#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৭
___________________
হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলো।তৃধা সেই বেঞ্চে বসেই বৃষ্টির মধ্যে কাঁদছে।তার চোখের নোনা জলগুলো বৃষ্টির নোনাজলের সাথে মিলিয়ে যাচ্ছে!হঠাৎ কেউ এসে তার মাথার উপর ছাতা ধরলো।সে তাকিয়ে দেখলো আহাদ দাঁড়িয়ে আছে।আহাদ চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“এই বৃষ্টির মধ্যে বসে কাঁদার কোনো মানে নেই বাড়িতে যান অসুস্থ হয়ে যাবেন।”
-“তুমি যাও আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার।”
আহাদ আর কিছু না বলে তৃধার হাত ধরে টেনে নিয়ে তাকে গাড়িতে বসালো।আহাদ গাড়ি স্টার্ট করলো।তৃধা একদম ভিজে গেছে।আহাদ তা খেয়াল করে গাড়ি দাঁড়া করালো।গাড়ির এসি অফ করে নিজের গায়ের ব্লেজারটা খুলে তৃধার দিকে এগিয়ে দিল।তৃধা নিজেকে সামলে বললো,
-“লাগবে না!আমি ঠিক আছি।”
আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“এইসব ড্রামা বন্ধ করে ব্লেজারটা পড়ে নিন।”
-“বললাম তো লাগবে না।”
-“জাস্ট সার্টআপ তৃধা!যা বললাম তাই করুন।”
তৃধা চোখ রাঙিয়ে ব্লেজার পড়ে বললো,
-“এইসব করে কি নিজে এখন দয়া দেখাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ দেখাচ্ছি।”
কথাটা বলে আহাদ আবার গাড়ি স্টার্ট করলো।সারা রাস্তায় দুজনে একটা কথাও বলেনি।আহাদ তৃধাদের বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো।বৃষ্টি থেমে গেছে!তৃধা গাড়ি থেকে নেমে আহাদকে ব্লেজারটা দিতে গেলে সে বললো,
-“রেখে দেন লাগবে না আমার!”
আহাদ কথাটা বলে গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।তৃধা নাক ফুলিয়ে বললো,
-“কি ত্যা*ড়া রে বাবা!একটা কথা বলারও সুযোগ দেয় না।”
তৃধা কথাটা বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।তার রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।তার আজ ভীষণ মন খারাপ লাগছে।এতোদিন যাও একটু আশা ছিল সবটা জানলে হয়তো আহাদ তাকে আর ফিরিয়ে দিবে না কিন্তু সবটা জেনেও আহাদ তাকে ফিরিয়ে দিল!এখন সে কি করবে!চোখ বন্ধ করতে তার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।তোহা তৃধার রুমে এসে দেখলো তৃধা বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।তোহা এসে তৃধার পাশে বসে দেখলো তৃধার চোখে পানি!তোহা তড়িঘড়ি করে বললো,
-“কি রে আপু কি হয়েছে তোর?কান্না করছিস কেনো?”
তৃধা চোখ খুলে তাকিয়ে দেখলো তোহা বসে আছে তার পাশে।তৃধা উঠে বসে বললো,
-“আহাদ আজকে সবটা শুনেও আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে রে!”
তোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“মানে?”
তারপর তৃধা সবটা তোহাকে বললো।সবটা শুনে তোহা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“আপু’ আহাদ ভাইয়া যখন তুই সবটা বলার পরেও তোকে ফিরিয়ে দিয়েছে তাহলে আমার মনে হয় তোর উনাকে ভুলে যাওয়া উচিত!”
তৃধা কিছুক্ষণ তোহার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আমি যে বিরহডোরে বাঁধিয়াছি তারে
তাহারে ভুলিবার সাধ্য যে মোর নাই।
তাকে না পাইবার ক্ষত;
সে যে এক বিষধর বিষাদ হইয়া রইয়া যাবে!”
তৃধা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে কেঁদে দিল।তোহা তৃধাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“কাঁদিস না আপু।এতো বছর যখন ধৈর্য্য ধরেছিস আরেকটু ধর।”
তৃধা আর কিছু না বলে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগলো।তোহা তৃধার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
–
–
–
রাতে বিছানায় শুয়ে তৃধার বলা কথাগুলো ভাবছে আহাদ।
-“একটা কসম আমাদের সুন্দর সম্পর্কটাকে এভাবে শেষ করে দিল!যাইহোক এতোগুলো বছর যখন তোমাকে ছাড়া থাকতে পেরেছি বাকি জীবনও পারবো।কিন্তু আমি আর তোমাকে আমার জীবনে চাই না তৃধা।একবার যখন ছেড়ে যেতে পেরেছো আবারও পারবে তাই আমি আর তোমাকে গ্রহণ করবো না!”
কথাগুলো বলে চোখ বন্ধ করলো আহাদ।
_______
-“আজকে তো ছুটির দিন।আজই আমি আহাদকে নিয়ে তৃধাদের বাড়িতে যাবো।যা করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে।”
আয়েশা বেগমের কথা শুনে রফিকুল সাহেব বললেন,
-“তোমার ছেলে যেতে রাজি হবে?”
-“দরকার হলে জোর করে নিয়ে যাব।আমি ওর মা আমার ওর উপর একটা অধিকার তো আছেই।”
-“দেখো তোমার ছেলে সেই অধিকার মানে নাকি!”
আহাদ ফ্রেশ হয়ে নিচে এসে ডাইনিং টেবিলে বসে বলল,
-“এত বেজে গেছে আমাকে ডাকলে না কেন আম্মু?”
আয়েশা বেগম সকালের নাস্তা এনে আহাদের সামনে রেখে বলল,
-“আজ তো ছুটির দিন তাই ডাকিনি!আর শোন আজকে সন্ধ্যায় আমি তোর জন্য মেয়ে দেখতে যাব আর তুই আমার সাথে যাবি!”
আহাদ নাস্তা খেতে গিয়ে থেমে গেল।চোয়াল শক্ত করে বলল,
-“আম্মু তুমি আবার শুরু করলে!আমি কিন্তু তোমাকে নিষেধ করেছি।”
-“দেখ তোর বয়স কম হয়নি।যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে ওইসব এখন বাদ দে।আমি যা বললাম তাই হবে।আমি আর কোন কথা শুনতে চাই না।”
আয়েশা বেগুন কথাগুলো বলে নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।দূরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল রফিকুল সাহেব আর রুহি!রফিকুল সাহেব মৃদু হেসে রুমের দিকে চলে গেলেন।আহাদ নাস্তা না করে উঠে যেতে গেলে রুহি সেখানে গিয়ে বলল,
-“ভাইয়া যাই করিস খাবারের উপর রাগ করিস না।এটা কিন্তু ঠিক না।তুই এখন না খেয়ে উঠে গেলে এই খাবারগুলো নষ্ট হবে।আর এগুলো ফেলে দিতে হবে।কত মানুষ খেতে পায় না আর তুই এভাবে খাবার নষ্ট করবি!”
রুহির কথাগুলো শুনে আহাদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নাস্তা খেতে বসলো।নাস্তা খেতে খেতে বলল,
-“ভালোই তো কথা শিখেছিস তা আম্মুকে একটু বুঝাতে পারছিস না যে আমার বিয়ে নিয়ে জানি মাতামাতি না করে!”
-“না বোঝাতে পারতেছি না কারণ আমার ভাবি চাই।”
আহাদ চোখ রাঙিয়ে রুহির দিকে তাকালো।সে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে গেল।আহাদ বিড়বিড় করে বলল,
-“এই পুরো বাড়ি আমার শত্রু!”
আহাদ সকালের নাস্তা শেষ করে নিজের রুমে চলে গেল।রুমে গিয়ে মুহিতকে কল করলো।
-“আম্মু আমাকে নিয়ে বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে আজকে।কি করবো বল!”
-“কার বিয়ে?আন্টি কি কোনো ভাবে আঙ্কেলের আবার বিয়ে দিবেন নাকি?”
-“তোরে ধরে কানের নিচে তিন-চারটা দেওয়া উচিত।আমার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবে।”
-“তা ভালো তো!বিয়ে করে ফেল ভাই।কত দিন হলো কারো বিয়ে খাই না।”
-“মজা করতেছিস তুই?সব জেনে এসব বলতেছিস কেনো!”
-“বা রে!তুই তো তৃধাকেও চাস না আর তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কি!আর শোন মেয়ে দেখলে বিয়ে হয়ে যায় না।তাই মেয়ে দেখে আয় পরে কি করবি ভাবিস।”
আহাদ আর কিছু না বলে কলটা কেটে দিল।তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“আসলেই তো মেয়ে দেখলেই তো বিয়ে হয়ে যাবে না।তাই মেয়ে না হয় দেখেই আসি।নাহলে আম্মু যা শুরু করবে নে!আজকে তো মনে হলো পুরো দিনের মতো রুদ্রমূর্তি ভাব চলে এসেছে আবার।”
-“আরে ওটাই তো বললাম।শোন আমাকে নিয়ে চল না!আহাদ ভাইয়ার সাথে সাথে আমি আমার রিশতাটাও পাক্কা করে আসি।”
রুহি কিছুক্ষণ আদির দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
-“তুই পুরা আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে গেছিস।আচ্ছা সন্ধ্যার সময় রেডি হয়ে চলে আসিস তারপরে আমাদের সাথে যাস।”
-“ওকে।”
রুহি আদিদের বাড়ি থেকে চলে আসতে যাবে এমন সময় এশা বললো,
-“কই যাবি রে তোরা?”
-“ওই তো ভাইয়ার বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে যাবো।”
কথাটা শুনে বেশ কষ্ট পেল এশা।সে নিজেকে সামলে বললো,
-“আহাদ বিয়ে করতে রাজি হয়েছে?”
-“ওই আম্মু জোর করে নিয়ে যাচ্ছে।আচ্ছা আপু যাই এখন আমার আবার অনেক কাজ বাকি আছে!”
এশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল।রুহি চলে গেল।আদিও তার নিজের রুমের দিকে চলে গেল।এশার চোখের কোণে পানি জমেছে।সে তা মুছে নিয়ে বললো,
-“আমার এই কপালে মনে হয় তোর নামটা লেখা নেই আহাদ।আমার এই এক তরফা ভালোবাসা হয়তো কখনোই পূর্ণতা পাবে না।তবে যাইহোক আমি সবসময় চাই তুই যেন সুখে থাকিস!আর সারাজীবন এটাই চাইবো।”
কথাগুলো বলে এশা মলিন হাসি দিল।
___________
সন্ধ্যা বেলা আদি রেডি হয়ে এসে হাজির।আদিকে দেখে আহাদ বললো,
-“তুইও যাবি নাকি?”
আদি কিছু বলার আগে রুহি বললো,
-“হ্যাঁ ভাইয়া কারণ ও হবু ভাবিকে দেখার জন্য খুব এক্সাইটেড!”
আহাদ চোখ রাঙিয়ে রুহির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এইসব ভাবি ভাবি করা বন্ধ কর।”
রুহি চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-“করবো না।”
আহাদ কিছু বলতে যাবে তার আগে আয়েশা বেগম বললেন,
-“চুপ কর তোরা।আর চল এখন রওয়ানা দেই।”
সবাই এক সাথে রওয়ানা দিল।ড্রাইভার তৃধাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে আহাদ অবাকের চরম পর্যায় চলে গেল।সে চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“অবিয়াসলি!আগে যতবার আপনাকে দেখেছি আমার এটা বলতে মন চাইতো পরে ভাবতাম না থাক বেচারি কষ্ট পাবে তাই আর বলতাম না।”
-“আমারো আপনাকে দেখলেই মন চাইতো কঙ্কাল বলে ডাক দেই কিন্তু পরে বেচারা কষ্ট পাবে তাই ভেবে আর ডাকতাম না।”
অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও মুহিত না আসায় আহাদ দরজার দিকে এগিয়ে যেতে দেখতে পেল মুহিত একটা মেয়ের সাথে ঝগড়া করছে।তবে মেয়েটাকে চিনতে আহাদের সময় লাগলো না কারণ তাকে সে তৃধার সাথে অনেকবার দেখেছে।তৃধার বেস্টফ্রেন্ড সৃজা!সৃজার পাশে তাকাতে সে দেখলো তৃধা দাঁড়িয়ে আছে।তবে মুহিত আর সৃজার মাঝে কি নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি চলছে তৃধা অনেক চেষ্টা করেও তাদের থামাতে পারছে না।আহাদ গিয়ে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“কি হয়েছে এখানে?”
মুহিত চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“সৃজা আমাকে কঙ্কাল বলতেছে।”
সৃজা চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“আর নিজে যে আমাকে কালির তারা বলেছেন তার বেলায়!”
তৃধা পাশে থেকে বললো,
-“আহাদ তুমি একটু বুঝাও আমি অনেক চেষ্টা করেও থামাতে পারছি না।”
-“আপনার আমাকে তা বলা লাগবে না।আর মুহিত চল এখান থেকে যা হওয়ার হয়ে গেছে।”
মুহিত কিছু বলতে গেলে আহাদ বললো,
-“আজকের মতো ভেবে নে ঝগড়ার ঝুড়ি শেষ!পরে দেখা হলে আবার করে নিস।”
মুহিত আর কিছু না বলে আহাদের সাথে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।আহাদ একবার তৃধার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে ফেলল।তৃধা মুচকি হেসে বললো,
-“এখনো আগের মতো মজার কথা জানে তাহলে!”
সৃজা চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“ওই কঙ্কালকে তো আমি ছাড়বো না আমাকে কালির তারা বলা!”
তৃধা সৃজার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“হয়েছে এবার ঠান্ডা হ।তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে হবে।পেসেন্টদের চেক-আপ করার টাইম হয়ে গেছে।”
দুজনে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে চলে গেল।তৃধাকে চলে যেতে দেখে আহাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
———————-
ক্লাস শেষ হলে রুহি আর তোহা ভার্সিটি থেকে বের হয়ে দেখল আদি দাঁড়িয়ে আছে।রুহি তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“কিরে তুই এখানে কি করছিস?এশা আপুকে তো নিতে আসিসনি কারণ নিশ্চয়ই জানিস এশা আপুর আরো ক্লাস নেওয়া বাকি আছে!তাহলে তোর এখানে কি কাজ?”
-“আরে আমি তো তোকে নিতে এসেছি রুহি।”
রুহি আস্তে করে আদিকে বললো,
-“আমাকে না কাকে নিতে এসেছিস ভালো করেই জানি আমি!”
আদি তোহার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো।রুহি হাসি দিয়ে বললো,
-“তোহা চল আমার খাসি ভাই আমাদের ড্রাইভারের দায়িত্ব পালন করছে তো!বেশিক্ষণ দাঁড়া করিয়ে রাখলে তার আবার কষ্ট হবে।”
-“রুহি এইসব বলে ডাকিস না কেমন দেখায়!”
আদি তোহার সাথে তাল মিলিয়ে বললো,
-“শিখ কিছু।সম্মান করতে তো জানিস না।আমি কিন্তু তোর এক মাসের বড় ভুলে যাস না!”
-“ইশ্ আসছে আমার এক মাসের বড়!আর তোহা শোন খাসিকে না খাসি বললেই মানায় অন্য কোনো ডাকে না।”
কথাটা বলে রুহি তোহাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো।আদিও গাড়িতে উঠে ড্রাইভ করা শুরু করলো।ড্রাইভ করছে আর লুকিং গ্লাস দিয়ে তোহাকে দেখছে।তোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“রুহি তোর এই ভাই আসার চক্করে আমরা কিন্তু এই দুইদিন ধরে একটুও ঘুরতে পারিনি।”
আদি হাসি দিয়ে বললো,
-“তুমি চাইলে আমরা এখন ঘুরতে পারি।”
তোহা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“না থাক।আমরা দুই বান্ধবী একসাথে ঘুরে যা মজা পাই তা আপনি থাকলে হবে না।”
আদি অভিমানের সুরে বললো,
-“আবার আপনি করে বলছো!”
রুহি পাশে থেকে বললো,
-“আদি ও-কে একটু টাইম দে ও ওমন মেয়ে না যে দুইদিনের পরিচয়ে তোকে তুমি তুমি করবে!”
আদি আর কথা না বাড়িয়ে ড্রাইভ করায় মন দিল।
_______________
তৃধা তার কেবিনে বসে ভাবছে,
-“আচ্ছা আহাদের হাতে তো ব্যান্ডেজ করা দেখলাম না।তার মানে ও ব্যান্ডেজ খুলে ফেলেছে।এই ছেলেকে নিয়ে তো আর পারা যায় না!আমার উপর রাগ ঠিক আছে।তাই বলে ব্যান্ডেজটাও খুলে ফেলতে হবে!”
তৃধা তার হাত জোড়া কপালে ঠেকিয়ে বললো,
-“কিভাবে যে সবটা আবার ঠিক হবে কে জানে!ও তো আমার সাথে দেখাই করতে চায় না সেখানে কথা বলা তো দূরে থাক। ”
_____
-“রুহির থেকে আমি সবটা শুনেছি।আমি আসলে কিছুই জানতাম না এই বিষয়ে।”
-“মেয়েটা একদম শেষ হয়ে যাচ্ছে রে ভিতরে ভিতরে।আমি তো মা সব বুঝি!”
-“তুই চিন্তা করিস না আমি যখন একবার সিদ্ধান্ত নিয়েছি তৃধার সাথে আহাদের বিয়ে হবে আর তাই হবে!আমার কিছু কাজ আছে এখন কলটা কাটলাম ভালো থাকিস।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আয়েশা বেগম কলটা কেটে দিলেন।আয়েশা বেগম রান্নাঘরে কাজ করছেন রফিকুল সাহেব এসে বললেন,
-“সবটাই শুনলাম তুমি যা বলছিলে!তবে কি করে তুমি বিয়েটা দিবে?তোমার ছেলেকে চিনো না?একরোখা,অভ*দ্র ছেলে কোথাকার!”
-“দেখো ও তো আগে এমন ছিল না।তৃধার সাথে সম্পর্কটা ভেঙে যাওয়ার পরেই তো এমন হয়ে গিয়েছে।”
-“তুমি নিজের ছেলের সাইড নিও না তো!সবটাই তো বললে আমাকে তৃধা তো ওর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে অনেক তোমার ছেলেই তো শুনতে চায়নি একবার।শুনলে কি হবে?একবার শুনলেই তো সবটা ঠিক হয়ে যায়।”
আয়েশা বেগম আর কিছু না বলে চুপ করে রইলেন।রফিকুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমের দিকে চলে গেলেন।
—————-
আগের দিন আহাদের সাথে যেখানে দেখা হয়েছিল তৃধা সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ করে সে দেখলো আহাদের গাড়ি ওদিকে আসছে। তৃধার মুখে হাসি উঠলো।সে হাত নাড়িয়ে গাড়ি থামাতে ইশারা করলো।আহাদ দূর থেকে দেখলো একটা মেয়ে হাত নেড়ে ইশারা করছে গাড়ি থামাতে।কিছুটা কাছে যেতে সে দেখলো মেয়েটা আর কেউ না তৃধা।আহাদ চোয়াল শক্ত করে গাড়ি না থামিয়ে স্পিড বাড়িয়ে চালাতে শুরু করলো।তৃধা বুঝতে পেরেছে আহাদ গাড়ি থামাবে না সে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়ালো।তৃধার এহেন কাজে আহাদ জোরসে ব্রেক কষলো!তৃধার একটু সামনে গিয়ে গাড়ি থামলো।তৃধা চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে!
আহাদ গাড়ি থেকে নেমে তৃধার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার হাত চেপে ধরে বললো,
তৃধা চোখ খুলে তাকালো।আহাদ রাগান্বিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।যা দেখে তৃধা হাসি দিয়ে বললো,
-“যাক আমার প্রতি এতো চিন্তা দেখে ভালোই লাগছে।”
আহাদ তৃধার হাত ছেড়ে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বললো,
-“আপনার প্রতি আমার কোনো চিন্তা নেই!আমার কারণে কোনো মানুষের কোনো প্রকার ক্ষতি হোক আমি তা চাই না।”
কথাগুলো বলে আহাদ চলে যেতে গেলে তৃধা তার হাত টেনে ধরে বললো,
-“প্লিজ আহাদ আজ অন্তত আমার কথাগুলো শুনে যাও।”
আহাদ তৃধার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,
-“আপনার কোনো কথা শোনার আমার ইচ্ছা নেই।
-“কিন্তু আজ তোমাকে শুনতেই হবে!”
-“না আমি শুনবো নাহ্!”
-“প্লিজ আহাদ একবার শুনো আর জোর করবো না।”
তৃধার মলিন মুখ দেখে আহাদের কিছুটা খারাপ লাগলো।সে বললো,
-“আচ্ছা বলুন কি বলবেন!”
-“চলো ওইদিকের বেঞ্চে গিয়ে বসি।”
আহাদ তৃধার সাথে গিয়ে বেঞ্চে বসলো।তবে সে বেশ দূরত্ব রেখে বসেছে!তৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“আহাদ আমি সেদিন তোমার থেকে নিজের ইচ্ছায় বিচ্ছেদ চাইনি।”
-“আমি এই বিষয়ে কোনো কথা শুনতে চাই না।”
আহাদ উঠে চলে যেতে গেলে তৃধা বললো,
-“প্লিজ আহাদ সবটা শুনে যাও।নাহলে যে আমি ম*রেও শান্তি পাবো না।”
তৃধার এহেন কথায় আহাদের বেশ কষ্ট লাগলো যা তার চোখে ফুটে উঠেছে।তৃধা ভালো করেই বুঝতে পারলো আহাদ তার এই কথায় কষ্ট পেয়েছে।আগে কখনোই আহাদ তৃধার ম*রে যাওয়ার কথা শুনতে পারতো না।আহাদ আবার শান্ত হয়ে বসলো।তৃধা বলতে শুরু করলো,
-“বাবার মনে হয়েছিল আমাদের রিলেশনের জন্য আমার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে এর জন্য বাবা আমায় উনার মাথার কসম কাটিয়েছিল আমি যেন তোমার সাথে সম্পর্কটা শেষ করে ফেলি।আমার কাছে কোনো উপায়ও ছিল না।যতই হোক বাবা কসম কাটিয়েছে তা তো মানতেই হবে!কিন্তু জানো বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।আমি তো কসম মেনেছিলাম তাও কেন বাবা চলে গেল!আমার জীবনের দুইজন ভালোবাসার পুরুষকেই হারিয়ে ফেললাম আমি।”
তৃধার চোখে পানি!তৃধার বাবার মৃত্যুর কথা শুনে আহাদের বেশ খারাপ লাগলো আবার রাগও উঠলো।একটা কসমের কারণে সবটা শেষ হয়ে গেল!আহাদ নিজেকে সামলায় বললো,
-“আপনি আমাকে এগুলো আগেই বলতে পারতেন।তাহলে আমি নিজেই আপনার জীবন থেকে সরে যেতাম।এতোগুলো বছর নষ্ট হতো না।আর শুনুন যে একবার ছেড়ে যায় সে আবারও ছেড়ে যেতে পারে।তাই আমাদের সম্পর্কের ইতিই ঠিক আছে;নতুন সূচনা এখানে অর্থহীন!”
আহাদ সেখান থেকে উঠে চলে গেল।তৃধা আর কিছু বলতে পারলো না।তার চোখ দিকে একভাবে পানি পড়ছে।সে ভেবেছিল হয়তো আহাদ সবটা শুনে তাকে আর ফিরিয়ে দিবে না।কিন্তু আহাদ তাকে প্রত্যাখ্যান করলো!
-“আরে তা তো ভালো খবর।ভালোই করেছিস তাড়াতাড়ি চলে এসেছিস তোকে ছাড়া একা লাগছিল ভাই!”
-“আজকে সারাদিন কি বিজি আছিস নাকি?”
-“না আজকে আমার তেমন কোনো কাজ নেই।তুই এক কাজ কর অফিসে চলে আয়।”
মুহিত হাসি দিয়ে বললো,
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
মুহিত কলটা কেটে দিল।আহাদ বিছানা থেকে উঠে ফ্রেশ হতে গেল।ফ্রেশ হয়ে এসে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হতে গিয়ে চোখ পড়লো হাতের ব্যান্ডেজের দিকে।তৃধা কত যত্ন করে তার হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল।সেই আগের মতো কেয়ার!আহাদ কোনো আঘাত পেলে যেন তৃধাও আঘাত পেতো।আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল আহাদের।ক্লাস টেনে থাকতে তাদের প্রেম শুরু হয়।তৃধা পড়তো গার্লস স্কুলে আর আহাদ বয়েজ স্কুলে!তবে দুটো স্কুল পাশাপাশিই ছিল।আহাদ প্রায় প্রতিদিন লুকিয়ে লুকিয়ে তৃধাকে দেখতো।একদিন তৃধার কাছে ধরা পড়ে গেলে তৃধা তাকে ডেকে বললো,
-“এই তুমি প্রতিদিন আমাকে ফলো করো কেন?”
আহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের মনে সাহস সঞ্চয় করে বললো,
-“আমার তোমাকে ভালো লাগে।”
কথাটা বলেই আহাদ চোখ বন্ধ করে ফেললো।সে ভেবেছিল তৃধা হয়তো এই কথা শোনা মাত্রই থা*প্পড় মারবে।কিন্তু অনেকক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখার পরেও যখন গালে থা*প্পড় পড়লো না তখন আহাদ প্রথম এক চোখ খুলে দেখলো তৃধা তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।আহাদ তারপরে তার দুচোখ খুলে হালকা কেশে বললো,
-“কিছু বলবে না?”
তৃধা আহাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বললো,
-“আমার কিন্তু তোমাকে মন্দ লাগে না।”
কথাটা বলে সে সেখানে এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে বান্ধবীদের সাথে হাসতে হাসতে চলে গেল।আহাদের মুখে হাসি ফুটলো।এভাবেই তাদের প্রেম শুরু হলো।খুব সুন্দর কাটছিল দিনগুলো,মাসগুলো,বছরগুলো!তবে মেডিকেল ভর্তি হওয়ার পরে তৃধা পাল্টে।আহাদকে ইগনোর করতে শুরু করলো আর একদিন তো বিচ্ছেদই চেয়ে বসে।আহাদ কত কান্না করেছিল তৃধার হাত জোড়া ধরে কিন্তু সে তার সিদ্ধান্তে অটুট ছিল।চলে গেল আহাদের হাত ছেড়ে!
বর্তমানে,
আহাদের চোখের কোণে পানি জমেছে।সে তা মুছে ফেলল।এক টান দিয়ে হাতের ব্যান্ডেজ খুলে বললো,
-“না!এইসব ড্রামাতে আমি আর বিশ্বাস করবো না।তোমাকে তো কোনো ভাবেই না আর তোমার করা ব্যান্ডেজও আমার সঙ্গে থাকবে না।আই হেট ইউ তৃধা।আমি তোমাকে কখনো ক্ষমা করবো না!”
কথাগুলো বলে রাগে কাঁপছে আহাদ।সে অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রুম থেকে বের হয়ে সোজা অফিসে চলে গেল।আয়েশা বেগম আহাদের যাওয়া দেখে বললেন,
-“আজকেও না খেয়ে চলে গেল।”
রফিকুল সাহেব বললেন,
-“যা মন চায় তাই করে কারো কথা শোনার প্রয়োজন বোধ করে না।”
_____________
তৃধা পেসেন্টদের দেখে রুমে এসে বসতে সেখানে এসে হাজির হলো সৃজা।সৃজাকে দেখে তৃধার মুখে হাসি ফুটলো।সৃজা এসে তৃধাকে জড়িয়ে ধরলো।তৃধাও সৃজাকে জড়িয়ে ধরলো।তৃধা হাসি দিয়ে বললো,
-“যাক সৃজু ম্যাডাম তাহলে ছুটি শেষ করে ফিরলো।”
-“একদম রে।বাড়ির সবার সাথে অনেক হৈ-হুল্লোড় করে কাটিয়েছি এই কয়দিন।তবে তোকেও মিস করেছি।যতই হোক তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড বলে কথা।”
-“আমিও তোকে মিস করেছি অনেক।তবে তোর জন্য একটা সুখবর আছে।আমি কলে বলবো ভেবেছিলাম পরে ভাবলাম না থাক সামনাসামনি বরং বলবো!”
-“কি সুখবর রে?”
-“আহাদ ইজ ব্যাক।আহাদ ফিরে এসেছে মানে তোর জিজু ফিরে এসেছে।”
সৃজা এক্সাইটেড হয়ে বললো,
-“কি বলিস?তা তোদের কথা হয়েছে?সবটা ঠিক হয়েছে দুজনের?”
-“চিন্তা করিস না সবটা ঠিক হয়ে যাবে।আর ও-কে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব সবটা জানিয়ে দে কেন ওমনটা করেছিলি!”
-“হুম রে ঠিক বলেছিস।আহাদকে সবটা জানাতে হবে।”
———————
রুহি আর তোহা ভার্সিটির ক্যাম্পাসে বসে গল্প করছে।এমন সময় জয়ের আগমন ঘটলো।জয়কে দেখেই রুহির মেজাজটা বিগড়ে গেল।অবশ্য মেজাজ বিগড়ানো স্বাভাবিক!তিন বছর ধরে যদি এক কথায় সে আটকে থাকে মেজাজ তো বিগড়াবেই।জয় এসে রুহির সামনে দাঁড়াতে রুহি চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“কি আজকেও কি ওইটুকু বলতে এসেছিস?”
জয় শুকনো ঢোক গিলে বললো,
-“দেখ রুহি আমি অনেক সাহস নিয়ে তোর সামনে এসে দাঁড়াই পুরো কথাটা বলার জন্য।কিন্তু তোর এই ভয়ংকর দৃষ্টি দেখলেই তো আমার ব্লাড প্রেশার বেড়ে যায়।পুরো কথা আর বলা হয় না।”
জয়ে কথা শুনে তোহা হেসে দিল।রুহি চোখ ছোট ছোট করে বললো,
-“ওহ্ আচ্ছা এখন দোষ আমার!তিন বছর ধরে তুই ওটুকুতে আটকে আছিস তোর দিকে ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে না তাকিয়ে কি ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাবো?”
জয় মুচকি হেসে বললো,
-“তাকাতেই পারিস আমি কিছু মনে করবো না।”
রুহি বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“ওয়েট তোর দিকে ভালোবাসার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি!”
এই বলে রুহি যেই জয়কে মা*রতে যাবে সে দৌড় দিকে ক্লাসের দিকে চলে গেল।জয়ের কান্ডে দেখে তোহা হাসতে হাসতে শেষ।রুহিও তার সাথে হেসে দিল।হাসি থামিয়ে তোহা বললো,
-“রুহি ও তো ভয়ে বলতে পারে না তুই বলে দিলেই পারিস।”
-“তা বল তোর কি খবর?এতোবছর পরে দেশে এসে কেমন লাগছে?”
-“ভালো লাগছে না।যার জন্য দেশ ছেড়ে চলে গেছিলাম দেশে ফিরতে না ফিরতেই তার সাথে কোনো না কোনো ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছি!”
মুহিত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তোর কি তৃধার সাথে দেখা হয়েছে নাকি?”
আহাদ সব ঘটনা মুহিতকে বললো।সবটা শুনে মুহিত বললো,
-“তা তো ভালোই আন্টি তোর জন্য তৃধাকেই পছন্দ করলো শেষমেশ!তবে আহাদ’ তৃধা যখন এখন এইসব করছে মেনে নে ও-কে।অনেক বছর তো হলো।”
আহাদ চোখ রাঙিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যা বলেছিস বলেছিস!এই কথা যেন আমি আর না শুনি।”
মুহিত নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“আচ্ছা কুল কুল!চল দুজনে গিয়ে কোথাও থেকে কফি খেয়ে আসি।”
-“কোথাও যেতে হবে কেন!অফিসেই তো সব আছে।”
-“আরে না ওই রেস্টুরেন্টে চল যেখানে আমরা স্কুল-কলেজে পড়াকালীন গিয়ে আড্ডা দিতাম!”
আহাদ মৃদু হেসে বললো,
-“আচ্ছা চল।”
________________
-“এই রেস্টুরেন্টে আসলে একটা আলাদা শান্তি লাগে তাই না তৃধা?”
-“হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস কত স্মৃতিময় জায়গা!”
-“হ্যাঁ তোর আর আহাদ জিজুর প্রেমের স্বাক্ষী!”
সৃজার কথা শুনে তৃধা মৃদু হাসলো।রেস্টুরেন্টের দরজার দিকে সৃজার চোখ যেতে সে বললো,
-“ওই দেখ আহাদ জিজু একটা লোকের সাথে এসেছে।”
তৃধা দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো আহাদ আর একটা লোক।তৃধা ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-“লোকটাকে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে!”
সৃজা ভাবান্নিত ভঙ্গিতে বললো,
-“আমারও রে।আচ্ছা ওয়েট আমি একটু কুশল বিনিময় করে আসি আহাদ জিজুর সাথে।”
তৃধা সৃজাকে বাঁধা দিয়ে বললো,
-“দরকার নেই।দেখে মনে হচ্ছে মনমেজাজ ভালো আছে।আমাকে দেখলেই আবার তা বিগড়ে যাবে!”
-“কিন্তু……..”
-“কোনো কিন্তু না চুপচাপ কফি খা।”
আহাদ আর মুহিত গিয়ে এক পাশে বসলো।তবে তারা দুজনের কেউ তৃধাকে দেখেনি।খাবার অর্ডার দিয়ে মুহিত বললো,
-“এই যা আমি তো আমার মোবাইলটা গাড়িতে ফেলে এসেছি।আচ্ছা তুই বস আমি মোবাইলটা নিয়ে আসি।”
-“আচ্ছা যা।”
মুহিত মোবাইল আনতে চলে গেল।তৃধা আর সৃজা বিল দিয়ে চলে যেতে গেলে সৃজা গিয়ে মুহিতের সাথে ধাক্কা খেল।সৃজা পড়ে যাওয়ার আগেই মুহিত তাকে ধরে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগে সৃজা বললো,
-“এই দেখে চলতে পারেন না?চোখ কি পকেটে নিয়ে ঘুরেন নাকি?”
-“আপনি নিজেই তো ইঁদুরের মতো ছোটাছুটি করে বের হচ্ছিলেন আমার কি দোষ!”
সৃজা কিছু বলতে যাবে তার আগে তৃধা বললো,
-“আচ্ছা বাদ দে না সৃজা।উনি ইচ্ছে করে ধাক্কা দেননি।”
তৃধাকে দেখে মুহিতের মুখে হাসি ফুটলো।
-“আরে তৃধা তুমি!কেমন আছো?”
মুহিতের কথা শুনে তৃধা অবাক হয়ে বললো,
-“জ্বি ভালো আছি।তবে আপনাকে তো ঠিক চিনতে পারলাম না।”
-“আরে আমি মুহিত।আহাদের বেস্টফ্রেন্ড!”
তৃধা হাসি দিয়ে বললো,
-“মুহিত!আমার তোমাকে চেনা চেনা লাগছিল কিন্তু বুঝতে পারিনি।”
সৃজা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি এই সেই কঙ্কাল মুহিত?একে তো চেনার কোনো উপায়ই নেই।কি থেকে কি হয়ে গেছে!”
মুহিত চোখ রাঙিয়ে সৃজার দিকে তাকালো।পরক্ষণেই হাসি দিয়ে বললো,
-“আমিও তো আপনাকে চিনতেই পারিনি নেহাৎ তৃধা নাম ধরে ডাকলো!তবে আমিও বুঝতে পারলাম না কালির তারা থেকে এমন রূপবতী হলেন কি করে!কোন ব্রান্ডের নাইট ক্রিম মেখেছেন নামটা জানিয়েন তো।”
-“কি বলিস!তৃধা আপু’ ভাইয়ার এক্স?ভাইয়া কি রাজি হবে?”
-“এটাই তো চিন্তার!”
রুহি কথাটা বলে মুখটা মলিন করে ফেললো।
————————
তৃধা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে কোনো রিক্সা না পেয়ে হাঁটতে শুরু করলো।আজকে বেশ রাত হয়ে গেছে!বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তা-ঘাটে তেমন মানুষও নেই!হঠাৎ করে কয়েকটা বখাটে টাইপ ছেলে এসে তাকে বিরক্ত করতে লাগলো।
-“কি হলো সুন্দরী একা একা কোথায় যাচ্ছো?আমাদেরও সঙ্গী করো!”
তৃধা চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“দেখুন রাস্তা থেকে সরে যান।”
আহাদ অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে দেখলো তৃধাকে কিছু ছেলে ঘিরে রেখেছে।যা দেখে সে গাড়ি থামালো।সে গাড়ি থেকে নেমে সেদিকে যেতে গেলে দেখলো তৃধা একটা ছেলের গালে চ*ড় মেরেছে।ওই ছেলেটা তৃধার দিকে তেড়ে আসতে গেলে আহাদ গিয়ে তৃধার সামনে দাঁড়ালো।ছেলেটা আহাদকে দেখে বললো,
-“কে রে তুই?সরে যা সামনে থেকে।এই মেয়ের তো আজকে খবর আছে আমার গায়ে হাত দেওয়া!”
ছেলেটা কথাগুলো বলে আবার তৃধার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে আহাদ তার পেট বরাবর একটা লাথি দিল।যার ফলে সে রাস্তায় পড়ে গেল। আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“আমি থাকতে ওর গায়ে তোরা একটা টোকাও দিতে পারবি না!”
কথাটা বলে সে সবগুলো ছেলেকে ইচ্ছা মতো পিটালো।সবগুলো ছেলে দৌড়ে পালিয়ে গেল।আহাদ তাদের পিছনে যেতে গেলে তৃধা তার হাত ধরে তাকে আটকালো।তৃধা বুঝতে পেরেছে আহাদ অনেক রেগে গেছে।আহাদ নিজেকে শান্ত করে খেয়াল করলো তৃধা তার হাত ধরে আছে।আহাদ এক ঝটকা দিয়ে তৃধার থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে ফেললো।চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“আমার হাত ধরার কোনো অধিকার আপনার নেই।”
তৃধা কিছু বলতে যাবে এমন সময় সে দেখলো আহাদের হাত থেকে র*ক্ত পড়ছে।তৃধা ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,
-“আরে হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে।ওয়েট আমি এখনি ব্যান্ডেজ করে দিচ্ছি।”
সে তার ব্যাগ থেকে ফাস্টএইড বক্স বের করে আহাদের হাতটা ধরলো।আহাদ হাতটা ছাড়াতে গেলে তৃধা বললো,
-“স্টপ আহাদ!বাচ্চামো বাদ দেও।”
তৃধা এক প্রকার জোর করেই আহাদের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল।আহাদ ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলতে গেলে তৃধা আহাদের হাত চেপে ধরে বললো,
-“আমার উপর রাগ দেখিয়ে নিজের ক্ষতি করো না!”
-“আমাকে ‘তুমি’ করে সম্বোধন করা বন্ধ করুন।আর আমার জীবনের যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে আর কিছু বাদ নেই।”
তৃধা মুচকি হেসে বললো,
-“আমি তো তুমি করেই বলবো।এটা আটকানোর ক্ষমতা তোমার নেই।আর সমস্যা নেই যা ক্ষতি হয়েছে পুষিয়ে নিবো চিন্তা করো না।”
-“বিরক্তিকর!”
আহাদ কথাটা বলে চলে যেতে গিয়ে থেমে গেল।তৃধার সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললো,
-“যাবেন কিভাবে আপনি?”
-“রিক্সা তো পাচ্ছি না।হেঁটেই চলে যাবো।”
-“ক্যাব বুক করে নিলে তো হতো।”
-“পাইনি!”
-“ওয়েট আমি চেক করে দেখছি।”
সে মোবাইল বের করে চেক করা শুরু করলো।তৃধা মনে মনে বললো,
-“এতো বড় একটা গাড়ি থাকতে নাকি আবার ক্যাব বুক করে দেওয়া লাগে!”
আহাদ চেক করে বললো,
-“কার তো পেলাম না কিন্তু বাইক আছে।”
“ওকে বাইক বুক করে দেও তাহলে।রাইডারের পিছনে বসে বাড়িতে যাবো।”
আহাদ চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“থাক কোনো দরকার নেই।গাড়িতে উঠে বসুন আমি পৌঁছে দিচ্ছি।”
আহাদ গাড়িতে গিয়ে বসলো।তৃধা হাসি দিয়ে গাড়িতে উঠে বসলো।আহাদ ড্রাইভ করা শুরু করলো।
-“দেখুন বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি বলে এটা ভেবেন না যে আপনার প্রতি আমার এখনো ভালোবাসা আছে।কিছুই নেই!জাস্ট সহানুভূতি দেখাচ্ছি!”
তৃধা কিছুক্ষণ আহাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
-“তুমি যদি সত্যি সহানুভূতি দেখাতে তাহলে বাইকই বুক করে দিতে আহাদ!আমি ভালো করেই জানি তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো!”
আহাদ তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-“আপনার এইসব ভাবনা নিজের কাছেই রাখুন।এইসব প্রকাশ করে মানুষকে বিরক্ত করবেন না।”
তৃধা আর কিছু না বলে মৃদু হাসলো।আহাদ তৃধাদের বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো।তৃধা আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমাদের বাড়ি কোথায় তা মনে আছে এখনো?”
-“কিছু জিনিস ভুলা অসম্ভব!বাই দ্যা ওয়ে গাড়ি থেকে নামুন আমার বাড়ি যেতে হবে।”
তৃধা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“ব্যবহার তো দেখছি যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে!”
আহাদ’ তৃধার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনি ভালো ব্যবহার পাওয়ার যোগ্য না।”
আহাদের কথায় কষ্ট পেলেও তৃধা নিজেকে সামলে বললো,
-“বাড়িতে চলো!”
-“কোনো ইচ্ছে নেই।গাড়ি থেকে নেমে যান প্লিজ।”
তৃধা আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো।তৃধা গাড়ি থেকে নামতে আহাদ বললো,
-“ওইসব রাস্তা দিয়ে একা একা আসা বাদ দেওয়া উচিত।”
তৃধাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আহাদ গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।তৃধা হাসি দিয়ে বললো,
-“আমি আজ শিওর হয়ে গেলাম তুমি যে এখনো আমাকে ভালোবাসো!”
তৃধা বাড়ির ভিতরে চলে গেল।
—————————
সবাই মুভি দেখতে ব্যস্ত কিন্তু অয়নের চোখ এশাকে দেখতে ব্যস্ত!মুভির একেকটা সিনে এশা একেক রকম এক্সপ্রেশন দিচ্ছে যা দেখতে বেশ লাগছে অয়নের কাছে।মুভি শেষ হতে এশা বললো,
-“অয়ন মুভিটা কেমন লাগলো?অনেক সুন্দর না!”
অয়ন মনে মনে বললো,
-“আমি তো মুভি না তোকেই দেখতে ব্যস্ত ছিলাম।তোকে তো বেশ সুন্দরই লেগেছে কিন্তু তা তো বলা বারণ!”
অয়নকে চুপ থাকতে দেখে এশা বললো,
-“কিরে কিছু বলছিস না কেনো?”
-“হ্যাঁ সুন্দর ছিল!”
তারপরে অয়ন আর এশা তাদের বাকি কলিগদের সাথে রাতের খাবার খেল।সবাই যার যার মতো চলে যেতে শুরু করেছে।বাইরের আবহাওয়া তেমন ভালো না!এশা অয়নের কাছে গিয়ে বললো,
-“আচ্ছা থাক তাহলে আমি বাড়িতে গেলাম।”
-“চল দুজনে একসাথেই যাই।”
-“না তোর বাড়ি তো উল্টো দিকে।তুই যা আমি চলে যেতে পারবো!”
-“উল্টো দিকে তো কি হয়েছে?রাত ভালোই হয়েছে আমি তোকে একা ছেড়ে দিতে পারবো না এভাবে!”
এশা আর কথা বাড়ালো না।অয়ন গাড়ি নিয়ে এশাদের বাড়ির সামনে দাঁড়ালো।এশা গাড়ি থেকে নেমে বললো,
-“থ্যাংকস রে ভাই!আয় বাড়ি থেকে ঘুরে যা।”
এশার মুখে ভাই ডাক শুনে মেজাজটা বিগড়ে গেল অয়নের।তাও সে নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
-“আজকে না অন্য একদিন যাবো।”
-“আচ্ছা তাহলে সাবধানে যা।”
এশা কথাটা বলে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।অয়ন গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে বললো,
-“ওফ!একদিকে ভালোবাসা বুঝে না আবার ডাকে ভাই!মানে আমি মরে যাই না কেন!”
অয়ন তার বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো।বাড়ির ভিতরে যেতেই বৃষ্টি শুরু হলো।অয়ন হাসি দিয়ে বললো,
-“ওয়াও!পারফেক্ট টাইমিং।”
_________
আহাদ তার রুমের বিছানায় বসে ব্যান্ডেজ করা হাতটার দিকে তাকিয়ে আছে।
-“নিজের ইচ্ছায় সম্পর্কটা শেষ করে দিয়ে এখন এইসব মিথ্যা নাটক করার মানে কি তৃধা?দয়া করছো তুমি আমার প্রতি?হুম বুঝেছি দয়াই করছো।ভাবছো আমি তোমাকে ছাড়া কষ্টে ম*রে যাচ্ছি তাই এইসব করছো।আমি তোমাকে কখনোই ক্ষমা করবো না!”
কথাগুলো বলে আহাদ ধপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টায় মনোনিবেশ করলো!
_
_
_
বেলকনিতে বসে বৃষ্টি পড়া দেখছে তৃধা।বৃষ্টি দেখতে তার বেশ ভালোই লাগে।আহাদের সাথে যখন তার সম্পর্ক ছিল তারা একসাথে প্রায়ই বৃষ্টিতে ভিজতো।এইসব ভাবতেই তৃধার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।পরক্ষণেই আজ আহাদের তার প্রতি যত্নশীল ব্যবহার মনে পড়তেই তৃধার মুখে হাসি ফুটলো।
-“আমি জানতাম আহাদ তুমি যে আমাকে এখনো ভালোবাসো।শুধু আমার সেদিনের বিচ্ছেদ চাওয়াটাই তোমাকে আমার সাথে ওমন রুক্ষ ব্যবহার করতে বাধ্য করে!ভালোবাসার তুলনায় ঘৃণার পাহাড়টা একটু বেড়ে গেছে।কিন্তু আমি আবার আমার প্রতি তোমার আগের সেই ভালোবাসা ফিরিয়ে আনবো।তুমি আমার ছিলে আমারই হবে!আমি তোমাকে দ্বিতীয় বার আর হারাতে পারবো না।”
#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৩
___________________
আহাদ রুহির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তোর কি আমার এমন হওয়া নিয়ে খুব বেশি সমস্যা নাকি?”
-“শুধু খুব না!খুব খুব খুব বেশি সমস্যা।”
-“তা তুই এতো সমস্যা নিয়ে কিভাবে টিকে আছিস রুহি?”
এশা প্রশ্নটা করে আহাদের পাশে গিয়ে বসলো।আহাদ সেখানে এক সেকেন্ডও না বসে পাশের সোফায় গিয়ে বসলো।আহাদের এমন কাজে এশা বেশ লজ্জায় পড়লো।আহাদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললো,
-“এশা তুই ভালো করেই জানিস এমন গা ঘেঁষে বসা আমার পছন্দ না।তাই উঠে আসলাম!”
এশা ছলছল চোখে আহাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেকে সামলে বললো,
-“তুই আর পাল্টাবি না আহাদ!আমি ভেবেছিলাম বিদেশ থেকে ফিরে হয়তো এইসব অভ্যাস চলে যাবে তোর।”
আহাদ মৃদু হেসে বললো,
-“অভ্যাস পরিবর্তন করা এতো সহজ না।অভ্যাস পরিবর্তন করা যদি এতোই সহজ হতো তাহলে মানুষকে কখনো অভ্যাসের দাস বলা হতো না!”
এশা কিছু বলার আগের রবিউল সাহেব বললেন,
-“আহ্ এশা!আহাদ যা পছন্দ করে না তা তুই করিস না।আমি তোকে আগেও বারণ করেছি।”
এশা আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো।আদি পরিস্থিতি সামলাতে বললো,
-“আমি যখন ফাস্ট ইয়ারে তখনই!প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে!”
-“মানে তুই মেডিকেলে ভর্তি হওয়ার পরে বাবা এমনটা করেছিল?”
-“হুম!”
-“কি অদ্ভুত বিষয়!আহাদ ভাইয়ার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় তুই মেডিকেলে চান্স তো ঠিকই পেয়েছিস তাহলে কিভাবে তোর পড়াশোনায় ক্ষতি হচ্ছিল?”
তৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“থাক বাদ দে এইসব।”
-“আচ্ছা যা বাদ দিলাম।”
________________________
সকাল বেলা রাহেলা বেগম ব্রেকফাস্ট রেডি করে তৃধা আর তোহাকে দিলেন।তোহা তা বক্সে ভরে ব্যাগে নিয়ে বললো,
-“আম্মু আমি ভার্সিটিতে গিয়ে খেয়ে নিবো এখন খেতে মন চাচ্ছে না।গেলাম আমি টাটা!”
কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তোহা বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।রাহেলা বেগম রাগান্বিত হয়ে বললেন,
-“এই মেয়েটা দিন দিন বেশি বেড়ে গিয়েছে একদম!”
তৃধা সকালের নাস্তা খাওয়া শেষ করে বললো,
-“আচ্ছা আম্মু আমিও যাই আমার আবার আজকে আইসিইউ-র কিছু পেসেন্টকে চেক-আপ করতে হবে।বেশি লেট হয়ে গেলে সমস্যা!”
-“আচ্ছা যা।”
-“আর শোনো আম্মু তুমি কিন্তু তোহাকে বেশি বকাবকি করো না বাড়িতে আসলে।”
রাহেলা বেগম মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালেন।তৃধা মৃদু হেসে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।
ভার্সিটির ক্যাম্পাস দিয়ে হেঁটে ক্লাসের দিকে যাচ্ছে রুহি আর তোহা।এমন সময় পিছন থেকে জয় বললো,
-“রুহি একটু দাঁড়া!”
রুহি আর তোহা দাঁড়িয়ে পড়লো।তোহা মুচকি হেসে বললো,
-“তোর আশিক চলে এসেছে!”
রুহি চোখ রাঙিয়ে তোহার দিকে তাকালো।রুহি আর তোহাকে দাঁড়াতে দেখে জয় দৌড়ে তাদের সামনে গিয়ে বললো,
-“রুহি আমার তোর সাথে কিছু কথা আছে।”
রুহি তার হাত জোড়া বেঁধে বললো,
-“আমি তোকে…..এটুকুর পরে যা বলবি বল!সেই কলেজ থেকেই এটা শুনে আসছি।”
জয় মাথা নিচু করে বললো,
-“এর বেশি তো বলতে পারি না এটাই তো সমস্যা!”
রুহি চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“তাহলে তোর মতো ডাফারের কথা শোনারও কোনো মানে হয় না!”
রুহি কথাটা বলে তোহার হাত টেনে নিয়ে চলে গেল।তোহা যেতে যেতে বললো,
-“আহারে বেচারার মুখটা একদম চুপসে গেছে।”
রুহি তোহাকে ক্লাসে নিয়ে গিয়ে বললো,
-“তুই চুপ কর।নাহলে তোর মুখে কিন্তু সুপার গ্লু লাগিয়ে দিবো!”
তোহা আর কিছু না বলে চুপ করে রইলো।জয় ক্লাসে এসে কিছুটা পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসে রুহির দিকে তাকালো।রুহি তার দিকে একবার তাকিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ডাফার কোথাকার!”
ভার্সিটির ক্যাম্পাসে আনমনে বসে আছে এশা।আহাদের গতকালের ব্যবহারে বেশ কষ্ট পেয়েছে সে!
-“আমার ভালোবাসা কি কোনোদিনও বুঝবি না আহাদ?যার জন্য আমার এতো ভালোবাসা সে আমায় সর্বদা এভাবে আঘাত করে!আমারও তো খারাপ লাগে,কষ্ট হয়!”
কথাগুলো বলতেই তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।ক্লাসের দিকে যেতে গিয়ে অয়ন খেয়াল করলো এশা একা একা ক্যাম্পাসে বসে আছে।অয়ন এশার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“কি রে ক্লাস করাতে না গিয়ে এখানে বসে আছিস কেনো?”
এশা নিজেকে সামলে বললো,
-“তুই যা আমি একটু পরে যাচ্ছি!”
-“কি হয়েছে তোর এশা?”
-“আহাদ আমাকে কখনোই বুঝবে না রে!ও আমার ভালোবাসা বুঝার চেষ্টাই করে না!”
অয়ন মনে মনে বললো,
-“যেমন তুই তোর প্রতি আমার ভালোবাসা বুঝিস না!”
তারপর নিজেকে সামলে বললো,
-“সিরিয়াসলি এশা!তোর ক্লাসে স্টুডেন্টরা তোর জন্য ওয়েট করতেছে আর তুই বসে বসে এইসব ভাবছিস?”
এশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস ক্লাসের টাইম হয়ে গেছে।তুই ও তোর ক্লাসে যা তোর জন্যও তোর স্টুডেন্টরা বসে আছে!”
এশা কথাটা বলে চলে যেতে গেলে অয়ন বললো,
-“আজকে ভার্সিটি শেষে তোর কোনো কাজ আছে?”
-“না।কেনো?”
-“কালকে সব কলিগরা মিলে প্লান করেছি মুভি দেখতে যাবো।তুই তো কালকে তাড়াতাড়ি চলে গেছিলি তাই আর জানানো হয়নি।আজকে যেহেতু তোর কোনো কাজ নেই তাহলে চল সবাই মিলে আজকে একসাথে মুভি দেখতে যাই!”
-“না রে আমার মনমেজাজ ঠিক নেই।”
-“তোর মনমেজাজ ঠিক করার জন্যই বললাম!”
এশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“আচ্ছা যাবো নে।”
এশা কথাটা বলে ক্লাসের দিকে চলে গেল।অয়নের মুখে হাসি ফুটলো!
–
–
–
ভার্সিটি শেষে এশা দেখলো আদি ভার্সিটির গেটে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।এশা তার কাছে গিয়ে বললো,
-“কি রে তুই আজকে কোথা থেকে হাজির হলি?”
-“আজকে আমার ক্লাস এই টাইমেই ছিল তাই ভাবলাম তোকে যাওয়ার পথে নিয়ে যাই।আমার ভার্সিটি থেকে যাওয়ার পথেই তো তোর ভার্সিটি পরে!”
-“তুই এক কাজ কর রুহিকে নিয়ে যা আমি আজকে আমার কলিগদের সাথে মুভি দেখতে যাবো!”
-“কি?আমি ও-কে নিয়ে যেতে পারবো না।”
এর মধ্যে রুহি আর তোহা এসে সেখানে হাজির হলো।আদিকে দেখে রুহি বললো,
-“আরে ড্রাইভারের বদলে কি আজকে খাসি ভাই এসেছে নাকি!”
আদি কিছু বলতে যাবে এমন সময় তার চোখ আটকে গেল তোহাকে দেখে।এশা রুহির কথায় হাসি দিয়ে বললো,
-“আরে না ওর ক্লাস শেষ তাই আমাকে নিতে এসেছিল।তবে তুই বরং তোহাকে নিয়ে ওর সাথে চলে যা।আমি আমার কলিগদের সাথে একটু মুভি দেখতে যাবো আজকে!”
রুহি কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,
-“আমাদের জিনা হারাম করে তোমরা স্যার-ম্যাডামরা মুভি দেখতে যাচ্ছো!”
এশা হেসে দিল।তারপরে আদির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ওদের সাবধানে নিয়ে যাবি।”
-“আচ্ছা আপু তুই যা।”
এশা চলে গেল।রুহি আর তোহা গাড়িতে উঠে বসতে আদি ড্রাইভ করা শুরু করলো।কিছুক্ষণ পরে হালকা কেশে আদি বললো,
-“রুহি তোর পাশের জনের সাথে তো পরিচয় করালি না!”
-“ও হলো তোহা আমার বেস্টফ্রেন্ড আর তোহা ও হলো খাসি না মানে আদি আমার চাচাতো ভাই!”
আদি চোখ রাঙিয়ে রুহির দিকে তাকালো।তোহা হাসি দিয়ে বললো,
-“উনাকে খাসি বলিস কিসের জন্য?”
-“খাসিকে তো খাসিই বলবো!”
-“রুহি তুই কিন্তু বেশি শুরু করেছিস।আর তোহা আপনি না না তুমি!আমরা সেম এইজ!তুমি করে বলাটাই ঠিক।তুমিও তুমি করেই বলো আমাকে।”
#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০২
___________________
আহাদ তার রুমের বেলকনির দোলনায় বসে তৃধার কথা ভাবছে।এতোবছর পরে তৃধাকে দেখলো!যতটা ভালো লাগা কাজ করছে ঠিক ততটাই ঘৃণা কাজ করছে।
-“তৃধা কেমন যেন অগোছালো হয়ে গিয়েছে।চোখ-মুখ ফ্যাকাসে,মনে হয় আগের চেয়ে আরো বেশি রোগা হয়েছে!খাওয়া-দাওয়া করে না নাকি ঠিকভাবে?……এটুকু বলে সে থামলো।পরক্ষনেই চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“নাহ্!এইসব নিয়ে আমি আর কিছু ভাববো না।ওই মেয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই আমার জীবনে।সে আমার কেউ না!”
কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো আহাদ।কিছুই ভালো লাগছে না তার।যার থেকে দূরে থাকতে চায় সেই তার কাছে চলে আসছে বারবার!
–
–
–
সকালবেলা নাস্তা করতে করতে রুহি বললো,
-“আম্মু আমার হিসাব একদম মিলে গেছে।”
আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
-“কিসের হিসাব?”
রুহি গতকালের সব ঘটনা আয়েশা বেগমকে বললেন।আয়েশা বেগম সবটা শুনে বললেন,
-“তার মানে ওরা একে-অপরকে আগে থেকে চিনে?”
-“হ্যাঁ!তবে ভাইয়া না তৃধা আপুকে সহ্যই করতে পারে না।কিন্তু কেন?এই কেনোর উত্তরই পেলাম না।”
আয়েশা বেগম চিন্তিত ভঙ্গিতে বললেন,
-“আহাদ যা ছেলে ও তো কিছুই মুখ খুলে বলবে না!আমার মনে হয় তৃধার সাথেই কথা বলতে হবে।”
রুহি’ আয়েশা বেগমের কথায় সম্মতি জানালো।
________________
সোফায় বসে সকালের নাস্তা নিয়ে নাড়াচাড়া করছে তৃধা।তার চোখ-মুখ ফুলে আছে,দেখে মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমায়নি!সবটা লক্ষ করলেন রাহেলা বেগম।তিনি গিয়ে তৃধার পাশে বসে বললেন,
-“কি হয়েছে মা তোর?”
তৃধা নিজেকে সামলে মৃদু হেসে বললো,
-“কই আম্মু আমার আবার কি হবে!আমি তো ঠিকই আছি।”
-“চোখ-মুখ ফুলে আছে,নাস্তা না খেয়ে নাড়াচাড়া করছিস আর বলছিস তুই ঠিক আছিস!”
-“হ্যাঁ আম্মু আহাদই সেই ছেলে যার জন্য আমি এতো বছর অপেক্ষা করছি!”
-“আরে আমি তো আহাদের সাথেই তোর বিয়ের বিষয়ে কথা বলেছি।আহাদের মা আয়েশার সাথে তো আমার ভালো সম্পর্ক!আমরা এক কলেজেই চাকরি করতাম।”
তৃধা খুশি হয়ে বললো,
-“কি?তুমি আহাদের সাথেই আমার বিয়ের কথা বলছো?”
-“হ্যাঁ!”
হঠাৎ তৃধার মুখ মলিন হয়ে গেল।সে বললো,
-“কিন্তু আহাদ তো এই বিয়েতে রাজি হবে না!”
-“কেনো?”
-“আম্মু’ বাবা আমাকে উনার মাথায় হাত রেখে কসম কাটিয়েছিল জানি আমি আহাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক নষ্ট করে দেই।আমাদের সম্পর্কের কারণে নাকি আমার পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছিল।বাবা আরো বলেছিল আমি যদি কসম না মানি তাহলে নাকি উনার মরা মুখ দেখবো!কিন্তু আম্মু আমি তো কসম মেনেছিলাম।নিজের বুকে পাথর চেপে আহাদের সাথে সেদিনই সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে এসেছিলাম।জানো আম্মু ও না একদম বাচ্চাদের মতো কান্না করে বলেছিল আমাকে ছাড়া ও ভালো থাকবে না।কিন্তু আমি ওর কোনো কথাই শুনিনি বাবার কথাই রেখেছিলাম!কিন্তু কি হলো তাতে?বাবা তো আমাদের মাঝে থেকে ঠিকই হারিয়ে গেল।”
কথাগুলো বলে কেঁদে দিল তৃধা।রাহেলা বেগম ছলছল চোখে বললেন,
-“কি তোর বাবা এইসব করিয়েছিল?আমি তো জানতামই না কিছু!”
তৃধা কিছুক্ষণ কান্না করে নিজেকে সামলে বললো,
-“না আমি এতো সহজে হাল ছাড়বো নাহ্।বিয়ে করলে আমি আহাদ আহমেদ খানকেই করবো!ইট’স মাই চ্যালেঞ্জ!”
তৃধার কথা শুনে রাহেলা বেগম মৃদু হেসে বললেন,
-“এই না হলে আমার মেয়ে!”
তোহা হাই তুলতে তুলতে রাহেলা বেগম আর তৃধার মাঝে বসে বললো,
-“আপু তোর জীবনের এই ইতিহাসটা আমাকে না জানিয়ে পারলি কি করে?”
-“অনেকদিনের লুকানো কষ্ট তো!বলার সময় নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি।”
তোহা থুতনিতে হাত দিয়ে ভাবান্নিত ভঙ্গিতে বললো,
-“আহাদ ভাইয়াকে রাজি করাবি কি করে আপু?শপিংমলে উনার যা অ্যাটিটিউড দেখলাম!”
তৃধা হাসি দিয়ে বললো,
-“আমি যখন আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম আমিই আবার আমার করে নিবো!আর এটা আমার পারতেই হবে।”
–
–
–
ব্রেকফাস্ট করে নিজের রুমে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছে আহাদ।হঠাৎ তার মোবাইলে একটা কল আসলো।সে দেখলো আননং নাম্বার থেকে কল এসেছে তাই সে রিসিভ করলো না।কলটা কেটে গেল।কিছুক্ষণ পরে আবার কল আসলো।সে এবার কলটা রিসিভ করতে অপাশ থেকে তৃধা বললো,
-“অন্য নাম্বার থেকে কল করলাম তাও ধরতে এতো টাইম লাগে!”
কণ্ঠস্বর শুনেই আহাদ বুঝতে পারলো এটা তৃধা।সে কিছু না বলে কলটা কেটে দিয়ে মোবাইল অফ করে বিছানায় ছুড়ে মারলো।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-“এই মেয়ের কি সমস্যা!নিজেই আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিল আর এখন এমন করতেছে।নতুন ড্রামা শুরু করেছে!”
-“এভাবে কলটা কেটে দিলে আহাদ?মোবাইলটাও অফ করে ফেললে!এতোটা অভিমান!”
তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“সমস্যা নেই।আমি আবার তোমার মনে আমার জন্য ভালোবাসা তৈরি করবো!এতো সহজে ছাড়ার পাত্রী আমি না মি.খান!”
কথাগুলো বলে হেসে দিল তৃধা।তাদের যখন সম্পর্ক ছিল সে বেশিরভাগ সময়ই আহাদকে মি.খান বলে ডাকতো।এটা বলে ডাকতেই তার বেশি ভালো লাগতো!এতো স্মৃতি ভুলা কি সম্ভব নাকি!এগুলো আঁকড়েই তো সে এতোদিন বেঁচে ছিল।তৃধার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই সে তা মুছে ফেলে উজ্জ্বল হাসি দিল!
—————
-“একা একা এতো কাজের চাপ না নিলেও তো পারো!ছুটির দিনও কাজ করা লাগছে তোমার।”
স্টাডি রুমে বসে অফিসের কাজ করছিল আহাদ।রফিকুল সাহেবের কথা শুনে সে বললো,
-“কাজের মধ্যে থাকতে আমার ভালো লাগে।মনের শান্তি পাই!”
-“শুধু কাজ করলেই তো হবে না বাড়ির লোকদেরও তো একটু সময় দিতে হবে।এতোদিন পরে বিদেশ থেকে ফিরেছো মা-বোনকে একটু সময় দেও;আমাকে না দিলেও চলবে!”
আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কেনো তুমি কি বাইরের লোক নাকি?”
-“তা নয় তবে তোমার আর আমার কোনো কিছুই তো ম্যাচ খায় না!”
-“তারপরেও আমরা বাবা-ছেলে!মা আর বোনকে সময় দিতে গেলে তোমাকেও দিতে হবে এর জন্যই তাদের সময় দেই না আমি!”
রফিকুল সাহেবের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল।এই ছেলেকে তিনি জীবনেও শুধরাতে পারবেন না।এ সারাজীবন এমন খাপছাড়াই থাকবে!হঠাৎ করে সেখানে আহাদের চাচাতো ভাই আদি এসে হাজির হলো।আদি এসে বললো,
-“ভাইয়া তুমি এসেছো তো কম দিন হলো না আমাদের বাড়িতে তো একবারও গেলে না!”
আদির কথা শুনে হাসি দিয়ে আহাদ বললো,
-“তোদের সবার সাথেই তো দেখা হয়েছে তা আর বাড়িতে গিয়ে কি হবে!”
-“এ আবার কি কথা!”
-“এগুলাই তোমার আহাদ ভাইয়ার কথা।”
কথাটা বলে রফিকুল সাহেব চলে গেলেন।আহাদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“এসে পড়েছিস যখন তাহলে চল একসাথে লাঞ্চ করি!”
-“আমি খেয়ে এসেছি ভাইয়া।”
-“তো কি হয়েছে!একদিনে দুইবার খেলে কিছু হয় না।”
আহাদ জোর করে আদিকে নিয়ে খেতে বসালো।সবাই একসাথে দুপুরের খাবার খাচ্ছে এমন সময় রুহি আদিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-“বিষয়টা কেমন অদ্ভুত না খাসি নাকি খাসির মাংস খাচ্ছে!”
আদি চোখ রাঙিয়ে বললো,
-“রুহি একদম এইসব উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।”
-“যা সত্যি তাই বললাম উল্টাপাল্টা কই!”
আদি’ আয়েশা বেগমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“চাচি মা দেখছো তোমার মেয়ে আমাকে কি সব বলে!”
আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-“রুহি একদম এইসব কথা বলবি না আদিকে।মা*র খাবি কিন্তু তুই আমার হাতে।আদি বাবা তুই ভালো রে খা তো ওর কথা বাদ দে।”
রুহি আর কিছু না বলে আদির দিকে তাকিয়ে মুখ ভেঙচি কাটলো।
/
/
/
-“আজ তোর সময় হলো আমাদের বাড়িতে আসার!”
তৃধা হাতে থাকা এপ্রোনটা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে রেখে নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“আম্মু আমি কোনো কিছু না জেনে কিন্তু তোমাকে প্রশ্ন করিনি!”
রাহেলা বেগম এবার বেশ জোর গলায় বললেন,
-“যাকে ছবি দিয়েছি বেশ করেছি।এবার আমি আর তোর কোনো কথা শুনবো না।এতোদিন পড়াশোনার কথা বলে বিয়ে করিসনি।এখন তো তুই একটা নামকরা হসপিটালের ডাক্তার!এখন তো আর বিয়ে করতে কোনো বাঁধা নেই।”
রাহেলা বেগম তৃধার কাছে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“সমাজ বলেও একটা বিষয় আছে মা।”
তৃধা’ রাহেলা বেগমের হাত জোড়া ধরে বললো,
-“আম্মু প্লিজ আমাকে আরেকটু সময় দেও।তুমি তো জানো আমি একজনের অপেক্ষায় আছি।সে একদিন না একদিন ঠিকই ফিরে আসবে।তাকে আসতেই হবে!”
-“কে সে?আমাকে তো বল!”
তৃধা মৃদু হেসে বললো,
-“তোমার মেয়ের হবু জামাই।”
কথাটা বলে এপ্রোনটা নিয়ে তার রুমের দিকে চলে গেল তৃধা।রাহেলা বেগম চিন্তিত হয়ে বললেন,
-“ছেলেটা কে আজ পর্যন্ত আমি জানতে পারলাম না।”
–
–
–
একটা ছবির ফ্রেম হাতে নিয়ে তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বসে আছে আহাদ।চোখ জোড়া লালচে হয়ে গেছে।হয়তো এতোক্ষণে জল গড়িয়ে পড়তো।তবে তা গড়িয়ে না পড়ার জন্য জোরপূর্বক বাঁধা পেয়ে চোখেই মিশে গেছে।
-“তোমার শোকে আমার মৃত্যু হোক,তবুও আমার জীবনে দ্বিতীয় বার তোমার আর ফেরা না হোক!”
আহাদ ছবির ফ্রেমটা আলমারিতে ঢুকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে নিচে গেল।নিচে গিয়ে দেখলো সবাই খাবার টেবিলে তার জন্য অপেক্ষা করছে।সে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।রফিকুল সাহেব চোয়াল শক্ত করে বললেন,
-“এমন হুটহাট রেগে গিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করা বন্ধ করো!”
আহাদ প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তে বললো,
-“আমি কাউকে বিভ্রান্ত করিনি।”
রফিকুল সাহেব চোখ রাঙিয়ে বললেন,
-“তোমার জন্য আমাদের এতোক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে।”
-“আমি তো তোমাদের অপেক্ষা করতে বলিনি।তোমরা নিজেদের ইচ্ছাতে অপেক্ষা করেছো।”
রফিকুল সাহেব কিছু বলতে যাবেন তার আগে আয়েশা বেগম ইশারা করে উনাকে চুপ থাকতে বললেন।উনিও আর কথা না বাড়িয়ে খাবার খাওয়ায় মন দিলেন!
_________________________
-“আপু চল না কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।”
তোহার কথায় বই পড়া বন্ধ করে তার দিকে তাকালো তৃধা।ভ্রু উঁচিয়ে বললো,
-“কই যাবি তুই এখন?”
-“এমনি একটু শপিং করতে যেতাম।তোর সাথে কতদিন শপিং করতে যাই না!”
মৃদু হেসে তৃধা বললো,
-“আচ্ছা যা রেডি হয়ে আয়।”
তোহা দৌড়ে রেডি হতে গেল।যা দেখে তৃধা হেসে দিল।হঠাৎ কি যেন মনে হতে তার হাসি মিলিয়ে গেল।
-“তোমার দেখা কি আমি আর কখনোই পাবো না!এতো বছরের অপেক্ষা বৃথা যাবে না তো!”
কথাগুলো বলে সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
__________________
“ভাইয়া কতক্ষণ ধরে বলছি চল না রে!”
রুহির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে আহাদ বললো,
-“তুই আম্মুকে নিয়ে শপিংয়ে যেতে পারতেছিস না?”
-“না পারতেছি নাহ্।আমি আজকে তোর সাথেই যাবো।”
রুহির জোরাজুরিতে আহাদ তার সাথে শপিংয়ে যেতে রাজি হলো।
___________
রুহি শপিংমলে ঘুরছে আর আহাদ তার পিছনে পিছনে ঘুরছে।
-“রুহি তোর আর কতক্ষণ লাগবে বলতে পারিস?”
-“ভাইয়া তুই এমন করছিস কেনো?এতোদিন পরে দেশে এসেছিস।কোথায় বোনকে নিয়ে কতো জায়গায় ঘুরে বেড়াবি তা না তুই এমন তাড়া দিচ্ছিস!”
-“আমরা দেড় ঘন্টা ধরে ঘুরতেছি রুহি!”
হঠাৎ রুহি তোহাকে দেখতে পেয়ে তার কাছে দৌড়ে গেল।আহাদ অবাক হয়ে সেদিকে তাকালো।দেখলো রুহি গিয়ে তার বয়সী একটি মেয়েকে জড়িয়ে ধরেছে।তবে মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিকে দেখে আহাদ চমকে গেল।সেই চিরচেনা মুখ!
-“তৃধা এখানে?”
-“কি রে রুহি তুই কার সাথে শপিং করতে এসেছিস?”
রুহি আহাদকে দেখিয়ে বললো,
-“আমার ভাইয়ার সাথে।”
রুহি যে দিকে তাকিয়ে আছে তৃধা সেদিকে তাকিয়ে দেখলো তাদের থেকে কয়েক কদম দূরে আহাদ দাঁড়িয়ে আছে।আহাদকে দেখে তৃধা বেশ অবাক হলো।তবে আহাদকে দেখে সে অনেক খুশি হয়েছে।মুখে হাসি ফুটলো,কিন্তু তার চোখ ছলছল করছে।
আহাদ আর তৃধা দুজনে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ কিছু মনে হতে আহাদ তৃধার দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেললো।যেই কারণে তৃধা কিছুটা কষ্ট পেল।তার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
রুহি আর তোহা বিষয়টা খেয়াল করলো।তোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“আপু তুমি কি আহাদ ভাইয়াকে চিনো?”
তৃধা মৃদু হেসে বললো,
-“অনেক ভালো করেই চিনি।”
রুহি আহাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাইয়া তুমি কি তৃধা আপুকে চিনো?”
তৃধা আর তোহা তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।আহাদ চোয়াল শক্ত করে তৃধার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“নাহ্!আমি এই নামে কাউকে চিনি না।রুহি অনেকক্ষণ হয়েছে আমরা এসেছি।এখন বাড়িতে চল।”
তৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিজেকে সামলে নিলো।রুহি ফের আহাদকে প্রশ্ন করলো,
-“হয়নি।তবে যাকে চিনিসই না তার সাথে এমন করার তো কোনো মানে নেই।”
-“চিনি না!”
এটুকু বলে তাচ্ছিল্যের হাসি দিল আহাদ।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“অনেক ভালো করে চিনি আমি তোর তৃধা আপুকে।”
রুহি অবাক হয়ে বললো,
-“কিভাবে?”
-“তা তোর জানতে হবে না।”
রুহি আর কথা বাড়ালো না।সে ভালো করেই জানে আহাদের পেট থেকে কথা বের করা খুবই কষ্টকর!
_________________
বেলকনির দোলনায় বসে আকাশের চাঁদ দেখছে তৃধা।চোখ থেকে দু-এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ছে তার।
-“এতোটা ঘৃণা করো আমায় তুমি আহাদ?তবে এই ঘৃণা করা ব্যক্তিটাকেই একসময় তুমি কত’ই না ভালোবাসতে!আমার অপরাধ ছিল সেদিন আমি বিচ্ছেদ চেয়েছিলাম।কতটা কষ্ট বুকে চেপে রেখে সেদিন বিচ্ছেদ চেয়েছিলাম সেটা শুধু আমি জানি!”
কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো তৃধা।মোবাইলটা অন করে দেখলো রাত দেড়টা বাজে।সে উঠে গিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
(৬৯)
রুমির মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে তেলে বেগুনে জ্ব*লে উঠেন যেনো রাহেলা ও রাজিবুল। রাহেলা নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে বললেন….
—“রুমি! তুই কি আদেও আমার গর্ভের সন্তান? নাকি প্র*স*বের পর পরই আমার আড়ালে আমার সন্তানকে নিয়ে অন্য কেউ তার সন্তানকে আমার কাছে রেখে গিয়েছিলো? টাকার লো*ভে এতোটা জ*র্জ*রিত হয়ে গিয়েছিস তুই ভাবতেও অবাক লাগছে আমার। আমার আর রাজিবুলের নামে বানোয়াট কথা বলার জন্য এবং রিজওয়ানের পক্ষ নেওয়ার জন্য ও-তোকে কতো টাকা দিয়েছে শুনি? বল নিজের বাবার সামনে গলা উঁ*চিয়ে। দেখি কতো জোর তোর গলায়।”
রাহেলাকে এতো জোরের সাথে রুমিকে মি*থ্যে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগতে দেখে ঊর্মিলা কিছু বলতে নিবে সেইসময় রফিকুল ঊর্মিলার হাত ধরে ওকে থামিয়ে দিতে নিলে ঊর্মিলা রফিকুলের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আর সঙ্গে সঙ্গেই রফিকুল ঊর্মিলার হাত ছেড়ে দেয়। রাজিবুল রাহেলার কথার তালে তাল মিলিয়ে বললো….
—“ছি রুমি ছিহ্: তুই এতোটা নি*চে নেমেছিস? তোকে কিসের অভাব দিয়েছিলাম আমরা বলতো যে আজ অ*ন্যা*য় কারীর পক্ষ নিয়ে মি*থ্যে কথা বলতে হচ্ছে তোর? আল্লাহর ভ*য় করিস একটু। মি*থ্যে বলে আজ অ*ন্যা*য় কারীকে হয়তো শা*স্তির হাত থেকে বাঁচাতে পারবি ঠিকই কিন্তু পরকালের দুনিয়ায় শা*স্তি*র হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারবি না।”
রুমি তেজী স্বরে বললো…..
—“বন্ধ করো বড় ভাইয়া, তোমার ঐ নোং*ড়া মুখ থেকে আল্লাহর পবিত্র নাম নেওয়া বন্ধ করো। নিজেদের পা*প কর্মকে বাবার সম্মুখে না আনার জন্য আল্লাহর দোহাই দেখাতে বিন্দুমাত্র লজ্জা করছে না তোমার তাই না! আল্লাহর ভয় তো তোমাদের মধ্যেই নেই। আমার ভিতর আছে জন্যই আজ আমি মি*থ্যে*র নয় সত্যের পক্ষ নিয়েছি। অ*ন্যায় কারীর নয় সত্যবাদী ও ভালো মানসিকতার মানুষদের পক্ষ নিয়ে দু’টো সত্য কথা বলছি।”
রুমির মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে রাজিবুল এবার আর নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নিজ স্থান থেকে উঠে রুমির কাছে এসে ওকে সকলের সম্মুখেই থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হলে রিজওয়ান এবারও রাজিবুলের হাত ধরে সে হাত ওর পিঠের সাথে শক্ত করে মু*চ*ড়ে ধরে। মূহূর্তের মধ্যেই সম্পূর্ণ পরিবেশের রূপ পরিবর্তন হয়ে যায়। রাহেলা বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে ন্যকা কান্নার স্বরে শরীফ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“ওগো আমাদের ছেলেটার হাত ভে*ঙে ফেললো গো। ঐ অ*মানুষটার হাত থেকে আমার নিষ্পাপ ছেলেটাকে বাঁচাও তুমি।”
শরীফ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন….
—“রিজওয়ান..রাজিবুলের হাত ছেড়ে দাও।”
রিজওয়ান চোখ বন্ধ করে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে এক ঝ*ট*কা দিয়ে রাজিবুলের হাত ছেড়ে দেয়। রাজিবুল নিজের ব্য*থা দায়ক হাতে হাত বুলাতে বুলাতে রিজওয়ানের থেকে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো…
—“দেখলে তো বাবা, দেখলে তুমি! রিজওয়ান এভাবেই কথা নেই বার্তা নেই হুটহাট আমাকে আ*ঘা*ত দেওয়ার চেষ্টা করে। আমাকে যে রিজওয়ান নিজের বড় ভাই হিসেবে মানে না তার প্রমাণ তোমাকে দেখিয়ে দিলাম।”
শরীফ সাহেব রাজিবুলের দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“আমি এখানে উপস্থিত আছি দেখেও কোন সাহসে রুমিকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিলে তুমি রাজিবুল? আমি কি তোমাকে বলেছিলাম যে তোমরা যা বলেছো তা-ই সত্য আর আমি তা বিশ্বাস করেছি তাই রুমির মি*থ্যে সহ্য করতে না পেরে ওকে থা*প্প*ড় দিতে উদ্যত হওয়ার অধিকার আছে তোমার!”
শরীফ সাহেবের এরূপ কথার প্রতিত্তুরে কি বলবে তা বুঝে উঠতে পারে না যেনো রাজিবুল। রাহেলা বললেন….
—“এখানে তুমি রাজিবুলের দো*ষ কেনো খুঁজতে বসলে! রুমি মি*থ্যে বলেছে নাকি সত্য তা আমরা খুব ভালো ভাবেই জানি। তাই নিজের ছোট বোন যখন মি*থ্যে*কে প্রশ্রয় দিবে তখন বড় ভাইয়ের রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু তো নয়। রাগের বশেই রাজিবুল রুমিকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হয়েছিলো। কিন্তু রিজওয়ান যা করলো তা তো অত্যন্ত বাড়াবাড়িই। দো*ষ দেওয়ার হলে ওকে দাও। বয়সের দিক থেকে ছোট হয়েও তোমার সামনে ও কি করে রাজিবুলের হাত মু*চ*ড়ে ধরে?”
শরীফ সাহেব বললেন…..
—“কার দো*ষ আছে কার নেই তা বোঝার যথেষ্ট বয়স হয়েছে আমার রাহেলা। এমনি এমনিই মাথার সব চুলগুলো সাদা বর্ণ ধারণ করে নি আমার।”
—“এখানে উপস্থিত প্রত্যেকেরই নিজ নিজ মতামত পেষণ করার সম্পূর্ণ অধিকার। কে বা কারা সত্য বলছে আর কে বা কারা মি*থ্যা বলছে তা একে একে সবার মতামত শোনার পরই বোঝা যাবে।”
শরীফ সাহেবের এরূপ কথা শুনে রাজিবুল শেফালির পাশে এসে দাঁড়ায়। শেফালি চোখ তুলে রাজিবুলের দিকে তাকালে রাজিবুল শেফালিকে ইশারায় নিজের বলানুযায়ী কাজ করতে বলে। শরীফ সাহেব বললেন….
—“বড় বউমা, আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াও তুমি।”
শরীফ সাহেবের কথায় শেফালি তার সম্মুখে এসে দাঁড়ায়। শরীফ সাহেব শেফালির দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্থির করে বললেন…..
—“সত্যের পক্ষ নিবে নাকি মি*থ্যা*র তা তোমার উপর নির্ভর করছে। বলো এখন রাজিবুল আর রাহেলা এতোসময় ধরে যা যা বলেছে তা কি সত্য নাকি রুমি যা বলেছে তা সত্য?”
শেফালি রাজিবুলের দিকে একপলক তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেখা স্পষ্ট রেখে নিজের কমোরের ভাঁজ থেকে একটা মোবাইল ফোন বের করে। অতঃপর একটা অডিও রেকর্ড চালু করে। যে রেকর্ডে ঘন্টাখানেক পূর্বে রাজিবুল শেফালির শরীরে আ*ঘা*ত করার সময় ওকে রিজওয়ানের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য হু*ম*কি দিয়েছিলো তা সবাই স্পষ্ট শুনতে পারছে। শেফালির এমন কাজে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় রাহেলা ও রাজিবুল দু’জনেই। শেফালি এমন কিছু করতে পারে তা কল্পনাও করতে পারে নি ওরা। রাজিবুল বললো…..
—“এসব মি*থ্যে, আমি এমন কিছু করিই নি। শেফালি আমাকে ফাঁ*সা*তেই অন্য কাওকে দিয়ে আমার কন্ঠ ন*ক*ল করিয়েছে। আসলে বাবা তোমাকে বলতে লজ্জা লাগছে নিজের বউয়ের বিষয়ে। তবুও বলছি। শেফালিকে আমি পর পর কয়েকবার অন্য পুরুষের সাথে অন্তঃর*ঙ্গ অবস্থায় হাতে নাতে ধরেছিলাম। শেহজাদের কথা চিন্তা করে বারবার আমি ওকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ ও আমাকেই ফাঁ*সা*নোর চেষ্টা করছে দেখে নিজের মুখ আর বন্ধ রাখতে পারলাম না।”
রাজিবুলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে শেফালির দু’চোখ নোনাজলে টইটম্বুর হয়ে উঠে। শেফালিকে মি*থ্যে প্রমাণ করতে রাজিবুল এতোটা নি*ম্ন মানসিকতার পরিচয় দিতে পারলো তা ভাবতেও শেফালির বুকের বাম পার্শে চিনচিন করে ব্য*থা অনুভব হচ্ছে। রাগে সর্বশরীর রিরি করে কাঁপছে রিজওয়ানের। মেহরিন রিজওয়ান হাত ধরে আছে ওকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। ঊর্মিলা আর নিরব থাকতে না পেরে রাজিবুলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে মুখের উপর থু*থু দেয়। ঘৃ*ণা*য় সঙ্গে সঙ্গে চোখ-মুখ কুঁ*চ*কে ফেলে রাজিবুল। ঊর্মিলা রাগ ও ঘৃণামিশ্রিত স্বরে বললো…..
—“নিজেদের সাজানো মি*থ্যাকে সত্য হিসেবে প্রমাণ করতে নিজের সন্তানের মায়ের চরিত্রের উপর এতো বড় মি*থ্যা ক*ল*ঙ্ক লাগাতে একটুও বুক কাঁপলো না আপনার! অবশ্য কাঁপবেই বা কি করে আপনারা তো মানুষের কাতারেই পড়েন না।”
ঊর্মিলার কাজে ও কথায় ক্ষি*প্ত হয়ে উঠে রাজিবুল। ঊর্মিলাকে মা*রা*র জন্য উদ্যত হলে পূর্বের ন্যয় রফিকুল নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আর তা দেখে না। দ্রুততার সাথে এগিয়ে এসে রাজিবুলকে ধরে বললো….
—“এর আগেও তুমি আমার বউয়ের শরীরে হাত উঠানোর জন্য উদ্যত হয়েছিলে, বড় ভাই হও তুমি আমার তাই সম্পর্কের কথা চিন্তা করে তোমাকে কিছু না বলে নিজের বউকেই সমযত থাকতে বলেছিলাম পরবর্তীতে। কিন্তু এটা যে আমার ভু*ল চিন্তা ছিলো তা আজ পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারলাম। আজ তুমি নিজেকে বাঁচাতে নিজের বউয়ের চরিত্রে মি*থ্যা ক*ল*ঙ্কে*র দাগ লাগাতেও দু’বার ভাবো নি। আজ তোমার পক্ষ নিয়ে আমি যদি বাবার সামনে মি*থ্যা বলিও, কাল তুমি যে আমাকেও রিজওয়ানের মতো তা*ড়া*তে কোনো নোং*ড়া পরিকল্পনা করবে না তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। যে কেবল নিজ স্বার্থের কথাই চিন্তা করে তার পক্ষ নেওয়া কখনই উচিত না।”
এই বলে রফিকুল স্বজোরে রাজিবুলকে ধা*ক্কা দেয়। তাল সামলাতে না পেরে রফিকুলের থেকে কয়েক হাত দূরে মেঝের উপর ছিটকে পরে যায় রাজিবুল। অতঃপর রফিকুল আর কোনো চিন্তা না করে শরীফ সাহেবের পায়ের কাছে এসে বসে অনুনয়ের স্বরে বললো….
—“বাবা, তুমি আম্মাকে বিয়ে করে আমাদের নিয়ে এ বাড়িতে আসার পর পরই প্রবাসে চলে গেলে। তারপর থেকে আম্মা তোমার কথানুযায়ী রিজওয়ানকে নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহন করে নি। আমাদের মাঝেও হিং*সা, অ*হং*কারের বিস্তার ঘটিয়েছিলো। রিজওয়ানকে সবসময় হে*য় করতো আম্মা, আমরাও এসব থেকে বাদ যাই নি। সকল ক্ষেত্রে রিজওয়ানকে খুব সামান্য ভাগ দিয়ে আমরা বেশিঅংশ নিয়ে এসেছি। রিজওয়ানকে আম্মা সরকারি স্কুলে পড়িয়েছেন আর আমাদের বেসরকারি স্কুলে। আর তোমার সামনে রিজওয়ানের নামে বানোয়াট কথা তুলে ধরেছিলেন। সে ব*খা*টে চালচলন করতো তাই বেসরকারি স্কুল থেকে ওকে বের করে দিয়েছিলো স্যার, ম্যডামরা। এভাবেই চলতে চলতে রিজওয়ান ১০ম শ্রেণির গন্ডি পেড়িয়ে কলেজে পড়ার ইচ্ছে পেষণ করলে আম্মা ওর নামে আরো বড় একটা বানোয়াট ঘটনা সাজিয়ে তোমার সামনে তুলে ধরে। যার দরুণ রাগের বশে তুমি ওর পড়াশোনাই বন্ধ করে দাও চিরতরের জন্য। কয়েকবছরের ভিতর আমি আর বড় ভাইয়া নিজেদের মতো করে বিয়ে নেই। তুমি এতে অ*সন্তুষ্ট হয়েছো তা বুঝেও আমাদের মাঝে কোনো ভাবান্তর হয় নি। কয়েকবছর পর দেশে ফিরেই তুমি রিজওয়ানের বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে। আমরা সবাই চেয়েছিলাম বড় কোনো ঘরের মেয়েকে রিজওয়ানের বউ বানিয়ে আনতে। এতে মেয়ের বাড়ি থেকে দামি দামি জিনিসপত্র ও মোটা অংকের টাকা পাওয়া সম্ভব ছিলো। আমাদের চিন্তায় পানি ঢেলে দিয়ে তুমি মেহরিনের সাথে রিজওয়ানের বিয়ে দিলে। মেহরিন আমাদের সকলের অপছন্দের হলেও আমরা সবাই তোমার সামনে ওকে মেনে নেওয়ার নাটক করেছিলাম। রিজওয়ানকে যখন ফোন কিনে দিতে চেয়েছিলে তখন আমাদের সত্য যেনো তোমার সামনে না আসে তাই কৌশলে ওকে দিয়ে ওর ফোন কিনার বিষয়টা ধা*মা*চাপা দিয়েছিলাম আমরা। মেহরিন বিয়ের পরেও পড়াশোনা করবে এই বিষয়টা আমরা কেউ-ই মেনে নিতে পারি নি। তাই মেহরিনকে দিয়েই ও যে পড়াশোনা করতে ইচ্ছুক নয় এমনটা তোমাকে বলতে বাধ্য করিয়েছিলাম আমরাই। সবকিছু আমাদের ইচ্ছেনুযায়ীই চলছিলো। রিজওয়ান আর মেহরিনকে কথার ও আচারণের অ*ত্যা*চা*রের জাঁ*তা কলে পি*ষ্ট করতাম আমরা সর্বক্ষণ। প্রায় ১মাস আগে রিজওয়ানের মাঝে আকস্মিক পরিবর্তন লক্ষ্য করি আমরা। সে প্র*তি*বাদী হয়ে উঠে। আমাদের আসল জায়গাটা চিনিয়ে দিতে শুরু করে। আমরা যে এ বংশের সন্তান নই তা বুঝিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু রিজওয়ানের এমন পরিবর্তন মেনে নিতে পারি নি আমরা কেউ-ই। ওকে তোমার সামনে ফাঁ*সা*তে সবরকম কূ*ট*নৈতিক পরিকল্পনা করতে শুরু করি। এর মাঝেই বড় ভাইয়া রুমির জন্য তার অফিসের চল্লিশোর্ধ্ব বয়সের ম্যনেজার যার প্রথম স্ত্রী মা*রা গিয়েছে ও বর্তমানে দু’টো ছেলে-মেয়ে আছে সেই লোকের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসে। রুমি সেই সম্বন্ধে নারাজ হলে বড় ভাইয়া আম্মাকে দিয়ে রুমিকে জোরপূর্বক এই সম্বন্ধ মেনে নিতে বাধ্য করাতে বলে। বড় ভাইয়ার আসল উদ্দেশ্য ছিলো অফিসে নিজের পজিশন বাড়ানো, স্যলারি বাড়ানো পাশাপাশি ওর ম্যনেজারের যাবতীয় সয়-সম্পত্তির মালিকানা নিজের নামে করে নেওয়া। আমরা কেউ রুমির পাশে দাঁড়াই নি। রুমির সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো রিজওয়ান আর ওর স্ত্রী। ওরা আমাদের সাথে কখনও অকারণে দূর্ব্যবহার করে নি। বড় ভাইয়ার দো*ষে*ই সে রিজওয়ানের হাতে মা*ই*র খেয়েছে বারংবার। কিছুদিন আগে ঊষাকে এ*ক্সি*ডে*ন্ট হওয়া থেকে বাঁচিয়েছিলো মেহরিন। সে চাইলেই পারতো নিজের স্বামীর সাথে হওয়া অ*ন্যা*য় গুলোর প্র*তি*শোধ নিতে৷ কিন্তু সে ভালো মানসিকতার পরিচয় দিয়েছে। ওদের ভালো আচারণ আমাদের সবার মাঝে ভালো প্রভাব ফেললেও বড় ভাইয়া বা মায়ের উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারে নি। তারা আজও নিয়ত রেখেছিলো সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে তোমার সামনে রিজওয়ান আর মেহরিনকে ছোট করে এ বাড়ি থেকে তা*ড়ি*য়ে দিয়ে সব সয়-সম্পত্তি নিজের নামে করে নেওয়া। এ বাড়িজুড়ে নিজে একা রাজত্ব করা। আজ বড় ভাবী রিজওয়ানের পক্ষ নেওয়ায়, বড় ভাইয়ার সত্য সামনে আনায় তার চরিত্রেও ক*ল*ঙ্ক লাগানোর মতো ঘৃ*ণ্য কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করলো না। এবার তুমি সিদ্ধান্ত নাও বাবা কি করবে তুমি। সব সত্য তোমার সামনে তুলে ধরেছি আজ আমরা। আমাদের কাজের জন্য আমরা সবাই ভিষণ অনুতপ্ত বোধ করছি। পারলে আমাদের ক্ষমা করে দিও তুমি।”
রফিকুলের মুখে এতোসময় ধরে এতোগুলো কথা শোনার পর শরীফ সাহেব যেনো স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। রাজিবুল ক্ষি*প্ত নজরে রফিকুলের দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“কাজটা তুই ঠিক করলি না রফিকুল। এর হিসাব তোকে দিতেই হবে। তোদের সবাইকেই আমি দেখে নিবো।”
শরীফ সাহেব বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন….
—“সৎ কখনও আপন হতে পারে না এই কথা আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আজ আমার ভুলে যাওয়ার ফল আমার চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে ভাসছে।”
এই বলে শফিক সাহেব একহাত দিয়ে নিজের বুকের বাম পাশ চেপে ধরেন। রফিকুল তাঁকে ধরতে নিলে তিনি অন্য হাত উঠিয়ে ওকে থামতে বলে বললেন…..
—“আমি ঠিক আছি।”
নিজের পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গিয়েছে বুঝে রাহেলা আর কোনো দিক-বেদিক চিন্তা না করে শরীফ সাহেবের সম্মুখে এসে তার পায়ের কাছে বসে কান্নারত স্বরে বললেন…..
—“ওগো, আমাদের ভুল হয়ে গিয়েছে। আমরা আমাদের ভুল বুঝতে পেরেছি। রিজওয়ান এর সাথে বিগত বছরগুলো ধরে এমন করা উচিত হয় নি আমাদের। তুমি দয়াকরে আমাকে আর আমার ছেলেদের এ বাড়ি থেকে বের করে দিও না। আমি কথা দিচ্ছি আজকের পর আর কখনও রিজওয়ান বা ওর বউয়ের সাথে বৈ*ষ*ম্য*তা মূলক আচারণ করবো না। ওদের প্রাপ্য অধিকার পেতে কোনোরূপ বাঁ*ধা প্রদান করবো না। রিজওয়ানের যোগ্য মা আর মেহরিন বউমার যোগ্য শ্বাশুড়ি হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করবো। আমাকে নিয়ে কোনো অভিযোগ করতে দিবো না ওদের। রাজিবুলকেও বুঝিয়ে বলবো। ও-ওও নিজেকে শু*ধ*রে নিবে। শেষ একটা সুযোগ দাও তুমি আমাদের।”
কথাগুলো বলে রাহেলা শরীফ সাহেবের পা স্পর্শ করতে নিলে শরীফ সাহেব কয়েক কদম পিছিয়ে যান সঙ্গে সঙ্গেই। তার কঠিন দৃষ্টি ও অন্যত্র স্থির। রাহেলা বুঝতে পেরেছেন তার একার ক্ষমা চাওয়াতে কোনো লাভ হবে না৷ রাহেলা বসা থেকে উঠে রাজিবুলের কাছে গিয়ে ওর হাতজোড়া ধরে বললেন……
—“রাজিবুল..বা’জান আমার। নিজের মাঝে আর ইগো রাখিস না। বাবার সামনে নিজের দো*ষ গুলো স্বীকার কর। ক্ষমা চা তোর বাবার কা…..!”
রাহেলার মুখে এরূপ কথা শুনে রাজিবুল চি*ল্লি*য়ে বলে উঠলো……
—“বাবা! কিসের বাবা হন উনি আমার! উনি আমাকে জন্ম দেন নি। তাই উনাকে আমি আমার বাবা হিসেবে মানি না। তাই উনার কাছে ক্ষমা চাওয়ার কোনো প্রশ্নই উঠছে। শোনো মা..উনি তোমাকে বা আমাকে চাইলেও এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারবেন না। আর না এই সম্পত্তির ভাগ পাওয়া থেকে ব*ন্ঞ্চি*ত করতে পারবেন। ওনার সাথে আমার র*ক্তে*র কোনো সম্পর্ক না থাকলেও তুমি ওনার বিবাহিতা স্ত্রী হও। তাই তুমি তোমার ভাগ চাইবে ওনার থেকে। উনি তোমায় তোমার নায্য ভাগের সম্পত্তি না দিলে পুলিশের কাছে যাবো আমরা। এদের সবার বিরুদ্ধে এমন এমন অ*ভি*যো*গ করবো যে পুলিশ এদের বয়ান পেষ করার সময়টুকুও দিবে না। এদের সবার কমোরে দড়ি পড়িয়ে টানতে টানতে থানায়…….!”
রাজিবুল পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই শরীফ সাহেব বললেন…..
—“এতো বড় অ*ন্যা*য় করেও তোমার ভিতর নূন্যতম চক্ষুলজ্জাও কাজ করছে না। খুব জোড়ের সাথে নিজের মা’কে অধিকার দাবি করতে বলছো। সেই অধিকার দাবি করার ক্ষ*ম*তাও এবার আমি তুলে নিচ্ছি। মিসেস. রাহেলা বেগম, আমি মোঃ শরীফ সাহেব সম্পূর্ণ সজ্ঞানে আপনাকে তালাক দিচ্ছি, তালাক দিচ্ছি, তালাক দিচ্ছি।”
শরীফ সাহেবের এরূপ কথা ও কাজে পুরো পরিবেশ যেনো থ*ম*থ*মে বর্ণ ধারণ করে। রাহেলা ধ*প করে রাজিবুলের পায়ের কাছে মেঝের উপর বসে পড়েন। রাজিবুল ও রাগের বশে বুঝতেই পারে নি শরীফ সাহেব এমনটাও করতে পারবেন। শরীফ সাহেব আবারও বললেন…..
—“এই মুহূর্তে তুমি তোমার মা’কে নিয়ে আমার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাবে। তোমার মায়ের সাথে আমার আইনত কোনো সম্বন্ধ নেই। আমাদের ইসলামি শরিয়ত মতে বিয়ে হয়েছিলো আজ তা শেষ হয়ে গিয়েছে। তাই পরবর্তীতে তুমি এ বাড়িতে সম্পত্তির দাবি নিয়ে আসলে পুলিশ তোমার কমোরে দড়ি পড়িয়ে টানতে টানতে থানায় নিয়ে যাবে।”
রাজিবুল থ*ম লেগে দাঁড়িয়ে আছে। রাজিবুলকে কোনো রিয়াকশন করতে না দেখে শরীফ সাহেব বললেন…..
—“স্বইচ্ছায় যাবে নাকি ঘাড় ধরে বের করে দিতে বলছো আমায়!”
রাজিবুল আর দাড়িয়ে না থেকে নিজের মা’কে সেখানেই ফেলে রেখে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যায়। শরীফ সাহেব রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“নিজের দো*ষে আজ সর্বহারা হলেন আপনি রাহেলা বেগম। যে ছেলের জন্য সবার সাথে অ*ন্যায় করেছিলেন আজ আপনার খারাপ সময়ে সেই ছেলে আপনাকে ফেলে রেখেই চলে গেলো। আপনাকে নতুন করে চলে যাওয়ার কথা বলতে হবে না আশা করছি।”
রাহেলা বসা থেকে উঠে কান্নাভেজা দৃষ্টি নিয়ে সকলকে একপলক দেখে ঢলতে ঢলতে বাড়ি থেকে বেড়িয়ে গেলেন। রফিকুল অধীর চাহুনি নিয়ে তাকিয়ে আছে শরীফ সাহেবের দিকে। এবার যে তার সা*জা পাওয়ার পা*লা। শরীফ সাহেব রফিকুলের উপর দৃষ্টি স্থির করে বললেন…..
—“তুমি নিজের ভু*ল বুঝতে পেরেছো। তোমার চোখে আমি অনুতপ্ততার ছাপ ও স্পষ্ট দেখতে পারছি। কিন্তু অ*ন্যায় করলে শা*স্তি পেতেই হবে। তাই আজ থেকে তোমাকে আমি আমার উপার্জনের টাকা থেকে কোনো টাকা দিবো না। এ বাড়িতেই থাকতে পারবে তুমি তোমার স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে কিন্তু নিজের ও নিজের স্ত্রীর যাবতীয় খরচ নিজের উপার্জনের টাকায় সামলাবে। আমার নাতনী ঊষাকে কোনোকিছুর অভাববোধ করতে আমি দিবো না কেবল। আর বড় বউমা, তোমার সততা ও সাহসিকতার জন্য তোমার উপর সন্তুষ্ট হয়েছি আমি। তাই তুমিও আমার নাতী শেহজাদকে নিয়ে এ বাড়িতেই থাকবে। তোমাদের যাবতীয় খরচ আমি সামলাবো। আজ থেকে এ বাড়ির মূল কর্তী হবে ছোট বউমা। সে সংসারের জন্য যে সিদ্ধান্ত নিবে সেটা সকলেই মানতে বাধ্য হবে। আজকের পর আর কখনও যদি তোমাদের কারোর আচারণে আমি বিন্দুমাত্র হিং*সা, অ*হং*কার লক্ষ্য করেছি তাহলে তক্ষুনি তাঁদের এ বাড়ি থেকে চিরতরের জন্য বের করে দিবো আমি। আর কোনো রকম ক্ষমা করা হবে না কাওকে। রিজওয়ান আগামীকালই তুমি ছোট বউমাকে নিয়ে পুনরায় কলেজে যাবে আর ওকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করবে। আর রুমি, তুমি তোমার যতোদূর ইচ্ছে হয় ততোদূর পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারবে। তোমার যখন মনে হবে তুমি এখন বিয়ে করতে ইচ্ছুক আছো আমাকে জানাবে। এছাড়াও তোমার যদি কাওকে পছন্দ হয়ে থাকে সে বিষয়ে নির্দ্বিধায় আমাকে জানাবে। আমি তার সাথেই তোমার বিবাহকার্য সম্পন্ন করবো।”
এই বলে শরীফ সাহেব নিজ রুমে চলে গেলেন। সকলের চোখে-মুখেই প্রশান্তির ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। শা*স্তি পেয়েও রফিকুল মনে মনে যে সন্তুষ্ট তা ওর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ঊর্মিলার চেহারাতেও অ*সন্তুষ্টির ছাপ দেখা যাচ্ছে না। রিজওয়ান হাসিমুখে মেহরিনকে একহাতে জড়িয়ে ধরে।
(৭০)
হাসপাতালে আরফার কেবিনরুমে ওর বাম হাতের উপর মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে আছে আরহাম। সেইমূহূর্তে আরহাম অনুভব করে আরফার হাত নড়ছে। আরহাম চট করে সোজা হয়ে বসে আরফার দিকে তাকাতেই দেখে আরফা বড় বড় করে চোখ মেলে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। আরফার মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো ছিলো। আরফা ধীরস্বরে তা খুলতে বলে আরহামকে। আরহাম আকস্মিক ভাবে আরফার জ্ঞান ফিরে আসায় কি বলবে কি করবে তা যেনো বুঝে উঠতে পারছে না। পরক্ষণেই আরহামের ঘোর কেটে গেলে সে দ্রুততার সাথে আরফার মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্কটা খুলে দেয়। আরফার মুখের যে পার্শে আঘাত বেশি লেগেছিলো তা শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। ব্যন্ডেজ খুলে ফেলেছেন ডাক্তার গতকালই৷ আরফা বললো…..
—“বাবাই.. আমি স্টার হয়ে যাই নি মাম্মামের জায়গায়?”
আরফার মুখে এরূপ কথা শুনে আরহামের ভিতরটা ভে*ঙে দলা পাঁকিয়ে থাকা কান্নাগুলো বেড়িয়ে আসে। আরহাম ওর মাথা এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে না সূচক জবাব দেয়। আরফা আবারও বললো…
—“বাবাই তুমি কাঁদছো কেনো?”
আরহাম কান্নারত কন্ঠে বললো….
—“আমার মেয়েটা আবারও আমার কাছে ফিরে এসেছে পুরোপুরি ভাবে তা দেখে আমার দু’চোখ দিয়ে খুশিরা অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ছে মামনি।”
—“বাবাই, আমি তো আমার কথা রাখতে পারি নি। তোমার কাছে মাম্মামকে এনে দিতে পারি নি। তবুও তুমি খুশি হয়েছো!”
আরহাম আরফার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো….
—“তোমার মাম্মাম চিরতরের জন্য আল্লাহর কাছে ফিরে গিয়েছেন। তাকে তুমি আমি শত বার চাইলেও আর ফিরিয়ে আনতে পারবো না আমাদের কাছে। তোমার মাম্মামের চলে যাওয়ার জন্য এতোগুলো বছর ধরে আমি তোমাকে দায়ী করে ভিষণ ভু*ল করেছি মামনি। তোমাকে বাবার ভালোবাসা দেই নি। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও মামনি। আজ থেকে তোমাকে আমি বাবা-মা দু’জনের ভালোবাসাই দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আর কখনও ক*ষ্ট দিবো না তোমায়।”
(৬৩)
পরের দিন সকালবেলা…..
ডাইনিং টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছে রাজিবুল, রফিকুল, রাহেলা ও বাচ্চারা। শেফালি আর ঊর্মিলা ওদের প্রয়োজন অনুসারে খাবার পরিবেশন করে দিচ্ছে। পরক্ষণেই শেফালি চেয়ার টেনে রাজিবুলের পাশে বসতে নিলে রাজিবুল খাবার খেতে খেতেই বললো….
—“তুমি এখানে বসলে আমি উঠে যাবো।”
শেফালি থেমে গিয়ে চেয়ার স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে বললো…
—“মানে!”
—“মানে তোমার মতো মেয়ের সাথে এক স্থানে বসে খাবার খাওয়ার থেকে ক্ষুধার্ত থাকা শ্রেয় মনে করি আমি। যদি তুমি এখানে রাখা কোনো চেয়ারে বসো তাহলে আমি খাবার না খেয়েই উঠে যাবো।”
সবার সামনে এমন অপমানমূলক কথা হজম করে নিতে পারে না শেফালি। রাগী স্বরে বললো….
—“আমার হাতে রান্না করে খাবার খাচ্ছো কি করে? রাতে এক রুমে এক বিছানায় থেকেছো কি করে? তখন এই অতি সম্মানবোধ কোথায় ছিলো!”
রাহেলা উচ্চস্বরে বললেন…
—“ছি বউমা। নিজেদের শোয়ার ঘরের কথা এভাবে নির্লজ্জের মতো সবার সামনে বলছো কি করে? এখানে বাচ্চারাও আছে সে বিষয় কি খেয়াল নেই?”
শেফালি কিছু বলার পূর্বেই ঊর্মিলা বললো….
—“ভাবী তো তেমন আহামরি কিছু বলে নি আম্মা। আর বাচ্চাদের কথা বড় ভাইয়ার সর্বপ্রথম খেয়াল করা উচিত ছিলো। তারা ১-২ বছর হলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে আবব্ধ হন নি। প্রায় ১২ বছরের সংসার জীবন তাদের। তাদের মাঝে কোনো বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য হলে তা একান্তে সমাধান করে নেওয়া উচিত। বড় ভাইয়ার পাশে ভাবী বসলে তিনি খাবার শেষ না করে উঠে যাবেন এমন কথা বাচ্চাদের সামনে বলাটা কি তার খুব উচিত কাজ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে আপনার?”
ঊর্মিলার প্রতিত্তুরে ভিষণ রাগ ও বিরক্ত হন রাহেলা ও রাজিবুল দু’জনেই। উচিত সময় উচিত কথা বললে তা সহ্য না হওয়ারাই স্বাভাবিক। রাজিবুল রাগী স্বরে বললো….
—“রফিকুল তোর বউকে বল সীমা অতিক্রম না করতে। সাংসারিক কিংবা বাহ্যিক দুই ক্ষেত্রেই মেয়ে মানুষের মুখ এতো চলা ভালো না। আমি কিন্তু এসব সহ্য করবো না।”
ঊর্মিলা তেজী স্বরে বললো….
—“আপনি সেইসব কা*পুরুষের তালিকায় পড়েন যাদের ধারনা এতোটাই নিম্ন হয় যে, তারা মনে করে এ জগতে তারাই সর্বেসর্বা। তারা যেই কাজই করুক না কেনো সেটা খুব ভালো। সেটা অ*ন্যায় কাজ হলে কোনো নারী তার প্রতিবাদ করলেই শরীরে গিয়ে যেনো কাঁ*টা*র মতো বিঁ*ধে যায় তাদের। নারী জাতিকে, বিশেষ করে নিজের বউ, বাচ্চাদের পায়ের নিচে দা*বি*য়ে রাখার চেষ্টা আপনারা সর্বক্ষণ করে যান। আমি আপনার কথায় ভ*য় পাই না। আর না আপনি আমার মুখ বন্ধ করতে পারবেন।”
ঊর্মিলার কথায় এবার রাগ যেনো রাজিবুলের মাথায় চড়ে বসে। রাজিবুল নিজ চেয়ার থেকে উঠে দ্রুত পায়ে ঊর্মিলার সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে ওকে থা*প্প*ড় দেওয়ার জন্য উদ্যত হলে পিছন থেকে শেফালি রাজিবুলের হাত ধরে ফেলে। রাজিবুলের এমন উদ্দেশ্য দেখে রফিকুলও নিরব হয়ে বসে থাকতে পারে না। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় সে। রাজিবুল কিছু বলতে নেওয়ার পূর্বেই শেফালি রাজিবুলের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাত ছেড়ে দিয়ে স্বজোড়ে ওর গালে একটা থা*প্প*ড় দেয়। মূহূর্তেই মধ্যেই সম্পূর্ণ পরিবেশের রূপ বদলে যায়। রাহেলা অত্যন্ত অবাক হয়ে একহাত নিজের মুখের উপর রাখলেন। শেফালির এমন কাজে বাচ্চারাও অবাক দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ঊর্মিলার ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠেছে। রাজিবুল নিজের গালের উপর হাত রেখে নিজের দৃষ্টি মেঝের উপর স্থির করে রেখেছে। শেফালি তেজী স্বরে বললো…..
—“সাহস কি করে হলো তোমার ঊর্মিলাকে মারার জন্য ঊদ্যত হওয়ার! ভুলে যেও না সে তোমার বোন বা বউ না। সে তোমার ভাইয়ের বউ। তাঁকে উঁচু গলায় একটা কথা বলারও অধিকার নেই তোমার। এখানে তাঁর স্বামী উপস্থিত আছেন৷ যদি সে ভুল কিছু বলে থাকতো বা করতো তাহলে তাঁকে শা*ষণ করে নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার দায়িত্ব তাঁর স্বামী পালন করতো। ১০ জনের সামনে যদি তুমি নিজের স্ত্রীকে অসম্মান করো তাহলে সেই ১০ জনের ভিতর অন্তত একজন তোমার চোখে আঙুল দিয়ে ভুলটা অবশ্যই দেখিয়ে দিবে৷ একজন মানুষ হিসেবে তা করার তার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। তোমার আর তোমার মায়ের কথা মেনে নেই নি জন্য গতকাল থেকে তোমরা আমাদের নিজেদের বাধ্য বানাতে কম চেষ্টা করো নি। এখন যখন কোনোভাবেই নিজেদের কাজে সফল হতে পারছিলে না তখন বাচ্চাদের সামনে ছোট বানাতে এমন কাজ করলে। যার কোনো মানেই কেউ খুঁজে পাবে না। শুরু তুমি করেছিলে আর শেষটা আমি করছি। আগেও বলেছিলাম এখন আবারও বলছি, একবার যখন আমি সৎ পথে উঠেছি তখন তোমরা শত চেষ্টা করলেও আমাকে অসৎ পথে পরিচালনা করতে সফল হবে না। তাই নিজেদের কাছে নিজেদের সম্মান যদি প্রিয় হয়ে থাকে, তা একেবারে খোঁয়াতে না চাও তাহলে নিজের চিন্তা, চালচলন ও কাজে সীমা বজায় রাখো।”
লজ্জায়, অ*পমানে থম থমে ভাব ধারণ করেছে রাজিবুলের সম্পূর্ণ চেহারা। রাহেলা ও একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। শেফালি কাজ ও কথা তাকে-ও কিছুটা কা*বু করে দিয়েছে। সেইসময় মূল দরজা থেকে ‘রাহেলা’ বলে কারোর ডাকার আওয়াজ ভেসে আসে। রিজওয়ান আর মেহরিন সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছিলো। রিজওয়ান মূল দরজার দিকে লক্ষ্য করতেই নিজের বাবা শফিক সাহেবকে ভিতরে আসতে দেখে ওর চেহারায় এক অন্যরকম খুশির ছাপ স্পষ্ট হয়। মেহরিনের ঠোঁটেও হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। ডাইনিং স্থান ত্যগ করে ওরা সবাই আঙিনায় এসে দাঁড়ায়। স্থান ত্যগ করে না শুধু রাজিবুল। ঊষা আর শেহজাদ ‘দাদু ভাই’ বলে ছুটে গিয়ে শফিক সাহেবকে জড়িয়ে ধরে। শফিক সাহেব ওদের দু’জনের মাথায় আদুরে হাত বুলিয়ে দিয়ে ওদের দু’জনের কপালে ও গায়ে পরম স্নেহের পরশ এঁকে দেন। রাহেলা একের পর এক ধা*ক্কা যেনো মেনে নিতে পারছেন না। একেই বাড়ির অবস্থা বেগতিক। হাতের নাগাল থেকে বেড়িয়ে গিয়েছে তার বউমারা, মেয়ে, নাতি-নাতনিরা ও ছোট ছেলে তার মাঝে আজ আকস্মিক ভাবেই শফিক সাহেবের আগমন ঘটলো। এ বাড়ি ছাড়া হতে যে তার আর খুব বেশি সময় লাগবে তা ভেবেই এখন থেকে তার ভিতর অন্যরকম দু*শ্চি*ন্তা কাজ করছে।
রিজওয়ান ওর বাবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে নম্র স্বরে সালাম দিলে শফিক সাহেব দৃষ্টি অন্যদিকে স্থির রেখে গম্ভীর স্বরে সালামের উত্তর দিলেন। বাবার এমন আচারণে রিজওয়ানের বুকের ভিতরটা মো*চ*ড় দিয়ে উঠে। বিগত কয়েকদিন যাবৎ সে তার বাবার সাথে যোগাযোগ করার শত চেষ্টা করেও ব্য*র্থ হয়েছে। তবে কি ওর ধারণাই ঠিক হলো। ওর সৎ মা ইতিমধ্যেই ওর বাবার কান বি*ষ মন্ত্র দ্বারা ভরে দিয়েছেন! যার জন্যই আজ আকস্মিক ভাবে শফিক সাহেব উপস্থিত হলেন! রিজওয়ান একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছিয়ে গিয়ে মেহরিনের পাশে পুনরায় দাড়িয়ে পরে। মেহরিন সম্পূর্ণ বিষয়টাই লক্ষ্য করেছে। ওর কাছেও সম্পূর্ণ বিষয়টা পানির মতো স্বচ্ছ ও পরিস্কার। একে একে রফিকুল, ঊর্মিলা, শেফালি শফিক সাহেবকে সালাম জানায়। শফিল সাহেব ডাইনিং সাইডে তাকাতেই রাজিবুলকে সেখানে স্থির হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন….
—“কি ব্যপার, রাজিবুল ওখানে ওভাবে দাঁড়িয়ে আছে কেনো? আমার উপস্থিতি কি সে উপলব্ধি করতে পারছে না!”
রাহেলা জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো….
—“পারবে না কেনো! পেরেছে নিশ্চয়ই। মাত্রই খাওয়া শেষ করে উঠলাম আমরা সবাই। তাই হয়তো…!”
শফিক সাহেব ‘রাজিবুলের’ নাম ধরে ডাক দেন। রাজিবুল ডাক শুনতে পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই শফিক সাহেবকে দেখতে পেয়ে বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে আঙিনায় এসে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়।
(৬৪)
শরীফ রাজিবুলকে নিজের তীক্ষ্ণ নজর দ্বারা পর্যবেক্ষণ করে সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“আমার বিশ্রামের প্রয়োজন। এখন আমি রুমে যাচ্ছি। সকলে নিজ নিজ কাজে যাও। বিকেল বেলা ঠিক ৪ টে নাগাদ সকলের যেনো বাড়িতে উপস্থিত থাকা হয়।”
এই বলে শরীফ সাহেব নিজ রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরলেন। রাহেলা ও আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে শরীফ সাহেবের পিছন পিছন চলে গেলেন। রাজিবুল একবার রিজওয়ানকে রাগান্বিত চাহুনি নিয়ে দেখে শেফালিকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“শেফালি! এক্ষুণি রুমে এসো।”
এই বলে সে নিজেও স্থান ত্যগ করে। শেফালি একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বামী আজ্ঞা পালন করতে রুমে যায়। রফিকুল আর ঊর্মিলাও বাচ্চাদের নিয়ে রুমের দিকে অগ্রসর হয়। রুমি রিজওয়ানের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..
—“মা মা*রা যাওয়ার পর এই পৃথিবীতে আপন বলতে বাবা-ই আছেন। আজ আসার পর থেকে বাবা আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। বাবার ছায়াতল আমার উপর থেকে হারিয়ে গেলে আমি নিজেকে সামলাতে পারবো না বোন।”
রিজওয়ানের কথায় রুমির বুঝতে বাকি রয় না সে কি বুঝাতে চাইছে। রুমি শুকনো হাসি দিয়ে বললো….
—“সৎ ও ভালো মানসিকতার মানুষদের পাশে এই পৃথিবীর মানুষরা না থাকলেও পৃথিবীর ও মানবজাতির স্রষ্টা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা থাকেন। তার রহমতের ছায়াতল থেকে কেউ তাদের ব*ন্ঞ্চি*ত করতে পারে না কখনও। পৃথিবীতে এখনও অব্দি পা*পে*র রাজ্য তৈরি করা অমানুষদের ক্ষমতা এতোটাও বেড়ে যায় নি যে তারা আল্লাহ তায়ালার রহমতের ছায়াতলে থাকা তার বান্দাদের চুল পরিমাণ ও ক্ষতি করতে সক্ষম হবে। জীবন অনেক অ*ন্যায় করেছি তোমার সাথে ভাইয়া। কিন্তু এখন আল্লাহ আমার উপর থেকে অ*ন্যায়ের বোঝা হালকা করতে অনেক বড় একটা সুযোগ দিয়েছেন আমাকে। আমি সেই সুযোগকে বৃথা যেতে দিবো না। আম্মা আর বড় ভাইয়া বাবার মন বি*ষি*য়ে দেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন ঠিকই কিন্তু বাবার চোখের উপর থেকে তাদের ফেলানো মি*থ্যে ষ*ড়*য*ন্ত্রের পর্দা সরাতে আমি আমার শেষ র*ক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও চেষ্টা করবো৷ তোমার মাথার উপর থেকে এভাবে বাবার ছায়াতল সরে যেতে দিবো না আমি।”
রুমির কথাগুলো শুনে রিজওয়ান ও মেহরিনের হৃদয়জুড়ে পরম তৃপ্তি কাজ করতে শুরু করেছে। মেহরিনের দু’চোখে খুশির অশ্রুরা এসে ভীর জমিয়েছে। ওদের মনে সত্যের জয় হবেই তার কিছুটা আশ্বাস জেগেছে।
(৬৫)
শেফালি রুমে প্রবেশ করতেই রাজিবুল দরজাটা ভিতর থেকে আটকে দিয়ে শেফালির পিছন থেকে ওর মাথার চুলগুলো নিজের পাঁচ আঙুলের ভাঁজে নিয়ে দেওয়ালের সাথে ওর মুখের বামপার্শ চেপে ধরে রাগে রি রি করতে করতে বললো…..
—“খুব নারী শক্তি জেগে উঠেছে তোর মাঝে তাই না! সবার সামনে আমাকে এই রাজিবুলকে থা*প্প*ড় দিয়েছিলি তুই। কোন হাত দিয়ে যেনো থা*প্প*ড়*টা দিয়েছিলি! এই হাত তাই না! এই হাত!”
এই বলে রাজিবুল শেফালির ডান হাত ওর পিঠের পিছনে বেঁকে ধরে। গাল, চুল ও হাত তিন দিকের য*ন্ত্র*ণা*য় মুখ দিয়ে কেবল গো*ঙা*নি*র মতো আওয়াজ বের করছে শেফালি। দু’চোখ দিয়ে ঝর ঝর করে নোনাজলরা গড়িয়ে পড়ছে। রাজিবুল আবারও বললো…
—“সতি সাধ্যি সাজার শখ জেগেছে খুব। নিজের স্বামীর হুকুম অ*মান্য করে ঐ রিজওয়ানের পক্ষ নিবি তুই এমনটাই তো বলেছিলি তাই না! এই মুখ দিয়েই তো ঐ শব্দ গুলো বের করেছিলি তাই না!”
এই বলে রাজিবুল আরো শক্ত ভাবে শেফালির মুখ দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে। সে যেনো চাইছে দেওয়ালের ভিতর শেফালির সম্পূর্ণ শরীরটা ঢুকিয়ে দিতে। য*ন্ত্র*ণায় শেফালি মেঝের উপর পা দিয়ে আ*ঘা*ত করছে। রাজিবুল শেফালির কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে গিয়ে হি*স*হি*সি*য়ে বললো…..
—“শরীফ সাহেব এভাবে বাড়িতে হাজির হবেন এ বিষয়ে আমি পূর্ব থেকে অবগত ছিলাম না। বিগত দিনগুলো ধরে যা করে এসেছিস তার যে প্রভাব আমার উপর পরেছে তা আমি আমার মন ও মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিবো। তোকে আগের ন্যয় ভালোবাসবো। শেহজাদ আর তোকে নিয়ে আগের মতো সুখে-শান্তিতে সংসারও করবো কিন্তু আমার দু’টো শর্ত তোকে কোনো প্রশ্ন ছাড়া মেনে নিতে হবে। ১ম শর্ত হলো তোকে আগের মতো হয়ে যেতে হবে। সেই শেফালি হতে হবে যে ছিলো অত্যন্ত লো*ভী, স্বামী-সন্তান বলতে অ*ন্ধ। স্বামীর সকল কাজে যে সমানতালে সঙ্গ দিতো। রিজওয়ান আর ওর স্ত্রী ছিলো যার দু’চোখের বি*ষ। ২য় শর্ত হলো আজ বিকালে যখন বাবা বৈঠক বসাবেন তখন আমার আর আম্মার বুঝানো কথার প্রেক্ষিতে তিনি তোকে যা যা প্রশ্ন করবেন তার উত্তর আমার মন মতো করে দিবি। সেখানে আমার বিরোধিতা করে কিছু বলবি না। যদি আমার শর্তগুলো না মানিস, আজ তোর জন্য আমি বাবার সামনে ফেঁ*সে গেলে এই বাড়ি ও যাবতীয় সয়-সম্পত্তি থেকে বন্ঞ্চিত হলে তোকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না৷ এ বাড়ি থেকে আমার বেড়িয়ে যেতে হলে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ির সামনে গেইটের উপর তোর লা*শ ঝুলন্ত অবস্থায় পাবে ওরা। আমার হাত থেকে তখন তোকে কেউ বাঁ*চাতে পারবে না।”
এই বলে রাজিবুল শেফালিকে ছেড়ে দিয়ে রুমের দরজা খুলে বাহিরে চলে যায়। শেফালি দেওয়াল ঘেঁষে মেঝের উপর বসে পরে। ওর দু’চোখ দিয়ে এখনও নোনাজলরা গড়ে পড়ছে। কিয়ৎক্ষণ নিরবে কান্না করার পর শেফালি একহাত দিয়ে নিজের অশ্রু গুলো মুছে নিয়ে বললো…..
—“এতো তাড়াতাড়ি আমাদের ১২ বছরের গড়ে তোলা ভালোবাসার সমাপ্তি ঘটবে আমি ভাবি নি।”
—“আমার এক কথায় তুমি সত্যিই চলে আসবে আমি ভাবতে পারি নি গো। আসার আগে জানাও নি যে এটা অনেক ভালো করেছো। নয়তো তোমার মুখোশধারী ছেলে তোমার সামনে সত্যের প্রকাশ যেনো না ঘটে তার জন্য আরো বড় কোনো ষ*ড়*য*ন্ত্র তৈ……!”
রাহেলা সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারে না। তার পূর্বেই শরীফ চোখ বন্ধ অবস্থায় নিজের হাত উঁচিয়ে রাহেলাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন…..
—“আমার বিশ্রামের প্রয়োজন। যা বলার বিকালে সবার সামনে বলিও। এখন নিরব থাকো।”
শরীফের এরূপ কথায় অ*স*ন্তু*ষ্ট হন রাহেলা। তবুও নিজের অ*স*ন্তু*ষ্টি ভাবকে নিজের মধ্যেই দাবিয়ে রেখে শরীফের পাশ থেকে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে যান।
(৬৭)
নিজরুমে বিছানায় পাশাপাশি বসে আছে ঊর্মিলা আর রফিকুল। ঊর্মিলার চেহারায় অসন্তুষ্টি ও রাগের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। রফিকুল ও নিরব হয়ে বসে আছে। নীরবতার দেওয়াল ভে*ঙে ঊর্মিলা বললো…..
—“কা*পুরুষের মতো ডাইনিং টেবিলে বসে অনরগল ভাবে খাবার গুলো গিলতে একটুও লজ্জা করছিলো না তোমার তাই না?”
ঊর্মিলার এরূপ প্রশ্নে অবাক হয় না রফিকুল। শান্ত স্বরে সে বললো…..
—“কি করতাম আমি তখন!”
—“কি করতে মানে! তোমার ভাই আমার শরীরে হাত উঠানোর জন্য উদ্যত হয়েছিলো মাঝখানে ভাবী না আসলে আমার গালে আজ তোমার ভাইয়ের থা*প্প*ড়ে*র দাগ জ্বল জ্বল করতো। এতো বড় একটা ঘটনা দেখেও জিজ্ঞাসা করছো তুমি কি করতে?”
—“ওখানে ভাবীর হয়ে ওভাবে কথা না বললেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না৷ কে বলেছিলো তোমায় মুখের লা*গা*ম ছুটাতে!”
—“অ*ন্যায়ের প্র*তি*বাদ করতে জানো না আর আমাকে বলতে এসেছো আমি কেনো মুখের লা*গা*ম ছু*টি*য়েছি! আজ বিকালে বাবার সামনে যদি নিজের মা আর ভাইয়ের সমর্থন নিয়ে একটা কথাও বলেছো তাহলে তোমার পুরুষত্বের যে ছিটেফোঁটাও বাকি আছে তা ঘু*চি*য়ে হাতে চুড়ি পড়িয়ে ঘরে বসে রাখবো আমি বুঝলে!”
এই বলে ঊর্মিলা রফিকুলের মুখ ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের ভিতরে প্রবেশ করে। ঊর্মিলার এমন কাজে রফিকুলের সম্পূর্ণ শরীর যেনো মুহূর্তের মধ্যেই ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে। সে নিজের মুখে হাত বুলাতে বুলাতে বার কয়েক শুকনো ঢো*ক গি*লে।
(৬৮)
বিকেল বেলা,
রিজওয়ানদের বাড়ি জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। আঙিনায় মাঝ বরাবর চেয়ারে বসে আছেন শরীফ সাহেব। তার পাশে রাজিবুল, রাহেলাও বসে আছে। বাকিরা সবাই দাঁড়িয়ে আর বাচ্চারা নিজ নিজ রুমে আছে। শরীফ সাহেব তীক্ষ্ণ নজরে সকলকে একবার দেখে নিয়ে রাজিবুলকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“রাজিবুল, তোমার নাকে এই বে*ন্ডে*জটা কিসের! আ*ঘা*ত পেলে কি করে?”
রাজিবুল রিজওয়ানের দিকে একপলক তাকিয়ে বললো….
—“বাবা, আমি আর রফিকুল তো আপনার সৎ সন্তান। আপনি আমাদের জন্ম দেন নি। আপনার সাথে, এই বংশের সাথে আমাদের র*ক্তে*র কোনো সম্পর্ক নেই। আমাদের জন্মদাত্রী মা’য়ের সাথে আপনি ২য় বার বৈবাহিক বন্ধনে আবব্ধ হয়েছিলেন সেই সূত্রে আপনি আমাদের বাবা আর আমরা আপনার সন্তান। কিন্তু সৎ যে সৎ ই হয়, সৎ কে কখনও আপন ভাবা যায় না এমন চিন্তার ও বহিঃপ্রকাশ বিগত ১৭ বছর ধরে এই বাড়িতে আমরা থাকাকালীন সময়ে বহুবার। এটা অস্বীকার করবো না যে, আপনি আমাদের সন্নিকটে থাকাকালীন কখনও বাবার অভাব কিংবা অন্য কোনো কিছুর অভাব অনুভব করতে দেন নি৷ আমরা যেনো স্বচ্ছল ভাবে নিজেদের জীবন কাটাতে পারি তাই আপনি নিজের পরিবার, দেশকে ছেড়ে প্রবাসে গিয়ে থেকেছেন। নিজের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দিন-রাত পরিশ্রম করে আমাদের জন্য অর্থ পাঠিয়েছেন। কিন্তু সত্যি কথা বলতে আপনার রোজগার করা অর্থ ও এ বাড়ির সয়-সম্পত্তির উপর আমার কিংবা আমার ছোট ভাই রফিকুলের কোনো অধিকার নেই এটাও আমাদের খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা যে উড়ে এসে জুড়ে বসা মানুষ এমন চিন্তা রাখার মতো মানুষও যথেষ্ট আছে এ বাড়িতে। আমরা এ বাড়ির কোনো কাজে, কোনো সিদ্ধান্তে মতামত পেষণ করতে পারি নি কখনও আর পারবোও না এমনটাও আমাদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আপনার অগোচরে। যখন এসব অ*ন্যায় অ*ত্যা*চার সহ্য করতে না পেরে আমি জোর খাটানোর সামান্যতম ও চেষ্টা করতাম তখনই রিজওয়ান আমাকে যা*চ্ছে তাই ভাবে মারতো। সেসব ক্ষ*ত শুকিয়ে গিয়েছে শরীর থেকে ঠিকই কিন্তু মনের উপর যে দা*গ গুলো বসেছে তা মৃ*ত্যু না হওয়া পর্যন্ত ভোলা সম্ভব না। কিছুদিন আগেই আমার নাকে বা*জে ভাবে আ*ঘা*ত করেছিলো রিজওয়ান। যার ফলস্বরূপ আজও আমি আমার নাক থেকে ব্য*ন্ডে*জটা খুলতে পারি নি।”
রাজিবুলের মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে রিজওয়ান বা উপস্থিত কেউ ই বিন্দুমাত্র অবাক হয় নি। কারণ রাজিবুল যে রিজওয়ানকে ফাঁ*সা*তে এমন কিছুই বলবে তা সবাই আগে থেকেই খুব ভালো ভাবে বুঝতে পেরেছিলো। শফিক সাহেব গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে বসে আছেন। রাজিবুলের কথার তালে তাল মিলিয়ে রাহেলা ন্যকা কান্নার স্বরে বললেন….
—“এ সংসারকে ও রাজিবুল-রফিকুল-রুমির মতো রিজওয়ানকেও আমার সন্তান হিসেবে গ্রহন করেছিলাম আমি। ওর ভালো লাগা, খারাপ লাগা, ইচ্ছে-অনিচ্ছা গুলোর দিকে সর্বদা সতর্ক থাকতাম। তবুও আমরা কেউ ওর মনে বিন্দুমাত্র জায়গা করে নিতে পারি নি। সর্বদা আমাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করে এসেছে ও। রাজিবুল-রফিকুল এ বংশের সন্তান নয় বলে ওদের উঠতে বসতো খোঁ*টা দিয়ে এসেছে। সাংসারিক অ*শান্তি এড়াতে এতোগুলো বছর ধরে আমরা সবাই ওর সকল অ*ন্যায়, দূ*র্ব্যবহার মুখ বুঝে সহ্য করে এসেছিলাম।
সহ্য করতে করতে এখন আমাদের সব সহ্যক্ষমতা শেষ হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি যাকে বলে। তুমি এ বাড়ির প্রধান কর্তা। নিজের ১ম স্ত্রীর সন্তানের করা অ*ন্যায় গুলোকে সাপোর্ট করবে নাকি আমাদের উপর হওয়া অ*ন্যায়, অ*বিচারের জন্য রিজওয়ানকে শা*স্তি প্রদান করবে সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নাও।”
এই বলে রাহেলা থেমে যায়। শরীফ সাহেব চোখ তুলে রাহেলার দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“এক পাক্ষিক মতামত শুনে বিচার করলে সেটাকে সঠিক বিচার বলবে না কেউ রাহেলা। তোমরা তোমাদের মত পেষণ করলে ঠিক আছে। এবার রিজওয়ানের মুখ থেকে আমার শোনা উচিত সে আসলে তোমাদের নিয়ে কেমন চিন্তাধারা রাখে।”
রাজিবুল কিছুটা বিরক্তির স্বরে বললো….
—“ওর মতামত শোনার কি আছে এখানে বাবা! ও তো এখন নিজেকে বাঁচাতে আমাদের বিরুদ্ধে উল্টো-পাল্টা কথা বলবেই। দুই পাক্ষিক মতামত শুনে তোমারই বরং একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হবে।”
রাহেলা ন্যকা কান্নার স্বরে বললেন….
—“থাম রে বা’জান, থাম তুই। তোর বাবার আমাদের প্রতি থাকা বিশ্বাসের জায়গাটা যে ঠিক কতোটা মজবুত তা তার কথার মধ্য দিয়েই বোঝা হয়ে গিয়েছে আমার। আমরা এতোগুলো বছর ধরে অ*ন্যায়-অ*ত্যা*চার সহ্য করে আসতে পেরেছি যখন তখন রিজওয়ানের মুখ থেকে আমাদের নিয়ে মি*থ্যে রটনা গুলোও শুনে সহ্য করে নিতে পারবো। তোর বাবা যদি আজ নায্য বিচার না করেন তাহলে আমাদের এক কাপড়ে এ বাড়ি থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার মতো মানসিক শক্তি আছে।”
শরীফ সাহেব বললেন….
—“তোমরা যদি সত্যি বলে থাকো তাহলে তোমাদের আমার সিদ্ধান্তের উপর ভরসা রাখা উচিত। ভালো-খারাপ, সত্য-মি*থ্যার মধ্যে পার্থক্য বোঝার বয়স আমার যথেষ্ট হয়েছে। এমনি এমনিই মাথার সব চুলগুলো সাদা বর্ণ ধারণ করে নি। তাই অহেতুক কথা বাড়িয়ে সকলের মূল্যবান সময় ন*ষ্ট করো না তোমরা।”
রাহেলা আর রাজিবুল এবার নিরব হয়ে যায়। শরীফ সাহেব রিজওয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন…..
—“রিজওয়ান, তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো তুমি আমার কাছে তোমার মায়ের রেখে যাওয়া মহা মূল্যবান আমানত। তোমার দিকে আমি যখন-ই তাকাই তখন-ই তোমার মায়ের মায়া মাখানো, মন জুড়ানো মুখশ্রী আমার সামনে জ্বল জ্বল করে ভাসে। তোমার মা’কে আমি বড্ড ভালোবাসতাম। আজও আমার হৃদয়ের গহীনে তোমার মায়ের জন্য ভালোবাসা বেঁচে আছে। সে আমাদের সঙ্গে না থাকলেও আমার মন ও মস্তিষ্ক জুড়ে বেঁচে আছে। ওর সাথে কাটানো ১০ বছরের সংসার জীবনের সুমধুর সময়গুলোর স্মৃতি আমি আজও ভুলতে পারি নি মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তা ভোলা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সংসারের খরচ যোগানোর জন্য আমাকে কাজ করতে বাহিরে যেতে হবে। এই এতো বড় বাড়ি জুড়ে সদ্য মা হারা ৯ বছরের শিশু সন্তান তোমাকে একলা রেখে যাওয়া আমার পক্ষে অ*সম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। তোমার একাকিত্ব দূর করতে, তোমাকে মায়ের ভালোবাসা, ভাইয়ের স্নেহ দিতে পারবে এমন চিন্তা করেই আমি রাহেলার সাথে ওর দুই ছেলে সন্তান সমেত ২য় বার বৈবাহিক বন্ধনে আবব্ধ হওয়ার মতো এতো বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আজ দীর্ঘ ১৭ বছর পর এসে আমাকে শুনতে হচ্ছে তুমি ওদের কাওকে নিজের আপন মনে করো নি কখনও। ওদের সাথে দূ*ব্যবহার করেছো। এমনকি রাজিবুল যে তোমার থেকে ৬ বছরের বড় তার শরীরেও যখন ইচ্ছে তখন যা*চ্ছে তাই ভাবে আ*ঘা*ত করেছো। ওদের খোঁ*টা দিয়েছো। এসব কি তুমি সত্যিই ঠিক করেছো?”
রিজওয়ান কিছু বলার পূর্বেই রাহেলা বললেন……
—“এমন ইমোশনাল ভাবে কথা বলে তুমি রিজওয়ানকে আরো সাহস দিচ্ছো আমাদের নামে বানোয়াট কাহিনী সাজানোর জন্য৷ একটু কঠিন হ……!”
রাহেলা সম্পূর্ণ কথা শেষ করার পূর্বেই শরীফ সাহেব রাহেলার দিকে রাগে ভরপুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। সঙ্গে সঙ্গেই রাহেলার বাকিগুলো গলা পর্যন্ত এসেও আটকে যায়। রাহেলা শরীফ সাহেবের দৃষ্টি উ*পে*ক্ষা করতে না পেরে গলায় বে*ধে যাওয়া কথা গুলো বার কয়েক ঢো*কের সাহায্যে গি*লে নেন। রুমি বললো….
—“বাবা আমি কিছু বলতে চাই।”
শরীফ সাহেব অনুমতি দিলে রুমি পুনরায় বললো….
—“বাবা, আপনি আমাকে অনেক ভালোবাসেন আমি জানি। আপনি আম্মা, বড় ভাইয়াকেও যথেষ্ট ভালোবাসেন এ কথাও আমি জানি। রিজওয়ান ভাইয়ের বিরুদ্ধে তাদের করা এই অ*ভি*যোগের সম্পূর্ণ বি*রো*ধীতা করছি আমি। কারণ রিজওয়ান ভাইয়ের. নামে এতো সময় ধরে আম্মা আর বড় ভাইয়া যা যা বলেছেন মূলত সেগুলোই ছিলো বানোয়াট ঘটনা। আপনি ওদের এক পাক্ষিক কথার উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেন নি দেখে ভিষণ ভালো লাগলো। আপনি বড় ও মেজো ভাবী এমনকি শেহজাদ, ঊষার মুখ থেকেও আসল সত্যটা শুনতে পারবেন। কারণ মি*থ্যু*করা শত চেষ্টা করলেও সমাজের চোখের সামনে থেকে সত্যের পর্দা সরিয়ে মি*থ্যার পর্দা ফেলতে সক্ষম হবেন না। সত্যের জয় সবসময় হবেই। বাচ্চারা অন্তত আমরা বড় মানুষদের মতো গুছিয়ে মি*থ্যা কথা বলতে পারবে না।”
রুমির মুখে এরূপ কথা গুলো শুনে তেলে-বেগুনে শরীর জ্ব*লে উঠে যেনো রাজিবুলের। কিন্তু বাবার সামনে তার বহিঃপ্রকাশ করতে পারবে না।
(৫৪)
রিজওয়ানের মু*চ*ড়ে ধরা সেই হাতে হাত বুলাতে রাজিবুল আঙিনা থেকে সোজা নিজের মা রাহেলা বেগমের রুমে এসে দরজার পাশে থাকা ছোট টেবিলের উপর রাখা ফুলদানিটা হাতে নিয়ে স্বজোরে মেঝের উপর আ*ছা*র মা*রে। রাহেলা বিছানার কর্ণিশে দাঁড়িয়ে নিজের পানের বাটি সাজাচ্ছিলেন। আকস্মিক কিছু ভাঙার শব্দ শুনতে পেয়ে তিনি কিছুটা ভরকে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই রাজিবুলকে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে দেখলেন। রাহেলা দ্রুত পায়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে আসতেই মেঝের উপর কাঁচের ফুলদানির অংশগুলো কয়েকশত টুকরোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেখতে পেয়ে বললেন….
—“রাজিবুল! বা’জান আমার, কি হয়েছে তোর? ফুলদানিটা ভাঙলি কেনো? তোকে দেখেও তো মনে হচ্ছে অনেক রেগে আছিস। ঐ রিজওয়ান আর ওর বউ আবার কিছু করেছে নাকি!”
রাজিবুল রাগী স্বরে বললো….
—“ওরা নিশ্চুপ থাকে কখন মা! যেদিন থেকে রিজওয়ান আমাদের মুখে মুখে কথা বলতে শুরু করেছে সেদিন থেকে এই বাড়িটা আমার জন্য জা*হা*ন্না*মে পরিণত হয়ে গিয়েছে। আমার যেনো কোনো ক্ষমতাই নেই এ বাড়িতে। পুরো রাজত্ব ঐ রিজওয়ানের। আমার থেকে শারিরীক দিক দিয়ে একটু বেশি সক্ষম হওয়ায় যখন তখন আমাকে আ*ঘা*ত করে বসে ও। এখন তো আমার ধৈর্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে। শেফালি আর ঊর্মিলার মতো মেয়েদেরও নিজেদের বশে করে নিয়েছে ওরা। আমাদের দল এখন পাতলা হয়ে গিয়েছে মা। রফিকুলকে তো চিনোই। বউ বলতে অ*ন্ধ সে। বউ যা বলবে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই স্বভাব ওর। আজ শেফালি আর ঊর্মিলাকে হাত করে নিয়েছে ঐ রিজওয়ান আর ওর বউ। কাল ঊর্মিলাকে দিয়ে রফিকুলকেও নিজেদের হাতের পুতুল বানিয়ে ফেলবে। বাবা পুনরায় দেশে ফিরলে শুধু মাত্র তোমার আর আমার কথা মেনে নিয়ে রিজওয়ান আর ওর বউকে এ বাড়ি থেকে বের করে দিবে না আমি নিশ্চিত।”
—“দরজা বন্ধ কর। আর সাবধানে বিছানায় এসে বোস। তোকে তো একটা বিষয় সম্পর্কে এখনও জানানোই হয় নি।”
রাজিবুল নিঃশব্দে মায়ের কথা মেনে নিয়ে দরজা আটকে দিয়ে সাবধানে বিছানায় এসে বসে। রাহেলা রাজিবুলের সম্মুখপানে বসে বললেন….
—“শরীফ সাহেবের কানে বি*ষ মন্ত্র আমি অনেক আগেই ঢেলে দিয়েছি। আর কাজটা এতোই নিঁখুত ভাবে শেষ করেছি আমি যে শরীফ সাহেব দেশে আসার পর আমাদের কথার গুরুত্বই বেশি দিবেন। আর রইলো শেফালি আর ঊর্মিলার উপর থেকে আমার সতীনের ছেলের বশ ম*ন্ত্র কাটানোর বিষয়! সেটা করা আমাদের বা হাতের খেলা। ভুলে যাস না তোর একটা ছেলে আছে আর রফিকুলের একটা মেয়ে আছে। ওরা দু’জনই ওদের মায়েদের কলিজার ধন। যদি শেফালি আর ঊর্মিলা আমাদের কথানুযায়ী কাজ না করে রিজওয়ান আর ওর বউয়ের দলে যোগ দেয় তাহলে ওদের সংসার জীবন ও মা ধর্মের সমাপ্তি খুব শীঘ্রই ঘটিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করবো আমরা। ছেলে-মেয়েদের থেকে কিছুদিন দূরে থাকলেই সব ভীমরতি ছুটে যেতে বাধ্য হবে।”
—“শেফালিকে কন্ট্রোলে আনার দায়িত্ব তোর বা’জান। আর ঊর্মিলাকে কন্ট্রোলে আমি আনবো। আর সেটা আজই৷”
অনেকদিন ধরেই নিজের আসলে রূপ দেখাই না বউমাদের।
(৫৫)
রিজওয়ান শেফালির সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…..
—“বড় ভাবী…একটা কথা মনে রাখবেন অ*ন্যায় যে করে আর অ*ন্যায় যে সহে দু’জনেই সমপরিমাণ অপ*রা*ধের অপ*রা*ধী হয়। এই বাড়িতে আসলে মানুষ কে আর মানুষরূপী ‘কা * ল সা * প’ কে বা কারা তা আপনাদের ২জনের একজনকেও ভেঙে বুঝিয়ে দিতে হবে না। এই ক্ষণকালীন এক জীবনে ভালো থাকার জন্য অ*ন্যায় কারীদের সঙ্গ দিতে গিয়ে মৃত্যুর পরের চিরস্থায়ী জীবনকে ধ্বং*সের মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো ভু*ল করবেন না। নিজে শক্ত থাকুন ও অ*ন্যা*য়ের বিরুদ্ধে প্র*তি*বাদ করুন। এর ফলে পুরো দুনিয়া আপনাদের বিপক্ষে চলে গেলেও আপনাদের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে এই ছোট ভাই টা।”
এই বলে রিজওয়ান মেহরিনকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে নিজেদের রুমে চলে যায়। শেফালি আর ঊর্মিলা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রিজওয়ানের বলে যাওয়া প্রতিটি শব্দ এখনও যেনো ওদের কানে বাজছে।
মেহরিন আর রিজওয়ান নিজরুমে আসার পর মেহরিন বললো….
—“চেয়ারম্যনের ছেলে জিহাদের সাথে রুমির বিষয়ে কথা বলতে চেয়েছিলে তো, এখনও বলা হলো না তোমার!”
—“একটার পর একটা স*ম*স্যা লেগেই আছে। বসের ছোট্ট মেয়েটার কি ক*রু*ণ অবস্থা যাচ্ছে। জানি না কতোদিনে সুস্থ হয়ে উঠবে ঐ ছোট্ট বাচ্চাটা। আবার বাড়িতে অ*শান্তি করার মানুষের তো অভাব নেই। বাবার সাথেও কোনো যোগাযোগ করতে পারলাম না এখনও। যখনই কল করছি ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। অনলাইন এ’ও এক্টিভ হয় নি সেদিনের পর থেকে। সবকিছুর ভিড়ে জিহাদের সাথে কথা বলার বিষয়টা আমার মাথা থেকেই বেড়িয়ে গিয়েছিলো। আজ বিকালে আমি জিহাদের সাথে দেখা করবো। আমার ফোনটা নিয়ে রুমির কাছে যেও একবার। জিহাদের ফোন নাম্বারটা নিতে হবে। আর ওকে বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে যে পার্কটা আছে ওখানে ৪ টার পর আসতে বলতে হবে।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে।”
(৫৬)
শেফালি নিজরুমে প্রবেশ করতেই দেখে রাজিবুল ওদের ছেলে শেহজাদকে নিয়ে বিছানায় বসে আছে। রাজিবুল শেহজাদকে কোনো একটা বিষয় নিয়ে বুঝাচ্ছিলো। শেফালিকে দেখা মাত্র সে চুপ হয়ে যায়। শেফালি কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও রাজিবুলকে কিছু না বলে বিছানার একপার্শে বসে শেহজাদকে নিজের কাছে ডাকে। কিন্তু শেহজাদ শেফালিকে অবাক করে দিয়ে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে রুমের বাহিরে চলে যায়। শেফালি অবাক হয়ে শেহজাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। নিজের কাজে সফল হয়েছে কিছুটা দেখে রাজিবুলের ঠোঁটের কোনে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। শেফালি রাজিবুলের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“শেহজাদকে আমার বিরুদ্ধে কি উল্টো পাল্টা বুঝালে তুমি এতো সময় ধরে রাজিব?”
রাজিবুল কোনো প্রতিত্তুর করলো না। শেফালি আবারও বললো….
—“যেই ছেলে মা ছাড়া কিছুই বুঝতো না। সব কাজে, ভালো লাগা-খারাপ লাগায় যার সঙ্গী ছিলাম আমি আজ তাঁকে নিজের কাছে ডাকায় সে কি না ছুটে বাহিরে চলে গেলো! এটা তো নরমাল বিষয় লাগছে না আমার। কি বলেছো তুমি আমার ছেলেকে রাজিব? আমি উত্তর চাই।”
রাজিবুল বাঁকা হেসে বললো….
—“অনেক লম্বা সময় দিয়েছিলাম তোমায় নিজেকে শুধরে নাও। তোমার এই পরিবর্তন ও অতি ভালো মানুষি চাল-চলন মোটেও পছন্দ হয় নি আমার। কিন্তু আমার কথা তুমি ভিষণ ই সাধারণ ভাবে নিয়েছো। আজ তোমার জন্য রিজওয়ান আবারও আমার শরীরে হাত দেওয়ার সাহস দেখিয়েছিলো। কি ভেবেছিলে তোমার এই কর্মকান্ডের জন্য কোনো ফল তুমি ভোগ করবে না! এতো সহজে ছেড়ে দিবো আমি তোমায়!”
শেফালি রাগী স্বরে বললো….
—“তুমি যে আসলে কতো বড় অ*মানুষ তা আমার বোঝার বাকি নেই। ভালো ভাষায় বলে নিজের অ*ন্যায় কাজের সঙ্গী হিসেবে পাচ্ছো না আমায় তাই আমার দূর্বলতাকে ব্যবহার করছো। আমার প্রতি ছেলের মন বি*ষি*য়ে দিয়ে ওকে আমার থেকে দূরে সরানোর মতো নিম্ন কাজে নেমেছো। তবে একটা কথা কান খুলে শুনে রাখো, তোমাদের মতো অ*মানুষদের সঙ্গ দিয়ে বিগত ১২ বছরে অনেক অ*ন্যায় করেছি, অনেক পা*প করেছি, ভালো মনের মানুষদের সাথে দূ*ব্যবহার করেছি, মুখের অ*প*ব্যবহার করেছি কিন্তু এখন থেকে আর সেসব করবো না। তুমি যতো নিচে নামার নামতে পারো। আমি সৎ পথে যখন একবার উঠেছি এ পথ ছেড়ে অ*সততার পথে আর পা বাড়াবো না কখনও। সৎ পথে চলতে গিয়ে যদি আমাকে আমার সংসার ও সন্তান উভয়কেই হারাতে হয় তাতেও কোনো আফসোস থাকবে না।
এই বলে শেফালি রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। শেফালির বলা কথাগুলো শুনে রাগে রাজিবুলের সর্বশরীর থর থর করে কাঁপছে যেনো। এই কোন শেফালিকে দেখছে সে! এই শেফালি তো সম্পূর্ণ নতুন রূপ নিয়ে দাঁড়িয়েছিলো তার সামনে। একে কি আদেও কা*বু করা সম্ভব হবে না রাজিবুলের পক্ষে!
(৫৭)
ঊর্মিলা সবেমাত্র গোসল সেরে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়েছে সেইসময় রফিকুল রুমে প্রবেশ করে তাড়া দিয়ে বললো….
—“আম্মা তোমাকে এক্ষুণি তার রুমে যেতে বলেছেন। জরুরী কোনো বিষয় নিয়ে তার তোমার সাথে কথা বলার আছে বললেন।”
ঊর্মিলা চুল মুছতে মুছতে বললো….
—“আচ্ছা।”
মিনিট পাঁচ পেরিয়ে গেলেও ঊর্মিলাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজের শারীরিক যত্ন নিতে দেখে রফিকুল কিছুটা রাগী স্বরে বললো….
—“মায়ের কাছে যেতে বলেছি, কোনো পাত্রপক্ষের সামনে বসতে বলি নি যে এতো যত্ন নিয়ে সাজতে হবে তোমায় এখন!”
রফিকুলের এমন কথায় বিরক্ত হয় ঊর্মিলা। রফিকুলের দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো….
—“তোমার মা’কে দেখানোর জন্য আমি সবসময় পরিপাটি হয়ে থাকি না। সবেমাত্র গোসল সেরে বের হয়েছি। ভেজা চুলগুলো মুছে চিরুনিই করছিলাম যা এতেই অতিরিক্ত সাজগোছ করা হলো আমার! আর এতো তাড়া দেওয়ারই বা কি আছে এখানে? তোমার মা ডেকেছে বলেছো আমি শুনেছিও। এখন যখন আমার সময় হবে আমি যাবো।”
রফিকুল কিছুটা আটকানো স্বরে বললো….
—“তুমি নিজেই তো বলেছিলে আম্মার সঙ্গ হয়ে থাকতে সবসময়। বড় ভাইয়া রুমিকে ব্যবহার করে বাহ্যিক থেকে সম্পত্তি, টাকা-পয়সা হ*র*ণ করবে আমরা যেনো ঘরোয়া সম্পত্তি গুলো হ*র*ণ করতে পারি তার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি তো সেই কথা ভেবেই তাড়া দিলাম তোমায়। আম্মা কি বলে তা দ্রুত শুনতে যাও।”
ঊর্মিলা শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে রফিকুলের পাশে এসে বসে ওর হাতের উপর নিজের হাত রেখে বললো…..
—“বহুবছর ধরে আমরা মরুভূমির পথ ধরে হেটে যাচ্ছিলাম। সামনে পানি আছে মনে করে মরিচিকার পিছনে ছুটছিলাম। আমাদের চোখের সামনে পরে থাকা লো*ভে*র পর্দাটা সরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। কে আমাদের আসলে আপন আর কে আমাদের পর তা আমরা একটু ভালো ভাবে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারবো। একটা সত্য কথা শুনতে তিক্ত লাগলেও বলতে হচ্ছে আমায়। তোমার বড় ভাই কেবল নিজের স্বার্থ টা বুঝেন। নিজের স্বার্থ হাসিল করার জন্য উনি নিজের মা, বোন, ভাই সবাইকেই ব্যবহার করবেন কেবল। যখন তার স্বার্থ পুরোপুরি ভাবে হাসিল হয়ে যাবে তখন তিনি তোমাদের সবাইকে আ*স্তা*কুঁ*ড়ে ছুঁ*ড়ে ফেলে দিতে দু’বার ভাববেন না। তোমার মায়ের কাছে তোমার ও রুমির গুরুত্ব ততোটা নয় যতোটা তোমার বড় ভাইয়ের গুরুত্ব রয়েছে। নয়তো নিজের ছেলের ভালোর কথা চিন্তা করে মা হয়েও নিজের মেয়েকে কো*র*বা*নির প্রাণী বানাতে পারতেন না। কাল তোমার বোনের মতো তোমাকেও যে কু*র*বা*নি*র প্রাণী ঐ মহিলা বানাবেন না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই৷”
—“আপন বলতে কি তুমি রিজওয়ান আর ওর স্ত্রীকে বুঝাচ্ছো ঊর্মি!”
—“রিজওয়ান আর মেহরিনের সাথে আমরা কম দূর্ব্যবহার করি নি বিগত সময়ে। তবুও সব ভুলে গিয়ে সেদিন মেহরিন নিজের জীবনের ঝুঁ*কি নিয়ে আমাদের মেয়েকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়েছিলো। ওদের এই ঋণ কি অস্বীকার করতে পারবে তোমরা! আম্মাকে এসে যখন ঊষাকে মেহরিনের এ*ক্সি*ডে*ন্ট হওয়া থেকে বাঁচানোর কথা বললাম আম্মা দায়সারা ভাবে বললেন সেখানে অন্য কেউ হলেও এমন কাজ করতো৷ এরপর বড় ভাবীকে নিয়ে আমরা হাসপাতালে রাত কাটালাম জন্য আজ বড় ভাইয়া বড় ভাবীর সাথে দূ*র্ব্য*বহার করলেন, গাঁয়ে হাত উ*ঠা*তেও নিয়েছিলেন কিন্তু বড় ভাবীর সামনে ঢাল হয়ে রিজওয়ান দাঁড়িয়েছিলো। ওরা তো চাইলেই আমাদের দূ*র্ব্যবহারের কথা স্মরণ করে আমাদের ক্ষ*তি হতে দেখতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা নিতো। ওরা এমন করে নি কারণ ওরা সৎ ও ভালো মানসিকতার অধিকারী। বিশ্বাস যদি চোখ বন্ধ করে কাওকে করা যায় তাহলে সেই তালিকায় রিজওয়ান ও মেহরিন ই থাকবে কেবল তোমার মা বা ভাই নয়। আর আমি এ’ও জানি এখন তোমার মা আমাকে শা*ষা*বেন জন্যই ডেকে পাঠিয়েছেন। হয়তো আমাদের সম্পর্ক ও ঊষার কথা বলে আমাকে মানসিক ভাবে দূর্বল করানোর চেষ্টা করবেন, বাধ্য করবেন ওনাদের সঙ্গ দিতে। কিন্তু আমি তোমাকেই পরিষ্কার ভাষায় একটা কথা বলে দিচ্ছি। আম্মা বা বড় ভাইয়া হাজার চেষ্টা করলেও আমার মন তাদের দিকে আর কখনও ঘুরাতে পারবে না। এবার থেকে আমি সৎ ও ভালো মানসিকতার মানুষদের সাথে থাকবো, নিজের সবটুকু দিয়ে তাদের সাহায্য করবো এতে আমার সাথে যা হওয়ার হউক।”
এই বলে ঊর্মিলা রফিকুলের পাশ থেকে উঠে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। উদ্দেশ্য রাহেলার রুমে যাওয়া।
(৫৮)
শ্বাশুড়ি মা রাহেলা বেগম এর রুমে প্রবেশ করতেই ঊর্মিলা দেখলো তিনি ঊষাকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। ঊর্মিলা ঊষাকে উদ্দেশ্য করে বললো……
—“ঊষা..মামনি এখন তোমার রুমে যাও। পরে আবার এসে দাদী মা’র সাথে খেলা করো৷”
ঊর্মিলার কথায় ঊষা কোনো রেসপন্স করে না। ঠায় দাদীর কাছে বসে আছে। রাহেলা তার ঠোঁটে বাঁকা হাসির রেখা স্পষ্ট রেখে ঊষার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। কিছুসময় পেরিয়ে গেলেও ঊষাকে নড়তে চড়তে না দেখে ঊর্মিলার বুঝতে বাকি রয় না তার বাচ্চা মেয়েটার মন বি*ষি*য়ে দেওয়ার কাজে ইতিমধ্যেই তার শ্বাশুড়ি মা লেগে পড়েছেন। ঊর্মিলা ঊষাকে ধমকের স্বরে বললো…..
—“ঊষা..তোমাকে রুমে যেতে বললাম না আমি!”
মায়ের ধমকে কেঁপে উঠে ছোট্ট ঊষা। মুহূর্তের মধ্যেই দাদীর শিখিয়ে দেওয়া কথাগুলো হজম হয়ে যায় ওর। কাঁদো কাঁদো নয়নে একবার দাদীর দিকে তাকিয়ে দ্রুততার সাথে বিছানা থেকে নেমে এক দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায় সে। ঊষার এভাবে চলে যাওয়ায় বিরক্ত হন রাহেলা। রাগী স্বরে বললেন…..
ঊর্মিলা স্বাভাবিক কন্ঠেই বললো…..
—“দশ মাস দশ দিন পেটে রেখে মৃ*ত্যু য*ন্ত্র*ণা সহ্য করে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছি যেই সন্তানকে সে অবাধ্য আচারণ করে তাঁকে বাধ্য বানাতে যা করা দরকার মা হিসেবে সেই সব করবো আমি। আর আমার কাজের কৈফিয়ত আমি কাওকে দিতে রাজি নই। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা আমি বলতে পারি না। তাই সরাসরিই নিষেধ করে দিচ্ছি আমার মেয়ের থেকে আপনি দূরে থাকুন। আমার নামে আমার বাচ্চা মেয়ের কাছে বি * ষ মন্ত্র ঢেলে তাঁকে আমার থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলে আপনাকে আমি ছেড়ে কথা বলবো না। আমি ঠিক কতোটা খা*রাপ আর জ*ঘ*ন্য হতে পারি সে সম্পর্কে আপনার সামান্যতম ধারনাও নেই শ্বাশুড়ি মা।”
এই বলে ঊর্মিলা রাহেলাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রুম থেকে বেড়িয়ে যায়৷ রাগে যেনো শরীর জ্ব*ল*ছে রাহেলার। তার ভ*য়ে একসময় থ*র থ*রি*য়ে কাঁ*প*তো যেই মেয়ে সেই আজ তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় হু*ম*কি দিয়ে গেলো! এভাবে সবকিছু তার হাতের বাহিরে চলে যাবে ভাবতেও পারে নি রাহেলা। আকস্মিক ভাবে তার স্বামী শরীফ সাহেব দেশে ফিরলে দু’টো মানুষের হালকা দল নিয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে জোড় গলায় রিজওয়ান আর ওর স্ত্রীকে বাড়ি ছাড়া করার দাবি করবেন কি করে! ইতিমধ্যেই রাহেলার কপালে চিন্তার কয়েকটা ভাঁজ স্পষ্ট হয়েছে।
(৫৯)
নিজবাড়ি থেকে কিছুটা দূরে পার্কের ভিতর বেন্ঞ্চে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে রিজওয়ান ও জিহাদ দু’জনেই। জিহাদের মুখশ্রী জুড়ে অজানা চিন্তা ও হালকা ভ*য় ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। বিকেল হয়ে গিয়েছে। সূর্যের তেজ একেবারে হালকা এখন। তবুও ঘেমে কপাল ভিজিয়ে ফেলেছে জিহাদ। রিজওয়ান তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে জিহাদকে দেখছে। জিহাদের এই রূপ রিজওয়ানকে কিছুটা সন্তুষ্ট করছে। কারণ একজন ছেলে তার ভালোবাসার মানুষের গার্জিয়ানদের সামনে তখনই ভয় পায় তখন সেই ভালোবাসার মানুষটার প্রতি তার ভালোবাসা প্রকৃত হয়। রিজওয়ান স্মিত হাসি দিয়ে নিজের পকেট থেকে রুমালটা বের করে জিহাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো….
—“কপালের ঘাম টুকু মুছে নাও। আমার সামনে এতো ঘা*ব*ড়া*নোর কিছু নেই।”
জিহাদ জোরপূর্বক হাসি দিয়ে রিজওয়ানের থেকে রুমালটা নিয়ে দ্রুততার সাথে কপালের ঘামটুকু মুছে পুনরায় রুমালটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিতে নিলে রিজওয়ান বললো….
—“তোমার কাছেই রেখে দাও এটা।”
জিহাদ নিঃশব্দে রুমালটা নিজের পকেটে রাখে। রিজওয়ান পুনরায় বললো….
—“কতোদিন থেকে আমার বোন আর তুমি একে-অপরকে মন দিয়ে রেখেছো শুনি!”
জিহাদ নিজের মাথার পিছনের চুলগুলো আলগা হাতে বুলাতে বুলাতে বললো….
—“ইয়ে মানে ভাইয়া, ২বছর হচ্ছে প্রায়।”
—“সারাজীবনের জন্য আমার বোনের দায়িত্ব নিতে পারবে!”
—“আমার শুধু একটা কাজ নেওয়া প্রয়োজন। রুমির খরচ বহন করার সামর্থ্য হলে আমি নিজেই আপনাদের কাছে আসতাম রুমিকে নিজের করে চাওয়ার দাবি নিয়ে।”
—“তোমার বাবার সম্পর্কে তোমাকে কিছু বলতে হবে আমায় আমি জানি। শুধু একটা প্রশ্নই করবো, তোমার বাবা যদি এই সম্পর্ক না মানেন তাহলে তখন তুমি কি সিদ্ধান্ত নিবে!”
—“হারাম উপায়ে অর্জিত সয়-সম্পত্তির উপর আগ্রহ শুরু থেকেই ছিলো না আমার। এখনও নেই। বাবা আমাদের সম্পর্কের কথা জানতে পারলে যদি বাঁধা প্রদান করেন আমি এক কাপড়ে সব ছেড়ে-ছুঁড়ে তার বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসতে মানসিক ভাবে প্রস্তুত আছি ভাইয়া।
জিহাদের মুখে এমন প্রতিত্তুর শোনার জন্যই প্রস্তুত ছিলো রিজওয়ান। জিহাদ যে তার বোনের জন্য যোগ্য তা বুঝতে আর বাকি রয় না রিজওয়ানের।
রিজওয়ান এর কন্ঠ কর্ণপাত হতেই রুমি ওর দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বললো….
—“ভিতরে আসতে পারমিশন চাইছো কেনো ভাইয়া! অনায়াসেই চলে আসতে পারো।”
রিজওয়ান ভিতরে প্রবেশ করতে করতে বললো…..
—“তুই একজন বিবাহযোগ্য বয়সের মেয়ে। এই রুমটা তোর একান্ত নিজের জায়গা। একজন ভাই হওয়ার পাশাপাশি আমি একজন ছেলে। তাই তোর রুমে প্রবেশ করার পূর্বে অবশ্যই আমাকে তোর অনুমতি নিতে হবে।”
রিজওয়ানের চিন্তাভাবনা বরাবরের মতো রুমিকে মুগ্ধ করে। রিজওয়ান রুমির সম্মুখে দাঁড়িয়ে বললো….
—“আজ জিহাদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম বিকালে।”
রুমি উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে রিজওয়ানের দিকে। আশানুরূপ জবাব সে শুনতে চায় তার ভাইয়ের কন্ঠে। রিজওয়ান আবারও বললো…..
—“জিহাদ নিজের পায়ে দাঁড়ালে তোদের দু’জনের চারহাত এক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি। এখন শুধু কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। এই সময়ের ভিতর তোদের মাঝে যে বা যারা সমস্যার সৃষ্টি করতে চাইবে তাদের সর্বপ্রথম আমার সম্মুখীন হতে হবে। নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস তুই।”
রিজওয়ানের মুখে আশানুরূপ কথাগুলো শুনে রুমির দু’চোখ খুশির নোনাজলে টইটম্বুর হয়ে যায়। রুমি সঙ্গে সঙ্গেই কোনো দ্বিধা ছাড়া রিজওয়ানকে জড়িয়ে ধরে শব্দ করেই কেঁদে উঠে। রুমির আকস্মিক এমন কাজে কিছুটা অবাক হয় রিজওয়ান। পরক্ষণেই রিজওয়ান ওর ঠোঁটে প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে রুমির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো….
—“চোখের সব পানি যদি আজই শেষ করিস বিয়ের পর বিদায়বেলায় কিন্তু আর চোখে পানি আনতে পারবি না। আমাদের ছেড়ে নতুন বাড়িতে, নতুন পরিবেশে যেতে হবে। খুশির পাশাপাশি হালকা দুঃখ ও থাকবে। তাই কিছু পানি বাঁচিয়ে রাখ পাগলী৷”
রুমি রিজওয়ানকে ছেড়ে দু’হাতে নিজের দু’চোখের পানি মুছে হাসিমুখে বললো…..
—“তোমাকে আর ভাবীকে চিনতে বড্ড দেড়ি করে ফেলেছি আমি ভাইয়া। তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিও। তোমার এই ছোট বোনটা তার খারাপ আচারণের জন্য ভিষণ লজ্জিত।”
—“তোর উপর আমার যদি সামান্যতমও রাগ জমে থাকতো তাহলে আজ তোর জন্য জিহাদের সাথে কথা বলতে যেতাম না আমি। তুই তোর ব্যবহারের জন্য অনুশোচনা করছিস এই যথেষ্ট। এখন ভালো মেয়ের মতো নিজের পড়াশোনায় মনোযোগী হ। জীবনে ভালো রেজাল্ট ও জরুরী।”
—“ঠিক আছে ভাইয়া।”
অতঃপর রিজওয়ান স্থান ত্যগ করে।
(৬১)
হাসপাতালে আরফার কেবিনরুমে ওর মাথার পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসে আরফার উপর নিজের অ*প*রাধী দৃষ্টি স্থির করে রেখে আরহাম। আরহামের দু’চোখ নোনাজলে ভরপুর হয়ে আছে। আরহাম ঢোকের সাহায্যে গলা পর্যন্ত আসা কান্নার দলাগুলোকে গি*লে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো……
—“আমার মেয়ের এতোটুকু শরীরে কতো কতো সুঁ*চ, যান্ত্রিক লাইন লাগিয়ে রেখেছে ডাক্তাররা। এগুলো তো মানুষকে য*ন্ত্র*ণা দিয়ে দিয়েই উপকার করে। আমার মেয়েটা তো পাথর মূ*র্তি*র ন্যয় শুয়ে আছে। মুখ দিয়ে একটা টু শব্দ করছে না। ওর ও নিশ্চয়ই অনেক য*ন্ত্র*ণা হচ্ছে! কিন্তু চেয়েও নিজের য*ন্ত্র*ণা গুলোকে বাহিরের মানুষদের সামনে প্রকাশ করতে পারছে না।”
আরহামের কথার মাঝেই কেবিনরুমের ভিতরে আমজাদও প্রবেশ করেন। আমজাদ আরহামের পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই আরহাম বললো….
—“বাবা, আমার মেয়েটা যখন অভিমানী স্বরে প্রথম বার বলেছিলো সে তার মাম্মামের জায়গায় স্টার হয়ে তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিবে তখনও কেনো আমার ভিতর মনুষ্যত্ব বোধ জাগ্রত হলো না বলো তো! সেদিন বুকের ভিতরে চাপা য*ন্ত্র*ণা হচ্ছিলো। যদি সেই য*ন্ত্র*ণা*কে নিজের নিচ চিন্তার জাঁ*তা*কলে না পি*ষ্ট করে আমার মেয়েটাকে আপন করে নিতাম ওকে আর পাঁচজন বাবার মতো আদর দিতাম তাহলে হয়তো আজ আরফা এভাবে আমাদের সামনে জীবন-মৃ*ত্যু*র ল*ড়া*ই করতো না।”
আমজাদ একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন……
—“মানুষ তখনই নিজের ভু*লটা বুঝতে পারেন যখন সেই ভুলের জন্য নিজের জীবনকে দূ*র্বি*ষহ মূহূর্তের মধ্য দিয়ে পার করেন। আর সেই বুঝ ও শিক্ষা হয় চিরস্থায়ী। মানুষ পুনরায় সেই ভু*ল করার আগে ২ বার ভাবেন অন্তত। তুমি জীবনে যে ভু*ল করেছিলে তার জন্য এখন তোমার জীবনকেও দূ*র্বি*ষহ মূহূর্তের মধ্য দিয়ে পার করতে হচ্ছে। আর তুমি অনুশোচনাও করছো। তোমার এই শিক্ষাও চিরস্থায়ী হবে। শুধু আল্লাহ তায়ালার নিকট দু’হাত জুড়ে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা ভি*ক্ষা চাও আর নিজের এই ফুলের মতো মেয়েটার সুস্থতার জন্য দোয়া করো। আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং বলেছেন , আমার বান্দারা তোমরা আমার নিকট আর্জি নিবেদন করো তোমাদের মনের গহীন থেকে যতো পারো ততো, তোমাদের চাওয়া ফিরিয়ে দেওয়ার সাধ্য আমারও নেই, তোমাদের আর্জিগুলো যদি কারোর ক্ষতির কারণ না হয় তাহলে অবশ্যই আমি তা কবুল করে নিবো।”
নিজের বাবার মুখে এরূপ কথাগুলো শুনে আরহামের হৃদয় আগের তুলনায় অনেকটা শীতল হয়ে যায়। সে নিজের দু’চোখ দিয়ে এতোসময় ধরে জমে রাখা নোনাজলগুলো বের করতে করতে বললো….
—“আমার মেয়েটার সুস্থতা আমার আল্লাহর নিকট ভি*ক্ষা চাইলে তিনি আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না তাই না বাবা!”
—“ইনশাআল্লাহ এমনটাই হবে। একজন সন্তানের জন্য তার বাবা-মায়ের দোয়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সন্তানকে জীবনে সুস্থ ও সফল দেখতে হলে আল্লাহর নিকট তার জন্য মন খুলে দু’হাত তুলে দোয়া করো। দোয়া ঔষধের থেকেও বেশি কার্যকরী হয়।”
এই বলে আমজাদ আরফার কেবিনরুম থেকে বেড়িয়ে যান। আমজাদের বলে যাওয়া শেষ কথাটা আরহামের কানে এখনও বাজছে, ‘দোয়া ঔষধের থেকেও বেশি কার্যকরী হয়।’ আরহাম বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে আসে। আরফার বিছানার ডানপার্শে থাকা ছোট র্যকের ভিতর জায়নামাজ ভাঁজ করে রাখা দেখে আরহাম জায়নামাজ টা নিয়ে কেবলামুখিতে বিছিয়ে দিয়ে নফল নামাজ আদায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে পরে।
(৬২)
রাতে ঘুমানোর পূর্বে শেহজাদের একগ্লাস গরম দুধ খাওয়ার রোজকার অভ্যাস জন্য শেফালি দুধের গ্লাস হাতে নিয়ে শেহজাদের রুমে প্রবেশ করে। শেহজাদ বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বই পড়ছিলো। শেফালি শেহজাদের হাতের ডান পার্শে এসে দাঁড়িয়ে বললো…..
—“শেহজাদ, এই যে বাবা দুধটুকু খেয়ে নাও তো। অনেক রাত হয়ে গিয়েছে। আজ আর পড়তে হবে না। দুধটুকু শেষ করে ঘুমাতে হবে।”
শেফালির কথাগুলো শেহজাদের কান পর্যন্ত পৌঁছালেও সে কোনো রেসপন্স করে না। আগের ন্যয় নিজের মন ও দৃষ্টি সে হাতে থাকা বইয়ের উপরেই স্থির করে রেখেছে। শেফালি নিজের কথার পুনরাবৃত্তি করলো। শেহজাদকে এবারও কোনো রেসপন্স করতে না দেখে শেফালি নিজের রাগ আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। দুধের গ্লাসটা বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে শেহজাদের হাত থেকে ওর বইটা কেঁ*ড়ে নিয়ে বিছানার অন্যপাশে ছুঁ*ড়ে মে*রে ধ*ম*কের স্বরে বললো…..
—“এতো বড় লায়েক হয়ে যাও নি তুমি যে এখনই আমার কথা গাঁয়ে লাগাবে না নিজের মর্জি মতো চলবে আর আমি তোমাকে কিছুই বলবো না শেহজাদ। জন্ম দিয়েছি তোমায়। ছোট্ট বাচ্চা থেকে এতো বড় করেছি। কখনও যত্ন ও ভালোবাসায় সামান্যতম ত্রুটি হতে দেই নি। যখন যেটা আবদার করেছো বাবার সাথে রাগারাগি করে হলেও সেই আবদার পূরণ করেছি। আর আজ সেই তুমি আমাকে এড়িয়ে চলার মতো দুঃসাহ*সিকতা দেখাচ্ছো কি করে! বলো!”
নিজের মায়ের ধ*ম*কে এবার শেহজাদ পুরোপুরি ভাবে নড়ে-চড়ে বসে৷ ওর দু’চোখে ইতিমধ্যেই নোনাজলরা বাসা বেঁধেছে। শেফালি আবারও বললো…
—“আজই শুরু করেছিলে আজ আজই শেষ হচ্ছে। এরপর যদি ভুলেও কখনও আমার কথার অবাধ্য হয়েছো কিংবা আমাকে এড়িয়ে চলার মতো দুঃসা*হসি*কতা দেখিয়েছো তবে তোমাকে আমি বোডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়ার বন্দবস্ত করবো। থেকো সেখানে একা একা। কেউ তোমাকে আদর দেখিয়ে খাবার খাওয়াতে যাবে না, তোমার কাপড় ধুয়ে দিবে না, প্রতিরাতে তোমাকে দুধ গরম করে এনে খেতে দিবে না৷”
শেফালির বলা কথাগুলো শুনে শেহজাদ এবার শব্দ করেই কেঁদে দেয়। ছেলেকে কাঁদতে দেখে শেফালির মায়ের মন শান্ত হয়। শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে সে বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে পুনরায় শেহজাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো…..
—“দুধ টুকু এই মুহূর্তে শেষ করো।”
শেহজাদ সঙ্গে সঙ্গেই ওর মায়ের হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিয়ে কয়েক ঢোকের সাহায্যে শেষ করে। শেফালি নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে শেহাজাদের দু’চোখ ও মুখ মুছে দিয়ে বললো…..
—“কান্না করেছো জন্য তোমার আজকের আচারণ আমি ভুলে যাবো আর পুনরায় তোমাকে এমন আচারণ করার সুযোগ দিবো এমনটা ভেবো না। আমি যা বলেছি তা মাথা থেকে বের করে দিও না। তাহলে ফল কি হবে সেটা সম্পর্কেও তুমি অবগত। এখন ঘুমিয়ে পড়ো।”
শেহজাদ বিছানায় শুয়ে পড়ে। শেফালি শেহজাদের শরীরে কাঁথাটা টেনে দিয়ে ওর রুমের লাইটটা বন্ধ করে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।