Monday, July 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 127



প্রিয়তোষ পর্ব-০৬

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৬
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা কাঁদতে কাঁদতে কোচিং এর ছাদে চলে এসেছে। তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত বর্ষণ বয়েই চলেছে। নোরা নিজেকে থামাতে পারছেনা। কেনো এইটা করতে গেল সে? সারাজীবনের জন্য অনিকের চোখে নিচে নেমে গেল। অনিক তার সম্বন্ধে কি ভাবছে কে জানে? কিন্তু তার তো কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিলনা। এটা ঠিক যে অনিকের সাথে তার যেই সম্পর্ক তাতে এ ধরণের উপহার সম্পুর্ণ বেমানান। কিন্তু তাই বলে অনিক সবার সামনে এভাবে অপমান করল? অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। বরং অনিক যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহার করেছে। ওর জায়গায় অন্যকেউ হলে হয়তো নোরা এতোক্ষণে একটা চড় উপহার পেয়ে যেতো।

চোখের জল মুছতে মুছতে নিচের দিকে তাকাল নোরা। মেয়েরা কোচিং থেকে বের হচ্ছে। তন্নীরা রিকশাতে উঠে যাচ্ছে। সেজুতি আর অন্তরা রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। কোচিং কি তাহলে ছুটি হয়ে গেছে? নোরা নিজের হাতের ঘড়ি দেখল। মাত্র পাঁচটা বেজে সাতমিনিট। কোচিং ছুটি হওয়ার কথা ছয়টায়। তাহলে সবাই চলে যাচ্ছে কেন? নাকি অনিকস্যার তার উপর রাগ দেখিয়ে সবাইকে ছুটি দিয়ে দিয়েছে?, এতোটাই মেজাজ গরম হয়েছে উনার, যে এখন আর ক্লাসও নিতে চান না।

নোরার আবার কান্না পেল। জোরে কান্না পেল। সে আসলেই খুব বোকা। তার থেকে দুর্ভাগ্যবতী পৃথিবীতে হয়তো আর একটাও নেই। তাইতো ওর সাথেই এমন হলো। অন্তরা আর সেজুতি নোরার জন্যই নিচে দাঁড়িয়ে আছে৷ কিন্তু নোরা এখন নিচে যাবেনা৷ তার কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা। নিজের চেহারাও কাউকে দেখাতে ইচ্ছে করছে না। নোরা নীরবে কাঁদতে লাগল।

হঠাৎ কারো উপস্থিতি টের পেয়ে চোখ-মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে নিল নোরা। পেছনে তাকাতেই সে অবাক, অনিক! ওর হাত সিগারেট। সেই সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বামসাইডের দেয়াল ঘেঁষে দাড়াল। নোরা সামনের দিকে ফিরে গেল। কোচিং এর ভেতর স্মোকিং নিষেধ। তাই হয়তো ছাদে এসেছে। কিন্তু নোরা এবার কি করবে? চলে যাবে ছাদ থেকে? অনিকের সামনে আপাতত থাকতে ইচ্ছে করছে না।

নোরার ভাবনার মাঝখানেই অনিক পাশে এসে দাঁড়াল। নোরা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। সিগারেটের গন্ধে তার বমি পাওয়ার কথা৷ কিন্তু পাচ্ছেনা। বরং জীবনে প্রথমবার সিগারেটের গন্ধটাও ভালোই লাগছে৷ অনিকের ঠোঁটের ছোয়া পেয়ে সিগারেটটাও যেন ধন্য। তার পারফিউমের ঘ্রাণের সাথে নিকোটিনের গন্ধ মিশে চমৎকার এক মাদকতার সৃষ্টি হয়েছে যেন। অনিক সামনে তাকিয়ে খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” কি দেখছো? ”

নোরা জবাব দিতে পারলনা। বিস্ময়ে জবাব দিতে ভুলে গেছে। অনিকই বলল,” এদিকের ভিউটা খুব সুন্দর। মনে হয় এক নজরে পুরো শহর। তাইনা?”

এ কথা বলেই অনিক নোরার দিকে তাকিয়ে হাসল। নোরা এই মুহুর্তে কি করবে দিশা খুঁজে পাচ্ছে না। হাসবে? না হাসা ঠিক হবেনা। মুখ গম্ভীর রেখেই মাথা নাড়াল। অনিক নোরার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। নোরা বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। একটু আগেই যে এতো ধমকালো, খারাপ ব্যবহার করল, এখন সে-ই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে কথা বলছে?এমন পরিস্থিতিতে কি করা উচিৎ নোরার জানা নেই। অনিকস্যার কি সবকিছু ভুলে স্বাভাবিক হতে চাইছে?

অনিক ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলল,” নোরা একটা কথা বলবে?”

” বলুন?”

” আমার স্মোকিং এর অভ্যাস আছে এই কথা তোমাকে কে বলল? আমি তো কখনো তোমাদের সামনে স্মোক করিনি! তাহলে জানলে কিভাবে?”

নোরা ইতস্ততায় পড়ে গেল। রেশমির কথাটা কি বলবে? বলা ঠিক হবে? যদিও এখানে রেশমির দোষ নেই। রেশমি বললেই যে ওকে সেই কাজ করতে হবে এমন তো নয়। সিগারেটের কার্টুন নোরা নিজের ইচ্ছায় অনিককে দিয়েছে। এখানে রেশমির কি দোষ? রেশমি তো আর জোর করে ওকে দিয়ে কিছু করায়নি। নোরা বলল,” জেনেছি।”

” কিভাবে জেনেছো? আর তোমার তো সিগারেটের গন্ধও সহ্য হয়না। তাহলে আমাকে দিলে কি মনে করে?”

” আপনি কিভাবে জানলেন আমার সিগারেটের গন্ধ সহ্য হয়না?”

” আমি আসার পর থেকেই অস্বাভাবিকভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছো। এটা দেখেই বুঝেছি। তোমার কষ্ট হচ্ছে।”

একটু থেমে অনিক আবার বলল,” আচ্ছা আমাকে এসব গিফট করলে আমি খুশি হবো এই আইডিয়া তোমাকে কে দিল?”

নোরা চুপ। অনিক জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে আবার বলল,” দেখো আমি জানি আইডিয়াটা তোমার না। এ ধরণের বুদ্ধি তোমার মাথায় আসতে পারেনা। আর তোমাকে বোকা বানানো অনেক সহজ। তাই সত্যিটা বলো।মেইন কালপ্রিট কে?”

নোরা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু বলল না। অনিক কিছুক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করল। তারপর বলল,” আচ্ছা নাম বলতে না চাইলে থাক। বাদ দাও। কিন্তু একটা সত্যি কথা কি জানো?”

“কি?”

” স্মোকিং এর প্রতি আমার এ্যাডিকশন ছিল এটা ঠিক। কিন্তু আমি স্মোকিং ছেড়ে দিয়েছি প্রায় চারবছর আগে।”

নোরা অবাক হয়ে তাকাল। অনিক নরমগলায় বলল,” সরি।”

” সরি কেন?” নোরার প্রায় নিশ্বাস আটকে আসছে।

” হঠাৎ এই জিনিসটা দেখে মাথাগরম হয়ে গিয়েছিল। তাই অনেক কিছু বলে ফেলেছি তোমাকে। সেজন্য সরি।”

নোরা আনন্দের সাগরে ভাসছে৷ খুশিতে তার চোখ-মুখ উজ্জল। যদিও দোষটা তারই, তবুও অনিক ওকে সরি বলছে। এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে?

নোরা উত্তেজিত হয়ে বলল,” ছি ছি! স্যার আপনি কেন সরি বলছেন? ভুলটা তো আমারই ছিল। আমারই আপনাকে এ ধরণের উপহার দেওয়া উচিৎ হয়নি। তাই সরি আমার বলা উচিৎ। আমি সরি। খুব সরি।”

অনিক হাসল। তারপর বলল,” সিগারেট খাওয়া তো চারবছর আগেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তখন ডেঞ্জারাস এ্যাডিকশন ছিল৷ এখন তার এক পারসেন্টও নেই। গন্ধটাও সহ্য হয়না। আজ অনেকদিন আধঘণ্টায় দুইটা শেষ করলাম। তাও তোমার জন্য।”

” আমার জন্য কেন?”

,” না মানে.. তুমি গিফট না করলে তো আমি খেতাম না। তাই বলছি।”

” ও। তাহলে আমি আপনাকে খেতে বাধ্য করেছি।”

” বাধ্য করোনি, সুযোগ করে দিয়েছো।”

” স্যার আসলে আমি বুঝতে পারিনি আপনি এতোটা রেগে যাবেন।”

” তুমি কি চাও? আমি তোমার দেওয়া এক কার্টুন শেষ করি? তাহলে কিন্তু আবার আগের অভ্যাসে ফিরে যেতে হবে।”

” স্যার আমি কিছুই চাইনা। আমি শুধু আপনাকে খুশি করতে চেয়েছিলাম।”

“খুশি করার আরো অনেক উপায় ছিল। তাছাড়া আজকে তোমাকে দেখে আমি এমনিই খুশি হয়ে গিয়েছি। সুন্দর লাগছে। লালরঙে তোমাকে এতো ভালো মানায় জানা ছিলনা ”

নোরা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। অনিক তার প্রশংসা করল? এটাকে শুধুই তাকে খুশি করার জন্য বলল? নাকি সত্যিই মন থেকে বলল? যে কারণেই বলুক, বলেছে তো! এটাই বড় কথা। নোরার নিজেকে সার্থক মনে হচ্ছে।
অনিক বলল,” শোনো নোরা, সরলতা ভালো। কিন্তু বোকামি না। তুমি বোকামি করেছো। এই জিনিসটা আমাকে দেওয়ার আগে অন্তত একবার চিন্তা করা উচিৎ ছিল। টিচারকে মানুষ এসব গিফট করে? কমন সেন্স নেই? ও সরি, তোমার তো আসলেই কমন সেন্স নেই।ভুলে গেছিলাম।”

নোরা মাথা নিচু করে বলল,” স্যার আপনি আবার শুরু করলেন।”

অনিক হেসে উঠল। কি যে সুন্দর সেই হাসি!

নোরা নিচে নেমে দেখল অন্তরা আর সেজুতি তখনও দাঁড়িয়ে আছে। অন্তরা নোরাকে নামতে দেখেই জিজ্ঞেস করল,” কিরে তুই কই ছিলি এতোক্ষণ? তোকে কত খুঁজলাম!”

নোরা বলল,” পরে বলছি। তার আগে বল তোরা অনিকস্যারকে কি বলে কনভেন্স করেছিস?”

সেজুতি আর অন্তরা একবার চোখচোখি করল। সেজুতি বলল,” আমরা আবার কখন অনিকস্যারকে কনভেন্স করলাম?”

নোরা বলল,” কনভেন্স করিসনি? কিছু বলিসও নি?”

অন্তরা বলল,” উহুম! বলার সুযোগই হয়নি। তুই ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর অনিকস্যার অনেকক্ষণ চুপ করে চেয়ার বসে ছিলেন। তারপর আমাদের ছুটি দিয়ে দিলেন। আমরা সবাই বের হয়ে গেলাম কিন্তু উনি তখনো বসেছিলেন। উনার সাথে কোনো কথাও তো হয়নি।”

নোরা বলল,” ও। আমি আরো ভাবলাম তোরাই উনাকে কনভেন্স করে আমার কাছে পাঠিয়েছিস।”

সেজুতি বলল,” স্যার তোর কাছে গিয়েছিল?”

নোরা বলল,” হ্যাঁ৷ সরি বলেছে।”

সেজুতি আর অন্তরা অবিশ্বাস্য নজরে তাকাল।

” কি সত্যি?”

নোরা হাসি হাসিমুখে মাথা নেড়ে বলল,” হুম।”
তারপর ওদেরকে সব কাহিনি শোনাল। সেজুতি হাসতে হাসতে বলল,” সত্যি করে বলতো! সিগারেটের সাথে কি তাবিজ মেশানো ছিল? স্যার কি খেয়ে পাগল হয়ে গেছে?”

নোরা বলল,” জানিনা। কিন্তু আজকে আমি খুব খুশি। তাই তোদেরকে ট্রিট দিবো। আয়।”

অন্তরা বলল,” ট্রিটটা আমার বেশি পাওয়া উচিৎ। কারণ আমিই তোকে এভাবে সাজিয়েছি। যা দেখে স্যার ফিদা হয়ে গেছে।”

নোরা বলল,” তুই আবার বেশিই ভাবছিস। স্যার ফিদা হয়নি। শুধু সুন্দর বলেছে।”

অন্তরা বলল,” আরে ওইটাই। সরাসরি বলেনি। আকার-ইঙ্গিতে বুঝিয়েছে।”

নোরা মুখে অন্তরার কথাটা অগ্রাহ্য করলেও ভেতরে ভেতরে খুশির জোয়ারে ভাসছিল। একসঙ্গে স্কুটারে বসল তারা। সেঁজুতি বসতে বসতে বলল,” দোস্ত তুই যখন অনিকস্যারকে গিফট দিতে গিয়েছিলি আর অনিক স্যারের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলি? তোদেরকে দেখতে এত কিউট লাগছিল! মনে হচ্ছিল মেড ফর ইচ আদার। একদম পারফেক্ট জুটি। ”

অন্তরা বলল,” হ্যাঁ একদম একদম ঠিক বলেছিস। আমার কাছেও খুব ভালো লাগছিল দুজনকে একসাথে দেখতে।”

নোরা চোখ বড় করে বলল,” সিরিয়াসলি? নাকি আমাকে খুশি করার জন্য বলছিস?”

সেঁজুতি বলল,”না দোস্ত একদমই না। খুশি করার জন্য কেন বলব? সত্যিই তোদের কে একসাথে দেখতে খুব ভালো লাগে বিশ্বাস কর!”

নোরা মন খারাপ করে বলল,”কিন্তু আমার মনে হয় আমি একটু বেশিই শর্ট। উনি কত লম্বা! আমি যেন একদম ওনার কোমরের নিচে পড়ে থাকি।”

সেঁজুতি বলল,” ধুর এটা কোন ব্যাপার হলো? তোদেরকে তো আরো বেশি কিউট লাগে সেজন্য। মনে হয় দা বেস্ট পেয়ার। তাইনা অন্তরা?”

অন্তরা সুর মিলিয়ে বলল, “একদম। আমার তো তোদের আগে থেকেই ভালো লাগতো। তার ওপর আজকে আবার সেইম কালার ড্রেস পরেছিলি। সত্যিই অসাধারণ লাগছিল। আমার কাছে বেস্ট কাপলের অ্যাওয়ার্ড থাকলে তোদের হাতে ধরিয়ে দিতাম।”

নোরা হেসে বলল,”ইশশ!”

ডিনারের পর মাত্র বিছানায় শুয়েছে নোরা। তখনই ফোনটা হাতে নিল।মেসেজ বক্স চেক করতেই এক প্রকার লাফিয়ে উঠলো। অনিক স্যারের রিপ্লাই। কাল যে অনিককে মেসেজ দিয়েছিল, সেই রিপ্লাই এখন এসেছে। নোরার বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যিই কি অনিক স্যার তার মেসেজের রিপ্লাই করেছে? এক মুহূর্ত দেরি না করে মেসেজটি চেক করলো,” এই পিচ্চি, কি খবর? ”

নোর খুশিতে ডগোমগো চোখে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে চিন্তা করতে লাগল এ ধরনের মেসেজ অনিক লিখেছে? কেন যেন বিশ্বাসই করতে পারছেনা নোরা। কি রিপ্লাই দিবে সেটাও বুঝতে পারছে না। তার হাতের আঙুলগুলো থর থর করে কাঁপছে। কি মুশকিল! অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে মেসেজ লিখল,” ভালো। আপনি কেমন আছেন স্যার? ”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সিন হলো মেসেজটি। মানে অনলাইনে আছে। প্রচন্ড উত্তেজনায় নোরার হার্টবিট বাড়তে লাগলো। অনিক রিপ্লাই দিলো, “আমি ভালো। কিন্তু তুমি এখনো ঘুমাওনি কেন?”

” আসলে মাত্র ডিনার শেষ করলাম।”

” এত দেরিতে ডিনার? ”

“আমাদের বাসার এমনই রুটিন ”

“ও আচ্ছা। তবে বেশি রাত জাগা কিন্তু ভালো অভ্যাস না়। এতে মস্তিষ্কের ওপর চাপ পড়ে। তাই জলদি ঘুমানোর অভ্যাসটা করে নিও।”

নোরা সাহস করে লিখল, ” স্যার আপনিও তো জেগে আছেন। ”

“আমি তো জেগে আছি কাজে। এত রাতে তোমার কি কাজ? নাকি বয়ফ্রেন্ডঘটিত ব্যাপার?”

নোরা এই মেসেজ দেখে হালকা লজ্জিত বোধ করলো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখল, “ছি ছি! আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই।”

অনিক বলল, “সত্যি? ”

নোরা লিখল,” আজ্ঞে।”

” তাহলে তো রাত জাগার কোন কারণই দেখছিনা।”

“কেন? মানুষ বুঝি শুধু প্রেমের জন্যই রাত জাগে! তাহলে আপনিও কি গার্লফ্রেন্ডের জন্য জেগে আছেন?”

অনিক অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” ভালোই তো কথার প্যাঁচে ফেলতে পারো দেখছি। রাত জেগে আর কোনো কাজ নেই তাইনা? ঘুমাও!”

” ধমকাচ্ছেন কেন? আপনি কি আমাকে মেসেঞ্জারেও রেহাই দিবেন না?”

“আমি তো ভেবেছিলাম তুমি ধমকও বুঝবেনা। কমন সেন্স আছে তাহলে!”

” আবার? ধুর আপনার সাথে আর কথাই বলব না। আমি ঘুমাচ্ছি৷ ”

” সেটাই ভালো। ফোন রেখে ঘুমাও।”

“ফোন নিয়ে কি ঘুমানো যায়? রেখেই তো ঘুমাবো।”

” হ্যাঁ তাইতো।”
” আচ্ছা তার আগে একটা কথা বলুনতো?”

অনিক শুধু প্রশ্নবোধক চিহ্ন পাঠাল। কোনো শব্দ লিখল না। নোরা বলল,” আপনি আমাকে পিচ্চি বললেন কেন?”

” পিচ্চিকে পিচ্চি বলতে পারবো না?”

” না পারবেন না। আমি পিচ্চি কিভাবে হলাম?”

” আমার কাছে তো তুমি পিচ্চিই। তোমরা সবাই পিচ্চি।”

” আমার আঠারো বছর চারমাস। ”

” মাত্র?”

” এটা মাত্র মনে হল? কতবছর হলে পিচ্চি থাকবো না?”

” যত বয়সই হোক, আমার কাছে পিচ্চিই থাকবে।”

” আপনার বয়স কত?”

” আজকে আমার ছাব্বিশতম জন্মবার্ষিকী ছিল।”

” কি? আপনার ছাব্বিশ বছর?”

” অবাক হলে মনে হচ্ছে? ”

” অবাক তো হচ্ছিই। আপনাকে দেখে তো একদমই বোঝা যায়না যে আপনার বয়স ছাব্বিশ।”

” তাহলে কি বোঝা যায়?”

” একুশ কি বিশ।”

” হাহাহা। মজা পেলাম।”

” আপনি দৈত্যের মতো হাসছেন কেন?”

” দৈত্যের মতো কোথায় হাসলাম?”

” হাহাহা! এটা তো দৈত্যের মতো হাসি। রুপকথার গল্পে শোনেননি? দৈত্যরা বিশাল শরীর নিয়ে ভারী শব্দে হিহোহা করে হাসে। হাসার সময় ওদের ভুড়ি নড়তে থাকে।”

” আমি তো হিহোহা করে হাসিনি। হাহাহা করে হেসেছি।”

” তবুও আমার দৈত্যের কথা মনে পড়ছে। ভয় লাগছে।”

” ভয় লাগার কি হলো? ”

” জানি না।”

“তুমি কি রাতে একা ঘুমাও?”

” না। আমার সাথে কিড্ডো ঘুমায়। ”

” কিড্ডো কে?”

” আমার টেডিবিয়ার। ওর শরীর অনেক মসৃণ। ওকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুমই আসেনা। তাই প্রতিদিন ওকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই।”

” ঠিকাছে তাহলে কিড্ডোকে জড়িয়ে ধরেই ঘুমাও। কিন্তু দেখো কিড্ডো যেন আবার তোমাকে জড়িয়ে না ধরে।”

এই মেসেজ দেখে নোরা ভয় পেয়ে একটা চিৎকার দিয়ে ফেলল। তারপর লিখল,” আজব তো! আপনি আমাকে এভাবে ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”

” তুমি ভয় পাচ্ছো ?”

” আপনি তো চাইছেনই আমি ভয় পাই।”

” আমি এটা চাইছি না।”

” অবশ্যই চাইছেন। নাহলে ওমন কথা কেন বললেন? আমার এখন সত্যি ভয় লাগছে, কি করবো?”

“যিকির করো। দোয়া পড়ো। আর ভয় লাগবেনা।”

” নিজে ভয় দেখিয়ে এখন আবার বলছে যিকির করতে, দোয়া পড়তে। কি অদ্ভুত! আপনি ভয় না দেখালে তো আমি ভয়ই পেতাম না।”

” ভয় তাড়ানোর আরেকটা উপায় আছে। একটা সিগারেট ধরিয়ে শুয়ে পড়ো। আগুন দেখলে ভূত কাছে আসেনা।”

” সিগারেট ধরিয়ে শুয়ে পড়বো মানে? আমি কি সিগারেট খাই?”

” আমাকে এক কার্টুন দিলে, অথচ নিজে খাওনা? আমি তো ভেবেছিলাম তোমার বাবার সিগারেটের ফ্যাক্টরি আছে।”

” ধেৎ! আর মজা নিয়েন না। ব্যাপারটার জন্য তো সরি বলেছি আমি।”

” সব ভুলের সমাধান সরি দিয়ে হয়না নোরা।”

” তাহলে কি করতে হবে?”

” কিছুনা, তুমি ঘুমাও নোরা। অনেকরাত হয়েছে। ”

” আপনি ঘুমাবেন না?”

” আমি ঘুমাতেই যাচ্ছি।”

” ঠিকাছে চলুন একসাথে ঘুমাতে যাই।

” তুমি কি এ ধরণের দুষ্টুমি সবার সাথেই করো?”

” সবার সাথে কেন করবো? সবাই তো সব দুষ্টুমির যোগ্য না।”

অনিক লিখল,” ঘুমাও নোরা। রাত কম হয়নি।”

” আপনার কি খুব ঘুম পাচ্ছে?”

মেসেজটা সেন্ড হল। কিন্তু অনেক সময় কেটে যাওয়ার পরেও সীন হলনা। অনিক অফলাইন হয়ে গেছে। নোরার হালকা মনখারাপ হল। অনিক হঠাৎ কনভারসেশনটা শেষ করে দিল কেন? ভালোই তো লাগছিল কথা বলতে। সারাজীবন যদি এভাবে কথা বলে যাওয়া যেতো! এই কথপোকথন হতো অনন্তকালের। নোরা বামকাত হয়ে শুয়ে পড়ল। আজরাতে তার ঘুম আসবেনা।

নোরা ক্লাসে বসে আছে। ক্লাস চলছে ফিজিক্স। আফজাল স্যার লেকচার দিচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে নোরার কোন মনোযোগ নেই। তার দৃষ্টি দরজার বাইরে। অনিকস্যার এর বিখ্যাত লাঠিটা আজ তাদের ক্লাসে। প্রতিদিন এই সময় লাঠিটা নিতে আসে অনিকস্যার। আজকেও নিশ্চয়ই আসবে। তখন একটিবার দৃষ্টি বিনিময় হবে। সেই অপেক্ষাতেই প্রহর গুনছে নোরা। কিন্তু অনিক আসছে না। অপেক্ষাও শেষ হচ্ছেনা।

কোচিং এর প্রায় সবাই মোটামোটি কালকের ঘটনাটা জেনে গেছে। অনিককে সিগারেট গিফট করার ঘটনা। অনেকে এই নিয়ে হাসি-তামাশাও করছে। আফজাল স্যারও ছাড় দেননি। কিছুক্ষণ আগে তিনিও পচালেন। বলেছিলেন,” গিফটটা কিন্তু খুব দামী। সবাই এর মুল্য বোঝেনা। অনিককে না দিয়ে যদি আমাকে দিতে, খুব যত্ন করে ব্যবহার করতাম।”

নোরার কারো কথাতেই কোনো মাথাব্যথা হচ্ছেনা। অনিকস্যার যে তাকে মাফ করেছেন এবং স্বাভাবিক ব্যবহার করছেন এটাই তার কাছে অনেক। এতোসময় কেটে যাওয়ার পরেও যখন অনিক আসল না, নোরা ফেসবুকে মেসেজ পাঠাল,” স্যার, আপনি কি আজ এসেছেন?”

পাঁচমিনিটের মধ্যেই রিপ্লাই এলো,” আসবো না কেন?”

” তাহলে আপনাকে দেখতে পেলাম না যে?”

” আমি গ্রাউন্ড ফ্লোরে ক্লাস নিচ্ছি। উপরে আসিনি। তাই দেখা হয়নি।”

” আমাদের ক্লাসে তো আপনার লাঠি আছে। লাঠি নিতেও আসবেন না?”

” নাহ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে ইচ্ছে করছেনা। টায়ার্ড লাগে।”

“তাহলে আমি আপনার লাঠি নিয়ে আসি?”

” তুমি কেন নিয়ে আসবে? তোমার না ক্লাস চলছে?”

” কিছু হবেনা। মাত্র পাঁচমিনিটেরই তো ব্যাপার।”

“দরকার নেই। পরে সবাই বলবে আমি আলসেমি করে নিজের কাজ স্টুডেন্ট দিয়ে করাচ্ছি।”

” কেউ জানবেনা। আমি বলবো ওয়াশরুমে যাচ্ছি।”

” লাঠি নেওয়ার সময় কেউ তোমাকে দেখবে না? তখন তো বুঝবেই।”

” বুঝবে না। আমি ম্যানেজ করে নিবো।”

” লাগবে না নোরা! বাদ দাও।”

নোরা মনখারাপের ইমোজি দিল। তারপর লিখল,” ভেবেছিলাম এই বাহানায় আপনার সাথে একটু দেখা হবে।”

” আমার সাথে দেখা করে তোমার লাভ কি?”

” লাভ আছে। অনেক Love। আপনি বুঝবেন না।”

নোরা ইচ্ছে করেই ‘লাভ’ এর জায়গায় ‘Love’ লিখেছে।অনিক সেটা বুঝতে পেরে বলল,” তুমি ক্লাসে বসে ম্যাসেজিং করছো আফজাল ভাই দেখে না?”

” দেখবে কিভাবে? আমি তো লুকিয়ে করছি।”

” মোবাইল রেখে ক্লাসে মনোযোগ দাও। নাহলে আমিই আফজাল ভাইকে ফোন দিয়ে বলবো তুমি কি করছো।”

” ঠিকাছে রাখছি। বায়।”

“নোরা শোনো!”

“জ্বী বলুন?”

“ছুটির সময় আমি ছাদে থাকবো।”

নোরা ভীষণ অবাক হল। অনিক কি চাইছে ছুটির পর ছাদে দেখা করতে? নোরা অস্থিরতা নিয়ে লিখল,” আমিও আসবো?”

“তোমার ইচ্ছা। আমি শুধু আমারটা বললাম। এখন বায়। ক্লাস করো।”

“ঠিকাছে। থ্যাঙ্কিউ স্যার। ”

মেসেজটা সেন্ড হল, কিন্তু সীন হলনা। অনিক অফলাইন হয়ে গেছে। নোরার ভেতরে হাঁসফাস করছে। অস্থির লাগা শুরু হয়ে গেছে। কখন ছুটি হবে? ঘড়ির কাটা যেন চলছেইনা। লেকচার শুনতেও বিষাক্ত লাগছে। অনেক অপেক্ষার পর অবশেষে আসল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ক্লাস ছুটি হল। সবাই ব্যাগ গুছিয়ে ক্লাস থেকে বের হচ্ছে। নোরা,অন্তরা আর সেজুতি একসাথে বের হচ্ছিল তখন রেশমি এসে নোরার সামনে দাড়াল। অপরাধী কণ্ঠে বলল,” নোরা কালকের জন্য সরি। আমি বুঝতে পারিনি এমন হবে। প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও।”

অন্তরা আর সেজুতি কিছুই বুঝলনা। নোরা বলল,” তুমি কেন সরি বলছো? দোষটা আমারই। মানুষের কথা শুনে কিছু যাচাই-বাছাই না করে কোনো পদক্ষেপ নিতে হয়না। এটা আমার শিক্ষা হয়েছে। আমি কিছু মনে করিনি।”

রেশমি আবার বিনয়ী কণ্ঠে বলল,” সরি হ্যাঁ? স্যার কালকে তোমার সাথে যেমন বিহেভ করল আমার খুব খারাপ লেগেছে। তাই ক্ষমা চাইতে আসলাম। আমি এমন আইডিয়া না দিলে তো তুমি এটা করতে না। এক্সট্রিমলি সরি।”

নোরা নকল হাসি দিয়ে বলল,” ইটস ওকে।”

রেশমি চলে যাওয়ার পর অন্তরা আর সেজুতি নোরাকে চেপে ধরল। অন্তরা বলল,” আইডিয়াটা তাহলে রেশমির ছিল?”

নোরা বাধ্য হয়ে স্বীকার করল,” হুম।”

অন্তরা বলল,” তুই এটা আগে বললি না কেন? ও না আসলে তো আমরা জানতেও পারতাম না।”

সেজুতি বলল,” আর এতোকিছুর পরেও তুই ওর সাথে এমন হেসে হেসে কথা বললি? আমি হলে তো সেদিনই গালে থাপ্পর লাগিয়ে দিতাম। তুই খুব বোকা নোরা। ওর এই কথাটা সবার আগে আমাদের সাথে আলোচনা করা দরকার ছিল তোর। তাহলে কালকের মতো দিনটা দেখতে হতো না।”

নোরা বলল,” আচ্ছা বাদ দে না। স্যার তো কিছু মনে করেনি।উনি আমাকে মাফ করে দিয়েছে। এটাই আমার কাছে বড় ব্যাপার। আর কিছু লাগবেনা।”

সেজুতি বলল,” বাদ দেওয়া যাবেনা। তুই এখনি আমাদের সাথে অনিকস্যারের কাছে যাবি। আমরা তিনজন মিলে স্যারকে রেশমির ঘটনা বলবো।”

নোরা বলল,” কোনো দরকার নেই। আমি যাবোনা। বিষয়টা তো শেষ হয়ে গেছে, স্যারও সব ভুলে গেছে। তাহলে কি দরকার আবার নতুন করে সব টেনে আনার?”

সেজুতি বলল,” তাই বলে স্যার সত্যিটা জানবে না?”

নোরা বলল,” না জানবে না।”

অন্তরা বলল,” আচ্ছা থাক বাদ দে তো। ও যখন চাইছে না তখন থাক। নোরা চল আমরা নিচে যাই।”

নোরা বলল,” আচ্ছা শোন, আমি না এখন যেতে পারবো না। একটু ছাদে যাব।”

অন্তরা বলল,” ছাদে কি?”

“কাজ আছে। তোরা আমার ব্যাগটা নিয়ে নিচে চলে যা। আমি দশমিনিটের মধ্যে আসছি।”

নোরা ওদের হাতে ব্যাগ ধরিয়ে ঝড়ের গতিতে ছাদে চলে গেল। সেজুতি আর অন্তরা কিছুই বুঝল না। নোরা ছাদে উঠে দেখল অনিক উপরে উঠে কালো ট্যাংকটায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে। অনিককে এতো উঁচুতে দেখে নোরার ভেতরটা ধক করে উঠল। শব্দ করে বলল,”স্যার! এটা আপনি কোথায় উঠেছেন?”

অনিক তাকাল। তারপর দারুণ একটা হাসি দিল,” নোরা, তুমিও এসো।”

” না না আমি আসতে পারবো না। আমার তো দেখেই ভয় লাগছে।”

অনিক হাসতে হাসতে বলল,” দাঁড়াও তাহলে নামছি।”

” আচ্ছা থাক, আপনার নামতে হবেনা। আমিই আসছি।”

” আসতে পারবে?”

” পারব।”

নোরা প্রথমে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠল। তারপর ইটের উপর পাড়া দিয়ে ট্যাংকে চড়ার চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু পারছে না। অনিক হেল্প করল। নোরার হাত ধরে টেনে উঠাল। নোরাও অনিকের মতো পা ঝুলিয়ে বসে পড়ল। নিচের দিকে তাকাতেই নোরার হৃৎস্পন্দন আটকে যাচ্ছে। শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসেছে। সবকিছু ক্ষুদ্র মনে হচ্ছে। মাথা ঘুরে যাচ্ছে। শরীর কাঁপছে। ঠান্ডা হাত-পাও কেঁপে কেপে উঠছে।

অনিক এ অবস্থা খেয়াল করে বলল,” কি হয়েছে নোরা? ভয় পাচ্ছো?”

নোরা অলরেডি ভয়ে সিটিয়ে আছে৷ তবুও বলল,” না। ভয় লাগছেনা।”

নোরা এ কথাটা বলল কারণ অনিক তাকে একহাত দিয়ে ধরে আছে। অনিকের স্পর্শ অনুভব করতে পেরে তার প্রতিটা মুহুর্ত দামী মনে হচ্ছে। নিচে নেমে গেলে তো আর এই সুখটা পাওয়া যাবেনা। নোরার চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট।

সেটা লক্ষ্য করেই অনিক বলল,” অবশ্যই ভয় পাচ্ছো তুমি। নাহলে এভাবে কাঁপছো কেন? এতো ভয় নিয়ে বসে থাকার দরকার নেই। চলো নিচে নামি।”

” না। আমি এখানেই বসে থাকতে চাই।”

” পাগলামি করো না নোরা! তোমাকে নিয়ে এখন আমারই ভয় লাগছে।”

” আপনি থাকলে আমার কোনো ভয় নেই। আপনি যদি বসে থাকতে পারেন আমিও পারবো।”

” আমার তো অভ্যাস আছে। তোমার নেই। প্রথমবার আমারও ভয় লেগেছিল। তাই আমি বুঝতে পারছি তোমার কেমন লাগছে। চলো নামো।”

“আপনি এখানে কেন বসেন? জায়গাটা কি ভয়ংকর! যদি পড়ে যান?”

” এখানে নেটওয়ার্ক ভালো আসে। আর বললাম তো আমার অভ্যাস আছে। আমি পড়বোনা। কিন্তু আর কিছুক্ষণ বসে থাকলে তুমি পড়ে যাবে।”

” আমিও পড়বোনা। আপনার যেমন অভ্যাস আছে তেমনি আমারও আপনি আছেন। আপনি আমাকে ধরে থাকুন, তাহলেই আমার কিচ্ছু হবেনা।”

” ইউ আর লস্টেড। কিছু বলেও লাভ নেই।”

” এখানে উঠে কি গার্লফ্রেন্ডের সাথে গল্প করেন?”

” হোয়াট? তোমাকে কে বলল আমি এখানে উঠে গার্লফ্রেন্ডের সাথে গল্প করি?”

” আপনিই বলেছেন।”

” আমি কখন বললাম?”

” মাত্রই তো বললেন, এখানে নেটওয়ার্ক ভালো পাওয়া যায়। মানে নিশ্চয়ই ফোনে কথা বলার জন্য এখানে উঠেন। আর গার্লফ্রেন্ড ছাড়া অন্যকোনো কারণে কেউ এতো কষ্ট করবেনা।”

” নোরা, তোমার কিন্তু অনেক সাহস। স্টুডেন্টদের মধ্যে তুমি ছাড়া কেউ আমার সাথে এভাবে কথা বলেনা।”

“সাহসটা তো আপনিই দিয়েছেন?”

” তাহলে কি চাও সাহসটা কেঁড়ে নেই?”

” না না! একদমই না। সেটা কেন চাইবো?”

” তাহলে নিজেকে সামলাও। নাহলে মরবে।”

” মরবো কেন?”

” তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার দায়িত্ব নেইনি আমি। এখন নামো।”

এ কথা বলেই অনিক ট্যাংক থেকে নামতে লাগল। নোরা বলল,” একি আপনি নেমে যাচ্ছেন কেন? আমার কি হবে?”

” আমি নামার পর তুমি নামবে।”

অনিক নিচে নেমে নোরাকে বলল,” এসো নামো।”

“কিভাবে নামবো?”

“যেভাবে উঠেছো সেভাবেই নামবে! পাথরে ভর দিয়ে নামো।”

নোরা তাই করছে। কিন্তু তার পা পাথর পর্যন্ত পৌছাচ্ছে না। নোরা বিরক্ত হয়ে বলল,” উফফ আমার পা কি আপনার মতো জিরাফের পা? আমি কিভাবে পাথরে ভর দিবো?”

” তাহলে উঠেছো কিভাবে?”

” আপনি আমাকে টেনে উঠিয়েছেন। ”

অনিক বাধ্য হয়ে হাত বাড়িয়ে দিল।বলল,” আচ্ছা এসো।”

নোরা চোখ বড় করে বলল,” কোলে নিবেন নাকি?”

অনিক তেতে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নিয়ে বলল,,” বসে থাকো। আমি মই খুজে আনছি।”

” এই না না না! প্লিজ প্লিজ, মই আনবেন না। আপনি মই আনতে আনতে আমি হার্টঅ্যাটাক করে মরে যাব।”

” তাহলে কি করবো?”

নোরা লাজুকমুখে বলল,” যেটা করছিলেন সেটাই করুন।”

অনিকের গম্ভীরমুখে বলল,” তাহলে মুখটা বন্ধ রেখে এসো।”

অনিক পাথরে পাড়া দিয়ে উঁচু হল। নোরা অনিকের গলা জড়িয়ে ধরল। অনিক নোরাকে পাজাকোলা করে নিচে নামালো। এই কয়েক সেকেন্ডে নোরার সম্পুর্ণ শরীর বেয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হল। কোনো এক সুখময় অনুভূতিতে তার চোখে পানিও চলে এসেছে। হৃৎস্পন্দনের গতিবিধি তুমুলে। মনে হচ্ছে, এই অবস্থায় মরে গেলেও তার কোনো আফসোস থাকবেনা!

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০৫

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৫
লিখা: Sidratul muntaz

ম্যাথ এক্সাম চলছে। নোরার সিট অনেকটাই পেছনে। প্রতি বেঞ্চে দুজন করে স্টুডেন্ট। নোরার সামনের বেঞ্চে সেজুতি আর অন্তরা। পাশের সারির ঠিক সামনে তন্নী আর জবা। তাদের পেছনে রেশমি আর সাদিয়া। অনিক পুরো ক্লাসরুম পরিদর্শন করছে। রেকর্ড বলে অনিকস্যারের গার্ড মানেই ভয়ংকর কিছু। গত একঘণ্টা যাবৎ সবাই সেটা বেশ ভালোভাবেই টের পাচ্ছে। নোরা হঠাৎ ফিসফিস করে অন্তরাকে ডাকল,” অন্তু, এই অন্তু।”

অন্তরা বিরক্তগলায় বলল,” কি?”

“স্যার তন্নীকে সামনের বেঞ্চে দিয়েছে, তাহলে আমাকে পেছনের বেঞ্চে কেন?”

” সেটা আমি কিভাবে জানবো। স্যারকে জিজ্ঞেস কর!”

নোরা আর কিছু বলার আগেই তার মাথায় খট করে একটা আওয়াজ হল। সবাই লেখা রেখে নোরার দিকে তাকাল। অনিক ওর মাথায় মার্কার প্যান ছুঁড়ে মেরেছে। নোরা মাথায় হাত ডলতে ডলতে বলল,” সরি স্যার।”

সবাই হেসে উঠল। অনিক টেবিলে ডাস্টার বারি দিয়ে বলল,
” সবাই সাইলেন্ট। আর মাত্র বিশ মিনিট সময় আছে। জলদি শেষ করো। আর নোরা তোমার খাতা আমি পাঁচমিনিট আগে নিবো।”

নোরা চোখ বড় করে বলল,” কেন স্যার?প্লিজ এমন করবেন না আমি..”

অনিক নিজের ঠোঁটে আঙুল ঠেঁকিয়ে বলল,” হিশশশ! কোনো কথা না। পরীক্ষা দাও।”

নোরা আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ পর সামনে থেকে হাসির শব্দ পাওয়া গেল। তন্নী হাসছে। অনিক আবার ডাস্টার দিয়ে টেবিলে আঘাত করে বলল,” তন্নী! সাইলেন্ট থাকো। নাহলে লাস্ট টেন মিনিটস দাঁড় করিয়ে এক্সাম দেওয়াবো।”

তন্নী বলল,” সরি স্যার।”

নোরা সেজুতিকে পেছন থেকে খোঁচা মারল। সেজুতি বলল,” উফফ কি?”

নোরা বলল,” আমার বেলায় মার্কার ঢিল মেরে মাথা ফাটিয়ে দেয়,আর তন্নীর বেলায় শুধু একটা ধমক কেন?”
” তুই তো কথা বলেছিস। আর তন্নী তো কথা বলেনি না? শুধু হেসেছে। সেজন্য। ”

” হাসলে তো শাস্তি আরো বেশি হওয়া উচিৎ। ”

অনিক কড়াশব্দে ডাকল,” নোরা! আর জাস্ট ফাইভ মিনিটস। তারপর আমি তোমার খাতা নিবো।”

“সরি স্যার। আর হবে না। আমার এখনও অনেক কিছু বাকি।”

” লেখা রেখে কথা বললে বাকি তো থাকবেই। একটা কথা সবাইকে আমি আরেকবার মনে করিয়ে দেই, ফুল এনসার না করলে কিন্তু আমি খাতা নিবো না। এক্সাম বাতিল।”

সবাই আতঙ্ক নিয়ে শব্দ করল,” কি?”

রেশমি বলল,” স্যার প্লিজ এতো নিষ্ঠুর হবেন না। কুয়েশ্চন এতো কঠিন আসছে আমরা কিভাবে ফুল এনসার করবো? কিছু কিছু প্রশ্নের তো মানেও বুঝিনাই।”

অনিক বলল,” প্রশ্ন ঠিকই আছে। না পড়লে তো এমন লাগবেই। আর তোমাদের এখন এসব কথা বলতে লজ্জা লাগেনা? এরাই নাকি আবার এইচএসসিতে জিপিএফাইভ পেয়ে আসছে। আনবিলিভেবল!”

রেশমি চুপ হয়ে গেল। অনিক ঘড়ি দেখে বলল,” আর মাত্র দশমিনিট। সবাই জলদি শেষ করো।”

রেশমি আবার বলল,” স্যার একটু মেহেরবানি করে আর পাঁচটা মিনিট সময় কি বাড়িয়ে দেওয়া যায়না?”

অনিকের তাৎক্ষণিক জবাব,”না।”

সবাই হেসে দিল। অনিক আবার ধমকে উঠল,” সাইলেন্ট।”

তারপর আবার সবাই চুপ। একটু পর সময় শেষ হল। সবাই খাতা জমা দিল। অনিক খাতাগুলো নিয়ে পাশের রুমে চলে গেল। সবাই বসে টুকটাক গল্প করছে। কে কেমন এক্সাম দিল এসব নিয়েই চলছে আলাপ। তন্নী ম্যাথ প্রশ্নটা ইনিয়েবিনিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ জবাকে বলল,”জবা শোন,আমি না একটা কুয়েশ্চনের মানে বুঝিনি। এইটা স্যারকে জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি জিজ্ঞেস করে আসছি।”

তন্নী দ্রুতগতিতে পাশের রুমে চলে গেল। তন্নী যাওয়ার পর নোরা বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আর অস্থিরভাব করতে লাগল। অন্তরা বলল,” নোরা তোর কি হয়েছে?”

নোরা কোমরে হাত রেখে বলল,” অনিকস্যার ওইরুমে একা। তন্নীর এখন যাওয়ার কি দরকার ছিল? স্যার এখানে আসার পর জিজ্ঞেস করা যেতো না?”

সবাই এ কথা শুনে অদ্ভুতচোখে তাকাল। অন্তরা হেসে বলল,” কন্ট্রোল!”

দিনটি শুক্রবার হওয়ায় পুরো কোচিং এ আর কোনো স্টুডেন্ট ছিলনা। শুক্রবারে কোচিং এ এক্সাম থাকে। তাই যাদের এক্সাম হয় তারাই সকালে আসে। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়ার পরেও তন্নী এলো না। নোরা অন্তরা আর সেজুতির মাঝখানে বসে ফিসফিস করে বলল, ” আচ্ছা আমি একবার গিয়ে দেখবো তন্নী কি করছে?”

অন্তরা বলল,” পাগল? স্যার রেগে যাবে।”

নোরা বলল,” রাগবে কেন? আমি বলবো আমারও কুয়েশ্চনে সমস্যা আছে।”

সেজুতি বলল,” তোর সমস্যা কোথায় দেখা!”

ওদের কথার মাঝখানেই তন্নী আর অনিক ঢুকল। দরজা দিয়ে ঢোকার সময় অনিক তন্নীকে সাইড দিল। তন্নী আগে ঢুকল আর অনিক পরে। নোরা সরুচোখে তন্নীর দিকে তাকিয়ে ছিল। অনিক বলল,” সবাই জায়গায় বসো। এক্সামের সময় যে যেভাবে বসেছিলে ঠিক সেভাবে।”

সবাই তাই করল। অনিক খাতা বিলি করতে শুরু করল। নোরার খাতাটা দেওয়ার সময় অনিক ছুঁড়ে মারল। নোরা ক্যাচ ধরতে পারল না বলে খাতাটা তার নাকে-মুখে এসে লাগল। অনিক ধমকের সুরে বলল,” খাতাটাও ধরতে শিখোনি। কত মার্কস পেয়েছো গুণে আমাকে জানাও।”

নোরা নরম সুরে বলল,” আচ্ছা স্যার।”

সবাইকেই একই কথা বলা হল। তন্নীর খাতা দেওয়ার সময় অনিক খাতাটা তন্নীর বেঞ্চের উপর রাখল। তন্নী অনায়াসে খাতাটা নিয়ে নম্বর গুণতে শুরু করল। নোরা এই ঘটনা দেখে সেজুতিকে বলল, ” আমার খাতাটা মুখের উপর ছুঁড়ে মারল। আর তন্নীরটা এতো সুন্দর করে বেঞ্চের উপর রেখে দিল কেন?”

অন্তরা নোরার কথায় হেসে দিল। সেজুতি বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
” কারণ তুই পেছনে বসেছিস। আর তন্নী স্যারের সামনে ছিল তাই।”

” তাহলে স্যার আমাকে পেছনে কেন বসাল?”

” জানিনা। এখন ডিস্টার্ব করিস না, মার্কস গুণতে দে। ”

“কত পেলি?”

” গোণা শেষ হয়নি। ”

নোরা অন্তরার দিকে তাকাল,” অন্তু তুই কত?”

অন্তরা বলল,” পঞ্চাশে বত্রিশ। তুই?”

” আমি পয়ত্রিশ।”

“কংগ্রেটস।”

অনিক তন্নীকে জিজ্ঞেস করল,” তন্নী কত পেয়েছো?”

তন্নী চাপা গলায় বলল,” চৌত্রিশ।”

নোরা ফিসফিস করে বলল,” ইয়েস! আমি ওর থেকে এক মার্ক বেশি। স্যার আমাকে কখন জিজ্ঞেস করবে?”

অন্তরা বলল,” এতো কথা বলিস না। চুপ থাক।”
অনিক একে একে সবাইকে জিজ্ঞেস করছিল। নোরার সময় না আসতেই সে বলে ফেলল,” স্যার আমি পয়ত্রিশ।”

অনেক খুশি খুশি ভাব নিয়ে কথাটা বলল। অনিক দায়সারাভাব করে বলল,” তো আমি কি করবো?”

ক্লাসরুমে হাসির রোল পড়ে গেল। নোরার মুখটা এতোটুকু হয়ে গেছে। অন্তরা হাসতে হাসতে বলল,” এজন্যই তোকে বলেছি কথা একটু কম বল।”

নোরা কাঁদো কাঁদো মুখে বলল,” সবার থেকে আমিই বেশি মার্কস পেয়েছি। তবুও স্যার আমাকে কিছুই বলল না। একটু বাহবা পর্যন্ত দিল না। আমার জায়গায় তন্নী হলে এতোক্ষণে মাথায় তুলে নাচতো।”

সেজুতি বলল,” তন্নীর মতো কম কথা বলার অভ্যাস কর। তাহলে দেখবি তোকেও মাথায় তুলে নাচবে।”
নোরা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,” আমি মাথায় উঠতে চাইনা, আমি তো কোলে উঠতে চাই।”

সেজুতি বলল,” আস্তাগফিরুল্লাহ।”

অন্তরা সেজুতিকে বলল,” বলেছিলাম না? ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে! আসলেই মাথাখারাপ হয়ে গেছে।”

ছুটির পর কোচিং এর গেইট দিয়ে বের হয়ে নোরা আর অন্তরা স্কুটিতে উঠছিল। সেজুতি ওদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল। নোরার মন খুব খারাপ। সবার চেয়ে বেশি মার্কস পাওয়ার পরেও অনিকস্যার কেন তাকে কিছু বলল না। সবাই এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলছে। হঠাৎ কোথ থেকে যেন রেশমি এসে ডাকল,” এই নোরা!”

নোরা হেলমেট খুলে রেশমির দিকে তাকাল,” কি?”

” এদিকে এসো। তোমার সাথে একটু কথা আছে।”

নোরা সেজুতি আর অন্তরাকে দাঁড়াতে বলে রেশমির কাছে গেল,” বলো কি কথা?”

রেশমি নোরার ঘাড়ে হাত রেখে হাঁটতে হাঁটতে বলল,” আমি জানি আজকে তোমার মনখারাপ। সেজন্য আমার কাছে তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে।”

নোরা হাঁটা থামিয়ে নিজের ঘাড় থেকে রেশমির হাত সরিয়ে বলল,”আমার মনখারাপ না। আর কি গুড নিউজ?”

রেশমি হেসে বলল,” আর দুদিন পর অনিকস্যারের বার্থডে।”

নোরা হেসে বলল,” আমি জানি।”

রেশমি উৎকণ্ঠা নিয়ে বলল, ” জানো? তাহলে কিছু প্ল্যান করেছো স্যারের জন্য?”

” এখনও কিছু ভাবিনি। আমি কনফিউজড। স্যার কি পছন্দ-অপছন্দ করে সেটা তো আমি জানিনা।”

” আমি জানি। স্যার কফি খেতে খুব পছন্দ করে। কফি উনার নেশা। স্যার কিন্তু একবার নিজেই বলেছিল, মনে আছে?”

নোরা খুশিতে লাফিয়ে উঠে বলল,” হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে। তাহলে কি স্যারকে একটা ইন্সট্যান্ট কফি মেশিন গিফট করবো? স্যার খুব খুশি হবে।”

রেশমি মুখ গোমরা বানিয়ে বলল,” আমিও সেটা ভেবেছিলাম। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।”

” কি সমস্যা? ”

” তন্নী স্যারের জন্য আগেই কফি মেশিন কিনে ফেলেছে।”

নোরার মাথায় বাজ পড়ল,” কি?”

“হুম। একই গিফট দুইটা হয়ে গেলে সেটার তো আর ভ্যালু থাকবে না। তাই আমাদের অন্যরকম কিছু ভাবতে হবে। আমি ভাবছি স্যারকে শেক্সপিয়রের একটা বই দিবো।”

” হ্যাঁ এটাও দারুণ আইডিয়া। বই তো যে কেউ পছন্দ করবে। কিন্তু আমি কি দিবো?”

“তোমার জন্য আমার কাছে অন্য প্ল্যান আছে।”

” কি প্ল্যান? আমি এমনকিছু দিতে চাই যেটা স্যারের সবথেকে পছন্দ হবে।”

” একটা জিনিস আছে। যেটা স্যারের সবথেকে পছন্দ। বলতে পারো স্যারের নেশা।”

” কি সেটা?”

রেশমি নোরার কাঁধে হাত রেখে রেশমি বলল, “শোনো নোরা, তুমি যদি চাও তোমার গিফট স্যারের সবচেয়ে পছন্দ হোক, তাহলে আমি বলি? তুমি উনাকে এক কার্টুন ব্যানসন গিফট করো।”

“ব্যানসন? মানে সিগারেট?”

নোরার চোখ বড় হয়ে গেল। রেশমি বলল,” হুম৷ স্যারের সিগারেটের নেশা আছে। আর ব্যানসন তো সবার অন্যতম ফেভরেট ব্র্যান্ড। স্যার এটা পেলে অনেক খুশি হবে।”

” পাগল? স্যার যদি রেগে যায়? আমি স্টুডেন্ট হয়ে টিচারকে সিগারেট গিফট করবো? ছি ছি!”

” এখানে ছি এর কি হল? আরে যারা সিগারেটখোর ওরা এতোকিছু চিন্তা করেনা। ওরা শুধু পেলেই খুশি। তুমি এক কার্টুন ব্যানসনের সাথে একটা সুন্দর লাইটার গিফট করো। দেখবা স্যার এত্তো খুশি হবে! আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।”

“ছি! জীবনেও না। উনি টিচার মানুষ এসব আমি কিভাবে গিফট করব উনাকে?”

” আরে গাঁধী, এইটা ছেলে পটানোর একটা অভিনব পদ্ধতি। আমি জানি তুমি অনিকস্যারকে লাইন মা’রছো। তাই তোমাকে বুদ্ধিটা দিলাম। বেশিরভাগ মেয়েই সিগারেট পছন্দ করেনা। আর তুমি যদি মেয়ে হয়ে সিগারেট গিফট করো, স্যার তোমাকে ইউনিক আর স্মার্ট ভাববে। একবার ট্রাই করে দেখো! তুমি রাজি না হলে সুযোগটা আমিই কাজে লাগাবো। মানে আমিই ব্যানসন গিফট করবো। তুমি বই দিও। শেক্সপিয়রের বই।”

নোরা কিছু একটা ভেবে বলল,” না থাক! ব্যানসন আমিই দিবো। বই তুমি দিও।”

” সিউর?”

” হ্যাঁ সিউর।”

” ঠিকাছে। তাহলে ডান। আর গিফট কেনার জন্য হেল্প লাগলে আমাকে বলো। আমার চেনা-জানা একটা ব্র্যান্ডের দোকান আছে। সেখানে সব ব্র্যান্ডের সিগারেট পাওয়া যায়। দামী ব্র্যান্ড। আমি তোমাকে নিয়ে যাবো।”

“আচ্ছা। আমি জানাবো তোমাকে।”

নোরা মুখে এ কথা বললেও মনে মনে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। কাজটা ঠিক হবে কিনা।রেশমির সাথে কথা বলে নোরা ফিরে আসার পর অন্তরা বলল,” কিরে, রেশমি কি বলে?”

নোরা বলল,” সোমবার অনিকস্যারের বার্থডে। সেটা নিয়েই কথা বলছিল।”

“ওহ।”

সেজুতি বলল,” অনিকস্যারের বার্থডে’র কথা তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

নোরা চিন্তিত মুখে হেলমেট পরে নিল। তারপর স্কুটারে বসল। সেজুতি ওদেরকে বাই বলে চলে গেল। নোরা অন্তরাকেও এ বিষয়ে কিছু বলল না। এখন বললে অন্তরা অযথাই বকাবকি করবে। ব্যাপারটা নিয়ে নোরা আরও ভাববে। অনিকস্যারের সত্যিই সিগারেটের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি আছে কিনা সেটা জেনে নেওয়া দরকার। সেদিনরাতে নোরা শুধু এই বিষয়টা নিয়েই চিন্তা করল। অনিককে ফেসবুকে রিকোয়েস্ট পাঠানো হয়েছিল কালরাতেই। সে আজ এক্সেপ্ট করেছে।

নোরা কোনোকিছু চিন্তা না করেই অনিককে মেসেজ দিল,
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার ভালো আছেন?”

তারপর সারারাত রিপ্লাইএর জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু রিপ্লাই এলো না। নোরা মনখারাপ নিয়েই ঘুমিয়ে গেল। ঘুমানোর আগে কেঁদেছিল খুব। তারপর ঘুম ভেঙে দেখল চোখ ফুলে লাল টকটকা হয়ে আছে। আরেকবার ফেসবুকে ঢুকল। রিপ্লাই এখনো আসেনি। তবে অনিক অনলাইনে ছিল দুইঘণ্টা আগে। তখনো কি মেসেজটা দেখেনি? নাকি ওকে ইগনোর করছে? নোরা মেনে নিতে পারছে না। বুকের মধ্যে চিনচিনে ব্যথাটা শুধু বেড়েই চলেছে। সাথে সেই দমবন্ধকর অনুভূতি তো আছেই। সব মিলিয়ে নোরার অসহ্য লাগছে।

এই কয়েকদিনে একটা জিনিস বেশ ভালোভাবেই টের পেয়েছে সে। অনিকের প্রতি তার অনুভূতিটা দিন দিন আসক্তির রুপ নিচ্ছে। এক মুহুর্তও অনিকের কথা না ভেবে থাকতে পারেনা সে। আর এই ব্যাথাটা যে কতটা যন্ত্রণার সেটা যে পায় সেই-ই বুঝে। সানিও কি এতোটাই কষ্ট পেয়েছিল ওর জন্য? এই প্রথম নোরার সানির জন্য খুব খারাপ লাগছে। সানিকে ফোন করে সরি বলতে ইচ্ছে করছে। ওর কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু ক্ষমা চাওয়ার মুখ তার আর নেই।সে অন্যায় করেছে সানির সাথে। চরম অন্যায়।

সন্ধ্যার শুরুতে কোচিংরুমের সিঁড়ির পাশে কাঁচের গ্লাসের জানালায় চোখ রেখে দাঁড়িয়ে ছিল নোরা। সামনের ক্লাস থেকে একটু পর অনিকস্যার বের হবে। নোরা অনিককে একনজর দেখবে। অনিকও তাকে দেখবে। কয়েক সেকেন্ডের দৃষ্টি বিনিময়! এতেই নোরা সারাদিনের প্রশান্তি পেয়ে যাবে। নোরা অন্যমনস্ক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।

হঠাৎ একটা মিষ্টি কণ্ঠ শুনে ঘুরে তাকাল। তাকে কেউ ডাকছে না। একটা মেয়ে খুব শব্দ করে হেসে আফজাল স্যারের সাথে কথা বলছে। মেয়েটা আফজালস্যারকে কিছু দিচ্ছে। আফজাল স্যারের মুখ হাসি হাসি। উনি খুব খুশি হয়ে প্যাকেট টা নিয়ে বললেন,” থ্যাঙ্কিউ।”

নোরা ভালো করে তাকিয়ে দেখল ওইটা একটা সিগারেটের প্যাকেট। মেয়েটা আফজাল স্যারকে সিগারেট দিচ্ছে কেন? আবার স্যারও কত খুশি হয়ে নিচ্ছেন। মেয়েটা স্যারের সাথে দাড়িয়ে আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। তারপর চলে গেল। মেয়েটা যাওয়ার সময় আফজাল স্যার হাসি হাসিমুখ করে অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। ছাত্রী হয়ে এই মেয়েটা যদি আফজাল স্যারকে সিগারেটের প্যাকেট দিতে পারে তাহলে সে কেন পারবেনা? আফজাল স্যারকে দেখে মনে হল বিষয়টায় সে ভীষণ খুশি। অনিকস্যারও কি খুশি হবে?

রেশমির কথাগুলো আরেকবার মনে পড়ছে। নোরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। সে অনিকস্যারের বার্থডেতে ব্যানসন গিফট করবে। সাথে খুব সুন্দর একটা লাইটার। অনিকস্যারের রিয়েকশন কেমন হবে আন্দাজ করা যাচ্ছেনা। একটু তো রিস্ক নেওয়া যেতেই পারে। পরে কি হবে সেটা দেখা যাবে।

আজ সোমবার। অন্তরা নোরাকে বাসা থেকে নিতে এসেছে। নোরা কোচিং এ যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আলমারির সামনে একঘণ্টা যাবৎ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু পড়ার মতো কোনো ড্রেস পাচ্ছে না। অন্যান্যদিন জামা-কাপড় নিয়ে এতো ঝামেলা হয়না তার। আজ হচ্ছে। কারণ আজ একটা স্পেশাল দিন। অনিকস্যারের বার্থডে।নোরা এমন রঙের জামা খুঁজছে যেটা কোচিংয়ের সাথেও মানিয়ে যায় আবার গর্জিয়াসও দেখায়। কিন্তু এমন কোনো রঙ খুজে পাচ্ছেনা। অন্তরা এসে নোরাকে জামা চুজ করে দিল। লাল রঙের সিল্কের কামিজ। কালো ওরনা আর সেলোয়ার।

নোরা জামাটা দেখে বলল,” নারে অন্তু এটা আমি পরবো না।”

” কেন?”

” এটা বেশি গর্জিয়াস হয়ে যায়। পরে স্যার কি মনে করবে?”

” আরে ধুর! কিচ্ছু হবেনা। তোকে পরতে বলছি পর। খুব সুন্দর লাগবে। এটা পরে লাল টুকটুকে লিপস্টিক আর চোখে গাঢ় করে কাজল লাগাবি। চুলগুলো স্ট্রেইট করে পেছনে ছেড়ে দিবি। আর সামনের কয়েকটা চুল কার্ল করে কপালে ফেলে রাখবি। তোকে যে কি সুন্দর লাগবে রে নারু! সাথে যদি বড় পাথরের কানের দুল পড়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। এই তোর কাছে আছে বিগস্টোন?”

“তুই কি পাগল হয়েছিস? বিগস্টোন পড়ে কি আমি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি? আমি এসব কিছুই করবোনা। আর আমাকে এতো কিছু বলছিস, তুই নিজে কি পরেছিস হ্যাঁ? মুখে তো স্নো টা পর্যন্ত মাখিস নাই। আর চুলও মনে হয় ঠিকমতো আচড়াস নাই। আর কি ড্রেস পড়েছিস এটা? ম্যান্ধামার্কা রং!”

” আমার তো আর অনিকস্যারের অ্যাটেনশন পাওয়ার দরকার নেই। দরকারটা হচ্ছে তোর। সেজন্য তোকে সাজতে হবে। আর কোনো কথা না। যা বলছি তাই কর। হাতে বেশি সময় নেই।”

” ধুর অন্তু তুই কিচ্ছু বুঝিস না। আমি এভাবে সেজে গেলে মানুষ কি ভাববে? আর অন্য টিচাররাই বা কি ভাববে?”

” কেউ কিছুই ভাববে না। সব তুই একাই ভাবছিস। আর অনেক মেয়েরা তো মেকআপ করেও কোচিং এ আসে। মনিকা, সানজিদা ওদের দেখিস না?”

” ওরা তো সবসময় সাজ-গোজ করে। কিন্তু আমি হঠাৎ একদিন সেজে গেলে সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকবে। আমার খুব অকওয়ার্ড লাগবে। ভাবতেই কেমন শরীর শিরশির করছে। ও মাই গড। আমি পারবোনা।আল্লাহ!”

” এখন কিন্তু থাপ্পড় খাবি। বেশি ন্যাকামি করছিস। চুপচাপ ড্রেস পর। আমি বলছি কিচ্ছু হবেনা।”

অন্তরা একপ্রকার জোর করেই নোরাকে সাজিয়ে দিল। কানে বড় পাথরের দুলও পড়ালো। কোচিং এ ঢোকার সময় নোরার খুব লজ্জা লাগছিল। সে ওরনা দিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে রাখল। আর নিকাবের মতো মুখ ঢেকে রাখল। যেন কেউ তাকে না চিনতে পারে। ক্লাসে যাওয়ার পর অন্তরা তার মাথার ঘোমটা খুলে দিল। আর স্বাভাবিকভাবে ওরনাটা পড়িয়ে দিল।

সেজুতি নোরাকে দেখে অবাক হয়ে বলল,” দোস্ত তোকে তো আজ দারুণ লাগছে। পুরাই লালকুমারী।”

নোরা হেসে দিল। সেজুতি নোরার হাতে বড় বক্স দেখে বলল,” এটা কি?”

নোরা বলল,” অনিকস্যারের গিফট।”

সেজুতি বলল,” এতোবড় প্যাকেটে? কি এমন কিনেছিস স্যারের জন্য? ”

নোরা বলল,” সারপ্রাইজ। শুধু স্যার দেখবে। তখন তোরাও দেখিস।”

সেজুতি অন্তরাকে বলল,” অন্তরা বলতো এটার ভিতর কি? তুই জানিস?”

অন্তরা বলল,” জানিনা।আমাকেও কিছু বলেনি।”

সেজুতি আর অন্তরা মিলে গেস করা শুরু করল। একজন বলছে চকলেট, আরেকজন বলছে বড় টেডি বিয়ার, আরো অনেক কিছুই বলছে। কিন্তু আসল জিনিসটা কেউই ধরতে পারছেনা।

নোরা সবার মন্তব্য শুনে মিটিমিটি হাসছে। নোরা প্রথমে ভেবেছিল সে-ই সবথেকে বেশি সেজেছে। কিন্তু তন্নী যখন ভেতরে ঢুকল সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাওয়ার উপক্রম। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে তন্নীর দিকে। এমনিতে মেয়েটা খুব ফরসা তার উপর পড়েছে গোলাপী রঙের শাড়ি। এলোমেলো খোলা চুল। মাথায় ছোট্ট টিকলি। গলায় কিছু নেই। কানে ছোট ছোট দুল। টিকলিটাই বেশি চোখে লাগছে। আর সেজন্যই তাকে বেশি আকর্ষণীয় লাগছে। ঠোঁটে গোলাপী রঙের লিপগ্লোস আর বড় করে আই লাইনার পড়েছে। সব মিলিয়ে তন্নীকে আশ্চর্যরকম সুন্দর লাগছে।

নোরা নিজে মেয়ে হয়েও তন্নীর থেকে চোখ ফেরাতে পারছে না। তাহলে ছেলেদের কি অবস্থা হয়েছে আল্লাহ ভালো জানে। অন্তরা তন্নীকে দেখে রসিকতা কর বলল,”বাব্বাহ! তন্নী তোমাকে তো পুরা আগুন লাগছে। রাস্তা দিয়ে আসার সময় কয়জন হার্ট অ্যাটাক করেছে শুনি?”

অন্তরার কথায় সবাই হাসল। তন্নী লজ্জা পেলেও সেটা প্রকাশ করল না। দায়সারাভাবে বলল,” একজনও না।”

অন্তরা বলল,” আরে কি বলো? তুমি দরজা দিয়ে ঢোকার সময় আমারই তো হার্টঅ্যাটাক হতে যাচ্ছিল। তাহলে রাস্তাঘাটের মাসুম ছেলেগুলোর যে কি বেহাল দশা হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। আমার তো মনে হয় যে কয়জন তোমাকে দেখেছে সবকয়টা হার্টঅ্যাটাক করেছে। কিন্তু তুমি অন্যকারো চিন্তায় ব্যস্ত ছিলে তো, তাই দেখোনি।”

নোরা এই কথা শুনে হেসে উঠল শব্দ করে। আর কেউ না বুঝলেও সে বুঝেছে অন্তরা কোন অর্থে কথাটা বলেছে!

জবা বলল,” এই তন্নী, জিনিসগুলো বের কর! সাজাতে হবে না?”

তন্নী বলল,” ও হ্যাঁ। আমি বের করে দিচ্ছি, তোরা সাজা। আমি শাড়ি পরে এতো কাজ পারবো না।”

সেজুতি বলল,” কি সাজানোর কথা হচ্ছে?”

সাদিয়া বলল,” আজকে অনিকস্যারের বার্থডে না? তাই আমরা সবাই মিলে চাদা তুলে ডেকোরেশনের জিনিস কিনেছি। ক্লাসরুমটা সাজাবো। আর তন্নী তো স্যারের জন্য কেকও বানিয়েছে।”

তন্নী মিটিমিটি হাসছে আর ব্যাগ থেকে ডেকোরেশনের জিনিস বের করে টেবিলে রাখছে। সেজুতি, অন্তরা আর নোরা কিছুক্ষণ চোখাচোখি করল।

সেজুতি বলল,” তাই নাকি? আমাদের বললে না তো! তাহলে আমরাও জয়েন করতাম।”

জবা বলল,” আরে এটা আবার বলার কি আছে?”

সেজুতি বলল,” না বললে জানবো কিভাবে?”

নোরা সেজুতিকে থামিয়ে ফিসফিস করে বলল,” বাদ দে। ওদের কাজ ওরা করুক।”

সেজুতি আর কিছু বলল না। সবাই ক্লাসরুম সাজানোয় ব্যস্ত হয়ে গেল। দরজার উপর দড়ি টানিয়ে ঝুড়ি আটকে রাখা হয়েছে। ঝুড়িতে অজস্র ফুলের পাপড়ি। অনিকস্যার যখন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকবে দড়ির টান লেগে ফুলগুলো ঝড়ঝড়িয়ে পড়বে তার উপর। তন্নী টেবিলে কেক রেডি করে দাঁড়িয়ে থাকবে। সবাই তাকে ঘিরে থাকবে।

অনিকস্যার ঢোকামাত্রই সবাই চিৎকার করে বলবে,” হ্যাপি বার্থডে স্যার।” সবাই তন্নীকে ঘিরে দাঁড়াল। পুরো ক্লাসরুমের সবাই সমবেত হয়েছে। শুধু সেজুতি, নোরা আর অন্তরা আসল না। ওরা বেঞ্চেই বসে আছে। কারণ এই আয়োজনের কথা ওরা তিনজন ছাড়া সবাই জানতো। তাই ওরা তিনজন ইচ্ছে করেই যায়নি।

সময়মতো অনিক ক্লাসে ঢুকল। সবাই উচ্চশব্দে চিৎকার দিয়ে তাকে উইশ করল। অনিক সবকিছু দেখে মোটামোটি চমকালো। কিন্তু এতোটাও চমকালো না যতটা দরকার ছিল। হয়তো প্রায় প্রত্যেক ক্লাস থেকেই এমন সারপ্রাইজ পেয়ে এসেছে সে। এই ক্লাসেও যে সারপ্রাইজ ওয়েট করছে সেটা আগে থেকেই জানতো। তাই খুব একটা অবাক হয়নি।

কিন্তু নোরা অবাক হয়ে অনিকের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ আটকে গেছে অনিকের লাল পাঞ্জাবীতে। পলক ফেলতেও যেন ভুলে গেছে সে। লাল পাঞ্জাবীর উপর কালো সুতোর এমব্রয়ডারি ডিজাইন। নোরা বুঝতে পারছে না তার কামিজের সাথে মিলে গেল কি করে? এই কামিজটা চুজ করার জন্য এখন অন্তরাকে একটা কিস দিতে ইচ্ছে করছে। অনিক মাথার ফুলগুলো ঝাড়তে ঝাড়তে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াল।

সবাই কেক কাটার জন্য জোরাজোরি করতে লাগল।নোরা, সেজুতি আর অন্তরা আগে বেঞ্চে বসেছিল। এবার শুধু উঠে দাঁড়াল। অনিক ওদের দেখে বলল,” তোমরা ওখানে কেন? তোমরাও আসো!”

অন্তরা হেসে বলল,” না স্যার থ্যাঙ্কিউ। আমরা এখানেই ঠিকাছি।”

অনিক কি মনে করে যেন আর কিছু বলল না। নোরার হালকা মনখারাপও হল। অনিক যেন তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। কি লাভ হলো এতো সেজে-গুজে এসে? কেক কাটার সময় জবা, রেশমি আর সাদিয়া বার বার এক কথা বলছিল,” স্যার কেক টা অনেক স্পেশাল। এটা তন্নী নিজের হাতে বানিয়েছে।”

তখন নোরা উদাশমুখে দাঁড়িয়ে ছিল। কেক কাটার পর্ব শেষ হল। কিন্তু অনিক কেক খেলনা। তার নাকি চকলেট কেকে এ্যালার্জী। এই কথা শুনে নোরা মনে মনে হেসে উঠল৷ তার যে কি আনন্দ লাগছিল। তন্নীর মুখ শুকিয়ে এতোটুকু হয়ে গেছে। বেচারা যার জন্য এতো কষ্ট করে কেক বানাল সে-ই খেল না। নোরার হাসি যেন থামছেই না। তারপর আসলো গিফট দেওয়ার পালা। সবাই এক এক করে গিফট বের করছে। তন্নী সত্যি সত্যি কফি মেশিন কিনেছে। সাথে একটা হাতঘড়ি আর পারফিউমও। তন্নীর আয়োজন দেখে নোরা, সেজুতি, অন্তরা একজন আরেকজনের দিকে আড়চোখে তাকাল। রেশমি শেক্সপিয়ারের বই দিয়েছে। সাদিয়া আর জবা দিয়েছে চকলেটের বক্স। সবার শেষে নোরা গেল গিফট দিতে। অনিক গিফট তুলতে তুলতে ক্লান্ত। নোরার হাতে এতোবড় বক্স দেখে অনিক খুব কৌতুহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল,” কি এটা?”

নোরা হেসে বলল,”খুলে দেখুন।”

অনিক একটা সন্দেহের হাসি দিয়ে গিফট খুলতে শুরু করল। নোরার হঠাৎ মনে হল অনিক খুব আগ্রহ নিয়ে তার গিফটটা খুলছে। অন্যান্য গিফটগুলো খোলার সময় এতোটা আগ্রহ ছিলনা ওর। বেশিরভাগ গিফট তো সে খুলেওনি৷ যার গিফট সে-ই খুলে দেখিয়েছে। অনিক গিফটটা খুলার পর দেখল এক কার্টুন ব্যানসন সিগারেট। প্যাকেটের উপর বড় বড় অক্ষরে লেখা,” ধূমপান যৌনক্ষমতা হৃাস করে।”

অনিক লেখাটার দিকে তাকিয়ে ছিল। কে জানি লেখাটা শব্দ করে পড়ল। আর সবাই সঙ্গে সঙ্গে হেসে উঠল। পুরো ক্লাস জুড়ে হাসির রোল পড়ে গেল। সেজুতি আর অন্তরা হাসল না কেবল। নোরা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গিফট কেনার সময় এই লেখাটা একদমই খেয়াল করেনি সে।অনিক ক্লাসে হাসির শব্দ এমনিতেই অপছন্দ করে। এবার আরো বেশি রেগে গেল। উচ্চশব্দে বলল,” সবাই সাইলেন্ট!”

সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসরুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা তৈরি হল। অনিক নোরার দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,” নোরা! তুমি এইটা দিয়ে কি বুঝাতে চাইছো?”

নোরা অবাক হয়ে বলল,” কই? আমি তো কিছু বুঝাতে চাইছি না স্যার!”

” তাহলে এ ধরণের উপহার দেওয়ার মানে কি? তুমি জানো এটা কতবড় বেয়াদবি?”

নোরা আকাশ থেকে পড়ল। কি বলবে বুঝতেই পারছেনা। অনিক ধমক দিয়ে বলল,” আমাকে এ ধরণের জিনিস দেওয়ার সাহস তুমি কিভাবে পেলে?”

নোরা আৎকে উঠল। বুকটা ধুকধুক করতে লাগল তার। পাখির মতো আত্মাটা ছটফটানি শুরু করে দিয়েছে। অনিকের রাগে কণ্ঠনালি পর্যন্ত কাপছে। চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। শিরা-উপশিরা যেন দপদপ করে লাফাচ্ছে। নোরা সেটা স্পষ্ট টের পাচ্ছে। ক্লাসের সবাই নিস্তব্ধচোখে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। নোরা কাঁপা কণ্ঠে বলল,” সরি স্যার। কিন্তু আমার মনে হয়েছিল আপনি খুশি হবেন।”

অনিক বিস্মিত হয়ে বলল,” জানিনা এই জিনিস তুমি কি বুঝে দিয়েছো। আবার বলছো আমি খুশি হবো? নোরা আমি তোমাকে এতোদিন বোকামেয়ে ভাবতাম। কিন্তু তুমি আসলে বোকা না, তুমি একটা বেয়াদব। ”

অনিক সিগারেটের কার্টুনটা প্রায় ছুঁড়ে ফেলল। নোরা সরে দাঁড়াল। নাহলে বক্সটা তার মাথায় বারি খেত। নোরার চোখ দিয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পানি আসছে। কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎ ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে গেল সে।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০৪

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৪
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা আর অনিক পাশাপাশি স্কুটারের উপর বসে আছে। চারদিকে ঠান্ডা বাতাস। নোরার শীত লাগছে। অনিক বলল,
” তোমার বাসা এখান থেকে আর কতদূর?”

” এখান থেকে তো বেশি দূর না। এই বিশমিনিটের রাস্তা! ”

” তাহলে শুধু শুধু দেরি করছি কেন? চলো রওনা দেই? আমি তো ভেবেছিলাম আরো অনেক দূরে।”

” স্কুটিতে উঠলে যদি আবার বমি বমি লাগে? এভাবে বসে থাকতেই ভালো লাগছে। একটু বসে থাকি না!”

অনিক মৃদু হেসে বলল,” আচ্ছা। বসো।”

” আপনার কি তাড়া আছে? তাহলে চলুন চলে যাই।”

” না, আমার কোনো তাড়া নেই। তুমি বসো, তোমার যখন ভালো লাগবে তখনি যাবো।”

নোরা আর কিছু বলল না। শুধু হাসল। তারপর আবার কিচ্ছুক্ষণ নিরবতা। এরপর অনিক বলল,” আচ্ছা নোরা, তুমি খাবে কিছু?”

খাওয়ার কথা শুনে নোরার মনে পড়ল সে সকাল থেকে কিছুই খায়নি। জ্বরের মুখে সব খাবার তেঁতো লাগে। তাই কিছু খাওয়া হয়নি তার। কথাটা মনে পড়তেই নোরার ভীষণ ক্ষিধে পেল। নোরা বলল,” হ্যাঁ ক্ষিধে পেয়েছে৷ কিন্তু কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না।”

“এজন্যই তো শরীর দুর্বল। খেতে ইচ্ছে না করলেও খাওয়া উচিৎ। ”

” অসম্ভব। খাওয়ার কথা মনে হলেই আমার বমি আসে। সকাল থেকে কিছু খাইনি, তবুও আমার খেতে ইচ্ছে করছে না।”

” সকাল থেকে না খেয়ে আছো? তাহলে জ্বর কমবে কিভাবে বোকা! আর এটা ঔষধ খাওয়ার আগে বলোনি কেন? খালি পেটে থাকলে ঔষধ কোনো কাজে আসবে না৷ তোমার খাওয়া উচিৎ।

” খালি পেটে ওষুধ কাজে আসবে না কেন?”

অনিক শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,” তোমার জেনারেল সেন্সের অনেক অভাব নোরা!”

” এতোদিন পড়েছিলেন আমার কমন সেন্স নিয়ে। সেটা বাদ দিয়ে এখন জেনারেল সেন্স নিয়ে লাগলেন? আচ্ছা আমার আর কি কি সেন্সের অভাব আছে বলুনতো?”

“তোমার সব ধরণের সেন্সের অভাব। নাহলে এমন মারাত্মক জ্বর নিয়েও কেউ সারাদিন না খেয়ে থাকে? আবার কোচিংয়েও চলে এসেছো। সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাচ্ছিলে। ভাগ্য ভালো যে ঘটনাটা ক্লাসে ঘটেছে। যদি রাস্তায় এমন হতো? স্কুটি চালিয়ে যাওয়ার সময় যদি সেন্সলেস হয়ে যেতে?বিষয়টা খুব সেন্সিটিভ নোরা। তোমার আজকে কোচিংয়ে আসাই উচিৎ হয়নি।”

” হুম। এসে হয়তো আপনাকে ঝামেলায় ফেলে দিলাম।”

” আমি আমার ঝামেলার কথা বলছি না। তোমার বিপদে পড়ার কথা বলছি। একদিন ক্লাস মিস দিলে বিশাল কিছু ক্ষতি হতো না। কিন্তু ক্লাসে আসার কারণে তোমার অনেকবড় বিপদ হয়ে যেতে পারতো।”

” কিভাবে বিপদ হতো? আপনি ছিলেন তো, আপনি বাঁচিয়ে নিতেন।”

” আজকে না হয় আমি ছিলাম। কিন্তু সবসময় কি আমি থাকবো? আজকে যদি আমার জায়গায় আফজাল ভাই অথবা আদনান ভাইয়ের ক্লাস হতো? ওরা কিন্তু তোমাকে অন্তরার সাথেই পাঠিয়ে দিতো। কখনো নিজে আসতো না।”

” তাদের ক্লাস হলে তো আমি আজকে আসতামই না। শুধুমাত্র আপনার ক্লাস বলেই গায়ে একশো তিন ডিগ্রি জ্বর নিয়েও ছুটে এসেছি। সেই জ্বর আপনাকে দেখেই অর্ধেক চলে গেছে। এখন বাকি অর্ধেকও চলে যাচ্ছে। এই দেখুন, শরীর ঘাম দিচ্ছে। জ্বর নেই। ভ্যানিশ।”

নোরা কথা বলতে বলতে হেসে দিল। অনিকের স্বাভাবিক মুখ গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। নোরার কথার গভীরতা বোঝার মতো বুদ্ধি তার আছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কথাগুলো শুনে সে মোটেও সন্তুষ্ট নয়। নোরা অনিকের অভিব্যক্তি দেখে চুপসে গেল।এভাবে বলা উচিৎ হয়নি বোধহয় তার। এখন অনিক মনে মনে কি ভাবছে কে জানে?

নোরা প্রসঙ্গ বদলানোর উদ্দেশ্যে বলল,” স্যার,আমার না এখন ক্ষিধে পাচ্ছে। মানে কিছু খেতে ইচ্ছে করছে।”

অনিক স্বাভাবিক হয়ে নোরার দিকে তাকাল,” কি খাবে বলো?”

” টকজাতীয় কিছু।”

“এতোকিছু থাকতে টক কেন?”

“জানিনা, ইচ্ছে করছে। জিহবা ছুলে যাওয়ার মতো টক মুখে নিয়ে চোখ-মুখ খিচে বসে থাকতে। ”

অনিক হালকা হাসল। তারপর কি একটা মনে করে বলল,” আমার বাসায় যাবে?”

অনিকের প্রশ্নে নোরা হকচকিয়ে গেল।প্রশ্নটা তার জন্য নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। অনিক বলল,” মা খুব সুন্দর একটা রেসিপি রান্না করে। নামটা মনে পড়ছে না। কিসের টক যেন, খুব টেস্টি। গরমভাতের সাথে খেতে অসাধারণ লাগে। যাবে?”

নোরা তো পারলে এক লাফে রাজি হয়ে যায়। কিন্তু সাথে সাথে রাজি হওয়াটা কি ঠিক হবে? অনিকই বা কি ভাববে? নোরা হাসার চেষ্টা করে বলল,” আমি আপনার বাসায় গেলে সবাই কি মনে করবে?”

” কিছুই মনে করবে না। এইসময় বাসায় শুধু মা আর আপু থাকে। তোমাকে দেখলে ওরা খুশিই হবে৷ তুমি যেতে চাও কিনা বলো। যদি তোমার বাসায় কোনো প্রবলেম না থাকে।”

” আমার বাসায় তো কোনো প্রবলেম নেই। আমি তো মাঝে মাঝে কোচিং থেকে অন্তরাদের বাসায় চলে যাই। তারপর রাত নয়টা-দশটায় বাসায় ফিরি। সমস্যা হয়না।”

” তাহলে যাবে?”

” ঠিকাছে।”

অনিক নোরাকে নিয়ে তার বাসায় নিয়ে গেল। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তখন বাসায় কেউ ছিলনা। দরজা লক। অনিকের কাছে এক্সট্রা চাবি থাকে। কিন্তু বাসার সবাই এই অসময়ে কোথায় যেতে পারে অনিক আন্দাজ করতে পারছে না। তার রাগ লাগছে। আজকেই নোরাকে বাসায় এনেছে আর আজকেই এই ঘটনা ঘটতে হল? বাসায় যে কেউ নেই এটা অনিক সত্যিই জানতো না। কিন্তু নোরা যদি ভাবে এটা অনিকের ইচ্ছাকৃত কাজ? সে জেনে-শুনেই নোরাকে খালিবাসায় নিয়ে এসেছে! অনিকের রাগে হাত কামড়াতে ইচ্ছে করছে। ধুর! মেয়েটাকে ফিরে যেতে বলারও উপায় নেই। যেচে কাউকে বাসায় দাওয়াত করে এনে ফিরিয়ে দেওয়া যায়না। আবার খালিবাসায় বসতে বলাও যাচ্ছেনা।

দরজার সামনে দাঁড়িয়েই ইলোরাকে ফোন করল অনিক। নোরা বলল, ” কি হয়েছে?”

অনিক ফোন কানে রেখেই হেসে বলল, ” মাকে একটা ফোন করে দেখি কোথায় আছে।”

নোরা বলল,”ও।”

মিসেস ইলোরা ফোন ধরলেন না। অনিক কান থেকে ফোন নামাতেই নোরা বলল, ” আমরা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবো?”

” তোমার কি দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে?”

” না। সেজন্য না। এমনি জিজ্ঞেস করছি।”

” আসলে বাসায় তো কেউ নেই। কোথায় গেছে তাও জানিনা।”

” আপনার কাছে চাবি নেই?”

” চাবি আছে। কিন্তু বাসা তো খালি। খালিবাসায় ঢুকে কি হবে?”

অনিকের অস্বস্তি বুঝতে পেরে নোরা বলল,” হ্যাঁ সেটাই। আর আমার এমনিতেও বাসায় ঢুকতে ইচ্ছে করছে না। আচ্ছা আপনাদের ছাদ খোলা থাকে এই সময়? আসলে আমার আবার বমি বমি লাগছে। একটু খোলামেলায় গেলে হয়তো ভালো লাগবে।”

” আচ্ছা তাহলে চলো ছাদে যাই।”

“ঠিকাছে।”

নোরা সিঁড়ি বেয়ে আগে উঠতে লাগল। অনিক পেছন পেছন উঠল। নোরা ছাদে উঠে দেখল রেস্টুরেন্টের মতো বড় ছাতার নিচে আসন পাতা চারটা চেয়ার। চেয়ারগুলো সিমেন্টের তৈরি। উপরে রং দেওয়া। সবুজ রঙ। দোলনাও আছে। নোরা দোলনা দেখে খুব খুশি হল। হাসিমুখে দোলনাতে গিয়ে বসে পড়ল। তার চোখেমুখে বাচ্চাদের মতো আনন্দ।

অনিক পেছনে গিয়ে দোলনা ধাক্কা দিতে লাগল। নোরা বলল,” বাহ! আপনাদের ছাদটা তো খুব সুন্দর।”

” রাতেরবেলা আরও বেশি সুন্দর লাগে। আমি প্রায়রাতেই এখানে বসে চা খাই। আর ওইযে সামনে একটা কৃষ্ণচূড়ার গাছ দেখছো? ওইটা কিন্তু মায়ের খুব শখের গাছ। সুন্দর না?”

” হ্যাঁ সুন্দর।আমার কষ্ণচূড়া খুব ফেভারিট। আমি একটা ফুল ছিঁড়ে নেই?”

” হ্যাঁ নিতে পারো। মা যেহেতু নেই। ”

” উনি থাকলে কি হতো?”

” ফুল ছিঁড়তে দেখলে ভুমিকম্প শুরু হয়ে যেতো।”

” ওরে বাপরে। তাহলে দরকার নেই।”

অনিক হেসে বলল,” আরে নাও। কিছু হবেনা। মা জানবে কিভাবে?”

“আন্টি মনে হয় খুব রাগী তাইনা?”

” হুম। এমনি খুব সহজ সরল। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর।”

” বুঝতে পেরেছি। আমার বাবার মতো। কিন্তু আমার মা খুব ভালো। উনার রাগ করার ক্ষমতাই নেই জানেন? একদম মাটির মানুষ। ”

নোরা এবার দোলনা ছেড়ে উঠে দেয়াল ধরে দাঁড়াল। অনিকও ওর পেছনে এসে থামল। নোরা বলল, ” একদম নিচের দিকে তাকান, কি ভয়ংকর!”

” জায়গাটা খালি বলে এমন লাগছে।”

নোরা উল্টোদিকে ঘুরে বলল, ” আমি আর এদিকে দেখবো না। মাথা ঘুরাচ্ছে।”

অনিক হেসে ফেলল, ” তুমি মনে হয় ছাদে খুব কম ওঠো তাইনা?”

” খুব কম না একেবারেই উঠি না বললেই চলে। আমাদের ছাদ সারাখন তালা দেওয়া থাকে। চাবি থাকে বাড়িওয়ালির কাছে। আর কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে যদি ছাদে যেতেই হয়, তাহলে জুতা খুলে রেখে যেতে হয়। খালি পায়ে। কারণ ছাদ অত্যন্ত পরিষ্কার করে রাখা হয়।”

” বুঝতে পেরেছি। এই চাচা!”

অনিক গলা উঁচু করে হাত উঠিয়ে কাকে যেন ডাকল।অনিকের ডাক শুনে নোরাও ওইদিকে তাকাল। পাশে ছাদের একজন বুড়োলোককে দেখা যাচ্ছে। লোকটা অনিককে দেখে মুখে বড় একটা হাসি আনল।

” আব্বা ভালো আছেন?”

” ভালো চাচা। আপনার কি খবর?”

” এইতো ভালো। সাথে এইটা কে?”

” আমার স্টুডেন্ট, কোচিং এর। ঘুরতে আসছে।”

“ও আচ্ছা, ভালো আছেন মা?”

নোরা বলল,” আমাকে?”

অনিক বলল,” হ্যাঁ তোমাকেই।”

নোরা হেসে বলল,” হ্যাঁ ভালো আছি।”

বুড়লোকটা বলল,” কমলা খাবেন কমলা?”

নোরা উনার কথা বুঝতে পারছে না৷ তাই অনিকের দিকে তাকাল। অনিক বলল, ” হ্যাঁ খাবে চাচা। দিন।”

লোকটা গোল গোল কি যেন ঢিল মারল। অনিক ক্যাচ ধরল। নোরা বলল, ” কি এগুলো? ”

” গাছের কমলা। খাবে?”

” এতো ছোট?”

“হুম। এগুলো অনেক টক। তোমার পছন্দ হবে। তুমি না টক খেতে চাইছিলে?”

নোরা খুশি হয়ে বলল,” তাহলে খাবো। দিন।”

অনিক একটা কমলার কোষ ছুলে নোরাকে দিল। নোরা মুখে নিয়েই কানে হাত দিয়ে চোখ বুজে ফেলল। সত্যিই অনেক টক। অনিক বলল, ” পছন্দ হয়েছে?”

নোরা বলল,” খুব। সাথে লবণ থাকলে আরো ভালো হতো। ”

অনিক হেসে ফেলল। তারপর ওই বুড়োলোকটাকে হাত উঠিয়ে বলল,” চাচা থ্যাঙ্কিউ।”

লোকটা বলল,” আর লাগবে?”

অনিক নোরাকে বলল,” আর নিবো?”

“এতোগুলো খাবো কখন?”

” বাসায় নিয়ে যেও। ”

” আচ্ছা তাহলে নিন।”

অনিক আরো অনেকগুলো নিয়ে নিল। লোকটা শুধু ছুঁড়ে ছুড়ে দিচ্ছে আর অনিক নিচ্ছে। নোরা বলল,” ব্যাস ব্যাস আর লাগবে না। আমি কোনো রাক্ষস না।”

আরো কিছুক্ষণ টুকটাক গল্প করার পর নোরা বলল বাসায় যাওয়ার কথা৷ কারণ অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছিল। সে ছাদ থেকে নামার সময় অনিক কৃষ্ণচূড়া গাছের লাল টকটকে কয়েকটা তাজা ফুলের তোড়া বানিয়ে তার হাতে দিল। এই ঘটনায় নোরার এতো খুশি লাগল যে চোখ দিয়ে পানি চলে এলো। আজ এতো মূল্যবান কিছু পেয়ে যাবে তা যেন কল্পনাও করতে পারেনি সে। খুশিতে নোরা কোনো কথাই বলতে পারছিল না। তার মনে হচ্ছিল জীবনের সার্থকতা সে পেয়ে গেছে। অনিকস্যারের যদি তার প্রতি দুর্বলতা না থাকে তাহলে তাকে ফুল দিবে কেন? তাও আবার লাল টকটকে কৃষ্ণচূড়া ফুল?

ফুলগুলোর পাপড়ি খুব যত্ন করে ছিড়ে প্রিয় উপন্যাসের বইয়ে রেখে দিয়েছিল নোরা। অন্তরা উপন্যাসের বইটা হাতে নিয়ে ফুলগুলো দেখতে দেখতে বলল,” আচ্ছা নোরা, এমনও তো হতে পারে তোর কৃষ্ণচূড়া ফুল পছন্দ বলেই উনি তোকে ফুলগুলো দিয়েছে। তুই তো উনাকে বলেছিলি এই ফুল তোর ফেভারেট।”

নোরা বলল,” হ্যাঁ জানি। কিন্তু তবুও খুশি লাগছে। উনি মায়ের শখের গাছ থেকে ফুল ছিঁড়ে এনেছেন শুধু আমার জন্য! এটা উনার মা জানতে পারলে রেগে যেতেন। তবুও তোয়াক্কা করেন নি৷ এটা কি তোর কাছে পজিটিভ সাইন মনে হচ্ছেনা অন্তু?”

” হ্যাঁ হচ্ছে। তোকে বাসায় নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে সেদিন যা কিছু হয়েছে সবই পজিটিভ সাইন মনে হচ্ছে। কিন্তু আজ-কাল ক্লাসে উনি যেরকম বিহেভিয়ার করে, তাতে আমি কনফিউজড। ”

” কনফিউজড তো আমিও। কিন্তু এটুকু তোকে আমি বলে রাখি, উনি যদি আমাকে প্রপোজ না করে তাহলে আমিই করবো।”

” কি বলছিস? তুই মেয়ে হয়ে প্রপোজ করবি?”

” কেন? করলে কি হয়েছে? কোন আইনে আছে মেয়েদের প্রপোজ করা নিষেধ? ”

” তবুও অ্যাটিটিউড বলে তো একটা ব্যপার আছে। তুই প্রপোজ করলে তোর দাম কমে যাবেনা?”

” এগুলো কোনো বিষয় না। উনাকে পাওয়ার জন্য আমি সব করতে পারি। আর সেখানে অ্যাটিটিউড কোনো বিষয়ই না। ভালোবাসার থেকে ইগো/অ্যাটিটিউড কখনো বড় হতে পারে না।”

অন্তরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,” বেস্ট অফ লাক।”

নোরা অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল,” কিন্তু দোস্ত, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় কি জানিস?”

” কি?”

“তন্নীও অনিকস্যারকে পছন্দ করে। ছোটবেলা থেকেই তো, আমার যেটা লাগে ওরও সেটা লাগে। এবারও যে তাই হবে না গ্যারান্টি কি?”

” তুই কি তন্নীকে বলেছিস তোর অনিকস্যারকে পছন্দ? ”

” বলিনি। কিন্তু ও তবুও বুঝে সেটা আমি জানি।”

” বাদ দে তো ওর কথা। কিছু হবেনা। আচ্ছা আজকে আমি উঠি, কাল তো ম্যাথ এক্সাম। বাসায় গিয়ে পড়তে হবে। শুক্রবারটাও শান্তি নেই।”

” দোস্ত খেয়ে যা।”

” পাগল? লেইট হয়ে যাবে।”

” দোস্ত, আয় আমরা একসাথে পড়ি? আমি না কিছুই পারিনা।”

” আমিও তো কিছু পারিনা। বাই দ্যা ওয়ে, তোর কাছে কি অনিকস্যারের ফোন নম্বর আছে?”

” ফোন নম্বর তো সবার কাছে আছে। প্রথমদিন কোচিং থেকে সবাইকে একটা শিট দিয়েছিল না? ওইখানে সব টিচারদের নম্বর আছে।”

” তাই নাকি? আমি কখনো খেয়াল করিনি। তোর কাছে আছে শিটটা?”

” আছে মানে? খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছি। আর আমি তো মাঝে মাঝে অনিকস্যারের নম্বরে ফোনও দেই।”

” বলিস কি? উনি কথা বলে তোর সাথে?”

” উনি তো জানেইনা ওটা আমি।”

” মানে?”

” মানে ফোন দিয়ে ওইপাশ থেকে কণ্ঠ শুনেই আমি কেটে দেই। কখনো কথা বলিনা।”

” এমন কেন করিস?”

” মজা লাগে। ”

কথাটা বলেই নোরা হাসল। অন্তরা বলল,” পরে ডিস্টার্বিং কল ভেবে ব্ল্যাকলিস্ট করে দিলে বুঝবি।”

অন্তরার কথা শুনে নোরার হাসি মিলিয়ে গেল। তারপর কি একটা ভেবে বলল,” করলেও কি? আমার তো দুটো নম্বর। একটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিলে আরেকটা দিয়ে ফোন দিব। ওইটায় নিজের পরিচয় দিবো। আচ্ছা দোস্ত, আজকে চল উনাকে ফোন করি। তুইও শুনবি।”

” ফোন করে কি বলবি?”

” আমার আরেকটা নম্বর থেকে ফোন দিবো। কালকে তো এক্সাম। এক্সামের বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করবো। মানে কিভাবে কি পড়বো নাকি.. বাহানা আর কি!”

অন্তরা হেসে বলল,” ঠিকাছে দে।”

” আচ্ছা।”

নোরা আর অন্তরা মিলে ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে অনিককে ফোন করল। যেন দু’জনেই কথা শুনতে পারে। ওইপাশ থেকে রিং হচ্ছে। নোরার হৃৎস্পন্দন অস্বাভাবিক গতিতে উঠা-নামা করছে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হল। সেই সুন্দর কণ্ঠ, ” হ্যালো!”

তৃপ্তিতে নোরার চোখে পানি চলে এলো। ছোট্ট একটা শব্দ,”হ্যালো”। এটুকুও যে কেউ এতো সুন্দর করে উচ্চারণ করতে পারে নোরার জানা ছিলনা। প্রতিদিন একবার হলেও এই একটা শব্দ শোনার জন্য নোরা অনিককে ফোন দেয়। তার সারাটাদিন স্পেশাল করে তুলতে হ্যালো নামক এই ছোট্ট শব্দটাই যথেষ্ট। ওইপাশ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে অনিক আবারও বলল,” হ্যালো!”

নোরার বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে৷ একটা দমবন্ধকর অনুভূতি তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে রেখেছে। এই ছেলে তো হ্যালো দিয়েই মানুষ খু’ন করে ফেলার ক্ষমতা রাখে৷ সেটা কি সে জানে? নোরা জোরে নিঃশ্বাস নিল।

অনিক চমকে উঠল। এই নিঃশ্বাস তার খুবই পরিচিত। প্রতিদিন যে অচেনা নম্বর থেকে তার কাছে ফোন আসে সেখানে নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা যায়না। অনিকের একদমই ভুল হচ্ছে না। এটাই সেই নিঃশ্বাস। অনিক ফোনটা কান থেকে সরিয়ে একবার নম্বরটা দেখে নিল৷ এই নম্বর আর সেই নম্বর তো মিলছে না। কিন্তু নিঃশ্বাসের শব্দটা একদম হুবুহু মিলে গেছে। অনিক ফোনটা আবার কানে লাগিয়ে বলল,” হ্যালো কে বলছেন?”

নোরা কোনো কথা বলছে না দেখে বাধ্য হয়ে অন্তরাই বলল,
” স্যার আসসালামু আলাইকুম। আমি অন্তরা।”

অন্তরার নাম শুনে অনিক অবাক হল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না মেয়েটা অন্তরা। অন্তরার নিঃশ্বাসের শব্দ এমন হতেই পারেনা। অনিকের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে,” অন্তরা, তোমার আশেপাশে কি কেউ আছে?”

কিন্তু জিজ্ঞেস করা হলো না৷ নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
” হ্যাঁ অন্তরা, বলো। কেমন আছো?”

অন্তরা হেসে বলল,” এইতো স্যার ভালো। একটা হেল্পের জন্য ফোন করেছিলাম।”

” বলো।”

” স্যার ম্যাথ সেকেন্ড পেপারের গাইডের ছয়শো নম্বর পেইজের একশো নম্বর প্রবলেমের দৃশ্যকল্প এক এর ‘ক’ নম্বর অঙ্কে ভেদাঙ্কের কোন সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে আমি বুঝতে পারছি না। একটু হেল্প করবেন?”

” আচ্ছা অন্তরা, আমার কাছে এই মুহুর্তে মেইন বইয়ের গাইডটা নেই। তুমি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে ছবি তুলে দিতে পারবে?”

” স্যার আমার তো হোয়াটসঅ্যাপ নেই।”

” ওহ। তাহলে ফেসবুকে? ”

” আচ্ছা স্যার। ফেসবুকে দিচ্ছি। কিন্তু আপনার আইডি?”

” তোমার আইডি বলো।”

” আফসানা অন্তু।”

” আচ্ছা, পাঁচমিনিট ওয়েট করো। আমি নক দিচ্ছি তোমাকে।”

“ঠিকাছে স্যার।”

অন্তরা ফোন রাখতেই দেখল নোরা কেঁদে ভাসাচ্ছে। অন্তরা অবাক হয়ে বলল,” কিরে দোস্ত, তুই কাঁদছিস কেন?”

নোরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,” উনার কণ্ঠ শুনলেই আমার কান্না পায়। একটা মানুষ এতো সুন্দর করে কিভাবে কথা বলতে পারে?”

” তো এতে কাঁদার কি হলো?”

” জানিনা। প্রতিবার উনার ফোন রাখার পরই আমার চোখে পানি চলে আসে। আর আজকে তো উনি এতোক্ষণ কথা বললেন। আমি কান্না থামাতে পারছি না।”

” তুই তো দেখছি পুরাই শেষ। এমনভাবে চলতে থাকলে একদিন মরবি।”

” আমি তো প্রতিদিনই মরছি। উনাকে দূর থেকে দেখছি আর ধুকে ধুকে মরছি। এই কষ্ট যে কতটা গভীর তোকে আমি বুঝাতে পারবোনা। যদি উনাকে না পাই আমি সিউর মরে যাব। কিছুতেই বাঁচবো নারে!”

নোরা আবার কান্না শুরু করল। অন্তরা বলল,” আচ্ছা শান্ত হো। আর অনিকস্যার কিন্তু বলেছে ফেসবুকে নক দিবে। তাহলে উনার আইডিও পাওয়া যাবে।”

নোরা দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে বলল,” হ্যাঁ হ্যাঁ তোর আইডিতে লগইন কর।”

” তোর কাছেও তো পাসওয়ার্ড আছে৷ তুই লগইন কর।”

“আমি পারবো না। আমার আঙুল কাঁপছে।”

” হাইরে!”

অন্তরা ফেসবুকে লগইন করে দেখল অনিক মেসেজ পাঠিয়েছে। আইডির নাম অনিক আবেদিন। অন্তরা বলল,”দোস্ত এইযে, অনিক স্যারের আইডি।”

নোরা অন্তরার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে অনিকের প্রোফাইলে ঢুকল। প্রোফাইল ঘাটতে ঘাটতে বলল,” এই নাম লিখে যে আমি কতবার আইডি সার্চ করেছি। কিন্তু কখনো পাইনি। অনেকগুলো অনিক আবেদিন আসে। কিন্তু আসলটা কখনোই আসেনা। আমি উনার প্রোফাইলের লিংকটা কপি করে আমার আইডিতে মেসেজ পাঠিয়ে রাখি। যেন পরে পাওয়া যায়।”

অন্তরা হেসে বলল,” ঠিকাছে রাখ। কিন্তু তার আগে অনিকস্যারকে অঙ্কের ছবি পাঠাতে হবে তো।”

“ছবি পরে পাঠাস৷ আগে আমি উনার ছবি দেখি।”

” ছবি দেখ সমস্যা নেই। কিন্তু ছবি দেখতে দেখতে আবার কান্না জুড়িস না।”

নোরা ছলছল চোখে অনিকের প্রোফাইলের ছবিগুলো ঘেটে-ঘুটে দেখতে লাগল৷ উনাকে ছবিতেও কত সুন্দর লাগে। একটা মানুষের মধ্যে এতো এতো পারফেকশন কিভাবে থাকতে পারে? কিভাবে?

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০৩

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_৩
লিখা: Sidratul muntaz

নোরা কোচিং থেকে বাসায় ফিরেই দেখল অবন্তীর অনেকগুলো মেসেজ। অবন্তী নোরার ফেসবুক ফ্রেন্ড। প্রায় চার-পাঁচমাসের মতো পরিচয়। এর মধ্যেই বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে ওদের। অবন্তী কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে। ছবিগুলো সানির সাথে ভিডিওকলের স্ক্রিনশট। সানি কাঁদছে! অবন্তী মেসেজে লিখেছে,”তুই সানিকে ব্লক করেছিস কেন নোরা? রিলেশন যেহেতু রাখবিই না, ওকে কারণ বুঝিয়ে বললেই হতো। এভাবে হুটহাট ব্লক মারার মানে কি? সামনে বেচারার ফাইনাল এক্সাম। সে লেখাপড়াতেও কনসেন্ট্রেট করতে পারছে না শুধু তোর জন্য। ”

নোরা রিপ্লাই দিল,” দ্যাখ অবন্তী, ওর প্রতি আমার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি রিলেশনটা কন্টিনিউ করতে পারবো না। তুই ওকে বুঝিয়ে বলিস।”

মেসেজটা পাঠানো হয়েছিল সন্ধ্যায়। তখন অবন্তী অনলাইনে ছিলনা। সে এক্টিভ হলো রাতে। তখন নোরাকে মেসেজ পাঠালো,”রিলেশন কন্টিনিউ করতে পারবি না মানে? এটা আবার কেমন কথা? তাহলে দুইমাস ধরে ওর সাথে রিলেশন কেন করলি?”

নোরা বই পড়ছিল। মেসেজের আওয়াজ শুনে ফোনের কাছে আসল। তারপর রিপ্লাই লিখল,” ভুল করে করেছি। ওর সাথে রিলেশনে যাওয়া আমার উচিৎ হয়নি। ওর জন্য আমার কোনো ফিলিংস নেই। ও যেন আমাকে মাফ করে।”

” তুই কি বলছিস এসব? ছেলেটা তোকে কত্ত লভ করে। মানুষকে এভাবে কষ্ট দেওয়া কি ঠিক? আচ্ছা ও কি কোনো ভুল করেছে? শোন আমি তোকে গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি সানি খুব ভালো ছেলে। যদি তোর কাছে কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে আমি বলছি তুই ওকে আরেকটা চান্স দে। কেউই কিন্তু একেবারে পারফেক্ট হয়না। ওর থেকে ভালো ছেলে তুই আর একটাও পাবিনা। হি ইজ আ গুডম্যান। আর তুই ওর বেস্ট চয়েস।”

“অবন্তী আমি জানি আমি ওর বেস্ট চয়েস। কিন্তু ও আমার বেস্ট চয়েস না। আর ও আমার কাছে কোনো অপরাধও করেনি। বরং আমি ওর সাথে অপরাধ করেছি। এতোদিন ওর সাথে টাইমপাস করাই আমার অপরাধ ছিল।”

“তুই ওর সাথে টাইমপাস করেছিস?”
” হ্যাঁ। সেজন্যই তো ক্ষমা চাইছি। ও যেন আমাকে ক্ষমা করে। আমি পারবো না ওর সাথে থাকতে।”

” তাহলে আর কি বলার। শোন এক কাজ করি, আমি ওকে বলে দেই তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তুই যে এতোদিন ওর সাথে টাইমপাস করেছিস এটা ওকে জানানোর কোনো মানে হয়না। তাহলে বেচারা খুব কষ্ট পাবে।”

” মিথ্যে কেন বলবি? যা সত্যি তাই বল। আর ও হয়তো আগে থেকেই বুঝতে পেরেছিল আমি ওর সাথে টাইমপাস করছি। তাই নতুন করে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। ”

“আচ্ছা ঠিকাছে। আমি ওকে বলে দিব।”

“হুম থ্যাঙ্কস।”

“মাই প্লেজার।”

তাদের আর কোনো কথা হলনা। সকালে ঘুম থেকে জেগে নোরা বিরাট একটা সারপ্রাইজ পেল। বাবা তার জন্য স্কুটি কিনে এনেছে। নোরার ছোটবেলা থেকে শখ স্কুটি চালিয়ে ভার্সিটি যাবে। বাবাকে বলেও রেখেছিল। কিন্তু বাবা যে এতো জলদি ব্যবস্থা করে ফেলবেন নোরা সেটা ভাবেনি। স্কুটিটা তার ভীষণ পছন্দ হল। সকালে ঘুম ভাঙার পর হঠাৎ মা বললেন তার জন্য সারপ্রাইজ আছে। নোরা ভাবলো মা হয়তো বিরিয়ানি রান্না করেছে। নাহলে বাবা নতুন জামা কিনে এনেছে। লীরা বলল সারপ্রাইজ দেখার জন্য চোখ বন্ধ করে নিচে যেতে হবে। নোরা বলল,” মা! চোখ বন্ধ করলে আমি হাঁটবো কিভাবে? আর সিঁড়ি বেয়ে নিচেই বা কিভাবে যাবো?”

লীরা হেসে বললেন,”তোর হাঁটতে হবে না। আমি তোকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাবো। এবার চল।”

লীরা নোরার চোখ ধরে নোরাকে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিচে নিয়ে গেল। যেতে যেতে নোরা বলছিল,”হাঁটি হাঁটি পা পা, নোরা এবার নিচে যা।”

নিচে গিয়েই খুঁজে পেল তার অতিশখের সেই স্কুটি। স্কুটি দেখেই নোরা একটা চিৎকার দিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। নোরার বাবা আনিস সাহেব মেয়ের হাতে স্কুটারের চাবি তুলে দিলেন। স্কুটারের রং রাণী গোলাপী আর হলুদ। কালার কম্বিনেশনটাও নোরার খুব পছন্দ হয়েছে। একদম তার মনের মতো।

সেদিন বিকালে নোরা স্কুটি নিয়েই কোচিং এ গেল। স্কুটি চালানোর প্র্যাকটিস নোরার আগে থেকেই আছে। দিশাআপুর স্কুটি বেশিরভাগ সময় নোরাই চালাতো। দিশা নোরার কাজিন। সেই-ই নোরাকে স্কুটি চালানো শিখিয়েছে।

কোচিং এর গেইটের সামনে দাড়িয়ে নোরা,সেজুতি আর অন্তরা স্কুটি নিয়ে আলাপ করছিল। সেজুতি আর অন্তরা নোরার স্কুটিটা চালিয়ে দেখার চেষ্টা করছিল। প্রথমে আলাপটা স্কুটি নিয়ে শুরু হলেও পরে কিভাবে যেন টপিক চেঞ্জ হয়ে অনিকস্যারের দিকে চলে গেল। তখন অন্তরা বলল,” সেজুতি তুমি জানো? আমাদের নোরা কিন্তু অনিক স্যারকে খুব পছন্দ করে।”

সেজুতি স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,” এটা আবার কে- না জানে? অনিকস্যারকে তো সবাই পছন্দ করে!”

অন্তরা টিপ্পনী কেটে বলল,” কিন্তু ওর পছন্দটা একটু অন্যরকম স্পেশাল!”

নোরা লজ্জিত কণ্ঠে বলল,”একদমই না, অন্তু তুই ফালতু কথা বলা বন্ধ কর।”

অন্তরা বলল,” সেজুতি আমি কিন্তু সত্যি বলছি। সেদিন আফজাল স্যার আমাদেরকে উনার লভস্টোরি শুনাচ্ছিল না, তখন নোরার খুব মনখারাপ হয়েছিল। কেন জানো? যদি অনিক স্যারেরও গার্লফ্রেন্ড থাকে সেই চিন্তায়।

সেজুতি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। নোরা রেগে বলল,” অন্তু তুই চুপ করবি?”

অন্তরা বলল,” আচ্ছা সেজুতি, তুমি আফজাল স্যারের গার্লফ্রেন্ডের ব্যাপারে তুমি কিভাবে জানলে?”

“স্যারই আমাকে বলেছিল।”

“অনিক স্যারেরও কি গার্লফ্রেন্ড আছে?”

সেজুতি বলল,”থাকতে পারে৷ আমি সিউর না।”

অন্তরা নোরার বাহু ধরে বলল,” অনিক স্যারকে একটু জিজ্ঞেস করতে পারবে? তাহলে আমার বান্ধবীর মনের খচখচানি একটু কমতো।”

সেজুতি আতঙ্কিত হয়ে বলল,”পাগল? স্যারকে আমি এটা কিভাবে জিজ্ঞেস করবো?”

অন্তরা শ্রাগ করে বলল,” আফজাল স্যারকে যেভাবে জিজ্ঞেস করেছো সেভাবে?”

সেজুতি দুই পাশে মাথা নেড়ে বলল,” অসম্ভব! ওইটা আফজাল স্যার। উনাকে জিজ্ঞেস করতে হয়না। উনি নিজেই গড়গড় করে সব বলে দেয়। কিন্তু অনিক স্যারকে এসব জিজ্ঞেস করলে তুলে একটা আছাড় মারবে।”

নোরা মনখারাপ করে তাকিয়ে আছে। অনিকস্যারের গার্লফ্রেন্ড আছে কিনা সেটা জানার কোনো উপায় কি নেই?অন্তরা সন্দেহীচোখে বলল,” দ্যাখ, ওর চেহারা কেমন হয়ে গেছে! নারু রে! তোর হাব-ভাব কিন্তু আমার সুবিধার লাগছে না। তুই সত্যি অনিক স্যারের প্রেমে পড়িস নাই তো?”

সেজুতি বলল,”আমারও তাই মনে হয়। ও মনে হয় প্রেমেই পড়েছে।”

নোরা লজ্জা পেয়ে বলল,” প্রেমে পড়েছি কিনা জানিনা। কিন্তু আমার উনাকে খুব ভালো লাগে। উনার সবকিছুই ভালো লাগে। উনি রাগ করলেও ভালো লাগে, রাগ করে ধমক দিলে সেটাও ভালো লাগে। এমনকি উনার দেওয়া শাস্তিগুলোও শাস্তি মনে হয়না। উনি সামনে থাকলে বুকের মধ্যে ধাকধাক শব্দ হতে থাকে, আর সবকিছু কেমন রঙিন রঙিন লাগে। একটা অন্যরকম ফিলিংস।”

নোরা কথাগুলো বলতে বলতে যেই সামনে ঘুরে তাকাল, তখনি দেখল অনিক স্যার দাড়িয়ে। নোরা প্রচন্ড চ’মকে জোরে একটা চিৎকার দিয়ে উঠল। তারপর দৌড়ে চলে গেল ক্লাসরুমে। নোরা চলে যাওয়ার পর সেজুতি আর অন্তরাও দৌড় দিল। অনিক ভ্রু কুঁচকে বোকার মতো তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সাইকেল থেকে নেমে একটু সামনে গিয়ে দাঁড়াল সে। ব্যাপারটা বোধগম্য হচ্ছে না তার। মেয়েগুলো হাসি-খুশি গল্প করছিল, তাহলে তাকে দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে গেল কেন?

সামনে নোরার স্কুটি থাকায় অনিক স্কুটির আয়নায় নিজের চেহারা একবার দেখল। চেহারায় কিছু লেগে নেই। সব তো স্বাভাবিকই। তাহলে মেয়েগুলো কি দেখে এতো ভয় পেল?

নোরা ক্লাসে ঢুকেই দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করেছে। তার হৃৎপিন্ড সমান তালে আপ-ডাউন করছে। সেই শব্দটাও নোরা ভীষণভাবে টের পাচ্ছে। তার উপর হাত-পায়ের অস্বাভাবিক কম্পন তো আছেই। সেজুতি আর অন্তরা হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকল। নোরা ওদেরকে দেখে অস্থির গলায় বলল,” স্যার কি সব শুনে ফেলেছে? কি বলেছে স্যার? খুব রেগে গেছে তাইনা?”

সেজুতির মাথায় বুদ্ধি চাপল একটু দুষ্টমী করার। তাই আড়ালে অন্তরার হাতে চি’মটি কেটে বলল,” হ্যাঁ। স্যার অনেক রেগে গেছে। আমাদের সাথে ধমকে ধমকে কথা বলছিল।তোমার রাগ আমাদের উপর ঝেড়েছে। বলেছে তোমাকে পরে দেখে নিবে।”

নোরার গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ বড় করে বলল,”কি? অন্তু সত্যি? ”

অন্তরা মাথা নেড়ে বলল,” হ্যাঁ। সত্যি তো। স্যার তো এটাও বলেছে তোর বাসায় ফোন দিবে।”

নোরার হৃৎস্পন্দন থেমে গেল। প্রচুর ঘামতে লাগল সে। মাথা ঘুরাচ্ছে। অস্পষ্ট গলায় বলল,” এবার কি হবে? আল্লাহ সব শেষ সব শেষ। ”

সেজুতি আর অন্তরা নোরার রিয়েকশন দেখে ভুবন কাঁপিয়ে হাসতে শুরু করল। তাদের হাসি দেখে নোরা বুঝে গেল এতোক্ষণ তার সাথে মজা করা হচ্ছিল। রাগে অন্তরাকে ধরে মারতে শুরু করল নোরা।

ক্লাস চলছে কেমিস্ট্রি। নোরার ক্লাসে মনোযোগ নেই। সে জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছে। অনিকস্যার আজকে সাইকেল নিয়ে কোচিং এ এসেছে। সাইকেলটা জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে। নোরার মাথা একটা বুদ্ধি আসল। এই সাইকেলের চেইনটা যদি কোনোভাবে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে অনিকস্যারের বাসায় যাওয়া আটকে যাবে৷ তখন নোরা তার স্কুটিতে অনিকস্যারকে লিফট দিতে চাইবে। স্যার বিপদে পড়ে নিশ্চয়ই রাজি হবে৷ আর খুশিও হবে। সে স্কুটি চালাবে আর অনিকস্যার তার পেছনে থাকবে। ইশ,একথা চিন্তা করতেই নোরার শরীর শিরশির করছে। চোখ-মুখ খুশিতে ঝলমল করছে।

ছুটির পর পরিকল্পনা অনুযায়ী নোরা অন্তরাকে বলল,” অন্তু, আজকে তোকে আমার স্কুটিতে চড়াতে পারবো নারে। আমার আরেক জায়গায় একটা কাজ আছে। তুই বাসে করে চলে যা।”

” কোন জায়গায় কাজ আছে? চল আমিও যাই। আমার বাসায় ফেরার এতো তাড়া নেই।”

” আরে না, তুই যেতে পারবি না। ”

” কি এমন জায়গা যে আমি যেতে পারবো না?”

“আছে। আমাকে বাবার অফিসের ওইদিকে যেতে হবে। অনেকদূর। তুই পারবি না।”

” দূর হলেও সমস্যা নেই। তুই একা একা এতোদূর কেন যাবি। আমিও যাবো তোর সাথে ”

” বললাম তো বেবি আমি পারবো। বেশি কথা বাড়ালে এখন চড় খাবি কিন্তু।”

“অদ্ভুত! আচ্ছা যাচ্ছি। তুই সাবধানে যাস।”

“ওকে আম্মা।”

অন্তরা হেসে চলে গেল। নোরা প্ল্যান মোতাবেক কাজ করল। অনিকস্যারের সাইকেলের চেইন টেনে হিঁচড়ে শেষমেষ ছিঁড়ে ফেলল। এই কাজ করতে গিয়ে নোরার হাতের অর্ধেক জায়গা কেটে গেছে। চেইন ছিঁড়ে নোরা ভদ্রমেয়ের মতো স্কুটির সামনে দাড়িয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে অপেক্ষা করতে লাগল। কখন আসবে অনিকস্যার। দশমিনিটের মতো কেটে গেল। অনিকের আসার নাম নেই।

বেশ কিছু সময় পর অবশেষে ক্লাস শেষ করে বাহিরে এলো অনিকস্যার। নোরা অনিককে দেখেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। নরমগলায় বলল,” স্যার আসসালামু আলাইকুম। ”

” নোরা, কেমন আছো?”

“জ্বী ভালো স্যার।”

” তুমি এখনো যাওনি কেন? তোমাদের তো অনেক আগে ছুটি হয়েছে।”

নোরা আমতা-আমতা করে বলল,” অন্তরার জন্য ওয়েট করছি। আমাকে এখানে দাঁড়াতে বলে কোথায় যে গেল..”

অনিক হালকা হেসে বলল,” ও আচ্ছা।”

এতোক্ষণে সাইকেলের দিকে নজর পড়ল অনিকের। ভ্রু কুঁচকে বলল,” একি! সাইকেলটার এই অবস্থা কিভাবে হলো?”

নোরা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে মুখে হাত দিয়ে বলল,” আল্লাহ স্যার, এবার কি হবে?”

অনিক বিরক্তির শব্দ করে বলল,” আফজাল ভাইকে এবার কি বলবো?”

নোরা বিস্মিত হয়ে বলল,” আফজাল ভাই? স্যার এটা কার সাইকেল?”

“আফজাল ভাইয়ের।”

নোরা বিস্ময়ে পড়ে যেতে নিল। তারপর স্কুটার ধরে দাঁড়াল। এতোক্ষণে আফজাল স্যার চলে এসেছে। নোরাকে দেখেই হাসি দিয়ে বলল,” কি অবস্থা নোরা? অনিক?”

অনিক বলল,” ভাই, একটা ঝামেলা হয়েছে। ”

আফজাল বলল,” কি ঝামেলা?”

অনিক বলল,” সাইকেলের চেইন ছেঁড়া।”

আফজাল বিস্মিত হয়ে বলল,” বলো কি? কই দেখি?”
আফজাল ভালো করে দেখল। তারপর বলল,” দেখে তো মনে হচ্ছে কেউ টেনে ছিঁড়ছে।”

নোরা ভয়ে তটস্থ। হেলমেটটা মাথায় পড়ে হাসার চেষ্টা করে বলল,” স্যার আমি যাচ্ছি। আসসালামু আলাইকুম। ”

আফজাল বলল,” দাঁড়াও তো নোরা।”

নোরা হেলমেট পরতে পরতে বলল,” জ্বী স্যার?”

আফজাল এগিয়ে এলো,” আমার একটা জরুরী কাজ আছে। হাতে বেশি সময় নেই। তোমাদের বাসায় ওদিক দিয়েই যাবো। আমাকে একটু ড্রপ করে দিবে? হেল্প হতো।”

নোরা রসগোল্লা চোখে তাকাল। অনিক বলল,” হ্যাঁ ভাই। আপনি ওর সাথে চলে যান। আর আমি সাইকেলটা নিয়ে যাই। রিপেয়ার করে পাঠিয়ে দিবো।”

আফজাল বলল,” আচ্ছা তুমি চলে যাও অনিক।”

নোরা বড় বড় চোখ করে তাকালো। অনিক চলে যাচ্ছে সাইকেল নিয়ে। আফজাল বলল,”তাহলে চলো নোরা!”

নোরা আহত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। মনে মনে বলল,” ঝাড়ুমার্কা কপাল।”

“কি বললে?”

“কিছুনা স্যার। আসুন।”

আফজাল হেসে বলল,” থ্যাঙ্কস নোরা।”

নোরা স্কুটিতে বসতে বসতে নিজের মনে বলল,”অন্তুরে! আমাকে মাফ করে দিস।”

আজ সকাল থেকেই নোরার তীব্র মাথাব্যথা। রাতে জ্বরও এসেছিল। ডক্টরের কাছে যায়নি। মা-বাবাকেও কিছু বলেনি। উনারা জানতে পারলে ব্যস্ত হয়ে পড়বে। তাছাড়া নোরা চাইছে শরীর খারাপটাকে যথাসাধ্য এড়িয়ে চলতে। মা জানলে সেটা হবে না। আজ বিকালে অনিকস্যারের ক্লাস। শরীরখারাপের কথা জানলে মা কোচিংএও যেতে দিবেন না।

কিন্তু নোরা দুনিয়া উল্টে গেলেও আজকের ক্লাসটা মিস করতে চায়না। এমনিতেই সপ্তাহে মাত্র একদিন অনিকস্যারের ক্লাস হয়। রোজ সোমবার। এই সোমবারের জন্য নোরা পুরো সপ্তাহ ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে। সোমবারটা তার কাছে স্বর্গীয় বোধ হয়। অনিকস্যারকে পুরো দুইঘণ্টার জন্য কাছ থেকে দেখা যায়। তার পারফিউমের ঘ্রাণে সম্পুর্ণ ক্লাসরুম ভরে থাকে। নোরা সামনের বেঞ্চে বসে মুগ্ধচোখে দেখতে থাকে, ম্যাথক্লাসটা এক প্রকার ঘোরের মধ্যেই কেটে যায় তার।

কিন্তু আজকাল নোরার মনে হয় সোমবারটা বড্ড দেরি করে আসতে। আর দুইঘণ্টার লেকচার খুবই অল্প সময়। অন্যান্য ক্লাসের বেলা তো এমন হয়না। বিকালের দিকেও নোরার মাথাব্যথা একটুও কমেনি। শরীরে জ্বরও ছিল। সেই জ্বর,মাথাব্যথা উপেক্ষা করেই নোরা স্কুটি চালিয়ে বেরিয়ে গেল কোচিং এর উদ্দেশ্যে।

ক্লাসে গিয়ে নোরার মনে হল সে বিরাট একটা ভুল করে ফেলেছে। আজকে ক্লাসে আসাটা একদমই উচিৎ হয়নি। ক্লাসরুমে এসি চলছে। শরীরে জ্বর থাকায় নোরার ভীষণ ঠান্ডা লাগছে। এই ঠান্ডায় মাথাব্যথাটাও একদম জেকে বসেছে ভালোমতো। অন্তরা নোরার গায়ে হাত দিয়ে চমকে উঠল,”একি! তোর তো মারাত্মক জ্বর। এই জ্বর নিয়ে তুই এলি কেন?”

“না আসলে তো জীবনের শ্রেষ্ঠ দুইঘণ্টা মিস করতাম।”

” পাগলের মতো কথা বলিস না।আজকে তোর ক্লাস করা লাগবে না, চল ছুটি নিয়ে বাসায় চলে যাই।”

” আমি যাবোনা। কিছুক্ষণ থাকি প্লিজ।”

“অনিকস্যার ক্লাসে ঢুকে পড়লে কিন্তু ছুটি নেওয়া মুশকিল হয়ে যাবে। ”

” হোক। আমার ছুটির দরকার নেই। অনিকস্যারকে দরকার। উনি আসলে আমি উনাকে দেখেই সুস্থ হয়ে যাবো।”

“বুঝছি। জ্বরে তোর মাথাও খারাপ হয়ে গেছে। উল্টা-পাল্টা বকছিস।”

নোরা হেসে বলল,” মাথা ভালো ছিল কবে?”

“সেটাও।”

অনিক ক্লাসে ঢুকল। প্রতিদিনের মতোই শুরু করল তার বিখ্যাত স্টাইলে লাঠি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লেকচার দেওয়া। এইটা তার অভ্যাস। ক্লাস করানোর সময় তার হাতে বিরাট সাইজের একটা লাঠি থাকে। কাউকে মারার জন্য না, নিজের কাছে রাখার জন্য। লাঠি হাতে নিয়ে পাঁচ আঙুলে ঘুরাতে ঘুরাতে সে লেকচার দেয়। সেদিনও তাই করছিল। হঠাৎ নোরার দিকে নজর পড়ায় জিজ্ঞেস করল,” নোরা কি অসুস্থ নাকি?”

প্রশ্ন শুনে ধন্য হল নোরা। অবশেষে অনিকস্যারের নজর তার উপর পড়ল। এই নজর পাওয়ার জন্যই প্রতিদিন আধঘণ্টা আগে কোচিং এ এসে সামনের বেঞ্চে বসে থাকে। কিন্তু অনিক এক জায়গায় দাচবড়িয়ে কখনোই লেকচার দিতে পারেনা। সে সারা ক্লাসরুম হেঁটে বেড়ায়। আর বেশিরভাগ পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকে। নোরার তখন রাগে শরীর জ্বলার মতো অবস্থা হয়। এতো আগে এসে সামনে বসে লাভটা কি হলো যদি অনিকস্যার পেছনেই দাঁড়িয়ে থাকে?এবার যদি পরবর্তী ক্লাস থেকে নোরা পেছনে বসা শুরু করে, তাহলে দেখা যাবে অনিকস্যার সামনে দাঁড়িয়ে লেকচার দিচ্ছে। আর পেছনে আসছে না। নোরা জানে এমনটাই হবে।

অন্তরা বলল, ” জ্বী স্যার। নোরা খুব অসুস্থ। ওর শরীরে অনেক জ্বর।”

অনিক ভ্রু কুঁচকে চিন্তিত গলায় বলল,” তাই নাকি?”

নোরা বলল,” না স্যার। এতোটাও জ্বর নেই। মোটামোটি ঠিকাছি।”

অনিক বলল,” ছুটি লাগবে? তাহলে বলো, আমি ব্যবস্থা করে দেই।”

নোরা বলল,” অর্ধেক সময় তো চলেই গেছে। বাকি সময়টাও থাকতে পারবো সমস্যা হবেনা।”

“সিউর তুমি?”

” জী স্যার। সিউর।”

অন্তরা বলল,”দেখিস আবার। বেশি খারাপ লাগলে বলিস কিন্তু।”

নোরা বলল,” হুম বলবো।”

জ্বর নিয়েই ক্লাস শেষ করল নোরা। ছুটির সময় অনিক বোর্ড পরিষ্কার করছিল। অন্যান্য ক্লাসে টিচাররা স্টুডেন্টদের দিয়ে কাজটা করায়। আর নিজে বেরিয়ে যায়। কিন্তু অনিক এমন করেনা। এই ব্যাপারটাও নোরাকে মুগ্ধ করে। সবাই যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল তখন অন্তরা নোরাকে নিয়ে আস্তে আস্তে হেঁটে বের হচ্ছিল। অনিক জিজ্ঞেস করল,” নোরা তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? বাসায় যেতে পারবে?”

নোরা হালকা গলায় বলল,” পারবো স্যার।”

অনিক অন্তরাকে বলল,” তোমাদের বাসা কি পাশাপাশি? ”

অন্তরা বলল,” না স্যার। আমার বাসা আগে। ওর বাসা অনেক পরে।”

অনিক বলল,” ওর কন্ডিশন তো সিরিয়াস মনে হচ্ছে। ও একা বাসায় যেতে পারবে বলে মনে হয়না। তুমি ওকে নিয়ে যেতে পারবে না?”

অন্তরা কিছু বলার আগেই নোরা মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। তারপর সবকিছু অন্ধকার মনে হতে লাগল তার কাছে৷ অন্তরার ডাক শোনা যাচ্ছিল,”নোরা, নোরা, এই নোরা!”

এরপর আর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফেরার পর নোরার মনে হল শক্ত কিছুর উপর ভর দিয়ে শুয়ে আছে সে। চারপাশে একটা পরিচিত সুঘ্রাণ। শুধু পরিচিত না, অসম্ভব প্রিয়ও বটে। প্রিয়তোষের এই সুভাষ সনাক্ত করতে নোরার একটুও ভুল হলো না। সে স্কুটিতে বসে আছে। অনিকস্যার স্কুটি চালাচ্ছে। সে অনিকস্যারের পিঠের উপর গা এলিয়ে ছিল এতোক্ষণ। মাথা তুলেই বুঝতে পারল পেছনে অন্তরা তাকে ধরে বসে আছে।

নোরা অন্তরার দিকে তাকাল। পুরোপুরি তাকাল না। শুধু বামে তাকাল। অন্তরা সেটা টের পেয়েই বলে উঠল,” স্যার নোরার জ্ঞান ফিরেছে?”

অনিক সাথে সাথে স্কুটি সাইড করে থামাল। তারপর পেছনে ঘুরে বলল,” নোরা, কেমন আছো? এখন কেমন লাগছে তোমার?”

কথাগুলো বলতে বলতে নোরার কপালে হাত রাখল সে। নোরা এখনও একটা ঘোরের মধ্যে আছে৷ তার ধারণা এটা স্বপ্ন। বাস্তবে অনিকস্যার কখনোই তাকে স্পর্শ করবে না।

অনিক চিন্তিত মুখে বলল,” জ্বর তো এখনও কমেনি। আচ্ছা অন্তরা, তুমি ওকে ধরে একটু বসো। সামমেই একটা ফার্মেসী দেখা যাচ্ছে। আমি ওখান থেকে নাপা এক্সট্রা কিনে আনছি ”

” ওকে স্যার।”

অন্তরা শক্ত করে নোরাকে ধরল। অনিক স্কুটি থেকে নেমে বড় বড় কদম ফেলে চলে যাচ্ছে ফার্মেসীতে। নোরা তার দূর্বল শরীর নিয়ে মাথা এলিয়ে দিল অন্তরার কাঁধে। অন্তরা ফিসফিস করে বলল,”কেমন লাগছে দোস্ত?”

” এটা কিভাবে হলো?” নোরার কণ্ঠে তীব্র বিস্ময়।

” তুই সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলি। আমি অনিকস্যারকে বলেছি আমি স্কুটি চালাতে পারিনা। তাই উনিই আমাদের সাথে আসতে বাধ্য হয়েছেন।”

” কিন্তু তুই তো ছোটবেলা থেকেই স্কুটি চালাতে পারিস। ”

” সেটা কি স্যারকে বলে দিলে ভালো হতো?”

নোরা মুচকি হেসে বলল,”থ্যাঙ্কিউ দোস্ত। এই নে ফ্লায়িং কিস।”

অন্তরা হেসে ফেলল। নোরা দূর্বল গলায় বলল,”আরেকটা হেল্প করবি দোস্ত?”

“কি?”

“তুই নেমে যা।”

” সেলিফিশ! আমি তোকে এতোক্ষণ ধরেছিলাম বলেই এখনও বেঁচে আছিস। নাহলে কখন উল্টে পড়ে যেতিস। তোর তো হুশই ছিলনা।”

” এখন হুশ আছে। তোকে আর দরকার নেই।তুই বাহানা বানিয়ে চলে যাতো!”

” তুই যে এতো সেলফিশ আমি জানতাম না হুহ!”

“ন্যাকামি করিস না। যা।”

অন্তরা বলল,” ধৈর্য্য রাখ। যাব। আগে স্যার আসুক!”

পাঁচমিনিট পর অনিক ঔষধের প্যাকেট আর একটা ইনটেক পানির বোতল নিয়ে হাজির হলো।

” ঔষধটা খেয়ে নাও নোরা।”

নোরা চুপচাপ অনিকের হাত থেকে ঔশধ নিয়ে খেল৷ অনিক জিজ্ঞেস করল,”এখন কেমন লাগছে নোরা?”

“ভালো স্যার। কিন্তু একটু দুর্বল লাগছে। ”

“হুম সেটাই স্বাভাবিক। তোমার শরীরে তো অনেক জ্বর।”
অন্তরা নোরাকে চিমটি দিল। ফিসফিস করে বলল,” খুব দুর্বল লাগছে তাইনা?”

নোরা চোখ নামিয়ে নিল। অন্তরা বলল,” স্যার আমই বরং এখানেই নেমে যাই।”

“নেমে যাবে মানে? কেন?”

“আমাকে বাসায় ফিরতে হবে।অলরেডি অনেক দেরি হয়ে গেছে। এবার না গেলে আম্মু টেনশন করবে।”

” তাই বলে ফ্রেন্ডকে এই অবস্থায় রেখে চলে যাবে?”

অন্তরা অপ্রস্তুত হয়ে গেল। নোরা বলল,” আসলে স্যার, ওর বাসাটা অনেক দূরে তো। বেশি রাত হলে বাস পেতে সমস্যা হবে।”

“তোমার বাসা কোথায়?”

” নাখালপাড়া। স্যার আমি এখান থেকেই ইজিলি চলে যেতে পারব।”

“আচ্ছা যাও তবে।”

অন্তরা নেমে নোরাকে বিদায় জানাল।অনিক বলল,” বাকিটা রাস্তা তুমি যেতে পারবে না নোরা?”

নোরা প্রশ্ন শুনে অবাক হল। অনিকস্যার কি ওকে মাঝরাস্তায় ফেলে রেখে চলে যেতে চাইছেন? নোরা অভিমান করে বলল,
” হুম পারবো। এখন তো আমার জ্ঞান ফিরে এসেছে। শরীরের উত্তাপটাও কম। আমি একাই স্কুটি চালিয়ে চলে যেতে পারবো। আপনাকে এতোদূর কষ্ট করে আসার জন্য ধন্যবাদ স্যার। আপনি যেতে পারেন।”

অনিক বলল,” আমি সেটা বলিনি। মানে আমি বলছি তুমি কি বাকি রাস্তা জার্নি করার জন্য প্রস্তুত নাকি কোথাও ব্রেক নিবো?তোমার শরীরের কন্ডিশন কি বলে?”

এ কথা শুনে নোরার মনে স্বস্তি এলো। অগাধ খুশির ঢেউ খেলে গেল যেন। কিন্তু সেটা প্রাণপণে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলল,”ও। আমি ভাবলাম আপনি আমাকে একা চলে যাওয়ার কথা বলছেন।”

” এতোটাও কেয়ারলেস না আমি!”

নোরা হেসে বলল,” মাথাব্যথা করছে। গা গুলিয়ে বমিও আসছে। বুঝতে পারছিনা বাকি রাস্তা যেতে পারবো কিনা।”

“বমি আসলে যাওয়ার দরকার নেই। হাঁটাহাঁটি করবে?”

“হুম।”

” তাহলে নামো।”

অনিক নোরাকে নিয়ে দাঁড়াল। নোরা ভাবতেও পারেনি আজকের দিনে এতো সুন্দর একটা উপহার পাবে সে। এই দিনটির কথা তার সারাজীবন মনে থাকবে। এতোক্ষণ নোরা সাথে লেগে থাকায় অনিকের পিঠটা পর্যন্ত গরম হয়ে গেছে। অনিক বলল,”ইশ! এতো মারাত্মক জ্বর এলো কিভাবে তোমার?”

নোরের ঘোরের মধ্যে মুখ ফসকে বলে ফেলল,”জ্বর থেকে যদি দারুণ কিছু হয়, তাহলে জ্বরই ভালো! ”

“মানে?”

সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলালো নোরা, বলল,” কিছুনা।”

তারপর উল্টোদিকে ঘুরে নিজের মাথাতেই গাটটা মারল। মাঝে মাঝে যে তার কি হয়, যা মুখে আসে চিন্তা-ভাবনা না করেই বলে ফেলে।

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০২

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_২
লিখা: Sidratul muntaz

নোরাকে বিড়বিড় করতে দেখে অন্তরা জিজ্ঞেস করল,”কি বলছিস?”

“দোয়া পড়ছি।”

“দোয়া কেন?”

“ভয় লাগছে দোস্ত।”

“ভয় লাগছে কেন?”

“দোস্ত চল আমরা পেছনে গিয়ে বসি। এখানে খুব গরম। পেছনে ফ্যান আছে।”

“পাগল হয়েছিস? এসি থাকতে ফ্যান কেন লাগবে? সামনে দেখ আমরা ঠিক এসির বরাবর বসে আছি। এ জায়গাটাই সবথেকে ঠান্ডা আর তোর এখানেই গরম লাগছে?”

“অন্তরা শোন, এই ছেলেটা..”

নোরা কিছু বলতে পারল না। এর আগেই অনিক সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলল,” এভরিওয়ান সাইলেন্ট প্লিজ! আমরা কি সাইড টক বন্ধ রেখে ক্লাসে এ্যাটেনশন দিতে পারি?”

সবাই একসাথে বলল,” জ্বী স্যার!”

“ভেরি গুড। তোমরা এখানে প্রায় পঞ্চাশ থেকে ষাট জনের মতো আছো, এবং বেশিরভাগই হয়তো আলাদা আলাদা কলেজ থেকে। তাইনা?”

অন্তরা বলল,” না স্যার। আমরা সবাই এক কলেজের।”
অনিক তাকালো অন্তরার দিকে। অন্তরা বলল,” মানে স্যার আমরা পাঁচজন একই কলেজের।”

অনিক নোরার দিকেও তাকাল। এদিকে নোরার ইচ্ছে করছে বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়তে। অন্তরার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি। কি দরকার ছিল কথাটা বলার? অন্তরার জন্য অনিকের মনোযোগ এখন ওদের দিকে। অনিক বলল,” তোমরা কোন পাঁচজন? দাঁড়াও তো।”

চারজন দাঁড়ালো। নোরা দ্বিধা-দ্বন্দে ভুগছে। তার হাত-পা শিথিল হয়ে আসছে। অন্তরা বলল,”নোরা তুই দাঁড়াচ্ছিস না কেন দাঁড়া!”

নোরা ভয়ে ভয়ে দাড়ালো। তার মাথা নিচু। অনিক আগে নোরাকেই প্রশ্ন করল,”নাম কি ?”

নোরা অবাক হল। অনিক নাম কেন জিজ্ঞেস করছে? তাহলে কি ওকে চিনতে পারেনি? চিনতে না পারার তো কথা না। নোরা কিছু বলার আগেই অন্তরা বলল,”ওর নাম নোরা।”

অনিক অন্তরাকে বলল,”তোমার নাম কি?”

” আমার নাম অন্তরা।”

“পাশেরজন?”

অন্তরাই বলল,” ও রেশমি।”

অনিক বিরক্তগলায় বলল,” তুমি কি সবার বার্তাবাহক নাকি? যাকে জিজ্ঞেস করবো সে উত্তর দিবে। এই বলো তোমার নাম কি?”

“স্যার আমার নাম রেশমি।”

” রেশমি। মানে সিল্ক? খুব ভালো নাম। তোমার?”

“আমি সাদিয়া।”

অনিক বলল,” আর তোমার?”

“আমি জবা।”

” তাহলে তোমরা পাঁচজন একটা গ্রুপ। তাইতো?”

অন্তরা বলল,” জ্বী স্যার। তবে আমাদের গ্রুপে আরেকজন আছে। তন্নী। ও এখনো আসেনি।”

অনিক বলল,” বুঝেছি। লেইট পার্টি। আমি নিজেও অবশ্য লেইট করেছি আজকে। কিন্তু নেক্সট দিন থেকে কেউ লেইট করে আসবে না। এটা আমার খুবই অপছন্দ। আমি ক্লাসে ঢুকে পড়ার পর কেউ আসলে কিন্তু দশমিনিট বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সো এটা সবাই ব্রেইনে সেট করে নাও। অনিক স্যারের ক্লাসে লেইট করা যাবেনা।”

অন্তরা বলল,” স্যার আমরা কি বসবো?”

“আমি কি বসতে বলেছি?”

” না স্যার। সরি।”

অনিক জিজ্ঞেস করল,”তোমরা কোন কলেজের?”

“হলি ক্রস।”

“ওহ। ক্রসিয়ান! দারুণ,একজন একজন করে এইচএসসি’র রেজাল্ট বলো।”

সবাই এক এক করে রেজাল্ট বলতে লাগল। নোরা বলল সবার শেষে। তাও বলতে চাইছিল না। অনিক ইশারা করে জিজ্ঞেস করার পর বলল,”5.00।”

“গোল্ডেন?”

“না।”

“কোনটায় মিস হয়েছে?”

“ইংরেজি। ”

“ইংরেজিতে কত মার্কস পেয়েছিলে?”

নোরা ক্ষীণ গলায় বলল,” সেভেন্টি এইট।”

” ইংরেজি এক্সাম খারাপ হলো কেন?”

“এক্সাম তো ভালোই দিয়েছিলাম। কিন্তু রেজাল্ট যে কেন খারাপ হলো..”

“এতো কনফিডেন্স যখন চ্যালেঞ্জ করতে!”

অন্তরা বলল,” চ্যালেঞ্জ করেও লাভ হয়না স্যার। আমাদের ফ্রেন্ড তন্নী চ্যালেঞ্জ করেও কিছু পায়নি।”

অনিক বলল,” নোরা পেতো। ও তো একটিং খুব ভালো জানে। একটু ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইলের একটিং করলেই শিক্ষাবোর্ড ভয়ে তটস্থ হয়ে দিয়ে দিতো। তাইনা নোরা?”

নোরা চোখ বড় করে তাকালো। অন্তরা বলল,” মানে স্যার? বুঝলাম না।”

“বুঝতে হবে না। তোমরা বসো।”

মনে মনে অনিককে হাজারটা গালি দিয়ে নোরা বসে পড়ল। তারপরই দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তন্নী,”আসবো স্যার?”

অনিক তন্নীর দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।মেয়েটাকে দেখতে চেনা চেনা লাগছে। কোথায় দেখা হয়েছে মনে পড়ছে না। অনিক বলল,” আসো।”

তন্নী ভিতরে এসে অন্তরার পাশে বসল। নোরা কোণায় পড়ে গেল। তার অস্বস্তি লাগছে। তন্নী মেয়েটাকে সে প্রথম থেকেই কোনো এক বিচিত্র কারণে পছন্দ করে না। স্কুল-কলেজে থাকাকালীন এই মেয়েটির সাথে নোরার সব বিষয়েই ছিল হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। নোরা লেখাপড়ায় মোটামোটি ধাঁচের ভালো। তন্নীও তাই। পরীক্ষায় ফেইল করলে নোরার যতটা না দুঃখ হয়, তন্নী ফেইল করেছে শুনলে তার চেয়ে দ্বিগুন সুখ হয়। এইটা ছিল লেখাপড়ার বিষয় নিয়ে লড়াই। সাজ-সজ্জার বিষয়েও ওদের মধ্যে লেগে থাকে কম্পিটিশন। দুজনই যথেষ্ট সুন্দরী। তবুও একে-অন্যকে ভীষণ হিংসা করে। কারণটা সবারই অজানা। অথচ নোরা আর তন্নী মনের দিক থেকে খুব ভালো। তবুও ওদের মনে একজন-আরেকজনের জন্য কেন যে এতো হিংসা, সে এক বিরাট রহস্য।

ক্লাস পুরো দুইঘণ্টার মতো চলল। ছুটির পর সবাই যখন ক্লাস থেকে বের হয়ে যাচ্ছিল, নোরা বসেছিল। অন্তরা আর নোরা বাসার দূরত্ব অনেক। কিন্তু তবুও দুজন একসাথে যায়। তন্নী আর নোরার বাসা একসাথে। তবুও তারা আলাদা যায়। অন্তরা নোরার ব্যাগ গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,” বসে আছিস কেন নোরা? যাবিনা?”

“যাব। তার আগে আমার একটা কাজ আছে।”

” কি কাজ?”

” তোর কাছে পঞ্চাশটাকা হবে?”

“হুম, হবে।”

” দে।”

নোরা টাকা নিয়ে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল। অন্তরা কিছুই বুঝল না। দুইটা ব্যাগ সাথে নিয়ে বোকার মতো বসে রইল খালি ক্লাস রুমটাতে। নোরা গেল অনিককে খুঁজতে। টাকা ফেরত দেওয়া একটা বাহানা। এই বাহানায় স্যারের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলা যাবে। আর স্যারকে সরিও বলা যাবে। সিড়ির সামনে অনিকের সাথে দেখা হয়ে গেল। অনিক সিঁড়ি দিয়ে নামছিল। নোরা ডাকল,”স্যার।”

অনিক পেছনে তাকিয়ে নোরাকে দেখে একটা হাসি দিল। সেই হাসিতে ঘায়েল হল নোরা। মানুষটা খুব সুন্দর করে মুচকি হাসি দিতে পারে। উফ, নোরা কি ক্রাশ খাচ্ছে? সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,” স্যার আপনার সাথে কথা ছিল।”

” বলো।”

” স্যার তখনের জন্য সরি।”

” কখনের জন্য? ”

নোরা লজ্জিতমুখে বলল,” তখন রিকশায় আপনাকে যা কিছু বলেছি সবকিছুর জন্য সরি। আমি আন্দাজও করতে পারিনি যে আপনি আমার টিচার হবেন।”

“সেটাই স্বাভাবিক। আমিও আন্দাজ করতে পারিনি তুমি আমার স্টুডেন্ট হবে। ”

নোরা হেসে বলল,” স্যার আপনি কিছু মনে করেননি তো?”

“মনে তো অনেককিছুই করেছি। কিন্তু কি মনে করেছি সেটা বলা যাবেনা।”

” বলা যাবেনা কেন? আমি জানতে চাই।”

” উহুম। আমি বলবো না। তুমিই লজ্জা পাবে।”

” তবুও বলুন। না শুনলে আমার ভেতরে খচখচ করবে। অস্থির লাগবে।”

” অস্থির লাগুক। কিছুদিন অস্থিরতায় থাকা ভালো।”

“তাহলে কি আপনি বলবেন না?”

“না।”

নোরা মনে মনে উচ্চারণ করল,” ব্যাটা ঘাড়ত্যাড়া!” কিন্তু মুখে বলল,” স্যার, আপনার টাকাটা দিতে এসেছিলাম।”

” সেই রিকশাভাড়ার অর্ধেক টাকা?”

“হুম।”

“লাগবে না। এটা তোমার কাছেই রেখে দাও।”

“কেন স্যার লাগবে না কেন? আপনিই তো বলেছিলেন দ্বিতীয়বার দেখা হলে ঋণ মিটিয়ে নিতে।”

“তখন তো জানতাম না তুমি আমার স্টুডেন্ট। আমি স্টুডেন্টের কাছ থেকে টাকা নেইনা। তোমার কাছেই রেখে দাও। আর নাহলে কোনো মাদরাসায় কিংবা এতিমখানায় দান করে দিও।”

” ঠিকাছে।”

” আর কিছু বলবে?”

” না।”

” তাহলে আমি যাই।”

” আচ্ছা।”

অন্তরা নোরাকে ক্লাসে ঢুকতে দেখে বলল, ” কোথায় গিয়েছিলি?”

” ওয়াশরুমে।”

“ওয়াশরুমে গিয়েছিলি তো টাকা নিয়ে কেন?”

” এমনি। চল বের হই।”

” নে ব্যাগ ধর।”

নোরা নিজের ব্যাগ নিল। অন্তরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,” অনিক স্যারকে দেখতে খুব হ্যান্ডসাম নারে?”

নোরা চমকে উঠল,” তোর কাছে ভালো লেগেছে?”

” খুব ভালো লেগেছে। হি ইজ সো কিউট।”

নোরার অবাক লাগছে। অন্তরার সহজে কাউকে ভালো লাগে না। আর যাকে ভালো লাগে, তার মধ্যে বিশেষ কিছু অবশ্যই থাকে। তার মানে অনিক স্যারের মধ্যেও নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু আছে। নোরার অনিককে প্রথম থেকেই ভালো লেগেছিল এইটা ঠিক। কিন্তু অন্তরার উক্তি শোনার পর এখন আরো বেশি করে ভালো লাগতে শুরু করেছে।

এমনটা সবসময় হয়। নোরার কোনো পছন্দের জিনিস অন্তরাকে দেখালে অন্তরা যদি বলে ভালো, তাহলে জিনিসটার প্রতি নোরার আগ্রহ বেড়ে যায়। আর অন্তরা যদি একবার বলে খারাপ, তাহলে সেই জিনিসটাই মন থেকে ছুড়ে ফেলতে নোরা একবারের জন্যেও পিছপা হয়না। অনিককে এখন নোরার ভীষণ ভালো লাগছে। বাড়াবাড়ির রকমের ভালো। এরকম ভালোলাগাকে কি বলে? ক্রাশ? না ক্রাশ না। নোরা নিজেও বুঝতে পারছে না অনিকের জন্য তার অনুভূতিটা কেমন। সে শুধু জানে ভালোলাগে। যে ভালোলাগার নাম নেই।

নোরার খুব রাগ উঠছে। আজ ম্যাথ ক্লাসে দেরি করে যাওয়ার অপরাধে অনিক স্যার ওকে আধঘণ্টার মতো বাহিরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। লোকটার কি দয়া-মায়া বলতে কিচ্ছু নেই? বাস জার্নি করে এসে ক্লান্ত শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্লাস করতে কার ভালো লাগে? মাত্র দশমিনিটই তো লেইট করেছিল সে। তার জন্য এতো কঠিন শাস্তি? নোরার রাগের মূল কারণ হল, এর আগে তন্নীও একবার লেইট করে এসেছিল। কিন্তু তখন অনিক স্যার তন্নীকে কোনো শাস্তি দেয়নি। শুধু একটা ধমক দিয়েছিল। তাহলে নোরার বেলায় কেন শাস্তি? তন্নীর বেলায় নরম আর তার বেলায় এতো কঠিন?

নোরার ফোন টুংটাং শব্দে বেজে উঠল। মেসেঞ্জারে সানি একটা ভিডিও পাঠিয়েছে। সানি নোরার বয়ফ্রেন্ড। ছেলেটার সাথে ওর ফেসবুকে রিলেশন। বাস্তবে কখনও তাদের দেখা হয়নি। কিন্তু ভিডিও কলে কথা হয়েছে বহুবার। সানি দিনাজপুরে থাকে। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তার ফাইনাল এক্সাম শেষ হলে নোরার সাথে দেখা করতে ঢাকায় আসবে। এটা ওর অনেকদিনের পরিকল্পনা। যদিও নোরা কখনোই দেখা করতে যাবে না। এটা নোরা জানে, সানি জানেনা।

নোরা ভিডিওটা অন করল। একটা বাচ্চার ভিডিও। বাচ্চাটা দুষ্টুমি করছে আর সানি ভিডিও করছে। বাচ্চাটার পাশে সানির ভাবী পাশে দাড়ানো। পিচ্চিটা সম্ভবত সানির বড়ভাইয়ের ছেলে। ভিডিও দেখার মাঝখানেই সানি মেসেজ দিল,” ভিডিওটা দেখেছো?”
নোরা ভিডিও শেষ করে রিপ্লাই দিল,” হুম৷ বাচ্চাটা খুব কিউট। কে এটা?”

” সাহিল। আমার ভাগ্নে। অনেক দুষ্টু বুঝছো!”

“হুম দেখলাম তো। এয়ারফোন কানে লাগিয়ে দুষ্টুমী করছে।”

“তোমার কি এমবি আছে? নাহলে ভিডিও কিভাবে দেখলে?”

নোরা জিভ কাটল। তাদের বাসায় ওয়াইফাই আছে। কিন্তু সানি সেটা জানেনা। নোরা কখনও জানায়নি। কারণ সানি জানতে পারলে কারণে অকারণে ভিডিও কল দিয়ে বিরক্ত করবে। নোরার এটা ভালো লাগেনা। প্রেম করবে ভালো কথা,কিন্তু সারাখন কথা বলতে হবে কেন? আর ভিডিও কলে এতো দেখারই বা কি আছে? তার চেহারা কি ক্ষণে ক্ষণে বদলে যায়? সানি ভিডিও কল দিতে চাইলে নোরা সবসময় বলে এমবি নেই। কিন্তু আজকে সেটা বলা যাবে না। কারণ ধরা পড়ে গেছে। সানি তাৎক্ষণিক নোরাকে ভিডিও কল দিল। নোরা বাধ্য হয়েই রিসিভ করল।

“হাই সানি।”

” নোরা, কেমন আছো?”

“ভালো। তুমি কেমন আছো?”

“আমি ভালো। কিন্তু তোমার মনখারাপ কেন?”

“কই মনখারাপ? মনখারাপ না তো!”

“তোমার মুখ দেখে আর কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে তোমার মনখারাপ। কি হয়েছে? আমাকে বলবে না!”

” মনখারাপ না সানি। তুমি বেশি ভাবছো।”

” আজকে তোমার কত এমবি আছে? কতক্ষণ কথা বলতে পারবো?”

” বেশি নেই, দশমিনিটের মতো কথা বলা যাবে।”

” তাহলে একটু হাসো। দশমিনিট তোমার হাসি মুখ দেখি।”

“সবসময় হাসতে ভালো লাগে না।”

” আর তুমি না হাসলে আমার ভালো লাগে না।”

নোরা জবাব দিল না। তার কথা বলতে কেন জানি খুব বিরক্ত লাগছে। সানি বলল,” তোমাকে কতবার বলেছি, ফোন নম্বরটা দাও। আমি রিচার্জ করে দেই তোমার ফোনে। তাহলে অন্তত প্রতিদিন মন ভরে তোমাকে দেখতে পারতাম। কথা বলতে পারতাম। এই দশমিনিট,পাঁচমিনিট কথা বলে আমার মন ভরে না।”

” তুমি কেন আমার ফোনে রিচার্জ করবে? আর আমি তোমার টাকা নিবো কেন? আমার কি কোনো সেল্ফ রেস্পেক্ট নেই?”

“এখানে সেল্ফ রেসপেক্টের কি হলো? আই এম ইউর বয়ফ্রেন্ড। কিছুদিন পর হাসব্যান্ড হয়ে যাবো। আমার সবকিছু তো তোমারই। ইনফেক্ট আমি নিজেও তোমার।”

” কিছুদিন পর হাসব্যান্ড হবে মানে? আমাকে বিয়ে করতে হলে অন্তত দশবছর অপেক্ষা করতে হবে তোমাকে। এর আগে বিয়ের কথা আমি চিন্তাও করিনা। বুঝেছো?”

” বুঝেছি বাবা। শুধু দশবছর না, একশোবছর অপেক্ষা করতেও আমার কোনো সমস্যা নেই। শুধু তোমাকে পেলেই হলো। আই লভ ইউ।”

” সারাদিন আই লভ ইউ বলতে বলতে তুমি বিরক্ত হওনা?”

“বিরক্ত হবো কেন? তোমার কোনো বিষয়েই আমার বিরক্তি আসেনা। কিন্তু আমার মনে হয় তুমি শুনতে বিরক্ত হও। ”

” না, সেরকম কিছুনা। তুমি ভুল ভাবছো।”

“আমিও চাই, আমি যেন ভুল হই।”

“আচ্ছা এখন রাখছি। কাল কোচিং-এ ফিজিক্স এক্সাম আছে। অনেক পড়া। আমি একটু পড়তে বসবো।”

“আর পাঁচমিনিট?”

“আচ্ছা বলো।”

“বলবো না, শুধু দেখবো তোমাকে। একবার হাসো।”

নোরা হাসল। জোর করে ঠোঁট প্রসারিত করল শুধু। এই হাসিতে কোনো অনুভূতি নেই।

নোরা আর অন্তরা পাশাপাশি বসে আছে। সামনে আফজাল স্যার। ক্লাস চলছে ফিজিক্স। আফজাল স্যার হোয়াইট বোর্ডে অংক বুঝাচ্ছেন। ভদ্রলোক কিছুটা বেটে।চোখে মাইনাস পয়েন্টের চশমা। গায়ের রং ফরসা আর চেহারাটা একটু বাচ্চা টাইপ।লেকচারের মাঝখানে অন্তরা হঠাৎ জিজ্ঞেস করল,” স্যার আপনার হাতে এগুলো কিসের দাগ?”

আফজাল খানিক অপ্রস্তুত হল যেন। পাঞ্জাবীর হাতাটা নিচে নামিয়ে বলল,”কিছুনা। কেটে গেছিল।”

সেজুতি দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,” স্যার মিথ্যে বলেন কেন? এইটা কিসের দাগ সেটা কিন্তু আমি জানি।”

আফজাল চোরের মতো হাসি দিয়ে বলল,” কি জানো?”

সেজুতি বলল,” আপনি না একবার বলেছিলেন গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে ব্লেড দিয়ে হাত কেটেছেন?”

সেজুতির কথায় ক্লাসে হুলুস্থুল পড়ে গেল। সবাই হাসি-ঠাট্টার শব্দ করছে। সেজুতি আফজাল স্যারের কাছে বাসায় টিউশন পড়তো। তাই অনেককিছুই উনার ব্যাপারে জানে। অন্তরা চোখ বড় করে বলল,” স্যার আপনার গার্লফ্রেন্ডও আছে?”

আফজাল সেজুতির দিকে তাকিয়ে বলল, ” মেয়ে তুমি তো দেখছি মান-সম্মান কিচ্ছু রাখবা না। আমি কবে বলেছি গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়া করে হাত কাটার কথা?”

সেজুতি বলল,” তাহলে কেন কেটেছেন?”

আফজাল বলল,” এটা অনেক আগের দাগ। আমি তখন কলেজে পড়তাম। সেই সময় ও আমার বাসার পাশে থাকতো। ও পড়তো ক্লাস টেনে আর আমি পড়তাম ইন্টারে। ”

সেজুতি বলল,” ওয়াও, এই ঘটনা আমাকে একবার বলছিলেন স্যার। মনে পড়েছে।”

অন্তরা বলল,” আমাদের জন্য আরেকবার বলেন স্যার, আমরাও শুনি।”

আফজাল হেসে বলল,” তেমন আহামরি কিছু না। আমি শুধু ওকে দেখানোর জন্য হাত কেটেছিলাম৷ আসলে কি হয়েছিল? ওর বাসা থেকে ওকে ছেলেপক্ষ দেখতে আসছে। আমি সে বিষয় নিয়ে কিছু জানতাম না। পরেরদিন ছিল আমার কেমিস্ট্রি এক্সাম। আমি তো পড়াশুনা নিয়েই ব্যস্ত। রাত বারোটা বাজে ও আমাকে কল দিয়ে বলে বারান্দায় আসতে। আমি বারান্দায় গিয়ে দেখি হাত-টাত কেটে রক্তে মাখামাখি অবস্থা। আর কান্নাকাটি করে চোখমুখ লাল করে ফেলছে। ”

অন্তরা গালে হাত দিয়ে বলল,”ওমা,কি ডেঞ্জারাস মেয়ে! তারপর কি হলো স্যার?”

আফজাল বলল,” তারপর আমি ধমক-টমক দিলাম। জিজ্ঞেস করলাম এমন কেন করল। ও বলে- হুম তুমি তো কোনো খবরই রাখোনা। আজকে পাত্রপক্ষ আমাকে দেখতে আসছিল। সেটাও তুমি জানোনা। আমি বললাম আমার এক্সাম চলতেছে৷ ও আরও কাদতে কাদতে বলে-আমাকে বিয়ে করে নিয়ে গেলেও তুমি এক্সাম দিও৷ একটুও ভালোবাসো না, হেন তেন আরো কত ন্যাকামি। তারপর আমারও জিদ উঠল। হাতের কাছে ব্লেড ছিল, রাগের মাথায় ব্লেড দিয়ে হাতে কয়েকটা আচড় মারলাম, যে দেখ আমিও তোকে কত ভালোবাসি। তোর জন্য হাত কেটে ফেলছি।”

একথা শুনে সবাই হাসতে লাগল। নোরার অবশ্য বিরক্ত লাগছে। ফিজিক্সের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা ক্লাসে কেউ পড়া বাদ দিয়ে ব্যক্তিগত প্রেমালাপ শোনাতে পারে সেটা আফজাল নামক লোকটিকে না দেখলে তার বিশ্বাস হতো না। অন্তরা অবশ্য এসব আলাপে একটু বেশিই মজা পাচ্ছে। হাসতে হাসতে বলল,” ভালোবাসার প্রমাণ দেওয়ার জন্য হাত কেটেছেন?”

আফজাল বলল,” অনেকটা তাই।”

সেজুতি বলল,” স্যার তখন তো এমন করতেন। আর এখন ঈশা আপুকে ইম্প্রেস করার জন্য কি করেন? ”

আফজাল বলল,” ওর জন্য তেমন কিছু করতে হয়না। শুধু পাচশো টাকার চকলেট কিনে দিলেই ও খুশি।”

অন্তরা জিজ্ঞেস কর বলল,” ঈশা কে?”

সেজুতি হাসি মাখা কণ্ঠে বলল,” জানো না? ঈশা তো স্যারের ব্যক্তিগত টুনটুনি।”

আফজাল চোখ বড় করে বলল,” সেজুতি কিন্তু এবার মাইর খাবা।”

সেজুতি বলল,” স্যার আপনিই তো আপুকে টুনটুনি বলে ডাকেন। আমার কি দোষ?”

” সেজন্য তুমিও বলবা নাকি? পাজি মেয়ে!”

অন্তরা সেজুতিকে বলল,” আপুকে তুমি চিনো?”

সেজুতি বলল,” হ্যা চিনি তো। স্যারের ফোনে ছবিও আছে। স্যার দেখান।”

অন্তরা বলল,” দেখি স্যার। আপু কেমন দেখতে?”

আফজাল ফোন বের করে সবাইকে ছবি দেখাল। সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে দেখল। মেয়েটা আহামরি কিছু সুন্দর না। তবে চেহারায় একটা কিউটনেস ভাব আছে। আফজাল সেদিন আর ক্লাস করালো না। পুরোটা সময় স্টুডেন্টদের নিজের লভস্টোরি শুনিয়ে পার করে দিল। অবশ্য আফজালের প্রায় সব ক্লাসেই পড়ার চেয়ে গল্প বেশি হয়। সে এসেই সবার সাথে গল্প শুরু করে দেয়। তার বেশিরভাগ গল্প হয় চাপাবাজী নিয়ে। নিজের নামে প্রশংসা করতে তার ভালো লাগে। সেগুলো আদৌ সত্য কিনা, কেউ জানেনা। জানার প্রয়োজনও মনে করেনা। স্টুডেন্টরা তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে। সে যাই বলে সবাই অমৃতের মতো গিলে নেয়। তবে নোরার আফজালকে একটুও পছন্দ না।

ছুটির পর কোচিং থেকে বের হওয়ার সময় অন্তরা হাসতে হাসতে অন্তরাকে বলল,” আজকের ক্লাসটা মজার ছিল তাইনা? আফজাল স্যারের লভস্টোরিটা দারুন।”

নোরা চাপা স্বরে বলল,”হুম।”

অন্তরা খেয়াল করে দেখল নোরা খুব অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। তার মনমরা ভাব দেখে অন্তরা জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে নোরা?”

“অন্তু, আমার না খুব খারাপ লাগছে।”

“কেন? আফজাল স্যারের গার্লফ্রেন্ডের কথা শুনে?”

নোরা বিরক্তসূচক শব্দ করে বলল,” আরে না বাবা! উনার গার্লফ্রেন্ড দিয়ে আমার কি? আমি তো ভাবছি অনিক স্যারের কথা… আফজাল স্যারের মতো লোকেরই যদি এতো মিষ্টি একটা গার্লফ্রেন্ড হতে পারে তাহলে অনিকস্যারের গার্লফ্রেন্ড না জানি কত সুন্দর হবে! এই কথা চিন্তা করেই আমার বিরহ বিরহ ফীল হচ্ছে।

অন্তরা কপালে হাত ঠেঁকিয়ে বলল,”সর্বনাশ! তুই আবার অনিকস্যারের প্রেমে-টেমে পড়ে যাসনি তো? নোরা খবরদার, তোকে সাবধান করছি। অনিকস্যারের তো নিশ্চিত গার্লফ্রেন্ড আছে। একটা না, দেখ গিয়ে দশ-বারোটা আছে। উনার পেছনে লাইন ধরে কোনো লাভ নেই। আজীবন সিরিয়ালে থাকতে হবে।”

নোরার মুখ আরও মলিন হয়ে গেল। অন্তরা নোরার হাত ধরে বলল,”মনখারাপ করিস না। উনার থেকে আরো অনেক ভালো ছেলে পাবি তুই। আচ্ছা তোকে না সানি নামের একটা ছেলে প্রপোজ করেছিল? সেটার কি হলো?”

“ওহ। তোকে বলতেই ভুলে গেছি। সানিকে ব্লক ডান।”

“ব্লক মেরে দিলি? কেন?”

“আমার ওকে ভালো লাগেনা৷ যেখানে আমি জানিই আমি ওকে কোনোদিন মেনে নিতে পারবো না।সেখানে শুধু শুধু বেচারাকে আশায় রাখবো কেন? তাই ব্লক মেরে দিয়েছি। কয়েকদিন কান্নাকাটি করবে, তারপর এমনি সব ভুলে যাবে।”

“তুই বুঝলি কিভাবে তুই ওকে মেনে নিতে পারবি না?”

“এটা আবার বুঝতে হয়? ও আমাকে আই লভ ইউ বললে আমার অস্বস্তি লাগে। ওর মেসেজ দেখলে আমি সবসময় ইগনোর করি। মাঝে মাঝে তো ওর ভয়ে অনলাইনেও যাইনা৷ এতো প্যারা নিয়ে বাঁচা যায়? ব্লক করে দিয়েছি, এখন আমি শান্তি। মনে হচ্ছে মাথা থেকে পাহাড়সমান বোঝা নেমে গেছে। ”

” ভালোই করেছিস। চল।”

চলবে

প্রিয়তোষ পর্ব-০১

0

#প্রিয়তোষ
#পর্ব_১
লিখা: Sidratul muntaz

“এইযে ম্যাডাম, ওয়ালেটটা ধরুন।”

“আমি কি আপনার পারসোনাল মালবাহী কর্মচারী যে আপমার ওয়ালেট ধরব আশ্চর্য! আমি আপনার ওয়ালেট কেন ধরবো?”

ছেলেটা নোরার উত্তর শুনে অবাকচোখে তাকাল। নোরাও এতোক্ষণে ঘুরে তাকাল ছেলেটির দিকে। কিন্তু এখন তার মনে হচ্ছে এটা কোনো সাধারণ ছেলে নয়। কারণ ছেলেটা বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর। মনে হয় না এতো সুন্দর ছেলে সে আগে কখনো দেখেছে।

ছেলেটি অনেকটা প্রায় ধমকের সুরে বলল,
“আপনার ওয়ালেট। ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েছিল। ধরুন।”

নোরা চমকে উঠল। ছেলেটার হাতের দিকে তাকাল। পার্সটা তারই। এই পার্সে পাঁচশো টাকার নোটও আছে। নোরার হৃদস্পন্দন থেমে গেল। পাঁচশো টাকার নোটটা যদি এখন না পাওয়া যায়? সে এতোটা বেখেয়ালি কেন? নিজের উপর রাগ হলো।

ছেলেটা বলল,
” ফোনে কথা বলার সময় এতোটাও মগ্ন হতে নেই যে আশেপাশের কোনো খেয়াল থাকে না। আমি আপনাকে অনেকক্ষণ ধরেই ডাকছিলাম।”

ওই পাশ থেকে অন্তরা আওয়াজ দিল,” এই নোরা, কি হয়েছে রে?”

” অন্তু, তুই এখন ফোনটা রাখ। পরে কথা বলছি হ্যাঁ?”
নোরা লাইন কেটেই ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর ছেলেটার হাত থেকে পার্সটা নিতে নিতে হালকা হেসে বলল,
” সরি। আসলে আমি আপনার ডাক শুনেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি যে আপনি এজন্য আমাকে ডাকছেন।”

“কমন সেন্স থাকা উচিৎ। ”

নোরা ভ্রু কুঁচকে বলল,” কমন সেন্সের কথা আসলো কেন?”

“কেউ নিশ্চয়ই আপনাকে অকারণে ডাকাডাকি করবে না? এটুকু বোঝা উচিৎ ছিল যে কোনো দরকারেই ডাকা হচ্ছে। ”

“কমন সেন্স আপনারও নেই। আপনার উচিৎ ছিল আমাকে ডেকে বলা যে আমার পার্স পড়ে গেছে৷ কিন্তু আপনি কি করলেন? পার্সটা হাতে নিয়ে ঘ্যান ঘ্যানাতে লাগলেন। ম্যাডাম ওয়ালেট ধরুন, ওয়ালেট ধরুন। আমি কিভাবে বুঝবো? আপনি আমাকে পার্সের কথা বলেছেন? আর এটাকে পার্স বলে। ওয়ালেট না”

” এক্সকিউজ মি! এটা ওয়ালেটের মতো দেখতে তাই আমি ওয়ালেট বলেছি। আর কারো কোনো জিনিস পড়ে গেলে সেটা তুলে দেওয়া ভদ্রতা। আমি যাস্ট ফরমালিটির খাতিরে আপনার পার্সটা তুলে দিয়েছি। আর আপনি হয়তো ভাবছিলেন আমি আপনাকে হ্যারেস করার জন্য ডাকছি। আসলে কি আর বলবো? মানুষের মেন্টালিটি এতো মিন…”

” আপনি কি আমাকে নিচু ম্যান্টালিটির মানুষ বললেন?”

” সেরকম কিছু না। ফরগেট ইট।”

ছেলেটা সামনে হাঁটতে শুরু করল। নোরা তার পার্সটা খুলে দেখল পাঁচশো টাকার নোট ঠিকঠাকই আছে। সে ছেলেটার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে ডাকল,” এইযে মিস্টার, শুনে যান।”

ছেলেটা থামল। ঘুরে তাকাল,” জ্বী? কিছু বলবেন?”

“অবশ্যই বলব। আপনি যে ইন্ডিরেক্টলি আমাকে অপমান করে গেলেন সেটা কি আমি বুঝিনি? শুনুন একটা কথা বলি, আমি কেয়ারলেস হতে পারি,বোকা হতে পারি, কমন সেন্সের অভাবও আমার থাকতে পারে, কিন্তু তাই বলে নিচু মেন্টালিটির মানুষ আমি একেবারেই নই। আমার মেন্টালিটি যথেষ্ট উঁচু। আপনার হাইটের থেকেও উঁচু। এত্তো উঁচু। বুঝেছেন?”

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপ রইল। তারপর মুখে হাত ঠেঁকিয়ে থেকে মুচকি হেসে বলল,”অন্তত এটা স্বীকার করলেন, যে আপনার কমন সেন্সের অভাব আছে। ভেরি গুড।”

ছেলেটা এই কথা বলেই আবারও সামনে হাঁটতে শুরু করল। নোরার এবার রাগ আরও হচ্ছে। রাস্তাঘাটে একটা অতিসুন্দর ছেলের ত্যাড়ামার্কা কথা শুনে এভাবে অপমানিত হওয়ার থেকে বেদনাদায়ক মনে হয় আর কিছু নেই। তার উপর ছেলেটা যদি হয় এমন ভাবওয়ালা। সুন্দর ছেলেদের ভাব থাকে। কিন্তু এই ছেলেকে দেখলে দু মিনিটের মধ্যে যে কেউ বলে দিতে পারবে তার প্রতিটি শিরায় শিরায় তিন-চার কেজি করে ভাব। যেন আস্তো একটা ভাবের গোডাউন। কোনো ছেলে তাকে ভাব দেখিয়ে অপমান করবে, আর সে চুপচাপ মেনে নিবে,এটা হতে পারেনা। নোরা এবার ছেলেটার একদম সামনে গিয়ে দাঁড়াল। দুইহাত মেলে দিয়ে বলল,” ওয়েট ওয়েট ওয়েট।”

” আবার কি?”

” দেখুন, আমি কিন্তু এটা বলিনি যে আমার কমন সেন্সের অভাব। আমি শুধু আপনার আঙ্গিকে বুঝাতে চেয়েছি, যে আপনি ভাবতেই পারেন আমার কমন সেন্সের অভাব আছে। কিন্তু তাই বলে নিচু মনের মানুষ আমাকে ভাববেন না। বুঝেছেন?”

” সব বুঝেছি। কিন্তু আপনি আমার পেছনে কেন লেগে আছেন বলুন তো? রাস্তা ছাড়ুন।”

নোরা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,” পেছন কই লেগে আছি? আপনিই তো কথা শেষ হওয়ার আগেই বারবার চলে যাচ্ছেন।তাই আমাকেও পেছন পেছন আসতে হচ্ছে।”

“কথা শেষ হয়েছে? আর আসবেন না দয়া করে।”

ছেলেটা চলে গেল। নোরা মাথা চুলকে চিন্তা করছে, সে কি এবারও অপমানিত হল?

বাসস্ট্যান্ডে প্রচন্ড ভীর। সবাই ঠেলে-ঠুলে বাসে উঠছে। নোরা বসার মতো সামনে একটা আরামের জায়গা পেয়ে গেল। ছেলেটাও একই বাসে উঠেছে। পেছনে গিয়ে বসছে। নোরা তাকাল না। ছেলেটাকে দেখে মনে মনে বলল,” ভাবওয়ালা।”

বাস চলতে শুরু করেছে। যাত্রার পাঁচমিনিটের মাথায় হঠাৎ কি যেন হল। বাস থামিয়ে দেওয়া হল। সম্ভবত বাস ড্রাইভার ট্রাফিক আইন অমান্য করেছে। ট্রাফিক পুলিশ বাসে ঢুকে ড্রাইভারের কাছ থেকে চাবি নিয়ে চলে গেল। সবাই হা হুতাশ করতে করতে বাস থেকে নেমে যাচ্ছে। তাও মেইন রাস্তায়। যেখানে দাড়ানোর জায়গাটুকুও নেই। নোরা হা করে দেখছে। হঠাৎ কি হলো? সেই ছেলেটা বাস থেকে নামার সময় নোরার দিকে তাকিয়ে বলল,”সবাই নেমে যাচ্ছে। আপনি কি একাই বসে থাকবেন? আসলেই কোনো কমন সেন্স নেই।”

নোরা এ কথা শুনে তড়িঘড়ি করে নামল। তারপর ছেলেটার পেছনে যেতে যেতে বলল,” ভাইয়া, বাস কি আর যাবে না?”

” দেখলেনই তো সবাই নেমে গেল। গেলে কি আর কেউ নামতো? আর ট্রাফিক পুলিশ চাবি নিয়ে গেছে। বাস যাবেই বা কি করে? কমন সেন্স!”

” আপনি কথায় কথায় শুধু কমন সেন্স নিয়ে খোঁটা দিবেন না তো। এবার আমরা কিভাবে যাবো সেটা বলেন। নতুন বাস আসবে?”

” নতুন বাস কেন আসবে? এখানে আর বাস-টাস পাওয়া যাবে না। হয় হাঁটতে হবে, নাহলে রিকশা নিতে হবে।”

“আপনি কোনটা করবেন?”

” আমি ভাবছি রিকশা নিবো। এতোদূর হাঁটা সম্ভব না।”

“আপনি কোথায় যাচ্ছেন?”

“গ্রীনরোড,ফার্মগেট।”

“আরে আমিও তো সেখানেই যাচ্ছি। চলুন একসাথে যাই?”

ছেলেটা আড়চোখে তাকাল। তাই দেখে নোরার হাস্যোজ্জল মুখ মলিন হয়ে গেল। এভাবে সরাসরি জিজ্ঞেস করা উচিৎ হয়নি। একটু অন্যভাবে জিজ্ঞেস করলেও হতো। ছেলেটা কি এখন ওকে ছ্যাঁচরা মেয়ে মানুষ ভাবছে? নোরার অপ্রস্তুত মুখ দেখে ছেলেটা হেসে ফেলে বলল,” চলুন।”

নোরা বিরাট একটা হাসি দিয়ে ছেলেটার পিছু নিল। মোড়ে গিয়ে ওরা একটা রিকশা পেয়ে গেল। রিকশা ভাড়া একশো টাকা। দুজন পঞ্চাশ পঞ্চাশ করে দিবে। নোরা রিকশায় উঠতে উঠতে বলল,”ভালোই হয়েছে। আলাদা আলাদা গেলে দুজনেরই একশোটাকা লাগতো। কিন্তু এখম কম লাগবে। পুরো অর্ধেক। একেই বলে, একতাই বল!”

ছেলেটা হাসল। নোরা বলল,”আরে আপনার নামটাই তো জানা হল না। নাম কি আপনার?”

“অনিক আবেদিন। আপনার?”

” আমি নৌরিন জাহান। ডাকনাম নোরা। নোরা বলেই ডাকতে পারেন।”

” নোরা? নামটা খুব কিউট, একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে।”

” নামে বাচ্চা ভাব থাকলে কি হবে? আমি কিন্তু বাচ্চা নই।”

“তাই নাকি? কিসে পড়েন আপনি?”

“এইতো, এবার এইচএসসি এক্সাম দিলাম!”

“এসএসসি নাকি এইচএসসি? ”

“এইচএসসি। হায়ার সেকেন্ডারি!”

“ওহ আচ্ছা।”

ছেলেটা হাসছে। কিছুক্ষণ আগের প্রশ্নটা যে উপহাসের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল নোরা সেটা বুঝতে পারল। তাই সরুচোখে বলল,” আপনার এসএসসি কেন মনে হল?”

“আপনাকে দেখে বোঝা যায়না যে আপনি কিছুদিন পর ভার্সিটিতে উঠবেন।”

“সবাই অবশ্য তাই বলে। আমার মধ্যে নাকি কেমন একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব। এটা হয়তো আমার হাইটের কারণে। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আই এম প্রাউড অফ মাই হাইট। আর আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি লম্বা হলে আমাকে একদমই মানাতো না। আমাকে শর্ট হাইটেই মানায়। ঠিক বলেছি না? ”

“হুম। ঠিক বলেছেন। হাইট ডাজন্ট মেটার।”

“ঠিক এই কথাটাই না আমার এক্স বয়ফ্রেন্ডও আমাকে বলতো। ঠিক আপনার মতো, হাইট ডাজন্ট মেটার। মিলে গেল কি করে?”

” জানিনা তো।”

“ধুর,ওর কথা মনে পড়লেই আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আপনি মনে করিয়ে দিলেন। আসলে ও আমাকে খুব লভ করতো।”

“লভ করতো তাহলে এক্স কেন হলো?”

“সেটা তো আমার দোষে হয়েছে। আমি কি করেছি জানেন? দাঁড়ান আপনাকে ঘটনা বলি। ”

“ইটস ওকে, বলতে হবে না।আমি বুঝেছি।”

” না শুনে কিভাবে বুঝে গেলেন? কিচ্ছু বুঝেননি আপনি।আগে শুনুন তারপর বুঝবেন। ইন্টারেস্টিং কাহিনি। সময়টা ছিল মধ্যদপুর। প্রতিদিন দুপুরেই লাঞ্চের পর ওর সাথে আমার কথা হতো। সেদিনও হচ্ছিল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ওর কোনো এক্স আছে কিনা। তখন কিন্তু আমার কোনো এক্স ছিল না। সে বলল তারও এক্স নেই। কিন্তু ক্রাশ আছে। ক্রাশের নাম তামান্না। মেয়েটাকে সে প্রপোজও করেছিল। আচ্ছা আপনিই বলুন, আমার বয়ফ্রেন্ড অন্যমেয়েকে প্রপোজ করেছে, এই ঘটনা শুনলে আমার রাগ উঠবে না? কান্না পাবেনা?”

” কিন্তু তখন তো সে আপনার বয়ফ্রেন্ড ছিল না।”

” না থাকুক। পরে তো হয়েছে। সে কেন অন্যমেয়েকে প্রপোজ করবে? আমার ভীষণ রাগ উঠল ওর উপর। দিলাম ব্লক করে। ফেসবুক, মোবাইল, সব জায়গা থেকে ব্লক। তখন অবশ্য আমি শুধু ফেসবুক ইউজ করতাম৷ ক্লাস এইটে পড়তাম তো! আমি ওকে ব্লক দেওয়ার পর ও আমাকে আলাদা আলাদা নম্বর থেকে কল দেওয়া শুরু করল। আমি সব নম্বর ব্ল্যাকলিস্ট করে দিলাম। তারপর চলে গেলাম অন্তরাদের বাসায়। অন্তরা আমার বেস্টফ্রেন্ড। ওইখানে গিয়ে দেখি, ও অন্তরাকেও মেসেজ দিয়ে ডিস্টার্ব করছে। আমি যেন ওকে আনব্লক করি। তারপর আমার মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। ওকে শিক্ষা দেওয়ার বুদ্ধি। অন্তরাকে বললাম, ফারহানকে বলতে আমি বিষ খেয়েছি। ও বলতে ভুলে গেছি, আমার বয়ফ্রেন্ডের নাম ছিল ফারহান। অন্তরা আমার কথামতো ফারহানকে বুঝাল আমি বিষ খেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছি। ফারহান বিশ্বাস করলনা। প্রমাণ চাইল। তারপর আমি কি করলাম জানেন? ফ্লোরে উল্টো হয়ে শুয়ে অন্তরাকে দিয়ে ছবি তুলিয়ে ফারহানকে পাঠিয়ে দিলাম। ওইটা দেখে ফারহান এতো ভয় পেল, বাসার সবাইকে ঘটনা জানিয়ে দিল। পরে অবশ্য আমি স্বীকার করেছিলাম যে আমি বিষ খাইনি। কিন্তু ওর বাসার মানুষ ওকে কি বুঝালো জানেন? আমি নাকি ধোকাবাজ। যে বিষ খাওয়া নিয়ে নাটক করতে পারে, সে সম্পর্ক নিয়েও নাটক করতে পারে। ফারহান আমার উপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলল। তারপর একসময় আমাকে ছেড়ে দিল। আর কোনোদিন ওর সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি। এখনো না। ”

অনিক ঝেড়ে কাশল,” এবার আমাদের নামতে হবে। এসে গেছি।”

“ও। খেয়ালই ছিলনা। নামছি।”

নোরা রিকশা থেকে নেমে পার্স বের করল। পাঁচশো টাকার নোটটা রিকশাওয়ালার দিকে এগিয়ে দিল। রিকশাওয়ালা বলল,”আপা, ভাঙতি তো নাই।”

“ওহ। আমার কাছেও তো ভাঙতি নেই। যা ছিল বাস কন্ট্রাক্টরকে দিয়ে দিয়েছিলাম৷ আপনার কাছে আছে?”

অনিক বলল,” হ্যাঁ আছে। আমি দিয়ে দিচ্ছি কোনো সমস্যা নেই।”

“না না আপনি কেন দিবেন? আপনি আমাকে পাঁচশোটাকা ভাঙতি দেন আমি দিচ্ছি।”

“লাগবে না। আমিই দিয়ে দিচ্ছি।”

অনিক একশোটাকা রিকশাওয়ালাকে দিল। রিকশাওয়ালা চলে যাওয়ার পর নোরা হাঁটতে হাঁটতে বলল,”এটা কিন্তু ঠিক হলো না। কারো কাছে ঋণ করতে আমার একদম ভালো লাগেনা। কিন্তু আপনি আমাকে ঋণী করে দিলেন।”

” আবার যদি কোনোদিন দেখা হয়, আর আপনার কাছে ভাঙতি থাকে, তাহলে ঋণটা মিটিয়ে দিবেন! সমস্যা কই?”
“যদি আর কোনদিন দেখা না হয়?”

” তাহলে আমার নামে পঞ্চাশটাকা মসজিদে দান করে দিবেন। আমার পাওয়া হয়ে যাবে।”

নোরা হেসে বলল,” আচ্ছা ঠিকাছে। ”

অনিক বলল,” বায়।”
“বায়।”

নোরা কোচিংরুমে ঢুকল। ঠান্ডা ক্লাসরুম। আজকে তার এডমিশন কোচিং এর প্রথমদিন।নোরা অন্তরাকে সামনের বেঞ্চে দেখে সেও অন্তরার পাশে গিয়ে বসল। অন্তরা বলল,
“এতো দেরি লাগল কেন তোর? আমি কখন থেকে একা একা বসে আছি।”

” সরি রে। রাস্তায় একটা ঝামেলা হয়েছিল। তাই দেরি হয়েছে। ”

“আচ্ছা তখন কি হয়েছিল রে? ফোন কেটে দিয়েছিলি কেন?”

” বলছি বলছি সব বলছি।”

নোরা অন্তরাকে সবকিছু গুছিয়ে বলতে শুরু করল। অন্তরার প্রায় মাথা ব্যথা হওয়ার উপক্রম! এই মেয়ে এক নিশ্বাসে এতো কথা কি করে বলতে পারে? অন্তরা বলল,”এইটুকু সময়ের মধ্যে তুই ছেলেটাকে ফারহানের ঘটনাও শুনিয়ে ফেলেছিস? হাইরে! তুই পারিসও।”

নোরা হেসে বলল,” আচ্ছা আজকে কোন বিষয়ের ক্লাস?”

“ম্যাথ।”

“ও। স্যার কখন আসবে?”

” সময় তো হয়ে গেছে। এখনি আসার কথা।”

অন্তরার কথার মাঝখানেই কেউ দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। সবাই সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। নোরাও দাঁড়িয়ে গেল। তার চোখ দুটো আলুর মতো গোল হয়ে যাচ্ছে। সে কি সত্যিই অনিককে দেখছে? নাকি হ্যালুসিলেশন? অনিকের সাথে দ্বিতীয়বার দেখা হলে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এতো জলদি দেখা হয়ে যাবে নোরা ভাবেনি।

নোরার ভীষণ লজ্জা লাগছে। লজ্জার কারণ হল সে নিজের বয়ফ্রেন্ডের সাথে ব্রেকআপের কাহিনি অনিককে শুনিয়েছে। যেই অনিক এখন তার কোচিং এর ম্যাথ টিচার! নোরা মনে মনে উচ্চারণ করল,”লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা ইল্লাহ বিল্লাহ।”

চলবে

চৈত্রের প্রেম পর্ব-০৭ এবং শেষ পর্ব

0

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
অন্তিম পর্ব

❝অস্থিরতার মধ্য দিয়ে সাঁঝির একটা দিন কেটে যায়। হাতে রয়েছে আর মাত্র একটা দিন। সাঁঝি কেসটা কে অনেক ভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু কোনো প্রমাণ বা খুনির চিহ্ন পাইনি। সাঁঝি অবাক হয় এটা ভেবে যে মানুষ এতোটা নিখুঁত ভাবে খুন কিভাবে করতে পারে। কোনো এভিডেন্সই কোথাও নেই এটাও সম্ভব?

শ্রাবণ রেডি হচ্ছে ঢাকার বাইরে যাওয়ার জন্য। সাঁঝি শ্রাবণের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো গুছিয়ে দিচ্ছেন। আজকের রাতটা শ্রাবণ বাইরে থাকবে৷ একটা প্রোগ্রামে তাকে গেস্ট হিসেবে ডাকা হয়েছে তাই সেখানে যাচ্ছে শ্রাবণ। সাঁঝি শ্রাবণের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আনমনে হয়ে কিছু একটা ভাবে। শ্রাবণ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তার ড্রেসাপ দেখছে সব ঠিকঠাক আছে কি-না। তখনই নজর যায় সাঁঝির দিকে। শ্রাবণ বিস্ময় নিয়ে সাঁঝিকে ডাকলে সাঁঝি শুনতে পায়না৷ সে তার ভাবনায় মগ্ন এখনো। শ্রাবণ ভ্রু কুচকে এগিয়ে এসে সাঁঝির কাধে হাত রাখলে সাঁঝি কিছুটা হকচকিয়ে উঠে শ্রাবণের দিকে কৌতুহলী দৃষ্টি রাখে।

কি হয়েছে তোমার সাঁঝি? কি ভাবছো এতো? গতকাল থেকে তোমাকে কেমন উদাস আর অস্থির দেখাচ্ছে৷ কোনো সমস্যা হয়েছে কি? শ্রাবণের কথায় সাঁঝি হাসার চেষ্টা করে বলে সমস্যা? সমস্যা আবার কি হবে? আমি তো এমনি ভাবছিলাম, আপনি রেডি? সাঁঝি কথা ঘোরানোর জন্য বলে।

হ্যাঁ রেডি! কিন্তু আমার তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না৷ কি করবো আমি তো তাদের কথা দিয়ে ফেলেছি। আমি নিশ্চিত কিছু একটা লোকাচ্ছো আমার থেকে। সত্য করে বলো তো কি হয়েছে? শ্রাবণ উত্তেজিত কন্ঠে বলে।

আপনি শুধু শুধু দুঃচিন্তা করছেন। আমার কিছু হয়নি৷ আমি তো জাস্ট এই কেসটা নিয়ে ভাবছিলাম। পুলিশ তো আপনাকে সন্দেহ করছে এখনো তাই না। সাঁঝির কথায় শ্রাবণের মনটা খারাপ হয়ে যায়।

ওহ বলে ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্রাবণ শারিয়ার।

সাঁঝির ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই বলে আপনার তো দেরি হয়ে যাচ্ছে। গাড়ি চলে আসবে কিছুক্ষণের মধ্যে। শ্রাবণ হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে অয়ন মনে হয় এদিক হয়ে আসবে। আচ্ছা তুমি সাবধানে থাকবে৷ আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চলে আসবো বলে শ্রাবণ সাঁঝির কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে রওয়ানা হয়। শ্রাবণ বেরিয়ে যেতেই সাঁঝি ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

অয়নও শ্রাবণের সাথে যাচ্ছে। কারণ তাদের দুজনকেই ইনভাইট করা হয়েছে।

পরের দিন ঠিক সকাল ১০ টা৷ এমন সময় সাঁঝির ফোন বেজে উঠে। হারুন রশীদের ফোন পেয়ে সাঁঝি চটজলদি ফোন তুলে উত্তেজিত কন্ঠে বলে আব্বু উনার ফোন রাত থেকে বন্ধ। আমি কোনো ভাবেই কন্ট্রাক্ট করতে পারছি না উনার সাথে। অয়ন ভাইয়ার নাম্বারেও ট্রাই করেছি বেশ কয়েকবার কিন্তু উনিও ফোন তুলছে না৷ আমি বুঝতে পারছি না কি করবো। উনার কিছু হয়নি তো? কোনো বিপদে পড়েনি তো উনি৷ আমি আর কিছু ভাবতে পারছি না আব্বু।

সাঁঝিকে থামিয়ে হারুন রশীদ গম্ভীর স্বরে বলে সাঁঝি তুমি জলদি উত্তরার চলে এসো৷ আমি লোকেশন সেন্ড করছি৷ এখানে আসলে তুমি শ্রাবণের খোঁজ পাবে আশা করছি। কথাটা শেষ করা মাত্র হারুন রশীদ ফোন রেখে দেয়৷ সাঁঝি এপাশ থেকে আব্বু আব্বু বলে ডেকেও লাভ হয়না। কিছুক্ষণ ফোনের দিকে চেয়ে থেকে সাঁঝি হম্বিতম্বি করে বেড়িয়ে যায়।

হারুন রশীদ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে, পাশেই একজন মহিলা কান্না করছে৷ একজন মহিলা কনস্টেবল তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে। মামুনুর সাহেব লাশের সামনে বসে তল্লাশি করছে। নাকে শক্ত করে রুমাল চেপে ধরেও যেনো লাভ হচ্ছে না৷ রক্তের তীব্র পঁচকাটে গন্ধ বারবারই নাকে এসে ধাক্কা খাচ্ছে। আর ততবারই মামুনুর সাহেবের চোখ মুখের গড়নের পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ এমন জঘন্য ভাবে একজন মানুষকে কিভাবে মারতে পারে এটাই ভাবছে বসে।

এরই মধ্যে সাঁঝি ছুটে আসে প্রায়। সাঁঝিকে দেখে হারুন রশীদ বলেন এসে গেছো।

আরও একটা খুন? সাঁঝি বিস্মিত কন্ঠে বলে।
হ্যাঁ আরো একটা খুন এবং আমরা এবার খুনের সাথে খুনিকেও পেয়েছি৷ হারুন রশীদের কথায় সাঁঝি ভ্রু কুচকে বলে খুনি? কে খুনি কোথায় খুনি?

তোমার সামনে হারুন রশীদ গম্ভীর স্বরে বলেন সামনে ইশারা করে দেখিয়ে। হারুন রশীদের হাতের ইশারা বরাবর তাকাতেই চমকে উঠে সাঁঝি। শ্রাবণ পড়ে আছে মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে। সাঁঝি ছুটে যায় শ্রাবণের কাছে।
কি হ’য়েছে উনার? উনি এখানে এইভাবে পড়ে আছে কেনো? আর উনি এখানেই বা আসলো কিভাবে? সাঁঝি তটস্থ হয়ে উঠে।

আমি তোমাকে বলেছিলাম শ্রাবণ শারিয়ারই এইসব খুন করছে। তুমি আমার কথা বিশ্বাস করোনি আজ হাতেনাতে প্রমাণ পেলে। জীবনে বড় ভুল করেছো তুমি শ্রাবণ শারিয়ারের মতো মানুষকে বিয়ে করে। আমি তোমাকে অনেকবার বোঝানোর চেষ্টা করেছি সাঁঝি কিন্তু তুমি আমার কথা একটিবার বোঝার চেষ্টা করোনি।

প্লিজ আব্বু তুমি চুপ করো৷ এখন এইসব কথা বলার সময় নয়। আর হ্যাঁ, একটা কথা মনে রেখো সাঁঝি কখনো ভুল করিনি আর করবেও না। আমি কোনো ভুল মানুষ চয়েজ করিনি। উনি নির্দোষ। কি হয়েছে আমাকে সম্পুর্ণ খুলে বলো, উনি এখানে কিভাবে এসেছে?

আমি বলছি আপনাকে সবটা, মামুনুর সাহেব এগিয়ে এসে সাঁঝির দিকে তাকিয়ে বলে। আমরা সকালে ফোন পেয়ে এখানে আসি। যিনি খুন হয়েছেন তার স্ত্রী আমাদের ফোন করে জানায় ব্যাপার টা। উনার স্ত্রী গতকাল বাসায় ছিলেন না। বোনের মেয়ের জন্মদিন উপলক্ষে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। উনার স্বামীরও সেখানে যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু সন্ধ্যার পর নাকি উনার স্বামী উনাকে ফোন করে জানায় যেতে পারবেন না। জরুরি একটা কাজে আটকা পড়েছেন। আজ সকালে মিসেস শায়লা বাসায় এসে দেখেন উনার স্বামীর এই রকম অবস্থা আর তার পাশে শ্রাবণ শারিয়ার অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমরা এসে শ্রাবণ শারিয়ারকে এইভাবে পাই এখানে। যত সম্ভব উনাকে মাথায় এই লাঠিটা দিয়ে আঘাত করা হয় যার জন্য উনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। আমাদের ধারণা মিস্টার আসাদ মৃত্যুর আগে নিজেকে রক্ষা করার অনেক চেষ্টা করেছে। কিন্তু শেষ রক্ষা তিনি করতে পারেননি।

ওয়েট ওয়েট! আপনার কথা অনুযায়ী শ্রাবণ শারিয়ার যখন মিস্টার আসাদকে খুন করতে যায় তখনই উনি শ্রাবণ শারিয়ারকে আঘাত করে এবং তারপর তিনি অজ্ঞান হয়ে যায়। তাহলে আমার কথা হলো, উনি যদি অজ্ঞানই থাকে তাহলে মিস্টার আসাদকে এমন নৃশংস ভাবে খুনটা করলো কে? উনি নিশ্চয় অজ্ঞান হয়ে এইসব করেনি।

সাঁঝির কথায় হারুন রশীদ আর মামুনুর সাহেব ভাবান্তর হয়ে পড়েন৷ বিস্ময় নিয়ে দুজন দুজনের দিকে তাকায়। সত্যি তো উনারা এইভাবে ভাবেনি৷ এতোটা নির্বুদ্ধিতার পরিচয় কিভাবে দিতে পারলো তারা ভেবে লজ্জা পাচ্ছে।

তাহলে এইসব খুন করেছে কে? আর শ্রাবণ শারিয়ারই বা এখানে আসলো কিভাবে? মামুনুর সাহেবের কথায় সাঁঝি বলে এখুনি জানতে পারবে সবাই খুনি কে? কে এই সকল খুন করেছে। সাঁঝির কথায় হারুন রশীদ কৌতুহলী হয়ে তাকালে সাঁঝি মামুনুর সাহেবকে বলে শ্রাবণের শার্টের বোতামের সঙ্গে একটা গোপন ক্যামেরা আছে নিয়ে আসুন ওইটা। আর একটা ল্যাপটপের ব্যবস্থা করুন জলদি।

সাঁঝি দুদিন আগে যখন এই কেস নিয়ে প্রমাণ জোগাড় করার জন্য উঠে পড়ে লাগে তখনই সাঁঝি শ্রাবণকে টার্গেট করে। সাঁঝি এটা বুঝে গিয়েছিলো যে খুনি শ্রাবণকে ফাঁসানোর জন্য এইসব করছে। আর যে কোনো মূল্যে শ্রাবণ যে দোষী এটা সবার সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে৷ যেহেতু পুলিশসহ সাধারণ মানুষও এখন প্রায় বিশ্বাস করতে শুরু করেছে এইসবের পেছনে শ্রাবণই আছে। তাই খুনি এবার চেষ্টা করবে শ্রাবণ যেনো হাতেনাতে ধরা পড়ে সবার কাছে। আর এই অনুযায়ী সাঁঝি এগুতে থাকে। শ্রাবণ শারিয়ার যখন সাঁঝিকে জানায় তাকে একটা প্রোগ্রামের জন্য ঢাকার বাইরে যেতে হবে এবং সাথে অয়নও যাবে তখনই সাঁঝি পরিকল্পনা করে শ্রাবণকে সব সময় নজরে রাখার। আর তার জন্য এই ক্যামেরাটা শ্রাবণের সাথে দিয়ে দেয়। সাঁঝির আরও বেশি সন্দেহ হওয়াতে শ্রাবণের থেকে প্রোগ্রামের ডিটেইলস জেনে নেয় এবং খোঁজ করে সেখানে৷ কিন্তু সেখানে খোঁজ নেওয়ার পর জানা যায় যে আসলে কোনো প্রোগ্রামই সেখানে হচ্ছে না।

ক্যামেরা থেকে ক্লিপ নিয়ে ল্যাপটপে অন করে সাঁঝি। শ্রাবণ বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর কি কি করেছে সবই রেকর্ড হয়েছে।

এরপর সবাই যা দেখে তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলো না৷ তবে সাঁঝি ভাবভঙ্গি স্বাভাবিক, মনে হচ্ছে উনি আগে থেকে এইটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন।

অয়ন শ্রাবণকে অজ্ঞান করে দুটো মানুষের সাহায্য নিয়ে এখানে নিয়ে আসে। তারপর শ্রাবণকে মেঝেতে শুয়ে রেখে মিস্টার আসাদকে খুন করে এবং শ্রাবণের মাথায় আঘাত করে একটা লাঠি দিয়ে সেই লাঠি আবার মেঝেতে ফেলে যায় মিস্টার আসাদের হাতের ছাপ নিয়ে । যাতে সবাই ভাবে এটা মিস্টার আসাদ করেছে। এতো কাচা বুদ্ধি নিয়ে অয়ন এতোগুলা খুন কিভাবে করলো ভেবে হাস্যকর লাগছে সাঁঝির।

ডিবি অফিসের জিজ্ঞাবাদ রুমের চেয়ারে বসে এইসব ভিডিও দেখতে ছিলো অয়ন। এইসব দেখে তার চোখ কপালে। শরীর থেকে ঘাম ঝরতে শুরু করেছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে।

সামনে সাঁঝি, শ্রাবণ আর মামুনুর সাহেব দাঁড়িয়ে আছে। অয়নের সামনে চেয়ারে গম্ভীর মুখে বসে আছে হারুন রশীদ। অয়নকে সাথে সাথে বাড়ি থেকে ফোর্স পাঠিয়ে তুলে নিয়ে আসে হারুন রশীদ। এরপর তাকে এই ভিডিও টা দেখায়। সব দেখার পর অয়ন বুঝে গেছে তার আর পালানোর পথ নেই। অয়ন কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে থেকে হঠাৎ করে হো হো করে হেসে উঠে। অয়নের এহেন কান্ডে সবাই হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে।

যাহ শালা এতো কিছু করে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়ে গেলাম। শ্রাবণ তোর কপাল বড্ড ভালো রে ভাই মানতেই হবে। নাহলে শেষে এসে এইভাবে তরি ডুবে বল। হাসি থামিয়ে বলে অয়ন। উৎসুক চাহনি আগ্রহপূর্ণ ভাবে সবাই অয়নকে পর্যবেক্ষণ করছে।

অয়ন প্রথম থেকে শ্রাবণকে হিংসা করে। তার পাঠকপ্রিয়তা, তার জনপ্রিয়তা এইসব দেখে অয়ন হিংসাপরায়ণ হয়ে উঠে বরাবরই। যার জন্য অয়ন শ্রাবণের বইকে কেন্দ্র করে এইসব খুন করে। আসলে অয়নের মানসিক সমস্যা আছে ছোট থেকে। অয়নের বাবা তার একটা ফিমেল কলিগের সাথে পরোকিয়ায় জড়ায়। যার জন্য অয়নের মায়ের সংসার ভেঙে যায়। অয়নের মা অনেক কষ্ট পেয়েছিলেন তার বাবার জন্য। অয়ন সেদিন থেকে তার বাবা এবং এই পরোকিয়া সম্পর্কটাকে প্রচন্ড ঘৃণা করে। তার মধ্যে এই ঘৃণা বাড়তে থাকে দিনকে দিন। শেষ শ্রাবণ যখন এই পরোকিয়া সম্পর্কিত একটা থ্রিলার বই রিলিস করে সেখানে থেকে অয়ন প্ল্যান করে পরোকিয়ায় যারা আসক্ত তাদের নিধন করা সাথে শ্রাবণ শারিয়ারের ক্যারিয়ারও ধ্বংস করার।

পুলিশ অয়নের স্বীকারোক্তি নিয়ে তাকে কাউন্সিলের জন্য পাঠায়। আদালত থেকে রায় হয় আগে অয়নের মানসিক সমস্যার চিকিৎসা হবে এরপর এই কেসের রায় দেওয়া হবে।

খোলা আকাশ, অজস্র তারা। পূর্ণ চাঁদ সাথে জ্যোৎস্নার মেলা। দুটি মানব আজ খুবই কাছাকাছি, মুখে নিরবতা কিন্তু বাকবিতণ্ডা চলছে হৃদয়ে হৃদয়।

ছাদের উপর জ্যোৎস্নার আলোয় শ্রাবণ আর সাঁঝি বসে আছে। সাঁঝির দুটো হাত শ্রাবণের হাতের মধ্যে। সাঁঝি লজ্জারাঙা হয়ে আকাশ পাণে চেয়ে আছে আর শ্রাবণ তার কোমল চাহনি রেখেছে তার প্রিয়তমার দিকে।

সত্যি বড় ভাগ্য করে পেয়েছি তোমায় সাঁঝি। আমার জীবনে পাওয়া শ্রেষ্ঠ উপহার তুমি। অয়নের উপর আমার অভিমান হলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞ। কেনো জানো? শ্রাবণের কথায় সাঁঝি ভ্রু কুচকে তাকালে বলে। ওর জন্য তুমি আমার কাছাকাছি এসেছো, আমার সাথে তোমার সম্পর্ক তৈরির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে অয়নকে একটা ধন্যবাদ দেওয়ায় যায়।
সাঁঝি হাসে শ্রাবণের কথায়।

জানো সাঁঝি, নিজেকে বড় অসহায় লাগতো। দম বন্ধ হয়ে আসতো মাঝেমাঝে। এতোগুলা খুনের দায় আমার উপর। অথচ আমি এর কিছুই জানতাম না। তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে আমাকে সাহস না দিতে৷ আমাকে প্রটেক্ট না করতে তাহলে হয়তো আজ আমি শেষ হয়ে যেতাম। আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যেতো।

ওইসব কথা থাক এখন। যেহেতু সবটা এখন সবার সামনে চলে এসেছে৷ তোমার পাঠকবৃন্দ, আশেপাশের মানুষ ইনফ্যাক্ট পুরো দেশ জানে এখন কে প্রকৃত দোষী। নিউজ চ্যানেল, সোসাল মিডিয়া সব জায়গায় শুধু একটায় নিউজ। তবে একটা কথা কি জানো! অয়ন তোমাকে ধ্বংস করতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সবার উপরে স্থান করে দিয়ে গেলো। যারা তোমাকে চিনতো না৷ তোমার বই কখনো পড়েনি তারাও আজ তোমাকে চিনেছে৷ তোমার বই পড়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

সাঁঝির কথায় শ্রাবণ মুচকি হেসে বলে তুমি সত্যি খুব বুদ্ধিমতি সাঁঝি। কথাটা বলে শ্রাবণ দাঁড়িয়ে যায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে দুই হাত মেলে দিয়ে বলে ❝পৃথিবী তুমি শুনছো? আমার একটা সাঁঝি আছে, যে আমাকে বুঝে,আমাকে বিশ্বাস করে আমাকে ভালোবাসে। আমি তোমার কাছে ঋণী পৃথিবী আমাকে এমন একটা সাঁঝি উপহার দেওয়ার জন্য। পৃথিবী তুমি আরো জেনে রাখো! বয়সের বিভেদ ভুলে ভালোবাসার চাদরে আমরা মোড়ানো। এই ভালোবাসা যে তোমার থেকে শেখা, তোমার থেকে পাওয়া, তুমি শিখিয়েছো নিঃস্বার্থ ভালোবাসা❞।

কি করছেন টা কি পাগল হয়ে গেছেন নাকি? সাঁঝি লাজুক হেসে বললে শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝির হাত ধরে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলে ❝তুমিতেই মানানসই আমি প্রিয় আপনিতে বড্ড দূর দূর লাগে❞।

সাঁঝি হেসে আকাশ পাণে চেয়ে থাকে সাথে শ্রাবণও তার প্রিয়সীকে আগলে রাখে।

‘সমাপ্তি’

ভুলক্রুটি মাফ করবেন।

চৈত্রের প্রেম পর্ব-০৬

0

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(৬)

সাঁঝি একজন উকিলকে নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। হারুন রশীদ আর মামুনুর সাহেব সেখানে আসলে উকিল সাহেব বলেন আমরা মিস্টার শ্রাবণ শারিয়ারের জামিন করাতে এসেছি বলে একটা কাগজ এগিয়ে দেয় তার দিকে।

এইসবের কোনো প্রয়োজন ছিলো না আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দিতাম উনাকে। হারুন রশীদ গম্ভীর স্বরে বলেন।
এরপর একজন কনস্টেবলকে ইশারা করলে শ্রাবণকে নিয়ে আসা হয়।

মিস্টার শারিয়ার আমাদের নজর সব সময় থাকবে আপনার উপর এটা মাথায় রাখবেন৷ এবার শুধু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য এনেছিলাম এরপর যদি আপনাকে থানায় আসতে হয় তবে গ্রেফতার হয়ে আসতে হবে মাথায় রাখবেন। কথাটা যেনো সাঁঝির উদ্দেশ্যে বললেন হারুন রশীদ।

খুন করছে একজন আর আপনারা খুনি বানাচ্ছেন আরেকজনকে, এটা আপনাদের ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই না। কথাটা বলে সাঁঝি, শ্রাবণকে নিয়ে চলে আসে।

দুই তিনদিন ধরে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয় হারুন রশীদকে। উপর মহলের চাপ দিনকে দিন বেড়ে চলেছে৷ এখন মিডিয়া গুলো রসকষ মিশিয়ে নিউজ করা শুরু করেছে। সাধারণ জনগণ আতঙ্কিত সাথে প্রশাসনের উপর চড়াও হচ্ছেন। কিন্তু এই কেসের কোনো কিনারা যেনো পাচ্ছেন না তারা। শ্রাবণ শারিয়ারের বিরুদ্ধে শুধু ওই একটা প্রমাণ ছাড়া আর কিছুই পুলিশের হাতে নেই। আর যে প্রমাণ আছে সেটাও ভিত্তিহীন। তাই শ্রাবণকে পুরোপুরি দোষী বলা যায় না।

থানা থেকে আসার পর থেকে শ্রাবণের মনটা আবার খারাপ হয়ে যায়। এতগুলো খুন হয়েছে সেখানে বারবার শুধু তারই নাম আসছে৷ কে করছে এমন তার সাথে আর কেনো করছে এইসব প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মনে।

আমাকে আজ একটু ঘুরতে নিয়ে যাবেন কোথাও? শ্রাবণ বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো আকাশ পাণে স্নিগ্ধ চাহনিতে। সন্ধ্যার আজান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে। চারিদিকে আঁধার নামতে শুরু করেছে। কয়েকটা তারা জ্বলজ্বল করছে তার থেকে খানিক দূরে সুন্দর একটা চাঁদ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে।

শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝির দিকে ফিরে। সাঁঝির উৎসুক চাহনি, উত্তরের প্রতিক্ষা।

কোথায় যাবে? ধীর শান্ত কন্ঠ শ্রাবণের।

যেখানে আপনার খুশি? আসলে সাঁঝি চাইছে শ্রাবণের মনটা ভালো করতে। সাঁঝি ভাবছে বাইরে গিয়ে একটু ঘুরাঘুরি করে আসলে হয়তো শ্রাবণের মুড ঠিক হবে।

তাহলে আজ রাতের খাবার টা আমরা বাইরে খেয়ে আসি? শ্রাবণের কথায় সাঁঝি বলে তাও হবে, আমি রেডি হয়ে আসি। সাঁঝি চলে আসতে নিলে শ্রাবণ সাঁঝির হাত ধরে থামায়। সাঁঝি কৌতুহলী দৃষ্টি রাখলে শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝিকে কাছে টেনে নিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি রাখে। সাঁঝির শরীরে ছোটখাটো একটা কম্পন খেলে যায়। সাঁঝির এই ফিলটা প্রায় হয় যখন শ্রাবণ তাকে ভালোবেসে কাছে টানে।

ওদের মতো কি তোমারও সত্যি মনে হয় আমি দোষী? হঠাৎ শ্রাবণ বলে উঠে এমন কথা। সাঁঝি ভাবান্তর হয়না একটুও। কারণ সে জানে শ্রাবণ এমন কিছু প্রশ্নই তাকে করবে যেটা তার হৃদয় স্পর্শ করতে বাধ্য। তাই সে নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলো।

সাঁঝি একটু সময় নেয়, এরপর নির্লিপ্ত ভাবে বলে যদি তাই মনে হতো তাহলে আপনাকে ছাড়ানোর জন্য থানায় যেতাম না। এতোটা ভরসা করতাম না।

তাহলে কেনো এতো লুকোচুরি সাঁঝি? কিসের জন্য এই আঁধার আলোর খেলা? শ্রাবণের রহস্যময় কথায় সাঁঝির ভ্রু কুচকে আসে। শ্রাবণকে ছাড়িয়ে বিস্ময় নিয়ে তাকায়।

আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন? আমি আপনার কথার মানে বুঝলাম না জিজ্ঞাসু দৃষ্টি সাঁঝির।

তোমার আসল পরিচয় কি সেটা আমি জানি সাঁঝি, ভণিতা ছাড়াই বলে শ্রাবণ। শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় যেনো চমকে উঠে সাঁঝি৷ কাঁপা কাঁপা গলায় বলে কি জানেন?

এখনো কি আমাকে এর উত্তর দিতে হবে সাঁঝি? আমি কি জানি সত্যি তুমি বুঝতে পারছো না। শ্রাবণ শারিয়ারের কথায় সাঁঝি দু কদম পিছিয়ে যায়। শ্রাবণের দিক হতে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকায়। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ।

কেনো এমন লুকোচুরি আমার সাথে, কেনো তুমি ভুয়া পরিচয় দিয়ে এ বাড়ি এসেছিলে। কেনো তুমি রাশেদা আন্টিকে নিয়ে এই বাড়িতে এসেছো এইসব প্রশ্ন ধুসর হয়ে আছে এখনো।

আপনি যখন সব টা জেনে গেছেন তাহলে আজ আপনাকে সত্য বলতে কোনো বাধা নেই। তবে বিশ্বাস করুন আমি যে মনোভাব নিয়ে এই বাড়িতে এসেছিলাম সেটার এখন বদল হয়েছে। আমি সত্যটা খুঁজে পেয়েছি।

এরপর সাঁঝি বলতে শুরু করে, হারুন রশীদ আমার বাবা। তবে তার সাথে আমার পার্সোনাল একটা মনোমালিন্য রয়ে গেছে, কেনো কি কারণ সেটা আমি প্রকাশ করতে চাইনা। দয়া করে আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না এ ব্যাপারে, মাফ করবেন আমাকে এই বিষয়টা স্ক্রিপ করছি। আমি বাবার সাথে থাকি না। রাশেদা খালা ছোট থেকে বড় করেছে আমাকে তার আদর সোহাগ ভালোবাসা দিয়ে। মায়ের পর এই মানুষটা আমাকে মায়ের স্থান দিয়েছে মায়ের মমতায় বড় করেছেন।

আমি রাশেদা খালাকে নিয়ে একটা বাসায় ভাড়া থাকি। সেখানে থেকে পড়াশোনা করি। তবে আমার সব খরচ বাবাই বহন করেন৷ মানুষটাকে আমি অনেক ভালোবাসি কিন্তু মন থেকে মাফ করতে পারিনা তাই…

একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সাঁঝি। শ্রাবণ বিস্ময় নিয়ে সব কিছু শুনছে।

ছোট থেকে আমার গোয়েন্দার প্রতি ঝোঁক বেশি। থ্রিলার কাহিনি, রহস্যময় সব বই, গোয়েন্দা রিলেটেড যত বই বাজারে আসতো আমি সব আগে নিয়ে পড়তাম৷ এইসব থেকে আমার মধ্যে একটা প্রবৃত্তি আসে এবং মনস্থির করি আমি বড় হয়ে ডিটেক্টিভ হবো। তখন থেকে আমি এইসব নিয়ে ভাবা শুরু করি, কোনো কেস যদি বাবা সলভ করতে হিমশিম খেতেন তাহলে আমি সেটা সমাধান করার চেষ্টা করতাম এবং সারপ্রাইজলি আমি সেটা সমাধান করে দিতাম৷ বাবা খুশি হতেন এবং অবাকও হতেন আমার প্রতিভা দেখে৷ এইভাবে আমি বাবার কাজে সাহায্য করা শুরু করি এবং একটা সময় বাবার সিক্রেট ডিটেক্টিভ এজেন্সির মেম্বার হয়ে যায়৷ তবে এই টিমের কেউ কারো পরিচয় জানে না বা কখনো জানার আগ্রহও করবে না। আর সেইভাবে কাজ চলে।

আপনার লেখা প্রতিটি বই আমার খুব ভালো লাগতো৷ আপনি খুব সুন্দর ভাবে সব কাহিনি ফুটিয়ে তুলতেন এবং খুবই রহস্য থাকতো আপনার লেখায়৷ এইভাবে আমি আপনার ফ্যানে পরিণত হয় এবং অজান্তে ভালো….

সাঁঝি লজ্জায় মাথা নামিয়ে নেয়। সাঁঝি আবারও ছোট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে এরপর একদিন আপনার কেসটা সামনে আসে৷ বাবা আমাকে সবটা খুলে বলে যদিও আমি আগে জানতাম আপনার বই সম্পর্কে। এই কেসটা নিয়ে খুবই হিমসিম খাচ্ছে সবাই৷ এবং উপর মহল সহ এই কেস নিয়ে নাজেহাল। তখন বাবা আমাকে দায়িত্ব দেন এই কেসের সমাধান করার জন্য। এরপর একদিন আপনার বিজ্ঞাপন দেখি একটা নিউজে যেখানে আপনি উল্লেখ করেন আপনার বাসার জন্য একজন পরিচারিকা দরকার যে আপনার মায়ের দেখাশোনা করবে৷ তখনই আমার মাথায় একটা আইডিয়া আসে আর রাশেদা খালাকে এখানে পাঠায় সাথে আমিও আসি কিছুদিন পর৷

ডিপার্টমেন্টের সবাই মনে করে এইসব আপনি করছেন। সত্যি বলতে আমিও প্রথম প্রথম বিশ্বাস করতাম এইসবের মধ্যে আপনি জড়িত আছেন৷ তবে এখানে আসার পর এবং আপনাকে দেখার পর আমার সে বিশ্বাস ভেঙেছে। এখন আমি বিশ্বাস করি আপনি কোনো খুন করেননি। আপনাকে কেউ ফাসানোর চেষ্টা করছে৷ কিন্তু কে এমন করছে এটাই বুঝতে পারছি না। এই কেসটা আমাকেও নাজেহাল করে তুলেছে৷ একবার যদি তাকে হাতে পাই তাহলে বোঝাবো… কথাটা বলে সাঁঝি হাত গোটায়। শ্রাবণ ভ্রু কুচকে তাকায়।

তুমি না ঘুরতে যাবে, যাও রেডি হও। শ্রাবণ প্রসঙ্গ বদলে নেয়। শ্রাবণের কথায় সাঁঝি বলে এখন আর যেতে ইচ্ছে করছে না৷ রাশেদা খালাকে বলি রান্না বসাতে। সাঁঝি আসবে এমন সময় শ্রাবণ আবারও সাঁঝির হাত ধরে আটকায়। কাছে টেনে নিয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে সাঁঝির কপাল স্পর্শ করে শ্রাবণের ঠোঁটদ্বয়। সাঁঝির মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করে। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে সাঁঝির দুটো গাল। ভালোবাসার অনুভূতি গুলো সব সময়ই অন্য রকম হয়।

আচ্ছা সাঁঝি, যদি কখনো সত্যি জানতে পারো যে এই খুন গুলো আমি করেছি তাহলে তুমি কি করবে? মেনে নিতে পারবে মন থেকে?

শ্রাবণের কথায় সাঁঝি চুপ থাকে। শ্রাবণের দিকে না তাকিয়ে বলে ভালোবাসা হয় বিশ্বাস আর ভরসা থেকে। আর আমার, আপনার প্রতি সে বিশ্বাস এবং ভরসা দুটোই আছে। এখন আপনি বলুন আমার কি মেনে নেওয়া উচিত নাকি উচিত নয়?

শ্রাবণ মুচকি হাসে। সে জানে সাঁঝি খুবই বুদ্ধিমতী। তার প্রশ্নের উত্তর কৌশলে দেবে।

দুই তিনদিন পর। শ্রাবণ কাজের জন্য বাইরে গেছে। সাঁঝি তার রুমে বসে আনমনে কিছু একটা নিয়ে ভাবছে৷ বিশেষ করে এই কেসটা তাকে খুব ভাবাচ্ছে। সাঁঝি প্রথম থেকে সব পয়েন্ট গুলো একে এক সাজিয়ে তোলার চেষ্টা করছে। কোথায় ফাঁকফোকর রয়ে গেছে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। খুনি যতই চালাক চতুর হোক না কেনো৷ কোনো না কোনো ভুল তো সে করবেই। এতো নিখুঁত ভাবে আজ পর্যন্ত কেউ খুন করতে পারেনি। সাঁঝির বিশ্বাস এই খুনিও পারবে না৷ তার দ্বারা ভুল হবে৷ আর সেই ভুলের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু করার নেই। এমন সময় সাঁঝির ফোন কেঁপে উঠে। ফোন স্ক্রিনে বাবার নাম দেখে কৌতুহলী হয়ে ফোন তুলে।

সাঁঝি ফোন কানে ধরতেই ওইপাশ থেকে হারুন রশীদ উত্তেজিত কন্ঠে বলে, আমার হাত থেকে কেসটা বেরিয়ে যাচ্ছে সাঁঝি। উপর থেকে নির্দেশ এসেছে। আগামী দুদিনের মধ্যে যদি আমি এই কেসের সমাধান করতে না পারি তবে কেসটা তারা CID -এর কাছে ট্রান্সফার করবে। আর CID কেসটা হ্যান্ডেল করলে কি হবে বুঝতে পারছো। শ্রাবণকে তারা সন্দেহ করবে এবং বারবার তাকেই হয়রানি করা হবে। আমার তো মনে হচ্ছে শ্রাবণই দোষী কিন্তু তুমি মানতে নারাজ। আমরা শ্রাবণ ছাড়া আর কাউকে সন্দেহ করতে পারিনা।

কিন্তু আমি পারি আব্বু! আর আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আগামী দুদিন শেষ হওয়ার আগেই তোমাকে খুনি পর্যন্ত নিয়ে যাবো Its my promise. খুনি যতই চতুর হোক না কেনো এবার তার নিস্তার নেই। শ্রাবণ শারিয়ার যে নির্দোষ আমি প্রমাণ করে ছাড়বো। কথাটা বলে সাঁঝি ফোন টা কেটে দেয়। আবারও ভাবনার দরিয়ায় ডুব দেয়৷ বলে তো দিলো সে খুনি পর্যন্ত যাবে কিন্তু কিভাবে? খুনির চিন্তাভাবনার তৎপর্য কীভাবে করবে সাঁঝি। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে আজ৷ সাঁঝির কাছে অনেক কেস এসেছে অনেক জটিল কেস সে সমাধান করতে পেরেছে৷ কিন্তু আজ যখন তার ঘর বাঁচানোর প্রশ্ন, প্রিয় মানুষকে রক্ষা করার হিসাব তখন সে নিরুপায়। সে অপারগ হয়ে বসে আছে।

না না না এইভাবে ভাবলে হবেনা৷ আমাকে খুনির চিন্তা ধারার সাথে সঙ্গতি রেখে ভাবতে হবে। প্রথম খুন থেকে আমাকে শুরু করতে হবে৷ আমি নিশ্চিত একটা না একটা ক্লু আমি ঠিক পেয়ে যাবো এর মধ্যে । সাথে সমস্ত খুনের ফাইল নিয়ে বসে। হারুন রশীদ কপি করে পাঠায় সব কেসের তথ্য যেখানে থেকে সাঁঝি সহজে কেস সমাধান করার প্রয়াস পেয়ে থাকে।

চলবে…

চৈত্রের প্রেম পর্ব-০৫

0

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(৫)

❝ ধানমণ্ডির একটা ফ্ল্যাটে পুলিশ এবং সে ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী যারা আছে সবাই মিলে একটা ভীড় জমিয়ে রেখেছে সেখানে। যেখানে লাশ পড়ে আছে সেখানে ফ্লোরের চারিপাশে রক্তের দাগ। মৃত শরীরের সব রক্ত বেরিয়ে টাইলসের এক পাশে জমা হয়ে আছে। সেখানে মাছি ভনভন করছে অসংখ্য।

চারতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন রুমানা এবং আফজাল হোসেন নামের দুজন ব্যক্তি। রুমানা হাউজ ওয়াইফ এবং আফজাল হোসেন একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। কাজের সূত্রে আফজাল হোসেনকে প্রায় বাইরে থাকতে হয়। রুমানা এবং তার একজন গৃহ পরিচারিকা থাকতেন এখানে। গত দুদিন হলো রুমানার কাজের মানুষ ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যায়। রুমানা বর্তমানে একাই ছিলো ফ্ল্যাটে। রুমানার স্বামী আফজাল হোসেন এখন জার্মানি অবস্থান করছেন। তাকে খবর দেওয়া হয়েছে সে দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে আসবেন জানিয়েছেন।

মামুনুর সাহেব এবং হারুন রশীদ নাকে একটা রুমাল চেপে ধরে লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। বিভৎস সে অবস্থা। বাকি ৯ টা খুনের ন্যায় এটাও একই ভাবে খুন করা হয়েছে। শরীরে রাতের পোশাক রক্তে রঙিন হয়ে উঠেছে।

মামুনুর সাহেব ঝুকে লাশকে পর্যবেক্ষণ করে।

স্যার এটাও সেম কেস। আগে মাথায় আঘাত করা হয়, এরপর ধারালো কিছু দিয়ে ইচ্ছে মতো শরীরে জখম করা হয়েছে। মনে হচ্ছে মধ্যরাতের দিকে মারা হয়েছে ইনাকে। শরীর থেকে পচা দুর্গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছে।

ফরেনসিকে খবর দিয়েছো? কোথায় তারা? হারুন রশীদ লাশ থেকে দূরে সরে আসেন৷ সহ্য হচ্ছে না তার আর এইসব। পুলিশে জয়েন করার পর থেকে বিভিন্ন কিছুর সাক্ষী হয়েছেন তিনি৷ কিন্তু বর্তমানে যেভাবে খুন করা হচ্ছে এটা তার কাছে নতুন। কেউ কাউকে এমন জঘন্য ভাবে মারতে পারে কিভাবে হারুন রশীদের মাথায় আসেনা। একজন সুস্থ মানুষের পক্ষে এমন করা সম্ভব না যদি না সে সাইকো প্রকৃতির কেউ হয়।

জ্বি স্যার তাদের খবর দেওয়া হয়েছে। রাস্তার মধ্যে আছে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌছে যাবেন এখানে। মামুনুর সাহেব বলেন।
এই সাদ্দাম সব সময় লেট করে। ও না আসলে তো লাশ সরাতেও পারবো না৷ না জানি কতখন এই দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে হবে। হারুন রশীদ বিরক্ত নিয়ে বলেন।

ফরেনসিক অফিসার সাদ্দাম। যিনি এই কেসের ময়নাতদন্তের দায়িত্বে আছেন৷ প্রখর মেধাশক্তি সম্পন্ন একজন ব্যক্তি।

স্যার আমারে খবর দিছেন আইবার জন্যে! হঠাৎ এমন কথায় হারুন রশীদ এবং মামুনুর সাহেব পিছু ফিরে তাকায়। ধুসর ময়লা একটা শাড়ি পরিহিতা মহিলা মাথায় অর্ধেক ঘোমটা টানা, পায়ে সস্তার স্যান্ডেল। গায়ের রং কিছুটা ময়লা ধরনের।

মহিলা ভেতরে আসতে চাইলে পুলিশ কন্সটেবল বাধা দেয়। তাই দেখে হারুন রশীদ বলেন উনাকে ভেতরে আসতে দাও।
ইনি কে স্যার? মামুনুর সাহেব কৌতুহল নিয়ে বলেন।

হারুন রশীদ গলা পরিষ্কার করে বলেন ইনি এই বাসার কাজের মহিলা। ছুটিতে ছিলো, ফোন দিয়ে ডাকা হয়েছে তাই এসেছে।

উনি না গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলো। এত দ্রুত চলেও আসলো? মামুনুর সাহেব ভ্রু কুচকে বলে।

আসলে স্যার অইছে কি, আমার তো কাল রাতরে আহনের কতা ছিলো কিন্তু আইতে পারিনাই। তাই আমি সক্কাল সক্কাল বেরিয়ে পড়ি আইবার জন্যে। পথের মধ্যে স্যারের ফোন পাইয়া আরও জলদি আইছি মহিলা বলেন।
যাকগে স্যার আমারে কেন ডাকছেন? ম্যাডামের কি কিছু অইচে? মহিলার কথায় হারুন রশীদ বলেন আপনার ম্যাডামকে কেউ খুন করেছে।

ইয়া আল্লাহ কিতা কন। কেমনে কি অইলো এইসব। দেকি দেকি বলে মহিলা লাশের সামনে এসে চোখ ছানাবড়া। প্রায় বমি উঠে আসার জো। নাকে কাপড় ধরে বলে একি অবস্থা ম্যাডামের। কেডাই মারছে এইভাবে।

এই আপনি সরুন, লাশের কাছে যাবেন না এখন৷ ফরেনসিক টিম না আসা পর্যন্ত লাশের কাছে কেউ যেতে পারেনা৷ কারণ আমাদের রিপোর্ট করতে হবে সব কিছু বুঝেছেন৷ মামুনুর সাহেবের কথায় হারুন রশীদ বলেন উনি থাক সমস্যা নেই।

এই যে আপনি কোনো কিছু হাত দেবেন না কিন্তু। আপনি তো এই বাড়িতে কাজ করেন৷ একটু দেখবেন কিছু খোয়া গেছে নাকি বাসা থেকে। হারুন রশীদের কথায় মহিলা বলে আমি অহনি দেখতাছি স্যার৷ এই বাড়ির সব কিছু আমার অক্ষরে অক্ষরে মুখস্থ আছে। কথাটা বলে মহিলা লাশের কাছে থেকে উঠে আসতে গিয়ে একটা জিনিসে চোখ আটকে যায়। সেদিকে হাত বাড়ালেই মামুনুর সাহেব আবারও ধমকে বলেন আপনাকে না হাত দিতে বারণ করেছি।

স্যার, দেহেন না ম্যাডামের চুলের নিচে কি যেন একটা আছে। মহিলার কথায় হারুন রশীদ বলেন কি আছে দেখি বলে ঝুকে বসেন৷ রক্তের জন্য চুল সব দলা পাকিয়ে শক্ত হয়ে উঠেছে৷ তারই ভাজে সোনালী রঙের একটা বস্তু। হারুন রশীদ সেটা হাতে তুলে নিয়ে দেখে বলেন এটা তো মনে হচ্ছে ঘড়ির একটা অংশ। যেটাই চেইন আটকানো হয়।

দেখুন তো এটা আপনার ম্যাডামের কি-না হারুন রশীদ মহিলার হাতে দেয় সেটা দেখার জন্য। মহিলা ভালো দেখে বলে না স্যার এইটা আমার ম্যাডামের না।
কিন্তু তার মুখটা থমথমে হয়ে যায় ঘড়ির টুকরো টা দেখে। পরিচিত ঘড়ির টুকরো বলে মনে হচ্ছে তার।

এর মধ্যে ফরেনসিক টিম চলে আসে। হারুন রশীদ ওদের কাজ করতে দিয়ে মহিলাকে নিয়ে একটা রুমে আসেন সব কিছু দেখার বাহানায়।

এতো দেরি হলো কেনো আসতে? ফরেনসিক টিম চলে আসলে তো আমরা আর লাশটা রাখতে পারতাম না। হারুন রশীদ বলেন মহিলাকে উদ্দেশ্য করে।

রাস্তায় অনেক জ্যাম ছিলো। ঢাকা শহরের রাস্তার পরিবেশ কেমন এটা আর নতুন করে বলতে হবে না নিশ্চয় তোমাকে। এ্যানি ওয়ে, এই মহিলাকেও একই ভাবে খুন করা হয়েছে। খুনি যে একজনই এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ তবে এবার খুনি তার ক্লু রেখে গেছে। আমার মনে হয় ঘড়ির অংশ টা খুনির হবে। ওইটার ভালো ভাবে ফরেনসিক টেস্ট করাও। এই মহিলা নিশ্চয় স্বামী বাইরে থাকার সুযোগ নিয়ে পরোকিয়ায় আসক্ত ছিলো। যার জন্য একেও খুন করা হয়েছে। আপাতত আমার এখানে কাজ নেই। আমি এখন যাচ্ছি আর হ্যাঁ ওই একটা ক্লু ছাড়া আমাদের কাছে কিছু নেই৷ বাকিটা ময়নাতদন্ত করার পর জানা যাবে। তবে হ্যাঁ! আমরা খুব শীগ্রই খুনি পর্যন্ত পৌছাতে পারবো এটা নিশ্চিত থেকো। যদি বইয়ের সাথে মিল রেখে সব কিছু হয় তাহলে খুনির সময় এসে গেছে সামনে আসার। অলরেডি ১০টা শেষ এবার টার্গেট ১১ নাম্বার আর এতেই খুনি তার ঠিকানা পেয়ে যাবে। মহিলা কথাগুলো বলে চলে আসে হারুন রশীদের সাহায্যে।

দুদিন পর আবারও পুলিশ এসে উপস্থিত হয় শ্রাবণ শারিয়ারের বাড়িতে। এবং এবার তারা শ্রাবণ শারিয়ারকে থানায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আসে। মূলত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে নিয়ে যাওয়া হবে।

আপনারা আমাকে কোন ভিত্তিতে থানায় নেওয়ার কথা বলছেন? শ্রাবণ ক্ষিপ্ত স্বরে বলেন।

দেখুন মিস্টার শারিয়ার আপনি যদি আমাদের সাথে কো-অপারেট না করেন তবে জোর করে নিয়ে যেতে বাধ্য হবো। আমরা আপনাকে এমনি এমনি থানায় যাওয়ার কথা বলছি না। উপর থেকে আমাদের কাছে অর্ডার এসেছে এবং কেনো থানায় যাবেন, কোন ভিত্তিতে নিয়ে যাচ্ছি সব কিছুই আপনি থানায় গেলে জানতে পারবেন।

সাঁঝি শ্রাবণ শারিয়ারের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। তার মধ্যে বেশ চিন্তার উদ্ভাস। শ্রাবণ শারিয়ার সাঁঝির দিকে অসহায় চোখে তাকায়। সাঁঝিকেও আজ নিরুপায় দেখাচ্ছে। এই ব্যাপারটায় যে শক সেটা তার চোখ মুখের রিয়াকশনই জানিয়ে দিচ্ছেন। এরপর সাঁঝিকে সান্ত্বনা স্বরুপ বলেন একদম চিন্তা করবে না আমি খুব শীগ্রই ফিরে আসবো। আমার কিছু হবে না।

অফিসার চলুন, শ্রাবণ শারিয়ার আগে আগে আসে পেছনে আসেন মামুনুর সাহেব।

আমার আগেই সন্দেহ ছিলো মিস্টার শারিয়ারের উপর। এখন সেটা প্রমাণ হয়ে গেছে সাঁঝিকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে হারুন রশীদ বেরিয়ে আসেন।

এবার কি হবে সাঁঝিমা। জামাই বাবাজিকে তো নিয়ে গেলেন। রাশেদা বেগম বলেন হতাশা নিয়ে।

চিন্তা করো না! কিছু হবেনা উনার৷ আমি বিশ্বাস করিনা উনি এইসব করতে পারেন৷ গভীর রহস্য আছে এখানে আর সেটার সমাধান আগে করতে হবে। উনার উকিলের ব্যবস্থা করতে হবে আগে এরপর বাকি কাজ। সাঁঝি কথাগুলো বলে ঘরে আসেন কিছু কাজ সম্পন্ন করতে।

শ্রাবণ শারিয়ারকে একটা রুমের মধ্যে বসানো হয়৷ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এটা আসামিদের জিজ্ঞাবাদের জন্য বরাদ্দ। শ্রাবণ শারিয়ারের সামনে একটা ছোট টেবিল আর মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে একটা একশো ওয়াটের বাল্ব। মাথার উপর ফ্যান ঘুরছে ঠিকই কিন্তু তার হাওয়া শ্রাবণ শারিয়ারের শরীর পর্যন্ত আসতে আসতে ক্ষীণ হয়ে পড়ছেন৷ যার কারণে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের রেখা ফুটে উঠেছে।

একটু পরে হারুন রশীদ আর মামুনুর সাহেব উপস্থিত হয় সেখানে। শ্রাবণ শারিয়ারের বিপরীত পাশে চেয়ার নিয়ে বসেন হারুন রশীদ। তার পাশে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন মামুনুর সাহেব।

কিছুদিন আগে আরেকটা খুন হয়েছে শুনেছেন নিশ্চয়? হারুন রশীদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলে শ্রাবণ শারিয়ার বলেন নিউজে দেখেছি। কিন্তু এর সাথে আমার কি সম্পর্ক?

মিস্টার শারিয়ার, এই কেসের সাথে তো আপনারই সম্পর্ক তাই তো বারবার আপনার কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের। আমরা এতদিন সন্দেহের বশে ছিলাম বলে আপনাকে কিছু বলতে পারিনি কিন্তু এখন আমাদের হাতে শক্ত প্রমাণ আছে যার জন্য আপনাকে আমরা থানায় নিয়ে আসি।

প্রমাণ? কিসের প্রমাণ? শ্রাবণ শারিয়ারের কপালে যেনো চিন্তার ভাঁজ।

হারুন রশীদ, মামুনুর সাহেবের দিকে ইশারা করলে তিনি পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করে টেবিলে রাখেন। শ্রাবণ শারিয়ার কৌতুহলী চোখে সেদিকে তাকায়।

হারুন রশীদ প্যাকেট থেকে সেই ঘড়ির কাটা অংশটা বের করে বলেন এটা দেখুন তো চিনতে পারেন কি-না?

শ্রাবণ ঘড়ির টুকরো টা হাতে নিয়ে ভালো করে দেখে বলেন এটা তো আমার ঘড়ির অংশ মনে হচ্ছে। এই ব্যান্ডের ঘড়ি একটা আমার ছিলেন।

ছিলেন কেনো? এখন কি নেই? সেটা কোথায়? মামুনুর সাহেব বলেন।
শ্রাবণ হতাশ হয়ে বলে বিশ্বাস করুন অফিসার ঘড়িটা আমি এক সপ্তাহ আগে হারিয়ে ফেলি। কিভাবে কখন হারিয়েছে যদি জানতে চান তাহলে বলবো এর কোনো উত্তর আমার কাছে নেই। কারণ আমি নিজেও জানিনা ঘড়িটা কখন আমার হাত থেকে পড়েছে বা এটা কেউ কি প্ল্যান করে নিয়েছে কি-না এখন এটাও সন্দেহ হচ্ছে।

বাহ! আপনার ঘড়ি আপনার হাত আর আপনি কিছু জানেন না। তাছাড়া এটা তো কোনো নরমাল ঘড়ি না৷ বেশ ভালো ব্যান্ডের দামি ঘড়ি। আর এতো দামি একটা জিনিস হারিয়ে গেলো তাতে আপনার কোনো কিছু মনে হলো না।

আচ্ছা আপনারা হঠাৎ আমার ঘড়ি নিয়ে পড়লেন কেনো? শ্রাবণ শারিয়ার উৎসুক চাহনি রেখে বলে।

কারণ আপনার ঘড়ির এই টুকরোটা আমরা লাশের চুল থেকে পেয়েছি।

হোয়াট? দাঁড়িয়ে যায় শ্রাবণ।
বসুন মিস্টার শারিয়ার। এমন ভাব করছেন আপনি মাত্র ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছেন৷ হারুন রশীদ তীক্ষ্ণ সুরে বলেন।

বিশ্বাস করুন অফিসার আমি এর কিছুই জানিনা৷ কিভাবে সেখানে গেলো আমি বুঝতে পারছি না৷ তাছাড়া যিনি বা যারা খুন হয়েছে আমি তাদের কাউকেই চিনি না৷ আর যাদের চিনিনা জানিনা তাদের কেনো খুন করবো আমি?

এটা তো আমাদেরও প্রশ্ন মিস্টার শারিয়ার। কেনো করছেন এমন? আমার তো মনে হচ্ছে আপনার মানসিক সমস্যা আছে। মামুনুর সাহেবের কথায় শ্রাবণ রেগে বলে মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ মিস্টার মামুনুর। আমি একদম ঠিক আছি এবং সত্যি বলছি এইসবের কিছুই আমি জানিনা। আমি কোনো খুন করিনি।

আওয়াজ নিচে করুন মিস্টার শারিয়ার। এখনো পর্যন্ত আপনার সাথে ভদ্র আচরণ করছি আমরা, অন্য কেউ হলে এতখন সুস্থ হয়ে এইভাবে বসে থাকতে পারতো না এখানে৷ এতগুলো মানুষের জীবন নিয়ে খেলা করার কোনো অধিকার আপনার নেই। হারুন রশীদ উত্তেজিত হয়ে বলেন তখনই একজন কনস্টেবল এসে বলে বাইরে একটা মেয়ে এসেছে সাথে উকিল নিয়ে। হারুন রশীদের বুঝতে বাকি নেই কে এসেছে শ্রাবণও জানে সাঁঝি এসেছে তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য।

চলবে…

চৈত্রের প্রেম পর্ব-০৪

0

#চৈত্রের_প্রেম
#লেখিকা_আলো_ইসলাম
(৪)

❝শ্রাবণ শারিয়ারকে দুই হাতে আগলে নেয় সাঁঝি। তার মধ্যে প্রচন্ড রকমের ভালো লাগা কাজ করছে। সে শ্রাবণকে ভালোবাসে এটাই সত্যি তার কাছে। দুনিয়ার মানুষের কাছে হতে পারে বয়সের পাগলামি কিন্তু সাঁঝির কাছে এটা ভালোবাসা৷ শ্রাবণ শারিয়ারের বই পড়ে ভালো লাগার জন্ম এরপর কখন যে শ্রাবণ শারিয়ারকে ভালোবাসতে শুরু করেছিলো সাঁঝি সেটা নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। আসলে এইটা আবেগ,হয়তো তাই। হোক না কিছু ভালোবাসা আবেগে আবদ্ধ। আবেগ আছে বলেই না দুনিয়ায় ভালোবাসার মতো পাগলামি চলে।

আপনার খাবার এনেছি খেয়ে নিবেন চলুন। সাঁঝি খুবই ক্ষীণ স্বরে বলে কথাটা। আর শ্রাবণ! সে একই ভাবে সাঁঝিকে আলিঙ্গন করে রেখেছে।

কি হয়েছে আপনার ভাই.. সাঁঝি ভাইজান বলতে গিয়ে আজ নিজেকে সংবরণ করে নেয়। শ্রাবণের মসৃণ চুলের ফাঁকে আঙুল তুলে বলে কেনো এতো ভেঙে পড়ছেন আপনি? এই পরিস্থিতিটা শক্তভাবে কাটিয়ে উঠতে হবে আপনাকে। এইভাবে ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আমি যতদুর আপনাকে জানি,চিনি তাতে এটা বুঝেছি আপনি খুবই শক্তভীতের একজন মানুষ। আপনাকে সহজে টলানো যায় না। তাহলে আজ কেনো এমন দুর্বল ভাবছেন নিজেকে।

আমি যেনো বাধ হারিয়ে ফেলেছি সাঁঝি। এতগুলো মানুষের খুনের দায় আমার উপর। যেখানে আমি কিছু জানিনা, যে বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র জ্ঞান নেই আজ তারই দোষারোপ করা হচ্ছে আমাকে। একটু একটু করে যে সম্মান,আত্মমর্যাদা আমি গড়ে তুলেছি সেটা এক নিমিষে শেষ করে দিতে চাই ওরা। কে করছে এমন? কেনো বা করছে এমন আমার সাথে। শ্রাবণ হতাশ হয়ে বলে।

সত্য খুব শীগ্রই সামনে আসবে আপনি দেখে নিয়েন। দয়া করে আপনি নিজেকে সামলান। খেয়ে নিবেন আসুন। এই কয়দিনে চেহারার কি হাল করেছেন খেয়াল করে দেখেছেন আপনি। এখন তো যে কেউ আপনাকে দেখে বলবে আপনি সত্য বুড়ো হয়ে গেছেন। সবাই আমার দিকে আঙুল তুলে বলবে ওই দেখ বুড়ো বেটার কচি বউ যাচ্ছে। সাঁঝি রসিকতা করে বলে কথাটা যাতে শ্রাবণের মনটা একটু ভালো হয়।

সাঁঝি আজ আমাকে একটু ভালোবাসবে? আপন করে নিবে আমাকে? হঠাৎ শ্রাবণের এমন অদ্ভুত আবদারে দমে যায় সাঁঝি। শরীরে কাটা দিয়ে উঠে শরীরের প্রতিটি লোম দাঁড়িয়ে যায়। অন্ধকারের মাঝেও সাঁঝির অবাক চাহনি চোখ এড়ায়নি শ্রাবণের। তার উৎসুক চাহনি,সাঁঝির জবাবের অপেক্ষা। সাঁঝি চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকায়, ঠোঁটের কোণে এক চিলতে রোদ্দুর। একটা অস্বস্তিকর পরিবেশ দাঁড়িয়ে গেছে সাঁঝির কাছে। ভারী ভারী নিশ্বাস, ছুটে পালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে।

খেয়ে নিবেন আসুন, সাঁঝি কথা ঘুরিয়ে চলে আসতে গেলে শ্রাবণ আবারও সাঁঝির হাত চেপে ধরে। দ্বিতীয়ভাবের মতো একই অনুভূতির শিকার হয় সাঁঝি।

আমার প্রশ্নের উত্তর এখনো পাইনি! শ্রাবণ শারিয়ারের নির্লিপ্ত আওয়াজ।

❝উত্তর দেওয়ার মতো শব্দ খুঁজে পাইনি, তাই প্রশ্নরা আহত হয়ে ফিরছে উত্তরের তরে। তবে সব প্রশ্নের উত্তর কি জরুরি। থাকনা একটা প্রশ্নবোধক হয়ে। ভালোবাসি এতটুকু বুঝতে পারলে হবে।❞ সাঁঝির কথায় শ্রাবণ মুচকি হেসে একটা হেঁচকা টান দেয় সাঁঝির হাত ধরে। সাঁঝি এসে পড়ে শ্রাবণের কোলে। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে সাঁঝির ঘাড়ে মুখ ডোবায় শ্রাবণ। আবারও নতুন এক ভালো লাগার সাক্ষি, নতুন অনুভূতি, হয়তো একটা অজানা সুখের সন্ধানে।

পরের দিন শ্রাবণ শারিয়ার প্রকাশনীতে ফোন দিয়ে জানায় যে, সে আগামী তিনদিনের মধ্যে তার বইয়ের কাজ শেষ করে জমা দেবে। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে তাকে বেরুতে হবে। একটা বিষয় নিয়ে জীবন কখনো আটকে থাকে না। তাই তারও উচিত সব কিছু উপেক্ষা করে সামনে এগিয়ে চলা। জীবনে চলার পথে বাঁধা আসবে এবং সেই বাঁধা অতিক্রম করে তবে জীবনের প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করা যায় । কিছু সময়ের জন্য শ্রাবণ এটা ভুলে গিয়েছিলো। যে ঘটনা কেন্দ্র করে তার জীবন ত্বরান্বিত হচ্ছে সেটার দায় তার নেই। কারণ সে জানে,কোনো দোষ সে করেনি। তাই সত্যের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।

হারুন রশীদ সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আসে। আজ তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন তিনি। হঠাৎ করে দুদিন ধরে শরীরটা যেনো সায় দিচ্ছে না তাকে। তার উপর এই জটিল কেস। পুরো ডিপার্টমেন্টকে যেনো নাজেহাল করে ছাড়ছে। কোনো রকম কুলকিনারা পাচ্ছেন না কেসের। উপর মহল থেকে বরাবরই চাপ পড়ছে হারুন রশীদের উপর, কারণ তিনি এই কেসের প্রধান দায়িত্বে আছেন।

এতো তাড়াতাড়ি ফিরবে আশা করিনি। হঠাৎ কারো কথায় থমকে দাঁড়ায় হারুন রশীদ। তিনি সবে মাত্র ড্রয়িংরুমে পা রেখেছিলেন। তবে কন্ঠস্বরটা চিনতে তার অসুবিধা হয়নি সাথে মানুষটাকেও।

তুমি এখানে? কখন এসেছো? হারুন রশীদ গম্ভীর স্বরে বলেন।

তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? সামনে থাকা ব্যক্তির কথায় হারুন রশীদ ক্ষোভ নিয়ে বলেন তার কি কোনো মূল্য আছে তোমার কাছে। তুমি তো সর্বদা তোমার নিয়মে চলো, তোমার ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করো৷ এখানে আমার রাগ হওয়া বা না হওয়াতে তোমার কিছু এসে যায় বলে তো আমার মনে হয়না।

সত্যি আমার কিছু এসে যায় না আব্বু। কারণটা তুমি খুব ভালো করে জানো। মেয়ের কথায় হারুন রশীদ এবার দমে যায় একটু। নিভে যাওয়া পোড়া কয়লার ন্যায় নুয়ে পড়েন।

এইভাবে আর কতদিন আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় রাখবে ছুটকি মামনী। মুমূর্ষু কন্ঠে বলেন হারুন রশীদ।

ওইসব কথা আজ থাক! যে কাজে এসেছিলাম সেটা শেষ করি এবার। মেয়ের কথায় হারুন রশীদ বলেন আমি কি চেঞ্জ করে আসতে পারি।
হারুন রশীদকে এবার একটু ভালো করে পরখ নেয় তার মেয়ে।
তোমার কি শরীর খারাপ? মেয়ের কথায় হারুন রশীদ স্মীত হেসে বলেন বয়স হচ্ছে আর কত সহ্য করবে এই দেহ। তার উপর এতো চিন্তা,নতুন নতুন কেসের সাথে যুক্ত থাকা। বেশিদিন মনে হয় আর ডিপার্ট্মেন্টের সাথে থাকতে পারবো না। হতাশা নিয়ে বলেন তিনি।

আমার হাতে সময় কম, যা করার একটু তাড়াতাড়ি করবে প্লিজ। মেয়ের অনুমতি পেতেই হারুন রশীদ নিজের ঘরের দিকে ছুটে যায়।

হারুন রশীদ ফ্রেস হয়ে এসে সোফায় বসে। আদা দেওয়া এক কাপ চা তার সামনে।
অনেকদিন পর তোমার হাতের চা খাচ্ছি। হারুন রশীদ চায়ের কাপ হাতে তুলে বলেন।

তোমার কেসের তদন্ত কতদূর?

চলছে, তবে এখনো কোনো সঠিক ক্লু পাইনি ওইগুলো ছাড়া। তবে আমরা সাবধান আছি, পরবর্তী খুনের শিকার আর কাউকে হতে দেবো না আমরা। শহরের প্রতিটি জায়গায় আমরা পাহারা বসিয়েছি।

তোমার কি মনে হয় এইভাবে খুনিকে আটকাতে পারবে? অলরেডি ৯ টা খুন সে করে ফেলেছে এমনি এমনি না। যে ৯টা খুন এতো নিখুঁত ভাবে করতে পেরেছে সে পরবর্তী খুনগুলো করার জন্য নিশ্চিয় ঢাক ঢোল পিটিয়ে বলবে না৷ তোমাদের চিন্তাভাবনার থেকে তার চিন্তাভাবনা অনেকদূর এগিয়ে এটা মাথায় রাখতে হবে। মেয়ের কথায় হারুন রশীদ ভ্রু কুচকে বলে তুমি ঠিক কি বলতে চাইছো? তুমি কি এমন কাউকে সন্দেহ করছো যে এই খুনের সাথে জড়িত থাকতে পারে।

এখনো পর্যন্ত কোনো ক্লু পাইনি। একটা ইনফরমেশন যদি পাই তাহলে খুনি পর্যন্ত পৌছাতে কেউ আটকাতে পারবে না আমায়৷ বেশ নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে সবাইকে। তাই আমাদেরও সতর্ক ভাবে এগিয়ে যেতে হবে৷ খুনির চিন্তাভাবনার সাথে আমাদের চিন্তাভাবনার একটা সংগতি রাখতে হবে।

তবে তোমরা মিস্টার শ্রাবণ শারিয়ারের বাড়ি গিয়ে ঠিক কাজ করোনি। অলমোস্ট আমাকে ইনফর্ম করে তো যেতে পারতে। যদি আমাকে ছাড়াই তোমরা সব কিছু করার চিন্তাভাবনা করো তাহলে আমাকে এই কেসে ইনভলভ করেছো কেনো? রেগে যান উনার মেয়ে।

তুমি শুধু শুধু আমার উপর রাগ করছো ছুটকি, আমি তোমাকে ইনফর্ম করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি এতোটাই ব্যস্ত ছিলে যে আমার ফোন ওঠানোর প্রয়োজন মনে করোনি। তাই কোনো উপায় না পেয়ে আমরা সেখানে যায়। উপর থেকে কি পরিমাণ চাপ আসছে এটা তোমাকে নতুন করে বোঝাতে হবে না নিশ্চয়। বাই দ্য ওয়ে, তুমি কি একবার মর্গে যাবে লাশ গুলো পর্যবেক্ষণ করতে। হারুন রশীদের কথায় ছুটকি বলে যদি সময় পাই তাহলে ভেবে দেখবো আজ আমি উঠি আর হ্যাঁ! আমাকে না জানিয়ে শ্রাবণ শারিয়ারকে আর ঘাটাবে। তোমাদের এই কেসের সমাধান চাই, আমি দেবো এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। কথাটা বলে ছুটকি চলে আসতে গেলে হারুন রশীদ বলেন যদি খুনি সত্যি সত্যি শ্রাবণ শারিয়ারই হয়।

ছুটকির পা টলে যায়। স্বাভাবিক দৃষ্টি রেখে কোমল স্বরে বলে, সত্যির উপর থেকে যদি শব্দটা উঠে যাক তারপর নাহয় ভেবে দেখবো৷ আপাতত উদ্ভট ভাবনায় জড়াতে চাইনা। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়না সে।

আজ এতো দেরি হলো যে বাড়ি ফিরতে? সাঁঝি ঘরে ঢুকতেই শ্রাবণ প্রশ্ন করে। সে তার পড়ার টেবিলে কিছু কাগজপাতি ঘাটছিলো।
শ্রাবণকে দেখে সাঁঝি যেনো চমকে উঠে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলে ওহ আপনি। এতো তাড়াতাড়ি চলে এসেছেন। সাঁঝি কাধে থেকে ব্যাগ নামিয়ে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেস হতে। শ্রাবণ শারিয়ার অপেক্ষা করে সাঁঝির জন্য।

সাঁঝি আসতেই শ্রাবণ শারিয়ার বলেন আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি।

কোচিং-এ আজ এক্সাম ছিলো৷ তাই দেরি হয়ে গেছে । তাছাড়া কোচিং থেকে বেরিয়ে আজ একটা রিকসাও পাইনি। হেঁটে আসছি বুঝতে পারছেন।

তোমার ফোন অফ কেনো? শ্রাবণের কথায় সাঁঝি ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে করতে বলে ওহ অফ নাকি৷ তাহলে বোধহয় চার্য আউট হয়ে গেছে। আপনি আমাকে এইভাবে জেরা করছেন কেনো?

সাঁঝির কথায় শ্রাবণ বলে সচারাচর তোমার এতো দেরি হয়না তার উপর ফোনও অফ বুঝতে পারছো কতটা চিন্তা হচ্ছিলো। অলরেডি ৮ টা বেজে গেছে সাঁঝি, সেখানে আমার প্রশ্ন করাটা কি স্বাভাবিক নয়?

সাঁঝি বুঝতে পারে শ্রাবণ রেগে আছে। সাঁঝি এগিয়ে এসে শ্রাবণের কোলের উপর বসে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলে খুব মিস করছিলেন বুঝি আমাকে।সাঁঝি আর শ্রাবণের সম্পর্ক টা এখন স্বাভাবিক। ঠিক আর পাঁচটা স্বাভাবিক দম্পতির ন্যায়।

তুমি কি কোচিং থেকে অন্য কোথাও গিয়েছিলে? হঠাৎ শ্রাবণ শারিয়ারের এহেন কথায় হকচকিয়ে উঠে সাঁঝি। কৌতুহলমিশ্রিত কন্ঠে বলে অন্য কোথাও আবার কোথায় যাবো?

না এমনি মনে হলো তাই শ্রাবণ শারিয়ার আর কিছু বলে না এই বিষয়ে। সে যে সাঁঝির কোচিং এ গিয়েছিলো এটা আর প্রকাশ করলো না।

এইভাবে কাটে এক সপ্তাহ!

শ্রাবণ আজ সকাল সকাল বেরিয়ে গেছে। সাঁঝির কলেজ বন্ধ আজ। তাই সে বাড়িতেই আছে। সকালের নাস্তা শেষে রুমে আসতেই সাঁঝির ফোন বেজে উঠে। স্ক্রিনে পরিচিত নাম্বার দেখে তাড়াতাড়ি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে ইমিডিয়েটলি একবার ধানমন্ডি আসতে পারবে৷ আমি তোমাকে লোকেশন সেন্ড করছি কথাটা বলে ফোন রেখে দেয়। সাঁঝি বুঝতে পারে তাকে কেনো ডাকা হচ্ছে এবং কি কাজ তার সেখানে…

চলবে…

ভুলক্রুটি মাফ করবেন।