Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 132



ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০৪

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৪

তিশা আপু পা’লিয়ে যাওয়ার মেয়ে নয়। কোন ছেলের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক নেই। থাকতেও পারে না। অন্তত আমার এমন মনে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে আপুকে দেখছি। একবারের জন্যও মনে হয়নি এই মেয়ে প্রেম করতে পারে। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে থাকা মেয়েদের খুব সহজে প্রেম হয় না। তারা গল্প উপন্যাসের নায়ক খুঁজে বেড়ায়। সেই স্বপ্নের পুরুষকে খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে যায়। যে ছেলেকে দেখে তাকেই কোন না কোন উপন্যাসের নায়ক বানিয়ে ফেলে। উৎসাহ নিয়ে দু’জনের চরিত্র মিলিয়ে দেখে এবং হতাশ হয়। বাস্তবে উপন্যাসের চরিত্র পাওয়া খুব মুশকিলের কাজ। কাজেই আমার মনে হচ্ছে মনিরা আপু মিথ্যা বলছে। কেন বলছে তা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে না। হয়তো তিশা আপুর নিজেই উনাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে। উনি এখানে এসে আপুর শেখানো কথাগুলি তোতা পাখির মতো আওড়াচ্ছে। কয়েক মিনিট বাদে দেখা যাবে আপু ফিরে এসেছে। তার মুখ হাসি-হাসি। বাড়ির সবাইকে চমকে দিয়েছে ভেবে মনে মনে খুব মজা পাচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত আমার ধারণাই ঠিক হলো। মনিরা আপু বের হয়ে যাওয়ার পরপরই তিশা আপু বাড়ি ঢুকল। হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “সবার জন্য ডালপুরি নিয়ে এসেছি। দোকানদার বেশ ভালো মানুষ। পুরির সাথে চাটনিও দিয়েছে। মা একটু চা বানিয়ে দেবে? ডালপুরির সাথে চা। চমৎকার কম্বিনেশন!”

ফুফু বিস্মিত গলায় বলল, “তুই এখানে কেন এসেছিস?”

আপু স্বাভাবিক গলায় বলল, “এখানে আসব না তো কোথায় যাব?”

“যে ছেলের হাত ধরে চলে পালিয়ে গিয়েছিলি তার কাছে যাবি। এ বাড়িতে তোর কোন জায়গা নেই।”

“অদ্ভুত কথা বলো না তো মা। আমি কেন কোন ছেলের সাথে পালাতে যাব?”

“মনিরা যে বলল- তুই পালিয়ে গেছিস? ছেলেটা তোর সাথে একই ক্লাসে পড়ে।”

“আচ্ছা মা! মনিরা বলল আর তোমরা মেনে নিলে? আমার ওপর কি তোমাদের একটুও বিশ্বাস নেই?”

ফুফা চেয়ারে বসে পা নাড়াচ্ছিলেন। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। কোমল গলায় বললেন, “আমার বিশ্বাস ছিল। মনিরাকে যা বলার বলে দিয়েছি। চিন্তা করিস না। তোর মা একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল আর কি! পা’প থাকলে তো শা’স্তির ভয় পেতেই হবে। যাইহোক তুই ঘরে যা। ফ্রেশ হয়ে কিছু মুখে দে।”

তিশা আপু শান্ত ভঙ্গিতে ডালপুরির প্যাকেট দাদির হাতে দিল। তারপর স্বাভাবিক পায়ে নিজের ঘরের চলে গেল। দাদি বললেন, “আজকালকার ছেলে-মেয়েরা হয়েছে বটে। এক নম্বরের বে’য়া’দ’ব।”

িহপওহহিজহডিাফুফু কিছু বলল না। চোখের পানি মুছে কঠিন মুখে তাকিয়ে রইল।

সূর্য ডুবছে অনেকক্ষণ। এখনও সন্ধ্যার নাস্তা হাতে পৌঁছায়নি। আপু ডালপুরি নিয়ে এসেছিল। বেশি না হলেও একটা অন্তত আমার পাওয়ার কথা। পাইনি। বাড়ির পরিবেশ থমথম হয়ে আছে। ফুফু আপুকে অনেক কথা শুনিয়েছে। গায়ে হাত তুলেছ পর্যন্ত। আমার কাছে ব্যাপারটা একটুও ভালো লাগেনি। বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে। তবে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে যাইনি। এ বাড়িতে আমার মতামতের গুরুত্ব নেই বললেই চলে। তাছাড়া এমনিতেও ফুফু মেজাজ তেঁতো হয়ে আছে৷ আমি কিছু বললে আর রক্ষে থাকত না।

দাদি দু-কাপ চা হাতে নিয়ে আমার ঘরে আসলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “পড়াশোনা করছিস নাকি?”

“না। এমনি শুয়ে আছি। ভালো লাগছে না।”

“চা নিয়ে এসেছি। চা খেয়ে দেখ। ভালো লাগবে।”

“আচ্ছা দাও।”

বিছানায় উঠে বসলাম। হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিতে নিতে বললাম, “দাদি তোমার শরীর ভালো?”

“বুড়ো বয়সে শরীর ভালো থাকে না। তোর পড়াশোনা কেমন চলছে? ক্লাস হয়?”

“পরীক্ষা হচ্ছে। মূল্যায়ন যাকে বলে। বই দেখে লেখালেখি।”

“কেমন হচ্ছে?”

“খুব বেশি ভালো হচ্ছে না। সবাই আগে আগে প্রশ্ন পেয়ে যাচ্ছে। উত্তরও পাচ্ছে। আমি কিছু পাচ্ছি না।”

“এসব কোথায় পাওয়া যায়?”

“ওইতো অনলাইনে পাওয়া যায়। ইউটিউবে পরীক্ষার আগের দিন রাত নয়টায় উত্তরসহ প্রশ্ন পাওয়া যায়।”

দাদি আৎকে উঠলেন। হয়তো তার কিছু বলার ছিল। বলতে দিলাম না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললাম, “তুমি কি কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ বলব। বলব বলেই তোর কাছে আসা। দরজা খোলা। দরজা ভেজিয়ে দিয়ে এসে বোস। অনেক কথা আছে।”

উঠে গিয়ে দরজা ভেজিয়ে দিলাম। দাদি শীতল গলায় বললেন, “চেকে সই করেছিস কেন?”

“ফুফু টাকা চাইছিল। ফুফা নাকি কার কাছে দেনা আছে। আমাকে সই করতে বলল তাই করেছি।”

“ফুফার দেনার ব্যাপার ফুফা বুঝবে। তোকে ভাবতে হবে না। তুই সই করলি কেন?”

“চিন্তা করো না। আমি সব জেনে-বুঝেই সই করেছি। অল্পবয়সী ছেলের সই নিয়ে ওরা টাকা তুলতে পারবে না। ব্যাংক বাচ্চাদের সইয়ের গুরুত্ব দেয় না। সাথে একজন অভিভাবক লাগবে। আর ফুফু তো তোমাকে সই করতে বলতে পারবে না।”

দাদি চমকে উঠলেন। নিজেকে সামলে নিতে নিতে বললেন, “তুই এতো চালাক হলি কবে? দেখে তো হাঁ’দা মনে হয়।”

“সব জিনিস দেখা দিয়ে বিচার করা যায় না দাদি। চোখে দেখা সত্যও কখনও কখনও মিথ্যে হয়ে যায়।”

“ভালোই বলেছিস। শোন দাদু ভাই, লাভের গুড় খাওয়া পিঁপড়কে কখনও বিশ্বাস করতে নেই। ওরা তোকে একদম নিঃস্ব করে দিতেও দু’বার ভাববে না।”

“আচ্ছা দাদি! আমি ওদের কি ক্ষ’তি করেছি? ওরা কেন আমার সাথে এমন করে? বাবা থাকতে ফুফু আমায় কত ভালোবাসত আর এখন চোখেই দেখতে পারে না। সবসময় আমাকে দু চোখের বি’ষ মনে করে।”

“এই পৃথিবীর মানুষ এতিমদের গুরুত্ব দেয় না দাদু ভাই। চিন্তা করিস না। আল্লাহ আছেন। তিনি সব ঠিক করে দিবেন। ভরসা রাখ।”

“এসব ভাবতে ভালো লাগে না।”

দাদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “আমি বেঁচে থাকতে ওরা কেউ তোর কোন ক্ষ’তি করতে পারবে না। চিন্তা করিস না দাদু ভাই।”

“ফুফু সেদিন জামদানী শাড়ির ব্যাপারে কি বলছিল? তুমি সত্যিই ওই শাড়ি কিনতে চেয়েছিল?”

“হ্যাঁ। আগামী শুক্রবার আমার মামাতো ভাইয়ের নাতির বিয়ে। দাওয়াত করেছে। ওকেই দিতে চেয়েছিলাম।”

“তাহলে তোমার কথা বলল কেন?”

“কাকে দেবো সে কথা বলেছিলাম না। তাই হয়তো ভেবে নিয়েছে আমার জন্য বলেছি।”

“আচ্ছা ফুফুদের মধ্যে ঝগড়া হচ্ছিল কি নিয়ে?”

“কিসব টাকা পয়সা নিয়ে। তুই ওদিকে খেয়াল দিস না। মন দিয়ে পড়াশোনা কর। সবসময় মনে রাখবি দুনিয়ার বুকে তুই একদম একা। অন্ধকারে তোর ছায়াও তোকে ছেড়ে চলে যাবে।”

“মনে রাখব।”

“শিমুল আর তালেবের থেকে দূরে থাকবি। ওদেরও খুব একটা সুবিধার মনে হয় না।”

“আচ্ছা থাকব।”

“তুলি বলছিল তোকে নিয়ে কার জন্মদিনে যাবে। যাবি না। ওদের কারো সাথে কোথাও যাবি না। আমায় না বলে মোশারফের সাথে মাছ ধরতে গিয়েছিস কিছু বলছি না। এরপর থেকে আর যাবি না।”

দাদিকে চিঠির ব্যাপারে বলে দিতে ইচ্ছে করল। কিন্তু বললাম না। দাদি শুনলে অযথা চিন্তা করবে। বুড়ো বয়সে অতিরিক্ত টেনশন নেওয়ার কোন মানে নেই। দাদি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন- ফুফু এসে দরজা খুলল। খটখটে গলায় বলল, “রাত হয়েছে। খেতে আসো।”

দাদি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ” আমার খাওয়ার দেরি আছে। গ্যাসের ওষুধ খাওয়া হয়নি। ফয়সাল তুই খেতে যা। বেশি রাত করিস না।”

উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎই খেয়াল হলো আমি খুব সাবধানে হাঁটছি। বেড়ালের মতো নিঃশব্দে পা ফেলার চেষ্টা করছি। যেন পায়ের নিচের মাটি নরম। একটু জোরে পা ফেললে ভেতরে ঢুকে যাব। রান্নার আয়োজন ভালো হয়নি। দু’দিনের বাসি ডালের সাথে পাটশাক ভাজি। ডালটা কেমন টকটক হয়ে গেছে৷ মুখে দেওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে কোণার চেয়ারটা আমার জন্য বরাদ্দ। ফুফা আমার সামনের চেয়ারে খেতে বসেন। আজও বসেছেন। তার খাবার জন্য আলাদা ব্যবস্থা হয়েছে। যবের আটার রুটির সাথে আলুভাজা আর ডিম। ফুফা খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছেন। খাওয়ার মাঝে মাঝে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। তাকানোর ধরণটা অদ্ভুত। বিরক্ত লাগে দেখতে।

ফুফু বলল, “শিমুল তোর ভাত খাওয়ার দরকার নেই। রুটি খা। ভাত বেশি নেই। সবার হবে না।”

শিমুল ভাত খেলো না। তিনটে রুটি সাথের একটা ডিম নিয়ে খেতে বসল। তালেবও অত্যন্ত সাবধানে খাবার খাচ্ছে। চো’রেরা চু’রি করার সময় এমন সাবধানতা অবলম্বন করে। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখন দাদি এলেন। আমার থালার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কি দিয়ে খাচ্ছিস?”

“ডাল আর পাটশাক।”

“তোকে ডিম ভাজা দেয়নি?”

আমি শুকনো মুখে ফুফুর দিকে তাকালাম। ফুফু চোখ গরম করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দাদি বললেন, “কাল থেকে তোমরা আলাদা রান্না করবে। আমি আর ফয়সাল তোমাদের হাঁড়িতে খাব না।”

ছোট দাদি বিস্মিত হওয়ার ভান করে বললেন, “কেন বেয়ান? আমাদের সাথে খেতে কি সমস্যা?”

দাদি কঠিন মুখে বললেন, “কি সমস্যা তা আপনি ঠিকই বুঝতে পারছেন। শুধুশুধু ভান করবেন না।”

ফুফু রেগে গিয়ে বলল, “মা তুমি কিসব কথা বলছ?”

“কি বলছি তা কি তুই বুঝতে পারছিস না? সবার জন্য ডিম ভাজা হয়েছে। ফয়সালের ডিমভাজা কোথায়?”

“সবার জন্য ডিম ভাজা হয়নি মা। তোমার জামাইকে রুটির সাথে ডিম দেওয়া হয়েছে। ভাত কম বলে শিমুল রুটি খাচ্ছে।”

দাদি বরফ শীতল গলায় বললেন, “বয়স বাড়লেও চোখ ঠিক আছে৷ তালেবের ভাতের নিচের ডিম ভাজা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হলফ করে বলতে পারি বাকিদের জন্যও ডিম ভাজা হয়েছে।”

ফুফু আমতা আমতা করে বলল, ” একটা দিন ঝামেলার মধ্যে রান্না হয়নি বিধায় তুমি হাঁড়ি আলাদা করতে চাইছ? আমরা কি খুব বেশি খাই? তোমার জামাই কি বাজার করে না?”

“আমার মনে হয় না জামাই নিজের টাকায় বাজার করে। প্রতি মাসে দু’জনের খাওয়া বাবদ বিশ হাজার টাকা করে নিলে নিজের পকেট থেকে এক পয়সাও খরচ হওয়ার কথা না।”

ফুফা বললেন, “আম্মা, আপনি ভুল ভাবছেন। আজ-কাল জিনিসপাতির দাম অনেক বেড়ে গেছে। তাছাড়া আপনার ওষুধের পিছনেই পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়।”

“দু’পাতা গ্যাসের ওষুধের দাম পাঁচ হাজার টাকা? কোন কোম্পানির ওষুধ কেনা হয়?”

ফুফা মিইয়ে গেলেন। ফুফু তেঁতো গলায় গা’লা’গা’ল করতে করতে নানান কথা বলতে লাগল। অশ্রাব্য কুৎসিত ধরনের কথা। সেসব কথায় দাদির কোন হেলদোল দেখা গেল না। তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাওয়া শেষ করে উঠে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, “শোনো জামাই। আমাদের জন্য একটা রান্নার লোক ঠিক করবে। আর নিচতলার দু’টো ঘর খালি করে দেবে। বাসাভাড়া দেব।”

ফুফা মাথা নাড়লেন। এর অর্থ হ্যাঁ হতে পারে আবার না-ও হতে পারে। মুখে কিছু বললেন না। বাকি সদস্যদের খুব বিচলিত মনে হতে লাগল। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে রাতেও ফুফু সাথে ফুফার ঝগড়া হবে। চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুমানোর জো থাকবে না। অশান্তি!

রাত এগারোটার দিকে তিশা আপু আমার ঘরে এলো। হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বলে বিছানার পাশে এসে বসল। নিচু গলায় বলল, “তোকে আমার হয়ে একটা কাজ করতে হবে।”

“কি কাজ করতে হবে?”

“একটা চিঠি দেখে দেখে নকল করে দিবি। বদলে তোকে কিছু পারিশ্রমিক দেব।”

“কার চিঠি? কিসের চিঠি? প্রেমপত্র?”

আপু আমার মাথায় গাট্টা মে’রে বলল, “এসব কথা কোথা থেকে শিখেছিস? প্রেমপত্রের তুই কি বুঝিস?”

“ইসসস! আমি কি এখনও বাচ্চা আছি নাকি? তুমি জানো আমাদের ক্লাসে কতজন প্রেম করে? বাথরুমের দরজার, দেওয়ালে কিসব বাজে বাজে কথা লেখা থাকে। পড়লে তোমার হাত পা অবশ হয়ে যাবে।”

“কি বলছিস তুই?”

“সত্যি কথা বলছি। ক্লাসের ফাঁকে এ ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। হাসার ভঙ্গিটা অ’শ্লী’ল মনে হয়।”

আপু বিব্রত মুখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। খানিকটা সময় নিয়ে স্বাভাবিক হয়ে বলল, “এসব কথা বাদ দে। কাজের কথা শোন।”

“বলো।”

“বলব। তার আগে বল কাউকে বলবি না।”

“আচ্ছা বলব না।”

“আমায় কথা দিচ্ছিস তো?”

“হু, দিচ্ছি।”

“আজকে সব বন্ধু-বান্ধব মিলে ট্রুথ আর ডেয়ার খেলছিলাম। আমি ডেয়ার নিয়েছি। ওরা বলেছে কালকের মধ্যে কেন ছেলের কাছ থেকে প্রেমপত্র লিখে আনতে হবে। এখন তুইই আমার ভরসা।”

ছোট সরু করে বললাম, “মনিরা আপু কি ডেয়ার কমপ্লিট করতে এসেছিল?”

“হ্যাঁ রে। কাউকে বলবি না তো?”

“না বলব না।”

“ডেয়ার পূরণ করতে না পারলে ওদের ট্রিট দিতে হবে। আমার হাতে কোন টাকা-পয়সা নেই। প্লিজ ভাই একটু লিখে দে না!”

“আচ্ছা দাও। লিখে দিচ্ছি। কাগজ এনেছ?”

আপু মুখ টিপে হাসল। এই বাড়িতে একমাত্র তিশা আপুর সাথেই আমার একটা সহজ সম্পর্ক আছে। কখনও কিছু প্রয়োজন হলে আপুকে বলতে পারি। ইসস! আপু যদি আমার নিজের বোন হতো!
দু’পাতা প্রেমপত্র লিখতে গিয়ে আমার হাত ব্যাথা গেছে। চিঠির ভেতর কিসব কঠিন কঠিন ভাষা। চুম্বন, আলিঙ্গন, প্রিয়তমাষু আরও কত কি!
ভোর রাতের দিকে একটা স্বপ্নে ঘুম ভেঙে গেল। বি’ভৎ’স ভ’য়ংক’র স্বপ্ন। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। স্বপ্নে সেই অচেনা লোকটা দেখলাম। যার একটা হাত কা’টা। লোকটা আমায় নৌকায় করে মাঝ নদীতে নিয়ে গেল। একটা ধা’রা’লো ছু’রি দিয়ে পেটের এফোড় ওফোড় করে দিলো। বুকে খুব ব্যাথা করছে। কেমন যেন দম আঁটকে আসছে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে মনে হয়।

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-২+৩

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-২ + ৩

আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ঘন কালো মেঘ। হঠাৎ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেছে। অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার। এমনই এক বর্ষার দুপুরে আমার জন্ম হয়েছিল। আকাশে কালো মেঘ। থেকে থেকে মেঘের গর্জন। বাবা হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটাহাটি করছেন। হাঁটছেন খুব বিচলিত ভঙ্গিতে। যেন তার দুনিয়া উলোট-পালোট হয়ে যেতে বসেছে। মায়ের শরীরে র’ক্তের ঘাটতি ছিল। ডাক্তার যে কোন মুহুর্তে র’ক্ত চাইতে পারে অথচ র’ক্ত দেওয়ার লোক পাওয়া যায়নি। যা হোক একজনকে পাওয়া গেছিল, শেষ মুহুর্তে জানিয়ে দিলেন- তিনি আসতে পারবেন না। খুব জরুরি কাজ পড়ে গেছে। বাবা হাসপাতালের বারান্দায় বসে পড়লেন। তিনি ক্রমাগত ঘামছেন। শার্টের হাতায় সেই ঘাম মুছছেন আর আল্লাহ আল্লাহ করছন। চারটে বেজে এক মিনিটে আমার জন্ম হলো। ওয়াও ওয়াও করে কাঁদার সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি লাগল। ডাক্তার জানালো র’ক্ত লাগবে না। রোগী বাচ্চা দু’জনেই সুস্থ আছে। বাবা হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। ঠিক করছেন একশটা এতিম বাচ্চাকে ভাত খাওয়াবেন। জোড়া খাসি জ’বা’ই করে সেই ভাত খাওয়ানোর অনুষ্ঠানও পালন করা হয়েছে। যদিও এসবের কোন কিছু আমার চোখে দেখা নয়। লোকের মুখে শুনেছি। লোকে বলে শোনা কথা বিশ্বাস করতে নেই। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি। অন্তত বাবার ব্যাপারে আমার ষোল আনা বিশ্বাস আছে।

অচেনা লোকটি ফুফার পাশাপাশি হাঁটছে। নিচু গলায় ক্রমাগত কথা বলে যাচ্ছে। তার কথার ধরণ খুবই হালকা। বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়। কান পর্যন্ত পৌঁছায় না। মাথা নিচু করে দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলাম। গ্রামের দিকে নদীর কাছাকাছি বেশিরভাগ খু’ন’খা’রা’বি হয়। নদীর পানিতে র’ক্তের দাগ ধুয়ে যায়। এরাও কি আমার সাথে তেমন কিছু করবে? বুঝতে পারছি না। অতিরিক্ত উত্তেজনায় মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দেয়। আমার সাথেও তাই হচ্ছে। চিন্তা শক্তি এলোমেলো হয়ে গেছে। দু-জনের ভাব সুবিধার মনে হচ্ছে না ঠিকই কিন্তু খুব একটা অসুবিধারও মনে হচ্ছে না। এই মুহূর্তে ঠিক কি করলে বিপদের সম্ভাবনা কমে যাবে? দৌড়ে পালাবো? দৌড়ে পালালে খুব একটা লাভ হবে না। নির্জন রাস্তা। রাস্তায় দু’পাশে কাঁটাবন। জায়গাটা একদম নিরিবিলি। এখান থেকে দৌড়ে পালানো সহজ কাজ না। নিশ্চিতভাবে ওরা আমায় ধরে ফেলবে। ধৈর্য ধরে আরও কিছুক্ষণ ওদের অনুসরণ করা যায়। কিন্তু এটাও বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। এতে বিপদ বাড়বে ছাড়া কমবে না। ফুফা বললেন, “ফয়সাল মিয়া, সাবধানে হাঁটবে। দেখে শুনে পা ফেলেবে। রাস্তার পাশে যেও না। নদীর পাড়ের এলাকা। সাপ থাকতে পারে।”

নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলতে পারছি না। প্রচন্ড ভয়ের কারণে গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। অচেনা লোকটি বলল, “এই ছেলেকে দিয়ে কাজ হবে তো?”

কথাটা সে বেশ জোরেই বলল। এই প্রথম তার কোন কথা আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাল। ফুফা জোর গলায় বললেন, “কাজ হবে না? কাজের ছেলের দেখেই তো সাথে নিয়ে এসেছি। কি ফয়সাল মিয়া? তুমি কাজের ছেলে না?”

আমি ক্রমাগত মাথা নাড়তে লাগলাম। সামান্য কথাবার্তায় অনেকখানি ভয় কেটে গেছে। এখন আর তেমন ভয় লাগছে না। শুধু মনে হচ্ছে শরীরের ওপর দিয়ে বরফ শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। খুবই ঠান্ডা হাওয়া। মন ভালো করার মতো ঠান্ডা। অচেনা লোকটাও অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। বেঁটেখাটো চেহারার মানুষটা হেলেদুলে হাঁটছে। পান খাওয়া হলদেটে-লাল দাঁত নিয়ে ক্রমাগত হাসছে। অদ্ভুতভাবে সেই হাসি দেখতে ভালো লাগে। মুখের দিকে তাকালে কেমন যেন মায়ায় পড়ে যেতে হয়। তখন লোকটাকে খুব অসহায় মনে হয়।

হাঁটতে হাঁটতে খোলা মাঠের মতো জায়গায় এসে উপস্থিত হলাম। মাঠের তিন পাশে ঘন জঙ্গলের মতো ঝোপঝাড়। এক পাশে নদী। ফুফা নদীর পানিতে পা ভিজিয়ে বললেন, “ফয়সাল মিয়া, এখানেই জাল ফেলা হোক। তুমি কি বলো?”

“হোক।”

ফুফা মায়া ভরা চোখে আমার দিকে তাকালেন। অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, “তোমার কি ভয় লাগছে?”

জড়ানো গলায় বললাম, “না না। ভয় লাগবে কেন? আপনি তো সাথেই আছেন।”

‘আপনি তো সাথেই আছেন’ এই কথাটা আমি ইচ্ছে করে বলিনি। মুখে চলে এসেছে। ফুফা হাসলেন। অচেনা লোকটি গায়ের চাদর খুলে মাটিতে রাখল। চাদর খুলে মাটিতে রাখার ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না। চাদরের আড়াল সরে যেতে অদ্ভুত একটা জিনিস খেয়াল করলাম। লোকটার একটা হাত নেই। কনুইয়ের উপরে শার্ট ঝুলছে। অবাক দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটি বিব্রত গলায় বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?”

“কিছু না। এমনিতেই।”

“কা’টা হাত দেখছ নিশ্চয়ই? বুড়ো বুড়ো লোকেরা পর্যন্ত আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। তুমি তো বাচ্চা ছেলে।”

“আপনার হাতে কি হয়েছিল?”

“বিশেষ কিছু হয়নি। জাহাজের দড়িতে আটকে গেছিল। এক কো’পে কে’টে ফেলেছি।”

চমকে উঠলাম। উত্তেজিত গলায় বললাম, “আপনি নিজে কে’টে’ছেন?”

“হ্যাঁ, নিজেই কে’টেছি। লম্বা ঘটনা। পরে একদিন সময় করে বলল। মোশারফ ভাই! মাছ ধরার কি করলেন? জাল এনেছেন তো?”

ফুফা ডানে বামে মাথা নাড়তে লাগল। এর অর্থ তিনি জাল আনেননি। জাল যেহেতু আনেননি তাহলে নিশ্চয়ই মাছ ধরতে আসেননি। অন্য কারণে এসেছেন। কি সেই কারণ? তিশা আপুর কথা সত্যি নয় তো? ভয় যতটা কেটে গেছিল তার থেকে হাজার গুন বেশি ফেরত এসে আমায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল। খেয়াল করলাম আমার শরীর মৃদু মৃদু কাঁপছে। ফুফা বললেন, “এখন কি করা যায়? আমি তো ভেবেছিলাম আপনি জাল নিয়ে আসবেন।”

অচেনা লোকটি অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাসলো। সরল গলায় বলল, “আমার ঘরে জাল রাখা আছে। একটু সামনেই। খোকা তুমি গিয়ে জাল নিয়ে এসো। আমি যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিচ্ছি।”

কথার ভাব শুনলেই বোঝা যায় সে মিথ্যে বলছে। লোকটা আমায় বোকাসোকা ধরনের ছেলে মনে করেছে৷ বুদ্ধিমান মনে করলে এলোমেলো কথা বলত না। আমি ভালো-মন্দ কিছু বললাম না। অল্প হাসলাম। সম্মতির হাসি। লোকটা আমায় জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পথ দেখিয়ে দিল। হাতের মধ্যে একটা পুঁটলি দিয়ে বলল, “ঘরের মধ্যে আমার ভাই থাকবে। এটা ওকে দিয়ে আসবে।”

কাঁপা হাতে শক্ত করে পুঁটলিটা চেপে ধরলাম। ফুফা ভাবলেশহীন চোখে নদীর দিকে তাকিয়ে আছে। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। প্রতি মুহুর্তে ভাবনা বদলে যাচ্ছে। আপাতত ওদের কথা শোনা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না। যে পথে এসেছি সে পথে ফিরে যেতে পারব না। অতিরিক্ত ভয় কাজ করলে পথ চিনে ফিরে যাওয়া যায় না। এলোমেলো পায়ে লোকটার দেখিয়ে দেওয়া পথে হাঁটতে লাগলাম। পথ চলছি যন্ত্রের মতো। ইস্পাতের তৈরি রোবটও বলা চলে। তবু অনুভূতি শক্তি প্রবল! মনে হচ্ছে দু’টো সাপ হিসহিস করতে করতে আমার পিছু নিচ্ছে।

শেষবার সাপ দেখেছিলাম বাবার সাথে মাছ ধরতে গিয়ে। তখন আমি ক্লাস থ্রি-তে পড়ি। বর্ষাকাল। আকাশে মেঘ দেখে বাবা বললেন, “ফয়সালের মা, মাছ ধরার জালটা এনে দাও তো। আকাশে মেঘ জমলে কৈ মাছ ডাঙায় উঠে আসে।”

মা ভীষণ বিরক্ত হলেন। তেঁতো গলায় বললেন, “ফ্রিজে অনেক মাছ আছে। বর্ষা মুড়ি তোমাকে মাছ ধরতে যেতে হবে না। ঘরে শুয়ে থাকো।”

বাবা মা’য়ের কথা শুনলেন না। চুপিচুপি গিয়ে খাটের নিচ থেকে জাল টেনে বের করে আনলেন। আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, “আব্বাজান, মাছ ধরতে যাবেন নাকি?”

খুশিতে মাথা দোলাতে লাগলাম। বাবা চওড়া হাসি দিলেন। মা’য়ের চোখের আড়ালে দু-জনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। কথা হয়েছিল মাছ ধরতে নদীতে যাব। কিছুদূর যাওয়ার পরই ঝুম বৃষ্টি নামল। বৃষ্টির ফোঁটা সুচের মতোই ধা’রা’লো। গায়ে বিঁধে যায়। ভাগ্যক্রমে তখন আমরা বাজারের মধ্যে ছিলাম। বাবা দোকান থেকে নতুন ছাতা কিনে ফেললেন। সেই ছাতা আমার হাতে দিয়ে বললেন, “জীবনে একবার যে সিদ্ধান্ত নেবে সেই সিদ্ধান্ত থেকে কখনও পিছু হটবে না। এতে ব্যক্তিত্ব নষ্ট হয়।”

ছাঁদ ফুটো করা বৃষ্টির মধ্যে জাল কাঁধে নিয়ে বাবা মাছ ধরতে গেলেন। ছাতা মাথায় বাবার পিছুপিছু হাঁটছি। প্রথমবারের জালে বিশাল এক সাপ উঠল। বাবা সাপটিকে ধরে জঙ্গলে মধ্যে ছেড়ে দিলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “কেউ বিপদে পড়লে তার সুযোগ নিতে হয় না।”

“সাপটা কি বিপদে পড়েছিল?”

“হ্যাঁ, পড়েছিল বৈকি! সেজন্য তো ছেড়ে দিলাম।”

কথায় কথায় উপদেশ দেওয়াটা বাবার স্বভাবেই ছিল। ব্যাপারটা আমার কাছে খুব ভালো লাগত। সেদিন মাছ ধরতে ধরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দাদি আমাদের বাপ-ছেলেকে ঘরে ঢুকতে দিলেন না। ভরাট গলায় বললেন, “তৃণু, ওদের ঘর থেকে চলে যেতে বল। এক্ষুণি বলবি। বাপ ছেলেকে দেখলে আমার চোখ জ্বালা করছে।”

মা অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। মা সাবান পানি দিয়ে আমার গা ধুইয়ে ঘরে তুললেন। দাদি খুব রাগী মানুষ। বয়সের সাথে সাথে তার রাগ কমেনি। সুদে আসলে চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েই চলেছে।

হঠাৎই খেয়াল করলাম চোখের কোণটা ভিজে উঠেছে। মধুর স্মৃতি মনে করলে চোখ ভেজার কারণ কি? অচেনা লোকটার কথা সত্যি। জঙ্গলে মধ্যে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরটা দেখে মনে হচ্ছে এক্ষুণি ভেঙে পড়বে। ঘরের দরজা খোলা। সাবধানী পায়ে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। মাচার ওপর একটা লোক বসে আছে। তার চোখ জোড়া র’ক্তের মতো লাল। লোকটা ভারী গলায় বলল, “কি চাই?”

কি বলবো বুঝতে পারলাম না। অচেনা লোকটার নাম জেনে আসা উচিত ছিল। ফুফার কথা বলব নাকি বলব না। লোকটা আবারও খেঁকিয়ে উঠল। তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “কথা বলছিস না কেন?”

“আপনার ভাই জাল নিতে পাঠিয়েছে।”

লোকটা ভ্রু কুঁচকে গেল। চোখ সরু করতে করতে বলল, “জাল নিতে এসেছিস?”

ওপরে নিচে মাথা দোলাতে দোলাতে হ্যাঁ বললাম।

“পুঁটলি এনেছিস?”

“হ্যাঁ, এনেছি।”

“দে, আমার হাতে দে।”

পুঁটলিটা তার দিকে এগিয়ে দিলাম। লোকটা চিলের মতো চো মে’রে আমার হাত থেকে পুঁটলিটা নিয়ে নিল। শক্ত গলায় বলল, “দরজার কাছে জাল রাখা আছে। নিয়ে যা।”

জালটা একটু বেশিই ভারী মনে হচ্ছে। সচারাচর মাছ ধরার জাল এতো ভারী হয় না। আমি জাল নিয়ে যাওয়ার পর মাছ ধরা শুরু হলো। ফুফা খুব মজা নিয়ে মাছ ধরছে। অচেনা লোকটার কথায় ক্রমাগত হাসছে। কতই না আনন্দ হচ্ছে ওদের। অথচ আমি এক ফোঁটাও আনন্দ করতে পারছি না। ভয়ে জড়সড় হয়ে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছি। আসরের আজান কানে আসতেই ফুফা পানি থেকে উঠে এলেন। সরু গলায় বললেন, “ফয়সাল মিয়া, পানিতে না নামলে কি মাছ ধরার মজা পাওয়া যায়?”

“আমার কেমন যেন শীত শীত করছে। মনে হয় জ্বর আসবে। আমি পানিতে নামব না।”

“জ্বর আসা তো ভালো কথা না। চলো তাহলে বাড়ি ফিরে যাই। এমনিতেই একটু পরে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা চলেন। দাদি খুব চিন্তা করছে।”

ফুফা জবাব দিলেন না। আমায় সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। বাড়ির মধ্যে পা দিতেই মনটা শান্ত হয়ে গেল। যেন সাক্ষাৎ মৃ’ত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। দাদি অনেক বকাঝকা করলেন। সেসব কথার জবাব দিলাম না। বাথরুমে ঢুকে গায়ে পানি ঢালতে লাগলাম। শরীরে মধ্যে অদ্ভুত জ্বালা জ্বালা করছে। পানি দিয়ে না ধুলে এ জ্বালা কমবে না।

আমাদের বাড়িটা দোতলা। নিচ তলায় ছয়টা রুম। এক রুমে ফুফু আর ফুফা থাকে। এক রুমে ফুফু শাশুড়ি, এক রুমে শিমুল আর তালেব, এক রুমে ফুফুর ছোট ননদ, একটায় দাদি অন্যটায় আমি। আগে আমি দাদির সাথে থাকতাম। ক্লাস এইটে ওঠার পর ঘর আলাদা করে দিয়েছে। দোতলার একটা ঘরে তিশা আপু থাকে। বিশাল বড় ঘর এটাচ বাথ। আপু নিজের মতো করে ঘরটাকে সাজিয়ে নিয়েছে। রাতের খাওয়া শেষ করে আপুর ঘরে গেলাম। আপু দরজা ভেজিয়ে দিয়ে বই পড়ছে। তার টেবিলের কাছে দাঁড়িয়ে বললাম, “কাগজে ওইসব কি লিখে দিয়েছ?”

তিশা আপু অবাক হওয়ার ভান করে বলল, “কোন সব লিখে দিয়েছি?”

“মাছ ধরতে যাওয়ার সময় যেটা আমার হাতে দিয়ে আসলে।”

“ওহ! ওইটা? ওইটা তো আব্বা তোকে দিতে বলেছিল।”

হাতে চিমটি কাটলাম। হ্যাঁ আমি ঠিকই শুনছি। এবং আপুর কথা সত্যি হতে পারে। সেজন্যই বোধহয় হাতের লেখা চিনতে পারছিলাম না। কিন্তু ফুফা কেন আমায় ওইসব লিখতে যাবেন?

চলবে

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট-৩

আজ সোমবার। এই সপ্তাহে আজই প্রথম স্কুলে যাব। আজকে দিনটা অন্য দশটি দিনের মতো এক রকম নয়। একটু যেন অন্য রকম। আলো কেমন অন্য দিনের চেয়ে কোমল। বাতাস ভেজাভেজা। মানুষের চিন্তা ভাবনার সাথে দিন পাল্টে যায় নাকি?
বেলা করে ঘুম ভেঙেছে। অনেক রাত পর্যন্ত ঘুমতে পারিনি। চোখ বন্ধ করে বিছানায় পড়ে ছিলাম। রাতেরবেলা ঘুম না আসলে গল্প করার জন্য একজন মানুষের প্রয়োজন হয়। অনেকদিন ধরে এই প্রয়োজনীয়তাটা অনুভব করছি। তবে সে প্রয়োজন মেটানোর কোন উপায় পাওয়া যাচ্ছে না। একটা অ্যান্ড্রয়েড ফোন থাকলেও কিছুটা সময় কাটানো যেত। কিন্তু দাদি আমার হাতে মোবাইল দিতে রাজি হন না। কেন হন না সেও এক রহস্য। এমন নয় যে তার টাকা পয়সার সমস্যা। দাদা সারাজীবন অমানুষিক পরিশ্রম করে অঢেল সম্পত্তি রেখে গেছেন। বাবাও কিছু কিছু করেছেন। সেই সম্পত্তির প্রতি ফুফুদের আগ্রহের শেষ নেই। দূরসম্পর্কের আত্মীয় পর্যন্ত কিছু পাওয়ার আশায় বসে থাকে। মানুষ হিসেবে দাদা খুবই চালাক এবং বুদ্ধিমান ছিলেন। সুস্থ থাকতেই সম্পত্তির ভাগবাটোয়ারা করে দিয়েছেন। যার যার প্রাপ্য অংশ তাদের নামে লিখে দিয়ে গেছেন। গ্রামের দিকে এক বিঘের মতো ধানিজমি ফুফুর নামে লিখে দেওয়া হয়েছে। বাবার নামে খুলনা শহরের দিকে ছোট মতো একটা বাড়ি কিনে দিয়েছেন। দাদিকেও আলাদা করে কিছু জমি লিখে দিয়েছিলেন। শুধু এই বাড়িটা নিজের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছেন। কথা ছিল বাড়িটা এমনই থাকবে। বংশ পরম্পরায় বসবাস করবে। বাড়িতে খুব বেশি কিছু নেই। কিন্তু মুফতে যা পাওয়া যায় তাতেই ফুফুর লোভ। বিশেষ করে ফুফুর শাশুড়ি। তাকে আমি ছোট দাদি বলে ডাকি। ছোট দাদি প্রথম প্রথম খুব ভালো ছিলেন। এখন কেমন অদ্ভুত হয়ে যাচ্ছেন। দিন গেলে সবাই পাল্টে যায়। আমিও বোধহয় অনেক পাল্টে গেছি। আগে দাদির সাথে অনেক সময় নিয়ে গল্প করতাম। আজ-কাল আর তেমন সময় হয়ে ওঠে না। একা থাকতে ইচ্ছে করে।

বেশ ক’দিন ধরে খেয়াল করছি বেশিরভাগ খারাপ খবরগুলো খাবার টেবিলে দেওয়া হচ্ছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। ফুফু বেজার মুখে বলল, “তাড়াতাড়ি খেয়ে নে সবাই। আজকে আমি তোদের স্কুলে দিয়ে আসব।”

শিমুল মুখ বেজার করে ফেলল। ম’রা গলায় বলল, “এই রোদের মধ্যে তোমাকে যেতে হবে না মা। আমরা তিন ভাই মিলে চলে যেতে পারব।”

তিন ভাই কথাটা বলে সে নিজে খানিকটা চমকে গেল এবং টেবিলে বসে থাকা বাকি সদস্যদেরকেও চমকে দিল। ফুফা গম্ভীর গলায় বললেন, “তোদের মা যা বলছে তাই কর। ফয়সালের ওপর এত বিশ্বাস করে বসে থাকিস না। ও তো তোদের সাথে যায় না। একা একা আগে আগে হাঁটে।”

শিমুল মুখ কালো করে তরকারির আলু ভাঙতে লাগল। তালেব বলল, “ফয়সাল ভাই আমাদের সাথে যাবে কিভাবে? দাদি তো তার সাথে কথা বলতেই নিষেধ করেছে।”

ফুফা তীক্ষ্ণ চোখে তালেবের দিকে তাকিয়ে রইলেন। মুখে কিছু বললেন না। খেয়াল করলাম ছোট দাদি চোখ মোটা করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মহিলা সবকিছুতে আমার দোষ দেখতে পান। শিমুল তালেব কোন ভুল কাজ করলেও দোষ হয় আমার।

ফুফু বলল, “শুনেছি ছেলে ধরা বের হয়েছে। ফেসবুকে খুব লেখালেখি হচ্ছে এটা নিয়ে। ছেলে মেয়েদের সাবধানে রাখতে বলা হচ্ছে। তাই আমি তোদের সাথে যাব। এই নিয়ে দ্বিতীয় কোন কথা শুনতে চাই না।”

শিমুল আর তালেব খুব করে চাচ্ছিল যেন ফুফু ওদের সাথে না যায়। আড়ালে আবডালে তিশা আপু সাথে যাওয়ার জন্য রাজি করতে চেষ্টা করল। লাভ হলো না। আজকে তার খুব জরুরি ক্লাস আছে। সকাল বেলা তৈরি হয়ে তারপর খেতে বসছে। আপুর সাজ খুব চমৎকার। কলেজ ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে সাদা পাথরের কানের দুল, গলায় পাতলা চেনের সাথে লকেট ঝুলছে। ঠোঁটে মেরুন কালারের লিপস্টিক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার সময় এমন কড়া লিপস্টিক পরার নিয়ম আছে জানা ছিল না। আমাদের স্কুলের রিতা মেডাম এসব ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি করেন। মেয়েরা উনার জন্য লিপস্টিক পরতে পারে না। উগ্র সাজে চুল বাঁধতে পারে না। এ কারণে বেশিরভাগ মেয়ে মেডামকে দু’চোখে দেখতে পারে না। বি’শ্রী ভাষায় গা’লা’গা’ল দেয়।

শেষ পর্যন্ত ফুফু আমাদের নিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ল। বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ছোট দাদির সাথে কিসব কথা বলে আসলো। আজ-কাল শাশুড়ি বউয়ের খুব ভাব হয়েছে। এক সময় সাপে নেউলের সম্পর্ক ছিল। স্বার্থ মিলে গেলে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
শিমুল আর তালেব বেজার মুখে হাঁটতে লাগল। ফুফার পকেট থেকে চু’রি করা পাঁচশ টাকার নোটটা আজ আর খরচ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

বাড়ি ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ফেরার পথে ফুফু সবাই আইসক্রিম কিনে দিল। আগে হেঁটে এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, “বাজান আমার উপর রেগে আছিস নাকি?”

চমকে উঠলাম ঠিকই, পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, “না না। রেগে থাকব কেন?”

“এই যে ঠিকঠাক তোর খেয়াল রাখতে পারি না। সারাক্ষণ মুখ পু’ড়ি’য়ে কথাবার্তা বলি।”

“না ফুফু, আমি রেগে নেই।”

“কি আর বলব বাজান! নানান চিন্তায় মাথা খারাপ থাকে।”

আমি চুপ করে রইলাম। ফুফু নিজের কন্ঠে আগের থেকে অনেক বেশি দরদ জড়ো বলল, “বাজান, তোর ফুফার হাতে টাকা-পয়সা নেই। সংসার চালতে গিয়ে অনেক ধার দেনা করতে হচ্ছে। মা তো আজ-কাল কোন টাকা পয়সা দিতে চায় না।”

“আমি কি দাদিকে টাকা দেওয়ার জন্য বলব?”

“বলে আর কি করবি? তোর দাদির হাত দিয়ে কি টাকা সরে নাকি? এমন কৃপণ মহিলা আজও আমার চোখে পড়েনি।”

ফুফু ছোট একটা নিঃশ্বাস গোপন করতে চেষ্টা করল। দাদি কৃপণ নয় বরং তাকে দিলখোলা মানুষ বলা যায়। বাবা থাকতে প্রায় প্রতি মাসে ফুফুর বাড়ি বাজার দিয়ে পাঠাতেন। অবশ্য বাজার খরচ বাবার দিতে হতো না। দাদা দাদির জন্য কিছু টাকা আলাদা করে সরিয়ে রেখেছিলেন। দাদি সেখান থেকেই সব খরচ করতেন। মাঝেমধ্যে বাবাকেও কিছু দিতেন। আশেপাশের মানুষ, দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনরা কেউ এই দেওয়া-নেওয়ার ভেতর থেকে বাদ পড়ত না। মাঝেমধ্যেই মনে হয় দাদা নিশ্চয়ই অসৎ পথে রোজকার করার ব্যবস্থা ছিল। না হলে উনি এতো টাকা কোথায় পেয়েছেন? প্রায়ই ভাবি দাদিকে জিজ্ঞেস করব, সময় কালে মনে থাকে না।

ফুফু বলল, “তোর ফুফার কাছে এক লোক টাকা পাবে। তাগাদা দিচ্ছে, মা’রার হুমকি দিচ্ছে।”

“কত টাকা পাবে?”

“তা লাখ খানেকের মতো। কোথা থেকে এতো টাকা জোগাড় করব ভেবে পাচ্ছি না। ভাবছি কিছু গহনা বিক্রি করব। মানুষটা তো আগে বাঁচুক। তোর ক্লাসের ছেলেগুলো বলে দেখিস তো। কেউ যদি কিনতে চায়।”

পৃথিবীতে এক শ্রেণির মানুষ থাকে। যাদের সাথে কেউ মিষ্টি করে কথা বললে খুব সহজে পুরনো কথা ভুলে যায়। সেই মুহূর্তে তাদের জন্য জীবন দিয়ে দিতেও পারে। আমি সেই শ্রেণির মানুষের মধ্যে একজন। যখন যে আমার সাথে ভালো কথা বলে তখন তাকে সবচেয়ে কাছের মনে হয়। এ কারণে ফুফুর কষ্ট খুব সহজে আমার হৃদয়ে আ’ঘা’ত করল। সাত-পাঁচ না ভেবেই বললাম, “আমি দাদিকে বলল টাকা দিয়ে দিতে। তোমার গহনা বেচতে হবে না।”

“লাভ নেই রে বাজান! আমি মা পায়ে ধরে পর্যন্ত বলেছি।”

“তবুও আমি বলে দেখব। যদি কিছু হয়।”

“চাইলে তুই নিজেও এই টাকা শোধ করতে পারিস।”

“কিভাবে? আমার কাছে এই মুহূর্তে বিশ টাকার একটা নোট ছাড়া এক পয়সাও নেই।”

“কাছে নেই তো কি হয়েছে? ব্যাংকে আছে। ভাইজান তোর জন্য আলাদা করে জমা করে রাখত। মা’য়ের কাছে চেকবই আছে। সেখান থেকে একটা চেক নিয়ে আসব। তুই সই করে দিলেই টাকা তুলতে পারব। দিবি বাজান? চিন্তা করিস না। তোর ফুফা টাকা পেলে পরে আবার ফেরত দিয়ে দেব।”

মাথা দোলাতে দোলাতে হ্যাঁ বললাম। ফুফু চওড়া হাসি দিল। তার চোখ মুখ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে।

রাতে খাবার আয়োজন ভালো। বড় সাইজের গলদা চিংড়ি ভাজা হয়েছে। গরুর গোশতের সাথে পাতলা ডাল। সরু চালের ভাত। সবগুলোই আমার পছন্দের। মজার ব্যাপার হচ্ছে এসব খাবারের ভালো ভালো অংশটুকু আমার পাতে জমা পড়েছে। বহুদিন বাদে মন ভরে খেতে পারছি। অনেকদিন এমন করে খাওয়া হয় না। দাদি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি খুব অবাক হচ্ছেন, সেই সাথে দুশ্চিন্তাও করছেন। খাওয়া শেষে মিষ্টি পানের ব্যবস্থা করা হলো। এই খাদ্যবস্তুটা আমার খুব পছন্দের। ছোট দাদি আমায় দু’টো পান দিলেন। আদুরে গলায় বললেন, “নেও জামাই, পান খাও। ঠোঁট লাল করে ঘুরে বেড়াও। মোরে পানে ফিরা চাও।”

ফুফু খুব জোরে জোরে হাসতে লাগল। আগে ছোট দাদি আমায় নানা ভাই বলে ডাকত। এই বাড়িতে আসার পর থেকে জামাই বলে ডাকে। এ বাড়িতে আসার পর সবার সম্মোধন পাল্টে গেছে। ফুফা আগে দাদিকে শাশুড়ি মা বলতেন, এখানে থাকতে শুরু করার পর থেকে আম্মা ডাকেন। ফুফার অন্য ভাই-বোনরাও আম্মা ডাকে। কেন ডাকে কে জানে! এসব নিয়ে দাদিকে খুব একটা ভাবতে দেখা যায় না।

শোবার আয়োজন করছিলাম। খাওয়াটা একটু বেশি হয়ে গেছে। বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বাতি নিভিয়ে বিছানায় যাওয়ার মুহূর্তে ফুফু এলো। তার আসার ভঙ্গি অনেকটা চো’রের মতো। ফিসফিস করে বলল, “বাজান, চেক নিয়ে আসছি। সই করে দে।”

কোনকিছু চিন্তা না করে সই করে দিলাম। আমার টাকায় যদি একটা মানুষের দেনা শোধ হয় তো হোক। একটা সইতে যদি ফুফুর চিন্তা দূর হয় তবে না হয় সই করেই দিলাম। কি যায় আসে? আমার তো কিছু কম পড়ে যাচ্ছে না। ফুফুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। অনেকক্ষণ ধরে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। বাতি নিভিয়ে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দিলাম।

সকালে ঘুম ভাঙলো চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে। ফুফু আর ফুফার মধ্যে তুমুল ঝগড়া হচ্ছে। ঝগড়ার কারণ বোঝা যাচ্ছে না। ফুফা কুৎসিত ভাষায় ফুফুকে গা’লা’গা’ল দিচ্ছেন। ফুফুও কিছু কম যাচ্ছে না। সমান তালে উত্তর দিচ্ছে। ছোট দাদি তাদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করছেন। ক্রমাগত ফুফার গায়ে হাত বুলাচ্ছেন। নিচু গলায় কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছেন। লাভ হচ্ছে না। দাদির অবশ্য কোন হেলদোল নেই। সোফায় বসে পান চিবুচ্ছেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তিনি ঝগড়া দেখে খুব মজা পাচ্ছেন। ফুফুদের ঝগড়া ততক্ষণ চলল যতক্ষন না খবর এলো তিশা আপু পালিয়ে গেছে। ক্লাসের কোন ছেলের সাথে তার সম্পর্ক ছিল। সেই ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গেছে। আপুর বান্ধবী মনিরা এসে এই সংবাদ দিল। ফুফু ধপ করে মেঝেতে বসে পড়ল।

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০১

0

সূচনা পর্ব
#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল

দাদি বারান্দায় রোদে বসে শাক কুটছেন। এমন সময় ফুফু এসে ঝাঁঝালো গলায় বললো, “এক পা কবরে চলে গেছে এখনও এতো শখ কেন তোমার? তোমার জামাইকে জামদানী শাড়ি কিনতে বলেছ কেন? এই বয়সে কি কেউ জামদানী শাড়ি পরে?

দাদি শান্ত দৃষ্টিতে ফুফুর দিকে তাকালেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ” নগদ টাকা দিয়ে শাড়ি কিনতে বলেছি। তাতে দোষের কি?”

“ওসব তুমি বুঝবে না মা। তোমার শাড়ি কেনা নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছে। শাশুড়ি ননদ খুব হাসাহাসি করছে। এমনিতেই সংসার চলে না তার মধ্যে তুমি ফট করে শাড়ি কিনতে চাইলে। তা-ও আবার লাল রঙের জামদানী। একটিবারের জন্যও আমাদের কথা ভাবলে না। আমার মান-সম্মানের কথা চিন্তা করলে না!”

“করুক হাসাহাসি। তাতে কি হয়েছে? তোর শরীর তো আর পঁচে যায়নি।”

ফুফু সরু চোখে দাদি দিকে তাকালো। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। আজ-কাল কোন কথাই দাদির ওপর প্রভাব ফেলতে পারছে না। তিনি ভাবলেশহীন ভাবে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন। দু-দিন আগের কথা, ফুফুর বড় ননদ বেড়াতে আসবে। ফুফা বাজারের সবচেয়ে বড় মাছটা কিনে আনলেন। বহু যত্নে সেই মাছ রান্না করা হলো। মাছের কোন পিস কার পাতে যাবে তাই নিয়ে বিশাল মিটিং। রান্নাঘরে গোল হয়ে বসে অনেকক্ষণ সেই আলোচনা চললো। ঠিক করা হলো সুমী আন্টি বেড়াতে আসছে। তাতে মাথা দেওয়া হবে। আন্টি মাছের মাথা খেতে ভালেবাসেন। তাছাড়া মেহমানের সম্মান বলেও একটা জিনিস আছে। খাওয়ার সময় দেখা গেল সেই মাছের মাথা পড়েছে দাদির প্লেটে। সুমী আন্টি দাদির প্লেট থেকে মাছের মাথাটা উঠিয়ে নিতে নিতে বলল,” আম্মা জীবনে অনেক মাছের মাথা খাইছেন। এটা আমি খাই।”

দাদি তার হাত চেপে ধরলেন। ভরাট গলায় বললেন, “অন্যের পাতের খাবার তুলে নেওয়া অসভ্যতা। এটা তোমায় কেউ শেখায়নি?”

আন্টি ভড়কে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বলল, “মায়ের থালা থেকে মেয়ে খাবার তুলে নিলে অসভ্য হবে কেন?”

এই কথার জবাবে দাদি খুব কুৎসিত একটা কথা বলে ফেললেন। আন্টি চোখ-মুখ লাল করে খাওয়া ফেলে উঠে গেল। সেই মাছের মাথা নিয়ে বিরাট অশান্তি হয়েছে। পারলে সবাই মিলে দাদিকে বাড়ি থেকেই বের করে দিতো। পারেনি। কারণ এটা ফুফাদের বাড়ি না। এই বাড়ি আমার দাদা তৈরী করেছিলেন। করোনার সময় মা-বাবার মা’রা যাওয়ার পর ফুফুরা সবাই এ বাড়িতে এসে উঠেছে। দাদি বয়স্ক মানুষ, আমার মতো বাচ্চা ছেলেকে নিয়ে একা থাকতে পারবেন না। এসব কথা দিয়েই থাকা শুরু হয়েছিল। প্রথম দিকে দাদি রাজি হচ্ছিলেন না। ফুফা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বললেন, “আম্মা, আপনি বয়স্ক মানুষ। এই বয়সে রান্নাবান্নার ঝক্কি সামলাতে পারবেন না। তাছাড়া ফয়সালের বয়সও খুব বেশি নয়। বাড়ি দেখাশুনোর একটা ব্যাপার আছে। সবকিছু মিলিয়ে এসব দায়িত্ব আপনার মেয়েকেই নিতে হবে। অতো দূর থেকে এসে এতো দায়িত্ব পালন করা সহজ কাজ নয়। কাজেই যদি এখানে থাকা যেত তাহলে তার সুবিধা হতো। এই আর কি!’

ফুফার কথায় দাদি রাজি হলেন। ফুফুরা নিজেদের বাড়ি ফেলে আমাদের বাড়িতে এসে উঠলো। এ বাড়িতে থাকাতে গিয়ে তাদেরও অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়েছে। বড় সাহেবের হাতে পায়ে ধরে ফুফার চাকরির বদলি করাতে হয়েছে। ফুফাতো দুই ভাই স্কুল বদলাতে হয়েছে। তিশার আপুর কলেজ পাল্টাতে হয়েছে। বিশাল ঝামেলা। সে ক’দিন ফুফার অনেক দৌড়াদৌড়ি করতে হয়েছে। অথচ তাকে দেখে মনেই হয়নি তার কষ্ট হচ্ছে। হাসি-হাসি মুখ করে সবকিছু সামলে নিয়েছেন। প্রথম দিকে সবাই দাদির খুব সেবাযত্ন করত। এমনকি ফুফুর শাশুড়ি পর্যন্ত মাথায় তেল চুল বেঁধে দিতো। ফুফুর ছোট ননদ তুলি। সে-ও দিনের বেশিরভাগ সময় দাদির সাথে গল্পগুজব করত। আঠারো বছরের একটা মেয়ের তেহাত্তর বছরের বুড়ির সাথে কি এমন গল্প থাকতে পারে আমার জানা নেই। তবে তারা দু’জন খুব হাসত। আমার যত্নেরও কোন ত্রুটি ছিল না। ফুফুর নিজের হাতে সাবান মেখে গোসল করিয়ে দিতেন। নিয়ম করে দু’বেলা মুখে তুলে খাবার খাইয়ে দিতেন। বেশ কয়েক মাস হলো এসব নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে। হঠাৎ করেই কেউ আমাদের সহ্য করতে পারছে না। কেন পারছে কে জানে?

দাদি বললেন, ” রোদে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? জ্বর হবে।”

“তুমিও তো রোদে বসে আছ। তোমার জ্বর হবে না?”

“বুড়ো হাঁড়ের জোর বেশি। সহজে কিছু হয় না। তাছাড়া একটা বয়সের পর গিয়ে এসব ছোটখাটো রোগ শরীরের বাসা বাঁধে না। তখন সব বড় বড় রোগের দেখা মেলে।”

“তোমার বয়সও তো অনেক। কই? তোমার শরীরে তো বড় কোন রোগ বাসা বাঁধেনি।”

“বেঁধেছে বৈকি! সারা রাত ঘুমতে পারি না। বারান্দার এ মাথা ও মাথা হেঁটে বেড়াতে হয়। ওষুধ খেলেও ঘুম আসে না।”

“ঘুম না হওয়া বড় রোগ নাকি?”

“হ্যাঁ, খুব বড় রোগ। যাদের ঘুম হয় না একমাত্র তারাই এ রোগের কষ্ট বুঝতে পারে।”

দাদি কথায় খিলখিল করে হেসে উঠলাম। অনেকদিন পর মন খুলে হাসতে পারছি। দাদি বললেন, “শাক বাছা হয়ে গেছে। তোর ফুফুর কাছে দিয়ে আয়।”

“আচ্ছা।”

শাকের ঝুড়ি নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম। ফুফু চুলায় ডাল বাগার দিচ্ছিল। আমায় দেখে চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “কি জন্য এসেছিস?”

“দাদি শাকের ঝুড়ি দিতে বলল।”

“তাহলে হা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ওখানে রেখে চলে যা।”

শাকের ঝুড়ি রেখে নিজের ঘরে চলে আসলাম। আজ-কাল এদের কেউই আমায় সহ্য করতে পারে না। ফুফু কথায় কথায় গায়ে তোলে। ফুফা চোখ রাঙিয়ে ছাড়া কথা বলতে পারে না। এক সময় শিমুল আর তালেবের আমার সঙ্গে খুব ভাব ছিল। তিনজন মিলে মার্বেল খেলতাম। এখন ওরাও আমার সাথে কথা বলে না। ফুফা নিষেধ করে দিয়েছে। কেন দিয়েছে কে জানে? সেদিন ওরা মার্বেল খেলছিল। আমি ওদের কাছে গিয়ে বললাম, “আমায় খেলতে নিবি?”

শিমুল গম্ভীর গলায় বলল, “না। তুই আমাদের সাথে মিশবি না।”

আমি অনেকক্ষণ ওদের কাছে দাঁড়িয়ে ঘ্যানঘ্যান করলাম। লাভ হলো না। ওরা আমায় খেলতে নিলো না। এখনও মনে আছে সেদিন স্কুলে টিফিন পিরিয়ডের সময় অনেকক্ষণ কেঁদেছিলাম। রাতের বেলা তালেব বলল, “আব্বা আমাদের তোর সাথে খেলতে নিষেধ করেছে। দেখতে পারলে খুব মা’র’বে। তুই কষ্ট পাস না ভাই।”

সেসব কথা আমি দাদিকে বলিনি। মা বাবা না থাকলে বাচ্চারা খুব সহজে বড় হয়ে যায়। আশেপাশের অনেক জিনিস তাড়াতাড়ি বুঝতে শেখে। আমিও কিছু বুঝেছিলাম। তাই তারপর থেকে আর কখনও শিমুল আর তালেবের সাথে কথা বলি না। স্কুলে যাওয়ার সময় ওদের আগে আগে হেঁটে চলে যাই।

ফুফা আজকে অফিসে যাননি। বাড়িতে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন। মাঝেমধ্যে উঁচু গলায় সেসব খবর পড়ে শোনাচ্ছেন। কেউ শুনছে না। তবুও তিনি পড়ছেন। উত্তেজনাপূর্ণ খবরগুলো লোকের কাছে বলে বেড়াতে ভালোই লাগে। আমারও ভালো লাগে। ইচ্ছে করে দারুণ একটা খবর দিয়ে সবাইকে চমকে দিই। লোকজন সেই খরব শুনে আঁতকে উঠুক। কিন্তু তেমন কোন খবর আমার কাছ পর্যন্ত পৌঁছায় না। বিছানায় শুয়ে ‘আরব্য রজনী’ পড়ছিলাম। তালেব এসে বলল, “বাবা তোকে ডাকছে।”

মেরুদণ্ডের মধ্যে দিয়ে হিমশীতল স্রোত বয়ে গেল। ফুফা আমায় ডাকছে কেন? গত চারমাসে তিনি মোট সাত বার আমায় ডেকেছন। সাত বারই কোন না কোন অন্যায়ের বিচার করেছেন। শিমুল তালেবের জন্য রাখা বেতের লাঠি দিয়ে বিশ্রীভাবে পি’টিয়েছেন। দু’বার জ্বর এসে গেছিল। ডাক্তার ডাকতে হয়েছে। দাদি ভীষণ রাগারাগি করেছিলেন। প্রতিবারই ফুফা ভাবলেশহীন গলায় বলেছেন, “বাচ্চা ছেলে অন্যায় করলে শাসন করতে হয়। এতে এতো রাগারাগির কিছু নেই। আমি শিমুল আর তালেবকেও পিটাই। ওদের ভালোর জন্যই মা’রি।”

দাদি আর কিছু বলতে পারেননি। ফুফা নিজের ছেলেদের মা’রে কথাটা সত্যি। কুকুর পে’টানোর থেকেও বেশি পে’টায় ওদের। ফুফু তখন ছেলেদের হয়ে ঝগড়া স্বামীর সাথে ঝগড়া করেন। কখনও সখনও দু-একটা কুৎসিত গালাগালি দিয়ে বসেন। তবে আমায় বেলায় কখনও এমনটা হয় না। আমায় কিছু বললে ফুফু প্রতিবাদ করে না। বরং ফুফাকে সাপোর্ট দিয়ে বলে, “বাচ্চা ছেলে অন্যায় করলে শাসন করতে হয়। এটা দোষের কিছু না। মানুষটা অন্যায় সহ্য করতে পারে না। নিজের ছেলেদেরও ছেড়ে কথা বলে না।”

কাঁপতে কাঁপতে ফুফার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। অন্যদিনের চেয়ে আজকে একটু বেশি ভয় লাগছে। অবশ্য এর কারণও আছে। গত শুক্রবার ফুফা একটা পদ্ম চারা কিনে এনেছেন। ছাঁদের টবে পানি দিয়ে সেই চারা লাগানো হয়েছে। আজ দেখতে গিয়ে ওটার শেকড় ভেঙে ফেলেছি। এ খবর ফুফার কানে গেলে উনি আমায় জ্যান্ত পুঁ’তে ফেলবেন। ফুফা শান্ত চোখে আমার দিকে তাকালেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “ফয়সাল মিয়া খবর ভালো?”

জড়ানো গলায় বললাম,”হ্যাঁ, ভালো।”

“পড়াশোনার কি অবস্থা? কেমন চলছে?”

“ভালো চলছে।”

তালেব আমার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। ফুফা তার দিকে তাকিয়ে ধমক দিয়ে বললেন, “এখানে কি শুনছিস? তোকে না চা আনতে বললাম?”

তালেব মাথা চুলকাতে চুলকাতে চলে গেল। ফুফা অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, “ফয়াসাল মিয়ার মাছ ধরার শখ আছে নাকি?”

“জ্বি।”

“তা ভালো। ভৈরব নদীতে বিশাল আকারের চিংড়ি মাছ পাওয়া যাচ্ছে। যাবে নাকি? তোমাতে আমাতে গিয়ে দু’চার কিলোগ্রাম ধরে আনবে নাকি?”

ডান দিকে মাথা কাত করলাম। মাছ ধরার প্রতি এক ধরনের দূর্বলতা আছে আমার। ফুফা বললেন, “তাহলে তৈরি থেকো। দুপুরে খাওয়ার পর পর বেরিয়ে পড়বো।”

“আচ্ছা। থাকব।”

“শিমুল আর তালেবকে বলার দরকার নেই। হাদা দু’টো মাছ ধরতে জানে না। শুধু খেতে জানে।”

“জ্বি আচ্ছা।”

“তোমার দাদিকেও বলার দরকার নেই। উনি জানতে পারলে তোমায় যেতে দিতে চাইবে না।”

“জ্বি৷ মনে থাকবে। আমি কাউকে কিছু বলব না।”

“এইতো ইন্টারলিজেন্ড বয়!”

সারা দুপুর উত্তেজনায় কাটলো। পরীক্ষা শুরু হবার আগে রাতে এমন উত্তেজনা থাকে। খাওয়ার সময় বিশেষ খেতে পারলাম না। দাদি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলেন কিন্তু কিছু বলেননি। বললেই সর্বনাশ হয়ে যেত। আমি আবার মিথ্যে বলতে পারি না। মিথ্যে কথা বলতে গেলে খুব হাসি পায়।

বাড়ির সামনের আতা গাছের নিচে বসে আছি। খাওয়া শেষ করার পরপরই এখানে চলে এসেছি। দাদি দেখলে ডেকে নিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। ঘড়িতে প্রায় তিনটে বাজে। ফুফা আসছে না। চাতক পাখির মতো সদর দরজার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ করে তিশা আপু ছুটে এলো। একটা চিরকুট মতো আমার হাতে গুঁজে দিয়ে হিসহিসিয়ে বলল, “এই কাগজটা পড়ে দেখ।”

বলেই এক দৌড়ে ঘরের মধ্যে চলে গেল। এবং প্রায় সেই মুহুর্তে ফুফা এসে হাজির হলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, “যাওয়া যাক।”

আমি মাথা নাড়লাম। শুনেছি নদীর পাড়ের রাস্তায় কাঁদা থাকে না। জোয়ারের পানিতে ধুয়ে চলে যায়। কথাটা মিথ্যে। গোটা রাস্তায় হাঁটু কাঁদা হয়ে আছে। ফুফা বিরক্ত চোখে কাঁদার দিকে তাকিয়ে আছেন।

“মাছ ধরা হবে না ফুফা?”

“হবে না কেন? তুমি একটু এখানে দাঁড়াও। ওদিকের রাস্তায় কাঁদা আছে কি-না দেখে আসি।”

ফুফা ব্যস্ত পায়ে ঝোপের আড়ালে হারিয়ে গেলেন। একা একা দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে না। পকেটে হাত দিয়ে তিশা আপুর দেওয়া কাগজের টুকরোটা বের করলাম। আপুর হাতের লেখা খুব সুন্দর। ছাপা হরফের মতো। কিন্তু আজকে কেমন হিজিবিজি করে লিখেছে। কাগজটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে।

‘আব্বা তোকে মে’রে ফেলবে। তুই তার সাথে একা কোথাও যাস না।’

বহু কষ্টে লেখাগুলো পড়তে পারলাম এবং পরমুহূর্ত থেকে আমার হাত-পা অবশ হয়ে যেতে শুরু করলো। আমি যেন বরফের মতো জমে যেতে শুরু করেছি। প্রথমে পায়ের পাতা তারপর হাঁটু থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত জমে গেছে। হঠাৎ ঝোপের আড়াল থেকে ফুফার দেখা মিললো। উনার সাথে আর একজন অচেনা লোক হেঁটে আসছে। এই গরমের মধ্যে লোকটার গায়ে কালো চাদর জড়ানো। হাত দু’টো সেই চাদরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে আছে। অনুভব করলাম আমি পড়ে যাচ্ছি। আমার শরীর নিজের ভর সইয়ে পারছে না।

চলবে

ইতি উতি সংসার পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#ইতি_উতি_সংসার
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)

রেবেকার বাবা মা যখন তার শ্বশুর বাড়ির গেটে পৌছেছে তখন রাত তিনটে পার হয়েছে।বার কয়েক ফোনে কল এবং ডাকাডাকির পরেও কেউ গেট খুলল না।তখন বাধ্য হয়েই জোরে জোরে শব্দ করলো রাজু সাহেব এবং সি এন জি চালক।আশেপাশের মানুষ জেগে গেছে অথচ বের হতে চায় না সুমনের মা। কিন্তু অনবরত ডাকাডাকির কারণে বাধ্য হয় বের হতে। রেবেকার মা কখনো এই বাড়িতে আসেনি।সে ছোটাছুটি করতে থাকে কোথায়, কোন ঘরে আছে তার মেয়ে।এক সময় পেয়েও যায়।রেবেকা তখন জ্বরে কাহিল হয়ে অনবরত গোঙাচ্ছে। পা ফুলে গেছে, মেয়ের মাথার নিচে হাত দিতেই আঁতকে উঠল ওর মা।কারণ স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে রক্ত জমাট বেঁধে গেছে যে। সুমনের মা তখন ব্যস্ত সবাইকে থামাতে।উচ্চবাচ্য করতেও পিছপা হয় না।কেবল রেবেকার মা তার স্বামীকে বলল,

“রেবুর বাবা, মেয়েরে কি মা’রতে চান? না চাইলে এক্ষুণি হাসপাতালে চলেন।”

“কি হইছে ওর?ও ঠিক আছে?”

“কিচ্ছু ঠিক নাই।ওর পা ফুলে গেছে আপনি দেখেন না?ওর শরীরে জ্বর, মাথার নিচে রক্ত।”

আবোলতাবোল বলতে থাকে রেবেকার মা।বুদ্ধি করে এই মুহুর্তে পাড়া প্রতিবেশীদের মাঝে দুই একজন ধরে তুলে দেয় সি এন জিতে। এক কালে লাল শাড়ি পরে রঙিন স্বপ্ন নিয়ে আসা মেয়েটা আজ রক্তাক্ত অবস্থায় ফিরে যাচ্ছে বাবা মায়ের সাথে। রেবেকাকে নিয়ে যখন হাসপাতালে পৌঁছেছে তখন পুরো শহর যেন ঘুমিয়ে। কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে দেখে ভীষণ বকাবকি করলেন।পায়ের হাঁড় ভেঙ্গে গেছে মেয়েটার। যতদ্রুত সম্ভব অস্ত্র পাচার করতে হবে। ভয়ে সিটিয়ে গেলেন রেবেকার মা বাবা। কাঁদতে কাঁদতে কল দিলেন তার ছেলেদের। রেবেকার দুই ভাই চাকরিসূত্রে শহরের বাইরে থাকে। বোনের এমন খবর পেয়ে এক মুহুর্ত অপেক্ষা করলেন না।নিজ নিজ স্ত্রীকে বললেন সকাল হলে সন্তান নিয়ে চলে যেতে তাদের গ্রামের বাড়ি।দুই ভাই ফোনে কথা বলে আজানের পূর্বেই মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটলেন বোনের কাছে।

ব্যথানাশক দেওয়ার পর রেবেকা ঘুমালো। তার দুই চোখে যেন ঘুমের রাজ্য নেমে এসেছে। ঘুম ভাঙলো ভাইদের কথায়।আজকেই অপারেশন করতে হবে। ছোটো ভাই সবার জন্য নাস্তা আনতে গেলে বড় ভাই গেলেন ব্যাংকে টাকা তুলতে।এসময়ে একটা বারের জন্যও সুমনকে কল দেওয়া হয়নি।রেবেকার মনে পড়লো তার কথা কিন্তু ছোটো ভাইয়ের রাগ অনেক।একটা বার যদি রেগে যান তাহলে সুমনকে আঘাত করতেও চিন্তা করবেন না। অপারেশনের পূর্বে ছোটো ভাই এসে তার পাশে বসে বলল,

“ওই বাড়িতে এতো অবহেলা কেন বলিস নি আমাদের?”

রেবেকা চমকে যায় ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনে।তার দুই চোখে ভয় দেখা দেয়। ভাঙ্গা গলায় বলে উঠে,

“সুমন খুব ভালো ছেলে ভাইয়া।ওর কোনো দোষ নেই।”

“দোষ নেই?তবে এখনো কেন এলো না?”

“ও কি জানে?”

রেবেকা নিজেই প্রশ্নটা করে থমকে গিয়েছে।সত্যি তো! সুমন কি জানে যে তার স্ত্রী হাসপাতালে? কিন্তু চিন্তা করার সময় নেই এখন। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় অপারেশন থিয়েটারে।পায়ের হাড় যে জায়গা চুত্য হয়ে গেছে।

পুরো রাত এপাশ ওপাশ করেও ঘুম হয়নি সুমনের।মায়ের থেকে গতকাল শুনেছিল রেবেকা অসুস্থ কিন্তু কতোটা কি হয়েছে তা জানার জন্য যতো বার কল দিয়েছে ততবার বড় ভাবী রিসিভ করেছে।জানিয়েছে রেবেকা ঘুমাচ্ছে।কিন্তু এতোটা ঘুম কিসের মেয়েটার?রেবেকার ঘুম ভীষণ হালকা।সামান্য ডাক কিংবা স্পর্শে তার ঘুম ভেঙ্গে যায় সেই মেয়েটা ফোনের শব্দেও জেগে উঠছে না?

সকাল সাতটা বাজতে না বাজতেই অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো সে। নয়টার সময় অফিস পৌঁছে নিজের মনকে আর মানাতে পারলো না। ছুটি নিয়ে চলে গেল বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি পৌঁছানোর পূর্বে বার কয়েক কল দিলো রেবেকার ফোনে কিন্তু অপর পাশ থেকে কেউ কল রিসিভ করলো না।বাড়ির সামনে বাইক থামিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে মাকে ডাক দিলো।

“তুই আমাকে আর মা বলে ডাকিস না সুমন। যদি ওই বউ আনিস তো!”

“বউ আনিস তো মানে মা?রেবেকা কোথায়?তুমি না গতকাল বললে ও একটু অসুস্থ? কোথায় ও?”

“কল পাড়ে আছাড় পড়ে একটু ব্যথা পাইছিল। এটা আর এমন কি?কিন্তু তুই জানিস? রাত তিনটার দিকে ওর বাপ মা এসেছিল,সেই রাতেই ওকে নিয়ে গেছে।”

সুমন জুতোর ফিতেটা মাত্র খুলতে বসেছিল কিন্তু মায়ের কথা শুনে দ্রুত বেরিয়ে গেল। প্রথমে কল দিলো রেবেকার ফোনে কিন্তু ফোন বন্ধ।রেবেকার বাবার ফোনে কল দিয়েও লাভ হলো না।শেষ মেষ শ্বাশুড়ির নাম্বারে কল দিয়ে খবর পেল তারা হাসপাতালে আছে। হাসপাতালের ঠিকানাটা নিয়ে দ্রুত সেখানে পৌঁছে গেল সে। রেবেকাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে ততক্ষণে বের করা হয়েছে। পায়ে রড পড়ানো হয়েছে তার। প্রচন্ড যন্ত্রণায় তার মুখশ্রী যেন নীল বর্ণের হয়ে গেছে।সুমন কিছুই বলল না যখন তার দুই সুমন্ধী তাকে নানান কথা শোনালো। ছোটো ভাই তো সরাসরি ডিভোর্সের কথা বলতেও একবার চিন্তা করলো না।সুমন মাথা নিচু করে কেবল শুনেই গেল।বেলা গড়িয়ে দুপুর হলে রেবেকার বাবা মাকে নিয়ে তাই বড় ভাই বাড়ির দিকে গেল। ভদ্রলোক সুমনকে বিশ্বাস করেন। তাছাড়া স্বামী স্ত্রীর মাঝে বোঝাপড়ার ব্যপারটাও তো আছে।ছোটো ভাইকে চোখ রাঙিয়ে যেতেও ভুললেন না।সুমন অপেক্ষা করলো তাদের চলে যাওয়া পর্যন্ত। কেবিন ফাঁকা হলেই কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।তার দুই চোখের পানি যেন আজ বাধন ছাড়া হয়েছে।রেবেকা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো,
“তার ব্যক্তিগত পুরুষ কাঁদছে।পুরুষের কান্না এতো সুন্দর কেন হয় যখন সে প্রিয় মানুষের জন্য কাঁদে?”
ক্যানোলাযুক্ত হাত দিয়ে রেবেকা স্পর্শ করে সুমনের হাত। সেই হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে নিজের কপালে ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো সুমন।

“আমায় মাফ করে দিও। আমি তোমার খেয়াল রাখতে পারিনি।”

“তেমন কিছুই নয়।ঠিক হয়ে যাবো।কিন্তু একটা কথা বলতে চাচ্ছি।আমি এই কয়েকদিন আমার বাবার বাড়ি থাকতে চাই।”

সুমন হ্যাঁ বা না কিছুই বলল না।কেবল স্ত্রীর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল।

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর রেবেকাকে তার বাবার বাড়িতেই নেওয়া হলো।এই সময়টায় সুমন হাসপাতাল থেকেই অফিস করেছে।বাড়ি ফেরার পাঁচ দিন পর সুমনের মা এসে হাজির হলো রেবেকাদের বাড়িতে।সেদিন ছুটির দিন ছিল। সুমন নিজ হাতে ডাব কেটে এগিয়ে দিচ্ছিলো রেবেকার দিকে।

“ঘরজামাই হয়ে গেলি শেষ পর্যন্ত?”
“ঘরজামাই কেন হতে যাবো মা?”
“তাহলে বাড়ি যাস না কেন?এখান থেকে অফিস করছিস, বাজারে যাচ্ছিস অথচ বাড়িতে গিয়ে একটা বার মায়ের সাথে দেখা করতে পারিস না?”

সুমন মায়ের দিকে তাকায়।হতাশায় ছেয়ে গেছে তার অন্তর।রেবেকার বাবার বাড়িতে রাতে কেবল কয়েকটা ঘন্টা থাকার সুযোগ পায় সে। সাতটায় বের হয়ে অফিস করে আবার ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বেজে যায়। এখানে আসার একটা মাত্র কারণ হচ্ছে এই অসুস্থ সময়ে রেবেকা যেন একটু স্বস্তি পায়। তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি দুজনেই বয়স্ক।সারা দিনে রেবেকার দেখাশোনার জন্য একজন মেয়েকে ঠিক করা হয়েছে কিন্তু রাতের বেলা বয়স্ক দুজনের কষ্ট হবে ভেবে সুমন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ক্লান্তিকে সায় দিচ্ছে না।অথচ তার মা উল্টো বুঝে বসে রইল।

“মা রেবেকা যে ব্যথা পেয়েছিল আমাকে কেন বলোনি?”
“একটু ব্যথায় কি হয়?”
“মাথার পিছনে তিনটে সেলাই আর পায়ে রড লাগাতে হয়েছে ওকে।এতো কেন বিরক্ত তুমি?”
সুমনের মা কিছু বলল না।যেমন এসেছিল তেমন ফিরে গেল।বেয়াই বেয়াইনের শত অনুরোধও রাখলো না। যাওয়ার সময় বলে গেল নিশ্চয়ই তার ছেলেকে যাদু টোনা করা হয়েছে। সুমন সেসবে কোনো ধ্যান দিলো না।অপর দিকে বোনের প্রতি ভালোবাসা দেখে রেবেকার দুই ভাইয়ের রাগ পড়ে গেল।তার বাবা মা তো শুরুর দিন থেকেই বুঝেছিল ছেলেটার দোষ নেই।কিন্তু রেবেকার মনে শান্তি রইল না। কেবল তার অল্প দিনের সংসারের দিকে টান তৈরি হলো দ্বিগুণ ভাবে।

রেবেকা সুস্থ হওয়ার পর সুমন তাকে নিয়ে শহরে নতুন করে সংসার পাতলো।কিন্তু যোগাযোগ হলো না মায়ের সাথে।একদিন জানতে পারে মায়ের আদরের বড় বৌ, যে বাবার বাড়ি থেকে এতো এতো জিনিস নিয়ে এসেছিল, স্বামী বিদেশ থেকে আসার পর সে পৃথক হয়ে গেছে।তার মা একা একাই এখন থাকছে।এমন কথা শুনে সুমন মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও ভদ্রমহিলা রাজি হলো না।সে কোনো ভাবেই আর ছেলেদের সাথে থাকবেন না। বাকীটা জীবন এভাবেই কাটাবেন।মায়ের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হলো সুমন।একটা সময় ভাবলো অন্তত খরচটুক তো নিবে।একজন কাজের লোক রাখবে কিন্তু তার মা তাতেও নারাজ।কেবল এক দিন রান্না করে তিন দিন খাচ্চে তবুও ছেলেদের কাছে হাত পাততে রাজি নয়।

রেবেকা সেদিনের পর শ্বাশুড়ির সাথে আর কোনো কথা বলেনি।যার জন্য সে মরতে বসেছিল তাকে কোনো ভাবেই মাফ করে দেওয়া যায় না।কিন্তু সুমনের কথা চিন্তা করে তার মন দুর্বল হয়।হয়তো সুমন চায়, রেবেকা নিজ শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলুক এবং মনোমালিন্য মিটিয়ে নিক কিন্তু মুখে বলতে পারে না।রেবেকার নিজেরো ইচ্ছে হয় না এই বিষয়ে কথা বলতে। সময়ের স্রোতে স্মৃতির উপরে অভিমানের পাল্লা কমে যাবে হয়তো একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই ইতি উতি সংসারে।

(সমাপ্ত)

ইতি উতি সংসার পর্ব-০১

0

#ইতি_উতি_সংসার
#সাদিয়া_খান(সুবাসিনী)
#পর্ব-১

“গয়নাটা খুলে দাও বৌমা।এটা তোমার নয়।” চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে রেবেকা বলল তার শ্বাশুড়ি মা।বিস্মিত কণ্ঠে রেবেকা ফিরতি প্রশ্ন করলো,
“আমার নয়?”
“না, আমার ছোটো মেয়ের গয়না।তোমাকে কেবল তুলে আনার জন্য দিয়েছিলাম।তুমি এবার দিয়ে দাও তো।”
“কিন্তু মা!”
“কোনো কথা নয়।দ্রুত হাতে, কানে,গলায় যা আছে খুলে দাও।”
হাতে, কানের দুল খুলে শ্বাশুড়ির সামনে টেবিলে রাখলো রেবেকা।বিরক্তির সাথে শ্বাশুড়ি বলল,
“নাকের ফুলটা খুলছো না কেন?সেটাও তো তোমার বাবা দেয়নি।আমার বাড়ি থেকেই দেওয়া হয়েছে।”

নাকের ফুলটা খোলার সময় বুকের ভিতর হাহাকার করে উঠলো রেবেকার।দুই চোখ ছলছল করে উঠলো। দীর্ঘশ্বাস চাপা রেখে টেবিলের উপর নাকফুলটা খুলে রেখে চলে আসছিল। সেই সময় পুনরায় শুনলো,
” তোমাকে কি ধরে ধরে বলতে হবে?গলার চেইন কে রাখবে?”

“চেইন তো আমার বাবা দিয়েছে মা।এটা কেন দিবো?”
“তোমার বাবা দিয়েছে ঠিক আছে কিন্তু তোমার কাছে রাখার কি দরকার?”
” আমার কাছে দরকার আছে মা।আপনাদের দেওয়া নাকফুলটাও যদি আপনারা নিয়ে যেতে পারেন তাহলে আমি কেন আমার জিনিস দিবো?”

বিয়ে করে আসার পর সাতদিনের মাথায় নতুন বউয়ের কাছ থেকে এমন ব্যবহার আশা করেনি ঝুমু বেগম।রাগে তার ফর্সা গাল দুটো লাল হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে তার মনে হচ্ছে রেবেকার গালে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতে।নেহাৎ ছোটো লোকের পরিচয় দেওয়া হবে বলে কিছু বলল না।বিয়েতে মেয়েটার বাবা কিছুই দেয়নি এমন নয়, দুশো মানুষ গিয়েছিল বরযাত্রী হিসেবে।তার ছেলে যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে। তাই বলে মেয়ের বাবা কি করে মেয়েকে সাজিয়ে দিলো না?ঘর সাজিয়ে দিলো না?এই যুগে এমন মানুষও আছে?

রেবেকা কিছু না বলে নিজের ঘরে চলে এলো।প্রেমের বিয়ে নয় তাদের। কয়েক বার দেখাশোনার পর বিয়ে ঠিক হয়েছে। বিয়ের আগে যখন সুমনের সাথে আলাপ হলো তখন দেখেছে সুমন মানুষ হিসেবে ভালো।আজ সকাল অবধিও তার মনে হচ্ছিলো সে ভালো পরিবার পেলো অথচ আজ এক মুহুর্তে সব বদলে গেল।সুমন চাকরিসূত্রে শহরের বাইরে থাকে। গতকাল রাতেই ফিরেছে নিজ কর্মস্থলে আর আজকেই এমন ব্যবহার পেল রেবেকা। গুমরে উঠলো নিজের ভিতরে রেবেকা।এই কথা সে কাকে বলবে?সুমনকে?যদি সে ভুল বুঝে?বাবাকে বললে বাবা নিজ থেকে এসে তাকে নিয়ে যাবে না হয় গয়না পাঠাবে।এতে কি সম্পর্ক নষ্ট হবে না?

জানালায় দাঁড়িয়ে রেবেকা দূর আকাশের মেঘগুলোকে দেখতে দেখতে ভাবে ‘এখন কি করবো?মা বলেছিল, বাবার বাড়ির কথা শ্বশুর বাড়ি এবং শ্বশুর বাড়ির কথা কখনো বাবার বাড়িতে বলতে নেই।’

রেবেকার উপর তার শ্বাশুড়ি বড় ছেলের বউয়ের সাথে মিলে শুরু করলো নতুন অত্যাচার। বিয়েতে উপহার পাওয়া সকল কিছুই ধীরে ধীরে তার থেকে নিয়ে যেতে লাগলো।এমন কি উপহার পাওয়া বিয়ের শাড়িগুলোও। দীর্ঘশ্বাস বাড়তে থাকে রেবেকার।অপর দিকে সুমন হুট করেই তার সাথে কথা বলাও কমিয়ে দিলো। বিয়ের একুশ দিনের মাথায় রেবেকার রাগ আর সীমায় রইলো না।হুট করেই সে খারাপ ব্যবহার করলো সুমনের সাথে।দুজনের ঝগড়া সীমাবদ্ধ রুমে রইলেও আঁচড় কেটে গেলো রেবেকার মনে।

খেতে বসেও রেবেকাকে শুনতে হলো এই বাটিটা ঝুমু বেগমের বাবার বাড়ি থেকে এসেছে, ওমুক বাটিটা বড় বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে এলো। এসব শুনে একটা সময় খাবার খাওয়ার চাহিদা কমে গেল। সুমনের সাথে মনোমালিন্য এবং তার পরিবারের এমন ব্যবহার আর নিতে না পেরে একদিন অসুস্থ হয়ে পড়লো রেবেকা।কলপাড়ে পড়ে গিয়ে আঘায় পেলেও তার চিকিৎসা করানোর জন্য নিয়ে গেল না কেউ।সুমনকে ওর মা বলল তেমন ব্যথা পায়নি। নাপা খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। রেবেকার সাথে কথা বলতে চাইলে বলল, ‘ওর বিশ্রাম প্রয়োজন, ওকে ঘুমাতে দে।’

সুমনের ভুলটা বুঝি এখানেই হলো।সে মায়ের প্রতিটা কথা নির্দ্বিধায় বিশ্বাস করে নেওয়াটা। বিশ্বাস না করেও বা কি করতো সে?যে মায়ের কাছে ত্রিশ বছর নিজের গোপন কথা জমা রেখেছে সে মা কেন তার স্ত্রী সম্পর্কে ভুল বলবে? রেবেকা মুখে মুখে তর্ক করে এটা অবিশ্বাস করার ও কিছুই নেই।উচ্চশিক্ষিত মেয়ে, তার পছন্দের অপছন্দের মতামত সে দিবেই। তবুও মনের মাঝে একটা খচখচানি রয়ে গেল মেয়েটার জন্য।মেয়েটা ঠিক আছে তো?মনে পড়ে গেল বিয়ের রাতের সেই লজ্জা রাঙা মুখশ্রীর কথা।মনে পড়লো একে অপরকে বিলিয়ে দেওয়ার লাল, গোলাপি রঙের অনুভূতির কথাগুলো। ফোনের ক্যালেন্ডারের দিকে চাইলো সে। সামনের সপ্তাহে বাড়ি যেতেই হবে।তখন অভিমান করে রেবেকা পালাবে কোথায়?

রাত বাড়তেই রেবেকার যন্ত্রণা বাড়লো।চোখ মুখ নীল বর্ণের হয়ে গেল সেই যন্ত্রণায়।পায়ের ব্যথা কিংবা মাথার যন্ত্রণায় অস্থির রেবেকার গায়ে তখন ভীষণ জ্বর।রাত দুটোর সময় বিছানা হাতড়ে নিজের ফোনটা পেল সে।বাড়ির সবাই তখন যার যার মতোন নিজের রুমে ঘুমিয়ে আছে। গলাটা পানির তেষ্টায় ফেটে যাচ্ছে। দুই বার সুমনের ছোটো বোনের নাম ধরে ডাকলেও কেউ এলো না।রেবেকার মনে হলো সে বুঝি আর বাঁচবে না।উপায়ন্তর না পেয়ে সে কল দিলো তার বাবাকে।
এতো রাতে মেয়ের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন রেবেকার বাবা রাজু সাহেব।উঠে বসে কল রিসিভ করে বললেন,

“কি হয়েছে মা? এতো রাতে কল দিয়েছিস?”

রেবেকা কিছু বলতে পারলো না।সে যন্ত্রণায় আঁতিপাঁতি করছে।তার কণ্ঠস্বর বাবা না বুঝলেও ছোঁ মেরে ফোন নিয়ে গেল তার মা।মেয়ের এমন যন্ত্রণা দায়ক কণ্ঠস্বর শুনে বললেন,

“তোর কি হয়েছে? তোকে ওরা কেউ কিছু করেছে?এই রেবু?কি হয়েছে মা?”

“আম্মা! পানির জন্য আমার গলা ফেঁটে যাচ্ছে আম্মা।আমাকে একটু পানি দিয়ে যাও।”

“কি হয়েছে তোর?”
“কলপাড়ে পড়ে গিয়ে ব্যথা পেয়েছি আম্মা।”
“বাড়ির সবাই কই?তারা জানে না?”
“সবাই ঘুমায়। আম্মা আমার ভয় লাগতেছে।”

রেবেকার বাবা মা অপেক্ষা করে না।পাশের বাড়ির একজনকে ডেকে তুলে তখনি।তার সি এন জি আছে, সেটা নিয়েই সেই গভীর রাতে ছুটে যায় মেয়ের শ্বশুর বাড়ি। মেয়ে যে তার পানির পিপাসায় অস্থির হয়ে আছে। কিন্তু ভয় বাধে রেবেকার মায়ের মনে।তার কেন যেন মনে হচ্ছে শেষ অবধি মেয়েটাকে পানিও দিতে পারলো না।

চলবে

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-১২ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
শেষপর্ব

মন খারাপ ভাবটা তখনও প্রাণেশার চোখেমুখে লেপটে আছে একেবারে। বার দু’য়েক সেই মুখ দেখে অনির্বাণ বলল,
‘আবার কী সমস্যা? চাচ্চু তো কথা বলেছে। এখন একটু স্মাইল দে প্লিজ।’

প্রাণেশা বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘তোমার কী ধারণা, বাবা সত্যিই আমাকে মন থেকে ক্ষমা করেছে? এত বছরে যে মানুষ আমার দিকে ফিরে তাকায়নি, আমার কোনো কথা ও কাজকে সাপোর্ট করেনি, আজ এক নিমিষেই সব সহজ হয়ে গেছে?’

গন্তব্যের আর অল্প বাকি। অনির্বাণ চায় না নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছানোর পর প্রাণেশার আর মন খারাপ থাকুক। এত বড়ো একটা সারপ্রাইজ অথচ এই মেয়ে গালমুখ ফুলিয়ে আছে, মানা যায়? তাই সে নিজের যুক্তি তুলে ধরতে বলল,

‘মানুষ কি সবসময় এক থাকে? পরিবর্তন তো আসে তাই না?’

‘হুম… আসে। কিন্তু এই পরিবর্তনটা এতটাও সহজ মনে হচ্ছে না।’

‘কেন?’

প্রাণেশা চুপ থেকে বাবার কথাগুলো ভেবে নিয়ে আস্তেধীরে বলল,
‘বাবার কণ্ঠস্বরে এতটাও জোর ছিল না, অনি। বাবা খুশি হয়েছেন, আমাকে বাড়ি যেতেও বলেছেন, কিন্তু আমার চলাফেরা নিয়ে নেগেটিভ-পজেটিভ কিছু বলেননি। আমার ধারণা বাড়ি গেলে উনি আগের মতোই বলবেন, ‘এখন অন্তত সবার কথা মতো চলো। নিজের মধ্যে পরিবর্তন আনো। বাড়ির আট-দশজন যেভাবে নিজের উন্নতি করছে, সেভাবে উন্নতি করার চেষ্টা করো।’ এই কথাগুলো বলবেন, এটা আমি নিশ্চিত।’

‘ছাড়। এসব নিয়ে এত ভাবতে হবে না। ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা পছন্দ করি না আমি। এই কারণেই আমি বলব না, তুই বদলে যা। বরং এটা বলব, যেমন আছিস, তেমন থেকে যা। এখন তোর পরিবর্তন হলে আমি-ই কষ্ট পাব।’

অনির্বাণের এই কথায় যারপরনাই চমকাল প্রাণেশা। বিস্মিত চোখজোড়া নিয়ে তাকিয়ে রইল। অনির্বাণ হাত বাড়িয়ে বউয়ের গাল টেনে দিল। প্রাণেশা সেভাবেই বলে উঠল,

‘পরে আফসোস করবে না তো?’

ভ্রু কুঁচকে গেল অনির্বাণের। বলল,
‘কেন? এখানে আফসোসের কী আছে?’

প্রাণেশা ঢোক গিলে বাইরের দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,
‘আমি তিনবেলা রান্না করতে পারব না। তবে তুমি চাইলে মাঝেমধ্যে চেষ্টা করব। শাড়ি পরে সাজুগুজু করে থাকতে পারব না। নিয়ম করে তোমাকে ‘ভালোবাসি’ বলতে পারব না। টিপিক্যাল বউদের মতো, এটা-ওটা নিয়ে আবদার করতে পারব না। কিংবা এখানে-ওখানে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে বায়না করতে পারব না। শাড়ি নেই কেন, মেকাপ নেই কেন, জুয়েলারি নেই কেন, ঘরে বাজার নেই কেন, তোমার ফিরতে দেরী হচ্ছে কেন, এমন সব উদ্ভট প্রশ্ন নিয়ে কোনোপ্রকার অভিমান ও জেদ দেখাতে পারব না। সারাক্ষণ গিন্নী গিন্নী ভাব দেখাতে পারব না। হবে না আমাকে দিয়ে এসব।’

অনির্বাণ ঠোঁট চেপে হেসে বলল,
‘এতে আমার আফসোস হবে, এটা তোর কেন মনে হলো প্রাণ?’

‘স্বামীরা তো বউয়ের হাতের রান্না খেতে পছন্দ করে। বউদের আবদার মেটাতে পছন্দ করে। একসাথে ঘুরতে যেতে পছন্দ করে। বউকে সাজুগুজু করে বউ বউ সাজে দেখতে পছন্দ করে। তাই। যদি পরে কোনোদিন তোমার মনে হয়, আমি তোমার মনমতো নই, কিংবা তোমার সাথে আমার ঠিক মানাচ্ছে না, তখন তো তোমার আফসোস হবে, কষ্ট হবে। প্রতিটা মানুষেরই বিয়ে নিয়ে, বউ নিয়ে অনেক স্বপ্ন, অনেক ইচ্ছে থাকে। তুমিই তো বলেছ, বউকে নিয়ে তোমারও অনেক স্বপ্ন আছে। আমি টোটালি সাধারণ মেয়েদের থেকে বিপরীত স্বভাবের মেয়ে। যে ঘর বুঝে না, সংসার বুঝে না, দায়িত্ব বুঝে না। তাকে বিয়ে করে জোরপূর্বক ঘর-সংসার করা তো আফসোসের শিকার হওয়া তাই না?’

সব কথা বুঝে, বিজ্ঞের মতো উপরনিচ মাথা ঝাঁকাল অনির্বাণ। ড্রাইভে মনোযোগ রেখে বলল,
‘আচ্ছা, একটা কথা বল তো। আমার জন্য তুই ঠিক কী পারবি?’

প্রাণেশা স্পষ্ট স্বীকারোক্তির সাথে বলল,
‘কিছু পারি আর না পারি, উপরের সবগুলো বাদে তোমার সব প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে আমি তোমার পাশে থাকব। আমি হয়তো অন্যসবার মতো নিজের সব চাওয়া-পাওয়া মেলে ধরব না, কোনোকিছুর কমতি দেখলে ঝগড়াঝাটি করব না, তবে তোমার সব ইচ্ছেদের প্রাধান্য দিব, আমার মতো করে। এই কথার গ্যারান্টি দিতে পারি।’

‘ওকে। আমি এতেই সন্তুষ্ট। আমার বউকে অন্যসব বউদের মতো হতে হবে না। নিয়ম করে সাজুগুজু করতে হবে না। শাড়ি ও হিল পরে বউ সাজতে হবে না। ঘুরতে যাওয়ার বায়নাও ধরতে হবে না। ঘর বুঝতে হবে না, সংসার বুঝতে হবে না। শুধু আমাকে বুঝলেই হবে। পারবি তো?’

‘খুব পারব।’

‘আমি তোর মধ্যে কোনোপ্রকার পরিবর্তন দেখতে চাই না। তুই যেমন আছিস, আমি তোকে সেভাবেই ভালোবাসব প্রাণ। তবে, একটা ব্যাপারে আমার কথার যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। নয়তো, সুনামি হয়ে যেতে পারে।’

প্রাণেশা চেহারার ভাবভঙ্গি পালটিয়ে বলল,
‘কোন ব্যাপারে?’

চোখের ইশারায় প্রাণেশাকে কাছে ডাকল অনির্বাণ। প্রাণেশা এগোলো। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে ভেসে এলো,
‘যখন তোকে আদর করব, তখন কোনোপ্রকার অজুহাত শুনব না। তবে কিছু কিছু সময় আমি নিজেই ছাড় দিব।’

ধুম করে অনির্বাণের পিঠের মধ্যে একটা বসিয়ে দিল প্রাণেশা। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,
‘নির্লজ্জ কোথাকার।’

হো হো শব্দে হেসে উঠল অনির্বাণ। হাসতে হাসতে সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,
‘আমার জন্য তুই নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তনের সুত্রপাত ঘটাবি না। এটা আমি মানতে পারব না। তোকে নিয়ে সবার মাথাব্যথা থাকলেও আমার নেই। চাচ্চু যা-ই বলুন, এসব কথা কানে নেয়ার দরকার নেই। তোর জীবনটা যেহেতু আমার সাথে জড়িয়ে গেছে, তা-ই তোকে নিয়ে পজেটিভ-নেগেটিভ সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার অন্য সবার চেয়ে আমারই বেশি। আমি বলব, নিজেকে বদলানোর দরকার নেই। তোকে আমি এভাবেই গ্রহণ করেছি, মেনে নিয়েছি, ভালোবেসেছি। অন্যদের কাছে এই চলাফেরাটা কেমন আমি জানি না, তবে আমার কাছে প্রাণ মানেই সদা নিজেকে ভালোবাসতে জানা এক নারী। যে সবার আগে নিজেকে ভালোবাসে, নিজের সিদ্ধান্ত ও স্বাধীনতায় বাঁচতে ভালোবাসে। পরিবর্তনের কারণে যদি প্রাণের মধ্যকার প্রাণ যদি হারিয়ে যায়, প্রাণকে যদি নিষ্প্রাণ হয়ে যেতে হয়, তাহলে প্রাণের পরিবর্তনের কোনো প্রয়োজন নেই। আমি তোকে নিষ্প্রাণ দেখতে পারব না।’

প্রাণেশা শুধু মুগ্ধ চোখে তাকাল একবার। এরপরই শব্দ করে হেসে ফেলল। কখন যে গাড়িটা অচেনা গন্তব্যে এসে পৌঁছাল, সে তা টের পেল না। গেটের কাছে গাড়ি পার্কিং-এ রেখে ইট সোলিংয়ের রাস্তায় নামল অনির্বাণ। অন্যপাশের ডোর খুলে দিয়ে বলল,

‘নেমে আয়।’

গেটের সামনে নেমেই বিস্ময়ে মুখটা হা হয়ে গেল প্রাণেশার। সে স্তম্ভিত, অনড় শরীর নিয়ে সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। সবুজ সাইনবোর্ডে হলুদ রং দিয়ে কী সুন্দর লেখা, ‘প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ’। দৃষ্টি ফিরে অনির্বাণের দিকে তাকাতেই অনির্বাণ চমৎকার হেসে ভেতরে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে হাত বাড়িয়ে রেখে বলল,

‘প্রাণের পুষ্পকুঞ্জে আমার ব্যক্তিগত প্রাণকে স্বাগত।’

সন্ধ্যার টিমটিমে আলোয় আলতোস্পর্শে অনির্বাণের হাত ধরল প্রাণেশা। গেটের ভেতরে পা ফেলে দেখল, দু’জন প্রৌঢ়বয়সী দম্পতি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন। অবাক দৃষ্টিতে সব দেখল। ডানে-বামে অসংখ্য ফুলগাছ ও নাম না জানা ফুলেদের ঘ্রাণে চোখেমুখে মুগ্ধতা ও আনন্দ নেমে এলো। সে দু’পা এগোতে গিয়ে শক্ত করে অনির্বাণের হাতটা ধরে বলল,

‘এটাই সেই জায়গা?’

অনির্বাণ স্পষ্টকণ্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ, এটাই। লাস্ট ইয়ারে আমার কিছু জমানো টাকা দিয়ে এই জায়গাটা কিনেছিলাম। যদিও ইচ্ছেটা অন্য ছিল!’

কথা শেষ করার আগেই প্রাণেশা বলল,
‘অন্য কী ইচ্ছে?’

‘আমি তো ঢাকাতেই সেটেল্ড হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, বিয়ের পর এখানে একটা বাড়ি বানাব। বউ নিয়ে এখানেই থাকব। দেশের বাড়িতে আর যাব না।’

‘তাই? হঠাৎ করে জমি কিনতে গেলে কেন?’

‘জমির মালিক, এই জায়গাটা নিজের স্ত্রীর জন্য সাজিয়ে ছিলেন। গতবছরেই ভদ্রলোকের স্ত্রী ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। তিনি এটা স্মৃতি হিসেবে রাখতে পারতেন, কিন্তু নিজের দুর্বল জায়গা ছিল বলেই, বিক্রি করে দিতে চাইলেন। আরিফ জায়গাটার সন্ধান দেয়াতে দেখতে এসে আমারও পছন্দ হয়ে গেল। তাই কিনে ফেললাম। খুব বেশি দাম না। মাত্র পনেরো লাখ।’

হাঁটতে হাঁটতে ওরা পর্ণকুটিরের সামনে গেল। দেখেই মনে হচ্ছে নতুন করে সাজানো। চারপাশ কেমন ঝিকিমিকি আলোয় উজ্জ্বল হয়ে আছে। সে ছোটো সাইজের পর্ণকুটির দেখে বলল,

‘সেদিন আমি তোমাকে এরকম একটা ঘরের কথা বলেছিলাম। তুমি মনে রেখেছ?’

‘হ্যাঁ, এটা ভাঙা ছিল। ঝড়তুফানে ভেঙে গিয়েছিল। তুই বলার পর, রহমত চাচাকে দিয়ে আবার এটার কাজ ধরিয়েছি। কিছু চারাগাছ লাগিয়েছি। সবকিছু নতুনভাবে সাজিয়েছি। পছন্দ হয়েছে?’

আনন্দে কোনো কথাই বলতে পারল না প্রাণেশা। শহর থেকে দূরে, একদম লোকসমাগমের আড়ালে সবুজ-শ্যামল পরিবেশে এমন একটা পর্ণকুটির সাজানোর খুব ইচ্ছে ছিল তার। রব যে তার ইচ্ছে এইভাবে পূরণ করে দিবেন, ভাবেনি। সে খুশিমনে সামনে থাকা দম্পতির দিকে এগিয়ে গেল। তাদের থেকেই জেনে নিল, এখানকার মালিকের যাবতীয় খবরাখবর ও পর্ণকুটির নিয়ে অনির্বাণের হুলস্থুল কাণ্ড। সব শোনে নিজেকে তার ভীষণ সৌভাগ্যবতী মনে হলো। এই প্রথমই মনে হয়, তার কোনো ইচ্ছেকে মুখফুটে বলা মাত্রই দু’হাতের মুঠোয় এনে দিল কেউ। সুখের এক দমকা হাওয়া ছুঁয়ে গেল তাকে। নিশ্চুপে নিজের সৌভাগ্যকে উপভোগ করতে লাগল প্রাণেশা।

অনির্বাণ ওই দম্পতির সাথে কথাবার্তা এগোলো। এরপর ওনারা খাবার-দাবারের বন্দোবস্ত করে চলে গেলেন। প্রাণেশা ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে সম্পূর্ণ বাগান দেখল। একটু একটু করে ছুঁয়ে দিল প্রত্যেকটা ফুলের গাছেদের। দু’হাতে ফুলেদের গাছ জড়িয়ে ধরে চুমু খেল। লাল টুকটুকে একটা রক্তজবা হাতে এনে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে বলল,

‘বউ বউ লাগছে?’

ভাবুক চেহারায় প্রাণেশার সামনে এসে দাঁড়াল অনির্বাণ। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের গালে আঙুল ঠেকিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,
‘কিছু একটা মিসিং মনে হচ্ছে।’

‘কী?’

‘বাসর।’

প্রাণেশা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘ধুর… ফাজিল।’

আর কিছু বলার আগেই শূণ্যে ভেসে উঠল প্রাণেশা। প্রথমে চমক ও ভয় দুটোই পেল। পরক্ষণেই নিজেকে নিরাপদ আশ্রয়ে দেখে দু’হাতে অনির্বাণের গলা পেঁচিয়ে ধরে বলল,

‘ভাব-ভালোবাসা বেড়ে গেছে দেখছি।’

অনির্বাণ সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ল,
‘কম ছিল?’

প্রাণেশা উত্তর দিল না। মুখ নামিয়ে হাসল শুধু। সেই হাসিটা মুহূর্তেই ঠোঁট ছুঁইয়ে বন্ধ করে দিল অনির্বাণ। বলল,
‘পর্ণকুটিরটা তোর মনের মতোই সাজিয়েছি। এখানে বাসর সারতে আপত্তি আছে, বউ?’

লজ্জায় মিইয়ে গেল প্রাণেশা। মুখ থেকে কোনো কথা বের হতে চাইল না। তবুও সব লজ্জাকে ঝাঁটা দিয়ে ঝাঁটিয়ে শক্ত হাতে অনির্বাণকে আঁকড়ে ধরল। চোখের চশমা সরিয়ে দুটো চোখের পাতায়, গালে ও কণ্ঠমণিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘ইউ আর দ্য বেস্ট হাসব্যান্ড ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। থ্যাংক ইউ সো মাচ্ অনি ফোর কামিং ইনটু মাই লাইফ।’

***

পরিশিষ্ট –

প্রতি বছর দুটো করে জমজ সন্তান নেয়ার বড্ড আশা ছিল অনির্বাণের। একগাদা বাচ্চাকাচ্চা না হলে সংসারটা ঠিক পরিপূর্ণ হবে না, এমনটাই ধারণা ছিল তার। কিন্তু, একসাথে তিনটে সন্তানকে পেয়ে তার সব ধারণা পালটে গেছে। এই তিনটে বাচ্চার জ্বালায় ও যন্ত্রণায় চোখে অন্ধকার দেখে সে। প্রথম তো সে খুব খুশি ছিল, একসাথে তিনটে বাচ্চাকে ছুঁয়ে। আস্তেধীরে বুঝতে পারল, মানুষ বাচ্চাদের জ্বালায় কীভাবে অতিষ্ঠ হয়। একসাথে তিনজনে সামলানো কী যে কষ্ট, সেটা দু’চোখে দেখার পর তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আর জীবনে বাচ্চাকাচ্চা নিবে না। দশ-বিশটা কেন, চতুর্থ বাচ্চা আনারই প্লান নেই তার। এরমধ্যে প্রাণেশার যাই যাই অবস্থা। মনে পড়লেই বুকের কাছে ব্যথারা ভীড় জমায়। দুটো মেয়ে ও একটা ছেলেই তাকে বিশটা সন্তানের জ্বালা দিচ্ছে রোজ। একা হাতে বাচ্চাকাচ্চা সামলানো কষ্ট দেখে, আইশা ও মাইশা ওদের সাথে ঢাকাতেই থাকত। ওরা দু’জনেই বাচ্চাদের দেখাশোনা করে বেশি। খাওয়ায়, ঘুম পাড়ায়, খেলাধুলা করে। বাইরের ব্যস্ততা সামলে ঘরে এসে একটু বিশ্রাম নিতে গেলে তিন বিচ্ছু তার হাত-পা ধরে লটকে গিয়ে কাঁধে চড়ে বসতে চায়। মাঝেমধ্যে এমন হয় যে, ওরা ওয়াশরুমে গিয়ে প্রাণেশাকে না ডেকে অনির্বাণকে ডাকে। চুপসানো মুখ নিয়ে বাচ্চার সামনে যায় অনির্বাণ। কটমট চোখে চেয়ে থেকে ধমকে উঠে। একটু ধমক খেলে ওরাও কেঁদেকেটে গাল ভাসিয়ে ফেলে।

আজ সকালেও একটা অঘটন ঘটে গেল। আইশা-মাইশা ক’দিনের জন্য বাড়িতে গেছে। ছেলেপক্ষ এসেছিল, কনে দেখতে। দু’জনকেই পছন্দ করেছে। একইদিনে দু’জনের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তা-ও একই বাড়িতে। আজ রাতেই ঘরোয়াভাবে আকদ হবে।

বাচ্চারা রাতে দুই ফুপির সাথেই থাকে। কিন্তু ওরা কেউ নেই দেখে তিনজনকে সাথে নিয়ে ঘুমাতে হয়েছে। ভোরে ঘুম থেকে উঠে, রান্নাঘরে এলো প্রাণেশা। সে খেয়ালও করল না, বাচ্চাদের এলোমেলোভাবে ঘুমানো ও বারেবারে হাত-পা ছড়িয়ে-ছিঁটিয়ে রাখার কারণে বেশ কয়েকবার লাথি খেল অনির্বাণ। ওদের ঘুমানোর অসুবিধা হচ্ছে ভেবে, সে একপাশে একটুখানি জায়গায় ঘুমাল। তাতেও হলো না। অঙ্কুরের পায়ের লাথিতে শেষমেশ সে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে গেল। পড়ে গিয়ে ব্যথা পেলেও আধোঘুমে বাচ্চাকে সামান্য সরিয়ে আবারও বিছানায় শুয়ে পড়ল অনির্বাণ। বিড়বিড়াল,

‘বিচ্ছুর দল। তোমাদের জন্য মোটা সাইজের খাটেও আমার জায়গা হবে না দেখছি।’

মেয়ে দুটো ততক্ষণে জেগে গিয়ে অনির্বাণের পিঠের ওপর বসে দুলদুলুনি খেলছে। আর ছেলেটা বাপের সবগুলো চুল টানছে, দাঁত দিয়ে পিঠে কামড়ে দিচ্ছে। বিরক্ত অনির্বাণ সহ্য করতে না পেরে চিৎকার দিয়ে প্রাণেশাকে ডাকল,

‘এই প্রাণ, তোর ডিমডাম সরাবি। আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। গুলুমুলু শরীর নিয়ে আমার সাথে জোর দেখায়। কত পাজি। এদেরকে কোন গ্রহ থেকে আবিষ্কার করলি? ভেবে পাই না আমি, এত মোটা খাটে যাদের জায়গা হয় না, তারা আমার বউয়ের এইটুকুন পেটে একসাথে কীভাবে ছিল?’

হনুফার হাতে নাশতার কাজ গছিয়ে দিয়ে প্রাণেশা রুমে এসে দেখল, ওরা খেলনাবাটির মতো বাপকে নিয়ে খেলছে। যেভাবে মেয়ে দুটো পিঠে দুলছে, মনে হচ্ছে দোলনায় দোল খাচ্ছে। আর অন্যজনকে এক মাসের উপোষী মনে হচ্ছে। খেতে না পেয়ে বাপের পেট-পিঠ খাচ্ছে। সে হাত বাড়িয়ে মেয়ে দুটোকে সরিয়ে ছেলেকেও কোলে টেনে নিল। গালে চুমু খেয়ে বলল,

‘ছিঃ বাবা, কী খাচ্ছ তুমি? তুমি জানো না, তোমার বাবার শরীরে ভোঁটকা গন্ধ। এখন তো তোমার মুখেও গন্ধ চলে এসেছে। ইশ, আসো আসো, মুখ পরিষ্কার করে দিই।’

কথাটা কানে গেল অনির্বাণের। লাফ দিয়ে বিছানায় বসল। রাগতস্বরে বলল,
‘কী বললি? আমার গায়ে কীসের গন্ধ?’

প্রাণেশা একইভাবে বলল,
‘কানে কম শোনো না কি?’

যেভাবে বিছানায় বসেছিল, সেভাবেই আবার বালিশে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল অনির্বাণ। ব্রাশে টুথপেস্ট লাগিয়ে তিনজনকে নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল প্রাণেশা। বাচ্চাদের হাত-মুখ ধুইয়ে দিল। পরনের জামা পালটে দিতে গিয়ে বিপদে পড়ল। মেয়ে টিউলিপ জেদী কণ্ঠে বলল,

‘আমি এটা পরব না, মাম।’

‘কেন?’

‘আমি তোমার মতো জামা পরব।’

মায়ের পরনের টি’শার্ট দেখিয়ে বলল টিউলিপ। প্রায়ই এমন করে। প্রাণেশা যদি গোল জামা বা টপস পরাতে যায়, মেয়ে টি’শার্ট ও শার্টের বায়না ধরে। সাড়ে তিন বছর বয়স হলেও ওদের প্রত্যেকের কথাবার্তা স্পষ্ট। শুনতে এত ভালো লাগে। মেয়ের জেদ শোনে প্রাণেশা বলল,

‘একজীবনে আমি অনেক কথা শুনেছি। তুমিও শুনবে?’

টিউলিপ এই কথার মানে বুঝল না। সে মায়ের টি’শার্ট ধরে টানাটানি শুরু করে দিল। অনির্বাণ বিছানায় থেকেই ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,

‘ও যেটা পরতে চাইছে সেটাই পরিয়ে দে না, প্রাণ। কেন ওকে এসব কথা বলছিস?’

প্রাণেশা আর দ্বিমত করল না। মেয়ের পছন্দের পোশাকই পরিয়ে দিল। এরপর টিউলিপ ও জিনিয়ার চুল বেঁধে দিয়ে, ছেলে অঙ্কুরকে পরিপাটি করে, রুম থেকে বেরিয়ে স্টাডিরুমে এসে, একেকজনকে ছোটো সাইজের স্টাডিটেবিলের সামনে বসিয়ে সব ধরনের রংপেন্সিল ও আঁকিবুঁকির জিনিসপত্র বের করে দিয়ে বলল,

‘আর কোনো দুষ্টুমি নয়। নাশতা তৈরী হলে আমি এসে ডাকব। পাপাকে বিরক্ত করো না। এখানেই থাকো।’

ওদেরকে একসাথে বসিয়ে রান্নাঘরের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল প্রাণেশা। টুকিটাকি যে কয়টা পদ রান্না করা শিখেছে, মাঝেমধ্যে সেসব নিজেই রাঁধে। হনুফা প্রত্যেকটা কাজে হাত লাগিয়ে দেয়। নাশতা তৈরী করে, টেবিলে খাবার সাজিয়ে যেই না রুমে এলো, অমনি তার চোখদুটো চড়কগাছ হয়ে গেল। বিছানায় অনির্বাণ নেই। এদিকে আলমারি খোলা। ভেতরের সব কাপড়চোপড় ফ্লোরে। তিনজনে কাপড় দিয়ে মুখ ঢেকে লুকোচুরি খেলছে আর সারা ঘরে ছোটাছুটি করছে। প্রাণেশা ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই চিৎকার দিল,

‘এ্যাই বিচ্ছুর দল, তোমরা এত অকাজ করে কী শান্তি পাও?’

মায়ের চিৎকার শোনে পড়িমরি করে দৌড় শুরু করল বাচ্চাগুলো। এরমধ্যেই অনির্বাণ ওয়াশরুম থেকে বের হলো। দুটো বেরিয়ে গেলেও দৌড় দিতে পারল না জিনিয়া। সে প্রাণেশার হাতের ফাঁকে আটকে গেল। সবে মেয়েকে বকতে যাবে, সেই মুহূর্তেই অনির্বাণ মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে কড়া শাসনের সুরে বলল,

‘খবরদার, ভুল করেও আমার বাচ্চাদের বকাবকি করবি না। ওরা তোর কী ক্ষতি করেছে শুনি?’

প্রাণেশা শক্তকণ্ঠে বলল,
‘ওরা এমনিতে কোনো ক্ষতি করেনি। শুধু আমার দিনরাতের সবটুকু শান্তির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।’

অনির্বাণ মেয়ের চোখে হাত রেখে টুপ করে প্রাণেশার গালে চুমু খেয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
‘আহারে, সোনা বউটা আমার। কষ্ট হয়ে যাচ্ছে না? অসুবিধা নেই। আরও তিনটে এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।’

আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজতে শুরু করল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,
‘খুঁজে লাভ নেই। শান্তির মা এই ঘরে নেই। এই বিচ্ছুদের জন্মের পরপরই শান্তির মা এই ঘর থেকে বিদায় নিয়েছে।’

কোমরে হাত রেখে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে প্রাণেশা বলল,
‘আমি শান্তির মাকে খুঁজছি না। খুঁজছি ঝাড়ুকে। যে মাথা থেকে আরও তিনটে বিচ্ছুর কথা বেরিয়েছে, সেই মাথাকে আজ চ্যাপ্টা করব। তাই…।’

‘এসব কী ধরনের কথাবার্তা? আদবকায়দা শিখিসনি? স্বামীর সাথে কেউ এইভাবে কথা বলে? দিনদিন তুই কেমন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস রে, প্রাণ।’

ফোঁসফোঁস করতে করতে বাকি দুটোকে খুঁজে বের করে ডাইনিংয়ে বসাল প্রাণেশা। এক হাতে আর কয়জনকে খাওয়ানো যায়? প্রাণেশা দু’জনকে খাওয়াল আর অনির্বাণ একজনকে। নাশতা শেষে বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নেমে এলো। গ্যারেজ থেকে গাড়ি বের করে টিউলিপ ও জিনিয়াকে পিছনে বসিয়ে অঙ্কুরকে সামনের সিটে বসিয়ে রাখল। অঙ্কুর বলল,

‘আমরা কোথায় যাচ্ছি, পাপা?’

‘দাদাবাড়ি।’

উত্তর দিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসার আগেই বাচ্চাদের প্রয়োজনীয় সবকিছু পিছনে তুলে রাখল প্রাণেশা। সন্দিহান মনে বলল,
‘সামাল দিতে পারবে?’

দুই মেয়ে এরমধ্যেই একটার সাথে আরেকটা দ্বন্দ বাঁধিয়ে দিয়েছে। ওদের দিকে তাকিয়ে অসহায় কণ্ঠে অনির্বাণ বলল,
‘তুইও চলে আয়, বউ। প্লিজ…। একটা হলে সামাল দেয়া কঠিন ছিল না। কিন্তু একসাথে তিনটে…। ওরা এমনভাবে হাত-পা ছুঁড়ে, কোনফাঁকে অঙ্কুর লাথি ছুঁড়বে, আমি ড্রাইভ রেখে সড়কে পড়ে যাব। এই তিনটাকে একসাথে দেখেশুনে রাখা অসম্ভব।’

হ্যান্ডিক্রাফটের বেশকিছু কাজ জমানো। কয়েকটা পুঁতির পার্স ডেলিভারির কথা ছিল আজ। তাই প্রাণেশা যেতে চায়নি। কিন্তু ননদদের বিয়ে। না গিয়েও উপায় নেই। এজন্য শেষবেলা সিদ্ধান্ত নিল, বিয়েতেই যাবে। ডেলিভারি আগামী সপ্তাহে করবে।

অনির্বাণের এই কথা শোনে ভীষণ হাসি পেল প্রাণেশার। সে কণ্ঠে কৌতুক ধরে রেখে বলল,

‘এখুনি অধৈর্য্য হয়ে গেলে? একগাদা বাচ্চাকাচ্চা হলে তুমি তো মনে হয় মঙ্গলে পালানোর পথ খুঁজবে।’

অনির্বাণ নিজেও হাসলো। বলল,
‘তিনটাই ইনাফ। আর দরকার নেই। এখন তাড়াতাড়ি আয়। দেরী হচ্ছে। বাড়ির সবাই অপেক্ষা করছে।’

‘যদি না যাই?’

‘এমন করিস না। তুই কাস্টমারকে বল, ডেলিভারি পরে হবে। ইমার্জেন্সি পড়ে গেছে। প্লিজ, সোনা… তোকে একশোটা চুম্মাহ দিব।’

‘আহা… ঢং। আমি যেন তোমার থেকে চুম্মা নেয়ার জন্য বসে রয়েছি।’

ভেংচি কেটে পিছনের সিটে এসে, মেয়েদের আগলে নিয়ে বসলো প্রাণেশা। অনিবার্ণ সামনে বসে গাড়ি স্টার্ট করে হাইওয়ে ধরে মেহেরপুরের পথে রওনা হলো। চলতে চলতে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে গান ধরল,

ভালোবাসি তাই তোকে চাই,
আমার পৃথিবী জুড়ে।
ভালো লাগে তাই চলে যাই,
আমি হাওয়াতে উড়ে।
যেন… বেপরোয়া ডানা, পেয়েছে ঠিকানা…
চোখে চোখে হলো পরিচয়।
এই পথ যদি না শেষ হয়…
ওওও এই পথ যদি না শেষ হয়…।

***

সমাপ্ত…

ওপাশ থেকে জবাব এলো না। মাশকুরার বুক কাঁপছে। শেষ পর্যন্ত যৌতুক দিয়েই মা তাকে বিদায় করবেন বলে বন্দোবস্ত করলেন! চরম আফসোস নিয়ে কপাল চাপড়ানো শুরু করল সে। ফোনের ওপাশ থেকে প্রথমে দীর্ঘশ্বাস এলো। পরক্ষণেই শোনা গেল,

-‘মাশকুরা আমি তোমারে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার সীমা-পরিসীমা হিসাব কইরা বুঝাইতে পারুম না। আমি জানি না তোমার আম্মা তোমারে কী বুঝাইছেন! ক্যান তোমার মাথায় এই টাকার হিসাব ধরাইয়া দিছেন, এ-ও বুঝবার পারতেছি না। তয় এইটুক বুঝতাছি, ওই টাকার সংখ্যা দিয়া উনি বুঝাইয়া দিছেন, তুমি ওই ঘরের বোঝা হইয়া গেছ। তোমারে বিদায় করতে এহন টাকা লাগে।’

মাশকুরা কথা বলল না। শুধু নীরবে শোনে গেল। এরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ফাহাদ বলল,
-‘তুমি আমার কাছে একবার চইল্যা আসো, আমি সারাজীবন তোমারে মাথায় তুইলা রাখুম। সত্য কইতাছি, একটুও মিছা না। ভরসা করবা না আমারে?’

কান্নার কারণে গলা দিয়ে আওয়াজ আসলো না মাশকুরার। ফাহাদও কী বুঝল কে জানে। ম্লানমুখে বলল,
-‘তুমি না চাইলে তোমারে জোর করার সাধ্য কারও নাই মাশকুরা। তুমি-ই সিদ্ধান্ত নাও, কী চাও। তয় একটা সত্য কথা কী জানো, তুমি আমার না হইলে, পাগল হইতে আমার একদিনও লাগব না।’

-‘কিন্তু আমি যে অন্য কাউরে ভালোবাসি।’

অনেকক্ষণ পর মুখ খুলল মাশকুরা। ওপাশে ফাহাদ নিঃশব্দে হাসল। বলল,
-‘মন তোমার, ভালোবাসতেই পারো। আমি জোর করে আটকানোর কে?’

-‘মনে একজনরে নিয়া আপনার সাথে সংসার করুম ক্যামনে? জিন্দা লাশ হইয়া যামু না?’

ফাহাদ কথা খুঁজে পেল না। এড়িয়ে যাওয়ার বাহানায় বলল,
-‘নম্বর কি আনব্লক কইরা কল দিছিলা?’

-‘হ। ক্যান?’

-‘আবার ব্লক কইরা দাও। আমি চাই না কেউ আমার লাইগ্যা জিন্দা লাশ হইয়া বাঁইচা থাকুক। ভালা থাইকো। আর কথা না হওয়াই মঙ্গল।’

-‘কিন্তু…?’

-‘চিন্তা কইরো না। আমি তোমারে বিয়া করুম না। তুমি আমার ভাগ্যে নাই, এইডা এহন নিশ্চিত হইয়া গেলাম। ফোন কইরা আমারে আর দুর্বল কইরো না।’

মাশকুরা হতভম্ব ফাহাদের এরূপ আচরণে। ছেলেটার আচরণ কেমন যেন। একটু পাগলাটে স্বভাবের মানুষ বলেই হয়তো। একদিকে একজন তাকে ভালোবেসে পুড়ছে, অন্যদিকে সে একজনকে ভালোবেসে পুড়ছে। চারিদিকে শুধু মন পুড়ছে তো পুড়ছেই। এই পোড়াপুড়ি কবে থামবে?

***

চলবে।

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-১১

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১১

নির্ধারিত সময়েই কুইজ প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। একক ও দলীয়ভাবে। প্রাণেশা দুটো বিভাগেই অংশ নেয়ার জন্য ফর্ম ফিলাপ করেছিল। প্রথমদিনের কুইজ প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে সেরা দশজনের একজন হয়েছে প্রাণেশা। যদিও প্রথম হতে পারেনি তবে দ্বিতীয় হয়েছে। আর দ্বিতীয় দিনের কুইজে সকাল থেকে দলীয়ভাবে অংশগ্রহণ চলছে। একটা দলকে হারিয়ে অন্য দলকে জিতিয়ে নেয়ার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এই সেগমেন্টে দলীয়ভাবে একেকটা কলেজের তিনজন করে ছাত্রছাত্রী সুযোগ পাচ্ছে। তারমধ্যে মেহেরপুর সরকারি কলেজের হয়ে দলে থাকছে প্রাণেশা, সাফওয়ান ও ওদের আরও এক সঙ্গী রিক্তা। যে দলের সাথে লড়াই চলছে, তারা রংপুর থেকে এসেছে। প্রতিটা রাউন্ডে খেলতে খেলতে রংপুরের পয়েন্ট হলো বেশি, মেহেরপুরের কম। বাকি শুধু শেষ রাউন্ডের খেলা। ‘কুইক কুইজ’ রাউন্ড। এক মিনিটের মধ্যে এই রাউন্ডে যারা সবচেয়ে বেশি প্রশ্নের উত্তর দিবে, তারাই হবে এই সেগমেন্টের বিজয়ী। প্রাণেশার বুক ধড়ফড় করছে। কী হয়, কী হয়, এরকম একটা পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে সামনে। ভয়ে চোখেমুখে আতঙ্ক ফুটে উঠেছে। একটুর জন্য হেরে যাবে? মেনে নিতে পারছে না। একমনে কিছু একটা বিড়বিড় করছে। যখন ‘কুইক কুইজ’ রাউন্ড শুরু হলো, সঙ্গে সঙ্গে ‘কুইকপ্রেস বাজার’এ আঙুল ছুঁইয়ে রাখল সবাই। স্ক্রিনে প্রশ্ন আসা মাত্রই বাজারে শব্দ তুলল প্রাণেশা। উত্তরটা ঠোঁটস্থ থাকায় ঝটপট উত্তর দিল। এভাবে যে কয়টা প্রশ্ন এলো, ভাগ্যগুণে বেশিরভাগ প্রশ্নেরই সঠিক উত্তর প্রাণেশা একা দিল, বাকিরা যে যেটা পারল দিল, যারা পারল না, ছেড়ে দিল। নির্দিষ্ট সময় শেষ হওয়ার পর ‘মেহেরপুর সরকারি কলেজ’ টিমকে বিজয়ী বলে ঘোষণা করা হলো। এবং দিনশেষে প্রাইজমানি, সার্টিফিকেট, বই, ক্রেস্ট ও মেডেল প্রধান করে বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানো হলো। পুরস্কার বিতরণী শেষে দলীয়ভাবে সবাই ছবি তুলে নিজেদের আনন্দ ও সুখকে বাকিদের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। ঠিক পাঁচটে বাজার পনেরো মিনিট আগেই সমস্ত আয়োজন শেষে সাফওয়ান ও রিক্তাকে নিয়ে ক্যাম্পাসের বাইরে এলো প্রাণেশা। অনির্বাণকে দর্শকসারিতে প্রথমে দেখলেও পরবর্তীতে কাছেপাশে দেখেনি। পুরস্কার বিতরণীর সময়ও সেখানে সে উপস্থিত ছিল না। গেটের বাইরে এসেও তার চিহ্নটি খুঁজে পেল না। এমনকি গাড়িটাকেও আশেপাশে দেখা গেল না। এখনও তার হাতে পুরস্কার, গলায় মেডেল। প্রিয়জন যদি এইমুহূর্তে সামনে না থাকল, তাহলে আনন্দ কই? এত এত আনন্দ ও উদ্দীপনা সবটাই মাটি হয়ে যেতে লাগল। সাফওয়ান ও রিক্তা বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিতে গিয়ে প্রাণেশাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখে সাফওয়ান বলল,

‘কী রে, তোর সঙ্গী কই? ট্রিট দিবে বলে কি হাওয়া হয়ে গেল?’

অস্থির চোখে চারপাশে তাকিয়ে অনির্বাণকে না পেয়ে প্রাণেশা বলল,
‘কী জানি! ওখানেই তো ছিল।’

রিক্তা বলল,
‘আরেহ্ ছাড়, ভাইয়া কিপটার জম। যখনই দেখলেন বউয়ের জেতার চান্স আছে, অমনি কেটে পড়েছেন।’

প্রাণেশা ফুঁসে উঠে বলল,
‘মোটেও এরকম কিছু নয়। নিশ্চয়ই জরুরী কোনো কাজে গেছে। দেখ, ওর গাড়িটাও নেই।’

সাফওয়ান বলল,
‘হয়েছে থাক, আর বরের হয়ে সাফাই গাইতে হবে না। বলেছিলি না, এক সপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্সের কথা উঠবে? তুই ঘর-সংসার করবি না, কাউকে ভালোবাসবি না, হ্যানত্যান আরও কতকিছু। এখন তো দেখছি, দিব্যিই ঝুলে আছিস। ছাড়ার নাম নিচ্ছিস না। ঘর বাঁধার যদি ইচ্ছেই ছিল, আমাকে দিয়ে হুদাই নাটক সাজানোর দরকার ছিল না। এখন তোর বাড়ির সবার কাছে আমি খারাপ। ভাবত, কেমনটা লাগে?’

বন্ধুর বর্তমান পরিস্থিতি আসলেই খারাপ। আগে প্রাণেশার বাড়ির সবাই সাফওয়ানকে পছন্দ করত আর বিয়ে ভাঙার পর থেকে ওর নাম শুনলেই সবাই রেগে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখলে তো রক্ষে নেই। সেদিন প্রাণেশার বাবা কী বাজে ব্যবহার করেছেন! মনে পড়লে এখনও শরীর ঘিনঘিন করে তার। একটা মানুষ মেয়েকে পড়াশোনা ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত নিয়ে এত কেন বাড়াবাড়ি করেন? ভাবলেই মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। সম্পর্কটা প্রাণেশার সাথে বলেই আজেবাজে কথাও হজম করে নেয়। কী করবে? বন্ধুত্ব তো! এত সহজেই কি এই সম্পর্ককে ফেলনা ভাবা যায়? সাফওয়ানের মন-মেজাজ যে খিঁচড়ে গেছে সেটা বুঝেই পাশে থাকা বাদামওয়ালার কাছ থেকে কিছু বাদাম কিনল প্রাণেশা। রাস্তায় দাঁড়িয়েই খেতে লাগল সবাই। বাকিরা বাদাম পছন্দ করে বলেই কেনা। সাফওয়ান বাদাম দেখে বলল,

‘এইটুকু? স্বামীর টাকা বাঁচানোর ধান্ধা? হবে না। জম্পেশ ট্রিট চাই?’

প্রাণেশা বলল,
‘রাগ করছিস কেন? খা। অনি আসুক… ট্রিট দিবেনে।’

‘বাকির নাম ফাঁকি। তাড়াতাড়ি আসতে বল।’

‘ট্রিট ছাড়া আর কিছু বুঝিস না, না?’

‘না বুঝি না।’

ফোন বের করে অনির্বাণের নম্বরে কল করতে গিয়েই দেখল, পার্কিংস্পটে গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। মুহূর্তেই ডোর খুলে নেমে এসেছে অনির্বাণ। হাতে একগুচ্ছ নানান মিশেলের ফুল। কোনো কাহিনী ছাড়াই ফুলগুলো বাড়িয়ে দিল প্রাণেশার দিকে। হাসিমুখে বলল,

‘কংগ্রাচুলেশনস্ মিসেস্ অনির্বাণ সৈকত।’

প্রাণেশা ফুলগুলো হাতে তুলে ঠোঁটে প্রশান্তিময় হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’

হাতের ক্রেস্ট, প্রাইজমানি, বই অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
‘দেখো…।’

দু’চোখে একরাঁশ মুগ্ধতা নিয়ে সব পুরস্কার ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল অনির্বাণ। সেগুলো গাড়ির পিছনের সিটে রেখে, সাফওয়ান ও রিক্তাকে বলল,

‘আমি চাইছি, বিয়ের ট্রিটটা আজকেই দিতে। তোমরা কি যাবে আমার সাথে?’

সাফওয়ান বলল,
‘শুধু বিয়ের না, আজকেরও। দুটো ট্রিট জমা হলো।’

‘জমা বলছ কেন? এখুনি এসো।’

বিকেলের শেষভাগ। আর আধঘণ্টার মধ্যেই আস্তেধীরে বেলা ডুবে যাবে। সে ঘড়িতে সময় দেখে বলল,
‘স্যরি, ভাইয়া। আজ আর হবে না। এখন রওনা না দিলে পৌঁছাতে শেষরাত হবে। বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।’

রিক্তাও বলল,
‘হ্যাঁ, একদম। ট্রিট জমা থাকুক। কোনো একদিন সম্পূর্ণ ঢাকা শহর ঘুরে দেখাবেন। আজ আসি।’

তাড়া দিয়ে ওরা প্রাণেশার থেকে বিদায় নিল। বিদায়বেলা বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরল রিক্তা। বলল,
‘সুখে থাকিস।’

অনির্বাণকে দাঁড় করিয়ে রেখে ভার্সিটির কমনরুমের ওয়াশরুমে প্রবেশ করে নির্দিষ্ট ইউনিফর্ম চেঞ্জ করে ফেলল প্রাণেশা। বাড়তি পোশাক আগে থেকেই সঙ্গে ছিল। পোশাক পরিবর্তন করে, ছাঁইরঙা টি’শার্ট ও গোল্ডেন কালারের লেডিস্ গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরে আগের রূপে ফিরে, গাড়ির সামনের সিটে বসলো। অনির্বাণ ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করলে প্রাণেশা জানতে চাইল,

‘তখন কি ফুল আনতে গিয়েছিলে?’

অনির্বাণ বলল,
‘শুধু ফুল নয়, স্পেশাল কিছু। পিছনে দেখ…।’

ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে একটা শপিংব্যাগ দেখে হাত বাড়িয়ে সেটা নিজের কাছে টেনে আনলো প্রাণেশা। ব্যাগ খুলে দেখল, ভেতরে একটা দলিল রাখা। চমকে গিয়ে বলল,

‘কী এটা?’

অনির্বাণ ড্রাইভ করতে করতে বলল,
‘বাংলা ভুলে গিয়েছিস না কি? পড়ে দেখ।’

ভয়ে ভয়ে দলিলটা মেলে ধরল প্রাণেশা। হার্টবিট বেড়ে যাচ্ছে তার। ডিভোর্সপেপারস কি না! কিন্তু না… অন্যকিছু। এটা তাদের বিয়ের কাবিননামা আর এর নিচে পুরনো একটা দলিলের সাথে নতুন আরেকটা দলিল। তাতে কিছু লেখা। সে-ই লেখা পড়তে গিয়েই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল প্রাণেশার। দেনমোহরের টাকার সাথে মোটা অংকের একটা অ্যামাউন্ট যোগ করে নতুন একটা জমি কেনা হয়েছে। সেই জমির মালিকানা কি না প্রাণেশার নামে। প্রাণেশা যখন বিস্মিত দৃষ্টি দিয়ে কাগজে চোখ বুলাচ্ছিল, তখুনি তার দিকে কলম বাড়িয়ে দিয়ে অনির্বাণ বলল,

‘সাইন কর।’

চোখ তুলে প্রশ্ন করল প্রাণেশা, ‘কেন?’

‘তোর জিনিস তুই বুঝে নিবি না?’

‘এটা আমার হলো কবে?’

‘এখুনি হবে। দেড় বছর আগে এটা কিনেছিলাম নিজের নামে। বিয়ের পর তো তোকে কিছু দেয়া হয়নি। দেনমোহরের টাকাটাও বাকি ছিল। ভেবেছিলাম, কোনো এক স্পেশাল দিনে দেব। আজ সেই স্পেশাল দিন। যা কিছু আমার, সবকিছুর সাথে তুই জড়িয়ে আছিস। এটায় কেন থাকবি না?’

‘আমি জমি দিয়ে কী করব?’

অনির্বাণ হেসে ফেলল। প্রাণেশা বলল,
‘হাসছ কেন? আমার তো জমির দরকার নেই।’

‘দরকার আছে কি নেই, সেটা তো জমি দেখলে বুঝবি। এখন ঝটপট সাইন কর, প্রাণ।’

অনির্বাণের কথা অনুযায়ী সাইন করে দলিলটা জায়গামতো রেখে দিয়ে জানালার দিকে দৃষ্টি দিয়ে রাখল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,

‘গাল ফুলিয়ে আছিস কেন? এমনদিনে কেউ গাল ফুলায়?’

‘আমি তোমার মতিগতি কিছুই বুঝছি না।’

অনির্বাণ একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
‘কাছে আয়।’

প্রাণেশা নড়েচড়ে বসলো। হুকুম পালনে সদা তৎপর এইটুকু বুঝাতে কাছেও এলো। অনির্বাণ তাকে একহাতে জড়িয়ে নিয়ে, কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘যা কিছু স্বপ্ন আছে, ইচ্ছে আছে, আমায় বলিস প্রাণ। জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে হলেও তোর স্বপ্ন ও ইচ্ছেদের আমি পূরণ করব।’

‘কেন?’

‘কোনো একদিন নিজের কাছে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছিলাম, আমার বউয়ের সব ইচ্ছে ও স্বপ্নদের যথাযথ মূল্যায়ন করব। যেদিন থেকে তুই আমার বউ হলি, সেদিন থেকে তোর ইচ্ছেই আমার ইচ্ছে, তোর স্বপ্নই আমার স্বপ্ন হয়ে গেল। এখন তো শুধু একটা একটা করে তোর সব ইচ্ছে ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া বাকি।’

‘তোমার নিজের কোনো ইচ্ছে নেই, স্বপ্ন নেই?’

‘নিজেকে নিয়ে আপাতত নেই। কিন্তু আমার বউকে নিয়ে আমার ইচ্ছে ও স্বপ্নের শেষ নেই। বউ পাশে থাকলে সব ইচ্ছে ও স্বপ্ন একদিন পূরণ হবে, ইনশা’আল্লাহ্।’

প্রাণেশা চোখ পাকিয়ে বলল,
‘বউ কি চলে যাচ্ছে?’

ধীর অথচ শান্তগলায় অনির্বাণ বলল,
‘আমি যেতে দেব না কি? যাওয়ার নাম নিলেই কঠিন শাস্তি দেব।’

‘কী শাস্তি?’

অনির্বাণ কৌতুকের সুরে বলল,
‘ঠ্যাং উপরে রেখে মাথা নিচে ঝুলিয়ে দেব। দারুণ অ্যাডভেঞ্চার হবে তাই না?’

প্রাণেশা কটমটিয়ে তাকাল। অনির্বাণ শব্দ তুলে হেসে উঠে বলল,
‘রাগ করলে তোকে কিন্তু দারুণ লাগে। অবশ্য তোর চেহারায় এখন একটা বউ বউ ভাব ফুটে উঠেছে। রাগী অথচ ভীষণ মায়াবী। এমন করে তাকালে হার্ট-অ্যাটাক হয়ে যাবে, বউ।’

***

টেলিভিশনে নিউজ দেখে, বাড়ির সবার মুখ থেকে মেয়ের জিতে যাওয়ার খবর শোনেও কোনোপ্রকার ভালো-খারাপ মনোভাব প্রকাশ করেননি সামিউল আলম। এর মানে এই না যে, তিনি খুশি হোননি। হয়েছেন। সেই খুশিটা অন্য সবার মতো প্রকাশ করতে পারছেন না। সবাই যেভাবে প্রাণেশার মেধার প্রশংসা করছে, সেভাবে তিনি করতে পারেন না। তাছাড়া যতবারই মনে হচ্ছে, ডাক্তার না হয়ে প্রাণেশা চরম ভুল করেছে, বাবার স্বপ্নকে ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে, ততবারই তিনি রেগে যাচ্ছেন। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছেন। বাড়ির ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা যখন খুশিটা একে-অন্যের সাথে ভাগ করতে অসময়ে কফির নিয়ে আড্ডায় বসলো, তখুনি তিনি চিৎকার করে বললেন,

‘এত খুশি হওয়ার মতো কিছু হয়নি। এই ধরনের কুইজে যে কেউ বিজয়ী হতে পারে।’

সেজো ভাই শরীফুল আলম বললেন,
‘যে কেউ পারলে বাকিরা পারল না কেন? ওখানে কি একটা কলেজের স্টুডেন্ট এসেছিল? পঞ্চাশেরও অধিক জেলার স্টুডেন্ট এসে অংশগ্রহণ করেছে। তারমধ্যে সেরা হয়েছে আমাদের মেহেরপুর। সেটা কেবলই, আমাদের বাড়ির মেয়েটির জন্যই। শেষকটা প্রশ্নের উত্তর যদি সবার আগে না দিত, নিশ্চিত হার লেখা ছিল কপালে।’

সামিউল আলম একরোখা মেজাজে বললেন,
‘তাতে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হলো? ওখানে আমি থাকলে এরচেয়ে ভালো খেলতাম।’

‘তাই? তাহলে যাওনি কেন?’

‘সেই কৈফিয়ত তোমাকে দেব কেন?’

শরীফুল কেশে গলা পরিষ্কার করে রূপকথাকে ইশারায় কাছে ডাকলেন। রূপকথা কফির কাপ নিয়ে সামনে এলো। সবার দিকে একেকটা কাপ বাড়িয়ে দিয়ে, সামিউল আলমের কাপ তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘কে জিতল, কে হারল, এই বিচারে যাওয়ার কোনো দরকার নেই। আসল কথা হচ্ছে, আমাদের প্রাণেশা শুধু নিজের নয়, পুরো জেলা ও দেশের কাছে নিজের কলেজকে জিতিয়ে দিয়ে সবার কাছ থেকে বাহ্বা কুড়াচ্ছে। আমি বলি কী, আজ যেহেতু একটা খুশির দিন, এইদিনে এত রাগারাগি না করে তুমি এখুনি প্রাণেশাকে একটা ফোন দাও। শুভেচ্ছা জানাতে নয়, কেমন আছে এইটুকু জানতে। আজ কতদিন হলো, ও বাড়িতে নেই। আমরা সবাই খোঁজ নিলেও তুমি ওর খোঁজ নাওনি, চাচ্চু। এটা কি তুমি ঠিক করলে?’

সামিউল আলম গম্ভীরমুখে বললেন,
‘ভালো যে থাকবে, সেটা তো নিশ্চিত। অনি ওর অসম্মান করবে না।’

‘হ্যাঁ, সেটা ঠিক বলেছ। অনি এই সম্পর্ককে যথেষ্ট সম্মানের চোখে দেখছে। শুধু অনি একা নয়, প্রাণেশাও। এ যাবৎ যা কিছু ওর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়েছ, কোনোকিছুর দিকেই কিন্তু মন বসেনি। একমাত্র বিয়েটা পবিত্র বন্ধন বলেই ইচ্ছে না থাকা সত্ত্বেও ‘কবুল’ বলে সেই সম্পর্কটার মধ্যে এখন অবধি নিজেকে আটকে রাখতে পেরেছে। চাইছেও। কারণ ও বিয়েটাকে সম্মান করে। অনিকে সম্মান করে। বাড়ির সবার সিদ্ধান্তকে সম্মান করে। এইটুকু যদি না করত, কবেই বাড়ি ছেড়ে পালাত।’

‘এতই যদি বিয়ের প্রতি সম্মান, তাহলে বিয়ের দিন এত কাহিনী কেন করল?’

রূপকথা এই কথাগুলো বলতে চায় না, কিন্তু কিছু করার নেই। প্রাণেশার ভয়টা পরিষ্কারভাবে সবার সামনে উঠে না এলে, সবাই মেয়েটাকে শুধু ভুল বুঝেই যাবে। সে নতমুখী হয়ে বলল,

‘চাচ্চু, মাফ করো। একটা কথা না বলে উপায় নেই।’

সামিউল আলম আগের মতোই নির্বিকার ভাব নিয়ে বললেন,
‘কী?’

‘ওর আসলে সম্পর্ক নিয়ে একটু ভীতি ছিল। বৈবাহিক সম্পর্কে যদি স্বামী ও স্ত্রীর একে-অন্যকে ঘিরে সম্মান না থাকে, যতই শিক্ষা-দীক্ষা ও ধন-সম্পদ থাকুক না কেন, ওই সংসারে সুখ আসে না। দশজনের সামনে হয়তো সুখী সাজা যায়, কিন্তু মানসিক শান্তিটা আসে না। যার কাছে যাবে, তার কাছে যদি মানসিক শান্তিটা না পায়, তাহলে বিয়ে করে লাভ কী, চাচ্চু?’

এতটুকু বলে বড়ো করে নিঃশ্বাস নিল রূপকথা। এরপর আবারও বলল,
‘পড়াশোনা নিয়ে তো কম অত্যাচার সহ্য করেনি। বিয়ের পরও যদি ওর স্বামী নামক প্রাণী ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ ও নিজস্ব সিদ্ধান্তকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে, তাহলে ওই মানুষকে জীবনে জড়িয়ে ওর লাভটা কী? আবারও জোর করে সবকিছুকে পড়াশোনার মতো সহজ ভেবে জীবন কাটিয়ে দেয়া? এতে হয়তো ও সারাজীবন তোমাদেরকে বুঝাত, ও সুখী। কিন্তু বাস্তবে সেটা হতো না। ও কতটা অসুখী হতো, সেটা ও ছাড়া আর কেউ জানত না। যে সংসারে সম্মান নেই, ইচ্ছে ও সিদ্ধান্তের মূল্য নেই, মানসিক শান্তি নেই, সেখানে সারাজীবন কাটবে কী করে? এই ভয়েই ও বিয়ে করতে চাইত না। কারণ ও নিশ্চিত ছিল, সবকিছুকে জোর করে মেনে নিয়ে দিন কাটাতে গিয়ে সুখী হওয়ার ভান করাটাই ওর জীবনের প্রধান লক্ষ্য হয়ে গেছে। যা কিছুই হবে, সবটাই জোরপূর্বক হবে। কোনোকিছুতেই সে তার নিজের ইচ্ছেদের মেলে ধরতে পারবে না। নিজের মনের ভাবটা প্রকাশ করতে পারবে না। এমন হলে মানুষ ভালো থাকে, চাচ্চু? এভাবে ভালো থাকা যায়?’

রূপকথা সরাসরি কিছু না বললেও, কারও নাম না তুললেও কী বলতে চাইছে, কী বুঝিয়েছে, সেটুকু বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠল সামিউল আলমের কাছে। তিনি চোখ ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ভয় পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে মুখ নামিয়ে ফেললেন তাহমিনা আহমেদ। রূপকথা টপিকটা ওখানেই থামিয়ে দিল। আইশা-মাইশার রুম থেকে আরুশির কান্না ভেসে এলে সে মেয়েকে সামলানোর অজুহাতে দূরে সরে গেল। এদিকে সামিউল আলম গম্ভীরমুখে ভেবেই চলেছেন। তার এতসব রাগ ও স্ত্রীর ওপর দাম্ভিকতা, চিৎকার-চেঁচামেচি যে বাড়ির সবাই-ই নোটিশ করত, এইটুকু ভেবেই বিব্রতবোধ করলেন, তবে মনের অবস্থা বাইরে টেনে আনলেন না। ছোটো ভাই শওকত আলম ততক্ষণে প্রাণেশাকে কল দিয়ে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি ভীষণ আমুদে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। সবার কথা ভালোমন্দ আলাপ হওয়ার পরে শওকত আলম আচমকাই বলে উঠলেন,

‘মেজো ভাইজানও আমার সামনেই বসা। কথা বলবি?’

ওপাশ থেকে প্রাণেশা কী বলল, সেটুকু না শুনেই ভাইয়ের হাতে ফোন ধরিয়ে দিলেন শওকত আলম। এরপর তিনি সাতেও নাই, পাঁচেও নাই, এমন একটা ভাব নিয়ে সোফা ছেড়ে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলেন। যাওয়ার বলা স্ত্রীকে আদেশ করলেন, তার কফিটা যেন রুমে পাঠানো হয়। এদিকে ফোন কানে ঠেকিয়ে কী কথা বলবেন, ভেবেও পেলেন না সামিউল আলম। দাঁত কামড়ে বসে রইলেন। তার এই ভাবভঙ্গি দেখে কেউ আর সামনে রইল না। সবাই-ই যে যার কাজের অজুহাত দেখিয়ে দূরে সরে গেল। শুধু পাশে রইল আরিয়ান। সে একদৃষ্টিতে মেজো চাচ্চুকে দেখে গেল। তিনি রাগেন না কি বকা দেন, এটাই দেখতে থেকে গেল সে। অনেকক্ষণ পর কণ্ঠস্বর নরম করে সামিউল আলম বললেন,

‘কেমন আছিস, প্রাণ?’

ওপাশ থেকে শুধু প্রাণেশার ফুঁপানি এলো। এখনও ওরা গাড়িতেই। অনির্বাণ ড্রাইভে ব্যস্ত। কোথায় যাচ্ছে, কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে, গেলেই বুঝতে পারবে। ড্রাইভ সামলানোর ফাঁকে যখন স্ত্রীর দিকে চোখ গেল, তখুনি দেখল বেচারী ফোন কানে চেপে ফুঁপাচ্ছে। আশ্চর্যান্বিত মনোভাব নিয়ে কাছে টেনে চোখের পানি মুছে দিল। প্রাণেশা তখন ভাঙা গলায় বলল,

‘আমি ভালো আছি, বাবা। তুমি কেমন আছো?’

সামিউল আলম গভীর করে শ্বাস টেনে বললেন,
‘এইতো, আছি একরকম।’

ওপাশ থেকে প্রাণেশা ছটফটিয়ে উঠল,
‘একরকম কেন, বাবা? শরীর খারাপ?’

‘না… শরীর ঠিক আছে। তোরা বাড়ি কবে ফিরবি?’

‘ওর তো এখন কাজের চাপ বেশি। জানি না কবে যেতে পারব।’

‘ওহ…। ঠিক আছে। যখন সময় পাবি, চলে আছিস।’

প্রাণেশা অস্ফুটস্বরে ডাকল,
‘বাবা…।’

‘বল… শুনছি।’

‘তুমি খুশি তো? রাগ নেই তো আমার ওপর?’

উত্তরে কী বলবেন, ভেবে পেলেন না সামিউল আলম। কখনও মেয়ের আনন্দে আনন্দিত হোননি, কিন্তু আজ হয়েছেন। অথচ সে কথা বলতে পারছেন না। কথা খুঁজে না পেয়ে বললেন,

‘তোর মায়ের সাথে কথা বলবি?’

‘আগে বলো, রেগে নেই তুমি?’

‘তুই ছাড়া বাড়িটা ভীষণ ফাঁকা লাগছেরে, মা।’

‘বারে, এখন আসি কী করে? বিয়ে দিয়ে পর করে দিয়েছ না?’

‘পর করলাম কোথায়? দূরে তো পাঠাইনি। কাছেই রেখে দিয়েছি।’

প্রাণেশা কান্নারত মুখে ভীষণ আবেগে বলে উঠল,
‘আই মিস ইউ, বাবা।’

সামিউল আলম উত্তরে বললেন,
‘শিগগির বাড়ি আয়।’

‘আসব, বাবা। খুব শিগগির আসব। মা কোথায়?’

ফোন হাতে নিয়ে তিনিও ড্রয়িংরুম ত্যাগ করে স্ত্রীকে খুঁজতে চলে গেলেন। আরিয়ান মুখ টিপে হেসে নিজের রুমে চলে এলো। তখুনি মেয়েকে কোলে নিয়ে রুমে ঢুকল রূপকথা। স্বামীকে ইশারা করে বলল,

‘কথা হয়েছে?’

আরিয়ান নির্ভার হেসে বলল,
‘যতটুকু হয়েছে যথেষ্ট।’

রূপকথা মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে হাতে খেলনা ধরিয়ে দিল। আরিয়ান মেয়ের পাশে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল,
‘আ’ম সো প্রাউড অফ ইউ, রূপ।’

রূপকথা মুচকি হাসলো। আরিয়ান স্ত্রীর দুটোহাত নিজের হাতের মুঠোয় আটকে বলল,
‘সম্মান করি বলে, মুখফুটে এই কথাগুলো বলতে পারিনি কোনোদিন। তবে আমার দিক থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতাম চাচ্চুকে বোঝানোর। হয়তো আমার বুঝানো ও তোমার বলার মধ্যে পার্থক্য ছিল।’

‘ছাড়ো…। এসব নিয়ে আর কথা বাড়ানোর দরকার নেই। আমাকে একটু হেল্প করো তো।’

‘কীসের হেল্প?’

‘আমি প্রাণেশাকে বলেছি, দু’জনকে গিফট দেব। কী গিফট দেব সেটাই তো ভেবে পাচ্ছি না।’

আরিয়ান বলল,
‘চাচ্চুর রাগকে পানি করে দিয়েছ। এটাই তো বিশাল একটা গিফট।’

‘ধুর… ফাজলামি করো না। সিরিয়াসলি বলছি, কিছু একটা দেয়া উচিত ওদের। দুই ঝগড়ুটে এক ছাদের নিচে থাকতে রাজি হয়েছে, ভাবা যায়? স্পেশাল কিছু তো দিতেই হয়।’

দু’জনে মিলেই ভাবছিল, কী গিফট দেয়া যায়! এরমধ্যেই রূপকথার ফোনে একটা ম্যাসেজ এলো। স্ক্রিনে চোখ বুলাতেই দেখল, প্রাণেশা লিখেছে –

‘থ্যাংক ইউ, ভাবী। থ্যাংক ইউ সো মাচ্। তোমার এই সুইট সুইট কাজের জন্য একটা উড়ন্ত চুম্মাহ।’

রূপকথা অবাক হলো। রিপ্লাইতে লিখল,
‘তুই জানলি কী করে?’

‘মা বলেছে।’

প্রাণেশার ম্যাসেজ আরিয়ানও দেখেছে। সে বউয়ের ঠোঁটের কোণের হাসি দেখে বলল,
‘ননদিনীর কাছে থেকে একটা চুমু পেয়েই এত খুশি? আমার থেকে চাও না?’

ফোন বিছানায় রেখে আরিয়ানকে জড়িয়ে ধরল রূপকথা। মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে, কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
‘তোমার থেকে একটা নয়, বেহিসাবী চুমু চাই। একদিন নয়, সারাজীবন চাই। সময়ে-অসময়ে, প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে, কারণ-অকারণে চাই। তুমি কিপটামি করলেও আমি মানব না। একদিন মিস করলে পরেরদিন ঠিকই আমি, আমার সব অধিকার ও ভালোবাসা সুদে-আসলে আদায় করে নেব। বুঝেছ?’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-১০

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ১০

সম্পূর্ণ অপরিচিত একটা অনুভূতির সাথে পরিচয় অথচ খুবই আকাঙ্ক্ষিত! আবেগ-অনুভূতিকে দূরে ঠেলে দিতে গিয়ে যে মেয়ে কোনোদিন ঘর-সংসারের স্বপ্ন দেখেনি, কাউকে ভালোবাসেনি, সে-ই আজ বিবাহিত জীবনের পরিপূর্ণ একটা সুখকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখেছে। এই অনুভূতি তাকে শুধু সম্পর্কটাই দামী বুঝায়নি, সে-ও যে দামী, আপাদমস্তক এক নারী, সেটাও বুঝিয়ে দিয়েছে। সকাল থেকে একটুকরো সুখকর অনুভূতির ঢেউ খেলে যাচ্ছে তার মনের সমুদ্রজুড়ে। সে-ই ঢেউয়ে দুলছে প্রাণেশার দেহ-মন। সেটুকু লুকাতেই কাজের অজুহাতে বেডরুম ত্যাগ করে অন্যরুমে এসে ঘাপটি মেরেছে প্রাণেশা। রুম-লাগোয়া বেলকনিতে রাখা বেতের সোফাতে বসে ঢাকা শহরের প্রথম সূর্যোদয়কে উপভোগ করছে সে। লাল টুকটুকে রং ধারণ করে সূর্য্যিমামা সবে আকাশের কোণে উঁকি দিয়েছে। ধীরেধীরে আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরনীতে। এই রোদ্দুর যেন নতুন ভোর নিয়ে এলো জীবনে। ঠোঁটের কোণে লাজুক হাসি নিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে চোখবুঁজে পড়ে রইল প্রাণেশা। আপাতত অনির্বাণকে ফেইস করা কঠিন। লজ্জার। বেচারা এখনও ঘুম থেকে উঠেনি। হাত বাড়িয়ে কাছে না পেলেই লাফ দিবে। ভাবতেই হাসি পেল তার। গতরাতের কিছু দুষ্টুমিষ্টি খুঁনসুটিময় মুহূর্ত মনে পড়ল। ক্ষণে ক্ষণে রেগে যাবে, গাল ফুলাবে, রাগ দেখিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিবে, আবার বলবে –

‘ঝগড়াঝাটি, তর্কাতর্কি যদি সমান-সমান হয়, ভাব-ভালোবাসাও সমান-সমান হবে। কোনো ফাঁকিবাজি নাই।’

অনির্বাণ যে এত রোমান্টিক, এত যত্নে বউকে ভালোবাসতে জানে, সেটুকু জেনে ক্ষণে ক্ষণে ভীষণ লজ্জায় লজ্জাবতী হচ্ছে প্রাণেশা। এত লজ্জা পাচ্ছে যে, নিজেকে আয়নার সামনে দাঁড় করানোর চিন্তা মাথায় এলেই সর্বাঙ্গে কাঁপন সৃষ্টি হচ্ছে। কী যন্ত্রণা! সমস্ত ভাবনার দৌড় থামিয়ে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। কতক্ষণ পর বের হতেই কলিংবেল বেজে উঠল। এত সকালে কে আসবে? ভেজা চুলে টাওয়েল পেঁচিয়ে, পরিপাটি হয়ে ডোর খুলতেই দেখল, ত্রিশোর্ধ এক নারী দরজায় দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই দাঁতপাটি বের করে হেসে বলল,

‘ওমা! ভাবী যে। চলে এসেছেন?’

প্রাণেশা একটু অবাক হলো। বলল,
‘আপনি কে? আমাকে চিনেন কী করে?’

মেয়েটা মুখের সুপারি চিবোতে চিবোতে উত্তর দিল,
‘আমি হনুফা। এই অ্যাপার্টমেন্টের সব বাসায় কাজ করি। ভাইজান গতকাল বলছিলেন, আজ থাইক্যা সাতটায় আসতে। তিনি দেশেরবাড়ি থাইক্যা বউ নিয়ে আসবেন। এই ফ্লাটে তো আর কোনো মাইয়া মানুষ নাই। আপনি-ই। তাই মনে হইলো, আপনিই ভাইজানের বউ।’

‘কথায় যুক্তি আছে। ভেতরে আসুন।’

হনুফা ভেতরে প্রবেশ করে ডোর আটকে দিল। প্রাণেশা বলল,
‘আপনি নাশতা বানান রোজ?’

‘না… ভাবীজান। আমি আসি নয়টায়। এর আগেই ভাইজান নিজে নাশতা বানাইয়া খাইয়া ফেলেন। আমি আইলে সবজি কাটাকুটি কইরা ভাত-তরকারি রান্না করি। বাসনকোসন মাজি, কাপড়চোপড় ধুই, আর ঘর পরিষ্কার কইরা তারপর যাই।’

‘ওহ…। আপনি এক কাজ করবেন, আজ থেকে আমাকে কিছু রেসিপি শেখাবেন। আমি একদমই রান্নাবান্না পারি না। যদি কোনোদিন আপনি না আসেন, খাব কী?’

হনুফা একগাল হেসে রান্নাঘরে এসে চা-নাশতার আয়োজন শুরু করল। কোথায় কী রাখা আছে সব তার মুখস্থ। সে চটপটে হাতে কাজ করতে করতে বলল,

‘রেস্টুরেন্টে অর্ডার দিবেন। ভাইজান তো এইটাই করেন।’

‘এখন থেকে আর করবে না। এসব আনহেলদি খাবার খেলে বড়োবড়ো রোগ হয়।’

‘আমিই তো রোজ ভাইজানরে এইসব বলি। উনি আমার কথা কানেই নেন না। এবার আপনি আসছেন, নিশ্চিত সব ঠিক হইয়া যাইব। আপনি আমার পাশে দাঁড়াই থাকেন, আমি দেখাইতেছি ক্যামনে কী করতে হয়! আগে কন, নাশতায় কী খাইবেন? রুটি-সবজি না কি পোলাও-খিচুড়ি?’

আপাতত রুটি-সবজিই যথেষ্ট। ইচ্ছে জানিয়ে হনুফার পাশে দাঁড়িয়ে রইল প্রাণেশা। হনুফা চা বানালো আগে। দু’কাপ প্রাণেশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে এককাপ নিজের জন্য রাখল। চা খেতে খেতে রুটি বেলার কাজ সেরে নিবে। প্রাণেশা চা হাতে নিয়ে রুমে প্রবেশ করে দেখল, অনির্বাণ তখনও গভীরঘুমে। ডাকাডাকি করতে লজ্জা লাগছিল দেখে, গরম চায়ের কাপ হাতে নিয়ে অনির্বাণের সবকটা আঙুল ডুবিয়ে দিল চা’তে। গরম ছ্যাঁকা খেয়ে তড়াক করে লাফ দিল অনির্বাণ। ঘটনা কী বুঝতে বেগ পেতে হলো। এরমধ্যেই প্রাণেশা দূরে সরে গিয়ে শব্দ তুলে হেসে উঠল। ভেংচি কেটে বলল,

‘আরও ঘুমাও।’

অনির্বাণ হাই তুলতে তুলতে বলল,
‘তোর মতো একটা বদ বউ জীবনে থাকলে সব পুরুষের জীবন ত্যানাত্যানা হবে নিশ্চিত। আলাদিনের দৈত্য এসেও আটকাতে পারবে না।’

আরও কিছু বলতে চাইছিল অনির্বাণ, পারল না। তার আগেই প্রাণেশা তার দিকে তেড়ে এসে বলল,
‘আমি বদ?’

‘হ্যাঁ… সন্দেহ আছে?’

‘অফকোর্স। আমার মতো একটা মেয়ের সাথে বদ শব্দটা যায়ই না।’

‘কতটা যায় সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কেউ জানে না। সর এখন…। কাছে এলে জাপটে ধরব।’

‘একটা সামাল দিতে গিয়ে মেজাজের দফারফা ঘটে যাচ্ছে, উনি না কি আবার বিশটা একসাথে পালবেন। দেখা যাবে, কেমন পারো।’

অনির্বাণ একইভাবে বলল,
‘ওই বিশটার একটাও তোর মতো হবে না। দেখিস…।’

‘হ্যাঁ, বসে বসে স্বপ্ন দেখো।’

‘চ্যালেঞ্জ করছিস?’

প্রাণেশা দাঁতপাটি বের করে হেসে বলল,
‘হ্যাঁ করছি। নেক্সট জেনারেশন এই প্রাণের ফটোকপি হবে।’

এমন হলে অনির্বাণ শেষ! কিন্তু তবুও… আশা রাখতে দোষ কী? এই সুন্দর সকালে অকারণ ঝগড়া ও তর্ক করতে ইচ্ছে হলো না তার। তা-ই ঝটপট ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। প্রাণেশা চায়ে চুমুক দিতে দিতে জানালার পর্দা ও কাঁচ সরিয়ে রুমের অন্যপাশের দরজাটাও মেলে দিল। আর সাথে সাথেই চমকে গেল। এই বেলকনিতে অনেকগুলো ফুলের টব। তা-ও নিচে, গ্রিলে, আবার উপরেও। প্রত্যেকটা টবে বিভিন্ন ধরনের ফুলের গাছ। হতবাক দৃষ্টি নিয়ে ফুলের গাছের দিকে তাকিয়ে দু’হাতে তাদের ছুঁয়ে দেখার লোভ হলো ভীষণ। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়েও দিল। ছোট্ট একটা বেলি ছিঁড়ে এনে ঘ্রাণ শুঁকে কানের পিছনে গুঁজে দিয়ে রান্নাঘরে এসে হনুফার পাশে দাঁড়াল। হনুফা রুটি বেলা শুরু করেছে। প্রাণেশা একটা রুটি সেঁকতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলে আফসোসের সুরে বলল,

‘ইশ্, পুড়ে গেল তো।’

সেটা দেখে হনুফা বলল,
‘একদিনে এইসব শিখতে পারবেন না, ভাবীজান। সময় লাগব। কোনো টেনশন নাই। আমি সব শিখাইয়া দিমু।’

একচুলোয় রুটি সেঁকতে দিয়ে অন্য চুলোয় আবার চা বসাল প্রাণেশা। আগের কাপ তো নষ্ট করে দিল। হনুফা তাকে চা বানাতে শেখাল। কতটুকু পরিমাণ চা’পাতা ও দুধ চিনি দিতে হয়, সেটাও শেখাল। ভীষণ ধৈর্য্য নিয়ে এককাপ চা বানিয়ে আবারও রুমে এলো। অনির্বাণ বিছানা পরিপাটি করছিল। প্রাণেশা বলল,

‘তুমি চা খাও, আমি রুম গুছাচ্ছি।’

অনির্বাণ গালে হাত দিয়ে বলল,
‘পারবি? পারলে কর দেখি।’

‘আশ্চর্য! সবসময় আমাকে এত অকর্মা ভাবো কেন?’

চা ধরিয়ে দিয়ে বিছানা পরিপাটি করল প্রাণেশা। ঝাড়ু এনে রুমটাও ঝাড়ু দিল। এতটাও অকর্মা সে নয়, যতটা সবাই বলে। বউয়ের এসব কাজকর্ম দেখে অনির্বাণ বলল,

‘তোর কাপড়চোপড় এখানেই রেখে দে। মানুষ একজায়গায়, কাপড় আরেক জায়গায়, কেমন দেখাচ্ছে না বিষয়টা?’

এরপর নিজের রুমের আলমারি দেখিয়ে বলল,
‘এটার ভেতর যথেষ্ট ফাঁকা। রাখতে পারিস।’

প্রাণেশা হাত বাড়িয়ে অনির্বাণের বুকের কাছে পাঞ্চ বসিয়ে বলল,
‘যা আমার, সেটার দখলদারি আমি এমনিতেই নিব। এসব আমাকে বলে দিতে হবে না।’

অনির্বাণ চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, আর এজন্যই অনুমতি ছাড়া আমার গাছের ফুল ছিঁড়ে কানে গুঁজিয়েছিস।’

‘বেশ করেছি। আচ্ছা, তুমি তো কখনও গাছ লাগাও না। এখানে এত ফুলগাছ কবে থেকে?’

‘তোর মতো নিয়ম করে গাছ রোপণ করি না, কিন্তু এই জায়গাটার সৌন্দর্যের জন্য কয়েক ধরনের ফুলগাছ লাগিয়েছি। সুন্দর লাগছে না?’

প্রাণেশা বেলকনির দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলল,
‘ভীষণ। আমার খুব শখ ছিল, কোনো একদিন একটা চমৎকার পুষ্পকুঞ্জ সাজাব। যেখানে শুধু ফুল আর ফুল থাকবে। আর একটা পর্ণকুটির থাকবে। আমি মাঝেমধ্যে সে-ই কুটিরে যাব আর নিজের মতো করে গাছেদের সাথে সময় কাটাব। এখন আর এই শখটা পূরণ হবে না, ভাবতেই কী খারাপ লাগছে আমার।’

অনির্বাণ কৌতূহলী হয়ে বলল,
‘কেন পূরণ হবে না?’

‘এই ইট-পাথরের শহরে আমি পর্ণকুটির পাব কোথায়?’

‘খুঁজলে পাওয়া যাবে হয়তো।’

‘কী জানি!’

দুষ্টুমিষ্টি খুঁনসুটির ফাঁকে নাশতাপর্ব শেষ হলো। নাশতা শেষ করেই তাড়াহুড়ো করে তৈরী হলো অনির্বাণ। আলমারি থেকে প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র বের করে, ওয়ালেট, ফোন ও গাড়ির চাবি হাতে তুলে বলল,

‘ফিরতে একটু দেরী হবে। ওয়ার্কশপ থেকে কোর্টে যাব। কিছু প্রয়োজন হলে দারোয়ানকে ফোন করিস, এনে দিবে।’

প্রাণেশা জানতে চাইল,
‘কেন?’

অনির্বাণ বউয়ের বিস্মিত চোখজোড়ায় ঠোঁট ছুঁইয়ে কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল,
‘একটা ছোট্ট সারপ্রাইজ রেডি করছি। সেটা কী, এখুনি বলা যাবে না। বসে বসে টেনশন কর। ঠিক আছে?’

***

আগামী সপ্তাহে যেহেতু প্রতিযোগিতা, প্রাণেশা স্টাডিটেবিল থেকে নড়ছেই না। হনুফা কাজ শেষ করে চলে যাওয়ার পর সে খাওয়া-দাওয়া বাদ দিয়ে বই নিয়ে বসেছে। একগাদা কুইজের বই তার সামনে। যেগুলো আগের জানা, শেখা সেগুলোও আবার পড়ছে। একেবারে ঠোঁটস্থ করছে, যেন কোনোভাবেই ভুল না হয়। পড়ার মাঝখানেই বাড়ি থেকে কল এলো। ভিডিওকলের ওপাশে সব কাজিনদের দেখে বই রেখে রুমের বেলকনিতে গেল প্রাণেশা। আইশা-মাইশা একসাথে বলল,

‘ঢাকায় গিয়ে তুমি আমাদের ভুলে গেছো, ভাবী। সকাল থেকে একবারও ফোন দাওনি।’

প্রাণেশা বিব্রত হলো। ব্যস্ততায় ভুলেই গিয়েছিল, বাড়িতে ফোন করা হয়নি। সে নিজের দিক স্পষ্ট করে বলল,
‘জানিসই তো, সামনে প্রতিযোগিতা। কাজ শেষ করে আমি পড়তে বসেছিলাম। ওই দেখ, এখনও টেবিলের ওপর একগাদা বই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা।’

ব্যাকক্যামেরা দিয়ে রুমের স্টাডিটেবিল দেখাল প্রাণেশা। ওপাশে সবাই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। নাহিয়ান বলল,
‘তুই তোর মাথাটাকে লাইব্রেরী বানিয়ে ফেল। তাহলে আর একগাদা বইপত্র টেবিলের ওপর রাখতে হবে না। ওগুলো তোর মাথাতেই ঠেসে রাখতে পারবি।’

প্রাণেশা ঝগড়ুটে মেজাজে বলল,
‘দূরে আছি বলে ভাবছিস বেঁচে গিয়েছিস, তাই না? ওইবাড়ি আমি সারাজীবনের জন্য ছাড়িনি। যখন আসব না, ঠ্যাং ভাঙব তোর। দেখে নিস…।’

ওপাশ থেকে রাফিয়ান বলল,
‘আমার দুলাভাই কই, সোনাপু?’

অনির্বাণ বাসায় থাকলে এখন শালা-দুলাভাইতে একদফা যুদ্ধ হয়ে যেত। রাফিয়ানের কথাতে সবার হাসির মাত্রা বেড়ে গেল। সে-ই হাসিতে তাল মিলিয়ে প্রাণেশাও হাসতে হাসতে বলল,

‘তোর দুলাভাই তো বাসায় নেই, রাফি।’

রাদিন-রামিশা, রেদোয়ান কেউ বাদ গেল না। সবাই-ই দুলাভাই শব্দটা নিয়ে মজা করল। সবশেষে ফোন নিল রূপকথা। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,

‘সব ঠিক আছে তো, প্রাণেশা?’

মুচকি হেসে প্রাণেশা উত্তর দিল,
‘হ্যাঁ।’

‘দুই ঝগড়ুটে মানুষ ঠিকঠাকমতো সংসার করতে পারবে কি না, এই নিয়ে আমার তো চিন্তার শেষ নেই। সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকছি।’

‘কেন?’

সবার থেকে দূরে সরে গেল রূপকথা। স্বর খাদে নামিয়ে বলল,
‘এই সম্পর্কটা তো লাভ ম্যারেজ না, আবার অ্যারেঞ্জ ম্যারেজও না। যা হয়েছে সবটাই জোরাজুরি করে চাপানো হয়েছে। এ যাবৎ যা কিছু তোর ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে, সেটাতেই গণ্ডগোল হতে দেখা গেছে।’

‘তেমন কিছু হবে না, ভাবী। আমি সবকিছু মন থেকে মেনে নিয়েছি।’

‘মানিয়ে নিতে পারবি তো?’

‘ধীরেধীরে অভ্যাস হয়ে যাবে। আর অভ্যাস হয়ে গেলে মানিয়ে নেয়া কঠিন হবে না, ভাবী।’

‘অনিচ্ছায় কিছু করিস না আর সম্পর্কটাকেও বোঝা ভাবিস না। একটু যত্ন নিয়ে এটাকে মূল্যায়ন করতে পারলেই সুখী হবি।’

‘জোরপূর্বক যা কিছু চাপানো হয়েছে, সেসবকেও তো যত্ন নিয়ে সফল করতে চেয়েছি। সাকসেস হলাম কই? তবে এটা নিয়ে ভেবো না। যেহেতু বিয়ে ও বন্ধন সারাজীবনের ব্যাপার, আমি অবশ্যই এর ব্যাপারে যথেষ্ট যত্নশীল হব। হয়তো আমাদের মধ্যে তথাকথিত প্রেমিক-প্রেমিকাদের মতো ভালোবাসাটা গড়ে উঠেনি, তবে সম্পর্কের প্রতি অদৃশ্য এক টান ও অধিকারবোধ জন্ম নিয়েছে। আমাদের মধ্যে এতটাও দূরত্ব আর নেই যতটা দূরে থাকলে সম্পর্কে ভাঙন আসতে পারে।’

রূপকথা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলে বলল,
‘তুই যে এটা বুঝতে পেরেছিস, তাতেই আমি শান্তি পাচ্ছি। বিশ্বাস কর, আমার এত খুশি লাগছে। বাড়ি এলে দু’জনকে একটা স্পেশাল গিফট দেব।’

‘তাই? তুমি স্পেশাল গিফট দিবে, আর তোমার দেবর গেল, সারপ্রাইজের ব্যবস্থা করতে। দু’জনে কী প্লান করেছ কিছু?’

‘আরেহ্ না। আমি ওর সাথে নাই। অনি কী করছে আমি জানি না। তবে আমি কী করব সেটা সময় এলেই দেখবি।’

‘আচ্ছা। এখন ফোন রাখি? পড়তে বসব।’

‘ঠিক আছে। ভালো থাকিস।’

পড়তে বসে দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমেছে অথচ দুপুরের খাবার খায়নি প্রাণেশা। কাজের চাপে অনির্বাণও ফোন দেয়নি। ফ্রি হয়ে যখন বিকেলের দিকে কল দিল, প্রাণেশা তখনও বইয়েই মুখ গুঁজে রাখল। ঠোঁট নাড়তে নাড়তে ফোন কানে ঠেকাল। ওপাশ থেকে অনির্বাণ বলল,

‘দুপুরে খেয়েছিস কিছু?’

প্রাণেশা ফ্যাকাসে মুখে বলল,
‘না… খাইনি।’

‘কেন?’

‘একা খেতে ভালো লাগছে না।’

‘বাড়ির সবাইকে মিস করছিস?’

‘একটু-আধটু। ক্ষিধে টের পেয়ে খেতে গেলাম, ওমা খাবার দেখি আমার গলা দিয়ে নামতেই চাইছে না। শেষে এককাপ চা নিয়েই বসে গেছি। এখন ওটাই গিলছি।’

অনির্বাণ হতাশ কণ্ঠে বলল,
‘এমন করলে হবে? নিজের যত্ন নিবি না? তুই যদি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া না করিস, তাহলে তো দুর্বল হয়ে পড়বি। আর তুই দুর্বল হলে নেক্সট জেনারেশন কী করে আসবে? তোকে তো অলওয়েজ স্ট্রং থাকতে হবে, তাই না?’

সিরিয়াস মোমেন্টে এমন একটা কথা শুনে মেজাজটায় আগুন জ্বলে উঠল প্রাণেশার। ঠোঁটমুখ বাঁকিয়ে বলল,
‘গাছে কাঁঠাল গোঁফে তেল – ব্যাপারটা এমন হয়ে যাচ্ছে না?’

অনির্বাণ উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল,
‘ছাড়… খেয়ে নে। টিপিক্যাল বউদের মতো আচরণ করিস না। বর না খেলে বউ খেতে পারবে না, এমন কোনো নিয়মে আমি বিশ্বাসী নই। তুই খেতে বোস। সময়মতো না খেলে অ্যাসিডিটি বাড়বে। ফিরে এসে একসাথে ডিনার করব।’

‘যদি না খাই?’

‘একটা চড় মারব।’

‘দূরে থেকে চড় মারতে পারবে তুমি?’

‘খুব পারব। ওই মেয়েটা যেভাবে ‘ফ্লায়িং কিস’ ছুঁড়েছিল। সেভাবেই ‘ফ্লায়িং স্ল্যাপ্’ মারব। মার খেতে না চাইলে এখুনি খেতে বোস। যা…।’

‘ছিঃ তুমি এত নিষ্ঠুর হতে পারবে?’

‘খুব পারব। আদর-শাসন দুটোই আমি বুঝেশুনে করব।’

‘তুমি একটা…।’

কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল প্রাণেশা। একা খেতে গিয়ে নিজের অজান্তেই অনির্বাণকে ভীষণ মিস করছিল। তাকে ছাড়া খেতে হবে ভেবেই খায়নি। সত্যিটা স্বীকার না করে বাড়ির সবাইকে টেনে এনে কাটিয়ে দিয়েছে। অথচ না বলা কথা নিমিষেই বুঝে নিয়েছে অনির্বাণ। সে ফোন কানে ঠেকিয়ে লাজুক হেসে বলল,

‘একটু তাড়াতাড়ি এসো।’

‘কোর্টে গেলে দেরী হবে। আমি মাত্র ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়েছি।’

প্রাণেশার কী হলো কে জানে! মন ভীষণ এলোমেলো হলো। চঞ্চল হলো। মনের ভেতর অসংখ্য অনুভূতিরা ডালপালা মেলল। সব অনুভূতিদের মুক্তি দিতে ইচ্ছে হলো। তবুও পারল না। দ্বিধা ও সংকোচ তাকে আটকে দিল। খানিক চুপ থেকে খুবই আস্তে অথচ দৃঢ়কণ্ঠে উচ্চারণ করল,

‘আই মিস ইউ, অনি।’

একহাতে ফোন কানে ঠেকিয়ে রেখে, অন্যহাতে মুখ ঢেকে ফেলল প্রাণেশা। ওপাশে অনির্বাণও থম মেরে থাকল কতক্ষণ। এরপর অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ড্রাইভ সামলে নিয়ে বলল,

‘দিলি তো মেজাজের বারোটা বাজিয়ে। আমি একদম সিরিয়াস মুডে ছিলাম, প্রাণ। অথচ তোর এই কথা শোনে এখন আমার শুধু প্রেম-প্রেম পাচ্ছে। সিচুয়েশনটা রোমান্সের নয়। এইমুহূর্তে কোর্টে যাওয়াটা ইম্পর্ট্যান্ট। নয়তো আমি এখুনি ব্যাক করতাম। আর আমার লজ্জাবতী বউটার লাজরাঙা মুখ দেখে দু’চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিতাম।’

প্রাণেশা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল। অনির্বাণ বলল,
‘মেজাজের বারোটা বাজানোর সাথে সাথে তুই আমার মনের মধ্যে বিরাট পরিবর্তন এনে দিলি, প্রাণ। চারপাশে শুধু প্রেমের মিউজিক বাজছে। এখন যেহেতু প্রেমের সময় নয়, তাই রাতে এর শোধ আমি অবশ্যই তুলব।’

এই কথায় ভরকে গেল প্রাণেশা। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বলল,
‘কী? কীসের শোধ?’

অনির্বাণ হাসতে হাসতে গানের সুরে বলল,
আদরে আদরে দেব ভালোবাসা।
সোহাগে সোহাগে দেব ভালোবাসা।
আকাশের নীল প্রান্ত ছুঁয়ে…
ভালোবাসা পড়ছে চুয়ে চুয়ে…
মুঠোভরে দেব তুলে…
মাখবে কলিজায়…
নজর না লাগে যেন চাঁন্দেরও গায়…।

***

চলবে…

⚫ খণ্ডাংশ | মনমোহিনী

এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে সড়কের মোড় ধরে হাঁটছে আদনান। কপালে চিনচিনে ব্যথার পাশাপাশি বুকের ভেতরটাও অদ্ভুত যন্ত্রণা হচ্ছে। এই যন্ত্রণা তাকে কাঁদাতে চাইছে। তবুও চিৎকার দিয়ে কাঁদতেও ইচ্ছে করছে না তার। সমস্ত যন্ত্রণাকে দামাচাপা দিয়েই শান্তি পাচ্ছে সে। সমানে বেজে যাচ্ছে ফোন। হাতে তুলে তানভীরের নাম্বার দেখে ফোন কেটে সাইলেন্ট করে পকেটে রেখে দিল সেটা। ভীষণ একা লাগছে আজ! এই একাকীত্বটা কারো সামনে প্রকাশ করতে চায় না সে। তাই এই অকারণ হাঁটাহাঁটিকেই সঙ্গী হিসেবে বেছে নিতে হয়েছে। হাঁটতে হাঁটতেই নোভার বলা কথাগুলো ভেবে চলেছে সে। কীসের পুরনো কথা! কেনই বা বাবা-ছেলে দু’জনকেই খারাপ বললো নোভা? কই, তার তো মনে পড়ে না; কখনো কোনো অবস্থায় নোভার সাথে বাড়াবাড়ি করেছে সে! তবে কেন এসব কথা আসবে?

একে একে নোভার সাথে কাটানো স্মৃতি কল্পনা করছে আদনান। খুঁনসুটি, হাসি-আনন্দ ছাড়াও কতশত কথার বাহানা, সেসব কথায়ও কোনোদিন ভুল করেও বাজে কোনো কথাই সে তুলেনি! তবুও কেন এই অযাচিত কথা উঠে আসলো? কোনো ভাবনাকে মিলাতে পারছে না আদনান। সবকিছু যেন মাথার ভেতর ঘুণপোকার মতো কিলবিল করে মাথাটাকে ভার করে তুলছে। চুলগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে কর‍ছে তার।

পুরোটা অন্যমনস্ক হয়েই হাঁটছিল সে। খেয়ালই করেনি কখন মাঝরাস্তায় চলে এসেছে। হঠাৎই একটা মোটর সাইকেল ফুল স্পীডে পাশ ঘেঁষে যেতে চাইলেই তড়িঘড়ি করে দূরে সরে গেল। কয়েক মিনিট হাঁটু ভাঁজ করে সড়কের সাইডে বসে রইলো। হঠাৎ করেই মায়ের বলা সেদিনের কিছু কথা, বিচে নোভার বলা গল্প, আর আজকে নোভার আচরণ এমনকি রেদোয়ান হাসানের জানাযায় না আসার কারণ সবমিলিয়ে দ্রুত একটা হিসাব কষলো আদনান। সোজা হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তানভীরকে ফোন করে বলল,
-‘আজ আমি ফিরছি না। নোভাকে সামলে রাখিস।’
-‘আসবি না মানে! কোথায় তুই এখন?’
-‘রাস্তায়।’
-‘রাস্তায় কী করছিস? বাইরে ঠাণ্ডা বাড়ছে আদি, যথেষ্ট কুয়াশাও ঝরছে!’
-‘ঝরুক! রাখছি।’
লাইন কেটে ফোনে নোভার পরীক্ষার রুটিনটা চেক করে নিল। আগামীকাল কোনো পরীক্ষা নেই দেখে একটু নিশ্চিত হলো সে। ঝটপট সেটা পকেটে রেখে টিস্যু বের করে কপালটা মুছে নিল এবার। রক্তটা কপালে বসে গেছে নিশ্চিত! টিস্যুতে উঠে আসছে না। টিস্যু ফেলে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির কাছাকাছি গিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল দ্রুত।

***

চলবে।

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৯

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৯

মেহেরপুর থেকে ওরা যখন ঢাকায় এলো তখন রাত সাড়ে নয়টা। একটানা অনেকক্ষণ ধরে ড্রাইভ করাতে যথেষ্ট ক্লান্ত অনির্বাণ। প্রথমে গাড়িটা অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকিয়ে, একপাশে পার্কিংয়ে রেখে, ব্যাগপত্র বের করে দুটো লাগেজ প্রাণেশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে, তাকে লিফটের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখল। এরপর গাড়ি গ্যারেজে রেখে, বাকি লাগেজ ও ছোট্ট পার্সসহ সমস্ত ব্যাগপত্র হাতে ও পিঠে তুলে নিয়ে লিফটে পা রেখে সুইচ টিপে দিল। ছ’তলায় আসতে বেশি সময় লাগল না। ফ্লাটের সামনে দাঁড়িয়ে চাবি বের করে লক খুলে, ডোর মেলে দিয়ে বলল,

‘একদম ছোট্ট, সাদামাটা একটা ঘর। থাকতে পারবি?’

প্রাণেশা উত্তর না দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতে চাইল, অনির্বাণ তাকে ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে, সবগুলো লাগেজ ভেতরে ঢুকিয়ে দৌড়ের ওপর রান্নাঘরে গেল। প্রাণেশা দূর থেকে বলল,

‘আশ্চর্য! এতক্ষণ জার্নি করে এলাম, কোথায় একটু বিশ্রাম নিতে দিবে। তা না করে, দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে রেখেছ! এটা কী ধরনের নিষ্ঠুরতা?’

দু’মিনিটের মধ্যেই ছুটে এলো অনির্বাণ। হাতে ট্রে। তাতে একগ্লাস জুস। ছোট্ট পিরিচে চারটে মিষ্টি। সোজা প্রাণেশার সামনে দাঁড়িয়ে জুসের গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘বধূবরণ করছি।’

প্রাণেশা তাজ্জব বনে বলল,
‘বধূবরণ! তুমি?’

‘হ্যাঁ, আমি। আমার ঘরে আর কেউ নেই। তাই আমার বউকে আমিই স্ব-সম্মানে বরণ করে ঘরে তুলছি। নে, ঝটপট জুস খা। এরপর অল্প একটু মিষ্টিমুখ করবি।’

হাতের ঠ্যালায় সব দূরে সরিয়ে জোরপূর্বক ভেতরে প্রবেশ করতে চাইল প্রাণেশা। তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। প্রচণ্ড ঘুমে ধরেছে। শান্তির একটা ঘুম না হলে চলছেই না। কিন্তু কে বুঝে, কার কথা? ঠেলেঠুলেও লাভ হলো না। পালোয়ানের শরীর নিয়ে অনির্বাণ তার পথ আটকে বলল,

‘এমন করছিস কেন? নতুন বউ না তুই? নতুন বউকে বরণ করে ঘরে তুলতে হয়। এটাই নিয়ম। নিয়মের অবহেলা করা যাবে না।’

‘গুল্লি মারি তোমার এসব নিয়মে।’

‘গুল্লি পরে মার। আগে অল্প একটু মুখে দে। প্লিজ… প্রাণ। আমার গুলুমুলু, নাদুসনুদুস, দুষ্টুমিষ্টি বউ না তুই? সবসময় এত ঘাড়ত্যাড়ামি করতে হয় না তো, জান।’

এ কেমন বধূবরণ বুঝল না প্রাণেশা নিজেও। কোনো স্বামী তার বউকে বরণ করে ঘরে তুলে? তা-ও বিয়ের দু’সপ্তাহ পর? মেজাজ খারাপ হলেও অনির্বাণের এই পাগলামি সহ্য করে নিল। প্রথমে অল্প একটু জুস মুখে দিল, এরপর কাঁটা চামচের সাহায্যে খুব সামান্য মিষ্টি। এইটুকু খাইয়ে অনির্বাণ তাকে ইশারায় ভেতরে প্রবেশ করার অনুমতি দিয়ে বলল,

‘ওয়েলকাম মিসেস্ অনির্বাণ সৈকত। ওয়েলকাম টু ইউওর হোম।’

এরপর আবার ছুটে গেল ডাইনিংয়ে। ট্রে রেখে রুম থেকে খুঁজে খুঁজে হাতপাখা নিয়ে এলো। যদিও এটার প্রয়োজন হয় না, তবুও নিজের ঘরে দুটো হাতপাখা কিনে রেখেছিল সে। প্রাণেশা সবে ডোর বন্ধ করে ড্রয়িংরুমের সোফায় বসেছিল। তখুনি অনির্বাণ হাতে থাকা হাতপাখা দিয়ে উরাধুরা বাতাস শুরু করল। বিড়বিড় করল,

‘প্রাণের মাথা ঠাণ্ডা হোক। বরফ-শীতল মেজাজ হোক। সব শয়তানি, বদ বুদ্ধি, তিড়িংতিড়িং মাথা থেকে বের হয়ে যাক। হে আল্লাহ, আমার বউয়ের মন-মেজাজকে সবসময় ফ্রিজের বরফের মতোই ঠাণ্ডা রেখো। কু-বুদ্ধি, কূটনামি, রাগারাগি, ঝগড়াঝাটি সবকিছু থেকে তাকে দূরে সরিয়ে রেখো। আর আমাকে, এই ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটাকে সামলানোর মতো প্রচুর ধৈর্য্যশক্তি দিও। পাশাপাশি রোজ একশোটা চুমুর মাধ্যমে ঠোঁটে স্কচটেপ মারার সুযোগ করে দিও। যেন, ওর বেয়াদবি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেলে ওকে শাসন করতে পারি। সবশেষে, তোমার অশেষ মেহেরবাণীর মাধ্যমে আমার বউটাকে একগাদা আণ্ডাবাচ্চার মা হওয়ার সুযোগ করে দিও। আমীন…।’

দোয়া শেষ করে তড়িঘড়ি প্রাণেশাকে বলল,
‘আমীন বল, নয়তো দোয়া কবুল হবে না।’

প্রাণেশা হতবাক দৃষ্টি নিয়ে বলল,
‘এটা দোয়া?’

‘হ্যাঁ, দোয়া। কেন, খারাপ কিছু বলেছি?’

জোরেশোরে নিঃশ্বাস নিয়ে, হাতের ধাক্কায় অনির্বাণকে সোফায় ফেলে দিয়ে, দু’দিকে দু’পা ছড়িয়ে দিয়ে, তার গলা টিপে ধরল প্রাণেশা। খুনে দৃষ্টি মেলে বলল,

‘আমার মাথায় শয়তানি, কূটনামি, কুবুদ্ধিতে ভরা? আমি রাগারাগি করি, ঝগড়াঝাটি করি, ঘাড়ত্যাড়ামি করি? আর তুমি? তুমি কী করো? হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকো? আমার সাথে পায়ে-পা দিয়ে ঝগড়া করে কে? অকারণ বউ বউ বলে জ্বালায় কে? আর কী বললে? চুমু, আণ্ডাবাচ্চা, খুব শখ না? বাচ্চার বাবা হওয়ার খুব শখ?’

যেভাবে গলা টিপে ধরেছে প্রাণেশা, সেভাবেই প্রাণেশার হাতের ওপর নিজের দুটো হাত রাখল অনির্বাণ। সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা না করে, একইভাবে চেপে রেখে দুষ্টুমি করে বলল,

‘হবে না কেন? বিয়ে করেছি, বউ এনেছি, ঘর-সংসার শুরু করব। আণ্ডাবাচ্চা তো দরকারই। ওসব ছাড়া কি সংসার পরিপূর্ণ হয়?’

এই কথা শুনে প্রাণেশা আরও জোরে গলা টিপে ধরতে গেল। অনির্বাণ হাত আটকে বলল,
‘এখুনি মারিস না। এত তাড়াতাড়ি মরতে চাই না, প্রাণ। তোর হাত ধরে বৃদ্ধ হতে চাই। শুধু একগাদা আণ্ডাবাচ্চা কেন, আমি তো একগাদা নাতি-নাতনীও চাই। বউকে নিয়ে, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে, নাতি-নাতনীদের নিয়ে আমার তো শখ-আহ্লাদের শেষ নেই রে, প্রাণ। এসব পূরণ না করে এত অল্প বয়সে মৃত্যুকে গ্রহণ করি কী করে বল?’

হঠাৎ করেই প্রাণেশার মনটা খারাপ হয়ে গেল। সে হাত সরিয়ে এনে ঝটপট সোফা ছেড়ে নেমে যেতে চাইল। অনির্বাণ তার হাত ধরে আটকে ওখানেই দাঁড় করাল। এরপর নিজে সোজা হয়ে বসে হাতের টানে প্রাণেশাকে হাঁটুর ওপর বসিয়ে দু’হাতে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে বলল,

‘রাগ করলি?’

দু’দিকে মাথা নেড়ে প্রাণেশা বলল,
‘না…।’

‘তাহলে? দূরে যাচ্ছিস কেন?’

‘ফ্রেশ হওয়া দরকার। ক্ষিধে লাগেনি তোমার? রান্নাবান্না কিছু কি আছে ফ্রিজে? কী খাবে?’

অনির্বাণ মুচকি হেসে ঠোঁটের স্পর্শ দাবিয়ে দিল স্ত্রীর গলায়। ফিসফিসিয়ে বলল,
‘টেনশনের কিছু নেই। কাছেই একটা রেস্টুরেন্ট আছে। ওখানে কল করলে, ডিনার নিয়ে আসবে।’

‘ও… তোমার বুয়া আসে না?’

‘সকালে আসবে। আজকে তার ছুটি ছিল।’

‘সে কী রান্নাবান্না করে?’

‘হ্যাঁ, সব করে।’

‘আমি তো রান্নাবান্না কিছু করতে পারি না।’

‘তোকে কিছু করতে হবে না, প্রাণ। তুই শুধু চব্বিশঘণ্টা আমাকে ভালোবাসবি।’

‘হ্যাঁ, প্রেমের দোকান দিয়ে বসেছি। চব্বিশঘণ্টা সার্ভিস দেব।’

‘স্বামীকে শুধু চব্বিশঘণ্টা কেন, দিনে আটচল্লিশঘণ্টাও সার্ভিস দেয়া যায়।’

‘আটচল্লিশঘণ্টায় দিন?’

‘ডাবল সার্ভিস দিবি। এজন্যই বললাম। একদিনে যতটা ভাব-ভালোবাসা হয়, ডাবল সার্ভিসে তার দ্বিগুণ হবে। দ্বিগুণ ভালোবাসা দিয়ে আটচল্লিশঘণ্টার ভালোবাসা চব্বিশঘণ্টাতেই পুষিয়ে দিবি।’

প্রাণেশার মনে হলো, অনির্বাণ আস্তেধীরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। তাকে এই অবধিই আটকে দিতে সে ছটফটিয়ে উঠে বলল,
‘ফ্রেশ হও, কিছু খাও। টায়ার্ড না তুমি?’

‘উঁহু… এত নড়াচড়া করিস না। চুপ করে বোস। আমি কি তোকে বিরক্ত করছি? শুধু একটু আদর করছি। আদর করতে না দিলে আণ্ডাবাচ্চা কি গুগল থেকে ডাউনলোড করব?’

লজ্জায় সারাশরীর কেঁপে উঠল প্রাণেশার। ধুম করে কিল বসাল অনির্বাণের পিঠে। বলল,
‘তোমার মুখে সত্যি সত্যিই স্কচটেপ দেয়া উচিত।’

ব্যথা পেয়ে অস্ফুটস্বরে শব্দ তুলে, পিঠে একটু হাত বুলিয়ে, প্রাণেশাকে আরও চেপে ধরে অনির্বাণ বলল,

‘হাতদুটো বেঁধে রেখে দেব, প্রাণ। একদম শয়তানি করবি না। তোর সমস্যাটা কী? আমি আমার বউকে আদর করছি। তুই এত ক্ষ্যাপছিস কেন, ভূতনী?’

কোথা থেকে কোথা কোনদিকে ঘুরায়, ভেবে পায় না প্রাণেশা। হার মেনে নিয়ে শান্তস্বরে বলল,
‘এখন ফ্রেশ হও। খাবার অর্ডার দাও। আমার কিন্তু সত্যিই খুব ক্ষিধে পেয়েছে। না খেলে ঘুম হবে না। প্লিজ একটাকিছু করো।’

প্রাণেশার লজ্জা, অস্বস্তি ও অনিচ্ছা সবকিছুই বুঝতে পারল অনির্বাণ। সে চাইছিল, মেয়েটা একটু সহজ হোক। বাড়ির সবার সাথের এই দূরত্ব খুব সহজে মেনে নিয়ে সম্পর্কটাকে সহজেই গ্রহণ করে নিক। তা-ই একটু জ্বালাচ্ছিল। এখন ক্ষিধের কথা শুনে হাত ঢিলে করে, দুটোহাত মুঠোবন্দী করে মুচকি হেসে বলল,

‘মন খারাপ করিস না। তুই মন খারাপ করে থাকলে আমার নিজেরও খারাপ লাগবে। মনে হবে, তোকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ফোর্স করে এখানে টেনে এনেছি। প্রাণ, আমাদের সম্পর্কটা কেবলই দায়বদ্ধতার না হোক, প্লিজ…। আমি চাই, সম্পর্ক ও মানুষটাকে তুই পর্যাপ্ত মূল্য দিতে শিখ। বিয়ে ও স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা নিছকই কোনো ছেলেখেলা নয়। চাইলেই এই সম্পর্ক গড়া যায় না, আবার ভাঙা যায় না। তুই যতক্ষণ না সবকিছু মন থেকে গ্রহণ করতে পারবি, ততক্ষণ আমি তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কিচ্ছু করব না। প্রমিস…। এখানে যথেষ্ট স্পেস তুই পাবি। সবকিছু তুই তোর নিজের মতো করে গুছিয়ে নিতে পারিস। আয়, আমি তোর রুম দেখিয়ে দিচ্ছি।’

***

প্রাণেশা রুম দেখছিল। রুমগুলো খুবই ছোটো ছোটো। একজন মানুষ অনায়াসে এখানে হাত-পা ছড়িয়ে থাকতে পারে। সে ফার্ণিচারগুলো দেখতে দেখতে বলল,

‘একা মানুষের এত ফার্ণিচার লাগে?’

লাগেজগুলো ভেতরে এনে অনির্বাণ বলল,
‘আরেহ্ না, আগে ছিল না। এগুলো গতকালকেই এনেছি।’

এরপর হেঁটে হেঁটে বুকশেলফ, ওয়ারড্রব, ড্রেসিংটেবিল, কেবিনেট সব দেখিয়ে বলল,
‘তোর সব প্রয়োজনীয় জিনিস এখানে সাজিয়ে নিবি। তুই সাজাতে পারবি তো? না পারলে অসুবিধা নেই, আমি হেল্প করব। এখন ফ্রেশ হয়ে একটু বিশ্রাম নে। আমি খাবার অর্ডার দিচ্ছি।’

লাগেজের চাবি অনির্বাণের প্যান্টের পকেটেই ছিল। সেটা বের করে প্রাণেশার হাতে দিতেই প্রাণেশা বলল,
‘সবসময় ইয়ার্কি না? তুমি ইচ্ছে করেই আমাকে বিপদে ফেলেছ, যেন ননস্টপ ঝগড়া করতে পারো?’

অনির্বাণ হাত বাড়িয়ে প্রাণেশার চুলগুলো এলোমেলো করে বলল,
‘তোর সাথে ইয়ার্কি না মারলে, ঝগড়া না করলে পেটের ভাত হজম হয় না রে, প্রাণ।’

‘হয়েছে আর ঢং করতে হবে না, যাও।’

অনির্বাণ সরে এলে কান্ত শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দিতে বিছানায় বসলো প্রাণেশা। ফোন বের করে রূপকথার নম্বরে ভিডিওকল দিল। রিসিভ হতেই একগাদা ভাই-বোনের কিচিরমিচির শুনতে পেল সে। সবাই তার ফোনের অপেক্ষায় ছিল। সবার সাথে অল্পস্বল্প কথা বলল। এরপর মা-চাচীদের সাথে কথা বলে মনের ভার হালকা এলে একটু স্বস্তি পেল। লাগেজের লক খুলে কালো রঙের একটা টি’শার্ট ও সি গ্রিনের ট্রাউজার বের করে টাওয়েল হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। তার এতসব ব্যস্ততার ভীড়ে অনির্বাণ খাবার অর্ডার দিয়ে সেই খাবার টেবিলে সাজিয়ে প্রাণেশাকে ডাকল। গোসল সেরে ডাইনিংয়ে এসে সব প্রস্তুত দেখে একগাল হেসে প্রাণেশা বলল,

‘সোনায় বাঁধানো কপাল আমার। এমন বর কয়জনার কপালে জুটে?’

অনির্বাণও একইভাবে হেসে বলল,
‘আমি তো এসব তোর জন্য করছি না, আমার বউয়ের জন্য করছি। আমার বউ তো আমার জান, প্রাণ, হার্ট, কিডনি, ফুসফুস, লিভার, কতকিছু। তাই তারজন্য আমি সব করতে পারি।’

প্রাণেশা মুখ ভেঙচিয়ে চেয়ারে বসে গালমুখ ফুলিয়ে বলল,
‘বউপাগল লোক।’

খাওয়ার সময় আর কোনো ঝগড়াঝাটির দিকে গেল না কেউ। দু’জনেই চুপচাপ খেল। অনির্বাণের খাওয়া শেষ হওয়া মাত্রই তার ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু আরিফের নম্বর দেখে রিসিভ করে কথা বলতে বলতে রুমে চলে গেল। আরিফ তার বিজনেস পার্টনার। পড়াশোনা শেষ করে যখন একটা কোম্পানিতে অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরিজীবনের শুরু করেছিল, সেই চাকরি দিয়ে পোষায়নি বলে, নিজ চেষ্টা ও দক্ষতায় দুই বন্ধু মিলে নিজেরাই একটাকিছু করতে চাইছিল। লক্ষ্যে পৌঁছাবার জন্য বাড়ি থেকে ঢাকায় এসে গাড়ি নিয়ে রংঢং শুরু হলো অনির্বাণের। এখন তো সে একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার। যে নিমিষেই ভাঙাচোরা গাড়িকে ঠিকঠাক করে ফেলতে পারে। নিজের বুদ্ধি ও মেধা দিয়ে অত্যাধুনিক ডিজাইন ও সৌন্দর্য দিয়ে গাড়ির বেশভূষা পালটে দিতেও ওস্তাদ। বর্তমানে তার এই কর্মক্ষেত্রে তার বন্ধুর পাশাপাশি আরও অনেক বেকার তরুণেরা কাজ করে রুজিরোজগার করছে। নিজের এই দক্ষতা দিয়ে কিছু করা, কিছু বেকার মানুষের হাতে কর্ম তুলে দেয়ার মাধ্যমেই তৃপ্তি ও শান্তি খুঁজে পাচ্ছে অনির্বাণ। সে যখন দরকারী আলাপে ব্যস্ত ছিল, প্রাণেশা এরমধ্যেই সম্পূর্ণ ডাইনিং পরিষ্কার করে নিল। বাড়তি খাবার ফ্রিজে তুলে রেখে দু’কাপ কফি করতে চাইল। এটা বদভ্যাস বৈ কিছু না। ঘুমের আগে কেউ কীভাবে মগ ভরে চা-কফি খায়? কিন্তু তাদের দু’জনেরই এই বদভ্যাস আছে। যেহেতু অনির্বাণ ব্যস্ত, তাই প্রাণেশা ভাবল নিজেই কাজটা করে নেবে। সেই চেষ্টাতেই রান্নাঘরে এসে গ্যাস অন করে চুলোয় পানির পাতিল বসিয়ে কাছেপাশে কফির বৈয়াম খুঁজছিল। হাতের নাগালে কিছুই ছিল না। যা কিছু প্রয়োজনীয় মশলাপাতি সব উপরের কেবিনেটে সাজানো। তবুও হাত লম্বা করে ওপর থেকে কফির বৈয়াম আনার চেষ্টা করল। ব্যর্থ হলেও হাল ছাড়ল না। উঁকি দিয়ে আঙুলের ঠ্যালায় যখন একটু একটু করে বৈয়ামটা নাগালের মধ্যে আনল, পিছন থেকে অনির্বাণ বলল,

‘ওমা! আমার বউ রান্নাঘরে! কী রান্না করছে? দেখি, দেখি।’

আচমকা আওয়াজে সামান্য ভয় পেল প্রাণেশা। বৈয়াম হাতে নিতে গিয়ে পা স্লিপ খেল। উলটে না পড়লেও শক্ত মেঝেতে লেগে পায়ের আঙুলে যথেষ্ট ব্যথা পেল। বলল,

‘হয়েছে, সরো। আর দেখতে হবে না। পাঁচ মিনিট সময় দাও, দেখবে আমি তোমাকে স্পেশাল কফি খাওয়াব।’

অনির্বাণ চেহারায় বিস্ময় ধরে রেখে বলল,
‘স্পেশাল কফি? গিলতে পারব তো?’

‘লেগপুল করছ?’

‘একদমই না।’

‘তাহলে চুপচাপ দেখো।’

অনির্বাণ ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল। প্রাণেশার কাজকর্ম দেখে তার প্রচণ্ড হাসি পাচ্ছিল। তবে রান্না করতে না জানলেও তার এই চেষ্টাটা উপভোগ্য ছিল। সবশেষে গরম গরম কফি তৈরী করে, এক কাপ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে প্রাণেশা বলল,

‘বাড়িতে কাজ করার প্রয়োজন পড়ত না। তাই শেখা হয়নি। এতগুলো মানুষ, আমি কী কাজ করব? এই কারণে কখনও রান্নাঘরের ধারেকাছেও যাইনি। তাইবলে এক কাপ কফি বানাতে পারব না? এতটাও অকর্মা নই, যতটা তোমরা ভাবো।’

চমৎকার করে হেসে কফির কাপ হাতে নিয়ে তাতে চুমুক দিল অনির্বাণ। প্রশংসাসূচক বাক্য আওড়াল,
‘আসলেই তো। কে বলে আমার বউ অকর্মা? আমার বউ যে কত গুণী, সেটা একদিন সবাই জানবে। শুধু ধৈর্য্য ও মনের জোর নিয়ে শেষপর্যন্ত তোকে লড়তে হবে, প্রাণ।’

কফি হাতে নিয়েই নিজের রুমে গেল অনির্বাণ। ল্যাপটপ মেলে গুরুত্বপূর্ণ একটা মেইলে চোখ বুলালো। প্রাণেশাও রুমে এসে কফি খেতে খেতে বুকশেলফ গুছিয়ে নিল। যতক্ষণ ঘুম না আসছে, ঘরের টুকিটাকি কাজগুলো করছিল সে। একটা সময় জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি পড়ল। পাশের বিল্ডিংয়ে বিয়ের তোরজোড় চলছে। ডিজে গান বাজিয়ে একদল কিশোর-কিশোরী ছাদে এসে নাচছে। পর্দা সরিয়ে বেশ কিছুক্ষণ সবার এই নাচানাচি দেখল প্রাণেশা। সময় কত হলো খেয়াল করল না। সময়ের সাথে সাথে চারপাশের আলো নিভে গেল। গান বন্ধ করে কিশোর-কিশোরীও চলে গেল। চারদিক কেমন শুনশান ও ভীষণ শান্ত মনে হলো। ভাই-বোন নিয়ে জীবনটাকে হেসেখেলে, হৈ-হুল্লোড় করে কাটিয়ে দেয়া মেয়েটি হঠাৎ আবিষ্কার করল, এই শহরে সে প্রচণ্ড একা। চেনা মানুষ, চেনা পরিবেশ কিছুই নেই। এসব ভাবতে গিয়ে খুবজোর কান্না পেল। জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বাড়ির সবার কথা মনে করে অনেকক্ষণ নীরব কান্নায় গাল ভাসাল। কান্না থামলে নিজেকে মানিয়ে-বুঝিয়ে, জোরপূর্বক ঘুমানোর চেষ্টায় বিছানায় পিঠ ঠেকাল। তাতেও ঘুম এলো না। উলটে দুঃস্বপ্নেরা ভীড় জমাল চোখে। আবার উঠে বসলো। রুমের ভেতর পায়চারী করতে করতে, ঘড়িতে চোখ দিয়ে দেখল, রাত তিনটা। রুমের দরজা খুলে শব্দহীন পায়ে বেরিয়ে এসে, অনির্বাণের রুমের দিকে উঁকি মেরে দেখল, তখনও একইভাবে কাজ করছে। তাকে উঁকিঝুঁকি মারতে দেখে অনির্বাণ বলল,

‘ঘুমাসনি?’

প্রাণেশা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘ঘুম আসছে না।’

নতুন জায়গায় ঘুম না হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রাণেশার অসুবিধা বুঝতে পেরে অনির্বাণ বলল,
‘এখানে আয়, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।’

শুধু ঘুম আসছিল না, এটা নয়। অকারণ দুঃশ্চিন্তা ও দুঃস্বপ্ন তার স্বস্তি কেড়ে নিচ্ছিল। একা ঘুমাতে ভয় হচ্ছিল, আবার নতুন জায়গায় মানিয়ে নিতেও অসুবিধা হচ্ছিল। ডাক শুনে ধীরস্থির পায়ে হেঁটে হেঁটে সামনে এসে বলল,

‘তোমার অসুবিধা হবে না তো?’

অনির্বাণ ল্যাপটপ বন্ধ করে, চোখের চশমাও খুলে রাখল। রুমের দরজা আটকে লাইট অফ করে একপাশে প্রাণেশাকে ঘুমানোর জন্য যথেষ্ট স্পেস দিয়ে অন্যপাশে নিয়ে শুয়ে পড়ল। হাত বাড়িয়ে প্রাণেশার মাথার চুলের ফাঁকে আঙুল নেড়েচেড়ে বলল,

‘খুব হবে। তোকে আদর না করে ঘুমাতে হবে। অসুবিধা না হয়ে পারে?’

‘ছিঃ, সারাক্ষণ এসব কী কথা বলো? তোমার লজ্জা করে না?’

‘আমি এত লজ্জা দেখিয়ে কী করব? খাব না কি মাথায় দেব? লজ্জা তো তোর হওয়া উচিত। বিবাহিত পুরুষটাকে দূরে দূরে রেখে শাস্তি দিচ্ছিস।’

চট করে অনির্বাণের ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে কিছু একটা ভাবল প্রাণেশা। তারপর বলল,

‘আমি কোথায় শাস্তি দিচ্ছি? তুমি নিজেই তো এই শাস্তির ব্যবস্থা করেছ।’

অনির্বাণ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে ফটাফট তার টি’শার্টের সবকটা বোতাম খুলে, টি’শার্ট সামান্য মেলে ফাঁক দিয়ে নিজের মাথা গলিয়ে দিল প্রাণেশা। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

‘বিবাহিত পুরুষটা তো জানে, তার প্রাণ তাতে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তাহলে দূরে সরিয়ে রাখল কেন?’

মুচকি হেসে প্রাণেশাকে কাছে টেনে নিল অনির্বাণ। সম্পূর্ণ মুখজুড়ে ছোটো ছোটো চুমু এঁকে বলল,
‘আমি তো তোর সুবিধার জন্যই স্পেসটা দিলাম।’

‘উঁহু, তুমি স্পেস দাওনি। আমাকে শাস্তি দিচ্ছিলে। ডিভোর্সের কথা বলেছিলাম বলেই…।’

কথার ফাঁকে ফাঁকে প্রাণেশার ঠোঁটদুটো অনবরত কাঁপছিল। আঙুলের আলতোস্পর্শে কম্পনরত ঠোঁট ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনির্বাণ বলল,
‘হুস্…। সময় ও সম্পর্কটা কাছে আসার, ভালোবাসার, প্রাণ। ভাঙন কিংবা বিচ্ছেদের নয়।’

‘দুরে সরিয়ে এখন আবার ভালোবাসা দেখানো হচ্ছে। তোমার এই দুই নম্বরি ভালোবাসার কোনো দরকার নেই আমার। কী করব এই ভালোবাসা দিয়ে? দুইবেলা পানি খাব?’

এরকম একটা সিচুয়েশনে এসে, প্রাণেশার মুখে এই কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেল অনির্বাণ। গোলগোল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,

‘কী বললি তুই? দরকার নেই?’

‘ঠিকই তো বলেছি। এত ভালোবাসা দিয়ে কী হবে?’

‘কিছু হোক বা না হোক দশবারোটা আণ্ডাবাচ্চা হবে।’

‘দশবারোটা! আমার এইটুকু পেটকে কি তোমার পানির টাংকি মনে হচ্ছে? একসাথে আমি এতজনকে জায়গা দেব কী করে? আশ্চর্য! এ কেমন আবদার? কেউ কীভাবে একসাথে এত বাচ্চাকাচ্চা চাইতে পারে? জানের মায়া নেই? এইটুকুন মেয়ে আমি…।’

প্রাণেশার কথা শুনে হো হো শব্দে হেসে উঠল অনির্বাণ। হাসতে হাসতে হাতের বাঁধন আরও ধীর করে প্রাণেশাকে রাগাতে বলল,
‘চাইতে দোষ কী? বাচ্চাকাচ্চা আল্লাহর অশেষ রহমত। আমি এই রহমত থেকে বিতাড়িত হতে চাই না, বউ। তাইতো সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কোনো ধরনের পরিবার-পরিকল্পনা করব না। ‘দুটি সন্তানের বেশি নয়, একটি হলে ভালো হয়’ এই স্লোগানের দিকে ফিরেও তাকাব না। আমার স্লোগান হবে, ‘দশটি সন্তানের কম নয়, বিশটি হলে বেশি ভালো হয়।’ আর তারজন্য, প্রতি বছর টুইন বেবি নিয়ে গিনেসবুক অফ ওয়ার্ল্ডরেকর্ডসে নিজের নাম লেখাব। রাজি…?’

যেভাবে আহ্লাদী হয়ে টি’শার্টের ফাঁক দিয়ে ঢুকেছিল, সেভাবেই বেরিয়ে এলো প্রাণেশা। শব্দ করে দুটো হাতজোড় করে বলল,

‘মাফ চাই…। তোমার বউকে দিয়ে এ কাজ হবে না। আমি এ পথে নাই। বাচ্চাকাচ্চা ও গিনেসরেকর্ড নিয়ে কোনো স্বপ্ন আমার নাই। দূরে যাও…। দূরে গিয়ে তুমি আরেকটা বিয়ে করো। বিশটা নয়, একশোটা আণ্ডাবাচ্চা দিয়ে ওয়ার্ল্ডরেকর্ড করো। তাতে আমার কোনো আপত্তি নাই।’

***

চলবে…

মাহাশাদ | ই-বুক

⚫ খণ্ডাংশ –

-‘এ্যাই ভ্রমর, ভ্রমর! কোথায় তুমি?’

হাতে একটা ছোট্ট প্যাকেট নিয়ে বাসায় প্রবেশ করল শাদাব। রান্নাঘর ও রুম খুঁজে মাহদিয়াকে না পেয়ে, রুমের বারান্দা ও বসার ঘর বাদ রাখছে না। সব জায়গাতেই অর্ধাঙ্গিনীকে খুঁজছে আবার গলা উঁচিয়ে ডাকছে। কণ্ঠে হাজারও মুগ্ধতা, আকুলতা। হৃদয়ের স্পন্দন মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার ন্যায়। তবুও প্রাণপ্রিয় মানুষটা দু’চোখের বাইরে। অস্থির মন নিয়ে রুমে প্রবেশ করে আবারও মাহদিয়াকে ডাকতে চাইল শাদাব। তক্ষুণি কুট করে একটা শব্দ হলো। আধভেজা শরীর নিয়ে ওয়াশরুমের দরজা সামান্য ফাঁক করে তাকাতেই শাদাব বলল,

-‘এ্যাই, তুমি ওয়াশরুমে কী করছ এখন? এতক্ষণ ধরে গলা ফাটিয়ে ডাকছি। মহারানীর হুঁশবুদ্ধি কোথায় উড়ে গেল?’

-‘শাওয়ার নিচ্ছি তো। এজন্য তোমার ডাক শুনতে পাইনি।’

শাদাব তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল। হাতের প্যাকেট বিছানায় রেখে হাওয়ার বেগে দরজার সামনে গিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলল,

-‘রাত দশটায় কীসের শাওয়ার? তা-ও এই কনকনে শীতে, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা কুল কুল মেজাজে!’

শাদাবের বলার ধরন দেখে ফিক করে হেসে ফেলল মাহদিয়া। বলল,
-‘আর বোলো না। রান্না করতে গিয়েছিলাম, হাত থেকে গরম তেলসমেত কড়াইটা উপরে পড়ে গেল। পুরো ড্রেস তো নষ্ট হলোই, সাথে…।’

কথা শেষ করার আগেই ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল শাদাব। মাহদিয়া ভরকে গিয়ে বলল,

-‘কী হলো? তুমি আবার এখানে আসলে কেন? পাঁচ মিনিট অপেক্ষা কোরো আসছি।’

শাদাব শুনল না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মাহদিয়ার হাত-পা, পেট-পিঠ সবকিছু চেক করতে লাগল। দুঃশ্চিন্তাগ্রস্থ, মলিন চেহারা নিয়ে বলল,

-‘কোথায় পুড়েছে, দ্যাখাও। রান্নাঘরে যাবে কেন তুমি? রান্নার কাজ তো রেহনুমা সামলে নিতে পারত। কে বলেছে কাজ দ্যাখাতে গিয়ে অকাজ করতে?’

-‘পুড়েনি কোথাও। তুমি যাও। তেল খুব বেশি গরম ছিল না।’

-‘তবে শাওয়ার নিতে আসলে যে!’

প্লাজো খানিকটা উপরে তুলল মাহদিয়া। পুরো পা তেলে মাখামাখি। হাতেও। পেটে যতটুকু লেগেছে, সেটুকু আবার জামায় মাখামাখি হয়ে শরীরের সাথে লেপটে গেছে একদম। বড়ো অসময়ে মাহদিয়াকে এমন তৈলাক্ত শরীরে আবিষ্কার করে শব্দ করে হেসে ফেলল শাদাব। আঙুলের ভাঁজে আঙুল আটকে কানের নিচে অধর দাবিয়ে বলল,

-‘আজ তো তোমাকে একদম অন্যরকম লাগছে।’

-‘তোমার বউ বোধহয় পালটে গেছে, এজন্যই আজ তাকে অন্যরকম লাগছে।’

-‘উঁহু, প্রশ্নই আসে না। আমার বউ একেক সময় একেক রূপে আমার সামনে নিজেকে প্রেজেন্ট করে। আমি তখন তার ওইসব ভিন্ন ভিন্ন রূপ দ্যাখতে দ্যাখতে মাতাল হতে থাকি। এইযে, তোমাকে এইভাবে দ্যাখে নিজেকে এখন বড্ড উন্মাদ মনে হচ্ছে আমার। এটা কি আমার দোষে? না-কি তোমার এই ভিন্ন রূপে?’

-‘ইন্না-লিল্লাহ্। এখন মাতাল হইয়ো না প্লিজ। হুঁশে ফিরো।’

-‘কীসের হুঁশ? কোনো হুঁশ-টুঁশে ফেরা হবে না আজ। মাতাল আমি হবই। দারুণ এক অভিজ্ঞতা হবে আজ। চলো না, একটু রোমান্স করি!’

মাহদিয়া জোরপূর্বক শাদাবকে ধাক্কা মেরে ওয়াশরুম থেকে বের করে দিয়ে বলল,
-‘হয় এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নেশা দূর কোরো, নয় কাঁথা-বালিশের সাথে রোমান্স কোরো। আমি গোসল শেষ করে আসি। এরপর তুমি ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং-এ আসবে।’

কথা শেষ সঙ্গে সঙ্গে ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিল মাহদিয়া। শাদাব রুম থেকে চিৎকার দিয়ে বলল,
-‘এ্যাই, তুমি এত বেরসিক কেন গো? কোথায়, বর বাইরে থেকে এসেছে, তাকে একটু আদর-যত্ন করবে, কিছু খাবে কি-না জিজ্ঞেস করবে। তা না করে তুমি তাকে ধাক্কা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলে! ঠিক আছে। রাত গভীর হোক। তখন দ্যাখব, হাড়কাঁপানো শীতে আমার বুকের ভেতর কে এসে ঘাপটি মারে। সুযোগ আসলে আমিও এমন বেরসিক বউকে জোরসে একটা ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিব।’

***

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৮

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৮

অনির্বাণ চলে যাওয়ার পর এই ক’দিনে সম্পর্কের মধ্যে আর কোনো উন্নতি হয়নি। আগে মাঝেমধ্যে অনির্বাণ যদি তাকে কোনো প্রয়োজনে কল করত, ছোটোখাটো ঝড়তুফান হয়ে যেত। কারণ প্রাণেশা কোনো আদেশ-নিষেধ শুনত না। আর এখন নিয়মিত ফোন করলে, ‘বউ’ বলে ডাকা মাত্রই রেগে ব্যোম হয়ে যায় প্রাণেশা। ঝগড়া শুরু হয় ‘বউ’ শব্দটা থেকে। দিনরাত এমনই চলে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ফোন করলে প্রাণেশাকে ক্ষ্যাপাতে, রাগাতে, বউ ডেকে তার মেজাজের বারোটা বাজিয়ে দেয় অনির্বাণ। প্রাণেশাও এই নিয়ে সারারাত যুদ্ধ করে। সেই যুদ্ধ শেষ হয় ঘুমের মাধ্যমে। তর্কবিতর্কের ফাঁকে কোনদিক দিয়ে যে প্রাণেশা ঘুমিয়ে পড়ে, সেটা সে নিজেও জানে না। আজ সকালে বেশকিছু ব্যান্ডব্যাগের অর্ডার ছিল। সেগুলো সকাল নয়টার মধ্যে ডেলিভারিম্যানের কাছে দিয়ে, আরামসে একটু ঘুমাতে চাইছিল। রাত জেগে বকবক করলে ঘুম হয় না। সারাদিন শুধু মাথাব্যথা করে। তাই বিশ্রাম নেয়ার জন্যই রুমের দরজা সামান্য ফাঁক রেখে বিছানায় শরীর হেলিয়ে দিয়েছিল প্রাণেশা। আচমকাই সপাংসপাং শব্দে কানের ভেতর ভনভন শুরু হলো। শব্দটা একাধারে আসাতে ঘুম উড়ে গেল তার। লাফ দিয়ে বিছানায় বসতেই তার থেকে ঠিক কয়েক ইঞ্চি দূরে আবারও সপাংসপাং শব্দ হলো। চোখমুখে বিস্ময় নিয়ে প্রাণেশা বলল,

‘তুমি! তোমার হাতে কঞ্চি কেন? ওগুলো ধরেছ কেন তুমি? রাদিন-রামিশা শয়তানি করছিল?’

অনির্বাণ কোমরে হাত রেখে বলল,
‘ওরা শয়তানি করেনি, শয়তানি করছিস তুই। ছ’টায় ফোন করে বলেছি, দশটার মধ্যে রেডি হয়ে বসে থাকবি, আমি এসে তোকে ক্যাম্পাসে নিয়ে যাব। এখনও বিছানা ছাড়িসনি কেন? এখন তো এই কঞ্চির বাড়ি তোর পিঠেই পড়বে।’

প্রাণেশা রীতিমতো আঁৎকে উঠল। তার কঞ্চি দিয়ে তাকে মারবে? ভাবা যায়? সে ঘুমঘুম চোখে চিবিয়েচিবিয়ে বলল,
‘এত্তবড়ো সাহস। আমার কঞ্চি দিয়ে আমাকে ভয় দেখাচ্ছ? আজ তোমাকে আমি টাকলু বানিয়ে ছাড়ব।’

চুল ধরে টান মারতে এগিয়েছিল প্রাণেশা, এরমধ্যেই হাতে থাকা একগোছা কঞ্চি আগের মতো একদম প্রাণেশার গা ছুঁইয়ে বিছানায় আঘাত করল অনির্বাণ। ভয় পেয়ে দু’পা পিছাতে গিয়ে দড়াম করে বিছানায় পড়ে গেল প্রাণেশা। হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেলে অনির্বাণও তার উপরেই পড়ে গেল। সাথে সাথে বিছানার একপাশে থাকা নড়বড়ে তক্তা ভেঙে নিচে পড়ে গেল দু’জনে। অনির্বাণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঘর কাঁপিয়ে হেসে বলল,

‘বেশ হয়েছে? কোমর ভাঙল কি না দেখ!’

হাত বাড়িয়ে অনির্বাণ তাকে তুললও না আর। কঞ্চি হাতে নিয়েই প্রাণেশার ভোতা হওয়া মুখটা দেখল। প্রাণেশা কোনোমতে হাতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘সারাক্ষণ বউ বউ করো। এখন যে বউ পড়ে গিয়ে হাতে ব্যথা পেল, তাতে তোমার একটুও কষ্ট হলো না?’

অনির্বাণ হেসে উত্তর দিল,
‘না হলো না। এমনিতেই টানা কয়েকঘণ্টার ড্রাইভে আমি যথেষ্ট ক্লান্ত সোনা। এখন ঝটপট সবকিছু গুছিয়ে নে আগে।’

প্রাণেশা ঘাড়ত্যাড়ামি করে বলল,
‘আমি যাব না তোমার সাথে।’

‘না গেলে কোলে করে নিয়ে যেতে পারব।’

‘এমন করলে আমি বুড়িগঙ্গায় লাফ দেব।’

‘দঁড়ি দিয়ে টেনে তুলব।’

‘তোমার পাঠানো দঁড়িতে আমি ধরবোই না।’

‘তাহলে দুটোতে একসাথে ডুব দেব। পাড়ে না থেকে পানিতেই থাকব। সাঁতার-সাঁতার খেলে জীবন কাটিয়ে দেব।’

‘ধুর… তুমি একটা অসহ্য।’

হেলতেদুলতে ওয়াশরুমের দিকে এগিয়ে গেল প্রাণেশা। তখুনি কঞ্চি দিয়ে আবারও শব্দ তুলল অনির্বাণ। রুমটা ভালোমতো দেখে বলল,

‘সময় মাত্র পাঁচ মিনিট। যদি এরবেশি একমিনিটও দেরী হয়, এতগুলো কঞ্চির বাড়ি তোর পিঠেই পড়বে। এইটুকু নিশ্চিত হয়ে দেরী করিস। ঠিক আছে?’

প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘ওগুলো রেখে দাও বলছি।’

‘রাখব না। কঞ্চির আঘাত খেলে কেমন লাগে, সেটা তোকে প্রাকটিক্যালি দেখাব আজ।’

‘তুমি এমন করছ কেন আমার সাথে?’

‘আমি করছি না কি তুই করছিস? কী বলেছিলাম ফোন করে? সব যেন গোছানো থাকে। এই তোর গোছানোর নমুনা? এখন এতগুলো কাজ করতে গেলে কত সময় নষ্ট হবে জানিস?’

‘আমি তো বলিনি, আমার জন্য তুমি তোমার মূল্যবান সময় নষ্ট করো। যেচেপড়ে করছ কেন?’

‘আর একটা কথা বললে, মেরে পিঠের ছাল তুলে নেব।’

‘এ্যাহ… কোথাকার কোন বাহাদুর আসছে। প্রাণের গায়ে হাত দেবে। একবার হাত তুলেই দেখো, তোমার ওই হাত আমি কী করি!’

বিড়বিড় করতে করতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল প্রাণেশা। অনির্বাণ একা হাতে প্রাণেশার সব প্রয়োজনীয় জিনিস আলমারি থেকে বের করে লাগেজে ভরল। একটায় জামাকাপড়, একটায় সব পুরস্কার, একটায় বই, একটায় তার হ্যান্ডিক্রাফটের জিনিস ও আরেকটায় কসমেটিকস্। যদিও প্রাণেশার কসমেটিকস্ বলতে, ক্রিম, লোশন, ফেইসওয়াশ, চুলের তেল, ভেসলিন, চিরুনি, এসবই। সব ঢুকিয়ে লম্বুকে ডেকে সবগুলো লাগেজ গাড়িতে তুলে নিল। তখনও প্রাণেশা ওয়াশরুম থেকে বের হয়নি দেখে দরজায় নক দিয়ে অনির্বাণ বলল,

‘আর কতক্ষণ লাগবে?’

ভেতর থেকে প্রাণেশা বলল,
‘সারাদিন লাগবে।’

‘করছিসটা কী?’

‘ঘুমাচ্ছি। তুমিও ঘুমাবে?’

‘আমার এত শখ নেই। তুই ঘুমা। কাঁথা-বালিশ দেব?’

‘দিতে পারো। আমার খুব একটা অসুবিধা হবে না।’

অনির্বাণ বিরক্তির স্বরে বলল,
‘আশ্চর্য! আধঘণ্টা ধরে তুই ওয়াশরুমে কী করছিস?’

‘বললাম তো ঘুমাচ্ছি, কাঁথা-বালিশ দাও।’

কী বলবে বুঝে উঠতে পারল না অনির্বাণ। এরমধ্যেই শাওয়ার ছাড়ার শব্দ হলো। তার মানে প্রাণেশা গোসল করছে। এজন্যই দেরী হচ্ছে। বুঝতে পেরে বলল,

‘তুই এখন শাওয়ার নিচ্ছিস?’

‘হ্যাঁ, নিচ্ছি। বিরক্ত না করে ওয়ারড্রব থেকে আমার টাওয়েল ও কাপড়চোপড় দাও। তোমার জন্য কাপড় আনতে ভুলে গেছি।’

অনির্বাণের মাথায় হাত। এখন কাপড়চোপড় কোথা থেকে দিবে? সব তো গাড়িতে তুলে দিয়েছে। লক করে চাবিটাও সাইডের ছোট্ট একটা পকেটে রেখে দিয়েছে। এসব সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যেই প্রাণেশা বলল,

‘কই, দাও। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?’

অনির্বাণ দরজার কাছে এগিয়ে কৌতুক করে বলল,
‘ওসবের আর দরকার নেই, এমনিই চলে আয়।’

ভেতর থেকে রেগেমেগে প্রাণেশা বলল,
‘কী বললে তুমি?’

‘ঠিকই তো বললাম। এখানে আর কেউ নেই।’

‘তবেরে ফাজিল…।’

নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে, ফাঁক দিয়ে মাথা বের করে প্রাণেশা বলল,
‘প্লিজ, দাও।’

অনির্বাণ দুষ্টুমিষ্টি হাসি ঝুলিয়ে ওয়াশরুমের দরজার কাছে এসে বলল,
‘আমি তো ওগুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছি। চাবিটা কোথায় রেখেছি মনে নেই।’

চোখদুটো গোলগোল করে তাকিয়ে রইল প্রাণেশা। বলল,
‘তাহলে আমি এখন পরব কী?’

অনির্বাণ টিপ্পনী কেটে বলল,
‘বিছানার চাদর। ওটাতেই তোকে জোস্ লাগবে, বউ।’

‘একবার বের হই, তোমার মাথা আমি ফাটাব।’

‘কাপড় না পেলে বের হতে পারবি?’

প্রাণেশা এই সর্বনাশ মেনে নিতে পারল না। কী যা-তা কাণ্ড! কাপড় ছাড়া বের হওয়া যায়? ভেজা পোশাকেই বা কতক্ষণ থাকা যায়? উপায় না দেখে বলল,

‘প্লিজ, কিছু একটা ব্যবস্থা করো।’

উপায় অনির্বাণের কাছে আছে কিন্তু তবুও সে-ই উপায় সে বাতলে দিল না। প্রাণেশাকে বিপদে ফেলতেই বলল,
‘আইশা-মাইশার ড্রেস এনে দিই?’

প্রাণেশা অসহায় চোখে বলল,
‘বডির সাইজ আলাদা তো।’

‘ভাবীর?’

‘ভাবীরও সেইম অবস্থা।’

‘তাহলে এখন উপায়?’

‘তোমার ঘর থেকে একটা কিছু নিয়ে এসো।’

‘সাইজ তো আলাদা। মিলবে না। আমার টি’শার্ট ও প্যান্টে তোর সাইজের দু’জনকে ঢুকানো যাবে।’

উপায় না দেখে প্রাণেশা বলল,
‘তাহলে যাও, কোন লাগেজে রেখেছ, সেটা দেখে নিয়ে এসো।’

অনির্বাণ এক’পাও নড়ল না। স্টাডিটেবিলের চেয়ারে গিয়ে পা ছড়িয়ে বসে চুলে ব্যাকব্রাশ করে বলল,
‘দুঃখিত। আমি তোর ব্যক্তিগত কাজের লোক নই।’

প্রাণেশা একইভাবে বলল,
‘ব্যক্তিগত মানুষ হও তো।’

অনির্বাণের চোখে বিস্ময় নামল। ভাবুকনয়নে তাকিয়ে থেকে বলল,
‘তুই মানছিস, আমি তোর ব্যক্তিগত মানুষ?’

উপরনিচ মাথা নাড়ল প্রাণেশা। অনির্বাণ ফের ওয়াশরুমের দরজার কাছে গেল। প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে বলল,
‘তাহলে এখুনি প্রমাণ কর, আমি তোর একদম আপন কেউ। কাছের কেউ।’

সুযোগ পেয়ে অনির্বাণ তাকে নাজেহাল করতে চাইছে, এটা বুঝতে পেরেই চেহারায় রাগ নেমে এলো প্রাণেশার। পরিস্থিতি বুঝে সে-ই রাগ সামলে বলল,

‘অবশ্যই প্রমাণ দেব। তার আগে কিছু একটা দিয়ে তোমার বউয়ের ইজ্জতটা বাঁচাও। যে কেউ এসে পড়বে। শেষে লজ্জায় পড়তে হবে।’

অনির্বাণ মুখে হাত দিয়ে বলল,
‘তোর লজ্জাও আছে?’

‘উফফ, প্লিজ। এমন করো না।’

সময় নষ্ট না করে নিজের ঘরে গেল অনির্বাণ। কয়েক মিনিটের মধ্যে হাতে একটা প্যাকেট ও টাওয়েল নিয়ে প্রবেশ করল। নক দিয়ে সেসব বাড়িয়ে দিতেই প্রাণেশা বলল,

‘প্যাকেটে কী?’

‘খুলে দেখ।’

‘শাড়ি আনোনি তো আবার!’

টাওয়েল শরীরে পেঁচিয়ে ভয়ভয় চেহারায় প্যাকেট খুলে ভীষণরকম অবাক হলো প্রাণেশা। সাদা টি’শার্ট, সাথে নেভিব্লু লেডিস্ শার্ট ও অফ হোয়াইট ট্রাউজার। সাথে দরকারী জিনিসগুলোও। পোশাক দেখে মুহূর্তেই অনির্বাণের দিকে চোখ গেল। যে পোশকটা তার হাতে, একই কালারের টি’শার্ট ও শার্ট-প্যান্ট অনির্বাণের পরনেও। শার্টের সামনের বোতামগুলো খোলা। তার বিস্ময় দেখে চোখ নাচিয়ে অনির্বাণ বলল,

‘পছন্দ হয়নি?’

মুচকি হেসে দরজা আটকে দিল প্রাণেশা। ভেজা পোশাক পাল্টে, অনির্বাণের দেয়া পোশাক পরে, চুলে টাওয়েল পেঁচিয়ে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়াতেই, অনির্বাণও তার পিছনে দাঁড়াল। কাঁধে হাত রেখে, মাথাটা একদম প্রাণেশার মাথায় ঠুকে দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,

‘এখন মনে হচ্ছে, তুই মিসেস্ অনির্বাণ সৈকত।’

প্রাণেশা হাসতে গিয়েও হাসলো না, কারণ ততক্ষণে ড্রেসিংটেবিল ফাঁকা দেখে মেজাজ তার বিগড়ে গেছে। সে লোশন, তেল ও চিরুনী না পেয়ে বলল,

‘আমার দরকারী জিনিসগুলো কোথায়?’

অনির্বাণ জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,
‘এইরে, সব তো গাড়িতে।’

ফোলা ফোলা চোখে তাকিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘এক্ষুণি ওগুলো নিয়ে এসো। নয়তো কঞ্চি… দাঁড়াও।’

চটজলদি চোখ ঘুরিয়ে ফেলে রাখা কঞ্চি হাতে তুলল প্রাণেশা। রাগ দেখিয়ে দু’পা হেঁটে যখন অনির্বাণকে মারার চেষ্টায় এগিয়ে গেল, তখুনি তার সব রাগের মধ্যে পানি ঢেলে, ধুম করে গালে চুমু দিয়ে দৌড় দিল অনির্বাণ। হাতের কঞ্চি ফ্লোরে ফেলে প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘ওরে সুযোগসন্ধানী। আসো একবার। কাছে পেলে আমিও বুঝাব, কত চুমুতে কত প্রেম।’

***

প্রাণেশা এতদিন যে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল সেসব নিজের ক্যাম্পাসেই অনুষ্ঠিত হতো। এখন সুযোগ এসেছে সারা দেশের মানুষের সামনে নিজেকে সেরাদের একজন হিসেবে তুলে ধরার। কিছুদিন পর ঢাবিতে দুইদিন ব্যাপী কুইক-কুইজে দেশের এপ্রান্ত থেকে ও-ই প্রান্ত হতে আসা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কুইজ টিমদের নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে এই আয়োজন। প্রাণেশার ভার্সিটির অধ্যক্ষ চাইছেন শেষ একবার তাদের ব্যাচের টিমেরা এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুক। সাফওয়ান গতকাল সকালে এসেছিল প্রাণেশাকে সে-ই খবরটা দিতে। যেহেতু এই খেলা সারাদেশে লাইভ হবে, সেহেতু এটা যথেষ্ট আলোচিত একটি প্রতিযোগিতা হতে যাচ্ছে। সামিউল আলম এটা শুনেই রেগে গিয়েছিলেন। মুখের ওপর সাফওয়ানকে না করে দিয়েছেন। বেচারা মন খারাপ করে ফিরে গেছে। এরপর থেকে টেপ রেকর্ডারের মতো প্রাণেশার কানের কাছে বকাবকি চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। শুনতে শুনতে মেজাজ আর জায়গায় নেই প্রাণেশার। তার বড়ো চাচ্চু, সেজো চাচ্চু শেখ শরীফুল আলম ও ছোটো চাচ্চু শওকত আলম বাসায় ছিলেন না। থাকলে নিশ্চয়ই একটা না একটা সাপোর্ট সে পেত। তাহমিনা আহমেদ মেয়েকে সাপোর্ট দিয়ে দু’একটা কথা বলেছিলেন, তাতেই সামিউল আলমের এক কথা,

‘যে মেয়ে বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে পারে না, তাকে আর কোনো প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে সেরা প্রমাণ করতে হবে না।’

সামিউল আলম চেয়েছিলেন, প্রাণেশা ডাক্তার হোক। কিন্তু তার যা মেধা, তাতে আর ওইপথে যাওয়ার সুযোগ তৈরী হয়নি। মাঝপথেই বাংলা নিয়ে অনার্স শেষ করতে হয়েছিল। তবুও কম কী? কতজন এইটুকু শেষ করতে পারে? বাবা এতে খুশি নোন। মা বুঝাতে চাইলে গালিবকা শুনেন। গতকাল সকাল থেকে এই কুইজের কথা শুনে সেইযে সামিউল আমলের মেয়ে ও স্ত্রীকে বকাঝকা শুরু হয়েছে আর থামেনি। প্রাণেশার বড়ো চাচী, সেজো চাচী ও ছোটো চাচী কেউই ভদ্রলোককে বুঝাতে পারছিলেন না। কিছু বললেই তিনি চেঁচিয়ে ঘর মাথায় তুলে ফেলছেন। পুরুষ মানুষের তর্জন-গর্জন শুনলে নারীমনে এমনিতেই ভীতি জাগে। শ্রদ্ধা-সম্মানের জায়গা থেকে সবাই চুপ থেকে যায়। কিন্তু প্রাণেশা পারেনি। সে বাবার এত বকাঝকার বিপরীতে শক্ত কণ্ঠে বলেছিল,

‘আমি আজকেই প্রিন্সিপালকে কনফার্ম করছি, এই কুইজ প্রতিযোগিতায় শেখ প্রাণেশা আমরীন অংশগ্রহণ করছে। আর এটাই ফাইনাল। তোমার কোনো কথা আমি শুনব না বাবা। আমাকে আমার কলেজের সম্মান রক্ষা করতে হবে।’

সামিউল আলম তাতেই রেগে গিয়েছিলেন। শক্তহাতে মেয়েকে থাপ্পড় মেরেছিলেন। তাহমিনা আহমেদ ছুটে এসে বলেছিলেন,
‘তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? এত বড়ো মেয়ের আগে হাত তুলছ কেন? অনি জানলে কষ্ট পাবে না?’

এসব কথা প্রাণেশা অনির্বাণকে বলেনি। বলার প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু কীভাবে যেন ছেলেটা সব জেনে গেল। এরপরই গতকাল রাতে বাবা-চাচাদের ফোন করে স্পষ্টকণ্ঠে জানিয়ে দিল, আজ সকালেই এসে প্রাণেশাকে এখান থেকে নিয়ে যাবে। প্রাণেশা এখন থেকে ঢাকাতেই থাকবে। ব্যস… তার সিদ্ধান্তের ওপর কেউ আর কিছু বলেননি। কারণ, এইমুহূর্তে প্রাণেশার লিগ্যাল গার্ডিয়ান অনির্বাণ নিজেই। সেই অনুযায়ীই বাসায় এসে এই তোড়জোড়। শেষ আরেকবার গাড়ির ভেতরটা চেক করল প্রাণেশা। সব ঠিকমতো নিল কি না দেখল। এরপর সব ভাই-বোনদের জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল। মা-চাচী ও চাচারা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেও প্রাণেশা প্রচণ্ড ধৈর্যের সাথে নিজেকে সামলে নিল। বাবার থেকে বিদায় নিতে গিয়ে দেখল, তিনি দরজা আটকে বসে আছেন। চলে যাওয়ার আগে বিদায় নেয়াটা জরুরী মনে করেই বাবাকে ডাকতে গিয়েছিল সে। কিন্তু তিনি দরজা খুলে বের হোননি। আজ বিদায়ে তানিশাও তার ছেলেকে নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছে। বোনের অভিমানী মুখটা বড্ড চোখে লাগল তানিশার। সারামুখে হাত বুলিয়ে, কপালে স্নেহের চুমু এঁকে তানিশা বলল,

‘বাবা কেমন তুই তো জানিস। রাগ করিস না। অনির ব্যস্ততা কমলে মাঝেমধ্যে এখানে আসিস।’

প্রাণেশা বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘ভালো থেকো তোমরা।’

সবশেষে রূপকথা এসে বলল,
‘ননদিনী, আমার দেবরের খেয়াল রাখিস। অনেক যুদ্ধ করে এখান থেকে নিয়ে যাচ্ছে তোকে।’

যা বুঝার সব বুঝে নিল প্রাণেশা। মুচকি হেসে বলল,
‘তোমার দেবর নিজের খেয়াল নিজে রাখতে জানে, ভাবী। এজন্য আমাকে কিছুই করতে হবে না। খারাপ লাগছে এইভেবে যে, বেচারা কোনোদিন তার বউয়ের হাতের রান্নাবান্না খেতে পারবে না।’

রূপকথা হেসে উঠল এই কথায়। বলল,
‘সমস্যা নেই। ইউটিউব দেখে দু’একটা রান্না শিখে নিস। কষ্ট করে হলেও মাঝেমধ্যে স্বামীর পাতে তার পছন্দের খাবার তুলে দেয়ার মধ্যেও আনন্দ আছে। আমি জানি, তুই পারবি। যে এত কাজ পারে, সে এটাও পারবে।’

‘এত বাড়াবাড়ি চিন্তা করা ভালো না, ভাবী। আমি আসলেই অকর্মা।’

‘হয়েছে থাক… এই নিয়ে আর কথা বলতে হবে না। গাড়িতে উঠ। দেরী হচ্ছে।’

গাড়ির সামনের ডোর খুলে গাড়িতে ওঠার আগেই রাফিয়ান, রাদিন ও রামিশা এসে জাপটে ধরল প্রাণেশাকে। দু’হাতে তিন ভাই-বোনকে একসাথে জড়িয়ে ধরল প্রাণেশা। রাদিন বলল,

‘তুমি যেও না, সোনাপু। আমরা আর তোমার ফুলের গাছ নষ্ট করব না।’

রামিশাও বলল,
‘সত্যি বলছি, সোনাপু। আমরা তোমার গাছ নষ্ট করব না। প্রমিস করছি।’

প্রাণেশা ওদের দু’জনকে সান্ত্বনা দিতে প্রথমে কপালে আদর দিল, এরপর আহ্লাদী কণ্ঠে বলল,
‘আমি জানি, তোমরা দু’জনেই গুড বয়েজ এন্ড গার্লস্।’

রাদিন বলল,
‘তাহলে বলো, যাবে না?’

‘যেতে তো হবেই। তবে যাওয়ার আগে তোমাদের দু’জনকে একটা দায়িত্ব দিয়ে যাই। প্রতিদিন দুইবেলা করে গাছে পানি দিবে, আগাছা পরিষ্কার করবে, গাছের যত্ন নিবে। ঠিক আছে? সোনাপু ফিরে এসে যেন গাছে ফুল দেখতে পাই।’

দু’জনেই সম্মতি জানিয়ে ঘাড় নাড়ল। প্রাণেশা আরেকবার ওদের আদর দিয়ে গাড়িতে উঠল। রাফিয়ান গম্ভীরমুখে তার দুলাভাইকে বলল,

‘তুমি তো খুব খারাপ, দুলাভাই। বিয়ের একমাসও হয়নি। এরমধ্যেই আমার সোনাপুকে কেড়ে নিচ্ছ?’

অনির্বাণ তার গাল টেনে দিয়ে বলল,
‘দেশ ছাড়ছি না রে শালাবাবু। বাড়িও ছাড়ছি না। মাঝেমধ্যে ঘুরতে আসব তো। তখন সারাদিন তোর সোনাপুর কোলের ওপর চড়ে থাকিস। এখন বিদায় দে।’

বাবা-মা ও ভাই-ভাবীর সাথে কিছু প্রয়োজনীয় আলাপ সেরে, গাড়িতে উঠে কয়েক মিনিটের মধ্যেই বাড়ির সীমানা ত্যাগ করল অনির্বাণ। প্রাণেশা পিছনে তাকাল না, কাঁদলও না। শুধু দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ভেতরের যন্ত্রণাগুলোকে সহ্য করে সামনের গন্তব্যে এগিয়ে চলল।

***

ভার্সিটি তখনও খোলা ছিল। প্রতিযোগিতার বিষয়টা প্রিন্সিপালকে কনফার্ম করে বন্ধুবান্ধবদের থেকে বিদায় নিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে আবারও গাড়িতে উঠে বসলো দু’জনে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেউ কোনো কথা বলল না। সিটে হেলান দিয়ে খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে প্রকৃতির মায়ায় ডুবে-ভেসে, মায়ের কান্নারত মুখশ্রী কল্পনা করে একটা সময় চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে রইল প্রাণেশা। বিকেলের শেষভাগে ফাইভস্টার রেস্টুরেন্টে এসে গাড়ি পার্ক করল অনির্বাণ। তাড়াহুড়োয় বাড়ি থেকে খেয়ে বেরোয়নি। এখন পেটে অল্পকিছু না দিলে চলছেই না। গাড়ি থেকে নেমে রেস্টুরেন্টের ভেতরে গিয়ে খাবার অর্ডার দিয়ে, কর্ণারের একটা ফাঁকা জায়গায় বসলো দু’জনে। অধিকাংশ মানুষের দৃষ্টি তাদের দু’জনার দিকে। কারণ দু’জনের পোশাক সেইম। জুতো সেইম। হাতের ঘড়ি ও মাথার ক্যাপও সেইম। সবাই যখন কৌতূহলী হয়ে ওদের দেখছিল, সেটা অনির্বাণ খেয়াল না করলেও প্রাণেশা খেয়াল করল। এরমধ্যে একটা মেয়ে দূর থেকে অনির্বাণের দিকে ‘ফ্লায়িং কিস’ ছুঁড়ে দিল। প্রাণেশার মুখটা হা হয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। ছুটে গিয়ে বকতে যাবে, তখুনি অনির্বাণ তাকে আটকে দিয়ে বলল,

‘ছেড়ে দে। দশজনের মধ্যে দু’জন এরকম থাকেই।’

প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘তাইবলে অচেনা একটা পুরুষের দিকে কিস ছুঁড়বে? এত নির্লজ্জ, বেহায়া কেন? অন্যের ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে নজর দেয়ার এত সাহস হয় কী করে তার?’

‘আরেহ্ বাবা, এত চটে যাচ্ছিস কেন? সে কিস ছুঁড়ে মারলেই কি ওটা আমার গালে এসে পড়বে? তাছাড়া আমার গাল কি ওতো সস্তা? যে কারও জন্য বুকিং দিয়ে দেব? চুপ করে বোস তো এখানে। এসব থার্ডক্লাশ মানুষের দিকে ফিরে তাকাতে নেই।’

অনেক কষ্টে রাগ কন্ট্রোল করল প্রাণেশা। ওয়েটার খাবার নিয়ে এলো। স্ত্রীর প্লেটে অল্প চাউমিন তুলে দিয়ে নিজের প্লেটেও নিল। প্রাণেশা তখনও জ্বলন্ত দৃষ্টিতে ওই মেয়েটাকে দেখে যাচ্ছিল। অনির্বাণ সেটা দেখে বলল,

‘এ্যাই, তোর সমস্যা কী? ওদিকে কী দেখিস? আমাকে দেখ। কোথাকার কোন বেয়াদব মেয়ে, তাকে কেন এত দেখতে হবে? আমার দিকে তাকা, প্রাণ।’

দৃষ্টি ফিরিয়ে এনে খাবারের দিকে মনোযোগ দিল প্রাণেশা। অনির্বাণ আস্তেধীরে খাওয়া শুরু করল। ফাঁকে-ফাঁকে স্ত্রীর রাগ কমানোর চেষ্টায় তার মুখেও অল্প একটু চাউমিন তুলে দিল। প্রাণেশা বাঁধা দিল না। খাবার খেতে খেতে আড়চোখে অন্যদিকে তাকালোই সে। একটা সময় মাথায় খুন চেপে বসলো। অনির্বাণের চোখের চশমা খুলে, নিজের টি’শার্টের গলায় ঝুলিয়ে বলল,

‘ওদিকে কী হচ্ছে, কিচ্ছু দেখছ না। ক্লিয়ার?’

অনির্বাণ কড়া আদেশের স্বরে বলল,
‘খামোখা তর্কে যাস না।’

প্রাণেশা এই আদেশ কানেও নিল না। অনির্বাণের নাকের ডগায় টান দিয়ে বলল,
‘তোমার বউয়ের মাথাভরা দুষ্টুমি। আমার ব্যক্তিগত সম্পদের দিকে নজর দিচ্ছে। এত সহজে ওই বেটিকে আমি ছেড়ে দেব ভাবছ?’

দূরের জিনিস ব্লার দেখে অনির্বাণ, এজন্যই চালাকি করে চশমা খুলে নিজের কাছে নিয়ে এলো প্রাণেশা। এরপর এক’পা দু’পা করে সেই মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়াল। আঙুল নাড়িয়ে বলল,

‘হাই… আমি প্রাণেশা আমরীন। আপনি?’

মেয়েটা বলল,
‘আমি ডেইজি।’

‘ওহ… নাইস্ নেইম। কোথা থেকে এসেছেন?’

‘আমি লন্ডনে থাকি। দেশে ঘুরতে এসেছি। এখানে আমার দাদাবাড়ি।’

‘গুড, ভের‍্যি গুড। ক্যান আই সিট হেয়ার?’

পাশের চেয়ার দেখিয়ে বলল প্রাণেশা। ডেইজি হেসে বলল,
‘ইয়েস, অফকোর্স।’

চেয়ারে বসে ডেইজির সাজপোশাক ভালোমতো দেখল প্রাণেশা। এমন পোশাক পরেছে, উরু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। বুকের দিকটাও যথেষ্ট খোলামেলা। শরীর দেখিয়েই পুরুষের নজর কাড়তে চাইছে। মেয়েটির উদ্দেশ্য বুঝতে দেরী হলো না বিধায় টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে অনির্বাণের দিকে আঙুল তাক করে বলল,

‘ওই ছেলেটা সুন্দর না?’

ডেইজি বলল,
‘ইয়াপ। হ্যান্ডসাম, রাফ এন্ড টাফ, লুকিং গর্জিয়াস টাইপ।’

‘আমার একটা সমস্যা কী জানেন?’

‘কীসের সমস্যা?’

প্রাণেশা ঠাট্টা-তামাশা বাদ দিয়ে, সিরিয়াস হয়ে বলল,
‘যা কিছু আমার, সেটার ভাগ আমি কাউকে দেই না। বৈধ দৃষ্টিতে না, অবৈধভাবে তো একদমই না।’

‘মানে কী?’

‘মানে হচ্ছে, ওই পুরুষটা আমার বৈধপুরুষ। আর আমার বৈধপুরুষের দিকে অবৈধ দৃষ্টি নিয়ে যে নারী তাকাবে, তার চোখদুটো আমি টেনে ছিঁড়ে ফেলব। আপনি বাইরের মানুষ বলে সম্মানের সাথে কথাটা বললাম। নয়তো এতক্ষণে, আপনার ঠোঁট আমি সেলাই করে দিতাম, ডার্টি মাইন্ডেড পিপল্।’

ডেইজির হতবাক দৃষ্টিকে আরও অবাক করে দিয়ে, তার গালে আলতো চাপড় মেরে সেখান থেকে চলে গেল প্রাণেশা। চশমাটা টি’শার্ট থেকে খুলে অনির্বাণের চোখে পরিয়ে দিয়ে, খাবারের বিল মিটিয়ে, আঙুলের ভাঁজে আঙুল আটকে বলল,

‘চলো যাই।’

অনির্বাণ রীতিমতো শক খেল প্রাণেশার এই আচরণে। সামনে থাকা রমণীর অবাককরা করা দৃষ্টি দেখে গা কাঁপিয়ে হেসে উঠল সে। রেস্টুরেন্টের সীমানা পেরিয়ে গাড়িতে এসে ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে গাড়ির সিটে বসে প্রাণেশা বলল,

‘ওই নির্লজ্জ মেয়েটাকে দেখেছ, কেমন করে তাকাচ্ছিল?’

গা কাঁপানো হাসি থামিয়ে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘তো?’

‘তুমি ওই মেয়েটাকে দু’একটা কথা শুনালেই পারতে। না কি ওই মেয়েটার লোলুপ দৃষ্টি তোমার ভালো লাগছিল বলে বকা দিতে পারোনি?’

সঙ্গে সঙ্গে প্রাণেশার ঠোঁটের ওপর আঙুল রেখে তাকে চুপ করিয়ে দিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘মিছে সন্দেহকে মনে জায়গা দিস না, প্রাণ। ওই মেয়েটার ড্রেসাপ দেখেই আমি সামনে যাইনি। দেখছিলি তো, কী ছিল পরনে?’

বুদ্ধিমতী বলেই এই ইঙ্গিতটা বুঝে নিল প্রাণেশা। কিন্তু তার মনের জ্বালা মিটল না। কতটা নোংরা মানসিকতার হলে পাবলিক প্লেসে এসে এরকম একটা বিতিকিচ্ছিরি কাহিনী করে! ভেতর গুলিয়ে বমি এসে যাচ্ছিল যার। একাধারে বকতে বকতে সে যখন অস্থির হয়ে যাচ্ছিল, অনির্বাণ তাকে প্রশ্ন করল,

‘প্রাণ… আর ইউ ফিলিং জেলাস্?’

প্রশ্নটা করতে দেরী অথচ অনির্বাণের বুকের ওপর জাপটে পড়তে দেরী হলো না প্রাণেশার। দু’হাতে গলা পেঁচিয়ে ধরে মেজাজের ওঠানামাকে সামলে নিয়ে বলল,

‘জানি না… কিন্তু আমার মনে হচ্ছে, আমি তোমাকে আর কারও সাথে শেয়ার করতে পারব না। ওই মেয়েটার দৃষ্টি ও আচরণ কোনোকিছুকেই স্বাভাবিক ভাবতে পারছি না।’

অনির্বাণ তাকে একটু সহজ করতে, মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘রিল্যাক্স প্রাণ…। এইটুকু নিয়ে এত হাইপার হওয়ার কিচ্ছু নেই। রাস্তাঘাটে এমন কিছু মেয়ে থাকেই, যারা চলতে পথে পুরুষদের অস্বস্তির কারণ হয়। এরকম সিচুয়েশনে শুধু যে মেয়েরা বিব্রত হয় তা নয়, ছেলেরাও যথেষ্ট বিব্রত হয়।’

প্রাণেশা একটু সহজ হয়ে, নিজের সিটে সোজা হয়ে বসলো। মুচকি হাসলোও একটু। মেয়েটার এই কাণ্ডে ভয়ানক রকমের রাগ হয়েছিল তার। ইচ্ছে করছিল, ওখানে দাঁড়িয়েই ইচ্ছেমতো কয়েকটা দিয়ে আসুক। কিন্তু পারল না। মেয়ে বলেই পারল না। রাগ ও মেজাজ সবসময় দেখানো যায় না। তবে যেটুকু বলেছে, সেটুকুই বা কম কীসের? ভাবতে গিয়ে নিজের মধ্যকার পরিবর্তন টের পেল প্রাণেশা। তাতেই ঠোঁটের হাসি বিস্তৃত হলো। অনির্বাণ সেই হাসি দেখে, মনের কথা স্পষ্টভাবে জানতে চাওয়ার চেষ্টায় বলল,

‘তাহলে তুই স্বীকার করছিস, তুই-ই আমার বউ? আমাদের মাঝখানে আর কেউ আসবে না, তাই তো?’

সিটে হেলান দিয়ে দু’হাতে মুখ ঢেকে ফেলল প্রাণেশা। এত লজ্জা লাগছে তার! কথাই বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে। তবুও ঢেকে রাখা হাতের ফাঁক দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘না… আমি তোমার বউ না। তোমার বউ হতে আমার ভারী বয়েই গেছে।’

***

চলবে…