বিয়েবাড়িতে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। বউ নাকি পালিয়েছে। অনেকে তো এই ও বলছে যে একবার বড় বোনের কথা ভাবলো না। ওই বাসার বউ সে। এমন করে ভেগে গিয়ে নিজের পরিবারকে তো ছোট করলোই। নিজের বড় বোনের জন্য শশুর বাড়ির লোকের ক্ষোভ রেখে গেল।বিয়ের দিন নাকি সে তার আশিকের সঙ্গে পালালো।
কথাগুলো সবই কানে যাচ্ছিলো শাহরিয়ারের। বর সেজে একদম ফিটফাট হয়ে এসেছিলো সে তার প্রিয়তমাকে নিজের করে নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু না আজ তার দেখা হলো প্রিয়তমাকে লালটুকটুকে বউ সাজে দেখতে। হুট করেই শাহরিয়ার উঠে দাড়ালো। গটগট পায়ে হেঁটে চলে গেল প্রিয়তমার ঠোঁট রুমটাতে।
দক্ষিণ পাশের ছোট রুমটা আজ বেশ অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। বিছানায় ছড়িয়ে আছে লাল টুকটুকে শাড়িটা যেটা পড়ে নিজের প্রিয়তমাকে দেখার বেশ ইচ্ছা ছিলো শাহরিয়ার। গহনা সাজানোর জিনিস সবই ছড়িয়ে আছে ছোট বিছানাটায়।
শাহরিয়ার প্রাণ ভরে একটা নিশ্বাস টানলো। প্রিয়তমার গায়ের গন্ধ মো মো করছে পুরো ঘর জুড়ে। ধীর পায়ে সে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে। আলতো হাতে হাত বুলিয়ে দিলো সবগুলো জিনিসে। খুব পছন্দ করে পছন্দের মানুষের জন্য নিজে কিনেছে সে। বুকে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হচ্ছে তার। চোখ দুটো জ্বলছে। শাহরিয়ার সবকিছু নিয়ে নিজের বুকে চেপে ধরলো। চোখ বুজে কিছুসময় বসে রইলো সে।
বেডসাইট টেবিলে রাখা হিয়ার চিঠিটা তুলে নিলো শাহরিয়ার। চিঠিতে লেখা আছে
**আমি বাধ্য হয়েই তোমাদের না জানিয়ে পালাতে হচ্ছে। বাবা তোমাকে সাহস করে বলতে পারিনি। আমি একটা ছেলেকে ভালোবাসি। তার সঙ্গেই আমি সারাজীবন থাকতে চাই। সবার কাছে আমি ক্ষমা চাইছি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও। আমার পক্ষে একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করা সম্ভব না। তোমরা আমার খোঁজ করোনা।
ইতি
তোমার অপ্রিয় মেয়ে
হিয়া**
চিঠিটাও বুকে জড়িয়ে নিলো শাহরিয়ার। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো শাহরিয়ারের।
সে অগোছালো পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসলো। বেশ ভাঙা সুরেই সে দম নিয়ে ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলল
-“রহিম চাচা বাসায় চলো।”
রহিমের আত্মা ছ্যাত করে উঠলো। ছোটবেলা থেকে শাহরিয়ারকে দেখছে সে। এমনটা অগোছালো কখনো দেখেনি। হাসিখুশি গোছালো ছেলেটি আজ এলোমেলো হয়ে গেছে শুধু ভালোবাসার জন্য। রহিম আবারও একপলক তাকালো শাহরিয়ারের দিকে। শাহরিয়ার বুকে শাড়ি আকড়ে চোখ বুজে সিটে হেলান দিয়ে আছে।
রহিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে গাড়ি চালাতে শুরু করলো।
———————-
অন্যদিকে শাহরিয়ারের ভাই, ভাবি,মা,বাবা সবাই হাসপাতালে বসে আছে। হিয়ার বাবা স্ট্রোক করেছেন। আদরের ছোট মেয়েটার নামে এতো খারাপ কথা সে শুনতে পারেনি। তার উপর তার প্রাণপ্রিয় বড় মেয়ে হিমিশার সংসারের কি হবে। এতো টেনশন সে নিতে পারেনি।
শাহরিয়ারের বড় ভাই রণবীর অসহায় হয়ে পড়েছে। একদিকে আদরের ছোটভাই, প্রিয়তমার বাবার এতো বড় বিপদ, আবার হিয়া ছিলো তার ছোটবোনের মতো। সে এমনটা করতে পারে কল্পনাও করতে পারেনি। কিভাবে সবদিকে সামলাবে সে। অন্যদিকে তার মাও বেশ চটে আছে। সব রাগ হিমিশার উপর তুলতে চাইছেন। এই নিয়ে এতক্ষণে কম কথা শোনায়নি সে।
অসহায় দৃষ্টি বেশকিছু সময় চারপাশে তাকালো রণবীর। শাহরিয়ারের বন্ধু নিরবকে হিমিশাদের কাছে রেখে ওর বাবা মা আর শাহরিয়ারের আরেক বন্ধু শাদিকে নিয়ে সে বাড়ির দিকে রওনা হলো। ড্রাইভার ফোন দিয়ে জানিয়েছে যে শাহরিয়ার বাসায় ফিরেছে।
———————–
শাহরিয়ার বাসায় ফিরে টলমল পায়ে নিজের রুমে গেল। যত্ন সহকারে হিয়ার জিনিসগুলো বিছানার উপর রাখলো। সারা বিছানায় ছড়িয়ে নিজে তার পাশে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো। বিরবিরিয়ে বলতে লাগল
-“কোথায় হারিয়ে গেলে তুমি! আমি যে তোমাকে ছাড়া আর পারছিনা। দেখ না সবাই তোমাকে নিয়ে কি কি বলছে?”
পরপর কয়েকটা তপ্ত নিশ্বাস ত্যাগ করলো সে। চোখটা আজ খুব বেইমানি করছে শাহরিয়ারের সঙ্গে। অবাদ্ধ পানি গুলো গড়িয়ে পড়ছে চোখ বেয়ে। ভাঙা কন্ঠে আবারও সে বিরবির করে বলল
“নিজের ভালোবাসার উপর আমার বিশ্বাস আছে। আমার প্রিয়তমা কখনোই আমাকে ধোকা দিতে পারেনা। সবাইকে আমি প্রমাণ করে দিবো যে সবাই তোমরা ভুল।”
———————————-
রণবীর বাসায় ফিরে দেখলো বাসার সব সার্ভেন্ট একসঙ্গে দাড়িয়ে কানাঘুষা করছে। রণবীর ধমকে তাদের সরিয়ে দিলো। রণবীরের মা আয়েশা বেগম গম্ভীর মুখে নিজের ছেলের রুমে গেলেন। ওনার পিছনে ওনার হাসবেন্ড রেজাউল হকও গেলেন। রণবীর ও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো।
শাহরিয়ারের রুমে গিয়ে আয়েশা বেগম নিজের ছেলেকে অজ্ঞান হয়ে থাকতে দেখে অস্থির হয়ে পড়লেন। রণবীর কোনোমতে ওনাকে শান্ত ডাক্তারকে কল করলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ডাক্তার চলে এলেন। সবাই চিন্তিত চিত্তে তাকিয়ে রইলো। ডাক্তার শাহরিয়ারকে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“ওনার পেসার টা ফল করেছে। হয় তো উনি অনেকটা চাপ নিয়েছেন। যার কারণে জ্ঞান হারিয়েছেন। ওনার ঘুমের প্রয়োজন। আমার ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছি। আপনারা ওনার খেয়াল রাখবেন। তেমন সিরিয়াস কিছু না। টেনশন করার কিছু নেই।”
রণবীর একটা সস্থির নিশ্বাস ছেড়ে শাদিকে ইশারায় ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে বলল। শাদিও ডাক্তারকে এগিয়ে দিতে গেল।
রণবীর আয়েশা বেগমের কাধে হাত রেখে বলল
-“আম্মু তুমি এখন রুমে যাও। সারাদিন অনেক ধকল গেছে।”
আয়েশা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে বড় ছেলের দিকে তাকালো। রণবীরের বেশ খারাপ লাগল সেই দৃষ্টি। তবুও যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো।
বাহিরে ঝড়ো হাওয়া উথাল-পাতাল বইছে। গত দু’দিন যাবত এত বৃষ্টি কেন হচ্ছে তার হদিস পাচ্ছে না কেউ।
বেলির শরীরটা দুর্বল। কাল মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়ার পর তাকে ডাক্তারের কাছে নেওয়া হয়। কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তারপর মুনিব বাড়ি নিয়ে আসে তাকে। কিন্তু শরীরের দুর্বলতা কাটছে না কিছুতেই বেলির। মাথা ঘুরছে অনবরত। প্রেশারও বাড়া। ডাক্তার বলেছেন অতিরিক্ত প্রেশার বেড়ে যাওয়ার কারণে এমন মাথা ঘুরছে।
বেলি আজ স্নান করে বাথরুমেই কাপড় রেখে এসেছে। ধোয়ার মতন শক্তি তার ভেতরে অবশিষ্ট ছিল না। মুনিব সে-ই কাপড় গুলো অব্দি ধুয়ে দিয়েছে। বেলি বারণ করা স্বত্বেও শুনেনি সে।
এখন বিছানায় শুয়ে আছে বেলি। মুনিব বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। কারো সাথে ফোনে কথা বলছে হয়তো। বেলি তাকে একবার সাবধান করতে ডাকল,
‘বৃষ্টির ছিঁটা আসতাছে না শইলে? ঘরে আইসা কথা বলেন। ভিইজ্জা যাইবেন তো!’
বেলিও হাসির বিপরীতে হাসি বিনিময় করল। বৃষ্টির থামা-থামির নাম নেই। মুনিব কথা বলে ঘরে এলো। বেলির পাশ ঘেঁষেই বসল। স্নেহ ভরা হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বেলি উষ্ণ আদরে চোখ বন্ধ করে রাখল। অনেকটা নীরবতায় সময় কাটার পর মুনিব হুট করে বলল,
‘উড়নচন্ডী, একটা কথা বলবে?’
বেলি চোখ মেলল। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘কী?’
‘তুমি কি বিয়ের আগে কাউকে পছন্দ করতে?’
মুনিবের প্রশ্নে থতমত খেলো বেলি। গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে বলল,
‘ক্যান? এমন কথা জিজ্ঞাসা করেন ক্যান?’
‘না, হতেই তো পারে বিয়ের আগে তুমি কাউকে পছন্দ করতে।’
‘এমন কথা কেন কইতাছেন সেডা তো বলবেন!’
‘এই যে তুমি আমার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকো সেজন্য বললাম।’
এবার বেলির উদ্দীপনা নিভে গেল। মুনিবের থেকে চোখ সরিয়ে নিলো সে। ঠোঁট কাঁপলো কথা বলতে গিয়ে। অস্ফুটস্বরে বলল,
‘সেটা তো..’
কথা শেষ হতে দিল না প্রকৃতি। তার আগেই নিচ থেকে জামাল ভূঁইয়ার ডাক ভেসে এলো। ভয়ঙ্কর রকমের চেঁচিয়ে ডাকছেন ভদ্রলোক। বাড়িতে ডাকাত পড়লেও মানুষ এত জোরে জোরে চিৎকার করে না যতটা জামাল ভূঁইয়া করছেন।
চমকে উঠল মুনিব, বেলি দু’জনেই। বেলি উঠতে নিলে মুনিব তাকে উঠতে নিষেধ করে। নিজেই ছুটন্ত পায়ে ঘরের বাহিরে চলে যায়।
ড্রয়িং রুম জুড়ে তুমুল নিস্তব্ধতা। জামাল ভূঁইয়ার হুংকারের পর সবটাই শুনশান, নীরব। মুনিবের কপালে তিন ভাঁজ। অবাক স্বরে বলল,
‘চিৎকার করে ডাকলেন কেন? কী হয়েছে!’
জামাল ভূঁইয়া যেন রাগে অন্ধ। কাঁপছেন অনবরত। চোখের সাদা অংশ লাল হয়ে গিয়েছে রীতিমতো। নিজের বাবার এমন ভয়ঙ্কর পরিবর্তন দেখে খটকা লাগলো মুনিবের। সে দ্রুত পায়ে বাবার কাছে এগিয়ে গিয়ে বাবার বাহু ধরে দাঁড়ালো। উত্তেজিত বাবাকে শান্ত করতে করতে বলল,
‘কী হয়েছে আব্বু? এমন ভাবে রাগে কাঁপছেন কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?’
জামাল ভূঁইয়ার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না অতিরিক্ত উত্তেজনায়। কেমন ভয়ঙ্কর কম্পন তার শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়েছে। মুনিব বিচলিত হলো,
‘বলবেন তো, আব্বু, হয়েছেটা কী?’
মুক্তা ভূঁইয়াও বিচলিত হলেন। স্বামীকে সামলানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। মুক্তা ভূঁইয়া ভেবে পেলেন না মানুষটা কোন কারণে এতটা রেগেছে।
‘কী হইছে কইবা তো! এত রাগছো কার উপর!’
‘মুনিব, তোমার বউ কই ডাকো হেরে। বিশ্বাসঘাতকের এই দুনিয়ায় কোনো জায়গা নাই। ডাকো বলতাছি।’
ভ্রু কুঞ্চিত করল মুনিব। বাবার বাহু থেকে হাত সরিয়ে বলল, ‘কী বলছেন! বেলিকে সম্মান দিয়ে কথা বলবেন।’
‘সম্মান! কারে সম্মান দিতে কও? যারে ঘরে তুলছো বুইঝা তুলছিলা তো? সে তোমার পিঠ পিছে কী কী করছে?’
ঘটনার স্রোত এভাবে অন্য ধারায় বইবে কে জানতো? বেলি নিজেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো। দূরে দাঁড়িয়ে আছে চামেলি। বেলি শ্বশুরকে কাঁপতে দেখে ছুটে এলো। কিন্তু বেশি কাছে আসতে পারলো না। তার আগেই জামাল ভূঁইয়ার চিৎকার থামিয়ে দিল তাকে।
‘খবরদার তুমি এইখানে আসবা না। আমারে ধরবা না। একটা নষ্ট মেয়েমানুষ।’
জামাল ভুঁইয়ার কথা গুলো বড়ো অনাকাঙ্খিত ছিল। মুনিব বাবাকে ছেড়ে দিল। রেগে গিয়ে বলল,
‘আব্বু, মুখ সামলে কথা বলেন। বেলি আমার বিয়ে করা স্ত্রী।’
‘স্ত্রী না ইস্ত্রি জিগাও। যারে এত সোহাগ দিলা, বাপের কথা অমান্য কইরা বিয়া করলা সে কি করছে জানো?’
বাবার এই রাগ অযৌক্তিক কিংবা মিথ্যে লাগছিল না। কিন্তু বেলির সাথে বাবার বলা সম্বোধন গুলোও মানাচ্ছিল না। মুনিব পড়ে গেলে সংশয়ে। সংকোচ মাখা কন্ঠে বলল, ‘কী করছে ও?’
জামাল ভূঁইয়া সেন্টার টেবিলের উপর থেকে একটি রিপোর্ট নিয়ে এগিয়ে ধরল মুনিবের দিকে। তাচ্ছিল্য করে বলল,
‘তোমার বউ পোয়াতি কিন্তু সে বাচ্চার বাপ তুমি নও।’
আকাশে মেঘ করে ঘন গর্জন দিয়ে উঠলেও এত জোরে বুকের ভিতরে গিয়ে কম্পন সৃষ্টি করে না যতটা না এখন সৃষ্টি করল। মুক্তা ভূঁইয়া মুখ চেপে ধরলেন বিস্ময়ে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা চামেলিরও চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। চমকে উঠলো বেলি,
‘কী, কী কন এডি!’
‘আমি কী কই তুমি জানো না? এত বড় বেঈমান আমার বাড়িতে আছে এটা ভাবলেওতো আমার মাথায় রক্ত উঠে যাইতাছে।’
মুনিব হেসে দিল। বোকা বোকা কণ্ঠে বলল,
‘আব্বু, আপনিও না, এমন মজা কেউ করে?’
মুনিবের চোখে মুখে অবিশ্বাস। সে যেন বাবার কথাটা মানতেই পারছে না। জামাল ভুঁইয়ার চোখ টলমল করে উঠল। ছেলেকে চরম সত্যিটা জানাতেও তার কষ্ট হচ্ছে ভীষণ। তবুও বলল,
‘তোমার বউ পোয়াতি। তিন মাস তার বাচ্চার বয়স। অথচ তোমাগো বিয়া হইছে আইজ তেইশ দিন। এই হিসাব বুঝাও আমারে।’
মুনিব বাবার মুখের কথা বিশ্বাস করল না যেন। রিপোর্টের কাগজটা ছিনিয়ে নিয়ে নিজেই দেখতে লাগল। উদ্ভ্রান্তের মতন কতক্ষণ চোখ ঘুরালো সেই কাগজটায়। বেলিও এগিয়ে গিয়ে মুনিবের পাশে দাঁড়াল। কণ্ঠে ভয় তার। আতঙ্ক নিয়ে বার বার বলল,
‘কী দেহেন? সত্যি করে কন তো আব্বা যা কইছে তা সত্যি! আপনি বিশ্বাস করেন?’
মুনিব মৃত চোখ নিয়ে রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুই উত্তরে বলল না।
মুক্তা ভুঁইয়া ছুটে এলেন ছেলের কাছে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
‘আব্বা তোর বাপ যা কইতাছে তা কি ঠিক? আমার একটুও বিশ্বাস হয়না। একটু কস না। তোর বাপ ভুল দেখছে তাই না।’
পুরো ঘটনাটায় যে সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন সে হলো মুনিবের ফুপি তানু ভূঁইয়া। তিনি তো সোফায় পা দুলাতে দুলাতে মুখ ভেংচিয়ে বললেন,
‘প্রথম থেইক্যাই এই মাইয়ারে আমার সন্দেহ হইতো। কী চোপা মাইয়ার! আইজ হইলো তো শান্তি?’
বেলির মা পা ধরলেন জামাল ভূঁইয়ার। বেলির বাবাও তা-ই করলেন। কিন্তু বেলি নিরুত্তর।
জামাল ভূঁইয়া এমন নিরুত্তর বেলিকে দেখে আর খ্যাপে গেলেন, ‘কার লাইগ্যা আপনারা পা ধরেন? ঐ দেখেন আপনাগো মাইয়া কী সুন্দর ঐ হানে দাঁড়ায় আছে। দেখছেন? সত্য চাপা দিতে পারবো না তাই চুপ কইরা আছে। এই বেইমানির শাস্তি পাইতেই হইবো। আপনাগো মুখে চুন কালি লাগাইয়া এ বাড়ি থেইকা বের করুম নইলে আমার নাম জামাল ভূঁইয়া না।’
জামাল ভূঁইয়ার এমন রাগে আঁতকে উঠল সবাই। তানু ভূঁইয়ার স্বামী নিষেধ করতে এলে রামধমক দিয়ে থামিয়ে দেন তিনি। বেলির মায়ের হাউমাউ করা কান্না আরও বাড়তে থাকে। ছুটে গিয়ে মেয়ের গালে অনবরত চ ড় দিতে দিতে বলে,
‘মুখ পুড়ি তুই ক সব মিথ্যা। সবাইরে ক এই একটা কথাও সত্যি না।’
মায়ের চিৎকার মা করতেই থাকে। বেলি এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে মুনিবের দিকে। তারপর সর্বহারা অভাগিনীর মতন প্রাণহীন পায়ে মুনিবের কাছে এগিয়ে যায়। আসন পেতে বসে মুনিবের পায়ের কাছটায়। এক বুক আশা নিয়ে মুনিবকে শুধায়,
‘আপনে তো আমারে বিশ্বাস করেন তাই না? আপনে তো জানেন আমি কেমন? বিশ্বাস করেন তো না-কি?’
বিধ্বস্ত মুনিব চোখ তুলে অব্দি তাকায় না। কাঁদতে কাঁদতে চোখের কোণা লাল হয়ে গিয়েছে ছেলেটার। সে দু’হাতের আঁজলে মুখ চেপে ধরে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘আমি তোমায় ভালোবেসে ছিলাম, মল্লিকা। তুমি এভাবে ঠকাতে পারলা?’
এরপর পরিবেশ নিস্তব্ধ। কেবল মুনিবের হু হু কান্নার শব্দ গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে সকলের। বেলি হাসে। বিড়বিড় করে বলে,
‘কে কারে ঠকাইলো তার বিচার না-হয় গোপনে হইবো।’
এরপর ভাগ্য বিধাতার ইশারায় সব খারাপটা হয় বেলির পরিবারের সাথে। বেলির মাথার চুল গুলো ফেলে দিয়ে মুখে কালি মাখিয়ে এই ভর সন্ধ্যে বেলা পুরো গ্রামে ঘুরানো হয়। বেলিও ঘুরে। মুনিব হাজার বার বাবাকে নিষেধ করে কিন্তু জামাল ভূঁইয়া সে-ই নিষেধ মানলে তো! বেলির বাবা-মায়ের আকুতিও শুনে না কেউ। পুরো গ্রাম ঘুরিয়ে এরপর গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয় মেয়েটাকে। ও একটা বার ফিরেও তাকায় না। একটা বার নিজের পক্ষে কিচ্ছু বলে না। হয়তো বুঝে গিয়েছে ওর ভাগ্য আজ ওর বিপক্ষে।
মুনিব মাথা ঘুরে পড়ে যায় শেষমেশ। এত কঠোরতা সে মানতে পারে না হয়তো!
•
সপ্তাহ খানিক পর……
রাতের আকাশে ভীষণ জোরে জোরে বজ্রপাত হচ্ছে। খুব তাড়াতাড়িই বৃষ্টি আরম্ভ হবে হয়তো!
জানালার কাছের টেবিলটায় বসে আছে মুনিব। উদাস দু’টি চোখ। হুট করে মাঝ রাতে তার দরজা খোলার শব্দ হতেই সে চমকে দরজার দিকে তাকায়। চামেলি সেখানে দাঁড়িয়ে আছে লাল টুকটুকে শাড়ি পরে। মুনিব ভাবিকে দেখে কিছুটা অবাক স্বরে বলে,
‘আপনি এখানে? এখানে কী আপনার?’
চামেলি দরজাটার ছিটকিনি টেনে দেয়। কামুক হাসি নিয়ে এগিয়ে আসে মুনিবের দিকে। লাল লিপস্টিক দেওয়া ঠোঁট গুলোকে বাঁকিয়ে ইশারা করে। দেহের অঙ্গভঙ্গি গুরুতর অশ্লীল।
মুনিব আবার বলে, ‘কী চান এখানে আপনি? কী জন্য আসছেন?’
চামেলি এবার মুনিবের দিকে এগিয়ে গিয়ে মুনিবের গলা জড়িয়ে ধরল। মুনিবের ঠোঁটে ছোটো চুম্বন এঁকে বলল, ‘কী আর চাওয়ার আছে আমার? তোমারে চাই। একদম কাছাকাছি চাই। কতদিন হইলো দেহটা আমার উপোস কইরা শুকাইতাছে। আর কতদিন দূরে রাখবা আমারে?’
মুনিবের কুঁচকানো ভ্রু অস্বাভাবিক ভাবে শিথিল হয়ে যায়। তার পুরুষালি হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরে চামেলির কোমড়। খুব নিকটে এসে, ফিসফিস করে বলে,
‘আর এক মিনিটেও দূরে রাখবো না। আগে বলো কেউ সজাগ নেই তো?’
‘এত কাঁচা কাম আমি করমু? তোমার আমারে এতই কাঁচা লাগে? এত গুলা স্বর্ণের গয়না তোমার মার ঘর থেইকা নিয়া আমার ঘরে রাখছি কেউ টের পাইছে? পায় নাই। এই চামেলিরে ধরা অসম্ভব।’
চামেলির কথায় মুনিব হাসে। চামেলির গালে চপাস করে চুমু খেয়ে বলে,
‘মেয়েটা প্রথম দিন এসেই বেশি সন্দেহ সন্দেহ করেছে। ভাবছিলাম সরল-সোজা বউ আনবো কিছু বুঝব না । কিন্তু..তোমাকে নিয়ে সন্দেহ করাটাই তো সর্বনাশ। সেজন্য তাড়াতাড়ি বিদায় হতে হলো। তিন মাসের বাচ্চা পেটে এমন একটা ডাক্তারি রিপোর্ট না হলে বিদায় করতে সমস্যা হচ্ছিল। এত ভাবে চেষ্টা করেও কিছু হচ্ছিল না। এক ছেলেকে দিয়ে চুড়ি দেওয়ালাম, বাড়িতে ঢুকিয়ে মারার ভয় দেখালাম আরেকটাকে দিয়ে তবুও মেয়েটা যাওয়ার নাম নিল না। তাই এভাবেই বিদায় করতে হলো!’
মুনিবের কথায় মুখ ভেংচালো চামেলি। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘তার জন্য এখন দরদ লাগে না-কি গো?’
‘আমার তো সব দরদ তোমার জন্যই।’ কথাটা বলে দু’জন দু’জনের খুব নিকটে চলে এলো। সারা বাড়িতে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হলো অথচ তাদের এই অনৈতিক নৈকট্যের ভাব কমলো না।
দূর আকাশ বিদ্যুৎ চমকালো আবার। সে রুপোলী আলোয় ভুঁইয়া বাড়ির চন্দ্রমল্লিকার পাড়ে বসা বেলির কালো শরীরটা দেখা গেলো। চকচক করে উঠল তার হাতে থাকা ধারালো ছু রিটা। খুব শান দিয়ে নিয়ে এসেছে মেয়েটা।
ছু রিটার দিকে তাকিয়ে হাসল বেলি। বিড়বিড় করে বলল, ‘বেঈমানির শাস্তি কেমন হয় আপনের বাপ তা জানে না। কাইল যখন আপনাগোরে জড়াজড়ি কইরা ম ই রা পইড়া থাকতে দেখবো তখন বুঝবো শাস্তি কী।’
তারপর গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে দিঘির মাঝে পা ডুবিয়ে দিল মেয়েটা। বাতাসের সাথে ভেসে আসতে লাগল বাগানের মল্লিকা ফুলের ঘ্রাণ। তার সাথে ভেসে এলো মানুষ মল্লিকার খিলখিলিয়ে হাসি। মানুষ ভুলেই গেছে, মেয়ে ফুলের সুবাসকে দমানো যে কঠিন!
৯.
ভর সন্ধ্যে বেলার উষ্ণ গরমের মাঝে ভুঁইয়া বাড়িতে যে থমথমে আবহাওয়ার সৃষ্টি হলো তা নেহাতই অপ্রত্যাশিত ছিল। বেলি অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। কিন্তু হিংস্র বাঘের ন্যায় হুঙ্কার ছেড়ে উঠল মুনিব,
‘ভাবি, আপনার এতো বড়ো সাহস! বেলির গায়ে হাত দেন!’
চামেলি উদ্ভ্রান্ত। হুঙ্কারে ভয় পেলো কি-না বুঝা গেলো না ঠিক। কেবল সাপের মতন ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
‘একশ বার হাত তুলমু। অর সাহস হয় কী কইরা আমার চরিত্র নিয়া কথা বলার?’
চামেলির চোখে-মুখে বিস্ময়। ভাব এমন করছে যেন এ সম্পূর্ণ কিছুই তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। বেলি কুটিল হাসল। আরাম করে সোফায় বসতে বসতে বলল, ‘আপা, আপনের বিয়ার দিন না-কি আপনার চাচাতো ভাই অনেক ঝামেলা করছিলো? কেন করছিলো?’
চামেলির মুখ ছোটো হয়ে এলো। কথার মোড় ঘুরে এমন স্পর্শকাতর অংশে গিয়ে দাঁড়াবে সে বোধহয় এটা আঁচ করতে পারেনি। কেবল মুহূর্তটাকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্য বলল,
‘তোমারে না-কি সেইদিন মেলায় একজন আমার নাম কইরা চুড়ি দিয়া গেছে? তুমি না-কি এডা বলছো সবাইরে?’
‘হ্যাঁ। মিথ্যা বলি নাই তো। দিছেই তো!’
‘কে দিছে? আর দিলে সেটা তুমি এই পর্যন্ত আমারে না বইলা পুরা বাড়ি ছড়ায় ফেলছো ক্যান? পুরা বাড়ির মানুষ জানে আমারে কেউ একজন চুড়ি দিছে। অথচ আমি জানি না!’
‘কী জানতো হ্যাঁ? কী জানতো? আমাকে মেলায় কে চুড়ি দিতে যাবে? শুধু শুধু এসব কথা ছড়াইতাছো ক্যান তুমি? তোমার লগে আমার কিয়ের এত শত্রুতা?’
কথা বলতে বলতে চামেলির চোখ উপচে জল এলো। শরীরটাও কাঁপছে মৃদু। মুক্তা ভূঁইয়া বড়ো বউয়ের আচরণে অতিষ্ঠ বোধ করলেন। তাই রেগে গিয়ে কয়েকটা কথা শুনাবেনও ভাবছিলেন। কিন্তু তাকে থামিয়ে দিল মুনিব। সেই হিংস্র মুনিবের কণ্ঠে রইল কেবল অমোঘ নিরবতা।
‘থাক, আম্মা। আর কিছু বলার দরকার নেই ভাবিকে।’
ছেলের বারণের উর্ধ্বে গিয়ে কিছু বলার মতন মা মুক্তা ভূঁইয়া নন। তাই তিনি থেমে গেলেন। বেলি নরম চোখে তাকাল মুনিবের দিকে। লোকটার মুখে কেমন বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। কিছু নিয়ে অতিরিক্ত ভাবছে নিশ্চয়। অতিরিক্ত ঝগড়া আর অতিরিক্ত পর্যায়ে রইল না। নিমিষেই সেই ঝগড়ায় বিরতি ঘোষণা করা হলো। চামেলি কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেল। মুক্তা ভূঁইয়া গেলেন রান্নাঘরে। ড্রয়িং রুম জুড়ে কেবল রয়ে গেল বেলি ও মুনিব।
দু’জন নিজেদের মতন চুপ করে রইল অনেকক্ষণ। এরপর মুনিব ধীরে ধীরে বেলির পাশ ঘেঁষে বসল। মুনিবকে বসতে দেখে বেলি নিজেকে গুটিয়ে নিল অনেকটা। মুনিব সবটাই ভালো ভাবে খেয়াল করল। হাসলো খানিক। এরপর আলগোছে নিজের হাতের মুঠোয় বেলির ডান হাতটা মুড়ে নিল। বেলি চুপচাপ। কোন প্রশ্ন করল না। মুনিবই প্রথম কথাটা বলল,
‘চুরি গুলো সত্যিই ভাবিকে দিয়েছিল তো?’
স্বামীর প্রশ্নে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো বেলি। চমকে উঠল প্রায়। তার নিঃশ্বাসের গতি অস্বাভাবিক। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না প্রায় এমন নাজুক অবস্থা। তবুও আমতা-আমতা করে বলল,
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। নাহয় কারে দিবো?’
মুনিবের ঠোঁটে হাসি অক্ষত। কেমন যেন বাঁকা হাসি। নিখুঁত ভাবে চাইলে এই হাসির মানে পড়া যাবে অনায়াসেই। বেলির শরীরে ঘাম ছুটল। মুনিব আবার বলল, ‘সত্যিই ভাবিকে দিতে বলেছে?’
বেলি চোখ নামিয়ে ফেলল। গলা শুকিয়ে এসেছে তার। ধরা পড়ে যাওয়া গলা বলল,
‘আমাকে তো ভাবিদের দিকে দেখাইয়া বলছিল চুড়ি গুলো দিতে। আমি সেজন্য ভাবছি হয়তো ভাবির জন্য চুড়িডি। যদি ভাবির না-হয় তাহলে কণিকা আপুর হবে।’
‘তুমি যদি না-ই জানো সঠিক ভাবে চুড়ি গুলো কার তাহলে কেন ভাবির নামটা উচ্চারণ করে ছিলে?’
‘ভাবির নামে এমন একটা কথা বলার আগে তোমার ভাবা উচিত ছিল না?’
‘আপনেও তো সঠিক ভাবে জানেন না ভাবি সত্যি কথা কইতাছে কি-না। তাইলে কেন ভাবির পক্ষে কথা কইতাছেন? হইতেই পারে ভাবি মিথ্যা বলতাছে। ঐদিন চোর কিন্তু পুরা বাড়ি ঘুরে নাই। ভাবির ঘর পর্যন্ত ছিল। এত ঘটনার পরও আপনে কেন ভাবির পক্ষ নিতাছেন?’
বেলির অভিযোগ মাখা কথায় মুনিব শ্বাস ফেলল। বেলির মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘আসলে ভাবির চরিত্র নিয়ে এসব মানতে পারছি না।’
‘না পারার কী হইলো? আমি যেদিন আপনাগো বাড়িত আইলাম সেদিন ভাবি টিটকারি মাইরা কইতাছিল আপনের না-কি ভাবির প্রতি টান আছিল। ভাবি সুন্দর ছিল বইলা। ভাবি যদি এমন কইতে পারে আপনারে নিয়া তাইলে আপনে তার পক্ষ ধরেন ক্যান?’
বেলি প্রতিটা কথাই যুক্তিসঙ্গত তাই মুনিব আর রা করল না। কেবল বেলির চুলের ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে আপনমনে কী যেন ভাবল।
•
টানা কয়েকদিন যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। কালবৈশাখি ঝড়ে নড়েচড়ে যাচ্ছে যে চারপাশ। বাগান থেকে হরেক রকমের ফুলের ঘ্রাণ ভেসে আসে ঝড়ো হাওয়ায়। বেলি উন্মাদ হয়ে যায় ঝড় ছুটলেই। বৃষ্টিতে ভেজা যেন তার নেশা। এইতো কিছুক্ষণ আগে দুপুরের তীব্র রোদের আকাশ মুহূর্তেই অন্ধকার করে শুরু হয়ে গেলো ঝড়। বেলি তখন রান্নাঘরে ছিল। শাশুড়ির সাথে রান্নার কাজে নিমগ্ন। রান্নাঘরের জানালা দিয়ে বাতাস আসতেই বেলির মন ফুরফুরে হয়ে গেল। বাচ্চাদের মতন বেজায় আনন্দিত স্বরে বলল,
‘মা, বৃষ্টি আসবো লাগে!’
মুক্তা ভূঁইয়া মাছ ভাজছিলেন। দৃষ্টি তার কালো কড়াইটাতে ছিল। পুত্রবধূর কথায় তিনি দৃষ্টি নড়চড় না করেই বললেন,
‘হ। বাতাস তো তা-ই কইতাছে।’
বেলির আনচান আনচান মন উন্মনা হয়ে যাচ্ছে বারে বারে। জানলার দিকেই চোখ চলে যাচ্ছে তার। কিন্তু শাশুড়িকে বলার সাহস হচ্ছে না তার চঞ্চল মনের আবদার।
এর মাঝেই আকাশ কাঁপিয়ে বৃষ্টি এলো। বৃষ্টির অনন্ত ধারায় ভরে গেল আঙ্গিনা। বেলি খুশি মনে বার বার জানলা দিয়ে বাহিরে হাত বের করে দিচ্ছে। মুক্তা ভূঁইয়া সবটাই দেখলেন নীরব চোখে। কিন্তু বেলিকে কিছু বললেন না।
অবশেষে বেলিই গাঁইগুঁই করে আবার শাশুড়িকে ডাকল, ‘মা, আপনি বৃষ্টি পছন্দ করেন?’
বেলি শাশুড়ির দিকে তাকাল। কাজ শিঁকেয় তুলে জড়িয়ে ধরল তাকে। বাচ্চা মেয়েটির মতন আবদার করে বলল,
‘চলেন না একটু ভিজি। বয়স বাড়লে চাহিদা বদলায় কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজার আনন্দ সব বয়সে একই থাকে। আহেন না মা, একটু ভিজি।’
বেলির আচমকা জড়িয়ে ধরাটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে মুক্তা ভূঁইয়া অবাক হয়ে গেলেন। তার উপর এমন প্রাণখোলা আবদার!
তিনি কতক্ষণ শক্ত চোখে তাকিয়ে রইলেন পাথরের মতন। বেলি দ্বিধায় পড়লো তাই। হাতের বাঁধন আলগা করতে চাইল। কিন্তু তার আগেই মুক্তা ভূঁইয়া তাকে আরও শক্তপোক্ত ভাবে জড়িয়ে ধরলেন। আহ্লাদ করে বললেন,
‘ভিজবা তুমি বৃষ্টিতে? চলো। আজ রান্নাবান্না সব হবে পরে। আগে আমরা আনন্দ কইরা লই।’
খুশিতে আত্মহারা বেলি শাশুড়িকে নিয়ে এক ছুটে বাড়ির বাহিরে চলে গেল। ভারি বর্ষণে ভিজে গেলো দু’জনেই। তাদের খিলখিলিয়ে হাসি ভুঁইয়া বাড়ির প্রাঙ্গণে প্রেমের বীণা বাজাতে আরম্ভ করল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা মুনিব মুগ্ধ হলো এই দৃশ্যে। জামাল ভূঁইয়া কাজ করছিলেন ঘরে। এমন হাসির শব্দে তিনিও জানালা ভেদ করে নিচে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন। নিজের রাগী স্ত্রীর এমন শৈশব মেশানো আনন্দ দেখে তার ভারি মন ভালো হয়ে গেলো।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত ধরা পড়ল সওদাগর বাড়ির আঙ্গিনায়।
বৃষ্টি বাড়ল। সাথে বাড়তে লাগল আনন্দ। কিন্তু হুট করেই সেই আনন্দে বড়ো বিস্ময় দিয়ে বেলি মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গেল মাটিতে। শরীর হয়ে গেল অবচেতন, নিশ্চুপ।
৮.
ছাদে আচারের বয়াম রোদে দিয়েছেন মুক্তা ভূঁইয়া। আচার রোদে দিলে দীর্ঘদিন ভালো থাকে। তাই তিনি রোদ উঠলেই আচার শুকাতে দেন ছাদে। তাছাড়া বৃষ্টির মৌসুম, সবসময় রোদ পাওয়া যায় না। যখনই রোদ উঠে তখনই রোদের সঠিক ব্যবহার করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
মুক্তা ভূঁইয়া আচার রোদে দিতে দিতেই বেলি উড়নচণ্ডীর মতন হাজির হয়। উসকোখুসকো চুল গুলো খোলা। উদাস বাতাসে উড়ছে মৃদু মৃদু। শাড়িটাও ঠিক মতন পরনে নেই। কোণা দিয়ে পেট দেখা যাচ্ছে সামান্য। মুক্তা ভূঁইয়া ভ্রু কুঞ্চিত করলেন পুত্রবধূর এমন বেহাল দশায়।
‘এ কী অবস্থা! তুমি ঘুমাও নাই?’
বেলি শাশুড়ির দিকে আড়চোখে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘দুপুরে আমার ঘুম হইতে চায় না। আগে তো দুপুরে কখনোই ঘুমাইতাম না। সেই অভ্যাস যায় নাই।’
মুক্তা ভূঁইয়া ছেলে বউয়ের দিকে নিবিড় পায়ে এগিয়ে এলেন। কোমড়ে হাত রেখে বললেন,
‘না ঘুমাইয়া কী করতা?’
‘ক্যান! পথে পথে হাঁটতাম। আর দেখতাম কারো বাড়ির আম পাঁকছে কি-না। কারো বাড়ির গাছে জাম ধরছে কি-না।’
‘মাইনষের বাড়ির আম-জাম দিয়া তোমার কী কাম আছিল?’
শাশুড়ির প্রশ্নে লাজুক হাসল বেলি। কাপড়ের আঁচলে আঙুল প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল, ‘লুকাইয়া সেই গাছ থেইক্কা এগুলান পাইড়া আনতাম। তারপর খাইতাম।’
বেলির লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে হেসে ফেললেন মুক্তা ভূঁইয়া। বেলির কাছাকাছি এসে মাথায় হাত বুলালেন মেয়েটার। এই ছেলের বউকে দেখলে তার ভীষণ মায়া মায়া লাগে। কন্যা সন্তান তার ভীষণ পছন্দের ছিল যদিও সৃষ্টিকর্তা তাকে কন্যা দেননি। ভেবে ছিলেন ছেলের বউদেরকে নিজের মেয়ের মতন রাখবেন কিন্তু বড়ো বউ আসতেই তার সেই ধারণা বদলে গেলো। বড়োলোক বাপের মেয়ে ছিল বড়ো বউ। তেমন করে কারো সাথে মিশতে চাইতো না। আলাদা আলাদা থাকতেই যেন তার ভীষণ ভালো লাগে। তাই আগ বাড়িয়ে মুক্তা ভূঁইয়ার আর মেয়ে পাওয়া হলো না। কিন্তু ছোটো বউ সেই আফসোস ঘুচিয়ে দিল যেন। প্রথম যেদিন এলো সেদিনই পুরো বাড়িতে অবিশ্বাস্যকর চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটাকে একটু বেয়াদব লেগেছিল যদিও কিন্তু দিনে দিনে বড়ো কাছের হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। বড়ো মায়া পড়ে যাচ্ছে।
‘লুকাইয়া খাওয়া চুরি, জানো না?’
শাশুড়ির প্রশ্নে বেলি চোখ গোল গোল করে তাকাল। গাল ফুলিয়ে বলল, ‘কে কইলো চুরি? শৈশবের সবকিছুই আনন্দ, স্মৃতি আর সুখ। কোনোকিছুই চুরি না।’
‘বাপরে! এত জ্ঞানী কথাও জানো তুমি? ভাবছিলাম তো বাসর ঘরের গান ছাড়া তেমন কিছু জানো না হয়তো।’
শাশুড়ির ঠেস মারা কথায় বেলির গোল গোল চোখ লজ্জায় নিভু নিভু হয়ে গেল। দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেলল দ্রুত। দাঁত দিয়ে নখ কেঁটে পরিস্থিতি হালকা করতে চাইল।
মুক্তা ভূঁইয়া ছেলের বউয়ের জব্দ হওয়া মুখমন্ডল দেখে হেসে কুটিকুটি। বেলিও কতক্ষণ হাঁসফাঁস করে পরমুহূর্তেই হেসে দিলো। তাদের মধ্যে কথোপকথন গাঢ় হলো। মুক্তা ভূঁইয়া ছেলের বউকে বসিয়ে মাথায় তেল দিতেও শুরু করে দিলেন। সাথে কত গপ্পো!
দুপুরের রোদও নিভে এসেছে ততক্ষণে। বাতাসের বেগ বেড়েছে কিছুটা। ঠান্ডা বাতাসে আড্ডা জমে গেল আরও। দু’জনের সুখের কথা, শোকের কথা দু’জনকে বলতে লাগল বন্ধুর মতন। আড্ডার এক সময় মুক্তা ভূঁইয়া হুট করেই বেলিকে বললেন,
‘একটা কথা সত্যি কইরা বলবা?’
বেলি বসে ছিল সোজা মুখ করে। পেছনে বসে মুক্তা ভূঁইয়া তেল দিয়ে দিচ্ছিলেন। শাশুড়ির কথায় বেলি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাল। মাথা নাড়িয়ে বলল, ‘কী?’
‘বড়ো বউরে বলে সেদিন মেলায় একজন চুড়ি দিয়া গেছিলো? এডা সত্যি?’
বেলি হয়তো এই প্রশ্নটা আশা করেনি। তাই কিছুটা থতমত খেয়ে গেল। তার উপর সেদিন মুনিব বলেছিল এই চুড়ির কথাটা বাড়ির কেউ যেন না জানে। তাহলে মা জানলেন কী করে তা ভেবে ভেবে মাথা ব্যথা হয়ে গেল তার। মুখটা শুকিয়ে ছোটো হয়ে গেল। আমতা-আমতা করতে লাগল বারংবার। মুক্তা ভূঁইয়া ভরসা দিলেন। আশ্বস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আমারে কও। আমারে কইলি কিচ্ছু হইবো না।’
বেলি ভরসা পেল না তবুও মুনিবের কথা অমান্য করার সাহস পেল না। মুক্তা ভূঁইয়া ছেলে বউকে চুপ করে থাকতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হতাশ কণ্ঠে বললেন,
‘বড়ো বউরে বাড়িতে আনছি তিন বছর। বিয়ার কয়েকমাস পরেই আমার পোলাডা বিদেশ গেলো গা। অল্প বয়সী মাইয়া, স্বামীর সাথে সোহাগ বাড়ার আগেই স্বামীর সাথে দূরত্ব বাড়লো। কিন্তু তাই বইলা সে বাহিরে কারো সাথে এমন সম্পর্ক করব তা মন মানতে চায় না। তোমার শ্বশুর যখন কইলো আমার তো পায়ের নিচ থেইকা মাটি সইরা গেলো। মাইয়াটা উগ্রমেজাজী, রাগী, কটু কথা কয় সব মানছি। কিন্তু তাই বইলা চরিত্রে সমস্যা! এখন হাতেনাতে ধরতে না পারলে তো জিজ্ঞাসা করাও যায় না। কোন কথা কেমনে ঘুরাই ফেলবো কওয়া যায়! য়ে চালাক এই মাইয়া!’
শাশুড়ির এমন হাপিত্যেশে বেলি চুপ করে থাকে। তারও মন খারাপ হয় ভীষণ।
•
বেলি অবেলায় শুয়ে আছে বিছানায়। রুম অন্ধকার। মুনিব বাহির থেকে এসে এই অন্ধকার রুমটা দেখে অবাক হয় গিয়েছিল প্রথম পর্যায়ে। পরবর্তীতে ধাতস্থ হলো রুমে বেলি শুয়ে আছে। ভর সন্ধ্যে বেলা বাড়িতে লম্ফঝম্প না করে শুয়ে আছে মেয়েটা এই ব্যাপারটা বড়োই বিস্ময়কর ঠেকল মুনিবের কাছে। এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। বেলির পাশ ঘেঁষে গায়ে গা ঠেকিয়ে বসলো। নরম হাতে মাথায় হাত রাখলো।
মেয়েটার কাছে এলেই মুনিবের কী যেন হয়। পৃথিবীর সমস্ত মুগ্ধতা এসে ভর করে তার চোখে-মুখে। বুকের উত্তাল ঢেউ নিরব হয়ে যায়। নিজেকে মনে হয় সর্ব সুখী।
মাথায় কারো হাতের স্পর্শ পেতেই ঘুম ছুটে গেলো বেলির। চোখ মেলে তাকালো। আবছা চোখে দেখতে পার়ছিল না প্রথম অবস্থায় কিন্তু ধীরে ধীরে অন্ধকার রুমে পুরুষ অবয়বটা স্বচ্ছ হতেই আঁতকে উঠল। খানিক চেঁচিয়ে বলল, ‘কে? কে?’
বেলির বুকের গতি ওঠা-নামা করছে দ্রুত। মারাত্মক ভয় পেয়েছে যে তা তার শরীরের কম্পন দেখেই আঁচ করা যাচ্ছে ভালো ভাবে। কিন্তু এতটা ভয় পাওয়ার তো কিছুই হয়নি!
মুনিব ধীরে ধীরে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো। চুলের ভাঁজে ভাঁজে আঙুল ডুবিয়ে শরীরের কম্পন দূর করার চেষ্টা করল। এবং এক পর্যায়ে গিয়ে সে সক্ষম হলো। বেলির শরীরের কাঁপুনি কমে এলো। স্থির হলো অনেকটা। এমন বেপরোয়া মেয়েটার ইদানীং ভয় পাওয়ার ঘটনায় মুনিবের মনে চিন্তা বাড়তে থাকল। কী এমন কারণ যে মেয়েটা এত ভয় পেয়ে আছে? ওকে কি কেউ ভয় দেখিয়েছে?
মনের সন্দেহ মনেই রাখে মুনিব। উপর উপর বলে,
‘ঠিক আছো তুমি, মল্লিকা? ভয় গিয়েছে?’
বেলি বুকে মাথা গুঁজে রেখেই মাথাটা নাড়ায়। মৃদু স্বরে বলে, ‘ঠিক আছি।’
মুনিবের আলিঙ্গন ভরসা রেখে এবার নৈকট্যের দিকে যায়। ঘনিষ্ঠতা বাড়তে থাকে একটু একটু করে। তন্মধ্যেই বাহির দেখে হৈচৈ ভেসে আসে ভয়ঙ্কর ভাবে। দু’জনেই ছুটে যায় দ্রুত। ড্রয়িং রুম জুড়ে দাঁড়িয়ে আছেন মুক্তা ভূঁইয়া এবং উনার বড়ো ছেলের বউ চামেলি। মূলত উচ্চকণ্ঠটা চামেলির ছিল।
বেলি যেতেই চামেলি ছুটে আসে বেলির কাছে। শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে চ ড় বসায় বেলির গালে। আক্রোশে ফেটে পড়ে মুহূর্তেই। চেঁচিয়ে বলে,
‘তুমি কেমনে আমার নামে এমন বদনাম ছড়াইতাছো? তুমি কি-না আমার চরিত্র নিয়া গুজব ছড়াও! এতো বড়ো সাহস তোমার!’
৭.
বড়ো বউ এত বেশি ঘুমে নিমজ্জিত ছিল যে তার দরজায় পর পর অনেকগুলো কষাঘাত করার পর সে দরজা খুললো। ঘুমে ঢুলুঢুলু অবস্থা। টেনেও চোখ মেলে রাখতে পারছে না। জামাল ভূঁইয়া ধমকে উঠলেন চামেলিকে,
‘কী ঘুম ঘুমাও তুমি হ্যাঁ? বাড়িতে চোর পড়লো নাকি ডাকাত পড়লো কোনো খবরই নাই তোমার!’
বেলি তখনও মুনিবের বুকের কোণায় লেপটে আছে। জামাল ভূঁইয়া চামেলির দিকে গাঢ় সন্দেহ নিয়ে তাকাল। তার যেন বার বার মনে হতে লাগল চামেলির এই চোখ টেনে আসা ঘুমটা নেহাৎই নাটকীয়। কিন্তু সেটা প্রকাশ করলেন না। বরং গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
‘তালেব যতদিন না আসব তোমার সাথে ফরিদা বিবি ঘুমাইবো। তারে সঙ্গে নিয়া আইজ থেইক্যা ঘুমাইবা।’
শ্বশুরের আদেশ পছন্দ হলো না যেন চামেলির। সে কপাল কুঁচকে বলল, ‘কেন?’
‘আমি কইছি তাই। তালেব বিদেশ থেইক্যা আইলে ফরিদা বিবি আবার নিজের জায়গায় ঘুমাইবো না।’
‘না, আব্বা। আপনে তো জানেন অন্য কারো লগে আমি ঘুমাইতে পারি না।’
‘ঘুমাইতে হইবো এখন। বাড়িতে যা কীর্তিকলাপ শুরু হইছে তোমারে তো একলা রুমে আর দেওন যাইবো না। একলা মাইয়া মানুষের রুমে চোরও যদি ঢুকে কী খারাপ হইবো ব্যাপারটা ভাবছো একবার? আর কোনো কথা হইবো না।’
শ্বশুরের সিদ্ধান্ত অপছন্দ হলো চামেলির কিন্তু জামাল ভূঁইয়া তাতে আশকারা দিলেন না। বরং ফরিদা বিবিকে নির্দেশ দিলেন, ‘তুমি আইজ থেইকা বড়ো বউয়ের সাথে ঘুমাইবা। কান সজাগ রাখবা। কে, কী করে, কে আসে, কে যায় আমারে জানাইবা।’
জামাল ভূঁইয়ার শেষ কথায় ইঙ্গিত ছিল যা অন্যকেউ তেমন বুঝতে না পারলেও মুনিব বুঝল ঠিক। কিন্তু বেলির সামনে সেই ইঙ্গিত নিয়ে কথা বললে খারাপ প্রভাব পড়বে বলে সে বুঝেও চুপ থাকে।
•
দখিন দিকের জানালা ঘেঁষে সূর্যের আভা এসে পড়ছে কোণাকুণি খাটে। বেলির কৃষ্ণাভ মুখমন্ডলে সেই আলো দেখাচ্ছে আধ্যাত্মিক সুন্দর। সুন্দর, সূঁচালো ভ্রু জোড়া সাথে চোখের অত্যাধিক বড়ো বড়ো পাপড়িযুগলই যেন বেলির পুরো মুখের সৌন্দর্যতা বর্ধনে একাই ভূমিকা পালন করছে। মুনিব হাত-মুখ ধুয়ে সবে বের হয়েছে। সারারাত ঘুম না হওয়ায় চোখ জোড়া ফুলে লাল হয়ে আছে। শেষ রাতের দিকে বেলির যে-ই গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো! এরপর কি আর ঘুমিয়ে থাকা যায়? জলপট্টি দেওয়া, শরীর মুছিয়ে দেওয়া সব করেছে একা হাতে।
ঘরে ঢুকতেই রৌদ্রস্নানে মুখরিত ঘুমন্ত বেলিকে দেখে সারা রাতের ক্লান্তি যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল মুনিবের। এত শান্ত, কোমল মুখখানি পৃথিবীর সবটুকু শান্তি যেন ধারণ করে আছে। মুনিব গিয়ে রোদের বরাবর দাঁড়াল। অতিরিক্ত রোদে মেয়েটার ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে বিধায় সে জানালা আটকে দিল। পুরো রুম জুড়ে আধো অন্ধকার নেমে এলো নীরবেই। মুনিব গিয়ে আলগোছে বেলির কপালে হাত ছুঁয়ালো। ঝ্বর কমেছে অনেকটা। কাল রাত এত বেশিই ভয় পেয়েছে যে মেয়েটার জ্বরই উঠে গিয়েছে!
কপালের হাত গাল স্পর্শ করল। তারপর আঙ্গুল স্পর্শ করল রুক্ষ ঠোঁট গুলো। যেন কত বছরের পিপাসায় ক্লান্ত এই ঠোঁট জোড়া। মুনিবের সাধ জাগলো একবার পিপাসা মোচনের কিন্তু মেয়েটার ঘুম ভেঙে যাবে বলে সে নিজেকে সংযত রাখল। মাথায় পর পর কয়েকবার হাত বুলিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। যাওয়ার আগে দরজাটা টেনে দিতে ভুললো না।
খাবার টেবিলে সকলেই সকালের খাবারের জন্য একত্রিত হয়েছে। চামেলি খাবার এগিয়ে-পিছিয়ে দিচ্ছে। সাথে ফরিদা বিবি সাহায্য করছেন। মুনিবকে দেখেই মুক্তা ভূঁইয়া প্রথমে প্রশ্ন করলেন,
‘ছোটো বউ কই? উঠে নাই আইজ?’
মুনিব মাথা নাড়ালো। টেবিলে বসতে বসতে বলল, ‘না, জ্বর এসেছে। সারারাত ঘুমায়নি। তাই এখন ঘুমাচ্ছে।’
বিচলিত হলেন মুক্তা ভূঁইয়া। ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘জ্বর! মাঝ রাতেও না ভালো দেখলাম?’
‘হ্যাঁ। হয়তো ভয় পেয়েছিল রাতে। তাই জ্বরটা এসেছে।’
‘কী যে শুরু হইলো বাড়িডাতে! ভুঁইয়া বাড়িতে কহনো চোর পা রাখার সাহস করতে পারে নাই। এই এলাকার কারো এত কলিজা নাই। কিন্তু কয়দিন ধইরা হেই ভুঁইয়া বাড়িত কি-না চোর ঢুকতাছে! আমার কেমন ডর ডর লাগতাছে। বড়ে ভাই, আপনে কিছু ভাবেন না কী করবেন?’
মুনিবের ফুপু তানু ভূঁইয়ার কথায় মাথা নাড়ালের জামাল ভূঁইয়া। কী যেন ভাবতে ভাবতে কঠিন হয়ে এলো তার মুখ-চোখ। নিরানন্দ স্বরে বললেন, ‘দেহি কী করা যায়। কিছু না কিছু তো করতেই হইবো।’
‘এমন চোর কি এর আগে কহনো আইছিল এই বাড়িত?’
জামাল ভূঁইয়া উত্তর দেন না। মুখটা কেমন শুকিয়ে যায় কোন ভাবনায়। কিছু হয়তো ভাসতে থাকে চোখের পর্দায়। যা বলতে পারেন না অথচ অন্তরে রাখলেও ব্যথা হয়।
খাবার দাবার শেষ হতেই বাবার ঘরে এলো মুনিব। জামাল ভূঁইয়া তখন মোটা খাতায় ব্যবসায়ের হিসাব কষছেন। ছেলেকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে খাতাটা বন্ধ করে দিলেন। রাশভারি কণ্ঠে বললেন,
‘কিছু বলবা?’
মুনিব এসে কাঠের টুলটায় বসলো। তীর্যক চোখে তাকিয়ে রইল বাবার দিকে। মনে যেই প্রশ্ন গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে তা আদৌ বাবাকে বলা কতটুকু যুক্তিসংগত হবে তাই ভাবছে ভেতর ভেতর।
জামাল ভূঁইয়া বললেন, ‘কী কথা কইতে এত সময় নিতাছো?’
মুনিব এবার আর সংশয় ধরে রাখল না। কিছুটা বিব্রত কণ্ঠেই বলল, ‘আব্বা, আপনার কী মনে হয়? চুরির ব্যাপারটা আসলে কী?’
জামাল ভূঁইয়ার চোখে চিকন গ্লাসের চশমা ছিল। ব্যবসায়ের হিসেব কষতে নিলে তিনি চশমা ব্যবহার করেন। আজও সেই সূত্রে চোখে দিয়েছিলেন। সেই চশমার উপর দিয়ে তাকিয়ে বললেন৷
‘চুরি ব্যাপার কী হইবো? চুরি তো চুরিই না-কি!’
মুনিব বাবার চতুরতা সম্পর্কে অবগত তাই বাবার কথা ঘোরানোর এমন পারদর্শিতায় মোটেও বিচলিত কিংবা উত্তেজিত হলো না। ঠাঁই বসে থেকে বলল,
‘ভাবিকে সন্দেহ করার কারণ কী?’
মুনিব যে একেবারেই বাবার মতন চতুর হয়েছে তা জানেন জামাল ভূঁইয়া। তাই আর কথাকে ঘুরিয়ে নয়-ছয় না করেই বললেন,
‘তালেব দেশে নাই আড়াই বছর। বড়ো বউয়ের বয়স মাত্র তেইশ। এ বয়সে তার স্বামীর দূরে থাকাটা হয়তো তার জীবনে পাপ করার বড়ো কারণ হইয়া দাঁড়াইতাছে। তাই না?’
‘বিনা কারণে সন্দেহ করাটা অমূলক নয় কি?’
জামাল ভূঁইয়া ছেলের প্রশ্নে মাথা দুলালেন। আলগোছে খাট থেকে নেমে জানালা বরাবর দাঁড়ালেন। বললেন, ‘বহু বছর আগে এমন ঘটনা এ বাড়িতে ঘটেছিল। তুমি তো জানো সেইটা না-কি?’
‘গত কয়েকদিন যাবত তোমার চাচা রাতে আমাদের বাড়িতে একটা ছেলেকে ঢুকতে দেখেছেন। প্রথমে ভাবছিল তুমি হইবা। বা বাড়িতে কত মেহমান একজন না একজন হইবো। কিন্তু কাইল রাইতে দেখছে একজন কেউ ছেলেটারে বাড়িতে ঢুকাইতাছে। মেয়েলি অবয়ব ছিল। অন্ধকারে মুখ দেহে নাই তোমার চাচা। কিন্তু কয়েকবার ডাকাডাকি কইরা জিজ্ঞেস করছে কিন্তু কোনো সাড়া দেয় নাই। চোরকে কেউ নিজে যেচে বাড়িতে আনবো বইলা তোমার মনে হয়?’
মুনিব বাবার কথায় হতভম্ব হয়ে গেল। মাথা ঘুরাতে লাগল তার। মনের মাঝে যে কথাটা জাগ্রত হলো সেই চরিত্রের সাথে ভাবির চরিত্র মেলাতে বড়ো খারাপ লাগছে তার। সে বিমর্ষ মনে বলল, ‘আপনি যা ভাবছেন তা আদৌ সম্ভব?’
‘সম্ভব কি-না জানি না। কিন্তু অসম্ভবও তো না তুমিই কও।’
মুনিব আনমনে মাথা নাড়াল। আর কিছু বলার মতন শব্দ পেল না।
•
বেলিকে নিয়ে যদিও আগের দিন মেলা ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু যাওয়া হয়নি। তাই আজ মুনিব ঠিক করলো বেলিকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। শুধু বেলি নয় সাথে ভাবি এবং কণিকাও যাবে। বেলির জ্বরটা নেমেছে। মুখ-চোখ শুকিয়ে গিয়েছে অনেকটা একদিনের জ্বরেই।
বেলির শাশুড়ি বেলিকে একটা সুন্দর শাড়ি পরিয়ে দিলেন। মাথা ভর্তি চুলগুলোকে সুন্দর করে বেঁধে দিলেন। শাশুড়ির এমন যত্নে মুগ্ধ হলো বেলি। হেসে বলল,
‘আইজ সূর্য কোন দিকে উঠছে কন তো, আম্মা?’
মুক্তা ভূঁইয়া তখন চুলের শেষ অংশের বেণীখানি করছিলেন। ছেলের ভউয়ের কথায় ভ্রু কুঞ্চিত করে বললেন, ‘ক্যান?’
‘এই যে আপনি এত যত্নআত্তি করতাছেন। এই যত্ন আমার ভাইগ্যে আছে ভাবতেই পারতাছি না।’
মুক্তা ভূঁইয়া চোখ রাঙালেন। বেলিকে মিছি মিছি শাসিয়ে বললেন,
‘এত কথা একদম কইবা না। শুধু শুধু মানুষরে খোঁচা দেও ক্যান?’
‘অ্যাহ্! শুধু শুধু খোঁচা দিছি না কারণে তা আপনে ভালোই জানেন।’
মুক্তা ভূঁইয়া আর কথা বললেন না। মেয়েটা এত মুখের উপর কথা বলে! কোনো কিছু মানে না।
আকাশে সূর্য তখন ঢলে পড়েছে নিজ ভঙ্গিমায়। আলো আঁধারের মিশেলে অপূর্ব এক আকাশ বুক ফুলিয়ে যেন দাঁড়িয়ে আছে মাথার উপর। বেলিরা মেলাতে এসে প্রত্যেকেই যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে। চারপাশে এত আলোকসজ্জা, এত সুন্দর সুন্দর জিনিস যেন কোন আনন্দের বাজার এটা।
মুনিব পরিচিত একজনের সাথে কথা বলে আসতেই দেখলো বেলি আশেপাশে নেই। ভাবি আর কণিকা মাটির জিনিসপত্রের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জিনিসপত্র দেখছে। মুনিব আশেপাশে চোখ বুলাতেই খেয়াল করল বেলি একটা দোকানের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। মুনিব সেখানে যেতেই দেখল একটা ছেলে দ্রুত বেগে ছুটে যাচ্ছে।
আচমকা মুনিবকে দেখে যেন ভূত দেখার মতন চমকে উঠল বেলি। আর তার চমকে উঠাটা এতই অস্বাভাবিক ছিল যে মুনিবের চোখে লেগে গেল। সে অবাক স্বরে বলল, ‘তুমি এখানে কেন? কে ছিল ছেলেটা? তোমার পরিচিত?’
মুনিবের পর পর প্রশ্নে চুপ হয়ে গেল বেলি। থতমত খেয়ে আছে। তার মাঝেই বেলির হাতে এক মুঠ চুড়ি নজরে এলো মুনিবের। চুরি গুলো ছোঁ মেরে নিজের কাছে নিয়ে ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
‘এগুলো কে দিয়েছে তোমাকে? কার থেকে নিয়েছ?’
বেলির মুখটা এটুকু হয়ে এলো ভয়ে। কথা বেরোচ্ছে না। তবুও অস্ফুটস্বরে বলল, ‘ঐ ছেলেটা গিয়েছে।’
বেলি মাটির দিকে তাকিয়ে মিন মিন করে বলল, ‘আমি তো চিনি না। আমারে হুট করে এইখানে ডাইকা আইন্যা কইলো বড়ো ভাবিরে চুড়িডি দিতাম। আর কাউরে যেন না কই। এরপরেই তো আমি কিছু কওয়ার আগে দৌড়ায় গেলো গা।’
৬.
‘আম্মা, আমি হয়তো একটু ঝগড়া বেশি করি তাই বইলা তুমি আমারে চোর বানাইতে পারো না।’
মেয়ের উগ্র কণ্ঠে মানসুরা বেগম কিছুটা থতমত খেলেন। অতঃপর মেঘমন্দ স্বরে বললেন, ‘না, আমি ভাবছিলাম হয়তো তুই রাগ কইরা পলাইছত।’
‘এতডি গয়না আমি রাগ কইরা পলামু? আমার এত ক্ষমতা নাকি!’
বেশি বিরক্তি নিয়েই বলল বেলি। মানসুরা বেগম আর জবাব দিলেন না। চুপ করেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। বেলি মায়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলে তৈরি হওয়ায় মনযোগ দিল।
•
রাত হলেও ভূঁইয়া বাড়ির সকল ঘরে ঘরে আলো জ্বালানো। নিদ্রার আভাসটুকু নেই কারো চোখে। এতগুলো গহনা হারানোর পর শোকে যেন পাথর হয়ে গিয়েছেন মুনিবের বাবা।
বেলি রান্নাঘর থেকে খাবার এনে এক এক করে টেবিলে রাখল সাজিয়ে। তারপর সবাইকেই খেতে ডাকল। শ্বশুরের ঘরে গেল শ্বশুর, শাশুড়ি আর স্বামীকে ডাকতে।
ঘরের মাঝে চুপচাপ মা-বাবার সাথে বসে ছিল মুনিব। বেলি দরজায় দাঁড়িয়েই বলল, ‘মা, খাওন বাড়ছি। খাইতে আসেন।’
মুক্তা ভূঁইয়া স্বামীর পায়ে তেল মালিশ করছিলেন। বেলির কণ্ঠ পেতেই সকলের দৃষ্টি গিয়ে আটকাল দরজায়। জামাল ভূঁইয়া তো চোখ মেলেই ওকে দেখে খ্যাঁক খ্যাঁক করে উঠলেন, ‘ও আমার ঘরের সামনে কী করে? ওরে যাইতে বলো মুক্তা। বাড়িতে বউ তুলতে না তুলতে এত বড়ও সর্বনাশ হইলো আমার। অর লগে কুফা আসলো আমার বাড়িডায়।’
মুনিব বাবার আক্রোশের তীব্র প্রতিবাদ করে বলল, ‘আব্বা, ওর সাথে আপনি ভালো ভাবে কথা বলতে পারলে বলবেন নয়তো বলার দরকার নেই। সব ব্যাপারে আপনি এমন বাড়াবাড়ি করতে পারেন না।’
‘দেখছো, দেখছো, আমার নিজের ছেলে নাকি আমার লগে এমন আচরণ করতে পারে! বাপের প্রতি অর কোনো টান নাই। দুইদিনের বউয়ের লাইগ্যা যেন দুনিয়া আটকায় যাইতাছে।’
‘দুই দিনের বউ হোক আর একদিনের, কথা তো দিয়েছি চিরজীবন পাশে থাকার। আপনার আচরণ ঠিক করেন, আব্বা।’
‘ঠিক করমু না। কী করবা তুমি? হ্যাঁ?’
এবার বেলি দরজায় দাঁড়িয়েই উত্তর দিল, ‘হেয় আর কী করব? করতাছে তো উপরওয়ালা। আমারে গয়না দেওনের সময় কইছিলেন না এই গয়না আমার শরীরে মানাইবো না? এহন চোরের হাতে মানাইতেছে না? এক্কেরে ঠিক কাম হইছে। মাইনষেরে ছোডো কইরা কথা কইলে তা নিজের উপরে ফিরা আহে। বুঝছেন।’
বেলির কথা যেন আগুনে ঘি ঢালার মতন কাজ করল। জামাল ভূঁইয়া আরও রেগে গেলেন। মুহূর্তে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করলেন। তিনি তাজ্জব হয়ে যাচ্ছেন রীতিমতো নতুন বউয়ের কথা শুনে। বাড়ির এতগুলো গয়না চুরি হলো অথচ মেয়েটার মনে কোনো হা-হুতাশ নেই? বলে কি-না ঠিক হইছে?
অবস্থা বেগতিক দেখে মুনিব তাড়াতাড়ি বেলিকে নিয়ে চলে এলো সেখান থেকে। বাবার শরীর এমনেতেই খারাপ হয়ে গিয়েছে। পরে চেঁচামেচিতে আরও খারাপ হয়ে গেলে সমস্যা। এমনেতেই একটা স্ট্রোক করে ফেলেছেন মানুষটা কিছুদিন আগে। আজকে অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে আরেকটা স্ট্রোক করলে জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
রাত তখন ভালোই হয়েছে। যার যার ঘরে ঘুমিয়ে আছে সকলে। কেবল সজাগ বেলি। আজও দক্ষিণ দিকের জানালাটা মেলে দিঘির সৌন্দর্য মুগ্ধ হয়ে দেখছে। বাড়িতে আজও বিদ্যুৎ নেই। রাত হলেই বিদ্যুৎ থাকে না ইদানীং। অতিরিক্ত গরম কিংবা বৃষ্টি হলে বিদ্যুৎ চলে যায়।
বাহিরের মৃদুমন্দ বাতাস এসে গায়ে লাগছে। এক ধারে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। এরপর পানি খাওয়ার জন্য গেল ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলো কাজের মহিলাটি সজাগ। চা বসিয়েছেন চুলাতে। হয়তো তার শাশুড়ির জন্য। ভদ্রমহিলা আবার চা খেতে পছন্দ করেন।
‘নতুন বউ, ঘুমান নাই অহনো?’
ফরিদা বিবির কথায় রান্নাঘরের দরজায় তাকাল বেলি। পানির গ্লাসটা টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলল, ‘না। ঘুমাইলে কি আর পানি খাইতে আসতে পারতাম।’
ফরিদা বিবি হাসলেন নতুন বউয়ের কথায়। রান্নাঘর থেকে আরেকটু এগিয়ে এসে বেলির কাছাকাছি দাঁড়ালেন। কিছুটা ফিসফিসিয়ে বললেন,
‘জানেন আইজ কী হইছে? আপনে তো বাড়িত আছিলেন না, বড়ো বউ আপনের নামে কী কইছে জানেন?’
ফরিদা বিবি সাবধানী কণ্ঠে বললেন, ‘গয়না চুরির কথা ছড়ায় যাওনের পর বড়ো বউ কয় গয়না না-কি আপনে নিছেন। কারণ এর আগে কহনো এ বাড়িতে চুরি হয় নাই। আপনে আহনের পর হইছে তাই হের সন্দেহ আপনিই কামডা করছেন।’
‘খোদার কসম, নতুন বউ। হেয় বলছে। পরে মুনিব বাপজান আইস্যা এডি শুইন্যা অনেক চিল্লাফাল্লা করছে। হের লাইগ্যাই তো কেউ আর কিছু কয় নাই আপনারে। না হইলে এতক্ষণে আপনারে ছিঁড়া ফেলতো।’
বেলি হাসল। ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, ‘আমিও ছিঁড়তে জানি।’
কথা শেষ করেই ঘরে চলে গেল সে। মুনিব তখনও ঘুমুচ্ছে অথচ বেলি জেগে রইল নিশি। ঠান্ডা বাতাসে ঘর ভরে গেল অথচ কোনো এক চিন্তায় ঘুম এলো না বেলির।
•
বাড়ির মেহমান তেমন আর নেই। গয়না চুরি হওয়ার পরের দিনই প্রায় সকলে চলে গিয়েছে। কেবল ফুপি শাশুড়ি আর উনার মেয়ে কণিকা রয়ে গিয়েছে। জামাল ভূঁইয়া দুই দিনেই যেন গহনা হারানোর শোকো কুঁজো হয়ে গিয়েছেন তবে বেলিকে দেখলে তার যথারীতি আক্রোশ ছোড়া অব্যাহত আছে।
সকালে খাবার টেবিলে বসেছে সকলে। কেবল মুনিব আর বেলি বাদে। বেলি সবাইকে খাবার দিচ্ছে আর মুনিব দাঁড়িয়ে আছে অকারণ।
‘খিদা থাকব না ক্যান? প্রতি বেলা এক কথা কও। কাহিনি কী?’
‘যেহেতু এক কথাই বলি তার মানে কাহিনি তো আছেই কিছু একটা যা আপনাদের বলা যাবে না। তাহলে শুধু শুধু জিজ্ঞেস করার কী আছে?’
এবার মুনিবের ফুপু তানু ভূঁইয়া খোঁচা মেরে বললেন, ‘কাহিনি তুই না কইলে কী হইছে? আমরা কি জানি না লাগে? বউ পাগল এতই হইছত যে অহন বউরে ছাড়া খাইতে পারছ না।’
ফুপুর মুখে কোনো কালেই লাগাম ছিল না তা জানে মুনিব। তাই কিছুটা রাগান্বিত চোখেই ফুপুর দিকে তাকাল। কণিকা নিজের মায়ের আচরণে বিরক্ত হয়ে বলল, ‘আহা আম্মা! এত কথা কেন বলতে হবে তোমার?’
তানু ভূঁইয়া মেয়েকে ধমকে বললেন, ‘কমুই তো। আমি তো মিছা কিছু কই নাই। তুই চুপ থাক।’
‘সত্যই কইছেন ফুপু। কিন্তু আপনেরে তো কেউ সত্য কইতে কয় নাই এইহানে। আর হেইদিন দেখলাম ফুপা আপনার লাইগ্যা খাওনের টেবিলে অপেক্ষা করতাছিল, মাছের অর্ধেক টুকরা রাইখ্যা দিছিল, আপনের বাতের ব্যথা বাড়ব দেইখা নিজে মোড়া ছাইড়া আপনেরে বইতে দিছিল। ফুপার ভালোবাসা আপনি যে নিতাছেন আমরা কি কিছু কইছি কহনো? তাইলে আপনে কেন এত কথা কইবেন বুঝান আমারে।’
বেলির মোক্ষম সময়ে মোক্ষম কথায় চুপ করে গেলেন তানু ভূঁইয়া। মুনিব হাসল চাপা হাসি। ভ্রু নাচিয়ে বলল, ‘ফুপি, এ জন্য বলি এত কথা সবসময় বলবেন না। বেলির সামনে তো না-ই।’
মুনিবের বউকে এত আশকারা দেওয়া যেন মানতে পারল না চামেলি। তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘বাপরে, যেমনে বউরে মাথাত তুলো মনে হয় বউ না যেন শিন্নি।’
‘তাতে আপনের বড়ো জ্বলে তাই না, আপা?’
বেলির টিটকারিতে রেগে গেল চামেলি। ধমকে বলল, ‘তুমি আমার লগে এমন কইরা কথা কইবা না বইলা দিলাম।’
জামাল ভূঁইয়া এবার পুরো ঘর কাঁপিয়ে ধমকে উঠলেন, ‘ একটা কথা বলা যায় না আজকাল এই ঘরে। কী একটা বউ যে এলো এর চোপাই শেষ হয় না!’
বেলি মুখ ভেংচি দিল। আরও কিছু বলত কিন্তু মুনিবের ইশারায় চুপ করে গেল। তাছাড়া এমনেতেও তার ঝগড়ার মন নেই।
সবাই খেয়ে উঠতেই খেতে বসল মুনিব। মুখ-চোখ অন্ধকার করে তাকে খাবার দিতে লাগল বেলি। মেয়েটা যে রাগ করে আছে তা বুঝতে বাকি নেই মুনিবের। তাই সে বেলির ডান হাতটা টেনে ধরল। মৃদু স্বরে বলল, ‘রাগ করেছো?’
বেলি টেনে হাতটা ছাড়িয়ে নিল। কণ্ঠ ভার করে বলল, ‘না, রাগ করমু কেন? খুশি হইছে। আপনার আব্বা কইলো আমি না-কি চোপা করি। তো আমি খুশি হমু না এমন একটা কথা হুইন্যা?’
‘আব্বা ভালো হোক। তারপর তুমি তার কথার উত্তর দিয়ে দিও, কেমন? এখন তো আব্বুর শরীরটা একটু খারাপ তাকে উত্তেজিত করা যাবে না। নাহয় সমস্যা হবে।’
বেলি আর কথা বলল না। মুখ ফুলিয়েই রাখল। মুনিব খাবার নিয়ে মুখের সামনে ধরতেই মুখ ফিরিয়ে নিল। মুনিব হাত ধরে টেনে বসিয়ে খাবার পুরে দিল মেয়েটার মুখে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘রাগ করো না। আজ বিকেলে তোমাকে মেলা ঘুরতে নিয়ে যাব কেমন?’
এবার বোধহয় রাগ পড়ল বেলির। মুখের খাবার চিবুতে চিবুতে থাকা বলল, ‘সত্যি?’
‘একদম সত্যি।’
•
পুরো বাড়ি ঘুমে নিমগ্ন। হুট করেই চেঁচামেচির শব্দে কান খাঁড়া হলো মুনিবের। সজাগ হয়ে দেখলো এই রাতে বেলি তার পাশে নেই। ড্রয়িং রুম থেকে তাহলে নিশ্চয় মেয়েটাই চেঁচাচ্ছে!
মুনিব আর সাত-পাঁচ না ভেবে ছুটে গেল। বেলি টেবিলের সাথে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। মুনিব যেতেই জড়িয়ে ধরল তাকে। ততক্ষণে সজাগ হয়ে গিয়েছে সকলে। বাহির থেকে ছুটে আসতে দেখা গেল ফরিদা বিবিকে। হাতে মোটা লাঠি। মুনিব ভ্রু কুঞ্চিত করে শুধাল, ‘কী হয়েছে? কী হয়েছে?’
বেলি তখনো কাঁপছে। ফরিদা বিবি কপালে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, ‘চোর আইছিল মনে হয়। ঘুম থেইকা উইঠ্যা দেহি বহনের রুমে কেডা জানি ফিস ফিস করে। আমি জিগাইলাম— কে। কোনো জবাব আইলো না। এরপরই দেখলাম বড়ো বউয়ের দরজায় শব্দ হইলো আর ছুডো বউ দৌড়ায় আইস্যা চিৎকার দিল ভয়ে।’
জামাল ভূঁইয়ার কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। উনার বাড়িতে চোর আসছে আজকাল ব্যাপারটা যেন হজম হলো না। বড়ো বউয়ের রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন দরজা আটকানো কিন্তু দরজার সামনে পায়ের ছাঁপ রয়েছে কারো!
৫.
বেলির যে রুমে অবস্থান সে-ই রুমের দক্ষিণ দিকের জানলা খুললে দেখা যায় একটি শান্ত, নিবিড় দিঘি। পূর্ণিমার রাতে যে দিঘিতে চাঁদের জোছনা স্নান করে আহ্লাদে। দিঘিটির নাম চন্দ্রমল্লিকা। দিঘির জল গুলো কুচকুচে কালো। বুক থৈথৈ জল। কালো জলেও এই দিঘি যেন সমগ্র রূপ বুকে নিয়ে বসে আছে।
অদ্ভুত ভাবে বেলি আজ খেয়াল করল দিঘিটাকে। সন্ধ্যার দিকে বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় দক্ষিণ দিকের জানালাটা খুলে দিয়েছিল। জানালা খুলে দিতেই সুন্দর, স্নিগ্ধ বাতাসে ঘরটা ভরে যায়। তখনই সে খেয়াল করে দিঘিটিকে। মনে হয় তাকিয়ে থাকতে সেই দিঘির দিকে। দিঘির চারপাশে খোলা জঙ্গল তাই হয়তো বাড়ির পিছনের এই দিঘিটির সাথে বাহিরের কেউ তেমন পরিচিত নয়।
মুনিব ঘরে ছিল না। বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় বাহিরে গিয়েছিল কোনো একটা কাজে। যখন ঘরে ফিরল তখন সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবে যাবে ভাব। ঘরে ঢুকতেই দেখে চঞ্চল বেলি দিঘির পানে মুখ করে তাকিয়ে কী যে ভাবছে উদাস চোখে। সেই চোখে চঞ্চলতা নেই, দুষ্টুমি নেই। আছে এক রাশ আনমনা ভাবনা। যেই ভাবনার প্রখরতা এতই বেশি যে মুনিবের ঘরে প্রবেশ করার শব্দটুকুও আমলে নিল না।
‘কী ভাবে আমার উড়নচণ্ডী? কোথায় তার মন? কে নিল তার চঞ্চলতা শুনি?’
বেলির বাহিরে থাকা দৃষ্টির ধ্যান চ্যুত হয়। পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে মুনিব তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। একদম নিকটে।
বেলি মৃদু হেসে জবাব দেয়, ‘কিছু না।’
মুনিব এক হাতে বেলির বাহু জড়িয়ে ধরে। আরেক হাত মেয়েটার থুতনিতে রেখে শুধায়, ‘আমার কথা ভাবছিলে বুঝি?’
বেলি উত্তরে কেবল হাসে। মুনিব নিজেই তখন বাহিরের দিকে তাকায়। দিঘিটার দিকে আঙ্গুল তাক করে বলে, ‘এই যে দেখছ দিঘিটা, ওর নাম কি জানো?’
বেলি উত্তর দিল, ‘না।’
‘দিঘিটার নাম চন্দ্রমল্লিকা। চাঁদের আলো এসে দিঘিটায় পড়ে বলে এই নাম রাখা হয়েছিল। আর মল্লিকা রাখার কারণ দিঘির আশপাশ জুড়ে তখন নানান রঙের মল্লিকা ফুলের গাছ ছিল।’
বেলি উৎসাহী গলায় বলল, ‘তাই না-কি! কে রাখছিল এমন নাম?’
‘আমার দাদা। এটার নামকরণ করে আমার দাদা। শুনেছি তিনি খুব শৌখিন মানুষ ছিলেন। ফুল, জল, পাতা, আকাশ ছিল দাদার প্রথম ভালোবাসা। সবকিছুর তিনি নাম রাখতে ভালোবাসতেন।’
‘তার জন্যই কী আপনিও নাম রাখেন এত?’
বেলির প্রশ্নের মানে বুঝলো না মুনিব। ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, ‘কী?’
বেলি এবার মুনিবের দিকে ঘুরল। চোখে চোখ রেখে বলল, ‘এই যে আপনে আমারে কহনো মল্লিকা, কহনো উড়নচণ্ডী ডাকেন কিন্তু আমার নাম তো বেলি। আপনে তো আমারে অন্য নামে ডাকেন সেডাই কইছি। আপনিও কি নাম রাখতে ভালোবাসেন কি-না জিগাইলাম।’
মুনিব হাসল বেলির আগ্রহ দেখে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘বেলির সমার্থক নাম মল্লিকা। আমার দাদা বেলিফুলকে মল্লিকা ডাকতেন। সেজন্য আমিও তোমায় মল্লিকা ডাকি। আমি দাদার মতন সবকিছুর নাম রাখি না। শুধু যেগুলো যেগুলো আমি ভীষণ ভালোবাসি, সেগুলোর নাম রাখি।’
মুনিবের কথায় খানিক হাসল বেলি। এরপর কিছুটা ঘুরে দিঘির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কী সুন্দর ঘ্রাণ আইতাছে কন? বেলিফুলের গাছ আছে দিঘির লগে নাকি?’
‘হ্যাঁ, আছে। গতবছর লাগিয়ে ছিলাম আর দেখো এ বছরই ফুল হয়ে গিয়েছে। কী সুন্দর ঘ্রাণ! একটা গোপন কথা শুনবে?’
বেলি আগ্রহ ভরা কণ্ঠে বলল, ‘কী কথা?’
মুনিব বেলিকে সম্পূর্ণ ঘুরিয়ে বেলির কাঁধে থুতনি রেখে বলল, ‘এই গাছ গতবছর আমি লাগিয়ে ছিলাম। জানো কেন লাগিয়ে ছিলাম? কারণ গতবছরই আমি প্রথম তোমাকে দেখি। তুমি মাঠে তোমার আব্বুর খাবার নিয়ে যাচ্ছিলে সেদিন। আমার চোখ আটকে যায় তোমার দিকে। কালো কাজল দেওয়া তোমাকে যে আমার কী ভীষণ সুন্দর লেগেছিল! মনে হয়েছিল এ পৃথিবীতে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতেই পারে না। তখনই ঠিক করে রেখেছিলাম, বিয়ে করলে তোমাকেই করব।’
বেলি স্তব্ধ নয়নে সামনের দিঘিটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মুনিব তাকে যেভাবে ভালোবাসছে সেভাবে আদৌ কেউ তাকে কখনো ভালোবাসবে বলে তার মনে হয় না।
এত ভালোবাসা পেয়েও বেলির বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
•
মুনিবদের বাড়িতে সমস্যা হয়েছে। বিশাল বড়ো রকমের সমস্যা নাকি।
মুনিব আর বেলি নিয়মানুযায়ী আজ বেলির বাবার বাড়ি গিয়েছিল। বিকেলেই মুনিবের বাড়ি থেকে সংবাদ আসে বিপদ হয়েছে বাড়িতে ।
উঠোনে মাদুর পেতে বসে আড্ডা দিচ্ছিল বেলির কাজিন ভাইবোন, মুনিব সকলে। বেলি মায়ের সাথে রান্নাঘরে ছিল। তার মাঝেই মুনিবের কাছে কল আসে। মুনিব এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই বাড়ির দিকে রওনা হয়। পাশের গ্রামেই বাড়ি হওয়ায় যেতে তেমন অসুবিধা নেই। কিন্তু সে বেলিকে নিল না। বলল দু’দিন থাকতে। এমনেতেই বাবা-মা ছেড়ে শ্বশুর বাড়ি গিয়ে থাকতে মেয়েটার ভীষণ মন খারাপ হয়। আর কেউ না জানলেও মুনিব সেটা জানে, বুঝে। মুনিবকে এত হন্তদন্ত হয়ে যেতে দেখে বেলির বাড়ির সকলেই জানতে চায় কী হয়েছে কিন্তু মুনিব কিছু বলে না। পাছে শ্বশুর বাড়ির লোকেরা চিন্তা করবে সেই ভেবে।
মুনিব ঘর থেকে তৈরি হয়ে বেরুতেই বেলির মা বেলিকে রান্নাঘর থেকে ঠেলে বের করেন। জামাইকে এগিয়ে দিয়ে আসতে বলেন।
কালো রঙের পাঞ্জাবিতে মুনিবকে মাত্রাতিরিক্ত সুদর্শন লাগছে। পৃথিবীতে সুন্দর আর মায়াবী মানুষ একসাথে দেখা যায় না। কারো গায়ের রঙ ফর্সা অথচ চেহারায় মায়া নেই। আবার কারো-বা চেহারায় মায়া অথচ গায়ের রঙ ফর্সা নয়। অথচ মুনিবের এই দু’টো বৈশিষ্ট্যই আছে। দেখতে যেমন সুন্দর সে, তেমন গায়ের রঙও ফর্সা। রাজপুত্রের মতন লাগে তাকে। কোথাও কোনো খুঁত নেই মানুষটার।
বেলিদের বাড়ি থেকে বের হলেই কাঁচা রাস্তা। মাটির তৈরি রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। বেলির শাড়ি পরে সে-ই রাস্তায় হাঁটতে কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিল। হুট করেই মুনিব প্রকাশ্যে বেলির হাত জড়িয়ে ধরে। সাবধানে নিজের কাছাকাছি মেয়েটাকে এনে ফিসফিস করে বলল,
‘আমি আছি, পড়বে না। সাবধানে হাঁটো।’
রাস্তায় সামান্য মাত্র লোক আসা-যাওয়া করছে। সকলের চোখ ঘুরে ঘুরে এই হাতের বাঁধনে, এই নৈকট্যের দিকে এসে আটকাচ্ছে। তাতে হেলদোল নেই মুনিবের কিন্তু অস্বস্তি হলো বেলির। সে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, ‘হাত ছাড়েন। মানুষ দেখতাছে।’
মুনিবের যেন কথাটা গায়ে লাগল না। সে মুঠো আরও শক্ত করে বলল, ‘দেখুক মানুষ। আমি তো পরনারীর হাত ধরিনি। পাপও করিনি। আমার মানুষরে আমি ধরেছি। মানুষ কী বলবে শুনি?’
‘বলুক। বউকে ধরলে যদি বেশরম হতে হয়। তবে আমি তাতেই রাজি।’
বেলি আর কিছু বলল। লোকটার সাথে শক্তি কিংবা কথা কোনোটাতেই পারবে না জেনে সে চুপ হয়ে গেল। কিছু রাস্তা যেতেই রিকশায় উঠল মুনিব। বেলিকে ছেড়ে যেতে যেন তার মন টানছে না। তবুও যেতে তো হবেই।
রিকশায় উঠে মন খারাপ করে বলল, ‘তুমি চিন্তা করো না। কাল সকালেই আমি আসার চেষ্টা করব। আর সমস্যা মিটে যদি যায় তবে আজ রাতেই আসব। তুমি ভালো মতো খাওয়া-দাওয়া করো। আর রাতে কল দিবোনে তোমার আব্বুর ফোনে, মোবাইলটা সাথে রেখো। বাড়ি গেলে তোমাকে একটা মোবাইল কিনে দিবো কেমন? যা-ও বাড়ি ফিরে। আমি আসছি কেমন?’
বেলি ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিল। মুনিবের যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও অনিচ্ছা নিয়েই রিকশাচালককে বলল গন্তব্য ধরতে। বেলি দাঁড়িয়ে রইল কতক্ষণ। রিকশা চোখের দৃষ্টিসীমানা পার না হওয়া অব্দি দাঁড়িয়েই রইল।
মুনিবের রিকশা চলে যেতেই সে বাড়ির দিকে হাঁটা আরম্ভ করল। দু’কদম গিয়ে উষ্ঠাও খেলো। বাড়ির সামনে আসতেই দেখল তার মা দাঁড়িয়ে আছেন। ঠোঁটে হাসি। মেয়েকে দেখেই ভদ্রমহিলা বললেন,
‘দেখলি তো বেলি, কত ভালা পোলার লগে তোরে বিয়া দিলাম? এমন জামাই কয়জনের কপালে থাকে ক?’
মায়ের কথায় হাসল বেলি। বিদ্রুপ করে বলল, ‘হ, অনেক ভালা বিয়া দিছো তোমরা। তাই তো শাশুড়ি নতুন বউয়ের হাতের রান্ধা খাইয়া গয়না দিতে গেলে শ্বশুর তামাশা কইরা কয়— ফকিন্নিগো গলায় সোনা মানায় না। আমার মতন কালা মানুষের শইলে সেই সোনার হার নাকি বান্দরের গলায় মুক্তার মালার মতন লাগে! কী ভাইগ্য আমার ভাবো! এত ভালা কপাল কারো হয় না-কি! মাগ্গো মা, সোনায় বাইন্ধা রাখা কপাল।’
কথা শেষ করেই মা’কে কিছু না বলতে দিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেল বেলি। ভদ্রমহিলা মেয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষ।
বেলির শ্বশুর বাড়ির গয়না চুরির ঘটনা আর গোপন রইল না। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে গেল বিকেল পেরুতে পেরুতেই। বেলির বাবা করিম হাসান বাজারে একজনের মুখে খবরটা শুনেই হন্তদন্ত হয়ে বাড়িতে এলেন। বেলিরা তখন সে-ই উঠোনের মাদুরেই বসে আছে। কথা বলছিল কিছু একটা নিয়ে।
করিম হাসান বাড়িতে ঢুকেই মেয়েকে বললেন, ‘বেলি, জামাই বাড়িতে গেছে কেন জানছ কিছু? জিগাইছিলি?’
কথায় ব্যস্ত থাকা সকলের ধ্যান ঘুরে করিম হাসানের দিকে এসে নিবদ্ধ হলো। বেলি ভ্রু কুঞ্চিত করে বলল, ‘না তো, জানি না। কয় নাই তো কিছু।’
করিম হাসান এগিয়ে এসে বললেন, ‘তোর শ্বশুর বাড়িতে নাকি বিরাট চুরি হইছে। তোগো যত গয়নাপত্র আছে সব নাকি চুরি হইয়া গেছে। ভরি ভরি গয়নার টিকিটাও নাই। তোর শ্বশুর তো শোকে কয়েকবার জ্ঞান হারায় লাইছে।’
মাদুরে বসা সকলে তাজ্জব বনে যায়। বেলি তো বিচলিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল। করিম হাসান মেয়েকে তাড়া দিয়ে বলেন, ‘আইজ তোর ঐখানে থাকা উচিত মা। উঠ, তৈরি হইয়া নে। আমি নিয়া যামু তোরে এখনই। জামাই তোরে যে কেন নিল না! তুই ঐ বাড়ির বউ। এই বিপদে তো তোর ঐখানে থাকা উচিত।’
ভূঁইয়া বাড়ির খাবার টেবিল বিশাল বড়ো। আত্মীয় স্বজন বেশি বিধায় প্রথম থেকেই সবকিছু একটু বিশাল বিশাল করে তৈরি করা হয়েছে। এখন বিয়ের অনুষ্ঠান বিধায় মানুষ তাদের বাড়িতে বেশি আসলে তেমনটা নয়। বাড়িতে অনুষ্ঠান না থাকলেও মানুষে ভরে থাকে। বেলির ফুপু শাশুড়ি তো বেশিরভাগ সময়ই এ বাড়িতেই থাকেন। নাম মাত্র নিজের বাড়ি যান। বড়ো জা-এর বাপ-মাও উছিলা পেলেই এ বাড়িতে হানা দেয়। এরপর আছো ফুপু শাশুড়ির ঘরের ননদ, ননস, চাচাতো দেবর, জা, ননদরা। সকলেই অপেক্ষায় থাকে, অজুহাত খুঁজে এ বাড়িতে পাত পেরে বসে খাওয়ার।
বিশাল খাবার টেবিলের খাবার দেওয়ার দায়িত্ব প্রথা অনুসারে নতুন বউয়ের ঘাড়েই পড়ল। এতে নাকি নতুন বউয়ের আত্মা কতটুকু তা বুঝা যাবে। নতুন বউ মানুষকে খাওয়াতে পারে মন উজাড় করে না-কি কৃপণতা করে তা-ই বুঝা যায় এই নিয়মের মাধ্যমে। সকলেই খেতে বসেছে। জামাল ভূঁইয়া মুখ-চোখ অন্ধকার করে রেখেছেন বরাবরের মতন। নিজের অত্যন্ত অপছন্দের মেয়েটির হাতের রান্না খেতেও তার রুচিতে কুলোচ্ছে না। তবুও নিয়ম যা তা তো করতেই হবে। বাড়ি ভর্তি মানুষের সামনে তো আর তামাশা করা যায় না! সকলে খাবার খেতে বসলেও খাবার টেবিলে মুনিবকে পাওয়া গেল না। সে বসে রইলো কিছুটা দূরে একটা মোড়ায়। তার নাকি পেট ব্যথা করছে তাই এখন খেতে পারবে না। সকলে জোড়াজুড়ি করলেও সে উঠে এলো না। বরং ঠাই বসে রইল সেখানেই। সকলে বিশ্রামও করতে বলল অথচ বিশ্রাম করতেও গেল না সে। অবাধ্য ছেলের উপর জামাল ভূঁইয়া আরেকটু রাগলেন। বিয়ে তো করেনি যেন হাতির পাঁচ পা দেখে ফেলেছে ছেলেটা। কারো কোনো কথাকে তোয়াক্কাই করছে না যেন!
‘নতুন বউ, মাছ ভাজার পর তো মাছের তরকারি দিবা। তুমি ডাইল দিতাছো কেন তোমার ফুপারে?’
ফুপু শাশুড়ি কথায় বেলি ডাল দিতে গিয়েও থামল। ঘাড় ঘুরিয়ে ফুপু শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে একদম সহজ-সরল স্বরে বলল, ‘তরকারি তো ঝাল হইছে।’
খাবার টেবিলে এক লহমায় স্রোতের মতন নিরবতা বয়ে গেল। বেলির কথাটা এতই অপ্রত্যাশিত ছিল যে মিনিট এক সবাই চুপ করেই রইল। মুনিব হা করে দূর হতেই বেলির দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটা চালাক নাকি বোকা তা ভাবতে লাগল অবাক চোখে। এরপর নিরবতা ভেঙে প্রথম হাসিটা সে-ই দিল। বেশ জোরে শব্দ করেই হেসে উঠল। তার সাথে তাল মিলিয়ে রীতিমতো একটা হাসির ঝড় উঠে গেল টেবিলে। হাসলেন ফুপা শ্বশুর পাভেল ভূঁইয়াও। ফুপু শাশুড়ি তো কতক্ষণ এতই তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন যেন মূর্তি হয়ে গিয়েছেন। হাসির শব্দ দাপুটে ভাবে বাড়তেই তিনি রেগে-মেগে আগুন। চোখের রাগে যেন ভস্ম করে ফেলবেন বেলিকে।
পাভেল ভূঁইয়া বেলির শ্বশুরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ভাইসাহেব, বউ একটা আনছেন মনের মতন। এমন বুদ্ধি ক’জনারই বা থাকে? ক’জনই বা এমন করে হাসাইতে জানে?’
জামাল ভূঁইয়া এতক্ষণ চুপ করেই ছিলেন। বোনের জামাইয়ের প্রশংসায় এক, দু’বার একটু মাথা নাড়িয়ে খেতে লাগলেন।
‘তুমি সব জায়গায় এমন সবাইরে মাথায় উডাইবা না তো। এই মাইয়া অহন তোমার লগে যে-ই অশ্রদ্ধার কামডা করল তারপরেও তুমি কেমনে অর সুনাম গাও? সবাই কী ঠাট্টার পাত্র লাগে অর?’
বেলি ডাগর ডাগর নেত্র যুগল মেলে মুখ ভেংচিয়ে বলল, ‘ঠাট্টা করলাম কই? আপনে কইছেন দেইখ্যাই তো আমি কইলাম। আপনের কথা অক্ষরে অক্ষরে হুনলাম তা-ও আপনে রাগ করেন। আর কী করলে আপনার মন পামু কন তো?’
পাভেল ভূঁইয়া স্ত্রীকে তর্ক আর বাড়াতে না দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য নিজের স্ত্রীকে বললেন, ‘চুপ থাকোতো, তানু।’
এরপর থেমে বেলিকে বললেন, ‘দেন আম্মা, ডাইলই দেন। ঝাল খাইতে যেহেতু পারি না সেহেতু ডাইল দিয়েই নাহয় খাইলাম।’
সবাইকে অবাক করে দিয়ে বেলি সিরামিকের ঢাকনা খুলতেই সুন্দর মুরগীর মাংস আর রুই মাছের তরকারি দেখা গেল। কী সুন্দর করে বাটিতে রাখা! বেলির শাশুড়ি এতক্ষণ পর মুখ খুললেন, অবাক কণ্ঠে বললেন,
‘এগুলা আলাদা কেন? আর আলাদা কইরা পাকের ঘরেই কেন রাখছিলা?’
বেলি মাছের তরকারি ফুপা শ্বশুরের পাতে দিতে দিতে বলল,
‘এগুলা ঝাল কম দিয়া আলাদা রাঁধছি। এর জইন্যই আলাদা কইরা রাখছিলাম। আর আপনেরা নতুন বউয়ের মন পরীক্ষা করতে পারেন আর নতুন বউ শ্বশুর বাড়ির মানুষের মন পরীক্ষা করতে পারব না? আমার ফুপা শ্বশুরের মন পরীক্ষা করার লাইগাই এগুলা রান্নাঘরে রাখছিলাম। দেখতাম উনি কী কন।’
বেলির কথায় তাজ্জব বনে গেল সকলে। জামাল ভূঁইয়া তো নিজের পুত্রবধূর একের পর এক গুণ দেখে বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলেন। পাভেল ভূঁইয়া ভালো মানুষ। তাই হাসতে হাসতে বললেন,
‘মন পরীক্ষা কইরা কী বুঝলা বউ?’
বেলি নরম কণ্ঠে বলল, ‘আপনি ফুপুর মতন না। অনেক ভালা।’
পাভেল ভূঁইয়া আরেকটু মজা করতে বললেন, ‘আর যদি তোমার ফুপুর মতন হইতাম?’
বেলি এবার অকপটে বলল, ‘তাইলে এই তরকারির বাটি রান্ধা ঘরেই থাকত। খারাপ মানুষ হওয়ার শাস্তি আরকি।’
বেলির এমন অকপটে স্বীকারোক্তিতে খাবার টেবিলে আবারও হাসির বন্যা বয়ে গেল। এবার খুব গোপন একটা হাসি দেখা গেল মুক্তা ভূঁইয়ার মুখেও। তবে তা মুহুর্তেই আঁচল দিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। মুনিবের তো হাসতে হাসতে পেট ব্যথা হওয়ার জোগাড়। ভাগ্যিস! এমন একটা মেয়েকে সে বিয়ে করেছে। নাহয় কে এভাবে প্রাণ খুলে কথা বলে হাসাতো?
খাবার টেবিল ফাঁকা প্রায়। বাড়ির সকলেই খেয়েদেয়ে যার যার জায়গায় চলে গিয়েছে। কেবল বিশাল টেবিল জুড়ে রয়ে গিয়েছেন মুনিব আর মুক্তা ভূঁইয়া। দু’জনেই খেতে বসেছে। বেলি এঁটো থালাবাসন গুছিয়ে রাখছে। মুনিব ভাত মেখে প্রথম লোকমাটা বেলির মুখের সামনেই ধরল। আচমকা বেলি নিজের মুখের সামনে ভাতের লোকমা দেখতেই কিছুটা অবাক হলো। তারপর তাকাল শাশুড়ির দিকে। মুক্তা ভূঁইয়া তখন মুখ নামিয়ে খাচ্ছেন। দৃষ্টি প্লেটের দিকে। বেলি মুনিবকে চোখ দিয়ে ইশারা করে শাশুড়িকে দেখাল। মুনিব মাথা নাড়িয়ে বুঝাল কিছু হবে না, খাবারটা মুখে নিতে।
বেলি কিছুক্ষণ এধার ওধার তাকিয়ে খাবারটা মুখে নিল। অতিরিক্ত চঞ্চলতা আর উত্তেজনার জন্য খাবারটা উঠে গেল নাকে মুখে। চু রি করে খেতে গিয়েও শেষমেশ হাতে নাতে ধরার পড়ার জোগাড়। মুনিব পানির গ্লাসের জন্য হাত বাড়ানোর আগেই মুক্তা ভূঁইয়া নিজের সামনের পানির গ্লাসটা বেলির দিকে ঠেলে দিলেন। ভাতের দিকে এক ধ্যানেই তাকিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললেন,
‘খাবার দাঁড়ায় খাওনের নিয়ম নাই। বইস্যা খাইতে হয়। আগে অরে বইতে দে, মুনিব।’
মুক্তা ভূঁইয়ার কাছে এমন প্রকাশ্যে ধরা খেয়ে কিছুটা লজ্জায় মুখ নামাল বেলি। মুনিব সত্যি সত্যি তাকে হাত ধরে বসিয়ে দিল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে আরেক লোকমা ভাত আবার মুখের সামনে তুলে ধরল। কিন্তু বেলি অস্বস্তিতে একসার। বসে রইল মূর্তির মতন। মুক্তা ভূঁইয়া প্লেটের ভাতটুকু শেষ করেই এঁটো থালাবাসন গুলো গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন,
‘খাবার শেষ কইরা আমার ঘরে আইসো। নতুন বউরে জিনিস দিতে হয় খাবার খাইয়া।’
কথা শেষ করেই হনহনিয়ে চলে গেলেন। বেলি অবাক। হতভম্ব। যে শাশুড়ি এত রাগি মানুষ, সেই শাশুড়ি এমন একটা দৃশ্য দেখেও কোনো হৈ-হল্লা করলেন না কেন?
মুনিব বেলির মুখের সামনে ভাতের লোকমা ধরে রেখেই বলল, ‘হা করো না কেন? কতক্ষণ ধরে বসে থাকব?’
‘আপনে খান।’
‘আমি খাবো না। তুমি খাও।’
‘না খাইলে বইছেন কেন খাইতে?’
‘খেতে বসছি কে বলল তোমাকে? আমি খাওয়াতে বসছি। এত রান্নাবান্না করে নিজে মেখে খেতে গেলে বেশি খেতে পারতে না। তাই আমি খাওয়াতে এলাম।’
মুনিবের কথায় বেলি বিস্মিত হল। ভাত মুখে পুরে অস্ফুটস্বরে বলল, ‘তাই বলে আম্মার সামনে এমন করবেন? আম্মা যদি বকা দিতো?’
মুনিব গা-ছাড়া ভাবে বলল, ‘আম্মারে তুমি চিনো না। ধীরে ধীরে চিনবে। ধৈর্য রাখো।’
বেলি ঘাড় কাত করে সম্মতি দিল। মুনিব তাকে খাইয়ে দিল ছোটো বাচ্চাটির মতন যত্ন করে। যেন এত আদুরে মানুষ এই পৃথিবীতে আগে কেউ কখনো পায়নি।
বেলি পা দুলাচ্ছিল। বড়ো বৌয়ের দিকে তাকিয়ে চিকন ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলল,
‘পাকের ঘরে? কেন? আজকা কি রাঁধতে হইবো আমারে?’
‘হ। বিয়ার পরেরদিন এ বাড়িতে রানতে হয়।’
‘আপনে রাঁধছিলেন?’
বেলির আচমকা এই প্রশ্নে চামেলি তৎক্ষণাৎ জবাব দিল না। কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল, ‘না। আমি তো রান্ধা পারতাম না তহন।’
বেলি জবাবে কেবল বলল, ‘ওহ্।’
চামেলি কতক্ষণ চুপ করে বেলির দিকে তাকিয়ে রইল। বেগুনি রঙের শাড়িতে কালো বেলিকে তার কাছে মনে হলো কালাবেগুন। রূপের ছিটেফোঁটা সেই সারা শরীরের কোনো কোণাতে।
চামেলির এমন অদ্ভুত তাকানোতে বেলি বিব্রতভাব করল। কপাল কুঁচকে বলল, ‘কী দেহেন এমনে?’
বেলির কথায় চামেলির ধ্যানচ্যুত হলো। নাকটাকে পাঁচ হাত উঁচুতে তুলে ফেলল সে। যেন কোনো পচা সবজি দেখে ফেলেছে। মুখ-চোখে মারাত্মক রকমের বিরক্তি এনে বলল
‘দেহার মতন কিছু আছে না-কি তোমার ভেতরে?’
হয়তো এমন একটা প্রশ্নের পর যে-কোনো অসুন্দর মানুষ মুখ কালো করে ফেলতো। অস্বস্তিতে এটুকুন হয়ে যেত। অথচ বেলির মাঝে তার এক ভাগও দেখা গেল না। বরং মে দ্বিগুণ সম্মতি প্রদান করে বলল,
‘আমিও তো তা-ই কই। যেইহানে দেখার মতন কিছু নাই সেইহানে এমন কাঙ্গালিনীর মতন তাকায় আছেন ক্যান?’
বেলির কথায় তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল চামেলি। ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে উঠল তার মেজাজ,
‘তোমার তো ভারি চোপা! কাইল থেইকা দেখতাছি কারণে-অকারণে আমারে কথা শুনাইতে ভুল করো না। তোমার কোন পাঁকা ধানে আমি মই দিছি কও তো?’
বেলি চামেলির এমন রাগকে মোটেও তোয়াক্কা না করে হেলতে-দুলতে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। মাথার ঘোমটাটা আরেকটু আঁটসাঁট করতে করতে বলল,
‘এই বাড়িতে যহন প্রথম পা-ডা দিলাম তখন শুনি কে যেন আমারে শুনাইয়া শুনাইয়া কইতাছিল—”মুনিবের সবসময় একটা টান আছিল আমার প্রতি। ভাবছিলাম আমার রূপ দেইখা দেওর মনেহয় সামলাইতে পারে না নিজেরে। বউ আনলে মনেহয় আসমানের চান্দের চাইয়াও সুন্দর বউ আনব। কিন্তু শেষমেশ কি-না তালগাছের পেত্নী আনল!” এমন একটা কথা শুইন্যা আমি যখন মানুষটারে দেহনের লাইগ্যা তাকাই তহন আপনার মুখটাই দেখছি। লগে লগে এক দলা ছেফ ফালাইছি পিছনে ঘুইরা। দেওররে যে প্রেমিকের মতন ভাবে তারে কি বেডি কওয়া যায়? দেওরের বউরে যে সতীনের মতন কথা শোনায় তার লাইগ্যা এর চাইয়া বেশি ভালা আচরণ আমার আহে না। জামাই থাকতেও জামাইয়ের ভাইয়ের লাইগ্যা মন কান্দে যে বেডির, তারে কী কয় গেরামের মানুষ জানেন তো?’
সরাসরি এমন অপমান চামেলি আশা করেনি বোধহয়। কখনো কারো থেকে এমন আচরণ পেলে তারপরই না আশা করবে! দেখতে সে যেমন সুন্দরী, তার বাবার টাকাও আছে তেমন অঢেল। শ্বশুর বাড়ি হোক কিংবা বাপের বাড়ি, কোথাও তাকে তেমন কথা শুনতে হয় নাই। মাঝে মাঝে শাশুড়ি চোখ রাঙানো দেয় এতটুকুতেই তার শাসন সীমাবদ্ধ কিন্তু তাই বলে এমন বাজে ইঙ্গিত আর অপমান করবে নতুন বউ!
চামেলি আর টু শব্দটুকু করার আগেই বেলি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। তার ভেতরে কোনো অনুশোচনা নেই, আফসোস নেই। যে যেমন তাকে তেমন বলে কীসের আফসোস করবে সে? আফসোস করে বোকারা। কিন্তু সে বোকা নয়।
•
রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মুক্তা ভূঁইয়া। ছোটো বৌয়ের আসার অপেক্ষাতেই যে ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তার দাঁড়ানোর অঙ্গভঙ্গিই বলে দিচ্ছে সেটা। বেলি হেলে-দুলে রান্নাঘরে ঢুকতেই মুক্তা ভূঁইয়া স্বস্তির শ্বাস ফেললেন যেন। ছেলের বৌ যেমন চোপা নাড়ে, তিনি তো ভেবে ছিলেন হয়তো বেলি আসবেই না রান্না করতে। হয়তো এই রান্না নিয়ে আরেকটা কাহিনি করতে হতো বাড়িতে। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে বেলি আসলো। তা-ও খুব সুন্দর ভাবে ঘোমটা এঁটে। বেলিকে দেখেই মুক্তা ভূঁইয়া মুখ গম্ভীর করে বললেন,
‘কখন পাঠাইছি বড়োবৌরে ডাকতে? তুমি আইলা এখন৷ কী করছিলা এতক্ষণ লাগাইয়া?’
বেলি রান্নাঘরের পিঁড়িতে বসতে বসতে বলল, ‘আপার সাথে একটু কথা কইতে ছিলাম। আপা কইতেছিল আইজ নাকি আমারে সব রাঁধতে হইবো?’
‘হ। বিয়ার পরেরদিন আমরা বউগো হাতের রান্ধা খাই। এডা নিয়ম।’
‘কী রাঁধতে হইবো? কন।’
মুক্তা ভূঁইয়া জবাব দেওয়ার আগেই বাহিরে দাঁড়ানো বেলির ফুপু শাশুড়ি বললেন,
‘এখন ফ্রিজে চিংড়ি আছে ওডি নামাইয়া রান্ধন শুরু করো। এরপর বাজার থেইক্যা গুড়া মাছ, বড়ো মাছ, মুরগি আনবো। গুড়া মাছ বাইচ্ছা, কাইট্টা টমেটো, ধইন্যাপাতা দিয়া শুকনা কইরো আমার পছন্দ। বড়ো মাছের একপদ ভাইজো আরেকপদ ঝোল কইরো তোমার ফুপা আবার ঝোল ছাড়া খায় না। আর মুরগিটা রাইন্ধো। আর শেষে পোলাও আর ভাত রাইন্ধো। মুনিব আর তোমার শ্বশুর আবার বেশি পোলাও খাইতে পারে না।’
বেলি কতক্ষণ ফুপু শাশুড়ির দিকে চোখ ছোটো ছোটো করে তাকিয়ে থেকে মুখ ভেংচিয়ে বলল, ’এতডি রান্ধা আইজই রাঁধতে হইবো? জন্মের খানা খাইবো না-কি সকলে!’
বেলির মুখের লাগাম নেই। আর এখনের লাগামহীন কথাটাও বাহিরে থাকা ফুপু শাশুড়ি শুনে ফেললেন স্পষ্টই। হৈহল্লা করতে করতে ঢুকলেন রান্নাঘরে। বেলিকে মুখ ঝামটি দিয়ে বললেন,
‘ছি ছি ছি! এসব কেমন ধরণের কথা কয় এ বউ? বিয়া বাড়িতে একটু ভালো-মন্দ রানবো সেইডাই তো স্বাভাবিক। তোমরা আবার এডি বুঝবা কেমনে! আছিলা তো ফকিন্নির ঘরে।’
বেলিও ফুপু শাশুড়ির অঙ্গভঙ্গি নকল করে, শরীর নাচানোর মতন করে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,
‘হ, ঠিকই কইছেন। আপনাগো মতন রাক্ষসী খানা খাইলে আমার শ্বশুর বাড়িও ফকিন্নি হইতে বেশিদিন লাগব না। কত জনমেরডা এক লগে খাইতে চান হুনি? ভাইয়ের টেকা দেইখা মজাই লাগে তাই না খাইতে?’
অবস্থা বেগতিক দেখে মুক্তা ভূঁইয়া ছোটো বৌকে ধমক লাগিয়ে দিলেন। বেলি না জানলেও তিনি জানেন তার ননদ-ননসেরা কেমন ধরণের। তাই নতুন বউকে আর কথা বাড়ানোর সুযোগ দিলেন না তিনি। ননদকেও বুঝিয়ে শুনিয়ে বাহির করে দিলেন রান্নাঘর থেকে।
বেলি মুখ ভেঙিয়ে ফ্রিজ খুলল, চিংড়ি মাছ বের করল। তার শাশুড়ি তাকে সব দেখিয়ে দিল। সব দেখিয়ে-শুনিয়ে মুক্তা ভূঁইয়া বাহিরে যেতে নিলেই পিছু ডাকল বেলি,
‘আম্মা, শুনেন..’
মুক্তা ভূঁইয়াও পা থামালেন। বেলির মুখের আম্মা ডাকটা তার অন্তরের গভীরে গিয়ে একটা স্নেহের টান তৈরি করল যেন। তিনি প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে বেলির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কও?’
‘আপনেরা কি নতুন বউরে খাইতে দিতে চান না নতুন বৌ না কওয়া পর্যন্ত?’
মুক্তা ভূঁইয়া বুঝলেন না বেলির কথা। কপাল কুঁচকে বললেন, ‘কী?’
বেলি মাছ গুলো পানিতে ভিজিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘কাইল আসার পর আপনেরা আমারে কোনো খাওন দেন নাই। পরে আমি সন্ধ্যার দিকে আর টিকতে না পাইরা লাজ ভাইঙা খাওন চাইলাম। রাইতেও কেউ আর খাইতে ডাকলেন না। হেই কাইল সন্ধ্যায় খাইছি আর আইজ বেলা বাজে নয়টা। আমি তো মানুষ আম্মা, আমারও তো খিদা লাগে হেইডা আপনেরা বুঝেন না? না-কি কালা আর গরিব দেইখ্যা ভাবেন আল্লাহ্ আমাগোরে খিদা-তিষ্ণা দেন নাই? আমারে একটু খাওন দিতে এত গায়ে লাগে আপনাগো, আম্মা? অথচ কত পদ রানতে দিলেন নিজোগো লাইগ্যা। গরিবগো কি খাইতে মন চায় না? নাকি কালাগো পেট নাই?’
এতগুলো কথা বেলি এক মনে নিচের দিকে তাকিয়ে কাজ করতে করতেই বলল। একটা বারও হিংস্রতা দেখায়নি, রাগ দেখিয়েও বলেনি। মুক্তা ভূঁইয়া চুপ করেই রইলেন। এই কথার পরিবর্তে কী বলবেন তা খুঁজে পেলেন না যেন।
বেলি ততক্ষণে সবজি কাটতে শুরু করেছে। সবজি কাটাতে কাটতে বলল, ‘নতুন বউ কিছু কইলে কইবেন বেলাজা। অথচ এমন এমন কাজ কিংবা কথাই আপনারা বলছেন যে নতুন বউডার লাজ ভাঙতে হইছে বাইধ্য হইয়া। কিন্তু আপনাগো দোষ কেউ দেখব না। দেখব নতুন বউয়ের দোষ। ক্যান সে এমন করল? নতুন বউ হইয়া কেন এত চোপা করল। একটা বার ভাবেন না, চোপা করার লাইগ্যা আপনেরা কতখানি বাইধ্য করছেন।’
বেলির একের পর এক অভিযোগ মাখা বাক্যে মুক্তা ভূঁইয়া চুপ করেই থাকলেন। এরপর স্তব্ধ পায়ে নিঃশব্দে প্লেটে রুটি, মাংস সাজিয়ে পানির গ্লাস সমেত বেলির সামনে রেখেই অতি ব্যস্ততা দেখিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যেন কী রাজকার্য তিনি রেখে এসেছেন! অথবা নিজেরও প্রথম বউ হওয়া জীবনের কথা মনে পড়ে গিয়েছে! কেই-বা বলতে পারে? কে কখন কার ভেতরে নিজের গল্প খুঁজে পায়! আজকের শাশুড়ি একসময় এতটা অবহেলার বউ ছিলেন নিশ্চয়। যুগ বদলেছে, অবস্থান বদলেছে। তাই হয়তো তিনি যা পাননি তা আরেক জনকে দিতে এত কৃপণতা!
বেলি রান্নায় বেশ পটু বের হলো। এক হাতে সামলে নিচ্ছে বিরাট রান্নাবান্না। কাজের খালা টুকটাক আগপাছ করে দিতে এলেও বেলি সাহায্য লাগবে না বলে তাকে বিশ্রাম করতে পাঠিয়েছে। এতে কাজের খালা এত বেশিই খুশি হলেন যে পুরো বাড়িতে ঘুরে ঘুরে নতুন বউয়ের গুণগান শুরু করে দিলেন।
মুনিব বাজার করা সামগ্রী ভ্যানে করে পাঠিয়ে নিজে গিয়েছিল আরেকটা কাজে। ফিরতে ফিরতে বাজল দুপুর একটা। বাড়ির মোটামুটি সকলে তখন বাহিরের জায়গাটায় বসে হাসি-ঠাট্টায় ব্যস্ত। মুনিব সেই ফাঁকে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। ভেতরে ঢুকতেই রান্নাঘরের খুটখাট শব্দ শুনে উঁকি মারতেই ঘর্মাক্ত বেলিকে দেখল। ঘামে ভিজে একাকার মেয়েটার শরীর। এক মনে কাজই করে যাচ্ছে। মুনিব কোনো রকমের বিরক্ত না করে নিজের ঘরে চলে গেল।
বেলির রান্না প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। পোলাও রান্না বাকি আছে কেবল। তন্মধ্যেই সে পিঠে অনুভব করল শীতল বাতাস। কিছুটা চমকেই গেল। এমন ভ্যাপাসা গরমে বাতাসটা এতই আচমকা ছিল যে সে থমকে গিয়েছিল। তৎক্ষণাৎ পেছনে তাকাতে দেখল রান্নাঘরের দরজায় একটা ছোটো টেবিল ফ্যান রাখা। যা চলছে ঝড়ের গতিতে। ভ্যাপসা গরমটা নিমিষেই হাওয়ায় উড়ে গেল যেন। বেলি বুঝে উঠতে পারল না এ বাড়িতে তার এমন কোন শুভাকাঙ্খী আছে যে এতটা উপকার করল!
বেলিকে অবাক করে দিয়ে হাসতে হাসতে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়াল মুনিব। চোখে-মুখে উপচে পড়ছে স্নিগ্ধতা। ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘কী আমার, মল্লিকা, রান্না করছো বুঝি?’
মুনিব আরেকটু এগিয়ে এসে বেলির গালে ছোটো ছোটো স্নেহের আলতো চ ড় দিয়ে বলল, ‘না তো, বেশি বেশি। তার জন্যই তো আমি একটু বেশি ভালোবাসা দিয়ে দিচ্ছি। পর মানুষের দুঃখ নাকি আপন মানুষের ভালোবাসা ভুলিয়ে দিতে পারে? তবে কি আমার ভালোবাসা এতটাই কম পড়েছে যে আমার মল্লিকার দুঃখই ঘুচছে না?’
মুনিবের শক্ত কথা বুঝল না বেলি। অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইল। আবার হয়তো বুঝল কিন্তু কিছু বলল না। কিছু জিনিস না বুঝতে পারাই ভালো। বেশি বুঝে ফেললে সমস্যা আছে। তখন স্বার্থপর হওয়া যায় না। নিজের জন্য নিজেকে একমাত্র মানুষ ভাবা যায় না। তখন অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আমরা ভাবি আমাদের তো অমুক আছে। সে-ই আমাদের বাঁচাবে। কিন্তু দিনশেষে তো অমুকরা সবসময় থেকে যায় না।
মুনিব বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছিল বাড়ির পেছনে। সুবিশাল জায়গাটুকু আড্ডা দেওয়ার জন্য বেশি উপযুক্ত। একটা কাঠের বেঞ্চি, সাথে কাঠের টেবিল, চারপাশে সুবাসিত ফুল গাছ। এ যেন স্বর্গের নন্দনকাননের একাংশ।
বাড়ির কাজের মেয়ে মিনু চা, মুড়িমাখা দিতে এলো। মুনিবরা তখন গভীর আড্ডায় নিমজ্জিত। নতুন বিয়ের কত কথা নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করছে তারা। মিনু সেই জমে উঠা আড্ডায় বড়ো বিরক্তের কারণ হয়ে ডাকল মুনিবকে,
‘ভাইয়া, আম্মা ডাকে আপনেরে।’
মুনিব হাসতে হাসতে ভ্রু কুঁচকে মিনার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘কেন ডাকে? কিছু লাগবে?’
‘আপনে গেলেই তো কইবো। আহেন একটু।’
মায়ের কথার অর্থ মুনিবের কাছে অস্বচ্ছ। তাই কিছুটা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,
‘বেলি? কী করেছে ও?’
মুক্তা ভূঁইয়া এবার আরও খানিকটা বিরক্ত সহকারে বললেন, ‘কী করে নাই সেটা ক।’
মুনিব যদিও জানে না বেলি কী করেছে তবুও মায়ের আচরণ দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারছে। মা রাগী তবে সহজে এতটা রেগে যাওয়ার পাত্রী নন। যেহেতু বিচার দিচ্ছেন তবে কিছু একটাতো হয়েছেই। তাই সে আবার জিজ্ঞেস করল,
‘কী হয়েছে না বললে বুঝব কীভাবে বলো!’
মুক্তা ভূঁইয়া এবার ছেলেকে সবটুকু ঘটনা খুলে বললেন একেক করে। নতুন বউয়ের রঙ তামাশায় তিনি কতটুকু অবাক হয়েছেন সেটাও বললেন। আত্মীয় স্বজনরা কতটুকু হাসি-তামাশা করছে তা বলতেও বাদ রাখেননি।
সবটা শোনার পর কপালের মাঝে গাঢ় ভাঁজ পড়তে দেখা গেল মুনিবের। সে যতটুকু জেনেছিল, বেলি কিছুটা চঞ্চল কিন্তু এমন উড়নচণ্ডী তো না। কিছু সময় নীরবে সাত-পাঁচ ভেবে অবশেষে বলল, ‘আমি দেখছি।’
ছেলেকে কাছে পেয়ে মুক্তা ভূঁইয়া আরও খানিক আশকারা পেলেন যেন। মুখ-চোখ কুঁচকে বললেন,
‘তোর আব্বা নাকি বিয়াডা করতে না করছিলো। সেডা শুনলে আজ এমন দিন কি দেখতে হইতো?’
মুনিব মায়ের কথাটাকে প্রশ্রয় দিল না বরং বড়োই বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘আব্বার এসব কাজকে প্রশ্রয় দিও না তো, আম্মা। একটা মেয়েরে ওভাবে মহা ধুমধাম করে অপমান করার অধিকার কারো নেই। অমন ভরা মজলিসে মেয়েটাকে শুনতে হয়েছে তার গায়ের রঙ কালো বলে তার বিয়েটা হবে না। বুঝতে পারছো মেয়েটার মনের অবস্থা তখন কি হয়েছিল? অপমানে ও কতটুকু নিজেকে অসহায় ভেবেছিল? প্রকৃতপক্ষে ওর এমন ব্যবহারের জন্য আমাদের পরিবারই দায়ী। কেউ হুট করেই খারাপ হয়ে যায় না। আমরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করি যে সে খারাপ হতে বাধ্য হয়।’
ছেলের এত সুন্দর কথাটা মুক্তা ভূঁইয়ার কাছে বাড়াবাড়ি রকমের বউ পাগলামি মনে হলো। যার ফলস্বরূপ তিনি অবাক নয়নে তাকিয়ে কিছুটা মুখ ঝামটি মেরেই বললেন,
‘বিয়া হইতে না হইতে এমন বউ পাগল হইয়া গেছত? ছি!’
মুনিব আর কিছু বলল না। যেখানে তার এত বড়ো যুক্তি কেবল বউ পাগল নামি স্বীকৃতি পেয়েছে সেখানে কিছু বলা মানেই ওলু বনে মুক্তা ছিটানোর মতন।
•
বেলি নিজের রুমে বসে ভাত খাচ্ছে। চারদিকে তখন মাত্র সন্ধ্যা পেরুনো আবহাওয়া। মৃদু বাতাসে ভরে আছে সবটুকু ঘর।
মুনিব ঘরে ঢুকতেই দেখল নতুন ভাঁজ ভাঙা লাল রঙের সুতির শাড়ি পরে বেলি ভাত খাচ্ছে। বিয়ের সাজ শরীরে নেই। চোখ ভর্তি কাজল দেখা যাচ্ছে বড়োই উজ্জ্বল। ঠোঁটে বোধহয় লিপস্টিক দিয়েছিল মেয়েটা, যা ভাতের সাথে অর্ধেক গিলে নিয়েছে। আর অর্ধেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে লেগে রয়েছে চারপাশে। আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে এ মেয়েটির চেয়ে সুন্দর, সরল মানুষ দুনিয়াতে নেই। নীরবতার উপমা যেন সে। অথচ কিছুক্ষণ আগেই নাকি মেয়েটা কত রকমের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে।
বেলির ধ্যান তখনো খাবারের দিকে। ঘরে কেউ এসেছে যে সেদিকে তার খেয়াল নেই। মনের সুখে খেয়ে যাচ্ছে। মুনিব কিছুটা এগিয়ে এসে ডাকল,
‘আমার উড়নচণ্ডী কী করে?’
বেলির মুখ ভর্তি ভাত মুখেই রয়ে গেল। চমকে তাকাল গমগমে স্বরে কথা বলা মানুষটার দিকে। গোল গোল করে তাকানোর ভঙ্গিমা, মুখ ভর্তি ভাতে বেলিকে মনে হচ্ছে ছোট্টো খুকি। যাকে মা আদর যত্ন করে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। আহ্লাদের খাবারে ভরে আছে মুখ।
বেলি লাজুক হাসল। সত্যিই তো, স্বামীকে রেখে এমন গপাগপ করে খাওয়াটাতো অন্যায়ই বটে। মাথাটা খানিক নিচু করে বলল, ‘মনে আছিল না। খিদা লাগছিল অনেক।’
কী অকপটে স্বীকারোক্তি! কোনো দম্ভ নেই, অহংকার নেই। অথচ এই মাত্রই মা এ মেয়েটার নামে কতকিছুই বলে গেলেন। ইশারা ইঙ্গিতে ভাবিও বললেন কত কী!
মুনিবকে চুপ থাকতে দেখে বেলির অপরাধবোধ বাড়ল। কী জানি মানুষটা রাগ করল কি-না ভেবেই বুকের ভেতর চলল দেদার বুঝাপড়া। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘আপনে কি রাগ করলেন?’
বেলির প্রশ্নে হেসে দিল মুনিব। এগিয়ে এসে খাটে বসল ঠিক বেলির পাশাপাশি। ডান হাতে বেলির গালে আলতো হাত বুলিয়ে বলল,
‘না, রাগ করিনি।’
এই আহ্লাদে বেলির আড়ষ্টতা বাড়ল। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, ‘খাইবেন আপনে? আমি কি খাওন নিয়া আসমু?’
বেলির নিকটে আসতেই মুনিবের দুষ্টুমি মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল, ‘উম, না। খাবার আনতে হবে না। তোমার প্লেট থেকে খাইয়ে দেও।’
‘এঁটো আবার কী? স্বামী স্ত্রীর মাঝে এঁটো বলতে কিছু হয় না। তুমি কি দিবে খাইয়ে? নাহলে চলে যাচ্ছি।’
মুনিবের চলে যাওয়ার কথা শুনে বেলি ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘না, না, যাইবেন না। দিতাছি।’
কথা শেষ করেই এক লোকমা ভাত ধরল মুনিবের মুখের সামনে। মুনিব ভাত মুখে নিল। সাথে আলতো কামড় লাগাল বেলির আঙুলে। লজ্জায় বেলি আরও মিইয়ে গেল। মাথা এতটাই নামাল যে থুতনির সাথে লেগে গেল বুক। মুনিব হো হো করে হাসতে হাসতে বলল, ‘কী হলো? মাথা নামাচ্ছ কেন? আমার দিকে তাকাও।’
বেলি তাকাল না। বরং মাথা নামিয়েই বিড়বিড় করে জবাব দিল, ‘না, তাকামু না। আমার শরম লাগে।’
নির্দ্বিধায় লজ্জা পাওয়ার এমন স্বীকারোক্তিতে মুনিব ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠল। এমন একটা অসম্ভব মিষ্টি মেয়েকে বিয়ে করেছে ভেবেই তার ভেতর ভেতর আনন্দ হলো।