Saturday, July 26, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 137



বিয়ে থা পর্ব-১৪

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

শিশির ভেজা ঘাসকে পা দিয়ে পিষে ফেলে হেঁটে চলে যাচ্ছে নিনীকা। পড়োনে শীতের ভারী পোশাক। হুডির দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে সুমিত্রার সাথে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে সে। মাথায় টুপি। যা সুমিত্রা কয়েকমাস আগে দার্জিলিং থেকে নিয়ে এসেছিল।

বান্দরবান। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাহাড়ে ভরপুর। নিনীকারা সড়কে এসে দাড়ালো। গাড়ি চলাচল হচ্ছে। তন্মোধ্যে একটি সেনাবাহিনীর গাড়ি অতিক্রম করে যায় তাদের। নিনীকার বুক কেঁপে উঠলো। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলো গাড়িটার যাওয়ার দিকে। সুমিত্রা ওর হাত ধরে রাস্তা পাড় হচ্ছে। সামনের কাঠের কটেজে তারা উঠেছে। এসেছে গতকাল সন্ধ্যায়। সকাল হওয়ার পর একটু হাঁটতে বের হয়েছিল।

বাংলাদেশে ঘুরতে আসার পরিকল্পনা’টা সুমিত্রার। সে-ই আগে ইচ্ছে প্রকাশ করে। তারপর বিভিন্ন ভাবে নিনীকাকে রাজি করায়। সুমিত্রা বাংলাদেশে এসেছে এই প্রথমবার। সেজন্য তার সবকিছুর প্রতি মারাত্মক কৌতুহল।

দু’জন কটেজের রুমে ঢুকলো। ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে নিলো। তারপর বের হয়ে আসলো কটেজ থেকে। এগিয়ে চললো পাহাড়ের দিকে।

ছোট ছোট পাহাড় গুলো সবুজ। সব জায়গায় ঘাস। উঁচুনিচু জায়গা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তারা। পথের দ্বারের একটি হলুদ ফুল হাতে নিলো নিনীকা। তাদের দিকে তখন এগিয়ে আসছিল পাহাড়ি একজন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী। নিনীকা হেসে জিজ্ঞেস করলো,

‘ফুলটার নাম কি দাদা?’

তিনি নিনীকার হাতের ফুলটি পর্যবেক্ষণ করলেন।

‘ এ তো ভৃঙ্গরাজ। ‘

নিনীকার নামটা পছন্দ হলো। সে কানে গুঁজে নিলো একটি। বাকি কয়েকটা হাতে রেখে আকাশের দিকে তাক করে পিকচার তুলতে লাগলো।

রোদে চারিদিক ঝলমল করছে। পাহাড়ি তাদের সাবধান করলেন,

‘ওদিকে আর্মি ক্যাম্প, আপনারা যাবেন না।’

নিনীকার ভ্রু কুঁচকে গেলো,

‘আর্মি ক্যাম্প তো আমরা কি করবো? দেশের একজন নাগরিক হয়ে যেখানে সেখানে যাতায়াত করার অধিকার আমার আছে। আর্মিদের কাজ হলো সুরক্ষা দেওয়া, কাউকে প্রকৃতি দেখা থেকে বঞ্চিত বা আলাদা করা নয়।’

সুমিত্রা হাতে চাপ দিয়ে থামতে বললো। ফিসফিস করলো,

‘একটু বেশিই বকছিস না? চুপ যা।’

পাহাড়ি নিজের পথে চলে গেলেন। নিনীকা সুমিত্রার হাত টেনে পাহাড়ের দিকে যেতে লাগলো। দেখবে কে তাকে আটকায়।

ছোট ছোট পাহাড়গুলোর মধ্যে কিছু টা গাঢ় গর্তের মতো নিচু জায়গা আছে। সেগুলোতে ছোট্ট তাঁবু টাঙানো কয়েকটা। পাশে একটি কাঠের কটেজ। তাঁবু থেকে কটেজ, কটেজ থেকে তাঁবু পর্যন্ত আর্মিরা আনাগোনা করছে। কারো হাতে বন্দুক তো কারো হাতে নানান কিছু। কেউ কেউ কাপড় মেলে দিচ্ছে। কেউ কেউ জিপের সামনে দাড়িয়ে কথা বলছে।

সুমিত্রা আড়ালে থেকে ফিসফিস করে বলল,

‘কেন যে এখানে এসেছি ইয়ার। চল চলে যাই।’

নিনীকা বিরক্ত হলো।

‘ এতো ভয় পাচ্ছিস কেন? ‘

সুমিত্রার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো,

‘ সব জায়গায় তো তোর মেজর জামাই থাকবে না নিনীকা। থাকলে তো চিন্তা ছিল না। সুতরাং রিস্ক নেবো না। চল চলে যাই। ‘

নিনীকার চেহারা থমথমে। সুমিত্রা কি বলেছে বুঝতে পেরে জিহবায় কামড় দিলো।

‘স্যরি ইয়ার, মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে। তবে সত্যিই বলেছি বল? দেখ সেনাবাহিনীরা যদি তোকে আমাকে জোর করে বেঁধে ফেলে। যদি ভালোমন্দ কিছু করে ফেলে তবে আমরা নিজেদের রক্ষা করবো কিভাবে? আমাদের তো পরিচিত কেউ নেই।’

নিনীকা মৃদু জোরে চিৎকার করলো,

‘চুপ কর।’

সুমিত্রা চুপ হয়ে গেলো। কিন্তু নিনীকার মৃদু জোরে চিৎকার আর্মিদের কানে পৌঁছে গেছে। কয়েকজন বন্দুক হাতে নিয়ে এদিক ওদিকে তাকাচ্ছে। সবার চোখ চারিদিকে ঘুরছে। আওয়াজের উৎস খুঁজছে।

সেনবাহিনীর দক্ষ অফিসারদের চোখ ফাঁকি দিতে পারলো না তারা। দুজন অফিসার নিনীকা এ সুমিত্রার হাত টেনে বের করে আনলো আড়াল থেকে।

সুমিত্রা কাঁদোকাঁদো স্বরে বলল,

‘নিনীকা বলেছিলাম বেশি বেশি না করতে।’

নিনীকা ঢুক গিললো,

‘আরে আমি তো কৌতুহল নিয়ে দেখতে এসেছিলাম।’

অফিসাররা তাদের নিয়ে কটেজের সামনে এলো। একজন অফিসার গম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলেন,

‘আপনাদের মধ্যে কে চিৎকার করেছে?’

নিনীকা মৃদু স্বরে বলল,

‘আমি-ই।’

আরেকজন অফিসার বন্দুক ধরে রেখেছে। প্রশ্ন করলো,

‘আপনারা কি উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন? কুচক্রীদের মধ্যে কেউ?’

সুমিত্রা কাঁপা কাঁপা স্বরে বলল,

‘আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি ঘুরতে। কৌতূহল বসত এদিকে চলে এসেছি। প্লিজ আমাদের ছেড়ে দিন।’

নিনীকা নিজেও বলল,

‘ আসলে আমি বুঝতে পারিনি নাহলে জোরে কথা বলতাম না। আপনাদের বিরক্ত করার জন্য দুঃখীত। প্লিজ আমাদের ছেড়ে দিন। ‘

অফিসার দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলেন।

‘আপনাদের কি আমাদের নিজের আত্নীয় মনে হচ্ছে? যে আপনারা বলবেন আর ছেড়ে দিবো।’

আরেকজন অফিসারদের নির্দেশ দিলো এদের বন্দি করে রাখো। সিদ্ধান্ত তারা এসে নিবেন।’

নিনীকা ও সুমিত্রাকে কটেজের সিঁড়ির উপরের কাঠের উঠানে হাঁটু গেঁড়ে বসিয়ে রাখা হলো। দু’দিকে দুজন অফিসার বন্দুক ধরে রেখেছেন।

একজন অফিসার তাদের পরোখ করে আরেকজনকে বলছেন,

‘ নীল ড্রেস পড়া মেয়েটিকে আমার পছন্দ হয়েছে।’

সেই আরেকজন অফিসার বললেন,

‘আমার তো সাদা ড্রেস পড়া মেয়েটিকে পছন্দ হয়েছে।’

‘আজ রাতের কোনো ব্যবস্থা করা যায়?’

‘উপরে যারা আছেন তারা যদি অনুমতি দেন তো করা যাবে।’

নিনীকা ও সুমিত্রার শরীর ঘিনঘিন করে উঠলো। সুমিত্রার কপোল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।

‘ বলেছিলাম আসার দরকার নেই। শুনলি না। সব সৈনিক ধ্রুব জিজুর মতো নয় নিনীকা। আমাদের এখন কি হবে! হে ভগবান রক্ষা করো।’

নিনীকা ঠোঁট কামড়ে ধরেছে। সে কাঁদতে চাইছে না। আপাতত এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তা খুজতে হবে।

নিনীকা ও ধ্রুবের দার্জিলিংয়ের সেই বিচ্ছিন্ন হওয়ার তিনমাস পাড় হয়ে গেছে। নিনীকার দিনগুলো তেমন ভালো যেতো না। প্রথম কয়েকদিন পড়াশোনাতে মন দিতে পারেনি। সবকিছুতে ধ্রুবকে ভেবে যেতো। তার সবকিছু জুড়ে ধ্রুব, ধ্রুব, ধ্রুব! যে মানুষটাকে সে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। যার থেকে নিজ থেকে দূরে সরে এসেছে, আজও সেই মানুষটাতে মনে মনে সে খুঁজে বেড়ায়।

ধ্রুবের সাথে সম্পর্কিত কোনোকিছু চোখে পড়লেই নিনীকা নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারে না। সুমিত্রা অতিষ্ঠ হয়ে বারবার বলে বাংলাদেশে এসে ধ্রুবের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে। জীবনকে একবার সুযোগ দিতে। কিন্তু নিনীকার মনে খুঁত খুত থেকে যায়। পুরুষদের প্রতি বিশ্বাস-অবিশ্বাস নিয়ে মন নানান তর্ক করে নিজের সাথে। দোটানায় পড়ে যায় সে। একদিকে নিজের কঠিন সত্তা, অন্যদিকে ধ্রুবের প্রতি দূর্বল হওয়া কোমল মন।

আজ নিনীকা ধ্রুবের টানেই এদিকে চলে এসেছে। সেনাবাহিনীর জিপ গাড়ি যখন সড়ক দিয়ে গেলো তখন তার মনে হলো ধ্রুব আছে কোথাও। পাহাড়ি যখন বলল ক্যাম্পের কথা। তখনও সে ধ্রুবকে ভেবেই এগিয়ে এসেছে।

যাকে সে মনে করতে চায় না। যাকে তার কঠিন সত্তা বার-বার প্রত্যাখ্যান করে তাকেই তার কোমল মন ভেবে যায় প্রতিনিয়ত। নিনীকার এই মুহুর্তে নিজের কোমল মনের প্রতি ঘৃণা হচ্ছে। নিজে একা নয় সুমিত্রাকেও বিপদে ফেলে দিলো সে।

একবার যদি সে এখান থেকে বেরোতে পারে তবে সবার আগে নিজের কোমল মনে ছুরির আঘাত করবে। এমন মন তার দরকার নেই। যে মন তার কথা ভাবে না, ভাবে ওই পুরুষদের কথা যাদের নিনীকা বিশ্বাস করতে পারে না। যাদের বিশ্বাস করার কথা ভাবলে নিনীকার সব এলোমেলো হয়ে যায়। নিনীকার নিঃশ্বাস আটকে আসে। চোখের সামনে ভাসে নিজের মায়ের প্রতিনিয়ত দুঃখ, বেদনা। কতো ভালোবাসা কতো বিশ্বাস কতো ভরসা নিয়ে তার মা ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। শেষে কি পেয়েছিল? পায়নি, আজও পেয়ে যাচ্ছে কাঁটার আঘাত!

যার জন্মদাতা নিজের সন্তানের সামনে অন্য নারীকে টেনে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়, তার সন্তান হয়ে নিনীকা কিভাবে বিশ্বাস করবে পুরুষ জাতিকে! মেয়েদের জীবনের প্রথম পুরুষ হয় তাদের বাবা। যাদের দেখে মেয়েরা পুরুষদের সম্পর্কে প্রথম ধারণা করে। নিনীকার এ পর্যন্ত যতো ধারণা হলো সব নিকোষ অন্ধকার। নিনীকার দুঃখের মতো অন্ধকার, কালো সব!

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-১৩

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

(কপি নিষিদ্ধ)

শীতকাল। কাঁচের জানালায় শিশির বিন্দু জমেছে। মিথিলা হাত দিয়ে তা ছুয়ে দিলেন। শরীর শিরশির করে উঠলো তার। ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলেন। নাস্তা তৈরি করে রমজান শেখ কে ডাকতে এলেন। রমজান শেখ তখন তৈরি হয়ে নিচে নামতেই যাচ্ছিলেন। মিথিলা নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো,

‘খেতে এসো।’

রমজান শেখ ধীর পায়ে হেটে এলেন। দুহাতে মিথিলার মুখশ্রী তুলে ধরলেন। শব্দ করে চুম্বন করলেন ঠোঁটে। মিথিলার চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো। রমজান শেখ ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকালেন।

‘হুসস কাঁদে না।’

মিথিলা ফুপিয়ে উঠলেন,

‘সবসময় এরকম ভালোবাসতে কেন পারো না? তোমার কোন সত্তাকে আমি বিশ্বাস করবো?’

রমজান শেখ মুহুর্তেই পরিবর্তন হয়ে গেলেন। মিথিলার গাল চেপে ধরলেন শক্ত করে।

‘বেশি বেশি কথা আমার পছন্দ না। চুপচাপ থাকবে।’

মিথিলা নিজেকে স্বাভাবিক করলেন।

‘খেতে এসো।’

রমজান শেখ হাঁটা ধরলেন। যেতে যেতে করুণ চোখে পেছন ফিরে দেখলেন একবার।

মিথিলা নিচে নামলেন না। বিছানা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে বালিশের উপর একটি ডায়েরি দেখতে পেলেন। ডায়েরিটা তিনি সবসময়ই দেখেন। কখনো টেবিলে কখনো বিছানায়। কিন্তু কখনো খুলে দেখা হয়নি। আজ কৌতুহল নিয়ে হাতে নিলেন৷ রমজান শেখ ডায়েরিতে নিজের অনেক কথা লিখেন। যেমন লিখতেন প্রেম চলাকালীন মিথিলা কে নিয়ে নানান কথা।

মিথিলা পাতা উল্টালেন। সাল দেখে বুঝলেন তার ও রমজান শেখের প্রেমের শুরুর পর ডায়েরিটা লেখা শুরু করা হয়েছে। পুরনো স্মৃতি ধীরে ধীরে মনে পড়তে লাগলো তার। মানুষটা তাকে কতো ভালোবাসতো। তাকে নিয়ে কতো না বলা অনুভুতি লিখে রেখেছে। আস্তে ধীরে পৃষ্ঠা পাল্টাতে লাগলো। একটা পৃষ্ঠাতে চোখ আটকে গেলো মিথিলার। উপরে বড়বড় অক্ষরে লেখা,

‘ ঘৃণার শুরু’ ১৫ জুন

মিথিলা প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে পড়তে শুরু করলেন।

‘ আমি রমজান শেখ। আমার প্রিয়তমা মিথিলা ভালোবেসে আমাকে শেখ বাবু বলে ডাকে। তাকে আমি বিয়ে করেছি ভার্সিটি দ্বিতীয় বর্ষে। আজ থেকে আমি নতুন কিছু শুরু করবো। যেটা হবে ঘৃণার। তীব্র ঘৃণার। নিজেকে ঘৃণা করার এই যাত্রার শুরুটা আমি স্মরনীয় করে রাখতে লিখে রাখছি। আজ পনেরো জুন। মিথিলাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি পাঁচ মাস আগে। আমাদের টোনাটুনির সংসারে ঝুটঝামেলা নেই। আমার বাবার অটেল সম্পদ। সুতরাং বউ পালতে আমার কোনো অসুবিধা হয়না। মিথিলার বাবাও সব বুঝেই আমার মতো স্টুডেন্টের কাছে নিজের মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া আমি ছাত্র হিসাবে ভালো। ইতিমধ্যেই বাবার ব্যবসাতে হাত দিয়েছি। বিশ দিন আগে হোস্টেলে এসেছিলাম পরীক্ষার কারণে। আজ আমার শেষ পরীক্ষা ছিল। আমি খুশিমনেই পরীক্ষা দিয়েছি। আমার হৃদপিণ্ড, আমার মিথিলাকে টেলিফোন করে বলেছি আমি আগামী কালই গৃহে ফিরবো। হোস্টেল রুমে আমার সাথে আরও তিনজন থাকেন। হোস্টেলের প্রত্যেকটা রুমেই এমন করে। রুমে যারা থাকেন তাদের সাথে আমার কোনো সখ্যতা নেই। আমি পড়ার সময় পড়ি বাকিটা সময় প্রিয়তমাকে ভেবে কাটিয়ে দেই। সুতরাং আশপাশের খেয়াল আমার কখনোই ছিল না। এখন ভোর রাত। ঠিক তিনঘণ্টা আগে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সর্বনাশটা হয়ে গেছে।

আমি তখন হোস্টেলের জানালা দিয়ে চাঁদ দেখছি। মনে মনে ভাবছি প্রিয়তমাকে। সে টেলিফোনে বলেছে আমি বাড়িতে গেলে আমাকে সারপ্রাইজ দিবে। সেটা কি হতে পারে ভাবছিলাম। তন্মধ্যে আমার পেছনে এসে দাড়িয়েছে সাতজন পুরুষ। তারা ফাইনাল ইয়ারের। তিনজন আমার রুমমেট। বাকি গুলো হোস্টেলেরই কোনো না কোনো রুমের। আমি তাদের সালাম দিলাম। ভাবলাম হয়তো সিনিয়র বলে উপদেশ দিয়ে চলে যাবে। কিন্তু আমার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ হলো। আমি তখনো মনে মনে মিথিলাতে ডুবে। তাদের জঘন্য পরিকল্পনা আমি স্বপ্নেও বুঝতে পারিনি।

সমকামী অহরহ রয়েছে। কিন্তু আমার সামনে দাড়ানো সাতজন সিনিয়র যে তারই অন্তর্ভুক্ত তা আমি জানতাম না। আমাকে ওরা হাত পা বেঁধে উলঙ্গ করে নির্যাতন করলো। মেয়েদের বেলায় ধর্ষণ শব্দটা ব্যবহার হলে পৃথিবীর সবাই জেগে উঠে। বিচার চেয়ে রাস্তায় নামে। আমি একজন পুরুষ। নির্যাতিত পুরুষ। একজন পুরুষকেও ধর্ষণ করা যায় সেটা কি এই সমাজ মেনে নিবে?

আমাকে ছাড়া হলো তিনটার দিকে। ব্যাথায় আমি অজ্ঞান ছিলাম আধাঘন্টা। সাড়ে তিনটার দিকে হুশ আসে। আমার চোখে বারবার ভাসছিল আমার ভালোবাসা আমার অর্ধাঙ্গিনী প্রিয়তমার মুখ। সে যখন জানবে তার স্বামী সাতজন সমকামী দ্বারা নির্যাতিত হয়েছে তখন সে কি ঘৃনা করবে না?

চারটার দিকে আমি টেলিফোন করলাম পুলিশ স্টেশনে। বাবার ব্যবসার সুবাদে অনেক বড়বড় অফিসারদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। তাদের মধ্যেই শহরের একজনকে নিজের নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা বললাম। ভদ্রলোক বেশ মজা পেলেন। পুরুষ সমাজের প্রতি আমার ঘৃনা বাড়িয়ে দিলেন তীব্র ভাবে। অফার করলেন,

‘তুমি চাইলে আমাকে এক রাত দিতে পারো। মেয়ে ছেলে ইন্টিমেট কমন। বাট ছেলে ছেলে নট কমন। ফিল করতে পারছো? মজা না?’

ঘৃণায় আমি বমি করে ভাসিয়ে দিলাম। রুমে আমি ছাড়া কেউ নেই। প্রায় এক ঘন্টা শরীর ঢলে গোসল করলাম। তবুও যেনো সব রয়ে গেলো। আমি আমার শরীরের কোথাও আমার মিথিলার ছোঁয়া অনুভব করতে পারলাম না। আমার মিথিলার ভালোবাসাময় আদরগুলো চাপা পড়ে গেছে সাতজন সমকামীর ঘৃণ্য স্পর্শের কাছে।

আমি কপালে পাগলের মতো হাত ছোঁয়ালাম। বুকে কপালে কোথাও আমার মিথিলার ভালোবাসার স্পর্শ পেলাম না। তৃষ্ণার্থ হয়ে মিথিলাকে খুজলাম। আমার এই ব্যথা একমাত্র ও ভুলিয়ে দিতে পারবে। ওকে আমার প্রয়োজন। তীব্র ভাবে প্রয়োজন।

এই সময় টেলিফোনে তাকে পাওয়া গেলো না। দীর্ঘ এক ঘন্টা থম মেরে বসে থাকার পর আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জীবনে যতোদিন বেচে থাকবো ততোদিন আমি পুরুষদের তীব্রভাবে ঘৃনা করে যাবো। নিজের পুরুষ সত্তাকে ঘৃনা করে যাবো। আশেপাশের সবাইকে ঘৃনা করতে বাধ্য করবো। পৃথিবীতে সূচনা করবো ঘৃণ্য একটি সত্তার।

আমার মিথিলা, প্রিয়তমা আমার। আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। আমি তোমার শেখ বাবু হয়ে থাকতে পারলাম না গো।


মিথিলার চোখের পানিতে ডায়েরির পাতা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। মুখ চেপে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। হাত দিয়ে উল্টালেন পৃষ্ঠা।

তারিখ ২০ জুন

‘ পাঁচ দিন পর বাড়িতে এসেছি। মিথিলা অভিমানী মুখ নিয়ে আমার পাশে ঘুরঘুর করছে। আমি জানি আমার নির্বিকার ভাব তাকে কষ্ট দিচ্ছে। দিক, ঘৃনার সূচনাটা আজ থেকেই হোক।’

রাতে ঘুমানোর সময় মিথিলা আমার ভালোবাসা চাইলো। আমার অপবিত্র শরীর মিথিলার পবিত্র শরীর স্পর্শ করবে সেটা আমি চাই না। কিন্তু মিথিলা হার মানার পাত্রী নয়। সে আমাকে উত্তেজিত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করলো। কিন্তু পুরুষ সত্তাকে হার মানিয়ে আমার জেদ, ঘৃণা জিতে গেলো। আমি দূর্বল হলাম না। শেষরাতে মিথিলা কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত তার পেটে রাখলো।

আমি চমকে গেলাম। তার বলা সেই সারপ্রাইজটা আমার পছন্দ হলো না। হয়তো আগের আমি হলে খুশিতে কেঁদে ফেলতাম। কিন্তু এখনকার আমি সম্পূর্ণ ভিন্ন। মিথিলার গালে প্রথমবারের মতো আমার শক্ত হাতের থাপ্পড় বসালাম। আমি দেখেছি ও বড়বড় দুটো চোখে কিভাবে আমাকে দেখছিল। হয়তো বেচারি স্বপ্নেও ভাবেনি আমি কখনো তাকে আঘাত করতে পারি।

৪ জুলাই

আমি ওর থেকে দূরে থাকতে পারি না। অনেকদিন পর ওকে কাছে টেনেছি। অভিমানে ও আমার বুক ভাসিয়েছে। আমি নির্দয় পাষানের মতো কাছে টানার পর ওকে ছুঁড়ে ফেলেছি। দ্বিতীয় বারের মতো ও বড়বড় চোখে আমাকে দেখেছিলো।

বির বির হরে পেটে হাত রেখে হয়তো আমাদের সন্তানকে বিচার দিচ্ছিলো।

‘ তোর বাবা পাল্টে গেছে সোনা, তোর আসার খবর পেয়ে সে খুশি হয়নি। তুই একজন ভালো বাবা পাবি না।’

মিথিলার চোখের পানি বাঁধ মানছে না। চিৎকার করে কাঁদছেন তিনি। বাকিটা পড়ার শক্তি তার আর নেই। তার চিৎকারে নিচ থেকে সবাই উপরে উঠছে। সার্ভেন্ট থেকে শুরু করে কাজের মহিলা। রমজান শেখ এলেন সবার শেষে। মিথিলার হাতে ডায়েরি দেখে রাগলেন না। তিনি জানেন রহস্য একদিন সামনে প্রকাশ হবেই।

মিথিলা সবার সামনে ঝাপিয়ে পড়লেন স্বামীর বুকে। রমজান শেখ নির্দয়ভাবে ছুঁড়ে ফেললেন মেঝেতে। চোখের সানগ্লাস ঠিক করে বললেন,

‘অফিসে যাচ্ছি, ফিরে এসে যেনো এসব নাটক আর না দেখি।’

রমজান শেখ প্রস্থান করলেন। মিথিলা বুক চেপে আহাজারি করে কাঁদলেন। পৃথিবী এতো নিষ্ঠুর! তার অমন নরম মানুষটাকে কিভাবে বদলে দিলো। সহজ সরল হাসিখুশি মানুষটাকে কিভাবে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিলো। ভেঙে দিলো তাদের ভালোবাসাময় সংসার।’

যে মানুষটা বুক ফুলিয়ে বলতো,

‘আমার মতো আর কেউ পাবে না বুঝলে? কেউ তোমাকে আমার মতো করে ভালবাসবে না।’

নিজেকে নিয়ে গর্ব করা মানুষটা নিজেকে ঘৃণা করে!

কাঁদতে কাঁদতে মিথিলার চোখের অশ্রু ফুরিয়ে গেলো। মেঝে থেকে উঠে টলমল পায়ে বিছানাতে শুয়ে পড়লেন। নাক টেনে অনুভব করতে চাইলেন প্রিয় মানুষটার ঘ্রাণ।

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-১২

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

(কপি নিষিদ্ধ)

ফারিন অপলক তাকিয়ে নিনীকাকে দেখছে। ননীর পুতুল যেনো। কি সুন্দর শুভ্রতায় মোড়ানো তার ভাবী। ভাই এই পুতুল কোথায় পেলো? মনের কথা মুখে প্রকাশ করতেই ধ্রুব মাথা চুলকে হাসলো।

‘তোর সম্মানিত পিতা আমাকে বিয়ে করিয়েছেন, যখন তুই আর মা মামাদের কাছে গেছিলি।’

ফারিন আঁতকে উঠলো।

‘হায় আল্লাহ এসব কি বলো? মাম্মি জানলে তো খবর করে ছাড়বে ব্রো।’

ধ্রুব চিৎ হয়ে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লো।

‘যখন জানবে তখন দেখা যাবে।’

ফারিন নিনীকার পাশে গিয়ে বসলো। নিনীকাকে অপলক চিপসের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল,

‘খাচ্ছো না কেন? ভাইয়া বললো তুমি অনেক ক্ষুধার্ত।’

নিনীকা চিপসের প্যাকেট সাইট করে রেখে বিস্কুট খেতে শুরু করলো। ফারিন অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোমার চিপস পছন্দ না?’

নিনীকা বহু কষ্টে বলল,

‘পছন্দ ছিলো।’

বিস্কুট খেতে গিয়ে নিনীকার কাশি উঠে গেলো। ধ্রুব তড়িৎ গতিতে উঠে বসেছে। পানির বোতল ঠোঁটের সাথে লাগিয়ে বলল,

‘পানি খাও আগে। আস্তে ধীরে খাবে তো। ‘

ফারিন মৃদু জোরে ধমক দিলো,

‘ভাবিকে একদম বকা দিবে না ব্রো। সি ইজ এ ডল। কতো আদুরে সে। আমার খুব পছন্দ হয়েছে তাকে।’

ধ্রুব কিছু বললো না। নিনীকাকে চোখের ইশারায় পানি খেতে বললো। নিনীকা চুপচাপ খেয়ে নিলো। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

কয়েকটা বিস্কুট খেয়ে এক কোণায় শুয়ে পড়লো। ধ্রুব ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো। তার নিজেরো ক্ষিধে পেয়েছে। কিন্তু এসব খেয়ে পেটের এক কোনা ও ভরবে না। অগত্যা ফারিনকে বললো সব নিয়ে চলে যেতে। ফারিন মাথা নাড়ালো। ধ্রুব সাবধান করলো,

‘মা যেনো কিছু জানতে না পারে।’

ফারিন চলে যাওয়ার পর সে দরজা লক করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নিনীকার কাঁধে হাত রেখে নিজের দিকে ঘুরাতে চেষ্টা করলো। নিনীকা শক্ত হয়ে থাকলো। ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে হেসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো।

তীব্র অস্বস্তিতে নিনীকার দমবন্ধ হয়ে আসছে। ধ্রুবের হাতের বিচরণ তার পেটে। পা তুলে আষ্ঠেপৃষ্ঠে বেঁধেছে নিজের সাথে। নিনীকার নড়াচড়া করার উপায় নেই। কিছু সময় পর ধ্রুবের গরম নিশ্বাস তার গলায় অনুভব করলো। মানুষটা ঘুমিয়ে পড়েছে।

নিনীকার মন খারাপ হয়ে গেলো। মানুষটারও ক্ষিধে পেয়েছিল। সে যদি বলতো তাহলে নিশ্চয়ই খেতো। কেন সে বললো না? নিনীকা নিজের ভাবনার উপর বিরক্ত হচ্ছে। হঠাৎ করে এই লোকের প্রতি তার এতো মায়া কাজ করছে কেন?

মাত্র দুদিন ধরে লোকটা তার সাথে থাকছে। নিনীকাদের ট্রিপ ছিল তিনদিনের। সে মনে মনে ভেবে নিলো আরেকটু বেলা গড়ালে সুমিত্রার সাথে কথা বলবে। তাদের তিনদিনের ট্রিপের আজ শেষ দিন। গতকালই তারা শিলিগুড়ি ফিরে যাবে। তখন আর এই মানুষটার সাথে দেখা হবে না। দুদিনে হওয়া এই মায়া ভুলতে নিনীকার কঠিন মনের সময় লাগবে না। এরকম কতো মায়া সে অনায়াসে ফেলে এসেছে। আবারও না-হয় ফেলে যাবে দার্জিলিংয়ের মাটিতে।

ধ্রুবের ঘুম ভাঙলো সাড়ে নয়টায়। নিনীকা তখন থাই গ্লাসের ফাঁক গলিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তার ঘুম ধরা দেয়নি আর। ধ্রুব হাতের জোরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো তাকে। দু-হাত দিয়ে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে ঘুমঘুম কন্ঠে বড্ড মায়া নিয়ে শুধালো,

‘আমার ননীর পুতুলকে মিষ্টি সকালের শুভেচ্ছা।’

নিনীকা তাকিয়ে থাকলো। ধ্রুব ভালো করে চোখ মেলেনি। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো। মুখে কিঞ্চিৎ চাপদাড়ি৷ হয়তো পেশাগত কারণে ক্লিন করে ফেলে। চুলে আর্মি কাট। চুলগুলো বড় হয়ে কপালে পড়ে আছে। কি সুন্দর ঘন চুল। নিনীকা হাত বাড়িয়ে চুলে ডুবালো। ধ্রুব তৎক্ষনাৎ চোখ মেলে তাকিয়েছে। নিনীকা নিজেও তাকিয়ে থাকলো। মন অঘটন ঘটাতে চাইলো। মস্তিষ্ক বাঁধা দিলো। মন ও মস্তিষ্কের তর্কে মন জিতে গেলো। ইচ্ছে অপূর্ণ রাখতে নেই। আজ আছো কাল না-ও থাকতে পারো। ইচ্ছে পূরণ করে ফেলো।

নিনীকা তাই করলো। ধ্রুবের অপলক তাকিয়ে থাকা ও তার ইচ্ছে পূরণে বাঁধা দিতে পারলো না। সে মুখ উঁচু করে পরম আবেশ, মায়া মিশিয়ে ঠোঁট দিয়ে ছুয়ে দিলো ধ্রুবের কপাল। দীর্ঘক্ষণ ঠোঁটের স্থায়িত্ব রাখলো কপালে। আলগোছে হাত দিয়ে কপালের চুল সরিয়ে দিলো। নিনীকা যখন ইচ্ছে পূরণ করে বালিশে মাথা রাখলো তখন ধ্রুব চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নিনীকার মারাত্মক লজ্জা অনুভব হলো। নিজের পুরনো সত্তায় ফিরে গেলো। ঢুক গিলে বললো,

‘আ’ম স্যরি মিস্টার মেজর।’

ধ্রুব চট করে চোখ মেলেছে। সুখি একটা হাসি দিয়ে বলল,

‘আমি চাই এরকম ভুল তুমি সারাজীবন করো মিসেস। তুমি জানো না তুমি আজ আমায় কি দিয়েছো। এতো মায়া, ভালোবাসা নিয়ে মা-বাবা ছাড়া কেউ কখনো আমাকে স্পর্শ করেনি। বড়ো হওয়ার পর সেটাও ফুরিয়ে গেছে। কত বছর পর কেউ আমার কপালে স্পর্শ করলো ভালোবেসে। আমার অনুভূতি বুঝতে পারছো মিসেস? আমি তোমাকে ভালোবাসি।’

ধ্রুবের অকপট স্বীকারে নিনীকার দমবন্ধ হয়ে এলো। নিজেকে সংযত করে কঠিন কথা ছুঁড়ে দিলো।

‘আমি আপনাকে ভালোবাসি না, আর না কখনো বাসবো। হঠাৎ কি হয়েছিল জানিনা। হয়তো মোহের বশে আপনার কপালে স্পর্শ করেছি। তাই বলে আমি আপনাকে ভালোবেসে ফেলিনি।’

ধ্রুব হাসলো,

‘আজ বাসোনি কাল যে বাসবে না তার কি গ্যারান্টি?’

‘কাল আর আসবে না, আপনার সাথে আজই আমার শেষ দিন। কাল থেকে আপনি আপনার পথে আমি আমার।’

ধ্রুব রেগে গেলো।

‘কি বলছো এসব? মাথা ঠিক আছে? ‘

নিনীকা দমলো না,

‘আমার মাথা পুরোপুরি ঠিক আছে। আপনার মাথা হয়তো ঠিক নেই। আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমি পালিয়ে এসেছিলাম। আপনার সাথে সংসার করবো না বলেই পালিয়ে এসেছি, সেখানে আপনি ভাবলেন কিভাবে আমি দু’দিনে আমার মতামত চেঞ্জ করে আপনার সাথে থেকে যাবো?’

ধ্রুব জোরে জোরে শ্বাস ছাড়লো,

‘এমন করে বলো না মিসেস।’

‘আমি এমন করেই বলি। আপনি কি বাচ্চা? আপনার কি আত্নসম্মান নেই? একজন মেজর হয়ে কিভাবে একটা মেয়ের পেছনে পড়ে আছেন আপনি। এসব কি আপনাকে মানায়?’

ধ্রুবের শ্বাসরুদ্ধকর কন্ঠো,

‘তুমি আমার..মিসেস নিনীকা। আমার..

‘আমি আপনার কেউ না। কেউ না আমি আপনার। সামান্য কাগজ কলমের সম্পর্ক আমাদের। এক সাইনে যেটা মুছে যাবে। আপনি চাইলে সব ব্যবস্থা করতে পারেন। আমি সাইন করে দিবো।’

ধ্রুব উঠে বসলো। সাথে টেনে বসালো নিনীকাকে। প্রচন্ড জোরে চেপে ধরলো নিজের সাথে।

‘তোমার এতো বড় দুঃসাহস! এতো সাহস তোমার। কে টে টুকরো টুকরো করে ফেলবো। চেনো আমায়? আর একবার উচ্চারণ করে দেখো শুধু!’

নিনীকা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিলো,

‘কি করবেন আপনি?’

ধ্রুব চিৎকার করলো,

‘নিনীকা…’

‘আপনি আমার কেউ হোন না। আমি সাইন করে দিবো বলেছি না? আপনি সব ব্যবস্থা করুন। হয়তো সময় লাগবে। কিন্তু ছয়মাসের মধ্যে তিনমাস অতিক্রম হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের। তিনমাস পর কাগজ পাঠিয়ে দিবেন। ব্যস।’

নিনীকার শক্ত কথা ধ্রুবের বুক জ্বালিয়ে দিচ্ছে। সে বহু কষ্টে ঢুক গিললো।

‘তুমি ক্ষুধার্ত মিসেস, চলো আমরা খেয়ে আসি। তারপর দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিনীকা তীব্র আঘাত করার চেষ্টা করলো,

‘আমি ক্ষুধার্ত নই। আমার মনে হচ্ছে আপনি ক্ষুধার্ত। আপনারা সব পুরুষ এক। মেয়েদের কি মনে হয় আপনাদের? যখন ইচ্ছে তখন চেপে ধরবেন। অধিকার আছে বলে বিছানায় টেনে নিবেন?’

‘নিনীকা থেমে যাও..’

‘থামবো না আমি। সত্যি কথা গায়ে লাগছে? তবে শুনুন। আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। যেমনটা করি নিজের জন্মদাতাকে। আপনাদের পুরুষ জাতীর প্রতি আমার তীব্র ঘৃণা। আমি আপনাদের ঘৃণা করি। আপনাকে ঘৃণা করি। শুনতে পেয়েছেন আপনি?’

ধ্রুবের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। দু-হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো নিনীকা কাঁধ। ঝাকিয়ে বলল,

‘তোমাকে কি আমি খেয়ে ফেলেছি? নাকি বিছানায় টেনে নিজের পুরুষত্ব দেখিয়েছি? ঠিক কোন কারণে তুমি আমাকে জঘন্য স্থানে নামাচ্ছো?’

নিনীকা তাছ্যিল হাসলো,

‘দেখাননি? এইযে আমাকে আটকে রেখেছেন, সেটা কি? জোর করে বুকে ঘুমাতে বাধ্য করছেন। ইচ্ছে হলে চেপে ধরছেন, সেটা কি?’

ধ্রুবের হাত ধীরে ধীরে নিনীকার কাঁধ থেকে নেমে গেলো। আস্তে করে নামলো বিছানা থেকে। ট্রলি বের করে দরজা খুলে দিলো। জানালার দিকে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো। মনের আঘাত লুকিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

‘চলে যাও। আর এসো না। আমি কখনো তোমার উপর অধিকার দেখাতে যাবো না। তুমি মুক্ত।’

নিনীকা ধীরে পায়ে হেঁটে দরজার সামনে দাঁড়ালো। ট্রলিতে হাত রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিলো ধ্রুবকে। যে বর্তমানে জানালার দিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে। নিনীকা দরজার বাহিরে পা রাখলো। ঠোঁটে দাঁত গেঁথে গেলো। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো অশ্রুকণা।

জানালার দিকে শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকা ধ্রুবের কপোল বেয়ে এক ফোঁটা গরম জল গড়িয়ে পড়লো। কেউ দেখলো না। ভালোবাসার মানুষের কথার আঘাতে কিভাবে মন ভেঙে গেলো তার!

নিনীকা দুর্বল পায়ে হেঁটে এসে থামলো সুমিত্রার বুক করা রুমের সামনে। দরজায় পর পর দু’বার টুকা দিতেই তা খুলে গেলো। সুমিত্রা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

‘নিনীকা ইয়ার!’

নিনীকা প্রায় ঝাপিয়ে পড়লো। ফুপিয়ে উঠলো।

‘আজই শিলিগুড়ি ফিরে চল।’

সুমিত্রা মাথায় হাত ভুলিয়ে দিলো। পাল্টা প্রশ্ন করলো না। আশ্বাস দিলো,

‘আমরা আজ এখনই রেডি হয়ে ফিরে যাবো। শান্ত হো।’

ঠিক এক ঘন্টা পর তারা বেরিয়ে গেলো। গেইটের সামনে থেকে যখন টেক্সি ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে তখন বাম দিকের শেষ কামরার জানালার পাশে দাড়ানো মেজর ধ্রুব মাহবুব বুক চেপে ধরেছে। তার মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজা কে টে নিয়ে যাচ্ছে। ধ্রুব দূর্বল কন্ঠে বিরবির করলো,

‘পাষাণী মিসেস!’

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-১১

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ)

গভীর রাত। নিস্তব্ধ বারান্দায় একা বসে আছেন রমজান শেখ। একের পর এক সিগারেট টেনে চলেছেন প্রায় দু’ঘন্টা ধরে। চোখগুলো অন্ধকার তারা বিহীন আকাশে নিবদ্ধ। আকাশে চাঁদ ও নেই। নিস্তব্ধতার মধ্যে রমজান শেখ একা, একলা। তার বুক ছিঁড়ে বের হচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। আজ আষাঢ়স্যের পনেরো তারিখ। এই তারিখ কারো জন্ম তারিখ নয়, কারো মৃত্যু তারিখ ও নয়। কারো বিবাহ তারিখও নয়। এই তারিখটা তার জীবনটা কুলষিত করার তারিখ। আজকের এই তারিখেই এমনই একটি রাতে তার জীবনটা বদলে গেছিল। তিনি বেছে নিয়েছিলেন ঘৃণা। নিজের প্রতি ঘৃণা। পুরো বিশ্বের পুরুষ সমাজের প্রতি ঘৃণা। এতো ঘৃণা রমজান শেখ কাউকে করেন নি। যতোটা নিজেকে করেন। তার ঘৃণা হয় পুরুষ সত্তার প্রতি। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে পুরুষালি অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত করে দিতে। কেন তিনি পুরুষ হলেন? কেন তাকে এই ঘৃণ্য সত্তা নিয়ে জন্ম নিতে হলো।

পুরনো স্মৃতি গুলো আবছায়া হয়ে ধরা দিলো চোখে। তার চোখ গরম হয়ে টুপটাপ করে অশ্রু বিসর্জন দিলো। রমজান শেখ বাচ্চাদের মতো ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন। বড্ড ঘৃণামিশ্রিত কন্ঠে উচ্চারণ করলেন বিষ বাক্য।

‘পৃথিবীর সবাই জানুক পুরুষদের মতো ঘৃণ্য কেউ হতে পারে না। আমি পৃথিবীকে জানাবো। নিজের এই পুরুষ সত্তার প্রতি তীব্র ঘৃণা আমার। সবার ঘৃণা জন্মাক আমার প্রতি। আমার এই পুরুষ সত্তার প্রতি।’

আচমকা তিনি হু হা করে হেসে উঠলেন। একা একা বিরবির করলেন,

‘আমি চাই সবাই পুরুষদের ঘৃণা করুক। নিনী মা আমার তুমিও ঘৃণা করো। তীব্র ভাবে ঘৃণা করো। পুরুষদের কখনো আপন ভাববে না। আ’ম সাকসেসফুল ডেয়ার। তোমার বাবা সাকসেস। তুমি আজ সত্যিই পুরুষদের অবিশ্বাস করো। নিনীকা আমার মেয়ে, তুমি কখনো পুরুষদের মায়ায় আটকাবে না। শুনছো মা আমার? বাবা ইচ্ছে করে পাসপোর্টের লকারের চাবিটা তোমার মাকে দেখিয়ে দিয়েছিলাম। তোমার বাবা জিতে যাচ্ছে মা। তুমি কখনোই পুরুষদের বিশ্বাস করবে না মা। তোমার বাবা যা সহ্য করেছে তুমি তা কখনোই সহ্য করবে না। পুরুষদের প্রতি তীব্র ঘৃণা জন্মাক তোমার, ঠিক তোমার মায়ের মতো। বুঝলে মা আমার? নিনীকা! তুমি যখন জন্ম নিয়েছিলে তখন আকাশে চাঁদ উঠেনি। তারাগুলো ছুটি নিয়েছিল মনে হয়। আমার ননীর পুতুলের আগমনে তারা খুশি হয়নি। যেমনটা খুশি হইনি আমি। তোমাকে তো বড় হলে কোনো না কোনো পুরুষের সাথে জড়িয়ে দিতে হতো মা। বাবা তা কি করে পারতাম? বাবার প্রতি খুব ক্ষোভ না তোমার? বাবা যা করেছি তোমার ভালোর জন্যে করেছি মা। করেছি বলেই তো তুমি পুরুষদের থেকে দূরে দূরে থাকো। বাবা তোমাকে বড্ড বেশি ভালোবাসে মা। বাবাকে ক্ষমা করো।’

রমজান শেখ উঠে দাঁড়ালেন। বিরবির করতে করতে বিছানায় বসলেন। ড্রিম লাইটের আলোয় মিথিলার ঘুমন্ত মুখ দেখা যাচ্ছে৷ শরীরে কাপড়ের ছিটেফোঁটা নেই। অঙ্গে রমজান শেখের অত্যাচারের পরিচয় বহন করছেন এই মুহুর্তে। রমজান শেখের ঘৃণ্য পুরুষত্ব জেগে উঠলো। ক্লান্ত, ঘুমন্ত মিথিলার উপর হামলে পড়লেন আবারও। আচমকা আক্রমণে মিথিলা ভয় পেয়ে গেলেন। কিছু বলতে পারলেন না। তার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো দুঃখের অশ্রু। চোখ বুঝতে বুঝতে দেখে নিলেন তার ও রমজান শেখের প্রথম রাত। বাসর রাত। মানুষটা সেদিন তার হাত ধরেছিল শক্ত করে। বুকে জড়িয়ে বলেছিল, ‘আমার একটি ননীর পুতুল চাই বুঝলে? তাকে আমি-তুমি মিলে ভালো রাখবো। সে হবে আমাদের মেয়ে। নিনীকা শেখ।’

মিথিলা তখন হেসে ফেলেছিলেন।

‘বাসর করার আগেই মেয়ের নাম ঠিক করে ফেললে শেখ বাবু?’

আর কল্পনায় কিছু ভাসলো না। কানে শুধু ভেসে এলো রমজান শেখের বিরবির করে বলা, ‘পুরুষদের আমি ঘৃণা করি।’ কথাটি।

কথার সাথে সাথে মিথিলার কষ্ট বাড়ছে। কিসের রাগ মিটায় লোকটা তার উপর? কিসের এতো ঘৃণা পুরুষদের প্রতি। কেন তার শেখ বাবু বদলে গেলো! তার সুখের সংসারে কার যে কু-নজর লেগেছিল। সবকিছু ধ্বংস করে দিলো। মিথিলা মুখ এগিয়ে আনলেন রমজান শেখের কানের কাছে। ফিসফিস করে বড্ড দুঃখী কন্ঠে বললেন,

‘ভালোবাসারা আজ বুকের ভেতর গুমরে মরে শেখ বাবু। তারা মুক্তি পেতে চায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তে চায় আপনার তরে। আপনি কেন বদলে গেলেন শেখ বাবু?’

রমজান শেখ থমকে গেলেন। হুট করে আবেগ বেড়ে গেলো তার। প্রচন্ড ভালোবাসা নিয়ে চুম্বন করলেন স্ত্রীর কপালে। মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে বললেন,

‘আর কষ্ট দিবো না, সত্যি দিবো না।’

মিথিলা কিছু বললেন না। রাতের কথা সকালে বদলে যাবে। বদলে যাবে তার মানুষটার আচরণ।

*
ভোর ছয়টা। ক্ষিধায় পেট চু চু করছে নিনীকার। সে বিরস মুখে বসে আছে বিছানায়। ধ্রুব ফোন হাতে পায়চারি করছে। তার বউয়ের ক্ষিধে লেগেছে অথচ এই ভোরে কোথাও খাবার নেই। সে কিভাবে খাবার এনে দিবে এখন? নিরব বেটা ফোন ধরছে না। ফাহিম মাহবুব ও ফোন ধরছেন না। সে শেষ আশা নিয়ে ফারিনকে কল করলো। ফারিন রিসিভ করতেই তড়িৎ গতিতে জিজ্ঞেস করলো,

‘তোর কাছে চকোলেট বিস্কুট কিছু একটা হবে? বা চিপস?’

ফারিন ঘুমঘুম কন্ঠে বলল,

‘এই ভোরে ফোন দিয়ে তুমি এসব জিজ্ঞেস করছো আমাকে? তুমি কি ক্ষুধার্ত ভাইয়া? ক্যাম্পে খাবার সংকট নাকি তোমার ওই অফিসার একাই সব খেয়ে ফেলেছে?’

ধ্রুব বিরক্তিকর কন্ঠে বলল,

‘আমাকে বলতে দিবি তুই?’

ফারিন সিরিয়াস হলো,

‘বলো শুনছি।’

‘যে হোটেলে আছিস সেটার বাম দিকের শেষের রুমটাতে যতো চিপস, চকোলেট, বিস্কুট আছে সব নিয়ে এখনই আয়।’

ফারিন ঘোরের মধ্যে আচ্ছা বললো। কিন্তু মস্তিষ্কে চাপ পড়তেই বিস্মিত হলো।

‘তুমি হোটেলে! ও মাই গুডনেস ব্রো। মাম্মা পাপা জানে এটা? মাই গড তুমি ও আমাদের ট্রিপে জয়েন করবা বলোনি তো। আমি আরও আফসোস করছিলাম আমার ভাইটা ট্রিপটা মিস করে যাচ্ছে বলে।’

ধ্রুব ধমক দিলো,

‘একদম চুপ। মা বাবা কাউকে কিছু বলবি না। নিঃশব্দে এসে সব দিয়ে যা। এলেই দেখতে পাবি ট্রিপে জয়েন করতে এসেছি নাকি হানিমুন করতে এসেছি।’

ফারিন চুপসে গেলো। ভাই রেগে গেছে তার মানে সিরিয়াস কিছু। সে আসছি বলে ফোন রাখলো। মনে মনে ভাবলো ভাই নিশ্চয়ই ক্ষুধার্ত। সাথে যদি তার ওই নিরব ফিরব থাকে তো সেও নিশ্চয়ই ক্ষুধার্তই হবে। সে নিজের কাছে থাকা সব নিয়ে নিলো। বেলা গড়ালে আবার না-হয় কিনে ফেলবে।

বাম দিকের শেষের রুমটাতে যখন সে টুকা দিলো তখন দরজার ফাঁক দিয়ে মুখ বের করলো ধ্রুব। ভাইকে দেখে ফারিন উচ্ছাসে মৃদু জোরে চিৎকার করলো। ধ্রুব টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। ফারিন বিছানায় মাম্মামের সাথে ঝগড়া করা মেয়েটিকে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেললো। চিৎকার করলো উচ্চস্বরে,

‘ও মাই গড ব্রো তার মানে সেই ছেলেটা তুমি ছিলে। আমার আগেই মনে হচ্ছিল মেয়েটাকে টেনে নিয়ে আসা ছেলেটা তোমার মতো কিছু টা।’

ধ্রুব ওর মুখ চেপে ধরলো।

‘ মেয়েটা তোর ভাবী হয়।’

ফারিনের চোখ বড়বড় হলো। সে চিৎকার করতে চাইলো প্রাণপণে। ধ্রুব হেসে ফেললো,

‘মুখ থেকে হাত সরাবো তার আগে বল চিৎকার করবি না।’

ফারিন মাথা নাড়াতে লাগলো। ধ্রুব হাত সরিয়ে বলল,

‘আস্তে নাড়া খুলে পড়ে যাবে।’

ফারিনের হাত থেকে সব নিয়ে রাখলো বিছানায়। নিনীকার চোখ লেগে এসেছিল। ফারিনের চিৎকারে চোখ মেলেছে সে। কিছু বুঝতে না পেরে তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। ধ্রুব ওকে ইশারা করে বলল,

‘আপাতত এগুলো ছাড়া আর কিছুর ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় মিসেস। খেয়ে নাও।’

নিনীকা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চিপসের একটি প্যাকেট হাতে তুলে নিলো। দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলো চিপসের প্যাকেট এর দিকে। চোখে ভাসলো ছোটবেলার একটি ঘটে যাওয়া দৃশ্য।

রমজান শেখ থাপ্পড় মেরে চিপসের প্যাকেট কেঁড়ে নিয়ে চিৎকার করে বলছেন,

‘আজ থেকে চিপস খাবে না।’

নিনীকা ফুপিয়ে কাঁদছে,

‘চিপস খেতে ভালোবাসি বাবা।’

রমজান শেখ শুনলেন না। সেদিন থেকে জেদে রাগে নিনীকা চিপস খায়নি। আজ সামর্থ্য থাকলেও তার খেতে ইচ্ছে করে না। অথচ এক সময় ভাবতো নিজের টাকা হলে বাবাকে দেখিয়ে ট্রাক ভরে চিপস নিয়ে আসবে। পাড়া-মহল্লার মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে বলবে, ‘আমার নিজের ইনকাম করা টাকা দিয়ে প্রথম চিপস কিনেছি। দোয়া করবেন যাতে ভবিষ্যতে আরও ট্রাক ভরে চিপস কিনে আপনাদের মধ্যে বিলিয়ে দিতে পারি।’

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-১০

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-১০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( কপি নিষিদ্ধ।)

সূর্য নিভু নিভু। গোধূলির কিঞ্চিৎ আলো জানালার ফাঁক গলিয়ে এসে পড়ছে ধ্রুবের চোখমুখে। সে পিটপিট করে চোখ মেললো। আশেপাশে তাকিয়ে নিজের অবস্থান বুঝতে চেষ্টা করলো। কিছু সেকেন্ড পর সব মনে পড়ে গেলো৷ রুমে সে ব্যতীত অন্য কারো অস্তিত্ব নেই। মন কেমন করে উঠলো। তার মিসেস তো বলেছিল আশেপাশে ঘুরে ফিরে আসবে। তবে ফিরলো না যে? ধ্রুব উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটলো। এক দৌড়ে এসে থামলো গেইটের বাহিরে। ওইতো তার মিসেস। সামনে দাড়ানো কারো সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে। সে এগিয়ে এলো আরও। ধীরে ধীরে মহিলাটির মুখ তার কাছে স্পষ্ট হতেই চমকে গেলো। লুকিয়ে গেলো গেইটের কোণায়। কোণার ফাঁক দিয়ে পিটপিট করে দেখতে লাগলো তার মিসেস কোমড়ে হাত রেখে কথা বলছে। ঝগড়া করছে নাকি? ধ্রুবের মাথায় হাত। শেষে কি না শ্বাশুড়ি বউমার প্রথম সাক্ষাৎ টা ঝগড়া দিয়ে শুরু হলো!

পেছন থেকে ফাহিম মাহবুব বার-বার স্ত্রীকে টানছেন। কিন্তু ধারা কোনো কথাই শুনছেন না। থেমে নেই নিনীকাও। কোথাকার কে তাকে এভাবে ঝারবে আর সে চুপচাপ বোকার মতো শুনে যাবে তা তো হতে পারে না। তাদের ঝগড়ার মধ্যে ঘুমঘুম চোখকে খুলতে চেষ্টা করতে করতে টেক্সি থেকে নেমে এলো একটি মেয়ে। হাই তুলতে তুলতে নিজের বাবাকে বলল,

‘ তুমি চুপচাপ এক কোণে দাড়িয়ে ঝগড়া দেখো পাপা। মাম্মার ঝগড়া এত সহজে থামবে না। সুতরাং শুধু শুধু টানাটানি করে সময় নষ্ট করো না।’

ফাহিম মাহবুব অসহায় চোখে তাকালেন। ফারিন তখনও চোখ ভালো করে খুলতে পারছে না।

‘টেক্সির ভাড়া দিয়ে বিদেয় করো তো। বেচারা ড্রাইভার নিশ্চয়ই বিরক্ত হচ্ছে। আর তুমি আমাকে ডাকো নি কেন? আমাকে ফেলে চলে যেতে চাইছিলে নাকি?’

ফাহিম মাহবুব অসহায় কন্ঠে বললেন,

‘তোমাকে ডাকার সুযোগই তো পাইনি মা। তোমার মা যেভাবে ঝগড়া করছে মনে হয়না রাতের আগে থামবে।’

ফাহিম মাহবুব টেক্সি ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। ফারিন বাবার এক হাত জড়িয়ে ধরে ঝগড়া দেখতে লাগলো। দুনিয়া ভেসে যাওয়ার মতো আফসোস করে বলল,

‘এই মুহুর্তে পপকর্নের খুব অভাববোধ করছি পাপা। তুমি আশপাশ থেকে পপকর্ন আনতে পারবে?’

ফাহিম মাহবুব কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,

‘পপকর্ন তোমাকে পরে খাওয়াবো লক্ষী মা আমার। পারলে তোমার মাকে থামাও।’

ফারিন হেসে ফেললো,

‘এমন অসম্ভব কাজ আমার দ্বারা সম্ভব নহে পিতা জি।’

ধ্রুব আড়াল থেকে অগ্নি চোখে নিজের বাবাকে দেখছে। পকেট থেকে ফোন বের করে মেসেজ দিলো,

‘তুমি কি ঝগড়া থামাবে? নাকি আমি বেরিয়ে এসে বলে দিবো তুমি আমাকে কিভাবে বিয়ে করিয়েছো?’

ফাহিম মাহবুব মেসেজের শব্দে ফোন বের করলেন। তার গুনধর পুত্রের হুমকিতে শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে লাগলো। রিপ্লাই দিলেন,

‘তুমি তোমার বউকে টেনে নিয়ে যাও বাবা। আমি আমার বউকে নিয়ে যাচ্ছি। তবে সাবধান মুখে মাক্স পড়ে নিও।’

ধ্রুব সাথে সাথে সিন করলো। মাক্স তো পেলো না তবে পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ ঢেকে নিলো। দ্রুত গতিতে বাপ বেটা দু’দিক থেকে এগিয়ে এলেন।

ধারা রাগে কিড়মিড়িয়ে বললেন,

‘ছেড়ে দাও আমাকে ওই পুচকে মেয়েটাকে আমি দেখে নিবো ফাহিম। চিনে না ও আমায়। তোমাকে কতোবার বলেছি ছেলেটাকে বিয়ে করাবো। আজ একটা বউমা থাকলে আমার হয়ে ঝগড়া করতে পারতো। তুমি আর তোমার মেয়ে তো অকর্মা। মেয়েটার কতো বড় সাহস। মা বাবা শিক্ষা দিতে পারেনি। বেয়াদব মেয়ে।’

ফাহিম মাহবুব মনে মনে প্রার্থনা করলেন,

‘এবারের মতো বাচিয়ে দাও আল্লাহ। আর জীবনেও এই মহিলাকে লুকিয়ে কিছু করবো না।’

ধ্রুব নিনীকাকে টেনে নিয়ে যেতে না পেরে কাধে তুলে নিয়েছে। নিনীকা একাধারে রাগে ধ্রুবের পিঠে কিল-ঘুষি দিচ্ছে। রেগে বলে চলেছে,

‘অকর্মা লোক, বউয়ের হয়ে ঝগড়া না করে পালিয়ে যাচ্ছে। আমার কপালে এমন ভীতু লোক জুটলো কেন? আপনি না মেজর? বউয়ের সাপোর্টার হতে পারেন না তো কিরকম স্বামী আপনি? আমি আপনার সংসার করবো না। ছাড়ুন আমাকে।’

ধ্রুব হোটেল রুমে এসে দরজা লক করে নিনীকাকে খাটে বসিয়ে তবেই থামলো। নিনীকা তখন ফুসফুস করছে। ধ্রুব প্রস্তুত হলো, তার বউ এখন তার উপর রাগ ঝাড়বে নিশ্চিত। তাই হলো, নিনীকা চুলের মুঠো ধরলো শক্ত করে। টানতে টানতে ছিঁড়ে ফেলবে অবস্থা।

‘আপনি আমাকে নিয়ে এসেছেন কেন? ওই মহিলার কতো বড় সাহস আমার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলে। ওই মহিলা কি জানে আমি কিভাবে বড় হয়েছি? জানে না তো। কতোবড় সাহস তার।’

ধ্রুব নিনীকাকে ধরতে চেষ্টা করলো। কিন্তু নিনীকা ধরা দিতে নারাজ। মাঝে মধ্যে নিজের চুল খামচে ধরছে। বিছানার বালিশ কাঁথা সব ফেলছে নিচে। ধ্রুব জোর করে চেপে ধরলো। নিনীকা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে অসহায় কন্ঠে শুধালো,

‘আমার কি দোষ মেজর? সবাই কেন আমার মা বাবাকে নিয়ে বাজে কথা বলে? কেন বলে? আমার ভালো লাগে না মেজর। একদম ভালো লাগে না। যা বলার আমাকে বলবে ওরা কেন মা বাবা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে? কেন! কেন! কেন!’

নিনীকা শব্দ করে কাঁদছে। ধ্রুবের নিজেকে অসহায় লাগছে। শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়েছে। মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলছে,

‘হুস কাঁদে না। সে হয়তো বুঝতে পারেনি। দেখবে একদিন তোমাকে যখন বুঝতে পারবে তখন কাছে টেনে নিবে। মন খারাপ করে না মিসেস।’

নিনীকা নাক টানতে টানতে বলল,

‘সে কেন আমাকে কাছে টেনে নিবে? আমি চাই না এসব পাবলিকদের সাথে কখনো দেখা হোক।’

ধ্রুব কিছু বললো না। সত্যি কথা বললে নিনীকা এবার সত্যি সত্যি চুল ছিঁড়ে ফেলবে তার। তবে সে বুঝতে পেরেছে তার বউয়ের নিজের মা বাবাকে নিয়েই কোনো সমস্যা আছে। সেটা সে আগেই আন্দাজ করেছে নিনীকার বাবার নিজের বউয়ের প্রতি ব্যবহার দেখে। কিন্তু গভীরে কি কি সেটা নিনীকার থেকে জানতে হবে। তার বউয়ের সাথে কেউ কোনো অন্যায় করে থাকলে সে ছাড় দিবে না। এক চুল ও না।

নিনীকা কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। দরজায় কেউ টুকা দিচ্ছে। ধ্রুব নিনীকাকে শুইয়ে দিলো। দরজা খুলতেই সুমিত্রা উত্তেজিত হয়ে বলল,

‘নিনীকা কেমন আছে ভাইয়া? একজন মহিলাকে দেখলাম কেমন চিৎকার করে করে রিসিপশনে এসে দাড়িয়েছেন৷ আর বলছেন কে যেন তার সাথে বেয়াদবি করেছে। আমার ক্লাসমেইট রা তখন বলল মেয়েটা নাকি নিনীকা। তারা আমাকে বলতেই আসছিল তখনই আপনি ওকে নিয়ে চলে এসেছেন। ও ঠিক আছে তো ভাইয়া? মেয়েটা মা বাবা নিয়ে কথা শুনতে পারে না। ও অনেক কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই। বলুন না ও ঠিক আছে তো?’

ধ্রুব ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো।

‘রিলাক্স। আপনার বান্ধবী ঠিক আছে। কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে৷ ঘুম থেকে সকালের আগে উঠবে না হয়তো।’

সুমিত্রা বিছানায় ঘুমানো নিনীকাকে দেখে নিলো।তারপর বিদায় নিলো। বলে গেলো সে সকালে এসে দেখে যাবে। যতোই নিনীকা রেগে থাকুক, মেয়েটা তার দিক থেকে ঠিকই আছে।সে নিজে ওই অবস্থায় থাকলে একই ব্যবহার করতো।

ধ্রুব দরজা বন্ধ করে ওয়াশরুমে ঢুকলো। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হওয়া হয়নি তার। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হলো। আজ না-হয় না খাওয়াই থাক দুজন। ধ্রুব বুকে স্থান দিলো তাকে। কপালে দীর্ঘ চুম্বন করলো। ফিসফিস করে বলল,

‘তোমার জন্যে বালিশ নিষিদ্ধ করেছিলাম মিসেস। তবে তুমি মাঝে মধ্যে বালিশে মাথা রাখতে পারো। কিন্তু যখন আমি কাছাকাছি থাকবো তখন রাখতে পারবে না। মনে থাকবে?’

ঘুমন্ত নিনীকার থেকে উত্তর এলো না। জেগে থাকলে সে কি করতো? হয়তো বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে কঠিন একটি কথা ছুঁড়ে দিতো ধ্রুবের উদ্দেশ্যে। এমনই ধারণা করে নিলো ধ্রুব।

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-০৯

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৯
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

( অনুমতি ছাড়া কঠোরভাবে কপি নিষিদ্ধ।)

বেলা হতেই সোনালি রোদ উঁকি দিলো দার্জিলিংয়ের আকাশে। পাহাড় পর্বত গাঢ় সবুজ। আকাশে শুভ্র মেঘ জমে আছে। নীল-সাদা আকাশ সোনালী রোদে ঝলমল করছে। সুমিত্রা ও তার দুজন ক্লাসমেইট বসে আছে বিছানায়। তখনই দরজা ঠেলে ঢুকলো নিনীকা। চোখমুখে মারাত্মক বিরক্তি। সুমিত্রা ঢুক গিললো। নিনীকা শান্ত কন্ঠে শুধু বলল,

‘তুই এটা একদমই ঠিক করিস নি সুমিত্রা। আমি তোকে ক্ষমা করবো না।’

‘নিনীকা ইয়ার..’

নিনীকা হাত দিয়ে থামিয়ে দিলো।

‘তোর কোনো এক্সকিউজ আমি শুনতে চাই না। তুই যা করেছিস তার জন্য তোকে আমার কি কি যে করতে ইচ্ছে করছে তা তুই চিন্তা ও করতে পারবি না। কিন্তু আমি দমে গেছি। অসময়ে তোর সাহায্য পেয়েছি। কিন্তু সে-ই তুই-ই আমাকে যেটা থেকে বের করতে সাহায্য করলি সেটাতেই ঠেলে দিতে দু’বার ভাবলি না। কেন এমন করলি সুমিত্রা? এই তোর বন্ধুত্ব? এটা আমার জন্য তোর গুরুত্ব? এই দিলি প্রতিদান?’

সুমিত্রা কেঁদে ফেললো,

‘বিশ্বাস কর ইয়ার আমি তোর খারাপ চাই না। আমি সবকিছু বুঝে তারপরই করেছি। তুই আমাকে ভুল বুঝছিস। প্লিজ নিনী..এক্সপ্লেইন অল।’

নিনীকা শুনলো না। লাগেজ নিজের হাতে নিয়ে বলল,

‘তাকে আমার ড্রেসও তুই দিয়েছিস। কতো কি করলি। কিন্তু হাহ্, তোদের এসব প্লান সাকসেস হবে না। দেখ আমি কি করি। তোর এই মুখটা আমাকে দেখাস না। চলি।’

নিনীকা ট্রলি টেনে বেরিয়ে গেলো। সুমিত্রা মুখ চেপে কাঁদতে লাগলো। সে তো নিনীকার ভালোর জন্য সব করেছে। নিনীকাকে কষ্টে দেখতে চায় না সে। তবে নিনীকা কেন বুঝলো না? সুমিত্রা কিভাবে তার ক্ষতি হতে পারে এমন কিছু করতে পারে? কিভাবে ভাবলো এটা নিনীকা! এই চিনলো সুমিত্রাকে!

নিনীকা উদভ্রান্তের মতো ট্রলি টেনে নিয়ে যাচ্ছে। গেইটের বাহিরে এক পা রাখার আগেই পেছন থেকে হুংকার ছুড়লো ধ্রুব।

‘এক পাও বাহিরে রাখবে না মিসেস। যেভাবে গেইটের বাহিরে যাওয়ার দুঃসাহস করে হেঁটে গেছো, সেভাবেই হেঁটে পেছনে সরে এসো। নইলে খুবই খারাপ হয়ে যাবে।’

নিনীকা পেছনে ঘুরলো না।

‘কি খারাপ করবেন আপনি আমার? কি-ই বা করতে পারবেন আপনি?’

‘নিনীকা! তুমি যদি আর এক পা বাহিরে রেখেছো তবে এখন এই মুহুর্ত থেকে তুমি আর কখনোই আমাকে দেখতে পাবে না। আমি দেখতে দিবো না।’

নিনীকা বলতে চাইলো,

‘আপনাকে না দেখলে আমি মারা যাবো না।’

কিন্তু বলতে পারলো না। গলার কাছে এসে আঁটকে গেলো। এক পা এক পা করে পিছিয়ে গিয়ে পিঠ লেগে গেলো ধ্রুবের বুকে। ধ্রুব ট্রলি নিজের হাতে নিয়ে নিলো। আরেক হাতে জড়িয়ে ধরলো কোমড়। নিজের বুক করা রুমের দিকে যেতে যেতে বলল,

‘যেটা পারবে না সেটা করতে যা-ও কেন বলো তো মিসেস?’

‘পারবো না কেন? একশোবার পারবো।’

ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো,

‘ তুমি পারবে না মিসেস। এক রাত স্বামীর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েছো। প্রেমে তুমি পড়েছো নিশ্চিত। ‘

নিনীকা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। মনে মনে কিছু কঠিন কথা বলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যাতে করে ধ্রুব ভাবে তার ভাবনাগুলো মিথ্যা। নিনীকা শেখ কখনো প্রেমে পড়তে পারেনা।

কিন্তু আবারও তা গলায় এসে আঁটকে গেলো। সকালে ধ্রুবের মলিন মুখটা বার-বার চোখে ভাসছে। তার কঠিন কথায় মানুষটা কিরকম আঘাত পেয়েছিলো। নিনীকার নিজের প্রতি ক্ষোভ জন্মালো। সে কেন এসব ভাবছে? কেন ভাবছে সে। তার তো এখন ধ্রুবকে কিছু কঠিন কথা বলা উচিত। সে পারছে না কেন, কেন পারছে না!

ধ্রুব তাকে বিছানায় বসিয়ে নিজেও হাঁটু গেঁড়ে বসলো। নিনীকার দু’হাত মুঠোয় নিলো।

‘তার কোনো দোষ নেই। সে তোমার বন্ধু, তোমার ভালো চেয়েই সব করেছে। তুমি তাকে হার্ট করে কথা বলেছো। যখন নিজের ভুল বুঝতে পারবে, তখন স্যরি বলে দিও কেমন?’

নিনীকা অবুঝ হলো কি? বাধ্য মেয়ের মতো মাথা নাড়ালো। ধ্রুব গালে হাত ডুবালো,

‘তুমি কেন পালিয়ে এসেছিলে নিনীকা?’

নিনীকা অবাক হয়ে বলল,

‘সুমিত্রা আপনাকে বলেনি?’

‘না নিনীকা, সে তোমার বন্ধু। তুমি বিশ্বাস করে তাকে বলেছো, সে কেন আমাকে বলবে?’

নিনীকা অনুতপ্ত হলো, সুমিত্রাকে বেশি বেশিই বলে ফেলেছে সে। ধ্রুবের উদ্দেশ্যে বলল,

‘সেটা আমি আপনাকে জানাতে চাই না। লিভ মি।’

‘তোমার নিষ্ঠুর রুপ অনেক কষ্টের মিসেস। তুমি রুড হয়ে গেছো, তার মানে সত্যিই কোনো কারণ আছে যা আমি জানি না। বলো মিসেস, কি জন্য এমন করলে?’

নিনীকা জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। ধ্রুব তাকিয়ে দেখছে তার বউ কিভাবে ফুসফুস করছে। যেকোনো সময় হামলে পড়বে ভাব। ঢুক গিললো সে,

‘বলতে হবে না। শান্ত হও। যখন তোমার মনে হবে আমাকে তুমি নির্দ্বিধায় সব বলে দিতে পারবে, তখনই বরং বলে দিও। কেমন?’

নিনীকা ঘাড় কাত করে সায় জানালো। ধীরে ধীরে সে ঠিক হয়ে গেলো। ধ্রুব ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছাড়লো,

‘তোমার শ্বাশুড়ি স’পরিবারে দার্জিলিংয়ে আসছেন নিনীকা।’

নিনীকার ভ্রু কুঁচকে গেলো।

‘তাতে আমার কি? তিনি নিশ্চয়ই পালিয়ে আসা বউকে আদর যত্ন করতে আসবেন না?’

ধ্রুব হেসে ফেললো,

‘তিনি জানেন তার ছেলে সিঙ্গেল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সুতরাং পালিয়ে আসা বউকে আদর যত্ন করতে আসার কোনো কারণ নেই। তিনি জানেন না তার ছেলে বিবাহিত।’

‘ছেলে বিয়ে করেছে মা জানবে না কেন? মজা নিচ্ছেন? ভাবছেন আপনার মায়ের সামনে উপস্থিত করে অপমান করাবেন?’

‘তুমি চার লাইন বেশি বুঝো কেন? সে বিদেশে ছিল আমার বোনকে নিয়ে। মামারা বিদেশে সেটেল্ড। সেজন্য বিয়ের ব্যাপারটা সে জানে না। বাবা কাউকে জানাননি। তিনি চেয়ে ছিলেন তোমার আমার বিয়েটা তোমাদের বাড়িতে ঘরোয়া ভাবে হয়ে যাবে। তারপর মা এলে তাকে জানিয়ে অনুষ্ঠান করা হবে। আসলে আমারও তখন বিয়ের ইচ্ছে ছিল না। এক প্রকার বাবা জোর করাতে কবুল বলেছি।’

‘ওহ।’

‘আমার নানু বাড়ি কিন্তু ইন্ডিয়াতে নিনীকা। তুমি জানো, আমার জন্মও ইন্ডিয়াতে নানু বাড়িতে। ‘

নিনীকা চুপ করে শুনছে। ধ্রুব বলতে লাগলো,

‘আমার মা ইন্ডিয়াতেই বড় হয়েছেন। সেজন্য ইন্ডিয়ার প্রতি টান বেশি তার। প্রতি বছরই ঘুরতে আসেন। মা বাবার প্রেমটা কিন্তু ইন্ডিয়াতেই হয়েছিল জানো? তারপর বাংলাদেশ টু ইন্ডিয়া বিয়ে। নানা মশাই মারা যাওয়ার পর মামারা বিদেশে সেটেল্ড হয়ে গেছেন। মা সেখানে মাঝে মধ্যে যান মা ভাইকে দেখতে। তারাও বাংলাদেশে আসেন মাঝে মধ্যে।’

‘ভালো তো।’

‘তুমি জানো? আমার..

‘না বললে জানবো কিভাবে?’

ধ্রুব চোখ পাকালো,

‘চুপচাপ শুনবে।’

নিনীকা মাথা নাড়ালো।

‘আমার নানু সেনাবাহিনীর জব করতেন। বাবাকে তিনি পছন্দ করতেন অনেক। সীমান্তে তাদের আলাপ হয়। বাবা নানু বাড়িতে আসা যাওয়া করতেন মাঝে মধ্যে। তারপরই মাকে তার ভালো লাগে। প্রেম হয় দুজনের। কিন্তু বিয়েটা করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। আমার নানু মেয়েকে এতো দূর বিয়ে দিতে নারাজ ছিলেন। কিন্তু মায়ের পাগলামির জন্য রাজি হতে হয় শেষে।’

‘তারপর?’

‘তারপর ব্যস। তাদের বিয়ে হয়। আমি জন্ম নেই। আমার যখন বারো বছর তখন আমার একটি বোন জন্ম নেয়। নাম ফারিন, তুমি দেখোনি তাকে। তবে আজ দেখাবো।’

নিনীকা উঠে দাড়ালো। দরজা ঠেলে যেতে যেতে বলল,

‘আসেপাশে ঘুরে আসছি।’

ধ্রুব চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। তার একটু ঘুমঘুম পাচ্ছে। এ রমনীকে সে পরে দেখে নিবে। ধ্রুবের ঘুমটা দীর্ঘ হলো। বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো।

নিনীকা তখন হোটেলের দিকে ফিরে আসছে। পড়োনে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত একটি স্কার্ট ও টি-শার্ট। পায়ে সাদা কেডস। মাথার টুপি টা হাতে। সে যখন রোদের তাপ থেকে বাঁচতে হোটেলের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, তখন হোটেলের গেইটের কাছে এসে থামে একটি টেক্সি। নিনীকা একটু পিছিয়ে যায়। তার হাঁটার গতি ধীর ছিল নাহলে সে এতোক্ষণে টেক্সির নিচে চাপা পড়তো। গাড়ি থেকে নামলেন স্কার্ট, শার্ট ও গলায় ওড়না পেছানো একজন মধ্যবয়সী মহিলা। তার পায়েও কেডস। ঠোঁটে লিপস্টিকের আস্তরণ। চোখে রোদচশমা। মহিলাটির বয়স বোঝা দুষ্কর। তবে তাকে দেখতে একদমই মন্দ লাগছে না। নিনীকা বুঝলো তিনি তার মতোই ঘুরতে এসেছেন। সে যখন টেক্সিকে পাশ কাটিয়ে চলে যাবে তখনই মহিলাটি তাকে ডাকলেন। সে এগিয়ে এসে দাড়ালো। মহিলাটি ঠোঁট নাড়ালেন,

‘শুনো মেয়ে এখানে সবচেয়ে এক্সক্লুসিভ হোটেলের নাম বলতে পারবে?’

নিনীকা না করলো। সে প্রথমবার এসেছে কিছুই জানে না চিনে না। মহিলাটির তার উত্তর পছন্দ হলো না।

‘জানো না কেন? তুমি জানো এখানকার সবচেয়ে ভালো হলো মাউন্টেন ভিউ রুম।’

নিনীকা বলল,

‘আপনি নিজে যখন জানেন তবে আমাকে জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

‘তুমি তো ভারী বেয়াদব।’

নিনীকা চোখমুখ কুঁচকে তাকালো,

‘আপনি আজাইরা প্রশ্ন করে এ রোদের মধ্যে আমাকে শুধু শুধু দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।’

মহিলা রেগে বোম হয়ে গেলেন। তখন গাড়ির পেছন থেকে ব্যাগপত্র বের করে এসে দাড়িয়েছেন একজন পুরুষ। নিজের বউকে ফুসফুস করতে দেখে চমকে গেলেন। আরও চমকালেন সামনে দাড়ানো মেয়েটিকে দেখে। মেয়েটা এখানে কি করছে!

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-০৮

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

বাংলাদেশের সময় রাত আটটা। ধারা ও ফারিন ব্যাগপত্র গুছাতে ব্যস্ত। ফাহিম মাহবুব খাটে বসে স্ত্রী ও কন্যার কান্ড দেখছেন। মনে মনে বিরবির করে বলছেন,

‘ তোমার আর বউকে নিয়ে লুকিয়ে হানিমুন করা হলো না বাবা। তোমার মা বোন আসছে, পরিবার নিয়ে মুন দেখতে প্রস্তুত হও। ‘

ধারা মাঝে মধ্যে শাড়ি দেখাচ্ছেন।

‘ এটা নেই বলো? এটাতে দার্জিলিংয়ের সাথে ছবি সুন্দর আসবে। আচ্ছা এটা নিবো? ‘

ফাহিম মাহবুবের কাজ হলো মাথা নাড়িয়ে সাই দেওয়া। যদি একবার ভুলবশত মুখ থেকে না বেরিয়েছে তবে তার খবর করে দিবে ধারা আহমেদ। আগামীকাল তারা পথ ধরবেন ইন্ডিয়ার উদ্দেশ্যে।

বয়স হলেও চেহারা দেখে তাকে যথেষ্ট ইয়াং মনে হয়। রমজান শেখ বিদেশি কৃত্রিম জিনিস ব্যবহার করে নিজের হ্যান্ডসাম লুক ধরে রেখেছেন। এই বয়সে এসেও জেন্স পার্লারে তার আনাগোনা প্রতিনিয়ত। একজন পুরুষ নিজের সৌন্দর্যের বিষয়ে এতো পজেসিভ সেটা হয়তো রমজান শেখ কে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মাথার ঘন চুলগুলো ও কালো। মুখে চাপদাড়ি। এ বয়সেও তিনি অসংখ্য অল্প বয়সী মেয়েদের প্রপোজ পান৷ তবে তার একটি বিশেষ গুণ হলো তিনি কখনোই সেগুলোতে সিরিয়াস হোন না। প্রত্যাখ্যান করেন তৎক্ষনাৎ। সাথে কমন ডায়লগ ‘আমি তোমার বাবার বয়সী মেয়ে। তোমার বয়সী আমার একটি মেয়েও আছে, বলে কেটে পড়েন।’

এই একটি মানুষের বহুরুপ। স্ত্রীর সামনে নিজেকে চরিত্রহীন প্রমাণ করা যেন তার অভ্যাস। সেজন্য অসংখ্য বার স্ত্রীর সামনে দিয়ে কতশত রমনীকে রুম অব্দি নিয়ে গেছেন। তার স্ত্রী বিশ্বাসও করেছেন যে তিনি একাধিক নারীর কাছে যান। অথচ রমজান শেখ আত্নবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারবেন, ‘ প্রেম, বিয়ে তিনি যেমন একবারই করেছেন। তেমনই এক নারীকে ছাড়া তিনি কখনো দ্বিতীয় কাউকে ছুয়ে দেখেননি। ‘

পৃথিবীটা রহস্যময়। রহস্যময় এই পৃথিবীতে বাস করে রহস্যময় মস্তিষ্কের মানুষ৷ মানুষেরা আজকাল রহস্য করতে ভালোবাসে। রমজান শেখ নিজেকে রহস্যময় চরিত্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন। পৃথিবী ঠিক কখন কিভাবে তার রহস্য উন্মোচন করবে তা তিনি নিজেও জানেন না৷

সকাল সাড়ে সাতটা। রমজান শেখ নাস্তার টেবিলে খেতে বসেছেন। মিথিলা মাথা নিচু করে প্লেটে নাস্তা তুলে দিচ্ছেন। রমজান শেখ খেতে খেতে লক্ষ্য করলেন স্ত্রীর গলার ভাঁজে একটি লাল হয়ে যাওয়া ব্রাইট। তার মুখে কৌতুকের হাসি। মিথিলা সেটা দেখে বিচলিত হলেন। রমজান শেখ এক হাতে কোমড় জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করলেন,

‘ শেষ বয়স পর্যন্ত স্বামীর সোহাগের চিহ্ন নিয়ে বেঁচে থাকো দোয়া করছি। ‘

মিথিলা কিছু বললেন না। আবারও বললেন রমজান,

‘ তোমার চুলে একটা-দুইটা সাদা চুল দেখা যাচ্ছে। বাড়িতে পার্লারের লোক চলে আসবে, সব ঠিকঠাক করে নিও। ‘

মিথিলা নিরবে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নাড়ালেন।


ননীর পুতুলের মতো দেখতে মেয়েটিকে ঠিক কতক্ষণ ধরে দেখে যাচ্ছে সেদিকে হুস নেই ধ্রুবের৷ তার শুধু মনে আছে তার একটি নির্ঘুম রাত কেটে গেছে বুকে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখে। ধ্রুবের পুরো জীবনে যৌবনে এতো কাছে কোনো মেয়ে আসেনি। এটাই প্রথম৷ তার ভাবনার মধ্যে ননীর পুতুল মেয়েটি কিঞ্চিৎ নড়েচড়ে উঠলো। সে মাথায় আঙুল ডুবিয়ে দিলো। মেয়েটি পরম শান্তিতে ঘুমাতে লাগলো৷ ধ্রুব এই ফাঁকে নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত৷ মেয়েটি জেগে থাকলে ধ্রুবের থেকে দূরে দূরে থাকে৷ যা ধ্রুবের একদম পছন্দ না। বউ তার, বুক তার। বউ কেন তার বুকে মাথা না রেখে দূরে দূরে থাকবে?’

ধ্রুবের ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে তার মুঠোফোন বার্তা আসার শব্দ হলো। সে তৎকালীন সেটা অন করলো৷ তার নিরীহ বাবা লিখেছেন,

‘তোমার মা-বোন ব্যাগপত্র গুছিয়ে আজ দার্জিলিংয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করছেন। আমি চেষ্টা করেছি আটকাতে তবে ব্যার্থ৷ সাবধানে থেকো৷ ধরা পড়ে যেতে পারি বাপ-ছেলে। ‘

ধ্রুব সেন্ট করলো,

‘ ধরা পড়বো কেন? আমি কি চুরি করেছি? বিয়ে করেছি, বউকে নিতে এসেছি। মা জেনে গেলে আরও ভালো। আমার বউকে শীগ্রই ঘরে তুলার ব্যবস্থা করবেন তিনি। ‘

ফাহিম মাহবুব একটি কাঁদার ইমোজি দিলেন। লিখলেন,

‘আর আমার উপর দিয়ে যে বন্যা, সাইক্লোন, খরা যাবে তার দায়িত্ব কে নিবে বাবা? ‘

ধ্রুব রিপ্লাই দিলো না। বরং মনোযোগ দিলো ননীর পুতুলকে দেখতে। মা কেন পৃথিবী জানুক নিনীকা শেখ নামক রমনীটি তার বউ, মেজর ধ্রুব মাহবুব এর মিসেস।

নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। ধ্রুবের নজর তার দিকেই। এলোমেলো অগোছালো চুলগুলো ধ্রুবের বুকে লেপটানো। কিছুটা আটকে আছে শার্টের বোতামে। নিনীকা সেটা খেয়াল করলো না। উঠে বসতে গিয়ে চুলে ব্যাথা পেলো। পুনরায় শুয়ে পড়লো বক্ষে। ধ্রুব গম্ভীর স্বরে বলল,

‘এতো তাড়াহুড়ো কিসের? সবে তো আটটা বাজে। আরেকটু থাকো। দশটার পর উঠে একসাথে ফ্রেশ হয়ে খাবো। ‘

নিনীকা প্রচন্ড জোরে চুল টেনে ছাড়িয়ে নিলো। কিছু চুল ছিঁড়ে আটকে গেছে ধ্রুবের বোতামে। সে ওয়াশরুমের দরজা শব্দ করে বন্ধ করে দিলো। ধ্রুব রেগে উঠে বসলো। শার্টের বোতাম থেকে চুলগুলো না ছুটিয়ে শার্ট টাই খুলে ছুঁড়ে ফেললো বিছানার একপাশে। খাট থেকে নেমে দ্রুত গতিতে এসে দাড়ালো ওয়াশরুমের দরজার সামনে। প্রায় চিৎকার করলো,

‘তোমার সাহস কি করে হয় আমার বউয়ের চুল ছিঁড়ার? বের হও স্টুপিট মেয়ে তোমাকে আমি চেপ্টা করে ছাড়বো। বের হও বলছি। ‘

নিনীকার মুখে ব্রাশ। কুলি করে সে আস্তে করে বলল,

‘আমার চুল আমি যা ইচ্ছে করবো আপনার কি? ‘

‘তোমার চুল হলেও তা তোমার নয়। তোমার সবকিছু আমার, আমার বউয়ের চুল ছিঁড়ার দুঃসাহস করার অপরাধে তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। বের হও এক্ষুনি। ‘

বিরক্তিতে নিনীকার চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। ফ্রেশ হয়ে তবেই দরজা খুলে বের হলো। ধ্রুবকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে ধ্রুব হাত টেনে ধরলো শক্ত করে। তীব্র ক্ষোভ নিয়ে বলল,

‘ বেশি করে ফেলছো না? আমি তোমার কে হই ভুলে যাও কেন? ‘

নিনীকা পূর্ণ চাহনিতে তাকালো,

‘ আপনারা পুরুষেরা নারীদের কি জড়বস্তু মনে করেন? পুতুল মনে হয় নারীদের? আপনাদের যা ইচ্ছে তাই করাবেন? নারীদের কোনো ইচ্ছে থাকতে পারে না? ‘

ধ্রুব এক মুহুর্ত থমকালো। নিনীকা বলতে লাগলো,

‘ কথা বলছেন না কেন? উত্তর নেই? ‘

ধ্রুব কেমন করে যেন তাকালো।

‘তুমি ভুল বুঝছো। আমি তোমাকে একদমই পুতুল মনে করছি না। তবে তুমি সত্যিই ননীর পুতুল। তবে সেটা ভালোবাসার। আমি কখনোই তোমাকে জড়বস্তু বানাতে চাই না। আমি যেমন তোমার উপর অধিকার দেখাই, তেমনই তুমিও আমার উপর অধিকার দেখাবে। ভালোবাসার অধিকার। আমি তোমার স্বামী নিনীকা।’

‘আমি তো আপনাকে ভালোবাসি না মিস্টার মেজর। অধিকার দেখানোর কথা তবে কেন আসছে?’

চির সত্য। সত্যি কথাটা হজম করতে ধ্রুবের বড্ড কষ্ট হলো। আঘাত পেলো মনে। কিন্তু মুখ স্বাভাবিক রাখলো।

‘ আজ ভালোবাসো না কাল যে বাসবে না সেরকম কোনো সত্য নেই। মনে রেখো তোমার আমার সম্পর্ক পবিত্র। পবিত্র সম্পর্কে ভালোবাসতে হয় না। ভালোবাসাটা হয়ে যায়৷ তুমি কিভাবে কখন আমাকে ভালোবেসে ফেলবে তুমি নিজেও বুঝতে পারবে না। দেখে নিও। এই মিস্টার মেজর তোমাকে বলছে। ‘

নিনীকা চুপ করে বিছানায় বসে রইলো। ধ্রুব ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে গিয়ে খাবার নিয়ে এলো। ইচ্ছে ছিল দুজন একসাথে বেরিয়ে যাবে। তারপর নাস্তা করবে। কিন্তু নিনীকা তার মুডটা নষ্ট করে দিলো। মেয়েটাকে সে কিভাবে বুঝাবে সে ভালোবাসতে শুরু করেছে!’

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-০৭

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৭
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

দুপুরের হওয়া ঝিরঝিরি বৃষ্টিতে দার্জিলিংয়ের শুকনো মাটি কাদা হয়ে গেছে। তার উপর দিয়ে স্কার্টের দু’দিক উঁচু করে দৌড়ে যাচ্ছে একটি মেয়ে। নাম তার নিনীকা। ধ্রুব মাহবুব এর ননীর পুতুল।

মেয়েটি কাদায় পা পিছলে ধপাস করে পড়ে গেলো। চোখমুখ খিঁচে ব্যথা সহ্য করলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো কিছু মিনিট আগেই ‘শালা’ বলে সম্মোধন করা তার বর কাছাকাছি চলে এসেছে। নিনীকা তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। কিন্তু পারলো না। বরং হুমড়ি খেয়ে আরেকটু সামনে জমে থাকা পানি যুক্ত কাদামাটিতে পড়লো। সুন্দর মুখটি কাঁদা পানিতে ঢেকে গেলো। ততোক্ষণে এগিয়ে এসেছে তার বরটি। হাতে নিনীকার স্মার্টফোন। যেটা কিছুক্ষণ আগে কেঁড়ে নিয়েছিলো। নিনীকার বর মশাই ডেনিম প্যান্টের পকেটে সেটা রাখলো। চুলে ঢেকে যাওয়া চোখমুখ, তবুও সে পিটপিট করে দেখলো একজোড়া কালো শার্ট পড়া হাত তাকে টেনে নিজের কোলে তুলে নিয়েছে।

নিনীকা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো। আকাশ থেকে বজ্রপাত ধরনীতে নামুক। পৃথিবী থমকে যাক। সে অজ্ঞান হয়ে যাক। এসব মিথ্যা হোক।

ভাবনার মাঝে নিজের মুখের উপর গরম নিঃশ্বাস অনুভব করলো সে। পুরুষটি ফিসফিস করে বলল,

‘ বরকে শালা হনুমান বলে পালাতে চাইলে এমনি হবে মিসেস। স্বামী সোহাগি হও, তা না পালিয়ে বেড়াচ্ছো! মেজর ধ্রুব মাহবুবকে চিট করার অপরাধে তোমাকে আমৃত্যু দন্ডে দণ্ডিত করলাম। তুমি চাও বা না চাও সারাজীবন তোমাকে ধ্রুব মাহবুব এর বুকেই মাথা রাখতে হবে। আজ থেকে বিছানার বালিশ তোমার জন্য নিষিদ্ধ করলাম। ‘

নিনীকার কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে তবুও চোখ মেললো না। ধ্রুব ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে হোটেলে বুক করা রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। রিসিপশনে পা রাখতেই বিকালের সেই রিসেপশনিস্টকে দেখতে পাওয়া গেলো। সে এদিকেই তাকিয়ে আছে। ধ্রুব যখন রিসিপশন পেরিয়ে যাবে তখন সে উচ্ছ্বাস নিয়ে বলল,

‘মেজর সাব এ কোন হে? আপকি বিবি?’

ধ্রুব যেতে যেতে উত্তর দিলো,

‘ হ্যাঁ হামারি মিসেস। ‘

ধ্রুব রুমের দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। নিনীকাকে সোজা ওয়াশরুমে নামিয়ে দিলো। নিনীকা দেয়াল ঘেষে মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। চুলে চোখমুখ ঢেকে রেখেছে। ধ্রুব যত্ন করে চুল কানে গুঁজে দিলো। গালে হাত রেখে বলল,

‘ ফ্রেশ হয়ে নাও। তোমার জামাকাপড় এনে দিচ্ছি। ‘

ধ্রুব এক মিনিটের মাথায় এনে দিলো। বেরিয়ে যেতেই নিনীকা শব্দ করে দরজা বন্ধ করলো। বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। তার মিসেসের সংস্পর্শে আসার পর থেকে সে শুধু হেসে যাচ্ছে। হয়তো তার উপস্থিতি ধ্রুবর ভালো লাগছে। ভালো লাগা থেকে ভালোবাসা হতেও সময় নিবে না। পবিত্র সম্পর্ক তাদের। নিনীকা শেখ কে সে নিজের প্রতি দূর্বল করেই ছাড়বে। তখন দেখবে কিভাবে বর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

বিশ মিনিট পর নিনীকা নিজের দিকে চোখ রেখে বের হলো। ধ্রুব দাড়িয়ে তখনো। নিনীকার হাত টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। গালে হাত ডুবিয়ে অপলক তাকিয়ে তাকলো।

‘তাকাবে না? দেখবে না আমায় মিসেস?’

নিনীকা তাকাচ্ছে না। ধ্রুব মন খারাপ করলো,

‘ বাবার কথাই কি তবে সত্যি? তুমি আমাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছো? ‘

নিনীকা এবার চোখ তুলে তাকালো। ধ্রুব উত্তরের আশায় নিজেও তাকিয়ে আছে। কিন্তু নিনীকা কিছু বলছে না। শুধু তাকিয়ে আছে। হয়তো নিজের বিয়ে করা বরকে দেখছে। যাকে না দেখে সে পালিয়ে এসেছিল। সময় অতিক্রম হলো। নিনীকা প্রায় চার মিনিট পর মুখ খুললো,

‘ চেহারা আপনার মাশাআল্লাহ৷ ভয় নয় আপনাকে দেখলে প্রেমে পড়া যায়৷ কিন্তু আমি তো আপনাকে দেখিই-নি। সুতরাং আপনাকে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি সেরকম কোনো কারণ নেই। আপনার বাবার বলা কথাটি অবান্তর। ‘

কি সুন্দর! গোছানো কথা। ধ্রুব মুগ্ধ হয়ে শুনলো। তার বউ মিষ্টি করে গুছিয়ে কথা বলে। অথচ তখন বরের কথা জিজ্ঞেস করায় কি না কি বলেছিলো। হয়তো বেচারি ভাবতেই পারেনি সামনে দাঁড়ানো পুরুষটা তার নিজেরই বর হবে।

‘ তাহলে কিসের জন্য পালিয়ে এসেছিলে? তা-ও বিয়ে করে! ‘

‘ আপনাকে বলতে বাধ্য নই। ‘

মুখের উপর জবাব পেয়ে ধ্রুবের চোয়াল কঠিন হলো। নিনীকা পুনরায় বলল,

‘ আপনি আমার কাছে এসেছেন কেন? কেন এসেছেন? আপনার সাথে সংসার করার ইচ্ছে থাকলে আমি তো পালাতাম না। সুন্দর চেহারা হ্যান্ডসাম আছেন, মেয়ের অভাব হবে না। অন্য কাউকে দেখে বিয়ে করে নিতেন। ‘

ধ্রুব চোখমুখ শক্ত করে কথা হজম করলো। নিনীকা বেরিয়ে যেতে চাইলে ধ্রুব হাত আঁকড়ে ধরলো শক্ত করে। শক্ত কন্ঠে বলল,

‘অনেক বলে ফেলেছো। খেয়ে ঘুম দিবে আমার সাথে। কথা বলতেও এনার্জি প্রয়োজন। বাকিটা ঘুম থেকে উঠে রিলাক্স হয়ে বলবে। যদি কিছু ভুলে যাও আমি মনে করিয়ে দিবো না-হয় মিসেস।’

নিনীকা রাগে ফুসফুস করতে লাগলো।

‘আপনি কেন বুঝতে পারছেনা না?’

‘কি বুঝাতে চাও তুমি মিসেস?’

‘আমি..আমি চাইছি না আপনাকে। ইনফেক্ট কাউকেই না। আমি যদি কাউকে লাইফে চাইতাম তবে সেদিন বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরও পালিয়ে আসতাম না।’

ধ্রুব ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে চুপ করিয়ে দিলো। নিনীকা কেঁপে উঠলো। পুরুষালী শক্ত হাতটি তাকে নিয়ে বসালো বিছানায়। ছোট্ট টেবিল থেকে ঢেকে রাখা খাবার হাতে তুলে নিলো। নিনীকা বুঝলো সে যখন ওয়াশরুমে ছিল তখন ধ্রুব খাবারের ব্যবস্থা করেছে। ধ্রুব ভাত মাখিয়ে নিজের বড় হাতের মুঠোয় বড় লোকমা নিনীকার মুখের সামনে ধরলো। নিনীকা চোখ বড়বড় করে বলল,

‘এতো বড় লোকমা আমার মুখ দিয়েই তো ঢুকবে না, খাওয়া তো পরের ব্যাপার।’

ধ্রুব ঠেসেঠুসে ঢুকিয়ে দিলো। নিনীকার গিলতে বড্ড কষ্ট হলো। কথা বলতে না পেরে চোখ দিয়ে শাসাতে চেষ্টা করলো কিঞ্চিৎ। ধ্রুব একের পর এক বড় লোকমা খাইয়ে তবেই থামলো। নিনীকার মনে হলো তার পেট এখনই ফেঁটে যাবে। ধ্রুব ঠোঁট বাকিয়ে বলল,

‘স্লিম হওয়ার জন্য কম কম খাওয়ার দরকার নেই। তোমার হাসবেন্ড স্লিম থাকলেও তোমাকে ভালোবাসবে, মোটা হলেও তোমাকেই ভালবাসবে মিসেস।’

নিনীকার মাথা ঘুরতে লাগলো। সে কোন জনমে নিজের হাসবেন্ডের কথা ভেবে কম খেয়ে স্লিম হতে চেষ্টা করেছে?’

নিনীকার ভাবনার মধ্যে ধ্রুব হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এসেছে। নিনীকার পাশে পা তুলে বসলো সাহেব হয়ে। হাতের মুঠোয় হাত নিয়ে বলল,

‘নিয়ম যদি বলি তো আজ আমাদের প্রথম রাত। সেজন্য বাসর রাত ধরে নেওয়া যেতে পারে। তোমার হাসবেন্ড তোমার জন্যে অলওয়েজ রেডি মিসেস। তুমি কি ইন্টারেস্টেড?’

নিনীকার চোখমুখ গরম হয়ে গেলো। এ কেমন নির্লজ্জ স্বামী তার?

ধ্রুব পুনরায় বলল,

‘লজ্জা পাবে না, আমিই তো তোমার লজ্জা ভাঙাবো বলো?’

‘আপনি চুপ করবেন?’

ধ্রুব ঠোঁট উল্টালো,

‘বলছো না কেন?’

নিনীকা মহা’বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘কোনো ইন্টারেস্ট নেই, আপনি ঘুমিয়ে যেতে পারেন।’

‘ঘুমিয়ে যাবো? ঠিক আছে।’

একটা বালিশ নিজের কোমড়ের নিচে রেখে আরেকটা মাঝামাঝিতে রাখলো সে। শুয়ে বুক পেতে নিনীকাকে ইশারা করলো।

‘বলেছিলাম না তোমার জন্য বালিশ নিষিদ্ধ?’

নিনীকা ঢুক গিললো। এ কেমন জ্বালা? যেটা থেকে সে পালিয়ে বেড়াতে চেষ্টা করলো সেটাই তার সামনে। তাকেও মায়ের মতো স্বামীর সবকিছু মানতে হবে নাকি? নিনীকা পারবে না সেটা। সে প্রতিবাদী মেয়ে। এই শালা যদি বেশি বাড়াবাড়ি করে তবে সে এখানকার স্থানীয় পুলিশকে জানাবে। বলবে এ বেটা মেয়ে ধরা।’

ধ্রুব তখনও ইশারা করেই যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ঠোঁট চোকা করতে দেখা যাচ্ছে তাকে। নিনীকা নাক-মুখ কুঁচকে বলল,

‘এমন অশ্লীল ইঙ্গিত দিবেন না। ভালো ছেলেরা এসব দেয় না।’

ধ্রুব নিরীহ চোখে তাকালো,

‘বউয়ের কাছে তো ভালো ছেলে হতে নেই।’

‘কে বলেছে?’

‘ ও মাই গড মিসেস। তুমি জানো না? পৃথিবীর সব চাইতে ভালো ইনোসেন্ট ছেলেটিও বউয়ের কাছে নির্লজ্জ হয়।’

নিনীকা কিছু বললো না। আস্তে করে মাথা রাখলো বক্ষে। চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে রইলো। মনে মনে বিরবির করলো, ‘ঘুম আয়, ঘুম আয়।’

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-০৬

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৬
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

স্বামীর পেছনে ঘুরঘুর করছেন ধারা। উদ্দেশ্য নিজের ইচ্ছে পূরণ করা। ফাহিম মাহবুব তেমন পাত্তা দিচ্ছেন না। তিনি জানেন তার সঙ্গীনি কেন ঘুরঘুর করছেন। নিশ্চয়ই কোনো মতলব আছে। তার কথাটা সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে ধারা পাশে বসলেন। কাঁধে হাত রেখে আহ্লাদী কন্ঠে বললেন,

‘এই শুনো না।’

ফাহিম মাহবুব মুখে হাসি ফুটালেন। নাহলে বউ ফায়ার করে দিবে।

‘বলো শুনছি।’

‘চলো না ইন্ডিয়া যাই?’

ফাহিম মাহবুব চোখ বড়বড় করে তাকালেন।

‘সেখানে কে আছে তোমার?

‘আরে ঘুরতে যাবো। এ সময় দার্জিলিং ঘুরাটা উপভোগ করতে পারবো। চলো না যা-ই?’

‘না যাবে না। এখন তো অবশ্যই না।’

‘কেন কেন?’

ফাহিম মাহবুব ঢুক গিললেন। এই রমনীকে কিভাবে বুঝাবেন তাকে নিয়ে ইন্ডিয়া যাওয়া এখন বিপদ জনক হবে। ধ্রুব বার-বার না করেছে এই সময় তার পরিবারের কেউ যেনো ইন্ডিয়াতে পা না রাখে।

ধারা মানতে নারাজ। ফাহিম মাহবুবের শার্ট ধরে ঝুলে আছেন রীতিমতো। ফাহিম মাহবুব শব্দ করে হাসছেন। এই মহিলা এখনো অল্প বয়সী মেয়েদের মতো আবদার করে, পূরণ না করলে ঝুলাঝুলি করা তার স্বভাব। এতে ফাহিম মাহবুব বিয়ের আগে প্রেম চলাকালীন থেকে অভ্যস্ত। ধারার দল ভারী করতে সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো কিশোরী মেয়েটি। পড়োনে স্কুল ড্রেস। ব্যাগটা সোফায় রেখে সে-ও মায়ের মতো করে বাবার আরেকদিক ধরে ঝুলাঝুলি করা শুরু করেছে। ফাহিম মাহবুব বুঝলেন এই দু’রমনী আগে থেকে সব ভেবে নিয়ে শক্ত হাতে মাঠে নেমেছে। তিনি রাজি হওয়া ছাড়া উপায় নেই।

ফাহিম মাহবুব মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন,

‘প্রিন্সেস ও প্রিন্সেসের মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে ফাহিম মাহবুব প্রস্তুত।’

কিশোরী মেয়েটি জড়িয়ে ধরলো মা বাবাকে।

‘আ’ম সো হ্যাপি মাম্মি পাপা।’

ধারা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললেন,

‘টেবিলে খাবার গরম করে রাখছি, বাবাকে নিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে বসো ফারিন।’

ফারিন নিজের বাবার হাত কাঁধে নিয়ে টেনে টেনে উপরে নিয়ে গেলো। বাবাকে ফ্রেশ হতে বলে নিজেও ড্রেস চেঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামলো। খেতে খেতে মন খারাপ করে বলল,

‘আমাদের ফ্যামিলি ট্রিপটাতে ভাইয়া থাকবে না পাপা?’

ধারা’র ও মন খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেটা তার সারাবছরই কাজে ব্যস্ত থাকে। জীবনটা ঠিকঠাক উপভোগ করবে ট্যুর দিবে তা না। তিনি বাবা দাদার মতো দেশরক্ষা করতে চান।

ফাহিম মাহবুব খেতে খেতে বললেন,

‘এবার সে থাকছে না, তবে পরেরবার থেকে থাকবে। সাথে আরেকজনও যোগ হতে পারে।’

ধারার ভ্রু কুঁচকে গেলো,

‘আরেকজনটা কে?’

‘তোমার ছেলেকে কি বিয়ে করাবে না?’

ধারাকে এবার খুশি হতে দেখা গেলো।

‘ধ্রুব এইবার বাসায় ফিরুক। বিয়ে করিয়েই ছাড়বো। যদি দরকার হয় বউ নিয়ে সেনানিবাসে থাকবে। তবুও ওকে বিয়ে করতে হবে।’

ফারিন খিলখিল করে হাসলো।

‘সেনানিবাসে বউকে কিভাবে রাখবে মা?’

‘সেনানিবাসে না হোক। ও যেখানে কাজে থাকবে সেখানে বাংলো বা কোয়ার্টার তো থাকবেই। নিজের সাথে রাখবে। কি না কি খায়, আমার বাচ্চাটা তার বাবার মতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতে চায় না।’

ফাহিম মাহবুব কিছু বললেন না। ধারা নামক রমনী জানেন সেনাবাহিনীদের কি কি চিবিয়ে খেতে হয়। তার স্বামীও দীর্ঘ জীবন সেগুলোই চিবিয়ে এসেছেন। বাড়িতেই শুধু বউয়ের রান্না জুটতো। অন্য কোথাও তো আর জুটতো না। তবে ধ্রুব ও ফারিন যখন ছোট তখন তার যেখানে কাজ থাকতো সেখানের কোয়ার্টার বা বাংলোতে থাকতেন ছেলেমেয়ে নিয়ে। কখনো বান্দরবান, কখনো খাগড়াছড়ি। বাংলাদেশের কোনো অঞ্চল বাদ যায়নি।

ফ্রেশ হয়ে একটু রেস্ট নিয়ে নিলো তারা। গোধুলি বিকাল। পেট জানান দিলো খাবারের। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো বলে। আজকের সন্ধ্যাটা না-হয় দার্জিলিংয়ের স্ট্রিট ফুড খেয়ে এনজয় করা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নিনীকারা চারজন বের হয়ে পড়েছে। নিনীকার পড়োনে লং স্কার্ট ও সাদা শার্ট। গলায় একটি ছোট্ট স্কার্ফ ঝুলছে। কানে সাদা ছোট্ট টপ৷ সে হালকা গোলাপি রঙা ঠোঁট নাড়িয়ে সুমিত্রাকে বলল,

‘যতোই চারিদিক অন্ধকার হচ্ছে ততোই যেনো সৌন্দর্য বেড়ে যাচ্ছে।’

নিনীকা যখন মুগ্ধ চোখে দূরের পাহাড় পর্বত গুলোর বুকে অন্ধকার আকাশ দেখে মুগ্ধ হচ্ছে তখন তাকে দূর থেকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছে কেউ। মানুষটি প্যান্টে হাত গুঁজে দাড়িয়ে। চশমার আড়ালে থাকা চোখদুটো রমনীর দিকেই নিবদ্ধ। ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হাসছে সে। বিরবির করে বলল,

‘মিসেস তিনমাস কম সময় না। অনেক জ্বালিয়েছেন। মেজর ধ্রুব মাহবুব’কে বউহীন করার অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত হতে হবে। দুঃখে হোক সুখে হোক মুখ লুকাতে হবে ধ্রুব মাহবুব এর বুকে।’

নিনীকা যখন মুগ্ধ হয়ে সব দেখছে, তখনই তাকে একা রেখে তিনজন অন্যদিকে চলে গেলো। বউকে একা পেয়ে ধ্রুব এগিয়ে এলো। নিনীকা হঠাৎ নিজের সামনে চওড়া বলিষ্ঠ শরীরের কোনো পুরুষকে দেখে চমকে গেলো। পেছনে একবার তাকিয়ে খুজলো সঙ্গীদের। ধ্রুব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

‘হাই মিসেস।’

নিনীকা সম্মোধনটা খেয়ালই করেনি। সে-ও হাসিমুখে হাই জানালো। ধ্রুব হাস্কি স্বরে বলল,

‘আপনাকে নিতে এলাম যে।’

নিনীকা এবার ঢ্যাবঢ্যাব করে তাকালো।

‘আমাকে নিতে এলেন মানে?’

ধ্রুব এবার চোখমুখ গম্ভীর করলো,

‘অবাক হওয়ার কি আছে? আমিই তো নিতে আসবো। আমারই আসার কথা।’

নিনীকা বিরক্ত হলো। এদেশের ছেলেরা মজা করতে পছন্দ করে নাকি?

‘দেখুন ভাই আমি মজার মুডে নেই। আমার তিনজন সঙ্গীকে খুজে পাচ্ছি না। আপনি যদি আপনার মুখটা বন্ধ করেন তবে আমি তাদের ফোন করে খুঁজে নিতে পারি।’

ধ্রুব নিনীকার হাত থেকে মোবাইল কেঁড়ে নিলো তৎক্ষনাৎ।

‘তুমি আমার সাথে যাবে মিসেস।’

নিনীকা ঢুক গিললো।

‘দেখুন আপনি যদি ছিনতাইকারী হোন তো ফোন নিয়ে নিন, কিন্তু আমাকে ছেড়ে দিন। ‘

ধ্রুব নিনীকার ভয় পাওয়া মুখ দেখে নিঃশব্দে হাসলো। তার বাবা বলেছিলেন বউয়ের সামনে হাসার চেষ্টা করতে। ধ্রুবর চেষ্টা করতে হয়নি হাসি নিজ থেকেই এসে যাচ্ছে।

‘আমি কোনো ছিনতাইকারী না। তবে তোমাকে ছিনতাই করবো মিসেস।’

নিনীকা বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘কি তখন থেকে মিসেস মিসেস লাগিয়ে রেখেছেন। আপনার মিসেস কি হারিয়ে গেছে? নাকি আপনি তাকে খুঁজে পাচ্ছেন না? অতি শোকে পাগল হয়ে গেছেন নাকি? আহারে বউ পাগল লোকটা। আপনার মিসেসের ছবি দিন আমি আমার ফ্রেন্ডসদের নিয়ে খুঁজবো।’

ধ্রুব এবার নিনীকার হাত চেপে ধরে হোটেলের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো। নিনীকা মৃদুস্বরে চিৎকার করলো,

‘কি করছেন আপনি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?’

ধ্রুব কিছু বলছে না। নিনীকা হুমকি দিলো,

‘আমি কিন্তু চিৎকার করবো।’

ধ্রুবর গলা শুনা গেলো,

‘করো, বউকে নিয়ে যাচ্ছি তাতে কার কি?’

নিনীকার মুখ কাঁদোকাঁদো,

‘আপনার বউটা কে মশাই? আমার মতো সিঙ্গেল মেয়েকে কেন বার-বার বউ বলছেন?’

ধ্রুব পেছন ফিরে অবাক স্বরে বলল,

‘তুমি সিঙ্গেল?’

নিনীকা ‘হ্যা.. বলতে গিয়েও চুপসে গেলো। মনে পড়লো নিজের রুমে বিয়ের সাজে মুখ দিয়ে কবুল বলার কথা। হাত দিয়ে সিগনেচার ও করেছে সে।

নিনীকাকে চুপ হতে দেখে ধ্রুব ঠোঁট বাকালো।

‘চুপ হয়ে গেলে যে?’

‘আপনি কি চাইছেন বলুন তো? কে আপনি?’

ধ্রুব এবার দু’কাধ ধরে নিজের সাথে চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘কেন নাটক করছো মিসেস?’

‘আমি কোনো নাটক করছি না আমি সত্যিই জানি না আপনি কে।’

নিনীকার স্পষ্ট উত্তরে ধ্রুব কিছু একটা ভেবে বলল,

‘তুমি বিবাহিত না?’

নিনীকা এক মুহুর্ত থমকে গেলো। তারপর মিনমিন করে বলল,

‘হয়তো, কিন্তু তাতে আপনার কি?’

‘আমার কিছু না বলছো?’

নিনীকার রাগ বিরক্তি সব হচ্ছে। কিন্তু ভয়ে বলতে পারছে না। কি শক্ত শরীর বাবাগো। তাকে চেপ্টা করে দিতে সময় নিবে না।

‘আমার বিবাহিত হওয়ার সাথে আপনার কিছু না হওয়ার কি সম্পর্ক জি?’

‘তোমার বর কে নিনীকা শেখ?’

নিনীকার সবকিছু থেকে বিরক্তি ঝড়ে পড়লো।

‘কে জানে কোন শালা, আমি দেখিনি। তবে হবে কোনো হনুমান। আপনি তার কথা জিজ্ঞেস করছেন কেন?’

ধ্রুবের মাথায় বাজ পড়লো। তার বউ যে তাকেও ছাড়িয়ে গেছে তাতে আর কোনো সন্দেহ নেই। প্রায় চিৎকার করে বলল,

‘ ও মাই গড ও মাই গড তুমি আমাকে শালা বললে মিসেস। আমি দেখতে হনুমানের মতো? ‘

নিনীকার মুখ হা হয়ে গেলো। ধ্রুবের দিকে আর চোখ তুলে তাকাতে পারলো না। হা করা মুখটা বন্ধ করে স্কার্টটা দু’দিকে ধরে দৌড় দিলো জান হাতে নিয়ে।

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-০৫

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব-০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

শরৎকাল। ঝিরঝির বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে রেখেছে নিনীকা। মনটা তার বড়োই বিষন্ন। আজকাল কিছু ভালো লাগে না। এদেশের মাটিতে তার তিন মাস পূরণ হয়েছে। মনটা এখন একটু বেশিই বিষন্ন থাকে। বৃষ্টি এলে মনে পড়ে মা’কে। তার মা মিথিলা ভীষণ বৃষ্টি পছন্দ করতেন। মায়ের মুখে সে গল্প শুনেছে। তার বাবা আর মা তখন কিশোর বয়সের। ক্লাসমেইট হওয়ার দরুন তাদের টুকটাক কথা হতো। তার বাবা ক্লাসমেইট মিথিলার প্রেমে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। পড়াশোনা বিষয়ে আলাপ করতে এসে চোরা চোখে দেখে মন শান্ত করতেন। বৃষ্টিতে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতেন এক পলক দেখার জন্য। তখনকার দিনে সব কঠিন। নানু ভাই ছিলেন কঠিন মানুষ। দিনরাত তার মেয়ের জন্য কোনো ছেলে এখানে সেখানে দাড়িয়ে থাকছে তা তার কানে পৌঁছাতে সময় নিলো না। ছেলেটির ব্যাপারে খুঁজ নিলেন। সামান্য কিশোর হয়ে কি না তার ওমন সুন্দরী বাচ্চা মেয়েটাকে টাংকি মারতে চেষ্টা করছে। এ বড় আশ্চর্য ঘটনা। নানু ভাই ছিলেন আরও উপরে। তিনি ছেলেটাকে কিছু বললেন না। দিনের পর দিন রমজান মিথিলার প্রতি দূর্বল হতে থাকেন। এক পর্যায়ে মিথিলা ও দূর্বল হয়ে পড়েন। তাদের মধ্যে শুরু হয় একটি সম্পর্ক। প্রেয়সীকে দেখতে মানুষটা কখনো মাঝরাতে বাড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকতো। কখনো বা স্কুল ছুটির পর। কলেজে উঠে দুজন যখন আলাদা প্রতিষ্ঠানে তখন রমজানের পাগল প্রায় অবস্থা। প্রেয়সীকে দেখতে না পেরে তার মন শরীর সব যেনো নেতিয়ে গেছে। কলেজের হোস্টেল থেকে লুকিয়ে চলে আসলেন এক পলক দেখার আশায়। মিথিলা তখন তার বাড়ির পাশেরই একটা কলেজে পড়েন। কলেজ ছুটির পর বেরিয়ে রাস্তার চায়ের দোকানের সামনে অ-পরিপাটি অগোছালো ছেলেটিকে দেখতে পেয়ে থমকান। মানুষটি এতো পাগল কেন? যে-ই রমজান শেখ এক কালে মিথিলার মধ্যে নিজের প্রাণ খুঁজে পেতেন, যাকে আগলে রাখতে সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করতেন। যার গায়ে সামান্য মশা বসলেও তিনি ব্যথা পেতেন, সেই তিনিই এক সময় প্রেয়সীর প্রতি অমানুষিক অত্যাচার শুরু করেন। কেন করেন? জানা নেই নিনীকার। মা কখনো বলেননি। সবসময়ই এড়িয়ে গেছেন। মিথিলা বড়ো শখ করে আহ্লাদ করে ডাকতেন। বলতেন,

‘ আমাকে এতো ভালোবাসো কেন গো শেখ বাবু? অতি ভালো বেসো না গো। নাহলে যে ভালোবাসা কমিয়ে দিলে আমি বড়োই কষ্ট পাবো। ‘

মিথিলার কথাটা লেগে গেছিলো হয়তো। তার শেখ বাবু তাকে ভালোবাসা কমিয়ে দিলো। পরিবর্তে ছুড়লো একের পর এক কাঁটার আঘাত।

‘ নিনীকা ইয়ার ’

নিনীকা ভাবনা ছেড়ে বের হলো। সুমিত্রা হাসি-হাসি মুখে দাড়িয়ে আছে। হাতে একটি ব্যাগ। সে নিনীকার কাঁধ জড়িয়ে ধরলো।

‘ভালো কয়েকটা কাপড় গুছিয়ে নে, আমরা ঘুরতে যাবো। ফাস্ট।’

নিনীকা অবাক হলো।

‘হঠাৎ?

সুমিত্রা ভেংচি দিলো,

‘তোর যে ভালো লাগে না আমি কি জানি না? ঘুরলে মন ফ্রেশ হবে বুঝেছিস? তাছাড়া এখন তো আপাতত কিছু নেই। পূজার বন্ধ। সুতরাং ফ্রি আছি যখন তখন ঘুরে আসি না প্রব্লেম কি? ‘

নিনীকা অবাক হলো না। মেয়েটা তার এতো খেয়াল রাখে। নিনীকার নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হয়। নিনীকা রেডি হয়ে নিলো। সুমিত্রা নিজেই ওর কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে। দুজন যখন হোস্টেল থেকে বের হলো তখন নিনীকা প্রশ্ন করলো,

‘ কোথায় ঘুরতে যাচ্ছি? ‘

‘দার্জিলিং।’

‘শুধু আমরাই?’

‘না, আমার দুজন ক্লাসমেইট আছে। তারা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।’

‘কতোদিনের ট্রিপ?’

‘তিনদিনের।’

নিনীকা লম্বা শ্বাস ফেললো। মেয়ে টা তাকে আগে থেকে কিছু না জানিয়ে হুট করে চমকে দিলো। তার স্বপ্ন গুলো কিভাবে পূরণ করে দিচ্ছে। সে দার্জিলিং যাচ্ছে সেটা তার বিশ্বাসই হচ্ছে না।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং যেতে আড়াই ঘন্টা লাগে। তারা টেক্সিতে চেপে বসলো। যেতে যেতে নিনীকা পরিচিত হয়ে নিলো সুমিত্রার ক্লাসমেইট এর সাথে।


শৈল শহরের রানী নামে পরিচিত দার্জিলিং (Darjeeling) ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থিত। দার্জিলিং তার ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চা ও দার্জিলিং হিমালয় রেলওয়ের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিং এর জনপ্রিয়তা ব্রিটিশ রাজের সময় থেকেই বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে এটি যখন তাদের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী হিসাবে গড়ে উঠেছিল। পূর্বে দার্জিলিং ছিল প্রাচীন গোর্খা রাজধানী। পরে সিকিমের মহারাজা ব্রিটিশদের দার্জিলিং উপহার করেন। দার্জিলিং তার অনাবিল সৌন্দর্য এবং মনোরম জলবায়ুর কারণে ভারতের একটি জনপ্রিয় ছুটির গন্তব্য হয়ে আসছে। পর্যটন ছাড়াও, দার্জিলিং তার বিভিন্ন ব্রিটিশ শৈলীযুক্ত বেসরকারি বিদ্যালয় গুলির জন্য জনপ্রিয়, যা ভারত জুড়ে এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশগুলি থেকেও ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করে।

দার্জিলিং এর স্থানীয় মানুষেরা গোমাংস এবং মসুর দিয়ে ভাত খেতে পছন্দ করেন। অন্যান্য জনপ্রিয় স্থানীয় খাবার হল মম (মাংস বা সবজি দিয়ে পিঠার মত খাবার), থুপকা (মাংস এবং নুডলস দিয়ে তৈরি একটি ঘন স্যুপ), গানড্রাক (গাঁজানো সরিষা পাতা) এবং চ্যাং (স্থানীযবিয়ার)।

দার্জিলিং পরিভ্রমণের সেরা সময় হল বসন্ত ও শরৎকাল। দার্জিলিং-এ বসন্তকাল মার্চ থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত বিরাজ করে, অন্যদিকে শরৎকাল সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর মাস পর্যন্ত স্থিত হয়।

ছোট বড় মিলিয়ে বেড়ানোর জন্য প্রায় ১৭টি আকর্ষণীয় স্থান রয়েছে দার্জিলিং জুড়ে।

পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত রেলওয়ে স্টেশন ঘুম।
আছে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১০,০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের চূড়া থেকে অপূর্ব সুন্দর সূর্যোদয় দেখা।
পৃথিবীর বিখ্যাত প্রার্থনা স্থান ঘুম মোনাস্ট্রি।
ছবির মতো অপূর্ব সুন্দর স্মৃতিসৌধ বাতাসিয়া লুপ বিলুপ্ত প্রায় পাহাড়ি বাঘ Snow Lupard খ্যাত দার্জিলিং চিড়িয়াখানা।
পাহাড়ে অভিযান শিক্ষাকেন্দ্র হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইন্সটিটিউট।
সর্বপ্রথম এভারেস্ট বিজয়ী তেনজিং-রক- এর স্মৃতিস্তম্ভ।

নিনীকারা পৌছে গেলো। সে মুখে হাত দিয়ে আশপাশ দেখছে। দূরে উঁচু উঁচু পাহাড় দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে সবুজ আর সবুজ। পাহাড়ের বুকে যেনো আকাশ মিশে রযেছে। নিনীকা যদি পাহাড়ের চূড়ায় উঠে তাহলে কি সে আকাশ ছুতে পারবে?’

সুমিত্রা নিজেও মুগ্ধ। যদিও সে আগে দু’বার এসেছে। কিন্তু বারবারই মুগ্ধ হতে হয় তাকে।

ট্যুরিস্ট এরিয়া হওয়াতে এখানে বিভিন্ন রেঞ্জের হোমস্টে, আবাসিক হোটেল, রেস্ট হাউজ আছে। দার্জিলিংয়ে ক্লক টাওয়ার ও মল রোডের আশেপাশে অনেক হোটেল আছে, দরদাম করে উঠতে হয়। পিক সিজনে মানে এপ্রিল-জুন ও অক্টোবর-ডিসেম্বরে রুম রেন্ট একটু বেশি নিতে পারে। তবে আগে থেকে বুকিং না করে গেলেও থাকার জায়গা নিয়ে কোনো সমস্যা হলো না।

নিনীকারা মল রোডের আশপাশ হোটেল গুলোর একটিতে গেলো। দুটো রুম নিলো চারজন মিলে। একটাতে নিনীকা ও সুমিত্রা, আরেকটাতে বাকি দুজন।

তারা যখন রুমের চাবি নিয়ে হোটেল রুমের দিকে যাচ্ছিল তখনই মল রোডের সেই হোটেলের সামনে এসে থামলো সেনাবাহিনীর জিপ। সেটা থেকে নেমে এলো সেনবাহিনীর প্যান্ট পড়া কিন্তু মাটিয়া রঙের টিশার্ট পরিহিত এক যুবক। চোখে কালো চশমা। হাতের পেশিগুলো ফুলে পেঁপে উঠেছে। চারিদিকের অনেক রমনীই তার দিকে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘদেহী পুরুষটি বুট জুতার শব্দ তুলে রিসিপশনের সামনে এসে থামলো। রুম বুকিং করার জন্য রিসেপশনিস্ট তার নাম জিজ্ঞেস করলেন। সে হাস্কি স্বরে ঠোট নাড়িয়ে নিজের নাম উচ্চারণ করলো,

‘ মেজর ধ্রুব মাহবুব। ’

রিসেপশনিস্ট চমকে গেলেন হয়তো। হিন্দি নাকি উর্দু বললো ধ্রুব জানে না। প্রশ্ন ছুড়লেন,

‘আপ সেনাবাহিনী কা মেজর হ্যা জনাব? আইয়ে হামারি হোটেল মে আপকা সোয়াগাত হ্যাঁ জি। বলিয়ে কোন সি রুম লাগে গা? ‘

ধ্রুব চোখের চশমা খুলে নিলো। বলল,

‘পাকিস্তান?’

‘নেহি জি হামারি হিন্দি তোরাতোরা আতি হে সো মেরি উর্দু ওর হিন্দি গুলাই যা তা হে তো..

ধ্রুব গম্ভীর স্বরে ধমক দিলো।

‘আপনার ভাষা আপনার কাছেই রাখুন। আমাকে একটি রুম বুক করে দিন।’

রিসেপশনিস্ট চুপসে গেলেন। কথা না বাড়িয়ে একটি রুমের চাবি বাড়িয়ে দিলেন।

ধ্রুব চোখে চশমা পড়ে নিলো। নিচে রাখা ট্রলি ব্যাগটি টেনে নিয়ে যেতে লাগলো তার পালিয়ে যাওয়া বউয়ের পাশের রুমে। যেতে যেতে বিরবির করলো,

‘মেজর ধ্রুব মাহবুবের সাথে সংসার করতে প্রস্তুত হও নিনীকা শেখ। তোমাকে সারাজীবন মেজরের অলীক কন্যা হয়েই থাকতে হবে। সাথে করতে হবে পালিয়ে আসার প্রায়শ্চিত্ত।’

বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ভিজিয়ে দিচ্ছে দার্জিলিংয়ের পাহাড় পর্বত। ধ্রুব চশমার কোণ দিয়ে থাই গ্লাস ভেদ করে বাহিরে তাকালো। মুগ্ধতা ভর করলো দু’চোখে।

(চলবে)