Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 133



প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৭

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৭

রাত থেকে বার বার অদ্ভুত এক অনুভূতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রাণেশা। সেই অনুভূতি একপশলা বৃষ্টির ন্যায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছে তার সম্পূর্ণ অস্তিত্বের সাথে। ঝুমঝুম বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে তার শরীর-মন। যে মনে কখনও ভালোবাসার জন্ম হয়নি, যে মনে কোনো পুরুষ কখনও নিজের আধিপত্য জাহির করতে পারেনি, যে মন এতদিন রিক্ত-শূণ্য ছিল, আজ সে মনেই ক্ষণে ক্ষণে অনির্বাণের চেহারাটা উঁকিঝুঁকি মারছে। যতবারই ঘুমানোর চেষ্টায় চোখ বন্ধ করেছে ততবারই ঘুমের বারোটা বেজে গেছে ওই একটুকরো মিশ্র অনুভূতিকে অনুভব করতে গিয়ে। কেবলই মনে হচ্ছে, অনির্বাণ তার সামনে, কাছে, নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে। আর তাতেই ঘুম উড়ে গিয়ে একঝাঁক লজ্জায় কাবু হচ্ছে সে। সম্পূর্ণ রাত যখন এভাবেই কেটে গেল, নিজেকে শাসাতে, বকতে, বুঝাতে শেষরাতে বিড়বিড় করল,

‘তুইও অভদ্র হয়ে যাচ্ছিস, প্রাণ। ছিঃ… কীসব লজ্জাজনক ভাবনা এগুলো!’

শেষমুহূর্তে অনেক কষ্টে দু’চোখের পাতায় ঘুম টেনে এনে বেলা নয়টা পর্যন্ত ঘুমালো। দরজায় ঠকঠক আওয়াজ ও রূপকথার ডাক শুনে ঢুলুঢুলু চোখে বিছানা ছেড়ে নব ঘুরিয়ে দরজা খুলে বলল,

‘এত সকালে ডাকলে কেন? রাতে ঘুম হয়নি একটুও।’

রূপকথাকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে আবারও বিছানায় এসে ধপাস করে শুয়ে পড়ল প্রাণেশা। রূপকথা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর এই আলসেমি দেখে পিছনে থাকা অনির্বাণকে বলল,

‘তোমার বউ জীবনেও পাল্টাবে না। ওর ঘাড়ের সব ভূত তাড়াতে হলে, রোজ তিনবার কঞ্চি দিয়ে পিটাতে হবে।’

অনির্বাণ শব্দ করেও হাসতে গিয়ে থেমে গেল। রূপকথা বলল,
‘ভেতরে এসো।’

প্রাণেশা আবারও ঘুমিয়ে পড়েছে। তা-ই তাকে আর ডাকল না রূপকথা। অনির্বাণকে নিয়ে রুমে এসে জানালার কপাট খুলে পর্দা সরিয়ে প্রাণেশার রুমের একপাশে থাকা কেবিনেট ও শোকেসের লক খুলে ভেতরে থাকা জিনিসপত্রের দিকে আঙুল তুলে বলল,

‘দেখো, তোমার বউয়ের অর্জন।’

সম্পূর্ণ কেবিনেটের ওপর থেকে নিচে চোখ বুলালো অনির্বাণ। সঙ্গে সঙ্গে দুটো চোখে বিস্ময় নেমে এলো। এরপর শোকেসের দিকে চোখ ফেলল। তাতেও বিস্ময় বাড়ল বৈ কমল না। সবশেষে রুমের এককোণে ফেলে রাখা বেশকিছু পুঁতির হ্যান্ডব্যাগের দিকে চোখ গেল। টি-টেবিলে রাখা একটা অসম্পূর্ণ হ্যান্ডব্যাগ দেখে বুঝল, সদ্য হাত দিয়েছে এটায়, কিন্তু কাজ শেষ হয়নি। বিস্ময় নিয়ে সে যখন সবকিছুতে চোখ বুলাচ্ছিল, রূপকথা ফের কেবিনেটের ভেতর থেকে খয়েরী ও সোনালী রঙের দশ থেকে পনেরোটা ক্রেস্ট বের করে একটা অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘এগুলো সব ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পেয়েছে। যখনই কোনো খেলায় অংশগ্রহণ করত, ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড হতোই।’

বিস্মিত চোখে ক্রেস্টে চোখ বুলালো অনির্বাণ। তাতে লেখা, একুশে ফেব্রুয়ারীতে মঞ্চনাটকে অভিনয় করে, সেরা অভিনেত্রী হওয়ার প্রথম পুরস্কার এটা। তখন প্রাণেশা অষ্টম শ্রেণীতে ছিল। এভাবে ছাব্বিশে মার্চ, পনেরো ই অগাস্ট ও ষোলোই ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একেকটা ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মঞ্চনাটক, নৃত্য ছাড়াও, ক্রিকেট, ব্যাটমেন্টনসহ নানাজাতের খেলায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হওয়া প্রাইস। সাথে কিছু মেডেল। সবশেষে দেখল, বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রাণেশার অর্জিত সেই ‘চ্যাম্পিয়নস ট্রফি’। হাতে নেয়ার পর তার মনে হলো, এ জীবনে এতগুলো অর্জন তার কখনও হয়নি। পড়াশোনা বাদে অন্য কোনোকিছুর দেখে মনোযোগ দেয়ার সময় হয়নি তার। অথচ প্রাণেশা, জীবনে কত প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছে। যতবার অংশগ্রহণ করেছে হাতভরা পুরস্কার নিয়ে ফিরেছে। সবকিছু দেখা শেষ হলে রূপকথা বলল,

‘বাড়ির কেউ কখনও ওর এই খেলাধুলা ও অর্জনকে গুরুত্ব দেয়নি। সবারই ধারণা, এসব খামোখা। এগুলো দিয়ে কী হবে? গিফটের আশায় ডুকরে কাঁদা মেয়েটিও গিফট পেয়েছে, কিন্তু সেই গিফট তার হাতে এমনি-এমনি আসেনি। অনেক কষ্টে অর্জন করতে হয়েছে। ওর এই কষ্ট, অর্জন, এসবের কোনো গুরুত্ব নেই কারও কাছে।’

ধীরপায়ে প্রাণেশার সম্পূর্ণ রুমটা ঘুরে ঘুরে দেখল অনির্বাণ। শোকেসের পাশে দাঁড়িয়ে একপাশে থাকা ত্রিশ থেকে চল্লিশটা বই দেখছিল। একটা হাতে এনে দেখল, রবীন্দ্রনাথের নৌকাডুবি উপন্যাস। দু’একটা পৃষ্ঠা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগল। রূপকথা বলল,

‘এই বইগুলো কিছু ট্যুরে গিয়ে সেখানে অনুষ্ঠিত হওয়া প্রতিযোগিতা থেকে প্রাপ্তি। আর কিছু ওর নিজের সংগ্রহ।’

এরপর হ্যান্ডব্যাগটা হাতে তুলে বলল,
‘এই কাজটা ও নিজে করে। লুকিয়ে-চুরিয়ে। নির্ঘুম রাত কাটিয়ে। অনলাইন বিজনেস আছে ওর। এগুলো সারাদেশে সেল হচ্ছে। তবে, এই বিজনেসের খবর কেউ জানে না। কেউ এসবের খোঁজও রাখে না।’

অনির্বাণ এতটাই চমকাল যে ওর মুখের কথারা হারিয়ে গেল। নিশ্চুপে একটা একটা করে বউয়ের সব অর্জন দেখে বলল,

‘তুমি জানলে কী করে?’

রূপকথা বলল,
‘এ বাড়িতে বউ হয়ে আসার প্রায় ছ’মাস পর, প্রথমবার যখন অসুস্থ হয়েছিলাম, সারারাত ও আমার পাশে ছিল। তখন রাত জেগে এই হাতের কাজগুলো করত। মিথ্যুকটা প্রথমে স্বীকার করেনি। কিন্তু সে রাতে আমি অসুস্থ থাকার পরও আধোঘুমে আধোজাগরণে ওর এই কাজগুলো দেখেছি। সেদিনের পর অন্য এক প্রাণেশাকে আবিষ্কার করে ভীষণ অবাক হয়েছি, জানো? ওইদিন থেকে নিজের ভেতরে থাকা কষ্টগুলো একটু একটু করে আমার কাছে শেয়ার করেছিল ও।’

ধীরেধীরে সবকিছু আবারও গুছিয়ে রেখে রূপকথা বলল,
‘টপ রেজাল্ট হয়নি বলে ওর কোনো কাজে কেউ ওকে সাপোর্ট করেনি। সবার ধারণা ওকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। শুধু কি অ্যাকাডেমিক সার্টিফিকেটটাই সব, অনি? একটা মানুষের অভ্যন্তরীণ যে গুণ, সেটার কি কোনো মূল্য নেই? শিক্ষাদীক্ষা অনেকেরই থাকে, ক’জনের সব বিষয়ে পারদর্শী হওয়ার মতো পর্যাপ্ত মনের জোর, বুদ্ধি ও মেধা থাকে বলো তো? বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কতজন নিজের মধ্যকার অভ্যন্তরীণ গুণকে যাচাই করার মাধ্যমে সেরা স্থানে নিয়ে দাঁড় করাতে পারে? যারা পারে, তারা কি খুবই সাধারণ কেউ হয়? একদম তুচ্ছ হয়? এতকিছু অর্জনের পরও ও কেন সবার কাছ থেকে অকর্মা, অলস, গাধী, তকমা পাচ্ছে?’

একদৃষ্টিতে ঘুমন্ত প্রাণেশার দিকে তাকিয়ে রইল অনির্বাণ। দেখতে দেখতে চোখের কোণের বিস্ময়েরা মুগ্ধতায় রূপ নিল। আর কতবার মেয়েটার কাজে সে মুগ্ধ হবে? অনি নিজেও বোধহয় এটা জানে না। প্রয়োজনীয় কথা শেষ করে রূপকথা বলল,

‘তুমি কি এখুনি বের হবে?’

অনির্বাণ হাতের ঘড়ি দেখে বলল,
‘না… আরও ঘণ্টা-দেড়ঘণ্টা পর।’

‘আমি নাশতা সাজাচ্ছি। খেয়ে যেও।’

ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানাল অনির্বাণ। রূপকথা বেরিয়ে গেল। যাওয়ার আগে পর্দা টেনে দরজার দুটো কপাট আস্তে করে আটকে দিয়ে চলে গেল। গুটিকয়েক পা ফেলে বিছানার কাছে এগিয়ে এসে, ফাঁকা জায়গায় বসে, খানিকটা ঝুঁকে স্ত্রীর স্নিগ্ধ-সুন্দর মুখের দিকে তাকিয়ে, আলগোছে গালে আঙুল ছুঁয়ে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে অনির্বাণ ডাক দিল,

‘প্রাণ…। আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে বিদায় দিবি না?’

এত কাছে এসে ডাক দেয়াতে সেই ডাক প্রথমে ঘুমঘোরে ঘটে চলা স্বপ্নই মনে হলো প্রাণেশার। হাত বাড়িয়ে কাছে থাকা বালিশ টানতে গিয়ে, অনির্বাণের পিঠ ছুঁয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে প্রাণেশা বলল,

‘বিরক্ত করো না তো। ঘুমাতে দাও।’

‘এতবেলা অবধি ঘুমায় না, সোনা। প্লিজ…। ওঠে পর এখন।’

‘আহা… কেন কানের কাছে বকবক করছ? তুমি তো দেখছি, আমাকে আর শান্তিতে ঘুমাতে দিবে না। সেই রাত থেকে জ্বালাচ্ছ। যাও তো। তোমার বকবকানির জন্য সারারাত ঘুমাইনি আমি।’

প্রাণেশার সম্পূর্ণ কথা বুঝতে না পেরে অনির্বাণ বলল,
‘আমি আবার কখন তোকে বিরক্ত করলাম?’

‘করেছই তো। চোখ বন্ধ করলেই সামনে চলে আসছ।’

‘তুই কি জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছিস? আমি আসলে তোর স্বপ্নে না, সত্যি হয়েই সামনে এসেছি। চোখ মেলে তাকা একবার। দেরী হয়ে যাচ্ছে তো।’

এবার হাতের স্পর্শটা আরেকটু দাবিয়েই গালে ঠেকাল অনির্বাণ। ঠোঁট নামিয়ে গালে চুমু খেয়ে বলল,
‘এরপর কি মনে হচ্ছে, আমি স্বপ্নে এসে বিরক্ত করছি?’

স্বপ্ন না কি সত্যি সম্পূর্ণ ব্যাপারটা পরখ করতে জোরপূর্বক চোখ খুলল প্রাণেশা। নিঃশ্বাসেরও অতি নিকটে অনির্বাণকে দেখে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে, যথাসম্ভব দূরে সরে গিয়ে কম্পনরত কণ্ঠে বলল,

‘তুমি এখানে কখন এসেছ?’

‘ভাবীর সাথেই এসেছি।’

আরামের ঘুমের বারোটা বেজে যাওয়াতে প্রাণেশা যথেষ্ট বিরক্ত হলো। চোখেমুখে হাত ঢলে বলল,
‘এখানে কী চাই?’

‘বউয়ের কাছ থেকে বিদায় নিতে এলাম।’

‘আর কতবার বলব আমি তোমার বউ না? আমাকে বউ ডাকবে না। আমার এই ডাকটা অসহ্য লাগে। প্লিজ, যাও এখান থেকে।’

অন্যসময় হলে হয়তো এই কথাতে প্রচণ্ড মন খারাপ হতো, রাগ হতো, ঝগড়া করতে ইচ্ছে হতো। কিন্তু এই বিদায়ী মুহূর্তে এসে কোনোপ্রকার মন খারাপ, রাগ ও ঝগড়াঝাটিকে মনে জায়গা দিতে ইচ্ছে হলো না অনির্বাণের। সে হাত বাড়িয়ে প্রাণেশার একটা হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

‘আমি চলে গেলে তোর খারাপ লাগবে না?’

প্রাণেশা ঝটপট উত্তর দিল,
‘একদমই না। তুমি কে হও আমার?’

‘কে হই, জানিস না?’

‘জানি… কিন্তু মানি না।’

‘মানতে অসুবিধা কী?’

‘জানি না রে, ভাই।’

‘আবার ভাই? এবার কিন্তু খুব খারাপ হচ্ছে।’

প্রাণেশা এত আহ্লাদীর মেজাজে নেই। কাঁচাঘুম ভাঙাতে মেজাজ একদম তুঙ্গে। কন্ট্রোল করতে না পেরে বলল,
‘ভাইকে ভাই ডাকব না তো কী ডাকব?’

এতক্ষণ শান্ত মেজাজে কথা বললেও প্রাণেশার এই ভাই-ভাই ডাক শুনে প্রচণ্ড রাগ হলো অনির্বাণের। সে ধরে রাখা হাতটা শক্তভাবে চেপে রেখে রাগকে সামলে নিয়ে একটু নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল,

‘যখন ভাই ছিলাম তখন ভাই ডেকেছিস। এখন তো আর ভাই নই। এখন অন্যকিছু ডাক।’

প্রাণেশা ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘অন্যকিছুটা আবার কী?’

অনির্বাণ দুষ্টু হেসে বলল,
‘জান, বেইবি, ডার্লিং, সুইটহার্ট, মাই লাভ, এসব।’

‘ওরে বাবা, এসব ডাকতে হবে?’

‘হ্যাঁ, এসবও যদি না পারিস তাহলে ডাকবি, ‘ওগো শুনছ’। এই ডাকে একটা আদর-আদর ফিলিংস লুকিয়ে আছে।’

প্রাণেশা দ্রুত হাত ছাড়িয়ে নিয়ে খিটমিট মেজাজে বলল,
‘খেয়েদেয়ে কাজ নেই তো আমার। বাংলা সিনেমার ডায়লগ দিই। যাও তো এখান থেকে। মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।’

অনির্বাণকে এড়িয়ে দ্রুতপায়ে বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে যেতে চাইল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,
‘একটু দাঁড়া।’

পিছন ফিরে প্রাণেশা বলল,
‘কী?’

অনির্বাণ কাছে এলো। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রাণেশাকে বেকায়দায় ফেলতে বলল,
‘গতরাতে যে স্পেশাল গিফট দিলাম। রিটার্ন গিফট দিবি না? যেহেতু চলেই যাচ্ছি। একটা কিছু তো গিফট দিতেই পারিস।’

প্রাণেশার দম আটকে আসার যোগাড় হলো। দু’হাতে নিজের পরনের জেগিংস্ খামচে ধরে বলল,
‘আমার কাছে কিছু নেই।’

‘যা আছে, তা-ই দে।’

‘কী আছে?’

অনির্বাণ আরেকটু কাছে এসে, মাথা ঝুঁকিয়ে দু’হাতে প্রাণেশার দুটো হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, নিঃশ্বাস পরিমাণ দূরত্বে থেকে বলল,

‘গুডবাই কিস।’

এমন আবদার শুনে ভীমড়ি খাওয়ার যোগাড় হলো প্রাণেশার। চরম বিস্ময় নিয়ে, দ্রুত’পা পিছিয়ে যেতে চাইল। দুটো হাত বাঁধা থাকার কারণে পিছনে যেতেও পারল না। অনির্বাণ তাকে নিজের দিকে টেনে দু’হাতের ফাঁকে আগলে নিয়ে বলল,

‘আমি চাইলেই তোকে সঙ্গে নিতে পারতাম, কিন্তু এখুনি তোর মনের ওপর জোর দিতে চাইছি না। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে চাই না। তুই আমার স্ত্রী, প্রাণ। তাই তোর প্রত্যেকটা ইচ্ছে-অনিচ্ছের মূল্য আমি দেব। বিয়ের আগ অবধি তোকে নিয়ে এরকম ফিলিংস আমার ছিল না। অন্যসব কাজিনের মতোই তোকে দেখে এসেছি। কিন্তু যখন ‘কবুল’ বললাম, তখুনি আবিষ্কার করলাম, তুই আমার আত্মার চেয়েও আপন কেউ হতে যাচ্ছিস। আমি জানি, যা কিছু হয়েছে সেসব তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে। তবুও এই সম্পর্কটাকে আমি ভুল বা বোঝা ভাবতে পারছি না। আর এজন্যই ভাঙন আমি চাইছি না। তবে তুই যদি চাস, সেটাও করব।’

প্রাণেশা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল নিজের জায়গায়। কথার কোনো উত্তর দিতে পারল না। এরমধ্যেই হাতের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো। তার থেকে খানিকটা দূরে চলে গেল অনির্বাণ। ঘড়িতে সময় দেখে বলল,

‘সাড়ে নয়টা বাজে। আর আধঘণ্টা সময় আমি আছি। কিছু বলার থাকলে এই সময়ের মধ্যেই বলে ফেল। ঢাকায় ফিরে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে এত সহজে আর এমুখো হব না।’

প্রাণেশাকে পর্যাপ্ত সময় ও স্পেস দিয়ে স্টাডি টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে, ফোন হাতে নিয়ে তাতে চোখ ডুবিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘আধঘণ্টার বেশি আমি এক সেকেন্ডও বসব না।’

ধপ করে বিছানায় বসে দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরল প্রাণেশা। আধঘণ্টায় কী সিদ্ধান্ত জানাবে? কী বলবে? সে সম্পর্ক ভেঙে দিতে চায়? আসলেই কি চায়? সম্পর্ক নিয়ে মনের ভেতর যেসব ভীতি, সেটুকুর কারণেই তো বিয়ে নামক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হতে ভীষণ ভয় হতো তার। এরমধ্যে কোনো কাজকর্ম পারে না। বিয়ে হলেও ঘর-সংসার যে তার হবে না, এটুকু সে নিশ্চিত ছিল। স্বামী-সংসার কেমন হয়, বিবাহিত জীবনে কত জ্বালা-যন্ত্রণা হয়, সেটা নিজের বাবা-মা ও বন্ধুবান্ধবদের বিয়ের পরবর্তী জীবন দেখে বুঝা হয়ে গেছে তার। এজন্য এরকম পরিস্থিতিতে জড়াতে চায়নি সে। কিন্তু ভাগ্য! তাকে জড়িয়ে দিল। তা-ও আবার অনির্বাণের সাথে। প্রতিটা মিনিট যত এগোচ্ছে, প্রাণেশা এসব জটিল ও কঠিনসব বিষয়াদি নিয়ে ভেবে যাচ্ছে। সিদ্ধান্ত নিতে হিমশিম খেতে শুরু করেছে সে। সবকিছুর পরেও দু’দিনের এই সম্পর্কে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে সেটুকুর ছাপ এখনও তার মনের সর্বত্র জুড়ে আছে। চাইলেও দূরে সরানো যাচ্ছে না। সে দু’হাতে মুখ ঢেকে ভাবতে লাগল কী করবে! এতসব ভাবনার ভীড়ে সেকেন্ড, মিনিট পেরিয়ে গিয়ে অনির্বাণের দেয়া নির্দিষ্ট সময়ের দ্বারে এসে পৌঁছাতে লাগল মিনিটের কাঁটা। এখনও ত্রিশ সেকেন্ড বাকি ছিল। সময় দেখে উঠে দাঁড়াল অনির্বাণ। একবার প্রাণেশার দিকে তাকাল। তারপরই ফোন পকেটে রেখে, দুটো হাতও গুঁজে রাখল সেথায়। ম্লানমুখে বলল,

‘গুডবাই…।’

কয়েক’পা হেঁটে দরজার সামনে দাঁড়াল অনির্বাণ। পিছন থেকে প্রাণেশা বলল,
‘দাঁড়াও।’

দুরুদুরু বুকে সামনের দিকে পা ফেলল প্রাণেশা। মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘তুমি কি সত্যিই চাও, এই সম্পর্কটা দীর্ঘস্থায়ী হোক?’

অনির্বাণ বলল,
‘মিথ্যে মনে হওয়ার কারণ?’

প্রাণেশা ঢোক গিলল। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। কথা আসছে না। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
‘আসলে আমার একটু সময় চাই।’

‘কতদিন?’

‘ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘ঠিক আছে। যখন বুঝতে পারবি, তখন ফোন করে বলিস। এখন আসছি।’

অনির্বাণ চলে যেতে চাইলে, প্রাণেশা তার হাতের বাহু আঁকড়ে ধরে, সাহস নিয়ে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টায়, মনে মনে কথা গুছিয়ে নিতে চাইল। অনির্বাণ বলল,

‘কিছু বলবি?’

উপরনিচ মাথা নেড়ে প্রাণেশা বলল,
‘হ্যাঁ।’

‘কী?’

‘একটু আগে কী বলছিলে তুমি?’

কাঁপাকাঁপা গলায় এইটুকু বলেই থেমে গেল প্রাণেশা। অনির্বাণ বলল,
‘কোথায় কী বললাম?’

‘বলেছিলে কিছু একটা।’

‘স্যরি… মনে করতে পারছি না।’

প্রাণেশা মনে সাহস ধরে রেখে বলল,
‘চোখ বন্ধ করো।’

‘কেন?’

‘দরকার আছে।’

‘কেন’র উত্তর না দিলে চোখ বন্ধ হবে না।’

‘সময় নষ্ট করো না তো। চোখ বন্ধ করতে বলেছি, বন্ধ করো।’

‘করব না। চোখ খোলাই থাকবে। কী বলতে চাস, বল। একদম চোখে-চোখ রেখে বলবি।’

প্রাণেশা বিপদেই পড়ল। কিন্তু ভয়ের দ্বার ধারল না। যেভাবে সাহস নিয়ে কাছে এসেছিল, সেভাবে সাহস নিয়েই দু’হাতে অনির্বাণের গলা জড়িয়ে ধরে, নিচের দিকে নামিয়ে অধরোষ্ঠ দখল করে নিল। ব্যাপারটা ঘটল মাত্র কয়েক সেকেন্ড সময় ব্যবধানে। প্রথমে এই স্পর্শে থমকাল অনির্বাণ। পরক্ষণেই এই মহামূল্যবান মুহূর্তটাকে স্মৃতির পাতায় বন্দী করতে নিজেও তাকে আঁকড়ে ধরল। সময় কোনদিক দিয়ে, কত মিনিট অতিক্রম করল, কেউই সেটা খেয়াল করল না। দীর্ঘক্ষণ পর মুক্ত বাতাসে শ্বাস নিতে কপালে কপাল ঠেকিয়ে প্রাণেশা বলল,

‘তুমি গুডবাই কিস চেয়েছিলে।’

অনির্বাণ হেসে উঠল। দুষ্টুমি করে বলল,
‘হুট করে এত কাছে এলি কেন? এখন তো তোকে ছেড়ে যেতে ভীষণ কষ্ট হবে আমার। থাকব কী করে আমি?’

প্রাণেশা মন খারাপের সুরে বলল,
‘আমাকে একটু সময় দাও, প্লিজ।’

দুষ্টুমি রেখে সিরিয়াস হলো অনির্বাণ। দু’হাতের পাতায় প্রাণেশার ঘুমঘুম মুখশ্রী আগলে নিয়ে কপালের মধ্যিখানে ভরসার ন্যায় ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,

‘নিচে আয়। একসাথে নাশতা করব।’

অনির্বাণ আগে নিচে এলে, তার পনেরো মিনিট পর প্রাণেশা এলো। নাশতা খেতে বসার পর রূপকথা আড়চোখে দু’জনের দিকে তাকিয়ে চোখ নাচিয়ে প্রাণেশার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘মিটমাট হয়েছে?’

প্রাণেশা কেশে উঠল। দৌড়ে পালাতে চাইলে, অনির্বাণ তাকে আটকে দিল। আবারও চেয়ারে বসালে রূপকথা শব্দ করে হেসে উঠে বলল,

‘এ কী রে, তুই লজ্জা পাচ্ছিস?’

প্রাণেশা অসহায় কণ্ঠে বলল,
‘ভাবী প্লিজ।’

সবাই নাশতা খেয়ে যে যার কাজে চলে গেছে সে-ই সকালে। বাকি ছিল পিচ্চি দুটো আর রাফিয়ান ও রেদোয়ান। তারাও আজ সুযোগ পেয়ে বেলা অবধি ঘুমিয়েছে। এখন উঠে এসে নাশতা করছে। দুলাভাইকে দেখে আবারও রাফিয়ান গতকালকের মতোই অনির্বাণকে ক্ষ্যাপানোর চেষ্টায় বলল,

‘সোনাপু, দুলাভাই তো কাল খুব গলা উঁচিয়ে বলছিল, তোমাকে কিছু একটা গিফট দিবে। কী দিয়েছে দেখি? সুন্দর কিছু, দামী কিছু?’

সব গিফট যে আর টাকা দিয়ে কিনতে হয় না, এটা এদেরকে কে বুঝাবে? লজ্জায় যেন আজ তার না-ই হওয়ার দিন। আশ্চর্য, তার এত লজ্জা এলো কোথা থেকে! আগে তো এমন ছিল না। সবই অনির্বাণের স্পেশাল গিফট’এর ফল। দূর…। সকালটাই মাটি। এমনকিছু বিড়বিড়িয়ে প্রাণেশা তার ভাইকে বলল,

‘তুই দেখে কী করবি?’

রাফিয়ান বলল,
‘কেন? দেখলে দোষ কী?’

‘সব গিফট সবাইকে দেখাতে হয় না। তোদের এসব দেখতে হবে না। আমি ওটা লুকিয়ে রেখে দিয়েছি।’

মুখ ভেঙাল রাফিয়ান। খাওয়ার মুখে তুলে অভিমানী একটা ভাব দেখাল। রাদিন বলল,
‘সত্যিই মেজো ভাইয়া তোমাকে গিফট দিয়েছে?’

প্রাণেশা কাটকাট গলায় বলল,
‘হ্যাঁ, দিয়েছে। তো?’

‘আমাকে দেখাও না, সোনাপু।’

‘একবার বলেছি না, তোদের এসব দেখতে হবে না। কথা কানে যাচ্ছে না?’

ধমক খেয়ে কেঁপে উঠল রাদিন। তবুও আগ্রহী মেজাজে বলল,
‘দেখালে তোমার জিনিস আমি নিয়ে নেব না কি? কিপ্টুস মেয়ে।’

প্রাণেশা হা হয়ে তাকিয়ে রইল। রামিশা বলল,
‘একবার দেখাও না, সোনাপু। আমিও চাচ্চুকে বলব, আমাকেও একটা গিফট দিতে।’

রেদোয়ানও বলল,
‘সামান্য একটা গিফটই তো। দেখালে ক্ষতি কী? ওরা তো আর তোমার জিনিস কেড়ে নিচ্ছে না।’

ওদের সবার আগ্রহ দেখে প্রাণেশার মাথায়ও দুষ্টু বুদ্ধি চাপল। বলল,
‘কী দিয়েছে জানতে চাস তোরা?’

সবাই উপরনিচ মাথা নাড়ল। প্রাণেশা নিজের দু’হাত দু’দিকে মেলে ধরে বলল,
‘এই সাইজের একটা ঘোড়ার ডিম।’

রেদোয়ান ও রাফিয়ান তার দুষ্টুমি টের পেয়ে মুখ বাঁকিয়ে নাশতা খেতে লাগল। রামিশা অবাককরা দৃষ্টি মেলে বলল,
‘সত্যিই, সোনাপু? এত্তবড়ো ঘোড়ার ডিম?’

প্রাণেশাও উত্তর দিল,
‘হ্যাঁ, অনেক বড়ো।’

‘ডিমটা কোথায় রেখেছ, সোনাপু? আমায় দেখাবে?’

‘বাগানে আছে। দেখে আয়।’

রামিশা সত্যি সত্যিই ঘোড়ার ডিম দেখতে বাগানের দিকে দৌড় দিল। বাকিরা হো হো শব্দে হেসে উঠল। অনির্বাণ উঠে দাঁড়িয়ে মা-চাচীদের থেকে বিদায় নিয়ে রাফিয়ানের সামনে এসে বলল,

‘শালাবাবু, তোর কপালেও এমন গিফট জুটবে, যদি তুই আমাকে দুলাভাই ডাকা বন্ধ করিস। আর নয়তো জীবনেও ওই গিফট তুই ছুঁয়ে দেখতে পারবি না। সারাজীবন আইবুড়ো থেকে যাবি।’

রাফিয়ান চেয়ার ছেড়ে তেড়ে এসে অনির্বাণকে ধরতে যাবে, তার আগেই চিলের মতো উড়ে গেল অনির্বাণ। ব্যাকপ্যাক নিয়ে বাইকে চেপে বসলো। চাবি ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে একবার হাসলো শুধু। প্রাণেশা তাকে বিদায় দিতে এগিয়েছিল। হাত নেড়ে বিদায় দিয়ে ঘরে ঢুকেই রূপকথার ঠাট্টার শিকার হলো। তাকে দেখে রূপকথা দুষ্টুমির ছলে গাইল,

‘সোনাবন্ধু তুই আমারে, করলিরে দিওয়ানা। মনে তো মানে না, দিলে তো বুঝে না।’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৬

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৬

একটা সময় ‘গিফট’ নিয়ে খুব বেশি আগ্রহী ছিল প্রাণেশা। সময়ের সাথে সাথে সেই আগ্রহ মন থেকে উবে গেছে। কেউ খুশি হয়ে দিলে সেটা খুব যত্নেই তুলে রেখে দেয়। পছন্দ হোক অথবা না, মুখফুটে মনের ভাব প্রকাশ করবে না। বহুদিন পর অনির্বাণের কথা শুনে ঠোঁটে চাপা হাসি ফুটিয়ে তুলে প্রাণেশা বলল,

‘কে বলল, আমি গিফটের আশায় এই কাজটা করেছি? আমার কোনো গিফট লাগবে না। খামোখা টাকা খরচ করো না।’

অনির্বাণ এত কথা কানে না নিয়ে স্পষ্টকণ্ঠে বলল,
‘কেউ খুশি হয়ে কিছু দিতে চাইলে সেটা সাদরে গ্রহণ করতে হয়, স্টুপিড। ফিরিয়ে দিতে হয় না। এখনও এই বোধটুকু জাগার বয়স হয়নি তোর?’

‘ওসব আমার মধ্যে ছিল না কি কোনোকালে?’

প্রাণেশার এই ত্যাড়ামি শুনে ফুঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে অনির্বাণ বলল,
‘কবে হবে?’

‘না হলে কী আসে যায়? একটু অবুঝ থাকা ভালো নয় কী?’

‘সময় থেমে থাকে না, প্রাণ। একটা সময় বয়স বাড়বে, চুল পেকে যাবে, বাচ্চা-কাচ্চা থেকে নাতি-নাতনীও আসবে, তারা যদি জানে তাদের নানী অথবা দাদী সেই কৈশোরের মতো অবুঝ, কী ভাববে?’

অনির্বাণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনে বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে থেকে প্রাণেশা বলল,
‘বাহ্বা! আমাকে নিয়ে তুমি এইসব স্বপ্নও দেখো?’

‘ওমা, দেখব না কেন? বউ না তুই আমার? বউকে নিয়ে এমন আরও কত-শত স্বপ্ন আছে। সময়ের সাথে সাথে সব স্বপ্ন পূরণ হবে, ইনশা’আল্লাহ্।’

প্রাণেশা মুখ ভেংচিয়ে বলল,
‘কচু হবে। তোমার সাথে থাকলে তো আমি।’

‘তুই থাকবি, তোর ঘাড়ও থাকবে।’

‘এ্যাহ… বললেই হলো। জোর করবে না কি তুমি?’

অনির্বাণ চওড়া হাসি দিয়ে বলল,
‘না… যে গিফটটা দেব, এরপর তুই নিজেই বলবি, আমাকে ছেড়ে যেও না, অনি।’

শক্ত চোখে চেয়ে টি’শার্টের হাত গুটিয়ে কনুইয়ের কাছে আটকে রেখে এক’পা দু’পা করে অনির্বাণের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে ভয় দেখাতে চাইল প্রাণেশা। ঘাবড়ে দিতে চাইল। কিন্তু অনির্বাণ অনড়। তার ঠোঁটের কোণে শয়তানি হাসি। প্রাণেশা সেই হাসি দেখেও দমে গেল না। একদম কাছে গিয়ে বলল,

‘মরার শখ জাগলে সিলিংফ্যানে ঝুলব তা-ও তোমার গলায় ঝুলব না। বুঝেছ?’

অনির্বাণ এই কথাকে পাত্তা না দেয়ার ভান করে কাঁধ নাচিয়ে বলল,
‘ঝোলাঝুলি আর বাকি রাখলি কই, সোনা? অলরেডি ঝুলে আছিস।’

দাঁত কিড়মিড় করে প্রাণেশা বলল,
‘কী বললে তুমি? আমি তোমার গলায় ঝুলেছি? তোমার মতো ঝগড়ুটের গলায় যে ঝুলবে সে পাগল, তার চৌদ্দগুষ্টির সবাই পাগল।’

‘কথাটা কিন্তু ঘুরেফিরে তোর দিকেই যাচ্ছে।’

ওদের এই অকারণ কথা কাটাকাটি আরও দীর্ঘক্ষণ চলত। কিন্তু খাবার চলে আসার কারণে কেউ আর কথা বাড়ানোর সুযোগ পেল না। মাইশা প্রায় টেনে এনে প্রাণেশাকে চেয়ারে বসিয়ে বলল,

‘বাচ্চা-কাচ্চা, নাতি-নাতনী নিয়ে প্লানিং পরে করো। আগে এখানকার ঝামেলা শেষ করো।’

চারপাশের পরিস্থিতি খেয়াল করে মেজাজের ওঠানামাকে সামলে নিল প্রাণেশা। চেয়ারে বসে বড়ো করে শ্বাস টেনে প্রথমে একটু শান্ত হওয়ার চেষ্টা করল। এরপর আস্তেধীরে পাশে বসে থাকা রামিশার দিকে তাকিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

‘কী খাবি?’

রামিশা ও রাদিন আইসক্রিম পছন্দ করে বেশি। কাচ্চির সাথে সবার পছন্দের স্যপু, জুস ও বাচ্চাদের জন্য আইসক্রিম অর্ডার দিয়েছিল নাহিয়ান। সবার প্লেটে সে-ই নিজেই কাচ্চি তুলে দিল। প্রাণেশা বলল,

‘তোরা শুরু কর, আমি ওকে খাওয়াচ্ছি।’

টেবিলে থাকা ন্যাপকিন তুলে রামিশার পায়ের ওপর রেখে নেককারচিফ গলায় ঝুলিয়ে চামচের সাহায্যে অল্পস্বল্প কাচ্চি বোনের মুখে তুলে দিল প্রাণেশা। যত রাগ দেখাক, বকাবকি করুক, দিনশেষে ওদেরকে নিজের আত্মারও আপন ভেবে যত্ন নেয় সে। তখন বাচ্চাদুটোও শাসনের দিক ভুলে গিয়ে আদরটাকে উপভোগ করে বেশি। খেতে খেতে মাথা দুলিয়ে কিছু একটা গল্প করছিল রামিশা। প্রাণেশা শুনছিল আর হাসছিল। বাকিরা সবাই খাওয়া শুরু করলেও অনির্বাণ চুপ হয়ে বসে দু’জনকে দেখছিল। পরপর কয়েকটা দৃশ্য আজকে তার চোখে বার বার মুগ্ধতা এনে দিচ্ছে। অথচ এই প্রাণেশাকে দেখে কোনোদিন মনে হয়নি, তার মধ্যে কিছু গুণ আছে, যেটুকু একটা মানুষকে প্রবলভাবে টানতে পারে। সবসময় মেয়েদের মধ্যে মেয়েলী গুণাবলী খুঁজে অভ্যস্ত হওয়া মানুষও হুট করে যদি মনের চোখ দিয়ে প্রাণেশাকে দেখে, বিস্ময়ের সাথে সাথে মুগ্ধতাও এসে ভর করবে চোখে। যেমনটা আজ তার হচ্ছে। নিজের বৈধ স্ত্রী বলেই হয়তো একটুবেশি দেখছিল সে। দেখতে দেখতে আবিষ্কার করল, তখনকার তুলনায় প্রাণেশা এখন যথেষ্ট প্রাণবন্ত। কিছুক্ষণ আগেও যে মেয়ে মনখারাপ ও গাম্ভীর্যের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল, এখন সে শান্ত, চটপটে ও ফুরফুরে মেজাজে আছে। আর এসব ভাবনাই তার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দিল। উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করল, সব মানুষের নির্দিষ্ট একটা ‘কমফোর্ট জোন’ আছে। চলাফেরা, ব্যবহার ও নিজেকে মেলে ধরার আলাদা একটা বৈশিষ্ট্য আছে। যেটুকুকে ব্যবহার করে একটা মানুষ সাচ্ছন্দ্যে জীবন কাটাতে পছন্দ করে। এই বৈশিষ্ট্যের বাইরে ব্যক্তি চলে গেলে যেমন তার মনের পরিবর্তন ঘটে তেমনই মেজাজেও পরিবর্তন চলে আসে। প্রাণেশার ক্ষেত্রেও তেমনটাই ঘটেছে। এখন সে নিজের স্ব-রূপে আছে বলেই তাকে এত স্নিগ্ধ ও শান্ত লাগছে। আর এটুকুই তার সৌন্দর্য, তার ব্যক্তিত্ব। সব ভাবনাদের থামিয়ে সে ছুরি দিয়ে কাচ্চির ওপরে থাকা মাংসের পিস অল্প কেটে, চামচের সাহায্যে সেটা মুখে তুলে মুচকি হেসে বলল,

‘ওকে না খাইয়ে আমাকে খাওয়ালেও তো পারিস। সওয়াব হবে।’

সঙ্গে সঙ্গে হাতে থাকা ছুরিটা হাত দিয়ে ঘুরিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘এটা দেখেছ?’

অনির্বাণ একই মেজাজে বলল,
‘হ্যাঁ দেখেছি।’

‘একদম গলায় বসাব।’

‘ক্ষতি তোরই হবে। নাতি-নাতনী আসার আগেই দাদাভাই অক্কা পাবে।’

‘সেটাই ভালো হবে।’

‘তুই যে বিধবা হয়ে যাবি। তার বেলা?’

‘আমাকে নিয়ে তোমার এত ভাবতে হবে না।’

‘না ভাবলে চলে? একটা মাত্র বউ আমার।’

প্রাণেশা বিরক্ত হলো। সুযোগ পেলেই বউ বউ করছে। কেমনটা লাগে? দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
‘বার বার বউ ডাকবে না। শুনলে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।’

যখন-তখন যেকোনোকিছু নিয়ে এদের মধ্যে তর্ক শুরু হলে সে-ই তর্ক আর থামতে চায় না। ভাই-বোন এটা খুব ভালো জানে। ওদের থামাতে রাফিয়ান বলল,

‘দুলাভাই, খাবার মুখে নিয়ে আর একটা কথা যদি বলেছ…।’

কী বলবে ভেবে পেল না রাফিয়ান। অনির্বাণ বলল,
‘কী করবি রে, শালা?’

‘শালা…।’

রাফিয়ান ভাবল গালি দিয়েছে, শব্দটা উচ্চারণ করেই থেমে গেল। আইশা-মাইশা ও নাহিয়ান মিটমিটিয়ে হাসছে। নিজের পাতা ফাঁদে নিজে পড়ে রাফিয়ান বুঝল, শালা-দুলাভাই চক্করটা খুব একটা সুবিধার নয়। এই শালা শব্দটা বেশিরভাগ সময় আমজনতা গালি হিসেবে ব্যবহার করে। নিশ্চুপে যখন এসবই ভাবছিল, তাকে জব্দ করতে অনির্বাণ আবারও বলল,

‘কী ব্যাপার শালাবাবু, মুখটা বাংলার পাঁচ হয়ে গেল কেন? কাচ্চি ভালো হয়নি? আরেক প্লেট দেই? বাড়িতেও নিয়ে যাব। আগামী এক সপ্তাহ, দিন তিনবেলা দুলাভাই জপে জপে তুই শুধু এই কাচ্চিই খাবি। পারবি না?’

দুলাভাই ডাকটা যেমন-তেমন, শালা ডাক খুবই অস্বস্তিকর। এই ডাক শুনে মেজাজ খারাপ হয়ে যাওয়াতে দ্বিতীয় কোনো কথা বলল না রাফিয়ান। মুখ নামিয়ে চুপচাপ কাচ্চি খাওয়ায় মনোযোগ দিল। আশ্চর্য! শালা ডাক শুনে তার মেজাজ এত খারাপ হচ্ছে কেন?

***

রাত এগারোটায় বাড়ি ফেরার পর প্রাণেশাকে ঘরোয়া পোশাকে দেখে বাড়ির সবাই যারপরনাই হতাশ। কণ্ঠে আফসোস ও দুঃখ। মেয়েটা আর মানুষ হলো না। সবার এত কথার মধ্যে রূপকথার ঠোঁটে স্বস্তির হাসি। অনির্বাণের ইচ্ছে শুনেই শাড়ি পরার জন্য জোর করেছিল সে। কিন্তু সে জানত, দিনশেষে প্রাণেশা যে পোশাকে কমফোর্টেবল সেটা পরেই স্বস্তি খুঁজতে চাইবে। এইজন্য টি’শার্ট ও জেগিংস্’এর উপরেই সেফটিপিন দিয়ে ফিটিং করে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল সে। দলবেঁধে সবাই যখন ঘরে প্রবেশ করে যে যার রুমে চলে গেল, তখন প্রাণেশাও সবাইকে একনজর দেখে ধীরগতিতে ঘুমন্ত রামিশাকে কোলে নিয়ে ছোটো চাচ্চুর ঘরের দিকে পা বাড়াল। ড্রয়িংরুমে বসে চার ভাই গল্প জমিয়েছিলেন। প্রাণেশার বাবা শেখ সামিউল আলম ঘরে ফিরে শুনেছিলেন, মেয়ে শাড়ি পরে বাইরে গিয়েছে, তা-ও আবার অনির্বাণের ইচ্ছেতে। স্বস্তি পেয়েছিলেন। এখন মেয়েকে এই পোশাকে দেখে রাগান্বিত দৃষ্টিতে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে গলা উঁচিয়ে বললেন,

‘তুই কি সবসময় এমনই থাকবি? বাড়ির কারও কথা, কারও ইচ্ছের মূল্য দিবি না? কারও কথার কোনো দাম নেই কেন তোর কাছে? এটা কী ধরনের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন, প্রাণেশা?’

সিঁড়িতে পা রেখে, ওখানেই দাঁড়িয়ে গেল প্রাণেশা। পিছন ফিরে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এটা উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন? সুশৃঙ্খল জীবনযাপন কীভাবে হয় জানো তুমি? পারো তো শুধু দাম্ভিকতা ও গায়ের জোর দেখাতে স্ত্রীর শরীরে আঘাত করতে। যে পুরুষ নিজের স্ত্রীকে সম্মান দিয়ে কথা বলতে জানে না, তার কাছ থেকে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন কীভাবে শিখব?’

সামিউল আলম প্রচণ্ড রেগে গিয়ে সোফা ছেড়ে মেয়ের মুখের সামনে দাঁড়িয়ে, কোমরে হাত রেখে শক্তকণ্ঠে বললেন,
‘বেয়াদব মেয়ে। মুখে-মুখে তর্ক করছিস? ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বন্দী করে রাখব।’
এরপরই বড়ো ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘দেখেছ, ভাইজান? আদর দিয়ে মাথায় তোলার পরিণাম কী?’

প্রাণেশাও দমে গেল না। মুখের ওপর বলল,
‘মিথ্যে বলো না, বাবা। আদর অন্য সবার বেলায় থাকলেও আমার বেলায় অত্যাচার ছিল। যা কিছু আমি পারি না, যা কিছু আমি চাই না, সবটাই তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিয়েছ। তবুও তোমাদের মন রক্ষা করে চলতে গিয়ে আমার নিজের ইচ্ছে-স্বপ্নগুলোকে গলাটিপে মেরে ফেলেছি। তা-ও তুমি খুশি হওনি?’

শাফিউল আলম ভাইয়ের এই রাগ ও মেজাজে ভীষণ বিরক্ত। অতিরিক্ত আদর ও শাসন কখনওই ভালো ফল বয়ে আনে না। আদর-শাসন নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে ছোটোরা বখে যায়। তিনি বাবা-মেয়ের মাঝখানে প্রবেশ করতে চাইছিলেন না। শুধু দূর থেকে বললেন,

‘তোকে অনেকবার বলেছি, সন্তানদের সাথে এমন ব্যবহার করিস না। আদর দিয়ে বুঝালে যে কথা ওরা মেনে নিবে, সেটা তুই চড়-থাপ্পড় মেরে করাতে চাস্। মেয়ে বড়ো হয়েছে, বিয়েও হয়েছে। এখন আর তাকে এইভাবে শাসন করার প্রয়োজন দেখছি না। যদি ওর চলাফেরা নিয়ে কারও কিছু বলার থাকে, সেটা অনি বলবে। আর কেউ না।’

বাবা যে গুটি কেন তার দিকে দিলেন, প্রথমে সেটা না বুঝলেও বাবা-মেয়ের এই তর্কাতর্কি শেষপর্যন্ত তাহমিনা আহমেদের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে, এইটুকু কেউ না বললেও বাবার নিশ্চুপ ও শান্ত-শীতল চাহনি দেখেই বুঝে নিল অনির্বাণ। খাবারের প্যাকেটগুলো টেবিলে রেখে মেজো চাচ্চু সামিউল আমলের সামনে এসে বলল,

‘তুমি ওকে কিছু বলো না, চাচ্চু। ও যদি এভাবে থেকে স্বস্তি পায়, থাকতে দাও। জোর করে তো অনেককিছুই করলে। লাভ তো কিছুই হলো না। উলটে ক্ষতি হলো। ও যেমন আছে, তেমন থাকুক।’

সামিউল আলম মেজাজী কণ্ঠে বললেন,
‘ওর এই আচরণ-চলাফেরা তোর কাছে স্বাভাবিক লাগছে? যেখানে-সেখানে মারামারি করে, শার্ট-প্যান্ট পরে ঘোরাঘুরি করে, বড়োদের মুখে-মুখে তর্ক করে, যেমন খুশি তেমন চলে। এভাবে তো জীবন চলে না, তাই না?’

‘কাউকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করাটা অন্যায়, চাচ্চু। প্রতিটা মানুষ যেমন আলাদা, তাদের পছন্দ-অপছন্দ ও ইচ্ছেগুলো আলাদা। তবুও তুমি ওকে ভালো রেজাল্ট ও প্লাস টেনে আনার চেষ্টায়, প্রতিক্লাসে টপে থাকার জন্য যে টর্চার করেছ, সেসব ওর জন্য বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে। মেধা সবার সমান নয়। সবাই ভালো রেজাল্ট করতে পারে না।’

সামিউল আলম একইভাবে বললেন,
‘তুই আমাকে এসব উল্টাপাল্টা লজিক দেখাবি না। এই মেয়েকে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হতে বল। বাড়ির সবকটাই মানুষ হয়েছে। শুধু ও হলো অমানুষ।’

‘চাচ্চু… এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।’

‘আমাকে মেজাজ দেখাবি না। এখনও সময় আছে, ওকে বোঝা। মেয়ে হয়ে জন্মেছে, মেয়ে হয়েই থাকুক। বাহাদুরি সব জায়গায় খাটে না। যদি অন্য সবার মতো শান্তশিষ্ট জীবনে ফিরে না আসে আমি ওকে এই বাড়ি থেকে বের করে দেব।’

অনির্বাণ মেজাজ ধরে রাখতে না পেরে সমানতালে চেঁচিয়ে বলল,
‘এই বাড়ি তোমার একার নয়, চাচ্চু। এখানে আরও তিনজন পুরুষ আছে। তাদের ভাগ আছে। সন্তানদেরও ভাগ আছে। সেই হিসাবে এই বাড়িটা আমারও। আর আমার বাড়িতে আমার স্ত্রী থাকবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত শুধু আমার, তোমার নয়। দ্বিতীয়বার যদি এই কথা বলেছ, তাহলে বাবাকে বলব – মাঝখানে প্রাচীর তুলে দিয়ে প্রত্যেকের সংসার আলাদা করে দিতে।’

এতক্ষণ ধরে মেয়েকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিল আরিয়ান। তা-ই এতসব কথার ভীড়ে সে আসতে চায়নি। এখন ছোট্ট আরুশি ঘুমানোর পর, চেঁচামেচি সহ্য করতে না পেরে রুমের বাইরে এলো সে। নিচে নামতে নামতে বলল,

‘তুই তোর রুমে যা, অনি। আমি চাচ্চুর সাথে কথা বলছি।’

ঝামেলা শুরু হয় একটা বিষয় নিয়ে, টার্ণ নেয় অন্যদিকে। মাঝেমধ্যেই এমন হয়। সব পরিস্থিতি সুন্দরমতো সামাল দেয় আরিয়ান। সামিউল আলম তার এই বড়ো ভাতিজার কথা একটু বেশিই শোনেন। যেমন বুদ্ধিমান, তেমন শিক্ষা-দীক্ষা। প্রতিক্লাসে রীতিমতো টপার ছিল সে। এই কারণে প্রতিবছর তিনি নিজে, রেজাল্টের পরপর ভাতিজাকে সঙ্গে নিয়ে মার্কেটে গিয়ে তার চাহিদা অনুযায়ী ‘গিফট’ কিনে দিতেন। শুধু আরিয়ান নয়, বাকিদের ক্ষেত্রেও এই নিয়ম ছিল। টপ রেজাল্ট সবার হলেও পিছিয়ে থাকত প্রাণেশা। প্রতিবছর সবাই যখন দারুণ দারুণ গিফট পেত। পছন্দের কম্পিউটার, ভিডিওগেইম, ল্যাপটপ, মোবাইলফোনসহ আরও অনেক দামীদামী উপহার পেত। তখন ঘরের এককোণে শূণ্যহাতে বসে থেকে শুধু চোখের পানি ফেলত প্রাণেশা। এই একটা গিফটের জন্য প্রতিবছর গাদার খাটুনি খেটেছে সে। এই স্কুল থেকে ওই স্কুল, এই টিচার থেকে ওই টিচার, এই বান্ধবী থেকে ওই বান্ধবী, এরকম করতে করতে কাছের-দূরের সবাইকে সে হারিয়ে ফেলেছে। সামিউল আলম সবসময় বেটার অপশন খুঁজে খুঁজে মেয়েকে অধিক মাত্রায় অত্যাচার করেছেন। যখন যে স্কুলে মন বসে যেত, তখুনি তিনি ট্রান্সফার করিয়ে অন্যত্র সরিয়ে নিতেন। শহরের নামী-দামী এমন কোনো স্কুল-কলেজ বাকি নেই, যেখানে টপ রেজাল্টের আশায় ছোটাছুটি করেনি প্রাণেশা। ছুটতে ছুটতে একসময় সে হাল ছেড়ে দিয়ে নিজের ওপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। সে মেনে নিয়েছে, তাকে দিয়ে এই টপ রেজাল্ট হবে না। সবার টপ রেজাল্ট ও গিফট দেখে সে যখন আবদারের সুরে বাবাকে বলত,

‘আমাকেও একটা গিফট দাও না, বাবা।’

সামিউল আলম তখন বলতেন,
‘যেদিন টপ রেজাল্ট করবি, সেদিন তুইও পাবি।’

প্রাণেশা এভাবেই আশায় আশায় দিন কাটাত। টপ রেজাল্টের চেষ্টা করত। কিন্তু যত চেষ্টা ও জোরাজুরি থাকুক না কেন, মেধার যদি সঠিক বিকাশ না থাকে, টপ রেজাল্ট হবে কী করে? সে যে একটা গাধী, অকর্মা, এটা সে বুঝে নিল। মেনেও নিল। মেনে নেয়ার পর গিফট নিয়ে কোনোদিন কোনো চাওয়াকে কারও প্রকাশ করেনি। দাঙ্গাহাঙ্গামা অশান্তি ভালো লাগে না এই বাড়ির কারও। সবাই মিলেমিশে হেসেখেলে দিন কাটিয়ে দিতে চায়। এতসব কথা ও তর্কবিতর্কের ইতি টানতে আরিয়ান নিজে মেজো চাচ্চুর হাত ধরে বাবা ও বাকি দুই চাচ্চুদের পাশে বসিয়ে নিজের মতো করে বুঝাতে লাগল। আর কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি হবে না, এটা নিশ্চিত। কারণ আরিয়ান এসেছে। এখন সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। প্রাণেশা ততক্ষণে বোনকে কোলে নিয়ে সরে পড়েছে।

***

মেজাজ ঠাণ্ডা করতে, ফ্রেশ হয়ে বিছানায় পিঠ ঠেকাতেই লাফ দিয়ে বিছানা ছাড়ল অনির্বাণ। একটা গন্ধ নাকে এসে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে চাদর তুলে দেখল, তার তোষকের মাঝখানে অনেকাংশে ভেজা। সেখান থেকেই গন্ধ আসছে। সে চাদর সরিয়ে ওয়াশরুমে রেখে আবারও হাত-মুখ ধুয়ে দরজার কাছে গিয়ে মাকে ডাকল। তার মা জোহরা খানম ছেলের সামনে এসে বললেন,

‘কী হয়েছে? ডাকছিস কেন?’

অনির্বাণ বলল,
‘আরুশি আমার রুমে এসেছিল?’

জোহরা খানম জিহ্বায় কামড় দিয়ে বললেন,
‘তোকে বলতে ভুলেছিলাম। তোরা যাওয়ার পর ও যখন সারাঘর জুড়ে ছোটাছুটি করছিল, একফাঁকে তোর বিছানায় এসে নাচানাচি করছিল। তখনই বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে।’

মায়ের বলার ধরনে হেসে ফেলল অনির্বাণ। বলল,
‘ওহ, আচ্ছা… তুমি দরজা আটকে দাও। আমি গেস্টরুমে যাচ্ছি।’

‘ইন্না-লিল্লাহ! গেস্টরুমে থাকবি কেন? আজকের জন্য প্রাণেশার রুমে যা। কাল আমি তোষক শুকানোর ব্যবস্থা করব।’

‘আমি গেস্টরুমেই যাচ্ছি, মা। তুমি এককাপ কফি পাঠাও। ভীষণ মাথা ধরেছে।’

প্রাণেশার রুমে থাকা অসম্ভব বলেই মায়ের কথা এড়িয়ে গেল অনির্বাণ। হাঁটতে হাঁটতে গেস্টরুমে গিয়ে, চোখের চশমা খুলে আধশোয়া হয়ে বালিশে পিঠ ঠেকাল। কয়েক মিনিট পর দরজায় নক হলো। চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে দেখল, দরজার কাছে প্রাণেশা দাঁড়িয়ে আছে। স্বেচ্ছায় যে আসেনি, সেটা তার মুখ দেখেই বুঝল। অবাক হয়ে বলল,

‘তুই এখানে?’

প্রাণেশা উত্তর দিল,
‘তোমার বউয়ের রুমটা তো ফাঁকাই আছে। ওই রুম থাকতে গেস্টরুমে কেন ঘুমাবে?’

‘মানে কী?’

‘মানে হচ্ছে, বড়ো চাচীর কড়া আদেশ, শুধু আজকের জন্য তোমাকে যেন আমার রুমে নিয়ে যাই। তাতেই হবে না, তোমার মাথাটাও যেন টিপে দেই। এরকম একটা হুকুম এসেছে।’

‘মায়ের আদেশ ও হুকুম দেখে ডাকতে এসেছিস, নয়তো আসতি না?’

‘এত কথা জানি না। আসবে না কি দরজা আটকে দেব?’

‘তোর যা খুশি তুই তা-ই কর।’

এইবলে বালিশে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে রইল অনির্বাণ। সে যে যাবে না এটা বুঝতে পেরে দরজার মুখ থেকে সরে দঁড়াতেই জোহরা খানমের মুখোমুখি পড়ে গেল প্রাণেশা। তিনি তাকে দেখে কফি ও ঔষধ তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

‘যা মা, ওর একটু খেয়াল রাখ। এখন থেকে ওর দেখাশোনার দায়িত্ব তো তোকেই নিতে হবে। কাল আমার ছেলেটা চলে যাবে। ভালোমন্দ কিছু রান্না করে ওর সাথে দেব তো, রান্নাঘরে আমার আরও অনেক কাজ আছে, মা। তোর যদি কিছু লাগে, আমাকে বলিস। কেমন?’

অনির্বাণের মাইগ্রেনের সমস্যা আছে। মাঝেমধ্যে এই ব্যথা তাকে খুব ভোগায়। অসুস্থতার কথা ভেবেই হাতের কফি ও ঔষধ নিয়ে রুমে এলো প্রাণেশা। সেন্টারটেবিলে সবকিছু রেখে, পর্দা টেনে রুমের দরজা আটকে দিয়ে অনির্বাণের শিয়রে দাঁড়িয়ে বলল,

‘সোজা হয়ে বসো।’

প্রাণেশার গলার আওয়াজ শুনে আবারও চোখ মেলল অনির্বাণ। চোখমুখ কুঁচকে বলল,
‘বিরক্ত করিস না, প্রাণ। যা এখান থেকে।’

‘আমি এখানে তোমার আদর খেতে আসিনি। বড়ো চাচীর আদেশ পালন করতে এসেছি।’

বেহুঁশের তালে কী বলল, সেটা টের পেল কথা শেষ হওয়ার পর। ঠোঁট কামড়ে, উল্টোদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল প্রাণেশা। কীসব কথা বেরিয়ে এলো। ছিঃ… সে এত নির্লজ্জ কবে হলো? তখনও ড্যাবডেবে চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল অনির্বাণ। প্রাণেশার কথা ও লুকোচুরি ভাবসাব দেখে বিছানা কাঁপিয়ে হেসে উঠল। বলল,

‘আপাতত আদর দেয়ার মুডে নেই। যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে, পারলে একটু চুল টেনে দে।’

হুকুম করে, বালিশ ঠিকঠাক করে, চোখ বন্ধ করল অনির্বাণ। প্রাণেশা বলল,
‘পারব না। তুমি কফি খাও, এরপর ঔষধ খাও। ঠিক হয়ে যাবে।’

চট করে চোখ খুলল অনির্বাণ। বলল,
‘কী বললি?’

‘পারব না বলেছি। শুনতে পাওনি?’

‘আবার বল।’

‘পারব না, পারব না, পারব না।’

‘এরপর যা হবে তারজন্য আমাকে দোষ দিবি না।’

কথা শেষ করে একপলক দরজার দিকে তাকাল অনির্বাণ। সেটা বন্ধ দেখে হাতের টানে প্রাণেশাকে একদম নিজের কাছে টেনে নিল। আচমকা টান খেয়ে অনির্বাণের বুকের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ল প্রাণেশা। কী হলো, সেটা বুঝতে সময় লাগল তার। যখনই নিজেকে অনির্বাণের ওপরে আবিষ্কার করল, তখুনি রাগত্বস্বরে বলল,

‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।’

দু’হাতের বাঁধনে তাকে আটকে নিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘সবটাই ঠিক। বেগানা কোনো নারীকে ছুঁইনি আমি। আমার বউকে ছুঁয়েছি।’

‘ধুর… ছাড়ো তো। তোমার বউ হতে বয়েই গেছে আমার।’

‘উঁহু… ছাড়াছাড়ি নাই। মাথা টিপে দিসনি, এখন এই কঠিন মাথাব্যথা সারানোর দায়িত্ব নে। নয়তো…।’

‘আশ্চর্য! আমি কীভাবে মাথাব্যথা সারানোর দায়িত্ব নেব। ছাড়ো প্লিজ…।’

অনির্বাণ ছাড়া তো দূর, প্রাণেশার কথা কানেই নিল না। ফট করে একপাশ দিয়ে সরে গিয়ে, অন্যপাশের বালিশে প্রাণেশাকে শুইয়ে দিল। ঠোঁটের নিচে থাকা কালো তিলটায় বুড়ো আঙুল ছুঁইয়ে বলল,

‘আমার এখন মাথাব্যথা। তুই তার প্যারাসিটামল। বিবাহিত পুরুষদের জীবনে বউ-ই সর্বরোগের ঔষধ। আমি এখন তোকে আদর করে আমার মাথাব্যথা সারাব। বাধা দিস না, প্রাণ।’

‘ছিঃ কী ভয়ংকর কথা।’

‘ভয়ংকর হতে যাবে কেন? রোমান্টিক কথা এটা। আদর-আদর কথা। প্রেম-প্রেম কথা।’

প্রাণেশা নড়েচড়ে শক্ত হাতের বাঁধন থেকে মুক্তি নিতে চাইল। পারল না। পালোয়ানের শক্তির সাথে পারা যায় না কি? সে অসহায় কণ্ঠে বলল,

‘আই থিংক, তুমি হুঁশে নেই। সরো…। আমরা কিন্তু কেউ কাউকে ভালোবাসি না। আর ভালোবাসা ছাড়া এভাবে কাছে আসাটা অনুচিত।’

একইভাবে আলতোস্পর্শে বারংবার কালো তিলে আঙুল ছুঁয়ে গেল অনির্বাণ। বলল,
‘একসাথে থাকতে থাকতে ভালোবাসা ঠিকই হয়ে যাবে, প্রাণ। বউ হয়েছিস তুই আমার। বউকে ঘিরে আমার যত শখ-আহ্লাদ, সব একদিন পূরণ করে ছাড়ব। দেখিস…।’

নিজেকে বাঁচানোর আর কোনো উপায় খুঁজে পেল না প্রাণেশা। তবুও হাতের ঠেলায় অনির্বাণকে দূরে সরানোর চেষ্টায় বলল,

‘আমি কিন্তু ডিভোর্স…।’

বিপদ কাকে বলে, কত প্রকার ও কী কী, এরপরই টের পেল প্রাণেশা। মুখের কথা মুখেই আটকে গেল। অধরোষ্ঠে খুব অচেনা অথচ ভীষণ সুখের একটুকরো স্পর্শ এসে ছুঁয়ে গেল। না চাইতেও সেই সুখকর মুহূর্তটাকে নারী জীবনের স্বার্থকতা হিসেবে গ্রহণ করে নিল সে। কখন যে দু’হাতে অনির্বাণের পিঠ খামচে ধরল, টেরই পেল না। দীর্ঘ সময়ের প্রণয় চুম্বন শেষে, অনির্বাণ তার ঠোঁটের তিলে আলগোছে ঠোঁট ছুঁইয়ে, নাকে নাক ঘষে বলল,

‘তুই যে আধা ব্যাটাছেলে নোস্ এইটুকু নিশ্চয়তা দেয়ার জন্য থ্যাংকস্। এটা শুধু প্রথম স্পর্শ ছিল না, আমার পক্ষ থেকে প্রথম কোনো স্পেশাল গিফটও ছিল। একে যত্নে রাখিস।’

প্রাণেশা কোনো কথা বলতে পারল না। অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছে। বুঝাতে পারছে না আবার এড়াতেও পারছে না। তার নীরবতা দেখে অনির্বাণ বলল,

‘এইটুকু স্পর্শ দিয়ে অন্তত এতটুকু তো বুঝাতে পেরেছি যে, যেকোনো সম্পর্ককে এত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে নেই? প্রত্যেকটা সম্পর্ক তার নিজ নিজ জায়গায় এমনিভাবেই সুন্দর। এজন্য প্রত্যেকটা সম্পর্ককে শ্রদ্ধা, সম্মান ও পর্যাপ্ত ভালোবাসা দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করতে হয়। গোড়াতেই ভেঙে ফেলার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিতে হয় না, প্রাণ।’

এইটুকু বলে প্রাণেশাকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে ঔষধগুলো চেক করে নিল অনির্বাণ। প্রাণেশা বিছানা ছেড়ে নেমে রেগেমেগে অস্থির হয়ে পিছনে দাঁড়িয়ে গতকালকের মতো আজও অনির্বাণের চুলগুলো মুঠোবন্দী করে জোরেশোরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

‘তুমি একটা অসভ্য, অভদ্র, সুযোগসন্ধানী। এইভাবে কেউ কারও সাথে শয়তানি করে?’

আবারও হাতের তালুতে ছোটো ছোটো চুল নিয়ে, দরজা খুলে দৌড় দিল প্রাণেশা। ঔষধ মুখে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে অনির্বাণ বিড়বিড়াল,
‘নিশ্চিত থাক… যতবার ডিভোর্স শব্দটা উচ্চারণ করবি, ততবারই এইরকম শাস্তি দেব। সম্পর্কে ভাঙন টেনে আনা কি এতই সহজ? আমি বেঁচে থাকতে সে-ই সুযোগ তোকে দেব? মাথামোটা কোথাকার।’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৫

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৫

‘এ্যাই লম্বু, যা তো, গিয়ে দেখ ওরা সবাই তৈরী হলো কি না।’

পুরুষ মানুষ বলে সব ভাইদের তৈরী হতে বেশি সময় লাগল না। আধঘণ্টায়ই সবাই তৈরী হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়েছে কিন্তু যাকে নিয়ে এই ট্রিট তারই খবর নেই। এতক্ষণ ধরে কী এমন সাজগোজ করছে যে, সবাইকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। কোনো আয়োজিত অনুষ্ঠান কিংবা জন্মদিন পার্টিতে কখনও ভারী সাজপোশাকে সাজতে দেখা যায়নি প্রাণেশাকে। যেখানে বাড়ির অন্য বোনেরা মেকাপ ও জামাকাপড় সিলেক্ট করা নিয়ে হৈচৈ শুরু করে, সেখানে প্রাণেশা থাকে নির্বিকার। কোনোকিছু ধরাছোঁয়াতে যেমন থাকে না, তেমনই সাজগোজের ব্যাপারেও খুব একটা মাথা ঘামায় না। একদম শেষমুহূর্তে বাড়িতে যা পরে তা-ই পরে হাজির হয়ে যায়। এই নিয়ে তাহমিনা আহমেদের দুঃখের শেষ নেই। মেয়ের জন্য প্রতি ঈদে তিনি শাড়ি-থ্রিপিস, জুয়েলারি কিনেন অথচ প্রাণেশা সেসব পরে না। হাতে নিয়ে পছন্দ-অপছন্দ কিছুই জানায় না। নতুন কাপড় পেলে মুচকি হেসে সেগুলো তুলে রাখে আলমারিতে। যে-ই মেয়ের সাজগোজ নিয়ে কোনো আগ্রহ নেই, আজ তার এত দেরী দেখে অধৈর্য্য হয়ে পড়েছে অনির্বাণ। এজন্যই রেদোয়ানকে হুকুম করেছে, একবার গিয়ে দেখে আসতে বোনেরা ও তার বউয়ের তৈরী হওয়া আর কতদূর। ভাইয়ের আদেশ শুনে রেদোয়ান সবেমাত্র পা ফেলেছিল উপরে গিয়ে চেক করবে, তখুনি নিজের রুমের দরজা খুলে সব বোনদের বের করে দিয়ে, প্রাণেশার হাত ধরে তাকে খুব সাবধানে রুমের বাইরে এনে দাঁড় করালো রূপকথা। রেদোয়ান সঙ্গে সঙ্গে বলল,

‘ওইতো, ভাবী চলে এসেছে।’

প্রাণেশা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। হিলটা খুব বিরক্ত করছে তাকে। আঙুলে ব্যথা পাচ্ছে। শাড়ি পরার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু রূপকথার আদুরে কথায় না পরে উপায়ও ছিল না। এই মানুষটার কথা অগ্রাহ্য করার সাহস প্রাণেশার নেই বলেই অনুরোধ করা মাত্রই ঘাড় নেড়ে শাড়ি পরতে গিয়েছে। সব কাজে রূপকথাই তাকে সাহায্য করেছে। সাজগোজ কমপ্লিট করে এখন বাইরে এসে আবারও শেষ একবার প্রাণেশার সম্পূর্ণ সাজটা দেখছিল রূপকথা। দেখা শেষ হলে ভ্রু নাঁচিয়ে বলল,

‘খুব তো বলতি, শাড়ি পরলে তোকে দেখতে খারাপ লাগবে। কই, এখন তো মোটেও খারাপ লাগছে। একদম বউ বউ লাগছে। মনে হচ্ছে জলজ্যান্ত একটা পরী নেমে এসেছে এই আনন্দপুরীতে।’

লজ্জায় মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো প্রাণেশার। এইভাবে পঁচানোর মানে কী! সে অনভ্যস্ত হাতে শাড়ির এদিক-ওদিক টানছিল। গতকালকে শাড়ি পরে কী যে অস্বস্তি হচ্ছিল তার। ভারী শাড়ি গায়ে জড়িয়ে ঘণ্টার পর বসে থাকা কি চাট্টিখানি কথা! যে পরে সে-ই জানে, গরম কতপ্রকার! এখনও ঠিক সেরকমই অনুভূতি হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে, শরীরের এখানে-ওখানে সবখানে চুলকাচ্ছে। এটা ছিঁড়ে ফেলে যদি দৌড় দিতে পারত, তাহলেই বোধহয় একটু স্বস্তি পেত। কিন্তু তা তো আর হওয়ার নয়। রূপকথার আদুরে কথার ফাঁকে কড়া আদেশ ও অভিমান মিশানো একটা কথাও ছিল,

‘শাড়ি না পরলে তুই আমার সাথে আর কথা বলবি না।’

দুনিয়ার সবার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলেও কষ্ট হবে না প্রাণেশার। কষ্ট হবে, এই বিশ্বস্ত মানুষটা যদি তারওপর রাগ ও অভিমান পুষে রেখে দিন কাটায়। তাই তার আদেশ হোক কি অনুরোধ, কথা রাখতেই, খুবই সাদামাটা ডিজাইনের এই মেরুন রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়েছে। মুখেও দিয়েছে দামী দামী প্রসাধনী। যদিও হালকা মেকাপ তবুও এই শাড়ি ও মেকাপ তার প্রচণ্ড অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল। এরমধ্যে আবার সবার অবাককরা দৃষ্টি দেখে কোনদিক দিয়ে পালানো যায় সে-ই পথ খুঁজছিল। দুর্ভাগ্য, সেটাও আজ পেল না। কোনোদিকে ফাঁক নেই, যেদিক দিয়ে সে আরামসে পালাতে পারবে। তার এতসব লজ্জা ও অস্বস্তিকে পাত্তা দিল না রূপকথা। মিটমিটে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে হাত ধরে আস্তেধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে সাহায্য করল। প্রাণেশা শুধু পারল না হাত ছাড়িয়ে দৌড় দিতে। সবার সামনে দাঁড়ানোতে লজ্জা আরও ঝেঁকে ধরল প্রাণেশাকে। সে চোখ তুলে উপরের দিকে তাকাতেই পারল না। তবে না তাকিয়েই বুঝল, কেউ একজন দু’চোখের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিচ্ছে তাকে দেখে। আশ্চর্য! এমনটা কেন! ভেবে পেল না প্রাণেশা। ঠোঁট কামড়ে নতমুখেই দাঁড়িয়ে রইল সে। রূপকথা বলল,

‘চাচিম্মা, সাজটা কি ঠিক আছে? আর কিছু লাগবে?’

তাহমিনা আহমেদ মেয়ের সামনে এসে দু’চোখ ভরে মেয়েকে দেখে, স্নেহের পরশে সম্পূর্ণ মুখ ছুঁইয়ে, কপালে আদর দিয়ে বললেন,
‘এখন মনে হচ্ছে আমার মেয়েটা একদম স্বয়ংসম্পূর্ণা। কোনো ত্রুটি নেই। আমরা তো তোকে সবসময় এইভাবেই দেখতে চাই, প্রাণ।’

এইটুকু আদরে দু’চোখ ভাসিয়ে কাঁদার কথা ছিল প্রাণেশার। কিন্তু সে কাঁদল না। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের পানি কন্ট্রোল করে, নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে রইল। মা-চাচীরা আজ খুব প্রশংসা করছেন প্রাণেশার। রূপের, সাজের, সাজপোশাকের, সবকিছুর। শোনেও সেইসব প্রশংসায় আজ আর মনের কোণে আবেগ জমা হলো না। সবকিছুই নিছক সময় ও পরিস্থিতির পরিবর্তন ভেবে মেনে নিল। সবাই যখন প্রাণেশাকে এই রূপে ও সাজে দেখে অবিরত প্রশংসা করছিলেন, বিরক্ত হয়ে রাফিয়ান বলে উঠল,

‘সোনাপুকে তো চব্বিশ ঘণ্টাই দেখো। আগে যা ছিল এখনও তা-ই আছে। খামোখা আটকে রেখে দেরী করাচ্ছ। মনে হচ্ছে, রাত আজ এখানেই শেষ হবে।’

রাফিয়ানের গলার আওয়াজে অনির্বাণ নিজেও সহজ হলো। কতক্ষণ পর তার ঘোর কাটল, সেটা সে নিজেও বুঝল না। শুধু অনুভব করল, তার সামনে থাকা দৃশ্য ও নারীটি যেন কোনো রূপকথার রাজ্যের রাজকন্যা। শাড়ি-গয়না, মেকাপ, খোঁপায় আবার নিজেদের বাগানের অলকানন্দা ফুল, সবমিলিয়ে প্রাণেশার সৌন্দর্য যেন দ্বিগুণ হয়ে মনের পর্দায় ধরা দিল। অথচ এর আগে কোনোদিন এই মেয়েকে সে এভাবে দেখেনি, এত মুগ্ধ হয়নি, এত শান্তি পায়নি। সবটাই কি তবে বৈধ সম্পর্কের ভারী ও দামী সিলমোহরের কারণে? ভেবে কোনো কূল পেল না অনির্বাণ। মুগ্ধতা কাটিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে সময় লাগল তার। চশমা পরেও সে যেন ভুল ও অবিশ্বাস্য কিছু দেখে নিল আজকে। আর এই দেখাটাই তার মনকে টালমাটাল করে দিল। মেয়েলী পোশাক-আশাকের যে একটা অদ্ভুত সৌন্দর্য ও গুণ আছে, সেটা মন স্বীকার করতে বাধ্য হলো। না চাইতেও দৃষ্টি সরিয়ে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘দেরী হচ্ছে। তোরা গিয়ে গাড়িতে বোস্। আমি মনে হয় রুমে চাবিটা ফেলে এসেছি। এক্ষুণি ওটা নিয়ে আসছি।’

অনির্বাণের পালিয়ে যাওয়া আর কেউ বুঝতে না পারলেও নাহিয়ান ঠিকই বুঝে নিল। গা দুলানো হাসিতে মুখ ভরে উঠল তার। চেপে রাখতে চেয়েও পারল না। হাসতে শুরু করল। হাসতে হাসতে বলল,

‘বউয়ের এই রূপ দেখে মেজো ভাইয়া পালিয়েছে। এখন শুধু অজ্ঞান হওয়া বাকি।’

আশ্চর্যান্বিত মনোভাব নিয়ে সিঁড়ির দিকে তাকাল প্রাণেশা। তাকে কি দেখতে এতটাই খারাপ লাগছে যে, এইভাবে সরে যেতে হলো! কেউ তার রূপের, গুণের ও মেধার প্রশংসা না করলেও যেমন কষ্ট হয় না, করলেও সেসব নিয়ে খুব একটা আনন্দ-ফুর্তিও হয় না। তবে আজকের এই দৃশ্যটা খুবই চোখে লাগল। ঠোঁট কামড়ে বলল,

‘ভাবী, আমার মনে হয় শাড়িটা চেঞ্জ করে আসা উচিত। কেউ আমাকে দেখে বিব্রত বা বিরক্ত হোক, আমি সেটা চাই না।’

আসলেই গাড়ির চাবি ফেলে এসেছিল অনির্বাণ। ওটা হাতে নিয়ে নিচে নামতে গিয়েই প্রাণেশার কথাগুলো কানে বাজল। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,

‘এই নিয়ে আর একটা কথা বলবি তো, এমন চড় দেব, আক্কেলদাঁতসহ সবগুলো দাঁত খসে পড়ে যাবে। যা পরেছিস সেটাই যথেষ্ট। এখন চুপ করে গাড়িতে এসে বোস।’

***

অনির্বাণ ড্রাইভ করছে। পাশে বসেছে নাহিয়ান। পিছনে বাকি সবকটা বসেবসে বকবক করছে। সবার মধ্যে নীরব শুধু প্রাণেশাই। না কোনো কথা শুনছে, না কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে। মন খারাপ না কি মন ভালো সেটাও বুঝার উপায় নেই। লুকিং গ্লাসে বেশ কয়েকবার প্রাণেশার মুখখানি দেখল অনির্বাণ। তখনও জানালার কাঁচ খুলে বাইরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে প্রাণেশা। বৈরী হাওয়ায় উড়ছে তার সামনের ছোটো ছোটো চুল। খোঁপা করা থাকলেও ছোটো ছোটো চুলকে বেঁধে রাখা যায়নি। ওগুলো সামনের দিকেই ছিল। কপাল ও গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে। আকাশ ফেটে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও নেমেছে। হাত বাড়িয়ে সেই বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখছে প্রাণেশা। বৃষ্টির স্পর্শ শুধু শরীর নয়, মনজুড়েও শীতলস্পর্শ ছুঁইয়ে মনের সব অবসাদ দূর করে দিল। আচমকাই অনির্বাণ ধমকে উঠে বলল,

‘হাত বাইরে বের করছিস কেন, প্রাণ?’

সঙ্গে সঙ্গে ডানহাতটা ভেতরে নিয়ে কাঁচ তুলে দিল প্রাণেশা। ভয়ে নয়, অন্যমনস্কতার কারণে। খুব করে খেয়াল করছে, বিয়ের রাত থেকে অনির্বাণ তাকে ভাই-বোনের সামনে অথবা একা পেলেই প্রাণ ডাকছে, নয়তো আগে প্রাণেশা ডাকত। প্রথম যখন এই কথা শুনে হৃদপিণ্ড ধড়ফড়িয়ে উঠেছিল, এখনও তাই হলো। আজ কেন যেন তার কোনো তর্কে যেতে ইচ্ছে করছে না, তা-ই শান্ত হয়ে সিটে হেলান দিয়ে চুপ করে রইল। অন্য সময় হলে এই ধমকের তোয়াক্কা করত না সে, ঠিকই এর পালটা জবাব দিত। অনির্বাণ নিজেও যেন প্রাণেশাকে এত শান্তশিষ্ট মেজাজে মেনে নিতে পারল না। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলল,

‘শরীর খারাপ?’

ঝটপট দু’দিকে মাথা নাড়ল প্রাণেশা। অনির্বাণ আরও কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। শহরের নামী-দামী রেস্টুরেন্টে এসে পৌঁছেছে ওরা। পার্কিং প্লেসে গাড়ি থামিয়ে, ডোর খুলে একে একে সবাইকে নামালো। সব কাজিনেরা এলেও আসেনি রূপকথা, আরিয়ান ও তাদের ছোট্ট রাজকন্যা। বড়ো ভাই এখনও অফিসে। আর ভাবী, তাকে ছাড়া বাড়ির বাইরে পা-ও ফেলবে না। অগত্যা তিনটে মানুষকে ফেলে বাকিদের নিয়েই আসতে হলো। গাড়ি থামার সাথে সাথে ওরা সবাই ছুটে বের হলো। নাহিয়ান সবাইকে ধরে ধরে রেস্টুরেন্টের ভেতরে গেল। সবাই নেমে চলে গেলেও নামতে গিয়ে বিপদে পড়ল প্রাণেশা। হিলের সাথে শাড়িটা আটকে গেল। সেটা খুলতে গেলে দামী শাড়িটাও সামান্য ছিঁড়ে গেল। অনির্বাণ বলল,

‘একটা শাড়ি কী করে সামলাতে হয়, তা-ও জানিস না?’

প্রাণেশা রাগত্বস্বরে বলল,
‘না জানি না। কেন? কোনো সমস্যা? সবাইকে সবকিছু জানতে হবে কেন?’

‘রাগ করছিস কেন? আমি এতকিছু মিন করে বলিনি। এমনিই বলেছি।’

একপা বাইরে দিয়ে শাড়ির প্রতিটা ভাঁজ ঠিক আছে কি না সেটা দেখে নিয়ে নামতে যেতেই হাত বাড়িয়ে দিল অনির্বাণ। তার কেন যেন মনে হলো, এই মেয়ে পা ফেলতে গেলেই পড়ে যাবে। হলোও তাই। রাগ দেখিয়ে অনির্বাণের হাত ধরেনি প্রাণেশা। তাতেই নিচে পা দেয়া মাত্রই পায়ে মোচড় খেল। বিরক্তিতে পায়ের জুতো খুলে ডাস্টবিনে ফেলে এলো। হিল ফেলে দিয়ে শান্তি পেল সে। গাড়িতে থাকা নিজের ব্যাগপ্যাক টেনে এনে ভেতরে থাকা লেডিস্ স্যু বের করে সেটা পায়ে দিল। শাড়ির সাথে স্যু! ঠিকঠাক মানালো কি না কে জানে! সেই হিসেব মিলাতে গেল না অনির্বাণ। বিস্মিত দৃষ্টি নিয়ে বলল,

‘জুতা ফেলে দিলি কেন?’

প্রাণেশা সহাস্যে বলল,
‘যা আমার জন্য নয়, আমি তা পরি না।’

‘ওহ…। আচ্ছা, চল। এভাবেই ঠিক আছে। হিল পরার দরকার নেই। বাই দ্য ওয়ে… তোকে শাড়িতে অনেক প্রিটি লাগছে।’

খোঁচা দিল না কি প্রশংসা করল, সেসব ভেবে দেখল না প্রাণেশা। চোখ পাকিয়ে বলল,
‘তা-ই?’

‘ইয়াপ।’

মুচকি হেসে এই শব্দটা উচ্চারণ করে নিজের চুলে ব্যাকব্রাশ করতে করতে রেস্টুরেন্টের সিঁড়ির দিকে হাঁটতে লাগল অনির্বাণ। পাশে তাকিয়ে দেখল, প্রাণেশা আশেপাশে নেই। চমক তো বটেই, সেইসাথে ভয়ও পেল। পিছন ফিরতেই আরও বেশি চমক খেল। প্রাণেশা গাড়ির ভেতরে। দৌড়ে এসে জানালায় ঠোকা দিয়ে বলল,

‘আবার গাড়িতে কেন? কিছু নিতে ভুলে গিয়েছিস?’

গাড়ির কাঁচ খুলে দাঁত কেলিয়ে হাসলো প্রাণেশা। শাড়ি দেখিয়ে বলল,
‘এটা চেঞ্জ করতে এসেছি।’

অনির্বাণ আঁৎকে উঠল। মুখটা তার হা হয়ে গেল। বলল,
‘তুই গাড়ির ভেতরে কাপড় চেঞ্জ করবি?’

‘হ্যাঁ, তো?’

‘ছিঃ… কমনসেন্স বলে যে কিছু একটা আছে, সেটাও তোর মধ্যে নেই।’

প্রাণেশা এত কথা কানে নিল না। শাড়িটা তাকে জ্বালিয়ে মারছে। এরমধ্যে হিলে তার পায়ের আঙুল ছিঁলে গেছে। এত সাজগোছ ও পরিপাটি তাকে থাকতে হবে না। সে যেমন চলে অভ্যস্ত, যেভাবে শান্তি ও স্বস্তি, সেভাবেই নিজেকে আবিষ্কার করতে গিয়ে, ফটাফট শাড়ি-ব্লাউজ খুলতে যাচ্ছিল এরমধ্যেই অনির্বাণ পড়িমরি করে চেঁচিয়ে উঠে বলল,

‘এ্যাই, এ্যাই, সাবধানে। জ্যান্ত একটা পুরুষ মানুষ তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আর তুই…। একটু তো লাজলজ্জা নিজের মধ্যে রাখ। এত নির্লজ্জ হলে চলে?’

প্রাণেশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই পরনের কাপড়চোপড় খুলে, ভেতরে থাকা নীলাভ সবুজ রঙের লম্বা সাইজের ফুলহাতা লেডিস্ টি’শার্ট ও নেভি ব্লু রঙের জেগিংস্ দেখিয়ে বলল,

‘আমার না একদমই লজ্জাশরম নেই। ওসব কেমন করে আসে, কীভাবে আসে, কতটা আসে, সেটাও আমি জানি না। আমি শুধু নির্ভেজাল জামা-কাপড় পরতে পছন্দ করি।’

বলতে বলতে খোঁপায় গুঁজে রাখা ফুল ও গয়নাগাটি সব খুলে ফেলল প্রাণেশা। ব্যাগে থাকা ভেজা টিস্যু ও পানির বোতল বের করে গাড়িতে বসেই মুখের সব প্রসাধনী তুলে নিয়ে, ডোর খুলে বাইরে এসে অনির্বাণের সামনে দাঁড়িয়ে বুকের কাছে দু’হাত আড়াআড়িভাবে বেঁধে গাড়িতে হেলান দিয়ে বলল,

‘এখন প্রিটি লাগছে?’

মঙ্গলগ্রহে থাকা অ্যালিয়েন নামক প্রাণী দেখলেও এতটা অবাক অনির্বাণ হতো না, যতটা অবাক হলো প্রাণেশার এইসব উদ্ভট কাজকর্ম দেখে। সে বিশ্বাসই করতে পারল না, এই মেয়ে শাড়ির নিচে টি’শার্ট ও জেগিংস্ পরে এতক্ষণ গাড়িতে বসেছিল কীভাবে! গরম লাগেনি? চোখদুটো তার গোলগোল হয়ে রইল। কোনোমতে উচ্চারণ করল,

‘মানে কী এসবের? শাড়ির নিচে এসব কেন? শাড়ি যদি ভালোই লাগে না, তাহলে ওটা গায়ে জড়িয়েছিলি কেন?’

প্রাণেশা সবকটা দাঁত করে হেসে হেসে বলল,
‘ভাবীর কথা রাখতে।’

অনির্বাণ অভিমানী কণ্ঠে বলল,
‘শুধু ভাবীর কথাই? আর কারও না?’

‘আর কার কথা রাখব? আর কে আছে, যে আমাকে বুঝে? আমার জন্য ভাবে? আমার নিঃসঙ্গ ও কষ্টকর মুহূর্তে আমাকে সময় দেয়? সাপোর্ট দেয়? আছে এমন কেউ? নেই। কেউ নেই।’

অনির্বাণকে ভাবনারত অবস্থায় রেখে প্রাণেশা রেস্টুরেন্টের ভেতরে পা রেখেই ভয়ানক পর্যায়ের রেগে গেল। এত রাগ যে, তার দুটো হাত মুঠোবন্দী হয়ে গেল। মুঠোবন্দী হাত নিয়ে প্রায় ছুটে গিয়ে অচেনা ছেলেটার মুখের একপাশে ধুম করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিল। সাথে সাথে ছেলেটা ছিঁটকে পড়ল দূরে। ভীতিগ্রস্ত মন নিয়ে লাফ দিয়ে চেয়ার ছাড়ল আইশা। মুহূর্তেই জড়িয়ে ধরল মাইশাকে। দু’জনে জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে রইল। আর প্রাণেশা, সামনে পড়ে থাকা ইতরটাকে সাইজ করতে কলার ধরে টেনে তুলে বলল,

‘বোলতার বাসায় ঢিঁল ছুঁড়েছিস। কামড় তো তোকে খেতে হবে চান্দু। একবার কামড় খেলে বুঝবি, মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া হাতে ঠিক কতক্ষণ বোলতার বিষ থাকে।’

সবাইকে নিরাপদ জায়গায় বসিয়ে ওয়াশরুমে গিয়েছিল নাহিয়ান। পিচ্চিদুটো দুষ্টুমি করছিল। সেই দুষ্টুমি সামাল দিচ্ছিল রাফিয়ান। আর রেদোয়ান গিয়েছিল কয়েকটা পোজ নিতে যেন ফেসবুকে ছবি আপলোড দিতে পারে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে সবার পছন্দের খাবার অর্ডার দিয়ে ভাই-বোনের সামনে আসতে আসতে কেলেঙ্কারি কাণ্ড ঘটে গেছে এখানে। দৃশ্য দেখে দ্রুতই ছুটে এলো নাহিয়ান। বলল,

‘কী করছিস, প্রাণেশা? এটা পাবলিক প্লেস! এখানে কেউ মারামারি করে? ঘটনা কী ঘটেছে সেটা আগে বল।’

মেয়ে দুটোকে দেখে ইতর শ্রেণীর ভদ্রবেশী অমানুষটা সুযোগ নিচ্ছিল সবে। কেবলই আইশার পিছনে স্মুথলি নিজের লালসার হাতটা ছুঁয়েছিল মাত্র। সেটাই নজরে পড়ে গিয়েছিল প্রাণেশার। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হলো। রেগে গিয়ে স্থান, কাল, পরিস্থিতি সব ভুলে গিয়ে ছেলেটাকে কয়েকটা দিয়ে ঠাণ্ডা হলো। হুলুস্থুল দেখে মানুষ জড়ো হলো মুহূর্তেই। অনির্বাণও দৌড়ের ওপর ভেতরে প্রবেশ করল। নাহিয়ানের প্রশ্নের উত্তরে প্রাণেশা বলল,

‘ও আইশার গায়ে হাত দিয়েছে। এক্ষুণি পুলিশকে ইনফর্ম কর। ইতরটাকে জেলে ভরে দে।’

ঘটনার সত্যতা যাচাই করতে চাইলে, যারা দৃশ্যটা দেখেছে তারা সাক্ষী দিল। যা সত্যি তা-ই বলল। অনির্বাণ সব কথা রিসেপশনে জানালে কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা নিল। প্রাণেশার এই ধরনের কাজগুলোই তার বাবা-মায়ের পছন্দ নয়। অন্য মেয়ে হলে এই দৃশ্য হজম করে সম্মান বাঁচাতে মুখ লুকিয়ে এখান থেকে চলে যেত। কিন্তু প্রাণেশা বলেই দৃশ্যটা উলটো হয়। এই দৃশ্যগুলো দেখলে নিজে যে মেয়ে ও পুরুষের তুলনায় যথেষ্ট দুর্বল এইটুকু ভুলে গিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠে। আশ্চর্যজনকভাবে অনির্বাণ আজ আবিষ্কার করল, দশজনের মধ্যে একজন যদি এরকম নাহয়, সময়মতো অন্যায়ের প্রতিবাদ হবে না। এখানে তো কত পুরুষ ছিল, তাদের ভাইয়েরাও ছিল, কেউ দেখেনি দৃশ্যটা। দেখলেও প্রতিবাদ করেনি। অথচ তার বউ সবকিছু দেখে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে প্রতিবাদও করল। পুরো ভাবনাটা যতখানি আনন্দ দিল, তারচেয়ে বেশি স্বস্তি, শান্তি ও সুখ দিল। কতক্ষণ মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকে ধীর অথচ স্পষ্টস্বরে বলল,

‘যে কাজ আমার করার কথা, সেটা তুই করলি! তা-ও আবার এতগুলো মানুষের সামনে! এরজন্য অবশ্যই আমার পক্ষ থেকে তোর একটা স্পেশাল গিফট পাওনা রইল। যাওয়ার আগে দিয়ে যাব। হবে না?’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৪

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৪

সন্ধ্যে হওয়ার পরপরই বাড়ির ছোটোরা অনিবার্ণকে নাজেহাল করে দিচ্ছে বিয়ের পরবর্তী ট্রিট চেয়ে। অনির্বাণ কোনো একসময় বলেছিল, বিয়ে যদি করে – তাহলে তার বিয়ের দিনই ভাই-বোনদের সবাইকে নিয়ে জম্পেশ খানাদানা হবে। কথাটা অনির্বাণ ভুলে গেলেও বাড়ির ছোটোরা ভুলেনি। অবশ্য সবার মনেও ছিল না। মনে করিয়ে দিয়েছে প্রাণেশার একমাত্র ছোটো ভাই রাফিয়ান। বিশেষ করে রামিশা ও রাদিনের কানে ট্রিটের ভূত চাপিয়ে দিয়ে সে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে হাঁটছে। আর ওই দুটো ট্রিট কী, সেটা না বুঝলেও ট্রিটের নাম নিতে নিতে অনির্বাণের পেশীবহুল দুই বাহুতে ঝুলে আছে। বসা থেকে দাঁড়াতে গেলেই দুটো দু’দিকে লটকে গিয়ে বার বার বলছে,

‘দাও না, দাও না, ট্রিট দাও না, দুলাভাই।’

শুনতে শুনতে কানে পোকা ঢুকে গেল অনির্বাণের। কাল সকালে চলে যাবে আর রাতেই কি না এদের জ্বালাতন। জীবনটা তার শেষ। জীবনের সব শান্তিও শেষ। এই একগাদা ছেলেমেয়ে কি না এখন তার শালা-শালী। দুঃখে কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছিল তার। ওদেরকে শাসাতে বলল,

‘এ্যাই, কীসের ট্রিটরে? ট্রিটের কী বুঝিস তোরা? পড়াশোনা নাই তোদের? দিনরাত খালি খাওয়া-দাওয়া।’

রাদিন বলল,
‘ট্রিট না দিলে ছাড়ব না তোমায়। ট্রিট তুমি দিবেই।’

‘ঘোড়ার ডিম দেব। হাত ছাড় আমার। আমি কি দোলনা, তোরা এভাবে ঝুলে আছিস? ছাড়রে ভাই।’

‘ভাই না তো। শালা বলো। তুমি আমার দুলাভাই তো।’

মাটিতে মাথা ঠুকে কাঁদলেও মনে হয় এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে না অনির্বাণ। ছোটোবেলা থেকে যারা তাকে মেজো ভাইয়া বলে ডাকত, এখন এসে ওদের মুখ থেকে দুলাভাই ডাক শুনলেই গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। এই দুলাভাই, দুলাভাই ডাকটা তার পছন্দ নয় বলেই সে প্রায় ধমকে উঠে বলল,

‘খবরদার আমাকে দুলাভাই ডাকবি না। আমি তোদের দুলাভাই নই। আমাকে মেজো ভাইয়া ডাক।’

‘না… তোমাকে আমরা দুলাভাই ডাকব। এ্যাই, রামিশা ডাক দুলাভাই।’

শুরু হলো রামিশার ডাক। ও দুলাভাই, ও দুলাভাই এইভাবে একই ডাককে সে একশোবার রিপিট করছে। কোন ভূত চেপেছিল ঘাড়ে যে, প্রাণেশাকে বিয়ে করে এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ে গেল। সে কেন দুলাভাই হবে? তাও আপন কাজিনদের! অসহায় কণ্ঠে অনির্বাণ বলল,

‘আচ্ছা, হাত ছাড়। তোদেরকে ট্রিট দেব। তোরা গিয়ে তোদের ভাবীকে রাজি করা। গিয়ে বল যে, মেজো ভাইয়া বলেছে আধঘণ্টার মধ্যে তৈরী হতে। রাতে বাইরে ডিনার করতে যাবে। বলবি তো?’

রামিশা ভাবুক নয়নে তাকিয়ে রইলো। কাকে ভাবী ডাকবে? বুঝল না বিধায় কিছু বলতেও পারল না। রাদিন বলল,
‘ভাবী কে?’

‘কে আবার? তোদের আদরের বোন, প্রাণেশা। যদি আজ ট্রিট চাস, তাহলে এক্ষুণি প্রাণেশাকে ভাবী ডেকে আয়।’

রাদিন গালমুখ ফুলিয়ে বলল,
‘সোনাপুকে ভাবী কীভাবে ডাকব?’

‘ভাইকে দুলাভাই যেভাবে ডাকিস, আপুকে ভাবী সেভাবেই ডাকবি। যা ফুট…। ভাবী না ডেকে আমার কাছে আসবি তো, দুটোকে কান ধরে এখানেই ওঠবস করাবো। কথা ক্লিয়ার?’

এরপর দুটোকে কানপড়া দিল অনির্বাণ। রামিশা ও রাদিন বিড়বিড় করতে করতে প্রাণেশার রুমের দরজার কাছে গেল। বাইরে থেকে দরজা আটকানো দেখে রাদিন ডাক দিল,

‘ভাবী দরজা খুলো। ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।’

সেইযে লজ্জায় দরজা আটকেছিল, আর খুলেনি। ঘর থেকে বেরও হয়নি। রুমের ভেতর বসেবসে নিজের পছন্দের কাজটা করছিল প্রাণেশা। আচমকা ভাবী ডাক শোনে, অস্ফুটস্বরে সেই ডাক বিড়বিড়াল একবার। কানে নিল না। আবারও রাদিনের কণ্ঠে ‘ভাবী’ ডাক ভেসে আসাতে হাতের কাজ ফেলে দরজা খুলতেই দেখল, পিচ্চিদুটো দরজার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মুখোমুখি হয়ে বলল,

‘কে ভাবী?’

রাদিন স্পষ্টকণ্ঠে উচ্চারণ করল,
‘তুমি-ই তো ভাবী।’

‘আমি তোর ভাবী হলাম কবে?’

‘এখন থেকে।’

‘কে শিখিয়েছে তোকে এই কথা?’

কিছুটা ধমকে ওঠেই প্রশ্ন করল প্রাণেশা। রাদিন ও রামিশা দুটোই ভয় পেয়ে একটা আরেকটার হাত চেপে ধরল। রাদিন উঁকি দিয়ে ড্রয়িংরুমের সোফার দিকে দৃষ্টি দিতেই সেদিকে চোখ দিয়ে, কার শেখানো কথা এসব, সেটা বুঝে গেল প্রাণেশা। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার হাতে যে কঞ্চি থাকে, সেটা দেখেছিস তো?’

রাদিন কাঁচুমাচু হয়ে বলল,
‘কী করবে ওটা দিয়ে?’

‘তোদের পিঠ ভাঙব। আর যদি আমাকে ভাবী ডাকিস, রোজ সকালে নিয়ম করে একশোবার কান ধরে ওঠবস করবি, তা-ও বাড়ির সবার সামনে। মনে থাকবে?’

প্রাণেশাকে এমনিতেই ভয় পায় ওরা। এই কথাতে আরও ভয় পেল। ভাবী ডেকে বিপদ বাড়াতে রাজি নয় ওরা, তাই জান বাঁচাতে দৌড়ে আবার অনির্বাণের সামনে গেল। ওদের বুঝিয়ে-সুঝিয়ে আরাম করে আধশোয়া হয়ে টেলিভিশন দেখছিল অনির্বাণ। পিচ্চিদের আবার সামনে দেখে বলল,

‘ভাবী ডেকে এসেছিস তো?’

রাদিন বলল,
‘সোনাপু তো কঞ্চি দিয়ে মারবে।’

‘এখন আমি তোদেরকেই আছাড় মারব। আজ থেকে নিয়ম করে প্রাণেশাকে চব্বিশ ঘণ্টায় আটচল্লিশ বার ভাবী ডাকবি। বুঝা গেছে?’

ধমক খেয়ে দু’জনেই ফুঁপিয়ে উঠল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে রাদিন বলল,
‘যদি মারে?’

‘মারুক। মার খেয়েও ডাকবি। ডাকা মিস করা যাবে না।’

দুটোতে ঠিকঠাকমতো কাজ করতে পারে কি না সেটাই দূর থেকে দেখছিল রাফিয়ান। ওদের দিয়ে যে কোনো কাজ হবে না, উলটে ট্রিট মিস যাবে, সেটা বুঝে শেষবেলা সে-ই এলো। সামনে এসে নির্ভয়ে বলল,

‘তুমি কিন্তু বলেছিলে ট্রিট দেবে, এখন কথা পাল্টাচ্ছ।’

অনির্বাণ বলল,
‘আমি মোটেও কথা পাল্টাচ্ছি না। ট্রিট আমি দেব, কিন্তু ওদেরকে বল, তোর বোনকে গিয়ে ভাবী ডাকতে।’

‘সোনাপু যে কত মেজাজী সেটা তুমি জানো, দুলাভাই।’

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো রাফিয়ান। অনির্বাণ নিজের চুল টেনে ধরে বলল,
‘খবরদার আমাকে দুলাভাই ডাকবি না।’

‘বোনের স্বামী তো দুলাভাই-ই হয়, তাই না?’

‘বোনের স্বামী দুলাভাই হলেও বাড়ির ছেলে দুলাভাই হয় না। মাথায় ঢুকিয়ে নে এটা।’

‘বাড়ির ছেলে হও কী অন্যকিছু, আমার তাতে কী আসে যায়? আমার বোনের স্বামীকে আমি দুলাভাই ডাকব, এটাই শেষ কথা। একটু আগে ওদের বলেছি, এখন গিয়ে মিষ্টিপু, ছোটাপু, সেজো ভাইয়া ও লম্বু ভাইয়াকে বলব, সবাই যেন তোমাকে দুলাভাই ডাকে।’

নিজের বোনের কথা আসাতে অনির্বাণ বলল,
‘আইশা কেন আমাকে দুলাভাই ডাকবে?’

‘ছোটাপু না ডাকলেও মিষ্টিপু, সেজো ভাইয়া ও লম্বু ভাইয়া ঠিকই দুলাভাই ডাকবে।’

আগুনের পাত্রে খানিকটা ঘি ঢেলে মিষ্টি করে আবারও হাসলো রাফিয়ান। সে খুব একটা ছোটো নয়, এইবছর টেনে উঠেছে। আইশা, মাইশা ও রেদোয়ান তার চেয়ে তিন বছরের বড়ো। ওরা এইচএসসি দিয়েছে। বোন দু’জনকে রাফিয়ান ছোটাপু ও মিষ্টিপু বলে ডাকে আর রেদোয়ানকে লম্বু ভাইয়া ডাকে। ওদের মধ্যে রেদোয়ান ও আইশা কমার্সের স্টুডেন্ট ও মাইশা সাইন্সের। প্রাণেশার তুলনায় ওরা সবাই যথেষ্ট ভালো পড়াশোনাতে। একেকজন দুষ্টুমি করলেও মেপে মেপে করে। আজ অনির্বাণকে ক্ষ্যাপাতেই এই বুদ্ধি এঁটেছে রাফিয়ান। যেহেতু অনির্বাণ সকালে চলে যাবে, ট্রিট নেয়ার সুযোগ এখনই। এরপর আর কবে আসবে ঠিক নেই। সে জম্পেশ খানাদানা মিস করার ছেলে নয়। তা-ই এই দুষ্টুমি। তার হাসি দেখে ফুঁসে উঠে অনির্বাণ সোফার কুশন হাতে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলতে গেলে, তার আগেই নিজের রুমের দৌড় দিল রাফিয়ান। যাওয়ার আগে আরও দু’চামচ ঘি বাড়িয়ে দিতে গানের সুরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,

‘দুলাভাই, দুলাভাই, ও আমার দুলাভাই।’

অনির্বাণও একইভাবে চিৎকার দিয়ে বলল,
‘শয়তানের চ্যালা… নেক্সট টাইম যদি তোকে আমার সামনে দেখি, শালা-দুলাভাই সম্পর্ক কেমন হয়, বুঝিয়ে দেব।’

ওদের এই দুষ্টুমিষ্টি খুঁনসুটিময় মুহূর্ত বাড়ির বড়োরা উপভোগ করছিলেন। ছোটো ছোটো ছেলেরা ঘরকে প্রাণবন্ত করে রেখেছে বলেই বাড়িতে এত আনন্দ, এত সুখ। এই দুষ্টুমি সবাইকে আনন্দ দিলেও অনির্বাণকে খুব ঝামেলায় ফেলে দিয়েছে। বেচারা নিজেকে ‘দুলাভাই’ মানতেই পারছে না। তা দেখে বাড়ির সবার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। এদিকে সবার হাসি দেখে ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল অনির্বাণ। চোখ গরম করে মা-চাচীদের দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

‘শুধু তোমাদের জন্য আমি আজ এই সিচুয়েশনে পড়েছি। অসহ্য…। ছোটোরাও আমাকে পঁচাচ্ছে।’

***

সব কাজিনেরা একসাথে বসেছে ওদের বাড়ির হলরুমে। যেখানে শুধু ওদেরই আড্ডা ও হৈচৈ চলে। রাফিয়ানের একটাই কথা, ট্রিট আজকে তার চাই-ই চাই। মাইশা ও রেদোয়ান তাতে লাফ দিয়েছে। ওরা আবার জমজ ভাই-বোন। কিন্তু আইশা মানতে নারাজ। ভাইদের একেকটা ভীষণ রাগী। ওদের কাছে ট্রিট চাওয়া মানে বকুনি খাওয়া। ওদের এই মিটিংয়ে সবচেয়ে নীরব সদস্য নাহিয়ান। যে মাইশা ও রেদোয়ানের বড়ো ভাই। আবার আরিয়ান ও অনির্বাণের চেয়ে বয়সে ছোটো। ফ্রিতে কাচ্চি পেলে আছে, না পেলে নাই, তবে খাওয়ার জন্য এত যুদ্ধেও সে নাই। তাই নীরব শ্রোতা হয়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে চাকরীর বিজ্ঞাপন দেখছে। সে ও প্রাণেশা একই বয়সের। ফার্স্টক্লাস পেয়ে ইকোনমিকস্-এ অনার্স শেষ করেছে নাহিয়ান। আপাতত ছোটোখাটো একটা পার্টটাইম জব দরকার। পাশাপাশি মাস্টার্স শেষ করার চিন্তা তারমধ্যে বেশি। বিয়ের হুলস্থুলেও খুব একটা গায়ে মাখেনি, এই ট্রিটও গায়ে মাখল না। নিজের মতো করে কাজে ব্যস্ত হয়ে রইল। আইশা নখ কামড়াতে কামড়াতে বলল,

‘ট্রিটের ভূত মাথা থেকে সরিয়ে ফেলো সবাই। নাহলে বকা খেতে হবে।’

রাফিয়ান মোটেও ছাড়ার পাত্র নয়। বসেবসে ভাবছিল, দুলাভাইয়ের থেকে ট্রিট কীভাবে আদায় করবে। হঠাৎই আইশার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘এ্যাই ছোটাপু, তুমি তো প্রাণেশাপুকে ভাবী ডাকতে পারো। একবার ভাবী ডেকে এসো, ট্রিট কনফার্ম হয়ে যাবে।’

আইশা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলল,
‘না ভাই। আমি ওসবে নাই। শেষে আমার ভাইয়ের বউ কঞ্চি দিয়ে আমার পিছন পিছন দৌড়াতে শুরু করবে।’

এতক্ষণ কাজে ডুবে থাকলেও রাফিয়ান ও আইশার এইসব কথা শোনে হো হো শব্দে হেসে উঠল নাহিয়ান। ল্যাপটপ বন্ধ করে ওদের দিকে তাকিয়ে কৌতুকের সুরে বলল,

‘সামান্য একটা ট্রিটের জন্য ভাইয়াকে দুলাভাই আর আপুকে ভাবী ডাকতেই হবে? ট্রিট না খেলে হয় না, রাফি?’

রাফিয়ান বলল,
‘তুমি কি দলে থাকতে চাও না?’

‘থেকে লাভ? এক প্লেট কাচ্চি? ওটা তো বড়ো ভাবীই ভালো রান্না করতে পারে। বকাঝকা খেয়ে ট্রিট নেয়ার চেয়ে বড়ো ভাবীকে গিয়ে বল, বাড়ির সবাইকে স্পেশাল কাচ্চি রান্না করে খাওয়াবে।’

‘তুমি এভাবে দল পাল্টাতে পারো না, সেজো ভাইয়া।’

‘আশ্চর্য কথা তো! আমি কেন দল পাল্টাতে যাব? আমি কি তোদের বলেছি, এই দুলাভাই ও ভাবী ডাকার দলে আমার নাম লেখা? তোরাই তো কোথা থেকে একেকটা বুদ্ধি বের করিস আর ধরা খাস।’

মাইশা বলল,
‘তুমি একদম মেজো ভাইয়ার দলে যাবে না। ভাইয়া বলেছে, বিয়ের পর ট্রিট দিবে। এখন কেন দিচ্ছে না?’

নাহিয়ান বলল,
‘শখের বিয়ে হলে ঠিকই ট্রিট দিত। এটা তো আর শখের বিয়ে না। এটা হচ্ছে আইক্কাওয়ালা বাঁশের বিয়ে। বাঁশের বিয়েতে কেউ কেন ট্রিট দিবে?’

ওরা যেন এই কথা মানতেই পারল না। রেদোয়ান জোর দিয়ে বলল,
‘সবাই এসো আমার সাথে। আজ প্রাণেশাপুকে ভাবী ডেকে ট্রিট নিয়ে তবেই ছাড়ব। নয়তো আমাদের এই মিশন চলছে, চলবেতে নাম লেখাবে।’

এই সিদ্ধান্ত নিয়ে সবাই প্রাণেশার দরজায় নক করল। অল্প আওয়াজে ঠোকা দিয়ে বুকে ফুঁ দিল আইশা। সবাই ঠেলেঠুলে তাকেই সামনে রেখেছে। যেন বকা খাওয়াতে পারে। এদিকে সম্পর্কে প্রাণেশা তার ভাবীই হবে, তবুও মনে ভয়। তার এই ভয়মিশ্রিত পাংশু মুখ দেখে রাফিয়ান বলল,

‘ছোটাপু, দেরী করছ কেন? ডাক দাও। রাত তো শেষ হয়ে যাচ্ছেরে ভাই। কাচ্চি কখন খাব?’

আইশা বিরক্তিকর মেজাজে চেয়ে বলল,
‘তোর শখ থাকলে তুই ডাক। আমাকে কেন বকা খাওয়াতে চাইছিস?’

‘আরেহ্ ভাই বকা না, ট্রিট খাবে। ডাক দাও। কিচ্ছু হবে না। তুমি তো আপুর ননদিনী হও। তোমাকে কেন বকা দিবে?’

বকা খেলে খাবে, একবার ভাবী ডেকে তারপর দৌড় দিবে, এরকমটাই সিদ্ধান্ত নিয়ে আবারও দরজায় ঠোকা দিল আইশা। ভেতর থেকে প্রাণেশা বলল,

‘কে ওখানে?’

আইশা বলল,
‘ভাবী আমি। তোমার একমাত্র ননদিনী।’

দরজা বন্ধ থাকায় প্রাণেশার রি’অ্যাক্ট দেখল না আইশা। তবে দরজা খোলার পর আদরের ভাবীর মুখোমুখি হতে গিয়েই মাইশার হাত খামচে ধরল সে। প্রাণেশা সবাইকে দেখে চোখ নাচিয়ে আইশার মুখের দিকে চেয়ে বলল,

‘কী ব্যাপার, ননদিনী? কী আবদার আমার কাছে?’

বোনের মুখে ননদিনী ডাক শুনে, সব কথা গুলিয়ে ফেলল আইশা। কী বলতে এসেছিল সেটাও ভুলে গেল। মাইশা ওর হাতে জোরে চাপ দিয়ে বলল,

‘ঘাবড়াচ্ছিস কেন? বল…।’

আইশা তোতলানো কণ্ঠে বলল,
‘অনেক আগে… মেজো ভাইয়া বলেছিল, সে বিয়ে করলে সবাইকে ট্রিট দিবে।’

প্রাণেশা নিজের নখের নেইলপালিশে ফুঁ দিয়ে আইশার ভয় ভয় চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তো?’

‘না… মানে, যেভাবে হোক, বিয়ে তো হয়ে গেছে। তুমি এখন এই বাড়ির মেয়ে নও, বউ হয়ে গেছো। আর আমাদের প্রাণপ্রিয় ভাবী। সেই হিসেবে, বিয়ের পরবর্তী ট্রিট তো দিতেই পারো।’

প্রাণেশা ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
‘আমি ট্রিট দেব? আমার দেয়ার কথা ছিল?’

তখুনি রেদোয়ান বলল,
‘আরেহ্, তুমি কেন দিবে? ট্রিট তো ভাইয়া দিবে। তুমি শুধু ভাইয়ার সামনে আমাদের ভাবী হয়ে যাও। ভাইয়ার পকেট ফাঁকা করার দায়িত্ব আমরা নেব। হবে আমাদের, ভাবী?’

অনির্বাণকে আরেকদফা বাঁশ দেয়ার সুযোগটা ঝটপট লুফে নিল প্রাণেশা। ড্রয়িংরুমের দিকে উঁকি দিয়ে বলল,
‘অফকোর্স। তোদের ভাবী হতে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু…।’

মাইশা বলল,
‘কিন্তু কী?’

‘আমাকে বকা খাওয়াতে পারবি না। সব ধরনের বকা ও বাঁশ থেকে বাঁচাবি তো তোরা?’

সবাই ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে, অনির্বাণের দিকে তাকিয়ে উপর থেকে প্রাণেশা বলল,
‘তুমি না কি বলেছ, ভাবী ডাকলে ওদেরকে ট্রিট দেবে? ওরা আমাকে ভাবী ডেকেছে। আমিও ওদেরকে ননদ-দেবর মেনে নিয়েছি। এখন ওদেরকে ট্রিট দাও।’

এই অসম্ভব যে এত তাড়াতাড়ি সম্ভব হবে, ভাবতে পারেনি অনির্বাণ। প্রাণেশার থেকে স্বীকারোক্তি শোনেও যেন বিশ্বাস হলো না। নিচ থেকেই বলল,

‘তাহলে ওদের বল, আমাকে যেন দুলাভাই না ডাকে।’

প্রাণেশা ওদেরকে এই কথা বুঝাতে গেলে, রাফিয়ান বলল,
‘আমি কিন্তু দুলাভাই-ই ডাকব।’

শব্দ করে হেসে ফেলল প্রাণেশা। ভাইকে কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘তোর যা মন চায়, তুই তা-ই ডাকবি। আমরা কেউ কিচ্ছু বলব না, তাই না রে?’

সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠল। প্রাণেশা বলল,
‘যাও… ঝটপট রেডি হও সবাই।’

আবারও নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকাতে গেলে, আইশা বলল,
‘তুমিও রেডি হয়ে নাও, ভাবী। যেহেতু তোমাকে ঘিরেই ট্রিট হবে, তুমি না গেলে কেমন দেখাবে!’

একটু জোরে বলাতে কথাটা অনির্বাণের কানেও গেল। সে সিঁড়ি বেয়ে উপরে আসছিল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখল, মুরব্বিরা কেউ এদিকে নেই। রান্নাঘরে শুধু রূপকথা ও কাজের মেয়েটা। প্রাণেশাকে লজ্জায় ফেলার সুযোগ হাতছাড়া করতে পারল না। তা-ই নিজের রুমে প্রবেশের আগে একটু গলা উঁচিয়ে বোনকে শুনিয়ে বলল,

‘আমার বউটাকে বল, ট্রিটটা যেহেতু বিয়ে উপলক্ষে, সে যেন একটা লাল টুকটুকে শাড়ি পরে বউ সাজে। বউকে দেখে যদি বউ বউ ফিল না আসে – ট্রিট তো জমবে না…রে আপুনি।’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০৩

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ৩

বিল না মিটিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফিরতে পারবে না, এটা বেশ বুঝল অনির্বাণ। হাতে সামান্য খুচরো পর্যন্ত নেই। রাগে মেজাজ এখন সপ্তাকাশে। প্রাণেশা সামনে থাকলে সম্পর্কের দিক ভুলে গিয়ে জোরসে কয়েকটা চড়-থাপ্পড় দিয়ে বসত। কিন্তু মেয়েটাই তো পালালো। তা-ও আবার এরকম একটা লজ্জাজনক বাঁশ দিয়ে, বিব্রতকর অবস্থায় রেখে। কোনোমতে এখান থেকে সম্মানের সাথে উদ্ধার হতে পারলে, বাড়ি গিয়ে ইচ্ছামতো শাস্তি দিবে, এইটুকু মনস্থির করে উপায় খুঁজতে লাগল অনির্বাণ। ওয়েটার তার মনোভাব বুঝল না। সে তাড়া দিয়ে বলল,

‘বিল পেমেন্ট করুন, স্যার।’

অনির্বাণ খিটমিট মেজাজে বলল,
‘করছিরে ভাই। আপনার টাকা নিয়ে আমি পালাব না। একটু সময় দিন।’

ওয়েটার কিছুক্ষণ তাকিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনির্বাণ তাকে আবার ডেকে বলল,
‘আপনার ফোনটা একটু দিবেন?’

ওয়েটার তার বিপদ ও সম্মান বুঝল কি না কে জানে। তবে নিজের ফোন বাড়িয়ে দিয়ে টেবিল মোছা শুরু করল। ঠোঁট কামড়ে নিজের বড়ো ভাই শেখ আরিয়ান শামস্ এর নম্বরে ডায়াল করল অনির্বাণ। রিসিভ হতেই লজ্জিত কণ্ঠে বলল,

‘ভাইয়া, আমি অনি…। একটা হেল্প লাগবে।’

ভাইয়ের কণ্ঠস্বর চিনতে পেরে ওপাশ থেকে আরিয়ান বলল,
‘কী হেল্প?’

‘আমার পনেরো হাজার টাকা লাগবে। আমি বাসায় গিয়ে দিয়ে দেব। ইজ্জতের ব্যাপার। প্লিজ বাঁচাও।’

‘কী হয়েছে? তুই না প্রাণেশাকে নিয়ে বেরিয়েছিলি?’

‘হ্যাঁ, ও-ই তো বাঁশটা দিল।’

‘বাঁশ?’

সব কথা খুলে বলল অনির্বাণ। শোনে ওপাশে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল আরিয়ান। কৌতুকের সুরে বলল,
‘একদিনেই যদি পকেটের এই অবস্থা হয়, সারাজীবন ওকে সামলাবি কীভাবে, ভাই?’

অনির্বাণ দিকদিশা হারিয়ে বলল,
‘তোমরাই তো আমাকে বুঝলে না। এখন বলছ, সামলাব কী করে? ঘাড়ে চাপানোর আগে এটা ভাবোনি যে, প্রাণের সাথে আর যা-ই হোক, ঘর-সংসার হবে না। ভালো করেই জানো ও একটা মিচকে শয়তান। বদের হাড্ডি। কেমন বিপদে ফেলেছে দেখেছ? ইজ্জত নিয়ে টানাটানি।’

ভাইয়ের দুঃখে কষ্ট হওয়ার বদলে মাত্রাতিরিক্ত হাসি পেয়ে বসলো আরিয়ানের। ফোনের ওপাশে এত শব্দ করে হাসছিল সে, সে-ই হাসি অনির্বাণের মুখটা চুপসে দিয়েছে। সে মুখভার করে চুপ করে ছিল। সমাধান দিতে আরিয়ান বলল,

‘ওখানে কারও বিকাশ অ্যাকাউন্ট থাকলে, নম্বরটা টেক্সট কর। আমি টাকা পাঠাচ্ছি।’

‘থ্যাংক ইউ, ভাইয়া। আমি বাড়ি গিয়েই ফেরত দিয়ে দেব।’

‘দূর… ফেরত দিতে হবে না। নম্বর দে, কুইক। আমার মিটিং আছে।’

ওয়েটারের বিকাশ নম্বরটাই আরিয়ানকে দিয়ে পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করল অনির্বাণ। এরমধ্যেই টাকা চলে এলে, দশ হাজার টাকা বিল মিটিয়ে, বাকি টাকা পকেটে রেখে রেস্টুরেন্টের বাইরে পা রাখতেই ভিখারীদের সামনে পড়ে গেল সে। দলবেঁধে সবাই তার সামনে এসে, প্রশংসা ও দোয়া করে ভাসিয়ে দিল। সবচেয়ে বেশি যে দোয়া করল, তা হলো –

‘তোমার বউটা খুব সুন্দর, বাজান। ওমন সুন্দর মনের মানুষ আইজকাল দেখাই যায় না। আল্লাহর কাছে দোয়া করুম রোজ। ভালো থাইকো দু’জনে।’

এ জাতীয় দোয়া ও প্রশংসা শুনলে লজ্জাই লাগে। লজ্জা থেকে বাঁচতে ওনাদের পাশ কাটিয়ে একটা সিএনজি থামিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল অনির্বাণ।

***

নতুন যে চারাগাছ এনেছিল, সেগুলোই বাড়ির আঙিনায় রোপণ করছিল প্রাণেশা। যেহেতু তার আর কোনো কাজ নেই, তা-ই আস্তেধীরে, সময় নিয়ে, মনোযোগ দিয়ে নিজের কাজটা করছিল। মাথা নুইয়ে কাজ করছিল বলে বাগানের মাঝখানের রাস্তা দিয়ে অনির্বাণের প্রবেশটা সে দেখতে পেল না। অনির্বাণ ঘরে প্রবেশ করেই চারপাশে চোখ ঘুরিয়ে প্রাণেশাকে খুঁজল। এদিক-ওদিক কোথাও নেই। বকাঝকা পরে দেবে, এইভেবে ফ্রেশ হতে নিজের রুমে প্রবেশ করেই বিছানার ওপর রাখা নিজের ক্রেডিটকার্ড, মানিব্যাগ ও মোবাইল দেখে নিশ্চিত হলো, প্রাণেশা বাড়িতেই আছে। কিন্তু চিন্তা বাড়ল, মোবাইল নাহয় হাত থেকে কেড়ে নিয়েছিল বলে ওটা প্রাণেশার হাতেই ছিল। মানিব্যাগ ও ক্রেডিটকার্ডের নাগাল মেয়েটা পেল কী করে? পকেট কাটলো? সন্দিহান মনে নিজের প্যান্টের পকেট চেক করল অনির্বাণ। কোনোদিকে ছেঁড়াফাটা নেই, অথচ সবকিছু প্রাণেশার দখলে! কীভাবে? ভাবতে ভাবতে যখন কোনো সমাধান পেল না, চোখেমুখে বিরক্তি ও রাগ নিয়েই সবকিছু গুছিয়ে রেখে, টাওয়েল ও পোশাক নিয়ে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। লম্বা সময় ধরে শাওয়ার নিয়ে বের হতেই প্রাণেশার মা, তার মেজো চাচী, তাহমিনা আহমেদের মুখোমুখি পড়ে গেল। তিনি দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে আছেন। হয়তো কিছু বলতে বা জানতে এসেছেন। এতকিছু না ভেবে হাসিমুখে বলল,

‘কিছু বলবে, চাচিম্মা?’

তাহমিনা আহমেদ গম্ভীর চেহারা নিয়ে শুধু উপরনিচ মাথা নাড়লেন। অনির্বাণ সেই চেহারা খেয়াল করে চেয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘বসো এখানে। তারপর বলো।’

তিনি বসলেও কিছু বলতে পারছিলেন না, কেবলই আনমনে কিছু একটা ভেবে যাচ্ছিলেন। অনির্বাণ সেই ভাবনারত চেহারার দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কী বলতে এসেছ, নির্ভয়ে বলো। আমি তোমার ছেলের মতো। আমার সামনে কোনো সংকোচ করো না।’

তাহমিনা আহমেদ বিষণ্ণতায়ভরা কণ্ঠে বললেন,
‘প্রাণের এই উদ্ভট কাজকর্ম আমাকে খুব চিন্তা ফেলেছে, অনি। এই জেদ, এই রাগ, এসব কীভাবে এলো, মাঝেমধ্যে ভেবে পাই না আমি। মেয়েটাকে বুঝাবো, সেই সুযোগও আসে না। দু’মিনিট সময় দেয় না কাউকে। সবসময় ওর এই খামখেয়ালী আচরণ মেনে নেয়া যায় না। আমরা সবাই অতিষ্ঠ। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। কিন্তু ও… সব লিমিট ক্রস করে ফেলেছে। বিয়েটাকেও সিরিয়াসলি নিচ্ছে না। কেন বল তো?’

অনির্বাণ কী বলবে ভেবে পেল না। এমন না যে, প্রাণেশাকে সে খুব ভালো বুঝে। একেবারেও বুঝে না, এটাও নয়। তবে এইরকম চলাফেরাটা খুব চিন্তার। প্রাণেশা খুব যে বেয়াদব, উচ্ছৃঙ্খল কিংবা মারকুটে এমটাও নয়। তার একটাই সমস্যা, সে নিজের মতো করে বাঁচতে ভালোবাসে। নিজেকে সময় দিতে ভালোবাসে। নিজের কথা ও ইচ্ছেদের গুরুত্ব দিতে ভালোবাসে। এইটুকুতে যদি আঘাত চলে আসে, তাহলেই একটু রাগ, একটু জেদ ও গোসসা দেখায়। একটু ভেবেচিন্তে অনির্বাণ বলল,

‘ও কি কাউকে ভালোবাসতো?’

‘না না, এমনটা হলে রূপ ও তানি নিশ্চয়ই জানত।’

তানিশা হচ্ছে প্রাণেশার বড়ো বোন। আর রূপকথা হচ্ছে এই বাড়ির বড়ো ছেলে আরিয়ানের বিবাহিতা স্ত্রী। তাদের দু’বছরের একটা মেয়েও আছে। বাড়ির গুরুজনদের সাথে সম্পর্ক যেমনই হোক, রূপকথার সাথে প্রাণেশার সম্পর্কটা গলায় গলায়। প্রাণেশার বিষয়ে যদি কেউ বেশি জানে, সেটা একমাত্র রূপকথা। এরপর তানিশা। তানিশা খুব কমই বোনকে জানে, বুঝে। রূপকথার মতো করে বুঝে না। বিয়ের পর থেকে বোনকে সে সময় দিতে পারে না। নিজের স্বামী ও সংসার নিয়েই সে ব্যস্ত। চাচিম্মার কথায় মাথা নেড়ে অনির্বাণ বলল,

‘বিয়ের ব্যাপারটা কি ওর ওপর জোর করে চাপিয়ে দাওনি?’

তাহমিনা আহমেদ খানিক সময় চুপ থেকে বললেন,
‘ওর চেয়ে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ওর নিজেরই সবকটা বান্ধবী বিয়ে করে সন্তানের মা হয়ে গেছে। শুধু ও-ই উল্টাপাল্টা লজিক দেখিয়ে বিয়ে বানচাল করে দিতে চায়। আমি নিশ্চিত, গতকালকের বিয়েটা ও ইচ্ছে করেই ভেঙেছে।’

অনির্বাণ সামান্য হেসে বলল,
‘ঠিক ধরেছ। তোমার মেয়ে প্লান করে বিয়েটা ভেঙেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাকসেসফুল হয়নি। কারণ তোমরা মুরব্বিরা আমাকে বলিরপাঠা হিসেবে পেয়েছ।’

‘ওমন করে বলিস না, অনি।’

‘ছাড়ো…। তুমি ভাবীর সাথে কথা বলেছিলে প্রাণের পছন্দ-অপছন্দ নিয়ে?’

‘হ্যাঁ, বলেছিলাম। ও তো বলল, প্রাণেশা কাউকে ভালোবাসে না। এমন কেউ নেই ওর জীবনে।’

‘তাহলে বিয়ে নিয়ে ওর এত আপত্তি কেন!’

‘সেটাই তো ভাবছি, বাপ। গতকাল রাতে নিজের ঘরে ঘুমালো। সকালে উঠে জানতে চাইলাম, ঘরে কখন এলো। বলল, ও না কি এই বিয়েটাই মানে না। তাই তোর ঘরে থাকবে না। এখন আমি কী করব? তুই তো জানিস, ওর বাবা কতটা রাগী। কিছু হলেই লোকটা শুধু আমার ওপর চোটপাট করে।’

দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য দেবরকে ডাকতে এসেছিল রূপকথা। দরজায় দাঁড়াতেই দু’জনের কথা তার কানে এলো। কাছে এসে বলল,

‘তোমরা এই আধপাগলকে নিয়ে পড়ে আছো? ওর চিন্তা বাদ দিয়ে খেতে এসো। সবাই অপেক্ষা করছে। এমনিতেই আজ অনেকটা দেরী হয়ে গেছে।’

ঠিক সময়ে খাবার টেবিলে সবাইকে না দেখলে অনির্বাণের বাবা খুব রাগারাগি করবেন। নির্দিষ্ট সময়ে খাবার টেবিলের সামনে উপস্থিত হওয়া বাধ্যতামূলক। এই বিষয়টা মাথায় রেখেই এই ঘর-সংসার সামলাচ্ছেন বাড়ির গিন্নীরা। দেরী হলে বাড়ির মুরব্বি মানুষটা কষ্ট পাবেন দেখে চেয়ার ছাড়লেন তাহমিনা আহমেদ। অনির্বাণকেও তাড়া দিলেন। তিনি বেরিয়ে যাওয়ার পর রূপকথাও বেরিয়ে যাচ্ছিল। কী ভেবে যেন, কিছু পথ পিছিয়ে এলো সে। অনির্বাণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছছিল। রূপকথা বলল,

‘তুমি কি কাল ঢাকায় চলে যাবে?’

অনির্বাণ উত্তর দিল,
‘হ্যাঁ, ভাবী। কাজের চাপ আছে।’

‘প্রাণেশাকে সাথে নিবে?’

একটু ভেবে অনির্বাণ বলল,
‘যেতে চাইলে নিব, নয়তো এখানেই থাকবে। কিন্তু সমস্যা তো একটাই, ও ডিভোর্স চাইছে।’

প্রাণেশার জন্য এই সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন কিছু না, এটা আর কেউ না জানলেও রূপকথা খুব ভালোমতো জানে। সে এই কথা শোনে দেবরকে বলল,

‘ও চাইলেই তুমি ডিভোর্স দিয়ে দিবে? এত সহজ সব? সম্পর্ককে এতটা মূল্যহীন তোমরা কেন ভাবছ, অনি?’

অনির্বাণ হেসে বলল,
‘আমি না তো, তোমার ননদিনীর ইচ্ছে। স্বামী হিসেবে আমার দায়িত্ব ওর ইচ্ছের মূল্য দেয়া।’

এই কথাতে রূপকথা একটা নাটুকে হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বলল,
‘তোমরা কে-কবে ওর ইচ্ছের মূল্য দিয়েছ বলো তো?’

অনির্বাণ একটু থমকাল। টাওয়েল হাতে নিয়ে রূপকথার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,
‘ও যা করছে, নিজের ইচ্ছেতেই করছে। সবকিছুকে ফেলনা ভাবছে। জীবনে কোনোকিছুর গুরুত্ব ওর কাছে নেই। ও শুধু নিজেকেই ভালো রাখতে জানে। আর কিছু নয়। ওকে দিয়ে ঘর-সংসার, ভালোবাসা এগুলো আশা করা বোকামি।’

রূপকথা ফের হেসে বলল,
‘ঠিকই বলেছ, ওর কাছে এগুলো আশা করা বোকামি। ও নাহয় সম্পর্কের মূল্য বুঝে না। তুমি তো বুঝো। একটা সুন্দর সম্পর্ককে গোড়া থেকে যত্ন করে গড়ে তোলার আগে ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত কেন নিচ্ছ? সময় নিয়ে সম্পর্কটার ব্যাপারে একটু পজেটিভ ভাবনাকে মনে ঠাঁই দেয়া উচিত নয় কী?’

উপরনিচ মাথা ঝাঁকিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘অবশ্যই উচিত। এবং আমি সেটা চাই। কিন্তু এর মানে এই না যে, আমি তোমার ননদিনীকে ভালোবাসি! এই সম্পর্কটা পবিত্র। পবিত্র বলেই, এটা আমার কাছে মূল্যবান। ভীষণ যত্নের ও আকাঙ্খার। তাই আমি এর মূল্য দেব। যেমন করেই হোক, জড়িয়ে গেছি একসাথে। আলাদা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। ও মাথামোটা হলে কী হবে? আমি তো আর সেটা নই। যা করব, ভেবেচিন্তেই করব, ভাবী। তুমি টেনশন নিও না।’

এবার একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রূপকথা। নির্ভার হাসি দিয়ে বলল,
‘থ্যাংক ইউ।’

‘মোস্ট ওয়েলকাম।’

ফিরে যেতে গিয়ে রূপকথা আবারও অনির্বাণের সামনে এসে বলল,
‘আগামীকাল যাওয়ার আগে আমাকে আধঘণ্টা সময় দিও তো। কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা শেয়ার করব।’

গুরুত্বপূর্ণ কথা কী, কেন, কাকে নিয়ে, এসব কিছুই প্রশ্ন করল না অনির্বাণ। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
‘ঠিক আছে।’

***

দুপুরে খাবার টেবিলে সবাই উপস্থিত হলেও বাচ্চাদের যারা স্কুল-কলেজে পড়ে তারা ও কর্মজীবীরা ব্যতীত সবাই-ই নিজ নিজ আসনে বসে খাওয়ার আয়োজন শুরু করেছেন। প্রাণেশা তখন কাঁদামাটিতে মাখামাখি হয়ে ঘরে প্রবেশ করেছে। একসাথে অনেকগুলো গাছ রোপণ করে যথেষ্ট ক্লান্ত সে। ঘরে পা রাখতেই রূপকথা বলল,

‘সেই কখন ডাকলাম। এখন এলি? যা তাড়াতাড়ি গোসল করে খেতে আয়।’

অনির্বাণের বাবা শেখ শাফিউল আলম সব সন্তানকেই স্নেহের চোখে দেখেন। তাদের ভালো-মন্দের খোঁজখবর যেমন নেন, তেমনই ভুলত্রুটি দেখলে শাসনও করেন। সকালে তার মেজো ছেলে ও প্রাণেশা একসাথে বেরিয়ে গিয়েছিল। বাড়ির সবাই সেটা দেখেছে। কিন্তু ফিরেছে আগে-পরে। অনির্বাণ একটু আগেই মা-চাচীদের বলছিল, প্রাণেশা কীভাবে তার পকেটের বারোটা বাজিয়েছে আজকে। যদিও সে কৌতুক করে বলছিল, সবাইকে হাসানোর জন্য। তা শোনে সবাই হো হো করে হাসলেও শাফিউল আলম গম্ভীর মেজাজ ধরে বললেন,

‘তোমরাই মেয়েটাকে রাগিয়ে দাও। নয়তো ও ইচ্ছে করে দুষ্টুমি করে না। নিশ্চয়ই অনি এমনকিছু বলেছে, যার কারণে ও ক্ষ্যাপে গিয়ে উদ্ভট আচরণ করেছে।’

প্রাণেশাকে নিয়ে বাবার এই সাপোর্ট দেখে খাওয়া থামিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘আমি মোটেও ওকে রাগাইনি। ওর শিরা-উপশিরায় শয়তানি লুকানো। তুমি দেখতে পাচ্ছ না।’

কাছে ছিল বিধায় প্রাণেশাও এই কথা শুনল। রেগেমেগে ব্যোম হয়ে ডাইনিংয়ের সামনে এসে বলল,
‘আর তুমি যে ওখানে, সামান্য ক’টা গাছের মূল্য নিয়ে বিক্রেতার সাথে দর কষাকষি করছিলে, সেটা বুঝি দোষের না?’

কোনোকিছু কিনতে গেলে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে একটা দামাদামি হয়ই, নার্সারিতে গিয়ে সেরকমটাই হয়েছিল। এই মেয়েটা সেটা নিয়েও যে মেজাজ দেখাবে, তা কি সে জানত? নিজের দিক স্পষ্ট করতে অনির্বাণ বলল,

‘এটা নরমাল ব্যাপার, প্রাণেশা। একটু এদিক-ওদিক হয়। তাইবলে তুই আমাকে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দিয়ে ক্রেডিটকার্ড ও মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়ে আসবি? এটা কোন ধরনের বাচ্চামো?’

প্রাণেশাও একইভাবে বলল,
‘আমি মোটেও বাচ্চামো করিনি। লোকটা চা খেতে দিয়েছিল। চা খাওয়ার ফাঁকে ভ্যানচালককে ভাড়া দিয়ে, তুমি তোমার মানিব্যাগ ও বাইকের চাবি টেবিলের ওপর ফেলে রেখেছিলে। পরবর্তীতে সাফওয়ানকে দেখে দৌড় দিতে গিয়ে ওটা নিতে ভুলে গেছো। দরকারী জিনিস যেখানে সেখানে ফেলতে নেই। ওগুলো সবসময় খেয়ালের সাথে সঙ্গে রাখতে হয়। তাই তোমাকে এটা বুঝাতেই সবকিছু নিয়ে ওড়াল দিয়েছি। যদি ওগুলো আমি না তুলতাম, নির্ঘাত চুরি হতো। মনে করে দেখো, তুমি যখন লেমন জুস খাচ্ছিলে, আমি তোমার চোখের সামনে বাইকের চাবি ঘুরিয়েছি। তুমি তা-ও বুঝোনি। এটা কি আমার দোষ?’

এই ভুলটা কী করে হলো? যদি এরকমই হয়, তাহলে তো এখানে প্রাণেশার দোষ নেই। দশ হাজার টাকা লস দেয়ার সাথে সাথে লাখ টাকার বাইক ও মহামূল্যবান ক্রেডিটকার্ট বাঁচিয়ে দিয়েছে। বুঝতে পেরেও নিজের ভুল স্বীকার করল না অনির্বাণ। খাওয়ার মুখে নিয়ে শক্ত কণ্ঠে বলল,

‘হয়েছে আর দুই নম্বরি করতে হবে না। আমার পকেট ফাঁকা করেছিস। তারজন্য অবশ্যই তোকে আজ শাস্তি পেতে হবে।’

শাস্তি কী সেটা খুব ভালোভাবে জানে প্রাণেশা। সবার মতো একটু শাসাবে, বকা দিবে, কিছু সময় মেজাজ দেখাবে, এরপর সব ঠাণ্ডা। এসব বকা শোনে শোনে অভ্যস্ত সে। প্রথম প্রথম কষ্ট হতো, হাউমাউ করে কাঁদত, কিন্তু এখন আর কষ্ট হয় না। সয়ে গেছে। সে দোষী হলেও বকা শুনবে, দোষী না হলেও বকা শুনবে, ফেইল তকমা গুছিয়ে ভালো রেজাল্ট করলেও বকা শুনবে, এলোমেলো কাজকারবারের জন্যও বকা শুনবে। বকা তার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হয়ে গেছে। সে ছাড়তে চাইলেও ওগুলো তার পিছু ছাড়ে না। তাই অনির্বাণের এই কথাগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিল না। হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে নিজের রুমে চলে এলো। সময় নিয়ে গোসল করে, প্রতিদিনের মতো টি’শার্টের সাথে লেডিস্ জেগিংস্ পরে খাবার টেবিলে এলো। ততক্ষণে সবার খাওয়া শেষ শুধু রূপকথা বাকি ছিল। ননদিনীকে দেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,

‘তোকে সবাই যতটা অজ্ঞান ও অকর্মা ভাবে, আদতে তুই ততটা অজ্ঞান ও অকর্মা নোস। তুই যে একটা বুদ্ধিমতী ও যথেষ্ট মেধাবী মেয়ে সেটা আজ প্রমাণ করে দিয়েছিস।’

রূপকথার কথার অর্থ পুরো বুঝল না প্রাণেশা। চোখ তুলে তাকিয়ে প্লেট সামনে ধরে বলল,
‘ভাত দাও।’

ভাত-তরকারি সব ননদিনীর প্লেটে তুলে দিল রূপকথা। নিজেও নিল। পাশের চেয়ারে বসে হাস্যরসের মাধ্যমে বলল,
‘স্বামীর জিনিসের মূল্য বুঝতে শিখেছিস দেখে শান্তি শান্তি একটা ফিলিংস্ হচ্ছে।’

ঠোঁট কামড়ে কথার অর্থ বোঝার চেষ্টা করল প্রাণেশা। বুঝে, স্মিত হেসে বলল,
‘একই রক্ত। আলাদা নয়। একই হবে। বুঝেছ?’

‘না-ও হতে পারে। পজেটিভ ভাবতে দোষ কী?’

‘পজেটিভ তো কতকিছুই ভাবলাম, ভাবী। লাভ হলো কী? সে-ই একটা কথা, আমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না। আমি তাহলে করবটা কী, বলবে? ভালো রেজাল্ট আনতে পারি না, ঠিকমতো কোনো কাজকর্ম করতে পারি না, ঘরকন্নার কোনো কাজ জানি না। সামান্য এককাপ চা-কফি নিজে বানিয়ে খেতে পারি না, কাউকে খাওয়াতেও পারি। মেধা, বুদ্ধি, স্পেশালিটি বলতে কিচ্ছু নেই আমার মধ্যে। যা আছে, সব আলস্য। বাড়ির অন্যরা যা পারে, যেভাবে নিজেদের তুলে ধরতে পারে, আমি সেভাবে পারি না। এটা কি শুধু আমার চেষ্টার ব্যর্থতা না কি…।’

কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল প্রাণেশা। হয়তো বকতে বা শাসন করতে, কোনো এক কারণে অনির্বাণ এসে পাশে দাঁড়িয়েছে। তাতেই ভেতরের কথা গিলে নিতে বাধ্য হলো সে। একনলা ভাত মুখে নিয়ে, সেটুকুই পেটে চালান করল। একটু একটু করে খাওয়া-দাওয়ার মাঝেই নিজেকে ব্যস্ত রাখল। কোন কথা, কেন গিলে নিল, সেটা অনির্বাণ না বুঝলেও রূপকথা ঠিকই বুঝল। সে খেতে খেতে দেবরের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘কিছু বলতে এসেছ?’

অনির্বাণ মাথা নেড়ে প্রাণেশার দিকে ইশারা করে বলল,
‘তোমার ননদিনীকে বলে দিও, আজ রাতের জন্য যেন আমার রুমে আসে। কাল যেহেতু চলে যাব, যাওয়ার আগে কিছু স্পেশাল ফিলিংসের দরকার আছে।’

মুখের ভাত শেষ করে, আরেকটু ভাত-মাছ মুখে তুলেছিল প্রাণেশা। অনির্বাণের কথা শোনে কাশির সাথে সেটুকু আর পেটের ভেতরে গেল না, বিষমের সাথে নাকমুখ জ্বলে উঠে অসহ্যকর একটা পরিস্থিতি তৈরী হলো। অনির্বাণ পাশেই ছিল। পিঠে হাত ম্যাসাজ করে একগ্লাস পানি বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

‘আহা, এইটুকুতেই নার্ভাস?’

পানি খেয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘আমি কেন তোমার ঘরে থাকব?’

‘বারেহ্, আমার বউ না তুই?’

প্রাণেশা কটমট চোখে চেয়ে চেয়ে বলল,
‘যাব না আমি তোমার ঘরে।’

‘জরুরী কিছু কথা বলব, প্রাণ।’

‘যাব না মানে, যাব না। মাথায় ঢুকিয়ে নাও।’

‘না গেলে কী করব জানিস?’

প্রাণেশা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে, অনির্বাণ তাকে জব্দ করতে, একটু মাথা নুইয়ে, একদম বউয়ের কানের কাছে ঠোঁট এনে, ফিসফিসিয়ে বলল,

‘তোর নিচের ঠোঁটের ঠিক বামপাশে কালো একটা তিল আছে। গতরাতে খুব ইচ্ছে হয়েছিল, তিলটা ছুঁয়ে দেখি। তুই তো একটা মাথামোটা, বেকুব, তাই আমার ইচ্ছের মূল্য দিসনি। এখন কথার মূল্য না দিলে, লাজ-লজ্জা ও অনুমতির দিক ভুলে গিয়ে, দীর্ঘ সময়ের একটা স্পেশাল চুমু দেব ঠোঁটে। তখন মুখটা কোথায় লুকোস, সেটাও দেখে ছাড়ব। বুঝেছিস?’

প্রাণেশার মনে হলো, এক্ষুণি এখান থেকে না পালালে মান-ইজ্জতের দিকে ফিরেও তাকাবে না অনির্বাণ। লজ্জায় তাকে ফেলবেই। যতটুকু খেয়েছে, সেটুকুই যথেষ্ট। সে খাবার রেখে হাত ধুয়ে, নতমুখেই দৌড় দিল। ওর দৌড় দেখে রূপকথা ও অনির্বাণ শব্দ করে হেসে উঠল। রূপকথা বলল,

‘কী যে করো না তোমরা। কী দরকার ছিল, বেচারীকে এইভাবে পঁচানোর? দেখলে তো, খাবারটাও খেল না।’

অনির্বাণ সিঁড়ির দিকে চোখ রেখে বলল,
‘এখন না খেলে রাতে ঠিকই খাবে।’

‘ও তোমার সামনে আসবে আর?’

‘না আসলে আমি ওর রুমে যাব।’

রূপকথার হাসি আর থামলো না। হাসতে হাসতেই বলল,
‘দেখব কেমন পারো। ওই দেখো, দরজা বন্ধ করে দিচ্ছে।’

আসলেই তাই। এরমধ্যেই প্রাণেশা নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে দিয়েছে। মুখে হাসি ধরে রেখে অনির্বাণ বিড়বিড়াল,
‘শুধু কি বিয়েতেই ওর অ্যালার্জি না কি স্বামীর আদরেও অ্যালার্জি? আদর করতে চাইলে আমার আনরোমান্টিক বউটা এইভাবে পালিয়ে যায় কেন?’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০২

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
পর্ব – ২

অনির্বাণের ঘুম ভাঙল সকাল সাড়ে আটটায়। এতবেলা অবধি ঘুমানোর অভ্যাস নেই। গতকাল রাতে প্রাণেশা তার চুল ছিঁড়ে দৌড় দেয়ার পর আর মেয়েটার নাগাল পায়নি। তাতেই ঘর কাঁপানো হাসিতে পেট ফুলে উঠেছিল তার। প্রাণেশাকে ভয় দেখিয়ে রুম থেকে তাড়ানোর উদ্দেশ্যেই এইভাবে কাছে এগিয়েছিল সে। বউ হলেই তাকে ছুঁতে হবে এমন কোনো বাড়তি আকাঙ্খা তার মধ্যে ছিল না। ছিল শুধু প্রাণেশাকে দূরে সরানোর চিন্তা। শান্তিতে ঘুমানোর চিন্তা। যার কারণে ইচ্ছাকৃতভাবেই কাছে এগিয়ে এরকম একটা সিচুয়েশন তৈরী করেছিল সে। প্লান সাকসেসফুল হওয়াতে শান্তির একটা ঘুম হয়েছে। এসব চিন্তা করে একা একাই হাসছিল অনির্বাণ। হাই তুলতে তুলতে বেলকনিতে এসে দাঁড়াতেই দেখল, ভাঙা একটা গাছের নিচে ছোটো চাচা শেখ শওকত আলমের ছেলে ও মেয়েকে কান ধরিয়ে ওঠবস করাচ্ছে প্রাণেশা। হাতে একটা কঞ্চি। রাগত্ব মুখ। জ্বলন্ত দৃষ্টি। ভাই-বোন দুটো বেশ ভয় পাচ্ছে প্রাণেশার এই দৃষ্টি। ভয়েই কাঁচুমাচু হয়ে তারা কান ধরে ওঠবস করছে আর ফুঁপাচ্ছে। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে বড্ড মায়া হলো অনির্বাণের। গলা উঁচিয়ে বলল,

‘ওদেরকে এই শাস্তি কেন দিচ্ছিস, প্রাণেশা?’

প্রাণেশা চোখ কটমটিয়ে বলে উঠল,
‘সেটা তোমাকে কেন বলব? তুমি কে? কাজের মাঝখানে বিরক্ত করছ কেন? যাও এখান থেকে।’

পরপর রাগী চোখে ভাই-বোন দুটোর দিকে চেয়ে ধমকে উঠে বলল,
‘এই তোরা ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে আছিস কেন? কান ধর। নয়তো দিলাম।’

‘দিলাম’ শুনেই ওরা চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করে দিয়েছে। প্রাণেশা হা হয়ে ওদের কান্না দেখছিল। কারণ এখন অবধি কঞ্চি দিয়ে একটা আঘাতও সে দেয়নি। শুধু ভয় দেখাতেই কঞ্চি হাতে রাখা। এদিকে দূর থেকে ওদের কিছু একটা ইশারা করল অনির্বাণ। প্রাণেশা না বুঝলেও ভাই-বোন দুটো ঠিকই বুঝে নিল। সাউন্ড দিয়ে কান্না শুরু করল। অনির্বাণ তখন সুযোগ পেয়ে বলল,

‘তোর তো সাহস কম না। তুই ওদের গায়ে হাত দিচ্ছিস? ওরা এখনও ছোটো। এসব শাসনের কী বুঝে?’

প্রাণেশা ফুঁসে ওঠে বলল,
‘কিছু বুঝে না, শুধু বুঝে গাছের ডালে চড়ে গাছ ভাঙতে। এইটুকু একটা গাছ, এটার ডালে চড়ার কী দরকার ছিল? একটা গাছের দাম কত জানো? সেটাকে যত্ন করে বড়ো করার কষ্ট বুঝো? বুঝবে কী করে? জীবনে কোনোদিন একটা গাছ লাগিয়েছ? অলস কোথাকার।’

‘এ্যাহ… আসছে। জ্ঞান দিতে। অলস তো তুই। অকর্মাও তুই। কাজের মধ্যে পারিস ওই একটাই। মেয়ে হয়ে জন্মেছিস, তোর তো দিনরাত রান্নাঘরে থাকার কথা। তুই কেন পুরুষের মতো হাঁটাচলা করবি? আধা ব্যাটাছেলে একটা।’

‘আমি কী করব, কী করব না, সেটা আমি বুঝব। তুমি মাথা ঘামানোর কে?’

‘আমি কে, জানিস না? কবুল বলে যে আমার গলায় ঝুলেছিস, সেটা কি ভুলে গিয়েছিস? আমি তোর স্বামী। এখন থেকে আমার সব কথা মেনে চলবি। নয়তো…।’

প্রাণেশা দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
‘আমি তোমার গলায় ঝুলিনি। যা হয়েছে তাতে আমার হাত ছিল না। এজন্য তুমি যদি ভাবো, রোজ রোজ অফিস যাওয়ার আগে, রান্নাবান্না করে তোমাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিয়ে পতীসেবা করব, তাহলে ভুল ভাবছ। প্রাণ মরে গেলেও হাত-পা পুড়িয়ে তোমার জন্য রান্না করবে না।’

‘তোর হাতের রান্না খাওয়ার চেয়ে কচুগাছে দঁড়ি বেঁধে ঝুলে যাওয়া বেটার।’

অনির্বাণ যেভাবে কৌতুক করে বলল, প্রাণেশাও ঠিক একইভাবে বলল,
‘তাহলে যাও, ঝুলো। বাড়ির ওইপাশে পরিত্যক্ত ঝোপঝাড় আছে। ওখানে অসংখ্য কচুগাছও আছে। তোমার যেটা ভালো লাগে, তুমি সেটাতেই ঝুলে পড়ো। খামোখা আমার কাজে বিরক্ত করো না।’

কোনোমতেই প্রাণেশাকে থামানো গেল না। এদিকে বাচ্চাদুটো সমানে কেঁদে চলেছে। এ পর্যায়ে সে প্রাণেশাকে প্রায় ধমকে উঠে বলল,
‘ওদের ওপর টর্চার করিস না, প্রাণেশা। ব্যাপারটা ভালো দেখাচ্ছে না। তুই কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি করছিস।’

‘ওরা আমার গাছ নষ্ট করেছে। ওদেরকে এত সহজে ছেড়ে দেব না।’

‘তুই এত ছোটোলোক। সামান্য একটা গাছের জন্য অবুঝ বাচ্চাদের ওপর টর্চার করছিস? ছিঃ… প্রাণ।’

ছোটোলোক শব্দটা শোনে রাগে, দুঃখে, কষ্টে, অপমানে প্রচণ্ড কান্না পেল প্রাণেশার। তার এত যত্নের গাছ, এত প্রিয় গাছ। এই দারুচিনি গাছটা সংগ্রহ করার জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল তাকে। খুঁজেই পাচ্ছিল না। এই পাঁচ বছরে গাছটা যথেষ্ট বড়ো হয়েছিল। তবে এতটা শক্তপোক্ত হয়নি। গতকাল সবাই বিয়ের ঝামেলায় ব্যস্ত ছিল, সে নিজেও ব্যস্ত ছিল বিয়ে ভাঙার প্লান নিয়ে। মাঝখান দিয়ে বিচ্ছু দুটো কখন যে খেলার ফাঁকে তার শখের ও যত্নের গাছটা ভেঙে ফেলেছে, কেউ দেখেনি। আজ সকালে ঘুম ভাঙার পর বাগানে পানি দিতে এসে এই দৃশ্য দেখে কষ্টে হাউমাউ করে কেঁদেছিল প্রাণেশা। কে করেছে এই কাজ, সেটা খুঁজতে গেলে বিচ্ছু দুটো লুকাতে চাইছিল। তাতেই তাদের কাণ্ডকারখানা বুঝে গিয়েছিল সে। আর এজন্যই শাস্তি দিচ্ছে যেন পরবর্তীতে এই ধরনের ভুল তারা না করে।

কান্নার আওয়াজে শওকত আলম বাগানে এসে দুই বাচ্চার কাঁদোকাঁদো মুখ ও প্রাণেশার রাগী মুখ, ফোলা ফোলা চোখ ও ভেজা গাল দেখে ঘটনা কী তার আন্দাজ করতে পেরে সামনে গিয়ে বললেন,

‘ওরা কি আবারও গাছ ভেঙেছে?’

উপরনিচ মাথা দুলিয়ে ভাঙা দারুচিনি গাছটা দেখিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘সপ্তাহে একদিন একটা না একটা গাছ ওরা ভাঙবেই। তুমি ওদের হাত-পা বেঁধে দাও, চাচ্চু। পুরো বাগানের বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে ওরা।’

শওকত আলম নিজের ওয়ানে পড়ুয়া মেয়ে রামিশা ও থ্রিতে পড়ুয়া ছেলে রাদিনের দিকে রাগী মেজাজে তাকিয়ে শাসনের সুরে বললেন,

‘তোমরা কিন্তু কাজটা ঠিক করো না। খেলতে গেলে গাছ ভাঙে কী করে? সাবধানে খেলা যায় না? তাছাড়া খেলার জন্য ঘরভরা খেলনা আছে। বাগানে এসে খেলতে হবে কেন তোমাদের? গাছ কত উপকারী এটা জানো না? এভাবে যদি প্রতিদিন একটা করে গাছ নষ্ট করো, পরিবেশের কত ক্ষতি সেটা বুঝতে পারো না?’

কথার ফাঁকে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এইটুকু গাছে কে উঠেছে?’

রাদিন ফটাফট আঙুলটা বোনের দিকে ঘুরিয়ে নিল। রামিশা বলল,
‘আমি ইচ্ছে করে উঠিনি, আব্বু। ভাইয়াই তো আমাকে গাছে উঠা শেখাতে চাইল।’

দোষ যে দু’জনের সেটা বেশ বুঝতে পারলেন শওকত আলম। প্রাণেশাকে বুঝাতে বললেন,
‘তুই মন খারাপ করিস না, মা। ওরা আর গাছ ভাঙবে না। আমি বুঝিয়ে বলছি।’

এরপর পকেট থেকে বেশকিছু টাকা বের করে প্রাণেশার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘নাশতা খেয়ে আজই গিয়ে নিজের পছন্দমতো কয়েকটা চারাগাছ কিনে আনবি।’

চাচ্চুর কথা মেনে নিলেও ভাঙা গাছের জন্য যে যন্ত্রণা বুকে চেপে বসলো, সেটুকু থেকে মুক্তি মিলল না। মনের যন্ত্রণা হালকা করতে ভাই-বোন ও চাচ্চুকে বিদায় করে, ওখানেই দাঁড়িয়ে রইল প্রাণেশা। ভাঙা গাছটা হাতে তুলে, জায়গাটা পরিষ্কার করে, অন্যসব গাছে যত্ন করে পানি ঢেলে ঘরে ফিরতে গিয়েই অনির্বাণের বেলকনির দিকে চোখ পড়ল। তখনও ওখানেই দাঁড়িয়েছিল অনির্বাণ। প্রাণেশার কাণ্ডকারখানা দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই আদেশের সুরে অনির্বাণ বলল,

‘নাশতা খেয়ে ঝটপট তৈরী হ। আমিও তোর সাথে যাব।’

***

নার্সারি থেকে নিজের পছন্দমতো বেশ কয়েকটা ফুলের গাছ কিনল প্রাণেশা। মশলাজাতীয় গাছ পেল না। ঔষধি গাছ আগামী সপ্তাহে আসবে। অনির্বাণ শুধু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল। গাছ কেনা শেষ হলে, টাকা পরিশোধ করে, সবগুলো গাছ একটা ভ্যানগাড়িতে তুলে, চালককে বাড়ির ঠিকানা দিয়ে দু’জনে বাইকে উঠতে যাবে, অমনি বেশ কিছুটা দূরের একটা দামী রেস্টুরেন্টের দিকে চোখ গেল অনির্বাণের। কতক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রাণেশাকে বলল,

‘ওটা তোর বন্ধু সাফওয়ান না?’

প্রাণেশাও সামনের দিকে দৃষ্টি দিল। সাফওয়ান একটা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা ভীষণ খুশি খুশি মেজাজে রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়িয়ে ওয়েদারের সাথে মিলিয়ে চমৎকার করে ছবি তুলছে। সাফওয়ান ছবি তুলে দিচ্ছে আর মেয়েটি পোজ নিচ্ছে। দৃশ্য দেখে অনির্বাণের মনোযোগ সরিয়ে নিতে ঝটপট তার চোখ থেকে চশমা সরিয়ে নিল প্রাণেশা। বলল,

‘দূর, চশমা পরেও ভুল দেখছ। ওটা সাফওয়ান নয়।’

অনির্বাণ মুহূর্তেই সামনে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টি আবছা হয়ে গেল। দূরের কিছু আর ঠিকমতো দেখা গেল না। সবকিছু ব্লার দেখল। রাগে গজগজ করতে করতে বলল,

‘তুই চশমা নিলি কেন? ওটা সাফওয়ানই। আমি ভুল দেখিনি।’

দূরের জিনিস অস্পষ্ট দেখলেও কাছের সব পরিষ্কারই দেখে অনির্বাণ। হাত বাড়িয়ে প্রাণেশার হাত থেকে চশমাটা কেড়ে নিয়ে সেটা চোখে পড়ে দৌড় দিল রেস্টুরেন্টে দিকে। প্রাণেশা বোকা বোকা দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে, পরমুহূর্তেই অনির্বাণের মেজাজ বুঝে নিজেও পিছন পিছন দৌড় দিল। চেঁচাতে চেঁচাতে বলল,

‘খামোখা দৌড়াচ্ছ। ওটা সাফওয়ান না রে ভাই। সাফওয়ানের আত্মা।’

পরক্ষণেই ‘ভাই’ ডাকাতে জিহ্বাই কামড় দিল। কাহিনী যা হওয়ার তা-ই হলো। রেস্টুরেন্টের সামনে গিয়েই সাফওয়ানের কলার চেপে ধরল অনির্বাণ। বলল,

‘তোমার এত বড়ো সাহস, আমার বাড়ির ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলো? মেয়ে নিয়ে ঘুরবে, ঘুরো। আমাদের বাড়ির ইজ্জতের দিকে কেন হাত বাড়িয়েছিলে? তাকে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়ে অন্য মেয়েকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে তোমার লজ্জা হয় না?’

সাফওয়ান প্রথমে হতভম্ব হয়ে গেল অনির্বাণের এই কাণ্ডে। পরবর্তীতে ঘটনা কী, সেটা বুঝতে পেরে বলল,
‘আরেহ্ ভাই, ছাড়ুন। আমি আপনার বাড়ির ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলিনি। প্রাণেশা যতটা আপনার কাজিন, ততটা আমার ভালো বন্ধুও। আর বন্ধু হিসেবে আমার কর্তব্য, ওর চাওয়া না চাওয়ার মূল্য বোঝা। আমি জাস্ট এটুকু করেছি।’

দৌড়ে এসে জোরপূর্বক সাফওয়ানের কলার থেকে অনির্বাণের হাত ছাড়িয়ে নিল প্রাণেশা। জোরেজোরে নিঃশ্বাস নিয়ে বলল,
‘তুমি তো পাবনার পাগলের চেয়েও কম যাও না। একটা মানুষের সাথে কেউ এইরকম আচরণ করে?’

অনির্বাণের মেজাজে আগুন। নিজেকে সামলাতে পারছে না সে। যতবারই মনে হচ্ছে, প্রাণেশার বিয়ে ভেঙে এই ছেলে তাদের বাড়ির মান-সম্মান নষ্ট করে দিতে চাইছিল, ততবারই মেজাজটা চিড়বিড়িয়ে উঠছে। এখন প্রাণেশার হাতের টান খেয়ে রাগ যেন তার ফুলেফেঁপে উঠল। চিৎকার করে বলল,

‘ওর মতো দুই পয়সার ছেলের সাহস হয় কী করে, তোকে নিয়ে এই ধরনের ড্রামা করার? বিয়ে যদি না-ই করবে, দশজন জানিয়ে বিয়ের দিনতারিখ পাকা করেছিল কেন? বেইমান, মিথ্যুক, ধোঁকাবাজ একটা। ওকে আমি জেলে দেব।’

ঝটপট ফোন বের করে নিজের পরিচিত একজন পুলিশের সাথে যোগাযোগ করতে চাইল অনির্বাণ। প্রাণেশা টান মেরে ফোন নিজের হাতে এনে বলল,

‘শান্ত হও। ওর কোনো দোষ নেই। যা হয়েছে সব আমার ইচ্ছেতে হয়েছে।’

অনির্বাণ বড়োসড়ো একটা ধাক্কা খেল। বিস্মিতস্বরে বলল,
‘মানে!’

জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভেজাল প্রাণেশা। সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘তুমি তো জানোই, এই বিয়েশাদী নিয়ে আমার কোনো স্বপ্ন নেই, আগ্রহ নেই, মাথাব্যথাও নেই। সবাই যখন বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিল, নিজেকে বাঁচাতে ও আর আংকেল-আন্টির সাহায্যে এই প্লানটা করেছিলাম, যেন বিয়ে ভাঙার পর আর কেউ কোনোদিন বিয়ে নিয়ে আমাকে জোরাজুরি না করে।’

অনির্বাণ যেন শূণ্যে থেকে হোঁচট খেল। প্রাণেশার এই কথা তার বিশ্বাস হলো না দেখে যাচাই করতে বলল,
‘তার মানে তুই জানতি, বিয়ের দিন ও আসবে না?’

‘হ্যাঁ, জানতাম।’

‘তাহলে আমার ওপর চেপে বসেছিস কেন? এখন আমি কী করব? তুই তো ঘর-সংসার বুঝবি না। আমিও তোকে বউ মানতে পারব না। এখন আমার উপায় কী? এই ঝামেলায় আমি কেন জড়িয়ে গেলাম? তোর ফাঁদে তো আমার পা দেয়ার কথা ছিল না। আমি কেন ফেঁসে গেলাম?’

অনির্বাণের এই কথায় সাফওয়ানও যথেষ্ট অবাক হলো। কাহিনী কী, জানতে চেয়ে বলল,
‘আপনার ওপর চেপে বসেছে মানে?’

মেজাজে আগুন নিয়ে অনির্বাণ বলল,
‘সেটা তোমার প্রাণপ্রিয় বন্ধুটিকে জিজ্ঞেস করো। বিয়ের ভাঙার নাটক করতে গিয়ে আমার ঘাড়ে চেপে বসেছে।’

‘বুঝলাম না।’

প্রাণেশা ফেকাসে কণ্ঠে বলল,
‘কাল যখন তোর বাড়ি থেকে ফোন গেল, তুই পালিয়েছিস, তখন মান-সম্মান বাঁচাতে বাবা ও চাচ্চুরা মিলে আমাদের সিঙ্গেল জীবনের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আই মিন, আমরা এখন শুধু কাজিন নই, হাসব্যান্ড এন্ড ওয়াইফ।’

সাফওয়ানের চোখদুটো গোলগোল হয়ে গেল। সে কতক্ষণ বিস্মিত দৃষ্টিতে দু’জনকে দেখল, এরপর উচ্চস্বরে হেসে উঠল। তার সেই হাসি দেখে প্রাণেশার শরীর জ্বলে গেল। বলল,

‘হাসবি না শয়তান। তোর জন্যই এটা হয়েছে।’

সাফওয়ান তব্দা খেয়ে মুখে হাত চেপে বলল,
‘আমার কী দোষ? তুই-ই তো প্লান সাজালি। তোর প্লানে তো শেষ পর্যন্ত ‘কবুল’ বলার কথা ছিল না। বললি কেন?’

‘না বলে উপায় ছিল? সবাই আমাকে চেপে ধরে কবুল বলিয়েছে।’

পরক্ষণেই অনির্বাণের দিকে আঙুল তাক করে বলল,
‘এইযে সামনে থাকা একটা জ্যান্ত গাধা। তার মাথায় কোনো বুদ্ধিই নাই। আরেহ্ ভাই, কেউ চেপে ধরলেই কেন কবুল বলতে হবে? সদর দরজা তো খোলা ছিল, দৌড় দিতে পারল না? এই গাধার জন্য এখন আমার জীবনটা শেষ।’

উত্তর যেন ঠোঁটের কোণে ঝুলেছিল অনির্বাণের। ফটাফট বলল,
‘তুই দৌড় দিতে পারিসনি? আমি তো তোর প্লানের কথা জানতাম না। তুই যখন জানতি, তাহলে ভাগলি না কেন? মাথামোটা কোথাকার। নিজে তো বাঁচতে পারলি না, আমাকেও বাঁচতে দিলি না। কী যে করব! দূর…।’

সত্যিটা জানার পর মেজাজের বারোটা বেজে গেছে অনির্বাণের। প্রাণেশার যদি বিয়ে ভাঙারই ইচ্ছে ছিল, তাহলে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করল কেন! কেনই বা তার জীবনেই প্রবেশ করল! এই মেয়েকে নিয়ে ঘর-সংসার কীভাবে হবে? চিন্তা করতে গিয়ে অস্থির হয়ে গেল অনির্বাণ। নিজের আচরণের জন্য লজ্জিত হয়ে সাফওয়ানকে বলল,

‘তুমি কিছু মনে করো না, সাফওয়ান। এই গাধী আমাকে আগে কিছু বলেনি। তাই তোমাকে এখানে দেখে রি’অ্যাক্ট করে ফেলেছি। ভেবেছি, ওর জীবন নষ্ট করে…।’

লজ্জায় আর কথা বলতে পারল না অনির্বাণ। জেনে-বুঝে প্রাণেশা তাকে এরকম একটা সিচুয়েশনে ফেলল! কী লজ্জাজনক ব্যাপার হলো এটা। নির্দোষ একটা মানুষকে বকে দিল। সে কথা এড়িয়ে যাওয়ার বাহানায় খানিকটা দূরে গিয়ে মাথা ঠাণ্ডা করার জন্য একটা লেমন জুস কিনে, তাতে চুমুক দিয়ে ওদের দিকে চেয়ে রইল। সাফওয়ান তখন প্রাণেশাকে বলল,

‘বিয়ে করলি অথচ কিছু জানালি না। এখন ট্রিটটা অন্তত দিয়ে যা। নয়তো ছাড়ব না। বকা খাইয়েছিস। তার শোধ তুলে ছাড়ব।’

প্রাণেশা পাংশুমুখে বলল,
‘তোর কি ধারণা, আমি খুব জমিয়ে ঘর-সংসার করব? ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যে ডিভোর্সের কথা উঠবে। নিশ্চিত থাক। যদি ডিভোর্স না হয়, তাহলে ট্রিট দেব।’

এরপর সাফওয়ানের গার্লফ্রেন্ডের সাথে অল্পস্বল্প গল্প করে ওদেরকে বিদায় দিয়ে অনির্বাণের সামনে এসে বলল,
‘বাড়ি যাবে না?’

অনির্বাণ কাটকাট গলায় বলল,
‘তুই যা।’

‘বেরিয়ে এসেছি দু’জন। যাব একা?’

‘তাতে তোর কী? তুই তো একা পথ চলে অভ্যস্ত। এমন তো না যে, আমি সঙ্গে না গেলে বাড়ি পৌঁছাতে পারবি না।’

‘একা গেলে সবাই কী ভাববে?’

‘সবার জন্য চিন্তা হয় তোর? যদি চিন্তা হতো, এরকম একটা থার্ডক্লাশ প্লান করে আমার ঘাড়ে চেপে বসতি না।’

‘এখন কী চাইছ তুমি? ডিভোর্স?’

অনির্বাণ হেসে বলল,
‘তুই কী চাস?’

‘আমি কী চাই, সেটা তুমি জানো।’

‘তাহলে আর কী? সময়মতো পেয়ে যাবি। তোর মতো আধপাগলকে নিয়ে ঘর-সংসার করার ইচ্ছে আমার নেই।’

প্রাণে কটমট চোখে চেয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। অনির্বাণের সেদিকে দৃষ্টি ছিল না। সে জুস রেখে, সামনে থাকা পত্রিকায় চোখ ডুবিয়ে রেখেছিল। হুট করেই প্রাণেশার মাথায় দুষ্টুমি চেপে বসল। রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে একগাদা খাবার কিনল। অনিবার্ণ একবার সামনে তাকিয়ে দেখল, প্রাণেশা নেই। ভেবে নিল চলে গেছে। সে নিজের মতো করে জুস খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে পত্রিকা পড়ায় মনোযোগ দিয়ে সময়টাকে উপভোগ করতে লাগল। একটা সময় অনির্বাণের সামনে এসে আঙুলের মধ্যে বাইকের চাবি ঘুরিয়ে, জুসের গ্লাসের কাছে কাগজ রেখে প্রাণেশা বলল,

‘বিল পেমেন্ট করে আসো।’

সামনে তাকিয়ে চমকে গেল অনির্বাণ। বলল,
‘তুই যাসনি?’

‘তোমাকে বাঁশ না দিয়ে যাব না।’

বাঁশটা কেমন বুঝল না অনির্বাণ। তবে সামনে থাকা কাগজ খুলে লম্বা একটা লিস্ট দেখে আঁৎকে উঠে বলল,
‘এত খাবার কে খেল?’

প্রাণেশা রাস্তার দিকে বসে থাকা কয়েকজন ভিখারি দেখিয়ে বলল,
‘ওনারা খাচ্ছেন। আমাদের বিয়ের ট্রিট। বিল দিও কেমন? আমি যাচ্ছি।’

অনির্বাণ কিছু বলার আগেই আঙুলের প্যাঁচে থাকা চাবি দেখিয়ে রহস্যময়ী হাসি হেসে বাইক স্টার্ট করে হাওয়ার বেগে উড়ে গেল প্রাণেশা। অনির্বাণ দৌড়ে এসেও নাগাল পেল না। তার বাইক, অথচ মেয়েটা তাকেই ফেলে রেখে চলে গেল। এরমধ্যেই রেস্টুরেন্টের ওয়েটার এসে বিল চাইলে পকেটে হাত দিয়ে আরেকদফা বাঁশ খেল অনিবার্ণ। তার ক্রেডিটকার্ড, মানিব্যাগ কিচ্ছু পকেটে নেই। কারও হেল্প নেয়ার জন্য টেবিল থেকে ফোন নিতে এসে দেখল, ফোনটাও নেই। জীবনে এরকম বেজ্জতির সামনে পড়েনি সে। আজ পড়ে ভীষণ লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো তার। কপাল চাপড়ে বিড়বিড়াল,

‘উফফ আল্লাহ, এই লজ্জা আমি কোথায় রাখি! এখন কী হবে! বিল পেমেন্ট করব কী করে?’

***

চলবে…

প্রাণের পুষ্পকুঞ্জ পর্ব-০১

0

#প্রাণের_পুষ্পকুঞ্জ
লেখনীতে : তামান্না বিনতে সোবহান
ক্যাটাগরি : কমেডি, রোমান্টিক
পর্ব – ১

‘আমার বউ তুই। আমার বউকে দিয়ে আমি যা খুশি তা-ই করাবো তাতে তোর কী? তুই এখন আমার রুম গোছাবি, ফ্লোর মুছবি, বিছানার চাদর পাল্টাবি। সবশেষে ওয়াশরুম পরিষ্কার করবি। বুঝতে পারছিস? যদি না করিস, বাসরঘর ছেড়ে আজ রাতের জন্য আমি নাইটক্লাবে চলে যাব। একশো মেয়ের সাথে নাচব। কথা ক্লিয়ার না কি ভেজাল আছে?’

রাগে কিড়মিড় করতে করতে আঙুলে বারকয়েক তুড়ি মেরে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী প্রাণেশাকে কথাগুলো বলে অক্ষম আক্রোশে ফেটে পড়ল অনির্বাণ। যুতমতো বকতে না পারার কারণে মেজাজ কন্ট্রোলের বাইরে চলে গেল। কাজ দিয়েছে মাত্রই, সেটা না করে নবপরিণীতা তার সাথে তর্কাতর্কি করছে। মানা যায়? এমন বদ কিসিমের মেয়েকে কেন ‘কবুল’ বলে বিয়ে করল, এটাই এখন তার আফসোসের কারণ হয়ে দাঁড়াল। প্রাণেশা হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। সঙ্গে সঙ্গে অনির্বাণের চোখমুখে রাগ ও হিংস্রতা ফুটে উঠতে দেখল। স্বামী নামক প্রাণীটির কথাগুলো হজম করতে পারল না বিধায় জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির ন্যায় জ্বলজ্বল করে উঠে বলল,

‘তোমার সাথে বাসর করার জন্য আমি যেন হাত-পা ছুঁড়ে কেঁদে মরছি। বের হও রুম থেকে। কাছে আসবে তো তোমার রুমের সবকিছুকে ফুটবলের মতো পোটলা বানিয়ে লাত্থি দিয়ে গোলগোল খেলব।’

একেই তো মাথায় ভেতরে থাকা মগজটুকু ফুটন্ত পানির ন্যায় টগবগ টগবগ করে ওথলাচ্ছে, প্রাণেশার কথায় সেটুকু যেন এখন চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল। মস্তিষ্ক ধিকিধিকি করে জ্বলেজ্বলে উঠল। সহ্যের বাইরে চলে গেল সবকিছু। প্রাণেশার এই বেয়াদবি হজম কর‍তে না পেরে অনির্বাণ জোরেশোরে এক লাথি মারল ফ্লোরে। সারাদিনের কথা মনে করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘তোকে আমি কোনোদিন বউ হিসেবে মানব না। তুই একটা বেয়াদব। ডাইনী। কালনাগিনী। শাঁকচুন্নি। শেওড়াগাছের ভূত। সেই ছোটোবেলা থেকে জ্বালাচ্ছিস। তা-ও সুখ পাসনি? এখন আরও জ্বালানোর পায়তারা করছিস? বের হ আমার ঘর থেকে। এক্ষুণি বের হ। ভূতনী কোথাকার।’

‘প্রতি নিঃশ্বাসে যে মিথ্যে বোলো, তোমার লজ্জা হয় না? ছিঃ… একটু আগেই বলেছ, আমি তোমার বউ। বিয়ের পর বউয়েরা স্বামীর ঘরে থাকে। স্বামীর ঘরই তাদের ঘর হয়। যেহেতু আমি তোমার বউ, এই ঘর এখন আমার। এর মালিকানাও আমার। বকাবকি না করে ঘুমোতে দাও। তোমার মতো পালোয়ানের সাথে যুদ্ধ করার মতো অ্যানার্জি আপাতত নেই। ভালোমতো ঘুমোই, সকালে উঠে যুদ্ধ করব। গুড নাইট।’

অনির্বাণ দমে গেল না। তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে বলল,
‘বউ হওয়ার শখ হয়েছে না? বাসর করবি আমার সাথে? জীবনটা আমার ছ্যাঁড়াবেঁড়া বানিয়ে বউ সেজে থাকতে তোর লজ্জা হলো না? এই ছ্যাঁড়াবেঁড়া জীবন এখন আমি জোড়া লাগাব কী করে?’

‘তোমার ছ্যাঁড়াবেঁড়া জীবন কীভাবে জোড়া লাগাবে সেটা তো তুমি ভালো জানবে। আমি কী করে বলব? আমি কি সূঁই-সুতো যে বলা মাত্রই সেলাই হয়ে জোড়া লাগিয়ে দেব?’

‘উফফ…প্রাণেশা, খামোখা রাগ বাড়াচ্ছিস আমার। যা এখান থেকে।’

‘যাব না। কী করবে? আমি এই ঘরেই ঘুমাব। পারলে আটকে দেখাও।’

কথা শেষ করে জিহ্বা বের করে ভেংচি কাটল প্রাণেশা। আপাতত যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে পরনের বেনারসি পাল্টাতে ওয়াশরুমে প্রবেশ করল। কারণ এখন যদি কথার ইতি না টানে, এই যুদ্ধ সকাল পর্যন্ত চলবে। তা-ই বিরতি দিয়ে অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়ে, লেডিস টি’শার্ট ও ট্রাউজার পরে বাইরে এসে দেখল, অনির্বাণ তখনও ঝিম মেরে চেয়ারে বসে আছে। তাকে দেখে অনির্বাণ বলল,

‘তুই আমার ঘর থেকে যা, প্রানেশা। যাওয়ার বেলা তোর কাপড়চোপড়ও নিয়ে যাবি। এইমুহূর্তে তোকে আমার অসহ্য লাগছে। প্লিজ, লিভ…।’

সম্পর্কে দু’জনে চাচাতো ভাই-বোন হলেও বড়ো হয়েছে একসাথে, একই বাড়িতে। সেই সুবাদে রোজ ঝগড়া হতো, তর্কবিতর্ক হতো, কথা কাটাকাটি হতো তবে কখনও গায়ে হাত পর্যন্ত এগোত না। এইদিকটা খুব সতর্কতার সাথে এড়িয়ে যেত দু’জনে। দু’জনেই ভীষণ ঝগড়ুটে। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হয় এদের ঝগড়াঝাটি। তবে বর্তমানের সিচুয়েশনটা সম্পূর্ণ আলাদা। গত দুই বছর ধরে নিজের ব্যক্তিগত ব্যবসার সুবিধায় বাড়ির বাইরে গিয়ে ঢাকা শহরে নিজের আলাদা জগৎ তৈরী করে সেখানেই থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করে নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে অনির্বাণ। খুব বেশি প্রয়োজন না হলে বাড়ি আসে না। গতকাল এসেছিল, প্রাণেশার বিয়ের খবর শোনে। প্রাণেশা ভীষণ মেজাজী, ঘাড়ত্যাড়া, রগচটা, খামখেয়ালী ও ছন্নছাড়া মেজাজের মেয়ে। জীবনে ঘর-সংসার কী, কেন হয়, এসব নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। সারাদিন পুরুষ মানুষের মতো শার্ট-প্যান্ট পরে বাইরে ঘোরাঘুরি করে, বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে আড্ডা দেয়, ট্যুরে যায়। আলাদা কাজের মধ্যে একটা কাজ করে, নিয়ম করে বিভিন্ন ধরনের চারাগাছ রোপণ করে। ভার্সিটি যাওয়া-আসার পথে রোজ একেকটা ফুলের চারা অথবা ঔষধি গাছ নিয়ে আসে। সেটা বাড়ির আঙিনায় রোপণ করে নিয়মিত তার যত্ন নেয়। এভাবে এই কয়েক বছরে অসংখ্য নাম না জানা ফুলেদের গাছ ও ওষধি গাছে লাগিয়ে বাড়ির আঙিনা সাজিয়ে নিয়েছে সে, একদম নিজের মতো করে। তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান এই গাছেদের দিকে। অন্য কোনোদিকে মনোযোগ নেই। দিতেও রাজি নয় সে। ছন্নছাড়া স্বভাবের কারণেই বিয়ের নাম শুনলেই কাজিনদের বলত,

‘দূর বিয়ে করে কী হবে? দেখিস, আমি কোনোদিন বিয়েই করব না। এই গিন্নিপনা আমাকে দিয়ে হবে না।’

প্রাণেশা অনার্স শেষ করেছে কিছুদিন আগে। ভালো রেজাল্টও করেছে। তাই বাড়ির মুরব্বিরা আলাপ-আলোচনা করে তার বিয়ে ঠিক করেছিলেন তারই প্রিয় বন্ধুটির সাথে। কিন্তু বিয়ের দিন তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু লাপাত্তা। বরের গোষ্ঠীশুদ্ধ সবার ফোন নম্বর একসাথে বন্ধ। কারও সাথেই যোগাযোগ করা যাচ্ছিল না। এদিকে দিন গড়িয়ে যাচ্ছিল প্রায়। শেষবেলা ফোন এলো, পাত্র পালিয়েছে তার পছন্দের মানুষকে নিয়ে। সেটা শোনে দুঃখ পেয়ে কেঁদেকেটে গাল ভাসিয়ে দেয়ার বদলে বেনারসি খুলে সমবয়সী ও বয়সে ছোটো সব কাজিনদের নিয়ে উরাধুরা নাচানাচি শুরু করেছিল প্রাণেশা। যেন বিয়ে ভাঙেনি বরং তার রং লেগেছে। বাড়ির সবাই তার এতসব আচরণে রীতিমতো বিরক্ত, ক্ষুব্ধ। বিয়ে ভাঙলে আশেপাশের মানুষজন খারাপ কথা শুনাবে এইভেবে অনির্বাণের বাবা, প্রাণেশার বাবা, ও বাকি দুই চাচা মিলে নিজেদের সম্মান বাঁচাতে নিজেদের বাড়ির মেজো ছেলে শেখ অনির্বাণ সৈকতের ঘাড়ের ওপর চাপ বাড়িয়ে দিতে, কোনোপ্রকার পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই, বিয়ে পরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আর তাতেই ঘরের প্রত্যেকটা সদস্যের ওপর রেগেমেগে ব্যোম হয়ে গিয়েছিল অনির্বাণ। মুখের ওপর তর্ক করতে পারেনি, বড়ো ভাই, বাবা ও চাচাদের খুব সম্মান করে চলে সে। তাদের কথা মেনে চলার চেষ্টা করে। তাছাড়া বাড়ির সম্মান, বাবা-চাচাদের সম্মান, এসব ভেবেই রাজি হয়ে গিয়েছিল সে। কবুল বলে প্রাণেশার মতো ঘাড়ত্যাড়া, আধা ব্যাটাছেলে মেয়েকে বউ বানিয়ে নিজের ঘরেই জায়গা দিতে বাধ্য হলো। প্রাণেশা তার থেকে পাঁচ বছরের ছোটো হলেও নিজেকে সে সবসময় বড়ো ও পণ্ডিত দাবী করে। যে মেয়ে ঘর বোঝে না, সংসার বুঝে না, কাছের মানুষদের মূল্য বুঝে না, তাকে বিয়ে করে এখন কপাল চাপড়াতে হচ্ছে তার। সে নিয়মশৃঙ্খলা মেনে চলা মানুষ। কোনো ধরনের অসচেতনতা, অকারণ ঝুটঝামেলা, তর্কবিতর্ক পছন্দ করে না। এজন্য ভীড় এড়িয়ে চলে, ঝামেলা এড়িয়ে চলে, একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। অথচ এখন… বাড়ির সবার এই উদ্ভট আচরণ, হুকুম ও প্রাণেশার মেজাজ, একসাথে এতকিছু তার বিরক্তি বাড়িয়ে দিল। কয়েকঘণ্টাতেই অস্থির হয়ে গেল সে। বেয়াদব মেয়েটা কথা এড়িয়ে গেল দেখে বিরক্তির স্বরে অনির্বাণ বলল,

‘আমি তোকে যেতে বলেছি, প্রাণেশা।’

আজকের সারাদিনের ধকলে প্রাণেশা যথেষ্ট ক্লান্ত। তার রুমের সব কাপড়চোপড় এই রুমে এনে সাজানো হয়েছে। কাজিনগুলোই সাজিয়েছে। এগুলো এখন রুমে নিয়ে গিয়ে পূণরায় সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা ঝামেলা। এত কাজ করার শক্তি নেই। করে অভ্যস্ত নয় সে। আপাতত তার বিশ্রাম দরকার। তাই সে হাই তুলে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফুলে ফুলে সাজানো বিছানার একপাশে শুয়ে পড়ল। এত হুকুম পালন করা কোনোকালেই অভ্যাসে নেই তার। করতে বাধ্যও নয়। তাই নিজের মর্জি মতো, চোখের ওপর হাত রেখে অনির্বাণকে বলল,

‘বাতি নেভাও।’

অনির্বাণ বিরক্ত হলো। কেউ তার কথা বোঝারই চেষ্টা করছে না। এই মেয়েটাকে কী করে সে বউ হিসেবে মেনে নিবে? কীভাবে সারাজীবন একঘরে থাকবে? এ তো সারাদিন পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করে। নাকের ডগায় রাগ ঝুলিয়ে রাখে। সবসময় খিটমিট খিটমিট করে। এত বদরাগী বউ তার কপালে কীভাবে আসলো? তাছাড়া, সম্পর্ক! এগুলোর মূল্য এই মেয়েটা বুঝবে তো? তার কাছে তো সবকিছুই খামখেয়ালী। নয়তো কোনো মেয়ে নিজের বিয়ে ভাঙলে ডিজে গান বাজিয়ে নাচে? পুরোদিনের কথা ভাবতে গিয়ে রাগে সমস্ত শরীরে জ্বলুনি শুরু হলো অনির্বাণের। কটমট চোখে চেয়ে থেকে বলল,

‘এ্যাই নির্লজ্জ। তুই আমার বিছানায় শুয়েছিস কেন? বললাম না, তোকে আমি বউ হিসেবে মানি না। কথা কানে যায় না? নেমে আয় বিছানা ছেড়ে, নয়তো ভালো হবে না।’

চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে প্রাণেশা বলল,
‘নামব না। কী করবে?’

‘ঘর পরিষ্কার করাবো। এখানে থাকতে হলে ঘর পরিষ্কার করতে হবে। দেখছিস না, চারিদিকে কাঁচাফুল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে? চোখ কি কানা? কপালের নিচে থাকা চোখ কি উপরে নিয়ে হাঁটিস? কানি কোথাকার।’

দু’জনার তর্কাতর্কি শুরু হয়েছিল এই ঘর গোছানো নিয়েই। অনির্বাণ রুমে এসে প্রাণেশাকে বলেছিল, সম্পূর্ণ রুম পরিষ্কার করতে। কিন্তু প্রাণেশা শুনেনি। সোজা বারন করে দিয়েছিল। সেই থেকে শুরু হওয়া তর্ক এখনও একই জায়গায় এসে দাঁড়াল দেখে বিরক্ত প্রাণেশা থেতে উঠে বলল,

‘থাকলাম না এখানে। ক্ষতি কী? সকালে উঠে সবাই যখন দেখবে, আমি আমার রুমে ঘুমিয়েছি। বাবা ও চাচ্চুদের হাতের উদোমকেলানি ঘাড়ে নিও। ঠিক আছে?’

অনির্বাণ আঁৎকে উঠল। প্রাণেশা চলে যাচ্ছিল। দরজার কাছে যেতেই হেঁচকা টানে তাকে বিছানায় ফেলে দিল অনির্বাণ। তাড়াহুড়ো করে বলল,

‘তুই এখানেই ঘুমা। পারলে আমার ঘাড়ে উঠে ঘুমা। তা-ও ঘরের বাইরে যাস না।’

নিজের কপাল নিজেই পুড়াল অনির্বাণ। দাঁত কেলিয়ে হাসলো প্রাণেশা। ভুবন জয় করা হাসি। ফুলেভরা বিছানার চাদরটা তুলে অনির্বাণের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

‘সকালে উঠে ধুয়ে দিও এটা। কেমন? পারলে বাড়ির বাকিদের কাপড়চোপড়ও ধুয়ে দিও। মাসশেষে মোটা অংকের টাকা দেব। কাজ করবে আর টাকা দেব না? জানোই তো, এত কিপটামি আমার দ্বারা হয় না। আমি আবার ভীষণ দয়ালু। কারও কষ্ট একদমই সহ্য করতে পারি না।’

অনির্বাণ ঠোঁট কামড়াল শুধু। কী ডেঞ্জারাস মেয়ে! কৌশলে তাকে জব্দ করে নিল। এই বয়সে এসে বাবা ও চাচাদের হাতের উরাধুরা কেলানি খেতে চায় না সে। ছাত্রজীবনে অনেক খেয়েছে। শেষবার খেয়েছিল দশম শ্রেণীতে, টেস্টে ধরা খেয়ে। এরপর প্রিন্সিপালকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কতশত অনুরোধ করে ফাইনাল এ্যাক্সাম দিতে পেরেছিল। বাপরে… কী কেলানিটাই না খেয়েছিল! মনে পড়লে এখনও তার শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। সবার একটাই অভিযোগ ছিল, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া ছেলে কী করে টেস্টে ফেইল করে? তারা কি আর জানত, ওই বয়সে প্রেমের ভূত চেপেছিল মাথায়! যতসব নষ্টের গোড়া তো তার প্রথম প্রেম, প্রথম ভালোবাসা! আহা, সেকী ভুলা যায়? পিছনের কথাগুলো মনে পড়ে যাওয়াতে দুঃখী দুঃখী চেহারা বানিয়ে চাদরটা ওয়াশরুমে রেখে, ফ্রেশ হয়ে এলো অনির্বাণ। এরমধ্যেই অন্য একটা চাদর বিছানায় বিছিয়ে আরামসে ঘুমাচ্ছে প্রাণেশা। দেখে শরীর জ্বলে উঠল পূণরায়। বলল,

‘তুই চাদর পেলি কোথায়?’

চোখ বন্ধ রেখে প্রাণেশা উত্তর দিল,
‘আলমারি থেকে বের করেছি।’

‘তুই ওটাতে হাত দিয়েছিস? কেন? ওখানে আমার কত ব্যক্তিগত জিনিস রাখা আছে।’

ব্যক্তিগত জিনিস দিয়ে অনির্বাণ কী বুঝিয়েছে সেটা চোখে ভাসাতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠল প্রাণেশা। বলল,
‘হ্যাঁ, দেখেছি তোমার ব্যক্তিগত জিনিস।’

প্রাণেশার হাসি দেখে রাগ যেন আরও বেড়ে গেল অনির্বাণের। বলল,
‘হাত দিয়েছিস?’

‘ছিঃ… হাত দিতে যাব কেন?’
নাকমুখ কুঁচকে তাকাল প্রাণেশা। উলটো ঘুরে হাসি আড়াল করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

অনিবার্ণ বলল,
‘তুই আর ওটাতে হাত দিবি না।’

‘একশোবার দেব।’

‘মাথা ফাটিয়ে ফেলব কিন্তু।’

চট করে বিছানায় উঠে বসল প্রাণেশা। হাতের ইশারায় অনির্বাণকে কাছে ডেকে বলল,
‘ফাটাবে? এসো। এক্ষুণি ফাটাও। এরপর কয়েকমাস জেলে থাকবে। আমি আরামসে এখানে থাকব। হবে না?’

অনির্বাণ ফের বলল,
‘তোকে আমি মেরেই ফেলব।’

‘ভূত হয়ে ঘাড় মটকাব।’

‘উফফ আল্লাহ, এ আমি কার পাল্লায় পড়লাম?’

‘কেন? বেয়াদব, ভূতনী, শাঁকচুন্নি, এসবের পাল্লায়। একটু আগেই না বললে? এরমধ্যেই ভুলে গিয়েছ?’

কপালে হাত দিয়ে বিরক্তিকর ভাব প্রকাশ করল অনির্বাণ। আলমারি লক করে চাবি নিজের কাছে লুকিয়ে ফ্লোরে বিছানা বিছিয়ে একটা বালিশ ও নকশিকাঁথা নিচে ফেলে, বাতি নিভিয়ে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিয়ে বালিশে মাথা ঠেকাল। প্রাণেশা তার এসব কাণ্ডকারখানা দেখে মিটিমিটি হেসে বলল,

‘ভালো করেছ, ফ্লোরে শুয়েছ, এখানে আসলে আমি তোমার ঘাড় মটকেই দিতাম। শেষে দেখা যেত, বাড়ির সবারই ঘাড় আছে শুধু তোমার ঘাড়টাই নেই। হা হা হা…।’

অনির্বাণ কোনো আওয়াজ করল না। ঘুমানোর ভান ধরে চুপ করে পড়ে রইল। প্রাণেশা বালিশে মাথা ঠেকিয়ে অনির্বাণকে জ্বালানোর উদ্দেশ্যে গুনগুনিয়ে গাইল,

‘তুমি দিও না গো, বাসর ঘরের বাত্তি নিভাইয়া। আমি বন্ধ ঘরে, অন্ধকারে, যাব মরিয়া।’

গান গেয়ে নিজের বিপদ নিজেই ডেকে আনল প্রাণেশা, টের পেল কিছুক্ষণ পরই। অনির্বাণ সোজা হয়ে বসে আবছা আলোতে প্রথমে তার পরিণীতাকে দেখল। এরপর বাতি জ্বেলে ঘোরলাগা চোখে চেয়ে চেয়ে বিছানার দিকে অগ্রসর হতে হতে বলল,

‘পরের লাইনটা যেন কী?’

প্রাণেশা পরের লাইন মনে করার চেষ্টা করল। এরমধ্যেই অনির্বাণ বলল,
‘মনে পড়ছে না?’

ভয়মিশ্রিত মনে দু’দিকে মাথা নাড়ল প্রাণেশা। অনির্বাণ চোরা হাসিতে মুখ ভরিয়ে তুলে বিছানায় হাত রেখে প্রাণেশার দিকে একটু ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

‘তুমি ভয় কেন পাও, প্রাণসজনী আমায় দেখিয়া। তোমায় প্রেম সোহাগে রাখব আমার বুকে জড়াইয়া।’

প্রাণেশা ঢোক গিলল। হাতের আলতো ছোঁয়াতে অনির্বাণকে ছুঁয়ে দূরে সরানোর চেষ্টায় বলল,
‘না… প্লিজ। দূরে যাও। আ… আমি ঠিক আছি। আমার ভয় লাগছে না। তুমি বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ো।’

অনির্বাণ দূরে গেল না। আরও কাছে এসে আঙুলের আলতো স্পর্শে প্রাণেশার লাল হয়ে যাওয়া গাল ছুঁয়ে চোখেমুখে ফুঁ দিয়ে বলল,

‘তুই-ই তো কাছে ডাকলি। দূরে যা-ই কী করে বল?’

‘প্লিজ… তোমার দোহাই লাগে। তুমি যাও।’

‘উঁহুম… যাব না। আজ তো আমাদের বাসর। ইশারায় যখন কাছে ডাকছিসই, আদরটা শুরু করতেই পারি। কী বলিস?’

‘প্লিজ… মেজো ভাইয়া। যাও…।’

‘ভাইয়া?’

প্রাণেশা কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
‘ভাইয়া’ই তো ছিলে।’

‘এখন তো আর ভাইয়া নই। একান্তই ব্যক্তিগত মানুষ হয়ে গেছি। ফের ভাইয়া ডাকলে তোর ঠোঁটদুটো আমি সেলাই করে দেব, প্রাণ…।’

‘তুমি দূরে যাও, প্লিজ।’

‘দূরে যাওয়ার মুডে নেই আপাতত। আমি এখন রোমান্সের মুডে আছি।’

অনির্বাণ আরেকটু কাছে এগোলে ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে গেল প্রাণেশা। পরক্ষণেই চিন্তাভাবনা করে ফেলল কিছু। যখন দুজনের মাঝখানে একইঞ্চি সমান দূরত্ব রইল না, তখনই দু’হাতে অনির্বাণের চুল ধরে ঝাঁকুনি দিল। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল অনির্বাণ। জোরপূর্বক হাত ছাড়িয়ে নিতেই দেখল, কতগুলো ছোটো ছোটো চুল প্রাণেশার হাতের মুঠোতে। চুমুর বদলে চুল ছেঁড়া! রেগেমেগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রাণেশা রুমের দরজা খুলে বাইরে দৌড় দিল। দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার দিয়ে বলল,

‘বাবা গো, মা গো, কে কোথায় আছো গো, জলদি এসো। আমার ঘরে ডাকাত এসেছে। ও মা, ও বাবা… আমাকে বাঁচাও। হতচ্ছাড়া ডাকাত আমায় মেরে ফেলল রে…।’

***

চলবে…

বিয়ে থা পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৪৫ (অন্তিম বিয়ে)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

সকালে সবাই যখন নাস্তা করতে বের হয় তখন মুখোমুখি হয় মিথিলা ও রমজান শেখের। নিনীকা অবাক হলেও খুশি হয়েছে। মিথিলা নাতিকে কোলে নিয়ে বললেন,

‘ তোর বাবাকে রাজি করিয়ে চলে এসেছি বুঝলি। ‘

রমজান শেখ দিব্যর গাল টেনে দিলেন। মেয়ের উদ্দেশ্যে বললেন,

‘ তোমার মায়ের জন্য আমার অফিস রেখে আসতে হলো নিনী। ‘

ধারা হাসিমুখে বললেন,

‘ এসে ভালো করেছেন। আপনাদের ছাড়া অসম্পূর্ণ লাগছিল। ‘

সবাই একসাথে নাস্তা করে ঘুরতে বের হলেন। পারিবারিক এই বিশাল মেম্বারদের মধ্যে নিরবের মাও বাদ যাননি৷ মিথিলা সাথে করে নিয়ে এসেছেন। সবাই দার্জিলিংয়ের সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত হলো। উঁচু উঁচু পাহাড় আকাশের সাথে মিশে আছে যেনো। দিব্য হাত উঁচু করে বাবাকে দেখাচ্ছে।

‘ বাবা দেখু উ..’

ধ্রুব ছেলেকে এটা ওটা দেখিয়ে দিচ্ছে। আকাশ কোনটা পাহাড় কোনটা চিনিয়ে দিচ্ছে। দিব্যর ছোট মাথায় সেগুলো আটকেছে কি না বুঝা যাচ্ছে না। তবে সে মাথা নাড়াচ্ছে। মাঝে মধ্যে হাত নেড়ে কিছু একটা বলছে।

*
তারা একটি পার্কে ঘুরতে এলো। নিনীকা ওয়াটার রাইড করবে বললো। ধ্রুব মানা করলো, প্রেগন্যান্ট অবস্থায় রাইড করলে যদি কোনো সমস্যা হয়ে যায়! কিন্তু নিনীকা মানতে নারাজ সে রাইড করবেই। অগত্যা ধ্রুব রাজি হলো। নিনীকাকে দুহাতে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে ওয়াটার রাইড করলো। দিব্য বাবা মাকে পানির মধ্যে থেকে উপরে উঠে চারিদিকে ঘুরতে দেখে খুশিতে হাত তালি দিচ্ছে।

বেলা যখন গড়ালো তখন আরও তিনটা প্রিয়মুখ দেখলো নিনীকা। সুমিত্রা ও অনিরুদ্ধ, সাথে তাদের পাঁচ বছরের মেয়ে অঞ্জলি। সুমিত্রা সেই আগের মতোই নিনীকাকে জড়িয়ে ধরেছে।

‘ নিনীকা ইয়ার মিস ইউ সো মাচ। ‘

নিনীকা এই ফ্যামিলি ট্যুর কে প্রিয়দের সাথে সাক্ষাৎ বলে ধরে নিবে কি না বুঝতে পারছে না। তার জীবনে সুমিত্রার অবদান আছে। এই মেয়েটা তার খারাপ সময়ে পাশে ছিল। কতো বুঝদার ম্যাচিউর আলাপ করতো। ওভারথিংকার নিনীকাকে সাহস দিতো। ধ্রুবর কাছে আসাটাও সুমিত্রার মাধ্যমেই। তাকে দার্জিলিং নিয়ে আসা, বান্দরবানে ঘুরতে যাওয়া। সবকিছুই তো সুমিত্রার মাধ্যমে হয়েছে। ফোনে যোগাযোগ থাকলেও সামনাসামনি আজ দু’বছর পর দেখা। সুমিত্রা দিব্যকে দেখতে এসেছিল দু’বছর আগে।

নিনীকার মাথায় থাপ্পড় পড়তেই সে ভাবনা থেকে বের হলো। সুমিত্রা গাল ফুলিয়ে বলল,

‘ কি ইয়ার? তুমি কি খুশি হওনি নাকি? ‘

নিনীকা ঠোট প্রসারিত করলো।

‘ তোমার এখনো আমাকে সমরেশ মজুমদারের অর্জুন সিরিজে লেখা সেই জলপাইগুড়ি ঘুরে দেখানো বাকি সুমিত্রা। ভুলে গেছো? ‘

সুমিত্রার চোখমুখ উজ্জ্বল হলো।

‘ তুমি মনে রেখেছো ডিয়ার! ‘

নিনীকা মাথা নাড়ালো।

‘ ঘুরে দেখাবে না? ‘

‘ অবশ্যই। ‘

সুমিত্রা নিজেই সবাইকে জলপাইগুড়ি যেতে রাজি করালো। কিভাবে নিনীকা জানে না। তবে দুদিন পর তারা জলপাইগুড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। নিনীকা বহুকাঙ্ক্ষিত জলপাইগুড়ি ছুয়ে দেখলো। তিস্তার ব্রীজ কতো কি। ফিরে আসার মুহূর্তে সুমিত্রা কানে কানে বলল,

‘ ডিয়ার নিনীকা তোমার এই স্বপ্ন পূরণের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য তোমার হাসবেন্ডকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দিও। কথাটা তুলেছি আমি কিন্তু সবাইকে রাজি করিয়ে তোমার স্বপ্ন পূরণ করার পথ করে দিয়েছে সে! ‘

নিনীকা দিব্যকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো ধ্রুবর মুখের দিকে তাকালো তৎক্ষনাৎ। ধ্রুব তাকিয়েই ছিল। চোখে চোখ পড়ে যেতেই হাসলো। নিনীকা আবারও আটকালো এই হাসিতে।

ধ্রুব যত্ন করে এক হাত ধরে গাড়িতে বসালো। নিজেও পাশে উঠে বসলো।

‘ তুমি একটু বেশিই গ্লু করছো মিসেস। ‘

নিনীকা হাত ভাজ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো।

‘ আগে কি গ্লু করতাম না? ‘

‘ ওহ নো, তুমি তো সবসময়ই গ্লু করো। তবে মাঝে মধ্যে বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে যায়। ‘

‘ তো? ‘

ধ্রুব মুখ এগিয়ে এনে বলল,

‘ তো কিছু না। আমার শুধু রাস্তাঘাটে নিজেকে কন্ট্রোল করতে একটু কষ্ট হয় এই যা। ‘

নিনীকা মুখ চেপে ধরে হাসলো। দিব্য একবার বাবা একমার মায়ের দিকে তাকাচ্ছে। ধ্রুব ছেলের মাথার চুল এলোমেলো করে দিলো। দিব্য বাবার মুখে হাত রেখে বলল,

‘ বাবা মাম্মা লাভু ‘

নিনীকা গাল টেনে দিলো,

‘ দিব্যকে ও তার মাম্মা বাবা অনেক ভালোবাসে সোনা।’

‘ চত্তি? ‘

‘ তিন সত্যি। ‘

*

২০৫০ সাল। বউ কথা কও ঝলমল করছে। নিনীকা পুত্রবধূকে বরণ করতে সব তৈরি করে সদর দরজায় দাড়িয়ে আছে। পাশে দাড়িয়ে আছে ফারিন।

তাদের অপেক্ষা শেষ করে গেইট দিয়ে ঢুকলো একটি গাড়ি। ধ্রুব এগিয়ে এসে বলল,

‘ দিব্য বৌ নিয়ে আলাদা গাড়িতে আসছে। সাথে দীবা ও নীরা আছে৷ ‘

নিনীকা মাথা নাড়ালো। ধ্রুব ফ্রেশ হয়ে যখন নিচে নামলো তখন দিব্যকে এখনো বৌ নিয়ে আসতে না দেখে চিন্তিত হলো। বলল,

‘ এখনো আসেনি? ‘

নিনীকা ক্লান্ত মুখে বলল,

‘ না আসেনি। ‘

ধ্রুব সোফায় বসে অপেক্ষা করতে লাগলো। ধারা সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসলেন। বয়স হয়েছে তার। ধ্রুব এগিয়ে এনে পাশে বসালো।

‘ দিব্য এখনো আসেনি? ‘

‘ না মা, কেন যে এতো সময় লাগছে বুঝতে পারছি না। ‘

ধারা নিজেও অপেক্ষা করতে লাগলেন। এই বাড়ির একটা সদস্য কমেছে। ফাহিম মাহবুব চলে গেছেন অনেক বছর হয়েছে। নতুন সদস্য হয়ে দিব্যর বউ পা রাখতে চলেছে বাড়িতে। মেয়েটার নামটা তিনি মনে করতে পারলেন না। আজকাল তার অনেক কিছুই মনে থাকে না।

সদর দরজা দিয়ে ঢুকলেন স্যুট-কোট পড়া রমজান শেখ। সাথে মিথিলা। বয়সের ছাপ চেহারায় স্পষ্ট হয়েছে। কিন্তু স্টাইল আগের মতোই। রমজান শেখ ধ্রুবর পাশের বসলেন।

‘ বুঝলে মাই চাইল্ড আমি একটা জিনিস বুঝতে পেরে গেছি। ‘

ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,

‘ কি আব্বু? ‘

‘ দিব্য বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবে না। ‘

ধ্রুব অবাক হলো,

‘মানে? ‘

রমজান শেখ হাসলেন। তন্মোধ্যে সদর দরজা দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঢুকলো দীবা ও নীরা। নিনীকা মেয়েকে ধরলো।

‘ এতো হাঁপাচ্ছিস কেন? ‘

দীবা ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

‘ ব্রো আমাদের গাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বউমনিকে নিয়ে কোথাও চলে গেছে মাম্মা। ‘

নীরা বলল,

‘ হ্যাঁ মামি, দিব্য ব্রো আমাদের মাঝ রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে বলল তোরা বাড়িতে চলে যা। ‘

ফারিন মেয়ের দিকে চোখ রাঙালো,

‘ তোদের বললো গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে চলে যা আর তোরা ওদের রেখে চলে এলি?

নীরা ঠোঁট উল্টে বলল,

‘আমরা কিছু বলার সুযোগ পাইনি। ব্রো আমাদের নামিয়ে দিয়ে স্প্রিড তুলে চলে গেছে। ‘

নিনীকা মাথায় হাত দিয়ে বলল,

‘কোথায় যেতে পারে ওরা! ‘

সদর দরজা দিয়ে ঢুকলো নিরব। রিলাক্সে গিয়ে ধারার পাশে বসলো। নিনীকার উদ্দেশ্য বলল,

‘ দিব্য বউ নিয়ে পালিয়ে গেছে ভাবী। ‘

ফারিন প্রায় চিৎকার করে উঠলো,

‘ হোয়াট! বউ নিয়ে, বাট হোয়াই? ‘

ধ্রুব বউ ও বোনের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ মেইবি দিব্য তার মা বাবার থেকেও ইন্টারেস্টিং মাধ্যমে বউ নিয়ে লাইফ শুরু করতে চায়। ২০২৪ এ নিনীকা বর রেখে পালিয়ে ছিলো। সেজন্য সে ২০৫০ এ এসে বউসহ পালিয়ে গেছে। ‘

আকস্মিক শক নিনীকার হজম হয়নি। সে মাথা ঘুরে পড়ে যাওয়া ধরতেই দীবা ধরে ফেললো। ধ্রুবর উদ্দেশ্যে বলল,

‘ মাম্মা মেবি বেশিই শক পেয়েছে বাবা। ‘

ধ্রুব নিনীকাকে নিয়ে উপরে চলে গেলো। সবাইকে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়তে বললো।

*

রাত প্রায় দশটা। অন্ধকার নির্জন রাস্তা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ফুল দিয়ে সাজানো একটি গাড়ি। দিব্য ড্রাইভিং এর ফাঁকে পাশে বসা এলোমেলো বউকে দেখছে মাঝেমধ্যে।

‘ তুমি কি এভাবেই থাকবে? ‘

নতুন বউয়ের গায়ে শাড়ি নেই। জিন্স ও উপরে একটি শর্ট ফ্রক জড়িয়ে সে বলল,

‘ বাসর তো করেই নিয়েছো, শাড়ি ও খুলে ফেলেছো। এখন আর পড়ে কি করবো? ‘

দিব্য ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,

‘ তৈরি হও, আমরা সেকেন্ড বাসর করতে আপাতত দার্জিলিং যাচ্ছি মীরা। ‘

মীরা ক্লান্ত চোখ বন্ধ করলো।

‘ জীবনে এমন এডভেঞ্চার রচনা হবে আমি ভাবিনি। শেষে কি না বিয়ে করে বর নিয়ে পালাতে হলো। ‘

দিব্য শব্দ করে হাসলো,

‘ আমাদের ফুল লাইফটাই এডভেঞ্চার হবে মীরা। বিয়ে দিয়ে তো সবে শুরু করলাম। ‘

মীরা নিজেও হাসলো,

‘ তুমি একটা পাগল। ‘

দিব্য হাত বাড়িয়ে মীরার চুল এলোমেলো করে দিলো।

‘ আ’ম লাভ অফ এডভেঞ্চার মাই মীরা! ‘

*

বউ কথা কও অন্ধকারে ডুবে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। ডোয়িং রুমের বাম দিকের দেয়ালে নিনীকা ও ধ্রুবর বিয়ের ফটো ফ্রেমের পাশে আরেকটি নতুন ফটো ফ্রেম কাঁচের জানালা দিয়ে আসা বজ্রপাতের আলোয় জ্বলজ্বল করছে।

(সমাপ্ত)

বিয়ে থা সিজন-০২ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন

বিয়ে থা পর্ব-৪৪

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৪৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

দিব্য ঘুমাচ্ছে না। ধ্রুব লাইট অফ করলেই উঠে বসে বাবা বাবা করছে। ঘুমের মধ্যে নিনীকা ভ্রু কুঁচকে নিচ্ছে বার-বার৷ হয়তো লাইটের কারণে তার ঘুমের অসুবিধা হচ্ছে। ধ্রুব লাইট বন্ধ করে ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে সাইটে রেখে দিলো। দিব্য মুখে আঙুল ঢুকিয়ে বাবাকে এটা ওটা বলছে। ধ্রুব ছেলের কথা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু ঘুমালো না দিব্য। সে উঠে বসে মায়ের পেটে মুখ গুঁজে দিলো। ফিসফিস করে ডাকলো,

‘ বোন? ‘

নিনীকা ফট করে চোখ মেলে তাকালো। দিব্য বলছে,

‘ বোন আতো খেলি। ‘

নিনীকা চুপচাপ ছেলের কান্ড দেখতে লাগলো। পেট থেকে তার বোন কোনো উত্তর না দেওয়াতে দিব্য ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে। কেঁদে দিবে ভাব। নিনীকা টেনে বুকে নিলো।

‘ কি হয়েছে আমার দিব্যর? ‘

‘ বোন কুথা বুলে না ‘

‘ বোন আরও কয়েকমাস পর কথা বলবে সোনা, তখন তুমি তাকে কোলেও নিতে পারবে। ‘

‘ তততি? ‘

‘ হ্যাঁ সত্যি। তোমার বাবা কি করে? ‘

‘ বাবা ঘুম ‘

নিনীকা পাশ ফিরলো। ধ্রুব একেবারে কোনায় গুটিশুটি মে*রে ঘুমিয়েছে। ফ্ল্যাশের আলোয় চেহারা কিছু টা স্পষ্ট। ছেলেকে নিয়ে উঠে বসলো সে। ঘুমন্ত ধ্রুবকে টেনে মাঝে আনলো। উপরে কাঁথা দিয়ে ছেলেকে নিয়ে নিজেও ঢুকে পড়লো কাঁথার নিচে। দিব্য মা বাবার উম পেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। দিব্যকে পেরিয়ে ধ্রুবর একটা হাত নিনীকার কোমড় জড়িয়ে ধরে রেখেছে। নিনীকা ঘুমন্ত স্বামী সন্তানকে ফ্ল্যাশের আলোয় দেখছে। দিব্য পুরো ধ্রুবর মতো হয়েছে। গায়ের রঙটা ছাড়া বাবার সবকিছু পেয়েছে সে। নিনীকা একে একে দুজনের মাথাতেই হাত চালাচ্ছে। তার শান্তি লাগছে। ভেতরের ক্লান্তি ভাব নেই। এই মধ্যরাতে তার ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে। বেশি করে টক দিয়ে চটপটি আরও কতো কি। নিনীকার জিহ্বায় জল চলে এলো। ধীরে ধীরে উঠে ছেলেকে পেরিয়ে ধ্রুবর পেছনে শুয়ে পড়লো। ঘুমের মধ্যে ধ্রুব টের পাচ্ছে তার কাঁধে মুখ রেখেছে কেউ।

নিনীকা ডুবে গেছে। ধ্রুব জেগে গেলো। চোখ না খুলেই হাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরলো নিনীকাকে। অনেকক্ষণ পর নিনীকার ক্লান্ত মুখ তুলে ধরলো।

‘ মিসেস, ঘুমাওনি কেন? ‘

‘ ঘুম ভে*ঙে গেছে। ‘

‘ আদর পাওনি বলে? ‘

নিনীকা নাক ফুলিয়ে বলল,

‘ আমার ফুচকা, চটপটি খেতে ইচ্ছে করছে। ‘

‘ এখন তো পাবো না কোথাও। চিপস খাবে? ‘

নিনীকা মাথা নাড়ালো। যেটা পাওয়া যাচ্ছে সেটা দিয়েই কাজ চালানো যাক।

ধ্রুব উঠে চিপস বের করে আনলো।

‘ এগুলো একটু বেশিই স্পাইসি, তোমার ভালো লাগবে।’

নিনীকা বুকে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ফুপিয়ে উঠে বলল,

‘ তুমি খাইয়ে দাও। ‘

ধ্রুব গালে হাত রাখলো,

‘ কাঁদছো কেন? মন খারাপ? ‘

‘ ভালো লাগছে না। একটুও ভালো লাগছে না। কিছু মিনিট আগেও কতো ভালো লাগছিল। এখন লাগছে না গো। ‘

ধ্রুব এক হাতে ধরে রেখে আরেক হাতে চিপস খাইয়ে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে তার ঠোঁট নামিয়ে আনছে চুলে ও কপালে। কখনো বা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আর কিছু হোক বা না হোক প্রেগ্ন্যাসির সময় নিনীকার মুড সুইং হয় অনেক।

নিনীকা পা তুলে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ধ্রুবর উদাম বুকে আঁকিবুঁকি করে মাঝে মধ্যে ঠোঁট ফুলচ্ছে। কখনো বা ঠোঁট উল্টে ধ্রুবর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাচ্ছে।

এই সময় ধ্রুব টু শব্দ ও করে না। অপেক্ষা করে নিনীকার কিছু একটা বলার। নিনীকা অনেকক্ষণ পর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ তোমাকে একটা কথা বলি? ‘

‘ বলো না? ‘

‘ আমি তোমাকে অনেক ভালোাবাসি। ‘

ধ্রুব ঠোঁট প্রসারিত করলো। শব্দ করে ঠোঁটে চুমু খেলো।

‘ ধ্রুব ও তার মিসেস কে অনেক ভালোবাসে ম্যাডাম৷ ‘

‘ চলো বারান্দায়? ‘

ধ্রুব কোলে নিয়ে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়লো। অন্ধকার আকাশ। উঁচুনিচু পাহাড় অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে৷ নিনীকা নিজের মতো করে কথা বলে চলেছে। ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে। কখনো নিজেও কিছু বলছে। আচমকা নিনীকা কপালে কপাল ঠেকালো।

‘ তুমি কি জানো? আমি একেবারেই পাল্টে গেছি! ‘

‘ জানি মিসেস। ‘

‘ আমার মধ্যে আগের আমি’র কোনো বৈশিষ্ট্য নেই ধ্রুব। আমি এখন পুরোপুরি তোমার উপর নির্ভরশীল হয়ে গেছি। ‘

‘ তো? ‘

‘ তুমি বুঝতে পারছো না। আমি যখন অফিসে যাই, এক সেকেন্ড ও তোমাকে না ভেবে থাকতে পারি না। বাসাতে থাকলে তোমার অপেক্ষা করি কখন তুমি ফিরবে। কখন তোমাকে জড়িয়ে ধরবো। আমার তোমাকে ছাড়া একদম ভালো লাগে না। আমার দমবন্ধ হয়ে আসে। অথচ আমার বয়স ত্রিশ ছুঁয়ে ফেলেছে। একজন ত্রিশ বছরের নারীর কি এমন আবেগ শোভা পায়? ‘

ধ্রুব দুহাতে মুখ তুলে ধরলো। ঠোঁটে দীর্ঘক্ষণ নিজের ভেতরের প্রেম ঢেলে দিলো।

‘ তুমি শেষ বয়স পর্যন্ত আমাকে এভাবেই ভালোবেসে যেও মাই মিসেস। তোমার ভালোবাসাতে কোনো ছলনা নেই। তুমি আমাকে ভালোবাসো বলেই আমাকে তোমার সবমসময় মনে পড়ে। আমার জন্যে তুমি অপেক্ষা করো। ‘

‘ কিন্তু এটা তো বাড়াবাড়ি ধ্রুব। বয়সের দিক থেকে যদি দেখা হয় তবে এটা.. ‘

‘ তোমার এই বাড়াবাড়িটাই আমি চেয়েছি মাই ওয়াইফ৷ তুমি সব ভুলে শুধু আমাকেই ভালোবেসে যাবে। ‘

‘ এরকম আবেগ টিনেজারদের মানায়। আমার এই বাড়াবাড়ি রকম আবেগ আমাকে কখন না জানি ছোট করে ফেলে! আমি আমার আত্নসম্মান বিসর্জনের ভয় পাচ্ছি ধ্রুব। তুমি কখনো আমাকে অসম্মান করোনি। কিন্তু ভবিষ্যতে যদি কোনো কারণে করে ফেলো তখন আমি হয়তো আত্নসম্মান বিসর্জন দিয়ে দিবো! আমি তো এরকম ছিলাম না ধ্রুব। মায়ের মতো হয়ে গেলাম কিভাবে! ‘

ধ্রুব দীর্ঘক্ষণ নিনীকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বলল,

‘ এতোদিন যখন তোমার অসম্মান হয়নি, তোমার আত্নসম্মানে যখন আঘাত লাগেনি তার মানে ভবিষ্যতেও লাগবে না। মেজর ধ্রুব মাহবুবের কাছে নিজের বউয়ের আত্নসম্মান মানে তার নিজেরও আত্নসম্মান। তোমাকে অসম্মান করা হলে আমার নিজেকেও নিচু করা হবে। তুমি বরং নির্দ্বিধায় আমাকে ভালোবেসে যাও৷ তোমার আত্নসম্মান রক্ষার দায়িত্ব তোমার হাসবেন্ডের মাই ওয়াইফ। ‘

নিনীকা বুকে মুখ গুঁজে দিলো।

‘ তুমি প্রশ্রয় দিয়ে আমাকে এরকম বানিয়ে দিয়েছো। কোনোরকম শাসনই করো না। ‘

ধ্রুব হাসলো,

‘ তোমাকে ঢংঙি আহ্লাদী রুপেই মানায়। পাষাণী রুপে নয়। আমি তোমার পাষানী রুপ অনেক ভয় পাই। ‘

‘ তুমি কখনো আমাকে ছেড়ে যেও না গো। ‘

‘ দিব্যর আব্বু দিব্যর আম্মুকে রেখে কোথাও যাবে না মাই মিসেস। ‘

নিনীকা কিছু বলার আগেই দিব্যর গলা ভেসে এলো। সে ডাকছে বাবা মাকে। নিনীকা নিজেকে ছাড়াতে চাইলো।

‘ ছাড়ো দিব্য উঠে গেছে। ‘

ধ্রুব শক্ত করে ধরে রাখলো। ছেলের উদ্দেশ্যে বলল,

‘ দিব্য সাবধানে নেমে আসো তো বাবার কাছে। ‘

দিব্য বাবার গলা শুনেছে। ধীরে ধীরে বিছানা থেকে পিছলিয়ে নেমে গেলো৷ ডাকলো,

‘ বাবা ‘

‘ ধ্রুব উত্তর দিলো,

‘ এসো বাবা ‘

দিব্য গলা অনুসরণ করে চলে এলো। বাবার কাছে আসতে পেরে খুশিতে চিৎকার করলো। নিনীকা ছেলেকে টেনে নিজের কোলে বসালো৷

‘ দিব্য সোনার ঘুম ভে*ঙে গেছে? ‘

দিব্য হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল,

‘ ঘুম নাই ‘

ধ্রুব পেছন থেকে দুজনকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। দিব্য হাত নাড়িয়ে বড়োদের মতো বাবা মা’র সাথে কথা বলছে। মাঝে মধ্যে নিনীকার পেটে হাত রেখে বোনের কথা জিজ্ঞেস করছে।

(চলবে)

বিয়ে থা পর্ব-৪৩

0

#বিয়ে_থা
#পর্ব- ৪৩
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

নিনীকার ফোন হাতে নিয়ে কিছু একটা করছে দিব্য। মাঝেমধ্যে ঘুমন্ত মায়ের বুকে মুখ গুঁজছে। মুখ ফুলাতে দেখা যাচ্ছে তাকে। নিনীকা জেগে গেলো। ছেলের মুখ ফুলানো দেখে বুঝলো কিছু একটা হয়েছে। দিব্য মোবাইল দেখালো৷ নিনীকা হেসে ফেললো,

‘ দিব্য কি তার বাবাকে ফোন দিতে চায়? ‘

দিব্য খুশিতে চিৎকার করে মাথা নাড়ালো। নিনীকা ফোন দিলো ধ্রুবকে। রিসিভ করতেই বলল,

‘ দিব্য সোনা তার বাবার সাথে কথা বলতে চায় মিস্টার মেজর। ‘

ধ্রুব ছেলেকে ডাক দিলো,

‘ দিব্য? ‘

‘ বাবা…তুমি আতো ‘

‘ বাবা তো অফিসে দিব্য। আসার সময় তোমার জন্য কি আনবো বলো তো? ‘

দিব্য ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে ফেললো,

‘ তুমি আতো ‘

নিনীকা ছেলেকে বুকে জড়িয়ে ধরলো।

‘ ধ্রুব তাড়াতাড়ি এসো তো, দিব্য কাঁদে। ‘

‘ তাড়াতাড়ি আসবো মিসেস। দিব্যর কি লাগবে জিজ্ঞেস করো। ‘

নিনীকা ছেলের গালে আদর দিলো।

‘ দিব্যর কি লাগবে বাবাকে বলো সোনা৷ ‘

দিব্য ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ বাবা ‘

ধ্রুবর মন খারাপ হলো। বলল,

‘ দিব্যকে নিয়ে বের হও তো মিসেস, সেনানিবাসের দিকে আসো। আমি কিছুক্ষণের ভেতরে বের হতে চেষ্টা করছি। ‘

‘ ছেলের জন্য এতো মায়া, কই আমার জন্য তো কখনো অফিস রেখে আসো না। ‘

ধ্রুব কিছু বলতে নিলো তার আগেই দিব্য শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। বলতে লাগলো,

‘ বাবা আতো, বাবা আতো ‘

‘ নিনীকা দিব্যকে নিয়ে আসো। আমার ছেলে কাঁদছে কেন? তোমাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিবো, কি করেছো আমার ছেলেকে? দিব্য বাবা আমার কেঁদো না। তোমার মাম্মাকে আমরা বের করে দিবো। কেমন? ‘

দিব্য কান্না থামিয়ে নিজের মায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিনীকা নাক ফুলিয়ে বলল,

‘ তোমরা বাবা ছেলে থাকবে আমি চলেই যাবো। দেখবো কতোদিন থাকতে পারো। ‘

দিব্য নিনীকার গালে মুখ লাগিয়ে রাখলো। মোবাইল এক হাতে কানে লাগিয়ে বলল,

‘ মাম্মা দাবে না ‘

ধ্রুব হেসে বলল,

‘ ঠিক আছে তোমার মাম্মা যাবে না। এবার তুমি তাড়াতাড়ি বাবার কাছে এলো এসো। বাবা ওয়েটিং ফর ইউ দিব্য। ‘

দিব্য কান থেকে মোবাইল নামালো। মায়ের গালে হাত রেখে বলল,

‘ না না মাম্মা কাঁদে না, মাম্মা দাবে না৷ ‘

নিনীকা দিব্যকে জাপ্টে ধরলো৷ মুখে অজস্র আদর দিতে দিতে বলল,

‘ দিব্য আমার লক্ষী বাচ্চা। ‘

দিব্য মায়ের সাথে বাবার কাছে যেতে রওনা হলো। নিনীকা ড্রাইভ করছে। মা ছেলের চোখে গগলস। দিব্য বড়োদের মতো সিটে বসেছে৷ মাঝেমধ্যে পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ি দেখিয়ে বলছে,

‘ মাম্মা উ..’

নিনীকা ড্রাইভ করার ফাঁকে ছেলের উচ্ছাস দেখছে। সেনানিবাসের সামনে আসতেই দিব্য হাততালি দিয়ে ধ্রুবকে ডাকতে লাগলো। নিনীকা নিজে নেমে ছেলের সিট বেল্ট খুলে নামিয়ে দিলো। দিব্য নিজেই ছোট ছোট পায়ে হেটে সেনানিবাসে ঢুকতে লাগলো৷ ডাকতে লাগলো,

‘ বাবা, বাবা, বাবা…’

অফিসার রা অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন। দিব্য নিজেও মাঝে মধ্যে সবার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। নিজের ভাষায় জিজ্ঞেস করছে,

‘ বাবা কুথায়? ‘

নিনীকা দিব্যর অনেক পেছনে। সে হাসছে। তন্মধ্যে বেরিয়ে এলো ধ্রুব। দিব্য বাবাকে দেখে খুশিতে চিৎকার করলো৷ নিচে পড়ে গেলেও কাদলো না৷ হামাগুড়ি দিয়ে যেতে যেতে ডাকলো,

‘ বাবা..বাবা..’

ধ্রুব তৎক্ষণাৎ ছেলেকে কোলে তুলে নিয়েছে৷ দিব্য বাবার কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফেললো। অফিসার রা জিজ্ঞেস করলেন,

‘ আপনার ছেলে? কি সাহস বাবাকে খুঁজতে একা একা ঢুকে পড়েছে। ‘

‘ না একা আসেনি আমার মিসেস ও এসেছেন। সে তার মায়ের সাথে এসেছে। ‘

‘ ও তাই বলুন, আপনার বাচ্চা মাশাআল্লাহ। নাম কি তোমার বাবা? ‘

দিব্য বাবার কাঁধ থেকে মুখ তুলে পিটপিট করে তাকালো।

‘ আমি চুনা বাচ্চা ‘

ধ্রুব শুধরে দিয়ে বলল,

‘ দিব্য মাহবুব। দিব্যকে তার মা সোনা বাচ্চা ডাকে। ‘

ধ্রুব অফিসারদের থেকে বিদায় নিলো। দিব্যকে নিয়ে এলো গেইটের বাহিরে। নিনীকা গাড়িতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে। বাবা ছেলেকে আসতে দেখে হাসলো।

‘ দিব্যর মা ভেতরে গেলো না যে? ‘

‘ দিব্যর বাবাকে দিব্যই নিয়ে আসতে পারবে। সেজন্য অর্ধেক গিয়ে ফিরে এসেছি৷ ‘

ধ্রুব এক হাতে ছেলেকে ধরে, আরেক হাতে নিনীকার কোমড় জড়িয়ে ধরলো। নিনীকা চোখ রাঙালো।

‘ অসভ্য লোক গাড়িতে উঠো। ‘

ধ্রুব গাড়িতে উঠে বসলো ছেলেকে কোলে নিয়ে৷ নিনীকা ড্রাইভ করছে। তাদের গন্তব্য অজানা। চারিদিকে গোধুলি পেরিয়ে আঁধার নামতে শুরু করেছে। নিনীকা একটি নির্জন জায়গায় গাড়ি থামালো সূর্যাস্ত দেখার জন্য।

আর্মি ইউনিফর্ম পরিহিত ধ্রুব গাড়ি থেকে নেমে ছেলেকে দুহাতে উঁচু করে উপরে তুলে ধরলো। দিব্য হাত ছড়িয়ে খিলখিল করে হাসছে। তাদের চোখেমুখে গোধুলির অন্তিম আলো ছড়িয়ে পড়েছে৷ নিনীকা ধ্রুবকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ছেলের হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর মনোমুগ্ধকর দৃশ্য!

গাড়িতে আবারও উঠে বসলো তারা। তখনই নিনীকা ছেলে ও ছেলের বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘ দিব্যর বোন আসতে চলেছে দিব্যর আব্বু। ‘

*
দার্জিলিংয়ে ফ্যামিলি ট্যুরে যাচ্ছে সবাই। দিব্য বাবার কোলে বাবু সেজে বসে আছে গাড়িতে। হালকা উচু পেট নিয়ে নিনীকা তাদের পাশে উঠে বসলো। দিব্য হাত বাড়িয়ে মায়ের পেটে রাখলো। বলল,

‘ বোন বোন উম্মাহ..’

নিনীকা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। নিনীকার পাশে উঠে বসলেন ধারা। আরেক গাড়িতে ফারিন, নিরব ও ফাহিম মাহবুব৷

গাড়ি চলতে শুরু করেছে। তিন বছরের দিব্য কাঁচের ফাঁক গলিয়ে বাহির দেখতে চেষ্টা করছে। ধ্রুব ছেলেকে ধরে রেখেছে। ধারা নিনীকাকে ধরে বসেছেন। দ্বিতীয়বারের মতো প্রেগন্যান্ট তার বউমা।

নিনীকার পড়োনে সাদা লং শার্ট। উপর দিয়ে ওড়না দিয়ে পেট ঢেকে রাখা। হাইহিল পড়া বারণ তার৷ গাড়িতে সে জুতো খুলে বসে আছে৷ এসি তে-ও ঘামছে সে৷

ধ্রুব মাথায় হাত রাখলো।

‘ ঠান্ডা কিছু খাবে? ‘

নিনীকা মাথা নাড়ালো। ধ্রুব গাড়ি থামাতে বললো। নেমে গিয়ে কিছু ফাস্টফুড ও ঠান্ডা পানি কোল ড্রিংক নিয়ে এলো। নিনীকা পানি খেলো। আরাম করে চোখ বন্ধ করে কাঁধে মাথা রাখলো৷

দিব্য নিনীকার মুখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মধ্যে চিপসের প্যাকেট থেকে চিপস বের করে মায়ের মুখে দিচ্ছে। সে জানে তার মতো তার মাও চিপস খায়।

নিনীকা হাত বাড়িয়ে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। আদর করে ডাকলো,

‘ আমার সোনা বাচ্চা। ‘

দিব্য হাসছে। মায়ের কোলে যেতে চাইছে। ধ্রুব ধরে রাখলো।

‘ তোমার মা ব্যথা পাবে দিব্য, বাবার কোলে থাকো। ‘

দিব্য ঠোঁট উল্টে ফেলল।

‘ মাম্মা ব্যথা পায়? দিব্য ও ব্যথা পায়। ‘

নিনীকা ছেলেকে কোলে নিলো সাবধানে।

‘ দিব্য শান্ত হয়ে বসলে মাম্মা ব্যথা পাবে না। ‘

সন্ধ্যা নাগাদ ওরা দার্জিলিংয়ে পৌঁছে গেলো। হোটেল বুক করে খাবার অর্ডার দিয়ে সবাই যে যার রুমে চলে গেলো।

নিনীকা ভীষণ ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। ধ্রুব ছেলেকে খাইয়ে দিয়ে নিনীকাকে টেনে তুলে খাইয়ে দিলো। ঘুমানোর আগে দিব্যকে ওয়াশরুম নিয়ে গেলো। দিব্য কমোডে বসে এটা ওটা বলছে। বাবার সাথে বিস্তর আলাপ চলে তার। ধ্রুবর চোখেমুখে ক্লান্তি। ছেলের গালে হাত রাখলো।

‘ তাড়াতাড়ি চু চু করে ফেলো বাবা, তোমার মাম্মা আমাদের ঘুমাতে ডাকছে। ‘

দিব্য ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ বাবা চুচু আতে না৷ ‘

(চলবে)