Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 124



ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৭

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায় ‘
পর্ব-১৭
শাহাজাদী মাহাপারা

রুদ্মিলার অনার্স শেষ করে মাস্টার্সের জন্য ভর্তি হয়। সকলেই এবার তাকে বিয়ে দিতে উঠে পরে লাগে। মিলা নিজেও আর মানা করে না। রুদ্মিলার বাবার ফুফাতো ভাইয়ের ছেলে ফারদিন।ফুফুর বড় ঘরে বিয়ে হয় এবং তারা ইন্ডিয়া চলে যান সেখান থেকে লন্ডন। এবং তাদের সাথে যোগাযোগও কমতে থাকে যুদ্ধের পর আর যোগাযোগ থাকে না৷ রুদ্মিলার বাবা তখন অনেক ছোট৷ এবং ছোট চাচার জন্ম হয় তার দু বছর পর। সে ফুফাতো ভাইয়ের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিলো রুমকি বেগমের শশুরের। লতায় পাতায় আত্মীয় বলা চলে। সেই সুবাদেই রুদ্মিলার সাথে ফারদিনের বিয়ে ঠিক হয়৷ এরপর রুদ্মিলার শরীর দিন দিন ভেঙে পরতে থাকে। রুমকি বেগম জোর করেই রুদ্মিলাকে ডাক্তারের কাছে নেন। চিকিৎসার পর জানতে পারেন রুদ্মিলার জরায়ু বাচ্চা বহনে অক্ষম৷ তার জরায়ু একটা সুস্থ জরায়ুর তুলনায় আকারে ছোট। রুদ্মিলা বিয়ে করতে চায় নি। রুমকি বেগমও বিয়ে দিতে চান নি সবাইকে না জানিয়ে। রুদ্মিলার এহেন অবস্হার কথা জেনে রুমকি বেগম ভেঙে পরেন৷ তার এত আদরের ভাতিজির কপাল যে তার মতন হবে ভেবেই তার দেহ শিউরে ওঠে। তিনিই জানেন সে রাতে তিনি হাসানাত সাহেবের বুকে পরে কেমন হাউমাউ করে কেঁদেছেন আর জানেন রুদ্মিলার ফুফা। এরপর রুস্মিতার মা রুদ্মিলাকে আত্মহত্যার হুমকি দেয় এবং রুমকি বেগমকেও তিনি রুদ্মিলার মাথার কসম খাওয়ান। এক বিশাল নাটকের পর রুদ্মিলা নিজেই রুস্মিতার শাশুড়ি মায়ের কাছে চিঠি পাঠায়। এবং বিয়েতে বর যাত্রী আসার পরই সে এই চিঠি পাঠানোর ব্যবস্থা করে৷ তারপর এই কথা জানবার পর যা হওয়ার তাই হয়৷ রুদ্মিলা জানতো ভদ্রমহিলা এই বিয়ে হতে দিবেন না। কিন্তু মাঝখানে বলির বকরা যে রুস্মিতা হবে এটা সে ভাবতে পারে নি। এবং ফারদিনও যে বিয়ে না করে আসর ছেড়ে উঠবে না এটাও সে ভাবতে পারেনি।
তারপরের ঘটনা খুব সহজ। মিতাকেও নিজে সহ বাবা এবং মিলাকে বিষ খাওয়ানোর মতো ব্ল্যাকমেইল করে তাদের মা। এবং মিতাকে বিয়েতে বাধ্য করে৷ বোকা মিতাটাও রাজি হয়ে যায়৷ এরপরের দিন সকালেই ফুফু কোথা থেকে যেনো মুহিনকে ধরে নিয়ে আসেন এবং মিলার সাথে গাটছাড়া বেঁধে দেন। মিলা শুধু জিজ্ঞেস করেছিলো ফুফুকে মুহিন তার বিষয়ে কতটা জানে? ফুফু বলেছিলেন, গতকাল মুহিন তার বিয়েতে এসেছিলো। এবং পুরো বিষয়টাই তার কাছে পরিষ্কার। এরপর আর মিলা কিছুই বলতে পারেনি। তাকে যতক্ষণ সাজিয়েছে সে হয়তো সজ্ঞানেই ছিলো না। কবুল বলার পর তার হুশ ফিরেছে। এরপর সই স্বাক্ষর করে সে বিকেলের মধ্যে মুহিনের স্ত্রী হয়ে গিয়েছে, মাহতাবের মা হয়ে গিয়েছে।

বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ হলো। মাহতাব তার ফুফুর সাথে খেলছে। মিলা বারান্দায় চেয়ারে বসে সামনের বন্যার পানি আর সুন্দর সূর্য ডোবা সন্ধ্যা দেখার আনন্দ উপভোগ করছে। আর ফেলে আসা সময় গুলো নিয়ে ভাবছিলো। দুপুরের খাবার খেয়ে মুহিন বের হয় আশেপাশে ঘুরতে। মিলাকেও বলেছিলো তার সাথে যেতে। কিন্তু তার মা বারণ করেছে৷ নতুন বউ বাড়ির বাহিরে প্রথম দিন এসেই টই টই করলে ভালো দেখায় না৷ আগামীকাল সকালে সবাই এসে দেখে যাবে বউ এরপর ঘুরে বেড়াক যত খুশি৷ তাই মিলাকে ছাড়াই সে বের হয়েছে৷ মিলাকে এক কাপ চা পাঠিয়েছে তার শাশুড়ি। এই বাড়িতে দুজন কর্মী আছে স্বামী স্ত্রী সন্তান সহই পেছনের ঘরে থাকে। আর মুহিনের বাবার গরুর ফার্ম আছে। ধানি জমি, পুকুরে মাছ চাষ হয়। মুরগিরও ফার্ম আছে। তার শাশুড়ির হাত ভালো। তিনি যা বুনেন তাই ফলে। এই যে ছাদে গিয়েছিলো বিকালে গোসল সেরে কাপড় নাড়তে। ছাদে ডালিম, পেয়ারা গাছ। লেবু, বেগুন, মরিচ, ঢেড়শ,লাউ, চিচিঙ্গা আরও কিছু সবজির গাছ দেখে সে অবাক হয়েছে। তিন্নি মিলাকে দেখে বলল, “ভাবি এইগুলা সব আম্মার লাগানো। আম্মার হাতে সব হয়। ভাইয়ার হাতও এমন।
আম্মার এই গুণটা ভাইয়া পেয়েছে৷”

মিলা হাসে তিন্নির কথায়৷ তিন্নিও মিতার মতো ছটফটে। তিন্নিকে বেশ ভালো লেগেছে মিলার৷ নরম চেহারার দূরন্ত মেয়ে। মিতার চেহারায় একটা নরম ভাব আছে কিন্তু তিন্নির চেহারায় মায়া আছে। মিতার চেহারায় নমনীয়তা আছে।

রাতের খাবারের পর মুহিন রুমে এসে দরজা দেয়। মিলা আজ ঘরে একাই। মুহিন একটু অস্বস্তি বোধ করলো।
” মাহতাব কোথায়?”
” আব্বা আম্মার কাছে।”
” নিয়ে আসি। ”
” দিবে না। আমি চেয়েছিলাম। তারা আজ রাত এবং আগামী কয়েকদিন তাদের নাতির সাথেই থাকবেন বলেছেন। ”
“ও। কিন্তু মাহতাব তো আমাকে ছাড়া ঘুমায় না।”
মিলা একটু হাসলো।
” আপনার পুত্রকে কেউ কিডন্যাপ করতে চাইলে জোরও করা লাগবে না। সে এমনিতেই চলে যাবে। ঘুমন্ত রাজকুমার৷ তার দাদীর সাথে ঘুমাইতে কোনো সমস্যা নেই৷ সে ঘুমিয়ে কাঁদা।”
“ওহ৷ ঠিকাছে।”
মিলার মাথায় দুষ্টামির ভূত চাপলো। সে চুল খুলে চিরুনি করলো। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পাশ ফিরে তাকালো মুহিন তখনো দরজার সামনে দাঁড়ানো। সে হাতের উপর ভর দিয়ে কাত হয়ে শুয়ে মুহিনকে বিছানায় চাপড় দিয়ে ইশারা করলো। মুহিন ঢোক গিললো মিলার আচরণে। তার কাছে এই মিলা অপরিচিত, খুবই। মুহিন মিলার দিকে তাকিয়ে ধীরে বিছানায় গিয়ে বসলো। মিলা উঠে তার খুব কাছে গিয়ে বসলো৷ মুহিন মিলার চোখের দিকেই তাকিয়ে আছে এক ধ্যানে। তার চোখ হাসছে৷ অদ্ভুত সে হাসি। মিলার চিকন ঠোঁটে সে হাসি এতো মহোনীয় লাগছে যে মুহিনের ভেতরের সব বেসামাল হতে চাইছে। মিলা উঠে মুহিনের কাঁধে হাত রেখে উঁচু হয়ে তার চুলে হাত বুলালো।
তারপর আচমকা প্রায় চিৎকার করেই বললো, ” একি আপনার দেখি চুল পাকতে শুরু করেছে৷ ওহ নো! এতো দ্রুত? ” বলে সে দূরে সরে গেলো। মুহিন ভ্যাবাচেকা খেয়ে মিলার দিকে তাকালো।
” আপনি এখন থেকে স্ট্রেস কম নিবেন৷ খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে ঘুমিয়ে যাবেন যলদি৷ তারপর দ্রুত ঘুম থেকে উঠে হাটতে যাবেন রোজ। আপনার তো চুল পেকে গিয়েছে, সর্বনাশ!”
” যলদি ঘুমাতে হবে৷ হ্যাঁ! হ্যাঁ! তাই তো দ্রুত ঘুমাতে হবে৷ মুহিন বিছানা থেকে নেমে টেবিলের উপর রাখা গ্লাসের পানি ঢক ঢক করে গিলে আবার বিছানায় এসে কোনো দিকেই তাকালো না। দ্রুত বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লো।” নিজের চুল তার নিজের ছিড়তে ইচ্ছে হচ্ছে৷ ইশ!

মিলাও আর কিছু না বলে চুপ করে পাশ ফিরে শুয়ে পরলো।
তার পেট ফেটে যাচ্ছে। হাসি চাপতে কষ্ট হচ্ছে৷

রাতে আরেকদফা বৃষ্টি হলো৷ পাশের ঘরের টিনের চালে বৃষ্টির ঝম ঝম শব্দটাও এঘরে শোনা যাচ্ছে। মিলার ঘুম ভেঙে গেলো৷ মিতার কথা মনে পড়ছে। কক্সবাজারে এখন মিতা,ভালো আছে। ফারদিনের সাথে দুপুরে কথা হয়েছে। মিতার জন্য এই মুহূর্তে এই রিফ্রেশমেন্টটার দরকার ছিলো। তার নিজের জন্যেও দরকার ছিলো।

মুহিনের কাছে সে কৃতজ্ঞ। তার উচিৎ এই সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাকে একটা সুযোগ দেয়া। মাত্র তো কয়েকদিন কিন্তু মাহতাবের সাথে সে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গিয়েছে৷ হয়তো মা না হতে পারার দুঃখ থেকেই সে মাহতাবের প্রতি কনসার্ণ। মুহিন না থাকলেও তার চলবে কিন্তু মাহতাবকে ছাড়া কি করে থাকবে? ওই টুকু বাচ্চাকে বুকে নিয়ে নিয়ে ঘুম পাড়ায় সে। অসম্ভব! তাই মাহতাবের প্রতি টান থেকেই হোক আর মুহিনের প্রতি ভালো লাগা থেকেই হোক মুহিন আর তার এই সম্পর্ক কে তার নতুন করে সাজাতে হবে। সংসারটা এবার গুছিয়ে নিজের করে নিতে হবে৷

মিলার শীত শীত অনুভূত হচ্ছে। সে পাশে তাকিয়ে দেখলো মুহিন কাথা গায়ে শুয়ে আছে। এ ঘরে তিন্নি দুষ্টু একটাই কাথা দিয়েছে৷ মিলা নিজের পা দুটো ধীরে ধীরে মুহিনের কাথার নিচে আশ্রয় দিলো। মুহিন পাশ ঘুরে তাকে কাছে টেনে কাথার নিচে নিয়ে এলো। শক্ত করে জড়িয়ে রইলো। মিলার দম বন্ধ হবার জোগাড়। কিছুক্ষণ পর সে মুহিনের হাত তার হাতের উপর থেকে সরিয়ে কোমড়ে রাখলো। নিঃশ্বাস আটকে আসছিলো এতোক্ষণ। পরীক্ষা করে দেখলো মুহিন জেগে আছে কিনা৷ মুহিনের শ্বাস প্রশ্বাসের ওঠা নামা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে গভীর ঘুমে তলানো৷ সেও ঘুমিয়ে গেলো কিছুক্ষণের মাঝেই।

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৬

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৬
শাহাজাদী মাহাপারা

বৃষ্টি বাড়ছে। সমুদ্রে উত্তাল বড় বড় ঢেউ৷ ভিজে যাচ্ছে মিতা। ফারদিন বারান্দায় তাকিয়ে দেখলো মিতা বৃষ্টির ছাটে ভিজছে। ঘরের আলো কমিয়ে ফারদিন বারান্দায় এলো নিঃশব্দে। মিতার কাঁধে হাত রাখতেই মিতা চমকে গেলো। ফারদিন অবাক হলো মিতা তাকে ভয় পায়? এতটা?

” ভিজছো কেনো? তোমার এমনিতেই শরীর ভালো নেই।” ফারদিনের কন্ঠে উৎকন্ঠা কি মিতা টের পেলো?

” এই শরীর নিয়ে প্লেনে করে কক্সবাজার চলে আসতে পেরেছি তাই ভিজলেও সমস্যা নেই।” মিতার কন্ঠ গম্ভীর। মিতার চোখে মুখে বৃষ্টির ছাট। পড়নের শাড়ি ভেজা। এইখানে এসেও তাকে শাড়ি কেনো পরতে হবে? রিল্যাক্স হবার জন্য এনেছে তাকে। সুন্দর। ফারদিনের মাথায় হঠাৎ সুন্দর শব্দটা বেজে উঠলো। মিতাকে সত্যিই সুন্দর লাগছে। মিতা অনেক সুন্দর। এতে কোনো সন্দেহ নেই। আশ্চর্য! মিতাকে নিয়ে ভাবছে ফারদিন? মিতাকেতো কখনো ওই চোখে দেখেনি সে? দেখে নি? কিসব আবল তাবল ভাবছে সে? মিতা! তার স্ত্রী, অর্ধাঙ্গিনী। মিতার দেহের এমন কোনো বাঁক নেই যেখানে তার ঠোঁটের স্পর্শ নেই। মিতার কায়ার রহস্যের আদি অন্ত ফারদিন কবেই উন্মোচন করেছে। অথচ তবুও কেনো মনে হচ্ছে তখন কিছু একটা ছিলো না। মিসিং ছিলো কোনো একটা পার্ট। মিতার মন! মিতার মনের অলিগলিতেতো ফারদিন ছিলো না। সেটাই মিতাই কি ফারদিনের মনে ছিলো? এখন দিন রাত মাথায় শুধু মিতা ঘোরে। মিতার প্রতি সে কনসার্ণ এটা তো অসত্যি না। সে কি মিতাকে ভালোবাসে? যাহ! এতো দ্রুত? এত দ্রুত প্রেমে পরা যায়! ভালোবাসা যায়? কই ফারদিনের তো প্রেম আগেও ছিলো তখন তো এত দ্রুত সব ঘটে নি। শারিরীক টানের জন্যই কি মিতাকে তার এতো কাছের মনে হচ্ছে? নাতো। কিন্তু এই সুন্দর মুহূর্তে তো ফারদিন মিতার দেহের প্রতি কোনো মোহ পাচ্ছে না৷ তার চিন্তা হচ্ছে মিতাকে নিয়ে, তার সুস্থতাকে নিয়ে, শারিরীক, মানসিক দুটোই৷ মিতার মনে কি চলছে? এতো গম্ভীর হয়ে কথা বলাটাও ফারদিনের মনে আঘাত করছে৷ মনে হচ্ছে কেউ একশোটা সুই বিধিয়ে দিয়েছে তার মনে৷ কি ভাবছে সে এগুলো! পাগল হয়ে যাচ্ছে নাতো!
ফারদিন নিজের মাথার চুল টেনে ধরে বারান্দার বাহিরে চলে গেলো। মিতা আবার সামনে ফিরে সমুদ্রের দিকে মনোযোগ দিতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। ফারদিন সাথে সাথেই ফিরে এসে মিতাকে কাছে টেনে অধর বন্দী করলো। এই তৃষ্ণা মিটবে কিভাবে? মিতার নিজের কোনো বোধই রইলো না৷ ফারদিনের ডাকে তার দেহ সাড়া দিতে শুরু করেছে। আগে যেমন লাশের ন্যায় পরে থাকতে পারতো। এখন পারছে না। পারে না। তবে তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। মিতাকে ছেড়ে হঠাৎ ফারদিন আঙুল উঁচিয়ে চিৎকার করে বললো দ্রুত চেইঞ্জ করো৷ আর শাড়ি পরবে না৷ বলেই রুম থেকেই বের হয়ে গেলো। মিতা বোকার মতো চেয়ে রইলো।

ফারদিন ফিরলো ঘন্টা খানেক পর। এতক্ষণ সে বাহিরে বসে ছিলো। বাসার সবার সাথে কথা বলেছে। মুহিনকেও ফোন করে তাদের গন্তব্যের কথা জানিয়েছে। মিলার প্রতি এখন আর তার কোনো কিছুই নেই। রুমে এসে সে দেখলো মিতা ঘুমাচ্ছে বিছানায়। সালওয়ার কামিজ পরা। ফারদিন নিজেও চেইঞ্জ করে নিলো। বিছানায় গিয়ে শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মিতা এতো দূরে শুয়ে আছে যে আরেকটু নরলেই পরে যাবে মেঝেতে। ফারদিন মিতাকে টেনে আনলো না। সে নিজেই এগিয়ে গেলো মিতার কাছে৷ কম্ফোর্টারের নিচে৷ এক হাত মিতার উপরে দিয়েই বিছানায় আটকে বেড়িকেট বানালো৷ এখন মিতা পরবে না৷ মিতার ঘুমের দীর্ঘশ্বাস টের পাচ্ছে সে। পেটের উঠা নামাও টের পাচ্ছে। এখানে নিশ্চই কিছুদিন পর আরও একজন থাকবে৷ আরে কিসব ভাবছে সে! নিজের কপাল চাপড়ে মিতার কানে চুমু খেলো। এরপর ডুব দিলো ঘুমের দেশে। বাহিরে থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। ভেতরেও থেমে থেমে ভালোবাসারা উড়ে বেড়াচ্ছে।
*****

শরীরে আর এক ফোঁটাও বল নেই। এতো ক্লান্ত আগে কখনো লাগে নি রুমকি বেগমের। হাসানাত সাহেব এতোক্ষণ পাশেই ছিলেন। জানালা দিয়ে কন্যা সুন্দরী আলো এসে পড়েছিলো রুমকি বেগমের মুখে। সমস্ত মুখে চুমু খেয়েছেন হাসানাত সাহেব বেশ কয়েকবার। এতো সুন্দর পুরুষ রুমকি বেগম আগে কখনোই দেখেন নি। তার একান্ত ব্যক্তিগত এই মানুষটাকে নিয়ে তার অহংকার করতে ইচ্ছে হয়। একটু আগেই হাসানাত সাহেব উঠে গিয়েছেন তার কাছ থেকে। তিনি ভেবেছেন রুমকি বেগম ঘুমিয়ে গিয়েছেন সম্ভবতঃ। কিন্তু তিনি জেগেই ছিলেন। বিগত কয়েকদিনের কথাই তিনি ভাবছিলেন৷ ভাবতে ভাবতে পেছনে ফেলা আসা বহু স্মৃতিই তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে।

মিতার ফুফু রুমকি বেগম। তিন ভাইয়ের এক মাত্র অতি আদরের ছোট বোন। আদরেই বড় হয়েছেন সবার৷ প্রথমে বড় ভাবি, তার পর ছোট ভাবি, শেষে মেঝো ভাবি এলেন। জীবন পরিবর্তন হলো৷ ভাইয়েরা আলাদা হতে শুরু করলো। রুমকি কলেজে ভর্তি হলো বাবা মাও গত হলেন। রুমকির দায়িত্ব এখন কে নিবে? বাবার গ্রামে তেমন জমি জমা ছিলো না৷ শুধু ভিটে মাটি টাই ছিলো। আর ঢাকায় এক তলা বাড়ি আর একটা বিপণী বিতান। শাড়ির দোকান।
ছোট ভাই সারাদিন টই টই করে ঘুরে বেড়াতেন৷ তেমন একটা কাজ করতেন না। তার শখ হলো গরুর ফার্ম দেয়ার। তাই যখন সব কিছু ভাগ হলো তখন দেখা গেলো গ্রামের জায়গা টুকু ছোট ভাই পেলেন। এখনের বাড়িটা গেলো মেঝো ভাই এর হাতে। আর বড় ভাই ইন্টারের পরেই বাবার সাথে দোকানে বসায় বাজারের বড় দোকানটা তার আন্ডারে গেলো। আর রুমকি বেগমের জন্য কিছু রইলো না। এটা নিয়ে তিনি অবশ্য তেমন ভাবেনও নি। আদরে বড় হওয়া রুমকি তখন এতো সব কিছু বুঝতেন না। তারপর ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেন যখন তার ভাবিরা তাকে বোঝা ভাবতে শুরু করলেন। রুমকির দায় ভার অবশেষে গিয়ে পড়লো মেঝো ভাইয়ের কাঁধে। রুমকির মেঝো ভাবির বয়স বাকি দুই ভাবির থেকে কম ছিলো। মেঝো ভাই বিয়ে করেছিলেন একটু দেরিতে অল্প বয়সী মেয়ের সাথেই। রুমকির থেকে ভাবি দু তিন বছরের বড় হওয়ায় ভাবির সখ্যতাও একটু বেশি ছিলো বাকি ভাবিদের তুলনায়। এরপর মেঝো ভাইয়ের ঘরে এলো মিলা। রুদ্মিলাকে ভাবির চেয়ে বেশি রুমকিই পেলেছেন। রুদ্মিলা নামিটাও তার দেয়া। অন্য কোনো ভাইয়ের সন্তানদের প্রতি তার এতো টান নেই যতটা রুদ্মিলার জন্য আছে। ভাবি হঠাৎ একদিন স্ট্রোক করেন। এরপর ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে যান। মিলার বয়স তখন চার , ভাবিকেও সামলানোর কেউ নেই। তাই ভাবির বাবা মা ঠিক করেন ভাবির ছোট বোনের সাথে আবার মেঝো ভাইয়ের বিয়ে দিবেন। প্রথমে রাজি না হলেও যখন রুমকির জন্য বিয়ের ঘর আসতে শুরু করে তখন তাকে সব দিক বিবেচনা করে রাজি হতেই হয়৷ ভাবি কথা বলতে পারতেন না৷ ইশারায় বোঝাতেন৷ নতুন দম্পতি হোক ভাইয়ের দ্বিতীয় বিয়ে তবুও তো নতুন৷ তাদের কথা বার্তা, খুনশুটি আর ভাবির বোনের ভাবির প্রতি কিছুটা অবহেলা৷ সব মিলিয়ে ভাবিও হয়তো বেশিদিন সহ্য করতে পারেন নি৷ জীবনের মায়া ত্যাগ করে মিলাকে ফেলে চলে যান৷ তারপরের বছরই রুস্মিতা আসে। সময় সময়ের মতো পার হয়ে যায় আর রুদ্মিলাও রুমকির কাছেই বড় হতে থাকে৷ তখন রুমকি বেগম বড় ভাইয়ের দোকানে যান একদিন। একটা নতুন শাড়ি নিতে যেনো ইউনিভার্সিটির ফাল্গুণের অনুষ্ঠানে পরতে পারেন। শেষ বর্ষ চলছে তার। বড় ভাই অবশ্য শাড়ি দিতে চান নি। রাগ করে যখন রুমকি বেগম চলে আসছিলেন তখন তাকে কেউ একজন পিছু ডাকে৷ রুমকি বেগমকে ভদ্রলোক তার হাতে থাকা ব্যাগটা দিয়ে বলেন আপনি এটা কিছুক্ষণ রাখতে পারবেন? আমি সামনের দোকানে যাবো কাজটা সেরেই চলে আসবো। আপনিতো ওই শাড়ির দোকানেরই লোক তাই না? রুমকিও বোকার মতো মাথা নাড়ে৷ এত সুদর্শন পুরুষ কি সে আগে দেখেছে? ছোট ভাই ও সুন্দর কিন্তু এতোটাও না। বোকা রুমকি ব্যাগ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঘন্টা খানেক। তারপর বিরক্ত হয়ে তা দিয়ে আসতে যায় দোকানে। যার নেয়ার সেখান থেকেই নিয়ে যাবে। কি মনে করে যেনো রুমকি ব্যাগের ভেতর উঁকি দেয়৷ একটা বাসন্তি রঙের সিল্ক শাড়ি। তাতে একটা ছোট চিরকুটও রয়েছে৷ তাতে লেখা এই চিরকুট যে প্রথম খুলে পড়বে শাড়িটা তার। বোকা রুমকি আরও বোকা হয়ে রইলো। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে শাড়িটা নিয়ে দোনামোনায় ভুগলো৷ অবশেষে শাড়িটা পরার চিন্তা করলো। তার নিজেস্ব শাড়ি নেই। আগের অনুষ্ঠান গুলোতে মেঝো ভাবির শাড়ি পরতো। এখন তো সেগুলোও জবর দখল হয়েছে৷ রুমকি শাড়ি নিয়েই বাড়ি ফিরলো। এরপর ফাগুণ গেলো, চৈত্র গেলো, বোশেখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ় গেলো, শ্রাবণ এলো সাথে শাড়ি কিনে দেয়া ভদ্রলোকও এলেন৷ হাসানাত সাহেব এক সন্ধ্যায় সবাই কে অবাক করে দিয়ে রুমকির মেঝো ভাইয়ের বাড়িতে এলেন তার মাকে নিয়ে। রুমকি বেগমের খেলছিলেন তখন রুদ্মিলার সাথে কোলে রুস্মিতা। ভাই এসেছে ভেবে দরজা খোলে রুমকি। চমকে যান দরজার ও পাশের দুজনও। রুমকি তাদের ঘরে বসতে দেন। আপ্যায়ন করেন। রুমকির মেঝো ভাই বাড়ি ফিরে খানিকটা অবাকই হন। সিমেন্ট, রডের বিজনেস আছে হাসানাতদের ছেলে শিক্ষিত সুদর্শন৷ আর রুস্মিতা রুমকির মেয়ে না এটাও জানতে পারে হাসনাত। তারপর একদিন সব ভাইয়েরা মিলে অতি আদরের এবং অতি বোঝার বোন কে বিদায় করেন বাড়ি থেকে। রুদ্মিলা দেখতে দেখতে ছয় বছরের হয়ে যায়৷ স্কুলে ভর্তি হয়। তারপরের বছর রুমকিও বিদেশ যান বরের সাথে ফিরেও আসেন। ব্যবসা বৃদ্ধি হয় হাসানাত সাহেবের। খবর আসে রুমকি বেগম অন্তসত্তা। তারপর মিসক্যারেজ, রুমকি বেগমের আর মা না হতে পারার সংবাদ, রুমকির মিলাকে দত্তক নিতে চাওয়া। মিলাকে নিলে রুস্মিতাকে কে পালবে সেই চিন্তায় মেঝো ভাবির ঘুম হারাম হওয়া এবং অবশেষে মেঝো ভাবির গো এর কাছে মেঝো ভাই হার মেনে মিলাকে রুমকি বেগমকে দিতে না চাওয়া। সবটাই তার চোখে ভাসে এখনো। তবুও হাসানাত সাহেব একজন আদর্শ পুরুষ ছিলেন। তিনি এক ফাল্গুণে দেখা রুমকির হাত এতো বছরেও ছাড়েন নি। বিবাহিত জীবনের সপ্তম বছরে এসে শূন্য কোল ভরাট হয় রুমকি বেগমের। এক পুত্র সন্তানের জন্ম দেন তিনি। তারপর সব জায়গায় তার কদর বাড়তে থাকে। শ্বশুর বাড়ি, বাপের বাড়ি সব জায়গায়। রুদ্মিলাও খানিকটা অবহেলায় আর অনেকটা ভালোবাসায় বড় হতে থাকে।ছোট রুস্মিতা এবং তার পরে আসা সকলে ছাড়া বাকি সবাই জানে মিলার মা আসলে তার মা নয়। এ কথা মিলা নিজেও জানে৷

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৫

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৫
শাহাজাদী মাহাপারা

একটা লোহার গেটের ভেতরে ঢুকলো তারা। বিশাল বড় উঠান। ভিজে গিয়েছে বৃষ্টিতে। মুহিন তিন্নি বলে দুবার ডাকতেই ঘর থেকে একটা মেয়ে দৌঁড়ে বারান্দায় এসে দাড়ালো।
মা, মা বলে ডাকতে লাগলো তিন্নি। তিন্নি কাদার মাঝেই হেঁটে এসে মাহতাবকে জাপটে ধরলো মিলার কোল থেকে। মিলা তিন্নির দিকে তাকিয়ে হাসলো। মিলাকে দেখে তিন্নি কিছু বললো না৷ ভিতর থেকে তিন্নির মা বের হয়ে দেখলেন বাহিরে মুহিন দাঁড়ানো। তিনি তিন্নিকে সবাইকে নিয়ে ভিতরে আসতে বললেন৷ মিলা বুঝতে পারলো। সবাই মুহিনের উপর কিছুটা অভিমান করে আছে। খুব স্বাভাবিক। মুহিন এত কিছুর পরেও তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেনি৷ স্নেহার সাথে ডিভোর্সের পরেও না। সে অনুতপ্ত ছিলো৷ কিভাবে তাদের সামনে এসে দাঁড়াবে বুঝতে পারেনি। তবে তারা তো পরিবারই ছিলেন। তাদের মুহিনের সমব্যথী হবার কথা ছিলো। হয়তো ইচ্ছেও ছিলো৷ তবে দূরত্ব মুহিন নিজেই তৈরি করেছে। এবার সম্ভবতঃ সব ঠিক হয়ে যাবে।
ভিতরে গিয়ে মিলা তার শশুর কে দেখলো সাদা পাঞ্জাবী পরা একজন বৃদ্ধ লোক৷ মেহেদি দেয়ায় লাল রঙের দাড়ী। মিলা ঘোমটা আরেকটু টেনে তাকে সালাম করতে নিলো। তিনি গমগমে কন্ঠে বললেন, পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে না৷
মিলা, মুখে হাসি নিয়েই আসসালামু আলাইকুম আংকেল বললো। তিন্নি ফিক করে হাসলো।
” আংকেল আবার কি কথা তুমি আমার ছেলের বউ। আব্বা ডাকবা।” মিলা মুহিনের দিকে তাকালো। মুহিন মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মিলা ঘাড় কাত করে, “জ্বি আব্বা” বললো।
মিলা মাহতাব কে তিন্নির কোল থেকে নিয়ে তার শশুরের কোলে দিলো। তিনি বললেন, ” আমি হাত ধুইয়া আইসা ধরি। ”
মিলা হাসলো, ” হাত ধুতে হবে না৷ কিচ্ছু হবে না৷ বাচ্চাদের ইমিউনিটি অনেক শক্তিশালী থাকে৷”

মাহতাব তার দাদার দাড়ী দেখে অবাক হলো৷ খুশিও হলো। সে তা টেনে ধরে খেলছে। মুহিন তার বাবাকে সালাম দিলো।
” রেস্ট নাও আসতে বহু কষ্ট হইছে তোমার৷ বহুদূর থিকা আসছো৷ কয়দিনের জন্য আসছো?”
” পাঁচদিনের ছুটিতে আসছি।”
” ভালো। মুহিনের মা বউরে ঘরে নিয়া যাও।”
মুহিন লাগেজ নিয়ে তার ঘরের দিকে গেলো৷ সব আগের মতোই আছে৷ তিন্নি নতুন চাদর বের করে বিছানা ঝেড়ে বিছিয়ে দিলো৷ মুহিন উত্তরের জানালা খুলে দিতেই ঘরে হুরমুরিয়ে বাতাস ঢুকলো। পাকা বাড়ি৷ বেশ বড় সর। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকাতেই মিলা বুঝতে পারলো মুহিন কেনো বন্যার কথায় হাসছিলো। বাড়ি ধানী জমি থেকে অনেকটা উঁচুতে৷ তিন্নি পানির গ্লাস আর মিষ্টি নিয়ে ঘরে এলো তাদের মা ও এলেন পিছনে। বিছানায় বসে দেখলেন মিলাকে। মিষ্টির বাটি থেকে মিষ্টি মুখ করালেন দুজনকেই। তিন্নি খানিকটা সরিষা তেল নিয়ে মাহতাবের চাঁদিতে দিয়ে দিলো। একটু মিষ্টি নিয়ে তার মুখেও দিলো। যদিও মাহতাব তা খেলো না মাড়ি দিয়ে চিবিয়ে ছিবড়ে করলো৷ ওর কান্ড দেখে সবাই হাসলো।

” তোমার নাম কি?”
মিলা তাকালো তার শাশুড়ির দিকে।মুহিনের এত রূপ এই মহিলার থেকেই পাওয়া তাহলে।
মিলার হাতে একজোড়া স্বর্ণের বালা পরিয়ে দিলেন মুহিনের মা। সাইজে কিছুটা বড় হলো।
” মুহিন যখন হইছিলো তখন আমার শাশুড়ী এই বালা গুলা দিছিলো। তোমার শরীর ভরলে তখন পইরো। তখন হাতে লাগবে।” মিলার মন খারাপ হয়ে গেলো। মুহিন লক্ষ্য করলো।
” ওকে তোমার কাছে রেখেই যাবো কিছুদিন মা৷ তুমি খাওয়ায় দাওয়ায় মোটা বানায় ফেলবা৷ ঢাকায় তো খায়ই না৷ চড়ুইয়ের মতো খায়৷ ” মুহিনের মা কথা বলতে নিলেই মুহিন ইশারায় মাথা নাড়ে। তিনি বুঝতে পেরে বলেন,আচ্ছা।

মিতারা কক্সবাজার যখন পৌঁছালো তখন সেখানে তিন নম্বর বিপদ সংকেত জারি করেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। ফারদিনের বন্ধুর বাবার এখানে টুরিস্ট এন্ড লজের বিজনেস রয়েছে৷ সমুদ্র সৈকত থেকে কিছুটা দূরত্বে একটা কটেজে তারা উঠলো। আগামী দুদিন তারা এখানেই থাকবে। মিতা, ফারদিন যদিও বিয়ের পর হানিমুনে যায়নি কোথাও। তবে এটাকেও মধুচন্দ্রিমা বলা যায় না। মিতার সাথে দুজোড়া ঘরে পরার সালওয়ার কামিজ আর তিনটা শাড়িই রয়েছে। চেক ইন করে ভিতরে গেলো তারা। মিতার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে। গতকাল রাত থেকে শুধু সুপ্যের উপর বেঁচে আছে। এখন সলিড খাবার পেটে না পড়লে সত্যিই শরীর খারাপ করবে। মিতা ঘড়ি দেখলো ১:৪৫ বাজে। শাওয়ার নেয়া উচিৎ। রুমে গেলো তারা৷ দরজা খুলতেই একটু অবাক হলো মিতা। রুমটা আসলে হানিমুন কাপলদের জন্য। ফারদিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অফ সিজন বলে ভেবেছিলো ঝামেলা কম হবে। স্বস্তির শ্বাস নিতেই বন্ধুর কাছে হেল্প চেয়েছিলো। কখনো কারো থেকে কিছু ফরমায়েশ করে না ফারদিন৷ এই প্রথম। বন্ধুও বিটকেল। যেই শুনেছে বউ নিয়ে যাবে হানিমুন সুইফট বুক করেছে।

মিতা রুমে ঢুকলো সুন্দর সেন্টেড ক্যান্ডেলের স্মেলে মন ভালো হয়ে গেলো তার। বারান্দা থেকে সোজা তাকালেই সমুদ্রের উত্তাল ঢেউ দেখা যাচ্ছে। সমুদ্রের লবণাক্ত স্মেলটা যদিও তার ভালো লাগছে না। তবুও ঢেউ গুলো যেনো তার মন কে অন্যরকম অনুভূতি দিয়ে যাচ্ছে। মিতাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফারদিন বললো, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। ওরা কিছুক্ষণের মধ্যে লাঞ্চ রুমেই দিয়ে যাবে।”
মিতা লাগেজ থেকে ড্রেস বের করে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকেও সাগর দেখা যাচ্ছে। বাহির থেকে ভিতরে যদিও দেখা যায় না তবে ভেতর থেকে বাহিরে দেখা যাচ্ছে। একটা ছোট্ট জাকুজিও রয়েছে। মিতার খুব ইচ্ছে হলো জাকুজিতে নেমে দেখতে। কিন্তু ফারদিনও ক্লান্ত তারও ফ্রেশ হতে হবে ভেবে সে দ্রুত শাওয়ার নিয়ে বের হলো। মিতা বের হতেই ফারদিন ওয়াশরুমে গেলো। সেও চমকে গেলো৷ কটেজটা যে বেশ আধুনিক এতে সন্দেহ নেই। ভাগ্যিস পে করতে হচ্ছে না। বিয়ের গিফট। নইলে দারুণ ভাবে পকেট খসতো। ব্যাপারটা ভেবেই হাসি পেলো তার।

দুপুরের লাঞ্চ রুমেই দিয়ে গেলো। লাঞ্চ সেরে মিতা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। এত কিছুর মাঝে সে ঠিক মতো কিছু খেতে পারলো না। ফারদিন খেলো সব৷ ওর সম্ভবত খুব ক্ষুধা ছিলো পেটে।

মিতা মিলার ফোনে কন্টেক্টের চেষ্টা করলো তবে বৃষ্টি আর নেটওয়ার্ক দূর্বল হওয়ায় আর কথা হলো না।

ফারদিনের আর ১৩ দিন পর ফ্লাইট। যদিও ফারদিন কাওকে কিছু জানায় নি। আরেক মাস পরই যেতে চেয়েছিলো তবে এমন মন পরিবর্তন হবার কারণ ওর জানা নেই। ও ব্যাপারটা জেনেছে ফারদিন যখন কলে কারও সাথে কথা বলছিলো এই বিষয়ে তখন।

তবে এখন তার একটাই চিন্তা ফারদিন চলে গেলে তার কি হবে?
সে তো ওই বাড়িতে থাকতে পারবেনা। তাহলে কোথায় যাবে? বাবার বাড়িতেও যাবে না। তবে? ফুফুর বাড়িতে? হ্যাঁ সেটাই একমাত্র সেইফ প্লেস তার জন্য। তারপর সে কোনো ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে কয়েকটা টিউশন যোগার করে নিজের খরচ নিজে চালিয়ে নিতে পারবে৷ কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির টাকা এই মুহূর্তে তার নেই আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেয়ার প্রিপারেশন ও তার নেই৷ তাহলে? টাকা? এই মুহুর্তে তার কাছে কাবিনের আট লাখ টাকাই রয়েছে। কি মনে করে এতো টাকা কাবিন করেছিলেন ফুফা তার জানা নেই। তবে এইগুলোই তার শেষ সম্বল এখন। প্রাইভেটেই ঢুকতে হবে৷ ওয়েভারের এপ্লিকেশন করতে হবে৷ এতে কিছু খরচ বেচে যাবে আশা করা যায়। তারপর বাকিটা দেখা যাবে৷ জীবন খুবই নিষ্ঠুর৷ এতো দ্রুত এইসব সহ্য করতে হতো না হয়তো। সারাজীবন আপা আর বাবা মায়ের ছত্রছায়ায় কাটিয়ে দেয়া মিতা আজ কিভাবে একাকী জীবন পার করা যায় তা নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।

আচ্ছা এই যে মানুষটা, ফারদিন৷ মিতার কি একবারের জন্য তার প্রতি কোনো অনুভূতি আসে নি? জোর করেই হোক আর যেভাবেই ফারদিনের স্পর্শ কি একবারো মিতার মন কে আন্দোলিত করেনি? একবারো ভালো লাগায় ভাসতে ইচ্ছে করেনি তার?

ফারদিন! তার মনে কি চলছে? সে কি কখনো ব্যাকুল হয়েছে মিতার জন্য? তার সকল স্পর্শই কি শারিরীক আকর্ষণ ছিলো শুধু? কখনো কি ভালোবাসা ছিলো না তাতে? ফারদিন কি চলে যাবে তাহলে মিতাকে ছাড়া? দূরে, বহুদূরে যেখানে মিতার কোনো স্মৃতিই ফারদিনের আর মনে পরবে না? এভাবেই কি ফারদিনের জীবন থেকে মিতার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে? মিতাই কি ফারদিনকে আর মনে রাখবে?

মাথায় আবল তাবল কত কিছু ঘুরছে তার এই মুহূর্তে।

চলবে…

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৪

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৪
শাহাজাদী মাহাপারা

” আমি জুথিকে বিয়ে করতে রাজি হই না। স্নেহার কথা বাড়িতে জানাই৷ বাবা বেদম রাগ করেন। তারপর মায়ের অনেক বোঝানোর পর বোঝেন। স্নেহার সাথে কথা বলি। স্নেহার বাবাও রাজি হন৷ এরপর বিয়ে। স্নেহাদের আত্মীয় বলতে কেউ ছিলো না। ব্রোকেন ফ্যামিলিতে বড় হওয়া স্নেহা মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের পর মা লন্ডনে সেটেল হন। আর বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর বাবা বাকি সন্তানদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। হাস্যকর হলেও সত্যি জানো স্নেহা কিন্তু তার বাচ্চার সাথেও তাই করেছে যার ভিক্টিম ও নিজে। ”
মিলার মুহিনের জন্য খারাপ লাগলো।

” আপনার তাহলে এখন বয়স কত?”
” কত হতে পারে আন্দাজ করোতো?”
” চৌত্রিশ,পয়ত্রিশ?”
” ডেং৷ আমার এখন ৩১ বছর রানিং৷ তুমি হিসেবে অনেক কাঁচা।”
” জি না। আপনি নিজের হুলিয়া আর ভূড়ির এমন অবস্থা করেছেন যে আপনাকে বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক মনে হয়।” মুহিন নিজের পেটের দিকে তাকালো।
” আগে ছিলো না এটা। অনিয়মের জন্য এই অবস্থা। এখন থেকে ঠিক হয়ে যাবে দেখো।” মিলা মুহিনের কথার অর্থ উদ্ধার করে মুখ ভেঙালো।

” তারপর কি হলো?”
“বিয়েতে খুব একটা লোক জানাজানি হলো না। খুব সাদামাটা বিয়েই হলো। এরপর স্নেহাকে নিয়ে আমরা গ্রামে চলে এলাম। স্নেহা তো গ্রামের বাড়ি জীবনে প্রথম দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলো। উচ্ছ্বল কিশোরীর মতো দাপিয়ে বেড়ালো। মা হারা মেয়ে ভেবে আব্বা আম্মাও স্নেহা কে খুব স্নেহ করতেন। তবে যতদিন গেলো স্নেহা এসবে ক্লান্ত হতে লাগলো৷ নেটওয়ার্ক কাজ করেনা, বিদ্যুৎ থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপর আমরা আবার ঢাকায় ফিরে এলাম। আমার চাকরিতে তখনও প্রমোশন পাইনি তাই কিছুটা খরচ বাঁচাতেই এখন যে বাসায় থাকি তাতে উঠলাম। যদিও কিছুটা সমস্যা হতো তবে আমরা এতে অসুখী ছিলাম না। বাসায় ওঠার তিন মাস পর স্নেহা জানালো সে জার্মানের এক ইউনিভার্সিটি তে এপ্লাই করেছিলো৷ সেখানে তাকে রিসার্চের জন্য এপ্রুভ করেছে। এবং সে সেখানেই সেটেল করতে চায়। কিন্তু আমি তখনো এই বিষয়ে কিছু ভাবি নি। আব্বা আম্মাকে ছাড়া অলরেডি শহরে পরে থাকি এখন আবার বিদেশবিভুঁইয়ে যেতে হবে ভেবেই আমার কষ্ট হলো। আমি খুব আদরে বড় হওয়া ছেলে মিলা। আমিতো শহরে পড়তেই আসতে চাইনি৷ তবুও এসেছি। তবে নিয়তির কি পরিহাস স্নেহা প্রেগন্যান্ট এটাও ধরা পরে এর পরের সপ্তাহেই। আর্লি প্র‍্যাগন্যান্সি হওয়ায় স্নেহা আমাকে না জানিয়েই এবর্শন করতে চায়। কিন্তু এতে কমপ্লিকেশন থাকায় ডাক্তার এবর্শনের অনুমতি দেয় না৷ মাহতাব খুব যুদ্ধ করেই এই পৃথিবীতে এসেছে৷ এরপর শুরু হয় রোজ রোজ অকারণে ঝগড়া, রাগারাগি, ভাঙচুর তো রয়েছেই৷ স্নেহা উন্মাদ হতে থাকে। নিজের যত্ন নেয় না,ঠিক মতো মেডিসিন নিতে চায় না৷ আর আমাকে দোষারোপ করে। এতে যদিও আমি কষ্ট পেতাম না৷ আমার এক কলিগ আসিফ যে কিনা ইউনিভার্সিটিতে থাকতে আমাদের কমন ফ্রেন্ডও ছিলো সে একদিন আমাদের বাসায় আসে। স্নেহার সাথে দেখা করে৷ পুরনো বন্ধু আমাদের। তার পর স্নেহা ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায়। এক সপ্তাহের জন্য বাবার বাড়ি থেকেও ঘুরে আসে। সব কিছুই আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যায়। তখন স্নেহার সাত মাস চলে৷ আমি আসিফকে ধন্যবাদ জানাই। আম্মা সাধ করবেন তাই আমাদের গ্রামে যেতে বলেন। গাড়ি ভাড়া করে তিনজনেই যাই গ্রামে। সবাই খুশি হয়৷ স্নেহা রাত জেগে আসিফের সাথে গল্প করে তা দেখে আম্মা সন্দেহ করেন৷ আমাকে সাবধানও করেন৷ আমি রেগে স্নেহাকে নিয়ে পরদিন ঢাকায় ফিরি। স্নেহার এই কথা বলার বিষয়টা আমি বুঝেও বুঝতে চাইনি৷ আট মাসের সময় আম্মা এসে থাকতে চান স্নেহার সাথে৷ স্নেহা আম্মাকে ফোন করে রাগারাগি করে। এরপর আর আম্মার সাথে আমার কথা হয়নি। তখন আমি বাচ্চা আর স্ত্রীর চিন্তায় এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি আমলে নেই নি। আট মাসের শেষের দিকেই মাহতাবের জন্ম হয়। স্নেহা পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনের অজুহাত দিয়ে মাহতাবের থেকে দূরত্ব তৈরি করে৷ আমার আব্বা আম্মা নাতিকে দেখতে আসে। কোলে নিতেই বাবার সাথে স্নেহা চরম খারাপ ব্যবহার করে৷ কারণ খুবই সামান্য, বাবার হাত ধোয়া ছিলো না। বেবির গায়ে জার্ম লেগে যাবে। এরপর বাবা অপমান সহ্য করে চলে যান বাড়িতে। আমার সাথে আর তাদের যোগাযোগ নেই। সেবারই তারা মাহতাবকে প্রথম দেখেছিলেন সেইবারই শেষ। ”
গলা শুকিয়ে গিয়েছে মুহিনের। মিলা পানির বোতল টা এগিয়ে দিতেই মুহিন অর্ধেকটা বোতল খালি করে ফেলে।

****
গাড়িতে গুমোট পরিবেশ। এ কয়দিনের খরতাপের পর অবশেষে বাদল ধারার দেখা মিলবে হয়তো । মিতা জানালার কাঁচ থেকে বাহিরে দিকে তাকিয়ে রইলো৷ গাড়ি কুড়িল ফ্লাইওভার ক্রস করছে। নিকুঞ্জ ক্রস করার সময় বাড়ি গুলোর দিকে বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো সে।গাড়ি এয়ার্পোরটে এসে থামলো। মিতাকে গাড়ি থেকে বের হয়ে আসতে বললো ফারদিন। বিনা বাক্য ব্যয়ে মিতা ফারদিনের পিছু পিছু চললো। টিকিট দেখিয়ে ভিতরে ঢুকলো তারা। মিতা একবার জিজ্ঞেস করলো শুধু, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?” অপর ব্যক্তির উত্তর ছিলো কক্সবাজার।

*****
মিলা তন্ময় হয়েই যেনো গল্প শুনছে।
” এরপর স্নেহা মাহতাবকে কোলে নিতে চাইতো না, খাওয়াতে চাইতো না উদাসীন হয়ে থাকতো। তার বাবাকে জানানোর পর তিনি একজন মেইড ঠিক করে দেন মাহতাবকে দেখে রাখতে। তখন আমাদের কোম্পানিতেও ঝামেলা৷ তোমার ফুফা সেটা টেক ওভার করতে নিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য আমার বাবার পূর্ব পরিচিত ছিলেন। তারা একই স্কুলে পড়েছিলেন। ”
” এক মিনিট৷ হ্যাঁ তাইতো। ফুফুর শশুর বাড়িতো টাঙ্গাইলে যদিও তারা এখন আর যান না৷ আমার তো বোঝা উচিৎ ছিলো। ইশ!”
মুহিন হাসলো।
” আমদের বিয়েতে ফুফাই আমার অভিভাবক ছিলেন। তিনি সম্ভবতঃ বাবার সাথে আগেই কথা বলে নিয়েছিলেন। আর ফুফার উপর বাবার একটা উপকার থাকায় ফুফু আমার প্রতি এতটা যত্নশীল। সে গল্প অন্য একদিন বলবো।”

” আচ্ছা।”

“আমার প্রমোশন তখনও ঝুলে আছে নতুন এমডির উপর। তিনি চাইলে প্রমোশন হবে নইলে না। এমন কঠিন একটা পরিস্থিতি ছিলো যে আমি কোনো ভাবেই কোথাও মানসিক শান্তি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। এমন কি বাসায় ফিরে মাহতাবকে নিয়ে আমার ব্যস্ত থাকতে হতো।
স্নেহার সাথেতো রোজকার ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকে। একদিন আসিফ জানালো সে, চাকরি ছেড়ে জার্মান চলে যাচ্ছে। আমি অবাক হলাম, মনে সন্দেহও হলো । বাসায় ফিরে স্নেহাকেও জিজ্ঞেস করলাম। স্নেহা কিছু জানেনা বললো। এরপরের ঘটনা খুবই আনপ্রেডিক্টেবল ছিল আমার জন্য। স্নেহা নিরুদ্দেশ হবার একদিন আগে আমার প্রমোশন কনফার্ম হলো। সেদিন রাতে আমরা ডিনারে গেলাম দুজন। সবকিছুই স্বাভাবিক ছিলো। স্নেহার মাঝেও পরিবর্তন দেখলাম। পরের দিন স্নেহা মাহতাবকে মেইডের কাছে রেখে নিরুদ্দেশ হলো। ডিভোর্সের পেপার পাঠিয়ে দিলো। তার বাবা জানালো সে জার্মান চলে গিয়েছে। আর আমার কাছে ক্ষমা চাইলেন। আমিও রাগে, দুঃখে ডিভোর্স কনফার্ম করলাম। এরপর থেকে মাহতাব আমার কাছেই। মেইড চলে গেলো একসময়। আর আমি আর মাহতাব রয়ে গেলাম। ”

মিলা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষের জীবন কত বিচিত্র মনে হলো কোনো ছবি বা উপন্যাসের অংশ পড়লো। অথচ এমনটা সত্যিই তার পাশে বসা ভদ্রলোকের সাথে ঘটেছে। মিলা কাঁদতে চাইলো। কিন্তু পারলো না৷ বুক ভার হয়ে গেলো। সেও পানির বোতলে চুমুক দিলো।

বাস মির্জাপুরে চলে এসেছে। পাকা রাস্তা, ফ্লাইওভার একটার পর একটা দারুণ লাগছে মিলার। সাথে থেমে থেমে বৃষ্টি।

” আমরা আর কিছুক্ষণের মাঝে নামবো। ”
বাহিরে এখন বৃষ্টি নেই। মাহতাব ঘুম থেকে উঠেছে কিছুক্ষণ আগেই। বাস থেমেছে পাম্প স্টেশনের কাছে। মিলারা নামলো বাস থেকে। সামনে রাস্তা কাঁদা হয়েছে কিছুটা।

“মিলা আপনি কি ঘোমটা টেনে নিবেন মাথায়। বাধ্যতামূলক কিছু না তবে এখান থেকে সামনে এগুলেই মুরুব্বিরা চায়ের দোকানে বসে আছে দেখবেন।”
” এই বৃষ্টির মাঝেও?”
” হ্যাঁ। তারা বয়ঃবৃদ্ধ মানুষ, চায়ের দোকানেই তাদের আড্ডা জমে। ভাগ্য করে আপনি আজ লাল শাড়িই পরেছেন।”
হা হা করে হাসলো মুহিন।

মিলা মাথায় শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘোমটা টেনে নিলো। সামনের দিকে এগুতেই দেখলো ভ্যান পাওয়া যাচ্ছে। মুহিন স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো৷ দুবছর পর বাড়ি ফিরেছে সে। এই দু বছরে মোটামুটি রাস্তাঘাট অনেকটাই চেইঞ্জ হয়েছে। ভালো লাগছে তার। রাস্তা পাকাও হয়ে যাবে নিশ্চই আর কিছুদিন পর। এবার তার সত্যিই গাড়ি কিনে ফেলা উচিৎ। মিলা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো সত্যিই চায়ের দোকানে ভীড়। টিভিতে নায়ক মান্নার ছবি চলছে৷ সে ডায়ালগ দিচ্ছে কেঁদে কেঁদে আর ভীড় করা দর্শক সবাই তার সাথে গলা মিলিয়ে হ, হ করছে, আহা, উঁহু করছে। মিলা মৃদু হাসলো।

মুহিনকে দেখে চায়ের দোকানের ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, ” ছাত্তারের পোলা নি?”
” আসসালামু আলাইকুম কাক্কা। ভাল আছেন?”
” আছি আলহামদুলিল্লাহ। কয় বছর পর আইলা বাজান? নগে ক্যারা?”
” এই বছর দুয়েক হলো। আমার স্ত্রী মিলা। আর এইটা আপনাদের নাতী মাহতাব।”

” মাশাল্লাহ। ভ্যানের জন্য দাঁড়ায় আছো?”
” জ্বি।”
” চা খাইবানি?”
” না। ভ্যান পেলেই বাড়ি যাবো।”
” দাড়াও।ওই ইদ্রিস ওগোরে বাড়িতে পৌঁছায় দিয়ায়। বৃষ্টির মধ্যে খাড়ায় থাকবো নাইলে।”
ইদ্রিস নামের লোকটা তার ভ্যানে মিলাদের ব্যাগ উঠিয়ে মিলাকে বসতে বললো।

মুহিন মাহতাবকে ভ্যানের উপর রেখে মিলাকে সাহায্য করলো উঠে বসতে৷ মুহিন নিজেও চড়ে বসলো। স্কুল ঘরের সামনে যেতেই ব্রিজ পরে৷ মুহিন নেমে ভ্যানের পিছনে ধাক্কা দিলো উপরে তুলতে। মিলা আড় চোখে বেশ ক বার মুহিনকে দেখলো। মুহিন খেয়াল করলেও কিছু বললো না৷ মিলা আশে পাশের ক্ষেত দেখছে। বাতাসের ছন্দে ধানী জমি কিভাবে দুলছে৷ মনোরম এক দৃশ্য। আকাশে মেঘ। দূর দূরান্তে কেউ নেই৷ বাড়ি বাড়ি থেকে খিচুড়ির বাসনা যেন বাতাসে ভেসে আসছে। মিলার খুব মন চাইলো কোনো একটা বাড়িতে ঢুকে চট করে খেয়ে আসতে। মিলার ঠোঁটের হাসি যেনো সরছেই না। চোখে মুখে আনন্দ তার।

” অনেক দিন পর গ্রামের বাতাসে শ্বাস নিচ্ছি।”
” সুন্দর না? ”
” হ্যাঁ। দারুন লাগছে।”
” কয়েকদিনের মাঝে বন্যা হবে। তখন চারপাশে শুধু পানি আর পানি। নৌকা ছাড়া বের হবার উপায় নেই। নৌকায় করে ঘুরতে বের হওয়া যেতো। আবার শীতের সময় যতদূর চোখ যাবে শুধু হলুদ সরিষা। সেই দৃশ্য যেনো আরও মনোরম। আমরা বন্যার সময় আবার আসবো কেমন?”
” ঠিকাছে। আপনার অফিস ছুটি দিলেই আসবো।”
” বহু ছুটি জমে আছে। তাছাড়া আসতে যেতে এখন আর খুব একটা সমস্যা হয় না৷ দেড়, দু ঘন্টায় পৌঁছে যাওয়া যায়। ”
” বন্যায় গ্রাম ডুবে যায় না? ”
মুহিন হাসলো।
” না। একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”
একটা বড় পুকুরের সামনে গিয়ে থামলো ভ্যান। মুহিন ভাড়া কিছুটা বাড়তিই দিলো, মোড়লের বাড়ি। মুহিন ভ্যান চালকের ফোন নম্বর নিয়ে তাকে বিদায় দিলো।
মিলার কোলে মাহতাব মিলা দাঁড়িয়ে আছে। বললো, “আসুন।”

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১৩

0

ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১৩

মিতা বাড়ি ফিরলো পরের দিন সকালে। সকলেই অস্থিরতা নিয়ে তার জন্য অপেক্ষায় ছিলো। মিতাকে তার রুমে নিয়ে ফিরতেই ফারদিন তার শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বললো,
” আন্টি আমি এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবো না। মিতা যদি থাকতে চায় থাকতে পারে।”
মিলা মিতার দিকে তাকিয়ে বললো, “মিতাও তোমার সাথে যাবে ফারদিন।” মিলার মা বাধা দিয়ে বললো, ” মিতা এখানেই থাকবে। আমি আমার মেয়েকে কিছুদিন আমার কাছেই রাখবো।”

মিতা শুয়ে থেকেই ফারদিনের দিকে তাকিয়ে বললো, “আপনি আমাকে একা রেখে যাবেন না প্লিজ। আমিও আপনার সঙ্গেই চলে যাবো।”
” তাহলে শুধু শুধু আসলি কেন আবার৷ হাসপাতাল থেকেই চলে যেতি।” মিলার খালা বললেন।

“সেটার এখন কৈফিয়তও দিতে হবে?” মিলা প্রচন্ড বিরক্তবোধ করলো।

” ভুল হয়ে গিয়েছে। আব্বা ওনাকে আমায় এখানে নিয়ে আসতে বলেছিলো কিন্তু তিনিতো জানতো না আমি এখানে আসতে চাইছিনা। তাই নিয়ে এসেছে।”

মিতা ধীরে ধীরে উঠে যা কিছু বাহিরে ছিলো সুইটকেসের তা আবার গুছিয়ে ভরতে নিলো। মিলা দ্রুত সব প্যাক করে ফেললো। মিতা মিলার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ঘোলাটে চোখ দুটো স্পষ্ট তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করছে। মিলাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সে। মিলা আদর করলো তার একমাত্র বোনকে।

ফারদিনের গাড়ি এসে থেমেছে বাড়ির সামনে। মিতা আপাকে ছেড়ে মাকেও জড়িয়ে ধরলো।
” ভালো থেকো আম্মু। নিজের যত্ন নিয়ো।”
মিতা ফারদিনের দিকে তাকালো। ফারদিন তাদের ট্রলিটা নিচে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মিতা ড্রয়িং রুমে গিয়ে তার বাবাকেও বেশ ক্ষানিকক্ষন জড়িয়ে ধরে রাখলো। তারপর বিদায় নিয়ে চলে গেলো।

মিলা ফিরে এসে নিজের লাগেজে গুছিয়ে নিলো। মাহতাবের কিছু ডায়পার বাহিরে ছিলো তাও ব্যাগে গুছিয়ে নিলো। তারপর কল করলো মুহিনকে। মুহিন নিচেই দাঁড়িয়ে ছিলো মিলার কলের অপেক্ষায়। মিলার ফুফু গতকাল রাতে চলে গিয়েছিলেন বাসায়। আজ সকালে আবার এসেছিলেন। মিলা তার সাথে দেখা করেই বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। মুহিন সিএনজিতে মিলাদের ব্যাগ পত্র তুলে দিয়ে ফুফুর থেকে বিদায় নিয়ে সিএনজিতে উঠে বসলো।

আকাশে মেঘ করেছে।ঝড় নামবে নামবে করছে। মিলার মনটা মেঘের মতোই হয়ে আছে। যদিও সে খুব বেশি কিছু আশা করে আসেনি বাপের বাড়ি কিন্তু এতো কিছু ঘটে যাবে তাও আশা করেনি। মুহিন মিলার দিকে তাকালো মাহতাব তার শাড়ির আঁচল নিয়ে খেলছে। মিলার জন্য আফসোস হলো তার৷ পরিস্থিতি এমন করুণ না হলে নিশ্চই আজ সে তার পাশে থাকতো না। অনাকাঙ্ক্ষিত মাহতাব ও তার কোলে থাকতো না। যত যাই হোক এরকম হঠাৎ করেই সন্তানের মা হয়ে যাওয়াটা কোনো কুমারী মেয়ের কাম্য না৷ তবে মিলার মনোবল খুবই শক্ত তাই এই রকম কঠিন পরিস্থিতি তাকে বিচলিত কর‍তে পারেনি। সে কেঁদেছে, ভেঙেছে কিন্তু গুড়িয়ে যায় নি৷ আবার সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছে । দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো মুহিনের বুক থেকে। মিলা এক ধ্যানে বাহিরে তাকিয়েই রয়েছে। খেয়াল করেনি তারা কোথায় যাচ্ছে।

সিএনজি মহাখালী বাস টার্মিনালের কাছে যখন থামলো তখন ভর দুপুর। তবে আকাশে মেঘ জমায় কিছুটা স্বস্তি। মিলা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো মুহিনের দিকে।

” আমাদের এক্ষুনি টাঙ্গাইলের বাস ধরতে হবে মিলা।”
” টাঙ্গাইল কেনো? কে থাকে? আপনিতো আগে কিছুই বলেন নি৷ আমিতো কিছুই গুছিয়ে আনি নি।”
” যা আছে তাতেই হবে। আমার তিনদিনের ছুটি রয়েছে৷ আর রয়েছে শুক্র, শনিবার৷ এর মাঝে বেড়িয়ে আসলে আপনার মন ভালো হয়ে যাবে। আপনার এতো সুন্দর বউ বউ চেহারায় এমন মেঘের ঘনঘটা দেখতে একদম ভালো লাগছে না।”
” আমি অতি অবশ্যই নতুন বউ এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ধরনের স্বস্তা স্বান্তনা আমাকে আর দিবেন না প্লিজ।” মুখে বললেও মিলার মনে সত্যিই মুহিনের তার প্রতি কনসার্ণ দেখানোটা অন্যরকম অনুভূতি এনে দিলো।

একদম মহাখালী টার্মিনালে ঢোকার আগের লোকাল বাসেই চড়লো তারা। বাসে যাতায়াতের অভ্যাস রয়েছে মিলার নানাবাড়ি যেতেও তারা বাস বা ট্রেন ব্যবহার করে তবে তা সব সময় সিটিং সার্ভিস বা এসি বাস ছিলো। এমন লোকাল বাসে এন্ড মোমেন্টে বাচ্চা সহ চড়াটা আসলেই ভয়ংকর ব্যাপার আর একটা নতুন এক্সপেরিয়েন্সও বটে। মাঝের সিটটাই নিলো মুহিন। বাসে এখনো কিছু যাত্রী সিট খালি সেগুলো ভরলেই বাস ছেড়ে দিবে। মুহিন মাহতাব আর মিলাকে সিটে বসিয়ে দিয়ে ব্যাগটা উপরের ডিকি সাইডে রেখে নিচে নামলো হালকা কিছু স্ন্যাক্স কিনে নিতে। মুহিনের আসতে আসতে বাস ভর্তি হয়ে গেলো। বাস ছেড়ে দিবে বুঝতেই মিলা উদ্বিগ্ন হলো৷ কন্ট্রাক্টর কে উদ্দেশ্য করে বললো আমার হাজবেন্ড এখনো আসেন নি প্লিজ একটু আপেক্ষা করুন। মিলা ফোন বের করে অস্থির হয়ে মুহিনকে কল দিলো। মুহিন কল ধরতে ধরতেই দৌড়ে বাসের দরজায় দাঁড়ালো। মিলার জানে পানি এলো যেনো। মিলা ফোন নামিয়ে রাখতেই মুহিন সিটে বসলো এসে। কন্ট্র‍্যাক্টর ড্রাইভারকে “ওস্তাদ চালু, চালু ” বলতে বলতে সামনের দিকে এগুলো।

“ভয় পেয়েছিলেন?” মুহিনের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।
“তো? ভয় পাবো না? চিনি না জানি না একটা অপরিচিত জায়গায় যাচ্ছি আপনার ভরসায়। আপনি বউ, বাচ্চা রেখে হাওয়া হয়ে গিয়েছেন। আমি একা থাকলেও সমস্যা হতো না। এই বাচ্চা আর ব্যাগপত্র নিয়ে আমি কি করতাম যদি বাস ছেড়ে দিতো? অদ্ভুত।”

মুহিন হেসে মিলাকে নকল করেই বললো, “অদ্ভুত!”

মিলা আর কথা বাড়ালো না। বাস ছাড়লো মুহুর্তেই। বহুদিন পর গ্রামের দিকে যাবে ভাবতেই মিলার মন ভালো হয়ে যাচ্ছে। এর মাঝে একবার মিতাকে কল করেছিলো কিন্তু কল পিক করেনি। তবে মিলা জানে মিতা ভালো আছে। ফারদিনের সাথে সে ভালো থাকবে। মিলা জানালা দিয়ে সব দেখছে, মাহাতাব তার বাবার কোলে। মিলা জিজ্ঞেস করলো,”টাঙ্গাইল কি আপনার গ্রামের বাড়ি?”
“হ্যাঁ।”
” আপনি যাচ্ছেন তা কি আপনার পরিবার জানে?”
” পরিবারের কেউ জানে না। আমরা দু ভাই বোন আর বাবা মা। এই হলো পরিবার।”
” আমি খুবই দুঃখিত মুহিন। আপনাকে এই দু দিনে আমার পরিবারের ঝামেলা গুলোর মধ্য দিয়ে যেতে হলো। প্লিজ আপনি মনে রাগ বা কষ্ট রাখবেন না।”
মুহিন খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেলো। টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়া শুরু করেছে। বাতাস ভেসে আসছে বাসের জানালা দিয়ে। মুহিন দাঁড়িয়ে জানালা আটকে দিলো।

” আপনি আমার পরিবার সম্পর্কে প্রায় সবই জানেন। কিন্তু কখনো আপনার পরিবারের ব্যাপারে কিছু বলেন নি। বিয়েতেও আপনার বাবা- মা, বোন কেউ উপস্থিত ছিলেন না।”

“মিলা গল্প শুনবেন?”
মিলা গভীর দৃষ্টিতে মুহিনের দিকে তাকালো। বাস চলছে আশুলিয়ার কাছাকাছি চলে এসেছে প্রায়।

” আমার প্রথম স্ত্রী অর্থাৎ মাহতাবের মায়ের সাথে আমার বিয়েটা ছিলো প্রেমের বিয়ে৷ লাভ ম্যারেজ। আমার পরিবার খুবই সাধারণ মানসিকতার। তারা আধুনিক না হলেও আমার বিয়েটা তারা মেনে নিয়েছিলেন। আমাদের পরিবারে সবাই কম বেশি শিক্ষিত। আমার মা ম্যাট্রিক হোল্ডার, আব্বা আই.এ হোল্ডার তখনকার সময়ের। আমি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির আইবিএ তে পড়ি আর মাহতাবের মা স্নেহা আমরা ক্লাসমেইট ছিলাম। ওর বাবা অবশ্য ইউনিভার্সিটির একজন ফ্যাকাল্টি ছিলেন। আর আমি ছিলাম চাষা কাম ব্যবসায়ীর ছেলে। তাও ঢাকাই ব্যবসায়ী না৷ ”

মাহতাব ঠান্ডায় ঘুমিয়ে পরেছে। এই ছেলের ঘুম বেশি যেকোনো যায়গায় সে ঘুমাতে ওস্তাদ। অন্য বাচ্চারা যেমন অতিরিক্ত কাঁদে নখরা করে সে সম্পূর্ণই ভিন্ন। মিলা একটা পাতলা কাথা মাহতাবের গায়ে জড়িয়ে দিলো। গল্প চলছে গল্পের মতোই।

” ওর আব্বা প্রথমে রাজি না হলেও পরবর্তীতে আমার মেধা দেখে আর আপত্তি করেন নি।”
” স্বাভাবিক। শিক্ষা থাকলে কেউই ফ্যালনা নয়।” মুহিন হাসলো মিলার কথায়।
” আসলে তখন স্নেহার মাথায় ভূত ঢুকেছিলো ক্লাসের হ্যান্ডসাম বয়টাকে নিজের করে পাবার যার জন্য মেয়েরা লম্বা লাইন দিয়েছে। ”
মিলা চোখ গোল গোল করে তাকালো মুহিনের কথা শুনে। দুজনেই ফিক করে হেসে ফেললো। যদিও মিলা ভেবেছিলো মুহিন মজা করছে। তবে মুহুর্তেই মুড সিরিয়াস হয়ে গেলো।

” আমি স্নেহাকে শুরুতে খুব একটা গুরুত্ব দিতাম না। ধীরে ধীরে এক সাথে বসা, নোটস নেয়া, ওর ক্লাসের সি আর হওয়া টুকরো ঘটনাকে জুড়ে ভালো লাগা তৈরি হলো। আমি এমবিএ শেষ করে চাকরিতে ঢুকলাম। আর স্নেহা দেশের বাহিরে যাবার জন্য এপ্লাই করল। স্নেহা ডাবল এমবিএ করতে দেশের বাহিরে চলে গেলো৷ এরপর আর যোগাযোগ নেই প্রায় তিন বছর। তিন বছর পর রিইউনিয়নে স্নেহার সাথে আবার দেখা৷ এরপর ধীরে ধীরে ভালোবাসা।

স্নেহার পিএইচডি করার ইচ্ছে ছিলো। এপ্লাই ও করেছিলো। কিন্তু সে তা আমাকে কখনোই জানায়নি। সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলো। বাড়ি থেকে বিয়ের চাপ আসতে শুরু করলো। আমার খালাতো বোন জুথির সাথে আমার বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি। জুথি আবার তিতুমীর থেকে এমএসসি করছিলো। আমি বাড়ি গেলাম ছুটিতে৷ মা জানালো জুথির কথা। জুথিকে আমি বোন হিসেবে দেখেছি এমনটা বলবোনা৷ কারণ ওকে আমি বন্ধু হিসেবে ভাবতাম সবসময়। আমি স্টুডেন্ট ভালো হওয়ায় সবাই আমাকে কিছুটা এড়িয়েই চলতো৷ জুথিই একমাত্র আমাকে সঙ্গ দিতো। যদিও আমার চেয়ে বয়সে সে বছর দুয়েক এর ছোট।”

বাসটা থামলো চন্দ্রায়। যাত্রী নামছে আরও কিছু উঠছেন। তবে ভীর কম৷

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১২

0

‘ঝরা পাতা উড়ে যায়’
পর্ব-১২

দুপুরের খাবারে বহু অতিথি এলো। বিশাল বড় ছাদ জুড়ে প্যান্ডেল বেঁধে রাখাছিলো সেখানেই ভোজনের বন্দবস্ত হয়েছে। মিলার বাবা খুব গর্ব করে দুই জামাইয়ের সাথেই সবার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন ক্ষণে ক্ষণে। মিলা, মিতাও সেখানে উপস্থিত৷ ওরা একটুও ভুল ছিলো না৷ সত্যিই মিলা আর মিতার সাজ পোশাক নিয়ে আত্মীয়রা একচোট গসিপ করে নিয়েছে৷ কার বরের পয়সা বেশি আর কার কম তা গহনার পরিমাণ আর ওজনের তারতাম্য দেখেই বুঝে নিয়েছেন। তবে ওদের মাঝে এ নিয়ে কোনো এক্সাইটমেন্ট দেখা গেলো না৷ উলটো দুজন জড়াজড়ি করে বেশ কিছু ছবি তুলে নিলো। বিয়ের দিন এভাবে ছবি তোলা হয়নি। সবাই অবাক হয়ে শুধু দুবোনকে দেখেছে ।

খাবার পর্ব শেষ হতেই কানাঘুষো শুরু হলো। ছোটবোন বড় বোনের বরের দিকে নজর দিয়েছে। নজর খুব খারাপ জিনিস। তাই বিয়েটা হয় নি। আরেকদলের মতে বড় বোন অন্য জায়গায় সম্পর্কে ছিলো তাই নিজের জায়গায় ছোটবোনকে বসিয়েছে। গল্প খুবই রমরমা। শুরুতে মিতা খুব একটা কানে নেয়নি কথা গুলো। কিন্তু ধীরে ধীরে বিষয়টা চাউর হতে লাগলো। মাছের বাজারে ভিনভিন করা মাছির মতো গুঞ্জন উঠে গেলো। সবাই যেনো ওকে জোকার ভাবছে। শাড়ির আঁচলে মুখ ঢেকে হাসছে। সবার সেই হাসি মিতা চেয়েও সহ্য করতে পারলো না৷ শরীর খারাপের বাহানা দিয়ে ঘরে চলে গেলো। মিলা মাহতাবকে নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খুব একটা খেয়াল করতে পারলো না।
ঘটনা ঘটলো সন্ধ্যায়।

সব ধরনের ঝামেলা শেষ করে ফারদিন যখন ঘরে এলো, এসে দেখলো মিতা ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। লম্বা চুল গুলো এলোমেলো হয়ে বালিশে ছড়িয়ে আছে। গায়ের আঁচলের বালাই নেই, শাড়ি হাঁটু অব্দি উঠে আছে। ফারদিন ভাবলো ক্লান্ত হয়ে যাওয়ায় এভাবে ঘুমাচ্ছে মিতা। সন্ধ্যে নেমে এসেছে তাই ডাকতেই হবে এখন। ফারদিন মিতাকে লজ্জা দিতেই তার কাছে গিয়ে ডাকলো।
“মিতা,মিতা…! ”

মিতার কোনো হেলদোল নেই। ফারদিন এবার হাত দিয়েই মিতার কাঁধে ধাক্কা দিলো। তার চোখ মুখ মুহুর্তেই রক্তশূণ্য হয়ে গিয়েছে। মিতা ঠিক ভাবে নিশ্বাস নিচ্ছে না৷ বিছানায় অচেতন দেহ পরে আছে। ফারদিন ভয়ে আরও জোর বেগে ডাকলো মিতার নাম৷
মিতার সারাশব্দ নেই। ফারদিনের চিৎকারে সবাই দরজার সামনে এসে জড় হয়ে ফারদিনকে দরজা খুলতে বলছে। ফারদিন অস্থির পায়ে দরজা খুলে দিয়ে বললো, ”মিতাকে হাসপাতালে নিতে হবে।” মুহিন সেখানেই ছিলো। কথা না বাড়িয়ে সে দ্রুত সিএনজি খুঁজতে নিচে চলে গেলো। ফারদিন মিতাকে কোলে তুলে সিঁড়ি বেয়ে নামলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।

পরিচিত হাসপাতালেই নিলো ফারদিন। এখানে তার বন্ধুরা রয়েছে, দ্রুত সাহায্য পাওয়া যাবে। ঠিক তাই হলো। ডাক্তার নার্সরা দ্রুতই ছুটে এলো পেশেন্ট এটেন্ড করতে। ফারদিনের ভেতরে এক অন্যরকম অস্থিরতা।

মিতার জ্ঞান ফিরলো ২ ঘন্টা পর৷ এ দু ঘন্টা তাকে স্যালাইন দিয়ে রাখা হলো। প্যানিক এট্যাক হয়েছিলো মিতার৷ একা বদ্ধ ঘরে থাকায় আনকনশাস হয়ে গিয়েছিলো। ফিভারও আছে তাই ডাক্তার ব্লাড টেস্ট দিয়েছে। দ্রুত রিপোর্ট চলে আসবে। মিতার চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাশে লাগছে দেখতে৷ ফারদিনের খুব মায়া হলো। মিতা বড় হয়েছে নাবালিকা না তবুও তার ভেতরের কৈশরের উচ্ছ্বাস এখনো বহাল তবিয়তে আছে। এই বনে বাদারে ছুটে বেড়ানো উচ্ছ্বল হরিণীকে বন্দী করে ফেলেছে ফারদিন। অপরাধ বোধ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলো। সম্পর্কের দোহাই দিয়েই হোক আর প্রতিশোধ পরায়ণ হয়েই হোক যেভাবেই হোক মিতাকে সম্ভোগ করার যে অপরাধবোধ তা যেনো ভেতরের সবকিছু ভেঙে চূড়ে দিচ্ছে। ফারদিন বেশিক্ষণ সেখানে দাঁড়ালো না।

মিতাকে আপাতত ক্যাবিনে শিফট করা হয়েছে৷

মুহিন ফোন করে মিলাকে জানালো মিতার অবস্থার ব্যাপারে। মিলা এতক্ষণ মাহাতাবকে নিয়ে বসে ছিলো ড্রয়িং রুমে। ফোন রেখে তার মায়ের দিকে তাকালো সে। এক সুরে নাকি কান্না কেঁদেই যাচ্ছে সে। বাকি সবাই তাকে স্বান্তনা দিতে ব্যস্ত। বড় মামী এক গ্লাস লেবুর শরবত নিয়ে এলো তার জন্য। মিলা রাগে হিতাহিতজ্ঞান ভুলে হাত থেকে থাবা দিয়েই গ্লাসটা ফেলে দিলো। কাচের গ্লাস খান খান হলো ভেঙে সাথে তার মায়ের সুর করে কান্নাও থামলো।

“কেউ মরে যায়নি যে এইভাবে কাঁদছো। তাছাড়া তুমি কাঁদছোই বা কার জন্য? ওকেতো তুমি আগেই মেরে ফেলেছো, মা।”

মিলার মা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন এই মেয়ে দুটোকে তার বিষাক্ত সাপ মনে হচ্ছে৷ কোন কুক্ষণে পেটে ধরেছিলেন।
মিলার ফুফু মিলাকে ধমকে চুপ থাকতে বললেন। মিলা দমলো না।

” আমাকে চুপ করিয়েতো লাভ নেই ফুফু সব তো তুমি নিজেই দেখলে। শুধু মাত্র মায়ের হটকারিতার জন্য আজ মিতার এই অবস্থা। পায়ে পর্যন্ত ধরেছিলাম যেনো মিতার বলি না দেয়া হয়। কেউ শোনোনি আমার কথা তোমরা। মা কি বলেছিলো তোমার মনে নেই?”

রাগে যেনো মিলার চোখ দিয়ে আগুন ঝড়বে৷ মিলার ফুফু সোফায় নিরব হয়ে বসে আছেন। আজ এই বারুদ আর বন্দুকের ভেতরে নেয়ার মতো অবস্থায় নেই। আজ সব ক্ষত বিক্ষত হবেই।

মিলার মা ফের আঁচল মুখে চাপলেন আরেক চোট কান্নার উদ্দেশ্যে। মিলা ধমকে উঠলো –
” খবরদার তুমি কাঁদবে না। তোমার অভিনয় বন্ধ করো। তুমি সেদিন আমায় কি বলেছিলে? আমি নাকি নিজের ছোটবোনের সুখ দেখতে চাই না, নিজের বিয়ে হচ্ছে না অত বড় ঘরে তাই আমি হিংসে করছি মিতা কে? এটাইতো বলছিলা আমাকে? বলেনি মামী আপনি তো উপস্থিত ছিলেন। ”
মিলার মামী শুকনো ঢোক গিললেন।

” আমি যদি তখন বিয়েটা না দিতাম তাহলে সমাজে তোর বাবার সম্মান টা কই থাকতো ভেবে দেখেছিস? তুই অপয়া হয়ে জন্মেছিস সেখানে আমি কেনো দোষী হবো? তোর ভাগের দুঃখ মিতা কেনো ভুগবে? কখনো ভেবে দেখেছিস তখন মিতাকে বিয়ে না দিলে সবাই কত থু থু ছি ছি করতো? এরপর মিতার জন্য কি ভালো কোনো ঘর থেকে পাত্র পেতাম?”
শ্বাস যেনো আটকে আসছে মিলার মায়ের। তবুও তিনি সকল দোষ নিজের কাঁধে নিতে নারাজ।

“তাহলে তোমার বোন, ভাবীরা কেনো সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে যে মিতা বিয়ের আসর থেকে আমার বর কেড়ে নিয়েছে? ও ফারদিনকে সিডিউস করেছে? ছিহ। এরা তো তোমার ফ্যামিলিরই লোক। কই আমার ফুফু, চাচীরা তো কেউ এই বিষয়ে কথা বলেন নি। ”
” মিলা খবরদার মিথ্যা কথা বলবি না। আমরা কেউ এইসব বলি নাই। মিতা ছোট মানুষ। ওর ব্যাপারে এইসব কেন বলবো আমরা?” মিলার খালার প্রতিবাদী কন্ঠ।

” আবার মিথ্যা বলছেন? আমাকে কি ভাবছেন? আমার বর,আমি দুজনে মিলেই শুনেছি আপনারা কি নোংরা কথা বলছিলেন৷ আপনাদের একবারো বাঁধলো না?”
” মিলা ব্যবহার খারাপ করিস না। আম্মু এইসব কিছুই বলেনি। তুই ভুল বুঝতেছিস ব্যাপারটা।” মিলার খালাতো বোন বলে উঠলো।

রাগে, দুঃখ মিলার ইচ্ছে করছে সবাইকে খু*ন করে ফেলতে।
মিলা গর্জে উঠলো,
” সব বের হ আমার বাসা থেকে। এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকবি না কেউ। বের হ। মিতা আসার আগেই বের হবি। ” মিলার ফুফু মিলাকে টেনে ঘরে নিয়ে এলেন। এতোক্ষণের আটকে রাখা কান্না গুলো এবার আর্তনাদে পরিণত হলো। শান্ত হয়ে বসে থাকা মিলার সব বাধ ভাঙলো। বার বার নিজেকে দোষ দিতে থাকলো সে। ফুফু জড়িয়ে ধরে বসে রইলেন মিলাকে। কিছুক্ষণ পর মুহিন ঘরে প্রবেশ করেই দেখলো মিলা গুঙিয়ে কাঁদছে, যেন মুখ থেকে চিৎকারের আওয়াজ না বের হয় তাই শক্ত করে ফুফুর কাঁধে মুখ গুজে আছে। কান্না না থামলে কষ্টে বুক ফেঁটে যাবে তার। সে যে মিলাকে চেনে তার সাথে সামনে বসে থাকা মেয়েটার যেন কোনো মিল নেই। মুহিন ঘরে আসতেই ফুফু মিলাকে ছেড়ে দিয়ে রুম থেকে বের হলেন। মুহিন কি করবে বুঝতে না পেরে মিলার মাথায় হাত রাখলো। মিলা চোখ তুলে তাকালো। মুহিন অবাক হয়ে দেখলো বড় বড় নেত্রের অধিকারিণীর চোখে এক সমুদ্র জল। মুহিন পাশে বসলো। মিলার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
” মিতা ঠিক আছে। ওকে আগামীকাল সকালে রিলিজ করে দিবে৷ ও বাসায় ফিরলেই আমরা চলে যাবো। আর আসবো না কেমন? ”

মিলা ঘোলা চোখেই দেখলো মুহিনকে। কিভাবে যেনো তার ভিতরটা সে পড়ে নিয়েছে। মিলা কৃতজ্ঞ বোধ করলো যে মুহিনকে কিছু বলতে হয়নি তার।

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১১

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব-১১
শাহাজাদী মাহাপারা

জুম্মার নামাজে গিয়েছে মিলার বাবা সাথে দুই মেয়ের জামাই, মিলার চাচা, ফুফা, মামা আর চাচাতো ভাই।

খাবারের আয়োজন প্রায় শেষের দিকে অতিথিরা আসতে শুরু করবে কিচ্ছুক্ষণ পর। ফুফু বলে গিয়েছেন নতুন বউদের মতো সেজে থাকতে৷ মিতা একটা সবুজ রঙের জামদানী পরলো। লম্বা চুল গুলো হাত খোপা করে ফুল গুজে দিলো তার ভাবীরা। মিতাকে তার শশুর বাড়ি থেকে এক সেট স্বর্ণের গহণা দিয়ে পাঠিয়েছিলো তার শাশুড়ি। গলার হার, ঝুমকা, দু গাছি চিকন চুড়ি গোল্ডের আর বালা। হাতে আগের দুটো আংটিই ছিলো। মিতাকে স্বর্ণের গহনায় এতো মানিয়েছে যে সবাই চেয়েও চোখ ফেরাতে পারছে না। মিতার একটুও ভালো লাগছে না। সে শুধু দুটো বালা আর ঝুমকা পরতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার শাশুড়ি ফোন করে তার মাকে বলেছেন গহনা গুলো যেনো দেখে নেয় ঠিক ঠাক ভাবে আছে কিনা। তাকে একা বললেও চলতো কিন্তু তিনি তা করেননি। লাউডস্পিকারে দিতে বলে ঘর ভর্তি লোকের সামনে কি কি দিয়ে পাঠিয়েছেন তা জাহির করলেন।

মিলা মাহতাব কে খায়িয়ে নিজে সাজতে বসলো। তার রঙ মিতার মতো গোলাপি না। সে হলদেটে। উপটানের মতো রঙ তার৷ মিলার জন্মের পর তার দাদী নাকি তাকে উপটান দিয়ে গোসল করাতেন তাই নাকি তার গায়ের রঙ এমন। মিলার শশুর বাড়ির এখানে কেউ নেই। তাই তার ফুফু তাকে একটা গাড়ো গোলাপি রঙের জামদানী দিয়ে গিয়েছেন। মিলা হাসলো শাড়িটা দেখে। ফুফুর সবসময়ই ব্রাইট কালার পছন্দ। তিনি নিজেও সবসময় ব্রাইট কালার পরে থাকেন। ফুফাও তাকে এমন রঙে পছন্দ করেন।
শাড়ির নিচে গোলাপি ব্লাউজ পেটিকোট সবই আছে। এছাড়া আছে একটা গয়নার বাক্স। লাল বাক্স। মিলা বিরক্ত হলো এসবের কি দরকার ছিলো! তার এমনিতেই গহনা পরতে ভালো লাগে না।

মিলা বাক্সটা খুললো তাতে চিরকুট।

“রুদ্মিলা,
এই গহনা গুলো আমার তরফ থেকে আপনাকে বিয়ের উপহার। আমি কিপটে নই। আসলে হুট করে বিয়ে করায় আপনাকে কিছুই দিতে পারিনি। ফুফুর গহনা দিয়েই আপনাকে ঘরে তুলেছিলাম।কিন্তু সেগুলোতো আপনার নিজের নয়। ফেরত দিতে হবে অতি অবশ্যই। তাই এই অধমের সামর্থ্য অনুযায়ী এইগুলো যদি গ্রহণ করতেন তবে খুশি হতাম।

মুহিন।”

ব্যস। এইটুকুই লেখা চিরকুটে। মিলার মনে মিশ্র অনুভূতি। একটা পাতলা স্বর্ণের হার, ঝুমকা, বালা আর একটা বড় চেইন। মিলার মন ভালো হয়ে গেলো। গহনা দেখে না গহনার পেছনে মুহিনের এফার্ট দেখে। সবকিছু কি স্বাভাবিক হচ্ছে ধীরে ধীরে?

মিলা দরজা আটকে নিজের মন মতো সাজলো। লম্বা বেনি করে তাতে কিছু গোলাপ গুজলো। নিজের কাছেই নিজেকে অন্য রকম লাগছে। বিয়ের দিনের জবরজং সাজের মতো না,স্নিগ্ধ।
মিলা ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে মাথায় শাড়ির আঁচলের ঘোমটা দিয়ে বের হলো রুম থেকে, কোলে মাহতাব।

মিলার ফুফু মিলাকে দেখে সূরা পড়ে ফু দিলেন। তার সব ভাইদের সন্তানের মধ্যে মিলা তার খুব আদরের। মিলাকে দেখলেই তার মায়ের কথা মনে পরে। কি সুন্দর সেই হাসি, চোখ, রঙ, কথা বলার ভঙ্গি। তার মা এত শুদ্ধ করে কথা বলতে পারতেন না কিন্তু তার বচন ভঙ্গি ছিলো অতি অমায়িক৷

তিনি মিলাকে ড্রয়িং রুমে গিয়ে বসতে বললেন৷
মিতা কিছুক্ষণ পরই বের হলো। অপসরীর মতো দেখতে তার এই ভাতিজি। মিলা যতটা শান্ত, নম্র আর ধৈর্যশীল, মিতা ততটাই চঞ্চল, প্রাণোবন্ত আর উচ্ছল। অথচ আজ যেন দুবোন নিজেদের মাঝে বদলাবদলি করে নিয়েছে।

মিতা ফুফুর সামনে গিয়ে বললো,
” ফুফু, তুমিও কি আমার উপর রেগে আছো এখনো?”
তিনি হাসলেন। যা হয়েছে তার জন্য মিতার উপর রাগ করা যায় না৷ এটা সত্য সে এখন আর নাবালক না। তবে যে পরিবেশে সে বড় হয়েছে এবং সবার ছোট হওয়াতে তাকে কখনো বড় সিদ্ধান্ত নিতে হয় নি। তাই তাকে যা বলা হয়েছে সে তাই করেছে। আজীবন তাদের সন্তানদের তারা মধ্যবিত্তের মিথ্যে সম্মান রক্ষার গল্প শুনিয়ে এসেছে।” প্রাণ যাবে কিন্তু মান নাহি” এই দীক্ষায় দীক্ষিত সন্তান আর কিই বা সিদ্ধান্ত নিতো?
তিনি মিতার কপালে চুমু খেয়ে বললেন,
” তুই তো সবার ছোট,বড্ড আদুরে। তোর উপর কেউ রেগে থেকেছে কখনো?”
” আপা আমার সাথে কথা বলছে না ফুফু।”
” মিতা, তোর এখন বিয়ে হয়েছে। পারিপার্শ্বিক অনেক কিছুই তোকে এলম করে নিতে হবে মামনি।”

ফুফু মিতার দুহাত শক্ত করে ধরলেন,
” তোর বিয়ে যে পরিস্থিতি তে হয়েছে আর তোর বাবা মায়ের এমন প্রতারণা মিলাকে গুড়িয়ে দিয়েছে। তোর আপা কখনোই তোর উপর রাগ করতে পারে না৷ তাকে একটু সামলে ওঠার মতো সময় আর স্পেস দুটোই দিতে হবে। তাছাড়া মিলাকে দেখ সে মাহতাবকে নিয়ে কতটা ব্যস্ত। ওকে দেখলে কেউ বলবেই না এই সন্তান ওর গর্ভজাত না৷ কতটা মমত্ববোধ থাকলে মুহূর্তেই অন্য কারো সন্তানকে নিজের বলে পরিচয় দেয়া যায়!”

মিতা বুঝলো।
” ফুফু তোমরা কেনো আপাকে মুহিন স্যারের সাথে বিয়ে দিলে?”
” স্যার! দুলাভাই হয়৷” তিনি হাসলেন।
” উনি তো ফুফার অফিসে জব করতেন। ফুফা তাকে স্যার ডাকতেন তাই আমিও ডাকি।”
” আরে বোকা, উনিতো মজা করে ডাকতেন। মুহিনের সন্তানের জন্য মায়ের প্রয়োজন ছিলো আর মিলাকে ট্রমা থেকে বের করার জন্য তাকে এমন কারো হাতে সোপে দেয়া যে মিলাকে সর্বোচ্চ সম্মান করবে৷ তাই মিলার জন্য মুহিনের থেকে বেস্ট তোর বরও হতো না। ঠিক বলেছি?”
মিতা হাসলো। সত্যিই তো৷ মিতা পনেরো দিনে যতটা ফারদিনকে চিনেছে অবশ্যই আপা এই পরিবারে সার্ভাইব করতে পারতো না। তার শান্ত ভদ্র আপা এমন একটা খবিশ শাশুড়ি পেতো এটা মানা যায় না৷ যতই পরিস্থিতি অনুকূল থাকুক এক না একদিন তো খোলস থেকে বের হতেনই। পর্দার আড়ালে আর কতদিন। তার শাশুড়ির জন্য তার মতো ছেলের বউই পারফেক্ট। আজ বহুদিন পর মিতার হাসি পেলো। মন খোলা হাসি। সে হাসলো। ফুফুও হাসলেন। মিতার মনে হলো ফুফু ম্যাজিক জানেন। শী ক্যান মেক এভ্রি ইম্পসিবল পসিবল। মিলাও যোগ দিলো।

” দুজনে একা একা কি খি খি করছো আমাকে রেখেই৷”
মিতা আর অস্বস্তি বোধ করছে না। এইতো তার বাসা, তার ফুফু, তার সেই আপা। সাথে তার ভাগ্নে ছোট্ট মাহতাব। সব আগের মতো না থাকলেও সময়ের সাথে সবটাই সয়ে আসবে। মিতা মিলার কোল থেকে মাহতাবকে নিলো। মিলাও ডাইনিং এর চেয়ারে বসলো ফুফুর পাশে। মিতা জিজ্ঞেস করলো, ” নাম কি ওর?”
” মাহতাব।” ফুফু বললেন।
মিতা মাহতাবের গালে চুমু খেলো। মাহতাব মিতার কানের ঝুমকো নিয়ে খেলছে। মিলা বললো, “তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। এতো বড় কবে হলি ময়না?”
মিতার চোখে পানি টলটল করছে সে খুব কষ্টে ধরে রেখেছে৷ আপাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে৷ মিলা বুঝলো। সে উঠে এসে মিলাকে কাছে টানলো।

” আপা তুই ভালো আছিস?”
” আমি খুব ভালো আছি। দেখে বুঝতে পারছিস না? এবার বল এই শাড়িতে কেমন লাগছে?”
” সবাই একটু পর এলেই তামাশা দেখতে পারবি কিভাবে শাড়ি গহনা নিয়ে তুলনা শুরু করবে।”
দু বোন বাকি সবাইকে নিয়ে কথা বলা শুরু করতেই ফুফু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আশ্চর্য হবার কিছু নেই৷ কিছু অভ্যেস কখনোই যাবার নয়৷ ভালোবাসার মতো অভ্যেস তো কখনোই না৷ বোনেদের মাঝের গসিপ সেগমেন্ট দুনিয়া উল্টে গেলেও কখনো বদলাবে না। মেহমান এসে পড়েছে। ভাইরাও চলে আসবে একটু পর। তার এখন ওঠা দরকার সব বোঝা তো তার মাথায়ই। তার নিকাম্মি অলস ভাবীরা কি করছে তা একটু দেখা দরকার৷ বউয়ের চেয়ে এরা বেশি সেজে ফেললে আবার সমস্যা। অতঃপর তিনি সেখান থেকে প্রস্থান করলেন।

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-১০

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”
পর্ব-১০
শাহাজাদী মাহাপারা

মিতা বিশাল বড় গাড়ি থেকে নামলো বাড়ির গেটের সামনে। ড্রাইভার নেমে ব্যাগ গুলো গাড়ির ডিক্কি থেকে নামিয়ে সামনে নিয়ে রেখেছে। ফারদিন ড্রাইভারকে ব্যাগটা ভিতরে রেখে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বললো কারণ মিতাদের গাড়ি পার্কিং এর জায়গা নেই।

মিতা একবার ফারদিনের দিকে তাকিয়ে ভেতরে চলে গেলো।
তার এখানে আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিলো না। এখানে এলেই বড় আপার মুখোমুখি হতে হবে। চোখের দিকে তাকিয়ে কথাই বলতে পারবে না সে। কি লজ্জার পরিস্থিতি! বড় বোনের হবু বরের সাথে বিয়ে আর বড় বোন এখনো বিয়ে করেনি। এক সপ্তাহ পর তারা এসেছে অনুষ্ঠান করতে। মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ফারদিন বুঝতে পেরেই বললো,” যা হবার তাতো হয়েই গিয়েছে এখন এসব ভেবে নিজেকে ছোট করার কোনো মানে হয় না।”
মিতা ঘাড় উঁচু করে ফারদিনকে দেখলো।
” নিজের দায় এড়িয়ে যাচ্ছেন ভালো কথা। আমার অপরাধবোধ কম করার প্রয়োজন নেই।”
মিতা কলিং বেল বাজাতেই মিতার চাচী দরজা খুললেন। মিতাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে সবাইকে ডেকে বাড়ি মাথায় তুললেন। সবাই পড়িমরি করে ড্রয়িং রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।

মিতা আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো। মিলা আসে নি।
“আপা কি এখনো রাগ করে আছে আমার উপর!” নিজেকেই শুধালো সে।
তার খারাপ লাগছে। ফুপিও আসেনি৷ মিতার মা মিতার বর কে আপ্যায়ন করলেন। মিতার বাবা কিছুক্ষণ আগেই ড্রয়িং রুমে এসে বসেছিলেন। তার হাতে এক গ্লাস পানি ছিলো। দ্রুত গ্লাস টেবিলে রেখে মিতার কাছে গেলেন। ফারদিন সালাম করতে নিলেই তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে খোশামদিদ জানালেন। ফারদিন ও জড়িয়ে ধরলো। সবাই মিলে মিতাকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে বসালেন। মামী দ্রুত শরবত মিষ্টি নিয়ে এলেন। মিষ্টি মুখ করিয়ে তিনি জামাইকে স্বর্ণের আংটি পরিয়ে দিয়ে বললেন,” সেদিন হৈ হট্টগোলের মধ্যে তোমার জন্য কিছু করতে পারিনি বাবা। তুমি কিছু মনে করো না। আজকে উপহারটা গ্রহণ করো।”
ফারদিন তাকেও সালাম করলো।

মিতার ফুফু দাঁড়িয়ে সকলকে দেখছিলেন। মিলার বরের ক্ষেত্রে এমনটা হয়নি। মিলার বর কে এরা এতো সমাদর করেনি উলটো গেস্ট রুমে পাঠিয়েছে। তিনি বলার পর বড় ভাবী মিষ্টি শরবত নিয়ে গিয়েছেন। এদের তিনি এক হাত দেখে নিবেন।

তিনি হেসে সামনে গিয়ে বললেন, “পুরুষদের স্বর্ণ পরা নিষেধ। তাই তোমার জন্য আমি এটা দিলাম।”
তিনি একটা ব্র‍্যান্ডেড রোলেক্স ওয়াচ আর একটা রূপার উপর হিরে বসানো আংটি দিলেন।

ফারদিন তাকেও সালাম করতে চাইলে তিনি সরে গেলেন। ” মুখে সালাম দিলেই যথেষ্ট।” মিতার মামী খালা মিলে মুখ ভেঙালো।

ফুফু বললেন,” মিলা কে ডাকেন নাই কেন ভাইজান? ও কই ওরে ডাক দেন।” সবাই অস্বস্তি বোধ করলো।
মিলার মামী মিলার মা কে ডেকে বললেন মিলার বরের জন্য তারা কিছুই আনেন নি এখন কি হবে? মিলার মাও লজ্জায় পরলেন৷ কারণ তিনি নিজেই মুহিনের জন্য তেমন বিশেষ কিছু করেন নি। ননদ আরেক দফা ক্ষেপে বোম না হলেই হয়।

মিলার কাজিনরা গিয়ে দরজায় নক করলো। এতক্ষণ মিলা মুহিন কে নিয়ে শুয়ে ছিলো। বাড়িতে হৈচৈ এর খবর তারা পেয়েছে। মুহিন একবার যেতে বলেছিলো। মিলা যায় নি। প্রয়োজন পড়লে তারা নিজেরাই ডাকবে। সে নিজে থেকে আর কোনো কিছুতেই থাকবে না ঠিক করেছে। কারণ এইখানে একটা সার্কাস চলছে। তাকে ডাকা হয়েছে কারণ সমাজে সম্মান রক্ষা করতে হবে তাই।

মিলা দরজা খুলে দিলো। তার খালাতো বোন বললো তাদের ড্রয়িং রুমে ডাক পড়েছে। মিলা আসছি বলে দরজা বন্ধ করে দিলো। মুহিন এর প্রশ্নবোধক চাহনি দেখে সে বললো, “ডেকেছে। চলুন।” মিলা কোলে মাহতাব কে নিয়ে ড্রয়িং রুমের দিকে গেলো। মুহিন তার পেছন পেছন গেলো।

ফারদিনের অস্বস্তি লাগছিলো। এর আগে দু বার রুদ্মিলাকে দেখেছে সে। প্রথম যেদিন দেখতে এসেছিলো সেদিন। আর দ্বিতীয় বিয়ের দিন। এরপর আজ তৃতীয় দেখা। তবে তা খুবই অস্বস্তি কর কারণ যেখানে সম্পর্ক কাপলের হবার কথা ছিলো সেখানে মিলা এখন তার জেঠশ। বউ এর বড় বোন।

মিতা অস্থির হয়ে বসে আছে। কতদিন পর আপাকে দেখবে৷ এর আগে শেষ আপাকে না দেখে এতোদিন কবে ছিলো তার মনে পরে না। আপা কি তার উপর রেগে আছে?

অতএব সকল অপেক্ষার অবসান ঘটলো মিলার রুমে প্রবেশের মাধ্যমে। মিলার ফুফু নিজে উঠে মিলাকে আর মিলার বর কে বসার জায়গা করে দিলেন। মিলাকে শাড়ি পরা দেখে একটু চমকালো মিতা। ফারদিন ও চমকালো। মিলার কোলে মাহতাব। মুহিন শশুর কে সালাম দিলো। মিলার বাবা এতোক্ষণ কিছুটা বিরক্ত ছিলেন। মুহিন মিলা এসেছে এ কথা তাকে জানানো হয় নি।তাছাড়া তাদেরকে যে আপ্যায়ন করা হয় নি সেটাও আরেকটা কারণ। মুহিন কে দেখেই তার সকল বিরক্তি উবে গেলো। কি সুন্দর মন ভোলানো চেহারা। কি মায়া! তিনি মুহিনকেও জড়িয়ে ধরলেন। কেমন আছো বাবা বলে তার হাল হকিকত জানতে চাইলেন।

মিতা অবাক হলো। আপার বিয়ে হয়ে গেছে? এই লোকটার সাথে?
ফুফার অফিসে জব করে লোকটা। বিয়ের দিন দেখেছিলো তো। আপার বিয়ে এই বিবাহিত লোকটার সাথে হয়েছে। মিতার সব কিছু কেমন দুলছে। সে চোখ নামিয়ে মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো।

মিলা জিজ্ঞেস করলো, ” কেমন আছিস মিতা?” মিতা চোখ তুলে তাকালো। আপার চোখ হাসছে। কি চমৎকার সে হাসি।
মিতা তাকিয়েই রইলো।

ফুফু মুহিনকেও মিষ্টিমুখ করালেন। মুহিনের জন্যও তিনি একই রকম দেখতে ঘড়ি, আংটি কিনেছিলেন৷ তা পরালেন।মুহিন প্রথমে মাথা তুলে না করতে চাইলেই তিনি চোখ বড় বড় করে হুমকি দিলেন। মুহিন হাসলো। ফুফুর সাথে তার সম্পর্ক ভিন্ন। নিজের সন্তানের চেয়ে কোনো অংশেই কম ভালো বাসেন না তাকে।

মিলার বাবা মুহিনের সাথে ফারদিনের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
” আমার বড় জামাই মুহিন। ফারদিনকেতো চেনোই আমার ছোট জামাই।”
মুহিন ফারদিনের সাথে করমর্দন করলো।

মিতাকে তাদের রুমে নিয়ে যেতে বললেন মিতার মা। মিতা জিজ্ঞেস করলো, ” আপা তাহলে কোন রুমে থাকবে?”

মিতার মা একবার মিতার দিকে তাকালেন, ” তোর রুমে থাকবি। ওই রুমে এসি আছে। জামাইয়ের গরমে থাকতে কষ্ট লাগবে। তাই তোদের জন্য ওই রুম ঘুছাইতে কইছি।”

মিতা বললো,” তাহলে আপা কি গেস্ট রুমে থাকবে? ওই রুমের ফ্যানের স্পিডও তো কম, এসিও নাই।”
” ফ্যান ঠিক করাইছি। বড় জামাইয়ের গরমে থাইকা অভ্যাস আছে। উনি কিছু মনে করে নাই।”
” মা মিলা আপা কি তোমার আপন মেয়ে না?” মিতা খুবই শান্ত শব্দে কথাগুলো বললো।
চমকে তাকালেন মিতার মা।
মিতা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নিজের রুমে গেলো। তার পেছন পেছন ফারদিনও গেলো।

মিতা বিছানায় বসতেই ফারদিন রুমের দরজা আটকে দিলো। ফারদিনই আগে জিজ্ঞেস করলো, ” মিলার বিয়ে হয়ে গিয়েছে? কই কিছু বলোনি তো। বিয়ে ভাঙার সাথেই সে বর পেয়ে গেলো?”
মিতা স্মিত হাসলো।
” আমার কাছে আমার ফোন ছিলো না ফারদিন সাহেব। পনেরো দিন আমি আপনার বাসায় আপনার মায়ের অকথ্য কথা শুনে আর রাতে আপনার মনোরঞ্জন করে কাটিয়েছি। সুতরাং এটা আমার জন্যও সারপ্রাইজিং বটে।”

ফারদিন অবাক হয় মিতাকে দেখে। মিলাকে দেখতে আসার দিন গুলোয় সে এক প্রাণোচ্ছলা, চঞ্চলাকে দেখেছিলো। এই নারীর সাথে যার কোনোই সাদৃশ নেই।

অস্থিরতা জাপটে ধরে তাকে। তার সাথেও তো প্রতারণা হচ্ছিলো।

” তোমার পরিবার খুবই স্বার্থপর মিতা। এর দায় তুমি একা আমাকে দিতে পারো না।”
” আপনাকে দায় দেই নি তো। সবাই স্বার্থপর। সে আপনার পরিবার হোক বা আমার।” মিতা সেখানে বসা আর সমীচীন মনে করলো না। উঠে রুমের বাহিরে চলে গেলো। ফারদিন বিছানায় বসে দুহাতে মুখ ঢাকলো। কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতি এটা!

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০৯

0

ঝরা পাতা উড়ে যায়
পর্ব-০৯

শাহাজাদী মাহাপারা

দিনটা শুক্রবার। মুহিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাস্তা বানিয়েছে আজ। মিলা এখনো ঘুমাচ্ছে সাথে মাহতাব। গত রাতে মাহতাব খুব জ্বালিয়েছে। ঘুমাতে দেয় নি প্রথমে ২ টা পর্যন্ত সেও মিলার সাথেই জেগেছিল। এরপর কখন ঘুমিয়েছে খেয়াল নেই। ঘুম থেকে উঠে দেখে ৮ টা বাজে। মুহিন ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরের দিকে গেলো।

আজ মিলাদের বাসায় যাবার দিন। মিলার ফুফা কল করেছেন ফের একবার গত পরশু। তাদের দাওয়াত দিয়েছেন মিলার বাবা। মুহিন মাহতাব সমেত। মিলা অভিমান করে আছে তাই সরাসরি তাকে কল করেন নি। এমন কি মুহিনকেও তিনি শিকার করেছেন কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না। তবুও ফুফার কথা রাখতে মুহিন যাবে। দুপুরের লাঞ্চে৷ সম্ভবত মিলার বোন কেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। আত্মীয় স্বজনরাও আসবেন। মিলার সম্ভবতঃ অস্বস্তি লাগবে সেখানে যেতে। নতুন জামাই আর আতিথিয়েতা রক্ষার ঝামেলা না থাকলে মুহিন কক্ষনো সে বাড়িতে যেতো না। কিন্তু আজ যেতে হবে মিলার এটা প্রথম দ্বিরাগমন। তাছাড়া সামনের সপ্তাহে সেও ছুটি নিবে অফিস থেকে৷ বাড়ি যাবে বাবা মায়ের কাছে। কতদিন হলো বাবা মা কে দেখে না৷ নিজের গ্রামের সাথে সম্পর্ক ভুলেছে আজ তিন বছর হতে চললো। মাহতাবের মায়ের গ্রামের বাড়ি পছন্দ ছিলো না। তার সেখানকার পিওর আবহাওয়া স্যুট করতো না। তাই শেষবার গ্রামে গিয়েছিলো বিয়ের পর। এরপর আর যাওয়া হয় নি। আম্মা আব্বা এসেছিলেন। কিন্তু বেশিদিন থাকেন নি। আগে এলে বেশ কিছুদিন থাকতেন৷ একদিন অফিস থেকে এসে দেখে ঘর খালি৷ তাকে না জানিয়েই চলে গিয়েছেন তারা৷ এরপর মা নিজেই ফোন করে বলেছেন বাড়িতে জরুরি কাজ ছিলো তাই চলে গিয়েছেন। কত বোকা ছিলো মুহিন, সেটা বিশ্বাস করে নিয়েছে। আচ্ছা মিলাও কি এরকমই হবে? নাহ। এ কদিনে সে মিলাকে যতটা দেখেছে মিলা খুবই মিশুক। সে খুব সহজে সবাইকে কাছে টেনে নেয়। এটা তার একটা বিশেষ গুণ যা সে নিজেও জানে না৷ মুহিন চায়ের কেতলি থেকে চা কাপে ঢেলে মিলাকে ডাকতে গেলো রুমে।
**********

মিলা যখন মুহিনের সাথে বাড়ির গেইটে ঢুকলো তখন বাজে বেলা ১২ টা প্রায়। ভেতরে ঢুকে দেখলো এলাহি কান্ড। বিয়ের দিনের মতোই সাজ সাজ রব। বাড়ির এক সাইডে উঠানের মতো সেখানে রান্নার কাজ হচ্ছে৷ আর ভেতর থেকে বাচ্চাদের হৈচৈ এর আওয়াজ আসছে। মিলাতো জানতো সব মেহমান বিয়ের দিনই চলে গিয়েছে। মিলা ভাবলো ভেতরে যাবে না ফিরে যাবে। একবার সাহস করে মুহিনের দিকে তাকালো৷ মুহিন সম্ভবতঃ মিলার অস্বস্তি বুঝতে পারলো। মিলাকে সাহস দিয়ে সে বললো ভিতরে যেতে কারো অসম্মান যেনো না হয়। অতঃপর মিলা মাহতাবকে কোলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে গেলো। ৫ তলা বাড়ির ২ তলা বাদে বাকি সবই ভাড়া দেয়া। দু ইউনিটের বাড়িতে শুধু ২ তলাতেই একটা ইউনিট। মিলা কলিং বেল বাজালো। মিলার মা দরজা খুলেই মিলাকে দেখে জড়িয়ে ধরতে এলেন। মিলার কেনো যেনো মন সায় দিলো না তাকে জড়িয়ে ধরতে। তিনি ধরলেও মিলা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো শুধু। মুহিন ততক্ষণে ব্যাগ নিয়ে উপরে চলে এসেছে। শাশুড়ি কে দেখে লম্বা সালাম দিলো সে। তিনি সালামের উত্তর নিয়ে ওদের ভেতরে যেতে বললেন৷ মিলা ভেতরে গিয়ে রুমে ঢুকতে নিলেই মিলার মা বাঁধা দিলেন। মিলা পেছনে তাকালো।
” মিলা তোর জন্য ওইদিকের গেস্ট রুমটা ঠিক করেছি। এই রুমটায় মিতারা আসলে থাকবে।”
মিলা অবাক হলো না। হেসে জিজ্ঞেস করলো শুধু, ” কেনো মা? তোমার ছোট মেয়ের বিদেশি জামাই কষ্ট করে দুটো দিন এসি ছাড়া ঘুমাতে পারতো না? তুমি আমার রুমে আমাকেই যেতে নিষেধ করছো?”

মুহিন পরিস্থিতি বুঝলো।
” সমস্যা নেই মিলা আমরা ওই রুমেই যাই চলো। এমনিতেও মাহতাব এসির বাতাস সহ্য করতে পারে না। আমাদের সমস্যা হবে না।”
মিলা একবার মুহিনের দিকে তাকালো আরেকবার তার মায়ের দিকে। মুহিন ব্যাগ টা নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে এগুলো মিলার পেছনে পেছনে।

“আপনাকে লজ্জায় ফেলে দিলাম মুহিন সাহেব। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।” মুহিন হাসলো৷
“আমি জীবনে অনেক কঠিন পরিস্থিতি পার করেছি মিলা এইসব খুবই সাধারণ সেখানে। আপনি মন খারাপ করবেন না প্লিজ। ”

মিলা রুমে ঢুকে ফ্যান ছাড়লো৷ ব্যাগটা কাভার্ডের সাইডে রেখে মাহতাব কে বিছানায় শুয়িয়ে দিলো। গরমে ঘেমে গিয়েছে বেচারা।আজ বৃষ্টি হবার সম্ভবনা রয়েছে তাই বাহিরে বাতাস দিচ্ছে৷ মুহিন রুমের জানালা খুলে দিতেই একটা মিষ্টি সুঘ্রাণে ঘর ভরে গেলো৷ ভেজা মাটির ঘ্রাণ। বাহিরের বাতাসে মুহূর্তেই রুম ঠান্ডা হয়ে এলো। মুহিন সামনে রাখা ডিভানটায় বসে আছে মিলার চাচী রুমের সামনে এসে নক করলেন। মিলাকে দেখলেন মাহতাবকে বুকের কাছে নিয়ে শুয়ে আছে আর মুহিন ডিভানে বসা। তিনি শরবত আর মিষ্টি এনেছিলেন। মুহিন সালাম দিয়ে শরবতের গ্লাসটা হাতে নিলো। কুশল বিনিময় করে তিনি রুম থেকে চলে গেলেন। মিলা হাসলো।
” হাসছেন কেনো?”
” বাচ্চা দেখে সবাই অবাক হয়েছে তাই।”
” কেনো? কেউ জানে না মাহতাবের কথা?”
” না৷” মিলার সহজ স্বীকারোক্তি।
মুহিনের মাথায় যেনো বাজ পড়লো।
“কি বলছেন মিলা?”
” বিয়ের দিন ফুফু শুধু আমার কানে কানে বলেছিলো। আর আব্বা জানতেন। আম্মাও সম্ভবতঃ পরে জেনেছেন। আর কেউ জানেন না।”
” মিলা আপনি কি বলছেন এইসব? আমিতো আগেই সব জানিয়েছিলাম।” অস্বস্তিতে মুহিনের মাথার রগ দপদপ করছে।
” আপনি এতো চিন্তা করছেন কেনো? বিয়ে আমি রাজি খুশিতেই করেছি৷ সংসার ও আমিই করবো এতে অন্য কেউ জেনে কি করবে?”
মুহিন অবাক হয়ে তাকালো মিলার দিকে। কত সহজে মিলা কথা গুলো বলছে। অথচ তার অস্থির লাগছে এটা ভেবে যে সবাই জানার পর কিভাবে নিবে বিষয়টা।

মিলার মায়ের রুমে সব মহিলারা জড় হয়েছে৷ মিলার দুই চাচী, ২ খালা আর মামী। কাজিন বড় বোনেরা আর মিলার ফুফু। মিলার মা আর ফুফুকে এই মুহূর্তে চার্জ করা হচ্ছে কেনো মিলাকে জেনেশুনে একটা বিবাহিত এক সন্তানের পিতা এমন পাত্রের কাছে বিয়ে দেয়া হয়েছে? বংশে এমন কোনো হিস্ট্রি নেই৷ মিলার জন্য তাদের সবার নাম খারাপ হবে কাওকে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি৷ এতক্ষণ মিলার ফুফু ধৈর্য ধরেই সব শুনছিলেন। মিলার মায়ের কান্নার নাটক দেখে এবার বিরক্ত হলেন তিনি। ধমকে উঠলেন।
” বাড়িতে নতুন জামাই আসছে। আপ্যায়ন না করে এইখানে গোল টেবিল মিটিং বসাইছো। মশকরা করো আমার সাথে তোমরা?”
সবাই এবার চুপ হলো। মিলার চাচীরা ভেবেছিলেন এই মকায় তারাও এক হাত দেখে নিবেন একমাত্র ননদ কে। একদম বড়লোক বাড়িতে বিয়ে বসে ধরাকে সরা জ্ঞান করে। সব কয়টা ভাই কোনো কাজ করার আগে বউদের আগে বোনের পরামর্শ নেয়। মিলার গাঁধে বন্দুক রেখে একে একটা টাইট দেয়া যাবে এবার ভেবেছিলেন। কিন্তু জংগলের হিংস্র প্রাণী হায়না হলেও জঙ্গলের রাজা তো সিংহই থাকে৷ এক ধমকে সব ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গিয়েছে৷

মৃদু চিৎকার করলেন তিনি ভাতিজি,ভাতিজা বউদের উপর। মিলার মা ই মিলার মামাদের মধ্যে বড়। তাই হিসেবে সেই বাড়ির বড় কাজিনদের দিক থেকে বাকি ভাই বোনেরা ছোট হওয়ায় কেউ এই বৈঠকে নেই।

” খুব লায়েক হইছো একেক জন তাই না? মিলার চিন্তায় সবার কলিজা পুরতেছে। নকশা করো? আমার সামনে এইসব নাটক করবা না সব গুলারে হাড়ে মজ্জায় চিনি আমি। তোমাদের সবাইকে কৈফিয়ত দিতে হবে আমার যে ভাতিজিকে গাঙ্গে না ভাসায় বিবাহিত বাচ্চার বাপের সাথে কেন বিয়ে দিছি? মিতারে বিয়ে দিয়া তো সব পালাইছিলা আমার ভাতিজির খবর তখন কেউ নিছো? ”

মিলার চাচী একবার বলতে চাইলেন সব তো লুকিয়ে করেছে তাদের সাথেতো পরামর্শ করেনি। কিন্তু বললেন না। কাসুন্দি যত কম ঘাটা হবে গন্ধ কম ছড়াবে। তাছাড়া এই মেয়ে ডেঞ্জারাস তাদের শাশুড়ির কার্বন কপি। কখন না আবার তাকেই ওয়াশ করে দিবেন ঠিক নাই৷ শেষে ছেলের বউদের সামনে হবে বেইজ্জতি৷

” আমার ভাতিজিকে আমি যেখানে খুশি বিয়ে দিছি। মিলার সমস্যা নাই তার মানে তোমাদের কারোরই মাথা ঘামানির দরকার নাই। আর ছেলের সাথে এখনোতো কেউ দেখাই করো নাই। দেখলে বুঝতা মিতার জামাই সোনা হইলে,মিলার জামাই হীরা। এই বংশের কোনো পুরুষের কেন কোনো জামাইয়ের সাথেই মুহিনের তুলনা হয় না। আমার নিজের বরেরও না।” উত্তেজিত হয়ে বলেই যাচ্ছেন মিলার ফুফু। মিলার মা শেষে আপা বলে ডাকায়। তিনি ফিরে তাকালেন। রাগে তার শিরা উপশিরা জ্বলে যাচ্ছিলো এতোক্ষণ।
” তুমি এতো নাকি কান্না করতেছো কেন ভাবি? যাও আপ্যায়নের ব্যবস্থা করো। তাছাড়া তুমিওতো আমার মুহিনকে দেখতে পারো না। এইসব নাটক বাদ দিয়া যাও এখন।”

মিলার মা ননদের বাক্যবাণে থতমত খেলেন। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছে এই বৈঠকের সমাপ্তি টানতে রুম থেকে বের হলেন। তার ছোট কন্যা এলো বলে।

মিলার ফুফু রুম থেকে বের হবার আগে আরেকদফা সবাইকে চোখ রাঙিয়ে চলে গেলেন।

চলবে…!

ঝরা পাতা উড়ে যায় পর্ব-০৮

0

“ঝরা পাতা উড়ে যায়”

পর্ব-০৮
শাহাজাদী মাহাপারা

স্টেজে গিয়ে ক্যামেরার ফ্ল্যাশ উপেক্ষা করে ফারদিনের সামনে গিয়ে ডাকলো,
“শুনছেন।”
মিতার ডাক শুনে সবাই কম বেশি অবাক হলেও ফারদিন বিরক্ত হলো। প্রকাশ না করেই জিজ্ঞেস করলো, ” কোনো সমস্যা?”

মাথা উপর নিচে নেড়ে সে বললো, ” আপনি কোথায় ছিলেন এতক্ষণ? আমাকে ভিতরে আসতে বলার পর থেকেই আপনি গায়েব।”
ফারদিন একটা মুখ ভেঙালো। এতক্ষণ সে খেয়াল করেছে মিতা কি করছিলো৷ এসেই গিলতে বসেছে। একবারো ওকে খোঁজেনি। এখন ইচ্ছে করে সবার সামনে অপদস্ত করতেই তার এইখানে আসা।

ফারদিন বললো, ” এখানেই ছিলাম। তুমি অস্বস্তি বোধ করবে তাই ডাকি নি। এসো পরিচয় করিয়ে দেই। ”
মিতা সবার দিকে হেসে তাকালো। সবাই অবাক হয়ে ওদের কনভার্সেশন শুনছিলো এতক্ষণ।
“আমার বউ রুস্মিতা।”
ফারদিনের সম্বোধনটা অন্য রকম লাগলো মিতার কাছে। ভালো লাগা খারাপ লাগা দুটোর সংমিশ্রণ। এই জায়গাটা অন্য কারো ছিলো। এই জায়গাটার একান্ত মালকিন আমি। ঠিক এইরকমই অনুভূতি। সবাই কেমন বোকা বোকা হাসলো। বাংলাদেশে এমন অসম বয়সের বিয়ে অহরহ দেখা যায়। কিন্তু ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে এমন কিছু একটু অস্বস্তিকর। যেখানে ওরা বন্ধুরা মিলে এতক্ষণ অন্যকিছুরই ইঙ্গিত দিচ্ছিলো। মেয়েটা দেখলে নিশ্চই কষ্ট পেতো।বা মন খারাপ হতো৷ ফারদিনের হতে যাওয়া বিয়ে ভেঙেছে তা সবাই শুনেছিলো কম বেশি। একেক জন একেক জায়গায় থাকায় একসাথে হতে সময় লেগেছে তাই ফারদিনের বিয়ে এটেন্ড করতে পারেনি। তাছাড়া ওর বিয়েটাও ফ্যামিলি রিলেটিভ ছিলো আর কেউ দাওয়াত পায়নি। রিসেপশন দেরিতে হবার কথা ছিলো। অথচ ভেঙে যাওয়া বিয়েতেই যে ফারদিন বিয়ে করে এসেছে তা কেউ জানতো না। মিতা সবার চোখ মুখের এক্সপ্রেশন দেখলো। কিন্তু কি করবে বুঝতে পারলো না৷ মেরুন রঙের শাড়ি পরা মেয়েটার মুখে যেনো কেউ নুন ঢেলে দিয়েছে। বুঝতে পেরেছে মিতা। এটা ফারদিনের কিছুমিছু হলেও হতে পারতো টাইপ বান্ধবী৷ যার পাত্তা অলরেডি কেটে গিয়েছে। অন্যরকম আনন্দ হচ্ছে মিতার পেটের ভিতর। সে মেকি হাসি দিতে চাইলেও এখন তার সত্যিই সুখী সুখী হাসি দিতে মন চাইছে। এবং সে তাই করলো৷ সবাই একটু কনফিউজিড এখন মিতাকে কি ভাবী বলে সম্বোধন করবে? মিতা কম হলেও তাদের বয়সে নয় থেকে দশ বছরের ছোট।

সবার সাথে পরিচয় পর্ব শেষে মিতা আবার গিয়ে বসে নিজের জায়গায় । সব বন্ধুরা মিলে ফারদিনকে অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে করার জন্য টিপ্পনী কাটলো। শুধু তিশা বাদে। তিশা নিচে নেমে মিতার দিকে এগিয়ে যায়।
“কেমন আছো রুস্মিতা?”
কফির ছোট কাপটা হাত থেকে রেখে উপরে তাকায় মিতা।
” ভালো। আপনাকে চিনতে পারলাম না দুঃখিত।
” আমি তিশা, তোমার বরের বান্ধবী।”

বান্ধবী শব্দটা এমন ভাবে বলছে ইংরেজিতে ন্যারেট করলে ওটা গার্লফ্রেন্ড হয়ে যাবে। মিতা মনে মনেই বললো, বান্ধবী হতে যাবেন কেন! বলেন না প্রাক্তন প্রেমিকা ছিলেন। যত্তসব।
” ও আপু বসেন প্লিজ।” হেসেই উত্তর দিলো মিতা।

সামনের চেয়ার টেনে বসতে বসতেই তিশা মিতার দিকে ভালো করে একনজর দেখে নিলো।

” শুনেছি তোমার বড় বোনের জায়গায় নাকি তুমি জোর করে বিয়ে বসেছো। বোনের বর কে এতোই ভালো লেগেছিলো?তোমার বয়সতো খুবই কম। অনুভূতি কেমন?” বলেই সামনে রাখা একটা চিজ বল মুখে নিলো তিশা।

মিতা আর খেতে পারলো না। তখন না ওনার বন্ধুরা বললো তিশা ডাক্তার বিদেশ থেকে হায়ার স্টাডি করে এসেছে। অথচ তার বাক্যের ব্যবহারের যাচ্ছে তাই অবস্থা। খাবারটা গলায় আটকে আছে। মিতার চোখ দুটো জ্বলে যাচ্ছে। তবে দমে যাবার পাত্রী সে না। আর যাই হোক মিথ্যের প্রতিবাদ সে অতি অবশ্যই করে।
” এই বয়সে সিঙ্গেল থাকার চেয়ে আমার মতো বয়সে বিয়ে করে ফেলাই ভালো না আপু? আপনিও আপনার চেয়ে একটু বয়স্ক কাওকে দেখে বিয়ে করে ফেলুন। কনে সাজার এক্সপেরিয়েন্স আপনারও হবে। তখন আর জনে জনে অনুভূতি জানতে চাইতে হবে না আপু।”
তিশা মাথা নিচু করে হাসলো। মিতা সেখান থেকে উঠে চলে গেলো।

” মিতাকে দেখেছো? তোমার সাথেই এই টেবিলে বসে থাকতে দেখেছিলাম।”
” ওয়াশরুমে গিয়েছে হয়তো।”
” আচ্ছা।”
” ফারদিন শোনো।”
ফারদিন পিছনে ফিরে তাকালো।
” তুমি ভালো আছো?”
তিশা ভেবেছিলো ফারদিন মুখ কালো করে থাকবে হয়তো উত্তর দিবে ‘তুমি যেমন রেখে গিয়েছিলে’ টাইপ কিছু।

কিন্তু তিশাকে অবাক করে দিয়ে ফারদিন তার বত্রিশপাটি দাঁত বের করে ম্যাজিক টুথ পাওডারের এডের মতপ দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে গেলো। যার অর্থ এই দাঁড়ায় যে তুই ভাবছিস তুই গেলে আমি দেবদাস হবো? যা ভাগ।

তিশার বদৌলতে ফারদিনের বউ বেশ পরিপক্ক আর ঠোঁট কাঁটা। বন্ধু মহলে সে কথা চাউর হতে সময় লাগলো না। পার্টি সেন্টার থেকে ফেরার পথে ফারদিন তিশাকে তার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে এলো এক প্রকার অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো। নিজের ঘরে ঢুকে মিতার একটা বিচ্ছিরি অনুভূতি হচ্ছে। দ্রুত এই সঙ পালটে ফেলতে হবে। লাগেজ থেকে একজোড়া সালওয়ার স্যুট নিয়ে মিতা ঢুকলো ওয়াশরুমে।

মিতা যখন নিজের রুমে যাচ্ছিলো ফারদিনের বাবা তখন ফারদিনকে নিজের রুমে ডাকেন।

“মিতার ফুফা কল করেছিলেন।”
” ও। হঠাৎ?না মানে এই পাঁচদিনে তো একবারো কল করে খোঁজ নেন নি। বিয়ে দিয়েতো একটা বোঝা নামিয়েই দিয়েছেন আর খোঁজ না নিলেও চলে তাই না?”
” তুই তো এত কথা বলিস না। হঠাৎ এতো কথা বলছিস কেনো?”
” বাবা বাদ দাও। কি জন্য কল করেছিলো তা বলো।”
” মিতার বাবা তোদের তার বাসায় ডেকেছেন দাওয়াতে।”
” ও বাড়িতে গেলে আবার ওর বোনের মুখোমুখি হতে হবে। এটা কি শোভনীয়?”
” এইটা একটা একসিডেন্ট যা হয়ে গিয়েছে। পাস্ট টেনে লাভ নেই। তাছাড়া আজীবন তো আর তোমরা এমন মুখ না দেখে থাকতে পারবে না। মুখোমুখি একদিন হতেই হবে।”
ফোস করে নিশ্বাস ছাড়লো ফারদিন।

” ঠিকাছে। কবে যেতে হবে?”
” পরশু।”
” মা জানে? ”
” রুম দেখে বুঝতে পারছো নিশ্চই।”
ফারদিন হাসলো৷ তিনিও হাসলেন।
যেদিন ফারদিনের বাবা মায়ের মাঝে কথা কাটাকাটি হয় সেদিন মা তারিনের রুমে ঘুমান। ফারদিন নিজের রুমে এসে দেখলো বিছানার উপর মিতার শাড়িটা পরে আছে। সে কোর্ট খুলে শাড়ির পাশেই রাখলো। মিতা ওয়াশরুমে৷ এতো রাতেও শাওয়ার নিচ্ছে। ফারদিন শাড়িটায় হাত বুলালো। কি অদ্ভুত! মিতাকে গাড় রঙে সত্যিই অপ্সরীর মতো লাগে৷ বিয়ের দিন সে দেখেছিলো যখন সবার সাথে মিতা হাসছিলো তখন। একই বিয়ের শাড়িতে মিলা মিতা দুজনকেই দেখেছে ফারদিন৷ একই সাজে৷ অথচ শাড়িটা মিলার থেকে মিতার গায়ে বেশি মানিয়ে গিয়েছিলো। যেনো শাড়িটা তার জন্যই তৈরি ভুল করে অন্যের অঙ্গে চড়েছিলো। মামীর কিচকিচ আর রাগের জন্যই মিলাকে দেয়া সব শাড়ি গহনা খুলে মিলাকে পরানো হয়েছিলো। অথচ তিনি জেদ না করলে মিতাকে সত্যিই ওভাবে দেখা হতো না৷ মিতার নিশ্চই খুব কষ্ট হয়েছিলো বোনের কথা ভেবে।

আচ্ছা সে এসব কি চিন্তা করছে? মিতা কষ্ট পেলেই বা তাতে তার কি এসে যায়? সে তো এর জন্য দায়ী না। উল্টো তাকেই ঠকানো হচ্ছিলো।

ফারদিন নিজের কাপড় নিয়ে বাহিরের ওয়াশরুমে গেলো ফ্রেশ হতে।

চলবে…!