Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 144



সুবাসিত মল্লিকা পর্ব-০১

0

#সুবাসিত_মল্লিকা
কলমে: মম সাহা (বিষাদিনী)

“কালো মাইয়া কোনোমতেই আমার বাড়ির বউ হইতে পারব না।’

কালো বলে বেলির বিয়ের দিন ঝামেলা হয় তার গায়ের রঙ নিয়ে। উপরোক্ত বাক্যটি বেলির হবু শ্বশুরের। বেলির গায়ের রঙ পছন্দ হয়নি ছেলের বাবার। ছেলের বিয়ের সকল দায়িত্ব দিয়েছিলেন ছেলের উপরই। ছেলে-ই জানিয়েছিল ওর মেয়ে পছন্দ হয়েছে। তাই জামাল ভূঁইয়া আর মেয়ে দেখতে আসেননি। তাছাড়া ব্যবসায়ের কাজে তিনি অন্য শহরে গিয়েছিলেন। অনুমতি দিয়ে গিয়েছিলেন বিয়ের কাজ আগানোর। কিন্তু এত বড়ো সর্বনাশ যে হবে তা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি।
জামাল ভূঁইয়ার এই হম্বিতম্বি বিয়ে বাড়িটাকে নীরব করে দিল। সব হৈচৈ, আনন্দ নিমিষেই থেমে গেল। রঙ হারালো হাসিরা। জামাল ভূঁইয়ার কণ্ঠ তখন সর্বোচ্চে,
“কবীর আলী, এখানে আসুন।”

বেলির বাবা কবীর আলীর কানে এর আগেই হম্বিতম্বির কথা পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তিনি কথাটা বাড়াতে দেননি। কিন্তু যখন ডাক ভেসে এলো তখন আর দূরে থাকলেন না। দ্রুতই ছুটে এলেন,
“হ্যাঁ, বেয়াই সাহেব, বলুন।”

“আমি চাচ্ছি বিয়ের কাজ এখানেই থামিয়ে দিতে। আপনারা আমাদের ঠকাচ্ছেন।”

কবীর আলীর বুকে ছ্যাঁত করে উঠল। বেলির মায়া-মায়া মুখের দিকে তাকালেন। মেয়েটার মুখটা এটুকুন হয়ে এসেছে। কবীর আলী হাত জোর করলেন,
“এসব কী বলছেন! আমরা কীভাবে ঠকালাম?”

“আপনাদের মেয়ের গায়ের রঙ এত ময়লাটে! আমার ছেলে যেখানে ধবধবে ফর্সা!”

“আপনার ছেলে তো দেখেছিল আমার মেয়েকে। না দেখিয়ে তো বিয়ে ঠিক হয়নি।”

জামাল ভূঁইয়া যুক্তিতে হেরে গেলেও থামলেন না, “আমার ছেলের কি সেই বুঝ আছে? বুঝলে তো এ কাজ করতো না।”

“তাই বলে বিয়ের আসরে এসে বিয়ে ভাঙবেন নাকি!”

তর্কাতর্কি তুমুল হলো ধীরে-ধীরে। এতক্ষণ যাবত মুনিব ঘরে ছিল বন্ধুদের সাথে হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। চেঁচামেচি শুনতেই বাহিরে এসে নিজের বাবাকে শুধাল,
‘কী করছেন, আব্বা!’

ছেলেকে দেখেই জামাল ভূঁইয়া চেঁচিয়ে বললেন,
“এই মেয়েরে তুমি দেইখ্যা বিয়াতে রাজি হইছো?”

মুনিব সহজ-সরল কণ্ঠে সম্মতি দিল, “হ্যাঁ। কেন?”

“এইরকম গায়ের রঙ আমাদের বাড়ির কাউরে দেখছো তুমি?”

“না, দেখিনি। দেখিনি বলেই এ রঙে আমার আকর্ষণ জন্মেছে।”

ছেলের মুখের বুলিতে তাজ্জব বনে গেলেন জামাল ভূঁইয়া। অবাক স্বরে শুধালেন, “আর্কষণ! তাও এ রঙে! পাগল হলে নাকি?”

“দেখেন আব্বা, বিয়ে করাইলে ওর সাথেই করান নাহয় চলেন, বাড়ি ফিরে যাই। এরপর আর কোনোদিন বিয়ের কথা মুখেও তুলবেন না।”

“মুনিব? তোর আব্বার লগে কেমনে কথা কছ? মাথা গেছে তোর?”

চাচার প্রশ্নে মুনিবের কোনো হেলদোল নেই। সে গা-ছাড়া ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। জামাল ভূঁইয়া বুঝলেন তার কথার আর কোনো মূল্য নেই। অতঃপর না পারতে তিনি বিয়েতে সম্মতি দিলেন। হৈচৈ করা বিয়ে বাড়িটায় আবারও হৈচৈ শুরু হলো তবে আতঙ্ক নিয়ে। মেয়ের বাবা মুনিবের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ হলেন। মেয়ের আত্মীয়রা তো এই জামাই এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। কিন্তু ছেলের প্রতি অরুচি ধরল জামাল ভূঁইয়ার। পারছেন না বিয়ে বাড়ি থেকে চলে যেতে।

নতুন বউ ঘরে তুলতে গিয়ে হোঁচট খেলেন বাড়ির মেয়েলোকেরা। মুনিব বলেছিল বউ সুন্দর ভীষণ! কিন্তু কই সুন্দর? কালো শরীরে লাল রঙের বিয়ের শাড়িটা যেন কৌতুক করছে গায়ের রঙকে। বাড়ি ভর্তি মানুষের ফিসফিস শুরু হয় বউ দেখার পরই। এত সুন্দর মুনিব, পড়াশোনা জানা ছেলেটা কি-না বিয়ে করল এমন একটা মেয়েকে? ঝুমুরপাড়া গ্রাম অন্যান্য গ্রাম থেকে গরীব ভীষণ। তার উপর মেয়ে না দেখতে সুন্দর আর না মেয়ের বাপ কোনো টাকাকড়ি দিয়েছে তাহলে কী দেখে মুনিব এ-মেয়ে বিয়ে করল?
আত্মীয়-স্বজনের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে ভরে গেল বাড়ি। সব কথাই কানে পৌঁছাল বেলির।

বাড়ির বড়ো বউ চামেলি নতুন বউকে তৈরী করাতে এসে তাজ্জব বনে গেল। বেলির বিয়ের সাজ নেই গায়ে। একটা ক্যাটকেটে হলুদ রঙের শাড়ি জড়ানো শরীরে। চামেলি হতভম্ব কণ্ঠে বলল,
“আল্লাহ্ গো আল্লাহ্, ছুডু বউ, তুমি একলা একলা তৈরী হইয়া গেছো নাকি?”

বেলি তখন চোখে কাজল লেপছিল। এক ধ্যানে কাজল লাগাতে লাগাতে উত্তর দিল, “তৈরী হইতে কি আবার চৌদ্দজন লাগে নাকি? কী যে কথা কন!”

বেলির ঝটপট উত্তরে চামেলি আরও দ্বিগুণ অবাক হলো। গলা উঠলো তার তুঙ্গে। তার হৈহল্লা শুনে তার শাশুড়ি, চাচিশাশুড়ি, ফুপু শাশুড়ি, ননদ-ননাস হতে সব মেয়ে লোক উপস্থিত হলেন। ঘরে প্রবেশ করেই বেলির শাশুড়ি প্রথমে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
“কী হইছে, বড়ো বউ? আক্কেল-জ্ঞান কী খাইছো? এমনেই মানুষ কত কী কইতাছে, অহন আবার তুমিও ঢোল পিডাইতাছ যে?”

শাশুড়ির কথায় দুঃখী দুঃখী স্বরে সব বলল চামেলি। বেলি কীভাবে উত্তর দিয়েছে তা খুব সুন্দর ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে বলল। বেলির আচরণের কথা শুনতেই ঘরভর্তি সকলে হেসে দিল। ফুপু শাশুড়ি তো মুখ ঝামটে বেলির শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললেন,
“বাপরে জামাইল্যার বউ, তোর পোলার বউ দেহি দারোগা। তুই মাইনষেরে এত শাসন করছ আর তোর ঘরেই কি-না আসছে দজ্জাল?”

নিজের ননাসের এমন টিটকারিতে লজ্জায় যেন মাথা কাটা গেল মুক্তা ভূঁইয়ার। তিনি তার পুত্রবধূর দিকে অগ্নি দৃষ্টি ফেললেন। হুঙ্কার ছেড়ে বললেন,
“বাড়িতে আইছো একটা দিনও তো কাটাইলা না, তার আগে এমন কথা কও কোন সাহসে?”

বেলির ভেতর তেমন ভাবাবেগ দেখা গেল না। শাড়ির আঁচল কোমড়ে গুঁজতে-গুঁজতে বলল, “কী আজব কাহিনি! এই সামাইন্য কথা কইতে সাহস লাগে নাকি? আপনারা এমন ভাব করতাছেন যেন কোনোদিন কাউরে কথা কইতে শুনেন নাই! না শুইন্যা থাকলে এহন শুনবেন। কোনো সমস্যা নাই। এহন চাইরড্যা খানা দেন তো। সারাদিন কিছু খাই নাই।”

নতুন বউয়ের এমন আকপটে কথা বলার ভঙ্গি, খাবার চাওয়ার ধরন দেখে ঘরভর্তি মানুষ এবার চরম বিস্ময়ে হা হয়ে গেল। মুক্তা ভুঁইয়া হলেন বুদ্ধিমতী নারী। তিনি বুঝলেন, বেলির মনে ‘কে কী ভাবল’— এর ভয় নেই। তাই তাকে খোঁচা দেওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা। তাই তিনি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন,
“খিদা লাগছে ভালো কথা। সারাদিন না খাইলে তো খিদা লাগবোই। তুমি বও, বড়ো বউরে দিয়া তোমার খাওন পাডামু। তুমি তো নতুন বউ, তাই ঘর ছাইড়া বাইর হইও না।”

রণচণ্ডী মুক্তা ভুঁইয়ার এমন নরম আচরণে খ্যাপে উঠল বড়ো বউ,
“আম্মা, আপনি ছুডু বউরে কিছু কন না যে? হেরনি এমন আচরণ সাজে!”

বড়ো বউয়ের বুদ্ধির করুন দশার কথা জানেন মুক্তা ভুঁইয়া। তাই চোখ রাঙিয়ে বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন,
“হেয় হইল ছুডু বউ। বয়সেও ছুডু। হের বুদ্ধি থাকলে কী আর এমনে কথা কইতো। যাও খাওন নিয়া আহো।”

বড়ো বউ চামেলি শাশুড়ির উপর অসন্তুষ্ট হলো। চলে গেল তাই গটগট করে। মুক্তা ভুঁইয়ার ধমকে বাকিরাও এক-এক করে বিদায় নিল। পুরো ঘর জুড়ে রইলেন কেবল তিনি এবং নতুন বউ।

‘তুমি এমন আচরণ কেমনে করলা কও তো? তুমি কি জানো না এমনেই তোমারে লইয়া পুরা বাড়ির মানুষ হাসিহাসি করতাছে?’

বেলি ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছিল। শাশুড়ির কথায় তার হাত থেমে গেল। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, ‘তো হাসলে আমি কী করমু? সবার মুখ ধইরা রাখমু?’

তাজ্জব মুক্তা ভূঁইয়া বিস্মিত স্বরে বললেন, ‘তুমি কী বুঝতাছো না তোমার শরীরের রঙ লইয়া সবাই তামাশা করতাছে? তার উপর তোমার এমর জঘন্য আচরণ যদি মানুষ শুনতে পারে তাইলে কী হইবো বুঝতে পারো?’

শাশুড়ির চেয়েও দ্বিগুণ বিস্ময় নিয়ে বেলি শুধাল, ‘আমার গায়ের রঙ নিয়া হাসার কী আছে? আমার রঙ হলুদ, সবুজ নাকি নীল যে দেখলেই হাসি পাইবো! ভাব এমন করেন যেন কোনোদিন কালা মানুষ দেহেন নাই চোখে। যান তো এইখান থেইকা এখন। একটু সাজতে দেন। বিয়ার প্রথম দিনেই এমন ঝগড়াঝাটি ভালো লাগে না। আর কয়েকটা দিন পর থেইকা করমুনে। যান এহন।’

বেলির গলার স্বর যথেষ্ট উঁচুতে ছিল বিধায় মোটামুটি যারা কান খাঁড়া করে রেখেছিল তারা সকলেই সবকিছু শুনেছে। মুক্তা ভূঁইয়া নিজের রাগ সংবরণ করতে দ্রুত পায়ে নতুন বউয়ের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। এ মেয়ের মান ইজ্জত নাই সেটা তো তার আচরণেই পরিষ্কার। শুধু শুধু এ মেয়ের সাথে লেগে নিজেরও মান সম্মান নষ্ট করার ইচ্ছে হলো না উনার।

শাশুড়ি বেরিয়ে যেতেই বেলি গলা ছেড়ে গান ধরল,
‘তুমি দিও না গো বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া,
আমি অন্ধকারে বন্ধ হয়ে যাব মরিয়া….’

যেতে যেতে মুক্তা ভূঁইয়া অবাক হলেন। বাড়ি ভর্তি মেহমান অথচ নতুন বউ কি-না এসব গান গাচ্ছে? ছি! তার ছেলেটার কী চোখে সমস্যা ছিল? নাহলে এমন মেয়েরে কীভাবে বউ করে?

চলবে…..

এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[চতুর্থ ও শেষ পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

পুরো হাসপাতাল স্তব্ধ হয়ে আছে আমার মৃত্যুর কথা শুনে। বাবা যেনো নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। মা তো অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। জয়া পাথর হয়ে আছে। ডাক্তার বাবাকে বলল — শক্ত হোন।

এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। তার তো আর কিছু বলার নেই। এবার সবাই অঝোরে কান্না করতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। বাড়িতে আজ অনেক মানুষের আগমন ঘটেছে। আম্মু আর আব্বুকে অনেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে। জয়া প্রচুর কান্নাকাটি করছে।

এবার আমার লাশ নিয়ে যখন বাসা থেকে বের হবে তখনই হঠাৎ করে আমার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন বুঝতে পারলাম এতক্ষণ যা হয়েছে সেটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমার পুরো শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে। আমি দেরি না করে ফোন রিসিভ করলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি ডাক্তারের নাম্বার আমি ফোন রিসিভ করলাম।

— হ্যালো।

— সবুজ, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

— আপনি তো আমাকে কাল কল দিতে পারতেন দিনে।

— হ্যাঁ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। দেখো তোমার লাইফ রিক্স রয়েছে। আমি চাইনা আমার ভাতিজীর জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাক। তুমি খুব ভালো একটা ছেলে। আমি চাইনা তোমার সাথে খারাপ কিছু হোক।

— আচ্ছা বলুন কি বলবে?

— তুমি তোমার বাসায় সব টা জানাও। আর আমি তোমার রিপোর্ট আবার চেক করেছি। তোমার ক্যান্সার দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমি চাই তুমি হাসপাতালে চলে আসো খুব তাড়াতাড়ি। যে ভাবেই হোক আমি তোমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করব। বাকিটা আল্লাহর হাতে। কিন্তু তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো।

— আচ্ছা আমি আপনার সাথে কাল কথা বলব এ বিষয় নিয়ে।

— ঠিক আছে।

এই কথা বলে ফোন কেটে দিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি জয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম জয়া যে আমার পাশে শুয়ে আছে। জয়াকে তাহলে সব শুনে নিয়েছে?

— এতো রাতে আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন? আর কাকে কি জানানোর কথা বলছেন?

যাক জয়া তাহলে কিছু শুনেনি।

— আমার অফিসের কলিগ কল দিয়েছে, কবে জইন করব সেটা জানার জন্য।

— ওহ আচ্ছা।

তারপর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে হঠাৎ করে আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠে। আমি যেনো নিশ্বাস নিতে পারছিনা। যেনো বুকের উপরে কেউ বসে আছে এমন মনে হচ্ছে। হঠাৎ করে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তাহলে কি এবার আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলছে? আমি নাক মুখ ডেকে নিলাম। কিন্তু উঠে দাড়ানোর শক্তি নেই। রুমে একটা মানুষ নেই যে কাওকে ডেকে দেব। চিৎকার করার শক্তি ও আমি পাচ্ছিনা। হঠাৎ করে জয়া রুমে আসে। আমাকে চটপট করতে দেখে আমার কাছে চলে আসে।

— কি হইছে আপনার?

আমার পুরো চোখ ইতিমধ্যে ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।

যখন চোখ খুল্লাম তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডের উপরে আবিষ্কার করলাম। চোখ খুলে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আব্বু আম্মুর চোখে পানি। আর হতাশ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। সবাই হয়তো এতক্ষণে সব জেনে গিয়েছে।

বাবা আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলল,

— তুই নিজেকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছিস বাবা? আমাদের তো সত্যিই টা জানাতে পারতি। আমাদের জন্য নিজের এতো বড় অসুখ লুকিয়ে রেখেছিস। তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি নিয়ে বাঁচব বল?

— বাবা আমার কিছু হবে না। চিন্তা করনা তোমরা। আমি ঠিক হয়ে যাবো।

আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। আম্মুর কান্না দেখে আমি আর নিজের চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারলাম না। এই মানুষ গুলোকে ছেড়ে আমার চলে যেতে হবে? এবার ডাক্তার ফিরে আসে আমাকে দেখার জন্য। ডাক্তার আর কেউ না জয়ার চাচ্চু।

— এখন কি অবস্থা তোমার?

— আলহামদুলিল্লাহ।

— আজ রাতে তোমার অপারেশন হবে। ইনশাআল্লাহ তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

আমি কিছু বললাম না।

ডাক্তার চলে গেলো। দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেলো। এখনও জয়ার আমার সাথে কথা বলতে আসেনি। হয়তো রাগ করে আছে। কিন্তু জয়ার সাথে একবার আমার কথা বলা খুব দরকার। আমি আব্বুকে বললাম — আব্বু জয়া কথায়?

— মেয়েটা সকাল থেকে না খেয়ে আছে। এখনও কিছুই খায়নি। সারাক্ষণ কান্না করছে।

— ওরে একটু ডেকে দাও শেষ বারের মতো একটু কথা বলি।

— এভাবে বলিস না। আমি ডেকে দিচ্ছি।

এবার জয়া আমার কাছে আসে। কেবিনে এখন আমি আর জয়া ছাড়া কেউ নেই। মেয়েটা কান্না করতে করতে চোখ লাল করে ফেলছে।

— খাওয়া দাওয়া করলে না কেন? অসুস্থ হয়ে গেলে আমার মা-বাবার খেয়াল কে রাখবে? জয়া সরি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিয়ো। দেখো আমি তোমার জীবন নষ্ট করতে চাইনি। আমি জানতাম না যে আমি এতো বড় একটা রোগে আক্রান্ত। নাহলে আমি তোমার সুন্দর জীবন এভাবে শেষ করে দিতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দিয় পারলে।

— আপনার মতো মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। আপনার মতো মানুষ কয় জনের কপালে থাকে?আমি পেয়েছি। এটাই আমার ভাগ্য। যে মানুষ নিজের কথা না ভেবে অন্যকে নিয়ে ভাবে তার তোর কোনো ভুল থাকেনা।

— জয়া একটা শেষ কথা বলতে চাই। আমি আসলেই তোমাকে ভালোবাসি। আমার তোমাকে কাছে পাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয়না। আমার টাও না হয় হলোনা।

— আমিও আপনাকে ভালোবাসি। আপনার কিছু হবেনা। আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর আমার আর কিছু মনে নাই।
সবাই কান্না করছে সবুজের জন্য। সবুজের আম্মু নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করছে। আর বাবা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে অপারেশন চলছে। ভিতরে কি হচ্ছে কেউ জানেনা। জয়া অঝোরে কান্না করছে। জয়ার মা-বাবা এসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

এদিকে ডাক্তার অপারেশন শেষ করে বাহিরে আসতেই সবাই ডাক্তারের ছুটে আসে।

— ডাক্তার আমার ছেলে কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো?

ডাক্তার কোনো কথা বলছেনা।

এবার ডাক্তারের কাছে এসে বলল — চাচ্চু কথা বলছ না কেন? উনি ঠিক আছে তো?

— আপনারা চিন্তা করবেন না। আসলে আমার যেমনটা ভেবেছিলাম ঐরকম মারাত্মক প্রকারে যায়নি। অপারেশন সাকসেস হয়েছে। এখন সবুজ সুস্থ আছে। কিছুক্ষণ পরেই ওকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। ভালো মানুষদের সাথে কখনও খারাপ কিছু হয়না।

জয়া ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে।

— আরে বোকা মেয়ে কান্না করছিস কেন? সবুজ কয়েকদিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। কিছু দিন খেয়াল রাখিস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তখন নিজেকে কেবিনের মধ্যে আবিস্কার করলাম। সবাই আমার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে অনেক খুশি।

কিছুদিন পরে আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে যাই। এ কয়দিন জয়া আমার অনেক সেবাযত্ন করছে।

আমি রুমে বসে আছি তখন জয়া আমার কাছে আসলো।

— জয়া একটা কথা বলার ছিল।

— কি কথা?

— আমাদের তো এখনও বাসর সম্পুর্ন হয়নি। আজকে বাসর টা সম্পুর্ন করে ফেলি।

জয়া কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল — অনেক দুষ্ট হয়ে গেছেন তাইনা। কিছুই হবে না এসব।

— কি বলো। আমাদের তো বাচ্চাকাচ্চার পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

আমার কথা শুনে জয়া খিলখিল করে হাসতে হাসতে আমার বুকে মাথা রেখে বলল — এখন কোনো বাচ্চা নই। আগে আমরা লাইফ ভালো ভাবে ইঞ্জয় করব। তারপর বাচ্চা।

— ঠিক আছে। তাহলে আজকে রাতে হবে কিন্তু।

জয়া লজ্জা পেয়ে চলে গেলো। আমি বাহিরে গিয়ে ফুল কিনে এনে রুমটা সাজিয়ে নিলাম। রাত হয়ে গেলো সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে। জয়া এবার একটা লাল শাড়ী পড়ে আসলো। জয়াকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে।

এবার আমি জয়াকে খাটের উপরে বসিয়ে দিয়ে বললাম — তাহলে শুরু করি।

মেয়েটা লজ্জায় পুরো লালা হয়ে আছে। এবার আমি জয়ার কপালে একটা চুমু খেলাম। তারপর যা হলো তা আর বলা যাবেনা সিগ্রেট। যদিও বিবাহিত রা বুঝবে, আর অবিবাহিত রা বুঝতে হলে বিয়ে করে নিয়েন। (হাহাহা)

দু’জন হারিয়ে গেলাম ভালোবাসার অতলে। তারপর থেকে খুব ভালো ভাবেই কাটতে থাকে জয়া আর সবুজের নতুন জীবন।

সমাপ্ত।

এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০৩

0

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[তৃতীয় পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

জয়া দরজা খুলতেই দরজার ওপাশে থাকা লোকটাকে দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ লোকটা আর কেউ উনি ডাক্তার সাহেব। আমি বুঝতে পারছিনা এই ডাক্তার এখানে কেন এলো? আমার খোঁজে নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে?

হঠাৎ করে জয়া ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে বলল,

— চাচ্চু কেমন আছো?

— আমি ভালো আছি।

— আমি কিন্তু তোমার সাথে খুব রাগ করছি। তোমাকে কতো করে বলছি বিয়েতে থাকার জন্য। তুমি তাও এলে না।

— আসলে মা হাসপাতালে কাজের অনেক চাপ ছিল। তাই আসতে পারিনি। যখন শুনলাম তুই এলি আমি আর দেরি করলাম না। চলে এলাম।

এতক্ষণে ক্লিয়ার হলাম। কিন্তু মনের ভিতর একটা ভয় কাজ করছে ডাক্তার তো আমাকে দেখলেই চিনে ফেলবে। আর যদি সবাইকে বলে দেয়? আমি মনে মনে অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। যদি ডাক্তার সবাইকে সব সত্যি বলে দেয় তাহলে তো অনেক বড় ঝামেলায় হয়ে যাবে। আমি চাইনা এখন কেউ আমার অসুস্থতার ব্যাপারে জানুক।

— কিরে মা তোর হাসবেন্ড কোথায়? জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবিনা।

— ভিতরে আসো চাচ্চু।

এবার জয়া ডাক্তারকে আমার সামনে নিয়ে আসে। ডাক্তার আমাকে এখানে দেখে অবাক হলো। ডাক্তার হয়তো ভাবতেও পেরেনি আমাকে এখানে দেখতে পাবে। আমি যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটা হলো না।

জয়া বলল — চাচ্চু উনি আমার হাসবেন্ড।

আমি ডাক্তারকে সালাম করলাম। ডাক্তার সালামের উত্তর নিয়ে বলল — জয়া তুই একটু বাহিরে যা জামাইয়ের সাথে আমার কিছু কথা আছে।

— ঠিক আছে আমি গিয়ে তোমাদের জন্য নাস্তা রেডি করি। কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি এসো তোমরা।

— ঠিক আছে।

জয়া চলে গেলো। ডাক্তার আমার কাছে এসে বলল।

— তাহলে আমার ভাতিজীর সাথে তোমার বিয়ে হলো? ওকে বলছ তুমি যে ক্যান্সারে আক্রান্ত?

— না।

— ওহ।

— আমি এখনও কাওকে বলনি।

— দেখো আমার মনে হয় সবাইকে সব টা বলে দেওয়া উচিৎ। আর তোমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার। দেখো তোমার সাথে জয়ার জীবন জড়িয়ে আছে।

— চিন্তা করবেনা। জয়ার কোনো ক্ষতি হতে আমি দেবনা। মেয়েটা অনেক ভালো। আর ওর সাথে এখনও আমার ফিজিক্যাল সম্পর্ক হয়নি। আমি জেনেশুনে কারোর জীবন নষ্ট করার মতো ছেলে নই।

— কিন্তু তবুও এই সমাজ তো জানে তোমরা বিবাহিত। এসব বলে কোনো লাভ নাই। আমি যেটা বলছি তুমি সেটা করার চেষ্টা করবে। রোগ টা ক্রমশ বাড়বে আগে থেকে চিকিৎসা না করালে।

— আমি কোনো সমস্যা দেখলে আপনাকে অবশ্যই জানিয়ে দেব।

— ঠিক আছে। চলো এখন নাস্তা করতে যাই।

এবার দু’জনে নাস্তা করতে চলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের রুমে ফিরে এলাম।

কিছুক্ষণ পরে জয়া রুমের মধ্যে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার কাছে এলো।

— আপনাকে আমি খাটের উপরে ঘুমাতে বলার পরেও সোফায় কেন গিয়েছেন?

আমি নিশ্চুপ,

— আমাকে যখন আপনার পছন্দ না আমাকে কেন বিয়ে করতে গেলেন? বিয়ের আগেই তো বলতে পারতেন আমাকে আপনার পছন্দ না।

কি বলব আমি বুঝতে পারছিনা। মেয়েটা অনেক বেশি রেগে আছে। আমিও কিছু বলছিনা দেখে রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি খাটের উপরে চুপচাপ বসে রইলাম। বিকেল হতেই আমি আর জয়া আমাদের বাসায় চলে গেলাম। মেয়েটা সারা রাস্তা আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। বাসায় এসেও চুপচাপ হয়ে আছে। আমি একাই আমার রুমে বসে আছি তখন আম্মু আমার কাছে এসেছে।

— কিরে বউমার সাথে কি তোর কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা হইছে?

— না তো।

— তাহলে বউমা এতো চুপচাপ হয়ে আছে কেন?

— জানিনা। হয়তো মা-বাবার জন্য মন খারাপ হইছে ঠিক হয়ে যাবে।

রাতের খাবার খেতে গেলাম। সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে। জয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে চুপ হয়ে আছে। আমিও কোনো কথা না বলে খাবার খেয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। জয়া কিছুক্ষণ পরে রুমে এলো। কোনো কথা বা বলে খাটের উপরে শুয়ে পড়ে। মেয়েটাকে এভাবে দেখে আমারও ভালো লাগছেনা। ভাবলাম মেয়েটার জন্য ফুচকা নিয়ে আসি তাহলে হয়তো রাগ কিছুটা হলেও কমবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুচকা নিয়ে ফিরে এলাম। জয়ার কাছে আসতেই দেখি মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।

— জয়া তুমি বাচ্চাদের মতো কান্না করছ কেন?

— আমি কান্না করলে আপনার কি?

— আরে কান্না থামাও দেখ কি নিয়ে আসছি তোমার জন্য।

— আমার কিছু দরকার নেই।

— আরে আগে দেখো না কি এনেছি তারপর বলবে।

জয়া এবার আমার দিকে তাকিয়ে তারপর সে ফুচকার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে উঠে বসে পড়ে। মেয়েটা ফুচকা দেখে খুশি হয়ে প্রথমবারের মতো জড়িয়ে ধরে। তারপর আমার থেকে ফুচকা নিয়ে খাওয়া শুরু করে। ফুচকা দেখে সে হয়তো ভুলেই গিয়েছে সব রাগ অভিমান।

— শুনেন আপনি আজকে থেকে আমার সাথেই ঘুমাবেন বলে দিলাম। যদি ভুল করেও অন্য কোথাও যান তাহলে আপনার খবর আছে।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

দেখলাম জয়া একটা দড়ি নিয়ে আমার হাত বেধে নিজের হাত ও বেধে দিল। আমি ওর পাগলামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছি। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছে আমি আর বেশিদিন নেই। খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বলি আমার পাগলি বউটা। তাকে কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার কি আর সেই সুযোগ আছে? কিছু সময়ের জন্য কেন আমি তার সুন্দর জীবন শেষ করে দেব? এসব ভাবতেই নিজেকে শান্ত রাখলাম। এবার দু’জনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ করে আমার নাক দিয়ে র*ক্ত পড়তে শুরু করে। কাশির সাথেও র*ক্ত বের হচ্ছে। আমার নিশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা। হঠাৎ করে জয়া আমার এমন অবস্থা দেখে কান্নাকাটি শুরু করে।

— কি হইছে আপনার?

— আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।

জয়া চিৎকার দিয়ে মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে আসে। মা-বাবা আমার এমন অবস্থা দেখে অঝোরে কান্না করতে শুরু করে। আব্বু হাসপাতালে ফোন দিয়ে এম্বুল্যান্স পাঠাতে বলে। এদিকে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আম্মু আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে।

— বাবা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর তোর বাবা হাসপাতালে ফোন দিয়েছে।

— আম্মু। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিয়ো। আমি হয়তো তোমাদের একা করে দিয়ে চলে যাবো।

— কি বলছিস এসব আবল তাবল? তোর কিছু হবেনা বাবা। আমরা আছি তোর পাশে।

— আম্মু আব্বু কই।

আমার কথা শুনে আব্বু আমার কাছে আসে।

— বাবা তোর কিছু হবেনা। চিন্তা করিস না।

— শুনো বাবা। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তুমি মায়ের খেয়াল রেখো। আর জয়াকে তার বাসায় পৌছে দিয়। আমি মেয়েটার সুন্দর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।

— কি বলছেন এসব আপনি? আপনার কিছু হবে না।

ইতিমধ্যে এম্বুল্যান্স বাসার সামনে চলে আসে। কয়েকজন এসে আমাকে নিয়ে গাড়িতে তুলে। তারপর একটা অক্সিজেন মাস্ক আমাকে পড়িয়ে দেয়। বাবা আমার মাথার পাশে বসে আছে। জয়া আর আম্মু অঝোরে কান্না করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হাসপাতালে পৌছে গেলাম। আমাকে কেবিনে সিফট করা হলো। ডাক্তার আমাকে ভালো ভাবে পরিক্ষা করে বের হয়ে গেলেন।

আব্বু ডাক্তারের কাছে এসে বলল — ডাক্তার আমার ছেলে ঠিক আছে তো?

ডাক্তার নিশ্চুপ,,

— ডাক্তার কথা বলুন প্লিজ। আমার ছেলে ঠিক আছে তো?

— দেখুন অনেক দেরি করে ফেলছেন আপনারা। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করুন। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই আপনার ছেলে মারা গেছে। আমাদের হাতে আর কিছু করার নেই। সরি।

ডাক্তারের কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো এখানে কোনো মানুষ নেই। পুরো হাসপাতাল স্তব্ধ হয়ে গেছে। ছেলে হারানোর শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা।

চলবে?

এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০২

0

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[দ্বিতীয় পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

আচমকা বুকের উপরে ভারী কিছু অনুভব করতেই চোখ খুলে তাকালাম। চোখ খুলতেই আকি চমকে উঠলাম। কারণ আমার বুকের উপরে শুয়ে আছে জয়া, বেশ অবাক হলাম, জয়া কি তাহলে সারারাত আমার বুকের উপরে শুয়ে ছিলো? কিন্তু রাতে তো সে খাটের উপরে ছিলো।

আমি জয়ার দিকে তাকালাম। মেয়েটা খুব শক্ত করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে। আমি এবার জয়াকে যখন সরাতে চেষ্টা করলাম তখনই মেয়েটার ঘুম ভেঙে যায়।

আমার তাকানো দেখে জয়া খুব লজ্জা পেয়ে যায়। সে উঠতে উঠতে বলল — আসলে একা শোয়ার অভ্যাস নেই তো। খুব ভয় পাইছিলাম।

— আচ্ছা ঠিক আছে। ফ্রেশ হয়ে নেন।

জয়া আর কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে গেলো। জয়া কিছুক্ষণ পরে বেরিয়ে এলো। আমি তো মুগ্ধ নয়নে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে আছি। খুব সুন্দর লাগছিলো। মেয়েটা কখন যে আমার সামনে চলে এলো আমি খেয়ালি করিনি।

— এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?

আমি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম। তারপর বেরিয়ে এসে দু’জন নাস্তা করতে চলে গেলাম। দেখলাম আব্বু আম্মু আগে থেকেই বসে আছে। আমরা গিয়ে তাদের সামনে বসলাম।

হঠাৎ করে আব্বু বলল — সবুজ, তোর শ্বশুর ফোন দিয়েছে। উনি বলছে তোকে আর বউমাকে ওখান থেকে ঘুরে আসতে।

— আজকে?

— হুম। বউমা যাবে নাকি?

জয়ার দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করল আব্বু। জয়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলল। কিন্তু আমার কেন জানি খুব ভয় করছে। সেখানে গিয়ে যদি কিছু হয়? আমার শরীর টাও খুব একটা ভালো দেখছিনা। আমি বললাম — আব্বু আমি না গেলে হয়না? আসলে আমার একটু কাজ ছিল।

— তোর এখন কিসের কাজ? অফিস তো অফ। আর তুই না গেলে বউমা কি একা যাবে নাকি? বাচ্চাদের মতো কথা বলিস কেন?

আমি আর কোনো উত্তর দিতে পারলাম না। কি বলব? কিছুই তো বলার নাই। সবাইকে তো বলতেও পারছিনা আমার রোগের কথা। তারপর কোনো রকমে নাস্তা খেয়ে নিজের রুমে গেলাম। আমি রুমে একাই বসে আছি। তখন আম্মু আমার রুমে আসলেন।

— বাবা, তোকে কেমন যেনো দেখাচ্ছে, তুই ঠিক আছিস তো?

মায়ের মন বলে কথা। সন্তানের কিছু হলে আগে খবর পায় মা। কিন্তু আমি তো সত্যি টা বলতে পারছিনা।

— না আম্মু কিছু হয়নি তো।

— ওহ, আমার মনে হচ্ছে তুই কিছু একটা লুকিয়ে যাচ্ছিস আমার থেকে।

আমি একটা মুচকি হাসি দিয়ে বললাম — আরে কি লুকাবো? কিছু হয়নি তুমি অহেতুক চিন্তা করছ।

আম্মু আর কিছু বলল না। তারপর উনি চলে গেলো। আমি রুমে বসে ডাক্তারকে কল দিলাম। ডাক্তার ফোন রিসিভ করল।

— আসসালামু আলাইকুম।

— ওয়া আলাইকুম সালাম। এখন কি অবস্থা আপনার?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। গতকাল রাতে ব্লিডিং হইছিল আবার।

— আমার মনে হয় আপনার দ্রুত মেডিক্যাললে ভর্তি হওয়া উচিৎ। আগে থেকে চিকিৎসা করলে হয়তো ভালো হওয়ার চান্স আছে।

— আমি মনে হয় আর বেশি দিন বাঁচবোনা, যত দিন আছি পরিবারের সাথে সময় কাটাই। তাহলে মরে গেলেও আফসোস থাকবেনা।

— কি বলছেন এসব?

— ডাক্তার সাহেব, আমি তো জানি সব। আমাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিয়ে লাভ নেই।

— পরিবারকে জানিয়েছেন?

— নাহ। আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। ঘরে নতুন বউ।

— নতুন বউ মানে?

এবার ডাক্তারকে সব কিছুই বললাম। ডাক্তার কি বলবে সেও ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা।

— আচ্ছা কল রাখি এখন।

— আমার মনে হয় বিষয় টা বাসায় জানানো উচিৎ।

— তারা মেনে নিতে পারবেনা। সেই জন্য আমি কাওকে জানাতে চাইছিনা।

ডাক্তারের সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলাম। ইতিমধ্যে আমার স্ত্রী জয়া চলে আসছে।

— আপনি কি কোনো কারণে আমার উপরে রেগে আছেন?

মেয়েটার প্রশ্ন শুনে আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম — তোমার উপরে রাগ করব কেন?

— তাহলে আমাদের বাড়িতে যেতে চাইছেন না কেন?

— আসলে একটু কাজ ছিল সেই জন্য। সমস্যা নেই আমি যাবো। জামাকাপড় রেডি করে রেখে দাও।

— সত্যিই?

— হুম।

মেয়েটা আমার কথা শুনে অনেক খুশি হলো। মেয়েটা খুব অদ্ভুত। অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।

দেখতে দেখতে দুপুর হয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রেডি হয়ে এলাম দুজনে। আম্মু আর আব্বুর থেকে বিদায় নিয়ে বের হলাম। একটা গাড়ি দাঁড় করিয়ে দু’জন উঠলাম। গাড়ি তার নিজ গতিতে চলছে।

গল্পের এতো দূর অব্দি চলে এলাম আর এখনও আমার পরিচয় দিলাম না! যাইহোক, আমি সবুজ। একটা কোম্পানিতে ম্যানেজার পদে জব করছি। পরিবারে মা-বাবা আর আমি। আর আমার স্ত্রী জয়া। এবার নাইকার পরিচয় দিয়ে দেই। নাম জয়া, দেখতে প্রচুর কিউট। আর বেশি কিছু বললাম না। পোলাপান ক্রাশ খেতে পারে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি আর আমার স্ত্রী শ্বশুর বাড়ির সামনে পৌছে গেলাম। গাড়ি থেকে নামতেই আমার শ্বাশুড়ি এসে জয়াকে জড়িয়ে ধরে। তারপর আমরা বাসার ভিতরে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পরে নাস্তা দিয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি জয়ার রুমে চলে গেলাম। হঠাৎ একটা মেইলি কণ্ঠ শুনে আমি সামনের দিকে তাকালাম।

— কেমন আছেন ভাইয়া?

— আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনাকে তো চিনলাম না! কে আপনি?

— আমি আপনার শালীকা।

— আমার যে শালী আছে সেটা তো জানতাম না!

— আমি জয়া আপুর খালাতো বোন।

— ওহ আচ্ছা।

— ভাইয়া আপনি কিন্তু অনেক কিউট। আর অনেক হ্যান্ডসাম।

— আপনি অনেক কিউট।

— কি আপনি আপনি করছেন? আমি আপনার ছোট হই। তুমি করে বলুন।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

এমন সময় জয়া রুমের ভিতরে চলে আসে। কিরে রিয়া তুই এখানে কি করিস?

— তোর জামাইয়ের সাথে পরিচিত হতে আসলাম। তুই তো পরিচয় করিয়ে দিলি না।

— পরিচয় হওয়া শেষ? এখন খেতে চল। আপ্নিও আসুন, রাত হয়েছে।

তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ করে আমি ছাদের উপরে গিয়ে বসলাম। আমার শ্বশুর মশাই সিগারেটে টান দিতে দিতে আমার কাছে এসে বলল।

— কি ব্যাপার তুমি এতো রাতে ছাদের উপরে কেন? আমার মেয়ের সাথে ঝগড়া হয়েছে নাকি?

— না বাবা।

— আমি বুঝতে পারছি, বলতে হবেনা। আসলে বাবা স্বামী মানেই অবহেলিত। আমার বউ মানে তোমার শ্বাশুড়ি ও আমার সাথে খুব ঝগড়া করে। যাইহোক সিগারেট খাও?

শ্বশুরের মুখে এমন প্রশ্ন শুনবো আমি ভাবতেও পারিনি।

— না আমি এসব খাইনা।

— গুড, সিগারেট খাওয়া ভালো না। এতে অনেক রোগ হয়।

শালা সিগারেট খেতে খেতে আমাকে উপদেশ দিতাছে। শ্বশুর কে শালা বলে ফেললাম। আপনারা আবার বলে দিয়েন না।

— স্ত্রীকে কীভাবে নিজের দখলে রাখতে হয় জানো তো নাকি?

— বাবা এটা তো আমার প্রথম বিয়ে তাই জানিনা।

শ্বশুর মশাই হাসতে হাসতে বলল — আরো বিয়ে করার পরিকল্পনা আছে নাকি?

— না বাবা।

— ওহ আচ্ছা। শোনো সব সময় বউকে নিজের কন্ট্রোলে রাখতে হয়। আমার মতো। তোমার শ্বাশুড়ি আমাকে অনেক ভয় পায় বুচ্ছো।

হঠাৎ করে আমার শ্বাশুড়ির আগমন ঘটে।

— তোমাকে না কতবার বলছি রাতে ছাদের উপরে এসে এসব না খেতে।

আমার শ্বাশুড়ির কথা শুনে আমার সাহসী শ্বশুর বলল — আসলে জামাইকে দেখলাম একা বসে আছে। তাই এসে একটু কথা বলছি।

— অনেক কথা বলছেন। এখন রুমে আসুন। বাবা তুমিও রুমে চলে যাও অনেক রাত হয়েছে।

আমার সাহসী শ্বশুর রুমে চলে গেলো। শ্বশুরের অবস্থা দেখে অনেক কষ্টে নিজের হাসি আঁটকে রেখেছি। বউকে কন্ট্রোল করা শেখাতে আসছিল আমায়। এসব ভাবতেই হাসি চলে আসলো। তারপর আমিও নিজের রুমে চলে গেলাম।

— এতক্ষণ কোথায় ছিলেন আপনি?

— ছাদের উপরে।

— আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়ুন। রাত অনেক হয়েছে।

— আলাদা বিছানা নেই?

— কেন?

— আমি কোথায় ঘুমব?

— খাটে।

— আরে না। আচ্ছা আমাকে একটা বালিশ দাও। আমি সোফায় ঘুমতে পারবো।

— আচ্ছা একটা প্রশ্ন করতে পারি?

— হ্যাঁ।

— আমার সাথে ঘুমাতে কি সমস্যা আপনার? আমাকে কি আপনার পছন্দ না?

— আরে এমন কিছুই না। আমি তো বলছি আগে আমাদের মধ্যে চেনাজানা হোক। আমি চাইনা আপাতত আমাদের মধ্যে কিছু হোক।

— কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আমাকে আপনি পছন্দ করেন না।

— এমন কিছুই না।

— তাহলে আপনি আমার সাথে খাটের উপরে ঘুমবেন।

কি করব আর। আমি গিয়ে জয়ার পাশে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। আসলে চোখে ঘুম আসছেনা। খুব অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। সবাই কতটা হাসিখুশি। এই মানুষ গুলোকে ছেড়ে চলে যেতে হবে আমায়! নিজের অজান্তেই চোখের পানি পড়ছে। আমি এবার দেখলাম জয়া ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি বালিশ নিয়ে চলে গেলাম সোফায়। কারণ কখন কি হয় বলা মুসকিল। আমি চাইনা জয়ার সাথে আমার কিছু হয়ে যাক। এমনিতেই মেয়েটার জীবন আমি নষ্ট করে দিচ্ছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লাম। জয়ার ডাকে ঘুম থেকে উঠলাম। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখি রেগে আছে প্রচুর। রাগে মেয়েটার পুরো মুখ লাল হয়ে আছে। হঠাৎ করে দরজায় কে যেনো শব্দ করল। জয়া দরজা খুলে দিল। দরজা খুলতেই আমি সামনের দিকে তাকিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম।

চলবে?

এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০১

0

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[সূচনা পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

কিছুক্ষণ আগেই ক্যান্সার ধরা পড়ছে। বাসর ঘরে নববধু, সে তো আমার অপেক্ষায় বসে আছে। কীভাবে সবাইকে বলব আমি মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত! যেখানে নিজেই মানতে পারছিনা সেখানে পরিবারের লোকজন কীভাবে মেনে নিবে? আমিও জানতাম না এতো বড় একটা রোগে আমি আক্রান্ত। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার ফোন দিয়ে জানালেন। আমি যে একটা মেয়ের সুন্দর জীবন দংশ করে দিলাম। আমি তো কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। নিজের জন্য একটুও খারাপ লাগছেনা। কিন্তু আমার পরিবার, আমার মা-বাবা। তাদের কথা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। কারণ আমি ছাড়া তো তাদের কেউ নেই। তারপর আবার আমার বিয়ে করা নতুন স্ত্রী। কি করব মাথায় কাজ করছেনা।

এদিকে রাত গভীর হচ্ছে। আমি এখনও বাসর ঘরে প্রবেশ করলাম না। মেয়েটা হয়তো এখনও আমার অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ করে মায়ের ডাক শুনলাম। চোখের পানি গুলো তাড়াতাড়ি করে মুছে মায়ের দিকে ফিরলাম।

— কিরে, তুই এতো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস তোর কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? মেয়েটা একা রুমে বসে আছে, আর তুই বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস।

— যাচ্ছি আম্মু।

— এখনি চল আমার সাথে।

আম্মু আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বলে রাখি আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পরে হঠাৎ করে আমার মুখ দিয়ে ব্লিডিং হচ্ছিলো। ঐরকম একটা গুরুত্ব দেয়নি প্রথমে। দুইদিন আগে আবার হলো। তারপর ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। বিয়ের ডেট আগেই ঠিকঠাক হয়ে যায়। আমি ব্লাড পরিক্ষা করালাম। আর সেটার রিপোর্ট এসেছে মাত্র আমার হাতে। তাও অনেক দেরি করে এলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্মু আমাকে নিয়ে বাসর ঘরের সামনে চলে এলো। এবার আমি রুমের ভিতরে প্রবেশ করলাম। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আমি এবার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম।

এদিকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে মেয়েটা এসে আমার পায়ে সালাম করে আবার খাটের উপরে চলে যায়। মেয়েটার কাছে যেতেও বুকের ভিতর উতালপাতাল শুরু করে দিয়েছে। বাসর রাতে মেয়েটাকে কি সত্যিটা বলে দেওয়া ঠিক হবে? যদি কথা গুলো শুনে কষ্ট পায়? মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা এসে ভর করছে। আমি এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছি।

হঠাৎ করে জয়ার ডাকে দ্যান ফিরে এলো।

— আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভয় পাচ্ছেন নাকি আমাকে?

মেয়েটার কথা শুনে মুখে একটা মুচকি হাসি এনে আমি খাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর খাটের উপরে এসে বসলাম।

— খাওয়া দাওয়া হয়েছে রাতে? নাকি খালি পেটে বসে আছো?

মেয়েটা লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলল — আসলে আমার সত্যিই অনেক খিদে পেয়েছে। তখন খাবার দিয়ে গিয়েছে খেতে পারিনি।

— আচ্ছা আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি। আর তুমি শাড়িটি পরিবর্তন করে একটা পাতলা শাড়ি পড়ে নাও। আলমারিতে রাখা আছে।

এই কথা বলে আমি বেরিয়ে গেলাম। আর এক প্লেট খাবার নিয়ে ফিরে এলাম। রুমে আসার আগে দরজার মধ্যে টোকা দিলাম। মেয়েটা ভিতরে আসতে বলল। আমি মেয়েটার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বললাম — যা পেয়েছি নিয়ে আসছি।

— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই কথা বলে মেয়েটা খাওয়া শুরু করে। আমি তার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটাকে কী যে মায়াবী লাগছে। আমি গিয়ে খাটের উপরে বসে রইলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে এবার জয়া খাটের উপরে এসে বসে।

— আচ্ছা আপনি কি মেয়েদের দেখলে লজ্জা পান বুঝি?

আমি জয়ার প্রশ্নে কিছুটা অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললা — লজ্জা পাবো কেন?

— না মানে খেয়াল করলাম আপনি তখন থেকেই আমার থেকে দূরে সরে আছেন সেই জন্য বলছি।

— ওহ আচ্ছা।

— আচ্ছা আপনি কি কখনও প্রেম করছেন?

— নাহ।

— সত্যি বলছেন নাকি মিথ্যা বলছেন?

— সত্যি কথা বলছি।

— তাহলে ঠিক আছে।

— আচ্ছা তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে থাকলে বলতে পারো। আমি তার হাতে তোমাকে তুলে দেব।

এই প্রশ্নটা করে আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। আমার এমন প্রশ্নে মেয়েটা হয়তো বিরক্ত হয়েছে।

— আমি কখনও হারাম রিলেশনে যাইনি। আমার তো স্বপ্ন ছিল হাসবেন্ডের সাথে প্রেম করব।

— আচ্ছা শোন, তোমাকে কিছু কথা বলার দরকার।

— জ্বি বলুন।

— আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছে। আমরা তো কেউ কাওকে ভালো ভাবে চিনিনা। আমাদের একজন আরেকজনকে চেনার জন্য কিছুটা সময়ের দরকার। তাই আমি চাই আমাদের মধ্যে আগে চেনাজানা হবে তারপর আমরা শারীরিক সম্পর্ক করব।

জয়া একটা মুচকি হাসি দিয়ে সহমত পোষণ করল।

— আচ্ছা তোমার কোনো স্বপ্ন আছে এই বাসর রাত নিয়ে? আমাকে বলতে পারো আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করব।

— সত্যিই করবেন?

— হ্যাঁ।

— আমার ইচ্ছে করছে ফুচকা খাওয়ার। প্লিজ চলুন আমরা বাহিরে গিয়ে ফুচকা খেয়ে আসি।

— এতো রাতে?

— চলুন না প্লিজ প্লিজ।

— ওয়েট আগে দেখি আম্মু ঘুমাইছে নাকি।

এই কথা বলে আমি নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের রুমে গেলাম। দেখলাম তাঁরা ঘুমিয়ে আছে। এবার নিজের রুমে ফিরে এসে জয়াকে নিয়ে এতো রাতে বেরিয়ে এলাম। বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম। জয়া উঠে বসল। জয়ার পাশে বসতে খুব অস্থির লাগছে আমার। আমাদের দু’জনের পাশে কিছুটা গ্যাপ রেখে বসছি। আমার এভাবে বসতে খুব অসুবিধে হচ্ছিলো। হয়তো ব্যাপারটা জয়া লক্ষ্য করে।

— আপনি তো রিকশা থেকে পড়ে যাবেন। ঠিক করে বসুন। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি তো আপনার স্ত্রী।

মনে সাহস এনে আমি ঠিকভাবে বসলাম। হঠাৎ করে জয়া আমাত হাত চেপে ধরে। হঠাৎ করে মনে হলো আমি কারেন্টের শর্ট খেয়েছি। আমি জয়ার হাত টা সরিয়ে দেওয়ার শক্তি পাচ্ছিনা। কিছুক্ষণ পরে আমরা একটা ফুচকা দোকানের সামনে গিয়ে নামলাম। তারপর এক প্লেট ফুচকা ওর্ডার দিলাম।

— এক প্লেট কেন? আপনি খাবেন না?

— নাহ, ফুচকা আমি খাইনা।

এবার মেয়েটা খাওয়া শুরু করলো। আমি তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। আর খুব আপসোস হচ্ছে ঈশ, যদি আমি সুস্থ থাকতাম! যদি আরো কিছু দিন বেঁচে থাকার সুযোগ হতো। এই মেয়েটার সুন্দর জীবন আমি শেষ করে দিলাম।

ইতিমধ্যে জয়ার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জনে বাসায় ফিরলাম।

— শোনেন, চলুন আমরা ছাদের উপরে যাই। আকাশে আজ অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে আমরা আজ এক সাথে চাঁদ দেখবো।

তারপর দু’জন ছাদের উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হালকা বাতাসে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চাঁদের সব আলো যেনো মেয়েটার মুখের উপরে এসে পড়ছে। এ যেনো আমার সামনে দু’টি চাঁদ। মেয়েটার থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। হঠাৎ করে মেয়েটা আমার হাত ধরে বলল,

— জানেন খুব স্বপ্ন ছিল পূর্নিমার রাতে আমার বিয়ে হবে। আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে চাঁদ দেখবো। আপনি আমার সব ইচ্ছে পূরণ করে দিয়েছেন। আপনার মতো স্বামী পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।

আমি কিছু বললাম না। কি বা বলার আছে? আমি তো আর কিছুদিনের জন্য আছি। আমি তো এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলেই যাবো। এসব ভাবতেও অনেক খারাপ লাগছে।

হঠাৎ করে নাকে হাত দিলাম। হাত টা সামনের দিকে আনতেই দেখি আমার পুরো হাত লাল হয়ে গিয়েছে। আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ভালো ভাবে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। রুমে এসে দেখি জয়া বসে আছে।

— কি হইছে আপনার এভাবে চলে এলেন কেন?

— তেমন কিছু হয়নি। আচ্ছা রাত অনেক হয়েছে এখন আমাদের ঘুমিয়ে পড়া দরকার।

— হুম চলুন।

এবার খাট থেকে একটা বালিশ নিয়ে নিচে বিছানা করব তখনই জয়া বলল,

— একি নিচে বিছানা করছেন কেন?

— আমি নিচে ঘুমব। তুমি খাটের উপরে ঘুমিয়ে পড়।

— আরে নিচে কেন ঘুমাবেন? খাটের উপরে ঘুমতে পারেন আমার কোনো সমস্যা হবে না।

— সমস্যা হতে কতক্ষণ? একটা ছেলে একটা মেয়ে এক বিছানায় থাকলে নিজেকে কন্ট্রোল করে কতক্ষণ রাখা যাবে?

মেয়েটা একটা হাসি দিয়ে বলল — আপনি তো আমার হাসবেন্ড সমস্যা কি?

— কোনো সমস্যা নাই। আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমব।

এই কথা বলে আমি নিচে বিছানা করে বালিশে মাথা রাখলাম। মেয়েটাও খাটের উপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে আমার চোখে ঘুম নেই। আমার কি ঠিক হচ্ছে? মেয়েটাকে তো সত্যি টা বলে দেওয়ার উচিৎ ছিল। বললে হয়তো আজকে আর মেয়েটার মিষ্টি হাসি আমি দেখতেই পারতাম না। কেন জানি মেয়েটাকে কাছে পেয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কি আর সেই কপাল আছে? আমি তো আর সামান্য কিছুদিনের মুসাফির মাত্র। সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো। মা-বাবাকে কীভাবে বলব তোমাদের ছেলে তোমাদের একা করে দিয়ে চলে যাবে? বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে অঝোর ধারা বৃষ্টি নামছে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানিনা। হঠাৎ করে বুকের উপরে ভারী কিছু অনুভব করে চোখ খুলে তাকালাম। চোখ খুলতেই আমি চমকে উঠলাম।

চলবে?

বিরহডোরে বাঁধিয়াছি তারে পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_১২(অন্তিম পর্ব)
___________________
তৃধার মুখে হাসি ফুটলো।রুমা বেগমের কথায় সে যতটা না কষ্ট পেয়ে ঠিক ততটাই আনন্দ পেয়েছে আহাদ তার পাশে আছে দেখে!রফিকুল সাহেবকে উদ্দেশ্য করে রুমা বেগম বললেন,

-“দেখলি তো তোর ছেলে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করলো!”

রফিকুল সাহেব হাসি দিয়ে বললেন,

-“এতোদিন আহাদের কথাবার্তা নিয়ে আমার খুব সমস্যা ছিল।তবে আজ প্রথমবার ও যা যা বলেছে তার সাছে আমি একমত।”

রফিকুল সাহেব কথাগুলো বলে রুমের দিকে চলে গেলেন।রুমা বেগম চোয়াল শক্ত করে বললেন,

-“আমি আর এই বাড়িতে এক মুহুর্ত থাকবো না।”

আয়েশা বেগম গিয়ে রুমা বেগমের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন,

-“আপা এমনটা করবেন না।কালকে বৌভাতের অনুষ্ঠান আছে তারপরে না হয় যেয়েন।”

রুমা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে হাসি দিয়ে বললেন,

-“আরে আমি সবটা মজা করে বলেছি।”

আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

-“মানে?”

-“আরে আদি আমাকে সবটা বলেছিল ওদের বিয়েটা কিভাবে হয়েছে!তাই আমি ভাবলাম একটু পরীক্ষা করেই দেখি আহাদ ও-কে এখনো ভালোবাসে নাকি!আর পরীক্ষার ফলাফল দেখে আমার বুঝা হয়ে গেছে আহাদ এখনো তৃধাকে ভালোবাসে।”

কথাগুলো বলে রুমা বেগম তৃধার কাছে গিয়ে বললেন,

-“মা আমাকে ভুল বুঝো না।”

-“না ফুপি সমস্যা নেই কোনো।আপনি ওই কথাগুলো না বললে আমিও জানতাম না আহাদের যে আমার প্রতি এখনো এতোটা খেয়াল আছে!”

রুমা বেগম হাসি দিয়ে রুমের দিকে চলে গেলেন।

রাতের বেলা আহাদ বসে বসে বই পড়ছে আর তৃধা সৃজার সাথে মোবাইলে কথা বলছে।সৃজার সাথে কথা বলা শেষ হতে তৃধা বললো,

-“আজকে আমি খুব খুশি হয়েছি আহাদ।”

আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“কেনো?”

-“এই যে এটা তো শিওর হলাম তুমি সবসময় আমার পাশে আছো।”

আহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“আমার ওতোটা রিয়েক্ট করাও ঠিক হয়নি।ফুপি তো নাকি মজা করে বলেছে।”

-“হ্যাঁ তোমার ভালোবাসার পরীক্ষা নিয়েছে।”

আহাদ আর কিছু না বলে বই পড়ায় মন দিল।তৃধা আহাদের থেকে বইটা কেড়ে নিয়ে বললো,

-“বউ বসে আছে সামনে কোথায় বউয়ের সাথে গল্প করবে তা না গল্পের বইতে মুখ গুঁজে বসে আছে।”

-আমার জন্য এটা বেস্ট!”

তৃধা আর কিছু না বলে মুখ গোমড়া করে শুয়ে পড়লো।আহাদও কিছুক্ষণ পরে শুতে গিয়ে দেখলো তৃধা ঘুমিয়ে পড়েছে।আহাদ কিছুক্ষণ তৃধার দিকে তাকিয়ে থেকে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,

-“ভালোবাসি!অনেক বেশি ভালোবাসি!”

পরেরদিন,
আহাদ আর তৃধার বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হলো।তৃধা আহাদের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“সো মিস্টার আপনার মনে কি আমার জন্য আবার ভালোবাসার সৃষ্টি হয়েছে?”

আহাদ মৃদু হেসে বললো,

-“যেই ভালোবাসা শেষই হয়নি তা আবার নতুন করে কি সৃষ্টি হবে!”

তৃধা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“স্বীকার করলে তাহলে?”

-“হ্যাঁ!স্বীকার না করে তো আর উপায় নেই।বিয়ে যখন হয়ে গেছে সারাজীবন তো একসাথেই কাটাতে হবে তাই ভাবলাম স্বীকার করেই নি।”

দুজনে একসাথে হেসে দিল।রুহি জয়কে নিয়ে এসে রফিকুল সাহেব আর আয়েশা বেগমের সামনে দাঁড়া করিয়ে বললো,

-“বাবা-মা আমি জয়কে ভালোবাসি।”

আয়েশা বেগম অবাক হয়ে বললেন,

-“তুইও এইসব শুরু করে দিলি?”

জয় মাথা নিচু করে বললো,

-“আন্টি আমি রুহিকে অনেক ভালোবাসি।আমি ও-কে খুব ভালো রাখবো।”

রফিকুল সাহেব হাসি দিয়ে বললেন,

-“আমাদের ছেলে-মেয়ে দুজনই এডভান্স।আমাদের আর তাদের জন্য পাত্র-পাত্রী খোঁজা লাগবে না কষ্ট করে।”

রফিকুল সাহেবের কথা শুনে বাড়ির সবাই হেসে দিলেন।তৃধা অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করেছে এশা যেন কেমন করে আহাদের দিকে তাকিয়ে আছে।যা দেখে তৃধা আহাদকে বললো,

-“আচ্ছা এশা কি তোমাকে পছন্দ করতো?”

-“হয়তো!জানি না আমি।”

-“কিন্তু ও তোমার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিল তা দেখে তো মনে হলো হয়তো পছন্দ করে।”

-“করুক।আমাকে যেই পছন্দ করুক না কেনো আমার পছন্দ একজনেই সীমাবদ্ধ ছিল।তাই এইসব নিয়ে কথা না বলাই বেটার।”

তৃধা আর কিছু না বলে নিঃশব্দে হেসে দিল।

কিছুদিন পরে এশা আর অয়ন দেখা করলো।অয়ন হাসি দিয়ে বললো,

-“তুই আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিস যা দেখে আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছি!”

-“অয়ন আমার তোর সাথে কিছু কথা আছে।”

-“বল আমি তো তোর কথা শোনার জন্য সর্বদা বসে থাকি।”

-“অয়ন আমি এই কয়দিন অনেক ভেবে দেখেছি।তুই ছাড়া আর গতি নেই!”

অয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“মানে?”

-“আমি আমার জীবনের নতুন অধ্যায় তোর সাথে শুরু করতে চাই!”

-“সত্যি?”

-“হ্যাঁ।”

অয়ন হেসে দিল কিন্তু তার চোখে পানি।এশা অয়নের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো,

-“ভালোবাসাটা এখনো সৃষ্টি হয়নি তবে তোর এতো ভালোবাসা দেখে সৃষ্টি হতে সময় লাগবে না।”

তারপরে দুজনে একসাথে হেসে দিল।



-“এশা তুই বিয়ে করে ফেলেছিস।”

রবিউল সাহেবের কথা শুনে এশা বললো,

-“হ্যাঁ বাবা…আমি আর অয়ন বিয়ে করে ফেলেছি।”

-“তা আমাকে আগে বলতি।আমার একমাত্র মেয়ে তোর বিয়ে আমি ধুমধাম করে দিতাম।”

অয়ন পাশে থেকে বললো,

-“আসলে আমার মতো অনাথ ছেলেকে আপনি নিজের মেয়ের জামাই হিসেবে মেনে নেন নাকি সেই ভয়ে এশা এমনটা করেছে।”

এশা চোখ রাঙিয়ে অয়নের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“অয়ন একদম এইসব উল্টাপাল্টা কথা বলবি না।”

রবিউল সাহেব অয়নকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“তোমাকে আমার মেয়ের জামাই হিসেবে আমার খুব পছন্দ হয়েছে বাবা।”

আদি পাশে থেকে বললো,

-“আমারও দুলাভাই হিসেবে তোমাকে পছন্দ হয়েছে!”

এশার মুখে হাসি ফুটলো।



একবছর পরে,
আহাদ আর তৃধার সব ঝামেলা মিটে গিয়েছে।তারা এখন সুখী দম্পতি!আজকে মুহিত আর সৃজার বিয়ে।আহাদ গিয়ে মুহিতের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“কখন কি ঘটিয়ে ফেললি আমরা টেরই পেলাম না।”

মুহিত হাসি দিয়ে বললো,

-“ভালোবাসা গোপনেই সুন্দর,প্রকাশ করলে আবার নজর লাগতে পারে।”

মুহিতের কথা শুনে সবাই হেসে দিল।কিন্তু সৃজা চোখ রাঙিয়ে বললো,

-“এমন কতগুলো গোপন ভালোবাসা আছে?”

মুহিত ঘাবড়ে গিয়ে বললো,

-“আরে না তুমি ছাড়া আর কেউ নেই।ওটা তো কথার কথা বললাম।”

সৃজা ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-“পরে যদি কিছু শুনি তখন বুঝবে আমি কে!”

তৃধা হাসি দিয়ে বললো,

-“তোর গুন্ডী ভাব আর গেল না সৃজা।”

সৃজা হাসি বললো,

-“ওটা আর যাবে না।”

মুহিত আর সৃজার বিয়ে সুন্দর ভাবে সম্পূর্ণ হলো।

এভাবে তিন বছর কেটে গেল।আহাদ আর তৃধার একটা মেয়ে হয়েছে।মেয়ের বয়স দেড় বছর!মুহিত আর সৃজা এখন আমেরিকায় থাকে।অয়ন আর এশাও দেশ ছেড়ে কানাডায় চলে গেছে।সেখানের এক ভার্সিটিতে দুজনে প্রফেসর হিসেবে নিয়োজিত।তাদের একটা দুই বছরের ছেলে আছে।

আজকে রুহি-জয় আর তোহা-আদির বিয়ে!আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“রুহির টা না হয় জানি কিন্তু আমার শালিকাও দেখি ছুপা রুস্তম!”

তোহা মুখ গোমড়া করে বললো,

-“মোটেও না জিজু।আমি তোমার ভাইয়ের সাথে কোনো প্রেম করিনি।আমি প্রথমেই বলেছিলাম করলে একেবারে বিয়ে করবো আর আজকে সেটাই হচ্ছে।”

আদি ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আর এই তিন বছর ধরে অপেক্ষা করতে করতে আমি আধমরা হয়ে গেছি।”

রুহি পাশে থেকে বললো,

-“সমস্যা নেই বিয়ে হলে আবার জীবিত হয়ে যাবি।”

জয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“আর আমি সম্পূর্ণ মৃত হয়ে যাবো।”

রুহি জয়ের পিঠে একটা কিল মারলো।জয় হাসি দিয়ে বললো,

-“আরে আমি মজা করেছি!”

কাজী সাহেব বিয়ে পড়াচ্ছে।আহাদ তার মেয়ে তৃহাকে কোলে নিয়ে তৃধার কাঁধে হাত রেখে তা দেখছে।আহাদ হাসি দিয়ে বললো,

-“আমাদেরও এমন একদিন বিয়ে হয়েছিল তাই না তৃধা।”

-“হ্যাঁ তবে বিয়েটা তোমাকে জোর করে দেওয়া হয়েছিল।”

-“আরে ওটা তো বাইরে বাইরে না করেছি ভিতরে ভিতরে তো রাজি ছিলাম।এই যে তার প্রমাণ এখন আমার কোলে ঘুমিয়ে আছে।”

তারপরে দুজনে একসাথে হেসে দিল।দুই জোড়া বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।আহাদ আর তৃধা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের চাঁদ দেখছে।আর তৃহা বিছানায় ঘুমিয়ে আছে।তৃধা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“আহাদ আমি একটা জিনিস বুঝেছি মানুষ যা মন থেকে চায় তা পায়।এই যে দেখো আমার মন সবসময় বলতো তুমি একদিন আমার হবে।তুমি ঠিকই আমার হয়েছো!”

আহাদ তৃধার কপালে একটা চুমু দিয়ে বললো,

-“তোমার অনেক ধৈর্য্য!আমি তো আর তোমাকে কম কথা শোনায়নি।”

-“ভালোবাসলে একটু বেহায়া হতে হয় নাহলে তো ভালোবাসার মানুষটাকে হারিয়ে ফেলতে হয়।আর আমি চাইনি আমার ভালোবাসার মানুষ আমার থেকে হারিয়ে যাক।তাই বেহায়া হয়েই না হয় তাকে নিজের করেছি।”

আহাদ তৃধার কানের পাশে একটা গোলাপ গুঁজে দিয়ে বললো,

-“অনেক ভালোবাসি তোমাকে তৃধা।এই ভালোবাসা সবসময় একই থাকবে।”

তৃধা আহাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“আমিও তোমাকে অনেক ভালোবাসি আহাদ।সারাজীবন এভাবেই আমার পাশে থেকো!”

হঠাৎ করে তৃহা কেঁদে উঠলো।আহাদ আর তৃধা দুজনেই দ্রুত তার কাছে গেল।তৃধা মেয়েকে কোলে নিয়ে কান্না থামালো।একটু পরে তৃহা আবার ঘুমিয়ে পড়লো।আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“মেয়ে তো দেখছি বাবা-মায়ের ভালোবাসা সহ্য করতে পারে না।এভাবে চললে ওর সঙ্গী তো আসতে পারবে না।”

তৃধা আহাদের কাঁধে একটা থাপ্প*ড় দিয়ে বললো,

-“কি সব যে বলো!”

-“ম্যাডাম এতো লজ্জা পাওয়ার কি হয়েছে।একটা হয়ে গিয়েছে আরেকটা তো আসবেই তাই না!”

দুজনে একসাথে হেসে দিল।আহাদ…তৃধা আর তৃহাকে একসাথে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“আমার শান্তি এখানেই মিলে!”

________________#সমাপ্ত________________

বিরহডোরে বাঁধিয়াছি তারে পর্ব-১১

0

#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_১১
___________________
তৃধাকে আহাদদের বাড়িতে নিয়ে আসা হলো।তৃধাকে দেখে আয়েশা বেগম হাসি দিয়ে বললেন,

-“যাক আমার ঘরের লক্ষী চলে এসেছে।”

আহাদ তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হাসছে।আহাদ নিশ্বাস ফেলে বললো,

-“আম্মু সব তো হয়ে গেল এখন আমি রুমে যাই।আমার অনেক টায়ার্ড লাগছে!”

পাশে থেকে আদি বললো,

-“এখনি টায়ার্ড হয়ে গেলে হবে নাকি রাত তো এখনো বাকি আছে!”

আহাদ চোখ রাঙিয়ে আদির দিকে তাকালো।আদি আর কিছু না বলে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো।রুহি গিয়ে আহাদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-“ভাইয়া তোর যখন এতো টায়ার্ড লাগছে এক কাজ কর তৃধা ভাবিকে কোলে করে তোর রুমে নিয়ে যা।এটা আমার একমাত্র আবদার।আর তোদের কোনো ডিস্টার্ব করবো না।”

আহাদ চোয়াল শক্ত করে বললো,

-“কি বলছিস এইসব!বাড়ি ভর্তি মানুষ আর আমি ও-কে কোলে করে রুমে নিয়ে যাবো।”

আদি হাসি দিয়ে বললো,

-“আরে ভাইয়া’ ভাবি তো তোমার বউই।কোলে তুলে নেও সবাই হাততালি দিবে।”

তৃধা বাঁধা দিয়ে বললো,

-“আরে না দরকার নেই।আমি হেঁটেই যেতে পারবো।”

রুহি তৃধার কাঁধে হাত রেখে বললো,

-“আমরা জানি ভাবি তুমি হেঁটে যেতে পারবে।এটা আমাদের ইচ্ছা।”

আয়েশা বেগম বললেন,

-“ওরা যখন এতোবার বলছে কোলে করে নিয়ে যা না তৃধাকে আহাদ!”

সবার জোরাজুরিতে আহাদ বাধ্য হয়ে তৃধাকে কোলে করে তার রুমে নিয়ে গেল।তৃধাকে বিছানায় বসিয়ে দরজা লাগাতে গেলে রুহি উঁকি দিয়ে বললো,

-“অল দ্যা বেস্ট!”

আহাদ যেই রুহিকে মা*রতে যাবে সে দৌড়ে চলে গেল।আহাদ দরজার লক লাগিয়ে বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে বললো,

-“দেখুন এইসব ওদের কথায় করেছি।আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আপনাকে কোলে করে নিয়ে আসার!”

কথাগুলো বলে আহাদ ওয়াশরুমের দিকে চলে যেতে গেলে তৃধা আহাদের হাত টেনে ধরলো।আহাদ দাঁড়িয়ে পড়লো।তৃধা তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“আহাদ আমি জানি তুমি আমাকে এখন সহ্যই করতে পারো না।তবে প্লিজ আমাকে আর আপনি করে বলো না।আগের মতো তুমি করে বলো।সবার আবদার তো মানলে আমারটা না হয় একটু মানো!”

আহাদ কিছুক্ষণ তৃধার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“আচ্ছা ঠিক আছে।”

আহাদ ওয়াশরুমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।তৃধা হাসি দিয়ে বললো,

-“এভাবেই আমি আবার তোমার আপন হয়ে যাবো!”

আহাদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো তৃধা বিছানায় বসে বসে চকলেট খাচ্ছে।যা দেখে আহাদের মুখে হাসি ফুটলো।তৃধা সবসময়ই চকলেট খুব পছন্দ করে।আগেও বাচ্চাদের মতো চকলেট খেতো।এখনও সেই স্বভাবই রয়ে গেছে।আহাদ তৃধার সামনে গিয়ে বসে বললো,

-“বয়স তো কম হলো না এখনো এভাবেই চকলেট খাও!”

আহাদের মুখে তুমি বলে সম্বোধন শুনে তৃধার বেশ ভালো লাগলো।কত বছর পরে আহাদ তাকে তুমি করে বললো!তৃধা হাসি দিয়ে বললো,

-“বয়স বেড়েছে মিস্টার কিন্তু মানুষ তো আর পাল্টে যাইনি।”

আহাদ নিশ্বাস ফেলে বললো,

-“এইসব ভারি গহনা,শাড়ি পাল্টে অন্য কিছু পড়ো।রিলাক্স ফিল করবে!”

তৃধা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“এতো কেয়ার?”

-“এটুকু কেয়ার সবার প্রতিই দেখানো যায়।”

আহাদ কথাটা বলে মোবাইল চালাতে শুরু করলো।তৃধা বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল।কিছুক্ষণ পরে একটা লাল শাড়ি পড়ে বের হলো।লাল শাড়িতে অসাধারণ সুন্দর লাগছে তৃধাকে!তৃধা ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে চুলে বেণু করতে শুরু করলো।আহাদ তৃধাকে দেখতে ব্যস্ত!যা তৃধা ড্রেসিং টেবিলের আয়না থেকে দেখতেছে।বেণু করা শেষ হতে তৃধা বললো,

-“এতো দেখলে যে নজর লেগে যাবে!”

আহাদ আর কিছু না বলে চোখ সরিয়ে ফেলল।তৃধা গিয়ে আহাদের পাশে বসে বললো,

-“কি হলো লজ্জা পেলে নাকি?”

আহাদ তৃধার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“তুমি মেবি আমাকে বশ করার চেষ্টা করতেছো?”

তৃধা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“মানে?”

-“নাহলে ইদানীং এতো সুন্দর লাগছে কেনো তোমাকে!”

আহাদের কথা শুনে তৃধা হেসে দিল।কিছুক্ষণ পরে হাসি থামিয়ে বললো,

-“কেনো এর আগে সুন্দর লাগতো না?”

-“সুন্দর তো সবসময়ই লাগে।কিন্তু আগে আমার নিজের প্রতি কন্ট্রোল ছিল।তাকাবো না মানে তাকাবো না।কিন্তু সেই কন্ট্রোল বর্তমানে হারিয়ে ফেলেছি!”

তৃধা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“এখন তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমাদের তাই হয়তো মনের মাঝে থেকে দ্বিধাবোধটা অনেকটা কেটে গিয়েছে।”

-“সবকিছু এতোটা সহজ না তৃধা।তুমি আমাকে যা কষ্ট দিয়েছো তা আমি কোনোদিন ভুলবো না।”

-“আহাদ আজকের দিনে এইসব না মনে করালে হয় না?”

-“না হয় নাহ্!প্রতিটা ক্ষণে আমার ওইদিনটার কথা মনে হয় যেদিন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেছিলে। এতো সহজে তো ভুলে যাওয়া সম্ভব না।”

তৃধা আহাদের এক হাত শক্ত করে ধরে বললো,

-“এই যে হাত ধরলাম আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না।এক মৃত্যু ছাড়া আমাদের আর কিছুতেই আলাদা করতে পারবে না।”

আহাদ কিছুক্ষণ তৃধার দিকে তাকিয়ে থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে বললো,

-“অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো।আর শোনো বিছানার একপাশে তুমি শুবে আরেকপাশে আমি!কিন্তু আমাকে টার্চ করতে পারবে না।”

তৃধা মুখ ভেঙচি কেটে বললো,

-“আসছে!উনাকে টার্চ করার জন্য মনে হয় আমি ম*রে যাচ্ছি।”

তৃধা কথাগুলো বলে উল্টো দিকে মুখ করে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো।আহাদ মৃদু হেসে অপর পাশে শুয়ে পড়লো।



পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙতে আহাদ দেখলো তৃধা তাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।তৃধার ঘুমন্ত মুখ দেখে আহাদের মুখে হাসি ফুটলো।

-“ভেবেছিলাম আমি তোমাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি আর আজ তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছো তৃধা!কিন্তু আমি তো তোমাকে এতো সহজে মেনে নিতে পারছি না তৃধা।আমার বুকের গভীরের ক্ষত তো মুছে যাচ্ছে না!তবে আমি সবসময় তোমার পাশে থাকবো তৃধা।বিয়েটা যখন একবার হয়েই গিয়েছে আমি কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না।”

তৃধা হঠাৎ নড়েচড়ে উঠতে আহাদ চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে শুয়ে রইলো।তৃধা চোখ খুলে দেখলো সে আহাদকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে।যা দেখে তার মুখে হাসি ফুটলো!

-“হায় মাশা-আল্লাহ কি সুন্দর আমার বরটা!কত কিউট লাগতেছে ঘুমন্ত মুখখানা দেখে।জেগে থাকলে তো এতোক্ষণে এই জড়িয়ে ধরে আছি দেখে কটকট শুরু করতো।”

তৃধা তারপরে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সকাল আটটা বাজে।সে আহাদকে ছেড়ে উঠে বসে বললো,

-“না বাড়ি ভর্তি মানুষ এতো বেলা পর্যন্ত ঘুমানো ঠিক হবে না।যাই ফ্রেশ হয়ে নিচে গিয়ে আমার শ্বাশুড়ি মাকে সাহায্য করি!”

তৃধা বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হতে চলে গেল।তৃধা ওয়াশরুমে যেতে আহাদ উঠে বসে হাসতে হাসতে বললো,

-“এই মেয়ের বাচ্চামি আর যাবে না।এতো বড় ডাক্তার আর এখনো বাচ্চাদের মতো কথাবার্তা বলে!”

_________________
-“আপু চল না চাচি মা তোর কথা অনেকবার জিজ্ঞেস করতেছিল।”

আদির কথা শুনে এশা বললো,

-“না রে আমার শরীরটা ভালো না।তুমি যা আমি বরং কালকে বৌভাতে যাবো!”

-“শরীর ভালো না মানে কি হয়েছে তোর?”

-“আরে তেমন কিছু না এমনিই ভালো লাগছে না।”

-“আচ্ছা তাহলে রেস্ট নে।আমি বরং যাই।”

-“হ্যাঁ যা।”

আদি আহাদদের বাড়িতে চলে গেল।এশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“আমার জীবন থেকে এভাবেই আমার ভালোবাসার মানুষগুলো হারিয়ে যায়।প্রথমে আম্মু তারপরে আহাদ!”

এশার চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।

_______________
তৃধা নিচে নেমে আয়েশা বেগমের কাছে গিয়ে বললো,

-“মা বলো কি করতে হবে!”

আয়েশা বেগম হাসি দিয়ে বললেন,

-“তোর মুখে মা ডাক শুনে ভালো লাগলো।আর তোকে কিছু করতে হবে না।সকালের সব নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে।তুই বরং আমার সাথে চল আহাদের বড় ফুপির সাথে দেখা করতে।উনি বিয়েতে ছিলেন না আজকে এসেছেন!”

তৃধা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল।আয়েশা বেগম তৃধাকে নিয়ে রুমা বেগমের কাছে গেলেন।তৃধা’ রুমা বেগমকে সালাম করলেন।তৃধাকে দেখে রুমা বেগম বললেন,

-“দেখে তো মনে হচ্ছে মেয়ের বয়স কম হবে না।আয়েশা এতো বয়স্ক মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দিলে কি মনে করে!কিছুদিন পরে তো মেয়ে বুড়ি হয়ে যাবে তখন সংসার বাচ্চাকাচ্চা সামলাতে তো হিমশিম খেয়ে যাবে।বিয়ে দেওয়া উচিত ছেলের থেকে কম বয়সের মেয়ের সাথে আর তুমি সমবয়সী মেয়ের সাথে বিয়ে দিলে!”

আহাদ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে রুমা বেগমের কথাগুলো শুনতে পেল।সে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।আহাদ তৃধার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললো,

-“ফুপি তোমার চিন্তা ভাবনা দেখে তো আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি।ছেলের বয়স বেশি হলে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু মেয়ের বয়স বেশি হলেই সমস্যা!এই যুগে এসে তুমি এইসব চিন্তাধারা কিভাবে পুষে রাখো!আর শোনো তৃধা আমার বউ।ওর বয়স বেশি না কম সেটা আমি দেখবো।তা তোমার দেখার বিষয় না।খাও-দাও-থাকো কিন্তু তৃধাকে নিয়ে কোনো কথা বলবে না।তাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।”

আহাদ কথাগুলো বলে স্টাডি রুমের দিকে চলে গেল।

#চলবে………………..

[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

বিরহডোরে বাঁধিয়াছি তারে পর্ব-১০

0

#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_১০
___________________
দেখতে দেখতে আহাদ আর তৃধার হলুদের দিন চলে আসলো।অনেক চেষ্টা করেও আহাদ বিয়েটা ভাঙতে সক্ষম হয়নি।তাই সে হাল ছেড়ে দিয়ে বিয়েটা মেনে নেওয়ার চেষ্টায় মনোনিবেশ করেছে!

হলুদ রঙের শাড়ি আর ফুলের গহনায় সাজানো হয়েছে তৃধাকে।দেখে মনে হচ্ছে আকাশ থেকে হলুদ পরী নেমে এসেছে।তৃধা আর আহাদের হলুদের অনুষ্ঠান একসাথেই আয়োজন করা হয়েছে।দুজনে পাশাপাশি বসে আছে।আহাদ আড়চোখে তৃধাকে দেখছে।যা তৃধা বুঝতে পেরে মিটিমিটি হাসছে!তৃধা সরাসরি আহাদের দিকে তাকালে আহাদ সামনের দিকে তাকিয়ে বসলো।তৃধা এক পলকে আহাদের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“সিম্পল হলুদ রঙের পাঞ্জাবিতেও কোনো ছেলেকে এতো সুন্দর লাগতে পারে!”

তৃধার কথা শুনে আহাদ তার দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“কি সব বলছেন?”

-“যা শুনেছো তাই বলেছি।আমি তো আর তোমার মতো না যে দেখেও কোনো কমপ্লিমেন্ট দিবো না!”

-“আপনাকে দেখতেছে কে যে আবার কমপ্লিমেন্টের কথা বলেন।”

-“হ্যাঁ এতোক্ষণ যে আড়চোখে দেখছিলে তা আমি ভালো করেই জানি।এতো ভাব না দেখালেও হবে।”

আহাদ কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।কি আর বলবে সে তো আসলেই আড়াচোখে তৃধাকে দেখছিল।আজকে তৃধাকে এতো সুন্দর লাগছে যে তার চোখ সরাতে মন চাইছে না তার দিক থেকে।কিন্তু অজানা এক বাঁধা তাকে ঘিরে রেখেছে!

আদি গিয়ে তোহার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“হলুদ লেহেঙ্গাতে কিন্তু বেশ মানিয়েছে তোমাকে!”

-“থ্যাংকস!”

তোহার আদির সাথে কথা বলার মুড নেই।কারণ সেদিন তোহা শপিংমলে ওই কথা বলার পরে থেকে আদি একেবারে নিখোঁজই হয়ে গেছিল।আজ আবার দেখা হলো তাদের!আদি ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-“আই নো তুমি রাগ করেছো!”

তোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আমি কেনো রাগ করবো?”

-“এই যে এতোদিন তোমার সাথে একবারও যোগাযোগ করিনি।”

-“যোগাযোগ করবেন না তা তো জানা কথাই।এখনকার ছেলেরা প্রেম করতে আসে বিয়ে না।”

আদি হাসি দিয়ে বললো,

-“তোমার ধারণা ভুল!আহাদ ভাইয়া আর তোমার বোন মানে আমার ভাবির বিয়ে নিয়ে ব্যস্ততার কারণে যোগাযোগ করার সুযোগ হয়ে উঠেনি।আর শোনো আমি তোমার জন্য সারাজীবন অপেক্ষা করতে রাজি।তুমি প্রেম করতে চাও না করো না!তবে বিয়ে কিন্তু আমাকেই করতে হবে।নাহলে কিন্তু কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করবো!”

আদি কথাগুলো বলে মুচকি হেসে চলে গেল।তোহার মুখে হাসি ফুটলো।



-“এতো সুন্দর করে যে সেজে এসেছেন সব ছেলেরা তো ফিদা হয়ে যাবে।পরে আমার কি হবে!”

মুহিতের কথা শুনে সৃজা তার দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে বললো,

-“এইসব ফ্লার্টিং অন্য কারো সাথে গিয়ে করেন।আমার সাথে না!”

মুহিত মুখ গোমড়া করে বললো,

-“আপনি আমার মুডটাই নষ্ট করে দেন।”

-“তা যে মুড ভালো করতে পারে তার কাছে যান।”

-“না আপনার কাছেই থাকবো।আপনি না হয় শিখে নিন কিভাবে মুড ভালো করতে হয়।”

-“আমার শিখতে বয়েই গেছে।”

মুহিত সৃজার কানের কাছে গিয়ে বললো,

-“ডাক্তারি তো অনেক করলেন এখন না হয় একটু প্রেমবিলাস করুন!”

সৃজা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আপনার মতো ইবলিশের সাথে প্রেমবিলাস করার আমার কোনো ইচ্ছা নেই।”

-“আমি ইবলিশ?”

-“একদম!”

মুহিত আর কিছু না বলে মুখ মলিন করে দাঁড়িয়ে আছে।সৃজা হাসি দিয়ে বললো,

-“টেক ইট ইজি মুহিত জি!আমি মজা করে বলেছি।”

-“মুহিত জি!বাহ্ সুন্দর লাগলো তো ডাকটা।”

-“আপনি এতো কথা না বলে এখন এখান থেকে যান আমি এখন তৃধার কাছে যাবো।”

মুহিত হাসি দিয়ে বললো,

-“আচ্ছা যান আজকে না হয় আর ডিস্টার্ব করলাম না।কালকে আবার করবো নে!”

মুহিত কথাগুলো বলে চলে গেল।সৃজা হাসি দিয়ে তৃধার কাছে গেল।

_____________
-“তোর এখন ভিডিও কল দেওয়ার কি দরকার ছিল জয়?”

-“বাহ্ রে তুই কেমন সেজেছিস দেখবো না তা!”

-“হ্যাঁ তুই ওই বন্ধুদের নিয়ে বান্দরবানে বান্দর সেজে বসে থাক আমাকে দেখা লাগবে না।”

-“আরে রাগ করছিস কেনো!চলে আসবো তো দুদিন পরে।”

-“এখন থাকলে ভাইয়ার বিয়েতে থাকতে পারতি না?আমিও এই সুযোগে আম্মু-আব্বুর সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দিতাম।”

-“আচ্ছা আমি ফিরেই সবার আগে তোর বাবা-মার সাথে পরিচিত হবো কথা দিলাম।”

রুহি আর কিছু না বলে মুখ ভেঙচি কাটলো।জয় মুখ গোমড়া করে বললো,

-“এখন একটু হাসি দে।তোকে না হাসলে ভালো লাগে না!”

রুহি কিছুক্ষণ জয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে হেসে দিল।জয় বা পাশের বুকে হাত দিয়ে বললো,

-“হায় এখানে এসে লাগলো!”

তারপরে দুজনে একসাথে হেসে দিল।রুহি কল কাটতে তোহা এসে হাজির হলো।কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

-“আমি তোকে সারা জায়গায় খুঁজে রেড়াচ্ছি আর তুই এখানে এসে প্রেম করতেছিস।তাড়াতাড়ি চল আমরা একসাথে হলুদ ছোঁয়াবো!”

-“আচ্ছা চল।”

রুহি আর তোহা গিয়ে একসাথে হলুদ লাগালো আহাদ আর তৃধাকে।অনেক আনন্দের সাথে হলুদের দিন পাড় করলো সকলে!

বিয়ের দিন,
তোহা তৃধাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“অনেক মিস করবো আপু তোকে!”

তৃধা তোহাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

-“আমিও তোকে অনেক মিস করবো রে।”

সৃজা এসে বললো,

-“অনেক দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে চল এখন আমাদের জিজু তোর জন্য বসে আছে।”

সৃজা আর তোহা মিলে তৃধাকে নিয়ে গিয়ে আহাদের পাশে বসালো।আহাদ তৃধার দিকে তাকাতে দেখলো লাল বেনারসিতে অসাধারণ সুন্দর লাগছে তাকে!আহাদের চোখ সরাতেই মন চাইছে না।তৃধা আহাদকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বললো,

-“বাহ্!তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো?আমি তো ধন্য হয়ে গেলাম।”

তৃধার কথা শুনে আহাদ চোখ সরিয়ে ফেললো।নিজেকে সামলে বললো,

-“সুন্দর লাগছে!”

আহাদের কথা শুনে তৃধার মুখে হাসি ফুটলো।কত বছর পরে আহাদ তার প্রশংসা করলো!সে আহাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে বললো,

-“সাদা শেরওয়ানিতে কিন্তু তোমাকে বেশ মানিয়েছে!”

আহাদ কিছু না বলে মৃদু হাসলো।

কাজী সাহেব এসে বিয়ে পড়িয়ে গেলেন।আহাদ আর তৃধার বিয়ে সম্পূর্ণ হলো।তৃধার চোখ দিয়ে একভাবে পানি পড়ছে কিন্তু তার মুখে হাসি।আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“কান্না করার কি আছে?আপনার তো খুশি হওয়ার কথা।”

-“এটাকে খুশির কান্নাই বলে।”

আহাদ আর কিছু না বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সবার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আহাদ আর তৃধাকে দেখছে এশা।তার চোখ ছলছল করছে।চোখ বন্ধ করতে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।সে নিজেকে সামলে বললো,

-“আমি কখনোই তোর সুখের জীবনে বাঁধা হয়ে আসবো না আহাদ।আমার ভালোবাসা না হয় অপূর্ণই থাকলো।তোর পূর্ণতায় না হয় আমি পূর্ণ হলাম।”

এশা কথাগুলো বলে সেখান থেকে চলে গেল।রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছে এশা।সে নিজের মাঝে নেই।হঠাৎ করে পিছন থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিবে এমন সময় অয়ন এসে তার হাত টেনে ধরে রাস্তার অন্য পাশে নিয়ে গেল।তারপরে ঠাস করে এশার গালে একটা চ*ড় দিয়ে অয়ন বললো,

-“কি করছিস এইসব তুই?এতো ম*রার শখ জেগেছে কেনো?”

এশা গালে হাত দিয়ে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।তারপর নিজেকে সামলে বললো,

-“আমার জায়গায় থাকলে বুঝতে পারতি হয়তো।”

-“এশা আমি তোর চেয়েও খারাপ জায়গায় আছি।নিজের ভালোবাসার মানুষ যদি অন্য কাউকে ভালোবাসে তা সহ্য করা কম কষ্টের নয়!”

-“আমার মতো মরিচিকার পিছনে ছুটিস না অয়ন।কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবি না।”

অয়ন হাসি দিয়ে বললো,

-“কিছু মানুষ কষ্ট পেয়ে খুশি হয়।ধরে নে আমি তাদেরই একজন!”

এশা কিছুক্ষণ অয়নের দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“তুই এখানে কি করছিস?”

-“এদিক দিয়ে বাড়ি যাচ্ছিলাম তখনই তোকে দেখলাম।”

-“আচ্ছা তাহলে বাড়ি যা।আমিও বাড়ি যাই ভালো লাগছে না আমার।”

-“চল আমি এগিয়ে দিয়ে আসি।”

-“দরকার নেই আমি যেতে পারবো।”

-“বেশি কথা না বলে গাড়িতে উঠে বস।”

এশা আর কিছু না বলে গাড়িতে গিয়ে বসলো।অয়ন গাড়ি চালাতে শুরু করলো।

-“এশা এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করবি না।”

এশা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।এশাদের বাড়ির সামনে গাড়ি থামাতে এশা গাড়ি থেকে নেমে বললো,

-“ভিতরে চল।”

-“তোর বাড়িতে কেউ আছে?”

-“না।বাবা আর আদি তো আহাদের বিয়ের ওইখানে!”

-“তাহলে যাওয়া ঠিক হবে না।তুই যা আমি পরে আসবো নে।”

অয়ন গাড়ি চালিয়ে চলে গেল।এশা মৃদু হেসে বললো,

-“ছেলে তো বেশ বুঝদার!”

এশা বাড়ির ভিতরে চলে গেল।



খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে তৃধাকে নিয়ে আহাদদের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলো।আহাদ আর তৃধা পাশাপাশি বসে আছে।আদি গাড়ি ড্রাইভ করছে রুহি তার পাশের সিটে বসে আছে।আদির মনমরা দেখে রুহি বললো,

-“কি হয়েছে তোর?”

-“জানিসই তো আবার জিজ্ঞেস করছিস কেন!”

রুহি বুঝতে পারলো তোহাকে নিয়ে যেতে পারেনি দেখে আদির মন খারাপ।কিন্তু তোহা তাদের সাথে আসলে রাহেলা বেগম একা হয়ে যেতেন।রুহি আদিকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,

-“মন খারাপ করিস না একদিন পরেই দেখা হবে!”

আদি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিল।আহাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“তোরা কি ফিসফিস করছিস?”

রুহি ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-“তুই আমাদের দিকে মন না দিয়ে ভাবির দিকে দে।”

আহাদ রুহির কথা শুনে তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হাসছে।আহাদ চোখ রাঙিয়ে বললো,

-“তুই বেশি চালাক হয়ে গেছিস।”

-“তা তো আমি জন্ম থেকেই!”

#চলবে……………

[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]

বিরহডোরে বাঁধিয়াছি তারে পর্ব-০৯

0

#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৯
___________________
অয়নের কথা শুনে এশা কিছুক্ষণ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর মলিন হাসি দিয়ে বললো,

-“তাহলে তুই কেনো এখনো আমার অপেক্ষায় বসে আছিস?”

এশার কথা শুনে চমকে গেল অয়ন।সে এশার দিকে তাকাতে দেখলো এশা তার দিকে তাকিয়ে আছে।অয়ন কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।এশা মৃদু হেসে বললো,

-“অয়ন আমি বাচ্চা না।এইটুকু বোঝার ক্ষমতা আমার আছে।আর প্রতিটা মেয়ের এই ক্ষমতাটা থাকে আমার জানা মতে!কোন ছেলে তাকে কি চোখে দেখছে তা সে বুঝতে পারে।”

অয়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“সব যখন বুঝিসই তাহলে মেনে নিতে সমস্যা কি?”

-“মেনে নিবো?কিন্তু কিভাবে!যখন থেকে ভালোবাসা বলে যে একটা বিষয় আছে তা বুঝতে শিখেছি তখন থেকে শুধু একজনকেই ভালোবেসে গেছি।এতো সহজে তাকে ভুলে আরেকজনকে কিভাবে আপন করবো!”

অয়ন এশার হাত জোড়া ধরে বললো,

-“বিশ্বাস রাখতে পারিস এই হাত আমি কখনো ছাড়বো না।শুধু তুই আমাকে একটি বার ভালোবাস!আমি কখনোই আহাদের জায়গা নিতে চাইবো না তবে আহাদকে যতটা ভালোবাসিস তার থেকে না হয় কিছুটা আমায় ভালোবাসিস!তাহলে আমার হবে।”

এশা কিছুক্ষণ অয়নের দিকো তাকিয়ে রইলো।তার চোখ থেকে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।এশা অয়নের থেকে তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিজেকে সামলে বললো,

-“পারবো না রে।আহাদকে ভুলে যাওয়া এতোটাও সহজ হবে না আমার জন্য।তবে চেষ্টা করবো!”

অয়ন আর কিছু না বলে এশার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

___________
-“তুই কালকে আমায় জ্ঞান দিলি যে মেয়ে দেখতে গেলেই বিয়ে হয়ে যায় না।কিন্তু আমার তো বিয়ে পাকা করে চলে এসেছে!”

আহাদের কথা শুনে মুহিত বললো,

-“আরে পাত্রী যে তৃধা তা কে জানতো!তবে আমি অনেক খুশি।অবশেষে তোদের বিয়েটা হচ্ছে।”

আহাদ চোখ রাঙিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“হ্যাঁ তুই তো খুশি হবিই।তুই তো আমার বন্ধু নামক শত্রু!”

-“আরে ভাই এখন এইসব বাদ দে।দেখ তৃধা অনেক ভালো মেয়ে।তোকে অনেক ভালোওবাসে।তাই আর কষ্ট দিস না ও-কে।বিয়েটা করে ফেল!”

আহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“বিয়ে তো করতেই হবে।আম্মু যা সিনেমার ডায়লগ বলা শুরু করেছে!”

আহাদের কথা শুনে মুহিত হেসে দিল।আহাদ কিছু না বলে চোয়াল শক্ত করে বসে রইলো।



শপিংমলে ঘুরছে সাথে আইসক্রিম খাচ্ছে রুহি আর তোহা।রুহি হাসি দিয়ে বললো,

-“আজকে আমার সবচেয়ে খুশির দিন।ওই হাঁদারাম শেষমেষ মুখ খুলে বলতে তো পারলো!”

তোহা হাসি দিয়ে বললো,

-“আসলেই রে বেচারা কবে থেকে চেষ্টা করতে করতে আজকে সাকসেসফুল হয়েছে!”

আদি নিজের কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে শপিংমলে এসে রুহি আর তোহার সামনে এসে হাজির।আদি তোহার দিকে তাকিয়ে বললো,

-“আরে এ তো দেখছি মেঘ না চাইতেই জল!”

আদির কথা শুনে তোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“এটা বলে কি মিন করলেন?”

-“এই যে আমাদের আবার দেখা হয়ে গেল।তবে কাবাব ম্যায় হাড্ডি সঙ্গেই আছে।”

দ্বিতীয় বাক্যটি রুহির দিকে তাকিয়ে বললো আদি।রুহি শয়তানী হাসি দিয়ে বললো,

-“তোকে খাসি তো খালি খালি বলি না আমি!আমার বেস্টফ্রেন্ডের সাথে প্রেম করতে এসে আমাকে সাইড করে দিচ্ছিস।মানে তোর তো দেখছি সাহসের কমতি নেই।”

আদি রুহির কানের কাছে গিয়ে বিড়বিড় করে বললো,

-“সবার সেট হয়ে যাচ্ছে আমারটা আটকে না রেখে এগিয়ে দিলেও তো পারিস!”

-“নিয়ে যা ভাই।তোরা দুজনে ঘুরতে থাক আমি বরং বাড়ি যাই!”

রুহি যেতে চাইলে তোহা বললো,

-“না রুহি আমি তোর সাথে এসেছি তোর সাথেই যাবো।আর মি.আদি!আমার এইসব প্রেম করার কোনো শখ নেই।বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলে আসবেন সো বাই।”

তোহা কথাগুলো বলে রুহির হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে গেল।আদি মুচকি হেসে বললো,

-“আই লাইক ইওর অ্যাটিটিউড তোহাজান!”

আদির থেকে কিছুটা দূরে যেতে রুহি বললো,

-“তোহা আদি কিন্তু প্রেম করে ছেড়ে দেওয়ার মতো ছেলে না।ও তোকে ঠিকই আগলে রাখবে।”

-“আমি প্রেম করতে চাই না রে।করলে একেবারে বিয়েই করবো।তোর ভাই যদি ততদিন ওয়েট করতে পারে তাহলে বলিস!”

রুহি হাসি দিয়ে বললো,

-“আচ্ছা তুই যা বলবি তাই হবে।”

——————
-“ধূর আমাদের দুজনের বাড়ি উল্টো দিকে না হলেও পারতো তাহলে তো একসাথে যেতে পারতাম।”

সৃজার কথা শুনে তৃধা মুখ মলিন করে বললো,

-“আসলেই রে ঠিক বলেছিস!আচ্ছ শোন ভালোই রাত হয়ে গেছে।তুই যা আমিও যাই!”

-“হ্যাঁ ঠিকই বলেছিস।এখন যাওয়া উচিত।”

সৃজা চলে গেল।তৃধা কিছুটা হেঁটে একটা রিক্সা দেখতে পেল।সে যেই রিক্সার কাছে যেতে যাবে ঠিক তখনই সেখানে আহাদ এসে হাজির হলো।সে আহাদকে দেখে খানিকটা চমকে গেল।তারপর ভ্রু উঁচিয়ে বললো,

-“আহাদ তুমি এখানে?”

-“কেনো এখানে আসা নিষেধ নাকি?”

-“না তোমাকে তো আমার হসপিটালের আশেপাশে কখনো দেখা যায় না তাই বললাম আরকি!”

আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

-“এতো কথা না বলে আমার সাথে চলুন।আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

-“কি?তোমার আমার সাথে কথা আছে?আমি কি ভুল শুনলাম নাকি?”

আহাদ চোখ রাঙিয়ে তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে।তৃধা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,

-“মি.খান আপনার এইসব চোখ রাঙানোতে আমি ভয় পাই না।আপনি হয়তো তা ভালো করেই জানেন!”

অনেক বছর পরে তৃধার মুখে এই ডাকটা শুনে আহাদের বেশ ভালো লাগলো।সে শান্ত গলায় বললো,

-“এতো কথা না বলে আমার সাথে গেলেই তো হয়।মে*রে তো আর ফেলবো না আপনাকে!”

-“চাইলে মে*রে ফেলতে পারো।তোমার হাতে মরতেও আমার কোনো কষ্ট নেই।”

আহাদ আর কিছু না বলে হাঁটা শুরু করলো।হাঁটতে হাঁটতে বললো,

-“চাইলে আমার সাথে আসেন নাহলে ভাগাড়ে যান!”

আহাদের কথা শুনে তৃধা হেসে দিল।তারপরে আহাদের পিছনে হাঁটা শুরু করলো।আহাদ একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে ঘুরলো।তৃধাও তার সাথে গেল।দুজনে মুখোমুখি বসে আছে।তৃধা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“এমন বসে থাকার জন্য নিয়ে এসেছো এখানে?অনেক রাত হয়ে গেছে একা একা আমার বাড়ি যেতে সমস্যা হবে!”

-“আমি আপনার মতো অপক্ব না।আমি আপনাকে এতো রাতে একা যেতে দিবো না!আমি গিয়ে পৌঁছে দিয়ে আসবো।”

তৃধা চোখ রাঙিয়ে বললো,

-“আমি অপক্ব?”

-“অবিয়াসলি!”

-“আহাদ রাগ উঠিয়ো না আমার।”

-“ওকে এইসব বাদ দেন।আমি যা বলতে চাচ্ছি তা শুনুন।”

-“হ্যাঁ তোমার কথা শুনতেই তো বসে আছি।বলো!”

তৃধা আহাদের কথা শোনার জন্য খুব আগ্রহ নিয়ে বসলো।আহাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“আমাদের বিয়েটা ভেঙে ফেলুন।”

আহাদের কথা শুনতেই তৃধার মেজাজ গরম হয়ে গেছে।তাও সে নিজেকে শান্ত রেখে বললো,

-“এটা বলতে এসেছিলে?”

-“হ্যাঁ!”

তৃধা হাসি দিয়ে বললো,

-“সরি।আমি বিয়েটা ভাঙতে পারবো না।আমার তোমার জন্য এতো দরদ নেই যে তুমি বললেই বিয়েটা ভেঙে দিবো।”

আহাদ চোখ রাঙিয়ে তৃধার দিকে তাকিয়ে আছে।সে জানতো তৃধাকে কিছু বলেও লাভ হবে না।আহাদ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

-“চলুন আপনাকে বাড়িতে পৌঁছে দেই।”

-“তুমি এতো কিপ্টে আগে তো জানতাম না।”

-“মানে?”

-“এতো রাতে কাউকে এমন রেস্টুরেন্টে এনে কিছু খাইয়ে চলে যেতে চাচ্ছো।”

আহাদ আবার বসে পড়লো।মেনু কার্ড তৃধার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“যা খাবেন অর্ডার করুন!”

-“চলো দুজনে বিরিয়ানি খাই।অনেক বছর একসাথে আমাদের পছন্দের খাবার খাওয়া হয় না!”

আহাদ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।তৃধা হাসি দিয়ে বিরিয়ানি অর্ডার করলো।দুজনের খাওয়া শেষ হলে আহাদ বিল দিতে গেলে তৃধা বললো,

-“আজ না হয় আমি দেই।”

-“না আমি দিবো কারণ আপনি আমাকে কিপ্টে বলেছেন!”

তৃধা হাসি দিয়ে বললো,

-“আরে ওটা তো আমি মজা করে বলেছি।”

-“যাই বলুন বিল আমিই দিবো।”

-“ওকে দেও আমার টাকা বেঁচে গেল।”

কথাটা বলে তৃধা রেস্টুরেন্টের বাইরে চলে গেল।আহাদ বিল দিয়ে গাড়িতে উঠে বললো,

-“উঠুন।”

তৃধা গাড়িতে উঠতে আহাদ গাড়ি চালানো শুরু করলো।দুজনের মাঝে নিরবতা!হঠাৎ তৃধা হাসতে হাসতে বললো,

-“আহারে আমার হবু বর বেচারা!বিয়ে ভাঙতে আমাকে বলতে আসছে!”

আহাদ চোয়াল শক্ত করে বললো,

-“কারণ আম্মু আমাকে বলেছে আমি কিছু করলে আম্মুর মরা মুখ দেখবো!”

তৃধা হাসি দিয়ে বললো,

-“যাক ভালোই হয়েছে আমার কষ্টটা এখন টের পাবে।সবটা জানানের পরেও তো দূরে সরিয়ে দিয়েছিলে।এখন বুঝো কেমন লাগে!”

আহাদ আর কিছু না বলে ড্রাইভ করায় মন দিল।সে তৃধাদের বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়ি থামালো।আহাদ গাড়ি থামাতে তৃধা আহাদের একটা হাত ধরে বললো,

-“আই রেলি লাভ ইউ আহাদ।তুমি আমার জীবনের প্রথম ভালোবাসা।আমি চাই তুমি যেন আমার জীবনের শেষ ভালোবাসা হও।তাই প্লিজ আমাকে আর কষ্ট দিও না!”

আহাদ আলতো করে তৃধার থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-“অনেক রাত হয়েছে বাড়ি যান।’

তৃধা আর কিছু না বলে গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে চলে গেল।তারপরে আহাদ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেল।তৃধা গাড়ি স্টার্ট করার আওয়াজ শুনে হাসি দিয়ে বললো,

-“বাহ্ বাড়ির ভিতরে আসার পরে গেল!”

#চলবে…………

বিরহডোরে বাঁধিয়াছি তারে পর্ব-০৮

0

#বিরহডোরে_বাঁধিয়াছি_তারে
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৮
___________________
আহাদের কথা শুনে বেশ বিরক্ত হলেন রফিকুল সাহেব।তিনি কিছু বলতে গেলে আয়েশা বেগম বাঁধা দিয়ে বললেন,

-“আহাদ সিনক্রিয়েট করো না রাস্তায় দাঁড়িয়ে!”

-“আম্মু আমি এই বাড়ির ভিতরে যাবো না।তোমার উচিত হয়নি কিছু না জেনে আমাকে এখানে নিয়ে আসা!”

-“আমি সবটা জেনেই তোমাকে এখানে নিয়ে এসেছি।তাই কথা না বাড়িয়ে বাড়ির ভিতরে চলো।”

-“আম্মু আমি যাবো না বলছি!”

-“এই রাস্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে মায়ের হাতে থাপ্প*ড় খেতে ভালো লাগবে?”

আহাদ কিছু না বলে চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে।আয়েশা বেগম আাহদের হাত ধরে বললেন,

-“এভাবে দাঁড়িয়ে না থেকে ভিতরে চলো।”

আহাদ আর কিছু না বলে সবার আগে হাঁটা শুরু করলো।রুহি গিয়ে কলিংবেল বাজাতে তোহা এসে দরজা খুলে দিল।তোহাকে দেখে আদির মুখে হাসি ফুটলো।সবাই তৃধাদের বাড়ির ভিতরে গিয়ে বসলো।আহাদের মেজাজ বিগড়ে আছে!সে কোনো কথা বলছে না।”

-“তা যাকে দেখতে আসা সে কোথায়?”

আয়েশা বেগমের কথায় হাসি দিয়ে রাহেলা বেগম বললেন,

-“আসতেছে!”

তৃধা চায়ের ট্রে আর তোহা নাস্তার ট্রে এনে সবার সামনে রাখলো।তৃধা সবাইকে সালাম করলো।আহাদ একবার তৃধার দিকে তাকিয়ে দেখলো তৃধাকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে!নীল শাড়িতে বেশ মানিয়েছে!পরক্ষণেই আহাদ চোখ সরিয়ে ফেলল।

আয়েশা বেগম হাসি দিয়ে বললেন,

-“মাশাআল্লাহ!কি মিষ্টি লাগছে তৃধা মাকে।আমার ছেলের পছন্দ আছে বলতে হবে।”

আহাদ চুপ করে বসে আছে।সবাই মিলে বিয়ের দিন ঠিক করলো।এক সপ্তাহ পরে বিয়ে!

আহাদ কিছু বলতে যাবে এমন সময় আয়েশা বেগম বললেন,

-“আহাদ এই মুহুর্তে তুমি উল্টাপাল্টা কোনো কথা বলবে না।”

আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে বসে আছে।তৃধা বুঝতে পারলো আহাদ বিয়েতে রাজি না।তাও সে কিছু বললো না।কারণ সে চায় বিয়েটা হোক আর তাদের মাঝের সব দূরত্ব কেটে যাক।আদি গিয়ে তোহার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“তোমাকে কিন্তু খুব সুন্দর লাগছে।”

তোহা ভ্রু কুঁচকে বললো,

-“আমি তো প্রতিদিন যেমন ভাবে থাকি তেমনই আছি।সুন্দর লাগার কি আছে?”

-“তোমাকে তো আমার প্রতিদিনই সুন্দর লাগে!”

কথাটা বলে আদি আহাদের পাশে গিয়ে বসলো।তোহা মুচকি হাসলো।সে হালকা আঁচ করতে পেরেছে আদি যে তাকে পছন্দ করে!রুহি গিয়ে তোহার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

-“কিরে কি এমন বললো যে ব্লাশ করতেছিস?”

তোহা চোখ রাঙিয়ে বললো,

-“কোথায় ব্লাশ করলাম আবার!”

-“বুঝি বুঝি সব বুঝি আমি!”

-“হয়েছে অনেক বুঝেছিস।আমরা তো এখন বেয়াইন হয়ে গেলাম রে!”

-“একদম!”

দুজনে একসাথে হেসে দিল।

সব ঠিক করে আহাদরা তৃধাদের বাড়ি থেকে চলে আসলো।আহাদ কারো সাথেই কোনো কথা বলে নাই।তার রাগ চরম পর্যায় চলে গেছে।আহাদ বাড়িতে এসে সবার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

-“আমি আবার বিদেশে চলে যাবো।এই দেশ আমার জন্য না।”

আয়েশা বেগম চোখ রাঙিয়ে বললেন,

-“সব তোমার ইচ্ছা মতো হবে না আহাদ।এই বিয়ে তোমার করতেই হবে।অনেক কথা শুনেছি তোমার আর না।আর তুমি যদি আবার বিদেশে যাওয়ার কথা ভাবো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবে!”

আয়েশা বেগম কথাগুলো বলে রুমের দিকে চলে গেলেন।আহাদ থ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আয়েশা বেগমের বলা শেষ বাক্যটা তার মাথায় গেঁথে গেছে।সে আর কিছু না বলে তার রুমের দিকে চলে গেল।রুহি হাসি দিয়ে বললো,

-“আম্মু একদম ফর্মে চলে এসেছে!”

———————
সকালবেলা হসপিটালে যেতে দেরি হয়ে যাওয়ায় সৃজা দ্রুত রাস্তা পাড় হতে গিয়ে একটা গাড়ির সামনে পড়তে যাবে তার আগে কেউ তাকে টেনে ধরে অন্য পাশে নিয়ে গেল।সৃজা কিছুটা ভয় পেয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।সে চোখ খুলে দেখলো মুহিত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।সৃজা চোখ খুলতে মুহিত বললো,

-“মাথায় সমস্যা আছে নাকি আপনার?এভাবে কে রাস্তা পাড় হয়?এক্ষুনি তো একটা বিপদ ঘটে যেত।”

সৃজা কিছুক্ষণ মুহিতের দিকে তাকিয়ে থেকে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললো,

-“থ্যাংকস আমাকে এমন একটা দূর্ঘটনা থেকে বাঁচানো জন্য।তবে আমাকে যে কালির তারা বলে তার সাথে আমার কথা বলার কোনো ইচ্ছা নেই।”

সৃজার কথায় মুহিত মুচকি হেসে বললো,

-“ভুল বললেন এখন তো আপনাকে কেউ কালির তারা বলছে না।আগে ছিলেন!পাস্ট ইজ পাস্ট!এখন তো আপনাকে দেখলে বলতে ইচ্ছা করে ‘হে সুন্দরী আপনি আমার হবেন কি!’

মুহিতের কথা শুনে সৃজা চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালো।মুহিতের পা থেকে মাথা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে বললো,

-“পাগল হয়ে গেছেন নাকি?”

-“হ্যাঁ আপনাকে সেদিন দেখার পরে থেকে।”

-“এই যে ভাই এইসব ফ্লার্ট করা বাদ দেন।আমার হসপিটালে যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

-“এই ভাই আবার কি?হতে চাই জামাই বানায় দিচ্ছে ভাই!আর ফ্লার্ট কে করতেছে?যা বললাম সত্যি বললাম!”

-“হ্যাঁ বুঝেছি আপনি অনেক সত্যবাদী তবে আমার এখন এইসব শোনার টাইম নেই।আমার লেট হয়ে যাচ্ছে।”

সৃজা কথাগুলো বলে চলে যেতে গেলে মুহিত বললো,

-“চলুন আমি আপনাকে ড্রপ করে দিচ্ছি!”

-“কোনো দরকার নেই আমি একা যেতে পারবো।”

-“আরে এতো কথা না বলে চলুন তো নাহলে আরো লেট হয়ে যাবে।”

সৃজা তার হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো বেশ দেরি হয়ে গেছে তাই সে মুহিতের সাথে যেতে রাজি হলো।মুহিত গাড়ি নিয়ে হসপিটালের সামনে দাঁড়ালো।সৃজা গাড়ি থেকে নেমে বললো,

-“থ্যাঙ্কিউ!”

কথাটা বলেই সে এক প্রকার দৌড়ে ভিতরে চলে গেল।মুহিতকে কিছু বলার সুযোগই দিল না।মুহিত মুখ গোমড়া করে বললো,

-“ধ্যাত!এ কেমন মেয়ে!কিছু বলতে পারলাম না তার আগেই চলে গেল।”

——————–
জয় রুহির সামনে একটা গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,

-“রুহি আমি তোকে অনেক ভালোবাসি।প্লিজ আমার এই ভালোবাসা তুই গ্রহণ কর!”

রুহি অবাক হয়ে জয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।তারপরে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

-“আজকে কি সূর্য উল্টো দিকে উঠলো নাকি!”

জয় মৃদু হেসে বললো,

-“না ঠিক দিকেই উঠেছে।আজকে অনেক সাহস সঞ্চয় করে তোকে কথাটা বলেই ফেললাম।কারণ আমি এর আগে বুঝতাম না তুই আসলে আমাকে পছন্দ করিস নাকি!তবে এই কিছুদিনে বুঝে গেছি যে তুইও আমাকে পছন্দ করিস তাই ভাবলাম বলেই ফেলি না হয়!”

রুহি জয়ের হাত থেকে গোলাপটা নিয়ে বললো,

-“আপনার ভালোবাসা গ্রহণ করিলাম জনাব।”

তোহা হাত তালি দিয়ে বললো,

-“যাক এতোদিনে আমাদের জয়সাব বিড়াল থেকে সিংহ তে পরিণত হয়েছে তাহলে।”

তোহায় কথায় সবাই হেসে দিল।জয় হাসি দিয়ে লজ্জায় মাথা চুলকাচ্ছে।

________________
-“কিরে সৃজা তোর আজকে এতো দেরি হলো কেনো?”

সৃজা সব ঘটনা তৃধাকে বললো।তৃধা সবটা শুনে বললো,

-“কি মুহিত তোকে এইসব বলেছে?”

-“হ্যাঁ রে!আরে বুঝিস না ফ্লার্ট করতেছিল।এইসব আমি ভালো করেই বুঝি।”

-“মুহিত ফ্লার্ট করার মতো ছেলেই না।দেখ যদি তোকে পছন্দ করে তাহলে সব পাঁকা করে ফেল।ছেলে কিন্তু মন্দ না!তোর সাথে ঝগড়া করার এনার্জিও আছে।”

-“আপাতত এইসব বাদ দে।তোর কথা বল।বিয়ে তো ঠিক হয়ে গেল। তা আহাদ জিজুর সাথে কথা হয়েছে?”

-“ও আমার সাথে কথা বলা তো দূরে থাক কালকে আমাদের বাড়িতে এসে একটা কথাও বলেনি।শুধু আম্মুকে এসে সালাম করেছিল মনে হয়।আমি তো জানি ও বিয়েতে রাজি না আন্টি জোর করায় রাজি হয়েছে।তবে যাইহোক বিয়েটা ভালোয় ভালোয় হয়ে যাক তারপর ওর বারোটা আমি বাজাবো।এতো কিসের ইগো!”

তৃধার কথা শুনে সৃজা হেসে দিল।তৃধাও তার সাথে হাসলো।



আহাদ অফিসে তার ক্যাবিনে আনমনে বসে আছে।সবকিছু কেমন যেন বিরক্ত লাগছে তার কাছে!সে তৃধাকে বিয়েটা করতে চাচ্ছে না কিন্তু বিয়েটা ভাঙাও তার পক্ষে সম্ভব না।কারণ আয়েশা বেগম যা বলেছেন!সে কোনোভাবেই তার মাকে হারাতে চায় না।

-“আম্মু যে কেনো বললো ওই কথা!তাহলে তো কিছু করতে পারতাম।এখন তো কিছু করা সম্ভবও না।আমি কি সবটা ভুলে তৃধাকে মেনে নিতে পারবো?তা তো মনে হয় না আমার।যা থেকে আমার মন একবার উঠে যায় তাতে আর কখনো মন আসে না।তৃধাকে আমি যতটা ভালোবাসি ঠিক ততটাই ঘৃণা করি!কি যে করবো কিছুই মাথায় আসছে না।”

আহাদ কথাগুলো বলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করলো।

____________________
এশা মুখ মলিন করে লাইব্রেরিতে বসে আছে।ভার্সিটি কখন ছুটি হয়ে গেছে কিন্তু তার বাড়িতে যেতে মন চাইছে না।অয়ন এশাকে খুঁজতে খুঁজতে লাইব্রেরিতে এসে দেখলো এশা বসে আছে।অয়ন বুঝতে পেরেছে এশা কিছু নিয়ে আপসেট!এশা ভার্সিটিতে আসার পরে থেকেই সে খেয়াল করেছে এশার মন ভালো নেই।অয়ন গিয়ে এশার পাশে বসলো।অয়নকে দেখে এশা বললো,

-“তুই এখানে কি করছিস?ভার্সিটি তো ছুটি হয়ে গেছে!”

-“সেম প্রশ্ন আমি তোকে করি?”

-“আমি তো এমনি বসে আছি।একটু পরে চলে যাবো।”

-“এইসব না বলে সত্যিটা বল এশা।”

এশা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

-“আহাদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।সামনের সপ্তাহে বিয়ে!”

অয়ন কিছুক্ষণ এশার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,

-“আহাদকে নিয়ে এখন ভাবা বাদ দিয়ে নিজের জীবনকে নতুন করে গুছিয়ে নে।এক তরফা ভালোবাসা শুধু কষ্টই দেয় আর কিছু দিতে পারে না!”

#চলবে……………