Sunday, July 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 140



বক্ষপিঞ্জিরায় তুই বন্দীনি পর্ব-৪+৫+৬

0

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৪

{ ১৮+ এলার্ট }

গভীর দৃষ্টিতে আবসারের দিকে তাকিয়ে আছে মিস জুলি পুরো নাম জুলিয়ানা মার্টিন ক‍্যালির্ফোনিয়ার বাসিন্দা। জুলির সাথে আবসারের ব‍্যবসায়িক ক্ষেত্রেই আলাপ হয়। ভীন দেশী জুলিয়ানা মার্টিন মুগ্ধ হয়েছিল আবসারের ব‍্যাক্তিত্বে এই যে মিস জুলি গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার চোখ যেনো আবসারের পোশাক ভেদ করে আবসারের শরীরকে দেখছে এতে আবসারের অস্বস্তি হলেও মুখ তুলে একবারও তাকায় না জুলির দিকে

রিংটোনের শব্দে ঘোর ভাঙ্গে জুলির সে আবসারের দিকে তাকায় ফোনের দিকে তাকিয়ে আবসারের মুখে হাসি ফুটল আবসারের সেই হাসি জুলিয়ানার বুকটা আরো জ্বালিয়ে দিলো

— মিস মার্টিন ক‍্যান উই পোসপন্ড দিস মিটিং

— হোয়াই এ এস

— ফর পারসোনাল রিজন আই উইল ইনর্ফম ইউ আওয়ার নেক্সট মিটিং ডেট বলেই গট গট পায়ে বেরিয়ে পরে মিটিং রুম থেকে মিস জুলিয়ানাকে কিছু বলতে না দিয়ে।
মিটিং রুম থেকে বের হতেই দেখে ফোনটা কেটে গেছে ফুস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে আবসার। সে ঢাকা এসেছে আজ প্রায় একসপ্তাহ এই একসপ্তাহে খুব একটা কথা হয়নি ওয়াসিমার সাথে সে বেশি ডিস্টার্ব ও করেনি কারণ সামনে মেয়েটার এইচ এস সি পরীক্ষা এখন আবসার যদি ওয়াসিমার সান্নিধ্য পায় সে নিজেই মেয়েটার মধ‍্যে মজে থাকবে কোনো পড়া বা কিছু করার সুযোগ দিবে না কিন্তু কাল তো যেতেই হবে তার নানা নানী আসবে ওয়াসিমাকে দেখতে তারউপর দিলরুবা সাখাওয়াত ও এখন আলমনগর আছে সে না গেলে হবে না তাহলে তান্ডব বয়ে যাবে। ভেবেই তার পারসোনাল অ‍্যাসিসট‍্যান্ট পিয়াসকে ফোন দেয় — আগামী দুই দিনের আমার যত মিটিং আছে সব পোসপন্ট করো বলেই রেখে দিয়ে চেয়ারে গা এলিয়ে দেয় তার এখন তৃষ্ণা জেগেছে তার শুভ্র বউকে দেখার তৃষ্ণা

— এই মেয়েটাকে যদি আমি পিষে না ফেলেছি তাহলে আমার নাম আবসার সাখাওয়াত না বিড়বিড় করে বলল।

___________________

ওয়াসিমা ফোনের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু আগে সেই ফোন দিয়েছিল আবসারকে কিন্তু আবসার ফোন রিসিভ করে নি কাল থেকে সে টেনশনে মরছে আর এই লোক নিজের দুনিয়ায় মজে আছে বিড়বিড় করে বলল ওয়াসিমা।
গতকাল রাতেই তাকে সাখাওয়াত বাড়িতে যাওয়ার হুকুম করছে দিলরুবা সাখাওয়াত খবরটা কাল রাতে একজন দারোয়ান এসে দিয়ে গেছে।
একটু পর আরু আসবে তাকে নিতে সেটাই সকালে আরু তার মা আকলিমা রহমানের ফোনে কল করে জানিয়ে দিয়েছে। আকলিমা মেয়ের ঘরে উকি মেরে দেখে মেয়ে চিন্তিত মুখে বসে আছে

— কি হয়েছে আমার মায়ের
বলেই ওয়াসিমার পাশে বসল ওয়াসিমাও মায়ের কোলে মাথা গুজে দিল আকলিমা মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করে — কি হয়েছে মা

— আচ্ছা আম্মু আমি কি তোমাদের কাছে এতোই বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম যে একজন লোক জোর করল তার হাতে আমাকে তুলে দিলে। লোকটা আমার ভাইয়ের বন্ধু হলেও হাতে গোনা কয়েকবার তার সাথে আমার দেখা হয়েছিল চিনিনা জানিনা এমন একটা লোকের সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিলে।

ওয়াসিমার কথা শুনে চিন্তিত হয় আকলিমা মেয়েটা আজ একসপ্তাহ হয়েছে বাসায় এসেছে সেদিন আবসার দিয়ে গেলেও থাকেনি সে এরপর থেকে মেয়েটাকে খুব একটা জামাইয়ের সাথে কথাও বলতে শুনে নি তাহলে কি সে আবসারের চোখে ভুল দেখল সে যে সেদিন আবসারের চোখে ওয়াসিমার জন‍্যে একরাশ ভালোবাসা দেখেছিল যা তিনি বিয়ের এতো বছর পরেও ইরফান রহমানের চোখে দেখেন আর আবসার দশের মধ‍্যে একজন ছেলে নম্র ভদ্র সবাই তার প্রশংসা করে তাইতো সেদিন আবসার জোর করায় সেও দ্বিমত করেনি বীনা দ্বিধায় দিয়েছিল ওয়াসিমার হাত আবসারের হাতে তাই চিন্তিত স্বরেই জিজ্ঞাসা করলেন

— কেনো আম্মু তোমার কি সেখানে কোনো প্রকার কষ্ট হচ্ছে

— কষ্ট তো তখন বুঝবো যখন আমি সেখানে থাকব বিয়ের আট দিন হয়েছে সাত দিন ধরে তো আমি এখানেই আছি কিভাবে বুঝব কিন্তু প্রথম দিন সবাইকে ভালোই লেগেছে বাকীটা আল্লাহর হাতে

ওয়াসিমার কথা শুনে বুকটা ধক করে উঠে আকলিমার সে কি মেয়ের ভালো চাইতে গিয়ে খারাপ করে ফেলল। সবাই বলে ঘরের ছোট মেয়েরা নাকি চঞ্চল দুষ্টু হয় কিন্তু সেদিকে ওয়াসিমা ভিন্নধর্মী শান্ত শিষ্ট নম্র সভাবের মেয়ে তার পাচঁ ওয়াক্ত নামাজী যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখে চলে সেই দিকে অরিক আলাদা দুষ্টু চঞ্চল কিন্তু ছেলে মেয়ে দুটোই তাদের বাবা মায়ের গর্ব ছেলেটা তাদের জেলার সরকারি কলেজের শিক্ষক মেয়েটারও স্বপ্ন ডাক্তার হওয়ার।

— লিমা
ইরফান রহমানের হাক ডাকে ঘোর ভাঙ্গে আকলিমার
— লিমা দেখে যাও কে এসেছে
— কে ঘরের থেকে বের হতে হতে জিজ্ঞেস করে আকলিমা

— আসসালামু আলাইকুম আন্টি আমি আবসারের ভাইয়ের ছোট বোন আরিশা নিজের পরিচয় দিয়ে বলল

— ওয়ালাইকুম আসসালাম আম্মাজান ভালো আছেন মিষ্টি হেসে বলেন আকলিমা

আকলিমার মিষ্টি ব‍্যবহারের বেশ মুগ্ধ হয় আরিশা তার মনে হয় মানুষ গুলো বেশ ভালো

— আম্মাজান আপনি বসেন আমি নাস্তা আনি

— না না আন্টি এতো ব‍্যস্তা হবার দরকার নেই আমি বাসা থেকে নাস্তা করেই এসেছি

— সে অনেক্ষণ হয়েছে তা এতোক্ষণে হজম হয়ে গেছে আপনি বসেন তো মেয়েটার সাথে গল্প করেন শেষের কথাটুকু ইরফান রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল।

— বসেন আম্মাজান এখন আপনার আন্টি এখন দুনিয়া উল্টে গেলেও থামবে না বলেই হালকা হাসে তার হাসি দেখে আরুও হাসে ভাবে লোক গুলো আসলেই ভালো এই জন‍্যেই তার ভাবিটাও ভালো। আরিশা বেশ খুশী তার ভাইয়ের জন‍্যে যাক আল্লাহ্ দয়ায় এইবার অন্তত তার ভাইয়ের জীবনে সুখ নামক বস্তটা ধরা দিবে।
মনে মনে আরিশা নিজের ভাইয়ের জন‍্য দোয়াও চাইল

_________________

দিলরুবা সাখাওয়াত এবং ইসমাত আরা বেগম বসে আছে সামনাসামনি দুইজনের মুখ ভঙ্গিতে চরম বিরক্তিতে ছেয়ে আছে তাদের দুইজনের অবস্থা বর্তমানে এমন যেনো তাদের কেউ নিম পাতা ও করল্লা মিক্স করে শরবত খাইয়েছে।

তাদের দেখে আশে পাশের সবাই মিট মিট করে হাসছে আরিশা তো পারেনা দম ফাটিয়ে হাসতে। কেননা একটু আগেও এখানে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। আবসারের একধমকে থামে দুইজন

আবসার আর ওয়াসিমা এখনো নিচে নামে নি ওয়াসিমা বর্তমানে চাচী শাশুড়ির ঘরে অবস্থান করেছে

— মাশাল্লাহ্ আমাদের আবুর পছন্দ আছে
তানিয়া সাখাওয়াত মুগ্ধ হয় ওয়াসিমাকে দেখে পাট ভাঙ্গা লাল শাড়ি ওয়াসিমার জোরাজুরিতে মাথায় হিজাব পরিয়ে দিয়েছে বড় বড় চোখ কাজল পড়েছে এই অল্প সাজটুকু যেনো ওয়াসিমার রূপ খুলেছে।

_________________

ওয়াসিমাকে নিয়ে নিচে নামল আলিয়া সাখাওয়াত এবং তানিয়া সাখাওয়াত তাকে আবসারের নানী ইসমাত আরা আর নানা ভাই কায়সারে সাহেবের মাঝখানে বসায়। ওয়াসিমা মৃদুস্বরে সালাম দেয়
আবসারের নানী নানা ভাই দুইজনেরই ওয়াসিমাকে বেশ পছন্দ হয় তারা ওয়াসিমা দোয়া করেন সাথে ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করেন ওয়াসিমা তাদের সাথে হেসে গল্প করে। আবসারের নানী নানার সাথে ওয়াসিমাকে হেসে হেসে কথা বলতে দেখে মুখ বাকায় দিলরুবা সাখাওয়াত।

একটু পরে আবসারের নানা কায়সার সাহেব উঠে যেতেই কোথা থেকে আবসার এসে ধপ করে বসে পরে সেখানে একদম ওয়াসিমার গা ঘেসে বসে ওয়াসিমা একটু সরতে নিলেই আবসার ওয়াসিমার শাড়ির কুচিতে পারা দেয় যাতে ওয়াসিমা নড়াচড়া করতে না পারে। ওয়াসিমা আবসারের দিকে তাকায় সে এমন ভাবে বসে আছে যেনো সে কিছুই জানে না

— কি করছেন কুচি ছাড়েন প্লিজ

— ঘরে আসো ওয়াসিমার কথার জবাব না দিয়ে বলে আবসার

— এখন কিভাবে যাবো আর এতোদিন পরে আমার কথা মনে পরল তাহলে ওয়াসিমার অভিমানী স্বরে যার পুরোটাই টের পেলো আবসার কিন্তু কিছু না বলে দাড়িয়ে যায় আর যাওয়ার আগে ওয়াসিমাকে ঘরে যাওয়ার ইঙ্গিত করে দিয়ে যায়।

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৫

সাখাওয়াত ভিলা পুরোটা কবে আমাদের হবে। সাখাওয়াত ভিলার আলিশান বেডে শুয়ে লোকটি জিজ্ঞেস করল রমনীটিকে
— এখনতো আর এহসান সাখাওয়াত ও আসে না এই বাড়িতে সেই হিসেবে পুরো বাড়িটাই তো আমাদের তাই না রমনীটি লোকটির বুকে মুখ গুজে উত্তর দিলো

–হিসেবে হওয়া আর কাগজে কলমে হওয়ার মধ‍্যে একটা তফাৎ আছে সেইটা তুমি বুঝবা না বলেই রমনীটিকে উঠিয়ে ঘর থেকে বের হয় গেলো বার কাউন্টারে সেখানে বসে নিজের মতো ড্রিংকস করতে লাগল তার পিছু গেলো তাকে দেখে কেউ বলবে তিনি পঞ্চান্ন বছরের রমনী ক্রমাগত ফেসিয়াল ডায়েটিং তার উপর আবার শরীরের বাধন ভালো থাকার দারুন তাকে যে কেউ বলবে পয়ত্রিশ বছর বয়সী মহিলা।

— চিন্তা করোনা বাড়ি পুরোটাই আমি দানিশের নামে করে দিব

— দানিশের নামে না আমি বাড়িটা ফাহাদের নামে চাই বলেই নিজের মতো ড্রিংকস করতে লাগল

— কেনো তোমার সব কিছুই তো ফাহাদের নামে আর বাড়িটা অন্তত আমাদের ছেলে দানিশের নামে থাকুক
মহিলাটির কথা শুনে লোকটি তার দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে মহিলাটি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লোকটির চলে যাওয়ার দিকে।

________________

আবসারের বাইকের পিছনে বসে আছে ওয়াসিমা আবসারের কাধে তার হাত গম্ভীর মুখে আবসার বাইক চালাচ্ছে বাইক চালানোর অবস্থায় সামনের মিররে ওয়াসিমাকে দেখেতে ভুলে না এক ঝলক তাকাতে বুঝে যায় তার বউ গভীর চিন্তায় ব‍্যস্ত তাই আবসার গম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করল — কিছু হয়েছে কি চিন্তা করছিস

আবসারের কথায় ধ‍্যান ভাঙ্গে ওয়াসিমার সে মুখে হালকা হাসির রেখা টেনে বলল — না কি হবে

আবসার ওয়াসিমার মুখের দিকে তাকিয়ে একবার হুম বলে আবার নিজের মতো কাজ করতে থাকে।

আর ওয়াসিমা ডুবে যায় ভাবনায় তার মনে পরে সকালে ওয়াসিমা শশুর বাড়িতে গেলেও দুপুরে ওয়াসিমার বাপের বাড়ির সবাইকেই দাওয়াত দেওয়া হয়। সেই উপলক্ষ্যে সবাই ওয়াসিমার বাবা মা সহ অরিক ও পৌঁছে যায় সেখানে অরিককে সবাই আগে চিনলেও তার বাবা মায়ের সাথে নতুন পরিচয় তার উপর আবার নতূন তাই ড্রয়িং রুমে সকল পুরুষরা উপস্থিত থাকলেও সকল মহিলারা ছিলো রান্নাঘরে শুধু দিলরুবা সাখাওয়াত বাদে সেখানে ইসমাত আরাও উপস্থিত ছিলো তিনি আবসারের পছন্দের সরষে ইলিশ রান্না করছিল তিনি যখনই এখানে আসেন আবসারের জন‍্য রান্না করে।

সবাই যখন নিজেদের কাজে ব‍্যস্ত ওয়াসিমাকে মিষ্টি জাতীয় কিছু বানানোর জন‍্য বলা হয়েছে তাই সে নিজের মতোই কাজ করতেছিল তখন আলিয়া সাখাওয়াতের কথায় অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়

— আন্টি কত চামচ সরিষা বেটে নিব

কেউ কি নিজের মাকে আন্টি বলে ভেবে পায়না ওয়াসিমা
আলিয়া সাখাওয়াতের কথা ওয়াসিমা একবার শাশুড়ি ও একবার নানী শাশুড়ির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। আলিয়া সাখাওয়াত ও বুঝতে পারে তিনি ভুল জায়গা কথাটা বলে ফেলেছেন তাই আর কিছু না বলে নিজের মতো কাজ করতে থাকেন।
ওয়াসিমাও কেউ কিছু বলছে না দেখে কিছু না বলে নিজের কাজ শুরু করে কিন্তু মনের খুতখুতানি থেকেই যায় তারপর ও সে কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারছে না কেননা সে নতুন বউ কাউকে এখনই কিছু জিজ্ঞাসা করাটা অনুচিত মনে হবে।

— নাম
— হু

— বাসায় এসে গেছি নাম
আবসারের কথায় ধ‍্যান ভাঙ্গে ওয়াসিমার সে এতক্ষণে নিজের ভাবনার দুনিয়ায় ছিলো সামনে সামনে তাকিয়ে দেখে তাদের বাড়ির সামনে চলে এসেছে। ওয়াসিমার বাবা মা বিকালের দিকে চলে আসলেও ওয়াসিমা আসতে পারেনি সে নানা শশুর নানী শাশুড়িকে বিদায় দিয়ে এসেছে। গ্রাম অঞ্চলে রাত আটটা মানেই গভীর রাত আর ওয়াসিমাদের বাড়িটা একটু গ্রামের দিকেই।

— আপনি যাবেন না ভিতরে

— না আমি রাতের গাড়িতেই ঢাকা ব‍্যাক করব

— একটা দিন থেকে গেলে হয় না অনুনয়ের স্বরে বলল ওয়াসিমা

— থাকলে আমার লাভ
আবসারের কথায় ভরকে যায় ওয়াসিমা শশুর বাড়িতে থাকবে তার আবার লাভ লোকসানের কথা আসছে কোথা থেকে তাই সে অবুজ স্বরেই জিজ্ঞেস করল -” মানে

— এখানে যে থাকব তাতে আমার লাভ কি আপনি তো ব‍্যস্ত মানুষ তাইতো সকাল থেকে আপনার ছায়াটাও দেখে যায়নি রুমের ভিতর

আবসারের কথায় বুঝল সকালের বিষয়টা নিয়েই এই লোক আছে এখন তাই সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল — লাভ লোকসান দেখা লাগে শশুর বাড়িতে থাকতে আর আপনি আগে থাকেন তারপরেই না দেখতে পাবেন লাভ হয় না লোকসান হয়।

ওয়াসিমার কথা শুনে প্রথমে মুখ গম্ভীর থাকলেও শেষের কথাটুকু শুনে তার মুখে হাসি ফুটে ওঠে তাড়াতাড়ি বাইক বাড়ির উঠোনে পার্কিং করে ততক্ষণে ওয়াসিমা ভিতরে প্রবেশ করে আবসারও তার পিছু নেয়।

_______________________

বারান্দায় রকিং চেয়ারে চিন্তিত মুখে বসে আছে এজাজ সাখাওয়াত ঘরে ঘুমানোর জন‍্য বিছানা ঠিক করছে আলিয়া সাখাওয়াত

— কই গো এসো ঘুমাবে
বলেই হাক ছেড়ে স্বামাকে ঘুমানোর জন‍্য ডাকলেন আলিয়া সাখাওয়াত বালিশ দুইটা দুই পাশে রেখেও যখন দেখলেন এছাজ সাখাওয়াত ঘরে আসেনি তখন তিনি বারান্দায় যান স্বামীর কাছে — কি হয়েছে তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে স্বামীর কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করে আলিয়া সাখাওয়াত
তার কথা শুনে তার দিকে তাকায় এজাজ সাখাওয়াত কিছু না বলে স্ত্রীর হাত ধরে তাকে ঘরে নিয়ে আসে নিজের পাশে বসায়

— আমার কারণে তোমার জীবনটা বিপর্যয় হয়ে গেলো তাইনা আলিয়া স্ত্রীর দুই হাত নিজের মুঠোয় ভরে বলল

— হঠাৎ এই কথা

— হঠাৎই না আলিয়া আসলেই আমার কারণে তোমার জীবনটা এলোমেলো ভালোবাসলেও সাংসারিক সুখ আমি তোমাকে দিতে পারিনি বেশীর ভাগ সময়ই পড়ে থাকি বাড়ির বাইরে ইভেন আমার বড় ছেলেটাকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করেছো আমার কারণে আমাদের ছেলেটাও আমাদের কাছে নেই।
স্বামীর কথা শুনে ডুকরে কেদে উঠল আলিয়া সাখাওয়াত পুরোনো ক্ষত আবার তাজা হয়ে গেছে তাইতো কান্নাভেজা কন্ঠেই বলল — হ‍্যা হ‍্যা তোমার জন‍্যই সব কিছু হয়েছে তুমি দায়ী সব কিছুর জন‍্য বলেই এজাজ সাখাওয়াতের বুকে এলোপাথাড়ি কিল মারা শুরু করল আলিয়া সাখাওয়াত। এজাজ সাখাওয়াত ক্রন্দনরত স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে নেয় সেই অবস্থায় আবার বলে– আবসার আমাকে আবার ঢাকার অফিসে জয়ন করতে বলেছে

— কি আবার ঢাকা না না ঐ অভিশপ্ত শহরে আমি আর যাব না ইভেন তোমাকেও যেতে দিব বলেই স্বামীর জামার অংশ খামচে ধরে।
এজাজ সাখাওয়াত চিন্তিত ভঙ্গিতে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে তাকে শান্ত করে।

_________________________

আকলিমা বিড়বিড় করে মেয়েকে বকছে আর কাজ করতে কিছুক্ষণ পরে ওয়াসিমাও এসে হাতে হাতে কাজ করতে থাকে মায়ের সাথে

— মা এতো টেনশন করোনা উনি রাতে এতো খায় না আমি দুই দিন ছিলাম ঐ বাড়িতে দুই দিনেই দেখেছি রাতে হালকা খাবার খায়।

— তুই চুপ থাক মেয়ে জামাই প্রথম আমাদের বাড়িতে এসেছে নরমাল খাবার দেওয়া যায় নাকি বলেই আবারও নিজের কাজ করতে থাকে ওয়াসিমাও কিছু বলে না।

_____ ছাদে আড্ডা বসিয়েছে অরিক আবসার তাদের আড্ডার মধ‍্যে অরিকই বেশি কথা বলছে আবসার শুধু হু হা করে চলেছে।

— আমরা চাচ্ছি ওয়াসু মনির এইচ এস সি এক্সামের পর লাবনীকে তুলে নিয়ে আসতে
অরিকের কথা শুনে আবসার ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বলে — এই লাবনী কে আর তুই না বিবাহিত তারপরও একটা মেয়েকে তুলে আনার চিন্তা করতে লজ্জা করে না

— চুপ কর শা*লা আমার বিয়ের দিন আমার বউকে যে জামাল গোটা খাইয়ে আমাদের ব্ল‍্যাকমেইল করে আমার বোনটাকে বিয়ে করে নিলি বেটা যার ফায়দা উঠিয়ে বিয়ে করলি তার নাম ও জানিস না দাতে দাত চেপে বলল অরিক

— তোর বউয়ের নাম লাবনী

— আজ্ঞে হ‍্যা

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৬

ভালোবাসা সতো সুপ্ত এক অনুভূতি যা আবসার নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ের জন‍্য সৃষ্টি হয়েছিল কিন্তু সেটা পাত্তা দেয়নি পরবর্তীতে তার প্রত‍্যেকটা দিন কেটেছে ওয়াসিমাকে ভেবে সেই অনূভুতি যেনো প্রখর না হয় তাই তো খুব একটা গ্রামেও আসত না এমনিতে আবসার খুব একটা গ্রামে আসে না কিন্তু সেদিন বিয়ের খবর পেতেই দিন দুনিয়া ভুলে চলে আসে প্রিয়তমাকে নিজের করতে করেও নিয়ে ফেলে
পুরোনো সৃত্মি ভেবেই হাসি ফুটে আবসারের। আবসারকে একা একা হাসতে দেখে ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকায় অরিক

— কিরে ভুতে ধরছে নাকি একা একা হাসছিস যে

— হু কিছু না স্তম্ভিতে ফিরে আবসার বলেই আবসার অন‍্য কথা উঠায় এর মধ‍্যেই নিচে রাতের খাবারের জন‍্য ডাক পরে নিচে নেমে আসে দুই বন্ধু
টেবিলে খাবারের বাহার দেখে অরিক বলে — কি আম্মু এতো খাবারের ব‍্যবস্থা কেনো
অরিকের কথা শুনে চোখ রাঙ্গায় আকলিমা রহমান।
সবাই খেতে বসে ইরফান রহমানও বসে সেখানে আবসারকে দেখে মুখটা গম্ভীর করে রাখে ইরফান রহমানের গম্ভীর মুখ দেখে আকলিমা আর ওয়াসিমা একে অপরের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে

— আম্মু তুমিও বসে পড়ো ওয়াসু মনি তুইও বসে পড় ভাই তোকে খাইয়ে দিচ্ছি
ভাইয়ের কথা ওয়াসিমা উচ্ছসিত পায়ে বসে পড়ে
অরিক ওয়াসিমাকে নিজের হাতে খাওয়ানো শুরু করে।
আবসার তাকিয়ে দেখে ওয়াসিমার উচ্ছাস তার ভালো লাগে ভাই বোনের এই ভালোবাসা তারও মনে পড়ে তার ভাইয়ের কথা কিন্তু আজ তারা পরিস্থিতির কারণে আলাদা। অবশ‍্য তার কারো সাথেই খুব একটা ভালো সম্পর্ক নেই সে বাসায় থাকলেও চুপচাপ থাকে সে কারো সাথেই কথা খুব একটা বলে না শুধু আরু ছাড়া একমাত্র আরুর সাথেই সে মোটামুটি কথাবার্তা বলে নাহলে না।

ওয়াসিমা ও আকলিমা রহমান টেবিলের সব খাবার গুছিয়ে বেচে যাওয়া খাবার ফ্রিজে রাখছে নাহলে এই গরমে খাবার নষ্ট হয়ে যাবে আকলিমা অনেক বার বলেও মেয়েকে পাশ থেকে সরাতে পারেনি তাই অগত‍্যা হার মেনে নিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে।
একটু পরেই ঘড়ির কাটা এগারোটা বাজলেই ঘরে ঢোকে ওয়াসিমা দরজার সামনে দাড়াতেই দেখে আবসার পায়চারি করছে আর বিড়বিড় করে কি যেনো বলছে।

— এতোক্ষণ লাগল কেনো সেই কখন না খাওয়া দাওয়া শেষ ওয়াসিমা ঘরে ঢুকতেই আবসার জিজ্ঞাসা করল
উত্তরে ওয়াসিমা মিষ্টি হেসে বলল — আম্মুর সাথে একটু এগিয়ে দিচ্ছিলাম

— ওহ নামাজ পরেছ
— হ‍্যা রান্নার মাঝখানে পড়ে নিয়েছিলাম বলেই ওয়াসিমা ওয়াশরুমে চলে যায়। আবসার ওয়াসিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিছানায় বসে ফোনের মেইল চেক করতে থাকে।
ওয়াশরুমের গেইট খোলার শব্দে সেদিকে তাকায় আবসার ওয়াসিমা হাত মুখ মুছতে মুছতে বের হচ্ছে।
ওয়াসিমা আবসারের দিকে একবার তাকিয়ে চলে যায় বারান্দায় গামছা মেলে দিতে কোমরে এক উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে কুকরে গেলো আবসারের হাত অবাধে বিচরণ করছে ওয়াসিমার উন্মুক্ত উদরে ওয়াসিমার ঘাড়ে নাক ঘসতে ঘসতে বলল — লাভ লোকসানের হিসাব করছিলাম না কই লাভের কিছুই তো পেলাম না উল্টো লোকসানের খাতায় নাম লেখালাম

— লাভ হিসেবে কি চাই আপনার ( কাপা কাপা স্বরে বলল ওয়াসিমা )
ওয়াসিমার কথা শুনে আবসার তাকে একটানে সামনে ঘুড়িয়ে নেয় ওয়াসিমা চোখ বন্ধ করে রেখেছে ওয়াসিমার সারা মুখে বন্ধ চোখে অধর ছোয়ায়। ওয়াসিমা নিভু নিভু চোখে তাকায় দেখে আবসার তার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে

— কিস মি বউ ঘোর লাগা কন্ঠে বলল আবসার
আবসারের কথা শুনে ওয়াসিমা লজ্জায় খামচে ধরে আবসারের টিশার্টের অংশ। কোনোভাবে মাথা নাড়িয়ে না করে

— উহু মানব না আমার দাবী মানতে হবে

— প্লিজ আমার লজ্জা করে

— উহু সেদিনই না লজ্জা ভেঙ্গে দিলাম

— সেদিনের পর সাত দিন কেটে গেছে বলেই জিব কাটল ওয়াসিমা কি বেফাঁস কথা বলে ফেলেছে এখন এই লোক তাকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলবে ওয়াসিমার কথা উত্তরে আবসার কিছু বলতে নিবে তখনই কর্কশ শব্দে আবসারের ফোনটা বেজে উঠল। আবসার বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোনটা পকেট থেকে বের করেই ভ্রু কুচকে ফেলে তার অ‍্যাসিসট‍্যান্ট পিয়াস ফোন দিয়েছে এই সময় তো তার অ‍্যাসিসট‍্যান্ট ফোন দেয় না আর এই সিমের নাম্বার তো তার জানার কথা না।
আবসার ফোন ধরতেই ঐ পাশ থেকে সালাম দিলো
— ওয়ালাইকুম আসসালাম পিয়াস বলো

— স‍্যার ইমাজেন্সি একটু আসতে হবে ফ‍্যাক্টরির ওর্য়াকাররা ঝামেলা করছে আর নতুন প্রজেক্টের জন‍্য যেই জায়গাটা সরকার ঠিক করেছে সেই জায়গাই যেই বস্তির লোকজন থাকত তারা জায়গা ছাড়তে নারাজ।

— আমি আসছি পিয়াস সকাল এগারোটায় ওর্য়াকারদের একসাথে থাকতে বলো আর ঐ ম‍্যাটার ভেবে সলভ করবো বলেই ফোন কেটে আরেকটা ফোন কল করে

— হ‍্যা একটা টিকিট কেটে রাখো স্লিপার কোচের আমি আধ ঘন্টার মধ‍্যে পৌঁছে যাব বলেই আবসার রেডি হয়।

— কোনো সমস‍্যা এখনই চলে যাবেন আবসারের ঘড়ি এগিয়ে দিতে দিতে বলল ওয়াসিমা

— হুম এখনই বের হবো একটু জরুরি কাজ পরে গেছে তুমি নিজের খেয়াল রেখো আর ঠিক মতো থেকো বলেই ওয়াসিমার কপালে একটা দীর্ঘ চুমু দিয়ে বের হয় আবসারের পিছু পিছু ওয়াসিমাও বের হয় তাকে সদর দরজা পযর্ন্ত এগিয়ে দিয়ে সেখানেই দাড়িয়ে থাকে কতক্ষণ।

তার মনটা অশান্ত হয়ে গেছে বিড়বিড় করে আল্লাহর কাছে আবসারের সুস্থতা ও বিপদ মুক্তির দোয়া চায় আল্লাহর কাছে।

____________________

এভাবেই কেটে গেছে তিন মাস এই তিনটা মাস আবসার একবারো আলম নগর আসার সুযোগ পায়নি আজকে ওয়াসিমা এইচ এস সির প্রথম পরীক্ষা। ওয়াসিমার মনটা বেশ উদাসীন ও ভয়ে জর্জরিত আবসারের সাথে কালকে রাতেও কথা হয়েছে লোকটা খুব একটা কথা বলে নি ইভেন কালকে রাতে ভিডিও কলও দেয় নি কোনো বিপদ হলো নাতো ভেবেই ওয়াসিমা উদাসীন আর প্রথম পরীক্ষা সেই নিয়ে একটু ভয়ে আছে অবশ‍্য তার প্রিপারেশন বেশ ভালো কিন্তু তারপরও ভয়টা এসেই পরে।

— ওয়াসু মনি দ্রুত কর আবার হলে যেয়ে সীট খুজতে দেরী হবে
অরিকের ডাকে ওয়াসিমার ভাবনা ভাঙ্গে সে দ্রুত ব‍্যাগ নিয়ে বের হয় মা বাবার থেকে দোয়া নিয়ে সে সহ অরিক বের হয়

পরীক্ষা হলের সামনে দাড়ানো ব‍্যাক্তিকে দেখে ওয়াসিমার পা সেখানেই থেমে যায়।
আবসার অরিকের সাথে কোলাকুলি করে

— তুই না বললি আসতে পারবি না

— আসতে হলো বলেই ওয়াসিমার দিকে তাকায় অরিক বন্ধু আর বোনকে আলাদা স্পেস দিয়ে সামনে আগায় আর যাওয়ার আগে বলে যায় সে ওয়াসিমার সীট খুজে রাখবে। অরিক যেহেতু এই কলেজের টিচার সেই হিসেবে সেও টিচার্স রুমে গিয়ে এন্ট্রি করে বের হয় ওয়াসীমার রুমের সীটের তালিকা দেখতে।

— গাড়ির ভিতরে ঢুকে বস

— কেনো এটা কার গাড়ি আর আপনি কখন এলেন একসাথে গড়গড় করে বলল ওয়াসিমা

— আগে উঠে বস তারপর বলছি
ওয়াসিমাও কথা বাড়ায় না চুপচাপ গাড়ির ভিতরে ব‍্যাক সীটে বসে পড়ে আবসার ওপর পাশ দিয়ে বসে গাড়ি লক করে বসে হ‍্যাচকা টানে ওয়াসিমাকে বুকে জড়িয়ে নেয়। ওয়াসিমাও চুপ করে আবসারের বুকে মাথা রাখে তার ঢুকরে কান্না আসছে সে এখন চাচ্ছে না কান্নাকাটি করতে
— কান্না আসলে থামিয়ে রাখতে নেই বউ
আবসারের আহ্লাদ মাখা কথা শুনে ওয়াসিমা নিজেকে থামিয়ে রাখতে পারে না কান্না করে দেয়।

#চলবে

বক্ষপিঞ্জিরায় তুই বন্দীনি পর্ব-২+৩

0

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_২

( ১৮+ এলার্ট )

রাগ আর কান্না মিশ্রিত নয়নে তাকিয়ে আছে ওয়াসিমা। সর্ব শরীর যেমন ব‍্যাথা করতেছে তেমন আবসারের প্রতি রাগও হচ্ছে।

— ওমন করে তাকিয়ে আছিস কেনো শুভ্র বউ মনে হচ্ছে এখনি কাচা খেয়ে ফেলবি

— তো কি করব প্রেম করব আপনার সাথে অসভ‍্য লোক একে তো জোর করে বিয়ে করছেন তার উপর আপনি আমার পুরো শরীরে ব‍্যাথা করে দিছেন।

আবসার একটু এদিক ওদিক তাকিয়ে বোকা হেসে ওয়াসিমাকে বলে — ছি শুভ্র বউ আমার ভালোবাসাকে তুমি এভাবে বলতে পারলা আর আমি কি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি নাকি

— মানে এই আপনি কি বলতে চাইছেন কালকে এতো এতো কাহিনি করে আমাকে বিয়ে করে এখন নাটক করা হচ্ছে ( আবসারের গলা চেপে ধরে বলল ওয়াসিমা )

ওয়াসিমার কথা শুনে আবসার ওয়াসিমাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে — আমি কি তোকে কোনো ভাবে জোর করেছি বা কিছু বলেছি

আবসারের বক্ষে মিশে থেকেই না বোধক মাথা নাড়ে ওয়াসিমা — কিন্তু চোখ রাঙানো দিয়ে হ‍্যা তো বলিয়ে ছিলেন।

— আমার জানা মতে তুই তো ম‍্যাচিউরড সাহসী তোর তো আমার চোখ রাঙানোতে ভয় পাওয়ার কথা না ( দুষ্টু স্বরে বলে আবসার )

আবসারের দুষ্টু স্বর বুঝতে পেরে তার বুকে অনবরত কিল মারা শুরু করে ওয়াসিমা

— আরে আরে ব‍্যাথা পাই তো শুভ্র বউ
কথার মাঝেই ব‍্যাথায় কুকড়ে উঠল ওয়াসিমা বলিষ্ট দেহী আবসারের ভালোবাসার ঝড় ওয়াসিমাকে নিস্তেজ করে ফেলে। তাই তো এতক্ষণ কান্নাভেজা স্বরে এতো অভিযোগ করল ওয়াসিমা।

আবসার আর কিছু না বলে ওয়াসিমাকে নিজের টিশার্ট পরিয়ে নিজের কমোরে বেডে থাকা চাদরটা জড়িয়ে ওয়াসিমাকে নিয়ে যায় ওয়াশরুমে। ব‍্যাথায় কুকড়ে থাকা ওয়াসিমাকে দাড় করিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দিতেই শব্দ করে কেদেঁ দেয় ওয়াসিমা।

— আম সরি বউ আম রেলি ভেরি সরি ( বিড়বিড় করে করুণ স্বরে সরি বলছে আর পুরো মুখে ছোট ছোট চুমু দিচ্ছে )
আবসারের বিড়বিড় করে বলা কথা ওয়াসিমার কান পযর্ন্ত পৌছালেও সে বর্তমানে কিছু বলার মতো অবস্থায় নেই।

দীর্ঘ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে দুইজন বের হয় ওয়াশরুম থেকে সে ওয়াসিমকে কোনো রকম নিজের একটা টিশার্ট পরিয়ে দেয়। হঠাৎই বিয়ে হওয়ার দারুন কিছু কেনা হয়নি আবসারের ওয়াসিমার জন‍্য। ওয়াসিমাকে বেডে শুয়িয়ে আবসার দ্রুত নিচে নেমে হট ওয়াটার ব‍্যাগে করে গরম পানি সহ কিছু খাবার নিয়ে যায়।

— ওয়াসু সোজা হ পেটে এই ব‍্যাগটা ধর বলেই ওয়াসিমাকে সোজা করে হেড বোর্ডের সাথে হ‍্যালান দিয়ে বসিয়ে ওয়াসিমার পেটে হট ওয়াটার ব‍্যাগটা ধরে। ওয়াসিমাও আরাম পেয়ে ব‍্যাগটা আরেকটু ভালো করে ধরে। এই সুযোগে আবসার ওয়াসিমাকে খাওয়ানো শুরু করে ওয়াসিমা প্রথমে না করলেও পরে খেয়ে নেয় খাওয়া শেষে একটা পেইন কিলার খাইয়ে দেয় আবসার ওয়াসিমাকে। ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে ওয়াসিমাকে বুকে জড়িয়ে পাড়ি জমান গভীর নিদ্রায়।

______________________

চেয়ারে বসে ঝিমিয়ে যাচ্ছে অরিক অতিরিক্ত মাত্রায় পায়খানা হওয়ার কারণে মেয়েটা দূর্বল হয়ে পড়ে। পরে তাকে ইমিডিয়েট ডাক্তার দেখালে সে কিছু ঔষধ আর একটা ভিটামিন স‍্যালাইন ইনজেক্ট করে যায়। এই স‍্যালাইন শেষ হতে রাত পার হবে তাই পাছে যদি মেয়েটা ব‍্যাথা না তাই অরিক চেয়ারে বসে ঝিমাচ্ছে কারণ সে তার ঘুমকে একটু বিশ্বাস করে না পরে শশুর বাড়িতে তার মান সম্মান কিছুই থাকবে না।

__________________

সকাল সকাল তীব্র রোদের ঝলকানিতে ঘুমি ভাঙ্গে ওয়াসিমার মুখে হাত দিয়ে কোনো রকম ঘুম ভাব কাটিয়ে ঘড়ির দিকে তাকাতেই তার চোখ চরকগাছ সকাল আটটা বেজে গেছে।

— হায় আল্লাহ্ আমার ফজরের নামাজ বলেই লাফ দিয়ে ওঠে অনুভব করে রাতের মতো ব‍্যাথা এখন নেই। সে আর কিছু না ভেবে বিড়বিড় করে আবসারের মুন্ডুপাত করতে করতে চলে যায় ওয়াশরুমে।
ওয়াশরুমে দাড়িয়ে নিজের পরনে কাপড়ের দিকে তাকায় তার তো এখানে কোনো কাপড় নেই সে গোসল করে কি পরবে। ভাবতে ভাবতেই ওয়াসিমার নজর যায় আবসারের আলমারির দিকে সেখান থেকে ঘাটাঘাটি করে আবসারের অনেক আগের একটা গোল গলার গেঞ্জি আর নরমাল ট্রাউজার বের করে আবার চলে যায় ওয়াশরুম।
একেবারে গোসল করেই বের হয় দ্রুত কালকের সেই হিজাব জড়িয়ে কাজা নামাজটা পরেই নেয়। নামাজ শেষে সালাম ফিরাতে দরজায় নক হয় ওয়াসিমা জায়নামাজ ভাজ করতে করতে দরজা খুলতেই একটা মেয়েকে দেখতে পায় যে হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা সম্ভবত বয়সে ওয়াসিমার থেকে বড়ই হবে

— শুভ সকাল ভাবী আম্মু আব্বু অনেকক্ষণ ওয়েট করছে ভাইয়াকে ঘুম থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসো

— আপু আমার কোনো কাপড় নেই এই অবস্থায় কিভাবে যাব ইস্তত স্বরে বলল ওয়াসিমা

— ওও এই সমস‍্যা দাড়াও আমি আম্মুকে পাঠিয়ে দিচ্ছি
ওয়াসিমাকে ইস্তত করতে দেখে আর কিছু বলল না।
মেয়েটি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ওয়াসিমার শাশুড়ি আলিয়া সাখাওয়াত আসে সে দরজা নক করতেই ওয়াসিমা খুলে দেয়

— কোনো সমস‍্যা আম্মু

— না আসলে আমার তো এখানে কোনো কাপড় নেই ( এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল )

— আচ্ছা এসো আমার সাথে বলেই ওয়াসিমাকে সঙ্গে করে আলিয়া সাখাওয়াত নিজের ঘরে নিয়ে যায়।
আলমারি ঘেটে হালকা গোলাপি রঙ্গা মণিপুরী তাতের শাড়ি বের করে দেয় সাথে তার অনেক আগের একটা ব্লাউজ।

— শাড়ি পরতে পারো তো
ওয়াসিমা হ‍্যা বোধক সম্মতি দিতেই সে ওয়াসিমাকে রেখে ঘরের দরজা বন্ধ করতে বলে চলে যায়।

রেডি হয়ে বের হতেই নিচে হল রুমের থেকে জোরে চিল্লানোর আওয়াজ পায় ওয়াসিমা সিড়ি দিয়ে নিচে নামতে নামতে দেখে একজন বৃদ্ধা চিল্লাচিল্লি করছে আলিয়া সাখাওয়াতের সামনে আর আলিয়া সাখাওয়াত মাথা নিচু করে চুপচাপ তার কথা শুনছে কোনো জবাব দিচ্ছে না।

দাড়িয়ে দাড়িয়ে বৃদ্ধা মহিলার কথা শুনেছে ওয়াসিমা যতই শুনছে ততই তার রাগ উঠছে কিন্তু সে আজকে প্রথম এই বাড়িতে তার উপর নতুন বউ তাই চুপচাপ শুনে যাচ্ছে।

— এই মেয়ে সময়ের জ্ঞান নেই নাকি কয়টা বাজে হ‍্যা এই ভাবে তুমি সংসার সামলাবে ওয়াসিমাকে ঝাড়ি দিয়ে বলতেই পিছন থেকে আবসার বলল — সময়ের জ্ঞান থাকা লাগবেনা না শুধু স্বামীর ভালোবাসা বোঝার মতো জ্ঞান থাকলেই চলবে দাদি আর সংসার চালানোর জন‍্য তুমি তো আছোই তাই তো এতো বছরেও বছরের ছয় মাস আমাদের বাসায় এসে নিজের হুকুম চালাও

আবসারের কথা শুনে রাগে ফুসে উঠল আবসারের দাদি দিলরুবা সাখাওয়াত কিন্তু আবসারের সাথে কথায় পারবেনা বলেই কিছু না বলে গট গট পায়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

দিলরুবা সাখাওয়াত চলে যেতেই ফিক করে হেসে দিলো আরু। আরুর হাসি দেখে আলিয়া সাখাওয়াত তার কান মুচরে দিতেই থেমে যায় সে

— ভাইকে তুমিই উঠিয়েছো তাইনা

— তো উঠাবোনা বছরের ছয়টা মাস আমার আম্মুর উপর খবরদারি করেও বুড়ি ক্লান্ত হয় না এখানে এসেও তোমার উপর শুরু করে আমার কি মনে হয় জানো বড় আম্মু ঐ বুড়ির জন‍্য ঐ কুচুটি মহিলাই ঠিক বলেই জিহ্বায় কামর দিয়ে আলিয়া সাখাওয়াতকে ইশারায় সরি বলে।

আলিয়া সাখাওয়াত মাথা নাড়িয় ওয়াসিমার কাছে যায় — দাদী শাশুড়ির কথায় কিছু মনে করো না আম্মু বায়োজষ্ঠ‍্য মানুষ তো চিন্তা ধারা আগের তাই এতো রিয়েক্ট করে ফেলে

— আমি বুঝতে পারিনি আন্টি কখন সকাল হয়ে গেছে

— তোমাদের বাড়িতে বুঝি শাশুড়িকে আন্টি বলে

— সরি আসলে আমতা আমতা করে বলল

— ইটস ওকে আম্মু আস্তে আস্তে অভ‍্যাস হয়ে যাবে।

#চলবে

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সাদিয়া_আক্তার
#পর্ব_৩

দিলরুবা সাখাওয়াত ও ইসলাম সাখাওয়াতের দুইজন ছেলে এজাজ সাখাওয়াত এবং এহসান সাখাওয়াত। এজাজ সাখাওয়াতের স্ত্রী আলিয়া সাখাওয়াত তাদের দুইজন ছেলে বড় ছেলে আবসার সাখাওয়াত ও ছোট ছেলে আয়মান সাখাওয়াত। এবং এহসান সাখাওয়াতের স্ত্রী তানিয়া সাখাওয়াত তাদের একজন মেয়ে আরিশা সাখাওয়াত তাহা। বিয়ের ষোলো বছরের মাথায় বিধবা হন দিলরুবা সাখাওয়াত স্বামী হারা দিলরুবা সাখাওয়াত তখন দুই সন্তান সহ স্বামীর রেখে যাওয়া বিপুল সম্পত্তি ও ঢাকার ব‍্যবসা একা হাতে সামলায়।
তাই দুই ছেলের কেউই মায়ের উপর কথা বলে না আর দুই ছেলের বউরাও শাশুড়িকে বেশ সম্মান করে তাইতো তারা তাদের শাশুড়ির কটু কথা শুনেও চুপ থাকে কেননা একা হাতে সংসার সামলানো মহিলাটি এখনো বউদের হাতে নিজের গড়া সংসার ছেড়ে দিতে নারাজ। ভাগ‍্য সুপথে থাকায় বউরাও এই বয়সে এসেও শাশুড়ির সব কথাই মেনে চলেন।

কিন্তু এর বিপরীতে আছে তার তিন নাতী আবসার আয়মান আরিশা তারা কেউই দাদীর সেচ্ছাচারীতা মানতে চায় না। আবসার তো আরো না সে তার দাদীকে সহ‍্যই করতে পারে না।

__________________

সাখাওয়াত বাড়ির বিশাল ডাইনিং টেবিলে সবাই খেতে বসেছে আবসার ওয়াসিমা এখনো নিচে নামেনি তখন দিলরুবা সাখাওয়াত যাওয়ার পরপরেই আবসার ওয়াসিমাকে নিয়ে নিজের ঘরে চলে যায় এখনো বের হয়নি

— এই আরু মা যানা তোর ভাই ভাবিকে ডেকে নিয়ে আয় এখন যদি আম্মা এসে দেখে বউটা নিচে এখনো নামেনি তাহলে আরো তুল কালাম করে ফেলল

— ডাকতে হবে না আমরা এসে পড়েছি আলিয়া সাখাওয়াত কথার প্রেক্ষীতে নিচে নামতে নামতে বলল আবসার।
একটু পরেই দিলরুবা সাখাওয়াত নামতেই সবাই নাস্তা করতে বসল খাওয়ার সময় কেউ একটা বাক‍্য উচ্চারণ করল না।

খাওয়া শেষ করার সাথে সাথেই আবসার নিজের ঘরে চলে যায় যাওয়ার সময় ওয়াসিমাকে নিয়ে যেতে চাইলে ওয়াসিমা যায় না এই লোকের সাথে থাকলেই এই লোকের অসভ্যতামি শুরু হয়ে যায়

— ওয়াসিমা এটা তোমার চাচা শশুর এটা তোমার চাচী শাশুড়ি আর এটা আলিয়া সাখাওয়াতকে বলতে না দিয়ে আরুই বলা শুরু করে — আমি হলাম তোমার ওয়ান এন্ড অনলি ননদীনি আরিশা সাখাওয়াত তাহা
— বড় মা আবু ভাই এটা ঠিক করল না জানিয়ে বিয়ে করে ফেলল আমি একটু মজাও করতে পারলাম না ( আলিয়া সাখাওয়াতের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বলল আরু )
আরুর কথা শুনে সবাই হাসে। ওয়াসিমা নত মস্তকে মৃদু স্বরে সবাইকে সালাম দেয়। তানিয়া সাখাওয়াত ও এহসান সাখাওয়াত ওয়াসিমাকে স্বর্ণের চেইন এবং চুড়ি উপহার দেয়। সাথে তাদের বাড়ির সবার কথাও জিজ্ঞেস করে ওয়াসিমার তখন বাড়ির কথা মনে পরলেও কিছু বলে না মুখে হাসি টেনে সবার সাথে গল্প করে। ওয়াসিমার কাছে এই বাড়ির সবাইকেই বেশ ভালো লেগেছে শুধু দাদী শাশুড়ি বাদে।

দুই জা মিলে রান্নাঘরে কাজ করছিলো তখন ওয়াসিমা ধীর পায়ে সেখানে উপস্থিত হয় কিন্তু দুই শাশুড়ির একজনেও তাকে কাজ করতে দেয় না তাই উপায় না পেয়ে চুপচাপ দাড়িয়ে দুই শাশুড়ির গল্প করা শুনতে লাগে
— ভাবী ভাইয়া চট্টগ্রাম থেকে আসবে কবে ছোট জা তানিয়ার কথা কথা উত্তরে আলিয়া সাখাওয়াত বলল — পরশু আসবে

— ভাইয়া কি জানে আবসারের বিয়ের কথা
তানিয়ার কথা শুনে আলিয়া সাখাওয়াত ওয়াসিমার দিকে একবার তাকিয়ে মাথা নাড়ায়। শাশুড়ির মাথা নাড়ানো দেখে পায় আশঙ্কা করে আরেকটি ঝড়ের।

তাদের কথপোকথনের মধ‍্যেই উপর থেকে শুনা যায় আবসার রাশভারী স্বরে ওয়াসিমাকে ডাকছে
— ওয়াসিমা

আবসারের ডাক শুনে শাশুড়ি আর চাচী শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে লজ্জায় মাথা নত করে

— যাও মা দেখ হয়তো আবসারের কিছু প্রয়োজন
বলতেই ওয়াসিমা দ্রুত সেখান থেকে উঠে গেলো।

ওয়াসিমার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হাসে দুই জা

ঘরের সামনে এসে আটকে রাখা দমটা ফুস করে ছেড়ে দেয় ওয়াসিমা

— উফফ আমাকে লজ্জা না দিয়ে এই লোকটা কোনো কাজ করতে পারে না নাকি বিড়বিড় করে বলতেই আবসার তাকে টান দিয়ে ঘরের মধ‍্যে ঢুকিয়ে দরজা আটকে দেয়

— কাল থেকে স্বামীর সান্নিধ্য পাবে এখন একটু কাছে কাছে থাকবা তা না করে খালি পালাই পালাই করো কেনো বউ ওয়াসিমার সর্ব মুখে স্লাইড করতে করতে বলে
চোখ বন্ধ করে কোনো রকম কাপাস্বরে বলে — আপনি কি কোথাও যাবেন

— হু সাথে তুমিও বলেই ওয়াসিমার বন্ধ করে রাখা চোখ জোড়ার গভীর চুমু খায়। ওয়াসিমা খামচে ধরে আবসারের টিশার্ট

— কোথায় যাব কোনো রকম জিজ্ঞেস করে

— তুমি তোমাদের বাসায় যাবা তোমাকে সেখানে রেখে রাতের গাড়িতে আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিব

আবসারের কথা শুনে তড়াক করে চোখ খুলে ফেলে ওয়াসিমা অবাক স্বরেই বলে — মানে

— হু তোমার স্বপ্ন ভুলে গেলে নাকি বিয়ে হয়ে গেছে বলে পড়ার ইচ্ছা নেই নাকি
— আপনি আমাকে পড়তে দিবেন

— স্ত্রীর স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করা স্বামী হিসেবে আমার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বের মধ‍্যে পড়ে আমিও যাতে গর্ব করে বলতে পারি ড. ওয়াসিমা আমার স্ত্রী
আবসারের কথা শুনে তার বুকে ঝাপিয়ে পরে ওয়াসিমা।
লোকটার প্রতি আজ একরাশ শ্রদ্ধা জন্ম নিলো সকাল পযর্ন্ত সে আবসারকে ভুল বুঝে ছিল কিন্তু এখন তার ধারণা বদলে গেলো।

____________________

ঘুম ভাঙ্গতেই চারিদিকে তাকায় লাবনী চেয়ারে গুটিসুটি মেরে মুখ কুচকে ঘুমিয়ে আছে অরিক
অচেনা একটা লোককে নিজের ঘরে দেখে ভয় পায় লাবনী বেশ জোড়ে শোরেই একটা চিৎকার দেয়।
লাবনী ঘুম ভেঙ্গে যায় একটু নরতেই ঠাসস করে ফ্লোরে পরে যায়।
ফ্লোরে বসে মুখ বিরক্ত ভঙ্গিতে লাবনীর দিকে তাকায় অরিক

— এই এই কে আপনি আমার রুমে কি হ‍্যা এই চোর তাইনা চুরি করতে এসেছেন তাইনা দাড়ান এখনি যদি প‍্যাদানি না খাওয়াইছি না তো আমার নাম লাবনী না আম্মু আব্বু তোমরা কোথায় কে কোথায় আছো তাড়াতাড়ি আসো ঘরে চোর ডুকেছে
লাবনীর চিৎকারে সবাই হুরমুর করে ডোকে লাবনী ঘরে
— কি হয়েছে মা এমন চিৎকার করছিস কেনো লাবনীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে তার বাবা লতিফ আহমেদ

— দেখো বাবা এই লোকটা আমার ঘরে চুরি করতে এসেছে
সবাই লাবনী দিক অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখে অরিক আসন পেতে মাজায় হাত দিয়ে চোখ মুখ কুচকে বিরক্ত ভঙ্গিতে বসে আছে

— এইলো ছেরি নিজের স্বামীরে চিনোস না কালেই না তগো বিয়া হইল শাষনের ভঙ্গিতে বলে লাবনীর দাদী
লাবনীর বাবা মা যেয়ে দ্রুত অরিককে ধরে উঠায়

— ব‍্যাথা পেয়েছেন বাপজান আসোলে আমার মেয়েটা একটু অবুঝ তার উপর আবার কালকে অসুস্থ থাকাকালীন বিয়ে হয়েছে তাই বেশ ইস্তত করেই বলল লাবনীর মা লিপি বেগম।

— আহ লাবুর মা এতো কথা কয় না জামাই বাবাজি ব‍্যাথা পাইছে তারে আগে বিছানায় শোয়াও বললেন লাবনীর বাবা লতিফ আহমেদ।

লাবনীর মনে পড়ে কাল তার বিয়ে ছিলো শুরুতে সব ঠিক থাকলেও যখন লাবনী একটা শরবত খায় তখন থেকে লাবনীর ওয়াশরুম থেকে ঘর ঘর থেকে ওয়াশরুম করেই ক্লান্ত হয়ে পড়ে পরে একপ্রকার ঘোরের মধ‍্যেই সে বিয়ের সময় কবুল বলে।

— এই ছেরি খাম্বার মতো দাড়াইয়া আসোছ ক‍্যান তাড়াতাড়ি গরম পানি আন আর বাম নিয়া আয় মালিশ করতে হইব
দাদীর কথা শুনে লাবনী দ্রুত ঘর থেকে বের হয়ে রান্নাঘর থেকে গরম পানি করে আনে।

লাবনী গরম পানি করে ঘরে ঢুকতেই সবাই ঘর থেকে বের হয়ে যায়
অরিক উবু হয়ে শুয়ে আছে লাবনী কাপা কাপা হাতে গামছা গরম পানিতে ভিজিয়ে অরিকের শার্ট হালকা উচু করে শেক দেয়।

#চলবে

বক্ষপিঞ্জিরায় তুই বন্দীনি পর্ব-০১

0

#বক্ষপিঞ্জিরায়_তুই_বন্দীনি
#সূচনা_পর্ব
#সাদিয়া_আক্তার

ছোটবেলা থেকেই আমরা সব কাজ একসাথে করেছি তাহলে বিয়েটা কিভাবে তুই একা একা করবি সব কাজ যেহেতু একসঙ্গে করেছি বিয়েটাও একসঙ্গে করা উচিৎ তাইনা ( বলেই ঘাড় বাকিয়ে তিন হাত দূরত্বে থাকা রমনীর দিকে তাকায় )

আবসারের তাকানোতে ভরকে যায় রমনী। ভয়ে খামচে ধরে পরনের কামিজের অংশ লুকিয়ে পরে সামনে থাকা ব‍্যক্তিটির পিছনে।

— অবশ্যই করবি বিয়ে কিন্তু এই মূহুর্তে মেয়ে কোথায় পাব ( হালকা হেসে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে বলল অরিক )

— মেয়ে আমার পছন্দ আছে তোরা সবাই তাকে চিনিস ইভেন অনেক কাছের

— আমরা চিনি দেখ আবসার ঘুরিয়ে পেচিয়ে না বলে ডিরেক্ট বল কে সেই মেয়েটি

— কেনো তোর বোন ওয়াসিমা

— অসম্ভব আমি তোমার সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিব না ( আবসারের কথা শেষ হতেই গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে ইরফান রহমান )

— কেনো ভাই সাহেব আমার ছেলে কি ওয়াসু মায়ের যোগ্য না নাকি তার কোনো কমতি আছে

— কথাটা সেরকম না আপা আমি এখন আমার মেয়ের বিয়েটা দিতে চাচ্ছি না আর আমার মেয়েটা ছোট ( আলিয়া সাখাওয়াতের কথায় বিনয়ের স্বরে বলল ইরফান রহমান )

— তাহলে ছেলের বিয়ের আশাটাও ছেরে দেন

— মানে এই অরিক কি বলে এই ছেলেটা এখন কি এর কারণে তুমি তোমার বিয়েও আটকে দিবে আমি আগেই বলছি এরকম চিন্তা ভাবনা থাকলে বাদ দাও ( উত্তেজিত কন্ঠে বলল ইরফান রহমান )

— তুমি শান্ত হও বাবা। আজকে শুধুমাত্র আকদ পরিবারের লোকজন ছাড়া কেউ নেই তাই

অরিককে কথা শেষ না করতে দিয়েই ইরফান রহমান গম্ভীর স্বরে বলল — এখানে শুধুমাত্র পরিবারের লোকজন উপস্থিত থাকলেও একটা মেয়ের সম্মানের সাথে জড়িত বিষয়টা।

— হবু বউ সহি সালামত থাকলে তো বিয়ে করবে।

— মানে
বলেতেই একজন মহিলা এসে বলল — ইরফান ভাই লাবনীর ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ ভিতর থেকে ওর বান্ধবী ফোন দিয়ে বলল আমার মেয়েটা বার বার বাথরুম যাচ্ছে মনে হয় পেট খারাপ হয়ে গেছে আর তালাটাও আমাদের না সারাবাড়ী খুজেও ঐ তালার চাবি পাইনি।

লাবনীর মায়ের কথা শেষ হতে না হতেই ইরফান রহমান ও অরিক আবসারের দিকে তাকিয়ে দেখে তার ঠোঁটে মুচকি হাসি ঝুলছে।

— এই ছেলে তুমি মেয়েটার সাথে কি করেছ বলো হ‍্যা কি করেছ

— আস্তে শশুর মশাই আস্তে আপনি এতো হাইপার হোন কেনো কথায় কথায়।

— অরিক ওকে বলতে বল কি করেছে মেয়েটার সাথে

বাবার কথার উত্তর না দিয়ে অরিক চারপাশে তাকায় ড্রয়িং রুমে তার বাবা মা সহ লাবনীর বাবা মা আর লাবনীর কিছু আত্মীয় উপস্থিত তাদের মধ‍্যে একটা ছেলেকে ডাক দিয়ে কিছু বলতে নিলেই বাধ সাধে আবসার

— তালা ভাঙ্গার চিন্তা করে লাভ নেই ডিজিটাল লকও আছে সাথে আমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট ছাড়া খুলবে না

— কি খাইয়েছিস মেয়েটাকে

— জামাল গোটা

আবসারের কথা শুনে সবাই অবাক। অরিক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল — দেখ ভাই আমার বোনটা এখনো নাবালিকা আঠারো বছর হয়নি এখন বিয়ে দিলে আইন মোতাবেক হয় না।

— শরীয়ত মোতাবেক তো হবে আমার তাতেই চলবে

— দেখ ভাই তোর আর ওয়াসু মনির এজ ডিফারেন্ট টা অনেক প্রায় এগারো বছর।

— এই ডিফারেন্ট ডাজেন্ট ম‍্যাটার ( ত‍্যারা কন্ঠ বলল আবসার )
আবসারের ত‍্যাড়া কন্ঠে অরিক দীর্ঘ শ্বাস ফেললেও চেতে গেলো ইরফান রহমান। তার একটাই কথা এই ছেলে চরম লেভেলের বেয়াদব এর সাথে কিছুতেই তিনি তার রাজকন্যা বিয়ে দিবেন না।
তিনি গর্জন করে উঠতে নিলেই অরিক ও তার স্ত্রী আকলিমা তাকে থামায়।

— বাবা মেয়েটার এই গরমে আবার ডিহাইড্রেশন না হয়ে যায় একটু চিন্তা করো বাবা

অরিকের কথা শুনে ইরফান রহমান একটু শান্ত হোন এই আকলিমা রহমান ও মুখ খুলল — আর আবসার ছেলেটা তো ভালোই সব দিক দিয়েই ঠিক আমাদের মেয়ে সুখে থাকবে না করার তো কোনো প্রশ্নই আসে না

— আকলিমা ঐ ছেলেটা আমার মেয়ের থেকে এগারো বছর বড়

— তুমিও তো তোমার থেকে আট বছরের বড় আমি যদি তোমার মতো বুড়োর সাথে সংসার করতে পারি তো আমার মেয়েও পারবে।
স্ত্রীর কথা শুনে নাক মুখ কুচকে বসে আছে ইরফান সাহেব।
অরিক কোনো ভাবে হাসি আটকায় এখন হাসলেই তার বাবা খেপে যাবেন তা সে জানে তাইতো কোনো রকম হাসি আটকে সেখান থেকে চলে যায়। এতক্ষণ তারা একটা ঘরে নিজেদের মতো আলোচনা করছিল।

— বিয়ের প্রস্তুতি নে ভাই আর আমার হবু বউটাকে বের কর না জানি বেচারির কি অবস্থা।
আবসার অরিকের করুন স্বরের কথা শুনে হালকা হেসে চলে যায় লাবনীর ঘরের উদ্দেশ্যে কিন্তু যাওয়ার আগে একপলক ওয়াসিমার দিকে তাকায়।
আবসারের ভয়ানক দৃষ্টিতে ওয়াসিমার আত্মা কেপে ওঠে সে গালে হাত দিয়ে কাদোকাদো মুখ নিয়ে দাড়িয়ে আছে তার এখন ইচ্ছে করছে হাত পা ছড়িয়ে কান্নাকাটি করতে আর না হলে অজ্ঞান হতে কিন্তু কোনোটাই হতে পারছে না কেনো

— আল্লাহ্ আমাকে এই মানব রুপি দানবের থেকে বাচাও ( বিড়বিড় করে বলল ওয়াসিমা )

___________________

বাসর ঘরে বসে আছে ওয়াসিমা আবসার এখনো আসেনি। সে এখানে বসে বসে নাকে চোখে কান্না করছে আর ভাবছে কি থেকে কি হয়ে গেলো যেখানে সে গিয়েছিল ভাইয়ের বিয়ে খেতে সেখানেই নিজের বিয়েও হয়ে গেলো আর সে কিছুই করতে পারল না আর করবেই বা কিভাবে যখনই বিয়ের জন‍্য না করতে যাবে তখনই তো ঐ আসবাব পত্র তার ভয়ংকর চোখ দ্বারা ভয় দেখিয়ে তাকে বিয়েতে কবুল বলিয়ে নিলো কিন্তু তাও যা ভেবেছিল তার বাবা ভাই কেউই পরীক্ষার আগে তাকে শশুর বাড়িতে পাঠাবেনা কিন্তু কি এমন পানি পড়া খাওয়াইলো ঐ আসবাব পত্র সেটাও হলো না। আবসার যখন তাকে গরুর মতো টানতে টানতে নিয়ে আসল তখন কেউই কিছু বলল না কেনো

দরজা আটকানোর শব্দে নিজের কল্পনা জগত থেকে বেরিয়ে আসে ওয়াসিমা সে লক্ষ্য করে আবসার তার দিকেই এগিয়ে আসছে পরনে ট্রাউজার আর গোল গলার গেঞ্জি
এই লোক জামা কাপড় বদলালো কখন মনে মনে ভাবে ওয়াসিমা।

ভাবনা রানী ভাবনা শেষ হলে একটু বাস্তব জগতে ফিরেন। আবসারের কথা ভাবনা শেষ হয় ওয়াসিমার সে কিছু না বলে মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছে। আবসার হালকা হেসে এগিয়ে যায় ওয়াসিমার সামনে বসে তার নিচু মাথা শাহাদাত আঙ্গুল দিয়ে উচু করে একধ‍্যানে তাকিয়ে আছে মেকাপ বিহীন আদল কান্নার কারণে নাকটা লাল টকটকে হয়ে আছে চোখের কাজলটাও লেপটে গেছে পরনে লাল শাড়ী যা তার মা এই বাড়িতে আসার পরে পরিয়ে দিয়েছে। এই এলোমেলো রুপেও যেনো মেয়েটাকে স্নিগ্ধ লাগছে তার কন্ট্রোল ছুটে যাচ্ছে। আবসার তার মুখটা নামিয়ে আনতেই মুখ ঘুরিয়ে নেয় ওয়াসিমা কাপা স্বরে বলে — আমার এশার নামাজ এখনো পড়া হয়নি আমি নামাজ পরব

— যা ওযু করে আয় গম্ভীর স্বরে বলল আবসার

ওয়াসিমা আবসারের কথা শুনে দ্রুত বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে দৌড় দেয় এমন ভাব যেনো এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে আবসার নামক রাক্ষসটা তাকে গিলে খেতো।

— তুই যতই পালাস শুভ্রময়ী আজকে তোর আমার থেকে নিস্তার নেই ওয়াসিমার যাওয়ার দিকে মুচকি হেসে বলল আবসার।
কিছুক্ষন পরেই ওয়াসিমা ওয়াশরুম থেকে বের হলে আবসার ঢোকে যাওয়ার আগে বলে যায় আলমারির দ্বিতীয় সাড়িতে জায়নামাজ আছে সেটা বের করে তার জন‍্য আপেক্ষা করতে।

ওয়াসিমা ও চুপচাপ পাশাপাশি দুইটা জায়নামাজ বিছিয়ে আবসারের অপেক্ষা করে। আবসার বের হতে দুইজন নামাজ পড়া শুরু করে।

________________

নামাজ শেষ হতে না হতেই আবসার কোলে তুলে নেয় ওয়াসিমাকে। আচমকা এমন করায় ভরকে যায় ওয়াসিমা খামচে ধরে আবসারের ঘাড়ের অংশ।

— তোর মোহরানা আমি পরিশোধ করে দিয়েছি
আবসারের কথায় ওয়াসিমা লজ্জায় হাসফাস করে তারপরেও নির্লজ্জ আবসার ছাড়ে না

— তোর লাজরাঙ্গা আদল দেখে তো বেসামাল হচ্ছি শুভ্রময়ী এবার আমাকে সামলা বলেই বেডে ধপ করেই ফেলে দেয় ওয়াসিমাকে।
ওয়াসিমা মুখ কুচকে আবার উঠতে নিলেই আবসার ওয়াসিমার উপর নিজের সম্পূর্ণ ভার ছেড়ে দেয়। হাত গলিয়ে শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত উদরে নিজের ওষ্ট জোড়া দিয়ে বন্ধ করে দেয় ওয়াসিমার নরম পেলব অধর জোড়া।

#চলবে

পারফিউম পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

1

#পারফিউম
শেষ পর্ব
“ম্যাডাম আর কিছু লুকাবেন না। আপনার কীর্তিকলাপ সবকিছু আমরা জানতে পেরেছি?”

দিতিয়া শান্ত গলায় বলল,

“আপনি কী মিন করছেন? আমি আমার বোন কে মেরেছি? সিরিয়াসলি!”

পুলিশ অফিসার ভাবলেশহীন গলায় বলল,

“আপনি নিজেও বুঝতে পারছেন যে আমি কী মিন করছি। ”

দিতিয়া তবুও দমলো না। চোখে, মুখে নেই কোনো অনুতাপ। খবরের কাগজ, সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গায় এই মেয়েটাকে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে। চাকরি চ্যুত হয়েছে। এজাজ রহমান শাসিয়ে যাচ্ছেন সমানে। ফল ভালো হবে না। আহনাফও তার সমস্ত রূপ দেখাচ্ছে মুখোশের আড়াল থেকে। নেহাল কে টাকা দিতে হবে দ্বিগুণ। দিতিয়াকে তবুও বিচলিত লাগছে না। এমন কনফিডেন্ট যার আছে তাকে দরকার ছিলো ভালো কোনো ক্রিয়েটিভ কাজে।

দিতিয়া জিজ্ঞেস করলো,

“এই খুনের ব্যাপারে কী কী প্রমাণ পেয়েছেন আমার বিরুদ্ধে। ”

পুলিশ অফিসার হেসে বললেন,

“আপনাকে খুনী বানিয়ে আমার কী কোনো লাভ আছে ম্যাডাম?”

“তাহলে বললেন যে আমার কীর্তিকলাপ? ”

“আপনার ব্যাংক, ব্যালেন্স। আশুলিয়ায় প্লট বুকিং, সবকিছু তো এখন আয়নার মতো সবার সামনে এসেছে। ”

“এর জন্য কী এরেস্ট করবেন আমাকে?”

দিতিয়ার ঠোঁটে তীর্যক হাসি। না দিতিয়াকে এরেস্ট করা যাবে না। এজাজ রহমান ফ্যামিলি পার্সন। তিনি এই বিষয়ে আর জল ঘোলা করতে চাইছেন না। অলরেডি মিডিয়া নিউজ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সয়লাব। কোম্পানি এজাজ রহমান কে অবজার্ভেশনে রেখেছে। তার অবস্থা দিতিয়ার চেয়েও বেশি খারাপ। তারচেয়ে বড় কথা এরা চাইছে দিতিয়াকে উল্টো বাঁচাতে। কিছু তো আছে এই মেয়ের কাছে। এতো বড় বড় মাথাওয়ালা মানুষজন পর্যন্ত পিছু হটছে।

পুলিশ অফিসার বললেন,

“আপনার জন্য একটা ভালো খবর আছে। ”

“বলুন। কেন যেন মনে হচ্ছে আপনার ভালো খবরটাও আমার জন্য ভয়ংকর হবে। ”

“না না। এটা ভালো খবর। নেহাল সাহেব কে নয় লাখ টাকা দিলেই হবে। উনি এর বেশী চাইছেন না। ”

দিতিয়া ভাবলেশহীন গলায় বলল,

“আচ্ছা। ”

“নেহাল সাহেব কিন্তু ভদ্রলোকই ছিলো ম্যাডাম। কেন যে আপনি….

দিতিয়া কথা শেষ করতে দিলো না। বলল,

” আমি আমার পার্সোনাল ব্যাপার নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না। ”

পুলিশ অফিসার বিরস মুখে বলল,

“আচ্ছা। যেতে পারেন আপনি। কেস ক্লোজ না হওয়া পর্যন্ত আপনার সাথে দেখা হবে৷ গুড লাক। ”

দিতিয়া স্মিত হেসে বিদায় নিলো।

***
নেহালের নয় লাখ টাকা দিতিয়া ঝামেলা ছাড়াই দিয়েছে। সেই সঙ্গে টেক্সট লিখেছে,

“সবচেয়ে বেশী সারপ্রাইজ তো তুমি আমাকে করেছ ডিয়ার। আই এম ইমপ্রেসড। ”

নেহাল সেই টেক্সটের জবাবে কিছু লিখে নি। ওর লেখার দরকারও বোধহয় নেই। দিতিয়া শাস্তি পাচ্ছে প্রতি পদে। এখন যে হম্বিতম্বি দেখাচ্ছে সবই মিথ্যে।

***
আহনাফ বিয়ে করে নিলো মায়ের পছন্দ করা পাত্রীকে। শ্বশুর বিশাল বড়লোক। জামাই কে বিয়ের গিফট হিসেবে পঁচিশ লাখের গাড়ি পাঠালো। বিয়েটা একটু তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। হওয়া উচিত ছিলো বটে। দিতিয়ার আঘাত টা ভোলার দরকার ছিলো যে। ফ্যামিলি খুব টেনশনে ছিলো আহনাফ কে নিয়ে। যা ধকল গেল বেচারার। এখন সময় টা ভালো কাটুক।

***
দিতিয়ার এখন স্বাধীন জীবন। খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে আর ল্যাপটপে কী যেন করছে। দিলারা মেয়েকে নিয়ে খানিকটা চিন্তিত। দিতিয়া ঘরে বসে থাকতে পছন্দ করে না। সবসময় ই কাজে ডুবে থাকতে পছন্দ করে।

দিতিয়াকে দেখে অতো বিচলিত মনে হচ্ছে না। এখন ওরা অন্য একটা বাসায় আছে। এখানে ও’কে তেমন কেউ চেনে না বলে সমস্যা হচ্ছে না। দিতিয়া চাকরিচ্যুত হওয়া নিয়েও খুব বেশী বিচলিত নয়। ওর অপশন আছে অন্য। দুই তিন বছর চাকরি না করলেও দিব্যি চলবে। কিন্তু ঘরে বসে থাকা ব্যাপার টা ভীষণ বোরিং। চাকরি মানেই নতুন মানুষ, নতুন এক্সপেরিমেন্ট, নতুন এডভেঞ্চার।

এখন ও সারাক্ষন ল্যাপটপের সামনে বসে থাকে একটা বিশেষ কারণে। একজন বিশেষ মানুষের এক্টিভিটি চেক করার জন্য। সেই বিশেষ মানুষ টাকে ও একটা বিশেষ সারপ্রাইজ দিতে চায়। ঠিক এক ঘন্টা পর সে সারপ্রাইজ টা পাবে।

“দিতি শোন। ”

দিতিয়া ল্যাপটপ বন্ধ করে মায়ের দিকে তাকালো। বলল,

“পুলু কে ওর বাপ দিয়ে যেতে চায়। ”

“তোমার ইচ্ছে। আমার মনে হয় পুলু তোমার সঙ্গে থাকলেই ভালো হবে। ”

“শয়তান টা মনে হয় আবার বিয়ে করবে! তিনটা মাস যেতে না যেতেই….

দিলারার গলা বুজে আসে। দিতিয়া কিছু বলে না।

***
“আজ সব তোর পছন্দের রান্না হয়েছে। কতদিন ভালো কিছু রাঁধি না।”

দিতিয়া চিংড়ি মাছের বাটিটা সরিয়ে রাখলো। পুলিশ অফিসার লোকটা আজ আবার এসে জ্বালিয়ে গেছেন। কেস ক্লোজ করতে চাচ্ছেন। কারণ ওনারা কোনো ক্লু পাচ্ছে না। দিতিয়া হ্যাঁ, না কিছু বলে নি।

ফাইনালি বিশেষ মানুষ টাকে সারপ্রাইজ দেয়া গেল। আহনাফ নতুন বউকে নিয়ে ভালো সময় কাটাচ্ছিলো। তার মধ্যেই ও চাপে ফেলে দিলো। ওর ইমেইল হ্যাক করা দিতিয়ার কাছে তেমন কঠিন ছিলো না। ওর কিছু নিজের মানুষ আছে যাদের কে মিষ্টি করে বললেই কাজ টা করে দেয়। এজাজ রহমানের বোকা মেয়েটাকেও ফাঁদে ফেলতে ওর বেশী সময় লাগে নি। একটা লিংক পাঠিয়েছিল হোয়াটসঅ্যাপে। ব্যস সবকিছু চলে এলো। এই মেয়েটার চরিত্র বাপের চেয়েও ভয়ংকর। দিতিয়া নিজেও কনফিউজড ছিলো যে ও আসলে কার ব্যাপার টা সামনে আনবে। তারপর মনে হলো এজাজ রহমান কে ধাক্কা দেবার জন্য আসলে টিচার টাই ঠিকঠাক।

“মাংস টা নে। কষা মাংস তো তোর পছন্দ। ”

“তুমি খাও আগে। ”

দিলারা আজ খুশি। পুলিশের ঝামেলা থেকে পরিত্রাণ পেতে যাচ্ছে অবশেষে। সেই খুশিতেই এই আয়োজন। দিলারা কষা মাংস টা নিলো। দিহানের পছন্দ ছিলো। সেদিন রান্নাও করেছিলেন দিহানের জন্য। শেষবারের মতো! দিলারা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। মেয়েটা মরলো নিজের দোষে। দিতিয়া বাইরে কী করে বেড়ায় সেগুলো নিয়ে দিলারার আপত্তি নেই। ওরকম টুকটাক দোষ সবার থাকে। তারও ছিলো কম বেশী। তার পরিবারও ভালো ছেলে দেখে বিয়ে দিলো। সংসার করতে এসে দেখেন মুলো, আলু, কচু ছাড়া কপালে তেমন কিছু জোটে না। এভাবে কতদিন! বাড়িওয়ালার ছোট ভাইয়ের সঙ্গে একটা সম্পর্ক হয়ে গেল। দেয়া নেয়ার সম্পর্ক। দিলারার শাড়ি, গয়নায় ভর্তি হতে লাগলো আলমারি। দিহানের বাবা কিছু বোঝেন না। এর ওর গিফট বলে দিব্যি চালাচ্ছিলেন। গয়নাগুলো এমিটিশন বলেও বুঝ দেয়া যাচ্ছিলো। কিন্তু ঝামেলা করলো দিহান। একদিন দেখে ফেলল। বুঝিয়ে সুঝিয়ে চুপ করে রাখলেও মেয়ে সুযোগ নিলো। বাবাকে বলে দেবার ভয় দেখিয়ে সব হাতিয়ে নিচ্ছিলো। বিয়ের সময় গুনে গুনে সবগুলো গয়না নিয়ে গেল। দিতিয়ার জন্য রাখা অল্পকিছু গয়নাও ছাড় দিলো না। ওদের বাবা মরে যাবার পরও দিহান শোধরালো না। সেই সঙ্গে নতুন বিষয় টানলো। দিতিয়া আর নেহালের ব্যাপার নিয়েও শুরু করলো ব্ল্যাকমেইল। দিতিয়াকে দেখলে আদুরে ভঙ্গিতে কথা বললেও দিলারাকে এসে বলতো,

“মা দিতিয়াকে বোলো তো আমাকে এক জোড়া হিরের দুল কিনে দিতে। নেহালের ব্যাপার টা ভুলে যেও না। ওইটা আমিই সামাল দিচ্ছি। ”

দিলারা বুঝতে পারছেন মেয়ের খিদে দিনকে দিন বেড়ে যাচ্ছে। এখন চাচ্ছে দিতিয়ার কেনা ফ্ল্যাট যেন দিলারার নামে হয় তাহলে ও কব্জা করতে পারবেন।

দিলারা সিদ্ধান্ত নিলেন দিহান কে সরিয়ে দিবেন। তার কাছে ব্যাপার টা সহজ ছিলো না। খাবারে বিষ মেশানো, গলা টিপে মারা এসবে ধরা পড়ে যেতেন। তাই পারফিউমে বিষের প্ল্যান করলেন। এই বিষদেয়া পারফিউম এসেছে বিদেশ থেকে। পাঠিয়েছে সেই মানুষ টা যার সঙ্গে দিলারার অনৈতিক সম্পর্ক ছিলো। সংসার জীবনে ভীষণ অসুখী মানুষ টার মনে এখনো একটু বিশেষ জায়গাজুড়ে দিলারা আছে। তাই সে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

দিলারা জানতো এই পারফিউম দিতিয়া ব্যবহার করবে না। কোনো ব্র‍্যান্ড নাম নেই দেখেই ও ফেলে দিবে। নিজেকে নিয়ে দিতিয়া খুব সচেতন। এই ভুল ওর করার সম্ভাবনাও জিরো পার্সেন্ট৷ তবে দিহানের যে অল্পতেই পছন্দ হবে সেই বিষয়ে সন্দিহান ছিলেন। হলোও তাই।

দিলারার মন টা খারাপ হয়। দিতিয়া খুব বিপদে পড়লো। তবে এসব বিপদের চেয়েও বড় বিপদ থেকে বাঁচালো। দিহানের প্রেশার নেয়া যাচ্ছিলো না আর!

দিতিয়া কষা মাংস থেকে এক টুকরো মাংস খেল। মা যেহেতু খাচ্ছে সেহেতু খাওয়া যায়। পারফিউমে বিষের ব্যাপার টা যে মায়ের কারসাজি সেটা দিহানের পোস্টমর্টেম যেদিন এলো সেদিন ই বুঝলো। মায়ের সঙ্গে দিহানের অন্য হিসাব আছে সেটা দিতিয়া জানে। কিন্তু ওর খটকা অন্য জায়গায়। পারফিউম বক্সটা দিহান কে সরাসরি পাঠিয়ে দিতে পারতো। দিতিয়াকে কেন পাঠালো! এই যুক্তি দিতিয়ার আছে। তবুও প্রশ্ন একটা থেকে যায়, বাই এনি চান্স ও যদি পারফিউম ব্যবহার করতো!

দিতিয়া আড়চোখে মায়ের দিকে তাকালো। ওর একটা স্পেশাল লিস্ট আছে। ধ্বংস লিস্ট। সেই লিস্টের লাস্ট নামটা মায়ের। একে একে সবাইকে পানিশমেন্ট পেতে হবে। মা’কে ছাড় দেয়া যাবে না কারণ ও জানেনা মায়ের উদ্দেশ্য ঠিক কী ছিলো! পারফিউম সেট টা তো ও’কেই পাঠানো হয়েছিল।

….সমাপ্ত….

পারফিউম পর্ব-০৫

0

#পারফিউম
#পর্ব-৫
এজাজ রহমান এর শত্রু সংখ্যা কম নয়। দিতিয়াকে যে অফিসে একটু বেশী সুবিধা দেয়া হয় সেটা অফিসে সবার জানা আছে। এই সুবিধা ঠিক কী কারণে দেয়া হয় সেটাও বুঝতে কারো বাকী থাকে না। অনেকের রোষের শিকার দিতিয়া ঠিক এই কারণে। কয়েক মাস আগে জাবেদ নামে একটা ছেলে ভালো কাজ করেও অফিসের বিগ বাজেটের প্রজেক্টের ইন চার্জ না হতে পেরে আক্রোশ দেখিয়েছিল। রিজাইন দিয়ে যাবার সময়ও বেশ সিনক্রিয়েট করলো। খুব খারাপ কিছু কথাবার্তাও বলেছিল দিতিয়াকে। দিতিয়া ব্যাপার টাকে পাত্তা দেয় নি। অফিসে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক যারা ও’কে পছন্দ করে না। দরকারের খাতিরে আলগা সম্পর্ক রাখে। দিতিয়া এই ব্যাপার টা সহজ ভাবে নিয়েছে। যাকে দরকার সে ঠিকই দলে আছে, অন্যদের না হলেও চলবে। কিন্তু এখন ব্যাপার গুলো ওর জন্য অস্বস্তিকর হয়ে গেছে। এতকাল মনে হয়েছে যাদের সঙ্গে মিশছে তারা নিজেদের ইমেজ বাঁচাতে কখনো ও’কে ঝামেলায় ফেলবে না। কিন্তু বোকাসোকা নেহাল ও’কে বেশ বিপদে ফেলল।

পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলো,

“আপনি বলতে চাচ্ছেন নেহাল যেসব প্রমাণ দিচ্ছে সেগুলো মিথ্যে?”

“অফ কোর্স মিথ্যে। আমার রুচি এতোটা খারাপ নয় যে ওরকম আনস্মার্ট ছেলের সঙ্গে প্রেম করব। ”

“কিন্তু ম্যাডাম উনি তো প্রেমের ব্যাপারে কিছু বলে নি। উনি বলেছে আপনি টাকা হাতিয়েছেন?”

দিতিয়া শুকনো ঢোক গিলে বলল,

“সিরিয়াসলি! ওদের কী ই বা আছে যে আমি ফাঁসাব! তাছাড়া আমি ইনডিপেনডেন্ট, আমার কারও কাছে হাত পাততে হয় না। ”

পুলিশ অফিসার দিতিয়াকে ভালো করে দেখলেন। কী ধূর্ত মেয়েমানুষ! এমন অবলীলায় একের পর এক মিথ্যে বলছে যে চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই।

“ম্যাডাম, নেহাল সাহেবের ফোনে আপনাদের ম্যাসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপের সব টেক্সট, চ্যাট আমরা দেখেছি। ”

“তো? ওগুলো ফেইক। ”

“না। আমাদের সাইবার টিম কনফার্ম করেছে যে ওগুলো সত্যি। আর আপনারা যে হোটেল ভিউ তে রেগুলার যেতেন সেটার সিসিটিভি ফুটেজ উদ্ধার করা হয়েছে। অনেক আগের হলেও আমরা এই অসাধ্য সাধন করেছি। ”

দিতিয়া স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। পুলিশ অফিসার আবারও বলল,

“নেহাল সাহেব কে টিকটিকি ভাবলেও ওনার হাত অনেক লম্বা। আপনার নামে ওনারা মামলা করেছেন। আপনি ত্রিশ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। আপনি হয়তো জানেন না যে নেহাল সাহেবের এক খালু ডিআইজি। উনিও হাত ধুয়ে আপনার পিছনে লেগেছেন। ”

“না, এটা মিথ্যে.. মিথ্যে সব। এতো টাকা আমি নেই নি। ”

দিতিয়াকে কেমন উদভ্রান্তের মতো লাগলো!

“ম্যাডাম আপনি একটু সাবধানে থাকবেন। মানুষের যখন সময় খারাপ যায় তখন সব দিক থেকেই খারাপ সময় যায়।”

দিতিয়া কিছু বলতে পারলো না। স্থির চোখে তাকিয়ে রইলো।

***
পুলুকে এসে আজ ওর বাবা নিয়ে গেছে। দিলারা শত চেষ্টা করেও রাখতে পারলো না। দিতিয়ার চরিত্র খারাপ, দিহানের চরিত্রও ভালো ছিলো না এসব বলে গেছে। দিলারা খানিকক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। মেয়ের নামে যা শুনছেন সেগুলো কিছু বিশ্বাস করেন না। আহনাফ ছেলেটাও পিঠ দেখিয়ে দিয়েছে। দেখালে দেখাক, মেয়ের জন্য পাত্রের অভাব হবে না। কিন্তু এই বিপদ টা কাটুক। মেয়েটা সব ঝামেলা কাটিয়ে উঠুক।

***
এজাজ রহমান ধারণা করছেন তার মেয়ের ঘটনায় দিতিয়ার হাত আছে। দিতিয়া তাকে একটা টেক্সট করেছিল,

“আমাকে ইগ্নোর করছেন? এটার ফল কিন্তু খুব খারাপ হবে। দিতিয়া ইগ্নোর ব্যাপার নিতে পারে না। দেখুন, আপনার ই না আবার হা পা ধরে কাঁদতে হয়। ”

এজাজ রহমান খুব হেসেছেন। ওইটুকু একটা মেয়ে তাকে শাসাচ্ছে! ভাবা যায়! ওরকম দশটা মেয়ে পায়ের নিচে রাখার ক্ষমতা তার আছে।

এখন এজাজ রহমানের সন্দেহের লিস্টে দিতিয়াই আছে। মেয়ে তার অতি আদরের। দিতিয়াকে সে ছাড়বে না।

***
আহনাফের সাথে সম্পর্ক ভেঙেছে দিতিয়ার। ডায়মন্ড রিং সহ সবকিছুই ফেরত চেয়েছে আহনাফ। দিতিয়া আপত্তি করে নি। আহনাফ ও’কে খুব খারাপ কিছু কথা বলল। দিতিয়া গায়ে মাখলো না। সময় টা ওর খারাপ যাচ্ছে তবে মনোবল এখনো পুরোপুরি হারায় নি। ওর বিশ্বাস শেষ গুটিটা চেলে ও জিতে যাবে।

দিতিয়ার এমন জীবন আজ নতুন নয়। বাবা মধ্যবিত্ত চাকুরীজীবি। আরাম আয়েশ যেমন নিজে করতে পারে নি, তেমনি ওদেরও দিতে পারে নি। দিতিয়া বোকা না, ও বুঝে গেছিলো কিভাবে আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করা যায়। পড়াশোনায় ভালো ছিলো, সুন্দরী ছিলো। সব মিলিয়ে ছেলে পটাতে সময় লাগে নি। একটা সময় বুঝলো চাকরি বাকরি করে পরিশ্রম করে গাড়ি, বাড়ি করতে গেলে ও বুড়ো হয়ে যাবে। তাই শর্টকাট অপশন খুঁজলো, পেয়েও গেল। ওপরে ওঠার সিড়ি বেয়ে টপ ফ্লোরে প্রায় উঠে গিয়েছিল। মাঝখানে এই ঝামেলা টা!

দিতিয়া একটা ব্যাপার মিলাতে পারছে না কিছুতেই। কে ওর পিছনে হাত ধুয়ে লেগেছে! সত্যিই নেহাল নাকি অন্যকেউ। সমস্ত সন্দেহ নেহালের দিকে গেলেও দিতিয়ার অবচেতন মন বলছে এটা নেহাল নয়। অন্যকেউ। আর সে খুব চালাক। এজাজ রহমান না তো! নাকি তার পরিবারের কেউ!

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

পারফিউম পর্ব-০৪

0

#পারফিউম
#পর্ব-৪

দিতিয়া এজাজ রহমান কে তিন বার ফোন করলো। প্রত্যেকবার ই কল কেটে দিয়েছে। একটু পর টেক্সট পাঠালো,

“হলিডেতে আমি কারোর ফোন রিসিভ করি না। ”

দিতিয়ার ভীষণ রাগ হলো। এই ফ্যামিলি ম্যান বাইরে ঠিক কী কী করে বেড়ায় সেটা স্ত্রী সন্তান রা জানলে গলা টিপে মে*রে ফেলবে।

দিতিয়া বুঝতে পারলো ওর সময় টা খারাপ যাচ্ছে। আহনাফ ওর জন্য টেনশন করার বদলে রহস্য খুঁজে বেড়াচ্ছে। মেনীমুখো নেহাল ফনা তুলে ছোবল মারার চেষ্টা করছে। এজাজ সাহেব ফোন তুলছেন না।

দিতিয়া নিজের মন কে প্রবোধ দিচ্ছে। বিচলিত হলে চলবে না। রাস্তা খুঁজে বের করতে হবে। আহনাফ ছেলেটা উপর থেকেই হম্বিতম্বি। মাথায় তেমন কিছু নেই। আর নেহাল যতই পুলিশের ভয় দেখাক, নিজের মান সম্মান নিয়ে সে খুব ই সচেতন। ওটা দিতিয়াকে ভয় দেখানোর জন্যই বলা।

দিতিয়া নানান রকম যুক্তি খুঁজে নিজের মন কে শান্ত করার চেষ্টা করলো। এজাজ রহমান যত ব্যস্ততা দেখাক ছুটে আসতে হবে ওর কাছে। ঠিক আসবে, পায়ের কাছে এসে বসে থাকবে। দিতিয়া সেই ব্যবস্থা করবে।

***
“আপনি বলতে চাইছেন, আপনাকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে দিতিয়া ম্যাডাম টাকা হাতিয়েছে?”

নেহাল মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।

পুলিশ অফিসার বললেন,

“মুখে জবাব দিন। ”

নেহাল হ্যাঁ বলল।

“আপনি ফাঁদে পড়লেন কেন?”

নেহাল বুঝতে পারলো না কী জবাব দিবে। পুলিশ অফিসার আয়েশ করে চা খাচ্ছেন। তার মনে হচ্ছে না যে এই ছেলেটা মিথ্যে বলছে। কিছু মানুষ আছে যাদের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ দেখে সহজে বোঝা যায় যে মানুষ টা কেমন। তবে কেউ কেউ আছে ভীষণ ধূর্ত, এদের সহজে পড়া যায় না।

অফিসার জিজ্ঞেস করলো,

“আপনাদের গল্পটা খতম কেন হলো? ”

“কারণ টাকা দেয়া বন্ধ করেছিলাম। ”

“আপনি বাপের টাকা চুরি করে দিচ্ছিলেন কেন? আপনি কী গবেট?”

নেহাল মাথানিচু করে জবাব দিলো,

“আমি ভেবেছিলাম টাকাটা ওর দরকার। ”

“আচ্ছা। এখন কী মনে করে পুলিশের কাছে আসছেন?”

“আমার মনে হলো পুলিশের কাছে ব্যাপার বলা দরকার। ”

“দিতিয়াকে কোনো গিফট পাঠিয়েছেন রিসেন্টলি?”

“না।”

“সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন! ভালো করে হোমওয়ার্ক করে এসেছেন। ”

“পারফিউম এর ব্যাপার টা আমি জানি। বাবলু ভাইয়ের ওয়াইফ মারা গেছে। ”

পুলিশ অফিসার মাথা নাড়লো। আবারও জিজ্ঞেস করলো,

“সত্যিই পাঠান নি পারফিউম সেট আপনি? ”

“না। তবে….!”

“আমি এসিড সংগ্রহ করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম সুযোগ বুঝে….

পুলিশ অফিসার নেহালের দিকে ভালো করে তাকালো। শান্ত গলায় কথা বলা সুদর্শন পুরুষ টা রীতিমতো তাকে অবাক করে দিয়েছেন। চোর, বাটপার, খু*নী যারা সামলায় তাদের সহজে চমকে দেয়া যায় না। কী অবলীলায় এসিডের কথা বলে ফেলল!

***
এজাজ রহমান ছুটিতে এসেছেন। মেয়ে ও লেভেলে ভালো রেজাল্ট করেছে তার সেলিব্রেশন চলছে। ছেলে, মেয়ে দুজন কেই এজাজ রহমান ভালোবাসেন। বাচ্চারা সুইমিংপুলে নেমে মায়ের সাথে আহ্লাদ করছে। দেখতে ভালো লাগছে। ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো দিতিয়ার টেক্সট। আহারে মেয়েটা আবার রেগে গেল! এই মেয়েটা অবুঝ না, কিন্তু এই মুহুর্তে অবুঝের মতো আচরণ করছে। এজাজ রহমানের দুটো জীবন। একটা হচ্ছে সুইমিংপুলের যে দৃশ্যটা দেখা যাচ্ছে সেটা। অন্য জীবনের একটা অংশ দিতিয়া। এই মেয়েটা চাকরিটা পেয়েছে নিজ গুনে। কোয়ালিফিকেশন যেমন টপ ক্লাস ছিলো তেমনি ছিলো সুন্দরী। উপরে ওঠার সহজ সিড়িটা উনি দেখিয়ে দিয়েছেন। মেয়েটা সেটা চুজ করে স্মার্ট, বুদ্ধিমতির পরিচয় দিয়েছেন।

এখন কীসব ঝামেলা চলছে। বড়বোন টা মরে গেছে নাকি। একটু বেশী কঠিন সময় যাচ্ছে। এটারও দরকার আছে। এজাজ রহমান চাইলেই সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু তিনি তো সেটা করবেন না। কারণ দিতিয়াকে নাস্তানাবুদ অবস্থায় দেখে ভালো লাগছে। মেয়েটা এখন এসে কান্নাকাটি করে কাকুতি, মিনতি করলে সেটা আরও ভালো লাগবে।

***
“বিষয় টা অনেক জটিল হয়ে যাচ্ছে দিতিয়া। তুমি সম্ভবত অনেক কিছু লুকিয়েছ আমার থেকে। ”

দিতিয়ার শান্ত গলা। বলল,

“বিয়ে ক্যান্সেল করতে চাইছ?”

আহনাফ হ্যাঁ বলল না। অথচ ওর মনে এটাই চলছে। দিতিয়াকে সত্যি ধোয়া তুলসীপাতা না ভাবলেও ভালো মেয়ে ভেবেছে। যদিও নেহালের ব্যাপার টা দিতিয়া অস্বীকার করেছে। তবুও আহনাফের বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।

“আহনাফ, আমার খারাপ সময়ে যেভাবে তোমার পাশে থাকা দরকার সেভাবে কিন্তু তুমি থাকছ না। উল্টো আমার দোষ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছ।”

“দেখো দিতিয়া, আমার ফ্যামিলি একটা ঘরোয়া মেয়ে চেয়েছিল আমার জন্য….

“আহনাফ তুমি ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে পয়েন্টে আসো। ”

আহনাফ কিছু বলছে না। দিতিয়া সহজ মেয়ে নয়। বিয়ে ভেঙে দেবার কথা শোনার পর ঠিকই অন্য গুটি সাজিয়ে ফেলবে। করতে হবে কৌশলে। আহনাফ হঠাৎই শান্ত গলায় বলল,

“টেক কেয়ার বেবি। সব ঠিক হয়ে যাবে। ”

দিতিয়া এতো নরম কথায় গলল না। ওর সন্দেহের তীর এখন সবার দিকেই। নেহাল ও’কে প্যাচে ফেলেছে। আহনাফও ও’কে নিশ্চয়ই প্যাচে ফেলতে চাইবে। অন্য চাল চালতে হবে।

***
পুলিশ অফিসার ফোন করেছে দিতিয়াকে। সামনাসামনি কথা বলতে চায়। দিহানের স্বামী এসে দিতিয়াকে শাসিয়ে গেছে। এজাজ রহমান তার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টে শুধু হ্যাপি ফ্যামিলির ফটো আপলোড হচ্ছে।

দিতিয়া অন্য কাউকেও পাশে পাচ্ছে না। সব মিলিয়ে ওর সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে। খুব খারাপ।

এরমধ্যে আরেক ঘটনা ঘটলো। এজাজ রহমানের হ্যাপি ফ্যামিলি হঠাৎই আনহ্যাপি হয়ে গেল। এজাজ রহমানের মেয়ে এশার বেশ কিছু অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল হলো সোশ্যাল মিডিয়ায়। তাও আবার নিজের বয়সী টিচারের সঙ্গে।

দিতিয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার সময়টাও খারাপ যাচ্ছে।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

পারফিউম পর্ব-০৩

0

#পারফিউম
#পর্ব-৩
নেহাল ভীতু টাইপের মানুষ। সুদর্শন, ভদ্র ছেলে। কোনো মেয়ের দিকে বাজে নজরে তাকায় না। দিতিয়াকে প্রথম দেখেছে বাবলু ভাইয়ের বিয়েতে। জানতে পারলো দিতিয়া বাবলু ভাইয়ের শালি। প্রথম দর্শনে ভালো লাগার ব্যাপার টা যদি লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয় তবে ওটা তেমন ছিলো। নেহাল অনেকদিন ব্যাপার টা শুধু নিজের মধ্যে রেখেছে। হঠাৎ ফ্যামিলি গেট টুগেদারে দিতিয়াকে দেখলে ভালো লাগতো। ব্রাইট স্টুডেন্ট সেই সঙ্গে সুন্দরী স্টাইলিশ দিতিয়া নজর কাড়বার মতোই।

কিন্তু স্বপ্ন ভেঙে গেল তখন যখন শুনলো দিতিয়ার বয়ফ্রেন্ড আছে। দীর্ঘ সময় ধরে ওরা সম্পর্কে আছে। অন্তত সোশ্যাল মিডিয়ার ঘনিষ্ঠ ছবিগুলো সেটাই প্রমাণ করে। হৃদয় ভাঙার কষ্ট টা নেহাল প্রায় সামলে উঠলেও দিতিয়াকে চোখের সামনে দেখলে কেমন পাগল পাগল লাগতো। মাতাল করা পারফিউমের ঘ্রাণ। ইচ্ছে করতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখতে।

একবার একটা ব্যাপার ঘটলো। দিতিয়ার একটা কাজের জন্য ওদের বাসায় এসে কয়েকদিন থাকলো। তখন ওদের বাসা ছিলো পুরান ঢাকার দিকে। উত্তরাতে আসা যাওয়া সম্ভব নয় বলে ভাবী ফোন করে নেহালের মা’কে বলল।

নেহাল দিতিয়াকে দেখে খুশি হলো। পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই তবুও দেখতে ভালো লাগতো। দিতিয়ার নজর এড়ালো না বিষয় টা। খানিকটা উস্কানিমূলক আচরণ নিজেও করলো। একদিন ছাদে একা পেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

“তুমি আমাকে কিছু বলতে চাও নাকি?”

নেহাল কোনোকিছু না ভেবে বলল,

“তুমি কী তোমার ওই বয়ফ্রেন্ড কে বিয়ে করবে?”

দিতিয়া হেসে ফেলল। কাছে এসে নেহালের চোখের দিকে তাকালো। বলল,

“তুমি কী চাও?”

নেহাল তাকিয়ে রইলো। সেদিন বোধহয় ওর উপর শয়তান ভর করেছিল। কোনোকিছু না ভেবে দিতিয়ার ঠোঁটে চুমু খেয়েছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যাপার ছিলো মাত্র। যখন সেন্স হলো তখন বুঝতে পারলো যে এটা ঠিক ছিলো না। খুব খারাপ হয়েছে। দিতিয়াকে বলল,

“সরি সরি। আমি আসলে… আই এম সরি। ”

দিতিয়া শব্দ করে হাসলো। এগিয়ে এসে নেহাল কে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

“অফকোর্স তোমার সরি ফিল করা উচিত। কারণ তুমি আমাকে ইনসাল্ট করেছ। এখন তুমি তোমার কাজ টা ঠিক করে করবে। কিস মি রাইট নাউ। ”

সেদিন থেকে শুরু। সেই শুরুটাকে নেহাল ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছে। আর দিতিয়া জাস্ট ইউজ করেছে। এরপর ঘটে গেছে কতকিছু। হোটেলের বন্ধ রুমে একান্ত সময় কাটানো থেকে শুরু করে নেহালের বাবার ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা সরানো সব কিছুই হয়েছে দিতিয়ার ইচ্ছেতে। এক সময় দিতিয়া অন্য সিড়ি পেয়ে নেহাল কে রাস্তায় ছুড়ে ফেলল রীতিমতো। ততদিনে নেহালের চোখের রঙিন চশমাটাও সরে গেল। বাবার একাউন্ট থেকে নয়লাখ টাকা সরানো হয়েছে। বাবা, মা সবাই কে সন্দেহ করলেও নেহাল কে করে না। নেহাল বন্ধ দরজার আড়ালে কাঁদে। আয়নায় নিজেকে দেখতেও লজ্জা হয়। এক পর্যায়ে গিয়ে মনে হলো ওর এবার কঠিন হওয়া প্রয়োজন।

“আমার টাকাগুলো আমাকে বুঝিয়ে দাও। ”

নেহালের গলার স্বর শান্ত তবে দৃঢ়। দিতিয়া সানগ্লাস টা খুলে ফেলল। কঠিন গলায় বলল,

“তুমি কী আমাকে পারফিউম সেট টা পাঠিয়েছিলে?”

“কিসের পারফিউম সেট? ”

“ইনোসেন্ট হবার নাটক আমার সঙ্গে করবে না?”

“শয়তানের সঙ্গে ইনোসেন্ট হবার মতন বোকা আমি নই। ”

অন্য সময় হলে দিতিয়া এই ডায়লগ শুনে খুব হাসতো। কিন্তু এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। ঠান্ডা গলায় বলল,

“সত্যিই তুমি পারফিউম সেট টা পাঠাও নি?”

“না। তোমার এই পারফিউমের গল্প বন্ধ করো। আমার টাকাগুলো ফেরত দাও। ”

দিতিয়া স্বাভাবিক গলায় বলল,

“কিসের টাকা? ”

“নয় লাখ টাকা ক্যাশ। দামী গিফট সহ অন্যান্য সবকিছু বাদ দিলাম। ”

“তুমি যে হোটেলে গিয়ে আমার সঙ্গে শুয়েছ? সেটা কী এমনি এমনি?”

নেহাল একটা ধাক্কা খেল। আশেপাশে তাকালো। ব্যস্ত রেস্টুরেন্টে কেউ কারো দিকে খেয়াল করছে না। নেহালের ইচ্ছে করলো মাটির নিচে ঢুকে যেতে। রুপের মোহে অন্ধ হয়ে এই বাজারের মেয়েটার জন্য সময় নষ্ট করেছে!

দিতিয়া শ্লেষের সুরে বলল,

“তোর কী এমন যোগ্যতা যে আমাকে ফ্রী ফ্রী পেয়ে যাবি? ”

নেহাল শান্ত অথচ ভয়ংকর চোখে তাকিয়ে আছে। দিতিয়া দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“এরপর যদি কোনো নাটক দেখি তাহলে আমার কাছে যা আছে সেগুলো সবাই দেখবে। ”

নেহাল জানে দিতিয়া ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে না। তবুও বলল,

“আচ্ছা। যা হয় হোক। আমিও পুলিশের কাছে সব সত্যি বলব। ”

দিতিয়ার মুখের রঙ পাল্টালো এবার। নেহাল উঠে গেল দিতিয়াকে কিছু না বলার সুযোগ দিয়ে।

***
“পারফিউম গুলো ভালো করে দেখেন নি?”

দিতিয়া মাথা নেড়ে না বলল।

পুলিশ অফিসার পারফিউমের বোতল গুলো দেখিয়ে বলল,

“কোনো ব্র‍্যান্ড লোগো নেই।”

দিতিয়া বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। এতো বড় বোকামি কিভাবে হলো।

পুলিশ অফিসার বলল,

“আইডিয়া করতে পারছেন কে পাঠাইছে?”

“না। আসলে আমাকে প্রায়ই অনেকে সারপ্রাইজ গিফট পাঠায়।”

“অনেকে?”

“জি। ”

“এই অনেকের মধ্যে কারা কারা আছে। ”

“কলিগ, ফ্রেন্ডস রিলেটিভস। ”

“সবার নাম লিখে দিন তো একটা কাগজে। ”

“এতো মানুষের নাম লেখা সম্ভব? ”

পুলিশ অফিসার সন্দেহের চোখে তাকালেন। বললেন,

“সম্ভব না?”

দিতিয়া জবাব দিলো না। পুলিশ অফিসার বললেন,

“আপনাকে একজন মারতে চায়। আনফরচুনেটলি তার প্ল্যান ফেইল করেছে। সে কী এখনো চুপচাপ বসে আছে বলে মনে করেন? নিশ্চয়ই অন্য কোনো প্ল্যান শুরু করেছে এতক্ষনে। ”

“আমার এরকম কোনো শত্রু নেই। ”

“তাহলে? ”

“মানে?”

“তাহলে এই পারফিউম কেন পাঠাল?”

“ভুলে আসতে পারে। ”

“ভুলে আসা পার্সেল রিসিভ করেছেন?”

দিতিয়া জবাব দিতে পারলো না। পুলিশ অফিসার বলল,

“ব্যাপার টা হালকা ভাবে নেয়ার চেষ্টা করছেন তার মানে ভেতরে অন্য কাহিনী আছে। আপনি ওই লোকগুলোর নাম লিখে রাখবেন। ”

“কোন লোকগুলো? ”

“যারা আপনাকে সারপ্রাইজ গিফট পাঠায় তাদের। ”

দিতিয়া কিছু বলল না। পুলিশি ঝামেলা ভালো লাগছে না। কে জানে কখন কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে আসে।

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

পারফিউম পর্ব-০২

0

#পারফিউম
#পর্ব-২
বন্যা, রাখী, সুমী তিনজন ই দিহানের ক্লাসমেট। বন্ধুত্বের চেয়ে লোক দেখানো সম্পর্ক বেশী। ব্যক্তিজীবনে কে কতটা সুখী, কার হাজবেন্ড কত কী করছে সেসব নিয়ে গসিপ চলে।

আজকের গেট টুগেদার ছিলো বন্যার কারণে। খুব শিগগিরই ও হাজবেন্ড, বাচ্চাসহ আমেরিকা সেটল্ড হচ্ছে। সেই সুখবর টা শোনার পর বন্ধুদের মুখ কেমন হয় সেটা দেখার জন্য মূলত তিনজন কে ডাকে।

দিহান এসেছিল সেজেগুজে। ওর সাজগোজ এমনিতে খানিকটা ব্যাকডেটেড টাইপ। ফ্যাশন সেন্স খানিকটা কম। তবে আজকে ওর শাড়ি, জুয়েলারি, সাজ সবকিছুই চমৎকার ছিলো। সুমি তো বলেই ফেলেছিল প্রায়, যাক দিতিয়াকে দেখে অন্তত কিছু শিখলি শেষ পর্যন্ত৷ কিন্তু আলগা প্রশংসা ছাড়া আর কিছু বলে নি।

বন্যা খাবার এনেছিল দামী রেস্টুরেন্ট থেকে। খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে ওর হাত খোলা। এদিক থেকে দিহান বেশী হাতখোলা হতে পারে না। নিজের বানানো মোরগ পোলাও, খিচুড়ি, বিরিয়ানি ছাড়া তেমন কিছু পারে না।

আড্ডা শুরু হলো চা আর গরম শিঙারা দিয়ে। চা খেতে শুরু করার খানিকক্ষণ পর ই দিহান বলল,

“বন্যা চায়ে কী দিছিস? ”

“এলাচিগুঁড়া দিছি। কেন খারাপ লাগছে? এলাচি স্বাস্থ্যের জন্য তো ভালো। ”

“উঁহু। কেমন যেন লাগছে। ”

বন্যা পাত্তা দিলো না। স্বপ্নের দেশ নিয়ে গল্প করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বাকী বন্ধুরা উচ্ছ্বাস দেখালেও দিহানকে তেমন উচ্ছ্বসিত মনে হয় নি। তাছাড়া অন্যান্য সময়ের চেয়ে খানিকটা অস্থিরও মনে হলো। খাওয়া দাওয়ার আগেই বাসায় চলে যেতে চাইলো। বাকীরা জোর করে রেখে দিলো। চাউমিনের খানিকটা খেয়েই বলল,

“বন্যা আমার খারাপ লাগছে? তোর গেস্ট রুমে গিয়ে একটু রেস্ট নেই। ”

বন্যা জিজ্ঞেস করেছিল,

“কী হয়েছে?”

জবাব দেবার আগেই চেয়ারসহ পড়ে গেল।

***
“ডাক্তার বলেছে মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। পোস্টমর্টেম করতে হবে? ”

দিহানের স্বামীর বেশ স্বাভাবিক গলা। এতোটা স্বাভাবিক কী সত্যিই থাকা যায়। দিলারা কিছু বলছে না। দিতিয়াকে এখনও কিছু জানাতে পারে নি। ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ফোন টা অফ করে বোধহয় ঘুমাচ্ছে।

দিলারা কিছুই বুঝতে পারছে না। দিহানের তো তেমন অসুখ, বিসুখ নেই। আজকে যাবার সময় তো অসুস্থ মনে হলো না। তার উপর এখন শুনছেন মৃত্যু স্বাভাবিক না। ওর কেন অস্বাভাবিক মৃত্যু হবে। বোকাসোকা এই মেয়েটারও শত্রু আছে!

***
দিতিয়া কড়া ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল। তবুও ঘুম টা ভেঙে গেল হঠাৎ ই। বুক ধড়ফড় করছে। ফোন হাতে নিয়ে দেখলো সাতচল্লিশ টা মিসড কল। মায়ের মেসেজ ও আছে। মেসেজে লিখেছে, দিহান আর নেই দিতি।

দিতিয়া এই কথার অর্থ ধরতে পারলো না। নেই মানে কী!

দিতিয়া ফোন করলো। দিলারা ফোন ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগলো।

***
পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসার পর জানালো ডাক্তারের আশঙ্কা সত্যি। দিহানের শরীরে বিষ পাওয়া গেছে। তবে স্টমাকে বিষ ছিলো না।

যা ঘটেছে সব ভাবনার উর্ধ্বে। সন্দেহের তালিকায় প্রাথমিক ভাবে দিহানের বন্ধুদের রাখা হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি।

দিলারা শোকে কাতর হলেও একটা ব্যাপার খেয়াল করছেন। পুলুর বাবাকে অতো বেশী দু:খী মনে হচ্ছে না। দিহানের মৃতদেহ দেখে দুই, চার ফোঁটা চোখের জল ফেলেছে। এরপর তো স্বাভাবিক ই মনে হলো।

***
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ফরেনসিক রিপোর্ট এলো। পারফিউমে বিষাক্ত কিছু ছিলো। শরীরে ছড়িয়ে পড়ায় দিহান কে মৃত্যুর মুখ থেকে ফেরানো গেল না।

দিতিয়ার মাথা ফাঁকা হয়ে গেছে। পারফিউম! সেই সুন্দর সেট টা! ওর নামে পার্সেল এসেছিল।

***
পার্সেল টা দিয়ে গিয়েছিল এক লোক। দিলারা ভালো করে চেহারার বর্ননা দিতে পারলো না। প্যাকেট টাও ফেলে দেয়া হয়েছে। কিছুই জানা গেল না এখনো পর্যন্ত পার্সেল সম্পর্কে।

দিতিয়া অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে। বাইরেও কোথাও বেরোচ্ছে না। পারফিউমগুলো ওর জন্য ছিলো। ভাগ্য খারাপ বলে দিহান কে মরতে হলো। এই পারফিউম গুলো কে পাঠালো! এই মুহুর্তে ওর জীবনে নেহাল ছাড়া আর কেউ ই ঝামেলা করার মতো নেই। কিন্তু নেহালের মতো ছেলে কী সত্যিই এতো ভয়ংকর হতে পারে!

“দিতি! আহনাফ এসেছে।”

দিতিয়া উঠে দাঁড়ালো। আজ আর পরিপাটি হবার তাড়া নেই। আয়নায় নিজেকে দেখারও ইচ্ছে হলো না।

আহনাফ বসে আছে বিরক্তমুখে। দিতিয়াকে দেখে বলল,

“তুমি ঠিক আছ?”

দিতিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“এইতো….

“তোমার এমন ভয়ংকর শত্রু কে হতে পারে যে প্রাণে মারতে চায়?”

দিতিয়া একটু চমকে উঠলো। বলল,

“কে.. কেউ না তো!”

“কেউ তো আছেই। যে তোমাকে ভীষণ অপছন্দ করে। ”

“এমন কেউ নেই।”

আহনাফ সন্দিহান চোখে তাকালো। বলল,

“এতো শিওর কী করে হচ্ছো! হতেই তো পারে অফিসে কেউ তোমাকে অপছন্দ করে। তোমার সাকসেস টা ঠিক মেনে নিতে পারছে না। ”

দিতিয়া চুপ করে আছে। কিছু বলার নেই আহনাফ কে।

***
আহনাফ বিরক্ত হলো এই উটকো ঝামেলায়। নাহলে এতো দিনে বিয়েটা হয়ে যেত। সবকিছু ঠিকঠাক হবার পর এই ঝামেলা। সোসাইটি, রিলেটিভস দের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে অস্থির হতে হচ্ছে! তারচেয়েও বড় কথা হলো দিতিয়া নিশ্চয়ই কিছু লুকিয়েছে। ওর ফ্যামিলিতে এমন কিছু ঘটনা হয়তো আছে। কিংবা ওর কোনো বয়ফ্রেন্ড! বয়ফ্রেন্ড! শব্দটা দ্বিতীয়বার মনে মনে আওড়ালো। দিতিয়া ও’কে ঠকাচ্ছে না তো!

***
দিতিয়া নেহাল কে টেক্সট করলো।

“টাকা ফেরত দেব তোমার। দেখা করো আমার সঙ্গে। ”

নেহাল সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলো,

“এখন আর দরকার নেই। ”

টেক্সট টা দেখে দিতিয়ার মনে হলো যা কিছু ঘটেছে তাতে নেহাল খুশিই। হঠাৎ ই মনে হলো এই নেহাল ছেলেটাকে পিপীলিকা ভেবে ছেড়ে দেবার কোনো মানে হয় না।

দিতিয়া ফোন টা হাতে নিয়ে আসল জায়গায় ফোন করলো। যে ও’কে এই বিপদ থেকে মুক্তি দিতে পারবে।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

পারফিউম পর্ব-০১

0

#পারফিউম
#পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা

পারফিউম সেট টা এসেছে কুরিয়ারে। কে পাঠিয়েছে সেটা উল্লেখ করা নেই। দিতিয়া অতো মাথা ঘামালো না। ও’কে গিফট পাঠানোর লোকের অভাব নেই। শুভাকাঙ্ক্ষীরা প্রায় ই ও’কে সারপ্রাইজ দেবার জন্য এটাসেটা পাঠায়। তাদের মধ্যেই কেউ একজন হয়তো সারপ্রাইজ দিয়েছে। তবে পারফিউম সেট টা পছন্দ হলো ভীষণ। তিন সাইজের তিনটা পারফিউম। স্মেল টাও দারুন।

পারফিউম সেট সযত্নে রইলো ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে। দিতিয়ার আজ আবার তাড়া আছে। কক্সবাজার ট্রিপ আছে। অফিস থেকে প্রায় ই বাইরে যেতে হয়। এই চাকরি টা ওর জন্য লাকি। বেশ কয়েক জায়গা ঘোরা হয়ে গেছে অফিস খরচে। দুই মাস আগে ঘুরে এলো কালিম্পং থেকে। কাজের পাশাপাশি ঘোরাঘুরি করার সময়ও পেয়েছে বেশ। স্যালারির পাশাপাশি ভালো একটা এমাউন্টও আসে এসব ট্রিপ থেকে।

***
দিহান এসেছে পুলুকে নিয়ে মায়ের কাছে। দিতিয়ার বিয়ের শপিং করতে হবে। বেচারি তো সময় ই পায় না অফিস সামলে। বোন কে নিয়ে গর্ব হয় খুব। কতো অল্প বয়সে কতকিছু অর্জন করেছে। ফ্ল্যাট কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছে। শ্বশুরবাড়িতে গর্ব করে বোনের গল্প বলে। খালাশাশুড়ির খুব ইচ্ছা ছিলো তার ছেলে নেহালের জন্য দিতিয়াকে নেবার। দিহান ই মুখের উপর বলে দিলো নেহালের যোগ্যতা সম্পর্কে। সবাই তো ক্ষেপে ব্যোম হয়ে আছে৷ থাকে থাকুক,

“এই টি সেট টা কবে কিনলে মা? বেশ সুন্দর তো। ”

“কিনিনি তো। দিতিয়াকে কে যেন পাঠালো ওর জন্মদিনে। ”

মায়ের গলায়ও উচ্ছ্বাস। ছোট মেয়ে সংসারের জন্য যা করছে অনেকের ছেলেও সেটা করতে পারে না। দিহান আহ্লাদী গলায় বলল,

“এই টি সেট টা আমি নিয়ে যাই মা। তুমি কিন্তু রাগ কোরো না। ”

“না রাগ করব কেন। নিয়ে যাস।”

এমন কতশত গিফট আসে। ওয়াশিং মেশিন, ফ্রিজ, প্রেশার কুকার সব ই আসে। মেয়ের বন্ধুভাগ্যও খারাপ না। কলেজের এক বন্ধু ইতালি থেকে ফোন পাঠালো। সেই ফোনের দাম দেশে নাকি দেড়লাখের উপরে। মেয়েটাও আবার ভীষণ পরোপকারী। কারোর দরকারে সবার আগে ঝাপিয়ে পড়ে। কাউকে ফিরায় না।

***
“এই দিতি টি সেট টা নিলাম। কালার, ডিজাইন অনেক পছন্দ হয়েছে। ”

দিতিয়া ফোন দেখতে দেখতে জবাব দিলো,

“আচ্ছা।”

“লিপস্টিকের শেড কত? দারুণ তো। ”

“ড্রেসিং টেবিলে এটার দুইটা আছে। একটা নিস। ”

দিহান খুশি হলো। ও নিজে একটু হিসেবি হলেও দিতিয়া ও’কে কোনো কিছু দিতে কার্পণ্য করে না। মনে আছে বিয়ের সময় মায়ের গয়নাগাটি নিয়ে খুব মান, অভিমান গেছে। মা দিতিয়ার জন্য তিনটা আংটি, হাতের দুটো চুড়ি, আর নেকলেস রেখে বাদবাকি সব গয়না ও’কে দিয়েছিল বলে ও সারারাত কেঁদেছিল।

***
দিতিয়ার মেজাজ টা খারাপ। নেহাল ও’কে হোয়াটসঅ্যাপে টেক্সট করেছে। ওর টাকা ফেরত চাই। নাহলে খুব খারাপ হয়ে যাবে।

নেহালের মতো টিকটিকি টাইপ ছেলে দিতিয়াকে থ্রেট দিচ্ছে! দিতিয়া লিখলো,

“কী খারাপ হবে? ”

নেহাল সেই টেক্সট সিন করে রাখলো। এবার দিতিয়ার হাসি পেল। এই ছেলে ওর কিছুই খারাপ করতে পারবে না, ওর কাছে কিছু নেই। কিন্তু দিতিয়ার কাছে অনেক কিছু আছে ওর ইমেজ খারাপ করার জন্য। দিতিয়া হোয়াটসঅ্যাপে একটা ছবি পাঠালো। নরমাল একটা ছবি। নেহাল খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। দেখতে বোকা বোকা লাগছে। সাথে লিখেছে,

“এটা জাস্ট ট্রেলার বেবস। পিকচার এখনো বাকী। ”

নেহাল সেটা সিন করে রেখে দিলো। দিতিয়ার ভীষণ হাসি পাচ্ছে। এই ছেলেটা নিশ্চয়ই এখন হাত, পা ছুড়ে কান্নাকাটি করছে। এরা আবার ইমেজের ব্যাপারে এতো সচেতন হয়!

মা ভাত নিয়ে এসেছে। ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভাত খাইয়ে দিচ্ছে মেয়েকে। দিতিয়াও নিশ্চিন্ত মনে খাচ্ছে। এইবারের কক্সবাজার ট্রিপ টা একটু স্পেশাল ওর কাছে। এই ট্রিপে ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে প্রোমোশন টা পাক্কা। স্যালারির এমাউন্ট টা ছয় ডিজিট হয়ে যাবে।

***
ড্রেসিং টেবিলের কসমেটিকস গুলো দেখে দিহানের চোখ চকচক করে উঠলো। সব ব্র‍্যান্ডেড জিনিসপত্র। একটা লিপস্টিক নিতে এসে কয়েকটা পছন্দ হয়ে গেল। নেইলপলিশগুলো তো আরও সুন্দর। সানগ্লাসের কালেকশন গুলো দেখে মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম। দিতিয়ার কপাল টা বেশ। যার সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে সেও বিশাল বড়লোক। সেই সঙ্গে হাতখোলাও। এঙ্গেজমেন্টে ডায়মন্ড রিং পরিয়ে দিলো। ভাবা যায়!

দিহানের নিজের ভাগ্য দেখলে ইচ্ছে করে কপাল টা দেয়ালে ঠুকে দেয়। পুলুর বাবার পয়সাকড়ি ভালোই। কিন্তু লোকটা ভীষণ কঞ্জুস। আশুলিয়ায় কী এক ছাতার মাথা বাড়ি করবে বলে টাকা গচ্চা দিচ্ছে। এদিকে কোথাও ফ্ল্যাট বুকিং দিবে তা না। কিছু বলতে গেলে যোগ্যতা নিয়ে খোঁটা দেয়। দিহানের মন খারাপ হয়। দিতিয়ার মতো পড়াশোনা করে চাকরি বাকরি করলে ওরও এমন একটা জীবন হতো! যাকগে সেসব ভেবে লাভ নেই।

দিহান দিতিয়ার আলমারি থেকে মেরুন রঙের মসলিন শাড়িটা নিলো। এই শাড়িটা ওর পছন্দের। আহনাফের মায়ের দেয়া শাড়ি বলে চাইতে সংকোচ হচ্ছে। তবে পরতে তো দোষ নেই।

দিহান শাড়ি পরে মনমতো সাজলো। আজকের আসা পারফিউম সেট টা নজরে পড়লো তখনই। ইশ! এতো সুন্দর একটা জিনিস! দিতিয়া একটা নিজের ব্যাগে রেখে দিলো।

***
“খুব খারাপ হবে দিতিয়া। ”

দিতিয়া গাড়িতে বসে টেক্সট দেখে হেসে ফেলল। মনে মনে গাধার বাচ্চা বলে একটা গালিও দিলো। এই নেহাল টা ওর প্রেমে এতো মাতোয়ারা হয়েছে যে বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে গেছিল। এমন ন্যাকা প্রেমিক টাইপ ছেলে দেখলে দিতিয়ার মেজাজ খারাপ হয়। আহনাফ কতো চমৎকার ছেলে। কী স্মার্ট, গোছানো ক্যারিয়ার। ছুটি কাটাতে অস্ট্রেলিয়া, থাইল্যান্ড যায়। সেই ছেলেকে রেখে এমন গাধাকে বিয়ে করবে!

দিতিয়ার মোবাইল ওই সময়ে আরেকটা টেক্সট এলো। এবারের টেক্সট টা একটু অন্যরকম। ওর কপালে ভাজ পড়লো।

***
“এতো সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছিস?”

“বন্যার বাসায় মা। ওখানে রাখি, সুমি ওরাও আসবে। তুমি পুলুকে দেখো। আর পুলুর বাবা ফোন করলে বলবে যে আমার শরীর ভালো না তাই ঘুমিয়ে গেছি। ”

“আচ্ছা। ”

দিহানের মা দিলারা বড় জামাই কে তেমন পছন্দ করেন না। তার স্বামী মানে দিহানের বাবা দেখেশুনে বিয়ে দিয়েছেন মেয়ের। জামাই বড্ড বেশী বাপের বাড়ির টান টানে। তার উপর মুখে আদর্শের বুলি। মেয়েকে অবশ্য সে বলেছিলেন নাতিকে নিয়ে এখানে চলে আসতে। মেয়ে কেন যেন আসতে চায় না।

***
“কিরে ফিরে এলি যে?”

“হু। ”

“যাওয়া ক্যান্সেল হলো। ”

“এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও তো। ”

দিলারা পানি এনে দিলেন। দিতিয়ার মুখ শুকনো লাগছে। আবারও জিজ্ঞেস করলেন,

“কোনো সমস্যা? ”

“হু। ”

“কী হয়েছে? ”

দিতিয়া এবার মেজাজ খারাপ করলো। বলল,

“এতো কথা কেন বলছ? কোন সমস্যার সমাধান আছে তোমার কাছে? ”

দিলারা চুপসে গেলেন। বললেন,

“আচ্ছা থাক রাগিস না। ”

ঘরে ঢোকার আগে দিতিয়া বলল,

“আমাকে ডাকবে না। যতক্ষন না দরজা খুলব ভুলেও ডাকবে না। কেউ মরে গেলেও না। ”

***
রাত সাড়ে নয়টার দিকে দিলারার ফোনে খবর এলো দিহানকে হসপিটালে নেয়া হচ্ছে। বলা নেই, কওয়া নেই হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেল। দিলারা একাই পুলুকে হসপিটালে নিয়ে গেল। গিয়ে শুনলো দিহান মারা গেছে।

চলবে…..

নিভৃত রজনী পর্ব-৩০ এবং শেষ পর্ব

0

নিভৃত রজনী
| ৩০.১ | (১৭৫০+ শব্দ)

নম্রতা বাসায় পৌঁছেই মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। সাখাওয়াত, চাঁদনী আর মরিয়ম খাতুন তিনজনে হতভম্ব হয়ে গেল নম্রতার এমন আচরণে।

মরিয়ম খাতুন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সস্নেহে জিজ্ঞাসা করলেন,
“কী হয়েছে মা? কাঁদছিস কেন এভাবে?”

সাখাওয়াতকে ঠিক যা বলেছিল সেটা বলেই মাকেও বুঝ দিল নম্রতা।
“গতকাল রাতে তোমাকে নিয়ে খুব বাজে একটা স্বপ্ন দেখলাম। সেজন্য খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল আম্মু।”

“পাগল মেয়ে একটা। তাই বলে এভাবে কাঁদবি? এই যে আমি ঠিক আছি।”

মরিয়ম খাতুনের কোনো সান্ত্বনাই কাজে এলো না। নম্রতা কাঁদতেই থাকল অনেকক্ষন ধরে। সাখাওয়াত নম্রতাকে পৌঁছে দিয়েই বিদায় নিল। ব্যস্ততা থাকা স্বত্বেও শুধু নম্রতাকে দিয়ে যাওয়ার জন্যই এতদূর এসেছিল ও।

নম্রতাকে ওভাবে কাঁদতে দেখে শুরু থেকেই সন্দেহ হয়েছিল চাঁদনীর। তাই অন্য সবাই বিশ্বাস করলেও চাঁদনী এটা বিশ্বাস হলো না যে শুধু মায়ের জন্য নম্রতা এভাবে কেঁদেছে। বিয়ের আগে থেকেই তানিম আর নম্রতার মধ্যে একটা তিক্ততার কথা ও জানত। সেজন্যই সন্দেহটা আরও জোরালো হলো।

নম্রতা রুমে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে তার পিছুপিছু চাঁদনীও গেল। রুমে গিয়ে দরজা লক করে নম্রতার মুখোমুখি বসে সরাসরি প্রশ্ন করল, “আমার কাছে কিচ্ছু লুকাবে না নম্রতা আপু৷ সত্যি করে বলোতো কী হয়েছে?”

নম্রতা চাঁদনীকে আর মিথ্যে বলল না। তানিমের সাথে ওর সম্পর্কটা ঠিক কোন পর্যায়ে আছে সেটা পুরোটাই ব্যাখ্যা করে বলল।

চাঁদনী সব শুনে অবাক হল।
“কী বলছ? তোমাদের মধ্যে সবকিছু এখনও স্বাভাবিক হয়নি? বিয়ের পর যে একবার বাড়িতে গেলাম, তানিম ভাই তো তখন তোমার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহারই করছিল। আমি তাই ভেবেছিলাম তোমাদের মধ্যকার মনোমালিন্য সব ঠিক হয়ে গেছে। আর বাড়ির বাইরে বের হয়েছ, শুধু এইজন্য তানিম ভাই তোমাকে এতবড় একটা কথা বলেছে? দাঁড়াও, এক্ষুনি আমি কল করছি তাকে।”

“না, ভাবি। তুমি তাকে কিচ্ছু বলবে না।”
“কিন্তু…।”
“প্লিজ, আমার রিকোয়েস্ট এটা।”
“ওকে, বলব না কিছু। এখন তাহলে তুমি রেস্ট নাও। আবার পরে কথা হবে।”

নম্রতা ইচ্ছে করেই মুক্তার সাথে যে কথাবার্তা হয়েছিল, সেগুলো কিছু বলল না চাঁদনীকে। কেন জানি মন বলছে এখনই সবটা সবাইকে বলা ঠিক হবে না। ও জানে, তানিম ওকে পছন্দ করে না। তবুও বেহায়া মন মানতেই চায় না কেন জানি। সব বাস্তবতাকে ভুলে গিয়ে নম্রতা কল্পনার জগতে ভেসে থাকে। চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পায়, তানিম ওর অভিমান ভাঙাতে এসেছে।

মা যাতে কিছু বুঝতে না পারে, তাই নিজেকে স্বাভাবিক রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে নম্রতা। সবার মধ্যে থেকে অবশ্য কিছুক্ষনের জন্য নিজের মনের বেদনাগুলোকে ভুলে গিয়েছিল নম্রতা। কিন্তু রাতে একা ঘুমাতে গিয়ে বাঁধল বিপত্তিটা। তানিমের কথা মুক্তার কথা সব আবার মাথার মধ্যে ভজঘট পাকিয়ে ফেলল। ফলস্বরূপ সেদিন রাতটাও ঠিক আগের রাতের মতোই নির্ঘুম কাটল। বাধ্য হয়ে তাই পরের রাতে ঘুমানোর আগে মায়ের মেডিসিন বক্স থেকে একটা স্লিপিং পিল খেয়ে ফেলল নম্রতা।

নম্রতা জানে, এতে ক্ষতি তেমন হবে না। বরং চলমান সকল দুশ্চিন্তা, হতাশা থেকে কিছুক্ষনের জন্য রেহাই মিলবে। একটা শান্তির ঘুম হবে।

স্লিপিং পিলটা সত্যিই কাজে দিল। সেদিন রাতের খাবার খেয়ে একটু আগেভাগেই শুয়ে পড়ল নম্রতা। শুয়ে পড়ার কিছুক্ষনের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়েও গেল। শেষরাতের দিকে গভীর ঘুমের মধ্যে খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখল ও। পুরো স্বপ্নটাই ওর কাছে একবারে বাস্তব বলে মনে হচ্ছিল।

স্বপ্নের মধ্যেও নম্রতা দেখল যে ও ওর নিজের রুমের খাটে শুয়ে আছে। তানিম ওর পাশে বসে আছে। নম্রতা তানিমকে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি! এখানে?”
“হ্যা, আমি এসেছি। আচ্ছা নম্রতা, আমি যদি তোমাকে এখন একবার স্পর্শ করি, তাহলে কী তুমি আমাকে আবার ক্যারেক্টারলেস বলবে?”

তানিমের এই প্রশ্নে নম্রতা ফুপিয়ে কেঁদে উঠল।
“না বুঝে সেই প্রথম পরিচয়ের দিন আমি একটা ভুল করে ফেলেছিলাম। তারজন্য আপনি আমাকে আর কত শাস্তি দেবেন? আর কতবার আমাকে পালটা অপমান করলে আপনার মনের জমে থাকা রাগ আর ক্ষোভ মিটবে? আর কতবার আপনার সামনে অনুতপ্ত হয়ে গিয়ে দাঁড়ালে আমার জন্য আপনার মনে একটু মায়া জন্মাবে?
কতবার স্যরি বলার জন্য আপনার কাছে সেধে গিয়েছি, আপনি পাত্তা দেননি। ভেবেছিলাম বিয়ের পর হয়তো আমার চোখের ভাষা দেখে হলেও বোঝার চেষ্টা করবেন, আমি কী চাই। কিন্তু আপনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন তখনও। বারবার চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়ে গেলাম। ইভেন এখন স্বপ্নের মধ্যেও আপনি সেই একই কথা নিয়ে খোঁচা দিচ্ছেন আমাকে।

কী করব আমি, বলুন তো। আপনার পা ধরে মাফ চাইতে বললে আমি সেটা করতেও রাজি আছি। বলুন এখন কি তাহলে সেটাই…।”

“হুশ!” নম্রতার ঠোঁটে তর্জনী ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিল তানিম।”এসব কথা আর একদম বলবে না। আর এটা কোনো স্বপ্ন নয়। আমি সত্যিই এসেছি তোমার কাছে।”

“হ্যাঁ, আমার কাছেও স্বপ্নটাকে একেবারে সত্যি বলেই মনে হচ্ছে।”

কথাটুকু বলে, যেটুকু দুরত্ব ছিল, সেটুকুও ঘুচিয়ে দিল নম্রতা। তানিমের উপর ঝাপিয়ে পড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ওকে।

এইতো সেই চেনা পরিচিত শরীরের ঘ্রানটা পাওয়া যাচ্ছে। না, নম্রতা কখনও তানিমের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ পায়নি। কিন্তু তানিমের অনুপস্থিতিতে ওর সবগুলো শার্ট নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে পুরুষালী ঘ্রাণটা ওর রন্ধ্রে রন্ধ্যে গেথে গেছে।

স্বপ্নটা এত বাস্তব কেন লাগছে কে জানে৷ তাহলে কি সত্যিই তানিম এসেছে? নম্রতার মস্তিষ্কে তখন ভাবনার ঝড়।

তানিম শক্ত করে জাপটে ধরে নম্রতার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো। নম্রতা এবার নিশ্চিত হয়ে গেল, এটা আসলেই স্বপ্ন। স্বপ্ন ভেবেই পরবর্তী কথাগুলো অকপটে বলে গেল ও,
“আপনি তো আস্ত একটা বেরসিক লোক। এই যে আপনার একটু কাছাকাছি যাওয়ার জন্য কত চেষ্টা করি অথচ আপনি ফিরেও তাকান না। রিয়েল লাইফে না হোক, অন্তত এই স্বপ্নেই একবার আমাকে আদর করে দিন না প্লিজ।”

তানিম ঘায়েল করা সেই হাসি হেসেই যাচ্ছে, “আদর করলে যদি তুমি আবার আমার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলো।”
“উফ! আবার এক কথা। এখন আর কথা বলে সময় নষ্ট করবেন না প্লীজ। যেকোনো সময় আমার ঘুমটা ভেঙ্গে যেতে পারে। আমাকে এক্ষুনি অনেকগুলো চুমু দিন। এখানে, এখানে আর সবখানে।” নিজের কপাল,গাল আর ঠোঁট দেখিয়ে বলল নম্রতা।
“শুধু চুমু? আর কিছু চাও না?”
“চাই তো। আরও অনেক কিছু চাই।”
“আর কী চাই?
” ভালোবাসা চাই। যতভাবে ভালোবাসা যায়, ঠিক ততভাবেই চাই।”

“দেব তো। সবরকমভাবে ভালোবাসা দেব৷ কিন্তু সেটা স্বপ্নে নয়। আগে তুমি এই স্বপ্ন স্বপ্ন ভাবনাটা থেকে বের হও৷ আজ যা হওয়ার সব বাস্তবেই হবে।”

“আপনি খুব খারাপ। স্বপ্নেও আমাকে ফিরিয়ে দিলেন।”

সুন্দর স্বপ্নটা ওখানেই শেষ। নম্রতা আবার গভীর ঘুমের দেশে চলে গেল। তারপর ওর ঘুম ভাংল বেশ বেলা করে। তলপেটে প্রচন্ড চাপ নিয়ে ঘুমটা ভেঙেছে। সারারাত স্লিপিং পিলের জন্য গভীর ঘুমে থাকায় ওয়াশরুম যাওয়া হয়নি। নম্রতা ঘুম থেকে উঠে দৌড়ে ওয়াসরুমের দিকে গেল। তারপর ঘুমে ঢুলুঢুলু হয়ে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ল। লম্বা সময় ঘুমিয়ে সেই রেশ এখনও পুরোপুরি যায়নি ওর।

“তোমার বোধহয় শীত লাগছে নম্রতা। কম্ফোর্টারটা গায়ে দিয়ে দেই? তাহলে আরাম করে ঘুমাতে পারবে। নাকি আরেকবার আমার কাছাকাছি আসবে?”

এক, দুই, তিন সেকেন্ড সময় নিল নম্রতার মস্তিষ্ক সিগন্যালটা ক্যাচ করতে। তারপরেই ধরফর উঠে বসে পাশের দিকে তাকাল নম্রতা। তানিম ফোন হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে। নম্রতা চোখ কচলে আবার তাকাল।
তানিম হেসে বলল, “এবার কি স্বপ্ন আর সত্যির মধ্যে তফাৎটা বুঝতে পারছ? নাকি এটাকেও স্বপ্ন বলে মনে হচ্ছে?

যা যা ঘটছে সেটাকে এখনও বাস্তব বলে মেনে নিতে পারছে না নম্রতা। বিশেষ করে তানিমের আচরণে হঠাৎ এই পরিবর্তনের জন্য।

হঠাৎ তানিমের ফোন বেজে উঠল। তানিম ফোনে কথা বলা শুরু করল সবসময়ের মত যান্ত্রিক ভাষায়। ব্যবসায়িক কলগুলো অ্যাটেন্ড করার সময় এভাবেই কথা বলে তানিম। নম্রতা এবার নিশ্চিত হলো, তানিম সত্যিই এসেছে ওর কাছে।

“ও মাই গড!” চাপা স্বরে আর্তনাদ করে উঠল নম্রতা। তারমানে শেষরাতের দিকে তানিমের সাথে কাটানো সময়টুকু স্বপ্ন ছিল না। সত্যিই ও তানিমকেই বলেছিল কথাগুলো। সেজন্যই কি স্বপ্নটা এত বাস্তব বাস্তব লাগছিল। কী কী বলেছিল সেটা মনে করার চেষ্টা করল নম্রতা। আদর, চুমু চাওয়া সব এক এক করে মনে পড়ছিল ওর। আর সেই সাথে লজ্জাও বেড়ে যাচ্ছিল সমানুপাতিক হারে।

নম্রতা নড়াচড়া করতেও ভুলে গেল হঠাৎ। কী করবে এখন ও? আচ্ছা এখনই একছুটে রুম থেকে পালিয়ে গেলে কেমন হয়? কিন্তু পালাবেই বা কোথায়?

তানিম ওর চোখের সামনে এসে দুই আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বলল, “কোথায় হারালে?”

নম্রতা হুঁশে এলো এবার। জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে এক্সপ্লেইন করার চেষ্টা করল তানিমকে, “দেখুন আমি আসলে তখন ঘুমের ঘোরে ছিলাম। কি বলেছি না বলেছি সেটা আমার নিজেরও মনে নেই।”

“সত্যিই কি তাই? আমার তো মনে হচ্ছে তুমি কিছুই ভুলে যাওনি।”

নম্রতা মুখে কুলুপ আঁটল আবার৷ কী চাইছে এই লোক, ওকে লজ্জা দিয়ে মেরে ফেলতে! প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করল নম্রতা, “আপনি এখানে কেন এলেন?”
“দরকার আছে তাই এসেছি।” সাথে সাথেই উত্তর দিল তানিম।

দরকার! নম্রতা আবার ভাবতে শুরু করল। কী দরকারে এসেছে তানিম? নম্রতা আশেপাশে থাকলে তো সমসময় বিরক্তবোধ করত ও। এখন চলে আসায় তো আরও সুবিধা হয়েছিল। তাহলে তানিম নিজের অসুবিধা করে কী এমন দরকারে এসেছে। আচ্ছা সেই চিঠি, সেটা কি পেয়েছে তানিম? চিঠিতে তো নম্রতা লিখে রেখে এসেছিল ওকে ডিভোর্স দিতে। ও মাই গড! তানিম কি তাহলে ডিভোর্সের জন্যই এসেছে? শীট! এই কথাটা আগে কেন ওর মাথায় এলো না। এতক্ষন কিনা বোকার মতো ও ভাবছিল, তানিম মিটমাট করে নেওয়ার জন্য এসেছে।

নম্রতার মুখে ভেসে ওঠা লাজুক আভাটা সরে গিয়ে মুখটা বিবর্ণ হতে শুরু করল। তানিম খেয়াল করল এই বদলে যাওয়াটা। সিরিয়াস গলায় এবার ও বলল, “নম্রতা, তুমি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাও?”

নম্রতা বসে থাকল চুপ করে। ওর দুচোখে তখন মেঘের ঘনঘটা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামল বলে। তানিম আবারও জিজ্ঞাসা করল, “চুপ করে আছ কেন?”

“আমার কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই।”
“ভেবে বলো।”
“ভেবেছি, আমার সত্যিই কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই। আপনার জীবনের যেকোনো সিদ্ধান্ত আপনি নিতেই পারেন, সেটা নিয়ে প্রশ্ন তোলার রাইট আমার নেই। শুধু এতটুকুই বলতে চাই, চাঁদনী ভাবির কথায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার উচিৎ হয়নি। যাই হোক, যেটা হওয়ার হয়ে গেছে। এখন আপনার পছন্দের মানুষটি মানে মুক্তার সাথে আবার নতুন করে শুরু করুন।”

“এক মিনিট, তোমাকে কে বলল যে মুক্তা আমার পছন্দের মানুষ? আর চাঁদনীর কথায় আমি কোন সিদ্ধান্তটা নিয়েছি?”

“না,মানে… মুক্তা নিজেই তো বলল…।”
“মুক্তা ওর নিজের কথা বলেছে। কিন্তু তার জন্য তুমি এটা ভেবে নিতে পারো না যে আমি মুক্তাকে পছন্দ করি। আর প্রথম সাক্ষাতেই তুমি মুক্তার কথাগুলো কীভাবে বিশ্বাস করে নিলে? মুক্তা মিথ্যেও তো বলতে পারে।”

নম্রতা কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল। তানিম আবার বলল, “শোনো নম্রতা, আজকে পর্যন্ত আমার জীবনে আসা প্রথম এবং সর্বশেষ নারীটি তুমি। মুক্তাকে পছন্দ করা তো দুরের কথা, ওর দিকে ভালো করে আমি কখনও তাকাইনি পর্যন্ত।”

নম্রতার খুব ভালো লাগল তানিমের মুখের কথাগুলো। কিন্তু আবার কিছু একটা মনে হতেই গুটিয়ে গেল ও।
“হ্যা, আমি আপনার জীবনের প্রথম নারী। কিন্তু আপনার পছন্দের নারী নই। শুধু চাঁদনী ভাবি যাতে কষ্ট না পায় তাই তো অপ্রিয় হওয়া স্বত্বেও আপনি বিয়েটা করেছেন।”

“বোকা মেয়ে, এতো আবোল-তাবোল ভাবনা তোমার মাথায় এলো কী করে? চাঁদনী আমাদের পাঁচ ভাইয়ের খুব আদরের একটা মাত্র বোন। ছোটবেলা থেকে ও যেটা চেয়েছে আমরা সবাই সেটাই ওকে দিয়েছি। কিন্তু তাই বলে ওর কথায় নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করার কথা তো কল্পনাও করতে পারি না। এটা করলে তো একপ্রকার ক্রাইম করা হয়ে যাবে তোমার সাথে। চাঁদনীও নিজেও গিল্ট ফিল করবে এসব শুনলে। এমনকি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটা করলে সেটা নিজের সাথেই প্রতারনা এবং প্রবঞ্চনা করা হতো। এসব আমার এথিক্সের মধ্যে পড়ে না নম্রতা।

সজ্ঞানে আমার জীবনে এরকম গুরুতর অন্যায় করা তো দূর, কখনও অন্য কারও ক্ষেত্রেও এমন কোনো অন্যায়কে সমর্থন করিনি আমি।”

তানিমের বলা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে প্রথমে যে প্রশ্নটা নম্রতার মাথায় এলো, সেটাই মুখ ফসকে বলে ফেলল ও,
“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনি আমাকে পছন্দ করেন।”

প্রশ্নটা করে নিজেই হকচকিয়ে গেল নম্রতা। এটা কী বেরিয়ে এল মুখ ফসকে!

তানিম হাসল আবার। অকপটে উত্তর দিল, “হ্যাঁ। করি তো।”

তানিমের জবাব শুনে নম্রতার মুখটা বোয়াল মাছের মতো হা হয়ে গেল। আজ যেন ওর শুধু অবাক হওয়ার দিন। তানিম নিজের মুখে ওকে পছন্দ করার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে! এটাও সম্ভব!

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

(প্রাপ্তবয়স্ক সতর্কতা)
নিভৃত রজনী
| ৩০.২ | (শেষ) (১৮০০+ শব্দ)

তানিমের জবাব শুনে নম্রতার মুখটা বোয়াল মাছের মতো হা হয়ে গেল। আজ যেন ওর শুধু অবাক হওয়ার দিন। তানিম নিজের মুখে ওকে পছন্দ করার স্বীকারোক্তি দিচ্ছে! এটাও সম্ভব!

পরের প্রশ্নগুলোও ঘোরের মধ্যেই বের হয়ে এলো ওর মুখ থেকে,
“কবে থেকে হলো এসব? আপনি তো আমাকে দুচোখে দেখতেই পারতেন না। তাহলে কীভাবে..?”

“তুমি প্রথমবার যখন তালুকদার মঞ্জিলে গেলে তখন থেকেই শুরু হয়েছিল। সারাক্ষন আমাকে লুকিয়ে দেখতে তুমি, আশেপাশে ঘুরঘুর করতে একটু কথা বলার জন্য। সম্ভবত তোমার প্রথমদিনের করা ভুলের জন্য অনুতপ্ত হয়ে স্যরি বলতে। কিন্তু আমি প্রত্যেকবারই সুকৌশলে তোমাকে এড়িয়ে যেতাম। তখন পর্যন্ত তুমি শুধুই আমার বিরক্তির কারন ছিলে। তারপর ওখান থেকে ফিরে আসার দিন তুমি সেধে আমার সাথে কথা বলতে গেলে। আমি কথা বলতে চাইলাম না তোমার সাথে। বরং ইনসাল্ট করলাম তোমাকে। আমার সামনে দাঁড়িয়েই তুমি কাঁদলে।

ব্যাস সেদিন থেকেই শুরু হলো ব্যাপারটা। তুমি চলে যাওয়ার পর মনে হলো, তোমার সাথে ওরকম ব্যাবহারটা না করলেই হতো।

আরও একটা বিষয়ে খটকা লাগছিল আমার। মনে হচ্ছিল অনুতপ্ত হওয়ার সাথে সাথে আমার প্রতি কোনো অনুভূতি হয়তো বাসা বাঁধছে তোমার মনে। তারপর চাঁদনী যেদিন সবার সামনে তোমার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাবটা রাখল, সেদিন একেবারে নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে আমার ধারনা ভুল নয়।”

নম্রতা অপ্রস্তুত স্বরে বলল, “নিশ্চিত হয়েছেন মানে? প্রস্তাবটা চাঁদনী ভাবি রেখেছিল, আমি নই।”

“শোনো নম্রতা। জন্মের পর চাঁদনীকে সবার আগে আমার কোলে দেওয়া হয়েছিল। নিজের আপন ভাইদের চেয়েও আমার কাছে বেশি আবদার করত ও। চাঁদনীকে আমি খুব ভালো করে চিনি। যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মেয়ে ও। তোমার কোনোরকম মতামত না নিয়ে হুট করে এত বড় একটা প্রস্তাব রাখার মতো মেয়ে অন্তত নয় চাঁদনী। সবার সামনে প্রস্তাব রাখার পর তুমি যদি না বলে দিতে, তাহলে আমাকে ওখানে সবার সামনে ছোট হতে হতো। নিজের তানিম ভাইয়ের ব্যাপারে সেই রিস্ক চাঁদনী কখনও নেবে না। আর তাছাড়া আমাকেও চাঁদনী খুব ভালো করে চেনে। এমনকি মুক্তাকে যে আমার পছন্দ নয়, সেটাও ও বুঝেছিল। সেজন্যই সবার সামনে প্রস্তাবটা রেখেছিল ও।

নম্রতা, আমার যতদূর ধারনা, তুমি নিজের মনের কথাগুলো শেয়ার করেছিলে ওর সাথে। যার প্রেক্ষিতেই ও প্রস্তাবটা রেখেছিল। আমার ধারনা ভুলও হতে পারে। তুমি যদি আমার চোখে চোখ রেখে শুধু একবার ‘না’ বলতে পারো, তাহলেই আমি বুঝে নেব আমি যা ভেবেছি সব আমার ভুল।”

নম্রতা বুঝল, ধরা পড়ে গেছে ও। এখন আর অস্বীকার করার জো নেই কোনো। ওর মনের গোপন কথাগুলোর ব্যাপারে অনেক আগেই ওয়াকিবহাল ছিল তানিম। নীরব হয়ে থাকা ছাড়া অগত্যা নম্রতার আর কোনো উপায় রইল মা।

তানিম বলল, “তুমি চুপ করে আছো, তাহলে কি আমার ধারনাই ঠিক ছিল।”

আরও কিছুক্ষন অপেক্ষা করল তানিম। নম্রতার তরফ থেকে কোনো রেসপন্স না পেয়ে পুনরায় বলল, “তারমানে উত্তরা নিবাসী, নম্রতা নামের বদমেজাজি মেয়েটি সত্যি সত্যিই হলুদিয়া গ্রামের নাকউঁচু স্বভাবের তানিম তালুকদারের প্রেমে পড়েছিল।”

নম্রতা চমকে উঠল।

“একদিন সকালে রুম থেকে বের হওয়ার সময় মোবাইল নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। যখন মোবাইলটা নিতে আবার রুমে ঢুকতে যাব, তখন দেখলাম আপনমনে একজন বিড়বির করে বলছে, আমার উঁচু নাকটা সে কাচি দিয়ে ঘ্যাচ করে কেটে দিতে চায়।” এতটুকু বলে তানিম উচ্চস্বরে হেসে উঠল।

লজ্জার চূড়ান্ত সীমাটাও এবার মনেহয় পার করে ফেলল নম্রতা। একে তো নম্রতার মনের কথাগুলো সব বুঝে ফেলেছে তানিম। তারউপর মাঝে মাঝে তানিমের নির্লিপ্ত আচরণে অভিমান করে যেসব আজেবাজে কথাগুলো একা একাই বলত তানিমকে উদ্দেশ্য করে, সেগুলোও আড়ি পেতে শুনে ফেলেছে তানিম। নম্রতা ওড়নার এককোনো তুলে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল। তানিমের হাসি বিস্তৃত হলো আরও,
“তো ম্যাডাম। আপনার সব কনফিউশান ক্লিয়ার হয়েছে এখন? আপনার হাজবেন্ডের হৃদয়ে আপনি ছাড়া আর কেউ নেই।”

নম্রতা মুখ ঢেকেই অভিমানী স্বরে বলল, “আরও একটা প্রশ্ন আছে। সেদিন আমার সাথে ওরকম বাজে ব্যবহার কেন করলেন? সামান্য বাড়ির বাইরেই তো একটু গিয়েছিলাম। তাতেই আপনার মনে হলো, আমি বাইরের লোকের কাছে নিজের শরীর…।”

আবারও নম্রতাকে থামিয়ে দিল তানিম, “ব্যাস নম্রতা, আর বলতে হবে না। সেদিন আসলেই অকারণে আমি তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলাম। সেজন্য আমি মন থেকে স্যরি বলছি তোমাকে।”

“কিন্তু হঠাৎ ওরকম কেন করলেন।”
তানিম নম্রতার কাছে ব্যাখ্যা করল পুরো ব্যাপারটা। নম্রতা সব শুনে বলল৷ “কিন্তু আমি তো শালীন ভাবেই বের হয়েছিলাম।”
“আমি জানি। আসলে ছেলেগুলোই খারাপ। বোরখা পড়ে এমন মেয়ে হেটেঁ গেলেও তাদের দিকে বাজে নজরে তাকায়। তোমার কোনো দোষ নেই জেনেও, তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করেছিলাম। বাইরের কিছু ছেলে আমার স্ত্রী সম্পর্কে বাজে কমেন্ট করছে, এটা কেন জানি মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই খুব রাগ উঠে গিয়েছিল। আই অ্যাম স্যরি।”

“আমি বুঝতে পেরেছি। আর স্যরি বলতে হবে না।”

“তারমানে সবকিছু ক্লিয়ার এখন তোমার কাছে। অতীতের আলোচনা এই পর্যন্তই। এখন থেকে আমরা বর্তমান নিয়ে কথা বলব। বাই দ্যা ওয়ে, একটা প্রশ্ন করার ছিল তোমাকে?”
“কী?”

“এতদিনে যা বুঝেছি, তোমার ঘুম খুব পাতলা। অল্প আওয়াজেই তুমি জেগে যাও। আজ এত গাড় ঘুম হলো কেন? এমনকি ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন আর বাস্তবের তফাতটাও বুঝতে পারলে না।”

“না মানে, মায়ের তো ইনসনোমিয়া আছে। তাই স্লিপিং পিল খেতে হয়। সেখান থেকে কাল রাতে…।”

“আল্লাহ! তুমি স্লিপিং পিল খেয়েছ? কয়টা? বাই এনি চান্স, সুইসাইড করতে যাচ্ছিলে না তো?” নম্রতার পুরো কথা না শুনেই আতঙ্কিত হুয়ে পড়ল তানিম।

“আপনি এত ব্যস্ত হবে না তো। একটা ট্যাবলেট খেয়েছি। ঘুম হচ্ছিল না রাতে, তাই খেয়েছি। এতটুকুতে ক্ষতি হবে না কোনো। ভেবেছিলাম ভালো একটা ঘুম হবে। কিন্তু এই প্রথমবার খেলাম তো, তাই ওটার এফেক্ট একটু বেশিই হয়েছে।”

তানিম ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল, “ভালোই হয়েছে তাহলে ওটা খেয়ে। যা যা বলেছে আমাকে তখন৷ সজ্ঞানে থাকলে তো ওগুলো কখনও শোনাই হতো না তোমার মুখ দিয়ে।”

নম্রতা অসহায় কন্ঠে বলল, “আমার সত্যিই কিছু মনে নেই।”

“কিন্তু আমার সব মনে আছে। তুমি আমার কাছে চুমু, আদর, ভালোবাসা এসব চেয়েছ। কোথায় কোথায় চুমুগুলো দিতে হবে সেটাও দেখিয়ে দিয়েছে। আর…।”
“চুপ করুন, প্লিজ।” দুহাতে কান চেপে আকুতিভরা স্বরে বলল নম্রতা।
“আজ আর চুপ থাকা চলবে না। দরকারি কথা আছে।”
“বলুন।”
“অনেক হয়েছে দূরে থাকা। একটা সম্পর্কে যখন আমরা বাঁধা পড়েই গেছি, এভাবে দুরত্ব তৈরি করে আমি আর রাখতে চাইছি না। আজ, এই মুহুর্তে আমাদের বৈধ সম্পর্কটাকে পূর্ণতা দিতে আমি যদি তোমার কাছাকাছি আসি, তাহলে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে।”

তানিমের কথা শুনে নম্রতা বরফের মতো জমে গেল। শিরা-উপশিরায় ঝিমঝিমে একটা রেশ ছড়িয়ে পড়ছিল ক্রমশ। অবশেষে সেই সময়টা এলো তবে। অনেকক্ষন চেষ্টা করেও নম্রতা ওর মুখ থেকে একটা শব্দ উচ্চারন করতে পারল না। তানিম বলল, “সবসময় চুপ থাকলে তো হবে না।”

“আমি কিছু বলতে পারব না। আপনি বুঝে নিন।”
“একদম না। আমি এখন কিছু বুঝে নিতে পারব না। এখন আমি বুঝে নিয়ে এগিয়ে গেলে, পরে যদি আবার চরিত্রহীন বলে খোঁটা দাও আমাকে।”

“এক কথা আর কতবার বলবেন।”

“তুমি মতামতটা জানাও। প্রমিস করছি, এরপর থেকে আর এই প্রসঙ্গ তুলব না।”

“আমার খুব লজ্জা লাগছে। আমি কিছু বলতে পারব না।”
“তাহলে আর কিছুই করার নেই। আমি চলে যাচ্ছি এখনই।”
নম্রতা চমকে উঠে বলল৷ “চলে যাচ্ছি মানে! যাবেন না প্লীজ। বলছি, আমার কোনো আপত্তি নেই।”

সম্মতি পেয়ে আর সময় ব্যায় করল না তানিম। নম্রতার কাছাকাছি এগিয়ে গেল।
নম্রতা আঁতকে উঠে বলল, “কী করছেন?”
“আশ্চর্য! তুমি না এইমাত্র বললে আপত্তি নেই।”
“হ্যা, বলেছি। কিন্তু তাই বলে এখন?
“এখন হলে কী প্রব্লেম?”
“সকাল হয়ে গেছে। কেউ যদি ডাকতে আসে?”
“বোকা মেয়ে, তুমি যদি একা থাকতে তাহলে হয়তো ডাকতে আসত। কিন্তু এখন তোমার হাজবেন্ড আছে তোমার সাথে। সারাদিন রুমের দরজা বন্ধ করে থাকলেও কেউ তোমাকে ডাকতে আসবে না। তারা জানে নতুন বিবাহিত কাপলকে নিজের মতো করে সময় কাটানোর জন্য স্পেস দিতে হয়।”
“কিন্তু তাই বলে এই সকাল বেলা?” মিনমিন করে আপত্তি জানাতে চাইল নম্রতা।

“নম্রতা, এতদিন আমাদের সম্পর্কটা রাতের অন্ধকারের মতো ছিল। দীর্ঘ তিনমাস পরে সেই অন্ধকার শেষে নতুন সুর্যোদয় হয়েছে। অবশেষে আমাদের সম্পর্কটা রাত পেরিয়ে সকালের দেখা পেয়েছে। তাই এই শুরুটাও নাহয় আমরা আজকের এই সুন্দর সকালটাইতেই করলাম।”

নম্রতা লাজুক হেসে চোখ নামিয়ে নিল। তানিম আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে এগিয়ে গেল ওর দিকে।

★★★

পরিশিষ্ট:-

মা হওয়া যে ঠিক কতটা কঠিন, সেটা প্রেগন্যান্সির লাস্ট মান্থে এসে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নম্রতা। কিছুক্ষন আগে হাত থেকে ফোনের চার্জারটা ফ্লোরে পড়ে গেছে। শুধু একটু নুয়ে সেটাকে তোলাও নম্রতার কাছে বিশ্বযুদ্ধের মতো লাগছে।

অনেক কসরত করে চার্জারটা তোলার জন্য ঝুঁকতে যাচ্ছিল ও, তার আগেই তানিম রুমের মধ্যে ঢুকল। তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে নিজেই চার্জারটা তুলে মোবাইল চার্জে লাগিয়ে দিল। তারপর নম্রতার কাছে এসে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলল, “এখন কেমন লাগছে শরীর?”

নম্রতার গা গুলিয়ে উঠল সাথে সাথে। নিজেকে তানিমের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মেজাজ তুঙ্গে তুলে বলল, “তোমাকে কতবার বলেছি, এই পারফিউমটা লাগাবে না। আমার তাতে…”

কথা শেষ করার আগেই হরহর করে বমি করে তানিমের শার্ট মেখে ফেলল ও।

তানিম হতাশ দৃষ্টিতে তাকাল নিজের দিকে। ভুল হয়ে গেছে আসলেই। পারফিউমটা নম্রতা নিজেই পছন্দ করে কিনে দিয়েছিল ওকে। অথচ কনসিভ করার পর থেকে এটার স্মেল সহ্যই করতে পারে না নম্রতা।

প্রেগন্যান্সির লাস্ট মান্থে যেকোনো সময় কিছু একটা হয়ে যেতে পারে বলে নম্রতা ঢাকায় চলে এসেছে। তানিমও বেশিরভাগ সময় স্ত্রীর সাথে থাকলেও মাঝে মাঝে হলুদিয়া যেতে হয় নিজের কাজের প্র‍য়োজনে। আজ সকালে নম্রতা ফোন করে বলেছিল, ওর শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না। চিনচিনে ব্যাথ্যা হচ্ছে তলপেটে। অগত্যা তানিম সব কাজ ফেলে তখনই রওয়ানা হয়েছিল গ্রাম থেকে। তাড়াহুড়োয় রেডি হতে গিয়ে পারফিউম যেটা সামনে পেয়েছে সেটাই স্প্রে করে চলে এসেছে। তাই অঘটনটা ঘটল।

তানিম বলল, “স্যরি একদম খেয়াল ছিল না। আমি এখনই গোসল সেরে আসছি।”

নম্রতাকে খাটের এককোনে বসিয়ে তানিম ওয়াশরুমের দিকে ছুটল। এই স্মেল যতক্ষন নম্রতা পাবে, ততক্ষন বমি হতেই থাকবে ওর।

সেরাতেই নম্রতার পেইন উঠল। রাত তখন প্রায় তিনটা বাজে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো সাথে সাথেই। অনেক যুদ্ধের পর অবশেষে সকালবেলা নম্রতা একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তানের জন্ম দিল।

পরিবারের সকলেই উপস্থিত ছিল সেখানে। নার্স বাচ্চা নিয়ে বের হওয়ার পর তানিম বলল, “আমার মেয়েকে সবার আগে কোলে নেবে চাঁদনী।”

চাঁদনী উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে গেল। পিটপিট করে তাকানো চোখদুটো দেখে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে থাকল।

তানিম নার্সের কাছে গেল নম্রতার শারিরীক অবস্থার খোঁজ নেওয়ার জন্য। নার্সের সাথে কথা বলে ফোন করল বাড়িতে, সবাইকে খুশির খবরটা দেওয়ার জন্য।

চাঁদনী, নওয়াজ আর মরিয়ম খাতুন ততক্ষনে নতুন অতিথিকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। চাঁদনী বাচ্চাকে কোলে নিয়ে তানিমের কাছে গিয়ে বলল, “ভাইয়া, তুমি এখন একবার কোলে নাও।”

নম্রতাকে কেবিনে শিফট করা পর্যন্ত সবাই হাসপাতালেই ছিল। নম্রতার সাথে দেখা হয়ে যাওয়ার পর চাঁদনী ওর শ্বাশুড়িকে বলল, “মা, আপনি আর তানিম ভাই এখানেই থাকুন। আমি বরং বাড়ি যাই। দুপুরের খাবার নিয়ে আবার আসব।”

“কিন্তু তোমার তো কলেজ যেতে হবে।”

“দুই একদিন কলেজে না গেলে তেমন কিছু হবে না মা। আমি ম্যানেজ করে নেব।”

ফেরার পথে চাঁদনী কিছুক্ষন উশখুশ করে নওয়াজকে বলল, “আমিও বেবি নিতে চাই।”

নওয়াজ অবাক হয়ে বলল, “কী বলছ তুমি? এখন বেবি? তোমার এমবিবিএস শেষ হতে এখনও প্রায় দুবছর বাকি। এখন বেবি নিলে তোমার পড়াশোনার কী হবে?”

“কিছুই হবে না। আমাদের বিয়েটা তো আগে হয়েছে। অথচ ওরা আগে বাবা-মা হয়ে গেল। আমারও বাচ্চা চাই।”

“এটা ছেলেমানুষী করার সময় নয় চাঁদনী। আল্লাহ চাইলে অনেক সময় আছে আমাদের হাতে। এখন বাচ্চা নিলে দুদিক সামলানো তোমার জন্য অনেক কঠিন হয়ে যাবে। তাছাড়া তোমার তো ছোটবেলা থেকেই স্বপ্ন ছিল ডাক্তার হওয়ার।

“জানি কঠিন হবে, কিন্তু আমি সামলে নেব ইনশাআল্লাহ। তাছাড়া আপনি আছেন, মা আছেন। আপনারা পাশে থাকলে ততটাও সমস্যা হবে না আশা করি। প্লিজ আপনি রাজি হয়ে যান।”

“ভেবে কথা বলো চাঁদনী। এখন ঝোঁকের মাথায় একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলে পরে সেটার জন্য আবার আফসোস করবে নাতো?”

“মাথা খারাপ আপনার? মা হতে পারাও আল্লাহর তরফ থেকে কত বড় একটা নেয়ামত, আমি কিনা সেটার জন্য আফসোস করব? কখনও নয়। আমার পাশে আপনি থাকলে সব ঠিক হবে ইনশাআল্লাহ। শুধু ক্যারিয়ারের জন্য আমি মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে চাই না প্লিজ।”

নওয়াজ ভেবে যাচ্ছিল তখনও। চাঁদনী আবার প্রশ্ন করল, “কী হলো? আপনি রাজি তো?”

“তুমি যখন চাইছ, রাজি না হয়ে তো উপায় নেই।”

চাঁদনী হাসল। আদুরে স্বরে বলল, “আপনি অনেক ভালো।”

নওয়াজও হেসে ফেলল ওর সাথে। রাস্তার পাশে গাড়ি পার্ক করে, চাঁদনীকে টেনে নিল নিজের কাছে। কপালের মাঝখানে ছোট্ট করে একটা চুমু দিয়ে আবার গাড়ি স্টার্ট দিল।

ওদের দুজনের চোখেই তখন স্বপ্ন। সুন্দর আগামীর স্বপ্ন।

(সমাপ্ত)