Monday, July 28, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 141



নিভৃত রজনী পর্ব-২৮+২৯

0

নিভৃত রজনী
| ২৮ | (১৪৮০+ শব্দ)
[প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা]

ইদানিং ব্যাবসার কাজে কিছুটা ঘনঘন ঢাকা যেতে হচ্ছে তানিমকে। গতকাল সকালেও ঢাকা গিয়েছিল ও। ফিরল তার পরেরদিন বিকেলে।

নম্রতা তখন নায়লা আর পাশের বাড়ির মেয়েটির সাথে ঘরের সামনের সিঁড়িতে বসে চালতা মাখা খেতে খেতে আড্ডায় মেতে উঠেছিল। তানিম ওদের পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে নম্রতার দিকে একপলক তাকিয়ে বলল, “নম্রতা, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। টেবিলে খাবার দাও।”

নম্রতা সাথে সাথে উঠে দাড়াল।

“এক্ষুনি যাচ্ছি।” বলে তানিমের পিছু পিছু রওয়ানা দিল বাড়ির মধ্যে৷

সাধারনত নববিবাহিত দম্পতিরা বেশিরভাগ সময়ই চার দেয়ালের মধ্যে নিজেদের মতো করে সময় কাটাতে চায়। কিন্তু নম্রতার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা হয় উলটো। ওর ইচ্ছে করে সারাদিন, সারারাত তানিমকে নিয়ে বেডরুমের বাইরে সবার সামনে বসে থাকতে। কারন শুধু সবার সামনে থাকলেই তানিম ওর সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলে। তখন তানিমকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে এই মানুষটি বদ্ধ ঘরে কথা তো দূর, নম্রতার দিকে ফিরে পর্যন্ত তাকায় না। তানিমের সাথে একই ঘরে যতক্ষন থাকে ততক্ষন নিজেকে জেলখানায় বন্দি দাগী আসামী বলে মনে হয়। ছটফট করতে করতে কাটে পুরোটা সময়। নম্রতা হাজারটা উপায় বের করে তানিমের সাথে কথা বলার। কিন্তু গুরুগম্ভীর মুখটার দিকে তাকিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করার মতো সাহস পায় না।

টেবিলে খাবার দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল নম্রতা। তানিম গোসল সেরে এসে সাথে সাথেই খেতে বসল। নম্রতা একের পর এক খাবার আইটেম দক্ষ হাতে তুলে দিল তানিমের প্লেটে। এতদিনে তানিমের দৈনন্দিন জীবনের সকল পছন্দ-অপছন্দ বেশ ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছে নম্রতা। তবুও যদি তার মনে জমে থাকা শীতল বরফ একটু গলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত পুরোটাই উলুবনে মুক্তা ছড়ানোর মতো হয়ে যায়।

তানিম খেয়ে উঠে গেল। নম্রতা খাবারগুলো তুলে রেখে রুমে গিয়ে দেখল, তানিম আবার রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। নম্রতাকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত নেমে গেল ও।

নম্রতা জানে, এখন তানিম গঞ্জের বাজারে যাচ্ছে। বিশেষ কোনো কাজ না থাকলে রাত ন’টার মধ্যে বাসায় ফিরবে। তানিমের ডেইলি রুটিন এখন নম্রতার নখদর্পনে।

ছাদ থেকে নিয়ে আসা শুকনো কাপরগুলো ভাজ করতে করতে নম্রতা ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত পৌনে নয়টা বাজে। তারমানে তার আসার সময় হয়ে গেছে। নম্রতা জলদি করে কাপর ভাজ করল। যদিও তানিম ওর দিকে ফিরেও তাকায় না, তবুও তানিমের ফেরার সময়টাতে ও যথাসম্ভব পরিপাটি হয়ে থাকার চেষ্টা করে।

নম্রতা চুল আঁচরে সুন্দর করে খোঁপা করে ফেলল, ঠোঁটে ন্যুড কালারের লিপস্টিক লাগাল খুব হালকা করে। ড্রেসিং টেবিল থেকে মুক্তা পাথরের ছোট্ট একজোড়া কানের টপ তুলে নিল পড়ার জন্য। একটা দুল তাড়াহুড়ায় কানে পড়তে গিয়ে অন্যটা হাত পিছলে পড়ে গড়িয়ে একেবারে দরজা কাছে গিয়ে থেমে গেল। নম্রতা দরজার সামনে গিয়ে নিচু হলো দুলটা তোলার জন্য। ঠিক তখনই দরজার অপর পাশে পা দুটো এসে থামল। হঠাৎ করেই তানিম এসে পড়ায় কিছুক্ষনের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে গেল নম্রতা। উঠে দাঁড়াতেও ভুলে গেল তাই।

তানিম ফোন স্ক্রল করতে রুমে ঢুকতে যাচ্ছিল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে বসে থাকা একটা অবয়ব দেখে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল সেদিকে। পরিচিত মুখের দিকে তাকিয়ে ঠিক তার পরের সেকেন্ডেই তানিমের চোখ চলে গেল অন্য কোথাও।

নম্রতার জামার গলাটা একটু বেশিই বড় ছিল, তারপর আবার সামনের দিকে ঝুঁকে ছিল ও অনেকটাই। গলার সাথে লেগে থাকা চকচকে গোল্ড চেইন, তার অনেকটা নিচে কুচকুচে কালো তিল, গাঢ় বাদামি রঙের অন্তর্বাস। আর তাকিয়ে দেখতে পারল না তানিম। হঠাৎ করে হেঁচকি উঠে গেল ওর। নম্রতা সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। জলদি করে টেবিলে ঢেকে রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে ধরল তানিমের দিকে। তানিমের মনে হলো, ওর শরীরে বৈদ্যুতিক শক লেগে গেছে। নম্রতার হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানিটা খেয়ে ফেলল।

নম্রতা অবাক হয়ে তাকাল। গত সপ্তাহেও যে নাভিদকে বোঝাল যে পানি সবসময় বসে খেতে হয়। সেই নিয়ম মেনে চলা মানুষটা আজ দাঁড়িয়েই পানি খেয়ে ফেলল।

তানিম পানি খেয়ে গ্লাসটা নম্রতার হাতে দিল। নম্রতা গ্লাসটা রাখতে গেল আবার। তানিম ওকে ডেকে উঠল পেছন থেকে,
“শোনো।”
“বলুন।”
“বিয়ের পরে তোমাকে যে স্যালোয়ার কামিজগুলো কিনে দিয়েছিলাম, সেগুলো সব দর্জির থেকে বানিয়ে এনেছ?”

বিয়ের আগে স্যালোয়ার কামিজ নম্রতা তেমন পড়ত না বললেই চলে। কিন্তু শ্বশুড়বাড়িতে ওসব জিন্স, টপস আর কুর্তি চলবে না বলে তানিম নিজেই ওকে কিছু স্যালোয়ার কামিজ আর সুতি কাপর কিনে দিয়েছিল। কিন্তু সেগুলোর কথা আজ হঠাৎ করে জিজ্ঞাসা কেন করছে সেটাই বুঝতে পারল না নম্রতা।

“হ্যা। এনেছি।”
“এখন যেটা পড়ে আছ, প্রত্যেকটা জামা কি এভাবেই বানিয়েছ?”
আজকে যেন নম্রতার অবাক হওয়ার দিন। তানিম পরপর এতগুলো কথা বলছে ওর সাথে। নম্রতা আবারও জবাব দিল,
“হ্যা।”
“ওগুলো কাল থেকে আর পরতে হবে না। আমি আবার জামা কিনে দেব, নায়লা ভাবির সাথে গিয়ে সেগুলো বানাতে দিয়ে আসবে। আর শোনো, প্রত্যেকটা জামার গলা এখনকারগুলোর চেয়ে আরও ছোট করে দেবে। আরও একটা কথা প্রত্যেকটা জামার লেন্থ যেন হাঁটুর নিচ অব্দি হয়।”

নম্রতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বোঝার চেষ্টা করল হঠাৎ করে তানিমের এই কথাগুলো বলার কারন। কিছুক্ষনের মধ্যে পুরো ঘটনাটা বুঝেও গেল ও। ঝুঁকে কানের দুলটা নেওয়ার সময় তানিমের সামনে এসে দাঁড়ানো, হেচকি উঠে যাওয়া, কিছুদিন আগেই বানানো সালোয়ার কামিজগুলো পড়তে বারণ করা।

তারমানে তানিম অনাকাঙ্ক্ষিত কিছু দেখে ফেলেছে! ঠিক কতটা দেখেছে? লজ্জায় নম্রতার মাটি দুভাগ করে ভেতরে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করল।

উল্টোদিকে ঘুরে তড়িঘড়ি করে টেবিলে গ্লাসটা রাখতে গেল ও। কিন্তু ওর হাত ফসকে পড়ে গেল সেটা। স্টিলের গ্লাস বলে না ভেঙে ঝনঝন শব্দ করে উঠল। নম্রতা তাড়াহুড়ো করে সেটা আবার তুলে রাখল। কাঁপা গলায় কোনোরকমে বলল, “খেতে আসুন। আমি খাবার ঘরে যাচ্ছি।”

তারপরে একছুটে বেড়িয়ে গেল ঘর থেকে। তানিম সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষন।

নম্রতা কিছুক্ষন সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে এনেছিল অনেকটাই। খাবার ঘরে সবার সামনে নায়লা আবারও অজান্তেই অপ্রস্তুত করে তুলল ওকে।
“একি নম্রতা। তুমি এক কানে দুল পড়ে আছ কেন?”

নম্রতা চমকে উঠল। দুল! এই দুলের জন্যই তো আজ এতবড় ঘটনাটা ঘটে গেল।

নম্রতা চমকে ওঠার সাথে সাথেই তানিম শব্দ করে কেশে উঠল। নম্রতা ওর সামনে রাখা গ্লাসে পানি ঢেলে দিল।

রাতে নম্রতার পাশে ঘুমতে গিয়ে এই প্রথমবার তানিম হাঁসফাঁস করে উঠল। এতদিন কঠিন একটা সংকল্প করেছিল ও। নম্রতার ওকে প্রথমদিন সেই করা অপমানের শিক্ষা দেওয়ার জন্য ওকে স্পর্শ করবে না কখনও। অন্তত কয়েকটা মাস নম্রতাকে অনুশোচনায় দগ্ধ করবে। কিন্তু আজ আর নিজের সংকল্পে অটল থাকতে পারছে না ও। কেন জানি মনে হচ্ছে ভুল কিছু হয়ে যাবে হয়তো।

পুরো রাত তানিম তাই আর ঘুমাতেই পাড়ল না। এপাশ ওপাশ করেই রাত কাটিয়ে দিল। নম্রতাও উলটো দিকে মুখ করে বিছানার চাদর খামচে পড়ে থাকল। তানিমের দিকে তাকানোর জন্য ওর মধ্যে বিন্দুমাত্র সাহসও আর নেই।

৪৫.
চাঁদনী যেদিন থেকে ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, সেদিন থেকেই শুনে এসেছে যে ডাক্তারি পড়া খুব কঠিন। এমবিবিএস জার্নিটা শুরু করার পর থেকে চাঁদনী বুঝতে পেরেছে যে ওরা কেউ ভুল বলত না।

একটানা অনেকক্ষন পড়ে চেয়ারে শরীরটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল চাঁদনী। কয়েকমিনিট এভাবে থেকে চোখে তন্দ্রাভাব আসছিল খানিকটা। কপালে কারও হাতের স্পর্শ পেয়ে চোখ মেলে তাকাল চাঁদনী। নওয়াজ হাসিমুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। একহাত চাঁদনীর কপালে আর অন্য হাতে কফিমগ। স্টাডি টেবিলের পাশে কফিমগটা রেখে নওয়াজ বলল, “অনেকক্ষন যাবত পড়ছ, প্রেসার যাচ্ছে নিশ্চই খুব। কফিটা খেয়ে মিনিট দশেকের একটা ব্রেক নিয়ে আবার পড়া শুরু করো। রিল্যাক্সড লাগবে তাহলে।”

চাঁদনীর সত্যি এখন এককাপ চা কিংবা কফির খুব দরকার ছিল। এমনকি হলে থাকাবস্থায় মাঝে মাঝে চাঁদনীর মনে হতো, ইশ! কেউ যদি থাকত এককাপ চা বানিয়ে দেওয়ার জন্য।

চাঁদনী কফিমগটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করল নওয়াজকে
“আপনি এখন কী করবেন?”

“অফিসের কিছু ফাইল আছে। ওগুলো নিয়ে বসব। তুমি কফিটা খেয়ে নাও, ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

চাঁদনী মাথা নেড়ে কফিতে চুমুক দিল। নওয়াজ আর চাঁদনীর সম্পর্কটা আজকাল অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। নওয়াজ ওর কথা রেখেছে। চাঁদনীর পড়ায় কখনও এতটুকু বাঁধাও সৃষ্টি করে না ও। বরং স্ত্রীর সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখে খুব করে। সত্যিই হাজবেন্ড ওয়াইফ একে অপরকে বুঝলে বিবাহিত লাইফটা অনেক বেশি সুন্দর হয়ে ওঠে।

চাঁদনী এই বাড়িতে এসেছে প্রায় একমাস হতে চলল। এখানে আসায় নওয়াজ খুশি হয়েছিল প্রচন্ড। শুধু নওয়াজ কেন। চাঁদনীর শ্বাশুড়ি মরিয়ম খাতুনও খুব খুশি হয়েছিলেন।

এখন চাঁদনী বোঝে, চাঁদনীর কথা মেনে নিয়ে ওকে হলে থাকার অনুমতি দিলেও তিনি মনে মনে চাইতেন চাঁদনী বাড়িতে থেকেই পড়ুক।

চাঁদনীর মাঝেমাঝেই মনে পড়ে সেই প্রথমদিকের কথা। বিশেষ করে যেদিন সাখাওয়াত আর তানিমকে নিয়ে চাঁদনী প্রথমবার এসেছিল মরিয়ম ভ্যালিতে। তখন ও জানত না যে একদিন এই বাড়ির পুত্রবধু হয়েই থাকতে হবে ওকে।

তারপর নওয়াজ যখন জানাল যে চাঁদনীর প্রতি ওর কোনো অনুভূতি নেই। তারপর থেকে চাঁদনী শুধু দিন গুনত। কবে অ্যাডমিশন টেস্ট শেষ হবে আর কবে এই বাড়ি থেকে ও চলে যেতে পারবে। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল খুব প্রয়োজন ছাড়া কখনও এই বাড়িতেই আর পা রাখবে না। অথচ সময়ের ব্যাবধানে সবকিছু কেমন বদলে গেল।

চাঁদনী চেয়ারটা ঘুরিয়ে নওয়াজের মুখোমুখি বসে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল। নওয়াজ ফাইলে চোখ বোলাতে বোলাতেই প্রশ্ন করল, “এভাবে কী দেখছ চাঁদনী?”
“আপনাকে দেখছি।” জড়তাহীন উত্তর দিল চাঁদনী।

হাসল নওয়াজ। চাঁদনী মুগ্ধ চোখে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে বলল, “এভাবে হাসবেন না। নজর লেগে যাবে।”

নওয়াজ বলল, “এখানে তুমি ছাড়া আর কেউ নেই চাঁদনী।”

“মনে হচ্ছে, আমার নজরই লাগবে শেষ পর্যন্ত।”

” লাগুক নজর। ছাদে যাবে চাঁদনী?”
“এত রাতে?”
“হ্যা। তুমি যদি আরও ঘন্টাখানিক পরে আবার পড়তে বসো, তাহলে কি তোমার পড়ার খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে?”
“একদমই না।”
“চলো তাহলে।”
মধ্যেরাতে নিস্তব্ধ নিরিবিলি ছাদের ঝিরিঝিরি বাতাসে নওয়াজের কাঁধে মাথা রেখে পাশাপাশি বসল চাঁদনী। নওয়াজ চাঁদনীর একটা হাত টেনে নিল নিজের কোলের মধ্যে। চাঁদনীর মনে হলো, উপভোগ করতে জানলে খুব সাধারন মোমেন্টগুলোও অনন্য হয়ে উঠতে পারে।

৪৬.
অনেকদিন পর বাইরের মুক্ত বাতাস পেয়ে নম্রতার ভালো লাগল বেশ। পাশের বাড়ির আমিনার সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে ও এগিয়ে চলল গ্রামের মেঠো পথ ধরে। গ্রামের এদিকটা একেবারে চোখ ধাধানো সুন্দর। দেখে মনে হয় ক্যানভাসে রঙতুলির আঁচরে নিঁখুতভাবে আঁকা কোনো চিত্রশিল্পীর চিত্রকর্ম।

পথে যেতে যেতে আশেপাশের বাড়ির মেয়ে বউরা আড়চোখে দেখছিল নম্রতাকে। তালুকদার বাড়ির ছেলে শহুরে বড়লোক মেয়ে বিয়ে করেছে বলে তাদের আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৯ | (১৬৭০+ শব্দ)

পথে যেতে যেতে আশেপাশের বাড়ির মেয়ে বউরা আড়চোখে দেখছিল নম্রতাকে। তালুকদার বাড়ির ছেলে শহুরে বড়লোক মেয়ে বিয়ে করেছে বলে তাদের আগ্রহটা একটু বেশিই ছিল।

কিছুক্ষন হাঁটাহাঁটি করে ফেরার পথে যার সাথে দেখা হলো, এই সময়ে তাকে অন্তত আশা করেনি নম্রতা।

বয়সে নম্রতার চেয়ে বছরখানেকের ছোট হবে বোধহয় মেয়েটা। ওদের দেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। তারপর আমিনাকে জিজ্ঞাসা করল, “এইটা কে রে?”
“তানিম ভাইয়ের বউ।” আমিনা সরু চোখে তাকিয়ে জবাব দিল।
“ও তাহলে তো পরিচিত হওয়া দরকার। আমি মুক্তা। ভালো আছেন ভাবি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।” জবাব দিল নম্রতা। মেয়েটার কথা বলার ধরন কেন জানি একটু অন্যরকম লাগছিল ওর।
“ভাবী মনেহয় এখনও আমাকে চিনতে পারেননি। আমি পাশের গ্রামের চেয়ারম্যানের মেয়ে। তানিম ভাইয়ের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।”

নম্রতা চমকে উঠল মেয়েটার কথা শুনে। এতক্ষনে মেয়েটার এভাবে কথা বলার কারনটাও কিছুটা পরিস্কার হলো।
নম্রতা পরিস্থিতি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলল, “তোমার সাথে কথা বলে ভালো লাগল।”

“শেষ পর্যন্ত আপনিই পেয়ে গেলেন তানিম ভাইকে। চাঁদনীর জন্যই অবশ্য ব্যাপারটা ঘটেছে। আমাদের বিয়েটা তো প্রায় পাকাপাকিই হয়ে গিয়েছিল। তানিম ভাইও আমাকে দেখে মত দিয়েছিল। কিন্তু চাঁদনী আপনাকে পছন্দ করল বলে তানিম ভাইয়ের বাধ্য হয়ে আপনাকেই বিয়ে করতে হলো শেষপর্যন্ত। আসলে চাঁদনী খুব আদরের বোন তো, তাই বোনের কথা ফেলতে পারেনি।”

নম্রতার গালে অদৃশ্য চপেটাঘাত পড়ল যেন। মেয়েটা আকারে-ইঙ্গিতে এটাই বুঝিয়ে দিল যে নম্রতাকে বিয়ে করতে রাজি হলেও মনে মনে তানিম বিয়েতে রাজি ছিল না একদমই।

আমিনা পাশ থেকে বলে উঠল, “এইসব আপনি কী বলছেন?”
“তুই থাম তো। যেটা সত্যি সেটাই বলেছি আমি। সত্যিই তো তানিম ভাই মন থেকে করেনি বিয়েটা। আর তাছাড়া তানিম ভাই যেমন মানুষ তাতে শহুরে আধুনিক কোনো মেয়েকে পছন্দ করার কথাও না তার। চাঁদনীটা জোর করে অপছন্দের জিনিসটা চাপিয়ে দিল বেচারার ঘাড়ে। আহারে!”

খোঁচাগুলো নম্রতার দুকান দিয়ে ঢুকে ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। এজন্যই কি তাহলে তানিম এমন দুরত্ব বজায় রেখে চলে ওর সাথে। নম্রতার পৃথিবীটা হঠাৎ করেই দুলে উঠল।

আমিনা এবার আর মুক্তার সাথে কথা বলল না। নম্রতাকে বলল, “ভাবি, চলেন তো এখান থেকে। এইসব আজেবাজে কথা শোনার দরকার নেই।”

নম্রতা তবুও নড়ল না। আমিনা জোর করে হাত টেনে ধরে নিয়ে গেল নম্রতাকে। যেতে যেতে নম্রতা আরেকবার পিছু ফিরে তাকাল। মুক্তার তাচ্ছিল্য মাখা হাসিটা ওর মনের রক্তক্ষরণ বাড়িয়ে দিল আরও।

রাতে বাজার থেকে ফেরার পথে সামনের উঠতি বয়সী ছেলেগুলোর কথোপকথন কানে আসছিল তানিমের। একপর্যায়ে ওদের মুখে নিজের নাম শুনে পায়ের গতি শ্লথ হয়ে এলো ওর। কানদুটো সজাগ হয়ে গেল।

দলের মধ্যে একটা ছেলে তখন বলে চলেছে, “আজ প্রথমই দেখলাম বুঝেছিস। যেমন চেহারা তেমন ফিগার। তানিম তালুকদার বউ একটা পেয়েছে…।”

তানিম এগিয়ে গেল দলটার দিকে। ছেলেদের দলটা ওকে অপ্রত্যাশিতভাবে দেখে ভরকে গেল। যেই ছেলেটা কিছুক্ষন আগে কথাগুলো বলছিল, তার মুখমন্ডল লক্ষ্য করে তানিম এলোপাতাড়ি ঘুষি বসাল অনেকগুলো। ছেলেটা শেষমেষ ওর পা ধরে বসে পড়ল, “আমার ভুল হয়ে গেছে ভাই। আর এমন হবে না জীবনেও।”
তানিম বলল, “আরেকদিন গ্রামের কোনো মেয়ে-বউদের দিকে তাকাতে দেখলে ওখানেই চোখদুটো উপড়ে ফেলব। আমার নজর এখন থেকে তোর উপরেই থাকবে। মনে রাখিস।”
ছেলেগুলো মাফ চেয়ে বিদায় নিল অবশেষে।

তানিম যে ঠিক কীভাবে বাড়ি ফিরল সেটা ও নিজেও জানে না। নম্রতাকে এসে বসার ঘরেই পেল ও। নাভিদকে পড়াচ্ছিল নম্রতা।

তানিম এসে ওর হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে রুমে নিয়ে গেল। শক্ত করে ধরায় নম্রতার হাত ব্যাথায় টনটন করে উঠল। শরীরের ব্যাথা আর মনের ব্যাথা মিলেমিশে একাকার হয়ে দলা পাকানো কান্না হয়ে উঠে আসতে চাইছিল। তানিম রুমের মধ্যে ঢুকে ওর হাত ছাড়ল। তারপর দরজা বন্ধ করে দাতে দাত চেপে প্রশ্ন করল, “আজ বিকেলে তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”

নম্রতা তানিমের দিকে তাকিয়ে আঁতকে উঠল। রাগে আপাদমস্তক কাঁপছিল তানিম। নম্রতা ভয়ে ভয়ে উত্তর দিল, “আমিনাদের বাড়ির ওদিকে…।”
“সাথে কে ছিল?” প্রথম প্রশ্নের উত্তর সম্পূর্ণ না শুনেই পরের প্রশ্ন করল তানিম।
“আমিনা।”
“আমাদের বাড়ির আশেপাশে এত জায়গা থাকতে বাইরে কেন গেলে তুমি?”
“আসলে আমি, মানে, আমিনা…।” নম্রতার কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল ক্রমশ।
“স্পষ্ট করে কথা বলো। আমার থেকে অনুমতি না নিয়ে বাইরে যাওয়ার সাহসটা তোমার হলো কী করে?”
সামান্য বাড়ির বাইরে যাওয়ায় অনুমতি নিতে হবে? তাছাড়া আমিনাদের বাড়িটা ওদের বাড়ির পাশাপাশিই। এতটুকু যাওয়ার স্বাধীনতাও কি নেই নম্রতার! এতটুকু আদৌ কি রেগে যাওয়ার মতো কারন! বহু প্রশ্ন উঁকি দিল নম্রতার মনে। সাথে একটা খচখচানি। নম্রতাকে সহ্য করতে পারে না বলেই কি এমন আচরণ তানিমের। ওর জায়গায় যদি মুক্তা থাকত, তাহলে কি তানিম এমন করে বলত?

বিকেল থেকে বহু চেষ্টার পর মুক্তার বলা কথাগুলো কিছুটা ভুলে গিয়েছিল নম্রতা। এখন সেগুলো মনে পড়তেই পুরো ক্ষত তাজা হলো আবার। তানিমের পরবর্তী কথাগুলো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিল যেন।

” কথার উত্তর দাও৷ আমাকে না বলে বাইরে কেন গিয়েছিলে? আমার অ্যাটেনশন পাচ্ছ না বলে শরীরের সুন্দর কার্ভগুলো বাইরের লোককে দেখাতে গিয়েছিলে?”
নম্রতার কানে যেন গরম সীসা ঢেলে দিল কেউ৷ সামান্য একটা বিষয়ের জন্য তানিম ওর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলল? এই কথাটা সত্যিই তানিমের মুখ থেকে বের হয়েছে। দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে নম্রতা ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়ল। স্থান, কাল, পাত্র ভুলে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল ও।

ততক্ষনে তানিমও নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। একজনের রাগ অন্যজনের উপর দেখানো কোনোকালেই তানিমের অভ্যাস ছিল না। কিন্তু আজ সেই কাজটাই হয়ে গেল ওকে দিয়ে।

ছেলেগুলোর উপরে যে রাগটা জমেছিল, সেটা ঝাড়ল আজ নম্রতার উপরে। শেষের কথাটুকু যে বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে, সেটাও বুঝতে পারল তানিম। এখানে থাকলে হয়তো আরও বেফাঁস কথা বের হয়ে যাবে মুখ থেকে৷ সেজন্য আর দাঁড়াল না তানিম। ঝড়ের বেগে রুম থেকে বের হয়ে একেবারে বাড়ির বাইরে চলে গেল। ফিরল অনেক রাত করে।

অন্যান্য দিনগুলোতে তানিম ফিরতে দেরি করলে নম্রতা বসার ঘরে অপেক্ষা করে তানিমের জন্য। দুজনের কথা তেমন হয় না বললেই চলে। কিন্তু তবুও তানিম রাতের খাবার খাওয়ার পুরোটা সময় নম্রতা ওর পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। আজ বসার ঘরে নম্রতার বদলে বসে আছে ওর মা দেলোয়ারা বেগম, ঠিক যেমনটা তানিমের বিয়ের আগে থাকত। তানিমকে দেখে বললেন, “এসেছিস। আয়,খেতে আয়।”

তানিম খেতে বসেই প্রশ্ন করল, “নম্রতা কোথায় মা?”
“মেয়েটার যে হঠাৎ কী হলো। রাতে খাবার সময় ডাকতে গিয়ে দেখলাম রুমের লাইট নিভিয়ে শুয়ে আছে। জিজ্ঞাসা করলে বলল, মাথা ধরেছে নাকি খুব। রাতের খাবারটাও খেল না।”

তানিমের ভাত খাওয়ার গতিও কমে গেল। নম্রতাটাকে কথাটা বলে বাইরে বের হয়ে যাওয়ার পর পুরোটা সময় ভীষণ এক অপরাধবোধ আর আত্মগ্লানিতে ভুগেছে ও। তানিম জানে, নম্রতা ছোটবেলা থেকে বিলাসবহুল পরিবেশ আর আহ্লাদে বেড়ে ওঠা একটা বদমেজাজি মেয়ে। কিন্তু ক্যারেক্টারলেস মেয়ে নয় ও। তাহলে নিশ্চই চাঁদনী তাকে নিজের ভাইয়ের বউ হিসেবে নির্বাচন করত না। এখন তো নম্রতাকে বদমেজাজিও বলা যায় না আর। পুরোনো নম্রতাকে ভেঙেচুড়ে একেবারে নতুন করে নিজেকে গড়ে তুলেছে ও৷ তানিম কখনও ভাবেনি, এই বাড়ির লোকগুলোর সাথে এত সুন্দরভাবে মানিয়ে নিতে পারবে নম্রতা৷

তানিম কোনোরকমে খেয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর জন্য না খেয়ে আছে নম্রতা৷ তানিম মাকে বলল, “একটা প্লেটে ভাত দাও তো মা। আমি খাবারটা রুমে নিয়ে যাই নম্রতার জন্য।”

তানিম রুমে ঢুকল নিঃশব্দে। ডিম লাইটের মৃদু আলোতে ও দেখল, খাটের উপর দেয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে নম্রতা হেঁচকি তুলে কাঁদছে তখনও। খাবারের প্লেটটা টেবিলের উপর রেখে লাইট অন করল তানিম। ওপাশে কান্না আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা চলছে তখন। কান্না চেপে রাখার জন্য শরীরটা মৃদু কেঁপে উঠছিল ক্ষনে ক্ষনে।

তানিম খাটের একপাশে বসে বলল, “নম্রতা, তোমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছি। উঠে খেয়ে নাও।”

নম্রতা কোনোরকম রেসপন্স করল না। তানিম বুঝল, শুধু মুখে বলে কোনো কাজ হবে না। ও আরেকটু এগিয়ে নম্রতার কাছাকাছি গিয়ে বসল। তারপর নম্রতার হাতের বাহু ধরে টেনে তুলল।

নম্রতা বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে বসল। ওর দিকে তাকিয়ে এবার খুব অনুশোচনা হলো তানিমের। ক্রমাগত কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। পুরো মুখমন্ডল বিধ্বস্ত। তানিম নরম স্বরে আবার বলল, “নম্রতা খেয়ে নাও।”

ওর দিকে একপলক তাকাল নম্রতা। তারপর নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে আবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়ল।

নম্রতার পুরো রাত কাটল নির্ঘুম। তানিম মুখ থেকে উচ্চারিত একটা লাইন বিরতিহীনভাবে ওর মস্তিষ্কে বেজে চলল৷ তার সাথে মুক্তার বলা কথাগুলো।

তানিমও নির্ঘুম ছিল সেরাতে। পাশাপাশি শুয়ে নম্রতার ছটফটানি টের পাচ্ছিল। নম্রতাকে নিজের কাছে টেনে দুরত্ব কমানোর ইচ্ছেটা খুব কষ্টে দমিয়ে রাখল তানিম। বুঝল, নিদেনপক্ষে একটা স্যরি অন্তত বলা উচিৎ মেয়েটাকে। কিন্তু মুখ থেকে একটা অক্ষরও উচ্চারণ করতে পারল না।

নম্রতা শেষরাতের দিকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেও তানিমের ঘুম হলো না আর। নম্রতা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ওই আদুরে মুখটাকে নির্নিমেষ দেখতে থাকল তানিম। এভাবেই তানিমের বাকি রাত কাটল। ফজরের আজান শুনে নামাজ পড়ে কিছুক্ষন বাইরে হাঁটাহাঁটি করে এসে নাস্তা করল ও। তারপর রান্নাঘরে নায়লার কাছে গিয়ে বলল “ভাবি, একটু এদিকে এসো তো। তোমার সাথে কথা আছে।”

নায়লা ওর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, “কী বলবে বলো।”
“গতকাল নম্রতার সাথে একটু রাগারাগি হয়েছিল। রাতে খাবার খায়নি। সারারাত ঘুমায়নি। এখন একটু ঘুমাক। একটু পরে ঘুম থেকে তুলে জোর করে হলেও সকালের নাস্তাটা খাইয়ে দিও। আর আমি এখন ঢাকা যাব। আজ আর ফিরব না, ওকে বলে দিও।”
“এসব কী তানিম? এত শান্ত একটা মেয়ে। তার সাথে তুমি ঝগড়া করেছ? কেন?”
“তেমন কিছু না৷ বাদ দাও। আমি এখন আসছি।”

তানিম বাড়িতে ফিরল পরেরদিন দুপুরে। অভ্যাসবশত হাতঘড়িটা রাখতে গিয়ে টেবিলের উপরে ব্রাউন পেপারের ব্যাগটা দেখতে পেল ও। ব্যাগটা ওর খুব পরিচিত বলে মনে হলো। ব্যাগের ভেতরে হাত দিয়ে মোবাইলের বক্সটা বের করে আনল ও। সবকিছু মনে পড়ে গেল ওর। ঠিক একই রকম আছে ব্যাগটা এখনও। এমনকি বক্সের মধ্যে মোবাইলটাও এখনও আন-ইউজড। ব্যাগের নিচেই ভাজ করে রাখা ছিল চিঠি। তানিম পড়তে শুরু করল,
“শুধুমাত্র বোনের ইচ্ছে রাখতে নিজের এতবড় ক্ষতিটা না করলেও পারতেন। আমিও বোকা, ভেবেছিলাম সময়ের সাথে সাথে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে। যাইহোক, গত তিনমাসে আমার সাথে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যে দিনগুলো কাটিয়েছেন, সেগুলোকে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবেন আশা করি৷ আর সেপারেশনের প্রসিডিওরগুলো আমার সেভাবে জানা নেই। তাই আপনাকেই ব্যবস্থাটা করতে হবে। আপনি ডিভোর্স লেটার পাঠালে আমি সাইন করে দেব।
আপনার এবং মুক্তার ফিউচার লাইফ খুব ভালো কাটুক। বেস্ট অফ লাক।
-নম্রতা।”

চিঠিটা পড়েই তানিম আগে নায়লার রুমে গেল। সরাসরি প্রশ্ন করল, “নম্রতা কোথায় ভাবি?”
“ওদের বাসায় গেছে। ঢাকা আরকি।”
“কার সাথে? কখন গেল?”
“গতকাল তুমি যাওয়ার কিছুক্ষন পরেই। ঘুম থেকে উঠে তোমার ভাইজানের কাছে এসে প্রায় কেঁদে বলল, মায়ের কথা মনে পড়ছে হঠাৎ। ওকে যেন একটু দিয়ে আসে তোমার ভাইজান। তারপর সকালেই রওয়ানা হয়ে গেল। আমি নাস্তা করানোর জন্য কত জোড়াজুড়ি করলাম, কিন্তু কিছুই খেল না। মেয়েটার চেহারা একরাতের মধ্যে ভেঙ্গে গেছে একবারে। কী নিয়ে এত রাগারাগি করলে ভাই? ও খুব কষ্ট পেয়েছে মনেহয়।”
তানিম কোনো জবাব না দিয়ে চলে গেল। একটা ব্যাপার মাথায় খচখচ করছে। নম্রতা ওর কথায় রাগ কিংবা অভিমান করে চলে গেছে। এইপর্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু চিঠিতে মুক্তার নাম মেনশন করল কেন? মুক্তাকে চিনলই বা কী করে? আমিনা বলেছে?

তানিম নিজের রুমে না গিয়ে আমিনাদের বাড়ির দিকে গেল। চোখে তখনও স্ত্রীর কান্নাভেজা মুখটা ভেসে উঠছিল বারবার। নিজেদের মধ্যে দুরত্ব আরও বাড়তে দিলে সেটা দুজনের কারোর জন্যই ভালো হবে না বোধহয়। অনেক হয়েছে ওকে শিক্ষা দেওয়া৷ এবার যতদ্রুত সম্ভব পৌঁছাতে হবে তার কাছে।

৪৭.
নম্রতা বাসায় পৌঁছেই মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। সাখাওয়াত, চাঁদনী আর মরিয়ম খাতুন তিনজনে হতভম্ব হয়ে গেল নম্রতার এমন আচরণে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-২৫+২৬+২৭

0

নিভৃত রজনী
| ২৫ | (১৪০০+ শব্দ)

নম্রতা এসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াল এককোনে। হঠাৎ করেই কেন জানি ওর ভয় লাগছিল খুব।

সবার সামনেই নম্রতার মতামত জানতে চাওয়া হলো। জীবনে এতটা নার্ভাস আগে কখনও লাগেনি নম্রতার। শহুরে স্মার্ট মেয়ে ও। মাঝে মাঝে মরিয়ম খাতুনের সাথে মজা করে বলতো, “মা, সবসময় পাত্রপক্ষ পাত্রী দেখতে আসে। কিন্তু আমার বেলায় হবে উলটো। আমি নিজে যাব পাত্রকে দেখতে।”

এতটা ডেস্পারেট ছিল সে। অথচ আজ কিনা সামান্য একটু মত জানাতে হাত-পা কাঁপছে। তানিম তালুকদার নামের লোকটা সামনে বসে আছে বলেই কি এতটা নার্ভাস লাগছে!

কিছুক্ষন চুপ করে থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে নম্রতা জানাল, মুরুব্বিরা যা সিদ্ধান্ত নেবে তাতে ওর কোনো আপত্তি নেই৷

তানিম বোধহয় এই কথাটুকু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছিল এতক্ষন ধরে। নম্রতা ওর কথা শেষ করার সাথে সাথেই উঠে দাঁড়াল তানিম। সবার আগেই বের হয়ে গেল রুম থেকে৷

নম্রতার সম্মতি পেয়ে মরিয়ম খাতুন আনন্দে প্রায় কেঁদেই ফেললেন। তিনি ভেবেছিলেন তার মেয়ে হয়তো মুখের উপরে না করে দেবে। মাঝখান থেকে বেচারি চাঁদনীর মনটা খারাপ হয়ে যাবে। কিন্তু তার বদমেজাজি মেয়েটা যে বিয়েতে রাজি হয়ে যাবে সেটা তিনি কল্পনাও করেননি।

চাঁদনীকে নিজের রুমে ডেকে এনে ওর হাতদুটো ধরে বললেন, “তোমাকে যে কী বলে আমি ধন্যবাদ জানাব জানি না। আমার এই উড়নচণ্ডী, বদমেজাজি মেয়েটাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তার মধ্যে ছিলাম এতদিন। তুমি আজ আমাকে নিশ্চিন্ত করলে।”

চাঁদনী মনে মনে বলল, “আমি কিছুই করিনি, আপনার মেয়ে নিজেই আমার ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

কিন্তু মুখে কোনো জবাব না দিয়ে শুধুই হাসল চাঁদনী৷

তারপরের দিনগুলো সবার প্রচন্ড ব্যস্তটায় কাটল। সাদমানের বিয়ের পরপরই তানিমের বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল। আগেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সাদমানের বিয়ের পরের সপ্তাহেই তানিমের বিয়ের কাজটাও সেরে ফেলা হবে। সবই যেহেতু ঠিকঠাক তাই অহেতুক দেড়ি করতে চাইছিল না কেউই৷

অবশেষে চলে এলো সেই বিশেষ দিনটি। বরযাত্রী এসে যখন কমিউনিটি সেটারে পৌঁছাল তখন প্রায় সন্ধ্যা। সব ফর্মালিটি সেরে বিয়ের কাজ কমপ্লিট করতে রাত প্রায় দশটা বেজে গেল। আর তার পরপরই নতুন বউ নিয়ে নিয়ে বরযাত্রীরা পুনরায় হলুদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।

৪০.
সাধারনত বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে মেয়েরা অন্য একটা জগতে বিচরণ করে। নতুন পরিবেশে কিভাবে মানিয়ে নেবে, একই কক্ষে নতুন একজন মানুষের সাথে কীভাবে এডজাস্ট করবে এসব নিয়ে চিন্তা হয়। পাশাপাশি সেই বিশেষ একজনের কথা ভেবে অদ্ভুত একটা শিহরণ বয়ে যায় মনের মধ্যে। আচমকা দমকা হাওয়ার মতো লজ্জারা এসে জড়ো হয় মনে।

কিন্তু নম্রতার ক্ষেত্রে পুরো ব্যাপারটাই কেমন একটা অন্যরকম হচ্ছে। নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া নিয়ে ওর যতটা না টেনশন হচ্ছে, তারচেয়ে অনেক বেশি টেনশন হচ্ছে হবু বরটিকে নিয়ে।

বিশেষ করে সেবার তালুকদার মঞ্জিল থেকে ফেরার দিনের সেই কথোপকথন মনে পড়লেই বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠছে। লোকটা বলেছিল, নম্রতার সাথে কথা বলতে সে বিরক্তবোধ করে। অর্থাৎ নম্রতা তার বিরক্তির কারণ। নম্রতা কি পারবে এই বিরক্তি ঘুচিয়ে তার ভালোলাগার কারন হয়ে উঠতে? এই চিন্তাতেই কেটে গেল নম্রতার পুরোটা সময়।

বিয়ে ঠিক হওয়ার পর সেই যে হলুদিয়া থেকে ফিরল নম্রতা, তারপর দেখা হওয়া তো দূরের কথা, সামান্য সময়ের জন্য মুঠোফোনে তার কন্ঠটাও শোনা হলো না। নম্রতা বিয়ের আগের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে থাকল। একবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য ফর্মালিটি করে হলেও হয়তো কল আসবে নির্দিষ্ট ফোন নাম্বারটি থেকে। কিন্তু না, ওর সকল আসা ধূলিসাৎ করে দিয়ে অপরপক্ষ একেবারেই নিস্পৃহ হয়ে রইল। বিয়ের দিন সকালে হঠাৎ নম্রতার মনে হলো, কোনো ভূল হয়ে যাচ্ছে না তো!

বিয়ের আগেই এত এত তিক্ততা ওর প্রতি লোকটার। বিয়ের পরে কি সেটা আদৌ কমবে? নাকি সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সেই তিক্ততা আরও বাড়বে?

একরাশ মনখারাপ আর হতাশা নিয়ে বিয়ের দিন সকালের নাস্তা করে চাঁদনী আর নিকিতাকে সাথে নিয়ে পার্লারে গেল নম্রতা৷ তারপরে সারাদিন কোথা থেকে যে চলে গেল, টেরই পেল না নম্রতা। এইপ্রকার ঘোরের মধ্যেই ছিল ও সারাদিন। ওর সেই ঘোর কাটল কমিউনিটি সেন্টারে বসে। আশেপাশের সবাই তখন বলাবলি করছে, “বর এসে গেছে, বর এসে গেছে…।”

বিয়ে পড়িয়ে যখন তানিম আর নম্রতাকে পাশাপাশি বসানো হলো, তখনও নম্রতার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে সত্যিই বিয়েটা হয়ে গেছে।

বিদায়ের সময় নম্রতা মাকে আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদল। কাঁদলেন মরিয়ম খাতুনও।

ফেরার পথে গাড়িতে বসেও একটা কথা হলো না সদ্য বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর। সারারাত জার্নি করে শেষ রাতের দিকে তালুকদার মঞ্জিলে পৌঁছাল বরযাত্রীরা।

সারাদিনের ধকল আর সারারাত নির্ঘুম থেকে জার্নি করে নম্রতার শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে আসতে চাইছিল। গাড়ি থেকে নামার সময় তাই বেখেয়ালেই শাড়িটা বেঁধে গিয়েছিল জুতোর সাথে। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে যেতে দাত খিঁচে চোখ বন্ধ করে ফেলল নম্রতা। এইবার বুঝি মানসম্মান সব গেল।

কিন্তু পড়ে যাওয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ওকে ধরে ফেলল কেউ। চোখ খুলে তাকাল নম্রতা। তানিমের চোখদুটো তখন ওর দিকেই স্থির। শক্ত করে সে ধরে আছে নম্রতাকে। কয়েক সেকেন্ডে নম্রতা ধাতস্থ হতেই ওকে ছেড়ে দিল তানিম। খুব ক্ষীন কন্ঠে, যেন অন্য কেউ শুনতে না পায় এমনভাবে বলল, “সাবধানে নামো।”

নম্রতা ততক্ষনে অন্য কোনো জগতে হারিয়ে গেছে। বিশেষ মানুষটির একটু ছোঁয়া আর একটুখানি কথা ওর মনের মধ্যে দাবানল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল।

নম্রতাকে তানিমের রুমে নিয়ে গেল চাঁদনী। নম্রতাকে খাটের এককোনে বসিয়ে বলল,
“এখন থেকে এটাই তোমার রুম। তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে। এইসব ভারী শাড়ি গয়না চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি তোমার জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি।”

“আচ্ছা।”

চাঁদনী চলে গেল। নাস্তা নিয়ে ফিরে দেখল, নম্রতা মুখটা কাঁদকাঁদ করে চুলের জট ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। অগত্যা চাঁদনীই হেল্প করল ওকে। সবশেষে লাগেজ খুলে একটা সুতি কাপর এগিয়ে দিল নম্রতার দিকে।
“চেঞ্জ করে নাও এখন। সারারাত জার্নিতে ঘুমাতে পারনি। নাস্তা করে কিছুক্ষন ঘুমিয়ে নিও। এরপর নাহলে আর সুযোগ পাবে না। অনেক কাজ বাকী এখনও। বিকেলে সাদমান ভাইয়ের বউ সাজিয়ে দেবে তোমাকে। তারপর আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা সবাই নতুন বউ দেখতে আসবে। তাছাড়া আজ রাতেও তো ঘুমাতে পারবে না।”

শেষের কথাটুকু বলেই হেসে দিল চাঁদনী। ইঙ্গিতপূর্ন কথাটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর। নিজেও তাই হেসে ফেলল চাঁদনীর সাথে।

তানিম যখন রুমে ঢুকল তখন নম্রতা কেবল নাস্তার প্লেট হাতে নিয়েছে। ওদের দিকে একপলক তাকিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল তানিম। হাতঘড়ি, ওয়ালেট আর মোবাইলটা টেবিলের উপর রেখে আলমারির দরজা খুলে ট্রাউজার, টিশার্ট আর তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে গেল। ঠিক দশ মিনিটের মধ্যে গোসল সেরে বের হয়ে পরিধেয় পোশাকগুলো বারান্দায় মেলে দিয়ে আবার ড্রেসিং টেবিলের সামনে এলো। তারপর ওয়ালেট আর মোবাইল নিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে।

তানিম যাওয়ার আগ পর্যন্ত পুরোটা সময় নম্রতা নাস্তার প্লেট হাতে আড়ষ্ট হয়ে বসে থাকল। চাঁদনী এতক্ষন তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষন করছিল দুজনকেই। দুজনের হাবভাব দেখার পর চাঁদনী বুঝতে পারল যে দুজনের সম্পর্কটা এখনও একবিন্দুও স্বাভাবিক হয়নি।

নম্রতাকে এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করতে গিয়েও আবার থেমে গেল ও। কেবল বিয়েটা হয়ছে, এখনই বেচারিকে প্রশ্ন করে বিব্রত করার দরকার নেই। কিছুদিন সময় দিলে হয়তো সব ঠিক হয়ে যাবে৷
চাঁদনী তাগাদা দিল,
“কই? জলদি খাও। খেয়ে ঘুমিয়ে নাও কিছুক্ষন। দুপুরে আমি তোমাকে ডেকে দেব। তার আগে আর কেউ তোমাকে ডিস্টার্ব করবে না।”

চাঁদনী চলে গেল। নম্রতা উঠে গিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকাল। একদিন পরে বউভাত, তার আয়োজনেই ব্যাস্ত বাড়ির পুরুষরা। এককোনে বিশাল সাইজের চারটা গরু বেঁধে রাখা, তারপাশে দাঁড়িয়ে কয়েকজন লোকের সাথে কথা বলছে সাখাওয়াত। নম্রতা চোখ সরিয়ে নিল। ওর অবচেতন মন অন্য কাউকে খুঁজছে। চোখদুটো এলোমেলো ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে পেয়ে গেল তাকে।

গেটের দিকটায় দাঁড়িয়ে ছিল তানিম। হাত নেড়ে কিছু একটা বলছিল সামনের লোকগুলোকে। সম্ভবত ওই দিকটাতেই প্যান্ডেল করা হবে অতিথিদের খাবারের জন্য। নম্রতা দূর থেকেই একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে তানিমের দিকে। ঠিক ততক্ষন পর্যন্ত দেখতে থাকল যতক্ষন তানিম ওর দৃষ্টির আড়ালে চলে না গেল।

গতকাল অব্দি মানুষটার প্রতি একটা স্ট্রং অ্যাট্রাকশন ছিল নম্রতার। কিন্তু আজ সেই অ্যাট্রাকশনের সাথে তীব্র একটা অধিকারবোধও ফিল করল। সে এখন ওর একান্তই আপনজন।

জানালা থেকে সরে এসে পুরো ঘরময় পায়চারি করল নম্রতা। এর আগেও ও দুইবার এসেছে তালুকদার মঞ্জিলে। প্রত্যেকবারই অদম্য একটা ইচ্ছে আসত ওর মনে। ইচ্ছে হতো একবার তানিমের রুমে ঢুকে দেখতে। কিন্তু সেই সাহসটা কখনোই করে উঠতে পারেনি নম্রতা। ভয় হতো, যদি কেউ দেখে ফেলে। যদি জিজ্ঞাসা করে, অচেনা একটা পুরুষের ঘরে ও কী করছে। তাহলে কী জবাব দেবে নম্রতা। ভয়ে আর সংকোচে তাই মনের ইচ্ছে মনের মধ্যেই চাপা দিয়েছিল নম্রতা।

অথচ আজ সময়ের সাথে সাথে ম্যাজিকের মতো সব বদলে গেল। অচেনা লোকটি এখন আর অচেনা নেই। এখন সে ওর স্বামী। এখন এই ঘরে দিন-রাত চব্বিশ ঘন্টা বসে থাকলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না ওকে।

সারাঘরে কিছুক্ষন হেঁটে বিছানায় বসে ভেজা চুলের খোপাটা খুলে দিল নম্রতা। তারপর বালিশে গা এলিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেল ঘুমের দেশে।

৪১.
বউভাতের পূর্বপ্রস্তুতির ব্যস্ততায় দুপুর পর্যন্ত রুমের বাইরেই ছিল তানিম। শাওয়ার নেওয়ার জন্য দুপুরের দিকে নিজের রুমে আসল ও। ঠিক সকালের মতোই হাতঘড়ি আর ওয়ালেট ড্রেসিং টেবিলের উপরে রাখতে গিয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে বিছানার প্রতিবিম্বে চোখ আটকে গেল ওর। সাথে সাথেই পিছনে ফিরে বিছানার দিকে তাকাল ও। বহু বছরের পরিচিত রুমটাকে আজ হঠাৎ করেই অচেনা মনে হলো ওর।

বিছানার উপর আলুথালু হয়ে ঘুমিয়ে আছে নম্রতা। লম্বা আধভেজা চুলগুলো বিছানাময় ছড়ানো, কয়েকগাছি ছোট চুল গালে আর কপালে লেগে আছে। সদ্য ভাঁজভাঙা বেগুনি রঙের সুতি শাড়িতে ওকে দেখে তানিমের মনে হচ্ছিল, বিছানার উপরে সদ্য প্রস্ফুটিত ল্যাভেন্ডার ফুল সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এই প্রথমবার তানিম পূর্ণদৃষ্টিতে তার বৈধ স্ত্রীর দিকে তাকাল। এবং আগের প্রত্যেকবারের মতো তাকানোর সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল না। অনেকক্ষন ধরে তাকিয়েই থাকল। ঘুমন্ত মেয়েটিকে প্রচন্ড আদুরে লাগছিল ওর কাছে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৬ | (১২৯০+ শব্দ)

এই প্রথমবার তানিম পূর্ণদৃষ্টিতে তার বৈধ স্ত্রীর দিকে তাকাল। এবং আগের প্রত্যেকবারের মতো তাকানোর সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিল না। অনেকক্ষন ধরে তাকিয়েই থাকল। ঘুমন্ত মেয়েটিকে প্রচন্ড আদুরে লাগছিল ওর কাছে।

শাড়ি পড়ায় অনভ্যস্ত মেয়েটা, বোঝাই যাচ্ছে। হাঁটুর প্রায় কাছাকাছি উঠে গেছে শাড়ি। ফর্সা পা দুটো অনাবৃত। কোমরের দিকে গোজা কুচিগুলো এবড়ো থেবড়ো হয়ে আছে।

তানিম শাড়ি টেনে নম্রতার পা দুটো ঢেকে দিল। বিছানার পাশে ভাঁজ করে রাখা পাতলা কাঁথাটা মেলে নম্রতার পা থেকে গলা পর্যন্ত ঢেকে দিল। তারপর ওয়াশরুমে গেল গোসলের জন্য।

অপরিচিত জায়গাতে নম্রতার ঘুম কখনও গভীর হয় না। তানিম রুমে ঢোকার সাথে সাথেই ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। কিন্তু মুখোমুখি হওয়ার ভয়ে চোখ বন্ধ করেই শুয়ে ছিল ও।

ওয়াশরুমের দরজা আটকানোর শব্দটা কানে আসার সাথে সাথেই নম্রতা চোখ খুলে তাকাল।টের পেল, পুরো শরীর কাঁপছে ওর। আরেকটু হলে বোধহয় হৃদপিণ্ডের লাব-ডাব স্পন্দনও পৌঁছে যেত তানিমের কানে।

তানিম রুম থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত নম্রতা ঘুমের ভান করেই শুয়ে থাকল। তানিম চলে যাওয়ার পরে উঠে বসল ও। পুরো রুমে শাওয়ার জেলের একটা মিষ্টি স্মেল ছড়িয়ে আছে। নম্রতা জোরে নিশ্বাস টেনে সেই স্মেলটা ফিল করল।

ওর দুপুরের খাবারটাও রুমেই নিয়ে এলো চাঁদনী। নম্রতা তখন ফোনে মায়ের সাথে কথা বলছিল। চাঁদনী অপেক্ষা করল কথা শেষ হওয়ার। নম্রতা ফোনে কথা শেষ করে বলে উঠল, “ভাবি, তোমাকে শুধু শুধু আমার জন্য কষ্ট করতে হচ্ছে। আমি নিচে গিয়েও তো খেয়ে নিতে পারতাম।”

“এ আর এমন কী কষ্ট। নিচে সব মেহমানে গিজগিজ করছে। তাদের মধ্যে গিয়ে বসলে তুমি খেতে কম্ফোর্টেবল ফিল করতে না একদমই। সেজন্যই তোমার হাজবেন্ড স্পেশালি আমাকে বলে গেছে তোমার খাবারটা যেন ঘরেই দিয়ে যাই।”

নম্রতা মুচকি হেসে খাবারটা হাতে নিল। গায়ে কাঁথা দিয়ে দেওয়া, পাশে বসে তাকিয়ে থাকা, ওর সুবিধার কথা ভেবে চাঁদনীকে দিয়ে খাবার পাঠানো, এসবকিছু মিলিয়ে নম্রতার মাথায় পজিটিভ সিগন্যাল এলো। ওর প্রতি তানিমের রাগটা কি তাহলে আস্তে আস্তে কমতে শুরু করেছে!

বিকেলে নম্রতাকে চাঁদনী নিজের রুমে নিয়ে গেল। সেখানে বসেই সাদমানের বউ রুশিতা সাজিয়ে দিল ওকে। সন্ধ্যার পরে পাড়া-প্রতিবেশী মহিলারা সবাই দেখতে এলো নতুন বউকে। রাতের খাবার খাওয়ারও অনেক পরে তানিমের রুমে নিয়ে যাওয়া হলো নম্রতাকে। রুমের মধ্যে ঢুকেই নম্রতার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। পুরো রুম জারবেরা, গোলাপ আর গাদা দিয়ে সাজানো হয়েছে। বিছানাতেও খুব সুন্দর করে ফুলের পাপড়ি দিয়ে হার্ট শেইপ করা হয়েছে।

নম্রতাকে বিছানায় বসিয়ে রেখে একে একে সবাই চলে গেল রুম থেকে। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলল, টিক-টিক। একসময় সেটা বারোটার ঘর পেরিয়ে গেল। একভাবে বসে থাকতে থাকতে নম্রতার পা-দুটো ব্যাথায় টনটন করে উঠল। একসময় যখন আর বসে থাকতে না পেরে উঠে দাঁড়াবার কথা ভাবল, ঠিক তখনই ঘরে ঢুকল তানিম। রাত তখন একটারও বেশি বাজে। তানিমের ঘরে ঢোকার শব্দ শুনে নম্রতা নড়েচড়ে বসল। কিন্তু ওর উপস্থিতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তানিম একবারের জন্য ওর দিকে ফিরেও তাকাল না। বরং নম্রতা খাটের যেদিকটায় বসে ছিল, তার অপরপাশ থেকে খাটে উঠে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে পড়ল।

নম্রতা তারপরেও কিছুক্ষন বসে থাকল। এরপর একসময় বুঝতে পারল, তানিম উল্টোদিকে মুখ করেই ঘুমিয়ে পড়েছে। এবার নম্রতা উঠে দাঁড়াল, ড্রেসিং টেবিলের সামনে গিয়ে সমস্ত অর্নামেন্টস খুলে ফেলল, ওয়াশরুমে গিয়ে পড়নের টকটকে লাল জামদানিটা খুলে নরমাল একটা সুতি শাড়ি পড়ে বের হলো। আবার আয়নার সামনে গিয়ে খোপায় গোজা ফুলগুলো খুলে রাখল। আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখল টপটপ করে পানি পড়ছে। ইচ্ছে করেই কান্নাটা আর আটকে রাখল না নম্রতা।

দুজনের সম্পর্কটা যেমনই হোক, আজকের রাতটা নিয়ে কিছুটা হলেও এক্সপেকটেশন ছিল নম্রতার। বিশেষ করে তানিমের দুপুরের আচরণের পর ভেবেছিল সবকিছু কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে৷ কিন্তু না, কিছুই স্বাভাবিক হয়নি। বরং পুরো পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে গেছে ওর জনে।

বিয়ের পরে এই প্রথমবার নম্রতা উপলব্ধি করতে পারল, নাকউঁচু স্বভাবের ওই নিষ্ঠুর ছেলেটির মন জয় করা খুব একটা সহজ হবে না ওর জন্য।

৪২.
তানিম উল্টোদিকে মুখ করে শুয়ে ছিল। নম্রতার আর সহ্য হলো না এই নীরবতা। তানিমের হাত ধরে টেনে ওকে বসাল নম্রতা। তানিম ওর দিকে তাকিয়ে বিরক্ত স্বরে বলল, “সমস্যা কী তোমার? এভাবে টেনে তুলেছ কেন?”
“কথা আছে আপনার সাথে আমার।” জেদি স্বরে জবাব দিল নম্রতা।
“কিন্তু আমার কোনো কথা নেই তোমার সাথে। তোমার কি মিনিমাম লজ্জাটুকুও নেই? আগেই তো একবার বলেছি, তোমার সাথে কথা বলতে বিরক্তবোধ করি আমি।”

“তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করেছেন।” প্রশ্নটা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল নম্রতা।

তানিমের কন্ঠেও তখন তেজ, “প্রতিশোধ নিতে।”
“প্রতিশোধ?” অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল নম্রতা।

“হ্যা, প্রতিশোধ। শুধু অনিচ্ছাকৃত একটু স্পর্শের জন্য একদিন আমাকে চরিত্রহীন উপাধি দিয়েছিলে তুমি। তাই সুযোগ পেয়ে সেটার প্রতিশোধ নিলাম। একটুখানি ছোঁয়া লেগেছিল বলে যা নয় তাই বলে অপমান করেছিলে একদিন৷ এখন তুমি আমার স্ত্রী হওয়া স্বত্বেও তোমাকে আমি ছোঁব না। দিনের পর দিন একই ছাদের নিচে থাকব আমরা কিন্তু আমাদের মধ্যে থাকবে যোজন যোজন দূরত্ব। সবার সামনে আর পাঁচটা স্বাভাবিক সুখী স্ত্রীর মতো অভিনয় করতে হবে তোমাকে৷ কিন্তু আদতে পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী নারীটি হবে তুমি, যাকে তার স্বামী স্পর্শ অব্দি করেনি। এভাবে তোমার প্রতি অবহেলা করে অপমানের শোধ তুলব আমি।”

কঠিন স্বরে কথাগুলো বলে আবারও শুয়ে পড়ল তানিম। নম্রতা এবার শব্দ করে কেঁদে ফেলল। ওর ভাবনাই তাহলে ঠিক ছিল। তানিম শুধু অপমানের প্রতিশোধ নিতে বিয়েটা করেছে।

নম্রতার কান্নার শব্দ শুনে উচ্চস্বরে ওকে একটা ধমক দিল তানিম। ঠিক তখনই চোখ খুলে তাকিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল নম্রতা। এসি চলা স্বত্ত্বেও পুরো শরীর ঘেমে গেছে ওর। নম্রতা চারদিকে তাকিয়ে দেখল ও তালুকদার মঞ্জিলে নেই। বরং ওর নিজের বাসায় নিজের সেই পুরোনো রুমে আছে। পরক্ষনেই মনে পড়ল নম্রতার, কাল বিকেলে বৌভাতের পরে তানিমকে নিয়ে ওদের বাসায় এসেছে নম্রতা।

তারমানে এতক্ষন স্বপ্ন দেখছিল ও। নম্রতা ওড়না দিয়ে মুখ আর গলার ঘাম মুছল। ঠিক তখনই ফজরের আজানের শব্দ কানে এলো ওর। পাশে তাকিয়ে দেখল তানিম নেই। ওয়াশরুম থেকে আসা শব্দ শুনে বুঝল, তানিম সেখানেই আছে।

বেডসাইড টেবিলে রাখা গ্লাসভর্তি পানি ঢকঢক করে খেয়ে ফেলল নম্রতা। তারপর আবার বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। স্বপ্নটা এত বেশি জীবন্ত ছিল যে এখনও ওর বুক ধড়ফড় করছে। মা বলে, শেষরাতের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়। এই স্বপ্নটাও কি তাহলে সত্যি হবে?

চোখ বন্ধ অবস্থতেই নম্রতা টের পেল, তানিম ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। কিছুক্ষিন পরেও যখন তানিম খাটে এল না, তখন নম্রতা আবার চোখ খুলে তাকাল। রুমের এককোনে জায়নামাজ বিছিয়ে ফজরের নামাজ আদায় করছিল তানিম তখন। তানিম নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই নম্রতা আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল। তানিম খাটে এসে ঠিক আগের মতোই দুরত্ব বজায় রেখে একপাশে শুয়ে পড়ল৷ এরপর কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘুমিয়ে গেল। কিন্তু পরের সময় টুকু নম্রতার আর এক ফোঁটাও ঘুম হলো না।

নম্রতার ভেতরে যে ঠিক কী হচ্ছে সেটা ও কাউকে বোঝাতে পারবে না৷ সবার সামনে তানিম একেবারেই স্বাভাবিক। নরমালি নতুন বিবাহিত স্ত্রীর সাথে মানুষ যেমন ব্যাবহার করে ঠিক তেমনই আচরণ তার। কিন্তু যখন শুধু দুজনে একত্রে থাকে তখন যেন ওরা দুই গ্রহের বাসিন্দা।

শেষে সকাল সকালই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল নম্রতা। নিচে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল মরিয়ম খাতুন, টুলুর মা আর চাঁদনী মিলে সকালের নাস্তার যোগার করছে।

ওদের সাথে টুকটাক কথা বলার পরে আবার নিজের রুমে ফিরে এলো নম্রতা।

নম্রতা আর তানিম, তালুকদার মঞ্জিলে ফিরল পরেরদিন সকালে।

তারপর কেটে গেল প্রায় মাসখানেক। নতুন পরিবেশে নম্রতার দিনগুলো খুব একটা খারাপ কাটছিল না। সারাদিন পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সাথে গল্প করে আর টুকটাক কাজ করে সময় চলে যায়। নম্রতার সবচেয়ে বেশি সখ্যতা হয়েছিল সাদমানের বউ রুশিতার সাথে। কারণ দুজনে প্রায় সমবয়সীই ছিল। তবে বেশিদিন রুশিতা ওদের সাথে থাকতে পারল না। সাদমানের জবের পোস্টিং যেখানে হয়েছে, সেখানে নিয়ে গেল রুশিতাকে।

সব ঠিক থাকলেও তানিমের সাথে সম্পর্কটা ভীষণ রকম নিস্পৃহ রয়ে গেল ওর। ইদানিং কী একটা নতুন ব্যবসা শুরু করেছে তানিম৷ তাই বেশিরভাগ সময় বাড়ির বাইরে বাইরেই থাকে। সারাদিন পর রাতে যেটুকুও বা দেখা সাক্ষাত হয়, কিন্তু কথা হয় না একদমই।

তানিম রুমে এসে উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে৷ আর খাটের অপরপাশে নম্রতা একটু কথা বলার জন্য ছটফট করতে থাকে। সম্পর্কটা আর ঠিক কতদিন এমন বোবা থেকে যাবে নম্রতা জানে না। বিবাহিত জীবনের এই একমাসে অন্তত একশোবার নম্রতা আগ বাড়িয়ে কথা বলার কথা ভেবেছে। কিন্তু তানিমের ওই কঠোর আর গম্ভীর মুখখানার দিকে তাকিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করতে পারেনি।

৪৩.
ক্লায়েন্টদের সাথে দেড়ঘন্টার একটা লম্বা মিটিং সেড়ে নওয়াজ সাইলেন্ট মোডে থাকা ফোনটা হাতে নিল এবং অবাক হয়ে গেল। চাঁদনীর নাম্বার থেকে তিনটা মিসডকল।

যে মেয়ে সহজে একটা টেক্সট পর্যন্ত করে না, সে কল দিয়েছে, এটা নওয়াজের বিশ্বাস হতে চাইল না। পরের মোমেন্টে ওর মাথায় নেগেটিভ চিন্তাটাই এলো। চাঁদনীর কোনো বিপদ হলো না তো?

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৭ | (১৫৮০+ শব্দ)

যে মেয়ে সহজে একটা টেক্সট পর্যন্ত করে না, সে কল দিয়েছে, এটা নওয়াজের বিশ্বাস হতে চাইল না। পরের মোমেন্টে ওর মাথায় নেগেটিভ চিন্তাটাই এলো। চাঁদনীর কোনো বিপদ হলো না তো?

নওয়াজ সাথে সাথেই কলব্যাক করল, এবং কয়েকবার রিং বাজার সাথে সাথেই রিসিভ করল চাঁদনী,

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কী ব্যাপার চাঁদনী? সব ঠিকঠাক আছে তো?”
“কেন? ঠিকঠাক থাকার কি কথা ছিল না?” নওয়াজের প্রশ্নে উত্তরে পালটা প্রশ্ন করল চাঁদনী।

“না মানে, তুমি তো কখনও কল করো না তাই…।”

“কখনও করি না বলে এখন করা যাবে না, এমন তো কোনো কথা নেই। কল করায় কি আপনার খুব সমস্যা হয়ে গেল?”

“ধুর! সবসময় ঝগড়া করার জন্য একদম মুখিয়ে থাক। আমি কখন বললাম যে আমার সমস্যা হচ্ছে!”

চাঁদনী হেসে ফেলল এবার।
“আপনি তো আর আমার খোঁজখবর নেবেন না, তাই আমাকেই কল দিতে হচ্ছে।”

নওয়াজ বিড়বিড় করে বলল, “খোঁজ খবর নেওয়ার সুযোগটা পাচ্ছি কই। কথা বলতে গেলেই তো রেগে রেগে আগুন হয়ে যাও।”

চাঁদনী কথাগুলো শুনেও না শোনার ভান করে জিজ্ঞাসা করল, “কী বললেন?”

“কিছু না। অনেকদিন হয় বাসায় আসো না। আজ আসবে?”

“কেউ যদি নিতে আসে তাহলে যাব।”

নওয়াজের মনে হলো আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। উচ্ছ্বসিত স্বরে ও বলল, “বিকেলে রেডি থেক তাহলে, আমি নিতে আসব।”

নওয়াজ ওর কথা রাখল। বিকেলেই নিতে এলো চাঁদনীকে। চাঁদনী ফিরে প্রথমেই গেল মরিয়ম খাতুনের রুমে। মরিয়ম খাতুন চাঁদনীকে পেয়েই অভিযোগের ডালি খুলে বসলেন,
“চাঁদনী, তুমি মনেহয় ভুলেই গেছ যে তোমার একটা শ্বশুড়বাড়ি আছে। তুমি বলেছিলে পড়াশোনায় কন্সেন্ট্রেশন রাখার জন্য তুমি হলে থাকতে চাও। আমি তাতে আপত্তি জানাইনি। কিন্তু তাই বলে আমাদের একদম ভুলে যাবে? গত দুই সপ্তাহ ধরে কোনো খোঁজ নেই তোমার।”

“আমি তো আপনাকে ফোন করি মা। আপনি ইদানিং আমার ফোনও ধরছেন না।”

“কেন ধরব? শুধু ফোন করলেই সব দায়িত্ব শেষ? আমি খুব রেগে আছি তোমার উপর।”

“খুব ভুল হয়ে গেছে মা। আসলে পড়ার এত প্রেসার যাচ্ছিল। এখন থেকে আর এমন হবে না।”

“শোনো মা, তোমার ভালোর জন্যই বলছি। পড়াশোনা করছ করো, তাই বলে বাকীসব হেলা করো না। সংসারের দায়িত্ব আমি তোমার উপর চাপিয়ে দিতে চাইছি না। শুধু এতটুকু বলব, আমার ছেলেটার ভালো থাকা না থাকাটাও কিন্তু তোমার সাথেই জড়িয়ে আছে।”
ইঙ্গিতটা ধরতে পারল চাঁদনী।

শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে রুমে এসে চাঁদনী দেখল নওয়াজ ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। চাঁদনী বোরখা চেঞ্জ করে রান্নাঘরে গেল। মরিয়ম খাতুনের আপত্তি স্বত্ত্বেও নিজের হাতে সবার জন্য সন্ধ্যার নাস্তা বানাল। অনেকদিন পর হলের একঘেয়ে লাইফ থেকে মুক্তি পেয়ে সময়টা আনন্দেই পার হলো।

রাতে ঘুমানোর সময় আজ আর বিছানার মাঝখানে কোলবালিশ রাখল না চাঁদনী। অনেক হয়েছে নওয়াজকে শাস্তি দেওয়া৷ দুজনের মধ্যের এই দুরত্বটা আজকাল ওর নিজেরই ভালো লাগছে না।

নওয়াজের বোধহয় ব্যস্ততা যাচ্ছে খুব। রাতের খাবার খেয়ে আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসে গেছে ও।

নওয়াজ বিছানায় এলো বেশ দেরি করে। চাঁদনী তখন অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়েই যাচ্ছিল প্রায়৷ নওয়াজ ঘুমাতে এসে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“চাঁদনী, আজকে তুমি দুজনের মধ্যে কোলবালিশ রাখতে ভুলে গেছ মনেহয়।”
চাঁদনী উঠে বসে কটমট করে তাকাল নওয়াজের মুখের দিকে। আগ বাড়িয়ে সম্পর্ক সহজ করতে চাওয়াটা মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে৷ এই মহাবদ ছেলের সাথে দুরত্ব বজায় রাখাই ভালো। কোনো কথা না বলে চাঁদনী বিছানার পাশে থেকে কোলবালিশ নিয়ে একেবারে মাঝ বরাবর দিয়ে দিল। তারপর উলটোপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল আবার৷

নওয়াজ খাটে উঠে এক ঝটকায় কোলবালিশ তুলে ফ্লোরে ফেলে দিল। তারপর বলল,
“উঠে বসো চাঁদনী। তোমার সাথে আমার কথা আছে।”

নওয়াজের কন্ঠে কিছু একটা ছিল। চাঁদনী তাই কোনো উত্তর না দিয়ে উঠে বসল। নওয়াজের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“কী কথা?”
“এভাবে আর কতদিন চলবে?”
“কীভাবে?” আবারও প্রশ্ন চাঁদনীর।
“চাঁদনী, তুমি খুব ভালো করেই বুঝতে পারছ আমি কী মিন করতে চাইছি।”
চাঁদনী এবার কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, “আমি তো আজ আমার মতো করে চেষ্টা করতে গিয়েছিলাম কিছুক্ষন আগে৷ এমনকি আজ এই বাড়িতে আমি নিজেই সেধে এসেছি। আর ঠিক কী করতে পারি আমি? আপনি একটু বলে দিন।”
“বুঝলাম, তুমি চেষ্টা করছ। কিন্তু কী লাভ এসব করে? আজকের রাতের কিছুটা সময় হয়তো ভালো কাটবে আমাদের। তারপর কাল থেকে আবার সব আগের মতো। দিনের পর দিন চলে যাবে তুমি একটা কল পর্যন্ত করবে না। আমি কল দিলেও কথা বলবে রেগে রেগে। শুধু কয়েকদিন পরপর ইন্টিমেট হওয়া ছাড়াও হাজবেন্ড ওয়াইফের মধ্যে আরও অনেক কিছুই থাকে। ফিজিক্যালের সাথে সাথে ইমোশোনাল অ্যাটাচমেন্ট থাকাটাও জরুরি। আচ্ছা, তুমিই বলো। আমাদের মধ্যে কি তেমন কিছু আছে?

রুমের মধ্যে আবারও নেমে এলো শ্মশানের নীরবতা। নওয়াজ আবারও বলল, “কিছু তো বলো চাঁদনী। এভাবে আর কতদিন চলবে?”

“আমি কী করব বলুন তো? চেষ্টা করলেও কেন জানি আমি ইজি হতে পারি না একদম। এখনও মনের মধ্যে সংশয় কাজ করে৷ সত্যিই আপনি মন থেকে মেনে বিয়েটা করেছেন তো! একসময় আপনি নিজেই বলেছিলেন, আপনার প্রতি আমার ফিলিংসগুলোকে যেন বাড়তে না দেই। তারপর আবার সেই আপনিই স্বেচ্ছায় বিয়েটা করলেন। নিজে থেকে আপনার কাছে আসতে গেলেও নিজেকে কেমন হ্যাংলা বলে মনে হয়। আপনার সেই প্রথমদিককার বলা কথাগুলো মনে হয়ে যায়। তখন ভাবি আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করছি না তো। আমার নেচারই এরকম। একবার নেগেটিভিটি মনের মধ্যে চলে আসলে সেটাকে খুব সহজে ভুলতে পারি না। বিশ্বাস করুন, আমি চেষ্টা করি। তারপরেও কেমন জানি সব ওলটপালট হয়ে যায়। আমি কি করব, আপনিই বলে দিন।”

বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই ফেলল চাঁদনী। নওয়াজ আরেকটু কাছে এগিয়ে এসে চাঁদনীর ডানহাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। কাতর স্বরে বলল,
“আমি প্রথমে ভুল করেছিলাম চাঁদনী৷ সেই ভুলের জন্য আমার মধ্যে সারাজীবনই হয়তো আফসোস থেকে যাবে৷ প্রথমবার যেদিন তোমার সাথে দেখা হলো, সেদিনই মনের মধ্যে তোমার জন্য একটা সফট কর্ণার তৈরি হয়েছিল। প্রত্যেকদিন তোমাকে চোখের সামনে দেখা একটা অভ্যাসের মতো হয়ে গিয়েছিল। মাঝেমাঝে তুমি তোমাদের বাড়ি যেতে। তখন কিছুটা বুঝতে পারতাম তোমার শূন্যতা। এরপর সেদিন যখন রুমে গিয়ে আকরামের সামনে তোমাকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখলাম, সেদিন যে কী তোলপাড় আমার মধ্যে হয়ে যাচ্ছিল সেটা তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারব না। তোমার সেই কান্নাভেজা মুখ দেখেই আমি প্রথমবার রিয়েলাইজ করেছিলাম, আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি।”

কিছুক্ষনের জন্য থামল নওয়াজ। তারপর আবার বলল, “আগে যা হয়ছে সব ভুলে যাও চাঁদনী। চলো আমরা আবার নতুন করে শুরু করি৷ যতটুকু দুরত্ব আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে, সেটা স্বাভাবিক করার জন্য আমাদের দুজনেরই চেষ্টা করতে হবে।”

চাঁদনী বলল, “আমিও চাই, সেই চেষ্টাটাই করতে।”

“তাহলে আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য প্রথম ধাপটা আমরা শুরু করে দিতে পারি কালই। কী বলো?”

“কী করতে হবে আমাকে?”

“কালই তোমার জিনিসপত্র সব নিয়ে আমাদের বাসায় শিফট হয়ে যাও।”

চাঁদনী থতমত খেয়ে গেল। মোক্ষম চালটাই চেলেছে নওয়াজ। পালটা যুক্তি দেখানোর চেষ্টা করল চাঁদনী এবার।

“মায়ের সাথে তো আগেই আমার কথা হয়েছে এই ব্যাপারে। হলে থেকে আমি পড়াশোনায় যেমন কনসেনট্রেশান দিতে পারব, বাড়িতে থেকে সেটা…।”

“কেন? তোমার কী মনে হয়? তুমি বাড়িতে থাকলে আমি সারাক্ষন তোমাকে ডিস্টার্ব করব?”

চাঁদনী হতভম্ব হয়ে বলল, “আশ্চর্য! আমি সেটা কখন বললাম?”

“সবকিছু বলে দিতে হয় না চাঁদনী। কিছু ব্যাপার নিজে থেকেই বুঝে নেওয়া যায়। আমার বাবা ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মানুষ তাই সবার সাথেই কথা কম বলে, নম্রতা এখন আর এখানে নেই। মা আছে, তবে সে তোমার পড়াশোনা নিয়ে যথেষ্টই সিরিয়াস। বাকী রইলাম শুধু আমি। অর্থাৎ তুমি আমার জন্যই এই বাড়িতে থেকে পড়তে চাইছ না। তোমার কী মনে হচ্ছে? এই বাড়িতে থাকলে সময়ে অসময়ে আমি তোমার পড়াশোনার ক্ষতি করে তোমার সাথে রোমান্স করতে চাইব?”

শেষের কথাটুকুতে চাঁদনী লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। বুঝল, ও ধরা পড়ে গেছে নওয়াজের কাছে। যার থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে এমন পালিয়ে বেড়ানো, অবশেষে সে হাতেনাতে পাকড়াও করে ফেলেছে ওকে। চাঁদনী মাথা নিচু করে ভাবতে লাগল, এই পরিস্থিতিটা ঠিক কীভাবে সামাল দেবে।

চাঁদনীর থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে নওয়াজ বলল, “সত্যিই এটাই তাহলে কারণ। ওকে ফাইন, আমিই যদি সমস্যা হই, তাহলে আমার রুমে ওঠার দরকার নেই। বিয়ের আগে প্রথমবার যেমন আলাদা রুমে উঠেছিলে, সেভাবেই আবার ওঠো। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি কখনও তোমার রুমে উঁকি পর্যন্ত দেব না। মাঝে মাঝে শুধু একটু সময় দিলেই হবে আমাকে। আর তাতেও যদি তোমার আপত্তি থাকে, তাহলে আমি প্রমিস করলাম, তুমি ডাক্তার না হওয়া পর্যন্ত আমি তোমাকে স্পর্শও করব না।”

শেষের কথাটুকু নওয়াজ একটু জোর দিয়েই বলল। চাঁদনী আঁতকে উঠল। ডাক্তার না হওয়া পর্যন্ত স্পর্শ করবে না মানে! সে তো এখনও বহু বছরের ব্যাপার। এই যে, ঠিক এই মুহূর্তটাতেই তো চাঁদনী ব্যাকুল হয়ে আছে নওয়াজের এলোমেলো ছোঁয়াগুলো পাওয়ার জন্যে। ডাক্তার হওয়া তো এখনও অনেকগুলো বছরের ব্যাপার। এতদিন নওয়াজ দূরে থাকলে তো ও মরেই যাবে। চাঁদনী এবার চাপা গলাতেই জোরে বলে উঠল, “না!”

“না মানে?” নওয়াজ প্রশ্ন করল।

আবারও অপ্রস্তুত হয়ে গেল চাঁদনী। নওয়াজের যেই কথায় আপত্তি জানিয়ে না বলেছিল, সেটা এড়িয়ে গেল। পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলো এবার।

“মানে আপনার ধারনা পুরোপুরি ভুল। আমি মোটেও আপনার জন্য হলে থাকছি না।”

“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
“ওকে। আমি কালই এই বারিতে শিফট হব।”

চাঁদনীর উত্তর শুনে নওয়াজকে ততটাও খুশি বলে মনে হলো না। ও বোধহয় আরেকটু ক্লারিটি চাইছিল। সেজন্যই আবার বলে উঠল,
“ওকে। তাহলে আম্মুকে বলে তোমার রুমটা পরিস্কার করে রাখতে বলব কালই৷”

চাঁদনীর নিচু মাথা লজ্জায় আরও নুয়ে গেল
“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি আপনার রুমেই উঠব।”

নওয়াজ এবার শব্দ করেই হাসল। এতক্ষনে অশান্ত মনটা শান্ত হয়েছে ওর। আপাতত চাঁদনী বাসায় আসতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক। নওয়াজ আবার অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল,
“তো ম্যাডাম। আপনার কোলবালিশের ব্যারিকেড তো আমি নিচে ফেলে দিয়েছি। এবার কি আমরা একটু কাছাকাছি আসতে পারি?”

চাঁদনী চুপ করে বসে থাকল। নীরবতাকে সম্মতির লক্ষন ধরে নিয়েই এগিয়ে গেল নওয়াজ। চাঁদনী থামিয়ে দিল ওকে। নিচু স্বরে বলল, “লাইটটা অফ করে আসেন প্লীজ।”

নওয়াজ আরেকধাপ এগিয়ে গিয়ে বলল, “উফ! জানো যে বলে কোনো লাভ হবে না। তারপরেই প্রত্যেকবার কেন যে একই কথা বলো তুমি।”

চাঁদনী বোধহয় আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল। চতুর নওয়াজ সেটা বলার সুযোগটুকু দিল না। তার আগেই চাপা শীৎকারে ভারী হয়ে উঠল রুমের পরিবেশ৷

৪৪.
তানিমের ইদানীং ব্যস্ততা যাচ্ছে খুব। বিয়ে ঠিক হওয়ার পরেই নতুন ব্যাবসাটা শুরু করার সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল ও। এমনিতে আমবাগান, মাছের ঘের, গঞ্জের বাজারের স্টলগুলো আর শেয়ারে কয়েকটা ছোটখাট বিজনেস থেকে প্রত্যেক মাসে ওর যা লাভ হয় সেটা বেশিরভাগ সময়েই লাখ ক্রস করে।

তবুও আজকাল তানিম চেষ্টা করছে নিজের ইনকাম আরও বাড়ানোর জন্য। বিশেষ করে নম্রতাকে বিয়ে করার পরে। বিলাসবহুল পরিবেশে ছোট থেকে বড় হয়েছে সে। শ্বশুড়বাড়িতেও নিশ্চই সেরকম একটা পরিবেশই চাইবে সে৷ সেজন্যই আজকাল প্রানান্তকর চেষ্টা তানিমের।

ইদানিং ব্যাবসার কাজে কিছুটা ঘনঘনই ঢাকা যেতে হচ্ছে তানিমকে। গতকাল সকালেও ঢাকা গিয়েছিল ও। ফিরল তার পরেরদিন বিকেলে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-২২+২৩+২৪

0

(প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা)
নিভৃত রজনী
| ২২ | (১৪৫০+ শব্দ)

নওয়াজ লাইটের সুইচ অফ করে দিল আগে, তারপর ডিম লাইটের মৃদু আলোতেই ওয়ারড্রব খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল ফ্রেশ হতে।

বেশ লম্বা সময় নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বিছানার দিকে গেল নওয়াজ। উঁকিঝুঁকি মেরে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করল চাঁদনী ঘুমিয়েছে নাকি। নওয়াজ ইদানিং চাঁদনীকে ভয় পাচ্ছে অল্প অল্প। বিশেষ করে সেই বিয়ের রাতে চাঁদনী যখন জেরা করল বিয়ে করার কারন জানতে চেয়ে, ঠিক তখন থেকেই।

নওয়াজ ভেবেছিল বিয়ের কথা জেনে চাঁদনী সারপ্রাইজড হয়ে যাবে। খুশিও হবে। কিন্তু বিয়ের পরে চাঁদনীর ওভাবে রিয়্যাক্ট করাটা নওয়াজের জন্যে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।

অবশ্য চাঁদনীর ওই আচরণটার পিছনে লজিক আছে। নওয়াজ নিজেই তো সেধে ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিল একদিন৷ তারপর হুট করে আবার বিয়ে করতে চাইলে মনের মধ্যে প্রশ্ন আসাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

নওয়াজ স্বগতোক্তি করল, বি ব্রেভ নওয়াজ। এত হেজিটেড করার কিছু নেই। এটা চাঁদনী। সেই নরম মেয়েটা যে তোকে দেখলে সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিত একসময়। তুই আশেপাশে থাকলেও যার শরীরে মৃদু কাঁপুনি শুরু হয়ে যেত। যার চোরা চোখ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তোর দিকে। সবচেয়ে বড় কথা, মেয়েটা এখন তোর বউ। তার উপরে অধিকার আছে তোর।

নওয়াজ কয়েকটা শুকনো কাশি দিয়ে প্রশ্ন করল, “ঘুমিয়েছ চাঁদনী?”
“না।” সাথে সাথেই জবাব দিল চাঁদনী।

“আজ একটু কম ঘুমালে কি খুব অসুবিধা হবে?”
“তা তো হবেই।”

চাঁদনীর যান্ত্রিক জবাবে দমল না নওয়াজ।
“অসুবিধা হলে হোক। চলো আজ রাতটা আমরা গল্প করে কাটাই।”
“এবার কিন্তু আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন।”
চাঁদনীর কথা শুনে নিঃশব্দে হাসল নওয়াজ। ওর পুরোনো সাহসটা ফিরে এসেছে আবার। এখন আর চাঁদনীকে ভয় লাগছে না।

সম্পূর্ণ সিরিয়াস স্বরেই রসিকতাটা করল নওয়াজ, “সেকি, তুমিই তো কিছুক্ষন আগে বললে লাইট অফ করে আমার যা খুশি করতে। এখন বিরক্ত কেন হচ্ছ?”

ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা বুঝতে অসুবিধা হলো না চাঁদনীর। এতক্ষন উলটো দিকে মুখ করে শুয়ে নওয়াজের সাথে কথা বলছিল ও। এবার এপাশ ফিরে নওয়াজের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকাল ও।
“আমি মোটেও ওরকম কিছু মিন করে বলিনি।”

“কীরকম কিছু?” চাঁদনীকে নাস্তানাবুদ করতে প্রশ্ন করল নওয়াজ। ওর ঠোঁটের কোনো আলতো হাসি লেগে আছে।

চাঁদনী কিছুক্ষন আমতা আমতা করে প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বলল, “এসিটা একটু কমিয়ে দিন। শীত লাগছে।”

নওয়াজও আজ নাছোড়বান্দা। যেভাবে হোক চাঁদনীকে আজ আত্মসমর্পণ করিয়েই ছাড়বে।
“এসির পাওয়ার না কমিয়ে শীত নিবারণের আরও অনেক উপায় আছে। অনুমতি দিলে আমি এক্ষুনি তোমার শীত কমানোর ব্যবস্থা করি?”

চাঁদনী থেমে গেল এবার। নওয়াজের কথাগুলো একেবারে অন্যরকম লাগছে এই রাতের নির্জনতায়। এতক্ষনের হালকা শীত-শীত অনুভূতির সাথে শিরা উপশিরায় একটা শিরশিরে অনুভূতিও টের পেল চাঁদনী।

নওয়াজ ওর চুপ থাকাকে সম্মতির লক্ষন ধরে নিল বোধহয়। আধো আলোতেই চাঁদনীকে পাতলা কম্ফোর্টারে ঢেকে দিল ও। তারপর নিজেও কম্ফোর্টারের ভিতরে ঢুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল চাঁদনীকে। কন্ঠস্বর একেবারে স্বাভাবিক।

“এখনও শীত লাগছে?”

চাঁদনীর টের পেল ওর হাত পা অসার হয়ে আসছে। মস্তিষ্ক বলছে নওয়াজকে এত সহজে নিজের কাছে ঘেসতে দেওয়া যাবে না একদম। কিন্তু শরীরটা নওয়াজের উষ্ণ আলিঙ্গণ উপভোগ করছিল খুব করে। একই সাথে মন বলছিল, এভাবেই সে নিজের সাথে ওকে জড়িয়ে ধরে রাখুক অনন্তকাল।

চাঁদনীর প্রতিক্রিয়া বোঝার জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করল নওয়াজ। তারপরে স্পর্শগুলোকে আরেকটু গভীর করল।

নওয়াজকে বাঁধা দেওয়ার মতো সামান্য শক্তিটুকুও চাঁদনীর শরীরে রইল না। বরং সেই আলতো, গভীর এবং উষ্ণ স্পর্শগুলো পাওয়ার জন্য ও নিজেও উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। একসময় নিস্তেজ হয়ে শরীরের ভার নওয়াজের উপরেই ছেড়ে দিল ও। কাঁপা গলায় শুধু এতটুকুও বলতে পারল ও, “ডিম লাইটটাও অফ করে দেন প্লিজ।”

নওয়াজ ঘন স্বরে ফিসফিস করে চাঁদনীর কানে কানে বলল, “মোটেও না। বরং প্রথমবার বলে কিছুটা স্যাকরিফাইস করলাম। এরপর প্রত্যেকবার আদর করার সময় রুমের সবগুলো লাইট জ্বেলে রাখব আমি।”

ক্লান্ত চাঁদনীর পুরো রাতে আর ঘুমানো হলো না একফোঁটাও। সুখময় অত্যাচারে নতুন এক নওয়াজকে আবিষ্কার করতে করতেই কেটে গেল সারারাত।

নওয়াজ এবং চাঁদনী দুজনেরই চোখ লেগে এসেছিল শেষরাতের দিকে। সকালে নওয়াজের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। ঘুম থেকে উঠে আশেপাশে কোথাও চাঁদনীকে পেল না ও। ব্যালকনিতে গিয়েও খোঁজ করল। সেখানে রেলিঙের সাথে কাল রাতে চাঁদনীর পড়নে থাকা আধভেজা স্যালোয়ার কামিজ মেলে দেওয়া।

নওয়াজ গোসল সেরে নিচে নামল নাস্তা করতে। খেতে খেতে মাকে প্রশ্ন করল,
“চাঁদনী গতকাল কার সাথে এসেছে মা?”

মরিয়ম খাতুন বললেন, “তানিম আর রেবেকা ভাবি এসেছেন চাঁদনীর সাথে।”

“কাল তো বললে না যে ওরা আসবে।”
“তুই সকালে অফিসে চলে যাওয়ার পর জানতে পারলাম যে আসবে। তারপর সারাদিন তো জানানোর সুযোগটুকুও পেলাম না। রাতেও ফিরলি দেরি করে। জানাবটা কখন!”

“বুঝেছি। এখন বাসায় তো দেখছি না চাঁদনীকে। কোথায় গেছে আবার?”
“কেন? তুই জানিস না? চাঁদনীর আজ ভর্তির ডেট। তাছাড়া চাঁদনীর হলে ওঠার বিষয়টাও ঠিকঠাক করতে হবে। সেজন্যই বেরিয়েছে ওরা।”

নওয়াজ খাওয়া থামিয়ে দিল মাঝপথেই। চাঁদনীর আজ ভর্তি অথচ কাল কিছুই বলল না। আর কি বলল মা! চাঁদনী হলে উঠবে!

“মা, চাঁদনী হলে থাকবে? মানেটা কী?”

“চাঁদনী হলে থেকেই পড়তে চাইছে। আর ওর চাওয়াটাকে আমি গুরুত্ব দিতে চাই। চাঁদনীর থাকা নিয়ে আর কোনো কথা হবে না”

“কিন্তু তাই বলে…।”

“শোন নওয়াজ, দিনের পর দিন তুই মেয়েটাকে অবহেলা করে গিয়েছিস। তারপরেও ওর সাথে বিয়েটা যে হয়েছে সেটাই অনেক। চাঁদনী বলেছে পড়াশোনার সুবিধার্থে ও হলে উঠতে চায়৷ কিন্তু আমি জানি আসল কারণটা কী। বিয়ের আগেই এমন তিক্ততা তুই তৈরি করেছিস ওর সাথে যে মেয়েটা বাড়িতে থাকতে অব্দি চাইছে না। এখন ওকে ওর মতো থাকতে দে।”

মায়ের কথা শুনে নওয়াজ অর্ধেক নাস্তা করেই উঠে গেল। চাঁদনীর আজ ভর্তি, অথচ একবারও ওর সাথে সেটা বলল না! এমনকি হলে উঠতে চাওয়ার ব্যাপারটাও বলার প্রয়োজনবোধ করল না! নওয়াজের খুব একটা ভালো লাগল না বিষয়টা। চাঁদনী ওর স্ত্রী, তার ছোটখাট বিষয়গুলোও জানার অধিকার আছে ওর। সেই অধিকার থেকে চাঁদনী কেন ওকে বঞ্চিত করবে?

কিছুক্ষন ভাবার পর নওয়াজের মনে হলো, চাঁদনীকে একতরফা ভাবে দোষ দেওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। ও নিজেও তো হলুদিয়া থেকে ফেরার পর একবারও চাঁদনীর সাথে যোগাযোগ করেনি। অবশ্য নওয়াজ যে ইচ্ছে করে এই কাজটা করেছে তেমনটাও নয়৷ চাঁদনীর ফোনে অসংখ্যবার ডায়াল করতে গিয়েও শেষপর্যন্ত করতে পারেনি ও। ওদের মধ্যে তেমনভাবে সখ্যতাটাই গড়ে ওঠেনি আসলে।

নওয়াজ তালুকদার মঞ্জিলে যেই দুদিন ছিল, চাঁদনী কথা বলা তো দূরের কথা একবার তাকিয়েও দেখেনি ওর দিকে। বরং যতবারই নওয়াজ কথা বলতে গেছে, ততবারই এমন ভাবে জবাব দিয়েছে যেন সে মহাবিরক্ত ওর উপরে। নওয়াজও তাই আর ঘাটায়নি ওকে। ভেবেছে কিছুদিন গেলে তারপর চাঁদনীর সাথে মিটমাট করে নেওয়ার আরেকটা চেষ্টা করবে।

এরমধ্যেই গতকাল হঠাৎ চাঁদনীকে নিজের রুমে দেখে যথেষ্টই ভড়কে গিয়েছিল ও। তারপর হঠাৎ করেই এতটা কাছে আসা ছিল মেঘ না চাইতেই বৃষ্টির মতো। কাল রাতে শারিরীক দুরত্ব ঘুচিয়ে কাছে আসাটা হয়েছে বটে কিন্তু তবুও কোথাও একটা আক্ষেপ। চাঁদনী কি আদৌ সহজ হতে পেরেছে ওর সাথে। নাহ, আর এভাবে হেলাফেলা করা যাবে না ব্যাপারটাকে। চাঁদনীর সাথে সহজ স্বাভাবিক একটা সম্পর্ক তৈরির জন্য এখন থেকেই চেষ্টা করতে হবে।

৩৬.
তানিম গ্রাজুয়েশন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। খুব ভালো সিজিপিএ থাকার কারনে অনেকগুলো হ্যান্ডসাম স্যালারি জব অফারও পেয়েছিল। কিন্তু সেগুলো সব রিজেক্ট করে ও ফিরে গিয়েছিল গ্রামে। কারণ শহর কখনোই ওর পছন্দের তালিকায় ছিল না।

তানিমের শহরকে অপছন্দ করার পেছনে যেকটা মেজর রিজন ছিল তারমধ্যে অন্যতম হলো ধূলো-বালিময় শহরের তীব্র যানজট। ঘন্টার পর ঘন্টা গাড়িতে জ্যামে বসে থাকাটা ওয়েস্ট অভ টাইম ছাড়া আর কিছুই মনে হতো না ওর।

খুব প্রয়োজন না হলে ও শহরমুখো হতো না ও। কিন্তু এখন চাঁদনীর জন্য মাঝেমধ্যেই আসতে হয় ঢাকায়। আজ ও তীব্র গরমে প্রায় দেড় ঘন্টা জ্যামে বসে থেকে তিরিক্ষি মেজাজ নিয়ে অবশেষে চাঁদনীর হলের সামনে পৌঁছাল ও।

গাড়ি পার্ক করে কল করল চাঁদনীর ফোনে। গুনে গুনে তিনবার রিং হওয়ার পর রিসিভ করল চাঁদনী। তানিম ওর কাছে এসেছে শুনে বলল,
“উফ, তানিম ভাই। তুমি আসার আগে অন্তত একবার জানাবে তো। আমার শ্বাশুড়ি তো সকালে গিয়ে আমাকে তার কাছে নিয়ে এসেছেন। আজ বোধহয় আর ফেরা হবে না। তুমি এক কাজ করো, এখানেই চলে এসো।”

“চাঁদনী, এখন তাহলে আমি ফিরে যাই। পরে আবার এসে তোর সাথে দেখা করে যাব।”

“মানে কী! এতদূর এসে তুমি আমার সাথে দেখা না করেই চলে যাবে?”

“তুই হলে ফিরে আমাকে ফোন দিস। আমি সেদিনই এসে তোর সাথে দেখা করে যাব।”

“আমি বুঝতে পারছি না, এই বাড়িতে আসতে তোমার এত কিসের সমস্যা! আমার শ্বাশুড়ি মা এত পছন্দ করেন তোমাকে, তার সাথে অন্তত দেখা করে যাওয়া উচিৎ তোমার।”

“কিন্তু চাঁদনী…।”

“আবার কিন্তু? এবাড়িতে কেন তুমি আসতে চাও না, সেটা আগে আমাকে ক্লিয়ার করো। ওকে, ফাইন৷ যখন তুমি আসতেই চাও না। আসতে হবে না তোমাকে।”
তানিমকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই চাঁদনী খট করে লাইন কেটে দিল।

কথায় আছে, মানুষ যেটা এড়িয়ে যেতে চায়, বেশিরভাগ সময় ভাগ্যক্রমে তাকে সেটারই মুখোমুখি হতে হয়। চাঁদনীর সাথে কথা বলার পর তানিমের মেজাজ আরও চড়ে গেল। সত্যিই ভুল হয়ে গেল। আগে চাঁদনীকে কল করে নেওয়া উচিৎ ছিল। চাঁদনীর শ্বশুড়বাড়ি যেহেতু ঢাকাতে, মাঝেমাঝে চাঁদনী সেখানেও যাবে এটাই স্বাভাবিক। এখন তো আর এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। মরিয়ম খাতুনদের ওখানে যেতেই হবে। নইলে আবার চাঁদনী রেগে যাবে।

ওখানে যাওয়া মানেই আবার ওই মেয়েটার মুখোমুখি হতে হবে। তানিম চায় না ওই মেয়েটার সামনে যেতে। যদিও তানিম জানে, মেয়েটা হয়তো তার প্রথমদিনের সেই ব্যাবহারের জন্য অনুতপ্ত। তালুকদার মঞ্জিলে যেকদিন ছিল মেয়েটা, প্রত্যেকবারই তানিম সামনে থাকলে কী ভীষণ একটা কুন্ঠাবোধে গুটিয়ে নিত নিজেকে। তখনই তানিম বুঝেছিল, যে প্রথম সাক্ষাতের সেই ব্যাবহারের জন্য লজ্জিত সে। তারপর তালুকদার মঞ্জিল থেকে ফেরার দিন যখন তানিমের সাথে কথা বলতে চাইছিল, তখনও তানিম আন্দাজ করে নিয়েছিল কারনটা। সেদিন ইচ্ছে করেই মেয়েটাকে পালটা অপমান করেছিল ও। তারপর মেয়েটা যখন ওর কথা শুনে কেঁদে ফেলল, তখন অবশ্য মনে হয়েছিল যে কথাগুলো ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। একটা সুক্ষ্ণ অপরাধবোধও বাসা বেঁধেছিল মনে। কিন্তু তানিম সেটাকে খুব একটা পাত্তা দেয়নি।

আসলে জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ের থেকে অপমানিত হওয়া ওর পৌরুষে আঘাত করেছিল ভীষনভাবে। বিশেষ করে সামান্য একটা ধাক্কার জন্য ওর চরিত্রের উপর আঙুল তোলাটা মেনে নিতে পারেনি তানিম একদমই।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৩ | (১৪৫০+ শব্দ)

আসলে জীবনে প্রথমবার কোনো মেয়ের থেকে অপমানিত হওয়া ওর পৌরুষে আঘাত করেছিল ভীষনভাবে। বিশেষ করে সামান্য একটা ধাক্কার জন্য ওর চরিত্রের উপর আঙুল তোলাটা মেনে নিতে পারেনি তানিম একদমই।

মরিয়ম খাতুনদের বাড়ি পৌঁছে তানিম দেখল সেখানে এলাহি কারবার চলছে। আত্মীয়স্বজনে গিজগিজ করছে বাড়ি। মরিয়ম খাতুন ব্যস্ত হয়ে ছোটাছুটি করছেন। তানিমকে দেখে তিনি খুশি হলেন খুব। কুশলাদি জিজ্ঞাসা করে বললেন, “নওয়াজের বিয়েটাতো একেবারেই হঠাৎ করে হয়েছে, তখন কাউকেই তেমনভাবে বলা হয়নি। কাছের আত্মীয়স্বজনেরা খুব করে চাইছিল নওয়াজের বউ দেখতে। সেজন্যই আজ সবাইকে ইনভাইট করেছিলাম। খুবই ব্যস্ততা যাচ্ছে বুঝলে।”
মরিয়ম খাতুনের কথার প্রত্যুত্তরে তানিম শুধু স্মিত হাসল।

কিছুক্ষন থেমেই মরিয়ম খাতুন ডেকে উঠলেন আবার, “নম্রতা, এদিকে আয় তো।”

নম্রতা প্রায় সাথেসাথেই ছুটে এলো। এসেই চমকাল খুব। একপ্রকার বিভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করল, “ডেকেছিলে আম্মু?”

“হ্যা, তানিমকে নিয়ে ডাইনিংয়ে যা। ছেলেটা এতদূর জার্নি করে এসেছে। দুপুরের খাওয়া নিশ্চই হয়নি এখনও।”

তানিম বলে উঠল, “আন্টি, আজ থাক। আমি চাঁদনীর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। দেখা করেই রওয়ানা হব আবার।”

“একদম চুপ। আজ আর তোমার ফেরা হবে না। আমি এদিকটায় একটু ব্যস্ত, তুমি নম্রতার সাথে যাও। প্রায় বিকেল হতে চলল, খাবার খেয়ে তারপর চাঁদনীর সাথে দেখা করবে।”

অগত্যা নম্রতার সাথেই যেতে হলো তানিমকে। তবে এই প্রথমবার একটা ব্যাপার উলটো ঘটল। ডাইনিং রুমে গিয়ে খাবার সার্ভ করে দেওয়ার পুরোটা সময়ে নম্রতা একবারও তাকাল না তানিমের দিকে। কিন্তু তানিম বেশ কয়েকবারই আনমনে তাকিয়ে ফেলল সুশ্রী ওই মুখটির দিকে। প্রত্যেকবারই তাকানোর পরেই আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছিল ও। একসময় নিজের কাজে নিজেই বিরক্ত হয়ে খাবার খাওয়ায় মনোযোগ দিল ও।

তানিম খাওয়া শুরু করার সাথে সাথেই নম্রতা রান্নাঘরে গেল। কিছুক্ষনের মধ্যে ফিরে এলো একটা পিরিচে কয়েকটা কাঁচামরিচ নিয়ে। তানিমের প্লেটের পাশেই সেটাকে রাখল।

তানিম থামল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। খাবার খাওয়ার সময় আস্ত কাঁচমরিচ লাগবেই তানিমের। ভাতের প্রত্যেক লোকমার সাথে একটু একটু করে কাঁচামরিচ কামড়ে খাওয়া অভ্যাস ওর। কিন্তু এই মেয়েটা সেটা কীভাবে জানল! তালুকদার মঞ্জিলে থাকাকালীন খেয়াল করেছে? হয়তোবা।

খাওয়ার মাঝপথে তানিমের প্লেটে আরেকটু মুরগির মাংস তুলে দিল নম্রতা। তানিম চমকাল। ওর খাওয়ার দিকে খুব ভালো করেই খেয়াল করছে মেয়েটা। খাবার টেবিলে যতগুলো আইটেম ছিল, তারমধ্যে সবচেয়ে তৃপ্তি করে মুরগির মাংসটাই খেয়েছে ও। সেজন্যই বোধহয় আবারও ওর প্লেটে মাংস তুলে দিয়েছে।

তানিমের খাওয়ার প্রায় শেষের দিকে আরেকচামচ ভাত দিতে গেল নম্রতা। তানিম বাম হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ভাতের চামচ আটকে দিল।

ডাইনিং রুমে পিনড্রপ সাইলেন্স। একটাও শব্দ উচ্চারণ না করে কাটল পুরোটা সময়। তানিম খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। এবার স্বেচ্ছায় পূর্ণদৃষ্টিতে তানিমের দিকে তাকাল নম্রতা। গ্রে কালারের শার্ট আর রংচটা জিন্সে পিছন থেকেও যথেষ্ট হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। সামনাসামনি তাকানোর সাহস নেই বলে পিছন দিকে থেকেই তাকিয়ে থাকল নম্রতা। আনমনেই ভেতর থেকে বেড়িয়ে এল দীর্ঘশ্বাস। সেই দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কি সামনের মানুষটার কানেও পৌঁছাল? নইলে চলতে চলতেও ওই পা দুটো কয়েক সেকেন্ডের জন্য থেমে কেন গেল?

৩৭.
নওয়াজের আজকাল আর কিছুই ভালো লাগে না। জলজ্যান্ত সুন্দরী একটা বউ থাকা স্বত্বেও সিঙ্গেলদের মতো দিন কাটাতে হচ্ছে। চাঁদনীর সাথে বিয়ের প্রায় তিনমাস হতে চলল। আস্তে আস্তে সময় যত যাচ্ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে নওয়াজের হতাশাও বাড়ছে।

সেই যে বিয়ের তিন-চারদিন পর এক রাতে হঠাৎ চাঁদনীকে আবিষ্কার করেছিল ওর রুমে। তারপর স্বপ্নের মতো কাটল রাতটা।

ভেবেছিল সেই রাতের পর চাঁদনীর সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে৷ কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। পরেরদিন থেকে চাঁদনী ঠিক আগের মতোই হয়ে গেল। নওয়াজ কথা বললেও ওর দিকে বিরক্ত চোখে তাকাত। তারপর প্রায় তিনটি মাস চলে গেল, কিন্তু চাঁদনী অধরাই রয়ে গেল ওর কাছে।

চাঁদনীর সাথে ফিজিক্যাল অ্যাটাচমেন্টটা তৈরি না হলে হয়তো নিজেকে দমিয়ে রাখা যেত। কিন্তু সেদিন রাতের প্রত্যেকটা সেকেন্ডের কথা এখনও মনে আছে ওর। আর যতবার সেই কথা নওয়াজ মনে করে, ততবারই চাঁদনীকে পাওয়ার তৃষ্ণাটা বেড়ে যায় সমানুপাতিক হারে।

এমন না যে চাঁদনী বাসায় আসে না। দুই-এক সপ্তাহ পরপরই শ্বশুড়বাড়িতে আসে চাঁদনী। দুই-তিনদিন থেকে যায়।

সবচেয়ে বড় কথা বিয়ের আগে চাঁদনী ঠিক যতটা চুপচাপ ছিল, এখন ঠিক ততটাই সরব। মরিয়ম খাতুন এবং নম্রতার সাথে তার সখ্যতা একেবারে চোখে পড়ার মতো। এমনকি অন্তর্মুখী স্বভাবের জামশেদ সাহেবকেও মাঝে-মাঝে চাঁদনীর সাথে হেসে কথা বলতে দেখা যায়।

একমাত্র নওয়াজের বেলাতেই চাঁদনীর যত উদাসীনতা। সারাদিনে একবার তাকিয়ে দেখবে না নওয়াজের দিকে। এতো গেল সারাদিনের কেচ্ছা, রাতেও আরেক কাহিনী ফেঁদে বসে থাকে। ঘুমানোর সময় সে নওয়াজের রুমেই আসে। কিন্তু বিছানার মাঝখানে থাকে একটা নাদুসনুদুস স্বাস্থ্যবান কোলবালিশ। সেটা বিছানার মাঝে রাখার সময় চাঁদনী নওয়াজের দিকে এমনভাবে তাকায়, যেই তাকানোর ভঙ্গিটাই বলে দেয়, রাতে নওয়াজ কোলবালিশ ক্রস করতে চাইলে ভয়াবহ কিছু ঘটে যাবে। চাঁদনীর ওই দৃষ্টি দেখে নওয়াজ আর সাহস করে কোলবালিশ ডিঙিয়ে যেতে পারে না। সারারাত ওর কাটে নিদ্রাহীন। কোলবালিশটাকে মনে হয় চীনের দূর্ভেদ্য মহাপ্রাচীর।

নওয়াজের এই ছটফটানির বিপরীতে চাঁদনী খুব আরাম করে ঘুমায়। ঘুমন্ত সেই মুখ, বালিশের ঘষায় এলোমেলো হয়ে থাকা চুল, ফোলা ঠোঁট নওয়াজকে অশান্ত করে তোলে। মেয়েটা ওর বৈধ স্ত্রী, মেয়েটার শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ সম্পর্কে ও অবগত। অথচ তবুও তাকে ছুঁতে না পেরে অন্তর্দহনে শেষ হয়ে যেতে হচ্ছে নওয়াজকে।

শারিরীক চাহিদা তবুও দমিয়ে রাখা যায়। কিন্তু চাঁদনীর সবচেয়ে কাছের মানুষটি হয়েও তার মনের নাগাল না পাওয়াটাকে নিজের সবচেয়ে বড় অক্ষমতা বলে মনে হয়।

শুধু বিয়ে নামের একটা ট্যাগ লেগে আছে দুজনের মধ্যে। অথচ দুজনে দুই পৃথিবীর বাসিন্দা। চাঁদনী নিজের মতো করে যেই পৃথিবীটা তৈরি করেছে সেখানে নওয়াজের প্রবেশাধিকার নেই। কিন্তু নওয়াজের তৃষ্ণার্ত মন সেকথা মানতে চায় না একদমই। সে প্রত্যেকদিন, প্রত্যেক ক্ষনে দেখতে চায় নিজের সহধর্মিণীকে। দেড় দুই সপ্তাহ পরপর একটা রাত তাকে দেখে আশ মেটে না নওয়াজের।

কাছে থেকে না হোক দূর থেকে অন্তত একনজর দেখার জন্য চাঁদনীর হলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে নওয়াজ। চাঁদনী হিজাব, নিকাব পড়া থাকে। শুধু চোখদুটো ছাড়া তার আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। নিরাপদ দুরত্ব বজায় রেখে নিজেকে আড়াল করে থাকে বলে দূর থেকে চাঁদনীর চোখদুটোও স্পষ্ট দেখা যায় না। তবুও নওয়াজ আসে। প্রত্যেকদিন একবার মিনিটখানেকের জন্য চাঁদনীকে দেখলে নিজেকে ও সান্ত্বনা দিতে পারে, চাঁদনী ওর কাছাকাছিই আছে।

আজও চাঁদনীকে একটু দেখার আশায় কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে ছিল নওয়াজ। কাঁধের উপরে হঠাৎ কারও আলতো টোকায় চমকে পিছনে ফিরে তাকিয়ে ওখানেই ফ্রিজড হয়ে গেল। চাঁদনী নেকাব খুলে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল
“কী ব্যাপার? এখানে কী দরকার?

এরকম ক্ষেত্রে ধরা পড়ে গেলে আর পাঁচজনে যা বলে নওয়াজও তাই বলল,
“আসলে এই রাস্তা দিয়েই একটা কাজে যাচ্ছিলাম।”

“কাজে যাচ্ছিলেন, ভালো কথা। কিন্তু এখানে কেন দাঁড়িয়ে আছেন?”

“না, মানে। গাড়িটার হঠাৎ যে কী হয়েছে! স্টার্টই হচ্ছে না।”

“তাহলে গাড়িটা এবার বদলে ফেলুন।”
“বদলাতে হবে কেন? সার্ভিসিংয়ে নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“একদিন গাড়ি নষ্ট হলে সেটা সার্ভিসিংয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু রোজ রোজ নষ্ট হলে সেটা বদলে ফেলাই ভাল।”
“মানে?”
“মানে গত দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে এই রোডে এসে আপনার গাড়ির স্টার্ট বন্ধ হয়ে যায়। তাই বলছিলাম, গাড়িটা বদলে ফেলুন।”

নওয়াজ বুঝল, ধরা পড়ে যাচ্ছে ও। তাই এবার প্রসঙ্গ বদলাল।
“তুমি এদিকে কী করছ চাঁদনী?”
“শ্বশুড়বাড়িতে যাচ্ছি।”
“আমাদের বাসায় যাচ্ছ? গাড়িতে উঠে বসো তাহলে। আমিই নিয়ে যাই।”
“কিন্তু আপনার গাড়ি তো স্টার্ট নিচ্ছে না।” কথাটা বলে হেসে ফেলল চাঁদনী।

নওয়াজ কান চুলকে মিনমিন করে বলল, “আরেকবার চেষ্টা করে দেখি। এবার মনেহয় স্টার্ট নেবে।”

চাঁদনী পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল এবার নওয়াজের দিকে। সামনে ফর্মাল গেটাপে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটি ওর স্বামী, এটা ভাবলেও সুখময় একটা অনুভূতি হয় চাঁদনীর। পড়ন্ত দুপুরের ক্লান্তিটাও কী চমৎকারভাবে মানিয়ে গেছে তার চেহারার সাথে। কিছুটা বিষাদও কি খেলা করে যাচ্ছে দুটি চোখের তারায়?

চাঁদনী গাড়িতে উঠে বসল। হঠাৎ করেই ওর খুব মায়া হলো৷ নাহ, মানুষটার সাথে এতটা কঠোর হওয়া বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। বাইরে যতই কাঠিন্যের খোলসে নিজেকে আবৃত করে রাখুক, ভেতরের প্রায় পুরোটা জুড়েই তো তার বসবাস। শরীর এবং মনের সবটুকুই যাকে উজাড় করে দেওয়া হয়ে গেছে, তার সাথে অযথা এতটা দুরত্ব তৈরি করার আদৌ কি কোনো প্রয়োজন আছে।

চাঁদনী জানে, নওয়াজ ওকে ভালোবাসে। চাঁদনী নিজেও চায় দেয়ালটা ভেঙে গুড়িয়ে দিতে। কিন্তু সেই প্রথমদিককার নওয়াজকে মনে পড়ে যায় মাঝে মাঝেই। যার কাছে চাঁদনীকে বিয়ে করাটা যন্ত্রনা বলে মনে হতো।

চাঁদনী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিজের মধ্যে তৈরি হওয়া এই অন্তর্দন্দের অবসান কবে হবে কে জানে।

৩৮.
অনেকদিন পর দুপুরের খাওয়ার পরে বেশ আয়েশ করে লম্বা একটা ভাতঘুম দিল নম্রতা। অবশেষে ওর ইয়ার ফাইনাল শেষ হলো। দীর্ঘ বিবিএ লাইফের সমাপ্তি হলো শেষ পর্যন্ত। আপাতত একটা লম্বা সময়ের জন্য পড়াশোনার মতো বোরিং একটা বিষয় থেকে রেহাই পেয়ে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই ছিল ও।

ঘুম থেকে উঠল সন্ধ্যারও পরে। নাস্তা করে সোশ্যাল সাইটে বন্ধুদের সাথে তুমুল আড্ডায় মাতল। সামনের লম্বা ছুটির সময়টা কীভাবে কাটাবে তার একটা প্লানও করে ফেলল নম্রতা। আসলে এই সময়টুকু ও সবকিছু ভুলে গিয়ে একেবারে নিজের মতো করে পার করতে চায়।

এমনকি তানিম নামের যে নাকউঁচু স্বভাবের লোকটা মনের মধ্যে গেড়ে বসে আছে, তাকেও আপাতত আর মনে করতে চায় না ও।

কিন্তু মানুষ ভাবে এক আর হয় আরেক। সেজন্যই বোধহয় ঠিক তিনদিনের মাথায় নম্রতাদের বাসায় এসে হাজির হলো এনায়েত তালুকদার,বেলায়েত তালুকদার এবং তানিম। আবারও একটা বিয়ের দাওয়াত দিতে আসা তাদের।

সাদমান দিনরাত এক করে প্রিপারেশন নিয়েছিল একটা সরকারী চাকরির। অবশেষে সাদমানের একটা প্রথম শ্রেণির চাকরি হয়েছে কিছুদিন আগেই। চাকরি হতেই তাই বিয়ের তোড়জোর শুরু হয়ে গেছে।

আগেরবারের মতোই যথারিতী চাঁদনী, নম্রতা আর মরিয়ম খাতুনকে নিয়ে হলুদিয়ার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন দুই ভাই। নম্রতার মনের মধ্যে ভাষাহীন আনন্দ হচ্ছিল। চোখদুটো বারবার চলে যাচ্ছিল ড্রাইভিং সিটের দিকে। তানিমের পিছনে কোনাকোনি জানালার পাশের সিটে বসেছিল নম্রতা। আড়চোখে তাকালেই তাই তানিমের মুখের একটা পাশ দেখা যাচ্ছিল।

নম্রতা খুব সতর্ক দৃষ্টি রেখে পুরোটা পথ দেখে গেল তাকে যেন কিছুতেই তানিম বুঝতে না পারে। কিন্তু বোকা মেয়েটা বুঝতেও পারল না যে তানিম তালুকদারের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া এতটা সহজ নয়৷

সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতেও নম্রতার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট নোটিস করছিল তানিম খুব ভালোভাবেই।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২৪ | (১৪৩০+ শব্দ)

সামনের দিকে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতেও নম্রতার প্রত্যেকটা মুভমেন্ট নোটিস করছিল তানিম খুব ভালোভাবেই।

প্রায় সারারাত জার্নি করে ওরা তালুকদার মঞ্জিলে পৌঁছাল খুব সকালবেলা। প্রথমবার এবাড়িতে এসে স্বভাবতই কিছুটা সংকোচবোধ করেছিল নম্রতা। কিন্তু এই বাড়ির সবার আন্তরিক ব্যবহারে এত সুন্দর একটা সখ্যতা তৈরি হয়েছিল যে এবার আর একদমই প্রথমবারের মতো লাগছিল না।

সারাদিন আনন্দেই কাটল নম্রতার। কিন্তু তখনও ও জানত না যে দিনের শেষে ওর এই সব আনন্দ রূপ নেবে বিষাদে। ব্যাপারটা ও জানতে পারল রাতে। চাঁদনী, রেবেকা বেগম আর মরিয়ম খাতুন বসে গল্প করছিলেন তখন। নম্রতা ওর একটা ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিল রুমের সাথে লাগোয়া বারান্দায় বসে। কথা বলা শেষ করে রুমে ঢুকতে গিয়েও মায়ের কথা শুনে থেমে যেতে হলো ওকে।

“কী বলেন! তানিমের জন্যেও প্রস্তাব এসেছে? কোথা থেকে?”
“হ্যাঁ। প্রস্তাব এসেছে আরও মাস দুয়েক আগে। মেয়ের বাবা পাশের গ্রামের চেয়্যারম্যান। একমাত্র মেয়ে তাই নিজের কাছাকাছিই রাখতে চাইছেন। তিনি শুনেছেন তানিম ব্যাবসা বানিজ্য সব গুছিয়ে গ্রামেই থাকবে। তাছাড়া তিনি তানিমকে আগে থেকেই চেনেন। সবমিলিয়ে তিনিই তাই আগ বাড়িয়ে প্রস্তাব রেখেছিলেন।

মেয়েটাকে আমরা চিনি। পছন্দ করার মতো মেয়ে। যদিও এই বিষয়ে মেয়ের বাবাকে কোনোপ্রকার সিদ্ধান্ত জানাইনি। যেহেতু সাদমান তানিমের বড়, তাই আগে ওর বিয়েটাই করাতে চাইছিলাম আমরা। এখন তো সাদমানের বিয়েটা হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ। তাই চাঁদনীর বাবা আর চাচা চাইছেন তানিমের বিয়ের কথাটাও পাকা করে রাখতে।”

“ভালোই হলো ভাবী। সাদমানের বিয়ের পর তানিমের বিয়ের দাওয়াতটাও তাহলে খুব তারাতারিই পারব।”

“হ্যা, আল্লাহ যদি চান তানিমের বিয়েটাও খুব জলদিই করাতে চাই। ছেলেমেয়েগুলোর সংসার গুছিয় দিতে পারলে আমরা বুড়ো-বুড়িরা একটু নিশ্চিন্ত হতে পারি।”

তারা কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু নম্রতার পৃথিবীটা দুলে উঠল মুহুর্তে। চোখ তখন পানিতে টইটম্বুর। একসময় চোখ উপচে তারা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে৷ ঠিক সেই সময় কান্নারত নম্রতার চাঁদনীর সাথে চোখাচোখি হলো ওর। চাঁদনী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নম্রতা রুমের মধ্যে থাকা মানুষগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য একছুটে রুম থেকে বের হয়ে গেল। এই রাতের বেলা নিস্তব্ধ, নিরিবিলি ছাদটাই ওর জন্য উপযুক্ত জায়গা, তাই ছাদের দিকেই এগিয়ে গেল নম্রতা।

নম্রতা রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই চাঁদনীও ওর পিছু নিয়েছিল। নম্রতা বারান্দার দরজায় এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই সেদিকে চোখ গিয়েছিল ওর। তানিমের বিয়ের আলোচনা শুনে নম্রতার মুখমন্ডল বিবর্ণ হয়ে যাওয়া, কেঁদে ফেলা সবটাই গভীর মনোযোগের সাথে খেয়াল করেছে ও। গাড়িতে ফেরার পথেও তানিমের দিকে নম্রতার আড়চোঝে তাকানোটা খেয়াল করেছিল ও কয়েকবার। তাই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে খুব একটা অসুবিধা হলো না চাঁদনীর।

নম্রতাকে ফলো করে চাঁদনী যখন ছাদে গিয়ে পৌঁছাল তখন নম্রতা ছাদের এককোনে বসে হাঁটুতে মাথা গুজে কাঁদছিল। চাঁদনী ওর কাধে গিয়ে হাত রাখার সাথে সাথেই চমকে উঠে চাঁদনীর দিকে তাকাল নম্রতা। চাঁদনী কোনোরকম ভনিতা ছাড়াই প্রশ্ন করল, “তানিম ভাইকে পছন্দ করো তুমি?”

নম্রতা জবাব না দিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। কী জবাব দেবে সে!

“নম্রতা আপু, চুপ করে থেকো না৷ যা জিজ্ঞাসা করছি তার জবাব দাও।”
নম্রতা তবুও চুপ। চাঁদনী কিছুটা সময় দিল এবার নম্রতাকে। তারপর আবার বলা শুরু করল, “পরে কিন্তু আফসোস করেও লাভ হবে না। তানিম ভাইয়ের প্রতি তোমার মনে যদি কোনো উইকনেস তৈরি হয়ে থাকে,তাহলে সেটা আমাকে বলো। হয়তো আমি তোমাকে হেল্প করতে পারব।”

অনেকক্ষন পর চাঁদনীর কথার এবার জবাব দিল নম্রতা, “কোনো লাভ হবে না ভাবি৷ তোমার ভাই আমাকে পছন্দ করে না একদমই। বরং ঘেন্না করে ভীষণ।”

“কিন্তু আমি যতদূর জানি, শুধু শুধু কাউকে ঘৃণা করার মতো মানুষ নয় আমার তানিম ভাই।”

“শুধু শুধু তো নয়। এই তিক্ততার সূত্রপাত আমিই করেছিলাম।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথম দিনের ঘটে যাওয়া সেই ঘটনাটুকু বলে গেল নম্রতা। চাঁদনী শুনল চুপ করে। নম্রতা কথা শেষ করে থামার পর চাঁদনী বলল,
“আমার পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তানিম ভাইয়ের আত্মসম্মানবোধ সবচেয়ে বেশি। এমনকি আব্বু আর ছোট আব্বুও হিসেব করে কথা বলেন তার সাথে। যে কিনা জীবনে কোনো মেয়ের দিকে ভালো করে চোখ তুলেও দেখেনি, তার চরিত্র নিয়ে তুমি প্রশ্ন তুললে, সেটাই হয়তো তানিম ভাই মেনে নিতে পারেনি।”

“সেটাই তো সবচেয়ে বড় ভুল আমার জীবনের। সেদিন না জেনেই বাজে ব্যবহারটা করেছিলাম। জানো ভাবি, আমার অপমানের জবাবে সেদিন তোমার ভাই নতুন একটা স্মার্টফোনের সাথে সেই যে চিঠিটা দিয়েছিল সেটা পড়ে প্রচন্ড রাগ হয়েছিল আমার। আমি শুধু একটা মোক্ষম সুযোগ খুঁজছিলাম পালটা অপমান করার জন্য। যাতে রাগটা কমে না যায়, সেজন্য মাঝেমাঝে চিঠিটা নামিয়ে পড়তাম। এরকম করতে করতে কখন জানি সব ওলট-পালট হয়ে গেল। একসময় খেয়াল করলাম আমার আর আগের মতো রাগ লাগছে না। বরং তার কথা ভাবতে ভালো লাগছে। তারপর একসময় বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা শুধু ভালোলাগার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। তাকে আমি..।”

নম্রতা থেমে গেল। ওর অসম্পূর্ণ বাক্যটি শেষ করল চাঁদনী,
“ভালোবেসে ফেলেছ, তাই তো? আচ্ছা, তুমি কি ভাইয়ার কাছে একবারও তোমার করা কাজের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্যরি বলেছ?”

“সেই সুযোগটা তোমার ভাই দিলে তো। গিয়েছিলাম তো মাফ চাইতে। কিন্তু তোমার ভাই বলেছে, আমার সাথে কথা বলতে সে বিরক্তবোধ করে। সম্ভবত আমার চেহারাটাও সে দেখতে চাও না। যাই হোক, বাদ দাও। এসব কথা বলে আর কোনো লাভ নেই।”

“লাভ আছে কী নেই সেটা পরে দেখা যাবে। আমি নিশ্চয়তা দিতে পারছি না, তবে আমার মতো করে চেষ্টা করব আমি। কিন্তু আল্লাহ চাইলে তানিম ভাইয়ের সাথে যদি তোমার বিয়েটা হয়৷ তাহলে কিন্তু অনেককিছুই চেঞ্জ হয়ে যাবে। বিশেষ করে তোমার ছেলে বন্ধুদের সাথে কন্টাক্ট অফ করে দিতে হবে। তানিম ভাই যেরকম মেয়েকে নিজের স্ত্রী হিসেবে চায়, তুমি তার একেবারে বিপরীত। বিয়ের পরে নিজেকে চেঞ্জ করতে পারবে তো?”

চাঁদনী হঠাৎ বিয়ের কথা বলায় কিছুটা লজ্জা পেল নম্রতা। আবারও চুপ করে রইল ও।
চাঁদনী এবার বিরক্ত হলো কিছুটা,
“আমি একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে আলাপ করছি। তুমি এভাবে চুপ করে থাকলে তো হবে না।”

“প্রয়োজনে চেঞ্জ করব নিজেকে।”

কিছুক্ষন থেমে চাঁদনী আবার বলল, “তোমার কাছে আরও একটা অনুরোধ। যদি কেউ বিয়ে সম্পর্কে তোমার মতামত জানতে চায়, তাহলে এমন চুপ করে থেক না। সরাসরি ‘হ্যা’ না বললেও এটা বোলো যে পরিবারের সবাই যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই তোমার সিদ্ধান্ত হবে।”

নম্রতা ভরসা পেল না তেমন চাঁদনীর কথায়। যে লোকটা নম্রতার সাথে কথা অব্দি বলতে চায় না, সে ওকে বিয়ে করতে রাজি হবে? আদৌ সম্ভব এটা।

৩৯.
চাঁদনী শুধু একটা সুযোগ খুঁজছিল কথাগুলো বলার জন্য। সেই সুযোগটা ও পেল পরেরদিন বিকালে। আর ঠিক আটদিন পরে সাদমানের বিয়ে। চাঁদনীর বাবা, চাচা আর ভাইয়েরা মিলে দাওয়াতের লিস্টটা চেক করছিল। আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে কাউকে দাওয়াত দেওয়া বাদ পড়ে গেল নাকি। চাঁদনী তখন রুমে ঢুকে জিজ্ঞাসা করল,
“তোমাদের সাথে কিছু কথা ছিল। আগে তোমাদের কাজগুলো শেষ করো, তারপর কথা বলব।”

তানিম বলল, “কাজ শেষ করতে হবে না৷ তুই কি বলতে চাইছিস বল।”

“আমি খুব সিরিয়াস একটা কথা বলতে চাইছি। সময় লাগবে আমার। তাই বলছিলাম…।”

“সমস্যা নেই৷ আমরা পরে করে নেব কাজ।” চাঁদনীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন এনায়েত তালুকদার।

“এভাবে কথা বলা যাবে না বাবা। দাঁড়াও আমি আগে মা, চাচী আর আমার শ্বাশুড়িকে ডেকে নিয়ে আসি৷ সবার সামনেই আমি কথাটা বলতে চাই।”

চাঁদনী রুম থেকে বের হয়ে গেল। অন্যরা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। চাঁদনীর কথায় সবাই মোটামুটি কনফিউজড হয়ে গেছে। চাঁদনী সবাইকে নিয়ে ফিরল কিছুক্ষনের মধ্যেই।

সোফার এককোনে বসে সিরিয়াস স্বরেই সে বলা শুরু করল, “কথাটা আসলে আমার ননদ নম্রতা আপু বিষয়ক। পরিচয়ের শুরু থেকেই আমার সাথে তার খুব ভালো সখ্যতা ছিল৷ এবং তখন থেকেই তাকে নিয়ে আমার মনে একটা সুপ্ত ইচ্ছেও ছিল। সাদমান ভাইয়ের বিয়েটা হুট করে ঠিক হয়ে যাওয়ায় আমি আমার ইচ্ছের কথা জানাতে পারিনি। কিন্তু এবার আর আমি দেরি করতে চাই না। আমি চাই, তানিম ভাইয়ের সাথে নম্রতা আপুর বিয়ে হোক।”

রুমের মধ্যে পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল চাঁদনীর মুখের দিকে। নীরবতা ভেঙে সবার আগে কথা বললেন মরিয়ম খাতুন
“তুমি এসব কী বলছ চাঁদনী? এভাবে হুট করে কি বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। তাছাড়া তানিমের বিয়ে তো ঠিক হয়েই আছে।”

“বিয়ের কথা চলছে মা, এখনও মেয়েপক্ষকে সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। সেরকম হলে তাদের না বলে দেওয়া হবে। কিন্তু আপনি এমনভাবে বলছেন কেন? নম্রতা আপুর জন্য তানিম ভাইকে কি আপনার যোগ্য বলে মনে হচ্ছে না?”

“না না। কি বলছ তুমি এসব! তানিমের মতো ছেলেকে পছন্দ না করার কোনো কারন নেই। বরং সেরকম কিছু হলে আমি খুশিই হবো। কিন্তু এরকম হুট করে তো কিছু হয় না। সবার মতামত নেওয়ারও তো প্রয়োজন আছে। বিশেষ করে তানিম এবং নম্রতার।”

চাঁদনী এবার তানিমের দিকে তাকিয়ে বলল, “নম্রতা আপুর মতামত পরে নেব। আগে অন্য সবার মত আছে কিনা জেনে নেই। এটা আমার আবদার বলতে পার তোমাদের কাছে। আশা করি আমার ইচ্ছেটা গুরুত্ব পাবে তোমাদের কাছে।”

বেলায়েত তালুকদার সবার আগে তার মত জানালেন, “আমার কোনো আপত্তি নেই। বরং নতুন একটা সম্পর্ক তৈরি হলে নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তাটা আরও মজবুত হবে। ভাইজান, সাখাওয়াত তোমরা কী বলো?”

এনায়েত তালুকদার জবাব দিলেন, “মরিয়মের মেয়ে এই বাড়ির বউ হয়ে আসবে এতে আপত্তির কী আছে। চেয়ারম্যান সাহেবকে নাহয় না বলে দিলাম। কিন্তু তানিমের মত আছে কিনা সেটাও তো জানা দরকার। তানিম, তোর কিছু বলার থাকলে বলতে পারিস।”

রুমের সবগুলো চোখ এবার স্থির হলো তানিমের দিকে। তানিম গম্ভীর মুখে এতক্ষনের আলাপ শুনছিল। চাচার প্রশ্ন শুনে জবাব দিতে খুব একটা সময় নিল না ও।
“চাঁদনী যেটা চেয়েছে সেটাই হোক।”

চাঁদনী হাসল বিজয়ের হাসি।

এনায়েত তালুকদার বললেন, “মরিয়ম, এবার তাহলে নম্রতা মাকে ডেকে তার মতটা নিয়ে নেই। তারপর তুমি নম্রতার বাবা আর ভাইয়ের সাথে আলাপ করে ফেল পুরো ব্যাপারটা। তারপর একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা যাবে।”

মরিয়ম খাতুন সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। চাঁদনী প্রায় সাথে সাথেই ছুটল নম্রতাকে ডাকতে।

নম্রতা এসে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়াল এককোনে। হঠাৎ করেই কেন জানি ওর ভয় লাগছিল খুব।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-১৯+২০+২১

0

নিভৃত রজনী
| ১৯ | (১৬৫০+ শব্দ)

জামশেদ সাহেব কিছু বলার ভাষা হারিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

নওয়াজ একটু সময় দিল বাবাকে প্রথম কথাটুকু গলাধঃকরণ এর জন্য। জামশেদ সাহেবও খুব দ্রুতই সামলে নিলেন নিজেকে।
“ভালো কথা বিয়ে করবে। আমরা ঢাকায় ফিরে নাহয় এই বিষয়ে আলাপ করব৷ এখন একটা ইনভাইটেশনে যাচ্ছি। এখন এসব বলার কি খুব দরকার আছে?”

“দরকার আছে আব্বু। এখনই সঠিক সময় তোমাকে কথাগুলো বলার। তুমি প্লিজ একটু মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনো।”

নওয়াজ সংক্ষেপে চাঁদনীর প্রতি ওর দুর্বলতাটুকু বলে গেল। যদিও বাবার কাছে ব্যাপারগুলো শেয়ার করতে কিছুটা আনইজি লাগছিল। কিন্তু না বলেও পারছিল না ও। মরিয়ম খাতুনও যে চাঁদনীকে পুত্রবধূ করতে চান, সেটুকু উল্লেখ করতেও ভুলল না। কারণ ও জানে মায়ের কথা বললে বাবা ব্যাপারটাকে একটু বেশিই গুরুত্বের সাথে দেখবেন।

জামশেদ সাহেব সব শুনলেন গম্ভীরমুখে। তারপর বললেন,
“সব ঠিক আছে। কিন্তু এখনই বিয়ের ডিসিশানটা নেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা খুঁজে পাচ্ছি না আমি। আচ্ছা, এখন এসব কথা থাক। দাওয়াতটা অ্যাটেন্ড করে ঢাকা ফিরে আসি আগে। তারপর তোমার মায়ের সাথে বসে পুরো ব্যাপারটা ডিসকাস করা যাবে।”

নওয়াজ ইচ্ছে করেই আকরাম সম্পর্কিত সেদিন রাতের ব্যাপারটুকু আমজাদ সাহেবকে বলেনি। তাই তিনি ছেলের মনের অবস্থা পুরোপুরি আঁচ করতে পারছিলেন না। নওয়াজ নিজেও বলতে পারছিল না যে চাঁদনীকে হারিয়ে ফেলার একটা ভয় অট্টালিকা গড়ে তুলছে ওর মনের মধ্যে।

যদিও ব্যাপারটা বাবার সাথে আলাপ না করে মায়ের সাথে করতে পারলে ভালো হতো৷ কিন্তু সেই রাস্তাও নওয়াজ নিজ হাতে বন্ধ করে দিয়েছে।

শেষদিন যখন চাঁদনীকে বিয়ে করা নিয়ে মায়ের সাথে তর্ক হয়েছিল সেদিন মরিয়ম খাতুন স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন, নওয়াজের বিয়ে সম্পর্কিত কোনো ব্যাপারে তিনি আর কখনও থাকবেন না। নিজের মায়ের রাগ আর জেদ সম্পর্কে নওয়াজ খুব ভালো করেই অবগত আছে। খুব সহজে রাগে না মা, কিন্তু একবার রেগে গিয়ে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে হাতে পায়ে ধরেও তাকে টলানো যায় না।

নওয়াজ জানে মাকে এখন হাজারবার অনুরোধ করলেও তিনি নওয়াজকে কোনোপ্রকার সাহায্য করবে না। এই মুহূর্তে তাই এরচেয়ে ভালো কোনো উপায় ওর মাথায় আসছে না। মন বলছে, যত দ্রুত সম্ভব চাঁদনীকে নিজের করে নিতে হবে, নইলে যেকোনো সময় হাতছাড়া হয়ে যাবে সে।

নওয়াজ তাই খুব বেশি ব্যাখ্যার মধ্যে গেল না। ও অনুমান করেছিল, বাবা হয়তো এমন কিছুই বলবে। তাই পরের চালটা চালল ও,
“আমি তোমার কথা রেখেছি আব্বু৷ নিজে কিছু করার খুব ইচ্ছে ছিল আমার৷ তবুও শুধু তোমার কথায় তোমার ব্যাবসা বুঝে নিচ্ছি। তাই তোমারও উচিৎ আমার কথা রাখা।”

কথাগুলো বলার সময় নওয়াজ নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলেও ভেতরে ভেতরে নার্ভাস লাগছিল খুব৷ ও অপেক্ষা করছিল জামশেদ সাহেবের পরবর্তী কথা শোনার জন্য। কিন্তু তিনি আর খুব একটা তর্কে গেলেন না। বললেন, “আমার ভেবে দেখতে হবে আরেকটু।”
নওয়াজ সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।

তালুকদার মঞ্জিলে যখন ওরা পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
সবার সাথে সৌজন্যসাক্ষাতের পর জামশেদ সাহেব রুমে গিয়ে ফ্রেশ হলেন। মরিয়ম খাতুন বললেন, “তুমি এখন কিছুক্ষন রেস্ট নাও। আমি গিয়ে দেখি তোমাদের নাস্তার কী বন্দোবস্ত হলো।”
“নাস্তা পরে হবে। আগে এখানে বসো, তোমার সাথে আমার কথা আছে।”
“বুঝলাম, শুনব কথা। তার আগে অন্তত খাও কিছু। এত লম্বা জার্নি করে এসেছ।”

মরিয়ম খাতুনের আপত্তি স্বত্বেও তাকে হাত ধরে টেনে এনে বসালেন জামশেদ সাহেব। নওয়াজের সাথে রেস্টুরেন্টে হওয়া কথোপকথন পুরোটাই খুলে বললেন স্ত্রীকে। মরিয়ম খাতুন অবাক হয়ে শুনলেন সব কথা। তারপর আনন্দের আতিশায্যে স্বামীর একহাত ধরে উৎফুল্ল কন্ঠে বললনে, “তাহলে চলো, আজই এনায়েত ভাইয়ের সাথে আলাপ করে বিয়ের কথাটা পাকা করে ফেলি। পারলে বিয়েটাও আজ পড়িয়ে রাখব।”

জামশেদ সাহেব স্ত্রীর কথায় দ্বিগুন আশ্চর্য হলেন।
“তুমিও কি তোমার ছেলের মতো পাগল হয়ে গেলে। বলল আর বিয়ে হয়ে গেল। এত সহজ সব?”

মরিয়ম খাতুন এবার ঠান্ডা মাথায় বোঝাতে লাগলেন স্বামীকে,
“আমি প্রথম থেকেই চাইতাম চাঁদনীকে আমার পুত্রবধূ করতে। কিন্তু তোমার ছেলে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। অনেক চেষ্টা করে তাই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখানে আসার পর জানতে পারলাম, চাঁদনীর পরিবার থেকে যতদ্রুত সম্ভব ওর বিয়ে দিতে চাইছে। বিশেষ করে চাঁদনী ডাক্তারিতে চান্স পাওয়ার পর তাদের তোড়জোড় আরও বেড়ে গেছে। চাঁদনী এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে। তাই ওকে নিয়ে কেউ রিস্ক নিতে চাইছে না। ঢাকা শহরে একা একটা মেয়ে ডাক্তারি পড়তে গিয়ে যদি কোনো সম্পর্কে জরিয়ে যায়, এই ভয় পাচ্ছে সবাই। তাই এনায়েত ভাই চান যত দ্রুত সম্ভব ওর বিয়ে দিতে। সম্ভবত এখন একটা খুব ভালো প্রপোজালও আছে ওনাদের হাতে। যেকোনো সময় সেটা ফিক্সড হয়ে যেতে পারে। এতদিন আমি কিছুই বলিনি, কারন আমি জানতাম নওয়াজ চাঁদনীকে বিয়ে করতে চায় না। কিন্তু এখন নিজেই যেহেতু তোমার কাছে বলেছে যে ও চাঁদনীকে পছন্দ করে, তাহলে আর আমি দেরি করতে চাই না।”
একটানা কথা বলে থামলেন মরিয়ম খাতুন।

জামশেদ সাহেবের আর কোনো কথা বলার জো রইল না। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে তিনি বললেন, “ঠিক আছে, তোমরা মা ছেলে দুজনেই যেহেতু চাইছ, আমি আর কি বলব, যা খুশি করো।”

“যা খুশি করো মানে? আমি একা করব নাকি? তুমিও যাবে আমার সাথে।”

“ওকে, যাব। আগে কিছুক্ষন রেস্ট নেই।”
“রেস্ট পরে, তুমি এখনই যাবে।”

জামশেদ সাহেব উঠে বসতে বসতে বললেন, “সত্যিই, এখানে আসার পর তোমার বয়স মনে হয় পঁচিশ বছর কমে গেছে।”

৩২.
রাতের খাবারের পর চাঁদনীর ডাক পড়ল বাবার রুমে। রুমের সামনে দাঁড়িয়ে কড়া নাড়লো চাঁদনী, “বাবা, আসব?”
“আয়।”
চাঁদনীকে ডেকে এনে নিজের পাশে বসালেন এনায়েত তালুকদার। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবেগপ্রবণ হয়ে উঠলেন তিনি। সেদিনের সেই ছোট্ট চাঁদনী আজ কত বড় হয়ে গেছে। আজকে তিনি চাঁদনীকে ডেকেছেন বিশেষ একটি কারনে।

চাঁদনী জিজ্ঞাসা করল, “হঠাৎ আলাদা করে ডেকে পাঠালে যে? ব্যাপারটা কী?”
“একটা বিষয়ে তোর মতামত জানতে ডেকেছি। তোর মায়ের শারিরীক অবস্থা তো জানিস। বেশিরভাগ সময় অসুস্থই থাকে। সে চায় তোর বিয়েটা দেখতে। শুধু সে নয়, আমি তোর ছোট আব্বু, এমনকি তোর ভাইদেরও একই মত। সেজন্যই তোকে আজ এখানে ডাকা। আমি সবার সাথে আলোচনা করে একটা ছেলেকে পছন্দ করেছি। চাইলে তুই নিজেও ছেলের সাথে আলদা করে কথা বলতে পারিস। তোর মা নিজেই তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিল। কিন্তু মতামতটা আমি তোর মুখ থেকেই শুনতে চাইছিলাম। দরকার হলে সময় নে, তারপর আমাকে ভেবে জানা, মা।”

বিয়ে সম্পর্কিত আলাপ একটু আধটু চাঁদনীর কানেও আসছে কয়েকদিন ধরে। নায়লা ভাবী কয়েকদিন আগে বলেছিল চাঁদনীকে। আজ এখানে আসার আগে চাঁদনী কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছিল, ওকে ঠিক কিসের জন্য ডাকা হচ্ছে। বাবা মায়ের টেনশন বুঝতে পারছে চাঁদনী। বিয়ে করতে খুব একটা আপত্তিও নেই ওর। কিন্তু অন্য কাউকে বিয়ে করতে হবে মনে পড়লেই সেই বিশেষ একজনের কথা মনে পড়ে যায়। পরক্ষনেই শাসায় নিজেকে। না ওই লোকটার কথা আর একদম ভাবা যাবে না।

ভুলতে চেয়েও তাকে ভোলা দায় হয়ে যাচ্ছে চাঁদনীর জন্য। হঠাৎ ওর মাথায় এলো, আচ্ছা বিয়েটা করে ফেললে কেমন হয়? এখন তাকে ভুলে যাওয়া যতটা কঠিন মনে হচ্ছে, হতে পারে বিয়ের পর তাকে খুব সহজেই ভুলে যাওয়া যাবে। হয়তো নতুন একজনের সাথে বাঁধা পড়ে গেলে পুরোনোকে ভুলে যাওয়া সহজ হবে। সবসময় ভাবনা চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া চাঁদনী জীবনে প্রথমবার নিজের জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্তটি নিয়ে নিল কয়েক মিনিটের মধ্যেই।

“ভাবার দরকার নেই বাবা। তোমরা যা ভালো মনে করবে আমার জন্য সেটাই করো। আমি জানি, তুমি, ছোট আব্বু আর ভাইয়ারা আমার জন্য খারাপ সিদ্ধান্ত নেবে না।”

এনায়েত তালুকদার অনেকটাই নিশ্চিত ছিলেন যে মেয়ে তার মুখের উপরে অমত করবে না। সেজন্য আগেই তিনি কথা দিয়ে ফেলেছেন মরিয়ম খাতুনকে।

এনায়েত তালুকদারের এখনও মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। যেদিন গুটিগুটি পায়ে তালুকদার মঞ্জিলে প্রথমবার তার বাবার সাথে মরিয়ম নামের ছোট্ট মেয়েটি এসেছিল। দুপাশে বিনুনি ঝুলিয়ে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি তখন সবে শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা রেখেছে। বাবা সেদিন বলেছিলেন, “এনায়েত, তোমাদের দুই ভাইয়ের কোনো বোন নেই বলে তোমরা খুব আফসোস করতে না? নাও, আজ তোমাদের জন্য বোন নিয়ে এসেছি।”

ব্যাস, সেদিন থেকেই শুরু। মরিয়ম খাতুনকে ওরা দুই ভাই ভালোবাসত নিজের মায়ের পেটের বোনের মতো। মরিয়ম খাতুন যখন ‘ভাইজান’ বলে ডাক দিত, তখন মনেই হতো না যে তার সাথে তালুকদার মঞ্জিলের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই। এভাবেই চলছিল দিনগুলো।

বছরের পর বছর পেরিয়ে গেল। তারপর একদিন মরিয়ম খাতুনের বিয়ে হয়ে গেল। প্রথম প্রথম বিয়ের পরে মাঝেমাঝে আসতেন মরিয়ম খাতুন, চিঠিও লিখতেন। কিন্তু আস্তে আস্তে দুটোই বন্ধ হয়ে গেল। দুরত্ব বাড়ল, পক্ষান্তরে কমল যোগাযোগ।

তখনকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনের মতো উন্নত হলে হয়তো যোগাযোগটা ওভাবে বন্ধ হয়ে যেত না। দেখাসাক্ষাৎ অথবা কথাবার্তা না হলেও এনায়েত কিংবা বেলায়েত তালুকদার কখনোই ভোলেননি তাদের বোনটির কথা। আজ বহুবছর পর চাঁদনীর জন্যই বলতে গেলে আবার যোগাযোগ হলো তার সাথে। সেই বোন আজ এনায়েত তালুকদার সহ বাড়ির সবাইকে একত্রিত করে প্রস্তাব রেখেছে চাঁদনীকে তার পুত্রবধূ করে নেওয়ার জন্য৷

অন্য জায়গায় চাঁদনীর বিয়ে প্রায় ঠিক হয়েই ছিল। কিন্তু মরিয়ম খাতুনের মুখের উপর বারণ করার সাধ্য এনায়েত তালুকদারের ছিল না। তাই প্রায় ঠিক হয়ে যাওয়া বিয়েটা ভেঙে দিয়ে মরিয়ম খাতুনের ছেলের সাথেই বিয়েটা ঠিক করল সবাই মিলে। এই কয়েকদিনে মরিয়ম খাতুন সম্পর্কে সবারই একটা ধারণা হয়ে গেছে। তাই কারোর দ্বিমত পোষণ করার মতো কোনো অবকাশই রইল না।

অন্যকেউ হলে এত সহজে কখনও রাজি হতেন না এনায়েত তালুকদার। অন্তত কয়েক দফায় পাত্রপক্ষ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে তবেই জানাতেন মতামত। মরিয়ম খাতুনকে তিনি বিশ্বাস করেন বলেই খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি।

কিন্তু সমস্যা হলো, মরিয়ম খাতুন আজই বিয়েটা পড়িয়ে রাখতে চাইছেন। এনায়েত তালুকদার চাইছিলেন তামজীদের বিয়ের পর ধুমধাম করে চাঁদনীর বিয়ে দিতে। কিন্তু মরিয়মের যুক্তি শোনার পর মনে হলো, এখনই বিয়ে দেওয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে। সত্যিই তো, আর কিছুদিন পর চাঁদনী পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে৷ তাছাড়া ডাক্তারীতে যে পড়ার চাপ তাতে বিয়েশাদির ঝামেলা করলে ওর পড়ার ক্ষতি হতে পারে। তারচেয়ে এখন যখন আত্মীয়স্বজন সবাই আছে, তাহলে এখনই বিয়েটা পড়িয়ে রাখা যাক। পরে একসময় সুযোগ বুঝে অনুষ্ঠান করলেই হলো। আর বিয়েটা হয়ে গেলে চাঁদনীকেও নিশ্চিন্ত মনে আবার ঢাকা পাঠানো যাবে। এনায়েত তালুকদার চাঁদনীর মতামত নিয়ে গঞ্জের বাজারে লোক পাঠালেন কাজী নিয়ে আসার জন্য।

তালুকদার মঞ্জিল আজ আত্মীয়স্বজনে ভরপুর। রাত পোহালেই তামজীদের বিয়ের জন্য বরযাত্রী যাবে। রাতে সবাই তখন আগামীকালের প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। চাঁদনী সবেমাত্র রাতের খাবার খেয়ে রুমে এসেছে। ঠিক তখনই তার পিছুপিছু এসে ঢুকল নায়লা আর নম্রতা। তাদের মুখের হাসিটা কী আজ অন্যরকম লাগছে!

নায়লার হাতে লাল বেনারসি। পুরো ব্যাপারটা তখনও বোধগম্য হচ্ছিল না চাঁদনীর। তারপর হুট করেই ওর মস্তিষ্ক কাজ করতে শুরু করল। তারমানে আজই বিয়ে? কীভাবে সম্ভব! কিছুক্ষন আগে মতামত নিয়ে এত দ্রুত বিয়ের আয়োজন।

হতভম্ব চাঁদনীকে নায়লা নিজেই শাড়িটা পড়িয়ে দিল। নম্রতা সাজিয়ে দিল অল্পস্বল্প। চাঁদনীর বুকের মধ্যে তখন দামামা বাজছে। একতরফা একটা ভালোলাগাকে তাহলে আজই হত্যা করতে হবে গলা টিপে। এরপর আর ওই মানুষটাকে নিয়ে ভাবা যাবে না কখনও। আজ রাতেই শরীরে আর মনে অন্য কারও সীলমোহর লেগে যাবে। উদাস দৃষ্টি আর ভগ্ন হৃদয় নিয়ে চাঁদনী অপেক্ষা করতে লাগল সেই বিশেষ মুহূর্তের। অনেক চেষ্টা করেও আর শেষপর্যন্ত সামলাতে পারল না নিজেকে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল চাঁদনী।

বিয়েটা হলো খুব সাদামাটা ভাবে। কাজীর মুখে প্রথমবার হবু বরের নামটা শুনল চাঁদনী। সাথে সাথেই বুকটা ধ্বক করে উঠল ওর। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেল ও।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২০ | (১৭০০+ শব্দ)

বিয়েটা হলো খুব সাদামাটা ভাবে। কাজীর মুখে প্রথমবার হবু বরের নামটা শুনল চাঁদনী। সাথে সাথেই বুকটা ধ্বক করে উঠল ওর। চোখ তুলে সামনের দিকে তাকিয়ে পলক ফেলতে ভুলে গেল ও।

নিশ্চিত হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। নইলে এরকম অসম্ভব একটা বিষয় কেন চোখের সামনে দেখবে ও! তাকে নিয়ে বেশি ভাবছে বলেই বোধহয় চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে। চোখ নাহয় ভুল দেখছে, কিন্তু তাই বলে কি কানও ভুল শুনছে! নাহ, আর ভাবা যাচ্ছে না কিছু। সব কেমন ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে। একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে ফেলল চাঁদনী।

আকদ হয়ে যাওয়ার পর মরিয়ম খাতুন এসে আলতো করে জরিয়ে ধরলেন চাঁদনীকে। কপালে ছোট্ট করে চুমু দিয়ে বললেন, “আলহামদুলিল্লাহ, অবশেষে আমার মনের ইচ্ছে পূরণ হলো। আমি সবসময় চাইতাম এই মিষ্টি মেয়েটাকে আমার পুত্রবধূ করতে। শেষপর্যন্ত আমাকে নিরাশ হতে হয়নি।”

তখনও সবকিছু চাঁদনীর মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছিল। নিজের মনের অনুভূতিগুলো সংশয়ে দোদুল্যমান আজ। মনের মধ্যে একান্ত গোপনে যাকে জায়গা দিয়েছিল, সেই মানুষটাকেই আজ নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে পেয়েছে, কিন্তু তবুও খুশি হতে পারছে না চাঁদনী। বিশাল এক প্রশ্নবোধক চিহ্ন মনের মধ্যে আটঘাট বেঁধে বসে আছে। বিয়েটা কেন করল নওয়াজ? যে কখনও চাঁদনীর দিকে ভালো করে ফিরেও তাকায়নি, চাঁদনীর দুর্বলতার কথা জেনে যে নিজে থেকে প্রত্যাখ্যান করেছিল, চাঁদনীকে বিয়ে করতে যার এত অনীহা ছিল, সে হুট করেই কেন বিয়েটা করল?

বাড়িভর্তি লোকজন সবাই এসে দেখে যাচ্ছে চাঁদনীকে। কেউ কেউ ঠাট্টাও করছে। ওর কানে এসব ঢুকলেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছে না। নিজের ভাবনাতেই বুদ হয়ে আছে চাঁদনী। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে একটা মাটির পুতুল বসে আছে নিশ্চুপ হয়ে।

রাত বেড়ে যাচ্ছে। কাল সকালে আবার বর‍যাত্রী যাবে তামজীদের সাথে। তাড়াহুড়ো করে তাই চাঁদনীকে ওর রুমে দেওয়া হলো। এই অল্প সময়ের মধ্যেই চাঁদনীর রুমের চেহারা পাল্টে গেছে। হালকা ফুল দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো হয়েছে পুরো রুম। বিছানার পাশেই একটা লাগেজ। লাগেজটা কার সেটা বুঝতে অসুবিধা হলো না ওর। এরকম ভারী শাড়ি সচরাচর পড়া হয় না বলে বিরক্ত লাগছে খুব। কিন্তু তবুও চেঞ্জ করল না চাঁদনী। মনের ভিতরে জমা প্রশ্নগুলো এখন ক্রোধে পরিনত হচ্ছে।

শাড়ি পড়েই খাটের এককোনে থম মেরে বসে থাকল চাঁদনী। নওয়াজ রুমে ঢুকল নিঃশব্দে। এসে চাঁদনীর পাশে কিছুটা দুরত্ব রেখে বসল। তারপর ঘন গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করল, “কেমন আছ চাঁদনী?”

খুব সাধারন প্রশ্ন, তবুও চাঁদনী কেঁপে উঠল। আজ নওয়াজের কন্ঠস্বরটা কি অন্যরকম লাগছে? কেমন একটা মাতাল করা। জবাদ দিতে গিয়েও কী একটা মনে হতে আর জবাবটা দিল না ও। পালটা প্রশ্ন করল সরাসরি নওয়াজের মুখের দিকে তাকিয়ে, “বিয়েটা কেন করলেন?”

হঠাৎ প্রশ্নটা করায় নওয়াজ চমকাল ভীষণভাবে। চাঁদনীর এমন কঠিন দৃঢ় কন্ঠস্বর এর আগে কখনও শোনেনি ও। নওয়াজ বলল, “তুমি কি খুব বেশি রেগে আছ? আমরা ঠান্ডা মাথায় বসে কথা বলতে পারি।”

আবারও নওয়াজের কথা এড়িয়ে নিজের মতো করেই বলে গেল ও, “মায়ের কথা রাখতে এতো বড় আত্মত্যাগ না করলেও হতো।”
নওয়াজ অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “মানে?”
“বিয়েটা তো মায়ের খুশির জন্যই করেছেন, তাই না?”
“তোমাকে কে বলল এসব?”
“আপনি নিজেই তো বলেছেন। আপনার মা চায়, আমাকে ছেলের বউ করে নিতে কিন্তু আপনি চান না। চাইবেনই বা কেন? আমাকে বিয়ে করা মানে তো একপ্রকার পেইন, আমাকে বিয়ে করলে সাফার করতে হবে আপনাকে। আমি তো একটা বোঝা, যেটা আপনি না চাওয়া স্বত্বেও আপনার মা আপনার মাথায় চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। তাই না?”

নওয়াজের স্মৃতিপটে ভেসে উঠল সেই দিনটার কথা। যেদিন চাঁদনী কোচিং থেকে বাড়ি ফেরার পথে চলন্ত গাড়িতে ঠিক এই কথাগুলোই ও বলেছিল চাঁদনীকে। সেদিন মনে হয়েছিল ও যা করছে ঠিকই করছে। কিন্তু আজ ও বুঝতে পারছে সেদিন ওভাবে চাঁদনীকে কথাগুলো বলা মস্তবড় ভুল ছিল। পারলে সেদিনের সেই কথাগুলো এক্ষুনি উইথড্র করে নিত নওয়াজ।

নওয়াজ নিজের পক্ষে সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল, “তোমার বুঝতে কোথাও একটা ভুল হচ্ছে চাঁদনী।”

“আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। আপনি অস্বীকার করতে পারবেন, আমাকে বিয়ে করা নিয়ে আপনার মায়ের সাথে আপনার তর্ক হয়নি? আপনি নিজে আপনার মাকে বলেছেন, আমাকে বিয়ে করলে আপনার লাইফ স্পয়েল হয়ে যাবে। আমি আপনার সাথে ঠিক ম্যাচ করি না। কী? বলেননি এসব?”
অবাক স্বরে প্রশ্ন করল নওয়াজ, “তুমি এসব কীভাবে জানলে?”

হাসল চাঁদনী, “সেদিন আপনার রুমে যেতে চেয়েছিলাম আপনার ঐ চরিত্রহীন বন্ধুটির কথা জানাতে। সে আমাকে বিরক্ত করছিল প্রচন্ড রকমের। সেদিন না চাইতেও আপনার এবং আপনার মায়ের কথোপকথন কানে এসেছিল আমার।”

নওয়াজ বুঝল চাঁদনীকে পেয়েও পুরোপুরি পাওয়া হয়নি ওর। নওয়াজের করা প্রত্যাখ্যান ওর মনে এখনো গেঁথে আছে ভয়ানকভাবে। ঠিক কীভাবে নিজের কথাগুলো শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছিল না নওয়াজ। চাঁদনী এখনও ভাবছে নওয়াজ মায়ের কথাতে বিয়েটা করেছে। চাঁদনীর এমনটা ভাবাই স্বাভাবিক।

বিছানায় এলিয়ে রাখা চাঁদনীর একটা হাত আলতো করে ধরে কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল নওয়াজ। চাঁদনী তৎক্ষনাৎ ঝটকা মেরে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জ্বলজ্বলে চোখে তাকাল নওয়াজের দিকে। সেই অগ্নিঝরা চোখের দিকে তাকিয়ে নওয়াজের সব ওলটপালট হয়ে গেল। প্রথমদিনের এক পলক দেখাতেই যেই চোখের ভাষা ও পড়ে নিয়েছিল, আজ সেই একই চোখের চাহনীকে এত দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে কেন কে জানে। এই চোখে কি আগের মতো মুগ্ধতা আর কোনোদিন দেখতে পাবে নওয়াজ?

চাঁদনীর গলা চড়ল কিছুটা, “একদম ছোঁবেন না আমাকে। আগে আমার প্রশ্নগুলোর স্পষ্ট উত্তর দিন। কেন এভাবে আমার জীবনটা নষ্ট করলেন?”

“আমি তোমার জীবন নষ্ট করেছি? এসব কী বলছ তুমি?”

“ঠিকই বলছি৷ সেচ্ছায় তো বিয়েটা করেননি। মাকে খুশি করতে করেছেন। তারমানে নিশ্চই স্বাভাবিক স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক আমাদের মাঝে হবে না। তাহলে তো আমার জীবনটা নষ্টই হলো, তাই নয় কি?”

“তুমি একটু মাথা ঠান্ডা করে আমার কথা শোনো চাঁদনী।”

“আমি এখন কোনো কথা শোনার মতো অবস্থাতে নেই। এরকম অনুভূতিহীন একটা সম্পর্ক দিনের পর দিন বয়ে নিয়ে চলা আমার পক্ষে সম্ভব না।”
“তারমানে! তুমি কী বলতে চাও?”

“এই বিয়ে বিয়ে খেলা যথেষ্ট হয়েছে। এসব থেকে মুক্তি চাই আমার। যত দ্রুত সম্ভব আপনার মায়ের সাথে কথা বলবেন, তারপর ডিভোর্স….।”

“চাদনী!” এবার স্থান কাল পাত্র ভুলে চেঁচিয়ে উঠল নওয়াজ।
“তোমার মাথা ঠিক আছে? এখনও একঘন্টা পার হয়নি আমাদের বিয়ে হয়েছে। তুমি এরমধ্যেই এসব কী বলছ? নিজের মনগড়া কিছু ভিত্তিহীন ভাবনার উপর নির্ভর করে হুট করে একটা কথা বলে দিলেই হলো? এত সস্তা মনে হয় তোমার কাছে সব? আমি একবারও বলেছি যে মায়ের কথায় আমি তোমাকে বিয়ে করেছি? হ্যা, আগের কিছু পরিস্থিতির ভিত্তিতে তোমার মনে এরকম একটা ভাবনা আসা স্বাভাবিক। কিন্তু তার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য একবার আমার সাথে কথা বলো। সেটা না করে তুমি কী বলছ এসব আবোলতাবোল।”

একটু থেমে নওয়াজ আবার গলার স্বর নরম করল কিছুটা, “তোমাকে কীভাবে বোঝাব জানি না। আমি মায়ের কথায় বিয়েটা করিনি। আম্মু তো আমাকে বুঝিয়ে হাল ছেড়েই দিয়েছিল। আমি নিজেই আবার আব্বু এবং আম্মুর মাধ্যমে তোমার পরিবারের কাছে প্রস্তাবটা রেখেছিলাম।”

“তা হঠাৎ আপনার এমন পরিবর্তনের কারন জানতে পারি?”

চাঁদনী প্রশ্ন করার সাথে সাথেই দ্বিধাহীনভাবে উত্তর দিল নওয়াজ, “কারণ আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি।”

কয়েকটা শব্দের ছোট্ট একটা লাইন। লাইনটা শুনে চাঁদনী পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল নওয়াজের দিকে। নওয়াজ আগে থেকেই তাকিয়ে ছিল ওর দিকে। শুধু মুখের কথায় কখনও বিশ্বাস করত না চাঁদনী এই কথাটা৷ কিন্তু চোখ, চাঁদনীর দিকে স্থির হয়ে থাকা ওই অন্তর্ভেদী চোখদুটো বলে দিচ্ছে, এইমাত্র উচ্চারিত শব্দগুচ্ছ শুধুই কথার কথা নয়। হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ সেগুলো।

ওই চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লেগে যাচ্ছিল চাঁদনীর। অজান্তে কখন মাথা থেকে শাড়ির আঁচলটা খসে পড়েছে সেটা ও নিজে না দেখলেও নওয়াজ খেয়াল করেছে। একগাছি ছোট চুল কানের পাশে বেয়ে গালের উপর পড়ে আছে অবিন্যস্ত হয়ে। অজান্তেই নওয়াজের হাত আবার চাঁদনীর গাল ছুঁয়ে গেল অবাধ্য চুলগুলোকে সরিয়ে দিতে।

চাঁদনীর হুঁশ ফিরল। ঝাড়া দিয়ে ক্ষিপ্র হাতে নওয়াজের হাত সরিয়ে দিল ও আবারও।

নওয়াজের ভালোবাসার ছোট্ট স্বীকারোক্তিতে মনের মধ্যে জমে থাকা অভিমানগুলো বাষ্পীভূত হয়ে উড়ে মিলিয়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। কিন্তু তবুও কোথাও একটা কুন্ঠাবোধ রয়েই যাচ্ছে। এতদিন পরে হুট করে বোধোদয় হলো তবে তার।

চেয়েও নিজের রাগ ধরে রাখতে পারছিল না চাঁদনী। কিন্ত চোখেমুখে তার বিন্দুমাত্র রেশটুকু আসতে দিল না ও। এত সহজে ধরা দেবে না ও কিছুতেই। এতদিন প্রত্যাখান করে এসে এখন সে চাইলে তার এক কথাতেই সব ভুলে যাবে চাঁদনী? কক্ষনো না। চাঁদনী সস্তা কোনো খেলনা নয় যে নওয়াজের ইচ্ছেমতোই চলতে হবে ওকে। দেখা যাক, কতদিন ধৈর্য ধরতে পারে সে। মনের ভাবনাটুকু মনেই লুকিয়ে রেখে চাঁদনী কঠোর স্বরে প্রশ্ন করল আবার, “আশ্চর্য! আপনাদের বাড়ি থেকে এসেছি মাত্র কয়েকটা দিন গেল। এর মাঝে কী এমন হলো যে আপনি আমাকে ভালোবেসে ফেললেন?”

“কয়েকটা দিন না চাঁদনী। আমি অনেক আগে থেকেই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু আমি এমনই গাধা, নিজের অনুভূতিগুলো নিজেই বুঝতে পারিনি কখনও।”
পুরো চেহারায় করুণ এক অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে কৈফিয়ত দেওয়ার মতো করে বলল নওয়াজ।

নওয়াজ মুখে ‘না’ বললেও তার চোখের ভাষা অন্যকিছু বলত সবসময়। এতদিন চাঁদনীর মনে হয়েছিল, নওয়াজের প্রতি উইকনেস কাজ করে বলেই হয়তো ওরকম মনে হচ্ছে ওর। কিন্তু নওয়াজের কথা শুনে নিশ্চিত হলো ও, কিছু একটা ওদের মধ্যে তৈরি হয়েছিল সেই প্রথম দিন থেকেই।

চাঁদনী তবুও পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারল না। বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারির দিকে এগিয়ে গেল ও,

“সারাদিন অনেক পরিশ্রম হয়েছে। আমি ক্লান্ত খুব। এসব বাজে কথা শোনার সময় এখন আমার নেই।”

আহত শোনালো এবার নওয়াজের কন্ঠস্বর, “এসব তোমার বাজে কথা বলে মনে হচ্ছে? এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না প্লিজ। তুমি তো এমন ছিলে না চাঁদনী।”

চাঁদনী কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করল না। ওয়াসরুম থেকে চেঞ্জ করে এসে বিছানার এককোনে শুয়ে পড়ল।

অগত্যা নওয়াজও চুপ করে শুয়ে পড়ল বিছানার অপরপাশে চাঁদনীর থেকে কিছুটা দুরত্ব বজায় রেখে। চাঁদনীকে নিজের কাছে টেনে নেওয়ার জন্য ওর হাতদুটো নিশপিশ করছিল, কিন্তু সাহস করে এগিয়ে যেতে পারছিল না নওয়াজ। চাঁদনীর এই রাগ কীভাবে ভাঙাবে সেট ভাবতে ভাবতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল ও।

৩৩.
তালুকদার মঞ্জিলে আসার পর এই কয়েকদিনে নম্রতার একটা অভ্যাস বদলেছে। সেটা হলও, খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠা।

এ বাড়ির সবাই সকাল সকালই ঘুম থেকে উঠে যায়। এমনকি সাখাওয়াত এবং নায়লার পাঁচ বছরের ছোট্ট ছেলে নাভিদ, সেও সেই ফজরের ওয়াক্তে উঠে বসে থাকে বাবার সাথে মসজিদে যাওয়ার জন্য।

বাড়ির সবাই যেখানে খুব ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, সেখানে অনেক বেলা অব্দি ঘুমিয়ে থাকাটা নিজের কাছেই কেমন একটা বেমানান লাগে নম্রতার। সেজন্য নম্রতাও আজকাল ঘুম থেকে উঠে পড়ে জলদি জলদিই। আজও খুব ভোরেই উঠল ও।

বাড়িতে আজ একটু বেশিই হৈচৈ হচ্ছে। নম্রতা নিচে নেমে দাঁড়িয়ে পড়ল। তানিম বসে আছে সোফাতে। তার পাশেই বসে আছে নাভিদ। নাভিদকে সকালের নাস্তা খাইয়ে দিচ্ছে তানিম। নম্রতা মাথা নিচু করে খাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ও জানে, কঠিন হৃদয়ের পুরুষটি ওর দিকে ফিরেও তাকাবে না। তবুও তার সামনে গেলে চলার গতি কেন জানি শ্লথ হয়ে আসে, বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করে।

খাবার ঘরে ঢুকতেই নম্রতার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। নওয়াজ করুন মুখে বসে আছে একটা চেয়ারে। আর তার সামনে দশ থেকে বারো রকমের খাবার সাজিয়ে পাশেই দাঁড়িয়ে আছে রেবেকা বেগম।

নওয়াজ খাবার খায় খুবই পরিমিত। সাধারণত বাসায় অনেকগুলো আইটেম রান্না হলেও নওয়াজ দুই একটা দিয়েই তার খাওয়া কমপ্লিট করে। এখানে এতো এতো খাবাররে চাপে পড়ে নওয়াজের বর্তমান অবস্থা কিছুটা হলেও আঁচ করতে পারছে নম্রতা। বাড়ির একমাত্র মেয়ে-জামাই বলে আপ্যায়নের ডোজটা একটু বেশিই হচ্ছে।

নম্রতা মুখ টিপে হেসে একদিকের চেয়ারে বসে পড়ল। নওয়াজ হতাশ চোখে তাকাল ওর দিকে। তাকানোর ভঙ্গিটাই ওর মনের কথা বলে দিচ্ছিল যেন, “এইবারের মতো বাঁচিয়ে নে বোন।”

নওয়াজকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নম্রতা নিজের মতো নাস্তা খাওয়া শুরু করল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ২১ | (১৪৫০+ শব্দ)

নওয়াজকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে নম্রতা নিজের মতো নাস্তা খাওয়া শুরু করল।

নাস্তা খাওয়া শেষ করে নাজেহাল নওয়াজকে ওখানে রেখে নম্রতা পা বাড়াল চাঁদনীর রুমের দিকে। একদিনের ব্যবধানে চাঁদনীর সাথে সম্পর্কের সমীকরণ বদলে গেছে।

নম্রতা দরজায় নক করে ঘরে ঢুকে প্রথমেই বলল, “তুমি তো আমার বড় ভাইয়ের বউ হয়ে গিয়েছ। এখনও কি আগের মতো নাম ধরেই ডাকব নাকি ভাবি ডাকব?”

চাঁদনী হাসল।
“তুমি আমাকে নাম ধরেই ডেক।”
“তুমি বললেই তো হচ্ছে না। ভাইয়ার কাছেও জিজ্ঞাসা করে দেখি। আফটার-অল তার বউ। তার মতামতেরও তো একটা ব্যাপার আছে।”
নম্রতার কথার প্রত্যুত্তরে চাঁদনী হাসল আবারও।

ততক্ষনে নওয়াজও রুমে এসেছে। নম্রতা ওকে দেখে অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “আরে ভাইয়া, এত জলদি তোমার ব্রেকফাস্ট করা হয়ে গেল?”

নওয়াজ চোখ পাকিয়ে তাকাল ওর দিকে।
নম্রতা হেসে বলল, “ভালো সময়েই এসেছ। তোমার বউয়ের সাথে সম্মোধন নিয়ে কথা হচ্ছিল। তাকে নাম ধরে ডাকব নাকি ভাবি ডাকব?”

“অফকোর্স ভাবি ডাকবি। বড় ভাইয়ের ওয়াইফকে কেউ নাম ধরে ডাকে?”

“ওকে, তবে তাই হোক।” হেসে বলল নম্রতা।

তারপর চাঁদনীর দিকে তাকিয়ে বলল, “ভাবি, আমি এখন যাই তাহলে। তোমরা নিজেদের মতো সময় কাটাও।”

নম্রতা চলে গেল। তার পিছু পিছু রুমের বাইরে রওয়ানা দিল চাঁদনীও। নওয়াজ প্রশ্ন করল, “চলে যাচ্ছ?”
“কেন, কোনো দরকার আছে?”

“দরকার ছাড়া কি কিছুক্ষন সময় আমরা একসাথে থাকতে পারি না?”

“না।”

প্রশ্নটা নওয়াজ খুব আগ্রহ নিয়েই করেছিল। কিন্তু একটিমাত্র শব্দের উত্তর শুনে ওর মুখটা চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো হয়ে গেল।

সেই মুখটা দেখে চাঁদনীর মায়া হলো। কিন্তু তবুও ধরা দিল না ও।

দেখতে দেখতে কয়েকটা দিন কেটে গেল। বৌভাতের প্রোগ্রামের পরে আত্মীয়স্বজন যারা ছিল, সবাই একে একে বিদায় নিতে লাগল৷ নম্রতাদেরও ফিরে যাওয়ার সময় চলে এলো।

এই কয়দিনে নওয়াজ এবং চাঁদনীর মধ্যকার দুরত্ব কমেনি এতটুকুও। যদিও নওয়াজ শেষপর্যন্ত চেষ্টা করেই যাচ্ছিল নিজের মতো। কিন্তু চাঁদনীর দিক থেকে চেষ্টা ছিল না বিন্দুমাত্রও।

যাওয়ার দিন মরিয়ম খাতুন আলাদা করে চাঁদনীকে ডাকলেন নিজের রুমে।

“ডেকেছেন আন্টি?”
“এখনও আন্টি বলেই ডাকবে?”
“স্যরি, মা।”
“হয়েছে, আর স্যরি বলতে হবে না। চেয়েছিলাম তো তোমাকে সাথে নিয়ে যেতে, কিন্তু শুনলাম যেতে চাইছ না নাকি।”
“আসলে মা, কিছুদিন পরেই অ্যাডমিশন। একবার ঢাকা গেলে তো অনেকদিন আবার বাড়িতে আসা হবে না৷ তাই চাইছিলাম, আরও কিছুদিন থেকে যেতে।” কৈফিয়ত দেয়ার স্বরে বলল চাঁদনী।

“পাগলী একটা, এভাবে কেন বলছ। তোমার বাড়িতে তুমি যতদিন খুশি থাকবে। সাবধানে থেক। আর যত দ্রুত সম্ভব আমার কাছে চলে যেও।”

“আরেকটা কথা মা।”
“কী কথা?”

“আমার পড়াশোনাটা আমি হোস্টেলে থেকে চালিয়ে যেতে চাই।”

“সেকি? কেন? আমাদের বাড়িতে থেকে পড়তে অসুবিধা কোথায়? ওখানে কি তোমার কোনো সমস্যা আছে?”
“কোনো সমস্যা নেই মা।”

“তাহলে কেন যাবে না? আমি চাই তুমি আমার কাছেই থাক।”

“আপনি চাইলে অবশ্যই সেটা হবে। কিন্তু মা, আপনি তো জানেনই ডাক্তারি পড়াটা আমার ছোটবেলার স্বপ্ন। আমি জানি, বাড়িতে থাকলে আপনি আমার যথেষ্ট খেয়াল রাখবেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, হোস্টেলের স্ট্রিক্ট পরিবেশে আমি পড়াশোনায় আমার কনসেন্ট্রেশন যতটা ধরে রাখতে পারব, বাড়িতে থাকলে আমি ততটা পারব না। আপনি চাইলে আমি বাড়িতে থেকেই পড়ব। কিন্তু তাতে আমার কনসেনট্রেশান ডিসট্রাক্টেড হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এমবিবিএস করার পুরোটা সময় আমি শুধু পড়াতেই ফোকাস করতে চাই। যেটা বাড়িতে থেকে আমার জন্য কঠিন হয়ে যাবে।”

“আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি মা। আচ্ছা, তুমি যেভাবে চাও, সেভাবেই হবে।” চাঁদনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন মরিয়ম খাতুন।

চাঁদনী মৃদু হেসে বলল, “অনেক ধন্যবাদ মা।”

৩৪.
টেবিলের সামনে রাখা বইটা শব্দ করে বন্ধ করে দিয়ে বিরক্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেলল নম্রতা। গত দেড়ঘন্টা যাবত বই সামনে নিয়ে বসে থাকলেও পড়া হয়নি একটা অক্ষরও। হবেই বা কী করে! বিক্ষিপ্ত মন মেজাজ নিয়ে চাইলেও পড়ায় মনোযোগ ধরে রাখা যায় না।

তালুকদার মঞ্জিল থেকে ওরা ফিরেছে আর চারদিন হতে চলল। কিন্তু ফিরে আসার দিনের সেই তীব্র অপমানবোধ এখনও মস্তিষ্কে সদর্পে ঘুনপোকার মতো আক্রমণ করে চলেছে, কুটকুট করে।

নম্রতা তালুকদার মঞ্জিলে থাকাকালীন খুব করে একটা সুযোগ খুঁজছিল তানিমের সাথে কথা বলার। সেই সুযোগটা পেল ফিরে আসার দিন। সকালের নাস্তা করার পরে দক্ষিনের বারান্দায় গিয়ে যখন ও দাঁড়াল, তানিম তখন বাইরে কারও সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত ছিল।

নম্রতা মনের কথাগুলো গুছিয়ে গুটিগুটি পায়ে দ্বিধা নিয়ে দাঁড়াল তানিমের পিছনে। সেই প্রথমদিন তানিমের সাথে করা অহেতুক দুর্ব্যবহার ওকে পীড়া দিচ্ছিল খুব। নিজের সেই চুড়ান্ত বাজে ব্যবহারের জন্য ক্ষমা চাইতেই গিয়েছিল ওখানে।

কয়েক মিনিট দাঁড়ানোর পরেও যখন তানিম ওর দিকে ফিরে তাকাল না, তখন ইচ্ছে করেই কয়েকটা শুকনো কাশি দিল দৃষ্টি আকর্ষনের জন্য। তবুও তানিমের কোনো হেলদোল নেই। ফোনের ওপাশে কারও সাথে কথা বলেই গেল। নম্রতা চুপ করে অপেক্ষা করল ফোনালাপ শেষ হওয়ার। কিন্তু কথা বলা শেষ করে তানিম নম্রতাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে চলে যেতে শুরু করল। বাধ্য হয়েই নম্রতা ডাক দিল ওকে।
“শুনছেন?”
“আমাকে বলছেন?” খুব স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন করল তানিম।
“হ্যা, আপনার সাথে একটু কথা ছিল।”
“আমি আসলে ব্যস্ত কিছুটা।”
“ওকে, নো প্রব্লেম। তাহলে পরে কথা হবে।” যথেষ্ট বিনয়ের সাথে বলল নম্রতা।
“পরেও কথা হবে না।” কাটাকাটা জবাব তানিমের।
“মানে?” পরের কথাটা যেন বুঝতে পারল না নম্রতা।

“মানে নরমালি আমরা যদি কারও সাথে কথা বলতে আগ্রহী না হই, এবং সেটা তাকে সরাসরি না বলতে পারি, তখন আমরা ব্যস্ততার অযুহাত দেই। আপনি যেহেতু শহরে থাকা স্মার্ট মেয়ে এতটুকু তো আপনার বোঝার কথা। কিন্তু আপনি যখন বুঝতে পারছেন না, তাই আমিই বলছি। আমি আপনার সাথে কথা বলতে প্রচন্ড বিরক্তবোধ করছি। বলা যায়, আমি একেবারেই আগ্রহী নই আপনার সাথে কথা বলতে।”

কথাগুলো তানিম বলেছিল একেবারেই স্বাভবিক কন্ঠে। রাগের ছিটেফোঁটা বহিঃপ্রকাশ ছিল না ওর কন্ঠে। নম্রতার এতদিন মনে হতো, পুরুষরা রাগলে তাদের গলা চড়ে যায় সবার আগে। কিন্তু এরকম শান্ত নরম স্বরেও যে কোনো পুরুষ রাগ দেখাতে পারে, সেটা ও জানত না। তানিমের ঠান্ডা মেজাজে বলা কথার তীর লক্ষ্যভেদ করল ঠিক নম্রতার হৃদয় বরাবর। শুধু কয়েকটা বাক্যে কী ভীষণভাবেই না সে অপমান করল নম্রতাকে।

নম্রতা ওখানে দাঁড়িয়েই কেঁদে ফেলল। তবুও তানিমের মন গলল না। কান্নারত নম্রতাকে ওখানে রেখেই চলে গেল তানিম। চূড়ান্ত পর্যায়ের অপমানিত হয়ে সারাটা সকাল কেঁদেই কাটাল নম্রতা।

সেই অপমানবোধের দগদগে ঘা গত চারদিনে এতটুকুও শুকায়নি। বরং প্রত্যেকদিন অসংখ্যবার সেই মুহুর্তটুকুর কথা মনে করে ঘা-টা আরও তাজা হয়েছে।

কিন্তু এতকিছুর পরেও তাকে ভুলতে পারছে না ও কিছুতেই। বরং অ্যাট্রাকশনটা আগের চেয়ে আরও স্ট্রং হয়েছে। এমনকি নম্রতারা যখন ফিরে আসছিল, কতবার যে ও পিছনে ফিরে তাকিয়েছে তাকে একপলক দেখার জন্য।

মোবাইলে আসা নোটিফিকেশনের শব্দে চমকে উঠে ভাবনার জগৎ থেকে বের হলো ও। চেয়ার ছেড়ে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়াল কিছুক্ষনের জন্য। বিকেলের এই সময়টাতে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালে মন কিছুটা হলেও ফুরফুরে হয়।

নম্রতার দৃষ্টি কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে গেটের কাছে এসে থেমে গেল। গেট দিয়ে যেই গাড়িটা ঢুকছে, এটাকে নম্রতা চেনে। আর চেনে বলেই ওর পালপিটিশিন বেড়ে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে। নম্রতার মনে হলো ওর দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। নইলে হঠাৎ এই অসময়ে তাকে কেন দেখবে! পরক্ষনেই বুঝতে পারল, ও যা দেখছে সবই বাস্তব।

গাড়ি থেকে প্রথমেই নামল তানিম। তারপর একে একে চাঁদনী আর রেবেকা বেগম নামল। নম্রতা দৌঁড়ে নামল দোতলা থেকে। দরজার কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই বাজল কলিংবেল। নম্রতা দরজা খুলে সালাম দিল রেবেকা বেগমকে। তারপর হেসে চাঁদনীকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছো ভাবি?”

হুট করে ভাবি ডাকটায় অপ্রস্তুত হলো চাঁদনী। তবু নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে জবাব দিল, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি?”
“ভালো।”
জবাব দিয়ে গেস্টদের লিভিংয়ে বসাল নম্রতা। তারপর মায়ের রুমের দিকে গেল তাকে ডাকতে।

মরিয়ম খাতুন সব শুনে বললেন, “ওহ, ওরা এসে গেছে।”
“তুমি জানতে ওরা আসবে?”
“হ্যা। জানব না কেন! চাঁদনীর ভর্তি কাল, তাই তানিম ওকে নিয়ে এসেছে। আর রেবেকা আপাকে আমি খুব করে বলেছিলাম বেড়াতে আসতে। তাই তিনিও এসেছেন।”
“ওহ।” ছোট্ট করে জবাব দিল নম্রতা।

৩৫.
নওয়াজের আজকাল ফিরতে বেশ রাত হয়ে যায়৷ জামশেদ সাহেব খুব শীঘ্রই ব্যবসার পুরো ভার নওয়াজের হাতে তুলে দিতে চাইছেন। সেসব বুঝে নিতে নওয়াজের নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছে। সকালে অফিসে ঢোকার পর শুধু লাঞ্চ টাইমে কিছুটা সময় পায়৷ তারপর কখন যে আবার রাত হয়ে যায়, নওয়াজ নিজেও জানেনা।

আজ অবশ্য আরও বেশি দেরি হয়েছে। অফিস শেষ করে আবিরের সাথে ডিনার করেছে বাইরে। ওদের পাঁচজনের ফ্রেন্ড সার্কেলটা এখন দুইভাগে বিভক্ত। আকরামের সাথে ইচ্ছে করেই আর যোগাযোগ করে না নওয়াজ। যেহেতু মিশকাত আর ফাহিমের সাথে আকরামের বন্ধুত্ব বেশ স্ট্রং, তাই ওদের সাথেও অটোমেটিক যোগাযোগ কমে এসেছে। এদিকে আবির সেদিন আকরামের করা জঘন্য কাজটার পরে ওর সাথে বন্ধুত্ব শেষ করে দিয়েছিল নিজে থেকেই। এখন তাই আবিরের সাথেই শুধু মাঝেমধ্যে আড্ডা দেওয়া হয়।

নওয়াজ যখন বাসায় ফিরল তখন রাত প্রায় এগারোটা। রুমের মধ্যে ঢুকে দেখল ডিম লাইট জ্বেলে রাখা হয়েছে। নওয়াজ অবাক হল। ওর রুমে ডিম লাইট জ্বালল কে?

রুমের লাইটের সুইচ অন করে বিছানার দিকে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠল ও। চাঁদনী শুয়ে আছে বিছানায়। নওয়াজ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে বিছানার এককোনে বসল। তার প্রায় সাথে সাথেই চাঁদনী উঠে বসল।

রোবোটিক গলায় প্রশ্নটা করল নওয়াজ,
“চাঁদনী, তুমি এখানে?”

চাঁদনী হাই তুলে বলল,”এখানে আসায় কি আপনার খুব অসুবিধা হয়ে গেল? তাহলে বলুন, আমি অন্য রুমে চলে যাচ্ছি।”

কথা শেষ করে চাঁদনী খাট থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলো। নওয়াজ হাত ধরে থামিয়ে দিল ওকে,
“চলে যেতে কখন বললাম আমি!”

চাঁদনী নওয়াজের ধরা হাতটার দিকে তাকাল। নওয়াজ সাথে সাথেই ছেড়ে দিল হাতটা। তারপর কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকল। কয়েকমিনিট অপেক্ষা করে অধৈর্য হয়ে গেল চাঁদনী।
“আজ সারারাত কি এভাবেই বসে থাকবেন?”
চাঁদনীর প্রশ্নে নওয়াজকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল।
“তাহলে কী করব?”
“আপনি যা খুশি করুন। কিন্তু সবার আগে লাইটটা বন্ধ করুন প্লিজ। সারাদিন জার্নি করে আমি খুব ক্লান্ত। একটু ঘুমাব এখন।”
“ওহ, আমি এক্ষুনি লাইট অফ করে দিচ্ছি।”

নওয়াজ লাইটের সুইচ অফ করে দিল আগে, তারপর ডিম লাইটের মৃদু আলোতেই ওয়ারড্রব খুলে একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে গেল ফ্রেশ হতে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-১৬+১৭+১৮

0

নিভৃত রজনী
| ১৬ | (১৪০০+ শব্দ)

পুরোটা সময় শুধু চাঁদনীকে নিয়েই ভেবে গেল ও। ভাবতে ভাবতে একসময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, চাঁদনী কী বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে ওর জন্য?

নওয়াজ চাঁদনীর রুমের দরজায় টোকা দিল ঘন্টাখানেক পর। ভিতর থেকে জবাব দিল নম্রতা,
“কে ভাইয়া? ভেতরে এসো। দরজা খোলাই আছে।”
নওয়াজ ধীরপায়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। চাঁদনী উলটোদিক মুখ করে গায়ে কাঁথা দিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে। আর তার পাশেই বসে আছে নম্রতা।
নওয়াজ প্রশ্ন করল, “ঘুমাচ্ছে?”
“না, জেগেই আছে এখনও।”

অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থেকেও বলার মতো আর কিছু খুঁজে পেল না নওয়াজ। অগত্যা বলল, “তুই আজ রাতটুকু ওর সাথেই থাকিস। কিছু দরকার হলে আমাকে ডাক দিস।”
নম্রতা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। নওয়াজ রুম থেকে বের হতেও গিয়েও আবার থেমে গেল চাঁদনীর গলার স্বর শুনে।
“আমি একটা অনুরোধ করতে চাই। আজকের এই ইনসিডেন্টটা সম্পর্কে মরিয়ম আন্টি যেন কিছু না জানতে পারেন। তিনি এখানে আসার সময় আমার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন, আমার যাতে কোনো সমস্যা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আজ যদি শোনেন যে তার বাসাতেই আমার সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হতে যাচ্ছিল। তাহলে আমার পরিবার এমনকি আমার সামনেও লজ্জায় পড়ে যাবেন। তাই আমি চাই যে কিছুক্ষন আগে যা হয়েছে সেটা এই রুমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক।”

নওয়াজ আর নম্রতা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। ওর দুজনেই ভাবছিল, হয়তো চাঁদনী সব বলে দেবে মরিয়ম খাতুনকে। এখন চাঁদনীকেই বারন করতে দেখে দুজনে নিশ্চিন্ত হলো কিছুটা। কিন্তু চাঁদনীর পরের কথাটাতেই নওয়াজ অবাকের চূড়ান্তে পৌঁছে গেল,
“আর নম্রতা আপু, তোমার ভাইকে প্লিজ এই রুমে থেকে বের হয়ে যেতে বলো। ওনাকে আমার সহ্য হচ্ছে না।”

নম্রতা আর নওয়াজ দুজনেই চুপ হয়ে গেল কিছুক্ষনের জন্য। নওয়াজের মনে তখন তোলপাড় চলছে। চাঁদনী এভাবে কেন বলল? তাহলে কি আজকের এই ইনসিডেন্টের জন্য ওকেই দায়ী করছে চাঁদনী?

হ্যা, ভুল একটু ছিল ওর। আজকের রাতটা ওদের থাকতে দেওয়া একেবারেই উচিৎ হয়নি। কিন্তু ওই বা কীভাবে বুঝবে যে আকরাম এমন একটা পদক্ষেপ নেবে। আকরামের নারীলিপ্সা থাকলেও কখনও কাউকে জোর করেনি ও। বরং বরাবরই বলত, জোর জবরদস্তি ওর ভালো লাগে না। ওর কথায় ইমপ্রেসড হয়ে যে মেয়ে এগিয়ে আসত তার সাথে ওর একটা সম্পর্ক তৈরি হত কিছুদিনের জন্য। নইলে একেবারে বিদায়। আকরামের কথা মনে আসতেই নওয়াজের মেজাজটা আবার চড়ে গেল।

আপাতত নিজের কনসেনট্রেশান আবার চাঁদনীর দিকেই দিল ও। কিছটা কৈফিয়তের মতো শোনাল ওর কথাগুলো, “চাঁদনী, তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি…”
“বোঝাবুঝির কিছু নেই আর। যে ছেলে বাবা মায়ের অনুপস্থিতিতে তার বন্ধুদের নিয়ে বাসায় মদের আসর বসায়, তাকে আর নতুন করে বোঝার কী আছে। আমি নাহয় বাইরের মেয়ে, কিন্তু ঘরে নিজের একটা বোন থাকতে এরকম জঘন্য কাজ যে করতে পারে, তার সাথে কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে।”
“চাঁদনী প্লিজ, আমার কথাটা একবার..”
“দয়া করুন আমার উপর। এখন যান এখান থেকে। আমি একটু ঘুমাব।”

নওয়াজের হৃদয়টা এফোড় ওফোড় হয়ে যাচ্ছিল চাঁদনীর বলা প্রত্যেকটা কথায়। ধীরপায়ে টলতে টলতে একপ্রকার ঘোরের মধ্যে নিজের রুমে এসে খাটের এককোনে ধপ করে বসে পড়ল ও। দুহাতে খামচে ধরল নিজের চুল। চাঁদনীর কথাগুলোতে নিজের ভিতরে হওয়া অদৃশ্য রক্তক্ষরণ টের পাচ্ছিল নওয়াজ। ইচ্ছে করছিল এখনই গিয়ে চাঁদনীর ভুলগুলো ভাঙিয়ে দিয়ে আসতে। নিজেকে পাগল পাগল লাগছিল। চাঁদনী শেষের কথাগুলো বলার সময় একেবারে নওয়াজের চোখের দিকে তাকিয়েছিল। সেই প্রথম দিন ওই চোখদুটোতে যতটা মুগ্ধতা দেখেছিল নিজের জন্য, আজ তার দ্বিগুন ঘৃণা উপচে পড়ছে সেই একই চোখে। মাতাল করা ওই চোখদুটো আজ ওকে সমুদ্রসমান ঘৃণা নিয়ে দেখছিল। সেসব ভাবলেও নওয়াজের নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল।

অনেকক্ষন স্থবিরের মতো বসে থাকল নওয়াজ। চাঁদনীর ওই এলোমেলো রূপটি চোখের সামনে ভেসে উঠছিল বারবারই। অস্থিরভাবে বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় অজানা অনুভূতিগুলো খোলা বইয়ের মতো পরিষ্কার হয়ে গেল ওর কাছে। নওয়াজ এই প্রথমবার বুঝতে পারল ও চাঁদনীকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে। চাঁদনী নামের মেয়েটি ওর হৃদয়ের সবটুকু জায়গা দখল করে ফেলেছে সুনিপুণভাবে।

২৭.
সকালে চাঁদনীর ঘুম ভাঙল উষ্ণ করতলের নরম স্পর্শে। মায়েরা ঠিক যেভাবে সন্তানের মাথায় পরম মমতায় হাত বুলিয়ে দেয়, অনেকটা তেমনই লাগল স্পর্শটা ওর কাছে। চোখ খুলতে খুলতে চাঁদনী অস্ফুটস্বরে ডেকে উঠল “মা!”
ঘুমের ঘোরে স্পর্শটা ঠিক মায়ের মতো লাগলেও চোখ খুলে অন্য কাউকে দেখতে পেল। তিনিও অবশ্য মায়ের চেয়ে কোনো অংশে কম নন চাঁদনীর জন্য। চাঁদনী কয়েক সেকেন্ড মুখটার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার চোখ বন্ধ করে ফেলল।

মরিয়ম খাতুন স্নেহময় কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখন কেমন লাগছে শরীর?”
চাঁদনী চমকে গেল হঠাৎ এমন প্রশ্ন শুনে। আমতা আমতা করে বলল, “আমি তো ঠিকই আছি।”

“তাহলে নম্রতা যে বলল, গতকাল রাত থেকেই নাকি মাথাব্যাথা করছে তোমার। সকালে নাস্তা করতেও তো নিচে গেলে না। এত বেলা করেও তো কখনও ঘুম থেকে ওঠ না তুমি। সত্যি করে বলো তো, খুব বেশি খারাপ লাগছে শরীর?”
চাঁদনী বলল, “আরে না। সামান্য মাথাব্যাথা। আরও কিছুক্ষন ঘুমালেই ঠিক হয়ে যাবে।”
“আচ্ছা, আবার ঘুমিয়ে থেক। কিন্তু তার আগে নাস্তাটা করে নাও অন্তত।”
“আন্টি, খেতে ইচ্ছে করছে না কিছু।”
“চুপ, একদম কোনো বাহানা চলবে না। আমি নাস্তা নিয়ে এসেছি। উঠে বসে খেয়ে নাও এক্ষুনি।”

মরিয়ম খাতুন নিজেই পরোটা ছিঁড়ে ডালে ডুবিয়ে চাঁদনীর মুখের সামনে তুলে ধরলেন। মেয়েটাকে আজ একেবারেই বিধ্বস্ত লাগছে। চাঁদনী চুপচাপ খেয়ে নিল খাবারটুকু।

মরিয়ম খাতুন নাস্তা খাওয়ানো শেষ করে চলে গেলেন। চাঁদনী আবার শুয়ে পড়ল বিছানায়। কিন্তু একফোঁটা ঘুমও আর ওর চোখে এলো না। গতকাল রাতের ভয়াবহতা কথা ভাবলে এখনও শিউরে উঠছে শরীর। গতকাল ঠিক সময়ে যদি নওয়াজ না আসত, তাহলে আজ হয়তো এই সুন্দর সকালটাও দেখা হতো না। নাহ, আবার ওই লোকটাই এসে যাচ্ছে ভাবনায়। ওর জন্যই তো কাল দুর্ঘটনাটা ঘটতে যাচ্ছিল। নিজের উপরে বিরক্তি এসে গেল চাঁদনীর। বারংবার চেষ্টা করেও তার প্রতি অনুভূতিগুলোকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই। বেইমান মন কেন জানি নিয়ন্ত্রণে থাকতে চাইছে না একদমই। কাল রাতের কথাই ধরা যাক না। যার জন্য এত বড় একটা বিপর্যয় ঘটে যাচ্ছিল প্রায়, তাকে বাঁচিয়ে দিতেই চাঁদনী বলেছিল যাতে ব্যাপারটা মরিয়ম খাতুনকে না জানানো হয়।

মরিয়ম খাতুনের সাথে নওয়াজের সম্পর্কটা ইদানিং এমনিতেই খুব একটা ভালো যাচ্ছে না, সেটা কয়েকদিন ধরেই আঁচ করতে পারছিল চাঁদনী। সম্ভবত চাঁদনীকে নিয়েই সমস্যাটার সূত্রপাত হয়েছে। এরমধ্যে আবার যদি মরিয়ম খাতুন জানতে পারতেন যে নওয়াজের বন্ধুর দ্বারা চাঁদনীর এতবড় একটা ক্ষতি হতে যাচ্ছিল, তাহলে তার অনুশোচনা হতো ঠিকই। পাশাপাশি ছেলের সাথে তিক্ততা আরও বেড়ে যেত। নওয়াজ নিজের মায়ের চোখে ছোট হয়ে যেত অনেকটা। সেজন্যই মূলত চাঁদনী ব্যাপারটা তাকে জানাতে বারণ করেছিল।

ভাবনাগুলো ডালপালা ছড়াচ্ছিল মনের মধ্যে। আচমকা ফোনের ভাইব্রেশনে সংবিৎ ফিরল ওর। মোবাইল স্ক্রিনে জ্বলে নিভে ভেসে উঠছে নামটি, ‘ভাইজান’।

চাঁদনী ফোন রিসিভ করে যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় সালাম দিল। কিন্তু এত চেষ্টা করেও শেষরক্ষা হলো না। সালামের জবাব দিয়ে প্রথমেই প্রশ্ন করল সাখাওয়াত, “তোর কন্ঠটা এমন শুকনো লাগছে কেন? শরীর খারাপ করেছে?”

“আরে না, বিছানায় শুয়ে আছি বলে এমন মনে হচ্ছে কন্ঠ।”
“এতো বেলা করে তো তুই বিছানায় থাকিস না কখনও।”
চাঁদনী কয়েক সেকেন্ডে মনে মনে সাজিয়ে নিল কথাগুলো। তারপর বলল, “আসলে করার মতো কোনো কাজ নেই। পড়াশোনাও তো নেই এখন। তাই শুয়ে ছিলাম।”
“ও। শুনলাম রেজাল্ট না জেনে নাকি বাড়ি আসতে চাইছিস না?”
“হ্যাঁ। সেটাই করব ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন খুব বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে। তোমাদের কথা মনে পড়ছে খুব।”
“এই চাঁদনী, তুই কি কাঁদছিস?”
চাঁদনী উপচে পড়া চোখের জল মুছে বলল, “কী যে বলো। কাঁদব কেন!”
“আমার চাঁদনী কাঁদলে আমি ঠিক বুঝতে পারি। বাড়ির জন্য খুব বেশি মন খারাপ লাগছে, তাই না?”
“হ্যাঁ,ভাইজান। খুব মন কেমন করছে বাড়ির জন্য। তুমি জলদি এসে আমাকে নিয়ে যাও।”
“কালই তোকে বাড়ি আনার ব্যবস্থা করছি। বাড়িতে তোর জন্য বিশাল একটা সারপ্রাইজ আছে।”
হঠাৎ আগ্রহী হয়ে উঠল চাঁদনীর কন্ঠ, “কী সারপ্রাইজ?”
“সেটা কালই জানতে পারবি।”

পরেরদিন সকালেই সারপ্রাইজটা পেয়ে গেল চাঁদনী। এনায়েত আর বেলায়েত তালুকদার দুজনেই মরিয়ম খাতুনদের বাসায় এসে হাজির হলো খুব সকালে। মূলত জামশেদ সাহেবের সাথে কথা বলার উদ্দেশ্যেই এত সকালে আসা। তাদের মুখেই জানা গেল সব।

তামজীদের বিয়ে ঠিক করা হয়েছে। এগার দিন পরে বিয়ে। সেজন্য চাঁদনীকে নিতে এসেছেন তারা। শুধু চাঁদনী নয়, তারা চান জামশেদ সাহেবও যেন সপরিবারে তাদের বাড়িতে গিয়ে থাকেন বিয়ে অব্দি।জামশেদ সাহেব বিনয়ের সাথেই জানালেন, অফিস ফেলে এতদিন আগে গিয়ে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব নয়।

এনায়েত তালুকদার তবুও দমবার পাত্র নয়। জামশেদ সাহেব নিজে আগে যেতে না পারলেও মরিয়ম খাতুন এবং নম্রতাতে যেন তাদের সাথেই যেতে দেন, তারজন্য সবিনয় অনুরোধ করলেন। জামশেদ সাহেব কিছুক্ষন ইতস্তত করে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকালেন। তারপর সম্মতি দিলেন যাওয়ার জন্য। জামশেদ সাহেব তাদের দুই ভাইয়ের থেকে বিদায় নিয়ে অফিসের জন্য রওয়ানা দিলেন। এনায়েত তালুকদার শেষবারের মতো আবার স্মরণ করিয়ে দিলেন, জামশেদ সাহেব তাদের নিমন্ত্রণ রক্ষার্থে বিয়েতে উপস্থিত থাকলে তারা খুব খুশি হবেন।

মরিয়ম খাতুন অতিথিদের নাস্তা দিয়ে নম্রতার রুমে গেলেন। মেয়েটা যেতে রাজি হবে কিনা কে জানে। মেয়ে যেতে না চাইলে তার একা যাওয়া হবে না কখনও। অথচ হলুদিয়া গ্রামে যাওয়ার কথা শুনে তার মনটা আবার সেই দুরন্ত কৈশোরে ফিরে গেছে। নম্রতাকে বিস্তারিত জানানোর পর কিছুক্ষন কী একটা ভেবে রাজি হয়ে গেল যাওয়ার জন্য। অতঃপর ঘন্টা দুয়েক পরে এনায়েত ও বেলায়েত তালুকদারের সাথে চাঁদনী, মরিয়ম খাতুন এবং নম্রতা রওয়ানা হয়ে গেল হলুদিয়া গ্রামের উদ্দেশ্যে।

২৮.
নওয়াজের ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। গত দুদিন ধরে সবকিছু কেমন একটা ওলটাপালট হয়ে যাচ্ছে। সারারাত ধরে ঘুম না হওয়ার কারনে সকালে ঘুম থেকে উঠতে অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।

ওর নিদ্রাহীনতার একমাত্র কারণ চাঁদনী নামের মেয়েটি। গত পরশু হয়ে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটার পর থেকে একবারের জন্যও চাঁদনীর দেখা পায়নি নওয়াজ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ১৭ | (১৫৩০+ শব্দ)

ওর নিদ্রাহীনতার একমাত্র কারণ চাঁদনী নামের মেয়েটি। গত পরশু হয়ে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটার পর থেকে একবারের জন্যও চাঁদনীর দেখা পায়নি নওয়াজ।

গতকাল সারাদিন নিজের রুম থেকে একবারের জন্যেও বের হয়নি চাঁদনী। এমনকি তিনবেলার খাবারও নিজের রুমে খেয়েছে। নওয়াজ তীর্থের কাকের মতো সারাদিন তাকিয়ে ছিল ওই দরজার দিকে। ইশ! যদি একবার কিছুক্ষনের জন্য হলেও তার দেখা পাওয়া যেত! চাঁদনীর প্রতি অনুভূতিগুলো নিজের কাছে স্পষ্ট হওয়ার পর থেকে ওকে দেখার আকুলতা বেড়েই যাচ্ছে ক্রমাগত৷ অথচ সে এখন আলোকবর্ষ দূরে৷ সবচেয়ে বেশি যেই যেই ব্যাপারটা নওয়াজকে পীড়া দিচ্ছে সেটা হলো, চাঁদনী ওকে ভুল বুঝে আছে। আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সুযোগও পাচ্ছে না নওয়াজ।

ঘুম ঘুম চোখে এসে সকালের খাবার খেতে বসল নওয়াজ। নওয়াজ বসার পর টুলুর মা নাস্তা এনে দিল।

নওয়াজ খেতে খেতে প্রশ্ন করল,
“মা কোথায়? নিচে দেখছি না যে আজ।”
“তারা তো কেউ বাড়িতে নেই।”
“বাড়িতে নেই মানে।”
সকালে চাঁদনীকে নিতে আসা থেকে শুরু করে সবটাই বলল টুলুর মা।
“ভাইজান, আপনি ঘুম থেকে ওঠার আগেই তারা চলে গেছে। আমাকেও ছুটি দিয়ে গেছে এই কয়দিনের জন্য।”
“আচ্ছা।”
নওয়াজের এবার প্রচন্ড হতাশ লাগল। চাঁদনী চলে গেছে একেবারে।

অর্ধেক নাস্তা করেই ও ছুটে গেল চাঁদনীর রুমে। বেশিরভাগ সময় যেই দরজাটা ভেজানো অথবা ভেতর থেকে লক করা থাকে আজ সেটা পুরোপুরি খোলা। কয়েক ঘন্টা আগেও এই রুমে চাঁদনী ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। চলে গেছে চাঁদনী। আর ফিরে আসার সম্ভাবনাও হয়তো নেই। খাটটা ছিমছাম গোছানো এখনও। মনে হচ্ছে এইমাত্র চাঁদনী উঠে ব্যালকনিতে গেছে খাট থেকে। খাটের সাথে লাগোয়া টেবিলটা খালি একেবারে। এই টেবিলেই থরে থরে সাজানো ছিল চাঁদনীর বইখাতা। নওয়াজ পুরো রুমে একবার চোখ বুলিয়ে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদনী এই রুমে আসার পর এই প্রথমবার নওয়াজ ব্যালকনিতে এলো। ব্যালকমিতে পা রেখেই চমকে গেল ও। পুরো ব্যালকনি ফুলের টবে ভর্তি। জানা অজানা নানা ফুল ফুটে আছে সেখানে। ওর বুঝতে অসুবিধা হলো না, এসব কে করেছে। নওয়াজ আলতো হাতে ছুঁয়ে গেল ফুলগুলো। চাঁদনীও নিশ্চই এভাবেই আদর করে দিত ফুলগুলোকে। নওয়াজ দেরিতে হলেও উপলব্ধি করতে পারল, ওর পুরো পৃথিবীটাই চাঁদনীময় হয়ে গেছে।

এ কেমন টানাপোড়েন! যখন চাঁদনী কাছে ছিল, তখন তাকে দূরে সরিয়ে দেয়ার জন্য কতই না প্রচেষ্টা ছিল ওর। অথচ যখন চাঁদনী নাগালের বাইরে চলে গেল তখন তাকে পাওয়ার জন্য মন-প্রাণ সব আকুল হয়ে আছে। ভালোবাসার প্রগাঢ়তা আজ টের পাওয়া যাচ্ছে হাড়ে-হাড়ে।

ধ্যানমগ্ন নওয়াজ কল্পনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো মোবাইলের রিংটোনে। মিশকাত ফোন দিয়েছে। নওয়াজ রিসিভ করে জিজ্ঞাসা করল, “কল করেছিস কেন?”

নওয়াজের কথা বলার ধরন শুনেই মিশকাত বুঝতে পারল, এখনও রাগ পড়েনি ওর। ও কল দিয়েছিল নওয়াজকে কিছুক্ষন গালিগালাজ করতে। কিন্তু নওয়াজের মেজাজ অনুধাবন করে নরমালিই কথা বলা শুরু করল, “কিছু না। এমনি কল করলাম। আমি আর ফাহিম তো সেই পরশু থেকেই হাসপাতালে। আকরামের অবস্থার তো এখনও কোনো উন্নতি নেই।”
“তারমানে এখনও মরেনি।”
“নওয়াজ! তোর মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেল? মানলাম আকরাম একটা অন্যায় করেছে। কিন্তু তার জন্য তুই পানিশমেন্টও তো যথেষ্ট দিয়েছিস। তাছাড়া ও সেদিন ড্রাঙ্ক ছিল। তুই নিজেও তো ওকে ভালো করে চিনিস। ও যেমন স্বভাবেরই হোক না কেন, কখনও কোনো মেয়েকে এভাবে ফোর্স করেনি এর আগে।”
“আকরামকে ডিফেন্ড করার জন্য এই লেইম এক্সকিউজগুলো দেওয়া বন্ধ কর প্লিজ। সেই প্রথমদিনই আমি তোদের সামনে আকরামকে ওয়ার্ন করেছিলাম। বলেছিলাম, চাঁদনীর থেকে দূরে থাকতে। কিন্তু ও কানে তোলেনি আমার কথা। এমনকি চাঁদনীর সম্মতি না থাকা স্বত্বেও বারবার চাঁদনীকে বিরক্ত করে গেছে। পরশু রাতের ব্যাপারটাতেও তোরা আকরামের দোষ ধামাচাপা দিতে চাইছিস ও ড্রাঙ্ক ছিল বলে। কিন্তু তুই নিজেও খুব ভালো করে জানিস যে সেই রাতে আকরাম ততটাও ড্রিংক করেনি যাতে ও একেবারে ভারসাম্যহীন হয়ে যাবে। অর্থাৎ চাঁদনীর সাথে ও যেটা করেছে, সেটা ওর সজ্ঞানেই করেছে।”

“তুই আর আবির যে কী শুরু করেছিস৷ সেদিন রাতে আবির সেই যে হসপিটালে পৌঁছে দিয়ে গেল, আর কোনো খোঁজ নিল না। বুঝলাম যে ও ভুল করেছে। তারজন্য শাস্তিও পেয়েছে। এখন পুরোনো কথা মনে রেখে শত্রুতা বাড়ানোর আদৌ কি কোনো দরকার আছে। আফটার-অল এতদিনের বন্ধু আমরা।”

“শুধু বন্ধু বলেই এতদিন আমি চুপ ছিলাম। নইলে ওর ওই নোংরা কাজগুলোর জন্য অনেক আগেই ওকে শিক্ষা দিয়ে দিতাম। সত্যি কথা বলতে ওর সাথে বন্ধুত্ব রাখার কোনো ইচ্ছেও আর নেই আমার। অন্তত এবারের ওর ওই জঘন্য কাজগুলোর জন্য। আমি যদি ঘুনাক্ষরেও আগে বুঝতে পারতাম যে সেদিন রাতে ও প্লান করে আমাদের বাসায় এসেছে তাহলে…।
” প্লান করে মানে?”
নওয়াজকে মাঝপথে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করল মিশকাত।
“সেদিন আকরাম নিজেই গিয়ে তোদের বলেছিল আমার বাসায় আড্ডা দেওয়ার জন্য আমাকে রাজি করাতে। ও সেদিন আগে থেকেও ভেবে রেখেছিল, যেকোনোভাবে চাঁদনীর রুমে যাবে।”
“তোকে এসব কে বলল!”
“অবাক হওয়ার কিছু নেই। আবির নিজেই আমাকে সব বলেছে কাল। শোন মিশকাত, তোদের সাথে আমার অলমোস্ট ফাইভ ইয়ারের ফ্রেন্ডশিপ। কিছুটা হলেও তোদের নেচার আমি জানি। আকরাম এর আগে কোনো মেয়ের সাথেই জোর করেনি। এর কারণ কি জানিস? কারণ এর আগে ও যেই মেয়েকেই টার্গেট করেছে সেই ওর ফাঁদে পা দিয়েছে। তাই জোর করার প্রয়োজন পরেনি। কিন্তু চাঁদনীই প্রথম যে ওকে বারবার রিজেক্ট করেছে। প্রথমে সামনাসামনি, তারপর ফোনে বহুবার চাঁদনীকে বিরক্ত করেছে ও। ওর অনেকগুলো কন্যাক্ট নাম্বার চাঁদনীর ফোনে ব্লাকলিস্টেড করা। এই যে বারবার প্রত্যাখ্যান, এটাই মেনে নিতে পারেনি আকরাম। সেজন্যই সেদিন ইচ্ছে করে চাঁদনীর চরিত্রে কলঙ্ক লাগাতে ওরকম একটা স্টেপ নিয়েছে।”

“নওয়াজ প্লিজ, এখন আর এসব কথা থাক। আকরাম আমাদের বন্ধু, এখনও হাসপাতালে অসুস্থ হয়ে পরে আছে। মাথায় স্টিচ লেগেছে অনেকগুলো। এখন পুরোনো কথাগুলো ভুলে যা।”
“তোকে আজ একটা কথা ক্লিয়ার ভাবে বলি। আকরাম আমার বন্ধু ছিল, কিন্তু এখন আর নেই। ভবিষ্যতেও আর কখনও হবে না। এটা যেমন আমার মনের কথা, আকরামেরও ঠিক তাই।”
“মানে?”
“ওই যে বললাম,তোদের নেচার আমি কিছুটা হলেও জানি। আমার ধারনা যদি ভুল না হয়, এইযে তুই আমাকে আজ কল দিয়েছিস, এটাও তোকে আকরাম শিখিয়ে দিয়েছে। আকরাম চায় আমার সাথে এখন একটা ভালো সম্পর্ক রাখতে তারপর একদিন সুযোগ বুঝে বদলা নেবে আমার উপর। কি? ঠিক বলেছি তো?”
“তুই ভুল বুঝছিস নওয়াজ।..”
মিশকাত ভড়কানো এবং দুর্বল গলায় সাফাই দেওয়ার চেষ্টা করল।
নওয়াজ হেসে বলল, “ওকে সাবধান করে দিস মিশকাত, আর যেন কখনও আমার সামনে না আসে।”

২৯.
তালুকদার মঞ্জিলে চাঁদনীরা যখন পৌঁছাল, তখন প্রায় সন্ধ্যা। গাড়ি থেকে নেমে নম্রতা হাফ ছেড়ে বাঁচল। এরকম লং জার্নি ওর কাছে সবসময়ই বিরক্তিকর লাগে। চাঁদনী সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছে, মরিয়ম খাতুনও খুশিমনে সৌজন্যমূলক আলাপচারিতা করছেন। নম্রতা সবাইকে সালাম দিয়ে সোফার এককোনে চুপ করে বসে পড়ল। ওর চোরা দৃষ্টি খুঁজে যাচ্ছিল বিশেষ একজনকে। কিন্তু তার ছায়ার হদিসও পাওয়া গেল না বসার ঘরের আশেপাশে। টুকটাক নাস্তার পরে ওদের বিশ্রামের জন্য রুমে নিয়ে যাওয়া হলো। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেওয়ার জন্য বিছানায় শোয়ার কিছুক্ষন পরেই নম্রতা টের পেল, চিনচিনে একটা ব্যাথা হচ্ছে মাথার মধ্যে। বেশিক্ষন জার্নি করলেই এই সমস্যাটা হয় ওর। সময়ের সাথে সাথে ব্যাথাটা আরও বাড়তে থাকল। তাই রাতের খাবার খেতেও আর নিচে নামা হলো না নম্রতার।

তানিমের সাথে ওর দেখা হলো পরেরদিন সকালে। ওদের এই সাক্ষাতের সাক্ষী হয়ে রইল আরেকটা দুর্ঘটনা ঠিক প্রথম দিনের মতোই। রাতে জলদি ঘুমিয়েছে বলে নম্রতার ঘুম ভাঙল সকাল সকালই। রুম থেকে বাইরে বের হয়ে নিচে যাওয়ার জন্য সিঁড়ির কয়েকটা ধাপ এগিয়েছিল ও। হঠাৎ কি একটা মনে হতে উলটো ঘুড়ে তাড়াহুড়ো করে উঠতে গেল, ঠিক তখন বাঁধল বিপত্তিটা।

ঠিক প্রথম দিনের মতো আরেকটি ধাক্কা। না, এবার নম্রতার হাতে কোনো ফোন ছিল না। তবে তানিমের হাতে ল্যাপটপ ছিল। সেটা হাত ফসকে সিড়ি দিয়ে গড়িয়ে একেবারে নিচে পড়ল। নম্রতা অসহায় চোখে প্রথমে তানিমের দিকে তাকাল। তারপরে তাকাল ফ্লোরে পড়ে থাকা দ্বিখন্ডিত ল্যাপটপটির দিকে। একেবারে মাঝ বরাবর ভাগ হয়ে পড়ে আছে ল্যাপটপটি। নম্রতা মাথা নিচু করে চোখ বন্ধ করে ফেলল। এখনই বুঝি শুরু হবে কথার গোলাবর্ষণ। অপমান করার এতবড় সুযোগ নিশ্চই লোকটা হাতছাড়া করবে না। নম্রতাও তো ঠিক একই কাজ করেছিল একদিন। নম্রতা সাহস সঞ্চয়ের চেষ্টা করল। করুক অপমান। নম্রতাও এবার অপমানের যোগ্য জবাব দেবে ঠিক একইভাবে। নতুন একটা ল্যাপটপ কিনে এনে দেবে প্রয়োজনে লোকটাকে।

অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরেও কোনো শব্দ না পেয়ে নম্রতা চোখ খুলে তাকাল। তানিম ততক্ষনে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ল্যাপটপটা তুলে নিয়েছে হাতে। নম্রতা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকল সেদিকে।

তানিম ল্যাপটপটা তুলে নিয়ে আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। নম্রতার দিকে একবারও না তাকিয়ে হেঁটে সোজা অন্যদিকে চলে গেল। নম্রতার মনে হলো, তানিমের কিছু না বলাটাও একরকম অপমান করাই হলো। নম্রতা সেদিন আজবাজে কথা বলে যতটা অপমান করেছিল তানিমকে আজ তানিম কিছু না বলে তার চেয়েও বেশি অপমান করে গেল ওকে। নম্রতার দিকে একবারও না তাকিয়ে, ভালো-মন্দ কথা না বলে একপ্রকার অগ্রাহ্য করে গেল ওকে। নম্রতা টের পেল, ওই দাম্ভিক লোকটির এমন নিস্পৃহ আচরণে ওর দুচোখ ভর্তি জল জমছে। নম্রতা ওড়নার এককোনা দিয়ে চোখের পানি মুছল। তারপর সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল নিচে। চাঁদনীর সাথেই প্রথম দেখা হলো ওর,
“ও তুমি এসে গেছ। আমি এক্ষুনি যাচ্ছিলাম তোমাকে ডাকতে। রাতেও তো না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লে। ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই। চলো, নাস্তা করে নেবে।”

নম্রতা চাঁদনীকে অনুসরণ করে এগিয়ে গেল। খাবার ঘরে ঢুকে আবারও ওর পা থেমে গেল তানিমকে দেখে। চাঁদনী তাড়া দিল, “কই আপু? বসো।”
নম্রতা বসে পড়ল চুপচাপ। নম্রতা বসতেই নায়লা ওর খাবার বেড়ে এগিয়ে দিল। নম্রতা চাঁদনীকে জিজ্ঞাসা করল, “আম্মু কোথায়?”
“আন্টি তো মা আর চাচীর সাথে বাড়ির পিছন দিকটায় ঘুরতে গেছে। তুমি খেয়ে নাও, তারপর আমরাও যাব। তোমাকে আমাদের এই সুন্দর গ্রামটা ঘুরিয়ে দেখাব।”

চাঁদনীর কথার প্রত্যুত্তরে নম্রতা হাসল কেবল। হঠাৎ করেই ওর মনে পড়ল, চাঁদনীর ওদের বাসায় যাওয়ার প্রথম দিনগুলোর কথা। ঠিকভাবে কথা পর্যন্ত বলত না ও চাঁদনীর সাথে। গ্রাম থেকে এসেছে শুনে অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে।

অথচ চাঁদনীদের বাসার মানুষগুলো একেবারেই আলাদা। গতকাল এই বাড়িতে আসার পর থেকে বাড়ির সদস্যরা মাথায় তুলে রাখছে অতিথিদের। কিছুক্ষন পরপরই এসে খোঁজ নিচ্ছে কিছু লাগবে কিনা। এইযে নায়লা নাস্তা দিতে দিতে টুকটাক কথা বলছে। কথাগুলো এমনভাবে বলছে যেন নম্রতারা এই বাড়ির কত আপন। অথচ মায়ের কাছে যতটুকু শুনেছে তারে এই বাড়ির সাথে ওদের কোনো রক্তের সম্পর্ক নেই।

তানিম এককোনের চেয়ারে বসে নাস্তা করছিল। যদিও সে একবারও চোখ তুলে নম্রতার দিকে তাকাচ্ছিল না, তবুও নম্রতার অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। ওকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতেই বোধহয় তানিম জলদি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ১৮ | (১৪৫০+ শব্দ)

তানিম এককোনের চেয়ারে বসে নাস্তা করছিল। যদিও সে একবারও চোখ তুলে নম্রতার দিকে তাকাচ্ছিল না, তবুও নম্রতার অস্বস্তি হচ্ছিল খুব। ওকে এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি দিতেই বোধহয় তানিম জলদি খাওয়া শেষ করে উঠে দাঁড়াল।

নায়লার দিকে তাকিয়ে তানিম বলল, “ভাবি, বাড়িতে কিছু লাগলে বোলো। আমি আজ বিকেলে শহরে যাচ্ছি।”
কথাগুলো নায়লার উদ্দেশ্যে বললেও তানিমকে পালটা প্রশ্ন করলেন খাবার ঘরের দরজায় দাঁড়ানো তানিমের মা দেলোয়ারা বেগম, “হঠাৎ শহরে কেন যাবি আবার?”
“ল্যাপটপটা ভেঙে গেছে। নতুন একটা নিতে হবে।” তোয়ালে দিয়ে হাত মুছতে মুছতে জবাব দিল তানিম।
“সেকি! ভাঙল কীভাবে?”
“সিঁড়ি থেকে নামার সময় হাত ফসকে নিচে পরে গেছে।”
“এতবড় একটা জিনিস এমনি এমনি হাত থেকে পড়ে গেল? কারও সাথে ধাক্কা লেগেছিল?”

দেলোয়ারা বেগমের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই মুখভর্তি খাবার নিয়ে বিষম খেল নম্রতা। নায়লা এবং দেলোয়ারা বেগম দুজনে মুহূর্তেই ব্যস্ত হয়ে গেল নম্রতাকে নিয়ে। নায়লা পানি এগিয়ে দিল ওর দিকে।
তানিম অবশ্য এসবকিছু দেখেও দেখল না। স্মার্টফোনে কী একটা দেখতে দেখতে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

সকালের নাস্তার পর নম্রতাকে নিয়ে নিজের গ্রাম দেখাতে বের হলো চাঁদনী। অক্টোবরের শেষের দিক, তাই গ্রামাঞ্চলে শীতের আমেজ শুরু হয়ে গেছে অল্পবিস্তর। ওরা বাড়ি ফিরল মধ্যদুপুরে। সময়গুলো কেটে যাচ্ছে ভালোই।

বিকেলের দিকে বাড়ি ফিরল তুরাগ। কিছু কিছু আত্মীয়স্বজনও আসা শুরু করেছে তামজীদের বিয়ে উপলক্ষ্যে। দেখতে দেখতে দুইদিন চলে গেল। বিয়ে উপলক্ষ্যে তালুকদার মঞ্জিলে ইতোমধ্যে আনন্দপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়ে গেছে, সেই আনন্দকে আরেকটু বাড়িয়ে দিল চাঁদনীর অ্যাডমিশন টেস্টের রেজাল্ট। বিকেলের দিকে জানা গেল, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চান্স পেয়েছে চাঁদনী। ভাইয়েরা মিলে চাঁদনীর এই অ্যাচিভমেন্টকে সেলিব্রেট করল সেদিন।

৩০.
মনস্তাত্ত্বিক কিছু বিষয় মাঝে মাঝে এমন জটিল হয়ে ওঠে যে স্বয়ং মানুষটিও বুঝতে পারে না, সে নিজে আসলে কী চায়। নম্রতার সাথেও আজকাল এমনটাই হচ্ছে। নিজের মধ্যে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা অন্য এক নিজেকে আবিষ্কার করছে আজকাল ও। এই নম্রতার সাথে আগের নম্রতার ব্যাবধান আকাশ পাতাল। নিজের মধ্যে জাগ্রত হওয়া এই নতুন সত্তা একেবারে অজানা কেউ৷

কবে থেকে এটা শুরু হয়েছে ও নিজেও জানে না। কিন্তু ভয়ংকর কোনো একটা অসুখে কাবু হয়ে আছে, শুধু এতটুকু উপলব্ধি করতে পারে ইদানিং। সে পাশ থেকে হেঁটে গেলেও মাদকতা ছড়িয়ে দিয়ে যায়। আর সেই নেশায় বুদ হয়ে থাকে নম্রতা। ঠিক কতটা আত্মসম্মানবোধে টইটম্বুর লোকটা, সেটা তার প্রতিটি দাম্ভিক পদক্ষেপই প্রমাণ করে দেয়৷

এমনিতে সব ঠিকঠাক। সবার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলছে লোকটা, বিয়ে বাড়িতে আসা অতিথিদের আপ্যায়ন করছে। কিন্তু শুধু নম্রতা যেখানে যাচ্ছে সেই জায়গাটিকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছে সবসময়। নম্রতা যে তার বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সেটা ও নিজেও বুঝতে পারছে। কিন্তু নিজেকে মানাতে পারছে না তবুও। লোকটা বিরক্ত হচ্ছে জানা স্বত্ত্বেও তার সামনে যাওয়াটা যেন সহজাত প্রবৃত্তির মতো হয়ে গেছে নম্রতার জন্য।

তালুকদার মঞ্জিলে নম্রতারা চারদিন হয় এসেছে। এই চারদিনে নম্রতা অগণিতবার তানিমের সামনে গেলেও ওর সাথে তানিমের চোখাচোখি হয়েছে মাত্র কয়েকবার। এবং দুজনার দৃষ্টি মিলিত হওয়ার ন্যানোসেকেন্ডের মধ্যে তানিম চোখ সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু নম্রতা তাকিয়ে ওকে দেখেছে অনেকক্ষন। এমন না যে ও ইচ্ছে করেই তাকিয়ে থেকেছে। যতক্ষন তানিম সামনে থাকে, ততক্ষন কেমন একটা ঘোরের মধ্যে থাকে ও। মনে হয় তানিম ছাড়া বাকি সবকিছু অদৃশ্য হয়ে গেছে। তারপর হঠাৎ করেই হুঁশ ফেরে ওর। নিজের কর্মকান্ডে নিজেই বিব্রত হয়।

একটা নতুন অনুভূতির উন্মোচন করার জন্য নম্রতার দিক থেকে ঠিক যতটা আগ্রহ, তানিমের দিক থেকে ঠিক ততটাই বিতৃষ্ণা আর অনীহা। এই যে তালুকদার মঞ্জিলে আসার পর থেকে নম্রতা ভদ্র মেয়েটি হয়ে আছে। তানিমের আশেপাশে কারণে অকারণে ঘুরঘুর করছে, চোরা দৃষ্টিতে বারবার ওকে দেখার চেষ্টা করছে। এসবের কিছুই চোখ এড়ায়নি তানিমের। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহও জন্মায়নি ওর নম্রতা নামের ওই মেয়েটির প্রতি। কিংবা বলা যায়, আগ্রহ জন্মানোর সুযোগ তানিম নিজেই দেয়নি। নম্রতার ছায়া আশেপাশে দেখলেও তানিমের সেই প্রথমদিনের করা অপমানের কথা মনে পড়ে যায়। খুব প্রয়োজন ছাড়া তানিম কখনও কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা তো দূরের কথা ঠিকভাবে কখনও চোখ তুলে অব্দি তাকায়নি। অথচ ওই মেয়েটা কয়েক মিনিটের পরিচয়ে সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনিচ্ছাকৃত ভুলের জন্য তানিমকে চরিত্রহীন বলে ফেলেছিল। তানিমের আত্মসম্মানে প্রবলভাবে আঘাত করেছিল সেদিন নম্রতার বলা প্রত্যেকটি শব্দ।

তারপর চলে গেছে অনেকগুলো মাস। কিন্তু নম্রতার দেওয়া সেই আঘাতের ক্ষত এখনও একই রকম দগদগে যন্ত্রনাদায়ক হয়ে রয়ে গেছে তানিমের মনের মধ্যে।

দুজনের মধ্যে যে ভালোলাগা, মন্দলাগা, আগ্রহ আর অনীহার বিপরীতমুখী একটা লুকোচুরি খেলা চলছিল সেটা ওরা ছাড়াও তৃতীয় একজনের নজরে খুব ভালোভাবেই পড়ল। সেই একজনটি হলো চাঁদনী। চাঁদনীর মনে হলো নম্রতার চোখে নিজেকেই দেখতে পাচ্ছে ও। ঠিক এরকম মুগ্ধতা নিয়ে ও নিজেও তো দেখত একজনকে। এখনও চোখ বন্ধ করলে তাকে দেখতে পায় ও। চাঁদনী যতই তাকে মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করে, ততই যেন মনের মধ্যে পাকাপোক্ত করে গেড়ে বসে সে। চাইলেও তাকে ভুলে যাওয়া যায় না। কিন্তু ভুলতে তো হবেই। যে ওকে চায় না, তাকে মনের মধ্যে পুষে রাখারও কোনো মানে হয় না৷ তাই প্রতিনিয়তই নওয়াজকে ভুলে যাওয়ার উপায় খুঁজে চলেছে ও।

তানিম এবং নম্রতার মতো চাঁদনী এবং নওয়াজের সম্পর্কটাও বিপরীতেই চলছিল। চাঁদনী যখন নওয়াজকে ভুলে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিল, নওয়াজ তখন ভাবছিল, কীভাবে চাঁদনীকে পাকাপোক্তভাবে নিজের করে নেবে।

ক্ষনে ক্ষনে নওয়াজের অস্থিরতা বেড়েই চলছিল। সেই ইনসিডেন্টের পর থেকে চাঁদনী ওকে ভুল বুঝে আছে, এবং সেদিন থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য একবার চাঁদনীর সাথে কথা বলারও সুযোগ পায়নি ও। এই নিয়ে আত্মগ্লানিতে ভুগে চলছিল ও প্রত্যেকটা মুহূর্তে।

চাঁদনী অনেকগুলো মাস ওর কাছাকাছি একই ছাদের নিচে ছিল, তখন চাঁদনীকে খুব একটা কাছে থেকে দেখা হয়ে ওঠেনি কখনও। অথচ এখন যখন চাঁদনী যোজন যোজন দূরে চলে গেছে, তখন তাকে একটাবার দেখার জন্য মন চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত হয়ে আছে। মনেহয় যেন কত যুগ পার হয়ে গেছে চাঁদনীকে না দেখে, তার ওই কন্ঠস্বর না শুনে।

নওয়াজ ওর স্বাভাবিক জীবনের ছন্দপতন অনুভব করছিল বেশ ভালোভাবেই। চাঁদনীর সেই কান্নাভেজা মুখ প্রত্যেকরাতেই অবিকল ভেসে ওঠে মানসপটে। ধারাল সেই কন্ঠস্বর কঠোরভাবে বলেছিল নওয়াজকে রুম থেকে বের হয়ে যেতে। চাঁদনীর রেগে উচ্চারণ করা সেই প্রত্যেকটা শব্দ এখনও ঝংকার তুলে যায় ওর কানে। সেই শেষ কথা চাঁদনীর সাথে। আর সেদিনই প্রথম হৃদয় জানান দিয়েছিল তার গোপনে থাকা প্রণয়ের আভাস। নিজেকে আজকাল ওর গাধা বলে মনে হয়। চাঁদনীর ফোন নাম্বারটা থাকলে অন্তত যোগাযোগ করা যেত৷ অথচ এতদিনে সেটাও রাখা হয়নি কখনও৷

সবকিছু নিয়েই এখন আফসোস হয় নওয়াজের। এগার ডিজিটের একটা মোবাইল নাম্বার কেন রাখল না। কিংবা সময় থাকতে নিজের মধ্যে অজান্তে পুষে রাখা গোপন কথাগুলো কেন টেনে হিঁচড়ে বের করতে পারল না, তারজন্যেও হা-হুতাশ করে খুব। কিন্তু এখন এসব নিয়ে ডিপ্রেশনে ভুগে আদৌ কি কোনো লাভ আছে। তারচেয়ে বরং এই ড্যামেজটুকু কন্ট্রোল করার জন্য কিছু একটা করা উচিৎ। ভাবতে ভাবতেই নওয়াজের মস্তিষ্কের ঘুটঘুটে অন্ধকারে হঠাৎ বৈদ্যুতিক বাল্ব জ্বলে উঠল। এই প্লানটা নিশ্চিত কাজে দেবে। এবার আর কোনো ভুল নয়। সঠিক সুযোগ ও সময় পেলেই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করে ফেলতে হবে।

৩১.
তালুকদার মঞ্জিলের অন্দরমহলে আজকাল সন্ধ্যাকালীন চায়ের আসরটা বেশ জমে ওঠে। মাঝখানে আর একদিন বাদ দিয়েই বিয়ে। তাই স্বভাবতই বাড়িতে ব্যস্ততা প্রচুর। বাড়ির মহিলারা কাজ করতে করতেই আড্ডাটা জমিয়ে তুলেছে বেশ। চাঁদনীর মা রেবেকা বেগম আর মরিয়ম খাতুন এককোনে বসে ঝি-বউদের হাসিঠাট্টা দেখতে দেখতে টুকটাক গল্প করে চলছিলেন।

হঠাৎ কল আসায় কথা বলার জন্য উঠে বারান্দার দিকে গেলেন মরিয়ম খাতুন। কল করেছেন জামশেদ সাহেব। মরিয়ম খাতুন ফোন রিসিভ করে সালাম দিলেন। জামশেদ সাহেব সালামের জবাব দিয়ে বললেন, “ভালোই সময় কাটছে তোমার তাহলে।”
“সময় ভালো যাচ্ছে সেটা তুমি কীভাবে বুঝলে?”
“দেখলাম, সবাই মিলে হাসিগল্প করছ, ছাদে বসে পা দুলিয়ে আচার খাচ্ছ, তাই বললাম আরকি।”
“মানে, এসব তুমি কীভাবে দেখলে?”
“নম্রতা ভিডিও করে পাঠাল। মেসেজে লিখেছে, গ্রামে গিয়ে তার মা নাকি একেবারে বাচ্চা হয়ে গেছে।”
“মেয়েটা এসব আবার কখন করল?”
“ভালোই করেছে। এত ভালো লাগছিল ভিডিওগুলো দেখতে। মনে হলো যেন বিয়ের সময়ের সেই চঞ্চলা মরিয়মকে দেখছি আমি।”
মরিয়ম খাতুন হেসে ফেললেন স্বামীর কথা শুনে। সারা পৃথিবীর কাছে মানুষটা গম্ভীর আর দাম্ভিক হলেও তার কাছে একেবারে খোলা বইয়ের মতো। মরিয়ম খাতুন প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “কাল কখন রওয়ানা দেবে?”
“ভাবছি বিকেলের দিকে।”
“বিকেলে রওয়ানা দিলে তো প্রায় সারারাত জার্নি করতে হবে। তারচেয়ে কাল সকালেই রওয়ানা দাও। একরাত এখানে এসে থাকলে না হয়। এনায়েত ভাই খুব খুশি হবেন তাহলে।”
“তুমি যখন বলছ, তাই করব নাহয়।”
“নওয়াজ কী বলল৷ সে আসবে?”
“বলল তো যাবে।”
টুকটাক কথোপকথন সেরে ফোন রাখলেন মরিয়ম খাতুন।

মরিয়ম খাতুনের কথামতো পরেরদিন সকালেই নওয়াজকে নিয়ে রওয়ানা হলেন জামশেদ সাহেব। প্রায় অর্ধেক পথ ড্রাইভ করার পর হাইওয়ের পাশে থামল নওয়াজ। তখন দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়।

লম্বা জার্নিতে একটু ঘুমঘুম এসে গিয়েছিল জামশেদ সাহেবের। হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় সকচিত হয়ে বসে নওয়াজের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। নওয়াজ বলল,
“একটা রেস্টুরেন্ট চোখে পড়ল এদিকে। যেতে যেতে তো বিকেল হয়ে যাবে। তাই ভাবলাম লাঞ্চটা এখন থেকেই করে নেই। কি বলো তুমি?”
“বলছিস যখন চল তাহলে।”

রেস্টুরেন্টে ঢুকে নিরিবিলি একটা কোনে গিয়ে বাবাকে নিয়ে বসল নওয়াজ। খাবারের অর্ডার দিয়ে আরেকবার নিজের কথাগুলো মনে মনে গুছিয়ে নিল ও। তারপরে বলা শুরু করল, “আব্বু, তোমার সাথে আমার খুব ইম্পর্টেন্ট কিছু বলার আছে।”
“গো অ্যাহেড।” বলে টেবিল থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতলটা তুলে নিলেন জামশেদ সাহেব।

নওয়াজ অপেক্ষা করল কিছুক্ষন। বাবার পানি খাওয়া অবস্থায় কথাগুলো বললে অঘটন ঘটে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। জামশেদ সাহেব তৃষ্ণা মিটিয়ে আবার ছেলের দিকে তাকালেন। নওয়াজ কথা বলা শুরু করল কোনো কোনোপ্রকার ভূমিকা ছাড়াই, “আব্বু, আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি, এবং তাকে বিয়ে করতে চাই।”

জামশেদ সাহেবের মনে হলো তিনি ভুল শুনছেন। গম্ভীর মেজাজের মানুষ বলে কখনও ছেলেমেয়েদের সাথে সামান্য সখ্যতাটুকু গড়ে ওঠেনি তার। নম্রতা এবং নওয়াজের যত আবদার আর চাহিদা সব মায়ের কাছেই ছিল। যেই ছেলে সামান্য হাতখরচটুকুও কখনও তার কাছে চায়নি সে আজ নিজের বিয়ে করার কথা বাবার কাছে বলছে এটা ঠিক তার হজম হলো না।

জামশেদ সাহেব কিছু বলার ভাষা হারিয়ে শুধু ফ্যালফ্যাল করে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-১৩+১৪+১৫

0

নিভৃত রজনী
| ১৩ | (১৩০০+ শব্দ)

আকরামের খুব জেদি প্রকৃতির ছেলে। সবসময় যেটা চায় সেটা আদায় করেই ছাড়ে। বিশেষ করে মেয়েঘটিত ব্যাপারে ও ঝানু। মেয়েদের নিজের কন্ট্রোলে আনার জন্য সবসময় নিখুঁত প্লান করে আকরাম এবং প্রত্যেকবারই সেই প্লানে সাকসেসফুলও হয়। কিন্তু এই প্রথমবার ওর কোনো প্লানই কাজে আসছে না।

আজকে শিওর ছিল, এখানে এসে সারাদিন থাকলে কোনো না কোনোভাবে ঠিক চাঁদনীর সাথে কথা বলতে পারবে। কিন্তু মেয়েটার কিনা আজই অসুস্থ হতে হলো।

আকরাম খাওয়ার পরে বিকেল পর্যন্ত আড্ডা দিল নওয়াজের সাথে। তারপর একটা ফোনকল আসায় ছাদের দিকে গেল কথা বলার জন্য। ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ওর মনে হলো, আজ এবাসায় আসাটা বৃথা যায়নি। চাঁদনী একা বসে আছে ছাদের কর্নারের দিকের একটা দোলনায়। কলটা কেটে দিয়ে মোবাইল সাইলেন্ট করে দিল আকরাম। তারপর ঠিক প্রথমদিনের মতো নিঃশব্দে গিয়ে চাঁদনীর পেছনে দাঁড়াল।
“কেমন আছ চাঁদনী?”

চাঁদনী হঠাৎ প্রশ্ন শুনে চমকে উঠে পিছনে ফিরে তাকাল। আকরামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর চেহারাটা রক্তশূণ্য হয়ে গেল। আজকেও একেবারে পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে আকরাম। চাঁদনী ইতিউতি তাকিয়ে ওখান থেকে সরে আসার রাস্তা খুঁজল, কিন্তু দোলনার দুই পাশের রাস্তাই বন্ধ। একপাশে সাড়ি করে রাখা ফুলের টব, অন্যদিকে আকরাম।

চাঁদনীর অস্থিরতা দেখে হাসল আকরাম। বড় বড় চোখদুটোর চঞ্চল দৃষ্টি এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু শুধু ওর দিকেই তাকাচ্ছে না। আকরাম আবার প্রশ্ন করল, “শুনলাম তুমি নাকি অসুস্থ। এখন কী অবস্থা শরীরের?”

“ভালো।” ছোট করে জবাব দিল চাঁদনী। ওর দৃষ্টি এখনও ছাদের দরজার দিকে। মনে মনে প্রার্থনা করে যাচ্ছিল, আজও সেদিনের মতো কেউ আসুক ছাদে। কিন্তু আজ আর ভাগ্য সহায় হলো না ওর। চাঁদনী ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল ছাদে।
“তুমি কাঁপছ কেন চাঁদনী? এখনও কি শরীর খারাপ লাগছে? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আমি কি তোমাকে ধরব? আমার মনে হচ্ছে এখন তুমি পড়ে যাবে।”
“না!” এবার বেশ জোড়ালো শোনালো চাঁদনীর কন্ঠস্বর।
ব্যতিব্যস্ত হলো আকরামও, “ওকে, ওকে। কুল ডাউন। এত হাইপার হয়ে যেও না প্লিজ। আমি তোমার কনসেন্ট ছাড়া তোমাকে টাচ করব না। আমি তো জাস্ট হেল্প করার জন্যই আস্ক করেছিলাম। তুমি বরং একটু বসো। আমরা নাহয় বসে বসেই কথা বলি।”
“আমার এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। আমি বাসার ভেতরে যাব।”
“শরীর কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? কিছুক্ষন অন্তত থাকো প্লিজ, তোমার সাথে কিছু কথা আছে।”

“আমার সাথে? কী কথা?”
“কথাগুলো তুমি ঠিক কীভাবে নেবে জানি না। সেই প্রথমদিন তোমাকে দেখার পর থেকে কথাগুলো বলার জন্য অনেক চেষ্টা করেছি আমি। কিন্তু কিছুতেই বলতে পারি নি। আমি মানুষ হিসেবে সবসময়ই স্ট্রেইট ফরোয়ার্ড। সোজাসাপটা কথা বলতে পছন্দ করি। আজও তাই বলছি। চাঁদনী, আই থিংক আই অ্যাম ইন লভ উইথ ইয়্যু।”

এতটুকু বলে আকরাম থামল চাঁদনীর প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য। অসুস্থতার ছাপ ফুটে উঠেছে মেয়েটার চেহারাতেও। বিশেষ করে চোখ এবং ঠোঁট ফুলে আছে কিছুটা। কান্না করেছিল বোধহয় মেয়েটি। ও নিজেও সম্ভবত জানে না, ওকে এখন ঠিক কতটা সুন্দর লাগছে। আকরামের ইচ্ছে হলো এখনই একটা হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে নিজের কাছে টেনে এনে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আপাতত নিজের ইচ্ছের লাগাম টানল ও। এমনিতেই মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে। এসব করলে আরো বেশি নার্ভাস হয়ে যাবে। যা করার ধীরেসুস্থেই করতে হবে।

আকরাম বলল, “তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ? প্লিজ, এরকম নার্ভাস হয়ো না। ট্রাই টু বি ইজি উইথ মি। আমি শুধুই একটা প্রপোজাল রেখেছি তোমার সামনে। এখনই তোমাকে কোনো উত্তর দিতে হবে না। তুমি ভেবে জানাও আমাকে। তবে কিছু কথা তোমাকে না বলে পারছি না। চারদিকের এতো এতো কৃত্রিম সৌন্দর্যের ভীরে তুমি একজনই প্রকৃত সৌন্দর্যের অধিকারী। ওই যে ফুলের টবে সদ্য ফুটে থাকা লাল গোলাপটি, যেটাতে কারও স্পর্শ লাগেনি এখন পর্যন্ত, ঠিক ওটার মতো। আমি আমার পুরো জীবনে এরকম একজনকেই খুঁজছিলাম। তোমার অ্যানসার যদি হ্যাঁ হয়, তাহলে আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব তোমার প্রতি।”
শেষের কথাগুলো বলে চাঁদনীর এক্সপ্রেশন দেখার জন্য ওর দিকে ভালো করে তাকাল আকরাম। কিন্তু কোনো পরিবর্তনই দেখতে পেল না ওর মধ্যে। অন্য কোনও মেয়ে হলে এতক্ষনে একটু হলেও কনভিন্স হয়ে যেত। নাহ, এই মেয়েকে বাগে আনতে পরিশ্রম করতে হবে অনেক।

২৩.
মাসের এই বিশেষ দিনগুলোতে চাঁদনীর ভুগতে হয় প্রচুর। বিশেষ করে পেটেব্যাথা হয় খুব। গতকালের চেয়ে অবশ্য আজ একটু বেটার লাগছে। মরিয়ম খাতুন অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকে যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন ওর। গরম পানি করে দেওয়া, পেইনকিলার খাওয়ানো। গতকাল কোচিং বন্ধ ছিল বলেও কিছুটা রিল্যাক্স পাওয়া গেছে। কিন্তু আজ তো যেতেই হবে। পেটের সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যাথাটা উপেক্ষা করেই চাঁদনী ঘুম থেকে উঠে পড়ল।

বালিশের পাশ থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে সময় দেখল। তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে বই নিয়ে বসল কিছুক্ষনের জন্য। পড়তে পড়তেই গতকাল বিকেলের কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ। আকরাম নামের লোকটার সাথে চাঁদনীর দ্বিতীয়বার দেখা হলো কাল। এত জলদি একটা মানুষকে যদিও জাজ করা ঠিক না, কিন্তু চাঁদনী কিছুতেই লোকটাকে পজিটিভলি নিতে পারছে না।

মেয়েদের স্বভাবতই কিছু বিশেষ ক্ষমতা থাকে। বিশেষ করে কোন ছেলে কী দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাচ্ছে সেটা কিছুক্ষন অবজার্ভ করলেই অনেকটা বুঝতে পারে একটা মেয়ে। সেই অনুমানের ভিত্তিতেই চাঁদনীর ঠিক ভালো লাগেনি আকরামের তাকানোর ভঙ্গি। যদিও রুমের বাইরে বের হলে চাঁদনী যথেষ্ট মার্জিত হয়েই থাকে। তবুও গতকাল আকরামের সামনে প্রচন্ড রকমের অস্বস্তি হচ্ছিল ওর। লোকটার দৃষ্টি স্থির নয় একদমই, পুরো শরীর, বিশেষ করে স্পর্শকাতর স্থানটিতে বারবার তাকাচ্ছিল লোকটা। সে কথা মনে হলেও কেমন একটা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয় ওর।

নওয়াজের বন্ধু সে। অথচ নওয়াজ একদমই এমন নয়। নওয়াজ কথা বললে সবসময় আই কন্টাক্টে বলে, এবং সেই তাকানোর ভঙ্গিতে কখনোই কলুষতা দেখেনি চাঁদনী। বরং, যতবারই নওয়াজের চোখে চোখ পড়েছে ততবারই অন্যকিছু মনে হয়েছে চাঁদনীর। নওয়াজ নিজের মুখে সরাসরিই জানিয়েছে যে চাঁদনীকে সে নিজের জীবনসঙ্গিনী হিসেবে চায় না, কিন্তু তার চাহনি বলে অন্যকিছু। নওয়াজের মুখের কথার সাথে তার আই এক্সপ্রেশন মেলাতে গেলেও বিভ্রান্তিতে পড়ে যায় চাঁদনী।

আকরামের বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসে কখন যে সেটা নওয়াজে এসে থেমেছে, সেটা চাঁদনী নিজেও জানে না। মোবাইলের নোটিফিকেশন টোন শুনে চমকে উঠল হঠাৎ ও। পরক্ষনে নিজেকে আবার শাসাল ও। না, ওই লোকটাকে নিয়ে আর কিছুতেই ভাবা যাবে না। যেখানে সে স্পষ্ট করে তার অসম্মতির কথা জানিয়েছে, সেখানে তাকে নিয়ে অহেতুক ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। সেদিন গাড়িতে বলা কথাগুলো মনে হতেই চাঁদনীর মুখটা আবার থমথমে হয়ে এলো।

চাঁদনী আপাতত চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাল। কোচিং-এ যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। নিচে নেমে নাস্তা করে রেডি হয়ে নিল চাঁদনী। তারপর পার্কিং-এ এসে গাড়ির সামনে দাঁড়াতেই পা দুটো থেমে গেল ওর। ড্রাইভিং সিটে নওয়াজ বসে আছে। চাঁদনীকে দেখে ও বলল,
“উঠে এস। আজ তোমাকে কোচিং-এ ড্রপ করতে আমিই যাব।”
“কেন?” চাঁদনীর ছোট প্রশ্ন।
“ওদিকটায় একটু কাজ আছে আমার আজ। তাই ভাবলাম তোমাকেও নিয়ে যাই।”
চাঁদনী গাড়িতে উঠে বসল।
নওয়াজ স্টার্ট দিয়ে প্রশ্ন করল, “এখন তোমার শরীরের কী অবস্থা? বেটার? মাথাব্যাথা কমেছে?”
চাঁদনী ইতস্তত করল। এক শব্দে জবাব দিল, “হ্যাঁ।”
“তোমাদের এক্সামের তো আর বেশি দেরি নেই। তা তোমার প্রগ্রেস কতদূর?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো।”
টুকটাক কথা বলতে থাকল নওয়াজ। চাঁদনী ও সেগুলোর জবাব দিতে থাকল। চাঁদনীর একবার মনে হলো, কাল বিকেলে ছাদে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা নওয়াজকে বলা উচিৎ। কিন্তু ঠিক কীভাবে যে বলবে সেটাই ও বুঝতে পারছিল না। তাই বলতে চেয়েও বলা হলো না কথাগুলো।

কোচিং-এর সামনে চাঁদনীকে নামিয়ে দিয়ে নওয়াজ আবার বাসার দিকে ব্যাক করল। চাঁদনীর সাথে কিছুক্ষন কথা বলার জন্য আজ একটা মিথ্যে বলতে হয়েছে ওকে। আসলে আজ ওর কোনো কাজই ছিল না এদিকে। গতকাল মায়ের কাছে চাঁদনীর অসুস্থতার কথা শোনার পর থেকেই ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সেই সুযোগটা হয়ে উঠছিল না। তাই আজ একটু মিথ্যের আশ্রয় নিতে হলো। মেয়েটার অসুস্থতার কথা শুনে যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছিল মনের মধ্যে সেটা এখন কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছে। একটা মানসিক শান্তিও অনুভূত হচ্ছে।

আজকাল চাঁদনী সারাক্ষনই মগজে গেথে থাকে একেবারে। এতদিন মনে হতো, চাঁদনীর প্রতি শুধুই অপজিট অ্যাট্রাকশন কাজ করে ওর। এর বেশি কিছু না। ও যেরকম কাউকে নিজের লাইফ পার্টনার হিসেবে চায় চাঁদনী ঠিক সেরকম নয়৷ কিন্তু ইদানিং সব কেমন ওলটপালট লাগে। নিজের বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলোকে নিজের কাছেই লাগামছাড়া মনে হয়। সংশয়ের কাঁটাটি দুলতে থাকে মনের মধ্যে। মনের অজান্তে চাঁদনী কি তাহলে বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে ওর জন্য? নওয়াজ আর ভাবতে চাইল না। নিজের কনসেনট্রেশান অন্যদিকে নেওয়ার চেষ্টা করল।

কিন্তু চাইলেই কি আর সব এড়িয়ে যাওয়া যায়? নওয়াজের জন্যও চাঁদনীর প্রতি অনুভূতিগুলো এড়িয়ে যাওয়া কঠিন থেকে কঠিনতম হয়ে যাচ্ছিল। গুনে গুনে ঠিক আটদিন বাদে সুন্দর এক গোধূলি বেলায় নওয়াজ ফিল করল, চাঁদনীর প্রতি ওর অবসেশন বেড়েই যাচ্ছে। সেদিন ছোট্ট একটা ঘটনার জের ধরে একটু জেলাসিও বোধহয় ছুঁয়ে গেল ওকে।

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল চাঁদনীর চাচাত ভাই তুরাগকে নিয়ে। চাঁদনী ঢাকায় আসার চারমাস পর প্রথমবার ওর সাথে দেখা করতে এলো ওর ছোট চাচার ছোটছেলে তুরাগ। হুট করে একদিন বিকালে তামজীদকে নিয়ে হাজির হলো সে।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ১৪ | (১২৯০+ শব্দ)

ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল চাঁদনীর চাচাত ভাই তুরাগকে নিয়ে। চাঁদনী ঢাকায় আসার চারমাস পর প্রথমবার ওর সাথে দেখা করতে এলো ওর ছোট চাচার ছোটছেলে তুরাগ। হুট করে একদিন বিকালে তামজীদকে নিয়ে হাজির হলো সে।

চাঁদনী সেদিন ছাদেই ছিল। গাড়ি থেকে তামজীদের সাথে তুরাগকে নামতে দেখে এক দৌড়ে নিচে নামল ও।

নওয়াজ লিভিংরুমে বসে ছিল ল্যাপটপ নিয়ে। চাঁদনীকে ওভাবে দৌড়ে দরজার দিকে যেতে দেখে সচকিত হলো ও। দরজা খোলার পর তামজীদকে ঢুকতে দেখে নওয়াজ বুঝতে পারল চাঁদনীর এভাবে উল্কার বেগে ছুটে যাওয়ার কারণ। হালকা হেসে নওয়াজ অতিথিদের সাথে কুশলাদি বিনিময় করল। চাঁদনীর জন্য ওর ভাইয়েরা যে ঠিক কতটা ইম্পর্টেন্ট সেটা এতদিনে খুব ভালো করেই বুঝে গেছে ও।

পুরো পৃথিবীর সামনে চাঁদনী শান্তশিষ্ট, মেপে কথা বলা একটি মেয়ে হলেও নিজের কাছের মানুষগুলোর সামনে চঞ্চলা হরিণীর মতো দুরন্ত। এই প্রমাণ নওয়াজ আগেও কয়েকবার পেয়েছে। আজ আবারও চোখের সামনে দেখলে প্রাণোচ্ছল চাঁদনীকে। তামজীদ আর তুরাগ লিভিং রুমে এসে বসতে না বসতেই চাঁদনী তুরাগের সামনে অভিযোগের ডালি খুলে বসল।

“এতগুলো দিন পর তোমার মনে পড়ল আমার কথা? কীভাবে পারলে তুমি? আমি ঠিকই ভেবেছি এতদিন, তুমি আসলে আমাকে একটুও ভালোবাস না। যেহেতু আমার প্রতি তোমার কোনো টানই নেই, তাই আজ থেকে তোমার সাথে আমার কথা বলা বন্ধ।”

তুরাগ হেসে বলল, “পাগলী একটা। জানিসই তো পড়ার খুব প্রেসার যাচ্ছে। বাড়িতেই তো ফিরলাম গতকাল বিকেলে। আর আজ সকালেই রওয়ানা দিলাম ঢাকা। সেজন্যই তো তোর সাথে এতদিন দেখা করতে পারিনি। আর তোকে ফোন দিলেও তো রিসিভ করিস না।”
“কেন করব, আমাকে একটু দেখতে আসার যার সময় হয় না, তার সাথে কোনো কথা নেই আমার।”
“এখনও রেগে আছিস? আচ্ছা মাফ চাইছি আবারও। এরপর থেকে যতই ব্যস্ততা থাকুক, ঠিক তোকে দেখতে আসব।”
“ইনশাআল্লাহ বলো।”
তুরাগ হেসে শুধরে নিল, “দেখতে আসব ইনশাআল্লাহ।”

তুরাগ সেদিন রাতে নওয়াজদের বাসাতেই থেকে গেল। চাঁদনীর মতো সিরিয়াস স্টুডেন্টও সেদিন পড়াশোনা শিকেয় তুলে গল্পে মেতে রইল ওদের সাথে। পরেরদিন সকালের নাস্তা করে বিদায় নিল ওরা। চাঁদনী মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে থাকল।

নওয়াজও দাঁড়িয়ে ছিল চাঁদনীর ঠিক পিছনেই। চাঁদনীকে বলে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পরে আবারও পিছনে ফিরে তাকাল তুরাগ। ঠিক সেই মুহূর্তেই নওয়াজ ব্যাপারটা বুঝতে পারল। চাঁদনীর দিকে তুরাগের তাকিয়ে থাকার সেই কয়েক সেকেন্ডেই সবটা স্বচ্ছ কাচের মতো হয়ে গেল ওর কাছে। ওই তাকানোর ভঙ্গি আর যাই হোক, ভাইসুলভ কোনোভাবেই হতে পারে না।

তুরাগ চলে যাওয়ার পর এই প্রথমবার নওয়াজ অনুভব করল, চাঁদনীর দিকে অন্য কোনো ছেলের অনুভূতি ওর ভালো লাগছে না। ইনসিকিউরড ফিল করল কিছুটা। কিন্তু তারপরেও নিজের ইগো থেকে বের হতে পারল না ও। একপ্রকার জোর করেও নিজেকে বোঝাল, চাঁদনী ওর সাথে যায় না। ওর দরকার এমন কাউকে যে হবে স্মার্ট এবং আধুনিক মানসিকতার।

২৪.
দেখতে দেখতে চাঁদনীর এক্সাম একেবারেই কাছাকাছি এসে গেল। কোচিং ও নেই এখন আর। বাসাতেই এখন তাই দিনরাত প্রিপারেশন নিচ্ছে এক্সামের জন্য। যেভাবে হোক, অ্যাডমিশন টেস্টে টিকে যেতেই হবে। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন হাতছানি দিয়ে ডাকছে ওকে। এমনকি আজকাল চোখ বন্ধ করলেও গলায় স্টেথোস্কোপ আর গায়ে অ্যাপ্রন জড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিজেকেই দেখতে পায় চাঁদনী।

কিন্তু এখন এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে একটা উটকো ঝামেলাও এসে জুটেছে। সেটা হলো আকরাম। ছেলেটা কীভাবে যে চাঁদনীর মোবাইল নাম্বার পেল সেটাই ওর বুঝে আসছে না। প্রত্যেকদিন চাঁদনীকে কল করে বিরক্ত করছে ছেলেটা। একটা নাম্বার ব্লাকলিস্টেড করলে আরেকটা দিয়ে কল করে। বাধ্য হয়ে চাঁদনী তাই আননোন কল রিসিভ করাই বন্ধ করে দিয়েছে৷ তবুও থেমে নেই আকরাম। ক্রমাগত টেক্সট করে যাচ্ছে। চাঁদনী অনেক ভেবেও কোনো কুলকিনারা পায়নি, আকরামকে আসলে নাম্বারটা দিল কে! নওয়াজ নয় তো? মনের মধ্যে প্রশ্নটা এলেও ও ঠিক মেনে নিতে পারল না যে নওয়াজ এই কাজটা করতে পারে।

আচ্ছা, পুরো ব্যাপারটা নওয়াজের সাথে আলাপ করলে কেমন হয়? এতদিনে যতটুকু চাঁদনী দেখেছে, তাতে নওয়াজকে দায়িত্বশীল ছেলে বলেই মনে হয়েছে। ওকে জানালে নিশ্চই কোনো স্টেপ নেবে। চাঁদনী অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল, নওয়াজকে ও জানাবে বিষয়টা৷ তাহলে যদি অন্তত ওই গায়ে পড়া ছ্যাচড়া লোকটা থেকে রেহাই পাওয়া যায়।

চাঁদনী বই বন্ধ করে নওয়াজের রুমের দিকে গেল। আজ বাসাতেই আছে নওয়াজ। আজই তাহলে কথা বলে নেওয়া যাক। যদিও এভাবে একটা ছেলের ঘরে একা কথা বলতে যাওয়টা চাঁদনীর নিজের কাছেই একটু অড লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। চাঁদনী চায় মরিয়ম খাতুনকে কিছু জানতে না দিয়েও সমস্যাটার সমাধান করতে। চাঁদনী নওয়াজের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দরজাটা ইঞ্চি তিনেক ফাঁকা হয়ে আছে তবুও ভদ্রতাবশত দরজায় নক করতে গেল চাঁদনী। কিন্তু দরজায় টোকা দিতে গিয়ে ঘরের মধ্যে কথোপকথন শুনে ওর হাত থেমে গেল।

না, আড়ি পেতে অন্যদের ব্যক্তিগত কথা শোনার বদ অভ্যাস চাঁদনীর কখনোই ছিল না। কিন্তু নওয়াজের গলায় নিজের নামটা শোনার পরে কোনো এক চৌম্বকীয় আকর্ষণে চাঁদনী চেয়েও নিজের পাদুটো ফ্লোর থেকে সরাতে পারল না। নওয়াজের উচ্চারণ করা প্রত্যেকটা শব্দই স্পষ্ট শুনতে পেয়েছে। এসময়টায় এই রুমের দিকে কারও আসার সম্ভাবনা নেই। সেজন্য নওয়াজ বোধহয় কথাগুলো একটু জোড়েই বলছে।

“দেখো আম্মু, আমি তোমার যেকোনো ডিসিশানের প্রতিই রেস্পেক্টফুল। তুমি চাঁদনীকে পছন্দ করেছ, ঠিক আছে। কিন্তু আমার দিকটাও তো তুমি একবার ভাববে। চাঁদনীর সাথে আমার মেন্টালিটির আকাশ পাতাল তফাত। এটা তো দুই একদিনের ব্যাপার না। ইটস দ্যা ম্যাটার অভ অ্যাওয়ার টোটাল লাইফ। এভাবে আমার লাইফটা স্পয়েল করে দিও না প্লিজ।”
“নওয়াজ! এসব তুই কী বলছিস? আমি তোর লাইফ স্পয়েল করছি?”

“ওহ! আম্মু। নাও ইয়্যু আর গেটিং মি রং। আই ডাজেন্ট মিন দ্যাট।”

“হয়েছে। আমি আর তোর থেকে কোনোরকম ব্যাখ্যা চাই না। আমার কথার মূল্য তোর কাছে ঠিক কতটুকু সেটা আমার খুব ভালো করেই বোঝা হয়ে গেছে।”
“আম্মু, তুমি মাথা ঠান্ডা করো। এখানে এসে বসো তো। লেট মি এক্সপ্লেইন ইউ।”

“কী এক্সপ্লেইন করবি তুই? চাঁদনীকে তোর কোন দিক থেকে খারাপ মনে হচ্ছে?”

“চাঁদনীকে আমার কোনো দিক থেকেই খারাপ মনে হচ্ছে না আম্মু। চাঁদনী চমৎকার একটা মেয়ে। কিন্তু ওর সাথে আমার ম্যাচ করে না আম্মু। তুমি ওর লাইফস্টাইল দেখো আর আমারটা দেখো, তাহলেই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে তোমার কাছে।..”

অনর্গল মাকে বুঝিয়ে যাচ্ছে নওয়াজ। ওর কথাগুলোর মর্মার্থ যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে, চাঁদনীকে বিয়ে করলে নওয়াজের জীবনটা শেষ হয়ে যাবে। নওয়াজের কথাগুলো শুনতে শুনতে চাঁদনীর চোখ থেকে অবাধ্য অশ্রুবিন্দুগুলো না চাইতেই টপটপ করে পড়ছিল। ঠিক ঐ মুহুর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে তুচ্ছ ফেলনা একটা বস্তু মনে হচ্ছিল। যাকে কিনা মরিয়ম খাতুন তার ছেলের কাছে গছিয়ে দিতে চাইছেন এবং ছেলে সেটা নিতে অসম্মতি জানাচ্ছে।

ওখানে দাঁড়িয়েই সবচেয়ে কঠিন সিদ্ধান্তটা নিল চাঁদনী। যদিও নওয়াজ চাঁদনীকে বিয়ে করতে চায় না। তবু যদি কখনও মায়ের চাপে রাজিও হয়, চাঁদনী বেঁচে থাকতে সেই সিদ্ধান্তে রাজি হবে না কখনও। এমনকি পৃথিবীতে বিয়ে করার জন্য সর্বশেষ ছেলেটিও যদি নওয়াজ হয়, তবুও না।

আকরামের ব্যাপারটা নওয়াজের সাথে আলাপ করার সিদ্ধান্ত নিলেও আপাতত সেটাও করল না চাঁদনী। আর তো মাত্র কিছুদিন। এরপরেই এক্সাম হয়ে যাবে। তারপর এই বাসা ছেড়ে চলে যাবে ও। আল্লাহ চাইলে যদি এখানে চান্সও হয়, তাহলেও এই বাসায় আর থাকবে না। প্রয়োজনে হোস্টেলে উঠবে।

দেখতে দেখতে এক্সামের দিনটিও চলে এলো। সব গোছগাছ করে রেডি হয়ে চাঁদনী দু’রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিল। তামজীদ বাসায় এলো ওকে নিয়ে যেতে। এক্সাম দিয়ে উৎফুল্ল মনেই বের হলো চাঁদনী। রুমে ফেরার পর সবাই একে একে জিজ্ঞাসা করল এক্সামের কথা। এমনকি নম্রতাও রুমে এসে জিজ্ঞাসা করে গেল, কেমন হয়েছে এক্সাম।

বিকেলে কল এলো তালুকদার মঞ্জিল থেকে। বাবা, ছোট আব্বু, ভাইজান, ভাবী সবার সাথে কথা হলো। শেষে দেওয়া হলো রেবেকা বেগমের কাছে। তিনি বললেন, “এবার তো পরীক্ষা শেষ। কাল তাহলে সাদমানকে পাঠাই। বাড়ি চলে আয়।”
“না, মা। কয়েকদিনের মধ্যেই রেজাল্ট দেবে। রেজাল্টটা নিয়ে একবারেই যাব। আমার কোচিং-এর ফ্রেন্ডরাও রেজাল্ট না পাওয়া অব্দি ঢাকা ছেড়ে যাবে না। তাছাড়া যতদিন পর্যন্ত ফলাফল না জানতে পারছি, ততদিন কিছুতেই শান্তি পাব না। তারচেয়ে বরং এখানেই থাকি আরও কয়েকটা দিন।”
“এত চিন্তার কিছু নেই। যা হবে ইনশাআল্লাহ ভালোই হবে। তাছাড়া তোর বাবা তো বলেছে, দরকার হলে তোকে প্রাইভেট কলেজে পড়াবে। তোর এত আগ্রহ, আল্লাহ তোর মনের আশা ঠিক পূরণ করবে।”
“দোয়া কোরো আমার জন্য।”
“পাগল মেয়ে। তোর জন্য আমরা সবসময় দোয়া করি।”
অনেকদিন পর বাড়িতে সবার সাথে কথা বলে চাঁদনীর খুব ভালো লাগল। আর কয়েকটা দিন মাত্র। তারপরে আবার সেই নিজের পরিচিত জায়গায় যাবে ও। এই জেলখানা থেকে মুক্তি মিলবে ওর।

২৫.
নওয়াজের ইচ্ছে ছিল গ্রাজুয়েশনের পর নিজে কিছু করার চেষ্টা করবে আগে। কিন্তু জামশেদ সাহেবের ইচ্ছায় তার বিজনেসেই মনোযোগ দিতে হচ্ছে এখন। অন্যান্য দিনের মতো আজ সন্ধ্যায়ও কিছু পেপারস নিয়ে বসেছিল ও। জামশেদ সাহেব কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছেন, তাই প্রেসারটা এখন আরও বেশি।

নওয়াজ পুরোপুরিই কাজে ডুবে গিয়েছিল, তক্ষুনি ঘরে ঢুকল মিশকাত, আবির আর আকরাম। নওয়াজ অবাক হলো খুব।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী [প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা]
| ১৫ | (১৮০০+ শব্দ)

নওয়াজ পুরোপুরিই কাজে ডুবে গিয়েছিল, তক্ষুনি ঘরে ঢুকল মিশকাত, আবির আর আকরাম। নওয়াজ অবাক হলো খুব।

“তোরা হঠাৎ? আসবি যে আগে তো জানালি না!”

মিশকাত হেসে বলল, “সারপ্রাইজ দিলাম। তুমি তো ইদানিং বিজনেসম্যান হয়ে গেছ। পাওয়াই যায় না তোমাকে। তাই আজ আমরাই চলে আসলাম। আজ সারারাত আড্ডা হবে।”

“মাথা খারাপ। তোদের আড্ডা মানে আমি ভালো করেই জানি। ড্রিংক করে মাতলামি করবি সারারাত। হাই ভলিউমে গানও বাজাবি। এসব এখানে চলবে না। তাছাড়া আম্মুও আজ বাসায় নেই।”
মিশকাত বলল, “তুই এভাবে বলতে পারলি? আচ্ছা গানের ভলিউম হাই করব না, প্রমিস। আন্টি নাই তাতে তো আরও ভালো হয়েছে। মুরুব্বি মানুষ বাসায় থাকলে আরও অস্বস্তি হতো। আর যা করার আমরা তো রুমের মধ্যেই করব। তুই রাজি হয়ে যা প্লিজ।”
“ওকে।” নওয়াজ উত্তর দিল।

ওরা সবাই হই হই করে উঠল। শুধু আকরাম মৃদু হেসে সোফার এককোনে বসল। অবশেষে ওর উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মিশকাত আর আবিরকে মূলত ওই নিয়ে এসেছে নওয়াজকে রাজি করানোর জন্য। অনেকদিন ধরে চেষ্টা করেও চাঁদনীর সাথে কোনোরকম যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। আজ তাই নিজেই প্লানটা করেছে ও। মিশকাত আর আবির অজান্তেই ওর ফাঁদে পা দিয়েছে। আকরাম বসে বসে ছক কষতে থাকল, কিভাবে চাঁদনীর সাথে দেখা করবে।

বাড়িতে মা নেই, তাই নওয়াজ রাতের খাবার খেতে ওদের নিয়ে নিচে গেল না আর। টুলুর মাকে বলে খাবার ঘরেই দিয়ে যেতে বলল।

চাঁদনী আর নম্রতা খাবার টেবিলে টুলুর মায়ের কাছেই জানতে পারল নওয়াজের বন্ধুদের আসার কথা। খাওয়া শেষে নম্রতা চাঁদনীকে বলল,
“আম্মু তো আজ বাসায় নেই। এখন রুমে গিয়ে ঢুকলে সকালের আগে আর দরজা খুলবে না। মনে থাকবে?”
নম্রতার বলার কারন বুঝতে পারল চাঁদনী। মাথা নেড়ে ও বলল, “আচ্ছা, আপু।”
নম্রতা কী একটা ভাবল কিছুক্ষন। তারপর বলল, “তারচেয়ে বরং আজ রাতে আমি তোমার সাথেই থাকব। আমার পড়তে হবে কিছুক্ষন। তারপর তোমার রুমে যাব আমি। এতে কি তোমার কোনো প্রব্লেম আছে?”
“না না। কী বলছেন আপনি। কোনো সমস্যা নেই।”
চাঁদনী নিশ্চিন্ত হলো কিছুটা।

মরিয়ম খাতুন আজ বাসায় নেই। সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়েছিলেন প্রতিবেশী একজন মহিলাকে দেখতে। হাসপাতালে যাওয়ার পর জানতে পারলেন, রোগীটির অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। রাতটুকুও হয়তো সার্ভাইব করবে না। সেজন্য আজ রাতটা হাসপাতালেই থেকে যাবেন। চাঁদনী রাতের খাবার খেয়ে রুমে গিয়ে আগে দরজা লক করল। তারপর একটা উপন্যাসের বই নিয়ে পড়তে শুরু করল। আর অপেক্ষা করতে লাগল নম্রতার আসার।

নওয়াজদের আড্ডাটা জমে উঠল রাত বারোটার পরে। অবশ্য নওয়াজের জন্য সেভাবে এনজয় করা যাচ্ছে না কিছুই। কারণ নওয়াজ বারবার করে বলে দিয়েছে, আওয়াজ যাতে কিছুতেই রুমের বাইরে না যায়।

দেড়টার দিকে আকরাম বলল, রুমের মধ্যে দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার। আমি একটু ছাদে যাচ্ছি। ওর মনের দুরভিসন্ধি কেউ আঁচও করতে পারল না। রুমের বাইরে বের হয়ে দরজা টেনে আটকে দিয়ে আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা করল না আকরাম। অপর প্রান্তের রুমের দিকে গেল সোজা। কাঙ্ক্ষিত দরজায় নক করতে গিয়ে ওর মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে উঠল। ড্রিংক এর মাত্রাটা একটু বেশিই হয়ে গেছে মনেহয়। আকরাম নিজেকে ধাতস্থ করে দরজায় নক করল। ভিতর থেকে প্রশ্ন এল, “কে?”
আকরাম জবাব না দিয়ে আবার নক করল। বেশ কয়েকবার নক করার পর খুলল দরজাটা। ওপাশে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে তাকিয়ে আকরাম হেসে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন আছ চাঁদনী?”

চাঁদনী পরপর কয়েকবার দরজায় করাঘাত শুনে ভেবেছিল নম্রতাই এসেছে বোধহয়। কিন্তু দরজা খোলার পরে বুঝল চূড়ান্ত বোকামিটা ও করে ফেলেছে। আকরামের প্রশ্নের জবাব না দিয়েই আবার দরজাটা আটকে দিতে গেল ও। কিন্তু আকরাম সেটা করার সুযোগ দিল না একদমই। গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে দরজা ঠেলে হুড়মুড় করে রুমের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর এক সেকেন্ডও সময় ব্যয় না করে চাঁদনীর দুহাত দুপাশ থেকে পিছনে নিয়ে শক্ত করে আটকে ধরল। নিজের এক পা দিয়ে পিছনে লাথি দিয়ে আটকে দিল দরজাটাও।

চাঁদনী কয়েক সেকেন্ডের জন্য রিয়্যাক্ট করতেও ভুলে গেল। ওর বিশ্বাসই হতে চাইল না সত্যিই এই ঘটনাটা ওর সাথে ঘটছে এখন।

চাঁদনী নিজের হাতদুটো ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে বলল, “আপনি এসব কী করছেন? প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে।”

চাঁদনীর কথা শুনে ওকে ছাড়ার বদলে আরেকটু শক্ত করে ধরল আকরাম। আলগা করে দেওয়া মাথার কাপরটা পড়ে গেছে কাঁধে। এত কাছাকাছি চাঁদনীকে পেয়ে নিজেকে সামলে রাখাও কঠিন হয়ে যাচ্ছে ওর জন্য। অবশ্য সামাল দেওয়ার চেষ্টাও ও করছিল না ও। আকরাম চাঁদনীকে ঠেলে দেওয়ালের সাথে নিয়ে মিশিয়ে দিল। নিজের এক হাত ছাড়িয়ে তরিৎ বেগে চাঁদনীর গলার দিকের ওড়না ধরে টান দিয়ে নিজের হাতে নিয়ে এলো। তারপর সেটা ছুঁড়ে মারল রুমের এককোনে। অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের আশঙ্কায় চাঁদনীর বুকটা ধ্বক করে উঠল। এবার বুঝি আর নিস্তার পাওয়া যাবে না।

নিজের চরম ক্ষতি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অনুমান করে চাঁদনী এবার ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। আকরাম ওর থুতনি ধরে হাসতে হাসতেই বলল,
“কাঁদছ কেন চাঁদনী? ভয় পাচ্ছ? এত নার্ভাস হওয়ার কিছু নেই। আমি তো শুধু কথা বলতে এসেছি তোমার সাথে। না মানে, কথা বলতে আসলেও এখন আমার অন্যকিছু করতে ইচ্ছে করছে। ড্রিংক করে কিছুটা মাতাল ছিলাম এতক্ষন, কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমি পুরোপুরি মাতাল হয়ে গেছি। সো চাঁদনী, এখন আর কেঁদ না প্লিজ। এস, আমরা আমাদের এই সময়টুকুকে ইঞ্জয় করি।”

চাঁদনী কান্না ভুলে বিস্ফোরিত চোখে তাকাল আকরামের দিকে। আজকের রাতের পর আত্মহত্যা করা ছাড়া আর কি কোনো পথ খোলা থাকবে ওর জন্য?

২৬.
নওয়াজের বিরক্ত লাগা স্বত্বেও কিছু করতে পারছে না ও। মিশকাত আর আবির দুজনেই ড্রিংক করে এখন পুরোপুরি কন্ট্রোললেস হয়ে আছে। এর আগেও রাত জেগে এরকম বহু আড্ডা ওরা দিয়েছে। তবে সেটা ফাহিমের ফাঁকা ফ্লাটে অথবা অন্য কোথাও। কিন্তু নওয়াজের বাসায় এই প্রথমবার এলো। নওয়াজই মূলত ওদের আনতে চাইত না ওদের বাসায়। স্পষ্টই সে সবাইকে জানিয়ে দিয়েছিল, ওরা এমনিতে আড্ডা দিতে যেকোনো সময় এই বাসায় আসতে পারে। কিন্তু মদ খেয় মাতলামো করতে কখনও নয়।

আজ যদিও ওরা একপ্রকার জোর করেই এসেছে। মিশকাত বলেছে, শুধু আজকের দিনই। এরপর আর কখনও এটা রিপিট হবে না। তাই বাধ্য হয়েই অনুমতি দিতে হয়েছে ওকে।

অন্যান্য দিনগুলোতে নওয়াজ নিজেও একটু আধটু লিমিটের মধ্যে থেকেই ড্রিংক করে। কিন্তু আজ নেশা হয়ে যাওয়ার ভয়ে আর সেসব কিছু করল না ও। মা, বাবা কেউই বাসায় নেই। চাঁদনী আর নম্রতা দুজনে একা আছে। যদি ওরা কেউ কন্ট্রোললেস হয়ে ওদের…। না, বন্ধুদের উপর ভরসা আছে নওয়াজের। ওরা বাইরে যাই করুক, নওয়াজের বাসাতে নিশ্চই উলটোপালটা কিছু করবে না। তবুও একটা খচখচানি থেকেই যায় মনের মধ্যে।

নওয়াজ মিশকাতকে বলল, “এবার তোদের থামা উচিৎ।”
মিশকাত সাথে সাথেই জবাব দিল,
“চুপ কর শালা। থামব মানে? এখন তো কেবল শুরু। দ্যা নাইট ইজ স্টিল ইয়াং। তুই কথা কম বলে নিচে যা। ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।”

“আমি এখন যেতে পারব না।”
আবির এবার বলল, “যা না ভাই, প্লিজ। এখনও ঠিকভাবে কিছু ফিল করতে পারছি না।”

নওয়াজ রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সিঁড়িতে দুই পা নেমে হঠাৎ থেমে গেল ও। কানে একটা সুক্ষ্ণ চিৎকারের শব্দ এসে লাগল। গলাটা চাঁদনীর নাকি! নিজের অজান্তেই নওয়াজ এগিয়ে গেল চাঁদনীর রুমের দিকে। এখন আর কোনো আওয়াজ আসছে না। দরজায় টোকা দিতে গিয়েও দিল না নওয়াজ। এটা মনের ভুলও হতে পারে। উল্টোদিকে ঘুড়ে ফিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল ও। এবার স্পষ্ট পুরুষালী গলার স্বর কানে এলো ওর।

নওয়াজের বুঝতে কয়েক সেকেন্ড লাগল যে এটা আকরামের গলা। সাথে সাথে পুরো ব্যাপারটাই ওর কাছে ক্লিয়ার হয়ে গেল। দরজা ভেজানো ছিল। নওয়াজ ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে যা দেখল তাতে ওর আপাদমস্তক রাগে দপদপ করে উঠল। এরকম রূপে চাঁদনীকে দেখতে হবে সেটা কখনও কল্পনাও করতে পারেনি নওয়াজ।

দেওয়ালের এককোনায় গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চাঁদনী। ভয়ে হাত পা কাঁপছে থরথর করে। ওরনাটা দলা করে বুকের কাছে এনে চেপে ধরা। এই প্রথম চাঁদনীর চুল দেখল নওয়াজ। কোমর অব্দি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে। তারসাথে আর যে দৃশ্যটি দেখল নওয়াজ সেটা দেকে ওর মস্তিষ্কে আগুন জ্বলে উঠল। চাঁদনীর ফুলহাতা কামিজের একটা পাশের হাতা পুরোপুরি ছেড়া। কাঁধ থেকে শুরু করে পুরো হাত উন্মুক্ত। জাফরান রঙের অন্তর্বাসের স্ট্রাপ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। ধবধবে সাদা বাহুতে টকটকে লাল হয়ে আছে সদ্য তৈরি হওয়া কামড়ের দাগটি।

দরজা খোলার শব্দে চাঁদনী আর আকরাম দুজনেই সেদিকে তাকাল। নওয়াজ এগিয়ে গিয়ে একটানে বিছানার চাদর তুলে ফেলল৷ তারপর সেটাই জড়িয়ে দিল চাঁদনীর গায়ে। চাঁদনী ওখানেই বসে পড়ল গায়ে চাদরটি পেঁচিয়ে। তখনও ও কাঁপছিল ও মৃগী রোগীর মতো।

অর্ধমাতাল আকরাম অনেকটা কৈফিয়ত দেওয়ার মতো বোঝানোর চেষ্টা করল নওয়াজকে, “আগেই রেগে যাস না। অ্যালাউ মি ট্যু এক্সপ্লেইন ইয়্যু দ্যা ম্যাটার। হয়েছে কি আসলে…।”

বাক্যটা শেষ করতে পারল না ও। তার আগেই নওয়াজ হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সর্বশক্তি দিয়ে আকরামের নাক বরাবর ঘুসিটা দিল। গলগল করে রক্ত বের হলো নাক দিয়ে। ঠিক কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দ্বিতীয় ঘুসিটা দিল তলপেটেরও অনেক নিচে। এবার আকরাম তলপেট চেপে ধরে ফ্লোরেই শুয়ে পড়ল। নওয়াজ টিশার্টের কলার ধরে উঠিয়ে দার করাল আকরামকে। পরের ঘুসিটা দিল গালে, আজ যেন ওর গায়ে অসুরের শক্তি ভর করেছে। আকরামের মাথাটা উল্টোদিকের দেয়ালে সজোরে ঠুকে গেল। আবার ধপ করে ও পড়ে গেল ফ্লোরে। নওয়াজ ওখানে দাঁড়িয়েই পকেট থেকে ফোন বের করে নম্রতার নাম্বারে কল দিয়ে চাঁদনীর রুমে আসতে বলল।

নম্রতা পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘুমঘুম চোখেই ও এসে দাঁড়াল চাঁদনীর রুমের সামনে। বিধ্বস্ত আকরামকে ফ্লোরে শুয়ে থাকতে এবং চাঁদনীকে এমন আলুথালু হয়ে বসে থাকতে দেখে ওর ঘুম পুরোপুরি উবে গেল। নওয়াজ কিছু না বললেও ও নিজ দায়িত্বেই পুরো বিষয়টা বুঝে নিল।

নওয়াজ বলল, “ওর সাথে একটু থাক তুই।”

পরক্ষনেই আবার আকরামের দিকে ফিরল ও। তলপেটে ক্রমাগত লাথি দিতে দিতে চেঁচিয়ে উঠল, “স্কাউন্ড্রেল। এতবড় সাহস হয় কী করে তোর!”

নওয়াজের গলার স্বর আবির এবং মিশকাতের কান অব্দিও পৌঁছে গেল। ওরা একছুটে চলে এলো চাঁদনীর রুমের সামনে। পরিস্থিতি দেখে, ঘরের মধ্যে কী হয়েছে সেটা বুঝতে মিশকাত আর আবিরেরও খুব একটা সময় লাগল না।

নম্রতার পাশে দাঁড়ানো অপরিচিতা বিধ্বস্ত মেয়েটিকে এই প্রথমবার দেখল ওরা। কিন্তু কারোরই বুঝতে অসুবিধা হলো না যে এটাই চাঁদনী। নওয়াজের অ্যাবসেন্সে আকরামের মুখে বর্ননা শুনে অপূর্ব সুন্দর একটি মুখ কল্পনা করে নিয়েছিল ওরা। কিন্ত আজকে চাঁদনীকে দেখে মনে হলো, আকরাম যা বলেছে তার চেয়েও হাজারগুন সুন্দর মেয়েটি।

নওয়াজ আকরামকে মেরেই চলেছে। মিশকাত আর আবির এক পলক তাকিয়েই চাঁদনীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল। তারপর গিয়ে নওয়াজকে জাপটে ধরে থামানোর চেষ্টা করল।

আবির বলল, “এবার থাম নওয়াজ। আর মারলে মরে যাবে। দেখছিস তো রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে। সেন্সলেস হয়ে যাচ্ছে মনেহয়। ও মাই গড, মাথা ফেটে গেছে মনে হচ্ছে।”
নওয়াজ থামল কিছুক্ষনের জন্য। বলল, “ওকে নিয়ে এখনই আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় হ। বাস্টার্ডটার এতবড় সাহস হয় কী করে?”

মিশকাত বলল, “আচ্ছা, ওকে নিয়ে বাইরে যাই আগে। মেয়েটা এমনিতেই ভয় পেয়ে আছে। এখানে আর কোনো সিনক্রিয়েট করিস না।”

“একেবারে বাডির বাইরে নিয়ে যা ওকে। নইলে আজ আমি ওকে মার্ডার করে ফেলব।” নওয়াজ চেঁচিয়ে বলল।

আবির আর মিশকাত জানে, এটা নিছকই কোনো হুমকি নয়। নওয়াজ রেগে গেলে নিজের উপর কোনো কন্ট্রোলই থাকে না ওর। সত্যিই হয়তো মেরেই ফেলবে আজ আকরামকে।

আকরামকে কোনোরকমে দুপাশ থেকে দুজনে ধরে দাঁড় করালো। মিশকাত বলল, “ওকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। মাথা থেকে এভাবে ব্লিডিং হতে থাকলে সিরিয়াস কিছু হয়ে যেতে পারে।”

ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পর নওয়াজ বলল, “নম্রতা, তুই ওর সাথেই থাক। একটু নরমাল করার চেষ্ট কর।”
নওয়াজ থেমে গেল এতটুকু বলেই। যদিও চাঁদনীকে দেখে বোঝা যাচ্ছে যে বড় কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই নওয়াজ এসে পড়েছিল। তবু নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রশ্নটা করল ও, “চাঁদনী। বলছিলাম যে তুমি কিছু মনে করো না, ওই স্কাউন্ড্রেলটা কি..।

প্রশ্নটা কীভাবে করবে সেটা বুঝে উঠতে পারছিল না ও। কিন্তু চাঁদনী বুঝে গেল। যান্ত্রিক স্বরে ও উত্তর দিল, “আমার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।”
“ওকে।”
ছোট্ট জবাব দিয়ে নওয়াজ বের হয়ে এলো ঘর থেকে। রুমে এসে অস্থিরভাবে পায়চারি করতে থাকল ও। আকরামের প্রতি প্রচন্ড রাগ হতো নওয়াজের ওর এই স্বভাবটার জন্য৷ কিন্তু আজ রাগের সাথে কোথাও একটা ব্যাথাও অনুভব হচ্ছে। চাঁদনীর জন্যই বোধহয় সেটা। ওই সময়টাতে মেয়েটার উপর থেকে ঠিক কী গেছে সেটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারছে ও।

পুরোটা সময় শুধু চাঁদনীকে নিয়েই ভেবে গেল ও। ভাবতে ভাবতে একসময় নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল, চাঁদনী কী বিশেষ কেউ হয়ে উঠছে ওর জন্য?

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-১১+১২

0

নিভৃত রজনী
| ১১ | (১৪০০+ শব্দ)

নম্রতা কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল খাটের এককোনে। কান পেতে ওপাশের কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টাও বোধহয় করছিল একটু-আধটু।

মরিয়ম খাতুন ফোন রাখতেই প্রশ্ন করল ও, “কার সাথে কথা বলছিলে আম্মু?”

“তানিমের সাথে। চিনেছিস তো? চাঁদনীর সাথে সেই প্রথম দিন যে এসেছিল।”

“চিনেছি।” নম্রতা ছোট্ট করে উত্তর দিল।

“ছেলেটা সেই একবার এলো শুধু বাসায়, তারপর আর কোনো খবর নেই। আজ হঠাৎ করে কথা হলো তো, তাই আসতে বললাম।”

“ও। তা কী বলল সে? আসবে?”

“বলল তো আসবে। দেখা যাক। কিন্তু তুই হঠাৎ এই সময়ে আমার রুমে?”

নম্রতার ঘোর কাটল মায়ের প্রশ্নে, “না মানে, মাথা ব্যাথা হচ্ছিল খুব। তোমার কাছে কি পেইন কিলার হবে?”

“আমার কাছে তো নেই, তবে নওয়াজের কাছে থাকতে পারে।”

নম্রতা কিছুক্ষন চুপ থেকে বলল, “খুব পেইন হচ্ছে আম্মু, ভাইয়ার কাছে একটু গিয়ে দেখবে, মেডিসিনটা পাও কিনা।”

“সারাক্ষন ফোন নিয়ে পড়ে থাকলে ব্যাথা তো হবেই। তুই এখানে বসে থাক। আমি নওয়াজের কাছে গিয়ে দেখছি।”

নম্রতা ভ্রু কুঁচকে তাকাল মায়ের দিকে। মাথাব্যাথার সাথে ফোনের কী সম্পর্ক সেটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করলেও চেপে গেল আপাতত। এখন ওর মাথায় অন্য একটা বিষয় ঘুরছে।

মরিয়ম খাতুন রুম থেকে বের হয়ে যেতেই নম্রতা চট করে মায়ের মোবাইলটা নিল। তানিমের সাথে কথা বলছিল মা। তার মানে কন্টাক্ট লিস্টের লাস্ট নাম্বারটাই ওই লোকটার। নম্রতা কললিস্ট চেক করল তড়িঘড়ি করে। কিন্তু শেষপর্যন্ত হতাশ হতে হলো ওকে। লাস্ট নাম্বারটা সেভ করা চাঁদনীর নামে। তারমানে কি চাঁদনীর মোবাইল থেকেই কথা বলছিল লোকটা৷ ইশ! নাম্বারটা পাওয়া গেল না। নম্রতা মুখ গোমড়া করে ফোনটা আবার রেখে দিল যথাস্থানে। ততক্ষনে মরিয়ম খাতুন ওষুধ নিয়ে চলে এসেছেন।

নম্রতা ট্যাবলেটের পাতাটা নিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। গ্লাসে পানি ঢেলে ওষুধের পাতা থেকে ওষুধ খুলতে গিয়ে খেয়াল করল, এখন একদমই আর মাথাব্যাথা নেই।

ওষুধ না খেয়েই বিছানায় এসে বসল ও। তানিমের ফোন নাম্বারটা না পাওয়ায় এখনও মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। আর কি কোনো উপায় আছে ওই বদ লোকটার কন্টাক্ট নাম্বার পাওয়ার? নম্রতা ভাবতে বসে গেল। ভাবতে ভাবতে একসময় হঠাৎ করেই খেয়াল এলো ওর। আশ্চর্য! ওই লোকটার কন্টাক্ট নাম্বার পাওয়ার জন্য এত চেষ্টা কেন করছে ও? কী হবে ওই অসভ্য লোকটার নাম্বার দিয়ে?

নম্রতার মেজাজের পারদ আস্তে আস্তে বেড়েই যাচ্ছিল। সব দোষ মিথিলার। সেদিন ও তানিমের ব্যাপারে কথাগুলো বলার পর থেকেই একেবারে মাথার মধ্যে গেঁড়ে বসেছে লোকটা। না, এরকম হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই। মনের মধ্যে কোনোরকম পজেটিভ জায়গা রাখা যাবে না লোকটার জন্য। শায়েস্তা করতে হবে লোকটাকে। লোকটা বাজেভাবে অপমান করেছে নম্রতাকে। তাকে সেই অপমানের আরও দশগুন ফিরিয়ে দিতে হবে। নম্রতা প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে। তবে সেই প্রতিজ্ঞাটা কতটা দৃঢ় হলো কে জানে?

চাঁদনী ফিরে এলো দুই দিনের মধ্যেই। যদিও রেবেকা বেগম বারবার করে বলেছিলেন আরও একটা দিন থেকে যেতে। কিন্তু কোচিং-এর ক্লাসগুলো মিস যাবে বলে চাঁদনী জোর করেই চলে এসেছে। চাঁদনীকে এবার নিয়ে এসেছে সাদমান।

নম্রতা সকালে নাস্তার টেবিলেই মায়ের কাছে শুনেছিল যে চাঁদনী আজ ফিরছে। চাঁদনী ফিরছে মানে তার সাথে তানিমের আসারও সম্ভাবনা আছে। নম্রতা সবরকম প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল তানিমের মুখোমুখি হওয়ার। সেই অপমানজনক চিঠিটার কী উত্তর দেবে সেটাও রিহার্সাল করেছে কয়েকশবার। যদিও আত্মবিশ্বাস কিছুটা কমই মনে হয়েছিল নিজের কাছে। তবুও অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে ছিল ও। কিন্তু নম্রতার সব প্লান ভেস্তে গেল, যখন দেখল চাঁদনীর সাথে তানিমের বদলে সাদমান এসেছে। অহেতুক নিজের রুমে গিয়ে জিনিসপত্রের উপরে রাগ ঝারল কিছুক্ষন। তারপর একসময় থেমে গেল।

২০.
চাঁদনী ফেরার পর থেকেই নওয়াজ সুযোগ খুঁজছিল ওর সাথে কথা বলার। কিন্তু সেই সুযোগটা হয়েও হচ্ছিল না। কিংবা চাঁদনী নিজেই সেই সুযোগটা দিতে চাইছিল না বোধহয়। শেষে নিরিবিলিতে কথা বলার জন্য নওয়াজ আগের পন্থাই বেছে নিল। কোচিং ক্লাস থেকে চাঁদনীকে আনার জন্য ড্রাইভারের বদলে ও নিজেই গেল।

চাঁদনী সবেমাত্র বের হয়ে গেটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, তখনই সামনে এসে থামল গাড়িটা। নওয়াজকে দেখে আজও কিছুটা চমকাল ও, তবে আজ আর কোনো প্রশ্ন করল না। এগিয়ে গিয়ে গাড়ির সামনে দাঁড়াল। নওয়াজ সরাসরিই কথা বলল, “তোমার সাথে কিছু কথা আছে। অপজিটেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে, তোমার যদি খুব বেশি তাড়া না থাকে তাহলে ওখানে গিয়ে আমরা কিছুক্ষন বসতে পারি।”

চাঁদনী উত্তর দিল কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই, “গাড়িতে যেতে যেতেও তো আমরা কথা বলতে পারি। আমার সাথে আপনার কী এমন কথা থাকতে পারে যার জন্য আলাদা করে বসতে হবে আমাদের!”

চাঁদনীর এরকম ঝটপট উত্তর আশা করেনি নওয়াজ। কিছুটা থমকাল ও। তারপর বলল, “ওকে। তোমার সমস্যা থাকলে দরকার নেই আলাদা করে কথা বলার। গাড়িতে উঠে বসো।”

নওয়াজের মুখ থমথমে। চাঁদনী সেদিকে একপলক তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। আবার নতুন করে কী বলতে চায় লোকটা। সেদিনের মতোই কি আবার কথার আঘাতে জর্জরিত করতে চাইছে ওকে। চাঁদনী ছোট্ট করে শ্বাস ছেড়ে বলল, “আচ্ছা, চলুন। আগে শুনে নেই আপনি কী বলতে চাইছেন।”

শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ছোট্ট রেস্টুরেন্টটিতে ঢুকতেই চাঁদনীর গায়ে এক পশলা শীতল হাওয়া এসে লাগল। নওয়াজ বেছে বেছে একেবারে কর্ণারের দিকের একটা টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। চাঁদনীও অনুসরণ করল ওকে। নওয়াজ টেবিলের কাছে গিয়ে বলল, “তুমি এদিকে মুখ করে বসো, ওদিকটায় লোকজন আছে ভালোই। তোমার আনইজি লাগতে পারে।”

চাঁদনী নওয়াজের কথামতই বসল। নওয়াজ মেন্যু কার্ড এগিয়ে দিয়ে বলল, “লাঞ্চ টাইম তো হয়ে এলো অলমোস্ট। কী খাবে বলো।”

“আমি এখন কিছুই খাব না। আপনি প্লিজ আপনার প্রয়োজনীয় কথাগুলো বলুন।”

“বলব তো। কিন্তু একেবারে না খেয়ে তো বসা যাবে না এখানে। হালকা কিছু হলেও নাও।”

“আমি আসলে এরকম পাবলিক প্লেসে খেতে অভ্যস্ত নই। ”

“আমি বুঝতে পারছি। সেজন্যই তো এদিকটায় বসলাম। এখন আর তাকালেও কেউ তোমার খাওয়া দেখতে পারবে না। তাই এখন মনেহয় আর হেজিটেড করার কোনো কারণ নেই।”

চাঁদনী বুঝল, এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কিছু না কিছু খেতেই হবে। অগত্যা বাধ্য হয়েই বলল “ঠিকাছে, আপনি আপনার পছন্দমতো অর্ডার করুন। তবে ভারী কিছু খাব না আমি এখন।”

“ওকে।” ছোট্ট করে জবাব দিয়ে নওয়াজ ওয়েটারকে ডাক দিয়ে অর্ডার দিল।

চাঁদনীর মনের মধ্যে উথালপাথাল চলছে। সেদিনের বলা প্রত্যেকটা শব্দ মনে গেথে আছে এখনও। চাঁদনী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, আজ আর সেদিনের মতো চুপ করে থাকবে না। নওয়াজই কথা বলা শুরু করল।

“আমি আসলে সেদিনের জন্য তোমার কাছে অ্যাপোলজি চাইতেই এখানে ডেকেছি।”

চাঁদনী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “আশ্চর্য! হঠাৎ আপনি আমার কাছে ক্ষমা কেন চাইবেন?”

“সেদিন ওভাবে কথা বলা আমার একদমই ঠিক হয়নি। তোমাকে নিজের অজান্তেই হার্ট করে ফেলেছি সম্ভবত। আমি আসলে কথাগুলো সেদিন ওভাবে বলতে চাইনি।”

“ঠিকাছে, আপনার যেভাবে বলতে ইচ্ছে হয়েছে সেভাবেই আপনি বলেছেন। সেজন্য তো আমি আপনাকে কিছু বলিনি। তাই আমাকে এভাবে কৈফিয়ত দিতে হবে না।”

“তবুও। সেদিন তোমাকে ওভাবে বলাটা আমার উচিৎ হয়নি। ভালোলাগাটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। সেটা নিয়ে প্রশ্ন করে শুধু শুধু তোমাকে বিব্রত করলাম।”

“আমি বুঝতে পারছি না, আপনি বারবার ভালোলাগার ব্যাপারটাকে কেন হাইলাইট করছেন? আমি কি আপনাকে একবারও বলেছি যে আমার আপনাকে ভালোলাগে?”

হঠাৎ চাঁদনীর এমন রিয়্যাক্ট করায় নওয়াজ আবারও থমকাল কিছুটা।

“না, বলনি। কিন্তু সেই প্রথমদিন…।”

নওয়াজের মুখের কথা কেড়ে নিল চাঁদনী।

“সেই প্রথমদিন কী? আমি আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম কিছুক্ষন, তাই আপনি ধরে নিলেন যে আমি আপনাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছি? দেখুন, প্রথম দেখায় হঠাৎ করেই একটা সুন্দর মুখের প্রতি অ্যাট্রাক্টেড হওয়া খুব কমন একটা বিষয়। এরকম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুবার হয়। যেমন ধরুন, একটা সিনেমা কিংবা নাটক দেখতে গিয়ে হঠাৎ করে নায়ককে ভালো লেগে যেতেই পারে। তারমানে তো এটা নয় যে সেই নায়ককে আমি বিয়ে করতে চাই। অথচ আপনি সেদিন ব্যাপারটাকে বিয়ে অব্দি টেনে নিয়ে গিয়েছেন। এই নরমাল ইস্যুটাকে নিয়ে এরটা সিরিয়াস হওয়ার কোনো কারণই দেখছি না আমি। আপনার প্রতি প্রথম দেখায় আমার মনে যেটা তৈরি হয়েছিল সেটা জাস্ট একটা ইনফ্যাচুয়েশন ছিল, যেটা সময়ের সাথে সাথে কেটে গেছে অনেক আগেই। এখনও কেন আপনি এই বিষয়টা নিয়ে পড়ে আছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।”

নওয়াজ চুপচাপ শুনছিল চাঁদনীর কথা। চাঁদনী থেমে যাওয়ার পরে ও বলা শুরু করল, “তুমি আমাকে ভুল বুঝছ। আমি মোটেও নেগেটিভভাবে কথাগুলো তোমাকে বলতে চাইনি। আমি চাইছিলাম তুমি যাতে পুরো ব্যাপারটা ইজিলি নাও। আমার সাথে কথা বলতে গেলে তুমি সবসময় নিজেকে কেমন একটা গুটিয়ে রাখো, তাই আমি চেয়েছিলাম ফ্রী ভাবে…”

আবারও মাঝপথে নওয়াজকে থামিয়ে দিল চাঁদনী।

“আপনি আবারও ভুল করছেন। আপনার সাথে ফ্রী ভাবে কথা না বলতে পারার সাথে আপনাকে পছন্দ বা অপছন্দ করার কোনো সম্পর্ক নেই। শুধু আমার ভাইয়েরা ছাড়া বাইরের আর কোনো ছেলের সাথেই কথা বলতে আমি কম্ফোর্টেবল ফিল করি না। আমি ছোট থেকে এভাবেই বড় হয়েছি। এমনকি স্কুল কলেজেও খুব একটা প্রয়োজন ব্যাতীত আমি কোনো ছেলের সাথে কথা পর্যন্ত বলিনি কখনও। আপনাকে আজ একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে দেই। আমার দিক থেকে আপনার প্রতি কোনোরকম অনুভূতিই নেই। তাই প্লিজ এই টপিকটা আজ এখানেই শেষ করলে ভালো হয়।”

“ওকে। সব তো তাহলে ক্লিয়ার করলেই তুমি। তবু আমার কোনো কথায় যদি তুমি হার্ট হয়ে থাক, তাহলে আমি সত্যিই স্যরি।”

চাঁদনী নওয়াজের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল, “এবার আমাদের বাড়ি যাওয়া উচিৎ। দুপুর হয়ে এসেছে প্রায়। যোহরের ওয়াক্ত শুরু হয়ে গেছে। আপনি যে খাবারটা অর্ডার করেছেন, সেটা বরং ওদের বলে পার্সেল নিয়ে নিন।”

গাড়িতে উঠে আর তেমন কোনো কথাই হলো না ওদের মধ্যে।

আজকে চাঁদনীর সহজ স্বীকারোক্তিতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে নওয়াজের প্রতি ওর স্পেশাল কোনো ফিলিংস নেই। এতে নওয়াজের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি চিনচিনে একটা মনখারাপের রেশ রয়ে গেল ওর মধ্যে। বারবার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেও এর যথাযথ কারণ খুঁজে পেল না নওয়াজ।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
|১২| (১৫০০+ শব্দ)

আজকে চাঁদনীর সহজ স্বীকারোক্তিতে স্পষ্টই বোঝা গেল যে নওয়াজের প্রতি ওর স্পেশাল কোনো ফিলিংস নেই। এতে নওয়াজের খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু কেন জানি চিনচিনে একটা মনখারাপের রেশ রয়ে গেল ওর মধ্যে। বারবার নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেও এর যথাযথ কারণ খুঁজে পেল না নওয়াজ।

২১.
রাতের ঘুমটা চমৎকার হয়েছে নম্রতার। মধ্যরাত থেকেই অবিরাম বৃষ্টি হওয়ায় গাঢ় একটা ঘুম হয়েছে। আজ ভার্সিটি যাওয়ারও তাড়া নেই। তাই বেশ বেলা করেই ঘুম থেকে উঠল ও। এখনও বৃষ্টি হচ্ছে।

নম্রতা ফ্রেশ হয়ে একমগ কফি নিয়ে ব্যালকনিতে বসল বৃষ্টি দেখার জন্য। কফিমগে কয়েকটা চুমুক দেওয়ার পরেই চোখ গেল রাস্তার দিকে। সাদা রঙের গাড়িটি এসে থামল ওদের বাসার ঠিক গেটের সামনে। গাড়ি থেকে যে অবয়বটি নামল তাকে দেখেই চমকে গেল নম্রতা। প্রথমবার সেই যে দেখা হলো, তারপর কতগুলো দিন গেল? প্রায় তিনমাস তো হবেই। হ্যাঁ, প্রায় তিনমাস পরে দ্বিতীয়বার দেখল এই লোকটাকে।

নম্রতা পাশের টি টেবিলের উপর কফিমগটা রেখে চট করে উঠে দাড়াল। পাঞ্চক্লিপ দিয়ে চুল আটকে দৌড়ে এলো রুমের মধ্যে। বিছানা থেকে ওড়নাটা কোনোরকমে গায়ে টেনে নিয়ে দৌড় লাগাল নিচতলার দিকে। পুরোনো অপমানগুলো আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে ওর। নিচে নেমে জলদি গিয়ে মেইন দরজাটা খুলল ও। এতগুলো দিন যেই সময়টার জন্য ও অপেক্ষা করে ছিল ফাইনালি সেই সময়টা এসেই গেল।

বন্ধ দরজা খুলে দেওয়ার সাথে সাথেই মুখোমুখি হলো দুজন। নম্রতা কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল, কিন্তু ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া চেকশার্টে উপর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠা ওই পেটানো শরীর আর গভীর কালো দুটি চোখের দিকে তাকিয়ে সহসাই থেমে যেতে হলো ওকে। এতগুলো দিন যাবত যেই কথাগুলো বলার জন্য জমিয়ে রেখেছিল তার একটা বাক্যও মনে পড়ল না ওর হঠাৎ করে। অনেকক্ষন যাবত আমতা আমতা করে একটা স্পষ্ট শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণ করতে পারল না নম্রতা। মস্তিষ্কটাও একেবারে ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। সবকিছু কেমন একটা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে যেন। সব ভুলে গিয়ে ফ্যালফ্যাল করে ওই কঠিন মুখটার দিকে তাকিয়ে থাকল নম্রতা।

সারারাত ড্রাইভ করে তানিমের প্রচন্ড রকমের ক্লান্ত লাগছিল। তারউপর আবার গেট থেকে বাড়ির মেইন দরজা পর্যন্ত আসতে আসতে পুরোপুরিই ভিজে গেছে বৃষ্টিতে। তাড়াহুড়ো করেই তাই কলিং বেল চাপতে যাচ্ছিল ও। কিন্তু তার আগেই হুট করে খুলে গেল দরজাটা। দরজার ওপাশে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে একদমই আশা করেনি তানিম।

সারাপথ মনে মনে ও প্রার্থনা করেছে যেন ওই বদমেজাজী মেয়েটার মুখোমুখি ওকে না হতে হয়। অথচ সবার আগে কিনা ওই মেয়েটার সাথেই ওর দেখা হয়ে গেল। তানিম একপলক নম্রতার দিকে তাকিয়েই আবার নিচের দিকে তাকাল। অদ্ভুত তো, মেয়েটা সরছে না কেন। আর এরকমভাবে তাকিয়েই বা আছে কেন? নিশ্চয় আবার কোনো ঝগড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তানিম নিচের দিকে তাকিয়েই নম্রতার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল। কিন্তু অনেকক্ষন কেটে যাওয়ার পরেও কোনো রেসপন্স না পেয়ে প্রশ্ন করল, “কিছু বলবেন?”
নম্রতা কোনো জবাব না দিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে তাকিয়েই থাকল। তানিম আগের চেয়েও কিছুটা উচ্চস্বরে প্রশ্ন করল, “এক্সকিউজ মি, কিছু কি বলবেন আপনি?”
নম্রতা ঘোরের মধ্যেই অস্ফুট শব্দ করল, “হ্যাঁ?”
তানিম ছোট্ট করে শ্বাস ফেলে তৃতীয়বারের মতো একই প্রশ্ন করল, “কিছু বলবেন আপনি?”
নম্রতার হুশে এলো এবার,”হ্যাঁ, বলব।”
“বলুন তাহলে।”
“হ্যাঁ মানে না, কিছু বলব না।”

তানিম কিছুটা বিরক্তবোধ করল এবার।
“কিছু না বললে পথটা ছাডুন। আমি ভেতরে যাব।”
নম্রতা চট করেই সরে গেল। তানিম ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে এসে ঢুকল।

মরিয়ম খাতুন লিভিং রুমে ঢুকে তানিমকে দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।
“অবশেষে তুমি এলে। কেমন আছো বাবা। তোমার বাসার সবাই কেমন আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে। আপনি কেমন আছেন আন্টি?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি। তুমি তো দেখি একদম ভিজে গিয়েছ। গেস্ট রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও জলদি, ঠান্ডা লেগে যাবে নইলে। আমি তোমার জন্য শুকনো জামাকাপরের ব্যবস্থা করছি।”

“আপনি ব্যস্ত হবেন না প্লিজ। আমার সাথেই শুকনো কাপর আছে। আপনার জন্য বাড়ি থেকে সামান্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে। সেগুলো একটু গাড়ি থেকে আনার ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।”
“আমি এক্ষুনি লোক পাঠাচ্ছি। কিন্তু এসবের কী দরকার ছিল আবার। প্রত্যেকবারই তোমরা কিছু না কিছু নিয়ে আসো।”

“তেমন কিছুই না আন্টি। বাড়ি থেকে সামান্য কিছু জিনিস পাঠিয়েছে আপনার জন্য। আর আমার বাগানের কিছু ফ্রেশ আম। আপনারা খেলে আমার ভালো লাগবে।”
“আচ্ছা, আমরা সবাই খাব। তুমি এখন গিয়ে চেঞ্জ করে নাও আগে৷ এভাবে ভেজা থাকলে ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। চাঁদনীও কোচিং থেকে চলে আসবে একটু পরেই। তোমাকে দেখলে খুব খুশি হবে।”
মরিয়ম খাতুনের কথার প্রত্যুত্তরে তানিম হালকা হাসল।

নম্রতা এতক্ষন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তানিমের সাথে মায়ের কথোপকথন শুনছিল। আর চোরাচোখে বারবার ওকে দেখছিল। তানিমের হাসিটা যেন একেবারে ওর হৃদয়ের গভীরে গিয়ে স্পর্শ করল। নম্রতা আর দোতলায় নিজের রুমে গেল না। এই সেই বাহানায় নিচেই থেকে গেল। তানিম ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতেই চাঁদনী বাসায় ফিরে এলো। আজও নওয়াজ ওকে আনতে গিয়েছিল। বাসায় ঢুকে তানিমকে লিভিং রুমের সোফায় বসে থাকতে দেখে কিছুক্ষন হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকল৷ তারপর “ভাইয়া!” বলে জোরে চিৎকার করে উঠল।

চাঁদনীর চিৎকার শুনে নম্রতা আর নওয়াজ অবক হয়ে তাকাল চাঁদনীর দিকে। সবসময় নিচুস্বরে কথা বলা মেয়েটা যে এত জোরে চিৎকার করতে পারে সেটা ওরা কল্পনাও করতে পারেনি। চাঁদনী অবশ্য কারও তোয়াক্কাও করল না। এগিয়ে গিয়ে তানিমের পাশে বসে বলল, “ভাইয়া, তুমি! কখন এলে? আসবে সেটা আমাকে আগে কেন বললে না?”
“সারপ্রাইজ দিলাম। আগেই বলে দিলে তো তোর এই হাসিমুখটা দেখতে পারতাম না।”

চাঁদনীকে এতটুকু বলে তানিম নিজেই আগে সালাম দিল নওয়াজকে। নওয়াজ সালামের জবাব দিয়ে টুকটাক সৌজন্যমূলক কথাবার্তা বলতে বলতে সোফার এককোনে এসে বসল।

চাঁদনী উচ্ছ্বসিত হয়ে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে তানিমকে। তানিমও সেসবের জবাব দিয়ে যাচ্ছে একের পর এক।
নওয়াজ চাঁদনীর এই নতুন রূপের সাথে একেবারেই অপরিচিত ছিল। ও শুধুই অবাক হয়ে দেখে যাচ্ছিল চাঁদনীকে।

তালুকদার বাড়ির সবগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে তানিমই সবচেয়ে তীক্ষ্ণবুদ্ধিসম্পন্ন। চারপাশের খুঁটিনাটি ব্যাপারগুলোও খুব সহজে ওর চোখ এড়িয়ে যেতে পারে না। চাঁদনীর প্রতি নওয়াজের বিশেষ দৃষ্টিও ঠিক ওর চোখে পড়ে গেল। সেই দৃষ্টিতে মুগ্ধটা স্পষ্ট। নওয়াজ নিজে ওর অনুভূতি সম্পর্কে বেখবর থাকলেও তানিমের চোখে সবটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেল। আরও একটা ব্যাপার ও এড়িয়ে যেতে পারল না। এই বাসার ম্যানারলেস মেয়েটা আজ একটু পরপরই ওর দিকে তাকাচ্ছে। যেটা ওর অস্বস্তি বাড়িয়ে দিচ্ছে আরও।

মরিয়ম খাতুন কিছুক্ষন পরেই এলেন নাস্তা নিয়ে। নম্রতা লিভিংয়ের সাথের লাগোয়া ব্যালকনিতে বসে ছিল। তানিমকে নাস্তা দিয়ে একটা পাকা আম আর নাইফ নিয়ে নম্রতার দিকে এগিয়ে দিল। নম্রতা বলল, “আম এনেছ কেন?”
“খাওয়ার জন্য এনেছি। বেশ মিষ্টি, খেয়ে নে একটা।”
“আমি খাব না।”
“সেকি। তুই তো পাকা আমের পোকা। আম দেখলেই হামলে পড়িস। এখন খাবি না কেন?”
“ইচ্ছে নেই তাই খাব না। এই আম আর কখনও আমার সামনে আনবে না।” শেষের কথাটুকু একটু চেঁচিয়েই বলল ও।
মরিয়ম খাতুন বিরক্ত স্বরে বললেন, “খাবি না বুঝলাম, কিন্তু সেটা এত চেঁচিয়ে বলার কি আছে?”

ব্যলকনির পুরো কথোপকথনই তানিমের কানে এসেছে স্পষ্টভাবে। ওর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আবার। মেয়েটির তার সবচেয়ে পছন্দের ফলটি না খাওয়ার কারণ আর কেউ না বুঝলেও তানিম খুব ভালোভাবেই বুঝেছে।

২২.
গাড়ি থামিয়ে লুকিং গ্লাসে শেষবারের মতো তাকিয়ে চুলটা হাতের আঙুল দিয়ে ঠিক করে নিল আকরাম। পাশের সিটে রাখা পারফিউমটা আরেকবার স্প্রে করে নিল গায়ে। তারপর নামল গাড়ি থেকে।

আজ অনেকটা সময় হাতে নিয়েই ও এসেছে নওয়াজদের বাসায়। সেদিন চাঁদনী নামের মেয়েটাকে দেখার পর থেকেই ওর রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সেই প্রথমদিনের পর থেকে অনেকবারই চেষ্টা করেছে চাঁদনীর সাথে একটু কথা বলার। কিন্তু সেই চান্সটাই পায়নি একবারও।

মেয়েটা বাসা থেকে কোচিং ছাড়া আর তেমন কোথাও যায় না। সেই কোচিং-এ যাওয়া আসার সময়েও ওকে ফ্রী পাওয়া যায় না। নওয়াজদের বাড়ির ড্রাইভার কিংবা নওয়াজ সাথেই থাকে। আকরাম বেশ কয়েকদিন চাঁদনীর কোচিং-এর বাইরে দাঁড়িয়ে থেকেছে ওর সাথে একটু কথা বলার জন্য। একদিন একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়েও গিয়েছিল প্রায় কাছাকাছি। এরমধ্যেই হুট করে একটা ছেলে আসলো চাঁদনীর কাছে। কিছুটা আড়ালে দাঁড়িয়ে ওদের কথোপকথন শুনে বুঝেছে যে ওটা চাঁদনীর ভাই ছিল।

আকরামের দৃঢ় বিশ্বাস, ও ঠিক চাঁদনীকে নিজের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়াতে পারবে। কিন্তু তারজন্য মেয়েটার সাথে আগে কথা বলতে হবে। জোর জবরদস্তি আকরামের কখনোই পছন্দ ছিল না। চাঁদনীর ব্যাপারটা তাই খুব সফটলি হ্যান্ডেল করতে হবে৷ সেজন্যই আজ এই বাড়িতে আসা।

আকরাম বাসার সামনে এসে কলিংবেল চাপল। দরজা খুলে দিল টুলুর মা। আজকে আকরাম সমস্ত প্লান করেই এসেছে। তাই আজ আর এসেই নওয়াজের খোঁজ করল না ও। তার বদলে লিভিংয়ের সাথে ব্যালকনিতে বসা মরিয়ম খাতুনের দিকে এগিয়ে গেল।
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। কেমন আছেন?”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। নওয়াজের কাছে এসেছ তো? যাও, ও উপরেই আছে।”
“না, আজ নওয়াজের কাছে আসিনি। আজ আপনার কাছে এসেছি।”
“আমার কাছে?” কিছুটা অবাক হলেন মরিয়ম খাতুন।
“হ্যাঁ। আজ আপনার হাতের রান্না খেতে এসেছি। আব্বু আর আম্মু কয়েকদিন আগে দেশের বাইরে গেছে। বাসার কাজের লোকের রান্না আর খেতে পারছি না। তাই চলে এলাম। আপনার হাতের মজার মজার রান্না খেতে। দুপুরে এখানেই খাব আজ।”

“খুব ভালো করেছ। শুধু দুপুরে কেন? রাতেও থেকে যেও আজ।”
“তাহলে তো আরও ভালো। থ্যাংকস আন্টি।”
মরিয়ম খাতুন হেসে বললেন, “এখন তাহলে উপরে যাও। নওয়াজ ওর রুমেই আছে।”
“ওকে আন্টি।” কথা শেষ করে আকরাম চলে গেল।

দীর্ঘ সময় নওয়াজের সাথে আড্ডা দিয়ে নিচে নামল দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। খাওয়ার চেয়ে অবশ্য চাঁদনীকে দেখা এবং একটু কথা বলার আগ্রহটাই বেশি ছিল। কিন্তু নিচে নেমে খাবার রুমের কোথাও চাঁদনীকে পেল না ও। তাহলে কি মেয়েটা এদের সাথে একত্রে বসে খায় না? আকরামের রাগ লাগল খুব। এত চেষ্টা করেও কি শেষপর্যন্ত দেখা হবে না চাঁদনীর সাথে? খাবার খেতে খেতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল ও। হঠাৎ সংবিৎ ফিরল নওয়াজের মুখে বিশেষ একটি নাম শুনে।
“চাঁদনী কোথায় মা? আজ খেতে এলো না কেন?”

মরিয়ম খাতুন উত্তর দিলেন, “চাঁদনীর শরীরটা একটু খারাপ করেছে আজ। নিচে নামতে পারবে না। একটু আগে ওর খাবার উপরে পাঠিয়ে দিয়েছি তাই।”

আকরামের খুব জেদি প্রকৃতির ছেলে। সবসময় যেটা চায় সেটা আদায় করেই ছাড়ে। বিশেষ করে মেয়েঘটিত ব্যাপারে ও ঝানু। মেয়েদের নিজের কন্ট্রোলে আনার জন্য সবসময় নিখুঁত প্লান করে আকরাম এবং প্রত্যেকবারই সেই প্লানে সাকসেসফুলও হয়। কিন্তু এই প্রথমবার ওর কোনো প্লানই কাজে আসছে না।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-৯+১০

0

নিভৃত রজনী
| ৯ | (১২০০+ শব্দ)

চাঁদনী হাফ ছেড়ে বাঁচল নম্রতা চলে আসায়। নম্রতার কথায় নিশ্চিত হলো, এটা নওয়াজেরই বন্ধু।

চাঁদনী কিছু বলার আগে আকরামই কথা বলল “আসলে অনেকক্ষন পড়তে পড়তে বোর হচ্ছিলাম। তাই ছাদের ফ্রেশ এয়ারে সময় কাটানোর জন্য এসেছিলাম। এখানে এসে ওনার সাথে দেখা হলো। কে ইনি? আগে তো কখনও তোমাদের বাসায় দেখিনি।”

“আম্মুর রিলেটিভ।”

“ও। বেড়াতে এসেছে।”

“মেডিক্যাল অ্যাডমিশন দেবে এবার। তাই গ্রাম থেকে ঢাকা এসেছে।”

“ও, তারমানে তো তোমারও জুনিয়র। তাহলে তুমি করেই বলা যায়। সো, হোয়াট ইজ ইওর নেম?”

“চাঁদনী।” প্রচন্ড অনিচ্ছাসত্বেও জবাব দিল চাঁদনী।

“ওয়াও, নাইস নেম। তুমি দেখতেও তোমার নামের মতই সুন্দর। এনিওয়ে, পড়াশোনা কেমন…”।

আকরামকে কথা বলার মাঝপথেই থামিয়ে দিল নম্রতা, “একচ্যুয়ালি আম্মু ওকে ডাকছে এখনই। প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড। আপনি রিল্যাক্স করুন এখানে কিছুক্ষন। আমরা আসছি। কই চাঁদনী, জলদি এসো।”

“ওহ, সিওর।” আকরাম কিছুটা পাশে সরে চাঁদনীকে যাওয়ার জন্য জায়গা দিল। চাঁদনী আর এক সেকেন্ডও দাঁড়াল না। ঝড়ের বেগে নম্রতার সাথে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। ওরা চলে যাওয়ার পর আকরাম চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস টেনে নিল নিজের ভেতরে। বাতাসে এখনও চমৎকার মেয়েলি একটা সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। আজ আর অন্য কোনো মেয়ের সাথে ফোনালাপে মত্ত হতে পারল না ও। ছাদ থেকে আবার সোজা নওয়াজের রুমে চলে এলো। মিশকাত ওকে দেখে হেসে বলল, “এরমধ্যেই চলে এলি! খাওয়া দাওয়া শেষ এত জলদি?”

ফাহিম উচ্চশব্দে হেসে উঠল মিশকাতের কথা শুনে। আকরাম ও সমান হেসে উত্তর দিল, “আজ থেকে অন্য সব চ্যাপ্টার ক্লোজ। নতুন মিশন শুরু করলাম আজ থেকে। মিশন চাঁদনী।”

এতক্ষন ওদের কথায় সেভাবে মনযোগ না দিলেও চাঁদনীর নামটা শুনে চমকে গেল নওয়াজ।

মিশকাত জিজ্ঞাসা করল, “সেটা আবার কে?”

“কিছুক্ষন আগে ছাদে গিয়ে দেখা হলো। নওয়াজদের কোনো আত্মীয় হবে মনেহয়। একেবারে ন্যাচারাল বিউটি বুঝেছিস। কোনো আর্টিফিশিয়াল কারুকার্য নেই চেহারায়। এটাকে আমার লাগবেই লাগবে।”

“আর একবার মেয়েটাকে বাজে নজরে দেখলে তোর চোখদুটো আমি উপড়ে ফেলব।”

শান্ত অথচ কঠিন গলায় থ্রেট দিল নওয়াজ। এবং এটা যে শুধু কথার কথা না সেটাও বোঝা গেল ওর বলার ধরন দেখে। সবাই কিছুটা থমকে গেল।

আকরামেরও ভ্রু কুঁচকে এলো কিছুটা। স্বল্পপরিচিত দুঃসম্পর্কের আত্মীয়াকে নিয়ে এত পজেসিভ কেন নওয়াজ? এরকম একটা থ্রেট অনেকদিন আগেও একবার ওকে দিয়েছিল নওয়াজ। প্রথমদিকে যখন আকরাম এই বাড়িতে আসত, তখনকার কথা এসব। এবাড়িতে প্রথমবার যখন এসেছিল তখন নম্রতাকেও ভালো লেগে গিয়েছিল ওর। নওয়াজ ব্যপারটা বুঝতে পেরে ঠিক আজকের মতো করেই শাসিয়েছিল আকরামকে। সত্যি বলতে নওয়াজকে ওরা চারজনই কিছুটা ভয় পেয়ে চলে। রেগে গেলে ওর মাথা ঠিক থাকে না।

ফাহিম পরিবেশ হালকা করার জন্য বলল, “কুল ব্রো। জানিস তো আকরাম এমনই৷ তুই এত রিয়াক্ট করিস না৷ কোথাকার কোন মেয়ে, তার জন্য নিজেদের মধ্যে প্রব্লেম ক্রিয়েট করিস না।”

আবির কৌতূহল থেকেই জিজ্ঞাসা করল নওয়াজকে, “তুই এত হাইপার হয়ে গেলি কেন মেয়েটার কথা শুনে। আকরামের চোখে যেহেতু পড়েছে, তাহলে বলা যায় মেয়ে সত্যিই সুন্দর। অনেকদিন যাবত আছে তোদের বাসায়, তাহলে কি তুইও…?”

মাঝপথে কথা থামিয়ে দিলেও ইঙ্গিতটা ধরতে অসুবিধা হলো না কারও।

“মেয়েটা সুন্দর কিংবা অসুন্দর, এই সবকিছুর উর্ধ্বে হলো, মেয়েটা আমাদের বাড়ির গেস্ট এখন৷ ওর সাথে আন-এক্সপেক্টেড কিছু ঘটে গেলে তার জবাবদিহিতাও আমাদেরই করতে হবে৷ বিশেষ করে আমার মায়ের উপর আঙুল তুলবে ওর পরিবার। তাছাড়া চাঁদনী একেবারেই অন্যরকম। এখনকার আধুনিক মেয়েদের মতো নয় একদমই।”

কথাগুলো বলতে বলতে নওয়াজের স্বর কিছুটা কোমল হয়ে এলো। চাঁদনীর মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। শেষে আবার কঠোর হয়ে আসলো ওর কন্ঠস্বর, “তাই ওয়ার্নিং দিচ্ছি। এরপর থেকে চাঁদনীর দিকে আর চোখ তুলেও তাকাবি না।”

টুলুর মা সবার জন্য নাস্তা নিয়ে আসায় আপাতত আলাপ থেমে গেল৷ কিন্তু আকরামের মনের মধ্যে গেঁথে রইল চাঁদনী৷ নওয়াজের বোন বলেই নম্রতাকে ছেড়ে দিয়েছিল ও, কিন্তু চাঁদনীকে ছাড়া অসম্ভব।

নম্রতা চাঁদনীকে ডেকে ওর রুমে নিয়ে এলো। চাঁদনী আড়ষ্ট ভঙ্গিতে ভিতরে ঢুকল। আজ দ্বিতীয়বার এই রুমে এলো ও৷ প্রথমকবার এই রুমে আসার অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর ছিল না ওর জন্য৷

“বসো।”

নম্রতা বিছানার একপাশ ইশারাই দেখিয়ে বলল চাঁদনীকে। চাঁদনী বসতেই প্রশ্ন করল আবার,

“আমি ছাদে যাওয়ার আগে তোমাকে কি বলছিলেন আকরাম ভাই?”

“কিছুই না। যা বলার আপনার সামনেই বলেছেন।”

“বুঝলাম। তোমাকে আগেই বলে রাখি শোনো, ভাইয়ার অন্য ফ্রেন্ডগুলো যথেষ্ট ডিসেন্ট হলেও আকরাম ভাই একেবারে অন্যরকম। বিশেষ করে মেয়েদের ব্যাপারে৷ আমি কী মিন করতে চাইছি, বুঝতে পারছো তো?”

“জি।”

“গুড। এখন থেকে তাকে যথাসম্ভব এভয়েড করে চলবে। সে আসলে রুমের দরজা লক করে রাখবে প্রয়োজনে।”

“আচ্ছা আপু। মাগরিবের আজান দিয়েছে, নামাজ পড়তে হবে। আমি আসি এখন।”

“হুম।”

চাঁদনী দরজা পর্যন্ত যাওয়ার পরে নম্রতা আবার ডাকল ওকে। “চাঁদনী। আরেকটা কথা।”

“বলুন।”

“সেদিনের মিথিলা আর রিতিমার ব্যাপারটা নিয়ে আমি স্যরি৷ ওরা যে ওভাবে কথা বলবে, সেটা আমি বুঝতে পারিনি। তুমি কিছু মনে কোরো না।”

“ঠিকাছে।”

ছোট্ট জবাব দিয়ে চাঁদনী নিজের রুমে চলে এলো। এই প্রথমবার চাঁদনীর মনে হলো, নম্রতাকে ও ঠিক যতটা অহংকারী ভেবেছিল ততটা সে নয়৷ উপরের এই ইগোর খোলসের আড়ালে কোথাও একটা সুন্দর মনও আছে তার। মরিয়ম খাতুনের মেয়ে বলেই মনেহয় এই ভালোটুকু পেয়েছে সে।

১৬.
সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছে বিরামহীন। এক্সাম হল থেকে বের হয়ে নওয়াজ অনুভব করল, এই মেঘলা দিনেও ভ্যাপসা গরমে ঘেমে উঠছে ও। এই ধরনের ওয়েদারে প্রচন্ড বিরক্ত লাগে ওর। বাসায় ফিরে আগে গোসলে ঢুকল নওয়াজ। গোসল সেরে বের হওয়ার সাথে সাথেই নম্রতা এসে ডেকে গেল দুপুরের খাবার খেতে। খাওয়া শুরু করার কিছুক্ষন পরে নওয়াজ খেয়াল করল অপজিটের ডানদিকের চেয়ারটা আজ খালি। সাথে সাথেই প্রশ্ন করল ও, “আম্মু, আজ চাঁদনীকে দেখছি না যে। ও খেয়েছে?”

“চাঁদনী তো নেই বাড়িতে।”

“নেই মানে? কোথায় গিয়েছে?”

“ওর ভাই এসেছিল সকালে। গতকাল চাঁদনীর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট আউট হয়েছে। খুব ভালো রেজাল্ট করেছে ও। সেজন্যই সাখাওয়াত মানে ওর বড় ভাই মিষ্টি নিয়ে এসেছিল। চাঁদনীর কোচিং দিন দুয়েকের জন্য বন্ধ বলে ওকেও সাথে করে নিয়ে গেছে। পরশু আবার এসে পড়বে।”

“ও।”

নওয়াজ আর তেমন কিছু জিজ্ঞাসা করল না। চুপচাপ খেয়ে সোজা নিজের রুমে চলে গেল। খাওয়ার পরে অভ্যাসবশত পায়চারি করতে করতে নওয়াজ টের পেল, মনের ভেতর কোথাও একটা সূক্ষ্ম শূন্যতা তৈরি হয়েছে ওর। মনকে প্রভাবিত করার মতো তেমন কিছুই নয় এটা, কিন্তু একেবারে এড়িয়েও যাওয়া যায় না। নওয়াজ বোকা বা অবুঝ নয়৷ এই চিনচিনে অনুভূতিটির সূত্রপাত যে চাঁদনীর চলে যাওয়ার খবরটা শোনার পরেই হয়েছে, সেটা বুঝতে খুব একটা সমস্যা হলো না ওর। প্রথমে মনে হলো, নিজের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো মনেহয় নিজেই আজকাল বুঝতে পারছে না। নইলে চাঁদনীর চলে যাওয়ার খবর শুনে এমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেন?

কিছুক্ষন ভেবে নিজের মনোমতো যে ব্যাখ্যাটা তৈরি করল ও সেটা অনেকটা এমন, সেদিন গাড়িতে সরাসরিই চাঁদনীকে কিছু কথা বলা হয়েছিল। চাঁদনী যে সেই কথাগুলো খুব একটা সহজভাবে নিতে পারেনি সেটা ওর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ঠিক তখন থেকেই একটা অপরাধবোধ তৈরি হয়েছিল নওয়াজের মধ্যে৷ বাসায় ফিরেও অনুশোচনায় ভুগেছে ও। সেদিন চাঁদনীর সাথে ওভাবে বলাটা যে ভুল হয়েছে সেটাও উপলব্ধি করেছিল নওয়াজ। তারপর চাঁদনীর সাথে আগের মতো টুকটাক কথাবার্তা হলেও ওই টপিকটা আর তোলা হয়নি ইচ্ছে থাকা সত্বেও। কয়েকবারই নওয়াজ ওইদিনের কথাগুলোর জন্য স্যরি বলবে ভেবেছিল, কিন্তু কি বলে যে কথা শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছিল না ও। সেই কথা বলার চেষ্টা থেকেই বোধহয় আজকের শুন্যতাটার উৎপত্তি।

আপাতত চাঁদনীকে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে পরবর্তী এক্সামের প্রিপারেশন নিতে স্টাডি টেবিলে বসে গেল ও। কিন্তু চাইলেই কি সব এড়িয়ে যাওয়া যায়? বোধহয় না। সেজন্যই চাঁদনী নামের গ্রাম্য মেয়েটার অনুপস্থিতিতে তৈরি হওয়া শূন্যতার ঘুনপোকা কুটকুট করে চলল ওর মস্তিষ্কে।

১৭.
অনেকদিন পর আজ চাঁদনীর ঘুম ভাঙল পাখির ডাকে। প্রায় তিন মাস আগে এই বাড়ি ছেড়ে ও ঢাকা গিয়েছিল। অথচ আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পরে ওর মনে হলো, নিজের গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার পর একযুগ পার হয়ে গেছে। যান্ত্রিক শহরের দূষিত ধোঁয়ায় দমবন্ধ হয়ে আসত ওর, যানবাহন চলাচলের বিকট শব্দে কানে তালা লেগে যাওয়ার উপক্রম হতো। আজ তাই ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করেই বারান্দায় গেল।

চাঁদনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিল নিজের মধ্যে। তারপরে তাকাল সামনের ফুলের বাগানের দিকে। নানা রকম ফুল ফুটে আছে সেখানে। চাঁদনীর অবর্তমানেও গাছগুলোর যত্নের এতটুকু কমতি হয়নি।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ১০ | (১৮০০+ শব্দ)

চাঁদনী বারান্দায় দাঁড়িয়ে বুকভরে বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নিল নিজের মধ্যে। তারপরে তাকাল সামনের ফুলের বাগানের দিকে। নানা রকম ফুল ফুটে আছে সেখানে। চাঁদনীর অবর্তমানেও গাছগুলোর যত্নের এতটুকু কমতি হয়নি।

কিছুক্ষন বারান্দায় সময় কাটিয়ে নিচে নেমে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল চাঁদনী। রান্নাঘরে সকালের নাস্তা তৈরির তোড়জোড় চলছে। চাঁদনীকে দেখে সাখাওয়াতের স্ত্রী নায়লা বলল, “উঠে গেছ! ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চই? টেবিলে গিয়ে বসো, আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

“না, ক্ষিধে পায়নি। সবাই আসুক, একসাথে খাব।”

“আচ্ছা।”

নায়লা আবার ভাজির কড়াইয়ে ব্যস্ত হাতে খুন্তি নাড়তে শুরু করল। চাঁদনী জিজ্ঞাসা করল, “ভাইজান কোথায়?”

“উত্তরপাড়া গেল নামাজ পড়ে। সেদিকের জমির ইজারা নিয়ে কী একটা যেন গন্ডগোল হয়েছে। সেটারই মিমাংসা করতে গেছে।”

“ও।”

অল্প সময়ের মধ্যেই খাবার ঘর লোকজনে ভর্তি হয়ে গেল। সকালের নাস্তা করতে করতে টুকটাক আলাপে মেতে উঠল সবাই। চাঁদনীও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করল তাতে। শহরের ওই ডুপ্লেক্স বাড়িটার ডাইনিং রুমের স্বচ্ছ কাঁচের টেবিলে রোবটের মতো বসে খাওয়ার সময় এই উৎসব মুখরিত পরিবেশটির শূন্যতা খুব করে অনুধাবন করেছে চাঁদনী।

বাবা, চাচা আর ভাইয়েরা সবাই চাঁদনীকে এটা সেটা প্রশ্ন করল। পড়াশোনা কেমন চলছে, ওবাড়িতে থাকতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে নাকি এসব। চাঁদনী জানাল, সব ঠিকঠাকই চলছে। নাস্তা শেষে চাঁদনী আবার নিজের রুমে চলে এলো। সাথে করে কিছু বই নিয়ে এসেছিল। সেগুলোই উলটেপালটে দেখতে থাকল। কিছুক্ষন পরেই পিঠা নিয়ে এলেন চাঁদনীর মা রেবেকা বেগম। চাঁদনী অবাক হয়ে প্রশ্ন করল, “পিঠা কখন বানালে, মা?”

“সকালেই বানিয়েছি। আমার হাতের পাটিসাপটা তো তুই খুব পছন্দ করিস।”

“তোমার শরীর তো ইদানিং এমনিতেই ভালো যাচ্ছে না। এত কষ্ট করার কী দরকার ছিল এখন?”

“এটা আর এমন কী কষ্ট! নায়লা আর তোর ছোটআম্মু তো রান্নাঘরে তেমন যেতেই দেয় না আমাকে। নিজেরাই সব সামলে নেয়। এতটুকু করতে তেমন পরিশ্রম হয়নি। আর তাছাড়া এতদিন পর বাড়ি এসেছিস। দুদিন পর তো আবার চলে যাবি। কতদিনে আবার আসতে পারবি না, কে জানে। নিজের হাতে কিছু তৈরি করে আমারও তো খাওয়াতে ইচ্ছে করে। কতগুলো দিন বাইরে। কী খাস না খাস কে জানে।”

চাঁদনী একটা পাটিসাপটা তুলে খেতে খেতে বলল,

“বাইরে কোথায়! ওখানেও একটা বাড়িতেই আমি থাকি মা। তছাড়া মরিয়ম আন্টি খুব ভালো একজন মানুষ। যথেষ্ট যত্ন করে আমার। অনেকটা তোমার মতোই। ক্ষিধে লাগার আগেই খাবার পৌঁছে যায় আমার রুমে। মাঝে মাঝে তো আমি নিজেই নিষেধ করি খাবার দিতে। তখন ঠিক তোমার মতই জোর করেন তিনি। বোঝাতে থাকেন, পড়াশোনায় মনযোগ ধরে রাখতে গেলে খেতে হবে বেশি করে। খালি পেটে থাকা যাবে না একদম। মানুষটা এত আন্তরিক, বলে বোঝানো যাবে না।”

“সেটা তোর বলতে হবে না, আমি জানি। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই আসত। খুব মিষ্টি একটা মেয়ে ছিল। তোর বাবাকে খুব সুন্দর করে ভাইজান বলে ডাকত, তুই এখন যেমনভাবে সাখাওয়াত কে ডাকিস, অনেকটা সেরকম। আমাকে সারাক্ষন ভাবি ভাবি বলে ডেকে অস্থির করে ফেলত। এটা সেটা আবদার করত। আমার হাতে বানানো আম কিংবা চালতার আচার খুব পছন্দ করত। ছাদের উপরে রোদে দেওয়া আচারের বৈয়ম খুলে পা দুলিয়ে দুলিয়ে আচার খেত। আমাদের পরিবারের সাথে একসময় মরিয়মদের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ওর উপরে ভরসা করেই তো তোর বাবা ওবাড়িতে পাঠিয়েছে তোকে।”

রেবেকা বেগম অতীতের কিছু স্মৃতিচারণ করে চলে গেলেন। তিনি চলে যাওয়ার ঘন্টাখানেক পরে এলো নায়লা। তার হাতে বাটিভর্তি চালতা মাখানো। শিলপাটায় ছেচে শুকনো মরিচ, লেবুপাতা, লবন আর চিনি দিয়ে মাখানো হয়েছে। চাঁদনী প্রায় হামলে পড়ল বাটির উপর। খেতে খেতে বলল, “তোমরা তো দেখি প্রচুর আয়োজন করে রেখেছ আমার জন্য।”

“গতকাল সকালেই তোমার ভাই ফোন করে জানিয়েছিল, তোমাকে নিয়ে ফিরছে, তখনই পাশের বাড়ির রফিককে দিয়ে আনিয়ে রেখেছিলাম। আমি তো জানি, ম্যাডাম চালতা বলতে অজ্ঞান।”

চাঁদনী হাসল, “অনেক ধন্যবাদ ভাবি।”

“হয়েছে, আর ফর্মালিটি করতে হবে না।”

“ওকে। করলাম না ফর্মালিটি।”

দুজনেই হাসল ওরা। তখনই দরজার পাশ থেকে ছোট্ট একটা মুখ উঁকি দিল, “এক্সকিউজ মি। আমি কি একটু রুমে আসতে পারি?”

চাঁদনী হেসে দিল কথা শুনে। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সাখাওয়াত আর নায়লার একমাত্র ছেলে নাভিদ। মাত্র পাঁচ বছর বয়স নাভিদের কিন্তু কথাবার্তা বলার ধরন একেবারেই বড়দের মতো। চাঁদনী হেসে বলল, “আরে আব্বা, আসো এদিকে। রুমে আসতে অনুমতি নিতে হবে না।”

“কিন্তু অনুমতি না নিলে সবাই আমাকে অভদ্র ভাববে।”

এই অনুমতি নেওয়ার ব্যাপারটা কিছুদিন আগে ওকে শিখিয়েছে তানিম। হুট করে কারও রুমে ঢুকে যাওয়াটা অভদ্রতা। তাই ঢোকার আগে অবশ্যই অনুমতি নিতে হবে। তাই এখন বাড়ির সবার রুমে ঢুকতে গেলেই সে অনুমতি নেয়।

চাঁদনী আবারও হাসল।

“অন্য সবার হিসাব আলাদা। আমার রুমে আসতে তোমার কখনও অনুমতি নিতে হবে না। এখন আমার কাছে আসো তো। তোমাকে একটু আদর করে দেই। খুব মিস করেছি আমার বাবাটাকে এতদিন।”

“আমিও খুব মিস করেছি তোমাকে। তোমাকে ছাড়া আমার একদমই ভালো লাগে না। আম্মু তোমার মতো ভালোবাসে না আমাকে। গল্প করে ভাতও খাইয়ে দেয় না৷ সারাক্ষন শুধু বকাঝকা করে।”

“ভেরি ব্যাড। যাওয়ার আগে আমি আম্মুকে বকে দিয়ে যাব। কিন্তু আম্মু বকাঝকা করে কেন? তুমি কি খুব বেশি দুষ্টুমি করো?”

“একদমই না। এখন আর আমি কোনো দুষ্টুমি করি না। তোমার বাগানের ফুল ছিঁড়ি না, এমনকি একা একা পুকুর পাড়েও যাই না। আমি এখন গুড বয়। সবার সাথে ভালো ব্যবহার করি।”

“হঠাৎ এত ভালো ব্যাবহারের কারনটা কী শুনি!”

“কারন এখন আমি জানি, সবসময় ভালো হয়ে থাকলেই আমি গুড বয় হতে পারব। তাছাড়া আমার স্কুলের টিচার বলেছে, ব্যবহারেই বংশের পরিচয়।”

নায়লা আর চাঁদনী দুজনেই উচ্চস্বরে হাসল নাভিদের কথা শুনে।

১৮.
তানিম আজ সারাদিনই ব্যস্ত ছিল। আম পাকার এই সময়টাতে স্বাভাবিকভাবেই ব্যস্ততা থাকে। কাজ করে দেওয়ার জন্য কয়েকজন লোকজন রাখা থাকলেও, গাছ থেকে আম পাড়া থেকে শুরু করে সেগুলো প্যাকেট করে ডেলিভারি দেওয়া পর্যন্ত সবকিছুর তদারকিই নিজে দাঁড়িয়ে থেকে করতে হয়। সব কাজ শেষ করে ফ্রি হতে হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল।

মাগরিবের নামাজ আদায় করে তানিম রেডি হয়ে নিল গঞ্জে যাওয়ার জন্য। চাঁদনী এসে দরজায় নক করল তখন, “ভাইয়া কি বাজারে যাচ্ছ?”

“হ্যাঁ। কেন? কিছু লাগবে? খেতে ইচ্ছে করছে কিছু?”

“না, খাবো না কিছু।”

“কেন?”

সারাদিন ধরে সবাই খালি খাইয়েছে। এখন আর পেটে জায়গা নেই একদম৷ আমি এসেছিলাম মোবাইলটা দিতে। আজ সকাল থেকেই লোডশেডিং। মোবাইলে চার্জ নেই একদমই৷ তুমি কি একটু বাজার থেকে চার্জ দিয়ে আনতে পারবে?”

“আচ্ছা, দিয়ে আনব। আর কিছু বলবি?”

“না। আমি আসছি।”

“শোন।”

“বলো।”

“না, থাক। তুই যা।”

প্রশ্ন করতে চেয়েও নিজেকে সামলে নিল তানিম। ওই অহংকারী বদমেজাজি মেয়েটার কথা মনেও করতে চায় না ও আর।

চাঁদনী সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “কিছু একটা বলতে চেয়েও বলছ না। ব্যাপারটা কী, বলো তো?”

“ওবাড়ির কেউ কোনো বাজে ব্যবহার করে না তো তোর সাথে?”

“আশ্চর্য! বাজে ব্যবহার কেন করবে? মরিয়ম আন্টি তো খুব ভালোবাসেন আমাকে।”

“জানি। অন্যদের কথা বলছি। মানে, ওই মেয়েটা তোর সাথে ভালো আচরণ করে তো?”

চাঁদনী বুঝেও না বোঝার ভান করল, “কোন মেয়েটা?”

“মরিয়ম আন্টির মেয়ের কথা বলছি।”

“ও, নম্রতা আপু। সে কেন খারাপ ব্যবহার করবে?”

“না মানে, চালচলন দেখে সেরকমটাই মনে হলো।”

“তানিম ভাই, তুমি তাকে একদিন শুধু কিছু সময়ের জন্য দেখেছ। এত জলদি একটা মানুষকে জাজ করে ফেলা একেবারেই ঠিক নয়। আমি কিন্তু নেগেটিভ কিছু পাইনি তার মধ্যে। হ্যা, কিছুটা মুডি টাইপের। তবে বাইরের দিক থেকে কিছুটা কঠিন হলেও মনের দিক থেকে ভালোই। তোমার মনেহয় তাকে বুঝতে ভুল হচ্ছে কোথাও।”

“হয়তো হচ্ছে ভুল। তবুও, কখনও যদি ওখানে কেউ তোর সাথে কোনো বাজে আচরণ করে তাহলে সাথে সাথে আমাকে জানাবি।”

“আচ্ছা, জানাব।”

তানিম বাজারে গিয়েই আগে চাঁদনীর আর নিজের ফোন চার্জে লাগাল একটা দোকানে। প্রায় ঘন্টাখানেক নিজের কাজ সেরে গেল ফোন আনতে। চাঁদনীর মোবাইল হাতে নেওয়ার সাথে সাথেই কলটা এলো। স্ক্রিনে নাম সেভ করাই আছে। মরিয়ম আন্টি। তানিম ইচ্ছে করেই ফোনটা রিসিভ করল না। কিন্তু একের পর এক কল বেজেই যাচ্ছে। তিনবারের সময় কিছুটা বাধ্য হয়েই ফোনটা রিসিভ করল ও।

“আসসালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে?”

“জি, আমি তানিম। চাঁদনীর ফোনটা আসলে আমার সাথে এখন। বাজারে নিয়ে এসেছি চার্জ দেওয়ার জন্য। বাড়ি গিয়ে চাঁদনীকে বলে দেব যে আপনি ফোন করেছিলেন।”

“চাঁদনীর সাথে আমি পড়ে কথা বলে নেব। এখন তোমার সাথে কথা বলে নেই কিছুক্ষন। আপত্তি আছে কথা বলতে?”

“না না। কি বলছেন? আপত্তি থাকবে কেন?”

“থাকতেও তো পারে। সেই যে একবার এলে আমাদের বাসায় তারপর আর কোনো খোঁজ নেই। সাখাওয়াত, সাদমান, তামজীদ ওরা সবাই আসে আমার বাসায় চাঁদনীর সাথে দেখা করতে। একমাত্র তুমিই আসো না। শুনেছি কোচিং থেকে চাঁদনীর সাথে দেখা করে আবার চলে যাও। এখানে কেন আসতে চাও না বলোতো? এখনও কি আমাদের আপন ভাবতে পারনি?”

“আন্টি প্লিজ, এভাবে বলবেন না। আলাদা করে আপন কেন ভাবতে হবে, আপনি তো আমাদের আপনজনই। আসলে খুব অল্প সময়ের জন্য যাই তো ঢাকাতে। তাই আর বাসায় যাওয়া হয় না।”

“কোনো অযুহাত শুনবো না আর। এরপর ঢাকায় এলে আমার বাসায় আসতেই হবে কিন্তু।”

“চেষ্টা করবো, ইনশাআল্লাহ। ”

“তোমরা আসলে আমার খুব ভালো লাগে। আমার আব্বা ছিলেন তোমাদের পাশের গ্রামেরই একজন স্কুলমাস্টার। আব্বা অর্থিক দিক থেকে একেবারেই অসচ্ছল ছিলেন। বলা যায় গ্রামের সবচেয়ে গরিব দশটি পরিবারের মধ্যে আমরাও ছিলাম। অন্যদিকে চাচাজান মানে তোমার দাদা ছিলেন আশেপাশের চার পাঁচটা গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী। এত উচ্চবিত্ত হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজে সেধে এসে বন্ধুত্ব করেছিলেন আব্বার সাথে৷ খুব ভালোবাসতেন তিনি আমাকে। একেবারে নিজের মেয়ের মতো করে।

আমার আর কোনো ভাইবোন নেই। মা মারা গিয়েছিল ছোটোবেলাতেই। বাবা আর আমি ছোট্ট একটা কাঠের ঘরে থাকতাম। সম্বল বলতে আমাদের ওইটুকুই ছিল।

চাচাজান বলতেন, আমি মরে গেলেও তালুকদার বাড়ির কথা ভুলে যেও না, মা। মনে রাখবা তালুকদার মঞ্জিলে তোমার দুইটা ভাই আছে।

তোমার বাবা আর চাচাও তোমার দাদার যোগ্য উত্তরসূরী। তার মতই উদার মনের মানুষ। তোমার দাদার মৃত্যুর পরেও আমাকে আগের মতোই সমাদর করেছেন তারা। নিজের বোনের চেয়ে কম কিছু ভাবেনি কখনও।

তোমার দাদা মারা গেলেন৷ তার কয়েকবছর পরে হুট করেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। তার কিছুদিন পরে আব্বাও মারা গেলেন। আব্বা মারা যাওয়ার পর গ্রামে যাওয়া একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। এখন মনেহয় ভিটেটুকুও অন্যের দখলে চলে গেছে।

তবুও মাঝে মাঝে তোমার দাদাজানের কথা কানে বাজে। তালুকদার বাড়িতে আমার দুটো ভাই আছে। অনেকগুলো বছর তোমাদের সাথে যোগাযোগ ছিল না। এখন যেহেতু আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে,এটা আর আমি নষ্ট করতে চাই না। আমার বাপের বাড়ির দিকের কোনো আত্বীয়স্বজন নেই বললেই চলে। অনেকগুলো বছর যোগাযোগ ছিল না ঠিকই, কিন্তু নিজের আত্মীয়স্বজনের কথা উঠলে সবার আগে তাই তালুকদার মঞ্জিলের কথাই মনে পড়ত৷

তাই তোমরা যদি মাঝেমধ্যে আসো। আমার খুব ভালো লাগবে।

কিছু মনে কোরো না। অনেক কথা বলে ফেললাম। তুমি বিরক্ত হচ্ছ নাতো?”

তানিম মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল মরিয়ম খাতুনের বলা কথাগুলো। তার করা শেষ প্রশ্নটির জবাবে তানিম বলল, “একদমই বিরক্ত হচ্ছি না। বরং আপনার মুখে কথাগুলো শুনতে খুব ভালো লাগছে। এবার চাঁদনীর সাথে আপনি আসলেন না কেন? বাবা আর বড়আব্বু আপনাকে দেখলে খুব খুশি হতো।”

“তোমার বাবা আর চাচাও অনেকবার করে যেতে বলেছেন। যাব ইনশাআল্লাহ। তুমি কিন্তু এরপরেরবার আমাদের এখানে আসবেই। ”

“যাবো ইনশাআল্লাহ।”

মরিয়ম খাতুন ফোন কেটে দিলেন। রাতের নিস্তব্ধ রাস্তায় টর্চ জ্বেলে হাঁটতে হাঁটতে তানিম ভাবনায় ডুবে গেল। এত চমৎকার মনের একজন মানুষ। এত আন্তরিক কথাবার্তা যার। তার মেয়েটি এত উগ্র আর বদমেজাজি হলো কী করে। চাঁদনী বলছিল, বাহ্যিকভাবে কিছুটা বদমেজাজি হলেও মনের দিক থেকে ভালো। আসলেই কি তাই। হঠাৎ করেই সেই প্রথমদিনের প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে গেল ওর। সাথে সাথেই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো৷ সেদিন মেয়েটির উচ্চারণ করা প্রত্যেকটি শব্দ এখনো ওর মাথায় গেঁথে আছে। চাইলেও যেগুলো ভোলা যাবে না খুব সহজে। সেদিন নম্রতার বলা সেই কথাগুলো মনে করতে করতে তানিম বাড়ির দিকে রওয়ানা দিল।

১৯.
নম্রতার মাথাধরাটা ইদানিং বেড়েই চলেছে। সন্ধার পরে পড়তে বসে কিছুতেই বইয়ের পাতায় মনোযোগ দিতে পারল না ও। চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে মেডিসিন বক্স হাতে নিল পেইনকিলার খাওয়ার জন্য। হঠাৎ করে মনে পড়ল, ওর বক্সে পেইনকিলার নেই। কয়েকদিন আগেই ফুরিয়ে গেছে এবং সেটা রিস্টক করা হয়নি। অগত্যা নম্রতা মেডিসিনের খোঁজে মায়ের রুমের দিকে গেল। তার কাছে ওষুধটা পাওয়া গেলেও যেতে পারে।

মরিয়ম খাতুনের রুমের সামনে গিয়েই নম্রতা টের পেল মা ফোনে কথা বলছে। কথা শুনেই ও কিছুটা আন্দাজ করতে পারল যে কার সাথে কথা হচ্ছে মায়ের। মরিয়ম খাতুন একের পর এক কথা বলেই যাচ্ছে।

নম্রতা কথা শেষ হওয়ার অপেক্ষায় বসে রইল খাটের এককোনে। কান পেতে ওপাশের কন্ঠস্বর শোনার চেষ্টাও বোধহয় করছিল একটু-আধটু।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-০৮

0

নিভৃত রজনী
| ৮ | (১২৩০+ শব্দ)

ক্লাসরুমের ভিতরে বসে বাইরের আবহাওয়া একদমই বোঝা যায়নি এতক্ষন। আজ সকালে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, তখন জুলাই মাসের চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল একটি সকাল ছিল।

অথচ এখন বিরামহীন বৃষ্টি। পাশের মেয়েটির সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতেই নিচে নামছিল চাঁদনী। নিচে নেমে গেটের দিকে তাকাতেই ভীষণভাবে চমকাল ও। নওয়াজ দাঁড়িয়ে আছে ওর দিকে তাকিয়ে। চাঁদনীর পা দুটো থেমে গেল অজান্তেই। নওয়াজ এগিয়ে এলো এবার।

“যাক, বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলো না।”

চাঁদনীর পা দুটোও আবার শ্লথগতিতে চলতে শুরু করেছে।

“আপনি হঠাৎ? আজ ড্রাইভার চাচা আসেনি?”

“কেন? আমি আসায় কি খুব অসুবিধা হয়ে গেল?”

“আমি তো সেটা বলিনি। ”

গাড়িতে পর্যন্ত হাঁটতে গিয়ে দুজনেই আরও খানিকটা ভিজে গেল। চাঁদনীর ইচ্ছে ছিল পিছনে বসার। কিন্তু নওয়াজ আগেই এগিয়ে গিয়ে সামনের দরজাটা খুলে চাঁদনীকে উঠতে ইশারা করল। অগত্যা ড্রাইভিং সিটের পাশেই গিয়ে বসতে হলো ওকে। নওয়াজ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল, “ড্রাইভার চাচাই গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন। কিছুদূর এগিয়েই এক্সিডেন্ট করেছেন। তাই আমাকেই আসতে হলো।”

“সেকি! এখন কী অবস্থা তার?”

“একটা পায়ে খুব বাজেভাবে ফ্রাকচার হয়েছে। আর তেমন কিছু না।”

“ও।”

“সেই সকালে বের হয়েছো বাসা থেকে। ক্ষিদে পেয়েছে নিশ্চই। খাবে কিছু?”

“তেমন ক্ষিদে পায়নি।”

“ওকে।”

কিছুক্ষন চুপচাপ দুজনে। তারপরেই নওয়াজ প্রশ্নটা করল আচমকা, “তুমি আমাকে পছন্দ করো?”

চাঁদনী যেন প্রথমে বুঝতেই পারল না প্রশ্নটা। ও সরাসরি তাকাল নওয়াজের দিকে। অভ্যস্ত হাতে স্টিয়ারিং হুইল ঘোরাচ্ছে নওয়াজ, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সামনের রাস্তার দিকে। নীরবতা ভেঙে নওয়াজই আবার কথা বলল, “প্রশ্নের উত্তর দিতে কি ভয় পাচ্ছ?”

নিচের দিকে তাকিয়ে কাঁপা স্বরে জবাব দিল চাঁদনী, “না, ভয় পাব কেন? হঠাৎ আপনি এরকম অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নই বা কেন করছেন?”

“আমার মনে হলো তাই।”

“এটা আপনার একটা ভুল ধারনা।”

“তুমি খুব ভালো করেই জানো, এটা ভুল ধারনা নয়। প্রথমদিনই তোমার চোখদুটো আমাকে বলে দিয়েছিল সব। তারপর যতবারই তোমার সাথে আমার দেখা হয়েছে প্রত্যেকবারই তুমি এড়িয়ে যেতে চেয়েছ আমাকে। যতক্ষন পর্যন্ত আমি তোমার চোখের আড়ালে থাকি ততক্ষন পর্যন্ত তুমি একেবারেই স্বাভাবিক, অথচ আমি সামনে গেলেই তোমার অস্থিরতা বেড়ে যায়। এসবই আরও বেশি করে প্রমাণ করে দেয় যে আমার ধারনা মোটেও ভুল নয়।”

এরকম স্পষ্ট ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে আর কিছু বলার অবকাশই রইল না চাঁদনীর। ও শুধু নিচের দিকে তাকিয়ে থাকল। অনুভূতিগুলো লুকানোর এত চেষ্টা করার পরেও শেষপর্যন্ত ধরা পড়ে যেতেই হলো।

কিছুক্ষন থেমে থাকার পরেও চাঁদনীর থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে নওয়াজই আবার বলতে শুরু করল, “তুমি কি খুব আনইজি ফিল করছো? বি ইজি। অপজিট অ্যাট্রাকশন, এটা খুব কমন একটা ব্যাপার আজকাল।”

চাঁদনীর নিচু মাথা আরও নিচু হয়ে গেল সংকোচে। হয়তো নওয়াজ কিংবা ওর মতো শহুরে ছেলেমেয়েদের জন্য এসব খুবই কমন কিন্তু চাঁদনীর জন্য এভাবে নিজের লুকোনো অনুভূতি প্রকাশ হয়ে যাওয়া ভীষণ রকমের লজ্জার। নওয়াজ বলে গেল, “একি, তোমার তো দেখি কথাই বন্ধ হয়ে গেছে। আমি কিন্তু আজ প্রশ্নটা করেছিলাম একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করার জন্য।”

“কী ব্যাপার?” নওয়াজের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকাল চাঁদনী।

“এই যে আমাকে দেখলেই তোমার আড়ষ্ট হয়ে থাকা। আমার মনেহয়, তোমার এগুলো থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করা উচিৎ এবার।”

“আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

“ওকে। মন দিয়ে আমার কথাগুলো শুনতে থাকো। আশা করি বুঝতে পারবে। আমার মনে হয় আমাকে দেখলেই এভাবে নিজেকে গুটিয়ে না নিয়ে আমার সাথে নরমালি বিহেভ করা উচিৎ তোমার। নইলে দিন দিন তোমার এই ইমোশনগুলো বাড়তেই থাকবে। কিন্তু একবার যদি আমার সাথে সহজ হয়ে যেতে পারো, তাহলে দেখবে সময়ের সাথে সাথে তোমার ইনফ্যাচুয়েশনও কেটে যাবে।”

নওয়াজের কথাগুলো বলার ধরন খুব একটা ভালো লাগল না চাঁদনীর। চাঁদনী ফের প্রশ্ন করল, “আমার বিষয়গুলো নাহয় আমিই বুঝে নেব। আপনি হঠাৎ এসব নিয়ে কেন ভাবছেন?”

“ভাবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে৷ আমার প্রতি তোমার অ্যাট্রাকশন আরও বেড়ে গেলে সেটা তোমার এবং আমার দুজনের জন্যই প্রব্লেম ক্রিয়েট করতে পারে। অন্য কেউ যদি ব্যাপারটা ধরে ফেলে, তাহলে তো আরও অকওয়ার্ড লাগবে। যেটা কখনও হওয়া পসিবল না সেরকম একটা ব্যাপার নিয়ে হেজিটেশনে ভুগতে হবে আমাকে অযথাই। এসব নিয়ে ভাবার আরেকটা মেজর কারণ হচ্ছে আমার মা। গত পরশুই সে তোমাকে নিয়ে তার নিজের একান্তই একটি ইচ্ছের কথা জানিয়েছেন আমাকে। তিনি চান, আমার সাথে তোমার বিয়ে দিতে। তিনি যদি কোনোভাবে জানতে পারেন আমার প্রতি তোমার দুর্বলতা রয়েছে তাহলে সিওর জোর করেই তোমাকে আমার মাথায় চাপিয়ে দেবে। ইউ নো, মায়ের ইমোশোনাল ব্লাকমেইলে পড়ে অনেকবার আমাকে সাফার করতে হয়েছে। নতুন করে কোনো পেইন আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। অ্যান্ড রিয়েলি আই মিন ইট। আই কান্ট টেইক ইট এনিমোর। এজন্যই তোমাকে আগে, অ্যালার্ট করে দিলাম।”

চাঁদনী মন দিয়েই শুনেছে কথাগুলো। প্রব্লেম ক্রিয়েট হওয়া, হেজিটেশনে ভোগা, অকওয়ার্ড ফিল, মাথায় চাপিয়ে দেওয়া, ইমোশনাল ব্লাকমেইল, সাফার করা, এসব বিক্ষিপ্ত কিছু শব্দ ওর কানে বাজতে লাগল অনবরত। নওয়াজের সব কথার মর্মার্থ উদ্ধারের পর চাঁদনীর মনে হলো, কেউ যেন খুব জোরে ওর গালে চপেটাঘাত করেছে। জানালার দিকে মাথা ঘুড়িয়ে দুফোটা অশ্রু বিসর্জন দিল ও।

না, নওয়াজ ওকে নিজের উপযুক্ত মনে করছে না বলে একদমই আক্ষেপ নেই ওর। কিন্তু এই যে হেয় করে কথা বলা, এগুলোই ওর আত্মসম্মানে আঘাত করল ভীষণভাবে। চাঁদনীকে বিয়ে করা মানে ওর মাথায় বোঝা চাপিয়ে দেওয়া? চাঁদনীকে বিয়ে করলে ওকে সাফার করতে হবে? এসব কথা বলে যে চাঁদনীকে তুচ্ছ প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে সেটা কি জানে ছেলেটা!

আচ্ছা, এরা দুই ভাইবোনই কি একইরকম? অন্যকে আঘাত করে ছোট করে, কিংবা তুচ্ছ প্রমাণ করে এরা আসলে কী পায়? সেদিন নম্রতার রুমে জঘন্য অপমানের পরেও ঠিক এমনই লেগেছিল ওর। নিজের রুমে ফিরে হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন চাঁদনী। আচ্ছা, ওরা কি জানে যে ওদের বলা কথাগুলো চাঁদনীর হৃদয়কে ঠিক কতটা ক্ষতবিক্ষত করেছে। রাগ আর অপমানবোধে চাঁদনী আর একটা কথাও বলল না।

অথচ, নাকউঁচু, আত্ম-অহংকারী ছেলেটা বুঝতেও পারল না,পাশে বসা মেয়েটিকে ভদ্র ভাষায় চুড়ান্ত পর্যায়ের অপমান করছে ও।

১৫.
নওয়াজের ফাইনাল এক্সাম আর কয়েকদিন পরেই। এক্সামের আগে তাই শেষবারের মতো গ্রুপ স্টাডিতে বসেছে ওরা। দুপুরের পরপরই বসেছিল ওরা। বিকালের দিকে আকরাম হঠাৎ বলে উঠল, “অনেক হয়েছে। এখন আর লোড নিতে পারছি না। তোরা কন্টিনিউ কর। আমি বাইরে থেকে একটু মাইন্ড রিফ্রেশ করে আসছি।”

নওয়াজ, আবির, ফাহিম আর মিশকাত চারজনই তাকাল ওর দিকে। কারণ আকরামের এই মাইন্ড রিফ্রেশের ব্যাপারটা ওদের সবারই জানা। বাইরে গিয়ে কোনো না কোনো মেয়ের সাথে ভিডিও কলে কিছুক্ষন নোংরা কথাবার্তা বলবে, তারপর আবার এসে পড়তে বসবে।

ফাহিম আর মিশকাত এসব নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না, তবে আবির চটে যায় খুব। আর নওয়াজ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে প্রচন্ডরকম বিরক্ত হয়। শুধু ফ্লার্ট কিংবা প্রেম হলেও ঠিক ছিল। কিন্তু আকরামের টার্গেট হলো মেয়েদের বিছানা অব্দি নেওয়া, তারপর ইন্টারেস্ট কমে গেলে ছেড়ে দেওয়া।

আকরাম ওদের কারও মেজাজের তোয়াক্কা না করেই রুম থেকে বের হয়ে এলো। ছাদের দিকটা নিরিবিলি থাকে বলে সেদিকেই এগিয়ে গেল ও। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নারী অবয়বের পিছনের দিক দেখে আবার নেমে যেতে শুরু করল ও। কয়েক সিঁড়ি নেমেও ফের দাঁড়িয়ে পড়ল।

ছাদের মেয়েটাকে ও নম্রতা ভেবেছিল এতক্ষন। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর মনে হলো এটা নম্রতা নয়। শারিরীক আকৃতি নম্রতার থেকেও কিছুটা ভারী। এমনকি ড্রেসাপও অন্যরকম। আকরাম আবারও ছাদে উঠল। নিঃশব্দে মেয়েটির আরও কাছে এগিয়ে গেল। কয়েক হাতের দুরত্বেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। মনোযোগ আকর্ষনের জন্য এবার ইচ্ছে করেই কাশি দিল আকরাম।

চাঁদনী প্রচন্ডভাবে চমকে উঠে পিছনে তাকাল। অপরিচিত একজনকে দেখে ঘাবড়েও গেল খুব। ছেলেটার পলকহীন তাকিয়ে থাকায় ঘাবড়ে যাওয়ার সাথে সাথে অস্বস্তিও লাগতে শুরু করল।

কে এই ছেলেটা? নওয়াজের বয়সী বলেই মনে হচ্ছে। তাহলে কি নওয়াজের বন্ধু? সে যেই হোক। ছেলেটার তাকানোর ধরন একেবারেই অন্যরকম। শুধু চেহারাতেই স্থির থাকছে না সেই দৃষ্টি। মাথা থেকে পা অব্দি, এমনকি সারা শরীরে বারবার ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে। সেই চাহনী খুব একটা শ্লীল মনে হলো না চাঁদনীর৷ আবার ছেলেটা এমনভাবে কর্ণারের দিকটায় এসে আটকে দাঁড়িয়েছে যে চাঁদনীর পাশ কাটিয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। চাঁদনীর মন বলছে, এখান থেকে এখনই সরতে না পারলে একটা বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে। নিরুপায় বোধ করল ও।

চাঁদনী প্রার্থনা করল মনে মনে, কেউ অন্তত আসুক। হঠাৎ করে ছাদের দরজায় কথা শোনা গেল, “একি চাঁদনী, তুমি এখানে কী করছ? আর আকরাম ভাই, আপনার তো ভাইয়ার রুমে থাকার কথা এখন। এখানে হঠাৎ?”

চাঁদনী হাফ ছেড়ে বাঁচল নম্রতা চলে আসায়। নম্রতার কথায় নিশ্চিত হলো, এটা নওয়াজেরই বন্ধু।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী পর্ব-৬+৭

0

নিভৃত রজনী
| ৬ | (১২৬০+ শব্দ)

নম্রতার কাটাকাটা কথায় অপমানে রিতিমার মুখ থমথমে হয়ে উঠল। হঠাৎই সবার মধ্যে নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন। শুধু নিকিতা চামচ দিয়ে ফ্রাইড রাইস নাড়তে নাড়তে মুচকি হাসল।

১১.
জুনের প্রায় শেষের দিক চলছে এখন। দেখতে দেখতে চাঁদনীর ঢাকায় আসার একমাস পেরিয়ে গেছে। আজকাল সময় খুব একটা খারাপ কাটছে না ওর। বেশিরভাগ সময় তো পড়াশোনার পিছনেই চলে যায়। বাকী সময়টুকুতে মরিয়ম খাতুনের সাথে গল্প করে অথবা ব্যালকনিতে লাগানো ফুলগাছগুলোর যত্ন করে কাটিয়ে দেয় চাঁদনী।

তাছাড়া ভাইদের সাথেও দেখা হচ্ছে নিয়মিত। শুধু তুরাগ বাদে বাকি চারজন অর্থাৎ সাখাওয়াত, তামজীদ, সাদমান এবং তানিম একের পর এক পালাবদল করে দেখা করতে আসে কয়েকদিন পরপরই। সাখাওয়াত, তামজীদ আর সাদমান মরিয়ম আন্টির বাসাতে এলেও তানিম সেই প্রথমদিনের পর থেকে আর একবারের জন্যেও মরিয়ম আন্টিদের বাসায় আসেনি। গ্রাম থেকে এসে হোটেলেই ওঠে সে। চাঁদনীর কোচিং-এর পর ওর সাথে দেখা করে আবার চলে যায়।

চাঁদনী অনেকবার জিজ্ঞাসা করেছে, কেন সে বাসায় যায় না। প্রত্যেকবারই সেই প্রশ্ন এড়িয়ে গেছে তানিম। সেদিন নম্রতার রুমের কথা কেন জানতে চেয়েছিল, সেটাও জিজ্ঞাসা করেছে চাঁদনী। তানিম উত্তর দিয়েছে, ওর সাথে ধাক্কা লেগে নাকি নম্রতার হাতের ফোনটা পরে গিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। সেজন্যই ক্ষতিপূরণ হিসেবে একটা ফোন কিনে সেটা দিতে গিয়েছিল নম্রতার রুমে।

তানিম শুধু এতটুকু বললেও চাঁদনীর মনের সংশয় যায়নি। ওর ধারনা আরও বেশি কিছু হয়েছে ওদের মধ্যে, হয়তো কথা কাটাকাটি অথবা নম্রতা হয়তো কোনো অপমানজনক কথা বলেছে। এতদিনে নম্রতার আচার আচরণে ওর সম্পর্কে ভালোই একটা ধারনা হয়ে গেছে চাঁদনীর। তাই চাঁদনীর দৃঢ় বিশ্বাস, ওর তানিম ভাইয়ের এবাড়িতে না আসার পিছনে নম্রতারই হাত রয়েছে।

চাঁদনীর সখ্যতা মরিয়ম খাতুনের সাথে থাকলেও পরিবারের বাকি তিনজন সদস্যকে ও খুব যত্ন করে এড়িয়ে যায়। বিশেষ করে নওয়াজ এবং নম্রতাকে।

নম্রতার খোঁচা দিয়ে কথা বলার একটা অভ্যাস আছে বোধহয়। মাঝে মাঝে ওর সাথে যতটুকু কথা বলে পুরোটাতেই যেন তাচ্ছিল্য মিশে থাকে। সত্যি কথা বলতে চাঁদনীর সাথে আগে কখনোই কেউ এভাবে কথা বলেনি।

নওয়াজ অবশ্য কখনও খোঁচা দেয় না। তবে তার চোখের দৃষ্টিই অন্যরকম। মনে হয় যেন একেবারে অন্তর্ভেদী।

লোকটার সাথে প্রথম দেখাতেই কিছু একটা ফিল করেছিল চাঁদনী, সেটা অস্বীকার করতে পারবে না। সুন্দর যেকোনো কিছুর প্রতি আকর্ষণ অনুভব করা অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে সেদিন প্রথম দেখার পর নিজের রুমে এসেই নিজের অনুভূতির লাগাম টেনেছিল ও। নিজেকে বুঝিয়েছিল, ও এখানে এসেছে একটি বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে। একমাত্র সেটার দিকেই ফোকাস করতে হবে ওকে। অন্য কোনো দিকে নিজেকে ইনভলভ করলে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যাবে।

তাছাড়া পুরো ব্যাপারটাই হারাম। এভাবেই তো শয়তান ওয়াসওয়াসা দেয়, কুমন্ত্রনার ফাঁদ তৈরি করে মানুষের জন্য। চাঁদনীর কানে বাজতে থাকে বাবার বলা কথা। ‘হারাম কখনও মানুষের জন্য কল্যাণকর হতে পারে না। হারাম সাময়িক শান্তি দিলেও তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল হয় ভয়াবহ।’

নিজের মনকে বোঝানোর সবরকম চেষ্টাই করে চাঁদনী। তবু মনের মধ্যে কোথাও বিন্দু পরিমাণ হলেও অনুভূতি থেকে যায় নওয়াজের প্রতি। কিন্তু বাইরের দিক থেকে চাঁদনী একেবারেই স্বাভাবিক।

মাঝে মাঝে দেখা হয়ে যায় তার সাথে। নাস্তার টেবিলে, লাঞ্চ টাইমে কিংবা শেষ বিকেলে মরিয়ম আন্টির সাথে ছাদে হাঁটাহাঁটি করার সময়। নওয়াজ মুচকি হেসে জিজ্ঞাসা করে, “কী খবর চাঁদনী? পড়াশোনা কেমন চলছে?”

চাঁদনী স্বাভাবিক গলায় ছোট্ট করে উত্তর দেয়, “জি, ভাইয়া। ভালো।”

“শুধু কি মেডিকেলেই দিতে চাচ্ছ? পাবলিকে ট্রাই করবে না?”

“না।”

“যদি মেডিক্যালে চান্স না হয়?”

“প্রাইভেটে ভর্তি হবো।”

“তারমানে ডাক্তারিই পড়তে চাইছ। ভালো। এক্সাম হবে কবে, জানতে পেরেছ কিছু?”

“এখনও নয় তবে শুনেছি অক্টোবরে হতে পারে।”

পুরো কথপোকথনে স্বাভাবিক থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করে চাঁদনী। তবুও কেমন একটা অস্বস্তিকর অনুভূতি হয় ওর। চাঁদনী দিন গুনতে থাকে, এইতো আর কিছুদিন। একবার এক্সামটা হয়ে গেলেই বাড়ি চলে যাওয়া যাবে।

১২.
নওয়াজ আজকাল প্রচন্ড ব্যস্ত থাকে। ব্যস্ততাটা অবশ্যই পড়াশোনা নিয়ে। প্রায়ই রাতজাগা হচ্ছে আজকাল। তাই আজ দুপুরে খাওয়ার পরেই ভাতঘুম দিয়েছিল। দীর্ঘ সেই ঘুম ভাঙল সন্ধারও পরে। ঘুম থেকে উঠে নিচে নামল ও। কিচেনের দিক থেকে শব্দ পেয়ে সেদিকে এগিয়ে গেল টুলুর মায়ের খোঁজে, তবে আজ আর আগেরবারের মতো ভুল করল না। আগেই কিচেনের ভেতরে উঁকি দিয়ে কনফার্ম হয়ে নিল এটা সত্যিই টুলুর মা কিনা। টুলুর মা নওয়াজকে দেখে বলল, “ভাইজান আপনি? কিছু লাগবে?”

“আজ এখনও চা দাওনি কেন?”

“নিয়ে তো একবার গিয়েছিলাম আপনার রুমের সামনে। অনেকবার নক করে আপনার সাড়া না পেয়ে আবার চলে এসেছি।”

“ওকে। এখন আবার গিয়ে আমার রুমে রেখে এসো ফ্লাস্কটা।”

“আচ্ছা।”

কিচেন থেকে মায়ের রুমের দিকে গেল নওয়াজ। অনেকদিন যাবত মায়ের সাথে সেভাবে কথা হচ্ছে না। মায়ের রুমে ঢুকতে গিয়েও পা থেমে গেল ওর। ভিতরে চাঁদনী নামের মেয়েটি বসে আছে। দুজনেই হাসছে আর গল্প করছে। চাঁদনীর মুখে কথার ফুলঝুরি ছুটেছে। হাত নাড়িয়ে কথা বলে যাচ্ছে সে। এতটা স্বতঃস্ফূর্ত আগে কখনোই চাঁদনীকে দেখেনি নওয়াজ। কেমন একটা গুটিয়ে রাখে নিজেকে সবসময়। নওয়াজ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ সরে গেল।

নওয়াজ রুমে এসেও চাঁদনীকে সরাতে পারল না মস্তিষ্ক থেকে। সেই প্রথম দিন দেখেই ও বুঝে গিয়েছিল যে মেয়েটার ওর প্রতি একটা মুগ্ধতা কাজ করছে।

সেদিন রাতে প্রচন্ড রাগ আর বিরক্তি নিয়ে বারবার কলিংবেল চেপেই যাচ্ছিল ও। অনেকক্ষন পার হয়ে যাওয়ার পর যখন দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েছিল, তখন ভেবেছিল ঘরে ঢুকে একটা লঙ্কাকাণ্ড বাধিয়ে দেবে। কিন্তু দরজার ওপাশে হঠাৎ অপরিচিত মুখ দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিল ও। মেয়েটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল ওর দিকে৷ কেন জানি ও নিজেও ওই মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল বেশ খানিকটা সময়। সেই সময়েই নওয়াজ মেয়েটির চোখে ওর প্রতি মুগ্ধতা আবিষ্কার করেছিল।

তারপর যখন ও পরিচয় জিজ্ঞাসা করল, তার জবাব না দিয়েই একপ্রকার দৌড়ে পালাল মেয়েটা। কিন্তু শুধু ওই একদিনই অস্বভাবিক আচরণ করেছিল চাঁদনী। তারপর থেকে সে একেবারেই স্বাভাবিক। বোঝা যায় নিজের অনুভূতি সামলাতে সে যথেষ্টই দক্ষ।

এটাই অবশ্য ভালো হয়েছে। মেয়েটি যদি হ্যাংলার মতো বার বার ওর সামনে আসত সেটা সত্যিই খুব বিরক্তির কারণ হয়ে যেত নওয়াজের জন্য। যত যাই হোক, এরকম একটি মেয়ের সাথে তো আর রিলেশনে যাওয়া যায় না।

না, চাঁদনী মেয়েটি অসুন্দর নয়। ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, টিকালো নাক, পাতলা দুটি ঠোঁট, থুতনি কিছুটা খাঁজকাটা। মেয়েটি নিজেকে আপাদমস্তক প্যাকেট করে রাখলেও সৌন্দর্য লুকাতে পারেনি একবিন্দুও। চাঁদনীর মুখের সবটাই নিঁখুতভাবে দেখেছে নওয়াজ। তবে শুধু চুলটাই দেখতে পারেনি। সবসময় এমনভাবে ওড়না পেঁচিয়ে রাখে যে কপালের পাশের ছোট কিছু চুল বাদে আর কিছুই দেখা যায় না।

কিছুটা সাজগোজ করে যদি এই মেয়ে বাইরে বের হয় তাহলে শ’খানেক ছেলের লাইন লেগে যাবে নিশ্চিত। কিন্তু তবুও কেন জানি মেয়েটাকে একেবারেই পারফেক্ট মনে হয় না নিজের জন্য৷ নিজের জীবনসঙ্গী হিসেবে ও সবসময় অন্য ধরনের একটি মেয়েকে ভেবে রেখেছে। যে ঘরে বাইরে সমানভাবে তাল মিলিয়ে চলবে। আধুনিক মানসিকতার হবে। নওয়াজ নিজের ভাবনায় নিজেই হঠাৎ থমকে গেল। আশ্চর্য! মেয়েটিকে নিয়ে এতই বা ভাবছে কেন ও? একেবারে বিয়ে অব্দি চলে গেল? প্রথম দেখায় ওর প্রতি মেয়েটির একটা অ্যাট্রাকশন তৈরি হয়েছে, এবং মেয়েটি সেটা খুব ভালোভাবেই সামলে নিয়েছে। তাহলে ও কেন অযথা মেয়েটিকে নিয়ে ভাবছে। আপাতত সব চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে নওয়াজ বইয়ের পাতায় মন দিল।

১৩.
নম্রতার আজ সকাল থেকে কিছুটা মাথাব্যাথা ছিল। সেজন্য আজ ভার্সিটিতে যাওয়া হয়নি। সারাদিন রুমের মধ্যেই কাটল ওর।

সারাদিনে খোঁজ না পেয়ে নিকিতা, রিতিমা আর মিথিলা এসে হাজির হলো সন্ধ্যাবেলাতে। ওরা মাঝেমধ্যেই এরকম বিনা নোটিশে এসে হাজির হয় আড্ডা দেওয়ার জন্য। নম্রতা ওদের বসিয়ে রেখে টুলুর মাকে গিয়ে নাস্তা দেওয়ার জন্য বলে এলো। রুমে এসে দেখল নিকিতা বুকশেলফ থেকে একটা বই নিয়ে পড়তে শুরু করে দিয়েছে, রিতিমা আর মিথিলা কী একটা বিষয় নিয়ে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

হুট করে মিথিলা নিকিতার হাত থেকে বইটা নিয়ে নিল, “এখানে তুই বিদ্যাসাগর হতে আসিস নাই বইন, এখন কোনো বইটই চলবে না। এখন শুধু আমরা আড্ডা দেব।”

নিকিতা হেসে বলল, “আচ্ছা, ধরব না বই।”

মিথিলা উঠে দাঁড়াল বইটা বুকশেলফে রেখে আসতে। বই রেখে ফিরে আসতে গিয়েই চোখে পড়ল ব্রাউন কালারের ব্যগটা৷ ব্যাগ থেকে মোবাইলের বক্সটা বের করে চিঠিটা পড়তে পড়তে নম্রতার পাশে এসে বসল ও।

“হ্যারে নম্র, এই তানিমটা কে? এরকম জ্বালাময়ী চিঠি লিখেছে তোকে।”

নম্রতা হঠাৎ করে নামটা শুনে চমকে উঠল। তারপর মিথিলার হাতের দিকে তাকিয়ে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারল। গতকাল ও নিজেই আলমারি থেকে ব্যাগটা বের করে কিছুক্ষন ভিতরের জিনিসপত্র নেড়েচেড়ে দেখে বুকশেলফের একটা তাকে রেখেছিল। সময়ের সাথে সাথে যেন তানিমের প্রতি রাগটা না কমে যায় সেজন্যই এই কাজটা করে নম্রতা।

মিথিলা চিঠিটা হাতে নিয়ে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে নম্রতার দিকে। অগত্যা বাধ্য হয়েই ওদের সবটা খুলে বলতে হলো নম্রতার।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

নিভৃত রজনী
| ৭ | (১৬০০+ শব্দ)

মিথিলা চিঠিটা হাতে নিয়ে উত্তরের আশায় তাকিয়ে আছে নম্রতার দিকে। অগত্যা বাধ্য হয়েই ওদের সবটা খুলে বলতে হলো নম্রতার।

সব শুনে নিকিতা বলল, “এটা একদমই ঠিক করিসনি। হয়তো অসাবধানতায় হয়ে গেছে ব্যাপারটা। প্রথম দেখায় একটা মানুষ সম্পর্কে কিছু না জেনে এভাবে জাজ করাটা ঠিক হয়নি তোর। তাছাড়া সে তোদের বাসার গেস্ট ছিল। যত যাই হোক, তার সাথে এরকম আচরণ একেবারেই কাম্য নয়। নিজের এই বদমেজাজের জন্যই একদিন তুই পস্তাবি দেখিস।”

মিথিলা কৌতুকের স্বরে বলল, “এইযে, আমাদের নিকিতা আন্টির ফ্রীতে অ্যাডভাইজ দেওয়া শুরু হয়ে গেছে।”

রিতিমা বলল, “ছাড় তো ওর কথা। নম্র যা করেছে ঠিক করেছে।”

মিথিলা বলল, “তবে একটা কথা কিন্তু না বলে পারছি না।”

নম্রতার চোখে প্রশ্ন, “কী কথা?”

“সেদিন তুই পারফেক্ট ম্যাচের কথা বললি না, এই তানিম ছেলেটা কিন্তু তোর জন্য পারফেক্ট ম্যাচ হতে পারে। তোর করা ইনসাল্টের যোগ্য জবাব দিয়ে গেছে, তারমানে আতিকের মতো মেরুদণ্ডহীন নয় একেবারেই। তুই যেমনটা চাইতি, মানে সেল্ফ-রেস্পেক্টও আছে খুব। স্মার্ট অ্যান্ড ইমপ্রেসিভ ক্যারেক্টার।”

যদিও ওদের কথার ধরন শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে ওরা ইয়ার্কি মারছে। তবু নম্রতার বুক ধ্বক করে উঠল। কানের ভিতর দিয়ে ঢুকে একেবারে শিরা উপশিরায় ঘুরে বেড়াতে লাগল মিথিলার বলা কথাগুলো।

নম্রতা বলল, “কিপ ইওর মাউথ শাট আপ। এইসব ননসেন্স কথাবার্তা একদম বলবি না।”

রিতিমা হেসে বলল, “আরে, হাইপার হয়ে যাচ্ছিস কেন? উই আর জাস্ট জোকিং।”

“তবুও ওই অসভ্যটার কথা আমি আর শুনতে চাই না।”

মিথিলা বলল, “আরে হয়, বেশিরভাগ লাভস্টোরি ঝগড়া থেকেই শুরু হয়। আমার তো এই কয়েক লাইনের চিঠি পড়েই কেমন প্রেম প্রেম পাচ্ছে। আচ্ছা ছেলেটা দেখতে কেমন বল তো।”

মিথিলার প্রশ্ন শুনে নম্রতার কল্পনায় সুদর্শন সেই মুখটি ভেসে উঠল। লোকটার প্রতি প্রচন্ড রাগ জমে আছে এটা সত্যি, কিন্তু তাই বলে তার সৌন্দর্য কে অস্বীকার করার অবকাশ নেই। উচ্চতায় পাঁচ ফিট নয় কিংবা দশ হবে বোধহয়। শক্তপোক্ত পেটানো শরীর। খুব বেশি রোগাও নয় আবার অনেক বেশি মোটাও না। খুর সুন্দরভাবে উচ্চতার সাথে মানিয়ে গেছে শারীরিক আকৃতি। শ্যামলা গায়ের রং। তবে সেই রঙটা যেন সৌন্দর্য বাড়িয়েছে আরও। প্রথমবার ঝগড়ার সময় যদিও এতকিছু ভালো করে খেয়াল করেনি নম্রতা, তবে পরে দুপুরে ডাইনিং রুমে, এবং খাওয়ার কিছুক্ষন পরে যখন লোকটা ওর মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে কী একটা কথা বলে যাচ্ছিল, তখনই তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে ও।

মিথিলা আবার জিজ্ঞাসা করল, “কী হলো! বললি না তো, দেখতে কি খুব বাজে কিংবা গেঁয়ো?”

কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে জবাব দিল নম্রতা, “না। দেখতে বাজে না মোটেও। স্মার্ট এবং ম্যানলি। ইনফ্যান্ট দেখে বোঝার উপায় নেই যে গ্রাম থেকে এসেছে। একবারে শহুরে ছেলেদের মতোই চলাফেরা।”

নম্রতার কথা শেষ হতে না হতেই মিথিলা বলল, “তাহলে তো হয়েই গেল। আচ্ছা, করে কী লোকটা, জানিস?”

“না, জানি না। আর জানতেও চাই না।” নম্রতার কাটকাট জবাব।

মিথিলা বলল, “জানিস না ঠিক আছে। তবে জেনে নিতে তো দোষ নেই।”

“মানে!”

“তুই তো বললি, ওর বোন নাকি এখন তোদের এখানেই আছে। ওকেই ডেকে নিয়ে আয়। ওর থেকে সব ইনফরমেশন নেওয়া যাবে।”

রিতিমা হঠাৎ কথা বলে উঠল, “কী ব্যাপার রে মিথি? তোর তো দেখছি খুব ইন্টারেস্ট লোকটার ব্যাপারে। কাহিনি কী?”
মিথিলার স্বাভাবিক উত্তর, “শুধুই কৌতূহল।”

ওদের জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে চাঁদনীকে ডাকতে গেল নম্রতা। চাঁদনী অবাক হলো খুব। প্রয়োজন ব্যাতীত যে একটা কথা পর্যন্ত বলে না ওর সাথে, সে হঠাৎ আজ বন্ধুদের সাথে পরিচয় করাতে চাইছে কেন? চাঁদনী কিছুটা ইতস্তত করে উঠে দাঁড়াল যাওয়ার জন্য, দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবার ফেরত এলো ফোনটা নেওয়ার জন্য। নম্রতা জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার? আবার ফেরত যাচ্ছ কেন?”

“ফোনটা নেব। আসলে এই সময়টাতে বড় ভাইজান বা তানিম ভাই ফোন দেয় মাঝেমধ্যে।”

“ও।”

চাঁদনীকে দেখে সবার প্রথমেই কথা বলল নিকিতা, “কেমন আছো চাঁদনী?”

“জি, আলহামদুলিল্লাহ। ভালো আছি। আপনি?”

“ভালো। তুমি কিন্তু খুব মিষ্টি দেখতে।”

চাঁদনী এবার আর কোনো জবাব দিল না। নিচের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল।

মিথিলা বলল, “শুনলাম তুমি এমবিবিএস অ্যাডমিশনের জন্য প্রিপারেশন নিচ্ছ?”

“হ্যাঁ।”

“তোমার সাথে কিছুক্ষন গল্প করার জন্য ডেকেছি আসলে। এতে তোমার পড়ার কোনো ক্ষতি হবে না তো?”

“না, আপু। সমস্যা নেই।”

শুধু নিকিতা আর মিথিলাই এটা সেটা গল্প করে যাচ্ছিল চাঁদনীর সাথে। রিতিমা খাটের এককোনে থম মেরে বসেছিল। ওর ধারনা ছিল চাঁদনী অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা গ্রাম্য অসুন্দর একটি মেয়ে হবে হয়তো। কিন্তু চাঁদনীকে সামনাসামনি দেখে ওর সব ধারনাই পালটে গেল। এই মেয়ে সৌন্দর্যে শহরের যেকোনো আর্টিফিশিয়াল সুন্দরীকে টেক্কা দিতে পারবে। কেন জানি, ওর হঠাৎই খুব ইর্ষা হলো চাঁদনীর প্রতি।

মিথিলা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে, “আচ্ছা চাঁদনী, তোমাদের বাড়িতে কে কে আছে?”

“আমাদের একান্নবর্তী পরিবার। আমার বাবা আর চাচা একসাথেই থাকেন।”

“ও, তোমরা কয় ভাইবোন?”

“ছয়জন। আমি সবার ছোট। আমার বড় আরও পাঁচজন ভাই আছে।”

“হোয়াট! এতগুলো ভাই তোমার?”

“আসলে তারা সবাই আমার আপন ভাই না। আমরা মূলত তিন ভাইবোন। বড় ভাইজান, সাদমান ভাই এবং আমি। বাকী তিনজন মানে তামজীদ ভাই, তানিম ভাই এবং তুরাগ ভাই আমার ছোটচাচার ছেলে। তাদের কোনো বোন নেই বলে তারাও আমাকে ঠিক আপন ছোটবোনের মতোই ভালবাসে।”

“ও। আচ্ছা, তোমার ভাইয়েরা কে কী করে?”

চাঁদনী থেমে গেল কিছুক্ষনের জন্য। একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছে মেয়েটা। পরিবারের লোকজন সম্পর্কে জানতে চাওয়া অব্দি ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ভাইদের পেশা সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় কিছুটা অন্যরকম লাগল ওর। চাঁদনী বুঝতে পারল কোনো একটা খটকা আছে। কিছু একটা প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে গেল চাঁদনী। যেহেতু এরা সবাই বয়সে বড় এবং নম্রতার ফ্রেন্ড, এদের পালটা প্রশ্ন করলে সেটা নম্রতার খারাপ লাগতে পারে। তাই ও বলে গেল, “বড় ভাইজান মানে সাখাওয়াত ভাইয়ের বরফ কল আছে। সদরেও ব্যাবসা আছে। পাশাপাশি আমাদের জায়গাজমির তদারকি করে।

তামজীদ ভাই ঢাকাতেই থাকে। এখানকার একটা কলেজের লেকচারার সে।

সাদমান ভাই এখনও সেভাবে কিছু করে না, সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছে আপাতত।

তানিম ভাইয়ের চাকরি পছন্দ নয় বলে সে গ্রাজুয়েশনের পরে ব্যবসা শুরু করেছে গ্রামেই। প্রায় এক একর জায়গা জুড়ে বিশাল আমবাগান আছে তানিম ভাইয়ের নামে। এছাড়াও মাছের ঘের, এবং গঞ্জের বাজারে স্টল আছে অনেকগুলো।

আর তুরাগ ভাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, এইতো।”

“বাহ, বেশ ভালো৷ তোমাদের ফ্যামিলির লোকজনদের ফটো নেই তোমার ফোনে? তোমার মুখে তাদের কথা শুনে দেখতে ইচ্ছে করছে খুব।”

“আমি তো আগে ফোন ইউস করতাম না। এখানে আসার পরে তানিম ভাই এটা কিনে দিয়েছিল। তাই এটাতে তেমন কোনো ফটো নেই বললেই চলে।”

“ওকে, ফাইন।”

আপাতত যা জানার জেনে থেমে গেল মিথিলা। চাঁদনীর দিকে ভালো করে তাকিয়ে কী একটা মনে করে আবার প্রশ্ন করল, “তোমার গায়ের এই গ্লিটারি ওড়নাটা খুব সুন্দর লাগছে। কোথা থেকে নিয়েছ এটা?”

“আমারও এটা খুব পছন্দের। ঢাকা আসার কয়েকদিন আগে ছোটআব্বু মানে আমার চাচা নিজে গঞ্জের বাজার থেকে আমার জন্য পছন্দ করে এটা…।”

কথা শেষ না করেই থেমে গেল চাঁদনী। ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিল, এরা মোটেও ওর পোশাকের প্রশংসা করছে না। বরং ওর পোশাকটা নিয়ে ঠাট্টা করছে। মিথিলা আর রিতিমার মুখের বিদ্রুপাত্মক হাসি দেখে আরও বেশি নিশ্চিত হয়ে গেল চাঁদনী।

নম্রতার খুব একটা ভালো লাগল না বিষয়টা। ও বিরক্ত স্বরে বলল, “তোরা থামবি এবার, প্লিজ।”

দুজনের কেউই নম্রতার কথা কানে তুলল না। রিতিমা হেসে বলল, “মিথিলার কথার মানে তুমি মনেহয় ঠিক ধরতে পারনি চাঁদনী৷ আজকালকার সময়ে তোমার গায়ের এই ড্রেসের ডিজাইনটি একেবারেই বেমানান। এই ড্রেসটায় তোমাকে একেবারে গেঁয়ো ভুতের মতো লাগছে। সত্যি বলতে, কেউ যে আজকাল এসব জঘন্য দেখতে ড্রেস পড়তে পারে, সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার মনেহয় সময়ের সাথে সাথে তোমারও আপডেট হওয়া উচিত। কিছু মনে কোরো না প্লিজ, যেটা সত্যি সেটাই বললাম আমি।”

রিতিমার কথাগুলো শুনে চাঁদনী কথা বলার ভাষাই হারিয়ে ফেলল। বিনা কারণে কোনোরকম শত্রুতা ছাড়াই প্রথম দেখায় একটা মেয়ে আরেকটা মেয়েকে যে এমন বিশ্রীভাবে কথা করতে পারে, সেটা চাঁদনী এর আগে কল্পনাও করতে পারেনি কখনও। মনেহয় এই প্রথমবার কেউ ওর সাথে এত বাজে ভঙ্গিতে কথা বলল। তীব্রভাবে অপমানিত বোধ করল ও। ছোট আব্বুর ভালোবেসে কিনে দেওয়া পোশাকটাকে খারাপ বলায় মন খারাপ হলো খুব। চাঁদনী চোখের পানি আটকানোর প্রাণপণ চেষ্টা করল।

নিকিতা এতক্ষন চুপচাপ এককোনে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখছিল। এবার আর ওর সহ্য হলো না। উত্তেজিত হয়ে বলল,
“এনাফ। অনেক বলে ফেলেছিস। সবারই নিজের রুচি অনুযায়ী পোশাক পড়ার স্বাধীনতা আছে। সেজন্য তুই ওকে যা খুশি তাই বলতে পারিস না। তাছারা ওকে পিতৃতুল্য একজন ভালোবেসে পোশাকটা কিনে দিয়েছে। সেটাকে অন্তত সম্মান করতে শেখ৷ তুই কোনো রিজন ছাড়াই মেয়েটাকে এতক্ষন অপমান করেছিস এবং ওর সাথে মিসবিহেভ করেছিস। সেজন্য এখনই ওর কাছে তোর স্যরি বলা উচিত।”

“ইমপসিবল। গ্রাম থেকে উঠে আসা ক্ষ্যাত একটা মেয়ে। দেখ গিয়ে, চাষাভুষা ফ্যামিলি থেকে উঠে এসেছে হয়তো, একে স্যরি বলব আমি! নো, নেভার। আর তাছাড়া আমি ভুল কিছু বলিনি যে ওকে স্যরি বলতে হবে।”

চাঁদনী বাকরুদ্ধ হয়ে রিতিমার করা অপমান হজম করছিল।

নিকিতা বলল,
“হ্যা সেটাই। ভুল করেও অনুতপ্ত না হওয়া, তোর মতো মেয়ের থেকে এটাই আশা করা যায়।”

“আমার মতো মেয়ে মানে? তুই কী মিন করতে চাইছিস?”

“সেটা তুই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছিস।”

দুজনের মধ্যে ক্রমশই ঝগড়া বেঁধে যাচ্ছে বলে মিথিলা আর নম্রতা ওদের থামাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। ততক্ষনে চাঁদনী চুপচাপ চলে গেছে নম্রতার রুম থেকে।

অনেক চেষ্টার পর পরিবেশ একসময় শান্ত হলো। ওরা তিনজন নম্রতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। চাঁদনীকে বলা রিতিমার কথাগুলো নিয়ে নম্রতাও কিছুটা অপরাধবোধে ভুগল। দ্বিধা-দ্বন্দ্বে কাটল কিছুক্ষন। একবার কি চাঁদনীকে গিয়ে স্যরি বলা উচিৎ ওর? মন সায় দিলেও ইগোতে লাগছে স্যরি বলতে। অনেকক্ষন ভাবার পরে সিদ্ধান্তটা নিল নম্রতা। মনের ইচ্ছেটা শেষপর্যন্ত হেরে গেল ইগোর কাছে। চাঁদনীর কাছে ওর আর যাওয়া হলো না।

আপাতত চাঁদনী আর রিতিমার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল নম্রতা। স্বাভাবিকভাবেই পড়তে বসল। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিল।

কিছুক্ষন ফোন স্ক্রল করে যখন চোখ বন্ধ করল, তখনই হঠাৎ করে মনে পড়ল মিথিলার ইয়ার্কির ছলে বলা কথাগুলো। স্বগোতক্তি করল ও “ওই অসভ্য লোকটা নাকি আমার জন্য পারফেক্ট ম্যাচ হবে। ননসেন্স কথাবার্তা সব।”

না চাইতেও তানিমের মুখটা ভেসে উঠল ওর মনের মধ্যে। এবং এই প্রথমবার নম্রতা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করল, ঠিক প্রথমদিনের মত তীব্রভাবে লোকটাকে ঘৃণা করতে পারছে না ও। বরং কেমন জানি একটা অন্যরকম নাম না জানা ফিলিংস কাজ করছে। নম্রতা বুঝতেও পারল না, নিজের অজান্তেই ওর উর্বর মস্তিষ্কে খুব যত্ন করে ভালোলাগার একটা ছোট্ট বীজ বপন করা হয়ে গেছে। এই বীজ থেকে কিছুদিন পর চারা বের হবে। তারপর সেটা ধীরে ধীরে বড় হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে সদর্পে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। একসময় ভালোলাগার ছোট্ট চারাগাছটি রুপান্তরিত হবে ভালোবাসার এক বিশাল বটবৃক্ষে।

১৪.
কোচিং থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেল চাঁদনী৷ টানা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ভিজে একাকার হয়ে আছে।

ক্লাসরুমের ভিতরে বসে বাইরের আবহাওয়া একদমই বোঝা যায়নি এতক্ষন। আজ সকালে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, তখন জুলাই মাসের চমৎকার রৌদ্রজ্জ্বল একটি সকাল ছিল।

(চলবে ইনশাআল্লাহ)