Thursday, July 17, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 123



আপনার শুভ্রতা পর্ব-০৩

0

#আপনার_শুভ্রতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ৩

শুভ্রতা এবার খানিকটা ঝাঝালো কন্ঠেই বলল
“হেয়ালি না করে বলুন কতটুকু চেনেন আমায়।”

রাদিফ এবার চোখ খুলে মুখটা শুভ্রতার কিছুটা কাছে নিয়ে এসে বলল
“শুভ্রতা শুভ্রা, অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। শামসুল হক আর রেহানা বেগমের বড় সন্তান। একটা ছোট বোনও আছে। এবার এসএসসি দিয়েছে। আর কিছু কি শুনতে চান মায়াবতী!”

শুভ্রতা বেশ অবাক হলো। চোখগুলো বড় বড় করে বলল
“আপনি কে!”

রাদিফ স্মিত হেসে বলল
“আমি রাদিফ”

“আপনি আমার খবর জানলেন কিভাবে?”

“কেউ যদি কোনো কিছু চায় চেষ্টা করলেই সে পায় বুঝলে মায়াবতী।”

“অসহ‍্যকর লোক আপনি।”

রাদিফ হাসলো। শুভ্রতা উঠে দাড়িয়ে চলে যেতে নিলেই রাদিফ বলল
“প্রেম অসুখে পড়েছেন কোনোদিন মায়াবতী!”

শুভ্রতা পিছু ফিরে তাকাতে দেখতে পেল রাদিফ বইয়ের দিকেই মনোযোগ দিয়ে রেখেছে। কপাল কুচকে ফেললো শুভ্রতা। মনে বিড়বিড়ালো
“মাথার সমস্যা আছে নাকি এই লোকের!”

রাদিফের কান পযর্ন্ত কথাটা গেল নাকি ঠিক বোঝা গেল না। শুভ্রতা আর ঘাটালো না। সে ব‍্যাগটা কাধে আরেকটু টেনে তুলে সামনে এগোতেই রেদোয়ানের মুখোমুখি হলো শুভ্রতা।

রেদোয়ানকে দেখতেই শুভ্রতার রাগে শরীর তির তির করে কাঁপতে শুরু হলো। হাতে থাকা রুমাল দিয়ে কপালের ঘামটা মুছে ওকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই রেদোয়ান শুভ্রতার ডান হাতটা আকড়ে ধরলো। শুভ্রতা রাগী চোখে রেদোয়ানের দিকে তাকাতেই রেদোয়ান শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল
“ভালোই তো একদিনেই ভার্সিটির সভাপতির ছেলেকে পটিয়ে ফেলেছিস। আবার আমাকে খারাপ বলিস।”

শুভ্রতা ভ্রুকুচকে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল
“মানে”

রেদোয়ান শুভ্রতার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলল
“এখন ভালো সেজে কি হবে! রাদিফ আহমেদ এর সঙ্গে তোর কি!”

“রাদিফ আহমেদ সভাপতি ছেলে মানে!”

“ঢং করছিস আমার সঙ্গে। সব জেনেশুনে ফাঁসিয়েছিস এখন নেকামি করছিস।”

শুভ্রতা কিছু বলতে নিবে তার আগে পুরুষালি গম্ভীর কন্ঠে রাদিফ বলে উঠলো
“রেদোয়ান শুভ্রতার হাত ছেড়ে দে।”

শুভ্রতা চোখ ফিরিয়ে রাদিফের দিকে তাকাতেই থমকে গেল। রাদিফের ফর্সা মুখটা রাগে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। পাতলা ঠোঁটগুলো রাগে কাঁপছে।

“ছাড়বোনা কি করবি তুই!”

শুভ্রতার হাত আরও শক্ত করে ধরতেই শুভ্রতা বাম হাতের একটা থাপ্পড় বসিয়ে দেয় রেদোয়ানের গালে। রেদোয়ান শুভ্রতার গায়ে হাত দিতে নিলেই রাদিফ শক্ত হাতে রেদোয়ানের হাত ধরে ফেলে। সে ঝাঝালো কন্ঠে বলল
“আমি কে তুই কিন্তু এখনো চিনিস না।”

“ক্ষমতা দেখাচ্ছিস আমাকে!”

“ক্ষমতার আর কি দেখেছিস তুই।”

“আমার ব‍্যাপার আমাকে বুঝে নিতে দে রাদিফ।”

রাদিফ শুভ্রতার হাত রেদোয়ানের হাত থেকে ছাড়িয়ে রেদোয়ানের কানে কানে কি যেন বলল। রেদোয়ান যেন দমে গেল। শুভ্রতা অবাক চোখে শুধু দেখছে সব।

রাদিফ আঙুল রেদোয়ানকে দেখিয়ে শুভ্রতার হাত ধরে সেই জায়গা ত‍্যাগ করলো। শুভ্রতা হতভম্ব হয়ে আছে।

ভার্সিটির গেট পেরিয়ে যেতেই রাদিফ শুভ্রতার হাত ছেড়ে দেয়। শুভ্রতা তীক্ষ্ণ চোখে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“আপনি সভাপতি স‍্যারের ছেলে! রেদোয়ানকে আপনি চেনেন! আর কিইবা ওকে বললেন যে ও দমে গেল!”

রাদিফ গম্ভীর কন্ঠে বলল
“বাসায় চলে যাও। এতোকিছু জেনে তোমার লাভ নেই।”

রাদিফ একটা রিক্সা ডেকে শুভ্রতাকে তুলে দিলো। শুভ্রতার বাসার ঠিকানা রিক্সাচালককে বলায় শুভ্রতা বেশ অবাক হলো। শুভ্রতাকে হতভম্ব করিয়ে চলে গেল রাদিফ। শুভ্রতার মাথায় হাজারো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

শুভ্রতা বেশ চিন্তিত হয়ে বাসায় ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে রুমে যেতেই ফোনটা বাজতে লাগলো। ফোনের স্কিনে তুরের নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে শুভ্রতার ঠোঁট প্রসারিত হলো। সে ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় গেল।

তুর অস্থির কন্ঠে বলল
“কি হয়েছে রেদোয়ান ভাইয়ার সঙ্গে তোর ঝামেলা হয়েছে শুনলাম।”

শুভ্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
“হুম যা শুনেছিস সব সত্যি। তোকে আমি বলছিলাম না ও আমাকে ইগনোর করছিলো। সেইজন‍্য আমি বিয়ের কথা বলতেই ও ওর আসলরূপ দেখিয়ে ফেলে। আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলাম রে।”

“আমি আগেই বলেছিলাম পোলা ভালো না। ওই বেডার হাবভাব আমার ভালো লাগে না।”

“অন্ধ ছিলাম আমি।”

“তুই অন্ধ কালা সব। ছ‍্যাকা খাইয়া এখন আবেগে ভাসতেছিস। ওই ফালতু ছেলেকে ভালোবাসলি তুই কি দেখে ক তো আমাকে!”

“কি জানি কি হয়েছিলো আমার!”

“মিরকি হয়েছিলো তো ফক্কিনি।

“থাক বাদ দে তোর কি খবর! চট্টগ্রাম থেকে কবে ঢাকায় ফিরছিস?”

“আর বলিস না ভাইয়ার একটা মাইয়া মনে ধরেছে। যেতেই চাচ্ছেনা এখান থেকে।”

“কি বলিস তুর তূর্য ভাইয়ার আবার কাকে পছন্দ হলো!”

তুর ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
“জানিনা গাধাটা নামটাম কিছু জানেনা। এসে ‍বলছে ভাল লাগছে। ওরে চাই। ফালতু পোলা ওই। কালকেই ফিরবো ইনশাআল্লাহ।”

“আচ্ছা আয়”

কল কেটে রুমে আসতেই শুভ্রতা দেখলো ওর মা রেহানা বেগম বসে আছে বেডের উপর। শুভ্রতা মায়ের পাশ ঘেঁষে বসতেই রেহানা বেগম বলল
“রেডি হয়ে নে আম্মা নাকি হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তোর বাবা ফোন দিয়ে বলল রেডি হয়ে থাকতে।”

“কি বলছো আম্মু দাদিমার অবস্থা যেহেতু খারাপ সেহেতু তো যেতেই হবে। আমি সব গুছিয়ে নিচ্ছি। তুমি টেনশন করো না।”

৫.
কেটে গেছে বেশ কয়েকটা দিন। শুভ্রতা আজই ফিরেছে গ্রাম থেকে। এখন ওর দাদিমা ভালোই আছে আগের থেকে। রাতে ফিরায়। ফ্রেশ হয়ে খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে পড়লো শুভ্রতা।

সকালের মিষ্টি আলো চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেল শুভ্রতার। শুভ্রতা আড়মোড়া ভেঙে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে। ভার্সিটিতে যাওয়ার জন‍্য একদম রেডি হয়েই রুম থেকে বের হলো।

শামসুল হক বসার ঘরে বসে খবর দেখছিলেন। শুভ্রতা হাসিমুখে বাবার কাছে গিয়ে কিছুসময় কথাবার্তা বলে মায়ের কাছে গেল। রেহানা বেগম ওকে নাস্তা দিলে তা খেয়ে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো শুভ্রতা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে।

ভার্সিটির গেট পেরিয়ে যেতেই তুর ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো শুভ্রতাকে। শুভ্রতাও মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো তুরকে।

তুর শুভ্রতাকে ছেড়ে দিয়ে বলল
“কেমন আছিস দোস্ত? আর দাদিমা কেমন আছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো আছি। উনিও আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন এখন।”

“তোকে অনেক মিস করছিলাম আমি।”

“আমিও রে একা একা ক্লাস করতে খুব অসহায় লাগছিলো আমার।”

কথা বলতে বলতেই ক্লাসে চলে গেল ওরা দুইজন।

———————

ক্লাস শেষে তুর আর শুভ্রতা খালের পাশের ব্রেঞ্চে এসে বসেছে। শুভ্রতা রাদিফের কথা সব বলল তুরকে। তুর রাদিফের কথা শুনে কিছু ভাবলো। তারপর ভাবুক কন্ঠেই বলল
“ছেলেটা কি লম্বা ফর্সা সুদর্শন পুরুষ। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে। আবার চোখে চিকন ফ্রেমের চশমা।”

শুভ্রতা অবাক হয়ে বলল
“হুম তুই যেমন বলছিস তেমনি। কিন্তু তুই জানলি কিভাবে!”

তুর দাঁত বের করে হেসে বলল
“দুলাভাই ইধার আ রেহি হে।”

শুভ্রতা ভ্রুকুচকে বলে উঠলো
“মানে”

তুর চোখ দিয়ে ইশারা করে সামনের দিকে তাকাতে বলল। শুভ্রতাও তাকালো সেদিকে। রাদিফ আসছে এইদিকে। চুলগুলো তার এলোমেলো হয়ে মৃদু বাতাসে উড়ছে। এই ছেলেটা সবসময় শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়ে কেন! সে কি জানেনা এতে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় শতগুণে! এগুলোই ভাবনায় আসছিলো শুভ্রতার।

শুভ্রতা বেশ অবাক নিজের ভাবনা দেখে। নিজেই নিজেকে এর জন‍্য গালি দিতে লাগল। তুর শুভ্রতাকে ধাক্কা দিয়ে বলল
“কি বান্ধবী আমার কি এতো ভাবছো!”

শুভ্রতা কটমট দৃষ্টিতে তুরের দিকে তাকিয়ে বলল
“বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু এবার।”

“কি বেশি বেশি হচ্ছে মায়াবতী!”

“আপনার মাথা”

“তোমার দাদিমা কেমন আছেন এখন!”

শুভ্রতা রাদিফের এই প্রশ্নে আকাশ থেকে পড়লো। রাদিফ কিভাবে জানলো। শুভ্রতা চোখ ছোট ছোট করে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“আমার দাদিমা কেমন আছে মানে!”

“না মানে উনি তো অসুস্থ ছিলেন তাই জিঙ্গাসা করলাম এখন কেমন আছেন?”

শুভ্রতা আরো দ্বিগুণ সন্দেহ নিয়ে বলল
“আপনি জানলেন কিভাবে যে আমার দাদিমা অসুস্থ!”

“না মানে জেনেছি একভাবে।”

“সত‍্যি করে বলুন বলছি।”

রাদিফ আমতা আমতা করতে করতে বলল

#চলবে

আপনার শুভ্রতা পর্ব-০২

0

#আপনার_শুভ্রতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ২

শুভ্রতা রাদিফের সামনে দাড়িয়ে বলল
“আপনার মতলব কি বলেন তো!”

রাদিফ মুচকি হেসে খানিকটা ঝুকে শুভ্রতার কপালে উড়তে থাকা চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে বলল
“মতলব আর কি হবে মায়াবতী। তেমন কিছুই না। এখন চলুন তো। নাকি মায়াবতীর আমার মতো অধমের সঙ্গে সময় অতিবাহিত করতে ভালো লাগছে!”

শুভ্রতা কপট রাগ দেখিয়ে বলল
“অসহ‍্য”

বলেই হাটা শুরু করলো। রাদিফও পিছু পিছু যেতে নিলে শুভ্রতা ওর দিকে ঘুরে বলল
“খবরদার আমার পিছু পিছু আসবেন না। তাহলে কিন্তু খবর করে ছাড়বো বলে দিলাম।”

রাদিফ সেখানেই দাড়িয়ে গেল। মুচকি হাসি ফুটিয়ে বলল
“মায়াবতীদের রাগলে আরো মায়াবতী লাগে। রাগ করেন না প্লীজ।”

শুভ্রতা ভ্রুকুচকালো। কি যেন ভেবে রাদিফকে পাত্তা না দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে লাগল। রাদিফ শুধু শুভ্রতার যাওয়ার দিকে পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো।

৩.
শুভ্রতা বাসায় ফিরতেই ওর মা ওকে কিছুসময় ঝারলো। শুভ্রতা কিছু না বলে চুপ করে রইলো। বেশ কিছুসময় পর রেহানা বেগম গম্ভীর কন্ঠেই বললেন
“ফ্রেশ হয়ে খেতে আয় আমি খাবার দিচ্ছি।”

শুভ্রতা কথা না বাড়িয়ে নিজের রুমে চলে গেল। মাথাটা ব‍্যথা করছে তার। হাতটাও টনটন করছে। গায়ের জোরেই চড়টা মেরেছিল তখন।

শুভ্রতা রুমের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে ব‍্যাগটা টেবিলের উপর রেখে টাওয়েল আর জামা কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ালো। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বের হতেই বেডের উপরে পা ঝুলিয়ে বসে থাকা নম্রতাকে দেখে কপাল কুচকে বলল
“কিরে তোর আবার কি হয়েছে!”

নম্রতা চোখ ঘুরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে উচ্ছসিত কন্ঠে বলল
“আপুনি তোর থাপ্পড়টা সেই ছিলো।”

নম্রতার মুখে এই কথা শুনে বেশ অবাক হলো শুভ্রতা। এ কথা ও জানলো কিভাবে। শুভ্রতা যেন ভাবনায় পড়ে গেল। নম্রতা ঠোঁটে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল
“আরে আপুনি এতো ভেবে কি করবি বল তো। আমিই বলছি একটু আগে তুর আপু কল করে বলল।”

শুভ্রতা বিষয়টা বুঝতে পেরে চুল মুছতে মুছতে বলল
“ও তো আজ ভার্সিটি যায় নি। তাহলে জানলো কিভাবে?”

নম্রতা ঠোঁট উল্টিয়ে বলল
“তা তো আমি বলতে পারলাম না। তোর বান্ধবী তুই জানিস।”

ওদের কথার মাঝেই রেহানা বেগমের ডাক পড়লো। শুভ্রতা টাওয়েলটা নম্রতার হাতে দিয়ে বলল
“বারান্দায় মেলে দে”

শুভ্রতা খাবার খেয়ে পুনরায় নিজের রুমে এসে দেখলো নম্রতা এখনো বসেই আছে আগের অবস্থায়। শুভ্রতা ভ্রু কুচকালো। সে ধীর পায়ে নম্রতার পাশে গিয়ে বসে বলল
“কি হয়েছে তোর!”

নম্রতা তাকালো বোনের দিকে। ঠাস করে বোনের কোলে শুয়ে বলল
“আপুনি সবাই এতো স্বার্থ খোঁজে কেন!”

শুভ্রতা নম্রতার মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে বলল
“কে বলেছে সবাই স্বার্থপর!”

“আমি জিপিএ পাইভ পেয়েছি তাই সবাই আমার সঙ্গে কেমন যেন করছে। আমরা কত ভালো ফ্রেন্ড ছিলাম। কিন্তু এখন আমার সঙ্গে কথা বলা অফ করে দিয়েছে। আপুনি ভালো রেজাল্ট করাটা কি আমার দোষ। আমি তো সবসময় ওকে সাহায্য করেছি। তবুও ও ওর অন‍্য ফ্রেন্ড বানালো আমাকে ছেড়ে।”

“দেখ বনু তোর বয়সটাই এমন এখন অনেকেই তোকে ছেড়ে যাবে। কেবল তো এসএসসি দিলি। দিন যাবে মানুষ চিনতে পারবি। বন্ধুবান্ধবের মধ্যে বিচ্ছেদ হবে। তবে মনে রাখিস যে তোর প্রকৃত ফ্রেন্ড সে কখনোই তোকে ছেড়ে যাবেনা। বুঝলি পাগলি। আর তুই অবশ্যই ভালো রেজাল্ট করেছিস। ওর তোর ভালোই হিংসা করছে। করুক হিংসা। তুই তোর জীবন উপভোগ করবি। কারো জন‍্য জীবন থেমে থাকে না।”

“আপুনি তোর বফ তো রেদোয়ান ভাইয়া ছিলো তাকে তুই
থাপ্পড় দিলি কেন!”

শুভ্রতা এক‍টা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
“ছিলো একসময়। কিন্তু সে আমার ধোকা দিয়েছে। আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসে আমার মূল‍্যবান সময় নষ্ট করেছি। আমি মনে করি আল্লাহ যা করে ভালোর জন‍্যই করে। ওই লোকের কথা আর তুলবি না। এরকম ছেলের জন‍্য মানুষ ভালোবাসা নামক পবিত্র শব্দটা কলঙ্কিত করে। বাদ দে এসব। আর তুই তোর ওই ফ্রেন্ড নিয়ে ভাবিস না। হয় তো ও তোর জন‍্য মঙ্গলকর ছিলো তাই আল্লাহ তোর কাছ থেকে সরিয়ে নিয়েছে।”

নম্রতা শুভ্রতার কোমর জড়িয়ে ধরে বলল
“আপুনি ঘুরতে যাবি!”

শুভ্রতা একটু ভেবে বলল
“সন্ধ‍্যার দিকে যাবোনি। এখন একটু রেস্ট নিয়ে নিই।”

শুভ্রতার হ‍্যাঁবোধক উত্তরে নম্রতা বেশ খুশি হলো। শোয়া থেকে উঠে বসে টুক করে শুভ্রতার গালে চুমু খেয়ে বলল
“আমার কিউটি আপুনি।”

নম্রতার কাজে শুভ্রতা হাসলো।

———————

সন্ধ‍্যার দিকে শুভ্রতা আর নম্রতা হাঁটতে বেড়িছে। আশেপাশে ঘুরে ফুচকা খেয়ে বাড়িতে ফিরলো দুইজন।

শুভ্রতার মনটাও এখন বেশ ফুড়ফুড়ে লাগছে। নম্রতার সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে খারাপ হয়নি। বরং ভালো হয়েছে।

শুভ্রতা বই নিয়ে পড়তে বসলো। বেশকিছুসময় পড়ে রাতের খাবার খেয়ে আরো কিছুক্ষণ পড়াশোনা করে শুয়ে পরলো সে।

চোখ বুজতেই হুট করে রাদিফের হাসিমুখটা ভেসে উঠলো। শুভ্রতা ধপ করে উঠে বসলো। এমন হলো কেন তার সাথে। ওই অসহ‍্য লোকটাকে কেন তার মনে পরলো। চোখ বুজতেই কেন তাকে দেখতে পেল।

শুভ্রতা পুনরায় শুয়ে বালিশের পাশে হাতরে ফোনটা হাতে নিলো। রেদোয়ানকে সব জায়গা থেকে ব্লক করে সস্থির নিশ্বাস ফেলল। সে বেশকিছুদিন আগে থেকে খেয়াল করছিলো রেদোয়ান তাকে ইগনোর করছে। তাই তো বিয়ের কথা বলতেই রেদোয়ানের আসল রূপ বেড়িয়ে এলো। সে ভুল মানুষকে ভালোবেসেছিলো। তারই ভুল ছিলো। কেন সে ওই ফালতু ছেলের জন‍্য নিজে কষ্ট পাবে। তার চরিত্রের সাথে কখনোই তা মিলবে না। কিন্তু রাদিফ!

শুভ্রতা একবার ভাবলো তুরকে একটা কল দিবে। কিন্তু মেয়েটা তো ঘুরতে গেছে। থাক পরে আসলে না হয় সব বলবে। ঘুরে আসুক।

শুভ্রতা ফোনটা নিয়েই বারান্দায় গেল। রাস্তায় থাকা ল‍্যাম্পপোস্টের আলো গুলো জ্বলছে টিপটিপ করে। রাস্তায় মানুষ নেই দু তিনটা কুকুর এদিক সেদিক ঘুরছে। শুভ্রতা নিচ থেকে চোখ ফিরিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। আজ পূর্ণিমা না হলেও চাঁদ আলো দিচ্ছে। মেঘগুলো চাঁদের সঙ্গে কানামাছি খেলছে। শুভ্রতা পলকহীন ভাবে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে।

আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ বুজে এলো শুভ্রতার। ঘুমটা ধরে আসতেই শুভ্রতা ঢুলুঢুলু পায়ে রুমে এসে বেডে শুয়ে পরলো।

৪.
শুভ্রতা ক্লাস শেষ করে আজও সেই খালের পাড়ে এসে ব্রেঞ্চে বসেছে। দৃষ্টি তার স্বচ্ছ খালের পানির দিকে।

আজকেও হুট করে রাদিফ শুভ্রতার পাশে ধপ করে বসলো। শুভ্রতার খেয়াল করলো আজও সে শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে। তার থেকে দূরত্ব নিয়েই বসেছে। তা দেখে কেন যেন অজান্তেই ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো শুভ্রতার।

রাদিফ বইটা খুলে নিরবেই সেদিকে চোখ রাখলো। শুভ্রতা আড়চোখে রাদিফকে দেখছে। রাদিফ বই থেকে চোখ ঘুরিয়ে শুভ্রতার দিকে তাকাতেই চোখে চোখ পড়ে গেল তাদের। শুভ্রতা সঙ্গে সঙ্গে অন‍্যদিকে ফিরে তাকালো। রাদিফ বিষয়টি বুঝতে পেরে ঠোঁট কামরে হাসলো।

হুট করে রাদিফ ঠাস করে বইটা ব‍্যাগে ঢুকিয়ে উঠে দাড়ালো। শুভ্রতা কপাল কুচকে রাদিফকে পর্যবেক্ষণ করছে শুধু। রাদিফ খানিকটা সামনে গিয়ে একটা কূষ্ণচুড়া ফুল কুড়িয়ে নিলো। নিজে মনে কি যেন বিড়বিড় করে আবারও ব্রেঞ্চে এসে বসলো।

শুভ্রতা কিছু বলছে না শুধু নিরবে রাদিফের কর্মকাণ্ড দেখছে। রাদিফ এবার নিরবতা ভেঙে ফুলটা শুভ্রতার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
“ফুলটা যদি গ্রহণ করে এই অধমকে ধন‍্য করতেন তাহলে বেশ খুশি হতাম।”

শুভ্রতা চোখ ছোট ছোট করে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“যদি না নেই তবে!”

রাদিফ ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
“তবে এই সতেজ ফুল‍টির জায়গা মায়াবতীর এলোকেশে না হয়ে বইয়ের ভাঁজে হবে। এই আর কি।”

শুভ্রতা কিছু বললো না। রাদিফ পুনরায় প্রশ্ন করলো
“নিবেন না মায়াবতী”

শুভ্রতা তীক্ষ্ণ চোখে রাদিফের দিকে তাকিয়ে বলল
“আমার নাম আছে”

রাদিফ ভাবলেশহীন ভাবে বলল
“তাতে কি!”

“আমার নাম ধরে ডাকলে খুশি হতাম। মায়াবতী শুনতে ভালো লাগছে না। আর আপনি কতটুকু চিনেন আমাকে।”

রাদিফ চোখ বুজে ব্রেঞ্চে হেলান দিয়ে বসে মুচকি হাসলো।

শুভ্রতা প্রশ্নবিদ্ধ কন্ঠে জিঙ্গাসা করলো
“কথায় কথায় এতো হাসেন কেন!”

রাদিফ চোখ বুজেই বলল
“কেন ভালো লাগেনা বুঝি।”

শুভ্রতা এবার খানিকটা ঝাঝালো কন্ঠেই বলল
“হেয়ালি না করে বলুন কতটুকু চেনেন আমায়।”

#চলবে

আপনার শুভ্রতা পর্ব-০১

0

#আপনার_শুভ্রতা
#লেখিকাঃশুভ্রতা_শুভ্রা
#পর্বঃ১

১.
রেদোয়ানের কথাগুলো যেন তীরের মতো ঠেকছে শুভ্রতার। দীর্ঘ চারবছর যে মানুষটাকে ভালোবেসেছে সেই আজকে পুরো ভার্সিটির সবার সামনে তাকে এমন করে অপমান করবে তা কল্পনাও করেনি শুভ্রতা। চোখ বেয়ে নোনাজল পড়তে শুরু করেছে। বাকি সবাই মুখ টিপে হাসছে। আর শুভ্রতাকে নিয়ে টিটকারি মারছে।রেদোয়ান নাক মুখ কুচকে বলল
“তুই কিভাবে ভাবলি তোকে আমি ভালোবেসেছি। তোর মতো মেয়েকে কি আমার মতো ছেলের সঙ্গে মানায়। আমি তো জাস্ট টাইম পাস করেছি।”

সঙ্গে সঙ্গে পরপর দুটো থাপ্পড় বসিয়ে দিলো শুভ্রতা রেদোয়ানের গালে। রেদোয়ান গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। শুভ্রতার রাগে গা থরথর করে কাঁপছে। শুভ্রতা শ‍্যামবর্ণের মুখটা অদ্ভুত রকমের ভয়ংকর লাগছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে অসম্ভব। মনে হচ্ছে আর একটু হলেই চোখ বেয়ে আগুন বের হবে যেটা দিয়ে জ্বালিয়ে ফেলবে সবাইকে। শুভ্রতা ডান উঁচিয়ে রেদোয়ানকে রাগান্বিত কন্ঠে বলল
“তুই কি ছেলে খেলা পেয়েছিস। মেয়েদের কি তোর হাতের পুতুল মনে হয়। খবরদার এমনটা ভেবে থাকলে তুই ভুল ভাবছিস। মেয়েরা হতে পারে নরম কিন্তু ওরা অসহায় কিংবা তোদের হাতের পুতুল না। আমার নরম রূপ দেখেছিস। আসল রূপ দেখাইনি।”

রেদোয়ান অপমানিত দৃষ্টিতে চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা কিছুক্ষণ আগের মুখ টিপে হাসতে থাকা মানুষরা এখন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে। রেদোয়ানের পাশ থেকে ওর বান্ধবী রিয়া বলে উঠলো
“এই মেয়ে তোর এতো বড় সাহস তুই রেদোয়ানের গায়ে হাত তুলিস। তোকে…!”

রিয়াকে আর কিছু বলতে না দেখে ওর দিকে ফিরলো। শুভ্রতার তাকানো দেখে দমে গেল রিয়া। শুভ্রতা চেঁচিয়ে বলে উঠলো
“কি হলো চুপ হয়ে গেলি কেন! কি করবি আমাকে! মারবি তো! মার মেরে দেখ। একটু কথা তোদের মাথায় ঢুকিয়ে নে ভেঙে যাওয়া মানুষের সঙ্গে লাগতে আসিস না। তোদের ভেঙে দিবে।”

কথাগুলো বলেই গটগট পায়ে সেই জায়গা ত‍্যাগ করলো শুভ্রতা।

২.
ভার্সিটির কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচের ব্রেঞ্চটিতে বসে আছে শুভ্রতা। কৃষ্ণচূড়া ফুলগুলো স্বচ্ছ খালের পানিতে পরে এক অপরূপ সৌন্দর্য প্রকাশ করছে। জায়গাটা বেশ প্রিয় শুভ্রতার। মন ভালো করার মতো জায়গা।

“সাহসী মেয়েদের চোখে জল মানায় না। আর সে যদি হয় মায়াবতী তাহলে তো প্রশ্নই উঠে না।”

হঠাৎ একটা পুরুষালি কন্ঠে শুভ্রতা ভ্রুকুচকে তাকালো পাশে। ওর পাশে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে একটা বলিষ্ট সুপুরুষ বসে আছে। হাতে তার বাংলা সাহিত্যের একটা গল্পের বই। পরনে আকাশি রঙের পাঞ্জাবি। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। চোখের চিকন ফ্রেমের চশমা ফর্সা গরনের সুদর্শন ছেলেটাকে এক পলকে দেখে নিলো শুভ্রতা। ছেলেটা আবার বলে উঠলো
“কি হলো এভাবে কি দেখছেন! আমি জানি আমি সুন্দর। তাই বলে এভাবে তাকিয়ে থাকবেন। তা তো ঠিক না মায়াবতী।”

শুভ্রতা চোখের পানি হাতে উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে খালের স্বচ্ছ পানির দিকে তাকিয়ে বলল
“ফ্লাট করছেন!”

ছেলেটা মুচকি হেসে শুভ্রতার দিক থেকে চোখ ঘুরিয়ে বইয়ের দিকে চোখ রেখে বলল
“এই অধমের এতো সাহস আছে নাকি যে আপনার সঙ্গে ফ্লট করবো। আপনি যে জোরে জোরে থাপ্পড় মারেন।”

শুভ্রতা মুখ ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকালো। ছেলেটা আবারও মুচকি হাসলো। ডান হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল
“আমি রাদিফ আহমেদ,আপনি!”

শুভ্রতা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো। রাদিফ বইটা বন্ধ করে ব‍্যাগে রেখে ফুস করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলল
“আপনি অন‍্যরকমের এক তেজি নারী। ভাবলাম আপনার সঙ্গে কথা বলে আপনার প্রতিবাদের ধরনটাকে নিজের মাঝে নিয়ে আসা যেতেই পারে। ফ্রেন্ড না হয় নাই হতে পারি কথা তো বলতেই পারি মায়াবতী।”

শুভ্রতা তবুও চুপ করে রইলো।

রাদিফ শুভ্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দু কদম এগোতেই শুভ্রতা গম্ভীর কন্ঠে বলল
“শুভ্রতা শুভ্রা”

রাদিফ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। বাম হাত দিয়ে মাথা পিছনে থাকা চুলগুলোই হাত বোলাতে বোলাতে আবারও এসে শুভ্রতা থেকে দূরত্ব বজায় রেখে আগের জায়গাই বসলো।

শুভ্রতা কিছু না বলে আগের ন‍্যায় চুপচাপই বসে রইলো। রাদিফ ও চুপ করে রইলো।

নিরবতা ভেঙে শুভ্রতাই বলল
“আপনি হঠাৎ আমার সঙ্গে কথা বলতে আসলেন কেন! আপনাকে তো আমি চিনি না। এর আগে তো আমাদের দেখা হয়নি। তাহলে…!”

রাদিফ শুভ্রতার কথা বলার অপেক্ষাই ছিলো। চোখের চশমাটা ঠিক করে শুভ্রতার দিকে তাকিয়ে বলল
“নাম তো জানাই হলো। এখন আর অচেনা কোথায়! আগে দেখা হয় নি ঠিক কিন্তু আজ তো হয়েছে।”

“আপনার কথাগুলো যেন কেমন!”

“কেমন!”

“বেশ অদ্ভুত”

রাদিফ আবারও মুচকি হেসে বলল
“তাই বুঝি আগে কেউ বলে নি তো তাই জানতাম না।”

শুভ্রতা কিছু বলল না।

——————–

অনেকক্ষণ পর রাদিফ হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিরবতা ভেঙে বলল
“বাসায় যাবেন না?”

এতক্ষণে শুভ্রতার হুশ হলো ব‍্যাগ থেকে ফোনটা বের করে দেখলো ওর মা অলরেডি ফোন দিয়েছে সাতবার। নিজের উপরই নিজে বিরক্ত হলো শুভ্রতা। তাড়াতাড়ি করে শুভ্রতা তার মায়ের নাম্বার কল দিতে সঙ্গে সঙ্গে কল রিসিভ হলো। অপরপাশ থেকে শুভ্রতা মা রেহানা বেগম ঝাঝালো কন্ঠে বলে উঠলেন
“কিরে ফোন ধরিস না কেন! বাসার কথা মনে নাই তোর। একজন যে চিন্তায় মরছে সেদিকে কোনো খেয়াল নাই তোর।”

“আম্মু জ‍্যামে আটকে আছি। আসছি আমি আর কিছুক্ষণ।”

বলেই কল কেটে দিলো শুভ্রতা। সে জানে এখন কল না কাটলে ওর মা তান্ডব চালাতো। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাড়ালো শুভ্রতা।

“চলে যাচ্ছেন!”

শুভ্রতা ভ্রুকুচকে রাদিফের দিকে তাকাতেই রাদিফও উঠে দাঁড়ালো। ব‍্যাগটা কাধে নিয়ে বলল
“চলুন এগিয়ে দিই আপনাকে।”

শুভ্রতা রাদিফের সামনে দাড়িয়ে বলল
“আপনার মতলব কি বলেন তো!”

#চলবে কি?

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-২৪ এবং শেষ পর্ব

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’

অন্তিম পর্ব

শাহাজাদী মাহাপারা

মিতা শপিং এ এসেছিলো তারিনের সাথে। নিজের জন্য টুকটাক কেনাকাটা করে ফারদিনের জন্য একটা ফাউন্টেনপেন আর একটা ঘড়ি কিনলো। এর চেয়ে বেশি কি দেয়া যায় গিফটে তা সম্পর্কে তার কোনো আইডিয়া নেই। ফারদিনের ফ্লাইট সম্ভবতঃ পরশু৷ সে মোটামুটি টুকটাক গোছগাছও করেছে। মিতা কোনো প্রশ্ন করেনি। ফারদিনও কিছু বলেনি।
মিতার অস্থিরতা কি তারিন বুঝতে পারছে?
তারিন বললো, ‘ ভাবি তোমার সাথে একজনের পরিচয় করাতে চাই৷’
‘আপু আপনি প্লিজ নাম ধরেই ডাকুন। আমি কমপক্ষে আপনার চার বছরের ছোট৷ আমার খুবই লজ্জা লাগে যখন আপনি ভাবি ডাকেন। ‘
তারিন হেসে ফেললো।
‘আমি তোমার ননদ৷ বড় ভাইয়ের বউকেতো ভাবিই ডাকে। আর তুমি এত মিষ্টি একটা মেয়ে তোমায় ভাবি না ডেকে উপায় আছে বলো?যাই হোক,তুমি এখন আমার সাথে একটা ক্যাফেতে যাবে৷ আমরা সেখানে কিছুক্ষণ গল্প করে এরপর বাড়ি ফিরবো। ‘ মিতা না করলো না।

ড্রাইভারকে বিদায় করে দুজন একটা ক্যাফেতে ঢুকলো। মিতা তারিনকে অনুসরণ করলো৷

একটা টেবিলে বসে তারা অর্ডার করলো৷ স্ন্যাক্স অর্ডার করলো দুজনে। কিছুক্ষণ পরই টেবিলে একজন এসে উপস্থিত হলো। মিতা মাথা তুলে তাকালো।

‘ স্যরি৷ বেশি অপেক্ষা করাইনি নিশ্চই।’
‘মারুফ স্যার।’

মারুফ চমকে তাকালো।
‘ রুস্মিতা৷’
তারিন একটু অবাক হলো।
‘ ইউ গাইজ নোউ ইচ আদার?’

‘ হ্যাঁ মিতা আমার স্টুডেন্ট ছিলোতো। সে অনেক বছর আগে। প্রায় ছ, সাত বছর তো হবেই।’
‘ মিতা কাষ্ঠ হাসার চেষ্টা করলো৷
‘ তুমি কি করে চেনো রুস্মিতাকে?’
‘ আমার ভাবি৷’
মারুফ যারপরনাই চমকালো।
‘ কি? এইটুকু মেয়ে? ওর বয়স জানো তোমরা?’
মারুফের এমন কথায় তারিন অফেন্ডেড ফিল করলো৷
‘ তোমায় সব ঘটনা আগেই বলেছি মারুফ৷ সিন ক্রিয়েট করবে না কাইন্ডলি৷ তাছাড়া পরিস্থিতি আমাদের হাতে ছিলো না। মিতা ভাবিকে কেউই জোর করেনি সে স্বেচ্ছায় বিয়ে করেছে। এন্ড শি ইজ নট আ মাইনর।’

মিতা বুঝতে পারছে না কিছু। তবে তারিন তার ভাই কে ডিফেন্ড করছে এটুকু বুঝলো। তারও উচিৎ নিজের বর কে ডিফেন্ড করা৷

মিতা হেসে বললো,
‘ একেক জনের একেক রকম স্বপ্ন থাকে স্যার৷আর তাছাড়া ভাগ্য বলেও কিছু আছে। আপনি তো জানতেনই আমার ড্রিম ছিলো বউ সাজার। দ্রুত বিয়ের ইচ্ছে থেকেই এখন আমি ফারদিন এর ওয়াইফ, তারিনের ভাবি। আমি ভুল না ভেবে থাকলে তারিন আপনার বিশেষ কেউ একজন। সব ঠিক ঠাক থাকলে আমি আপনারও ভবিষ্যৎ সম্বন্ধীর স্ত্রী, সম্পর্কে আপনার ভাবি হবো৷ তাছাড়া আমার বর কিন্তু বেশ হ্যান্ডসাম স্যার। দেখেছেন সবার সব ইচ্ছে পূর্ণতা না পেলেও আলহামদুলিল্লাহ আমার ইচ্ছে গুলো ঠিক পূরণ হয়েছে৷ আমি খুবই খুশি এখানে৷ ‘

মারুফ দেখছে তার সামনে বসা রুস্মিতা আর ক্লাস এইটে পড়া কিশোরী রুস্মিতার মধ্যে বিশাল পার্থক্য৷ পূর্বের দুষ্টু আর মিষ্টভাষী রুস্মিতার মধ্যে পার্থক্য হলো ব্যক্তিত্বের৷ প্রচন্ড অহংবোধ আর ব্যক্তিত্ববোধের সামনে বসা রুস্মিতা তাকে সত্যিই অবাক করেছে।
সে হয়তো সে সময় রুস্মিতাকে প্রত্যাখ্যান না করলে এই রুস্মিতা আজ তার থাকতো। কিন্তু সত্যিই কি এমন হতো? হতো না৷ কারণ এই রুস্মিতা এখন যেমন ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি করেছে তাকে সে গ্রহণ করতে পারতো না হয়তো। তারিনকে সে ভালোবাসে, পছন্দ করে কারণ তারিন স্পষ্টভাষী এবং স্বল্পভাষী, এছাড়া তারিন খুবই নরম স্বভাবের। মিতা তেমন না। মিতা ভিন্ন৷ আর কিশোরী মিতার ইনফ্যাচুয়েশন গ্রহণ করবে তেমন ব্যক্তিত্ব তার কখনোই ছিলো না৷ শিক্ষক হিসেবে সে মিতার সর্বাত্মক মঙ্গলই চাইতো এতে সন্দেহ নেই৷

মিতা নিজেও কৃতজ্ঞ মারুফের প্রতি। তিনি সত্যিই একজন চমৎকার শিক্ষক ছিলেন। তবে তার প্রত্যাখ্যান ভুলেনি সে। ভোলা উচিৎ ও নয়৷ আগামী দিন গুলোতে মিতা অতি অবশ্যই নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করবে । যদিও এতে বড়াই এর কিছু নেই।

সিরিয়াস টপিক বাদ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তারা সেখানে কথা বলেই কাটালো। মারুফ যে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে পজিশন হোল্ডার তা জানালো। মিতা ফারদিনের সাথে অস্ট্রেলিয়া স্যাটেল হবে এটাও তারিন জানালো। মিতা শুধু হু হা তেই উত্তর করলো।

*****

মিলার ফোনে নোটিফিকেশন এলো টুপ করে। মাহাতাবকে কোলে নিয়ে সে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছে। নোটিফিকেশন ওপেন করতেই তার এগাল ওগাল হাসি বিস্তৃত হলো। অবশেষে মুহিন তার স্ট্যাটাস চেইঞ্জ করেছে৷ কমপ্লিকেটেড থেকে ম্যারিড টু রুদ্মিলা হয়েছে। প্রোফাইলে তাদের গ্রামে তোলা আংটি পরানোর মুহূর্তের ছবি। আবার নোটিফিকেশন এলো। এবার দেদারছে ছবি দিয়েছে সে। গ্রামে যখন যত ছবি তুলেছে প্রায় সবই আছে। অনেক অনেক রিয়েকশন্স সাথে কমেন্টবক্সে অভিনন্দনের সয়লাব। শুভাকাঙ্ক্ষীদের এমন সয়লাব মিলার পক্ষ থেকেও৷ মিলা ছবি গুলো দেখছে৷ তারা ঠিক করেছে আবার যাবে গ্রামে মুহিনের নেক্সট ছুটিতে। ছোটবেলায় বান্ধবীদের মুখে শুনতো তাদের গ্রামের বাড়ির গল্প। কিভাবে গ্রামীণ জীবন তাদের টানে। নিজের গ্রামের বাড়ি থাকতেও মিলা মিতারা তেমন একটা টান খুঁজে পেতো না। অথচ এবার মুহিনের গ্রামে গিয়ে বুঝতে পেরেছে আসলে টানটা সৃষ্টি হয় সম্পর্কগুলো থেকে। পরেরবার ফারদিন আর মিতাকেও নিয়ে যাবে সে। খুব খুশি হবে তারা।

*****

ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন ল্যান্ড করার পরই মিতার বিশ্বাস হলো যে তারা সিলেট পৌঁছেছে।
নিজেকে এতো বোকা লাগছে মিতার। গতকাল সারা রাতই সে ফারদিনের বুকে শুয়ে কেঁদেছে। ফারদিনও তাকে একবারও বুঝতে দেয় নি যে কি হচ্ছে। ফারদিন যখন বুঝতে পেরেছে যে মিতা ভাবছে যে সে তাকে ফেলেই অস্ট্রেলিয়া ব্যাক করবে কাউকে কিছু না জানিয়া সে নিজেই বোকা বনে গিয়েছিলো। তারপর তার সে কি হাসি। মিতাকে বার কয়েক টিজও করেছে সে। মিতা বেচারি কাঁদোকাঁদো মুখ করেই তাকে নিজের কেনা গিফটগুলো দিয়েছে। ফারদিন এটা নিয়েও হেসেছে৷ তবে ভেতরে ভেতরে সে যে পুলকিত হয় নি তা কিন্তু না৷ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেছে মিতার কান্ড।

ফারদিন এ কদিন ঘুরে ঘুরে মিতার জন্য শপিং করেছে। সব এনে একটা লাগেজে গুছিয়ে রেখেছে৷ বাকি একটা লাগেজ তার নিজের। ফারদিন যে আরও একমাস এখানে থাকবে মিতাকে তা বলা হয়নি। বেচারি কতটা ভয়ে ছিলো ভাবতেই ফারদিনের মন খারাপ হয় কিন্তু হাসিও পায়। এতো বোকা কেউ হয়? সাহস করে জিজ্ঞেস করলেই হতো। তাতে কি! মিতা যে তাকে কতটা ভালোবেসে ফেলেছে তা সে আজ উপলব্ধি করলো৷ এর থেকে ভালো আর কিছুই হতে পারে না৷ আর তাছাড়া সে সত্যিই যে চলে যেতে চেয়েছিলো তা তো মিথ্যে নয়। শুধু মিতাদের বাড়ি যাবার পরেই তার আশেপাশের সবকিছু বদলে যেতে থাকে, সে নিজেও।

মিতারা তাদের সেই সিলেটের দাওয়াতে এসেছে। এছাড়াও এটা আরেকটা ছোট হানিমুন তাদের৷ ফারদিন ফ্লাইটে আসতে আসতে জানিয়েছে মিতার ভিসা প্রসেসিং এর জন্যও দেয়া হয়েছে৷ এছাড়া মিতা সিডনিতে কোনো ইউনিভার্সিটি তে এডমিশন নিতে চাইলে নিতে পারে। মিতা এপ্লাই করেছে তাও জানালো।

মিতা যখন কাঁদছিলো ফারদিনকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে ফারদিন তখন মিতার সমস্ত মুখে অজস্র চুমু খেয়েছে। এবং সৃষ্টি কর্তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছে মিতাকে তার করে দেয়ার জন্য৷ এমন মায়া যেনো তাদের মাঝে সবসময় থাকে সেই প্রার্থনাই সে করেছে৷

পরিশিষ্টঃ

অটাম শেষের দিকে প্রায়। দ্যা ইউনিভার্সিটি অফ ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া তে আজকে কনভোকেশন ডে কোনো এক ব্যাচের। সবার ফ্যামিলি উপস্থিত আছে আজ। স্টেইজে রুস্মিতা তার গ্র‍্যাজুয়েশন সার্টিফিকেট নিতে উঠেছে৷ চারপাশ থেকে করতালির সম্ভাশন সাথে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ। ফারদিন সকল ছবি ক্যামেরা বন্দিতে ব্যস্ত। রুদ্মিলা আর মুহিন কেও দেখা যাচ্ছে সেখানে। মিলার কোলে আরেকটা দেবশিশু। মাহতাবের বয়স এখন ৬ বছর। সিঙ্গাপুরে দেড় বছরের যুদ্ধের পর মিলা মা হতে পেরেছে। সন্তান সুখ তার ভাগ্যে নেই তা ভেবেই নিয়েছিলো সে। আর এটাও একটা এক্সিডেন্টই ছিলো বলা চলে৷ তবে মিলা হার মানে নি। তার আর মুহিনের অদম্য প্রচেষ্টা আর সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় তার নিজের জীবনও আজ কানায় কানায় পূর্ণ। মিলা মিতা একসাথে দাঁড়িয়ে বেশ কিছু ছবি তুলছে মিতা গ্র‍্যাজুয়েশন ক্যাপটা মিলার মাথায় পরিয়ে দিচ্ছে৷ মৃদু মন্দ বাতাসে ঝড়া পাতাগুলো উড়ে যাচ্ছে।

সমাপ্ত।

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-২৩

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২৩

শাহাজাদী মাহাপারা

দুপুরে ঘন ডাল, লাল চালের ভাত, ডিম ভূনা, বিভিন্ন রকমের শাক আর ছোট, বড় মাছের তরকারি দিয়ে লাঞ্চ সেরেছে মিলা। মিলা খাবারের ব্যাপারে খুব চুজি। নাক সিটকানোর মতো৷ কিন্তু আজ বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে৷ আচ্ছা মা বেঁচে থাকলেও কি এভাবেই রেঁধে খাওয়াতো?

মিলা ঘাসের উপর বসে আকাশ দেখছে৷ কিছুক্ষণ আগেই সে ভাত ঘুম থেকে উঠেছে৷ এ বাড়িতে এতো আনন্দ হচ্ছে তার ইচ্ছে করছে এখানেই থেকে যেতে। মৃদু বাতাসের দুলুনিতে ধান গুলো কি সুন্দর দুলছে৷ পাখি গুলো ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাচ্ছে৷ সূর্য কন্যা সুন্দরী আলো ছড়িয়েছে আকাশ জুড়ে। মিলা তার শাশুড়ির দেয়া একটা কাঁচা হলুদ রঙা শাড়ি পরেছে। সূর্যের সোনালী রঙ তার চোখে মুখে অন্য রকম দীপ্তি ছড়াচ্ছে। শাড়ির রঙটা যেনো তা আরও দ্বিগুণ করে দিলো। মুহিন বেশ কিছু ছবি মুঠোফোনে বন্দী করলো৷ মিলা দু হাতে ঘাসে হেলান দিয়ে মাথা এলিয়ে দিতেই তার এলোকেশ বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে৷ সে প্রাণ ভরে শ্বাস নিচ্ছে এতো সুন্দর বাতাস কি এর আগে সে স্পর্শ করতে পেরেছে? বাতাসে মিলার শাড়ির আঁচল কোমড় থেকে সরে তার পেটের কিছু অংশ দৃশ্যমান করে তুললো৷ সূর্যের আভায় যেনো তা আরও ঐশর্গীক মনে হতে লাগলো মুহিনের কাছে। মিলাকে সোনালী আভা ছড়ানো কোনো গ্রীক দেবীর ন্যায় লাগছে। মুহিন মিলার পেছনে এসে বসে তার পেটে হাত রাখলো। মিলা এ স্পর্শ চেনে৷ মুহিন গতকাল এখানেই শুয়ে নিদ্রায় গিয়েছিলো। মিলা জিজ্ঞেস করলো,
” ঘুম শেষ? মাহতাব উঠে গিয়েছে?”
মুহিন মিলার কাঁধে চিবুক রেখে উত্তর দিলো,
” মাহতাব আম্মুর কাছে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় দিয়ে এসেছি। আমার ঘুম ভেঙে তোমায় না পেয়ে এখানে চলে এসেছি।”
” আপনাদের গ্রামটা কি সুন্দর। আপনার পরিবারটাও।”
” তুমিও৷ এই সবই এখন তোমার মিলা৷ আমিও।”

মিলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। সূর্য ডুববে কিছুক্ষণ পর। এবার উঠতে হবে। রাতে আজ পিঠা বানানো হবে। সংসার পিঠা, সিদ্ধ পুলি, ছিট রুটি, হাসের মাংস, ক্ষীর,শেয়ই পিঠা, ম্যারা পিঠা ইত্যাদি৷ আরও অনেক ঐতিহ্যবাহী পিঠা রয়েছে টাঙ্গাইলের। এছাড়া টাঙ্গাইলের বিখ্যাত চমচম, দই যা বড় ফুফু এনেছিলেন এত্ত স্বাদ ছিলো মিলা দু বাটি খেয়েছে। টাঙ্গাইলে সরিষা, কাসুন্দি, শাড়ি, বিখ্যাত মানুষ জন, জমিদার বাড়ি সবই ঐতিহ্য বহন করে।

সবাই মিলে বড় উনুনের কাছে বসেছে পিঠা বানাতে। হাসের মাংস আর সিদ্ধ পুলি গ্যাসে চড়িয়েছেন মিলার শাশুড়ি। ক্ষীর বিকেলেই রান্না করেছিলেন। মুহিন খুব মজা করে খেয়েছে। বাড়ির সবাই খেয়েছে৷ তিন্নি, মিলা আর কাজিনরা মিলে সংসার পিঠার জন্য ছোট ছোট লুচি বেলছে কেউ, কেউ আবার তা কেটে তাতে মুরগির মাংসের পুর ভরছে৷ মিলার শাশুড়ি খোলা চুলায় তেলে তা ভাজছেন৷ গল্পের আসর জমে উঠেছে৷ পুরনো দিনের গল্প। মুহিনের দাদা, বড় আব্বাদের সময়কার গল্প,রয়েছে জ্বীন ভূতুরে গল্পও। মিলার গা কিছুটা ছমছমিয়ে উঠছে৷ মুহিন পাশে বসে মিলাকে দেখছে মাহতাব কোলে খেলনা নিয়ে খেলছে৷ মাঝে মাঝেই হা হা হিহি করে হাসির রোল পড়ছে। সময়টা এভাবেই বয়ে যাচ্ছে৷
রাতের আকাশে শত সহস্র তারার মেলা৷ গুণে শেষ করার উপায় নেই৷ পাখিরা ঘরে ফিরেছে বহু আগেই। মুহিনের মনে হচ্ছে বহু বহু যুগ পারি দিয়ে সেও ফিরে এসেছে তার চিরচেনা নীড়ে৷ সাথে রয়েছে তার রাণী আর রাজপুত্র৷ সে খুব করে প্রার্থণা করলো স্রষ্টার নিকট এই আনন্দঘন মুহূর্ত গুলো যেন বার বার বহুবার তার জীবনে ফিরে ফিরে আসে৷ এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতেও ভুললো না সে।

*****

বৌভাতের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে প্রায় তিন দিন আগে। মিতারা কক্সবাজার থেকে ফিরেছে আট দিন হতে চললো। হাতে সময় আছে আর পাঁচ দিনের মতো৷ বিগত আটদিন স্বপ্নের মতো কেটেছে মিতার৷ এতো দ্রুত সময় পাখা ঝাপটে উড়ে যাচ্ছে কেনো? কোনো উপায় কি নেই সময় কে বেধে ফেলার?

মিতার বৌভাতে মিলার আসা নিয়ে বেশ হাঙ্গামা করেছে তার শাশুড়ি৷ তবে তা বেশিক্ষণ চলতে পারেনি৷ ফারদিন বেদম ক্ষেপেছিল সেদিন। মিলাকে সেদিন মুহিনের সাথে দেখে খুব ভালো লেগেছিলো মিতার৷ তার আপাকে সে এতো হাসিখুশি কখনোই দেখেনি৷ তাদের পরিবারে আপা বেশ খানিকটা উদবাস্তুর মতনই বড় হয়েছে৷ তাদের পরিবার বলছে কেনো? আসলেতো আপার পরিবারেই তার মা আর সে ঢুকে পড়েছিলো। আপাকে মা কখনো খাবারের কষ্ট দেয়নি। পোশাকেরও না৷ তবে কষ্ট দিয়েছে ব্যবহার দিয়ে, ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করে। তাই হয়তো আপা মাহাতাবের প্রতি যেনো এই অন্যায় না হয় তাই খুব স্বচকিত এই ব্যাপারে। মিতার মা বাবা চাচা, ফুফুরাও এসেছিলেন পার্টিতে৷ মিতাকে অপ্সরীর মতো লাগছিলো দেখিতে। মিষ্টি গোলাপি রঙের কাজ করা জর্জেট শাড়িটা যেনো তার গোলাপি দেহের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। মিতার শ্বশুর বাড়ির সবাই বেশ প্রশংসা কিরছিলেন ছেলের জন্য এত সুন্দরী বউ আনায়। কিন্তু তিনি খুব একটা খুশি হলেন না।

বৌভাতের পর মিতাদের দিন কাটছে ফারদিনদের বিভিন্ন আত্মীয় স্বজনদের বাসায় দাওয়াতে গিয়ে গিয়ে৷ ঢাকা ছাড়াও ফারদিনদের সিলেটেও আত্মীয় রয়েছে৷ সেখানেও দাওয়াত রয়েছে। তবে সময় স্বল্পতার জন্য ফারদিনরা যেতে পারছে না। এ কয়দিন ফারদিন বেশ কিছু জায়গায় শপিং করে করেই কাটালো। মিতার সময় কাটছে বিভিন্ন বেসরকারি ইউনিভার্সিটি তে ভর্তির প্রিপারেশন নিয়ে। সে নিজের মাইন্ড ডাইভার্ট করতেই এখন এদিক ওদিক খুঁজছে। অস্ট্রেলিয়ার এক ইউনিভার্সিটিতেও এপ্লাই করেছে শুধু মাত্র ফারদিনের জন্য৷ তবে হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে ফারদিন এখনো ক্লিয়ার করে বলছে না তার চলে যাওয়ার ব্যাপারে। বাসায় এখনো কেউ জানে না৷ মিতা কারও সাথে শেয়ারও করতে পারছে না বিষয়টা। গুমরে মরছে ভিতরে ভিতরে। মিতা ঠিক করলো সেও যাবে শপিং এ ফিরে যাবার আগে ফারদিনকেওতো কিছু দিতে হয়। সে কারও পিছুটান হতে রাজী নয়। এতে তার আত্মসম্মানে যে আঘাত আসবে তা সে সহ্য করতে পারবে না। স্বাভাবিক বৈবাহিক জীবন সবাই চায় তবে ওদের এই আকস্মিক বিয়েটাকে ওরা এখনও মেনে নিয়েও মেনে নিতে পারছেনা। শারীরিক টান থেকে আসা ভালোবাসা আর মায়ার মাঝে যেন এখনো একটা দ্বিধার দেয়াল রয়েই গিয়েছে। মরিচীকার ন্যায় হাতরে বেড়াচ্ছে শুধু।

*****

মাহতাবকে সামান্য আলু গাজরের আর একপিস মাঝের খিচুড়ি খাওয়াচ্ছে মিলা। মা হওয়াটা আসলে কঠিন ব্যাপার। গর্ভে ধারণের চেয়ে বড় করে তোলাটাই কষ্ট সাধ্য। মিলার মাহতাবের প্রতি টান রয়েছে। হয়তো নিজের গর্ভজাত সন্তান নয় তবুও মিলা চায় না আরেকটা মিলা এই পৃথিবীতে তার নিগ্রানীতে বেড়ে উঠুক। তার কাছে যখন সৃষ্টিকর্তা একটা সুযোগ দিয়েছে অতএব তাকে সেই সুযোগের সঠিক ব্যবহার করতে হবে এবং সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে যে জন্মসূত্রেই নয় শুধু মাতৃত্ববোধ আর কর্মসূত্রেও মা হওয়া যায়৷ মা হতে বিশেষ কিছুর প্রয়োজন নেই একটা সুস্থ মন আর মানসিকতা ছাড়া৷ যেমন ফুফু তার জন্য তার মা হয়ে উঠেছিলেন একদিন৷ তেমনি মিলাও মাহতাবকে একটু একটু করে আগলে নেবে। জীবনটাকে সুন্দর করতে নিজেদের ছোট ছোট প্রয়াসই যথেষ্ট৷ এই যে মুহিন রোজ একটু একটু করে নিজেকে মিলার কাছে মেলে ধরছে এটা কি ভালোবাসার প্রকাশ নয়? হয়তো আরও কিছু বছর পর তাদের মাঝেও আর দশটা কাপলদের মতো সম্পর্ক হবে। মান অভিমান, রোজকের টুকটাক খুটিনাটি নিয়ে ঝগড়া খুনসুটি। হয়তো একটা সময় মায়া বেড়ে বেড়ে বিশাল সমুদ্রের আকার ধারণ করবে। মিলার ছন্নছাড়া চিন্তারা পাখা মেলে উড়ে বেড়ায় তাদের এই ছোট্ট বেডরুমটায়৷ হয়তো তখন এই বাসা থাকবে না, বেডরুম থাকবে না, দখিনের জানালাটাও থাকবে না কিন্তু মিলার জীবনে মুহিন থাকবে আর থাকবে মাহতাব। মায়া, আদর, স্নেহ, যত্ন সব দিয়েই সে এক বিশাল আঁচল রাঙাবে।

চলবে।

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-২২

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২২
শাহাজাদী মাহাপারা

ভালোবাসার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হয় কিভাবে? ফারদিনের জানা নেই। তবুও মিতা তাকে ভালোবাসে কি না তা নিয়ে তার দ্বিধা এখনো কাটেনি৷ এইজে সুন্দর তার দেহের উপর লেপ্টে ঘুমাচ্ছে এই রহস্যময়ী নারী৷ আচ্ছা সে কি নারী? বয়সই বা কত তার? মাত্রই তো বিশ। টিন এইজ পার করে এসেছে মাত্র। অথচ তার কথা বার্তা কত স্পষ্ট, তীক্ষ্ণ। প্রত্যেকটা কাজই গোছানো। এবং ভঙ্গুর না। অত্যন্ত শক্ত মানসিকতার মেয়ে, শুধু ধৈর্য কম। এতো বড় ধাক্কা সয়ে গিয়েও সে দিব্যি আছে তবুও ফারদিনের মনে হচ্ছে মিতাকে ঢাকায় ফিরে একবার কাউন্সিলিং এর জন্য নিতে হবে৷ শুধু মিতা না তার নিজেরও যাওয়া উচিৎ। তাদের সম্পর্কটাকে সুন্দরভাবে শুরু করতে চাইলে এইটা প্রথম প্রয়োজন৷ এতে মিতার মানসিক শান্তিটাও ফিরে আসবে৷

গতকালের রাতটা কতটা হেভেনলি ছিলো শুধু ফারদিনই জানে। এই মিতার সাথে আগের মিতার কোনো চেনা পরিচিতি নেই৷ মিতা যেন প্রথমবার খোলস ছেড়ে বেড়িয়েছিলো। কি অদ্ভুৎ মায়াময় একটা সময় কেটেছে তাদের৷ ভালোবাসা সবটুকু নিঙড়ে নিয়ে যেনো দ্বিগুণ হারে ফিরিয়ে দেয়া। ফারদিন মিতার দিকে তাকিয়ে হাসছে। দুপুরে ফিরতে হবে৷ মিতাকে কি এখন জাগানোটা ঠিক হবে? সমুদ্রের ঢেউগুলো যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাদের৷ কত কিছুই তো তাদের একসাথে দেখা বাকি৷ প্রথম দিন দুই তো বৃষ্টি আর অসুস্থতা নিয়েই কাটলো তাদের। ফারদিন ঠিক করলো আবার ফিরবে তার রুস্মিতাকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে তাদের জীবনের মাধুর্যময় সনেট লিখতে৷

*****
মিলা হাঁটছে আইল দিয়ে৷ তার জলপাই রঙা শাড়িটা সবুজ ধানের সাথে একদম মিশে মিশে যাচ্ছে। মিলা হাসছে মুক্তঝরা হাসি। মুহিন বেশ কিছু ছবি তুললো তার। একটা ছোট ছাগলের বাচ্চা মিলার কোলে। কি সুন্দর মুহূর্ত গুলো৷ শিশির পরেছে ঘাসে ঘাসে। মুহিন আঙুল উঁচু করে করে মিলাকে দেখাচ্ছে তাদের ফসলী জমির সীমানা। মিলা দেখছে অবাক চোখে। মুহিন শক্ত করে মিলার হাত ধরে আছে। মাঠের একপাশে বড় একটা গাছে দোলনা বাধা মিলা দৌড়ে দোলনায় গিয়ে চড়লো৷ মুহিনের কি কারো কথা মনে পড়ছে? না। মনে করতে চাইছেও না সে। শুধু মাহতাব বাদে বাকি সবকিছুই পেছনে ফেলে আসা, অপ্রয়োজনীয়। সে শুধু এখন মিলাকে অনুভব করতে চায়। মিলা এখন আর তার কাছে অপরিচিতা নয়। তার সহধর্মিণী, বন্ধু, দোসর,তার তৃপ্তি, প্রাপ্তি এমনকি ভালোবাসাও। ভালোবাসারা সবসময় একই আদলে আসে না মুহিন তা গতকাল রাতের পর মানতে বাধ্য। স্নেহার জন্য তার ভালোবাসা ভিন্ন ছিলো। আর মিলার প্রতি ভালোবাসার মাত্রা ভিন্ন। সে ভেবেছে, মিলাকে নিয়ে। তার ভালোবাসা কি সত্যিই ভালোবাসা? নাকি শুধু মাত্র মিলা মাহতাবকে ভালোবাসে বলেই তাকে সে পছন্দ করে৷ নাকি মিলার প্রতি সিম্প্যাথী থেকেই সে কিছুটা দূর্বল। সে তার যথাযথ উত্তর পেয়েছে৷ রুদ্মিলাকে সে সত্যিই ভালোবাসে। হয়তো সময়ের সাথে তা বাড়বে বা ফিকে হবে কিন্তু নিঃশেষ হবে না। এক অদ্ভুৎ সুন্দর রাত কেটেছে তার৷ মিলার জন্য প্রথম হলেও তার প্রথম ছিলো না৷ অথচ নিজেকে আজ পরাজিত সৈনিক মনে হচ্ছে যে রাণীর কাছে পরাস্ত। এতো ভালোবাসতে জানে মেয়েটা৷ কিভাবে তার মর্যাদা ধরে রাখবে সে চিন্তায় বিভর সে। মিলাকে ছাড়া যে তার এক মিনিটও চলবে না সে বুঝে গিয়েছে। এখন শুধু মৃত্যু বাদে সে তাকে কাছ ছাড়া করতে নারাজ। এই যে তার এথেনা সামনে বসে খিলখিল করে হাসছে প্রাণখোলা হাসি। মিলাকে কখনো এভাবে হাসতে দেখেনি সে।

“কি দেখছেন? এতো দেখলে চোখ ক্ষয়ে যাবে৷”
” যাক৷ অন্ধ হলেও আমি তোমার হাসি খুব করে অনুভব করতে পারবো৷ ”
” খুব ফ্লার্টিং চলছে তাই না? অবশ্য ইউনিভার্সিটি তে তো আপনার পেছনে এর জন্যই আপা সমাজের লাইন লেগে থাকতো। ”
” সে বহু পুরোনো কথা। এখন আমার সবটা জুড়েই একজন। তার আমার স্বামীগত অধিকার ফ্লার্ট করা৷ ”
মিলা হাসছে।
” সত্যি করে বলো তুমি কি হার্ট হয়েছো? এটা সফট ফ্লার্টিং বুঝলে? আসলে সব মেয়েরাই চায় তাদের বড় ম্যাচিউর এন্ড ফ্লার্টিস দুটোই হবে। ”
” বাহ! খুব পিএইচডি করেছেন তাই না মেয়েদের উপর?”
” আরে নাহ৷ আমি বলছি কার আমি মনে হয় সত্যিই একটু রিসার্চ করেছি।ওহ পিএইচডি তে তো রিসার্চই করা হয় তাই না?”
মিলা আবারও হেসে ফেললো। মুহিন চমৎকার মানুষ৷ প্রচন্ড দুষ্টু কিন্তু কাছে না গেলে বোঝার উপায় নেই। এ কদিনে মনে হচ্ছে মুহিন তার পুরোনো স্বত্তাকে ফিরে পেয়েছে। চেহারা থেকে হাসি সরছেই না। মিলার খুব ভালো লাগছে। মুহিন যদি সব ছেড়ে ছুড়ে এখানে কৃষিকাজও করে খায় তাও মিলা সুখী সুখী মুখ করে রোজ তার জন্য খাবার নিয়ে আসবে এই আইল বেয়ে গামছায় বেঁধে। যাহ ওইসব দিন আছে নাকি এখনো! নিজের অদ্ভুৎ কল্পনায় হাসলো সে। সামনের বাড়িটা থেকে কেউ হাত নেড়ে ডাকছে মুহিনকে। মুহিন দেখলো তাদের এক চাচী৷ মিলার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো সে। সে পড়িমরি করে মাথায় আঁচল টানলো।
গ্লাস ভরা ডাবের পানি।
” নতুন ভাবী ডাবের পানি খাও। আজকে আমাদের এই গাছের ডাব সব পাইরা ফেলবো। প্রথম ডাবের পানিটা তোমার।”
মিলা গ্লাস হাতে নিলো৷ এত্তো ভালো লাগছে তার। চাচী বললেন,
” আর কয়দিন আছো বাপ? তুমি চইলা গেলেই ওই বাড়ির হইচই কইমা যাবে। সব নীরব হইয়া যায়। গত দুই বছরতো ফুচ্চিও দেও নাই। তোমার আম্মা কাইলকা নাতিরে নিয়া কত খুশি ছিলো। তোমার বাপেরেও দেখলাম চোখ ভিজা যাইতাছিলো সবার। মাতবর বাড়িতে কতদিন ধইরা এমন আনন্দ হয় না।”
চাচী শাড়ির আঁচলে চোখ মুছলেন। মিলা অবাক হলো৷ তিনি কাঁদছেন কেনো। মুহিনেরও কি মন খারাপ লাগছে? একি তার নিজের চোখেও পানি। না না কান্না করা যাবে না৷

মিলা বললো,
” চিন্তা করবেন না চাচী৷ এখন থেকে প্রায়ই আমাদের দেখবেন। দেখতে দেখতে হাপিয়ে যাবেন।”
সবাই হাসলো। মুহিন মিলার দিকে তাকালো। পরিবেশ হালকা করার মতো গুণও তার বউয়ের আছে।

” চমৎকার বউ পাইছো মুহিন ভাই।”
সবাই আরেক দফা হাসলো।

মিলা ডাবের শ্বাস খেয়ে মুহিনের সাথে সাথে নামলো।

” চলেন বাজারে যাবো৷ আজ ওইখানেই নাস্তা করবো৷ ডিম পোচ, বুটের ডাল, পরোটা আর সাথে হালুয়া এবং গরম এক কাপ মালাই চা। চলবে?”
” চলবে মানে? দৌড়াবে, উসাইন বোল্টের মতো।”

মুহিন হাসলো। তার খুব করে বউকে চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কিন্তু সম্ভব না। মুহিন দৌড়ে উপরে গেলো আবার ফিরলো চাচীদের বাড়ি থেকে চাচাতো ভাইয়ের সাইকেল টা ধার করে নিয়ে।

মিলা সাইকেলের পিছনে বসলো মুহিনের টিশার্ট শক্ত করে ধরে আছে সে৷ মুহিনের কথা বলা থামছেই না। মিলা দুবার তার পিঠে নাক ঘষলো। মুহিন বিরক্ত হলো না৷ হেসে বললো, ” আপনি এমন দুষ্টু হওয়া বন্ধ করুন। নইলে হয় আমি এক্সিডেন্ট করবো নইলে সাইকেল ঘুরিয়ে সোজা বাড়ি যাবো। তারপর সারাদিনে আর রুম থেকে বের হওয়া যাবে না।”
মিলা হেসে কাত৷ চাপড় দিলো মুহিনের গায়ে বার দুয়েক। মুহিনও হাসলো।

মেয়েরা বেশি কিছুতো চায় না৷ লোকে বলে ভদ্র ছেলে রেখে মেয়েরা সব সময় খারাপ ছেলেদেরই মন দেয়। বিষয়টা কি আদৌ এমন? মোটেই না। ম্যাক্সিমাম মেয়েই সম্ভবতঃ ম্যাচিউর বর চায় যে সবার সামনে নিজের পারসোনালিটি ধরে রাখবে। শুধু তার সব দুষ্টুমি,আহ্লাদ আর ফ্লার্ট তার জন্যেই বরাদ্দ থাকবে৷ ব্যস এইটুকুন খায়েশ।

বাজারে খেয়ে মিলারা বাড়ি ফিরলো। ফেরার সময় আরেক বাড়ির চাচী একটা বড় গরুর দুধের বোতল ধরিয়ে দিলো৷

দুপুরের রান্নার আয়োজন চলছে। ফুফুরা এখনো আছেন। আগামীকাল চলে যাবেন। মিলারা যাবে পরশু। মুহিন দুধের বোতল মায়ের হাতে দিয়ে বললো ঘন করে ক্ষীর রাধতে। মুহিনের গুড়ের ক্ষীর খুব পছন্দ৷
মিলা হাত মুখ ধুলো রান্না ঘরের পাশের টিউবওয়েল এর ঠান্ডা পানি দিয়ে। তার শ্বশুর বাড়িতে আধুনিক সবই আছে। কিন্তু পুরোনো কিছুই ফেলে দেয়া হয় নি৷ এই উঠানের এক পাশে বড় উনুন আছে। অথচ গ্যাস সিলিন্ডারও আছে বাড়ির ভেতরের রান্না ঘরে। এছাড়া টিউবওয়েল আছে এমন কি ঢেঁকির মতো বিলুপ্ত প্রায় জিনিসও আছে। আজ কয়েক পদের পিঠা বানাবেন ফুফুরা। তাই ঢেঁকিতে পার দেয়ার শব্দ আসছে। মিলা ঝুকে শাশুড়ির আঁচল দিয়ে হাত মুখ মুছেই ঢেঁকির কাছে ছুটে গেলো। এক উচ্ছ্বল কিশোরী। বড় ফুফু চাল দিচ্ছে ঢেঁকির সামনে আর ছোট ফুফু পার দিচ্ছে। মাহতাব তিন্নি আর কাজিনদের কাছে। মাহতাবের দিনকালও বেশ আনন্দে কাটছে। মিলাও কার্ণিশে উঠে আঁচল কোমড়ে পেঁচিয়ে শাড়ি উঁচু করে উপরে ঝোলানো বাঁশে হাত দিয়ে ঢেঁকি পার দিচ্ছে। মুহিন মিলার অবস্থা দেখে হো হো করে হাসছে।
” রাতে প্রচুর পা ব্যথা করবে দেখে নিয়েন৷”
ছোট ফুফু বললো,
” তুই টিপে দিবি পা। তোকে রাখা হইছে কেন? স্ত্রী সেবা বড় সেবা।”
মিলা আর বড় ফুফু হাসলেন।

মুহিনের খুব আনন্দ হচ্ছে।

চলবে।

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-২১

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২১

শাহাজাদী মাহাপারা

ঠান্ডা সকাল, বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। মিতার ঘুম ভেঙেছে কিছুক্ষণ আগে৷ হোয়াটসঅ্যাপে আপার গতকালের ছবি। মিতা জিজ্ঞেস করেছে এটাই কি তার বৌভাত নাকি? মিতার টেক্সটের কোনো রিপ্লাই আর আসেনি। মিতা আরেকটা টেক্সট দিয়ে ঘুমিয়েছিলো ‘এঞ্জয়’। এরপর মিলার আরেকটা টেক্সট এসেছিলো যা মিতা এখন দেখলো তাতে লেখা, ‘সেইম গোজ টু ইউ।’ মিতা হাসলো ফারদিনের দিকে তাকালো সে উলটো হয়ে ঘুমাচ্ছে। এক হাতে মিতাকে বগল দাবা করে রেখেছে যেনো খাটের নিচে না পরে যায়। তার সাথে এতো ড্রামাটিক বিয়ে না হলে এতোক্ষণে সে ভালোবাসায় গদগদ হয়ে যেতো৷ অথচ ভাগ্যের পরিহাস মনে হয় তার কাছে সব। ফারদিনের সামান্য স্পর্শও তাকে অস্থির করে তোলে। সারাক্ষণ লেপ্টে থাকতে ইচ্ছে করে। আগে এমন ছিলো না৷ ইদানীং এমন হচ্ছে। ফারদিন চলে যাবে ভাবতেই আরও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷

মিতা বৃষ্টির ধারার দিকে তাকিয়ে ভাবছে ফারদিন যেভাবেই তার সাথে সম্পর্ক তৈরি করুক তাতে কি তার সায় ছিলো না? ফারদিনের স্পর্শেতো সে কখনো বাধা দেয় নি। নিজের কাছে সত্যি বলতে পিছপা হওয়া উচিৎ না। ফারদিন কখনো তাকে জোর করেনি। শারিরীক টান থেকেই তার কাছে এগিয়েছে হয়তো ভালোবাসাটা মানসিক বা আত্মিক ছিলো না। কিন্তু শারিরীক যে ছিলো না তা কিন্তু না৷ ফারদিন হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করেনি, কিন্তু সে কেনো বাধা দেয় নি? বাসর নিয়ে অল্প বিস্তর সবারই ফ্যাসিনেশন থাকে মিতারও ছিলো। কিন্তু তার বাসর কি সত্যিই অতটা ম্লান ছিলো? নাহ তার এতে সায় ছিলো এবং অতি অবশ্যই ফারদিনের সংস্পর্শে সেই সময় তার কল্পনার চেয়েও রোমাঞ্চকর ছিল৷ জোর করে করা বিয়েতে সে কি নিজেও আক্রোশের বসেই কাজটা করেছিলো? হ্যাঁ। তার ঘৃণা হয় নি একবারও ফারদিনকে। তখন তার বোধজ্ঞানই ছিলো না। কি আশ্চর্য! ভাবলে তার বিষণ্ণ লাগে। ফারদিনের জন্যও খারাপ লাগে। সেতো মিতাকে জোর করেনি। মিতা স্বেচ্ছায় এগিয়েছে৷ ফারদিনের স্পর্শে সে শিহরিত হয়েছে, উদ্দম ভালোলাগায় ভেসেছে অথচ এরপরের রাত গুলো সে নির্জীব ছিলো। সে সাড়াও দেয়নি বারণও করেনি৷ তবুও ফারদিন তাকে অসম্মান করেনি অন্ততঃ। তারপর ফারদিনের কেয়ার তার প্রতি দিন দিন পাল্লা দিয়ে বেড়েছেই। এই যে এখন তার সাথে সেটে আছে তার কি ভালো লাগছে না? অসম্ভব৷ এর কারণ কি? সে ফারদিনকে ভালোবাসতে শুরু করেছে। এটা শারিরীক ভালোবাসা নয়, এটা মন থেকে আসছে৷ সে রোজ একটু একটু করে মিতার মনে জায়গা করে নিচ্ছে। বয়সে সে মিতার নয় বছরের বড় অথচ এইজ গ্যাপ্টা তার কাছে এখন আর মেটার করছে না৷ রোজ কোনো না কোনো কারণে সে প্রেমে পড়ছে। হয়তো ফারদিন তাকে পোক করে কথা বলে কিন্তু তাতেও সে কষ্ট পায় না। সে নিজেই বা কম কিসে? সেও তো ছুরির মতো ধারালো জবাব দেয়৷
মিতা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সে নিজের লক্ষ্য থেকে সরতে চায় না৷ ফারদিন চলে যাবে এবং সেও নিজের জীবন আবার গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা করবে৷ ফারদিন ভালোবাসলে ফিরে আসবেই। সে জোর করবে না, বাধাও দিবে না৷ সে নিজের পায়ে দাঁড়াবে। সে তার নিজের জন্য যোগ্য হয়ে উঠবে যেনো হীনমন্যতা তার কাছে না আসতে পারে৷ জীবনে আবারও সুন্দর করে বাঁচবে। হয়তো পথে অনেক বাঁধা আসবে কিন্তু সে হাল ছাড়বে না। কিন্তু এখনের মতো যে কদিন ফারদিন কাছে আছে সে কোনোভাবেই এই মুহূর্ত গুলোকে বিষাদ করে তুলবে না। সে নিজের জন্য কিছু অপার্থিব স্মৃতি তৈরি করবে আর ফারদিনকেও কিছু মনে রাখার মতো দিন উপহার দিবে৷ এরপর আর নাইবা দেখা হলো, নাইবা পাওয়া হলো। আফসোস জিয়িয়ে রাখবে না৷

ফারদিন মিতার ঘাড়ে গরম নিশ্বাস ছাড়লো। মিতা টের পেলো তার উষ্ণ চুমু৷ ফারদিন জিজ্ঞেস করলো, ‘ বাহিরে তাকিয়ে কি ভাবছো?’ মিতা উত্তর দিলো না তার হাতটা কম্ফোর্টারের নিচে নিয়ে শক্ত করে ফারদিনের হাত জড়িয়ে রইলো। কাটুক এ কদিন সুখ স্বপ্নের মতো৷

***
আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে ফারদিনরা ফিরে যাবে৷ কয়েকদিনের মধ্যেই সে চলে যাবে তাই সবকিছু গোছগাছ করে নিতে হবে৷ সে আসলে মিতার দিক থেকে সাড়া পাচ্ছে না তাই ভাবছে মিতাকে কিছুদিন একা থাকতে দেয়াই ভালো হবে৷ হয়তো এই সময়ের মাঝে মিতা তাদের সম্পর্কটাকে আরেকটা সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করলেও করতে পারে৷ আর নইলে সে মিতাকে মিতার সর্তে জীবন কাটাতে দিবে। সে পর্যন্ত মিতার দায় ভার তার। ঢাকায় আবার বাবা মা বৌভাতেরও আয়োজন করেছে৷ মিতা যদি শেষ পর্যন্ত তাকে ভালো না বাসতে পারে তখন কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে? অবাক কান্ড ফারদিন নিজে দেশ ত্যাগী হচ্ছে অথচ ভাবছে মিতার চলে যাবার কথা। মিতা চলে গেলে সে কিভাবে থাকবে? আগের কথা ভিন্ন কিন্তু এখন পাশের বালিশে মিতা না থাকলে তার ঘুম আসবে কি করে? মিতার নিশ্চই কিছু বছর পর আবার বিয়ে হবে! মিতা অন্য লোকের সাথে সুখী সংসার করবে৷ সেও কি মিতাকে তার মতো করে মাতাল করে তুলবে রোজ? কি ভাবছে সে এসব! সেও কি বিয়ে করবে না ভবিষ্যতে? তখন! কিন্তু দ্বিতীয় কাওকে কি এভাবে ভালোবাসতে পারবে? মিতা আর তার মাঝেতো কোনো সম্পর্কের তিক্ততা নেই৷ তাদের সম্পর্ক তো শুরুই হয়নি। তাহলে কিভাবে থাকবে সে? যদি বিয়ে করেও একটা রিজন তো লাগবে অন্য জনকে ভালোবাসার। তার কাছেতো কোনো কারণই নেই৷ মিতাকে সে ঠিক অন্যরকম ভাবে ভালোবেসেছে৷ হয়তো জীবনে মিতার পর আরও ভালোবাসা আসবে কিন্তু মিতার মতো করে ভালোবাসতে পারবে না৷ হয়তো ভালোবাসা এমনই৷ সংজ্ঞাহীন। একেক জনের প্রতি একেক ধরনের ভালোবাসা৷

আবল তাবল কত চিন্তা মাথায় ঘুরপাক দিচ্ছে ফারদিনের৷

আজকেও বার্মিজ মার্কেটে লো ঘুরতে গেলো ওরা। কিছু কেনাকাটাও করলো। যদিও মিতা একটু ইতস্ততবোধ করছিলো ফারদিনের কেনা জিনিস নিতে বা ওর অর্থে কেনা জিনিস নিতে। কিন্তু ফারদিন চমৎকার ভাবে সেই পরিবেশটা বদলে দিলো। শাড়ির দোকেনের সামনে দিয়ে যেতেই একটা শাড়ি খুব পছন্দ হলো ফারদিনের ডার্ক কোরাল পিংক৷ চট করে সে শাড়িটা মিতার গায়ে জড়িয়ে দিলো। মিতা প্রথমে অবাক হলো৷ ফারদিন বললো, তোমাকেতো এখনো কিছুই গিফট দেয়া হয়নি। এটা যদি নিতে৷ তাছাড়া তুমি ভেবো না আমার পকেট খালি করলে তোমার আত্মসম্মানে আঘাত আসবে। আসলে আমার পকেট খালি না করাটাই বরং ভুল সিদ্ধান্ত। স্বামীর টাকায় স্ত্রীর সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

এরপর আর হেজিটেশন সাজে না।খুশিমনেই অনেক কিছু নিলো সে। ফারদিনও খুশি হলো মিতার আগ্রহ দেখে। শপিং পছন্দ করে বোঝাই যাচ্ছে। মিতা ফারদিনের জন্যেও একটা হ্যাট কিনলো।

দুপুরে বাহিরেই লাঞ্চ সারলো তারা এরপর বিকেলে বিচে গেলো ঘুরতে। ফারদিনের আগ্রহে তারা হর্স রাডিং করলো। মিতার খুব শখ হচ্ছিলো ঘোড়ার পিঠে চড়ার৷ খুব ছোটবেলায় ফুফারর সাথে চড়ে ছিলো। ফারদিন দেখলো মিতা তাকিয়ে আছে ঘোড়ার দিকে। সে বললো, ” হর্স রাইডিং পারো মিতা? আমি অস্ট্রেলিয়ায় থাকতে শিখেছিলাম।”

মিতা বললো,” খুব ছোট বেলায় ফুফার সাথে যখন আমি, মিলা আপু আর রাহিল ঘুরতে গিয়েছিলাম৷ তখন ফুফা আমাদের হর্স রাইডিং করিয়েছিলেন।”

ফারদিন বেশ কিছুক্ষণের জন্য একটা ঘোড়া ভাড়া নিলো। এরপর মিতাকে সামনে বসিয়ে বিচে ঘুরলো। মিতার মনে হচ্ছিলো ফুফুর ছোট বেলায় বলা ফেইরিটেইলে সেই ঘোড়ায় চড়া রাজা হচ্ছে ফারদিন আর সে তার রাজ্যের রাণী। এতো আনন্দ হলো মিতার মনে৷ ফারদিন মিতাকে শামুকের দুটো চুড়িও কিনে দিলো। মিতা বেশ খুশি মনে সন্ধ্যায় কটেজে ফিরলো। আজও কটেজে ডিনার প্ল্যান আছে৷ আজ সব সি ফুড আইটেম ডিনারে। মিতা শুধু কাকড়াই খেয়েছে সি ফুড বলতে। আজও তাই খেলো। গান বাজনা হলো। রাতে তারা রুমে চলে এলো।

বাথরুমে ঢুলে মিতার আজ খুব ইচ্ছে করলো জাকুজিটায় বসে থাকতে কিছুক্ষণ। মিতা সব গুলো ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে জাকুজিটা ফিল করে বাথরোব পরেই জাকুজিটায় বসলো। এতো আরাম আগে লাগেনি। স্যান্টেড ক্যান্ডেলগুলো যেনো অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে। মিতার রিলাক্সড লাগছে। বাথটাবে গোসলের সৌভাগ্য তার আগে হয়নি। তবে ফারদিনদের বাথরুমে বাথটাব রয়েছে। কিন্তু সে কখনো বাথটাবে সময় নিয়ে বসে থাকেনি। মিতা আরামে ফারদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিলো। ফারদিনেরও যে ফ্রেশ হতে হবে তা বেমালুম ভুলে গিয়ে অর্ধতন্দ্রায় চলে গিয়েছে৷

ফারদিন কয়েকবার নক করলো ওয়াশরুমে। তারা সারা না পেয়ে স্লাইডিং ডোরটা সামান্য খুলে উঁকি দিলো। মিতা জাকুজিতে। বেহুশ হয়ে গিয়েছে ভেবে সে উদগ্রীব হলো। মিতার তন্দ্রা কাটলো ফারদিনের ডাকে৷ ভয় পেয়ে সে ছিটকে সরে গেলো৷ পানি ছিটকে ফারদিনের গায়ে গিয়েও লাগলো।

” কি হয়েছে?”
” তুমি বলো তোমার কি হয়েছে? সময়ের খেয়াল আছে কখন থেকে ডাকছি।”
মিতা মুখের উপরে লেপ্টে থাকা চুল গুলো সরিয়ে বললো, ” ক্লান্ত লাগছিলো তাই একটু চোখ লেগে গিয়েছিলো।”
” বাহ! আর আমি যে ফ্রেশ হবো ভুলে গিয়েছো?”
” সরি। এই জাকুজিটা এতো সুন্দর আগামীকাল তো চলেই যাবো তাই এটার সদব্যবহার করতে চেয়েছিলাম।” হাসলো মিতা। ফারদিন খেয়াল করলো আশেপাশে সেন্টেড ক্যান্ডেলগুলোর ছোট ছোট আলো আর মোহনীয় সুবাস। মাথায় দুষ্টুমিরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলো তার,

” জাকুজির সাইজ দেখেছো? কাপল সুইটে তুমি একা বসেতো আর সব আনন্দ নিতে পারো না তাই না? দাঁড়াও তোমায় এটার আসল ব্যবহার দেখাচ্ছি।”
টিশার্ট খুলে ফারদিনও নামলো তাতে।

মিতার কাছে যেতেই মিতা বসে পরলো৷ সে মিতার গালে কোমল স্পর্শ করলো৷ সে ভেবেছিলো মিতা লজ্জায় উঠে চলে যাবে। মিতা নড়লো না চোখ বন্ধ করেই বসে রইলো৷ ফারদিন শব্দ করেই হাসলো।
” তুমি তোমার জাকুজি বিলাস করো৷ ঠান্ডা লাগলে খবর আছে৷ ”
বলেই উঠে চলে যেতে চাইলো। মিতা ফারদিনের হাত টেনে ধরলো। সে অবাক হলো। মিতাকে জিজ্ঞেস করলো,
” কিছু লাগবে?”
মিতা উত্তর দিলো না৷ ফারদিনকে জড়িয়ে নিলো আলিঙ্গনে।

আকাশ মেঘে ঢাকা আর আবহ মিষ্টি। না চাঁদ রয়েছে, না তারকারাজি৷ মোমের আলোয় মিতার স্বচ্ছজলে ভেসে বেড়াবার আহ্বান কি ফারদিন বুঝতে পারলো?

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-২০

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-২০
শাহাজাদী মাহাপারা

বাড়িতে মেহমানদের আনাগোনা শুরু হয়ে গিয়েছে। মুহিনের বাবা নাতিকে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবারের তদারকিতে ব্যস্ত৷ তার মুখের হাসি এগাল ওগাল হয়ে যাচ্ছে। শেষ কবে সবাই তাকে এতো খুশি দেখেছিলো মনে নেই৷ মাহতাবের জন্য সোনার চেইন, কাপড় সবই এনেছে মুহিনের ফুফুরা। দুই ফুফু মুহিনের এবং দুই মামা, এক খালা। সবাই স্ব পরিবারেই এসেছেন। এতো শর্ট নোটিসে কাছা কাছি গ্রাম হওয়ায় চলে এসেছেন। মুহিন সবাইকে সালাম করছে জরিয়ে ধরছে।ভাতিজা বলতে অন্তপ্রাণ ফুফুরা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন একমাত্র ভাইয়ের ছেলেকে দেখে৷ আহা কি দৃশ্য৷ খালা বুকে জরিয়ে রাখলেন বেশ খানিকক্ষণ। মিলা বুঝতে পারলো মুহিন আসলে খুব ভালোবাসার মাঝে বড় হয়েছে। এজন্যই সে গ্রামের বাহিরে পড়তে যেতে চায় নি। এমন পরিবারতো সবার কাম্য। মাহতাবও নিশ্চই এদের ভালোবাসায় বেড়ে উঠবে। মিলার ভালো লাগছে৷ আত্মীয় স্বজন বাড়িতে আসা যদিও মিলার খুব একটা পছন্দ না। তবে এ বাড়ির সকলেই একটু অন্যরকম। অন্তত মিলার পরিবার থেকে তো ফার বেটার।

আশেপাশের পাড়া প্রতিবেশিরাও বউ দেখে যাচ্ছেন। তার শাশুড়ি কে টিটকারিও করে যাচ্ছেন।

“ছাত্তারের বউ তোমারতো রাজ কপাল। দুই দুইটা বউ আনাইলা বাড়িতে রূপ চেহারায় কেউ কারো চাইয়া কম না।”
” হ তাইতো৷ ইডাতো আগেরটার চাইয়াও সুন্দর।”
” পয়লাডা তো বনে বাদারে পাক পাড়তো ইডা
কিরহম?”
মিলা কথাটা স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও বুঝলো যে স্নেহার ঘুরে বেড়ানোর স্বভাবকে নিয়ে কথা বলছে।

” পাক পাড়তো আবার কি কথা! গ্রামে শহর থিকা বউ আইলে গ্রাম তো ঘুইরা দেখবেই। কি কও ইগিনা? ” বললেন বড় ফুফু।

মিলাকে দুটো শাড়ি উপহার দিলেন তিনি টাঙ্গাইল শাড়ি৷ খুব সুন্দর। মাহতাবের জন্যেও তারা জিনিস নিয়ে এসেছে। এ বাড়ির মেয়েদের বাপের বাড়ি কিছু নিয়ে আসা নিষেধ শশুড়ালয় থেকে তাই ভাইয়ের জন্য কিছুই আনে নি কেউ৷ অথচ ভাইকে তারা খুব ভালো বাসে। মিলা সালাম করতে চাইলে ছোটফুফু বললেন আমরা তোমার মডার্ন ফুফু শাশুড়ি রুদমিলা। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা খুবই ব্যাকডেটেড। তুমি মুখেই সালাম করো।তারিন ফিসফিসিয়ে বললো, “ভাবি ছোট ফুফু কিন্তু স্কুলের টিচার৷ সমাজ পড়ায়।” ফুফুর ইন্টারে থাকতে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু ফুফারা ভালো ফ্যামিলির ছিলো তাই ফুফুকে পড়তে সুযোগ দেয়।” মিলা অবাক হয় তখনকার দিনে মেয়েদের পড়াশোনার বিষয়টা খুব রেয়ার। তবুও সে চমৎকৃত হয়। এ বাড়ির সবাই যে শিক্ষিত তা বোঝাই যায় এজন্যই হয়তো গ্রামে তাদের বেশ কদর। মিলা দেখলো মুহিন দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায় তাকে দেখছে।

মিলাকে সবাই দেখে দেখে যাচ্ছে। বাবা মা কি করে, পড়াশোনা কেমন, ইত্যাদি প্রশ্ন করছে। ছোট ফুফু মিলার জন্য স্বর্ণের আংটি এনেছিলেন তা পরিয়ে দিতে মুহিনকে ডাকলেন। সে ঘরেই ছিলো৷ সামনে এসে আংটি পরালো মিলার অনামিকায়। ফুফু তার মাথায় হাত দিয়ে খুব দোয়া করে দিলেন। মাহতাবের জন্যেও খেলনা, গিফটস এনেছেন তারা। সে দেখলো মিলার কপালে টিপ আছে কিন্তু হাতে চুড়ি নেই। হয়তো তার ভালো লাগেনি ভেবে সে উঠে পড়লো। কিছুক্ষণ পরেই তিন্নির মারফত মিলাকে নিজেদের ঘরে ডাকলো সে। মিলাও ওয়াশরুমের বাহানা করে উঠে রুমে গেলো৷ কিন্তু রুম খালি। খট করে দরজা বন্ধ হবার শব্দে চমকালো সে৷ মুহিন দাঁড়িয়ে আছে। মিলা জিজ্ঞেস করলো, ” এখানে ডাকিবার হেতু কি? ”
মুহিন হাসলো। তার হাতের চুড়িগুলো নাচিয়ে দেখালো। সে মুখ বাঁকালো।

” আমি কাঁচের চুড়ি পরি না।”
” আপনার বাসায় দেখেছি আলনা ভরতি কাঁচের চুড়ি। ”
” ও সব মিতার।”
” মোটেও না।”
” সরুন আম্মার কাছে যাবো৷ মিথ্যা বলে এখানে এসেছি। সবাই কি ভাববে! ”
” কিছুই ভাববে না।”
মিলা দরজার সামনে থেকে মুহিনকে টেনে সরাতে চাইছিলো। কিন্তু সম্ভব হলো না৷ মিলা ৫’২ ইঞ্চির মানুষ ৫’৯” ইঞ্চির মানুষকে টেনেও সরাতে পারবে না৷ মুহিন তার হাত ধরে ফেললো। স্বযত্নে হাতে চুড়ি গুলো পরিয়ে দিলো। মিলার কান্না আসছে৷ অসময়ে আবেগি হওয়া৷ অথচ মুহিন দেখলো তার চোখে হাসি এবং অশ্রু একসাথে চিকচিক করছে৷ সে মিলাকে জড়িয়ে ধরলো ঘন আবেগে। মিলার মনে হলো এ পরম আশ্রয়স্থল৷ এখান থেকে পালাবার আর সুযোগ নেই৷ মিলার কানে কানেই মৃদুস্বরে মুহিন বললো,
” আপনাকে আমার চাই মিলা। আজই চাই, এক্ষুনি সম্ভব হলে আরও উত্তম।” সে কথায় কি ছিলো কে জানে মিলা হাসলো, হাসলো মুহিনও।
” এই মুহূর্তে অসম্ভব স্যার৷ ”
” তবে কখন সম্ভব।”
” জানিন।”

মিলা মুহিনের পেটে আঙ্গুল দিয়ে খোঁচা দিয়েই সরে গেলো। মুহিন যখন ব্যথায় কাতর সে দরজা খুলে দ্রুত পালালো। মিলার কপাল দিয়ে ঘাম বের হচ্ছে। সবাই এখন হাতে চুড়ি দেখে কি ভাববে! যাহ আগে পরলেই হতো৷ ভালো হয়েছে৷ খুব শখ হয়েছিলো না মুহিনের হাতে চুড়ি পরার।

মিলার শাশুড়ি মিলাকে বললো, ” তুমি আর মুহিন উঠানে গিয়ে টেবিলে বসো খেয়ে নাও। বৃষ্টি গতকাল না হলে এখন দেখতা সবাই মেঝেতে কেমন লাইন ধরে বসে খাচ্ছে। বৃষ্টি হওয়ায় এই বন্দবস্ত। তবে আজ সারাদিনই লোকজন আসবে খেতে। ”

মিলা বুঝলো এরা লোকজন ডেকে খাওয়াতে পছন্দ করে খুব। একটা ওকেশন হলেই হলো। সন্ধ্যে পর্যন্ত লোকজন খেতেই এলো এ বাড়ি৷ অনেকে বাড়িতে নিয়েও গেলো খাবার৷ মিলা তার শাশুড়ির ধৈর্য দেখে বেশ অভিভূত হলো।সেও ধৈর্যশীলা তবে তার শাশুড়ির তুলনায় সে কিছুই নয়। অথচ মুহিন আর তিন্নি এতো ছটফটে চঞ্চল। মিলা ভেবেছিলো মুহিন হয়তো গম্ভীর৷ অথচ বাড়ি না এলে বুঝতেই পারতো না মুহিন যে কি দূরন্ত ডানপিটে ছিলো। মাহতাব তার দাদীর মতো শান্ত স্বভাবের হয়েছে। হয়তো আরেকটু বড় হলে বাবার মতোই চঞ্চল হবে। এ দুদিন মিলা মাহতাবকে তেমন করে কাছে পায়নি। সবাই একপ্রকার কারাকারিই করছে তাকে নিয়ে। মাহতাব বেশ মিশুক একটুও বিরক্ত হচ্ছে না। বিগত দেড় বছরে সে আর তার বাবা যতটা একাকীত্বে ছিলো আজ তা সবটাই পূরণ হয়ে যাচ্ছ।

মুহিনের বাল্য বন্ধুরাও এসে দেখা করে গিয়েছে বিকেলে। মিলার নিজেরই এখন ক্লান্ত লাগছে৷ তিন্নি আর সব কাজিনরা মিলে তাকে নিয়ে ঘরে গেলো। মিলা ঘরে গিয়ে চমকালো। এটা কখন করেছে এরা। পুরো ঘরে গোলাপের সুবাস।
তিন্নি রসিকতা করেই বললো,” ভাবি তোমার জন্য ভাইয়ার বন্ধুরা যে বুকি এনেছিলো তা দিয়েই রুম সাজিয়ে ফেলেছি দু দিন গেলেতো তা নষ্ট হবেই এর চেয়ে ভালো কোনো কাজে লাগা৷ তোমার পছন্দ হয় নি বলো? এই ফেইরি লাইট গুলো আমি অর্ডার করেছিলাম দুমাস আগে। আজ যে এতো সুন্দর করে কাজে লেগে যাবে ভাবিনি। দেখো এই সেন্টেড ক্যান্ডেলও অর্ডার করেছিলাম৷ হিহিহি। আমি মনে হয় মনে মনে বুঝে গিয়েছিলাম তোমাদের যে বাসর হবে ।”

সবাই হাসলো তিন্নির কান্ডে।

ঢপ দিতে এই মেয়ে ওস্তাদ। ওইসব ক্যান্ডেল সে গতকালই কিনিয়েছে কাজিনকে দিয়ে বড় বাজারের নাইনটি নাইনের শপ থেকে। রিসেন্টলি ওগুলো এইসব দোকানে পারচেজ করা হচ্ছে। অবশ্য এই দোকানের বর্তমান মালিক সাবের আমিন তিন্নিকে খুব পছন্দ করেন। অন্যরকম পছন্দ। তাই তিন্নি যখন যা বলে তাই কিনে আনেন তিনি। তার দোকানটাও বেশ ভালো ব্যবসা করছে তিন্নির পছন্দের জিনিস আনায়। তাদের কসমেটিকসের দোকানে তিন্নি একবার গিয়েছিলো মেকাপের জিনিস কিনতে পুরোনো দিনের মেকাপ দেখে সে বেশ বকাঝকা করে আসে দোকানিদের। তারপর সেই মালিক নিজেই বাড়ি বয়ে এসে কি কি প্রডাক্ট নতুন পারচেজ করা যায় তা তিন্নির সাথে যোগ পরামর্শ করে নতুন জিনিস দোকানে তুললেন। দ্রুতই ব্যবসায় উন্নতি দেখলেন। তারপর থেকেই তিন্নির জন্য ভদ্রলোকের দূর্বলতা কাজ করে। যদিও তিনি তা মুখে প্রকাশ করতে পারেন না। তিন্নি কিন্তু এতে অখুশি না সেও নব্য তরুণের মনের কথা বুঝতে পেরে আন্দলিত হয়। তারিয়ে তারিয়ে সে তা উপভোগ করে৷ তিন্নি ভেবেছিলো তাদের হয়তো একটাই কসমেটিক্সের দোকান। পরে জানতে পারলো এদের গাজীপুরে, উত্তরায় মিষ্টির দোকান, জুতার শোরুম, গহনার শোরুম, কাপড়ের দোকান, কিচেন এপ্লায়েন্সের দোকান আর গ্রামে দুটো কসমেটিক্স সহ ডেইরি ফার্মও রয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি মেঝজন। ছোটটা এখনো স্কুলে। এলাহি কারবার। তিন্নি একটু দূরত্ব বজায় রাখে তাই। কিন্তু গতকাল প্রয়োজনেই কল করেছিলো। আজ প্রয়োজনীয় জিনিস হাজির৷ ভদ্রলোককে একদিন এক কাপ চা খাওয়ানোই যায়৷

মিলার মন ভালো হয়ে গেলো তিন্নির আয়োজন দেখে। অবশ্য লজ্জাও লাগলো। মুহিন ঘরে আসালো এগারোটায় সবাই গল্প করছিলো মিলার সাথে। মুহিন রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে থমকে গেলো। মিলা বিছানার মাঝে বসা বাকিরা সবাই পাশে গোল হয়ে বসে আছে রুমের চেহারাই বদলে গিয়েছে। সবাই মুহিনের পথ আগলে দাঁড়ালো। টাকা ছাড়া ভিতরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। মুহিন বিনা বাক্য ব্যয়ে গুণে গুণে পাঁচ হাজার ধরিয়ে দিলো। সবাই তা নিয়ে বেশ হাসি ঠাট্টা করলো। মিলাও হাসলো।

মুহিন ঘরে গিয়েই দরজা দিলো। সবাই কান পাতলো দরজায় তবে মিনিট দশেক পরেও যখন কিছু শোনা না গেলো সবাই বিরক্ত হয়ে চলে গেলো। মিলা আর মুহিন তখন জানালার কাছে। মৃদু বাতাসে তার শাড়ীর আঁচল আর চুল উড়ে মুহিনের গায়ে এসে লাগছে। সে এই সুন্দর মুহূর্তটাকে ফোনের ক্যামেরায় বন্দী করলো।চুমু খেলে মিলার কপালের টিপে সহস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো মিলার চেহারা। মিলাকে খুব করে ভালোবাসতে চাইছে সে। কিন্তু কিছু একটা তার মনের দ্বিধার দেয়াল ভাঙতে পারছে না। মিলা কি কিছু বুঝতে পারছে? অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মিলাই এগিয়ে গেলো মুহিনের কাছে। মুহিন ডুব দিলো রুদ্মিলার মাঝে গহীন থেকে গহীনে। আজ ভালোবাসারা ভেসে ভেসে বেড়াক মিলা মুহিনের আকাশ জুড়ে।

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৯

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৯

শাহাজাদী মাহাপারা

আজ সমুদ্র খানিকটা শান্ত। বাহিরে মৃদু বাতাস হচ্ছে। মিতা একটু আগেই বাহিরে থেকে হেটে এসেছে। বেশিদূর যায়নি কটেজের সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলো। গতকালের ঘটনা তেমন মনে নেই। যা মনে আছে সবটাই আবছা। দুপুরের খাবারের পর ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত স্পষ্ট মনে আছে। এরপর যা ঘটেছে সবটাই অস্পষ্ট। এখানের রিসিপশনের লেডির সাথে দেখা হওয়ায় জিজ্ঞেস করলো,” ম্যাডাম এখন কেমন আছেন?”
মিতা ভালো আছি বলে সেখান থেকে সরতে চাইলো। মেয়েটা আবার বললো, ” গতকাল রাতে আপনি অনেকটাই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলেন। স্যার খুব চিন্তায় ছিলেন।”
বিরক্ত লাগলো তার৷ এতো কথা কেনো বলছে স্টাফ হয়ে! বলতেই পারে তারা হয়তো ফারদিনের সাথে পরিচিত৷ ফারদিনের বন্ধুর কটেজগুলোই তো সব৷ তাছাড়া গতকাল রাত কেমন গিয়েছে সেতো ঠিকঠাক জানেই না৷ ফারদিন এখনো ঘুমাচ্ছে। মেয়েটা কি রাতে এখানেই ছিলো, বাসায় যায় নি?

” আমার হাজবেন্ড আর আমি গতকাল নাইট ডিউটিতে ছিলাম। নেক্সট শিফট এলেই আমরা চলে যাবো। ” মেয়েটা কি বুঝে গিয়েছে তার অভিব্যক্তি? আগেই উত্তর দিয়ে দিলো।

“আচ্ছা। আপনাকে ধন্যবাদ। ” বলেই মিতা সামনে হেটে চললো।

গতকাল সন্ধ্যায় ফারদিনের ঘুম ভেঙেছিলো। চা কফির ব্যবস্থা ছিলো এখানে৷ দুকাপ কফি বানিয়ে সে মিতাকে ডেকেছিলো৷ সারা না পাওয়ায় কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ডেকেছে। মিতা কম্ফোর্টার গায়ে টেনে নিয়ে কাঁপছিলো। ফারদিন মিতার কপালে হাত দিতেই ঘাবড়ে গিয়েছিলো। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে সে। থার্মোমিটারের আর মেডিসিনের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলো। মিতাকে ওষুধ দিয়ে মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রাত যত বেড়েছে জ্বরও বেড়েছে৷ মৌসুম ভালো নেই তার উপর এতো রাত যে ডাক্তার পাওয়া দুষ্কর। সারা রাত এক অস্থিরতায় কেটেছে ফারদিনের। রাত তিনটার দিকে মিতার জ্বর নেমেছিলো। তারপর ফারদিন ঘুমিয়েছে। মিতার শুধু মনে আছে যতবার সে চোখ খুলেছে ফারদিনকে পাশে বসে থাকতে দেখেছে।

ফারদিনের ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। নাস্তা করেই তার বের হলো সামনের সমুদ্রটা ঘুরে দেখতে। মিতাও আপত্তি করলো না। তার না নেই কোনোকিছুতেই৷ সারা সকালে তাদের মাঝে যা কথা হয়েছে তা হলো,
” শরীর কেমন এখন?”
” ভালো। ”
” বাহিরে বের হবে?”
” আচ্ছা।”
” তৈরি হয়ে নাও।”

মিতা যা শাড়ি এনেছে তা আর পরে বের হবার মতো না৷ বিয়ের পর তারিনকে দিয়ে কিছু শপিং করিয়েছিলো তাই নিয়ে এসেছে। মাত্র তিনজোড়া সালওয়ার কামিজ৷ একটা জর্জেট বাকি দুটো সুতি। তবে তারিনের পছন্দ ভালো৷ সে জর্জেটটাই পরে নিয়ে বের হলো।

এদিকটা কিছুটা জন মানব শূণ্য। ফারদিন মিতার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে৷ মিতার ভালো লাগছে৷ মৃদু বাতাস৷ তবে সাগরের লোনা পানির গন্ধে একটু অস্বস্তি হচ্ছে। আবার এত বড় সমুদ্র দেখে তাতে একটু পা ভেজানোর ইচ্ছেটাও প্রবল। কিন্তু ফারদিন পানিতে নামতে নিষেধ করেছে। গতকালের মতো ঝামেলা নিতে সে প্রস্তুত না৷ মিতার কি মন খারাপ হয়েছিলো ফারদিনের কথায়?
হয়েছে বটে। তবে স্বস্তিও পেয়েছে৷ অন্ততঃ অসুস্থ স্ত্রী কে হেলা করেনি সে। যথাযথ যত্ন নিয়েছে। মিতা কৃতজ্ঞ৷

ফারদিন বেশ কিছু ছবি তুললো ইন্সটাগ্রামে পোস্ট দেয়ার জন্য। সবাই বৌভাতের দাওয়াত চায় সাথে মিতার সাথে কাপল ছবিও চায়। আগে ফারদিনের বিরক্ত লাগতো। তারিন অবশ্য নিজের আইডি থেকে মিতা আর ফারদিনের বিয়ের একটা চমৎকার ছবি দিয়ে কংগ্রাচুলেশনস জানিয়েছিলো। হাস্যকর একটা বিয়ে ছিলো তবুও বিয়েতো। ছবিটা কিছুটা এমন যে, একটা বড় ওড়নায় মিতা আর ফারদিনের মাথা ঢাকা আর আয়নায় ফারদিন আর মিতার চেহারা দেখা যাচ্ছে। এবং কারো মুখেই হাসি নেই। যদিও ক্যামেরা ম্যান হাসতে বলেছিলো৷ তবে আর যাই হোক বউ বদলালেও বিয়েতে কোনো নিয়মই বাদ যায় নি৷ ব্যস ওই একটা ছবিই তার কাছে আছে। বিয়েটা নিয়ে ফারদিন তিন দিন আগেও এতোটা সিরিয়াস ছিলো না। সে যদিও মা কে ভয় দেখিয়েছিলো মিতাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাওয়ার কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য ছিলো মাস শেষেই চলে যাওয়ার। সে রিটার্ন টিকিট ও করে ফেলেছে। বাসায় এ ব্যাপারে এখনো কেউ জানে না৷
ফারদিন দেশে বিয়ে করতে আসেইনি৷ তাকে জোর করেই আনা হয়েছে৷ সে ভালোবাসতো একজনকে তাকে আনা হয়েছে আরেকজনকে বিয়ে করতে৷ তারপর আবার তার সাথেতো বিয়ে হলোই না হলো বোনের সাথে৷ সেই রাগের রেশ ধরেই সে চলে যেতে চেয়েছে। যদিও মিতার উপর তার একটা বিশাল রাগ ছিলো। বিষয়টা এমন না যে মিতাকে বিয়ে করতে সে গো ধরেছে। সে চেয়েছিলো তার মাকে জব্দ করতে তাই বিয়ে না করে উঠতে চায়নি৷ সে ভেবেছিলো মিলার সাথেই বিয়ে হয়ে যাবে৷ কিন্তু মা যে মিতাকে চেয়ে বসবেন এবং বোকা মিতাটাও যে রাজি হয়ে যাবে তা ফারদিন নিজেও বুঝতে পারেনি। মিতাকে ফারদিনের কাছে স্বার্থান্বেষীই লেগেছিলো প্রথমে। নিজের রাগ কমে যাওয়ার পর ফারদিন বুঝতে পারে আসলে সবচেয়ে বড় অন্যায়টা হয়েছে মিতার উপর৷ তাই মিতাকে সে সব রকম ফ্যাসিলিটিজ দিতে চেয়েছে। মিতা নিজের পায়ে না দাঁড়ানো অব্দি তার সমস্ত খরচ সে বহন করবে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন বিষয়টা ভিন্ন। তার অনুভূতি ভিন্ন। নতুন মিতাকে আবিষ্কার করার নেশায় পেয়েছে তাকে৷ এখন মিতাকে ছাড়া তার চলবে না৷

ফারদিন মিতার দাঁড়িয়ে থাকা, পাড় দিয়ে হেঁটে বেড়ানো কিছু ছবি তুললো৷ তারপর মিতাকে ডাকলো। খোলা চুলের মিতার চুল গুলো সব মুখে এসে পড়লো বাতাসে। ফারদিন আর কথা বললো না। ক্যামেরায় বন্দী করলো সেই মুহূর্ত৷ মিতা ভরকে গেলো। ফারদিনের ইচ্ছে করছে মিতার হাত ধরে সমুদ্রে ডুবে যেতে। বেচারির শরীর ভালো থাকলে আর তাদের পরিস্থিতি অন্যরকম থাকলে অতি অবশ্যই সে তা করতো। কিন্তু এখন সম্ভব না।

মিতা সামনে এগিয়ে গেলো। ফারদিন বুঝলো না কি বলা উচিৎ! সে আমতা আমতা করে বললো, ” চলো কয়েকটা কাপল ফটো তুলি। আসলে আমার আইডির সবাই জেনে গিয়েছে যে আমার বিয়ে হয়েছে। তারিনের কাজ৷ সবাই ছবি চাইছে। তোমার সমস্যা না হলে তুলি? ”

মিতা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

ফারদিন খুশি হলো। মিতাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললো কয়েকটা৷
মিতা জোর করেই মুখ হাসি হাসি করে রেখেছে। তার মন খুলেই হাসতে ইচ্ছা করছে কিন্তু ফারদিন চলে যাবে কথাটা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে৷ এতো ঢংয়ের কি দরকার! দুদিন পর সব ছবি ডিলিট করে বলবে আমারতো ডিভোর্স হয়ে গেছে গাইজ৷
দুপুরে কটাজে ফিরলো তারা। লাঞ্চ সেরে মিতা মিলার সাথে ভিডিও কলে কথা বললো। বাবাকেও ফোন করে কথা বললো। তারিনের সাথেও কথা হলো। তারিন জানালো বাসায় রিসেপশনের জন্য তোরজোর চলছে। বাবা প্রায় জোর করেই অনুষ্ঠান করতে চাইছে৷ তারিনের কন্ঠেও এক্সাইটমেন্ট৷ মিতা মোটামুটি কথা বলে
ফোন রেখে দিলো।

সন্ধ্যায় কটেজের আরও কাপলরা মিলে ডিনার এরেঞ্জমেন্টে গিয়েছিলো। সবাই বেশ আনন্দ করলো। মিতাও পাশের কয়েকজনের সাথে কথা বললো৷ সে সবচেয়ে কম বয়েসী ব্রাইড ছিলো। নরমালি যা কথা হয় তাই হলো। যেমন – বিয়ে লাভ নাকি এরেঞ্জড? ভাইয়া কি গিফট দিয়েছে ফার্স্ট নাইটে? ফ্যামিলির সাথে এডজাস্টমেন্ট কেমন? বিয়ের পরপরই হানিমুনে কি না? মিতা হাসলো। এটা কি হানিমুন তাহলে তাদের? খুবই ফানি ব্যাপারটা। মিতা যতটা না কথা বললো তারচেয়ে বেশি সবার কথাই শুনলো। কাপলরা সামিয়ানার লাইটিং এর নিচে সুন্দর কিছু ছবি তুললো৷ ফারদিন মিতারও তোলা হলো। এক কপি ছবি সেখানের একটা বোর্ড রয়েছে রিসিপশনে সেখানে টাঙানো হবে।
ডিনার সেরে ওরা কটেজে ফিরলো।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৮

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৮
শাহাজাদী মাহাপারা

মুহিনের ঘুম ভাঙলো ভোরে। ডান হাতটা অসার হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কয়েকটা ভারী ভারী পাথর দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছে কেউ। নাকের কাছে কিছু খুচিয়ে যাচ্ছে লাগাতার। পা দুটো নাড়াচাড়া করার চেষ্টায় কিছুর সাথে ধাক্কা খেলো। পা! কাথার নিচে পা! ভয়ে সিটিয়ে গেলো সে। নাকের কাছের চুল গুলো বা হাত দিয়ে সরিয়ে উঠে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হতেই সে বুঝলো ওই পা টা মিলার। আস্তে করে ডান হাত টা তার মাথার নিচে থেকে বের করে বিরক্ত হয়ে তাকালো। কিছু দেখা যাচ্ছে না৷ বাহিরে এখনো খানিকটা অন্ধকার। তবে বিরক্ত হতে পারলো না। একটু দূরে সরে গিয়ে স্পেস তৈরি করে মিলার দিকে মুখ করেই শুয়ে রইলো। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। সে এতো কাছে এসে কখন শুয়েছে? শীত করছে বলেই হয়তো শুয়েছে। ঘুমের মাঝেই শুয়েছে নাকি সজাগ ছিলো?
মুহিনের ঘুম আর এলো না। কিছুক্ষণ পর যখন মোরগ ডাকার আওয়াজ এলো মুহিন বুঝতে পারলো মা উঠে মোরগ ছেড়েছে৷ বাহিরেও খানিকটা ফর্সা হয়ে এসেছে। উঠে জানালা খুলে দিলো সে। গ্রিলের ফাঁক গেলে সূর্যের নরম আলো এসে পড়লো মিলার মুখে। সকালের সতেজ বাতাসটাও প্রাণ ভরে ভিতরে নিয়ে নিলো মুহিন। বিগত দু বছরে এই নির্মল বাতাস তার ফুসফুসে প্রবেশ করেনি। সে মিলার দিকে তাকালো। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। মুহিনের বিশাল অবাক লাগলো। তার প্রেম পাচ্ছে। মিলার সাথে এখন দুষ্টুমিতে মাততে ইচ্ছে হচ্ছে। তার বয়সের সাথে এটা মানায় না। সে গাম্ভীর্য কে নিজের বাসন বানিয়ে এসেছে আজীবন। এমনকি মাহতাবের মায়ের ক্ষেত্রেও সে কখনো এমন অনুভব করেনি। এর পেছনের কারণ কি? গতকাল রাতের ঘটনা? তাহলে এর মানে কি দাঁড়ায়? মিলা তাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এমন অনুভব করার জন্য! স্নেহার সাথে তার সম্পর্ক ভালোবাসার ছিলো অবশ্যই৷ তাদের মাঝে শারিরীক টান ও ছিল উদ্দম। তাদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও ছিলো ভালো। সব দিক দিয়েই পারফেক্ট ছিলো। সেইম এইজ হওয়ায় রেস্পেক্ট ও ছিলো দুজনের মাঝে। তাহলে কি ছিলো না? এখন বুঝতে পারছে কি ছিলো না? মানুষের মানসিকতার তারতম্য। সেই একই মুহিন কিন্তু স্নেহা আর মিলার ক্ষেত্রে তার ব্যক্তিত্ব ভিন্ন। কেন? মিলা আর তার মাঝে সম্মান, খুনসুটি আর মতের ভিন্নতা আছে। কিন্তু আন্ডারস্ট্যান্ডিং ও আছে। মিলা আনপ্রেডিক্টেবল। আর স্নেহা ছিলো মিলার অপজিট৷ তার কাছে খুনসুটি করাটা খুবই হাস্যকর মনে হতো। বাচ্চামো মনে হতো। স্বাভাবিক, প্রতিটা মানুষের চিন্তা ধারা ভিন্ন। তবে সে স্নেহার সাথে কখনো আনহ্যাপি ছিলো না। হতে পারে অতিরিক্ত আন্ডারস্ট্যান্ডিংই তাদের মাঝে একটা গ্যাপ ক্রিয়েট করেছে। সে জানেনা আসলে এত সুন্দর সংসার রেখে কেনো স্নেহা চলে গিয়েছে। তবে সে স্নেহাকে কখনো অসম্মান করেনি। মিলার আর তার মাঝে ৬ বছরের গ্যাপ। হয়তো এ জন্যই মিলার মাঝের যে চাইল্ডিশ ভাবটা রয়ে গিয়েছে তা তাকে আকর্ষণ করে। আরও একটা জিনিস হচ্ছে, মিলার ক্ষেত্র বিশেষে গাম্ভীর্য ধারণ করা। জানেনা মুহিন। এখন, এই মুহূর্তে শুধু এতটুকু জানে সে, মিলাকে হারানো যাবে না৷

মিলার ঘুম ভাঙলো তিন্নির ডাকে৷ চোখ খুলে দেখে তিন্নি চা হাতে দাঁড়িয়ে ডাকছে৷ সে উঠে বসে তিন্নির হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে হেসে বললো, ” এইসব বেড টির অভ্যাস আমার নেইগো। তুমি আর কষ্ট করোনা। আমাকে তোমার ভাই ডেকে না দিয়ে পালিয়েছে কই?”
তিন্নি হাসলো। গতকালও ভাবি খানিকটা গম্ভীর ছিলো। সম্ভবত নতুন নতুন অস্বস্তিবোধ করছিলো৷ আজ কি সুন্দর কথা বলছে। অথচ ভাই বললো ভাবিকে বেশি জ্বালাতন না করতে৷

” ভাবি দ্রুত চা খেয়ে রেডি হও। আজ আশেপাশের মহিলারা সহ আমাদের আত্মীয়রাও দেখতে আসবে তোমাকে। নাস্তা করে মায়ের রুমে যেও মা ডেকেছে।”
” আচ্ছা। তোমরা খেয়ে নিয়েছো?”
” না। শুধু ভাই, বাবা খেয়েছে আমি আর মা তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।”
” আচ্ছা আমি এক্ষুণি আসছি।”
মিলা চা পান করেই বিছানা ছাড়লো দ্রুত।

রান্না ঘরে যেতে যেতেই দেখলো উঠানের এক পাশে বিশাল বড় বড় হাড়ি আনা হয়েছে৷ মিলা রান্না ঘরে গেলো।
” আম্মা, এইগুলো কি করবে?”
মিলার শাশুড়ি হাসলেন। মাহতাব তিন্নির কোলে।
” নাস্তা করো বউমা। ইডি তোমার শশুর আনাইছে। তার নাতি প্রথম আসছে বাড়িতে৷ আর আত্মীয় স্বজন আসবে বাড়িতে নতুন বউ আছে বাড়িতে। ভোজ দিবে, ভোজ।”
” এতো আয়োজন? ”
” ভাবি এটাতো যেই সেই বাড়ি না। তুমিতো গ্রামের পঞ্চায়তের মাথাদের একজনের বাড়ির বউ। আর এই গ্রামে আমাদের মোটামুটি একটা রেপুটেশন আছে।”
” তা গতকালই বুঝতে পেরেছি। ”
মিলা নাস্তা শেষ করে জিজ্ঞেস করলো তাদের কোনো সাহায্য লাগবে কি না?

” তুমি আমার সাথে আমার ঘরে আসো।”
মিলা তার শাশুড়ির পেছন পেছন গেলো। তার শাশুড়ি আলমারি খুলে দুইটা বড় বড় বাক্স বের করলেন। তিন্নিও পেছন পেছন এলো।
” এই খানে দুই জোড়া কানের দুল, গলার হার আর বালা আছে। একটা চেইন আছে তোমার দাদী শাশুড়ির৷ তিনটা আংটি আছে। তুমি শহরে থাকো৷ আর আমাদের জানায় আসো নাই। নাইলে আমি নতুন কইরা কিছু বানায় আনতাম। তুমি দেখো তোমার পছন্দ মতো কোনটা নিতে চাও। আগামীবার আসলে নতুন গয়না গড়ায় দিমানি৷ এইখান থিকা তোমার পছন্দ মতো রাখো। বাকিগুলো তিন্নির জন্য।”

মিতা তার শাশুড়ির বিচক্ষণতা বুঝলো। তিনি দুটো জিনিস খেয়াল করবেন এখানে৷ লোভ এবং ত্যাগ। মিতা এতো ইমপ্রেসড হলো তার শাশুড়ির কান্ডে। তার চোখ দুটো চকচক করে উঠলো।
এইটা হেরেম পলিটিক্স। জোরাজোরি নেই। স্বেচ্ছায় সমার্পণই জিতে যাওয়ার মূলমন্ত্র।

মিলা গয়নাগুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো৷ হাত দিয়ে ছুয়ে দিলো। তার ঠোঁটের কোনে হাসি৷ সে বড় গলার হারটা নিলো এবং সাথে সাথে তা পরে ফেললো, একটা আংটি পরলো অনামিকায়, ছোট ঝুমকাটা কানে পরলো আর একজোরা বালা নিলো যেটা পাতলা ছিলো। তারপর আয়নার সামনে গিয়ে বললো, “আম্মার এটার সাথে একটা সুন্দর বেনারসি হলে ভালো হতো।আমি যে শাড়ি আনি নি বেশি।”

মিলার শাশুড়ি হাসলেন। তার পুত্রবধূ যে চৌকস তা দেখে তিনি খুশিই হলেন। মিলা বললো, “আর কিছু লাগবে না আম্মা। আমি চেইন পরি না। তাছাড়া এইটাতো দাদীর এটাতে তিন্নির হক বেশি।”

তিন্নি হাসলো, ভাবি ভারি হারটা বাগিয়ে বাকি সব দিয়ে দিয়েছে।
এখন যদি সে নিজে বেশি নিয়ে তাকে কম দিতো তাহলে পরবর্তীতে আম্মার সাথে ভাবির সম্পর্ক ভিন্ন হতো। ভাবির জন্য মনে খুতখুতি থেকে যেতো। নতুন ভাবি তিন্নিকে কতটা যত্ন করবে তার উপর নির্ভর করে আম্মা তাকে কতটা যত্ন করবেন। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘেও ভয়৷ আগের ভাবি যদিও গহনা নিতে চান নি৷ তার কাছে এগুলো ব্যাকডেটেড গহনা আর তিনি ভারি কিছু পরতেন ও না এলার্জি হতো। তবে মিলা ভাবি খুব বুদ্ধিমতি মানতেই হবে৷ এছাড়াও গ্রামের সবাই দেখতে আসলে নতুন বউকে কি দিলো শাশুড়ি তা নিয়েও কথা হবে৷ সবার আগে গলার হারই চোখে পরবে।

“বেনারসি আনতে পাঠিয়েছি মুহিনকে। বাড়ির নতুন বউ লোকে দেখবে শাড়ি না হলে হয়?”
তিনি মিলার হাতে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে বললেন, ” বউমা অনেক লোকই আইবো বাড়িতে৷ তুমি কারও কথায় কিছু মনে করবা না৷ সংসারে থাকতে গেলে অনেক কথাই এক কানে হুইন্না আর কান দিয়া বাইর কইরা দিতে হয়।” মিলা তার শাশুড়ির ইংগিত বুঝে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরলো। এ যেন পরম ভরসার হাত৷

মাহতাবকে কোলে নিয়ে নিজের রুমে গেলো সে। গালে, কপালে চুমু খেলো। মিতাকে কল করলো তার খোঁজ নিতে। এরপর মাহতাবের কাপড় বের করে তিন্নির কাছে দিয়ে এলো। তিন্নি তাকে গা মুছিয়ে রেডি করে দিবে বলেছে। তিন্নির বড্ড আদরের মাহতাব। রুমকির কথা মনে পড়ে গেলো তার৷ সে দ্রুত ভিডিও কল করলো ফুফুকে।

মিলার কন্ঠে উচ্ছ্বাস শুনে রুমকির মন জুড়িয়ে গেলো। তার চোখের কোণে আনন্দ অশ্রু। বেশ খানিকক্ষণ গল্প করে মিলা তৈরি হতে গেলো।

মুহিন ফিরেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো৷ মিলার জন্য শাড়ি কিনতে গিয়েছিলো। সুন্দর একটা লাল আর মেরুন রঙের মিশেল টাঙ্গাইল পাড়ের শাড়ি আর কয়েকটা সুতি শাড়ি কিনেছে৷ এর মধ্যে আম্মা আর তিন্নির জন্যও আছে৷ আজ বহুদিন পর সে শপিং করেছে বাড়ির সবার জন্য।

মায়ের ঘরে গিয়ে সব দিয়ে মিলার শাড়ি নিয়ে ঘরে চলে এসেছে।
মিলা ছাদ থেকে নেমে ঘরে এসে দেখে মুহিন ব্যাগ খুঁজছে৷ মিলা জিজ্ঞেস করলো,” কি খুজছেন?”
” হ্যাঁ! ব্যাগ।”
” কাপড় সব আলমারিতে রেখে দিয়েছি ব্যাগ থেকে বের করে।”
মিলা গিয়ে আলমারি খুলে ট্রাউজার আর টিশার্ট বের করে দিলো।

“আপনাকে জিজ্ঞেস না করেই আপনার আলমারি ধরেছি। তিন্নি বলেছে সব বের করে গুছিয়ে রাখতে তাহলে বার বার ব্যাগ টানতে হবে না।”
” খুব ভালো করেছেন। আমি নিজেই বলতাম।”
” আমার বেনারসি কোথায়?”
” বেনারসি? ”
” আম্মা নাকি বেনারসি আনতে পাঠিয়েছিলো আপনাকে?”
মুহিন প্যাকেটটা খুলে মিলার হাতে দিলো।
লাল রঙের শাড়ির পাড়টা চোখে লাগছে৷ এইলোক সব ক্যাটক্যাটা রঙ দেখে৷ শাড়ি পুরোটা খুলে মিলা খুশি হলো৷ খুব সুন্দর শাড়ি দুটো রঙ মেশানো টাঙ্গাইল পাড়ের শাড়ি। মোটা চওড়া পাড়। এটার ম্যাচিং ব্লাউজ আছে তার কাছে ভাগ্যিস।

” আমি বেনারসিই আনতে গিয়েছিলাম। তবে আপনি তো আমাদের টাঙ্গাইলের শাড়ি পরেন নি কখনো। বা পরলেও এখন পরাটা ভিন্ন ব্যাপার তাই এনেছি৷ আর আপনাকে এই শাড়িটায় খুব ভালো লাগবে দেখবেন৷”

মিলা হাসলো। সে শাড়ি,গহনা পরে তৈরি হয়ে সামনে বিছানায় বসার জন্য প্যাকেট সরাতেই, প্যাকেটে আরও কিছু আছে বুঝতে পারলো। লাল কাচের চুড়ি, টিপের পাতা। মিলার এতো আনন্দ হচ্ছে কেনো? অদ্ভুত তো! মুহিনকে জড়িয়ে ধরতে মন চাচ্ছে৷ দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে বাহিরে তাকিয়ে দেখলো মুহিন রান্নার কাজ তদারকি করছে৷ মিলা চুড়ি গুলো পরলো না৷ যে বোকার মতো লুকিয়ে রেখে গিয়েছে, সেই পরাবে।

চলবে…