঢোকার জন্য টাকা ব্যয় করে টিকিট নিতে হয় না। যার যার যখন ইচ্ছে সে সে তখন অনায়াসেই ভিতরে প্রবেশ করতে ও বের হতে পারে। পার্কের মূল দরজা দিয়ে অনেকটা দূর পর্যন্ত সরু একটা পাঁকা রাস্তা চলে গিয়েছে৷ রাস্তার দুই ধারে ইট-পাথর দিয়ে বিভিন্ন জ্ঞানী, মহাপুরুষদের মূর্তি বানিয়ে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়াও পুরো পার্ক জুড়ে সুগন্ধী ছড়ানোর জন্য ও সৌন্দর্যে ভরপুর রাখার জন্য নানান ধরনের রং-বেরঙের ফুল-ফলের গাছ লাগানো রয়েছে। পার্কটির জায়গায় জায়গায় মানুষজনদের বসার ব্যবস্থা করা রয়েছে। এছাড়াও ছোট বাচ্চাদের আনন্দের সহিত সময় পার করার জন্য দোলনা, স্লিপার সহ নানান ধরনের জিনিস পত্র রয়েছে। মেহরিন চারপাশটা খুব মনোযোগী ও মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে দেখছে। আর রিজওয়ান নিজের দৃষ্টি কেবল মেহরিনের মুখশ্রী পানেই স্থির রেখেছে। বেশকিছুসময় ধরে পুরো পার্কের ভিতরে চারপাশ হাঁটাহাঁটি করার পর মেহরিন আর রিজওয়ান একটা বসার স্থানে এসে বসে। রিজওয়ান একমুহূর্তও দেড়ি না করে মেহরিনের কোলের উপর মাথা রেখে আদুরে স্বরে বললো…

—“এবার আমার চুলে হাত বুলিয়ে দাও তো বউ। আমি কিছুসময় চোখ বুঁজে আরাম করি।”

মেহরিন হাসিমুখে রিজওয়ানের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করে আর যে স্থানে বসেছে সেখানে পিঠ ঠেকিয়ে খোলা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। বিয়ের পর কলেজ যাওয়া বন্ধ হয়ে গেলে মেহরিন পুরোপুরি ভাবে বাড়িবন্দীনি হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন ধরে সংসারের যাবতীয় কাজ করার পর ক্লান্ত শরীরটাকে কোনোরকমে বিছানায় এলিয়ে দিতে পেরেছিলো ছিলো। প্রতিদিন এর রুটিন হয়ে গিয়েছিলো এটাই। এই প্রথম মেহরিন রিজওয়ানের সাথে এমন খোলামেলা পরিবেশে এসেছে। তাই আজকে প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করছে মেহরিন। মেহরিনের মাঝে এখন যে প্রশান্তি কাজ করছে তা সে কাওকে ভাষায় বলে প্রকাশ করতে পারবে না হয়তো।

এভাবেই যে কতোসময় পেরিয়ে যায় তা মেহরিন বা রিজওয়ান খেয়াল করে উঠতে পারে না। কিয়ৎক্ষণ পর মেহরিন একজন মধ্যবয়সের লোককে একটা মিষ্টি ৪-৫ বছরের মেয়ে বাচ্চার হাত ধরে পার্কের ভিতর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে দেখে। তারা মেহরিন আর রিজওয়ান বসার স্থানের সম্মুখপানের রাস্তা দিয়ে হাঁটা চলা করছে। এমন দৃশ্য দেখে মেহরিনের ওর বাবা আর মামার কথা মনে পড়ে। ছোটবেলায় মেহরিনের বাবা বেঁচে থাকাকালীন সেও ওর বাবার হাত এভাবে ধরে বিভিন্ন জায়গায় হাঁটাচলা করতো। সেসব স্মৃতি আবছা ভাবে মনে আছে মেহরিনের। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মেহরিন ওর মামার সাথেও বিভিন্ন জায়গায় হাঁটাহাঁটি করেছে। সেসব স্মৃতি স্পষ্ট মনে আছে মেহরিনের। ভাবতে ভাবতেই ওর দু’চোখের কোণে অশ্রুরা জমে আসে। মেহরিন একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো….

—“মামা-মামী কতোদিন তো তোমাদের দেখি না। ভিষণ মনে পড়ছে তোমাদের কথা। জানি না কেমন আছো তোমরা!”

মেহরিনের ভাবনায় ছেঁদ ঘটে ওদের পিছন থেকে ভেসে আসা কোনো বাচ্চার ‘দাদু ভাই, দাদু ভাই’ বলে বলে কান্না করার শব্দে। রিজওয়ান ও মেহরিনের কোল থেকে মাথা তুলে উঠে বসে। মেহরিন আর রিজওয়ান পিছন ফিরে তাকাকেই দেখে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে মেহরিন যেই মধ্যবয়সের লোকটিকে ছোট বাচ্চা নিয়ে হাঁটাহাঁটি করতে দেখেছিলো সেই লোকটি রাস্তা উপর পড়ে আছে আর তার মাথার কাছে বসে বাচ্চা মেয়েটি কান্না করছে। এমন দৃশ্য দেখে রিজওয়ান আর মেহরিন বসা অবস্থা থেকে উঠে ওদের দিকে ছুটে যেতে শুরু করে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………….