Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 142



নিভৃত রজনী পর্ব-৪+৫

0

নিভৃত রজনী
| ৪ | (১৩০০+ শব্দ)

চাঁদনী শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল দরজা খুলবে। শরীরে এবং মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে দরজাটা খুলল ও। সাথে সাথেই এক পশলা দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল ওর সর্বাঙ্গ। দরজা খুলে ওপাশের মানুষটাকে দেখে ওখানেই থমকে গেল চাঁদনী।

চোখাচোখি হলো চারটি চোখে। দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির চোখে ক্লান্তি আর বিরক্তি থাকলেও চাঁদনীর চোখে মুগ্ধতা। চাঁদনী খুব করে বুঝতে পারল, কিছু একটা হয়ে গেছে। এই কি তবে সর্বনাশের শুরু?

এভাবে কতক্ষন কেটে গেল কে জানে। বিরক্তি সরে বিষ্ময় ফুটে উঠল দরজার ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটার চেহারায়। প্রথমেই সে প্রশ্ন করল, “আপনি কে?”

চাঁদনী বুঝতে পারল না ঠিক কী উত্তর দেবে। ওর নিজের মনের মধ্যেও তো এই একই প্রশ্ন ঘুরছে “কে লোকটা?”

চাঁদনী আমতা আমতা করে কিছু একটা বলতে যাবে, তার আগেই পিছন থেকে কথা বলে উঠল বাড়ির কাজের মহিলা টুলুর মা।

“আপু, আপনি ঘরে যান। আমি দেখছি।”

হঠাৎ বোধোদয় হলো চাঁদনীর। এতক্ষন কিনা একজন অচেনা অজানা পুরুষের সামনে বেহায়ার মতো তাকিয়ে ছিল। ছিহ! এরকম একটা কাজ ও করল কী করে? দ্রুতপায়ে নিজের রুমের দিকে চলে গেল চাঁদনী। পিছন থেকে ছেলেটি শুধু হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল সেদিকে।

৭.
অ্যালার্মের শব্দে ঘুমঘুম চোখে উঠে বসল নম্রতা। আজ সকাল নয়টায় একটা ক্লাস আছে। সেজন্যই এত জলদি ওঠা। বালিশের নিচে থেকে ফোন বের করে অ্যালার্মটা বন্ধ করল ও। স্ক্রিনে স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, আঠারোটা মিসড কল, টেক্সট ও বেশ কয়েকটা। রোজ রাতে কল আর টেক্সট দিয়ে বিরক্ত করা আতিকের নিত্যদিনের অভ্যাস। আতিকের এই অহেতুক অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য রোজ মোবাইল সাইলেন্ট মোডে রেখে ঘুমাতে হয় নম্রতাকে। কিন্তু আতিক তো এতগুলো কল দেয় না কখনও।

নম্রতা কললিস্টে ঢুকে দেখল আতিকের নাম্বার থেকে আটটা কল এসেছে। আর বাকীগুলো সবই করেছে নওয়াজ। নম্রতা অবাক হলো কিছুটা। ভাবল, নাস্তা করে ভার্সিটি যেতে যেতে কলব্যাক করে নেবে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে দেখল ওর বাবা জামশেদ সাহেব ইতোমধ্যে নাস্তা করতে এসে পড়েছেন। কোনার দিকের একটা চেয়ারে বসে চাঁদনী নামের মেয়েটিও খাচ্ছে। নম্রতা একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “গুড মর্নিং।”

জামশেদ সাহেব প্রতিউত্তরে বললেন, “গুড মর্নিং।”

চাঁদনী চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। নওয়াজ দোতলা থেকে নামল হাই তুলতে তুলতে।

আসলে সপ্তাহের এই একটা দিনই পরিবারের সব সদস্যরা একসাথে সকালের নাস্তা করে। এইদিনে নওয়াজ আর নম্রতা দুজনেরই প্রায় একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতে হয় ভার্সিটির ক্লাস ধরার জন্য। জামশেদ সাহেবকেও ফিক্সড করা উইকলি একটা মিটিংয়ের জন্য জলদি অফিস যেতে হয়।

নওয়াজ নিচে নেমে নম্রতার ঠিক পাশের চেয়ারটাতেই বসল। নম্রতা ওকে দেখে অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “ভাইয়া, তুমি কখন এলে?”

“গতকাল রাতে। এসে আধঘন্টার মত বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাসার সবার হয়েছিল কী কাল? এতবার বেল বাজালাম, অথচ কেউ দরজা খুলল না। তোকে ফোনে অন্তত দশবারের উপরে ট্রাই করেও কোনো রেসপন্স পাইনি। মা নাহয় স্লিপিং পিল নেয় বলে টের পায়নি। কিন্তু তুই টের পেলি না কেন?”

“কানে হেডফোন নিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। তাই মনেহয় কলিংবেল টের পাইনি। আর ফোনটাও সাইলেন্ট মোডে ছিল। এনিওয়ে, দরজাটা শেষপর্যন্ত খুলল কে?”

কেন জানি হুট করে মিথ্যেটাই বলল নওয়াজ, “টুলুর মা খুলেছে।”

খাবার তুলতে গিয়েও চাঁদনীর হাতটা থেমে গেল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। তারপরে আবার খাওয়া শুরু করল ও। গতকাল রাতের ব্যাপারটার জন্য এখনও কিছুটা অপ্রস্তুত লাগছে ওর।

মরিয়ম খাতুন বললেন, “গতকাল সকালে যখন তোর সাথে ফোনে কথা হলো তখন তো বলেছিলি কাল ফিরতে পারবি না। আগে থেকে সব জানা থাকলে টুলুর মাকে জেগে থাকতে বলতাম নাহয়।”

“আসলে হুট করেই আকরামের একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল, তাই ভেবেছিলাম ফেরা হবে না। কিন্তু পরে আবার ডিসিশান চেঞ্জ করেছি।”

“ও।”

মরিয়ম খাতুন ছোট্ট একটা জবাব দিয়ে থেমে গেলেন।

নওয়াজ খেতে খেতে চাঁদনীর দিকে ইশারা করে বলল, “আম্মু, এটা কে?”

চাঁদনী কিছুটা নড়েচড়ে বসল। কেন জানি প্রশ্ন করার ধরনটা খুব একটা ভালো লাগল না ওর। চাইলে আরেকটু সুন্দর ভাবেও জিজ্ঞাসা করা যেত কথাটা। পরিচয়ের প্রথম দিন নম্রতাও ঠিক এরকম তাচ্ছিল্যের সুরেই কথা বলেছিল। বুদ্ধিমতী চাঁদনী বুঝে গেল, এদের সাথে খুব একটা প্র‍য়োজন ছাড়া কথা বলা যাবে না। যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে।

মরিয়ম খাতুন বললেন, “আমার এক আত্মীয়ের মেয়ে। মেডিকেল অ্যাডমিশন কোচিং করতে ঢাকায় এসেছে। কিছুদিন এখানেই থাকবে।”

“ও।” কোনোরকমে উত্তর দিল নওয়াজ।

চাঁদনী সবার আগেই খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল। তারপর নিঃশব্দে প্রস্থান করল ডাইনিং রুম থেকে।

৮.
কোচিং ক্লাসের প্রথম দিন সকাল বেলাতেই এসে হাজির হলো তামজীদ। নম্রতা তখন কেবল ঘুম থেকে উঠে মর্নিং ওয়াকের জন্য বের হবে। ইদানিং একটু বেশিই স্বাস্থ্য সচেতন হয়েছে ও। সেজন্যই মর্নিং ওয়াক শুরু করেছে। যদিও বেশিরভাগ দিন, ঘুমের বিসর্জন দিয়ে হাঁটতে যাওয়া হয়ে ওঠে না। কিন্তু মাঝে মাঝে সব আলস্য ঝেড়ে ও উঠে পড়ে সকাল সকালই।

দোতলা থেকে নামার সময়েই কলিং বেলের শব্দ শুনতে পেল নম্রতা। এগিয়ে এসে দরজা খুলল। লোকটাকে চেনে ও। চাঁদনীর ভাই। কয়েকদিন আগে আরও একবার এসেছিল বাসায়। একবার তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল লোকটা। নম্রতা ভ্রু কুঁচকে ফেলল। এরা সবগুলো ভাই কি একইরকম? সেদিন তানিম লোকটাও কথা বলছিল নিচের দিকে তাকিয়ে। নম্রতা দরজা থেকে সরে বলল, “ভেতরে আসুন।”

তামজীদ ভেতরে এসে বসল। তারপর নম্রতাকে বলল,”আপু, আপনি প্লিজ একটু চাঁদনীকে ডেকে দিন।”

নম্রতা একবার ভাবল টুলুর মাকে বলবে চাঁদনীকে ডেকে দিতে। তারপর মত বদলে নিজেই আবার ডাকতে গেল। মাথা নিচু করে থাকা একটা লোকের সামনে থাকতে অস্বস্তি লাগছে ওর। আর লোকটার সামনে দিয়ে বাইরেও চলে যাওয়া যাবে না। তাহলে আবার মা রেগে যাবে। মেহমানদের সামনে সামান্য অভদ্রতা করলেও রেগে আগুন হয়ে যায় মা।

চাঁদনীর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নম্রতা নক করল। দরজা খুলে ওকে দেখে খানিকটা অবাক হলো চাঁদনী। নরম গলায় প্রশ্ন করল, “আপু, আপনি? কিছু বলবেন?”

চাঁদনীর গেটাপ দেখে নম্রতার প্রচন্ডরকম হাসি পেয়ে গেল। কালো ঢিলেঢালা একটা বোরখায় নিজেকে পা থেকে মাথা অব্দি ঢেকে রেখেছে। শরীরের অবয়ব বোঝার সামান্য উপায়টুকুও নেই। শুধু মুখটা ঢেকে দিলে আপু নাকি আন্টি সেটা বোঝারও উপায় থাকবে না।

নম্রতা বলল, “তোমার ভাই এসেছে। তোমাকে ডাকছে নিচে।”

“এখনই যাচ্ছি। ধন্যবাদ আপু।”

নম্রতা জবাব না দিয়ে ফিরে যেতে পা বাড়াল। তারপর আবার চাঁদনীর দিকে ফিরে বলল, “কোথায় যাচ্ছ, কোচিং-এ? ”

“হ্যাঁ।”

“আমার মনেহয় তোমার কোচিং করাটা উচিৎ হচ্ছে না। বেটার হবে একজন হুজুর দেখে বিয়ে করে ফেলো।”

নম্রতার চেহারায় কৌতুক। বোরখা পড়ার জন্যই যে খোঁচাটা দেওয়া হয়েছে, সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না চাঁদনীর। এই খোঁচার উপযুক্ত জবাবও জানা আছে চাঁদনীর। কিন্তু এই বাড়িতে থেকে নম্রতার সাথে লাগতে যাওয়াটা ঠিক বলে মনে হলো না ওর। মুচকি হেসে পাশ কাটিয়ে গেল চাঁদনী। নম্রতাও সাথে সাথে নেমে এসে বেরিয়ে গেল মর্নিং ওয়াকের জন্য।

চাঁদনী নিচে নেমে দেখল তামজীদকে একপ্রকার জোর করেই নাস্তার টেবিলে বসিয়েছেন মরিয়ম খাতুন। তিনি খাবার এগিয়ে দিতে দিতে তামজীদকে প্রশ্ন করলেন,

“আজ তো চাঁদনীর প্রথম ক্লাস। তুমি নিয়ে যাবে ওকে?”

“জি, আন্টি।”

“কিন্তু তোমার জন্য তো অনেকটা দূর হয়ে যাচ্ছে। এভাবে রোজ যাতায়ত করে আবার কলেজের ক্লাস ধরতে পারবে?”

“না, তা তো পারব না। আপাতত সাত দিনের ছুটি নিয়েছি। এই সাতদিন আমি নেওয়া আনা করব, তারপর সাখাওয়াত ভাই আসবেন। তিনি এসে ব্যবস্থা করে দিয়ে যাবেন সব।”

“কী ব্যবস্থা?”

“সাখাওয়াত ভাই ভেবেছেন একটা গাড়ি কিনে ড্রাইভার ঠিক করে দিয়ে যাবেন। যাতে চাঁদনীর যাতায়তে কোনো সমস্যা না হয়।”

“সেকি। আমাদের বাড়িতেই তো তিন তিনটা গাড়ি। তারপরেও ওর চলাচলের জন্য তোমরা আলাদা করে গাড়ি কিনে কেন পাঠাবে? চাঁদনী আমার বাসায় যেহেতু আছে, ওর সুবিধা অসুবিধা দেখাটা তো আমাদেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বুঝেছি, তোমরা বোধহয় সেভাবে আমাকে ভরসা করতে পারছ না?”

“ছি ছি! কী বলছেন এসব? আপনাকে ভরসা করি বলেই তো আমাদের আদরের বোনটাকে আপনার এখানে রেখেছি। সত্যি বলতে এরকম বিশ্বাসযোগ্য একজনকে না পেলে কখনোই চাঁদনীকে এতদূরে আসতে দিতাম না আমরা।”

“তাহলে তো হয়েই গেল। চাঁদনী এবাড়ির গাড়িতেই যাতায়ত করবে। প্রয়োজনে আমি নিজে কিছুদিন ওর সাথে যাব।”

তামজীদ আর আপত্তি করল না তেমন। মরিয়ম খাতুনকে বিদায় জানিয়ে চাঁদনীকে নিয়ে বের হয়ে এলো।

প্রথমদিনের ক্লাসে খুব একটা খারাপ লাগল না চাঁদনীর। টুকটাক কথা বলে দুই একজন বন্ধুও জুটে গেল। বেশিরভাগই যদিও একেবারে অন্যরকম। কেমন জানি একটা আত্ম-অহংকার আর দাম্ভিকতা ফুটে ওঠে এদের আচার-আচরণ আর কথাবার্তায়। কে জানে, শহরের মানুষগুলো বোধহয় এমনই হয়।

কোচিং থেকে ফেরার পথে তামজীদকে নিয়ে নার্সারিতে গেল চাঁদনী। বেছে বেছে কয়েকটা ফুলের চারা কিনল ব্যালকনিতে লাগানোর জন্য। গতকাল রাতেই ব্যালকনিতে ফুলের চারা লাগানোর জন্য মরিয়ম খাতুনের থেকে পারমিশন নিয়েছিল ও। তিনি সানন্দেই মত দিয়েছেন।

চাঁদনী বাড়ি ফিরে দেখল মরিয়ম খাতুন মালীকে বলে মাটিভর্তি টব ব্যালকনিতে নিয়ে রেখেছেন আগেই। ওর ভালো লাগল খুব। আসার পর থেকে জামশেদ সাহেব, নওয়াজ আর নম্রতার গা-ছাড়া আর অবজ্ঞাসূচক আচরণে কিছুটা হলেও মন খারাপ হয়েছিল ওর। কিন্তু মরিয়ম খাতুন প্রথম থেকেই অত্যন্ত আন্তরিক ওর সাথে।

এই বাড়িতে অন্তত একজন হলেও ওর সাথে একটু ভালো আচরণ করেছে, এটা ভেবেই খুশি লাগল চাঁদনীর। বোরখা পালটে সাথে সাথেই গাছগুলো টবে লাগাতে শুরু করে দিল ও।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ৫ | (১৭২০+ শব্দ)

এই বাড়িতে অন্তত একজন হলেও ওর সাথে একটু ভালো আচরণ করেছে, এটা ভেবেই খুশি লাগল চাঁদনীর। বোরখা পালটে সাথে সাথেই গাছগুলো টবে লাগাতে শুরু করে দিল ও।

মরিয়ম খাতুন পিছনে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলেন প্রাণবন্ত স্বতঃস্ফূর্ত বালিকাটিকে। একটা দীর্ঘশ্বাসও বোধহয় বেরিয়ে এলো তার বুক চিড়ে। তিনিও তো একসময় ঠিক এমনই চঞ্চল ছিলেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে সেসব কোথায় যেন হারিয়ে গেছে।

৯.
ট্যুর থেকে ফেরার পর থেকেই নওয়াজের ব্যস্ততা বেড়ে গেছে। একই অবস্থা ওর অন্য চারজন বন্ধুরও। ওরা পাঁচ বন্ধুই বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর কোর্সে অধ্যয়নরত। আর কয়েকমাস পরেই ওদের ফাইনাল এক্সাম। সেজন্যই ওরা এখন পড়াশোনা নিয়ে প্রচন্ড ব্যস্ত। ফাইনাল এক্সামের প্রিপারেশন নেওয়ার সময় ব্রেইনের উপরে প্রেসার পরে খুব। তাই রিফ্রেশমেন্ট আর রিল্যাক্সের জন্য কিছুদিন আগের ট্যুরটা দিয়েছিল পাঁচজন মিলে। ট্যুর থেকে ফিরেই আবার নিজেদের পুরোনো ফর্মে ফিরে এসেছে সবাই। ওরা সবাই তুখোড় মেধাবী। সেজন্য নিজেদের সর্বোচ্চটাই চেষ্টা করতে চায়।

নওয়াজ আজকাল বাসা থেকে বের হয় না বললেই চলে। পুরোটা সময় নিজেকে ব্যস্ত রাখে বইয়ের পাতায়। নওয়াজের খুব পুরোনো একটা অভ্যাস আছে। খুব বেশি পড়াশোনার চাপ থাকলে ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ মিনিট অন্তর অন্তরই চা অথবা কফি লাগে ওর।

অনান্য দিন টুলুর মা নিজেই সন্ধ্যার পর একফ্লাস্ক চা অথবা কফি করে দিয়ে যায়। অথচ আজ এখন অব্দি কোনো খবর নেই। অনেকক্ষন অপেক্ষা করে শেষে বই হাতে দোতলা থেকে নেমে এলো নওয়াজ। নিচে নেমেই রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ শুনতে পেল। নওয়াজ বইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে গেল সেদিকে। রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ভেতরে না তাকিয়েই প্রশ্ন করল, “কী ব্যাপার টুলুর মা, এখনও আমার রুমে চা দাওনি কেন?”

কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ওপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে চোখ তুলে সামনে তাকাল নওয়াজ এবং তাকিয়েই বেশ বিব্রতবোধ করল। সেদিনের মেয়েটা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কী যেন একটা নাম বলেছিল মা, হুট করেই মনে করতে পারল না নওয়াজ। নাম দিয়ে অবশ্য দরকারও নেই কোনো। নওয়াজ বলল, “স্যরি। আমি ভেবেছিলাম টুলুর মা এখানে। আসলে এই সময়ে রোজ আমার রুমে চা দেওয়া হয়। সেজন্যই এখানে এসেছিলাম। আমি জানতাম না যে তুমি এখানে আছো।”

নিজের কথা শুনে নিজেই অবাক হয়ে গেল নওয়াজ। শেষ কথাটুকু কি কৈফিয়তের মতো শোনাল? কে জানে? নওয়াজ ফিরে যেতে পা বাড়াল। চাঁদনী কথা বলে উঠল, “আসলে আপা মানে টুলুর মা আজ বিকালেই তার দেশের বাড়িতে গেছেন। ওনার বাবা মারা গেছেন তাই। তিনি রোজ সন্ধ্যায় আমাকেও চা করে দেন। আজ তিনি নেই বলে আমি নিজেই এসেছি চা বানাতে। আমি বেশি করেই বানিয়েছি। ফ্লাস্কে রাখা আছে। আপনার প্রয়োজন হলে এখান থেকে নিতে পারেন।”

মেয়েটির সাথে বেশ কয়েকবার দেখা দেখা হলেও ওর কন্ঠস্বর এই প্রথমবার শুনল নওয়াজ। কথা শুনে কিছুটা অবাকও হয়েছে বটে। প্রথম দর্শনে মেয়েটির বাহ্যিক বেশভূষা দেখে যেরকম মনে হয়েছিল তার সাথে আজকের কথা বলার ধরন মিলাতে পারল না মোটেও।

প্রথম যেদিন ওকে নওয়াজ দেখেছিল সেদিন ফুলহাতা ঢোলাঢালা কামিজ ছিল পড়নে, ওরনাটা এমন আঁটসাঁট করে মাথায় এবং শরীরে প্যাচানো ছিল যে একটা চুল অব্দি দেখা যাচ্ছিল না। সেদিন মেয়েটাকে দেখে একেবারেই আনস্মার্ট বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ তার কথার বলার ধরন দেখে কিছুটা হলেও ধারনা বদলাল নওয়াজের। গ্রাম্য মেয়েরা সাধারনত এত সাবলীলভাবে কথা বলতে পারে না অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিত কারও সাথে। কেমন একটা সংকোচ এবং লজ্জাবোধ করে। কিন্তু এই মেয়েটি একদমই তেমন নয়। এমনকি কথায় কোনো গ্রাম্য বা আঞ্চলিক টানও নেই। আরেকটা ব্যাপারও নওয়াজকে বেশ ইমপ্রেস করল। মেয়েটির গলার স্বর৷ এত নীচু স্বরে এর আগে কখনও কাউকে কথা বলতে শোনেনি নওয়াজ। শান্ত নিরিবিলি একটা কন্ঠস্বর। ঠিক যেন গুন গুন করে গান গাইছে কেউ।

মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে এখনও। বোধহয় নওয়াজের উত্তরের অপেক্ষা করছে। নওয়াজ বলল, “আমার তো এককাপ চায়ে হবে না। আমি যদি পুরো ফ্লাস্কটাই নিয়ে যাই, তুমি কি আবার নতুন করে বানাতে পারবে?”

চাঁদনী বলল, “জি, সমস্যা নেই৷ আপনি নিয়ে যান। আমি আবার বানিয়ে নেব।”

“ওকে।”

নওয়াজ নিজেই এগিয়ে এসে ফ্লাস্কটা নিল। দুজনের মধ্যে এক হাতেরও বেশি দুরত্ব। তবুও চাঁদনী অনুভব করল, ও মৃদু কাঁপছে। ব্যাপারটা চোখ এড়াল না নওয়াজেরও। হাসল নওয়াজ। যতই স্বাভাবিকভাবে কথা বলুক, আর পাঁচটা গ্রাম্য মেয়েদের স্বভাবসুলভ বৈশিষ্ট্য কিছুটা এই মেয়েটির মধ্যেও আছে।

নওয়াজ চলে যাওয়ার পর চাঁদনী আবার নতুন করে চা বসাল। তারপর দুটো কাপে চা ঢেলে নিয়ে মরিয়ম খাতুনের রুমের দিকে গেল। তিনি চাঁদনীকে দেখে বললেন, “তুমি চা বানিয়ে নিয়ে এসেছ নাকি? কেন? আমি নিজেইতো এখন যাচ্ছিলাম রান্নাঘরে।”

“আমি বানিয়েছি তো কী হয়েছে? একদিন আমার বানানো চা খেয়ে দেখুন। খুব একটা খারাপ বানাই না আমি।”

চাঁদনী হাসছে। মরিয়ম খাতুন বললেন, “পাগল মেয়ে, আমি কি একবারও বলেছি তুমি খারাপ চা বানাও? আমি তো ভাবছিলাম, তোমার পড়ার ক্ষতি না হয় আবার।”

“কিছুক্ষনের ব্যাপার তো। এতে আর কী এমন ক্ষতি হবে। আপনার সাথে বসে চা-টা শেষ করেই পড়তে যাব।”

মরিয়ম খাতুন হাসলেন। তারপর কী একটা মনে হতেই বললেন, “তুমি বসো। আমার একটু রান্নাঘরে যেতে হবে। আসলে এই সময়টাতে নওয়াজেরও চা লাগে। টুলুর মা তো নেই আজ। আমি গিয়ে চা দিয়ে আসি ওকে।”

“তার দরকার হবে না আন্টি৷ উনি নিজেই নিচে এসেছিলেন চায়ের খোঁজে। আমি ওনাকেও চা করে দিয়েছি।”

মরিয়ম খাতুনের সাথে সময়টা ভালোই কাটল চাঁদনীর। ওখান থেকে রুমে ফিরে দেখল নওয়াজ ওর রুমের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। চাঁদনী থমকে দাঁড়াল। নওয়াজ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাতে এখনও বই। চাঁদনী পাশ কাটিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও পারল না। কারণ নওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে ওর রুমে ঢোকার একেবারে প্রবেশদ্বারেই। শেষে বাধ্য হয়েই প্রশ্ন করল চাঁদনী, “কিছু বলবেন?”

“হ্যাঁ। তোমাকে থ্যাংকস জানাতে এসেছিলাম। তখন এত কষ্ট করে চা বানালে, তাই।”

কথা শেষ করে চাঁদনীর উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে গেল নওয়াজ। চাঁদনী রুমে ঢুকে দরজা আটকে স্বস্তির স্বাস ছাড়ল।

১০.
মধ্যদুপুরের তপ্ত রোদ এখন বাইরে। কিন্তু সেই রোদের সামান্য আঁচটুকুও লাগছে না শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত রেস্টুরেন্টের ভেতরে বসা ছেলেমেয়েদের দলটির গায়ে। ওরা মোট সাতজন। চারজন মেয়ে এবং তিনজন ছেলে। সবাই ঢাকার একটা নামকরা প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ছে। ক্লাস শেষ করে কিছুক্ষন আগেই ওরা এখানে এসেছে। আজ এখানেই লাঞ্চ করবে সবাই।

ওদের মধ্যে একজন হলো রিতিমা, যে তার বার্থডে উপলক্ষে একটা ট্রিটের আয়োজন করেছে আজ। খাবার অর্ডার করে সবাই তুমুল আড্ডায় মেতে আছে এখন। শুধু নিকিতা নামের মেয়েটি কোনায় বসে ফোন স্ক্রল করে যাচ্ছে। নম্রতা ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিল।

“নিকি প্লিজ, সারাক্ষন ফোনটা নিয়ে পড়ে আছিস। আমরা এদিকে কথা বলে যাচ্ছি শুধু। আমাদের সাথে জয়েন কর।”

“মাফ কর ভাই, আমাকে আমার মতো থাকতে দে। তোদের এই বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কিত জটিল আলোচনায় মনোনিবেশ করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”

রিতিমা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “কী নিবেশ! এইসব উইয়ার্ড ওয়ার্ড যে তুই কই খুঁজে পাস!”

নিকিতা হাসল, “সেটাই। বিশুদ্ধ বাংলা তোদের কাছে সবসময়েই উইয়ার্ড।”

ছেলেরা ওদের কথা শুনছে আর মিটমিটিয়ে হাসছে। নম্রতা নিকিতাকে বলল, “তোর মত জিনিস মনেহয় একপিসই আছে। না, ভুল বললাম, আরও একজন এসে জুটেছে আমাদের বাসায়। চাঁদনী না কী যেন নাম।”

কল্লোলকে এবার আগ্রহী মনে হলো। বরাবরই মেয়েদের প্রতি ওর অ্যাট্রাকশন একটু বেশিই। কল্লোল বলল,

“সেটা আবার কে? কিছুদিন আগেও তো গেলাম তোদের বাসায়, তখন তো দেখলাম না”

“কয়েকদিন হয় এসেছে। মায়ের পরিচিত। একেবারে পিওর গাঁইয়া। মন মানসিকতা একেবারে আমাদের নিকিতা ম্যাডামের মতো।”

নিকিতা জানে ওদের কথা বলার ধরনই এমন। ওদের কাছে লাইফ মানে ঘুড়ে বেড়ানো, আড্ডা দেওয়া, এর ওর নামে গসিপ করা, একজনের একাধিক বয়ফ্রেন্ড কিংবা গার্লফ্রেন্ড রাখা। খুব একটা গায়ে মাখল না ও কথাগুলো। হেসে বলল, “তাহলে তো মেয়েটার সাথে একদিন দেখা করতে যেতে হয়।”

নম্রতা আবারও বিরক্ত চোখে তাকাল ওর দিকে। সত্যি এই মেয়েটা ওদের ফ্রেন্ড সার্কেলে একেবারেই বেমানান। কিন্তু তবুও শুরু থেকেই আছে ওদের সাথে। এটারও একমাত্র কারণ বোধহয় নম্রতা। ভার্সিটির একেবারে প্রথম দিনেই নম্রতার পরিচয় হয়েছিল নিকিতার সাথে। কয়েকদিনের মধ্যেই গভীর বন্ধুত্ব হয়ে গেল। তারপর আস্তে আস্তে রিতিমা, মিথিলা, কল্লোল, রাজীব আর রঞ্জনের সাথে পরিচয়। শুধু সবার আগে পরিচয় বলেই যে নম্রতার সাথে ও আছে এমনটাও নয়। মুখে স্বীকার না করলেও কোথাও একটা নিজের সাথেও নিকিতার মিল খুঁজে পায় নম্রতা।

এইযে রিতিমা আর মিথিলার কথাই ধরা যাক না। রিতিমার বর্তমানে বয়ফ্রেন্ড তিনটা। আরও দুজন হ্যাঁ এবং না এর মাঝামাঝি ঝুলে আছে। ওদের সাথে অন্তরঙ্গতা ঠিক কতদূর সেটা ওরা কেউ জানে না।

মিথিলা তো আরও একধাপ এগিয়ে। বেহিসাবি বয়ফ্রেন্ডদের সাথে রিলেশন পাট চুকিয়ে গত মাসেই এনগেজড হয়েছে ওদের মতোই এলিট ক্লাসের এক নামকরা ব্যবসায়ীর সাথে। বছরখানেক পরে বিয়ের ডেটও ফিক্সড হয়ে আছে। কিন্তু গতসপ্তাহেই সে রুমডেট করেছে কল্লোলের সাথে। রঞ্জন নিজেই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে। কল্লোল আর মিথিলা জানে ব্যাপারটা শুধু ওরা দুজন আর রঞ্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু রঞ্জনের কল্যানেই ব্যাপার বাকী চারজনেও জেনে গেছে। কল্লোল নাকি রঞ্জনকে এটাও বলেছে যে এটা মোটেও মিথিলার ফার্স্ট টাইম নয়। কল্লোল এবং মিথিলার অ্যাবসেন্সে এটা নিয়ে একদফা রসালো গসিপও হয়ে গেছে ওদের মধ্যে।

নিকিতা সেদিনের নোংরা আড্ডা শেষ হওয়ার আগেই উঠে পড়েছিল। সম্ভবত ওদের ওই রুমডেট সম্পর্কিত আলোচনায় থাকতে চাচ্ছিল না। নম্রতা উঠে না গেলেও মেনে নিতে পারছিল না এসব। অন্যরা ব্যাপারটাকে খুব স্বাভাবিকভাবে নিলেও নম্রতার পুরোটা নোংরামি ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি। ওদের মতো তথাকথিত রিলেশনেও কখনও যেতে পারেনি নম্রতা। অনেকগুলো প্রপোজাল পেয়েও এগোতে পারেনি সামনে। নিকিতারও একই অবস্থা।

টেবিলে খাবার আসার সাথে সাথে ওদের গসিপ থামল কিছুক্ষনের জন্য। রিতিমা চিকেন ফ্রাইয়ে কামড় দিতে দিতে হঠাৎ প্রশ্ন করল নম্রতাকে, “আতিককে নিয়ে কিছু ভেবেছিস?”

নম্রতা পালটা প্রশ্ন ছুড়ল, “হঠাৎ আতিকের কথা এলো কেন?”

“সেই কবে থেকে তোর পিছনে পড়ে আছে। এবার অন্তত হ্যাঁ বলে দে।”

“তোদের অনেকবার বলেছি, আমি ঠিক যেমনটা চাই, ও সেরকম নয়। তাই হ্যাঁ বলার প্রশ্নই আসে না।”

“রিডিকিউলাস। এই একই কথা শুনতে শুনতে কান পঁচে যাচ্ছে আমার। তুই আসলে ঠিক কেমন চাইছিস?”

“বাদ দে। তোদের সারাদিন বললেও তোরা বুঝবি না। শুধু এতটুকু বলি, আতিকের মধ্যে কোনো আত্মসম্মানবোধ নেই। বারবার রিজেক্ট করার পরেও আবার হ্যাংলামি করতে আসে। তাছাড়া কেমন একটা দাসত্ব প্রবৃত্তিও আছে ওর মধ্যে৷ এরকম মেরুদন্ডহীন ছেলেকে লাইফ পার্টনার হিসেবে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে একদমই সম্ভব না।”

“লাইফ পার্টনার করা বা না করাটা তো পরের ব্যাপার। তোকে তো আর এখনই কেউ বিয়ে করতে বলছে না। আপাতত রিলেশনে যা। বিয়ের ডিসিশান তো পরেও নেওয়া যাবে।”

“স্ট্রেঞ্জ! আমি যদি আগেই বুঝতে পারি যে সে আমার জন্য পারফেক্ট ম্যাচ নয়, তাহলে তার সাথে রিলেশনে যাব কেন?”

“ওহ, কাম অন নম্র। তুই অন্তত আমাদের টিপিক্যাল নিকিতার মতো কথা বলিস না। বিয়ে করবি না বলে রিলেশনে যাওয়া যাবে না, এমন কোনো কথা নেই। হাজবেন্ডের জন্য তো সারাজীবন পড়েই আছে। নিজের জন্য অন্তত একটা রিলেশনে যাওয়া উচিৎ। ইটস অল অ্যাবাউট এনজয়মেন্ট, ডিয়ার। এই বোরিং লাইফ থেকে বেরিয়ে থ্রিলিং কিছু কর এবার।”

নম্রতার মেজাজটা এবার বেশিই খারাপ হলো। একমাত্র নিজের পরিবার ছাড়া বাইরের কেউ নিজের সিদ্ধান্ত ওর উপর চাপিয়ে দিতে চাইলেই ওর রাগ উঠে যায়। রিতিমা যেন ইদানিং সেই কাজটাই করতে চাইছে খুব৷ আতিকের প্রতি ওর কোনো ইন্টারেস্ট না থাকা সত্ত্বেও বারবার ওর সাথেই রিলেশনে যেতে ইনসিস্ট করছে। নম্রতা তাই আর মেজাজ ধরে রাখতে পারল না।

“দেখ রিতি, প্রত্যেকটা মানুষই নিজের মতো করে ডিফ্রেন্ট অ্যাঙ্গেলে লাইফটাকে দেখে। তাই তোর কাছে যেটাকে এনজয়মেন্ট কিংবা থ্রিল বলে মনে হচ্ছে, আমার কাছে সেটা শুধুই ওয়েস্ট অভ টাইম। এখন তুই নিজে চৌদ্দটা বয়ফ্রেন্ড রাখতেই পারিস চাইলে, কিন্তু আমাকে এসব বিষয়ে ইনভলভ করিস না প্লিজ।”

নম্রতার কাটাকাটা কথায় অপমানে রিতিমার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। হঠাৎই সবার মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন। শুধু নিকিতা চামচ দিয়ে ফ্রাইড রাইস নাড়তে নাড়তে মুচকি হাসল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-২+৩

0

নিভৃত রজনী
| ২ | (১৩৬০+ শব্দ)

তানিমের শিরা উপশিরা তখন দপদপ করছিল রাগে। ও আরেকবার পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো।

অনেকক্ষন বাইরে কাটিয়ে তানিম যখন বাসায় ফিরল তখন সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। দুপুরে খাবার টেবিলে আবার দেখা হলো মেয়েটির সাথে। এবার বিস্তারিত জানা গেল তার সম্পর্কে।

মরিয়ম খাতুনের মেয়ে। নাম নম্রতা।

মরিয়ম খাতুন ওদের তিন ভাইবোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন নম্রতাকে। এবার শান্ত মেজাজেই সালাম দিল নম্রতা। সাখাওয়াত সালামের জবাব দিল। চাঁদনীও সৌজন্য রক্ষার্থে দুএকটা কথা বলল। কিন্তু তানিম একবারের জন্য চোখ তুলেও তাকাল না।

দুপুরে খাওয়ার পরে কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে গ্রামে ফেরার প্রস্তুতি নিল ওরা। যাওয়ার আগে তানিম এককোনে ডেকে নিল চাঁদনীকে। সাখাওয়াত যাতে শুনতে না পায় সেরকম নিচু গলায় বলল, “মরিয়ম আন্টির মেয়েটা কোন রুমে থাকে সেটা দুই মিনিটের মধ্যে খোঁজ নিয়ে জানা আমাকে।”

তানিমের কথা শুনে চাঁদনী অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ভাইয়ের মুখের দিকে। অপরিচিত একটা মেয়ের রুমের হদিস চাইছে তার তানিম ভাই, এটা ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিল না। তানিম বলল, “এভাবে না তাকিয়ে জলদি যা বলছি কর। আমার হাতে বেশি সময় নেই। তোকে পরে সব বিস্তারিত বলব।”

চাঁদনী বলল, “খোঁজ নিতে হবে না। দোতলায় ডানদিকের প্রথম রুমটাতেই থাকে আপুটা। ওই রুম থেকেই কয়েকবার বের হতে দেখেছি ওনাকে।”

তানিম বিছানার পাশে রাখা ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে সোজা দোতলার দিকে চলে গেল। কাঙ্ক্ষিত দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মধ্যমা এবং তর্জনী আঙুলের উলটো পিঠ দিয়ে আলতো করে টোকা দিল দরজায়। তারপর ব্যাগটা দরজার ঠিক সামনে রেখেই নিচে নেমে এলো। মরিয়ম খাতুনের থেকে বিদায় নিয়ে সাখাওয়াতকে নিয়ে বেরিয়ে এলো ওবাড়ি থেকে।

৩.
সার্কেলের কিছু ফ্রেন্ডদের সাথে কথা কাটাকাটির জন্য গতকাল রাত থেকেই নম্রতার মেজাজের পারদ চড়ে ছিল। আজ সকালে সেটা আরও একধাপ বেড়ে গেল। মর্নিং ওয়াক থেকে ফেরার পথেই ধাক্কা লাগল লোকটার সাথে। মুখে মিষ্টি কথা বললেও আসলে বদের হাড্ডি একটা। ও নাহয় মোবাইলের দিকে তাকিয়ে ছিল বলে সামনের কিছু লক্ষ করেনি, কিন্তু সে তো দেখেশুনেই আসছিল। ইচ্ছে করেই আসলে ধাক্কাটা দিয়েছে বদ লোকটা। ধাক্কা দিয়ে আবার কী সুন্দর করে ক্ষমা চাওয়ার নাটকও করল।

অনেক চেষ্টার পর মেজাজটা একটু ঠান্ডা করে দুপুরে ডাইনিং রুমে গিয়েছিল লাঞ্চ করতে। বদমাইশ লোকটা সেখানেও হাজির। পরে মায়ের কাছে থেকে পরিচয় জানা গেল।

লোকটা বিকেলে নাকি চলে যাবে, এটা শোনার পরেই রুমে এসে দরজা লক করে দিয়েছে নম্রতা। ক্যারেকটারলেসটা না যাওয়া অব্দি আর দরজাই খুলবে না ও। কিন্তু রুমের মধ্যে একা সময় কাটছে না ওর। অন্যসময় হলে এতক্ষনে বন্ধুদের সাথে ভার্চুয়াল আড্ডায় মেতে ওঠা যেত, কিন্তু ফোনটাও সেই সকাল থেকে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। না, আজকেই একটা নতুন ফোন নিতে হবে।

নম্রতা রেডি হয়ে নিল। আগে রিতিমাদের বাসায় যেতে হবে, ওখান থেকেই সোজা শপিংমলে যাওয়া যাবে। রেডি হয়ে বেডসাইড টেবিলের ড্রয়ার থেকে ক্রেডিট কার্ডটা বের করতে যাবে, ঠিক তখনই দরজায় মৃদু শব্দ হলো। নম্রতা থমকে গেল কিছুক্ষনের জন্য। এভাবে কে নক করছে দরজায়। এত আস্তে তো এবাড়ির কেউ কখনও নক করে না। তবে কি আজকের গেস্টদের কেউ? তারাই বা কেন নক করবে?

নম্রতা গিয়ে দরজা খুলল। আশ্চর্য! কেউ নেই দরজার ওপাশে। শুধু ব্রাউন পেপারের ছোট্ট একটা শপিং ব্যাগ পড়ে আছে দরজার সামনে। দ্বিধান্বিত নম্রতা প্যাকেট নিয়ে রুমের মধ্যে এলো আবার। ব্যাগ খুলে ভিতরের বক্সটা বের করেই চমকে উঠল। একটা নতুন মোবাইলের বক্স। বক্সের ভেতর থেকে মোবাইলটা বের করল নম্রতা। আজ সকালে যেই মোবাইলটা নষ্ট হয়েছে হুবহু সেই মোবাইলটাই। এমনকি কালারটাও এক। নম্রতার বুঝতে অসুবিধা হলো না, কাজটা কে করেছে। মোবাইলের বক্সটা ব্যাগের মধ্যে রাখতে গিয়ে আরও একটা জিনিস নজরে এলো ওর। ভাঁজ করা একটা কাগজ। খুলে দেখল সেটা একটা চিঠি আসলে।

পড়তে শুরু করল ও,

“আশা করি চিনতে পেরেছেন। ক্ষতিপূরণ দিয়ে গেলাম। যদিও আপনিও সমান দোষী ছিলেন, তারপরেও ক্ষতিপূরণ পুরোটাই আমি দিলাম। আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ফোনটার দাম জানি কিনা আমি। আপনাকে আজ বলি, এরকম দামি একশোটা ফোন কেনার সামর্থ্য তানিম তালুকদারের আছে আলহামদুলিল্লাহ।

আর একটা কথা, চিঠিটা সম্মোধনহীন শুরু করেছি। কারন আমার মনে হয়েছে আপনার নামটা আপনার স্বভাবের সাথে ঠিক যায় না। ঘরে আসা অতিথিদের সাথে প্রথম দেখাতেই যে দুর্ব্যবহার করে তার নাম নম্রতা না রেখে রাখা উচিৎ ‘অসভ্যতা।’

অথবা প্রথম দেখাতে আমার সম্পর্কে কিছু না জেনেই এই যে আপনি বললেন, আমি মেয়ে দেখলেই স্পর্শ করতে চাই, আপনার এই নোংরা চিন্তাভাবনার জন্য নম্রতা না ডেকে আপনাকে ‘নর্দমা’ বলেও ডাকা যায়।

যাই হোক, নামের পোস্টমর্টেমে আর না যাই। ভালো থাকুন।
আল্লাহ হাফেজ।”

চিঠি পড়া শেষ করে নম্রতা ফণা তোলা বিষধর সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে উঠল। চিঠিটা দুমড়ে মুচড়ে রুমের এককোনে ছুঁড়ে মেরে দৌড়ে নিচে নামল। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে নামল সেটায় আর সফল হতে পারল না।

মরিয়ম খাতুন জানালেন সাখাওয়াত এবং তানিম কিছুক্ষন আগেই বিদায় নিয়ে বের হয়ে গেছে বাসা থেকে৷ নম্রতা সাথে সাথেই আবার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। নিজের রুমে গিয়ে মোবাইলটাকে হাতে নিল ফ্লোরে আছাড় মারার জন্য। হাত উঁঁচু করেও কী একটা মনে করে থেমে গেল আবার। তারপর খুব যত্ন করে মোবাইলটাকে আবার প্যাকেট করল, চিঠিটাও তুলে এনে আবার সুন্দর করে ভাজ করল। তারপর সব আগের মতোই ব্যাগে ভরে আলমারির একটা তাকে সযত্নে তুলে রাখল।

বোনকে যেহেতু এখানে রেখে গেছে, আজ হোক বা কাল আবার দেখা হবেই। আজকের এই অপমানের জবাব সেদিন কড়ায় গন্ডায় বুঝিয়ে দেবে অসভ্য লোকটাকে। ইন ফিউচার দেখা হলে লোকটাকে ঠিক কীভাবে উচিত শিক্ষা দেবে তার একটা নীল নকশা তৈরির জন্য এখনই ভাবতে বসে গেল নম্রতা। অথচ নিজেকে বুদ্ধিমতী বলে দাবি করা বোকা মেয়েটা বুঝতেও পারল না, একদিন এই তীব্র ঘৃণা জমতে জমতে রূপ নেবে সমুদ্রসমান ভালোবাসায়। যেই স্পর্শের জন্য আজ তাকে অযৌক্তিক অপমান করল, সেই স্পর্শ পাওয়ার জন্য দিনরাত তড়পাতে হবে ওকে। দিনের পর দিন একঘরে থাকার পরেও সেই অসভ্য লোকটা ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না।

৪.
নতুন জায়গায় প্রথম রাত চাঁদনীর খুব একটা খারাপ কাটল না। তবে সকালটা তেমন পছন্দ হলো না ওর। সাধারনত ওর সকাল শুরু হয় পাখির ডাক শুনে। ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে রুমের সাথে লাগোয়া খোলা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেই চোখে পড়ে বিশাল ফুলের বাগান। মোট চার শতাংশ জায়গার উপর তৈরি করা এই ফুলের বাগানটি শুধুই চাঁদনীর। ভাইয়েরা বিভিন্ন জায়গা থেকে নানা রকম ফুলের চারা এনে দেয়। চাঁদনী সেগুলো নিজ হাতে রোপণ করে, পরিচর্যা করে সেগুলোর। চাঁদনীর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য।

কিন্তু এখন এসবই অতীত। নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে সবকিছু ফেলে চাঁদনীকে চলে আসতে হয়েছে। ফজরের নামাজ পড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে প্রচন্ড হতাশ হলো ও। রাস্তার ওপারে উঁচু উঁচু দালান ছাড়া আর কিছুই নেই। শুধু একটা বাড়ির গেটের দুইপাশে দুইটা বাগানবিলাস দেখা যাচ্ছে। এদিকটায় অবশ্য লোকজনের কোলাহল নেই তেমন। একেবারে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন চারদিক। মাঝে মাঝে দুই একটা গাড়ি যাওয়া আসা করছে রাস্তা দিয়ে।

চাঁদনী রাস্তা থেকে চোখ সরিয়ে আবার ব্যালকনির দিকে তাকাল। এতবড় ব্যালকনি অথচ একেবারেই খালি। একটা গাছের টব অব্দি নেই। পুরো বাড়িতে এখনও সুনসান নীরবতা? প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে চাঁদনী বিছানায় এসে বসল। সময় যেন কাটতেই চাইছে না। আচ্ছা, একবার মরিয়ম আন্টির কাছে গিয়ে দেখবে। না থাক, যদি বিরক্ত হয়। এরা বোধহয় আরও দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে। তারচেয়ে বরং ছাদে যাওয়া যাক। মরিয়ম আন্টি তো বলেছিলেন, বোরিং লাগলে চাঁদনী ছাদে গিয়েও সময় কাটাতে পারে। বিছানার পাশ থেকে ওড়নাটা নিয়ে সুন্দরভাবে মাথায় ও গায়ে পেঁচিয়ে নিল ও। তারপর রওয়ানা হলো ছাদের দিকে। ছাদে রোদ এসে পড়তে শুরু করেছে কেবল, গরম ও লাগছে বেশ। একটু ছায়ার জন্য আশেপাশে তাকাল ও।

পাশেই একটা ছাউনি। সেখানে চেয়ার টেবিল সবই আছে। সেখানের একটা চেয়ারে বসে ছিলেন মরিয়ম খাতুন। চাঁদনীকে তিনিই দেখলেন প্রথম। দেখে ডাক দিলেন, “আরে চাঁদনী, এদিকে এসো।”

চাঁদনী এগিয়ে গেল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছ কেন?”

“এত সকাল তো নয়, মে মাসের সকাল সাতটা মানে অনেক বেলা। আমারতো আরও সকালে ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস।”

“যাক, একজন অন্তত পাওয়া গেল আমার মতো। এবাড়িতে সকাল দশটার আগে কেউ ঘুম থেকে ওঠে না। শুধু ভার্সিটি বা অফিসের তাড়া থাকলে সেদিনই ভোরে ঘুম থেকে ওঠে এরা।”

চাঁদনী বলল, “আমাদের বাড়িতে সবাই খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে। সকাল সাতটার মধ্যে সবাই নাস্তার টেবিলে এসে যায়। বাবা সবসময় বলে, ফজরের নামাজ আদায় না করে দিন শুরু করলে সেই দিন কখনও ভালো কাটতে পারে না।”

“ঠিকই বলেন তোমার বাবা। এবাড়িতে শুধু আমি আর টুলুর মা ফজরের ওয়াক্তে ঘুম থেকে উঠি। আমি নামাজ পড়ে কোরআন তেলাওয়াত করে কিছুক্ষন ছাদে এসে হাঁটাহাঁটি করি। তারপর নিচে গিয়ে দৈনন্দিন কাজগুলো শুরু করি।

ভালো কথা, তোমার অ্যাডমিশন কোচিং-এ ভর্তির কী হলো?”

“আগামীকাল তামজীদ ভাই আসবে। সে নিয়ে যাবে ভর্তি করাতে।”

“কাল থেকে তাহলে নতুন জার্নি শুরু।”

“হ্যাঁ।”

“ও, এখন তাহলে নিচে যাই। অনেক ভোরে উঠেছ, ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই এখন। নাস্তা করে নেবে চলো।”

সারাদিন চাঁদনীর সময় কাটল মরিয়ম খাতুনের সাথে টুকটাক গল্প করে আর তানিম ভাইয়ের কিনে দেওয়া স্মার্টফোনটি ঘাটাঘাটি করে।

এত দিন চাঁদনীর কোনো স্মার্টফোন ছিল না। আসলে খুব একটা দরকারও ছিল না সেটার৷ কিন্তু এখন ঢাকায় থাকা হবে বলে গতকাল তানিম নিজেই ফোনটা কিনে দিয়ে গেছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ৩ | (১২৬০+ শব্দ) [প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা]

এত দিন চাঁদনীর কোনো স্মার্টফোন ছিল না। আসলে খুব একটা দরকারও ছিল না সেটার৷ কিন্তু এখন ঢাকায় থাকা হবে বলে গতকাল তানিম নিজেই ফোনটা কিনে দিয়ে গেছে।

এবাড়িতে সারাদিনই কেমন একটা দমবন্ধ করা পরিবেশ থাকে। চাঁদনীদের বাড়ির মতো কোলাহল নেই। কথাও মেপে বলে সবাই।

সকালে দেখা হলো মরিয়ম আন্টির হাজবেন্ড জামশেদ আঙ্কেলের সাথে। চাঁদনী সালাম দিল। সে শুধু সালামের জবাবটুকু দিল রোবটের মতো। তারপর নাস্তা করে বের হয়ে গেল বাসা থেকে। নম্রতা অবশ্য টুকটাক কিছু কথা বলেছিল। তবে চাঁদনী খুব একটা কম্ফোর্ট ফিল করেনি তাতে৷ কেমন জানি একটা তাচ্ছিল্য ছিল কন্ঠে। যেন দায়সারা কথা বলছে সে। দুই একটা প্রশ্ন করে সেও উঠে রুমে চলে গেল। শহরের মানুষগুলো বোধহয় এরকমই হয়। অথচ চাঁদনীদের বাড়িতে কোনো অতিথি গেলে তাকে মাথায় তুলে রাখা হয়। অতিথিটির কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা সেই খেয়াল রাখে বাড়ির সবাই মিলে।

মরিয়ম আন্টি অবশ্য সকাল থেকে যথেষ্ট খেয়াল রেখেছেন। বিকালে ওর সাথে বসে গল্পও করেছেন অনেকক্ষন। হলুদিয়া এবং তার গ্রামের গল্প। চাঁদনীদের বাড়ির গল্প। নিজের পরিবারের গল্প। একে একে সবই বললেন চাঁদনীকে। কথোপকথনের একপর্যায়ে চাঁদনী জিজ্ঞাসা করল, “নম্রতা আপু শুধু একাই? তার আর কোনো ভাইবোন নেই?”

মরিয়ম খাতুন হেসে বললেন, “আছে তো। ওরা দুই ভাইবোন। প্রথমেই আমার ছেলে নওয়াজ, তারপরে নম্রতা। নওয়াজ এখন ঢাকার বাইরে আছে, বন্ধুদের সাথে ট্যুরে গিয়েছে। কাল অথবা পরশুর মধ্যে চলে আসবে।”

চাঁদনী ছোট্ট করে বলল, “ও।”

৫.
বিলাসবহুল একটি রিসোর্ট। রিসোর্ট এর সামনের দিকে আছে সুইমিংপুল। সেই সুইমিংপুলের সামনেই বসে আছে চারটি ছেলে। সবার সাথেই ব্যাগপত্র। ওরা সবাই ঢাকা থেকে এখানে এসেছিল ছয়দিন আগে। আজ ওদের ফিরে যাওয়ার কথা ছিল। রিসোর্ট থেকে চেক আউট করাও হয়ে গেছে। কিন্তু ওরা এখনও রওয়ানা দিতেই পারেনি। না যেতে পারার অবশ্য বিশেষ একটি কারণও রয়েছে।

ওরা মোট পাঁচজন এসেছিল এখানে। গতকাল রাতেই একজন বলল, সে রাতে রিসোর্টে থাকবে না। কোথাও একটা যাবে৷ তবে সকালে ফেরার সময় সবার সাথে এসে জয়েন করবে। সেই একজন এখনও এসে পোঁছায়নি। এমনকি তাকে ফোনেও ট্রেস করা যাচ্ছে না এখন। বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে গেছে ওরা। একইসাথে বন্ধুটির জন্য কিছুটা চিন্তিতও।

আবির বলল, “শালাকে কাল বারবার করে বললাম, সাথে অন্তত একজনকে নিয়ে যা। কথাই শুনল না। এখন কোথায় গিয়ে যে মরেছে কে জানে।”

নওয়াজ বলল, “কোনো কারণে দেরি হতেই পারে, কিন্তু সেটা কন্টাক্ট করে জানাবে তো আমাদের। অযথা টেনশন নিতে হয় না তাহলে আর।”

ফাহিম এতক্ষন অস্থির ভঙ্গিতে ফোন হাতে নিয়ে পায়চারি করছিল। এবার সে হাঁটা থামিয়ে বলল, “সেই কখন থেকে ট্রাই করে যাচ্ছি, এখনও নট রিচেবল।”

মিশকাতের মুখের ভাষায় কখনোই লাগাম ছিল না। সে বলে উঠল, “দেখ গিয়ে, সারারাত মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে এখন মটকা মেরে ঘুমাচ্ছে। কাল রাতেই সন্দেহ হইছিল আমার, শুয়ো**টা নতুন কোনো মাল পাইছে। এই হ্যাবিট ওর জীবনেও যাবে না। শালা আস্ত একটা মা**বাজ।”

আবির বলল, “রাইট। আমিও এটাই ভাবছিলাম। দুনিয়া উলটে গেলেও আকরাম নারীসঙ্গ ছাড়তে পারবে না।”

ফাহিম বলল, “থাম তোরা, এইবার সব জানা যাবে। ওইযে স্যার আসছেন গাড়ি নিয়ে।”

ওর কথায় সবাই প্রবেশদ্বারের দিকে তাকাল। সত্যিই আকরাম আসছে। আকরাম আসার দুমিনিটের মধ্যেই ওরা রওয়ানা হয়ে গেল ঢাকার উদ্দেশ্যে। সবার প্যাকিং করাই ছিল। আকরামের দেরি দেখে ওর ব্যাগও গুছিয়ে নিয়েছিল বন্ধুরা মিলে। তাই আর তেমন কোনো সমস্যা হলো না। এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে অনেকটা। গাড়িতে যেতে যেতেই নাহয় আকরামের দেরি হওয়ার কারন জানা যাবে।

এখন ড্রাইভিং করছে নওয়াজ। তার পাশেই বসে আছে ফাহিম। পিছনের সিটে বসেছে যথাক্রমে আবির, মিশকাত আর আকরাম।

মিশকাত আকরামের শরীরের কাছে নাক নিয়ে শুঁকে বলল, “লেডিস পারফিউমের গন্ধ পাচ্ছি বডি থেকে। সত্যি করে বল, কাল রাতে কোথায় ছিলি।”

আকরাম জবাব না দিয়ে হাসল।

মিশকাত বলল, “হাসিস না বা*। যা জিজ্ঞাসা করছি জবাব দে। কাল রাতে কোথায় ছিলি? ফিরতে এর দেরি হলো কেন?”

আকরাম হাই তুলে বলল, “কাল রাতে লাখির সাথে ছিলাম।”

ফাহিম আর মিশকাত প্রায় একসাথেই চেঁচিয়ে উঠল, “কী!”

মিশকাত বলল, “লাখি, মানে ওই রাখাইন মেয়েটা? গত কয়েকদিন ধরে যাকে লাইন মারছিস?”

“হ্যাঁ।”

“ধুর, হু হা করিস না। ডিটেইলে বল।”

“কয়েকদিন ধরেই ভুজুংভাজুং দিয়ে পটিয়েছিলাম। কাল ভাবলাম, আজ তো চলেই যাব, দেখি যাওয়ার আগে কিছু করা যায় নাকি। সেজন্যই কাল ইমোশোনাল ড্রামা করলাম একটু। বললাম, ঢাকায় গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বাবা মাকে নিয়ে আবার আসব ওর কাছে। অনেক চেষ্টার পর রাজি হয়ে গেল৷

এখান থেকে কিছুদূর এগিয়ে সস্তার একটা হোটেল আছে। ওখানেই ওকে নিয়ে উঠলাম রাতে। অনেক দেরি করে ঘুমিয়েছি বলে সকালে উঠতেও দেরি হয়েছে। উঠে দেখি মোবাইলেও চার্জ নেই। সাথে সাথেই রওয়ানা দিলাম।”

“আসল কথায় আয়, তারমানে কাল রাতে ওই মেয়েটার সাথে ছিলি? ফাইনাল টাস্ক হয়ে গেছে তার মানে?”

আকরাম বিজয়ের হাসি হাসল।

নওয়াজ এতক্ষন চুপচাপ ওদের কথা শুনে যাচ্ছিল। এবার ও বলল,

“তারমানে মেয়েটার কনসেন্ট ছাড়াই তুই ওর সাথে ইন্টিমেট হয়েছিস।”

“আশ্চর্য! আমি কি জোর করেছি নাকি? ওর কনসেন্ট নিয়েই হয়েছে সব।”

“কিন্তু সেটা মিথ্যের মাধ্যমে। এরজন্য পরে যদি মেয়েটাকে ভুগতে হয়, তার দায়ভার কে নেবে?”

“ভুগতে হবে না। প্রোটেকশন নিয়েই করেছি সব। তারপরেও যদি কোনো সমস্যা হয়, তার দায়ভার ওর। ভুলও সব ওর। মাত্র ছয়দিনের পরিচয়ে যদি একটা অপরিচিত ছেলের সাথে ও বিছানা পর্যন্ত চলে যেতে পারে, তাতে আমার কী করার আছে?”

ফাহিম দেখল, নওয়াজের ঘাড়ের পাশের রগ ফুলে উঠতে শুরু করেছে। প্রত্যেকবার রেগে যাওয়ার আগে এমনটা হয়৷ আর একবার রেগে গেলে তুলকালাম বাঁধিয়ে দেবে নওয়াজ। আসন্ন বিপদের সম্ভাবনা অনুধাবন করে ফাহিম কথা ঘোরাতে বলল, “আচ্ছা বুঝলাম, তুই খুব ব্যস্ত ছিলি কাল। সকালে সেটা একবার অন্তত ফোন করে জানানো উচিৎ ছিল। আমরা এদিকে টেনশনে শেষ।”

“বললাম তো, ফোনে চার্জ ছিল না।”

“তোর ফোনে নাহয় চার্জ ছিল না, অন্য কারও ফোন থেকে অন্তত জানানো উচিৎ ছিল। হোটেল থেকেই নাহয় একটা কল করতি।”

“নাম্বার কোথায় পেতাম? সব তো ফোনে সেভ করা, আর ফোন তো বন্ধ।”

ফাহিম বিস্ময়ের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল।

“মানে? গত চার পাঁচ বছরে তুই আমাদের একজনের একটা কন্টাক্ট নাম্বারও মুখস্ত করতে পারিসনি?”

“স্ট্রেঞ্জ! দরকার হয় না তাই মুখস্ত করিনি। এতে এত রিয়্যাক্ট করার কী আছে?”

আকরামের নির্লিপ্ত উত্তরে ফাহিম থেমে গেল। বাকীরাও চুপ হয়ে গেছে। গাড়ি চলছে। মিউজিক প্লেয়ারে বেজে যাচ্ছে লিঙ্কিন পার্কের গান, ব্যাটল সিম্ফনি।

৬.
রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে একটা উপন্যাস নিয়ে বসে গেল চাঁদনী। অ্যাডমিশনের পড়া এখনও সেভাবে শুরু হয়নি। আজ তামজীদের সাথে গিয়ে ভর্তি হয়ে এসেছে ও। ক্লাস শুরু হবে আরও তিন দিন পরে। সেজন্যই এখনও কিছুটা চাপমুক্ত আছে চাঁদনী। পড়তে পড়তে একসময় পুরোপুরিই বইয়ের পাতায় ডুবে গেল ও।

দরজা কিছুটা খোলাই ছিল, তবুও মরিয়ম খাতুন এসে নক করলেন দরজায়। মনোযোগ বইয়ের পাতায় ছিল বলেই হঠাৎ শব্দে চমকে উঠল চাঁদনী। দরজার দিকে তাকিয়ে বলল, “আরে আন্টি, আপনি?”

“হ্যাঁ। খাওয়ার টেবিলে জিজ্ঞাসা করতে মনে ছিল না, তাই এখন এলাম। রাতে একা ঘুমাতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাতো? তাহলে আমাকে বলতে পার।”

“না আন্টি, একদমই অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি বসুন না।”

“না, এখন আর বসব না তাহলে। আসলে ইনসমনিয়ার জন্য স্লিপিং পিল নেই মাঝেমধ্যে। আজও নিয়েছি। এখন গিয়ে তাই ঘুমিয়ে পড়তে হবে৷ আসছি তাহলে। তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো।”

মরিয়ম খাতুন চলে গেলেন। চাঁদনী আবার ডুবে গেল বইয়ের পাতায়, তারপর দ্বিতীয়বারের মত চমকাল আবার। না, আর কেউ ওর রুমের দরজায় নক করেনি। তবে বাসার মেইন দরজার বাইরে কলিংবেল দিচ্ছে কেউ।

ঘড়ির দিকে তাকাল চাঁদনী। রাত এগারোটা ছত্রিশ। কে না কে এসেছে। আগ বাড়িয়ে দরজা খুলতে যাওয়া নিশ্চই ঠিক হবে না। চাঁদনী নিজের কাজে মনোযোগ দিল, তবে সেই মনোযোগ ধরে রাখতে পারল না। কারন অনবরত কলিং বেল বেজেই চলেছে। কী ব্যাপার? কেউ খুলছে না কেন দরজাটা? মরিয়ম আন্টি নাহয় স্লিপিং পিল খেয়ে ঘুমিয়েছে কিন্তু বাকীরা কী করছে? আন্টির মেয়েটাও কি ঘুমাচ্ছে? এবাড়িতে একজন ত্রিশ বত্রিশ বছর বয়সী কাজের মহিলাও আছে, তার তো অন্তত উঠে গিয়ে দরজাটা খোলা উচিৎ।

একটানা অনেকক্ষন কলিং বেল বেজে যাওয়ার পর একপ্রকার বাধ্য হয়েই চাঁদনীকে নামতে হলো। দরজার সামনে গিয়েও আবার থেমে গেল চাঁদনী। আচ্ছা, বোকার মতো এত রাতে ও দরজাই বা খুলতে যাচ্ছে কেন? চোর ডাকাতও তো হতে পারে। চাঁদনী আবার ওর নিজের রুমের দিকে পা পাড়াল। দরজার ওপাশের আগন্তুক তখন আরও বেশি অস্থির। আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে বাজিয়ে চলেছে বেল।

চাঁদনী শেষমেষ সিদ্ধান্ত নিল দরজা খুলবে। শরীরে এবং মাথায় ভালো করে ওড়না পেঁচিয়ে দরজাটা খুলল ও। সাথে সাথেই এক পশলা দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল ওর সর্বাঙ্গ। দরজা খুলে ওপাশের মানুষটাকে দেখে ওখানেই থমকে গেল চাঁদনী।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-০১

0

নিভৃত রজনী
| ১ | (প্রারম্ভিকা) (১৬০০+ শব্দ)

১.

গ্রামের নাম হলুদিয়া। সেই গ্রামের গা ঘেসেই বয়ে চলেছে ছোট্ট একটা নদী। পাখির কলতান আর নদীর কলকল ধ্বনিতে মুখরিত গ্রামটিতে আধুনিকতার ছোঁয়া এখনও তেমনভাবে লাগেনি বললেই চলে। গ্রামে বিদ্যুৎ এসে পৌঁছেছে সবেমাত্র কিছুদিন। বিদ্যুৎ আসার পরে গ্রামের সাথে লাগোয়া গঞ্জের বাজার আগের চেয়ে অনেকটাই জমজমাট হয়েছে। গঞ্জের সেই বাজারের সাথেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে প্রশস্ত পিচঢালা পথ ধরে মিনিট দশেক এগিয়ে গেলেই গ্রামের মূল সৌন্দর্য চোখে পড়ে।

গ্রামের ঠিক মাঝামাঝি স্থানেই রয়েছে প্রকান্ড এক বাড়ি। বাড়ির নাম “তালুকদার মঞ্জিল”। মূল বাড়ি, বৈঠকখানা, দিঘি, বাগান সব মিলিয়ে মোট দুই বিঘা জায়গা নিয়ে অবস্থিত এই বাড়িটি। শুধু হলুদিয়া গ্রাম নয়, আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের মধ্যেও তালুকদারদের মতো এরকম প্রতাপশালী পরিবার দ্বিতীয়টি নেই।

বাড়ির প্রধান কর্তা অর্থাৎ বড় ছেলের নাম এনায়েত তালুকদার। তালুকদার মঞ্জিলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সিদ্ধান্তগুলোও তাকে ছাড়া নেওয়া হয় না কখনও। এনায়েত তালুকদারের ছোট ভাইয়ের নাম বেলায়েত তালুকদার। মূলত এই দুই ভাই তাদের পরিবার নিয়ে থাকে তালুকদার মঞ্জিলে।

মে মাসের মাঝামাঝি সময় এখন। আজ সকাল থেকেই দলে দলে লোক এসে ভীর করছে তালুকদার বাড়িতে। আজ দুপুরে মহাভোজের আয়োজন করা হয়েছে এখানে। এই আয়োজনের পিছনে অবশ্য বিশেষ একটি কারণ রয়েছে। আজ এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে চাঁদনীর জন্মদিন। প্রত্যেকবছরই চাঁদনীর জন্মদিনে গ্রামের খেটে খাওয়া চাষাভুষা শ্রেণির মানুষগুলোকে পেটপুরে খাওয়ানো হয় তালুকদার মঞ্জিলে। মুসাফির বা ভিক্ষুকরাও বাদ যায় না। এবছরও সেই একই ধারা অব্যাহত আছে। চাঁদনী এবাড়ির বড় ছেলে এনায়েত তালুকদারের সর্বকনিষ্ঠা কন্যা। শুধু তাই নয়, পাঁচটি ভাইয়ের একমাত্র বোন হলো চাঁদনী।

ভাইদের বয়সের ধারাবাহিকতায় সবার প্রথমেই রয়েছে এনায়েত তালুকদারের বড় ছেলে সাখাওয়াত তালুকদার, তারপরে বেলায়েত তালুকদারের বড় ছেলে তামজীদ তালুকদার। তারপর আবার ঠিক একইভাবে এনায়েত তালুকদারের মেজ ছেলে সাদমান তালুকদার এবং বেলায়েত তালুকদারের মেজো ছেলে তানিম তালুকদার ও তুরাগ তালুকদার। তারপরেই রয়েছে এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে চাঁদনী। তুরাগের চেয়েও প্রায় ছয় বছরের ছোট চাঁদনী।

এনায়েত তালুকদার এবং বেলায়েত তালুকদার দুই ভাইয়েরই প্রচন্ড শখ ছিল একটা মেয়ের। বেলায়েত তালুকদার পরপর তিনটা ছেলের পর আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন। এনায়েত তালুকদারের স্ত্রী রেবেকা বেগমও মেজো ছেলে সাদমানের জন্মের পর নানাবিধ শারিরীক জটিলতায় ভুগে সন্তান নিতে পারেননি অনেকবছর। তারপর সবাই যখন আশা একেবারেই ছেড়ে দিল হঠাৎ তখনই সাদমানের জন্মের প্রায় এগারো বছর পর সন্তানসম্ভবা হলেন রেবেকা বেগম। নয়মাস পরে জন্ম দিলেন একটা মেয়ের। মেয়েটির জন্মের পর পরিবারের সকলে যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। সেজন্যই চাঁদের মতো সুন্দর মেয়েটির নাম রাখা হলো চাঁদনী। সেই থেকে চাঁদনী হয়ে উঠল বাবা-মা, চাচা-চাচী আর পাঁচ ভাইয়ের নয়নের মণি।

পরিবারের সবার আদর আহ্লাদ পেয়ে বড় হওয়া মেয়েগুলো সাধারনত খুব নরম প্রকৃতির হয়। তবে চাঁদনী এর একেবারেই বিপরীত। বিলের পানিতে ডুব দিয়ে শাপলা তোলা কিংবা গাছের উঁচু ডালে উঠে আম পেড়ে আনা, সবকিছুতেই সিদ্ধহস্ত সে। একইসাথে মেয়েটি প্রচন্ড রকমের বুঝদার। নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো খুব ভেবেচিন্তেই নেয় সে এবং একবার কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সেটা থেকে তাকে টলানো শুধু কঠিনই নয়, প্রায় অসম্ভব।

সাধারনত চাঁদনীর প্রত্যেকটা জন্মদিন কাটে মহা ধুমধামে। দুপুরে মহাভোজের পর পরিবারের সদস্যরা নিজেদের মতো করে নানা আয়োজন করে। প্রত্যেকেই আলাদা আলাদাভাবে উপহার দেয় চাঁদনীকে। এবারও সবই হচ্ছে কিন্তু পরিবারের কারও মুখে হাসি নেই এবার। তার কারন চাঁদনী এবাড়ি ছেড়ে দূরে চলে যেতে চাইছে। কিছুদিন আগেই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে চাঁদনীর। তারপর থেকেই সে জেদ ধরেছে শহরে যাবে। ছোটোবেলা থেকেই চাঁদনী স্বপ্ন দেখে এসেছে ডাক্তার হওয়ার। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই শহরে যেতে চায় সে। বাড়ির সকলেই চিন্তায় পড়ে গেল৷ এতদূরে শহরে তাদের আদরের মেয়েটি কীভাবে গিয়ে থাকবে? শহরে তাদের তেমন কাছের কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। সবাই গ্রামেই থাকে। বেলায়েত তালুকদারের বড় ছেলে তামজীদ অবশ্য ঢাকার একটি কলেজের লেকচারার হিসাবে আছে। কিন্তু চাঁদনী যেখানে থাকতে চাইছে, সেখান থেকে অনেকটাই দূরে থাকে তামজীদ। তামজীদের কাছে পাঠিয়েও লাভ হবে না কোনো।

তাই চাঁদনী তার ইচ্ছের কথা বাসায় জানানোর পর যথারীতি দ্বিমত পোষণ করল সকলেই। কিন্তু নাছোড়বান্দা চাঁদনীকে কোনোভাবেই বোঝানো গেলো না। সেই থেকেই পরিবারের সকল সদস্য, বিশেষ করে বাবার সাথে তার স্নায়ুযুদ্ধ চলছে। চাঁদনী যেভাবেই হোক শহরে যাবে, আর এনায়েত তালুকদারও বিশ্বাসযোগ্য কাউকে না পেলে মেয়েকে কিছুতেই ছাড়বেন না।

অনেক চেষ্টার পর একজনের খোঁজ পাওয়া গেল। তামজীদই খোঁজটা দিল। এনায়েত তালুকদারের বাবা মানে চাঁদনীর দাদার স্কুলমাস্টার এক বন্ধু ছিলেন পাশের গ্রামেই। তার মেয়ে ঢাকাতেই থাকে। চাঁদনী যেখানে মেডিক্যাল ভর্তি কোচিং করতে চায়, তার কাছাকাছিই থাকে সে। কয়েকবছর আগে তামজীদের সাথে হঠাৎ দেখা হয়েছিল তার৷ তামজীদ অবশ্য চিনত না তাকে। তিনি নিজেই সেধে এসে পরিচয় দিলেন। আরও অনেক কিছুই বললেন।

পাশাপাশি গ্রাম হওয়ায় তিনি প্রায়ই নাকি যেতেন তালুকদার মঞ্জিলে। এরপর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর ঢাকায় সেটেল হয়েছেন। বিয়ের পরেও নাকি একবার গিয়েছিলেন তালুকদার মঞ্জিলে। তখন তামজীদ ছোট ছিল। কিন্তু তার স্কুলমাস্টার বাবা মারা যাওয়ার পর সেভাবে আর গ্রামে যাওয়া হয়নি। তাই তালুকদার মঞ্জিলের সাথে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে গেল।
ছোটবেলার তামজীদের চেহারার সাথে কিছুটা মিল পেয়ে একপ্রকার অনুমান করেই তামজীদের পরিচয় নিশ্চিত হয়েছেন। ভদ্রমহিলা সেদিন অনেক করে বলেছিলেন তামজীদকে তার বাসায় যেতে। এমনকি নিজের মোবাইল নাম্বারও দিয়ে গিয়েছিলেন। তামজীদ যদিও সৌজন্যতার খাতিরে বলেছে, সময় করে যাবে একদিন। কিন্তু পরে আর যায়নি। এত আগের সম্পর্ক, এখন দাদা বা তার সেই স্কুলমাস্টার বন্ধু কেউই বেঁচে নেই। সেখানে যাওয়ার মতো কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পায়নি আসলে ও। কিন্তু চাঁদনীর জেদের কথা শুনে সে বড়চাচাকে বলল একবার সেই ভদ্রমহিলার সাথে যোগাযোগ করে দেখতে।

তামজীদের মুখে বিস্তারিত শুনেই এনায়েত তালুকদার চিনে ফেলেছিলেন তাকে। মরিয়ম খাতুন। বাবার সেই বন্ধুর মেয়ে। সত্যিই বহুবার তাদের বাড়িতে এসেছে মেয়েটি। এখন বোধহয় আর মেয়ে বলা যাবে না, মহিলা বলতে হবে। অমায়িক ব্যবহার ছিল তার। শেষ ভরসা হিসেবে তাকেই কল করলেন এনায়েত তালুকদার। সব শুনে মরিয়ম খাতুন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। এনায়েত তালুকদারকে বললেন, নিশ্চিন্তে যেন মেয়েকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তার কাছে। আরও বললেন, প্রয়োজনে তিনি নিজে এসে নিয়ে যাবেন চাঁদনীকে। এনায়েত তালুকদার জানালেন, চাঁদনীর ভাই গিয়েই দিয়ে আসবে তাকে।

২.
অবশেষে চাঁদনী তার দুই ভাই সাখাওয়াত আর তানিমকে নিয়ে স্বপ্নপূরণের শহর ঢাকায় পা রাখল। ওর যেন বিশ্বাসই হতে চাইল না সত্যিই ও ঢাকায় এসেছে শেষপর্যন্ত। ঠিকানা খুঁজে খুঁজে শেষপর্যন্ত ওরা এসে পৌঁছাল চূড়ান্ত গন্তব্যে। ঝা চকচকে অট্টালিকাটির নাম ‘মরিয়ম ভ্যালি’। বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সাখাওয়াত কল করল মরিয়ম খাতুনকে।

ভদ্রমহিলা নিজেই নিচে এলেন ওদের এগিয়ে নিতে। ওদের দেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে গেলেন তিনি। তিনজনেই সালাম দিল তাকে। সালামের জবাব দিয়ে তিনি বললেন, “তোমরা সবাই কত বড় হয়ে গেছ। শেষবার যখন তোমাদের দেখেছিলাম, সবাই অনেক ছোট ছিলে। চাঁদনী তো তখনও পৃথিবীতেই আসেনি।”

আরও নানান কথা বলতে বলতে ওদের নিয়ে গেলেন বাড়ির মধ্যে।

“তোমাদের দাদাজান খুব ভালো মানুষ ছিলেন। আমাকে ভালোবাসতেন খুব। এনায়েত ভাইজানও নিজের ছোট বোনের মতো স্নেহ করতেন। কতদিন যে তালুকদার মঞ্জিলের কথা মনে পড়েছে। মাঝেমাঝে ইচ্ছে করত, তৎক্ষণাৎ চলে যাই। কিন্তু সময় আর সুযোগের অভাবে যাওয়া হতো না শেষপর্যন্ত।”

মরিয়ম খাতুনের আন্তরিক কথাবার্তায় চিন্তামুক্ত হলো দুই ভাই। একমাত্র বোনটিকে এরকম একটা অজানা অচেনা পরিবেশে রেখে যেতে প্রচন্ড দ্বিধা কাজ করছিল ওদের মধ্যে, ভদ্রমহিলার কথায় সেই দ্বিধা একটু হলেও কেটেছে। সাখাওয়াত আর তানিমের ইচ্ছে ছিল বোনকে এখানে রেখে সাথেসাথেই চলে যাবে। তামজীদ তো ঢাকাতেই আছে, মেডিক্যাল অ্যাডমিশন কোচিং এ সেই ভর্তি করিয়ে দেবে। কিন্তু মরিয়ম খাতুন দুপুরে না খাইয়ে কিছুতেই ওদের যেতে দেবেন না। অগত্যা দুই ভাইয়েরই থেকে যেতে হলো। মরিয়ম খাতুন চাঁদনীকে অন্য একটা রুমে নিয়ে গিয়ে বলল, “আজ থেকে এই রুমে তুমি থাকবে। আশা করছি এখানে তেমন কোনো সমস্যা হবে না। তবু যদি কোনো সমস্যা হয়, আমাকে জানাবে সাথে সাথে। ওইযে দক্ষিন কর্নারের রুমটা দেখতে পাচ্ছ, ওটাই আমার রুম।”

চাঁদনী আন্তরিক হেসে বলল, “কোনো অসুবিধা হবে না আন্টি। সব ঠিকঠাকই আছে।”

মরিয়ম খাতুন বললেন, “তাহলে এখন চেঞ্জ করে ফেল। সারারাত জার্নি করে এসেছ, ক্লান্ত লাগছে নিশ্চই। বোরখা খুলে ফ্রেশ হয়ে নাও।”

“জ্বি।”

সকালের নাস্তার পর তানিম আর সাখাওয়াতকে গেস্টরুমে পাঠানো হলো বিশ্রামের জন্য৷ সারারাত জেগে থাকার কারনে সাখাওয়াত ঘুমিয়ে পড়ল কিছুক্ষনের মধ্যেই। কিন্তু অপরিচিত জায়গায় তানিমের ঘুম হলো না কিছুতেই। ও ভাবল, বাইরে গিয়ে ঘুরে আসবে কিছুক্ষন। মরিয়ম খাতুনকে জানিয়ে নিচে নেমে এলো ও। বাড়িতে থেকে বের হওয়ার মূল গেটের সামনে এসেই ঘটে গেল অঘটনটা।

মূল গেটের মধ্যেই আবার ছোট একটা পকেট গেট। একজন মানুষ অনায়াসে বের হয়ে যেতে পারবে এমন আকারের। বাড়ির সামনের বিশাল খোলা জায়গার আশেপাশে তাকাতে তাকাতেই হাঁটছিল ও। সামনের দিক থেকে যে একটা মেয়ে ঝড়ের বেগে এগিয়ে আসছে, সেটা খেয়ালও করেনি। মেয়েটিও হাঁটতে হাঁটতে মোবাইলে এমনভাবে ডুবে ছিল যে সামনের মানুষটাকে দেখতেই পায়নি। দুজনের অসাবধানতার কারনেই লেগে গেল ধাক্কাটা। তেমন জোরে লাগেনি ধাক্কাটা। কারন ধাক্কা লাগার পরেও দুজনই দাঁড়িয়ে ছিল বহাল তবিয়তে। কিন্তু অঘটন যেটা ঘটে গেল সেটা হলো, পাশের পানিভর্তি একটা বালতিতে মেয়েটির হাতের স্মার্টফোনটি টুপ করে পড়ে গেল। বাগানের মালী বোধহয় গাছে পানি দিয়েই বালতিটা রেখেছিল ওখানে।

তানিম শুধু একপলক তাকিয়েছিল মেয়েটির দিকে। আঁটসাট টিশার্টের সাথে থ্রি কোয়ার্টার লেগিংস আর পায়ে সাদা কেডস। চুলগুলো পনিটেইল করে বাঁধা। সারামুখ ঘেমে তৈলাক্ত হয়ে আছে। মাত্রই মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরেছে সম্ভবত।

কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল তানিম। শহুরে কালচারে এসব পোশাক খুব নরমাল হলেও ওদের জন্য এটা একটু বেমানানই বলা চলে। তানিম নিচের দিকে তাকিয়ে নম্র কন্ঠে বলল, “আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। একদমই খেয়াল করিনি আপনাকে।”

একজনের কন্ঠ ঠিক যতটা নমনীয় আরেকজনের কন্ঠে ঠিক ততটাই তেজ।

“হোয়াট দ্যা ফা**। কী হলো এটা? চোখ কি মাথার পিছনে নিয়ে হাঁটেন? নাকি অন্ধ? রিডিকিউলাস পিপলস। কোথা থেকে যে এসব উদ্ভট লোক আসে! হ্যালো মিস্টার, আপনার স্যরি ধুয়ে কি আমি পানি খাব? নাকি স্যরি এক্সেপ্ট করলে ফোনটা আমার হাতে চলে আসবে। ডু ইয়্যু নো, হাউ মাচ ডাজ ইট কস্ট?”

একনাগাড়ে কথা বলে থামল মেয়েটি। মেয়েটির শেষ প্রশ্নটিতে তীব্রভাবে অপমানিত বোধ করল তানিম। রাগে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেল। এখানে কোনো পুরুষ থাকলে হয়তো এতক্ষনে একচোট হয়ে যেত। কিন্তু তার পরিবার তাকে শিক্ষা দিয়েছে, সবসময় মেয়েদের সাথে নম্র ব্যবহার করতে হবে। তানিম তাই কোনো তর্কে গেল না। বরং পানিভর্তি বালতির মধ্যে হাত দিয়ে ফোনটা তুলে উলটেপালটে দেখল কিছুক্ষন। তারপর সেটা মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি আসলেই দেখিনি আপনাকে। নিজের অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য আমি আবারও ক্ষমা চাচ্ছি আপনার কাছে।”

মেয়েটি ছোঁ মেরে ফোনটা তানিমের হাত থেকে নিয়ে নিল। তারপর দ্বিগুন তেজ নিয়ে বলল, “আপনাদের মতো ছেলেদের আমার খুব ভালো করে চেনা আছে। ইচ্ছে করে ধাক্কা দেবেন আবার মাফ চাওয়ার নাটকও করবেন। মেয়ে দেখলে মাথা ঠিক থাকে না, তাই তো? শুধু ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে, না? ক্যারেক্টারলেস কোথাকার।”

কথা শেষ করে মেয়েটি আর দাঁড়ানোর প্রয়োজনবোধ করল না৷ দ্রুত পায়ে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। তানিম চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকল শুধু৷ আজপর্যন্ত কোনো মেয়ে তানিম তালুকদারের সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কথা বলার সাহস অব্দি পায়নি। বলা যায় সেই সুযোগ তানিম নিজেই কখনও কোনো মেয়েকে দেয়নি। অথচ আজ কিনা অচেনা একটা মেয়ে বিনাদোষে এতগুলো কথা শুনিয়ে গেল। চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল!

তানিমের শিরা উপশিরা তখন দপদপ করছিল রাগে। ও আরেকবার পিছনে ফিরে তাকাল। তারপর গেটের বাইরে বেরিয়ে এলো।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

আত্মা পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0

###আত্মা(৫ম ও শেষ পর্ব)
###লাকি রশীদ

বেলা সাড়ে তিনটায় লাঞ্চ করতে গিয়ে দেখি টেবিল জোড়া খাবার। লাল শাক ভাজি,উচ্ছে ভাজি,মোরগ ভুনা,ঘন মুশুর ডাল ও কচি লাউপাতা দিয়ে শুঁটকি তরকারি। এত তাড়াতাড়ি
৫টা আইটেম হলো কিভাবে বলতেই হুমায়রা বলছে রান্নাঘরের ২টা চুলা ছাড়াও বাইরে একটা চুলা আছে ভাবী। বাবার জন্য আবার নরম করে খিচুড়িও করেছে। চাচা, মামুন, আমার শাশুড়ি, মাহির, ইভান এবং চাচীকে ৬টি চেয়ারে আমি বসিয়ে দিলাম। তারপর, বাবা ও সিমিনের খিচুড়ি প্লেটে করে বিছানায় নিয়ে খাওয়াতে এলাম। ইভান এর অনেক প্রিয় আইটেম হলো লালশাক ও ডাল। বাসায় যখন খায় তখন বারবার তার লাল হয়ে যাওয়া জিহ্বা বের করে দেখায়। এবার সে দৌড়ে এসে দুইবার দেখিয়ে গেল।

কষা মোরগ ভুনা মাহির আর বাবার ভীষণ প্রিয় আইটেম। ওর অভ্যাস হলো,এক টুকরো নিয়ে আগে টেষ্ট বুঝবে। তারপর ভালো লাগলে নিবে। হুমায়রা দাঁড়িয়ে সবাই কে পরিবেশন করছে। মাহির এবার ওর দিকে তাকিয়ে বললো, এতো মজার তরকারি আমি খুব কম খেয়েছি। পারফেক্ট মশলা,ঝোল,তেল সবকিছু। নওশীন তোমার রান্নাও তো অনেক মজার। কিন্তু এটাতে ভিন্নধর্মী একটা ফ্লেভার আছে। আমি ঠিক ধরতে পারছি না। তুমি খেয়ে দেখো, ধরতে পারো কিনা। আমি হেসে বলি, আমি না খেয়েও বলতে পারবো সেই ফ্লেভারটা কি? সাথে সাথে অনেক জোড়া চোখ আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

হেসে বলি, সেটা হলো ভাইয়ের জন্য বোনের মিষ্টি
হাতের জাদু। পৃথিবীর সেরা ফ্লেভার সেটাই। পাঁচ তারা হোটেলের অনেক অভিজ্ঞ শেফও শত চেষ্টা করে করেও এই ফ্লেভার আনতে পারবে না। ভাই
এবার বোনকে বলছে, কিরে তোর ভাবীর কথাই সত্যি না মনে মনে অনেক বকা দিয়ে দিয়ে মোরগ রেঁধেছিস? হুমায়রা হেসে বললো, সুন্দর মানুষের সুন্দর কথা। জিহ্বা দিয়েই আপনার বৌ সবাইকে ঘায়েল করে ফেলে। কি সব হাড় নিচ্ছেন, আমার কাছে বাটি দেন ভালো টুকরো দিচ্ছি। আমি মনে মনে হাসি, একবার তারেক জামিল সাহেবের এক স্পীচ শুনেছিলাম। তিনি বলছেন, পৃথিবীর যতো মধু আছে তার চেয়েও বেশি মধু মানুষের জবানে
আছে। ঠিক তেমনি পৃথিবীর সব সমুদ্রে যতো লবণ আছে তার চেয়েও বেশি লবণ মানুষের জবানে আছে। আল্লাহ মিষ্টভাষী কে ভালবাসেন।
এক জিহ্বা দিয়েই আমরা আত্মীয়তা ছিন্ন করতে পারি, আবার এই জিহ্বা দিয়েই ভাঙ্গাচুড়ো সম্পর্ক
জোড়া লাগাতে পারি। জাষ্ট কার কি পছন্দ সেটাই হলো কথা।

ওদের খাওয়া শেষ হলে আমি মাহির কে বলি,
শোনো ড্রাইভারকে ডাক দাও। ও খেয়ে যাক্,পরে
আমরা ননদ ভাবী আয়েশ করে শান্তিতে খাবো।
ও ড্রাইভারকে ডাকতে যেয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে চাপা গলায় বললো, শান্তি ভাবে আয়েশ করে খাওয়ার খুব একটা সময় কিন্তু আমাদের হাতে নেই নওশীন। সোয়া চারটা বাজে, পাঁচটায় বের না
হলে সমস্যা আছে,রাস্তাও খুব খারাপ। আমি বলি
ঠিক আছে বের হবো। ওকে আগে ডাক তো দাও।অবসর বসে আছি, হুমায়রা ও ছমিরনের সাথে আমিও টেবিল লাগাতে সাহায্য করলাম। খেতে বসতেই চাচী পাশে এসে তরকারি প্লেটে তুলে দিয়ে বলছেন, নতুন বৌ আসছো। কি খাওয়াবো রে মা। উচিত তো ছিল, পোলাও,রোষ্ট, কাবাব করে খাওয়ানো। আমি হেসে বলি, নতুন বৌ কি করে হলাম বলেন? ৭ বছর আগে বিয়ে হয়েছে। চাচী এসবে পাত্তা না দিয়ে বললেন,ওই হলো আর
কি। হঠাৎ তার সোনার নথ দুলিয়ে দুলিয়ে বলেন,
নাকের ফুল,নথ এসব নাই কেন গো মা? কোনো কিছু কি কম আছে আমাদের ছেলের তবে? এসব
শুনলে আমি সাধারণত কিছু বলি। এখানে চাচীর সাথে তর্ক করতেই ইচ্ছে করছে না। বলি,পরবো।

চাচী সরে যেতেই হুমায়রা বলছে,প্লীজ ভাবী কিছু মনে করবেন না। মা মাঝে মাঝেই ভুলে যায়,কতো টুকু পর্যন্ত বলা যাবে। আমি হেসে বলি, আমার তো খারাপ লাগেনি। এতো ফরমাল না হলেও চলবে। খেয়ে উঠলে হুমায়রা বাটিতে সব পদ নিয়ে মহব্বত আলী ও ছমিরনকে খাবার জন্য দিলো। আমরা দুজন এইরুমে এসে দেখি চাচা, চাচী ও মামুন কে সামনে বসিয়ে মাহির বলছে,
আমাদের অফিসে একটা পদের জন্য মানুষ নেয়া হবে।স্যালারি হচ্ছে ফর্টি প্লাস। আমি চাই মামুন কে কাজটা দিতে। কারো কোনো আপত্তি নেই তো? এবার একদম আনপ্রেডিক্টেবল ভাবে ছোট চাচা বলে উঠলেন, আমি খুব খুশি হলাম। কিন্তু বাবা এটা নেয়া ঠিক হবে না। তাই নিচ্ছি না।
অনেক আগে তোমাদের বাসা থেকে এসে একটা ওয়াদা করেছিলাম যে,আর কখনো তোমাদের থেকে কোনো ধরনের সাহায্য নিবো না। ওয়াদার
বরখেলাপ হয়ে যাবে। মাহির এখন কি বলবে মনে হয় ভেবে পাচ্ছেনা।

পুরো একটা নাটকীয় অবস্থার মাঝে হঠাৎ আমার শাশুড়ি বলে উঠলেন,ছোটন ভাই আমি জানি কি জন্য তুমি বলছো আমাদের সাহায্য নিবে না। আমার বলা ঐদিনের কড়া কথার জন্যই। শোনো আজ প্রায় বছর তিনেক ধরে আমি কতো বার যে ভেবেছি তোমার কাছে মাফ চাইবো। কিন্তু লজ্জায়
অনুশোচনায় আমি আসতে পারিনি। আমি আজ তোমার কাছে করজোড়ে ক্ষমা চাইছি। নিশ্চয়ই
জানো,যে মাফ করে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন ও
মাফ করে দেন। তুমি দয়া করে আগের সবকিছু ভুলে যাও এবং ছেলেটাকে চাকরিটা করতে দাও।

চাচা এবার হুমায়রার দিকে তাকাচ্ছেন। ও মাথা
নেড়ে হ্যা বুঝাতেই চাচা বললেন, ঠিক আছে। তাই হবে। এবার সরলতার প্রতিমুর্তি চাচী মাহির কে বলছেন, সবই তো বুঝলাম। শুধু জিজ্ঞেস করছি, তার বেতন কতো বাপ? মাহির হেসে বলল আপাতত চল্লিশ এর সামান্য বেশি। চাচী এবার হাউমাউ করে কেঁদে বলছেন,ও আল্লাহ তোমার কোটি কোটি শুকরিয়া। ও বাজান, শহরে গিয়েই
তুমি আবার এই সব কথা ভুলে যাবে না তো?

মাহির হেসে বললো, এতো বছরের ভুল শুদ্ধ করতে এসে আবার ভুল করবো কিভাবে চাচী?
তবুও নানা আশঙ্কায় জর্জরিত বৃদ্ধা এবার বলেন,
যদি তোমার ভাইয়েরা না করে দেয়? মাহির বলে,
একটা পোষ্টে মানুষ নেয়ার ক্ষমতা আমার আছে চাচী। আপনি শুধু দোয়া করবেন, এই মাসের ৭ দিন যেন আমি বেঁচে থাকি। চাচী হাত তুলে দোয়া করছেন, মাহির কে তুমি দেখো মাবুদ। ২টা মাস যদি আমার ছেলে এই বেতন পায় তবে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তালুকদার এর ছেলেটাকে কিছু বলতে বা এগোতে পারছি না টাকার জন্য। এবার মাহির বলছে, কাউকে কথা দিবেন না এখন। আমাকে একজন এরকম ১টা মেয়ের কথা বলেছিল। অনেক দিন দেখা নেই,
বিয়ে করে ফেলেছে কিনা তাও জানি না। আমি বাসায় গিয়ে খবর করবো। এখন সেটা বলতে চাচ্ছিলাম না,কারণ ভাবতে পারেন সামনে এসেছে
তাই গাই ও বাছুর সবকিছু দিয়ে দিচ্ছে। এবার যদি অনুমতি দেন আমরা উঠে পড়ি।

এতোক্ষণ আমার শশুড় বসে বসে সবার কথা শুনছিলেন। এবার সটান করে শুয়ে পড়লেন। মাহির বলছে,চলো বাবা বাসায় যাবো। বিছানায় রাখা একটা কাঁথা নিয়ে চটপট খুলে তার গায়ে জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো বলছেন,তোমরা চলে যাও। আমি এদের সাথেই থাকবো। মাহির এবার বলছে, তোমার এতো এতো ঔষধ নিয়ে আসেনি তো নওশীন। কিছুদিন পর আবার না হয় আসবে।
বাবা অবুঝের মতো বলছেন, না আমি আমার ভাইয়ের সাথে থাকবো। মাহির আর ধৈর্য রাখতে পারেনি, ধমকে উঠেছে যন্ত্রণা করো নাতো বাবা। সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে,ড্রাইভার এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় পরে ঝাঁকুনি দিতে দিতে মারবে। বাবা এখন কথা না বলে,কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন। মামুন বলছে, উনি যদি থাকতে চান থাকুন, আমি না হয় কালকে গিয়ে ঔষধ নিয়ে আসবো।

মাহির বলছে, না রে ভাই। অনেক অসুবিধা আছে। এভাবে রেখে যাওয়া যাবে না। দেখিস্ না
দুজন দুদিকে ধরে ধরে নিতে হয়। পায়ের জোর কমে গেছে। চলো বাবা,উঠো চটপট। এরকম যদি
করো, তাহলে তো তোমাকে আর নিয়ে আসা যাবে না। বাবা বাচ্চাদের মতো একই কথা বলছেন
না আমি আমার বাড়ি থেকে কোথাও যাবো না।
তুই কারো সাথে আমার সব জিনিসপত্র পাঠিয়ে দিস্। আমি বুঝতে পারি,মাহিরের রাগ এবার চড়ে যাচ্ছে। আমার শশুড় এর কাছে গিয়ে বলি, বাবা কাঁথা সরান তো। শুনেন আমি কি বলছি। মুখ থেকে কাঁথা সরাতেই বললাম, আপনি যদি এখন না যান, আপনার ছেলে ঠিকই জোর করে নিয়ে যাবে। মধ্যে থেকে আমিই শুধু বকা খাবো, নিয়ে আসার জন্য তাকে জোর করাতে। আপনি কি চান, আমি বকা খাই? যদি চান তবে তো কিছু বলার নেই আর যদি না চান উঠে পড়ুন প্লিজ।

এবার বসে বলছেন, হারামজাদা তোমাকে বকা দেয় বৌমা? এদের কক্ষনো ভালো হবে না দেখো।
মাহির বলছে, ঠিক আছে ভালো না হোক। এখন দয়া করে নামো। ওর দিকে তাকিয়ে অসহায় এক
টা দৃষ্টি দিয়ে বলছেন, আবার কবে এখানে নিয়ে আসবি বল্? মাহির জবাব দেয়,আসবো আসবো।
খুব শীঘ্রই আসবো। এবার পা মেঝেতে ফেলে বলছেন, বুঝলি ছোটন শক্তিহীনতার অভিশাপ বড় কঠিন। এই দুনিয়ায় শক্তি না থাকলে, তোমায় কেউ গণনাতেও ধরবে না। এই কথা শুনে আমার মনে হলো, বাবা এখন হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ সত্যি কথা বলে ফেলেন। বিয়ের পর এই বাবার প্রতাপ কি ছিল আমি দেখেছি। ছেলেরা কিছু বলতে হলে আগে মাকে মাধ্যম হিসেবে ধরতো। সরাসরি কিছু বলার সাহস ছিল না। গত দুই বছরে সেই বাবার আমূল পরিবর্তন। পৃথিবীতে কখন কার জীবন কোন পথে বাঁক নিবে……… একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ কখনও বলতে পারবে না।

বাবা বসে থাকতে থাকতেই মাহির হঠাৎ বললো,
চাচী একটু শোনে যান প্লিজ। আমি বুঝতে পারি,
টাকা দিতে গেছে মনে হয়। একটু পর মাহির এসে বাবাকে ধরে ধরে বের করলে চাচীও আসলেন। হাজার টাকার কয়েকটি নোট হাতের মুঠোয় দিয়ে বললেন, নতুন বৌ তোমার মুখ সোনা দিয়ে দেখা উচিত ছিল মা। চাচীর সাধ্য নেই, এই টাকা কয়টা রাখো। তোমার পছন্দ মতো ভালো দেখে একটা শাড়ি কিনে নিও‌। আমি না না করতেই বললেন,
রাখো তো। বেশি মুরুব্বিয়ানা (পাকানো) করতে হবে না। একটা অনুরোধ মা, কখনো বদলে যেও না। গরীবদের প্রতি সবসময় অন্তরে ভালবাসা রেখো।

মামুন ও মাহির দুদিকে ধরে ধরে বাবাকে গাড়িতে তুলছে। আমার শাশুড়ি চাচীকে ধরে বললেন,
বাসায় অনেক জায়গা আছে আঙ্গুর। একদিন তুমি সবাইকে নিয়ে চলে এসো। তোমার ভাইজান খুব খুশি হবেন তাহলে। চাচী বললেন, মেয়ের তো স্কুল গো ভাবী। নাহলে তো যেতে পারতাম। বাবা এবার চাচাকে জড়িয়ে ধরে বলছেন,এরা আমায় না নিয়ে এলে তুই আমাকে আনতে যাস্। ড্রাইভার মাহিরকে এবার বলছে,স্যার আপনার চাচা ২টা বস্তা দিয়েছেন। গাড়িতে তুলেছি আমি। মাহির বলছে, ঠিক আছে। চাচা বললেন বস্তাতে সব্জি আছে গো মা। গিয়েই খুলে বাতাসে রেখো নয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। আমি মাথা নেড়ে হুমায়রা ও মামুন
এর সাথে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। মাহির দেখি, ৫০০ টাকার ২টা নোট মহব্বত আলী ও তার বৌকে দিল‌। লাখ টাকা পেলেও কেউ মনে হয় এতো খুশি হয় না,যা তারা হয়েছে।

গ্ৰামের এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় আমাদের চলা শুরু হয়েছে। মাহির বাবার বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, কি ব্যাপার বাবা আমরা কি তোমাকে আদর যত্ন করি না নাকি,যেখানে যাও সেখানে থেকে যেতে চাও? আমাদের কথা বাদ দাও, তোমার এতো আদরের বৌমা কেও তো তুমি ভুলে যাও। বাবা এবার রেগে বললেন, আমাকে
আমার ভাইয়ের সাথে থাকতে দিলি না। দেখিস কি হয় তোর আর তোর মায়ের। আমি বুঝি বাবা অসহায় রাগে, দুঃখে,ক্ষোভে এমনটা করছেন। ইশারা দিয়ে মাহির কে চুপ করে থাকতে বলি। পাঁচ মিনিটও যায়নি বাবা মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলছেন, আবার কবে নিয়ে আসবি এখানে? সে এবার হো হো করে হেসে উঠলো, তুমি তো একদম আমার ইভানের মতো হয়ে গেছো বাবা। আসবে, খুব শীঘ্রই আসবে তো বললাম।

কিন্তু বাবা তুমি খুব বড় একটা ভুল করেছো। সারা জীবন দুই হাতে রোজগার করেছো, কিচেন বাথরুম সহ দুই রুমের একটা বাসা বানাতে পারতে। চাচারা মানুষ ৪ জন,২ রুমে থাকে। তুমি এখন সেখানে কিভাবে থাকবে? তাছাড়া,২ জন মানুষের সাহায্য ছাড়া তুমি হাঁটতে পারো না। সবকিছু ভেবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে,তাই না? বাবা কি বুঝলেন উনিই জানেন। এবার নাছোড়বান্দা হয়ে বলছেন, ছোটবেলার মতো আমি ও ছোটন এক খাটে শুবো। আমাদের মা কর্ণারে থাকে তো,তাই আমরা পড়ে যাই না খাট থেকে। মাহির এবার মার
দিকে তাকাতেই মা বললেন,প্রতি রাতেই তোর বাবা তোর দাদী কে পাশে নিয়ে ঘুমায়, কথা বলে।
মাহির এবার আমার দিকে তাকিয়ে বলল,যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব ডাক্তারের সাথে এপোয়েন্টমেন্ট করো। এতো দেখি অবস্থা আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে।

বাসায় পৌছতে পৌছতে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার উপরে বাজে। পাড়া থেকে কিছু দূরে থাকতেই ফোন দিয়ে সেলিমাকে বলেছিলাম চা নাস্তা বানিয়ে রাখার জন্য। এসে সবাই ফ্রেশ হয়ে জামা কাপড় পাল্টে চা খেলেও বাবা খাননি। ছোট বাচ্চা যেমন তার পছন্দের জায়গা থেকে তাকে নিয়ে এলে রাগ করে খায় না, তেমনি অনেক রাগ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছেন। মাহির ২/৩ বার বলেও যখন নাস্তা করাতে নিয়ে আসতে পারেনি,
তখন রেগে গেছে। আমি বলি, এতো বছরের এতো এতো ধাক্কা একদিনে হজম করা অনেক কষ্ট মাহির। সময় দাও একটু, ঠিক হয়ে যাবে। এখন বাবাকে বিরক্ত করো না। পরে খাবেন না হয়। এবার সে আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, মনে আছে তো কিছু কথা বলবো। খুব মন দিয়ে শুনবে। বললাম,ভয় লাগিয়ে দিচ্ছো যে।
কি এমন কথা, সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

চাচা বস্তাতে দুনিয়ার সব্জি দিয়েছেন। এগুলো খুলতেই সেলিমা বলছে ছাদে রাখলে সব্জিগুলো ভালো থাকতো। বললাম, দাঁড়া পুরনো শাড়ি আছে,আনি। তাহলে লম্বা করে বিছিয়ে সব এক সাথে দিয়ে দিবি। উঠে দেখি সারা ছাদ জোৎস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে। সবকিছু ফকফকা,লাইট জ্বালাতে হয়নি। কিসের আমি সেলিমাকে সব্জি বিছোতে সাহায্য করবো, আমি তো রেলিং ধরে চুপচাপ দাঁড়িয়েই আছি। ভাবছি, এতো সুন্দর তোমার চাঁদের আলো তাহলে তুমি কতো সুন্দর মাবুদ !!! চর্মচক্ষে তা অবলোকন করা কি আদৌ সম্ভব হবে? বলো।

খাওয়াদাওয়া এখনো শুরু ই হয়নি। সবাই খুব আস্তেধীরে চলছে,কারণ কালকে অফডে। রাত সাড়ে দশটায় হঠাৎ রমু এসে উপস্থিত। তাঁর বাস না কি কোথায় নষ্ট হয়ে গিয়েছিল……… সেজন্য পৌঁছুতে দেরী হয়েছে। তাকে দেখে বাবা ভীষণ খুশি। রমু এতো দিন বাড়িতে কিকি করেছে তা সে সবিস্তারে বলছে, বাবা অবাক হয়ে শুনছেন আর আমি ঝটপট মুখে খাবার দিচ্ছি। তাও আজকে অন্যদিনের তুলনায় খুব কম সময়ে এই পর্ব শেষ হয়েছে। চাপা গলায় বলি,রমু তোর সব গল্প একদিনে শেষ করিস্ না বাপ। আমার তো মনে হয়,এটা কালকে আবার খুব কাজে আসবে। সে এবার হাসছে। তুই বাবার কাছে থাক্, আমরা খেয়ে আসি। ঠিক আছে? ও মাথা নাড়তেই আমার শাশুড়ি কে নিয়ে খেতে আসি। রমু চলে গেলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় মায়ের। সবসময় বাবার সাথে থাকতে হয়।

ইচ্ছে করেই এসে গা ধুইনি। ঘুমানোর সময় গোসল করলে আরামের ঘুম হয় বলে। সব কর্তব্য
শেষ করে রুমে ঢূকেছি। মাহির টিভি দেখছে। সারা দিনের হুটোপুটি শেষে ক্লান্ত সিমিন অনেক আগেই ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দিয়েছে। গোসল করে এসে বিছানায় গা লাগাতেই মাহির বলছে, খাওয়ার পর গোসল করার বদভ্যাস করো না। আমি হেসে বলি, একদিন নিয়ম ভাঙ্গলে কিছু হয় না। বলো তুমি কি বলবে? এবার টিভি অফ করে বললো,কথাগুলো মন দিয়ে শুনবে আশা করি।

হেসে বলি,খুব মন দিয়ে শুনবো। বলো তো। কেশে
বলছে, তুমি যে সবাইকে এতো যত্ন আত্তি করো,
সবার মন ভালো রাখতে চেষ্টা করো……….. কিন্তু আসল জায়গাতেই তুমি লবডঙ্কা। আমি তোমার সাথে প্রতারণা করে বিয়ে করেছিলাম? এই যে গত বছর কয়েক ধরে তুমি কথা বলা কমিয়ে দিয়েছো। আমি খেয়াল করে দেখেছি,সবার সাথে ভালো থাকলেও আমার সাথে তুমি ভালো থাকো না আর আমাকেও ভালো রাখো না……… এগুলো
অন্যায় নয় বলো? আমার যদি নিয়্যত খারাপ থাকতো, তবে তো বিয়ের আগে স্পষ্টভাষী হয়ে এসব বলে আনতাম না। তাহলে, এখানে আমার দোষটা ঠিক কোন জায়গায়? বুঝতে পারছি না। একটু ধরিয়ে দাও প্লিজ। আমি ভেবে দেখি, সে যা
বলছে তা তো একবিন্দুও ভুল নয়। এবার বলছে,
বাবা জন্মস্থান দেখে খুশি হবে বলে আমার এতো বকা খেয়েও তুমি তাকে সেটা দেখাতে নিয়ে যাও।
মা হ্যান্ডলুমের শাড়ি আরাম পায় বলে, সেটা তুমি খুঁজে খুঁজে আনো।

তোমার পছন্দ তো অনেক ভালো। তা আমাকে এই সাত বছরে একবার বলে দেখেছো, এই পাঞ্জাবি তোমার জন্য অর্ডার দিয়ে দিয়েছি। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা? আমার টা অর্ডার দিবে কি, তুমি তো তোমার নিজের জন্য ই কিছু কেনাকাটা করো না। ভাবসাব দেখে মনে হয়, কিডন্যাপ করে এনে বন্দী করে রেখেছি। রহিমাকে যতটুকু অন্তর থেকে ভালোবাসো এর ওয়ান থার্ড কি আমাকে ভালবাসো? সঠিক উত্তর হবে, না। কি হলো তুমি একদম চুপ মেরে গেলে যে? আমার বলার যা ছিল বলে ফেলেছি। আজকে এক্ষুনি কিছু বলতে হবে না। ভেবে কাল পরশু জানিও। তবে কি জানো, আমার মনে হয় সবসময় মেয়েরা কিন্তু শোষিত হয় না, অনেক ক্ষেত্রে ছেলেরাও হয়। আমি এসব বললাম কারণ সাতটা বছর আমার ভালবাসাহীন কেটেছে, একটু বিবেক বুদ্ধি দিয়ে যদি ভাবো তবে বাকি জীবন দুজনের হয়তো বা ভালবাসায় গড়াগড়ি দিয়ে কাটবে। এখন ঘুমাবো।
অনেক টায়ার্ড তুমিও, ঘুমিয়ে পড়ো তাহলে।ও হ্যা
হুমায়রার জন্য আমার যে কলিগের ভাইয়ের কথা বলেছিলাম, ফোন করে জেনেছি এখনো বিয়ে হয়নি উনার। দেখা যাক, ভবিষ্যতে কি হয়।

মাহির হচ্ছে পৃথিবীর সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে
একজন,মে শোয়ার সাথে সাথে ই ঘুমিয়ে পড়ে।
আমি ঘুমাবো কি, কি সব মাথার ভেতর ঢুকিয়ে দিয়েছে, সেটা নিয়ে ই ভাবছি। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করতে করতে, বিরক্ত হয়ে উঠে পড়েছি। খুব ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু এতো রাতে সেখানে যাবার সাহস আমার নেই। ব্যালকনির গ্ৰীল ধরে দাঁড়াতেই চাঁদের আলো সর্বশরীর যেন ধুইয়ে দিল।

অদৃশ্য অন্ধকারে তাকিয়ে জ্ঞানহীন নওশীন ভাবছে, কি রহস্যময় এক জিনিস সবাইকে দিয়ে পাঠিয়েছেন আল্লাহ, সেটা হলো আত্মা। এই মুহূর্তে আমার শশুড়ের আত্মা চাইছে একটা, শাশুড়ির আত্মা চাইছে আরেকটা। ক্ষুদ্র অতি ক্ষুদ্র নওশীন এতো দিন ভেবেছিলো, তার আত্মা বেঁধে রাখা হয়েছে। আজকে এসব কথা শুনে মনে হচ্ছে,সেই কারো আত্মা নির্মমভাবে নওশীনের হাতেই নিস্পেষিত হয়েছে। বাবা মায়ের উপর অভিমান অন্যায়ভাবে অন্যজনের উপর করেছি। কোথায় যেন কোন পাখি না কি পেঁচা ডেকে উঠলো। আমি অন্ধকারে তাকিয়ে ভাবছি,এ
অন্ধকার খুব তাড়াতাড়ি হয়তো বা আলোর দিশা
চেনাতে খুব সাহায্যকারী হবে আমার জন্য। সেটা
নিয়ে ভাবাই হয়তো বা নওশীনের জন্য উপকারী হবে। আত্মার মতো বিশাল জিনিস নিয়ে ভেবে ভেবে কোনো কূল হয়তোবা নওশীন পাবে না।

(সমাপ্ত)

আত্মা পর্ব-০৪

0

###আত্মা(৪র্থ পর্ব)
###লাকি রশীদ

বিশাল বাড়ির একপাশে দেয়াল তুলে দেয়া। দেয়ালের ওপাশে একটা পাকা বাড়ি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এখানকার যে বাসা সেটার বেশ জরাজীর্ণ অবস্থা। ভেতরে এখনো ঢুকিনি, উঠোনে এক কিশোর ছাগল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাবা দীঘির ঘাটে নেমে বলছেন, আমার বাবার এতো কষ্টের,
এতো শখের দীঘির এটা কি অবস্থা !!! বেলা প্রায় দেড়টা বাজে। তীব্র রোদে পুড়ে যাচ্ছে যেন সব কিছু। মাহির বলছে, এতো রোদ লাগিয়ে দেখবে বাবা,মা আর বাচ্চারা জ্বর বাধাবে। চলো আল্লাহ আল্লাহ করে ঘরে যাই। উঠোন থেকে একটু দূরে ঘর। আমি চেয়ে দেখি সমস্ত বাড়ির মধ্যে একটা জিনিস ই সুন্দর তা হলো, উঠোনের দুই পাশে কিছুটা ফাক রেখে রেখে অসংখ্য গাছ লাগানো।কৃঞ্চচুড়া, চাঁপা, আমি নাম নাম জানি না এরকম আরো অনেক ফুলের গাছ এতো গরমের মধ্যে স্নিগ্ধ ছায়া দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

এত গরমে মাথাগরম অবস্থা,এরমধ্যে সমস্যা হল
মাহির ও ড্রাইভার দুপাশে ধরে ধরে বাবাকে নিয়ে যাচ্ছে। ইভানের হাঁটা দেখে সিমিন রহিমার হাত ছেড়ে একা একা হাঁটতে গিয়ে পড়ে গেছে। এখন সে তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। এতো সব ঝামেলা দেখে এবার মাহির গজগজ করছে,গ্ৰামের পরিবেশ দেখে মা কবি হয়ে গেছেন। মেয়ে আছাড় খেয়ে পড়ে চিৎকার করছে…….. বাহ্ বেশ ভালো কিন্তু। এখনো তো অনেক কিছু বাকি। “উঠলো বাই তো কটক যাই”………….কারো কোনো কথা বুঝতে বা
শুনতে রাজি না। আমি কিছু না বলে সিমিন কে কোলে নিয়ে হাঁটা শুরু করেছি, রহিমা কে বলেছি মাকে ধরে ধরে নিয়ে আয়‌। হঠাৎ দেখি এক বৃদ্ধ বলছেন,কে রে তোমরা? মাহির সালাম দিতেই বাবা বলছেন, কিরে আমাকে চিনতে পারছিস না ছোটন? এবার বৃদ্ধ দৌড়ে কাছে এসে বলছেন,
ভাইজান !!! এ কি অবস্থা হয়েছে তোমার? দুই বৃদ্ধ একজন আরেকজনের গলা জড়িয়ে ধরে এবার হু হু করে কাঁদতে আছেন।

আমি মাহিরের এতো অস্বস্তির কারণ বেশ ভালো বুঝতে পারছি। এতো বেশি দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে গেছে
এবং ভালো অবস্থানে থেকেও এদের প্রতি কিছু না
করার অপরাধবোধে ভুগছে সে। আমার শশুড় এবার আমাকে দেখিয়ে বলছেন, আমার ছোট বৌমা রে। বুঝছিস্ ছোটন ঠিক আমাদের মায়ের মতো আদর ভালোবাসা দিয়ে সমস্ত শরীর ভরা।
ছোট চাচা এবার বলছেন, ভালো আছো তো মা?
আমি মাথা নাড়তেই বললেন,চলো চলো বাড়িতে গিয়ে ফ্যানের নিচে বসলে আরাম পাবে তোমরা।
আমি খেয়াল করে দেখেছি,সবার সাথে কথা বললেও আমার শাশুড়ি কে কিছু বলেননি। ঘরের
বাইরে থেকেই আঙ্গুর আঙ্গুর বলে চিৎকার করে যাচ্ছেন তিনি। এবার টকটকে ফর্সা এক বৃদ্ধা, রোদ পড়ে যার সোনার নাকফুল ও নথ চিকচিক করছে তিনি বের হয়ে মুখে হাসি নিয়ে বলছেন,ও আল্লাহ !!! কারে দেখছি? আজকে আমার ভাগ্য এতো ভালো কি করে হলো? এতো সমাদর দেখে হতবাক মাহির এবার আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

তিন রুমের টিনের ঘর। প্রথম রুমে ঢুকেই দেখি,
বড় বড় দুটো খাট দুপাশে রাখা। ওখানেই বসলাম আমরা। চাচা কথা না বললেও চাচী দেখলাম মা কে সালাম করে নিয়ে বসাচ্ছেন। বললেন, এখানে বসেন আমি ডাব পাড়াই।মা বলছেন,ব্যস্ত হইও না
তো আঙ্গুর,বসো গল্প করি। উনি এসব না শুনেই মহব্বত আলী বলে চিৎকার করছেন। এবার দেখি খালি গায়ে সেই মহব্বত আলী হাজির। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যে একেক জনের হাতে একেকটা ডাবের পানির গ্লাস চলে এসেছে। মহব্বত আলী চাচীর আদেশ মতো ড্রাইভারকে একগ্লাস দিয়ে এসেছেন। চাচী এবার মাহিরের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলছেন,কত্তো বড় হয়ে গেছে মাহির।
মাহির হেসে বলল,না গো চাচী বলেন কত্তো বুড়ো হয়ে গেছি আমি। এবার জিজ্ঞেস করলেন, বৌ কেমন হয়েছে বাপ? তোমায় যত্নআত্তি করে তো?
মাহির হেসে বললো, আমার,আমার বাবা মার সবার যত্ন করে সে। তার কাছে আমাদের ঋণের শেষ নাইগো চাচী। আমি অবাক হয়ে চেয়ে আছি।

চাচী এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, তোমার মা বাবার কিসমত ভালো বাপ। জানোই ত আমার ৬ মেয়ের পর এই ১ টাই ছেলে। সবচেয়ে বড় পাস দিয়েও ৮ মাস ধরে চাকরি পাচ্ছে না। আজকে সে
চেয়ারম্যান এর কাছে গেছে,যদি তার ফার্মেসীতে
থাকার কাজ দেয়। মাহির জিজ্ঞেস করলো, তার সাথে ফোন আছে? ফোন থাকলে বলুন, ওখানে না বসে এক্ষুনি এখানে যেন চলে আসে। উনি এবার ব্যস্ত হয়ে ভেতরে চলে গেলেন। ওই খাটে দেখি আমার শশুড় ভাইয়ের সাথে গল্পে মশগুল।
দেখে ভালো লাগছে, মনে হচ্ছে অনেক দিন পর তৃঞ্চার্ত চাতক পাখি যেন পানির দেখা পেয়েছে।

এরমধ্যে শাড়ি পরা হাতে অনেক গুলো খাতা নিয়ে একটা মেয়ে ঢুকেছে। আমার মতোই বয়স হবে বা কিছুটা কমও হতে পারে। চাচা তাকে ডেকে বলছেন, হুমায়রা দেখে যা তোর বড়চাচা এসেছেন। সে কাছে গিয়ে বললো, আমাকে কি চাচা চিনে বাবা? তুমি না বললে আমিও জানতাম না উনি আমার বাবার ভাই আর উনিও জানতেন না আমি তার ভাইয়ের মেয়ে। সুতরাং, নতুন করে সম্পর্ক ঝালাই করতে যেও না বাবা। তাহলে তুমি আগের মতো কষ্টই পাবে শুধু। আমি চাই না, তুমি নতুন কষ্টে জড়াও। ঘরের মধ্যে অস্বস্তিকর এক নীরবতা নেমে এসেছে। চাচী এবার তাকে ধমকে উঠলেন, এই মেয়ে এতো চ্যাটাং চ্যাটাং করে কথা
বলছিস কেন? রক্ত তো রক্ত ই। তোর সাথে তার রক্তের সম্পর্ক। এতো সহজে ছিন্ন হয়ে যায় না কি? এদিকে আয়, তোর চাচী,ভাই ভাবী এখানে বসে আছে। কথা বলে যা তো।

সে এসে সোজা মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিয়ে তীক্ষ্ম কন্ঠে বললো, চাচী কি ছিলেন আর কি হয়েছেন। সব বয়সের থাবা চাচী, বুঝলেন? মা
কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ছেন। এবার আঙ্গুর
বেগম আবার পরিবেশ রক্ষায় সচেষ্ট হয়ে বললেন
এই মেয়ে বয়স তোর মা বাপের হয় নাই? এ তোর
মাহির ভাই আর ও তোর ভাবী। সালাম দে। মুখে
শ্লেষের হাসি দিয়ে মাহিরকে বলছে,ভালো আছেন
ভাইয়া? মাহির স্পষ্ট স্বরে বলে, আলহামদুলিল্লাহ
তুই ভালো আছিস হুমায়রা? “তুই” শোনে এবার হকচকিয়ে গেল সে। হাসিমুখে বলছে,ভালো।ভাবী
কিভাবে এখানে বসছেন বলেন তো? আমাদের তো এসিও নেই। এতো গরমের মধ্যে আপনি সিদ্ধ হয়ে যাচ্ছেন না? আমি হেসে বলি, না আমার এই
অভ্যাস খুব আছে। বাবার বাড়িতে এসি ছিল না।
এবার চাচী বলছেন, শুনে যাতো হুমায়রা এদিকে।

৫ মিনিট পর চাচী ফিরে এসেছেন, হুমায়রা দেখি
ভেতর থেকে আসেনি এখনো। এদিকে ওদের ভাই
মামুন চেয়ারম্যান এর ওখান থেকে এসে, মাহির এর সাথে গল্প করছে,সার্টিফিকেট দেখাচ্ছে। মা ও চাচী গল্প করছেন,মা একেক জনের নাম বলছেন আর চাচী বর্তমানে তাদের অবস্থান, কর্মকাণ্ড সব বিস্তারিত জানাচ্ছেন। রহিমা উঠোনে গিয়ে গাছের ছায়ায় বাচ্চাদের নিয়ে খেলছে। বাবা ও চাচা যথারীতি গল্পে মশগুল। একমাত্র দলছাড়া দেখা যাচ্ছে আমিই। কি করবো, আল্লাহ আল্লাহ করে ভেতরে ঢুকি। মনে আবার ভয়ও লাগছে, হুমায়রা
ধমকে চলে যেতে বলে নাকি? বললে বলুক,ধমক
খেয়ে খেয়ে তো বছর সাতেক কেটেই গেল। নতুন আর কি এমন মন খারাপ হবে?

পরের রুমে কেউই নেই। সিঙ্গেল একটা খাট, এক টা চেয়ার ও টেবিল ও একটি আলনা পরিপাটি করে রাখা। বুঝাই যাচ্ছে এটা হুমায়রার রুম‌। এর
পরের রুমে একপাশে একটা খাওয়ার টেবিল ও ৬টা চেয়ার এবং অন্যপাশে মাটির চুলা,রান্নাঘরের
সরঞ্জামাদি রাখা। চুলা নীচু হওয়াতে পিড়িতে বসে
হুমায়রা চুলায় পাপড় ভাজছে। অপর চুলায় কি
ঠিক বুঝা যাচ্ছে না। তার ফর্সা মুখ গরমে লাল টকটকে হয়ে গেছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা আমাকে দেখে ব্যস্ত হয়ে বলছে,আরে এই ভাবী আফনে এইহানে আইছেন ক্যান? গরমে বইবেন কি কইরা ? আমি বলি, আপনারা যেভাবে বসছেন সেই ভাবেই বসবো।

হুমায়রা এবার তাকিয়ে ইশারা দিয়ে তাকে বলে,
একটা চেয়ার টেনে দেয়ার জন্য। আমি তার দিকে চেয়ে বলি, চাচী বললেন আপনি নাকি একটা স্কুলে পড়ান। দেখুন তো সারাদিন খেটে খুটে এসে না বলে কয়ে আসা, আমাদের জন্য এখন আবার কি ঝামেলায় পড়ে গেলেন। আমার আসলেই খুব খারাপ লাগছে। হুমায়রা ঝাজরিতে পাপড় তুলছে
আর হেসে হেসে বলছে, বলে কয়ে আসবেন কি করে ভাবী? আপনার শশুড়বাড়ির একটা মানুষও কি আমাদের কারো ফোন নম্বর জানে? তাহলে?
আপনি ভাববেন না, গরীবের এতো সহজে কষ্ট হয় না। তাদের শরীর আল্লাহ কঠিন ধাতুতে তৈরি করে দিয়েছেন। আমি মনে মনে বলি, চুপ করে থাক্ নওশীন। আবার কোন কথার জালে পড়বি।

ঐ মহিলা এবার ওকে বলছেন,আফা চুলা না দিলে মোরগের চামড়ার লোম পুড়ামু ক্যামতে? হুমায়রা চোখ তুলে বললো, তুমি দেখো না মামুন
কতো গুলো খড়ি জমা করে রাখছে। ঐগুলো তে
আগুন ধরিয়ে পুড়াও না কেন? সে চলে যেতেই
আমি উঠে বাসনের ষ্ট্যান্ড থেকে ট্রে নিয়ে এসে সেমাই আর পাপড় তুলে রাখি। হুমায়রা ঘন দুধ
দিয়ে চা বানাচ্ছিলো। হেসে বললো, আপনি কি এসব করেন না কি? শুধু শুধু কষ্ট করছেন। আমি হেসে বলি, করি না মানে? আপনার ভাই রীতিমত
শর্ত দিয়ে বিয়ে করে এনেছে। সে সহ পরিবারের সবার খেয়াল যেন রাখি‌। এবার সে এতো অবাক
হয়েছে যে, আমি দ্বিধায় পড়ে গেছি। চা বানানো বন্ধ করে সেকেন্ড দশেক আমার দিকে তাকিয়ে বললো,বড়চাচীর আসলেই ভাগ্য ভীষণ ভালো। আমরা সবাই ভেবেছিলাম, বুড়ো বয়সে তার অনেক কষ্ট হবে। এখন দেখি ছেলে,বৌ অনেক কেয়ার করছে তাকে। বুঝলেন ভাবী, কোনো কোনো মানুষকে আল্লাহতাআলা দুনিয়াতে এতো
বেহিসাব সৌভাগ্য, শান্তি দিয়ে পাঠিয়েছেন। তারা
দেখবেন খুব কম মানসিক ও শারীরিক কষ্ট পায়।

আমি বুঝি কোনো কারণে এরা মায়ের উপর ভীষণ খেপে আছে। অনেকগুলো কাপে চা ঢালল
সে। এবার বিড়বিড় করে বলছে, আমার মায়ের
কারবার !!! সকালের পাওয়া সব দুধ আমাকে দিয়ে ঘন করিয়েছে। ঘন দুধ ছাড়া নাকি চা মজা হয়না। আরে বাবা, আপনারা কতো মজার মজার খাবার খান। মনে হচ্ছে, এখানে এই মজার চা না
খেলে আপনাদের যেন খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। মা
আগেও বোকা ছিল এখনো আছে আর দেখবেন ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনো উন্নতি হবে না তার।
চা এর সব কাপ আরেকটা ট্রে তে নিতেই আমি অন্যটা নিয়ে হাঁটা দিলাম। ভয় লাগছে আবার কি
শুনি।পিছন ফিরে দেখি মন্থর পায়ে হেঁটে আসছে।

চাচী একদম হুলস্থুল লাগিয়ে দিয়েছেন। হুমায়রা কে বলছেন, বাচ্চাদের জন্য দুই কাপ দুধ নিয়ে আয়। হুমায়রা এনে টেবিলে রেখে বললো, তুমি একটু শুনে যাওতো মা। চাচী ওর সাথে যেতেই আমি ভাবছি, এই অবস্থার মাঝে মোরগ জবাই দেয়া হয়েছে। এখন আবার ভাতের ব্যবস্থা করতে
কতো ঝক্কি পোহাতে হবে তাদের। বাবা কে সেমাই
ও চা খাইয়ে দিয়ে দেখি, সিমিন চাচীর হাতে দুধ খাচ্ছে আর ইভান তার হাতে খাবে বলে বায়না ধরেছে। এবার মাহিরকে ইশারা দিয়ে উঠোনে নিতেই বলে, বাহ্ নওশীন তোমার তো খুব উন্নতি হয়েছে। কি রকম ইশারা দিয়ে আমাকে বের করে প্রেম করতে এখানে নিয়ে এসেছো !!! আমি বলি, আমার খেয়ে দেয়ে আর কাজ নাই তো তোমার সাথে প্রেম করতে আসবো।

আমি……..বলে কথা শেষ করতে পারিনি বলছে, আজকের যত কাজ ছিল সাগরে ফেলে তোমার সীমানা কতটুকু তা বোঝাতে নিয়ে এসেছি। এর কি কোনো পুরস্কার নেই? আমি মৃদু হেসে বলি,
বেশ তো বলো পুরস্কার কি চাও তুমি? সে বললো,
রাতে কিছু কথা বলবো। তুমি সেটা খুব মন দিয়ে শুনবে। তাহলেই হবে। এখন বলো কি বলতে এসেছিলে? আমি সবকিছু খুলে বলে যোগ করলাম, শেষ সময়ে আসা ঠিক হলো। কিছুই তো এদের জন্য আনলাম না। তুমি কি মাছ বাজারে গিয়ে দেখবে বড়মাছ পাও কিনা? মাহির রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বললো,বেলা বাজে সোয়া দুইটা। এখন মাছ নিয়ে আসতে গেলে বাসায় যাবো কখন? তুমি মোরগ খাওয়া নিয়ে চিন্তা করো না। আমি এমনিতেই চাচী কে বেশ ভালো একটা এমাউন্ট দিয়ে যাবো। এতো কিছুর পরেও তিনি আন্তরিক ভাবে যে ভালবাসা দেখিয়েছেন, তার তো আর দাম হয় না। তবে মনে মনে ঠিক করে রেখেছি এখনো ওদের বলিনি, আমি স্থায়ী ভালো একটা আয়ের উৎস দেখাতে চাই ওদের। কারো মুখাপেক্ষী যাতে ওরা আর না হয়।

রান্নাঘরে ট্রেতে করে খালি বাসন রেখে আসলাম। লাল শাক বাছছে হুমায়রা,আর ঔ মহিলা মশলা বাটছেন। অনেক ধোঁয়া রান্নাঘরে, আমি বসতে চাইলেও এবার হুমায়রা আমাকে আর বসতে দিলো না।

ঘরে ঢুকতেই বাবা বলছেন,ও বৌমা ছোটন না কি
কি সুন্দর সবজি বাগান করছে। চলো তুমি আমি দেখে আসি। আমি কিছু বলার আগেই মাহির বলল, বাইরে অনেক রোদ বাবা। তুমি অনেক কষ্ট পাবে। তোমার বৌমা যাক্, মোবাইলে ফটো তুলে এনে তোমাকে দেখিয়ে দিবে না হয়। কি যেন ভেবে
রাজি হলেন। আমি চাচার সাথে গিয়ে দেখি কতো সুন্দর করে যে সবজি বাগান করা যায়……. এটা
না দেখলে বুঝতে পারতাম না। চাচা উদার মনে বলছেন বলো তো মা তুমি কি কি নিতে চাও? যা যা তোমার পছন্দের সব নিয়ে যাও। ভাইজান আমাকে বলেছে, তুমি না থাকলে নাকি আসাই হতো না তার। একটা পরিবারকে খুশি করতে বা কষ্ট দিতে বৌদের যে অনেক বড় অবদান আছে
……….. আজকে আবার তুমি মনে করিয়ে দিলে।

অনেক বছর আগে তোমার শাশুড়ি সেটা মনে করিয়েছিলেন। তুমি যেভাবে দেখছো সেভাবে আমরা ছিলাম না মা। ভাইজান কঠোর পরিশ্রমের পর যখন সফল হলেন, আমাদের দুই ভাইকে অনেক কিছু করেছেন। আপদে বিপদে সবসময় পাশে থাকতেন। কিন্তু ভাবী কোনো দিনই এসব পছন্দ করতেন না। একবার রেগে গিয়ে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সব সাহায্য বন্ধ করে দিতে চাইলেন। যন্ত্রণা সহ্য করে ভাইজান তারপরও অনেক বছর দেখে গেছেন। এরপর একদিন হয়তো ভেবেছেন নিজের শান্তির জন্য ভাইদের না হয় ছেড়ে দেই। আমাদের কারো সাথে ফোনে কথা বলার তিনি সহ্য করতে পারতেন না। আমার আরেক ভাইয়ের মৃত্যুর পর শেষ দেখা ভাইজান ও তার ছেলেদের সাথে।

তারও অনেক বছর আগে, আমার দ্বিতীয় মেয়ের
বিয়ে ঠিক করে টাকার কথা বলতে বাসায় গিয়ে ছিলাম। ভাইজান বাসায় ছিলেন না,ভাবী অনেক কড়া কড়া কথা শুনিয়ে বিদায় দিয়েছিলেন। খুব বাজে ভাবে বলেছিলেন,বৌ না পালতে না পারলে
………… থাক্ মা বাজে কথায় শুধু দুর্গন্ধই ছড়ায়।
এসব তোমাকে বললাম কারণ তুমি ভাবতে পারো
যতদিন ভাই দিয়েছেন ততদিন আমরা যোগাযোগ রেখেছি মনে হয়। কতোজন মানুষের দিল ঠান্ডা করেছো আজ……. তুমি নিজেও জানো না মা। তুমি তো কি নিবে বলছোই না। আচ্ছা আমি দিয়ে
দিবো, তোমার কষ্ট হচ্ছে দাঁড়াতে চলে এসো।

বের হয়ে দেখালেন,ওই ভাইয়ের অংশ টুকু বিক্রি
করে ছেলেরা শহরে চলে গেছে। মাঝে মাঝে আসে, এটুকুই। দেখো মা মায়ের পেটের তিন ভাই
এর তিন রকম ভাগ্য। তোমার চাচী প্রায়ই বলেন,
মায়ের এতটুক্ পেটে সব বাচ্চার জায়গা হয় কিন্তু সারা দুনিয়ায় হয় না। কথাটা খুব সত্যি রে মা। অনেকবার ভেবেছি ওখানে গিয়ে খাবো না,বসবো না শুধু একবার ভাইজান কে দেখে চলে আসবো।
কিন্তু মন আর সায় দেয়নি। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর আগে দুজনে মিলে এতোটা সময় কাটালাম………
এটাই আমার অনেক বড় পাওয়া। তোমাকে এর উত্তম প্রতিদান নিশ্চয়ই আল্লাহতাআলা দিবেন।সম্পর্ক জোড়া লাগানোর সওয়াব বেহিসাব মা। আমি চেয়ে দেখি, চোখের পানিতে দাড়ি ভিজে গেছে চাচার। চিরকালের ইডিয়ট নওশীন তখন
তাকে ধরে কাঁদতে শুরু করেছে।

ঘরে ঢুকতেই দেখি খালি গায়ের মহব্বত আলী ও তার স্ত্রী মোরগের পশম তিনি পুড়িয়েছিলেন সেই ছমিরণ দৌড়াদৌড়ি করে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করছেন। চাচী টিউবওয়েল থেকে প্রথমে চেপে চেপে কিছু পানি ফেলে ঠান্ডা পানি আনার জন্য বলছেন। মহব্বত আলীকে বুঝিয়ে বলছেন, কোন গাছ থেকে গন্ধরাজ লেবু ও বোম্বাই মরিচ পেড়ে আনবে। আবার উল্টো পাল্টা যেন না করে।

আমার চোখ আর বশ মানেনি, এতো ভালবাসার স্রোত দেখে অঝোর ধারায় আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মনে হয়েছে খাঁটি মানুষ দেখতে হলে, কেউ গ্ৰামের এই সহজ সরল মানুষ গুলো দেখে যা। চুপ করে বারান্দার এককোণে গিয়ে চোখ মুছতেই দেখি, হুমায়রা পাশে এসে জড়িয়ে ধরে পরম মমতায় জিজ্ঞেস করছে, কি হয়েছে ভাবী? কেউ কিছু বলেছে? এতো কাঁদছেন কেন বলেন ? আমি তাকে কি বলবো বুঝতে না পেরে বললাম, কিছু না। চাচাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেছে। সে “ও আমার আল্লাহ” !!! বলে এবার আমায় আদর করছে।

(চলবে)

আত্মা পর্ব-০৩

0

###আত্মা(৩য় পর্ব)
###লাকি রশীদ

মাহির যেন অদ্ভুত কোনো কথা শুনছে এমন ভাবে বলে উঠলো, কোথায় যাবে? বাড়ি? বাড়ি কোথায় তুমি সেটা আদৌ জানো? ওখানে কে থাকে তুমি চেনো? ইদানিং একটু বেশি বেশি করছো মনে হচ্ছে না? অতিরিক্ত ভালো ও মহৎ সাজার চেষ্টা
করো না নওশীন। এটা তোমার জন্য কিন্তু মোটেই ভালো হবে না। আমি ভেবে দেখলাম, সম্পুর্ন দোষ
আমার। আমি আসলেই আগে মাহির এর সাথে কথা বলে বাবাকে প্রমিজ করা উচিত ছিল। কিন্তু, ভুল তো অলরেডি করে ফেলেছি। এখন এই ভুল সংশোধন করি কিভাবে?

গলা নামিয়ে বলি,আমি স্বীকার করছি আমার হুট করে বাবাকে এসব বলা উচিত হয়নি। কিন্তু,তখন যদি তুমি ঐ পরিস্থিতি দেখতে……..তাহলে হয়তো
বুঝতে পারতে। সামলানো মুশকিল ছিল বাবাকে।আর কি একটা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন, সেজন্য দুঃখে বলে ফেলেছি। আমার কথা বিশ্বাস না হলে মাকে জিজ্ঞেস করো। এবার সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলছে, আমি তো আর তোমার মতো এতো সহৃদয় ও বুদ্ধির সাগর নই। সুতরাং,কারোর ই বাড়িতে যাওয়া হবে না। এটা শুনে এতোক্ষণ ধরে নিশ্চল হয়ে তাকিয়ে থাকা আমার শশুড় কি বুঝলেন আল্লাহ মালুম, আমার হাত ধরে বলছেন
আমি বলেছিলাম না মা,এরা মা ছেলেরা কোনো ভাবেই আমাদের যেতে দিবে না। তুমিও ওদের মতো বাটপারি করো না মা। তুমি কিন্তু আমাকে কথা দিয়েছো, আগামী কাল আমাকে নিয়ে যাবে।

আমি ও আমার শাশুড়ি কে শুনিয়ে শুনিয়ে এবার মাহির বলছে,হ্যা পরের মেয়ে তো নিজের ছেলের থেকে ভালো হবেই। বেশি বাড় বেড়ে গেছে এবার।
যা ইচ্ছে যেন তাই করছে। কথা দিয়েছি !!! হুহ্ !!!
চলো বাবা তোমাকে রুমে দিয়ে আসি। মা চলো তো। আমার শশুড় ওর দিকে কড়াদৃষ্টিতে তাকিয়ে
তারপর বলে বলে যাচ্ছেন, আমি আর তুমি কিন্তু কালকে আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি বৌমা। মনে করে বেশি বেশি কাপড়চোপড় নিয়ে যেতে হবে।
তোমার না চিনলেও হবে। আমার বাবা ছিলেন মোকাম্মেল মাষ্টার। তার বাড়ি বললেই যে কেউ
দেখিয়ে দিবে। বুঝতে পারছো তো বৌমা? ভোরে উঠে রওয়ানা দিতে হবে কিন্তু। তিনি কথা বলছেন,
আর আমার মনে হচ্ছে নির্বোধ,অসহায় এক নারী কে গাছের সাথে বেঁধে প্রচন্ড বড় বড় গদা দিয়ে
অনেক মারছে আর বোকা গালি দিয়ে যাচ্ছে। একটু বুদ্ধিও কোথায় দেখাতে পারিস না নওশীন?

বাবা মা কে রুমে দিয়ে এসে এখনো মাথায় হাত চেপে বসে আছি দেখে মাহির পাশের চেয়ারে বসে
বলছে, শোনো আমি তোমার শত্রু নই। আমি জানি বাবাকে তুমি অনেক ভালবাসো। কিন্তু, মাঝে মাঝে আবেগটা কন্ট্রোলে রেখে মাথাটা কাজে লাগানো উচিত। তুমি জানো গত কয়েক বছর ধরে বাড়িতে আমরা যাইনি? আমাদের খুব ভালো অবস্থা থাকলেও ওদের কোনো দিনই খবর নেয়া হয়নি। আমার নানাবাড়ির সবার এই বাসায় অবাধ বিচরণ দেখলেও,দাদাবাড়ির কাউকে কখনো দেখিনি। এর রহস্য আমি জানি না আর জানতে চাইও না। ৩ ভাইয়ের মধ্যে আমার বাবা সবচেয়ে বড়। ছোট ২ ভাই ও ২ বোন। বড়চাচা মারা গেলে আমরা ভাইরা তখন বাবার সাথে গিয়েছিলাম। সেই শেষ তাও অনেক বছর পেরিয়ে গেছে।এই অবস্থায় ওখানে বাবা গেলে কোন মোক্ষ লাভ হবে বলতে পারো? আর ওরাই বা কি
ভাববে বলো তো? একটু চিন্তা ভাবনা করে সব ডিশিসন নেয়া ভালো না?

আমি এবার বলি, তোমার অস্বস্তি লাগলে যেতে হবে না। আমরা যাই, একটা লোক শুধু আমাদের সাথে দিয়ে দিবে প্লিজ। রমু থাকলে তাও বলতাম না। জন্মস্থান দেখতে ইচ্ছে করছে মনে হয়, আমি কথা দিয়েছি কাল যাবো। না গেলে বাবা আর কোনো দিন বিশ্বাস করবেন না আমাকে। প্লিজ মাহির আপত্তি করো না। ক্রোধে এবার অগ্নিশর্মা হয়ে গেল সে। চিৎকার করছে,সময় নিয়ে আমি এতোক্ষণ বুঝানোর পরও তুমি একই আগের
বুলি কপচাও !!! তোমার বাবা মা আসলে তোমার পড়াশোনা বুঝেশুনে ই বন্ধ করে বিয়ে দিয়েছেন। নয়তো তুমি তাদের একহাটে কিনে অন্যহাটে বেচে
দিতে পারতে। সারা গায়ে কে যেন আমার বিছুটি পাতা ঘঁষে দিয়েছে।সাথে সাথে আমি দাঁড়িয়ে বলি, ঠিক করেছেন না ভুল করেছেন সেটা না হয় তুমি আমাকে বুঝতে দাও। তুমি এতে নাক না গলিয়ে অন্য কাজ করো। এরপর সোজা রান্নাঘরে চলে গেছি।

রাতে খাওয়ানোর সময় বাবা বাচ্চাদের মতো হাত ধরে বলছেন,গাড়ি কয়টায় আসবে গো মা? আমি আমার শাশুড়ির দিকে তাকাই, উনি বুঝতে পেরে বলেন, আসবে আসবে সকালে আসবে। খাওয়ার সময় কথা বললে, গলায় বেঁধে যাবে। আমি বেশ বুঝতে পারছি, খুব কষ্ট করে খাচ্ছেন। চিকন চালের গলা ভাত, আমি একটু জাউয়ের মতো মেথি আর পেঁয়াজ দিয়ে বাগাড়(ফোড়ন) দিয়ে আনি। যখনি বানাই বুকটা হু হু করে কেঁদে ওঠে। আমার বিয়ের পর,উচ্ছল প্রাণবন্ত মানুষটা এক দিন আমাকে বলেছিলেন,নরম খাবারের সাথে আমার চিরকালের আড়ি রে মা। আমি খুব শক্ত খাবার খেতে পছন্দ করি। আমার মা কি বলতেন জানো, ভাত দিয়ে যদি চোখ কানা না করা যায়…..
তবে সেটা খেয়ে লাভ কি? বলেই হা হা করে জোরে হেসে উঠতেন‌। এখন স্বাভাবিক ভাত ই খেতে পারেন না। চিবোতে গেলে মনে হয় কষ্ট হচ্ছে খুব। একটু প্রোটিন শরীরে যাবে ভেবে এক পিস মাছ ভাজা এনে বেছে ভাতের সাথে মিশিয়ে দিয়েছি। দিন দিন যেন শক্তিহীন হয়ে পড়ছেন।

ভাত খাইয়ে সাথে সাথে ঔষধ খাওয়ালে বমি হয়ে যায়। একটু বসে গল্প করে তারপর ঔষধ দেই। কতো কিছু যে গল্প করছেন,তার দক্ষিণের ঘরের চাচা কিছুক্ষণ আগে না কি তাকে দেখতে এসে ছিলেন। আমি কি ভালো করে তাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছি? না হয় রাতে তার ক্ষিদে পাবে। তখন সবাইকে বকা দিবেন। আমি অনেক আগে মারা যাওয়া তার সেই অদেখা, অচেনা চাচাকে খুব ভালো করে আদর যত্ন করেছি বলি। তখন আবার ভীষণ খুশি। প্রতিদিনের তুলনায় আজ একটু বেশি সময় এই রুমে থাকা হয়েছে। রহিমা এসে এবার বলছে,মামী মামায় আপনারে বুলায়। আমার শাশুড়ি এবার ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন, তুমি তাড়াতাড়ি যাও তো বৌমা। মাহির ডাকছে মনে হয়। এবার চাপা স্বরে বলছেন, কালকের যাওয়া
নিয়ে আর বেশি উচ্চবাচ্য করোনা বৌমা। জানোই
তো মাহির রেগে গেলে যেন চন্ডাল রাগ উঠে ওর।
তোমার শশুড় কিছুক্ষণ চেঁচিয়ে ঠিক হয়ে যাবে।

রুমে ঢুকতেই মাহির বলছে, তারিন তোমার ফোনে
বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে। মোবাইল সঙ্গে রাখো না কেন? দেখো কোনো জরুরি কিছু নাকি?
তারিন ধরেই স্বভাবসুলভ ভাবে কতোক্ষণ চেঁচাল,
সংসার কি শুধু তুই একা করছিস না কি? রাত সাড়ে দশটায় ফোন করলেও তোকে মিলে না? শোন এতো গাধার খাটুনি খেটে কোনো লাভ নেই।যেসময় সেবা দেয়া বন্ধ করবি, আবার খারাপ হয়ে যাবি। আমি মৃদু স্বরে বলি, আমি তো গাধাই।
কি জন্য করেছিস বল্? এবার বলছে, কালকে
লিঙ্কন ভাইয়ার এনিভার্সারির দাওয়াত দেয় নি তোকে? সন্ধ্যার ঠিক পর পর আমরা একসাথে যাবো বুঝলি? তুই তোর গাড়িতে ভাইয়াকে নিয়ে, আমি আমার টাতে শাফকাতকে নিয়ে এদিকে চলে গেলাম। চাচ্ছিলাম একরকম শাড়ি পরে দুইবোন যাবো। কি পরা যায় বলতো?

আমি এবার বলি, আমি যাচ্ছি না। তুই তোর নতুন
জামদানি পরে যেতে পারিস। বিটরুট কালারের
শাড়িটা আসলেই সুন্দর হয়েছে। এখন রাখি রে।
জোরে এবার চেঁচিয়ে উঠলো, খবরদার ফোন রাখবি না বলে দিলাম। কেন যাবি না সেটা আগে বল্। আমি শক্ত গলায় বলি, ভালো লাগছে না তাই যাবো না। পরে কথা হবে,বাই। কোনো দিকে না তাকিয়ে নাইটি নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেছি। ঘুমে মনে হয় পড়ে যাচ্ছি। কোনোমতে ব্রাশ
করেই বের হয়ে বিছানায়। ইভান আলাদা রুমে শোয়। সিমিন কে একপাশে শুইয়ে দিয়েছে ওর বাবা। বিছানায় গা লাগাতেই মাহির বলে, কোথায়
যাবার কথা বলছিল তারিন?

বালিশ ঠিক করতে করতে বলি,লিঙ্কন ভাইয়ার এনিভার্সারিতে। এবার সে বলছে,ও সেটা কালকে নাকি? আমি আর জবাব দেই না। মনে মনে বলি,
আজকের মতো অনেক কথা বলে ফেলেছো নওশীন। এতো বকবক করার দরকার নেই, চেনা সেই ঘেরাটোপে বন্দী হয়ে যাও তুমি। এভাবেই চলা ঠিক হবে তোমার জন্য। মাহির এবার কাছে টেনে বলছে,রাগ করেছো? আমি মাথা নেড়ে বলি,
সীমানা ভুলে গেলে এসব তো হবার ই কথা। রাগ করবো কেন? তোমার সাইডের লাইট অফ করো প্লিজ। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এবার বলছে, এটা বলে তো মেরে ফেললে ডিয়ার। তোমার সীমানা কতোটা সেটা তুমি জানোই না আসলে। আমি চুপ
করে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। কথা বলতেই ইচ্ছে করছে না। ঘুমানোর সময়ই কি শুধু তোমার হৃদয় প্রেমসিক্ত হয় মাহির……… সেটাই ভাবছি।

কিন্তু সব ভাবনা মিথ্যে করে দিয়ে মাহির বলে উঠলো, ঠিক আছে কালকে বাড়িতে যাচ্ছি আমরা। কিন্তু সকাল সকাল উঠে অস্থির বানিয়ে ফেলো না। দশটার দিকে রওনা হবো। বাচ্চারা
স্কুলে যাচ্ছে না যখন তাদেরকেও ভোরে ডাকার দরকার নেই। আমি আমার নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছি না। তড়াক করে উঠে বলি,
সত্যি? কালকে যাচ্ছি আমরা? সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই পা দুটো মেঝেতে নেমে গেছে আমার। এবার বলছে,আশ্চর্য এখন আবার কই যাও? আমি বলি, মাকে বলে আসি। না হয় সারা রাত এটা নিয়ে ভাববেন।

রুমে ঢুকে দেখি আমার শাশুড়ি বেতের সোফায় বসে আছেন। আর শশুড় তার বড় এক গামছাতে
লুঙ্গি, পাঞ্জাবি এসব ঢুকিয়ে কোনাগুলো বাঁধতে চেষ্টা করছেন। আমাকে দেখেই হাসতে হাসতে বললেন,কিছু কাপড় বেঁধে নিয়েছি বৌমা। তোমার
শাশুড়ি কে বলে বলে হয়রান, কথা ই শুনছে না সে। শুধু বলে,যাওয়ার সময় আমি নিবো তো বললাম। আমার চোখ দুটো জ্বালা করে উঠলো,
যদি মাহির যেতে রাজি না হতো তবে এই বৃদ্ধকে
সামলানো কি আদৌও সম্ভব হতো? মনটা ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যেতো না তার? আমি শীর্ণকায় হাত দুটো ধরে বলি, না ঘুমালে আপনার ছেলে তো আবার হাঙ্গামা করবে বাবা। বলবে,যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমান।

সকালে আপনাকে ডেকে দিবো। ঠিক ইভান যেভাবে বলে সেরকম করে বলছেন, আমার ঘুম আসছে না মা। আমি বলি, ঘুম কি এভাবে বসে থাকলে আসবে বাবা? শুয়ে চোখ বুজে থাকুন, আসবে ইনশাআল্লাহ। মাকে বলি, আসেন তো মা আপনিও শুয়ে পড়ুন। আমি ডিমলাইট জ্বালিয়ে দিয়ে যাচ্ছি। বের হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আমি বারবার বলছি, আল্লাহ তাআলা আপনার প্রতি শোকরিয়া জানাচ্ছি মাহিরের মনটা বদলে দেবার জন্য। আমি কি বললে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পাবে? আসলেই আপনি হৃদয় পরিবর্তনকারী। আপনি আমাকে কতো বড় অসম্মান থেকে যে বাঁচিয়ে দিলেন। আমি কায়মনে আপনার শোকর আদায় করছি।

সকালে উঠে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসেছি। আমাকে গদাইলস্করি চালে চলতে দেখে রহিমা অবাক হয়ে বলছে,ও মামী ভুইল্যা গেছেন আইজ শুক্কুরবার
না বিষুধবার। ইভান এখানে থাকলে এখন তাকে শুক্র ও বৃহস্পতি জপাতে থাকতো। আমি হেসে বলি, আমি জানি তো। কিন্তু তোর মামা রাতে বলেছে, আমাদের কে আজ বাড়িতে নিয়ে যাবে।
তুইও যাচ্ছিস, বাচ্চারা যাবে তো। এবার সে হেসে
আইতাছি মামী বলেই দৌড় দিয়েছে। সেলিমা এবার গজগজ করছে, কেন আমি এত তাড়াতাড়ি ওকে যাবার কথা বললাম? এবার ড্রেস নির্বাচন ও
সাজগোজ করতে করতে ই দিন যাবে। আমি বলি
তোমার বয়স আর ওর বয়স কি সমান না কি? বাচ্চা একটা মেয়ে, ও যা করতে চাচ্ছে করুক।

দশটায় বের হবো বললেও বের হতে হতেই এগারোটা বাজলো। গাড়িতে উঠে সিমিনের খুশি দেখে কে? অনবরত হাততালি দিচ্ছে আর আমায়
বাইরের দিকে তাকাতে বলছে। সবচেয়ে ভালো লাগছে আমার শশুড়কে। ইস্ত্রী করা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি ও লুঙ্গিতে ফিটফাট হয়ে বসেছেন। মাহির অনেক বলেছে, প্যান্ট না পরলে পায়জামা
অন্তত পরো‌। উনি বলছেন,না লুঙ্গি পরেই যাবো।পরে আমি বলেছি, ঠিক আছে। বাবার কাপড় আরামদায়ক না হলে,পরে কষ্ট পাবেন তো। তার ছেলে এবার বলছে,তাই বলে লুঙ্গি !!! ছেলের এই পরাজয়ে বাবা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছেন।
কিন্তু অজ্ঞাত কারণে আমার শাশুড়ি ভীষণ রকম অস্বস্তিতে যেন পড়েছেন। কিচ্ছু বলছেন না, কিন্তু চুপ করে আছেন।

মাহির সামনে বসেছিল, তার ইম্পোর্টেন্ট কি কি ফোন কল নাকি সারবে। শহর ছাড়িয়ে কিছুদূর এগুতেই এবড়ো থেবড়ো রাস্তায় আমরা সবাই অনবরত ঝাঁকি খাচ্ছি দেখে সে গাড়ি থামিয়ে পিছনে এসে বসলো। সিমিন কে তার কোলে নিল,
তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলছে বাড়িতে যাব
বলে বলে অস্থির হয়ে এলে। কি খারাপ রাস্তা !!! সেটা দেখেছো? বাবা বলছেন,চৌমাথার বাজার এলেই ভালো রাস্তা পাবি। এবার সে হেসে বাবাকে বলছে, বলতো বাবা কে বেশি ভালো আমি না তোমার বৌমা? একসেকেন্ডও না ভেবে হাসিমুখে বললেন, আমার বৌমা বেশি ভালো। ঠিক বলেছি না বল্? মাহির হো হো করে হেসে উঠলো, একদম ঠিক বলেছো বাবা। তোমার কি কখনো ভুল হয়? আমার শাশুড়ি এবার তার ছেলেকে বলছেন,
হুট করে কাউকে না জানিয়ে যাচ্ছি। তুই বাজার এলেই নেমে চাপাতা,দুধ,চিনি,২/৩ পদের বিস্কুট নিয়ে নে বাবা। মাহির বললো, ঠিক আছে বাজার আসুক। আমি কিনে নিবো মা।

ড্রাইভার এবার বললো,স্যার এই যে এইমাত্র আমরা সিতাবগঞ্জের বাজারে এসেছি। এখন কি আপনি নামবেন? মাহির নেমে সবকিছু নিয়ে এসেছে। এবার ড্রাইভার জিজ্ঞেস করে,কোনদিকে যাবো? মাহির বলছে, এটা তো জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছি। তুমি একটু কষ্ট করে নেমে দোকানে গিয়ে জিজ্ঞেস করে এসো মোকাম্মেল মাষ্টার মশাইয়ের বাড়ি কোথায়? আমার শশুড বলছেন, আরে জিজ্ঞেস করতে হবে না। সামান্য এগিয়ে বামদিকে গেলেই হবে। মাহির ড্রাইভারকে নামতে ইশারা করলো। দেখা গেল বাবার কথাই ঠিক। এই পথে ৫ মিনিট যেতেই গন্তব্যে পৌঁছে গেছি।

আমি গাড়ির গ্লাস দিয়ে তাকিয়ে দেখি, বাড়ির সামনের বিশাল সেই দীঘির অর্ধেকটাই ময়লা ও শ্যাওলায় বুজে গেছে। পানিও পরিস্কার নয়, অনেক ময়লা। ভাবছি, বাবা নেমে আরেকটা ধাক্কা খাবেন,যন্ত্রণা পাবেন। আমি জানি,স্বপ্লভঙ্গের যন্ত্রণা বড় তীব্র। সহ্য করা খুব কঠিন। এর চেয়ে কি আগের স্মৃতি নিয়েই চলে যাওয়া ভালো ছিল? কিন্তু তখন তো আবার আমরা প্রিয়জনেরাও আফসোস করতাম, বাবা দেখে যেতে পারলেন না বলে। পৃথিবীতে কোনটা যে ঠিক আর কোনটা যে ভুল তা বুঝা সত্যি ই বিষম দায়।

(চলবে)

আত্মা পর্ব-০২

0

###আত্মা(২য় পর্ব)
###লাকি রশীদ

রান্না চড়িয়েছি মাত্র,একতালে কলিংবেল বেজে উঠলো। এরকম বেল শুনলে আমরা বুঝতে পারি লিউনা এসেছে। আমার বড় ভাসুর সাহিলের মেয়ে সে। মনে হয় ঘোড়ায় জিন দিয়ে এসেছে।এক সেকেন্ড অপেক্ষা করতে চায় না। চট্ করে দরজা খুলে দিয়ে বলি, তোর কি জীবনেও বুদ্ধি শুদ্ধি হবে না? দাদা ঘুমিয়েছেন মনে থাকে না? এইবার জিহ্বা তে কামড় দিয়ে বলে,স্যরি নওশীন আমি ভুলে গিয়েছিলাম। আমার নিস্পৃহ ভাব দেখে ও কথা কম বলি দেখে এই বাসার বাচ্চারা আমার খুব একটা কাছে আসে না। কিন্তু লিউনা কে আটকায় কার সাধ্য !!! ক্লাশ নাইনে পড়ুয়া মেয়ে অনেকটা জোর করেই যেন এই জায়গা দখল করে নিয়েছে।

আমি চেয়ে দেখি,কি একটা লো কাটের টপস পরেছে। আর এতো আঁটসাঁট, বলার মতো না।
হাসিমুখে বললাম, কি রে সেদিন না বললাম এসব পরে বাইরে বের হবি না। পরলে শুধু বাসায় পরতে পারিস। এবার হেসে বলল, ভুলে গেছি । আমি মৃদু হেসে বলি, তোর তো বাবার চেয়েও অবস্থা খারাপ রে। যা ই বলছি তা ই ভুলে যাস্। বাসায় গিয়ে একদৌড়ে বদলে আয় তো মা। এবার তার গড়িমসি শুরু হয়েছে। আবার উপরে উঠবো? কথা দিচ্ছি আর এটা পরে বের হবো না। আজকে তেঁতুল ভর্তা করবে না? আমি বলি, তুই খেলে খুব করবো।

প্রেসার কুকারে তড়কা ডাল বসাচ্ছিলাম। দেখে
এখন সে নাড়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। বললাম,
তোর মা যদি জানে তবে আমাকে ভর্তা বানিয়ে দিবে। চতুর্দশী কিশোরী মৃদু হেসে বলল,হ্যা মার তো আর কাজ নাই, সমাজসেবা ছেড়ে আমার খোঁজ নিবে। বাবার কথাই আজকাল শোনে না।
আমি ধমকে উঠি,মা বাবার কথা আড়ি পেতে শুনে বাইরে বলতে হয় না। এবার ফোঁস করে উঠে, বাইরের কাউকে বলিনি তো। তোমাকে শুধু বলেছি। আমি বলি, তবুও। আল্লাহ তাআলা বলে
দিয়েছেন,আড়ি পেতে শুনলে কানে সীসা ঢালা হবে। এসব গোনাহের কাজ করার দরকার টা কি?
এবার বলছে,এসব যে গোনাহ সেটাই তো আমি জানতাম না। মাঝে মাঝে এই মেয়ে একেকটা কথা বলে,ইডিয়ট নওশীন কে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।

আমাকে রান্না শেষ করে আবার স্কুলে দৌড়ুতে হবে। বাচ্চারা ছোট বেলা থেকেই আমরা যা খাই তা ই খায়। সবজি ২ পদের, মাছ ভাজা, মাছের তরকারি ও ডাল আজকের আইটেম। মাহির ও তার ছেলের মাছ ভাজা ভীষণ পছন্দের। তেঁতুল ভর্তা খাওয়া চলছে আর চোখ দিয়ে পানি পড়ছে লিউনার। আমি বোম্বাই মরিচ কুচি কুচি করে দেই। প্রচন্ড ঝাল ছাড়া আমার মজা লাগে না। ওর জন্য এটা ছাড়া স্বাভাবিক ঝালে দিয়েছিলাম প্রথম দিন। খায়নি সে,তাই এভাবেই দেই‌।

আমার শাশুড়ি গোসল করে এসেছেন। লিউনাকে দেখেই শুরু হয়েছে, আমাকে বকা। শোনো বৌমা, তোমাকে ওর মা যেদিন এসে কথা শোনাবে সেদিন তোমার শিক্ষা হবে। ওর মা চায় না, আমাদের কারো সাথে তার বাচ্চারা মিশুক। আমি কিছু বলার আগেই, লিউনা উঠে সারেন্ডার এর ভঙ্গিতে বলছে, ঠিক আছে ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি। নওশীন কে এজন্য বকার কি হলো? মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, পৃথিবীতে কোথাও কেউ শুনেছে চাচীর নাম ধরে কেউ ডাকে? সে এবার দাদুকে রাগানোর তালে আছে, বলে বলে অনেকেই বলে। তুমি আদ্যিকালের বুড়ি,তুমি কি একালের কিছু জানো? বলেই ধুপধাপ শব্দ করে তেঁতুলের বাটি নিয়ে প্রস্থান।

আমার শাশুড়ি এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলছেন,
রাগ করে চলে গেল। আমি বলি, সারাদিন একা একা থাকে। এখানে আসলে হয়তো ওর ভালো লাগে মা। আমার শাশুড়ি বলছেন, তুমি চেনো না।
আমি ওর মাকে হাড়ে হাড়ে চিনি। প্রচন্ড ঝগড়ুটে
সে। আমার ভয় কোনো দিন যদি এসব ঝগড়া হয়
আর মাহিরের কানে যায় তবে কুরুক্ষেত্র বাধাবে।
আমি কোনো কথা না বলে উনার লেবুর শরবত দেই‌। গ্লাসের দিকে তাকিয়ে একমনে বলছেন, কি
একটা ভয় বুকে চেপে আছে বৌমা। বললাম,ভয়
কিসের?

সত্তোরোর্ধ বৃদ্ধা এবার টলটলে চোখে বলছেন,
তোমার উপর এতো নির্ভরশীল হয়েছি যে স্কুলে গেলেও মনে হয় তোমার শশুড় ক্ষেপে গেলে আমি কি করবো? রমুটা চলে এলে এতো ভয় হয়তো বা লাগতো না। আমি বলি,রহমত আলী কে বলে যাচ্ছি নীচে এখানে বসে থাকবে। আপনি দরকার পড়লে ডাক দিয়েন, উপরে চলে যাবে। এবার আরেক শঙ্কা জানাচ্ছেন, ওকে গেটে না দেখলে কেউ যদি রাগ করে মা? আমি হেসে বলি, বাড়ির কর্তা যে এই সবকিছু বানিয়েছেন, ছেলেরা শুধু তৈরি পেয়েছে……… তাকে দেখার চেয়েও গেট দেখা তো জরুরি নয় মা। এতো ভাববেন না।

রহমত আলীকে সবকিছু বুঝিয়ে বড়গেট লক্ করে চলে যেতে বলি। গাড়ি চলছে, এতোক্ষণ গরমে থেকে এসির ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভাবছি, এই যে এতো এতো কষ্ট করে আমাদের বাচ্চাদের বড় করা, আবদার সব মেটানো……….. কয়েকটি বছর একই বৃত্তে ওদের নিয়ে আবদ্ধ থেকে,বয়স হলে ওদের সাথে ই ভয়ে ভয়ে কথা বলতে হবে? বাড়ির বৃদ্ধ হর্তাকর্তা পড়ে যাওয়ার চেয়েও অন্যেরা গাড়ি সময়মতো ঢুকাতে না পারলে যদি ভীষণ রাগ করে………বাড়ির বৃদ্ধা কত্রীকে সেটাও ভাবতে হবে। অথচ এই বাচ্চাদের বাইরে কতো বোলচাল। কতো মানুষ এদেরকে সভ্য,ভব্য মনে করে।আমার বড়মামী ঠিকই বলতেন, নিজের পশমও আপন না রে মা। তখন বুঝতাম না, এখন ঠিকই বুঝি।

আমার শশুড় কে এতো ভালবাসার কারণ,আমার
বাবার সাথে যেন মিল খুঁজে পাই। অথচ দেখতে বা আচার আচরণে দুজন সম্পুর্ন বিপরীত চরিত্রের মানুষ। আমার বাবার গায়ের রং শ্যামলা
আর শশুড়ের গায়ের রং ধবধবে ফর্সা। আমার শশুড় ভীষণ আমুদে স্বভাবের আর বাবা ভীষণ রাশভারী। তারপরও দুজন ই শশ্রুমন্ডিত বলেই হয়তো বা আমার অবচেতন মনে এ ভাবনা কাজ করে। স্কুলের গেটে অভিভাবকদের ভিড় জমেছে।
ছুটির এখনো ১০ মিনিট বাকি। দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ সুমনা ভাবী জড়িয়ে ধরে বলছেন, আমার আজ ভাগ্য ভীষণ ভালো বলতে হবে। এতো কাছে থেকেও আমাকে তো আপনার দেখতে মন চায় না। আমি হেসে বলি, আমার ভাই সারাদিন দেখে,
আদর যত্ন করে……… তারপরও আমি দেখি না বলে আফসোস !!!

সুমনা ভাবীর স্বামী ভীষণ স্ত্রী পাগল সেটা সবাই জানে। কিন্তু, জীবনে একটা না একটা অপূর্ণতা তো থাকবেই। উনার কোনো বাচ্চা নেই। বাচ্চাদের
ভদ্রমহিলা এতো ভালবাসেন যে বলার মতো না। আমার মতোই শশুড় শাশুড়ি নিয়ে থাকেন। ছোট দেবর ও জা ডাক্তার। ওদের দুইটা বাচ্চাকে নিয়ে যেতে আসেন মাঝে মাঝে। আমাদের পাড়ায় ৩/৪
টা বাড়ির পেছনেই উনাদের বাসা। আরেক দেবর
ইংল্যান্ড এ পরিবার নিয়ে থাকে। দেখতে এতো সুন্দর ভদ্রমহিলা,যেন একটা স্নিগ্ধরুপ চারপাশে বিরাজ করে। ডাক্তারী পরীক্ষা শেষে যখন বুঝা যায় প্রবলেমটা উনার স্বামীর, তখন ভাইয়েরা নিয়ে যেতে চায়। নিশ্চিত উনারো সায় ছিল, নয়ত
ভাইয়েরা বলতো না।

তখন তার স্বামী অস্থির হয়ে গিয়েছিলেন। আমার শশুড়, শাশুড়ি কে ভাবীর শাশুড়ি খবর দিয়ে নিয়ে বলেছেন, আমার ছেলে ওকে ছাড়া পাগল হয়ে যাবে। আপনারা ভাইদের সাথে কথা বলে দেখেন, কি করলে ওকে এখানে রেখে যাবে ওরা। আমার বিবেচক শশুড় না কি তখন বলেছিলেন, ভাবী তার ভাইদের আগে তাকে জিজ্ঞেস করা উচিত। জীবন তো ওর, ডিসিশন নেবার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে ওর। উনার শাশুড়ি তখন বলেছেন, ওর হাতে ধরে বুঝিয়েছি। ও যাবে না বলেছে। আমার শশুড তখন না কি বলেছেন,
ওকে আমার সামনে এসে বলতে বলুন। মানুষকে জোর করে কিছু করানো ঠিক নয় ভাবী। এসব আমার শাশুড়ি গল্প করতে করতে আমায় বলে ছিলেন।

ভাবী আসতেই বাবা চেয়ারে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি করতে চাও মা। শোনো কারো জোরাজুরিতে কিছু বলতে হবে না। শুধু তোমার নিজের ইচ্ছা টা আমায় বলো। উনি বললেন,
আমি থাকবো চাচা। তবে আমার ভাইদের মতামত আপনাদের শুনতে হবে। পরের শুক্রবার ভাইরা দাবি জানালো, বাচ্চাকাচ্চা নেই। স্বামীর কিছু হলে শশুড়বাড়ি তাদের বোনকে লাথি মেরে বের করে দিবে। তাই বাসার জায়গার অর্ধেক তাদের বোনকে রেজিষ্ট্রি করে দিতে হবে। সুমনা ভাবীর স্বামী আফজাল ভাই তাতেও রাজি। বাবা তখন বললেন,সম্পত্তি তো তিন ভাইয়ের। আগে তাদের সাথে তুমি কথা বলে দেখো। ডিসিশন নিলে তাদেরকে জানাবে। ভাইরা কেউই রাজি হননি। পরে তাদের মা কান্নাকাটি করে অনুমতি আদায় করেছেন। রেজিস্ট্রি করে তাকে বাসার অর্ধেক লিখে দেয়া হয়। বাবা না কি মাকে বলে ছিলেন, সবকিছু সুমনার ইচ্ছেমতো হয়েছে। কিন্তু দেখাতে চেয়েছে ভাইয়েরা করেছে। এখানে এতো লুকোচুরির কি আছে, বুঝলাম না তো আমি।

আর মাহির তো উনাকে দেখতেই পারে না। কথা প্রসঙ্গে উনার কথা উঠলেই বলে,খবরদার নওশীন
এই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা হলে বেশি কথা বলো না। এতো চালাক উনি আর যতো দুর্বুদ্ধি উনার মনে আছে……… সব তোমাকে শিখিয়ে দিবেন। কিন্তু আমার উনাকে ভীষণ ভালো লাগে। আমুদে একজন মানুষ, খুব সুন্দর করে উনি কথা বলতে পারেন। আমি তো খারাপ কিছু দেখিনা। আমার কথার জবাব দিতে হাস্যমুখ করে বলেন, আপনার ভাই তার ভাগের আদর দেয়। তাই বলে আপনি আমাকে দেখতে বাসায় যাবেন না মোটেই? বলি,
ঠিক আছে একদিন সময় করে যাবো। ওইটা ই তো সমস্যা,টাইম ই পাই না সারাদিন। এই ১০ মিনিট দুজনে গল্প করতে করতে কাটালাম।

বাচ্চাদের নিয়ে গাড়িতে উঠতেই ইভান বায়না ধরেছে আইসক্রীম খাবে। আমি বলি, চুপচাপ বসে থাকো। ইনশাআল্লাহ পরে তোমায় খাওয়াব।
সে জেদ করতেই বললাম,বুঝো না দাদা দাদু একা আছে। এবার গাল ফুলিয়ে বসে আছে সে। আমি পাত্তা দেইনি। গেটের সামনে এসে দেখি,২ ভাবীর গাড়ি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে ভাবছি,
হায়রে !!! আজকেই তোমাদের সময়মতো আসতে
হলো। বাচ্চাসহ ভেতরে ঢুকে ড্রাইভারকে বলি,
আপনি আপনার স্যারের ওখানে চলে যান।

আমি ভেবেছিলাম দুই ভাবী হয়তো ঝগড়া করতে দাঁড়িয়ে আছেন। না কেউ নেই,দেখেই খুব শান্তি
লাগছে। কিন্তু বাসায় ঢুকতেই রহমত আলী ডেকে
বললো, সর্বনাশ হইছে মামী। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই হড়বড় করে বলে যাচ্ছে। আমি তো আর বুঝিনি এই মিনিট পঞ্চাশে কতো ঘটনা যে ঘটে যাবে। বলছে,আফনে যাওনের একটু পরেই তো মাইঝ্যা মামী আইছে। হর্ণ দিতাছে সমানে, তারপর আমারে ফোন দিসে। আমি কইছি,ছোট মামী এই
হানে বইতে কইয়্যা গেছে।সাথে সাথে গাল পাড়ছে
“হারামজাদা তোর চাকরি যদি আজকে না খাই”।
মামী আমি গরীব মানুষ, চাকরি গেলে খামু কি?
বললাম, বললাম তো তোমার চাকরি যাবে না।
শুধু কেউ কিছু বললে জবাব দিতে যেও না, মাথা গরম করো না। বাকিটা ইনশাআল্লাহ আমি দেখবো তো বললাম। তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। এখন গিয়ে তুমি বড়গেট খুলে গাড়ি দুটো ভেতরে ঢুকাও তো। সে মাথা নেড়ে নেড়ে চলে যাচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে ভীষণ চিন্তায় আছে সে।

সবসময় নিরুপদ্রব থাকার পক্ষপাতী এই আমি, কেন যেন আজ এসব করতে মোটেও ভয় লাগছে না। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমার শাশুড়ির চোখের জল দেখে এরকমটা হয়েছে। ভীষণ ভাবে দেউলিয়া একজন মানুষ ই মনে হয় অন্য একজন দেউলিয়া কে চিনতে পারে। নিজেদের ব্যবসা বলে মাহির ৬টার মধ্যেই চলে আসে। ও এলে তারপর আমরা সবাই মিলে চা নাস্তা করি। আজ গোসল
সেরে বের হতেই দুই ভাবী ও মেজভাই চলে এসে
ছেন। আমি এখনো মাহির কে কিছু বলিনি। ভেবে ছিলাম চা খাওয়ার পর ধীরে সুস্থে বলবো। কিন্তু বলার আগেই এরা এসে হাজির।

এসেই মেজভাই চিৎকার করছেন, কিরে তুই তোর বৌয়ের কাছে শুনেছিস নিশ্চয়ই সবকিছু। মাহির বুঝতে পারছে কিচ্ছু একটা ঝামেলা হয়েছে। সে মুখে বিদ্রুপের হাসি নিয়ে বললো, না কিছু তো শুনিনি। এই ব্যাপারে আমার বৌ আবার তোমার বৌয়ের চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে। মেজভাবীর মতো স্বামী ঘরে এলেই, সত্য মিথ্যা দিয়ে মুড়ে রাখা সারাদিনের সংসারের সব ঘটনা বলে না সে। এবার মেজভাই চেঁচিয়ে উঠেছেন,বড়ভাবী ও তোর ভাবী একঘন্টা গাড়ি বাইরে রেখেছে। কোন দেশে দারোয়ান কে ঘরের কাজের জন্য এনে বসিয়ে রাখা হয়? এটা তো শ্রেফ একটা দুষ্টামি।

এবার মাহির আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাতে
ই আমি স্পষ্টস্বরে বলি, আমি স্কুলে যাওয়ার সময় মা ভয় পাচ্ছিলেন, রমুও নেই। বাবা ক্ষেপে গেলে তিনি সামলাতে পারবেন কি না। তখন আমি রহমত আলী কে বড়গেট লক করে এখানে আসতে বলি। সাহায্য লাগলে মা ডাকার সাথে সাথেই যেন হাজির হতে পারে। আমি ওদের নিয়ে স্কুল থেকে ফিরে আসতে আসতে ৫০ মিনিট সময় গেছে। ইতিমধ্যে ভাবীরা আসায় তাদের গাড়ি বাইরে ছিল। এই হচ্ছে মূল ঘটনা।

ইডিয়ট মেজভাই বলছেন,মার এতো ভয় পাবার কি আছে? এটুকু বুদ্ধি নেই যে, দারোয়ান কে এসব কাজে লাগাতে হয় না। আমি আগের মতোই পরিষ্কার গলায় বলি, মা সেটা আমাকে বলেছিলেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, বাড়ির কর্তার চেয়ে অন্য কোনো কাজ ই ইম্পোর্টেন্ট নয়। তাই এ ব্যাবস্থা করে গেছি। এবার কান পাতলা মেজভাই চুপ। আমি তাদের ৩ জনের দিকে এবার তাকিয়ে বলি,বসুন আপনারা চা খেয়ে যাবেন। এবার মেজভাই বলছেন, না না ঠিক আছে। সারাদিনে এসেছে,মাহির কে তুমি চা দাও।

ওরা বের হয়ে যেতেই আমার শাশুড়ি এসে বসেছেন। বুঝাই যাচ্ছে ইচ্ছে করেই এতোক্ষণ সামনে আসেননি। মাহির একটা চেয়ারে বসে বলে, দশটা কথা জিজ্ঞেস করলে একটা উত্তর আসে আর এখন নেত্রীগিরি শুরু করেছো নাকি?
আসার সাথে সাথেই আমাকে এটা বললে কি হতো? আমি রান্নাঘরে যাবার জন্য পা বাড়াতেই বললো, কি হলো কথা শোনো না? আগে আমার কথার জবাব দিয়ে যাও। এতো সব কান্ড ঘটানোর আগে, আমাকে একটা ফোন দিলেই তো হতো। আমি কিছু বলে গেলে এরা কি বিচার দিতে এখন আসতে আসতে পারতো? আমি বলি, সবেমাত্র তো তুমি গেছো তাই আর বলিনি। মাহির কিছু বলার আগেই আমার শাশুড়ি কান্না করতে করতে বলছেন, নিজের পেটের বাচ্চারা যা বুঝেনি এই মেয়েটা তা বূঝে করছে। বাবা পড়ে গেলে সমস্যা নেই কিন্তু ঘন্টাখানেক গাড়ি বাইরে থাকলে সমস্যা আছে। ওকে এখন বকে আমাকে আর ধুলোয় মিশিয়ে দিস্ না। আমি মাহির কে বলি,বাবা কে ধরে ধরে নিয়ে আসো। আমি চা নাস্তা দিচ্ছি।

সবসময় শক্ত খাবার খেতে পছন্দ করা আমার শশুড় এখন নরম সবকিছু খান। সাগু, সেমাই, লাচ্ছা সেমাই,পায়েস,পাতলা খিচুড়ি…….এসবই তার খাবার। আজ একসাথে সবার জন্যই করেছি
বেশি দুধ দিয়ে বানানো সেমাই। মাহির বাটিতে নিয়ে চামচ দিয়ে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছে। বাবাও বাধ্য ছেলের খাচ্ছেন।আমার শাশুড়ির ডায়বেটিস
বলে নোনতা বিস্কুট দিয়ে খাচ্ছেন। হঠাৎ বাবা বলে উঠলেন, গাড়ি রেডি তো মা? এই আসমা আমাদের কাপড় চোপড় ব্যাগে ভরেছো? মাহির শোনেও কিছু বলছে না কারণ তিনি প্রায়ই এসব বলেন।

আমি মনে মনে ভাবছি,এক ঝড় শেষ না হতেই হতেই আবার অন্য ঝড় শুরু হবে না কি? কিন্তু বৃদ্ধ মানুষ টাকে কথা দিয়েছিলাম, কালকে
তার দীঘিওয়ালা বাড়িতে নিয়ে যাবো। তার বাবার তৈরি মোকাম্মেল মাষ্টারের বাড়ি নিয়ে যাবো‌। এটা শুনে কি অপরিসীম তৃপ্তিতে অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে উঠেছেন। এবার পিছন ফিরি কিভাবে? আবেগে
কথা দিয়ে এখন মনে হচ্ছে,পরশু বললাম না কেন? কালকে তো অনডে। কিন্তু, গোয়ার মাহির কে ম্যানেজ করবো কিভাবে? বেশ ভালো দুর্ভোগে পড়লাম মনে হচ্ছে।

মেয়েকে নীচু গলায় গল্প বলে বলে খাওয়াচ্ছি। হঠাৎ মনে হলো,কি এক অর্থহীন বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছি শুধু আমি। আমার এসব আর ভালো লাগে না। এতো ভালো বৌমা সেজে, ভালো বৌ সেজে, ভালো মা সেজে থাকতে মোটেও ইচ্ছে করছে না। একটানে সব আবরণ ছিড়ে দূর কোথাও চলে যেতে মন চাইছে। মনে হচ্ছে স্কুল জীবনের টিফিন টাইমের ঘন্টা বাজুক, কাগজের মধ্যে ঝাল চালতার আচার মাখা কিনে এনে খাবো। তারপর অকারণে হি হি করে বন্ধুরা সবাই হাসতে হাসতে কলের পাড়ে হাত ধুতে যাবো। কিন্তু কল্পনায়ও সেই শান্তিরাজ্যে ঢোকার সব দরজা তো আমার বাবা মা রীতিমতো বন্ধ করে দিয়েছেন।

সিমিন কে ট্যিসু দিয়ে মুখ মুছিয়ে নামাতেই, মাহির বলছে সবকিছু রেখে চা খাও আগে। ঠান্ডা হয়ে যাবে। আমার চা খেতে খেতে মনে হয়,ধ্যাত এতো এতো চিন্তা না করে বলে দিলেই তো হয়। ইভান এর সাথে খোশগল্প রত মাহির এর দিকে তাকিয়ে এবার ধুম করে বলে উঠি, আগামীকাল কিন্তু মা ও আমি বাবাকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে যাচ্ছি।

(চলবে)

আত্মা পর্ব-০১

0

###আত্মা(১ম পর্ব)
###লাকি রশীদ

রাতে চুলে তেল দিয়ে রেখেছিলাম। তারিন এক মাস আগে হারবাল তেল নিয়ে এসেছে। অনেক বার দিতেও বলেছে। মাথায় তেল দিলে আমার প্রচন্ড গরম লাগে। সারা রাত গা যেন কেমন এক টা খিতখিত করে। মাস দুয়েক আগে জোর করে দিয়ে গেছে তারিন,সেও নাকি এটা ব্যবহার করে খুব উপকার পেয়েছে। বেসরকারি এক মোবাইল কোম্পানির উঁচু পদে আসীন তারিন আফসোস করে শেষ, এতো সুন্দর ঘন লম্বা চুল তোর আপু।
একটু যত্ন করলে কি হয়? কি রে দিবি তো? রাতে চুলের গোড়ায় ঘষে ঘষে লাগাবি, সকালে শ্যাম্পু করে ফেলবি। আমি তখন বলেছি, দিবো না কেন?
রেখে যা। গতকাল ফোনে জিজ্ঞেস করেছে, আপু সত্যি কথা বলতো তেলটা মাথায় লাগিয়ে ছিলি? আমি বলি,আজ রাতে লাগাবো ইনশাআল্লাহ। কতোক্ষণ চেঁচামেচি করেছে,আর লাগাবি !!! কাল
সকালে আমি আবার ফোন দিয়ে জানবো কিন্তু।

আমার এসব ভীষণ বিরক্ত লাগে। তেল বাটিতে ঢালো, মাইক্রোওয়েভে গরম করো তারপর ঘষে ঘষে লাগাও। অসুস্থ শশুড় শাশুড়ি, ছোট দুটি বাচ্চা নিয়ে ই সারাটা দিন পাগলের মতো শেষ হয়। বিয়ের প্রথম দিকে অসংসারি, সবকিছু তেই অনভিজ্ঞ নওশীন কম গাল খায়নি। কিচ্ছু পারতো না, তখন বিশেষ করে মাহির সর্বক্ষণ রেগে থাকত
আর কথায় কথায় বলতো, সবকিছু ক্লিয়ারকাট কথা বার্তা বলেই তো বিয়ে করলাম। তখন তো তোমার বাবা মা শুধু বলেছেন, আমার মেয়ে সব কিছু সামলাতে পারবে। তুমিও তাই বলেছো।এখন তো আমি দেখি,সব কাজেই তুমি অষ্টরম্ভা।

কথাটা অবশ্য সে ভুল বলেনি। আমার বড় খালুর
বন্ধু হলেন আমার শশুড়। বড় খালু যেদিন সম্বন্ধ আনেন সেদিন আমার মনে আছে, আমি অনার্স সেকেন্ড ইয়ারের প্রথম ক্লাশ করে এসেছি। তারিন মাত্র একই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। খালু মাকে বলছেন, চৌধুরী এন্ড সন্স এর ছোট ছেলের জন্য তোমার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব এনেছি। ছেলের বাবার সাথে আমার ৩০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। খুব ই ভালো মানুষ। দু দুটো চালু ইন্ডাষ্ট্রি। ছেলের একটা বোন শুধু বিয়ের বাকি। শশুড়, শাশুড়ি ও স্বামী নিয়ে বড়লোকের ঘরে তোমার মেয়ে খুব সুখে থাকবে। মা তো শুনে খুশিতে ডগমগ। বাবা শুধু বললো, এতো লাফানোর দরকার নেই আগে
খবর নিয়ে দেখি। পরবর্তী ৫দিন আমি শুধু মনে মনে দোয়া করছি, এই বিয়ে যেন না হয়। তারিন বলেছে, এতো চিন্তা করিস কেন? বিয়ে না করার কতো উপায় আছে।

মাহির দের মতো এতো টা না হলেও আমাদের আর্থিক অবস্থাও অনেক ভালো ছিল। ওদের মতো বাবাও ব্যবসায়ী ছিল। পাথরের ব্যবসা, ২টা বড় গ্ৰোসারি শপ্ ও শহরের উপকণ্ঠে ভালো ১টা চালু রেষ্টুরেন্ট ছিল। আমার ৬ ভাই, বাবা ৪ জন কে নিয়ে ব্যবসা দেখতো। বাকি দুজন পরিবার নিয়ে প্রবাসে স্থায়ী ভাবে বসবাসরত। বড় বোন দুজনও প্রবাসী। একজন অষ্ট্রেলিয়া ও একজন কানাডাতে থাকে। সুতরাং এক্ষুনি বিয়ে না দিলে যে, খুব সমস্যায় পড়বে এই পরিবার…………. তা
কিন্তু না। ৫ দিন পর বাবা বলল,সব খবর ভালো।
শুধু লেখাপড়ার চর্চাটা এদের কম। ছোট ২টা ছেলে মেয়ে ছাড়া আর কেউ ভার্সিটিতে যায়নি। আমাদের দরকার হলো, ছেলের সমন্ধে জানা।
আমি খোঁজ নিয়েছি ভদ্র ছেলে। বয়সও কম,মাত্র
মাষ্টার্স ফাইনাল দিলো। তবুও পরশু পরিবারের কিছু সদস্য কে নিয়ে আসবে। সামনাসামনি দেখা হবে। আমি ওদের ডিনারের দাওয়াত দিয়েছি।

সেই মুহূর্তে কে যেন ভেতর থেকে বলছে, বাবাকে বলে দেখ। মানতেও তো পারে তোর কথা। কাতর
স্বরে বলি, আমি এখন বিয়ে করবো না বাবা। ৪টা বছর সময় দাও,এর মধ্যে অনার্স শেষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। প্লিজ বাবা, আমার কথা টা রাখো।
বাবা বললো, কালকে সকালে এটা নিয়ে কথা বলবো। পরদিন রুমে ডেকে নিয়ে বললো, আমার শরীর ভালো যাচ্ছে না। বাবার হাতে বিয়ে আর ভাইয়ের হাতে বিয়ে তে অনেক পার্থক্য আছে মা। আমি চাই, কালকে ওদেরকে উল্টোপাল্টা কিছু যেন বলা না হয়। তুমি এটা কথা দাও আমাকে। কেন যেন সেই মুহূর্তে মনে হয়,এইসব কিছুর পেছনে আমার মা ই কলকাঠি নাড়ছেন। অদ্ভুত এক অভিমানে পুড়ছে হৃদয়। বাবা হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, হাত ধরে অস্ফুটে শুধু বলি “ঠিক আছে বাবা”।

পরদিন সন্ধ্যায় মাহির তার বাবা,মা ও বোনকে নিয়ে আসে। ভাবীকে না কি আগেই বলেছিল, আমার সাথে একা কিছুক্ষণ কথা বলতে চায়। প্রথমে অনেকক্ষণ কি করি,কি পড়ি,হবি কি এসব বলে হঠাৎ বললো, আপনাকে আগে থেকেই বলা ভালো আমার বাবা মা আমাদের মানুষ করতে অনেক কষ্ট করেছেন। কিন্তু বিনিময়ে আমরা কিছু ই উনাদের দিতে পারিনি। আমাদের বাসায় কিন্তু সহকারী ৩/৪ জন আছে। কিন্তু আমি চাই, আমার যে বৌ হবে সে আমার প্যারেন্টস কে একটু যত্ন করুক। একটু খেয়াল করে রান্না করে খাওয়াক।
ঔষধ টা টাইম মতো দুজনকে দিক। সবচেয়ে বড় কথা হলো,এরা অথর্ব নয়। বাবা এখনো কাজে যায়‌। আমি জাষ্ট উনাদের একটু খুশি করতে চাই। আপনি যদি এগুলো তে রাজি থাকেন এবং পড়া শোনার ইতি ঘটাতে চান………..তবেই এই বিয়ে হবে। আর যদি ভাবেন, বিয়ে না করে মেইড রাখলেই তো পারে…………. তাও বলতে পারেন। মোটকথা, আগে থেকেই আমার অবস্থান, চাওয়া ক্লিয়ার করছি। যতবারই কিছু বলবো ভেবেছি, বাবার হাত ধরে কথা দেয়াটা মনে পড়েছে। তারিন কতো উপায় দেখালো, কিন্তু বুরবক নওশীন কিচ্ছুই করতে পারলো না। হয়ে গেল তার বিয়ে।

তখন আমার ননদ মাহা ভার্সিটিতে পড়ে ও তার
বিয়ে হয়নি। বকা শুনে ও মাহির কে বলে,একটু সময় দে ছোট ভাইয়া। ২০ বছরের একটা মেয়ের কাছে তুই কিভাবে এতো এতো কিছু আশা করিস বলতো? অনেক পরে আমার শাশুড়ি একবার বলেছিলেন,নরম মাটিতে আঁচড়াতে খুব সুখ বলে এরকম করছিস। কথায় কথায় ও যদি ফোঁস করে উঠতো তবে বুঝতি। শর্ট টেম্পারড্ মাহির দাঁতে দাঁত চেপে বলতো, এতো বেশি বেশি করো না তো মা। তাহলে,তোমার বড় ৩ বৌমার মতো নওশীনও হবে। দয়া করে মা মেয়ে দয়ার প্রতিমা বনে যেও না। আমি প্রতারণা করে বিয়ে করিনি, সহকারী আছে তবু বাবা ও তুমি নয়টার মধ্যে নাস্তা খেয়ে ঔষধ না খেলে আমি অশান্তি করবোই। এটা দয়া করে সবার মাথায় গেঁথে নাও।

এই ঘটনার দুদিন পরেই, বিকেলে আমার শশুড় শাশুড়ি কে চা খাইয়ে দিয়ে ছাদে উঠেছি। ছাদটা দারোয়ান ঝকঝকে পরিস্কার করে রাখে। এক কোণে বসে রেলিং এর খাজকাটা অংশ দিয়ে,
বাইরের পৃথিবী দেখছি আর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছি। হঠাৎ কারো হাতের স্পর্শে কেঁপে উঠে দেখি,মাহা বলছে কেঁদো না ভাবী। আসলে ছোট ভাইয়া কিন্তু মানুষ খারাপ না। বড় ভাবীদের দুর্ব্যবহার দেখে দেখে এমন করছে আসলে। না হয় মাষ্টার্স দিয়ে ই কেউ বিয়ের জন্য পাগল হয়ে যায়? আর তুমি তো জানো ই আমাদের পরিবারে লেখাপড়ার চর্চা কম‌। বাবার অপরিসীম কষ্টে গড়া দুটো ইন্ডাষ্ট্রি ই
৪ ভাই মিলে চালাচ্ছে। বাবা মাকে শেষবয়সে একটু আরাম দেয়াই তার মুখ্য উদ্দেশ্য, কিন্তু পথটা যে ঠিক নয় সেটা সে পরে বুঝবে। তুমিও কিন্তু অনেক বোকা আছো। রাতে বলতে পারোনা,
এতো জ্বালালে আর সময়মতো ঘুমাতে না দিলে আমি সকালে উঠে এসব করতে পারবো না? এক
দিন বললেই দেখতে ঠিক হয়ে যেতো। সবসময় বোবা হয়ে থাকলে সংসারে বাঁচা খুব ই কঠিন।

তারপর একে একে সাতটা বসন্ত চলে গেছে। নওশীন দ্বায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন হয়েছে, সাংসারিক কাজে পটু হয়েছে। কাজেকর্মে খুঁত ধরার উপায় ই
নেই। শুধু বাবা,মা আর মাহিরের উপর অভিমান জমে জমে কথা বলতে ইচ্ছে করে না। বাধ্য না হলে মুখই খুলে না। সে এখন খুশি না রাগ তার ছাপ মুখে আনেই না বলতে গেলে। এখন আবার কথা বলেনা কেন, সে দুঃখ করলে আদৌও কি লাভ হবে কখনো?

সকালে উঠে ইভান চুপচাপ খেয়ে নিলেও সিমিন ভীষণ যন্ত্রণা করে। তার একঘেয়ে লাগবে না বলে একদিন কর্ণফ্লেকস তো একদিন দুধের সাথে ব্রেড
বাটার দেই। মাঝে মাঝে শরীর ভালো থাকলে আমার শ্বশুরও একসাথে খান‌। উনার খাওয়া দেখে দুধচিড়েও খেতে চায়। কিন্তু সারকথা হলো,
কিছুই খায় না। মুখে পুরে বসে থাকে। চিবোতে বললে রাগী একটি দৃষ্টি দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। আমার শাশুড়ি বলেন, বেশি বেশি আদর করে করে বাঁদর বানাচ্ছো। শোনো বৌমা যদি আমাদের সময়ের মতো সকালে উঠে দেখতো,ভাত আর আলুভর্তা দিয়ে খেয়ে পাঠশালা তে দৌড়ুতে হবে,
তবে দেখতে এসব সোনামুখ করে খেয়ে নিতো।
আমি যথারীতি জবাব না দিলেও মাহির হাসিমুখে বলে, শুধু শুধু সকালে উঠেই আমার মেয়েটাকে বকা দিও না তো মা। মা তখন ছেলের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেন,আর মাটা যে এখনো মুখে কুটোটি কাটেনি…….সে হিসেব আছে নাকি তোর?

সেলিমা ওর মেয়ের কাছে কাল গেছে,একা হাতে সকাল থেকে তোর বাবা আর আমাকে প্রথমে রুমে নিয়ে নাস্তা করালো। আবার তোদের ৩জন এর নাস্তা বানিয়ে এখন মেয়ে নিয়ে যন্ত্রণায় আছে এইসব দেখলে আমার খারাপ লাগে বলেই বলি।
এবার আমার দিকে তাকিয়ে মাহির বলে, তোমার বৌমার মুখ দেখে তো তেমন মনে হচ্ছে না মা। আমার শাশুড়ি এবার বিড়বিড় করেন, কোনসময়
ওর মুখ দেখে বুঝা যায় বাবা? মাহির এবার বলে,
তাহলে কি আর করা !!! তোমার বৌমার মুখ দেখে কিছু বুঝা যায় না, মুখে কিছু বলেও না……. মানুষ তো আর ভেতর পড়তে পারে না………। আমি খুব জানি, আমাকে রাগানোর জন্য ই এসব কথা ও বলছে। মনে মনে হাসি, না চিনলে ৭ বছরেও মনে হয় চিনবে না মাহির। তোমার পক্ষে আদৌও চেনা
সম্ভবও নয়।

আমার ছেলে তখন গুড বয় হবার তাগিদে তার কর্ণফ্লেকস এর বাটি দেখিয়ে বলছে, দেখো মা আমি ফারষ্ট। আমি ওর মুখে আদর করে দিতেই রাজ্যজয়ের হাসি এবার। পানি খাইয়ে কুলি করার জন্য বেসিনে নেবো সিমিনকে, মাহির বলল আমি
ওকে কুলি করাচ্ছি। তুমি চট্ করে চা এককাপ খেয়ে ফেলো। আমি সরে দাঁড়াই, রান্নাঘরে টিফিন বক্স দুটো নিয়ে টিফিন ভরি। নিয়ে আসার পর মা
কে বলছে শুনি, বলার পরও চা খেয়েছে তোমার বৌমা? ওর যা ইচ্ছে তাই করে মা, শুধু শুধু তুমি আমাকে দিয়ে বলাও। আমার শাশুড়ির মুখ তখন
রীতিমত অপ্রসন্ন। আমি এসব দিকে নজর না দিয়ে বলি, রহিমা দরজা লাগিয়ে দিবে মা। বাবার কাছে চলে যান আপনি।

এইমাত্র ঘুম থেকে উঠা কিশোরী রহিমা এবার বকা খাচ্ছে, আসলে বলা ভালো আমার শাশুড়ি সব রাগ,ক্ষোভ ঝাড়ার মানুষ পেয়ে গেছেন। গজগজ করছেন, এতো নবাবের মাইয়্যা তো কাজ করতে আসছিস কেন? সকালে আটটায়ও তোর ঘুম ভাঙ্গে না। আমার কোমরের ব্যথার জন্য নড়তে পারি না। মামী যে আজ একা হাতে সব কিছু করবে,তা জানো না? যখন মামী আদর করে তোকে যে বেশি বেশি খাওয়া, কাপড় দিয়ে থাকে……………….তখন তা নিতে তো হাত লম্বা হয়ে যায়। সব তোমার দোষ বৌমা, রাতে সিরিয়াল দেখতে চাচ্ছে দেখুক না মা। ওদের এসব বলে বলে বেশি বাড় বেড়ে গেছে। মাহির বলে, কি মুস্কিল !!! ঘর থেকে বের হবো কোথায় দোয়া করে দেবে তা না, চিৎকার করতে করতে শেষ। ছেলের কথায় এবার বলছেন,হ্যা যা। আল্লাহর হাওলা। ইভান চেঁচাচ্ছে,টা টা দাদু। মাও হাসিমুখে টা টা করছেন।

গাড়িতে উঠে মাহির বলছে, তুমি এই ভালোমানুষী
মুখোশ পরে কি সুখ পাও বলোতো? আল্লাদ করে কাজের মেয়েকে ঘুম না ভাঙ্গিয়ে মহৎ সাজার মানে কি বুঝিনা। আমাকে নিশ্চুপ দেখে এবার সে খেকিয়ে উঠলো, কি হলো? আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি না কি? আমি মৃদু হেসে বলি, মুখোশ পরে পরে অভ্যাস হয়ে গেছে হয়তো। তাই, ছাড়তে পারি না। আপনমনে গজগজ করছে, নিজেকে খুব করিৎকর্মা ভাবো, এজন্য বাচ্চাদেরকে নিজে স্কুলে না নিয়ে এলে শান্তি পাবে না। কোথাও তুমি দেখেছো, বাবা স্কুলে দিয়ে গেলেও মা বাচ্চাদের জন্য ভেবে ভেবে সারা হয়? তোমার কর্মকান্ড দেখে মনে হয়, পৃথিবীতে একমাত্র তোমারই ২টা ছেলেমেয়ে আছে। আর কাউকেই যেন আল্লাহ তাআলা দেন নি।

কথা বললেই বাড়বে, তাছাড়া ড্রাইভার শুনছে।
কতোবার বলেছি প্রথম প্রথম, গাড়িতে উঠে এসব বলো না। কিন্তু কে শোনে কার কথা !!! মাঝে মাঝে আমার মনে হয় সেই ভীতু,শরীর অনবরত কাঁপতে
থাকা নওশীন কে মাহির ভীষণ মিস্ করে। মানুষ আশেপাশে তার বাধ্য প্রজা দেখে খুব আনন্দ পায়। ভীষণ ভালো লাগে, নিজেকে কেউকেটা ভাবে। কে জানে হয়তো বা আমার ধারণা সঠিক নাও হতে পারে। ইদানিং গুলিয়ে ফেলি কে সঠিক আর কে বেঠিক। স্কুল খুব একটা দূরে নয় বলেই রক্ষা। আমি গেলে আমাকে বাসায় নামিয়ে দিতে মাহিরকে আবার ঘুরতে হয় বলে ও রাগ করে। কতোদিন বলেছি, তুমি চলে যাও। আমি যেতে পারবো। তখন আবার চেঁচায়,ঢং করো না তো।উঠো তাড়াতাড়ি। স্কূলের গেইটে সাড়ে ৩ বছরের সিমিন কে নামিয়ে দেই। মাহিরের হাতে ধরা ইভান বোন কে নিয়ে টুকটুক পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ঘুম ঘুম চোখে সিমিন খুব ই বিরক্তি নিয়ে এগোচ্ছে।
বাসায় ফেরার পথে মাহির বলে,গিয়েই আগে চা খেও না। হেভি কিছু খেয়ে চা খাবে।

আমি ঘরে ঢুকতেই রহিমা বলছে, মামী নানা খালি চিক্কুর পাড়তেছে। আমি দৌড়ুতে দৌড়ুতে সিঁড়ি দিয়ে উঠি আর জিজ্ঞেস করি, বাবা পড়ে গেছেন না কিরে? বলছে,ক্যামনে কমু? আমারে তো নানী উফর থাইক্যা বিদায় করে দিছে। আমি এটাই বুঝি না,বয়স হলে তো সবাইকেই রোগশোক পাকড়াও করবেই। এতে লজ্জা পেয়ে কাজের মানুষ কে সরানোর মানে কি? নিজেই হাঁটুর ব্যথা, কোমরের ব্যথায় অস্থির থাকেন,এর মধ্যে একা একা বাবাকে সামলানো সম্ভব না কি? বাবাকে যে
দেখে সেই রমু ছেলেটা ওর অসুস্থ মাকে দেখতে এক সপ্তাহের জন্য বাড়িতে গেছে। আল্লাহ মালুম কি হয়েছে,পড়ে গিয়ে হাড় ভেঙে গেলে আরেকটা বিপদ উপস্থিত হবে।

রুমে ঢুকে দেখি মা বাবাকে বিছানায় জোর করে বসাচ্ছেন আর বাবা চিৎকার করছেন, না বললাম
না আমি এখানে থাকবো না। আমি এক্ষুনি আমার নিজের বাড়িতে যাবো। আমি “কি হয়েছে বাবা?” বলতেই মা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন,এসো গেছো
বৌমা আমি সাহিলকে খবর দিতে চাচ্ছিলাম। দেখো তোমার শশুড় কি পাগলামি শুরু করেছে।
বাবা এবার রক্তচক্ষু মেলে বললেন,ইস্ সাহিল কে
খবর দিবে যেন সাহিল শুনলেই বাবা বাবা বলে চলে আসবে !!! এসব নাটক আমার সাথে করবে না বলে দিলাম। আমি দেখি ফর্সা মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। দুহাতে মুখ তুলে বললাম, কি হয়েছে বাবা? এই সকালেই না আমার সাথে কতো হাসলেন আর কতো গল্প করলেন।

বাবা রেগে গেছেন, আমার বাড়িতে না নিলে আমি কিভাবে ভালো থাকবো? আমি হেসে বলি, এটাই তো আপনার বাড়ি বাবা।এটাই আপনার বেডরুম। এই তো আপনার প্রিয় রকিং চেয়ার,যেটাতে বসে বসে দোল খেতে খুব ভালবাসতেন। এবার গলা আরো চড়েছে, আমার বাড়ি এটা না। আমার বাড়ি দীঘিওয়ালা বাড়ি। মোকাম্মেল মাষ্টারের বাড়ি বললেই সবাই দেখিয়ে দিবে। শোনো বৌমা এরা মা ছেলেরা দুষ্টুর শিরোমণি। আমাকে এরা নিবে না। তুমি আমাকে নিয়ে চলো মা। বাড়ি না গেলে আমি শান্তি পাবো না একটুও। রাতে কড়া সিডেটিভ খেয়েও ঘুমুতে না পারা ডিমেনসিয়ার রোগী ঢুলু ঢুলু চোখে তাকিয়ে থাকা আমার শশুড়ের দিকে তাকিয়ে এমন মায়া লাগছে বলেই
ফেলি, আল্লাহ যদি আমাকে বাঁচায় তবে কালকে আপনাকে নিয়ে বাড়িতে যাবো বাবা। খুশিতে হাত দুটো ধরে বলছেন, সত্যি নিবে তো মা? এরা মা ছেলের মতো বাটপারি করবে না তো? হেসে বলি,
কিন্তু শর্ত আছে একটা। সারা রাত শুধু পায়চারি করেছেন। এখন লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে। ছোট বাচ্চাদের মতো বলছেন, ঠিক আছে ঘুমুচ্ছি কিন্তু তুমি তোমার কথা কিন্তু রেখো বৌমা। বললাম,
ইনশাআল্লাহ রাখবো। শুয়ে পড়তেই গায়ে কাঁথা দিয়ে, পর্দা গুলো টেনে নিচে এলাম।

কিচ্ছু খেতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু খেতে তো হবেই। বমি বমি ভাব করছে,মুড়ি দিয়ে চা খেলাম। আমার শাশুড়ির গলা শুনি, শুধু মুড়ি দিয়ে খাচ্ছ,
ভারী কিছু খেয়ে নিলেই পারতে। আমি বলি, এখন আর কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না মা। পরে
খাবো। এবার জিজ্ঞেস করলাম, বাবা ঘুমিয়েছেন?
ভারী শরীরটা চেয়ারে রাখতে রাখতে বললেন,হ্যা
ঘুমিয়ে কাদা। আমি বুঝিনা বৌমা, আমি কক্ষণো তো তোমার শশুড়ের অবাধ্য হইনি।তবে, আমাকে সে একদম দেখতে পারে না কেন? আমি হেসে বলি, আপনিও ছেলেমানুষি শুরু করে দিলেন মা?
আপনি তো সেদিন ডাক্তারের কাছে যাননি।ডাক্তার আপনার ছেলেকে রোগের ধরণ,কি কি মনে হয় তখন রোগীর………. সেটা বিস্তারিত বলে
দিয়েছে। বাংলায় রোগটি কে স্মৃতিভ্রম বলে।

(চলবে)

প্রেমগুঞ্জন পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেমগুঞ্জন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৩(শেষ_পর্ব)

শাহরিয়ার উত্তরের আশা না করে ভিতরে চলে গেল।

ভিতরে যেতেই দেখতে পেল আজিম সাহেব মলিন মুখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। শাহরিয়ার এগিয়ে গিয়ে বেডের পাশে থাকা টুলটা টেনে বসলো। দুইহাত দিয়ে আজিম সাহেবের হাতটা ধরে বলল
-“আব্বু এখন কেমন আছেন!”

আজিম সাহেব কাঁপা হাতে শাহরিয়ারের হাত ধরে অপরাধী কন্ঠে বলল
-“আমাকে ক্ষমা করে দিও বাবা।”

-“না না আব্বু আপনি কেন ক্ষমা চাচ্ছেন। আর হিয়া নিশ্চিত কোনো বিপদে পড়েছে।”

মুহূর্তে আজিম সাহেব খানিকটা গম্ভীর কন্ঠে বললেন
-“ওর কথা বাদ দেও তুমি।”

শাহরিয়ার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
-“আব্বু কিভাবে ভুলে যাই ওকে। ও আমার হবু বউ ছিলো না। বিবাহিত বউ ছিলো আব্বু। যদিও ও আমার বিবাহিত স্ত্রী সেহেতু আমি ওর মিসিং ডায়েরি করতেই পারি। কিন্তু তাও যেহেতু ওকে তুলে নিতে পারিনি তাই আপনার পারমিশন নিতে এসেছি।”

আজিম সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন
-“সমাজে মাঝে এমনিতেই তো নাক কাটিতেছে। এখন আবার পুলিশের ঝামেলা। তাছাড়া ওতো নিজ ইচ্ছায় হারিয়েছে।”

শাহরিয়ার নিজেকে যথাসম্ভব গম্ভীর করে বলল
-“আমি এতো কিছু জানিনা। আমি ওকে বিশ্বাস করি। ও আমাকে ধোকা দিতে পারেনা। আপনি বাবা হয়ে নিজের মেয়েকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। আমি যাবোই পুলিশের কাছে। সমাজ আমাকে খাওয়াবে পড়াবে না।”

কথাগুলো বলেই আজিম সাহেবের কোনো কথা না শুনে বেড়িয়ে গেল শাহরিয়ার। আজিম সাহেব পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শাহরিয়ারের যাওয়ার পানে।

হিমিশা শুধু অপলক দৃষ্টিতে শাহরিয়ারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার মনমানুষিকতা পেল না সে। কিইবা বলবে সে।

———————–

শাহরিয়ার দীর্ঘ সাতদিন খুঁজেছে হিয়াকে। পুলিশও খুঁজে চলছে তাকে। এবার বেশ বিরক্ত শাদি আর নিরব। দুইজন শাহরিয়ারকে বুঝিয়েছে যে হিয়া তাকে ধোকা দিয়েছে। কিন্তু শাহরিয়ার বুঝতে নারাজ।

তিনজনই ক্লান্ত চিত্তে রেস্টুরেন্টের একটা টেবিলে বসে আছে। শাদি আর নিরব গোগ্রাসে খেয়েই চলছে। আর শাহরিয়ার নিজের ফোন বের করে হিয়ার ছ‍বি দেখছে। হুট করেই একটা অপরিচিত নাম্বার দেখে কপাল কুচকালো শাহরিয়ার। দুই তিনবার রিং হয়ে কেটে গেলেও চতুর্থবারের বার কল রিসিভ করে কানে ধরলো শাহরিয়ার। অপরপাশ থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই বসা থেকে উঠে দাড়ালো শাহরিয়ার। অস্থির কন্ঠে বলল
-“কান্না করছো কেন জান! কি হয়েছে তোমার! কে কি করেছে বলো আমায়!”

হিয়া কান্না থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। কান্নাগুলো যেন মুহূর্তেই দলা পাকিয়ে আসছে। এতে যেন শাহরিয়ারের অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। হিয়া কান্নাভেজা ভাঙা কন্ঠে বলল
-“আপনি বাঁচান আমাকে তমা আপু মেরে ফেলবে আমাকে। আপনি আসুন প্লীজ। আমাকে আপনার কাছে নিয়ে চলুন।”

শাহরিয়ারে কপাল কুচকে এলো। সে খানিকটা চেঁচিয়ে বলে উঠলো
-“তমা! তুমি কোথায় জান? ও তোমাকে কোথায় রেখেছে?”

হিয়া ভয় নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বলল
-“তমা আপুদের বাসার বাগানের দিকের ভাঙা ঘরে আমায় আটকে রেখেছে। আজ রাতে নাকি কার কাছে আমাকে বেঁচে দিয়ে আপনাকে বিয়ে করবে।”

শাহরিয়ারের রাগে চোখমুখ শক্ত হয়ে গেল। সে রাগান্বিত কন্ঠে বলল
-“আমি আসছি জান। তোমার কিছু হতে দিবোনা আমি।”

হিয়া অস্থির কন্ঠ বলে উঠলো
-“একা আসবেনা কিন্তু এখানে বেশ কিছু পাহাড়াদার আছে। তাদের একজনেরই ফোন এটা। আপনি আসুন তাড়াতাড়ি। কেউ একজন আসছে ফোন রাখতে হবে আমার।”

বলেই হিয়া কল কেটে দিলো। শাহরিয়ার সব খুলে বলল শাদি আর নিরবকে। দুইজনই বেশ অবাক হলো। তমা তো শাহরিয়ারের চাচাতো বোন। অবশ‍্য এর আগে শাহরিয়ার আর হিয়া ঘরোয়া ভাবে বিয়ে হয়েছিল দুই পরিবারের আর ওরা দুইজন ছাড়া কেউ জানেনা। তমা এমনটা করতে পারে কল্পনার বাহিরে ছিলো তাদের।

ওরা তিনজন আর কিছু পুলিশ নিয়ে কিছুসময়ের মধ্যে তমাদের বাসায় পৌঁছালো। তমা আর ওর মা বসার রুমে বসে চা খাচ্ছিলো। শাহরিয়ারকে দেখে খুশি হলেও পুলিশ দেখে খানিকটা ভরকে যায় তমা। তবুও নিজের মুখে জোরপূর্বক টেনে শাহরিয়ারের কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই শাহরিয়ার পরপর দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দেয় তমার গালে। থাপ্পড়ের বেগ এতটাই জোরে ছিলো যে তমা পড়ে যেতে নেয়। তমা মা ওকে ধরে বলল
-“শাহরিয়ার এ কেমন ব‍্যবহার তোমার। মানলাম তোমার প্রেমিকা বিয়ে না করে ভেগেছে তার রাগ তুমি আমার মেয়ের উপর ঝাড়বে।”

শাহরিয়ারের রাগে শরীর তরতর করে কাঁপছে। নিরব ওকে ধরে ঘৃণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল
-“আপনাদের লজ্জা করেনা অন‍্যায় করে এখন নাটক করছেন। আমরা জানি সব। অফিসার তমাকে ধরুন।”

দুইজনই বেশ চমকে উঠে। ওদের কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শাহরিয়ার বাগানের দিকে গেল। পুলিশ পাহাড় দেওয়া লোকদের ও ধরে নিলো। শাহরিয়ার দরজা ভাঙতেই হিয়াকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখলে। হিয়ার পায়ে বেড়ি দিয়ে আটকানো। চুলগুলো এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে মুখের সামনে ফর্সা মুখে মলিনতার ছাঁপ। ঠোঁটে পাশে রক্ত জমে আছে। হাতের কাঁচের চুড়িগুলো হাতে বিধে রক্ত শুকিয়ে আছে। উজ্জ্বল মুখটায় যেন এক অন্ধকার হয়ে গেছে। সাতদিনেই যেন ওজন কমে গেছে। নিভু নিভু দৃষ্টিতে হিয়া শাহরিয়ারকে দরজার কাছে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মলিন মুখেও যেন এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো হিয়ার।

শাহরিয়ারের বুকে এসে লাগল সেই হাসি। চোখ বেয়ে নোনা জল গড়িয়ে পরলো। শাহরিয়ার ছুটে হিয়ার কাছে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। হিয়াও মুচকি হেসে ক্লান্ত হাতে শাহরিয়ারকে জড়িয়ে ধরলো।

হিয়াকে বাঁধন থেকে মুক্ত করে ওর ছোট মুখটা নিজের হাতে মুঠে নিয়ে অসংখ্য চুমু এঁকে দিলো হিয়ার মুখে। ওকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হতেই নিরব আর শাদি মুখ টিপে হাসতে লাগল। যা দেখে বেশ লজ্জা পেল হিয়া। লজ্জায় মুখ গুজলো শাহরিয়ারের বুকে। শাহরিয়ার মুচকি হাসলো।

গাড়ির পিছন সিটে বসে শাহরিয়ার হাতটা ব‍্যান্ডেজ করে দিয়ে ঠোঁটের কাঁটা জায়গায় সযত্নে পরিষ্কার করে দিয়ে একটা ব্রেড নিয়ে হিয়ার সামনে ধরলো। এক কামড় দিতেই হুট করেই হিয়া বমি করে দিলো। নিরব গাড়ি ব্রেক করে পিছনে তাকালো। শাদিও চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকালো পিছনের দিকে। হিয়া অপরাধী কন্ঠে বলল
-“সরি আসলে সাত দিন তেমন কিছু না খাওয়ায় ব্রেডটা খেতেই বমি হয়ে গেল। আমি বুঝতে ‍পারিনি।”

শাহরিয়ার স্বাভাবিক কন্ঠেই টিস্যু চাইলো শাদির কাছ থেকে। টিস্যু দিয়ে হিয়ার মুখটা পরিষ্কার করে নিজের টিশার্টও পরিষ্কার করে হিয়াকে পানি খাইয়ে দিলো। হিয়াকে নিজের কাছে টেনে ওর বুকে নিয়ে বলল
-“চোখ বন্ধ করো। বেশিক্ষণ লাগবেনা এখনই বাসায় পৌঁছে যাবো আমরা।”

শাদি আর নিরবকে পিছনে তাকিয়ে থাকতে দেখে শাহরিয়ার ভ্রুকুচকে বলল
-“তোদের আবার কি হলো! সামনে ফিরে রাস্তা দেখ। তাড়াতাড়ি বাসায় চল দেখছিস না আমার বউয়ের কষ্ট হচ্ছে।”

নিরব কিছু না বলে ড্রাইভ করতে লাগল। আর শাদি বকবক করতে লাগল মনে মনে।

বাসায় ফেরার আগে শাহরিয়ার দুই বাসার মানুষকে একসঙ্গে তাদের বাসায় ডেকেছে। সবাই চিন্তিত হয়ে বসার রুমেই বসে ছিলো। কলিং বেল বাজতেই হিমিশা গিয়ে দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল শাহরিয়ারের কোলে হিয়াকে দেখে। শাহরিয়ার চুপচাপ বাসায় ঢুকে বসার রুমের সোফায় এনে হিয়াকে কোল থেকে নামিয়ে বসিয়ে দিলো। সবাই ইতিমধ্যে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেছে হিয়া দেখে তাও আবার এই অবস্থায়। শাহরিয়ার শান্ত কন্ঠে অবাক হয়ে থাকা হিমিশাকে উদ্দেশ্যে করে বলল
-“ভাবি একটু গরম দুধ নিয়ে আসো তো।”

হিমিশা দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে দুধ গরম করে নিয়ে এসে শাহরিয়ারের হাতে দিলো। শাহরিয়ার সযত্নে হিয়াকে খাইয়ে দিতে লাগল। অর্ধেক গ্লাস দুধ খেয়ে হিয়া না করলে শাহরিয়ার আর জোর করলো না। এবার সে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকা সবার দিকে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব ঘটনা খুলে বলল সে সবার কাছে। এমনকি চিঠিটাও যে তমা কপি করিয়ে লিখিয়েছে তাও বলল।

শাহরিয়ার মুখে সব শুনে সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। সবার ভিতরেই একটা অপরাধবোধ কাজ করতে লাগল। কেউ তো বিশ্বাস করতেই পারেনি মেয়েটাকে। কিন্তু শাহরিয়ার সবসময় বিশ্বাস করেছে মেয়েটাকে। আমেনা বেগম মেয়ের কাছে এসে মেয়েকে বুকে টেনে নিলেন। হিয়া ফুপিয়ে কেঁদে দিলো। আয়েশা বেগম অপরাধী দৃষ্টি হিয়ার দিকে তাকালো। আস্তে করে হিয়ার হাত ধরে বলল
-“আমাকে তুই ক্ষমা করে দে মা। আমি তোকে…!”

হিয়া আয়েশা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-“মামুনি এভাবে বলোনা। আর পরিস্থিতি তো অন‍্যরকম ছিলো। আর মা কি কখনো মেয়ের কাছে ক্ষমা চায় বলো তো।”

আয়েশা বেগম এক চিলতে হেসে বুকে টেনে নিলো হিয়াকে। শাহরিয়ার এবার গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“আর একটা কথা আমি আমার বউকে এখন আর ওই বাসায় যেতে দিবোনা। যেহেতু আমাদের বিয়ে আগেই হয়েছে। আমরা একসঙ্গে থাকবো। আর রইলো সবাইকে জানানো তা না হয় জানানো যাবে। আমি তোমাদের সবার কাছে পারমিশন চাইনি। আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছি। তাই আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না। আর জান চলো ঘরে যাবে। ফ্রেশ হয়ে খাবার খেয়ে রেস্ট নিবে। আর সবাইকে বলছি চোখে দেখা জিনিস যে সবসময় সত্যি হয় না এটা তোমার ভুলে যেও না।”

কথাগুলো বলেই শাহরিয়ার হিয়াকে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।

পরিশেষে আমরা চোখে যা দেখি সবসময় তা নাও হতে পারে। তাই সর্তকতার সাথেই চলা উত্তম।

#সমাপ্ত

প্রেমগুঞ্জন পর্ব-০২

0

#প্রেমগুঞ্জন
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২

আয়েশা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে বড় ছেলের দিকে তাকালো। রণবীরের বেশ খারাপ লাগল সেই দৃষ্টি। তবুও যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো। খানিকটা বাধ‍্য হয়েই আয়েশা বেগম নিজের রুমে গেলেন। রণবীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের দিকে তাকালো। শাহরিয়ারকে দেখে বেশ মায়া হলো রণবীরের। ভাইয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। পরনের পাঞ্জাবির পকেট হাতরে ফোনটা বের করে হিমিশাকে কল দিলো। দুবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো। অপরপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে হিমিশা বলে উঠলো
-“বলেন কি হলো? ছোটভাইয়ের কি অবস্থা!”

রণবীর তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে শাহরিয়ারের মলিন মুখটার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল
-“ডাক্তার ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে। এখন ঘুমাচ্ছে। আব্বুর কি খবর?”

-“আরো সময় লাগবে কি অবস্থা বুঝতে। ডাক্তার তো বলল ৪ ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছেনা। রণ এমন কেন হলো আমাদের সাথে। খুব কি প্রয়োজন ছিলো এমনটা হওয়ার। ভালোই তো ছিলাম আমরা।”

-“দেখো হিমি নিজেকে শক্ত করো। তাছাড়া মাকে কে সান্ত্বনা দিবে বলো। মাকে তো এখন তোমাকেই দেখতে হবে। আল্লাহ আছেন। টেনশন নিও না ইনশাআল্লাহ সব ঠিক হয়ে যাবে।”

-“কিন্তু রণ!”

-“কিন্তু কিন্তু কিছু না আমি নিরবকে ‍বলছি তোমাকে আর মাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। আমি হাসপাতালে যাচ্ছি।”

হিমিশা হাসপাতালের চেয়ারে বসে থাকা আমেনা বেগমের দিকে তাকালো। মায়ের মলিন আর ক্লান্ত মুখটা দেখে আর না করতে পারলো না। তার উপর ছেলেটাও কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। হিমিশাকে চুপ করে থাকতে দেখে রণবীর বলল
-“ছেলে ঘুমিয়েছে?”

-“হুম”

-“আর ভেবো না ছোট বাচ্চার ও ধকল গেছে অনেক। চিন্তা করোনা আমি যাচ্ছি।”

নিজের প্রিয়তমের সস্থিমূলক কথায় বেশ সস্থি পেল হিমিশা। আর কোনো বাক‍্য ব‍্যয় না করে সে রাজি হয়ে গেল।

রণবীরও হিমিশার রাজি হওয়াতে সস্থিরতা পেল।

——————————-

তীব্র মাথাব‍্যথা নিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো শাহরিয়ার। দুইহাত দিয়ে সামনের চুলগুলো পিছে টেনে ধরলো। হুট করেই হিয়ার কথা মনে পড়তেই বিছানা থেকে নেমে পড়লো সে। বাহিরে যেতে নিবে তার আগেই আয়েশা বেগম শাহরিয়ারের পথ আটকে বলল
-“কোথায় যাচ্ছিস এতো রাতে! রাত দুটো বাজে।”

শাহরিয়ার ভ্রুকুচকে গম্ভীর কন্ঠে বলল
-“হিয়া বিপদে আছে আমার যেতে হবে।”

হিয়া নাম শুনতেই রাগে লাল হয়ে গেল আয়েশা বেগম। হিসহিসিয়ে বলল
-“ওই ফালতু চরিত্রহীন লম্পট মেয়ের কথা আর বলবিনা তুই। ওই মেয়ে…”

শাহরিয়ার আয়েশা বেগমকে থামিয়ে দিয়ে বলল
-“মুখ সামলে কথা বলো মা। ও আমার ভালোবাসা।”

দুতলার উপর থেকে শাহরিয়ারের দাদি বলল
-“ওই মেয়ের হয়ে কথা বলতে লজ্জা হচ্ছেনা তোর। চুপচাপ রুমে গিয়ে রেস্ট নে। ভুলে যা ওকে।”

শাহরিয়ারের রাগে হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। নিজের রাগকে কন্টোল করতে না পেরে পাশে থাকা কাঁচের ফুলদানি মেঝেতে ছুড়লো। সাথে সাথে কাঁচের ছোট ছোট টুকরোই পুরো বসার রুমে ছড়িয়ে পড়লো। শাহরিয়ার রাগী কন্ঠে বলল
-“দাদিমা ও একদম পদ্মফুলের মতো পবিত্র। খবরদার ওকে নিয়ে কিছু বলবেনা। তাহলে আমি সম্পর্ক ভুলে যাবো। ও আমার জান। আমি বিশ্বাস করি ওকে।”

কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে হনহন পায়ে বাড়ি ছাড়লো সে। পায়ে কিছু কাঁচের টুকরো গেথে গেল। সেদিকে পাত্তা না দিয়ে হিয়াকে খুঁজতে লাগল সে। আশপাশের জায়গা খুঁজে খুঁজে বেশ ক্লান্ত হয়ে গেছে। তবুও দমে যাচ্ছেনা সে। টলমল পায়ে হেঁটেই চলছে সে। পায়ের কাটা জায়গা থেকে রক্ত ঝরছে তার। গাড়ির তীব্র ফ্লাশে চোখ বুজে ফেলল সে। রাস্তা থেকে সরে যাওয়া বাদ দিয়ে চোখ বুজে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো।

শাদি তাড়াতাড়ি করে ব্রেক চেপে নেমে পড়লো গাড়ি থেকে। রাগান্বিত কন্ঠে চেঁচিয়ে বলল
-“পাগল হয়ে গেছিস। আর একটু হলেই তো মরতি। তখন কি হতো! রাতে কি শান্তিতে ঘুমাতেও দিবিনা। আন্টি কল দিয়ে বলল তুই নাকি রেগেমেগে বাড়ি ছেড়েছিস। কি রে তুই!”

হুট করে শাহরিয়ার শাদিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো। শাদি মুহূর্তেই নরম হয়ে গেল। শাহরিয়ারের পিঠে হাত রেখে বলল
-“গাড়ি উঠ”

নিজের পিঠে উষ্ণ পানি অনুভূত হতেই শাদি নরম কন্ঠে আবারও বলে উঠলো
-“গাড়িতে উঠ। আমি তোর সঙ্গে খুঁজ‍বো হিয়া ভাবিকে। আর কান্নাকাটি করতে হবেনা। কিন্তু পরে যদি ঘটনা সত্যি হয় তখন কি করবি শাহি!

শাহরিয়ার শাদিকে ছেড়ে ধীর পায়ে গিয়ে গাড়িতে বসলো। শাদি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শাহরিয়ারের এমন পাগলামি দেখে বেশ রাগ হচ্ছে তার। এখনি কি হয়ে যেত। সে যদি ব্রেকটা না চাপতো। তবুও নিজের রাগকে কন্টোল করে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি শাদির বাসার দিকে যাচ্ছে দেখে শাহরিয়ার কিছু বলতে নিবে তার আগেই শাদি বলল
-“মা কসম তুই যদি এতো রইতে আমারে বলিস যে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে তোরে আমি মাইরা ফালামু। এতো রাতে পুলিশ স্টেশনেও কেউ তোমার লিগে বসে নাই। তাই চুপচাপ আমার বাসায় যাইবা। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে তারপর ঘুরবা। ফোন টাকা কিছুই তো আনো নাই। ঢং করো আমার লগে।”

শাহরিয়ার চুপ করে জানালার দিকে ফিরে আলোহীন অন্ধকার রাস্তাটা দেখতে লাগল। হিয়াকে ছাড়া তার জীবনটাও যেন এমন আলোহীন হয়ে পড়েছে। ভাবতেই অশ্রুকণা চোখের কোণ বেয়ে পড়লো। শাদি সবটা খেয়াল করেও চুপ করে রইলো। সে বুঝতে পেরেছে তার শক্ত বন্ধুটা একটা মেয়ের জন‍্য কতটা ভেঙে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। বেশ খারাপ লাগছে তার এই বন্ধুটার জন‍্য। বাবা মা মারা যাওয়ার পর থেকে বেঁচে থাকার প্রেরণা তো তার এই দুই বন্ধুই দিয়েই। বন্ধু তো নয় নিজের ভাই সমতুল‍্য ছেলেটা আজ কতটা কষ্ট পাচ্ছে।

শাদির বাসায় যাওয়ার পর শাদি জোর করে শাহরিয়ারে পায়ের ক্ষত পরিষ্কার করে দিয়েছে গালাগালি করে। ফজরের আযান দিতেই দুইজন একসঙ্গে নামাযে বসে পড়লো। শাদি খেয়াল করলো শাহরিয়ার মোনাজাতে শুধু একটা কথাই বলে যাচ্ছে
-“আমার ভালোবাটাকে ভালো রেখো মাবুদ।”

নামাজ শেষ হতেই শাদি একদৃষ্টিতে শাহরিয়ারের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
-“এতো ভালোবাসিস ওকে।”

শাহরিয়ার মুচকি হেসে বলল
-“বের হবো চল।”

শাদি তপ্ত শ্বাস টেনে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে দিলো। শাহরিয়ার বলল
-“কিছু টাকা দে তো।”

শাদি চোখ ছোট ছোট কে বলল
-“কেন ময়না খালি হাতে দেবদাস হয়ে বের হওয়ার সময় মনে ছিলো না যে টাকা লাগবে।”

শাহরিয়ার শাদির এমন অতিরিক্ত কথায় বিরক্তিতে চোখমুখ কুচকে বলল
-“দিবিনা বললেই হয়। তুই থাক আমি গেলাম।”

বলেই শাহরিয়ার হাঁটা দিলো। শাদি হতভম্ব হয়ে গেল। সবটা বোধগম্য হতে বেড সাইট টেবিলের উপর থেকে টাকা, ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে দৌড় দিলো। হাঁপাতে হাঁপাতে শাহরিয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে বলল
-“হালা তুই এমন কেন!বললামই তো আমি ও যাবো তোর সঙ্গে।”

নিরব ভ্রুকুচকে গাড়ির ভিতর থেকে বলল
-“তোদের আবার কিহলো!”

শাহরিয়ার একপলক শাদির হাঁপানো মুখে দিকে তাকিয়ে বলল
-“কি হবে! তুই এখানে!”

নিরব শাহরিয়ারের ফোন আর কিছু টাকা এগিয়ে দিয়ে বলল
-“রণ ভাইয়া পাঠালো।”

শাহরিয়ার অজান্তেই হাসলো একটু। গাড়ি উঠতে উঠতে শাদিকে উদ্দেশ্য করে বলল
-“যাবি না গাড়ি টান দিবো।”

শাদি তাড়াহুড়ো করে গাড়ির পিছনের দরজা খুলে উঠে বসে বলল
-“কি রে তুই?”

শাহরিয়ার কোনো উত্তর করলো। নিরব লুকিং গ্লাসে শাদির দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে কথা বলে নিলো। নিরব গলা খাকিয়ে বলল
-“কোথায় যাবি!”

শাহরিয়ার আস্তে করে বলল
-“হাসপাতালে যেখানে আব্বু ভর্তি সেখানে।”

নিরব কথা না বাড়িয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হলো। হাসপাতালে হিয়ার আব্বুর কেবিনের সামনে আসতেই হিমিশা শাহরিয়ারকে দেখে উঠে দাড়ালো। শাহরিয়ার নরম কন্ঠে বলে উঠলো
-“আব্বুর জ্ঞান ফিরছে শুনলাম। আমি কি যেতে পারি।”

হিমিশা এই অগোছালো শাহরিয়াকে দেখে নিজেকে বেশ অপরাধী মনে হচ্ছে। তার ছোট বোনটার জন‍্যই তো ছেলেটা আজ এতো অগোছালো। শাহরিয়ার উত্তরের আশা না করে ভিতরে চলে গেল।

#চলবে