Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 128



চৈত্রের প্রেম পর্ব-০৩

0

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(৩)

পুলিশের লোক শুনে শ্রাবণ শারিয়ারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়। শ্রাবণ শারিয়ার অফিসার দুজনের মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে নেয়। হারুন রশীদের বয়স আনুমানিক ৪৫ থেকে ৫০ এর ঘরের মধ্যে হবে আর মামুনুর সাহেব তরুণ অফিসার। বয়স ২৬-২৭। শ্রাবণ শারিয়ার, মামুনুর সাহেবের দিকে কিছুক্ষণ স্থির চাহনি রাখে। শ্রাবণ শারিয়ারের ভাবনা জুড়ে মামুনুর সাহেব। এই অল্প বয়সে বেশ অনেক দূর এগিয়ে গেছে ছেলেটা।

এবার আসল কথায় আসা যাক? হারুন রশীদ, শ্রাবণ শারিয়ারের ভাবনা ছেদ করে বলে। শ্রাবণ শারিয়ার একটু নড়েচড়ে বলে জ্বি বলুন। এরই মাঝে চা নিয়ে আসে রাশেদা বেগম। হারুন রশীদ তার দিকে তাকিয়ে বলে ইনি কে?
উনি আমাদের বাড়ির পরিচারিকা। এখন সম্পর্কে শ্বাশুড়িও হয়। শ্রাবণ বলে নির্লিপ্ত ভাবে।

ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা? মামুনুর বলেন কৌতুহল নিয়ে।

আপনারা কি আমার বাড়ির মেম্বারশিপ সম্পর্কে ইন্টারভিউ নিতে এসেছেন নাকি অন্য কোনো দরকারে? এবার একটু কঠোর হয় শ্রাবণ।

অবশ্যই ব্যাপারটা অন্য। মূল পয়েন্টে আসছি।

আপনার লাস্ট বইয়ের নাম ❝আঁধারে আড়ালে সে❞। সে বইয়ে আপনি থ্রিলার কাহিনি হিসেবে তুলে ধরেছেন একজন খুনি, ঠিক খুনি বলা যায় না সাইকো। একজন সাইকো দেশের বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ওইসব নারী পুরুষকে মে’রে ফেলছে যারা স্বামী বা স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও অন্যত্র সম্পর্ক করতো৷ আই মিন পরোকিয়া করে বেড়ায়। সাইকো খুনি তাদেরই খুঁজে খুঁজে হত্যা করে চলেছে অথচ তার কেউ কোনো হদিসও পাচ্ছে না। ভুমিকা ঠিক আছে?

শ্রাবণ শারিয়ার ভ্রু কুচকে সায় দেয়। কিন্তু আপনারা এইসব কথা আমাকে কেনো শোনাচ্ছেন। আমার বই আমি তো জানি সে বইয়ে কি আছে না আছে। কি সমস্যা বলুন তো? শ্রাবণ শারিয়ার এবার উদ্বেগ কন্ঠে বলে।

অপেক্ষা করুন মিস্টার শারিয়ার, আমরা পর্যায়ক্রমে যাচ্ছি আপনাকে সমস্যা বুঝানোর জন্য। এইজন্যই তো আসা আমাদের। হারুন রশীদ বলেন ঠোঁটে এক চিলতে রহস্যময় হাসি দুলিয়ে।

এরই মাঝে সাঁঝি আসে শ্রাবণ শারিয়ারের জন্য কফি নিয়ে।
ইনি কে? সাঁঝিকে উদ্দেশ্য করে বলে হারুন রশীদ। সাঁঝিও আগ্রহ পূর্ণ চোখে তাকিয়ে আছে অফিসারের দিকে।
ইনি আমার স্ত্রী সাঁঝি। স্বাভাবিক ভাবে জবাব দেয় শ্রাবণ।
দেখে মনে হচ্ছে নবদম্পতি? মামুনুর সাহেব বলেন।

জ্বি ঠিকই ধরেছেন৷ আমাদের বিয়ে হয়েছে একদিন হলো মাত্র।
ওহ আচ্ছা! কংগ্রাচুলেশনস। বেশ সাদরে হাত বাড়িয়ে দেয় মামুনুর সাহেব৷ শ্রাবণও হাসার চেষ্টা করে থ্যাংকস দেয় হাত বাড়িয়ে দিয়ে। কিন্তু হারুন রশীদ গম্ভীর হয়ে যান আগের তুলনায়। সাঁঝি রহস্যময় চাহনি রাখে দুজনের দিকে।

তো কথাবার্তা এগিয়ে নেওয়া যাক। হারুন রশীদের কথায় শ্রাবণ সাঁঝিকে বলে ঘরে যেতে। কিন্তু তিনি বাধা দিয়ে বলে সাঁঝি এখানে থাক। তারও তো কিছু বিষয় জানা দরকার তার বর্তমান স্বামী সম্পর্কে।

আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন খোলসা করে বলবেন প্লিজ৷ সাঁঝির কি জানা দরকার, কিসের কথা বলছেন আপনি? শ্রাবণ এবার অস্থির হয়ে যায়।

শান্ত হোন মিস্টার শ্রাবণ শারিয়ার। উত্তেজিত হওয়া একদমই ভালো কথা নয়।

সাঁঝি তুমি বসো। তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করো না। কারণ তোমার বয়সী একটা মেয়ে আমারও আছে। হারুন রশীদ সাঁঝিকে উদ্দেশ্য করে বললে সাঁঝি শ্রাবণের দিকে তাকায়। শ্রাবণ ইশারা করে বসতে বললে সাঁঝি শ্রাবণের পাশে গিয়ে বসে।

মিস্টার শারিয়ার কোনো রকম ভণিতা ছাড়াই বলছি, তার আগে বলুন আপনার বইয়ে কয়টা খু’নের কথা উল্লেখ করা আছে?

১১ টি! তবে খুনি ১১ নাম্বার খুন করার আগে ধরা পড়ে যায়। শ্রাবণ বলে।

আপনি কি জানেন আপনার বইয়ের কাহিনির সাথে হুবুহু কপি করে দেশে খুন হচ্ছে। এবং অলরেডি ৯ টা খুন হয়ে গেছে। হারুন রশীদ শান্ত স্থির মনোভাব নিক্ষেপ করে কথাগুলো বলে। কিন্তু শ্রাবণ শারিয়ার যেনো লাফ দিয়ে উঠে কথাটা শুনে৷ চমকে উঠে বলে হোয়াট? কি যা-তা বলছেন? কে করছে এমনটা আর কেনো? সাঁঝিও শ্রাবণের উদ্বেগ লক্ষ্য করার চেষ্টা করে। তবে সাঁঝিকে দেখে মনে হচ্ছে না সে অতটা বিচলিত হয়েছে যতটা বিচলিত হয়ে পড়ে শ্রাবণ শারিয়ার। সে তো ভাবতেও পারছে না এমন কেউ করতে পারে।

কিন্তু অফিসার, আমি তো এইসবের কিছুই জানিনা ইনফ্যাক্ট জানতামও না৷ মাত্রই আপনার থেকে শুনছি।
কেউ যে বাস্তবে এমন করতে পারে আমার ভাবনার উর্ধ্বে। আমি শুধু মাত্র আমার কল্পনার জগৎটাকে সাঁজিয়ে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করি। এর বেশি কিছু নয়।

এই পর্যন্ত ৯ টা খুন হয়ে গেছে অলরেডি। মামুনুর সাহেব বলেন এবার। শ্রাবণ এবার হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে যায়। তার কাধ ভেঙে যায় চিন্তায়।

আমার মনে হয় কেউ ইচ্ছে করে এইসব করছে যাতে আমাকে ফাঁসাতে পারে। শ্রাবণ বলে নির্লিপ্ত ভাবে।

তবে আমাদের কাছে তার উল্টো ব্যাখ্যা আছে মিস্টার শারিয়ার। হারুন রশীদের কথায় শ্রাবণ ভ্রু কুচকে বলে যেমন?

আমার তো মনে হয় আপনি এইসব করছেন আপনার বইয়ের সেল বাড়ানোর জন্য। আপনি কি জানেন আপনার ৪৮ টি বইয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ সেল হয়েছে এই বইটা। এমনকি এখনো মানুষের চাহিদার যোগান দিয়ে উঠতে পারছে না প্রকাশনী গুলো।

হ্যাঁ আমি জানি আমার সব বইয়ের তুলনায় আমার এই বইটার চাহিদা তুঙ্গে। কারণ পাঠক বরাবরই রোমাঞ্চকর, চাঞ্চল্যকর রহস্যময় কাহিনি হজম করে বেশি। যার দিকে নজর রেখে আমার এই বইটা লেখা৷ আমার প্রতিটি বই-ই বেশ সফল, তবে এটা অনেক বেশি। ইনফ্যাক্ট কিছুদিন আগে কয়েকটা প্রকাশনী থেকে ফোন আসে আমার কাছে৷ এবং তারা জানায় আরো এক হাজার কপি করে বইটা বাধতে চাই তারা৷ এখন বুঝতে পারছি কেনো এতো চাহিদা বইটার৷ কিন্তু অফিসার, বইয়ের সফলতার দিকে আমাকে কখনো তাকাতে হয়নি৷ এমনি আমার বই মার্কেটে সফল প্রথম থেকে এখন তো আরও বেশি চাহিদা। পাঠক অপেক্ষা করে থাকে কখন আমার নতুন বই মার্কেটে আসছে৷ সেখানে জনপ্রিয়তার জন্য এইসব নোংরামি করার প্রশ্নই আসে না আমার।

তাছাড়া জনপ্রিয়তার যদি দরকারই হয় তাহলে আমি আগে করতে পারতাম এমন। যখন আমার বইয়ের চাহিদা পাঠক মহলে সবে পরিচিত হচ্ছে। কিন্তু এখন তো একদমই আমার জনপ্রিয়তার কথা ভাবার অবকাশ নেই। কারণ আমি অলরেডি ইস্টাবলিশ
আপনারা ভুল ব্যাখ্যা করছেন আমার মনে হয়।

আচ্ছা কোনো ফ্যানও তো এমনটা করতে পারে। অনেকে আছে না শ্রাবণ ভাইজানের অন্ধভক্ত। তারাই হয়তো এই বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এইসব কর্মকাণ্ড করে বেড়াচ্ছে৷ আমরা তো এমন অনেক কাহিনি শুনেছি এবং নিউজও দেখেছি। সাঁঝি বেশ আগ্রহ নিয়ে বলে কথাগুলো। শ্রাবণ শারিয়ারের ভালো লাগে সাঁঝির কথা শুনে৷ তবে সবার সামনে ভাইজান বলায় একটু বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। কিন্তু এই সিরিয়াস মোমেন্টে এইসব নিয়ে ভাবার সময় নেই।

আপনার কথায় যুক্তি আছে মিসেস শারিয়ার৷ তবে কতটা গ্রহণ যোগ্য ভেবে দেখার বিষয়। যেমন ধরুন!যদি কোনো ফ্যান এইসব করে থাকে তাহলে তো সে জানে তার প্রিয় লেখক এইসবে ফেসে যাবে। আর আমরা তারই ফ্যান বা ভক্ত হয় যাদের আমরা পছন্দ করি,ভালোবাসি তাই না? সেহেতু আমরা কখনোই চাই না আমাদের পছন্দের মানুষ কোনো বিপদে পড়ুক। আর দ্বিতীয় ব্যাখ্যা যদি করতে যাই তাহলে বলতে হয়, যদি সরাসরি কেউ মিস্টার শারিয়ারের ক্ষতি চেয়ে থাকে তার শত্রু হয়ে থাকে তাহলে সে এমন কাজ করতে পারে তাকে ফাঁসানোর জন্য, তবে এই ভিত্তিটা খুবই দুর্বল আমরা অনুমানে ধরে নিচ্ছি৷

যাই হোক! মিস্টার শারিয়ার আপনি গতকাল সন্ধ্যা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন? হারুন রশীদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে।

কাল আমি প্রকাশনীতে ছিলাম সন্ধ্যায়। নতুন একটা বই বের হবে আমার তারই কথাবার্তা বলতে। শ্রাবণ জবাব দিতেই মামুনুর সাহেব বলেন ১২ টা পর্যন্ত কি সেখানেই ছিলেন?

না! প্রায় এগারো টা পর্যন্ত ছিলাম এরপর আমরা কয়টা ফ্রেন্ড মিলে একটা চা-এর দোকানে আড্ডা দিতে ছিলাম। এরপর বাড়ি ফিরে আসি।

এর কোনো প্রুফ আছে? হারুন রশীদের কথায় শ্রাবণ প্রকাশনীর ঠিকানা দিয়ে খোঁজ নিতে বলে, সাথে বন্ধুদের থেকেও খোঁজ নিতে বলে।

তার আর দরকার হবে না, আপাতত আমরা আপনার কথা বিশ্বাস করছি। তবে দরকার পড়লে আমরা তদন্ত করবো। তবে একটা কথা! যতদিন না এই কেসের সমাধান হচ্ছে ততদিন আপনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। শুধু দেশের বাইরে নয় এই শহর ছেড়েও কোথাও যেতে পারবেন না। আপাতত আপনি আমাদের হেফাজতে আছেন ধরে নিবেন। আপনার উপর আমাদের নজর থাকবে সর্বদা। উপর মহল থেকে চাপ আসছে এই কেস দ্রুত সমাধান করার জন্য। দেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে আছে এই ব্যাপারটা নিয়ে। যে-বা যারা এই কেসের সাথে জড়িয়ে কেউ ছাড় পাবে না এটা মনে রাখবেন। হারুন রশীদের কন্ঠস্বরটা এবার কঠিন শোনায়।

অফিসার আমার একটা প্রোগ্রাম আছে আগামী পরশু। আমাকে চট্রগ্রাম যেতে হবে। সেখানে আমার অনেক অনেক ফ্যান ফলোয়ার অপেক্ষা করে থাকবে আমার জন্যে। শ্রাবণ বলে উত্তেজিত কন্ঠে।

আগে নিজেকে বাঁচান তারপর নাহয় ভক্তদের কথা ভাববেন মিস্টার শারিয়ার। আমরা এসেছিলাম আপনাকে গ্রেফতার করতে। কিন্তু আপনার কথা আমাদের বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়েছে এবং আপনার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত আমরা কোনো আইনি প্রমাণ পাইনি তাই হেফাজতে নিতে পারছি না৷ তবে আপনি গৃহবন্দি থাকবেন এখন। আজ আমরা আসি বলে উঠে দাঁড়ায় দুজন অফিসার। হারুন রশীদ সাঁঝির দিকে তীব্র একটা চাহনি রেখে হনহন করে বেরিয়ে যায়।

শ্রাবণ শারিয়ার হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। কে এমন করতে পারে তার সাথে ভেবে পাইনা।

চিন্তা করবেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। আপনি যদি কোনো অন্যায় না করেন তাহলে কেউ আপনাকে অপরাধীর আসনে বসাতে পারবে না সাঁঝি সান্ত্বনা দিয়ে বলে শ্রাবণ শারিয়ারকে। শ্রাবণ অসহায় চোখে সাঁঝির দিকে তাকায় কিন্তু মুখে কিছু বলে না।

এইভাবে কেটে যায় সপ্তাহখানিক। এর মধ্যে অনেক কিছু ঘটে গেছে শ্রাবণ শারিয়ারের জীবনে। প্রতিদিন নিয়ম করে দুই বেলা রিপোর্টার আসছে তার ইন্টারভিউ নিতে৷ এই কেসের ব্যাপারে বারবার তাকে খোঁচানো হচ্ছে। শ্রাবণ সবাইকে একই কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আর নিতে পারছে না এইসব। যে সকল নিউজ রিপোর্টার শ্রাবণ শারিয়ারের একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য সদা উৎসুক থাকতো তার একটা ডেটের জন্য অপেক্ষা করতো মাসের পর মাস আজ তারাই এসে শ্রাবণকে বিভিন্ন প্রশ্ন করে মাটিতে ফেলার চেষ্টা করছে। পুলিশ বাড়িতে আসার পর থেকে এই রিপোর্টারদের অত্যাচার শুরু হয়েছে। তার আগে কেউ এই সম্পর্কে আসার সাহস পাইনি।

আজ সন্ধ্যাও একটা চ্যানেল থেকে শ্রাবণ শারিয়ারের একটা ইন্টারভিউ নেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু শ্রাবণ তাদের বারণ করে দেয় অসুস্থ বলে।

রুম অন্ধকার করে বসে আছে শ্রাবণ তার পড়ার টেবিলে। কোনো কিছুই তার ভালো লাগছে। নতুন যে বই আসার কথা ছিলো কিছুদিন আগে সেটাও বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সে এখনো পর্যন্ত লেখা জমা দিতে পারেনি৷ এইসবের মধ্যে তার মাথা কাজ করছে না৷ যার ফলে শ্রাবণ শারিয়ার গুছিয়ে লিখে উঠতেও পারিনি। সাঁঝি এই কয়দিন শ্রাবণকে একা ছেড়ে দিয়েছে। সাঁঝির মনে হয়েছে শ্রাবণ শারিয়ারের এই মুহুর্তে নিজেকে সময় দেওয়া দরকার। সাঁঝি তার কলেজ, কোচিং সব ঠিকঠাক ভাবে করে গেছে।

রাত ১০ টা! সাঁঝি শ্রাবণের খাবার নিয়ে আসে রুমে। এই কয়দিন শ্রাবণ রুমে খাওয়া দাওয়া করছে। সাঁঝি এসে শ্রাবণের খাবার দিয়ে যায়। শিরীন আক্তার তার বোনের বাড়ি গিয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। তাকে এই সম্পর্কে কিছুই জানানো হয়নি। কারণ তার হার্টের সমস্যা আছে। এইসব শুনে তিনি সহ্য করতে পারবে না। যার ফলে শ্রাবণ এবং সাঁঝি কৌশলে পাঠিয়ে দেন৷ যাতে করে এই সকল সমস্যা থেকে তিনি দূরে থাকেন।

সাঁঝি রুমে এসে দেখে শ্রাবণ রুম অন্ধকার করে বসে আছে। সাঁঝি খাবারের ট্রে সেন্টার টেবিলে রেখে কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে৷ আসলে সে দ্বিধায় আছে আলো জ্বালাবে নাকি জ্বালাবে না। আলো জ্বালালে শ্রাবণ যদি রাগ করে। শ্রাবণ হয়তো সাঁঝির উপস্থিতি বুঝতে পারেনি। সে আছে তার ভাবনায়। সাঁঝি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্ধকারে শ্রাবণের অব্যয়ের দিকে এগিয়ে যায়। শ্রাবণের পাশে দাঁড়িয়ে ক্ষীণ কন্ঠে ডেকে উঠে ভাইজান বলে।

সাঁঝির কন্ঠস্বর পেয়ে শ্রাবণ যেনো একটু হকচকিয়ে উঠে এরপর সে নিজেকে সামলে নিয়ে অদ্ভুত একটা কান্ড করে বসে। সাঁঝির কোমর ধরে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে দুই হাতে। নিজেকে আবৃত করার চেষ্টা তার সাঁঝির মাঝে। এহেন কাজে সাঁঝি কিছুটা ভয় পেয়ে যায় এবং একটা ঘোরের মধ্যে ডুবে যায়। অজানা একটা অনুভূতিতে কেঁপে ওঠে কিছুটা। শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত কম্পনের সৃষ্টি সাথে একরাশ ভালোলাগার উজ্জ্বল রোদ্দুর।

চলবে…

চৈত্রের প্রেম পর্ব-০২

0

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(২)

❝গুপ্তধন খুঁজছো কি? শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় সাঁঝি চমকে তাকায় তার দিকে৷ শ্রাবণ দুই হাত ভাজ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ মুখে কৌতুহল মিশ্রিত যেন।

সাঁঝি হাসার চেষ্টা করে বলে, না মানে! আমি দেখছিলাম আমার ড্রেস গুলো এখানে রেখে গেছে কি-না। এই ভারী শাড়ি, ভারী সব গহনা খুব আনইজি লাগছে। সাঁঝি কথাগুলো বলতে বলতে বেডের সাইডে চলে আসে।

তো এতখন চেঞ্জ করোনি কেনো? কে বলেছে এইসব পড়ে থাকতে। তুমি যেটা ক্যারি করতে পারবে না সেটা তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়ার অধিকার তো কারো নেই। শ্রাবণ শারিয়ার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। গায়ে থেকে ব্লেজার খুলতে খুলতে বলে, দেখো ড্রেস এই রুমে আছে নাকি নিয়ে আসতে হবে। অনেক রাতও হয়ে গেছে। সবাই তো দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছে।

থাক আমি কাল চেঞ্জ করে নেবো! সাঁঝি হাসার চেষ্টা করে বলে। শ্রাবণ ভ্রু কুচকে বলে, তাহলে যে ড্রেস খুঁজছিলে। তাছাড়া তোমার অসুবিধা হলে তুমি চেঞ্জ করতো পারো। শ্রাবণ একটা টি-শার্ট আর লুঙ্গি আলমারি থেকে বের করে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়েও থেমে যায়। সাঁঝি এতখন শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ শ্রাবণকে থেমে যেতে দেখে অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নেয়।

বাই দ্য ওয়ে! আমি রাতে লুঙ্গি পড়ে ঘুমাই, এতে তোমার সমস্যা নেই তো? কথাটা যেনো একটু গম্ভীর স্বরে বলে শ্রাবণ।

না না আমার একদমই সমস্যা নেই। আপনি যাতে কমফোর্ট ফিল করেন। সাঁঝির কথায় শ্রাবণ ছোট করে ওকে বলে বাথরুমে ঢুকে যায়।
ঘড়ির কাটা একটার ঘর অতিক্রম করতে যাচ্ছে। সাঁঝির চোখও বন্ধ হয়ে আসছে ঘুমে। সারাদিন তো কম ধকল যায়নি। তাছাড়া বিয়ে মানে একটা আলাদা চিন্তা, মেয়েদের কাছে এটা খুব একটা সহজ বিষয় না। শারীরিক এবং মানসিকভাবে একটু বিপর্যস্ত থাকে। হয়তো সেটা সময়ের সাথে ঠিক হয়ে যায়। আবার জীবন সঙ্গী যদি মনের মতো হয় তাহলে তো সব ক্লান্তি, চিন্তা নিমিষেই দূর হয়ে যায়।

সাঁঝি গহনা গুলো খুলে রাখে পাশে থাকা সেন্টার টেবিলে। এখন যেনো একটু স্বস্তি লাগছে। মুখ ভর্তি মেকাপের প্রলেপ। সাধারণত সাঁঝি এইসবে অভ্যস্ত না থাকলেও আজ তাকে সাজতে হতো। বিয়ে তো মানুষের জীবনে একবারই আসে। আর এই বিয়েকে ঘিরে কত স্বপ্ন কত আশা থাকে। শুধু যে বর-কনের ইচ্ছে অনিচ্ছার দাম দিতে হয় এমন নয়৷ সাথে আত্মীয় স্বজন, পরিবার তাদেরও মতামতের একটা গুরুত্ব থাকে। সবাই চেয়েছিলো সাঁঝি যেনো আজ সুন্দর করে সাজে। আর সাঁঝি তাই কোনো দ্বিমত করেনি৷ যেখানে বিয়েটা হচ্ছে পছন্দের মানুষের সাথে সেখানে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করাও তার কর্তব্য।

“শ্রাবণ ফ্রেস হয়ে আসলে সাঁঝি যায় ফ্রেস হতে। সাঁঝি ফ্রেস হয়ে এসে দেখে শ্রাবণ তার পড়ার টেবিলে বসে একটা বইয়ে মনোযোগ দিয়ে আছে। সাঁঝি চুপচাপ এসে শুয়ে পড়ে খাটের একপাশে।

তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার। যদি তুমি শুনতে আগ্রহী থাকো তবে বলতে পারি নয়তো কাল বলবো কোনো এক সময়। জানি তুমি অনেক ক্লান্ত আজ। আর হওয়াটা স্বাভাবিক।

আপনি ঘুমাবেন না? শ্রাবণ শারিয়ারের কথা শেষ হতেই সাঁঝি বলে।
আমার দেরি হবে ঘুমাতে। নতুন একটা বইয়ের কাজ চলছে। আমাকে পান্ডুলিপি জমা দিতে হবে দুদিনের মধ্যে। আজ সারাদিনটা তো বিয়ের ঝামেলায় কেটে গেলো। আর তো সময় নেই হাতে। আমি সময়ের কাজ সময়ে করতে পছন্দ করি। কথাগুলো বলতে বলতে শ্রাবণ শারিয়ার বইটা বন্ধ করে সোফায় এসে বসে। সাঁঝিও ততখনে উঠে বসেছে।

সব কিছু এত তাড়াতাড়ি হয়ে গেলো যে তোমার সাথে কথা বলার সময় করে উঠতে পারিনি। যদিও আমার উচিত ছিলো বিয়ের আগে তোমার সাথে কথা বলার৷ তোমার মতামতের গুরুত্ব সবার উপরে। আমাকে বিয়ে করতে চাও কি-না এটা তো জানা আমার দায়িত্ব ছিলো। But sorry to say আমি সেটা করতে পারিনি। তবে হ্যাঁ এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। যদি তোমার কোনো রকম দ্বিমত থাকে এই বিয়ে নিয়ে তো নির্দ্বিধায় বলতে পারো আমাকে। যদিও এখন বিয়েটা হয়ে গেছে। সব কিছু ম্যানেজ করতে একটু ঝামেলা পোহাতে হবে তবে অসম্ভব নয়।

যদি বলি এই বিয়েতে আমার দ্বিমত ছিলো তাহলে কি করবেন? প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি সাঁঝির! শ্রাবণ শারিয়ারও যেনো চাহনিকে আটকে রেখেছে সাঁঝির দুটি চোখে। চোখ মুখে বিষ্ময় নেই আছে শান্ত ভাব। সাঁঝি অপেক্ষা করছে শ্রাবণের উত্তরের।

কিন্তু তোমার চোখ মুখ তো অন্য কথা বলছে সাঁঝি! শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় সাঁঝি চোখ নামিয়ে দেয়। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা।

আমার মনে হয়না এই বিয়েতে তোমার আপত্তি ছিলো, থাকলে তুমি আগেই বলতে। কারণ তুমি এতটাও অবলা নারী নও যতটা তুমি দেখাও। কিন্তু, এরপরও যদি থেকে থাকে আপত্তি তো ফাইন, আমি কালই সব ক্লিয়ার করে দেবো সবাইকে। তাছাড়া আমাদের বিয়ের খবরটা তো এখনো পাবলিক হয়নি৷ তবে বেশিদিন হয়তো গোপন থাকবে না। যদি এখনই আমরা একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করি তাহলে হয়তো বিয়েটা পাবলিক হওয়া থেকে রক্ষা করতে পারবো। আমি শিওর নয় তবে চেষ্টা করা যাবে।

থাক আপনাকে এতকিছু করতে হবেনা ভাইজান, এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি ছিলো না। সাঁঝি একটু অভিমান নিয়ে বলে কথাটা।

তবে সাঁঝির মুখে ভাইজান ডাকটা আজ যেনো ভালো লাগলো না শ্রাবণের। সাঁঝি শ্রাবণকে বরাবরই ভাইজান বলে ডাকে। তবে এখন তো শ্রাবণ তার স্বামী। এখনো যদি শ্রাবণকে ভাইজান ডাক শুনতে হয় তাহলে কেমন দেখায় ব্যাপার টা। এরপরও হজম করে শ্রাবণ কথাটা, সাঁঝিকে কিছু বুঝতে দেয়না বলেও না।

তাহলে তো একটা ঝামেলা মিটে গেলো। আমি তোমাকে যে কথা গুলো বলতে চেয়েছিলাম!!

এই বিয়েতে আমার কিন্তু মত ছিলো না এটা তুমি জানো! কারণ আমি এইসব বিয়ের ঝামেলায় কখনোই জড়াতে চাইনি। কিন্তু মায়ের জন্য আর ভাগ্যে ছিলো তাই হয়ে গেছে এতে আমার আফসোস নেই। তবে আমার সময় লাগবে সব কিছু মানিয়ে নিতে৷ তাছাড়া তুমি আমার থেকে অনেক ছোট, তোমার আর আমার মেন্টালিটি কিন্তু একভাবে যায় না যাওয়ার কথাও না। তারপরও আমাদের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে হবে, মানিয়ে চলতে হবে। আর এইসব কিছু তো হুট করে হয়না৷ সব কিছুরই একটা সময় প্রয়োজন। আশা করি বুঝতে পারছো আমি কি বলতে চাচ্ছি?

সাঁঝি মাথা ঝাকিয়ে হ্যাঁ বলে শুধু।

যদিও তোমার যে বয়স এখন তাতে পার্টনারকে নিয়ে উচ্চাকাঙ্খা থাকা স্বাভাবিক। হয়তো মনের মধ্যে অনেক কিছু সাজিয়েও রেখেছো৷ কিন্তু আমার দিকটাও তো তোমাকে ভাবতে হবে৷ ৩৩ বছর বয়সে এসেছে এখন আর সে আবেগ কাজ করেনা৷ বয়সের ভাড়ে যেনো সব চাপা পড়ে গেছে।

৩৩ বছর বয়স মোটেও তেমন বেশি না৷ আপনি নিজেকে যতটা বয়স্ক দেখাতে চাচ্ছেন আপনি কিন্তু তেমন নয়। অজান্তেই কথাটা বলে দেয় সাঁঝি। যখন বুঝতে পারে আসলে কোন সত্য বলে ফেলেছে সে সাথে সাথে জিভে কামড় দিয়ে মাথা নুয়ে ফেলে। এদিকে সাঁঝির কথায় শ্রাবণ শারিয়ার ঠোঁট বাকিয়ে হাসে, যে হাসিটা সাঁঝির চক্ষুগোচরের বাইরে রয়ে যায়।

যাই হোক! কাল থেকে তাহলে আবার পড়াশোনা শুরু করে দাও। যেহেতু এক্সামের বেশিদিন বাকি নেই৷ তুমি আগেও যেমন এই বাড়িতে থাকতে, যখন তখন তোমার বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিলো এখনো তাই থাকবে৷ ভেবো না বিয়ে হয়েছে বলে তোমাকে কেউ গন্ডির মধ্যে বেঁধে রাখবে৷ আমি আসলে এইগুলো বিশ্বাস করিনা৷ মেয়েদের স্বাধীনতা খুব দরকার। বিয়ের পর যে স্বাধীনতায় কেউ হস্তক্ষেপ করবে এটা অন্যায়, তবে হ্যাঁ যদি কেউ সেই স্বাধীনতার অপব্যবহার করে তখন কিন্তু তার ব্যাপারে আমি ভীষণ কঠিন এটা মাথায় রেখে কাজ করবে আশা করি।

সাঁঝি এবার শুধু মাথা নাড়ায়।

নয়নকে নাকি দেশের বাইরে নিয়ে গেছে। ওর হাতের অবস্থাও বেশ খারাপ শুনেছি৷ আপাতত ওকে নিয়ে চিন্তা নেই৷ তবে যদি কখনো কোনো বিপদ হয়, কোনো প্রয়োজন লাগে সাথে সাথে আমাকে কল করবে৷ আমি যেখানে থাকি তোমাকে সেভ করার চেষ্টা করবো ক্লিয়ার?

সাঁঝি মুগ্ধ হয়ে শ্রাবণ শারিয়ারের কথা শুনছে৷ এই মানুষটা নিজেকে কঠিন দেখানোর চেষ্টা তো করছে কিন্তু সাঁঝিকে আগলে রাখার আবদারও আছে।

আমার কথা শেষ আপাতত। তুমি এবার ঘুমিয়ে পড়ো, বলে শ্রাবণ উঠে পড়ার টেবিলের দিকে অগ্রসর হতে গেলে সাঁঝি বলে অনেক তো রাত হলো আপনিও ঘুমিয়ে পড়ুন না। কাল থেকে নাহয় সব কাজ করবেন।

আমার ঘুম পেলে ঠিক ঘুমিয়ে যাবো, আমাকে নিয়ে ভেবো না। তুমি ঘুমাও! শ্রাবণ বেশ ভদ্রভাবে কথা টা বলে।

পরের দিন সকাল ৮টা বাজতেই দুজন ব্যক্তি এসে হাজির হয় শ্রাবণ শারিয়ারের খোঁজে। অনেক রাত করে ঘুমানোর ফলে সাঁঝির ঘুম ভাঙেনি৷ শ্রাবণও ভোরের দিকে ঘুমিয়েছে। শিরীন আক্তার শ্রাবণের ঘরে গিয়ে দরজায় টোকা দেয়। বেশ কয়েকবার ডাকার পরে সাঁঝির ঘুম ভাঙে৷ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ৮টা পার হয়ে গেছে। সাঁঝি তড়িঘড়ি করে উঠে দরজা খুলে দেয় শ্রাবণের দিকেও তার নজর যায়নি এখনো পর্যন্ত।

অনেক দেরি হয়ে গেলো খালাম্মা। তুমি নাস্তা করেছো? মা কি এসেছে? সাঁঝি ব্যস্ত হয়ে উঠে।

ওইসব ছাড়, তাড়াতাড়ি শ্রাবণকে ডেকে দে। দুজন মানুষ এসেছে৷ শ্রাবণের সাথে কথা বলতে চাইছে। ড্রয়িংরুমে বসে আছে। আমি তোর মাকে চা দিতে বলে এসেছি। শিরীন আক্তারের কথায় সাঁঝি ভ্রু কুচকে বলে এত সকালে আবার কে এলো? আচ্ছা আমি উনাকে ডেকে দিচ্ছি তুমি যাও।

সাঁঝি ঘরে এসে দেখে শ্রাবণ বাচ্চাদের মতো পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে৷ ঘুমন্ত মানুষটাকে একদম নিষ্পাপ বাচ্চা লাগছে দেখে। সাঁঝির একদমই ইচ্ছে করছে না শ্রাবণের এতো সুন্দর ঘুমটা নষ্ট করতে৷ কে জানে কখন ঘুমিয়েছে৷ হয়তো এখনো ঘুমটা ঠিক ভাবে হয়ে উঠতে পারেনি৷ এই সাত সকালে আবার কার যে প্রয়োজন পড়লো উনাকে।

সাঁঝি আর সাত পাঁচ না ভেবে শ্রাবণকে ডাকতে থাকে।
ভাইজান, ভাইজান উঠেন! কারা যেনো এসেছে আপনাকে ডাকছে নিচে। শ্রাবণ সাঁঝির ডাকে নড়েচড়ে আবার ঘুমায়।

সাঁঝি ভাবে এইভাবে হবে না। পাশেই গ্লাসে থাকা পানি হাতে নিয়ে শ্রাবণের চোখ মুখে ছিটিয়ে দিলে শ্রাবণ চোখ মুখ কুচকে বিরক্তি প্রকাশ করে।
ভাইজান উঠেন না! সাঁঝির ডাকে শ্রাবণ রেগে উঠে বসে।
কি সমস্যা সাঁঝি এতো ডাকাডাকি করছো কেনো? আর ভাইজান কি হ্যাঁ! আমি তোমার কোন জন্মের ভাইজান লাগি। স্বামীকে কোন মেয়ে ভাইজান ডাকে বলো আমাকে।

একে তো সকালের ঘুমটা নষ্ট করেছে তার উপর আবার ভাইজান ডাকটা আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। শ্রাবণের হুংকারে সাঁঝি ভয় পেয়ে যায়। শ্রাবণের থেকে দূরে গিয়ে মাথা নিচু করে থাকে।
শ্রাবণ নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে বলে সরি। আসলে প্রোপার্লি ঘুম না হলে মেজাজ ঠিক থাকে না৷ বাই দ্য ওয়ে কি যেনো বলছিলে?

ও ও ওই বাইরে কারা যেনো এসেছে তাই খালাম্মা বললো আপনাকে ডাকতে৷ সাঁঝি কথাটা বলে কেঁদে ফেলে। শ্রাবণ হতবাক হয়ে বলে এই মেয়ে কান্না করছো কেনো৷ বললাম তো সরি।

এতেও কাজ হয়না৷ সাঁঝি ফুপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে৷ শ্রাবণ উপায় না পেয়ে সাঁঝির হাত ধরে টেনে কোলের উপর নেয়৷ এতে সাঁঝির কান্না তো গায়েব হয়েছে অবাকের শেষ চুড়ায় পৌছে গেছে সে৷ শ্রাবণ যে এত তাড়াতাড়ি তাকে কাছে টেনে নিবে একদমই ভাবেনি।

বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করা এই একটা ঝামেলা জানো। কিছু একটু বললে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদে৷ শ্রাবণের কথায় সাঁঝি লজ্জায় মুখ লুকোয়। যে কান্না ছিলো তার চোখ মুখে জুড়ে সেটা এখন হাসিতে পরিনতি পেয়েছে৷।

থাক আর হাসতে হবে না৷ কান্না করতে দেরি হয়না আবার হাসতেও সময় লাগে না৷ দেখি কে এলো এতো সকালে জ্বালাতে। তুমি কি আমার জন্য এক কাপ কফি বানিয়ে দিতে পারবে? মাথাটা ব্যথা করছে। যদি ঠিক ভাবে ঘুমটা দিতে পারতাম আড়মোড়া ভেঙে বলে শ্রাবণ।

আমি এখুনি নিয়ে আসছি আপনি যান। সাঁঝি শ্রাবণকে ছাড়িয়ে উঠে দৌড় দেয় ঘরের বাইরে। আপাতত সে শ্রাবণের মুখোমুখি হতে পারবে না লজ্জায়। শ্রাবণ মুচকি হেসে ওয়াশরুমে যায়।

অনেকটা সময় নিয়ে আসলেন মিস্টার শ্রাবণ শারিয়ার। শ্রাবণকে দেখে বলে উঠে একজন ব্যক্তি।

আপনারা? আপনাদের তো ঠিক চিনলাম না? শ্রাবণ শারিয়ার কৌতুহল প্রকাশ করলে দুজন ব্যক্তির মধ্যে থেকে একজন বলে উঠে, আমি এএসপি হারুন রশীদ। আর ইনি সহকারী অফিসার মামুনুর। আমরা ডিবি পুলিশ থেকে এসেছি।

পুলিশের লোক শুনে শ্রাবণ শারিয়ারের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়।

চলবে.

চৈত্রের প্রেম পর্ব-০১

0

পর্ব-১
#চৈত্রের_প্রেম
আলো ইসলাম

পনেরো বছরের ছোট একটা মেয়ের সাথে বিয়ে, ব্যাপারটা একটু খাপছাড়া লাগছে না দ্য গ্রেট রাইটার শ্রাবণ শারিয়ার। তার উপর আবার বাড়ির কাজের লোক। আচ্ছা! তোমার বইয়ের চাহিদা তো আকাশ ছোঁয়া মার্কেটে তারপরও এমন পপুলেশন করার কি দরকার পড়লো? আরও কি সিমপ্যাথি চাই?

অয়নের টিটকারি সুলভ কথা শুনে শ্রাবণ কপাল কুচকে ধরলেও মুখে হাসিটা ঠিকই বজায় রাখলো। এদিকে অয়নের কথায় সাথে থাকা কিছু রিলেটিভরা ঠোঁট চেপে হাসছে। বেশ এনজয় করেছে তারা কথাটা।
আফসোস হচ্ছে বুঝি, বয়সের মধ্যপ্রাচ্যে এসে এমন সুন্দরী একটা বউ পাচ্ছি। হিংসা হওয়া টা স্বাভাবিক। তবে কি বলো তো অয়ন, বিয়ের ইচ্ছে একদমই ছিলো না৷ কিন্তু ভাগ্য দেখো! সেই বিয়ের পীড়িতে এনে বসালো তাও আবার সুন্দরী, আমার থেকে বয়সের অনেক গ্যাপ। তবে আফসোস করো না, তোমার বউটা কিন্তু কম না। ভাবি মাশা-আল্লাহ সুন্দর দেখতে৷ আর কি যেনো বললে, পাবলিসিটি! ওইটার আবার নতুন করে কি দরকার আমার৷ আমি তো বোরিং হয়ে গেছি এই পাবলিসিটি ভোগ করতে করতে। আসলে পাঠকের ভালোবাসা এতো গাঢ় যে, আমি যাই লিখি না কেনো পাঠকরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে। সমাদরে গ্রহণ করে, উপভোগ করে আমার লেখা তারা৷ আশা করি তুমি এইগুলো বুঝবে, আফটার অল তুমিও একজন রাইটার। আমার থেকে কোনো অংশে কম নয়৷ এনজয়, কথাটা বলে চলে আসে শ্রাবণ।

এদিকে শ্রাবণ শারিয়ারের ভদ্র কথার আড়ালে যে অপমান লুকিয়ে ছিলো সেটা হজম করতে বেশ বেগ পোহাতে হলো অয়নের। মুখের উপর হাসি থাকলেও ভেতরে ভেতরে ফুসে উঠলো।

অয়নও একজন লেখক। তবে শ্রাবণ শারিয়ারের পাঠক জনপ্রিয়তা বেশি। যার ফলে অয়ন বরাবরই হিংসা করে শ্রাবণ শারিয়ারকে। শ্রাবণ শারিয়ার একজন থ্রিলার রাইটার। আর অয়ন বরাবরই সামাজিক, প্রকৃতি বিষয়ক নিয়ে লেখালেখি করে। বর্তমান সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, পাঠকরা থ্রিলারে আগ্রহ প্রকাশ করে বেশি, এবং তারা খুব উপভোগও করে এমন হিম ধরা কাহিনি গুলো। যার ফলে শ্রাবণ শারিয়ারের বইয়ের জনপ্রিয়তা অনেক বেশি৷ রিডার্সরা অপেক্ষা করে থাকে কখন শ্রাবণ শারিয়ারের নতুন বই মার্কেটে আসবে।

শ্রাবণ শারিয়ার একজন সফল রাইটার। বয়স ৩৩, তবে তার পার্সোনালিটি যে কোনো মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। সব সময় পরিপাটি এবং নিজেকে গুছিয়ে প্রদর্শন করা পছন্দ করে। অনেক মেয়ে পাঠকের ক্রাশও বলা যেতে পারে তাকে। তবে শ্রাবণ শারিয়ার যে আজকের পজিশনে আছে সেখানে আসার জন্য তাকে কম কসরত করতে হয়নি৷ অনেক স্ট্রাগল করার পর আজকের শ্রাবণ শারিয়ার হয়ে উঠতে পেরেছেন তিনি। শ্রাবণ শারিয়ারের পরিবারে শুধু তার মা ছাড়া কেউ নেই। বাবাকে হারিয়েছে ছোট থাকতে। যার জন্য শ্রাবণ শারিয়ার ছোট থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছে আসলে জীবন কাকে বলে। কিভাবে সংগ্রাম করে পজিশন তৈরি করতে হয়।

শিরীন আক্তার শ্রাবণ শারিয়ারের মা। তিনি ছিলেন একজন স্কুল টিচার। এখন অবসর নিয়ে ছেলের সাথে থাকেন। শিরীন আক্তারকে দেখাশোনার জন্য একজন গৃহকর্মী রাখা হয়। রাশেদা বেগম হলেন শ্রাবণ শারিয়ারের গৃহকর্মী। তার মেয়ে সাঁঝি। যার সাথে আজ শ্রাবণ শারিয়ারের বিয়ে হচ্ছে। বিয়েটা হচ্ছে ঘরোয়া ভাবে। তবে একদম ঘরোয়া টাইপ বিয়েও বলা যায় না। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন আর শ্রাবণ শারিয়ারের বন্ধুবান্ধবদের ইনভাইট করা হয়েছে। এত বড় একজন লেখকের বিয়ে এমন ঘরোয়া ভাবে হচ্ছে এটা অনেকে মেনে নিতে পারছে না৷ কেউ মুখে কিছু না বললেও মনে মনে ঠিকই প্রতিবাদ জানাচ্ছে৷ তবে তার পাঠক সমাজ এখনো এই খবর টা পাননি যে তাদের প্রিয় লেখক এমন ঘরোয়া পরিবেশে বিয়ে করছে। যদি জানতো তাহলে হয়তো, নিউজ চ্যানেলে, যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে একদম ঝড় বয়ে যেতো এই একটা খবরে। কত মেয়ে ভক্তের মন ভেঙে যেতো কে জানে।

সাঁঝি এবার ইন্টার পরিক্ষা দেবে। বয়স সবে আঠারো বছর এক মাস যাচ্ছে। সব কিছু এমন ভাবে হয়ে গেলো যে সাঁঝি এখনো ঠিকভাবে নিজেকে সামলে নিতে পারেনি। তার বিয়ে হচ্ছে এমন একজন বড় লেখকের সাথে বিষয়টা ভাবা সত্যি কষ্ট সাধ্য। সাঁঝি নিজেও একজন শ্রাবণ শারিয়ারের ফ্যান। তার সব কয়টা বই সাঁঝি পড়েছে। আর এই গল্পের মাধ্যমে সাঁঝির মনে একটু একটু করে জায়গা করে নিয়েছে শ্রাবণ। কিন্তু সেই ভালোলাগা বা ভালোবাসা এইভাবে পরিনতি পাবে আশা করেনি।

আসুন এবার জেনে নেওয়া যাক কিভাবে শ্রাবণ শারিয়ার আর সাঁঝির বিয়ের সম্বন্ধ টা পাকাপাকি হলো।

সাঁঝি দেখতে শুনতে মাশা-আল্লাহ। গরীব ঘরের মেয়ে হলেও তার চলাফেরা আর আল্লাহর দেওয়া সুন্দর চেহারা দেখে কেউ সহজে বুঝতে পারবে না যে সাঁঝির জন্ম কোনো কুঁড়েঘরে হয়েছে। সাঁঝির মা মানুষের বাড়ি বাড়ি কাজ করে মেয়েকে মানুষ করেছে এবং পড়াশোনা শিখিয়েছে। রাশেদা বেগম কিছুদিন অসুস্থ হওয়ায় শিরীন আক্তারের দেখাশোনা করতে আসে সাঁঝি। অল্প সময়ের মধ্যে সাঁঝির সাথে ভাব জমে যায় শিরীন আক্তারের। মনে মনে পছন্দও করেন তিনি সাঁঝিকে। সাঁঝি সব কাজ গুছিয়ে করতেন যার জন্য শিরীন আক্তার আরও বেশি খুশি থাকতো সাঁঝির উপর। ছোট একটা মেয়ে কেমন সব সামলে নেয় একা হাতে ভেবে স্বস্তি পাই শিরীন আক্তার। এরপর যখন রাশেদা বেগম সুস্থ হয়ে কাজে আসে তখন শিরীন আক্তার জানায় সাঁঝিকে নিয়ে আসার জন্য। সাঁঝির পড়াশোনার খরচ তারা দেবে৷ শুধু সাঁঝি মাঝেমধ্যে এসে শিরীন আক্তারের সাথে গল্পগুজব করবে। সাঁঝি আসলে তার খুব ভালো লাগে। শ্রাবণ শারিয়ার এই কথা শোনার পর, মায়ের খুশির জন্য সাঁঝিকে পার্মানেন্ট ভাবে তাদের বাড়িতে থাকার জন্য বলে। এবং সাথে এটাও বলে সাঁঝির জন্যও মাসে আলাদা টাকা দেওয়া হবে৷ সাঁঝির পড়াশোনার খরচ সহ কলেজের খরচও দেবে।

এরপর থেকে সাঁঝি, শ্রাবণ শারিয়ারের বাড়ি এসে থাকা শুরু করে। কিন্তু ঝামেলা হয় এরপর।

সেখানকার মন্ত্রীর ছেলে নয়ন পড়ে সাঁঝির সাথে আর সাঁঝিকে পছন্দও করে। বড়লোকের বখে যাওয়া ছেলে। প্রায় সাঁঝিকে বিরক্ত করে, মাঝে মাঝে পথ আগলে দাঁড়িয়ে নানান বাজে কথা বলে। একদিন সাঁঝি এর প্রতিবাদ করায় রেগে যায় নয়ন। এরপর থেকে সাঁঝিকে তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দিতে থাকে সে। সাঁঝি সেটা তার মা রাশেদা বেগমকে জানালে তিনি অনেক ভয় পেয়ে যায় এবং সাঁঝিকে কলেজে যেতে বারণ করে। সামনে সাঁঝির ফাইনাল পরিক্ষা, কলেজ মিস দিলেও চলবে। কিন্তু নয়ন যা শুরু করেছে তাতে রিস্ক নিয়ে কলেজ যাওয়াও ঠিক কাজ হবেনা।

রাশেদা বেগম শিরীন আক্তারকে জানায় সে সাঁঝির বিয়ে দিতে চাই। সাথে এটাও জানায় কলেজে কি হয়েছে। সব শুনে শিরীন আক্তার শ্রাবণ শারিয়ারকে জানালে শ্রাবণ জানায় যে, সে কলেজে গিয়ে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলবে। দরকার পড়লে লিগ্যালি একশন নেবে নয়নের বিরুদ্ধে। মন্ত্রীর ছেলে বলে কি সব মাফ। শ্রাবণ শারিয়ার কথায় যা কাজেও তাই করেন। প্রিন্সিপালের কাছে নালিশ দেয় নয়নের নামে। শ্রাবণ শারিয়ারকে দেখে প্রিন্সিপাল তো মহা খুশি।এমন একজন গুণী রাইটার তার কদর তো সর্বস্থানে হওয়ার দরকার। সব শুনে প্রিন্সিপাল জানায় তারা নয়নের সাথে কথা বলবে দরকার পড়লে নয়নের বাবার সাথে আলাপ করবে এই ব্যাপারে। এরপর প্রিন্সিপাল শ্রাবণ শারিয়ারকে জিজ্ঞেস করে সাঁঝি কে হয় তার সম্পর্কে। শ্রাবণ শারিয়ার সত্যটা বলতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে একটু থেমে বলে, আমার হবু স্ত্রী। কথাটা শুনে প্রিন্সিপাল যেনো একটা শুকনো ঢোকই গিলে। ব্যাপারটা তার কাছে হজম না হলেও মুখে হাসি নিয়ে বলে বেশ ভালো। আমরা বিষয়টা দেখবো চিন্তা করবেন না।

আসলে শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝিকে হবু স্ত্রী বলে এই ভেবে যে, কাজের মেয়ে শুনে প্রিন্সিপাল আগ্রহ না দেখাতে পারে। তাছাড়া যার অর্থ আছে, আধিপত্য আছে তার কদর সর্বস্থানে হয়। যেহেতু শ্রাবণ শারিয়ার একজন ফেমাস রাইটার। তাকে সবাই গণ্যমান্য বলে মানে। সেহেতু সাঁঝি শ্রাবণ শারিয়ারের হবু স্ত্রী শুনলে কাজটা দ্রুত এবং ভালো হবে।

এরপর শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝিকে নিয়মিত কলেজে যেতে বলে।সে যে প্রিন্সিপালের সাথে কথা বলেছে এইসব বলে আশ্বস্ত করে সাঁঝি এবং তার মাকে। এদিকে সাঁঝি যে শ্রাবণ শারিয়ারের হবু স্ত্রী এটা পুরো কলেজে ছড়িয়ে যায়। সবাই নানান কথাও বলতে থাকে।

প্রিন্সিপাল নয়নকে ডেকে শ্রাবণ শারিয়ারের অভিযোগ গুলো তুলে ধরলে নয়ন প্রথমে সেগুলো অস্বীকার করার চেষ্টা করলেও পরে প্রিন্সিপালের কাছে স্বীকার করে। কারণ নয়ন কেমন উশৃংখল সেটা কলেজের সবাই জানে এমনকি প্রিন্সিপালেরও অজানা নয়৷ প্রিন্সিপাল শাসিয়ে বলে এরপর যদি সাঁঝিকে সে বিরক্ত করে তাহলে নয়নকে কলেজ থেকে বের করে দিতে বাধ্য হবে। এরপর থেকে নয়ন আরও ফুসে উঠে। সাঁঝির থেকে প্রতিশোধ নিতে তৎপর হয়ে উঠে।

একদিন সাঁঝি কোচিং শেষ করে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যায়৷ আসলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে গিয়ে দেরি হয়ে যায় সাঁঝির। সাঁঝি দ্রুত পা চালিয়ে আসছে৷ রাস্তায় আজ কোনো রিকসা বা সিএনজিও চোখে পড়ছে না৷ শ্রাবণ শারিয়ারের বাড়ি থেকে সাঁঝির কলেজের দুরত্ব প্রায় আধা ঘন্টা মতো। যেহেতু রাত হয়ে যাচ্ছে তাই সাঁঝি রিকশার জন্য অপেক্ষা না করে এগুতে থাকে।

মেইন রোড থেকে সাঁঝি তাড়াতাড়ি ফেরার জন্য শর্টকাট একটা রাস্তা ধরে। কিন্তু কিছুদুর আসার পর সাঁঝির মনে হয় কেউ একজন তাকে ফলো করছে৷ সাঁঝি বারবার পেছনে তাকায় কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনা৷ অথচ তার সিক্স সেন্স ঠিকই জানান দিচ্ছে কারো উপস্থিতি। সাঁঝি কোনো রকম রিস্ক নিতে চাইনা বলে আবারও মেইন রোডে চলে আসে। কিছুদূর আগানোর পর নয়নের ডাক শুনে থেমে যায় সাঁঝি। সাঁঝি ঠিক এমন কিছুই আঁচ করেছিলো। পিছু ঘুরে দেখে নয়ন হাসি মুখে দাঁড়িয়ে হাতে একটা কিসের বোতল আছে। সাঁঝি এক পলক দেখে বুঝতে পারে নয়নের হাতে ওইটা এসিডের বোতল। সাঁঝি ভয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে যায়। মুখ দিয়ে যেনো কথা সরে না।

ভয়ে পেয়ে গেলি বুঝি। খুব গৌরব না তোর সুন্দর চেহারার। এই চেহারা দিয়ে তো শ্রাবণ শারিয়ারের মতো একজন ফেমাস বুড়োকে ভুলিয়েছিস। আচ্ছা আমার বাবারও অনেক টাকা আছে, আমি ফেমাস। তাহলে আমাকে কেনো পছন্দ করিস না। নাকি বয়স্ক মানুষ বেশি পছন্দ। আচ্ছা শ্রাবণ শারিয়ার কি খুব সুখ দেয় তোকে৷ শুনেছি তো একই বাড়িতে থাকিস।

নয়নের বাজে কথাগুলো নিতে পারে না সাঁঝি। ভেতরের ভয়টা রাগে পরিনত হয়, তারপরও স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে সাঁঝি।

আজ তোর এমন অবস্থা করবো যে সারাজীবন আমার কথা মনে রাখবি৷ তোর চেহারার এমন হাল করবো আমি আজ, যেনো যে কেউ তোকে দেখে ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেয়। কথাগুলো বলে নয়ন এগিয়ে আসতে লাগলে সাঁঝি উল্টো ঘুরে দৌড় লাগায়। সাঁঝিকে ছুটতে দেখে নয়নও ছুটে সাঁঝির পিছু পিছু। সাঁঝি প্রাণপণে ছুটছে। নয়নের থেকে দুরত্ব টা তার ক্রমশ কমে আসছে। হঠাৎ সাঁঝির কিছু একটা মনে হতে কাধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে নয়নের দিকে ছুড়ে মা’রে৷ ব্যাগ গিয়ে লাগে নয়নের হাতে এবং নয়নের হাতে থাকা এ’সিডের বোতলও পড়ে যায়। তবে কিছুটা এ’সিড নয়নের হাতে পড়ে হাত ঝলসে দেয়৷ নয়ন এতে চিৎকার দিয়ে তার যন্ত্রণা জানান দিচ্ছে৷ তখনই শ্রাবণ শারিয়ার হাজির হয়। আসলে একটা ইভেন্ট থেকে ফিরছিলো সে। সাঁঝিকে ছুটতে দেখে থামে সেখানে। সাঁঝি ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা। সাথে ক্রমশ হাঁপিয়ে চলেছে৷ ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। এদিকে নয়ন রাস্তার উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে হাতের যন্ত্রণার প্রকোপে। কিছু মানুষও জড়ো হয়ে যায় সেখানে। নয়নকে সবাই কম বেশি চিনে। কয়েকজন ধরাধরি করে নয়নকে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়৷ আর এদিকে শ্রাবণকে সামনে পেয়ে সাঁঝি ছুটে গিয়ে তার বুকে পড়ে। ভয় আর শারিরীক দুর্বলতা মিটাতে মাথা গুজে ঠাই নেয় শ্রাবণ শারিয়ারের বুকে। শব্দ করে কেঁদে উঠে এবার সাঁঝি। শ্রাবণ শারিয়ার এক হাতে জড়িয়ে নেয় সাঁঝিকে৷ শান্ত করার চেষ্টা।

এরপর বাড়ি এসে সমস্ত ঘটনা শিরীন আক্তারকে খুলে বলার পর তিনি চিন্তায় পড়ে যান সাঁঝিকে নিয়ে। রাশেদা বেগমও অস্থির হয়ে উঠে। শিরীন আক্তার যেহেতু সাঁঝিকে পছন্দ করেন আগে থেকে তাই শ্রাবণ শারিয়ারকে বলে সাঁঝিকে বিয়ে করার জন্য। এমনিতেও শ্রাবণ শারিয়ার আগেই সাঁঝিকে হবু বউয়ের পরিচয় দিয়েছে, এটা নিয়ে মিডিয়া বেশ ভালোই গরম হয়েছিলো৷ এখন যদি শ্রাবণ সত্যি সাঁঝিকে বিয়ে করে তাহলে হয়তো নয়ন বা অন্য কেউ আর সাঁঝিকে বিরক্ত করার সুযোগ পাবে না। তারা হয়তো সাবধান হয়ে যাবে। শ্রাবণ প্রথমে এই বিয়েতে নাকোচ করলেও পরে রাজি হয়ে যায় মায়ের কথায়৷ শ্রাবণ শারিয়ার কখনো বিয়ের পীড়িতে বসবে না এই প্রতিজ্ঞাতে আবদ্ধ ছিলেন৷ কিন্তু ভাগ্য হয়তো অন্য কিছু চাই। নাহলে কেনো তার থেকে ১৫ বছরের ছোট একটা মেয়ের সাথে বিয়ের সম্বন্ধ হবে৷ তাই সে আর দ্বিমত করেনা। এরপর ঘরোয়া ভাবে বিয়ের আয়োজন করে তাদের বিয়েটা দেওয়া হয়।

বিয়ের কার্যকর ভালো মতো মিটে গেছে। সাঁঝি এখন শ্রাবণ শারিয়ারের ঘরে নববধূ সেজে বসে আছে। শ্রাবণ শারিয়ার সন্ধ্যার পর বাইরে গেছে একটা কাজে৷ এখনো ফেরার নাম নেই। সাঁঝি অনেকখন বসে থেকে অধৈর্য হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এই প্রথম সে শ্রাবণ শারিয়ারের ঘরে প্রবেশ করার সুযোগ পেয়েছে। শ্রাবণ শারিয়ার তার ঘরে কাউকে এলাউ করে না৷ নিজ হাতে সবকিছু গুছিয়ে রাখেন৷ যখন ঘর পরিষ্কার করার হয় তখন তিনি নিজে উপস্থিত থেকে পরিষ্কার করিয়ে নেন। তার মতে, ঘরে অন্য কেউ আসুক এটা পছন্দ নয়। সাঁঝি অনেকবার চেষ্টা করেও শ্রাবণ শারিয়ারের ঘরে আসতে পারেনি। শ্রাবণ শারিয়ার বাইরে বেরোলেই ঘর লক করে তবে যেতেন। একদিন শিরীন আক্তারকে সাঁঝি জিজ্ঞেস করে শ্রাবণ এমন কেনো করে, ওকি ছোট থেকে এমন নাকি। সেদিন শিরীন আক্তার জানায় শ্রাবণ খুব গুছালো ছেলে। তাছাড়া নিজের কাজকর্ম নিজে করা পছন্দ করে। তার জিনিসে কেউ হাত দিক এটা পছন্দ নয়। শিরীন আক্তার নিজেও শ্রাবণ শারিয়ারের অনুমতি ছাড়া কখনো নাকি ঘরে আসতে পারেনি৷ আর এটা নিয়ে তার কোনো অভিযোগও নেই।

আজ সুযোগ পেয়ে সাঁঝি ঘরটা ভালোভাবে পরখ করে। বেশ বড়সড় একটা রুম। সাথে বারান্দাটাও বড়। ঘরের মধ্যে একটা বড় সোফা, একপাশে পড়ার টেবিল যেখানে বিভিন্ন ধরনের বইপত্র সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রাখা আছে। শ্রাবণ শারিয়ারের নিজের লেখা বইও সেখানে আছে সব গুলো। বড় একটা আলমারি, ড্রেসিং আয়না। শ্রাবণ শারিয়ারের রুচিবোধ প্রখর মানতে হবে। মনে মনে ভাবে সাঁঝি। সাঁঝি খেয়াল করে শ্রাবণ শারিয়ারের রুমের সাথে আরেকটা দরজা আছে। দেখে মনে হচ্ছে এটা আলাদা একটা রুম৷ রুমের সাথে আরেকটা রুম এর মানে সাঁঝি বুঝে না। সাঁঝি সে দরজার কাছে গিয়ে চেক করে। দেখে লক করা আছে। আর এমন যে থাকবে সাঁঝি আগেই আন্দাজ করেছিলো। সাঁঝি আলমারির কাছে এসে একবার আলমারিটাও চেক করে। শ্রাবণ শারিয়ারের শার্ট কর্ণার টা টান দিতে খুলে যায় কিন্তু বাকিসব গুলো লক করা।

গুপ্তধন খুঁজছো কি? হঠাৎ শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় চমকে উঠে সাঁঝি…

চলবে…

নীল নীলিমায় পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#নীল_নীলিমায়
(শেষ অংশ)

বিয়েবাড়ির সবচেয়ে বিরক্তিকর ব্যাপার হলো কিছু মাঝবয়সী মহিলা। এরা আসে কনেকে নিয়ে সমালোচনা করতে, খাবার ভালো হলেও খুঁত ধরতে আর অবিবাহিত মেয়ের ঘটকালি করতে। নীরুকে দেখে এক মহিলার খুব পছন্দ হয়ে গেল তার ভাগ্নের জন্য। সোজা গিয়ে নীরুর মাকে প্রস্তাবই দিয়ে দিল। বিয়ের আসরে হাজারটা ব্যস্ততার মাঝেও মা যখন নীরুকে কোণায় ডেকে নিয়ে বললেন, “একটু রয়েসয়ে চল। তোর বিয়েরও সম্বন্ধ আসছে। ভালো ঘর। মাথায় কাপড়টা দে৷ এরকম চুলগুলো সব ছড়িয়ে দিয়ে রেখেছিস কেন?”, নীরুর সে কি রাগ! সেও বলে দিল, “আপা যেমন চাকরি পেয়ে বিয়ে করেছে, আমিও তাই করব।”

নীরুর মা বিরক্ত হয়ে বললেন, “যে না পড়ার ছিরি! তোর বোন পাবলিক ভার্সিটিতে ফিজিক্সে পড়ে ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছে। তুই তো বাংলায় পড়েও ফেল করিস। তোকে চাকরি কে দেবে?”

নীরু সমান তেজে জবাব দেয়, “যা বলেছি বলেছি। এরপর ছেলে দেখলে খুব খারাপ হয়ে যাবে বলে দিলাম। বাবা মা হয়ে দুই মেয়ের সাথে দুই রকম আচরণ চলবে না।”.

নীরুর মা আহত হলেন। ওর বাবাকে বললে তিনি খুব সহজ গলায় স্ত্রীকে বললেন, “নীরু প্রথমবার বলেছে কিছু করে দেখাবে। ওকে সুযোগ দেয়া উচিত। কিছু করতে পারলে তো খুবই ভালো। আর না হলে বিয়ে দিয়ে দেব। ছেলের কি অভাব নাকি দেশে?”

নীরুর মা আর উচ্চবাচ্য করেননি এ নিয়ে।

মেজাজ গরম নিয়ে নীরু যখন ঘুরে বেড়াচ্ছে, তখন ওর চোখ গেল খাবার টেবিলের দিকে। পাত্রপক্ষ এখনো এসে পৌঁছায়নি। তাদের আত্মীয়রা খাচ্ছে। একটা টেবিলে নিয়নের দুই বোন, মা আর নিয়ন বসেছে। নীরু দুটো জিনিস লক্ষ্য করল। প্রথমত, নিয়ন ভাইকে পাঞ্জাবিতে ভয়ানক সুন্দর লাগে, দ্বিতীয়ত, সে খুব যত্নশীল। বোনদের প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছে পরম যত্নে।

নীরু বাথরুমে গিয়ে নিজের সাজটা আরেকবার ঠিকঠাক করে নিয়ে নিয়নের সামনে ঘোরাফেরা করতে থাকল। নিয়ন ওর দিকে ঠিকমতো তাকাল পর্যন্ত না। আচ্ছা সেই বাক্সে প্রেম নিবেদন পেয়েও লোকটা এরকম নিস্পৃহ ভাব কেমন করে দেখাতে পারে?

শেষ পর্যন্ত সইতে না পেরে নীরু সরাসরি নিয়নের সাথে কথা বলতে চলে গেল। যা হয় হোক, আজ বলতেই হবে কিছু। নিয়ন ওকে দেখে ভুরু তুলে বলল, “কিরে, কিছু বলবি?”

“আপনি বিয়ে করবেন কবে?”

নিয়ন হেসে বলল, “কেন তুই জানিস না? আমি বিয়ে করব না।”

“কেন?”

নিয়ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আমাদের পোড়া কপাল রে নীরু। মা বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, আপাদেরও তাই, আমি বিয়ে করে ঠকতে চাই না রে।”

“আরে করেই দেখেন, টিকে যেতেও পারে।”

“না রে নীরু। আমার অত সাহস নেই। আপাদের তো দেখছি। ভালো….” কী মনে করে থেমে গেল নিয়ন। চোখ মটকে বলল, “তোকে আমি এসব বলছি কেন? আর তুই আমার বিয়ে নিয়ে পড়েছিস কেন?”

নীরু মনে মনে বলল, “কচি খোকা! জানে না যেন! সেদিন যে এত লম্বা চিঠিটা লিখলাম সেটা পড়েও বুঝলে না আমি কী চাই?”

নীরুকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিয়ন গম্ভীর গলায় বলল, “কিরে, বোবায় ধরল নাকি?”

নীরু বলল, “আমি যে সেদিন মাঠে বাক্সটা ফেলে এসেছিলাম সেটা কী করেছিলেন?”

“কেন তোর বাড়িতে দিয়ে গেছি।”

“কিহ?” নীরু আকাশ থেকে পড়ল। “কবে? কখন? কার কাছে?”

“বাড়ি এসে কাউকে পাইনি বলে বসার ঘরে রেখে চলে গিয়েছিলাম। এরপর কী হয়েছে জানি না।”

নীরুর বুক ধড়ফড় শুরু করল। জিজ্ঞেস করল, “বাক্সটা আপনি খুলে দেখেননি?”

“তোর বাক্স আমি খুলব কোন দুঃখে?”

নীরু আর কিছু না বলে দৌড়ে মায়ের কাছে চলে গেল। নীরুর মা তখন কন্যা বিদায় দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নীরুর কবেকার কোন বাক্সের কথা শুনে বেজায় বিরক্ত হলেন তিনি। কয়েকবার মুখ ঝামটা দিয়েও যখন নীরুকে দমানো গেল না, তখন খানিকক্ষণ চেষ্টা করে মনে করে বললেন, “একটা বাক্স তিনি পেয়েছিলেন, তবে সেটা নোংরা ভেবে ফেলে দিয়েছেন।”

নীরু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সাথে মনটাও বিষন্নতায় ছেয়ে গেল।

তরু চলে যাওয়ার সময় নীরুর এত কষ্ট হবে সে আগে ভাবেনি। প্রথমবার মনে হলো বোনটা তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে চিরতরে। নীরুর কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল। বড় প্রিয় ছিল তার বোনটা। এখন তার সাথে কে ঘুমাবে? কার সাথে ঝগড়া করবে? মন খারাপ থাকলে কার কোলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকবে?

তরু চলে যাওয়ার অনেকক্ষণ পরেও দেখা গেল নীরু আঁধার ঘরের কোণে বসে ফোঁপাচ্ছে। তাকে দেখে নাজিফা আপা এগিয়ে গেলেন। নীরুর মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “এক আপা গেছে তো কী হয়েছে? আমরা আছি তো। একা লাগলেই আমাদের কাছে চলে যাবি।”

নীরু মনে মনে বলে, “একেবারে তোমাদের বাড়িতে নিয়ে যাও না গো আমায়৷ আমি দু’পায়ে রাজি।”

দিন মাস গড়াতে থাকে। নীরুর আর নিয়নকে কিছু বলা হয় না। এদিকে সে বাড়িতে বলে রেখেছে চাকরি পেয়ে বিয়ে করবে। তাই পড়াশোনায় মন দিতে হচ্ছে অনেক বেশি। ধীরে ধীরে চঞ্চল নীরু কেমন যেন থিতু হতে শুরু করে। অনেক কিছুই বুঝতে থাকে সে। জগত সংসারের হাজারটা ব্যাপার একটু একটু করে মাথায় গেঁথে যায় তার। আগের পাগলামির কথা মনে পড়লে অনুতাপও হয়। তবে একটা জিনিস বদলায় না। নিয়নের প্রতি নীরুর ভালোবাসা। যত দিন যেতে থাকে, নীরুর ভালোবাসা তত গাঢ় হতে থাকে। নিঃসঙ্গ আর ভীষণ ভালোমানুষটাকে সে মনপ্রাণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করে। নীরুর বোধোদয় দেখে বোধহয় নিয়ন ভাইও তার সাথে আগের মতো ব্যবহার করে না। অনেক কথা হয় তাদের। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ চলে আসায় আড্ডার বেশিরভাগ হয় মেসেঞ্জারের পাতায়। বন্ধুত্ব বাড়ে, কিন্তু নিয়ন কখনোই সম্পর্কটা অন্যদিকে নিতে দেয় না। খুব সতর্কভাবে বিয়ে, প্রেম ইত্যাদি ব্যাপারগুলো এড়িয়ে চলে।

দেখতে দেখতে নীরুর মাস্টার্সের ফলাফল বের হয়। রেজাল্ট আশাতীত। বাবা মা খুব খুশি। আশ্চর্য হলেও সত্যি, কিছুদিনের মধ্যে নীরু চাকরিও পেয়ে যায়৷ খুব আহামরি কিছু নয়, একটা স্কুলে চারুকলার শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয় নীরু। স্কুলের ছেলেমেয়েদের সাথে তার দিন কাটতে থাকে স্বপ্নের মতো। কিন্তু ওইযে কথা ছিল চাকরির পর বিয়ে! সেই বিয়ের ঘন্টা বাজতে শুরু করে নীরুদের বাড়িতে। ছেলে দেখা চলতে থাকে। নীরু এবার নিষেধ করতে পারে না। বাহানাও দেখাতে পারে না। এ পর্যন্ত বহুবার সে আকার ইঙ্গিতে নিয়নকে তার ভালোলাগার ব্যাপারটা বোঝাতে চেয়েছে। নিয়ন বুঝেও বোঝেনি। নীরুর আর কী বা করার আছে!

অবশেষে একটা ছেলের সাথে নীরুর বিয়ে প্রায় পাকাপাকি হয়ে গেল। ছেলে তরু আপার দূর সম্পর্কের দেবর। সদ্য হওয়া বিসিএস ক্যাডার। নীরুকে নাকি তরুর বিয়েতে দেখেছিল, তখন থেকেই মনে ধরে আছে। নীরুরও ভালোই মনে হয় জাহেদ নামের মানুষটাকে। কিন্তু ভালোবাসা বা ভালোলাগা কোনোটাই তার মনে নতুন করে জন্ম নেয় না। ভয় হয়, যদি বিয়ের পরেও লোকটাকে ভালোবাসতে না পারে তবে ঠকানো হবে না? নীরুর দিনকাল কাটে চিন্তায়৷

বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা শুনে নিয়ন ভাই যেন খুব খুশি হয়। নীরুকে বারবার অভিনন্দন জানায়। নীরুও ভাব দেখায় যেন সে আনন্দে আটখানা!

এক শীতের সকালে ঘুম ভেঙে যায় নীরুর। গায়ে ধূসর রঙের চাদর জড়িয়ে সে উত্তরের জানালাটার কাছে বসে। নিয়ন ভাইকে দেখা যায় জেমিকে নিয়ে বের হয়ে এসেছে। জেমিটার বয়স হয়েছে। আগের মতো লাফাতে পারে না। নিয়ন ভাইয়ের মুখটাও বিষন্নতায় মাখামাখি। দেখে মনে হয় বয়স যেন অনেক বেড়ে গেছে হঠাৎ। অথচ তাতে তাকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। নীরুর বুকটা হু হু করে আসে। সে জানালা বন্ধ করে নিজের ঘরে চলে যায়। এতদিনের চেপে রাখা কান্না কোনোভাবে বাঁধ দিতে পারে না সে। আজকের দিনটা অন্য দিনগুলোর মতো নয়। আজ তাকে আংটি পরাতে আসবে ছেলেপক্ষ। নীরুর দিশেহারা মনে হয় নিজেকে।

সকাল থেকেই আজ রোদের দেখা নেই। দুপুরের দিকে আকাশ কালো হয়ে কুয়াশায় ছাওয়া প্রকৃতিতে ফোটা ফোটা বৃষ্টি ঝরতে থাকে। নীরুর বাবা টিভিতে খবর দেখে চিন্তিত সুরে বলে, “নিম্নচাপ শুরু হয়েছে। কয়েকদিন এমন বৃষ্টি থাকবে। এই দুর্যোগের দিনে ওনারা আসবেন কেমন করে?”

নীরুর মনটা দোটানায় দুলতে থাকল। সে প্রার্থনা করল যেন বরপক্ষ এসে না পৌঁছাতে পারে আজ। সে যেন আরেকটু সময় পেল নিজেকে সামলে নেবার। ভাগ্যবিধাতারও বুঝি তাই ইচ্ছে ছিল। বিকেলের দিকে বৃষ্টি বাড়ল। সেই সাথে লোডশেডিং। এনগেজমেন্টের অনুষ্ঠান পিছিয়ে গেল। নীরুর খুশি কে দেখে!

সন্ধ্যার পরপর মাকে বলে সে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে। পাশের বাড়িতেই যাবে। বলে এসেছে নাঈমা আপার কাছ থেকে বই আনতে যাবে। আসলে এসেছে নিয়নকে এক নজর দেখতে। সেখানে গিয়ে কাজের ছেলের কাছে শোনে দুই আপা আর চাচী গেছেন বেড়াতে। বাড়িতে শুধু একা নিয়ন ভাই আছে। নীরু পা টিপে টিপে নিয়নের ঘরে ঢোকে। ঢুকেই চমকে ওঠে সে। নিয়ন ঘরে নেই। তবে ঘরে এমন কিছু আছে যেটা নীরুর হৃৎপিণ্ডটা খামচে ধরে।

টেবিলের ওপর একটা কাচের জার। জারের গায়ে নানা রঙের নকশা করা। জারের ভেতর একটা মোমবাতি রাখা। মোমের আলো কাচের গা দিয়ে ঠিকরে বের হচ্ছে। আর কাঠের টেবিলের গায়ে নকশা কেটে দিয়েছে। এই জারের নকশাটা বহুদিন আগে নীরু নিজ হাতে বানিয়েছিল। বানিয়ে রঙিন কাগজের বাক্সে ভরে নিয়ে গিয়েছিল নিয়ন ভাইয়ের জন্য। সেই বাক্স সে ফেলে এসেছিল মাঠে। জারটা যেহেতু নিয়ন পেয়েছে, তার মানে এর ভেতরের চিঠি, কার্ড আর ফুলের মালিকও হয়েছে সেই ভদ্রলোক! কত যত্ন করে রেখেছে জারটা! অথচ কী সুন্দর মিথ্যে করে বলেছিল বাক্সটা ফেরত দিয়ে এসেছে! লোকটা তার মানে জানে নীরু তাকে কতটা…..!

টেবিলের এক কোণে একটা ডায়েরি দেখতে পায় নীরু। ভেতরে একটা কলম গোঁজা। কলমটা বের করে ডায়েরির পাতা খোলে সে। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ক’টা লাইন, “ভালোবাসার মায়ার খেলায় হেরে গেলাম নীরু। তোমায় দূর থেকেই ভালোবাসা যায়, কাছে গিয়ে কষ্ট দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। যার কাছে যাবে, মনপ্রাণ ঢেলে দোয়া করব যেন সুখে থাকো।”

নীরুর চোখভরে জল আসে। সে ডায়েরিটা রেখে মেঝেতে বসে কেঁদে ফেলে। নিয়ন বাথরুমে ছিল। বের হয়ে নিজের ঘরে বসে নীরুকে কাঁদতে দেখে যা বোঝার বুঝে নেয় সে। নীরু মুখ তুলে তাকায়। চোখে চোখ পড়ে। সেই নীরুর প্রেমে পড়ার দিনের মতো আজও বাইরে ডিসেম্বরের বৃষ্টি হচ্ছে। শীতে জমে আসছে গা হাত পা। ভেজা বাতাসের ঝাপটা জানালা দিয়ে এসে হিমের কণা বিঁধিয়ে দিচ্ছে নীরুর গায়ে। মোমের আলোয় সে দেখতে পায় তার সামনে দাঁড়িয়ে রূপকথার রাজকুমার, যাকে পাবার জন্য সে অপেক্ষা করেছে হাজার বছর। নীরু স্থান কাল পাত্র ভুলে এক ছুটে এসে আছড়ে পড়ে নিয়নের বুকে। নিয়ন ধাক্কা সামলাতে না পেরে পিছিয়ে পড়ে। তার হৃদয়েও আজ শ্রাবণের ঢল নেমেছে। নীরু তো তার প্রেমে পড়েছে অনেক পরে! এই শ্যামবর্ণা দীর্ঘকেশী মায়াবতীর প্রেমে তো সে বুঝতে শেখার পর থেকেই হাবুডুবু খাচ্ছে। তবু কাছে যেতে সাহস হয়নি। পেয়েও হারিয়ে যাওয়ার চেয়ে না পাওয়ার যন্ত্রণা ভালো!

কিন্তু আজ নীরুর কান্না দেখে মনে হলো, তাতে কষ্ট সে একা পেত না, এই মেয়েটাকেও যে খুব কষ্ট দিয়ে ফেলত! তারচেয়ে একটা সুযোগ দেয়াই যাক জীবনটাকে। অসুখ হলেও তা তো হবে সুখের অসুখ। হোক না! এই মেয়ের হাত সে কোনেদিন ছাড়বে না।

কাজের ছেলেটার স্যান্ডেলের শব্দ শুনে নিয়ন ফু দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে দেয়। নিজেও দু’হাতে জড়িয়ে ধরে নীরুকে।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

নীল নীলিমায় পর্ব-০১

0

#নীল_নীলিমায়
সুমাইয়া আমান নিতু

নীরুদের পাশের বাড়িতে মস্ত বড় একটা কুকুর পালা হয়। বড় বড় লোমওয়ালা বিদেশী কুকুরটার খাসা একখানা নামও আছে, জেমি। নীরু রোজ উত্তরের জানালাটা খুলে বসে থাকে জেমির ঘুরতে বের হওয়ার অপেক্ষায়। আসলে জেমিকে দেখতে নয়, জেমির মালিকটি, যিনি তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হন, তাকে দেখতে। ছেলেটার বয়স বোধহয় আটাশ-উনত্রিশ হবে। নাম নিয়ন। সে নাকি ঘোষণা করেছে চিরকুমার থাকবে, বিয়ে করার ঝামেলায় কোনো কালে যাবে না। এমন সিদ্ধান্তের কারণও আছে বৈকি! তার বড় দুই বোনেরই বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে গেছে বিয়ের বছর কয়েকের মধ্যে। এখন সে চায় ছোটবেলার মতোই ভাইবোনেরা একত্রে থাকবে আমৃত্যু! লোকে বলে বউ নেই বলেই নাকি সে কুকুর পালে। কী আজব কথাবার্তা!

নীরুর সাথে নিয়নের প্রায়ই দেখাসাক্ষাৎ হয়। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছে একে অপরকে। নীরু বয়সে ছোট হলেও নিয়ন ভাইয়ের সাথে কত খেলেছে! একটু বড় হওয়ার পর লজ্জায় ওদের বাড়িতে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। এখন মাঝেমধ্যে গেলেও নিয়নের সাথে তেমন কথা হয় না, ওর বড় বোন নাজিফা আপা আর নাঈমা আপার সাথে তাদের ঘরে বসে গল্প হয়, ফেরার সময় কখনো সামনে পড়ে যায়। নিয়ন একটু হেসে জিজ্ঞেস করে, “কিরে ফাঁকিবাজ, পড়াশোনা কেমন চলে?”

নীরু ফাঁকিবাজ সত্য। এসএসসি, এইচএসসিতে টেনেটুনে পাশ করে মুখরক্ষা হয়েছে। এবার অনার্স পড়ছে বাংলা সাহিত্যে। প্রথম বর্ষে উতরে গেলেও এবার পাশ করবে বলে মনে হয় না। নিয়নের উত্তরে তাই সে হাসার চেষ্টা করে, হাসি আসে না। নিয়ন কিন্তু ভালো ছাত্র। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, পড়া শেষ হতে না হতেই চাকরি পেয়ে গেছে। বাড়ি থেকে দশ মিনিটের পথ অফিস। তাই সকাল সন্ধ্যা তাকে বাড়িতেই দেখা যায়৷ নীরুও সকালবেলা দ্রুত হাতের কাজ শেষ করে জানালা খুলে বসে।

এক নজর এই মানুষটাকে দেখতে তার বড় ভালো লাগে। আগে কিন্তু এমন হতো না। বরং উল্টোটা হতো। নিয়ন যখন তাকে ফাঁকিবাজ বলে ডাকত, কিংবা এটা সেটার জন্য বকে দিত, তখন খুব রাগ হতো। কতবার ইচ্ছে হয়েছে নিয়ন ভাইকে মাঠের ধারের বদ্ধ ডোবাটাতে কয়েক দফা চুবিয়ে আনতে! কিন্তু একদিন সব কেমন বদলে গেল।

এমন অপোগণ্ড ঘটনাগুলো বৃষ্টির দিনেই বুঝি ঘটে! তাও আবার ডিসেম্বর মাসে অকালের বৃষ্টি। শীতে জমে যাবার অবস্থা! নীরু কলেজ গেটে দাঁড়িয়ে, একটা রিকশা নেই, রাস্তা হাঁটুপানিতে সয়লাব। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে নীরু। হঠাৎ রিকশায় নিয়ন ভাইকে দেখা গেল। নীরুর কাছে এসে রিকশা থামিয়ে বলল, “বাড়ি যাবি?”

নীরু যেমন ভরসা পেল, তেমন রাগও হলো। বলতে ইচ্ছে হলো, না বাড়ি যাব না, মরতে যাব। এখানে তো ঢং করতে দাঁড়িয়ে আছি। সে কথা না বলে রিকশায় চড়ে বসল। রিকশা একটু দূরে গিয়ে জ্যামে পড়ল। সামনে নাকি একটা বড় গাড়ির চাকা গর্তে আটকে গেছে। ভারি ঝামেলায় পড়া গেল তো!

নীরুর সোয়েটার ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে এর মধ্যে। শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে সে। নিয়ন কিছুক্ষণ নীরুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “শীত করছে?”

নীরু এবারও প্রশ্নের জবাব দিল না। মনে মনে একটা চিৎকার দিয়ে বলল, না গরম লাগছে। রিকশায় একটা এসি ফিট করে দাও না প্লিজ!

নীরুকে অবাক করে দিয়ে নিয়ন ভাই তার পরনের জ্যাকেটটা খুলে নীরুর গায়ে জড়িয়ে দিল। নীরু হতভম্ব হয়ে গেল। কান্ডটা ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারল না৷ নিয়ন ভাইয়ের দিকে এক পলক চেয়ে দেখল সে। বৃষ্টিতে আধভেজা চুলগুলো কপালের ওপর পড়ে আছে। বিকেলের মরে আসা আলোয় তার ফরসা গায়ের রঙ বাদামী দেখাচ্ছে। আধভেজা শার্ট শরীরের সাথে লেপ্টে আছে, আর চুলগুলো পড়ে আছে কপালে। একদম হিরোদের মতো দেখাচ্ছে নিয়ন ভাইকে! আগে তাকে কোনোদিন খেয়াল করে দেখেনি নীরু। একেই বলে মাথার ওপর চশমা রেখে সারা বাড়ি খোঁজা! ক্লাসে সবার প্রেমের গল্প শুনে কান ঝালাপালা নীরু নিজে কোনোদিন প্রেমে পড়েনি। যেসব ছেলের থেকে প্রস্তাব পেয়েছে তাদেরও সাড়া দেবার ইচ্ছে জাগেনি। বলা যায় মনের মতো কাউকে পায়নি। এখন পাওয়া গেল! ইশ্ ওর বান্ধবীরা যদি দেখত, নীরুকে ওর হিরো রিকশায় তুলে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিচ্ছে, গায়ের জ্যাকেট খুলে পরিয়ে দিচ্ছে, ওদের রিয়েকশান কেমন হতো? হা হয়ে চোয়াল ঝুলে যেত না? রিকশার ঝাঁকুনিতে সম্বিত ফেরে নীরুর। আর একটু পরেই বাড়ি এসে যাবে। নীরুর ইচ্ছে করে রিকশাওয়ালাকে বলে, একটু ঘুরে যান না মামা। আমি বহুকাল পর তাকে পেয়ে গেছি।

নিয়নের অবশ্য এরকম কোনো অনুভূতি নীরুর জন্য নেই। নীরু কিছু বলতে গেলেই এমন ভাব করে যেন উনি গুরু আর নীরু তার কাছে দীক্ষা নিতে যাওয়া কচি শিষ্যা। অসহ্য! আসলে প্রেম ব্যাপারটাই অসহ্য৷ অথচ নীরু সেদিনের পর থেকে নিয়ন ছাড়া কারো কথা মাথাতেও আনতে পারে না।

একদিন নীরু ঠিক করে ফেলল সে নিয়নকে প্রপোজ করবে। অসভ্য লোকটা সহজে মানবে না, কিন্তু নীরু মানিয়ে নেবে যে করেই হোক। সে একটু একটু করে টাকা জমাতে শুরু করল। দশ, বিশ, পঞ্চাশ, কখনো একশো। এভাবে জমে জমে সাতশো বিশ টাকা হলো। নীরু দোকানে গিয়ে খুব ভেবেচিন্তে অনেকগুলো রঙিন কাগজ, গ্লিটার, রঙ, আঠা ইত্যাদি কিনল। নীরু হাতের কাজ দারুণ জানে! কিছু একটা বানিয়ে ফেলবে। দুশো টাকা রাখল ফুল কিনতে। আর বাকি টাকা দিয়ে একটা ভালো দেখে লিপজেল কিনল। নিয়নের ঠোঁটদুটো সারাক্ষণ শুকনো খটখটে হয়ে থাকে। কখনো ফেটে একপাশে রক্ত জমে যায়, তবু লিপজেল দেবে না৷ বাজে কোথাকার! এতদিন কিছু বলতে পারেনি নীরু, এখন বলবে।

ঠিক তিনদিন পর নীরুকে দেখা গেল বিশাল একটা বাক্স নিয়ে পাড়ার মাঠের এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকতে। নিয়ন ভাইকে খবর দিয়েছে এখানে আসতে। মাঠের একধারে বড় একটা রেইনট্রি গাছ৷ তার নিচেই দাঁড়িয়েছে নীরু। মাঠে ছেলেরা ফুটবল খেলছে। নীরুর ছোটবেলায় ফুটবল খেলতে ভালো লাগত। সে খেলা দেখতে থাকল৷ একটা ছেলে দারুণ খেলছে। গোল হতে হতে হয়নি দু’বার। এবার হয়েই যাবে মনে হচ্ছে। হঠাৎ পাশ থেকে বাজখাঁই গলা শুনে চমকে উঠল নীরু।

“কিরে, তোর কী কথা এখানে এসে বলতে হবে? কোনে ঝামেলা পাকিয়েছিস নাকি?”

নিয়ন ভাইয়ের দারোগাদের মতো দৃষ্টি দেখে নীরুর এতদিনের আত্মবিশ্বাস গলে জল হয়ে গেল। ঘামতে শুরু করল সে। নিয়ন চোখদুটো ছোট করে সন্দেহের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “সত্যি করে বল তো কী হয়েছে? তোর হাতে এগুলো কী?”

সত্যি বলার কথা শুনে নীরু হাপ ছেড়ে বাঁচল। মিথ্যে বলার বুদ্ধি তবে নিয়ন ভাই নিজেই দিল। সে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “কলেজের প্রোজেক্ট। কাগজ দিয়ে একটা বাড়ি বানাতে হবে। তুমি আমাকে হেল্প করবে?”

নিয়নের চোখে সন্দেহ তীব্র হলো। “তুই নিজেই তো কতকিছু বানাতে পারিস। আমাকে কেন লাগবে? আর লাগলে বাড়িতে না এসে এখানে ডেকেছিস কেন? সত্যি করে বল নীরু।”

নীরু কেঁদে ফেলল। যা যা ভেবেছিল সব গুলিয়ে ফেলল। সে হাতের বাক্সটা মাটিতে নামিয়ে রেখে এক ছুটে পালিয়ে এলো সেখান থেকে। তারপর দুই মাস সে নিয়ন ভাইয়ের ধারে কাছেও গেল না৷ এমনকি জানালা খুলে লুকিয়ে দেখতেও কী ভীষণ লজ্জা করতে থাকল। আচ্ছা নিয়ন ভাই কী করেছিল বাক্সটা? পানিতে ফেলে দিয়েছে? নাকি রেখে দিয়েছে? নীরু ক’দিন কী যে ভয়ে ছিল! যদি নিয়ন ভাই বাড়িতে এসে বিচার দেয়? কিন্তু দেয়নি আজ পর্যন্ত। আপাদেরও বোধহয় কিছু বলেনি৷ নইলে নাঈমা আপা সেদিন ছাদ থেকে ডেকে হাসিমুখে বাড়িতে যেতে বলত না।

অবশেষে একদিন নিয়ন ভাইয়ের সামনে পড়তেই হলো। নীরুর বড় বোন তরুর বিয়ে। মফস্বলের বিয়েগুলোতে শহরের মতো অতটা জাঁকজমক না হলেও মজা হয় খুব। কিছু লোক এসে প্যান্ডেল খাটিয়ে, মরিচবাতি দিয়ে বাড়ি সাজিয়ে দিয়ে যায়৷ ডালা সাজানো, গায়ে হলুদের গয়না বানানো, ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো এসব নিজেদের কাজ। সবাই মিলে হৈ হৈ করতে করতে বিয়ে বাড়িটা কী দারুণ জমে ওঠে! নীরুও বড় বোনের বিয়ে উপলক্ষে যেন সব ভুলে মেতে উঠল একেবারে। হলুদের দিন সকালবেলা বাসন্তী রঙের শাড়ি পরল। চোখে গাঢ় কাজল, কানে ঝুমকা আর হাতভর্তি রঙিন চুড়ি পরে ঘুরতে লাগল বাড়িময়। ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সামনে পড়ে গেল নিয়ন ভাই। তার হাতে একটা ডালা। ছেলের বাড়িতে পাঠানোর জন্য ডালা সাজানো হচ্ছে, নিয়ন ভাইও যে সেখানে আছেন নীরুর জানা ছিল না। সে ভীষণ লজ্জা পেলে লাল টকটকে হয়ে গেল। পালানোর জায়গা খুঁজছে, এমন সময় কোথা থেকে নীরুর মা উদয় হলেন। নিয়নকে দেখে বললেন, “একটা ঝামেলা হয়ে গেছে রে বাবা।”

“কী হয়েছে চাচী?”

“হলুদের স্টেজ সাজানোর জন্য যে ফুলের অর্ডার দিছিল তোমার চাচা, সেই দোকান নাকি ফুল দিতে পারবে না৷ কী হইল তাদের কে জানে! এখন এত ফুল কই পাই? তুমি একটু দেখো না বাবা। আমার ছেলেপেলে নাই, ওর মামাতো ফুপাতো ভাইয়েরা তো এইদিকে থাকেও না, কিছু চেনেও না। তোমার চাচা যাইত, কিন্তু তার এদিকে শতেক কাজ।”

নিয়ন ভাই নীরুর মায়ের হাত ধরে বলল, “আমি আছি তো চাচী। চিন্তা কিসের? আমি ছেলে না? দেখছি কোথায় ফু্ল পাওয়া যায়।”

নীরুর মা যেন একটু স্বস্তি পেলেন। তারপর বললেন, “তুমি নীরুরে সঙ্গে নিয়ে যাও বাবা। ও ফুলটুল ভালো চেনে, তোমার সাহায্যও হবে।”

নিয়ন ভাইয়ের বোধহয় নীরুকে নেবার খুব একটা ইচ্ছে ছিল না। মানাই করে দিত, আবার কী ভেবে রাজি হয়ে গেল। নীরুর লজ্জা করলেও মনে মনে খুব খুশি লাগতে থাকল।

সেদিনকার মতো রিকশায় চড়ে বসল দু’জন। আজ বৃষ্টিবাদল নেই। শরতের আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার। রোদ উঠেছে আকাশ ভেঙে। নিয়ন ভাই কথাবার্তা বলছে না একটাও। নীরুও কিছু বলতে পারছে না। কিন্তু এইযে উঁচুনিচু পথে রিকশার ঝাঁকুনিতে হাতে হাত লেগে যাচ্ছে, কী যে ভালো লাগছে তার!

অবশেষে ঘন্টা তিন ঘুরে একেক জায়গা থেকে ফুল জোগাড় করা হলো। সেসব ফুল রিকশায় নিয়ে দু’জনের আসতে আসতে অবস্থা খারাপ। নীরু যেমনটা ভেবেছিল তেমন রোমান্টিক কোনোকিছু হয়নি। নিয়ন ভাইয়ের দু’চারটে ধমক খেয়েছে ফ্রিতে। তবু অতটা খারাপ লাগত না, যদি না বাড়ি ফিরে আয়না দেখত নীরু। চোখের কাজল ছড়িয়ে গেছে। ফুলের চাপে শাড়ির ভাজ নষ্ট হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে তাকে দেখতে লাগছে ভূতের মতো। নীরু আবার গোসল করল। হালকা মিষ্টি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে নিল। সাজগোজের ইচ্ছে হলো না আর। বিকেলটা কাটল তরু আপার সাথে। তরু নীরুর চেয়ে অনেক সুন্দর। ওর গায়ের রঙ দুধে আলতা। মুখটাও ভীষণ মিষ্টি৷ তরু অনেক আগে বলে রেখেছিল তার পড়াশোনা শেষ করে চাকরি হলে তারপর বিয়ে করবে। চাকরি হওয়ার পর প্রথম যে সম্বন্ধটা এসেছে, তারাই তরু আপাকে পছন্দ করে ফেলেছে। বিয়েটাও সেখানেই হচ্ছে। তরু আপার বরটা বেশ হ্যান্ডসাম দেখতে। দু’জনকে একসাথে খুব মানাবে। নীরু স্বপ্ন দেখতে শুরু করে, বিয়ের স্টেজে সে আর নিয়ন ভাই পাশাপাশি বসে আছে। চিন্তাটাও যেন লজ্জা দিয়ে যায়, নীরুর মুখের রঙ আপনাআপনি বদলাতে থাকে।

চলবে।

আমার তুমি ২ পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৪০[অন্তিম পর্ব]
#জান্নাত_সুলতানা

-“এই তুই তুরাগ এর সাথে কেনো আজ পুকুর পাড়ে গিয়েছিলি?”

ছোট সায়রা মিশানের প্রশ্নে মনে হয় ভীষণ খুশি হলো।তৎক্ষনাৎ হাতের পুতুল বিছানায় ফেলে দিয়ে বসা ছেড়ে ওঠে এগিয়ে এলো।আর খুশিতে গদগদ হয়ে জবাব দিলো,

-“তুলাগ ভাই আমাতে এতটা চতলেত দিয়েতে।তাই গিয়েতি।”

মিশান বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে নিলো। ক্লাস টুতে পড়ুয়া মেয়ে এখন ঠিকঠাক শব্দের উচ্চারণ করতে পারে না।ভূপৃষ্ঠ হওয়ার পর সাথে সাথে কাঁদে নি।টুইন বেবি ছিল তো।সেক্ষেত্রে প্রহর কাঁদলেও।সায়রা কাঁদে নি।চব্বিশ ঘন্টা অবজারভেশনে রাখতে হয়েছে। আর সেই থেকে সায়রা দ্রুত রিকোভার করে নি।আস্তে আস্তে সব হয়েছে যেমন বসা,কোনো জিনিস নিজের হাতে নিচ থেকে তুলতে পারা।কথা বলা হাঁটা চলা।সবাই অনেক টা সময় লেগেছে। তবে সেসব নিয়ে বেশি ভাবে না মিশান।কপালে বা হাতের তর্জনী আঙ্গুল ঘষে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

-“লোভী একটা।
ঠিক বাপের মতো।”

সায়রা গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে মিশানের অধরপানে।ঠিক শুনতে পায় নি কি বলছে মিশান।কিছু জিগ্যেস করবে তার আগেই মিশান বলে উঠলো,

-“আমি তোকে রোজ স্কুল থেকে ফিরার সময় একটা করে চকলেট দেই।তবুও কেনো তুই তুরাগ এর থেকে চকলেট নিস?”

-“তুমি তো এততা দাও।আরেত তা তুলাগ ভাইয়া দেয়।দুতা হয়।”

সায়রা জবাবে এবার মিশান চটে গেলো।সায়রার চুলের ঝুঁটি টেনে ধরলো।সায়রা আকস্মিক আক্রমণে হকচকালো।কি হচ্ছে বুঝতে পেরে ফুঁপিয়ে ওঠে। মিশানের খেয়াল এলো।রাগের মাথায় একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।তাই ঝুঁটি ছেড়ে দিতে দিতে ধমকের স্বরে বলল,

-“এই চোপ।
একদম কোনো সাউন্ড করবি না।”

সায়রা চোখ ডলে।পিটপিট করে মিশানের দিকে তাকিয়ে থাকে।মিশান নিজের মাথার পেছনে এক হাত রেখে আরেক হাত কোমড়ে রেখে আবারও বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

-“তোর বাপের পয়সার অভাব যে তুই মানুষের থেকে চকলেট নিস!বেয়াদব কোথাকার।”

পরপরই সায়রা’র দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।সায়রা সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে নিলো।মিশান বুঝতে পারে সায়রা ওকে ভয় পেয়েছে। অবশ্যই পাওয়ারই কথা যা ব্যবহার করেছে।না করে বা কি করত?যখন শুনেছে সায়রা তুরাগ এর সাথে স্কুল থেকে ফিরার সময় পুকুর পাড়ে গিয়েছে তখনই রাগ হয়।তবে তখন কিছু করতে পারে নি। তার অবশ্য কারণ রয়েছে। আজ মিশানের চৌদ্দ তম জন্মদিন। আর সেই উপলক্ষে ছোট খাটো একটা অনুষ্ঠান এর আয়োজন করছে সওদাগর বাড়ির সবাই। গরিব অসহায় মানুষদের খাবার আর মসজিদে ইমাম কে দিয়ে দো’আ পড়িয়েছে।সেই সাথে তাদের গ্রামের বড়ো মাদ্রাসা টায় সব শিক্ষার্থীদের খাবার দিয়েছে। সেইজন্য মিশান সারা দিন বাবার আর দাদার সাথে ছিল।আর বিকেলে বাড়ি ফিরে প্রহর এর কাছে এই খবর পাওয়া মাত্র মিশান রেগে আছে।এখন সন্ধ্যা। সবাই নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছে। আর এই সুযোগে মিশান খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছ সায়রা উপরে আছে।
তাই তো তৎক্ষনাৎ চুপিচুপি উপরে রুমে চলে এসছে।
আজ কিছু বলতে না পারলে আর সুযোগ পাবে না।কারণ মিশান কাল হোস্টেল চলে যাবে।আর সায়রা মির্জা বাড়ি।দেখা যদিও স্কুলে হবে। কিন্তু বেশি কিছু তখন বলার সময় হয় না।
মিশান সায়রার একটা পুতুল হাতে নিলো।সায়রার কাছে এগিয়ে এসে সেটার চুল গুলো এলোমেলো করতে করতে বলল,

-“এখন থেকে আমি তোকে রোজ দুই টা চকলেট দেব।
কিন্তু তার জন্য শর্ত মানতে হবে তোকে।রাজি?”

সায়রা চোখ চিকচিক করতে গিয়েও করে না।কি শর্ত দিবে মিশান ভাই?মানুষ টা বেশি সুবিধার নয়। তাই আগে থেকে সব ক্লিয়ার করে নিতে হবে। শর্ত মানার মতো হলে তবেই রাজি হবে।ভ্রু কুঁচকে কোমড় দুই হাত রেখে জানালো,

-“বলো।
বেতি ততিন হলে পারবো না।”

মিশান অদ্ভুত হাসলো।পুতুল টা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সায়রার ঠিক সামনে এসে দাঁড়ালো।
কণ্ঠে গম্ভীরতা এনে শুধালো,

-“আজ থেকে তুরাগ এর থেকে দূরে থাকবি।শুধু তুলার বস্তা নয়।সব ছেলের থেকে দূরে থাকবি। আর আমি যা বলবো তাই শুনতে হবে। নয়তো ছোট মনি কে বলে দেবো তুই ছেলেদের সাথে পুকুর পাড়ে যাস।”

সায়রা কিছু ভাবে। তুরাগ মাঝেমধ্যে চকলেট দেয়।প্রতিদিন দেয় না।কারণ রোজ তুরাগের সাথে ওর দেখা হয় না।ওদের সকালে ক্লাস হয় আর তুরাগের বারো টা থেকে। মাঝেমধ্যে ভাগ্যক্রমে দেখা হয়।তারমধ্যে আজ হয়েছিল।সব দিক ভেবে সায়রা বলল,

-“আত্তা।”

মিশান নিজের জিন্সের হাঁটু সমান প্যান্ট এর পকেট হাতরে একটা চকলেট বের করে। সায়রার হাত টেনে ধরে সেটা সায়রার হাতে দিতে দিতে হুশিয়ারি কণ্ঠে জানালো,

-“ভুলেও আমার সাথে চালাকি করতেই যাবি না।এই আশরিফ সওদাগর মিশান ভালোর ভালো তো খারাপের সরদার।”

কথা শেষ করে মিশান লম্বা লম্বা কদম ফেলে রুম ত্যাগ করে। সায়রা চকলেট পেয়ে সে কি খুশি। মিশান এর কথা এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আরেক কান দিয়ে বের করে দিয়েছে এতো ভারী কথার বিশ্লেষণ বোঝার সময় বা ব্রেইন কোনো টাই ওর হয় নি।

——-

সময় কত দ্রুতই চলে যায়।সময়ে সাথে সাথে আমরা কত কিছু হারিয়ে ফেলি আবার নতুন কিছু আসে জীবনে।তেমন সাদনানের আর প্রিয়তার ঘর আলো করে প্রহর সায়রা এসছে দেখতে দেখতে কেমন ছয় বছর চলে গেলো। কিন্তু প্রিয়তার যেনো চোখের সামনে এখনো ভাসে এই তো সেদিন না এই মানুষ টার সাথে কতরকম করে বিয়ে হলো।অথচ সেগুলো এখন সৃতি।
সবাই কত পরিবর্তন এসছে নিজেদের মাঝে কিন্তু ভালোবাসায় যেনো কোনো কমতি হয় মন্ত্রী সাদনানের।এখনো আগের মতোই ভালোবাসে, কেয়ার করে। এই তো একটু আগেও ফোন করে নিজের ছেলেমেয়েদের বাহানা করে বউয়ের সাথে পাক্কা এক ঘন্টা কথা বলেছে। অথচ মানুষ টা কিছু সময়ের জন্য বাহিরে গিয়েছে বলতে মূলত রিধি আর ওয়াজিদ কে এয়ারপোর্টে থেকে রিসিভ করতে গিয়েছে হয়তো ফিরেও আসবে কিছু সময় ব্যবধানে।
এখন সন্ধ্যা সবাই এক সাথে হলেই কেক্ কাটা হবে।প্রিয়তা ভাবলো কেক্ কাটা শেষ হলে আর প্রহর সায়রা কিছুই খাবে না।তাই খাবার নিয়ে ছেলে মেয়ে কে খুঁজতে লাগলো।রান্না ঘর হতে বেরিয়ে সিঁড়ির কাছে আসতেই দেখা মিললো ছেলে তার একদম নিচের সিঁড়িতে মনমরা হয়ে বসে আছে। প্রিয়তা কিছু ভেবে চট করে জিগ্যেস করলো,

-“প্রহর বোন কোথায়?”

প্রহর গম্ভীর হয়ে দাঁড়ালো মায়ের সামনে। বোন আজ তুরাগ এর সাথে পুকুর পাড়ে গিয়েছিল। সেই থেকে প্রহর আর বোনের সাথে কথা বলে নি। আর না খেলার জন্য ডেকেছে।তাই কোনো কথা সে বললো না। প্রিয়তা সন্দিহান চোখে ছেলের দিকে তাকালো। বোনের সাথে বেশ গলায়গলায় ভাব প্রহরের।টুইন হলেও দু’জন সম্পূর্ণ ভিন্ন দেখতে। আচার-আচরণ সব।প্রিয়তা জানে প্রহর রেগে থাকলে বোনের সাথে কথা বলে না।তাই নিজেই প্রহর কে আবার জিগ্যেস করলো,

-“ঝগড়া করেছে বোন?”

-“নাহ।”

প্রিয়তা আর কিছু জিগ্যেস করলো না। করেও লাভ নেই। প্রহর কখনো বলবে না কি হয়েছে। তাই প্রিয়তা কথা বাড়ায় না। খাবার প্লেট ডান হাতে নিয়ে ছেলের হাত বা হাতে আঁকড়ে ধরে উপরে আরভীর রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরে।মিশান, আরভী,তুরাগ,সায়রা, ছোট সোহান কে বিছানায় বসি চারদিক থেকে ঘিরে বসে আছে।
সোহান সারা আর রাহান এর ছেলে।দেড় বছর হয়েছে। দেখতে মাশাআল্লাহ মায়ের মতোই গুলোমুলো কিউট দেখতে হয়েছে।
সোহান কে দেখে প্রহর নিজে গিয়ে লাফিয়ে বসলো বিছানায়। প্রিয়তা নিজেও এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়ানো সার্ভেন্ট কে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“খালা আপনি ওদের সবার খাবার এখানে পাঠিয়ে দিন।আমি খাইয়ে দেবো।”

প্রিয়তা প্লেট রেখে হাত ধুয়ে সোহান কে কোলে তুলে কিছু সময় আদর করলো।বাচ্চাদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে দু’জন কাজের মহিলা এসে হাজির হলো।এখানে সবচেয়ে ছোট সদস্য আরভী আর সোহান প্রিয়তা ওদের খাবার আলাদা রেখে আর বাকি সবার খাবার নিজে হাতে খেতে দিলো।

——

রাত আটটা নাগাদ সাদনান এলো ওয়াজিদ রিধি কে নিয়ে। পুরো সওদাগর বাড়ি মানুষের হৈ-হুল্লোড় পরো গেলো।কেউ বাদ যায়নি আজ সবাই সওদাগর বাড়িতে রয়েছে।
সাদনান লিভিং রুম ছেড়ে আগে কক্ষে চলে গেলো। সেই সাথে বউ কে ইশারা করে রুমে আসার জন্য বলে এলো।রিধি ওয়াজিদ কে সবাই ফ্রেশ হয়ে নিতে বললো।আর বাকিরা কেক্ কাটার প্রস্তুতি নিতে লাগলো।
প্রিয়তা রুমে প্রবেশ করা মাত্র সাদনান ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে এলো।উদোম গায়ে অল্পস্বল্প পানির ছিটেফোঁটা মুখের আশেপাশে কিছু চুলও ভেজা। হাতে টাওয়াল প্রিয়তা রুমে আসতেই টাওয়াল সাদনান বউয়ের উপর ছুঁড়ে ফেলে।
প্রিয়তা কিছু টা হকচকিয়ে টাওয়াল হাতে এগিয়ে এলো।সাদনান ঝট করে বউয়ের কোমড়ে দুই হাত চেপে ধরে শুন্যে তুলে নিলো।
প্রিয়তা টাওয়াল দিয়ে সাদনানের মুখের পানি সহ বুকে থাকা অল্পস্বল্প পানি গুলো মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,

-“আপনার এই স্বভাব কোনো দিন যাবে না?”

-“আমার তুমি আছো।”

সাদনান মৃদু হেঁসে বলে উঠলো।
প্রিয়তা ছাড়া পেয়ে ব্যালকনিতে গিয়ে টাওয়াল মেলে দিয়ে রুমে এলো।সাদনান ততক্ষণে গায়ে পাঞ্জাবি পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রিয়তা নিজেও শাড়ী পড়ে রয়েছে।সাদা আর গাঢ় রানী গোলাপি সুতোর কাজ করা।সাদনান কে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দারুণ লাগছে।অবশ্য সব সময় সুদর্শন লাগে কিন্তু প্রিয়তা পাশে দাঁড়াতেই আজ পরিপূর্ণ মনে হলো নিজে কে।
সাদনান বউয়ের দিকে একপলক আয়নায় তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে সরাসরি তাকালো বউয়ের মুখপানে।
কিছু সময় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। পরপরই ঝুঁকে বউয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ দিলো।
নিজের বা হাতের মুঠোয় প্রিয়তার ডান হাত শক্ত করে আঙ্গুলের ভাঁজে পেঁচিয়ে ধরে রুম হতে বেরিয়ে এলো।
লিভিং রুম তখন মানুষ গিজগিজ করছে।
চারদিকে শুধু মানুষ।ছোট সায়রা সোফায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে। তার পাশেই সব বাচ্চারা রয়েছে। একটু পর কেক্ কাটা হবে। মিশানও রেডি হয়ে চলে এসছে।
সবাই আসতেই শফিক সওদাগর তাগাদা দিলো।
মিশান কে ঘিরে সব বাচ্চারা কেক্ কাটলো।
কেক্ কাটার শেষ রাহান এলো কোথা থেকে দৌড়ে। হাতে একটা ক্যামেরা।
একজন সিকিউরিটির হাতে ক্যামেরা দিয়ে সবাই কে এক সাথে দাঁড়াতে তাগাদা দিতে লাগলো।সোফায় শফিক সওদাগর এর কোলে আরভী জাফর মির্জার কোলে নিজের পুঁতি প্রহর। আজম মির্জার কোলে সোহান।পাশে মফিজুর মির্জা মিশান কে আগলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ওনার এক পাশে সুফিয়া বেগম অন্য পাশে তুরাগ কে কোলে নিয়ে কালাম খান। ওনার পাশে ওয়াসিফ দেওয়ান নিজের নাতনি রুহি কে কোলে নিয়ে দাঁড়ালো।
আয়না রাহাত সালেহা বেগম ইনিয়া কে সামনে নিয়ে রোজিনা বেগম তারা সবাই পুরুষদের পেছনে দাঁড়ালো। আর এক পাশে তিন্নি কবির এক সাথে দাঁড়ালো।মাইশা আয়ান মিশান কে সামনে রেখে এক সাথে, সারা রাহান ওদের পাশেই রিধি ওয়াজিদ আর তারপর প্রিয়তা সাদনান । সাদনান এক হাতে বউয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে একদম নিজের সাথে চেপে রাখলো।প্রিয়তা অবশ্য বারকয়েক ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে লাভের লাভ কিছু হলো না।মানুষ টার স্বভাব কোনো দিন বদলাবে না। রাহান সবার ঠিকঠাক দাঁড়ানো শেষ সিকিউরিটি কে ইশারায় ফটো ক্লিক করতে বললো।সিকিউরিটি মুচকি হেঁসে সবাই কে এক ফ্রেমে বন্দি করে নিলো।সাদনান ঠিক সেই সময় বউয়ের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠলো,

-“আমার তুমি আমার স্বভাব। এই স্বভাব আমি কোনো দিন বদলাতে চাই না।”

~সমাপ্ত~

আমার তুমি সিজন-০১ পড়তে লেখাটির উপর ক্লিক করুন

আমার তুমি ২ পর্ব-৩৮+৩৯

0

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৮
#জান্নাত_সুলতানা

সাদনান ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে আছে।পুরুষ টার গায়ে গাঢ় নীল রঙের টি-শার্ট। সব সময় পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা কুচকুচে কালো অল্পস্বল্প ভেজা চুল গুলো ভ্রু জোড়ার উপর এসে পৌঁছেছে। চোখের লম্বা ঘন পাপড়ি গুলো চোখ বন্ধ থাকায় দারুণ দেখতে লাগছে। সরু নাকটার নিচে সব সময় খবরদারি করতে থাকা চিকন পাতলা অধর জোড়া আপাতত বন্ধ আছে।
প্রিয়তা পাশের দোলনায় বারকয়েক তাকিয়ে কিছু সময় লাগিয়ে সব পর্যবেক্ষণ করলো।তারপর নিজের হাত টা সাদনানের গালে রাখলো।সাদনান প্রিয়তার চেয়ে একটু বেশি ফর্সা। কিন্তু ছেলে যেনো বাবার কার্বন কপি হলে গায়ের রং টা মায়ের মতো হবে বলে প্রিয়তার মনে হচ্ছে।
প্রিয়তার হাতের স্পর্শে সাদনান নড়েচড়ে প্রিয়তার হাত টা টেনে ধরে জড়িয়ে নিলো বুকে।একবার পিটপিট করে তাকিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুম জাড়ানো কণ্ঠে বলল,

-“আমার জান।
এতো দেখো না।নিজে কে সামলাতে পারলে আমাকে কিন্তু পারবে না। আর আমি এখন বেসামাল হতে চাইছি না।”

প্রিয়তা দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে।ঘুমিয়ে গিয়েও শান্তি দিচ্ছে না। অদ্ভুত লোক।

——

-“না আব্বা কাঁদে না।
মা চলে আসবে।”

কিসের কি মেয়ে তার ঠাশঠাশ করে গলা ফাটিয়ে কেঁদে চলছে।সাদনান অনেক্ক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও লাভের লাভ কিছুই হচ্ছে না। সাদনানের এবার নিজে কে বড্ড অসহায় লাগলো।প্রথমে কাঁদে নি বলে কত কি করতে হলো।আর এখন বেশি কাঁদার জন্য মনে হচ্ছে ডক্টর দেখাতে হবে। প্রিয়তা এখন নিচে আছে।
ছেলে বাবু টা সারা’র কাছে রয়েছে। প্রিয়তা শরীর ভীষণ দুর্বল। যদি প্রিয়তার মতে সে সুস্থ। কিন্তু সাদনান কিছুতেই তা মানতে রাজি নয়।প্রিয়তা কে কিছু করতে হয় না।শাশুড়ী, চাচী শাশুড়ী, ফুপি শাশুড়ী সবাই যেনো শাশুড়ী নয় মায়ের মতো আগলে সেবাযত্ন করছে।যদিও আগে প্রিয়তা নিজে কে এ বাড়ির বউ কম মেয়ের মতোই থেকেছে। কিন্তু এখন সব কিছু যেনো দিগুণ হচ্ছে। কত আদর যত্ন ভালোবাসে সবাই। আর এখন তো আম্বিয়া মির্জাও আহ্লাদে আটখানা হয়ে পড়েছে। হবে না বা কেনো নাতির ঘর আলো করে দুই দুই টা জীবন্ত পুতুল এনে দিয়েছে যে।নাতির জীবন পূর্ণ হয়েছে। এতেই তিনি প্রচুর খুশি।
এখন প্রায় বেলা বারোটা বাজে। প্রিয়তা কে খবর পাঠানো হয়ে গিয়েছে।নিশ্চয়ই কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসবে। তাছাড়া বাড়িতে কতবড় অনুষ্ঠান। ছেলেমেয়ের আকিকা দিয়ে নাম রাখবে আজ।অবশ্যই আরো আগেই রাখতো কিন্তু প্রিয়তা অসুস্থ বিধায় এতো দিনে এসে রাখছে।
সাদনান মেয়ের দিকে কতক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে রুম হতে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতেই প্রিয়তা রুমে প্রবেশ করলো।গায়ের ওড়না সোফায় রাখে।সাদনান এগিয়ে এসে প্রিয়তার বরাবর দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,

-“বারণ করেছিলাম নিচে না যাওয়ার জন্য।
বাবু কখন থেকে কান্না করছে।”

প্রিয়তা মেয়ে কে কোলে নিতে নিতে সাদনান এর কথা কে সম্পূর্ণ এড়িয়ে বলল,

-“সবাই চলে এসছে।
আপনি গোসল করে রেডি হয়ে নিন।মা বলেছে একটু পর এসে ওদের শরীর মুছিয়ে দিবে।”

সাদনান কিছু সময় বউয়ের মুখপানে তাকিয়ে রইলো।আগের মতো আর হ্যাংলা পাতলা নেই সাদনানের ছোট জান।এখন অনেক টাই শরীরের পরিবর্তন এসছে।সাদনান কে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সাদনান মুচকি হাসলো তারপর ঝুঁকে বউয়ের ফোলা ফোলা গালে টুপটাপ কয়েকবার চুমু খেয়ে পাশ থেকে টাওয়াল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।
প্রিয়তা ফ্যাল ফ্যাল করে সাদনান এর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।
কিছু সময় পর মুচকি হেঁসে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখলো মেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তা থমথমে খেলো।মেয়ের মুখ হতে আঙ্গুল বের করে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,

-“বাপকা বেডি।
বাপ কাহিনি করবে মেয়ে সেসব দর্শক হয়ে এনজয় করবে।”

——-

পুরো বাড়ি রমরমা পরিবেশ।
রিধি ওয়াজিদ ছাড়া সবাই উপস্থিত রয়েছে আজ।মাইশার ছেলে মিশান মায়ের কাছ ঘেঁষে বসে আছে। ছোট সায়রা কে মিশান এর নিকট দারুণ মায়াবী লাগে। যেনো জীবন্ত পুতুল একটা।বাবা-র মতো ধবধবে সাদা কুচকুচে কালো চুল।গোলাপি ঠোঁট। এমন মানুষ তো সে টিভিতে দেখেছে। কার্টুন নাম এদের। কিন্তু তার মা বলেছে ওর নাম সায়রা।আর মিশান এর বোন হয়।কিন্তু মিশান মানতে রাজি নয়।ছোট মামা বলেছে সায়রা ওর বউ।কিন্তু এটা কাউ কে সে জানায়নি। মনে মনে রেখেছে। চার বছর এর মিশান যথেষ্ট বড় হয়েছে। কিছু টা গম্ভীর।
রাত প্রায় অনেক টা হয়েছে।খাবার শেষ হতে অনেক সময় বাকি।সবাই খাওয়ার পর বাড়ির মহিলারা খেতে বসছে।যদিও প্রিয়তা কে খাবার খেয়ে নেওয়ার জন্য অনেক বার সবাই বলেছে কিন্তু খায় নি প্রিয়তা।সাদনান ছেলে কে নিয়ে উপরে রুমে চলে গিয়েছে। মাইশা আগে খেয়ে নিয়েছে সেইজন্য সায়রা কে কোলে নিয়ে বসে আছে।
প্রিয়তা খাবার শেষ হতে হতে সায়রা ঘুমিয়ে পড়লো।প্রিয়তা মেয়ে কে নিয়ে উপরে রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল।
সাদনান মাত্রই ছেলের কে দোলনায় শুইয়ে বিছানা ঠিকঠাক করছিল।আর তক্ষুনি প্রিয়তা রুমে এলো।মেয়ে কে দোলনায় শুইয়ে দেওয়ার জন্য এগিয়ে যেতেই সাদনান বলে উঠলো,

-“ওকে বিছানায় দাও।”

প্রিয়তা কোনো প্রতিত্তোর করে না।মেয়ে কেও দোলনায় রেখে কাবাড থেকে রাতের পোষাক নিয়ে ওয়াশরুম চলে গেলো। সাদনান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। হঠাৎ আজ হলো কি?
সব সময় মেয়ে কে বিছানায় রাখে।মেয়ের প্রতি যেনো প্রিয়তার ভালোবাসা একটু বেশি। হয়তো মেয়ে তার এ ক’দিনে অনেক টা কষ্ট পৃথিবীতে আসার পর পেয়েছে সেইজন্য মেয়ে কে যতটা পারে নিজের সাথে সাথে রাখে।যদিও ছেলে কেও সে একই নজরে দেখে তবে রাতে মেয়ে কে সে নিজের সাথে বিছানায় রাখে। আর আজ হঠাৎ দোলনায়?
সাদনান বেশি কিছু না ভেবে দরজা বন্ধ করে এলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত বাজে বারোটার বেশি। প্রিয়তার রাতের ঔষধ আছে। সেগুলো বেড় করে নিয়ে সোফায় বসতেই প্রিয়তা ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো।গায়ে তার কালো একটা লং নাইটি।সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। আজ অনেক দিন বাদে প্রিয়তা এগুলো পড়লো।প্রেগন্যান্সির সময় ঢিলাঢালা গেঞ্জি পড়তো।কাল রাতেও তাই পড়েছে।
সাদনান মনে মনে বারকয়েক নিজে কে শাসিয়ে নিলো।মাত্র তো এক মাস হয়েছে সুস্থ হয়েছে মেয়ে টা।যদিও পুরোপুরি সুস্থ এখন হয় নি।যতটা সম্ভব বউ কে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।সাদনান চায় না ওর জন্য বউ তার কষ্ট পায়।

-“এদিকে এসো।
ঔষধ খেয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ো।
আমি একটা জরুরি কল রয়েছে সেটা শেষ করে আসছি।”

-“মিথ্যা বলছেন আপনি।
আপনার এসিস্ট্যান্ট সন্ধ্যায় সব মিটিং টাইম ঠিক করে নিয়েছে।”

সাদনান চোর ধরে পরে গেলো যেমন ভাব করে সাদনানের মুখভঙ্গি এখন তেমন ভাব করে রেখেছে। প্রিয়তা ততক্ষণে ঔষধ খেয়ে পানির গ্লাস সেন্টার টেবিলে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুল বিনুনি করে নিলো।হাত পায়ে রাতের কিছু প্রসাধনী ব্যবহার করতে লাগলো।
সাদনান এর এপর্যায়ে এসে নিজে কে সামলনো দায় হয়ে পড়লো।আস্তে করে ঢোক গিলে এগিয়ে গিয়ে বউ কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে উন্মুক্ত ঘাড়ে লম্বা সরু নাকটা ঘষতে লাগলো।
প্রিয়তা এসবে পূর্ব অভিজ্ঞতা রয়েছে। কিন্তু আজ অনেক দিন পরে মানুষটার এমন স্পর্শে শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো।চোখ বন্ধ করে ভালোবাসার মানুষ টার স্পর্শ গুলো অনুভব করতে লাগলো।প্রিয়তা চোখ বন্ধরত অবস্থায় বলে উঠলো,

-“ভালোবাসি মন্ত্রী সাহেব।”

সাদনান বউয়ের সম্মতি পেয়ে আরো কিছু টা চেপে ধরলো বউ কে নিজের সাথে।অতঃপর আস্তে আস্তে টুপটাপ বৃষ্টির ন্যায় চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো বউয়ের গাল, গলা, ঘাড়ে।
তারপর নিজের দিকে ফিরিয়ে বেশ কিছু সময় ধরে নিজের ওষ্ঠদ্বয় দিয়ে বউয়ের ওষ্ঠদ্বয়ে রাজত্ব চালালো। সময় নিয়ে ছেড়ে দিয়ে বউ কে পাঁজা কোলে তুলে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর প্রিতার উপর ছেড়ে দিয়ে ঘোর লাগা কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“সরি জান।”

#চলবে…

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৯
#জান্নাত_সুলতানা

-“তুমি তুরাগ কে কেনো মেরেছো?”

বাবা-র প্রশ্নে মিশান আঁড়চোখে একবার মফিজুর মির্জার কোলে বসে থাকা তুরাগ এর দিকে তাকালো।
তুরাগ একদম চুপটি করে বসে আছে। চোখ গুলো লাল হয়েছে। হাতের আঙ্গুলে একটা ব্যান্ডেজ লাগনো।
যেটায় সে একটু আগে কামড়ে দিয়েছে। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে এসে সায়রা কে কোলে নিয়ে বসে থাকা সারা’র পাশে বসে ছোট সায়রার হাত ধরতে দেখে ভীষণ রাগ হলো।কিন্তু তখন কিছু করতে পারে নি লিভিং রুমে সবাই ছিল বলে।আর যখন ব্রেকফাস্ট করে যে যার মতো চলে গেলো তখনই সুযোগ বোঝে তুরাগ এর আঙ্গুল কামড়ে দিয়েছে। তুরাগ সে কি গলা ফাটিয়ে কেঁদে ওঠে ছিলো।কিন্তু মিশান নিজের রাগ মিটিয়ে তবেই ছেড়েছিল।ততক্ষণে পুরো বাড়ির মানুষ একত্রিত হয়ে অবস্থা বুঝতে পেরে তুরাগ এর হাতে বরফ লাগালো।তিন্নি তো কেঁদেকুটে নাজেহাল অবস্থা করে ফেলেছে নিজের। এটা দেখে অবশ্যই মিশানের খারাপ লেগেছে। কারণ তিন্নি মিশান কে অনেক আদর করে মিশান নিজেও তিন্নি কে অনেক ভালোবাসে।মিশান তখন সব খারাপ লাগা পেছনে ঠেলে যখন পালানোর ধান্ধায় কারণ সে বুঝতে পেরেছিল কপালে আজ শনি রবি সব আছে। কিন্তু পালানোর আগেই আয়ান কোথা থেকে এসে ছেলে কে ধরে টেনে নিয়ে গেলো সবার মাঝে।
সেই থেকে সবাই বলে যাচ্ছে কিছু না বলার জন্য। বাচ্চা মানুষ বুঝতে পারে নি।কিন্তু আয়ান কারোর কথা না শুনেই উপরোক্ত প্রশ্ন টা করে। কিন্তু মিশানের থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে এবার রেগে গেলো।ছেলের হাত টেনে ধরে সবাই কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“সবার আদরে আদরে আজ ওর এই অবস্থা। হিংসুটে হয়েছে একটা। ওর স্বভাব না যতদিন পরিবর্তন হবে ততদিন ওর মির্জা বাড়ি আসা বন্ধ। সবার সাথে মিলেমিশে থাকার মতো বাচ্চা ও নয়।”

সবাই শত চেষ্টা করেও আয়ান কে আটকাতে পারলো না। বাধ্য হয়ে মাইশাও পেছন পেছন চলে গেলো।যাওয়ার আগে অবশ্য বলে গেলো আয়ানের রাগ পড়ে গেলো ওকে বোঝাবে।
অগত্যা সবাই তাই মেনে নিলো।

—–

কবির তিন্নি দুপুরে খাবার খেয়ে নিজেদের বাড়ি চলে গেলো।আরো কিছু দিন থাকার জন্য ইচ্ছে ছিলো তিন্নির। কিন্তু কবির এর ভার্সিটি তারউপর সকালের ঘটনা নিয়ে একটু মন খারাপ।কিন্তু সেই খারাপ লাগা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় নি।আয়ান কবির এর সাথে ফোন করে কথা বলেছে। এতে আরও সবাই নিশ্চিত হয়েছে আয়ান তাহলে রাগ করে নি।ছেলের বিচ্ছু পানায় একটু অতিষ্ঠ সেইজন্য তাছাড়া এরপর মিশান যদি একটু ভয় পায় সেইজন্য এমন টা করে।
তিন্নি কবির যাওয়ার পর প্রিয়তা সায়রা আর প্রহর কে কাজের লোকের কাছে রেখে ছাঁদে গেলো।
অনেক দিন পর ছাঁদে এসছে। প্রায় বছর ঘনিয়ে আসতে চলে।ছাঁদে নানারকম ফুল রয়েছে। প্রিয়তা সারা কে নিয়ে সেগুলো কিছু গাছ থেকে ছিঁড়ে আনলো।
দু’জন মিলেমিশে কিছু ক্যান্ডেল আর ফুল দিয়ে রুম টাকে সাজিয়ে নিল।
আয়না ছোটখাটো একটা কেক্ বানিয়ে দিলো।প্রিয়তা অবশ্য জানতো না বোন তার কেক্ বানিয়েছে।অবশ্য এটা করাতে প্রিয়তার বেশ সুবিধায় হলো।শুধু শুধু তো আর উইশ করা যায় না।
বিকেলে নাস্তা করে ছেলে মেয়ে কে খাইয়ে সালেহা বেগম আর রোজিনা বেগম এর কাছে রেখে সুফিয়া বেগম এর সাথে রাতের রান্না করতে গেলো।অবশ্য কাজের লোক সব গুছিয়ে রেখেছে। শুধু রান্না টা বাড়ির যেকোনো মহিলা কে করতে হয়।কাজের লোকের হাতের রান্না কেউই তেমন একটা পছন্দ করে না।বিশেষ করে আম্বিয়া মির্জা আর জাফর মির্জা।
রাত সাত টা বাজার পর থেকেই বাড়ির সব পুরুষ এক এক করে বাড়ি আসতে লাগলো।
প্রথমে আজ্জম মির্জা আর মফিজুর মির্জা। তারপর রাহাত।তার কিছু সময় পর রাহান।রাত নয়টা নাগাদ সবাই বাড়ি চলে এলো।শুধু সাদনান এলো না। সে এতো দ্রুত আসেও না।অবশ্য প্রিয়তা অসুস্থ যখন ছিল তখন কোথাও যায় নি।আর গেলোও খুব দ্রুত ফিরে আসতো।প্রিয়তা নিজের ছেলে মেয়ে কে নিয়ে আগে ঘুম পাড়িয়ে দিলো।রোজিনা বেগম অবশ্য বাচ্চাদের সাথে রইলো।

——-

কালাম খান নাতির হাতের অবস্থা দেখে অনেকটা মনঃক্ষুণ্ন হলেন।অফিস থেকে ফিরার পর নাতি কে নিজের সাথেই রাখলেন। রাতে খাবার নিজে খাইয়ে নিজের সাথে রুমে নিয়ে চলে গেলো।
তুরাগ বাবা মায়ের চেয়ে বেশি দাদার সাথে সাথে থাকে।দাদার সাথে তার গলায় গলায় ভাব।দাদা তার সব আবদার পূরণ করে। বাড়িতে বাড়তি মানুষ না থাকায় খেলার সাথে টাও দাদাই হয়েছে।
তিন্নি কে বেশি জ্বালায় না তুরাগ। তিন্নি নিজের মতো করে সংসার এর সব সামলাতে পারে।তবে ছেলে না জ্বালালেও ছেলের বাপ যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণে তিন্নি কে ঠিকই বিরক্ত করে। তিন্নির অবশ্য এসব ভালোই লাগে। মানুষ টা ওকে ভালোবাসে ভাবলেই শরীর মন সব জুড়িয়ে যায়।আগের সব না পাওয়া ভালোবাসা এই মানুষ টা পুষিয়ে দেয়।সাথে শশুর নামক বাপ তো রয়েছে। পুত্র বধূ কম নিজের মেয়ের মতো দেখে।
রাত তখন দশ টার কোঠা ছাড়িয়েছে।কবির কিছু প্রশ্ন তৈরি করছে।বরাবরই প্রশ্ন তৈরী করার কাজ টা কবির পায়।যদিও এই সাবজেক্টের কবির এর ডিপার্ট্মেন্টের আর দু’জন প্রফেসর রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন প্রিন্সিপাল সহ সবাই ধরে বেঁধে প্রশ্ন তৈরী করার দায়িত্ব কবির কে দিয়ে দেয়।
কবির অনেক সময় নিয়ে প্রশ্ন গুলো তৈরী করলো।তিন্নি তখন বিছানায় ঠিকঠাক করে নিজেও পরিপাটি হয়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
কবির এর রুম টা বেশ বড়সড়।অর্ধেক টায় একটা ছোটখাটো লাইব্রেরি বলা চলে।কবির সেখানে বসেই কাজ করছিল।তবে তিন্নির ডাক শুনে প্রশ্ন গুছিয়ে নিজের কালো ব্যাগ টায় রাখতে রাখতে জানালো,

-“আসছি বউ।”

তিন্নি মুচকি হাসে।এই ডাকটা আজ চার বছর ধরে শুনে আসছে কিন্তু আজও শুনলে মনে হয় এই প্রথম শুনলে।সেই প্রথম দিনের মতোই অনুভূতি হয়।
কবির ওয়াশ রুম হতে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে লাইট অফ করে ড্রিম লাইট অন করে বিছানায় এলো।তিন্নি তখন পা গুটিয়ে বসে আছে। কবির ঠিক তিন্নির বরাবর বসে ভ্রু কুঁচকে জিগ্যেস করলো,

-“কি ব্যাপার?
মন খারাপ?”

-“নাহ।
ভাবছি!”

-“কি?”

-“তুরাগ বড়ো হচ্ছে।”

-“হ্যাঁ তো?”

কবির যে তিন্নির কথা বুঝতে পারছে না তেমন নয়।কিন্তু কবির চাইছে তিন্নি বলুক। নিজের মুখে বলুক। আবদার করুক।একটু তো ভালোবাসার মানুষ টার সাথে জোর খাটায়।কিন্তু তিন্নি তো কখনো কিছু জোর করে না।কবির যেভাবে বলে সেভাবে সব মেনে নেয়।প্রথম প্রথম তিন্নি যখন কবির এর মুখের উপর কোনো কথা বলতো না তখন কবির এর বেশ ভালোই লাগতো।ভাবতো হয়তো ওকে তিন্নি ভালোবেসে সম্মান করে সব কিছু মেনে নেয় অথবা সঠিক বলেই হয়তো সম্মতি দেয়।যদিও তিন্নি অল্পতেই খুশি হয়ে যায়।কিন্তু কবির এর মন খুশি হয় না।সে চায় তিন্নি নিজেও জোর করে। ভালোবেসে কিছু আবদার করে।
কিন্তু তিন্নি মুখ ফুটে কিছু বলার বা চেয়ে নেওয়ার মেয়ে নয় কবির এটা বেশ ভালোই বুঝতে পেরেছে এই কয়েক বছরে।
কবির নিজে থেকে তিন্নি কে কাছে টানলো।গভীর আলিঙ্গন করে শুধালো,

-“একটা প্রিন্সেস চাই?”

তিন্নি মুচড়ালো।কবির এর উন্মুক্ত কাঁধে অধর স্পর্শ করলো।কবির বুঝি নিজের উত্তর পেলো।তড়িৎ বউ কে আগলে নিলো।তিন্নি নিজেও স্বামী নামক ভালোবাসার মানুষ টার সঙ্গ দিলো।

—–

সাদনান বাড়ির ফিরে প্রিয়তা কে লিভিং রুমে পেলো।গেইট বন্ধ করে এগিয়ে এসে বউয়ের সামনে দাঁড়ালো।প্রিয়তা চোখ লেগে এসছিল।মাথা সোফায় এলিয়ে দেওয়া ছিল।কিন্তু সামনে কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ খুলে সামনে সাদনান কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঠোঁটের কোণায় মুচকি হাসি খেলো গেলো।
বসা ছেড়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-“আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি খাবার দিচ্ছি।”

সাদনান মাথা নেড়ে প্রিয়তা কে জিগ্যেস করলো,

-“তুমি খেয়েছো?
বাবুরা কোথায়?”

-“মনির কাছে রয়েছে।
আমি খেয়েছি।”

-“তাহলে চলো।
আমি খেয়ে এসছি।”

প্রিয়তা কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সাদনান ওকে টেনে নিয়ে উপরে যেতে লাগলো।
রুমে এসে লাইট অন করার জন্য সাদনান হাত বাড়াতেই প্রিয়তা সাদনান কে টেনে ধরলো।বিছানার উপর থেকে ড্রেস নিয়ে সাদনানের হাতে দিয়ে বলল,

-“ফ্রেশ হয়ে আসুন।
সারপ্রাইজ আছে।”

সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। বউ তার বড়ো হলো কি?মনে হচ্ছে না। কেমন বাচ্চাদের মতো করে।ক’বছরে কম তো আর বাচ্চামো করে নি।কিন্তু সাদনানের হঠাৎ মনে হলো।কাজের চাপে সে কিছু ভুলে গিয়েছে। কিন্তু কি?
মনে পড়লো না। ওয়াশ রুমে গিয়ে বলিষ্ঠ শরীরে পানির ঝাপটা গায়ে পড়তে কিছু মনে পড়লো।ঝটপট ড্রেস চেঞ্জ করে ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে এসে দেখলো প্রিয়তা প্রায় অনেক গুলো সুগন্ধি যুক্ত ক্যান্ডেল রুমে সুন্দর করে সাজিয়ে নিয়েছে।
সাদনান কিছু টা ছুটে গেলো প্রিয়তার কাছে। পেছন থেকে পেট জড়িয়ে ধরে শুন্যে তুলে নিলো।
চুলের ফাঁকে মুখ গুঁজে অপরাধী কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“আ’ম এক্সট্রিমলি সরি জান।
ইশ কি করে ভুলে গেলাম আমি?”

প্রিয়তা নিজে কে ছাড়িয়ে নিয়ে সাদনান এর দিকে ফিরে এক হাতে মোম অন্য সাদনান এর গালে রেখে বলল,

-“এতো বছরে একবারও তো আমার মনে থাকতো না।
কিন্তু আপনার ঠিকই মনে থাকতো।আমার একটু খারাপ লেগেছে। কিন্তু আপনার কাজের এতো চাপ তাই বেশি খারাপ লাগে নি।বিশ্বাস করুন একটুই খারাপ লেগেছে।বেশি না।”

সাদনান প্রিয়তার কথা শুনে শব্দ করে হাসলো।তবে পরক্ষণেই প্রশান্তির হাসি হাসলো।বউয়ের হাত থেকে ক্যান্ডেল পাশের টেবিলে রেখে বউ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,

-“ধনবান এই দিনে আমার জীবনে এসে আমার জীবন টা এভাবে ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার জন্য।”

প্রিয়তা কিছু বললো না। কিছু সময় চুপ থেকে সাদনান জিগ্যেস করলো,

-“ওদের ফিডার দিয়ে এসছো?”

-“হ্যাঁ।
সব নিয়েছে মনি।”

সাদনান বউয়ের মাথায় চুমু খেলো।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো।
আস্ত একটা ভালোবাসার, মায়ার রাজ্য এই তিনটা মানুষ ওর জীবনে। যেখান থেকে চাইলেও আর কোনো দিন বেরিয়ে আসতে পারবে না।

#চলবে….

আমার তুমি ২ পর্ব-৩৬+৩৭

0

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৬
#জান্নাত_সুলতানা

সাদনান আজ পাঁচ দিন হয় দেশে নেই।প্রিয়তা এই পাঁচ দিন পাঁচ যুগের সমান মনে হয়েছে। ঠিকঠাক খাবার খেতে পারে না। ঘুম হয় না।মানুষ টা কে একবার ছুঁয়ে দেখা না পর্যন্ত এই অস্থিরতা ঠিক হওয়ার নয়।
ফোনে কথা বলে তৃষ্ণা মিটে না।আচ্ছা সুদূর থাইল্যান্ড অবস্থান করা মানুষ টারও কি এমন হয়?না-কি হয় না?এমনতর একই অবস্থাও কি ওই মানুষ টার মনের?
প্রিয়তার কাছে এর কোনো উত্তর নেই।কারণ এইসব প্রশ্ন গুলো বৃথা। কারণ মন্ত্রী সাদনান কেমন সেটা ওর থেকে ভালো কেউ জানে না।মানুষ টা নিশ্চয়ই ওর থেকে-ও বেশি তৃষ্ণার্ত। আজ বাড়িতে অনেক মানুষ। শুধু এই একটা মানুষ নেই।অবশ্য ঘন্টাখানেক এর মধ্যে এসে মির্জা বাড়ি পৌঁছে যাবে বলে শুনেছে প্রিয়তা। রিধি ওয়াজিদ এসছে ওদের দেড়বছরের বাচ্চা রুহিকে কে নি।মাইশা, আয়ান এসছে চার বছরের ছেলে মিশান কে নি।তিন্নি কবির এসছে ওদের আড়াই বছরের ছেলে তুরাগ কে নি।বাড়ি ভর্তি মানুষ।বেশ বড়সড় করে অনুষ্ঠান হচ্ছে। সেটাও রাহান আর সারা’র বউভাত এর অনুষ্ঠান।রাহান তখন বউয়ের জন্য কিছু না করতে পারলে সামর্থ্য হওয়ার পর ঠিকই করছে।ভালোবাসা যেনো দুজনের মাঝে এক রত্তির কমে নি।বরং বেড়েছে।আজ্জম মির্জা এখন এসব দেখে এখন শান্তি পায়।ছেলের উপর গর্ববোধ হয় বোনের জন্য ছেলে তার একদম পারফেক্ট পাত্র চুজ করেছে। মাঝখানে তিনি কি বাগাড় টাই না দিয়েছিলেন।
প্রিয়তা নিচে একটা ঘরে থাকে এখন।সিঁড়ি বেয়ে উপর ওঠানামা করতে কষ্ট হয় বিধায় সাদনান প্রিয়তার যখন ছয় মাস চলে তক্ষুণি নিচে বাবা মায়ের পাশের রুমে সিফট করেছে। প্রিয়তার এতে অবশ্য সুবিধা হয়েছে।
এই যেমন রুমে বসে এখান থেকে পুরো লিভিং রুম দেখতে পাচ্ছে।সালেহা বেগম বলে গিয়েছে একটু পর এসে ওকে শাড়ী পড়িয়ে দিবে।
তাই বসে বসে অপেক্ষা করছে।
প্রিয়তা অনেক্ক্ষণ হয় বসে আছে। শরীর কেমন অস্থির লাগছে।তাই শোয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতেই রুমে হন্তদন্ত হয়ে রোজিনা বেগম প্রবেশ করলো।
হাতের শাড়ী প্রিয়তার দিকে এক পলক তাকিয়ে শাড়ির ভাঁজ খুলতে খুলতে ব্যস্ত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“তুই কষ্ট করে একটু দাঁড়িয়ে পর প্রিয়।
তোর শাশুড়ী ভীষণ ব্যস্ত।তাই আমি এলাম।”

প্রিয়তা মৃদু হাসলো।পেটে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু সেসব পাত্তা দিলো না।
রোজিনা বেগম এর কাছ থেকে শাড়ির সব প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো।টুইন বেবি হওয়ায় পেট টা একটু বেশি বড়ো।তাই চলাফেরা করতে যথেষ্ট কষ্ট হয়।
প্রিয়তা ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলে রোজিনা বেগম শাড়ী পড়িয়ে দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যাচ্ছিল।কিন্তু হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পেছনে ফিরে দেখতে পেলো প্রিয়তা ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে আর নিচে একটা কিছু পড়ে আছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে প্রিয়তা ঠিক নেই।হয়তো পরে যাচ্ছিল চেয়ার ধরে নিজে কে সামলে নিয়েছে।রোজিনা বেগম আঁতকে উঠলেন।বুকের ভেতর ভয় এসে হানা দিলো। কিছু টা দৌড়ে গিয়ে প্রিয়তা কে ধরলো।বিছানায় নিয়ে বসাতে বসাতে বিচলিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

-“কি হয়েছে?
শরীর খারাপ লাগছে?”

প্রিয়তা কোনো জবাব দিতে পারলো না।শরীর ঘামছে কেমন অস্থির অস্থির করছে। রোজিনা বেগম তৎক্ষনাৎ জোরে জোরে সবাই কে ডাকতে লাগলো।প্রিয়তা বারকয়েক জোরে জোরে শ্বাস টেনে হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলল,

-“পেটে ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ।
সকাল থেকে,,,

আর কিছু বলতে পারে না। চুপ করে ঠোঁট কামড়ে ধরে চুপ করে গেলো।সবাই ততক্ষণে এসে ভীড় জমিয়েছে।কোনো পুরুষ রুমে এলো না।সালেহা বেগম সুফিয়া বেগম সহ কাজের লোকের সাহায্যে প্রিয়তা কে গাড়ি পর্যন্ত নেওয়া হলো।এতোক্ষণ রমরমা করা পরিবেশ কেমন থমথমে হয়ে গেলো।

———

এয়ারপোর্টে থেকে বেরিয়ে সাদনান নিজের জন্য বরাদ্দকৃত গাড়িতে বসে গেলো।আজ পাঁচ দিন এক রাতেও ঠিকঠাক ঘুমোতে পারে নি।পাঁচ দিন পাঁচ বছর মতন হয়েছে।সময় যেনো পাড় হচ্ছিল না।এতো দীর্ঘ সময় সে কখনো বউয়ের এমন অবস্থায় বউয়ের থেকে দূরে সে কিছুতেই থাকতো না।শুধু জরুরি প্রয়োজন বিধায় থাকতে বাধ্য হয়েছে। যদিও প্রয়োজন টা নিজেরই।প্রাক্তন এমপি যে নিজে সুইসাইড করেছে আর খারাপ ছিল তার কিছু প্রমাণ এখান থেকে সংগ্রহ করেছে সে সেইজন্য এখানে থাকতে হয়েছে।কোটে যে কেসটা চলছে তার লাস্ট শুনানিতে এই প্রমাণ গুলো প্রয়োজন।সাদনান জানে এই প্রমাণ গুলো কোটে একবার পেশ করতে পারলে খেল খতম।গাড়ি চলছে মির্জা বাড়ির উদ্দেশ্যে।সাদনান চোখ বন্ধ করে গাড়িতে বসে ছিল।চোখে ঘুম প্রচুর। বাড়িতে গিয়ে বউ কে জড়িয়ে ধরে লম্বা একটা ঘুম দিতে হবে।নয়তো মনের মধ্যে যে বউ কে এতো দিন ছুঁতে না পারার তৃষ্ণা কিছুতেই মিটবে না।
সাদনানের চোখবুঁজে থাকা অবস্থায় পাশের সিটে ফোন টা সশব্দে বেজে উঠল। সাদনানের পার্সোনাল এসিস্ট্যান্ট সাদনানের দিকে একবার সামনের সিট হতে মাথা ঘুরিয়ে পেছন ফিরে তাকালো।সাদনান চোখ খুলে দেখলো সেদিকে একবার। পরপরই ফোন টা হাতে নিয়ে দেখলো রাহান কল করেছে।
সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। আধঘন্টা আগে এয়ারপোর্ট হতে বেরিয়ে কথা বলেছে ওর সাথে।
আবার কেনো ফোন করেছে বুঝতে পারলো না। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ পরিমাণ কুঁচকে ফোন টা রিসিভ করে কানে তুলে কিছু বলার আগেই রাহান ওপাশ থেকে চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“আমরা উপজেলায় চলে এসছি ভাবি কে নিয়ে।
তুই আসব,,,

রাহানের পুরো কথা শুনলো না সাদনান।কিছু মাথায় এলো না। শুধু ভাবলো বউ ঠিক আছে তো?এতোক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকা পুরুষ টার মুখ কেমন চিন্তিত দেখাচ্ছে।গাড়িতে এসি তারপরও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামে চিকচিক করছে। কোনো রকম ঠোঁট জোড়া নেড়ে রাহান কে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে নিজেই জিজ্ঞেস করলো,

-“এখন কোথায় ও?
ঠিক আছে?”

-“ওটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
মনে হচ্ছে স,,,

-“ফোন টা ওটিতে দিয়ে আয়।”

-“কিন্তু?,,

-“চুপ।
আমি যা বলছি তা কর।
পনেরো মিনিট এর মধ্যে আমি হসপিটাল পৌঁছাচ্ছি।”

রাহান সাদনানের এক ধমকে চুপ হয়ে গেলো। ডক্টর তাসলিমা রাউন্ড শেষ হয়েছে ওটিত যাচ্ছিল।রাহান ওনাকে ডেকে সাদনানের কথা জানালো।ডক্টর তাসলিমা বারণ করলো না।একজন আয়ার হাতে ফোন টা ভিডিও কলে দিয়ে বাহিরে দাঁড়িয়ে রইলো রাহান।সবাই দাঁড়িয়ে আছে সেখানে। আর মন্ত্রী সাদনান এর পাগলামির খবরও পেয়ে গেলো।

-“জানে মেরে দেবো।
এভাবেই থাকবে ফোন।
জান, জান আমি আছি তো।ভয়ে পাওয়ার কিচ্ছু নেই।”

সাদনানের বাজখাঁই কণ্ঠে সবাই চুপসে গেলো।মনে হচ্ছে গাড়িতে নয়।সে হসপিটাল রয়েছে।আর এক্ষুণি হাতের নাগালে পেলে সবাই কে চিবিয়ে খেতো।।চোয়াল শক্ত। কিন্তু অস্থির। একটু পরপরই বউ কে এটাসেটা বলে যাচ্ছে লাগাতার।আর হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ হচ্ছে একজন এনেস্থিসিয়া। তিনি সাদনান কে ঠিক চিনতে পারে নি। আর সেইজন্য রোগী কে অজ্ঞান হওয়ার ইনজেকশন দেওয়ার পর তিনি কল কাটার কথা বলেছেন। এতেই সাদনান রেগে বোম।আয়া ফোন সেভাবেই ধরে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ডক্টর তাসলিমা আর কিছু বলতে পারলো না।প্রিয়তা ব্যথায় ছটফট করছে।সাদনানের কথায় কাতর কণ্ঠে বলল,

-“প্লিজ আপনি শান্ত হোন।
আর কল টা রাখুন।”

সাদনান প্রিয়তার কথা পাত্তা দেয় না। ডক্টর তাসলিমা কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,

-“ওর যেনো কিচ্ছু না হয়।
আই সোয়ার ওর কিছু হলে হসপিটাল আমি চায়ের দোকান বানিয়ে দেবো।”

হুমকি টা ছিল বড়োই অদ্ভুত।হয়তো পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এতোক্ষণে এখানে হাসির বন্যা বয়ে যেতো।কিন্তু পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ায় এই হুমকি টা সবার কাছে ভয়ংকর মনে হলো।এরমধ্যে বাইরে কিছু টা শোরগোল এর আওয়াজ শোনা গেলো।প্রিয়তা নিবুনিবু চোখে একবার মাথা টা কাত করে আয়ার হাতের ফোন টার দিকে তাকালো। ওই তো সফেদা রঙের পাঞ্জাবি গায়ে উষ্কখুষ্ক চুলসহ অস্থির আর চিন্তিত মানুষ টা নজরে এলো।হসপিটাল পৌঁছে গেছে। এই মূহুর্তে ওটির বাহিরে অবস্থান করছে। প্রিয়তার ব্যথিত শরীর না চাইতেও ঠোঁটের কোণায় হাসি খেলে গেলো।আর সেই সাথে চোখ জোড়াও বন্ধ হয়ে এলো।

#চলবে…

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৭
#জান্নাত_সুলতানা

সাদনান বসে আছে বউয়ের পাশে একটা টুলে।অনেক্ক্ষণ হয় প্রিয়তা কে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে জানিয়েছেন ডক্টর তবে সন্ধ্যার আগেই ফিরতে পারে এরকম টাও আশ্বাস দিয়েছে।শরীর বেশ দুর্বল।রক্ত দিতে হয়েছে দুই বেগ।রক্ত লাগবে সেটা ডক্টর আগে থেকেই জানিয়ে রেখেছিল। সেইজন্য কোনো ঝামেলা হয় নি।এক ব্যাগ আয়ান দিয়েছে আয়না নিজেও দিতে চেয়েছিল কিন্তু আয়নার শরীর এর কন্ডিশন ভালো নয়।কয়েকমাস আগেই একটা বাচ্চা নষ্ট হয়ে গিয়েছে যার জন্য আয়নার অবস্থা তখন খারাপ ছিল।তিন ব্যাগ রক্ত লেগেছিল। এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি তাই রক্ত দিতে চাইলে কেউ রাজি হয় নি।কবির এর থেকে নিয়েছে আরো এক ব্যাগ।যদিও কবির কে কেউ বলি নি। কবির নিজ ইচ্ছে দিয়েছে।যতোই হোন প্রথম অনুভূতি। কোনো দিন কোনো মেয়ের আশেপাশে ঘেঁষে নি।মা ছিল না বিধায় বাবা কে বেশ মানতো।বাবার কষ্ট হবে এমন কিছু কবির কখনো করতে চায় নি।যখন প্রিয়তার সাথে বিয়ের কথা হলো তাই কবির কোনোরূপ ভাবনা চিন্তা করলো না।বাবার উপর বরাবরই বিশ্বাস সাথে সম্মান করতো বাবার সব ডিসিশন কে।তাই বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন সময় কবিরের প্রিয়তার প্রতি একটা অনুভূতি ছিল।যদিও কবির প্রিয়তা কে দেখে নি।তবে সব জল্পনা কল্পনা প্রিয়তা কে ঘিরেই শুরু হয়েছিল। কিন্তু এখন সেসব কিছুই নেই।এখন সব বউয়ের আর নিজের একমাত্র ছেলে তুরাগ এর জন্য।
সন্ধ্যায় প্রায় হয়ে এসছে।
হসপিটালে সাদনান ছাড়াও প্রিয়তার মা সাদনানের মা আর আয়ান রয়েছে। আর বাকিরা সবাই বেবি দেখে চলে গিয়েছে। বাড়িতে এতো বড়ো একটা অনুষ্ঠান তাই ওখানে থাকাটাও জরুরি। কিন্তু সবাই রাতে আসবে জানিয়েছে। কিন্তু সাদনান বারণ করছে। বউ সে সকালেই বাড়ি নিয়ে যাবে।কিন্তু ডক্টর তাসলিমা বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তিন দিন থেকে যাওয়ার কথা বলেছে। নয়তো সমস্যা হতে পারে।তাছাড়া মেয়ে বাবু টা ভূপৃষ্ঠ হওয়ার পর কান্না করে নি।অবস্থা খারাপ দেখে মেয়ে বাবু টা কে চব্বিশ ঘণ্টা অবজারভেশনে রাখতে হবে। সাদনান সেই থেকে রেগে আছে। কিন্তু সব দিক ভেবে তিন দিন থেকে যাওয়ার জন্য রাজি হয়েছে। তারজন্য আলাদা কেবিন বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু সে ওই কেবিনের আশেপাশে যায় নি। বউ কে কেবিনে দেওয়ার পর সেই যে এখানে এসে বসে এখনো এখানেই বসে আছে।
সালেহা বেগম আর মিতা সওদাগর ওই কেবিনে রয়েছে বর্তমানে।আর ছেলে বাবুটা ওনাদের সাথে রয়েছে।মেয়ে বাবুটা কে কাল সকালে মায়ের সাথে দেওয়া হবে।
সাদনান এসবই ভাবছিল।কিন্তু হঠাৎ শুনতে পেলো কেবিনে কেউ নক করছে।
সাদনান গম্ভীর কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

-“কে?”

সালেহা বেগম দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো। সাদনান মা কে দেখে চিন্তিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

-“বাবু কোথায়?
ঠিক আছে ও?”

-“হ্যাঁ ঠিক আছে।
মনে হয় পেটের ক্ষুধায় কান্না করছে কিন্তু ওর তো এখন জ্ঞান ফিরে নি।”

সাদনান প্রিয়তার দিকে তাকালো। সালেহা বেগম ক্লান্তিতে নুইয়ে থাকা ছেলের দিকে তাকিয়ে মলিন হয় মুখ।সফেদা রঙের পাঞ্জাবি টা কুঁচকে আছে। সব সময় ফিটফাট পরিপাটি হয়ে থাকা ছেলে তার আজ কত এলোমেলো। ছেলে-মেয়েদের চিন্তা বউয়ের চিন্তায় অস্থির। এখনো যেনো তা ঠিক হয় নি।অবশ্য বউয়ের জ্ঞান ফিরলে ছেলে ওনার একদম ফিট হয়ে যাবে তা তিনি নিশ্চিত।তিনি কিছু টা এগিয়ে এসে বলল,

-“আব্বা তুমি গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বাবু’র কাছে বসো।আমি এখানে আছি।”

সাদনান মায়ের দিকে একবার তাকালো।টানা সতেরো ঘন্টা শরীরে একটা পোষাক জড়ানো। নাওয়াখাওয়া পর্যন্ত কিছুই সে করে নি।শরীর কেমন মেজমেজ করছে। তাই ইচ্ছে না থাকা শর্তেও বাধ্য হয়ে সালেহা বেগম এর জোড়াজুড়িতে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।সাদনানের এসিস্ট্যান্ট আগে থেকে সব ব্যবস্থা করে রেখে ছিল সাদনান কোনো রকম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে ছেলের কাছে এলো।বাবু টা তখন ঠোঁট উলটে একটু পরপরই পেটের ক্ষুধায় কান্না করছে। মিতা সওদাগর কোলে নিয়ে রেখেছ।সাদনান বেরিয়ে এসে ছেলে কে দেখলো।কিছু সময় নীরব থেকে মিতা সওদাগর কে উদ্দেশ্য করে বলল,

-“মা আপনি কিছু খেয়ে রেস্ট করুন।
আমি ওকে ওর মায়ের কাছে নিয়ে যাচ্ছি।”

মিতা সওদাগর কিছু বলতে গিয়েও বলে না।
সেই বেলা বারোটা বাজে এসছে। মাঝে শুধু পানি খেয়েছে।সুযোগ যে ছিল না খাওয়ার জন্য তেমন নয়।আসলে খাবার খাওয়ার মতো মনের অবস্থা ছিল না।যদিও এখনো নেই মেয়ে টার এখনো জ্ঞান ফিরে নি।তবে ভাবলেন ফ্রেশ হয়ে মেয়ের কাছে যাবে। সাদনান ছেলে কে নিজের কোলে নিলো।মিতা সওদাগর অবশ্য বারণ করলো কিন্তু সাদনান পারবে বলে আশ্বাস দিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে এলো।আয়ান তখন কেবিনে ঢুকতেই যাচ্ছিল।কিন্তু সাদনান কে বেরিয়ে আসতে দেখে এগিয়ে এসে বলল,

-“তুই কিছু খেয়ে নিলে ভালো হতো না!”

-“এখন না।”

ছেলের গায়ে বেবিটাওয়াল টা ভালো করে জড়িয়ে নিতে নিতে কথা টা বলেই সাদনান পাশের কেবিনে ঢুকে গেলো।
আয়ান তাকিয়ে রইলো সেদিকে।বোন কে সে ভীষণ ভালোবাসে।সব সময় চাইতো বোনের জীবনে এমন কেউ আসুক যাতে করে তাদের থেকেও বেশি ভালোবাসে তার বোন কে।সত্যি এসছে।

——-

সাদনান ছেলে কে নিয়ে বসে আছে। সালেহা বেগম একটু আগে পাশের কেবিনে গিয়েছে।প্রিয়তার জ্ঞান ফিরেছে।মিনিট পাঁচ এক হবে। ডক্টর চেক-আপ করে বলেছে গরম খাবার খাইয়ে তারপর বেবি কে ফিডিং করাতে।মিতা সওদাগর মেয়ে কে ফ্রেশ করিয়ে খাবার খাইয়ে বেশ কিছুক্ষণ পর চলে গেলো।
সাদনান পুরো টা সময় ছেলে কে কোলে নিয়ে হাঁটা হাঁটি করলো কিছুক্ষণ সময় আবার দূরে সোফায় বসে গম্ভীর হয়ে বসে রইলো।কিন্তু শাশুড়ী যাওয়ার সাথে সাথে বউয়ের পাশে এসে ছেলে কে শুইয়ে দিয়ে নিজে আগে বউয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ দিলো।
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করতেই বা চোখ দিয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো।ফুঁপিয়ে বলে উঠলো,

-“আমার মেয়ে!”

সাদনানের বুকের ভেতর ধক ধক করতে লাগলো। মেয়ের জন্য সে নিজেও পাগল প্রায়। কত শখ ছিল মেয়ে আসার পরপরই সে আগে মেয়ে কে কোলে নিবে।আদর করবে। নিজের দুই টা অস্তিত্ব দুই টা প্রাণ একসাথে ছুঁয়ে দেখবে।কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। কিন্তু নিজের ভেতর চলতে থাকা তীব্র যন্ত্রণা চেপে রেখে বউয়ের কপালে ফের ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরে নিলো।মাথায় পরপরই কয়েকবার অধর স্পর্শ করে মোলায়েম কণ্ঠে জানালো,

-“আছে জান।
সকালে আমরা ওকে আমাদের কাছে নিয়ে আসবো।”

-“কেনো এমন হলো!
ওর কষ্ট হচ্ছে।”

সাদনান প্রিয়তা কে ছেড়ে দিয়ে ছেলে কে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

-“কখন থেকে কান্না করছে।”

প্রিয়তা বসে থেকে ছেলে কে কোলে নিতে চাইলো।কিন্তু সাদনান দিলো না। নিজের হাতের ভাঁজে রেখে এগিয়ে দিয়ে বলল,

-“তুমি মাথায় ধরো শুধু।
কোলে নিলে ব্যাথা পাবে।”

প্রিয়তা লজ্জা পাচ্ছে। চোখ ঘুরালো এলোমেলো। মিনমিন করে বলল,

-“মাকে ডেকে দিন না।”

-“কেনো?”

সোজাসাপটা প্রশ্নে প্রিয়তা অপ্রস্তুত হলো। সাদনান বুঝতে পারলো বউ তার লজ্জা পাচ্ছে।তাই মুখ গম্ভীর ভাব রেখেই ফের শুধালো,

-“মা হয়তো রেস্ট করছে।
তুমি একা পারবে না।
আমি সাহায্য করছি।”

সত্যি প্রিয়তা একা পারবে না।তাই বাধ্য হয়ে সাদনানের হাতে রেখেই বাবু কে ফিডিং করালো।চোখ বন্ধ করেই বাবু টা কিছু সময় ব্যবধানে ঘুমিয়ে গেলো।
সাদনান ছেলে কে পাশের দোলনায় শুইয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে এসে বউয়ের পাশে শুয়ে পড়লো।এক হাত আলগোছে বউ কে জড়িয়ে রাখে তবে বউয়ের যেন অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখলো।
বেড টা যথেষ্ট বড়ো। কিন্তু প্রিয়তা নড়াচড়া করে সরতে পারছে না। সাদনান জড়িয়ে রেখেছে বিধায়।
সাদনান চোখ বন্ধ করেই বউয়ের নড়াচড়া টের পেয়ে চোখ বন্ধরত অবস্থায় বলে উঠলো,

-“উম,জান নড়ে না।ভীষণ ক্লান্ত আমি।
একটু ঘুমোতে দাও।অনেক দিন হয় শান্তিতে একটু ঘুমোতে পারি না।”

#চলবে….

আমার তুমি ২ পর্ব-৩৪+৩৫

0

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৪
#জান্নাত_সুলতানা

[পর্ব টা একটু রোমান্টিক, পড়তে না চাইলে স্কিপ করতে পারেন।]

ভালোবাসা সত্যি অদ্ভুত।ভালো সবাই বাসলেও পূর্ণতা ক’জন দিতে পারে?একদম শেষ পর্যন্ত লড়াই করে নিজের ভালোবাসা কে ক’জন নিজের করার সবরকম চেষ্টা করতে পারে?হয়তো সবাই পারে না। আবার অনেকই পারে। তাদের মধ্যে রাহান একজন শতশত বাঁধা অতিক্রম করে জীবনের সাথে অনেক টা যুদ্ধ করে সে নিজের ভালোবাসার মানুষ টাকে আজ নিজের করে পেয়েছে।
আজ নিজে কে পূর্ণ মনে হচ্ছে। বুকের বা পাশের রমণী টা আজ তার ঘরে একই সাথে বসে আছে।এখন আর কোনো ভয় নেই।কেউ দেখা ফেলবে এমন কোনো আতংক নেই।সারা বিয়ের সাজ ছেড়েছে ফটো তোলার পরপরই।গায়ে এখন ফিনফিনে পাতলা সাদা মাঝে মিষ্টি কালার সংমিশ্রণে একটা শাড়ী। কোমড় সমান চুল গুলো ছেড়ে দেওয়া অধরে লাল টকটকে লিপস্টিক মাখা।চোখে গুলো সুন্দর করে সাজানো।চুল থেকে মাতাল করা এক স্মেল আসছে। রাহান চোখ বন্ধ করে নাক ঘষে ঘাড়ে।চুলের ভাঁজে নাক নিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নেশাময় কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

-“কি করবো?
পাগল হয়ে যাচ্ছি।”

সারা’র নিজেও চোখ বন্ধ করে ছিল।হঠাৎ রাহানের কথা শুনে চোখ খুলে নিলো।শরীর জুড়ে প্রথম বারের ন্যায় কোনো পুরুষের এতো টা সন্নিকটে এসে অবস্থা নাজুক। সরে বসার চেষ্টা করে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও করে। তবে কোনো টাতেই সফল হয় না।রাহান চেপে ধরে নিজের সাথে বসে আছে। সারা কিছু টা মজার ছলে বলে উঠলো,

-“এখন বললেন পাগল হয়ে যাচ্ছেন! তো দূরে থাকুন।”

-“এই মেয়ে একদম হেয়ালি করবে না।
আই ওয়ান্ট ইউ ইমমেডিয়েটলি।অল বাই ইউর সেল্ফ।”

সারা কিছু বলার আগেই রাহান সারা কে ঝট করে কোলে তুলে নিলো।সারা দুই হাত এগিয়ে গলা জড়িয়ে ধরলো রাহানের। রাহান বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো,

-“অনেক সাধনার ফল তুমি সুন্দরী।
যা এতো দিন দেখার সাধ্য থাকলে ছুঁয়ে দেখার উপায় ছিল না।আজ থেকে রোজ ছুঁয়ে দেখা যাবে।”

সারা কে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে রাহান একটা রিং সারা’র হাতে পড়িয়ে দিলো।
সারা’র হাতের উলটো পিঠে চুমু খেয়ে বলে উঠলো,

-“আই ওয়ান্ট ইউ অল টু মাইসেল্ফ।
ক্যান আই?”

-“ইয়েস।”

ইশ রাহান বুঝি আর দেরী করে বউয়ের অধর চেপে ধরে ঝটপট।
অতঃপর দুই ভালোবাসার মানুষের ভালোবাসা উজাড় করে একে-অপরকে ভালোবাসতে মত্ত হলো।রাত যত গভীর হলো দু’টো মানুষের নিঃশ্বাসের শব্দ ঠিক ততটাই ভারী হলো।

—-

কবির গাড়ি থেকে নামলো আগে। ঘুরে গিয়ে ওপাশের দরজা খুলে বউ কে গাড়ি থেকে ধরে নামালো।ড্রাইভার দৌড়ে এলো।কবির নিজের হাতের চাবি ড্রাইভার কে দিয়ে গাড়ি গ্যারেজে রাখতে বলে এগিয়ে এসে কলিং বেল চাপলো।কালাম খান সদর দরজা খুলে ছেলে বউ কে দেখে অবাক হলো।
বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,

-“সন্ধ্যায় এলেমা আমি।
তখন তো বলো নি আসবে?”

-“ওর না-কি ভালো লাগছে না।
তোমার জন্য মন কেমন করছে।তাই এই রাতবিরেত চলে এসছি।”

-“সবাই আসতে দিলো?”

-“অনেক বুঝিয়ে সুজিয়ে রাজি করিয়েছে তিন্নি।”

কালাম খান আর কিছু বলল না।তিন্নি কে ধরে নিয়ে বাড়ির ভেতর এলো।তিন্নি লম্বা শ্বাস নিলো।অনেক দিন পর নিজের ঠিকানায় এসে মনের মধ্যে আলাদা একটা শান্তি লাগছে।
ভাবতেই মন ভালো হয়ে যা নিজের একটা ঠিকানা হয়েছে।একটা বাড়ি আছে। পরিবার হয়েছে। দিনশেষে মানুষ গুলো তাকে ভালোবাসে।

—–

মির্জা বাড়ির যেনো আনন্দের শেষ নেই।প্রিয়তা কনসিভ করেছে কথা টা সবাই জানা মাত্র হইহই পরে গেলো।সওদাগর বাড়ির সবাই মির্জা রয়েছে। তারা সবাই বেশ খুশি।তাদের আদরের ছোট প্রাণ টা মা হবে। শফিক সওদাগর মেয়ের মুখপানে তাকিয়ে থাকে।মিতা সওদাগর স্বামীর পাশে দাঁড়িয়ে নিচু স্বরে বলল উঠলো,

-“আমার মেয়ে টা এভাবে যেনো সব সময় সুখী থাকে।”

প্রিয়তা আম্বিয়া মির্জার পাশে বসে আছে। সাদনান একটু দূরে সিঁড়ির কাছে রেলিঙে হেলান দিয়ে ট্রাউজার এর পকেটে দুই হাত রেখে লিভিং রুম পর্যবেক্ষণ করছে।রাত অনেক টাই হয়েছে। খাবার খাওয়া শেষ।কিন্তু আড্ডা যেনো আজ শেষ হওয়ার নাম-ই নিচ্ছে না।সাদনান মনে মনে সবার উপর বিরক্ত হলো।
প্রিয়তা রাতের খাবার টা ঠিকঠাক খেতে পারে নি। সুফিয়া বেগম দুধের গ্লাস হাতে প্রিয়তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সাদনান মায়ের দিকে একপলক তাকলো।সুফিয়া বেগম ছেলের দিকে তাকিয়ে প্রিয়তা কে বলল,

-“এখন রুমে যা।
রেস্ট কর গিয়ে। আর হ্যাঁ এটা নিয়ে যা।শোয়ার আগে খেয়ে নিবি।”

প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে তাকালো শাশুড়ীর দিকে। আয়ান বোনের দৃষ্টি বুঝতে পেরে গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। আগে না খেলেও এখন থেকে খেতে হবে।”

সবার জোরাজুরিতে প্রিয়তা দুধের গ্লাস নিয়ে রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলো।
সাদনান আগেই রুমে চলে এসছে। প্রিয়তা রুমে এসে দুধের গ্লাস সেন্টার টেবিলের উপর রেখে কাবাড থেকে রাতের পোষাক নিয়ে ওয়াশ রুম গেলো।সাদনান পুরো টা সময় সোফায় বসে বউয়ের সব কার্যকলাপ অবলোকন করে।অতঃপর বেরিয়ে আসে রুম হতে।লিভিং রুমের সবাই তখন যার যার রুমে চলে গিয়েছে। কিচেনে শুধু একজন কাজের লোক সব গুছিয়ে রাখছিল।সাদনান কে কিচেনে দেখা মাত্র তিনি বলে উঠলো,

-“ছোট সাহেব কিছু লাগবো?
আমারে কন।আম,,,

-“না খালা।
আপনি যান।আমি নিজে পারবো।”

সাদনানের আদেশ পেয়ে তিনি বিনাবাক্য রান্না ঘর ত্যাগ করে। সাদনান আগে একটা ক্যাবিনেট খুলে সেখান থেকে একটা স্যুপ এর প্যাকেট বের করে।
সেটা রান্না করে একটা বড়ো কাপে নিয়ে রুমে আসার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই নজরে পরে প্রিয়তা গায়ে একটা মোটা ওড়না পেঁচিয়ে রান্না ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে সাদনান এর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,

-“আমি জানি আপনি এসব আমাকে গিলানোর জন্য করেছেন।
কিন্তু এই মূহুর্তে কিচ্ছু খাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”

প্রিয়তার থমথমে কণ্ঠ শুনে সাদনান হেঁসে দিলো।অতঃপর এক হাতে প্রিয়তার বাহু টেনে ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

-“কিন্তু খেতে হবে।
ইউ নো না!না আমার একদম পছন্দ নয়।”

প্রিয়তা কিছু বলতে পারে না।
সাদনান রুমে এনে বউ কে বিছানায় বসিয়ে নিজেও পাশে বসলো।প্রায় অর্ধেক টা স্যুপ খাইয়ে দিলো।প্রিয়তা নাকমুখ কোঁচকালো।তবে ভালো লাগলো আবার পেটেও ক্ষুধা তাই খেয়ে নিলো।সাদনান স্যুপরে বাটি রেখে দুধের গ্লাস সামনে ধরলো।প্রিয়তা মুখ ভোঁতা করে গ্লাস হাতে ঢকঢক করে অর্ধেক গ্লাস খালি করে দিলো।পরপরই মুখ হতে গ্লাস সরিয়ে ওয়াক করে সব সামনে দাঁড়ানো সাদনানের উপর ঢেলে দিলো।সাদনান চোখ ছোট ছোট করে বউয়ের দিকে তাকালো।
প্রিয়তার মুখ ভয়ে ফাটা বেলুনের ন্যায় চুপসে গিয়েছে। সাদনানের হাসি পেলো।তবে হাসলো না। এখন হাসলে বউ তার আহ্লাদে গদগদ হয়ে যাবে। আর খাবে না সে জানে।তাই হাসি টুপ করে গিলে নিলো। থমথমে কণ্ঠে কাবাড এর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে আদেশের স্বরে বলল,

-“পুরো টা শেষ করো।
আমি ফ্রেশ হয়ে এসে যেনো গ্লাস খালি দেখি।
আর খবরদার ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করবে না।”

প্রিয়তা সাদনানের কথায় থমথমে খেলো।কি ভয়ংকর মানুষ।মনের কথা বুঝে যায়।
সাদনান ওয়াশ রুমে চলে গেলে প্রিয়তা অনেক টা কষ্ট করে দুধ টা খেয়ে নিলো।ফেলে দেওয়ারও উপায় নেই। ওয়ার্নিং দিয়ে গিয়েছে।বাধ্য হয়ে খেতে হলো।
সাদনান ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে এলো পাঁচ সাত মিনিট এর মধ্যে। এসেই দেখলো বউ তার শুয়ে পড়েছে। সাদনান লাইট অফ করে নিজেও এসে প্রিয়তার পাশে শুয়ে পড়লো। প্রিয়তা সাদনানের বুকে মাথা রেখে।গেঞ্জির বোতাম খুলতে নিলেই সাদনান বাঁধা দিলো। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
ড্রিম লাইট এর স্বল্প আলোয়ে বউয়ের ভ্রু কুঁচকানো দেখে সাদনান প্রিয়তার কপালে অধর স্পর্শ করে মূদু কণ্ঠে বলল,

-“কাল ডক্টর এর কাছে যাব।
টেস্ট করবো।এখন আর কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছি না জান।”

-“কিচ্ছু হবে না।
আপনি বেশি বুঝেন।”

প্রিয়তা নিজেই সাদনান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। সাদনান বুঝি বউয়ের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারে!অগত্যা নিজেও বউয়ের পাগলামিতে সঙ্গ দিলো।

#চলবে…

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৫
#জান্নাত_সুলতানা

-“রাত আড়াই টা বাজে জান।
প্লিজ ঘুমিয়ে পড়ো।”

সাদনান বউয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল।কিন্তু প্রিয়তা কাঠকাঠ কণ্ঠে জবাব দিলো,

-“একদম না।
আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন কি-না বলেন?”

সাদনান এবার এগিয়ে এলো। প্রিয়তার আট মাসের ভরা পেটে এক হাত রেখে আরেক হাত প্রিয়তার গালে রাখে।রাত বাজে আড়াই টা।আর এই মেয়ে?
এই রাতে ছাঁদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে যাওয়ার জন্য সেই কখন থেকে তর্ক করে যাচ্ছে। সাদনান জানে বউ কে সে অনুমতি না দিলে বউ এক পা ও নাড়াবে না।কিন্তু জেদ দেখাচ্ছে।সাদনানের হাত প্রিয়তা ঝট করে সরিয়ে দিলো।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,

-“যাবেন না তাই তো?”

-“নো, নেভার।”

সাদনান থমথমে কণ্ঠে কথা টা বলেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। প্রিয়তা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সেদিকে। সাদনান মিনিট দশ মিনিট এর মধ্যে ফিরি এলো।হাতে পাস্তা একটা মিনি প্লেট।
প্রিয়তা তখন উলটো ঘুরে শুয়ে আছে। সাদনান এগিয়ে গেলো।বিছানায় ওঠে বসে বউ কে খুব সাবধানে টেনে তুলে।প্রিয়তা মোচড়ামুচড়ি করেও কোনো লাভ হয় না।বসে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো।সাদনান এক হাতে প্রিয়তার মুখ চেপে ধরে মুখের সামনে খাবার ধরতেই প্রিয়তা মুখ শক্ত করে রইলো।সাদনানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো।মেয়ে টা দিন কি দিন বেশি ঘাড়ত্যাড়া হচ্ছে। ইদানীং বেশি করে হয়তো প্রেগন্যান্সির জন্য। সাদনান রাগ গিলে নিলো।মুখ এগিয়ে বউয়ের কপালে ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিয়ে মৃদু স্বরে বলে উঠলো,

-“জান আমার।খেতে হবে। আমি জানি তোমার ক্ষুধা পেয়েছে।”

প্রিয়তা টলমল চোখে তাকালো সাদনানের দিকে। সত্যি ওর খিদে পেয়েছে। কিন্তু মন টা বলছে একবার বৃষ্টির পানি ছুঁয়ে দেখার জন্য।
প্রিয়তার মাথায় চট করে একটা বুদ্ধি এলো।
গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“আপনি জানেন?বাবু পেটে এলে মায়ের মন যা চায় তাই করতে হয়!”

-“অবশ্যই করার মতো হলে।
এমন বেহুদা আবদার এর কোনো মানে নেই।”

সাদনান প্রিয়তা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মুখে খাবার পুরে দিলো।প্রিয়তা মুখ ভোঁতা করে খাবার খেয়ে নিলো।এখন যত যাই করুক সাদনান যে খাবার পুরো টা শেষ না হওয়া পর্যন্ত দমে যাওয়ার পাত্র নেই।
খাবার শেষ সব গুছিয়ে রাখতে রাখতে তিনটার বেশি সময় বেজে গেলো।প্রিয়তা সহ সাদনান তাহাজ্জত পড়ে নিলো।সকালেও প্রিয়তা ঠিক আগে আগে ওঠে বসে থাকবে।সাথে সাদনান কেও নামাজ পড়তে টেনে তুলবে।
সাদনান ঝটপট জায়নামাজ গুছিয়ে কাবাডে তুলে রাখে।
বিছানায় এসে প্রিয়তা কে জড়িয়ে ধরে।প্রিয়তা নড়েচড়ে মিনমিন করে জানালো,

-“কাল তুরাগ আসবে।”

-“হয়েছে এখন চোখ বন্ধ করো।
আর হ্যাঁ মিশান এর সামনে তুরাগে কে জামাই ডেকো না।”

প্রিয়তা সাদনানের কথা শুনে শব্দ করে হাসতে লাগলো। সাদনান ভ্রু কুঁচকালো।
বউয়ের ঘাড়ে দাঁত চেপে ধরতেই প্রিয়তা ব্যথাতুর শব্দ করে বলে উঠলো,

-“আহ,ছাড়ুন।
আর হ্যাঁ তুরাগ কে তো রিধি আপু জামাই করবে বলেছে।
ওনার মেয়ের জামাই।তাই আমারও জামাই।”

বলেই আবার জোর করে হাসার চেষ্টা করলো।সাদনান হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।
রিধির মেয়ে রুহির মাত্র তিন মাস চলে। আর তুরাগ এর এক বছর এর বেশি সময়। আর এই মহিলারা?এখুনি কি সব অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। হায়।
সাদনান কথা বাড়ালো না।বউ কে চুপ করে ঘুমোতে বলে নিজেও চোখ বন্ধ করে।

—-

সকালে মির্জা বাড়ির সব পুরুষরা সকালে ব্রেকফাস্ট করে যে যার মতো করে কাজে গেলো।শুধু সাদনান গেলো না।অবশ্য সাদনান এখনো নিচেই আসে নি।আজ অনেক দিন হয় সে বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাহিরে পা রাখে না।এর কারণ সবাই জানে।বউয়ের জন্য এই পুরুষ সব করতে পারবে।সকালে প্রিয়তাও নিচে আসে নি। সাদনান এর মা সার্ভেন্ট দিয়ে রুমে ছেলে আর বউয়ের জন্য উপরে রুমে খাবার পাঠালো।
সাদনান তখন ফ্রেশ হয়ে মাত্র রুমে এসছে বউ তখনো ঘুমিয়ে আছে। সকালে নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। রাতে ঠিকঠাক ঘুমোতে পারে না।এপাশ-ওপাশ করে।সাদনানের তখন কি মায়া না হয় বউয়ের জন্য।
তবে কিছু করার নেই। কিন্তু সাদনান কিছু করার চেষ্টা করে। হাতের নিচে বালিশ দেয় পায়ের নিচে দিয়ে দেয়।একটু আরাম পেলে হাত পা ছড়িয়ে একটু ঘুমায়।যেমন এখন ঘুমোচ্ছে। কিন্তু খাবার খেতে হবে তাই ডেকে তুলে বউ কে।
প্রিয়তা ঢুলতে ঢুলতে ওঠে বসে। সাদনান মগে করে পানি আনে।মিনি টাওয়াল ভিজিয়ে বউয়ের হাত মুখ মুছিয়ে দেয়।সকালে অজু করার সময় ফ্রেশ হওয়ার ফলে এখন আর বেশি কিছু করতে হয় না।
প্রিয়তা কে খাইয়ে দিয়ে মাত্র সাদনান খেতে বসেছে তক্ষুণি দরজায় টোকা পড়ে। সাদনান ভ্রু কুঁচকালো। প্রিয়তা সেদিকে তাকিয়ে বলল,

-“আপনি বসুন আমি দেখ,,

-“একদম নড়বে না।
হাঁটার সময় তো পা ব্যথা করে কাজের সময় করে না?”

সাদনানের তীক্ষ্ণ কণ্ঠের বাক্য শুনে প্রিয়তা ঠাঁই বসে রয়।
সাদনান দরজা খুলতেই একজোড়া হাত সাদনান এর হাঁটু জড়িয়ে ধরলো।একটু হকচকিয়ে নিচে তাকিয়ে হাতের মালিক কে দেখে চমৎকার করে হাসলো।আগলে নিয়ে কোলে তুলে রুমে আসতে আসতে বলল,

-“বাহ।
সুপার আমার জামাই চলে এসছে।”

ছোট মিশান গোল গোল চোখে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তার দিকে।তিন বছর মাত্র খুব বেশি বড়ো নয়।প্রিয়তা খুশি হলো মিশান কে দেখে।
হাত বাড়িয়ে ডেকে বলল,

-“সোনা আব্বা।
এসো মনির কাছে।”

সাদনান এগিয়ে গিয়ে মিশান কে কোলে নিয়ে বসলো প্রিয়তার পাশে। মিশান মোচড়ামুচড়ি করে সাদনান এর কোল হতে নেমে বসলো।প্রিয়তা এক হাতে জড়িয়ে ধরে মিশান কে।
মিশান নিজের ছোট হাত টা প্রিয়তার ঢিলাঢালা জামার উপর দিয়ে পেটে রাখলো।চোখ পিটপিট করে বলে উঠলো,

-“তোট বাবাই বলেতে আমার বউ আতে এতানে।”

সাদনান বিস্ময় খেলো।প্রিয়তা চোখ বড়ো বড়ো তাকালো সাদনানের দিকে।সাদনান সহসাই চোর ধরে পরে যাওয়ার অবস্থা হলো।তবে চট করে বলে উঠলো,

-“বিশ্বাস করো জান।আমি এমন কিছু বলি নি।”

মিশান দু’জনের দিকে বারকয়েক তাকালো বুঝতে পারলো না ওরা কি বলছে।মিশান নিজেই আবার জিজ্ঞেস করলো,

-“তবে আতবে আমার বউ?”

প্রিয়তা সাদনান কে কিছু বলে না। মিশান কে জড়িয়ে ধরে মুচকি হেঁসে বলল,

-“ছোট মনির জন্য দো’আ করবে।
খুব দ্রুত যেনো তোমার বউ কে সুস্থ ভাবে নিয়ে আসতে পারি।”

মিশান হয়তো আরো কিছু জিগ্যেস করতো।কিন্তু সাদনান তড়িঘড়ি করে মিশান কে নিয়ে রুম হতে বেরিয়ে গেলো। বেচারা কখনো আবার কি বলে বউয়ের কাছে তারপর দেখা যাবে বউ বেলুনের ন্যায় ফুলে থাকবে।
নিচে এসে সাদনান সবার সাথে সাক্ষাৎ করলো।শুক্রবার আজ।কবির তিন্নি এসছে।মাইশাও এসছে। আয়ান আসে নি।তবে সন্ধ্যায় এসে বউ আর ছেলে কে নিয়ে ঠিক বাড়ি ফিরে যাবে।

——

প্রিয়তা গুটিশুটি মেরে শুয়ে আছে সাদনানের বুকে।সাদনান বউয়ের পেটের উপর নিজের একটা রেখে বসে আছে। অনেক সময় হয় এভাবে বসে আছে সাদনান।মূলত বউয়ের জন্য এভাবে বসে থাকা।দুদিনের এর জন্য একটা জরুরি প্রয়োজন বাহিরে যেতে হবে। সব মিলিয়ে চার দিন লাগবে।আর এই কথা প্রিয়তা যেই থেকে শুনেছে সেই থেকে এমন মুখ বন্ধ করে বসে আছে।
এই সাপ্তাহে এর মধ্যে প্রিয়তার ডেলিভারি ডেইট।সেইজন্য মেয়ে টা আরো ভয়ে আছে।কিন্তু বাহিরে যাওয়া টাও ভীষণ জরুরি।যদিও সাদনান এ কয়েকমাসে সব কিছু থেকে নিজে কে সরিয়ে রেখেছিল।কিন্তু এটা থেকে পারে নি।উপর মহল থেকে নোটিশ এসছে।সাদনান চেষ্টা করেও কিছু করতে পারে নি।সময় গড়ালো। সন্ধ্যায় সাদনান এয়ারপোর্টে এর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।এখন বিকেলে।সাদনান এবার মুখ খুলল,

-“টাইম এর আগে চলে আসবো জান।”

প্রিয়তা তবুও টুঁশব্দ করে না। সাদনান নিজেও আর কিছু বলে না। সাদনান জানে এখন কিছু বলেও লাভ হবে না। সাদনান প্রিয়তা কে সরিয়ে ওঠে বসার চেষ্টা করতেই প্রিয়তা সাদনান কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,

-“একটু আদর করুন।
প্লিজ। যদি ফিরে এসে আর আমাকে না পান!”

সাদনান চমকে উঠলো।
বুকের ভেতর অজানা ভয় এসে হানা দিলো।শক্ত করে বউ কে জড়িয়ে ধরে অধর নেড়ে আওড়াল,

-“কিছু হবে না আমার জান।
ভয় কেনো পাচ্ছো তুমি আমি আছি তো।চলে আসবো দ্রুত। প্রমিস।”

সাদনান বউয়ের আবদার রাখলো।তবে মনে একটা খুঁতখুঁত থেকেই গেলো।কেনো জানি মন সায় দিচ্ছে না বউ কে ফেলে যেতে। কিন্তু যেতে হবে। পরিস্থিতি আমাদের মর্জি মতো চলে না আমাদের পরিস্থিতির মর্জি মতো চলতে হয়।

#চলবে….

আমার তুমি ২ পর্ব-৩২+৩৩

0

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩২
#জান্নাত_সুলতানা

প্রিয়তা রেডি হয়ে নিচে এলো।সাদনান অনেক আগেই রেডি হয়ে নিচে চলে এসছে।বর কনে একই বাড়ি থেকে বিয়ে হচ্ছে বিধায় হুলুস্থুল আয়োজন চলছে।যদিও সাদনান চেয়েছিল বোনের বিয়ে সে তাদের শহরের বাড়ি থেকে হোক।কিন্তু আম্বিয়া মির্জা আর জাফর মির্জা কোনো মতেই রাজি নয়।বাড়ি ভর্তি মানুষ গিজগিজ করছে। তবে এতো মানুষের ভীড়ে রাহানের বোন রিধি আসতে পারে নি। ওয়াজিদ কে সেখানের হসপিটাল থেকে কিছুতেই ছাড়াতে রাজি নয়।ওয়াজিদ বাধ্য হয়ে থাকতে রাজি হয়েছে।এখন সেখানে সেটেল্ড হওয়া ব্যতিত আর কোনো রাস্তা নেই।যদিও ওয়াজিদ এর মত আছে বলেই হসপিটাল কর্তৃপক্ষ রাখতে পেরেছে।তবে ব্যাপার টা ওয়াজিদ সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়েছে সে চাই ওখানে নিজের ছেলেমেয়ে লেখা পড়া করবে ভবিষ্যতে। বাংলাদেশে পড়াশোনার যা অবস্থা তাই ওখানে পড়াশোনা করার ব্যাপার টা বেশি গুরত্ব দিলো ওয়াজিদ। রিধি আর কিছু বলে নি।এটার অবশ্য একটা কারণ রয়েছে রিধি কনসিভ করেছে তিন মাস চলে।তাই এই অবস্থা ট্রাভেলিং করার টা ভালো হবে না।
রোজিনা বেগম কিছু টা মন খারাপ বড় মেয়ে রিধি।তারউপর মা হচ্ছে এখন তো মেয়ে ওনার কাছে থাকতো।সেখানে ছেলের বিয়েতেও মেয়ে আসতে পারছে না। তাই মনমরা হয়ে থাকছে। কোনো কাজেই যেনো হাত লাগছে না।

-“মনি!”

রোজিনা বেগম লিভিং রুমের পাশেই বারান্দায় বসে আছে। প্রিয়তা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ডেকে ওঠে।
রোজিনা বেগম কিছু টা হকচকিয়ে প্রিয়তার হাত টেনে সামনে আনলো।প্রিয়তা মুচকি হেঁসে ওনার পাশে বসে শাড়ীর আঁচল আঙ্গুলে পেঁচাতে পেঁচাত ঠোঁট উল্টে বলল,

-“আমি এখনো কিছু খাই নি।”

-“সে কি?
সাদনান কে যে খাবার দিয়ে বলেছিলাম তোকে খাইয়ে দিতে?”

-“ওনার না-কি কাজ আছে।
আমায় খেতে বলে চলে এসছে।”

-“আচ্ছা।
তুই বস।
আমি খাবার টা নিয়ে আসি।সারা টাও খায় নি।একটু পরেই হলুদ তারপর মেহেদী ওকেও খাইয়ে দিতে হবে। নয়তো মেয়ে টার আর খাওয়া হবে না। ”

রোজিনা বেগম কথা শেষ চলে গেলো। প্রিয়তা আয়েশ করে বসে বাহিরে তাকালো।সেখানে হলুদের জায়গায় সহ বিশাল বড় স্টেজ করা হয়েছে।সাদনান সেখানে পাশে বসে আছে। তার আশেপাশে কিছু গার্ড রয়েছে।মানুষ টা কোনো অনুষ্ঠান হলেই শুভ্র পাঞ্জাবি ছেড়ে কালো পাঞ্জাবি পড়ে।এতে আরো ভয়ংকর সুন্দর লাগে।প্রিয়তার পাশে এসেই রোজিনা বেগম সহ সারা বসতেই প্রিয়তা দৃষ্টি সরিয়ে নেয়।
রোজিনা বেগম দু’জন কে খাইয়ে দিলো টুকটাক কথা বলতে বলতে। খাওয়া শেষ এঁটো প্লেট হাতে ছুটলো রান্না ঘরে।

—–

তিন্নি একটা আরামদায়ক চেয়ারে বসে আছে।কবির তিন্নির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। তিন্নি কাঁচা হলুদ শাড়ী পড়ে অল্পস্বল্প তাজা ফুলের গহনা পড়েছে।মায়াবী দেখতে লাগছে। কবির বারংবারই বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে। তবে তিন্নির অল্পস্বল্প মন খারাপ সবাই কত আনন্দ করছে অথচ সে বসে আছে। অবশ্য সবাই আনন্দ করছে বললে ভুল হবে।মাইশা ছেলে কে একটু পরপরই কোলে নিতে হচ্ছে। আর প্রিয়তা আম্বিয়া মির্জার সাথে বসে আছে এটা আম্বিয়া মির্জার আদেশ।

সারা আর রাহান কে পাশাপাশি বসিয়ে হলুদ দেওয়া হচ্ছে।হলুদ সাজে সারা কে চমৎকার দেখতে লাগছে। আস্ত একটা তাজা ফুল বসে আছে যেনো।রাহান সারা’র মুখ দর্শন একবার করেছে আর তাকায় নি।যদিও কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলে?
তারচেয়ে বরং প্রেয়সী কে সে পরে সায়েস্তা করবে।সাদনান দূর থেকে বউ কে পর্যবেক্ষণ করে।হলুদ অনুষ্ঠান এর মধ্যে সারা কে মেহেদী লাগালো দু’জন মেহদি আর্টিস্ট।একে একে সবাই লাগালো।শুধু প্রিয়তা আম্বিয়া মির্জার সাথে বাড়ির ভেতর চলে গেলো। সাদনান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দাদি সহ বউয়ের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে।

—-

সারা একটু আগেই রুমে এসছে।হাতের মতো মেহেদী শুঁকিয়েছে।সেগুলো তুলে শাড়ী চেঞ্জ করে নরমাল পোশাক পড়ে নিলো।ফ্রেশ হয়ে ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে এসে।চুল গুলো আঁচড়ে নিলো।অবশ্য চুল গুলো আঁচড়াতে বেশ কসরত করে হলো।চুল আঁচড়ে লাইট অফ করে বিছানায় শোয়ার প্রস্তুতি নিতেই ব্যালকনিতে শব্দ হলো।মনে হলো ঠাশ করে কিছু পড়লো।সারা প্রথমে ভয়ে পেলো সেকেন্ড এর মতো সময় পর কিছু ভেবে চট করে বিছানা ছেড়ে এগিয়ে গেলো।দরজা খুলতেই রাহান সারা কে ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো।
সারা নিজেও পেছনে পেছনে আসতে আসতে কিছু টা চাপাস্বরে বলে উঠলো,

-“আল্লাহ!আপনি আবার আজ পাইপ বেয়ে উপর এসছেন?”

-“নাহ।
তোর বাপ আমায় বরণ করে তোর রুমে পাঠিয়েছে।
ইস্টুপিট।”

রাহান দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো। বিছানায় ততক্ষণে সটান হয়ে শুয়ে পড়েছে। সারা এসে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

-“হয়েছে।
আজ কেনো এতো উঁচু বেয়ে আসতে গেলেন?”

-“সেদিন ভালোবাসা দেখতে এসছি।আর আজ অধরসুধা প্রাণ করতে।”

বলে শোয়া থেকে ওঠে বসে রাহান।পরপরই সারা কে টেনে নিজের পাশে বসালো।সারা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাতেই রাহান নেশাময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে সারা’র দুই গালে হাত রেখে নিজের দিকে টেনে নিলো।সারা ভয়ে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে এক হাত রাহানের মুখ আলগোছে রেখে বাঁধা প্রদান করলো।
রাহান ভ্রু কুঁচকালো।
থমথমে কণ্ঠে আদেশ করলো,

-“হাত টা সরা।”

-“এতো বছর অপেক্ষা করলেন।
আর কিছু ঘন্টা মাত্র।”

-“প্লিজ বাঁধা দিস না।
রাত একটা বাজে।নিজের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করেই এখানে এসছি।ঘুম আসছে না।দিয়ে দে।জাস্ট টু মিনিটস্”

কি করুণ কণ্ঠে আবদার। সারা ফিরে দেয় কি করে? যেখানে ভালবাসার মানুষ সাথে রাত পোহালে মানুষ টাকে পবিত্র এক বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ নিজের করে পাবে।
হাত টা এগিয়ে রাহানের গলা জড়িয়ে ধরে।
রাহান সম্মতি পেয়ে সময় ব্যায় করলো না।মূহুর্তে মধ্যে সারা অধর নিজের অধরের মাঝে সন্ধি ঘটালো।

—–

-“মেহেদী কেনো লাগাও নি?”

-“সময় পাই নি।
দাদির সাথে ছিলাম।”

সাদনান কিছু না বলে আবার রুম হতে বেরিয়ে গেলো।প্রিয়তা বেশি কিছু না ভেবে শাড়ী চেঞ্জ করে রাতের পোষাক পড়ে ওয়াশ রুমে হতে বেরিয়ে এলো।এসেই সাদনান কে সোফায় মেহেদীর কোণ হাতে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিগ্যেস করলো,

-“আপনি এটা কেনো নিয়ে বসে আছেন?”

সাদনান কোনো জবাব দিলো না। প্রিয়তা বিছানার দিকে এগিয়ে যেতে নিলেই সাদনান পেছন থেকে গম্ভীর কণ্ঠে ডেকে বলল,

-“এদিকে এসো।
এসো!”

প্রিয়তা কিছু টা অবাক হয়ে এগিয়ে যেতেই সাদনান বউ কে টেনে পাশে বসিয়ে হাতে মেহেদী লাগাতে শুরু করে।
একদম আঁকাবাঁকা। তবে প্রিয়তার চোখে মনে হলো পৃথিবীতে এরচেয়ে সুন্দর করে কেউ আর মেহেদী আর্ট করতে পারবে না।হয়তো প্রিয় মানুষের এতোটুকু যত্ন অনেকটাই গভীর কোনো আঘাত কে ভুলিয়ে দিতে সক্ষম হবে।প্রিয়তা খুশিতে চোখ চিকচিক করে।সাদনান মেহেদী এমনভাবে দিয়েছে হাতের তালুতে ফাঁকা রয়েছে। সাদনান ইচ্ছে করে রেখেছে। সেখানে সুন্দর করে নিজের নাম টা।লিখে দিলো।অপর হাতেই সেম ডিজাইন তবে সেখানে প্রিয়তার নাম।
প্রিয়তা একটু নড়াচড়া করে না।চুপটি করে সাদনানের মুখের দিকে তাকায় একবার তো হাতের দিকে।সাদনান মেহেদী দিতে বেশ অনেকটাই সময় লাগে।পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে।প্রিয়তা সাদনান মেহেদী দেওয়া শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাদনানের গালে টুপ করে চুমু খায়।যদিও সাদনান সবসময়ই বউয়ের প্রতি ভীষণ কেয়ারিং। তবে প্রিয়তার কাছে এটা অন্যরকম লাগলো।
সাদনান বউয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরতেই প্রিয়তার ধ্যান ভাঙ্গে। নিজে দুই হাত সাদনানের কাঁধের উপর সোজা করে রেখে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই সাদনান চোখে হাসলো।অধর এগিয়ে বউয়ের অধর স্পর্শ করলো। প্রিয়তা ছটফট করে। দম বন্ধ হয়ে আসে।কিন্তু সাদনান ছাড়ার নাম-ই নেই।প্রিয়তা হাতে মেহেদী দেওয়ার ফলে কিছু করতেও পারছে না।প্রিয়তা কে এভাবে ছটফট করতে দেখে সাদনান মিনিট এর মাথায় বউয়ের অধর ছাড়ে।
কোমড় হতে হাত সরিয়ে প্রিয়তার মুখ নিজের দুই হাতের আঁজলে নিয়ে নেশাতুর কণ্ঠে বলে উঠলো,

-“জাস্ট ফাইভ মিনিটস্ জান।
কষ্ট করে এটুকু সময় থাকো।”

পরপরই আবার বউয়ের অধরে হামলে পড়ে। প্রিয়তা না চাইতেও সঙ্গ দিলো।সাদনান যেনো উন্মাদ গাঢ় হতে প্রগাঢ় হচ্ছে হাতের আর অধর স্পর্শ। প্রিয়তা অনেক টাই জোর করে নিজে কিছু টা পেছনে সরে বসলো।
সাদনান প্রিয়তার দিকে আহত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।মন ভরে নি পুরুষ টার।বউ তো এমন নয়।তবে আজ কেনো এমন রিয়াকশন দিলো সাদনান বুঝতে পারলো না। তবে সময় অপচয় না করে বউ কে কোলে তুলে ওয়াশ রুমের দিকে ছুটলো।
প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাসপ্রশ্বাস নিচ্ছিল।হঠাৎ নিজে কে কারোর দখলে বুঝতে পেরে ঝটপট চোখ খুলে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলো,

-“কোলে কেনো নিয়েছেন?”

সাদনান জবাব দেয় না।বউ কে সোজা ওয়াশ রুম নিয়ে বেসিনের সামনে দাঁড় করিয়ে হাত দু’টো পানির নিচে দিয়ে ধুয়ে নিলো।আবার কোলে তুলে রুমে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে লাইট অফ করে দিলো।প্রিয়তা পুরো টা সময় মুগ্ধ হয়ে দেখলো।তবে সাদনান কে কাছে আসতে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বলে উঠলো,

-“তাই তো বলি এতো কেনো কেয়ার!”

-“ইইউ মিন আমি নয়তো তোমার কেয়ার করি না?”

সাদনান থমথমে কণ্ঠে এরূপ প্রশ্নে প্রিয়তা ঠোঁট টিপে হেঁসে জবাব দিলো,

-“করেন তো।
খবরদারী।”

সাদনান দেখলো।আবছা আলোয়ে বউয়ের চোখে-মুখে হাসির ঝলক দেখতে পেয়ে বুঝতে পারলো প্রিয়তা মজা করছে। সাদনান প্রিয়তা কে এবার নিজের উপর থেকে নিচে ফেলে দিলো।
নিজে বউয়ের উপর চড়ে বসে আগের ন্যায় থমথমে কণ্ঠে জানালো,

-“তোমার যদি এটা মনে হয় তবে তাই।
আমার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে যতদিন বিদ্যমান ঠিক ততদিন তোমার জীবনেও এসব বিরাজমান।”

#চলবে….

#আমার_তুমি[২]
#পর্ব_৩৩
#জান্নাত_সুলতানা

-“দিলি তো বুকের হাহাকার বাড়িয়ে!”

সারা রাহানের কথায় লাজুক হেঁসে মাথা নিচু করে নিলো।বিয়ের ভারী মেক-আপ এ রমণী সারা কে দারুণ দেখতে লাগছে।
রাহান ফোন ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে মাথায় পাগড়ি পড়তে পড়তে আবার বলল,

-“আসছি।
অপেক্ষা কর।

অতঃপর কল কেটে দিলো। আয়ান সহ আরো কিছু ছেলে তখন রুমে এলো।রাহান কে সাথে নিয়ে নিচে এলো।আসার সময় অবশ্যই রাহান কে সবাই খুঁচাতে ভুলে না।

—-

সারা কে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাহাত আয়ান সাদনান সবাই এলো।মহিলারা সবাই সরে জায়গায় দিলো পুরুষদের। প্রিয়তা তখন এক পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। সাদনান বউয়ের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে অবাক হলো। শাড়ী সে যেভাবে পড়িয়ে দিয়েছে সেভাবেই রয়েছে। মুকে কোনো রকম সাজ নেই।লম্বা চুল গুলো হাত খোঁপা বাঁধা হয়তো। মাথায় ঘোমটা টানা তবে আশেপাশে দিয়ে কিছু চুল উঁকিঝুঁকি মারছে সেই কারণ সাদনান কিছু টা অনুমান করলো।যেখানে বিয়ের সাজে সবাই ভারী মেক-আপ দিয়ে একএকজন এর আসল চেহারা বুঝার উপায় নেই সেখানে তার বউ কে এম বিধস্ত কেনো দেখাচ্ছে?
কি হয়েছে মেয়েটার?সাদনান বউয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে প্রিয়তাও তাকালো সাদনানের দিকে। দু’জনের দৃষ্টি মিলন হলো।প্রিয়তা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে আবার দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে তাকালো।ততক্ষণে রাহাত বোন কে আগলে নিয়ে বিছানা হতে এগিয়ে এসেছে। সাদনান বোন কে আরেক পাশে দিয়ে আগলো ধরলো।অতঃপর এগিয়ে গেলো তাঁরা। পেছনে পেছনে সব মানুষের সিরিয়াল করে তাদের অনুসরণ করে। সাদনান বারকয়েক পেছনেই তাকায়।তার পেছনে কতগুলো মেয়ে রয়েছে। কেমন ড্যাব ড্যাব করে তাকেই দেখছে। কিন্তু সাদনানের সেসবে নজর নেই। তাঁর নজর একদম পেছনে লম্বা হওয়ার দরুনে একদম রুম পর্যন্ত দেখতে পেলো।বউ কেমন দুর্বল পায়ে এগিয়ে আসছে। সাদনান হঠাৎ মনে হলো।সকালে মেয়ে টাকে খাবার খাইয়ে দিতে গেলো প্রিয়তা পরে খাবে বলে বারণ করে দেয়।সাদনান অনেক জোরাজুরি করেও বিশেষ কোনো লাভ হয় নি।এরপর তো সে আর রুমে যায় নি।আর এক্কেবারে যখন গিয়েছে তখন বারো টা বাজে।নিজে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে প্রিয়তা কে রেডি করে হন্তদন্ত হয়ে আবার ছুটে নিচে চলে গিয়েছিল। কিছু সুনামধন্য ব্যক্তি এসেছিল তাদের রিসিভ করতে।এরমধ্যে এতো দৌড়া দৌড়েতে আর একবার খোঁজ নেওয়া হয় নি মেয়ে টা খেয়েছে কি-না?
সারা কে বসিয়ে এগিয়ে গেলো সাদনান চাচির কাছে।আস্তে করে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে জানতে চাইলো,

-“ছোট মা ও খাবার খেয়েছিল?
সকালে?”

-“নাহ আব্বা।
তুমি তো খাবার নিয়ে আবার ফিরে দিলে খালা কে দিয়ে।
এরপর আর ও আসে নি।
কেনো ও আর খায় নি?”

-“ইস্টুপিট।
আচ্ছা শোনো রুমে খাবার দাও।
আমি রুমে যাচ্ছি।”

প্রথমে বিড়বিড় করে বলে পরে সুফিয়া বেগম কে বলে রুমের উদ্দেশ্য হাঁটা ধরলো সাদনান।
প্রিয়তা নিচে আসার জন্য সবার পিছু পিছু আসছিল।কিন্তু হঠাৎ করে মাথা ঘুরে ওঠে।চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।নিচে আসার মতো শক্তি পায় না।একজন কাজের লোক ছিল সারা’র রুমে।তিনি করিডরে এসে প্রিয়তা কে দেখে বলে উঠলো,

-“ছোট গিন্নি?
আপনের কি শরীর ভালা না?”

-“তেমন কিছু না।
একটু দুর্বল লাগছে। আমায় রুমে দিয়ে আসুন একটু।”

প্রিয়তা মহিলার কাঁধে এক হাত রেখে আরেক হাতে শাড়ী সামলে রুমে এলো।বিছানায় বসে বলল,

-“দরজা টা চাপিয়ে যাবেন।
আর কাউ কে বলার দরকার নেই আমার শরীর খারাপ লাগছে।”

মহিলা টা মাথা নেড়ে জিগ্যেস করলো,

-“আমি কি ঠান্ডা পানি আনতাম?”

-“নাহ।
আপনি যান।”

মহিলা টা কিছু ভেবে রুম হতে বেরিয়ে গেলো।প্রিয়তা বারণ করেছে তাতে কি। তিনি তো এটা বলে দিবে কাউ কে সামনে পেলেই।মহিলা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি কাছে যেতেই সাদনান কে সিঁড়ি বেয়ে উপর আসতে দেখে হাত চাঁদ পাওয়ার মতো মুখে হাসি ফুটে উঠলো।এই বাড়িতে কাজ করছে অনেক দিন ধরে। বাড়ির প্রতিটা মানুষ ভীষণ ভালো।আর পুরোনো স্টাফ এর মধ্যে ওনি এখনো যুগ এর বেশি সময় ধরে কাজ করে।তাই আলাদা একটু দাম রয়েছে। সাদনান কে আসতে দেখে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে মাথা নিচু করে নমনীয় কণ্ঠে জানালো,

-“ছোট সাহেব ছোট গিন্নি রুমে আছে।
শরীর টা মনে হয় ভালা না।কেমন হাঁটতে পারছিল না। ধরে রুমে দিয়ে আইলাম।”

সাদনান বুঝি পুরো টা শুনে?সে তো অর্ধেক শুনেই দিশেহারা। কানে যেনো মহিলার বলা কথা গুলো বাজছে।ধুপধাপ পা ফেলে কিছু টা দৌড়ে রুমে এলো।দড়াম করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। প্রিয়তা চমকে ওঠে চোখ খুলে শোয়া থেকে ওঠে বসে।সাদনান অস্থির পায়ে ছুটে এলো।প্রিয়তার মুখ টা দুই হাতের আঁজলে নিয়ে বিচলিত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

-“আগে কেনো বলো নি শরীর খারাপ লাগছে?”

-“কিচ্ছু হয় নি।
শরীর টা এমনি দুর্বল লাগছে। আপনি কেনো আসতে গেলেন?বিয়ে পড়ানো শুরু হবে তো এখন।”

-“সবাই আছে সেখানে।
তুমি খাবার কেনো খাও নি?”

-“আচ্ছা শুনুন।
এতো অস্থির হতে হবে না।”

প্রিয়তা বসা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেলো।ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে হাতে একটা কিছু নিলো।সাদনান বউয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকে নিলো।প্রিয়তা হাতে কিট নিয়েছে।সাদনান সন্দিহান কণ্ঠে জিগ্যেস করলো,

-“এটা কেনো নিচ্ছো?
তোমার কি তাই মনে হচ্ছে?”

-“আগে টেস্ট করে আসি!”

বলে ওঠে দাঁড়াতে নিয়ে আবার মাথা ঘুরে গেলো।সাদনান তড়িৎ বউয়ের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। মেয়েটার এই এক সমস্যা। খাবার না খেলে মাথা ঘুরে। তারউপর শরীর বমির ভাব সেই সকাল থেকে হচ্ছে। কিন্তু ভেতর থেকে কিছুই আসে না।অবশ্যই পেটে কিছু থাকলে তো বমি হবে।
! সাদনান প্রিয়তা কে কোলে তুলে ওয়াশ রুম দিয়ে এলো।প্রিয়তা হাসলো।মানুষ টা সত্যি পাগল।প্রিয়তা ওয়াশ রুম হতে বেরিয়ে আসে প্রায় বিশ মিনিট এর মাথায় তাও সাদনানের ডাকাডাকিতে।সাদনান প্রিয়তা বেরিয়ে আসতে আগেই প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।প্রিয়তা টলমল পায়ে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো সাদনান কে।সাদনান কিছু জিগ্যেস করতে হলো না।প্রিয়তা ফুঁপিয়ে ওঠে ধরে আসা গলায় জানালো,

-“কংগ্রাচুলেশন।”

সাদনান প্রিয়তার কথায় চমকালো।বুকের ভেতর ধুকপুক ধুকপুক শব্দ হলো।অধর জোড়া তিরতির করে কাঁপতে লাগলো।কাঁপা কাঁপা অধর জোড়া সাদনান জিহ্বা ধারা ভিজিয়ে নিলো একবার।কাঁপতে থাকা অধর জোড়া নেড়ে অনেক্ক্ষণ পর বলে উঠলো,

-“আই কান্ট বিলিভ ইট, জান।
টাচ ওয়ান্স্?প্লিজ!”

সাদনান প্রিয়তা কে ছেড়ে দিয়ে হাঁটু মুড়ে নিচে বসে গেলো।প্রিয়তার পেট থেকে শাড়ী সরিয়ে উন্মুক্ত করলো মসৃণ পেট।ডান হাত টা একবার আলগোছে ছুঁয়ে দিতেই বা চোখ হতে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে সাথে সাথে মুছে নিয়ে মুখ এগিয়ে গভীর ভাবে অধর স্পর্শ করলো প্রিয়তার পেটে। প্রিয়তা সাদনানের মাথার চুল শক্ত করে ধরে বলে উঠলো,

-“সবে তো কিছু দিন।
এখনো,,

-“আমার অস্তিত্ব।
আমার তোমার ভালোবাসা এক প্রহর।”

সাদনানের আবেগি কথায় প্রিয়তার চক্ষু চড়কগাছ। মানুষ টা সুস্থ আছে? কি বলছে নিজে জানে?এই গম্ভীর মন্ত্রীর মুখে এসব যে অকল্পনীয়।প্রিয়তা বিস্ময় ভুলে অবাক হয়ে বলে উঠলো,

-“আরো কত প্রহর বাকি তবে?”

সাদনান প্রিয়তা কে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে।
গভীর ভাবে আলিঙ্গন করে শুধালো,

-“অনেক অনেক।এক-এক একটা দিনের সূচনা মানে তোমার আমার ভালোবাসা সুন্দর একটা প্রহর এর সূচনা।”

#চলবে….