Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 131



আমার তুমি ২ পর্ব-০১

0

#আমার_তুমি[২]
#সূচনা_পর্ব
#জান্নাত_সুলতানা

-“মির্জা সাদনান শাহরিয়ার কে বিয়ে করতে না চাওয়ার কারণ কি?
বয়সের ডিফারেন্স?”

লম্বাটে বলিষ্ঠ সুপুরুষ সাদনান শাহরিয়ার প্রশ্নে অষ্টাদশী কন্যা প্রিয়তার মুখের বুলি ফুঁড়িয়ে এলো। এই প্রশ্নের উত্তর কি দিবে কোনো জবাব খোঁজে পেলো না।
এমনিতেই এই সুদর্শন পুরুষ সাদনান ভাই কে যমের মতো ভয় পায় অষ্টাদশী কন্যা প্রিয়তা।সেখানে আজ এই পুরুষ কে বিয়ে করতে হবে। ভাবতেই প্রিয়তার গলা শুকিয়ে এলো।
সাদনান প্রিয়তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো জবাবের আশায়। কিন্তু মেয়ে টা কোনো কথা বলছে না। সাদনান বিরক্ত হলো।মেয়ে টা তাকে বিয়ে করতে রাজি নয়।এমন একটা গুঞ্জ কানে এসছে। আর তাই তাঁর দাদা জাফর মির্জা একান্তই মেয়ে টার সাথে তাকে কথা বলতে পাঠিয়েছে।
সাদনানের বিরক্তি মাত্রা ছাড়াল এবার।
নিজের গম্ভীরতা বজায় রেখে রাশভারি কণ্ঠে জানালো,

-“দাদা জান তোমার সাথে একান্তই আমাকে তোমার মতামত জানতে পাঠিয়েছে। আমি যাচ্ছি। হয়তো কিছু সময় ব্যবধানে বিয়ের কাজ শুরু হবে।”

সাদনান এক সেকেন্ড দেরী করে না নিজের গায়ের সফেদা রঙের পাঞ্জাবির হাত টা ভাঁজ করে কনুইয়ের উপর রাখতে রাখতে রুম হতে বেরিয়ে গেলো।
সাদনান বেরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে শফিক সওদাগর, আয়না, আয়ান সহ পেছনে পেছনে রুমে প্রবেশ করে।
প্রিয়তা তাদের দেখে এগিয়ে এলো।
শফিক সওদাগর কিছু বলার আগেই প্রিয়তা মিনমিন করে বলল,

-“আমি সাদনান ভাই কে বিয়ে করবো না বাবা।”

বিয়ের বঁধু সাজে সজ্জিত প্রিয়তার কাতর কণ্ঠে বলা কথায় শফিক সওদাগর পাত্তা দিলো না।যদিও ভুল টা ওনার নিজরই।কিন্তু এখন সেটা ভেবে মেয়ের জীবন তো আর অভিশপ্ত করতে পারেন না।একটা মেয়ের বিয়ের দিন বর না আসার মতো জঘন্য এই ঘটনা টা যে তার মেয়ের জীবন নরক করে দিতে দ্বিতীয় বার ভাববে না এই সমাজ।যদিও সমাজের ভয় তিনি করে না। তবুও সবদিক বিবেচনা করে এখন বিয়ে টা দিয়ে দেওয়া উত্তম মনে করেন। তাই নিজের কণ্ঠে গম্ভীর রেখে বলে উঠলো,

-“আমি তোমার মতামত জানতে আসি নি।
আমি আমার ডিসিশন আগেই জানিয়েছি।একটু পরই বিয়ে পড়ানো হবে।আর কোনো ঝামেলা চাই না আমি।”

কথা গুলো শেষ করেই শফিক সওদাগর প্রিয়তার রুম হতে বেরিয়ে গেলো। আয়ান আয়না বোনের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
তাদেরও কিছু করার নেই।
আয়নাও বাবার পেছনে পেছনে চলে গেলো।
আয়ান বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে আদুরে কণ্ঠ বলল,

-“রাজি হয়ে যা বোন আমার।
বাবা মা সন্তানের খারাপ চায় না।আর তুই একবার বাবার সম্মানের কথা ভাব।”

আয়ানের কথা গুলো প্রিয়তা মন দিয়ে শুনলো।সত্যি তো।পাত্র আসে নি বিয়ে করতে। এটা পুরো গ্রাম ছড়িয়ে গিয়েছে এখন যদি বিয়ে না হয় এই গ্রামের লোক তার জীবন ফুল থেকে কাটা’তে পরিণত করতে এক দন্ড ভাববে না।
প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই আয়ান চলে গেলো।আর দরজা খোলার সাথে সাথেই হুমড়ি খেয়ে রুমে প্রবেশ করলো সবাই।
অতঃপর শুরু হলো গ্রামের মানুষের জাতিগত স্বভাব কানাঘুঁষা করা।

-“এক বর পালিয়েছে।কিন্তু দেখো মেয়ের কি ভাগ্য চেয়ারম্যান নিজে তার নাতির জন্য প্রস্তাব রেখেছে। একেই বলে কপাল।”

এমন অনেক কথা প্রিয়তার কানে এলো।তবে প্রিয়তা কারোর কথায় কান দিলো না।
তার মনে তো অন্য প্রশ্ন ঘুরছে কবির খাঁন কেনো বিয়ে করতে এলো না?
——-

কালাম খাঁন শফিক সওদাগর এর কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইলো ছেলের এমন কর্মে।
নিজের ছেলের প্রতি অঢেল রাগ হচ্ছে এমন একটা জঘন্য কাজ কি করে তাঁর ছেলে করতে পারে ভেবে পেলো না আগে যদি বলত তাহলে সে এমন কিছু করতো! নিশ্চয়ই এতো দূর অব্দি এগুতো না।স্ত্রী মারা যাওয়ার পর আর বিয়ে করে নি। ছেলের অবহেলা হবে ভেবে নিজের যৌবন শেষ করে দিলো আর আজ সেই ছেলেই তাকে কি একটা লজ্জাজনক অধ্যায় ফেলে দিয়ে চলে গেলো। এই জীবনে কি আর শফিক সওদাগর এর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে তিনি!
শফিক সওদাগর কালাম খাঁন কে নরম স্বরে বোঝাল অনেক টা সময় নিয়ে।যে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে।
কালাম খাঁন তবুও বারবার ক্ষমা চান।বিয়ে পড়ানো হলে বউ নিয়ে যাওয়ার জন্য জাফর মির্জা তাগাদা দিলো।সন্ধ্যা গড়িয়ে অনেকটা রাত হয়ে এলো যে।

—–

সাদনানের কাকা মফিজুর মির্জার বন্ধু কালাম খাঁন।স্ত্রী নেই।এক সন্তান কবির খান। পড়ালেখার পাঠ চুকিয়ে বর্তমানে শহরের বেশ নামকরা একটা ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে রয়েছে।ছেলের জন্য গ্রামের সহজ সরল মেয়ে চাইছিল পুত্রবধূ রূপে।ব্যাপার টা মফিজুর মির্জা কে জানালে তিনি প্রিয়তার কথা জানায়।শফিক সওদাগরের সাথে কথা বললে দেখা সাক্ষাৎ করে কালাম খাঁন প্রিয়তা কে পছন্দ করে রাজি হয়।কিন্তু ছেলের পছন্দের কথা না ভেবেই কথা দিয়ে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে নেয়।বিয়ের সাপ্তাহ আগে অবশ্য কবির কে তিনি প্রিয়তার সাথে দেখা করতে বলেছে তবে কবির না করে দিয়েছে। জানিয়েছে বাবার পছন্দই তাঁর পছন্দ। কিন্তু বিয়ের দিন সকাল সাড়ে দশ-টার দিকে কবির খাঁন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। এদিকে ব্যাপার খুব দ্রুতেই গ্রামে ছড়িয়ে পরে বর আসবে না।শফিক সওদাগরের বড় মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকেরা ব্যাপার টা জানাজানি হওয়ার পর জাফর মির্জা নিজের ছোট নাতি সাদনান শাহরিয়ার জন্য প্রস্তাব রাখে।
শফিক সওদাগর যেনো অন্ধকারের মাঝে একটু আলোর দেখা পেলেন।
তিনি অবাক হয়ে ছিল।
বিস্ময় নিয়ে কিছু বলতে পারছিল না। বড় মেয়ে কে মির্জা বাড়ি বিয়ে দিলেও ছোট মেয়ে কে নিয়ে এসব কখনো ভাবেননি অবশ্য ভাবার কথাও নয়।সাদনানের বয়স যেমন তেমনি নিজের নামধাম।শুনেছেন এবার এমপি নির্বাচনেও সাদনান দাঁড়াবে। জয় তো নিশ্চিত হবে। ছেলেটার মাঝে বিশেষ গুন রয়েছে।
তাই তো বিনাবাক্যে রাজি হয়েছে।

——-

বরাবরই প্রিয়তা রাজনীতি পছন্দ করে না।অথচ ভাগ্য আজ তাকে এক নেতার বউ বানিয়ে দিলো।
এই তো একটু আগেই বিয়ে হয়েছে তাদের। প্রিয়তা বসে আছে সোফায় সাদনান এর পাশে। সাদনান গুরুগম্ভীর। কোনো প্রতিক্রিয়া তাঁর মাঝে নেই।আপাতত কিছু মানুষ তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।
বিদায় এতো কেন বিষাদ?এতো কষ্ট কেন?বুকের মাঝে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে প্রিয়তার। প্রিয়তার মা মিতা সওদাগর কেঁদেকুটে নাজেহাল অবস্থা। ছোট মেয়ে তাঁর ভীষণ আদুরে।
বিদায় দিতে দিতে রাত হয়ে এলো।যেহেতু বিয়ে টা হঠাৎ করেই হয়েছে তাই কোনো আত্মীয় সাদনানদের নেই।যা আছে সব পরিবারের।রাহাত আয়না,আজ্জম মির্জা,আম্বিয়া মির্জা,মাইশা,সুফিয়া বেগম আর সাদনানের ফুপি তাঁরা সবাই একটা গাড়িতে গেলো।আর সাদনান নিজের গাড়ি নিয়ে সাথে রয়েছে তাঁর ছেলেপুলে বাইক নিয়ে।
সারা সাদনান এর গাড়ীতে যাবে। কিন্তু মেয়ে টার মন অন্য কিছু চাচ্ছে। গাড়ির কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম দেখে সাদনান সারার দিকে ভ্রু কুঁচকে বলল,

-“ওঠে বস।”

-“তুই যা।
আমি নাহয় সার,,,,

মাঝে রাহান কোথা থেকে এসে ফোঁড়ন কেটে আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাচ্ছিল।
তবে সাদনান এর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারলো না।
সাদনান বোনের দিকে এক পলক তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল,

-“আমার বোন আমি ঠিক সময় বাড়ি দেখতে চাই।”

চোখের পলকে সাদনান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে শাঁই শাঁই করে চলে গেলো।
তাঁর পেছনে পেছনে বাইক গুলো গেলো।রাহান সারার দিকে তাকিয়ে একবার শুকনো একটা ঢোক গিলে নিলো।এই মেয়ে আস্ত একটা মায়ার সাগর যে সাগর অতল গভীরে রাহান ডুবে আছে। যা থেকে হয়তো কখনো মুক্তি পাওয়া সম্ভব নয়।

-“আপনি?”

-“ফাস্ট কোনো কমেন্ট নয়।
তাড়াতাড়ি ওঠে বস।”

সারাও তাই করলো।
রাহান বাইক স্টার্ট দেওয়ার আগে হুশিয়ারি দিয়ে বলল,

-“ধরে বস।
রাস্তা ভালো নয়।কিছু হলে তোর ভাইয়েরা আর বাপ আমাকে শেষ করতে দ্বিতীয় বার ভাববে না।”

সারা রাহান এর কথা শুনে ফিক করে হেঁসে দিলো। রাহান বাইকের মিররে সেটা দেখে নিজের বুকের বা পাশে ডান হাত টা রেখে মনে মনে বলল,”এভাবে হাসে না প্লিজ। আমার বুকে ভয়ংকর যন্ত্রণা হয়।”

——-

বিয়ে টা হঠাৎ হওয়াতে বাড়িতেও তেমন লোকজন নেই।যা আছে নিজেদের লোক।
সাদনান এর মা সালেহা বেগম সব নিয়মকানুন শেষ একটা শাড়ী মাইশার হাতে দিয়ে প্রিয়তা কে বিয়ের ড্রেস চেঞ্জ করে এটা পড়িয়ে সাদনান এর রুমে দিয়ে যেতে বলল।
মাইশা শাড়ী নিয়ে রুমে এসে দেখলো প্রিয়তা আয়নাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
মাইশা নিজেও এসে বসল।টুকটাক কথা বলে শাড়ী টা রেখে গেলো।আয়না কে অবশ্য বলে গিয়েছে শাড়ী টা পড়িয়ে দিতে।
কিন্তু আয়না কে রাহাত ডাকছে আয়নার আর রাহাতের দু’বছরের বাচ্চা ইনিয়া কান্না করছে তাই আয়না হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেলো।শাড়ী সেভাবেই পরে রইলো।প্রিয়তার শাড়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। গায়ে ভারী একটা শাড়ী মাথায় চমৎকার একখানা দোপাট্টা। মুখে রয়েছে কৃত্রিম সাজ।এতো সবে প্রিয়তার অবস্থা করুণ।
ফ্রেশ হতে পারলে হয়তো ভালো লাগত।কথা গুলো ভাবতে ভাবতে প্রিয়তা বিছানার উপর রাখা শাড়ী টা নিয়ে ওয়াশ রুম চলে গেলো।
ঝর্ণার ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেখানে।এদিকে হাতের শাড়ীও রাখতে ভুলে বসে। যতক্ষণ কথা টা মাথাটা এসছে ততক্ষণে শাড়ী পুরোপুরি ভিজে গিয়েছে।
রুম হতে হঠাৎই পুরুষালী কণ্ঠে স্বর ভেসে এলো। প্রিয়তার
বুঝতে এক সেকেন্ড সময় লাগল না সাদনান ভাই রুমে এসছে।

#চলবে…..

[ভেবেছিলাম সিজন টু দেব না।কিন্তু সবার ইচ্ছে সিজন টু যেনো দেই।তাই সবার আবদার আর আমার কথা রেখে চলে এলাম সিজন টু নিয়ে। আর এতো দিন আপনাদের অপেক্ষা করানোর জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন প্লিজ।]

আমার তুমি সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট

রাত বাড়ছে। চাঁদের আলো পরিষ্কার হয়ে আসছে। আকাশে ঘন-কালো মেঘের ছড়াছড়ি। অথচ চাঁদের গায়ে একবিন্দু মেঘের দেখা নেই। সে নিজস্ব ধারার জোছনা বিলিয়ে যাচ্ছে। ঈশান কোণে হালকা মেঘের গর্জন ভেসে আসছে। বৃষ্টি নামতে পারে। আত্মীয় স্বজনদের বেশিরভাগই বাড়ি ফিরে যায়নি। মেঝেতে বিছানা করা হয়েছে। উঠানে বড় হাঁড়িতে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে। এই মুহূর্তে বাড়ির পরিবেশ দেখলে মনেই হবে না এখানে কোন শোক আছে। এই বাড়ির কোন মানুষ মা’রা গেছে। বিকেলে ফুফু কাঁদছিল। সে কি কান্না! চিৎকার শুনলে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এখন অবশ্য ফুফুর কান্না থেমে গেছে। কোমরে কাপড় বেঁধে রান্নার তদারকি করছে। কয়েকজন বাচ্চা উঠানে দৌড়াদৌড়ি করছে। উৎসবমুখর পরিবেশ।
সবার চোখের আড়ালে বেশ খানিকটা দূরে চলে গেলাম। আমার এসব ভালো লাগছে না। অন্ধকারে মধ্যে বেতের চেয়ারে পা উঠিয়ে বসে আছি। হঠাৎই দারোগা সাহেব একটা চেয়ার নিয়ে এসে আমার পাশে বসলেন। কোমল গলায় বললেন, “খারাপ লাগছে?”

“না, আমি ঠিক আছি। আপনি ফিরে যাননি?”

“যেতে চেয়েছিলাম। তোমার ফুফু যেতে দেয়নি। খাওয়া-দাওয়া করে যেতে বলল।”

“ওহ আচ্ছা।”

“তোমার বলেছিলাম না- আমার তোমার প্রতি এক ধরনের দূর্বলতা আছে?”

“হ্যাঁ বলেছিলেন।”

“কারণটা জানতে ইচ্ছে করেনি?”

“করলেও কি আপনি বলবেন?”

“হ্যাঁ বলব। তোমার মা’কে আমি খুব পছন্দ করতাম। বলতে পারো ভালোবাসতাম। কিন্তু ”

“মাকে নিয়ে কিছু শুনতে চাই না। আমার কাছে মা এই পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ। তারপর এখন তিনি বেঁচে নেই। দয়া করে তাকে নিয়ে কোন বাজে কথা বলবেন না।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “তুমি ঠিক বলেছ। তোমার মা সত্যিই খুব ভালো মানুষ। আমি তাকে বদনাম দিচ্ছি না।”

“তাহলে?”

“তাকে আমি ভালোবাসতাম ঠিকই! তবে আমাদের মধ্যে কোন সম্পর্ক ছিল না। প্রেম আলাপ হতো না।”

“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”

“এক তরফা ভালোবাসার নাম শুনেছ? আমার ক্ষেত্রেও তাই। যেদিন প্রথম তাকে ভালোবাসার কথা জানালাম সেদিন সে বলল তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের সপ্তাহে বিয়ে। তোমার মামাদের অনেক অনুরোধ করেছি। লাভ হয়নি। সেদিন রাতের কথা মনে আছে? তোমার মামারা আমাকে মে’রে ওখানে ফেলে রেখে গেছিল। সারারাত ওখানেই পড়ে ছিলাম। পরেরদিন লোকজন ধরে নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করে দেয়। শারিরীকভাবে সুস্থ হয়ে উঠি। চাকরি পাই। কিন্তু মানসিকভাবে ঠিক হতে পারিনি।”

“কেন পারেননি?”

“নিজের ওপর প্রচন্ড ঘৃণা হয়। কেন কয়েকদিন আগে তাকে নিজের মনের কথা বলতে পারলাম না? শুধু তাই নয়। আমার জন্য তোমার মামারা তোমার মা’কেও অনেক মে’রে’ছিল। দু’দিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। এসব কারণে নিজেকে আজও ক্ষমা করতে পারিনি।”

“বিয়ে করেছেন?”

“না। এমন অদ্ভুত জীবনের সাথে কাউকে জড়াতে ইচ্ছে করেনি। একজনের স্মৃতি নিয়ে বেশ সুখে আছি। এক পলকের স্মৃতি নিয়েও যে বেঁচে থাকা যায় তা নিজেকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।”

“একটা কথা জানতে চাইবো?”

“বলো।”

“মামা খুঁজে খুঁজে আপনাকে আমার কে’সের দায়িত্ব দিলো কেন?”

“এই থানার দারোগা হিসাবে কেসের দায়িত্ব আগে থেকেই আমার ওপর ছিল। পরে তোমার মামা কল দিয়ে তোমার পরিচয় বললেন। এই আর কি!”

“আমার ওপর আপনার কিসের দূর্বলতা?”

“তোমাকে তোমার মায়ের মতো দেখতে। এটাই আমার দূর্বলতা।”

হাসলাম। আমার খুব ক্লান্তি লাগছে। মনে হচ্ছে এই বেতের চেয়ারের ওপরই আমি ঘুমিয়ে পড়ব। দাদি মা’রা যাওয়ার পর আমার মাঝে মাঝে এরকম হয়। নিজেকে অসহায় এবং খুব ক্লান্ত মনে হয়। আশেপাশে কোথায় কি হচ্ছে, কে কি বলছে কিছু বুঝতে পারি না। কারোর কথাবার্তা কানে আসে না। নিজেকে খুব একা মনে হয়। এইতো দারোগা সাহেব এখনও আমার পাশে বসে আছেন। সমান তালে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলছেন অথচ তার কোন কথা আমার কানে আসছে না। মায়ের গলা শুনতে পাচ্ছি। তিনি খুব আদর করে আমার নাম ধরে ডাকছেন। বাবা ফয়সাল! এতো সুন্দর করে কি কেউ কখনও আমার নাম ধরে ডেকেছে? মনে পড়ে না। পানির শব্দ কানে বাজছে। মনে হচ্ছে যেন কেউ নদীর বুক চিরে দাঁড় বাইছে।

বেলা করে ঘুম ভাঙলো। ঘড়িতে সকাল নয়টা বাজে। ফুফু বলল, “কাল রাতে কি তোর শরীর খারাপ লাগছিল? ওভাবে ঘুমিয়ে পড়েছিলি কেন?”

মাথা নাড়ালাম। আমার কিছু মনে পড়ছে না। শেষবার দারোগা সাহেবের সাথে কথা বলছিলাম তারপর আর কিছু মনে নেই। ফুফু চিন্তিত গলায় বলল, “তুই ঘুমিয়ে পড়ার পর দারোগা সাহেব কোলে করে খাটে দিয়ে গেলেন। তুই কি কিছু ঠিক পাসনি?”

“না। আমার কিছু মনে নেই। সবাই চলে গেছে?”

“না। আজ মা’য়ের নামে মিলাদ পড়ানোর কথা আছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে যে যার বাড়ি যাবে।”

“তুমিও ওদের সাথে এ বাড়ি থেকে চলে যেও ফুফু। আমি তোমাদের কারো সাথে থাকতে চাই না।”

ফুফু আৎকে উঠলো। ভেজা গলায় বলল, “তিশা এখানকার কলেজে পড়ে, শিমুল তালেবের স্কুলও এখানে। তোর ফুফা নেই। এই অবস্থায় আমি কোথায় গিয়ে থাকব?”

সহজ গলায় বললাম, “সে কথা জানার কোন ইচ্ছে আমার নেই। তোমাদের ব্যাপার তোমরাই ভালো বুঝবে।”

“সে না হয় আমরা চলে গেলাম। কিন্তু তুই? তুই কি একা একা এই বাড়িতে থাকতে পারবি? কে রান্না করে খাওয়াবে তোকে?”

“আমি যেহেতু একা। সেহেতু একা থাকতেও পারব। আজ তোমার আমায় কে রান্না করে খাওয়াবে তার চিন্তা হচ্ছে। অথচ যেদিন আমাকে জে’লে নিয়ে গেল। সেদিন কি একবারের জন্য ও চিন্তা হয়েছিল? বাকিরা না হয় অন্যরকম। কিন্তু তোমার সাথে তো আমার র’ক্তের সম্পর্ক আছে। আমি তোমার আপন ভাইয়ের ছেলে। মা বাপ ম’রা এতিম মানুষ। একবারের জন্য হলেও কি আমায় দেখতে যেতে পারতে না? সত্যি বলতে কি? সবাই স্বার্থপর। আজ তুমি আমার প্রয়োজনে আমার সাথে থাকতে চাইছ না। নিজের প্রয়োজনে চাইছ। আমি সবাইকে মাফ করে দিতে পারি। ফুফা, ছোট দাদি, তুলি আন্টি, শিমুল তালেব সবাইকে। শুধু তোমাকে কখনও মাফ করতে পারব না। পারলে তুমি আমায় মাফ করে দিও।”

ফুফু কিছু বলল না। মাথা নিচু করে রইলো। চোখ দু’টো ঝাপসা হয়ে আসছে। এখন আর পানি বন্ধ করার কোন উপায় নেই। আমি ইমোশনাল হতে চাই না। এদের জন্য কাঁদতে চাই না।
চোখ জোড়া শুকিয়ে যাক,
মুছে যাক অশ্রুকণা।
যে আমার জন্য কাঁদে না,
আমিও তার জন্য কাঁদব না!
চোখ মুছে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বারান্দার অনেকখানি জায়গায় সূর্যের আলো পড়েছে। গোটা ঘটনায় শুধু ওই হাত কা’টা লোকটার জন্য আমার আফসোস হচ্ছে। বেচারা কোন দো’ষ না করেও মারাত্মকভাবে ফেঁসে গেল। দাদি মা’রা যাওয়ার পর তার লা’শে ছু’রি ঢুকিয়ে রেখে গেল। লোকজন নিয়ে জায়গাটা পাহারা দিয়ে রাখল যেন কেউ আসতে না পারে। দিনশেষে তার কোন লাভ রইল না। মানুষের জীবন বড্ড অদ্ভুত!

মিলাদ শেষ হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব এসেছেন। হয়তো ফুফু উনাকে দাওয়াত দিয়েছে। সবকিছু মিটে যাওয়ার পর ফুফু আমাকে নিজের কাছে ডাকলো। সহজ গলায় বলল, “আমি যা করেছি তার জন্য ক্ষমা চাওয়ার কোন ভাষা আমার জানা নেই। ধরতে গেলে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছি। স্বামী, শশুর বাড়ি, মা, ভাইপো। সবাই আমায় ছেড়ে চলে গেছে। আমি কাউকে ধরে রাখতে পারিনি। তোর সাথে আমার সম্পর্ক কখনও স্বাভাবিক হবে না। তাই আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি। ছেলেমেয়েদের নিয়ে যেখানে আশ্রয় হয় সেখানেই না থাকব। খেতে পেলে খাব না পেলে না খেয়ে দিন কাটবো। তবুও তোর সাথে থাকব না। এই বাড়ি তোর। বাড়ি নিয়ে ভালো থাকিস।”

ফুফু নিজের ছেলেমেয়েদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি তাদের ডাকলাম না। বিবেকের বিপক্ষে গিয়ে মনের আবেগকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোন মানে হয় না। তিশা আপু যাওয়ার সময় দু’বার পিছন ফিরে তাকিয়েছিল। চোখ সরিয়ে নিয়ে গেছি। এই মানুষটা আমায় কখনও খারাপ জানেনি। সবসময় নিজের ভাইয়ের মতো ভালোবেসেছে। আপু হয়তো জানতো সে একবার বললেই আমি তাদের রেখে দেবো। সেজন্যই কিছু বলেনি। সদর দরজা লাগিয়ে দিয়ে গিয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ধরনীর বুকে রাত নামছে। রাত নামছে আমার জীবনেও। সবকিছু থাকার পরও আজ আমি একা। বিশাল বড় এই বাড়িতে ধুকে ধুকে ম’র’লেও কেউ আমাকে দেখতে আসবে না। তেষ্টায় কাতর হয়ে চিৎকার করলেও এক গ্লাস পানি পাওয়া যাবে না। অঢেল সম্পদের মাঝে ঢুবে থাকা অসহায় প্রাণ আমি। তবে কি কিছু ভুল করলাম? ফুফুকে মাফ করে দিয়ে আমার কাছে রেখে দেওয়া যেত না? ক্ষমা যে মহৎ গুন। কেন পারলাম না আমি? দুষ্টু গরুর থেকে শূন্য গোয়াল ভালো- এ কথাটা আমার মা বলতেন। এই কথাকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি বিধায়ই পারিনি। দারোগা সাহেবের সাথে কথা হয়েছে -উনি আমার সাথে ব্যাংকে যাবেন বলেছেন। কিছু টাকা তুলতে হবে। ফুফুর হাতে হয়তো টাকা-পয়সা নেই। তাকে কিছু দেবো। নিজের জন্যও কিছু রাখতে হবে। রান্নার লোক খুঁজতে হবে। দাদির ক’ব’রের পাশে দাঁড়িয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়া হয়নি। অনেক কাজ বাকি রয়ে গেছে। দিনের আলো ফুটতেই কাজ শুরু করতে হবে। সত্যিই কি আমার জীবনে নতুন সূর্য উঠবে? নাকি নিকষ কালো রাতের মতো আঁধারে ডুবে থাকবে এ জীবন! হয়তো ভালো কিছুই হবে। দারোগা সাহেব বলেছেন- আমায় দত্তক নিবেন। আঠারো বছর পর্যন্ত নাকি দত্তক নেওয়া যায়? সত্যি মিথ্যা জানি না। তবুও আশায় বুক বাঁধতে ইচ্ছে করে। সুন্দর স্বপ্ন দেখতে ইচ্ছে করে। এটাই যে জীবন। সে তো নদীর মতে বহমান।

সমাপ্ত

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-১২

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১২

দারোগা সাহেব চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছেন। তার মুখ থমথমে। তিশা আপুও কোন কথা বলছে না। এক কোণে গুটিসুটি মে’রে দাঁড়িয়ে আছে। ফুফু চিন্তিত মুখে ফুফার দিকে তাকাচ্ছে। মতিন বলল, “সবকিছু মিটে যাওয়ার পর আপনাদের আর কি কথা থাকতে পারে? এভাবে আমাদের সময় নষ্ট করবেন না।”

ফুফা বললেন, “সেটাই তো আমি বুঝতে পারছি না। সবকিছু স্বীকার করে নেওয়ার পরও এসব আলাপ আলোচনার দরকার কি? আপনারা এসব এলাউ করছেন কেন?”

দারোগা সাহেব মাথা নাড়ালেন। ভরাট গলায় বললেন, “তিশা কিছু বলতে চায়। সেজন্যই ওকে থানায় আনা হয়েছে। আপনার স্ত্রী আর ফয়সালও এসেছে। এতে আমার কোন হাত নেই। তিশা, তুমি কি বলতে চাও? বলো।”

ফুফার মুখ ভয়ে বিবর্ণ হয়ে গেছে। ফুফুও দাঁত কামড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তিশা আপু বলল, ” আমার আব্বুকে নানি আপুকে মা’রেনি। উনাকে আমি মে’রেছি।”

দারোগা সাহেব বললেন, “এ কথা বলছ কেন?”

তিশা আপু ঢোক শুকনো ঢোক গিলে বলল, “নানি আপু ফয়সালকে নিয়ে একটু বেশি চিন্তা করতেন। সেদিন ফয়সাল আব্বার সাথে মাছ ধরতে গেছিল। এটা নানি আপুর পছন্দ হয়নি। উনি আমাকে ডেকে নিয়ে বললেন,” তোর বাবা কোথায় মাছ ধরতে যায় জানিস? না জানলে তোর বাপের থেকে জেনে একটু জানাস তো।”
আমি জানতাম না ওরা কোথায় মাছ ধরতে যায়। সেজন্য আব্বুর থেকে জেনে নানি আপুকে বলেছিলাম। নানি আপু আমাকে নিয়ে ওই জায়গাটা দেখতে গেছিলেন। তারপর,”

দারোগা সাহেব ভ্রু কুঁচকে বললেন,” তারপর কি? চুপ করে থাকার কিছু নেই। যা বলতে চাও। সোজাভাবে বলো।”

“ওই জায়গায় যাওয়ার পর নানি আপুর সাথে একটা ব্যাপার নিয়ে ঝামেলা হয়। তর্কের এক পর্যায়ে আমি উনাকে ধাক্কা মা’রি। নানি আপু কাঁদায় পড়ে যায়। অনেক ডাকাডাকির পরেও ওঠেনি। অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওঠাতে পারিনি। ওই জায়গায় তেমন লোকজন থাকে না। সাহায্যের জন্যও কাউকে খুঁজে পাইনি। আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম। তাড়াতাড়ি করে নানির নম্বর থেকে আব্বুকে কল দিই। সবকিছু খুলে বলি। আব্বু আমাকে তাড়াতাড়ি করে হাসপাতালে যেতে বলে। কিন্তু আমি রাজি হচ্ছিলাম না। আব্বু বলল- তার কোন বন্ধু এসে নানি আপুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমি যেন হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারকে সব বলে রাখি।”

ফুফু ফুফার দিকে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি কিছু বলতে চাইছে। ফুফা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। দারোগা সাহেব বললেন, “থামলে কেন? বলো।”

তিশা আপু বলল, “আব্বুর কথামতো আমি হাসপাতালের দিকে যাই। কিন্তু ডাক্তারের কাছে যেতে পারিনি। তার আগেই ফুফু আর দাদি আমাকে ধরে নিয়ে আসে। আমাকে বলে যে নানি আপু সুস্থ আছে। দুশ্চিন্তা না করতে। আমি নানি আপুকে দেখতে চাইছিলাম কিন্তু আমাকে যেতে দেয়নি। ধরে বেঁধে বাড়িতে নিয়ে আসে। এরপর জানতে পারলাম নানি আপুর খু’নের অপরাধে ফয়সালকে গ্রে’ফ’তার করা হয়েছে। আমি সবকিছু সত্যি বলতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু দাদি বলতে দেয়নি। ফুফু আর দাদি মিলে আমাকে অনেক মা’র’ধ’র করে। ঘরে আটকে রাখে। মা এসবের কিছু জানত না। ওরা মা’কে বলেছিল আমি একটা ছেলের সাথে পালিয়ে যেতে গিয়ে ধরা পড়েছি। তাই এমন করছে।”

দারোগা সাহেব মতিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তাড়াতাড়ি যাও। ওরা যেন পালাতে না পরে। আমার মন বলছে ওরা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে।”

মতিন তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে গেল। ফুফু বলল, “তুই এসব কথা আগে বলিসনি কেন?”

তিশা আপু বলল, “আমি বলতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি শুনতে চাওনি। কালকেও না। উল্টো ফয়সালকে চড় মা’র’লে, ওর কোন কথা না শুনে আমাকে নিয়ে ঘরে চলে আসলে। দাদি তোমাকে যা বুঝিয়েছে তুমি তাই বুঝে গেছ। কখনও নিজের মেয়ের কাছে প্রশ্ন করার প্রয়োজন মনে করোনি। ফয়সাল আমার ছোট ভাই, শিমুল তালেবের মতোই ভাই মনে করি। ওর সাথে আমার অনৈতিক সম্পর্কের কথা কিভাবে বিশ্বাস করতে পারলে?”

ফুফু সত্যিকার অর্থে নিভে গেছে। কথা বলছে না। আঁচলে মুখ চেপে দাঁড়িয়ে আছে। দারোগা সাহেব বললেন, “চুপ করে আছেন কেন? বলুন। আপনার শাশুড়ি আপনাকে কি বলেছিল?”

ফুফু ইতস্তত করে বলল, “মায়ের মৃ’ত্যু, ফয়সালের ধরা পড়া এসবের মধ্যে তিশার ব্যাপারে কিছু ভাবার সময় পাইনি। শাশুড়ি ননদ বলেছিল- তিশা এক ছেলের সাথে পালিয়ে যাচ্ছিল ওরা ধরে নিয়ে এসেছে। আমার মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না বিধায় এসব নিয়ে চিন্তা করতে চাইনি। ওরা সবকিছু দেখেছে। গতকাল ফয়সাল বাড়ি যাওয়ার পর তুলি আমার কাছে এলো। একটা চিঠি দিয়ে বলল -ফয়সাল এই চিঠি তিশাকে লিখেছে৷ চিঠিতে ফয়সাল আর তিশার নাম ছিল। তুলি বলল, ‘ওদের মধ্যে নিয়মিত অনৈতিক যোগাযোগ আছে। তিশার জন্য হলেও ফয়সালকে সরাতে হবে।’ আমি বিশ্বাস করতে চাইনি। কিন্তু যখন দেখলাম তিশা লুকিয়ে লুকিয়ে চোরের মতো ফয়সালের ঘরে যাচ্ছে। তখন সবকিছু বিশ্বাস হয়ে গেল। দরজায় কান পেতে শুনলাম- তিশা ফয়সালকে লাইট নিভিয়ে দিতে বলছে। সহ্যসীমার বাইরে চলে গেল। ফয়সালকে ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়ে তিশাকে নিয়ে ঘরে চলে গেলাম। তখন তিশা বলল- সে একবার দারোগা সাহেবের সাথে কথা বলতে চায়। ওর আব্বু নাকি খু’ন করেনি। সেজন্যই আজ ওদের নিয়ে থানায় আসলাম।”

ফুফা মাথা নিচু করে সবকিছু শুনছে। তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে তিনি এই মুহূর্তে মাটির সাথে মিশে যেতে পারলে শান্তি পেতেন। দারোগা সাহেব বললেন, “শেষ প্রশ্ন। তিশা তোমার নানি আপুর সাথে কি নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল?”

“ফয়সালের লেখা চিঠি নিয়ে। ওটা আমরা মজা করে লিখেছিলাম। ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার জন্য। চিঠিটা নিয়ে বইয়ের মধ্যে রেখে দিয়েছিলাম। পরে আর খুঁজে পাইনি। সেদিন নানি আপু আমাকে ওই চিঠি নিয়ে কথা শোনাচ্ছিলেন। চরিত্র নিয়ে অনেক বাজে কথা বললেন। আরও কিছু বলেছিলেন যা মুখে আনতে পারছি না। সেগুলো খুবই কুৎসিত ধরনের কথা।”

আপু কাঁদছে। আমার চোখেও পানি চলে এসেছে। মানুষের মনে এতো প্যাঁচ কিভাবে থাকতে পারে? সংসারে অশান্তি লাগিয়ে তারা কি সুখ পায়? আমি না হয় ওদের কিছু না কিন্তু তিশা আপু তো ওদের আপন। তাকে নিয়ে এমন নোংরা খেলা খেলতে একবারও বাঁধলো না? ফুফুই বা কিভাবে এসব বিশ্বাস করে নিতে পারলো? কালকে চ’ড়ের কারণটা আজ পরিষ্কার হয়ে গেছে। দারোগা সাহেব বললেন, ” ফয়সালের দাদির মৃ’ত্যু হয়েছে হার্ট-অ্যাটার্কে। এটা যে কারো গভীর ষড়যন্ত্র তা বুঝতে পেরেছি যেদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট হাতে আসলো। রিপোর্টে স্পষ্ট লেখা আছে উনার মৃ’ত্যুর কারণ হার্ট-অ্যাটার্ক। সেদিন থেকে মোশারফ সাহেবের ওপর সন্দেহ তৈরি হয়। এসব পরিকল্পনা উনার তৈরি তার বুঝতে খুব বেশি সময় লাগেনি। কিন্তু এতে কার কার হাত আছে তা বোঝা সহজ কাজ ছিল না। মোশারফ সাহেব কিছু স্বীকার করতেন না। এই যেমন উনি তিশার নামটা এড়িয়ে গেছেন। সেদিন তিশা কল দেওয়ার পর উনি অতিদ্রুত পরিকল্পনা সাজালেন। উনার বন্ধু কাম কুকর্মের সাথীকে দিয়ে খু’ন করানোর প্লান করলেন। ফয়সালকে সাথে নিয়ে গিয়ে ওকে ফাঁসিয়ে দিলেন। উনি ভেবেছিলেন ভিডিও দেখিয়ে প্রমাণ করে দিবেন ফয়সাল খু’ন করেছে। আমিও প্রথম দিকে ফয়সালকেই সন্দেহ করেছিলাম। কিন্তু কিছুক্ষণ চিন্তা করার পর ভাবনা বদলাতে শুরু করলো। সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হয়ে গেল যেদিন পোস্টমর্টেম রিপোর্ট আসলো।”

আমি বললাম, “আপনি যখন সবকিছু বুঝে গেছিলেন তাহলে এতদিন নাটক করলেন কেন? সহজেই কে’সটা সমাধান করে দিতেন।”

দারোগা সাহেব তরল হাসি হাসলেন। শান্ত গলায় বললেন, “একটু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছে হলো তাই। এমন করলাম।”

ঘন্টা খানেক পর মতিন ফিরে এলো। তার সাথে দু’জন কনস্টেবল তুলি আন্টি আর ছোট দাদিকে ধরে নিয়ে এসেছে। মতিন বলল, “সব গহনাপত্র নিয়ে পালানোর চেষ্টা করছিল। সময় মতো গিয়ে ধরে ফেলেছি। একটু দেরি হলেই হাতের বাইরে চলে যেত।”

“খুব ভালো। জেলে ঢুকিয়ে দাও। মা আর ভাই-বোন জে’লে পঁচে ম’রুক।

ফুফু মেঝেতে ঢলে পড়লো। একদম পড়ে যায়নি। তিশা আপু তাকে ধরে ফেলেছে। মতিন বলল, ” ফ্যামিলি ড্রামার ষোলকলা পূর্ণ হয়েছে।”

হাসপাতালের বিছানায় বসে আছি। ফুফুর জ্ঞান ফেরেনি। ডাক্তার বলেছেন, ” অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে এমনটা হয়েছে।” তিশা আপু ক্রমাগত কাঁদছে। তালেব এসেছে। সে-ও মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে।
ঘন্টা খানেক পর ফুফুর জ্ঞান ফিরলো। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে সে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। ভেজা গলায় বলল, “আমার জীবনের পাপের শাস্তি আমি দুনিয়াতেই পেয়ে গেলাম। বাবা ফয়সাল, আমাকে মাফ করে দিস বাপ। আমাকে মাফ করে দিস। আল্লাহ আমায় দুনিয়ায় ঘোরাচ্ছে কেন? আমায় কেন তুলে নিচ্ছে না?”

ফুফু কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। ভুল বুঝতে পারার পর যে অনুশোচনা হয় তার কাছে দুনিয়ার সব শাস্তি হার মেনে যায়।

মর্গ থেকে দাদির লা’শ নিয়ে এসেছে। লা’শ থেকে কেমন গন্ধ আসছে। কপ্পুর, আতরের গন্ধ ওই গন্ধকে চাপা দিতে পারছে না। আসর বাদ জানাজা হবে। দাদির আত্মীয় স্বজনরা দলবেঁধে আসতে শুরু করেছে। অথচ এতদিন এদের বেশিরভাগ মানুষের দেখা পাওয়া যায়নি। কেউ সামান্য একটা কল দিয়েও খোঁজ নেয়নি। আজ তারা হাতে-হাতে কাজ করছে। বাঁশ কাটছে, ক’ব’র খুঁড়ছে। ম’রা লা’শকে দুনিয়ার ওপর ঘোরানোর নিয়ম নেই। যত দ্রুত সম্ভব তাদের মাটির নিচে চাপা দিয়ে দিতে হয়। এই কাজে কেউ কৃপণতা করে না। দারোগা সাহেব আর মতিন সাথে এসেছে। বোধহয় জানাজা পড়বেন।
লোকজনের মধ্যে থেকে খানিকটা দূরে চলে গেলাম। কোলাহল ভালো লাগছে না। শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি!

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-১১

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১১

দারোগা সাহেব হাসলেন। সে হাসিতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ে শরীর জমে আসে। ভীতু গলায় বললাম, “কাকে মা’র’তে চাইছেন? আমাকে?”

দারোগা সাহেব অট্টহাসি দিয়ে বললেন, “তোমাকে মে’রে আমার কি লাভ? আমি তো তোমার মা’কে মা’র’তে চাইতাম। যে মেয়ে আমার গোটা জীবনটা শেষ করে দিয়েছে। তাকে কিছুতেই ক্ষমা করা যায় না। কিছুতেই না।”

“মা বেঁচে নেই। অনেক আগেই পৃথিবীতে ছেড়ে চলে গেছে। তার ওপর আপনার কিসের এতো রাগ? কি করেছে আমার মা?”

দারোগা সাহেব হড়বড় করে বললেন, “জানি আমি। সবকিছু জানি।”

হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছি। কি বলবো কি করব কিছুই বুঝতে পারছি না। আমার অভিধানে এখন একটা শব্দ ঘুরে বেড়ায় -বুঝতে পারছি না। মাঝেমধ্যে নিজের ওপরই বিরক্ত লাগে। কেন আমি কিছু বুঝতে পারি না? সবকিছু কেন এলোমেলো হয়ে যায়? দারোগা সাহেব কিছু না বলে হনহনিয়ে মাঠের মধ্যে চলে গেলেন। কৌতুহল বশত আমিও উনার পিছন পিছন গেলাম। লোকটার আচরণ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। অদ্ভুত ব্যবহার করছে। যেন উনি মানসিকভাবে সুস্থ নেই। একটা কলাগাছের ওপর ক্রমাগত ছু’রির আঘাত করছে, বিড়বিড় করে কিছু বলছে। সেসব কথার ধরন খুব হালকা, বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়।

চাঁদের আলোয় খোলা মাঠের নিচে দারোগা সাহেবকে সম্পূর্ণ অন্যরকম লাগছে। সুস্থ মানুষ মনে হচ্ছে না। খানিক বাদে উনি ক্লান্ত হয়ে মাটিতে বসে পড়লেন। ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদতে লাগলেন। বিস্মিত গলায় বললাম, ” ঠিক আছেন আপনি? এমন ব্যবহার করছেন কেন? শরীর খারাপ লাগছে নাকি?”

দারোগা সাহেব মাথা নাড়লেন। অস্পষ্ট গলায় বললেন, “আমি ঠিক আছি। গাড়িতে গিয়ে বসো। দ্রুত যাও।”

উনার সাথে কথা বাড়ালাম না। তড়িঘড়ি করে এসে গাড়িতে বসলাম। ভয় কিংবা আতঙ্ক কোনটাই কাটেনি। ঘন্টা খানেক বসে থাকার পর দারোগা সাহেব ফিরলেন। গাড়িতে বসতে বসতে অসম্ভব কোমল গলায় বললেন, ” ফয়সাল, তুমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলে তাই না?”

মাথা নাড়ালাম। তিনি বললেন, “এটা আমার খুব পুরনো একটা রোগ। মাঝেমধ্যে মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। নিয়মিত সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে হয়। কয়েকটা ওষুধ নেওয়া লাগে। এ মাসে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি্ দু’দিন ধরে ওষুধ নেওয়া হচ্ছে না৷ সেজন্য খানিকটা ওলটপালট হয়ে পড়েছিলাম৷ তোমার কোন ক্ষতি করিনি তো?”

সরল গলায় বললাম, “না। আমার কিছু করেননি। আমি ঠিক আছি।”

” সত্যি বলতে কি? এই পৃথিবীতে অনেক কিছু আবিষ্কার হলেও আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার মেশিন তৈরি হয়নি। সাইকিয়াট্রিস্ট আমায় অনেক কিছু বুঝিয়ে বলে, আমিও উনার কথা বুঝতে চেষ্টা করি। নিয়ম-কানুন মেনে চলি। তারপরেও আমি তো একটা মানুষ! কত সময় আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি বলো?”

দারোগা সাহেব দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। কি বলবো বুঝতে পারলাম না। খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর দারোগা সাহেব বললেন, “তুমি হয়তো আমার কথা বুঝতে পারছ না। অবশ্য গোটা ঘটনা না শুনলে বুঝতেও পারবে না৷”

“বলুন আমাকে। আমি বুঝতে চাই। কোথায় কষ্ট আপনার?”

দারোগা সাহেব শব্দ করে নাক ঝাড়লেন। টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছতে বললেন, “তুমি বাচ্চা মানুষ। তোমায় সবকিছু বলা ঠিক হবে না। শুধু জেনে রাখো আমাকে তোমার মামা এই কে’সের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। উনি জানতেন তোমার প্রতি আমার অন্য ধরনের দূর্বলতা আছে। সেজন্যই দিয়েছিলেন। যেন আমি সবটুকু দিয়ে তোমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করি।”

“আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। মামা আপনাকে আমার দায়িত্ব কেন দিবে? উনি চাইলে তো সরাসরি আমার সাথে দেখা করতে পারতেন।”

“এতদিন খোঁজখবর না নেওয়ার পর হুট করে এসে দেখা করা যায় না। অন্তত তোমার মামা এমনটা মনে করেননি।”

“মামা কেমন আছে? শেষবার মা’য়ের সাথে গেছিলাম। তারপর আর যাওয়া হয়নি।”

দারোগা সাহেব কিছু বললেন না। গাড়ি চালাতে লাগলেন। মানসিকভাবে অসুস্থ একজন মানুষ পুলিশ চাকরি করে? কিভাবে? নাকি কেউ উনার এই সমস্যার কথা জানে না? কোন বিষয়ে অতিরিক্ত কৌতুহল ভালো না। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করতে লাগলাম। দারোগা সাহেব আমাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে সহজ গলায় বললেন, “পরে কখনও দেখা হলে আমার জীবনের গল্প বলবো। ভালো থাকবে।”

ব্যস্ত হয়ে প্রশ্ন করলাম, “আমার প্রতি আপনার কিসের দূর্বলতা? কি হন আপনি আমার?”

দারোগা সাহেব জবাব দিলেন না। শুধু হাসলেন। তারপর ব্যস্ত ভঙ্গিতে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে গেলেন। এক দৃষ্টিতে গাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আজ হঠাৎ অন্যরকম অনুভূতি হচ্ছে। এ অনুভূতি বলে প্রকাশ করা যায় না।
শান্ত পায়ে বাড়ির ভেতরে যেতে লাগলাম। এতদিন হয়ে গেছে দাদির লা”শ পাওয়া যায়নি। পুলিশেরা লা’শ দেয়নি। দাফন কাফন করা হয়নি। কেন দেয়নি বুঝতে পারছি না। দারোগা সাহেবকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করার দরকার ছিল। করা হয়নি। আজ-কাল গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মনে থাকছে না। ফুফু সোফার কোণায় বসে ছিল। আমায় দেখে স্বাভাবিক গলায় বলল, ” দারোগা সাহেব দিয়ে গেলেন?”

মাথা নাড়ালাম। মুখে কিছু বললাম না। ফুফু বলল, ” হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে। রান্না শেষ হলে খেতে ডাকছি।”

ফুফুর ব্যবহারে আশ্চর্য হলেও মুখে কিছু বললাম না। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ঘরে চলে এলাম। বহুদিন বাদে নিজের বিছানায় শুয়ে আছি। সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। হয়তো স্বপ্নটা সুন্দর নয়, তবে বিষাক্তও নয়। শূন্যতা আছে, পূর্ণতা নেই। তবুও খুব একটা খারাপ লাগছে না। রাতের খাওয়ার সময় ছোট দাদি বললেন, ” ফয়সাল, আমার ছেলেটা তো জে’লে চলে গেল। আমাদের একটু দেখে রাখবা? বড্ড অসহায় হয়ে পড়েছি।”

শান্ত গলায় বললাম, “আমি কিভাবে দেখে রাখবো? দেখে রাখার বয়স হয়নি আমার। আমি কখনও আপনাদের ক্ষতি চাইনি। তারপরও তো আপনারা আমায় আপন ভাবতে পারেননি।”

ফুফু বলল, “আমাদের ভুল হয়ে গেছে বাবা। তোর ফুফা বুঝতে পারেনি।”

“হাসালে! সত্যিই হাসতে ইচ্ছে করলো। ফুফা কি বাচ্চা ছেলে যে বুঝতে পারেনি? এসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না ফুফু। আমি তোমাদের আপন মনে করতাম। কিন্তু তোমরা তা করোনি। দাদিকে পর্যন্ত আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছ। তোমাদের ক্ষমা করার প্রশ্নই ওঠে না।”

ফুফু বিস্মিত গলায় বলল, “তার মানে? কি বলতে চাইছিস তুই?”

“কিছুই বলতে চাইছিলাম না। তবে তোমরা যখন নিজে থেকে জানতে চাইলে তখন বলছি- তোমাদের সাতদিন সময় দিলাম। এই বাড়ি থেকে চলে যাবে। কোথায় যাবে কি করবে কিছু জানার ইচ্ছে আমার নেই। আমি শুধু জানি তোমাদের এই বাড়িতে রাখলে আমি একদমই নিরাপদ থাকবো না।”

“আমাদের কাছে তুই নিরাপদ থাকবি না?”

“না থাকব না। এতদিন দাদি থাকার পরও কি নিরাপদ ছিলাম? ছিলাম না। শোনো ফুফু, তুমি খুব ভালো করেই জানো এই বাড়ি আমার। অন্তত দাদার উইল অনুযায়ী এই বাড়ির মালিক আমি। তাছাড়া আমার বাবার সব সম্পত্তির মালিকও আমি। দাদা তোমার অংশ আগেই তোমাকে দিয়ে দিয়েছে। কাজেই আমার সম্পত্তির একটা কানাকড়িও তোমরা পাবে না।”

ফুফু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে-মুখে বিস্ময়ের ভাব। আমি এমন কিছু বলব তা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি। ফুফুর চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট গলায় বললাম, “এসব সম্পত্তি নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যাথা ছিল না। কখনও ভাবিনি তোমরা সম্পত্তির মোহে পড়ে র’ক্তের সম্পর্কের মূল্য দেবে না।”

ফুফু আমতা আমতা করে বলল, “তোর ফুফা যা করেছে তাতে আমি খুব লজ্জিত রে বাপ। এসব বলে আমার কষ্ট বাড়িয়ে দিস না।”

“কষ্ট? লজ্জা? সবসময় ফুফার হয়ে সাফাই গাইতে তখন তোমার কোন লজ্জা ছিল না? আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর একবারও বলেছিলে আমি এমন কিছু করতে পারি না। বলোনি। সবসময় ফুফার হা তে হা বলেছ, না তে না মিলিয়েছ। এখন কুমিরের কান্না কেঁদে কোন লাভ হবে না।”

শিমুল তীক্ষ্ণ গলায় বলল, “মায়ের সাথে ঠিকভাবে কথা বল ফয়সাল। না হলে তোর খবর করে দিবো।”

মুচকি হেসে বললাম, ” কি খবর করবি আমার? আমার গায়ে যদি ফুলের টোকাও লাগে পুলিশ এসে তোদের সবাইকে জে’লে নিয়ে যাবে। দারোগা সাহেবকে বলে সেই ব্যবস্থা করে এসেছি। আর একটা কথা, এটা আমার বাড়ি। তুই আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমায় হুমকি দিতে পারিস না। এক্ষুনি আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যা।”

শিমুল খাবার ফেলে উঠে দাঁড়ালো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ফুফুর দিকে তাকিয়ে ফোসফাস করতে করতে ঘরে চলে গেল। ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে খেতে শুরু করলাম। ছোট দাদি বললেন, “দাদু ভাই তোমার কষ্টটা আমি বুঝতে পারছি। তাই বলে এতো তাড়াহুড়ো করে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত না। আমরা তোমার নিজের লোক।”

“না, আপনি কিংবা আপনারা কেউই আমার নিজের লোক না। এতদিন জে’লে ছিলাম। কয়বার আমায় দেখতে গিয়েছিলেন? একবার? দুবার? শূন্যবার?”

ছোট দাদি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, “তোমার দাদির লা’শ ফেরত দিক। দাফন হোক। আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। অন্যের কথা শুনে থাকার দরকার কি যখন নিজেদেরই বাড়িঘর আছে।”

“এইতো ঠিক বুঝেছেন। কাল সকালে থানায় যাব। দাদির লা’শের ব্যাপারে কথাবার্তা বলবো। তারপর আপনারা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবেন। কোন কিছুর বিনিময়ে আমি আর আপনাদের সাথে থাকব না।”

ছোট দাদি কিছু বললেন না। চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগলেন। খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরে চলে এলাম। দারোগা সাহেবের কথাটা মাথা থেকে সরাতে পারছি না। আমার প্রতি ওনার কি এমন দূর্বলতা থাকতে পারে? এই ব্যাপারটা আমায় খোঁজ নিতেই হবে। আমার কাছে মায়ের একটা ডাইরি আছে, ওইটা পড়ে দেখবো? ওখানে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। ভাবনা মতো ডাইরিটা বের করে নিয়ে বিছানায় বসে পড়লাম। হঠাৎই তিশা আপু দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। তড়িঘড়ি করে দরজা লাগাতে লাগাতে বলল, “ফয়সাল লাইট বন্ধ করে দে। তোর সাথে কথা আছে।”

খানিকটা অবাক হলেও লাইট বন্ধ করে দিলাম। তিশা আপু ফিসফিস করে বলল, “আব্বা নানিকে খু’ন করেনি রে ভাই।”

“এসব কি বলছ? তাহলে কে খু’ন করেছে?”

“আমি। আমি খু’ন করেছি। সেদিন নানির সাথে আমিও বেরিয়েছিলাম। তারপর!”

দরজার ওপর কেউ খুব জোরে আঘাত করল। যেন দরজা ভেঙে ফেলবে। ওপাশ থেকে ফুফুর গলা শোনা যাচ্ছে। তীক্ষ্ণ গলায় বলছে, “ফয়সাল দরজা খোল। এক্ষুনি দরজা খোল। তিশা তোর ঘরে এসেছে?”

তিশা আপু ভয়ে কাঁপছে। ইশারায় না বলতে বলছে। আপুকে খাটের কোণায় লুকিয়ে থাকতে বলে দরজা খুললাম। দরজা খোলার সাথে সাথে ফুফু আমার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় মা’রল। কর্কশ গলায় বলল, “তিশা কোথায়? বল তিশা কোথায়?”

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-১০

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১০

মিনিট পাঁচেক পর মতিন একজন মানুষকে নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। অবাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকটা হতবাক হয়ে গেছি বলা চলে। এই লোককে এখানে কেন আনা হয়েছে? দারোগা সাহেব বললেন, “মোশারফ সাহেব, দেখুন তো চিনতে পারেন কি-না? লোকটাকে আপনার পরিচিত মনে হচ্ছে।”

ফুফা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “না, চিনতে পারছি না। উনি আমার পরিচিত নয়।”

দারোগা সাহেব মৃদু হাসলেন। সহজ গলায় বললেন, “ফয়সাল, দেখো তো, তুমি একে চিনতে পারো কি-না?”

“জ্বি চিনতে পারি। ফুফার সাথে যেদিন ভৈবর নদীর পাড়ে মাছ ধরতে গিয়েছিলাম। ওইদিন উনার সাথে দেখা হয়েছিল। উনার একটা হাত কা’টা।”

“এইতো ফয়সাল চিনতে পেরেছে, তাহলে আপনি কেন চিনতে পারলেন না?”

ফুফা কিছু বললেন না। কঠিন দৃষ্টিতে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ছোট দাদি বললেন, “আমাদের হেনস্তা করবেন না। পুলিশ হয়েছেন বিধায় কি মাথা কিনে নিয়েছেন?”

দারোগা সাহেব বললেন, “মাথা কিনে নেওয়ার কথা আসছে কেন? তদন্তের খাতিরে অনেক কিছুই করতে হয়। যাইহোক। এই লোকটার সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই।”

ফুফু বলল, “কারো সঙ্গে পরিচিত হওয়ার প্রয়োজন মনে করছি না। সোজা কথাগুলো সোজাভাবে বলুন। এখানে মেয়ের বিয়ে দিতে বসিনি যে হাজার কথা আলোচনা করতে হবে।”

দারোগা সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, “বেশ। এই যে তুমি, মোশারফ সাহেবকে চিনতে? আগে থেকে পরিচয় ছিল?”

হাতকাটা লোকটা মাথা নাড়ালো। স্পষ্ট গলায় বলল, ” জ্বি চিনতাম। বেশ আগে থেকে পরিচয় ছিল।”

“কিভাবে পরিচয় হয়েছিল?”

“একটা অনুষ্ঠানে। তারপর থেকে যোগাযোগ আছে। নিয়মিত যোগাযোগ হয়।”

দারোগা সাহেব সরল গলায় বললেন, “পরিচিত হওয়া তো দোষের কিছু নয়। মোশারফ সাহেব, আপনি উনাকে চিনতে অস্বীকার করলেন কেন? এর পিছনে বিশেষ কোন কারণ নেই তো? নাকি আপনার ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় হচ্ছে?”

ফুফা কিছু বললেন না। ভাবলেশহীন চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। একটু খেয়াল করলে বোঝা যায় ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। বসার ঘরে পিনপতন নীরবতা। সবাই কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। তুলি আন্টি উসখুস করছে। খেয়াল করলাম মতিন এক দৃষ্টিতে তুলি আন্টির দিকে তাকিয়ে আছে। নিরবতা ভেঙে ছোট দাদি বললেন, “এখানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রেখেছেন কেন? কাজের কথা বলুন। অচেনা একটা লোককে ধরে এনে আমার ছেলেকে হেনস্তা করতে চাইছেন কেন? আপনাদের পুলিশদের উদ্দেশ্য নিশ্চয়ই খারাপ।”

দারোগা সাহেব বললেন, ” আমার উদ্দেশ্য খারাপ হলে আপনার ছেলের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যেতাম। যাইহোক কাজের কথা বলি। এই যে লোকটাকে দেখছেন, সে কোন সাধারণ মানুষ নয়। বরং কুখ্যাত অপরাধী। জে’ল পালানোর রেকর্ডও আছে। এমনকি এখনও জে’ল পালিয়ে বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

” অপরাধী পালিয়েছে, তাদের ধরবেন। এর সাথে আমার ছেলের কি সম্পর্ক?”

“সেই কথাটা না হয় তার মুখ থেকেই শোনেন। এই যে বলতে শুরু করেন আপনি।”

লোকটা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, ” মোশারফ ভাইয়ের সাথে বেশ অনেকদিনের পরিচয়। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা হতো। বিকেলে দেখা-সাক্ষাৎ, হালকা খাওয়া-দাওয়া। এভাবেই ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো। আমাদের কয়েকজনের মাদকের ব্যবসা আছে। পরিচিত বাড়ার পর উনাকেও সেই দলের সাথে যুক্ত করতে চেয়েছিলাম। উনিও রাজি হয়েছিলেন। বেশ কয়েকদিন দু’জনে মিলে মাল দেওয়া-নেওয়া করেছি। ভালোই চলছিল। লাভ হচ্ছিল প্রচুর। হঠাৎ করেই মোশারফ সাহেব প্রস্তাব করলেন- একটা ছেলেকে দলে আনবেন। ছেলেটা আনা-নেওয়ার কাজ করবে। বাচ্চা ছেলে বিধায় কেউ সন্দেহ করবে না। আমিও রাজি হয়ে গেছিলাম। বেশ কয়েকদিন ধরে পুলিশ আমাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। নতুন কেউ এলে আমার নিজের গা ঢাকা দেওয়ার ভালো সুযোগ হবে বিধায় একটুও অমত করিনি। ছেলেটা একদিন মাল ডেলিভারি দিয়েছিল, সমস্যা করেনি।”

আমার কেমন অদ্ভুত লাগতে আরম্ভ করলো। সেদিনের ওই পুটলির মধ্যে এসব জিনিস ছিল। আর আমি না বুঝেই ওই লোকটাকে দিয়ে এসেছিলাম। দারোগা সাহেব বললেন, “চুপ হয়ে যাওয়ার কিছু হয়নি। বলতে থাকেন।”

লোকটা একবার ফুফার দিকে তাকালো। তার দৃষ্টিতে রাগ ঝরে পড়ছে। গলার স্বর কর্কশ করে বলল, “বেশ নিশ্চিন্তে ছিলাম। হঠাৎ করে এই লোকটা আমায় কল দিয়ে বলল- একজনকে খু’ন করতে হবে। আমি প্রথমে রাজি হইনি। জে’ল পালানো আসামি হয়ে খু’নখা’রা’বি করার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু ওই পোড়া কপাল। উনি আমাকে ব্লাকমেইল করতে থাকলেন -যে কাজটা না করলে সবকিছু পুলিশকে বলে দিবেন। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। সেজন্য উনার প্রস্তাবে রাজি হই। উনি আমাকে পরিকল্পনা বললেন, ভৈবর নদীর পাড়ে একটা বুড়ি পড়ে আছে। তাতে গিয়ে ছু’রি মা’র’তে হবে। অন্যকিছু দিয়ে মা’র’লে হবে না। ছু’রিই মা’র’তে হবে।”

ফুফু বলল, “আপনি কাজটা করেছিলেন?”

“না করে আর কি কোন উপায় ছিল? আমার লাগাম ওই লোকটার হাতে ধরা, বাধ্য হয়ে এসব করেছি।”

ছোট দাদি বললেন, “দারোগা সাহেব, এই লোকটার কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। তাছাড়া ও নিজেই একটা অপরাধী ওর সাক্ষ্য নেওয়ার কি কেন প্রয়োজন আছে?”

দারোগা সাহেব বললেন, “অবশ্যই প্রয়োজন আছে। ভুলে যাবেন না অপরাধীরা পরস্পরের বন্ধু এবং শত্রু। আপনি যেহেতু ঘটনাটা বুঝতে পারছেন না। তাহলে আপনাকে বুঝিয়ে বলছি। আপনার গুনধর ছেলে এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে দিয়ে মা’দক পা’চার শুরু করতে চেয়েছিল। অবশ্য শুরু করতে চেয়েছিল না বলে শুরু করে দিয়েছিল বলা চলে।”

“তার সঙ্গে এই খু’নের কি সম্পর্ক? খু’ন যে ফয়সালই করেছে তার অসংখ্য প্রমাণ আছে। ভিডিও আছে, প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আছে।”

“এতকিছু প্রমাণ থাকার পরও ফয়সাল একদম নির্দোষ। অপেক্ষা করুন। আস্তে আস্তে সবকিছু পরিষ্কার হবে। প্রথম থেকে বলি, সবকিছু শুনলে বুঝতে পারবেন আপনার ছেলে কত বড় ঘুঘু। এমনিতেই আপনাদের পরিবারের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে ঝামেলা আছে। সবাই নিজের আখেরটা গোছাতে চান। এই অঢেল সম্পত্তির মাঝে মাত্র দু’জন লোক বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এক ফয়সাল, দুই ওর দাদি। এদের মধ্যে একজনকে মে’রে অন্যজনের কাঁধে খু’নের দোষ চাপাতে পারলে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। পরিকল্পনাটাও সেই অনুযায়ী হয়েছিল। তবে মোশারফ সাহেব খুব তাড়াহুড়ো করে এই পরিকল্পনা করেছিলেন বিধায় ফাঁক থেকে গেছে। সেদিন তুলিকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল। সবাই বাড়িতে, হঠাৎ করেই ফয়সালের দাদি বাড়ির বাইরে চলে গেলেন। যেহেতু উনি বাইরে গেলে কাউকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করতেন না। তাই সকলের কাছে ব্যাপারটা অজানা রয়ে গেল। দুপুরে খাওয়ার সময় উনি মোশারফ সাহেবকে কল দিয়েছিলেন। কেন দিয়েছিলেন তা সঠিক বলতে পারছি না। উনি কল দেওয়ার এক পাঁচ মিনিট পর মোশারফ সাহেব অন্য একটা নম্বরে কল দিয়েছিলেন। আর সেই নম্বরের মালিক ওই যে দাঁড়িয়ে আছে যাতে তিনি চিনতে অস্বীকার করেছেন।”

ফুফু বলল, “তারা পরিচিত ছিল। কল দেওয়া দোষের কিছু না। এতে কিছুই প্রমাণ হয় না।”

“আপনার স্বামী কিন্তু সেই পরিচয় স্বীকার করতে চাননি। যাইহোক! এই একবার নয়। এরপর থেকে উনি ক্রমাগত একটা নম্বরের কল দিয়ে গেছেন। ব্যাপারটা অনেক এমন- এই লোকটাই রেহানা বেগমকে খু’ন করে কাঁদার মধ্যে ফেলে রেখে গেছিল। তারপর মোশারফ সাহেব ফয়সালকে নিয়ে ওই জায়গায় যান। কৌশলে ওকে দিয়ে লা’শ ঘুরিয়ে ছু’রি বের করতে বলেন। ফয়সালের বয়স কম। সরল মনে ফুফার কথা মেনে নেয়। এখানেই হয় সবথেকে বড় চাল। ফয়সাল ছু’রি বের করার সময় উনি ছবি তোলেন এবং ভিডিও করেন। সেই ভিডিও একটা অ্যাপের সাহায্যে রিভার্স করে আমাদেরকে দেখান। লোক জড় করে সাক্ষী রেডি রাখেন। উনি বুঝতে পারেননি পুলিশ উনার ছয়-নয় ধরে ফেলবে।”

দারোগা সাহেবের কথাগুলো বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু এটাই সত্যি। ফুফার সাথে যাওয়ার সময় উনি কাউকে ক্রমাগত কল দিচ্ছিলেন। বারবার বলছিলেন- কাজটা হয়েছে কি-না। ঠিকঠাক হবে কি-না। ফুফু বলল, “আপনার এই কথার কি কোন ভিক্তি আছে?”

“অবশ্যই আছে। ভিডিওটা একটু ভালো করে দেখলেই বোঝা যায়। র’ক্ত কাঁদা মাখা ছু’রি কি করে কারো শরীরে ঢোকানো হয়। তাছাড়া তর্কের খাতিরে যদি এটা ধরেও নিই যে মোশারফ সাহেব যাওয়ার আগে ফয়সাল উনাকে মে”রে”ছে, তবে তা ভুল। কারণ এটা আগেই প্রমাণিত হয়েছে যে ফয়সাল মোশারফ সাহেবের সাথেই ওই জায়গায় গিয়েছিল। তাহলে কেন উনি ফয়সালকে আটাকে চেষ্টা করলেন না? কেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করলেন? শারিরীকভাবে উনি অক্ষম নয় যে একটা বাচ্চাকে আটকাতে পারবেন না।”

হঠাৎ করে ফুফা অট্ট হাসিতে ফেলে পড়লেন। তেজী গলায় বললেন, “দারোগা সাহেব, বলতেই হয় আপনার এলেম আছে। পুলিশ হওয়ার যোগ্যতা রাখেন। হ্যাঁ আপনি ঠিকই ধরেছেন। এই সব পরিকল্পনা আমার। আমিই আমার শাশুড়িকে খু’ন করিয়েছি। সেদিন হঠাৎ করে আম্মা আমায় কল দিয়েন, বললেন- উনি ভৈবর নদীর পাড়ে আছেন। আমি যেন তার সাথে দেখা করি। বুড়িটা ভীষণ চালাক। কিভাবে যেন ধরে ফেলেছিল আমি ওর নাতিকে দিয়ে মাদক ব্যবসা শুরু করেছি। আমায় হুমকি দিতে লাগলো। ব্যাপারটা আমার ঠিক হজম হলো না। কফুরকে কল দিয়ে বললাম বুড়িটাকে মে’রে দিতে। কফুর জে’ল পালানো আসামি, মাদক ব্যবসায়ী। ওর সমস্ত তথ্য প্রমাণ আমার কাছে আছে। আমার কথা শোনা ছাড়া ওর অন্য উপায় নেই। নদীর ওদিকে লোকজনের যাতায়াত নেই। কফুর বুড়িটাকে মে’রে কাঁদায় ফেলে রাখলো। তরপর যা তাই।”

ফুফু শাড়ির আঁচলে মুখ চেপে ধরলো। হয়তো সে এসব কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। নয়তো আগামীতে কি হবে সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। তুলি আন্টি নিজের ঘরে চলে গেলন। যাওয়ার আগে একবার মতিনের দিকে ফিরে তাকালেন। সেই দৃষ্টিতে খুব গভীর কথা লুকিয়ে আছে। কিন্তু পড়া যাচ্ছে না। মতিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার চোখে-মুখে লজ্জার ছাপ ফুটে উঠেছে।

দারোগা সাহেব বললেন, “সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেল। এবার কেসটা আদালতে যাবে। সব সিদ্ধান্ত ওখানে হবে। ফয়সালের নামেও একটা কে’স হয়েছে। আদালত তা মিমাংসা করে দিবে নিশ্চয়ই। মোশারফ সাহেব চলুন। নিজ আস্তানায় ফেরত যান। এখন থেকে চোদ্দ শিকের আড়ালে আপনার বাস।”

দারোগা সাহেব থানায় যাওয়ার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে গেলেন। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে জে’ল থেকে ছাড়ার নির্দেশ করে করলেন। যেন উনি আমার খুব কাছের কেউ। মানুষ যে নিঃস্বার্থভাবে এতটা সাহায্য করতে পারে, এতটা সৎ হয়, উনাকে না দেখলে বুঝতে পারতাম না।

দিনের আলো ম’রে এসেছে। চারদিকে অন্ধকারে ঘনত্ব বাড়ছে। দারোগা সাহেব হাসিমাখা মুখে আমার দিকে তাকালেন। সহজ গলায় বললেন, ” তোমাকে কি বাড়িতে দিয়ে আসবো?”

“হ্যাঁ, আসুন।”

“ঠিক আছে।”

অন্ধকার রাস্তায় গাড়ি চলছে। এটা আমাদের বাড়ির পথ নয়। একবার মনে হলো দারোগা সাহেবকে ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করি, পরক্ষণেই চুপ হয়ে গেলাম। এদিকে কোন কাজ থাকবে হয়তো। রাতের পরিবেশে ঘোরাঘুরি করতে বেশ ভালো লাগে। ফাঁকা মাঠের কোণায় এসে গাড়ি থামলো। দারোগা সাহেব বললেন, “নামো তো। একটু কাজ আছে।”

চুপচাপ গাড়ি থেকে নেমে এলাম। মাঠটা বেশ বড়। দূরে ঝোপঝাড় আছে। জায়গাটা নির্জন। লোকজন নেই। গা ছমছমে ভাব। দারোগা সাহেব বললেন, “ফয়সাল মিয়া, ভয় করছে নাকি?”

চমকে উঠলাম। নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করতে করতে বললাম, “না, ঠিক আছে।”

“বুঝলে এই জায়গাটা আমার খুব প্রিয় একটা জায়গা। তবে বিগত কুড়ি বছর ধরে আমি এই জায়গাটাকে ঘৃ’ণা করি।”

“মানে?”

“মানেটা খুব সহজ, আবার জটিলও বলতে পারো।”

“আপনার কথা বুঝতে পারলাম না।”

দারোগা সাহেব বরফ শীতল কণ্ঠে বললেন, “তোমার মা’য়ের নামটা যেন কি?”

দারোগা সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি খুব ভয়ংকর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। ডান হাতে একটা ছু’রি। চাঁদের আলোয় ছু’রিটা চকচক করছে।

“আপনার হাতে ছু’রি কেন?”

“লাইসেন্স করা পি’স্ত’ল দিয়ে খু’ন করতে হয় না।”

ভয়ে গলা শুকিয়ে গেছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে করতে বললাম, “মানে?”

দারোগা সাহেব হাসলেন। সেই হাসিতে গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়। ভয়ে শরীর জমে আসে।

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০৯

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৯

আমাকে আর ফুফাকে আলাদা সে’লে রাখা হয়েছে। দু’টো সেল মুখোমুখি। তাকালে সবকিছু স্পষ্ট দেখা যায়। ফুফা গম্ভীর মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখে-মুখে উদভ্রান্ত ভাব। যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। বয়স্ক কনস্টেবলটা সে’লের পাশে চেয়ার নিয়ে বসে আছে। মোবাইলে কিসব ভিডিও দেখেছে। প্র’তিবাদী কোন কিছু নিশ্চয়ই। কাজী নজরুলের কবিতা শোনা যাচ্ছে। এক গ্লাস পানি পান করলাম। শরীরটা ভালো লাগছে না। গতকাল দুপুরের পর থেকে আর কিছু খাওয়া হয়নি। রাতে দারোগা সাহেব ফল মিষ্টি নিয়ে এসেছিলেন সেসব মুখে তুলতে ইচ্ছে করেনি। মেঝেতে বসে পড়লাম। একটু ঘুমের প্রয়োজন। চোখ বন্ধ করলে দুনিয়া অন্ধকার হয়ে যায়। সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগে। ভয়ভয় হয়।

চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি দারোগা সাহেব মতিনকে খুব রাগারাগি করছেন। মতিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে৷ দারোগা সাহেব বললেন, “একজন পুলিশ সদস্য হয়ে কিভাবে এমন সাহস দেখালে? এজন্য তোমার কি শা’স্তি হতে পারে জানা আছে?”

মতিন জড়ানো গলায় বলল, “না স্যার। আমাকে মাফ করে দিন। আমার ছোট ভাইটা হাসপাতালে ভর্তি। ডাক্তার বলেছে ওর দু’টো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এক্ষুণি চিকিৎসা করতে না পারলে ওকে বাঁচানো যাবে না।”

দারোগা সাহেব খানিকটা শান্ত হলেন। স্বাভাবিক গলায় বললেন, ” এরপর যেন কখনও এমন কিছু না দেখি। মনে থাকে যেন।”

মতিন মাটিতে বসে পড়তে পড়তে বলল, “মনে থাকবে স্যার। মনে থাকবে।”

দারোগা সাহেব থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে বয়স্ক কনস্টেবলকে কিছু বলে গেলেন। তিনি শুধু মাথা নাড়ালেন। দারোগা সাহেব যাওয়ার পর থেকে থানার পরিবেশ বেশ ঠান্ডা। ফুফা কোন কথা বলছে না। অন্যরাও চুপচাপ। মতিন একটা চেয়ারে বসে আছে। ভয়ে তার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। বয়স্ক কনস্টেবল হাতের ইশারায় মতিনকে কাছে ডাকলো। নিচু গলায় বলল, “কত পেয়েছিস?”

মতিন বলল, “কি পাবো?”

“তুই আমাকে যতটা বোকা মনে করিস, আমি কিন্তু অতো বোকা না। এই ছেলেটাকে মা’রার জন্য কত টাকা পেয়েছিস? আমাকে চা পানি খেতে তো কিছু দিতে পারতি, কাজটা সহজ হয়ে যেত।”

“আমি কারো কাছ থেকে টাকা পাইনি। বাজে কথা বলবেন না।”

“শোন ছেলে, এতদিন ধরে পুলিশে চাকরি করি। দারোগা সাহেবের সাথে আছি। উনি মাথা নাড়লে আমি সব বুঝে যাই।”

“ভালো কাজ করেন। দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না।”

মতিন থানা থেকে বেরিয়ে গেল। বয়স্ক কনস্টেবল দেদার হেসে বলল, “কি মোশারফ ভাই? এমন বাচ্চা ছেলেকে দিয়েন কি এসব কাজ হয়? আমাকে তো বলে দেখতে পারতেন। নিরাশ করতাম না আপনাকে।”

হঠাৎই খুব বিশ্রী লাগতে শুরু করল। এই পৃথিবীর কোথাও কি একটু সুন্দর জায়গা নেই? সেখানে মানুষের মনে লোভ থাকবে না, হিংসা থাকবে না। সম্পত্তি পাওয়ার আক্রোশ থাকবে না। ফুফা কড়া চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছেন। যেন উনার এই পরিস্থিতির জন্য আমি দায়ী। সুন্দর করে হাসলাম। ফুফা চমকে উঠলেন। সেই চমক দেখতে খুব একটা খারাপ লাগলো না। বরং ভালো লাগলো। খুব ভালো লাগলো।

রাত নয়টার দিকে দারোগা সাহেব এলেন। আমাকে আলাদাভাবে উনার সাথে কথা বলতে নিয়ে যাওয়া হলো। দারোগা সাহেব বললেন, “কেমন আছো ফয়সাল? সব ঠিকঠাক?”

মাথা নাড়ালাম। অস্পষ্ট গলায় বললাম, “জ্বি।”

“তোমাকে একটা কথা বলি। মন দিয়ে শোনো। খালিচোখে সবাইকে মানুষ মনে হলেও সবাই মানুষ হয় না। থানার মধ্যে কারো দেওয়া কোন খাবার খাবে না। কোন ধরনের গল্পগুজব করবে না।”

“জ্বি মনে থাকবে।”

“আজ রাতে তোমাকে অন্য জে’লে পাঠানো হচ্ছে। সেখানে আমার এক বন্ধুকে বলে দেবো।”

“কেন পাঠানো হচ্ছে?”

“নিরাপত্তার জন্য। বলা ঠিক না তবুও বলছি। তোমার ফুফা মতিনকে দিয়ে তোমাকে মা”র’তে চেয়েছিল। ষাট হাজার টাকাও দিয়েছে শুনলাম।”

“ওহ!”

“মতিনের ছোট ভাই হাসপাতালে ভর্তি। ওর চিকিৎসার জন্য অনেক টাকার প্রয়োজন। অসহায় মানুষকে টাকার লোভ দেখিয়ে ন’রপি’শা’চরা ব্যবসা করে যায়।”

“এসব আপনি কিভাবে জানলেন? আর ফুফা এত টাকা দিবে কেন?”

“মতিন নিজেই আমাকে বলেছে। লাখ লাখ টাকার সম্পত্তির কাছে ষাট হাজার কোন ব্যাপারই না।”

” মতিন কি বলেছে?”

“মোশারফ সাহেব ওকে টাকা দিয়েছে। তারপর ওই খাবার-দাবার ইত্যাদি। সবকিছু কি আর কাকতালীয় হয়!”

“কি বলছেন বুঝতে পারছি না।”

“মতিন ছেলেটার টাকার প্রয়োজন ছিল। আগেরদিন মোশারফ সাহবকে কথায় কথায় সবকিছু বলে দিয়েছি। তখন উনি ভাবলেন যে মতিনকে দিয়ে তোমাকে মে”রে ফেললে কোন সমস্যা হবে না। সেই অনুযায়ী উনি মতিনকে টাকা দিলেন। মতিন প্রথমে অভাবের তাড়নায় টাকাগুলো নিয়েছিল ঠিকই পরে আমাকে সবকিছু বলে দিয়েছে। তখন আমিই ওকে বলেছিলাম তোমার জন্য খাবার নিয়ে যেতে।”

“আপনি তো চাইলে সোজাভাবেই সবকিছুর সমাধান করতে পারতেন। এভাবে ঘোরানোর কি ছিল?”

” অসৎ লোকের সম্পত্তি অন্যায়ভাবে দখল করাটাও অপরাধ। তোমার ফুফা দোষ করছে তিনি তার দোষের শাস্তি পাবেন। আমরা তো তার সম্পত্তি দখল করতে পারি না।”

“ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অপরাধ করলে কি সেটা অপরাধ নয়?”

“অবশ্যই অপরাধ। সেজন্যই মতিনকে রাগারাগি করেছিলাম।”

“খাবারে কি বি’ষ ছিল?”

“না, খাবারে বি’ষ ছিল না।”

“তাহলে বিড়াল মা’রা গেল কিভাবে?”

“মতিন দেখেছিল বিড়ালটা খাবার খাচ্ছে। পরে ওটাকে মে’রে ফেলেছে। সেজন্যই ওকে বকাঝকা করছিলাম।”

কি বলবো বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শুধু মানুষের প্রাণই কি প্রাণ? অন্য প্রাণীর কি জীবন নেই? দারোগা সাহেব বললেন, “যাও তৈরি হয়ে এসো। তোমাকে অন্য জে’লে দিয়ে বাড়িতে ফিরতে হবে।”

“ঠিক আছে।”

থানাটা আমার বাড়িঘর নয়। এখানে তৈরি হওয়ার কিছু নেই। তবুও শেষবারের মতো সেলটা দেখতে এলাম। জায়গাটা কেমন পরিচিত হয়ে গেছে। আপন আপন মনে হয়। তালেব ফুফার সাথে দেখা করতে এসেছে। আমায় দেখে অল্প হাসলো। সেলের কাছে এগিয়ে এসে বলল, “কেমন আছিস? তোর চোখ-মুখ শুকনো দেখাচ্ছে কেন?”

“এমনিতেই।”

“আমার ওপর কি রাগ করে আছিস?”

“না, তোর ওপর রাগ করে থাকব কেন?”

“সত্যিই রেগে নেই তো?”

“না।”

“আমি জানি রে তুই নানিআপুকে খু’ন করিসনি। আব্বাও করেনি। আমরা কেউ কিছু করিনি।”

“তালেব তুই যা। ফুফা রাগ করবেন।”

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই ফুফা খ্যাক করে উঠলেন। কর্কশ গলায় বললেন, “তুই গেলি ওখান থেকে? বেজন্মারা আপন পর চেনে না। সবই আমার কপাল।”

তালেব মাথা নিচু করে থানা থেকে বেরিয়ে গেল। দারোগা সাহেব এসে আমায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। গাড়ির কাছে তালেব দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে-মুখে আতঙ্ক ছড়িয়ে আছে। দারোগা সাহেব বললেন, “এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? কিছু বলবে?”

তালেব ইতস্তত করে বলল, “ফয়সালের সাথে একটু কথা বলতে চাইছিলাম।”

দারোগা সাহেব বললেন, “আচ্ছা বলো।”

“ভাই, তিশা আপু তোকে এই চকলেটগুলো দিতে বলেছিল। নিবি?”

দারোগা সাহেবের দিকে তাকালাম। উনি সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। তালেব বলল, “আপু না কেমন কেমন হয়ে গেছে। ঠিকমতো কথা বলে না। খায় না। সারাক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।”

“দাদির জন্য কষ্ট পেয়েছে হয়তো।”

“আমরা তো নানিআপুর মুখটাও আর দেখতে পারলাম না। উনাকে কি আর ফেরত দেওয়া হবে না?”

দারোগা সাহেব বললেন, “নিশ্চয়ই। তদন্ত চলছে। কাজ শেষ হলে লা” শ দেওয়া হবে।”

তালেব কেমন যেন কেঁপে উঠল। আমিও উঠলাম। লা’শ কথাটা মানতে পারিনি হয়তো। তালেব চলে গেল। ওর দু-চোখ ভিজে উঠেছে। শার্টের হাতায় চোখ মুছে গাড়িতে উঠে বসলাম। কিছুই ভালো লাগছে না।

সকালে ঘুম ভাঙলো একটা কাকের ডাকে। দাঁড়কাক বোধহয়। কেমন কা কা করে ডাকছে। নতুন জেলের পরিবেশ আলাদা কিছু লাগছে না। মনটা কেমন বি’ষিয়ে আছে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিলাম। নানান চিন্তায় মাথা খারাপ অবস্থা। বেলা নয়টার দিকে দারোগা সাহেব আমাকে নিতে এলেন। খুব জরুরি কোন কাজ আছে।

বহুদিন বাদে নিজের বাড়ির মুখ দেখতে পারলাম। সময়ের হিসাবে খুব বেশি না হলেও এতটুকু সময়কে আমার কাছে কয়েক যুগ মনে হয়েছে। বসার ঘরে সকলে গোল হয়ে বসে আছে। ফুফু আমায় দেখে মুখ বিকৃত করে ফেলল। ফুফাকেও এখানে আনা হয়েছে। বলতে গেলে সবাই এখানে আছে। দারোগা সাহেব বললেন, “আপনাদের এখানে নিয়ে আসার একটা বিশেষ কারণ আছে। আমাদের মাঝে একজন বিশেষ মানুষ আসতে চলেছে। তার সাথে পরিচয় করার জন্যই এই আয়োজন।”

ফুফু বলল, “যা বলার সোজাভাবে বলুন। আপনার হেয়ালি দেখতে ভালো লাগে না।”

“সোজাভাবেই বলব। পরনারীর সাথে হেয়ালি করতে আমারও ভালো লাগে না। যাইহোক কাজের কথা বলি। মোশারফ সাহেব কি সবকিছু স্বীকার করতে চান?”

ফুফা কিছু বললেন না। কঠিন চোখে তাকিয়ে রইলেন। দারোগা সাহেব বললেন, ” মানতেই হবে আপনার মস্তিষ্ক খুব দ্রুত কাজ করে। এই দ্রুততর মস্তিষ্ককে কি ভালো কাজে লাগাতে পারতেন না?”

ছোট দাদি কঠিন মুখে বললেন, “মস্কারা না করে সোজাভাবে বলুন। আমাদের আরও অনেক কাজ আছে।”

“জ্বি, সোজাভাবেই বলছি।”

দারোগা সাহেব মোবাইল বের করে কাউকে কল দিলেন। সহজ হয়ে বললেন, “মতিন, উনাকে নিয়ে আসো। হ্যাঁ হ্যাঁ, এই বাড়িতেই আসো।”

মিনিট পাঁচেক পর মতিন একজন মানুষকে নিয়ে সদর দরজা দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলো। অবাক দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকটা হতবাক হয়ে গেছি বলা চলে।

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০৮

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৮

সন্ধ্যা নামতে এখনও ঢের দেরি। কম করে হলেও পাঁচ মিনিট। অথচ এর মধ্যেই সবকিছু অন্ধকার হয়ে গেছে। জে’লের পরিবেশ বাইরের দুনিয়ার মতো নয়। কেমন যেন অন্যরকম। গা ছমছমে ভাব। ফুফুরা চলে যাওয়ার পর থেকে দারোগা সাহেবের সাথে দেখা হয়নি। তিনি দেখা করতে আসেননি। মতিন ছেলেটা বেশ কয়েকবার এসেছিল। সাধারণ কথাবার্তা হয়েছে। তেমন কাজের কথা হয়নি। বুকের মধ্যে জমা কষ্ট চোখের পানির সাথে গড়িয়ে না পড়লে হৃদয় ভাঙার আওয়াজ শোনা যায়। আমিও শুনতে পাচ্ছি। সে আওয়াজ বড্ড বেশি ভ’য়ং’ক’র, অশ্রাব্য! কানে তালি লেগে যায়। শুধু তাই নয়। বুকের ভেতর কোন এক জায়গায় বিরাট ক্ষ’ত হয়ে গেছে। সেখান থেকে র’ক্তের গলগল আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। পরিনত হয়েছি অনুভূতিহীন প্রস্তরখন্ডে!

রাত দশটার দিকে দারোগা সাহেব আমায় দেখেতে এলেন। খালি হাতে আসেননি। সাথে করে ফল মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। অবাকই হলাম। দারোগা সাহেব বললেন, “ফয়সাল, শরীর ভালো?”

হড়বড় করে বললাম, “জ্বি ভালো।”

“তোমার ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারছি। চিন্তা করো না। আল্লাহ চাইলে তুমি ন্যায় বিচার পাবে।”

“কি বুঝতে পারছেন?”

“এমনিতে তোমার বয়স কম। বাচ্চা ছেলে। সব কথা তোমার সাথে আলোচনা করা যায় না। তবুও কিছু করার নেই। আমাকে বলতেই হবে।”

“কি বলতে চান বলুন। আপনি বলতে পারলে আমার শুনতে সমস্যা হবে না।”

“তোমার দাদির খু”নের দুটো দিক আছে। প্রথমটা হচ্ছে তুমি যা বলছ তা সত্যি। অন্যটা তোমার ফুফুরা যা বলছে সেগুলো সত্যি। ”

“আপনার কি মনে হয়?”

“আমার কিছু মনে হয় না। কাজের কথা বলি। দাদির সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন ছিল?”

“ভালো ছিল। খুব ভালো ছিল। সত্যি বলতে মা বাবা মা”রা যাওয়ার পর থেকে দাদিই আমার অভিভাবক।”

“বুঝলাম। দাদির মা”রা যাওয়ায় তোমার কি লাভ হতে পারে?”

“দাদি মা”রা গেলে আমার কোন লাভ নেই। বরং ক্ষতি। সরল হিসাব।”

“ক্ষতির পরিমাণ বর্ণনা করো। হিসাব করে দেখি।”

“দুনিয়ার বুকে একা হয়ে গেছি। আমার জীবনে এর থেকে বড় ক্ষ’তি আর নেই।”

“তদন্তের সুবিধার্থে তোমার জীবন কাহিনী জানা প্রয়োজন। আমার হাতে সময় আছে। তুমি চাইলে বলতে পারো আবার না-ও বলতে পারো।”

অল্প হাসলাম। দারোগা সাহেবের কথা বলার ভঙ্গি চমৎকার। কথা বলার সময় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজের জীবনের সমস্ত ঘটনা গুছিয়ে বলার চেষ্টা করলাম। এবং মতিনের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে মনে হলো সেই চেষ্টা সফল হয়েছে।

মতিন বলল, “স্যার কিছু বুঝতে পারলেন?”

দারোগা সাহেব শীতল গলায় বললেন, “হ্যাঁ, অনেক কিছুই বুঝতে পারছি। অসংখ্য হা’য়েনার মাঝে অসহায় হরিণ! এখন শুধু প্রমাণের দরকার।”

মতিন ভাব নিয়ে বলল, ” স্যার! এই কে’সের দায়িত্বটা আমি নিতে চাই। জুনিয়র হিসাবে আপনার কাছে এটা আমার দাবী স্যার।”

“আচ্ছা বেশ। এই দায়িত্বটা তোমাকে দিলাম। তবে আমিও নিজের মতো করে খোঁজ খবর করব। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়!”

“স্যার কিছু মনে না করলে একটা কথা বলবো?”

দারোগা সাহেব থমথমে গলায় বললেন, “বলো।”

মতিন মিইয়ে গিয়ে বলল, “না থাক। অন্য একদিন বলবো।”

দারোগা সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর হনহনিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে গেলেন। মতিন নিচু গলায় বলল, “স্যারের মতিগতি সুবিধার মনে হচ্ছে না। কি বলো ভাই?”

বিরক্ত গলায় বললাম, “আপনাকে একটা কথা বলি, আমাকে বিরক্ত করবেন না। কিছু ভালো লাগে না।”

মতিন ভ্রু কুঁচকে ফেললো। সরু গলায় বলল, “আমাকে আপনি আজ্ঞে করবে না। আমার আপনি শুনতে ভালো লাগে না।”

“তাহলে কি বলবো?”

“তুমি করে বলবে। ইচ্ছে করলে তুইও বলতে পারো। আমার ছোট ভাই আমাকে তুই করে বলে। কাজেই তুমি তুই করে বললে তেমন অসুবিধা হবে না।”

“আচ্ছা বলবো।”

মতিন সরল ভঙ্গিতে হাসলো। আমার কাঁধের ওপর একটা হাত রেখে বলল, “আমি চলে যাচ্ছি। খানিকক্ষণ কেঁদে নাও। কাঁদলে না পারলে সহ্য করতে পারবে না।”

মতিন চলে গেল। কাঁদতে ইচ্ছে করছে, পারছি না। চোখের পানি কেন মনের সঙ্গ দেয় না?

ঘুম ভাঙলো ভোরের দিকে। ঠিক ভোর কি-না জানি না। চারপাশ অন্ধকার। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। মাঝরাতের দিকে হঠাৎ চোখ থেকে পানি বের হতে শুরু করল। ঘন্টা খানেক কাঁদা পর খেয়াল করলাম অদ্ভুত রকমের শান্তি লাগছে। কিছু ভালো স্মৃতি মনে পড়ছে। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতে পারিনি। চোদ্দ শিকের আড়ালে নিজেকে অনেক বেশি অসহায় আর একা মনে হচ্ছে। চার দেওয়ালের মাঝে ব’ন্দীর কাছে কোন খরব আসে না। সম্ভবও না। কাজেই আমার কাছে কোন খরব আসছে না। ফুফুরা কি করছে জানতে পারলে ভালো হতো। সে উপায় নেই। জে’লের মধ্যে আ’টকে রাখা হয়েছে। ফুফার দেখানো ভিডিও অনুযায়ী আমিই খু’নটা করেছি। সেই প্রমাণের ভিত্তিতে আমি দো’ষী। অথচ সবকিছু আয়নার মতো পরিষ্কার। একবার তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়।

সকাল নয়টার দিকে মতিন থা’নায় আসলো। নয়টা সঠিক সময় কি-না জানি না। অনুমান করে বলেছি। মাঝেমধ্যে অনুমান ঠিক হয়ে যায়। মতিন বলল, “সকাল সকাল আসতে চেয়েছিলাম। নয়টা বেজে গেল। যাইহোক ডিয়ার ব্রাদার! সকালের নাস্তায় পরোটা আর ডিম। চলবে?”

ভাঙা গলায় বললাম, “আমাকে বলছেন?”

“হ্যাঁ, তো আর কাকে বলব? এখানে তুমি ছাড়া কেউ নেই।”

“অপ’রাধীর সাথে পুলিশের এমন মিল বাস্তবে দেখা যায় না। বাস্তবের পুলিশ ছাত্রদের ওপর গু’লি চালাতেও দ্বিধা করে না। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বললেই দো’ষী হয়ে যেতে হয়।”

মতিন নিচু গলায় বলল, “চাকরি বাঁচাতে অনেক কিছুই করতে হয়। যাইহোক তুমি খেয়ে নাও। স্যার দেখলে রাগ করতে পারেন।”

“দারোগা সাহেবকে না বলেই খাবার নিয়ে এসেছেন?”

“হ্যাঁ, না বলেই এনেছি। নিজের পকেটের টাকা দিয়ে এনেছি।”

“কেন এনেছেন?”

“কৈফিয়ত দিতে পারছি না। খেতে ইচ্ছে করলে খাও- ইচ্ছে না করলে খেতে হবে না।”

“আমার খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি নিয়ে যান।”

মতিন মুখ গোমড়া করে চলে গেল। একটু খারাপ লাগলো। ছেলেটা ভালোবেসে এসব খাবার নিয়ে এসেছিল। আমার ব্যবহারে কষ্ট পেয়েছে নিশ্চয়ই। পাওয়াও উচিত। সত্যি বলতে আমার কিছু ভালো লাগছে না। এই মুহুর্তে কোন খাবারই গলা দিয়ে নামত না। শুধু শুধু খাওয়ার চেষ্টা করতে ইচ্ছে করেনি। মতিন দূরে সরে গিয়ে আমার দিকে পেছন দিয়ে চেয়ারে বসে রইলো।

বেলা এগারোটার দিকে ফুফুরা থানায় আসলো। ওদের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছে। তুলি আন্টি ঠোঁটে মেরুন কালারের কড়া লিপস্টিক দিয়েছে। পরনে চোখ ধাঁধানো উগ্র পোশাক। ছোট দাদি পরেছেন জামদানী শাড়ি। কটকটে হলুদ রঙের শাড়িতে তাকে খুব একটা খারাপ লাগছে না। দারোগা সাহেব সবে থানায় এসেছেন। চেয়ারে বসে চায়ের কাপে ছোট ছোট চুমুক দিচ্ছেন। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে চা-টা ভালো হয়েছে। ফুফু বলল, “আম্মার লা”শ পাওয়া যাবে কখন? ম’রা মানুষকে দুনিয়ায় ঘোরানোর নিয়ম নেই। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দা’ফ’ন করতে হয়। ”

দারোগা সাহেব হাসলেন। টেবিলের ওপর চায়ের কাপ রাখতে রাখতে বললেন, “এসব নিয়ম স্বাভাবিক মৃ’ত মানুষের। খু’ন হওয়ার লা’শের জন্য এই নিয়ম বরাদ্দ করা যায় না।”

“কিসব উল্টো পাল্টা বলছেন?”

“উল্টোপাল্টা বলা আমার স্বভাবে নেই। যা বলছি সহজভাবেই বলছি। আপনার মা’য়ের লা”শ ময়নাত’দ’ন্তের জন্য বেশ কয়েকদিন দুনিয়াতে রাখা হবে। কাজ শেষ হলে লা’শ ফেরত পাবেন। তখন ক’ব’র দিতে পারবেন।”

ফুফু মুখ কালো করে ফুফার দিকে তাকালো। ফুফা বললেন, “বুঝতে পারছি। তবুও যদি একটু দ্রুত করার চেষ্টা করতেন। শরিয়তের বিধান আছে।”

“সেই চেষ্টা করছি। চিন্তা করবেন না। আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? বসুন। মতিন ওদের চেয়ার এনে দাও।”

মতিন ব্যস্ত হয়ে চেয়ার আনতে লাগলো। যেন এরা খুব সম্মানিত মেহমান। একটু ত্রুটি হলে সবকিছু ফেলে দিয়ে চলে যাবে। ছোট দাদি চেয়ারে বসতে বসতে বললেন, “থাক বাবা, এতো কিছু করার দরকার নেই। আমরা এমনই ঠিক আছে।”

“এমনি ঠিক থাকলে বসছেন কেন? দাঁড়িয়ে থাকুন।” কথাগুলো বলে মতিন নিজের জিভ কা’ম’ড়ে ধরলো। মাথা নিচু করে বলল, “সরি স্যার।”

দারোগা সাহেব ব্যাপারটা খুব একটা আমলে নিলেন না। সহজ গলায় বললেন, “মোশারফ সাহেব, আপনার বাড়ির খানিকটা সামনে একটা শপিং মলের মতো হয়েছে দেখেছেন?”

ফুফা সম্মতি সূচক মাথা নাড়লেন। অথাৎ তিনি দেখেছেন। দারোগা সাহেব বললেন, “তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জানেন ওখানে একটা সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। সেখান থেকে আমরা কিছু ফুটেজ পেয়েছি।”

ফুফা উত্তেজিত গলায় বললেন, “কি ফুটেজ পেয়েছেন?”

“এই যে ফয়সাল আপনার শাশুড়ি সাথে হেঁটে হেঁটে কোথাও একটা যাচ্ছে। কোথায় যাচ্ছে তা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। দু’জনে হাত ধরাধরি করে আছে।”

ফুফার চোখ চকচক করে উঠলো। অথচ তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, “আপনাকে তো বলেছিলাম। ফয়সাল আম্মার সাথে বেরিয়ে গেছিল।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। অদ্ভুত গলায় বললেন, “আপনাদের বাড়ির সামনে কোন শপিং মল হয়নি। আপনি এতো উত্তেজিত হয়ে আছেন কেন?”

ফুফা চমকে উঠলেন। যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললেন, “তেমন কিছু নয়। ব্যক্তিগত ব্যাপার।”

“কি ধরনের ব্যক্তিগত ব্যাপার?”

ফুফা একটু ইতস্তত করে বললেন, “এক লোক আমার কাছে কিছু টাকা পায়। সে টাকার জন্য তাগাদা দিচ্ছে।”

“কত টাকা?”

“লাখ খানেক।”

সবকিছু কেমন এলেবেলে হয়ে আছে৷ দারোগা সাহেবের কথার আগামাথা পাওয়া যাচ্ছে না। কেমন যেন খাপছাড়া ভাব। কথা বলছেন অন্য সুরে। ফুফা ক্রমশ ঘামছেন। ফুফুসহ বাকিরাও হাস ফাঁস করছে। হঠাৎই খেয়াল করলাম তিশা আপু আসেনি। কেন আসেনি? ফুফুকে জিজ্ঞেস করবো? না থাক। আপাতত চুপ থাকাই ভালো। বয়স্ক কনস্টেবলটা হাতকড়া পরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। আবার খুব একটা খারাপও লাগছে না।

দারোগা সাহেব হাতের ইশারায় কাউকে ভেতরে আসতে বললেন। রোগা মতো একটা ছেলে ভেতরে প্রবেশ করল। ছেলেটা পরনের কাপড় ছেঁড়া, ধূলো ময়লা মাখা। দারোগা সাহেব বললেন, “তিতু যা বলবি সব সত্যি বলবি তো?”

“জ্বে স্যার। সব সত্যি বলবো। আল্লাহর কসম দিয়ে কচ্ছি।”

“ভালো করে এই ছেলেটাকে দেখ। একে আগে পরে কোথাও দেখেছিস?”

তিতু মাথা নাড়লো। সে আমাকে দেখেছে। দারোগা সাহেব বললেন, “কোথায় দেখেছিস?”

“ভৈবর নদীর পাড়ে আমার মামার চায়ের দোকান আছে। সেই দোকানের সামনে দিয়ে যেতে দেখেছি।”

“শেষবার কবে দেখেছিস?”

“গতকাল দুপুরের দিকে দেখছি।”

“ছেলেটার সাথে কি কেউ ছিল নাকি একা ছিল? যদি কেউ থাকে তাহলে কে কি এখানে আছে?”

তিতু ফুফার দিকে হাত উঁচু করে বলল, “এই লোকটা ছিল। দুজনে খুব গল্প করছিল।”

ফুফা খেঁকিয়ে উঠলেন। ঝাঁঝালো গলায় বললেন, “বেজ’ন্মা! মিথ্যা বলছিস কেন?”

তিতু জোর গলায় বলল, “মা বাপ তুলে গা’লি দেবেন না। যা দেখছি তাই বলছি। মিথ্যা কথা এই তেতু বলে না।”

দারোগা সাহেব বললেন, “মোশারফ সাহেব এটা থা’না। অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে আপনাকে জে’লে ভরতে দু’মিনিট সময়ও লাগবে না।”

ফুফা মিইয়ে গিয়ে রাগী দৃষ্টিতে তিতুর দিকে চেয়ে রইলেন। দারোগা সাহেব বললেন, “প্রতিদিন রাস্তা দিয়ে হাজার হাজার মানুষ চলাচল করে। তুমি আলাদা করে এদের চিনলে কিভাবে?”

“ওই ছেলেটার পায়ে কালো রঙের জুতো ছিল। ওইটা আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাই আলাদা করে মনে আছে।”

দারোগা সাহেব আমার পায়ের দিকে তাকালেন। আমিও তাকালাম। সত্যি এক জোড়া কালো জুতো পরে আছি। ফুফু বলল, “আপনারা বিনা কারণে আমার স্বামীকে ফাঁ’সা’নো
চেষ্টা করছেন। ও ফয়সালের সাথে যায়নি। একা গিয়েছিল। মা নিজেই কল দিয়ে ডেকেছিল। ওর মোবাইল চেক করে দেখুন। শেষবার মা নিজেই ওকে কল দিয়েছে।”

দারোগা সাহেব হাত বাড়িয়ে ফুফার মোবাইল নিলেন। কল লিস্ট চেক করে দেখে বললেন, “এই কলটা রেকর্ড করা নেই?”

ফুফা বললেন, “সবকিছু তো রেকর্ড করা নেই। তবে কিছু আছে৷ আমি বের করে দিচ্ছি।”

ফুফা কল রেকর্ড বের করলেন। তাতে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে আমি বলছি- আমি দাদিকে মে”রে ফেলবো! খানিকক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলাম। হায়রে সম্পত্তি! তোরা চাইলেই তো আমি দিয়ে দিতাম। এতিম না হয় এতিমের মতোই এতিমখানায় বড় হতাম। এমন বি’শ্রী পরিকল্পনা করতে কি একটুও লজ্জা করল না?

দারোগা সাহেব হাসলেন। সহজ ভঙ্গিতে বললেন, মোশারফ সাহেব ছোট্ট জীবনে কিসের চাহিদা আপনার? কেন মিথ্যে বলছেন?”

“মানে? কি বলতে চাইছেন?”

“আপনার বাড়ি থেকে ভৈবর নদীর পাড় পর্যন্ত যাওয়ার রাস্তায় তিনটে দোকানে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে। আমরা সেখান থেকে কিছু ফুটেজ পেয়েছি। সেসব ফুটেজে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ফয়সাল আপনার সাথেই ছিল।”

ছোট দাদি খেঁকিয়ে উঠলেন। তেঁতো গলায় বললেন, “আমার ছেলেকে ফাঁ’সাচ্ছেন কেন?”

“গলা নিচু করে কথা বলেন। না হলে আপনাকেও চোদ্দ শিকের ভাত খাওয়াতে পারি।”

ফুফু বলল, “আপনি কিসব বলছেন আমরা বুঝতে পারছি না।”

“না বোঝার মতো কিছু নেই। আমি বাংলায় কথা বলছি। তারপরও যখন বুঝতে পারছেন না। বুঝিয়ে বলছি। আপনার মা’য়ের খু’নি হিসেবে ফয়সালকে গ্রে’ফ’তার করা হয়েছিল। প্রমাণ হিসেবে মোশারফ সাহেব একটা ভিডিও দেখিয়েছিলেন। সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। আপনারা বলেছেন ফয়সাল নাকি তার দাদির সাথে গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে জানেন না। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা অনুসন্ধান করে দেখেছি গতকাল দুপুরের সময় ফয়সাল মোশারফ সাহেবের সাথে নদীর পাড়ে গিয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে আপনারা মিথ্যা সা’ক্ষ্য কেন দিয়েছেন? কি উদ্দেশ্যে দিয়েছেন? আসলে কে খু” ন করেছে, কেন করেছে সবকিছুর উত্তর জানতে হবে। সেজন্যই মোশারফ সাহেবকে গ্রেফতার করা হবে এবং আপনাদেরকে নজর বন্দী করে রাখা হবে।

ফুফু বলল, “কোন আইনে আমার স্বামীকে গ্রে’ফতা’র করতে চাইছেন?”

দারোগা সাহেব বরফ শীতল গলায় বললেন, “পুলিশকে ভুল পথে চালিত করার জন্য। বাড়াবাড়ি করলে আপনাকেও একই ধারায় গ্রে’ফ’তা’র করা হবে।”

ফুফু সত্যিকার অর্থে নিভে গেল। একজন কনস্টেবল এসে বলল, “স্যার থানার মধ্যে একটা বেড়াল ম”রে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কেউ বি” ষ দিয়েছে।”

দারোগা সাহেব ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। তরল গলায় বললেন, “কি খেয়েছিল কেউ কি দেখেছ?”

“হ্যাঁ স্যার দেখেছিলাম। মতিন পরোটা আর ডিম এনে টেবিলের ওপর রেখেছিল ওই খেয়েছে।”

মতিন বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেল। ফুফা তীক্ষ্ণ চোখে মতিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখের দৃষ্টি পড়া যায় না।

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০৭

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৭

পানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। ছলছল শব্দ। একে পানির শব্দ না বলে বয়ে চলা স্রোতের শব্দ বললে খানিকটা মানানসই মনে হয়। সবুজ ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে আছি। চোখ তুললেই নদী দেখা যায়। কেমন যেন শীত শীত করছে। একটা হিম হাওয়া শরীরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। ঘাসের ওপর হলদেটে চাদর বিছানো। চাদরের ওপর নানান পদের খাবার সাজিয়ে রাখা। মা বললেন, “কিছু মুখে দিচ্ছিস না কেন? খিদে পায়নি বুঝি?”

অবাক চোখে মা’য়ের দিকে তাকালাম। ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে মা’কে। পরনে সবুজ শাড়ি, গা ভর্তি গহনা, পায়ে আলতা দেওয়া। বিস্মিত গলায় বললাম, “তুমি এখানে?”

“পা”গ”ল ছেলে আমার! মা তোর কাছে আসতে পারে না বুঝি?”

“ঠিক তা নয়। বাবা কোথায় মা?”

“কোথায় আবার? তোর বাবা মাছ ধরতে গেছে। লোকটা এমন মেছো স্বভাবের কি বলবো! তুই কিছু একটা মুখে দে। অনেকক্ষণ ধরে না খেয়ে আছিস।”

হাত বাড়িয়ে একটা পুলিপিঠে নিলাম। মুখে দিতে যাব এমন সময় কেউ একজন খুব জোরে মুখের ওপর পানি ছিটিয়ে দিলো। চোখ খুললো শক্ত তক্তা জাতীয় বেঞ্চের ওপর। এতক্ষণ কি তবে স্বপ্ন দেখছিলাম? মাথার কাছে দু’জন লোক বসে আছে। একজনের বয়স অল্প। ক্লিন সেভ, মাথায় ঢেউ খেলানো চুল। অন্য মানুষটা অতিরিক্ত রকমের ফর্সা। বয়সের কারণে তার শরীরে থলথল ভাব চলে এসেছে। ডান হাতে কাঁচের একটা গ্লাস ধরে আছে। গ্লাসের মধ্যে স্বচ্ছ পানি। পোশাক দেখলে মনে হয় এরা পুলিশ কনস্টেবল। বয়স্ক লোকটা বলল, ” মতিন, ছেলেটার জ্ঞান আসছে। স্যারকে খবর দে। তাড়াতাড়ি যা।”

মতিন ছেলেটা এক প্রকার দৌড়ে চলে গেল। বেঞ্চের ওপর উঠে বসলাম। আশেপাশের পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে আমি এই মুহুর্তে থা’নায় আছি। দাদির খু”নের ব্যাপারে আমায় এখানে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে। ফুফা ফুফু নিশ্চয়ই আমার বি’রু’দ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছে। দেওয়াও উচিত। আমি সরে গেলে ওদের লাভই লাভ। শেষবার জ্ঞান হারিয়ে কাঁদার ওপর শুয়ে পড়েছিলাম। এখনও গায়ে কাঁদা লেগে আছে। বিশ্রী ব্যাপার। শুনেছি অজ্ঞান হবার পর মানুষ সবকিছু ভুলে যায়। জ্ঞান ফিরলে খানিকক্ষণ কাউকে চিনতে পারে না। কিন্তু আমার বেলায় এমনটা হচ্ছে না। আমি সবকিছু স্পষ্ট বুঝতে পারছি। আশ্চর্য! মতিন ছেলেটা দ্রুতই ফিরে এলো। তার সাথে মধ্যে বয়সী এক যুবক। লোকটা এই থানায় দারোগা মনে হয়। শক্ত-পোক্ত চেহারা, মুখের মধ্যে কাঠিন্য ভাব আছে। তাকে দেখলে রুক্ষ ধরনের মানুষ মনে হয়। অথচ তিনি অস্বাভাবিক কোমল গলায় বললেন, “বাবু, তোমার জ্ঞান ফিরেছে?”

ডান পাশে মাথা কাত করলাম। দারোগা সাহেব আগের চেয়েও কোমল গলায় বললেন, “তুমি কি কিছু মনে করতে পারছ?”

“হ্যাঁ, পারছি।”

“তোমার মাথায় কি ব্যাথা করছে?”

“সামান্য!”

“সমস্যা নেই। ডাক্তার সাহেব ইনজেকশন দিয়ে গেছে। সময়ের সাথে সাথে ঠিক হয়ে যাবে।”

“আচ্ছা।”

“কি নাম তোমার?”

“জ্বি, আমার নাম ফয়সাল।”

“পড়াশোনা করো নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ, আমি স্কুলে পড়ি।”

“তুমি কি জানো তোমার ওপর খু”নের দায় পড়েছে?”

“জ্বি না, আমি জানি না। তবে অনুমান করতে পারছি।”

দারোগা সাহেব চোখ-মুখে কাঠিন্যে ভাব এনে বললেন, “এই বয়সে এসব করা একদম উচিত নয়। যাইহোক মতিন ওকে নিয়ে এসো। অনেকক্ষণ ধরে ওর ফুফু ফুফা বসে আছে। তাদের সাথে কথা বলতে হবে।”

মতিন মাথা নাড়লো। আমার হাত নিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বলল, “ভাইটু এবার গেলে।”

দারোগা সাহেব নিজের চেয়ারে বসে আছেন। তার সামনের মাঝারি ধরনের একটা টেবিল। টেবিলে ওপর দু-কাপ চা। একটা পিরিচে কয়েকটা সিংগাড়া রাখা। ফুফা বললেন, “অনেকক্ষণ আমাদের বসিয়ে রেখেছেন। এবার কাজের কথা বলুন।”

দারোগা সাহেব ভারী গলায় বললেন, “কাজ আছে বিধায় বসিয়ে রেখেছি৷ খুচরো আলাপ করার জন্য বসিয়ে রাখিনি। যাইহোক এবার পুরো ঘটনা খুলে বলুন।”

ফুফু বলল, “আপনাকে তো সবকিছু বলা হয়েছে। আবারও জানতে চাইছেন কেন?”

দারোগা সাহেব বললেন, ” সেটা তো আমাকে বলেছেন। অ”প’রা’ধীর সামনে একবার বলুন। সে-ও শুনুক।”

ফুফু চোখ ছোট করে দারোগা সাহেবের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি বললাম, “ফুফু, দাদি ঠিক আছে তো?”

ফুফু খেঁকিয়ে উঠলো। কর্কশ গলায় বলল, “খুব ঠিক আছে। মে” রে ধরে এখন না’ট’ক করা হচ্ছে। দারোগা সাহেব এই ছেলেকে ফাঁ”সিতে ঝুলানোর ব্যবস্থা করেন। ওর জন্য আমি এতিম হয়ে গেলাম।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। গলার সুর পাল্টে বললেন, “এতো তাড়া কিসের? আগে খোঁজ খবর হোক। তদন্ত করে দেখি। পো’স্ট’ম’র্টে’ম রিপোর্ট আসুক। তারপর না হয় এসব দেখা যাবে।”

ফুফু মিইয়ে গেল। ফুফা বললেন, “আমি নিজের চোখে দেখেছি- ফয়সাল আম্মাকে ছু” রি দিয়ে আ’ঘা’ত করছে।”

“তখন আপনি কি করছিলেন? ভিডিও করছিলেন নিশ্চয়ই? এতেই আপনার দুই তরফের লাভ।”

“কিসব বলছেন আপনি? এখানে আমার লাভ লসের কি আছে?”

“কিছু না। বাদ দেন। ফয়সাল, তুমি বলো পুরো ঘটনা কি হয়েছিল? শেষবার তোমার দাদিকে কোথায় দেখেছ?”

জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,” সকালবেলা খাবার টেবিলে দাদির সাথে দেখা হয়েছিল। তারপর আর দেখা হয়নি।”

ফুফু বলল, “মিথ্যা কথা বলবি না। স্কুলের কিসব কাজ আছে- সেজন্য তুই মা’য়ের সাথে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলি।”

“না ফুফু, আমি মিথ্যা বলছি না। তোমরা মিথ্যা কথা বলছ।”

“আমরা সবাই মিথ্যা বলছি আর তুই একা সত্যি বলছিস? মিথ্যেবাদীর জন্ম মিথ্যেবাদী!”

দারোগা সাহেব বললেন, “আহা! কি শুরু করেছেন? এটা থানা। এখানে কেউ জোর গলায় কথা বলে না। ফয়সাল তুমি বলো।”

“সকালের পর দাদির সাথে দেখা হয়নি। আজ সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। তুলি আন্টিকে দেখতে আসার কথা চলছিল। কিন্তু ওরা শেষ পর্যন্ত এলো না। ফুফার সাথে দুপুরে খেতে বসলাম। এরপর দু’জনে মিলে মাছ ধরতে গেলাম। নদীর পাড়ে গিয়ে দেখি একটা লা” শ কাঁদার ভেতর উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আমি গিয়ে লা”শটা ঘোরালাম। দাদি ছিলো। ছু”রি ঢোকানো। ফুফা আমাকে সেই ছু”রি টেনে বের করতে বললেন। উনার কথামতো ছু”রি বের করার সময় দেখি ফুফার আমার ভিডিও করছেন।”

“ব্যাস এতটুকুই?”

মাথা নাড়লাম। দারোগা সাহেব ফুফার দিকে ইশারা করে বললেন, “নেন এবার আপনি বলুন।”

“আসলে আজ আমার ছোটবোনকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার কথা ছিল। সে কারণে অফিস যাওয়া হয়নি। বাড়িতে ছিলাম। ফয়সাল বলল- ওর স্কুলে কিসব কাজ আছে। আমাদের একজনকে সাথে যেতে হবে। ব্যস্ততার মাঝে আমাদের কারো সময় ছিল না বিধায় আম্মা ওর সাথে স্কুলে যেতে চাইলেন। ওরা দু’জন বের হয়ে গেল।”

“কয়টা নাগাদ বের হয়ে গেছিল?”

“এই ধরুন দশটা এগারোটা। সঠিক বলতে পারছি না।”

“আচ্ছা। তারপর বলুন।”

“দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর যখন পাত্রপক্ষের কেউ এলো না -তখন মনে হলো ওরা কেউ আসবে না। মেজাজটা বিগড়ে গেল। এমনিতেই অফিস থেকে ছুটি দিতে চায় না। নানান কাজের চাপ। এর মধ্যে বিনা কারণে একটা দিন নষ্ট হলো। খুব বেশি রাগ হচ্ছিল। ভাবলাম খাওয়া-দাওয়া সেরে একটু মাছ ধরতে যাই। এতে খানিকটা স্বস্তি মিললেও মিলতে পারে।”

“এরপর আপনি মাছ ধরতে গেলেন?”

“হ্যাঁ। জাল নিয়ে ভৈরবের উদ্দেশ্য বেরিয়ে পড়লাম। ভাবিনি এমন কিছু দেখতে হবে। হঠাৎই খেয়াল করলাম ফয়সাল আম্মাকে ছু” রি দিয়ে স্টেপ করছে।”

দারোগা সাহেব হাসলেন। ফুফার ইংরেজি শুনেই হাসলেন মনে হয়। সরল গলায় বললেন, “ফয়সাল যখন আপনার শাশুড়িকে আ’ঘা’ত করছিল তখন আপনি কি করছিলেন?”

“দৌড়ে ওদের কাছে গেলাম। আমায় দেখে ফয়সাল অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। কি করব কি করব ভাবতে ভাবতে আপনাদের কল দিলাম। তারপরের ঘটনা তো জানেনই।”

“অনেকদিন ধরে স্ক্রিপ্ট মুখস্থ করছেন নাকি?”

ফুফা তীক্ষ্ণ গলায় বললেন, “মানে? কি বলতে চান আপনি?”

“কিছু বলতে চাইছি না। আপনাদের দু পক্ষের কথার মিল নেই। অবশ্য এটা স্বাভাবিক। অপরাধী আর বিবাদী পক্ষের কথা কখনও এক হয় না। যাইহোক এখন কি করতে চাইছেন?”

ফুফু বলল, “কি করতে চাইছি মানে? আমরা চাই মা’য়ের খু” নির যোগ্য শা’স্তি হোক।”

“আমরাও তাই চাই। যাইহোক এই মুহুর্ত কি করতে পারি তাই বলেন।”

“কি করবেন মানে? এটা তো আপনাদের কাজ। আপনারা ভালো বুঝবেন।”

দারোগা সাহেবের কুঁচকে থাকা ভ্রু মসলিন হয়ে গেল। তিনি স্বাভাবিক গলায় বললেন, “এই মুহুর্তে ফয়সালকে থা’নায় রাখা হবে। আপনাদের ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে তবে এই শহরের বাইরে যেতে পারবেন না।”

ফুফা ফুফু দু-জনে একসাথে মাথা নাড়ালো। যেন তারা এটাই চাইছিল। দারোগা সাহেব বললেন, “আচ্ছা একটা কথা। কেন এই খু” নটা হয়েছে বলতে পারেন?”

ফুফু কিছু বলতে চাচ্ছিল। ফুফা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ” না। এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।”

দারোগা সাহেব মাথা নাড়লেন। শান্ত গলায় বললেন, “আপনারা এখন আসতে পারেন।”

ফুফুরা চলে গেল। যাওয়ার সময় একবার আমার দিকে তাকালো। ভয়হীন শান্ত চোখ!

বিনাদোষ জে’লের মধ্যে বসে থাকার চেয়ে আনন্দের কিছুই হতে পারে না। শুধু হাসি পায়। তাচ্ছিল্যের হাসি! দারোগা সাহেব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চা খাচ্ছেন। মতিন ছেলেটা আমার দিকে সরে এসে বলল, “ঘটনা একটু খুলে বলো তো।”

“কি ঘটনা?”

“এই যে নিজের দাদিকে মা” র”লে কেন? শুনলাম দাদি ছাড়া তোমার আর কেউ ছিল না।”

“আমি দাদিকে মা”রি”নি।”

“কোন অপরাধীই তার দোষ স্বীকার করে না।”

“করে। রজনী নিজের দো’ষ স্বীকার করে নিয়েছিল।”

“রজনী কে?”

“রূপার আংটি উপন্যাসের একটা চরিত্র।”

মতিন উঁচু গলায় হাসলো। হাসতে হাসতে বলল, “দাদাভাই এসব চরিত্র গল্প উপন্যাসে পাওয়া যায়। হা হা।”

ছেলেটা অতিরিক্ত রকমের উৎসাহী। সেই সাথে কথায় পটু একজন মানুষ। হালকা ফুর্তি ভাব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
“একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”

মতিন ভ্রু কুঁচকে বলল, “কি কথা জানতে চাও?”

“আমি জ্ঞান হারানোর পর কি কি হয়েছে?”

“ডিয়ার ব্রাদার! তুমি জ্ঞান হারানোর পর কি হয়েছে সে কথা আমি কিভাবে বলব? তবে হ্যাঁ কিছু কথা তোমায় বলতেই পারি।”

“কি কথা?”

“তোমার ফুফা লোকটা বেশ অসুবিধার। চূড়ান্ত হিসাব করে কথা বলে।”

“জানি।”

“যাইহোক। তুমি যা শুনতে চাইছিলে। থানায় বসে সিগারেটে সুখটান দেবো এমন এ সময় একটা কল আসলো। ভৈবর নদীর পাড়ে লা” শ পাওয়া গেছে। খু”নিকেও হাতে নাতে ধরা হয়েছে। সে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে আছে। দারোগা সাহেব তড়িঘড়ি গাড়ি বের করতে বললেন। কাঁদা ছিটিয়ে ভৈরব নদীর পাড়ে গিয়ে উপস্থিত হলাম।”

“কাঁদা ছিটিয়ে মানে?”

“আহা! ওটা হবে ধূলো উড়িয়ে। কিন্তু এই বর্ষায় ধূলো কোথায়? সব কাঁদা। তাই কাঁদা ছিটিয়ে বললাম।”

“আচ্ছা। তারপর?”

“তারপর গিয়ে দেখি তুমি আর একজন মহিলার লা” শ কাঁদার মধ্যে উল্টে পড়ে আছে। তোমায় ধরে গাড়িতে ওঠানো হলো। লা” শটা মর্গে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। পো’স্ট’ম’র্টে’ম হবে।”

“মহিলাটা কি সত্যি মা” রা গেছে?”

“হ্যাঁ তাই তো মনে হচ্ছে। ওই যে লোকটা থানায় এলো না। তোমার ফুফা নাকি সে নাকি তোমায় খু” ন করতে দেখেছে। সবকিছু স্যারের কাছে বর্ণনা করেছে। আরো কিছু লোকজন ছিল। তাদের মধ্যে একজন খু”ন হতে দেখেছে। খু”নের সময় সে দৌড়ে আসছিল।”

“ভালো।”

“ভালো কি মন্দ জানি না। তবে তুমি চরম ফাঁ’সা ফেঁসেছ। কম করে হলেও চোদ্দ বছরের জে’ল হবে। ফাঁ”সি টাসিও হতে পারে।”

মতিনের কথায় উত্তর দিলাম না। দাদির মুখটা চোখের সামনে ভাসছে। ধীরে ধীরে সেই মুখ অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বুকের ভেতর কেমন কেমন ব্যাথা করছে। শেষ পর্যন্ত এই দুনিয়ার বুকে একা হয়ে গেলাম। একদম একা!

চলবে।

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০৬

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৬

সারা শরীরে হিমশীতল বাতাস বয়ে গেল। ফুফার মুখের ওপর না বলার সাহস নেই। আবার তার সাথে যাওয়ার সাহসও নেই। খাওয়া শেষে ফুফা আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “ভৈরব নদীর পাড়ে চল। একটা কাজ আছে।”

নিজের সমস্ত সাহস এক করে বললাম,”ভরদুপুরে যেতে ইচ্ছে করছে না। অন্য সময় যাব।”

“দুপুর তো কি হয়েছে? রোদ নেই। বিকেলে বৃষ্টি নামতে পারে। এখনই চল। যা কাপড় বদলে আয়। আমি অপেক্ষা করছি।”

ফুফা পকেট থেকে সিগারেট বের করে সিগারেট ধরালো। সরল গলায় বলল, “দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কথা কানে যাচ্ছে না? দেরি করলে মাছ পাওয়া যাবে না।”

ফুফার দিকে তাকালাম। আকাশের দিকে তাকিয়ে সিগারেটের পশ্চাৎদেশে সুখটান দিচ্ছে। ভাব-ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে আমায় না নিয়ে এক পা-ও নড়বেন না। দাদিকে বলব? না থাক। সব কথা দাদিকে বলতে ইচ্ছে করে না। বৃদ্ধ মানুষ, সারাক্ষণ নানান চিন্তায় উত্তেজিত হয়ে থাকে। তার ওপর হাই প্রেশার, হার্টের সমস্যা। ডাক্তার সাহেব টেনশন করতে নিষেধ করেছেন। এই মুহুর্তে আমি কিছু বললে দাদি চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দেবে। সেটা একদম ঠিক হবে না। ঘরে গিয়ে কাপড় পাল্টে এলাম। বেরবার আগে দাদির ঘরে উঁকি দিয়ে এসেছি। দাদি ঘরে নেই। কোথায় গেছে কে জানে? দাদি কোথাও যাওয়ার সময় কাউকে বলে যায় না। নিজের ইচ্ছেমত চলে।

বর্ষার সময়। রাস্তাঘাট অন্ধকার। আকাশে মেঘ জমছে। ফুফা আগে আগে হাঁটছেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথাবার্তা বলছেন। কথার ধরণ খুবই স্বাভাবিক। এই যেমন-

“ফয়সাল মিয়া, পড়াশোনা কেমন চলে?”

“ভালো চলছে।”

“কেমন ভালো? মুটামুটি ভালো নাকি বেশ ভালো?”

“মুটামুটি ভালো।”

“ভালো করে পড়াশোনা করা উচিত। না হলে জীবনে কোন উন্নতি করতে পারবে না।”

“মনে থাকবে।”

“শুধু মনে রাখলে হবে না। সেই অনুযায়ী কাজ করে যেতে হবে।”

“আচ্ছা।”

“নিয়মিত স্কুলে যাবে। স্কুলে না গেলে পড়াশোনা হয় না।”

“ঠিক আছে। যাব।”

কথার পিঠে কথা বলতে ভালো লাগছে না। নানান চিন্তায় মাথা খা’রা’প হয়ে আছে। দাদি আজ-কাল যা শুরু করেছেন তাতে খুব তাড়াতাড়ি বিশাল ঝা’মে’লা বাঁধবে। এই বয়সে দাদির এতো ঝক্কি সহ্য হবে না। ফুফুর ইচ্ছে মতো বাড়িটা ওদের নামে লিখে দিলেই সব ঝামেলা শেষ হয়ে যায়। আমি আর দাদি গিয়ে খুলনার বাড়িতে উঠতে পারি। দাদি তা করবেন না। কেন করবেন না সে-ও এক রহস্য। কাঁদা রাস্তায় জুতো পায়ে দিয়ে হাঁটা যায় না। কেমন পিছল হয়ে যায়। ফুফা বললেন, “ফয়সাল মিয়া বোধহয় আমায় পছন্দ করো না।”

স্বাভাবিক গলায় বললাম, “আপনি কি আমায় পছন্দ করেন? কখনও তুমি কখনও তুই বলে সম্মোধন করেন। কখনও ঠান্ডা মেজাজে কথা বলেন কখনও শান্ত থাকেন।”

“মেজাজ এমন হলেও আমি মানুষ হিসেবে বেশ ভালো।”

মনে মনে বললাম, ‘নিজের ঢাক নিজে পে’টা’চ্ছে। খ’বি’শ লোক একটা!’

ফুফা বললেন, “তোমার একটা খরব দিই। শুনলে মাথা খারাপ হয়ে যাবে।”

ফুফা আমাকে কি এমন বলতে চাইছেন যা শুনলে আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে। আজ ফুফার ভেতর অস্বাভাবিক কিছু লক্ষ্য করছি না। ডান হাতে মাছ ধরা জাল নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে হাঁটছেন। টুকটাক কথাবার্তা বলছেন। এখানে ভয়ের কিছু নেই। হঠাৎই চিঠির কথা মনে পড়ল এবং ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেলাম। ফুফা বললেন, “কথা বলছ না কেন? শুনবে নাকি?”

কাঁপা গলায় বললাম, “হ্যাঁ শুনব। বলুন।”

“আগেরদিন তোমার একটা টেস্ট নিলাম। তুমি একশে একশ দশ নম্বর পেয়েছ।”

“কি টেস্ট নিয়েছেন? আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।”

“তোমার ফুফুর সাথে বাজি ধরেছিলাম।”

“আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”

“দাঁড়াও বুঝিয়ে বলছি। সেদিন রাতে খাওয়া শেষে দু’জন বিছানায় শুয়ে আছি। তোমার ফুফু বলল, ‘ফয়সাল আমাদের পছন্দ করে না। বিশ্বাসও করে না।’
আমি বললাম, ‘আরে তুমি ভুল ভাবছ। আমরা তো ওর নিজের লোক।’
‘নিজের লোক আর পরের লোক নেই। মা সবসময় ফয়সালের কানে আমাদের নামে বি’ষ ঢালে। বাচ্চা ছেলের ওপর এর প্রভাব পড়ে না বলো?’
‘তা পড়ে বৈকি! আম্মা যে কি শুরু করেছেন! নিজেদের মধ্যে ঝামেলা লাগতে চাইছেন। তবে তুমি কষ্ট পেও না। ফয়সাল আমাদের বিশ্বাস করে।’
‘না রে। ফয়সাল আমাদের বিশ্বাস করে না।’
‘ বাজি হয়ে যাক।’
‘কি বাজি?’
‘ফয়সাল যে আমাকে খুব বিশ্বাস করে, তা তোমাকে প্রমাণ করে দেখাব।’
‘কিভাবে দেখাবে?’
‘ওকে নিয়ে মাছ ধরতে যাব। তাহলেই সব বোঝা যাবে।’
‘মাছ ধরতে গেলে কিভাবে সব বোঝা যাবে?’
‘আহা! শোনোই না। মাছ ধরতে যাওয়ার সময় তিশার হাত থেকে ওকে একটা চিরকুট লিখব। তাতে লেখা থাকবে- আমি ওকে মা’র’তে চাই।’
‘তারপর?’
‘তারপর ফয়সাল আমার সাথে গেলে বুঝতে হবে ও আমাদের বিশ্বাস করে। আর যদি আম্মাকে ডেকে ঝামেলা শুরু করে তাহলে বুঝব ও আমাদের বিশ্বাস করে না। হিসাব বরাবর।’
‘আমার খুব ভয় করছে। মা জানলে থা’না পু’লি’শ করতে পারে। উনাকে একটুও বিশ্বাস নেই।’
‘কিছু হবে না। ফয়সালের প্রতি আমার বিশ্বাস আছে।’

হতভম্ব হয়ে ফুফার দিকে তাকিয়ে রইলাম। এই লোক বলে কি? এসব কিছু পরিকল্পনা করে করেছে শুধুমাত্র আমার বিশ্বাস পরীক্ষা করার জন্য? কথাটা আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না আবার ঠিক অবিশ্বাসও হচ্ছে না। ফুফা সহজ ভঙ্গিতে হাসলেন। তরল গলায় বললেন, “বাবা ফয়সাল। তোমাকে আমি ছেলের মতোই ভালোবাসি। শিমুল আর তালেবের সাথে পার্থক্য করি না। আমি তোমার ভালোই চাই।”

ফুফার এই কথার উত্তরে খুব গুছিয়ে কিছু বলা উচিত। যাতে উনি সন্তুষ্ট হয়ে যান। কিন্তু তেমন কোন শব্দ আমার মাথায় আসছে না। আমার চুপ থাকতে দেখে ফুফা বললেন, “কি হলো? চিন্তায় পড়ে গেলে নাকি?”

“না না। চিন্তা কিসের? আসলে কি বলব বুঝতে পারছিলাম না।”

ফুফা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “তুমি আর কি বলবে বলো! যাদের জন্য চু’রি করি তারাই বলে চো’র। তোমাকে আর আম্মাকে খুব ভালোবাসি বিধায় নিজের বাড়িঘর ফেলে এখানে এসে উঠেছি। চাকরির বদলি করাতে কত সমস্যা হলো। তারপর আম্মার মন পাওয়া যায় না।”

“দাদির মন দিয়ে কি করবেন ফুফা?”

ফুফা চমকে উঠলেন। সেই চমক আমার চোখ এড়ালো না। এই লোকটা হুট করে এমন কথা কেন বলছে বুঝতে পারছি না। কি চাইছে আমার কাছে? আমায় মে”রে ফেলা সহজ কোন কাজ না। বড় মামা পুলিশ অফিসার। ছোট মামা আর্মিতে চাকরি করে। এমনিতে তারা খোঁজখবর না নিলেও ম”রার পর ঠিকই নানান সমস্যা করবে। মৃ’ত মানুষের ওপর আমাদের মায়া মততা বেড়ে যায়। ভালোবাসা উপচে পড়ে। ম”রার পরপর দু-চার দিন মৃ’তব্যক্তিকে খুব ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। নানান স্মৃতি মনে পড়ে। কেউ সেই কষ্ট লুকাতে চায় না। দু’ফোটা চোখের পামি ফেলতেও দ্বিধা করে না।

খানিকক্ষণ চুপ থাকার পর ফুফা বললেন, “আমার বাবা খুব ধার্মিক মানুষ ছিলেন। সারাক্ষণ নামাজ রোজা নিয়ে পড়ে থাকতেন। বাবা কয়েকটা কথা বলতেন।”

কৌতূহলী গলায় বললাম, ” কি কথা বলতেন?”

“কুরআনের আয়াত বলতেন। কুরআন শরিফে এতিমদের নিয়ে অনেক কথা বলা আছে। সেসব বলতেন।”

বুকের মধ্যে ধক করে উঠল। ফুফা কি আমায় এতিম বলতে চাইছেন? অবশ্য চাওয়া না চাওয়ার কি আছে। সত্যিই তো আমি এতিম। আমার মা বাবা নেই। দুনিয়ার বুকে এতিমই আমার পরিচয়। নিতান্ত অনিচ্ছায় প্রশ্ন করলাম, “কি আয়াত আছে?”

ফুফা যেন এই প্রশ্নের অপেক্ষায় ছিলেন। তড়িঘড়ি করে বললেন, ” কুরআন শরীফে আল্লাহ বলেছেন ‘সুতরাং আপনি এতিমের প্রতি ক’ঠো’র’তা করবেন না।’ (সুরা দোহা : আয়াত ৯)
শুধু এটা নয় অন্য জায়গায় বলেছেন – ‘নিশ্চয়ই যারা পিতৃহীনদের (এতিমদের) সম্পদ অ’ন্যায়ভাবে গ্রা’স করে, তারা আসলে নিজেদের পেটে আ’গু’ন ভ’ক্ষ’ণ করে। আর অচিরেই তারা (জা”হা”ন্না”মের) জ্ব”ল’ন্ত আ’গু’নে প্রবেশ করবে।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১০)
এমনকি এতীমদের সম্পদের কাছে যেতেও নি’ষেধ করেছেন।
“এতিম পরিণত বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তার সম্পত্তির নিকটবর্তী হয়ো না।
তবে সদুপায়ে (সম্পদের উন্নতি করার লক্ষ্যে) তা ব্যবহার করা যাবে। আর প্রতিশ্রুতি পূরণ করো। কেননা (কি”য়া”ম”তের দিন) প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কৈফিয়ত তলব করা হবে।’ (সুরা : বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৪)”

মৃদু হাসলাম। শান্ত গলায় বললাম, “এসব আয়াত আপনার মুখস্থ?”

ফুফা লজ্জিত ভঙ্গিতে বললেন, “ওই টুকটাক মুখস্থ আছে। একটা জিনিস খেয়াল করেছ? আল্লাহ বলেছেন সম্পদের উন্নতির জন্য এতীমদের সম্পদ ব্যবহার করা যায়। এখন আমি যদি তোমার সম্পত্তি বৃদ্ধির জন্য তাই দিয়ে ব্যবসা করি তাহলে কোন পা”প হবে না। শুধু তুমি বড় হলে সেসব ফেরত দিতে হবে।”

এতক্ষণে ফুফার উদ্দেশ্য পরিষ্কার হলো। উনি যেকোন উপায়ে আমার কাছ থেকে সম্পত্তিগুলো হাতিয়ে নিতে চান। উনার এই চাহিদা পূরণের পেছনে সবচেয়ে বড় বাঁ’ধা দাদি। দাদির কারণে এমন করতে পারছেন না। সেজন্য আমার ব্রেনওয়াশ করতে চাইছেন। মানুষের ব্রেনওয়াশ করার সবচেয়ে সহজ উপায় হলো নিজেকে ভালো প্রমাণ করা। এই ভালো সাজার সবচেয়ে সহজ উপায় ধর্মকে কাজে লাগানো। ধর্মের ব্যাপারে মানুষের হৃদয় খানিকটা কোমল থাকে। কাজেই কুরআনের আয়াত তুলে ব্যাখ্যা করা খুব যুক্তিযুক্ত কাজ। যেন আমি ওনাকে বিশ্বাস করে সবকিছু ওনার হাতে তুলে দিই। আমি দিতে চাইলে দাদির খুব বেশি কিছু করার থাকবে না। ফুফা উকিল ধরে সবকিছু ঠিকঠাক করে নেবেন। যে লোক এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ে না সে-ও কুরআনের আয়াত পড়ে শোনায়। এসব নেহাৎ ভ’ণ্ডা’মি। চো’র মুসল্লীর সাজে জুতো চু’রি করে। তাই বলে কি মুসল্লী চো’র হয়ে যায়? খা’রা’প মানুষরা সবসময় ভালো মানুষির মু’খো’শ পরে আমাদের ধোঁ’কা দিতে চায়।

ফুফা বললেন, “তোমার দাদির ব্যাপারে একটা খবর শুনবে নাকি?”

“কি খবর শুনব?”

“আম্মা তার সব সম্পত্তি নিজের ভাইপোর নামে লিখে দিচ্ছে। শুনেছি বাড়িটাও তাকে লিখে দিবে। ক’দিন আগে কথা হয়েছে।”

“এসব আপনাকে কে বলল?”

“খবর দেওয়ার লোকের অভাব নেই বাজান। তাছাড়া এসব কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কান পাতলেই শোনা যায়।”

“ফুফা! মাছ ধরতে আসছি, চলেন মাছ ধরি। এই প্রসঙ্গ বাদ দেন। শুনতে ভালো লাগছে না।”

ফুফা ঠোঁট বাঁকা করে হাসলেন। অত্যন্ত শীতল গলায় বললেন, “তোমার দাদি যদি সব সম্পত্তি তার ভাইপোকে দিয়ে দেয় তখন তুমি কি করবে?”

“কি করবো? আপনার যদি আপনি ফুফুর সম্পত্তি ফুফুর নামে লিখে দেন এতে আমার কি করার থাকতে পারে? তেমনই দাদির বেলায়ও আমার কিছু বলার নেই।”

“কিছুই করবে না? এমনি এমনি সবকিছু ছেড়ে দেবে? তোমার জায়গায় আমি থাকলে তো দাদিকে খু” ন করে ফেলতাম।”

“দাদি এমন করতে পারে না। আর যাি করে তাহলে আমিও না হয় তাকে খু’ন করে ফেলবো।”

কথাটা বলে জিভ কা’ম’ড়ে ধরলাম। রাগের মাথায় এই কথাটা বলে ফেলা উচিত হয়নি। কিন্তু কি করার? বলা কথা ফেরত নেওয়ার কোন উপায় নেই। থাকলে এই কথাটা ফেরত নিতাম। ফুফা সহজ গলায় বলল, “যাকগে বাদ দাও। ওই ঝোপের দিকে চলো। ওখানে বেশ মাছ পাওয়া যায়।”

ফুফার পেছন পেছন ঝোপের দিকে গেলাম। ঝোপের পাশে কাঁদা মাখা শরীরে একটা মানুষ পড়ে আছে। মুখ বোঝা যাচ্ছে না। ফুফা বললেন, “বাবা ফয়সাল! দেখ তো ওইটা কে? আমার খুব ভয় করছে।”

সাহস দেখিয়ে লা”শটাকে ঘুরলাম। এবং চিৎকার দিয়ে পেছনে সরে আসলাম। ভয় জড়ানো গলায় বললাম, “ফুফা এটা তো দাদি! দাদি এখানে কিভাবে এলো?”

ফুফা ব্যস্ত গলায় বললেন, “ওই দেখ। ছু” রি ঢোকানো। তাড়াতাড়ি ওইটা বের কর। বেঁচেও থাকতে পারে।”

আমি গিয়ে ছু”রির হাতল ধরে ছু”রি বের করার চেষ্টা করতে লাগলাম। মিনিট খানেক পর ছু’রি বের করে ফুফার দিকে তাকিয়ে দেখলাম ফুফা মোবাইল বের করে ভিডিও করছেন বা ছবি তুলছেন। হাত থেকে ছু”রিটা পড়ে গেল। সারা শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় অজ্ঞান হয়ে যাব! দাদি এখানে এলো কিভাবে? সকালেও সুস্থ মানুষ দেখে এসেছি। অল্প সময়ের ব্যবধানে কিসব হয়ে গেল? হিসাব মেলানোর সময় পেলাম না। তার আগেই কাঁদা ভেতর লুটিয়ে পড়লাম।

চলবে

ভৈবর নদীর পাড় পর্ব-০৫

0

#ভৈবর_নদীর_পাড়
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৫

ভোররাতের দিকে একটা স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেল। বি’ভৎ’স ভ’য়ংক’র স্বপ্ন। লাফিয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে। স্বপ্নে সেই অচেনা লোকটা দেখলাম। যার একটা হাত কা’টা। লোকটার সাথে ভৈরব নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছি। সে আমায় নৌকায় করে মাঝ নদীতে নিয়ে গেল। ধা’রা’লো ছু’রি দিয়ে পেটের এ’ফো’ড় ও’ফো’ড় করে দিতে দিতে বলল, “কাজ শেষ! সব কাজ শেষ!”
বুকের ভেতর ব্যাথা ব্যাথা অনুভব হচ্ছে। কেমন যেন দম আঁটকে আসছে। নিঃশ্বাস ব’ন্ধ হয়ে যাবে মনে হয়। পানির পিপাসা তীব্র হয়ে উঠেছে। পরপর দু গ্লাস পানি পানি করলাম। হাত পা কেমন যেন অবশ হয়ে আছে। এলোমেলোভাবে বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম। চারদিকে অন্ধকার। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে মনে হয়। গাঢ় অন্ধকারে চোখ মেলে থাকলে ভয়ে অসাড় হয়ে যেতে হয়। কোলবালিশটা বুকে জড়িয়ে আছি। এতে ভয় একটু কম অনুভব হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। ঘুমের অতল গভীরে তলিয়ে গেলাম।

আজ আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। আলো তখনও ভালো করে ফোটেনি। এখনও অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। আকাশের ক্ষীণ আলো আঁধারিতে মন অন্যরকম হয়ে যায়। ভোররাতে স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেছিল। শরীরটা ম্যাজম্যাজ করার কথা। কিন্তু না শরীর বেশ ঝরঝরে লাগছে। স্বপ্নের ভয়টা আর নেই। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। বহুদিন হলো মা-বাবার ক’ব’রের কাছে যাওয়া হয় না। আজ যেতে ইচ্ছে করছে। কেন করছে সে-ও এক রহস্য! ধীর পায়ে হেঁটে ক’ব’রের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কালো সিমেন্ট দিয়ে ক’ব’রের দেওয়াল বাঁধানো। তাতে খোদাই করে বাবা মায়ের নাম লেখা। দেওয়ালের ওপার একটা হাত রাখলাম। মা! বাবা! বহুদিন হয়ে গেছে তোমাদের ক’ব’রের কাছে আসা হয় না। এখানে এলেই দু-চোখে পানি ভরে যায়। ব্যাপারটা একটুও ভালো লাগে না। তোমরা খুব রাগ করো তাই না? সত্যি বলতে কি? আমার তোমাদের কাছে আসতে ইচ্ছে করে না। কে আমি তোমাদের? বলো? আমি কি তোমাদের কিছু হই? হই না! আমি যদি সত্যিই তোমাদের কেউ হতাম- তবে আমায় ফেলে এভাবে চলে যেতে পারতে না। পারতে না। অঢেল সম্পদের মাঝে আমায় এমনভাবে ফেলে চলে গেলে যেন মনে হয় সহস্র হা’য়’না’র মাঝে আমি এক অসহায় হরিণ ছানা। যার কেউ নেই। পদে পদে মৃ’ত্যু’ভ’য় যাকে তাড়া করে বেড়ায়। প্রিয় মা! তোমার কথা একটু বেশিই মনে পড়ে। রোজ সকালে ঘুম থেকে ওঠা নিয়ে তোমায় শোনানো কড়া কথাগুলো খুব মনে পড়ে। আজকাল কেউ ঘুম থেকে উঠতে জোর করে না। ইচ্ছেমতো ঘুমতে পারি। রাতে খাওয়া শেষে দুধের গ্লাস নিয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে না। বইয়ের পাতায় মুখ গুঁজে কাউকে এখন ফাঁকি দিতে হয় না। সবকিছু বদলে গেছে মা। এমন বদল তো আমি চাইনি! ক’ব’রের পাশে দাঁড়িয়ে যেন কোন দোয়াটা পড়তে হয়? ভুলে গেছি। সূরা কালাম যা জানতাম প্রায়ই ভুলতে বসেছি। চর্চা নেই যে। এখন আর কেউ ফজরের নামাজ পড়তে জোর করে না। দাদি বলে ঠিকই। তোমার মতো হয় না। বাবাকেও খুব মনে পড়ে। ঘুমঘুম চোখে বাবার হাত ধরে রাস্তায় হাঁটতে যাওয়া। হিরুর দোকানের আলু পরোটা ছিঁ’ড়’তে ছিঁ’ড়’তে রূপকথার গল্প শোনা। মধ্যে দুপুরে পুকুরের পানিতে সাঁতার কে’টে বেড়ানো। এসবের কিছুই আমি ভুলতে পারি না। স্মৃতি আমায় ভুলতে দেয় না। মধুর স্মৃতি কেন বি’ষা’ক্ত হয়ে যায় বলতে পারো তোমরা? কেন তাতে অশ্রু ঝরে পড়ে?

হাত দিয়ে চোখ-মুখ মুছে ফেললাম। চারদিকে সূর্য আলো চকচক করছে। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে। চমৎকার একটা সকাল। মন ভালো করে দেওয়ার মতো চমৎকার। সকালে নাস্তায় টেবিলে খেয়াল হলো কিছু পরিবর্তন এসেছে। আজকের খাবার অন্যদিকের মতো নয়। পরোটা, ভুনা গোশত, চিঁড়ের পোলাও, দই মিষ্টি। সচারাচর এতো ভালো খাবার সকালের নাস্তায় পাওয়া যায় না। খানিকটা বিস্মিত ভঙ্গিতে বললাম, “কেউ কি বেড়াতে আসবে নাকি?”

ফুফু নাস্তা গুছিয়ে রাখছিল। মিষ্টির প্যাকেট থেকে মিষ্টি বের করতে করতে বলল, “তুলিকে ছেলে পক্ষ দেখতে আসবে।”

“তুলি আন্টির বিয়ে ঠিক হয়েছে?”

“বিয়ে ঠিক হয়নি। সবে দেখাদেখি হচ্ছে। মনে হয় বিয়েটা হয়ে যাবে। তুলি যেমন সুন্দর তেমনই গুণবতী। এমন মেয়ে কি কেউ হাতছাড়া করে!”

তুলি আপু সুন্দর কথাটা সত্যি। টানাটানা চোখ, জোড়া ভ্রু, ঠোঁটের রং হালকা গোলাপি। একবার চোখ পড়লে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। তবে তার চরিত্রে ভালোকিছু খুঁজে পাওয়া দায়। স্পষ্ট মনে আছে এই মেয়েই একদিন ফুফুর রান্নায় মরিচের গুঁড়ো মিশিয়ে দিয়েছিল। ঝাল তরকারি কেউ মুখে তুলতে পারেনি। সেই নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছে। ফুফু নিজেও তার ছোট ননদকে পছন্দ করত না। এখন খুব মিল হয়েছে। হঠাৎই ফুফুর শশুর বাড়ির লোকের প্রতি মহব্বত বেড়ে গেছে। উঠতে বসতে মনে হয় এরা ফুফুর আত্মার আত্মীয়।

কথা ছিল মেহমান আসলে তাদের সাথে সকালের নাস্তা করা হবে। আয়োজনও ছিল তেমন। কিন্তু দাদি তা হতে দিলেন না। নিজে খেয়ে নিলেন এবং আমাকেও জোর করে খাইয়ে দিলেন। ছোট দাদি তী’ক্ষ্ণ চোখে তাকালেও মুখে কিছু বললেন না। খাওয়া শেষ করে দাদি বললেন, “জামাই, তোমাকে একটা কাজ করতে বলেছিলাম। করেছ?”

ফুফা আমতা আমতা করে বলল, “কি কাজ আম্মা?”

“একজন রান্নার লোক ঠিক করতে বলেছিলাম আর দু’টো ঘর ফাঁকা করতে বলেছিলাম।”

ফুফু বলল, “মা তুমিই বলো কার ঘর ফাঁকা করব? সবাই যার যার নিজের ঘরে থাকে। তুমি যদি ফয়সালের সাথে থাকতে তাহলেও একটা ঘর ফাঁকা হয়ে যেত।”

দাদি কঠিন গলায় বলল, “এটা ফয়সালের বাড়ি। এখন ফয়সালকেই যদি অন্যের সাথে ঘর ভাগাভাগি করতে হয় তাহলে এতগুলো ঘরে কে থাকবে?”

ছোট দাদি বললেন, “তাহলে আপনিই বলেন কে কোথায় থাকবে। আমাদের বলা তো আপনাদের পছন্দ হবে না।”

“আপনি গিয়ে তুলির কাছে ঘুমাবেন। আর তিশাকে আমার ঘরে ঘুমাতে বললেন।”

ফুফা বললেন, “মায়ের কারো সাথে থাকতে অসুবিধা হয়। সমস্যা হলে ফয়সালকে তালেব আর শিমুলের সঙ্গে থাকতে দিলাম।”

“জামাই বাবা। এটা আমাদের বাড়ি। নিজের মা’কে স্পেশাল রুমে থাকতে দিতে হলে নিজের বাড়িতে গিয়েই থাকতে দাও। আমাদের কিছু সুবিধা অসুবিধা আছে।”

ফুফা চোখ গরম করে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার খুব রাগ হচ্ছে। তবে তিনি সেই রাগ প্রকাশ করতে পারছেন না।

ফুফু বলল, “মা তোমার কি মনে হয় না তুমি বাড়াবাড়ি করছ? এত বড় বাড়িতে আমাদের থাকা নিয়ে তোমার এত সমস্যা হচ্ছে কেন? তাছাড়া তোমার এত টাকার প্রয়োজন যে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে? দরকার পড়লে আমাদের বলো। আমরাই ভাড়া দিয়ে থাকছি। এ বাড়িতে তো তোমাদের সুবিধার জন্য এসেছিলাম। এখন তোমার ভাব লক্ষন দেখে মনে হয় টাকা-পয়সা ক’ব’রে নিয়ে যাবে।”

দাদি ফুফুর দিকে এগিয়ে গেলেন এবং সবাইকে চমকে দিয়ে ফুফুর গালে একটা থা’প্প’ড় মা’র’লেন। ফুফু হতভম্ব হয়ে দাদির দিকে তাকিয়ে রইল। দাদি বললেন, “অনেকদিন ধরে তোদের বাড়াবাড়ি সহ্য করছি। আর না। তোদের সবার খুব বেশি বাড় বেড়েছে। এতো বড় একটা বাড়ি অথচ ফয়সাল চিলেকোঠার ঘরে থাকে। ঘরে একটা খাট আর টেবিল রাখলে কোন জায়গা থাকে না। অনেকদিন থেকে দেখছি। ভেবেছিলাম তোরা শুধরে যাবি। কিন্তু আমার ধারণা ভুল। মা-বাপ ম’রা ছেলেটাকে নিঃস্ব করে দিতে চাস? লজ্জা করে না তোদের?”

ছোট দাদি বললেন, ” আপনি ভুল বলছেন বেয়ান। ফয়সাল নিজেই তো ওই ঘর পছন্দ করে নিয়েছে। আপনার মেয়ে তো ফয়সালকে নিজের ছেলেদের থেকেও ভালো জানে।”

দাদি গলায় স্বর বদলে বলল, “আজ-কাল আমার মেয়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা দেখে বিস্মিত হয়ে যাই। আশ্চর্য! একটা সময় আপনিই তাকে পছন্দ করতেন না। নিজের ছেলেকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিতে চাইতেন।”

ছোট দাদি সত্যিকার অর্থে নিভে গেলেন। মুখ দেখে মনে হচ্ছে তার আর কিছুই বলার ক্ষমতা নেই। ফুফুর বিয়ের দু’বছর পর্যন্ত কোন ছেলে-মেয়ে হচ্ছিল না। ছোট দাদি নিজের ছেলের বিয়ে দিতে চাইলেন। পাত্রী পর্যন্ত ঠিক করলেন। শেষ মুহুর্তে দাদা গিয়ে সেই বিয়ে ভেঙে দিয়েছি। টাকা পয়সা দিয়েই ভেঙেছিল তবে কখনও স্বীকার যাননি।
ভেবেছিলাম ছোট দাদি আর কিছু বলবেন না। তবে তিনি আমাকে ভুল প্রমাণিত করে বললেন, “আপনি অহেতুক তর্ক করছেন। ফয়সাল তো সামনেই আছে। ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখুন। নিজে থেকে ওই ঘর পছন্দ করেছিল কি-না।”

“না বেয়ান। ফয়সাল নিজে ওই ঘর পছন্দ করেনি। শিমুল আর তালেবের থাকার জন্য ফয়সালের নিজের ঘর ছেড়ে ওই ঘরে আসতে হয়েছে। আপনারা অনেক বেশি সর্তকতার সাথে এসব বিষয় পরিবর্তন করেছেন। যেন হুট করে চোখে না পড়ে।”

ফুফা বললেন, “সমস্যা নেই আম্মা। ফয়সালের জন্য দোতলায় একটা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়া যাবে। আপাতত আপনি একটু চুপ করেন। আজ তুলিকে দেখতে আসবে। ওদের পছন্দ হলে বিয়ে পড়িয়ে দেব। তখন আপনার একটা ঘর খালি হয়ে যাবে। সামনের মাসে আমরাও বাড়ি ভাড়া নেওয়ার চেষ্টা করব। এভাবে আর থাকা যায় না।”

দাদি চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলেন। তাকে দেখে খুব একটা দুঃখী মনে হলো না।
বেলা বারোটা পর্যন্ত সবাই মেহমানদের জন্য অপেক্ষা করল। ফুফা পর্যন্ত না খেয়ে বসে আছে। মেহমানদের ভাব লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে না তারা আসবে। তুলি আন্টি শুকনো মুখে সোফায় বসে আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে খুব অ’প’মা’নি’ত বোধ করছে। পৃথিবীর কোন ছেলের তার মতো সুন্দরী মেয়েকে অপেক্ষা করানোর যোগ্যতা নেই।
ফুফু বলল, “অনেক তো হলো! সবাই যার যার মতো খাবার খেয়ে নাও। আজ মনে হয় ওরা আসবে না।”

ফুফা মাথা নাড়লেন। শান্ত গলায় বললেন, “ফয়সালকেও খেতে দাও। ওকে নিয়ে একটা জায়গায় যাব।”

আমার সারা শরীরে হিমশীতল বাতাস বয়ে গেল। ফুফার মুখের ওপর না বলার সাহস আমার নেই। আবার তার সাথে যাওয়ারও সাহস নেই। খাওয়া শেষে ফুফা আমার হাত ধরে বাইরে নিয়ে গেলেন। বরফ শীতল গলায় বললেন, “ভৈরব নদীর পাড়ে চল। একটা কাজ আছে।”

চলবে