বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1184



অবেলায় ভালোবাসা  পর্ব-৩

0

অবেলায় ভালোবাসা  পর্ব-৩

 

লেখা –সুলতানা ইতি

 

চুহেস কফিশপ থেকে বেরিয়ে গেলো
রেস্ট হাউজে এসেই বিছানার উপর এলিয়ে দিলো নিজেকে

নিহার – স্যার ডিনার রেডী আপনি আসুন
চুহেস- আমি খাবোনা আজ, নিহার তুমি যাও
নিহার- স্যার না খেলে শরির খারাপ করবে

নিহারের কথা শুনে চুহেস রেগে যায়
– এই ছেলে তোমার কি আমাকে কোন দিক দিয়ে বাচ্ছা মনে হয়,আমাকে বাচ্ছাদের মতো বুঝাচ্ছো, না খেলে শরির খারাপ করবে, আমি তোমার থেকে সব কিছু ভালো বুঝি যাও এখান থেকে

চুহেসের এসব কথা নিহারের কাছে নতুন নয় তবু ও গ্রামে আসার পর এই প্রথম রাগ দেখালো সেই ভেবে একটু অবাক হলো নিহার দরজার বন্ধ করে নিহার বেরিয়ে যায়

চুহেস চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে আজকে কফি শপের মেয়েটা কে কোথায় যেন দেখেছি,হা সকাল বেলার ওর সাথে আমার দেখা হয়েছে কিন্তু সকালে আমি তার দিকে এতো খেয়াল করিনি,
আজ সন্ধায় যখন ওর চোখের দিকে নজর পড়লো মনে হলো ঐ চোখ আমার খুব পরিচিত কিন্তু এমন মনে হলো কেনো, ওর সাথে কি আমার পূর্বের কোন যোগসাজশ আছে মনে পড়ছে না,
আচ্ছা মেয়েটার নাম কি? নাম টা ও তো জানা হলো না, ইসস আবার যদি দেখা হতো তা হলে নাম টা যেনে নেয়া যেত

এই সব ভাবনার মধ্যে দিয়ে চুহেস কখন যে ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেলো টের ফেলো না,, সকালে ঘুম ভাংলো নটা বাজে
তা ও নিহার এসে জাগিয়েছে

চুহেস ঘুমের আড়মোড়া ভেঙে বল্লো, আর ও আগে ডেকে দাওনি কেনো নিহার, তোমাকে বলেছিনা গ্রামে যতো দিন থাকবো সকাল সকাল উঠে হাটতে বের হবো

নিহার অপরাধির মতো উত্তর দিলো,আসলে স্যার কাল রাতে আমার মনে হলো আপনার শরির ভালো নেই তাই আর জাগাইনি এতো সকাল সকাল

চুহেস -ঠিক আছে আমি ফ্রেশ হয়ে নিচ্ছি একটু গ্রাম্য বাজার টাতে ঘুরতে যাবো তুমি ও যাবে আমার সাথে সো রেডী হয়ে নাও

চুহেস ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে পড়লো নিহার কে নিয়ে
নিহার- স্যার আপনি কিন্তু নাস্তা করেন নি কাল রাতে ও না খেয়ে ঘুমালেন
চুহেস- হুম গ্রামের বাজারে কোন একটা দোকানে বসে কিছু খেয়ে নিবো
নিহার- কি বলছেন স্যার আমি যতোটুকু জানি গ্রামের এই সব দোকানে অসাস্থকর পরিবেশে খাবার তৈরী হয় এগুলা খেলে শরির আর ও খারাপ করে

চুহেস নিহারের কথা শুনে মৃদু হাসলো, বল্লো আজ না হয় খেয়ে দেখবে শহরের ঐ দামি রেস্টুরেন্ট এর খাবারের ছেয়ে গ্রামে রাস্তার পাশের দোকানের খাবার অনেক সুস্বাদু

নিহার- স্যার কিছু মনে করবেন না একটা কথা জানার খুব ইচ্ছে

চুহেস- বলো
নিহার- গ্রামে আসার পর আপনাকে দেখে গ্রামের সব কিছুর প্রতি আপনার টান দেখে মনে হচ্ছে আপনার ছোট বেলা কেটেছে এই রকম ই কোন একটা গ্রামে

নিহারের কথা শুনে চুহেস গম্ভীর হয়ে বলে
-উওর টা যে তোমার পেতেই হবে এটা কোন জরুরী নয়

চুহেসের গম্ভীর কন্ঠ শুনের নিহার আর কথা বাড়ানোর সাহস ফেলো না
ওরা গিয়ে রাস্তার পাশে একটা টং দোকানে বসেছে

দোকানে চা কেক কলার ওয়ার্ডার দিলো চুহেস,
চুহেস এগুলা ওয়ার্ডার দিয়েছে দেখে নিহার বড় বড় চোখ করে চুহেসের দিকে তাকায়, তার মুখে কোন কথা নেই সে সত্যি বোবা হয়ে গেছে মনে হয় মেহেরা ফ্যাশন শো এর মালিক এখন সাধারণ খাবার খাবে তা ও রাস্তার দ্বারে টং দোকানে বসে(কথা গুলো নিহার মনে মনে বলছিলো)

চুহেস- ও ভাবে তাকানো কিছু নেই নিহার আমরা সবাই মানুষ এক মাটিতে তৈরী আল্লাহ আমাদের মাঝে কোন বেঁধা বেধ সৃষ্টি করে দেয় নি,আমরা নিজেরা ই নিজের মধ্যে এতোটা দূরুত্ব সৃষ্টি করেছি,
এই খাবার যদি একজন দিন মুজুর মাঠে কাজ করা লোক খেতে পারে টঙ দোকানে বসে
তা হলে আমি কেনো পারবো না,
ঘৃনার চোখে নয় নিহার ভালোবাসার দৃষ্টিতে দেখো সব কিছুই আপন মনে হবে

নিহার যেন আবার ও বড় দরনের ধাক্কা খেলো চুহেসের কথাগুলো দোকানি মন দিয়ে শুনছিলো,
এতোক্ষনে চুহেস ছোট বেলার মতো করে চায়ের মধ্যে চুবিয়ে বন খেতে লাগলো নিহার খাওয়া ভুলে গিয়ে চুহেসের দিকে তাকিয়ে আছে, ওর চোখ যেন বিশ্বাস করতে পারছে না,সামনে বসে থাকা লোকটি তার বস

চুহেস খাওয়া শেষ করে নিহারকে বল্লো তুমি তো কিছুই খেলেনা, তুমি কি এখানে খাবে নাকি বড় মার্কেটে গিয়ে কোন একটা রেস্টুরেন্ট এ খাবে
নিহার- না স্যার আমি এখানেই খাবো আপনি খেয়েছেন যখন তখন আমি ও খেতে পারবো

এতোক্ষনে দোকানি কথা বল্লো,দোকানি মাঝ বয়সের তিনি বল্লো কিছু মনে করোনা বাবা তোমাদের দেখে মনে হচ্ছে তোমরা আমাদের গ্রামের নয়

চুহেস- জ্বী চাচা আমরা আপনাদের গ্রামে বেড়াতে এসেছি
দোকানী – কিন্তু বাবা তুমি কি এ গ্রামে আগে কখনো এসেছো
চুহেস- কিছু বল্লোনা

কিছুক্ষন পর দোকানী আনন্দে চিৎকার করে উঠে বল্লো,-তোমাকে ছিনতে পেরেছি আমি, তুমি আবরারের ছেলে তাই না, কি যেনো একটা নাম ছিলো তোমার মনে পড়ছে না

চুহেস- মাথা নিছু করে বল্লো জ্বী আপনি ঠিক ধরেছেন আমি আবরার মেহেরার ছেলে চুহেস মেহেরা

দোকানী চুহেস কে জড়িয়ে ধরলো বল্লো তোমার বাবা খুব ভালো মানুষ ছিলো আল্লাহ ভালো মানুষদের
খুব তাড়া তাড়ি নিয়ে যায় যার দৃষ্টান্ত তোমার বাবা আর মা রেখে গেছে

তা বাবা আহমদের খবর কি কিছু জানো
চুহেস- না চাচা তাদের সাথে কোন যোগাযোগ রাখিনি,আর কেমন করে রাখবো সব কিছু না জানলে অল্প কিছু তো আপনারা জানেন

দোকানীরর নাম রহিম তিনি বল্লেন- হুম তা ঠিক, তোমার জেঠিমা তো দু বছর আগে পৃথিবী ছেড়েছে,
শ্রুতির বিয়ে হয়েছে খুব ভালো জায়গাতে, আদনান বিয়ে করেছে একটা মেয়ে আছে

আহমদ এখন চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে সারাদিন বাড়ির পাশে একটা চেয়ারে বসে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে মনে হয় কারো পথ ছেয়ে বসে আছে

চুহেসেরর রহিম চাচার কথা শুনে চোখে পানি চিক চিক করছে, তবু ও অন্য দিকে তাকিয়ে পানি লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলো, তার পর বল্লো
-চাচা বাবুই কেমন কেমন আছে সে এখন কতো বড় হয়েছে বলতে পারেন

রহিম হেসে জবাব দিলো পারবো না কেনো, ওতো একটা লক্ষি মেয়ে।এবার কলেজে উঠেছে শুনেছি, এই তোমরা আসার আগে আমার দোকানে এসে ছিলো

চুহেস আর কিছু বল্লো না
কিছুক্ষন চুপ থেকে বল্লো চাচা আপনি আমার কথা টা একটু গোপন রাখবেন

রহিম- তা কেনো বাবা,তোমার কি এখন উচিত নয় সব ভুলে তোমার জেঠুর সাথে দেখা করা উনি যা করেছে তার শাস্তি উনি পেয়েছেন এবার তো তার কাছে ফিরে যাও

চুহেস কিছু না বলে, বল্লো আসি চাচা,
এতোক্ষন নিহার এদের মাঝে নিরব একজন দর্শক এর মতো সব কথা শুনছিলো, শুনে চুহেস কে সকালে করার প্রশ্ন গুলোর উত্তর পেয়ে গেছে

চুহেস দোকান থেকে বেরিয়ে গেছে তার পিছু পিছু নিহার ও হাটছে
নিহার- স্যার এবার কোথায় যাবেন ভাবছেন
চুহেস- আনমনা হয়ে বল্লো,চলো দিঘীর পাড়ে যাবো এখন অবশ্য দিঘীটা নেই তবে জায়গাটার নাম পরিবর্তন হয়নি

নিহার- ওখানে কেনো স্যার
চুহেস কিছু বল্লোনা নিরবে হাটতে শুরু করলো উদ্দেশ্য যদি একবার বাবুই কে দেখতে পায়

কদমতলী দিঘীর পাড়ে এসে চুহেস দাড়িয়ে আছে ভাবছে এক সময় এখানকার পঞ্চাশ একর জমির মালিক ছিলো আমার দাদা, দাদার মারা যাওয়ার পর বাবা আর জেঠু মালিক হয়,

তার পর একদিন এক ভয়াবহ এক্সসিডেন্টে বাবা কে হারাই আমি তখন খুব ছোট আমি আর মা দুজনের কোন ভাবে দিন চলে যেতে বাবাকে হারানোর ধাক্কাটা হয়তো মা সইতে পারেনি,

এমন সময় নিহার কিছু একটা বল্লো,চুহেস ও ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে
চুহেস- কিছু বল ছিলে নিহার
নিহার- হুম স্যার হাটতে হাটতে অনেক দূর এসেগেছি কোথায় যাবেন

চুহেস নিহারের কথা শুনে আসে পাশে তাকিয়ে দেখলো হুম ঐ তো বাড়িটা দেখা যাচ্ছে
নিহার- এই বাড়িটা কার?
চুহেস- কিছু বল্লোনা আনমনে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে একটু পরে দেখলো একজন বৃদ্ধা উঠোনে চেয়ার পেতে বসলো

এমন সময় একটা মেয়েলি কন্ঠে কথা কানে এলো চুহেসের তাকিয়ে দেখলো সেদিনের সেই মেয়েটি

মেয়েটি- এই নিয়ে আপনার সাথে তিন বার দেখা হচ্ছে আপনি কে আপনাকে তো আগে দেখেছি বলে মনে হচ্ছে না

চুহেস- হুম আমরা পরশু গ্রামে এসেছি এই তো গুরা ঘুরি করবো এই আরর কি

মেয়েটি বল্লো- তা আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন কেনো

মেয়েটির কথা শুনে চুহেসের হৃদয়ের সাগরে চলাত করে উঠলো, তার পর নিজেকে সামলে নিয়ে বল্লো – ওহ বাড়িটা বুঝি আপনাদের

মেয়েটি- হুম,কিন্তু আমাদের এতোবার দেখা হয়েছে আমি এখনো আপনার নামটা ই জানতে পারেনি
– ওহ তাই তো,আমি চুহেস আর ও নিহার
– আমি গাইথি

চুহেস নামটা শুনে চমকে উঠে, মনে হচ্ছে তার মনের মধ্যে ঢেউ বয়ে গেলো

গাইথি- কি ভাবছেন
চুহেস নিজেকে সামলে নিয়ে বল্লো কিছু না,

গাইথি- চলুন আমাদের বাড়িতে গিয়ে বসবেন

চুহেস- না আজ না অন্য একদিন এই বলে উলটো দিকে হাটা দরলো
গাইথি নির্বাক দৃষ্টিতে চুহেসের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে
to be continue

অবেলায় ভালোবাসা পর্ব-২

0
obelay valobashar
obelay valobasha

অবেলায় ভালোবাসা  পর্ব-২

 

লেখা –সুলতানা ইতি

 

ভোর পাঁচটা বাজার আগেই চুহেসের ঘুম ভেংগে যায় ঘড়িতে তখন চারটা চল্লিশ বাজে, চুহেস নিজেই ভেবে পাচ্ছে না এতো ভোরে তার ঘুম ভাংলো কি করে
কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে ও লাভ হয়নি ঘুম তার এলো না চারিদিকে ফজরের আজান শুরু হলো
আসতে আসতে হালকা ভোরের আভা দেখা দিলো
চুহেস বিছানা ছেড়ে উঠলো

-যাই হেটে আসি অনেক দিন ভোরের আলো বাতাস স্পর্শ করেনি আমার শরির আজ করবে, আর সেটা যদি গ্রামে স্বচ্ছ আলো বাতাস হয় তা হলে তো আর কথা ই নেই

বেরিয়ে পড়লো চুহেস ভাবনাহীন ভাবে চলতে শুরু করলো অনেক দিন পর এ ভাবে হাটছে ভালো লাগছে এখনো পুরোপুরি অন্ধকার কাটেনি

কিছুক্ষন উদ্দেশ্য হীন ভাবে হেটে থেমে গেলো তার পর ই মনে হলো কদমতলী দিঘীর কথা সাথে সাথে চুহেস ছোট বেলায় হারিয়ে গেলো, কতো যে কেঁদেছে একা একা ঐ দিঘীর পাড়ে বসে
এখন ও মনে পড়ে সব দুঃখের সাথি ঐ দিঘী ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে ফিরে এসে হাটা ধরলো পথ ঘাট সব কেমন অপরিচিত হয়ে গেছে

পনেরো বছরে অনেক কিছুই পালটে গেছে এখন গ্রাম গুলো গ্রামের জায়গায় নেই শহরে পরিণত হয়েছে তবু ও ভালো লাগছে হয়তো জন্মভূমি বলেই এতো ভালো লাগা

কিন্তু কিছুতেই কদমতলী দিঘী টা খুজে পাচ্ছে না চুহেস রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো কাউকে দেখলেই জিজ্ঞাস করে নিবে এই ভেবে,
পূর্ব আকাশ লাল হয়ে উঠেছে হয়তো কিছুক্ষন পরেই সূর্য উঠবে কিন্তু মানুষজন মনে হয় এখন ও ঘুম থেকে উঠেনি

ঘড়িতে কাটায় সাতটা বেজে গেলো কিন্তু এখনো কাউকে দেখলাম না

চুহেস- এবার কি সত্যি ফিরে যেতে হবে
না আমার শৈশবের প্রিয়ো জায়গা টা এক নজর না দেখে কিছুতেই যাবো না

এমন সময় কারো হাসিতে চুহেস চমকে উঠলো, দুটো মেয়ে হেসে হেসে কথা বলতে বলতে পশ্চিম দিকে যাচ্ছে

চুহেস মনস্থির করে নিলো এদের কেই জিজ্ঞাস করবে
দিঘী টার কথা
আসতে আসতে মেয়ে দুটো আর ও কাছে চলে এলো

চুহেস- এক্সকিউজমি কদমতলী দিঘী টা কোন দিকে একটু বলবেন

মেয়ে দুটো দাঁড়িয়ে কিছুক্ষন চুহেসের দিকে তাকিয়ে থেকে বল্লো আপনি কি এই গ্রামে নতুন

চুহেস কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বল্লো
– হুম বলতে পারেন নতুন

মেয়ে দুটো বল্লো আসুন আমাদের সাথে

প্রায় আধ ঘন্টা হাটার পর মেয়ে দুটো বল্লো এই জায়গার নাম ই কদমতলী দিঘী

চুহেস- ধন্যবাদ, মনে হয় আর একটু ওদিকে গেলেই দিঘী টা পাবো তাই না

মেয়ে দুটো বিস্ময় চোখে চুহেসের দিকে তাকিয়ে বল্লো আপনি মনে হয় কিছুই জানেন না ঐ দিঘী টা অনেক দিন আগে বালি দিয়ে পুরিয়ে ফেলেছে এখন সেখানে বিরাট এক কন্সটাকশনের কাজ চলছে একটু ওদিকে গেলেও দেখতে পাবেন,

চুহেস- ধন্যবাদ আপনাদের কে
মেয়ে দুটো চলে গেলো

চুহেস মনে খুব আঘাত ফেলো ছোট বেলার স্মৃতি টা এই ভাবে মুছে যাওয়াতে, কিন্তু ঐ দিঘীতে তো আমাদের ৫%অংশ ছিলো তা হলে জেঠু কি আমাদের অংশ বিক্রি করে দিয়েছে

আর ভাবতে পারলো না ফিরে এলো রেস্ট হাউজে, তখন সকাল দশটা বেজে গেছে প্রায়

চুহেস কে দেখে নিহার এসে বল্লো স্যার এতো ভোরে কোথায় গিয়েছিলেন কতো খুঁজেছি চলুন নাস্তা করবেন

চুহেস- হুম তুমি যাও আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি
চুহেস ফ্রেশ হয়ে এসে নাস্তা খেতে বসলো

নিহার-স্যার মিঃ প্লাতিনি ফোন করেছিলো, উনি আমাদের কম্পানির সাথে ডিল টা করতে চায়

চুহেস- কোন টা
নিহার- ঐ যে ডিজাইনের ব্যাপার টা, যেটা আপনি না করে দিয়েছিলেন,এখন তিনি আপনি যেমন টা বলেছিলেন তেমন ডিজাইন দিবে বলেছে

চুহেস- তুমি বলোনি আমি এখন ঢাকার বাইরে

নিহার- বলেছি, মিঃ প্লাতিনি নিজেই আসতে পারবে না উনি চিন গিয়েছে, ডিলটা করতে আসবে উনার ম্যানেজার, লোকেশন বললে ম্যানেজার সরাসরি চলে আসবে

চুহেস- ঠিক আছে আসতে বলো

নিহার- মিটিং টা কি এখানে হবে নাকি বাইরে কোথা ও

চুহেস- বাইরে কোন একটা কফি শপে হলে ভালো হয়,এখনকার সব কিছুর সাথে পরিচিত হওয়া যাবে

নিহার- ওকে স্যার তাই হবে

নাস্তা শেষে চুহেস রুমে ফিরে এলো উদ্দেশ্য একটু ঘুমিয়ে নিবে, শুধু শুধু গেলাম
শৈশব এর প্রিয় জায়গা টা তো ফেলাম ই না উলটো মনের কোনে কষ্টটা বেড়েছে, এই ভেবে যে আমার সব কিছু কেনো এতো তাড়া তাড়ি পরিবর্তন হয়ে যায়,কেনো কোন কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করে না
চুহেসের ভাবনায় ছেদ পড়লো দরজা নক হওয়াতে

চুহেস- এসো, ছোট্ট করে কথা টা বল্লো
নিহার- স্যার কি কিছু ভাবছেন
চুহেস- না, তুমি কিছু বলবে?
নিহার- হুম
চুহেস- বলো
নিহার- মিঃ প্লাতিনির ম্যানেজার আজ সন্ধায় মিটিং টা করতে চায়,, উনারা রওনা হয়েছেন
চুহেস- ঠিক আছে সময় মতো সব রেডী করে নিও,
নিহার- ওকে স্যার

সন্ধ্যা হওয়ার আগেই চুহেস আর নিহার কফিশপে বসে অপেক্ষা করছে, কাজের বেলায় চুহেস কোন গাফিলতি করে না, কোন কাজে দেরী করা,অনিয়ম প্রশ্নেই আসে না, মিঃ প্লাতিনির ম্যানেজার আসার ১৫ মিনিট আগেই চুহেস গিয়ে বসে আছে, ফাইল গুলো নতুন করে দেখে নিচ্ছে

ঘড়ি দেখে চুহেস বল্লো নিহার মিঃ প্লাতিনির ম্যানেজার এর নাম কি
নিহার- আদনান স্যার

চুহেস- মিঃ আদনান এখনো আসছে না কেনো ১০ মিনিট লেইট

নিহার- স্যার মনে হয় জ্যামে পড়েছে,এক্ষুনি এসে পড়বে হয়তো

মিঃ আদনান যখন কফিশপে এসেছে তখন অলরেডি ৩০ মিনিট লেইট
নিহার গেছে আদনান কে নিয়ে আসতে

নিহার- মিঃ আদনান আপনার এতো লেইট হলো কেনো স্যার কিন্তু খুব রেগে আছে,আমাদের চুহেস স্যার টাইমের ব্যাপারে খুব কড়া

আদনান- হুম বুঝতে পারছি বুঝেন ই তো ঢাকা থেকে আসা তো কোন মুখের কথা নয় রাস্তায় অনেক ঝামেলা থাকে

নিহার আদনান কে নিয়ে চুহেসের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো

যদি ও চুহেসের রাগে আগুন হয়ে থাকার কথা কিন্তু কেনো জানি রাগ তার আসছে না

এদিকে আদনাম ভাবছে এমা কি বলে আমার বয়সের একটা ছেলে মেহেরা ফ্যাশন শো এর বস এটা ও মানতে হবে কিন্তু এই বস কে কোথায় যেন দেখেছি মনে হচ্ছে

চুহেস- মিঃ আদনান চলুন কাজের কথা বলি
চুহেসের কথায় আদনান বাস্তবে ফিরে এলো জ্বী স্যার বলুন,

চুহেস সব ফর্মালিটি শেষ করে ডিলটা সাইন করলো

সব কাজ চুকাতে রাত ১১ টা বেজে গেছে
চুহেস- মিঃ আদনান এ রাতে তো আপনি ঢাকায় ফিরতে পারবেন না

আদনান- জ্বী স্যার, আমি ঢাকাতে ফিরছি না আজ, এখানে ই আমার গ্রামের বাড়ি আজ রাত টা সবার সাথেই থাকবো ভাবছি আমার বোন তো শুনেই পাগলের মতো ছুটে এসেছে

চুহেস- ওহ আচ্ছা, এই বলে চুহেস কফিশপ থেকে বের হয়ে আসছিলো এমন সময় কারো সাথে যেন ধাক্কা খেলো, ঘুরে তাকিয়ে দেখে একটা মেয়ে

চুহেস খুব অভাক ই হলো এতো রাতে একা একটা মেয়েকে কফিশপে দেখে

মেয়েটি চুহেসের ভাবনা ভেংগে দিয়ে বল্লো আরেহ আপনি ও তো সে যাকে সকালে আমি দিঘীর পাড়ে নিয়ে এসেছিলাম

এতোক্ষনে চুহেস খেয়াল করলো এই মেয়েটি সকালের দুটি মেয়ের মধ্যে একটি

চুহেস- হুম মনে পড়েছে, তা এভাবে হন্তদন্ত হয়ে কোথায় যাচ্ছিলেন
মেয়েটি আমার ভাইয়া এখানে এসেছে, তার কাছে এসেছি

চুহেস- ও আচ্ছা, এই বলে বেরিয়ে গেলো কফিশপ থেকে

to be continue

অবেলায় ভালোবাসা পর্ব-১

0
অবেলায় ভালোবাসা পর্ব-১
অবেলায় ভালোবাসা পর্ব-১

অবেলায় ভালোবাসা পর্ব-১

 

লেখা –সুলতানা ইতি

 

আজ সকালেই চুহেস সুন্দর নগর এসে পৌচায়, গ্রামটির নাম সুন্দর নগর, গ্রাম টি সত্যি অসাধারন সুন্দর চুহেস এখানে একটা রেস্ট হাউজে উঠেছে
এখানে তার থাকার কোন আপন নীড় নেই স্থায়ী ভাবে সে ঢাকায় থাকে ঢাকা নীল ক্ষেত তার বিশাল বিলাস বহুল বাড়ি মেহেরা মেনশন নামে খুব পরিচিত,,

গ্রামে আসার একটাই কারন ছোটবেলার কিছু স্মৃতি হাতড়ে বের করা, চুহেস এসেই বিশ্রামের জন্য শরির টা এলিয়ে দিলো সোপায় সংগে এসেছে তার বিশ্বস্ত পি এ নিহার

নিহার- স্যার আপনি বেডরুমে গিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিন সকাল নটার আগে নাস্তা আসবে না বলেছে রেস্ট হাউজের বাবুর্চি

চোখ বন্ধ করেই আরাম করছিলো চুহেস নিহারের কথা শুনে চোখ খুলে বলে, আমি এখন ঘুমাবো না নিহার গ্রাম টা ঘুরে দেখতে হবে বহুদিন পর গ্রামে আসা প্রায় পনেরো বছর হবে এই গ্রাম ছেড়েছি

নিহার – স্যার খারাপ সময় গুলো মনে না করাই ভালো ,

চুহেস- নিহার আমাকে আমার ঐ স্মৃতি গুলোই বাচার উৎসাহ দেয়, আমার এই কোটি কোটি টাকা আমাকে সেটা দিতে পারে না যেটা দিচ্ছে আমার ফেলে আসা স্মৃতি গুলো

নিহার- নাহ মানে স্যার

চুহেস- বুঝেছি তুমি চাইছো আমি এখন একটু ঘুমিয়ে নিই, পরে নাস্তা খেয়ে ঘুরতে বের হতে তাই তো

নিহার- একদম ঠিক স্যার

চুহেস- ঠিক আছে তোমার কথাই রইলো
চুহেস তার সবার ঘরে এসে গা টা এলিয়ে দিলো লম্বা জার্নির পরে সত্যি একটি বিশ্রামের দরকার ,
রেস্ট হাউজের জানালা দিয়ে বাইরে আকাসের দিকে চোখ যায় সত্যি গ্রামের আকাশ অনেক স্বচ্ছ যা শহরে থেকে উপভোগ করা যায় না,

মনে পড়ে এই সুন্দর নগরের এক সুন্দর রাতে বাবুই কে চাঁদ দেখাতে বের হয়েছি কতোইবা তখন আমার বয়স সাত কি বা আট হবে কি বা বুঝতাম তবুও জেঠি মা আমায় অনেক মেরেছে কেনো একা একা বাবুই কে নিয়ে বের হয়েছি তাই, এটা কি কোন অন্যায় হতে পারে,

আজ অনেক গুলি বছর বাবুই কে দেখিনা এখন নিশ্চয়ই অনেক বড় হয়ে গেছে, আচ্চা ও কি আমাকে দেখে ছিনতে পারবে,আমার কথা কি মনে রেখেছে ঐ টুকু বয়সের মেয়ে কি আমার কথা মনে থাকবে,

এমন সময় কেউ এসে দরজায় নক করলো
চুহেস ভাবনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো ঘড়ি দেখলো আট টা বাজে এখনো তো নাস্তার সময় হয়নি তা হলে কে এসেছে

চুহেস- দরজা খোলা ই আছে বিতরে এসো দেখলো দরজা ঠেলে নিহার ঘরে ঢুকলো হাতে নাস্তার ফ্লেট

চুহেস- কি ব্যাপার নিহার সময়ের আগে নাস্তা চলে এলো যে

নিহার- স্যার আপনাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হলো তাই বাবুর্চি কে তাড়া দিয়ে জলদি নাস্তা নিয়ে এলাম খেয়ে আরাম করুন ভালো লাগবে

চুহেস- তুমি আমার কথা এতো ভাবো কেনো নিহার
এই জগতে যার কেউ নিয়ে তাকে নিয়ে এতো ভাবা কি ঠিক

নিহার- স্যার এমন ভাবে বলবেন না শুনতে খারাপ লাগে, আল্লাহ তায়ালা কাউকেই একা করে রাখেন না জীবন চলার পথে কেউ ই একা চলতে পারে না,
সাথীর প্রয়োজন হয়, হয় তো একটু আগে বা একটু পরে তার দেখা পায়

চুহেস- তুমি বলছো আমি এই অভেলায় এসে চলার মতো সাথি পাবো

নিহার- অভেলায় বলছেন কেনো স্যার আপনার বয়স আর কতোই হলো এর থেকে ও অনেক বেশি বয়সে মানুষ বিয়ে করে সংসারি হয়
এর মাঝে চুহেস এর খাওয়া শেষ হয়ে যায় নিহার আর কথা না বাড়িয়ে এঁটো প্লেট গুলো নিয়ে চলে যায়

নিহারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চুহেস ভাবছে আজ কালকার যুগে নিহারের মতো ছেলে পাওয়া সত্যি দুষ্কর, সততা বিনয়ী সব দিক দিয়ে ই অনন্য নইলে আমার মতো উগ্র মেজাজের একটা ছেলের পি, এ, কিছুতেই হতে পারতো না

চুহেস একটা খারাপ দিক হুট হাট রেগে যাওয়া আর সব রাগ যায় নিহারের উপরে,আর কার উপরই বা রাগ ঝাড়বে কেউ তো নেই তার
ঘরে, বাইরে, একজন ই আছে নিহার। আর ঘোটা দশেক কর্মচারী যারা বাড়িতে কাজ ছাড়া আর কোন কিছুতেই মাথা ঘামায় না

বিকেলের দিকে চুহেস গ্রাম টা ঘুরে দেখতে বের হয় সাথে আছে নিহার

নিহার- স্যার আপনি ঘেমে উঠেছেন আপনার মাথার উপর ছাতা টা তুলে ধরি

চুহেস- নাহ দরকার নেই ভালো লাগছে গোধূলি বিকেল, লাল রোদ
হাটতে হাটতে অনেক দূর এসে থেমে গেলো চুহেস
নিহার- স্যার কিছু বলবেন

চুহেস- হুম একটু কদমতলী দিঘীর পাড় যেতে ইচ্ছে করছে কিন্তু এখন যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে ভাবছি কাল সকাল সকাল যাবো আজ এখানেই ঘাসের উপর বসে গোধূলি সন্ধ্যা দেখবো,
বসে পড়লো চুহেস ঘাসের উপর, নিহার বসবে কি বসবে না,ইতস্ত করছে

চুহেস- বসে পড়ো নিহার ভালো লাগবে , তুমি শহরের পরিবেশে জন্ম নিয়েছো গ্রামের এগুলা দেখার সোভাগ্য হয়নি তোমার,আজ যখন সুযোগ পেলে তখন একটু গ্রামের মাটির সাথে মিশে দেখো খুব আনন্দ লাগবে

নিহার ভাবছে স্যার গ্রামের মাটিতে পা দিয়ে কেমন যেন হয়ে গেছে, ঢাকা হলে তো এই দুই দিনে দুই হাজারের ও বেশি ধমক দিতো
তার ছেয়ে বেশি ভাংচুর করতো,
কিন্তু এই সুন্দর নগরের মাটি স্পর্শ করতে ই যেন উনার রাগি আচরণ গুলো কথায় হারিয়ে গেছে

আসতে আসতে সন্ধ্যা ফেরিয়ে রাত নেমে এলো
চুহেস বসে আছে ঘাসের উপরে যেমন টা বিকেলে বসে ছিলো ঠিক তেমন ই ভাবেই বসে আছে একটু নড়চড় করেনি মনে হচ্ছে চুহেস তার দেহ থেকে মনকে আলাদা করে অন্য কোথাও হারিয়ে গেছে

নিহার- স্যার অন্ধকার হয়ে গেছে চলুন এবার ফেরা যাক

নিহারে কথা শুনে চুহেস চমকে উঠলো এতোক্ষনে মনে হয় তার দেহে প্রান এসেছে নড়েচড়ে বসে বল্লো
-ও হা চলো এবার উঠি সত্যি রাত নেমে গেছে
রেস্ট হাউজে এসে ওরা খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে পড়লো

to. be continue

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ৩০/অন্তিমপর্ব

1

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ৩০/অন্তিমপর্ব

লেখিকা: সুলতানা তমা

কয়েক মাস পর…

মেঘের ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে। মধ্যে কেটে গেছে কয়েকটা মাস, মেঘ হয়তো নিজেকে বদলে নিয়েছে অনেক। জানিনা মেঘ কোথায় আছে আমাকে এখনো ভালোবাসে কিনা। আজ তোহাকে খুব মনে পড়ছে একটাবার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে হচ্ছে খুব। মেঘ’কে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে, জানতে ইচ্ছে হচ্ছে ও কি আমাকে এখনো ভালোবাসে নাকি চোখের আড়াল হতেই ভুলে গেছে কণা নামের এই পাগলীটাকে। মেঘ হয়তো ভাবছে আমি কানাডায় আছি আর নতুন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছি, মেঘ তো আর জানেনা আমি যে আজ ওর সন্তানের মা হতে যাচ্ছি। আজ আমার ডেলিভারির ডেইট সন্ধ্যায় সিজার করা হবে, এইতো আর দু একঘণ্টা পর হসপিটালে এডমিট হয়ে যাবো। আজ আমার বড্ড ভয় হচ্ছে শুধু মনে হচ্ছে আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমার বেবির কি হবে। আজ মেঘ’কে পাশে পেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আজ মেঘ আমার পাশে থাকলে আমার হাতটা ওর দুহাতের মুঠোয় পুরে রাখলে বুঝি আমি অনেক বেশি সাহস পেতাম, প্রত্যেকটা নারীই বোধহয় এই সময় নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে পাশে পেতে চায়। মেঘ আসবে কিভাবে ও যে জানেই না আমি ওর সন্তানের মা হবো আজ। ইচ্ছে হচ্ছে আম্মুকে একবার বলি মেঘ’কে জানাতে কিন্তু ভয়ও হচ্ছে কারণ আজ চাচ্চু আর চাঁচিআম্মা আসছেন। চাচ্চু যদি রেগে যান তা…
জোহা: আপু এই আপু.. (জোহা আসছে শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম, মেঘের ছবির সামনে থেকে সরে এসে বিছানায় বসলাম)
জোহা: আব্বুরা চলে এসেছেন নিচে যাবে?
আমি: নারে ভালো লাগছে না।
জোহা: আপু তুমি কাঁদছিলে?
আমি: কই নাতো।
জোহা: তোমাকে কতোবার বলবো এই অবস্থায় হাসিখুশি থাকবে একদম মন খারাপ করবে না। (মৃদু হাসলাম, কিভাবে বুঝাই ওদের আজ যে মেঘ’কে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে)
জোহা: আসছি আমি, একা একা একদম সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসতে যেওনা কিছু প্রয়োজন হলে আমাকে ডেকো।
আমি: ঠিক আছে।
জোহা চলে গেল। এই কয়েকমাস জোহা আর আম্মু আমাকে আগলে রেখেছেন। জোহা তো আমাকে একদম মন খারাপ করতে দেয়নি সারাক্ষণ এইটা ওইটা করে আমাকে হাসিখুশিতে মাতিয়ে রেখেছে। আর আম্মু তো সারাক্ষণ আমি কি খেলে ভালো হবে কোন খাবারটা খেলে বেবি ভালো থাকবে এসব নিয়েই পরে থাকতো। সত্যি এমন পরিবার পাওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না, আমি সত্যিই খুব ভাগ্যবতী।

জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আনমনে হয়ে বিকেলের আকাশ দেখছি, আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি একটু পর হসপিটালে চলে যেতে হবে। কেন যেন মনে হচ্ছে আজ আমার কিছু একটা হয়ে যেতে পারে, প্রত্যেক মেয়েরই বোধহয় এই সময় এমনটা মনে হয়। আচ্ছা সত্যি যদি আজ আমার কিছু হয়ে যায় তাহলে তো মেঘ’কে শেষ দেখাটুকুও দেখতে পারবো না, তোহাকে শেষবারের মতো বুকে জড়িয়ে নিতে পারবো না, তোহার মুখে নতুন আম্মু ডাকটাও আর শুনা হবেনা।
আস্তে আস্তে টেবিলের পাশে এসে চেয়ারটা টেনে বসলাম। ডায়েরীর একটা পাতা ছিঁড়ে ছোট একটা চিরকুট লিখতে বসলাম। “মেঘ তুমি হয়তো ভাবছ আমি কানাডা গিয়ে নতুন করে জীবন শুরু করেছি কিন্তু না মেঘ তুমি তো জানোনা আজ আমি তোমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছি। কোথায় যেন শুনেছিলাম প্রেগন্যান্ট অবস্থায় সবসময় যাকে দেখবে বেবি ঠিক তারমতো হবে, জানো মেঘ আমি সবসময় তোমার ছবিটার দিকে তাকিয়ে তাকতাম যেন বেবিটা দেখতে ঠিক তোমার মতো হয়। জানিনা এসব কথা সত্যি কিনা তবুও নিজের অজান্তেই এমন পাগলামি করতাম। সবসময় চেয়েছি আমার যেন আরেকটা তোহা হয় মানে মেয়ে বেবি যেন হয়। আজ সেই খুশির দিন যে দিনটার জন্য প্রত্যেক নারী অপেক্ষা করে। আজ খুব ভয় হচ্ছে মেঘ তোমাকে পাশে পেতে ইচ্ছে হচ্ছে কিন্তু তাতো সম্ভব নয়, আমার যদি কিছু হয়ে যায় আমার তোহা আর দোহা’কে তুমি দেখে রেখো। ওহ হ্যাঁ বলতে ভুলে গেছি আমার মেয়ে বেবি হলে দোহা নাম রেখো তোহার বোন তো নাম মিলিয়ে না রাখলে হয় বলো? আম্মুকে বলে যাবো আমার কিছু হলে যেন এই চিঠিটা আর বেবি তোমাকে দিয়ে দেয়। আমায় ক্ষমা করে দিও মেঘ তোমার থেকে দূরে থাকতে চাইনি পরিস্থিতি আমাকে বাধ্য করেছিল। ভেবো না দূরে আছি বলে তোমায় ভুলে গেছি, ভুলিনি মেঘ তোমায় এক মুহূর্তের জন্যও। যেমনটা আগে ভালোবাসতাম তোমায় এখনো ঠিক তেমনি ভালোবাসি শুধু এখন আর আগের মতো প্রকাশ করতে পারিনা নীরবে ভালোবাসি তোমায়”

চাঁচি: জোহা কণাকে সাবধানে নিয়ে আয়।
আমি: আরে আমি একাই যেতে পারবো।
চাঁচি: একদম চুপ বোকা মেয়ে এসময় কেউ একা চলাফেরা করে? (ওদের পাগলামি দেখে খুব হাসি পাচ্ছে বাসা থেকে বের হয়ে একা নাকি গাড়িতে উঠতে পারবো না)
আম্মু: কণা সাবধানে।
আমি: হুম।
চাচ্চু: কিরে কণা তুই কি আমার উপর রেগে আছিস? (গাড়িতে উঠে বসতেই চাচ্চুর এমন প্রশ্ন শুনে বোকা হয়ে গেলাম)
আমি: কেন চাচ্চু রাগ করবো কেন?
চাচ্চু: আমার সাথে কথা বলছিস না যে।
চাঁচি: এখন কি মেয়ের বকবক করতে ইচ্ছে হবে তুমিও না।
চাচ্চু: মা আমি যা করেছিলাম তোর ভালোর জন্যই করেছিলাম।
আমি: জানি চাচ্চু, আর তোমাদের কারো উপর আমার কোনো রাগ নেই। তোমরাই তো আমার সবকিছু আপন মানুষের উপর কি রাগ করা যায়?
চাচ্চু: এইতো লক্ষী মেয়ে।

গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি, গাড়ি চলছে হসপিটালের দিকে। যদিও জানি এই রাস্তা দিয়ে মেঘ কখনো আসবে না তবুও অবচেতন মন রাস্তার চারপাশে শুধু মেঘ’কে খুঁজছে। শুধু একটা বার আজ মেঘ’কে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে। আজ সবাই যেভাবে আমাকে নিয়ে পাগলামি করছে ভাবছে কিসে ভালো হবে আমার, মেঘ পাশে থাকলে হয়তো এভাবেই পাগলামি করতো।

একটু পর নাকি আমাকে অটি’তে নেওয়া হবে, চুপচাপ বসে চাচ্চুর এইটার জন্য ওইটার জন্য দৌড়াদৌড়ি দেখছি আর ভাবছি সবাই আমাকে কতো ভালোবাসে।
আম্মু: কিরে মন খারাপ কেন?
আমি: নাতো আম্মু।
আম্মু: ভয় পাচ্ছিস তোর চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে, পাগলী মেয়ে ভয় কিসের আমরা সবাই আছিতো তোর পাশে।
আমি: একজন মানুষের শূন্যতা সবার পাশে থাকার আনন্দটাকে ফিকে করে দিচ্ছে।
আম্মু: কার? (আনমনে কি বলে ফেললাম আম্মুতো আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে)
আমি: কিছুনাতো আম্মু। এক গ্লাস পানি দিবে বড্ড তৃষ্ণা পেয়েছে।
আম্মু: দাঁড়া নিয়ে আসছি।

দুজন নার্স এসেছে আমাকে অটি’তে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এটাই সুযোগ আম্মুর হাতে চিঠিটা দেওয়ার। আম্মু আমার পাশেই দাঁড়ানো, আম্মুর হাতে চিঠিটা গুঁজে দিলাম। আম্মু আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে মৃদু হাসলাম।
আমি: জানো আম্মু প্রত্যেক নারী এই সময়টায় নিজের স্বামীকে পাশে পেতে চায় আমারো ইচ্ছে হচ্ছে মেঘ’কে একবার দেখতে কিন্তু কি করবো বলো আমার যে এই ভাগ্য নেই। আজ মেঘ এখানে থাকলে হয়তো আমার হাতে চুমু খেয়ে বলতো “ভয় পেয়ো না পাগলী আমি আছিতো” জানো আম্মু এই একটা কথা আজ খুব মিস করছি, হয়তো এই কথাটা আমার মনে অনেক বেশি সাহস যুগিয়ে দিতো। চিঠিটা তুমি খুলো না, যদি আমার কিছু হয়ে যায় আর বেবিটা বেঁচে থাকে তাহলে এই চিঠি আর বেবি মেঘ’কে দিয়ে দিও। তোহা সবসময় আমার কাছে একটা পুঁচকে পুতুল চাইতো, মায়ের ভালোবাসা তো দিতে পারিনি মেয়েটাকে পুঁচকে পুতুলটাই নাহয় দিয়ে দিও ওকে। (আম্মুর দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে, এখনো আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। নার্সরা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে আর আমি আম্মুর মায়াবী মুখটার দিকে তাকিয়ে আছি)

দুচোখ মেলে যখন তাকালাম চারপাশ কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা লাগলো, অক্সিজেন মাস্ক মুখে লাগানো হাতে কিসব লাগানো সাথে পেটে খুব ব্যথা অনুভব হচ্ছে। সামনের দেয়ালে রাখা দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ পড়লো বারোটা পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাজে। সন্ধ্যায় সিজার হবার কথা ছিল তারমানে মধ্যে কেটে গেছে কয়েক ঘন্টা, আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম বলে ডক্টর আমার শরীরে একটা ইনজেকশন পোষ করেছিল ব্যাস আর কিছু মনে নেই। মিটমিট করে রুমের চারদিকে চোখ বোলাচ্ছি হঠাৎ রুমের এক কোণে আমার চোখ আটকে গেল, মেঘ মোনাজাতে দুহাত বাড়িয়ে পাগলের মতো কাঁদছে। মেঘের পাশেই তোহা বসে আছে তোহার কোলে ছোট বেবি, তোহা আর বেবিকে পপি দুহাত দিয়ে আগলে রেখেছে। জ্ঞান ফেরার পর এমন সারপ্রাইজ পাবো আমিতো ভাবিইনি। হুট করে জোহা রুমে এসে ঢুকলো হাতে কিছু ওষুধ আর ইনজেকশন, আমাকে মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জোহা দৌড়ে আমার দিকে এগিয়ে আসলো।
জোহা: আপু তোমার জ্ঞান ফিরেছে তুমি ঠিক আছ তো? (জোহার চেঁচামেচি শুনে মেঘ ঘুরে আমার দিকে তাকালো)
জোহা: আপু কষ্ট হচ্ছে তোমার? কোথায় কষ্ট হচ্ছে ডক্টর ডাকবো? (জোহা তাড়াতাড়ি কেবিনের বাইরে চলে গেল। মেঘ এসে আমার পাশে ফ্লোরেই হাটু গেড়ে বসে পড়লো, মেঘের দিকে তাকিয়ে আছি এক দৃষ্টিতে)
আম্মু: কোথায় কণা জ্ঞান ফিরেছে আমার মেয়ের? (আম্মুকে দেখে চমকে উঠলাম কি অবস্থা হয়েছে আম্মুর, সবাই এতো অস্থির হচ্ছে কেন বুঝতে পারছি না)
ডক্টর: সবাই এভাবে চেঁচামেচি করলে কিন্তু প্যাসেন্টের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে। (জোহা ডক্টরকে ডেকে নিয়ে এসেছে, ডক্টর এসেই আমার অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিলো)
ডক্টর: এখন আর ভয়ের কোনো কারণ নেই।
আম্মু: কিরে কষ্ট হচ্ছে?
আমি: না আম্মু আমি ঠিক আছি, তোমরা এতো অস্থির হচ্ছ কেন?
আম্মু: অস্থির হবো না কতো ঘন্টা পর তোর জ্ঞান ফিরেছে জানিস তুই? ডক্টর তো সোজা বলে দিয়েছিল আল্লাহ্‌ কে ডাকতে। আমার মনে হয় মেঘের ভালোবাসার জোড়েই আল্লাহ্‌ তোকে আমাদের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন। জানিস মেঘ নামাজ পড়ে পাগলের মতো কেঁদেছে, এক মুহূর্তের জন্য জায়নামাজ ছেড়ে উঠেনি। (মেঘের দিকে তাকালাম আমার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
চাচ্চু: পরে এসব বলো এখন ওদের একটু একা থাকতে দাও। (চাচ্চুর কথা শুনে সবাই কেবিনের বাইরে চলে গেল)

মেঘ আমার পাশে বসে আমার দুগালে আলতো করে ধরলো, আমি ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি দেখে আমার কপালে ওর কপাল ঠেকিয়ে হুহু করে কেঁদে উঠলো।
আমি: কাঁদছ কেন এভাবে?
মেঘ: (নিশ্চুপে কেঁদেই যাচ্ছে)
আমি: মেঘ আমার দিকে তাকাও। (মেঘ এখনো কাঁদছে দেখে ওর একটা হাত ধরলাম এবার মেঘ আমার দিকে তাকালো)
আমি: কি হয়েছে কাঁদছ কেন?
মেঘ: এমনি, আমাদের দোহা হয়েছে দেখবে না? (মেঘ চোখের পানি মুছে নিয়ে তোহার দিকে এগিয়ে গেল, তোহার কোল থেকে বেবিকে এনে আমার পাশে শুয়ে দিলো)
মেঘ: আল্লাহ্‌ তোমার কথা শুনেছেন এইযে দেখো আমাদের মেয়ে বেবি হয়েছে। (আমি দোহার কপালে চুমু দিতেই মেঘ আমার কপালে ওর ঠোঁট ছুঁয়ালো)
তোহা: এইযে নতুন আম্মু শুনো আমি কিন্তু ওকে পুঁচকে পুতুল বলেই ডাকবো। (তোহার কথা শুনে মেঘ আমি দুজনেই হেসে দিলাম)
আমি: আচ্ছা ঠিক আছে এবার তুমি আমার এ পাশে এসে বসো। (তোহাকে হাত বাড়িয়ে ডাকতেই তোহা বেডে উঠে আমার বুকে মাথা রাখলো, তোহাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে ওর মাথায় আলতো করে চুমু খেলাম)
পপি: বাব্বাহ্ তুমি তো দুই মেয়ের মা হয়ে গেছ।
আমি: হ্যাঁ এখন থেকে আমার দুটু মেয়ে।
পপি: হয়েছে এবার একটু রেস্ট নাও, তোহা চলো আমরা বাইরে যাই সবাই আছে তো ওখানে।
তোহা: চলো।

পপি তোহাকে নিয়ে চলে যেতেই মেঘ আমার একটা হাত ওর হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু খেলো।
মেঘ: কষ্ট হচ্ছে?
আমি: তোমাকে আর তোহাকে ফিরে পেয়ে সব কষ্ট ভুলে গেছি।
মেঘ: আমাদের নতুন মেহমানের জন্যই তো আমাদের তুমি ফিরে ফেলে।
আমি: আচ্ছা তুমি জানলে কিভাবে আমি হসপিটালে?
মেঘ: চাচ্চু বাসায় গিয়েছিলেন, সবকিছু বলার পর আমরা সবাই হসপিটালে চলে এসেছি।
আমি: তুমি হয়তো ভেবেছিলে আমি… (মেঘ আমার ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে আটকে দিলো)
মেঘ: চিঠিতে এসব কি লিখেছিলে? কণা আমি একবার ভুল করেছিলাম তারমানে এই নয় যে আমি বারবার তোমাকে অবিশ্বাস করবো। জানো আমি রোজ তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকতাম, আমার মন বলতো তুমি ঠিক আমার কাছে ফিরে আসবে।
আমি: চাচ্চু নিষেধ করেছিল আর তোমার প্রতি অনেক অভিমান ছিল তাই ফোন করিনি।
মেঘ: অভিমান হওয়াটা তো স্বাভাবিক। তবে তোমার অভিমানের পাহাড় এতো বেশি হবে ভাবিনি, আমি বাবা হবো অথচ আমাকে জানাওনি। তোমার এমন অবস্থায় আমি তোমার পাশে থাকতে পারিনি।
আমি: এসব নিয়ে আর মন খারাপ করো না।
দাদী: এইযে আসবো? (দাদীর কন্ঠ শুনে দরজায় তাকালাম দাদী আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসছেন)
মেঘ: এসো।
দাদী: আমার দাদু ভাইকে তো শাস্তিটা ভালো ভাবেই দিলি।
আমি: ও বুঝি একা কষ্ট পেয়েছে আমার কষ্ট হয়নি?
দাদী: কষ্ট তো পেয়েছিস দুজনেই, এখন আর কোনো কষ্ট নয় দুই মেয়েকে নিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করো।
আম্মু: নতুন করে তো শুরু করতেই হবে আমাদের সবার রাগ যে কমে গেছে মেঘের উপর থেকে।
চাচ্চু: মেঘ’কে এতোটা ভালোবাসিস অথচ আমাদের সামনে প্রকাশ করিসনি, আজ তোর লেখা চিঠি না পড়লে তো আমাদের রাগ কমতো না।
আমি: চিঠি তোমরা পড়েছ?
আম্মু: হ্যাঁ তোর কান্না দেখে চিঠিটা প্রথম আমি পড়েছিলাম তারপর তোর চাচ্চুর হাতে দেই। তোর চিঠি পড়েই আমাদের রাগ কমে যায়, তোর চাচ্চু গিয়ে মেঘদের নিয়ে এসেছে।
বাবা: তবে আপনারা কিন্তু কণাকে দূরে নিয়ে ভুল করেননি, কণা দূরে ছিল বলেই মেঘ নিজের ভুল বুঝতে পেরে নিজেকে শোধরে নিতে পেরেছে। এখন মেঘ আর আগের মতো নেই অনেক বদলে গেছে। মেঘ প্রতি মুহূর্তে কণার জন্য অপেক্ষা করেছে, ওর এই অপেক্ষার ফল যে নতুন মেহমান হবে আমরা তো ভাবতেই পারিনি। (মেঘের দিকে তাকালাম ও আমার চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আমিতো ভেবেছিলাম মেঘ আমাকে ভুল বুঝবে কিন্তু না মেঘ আমার জন্য প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষা করেছে)
ভাবি: আমিও চলে এসেছি নতুন মেহমানকে দেখতে।
আম্মু: খুব ভালো করেছ। (ভাবি এসে দোহা’কে কোলে তুলে নিলো, আজ মনে হচ্ছে সবকিছু একদম ঠিক নিজেকে খুব সুখী মনে হচ্ছে)
জোহা: ডক্টর এর সাথে কথা বলেছি এক সপ্তাহ হসপিটালে থাকতে হবে।
আমি: এক সপ্তাহ?
মেঘ: সমস্যা নেই আমি আছি কণার পাশে। (খুব ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু মেঘের এই কথায় সব ভয় কেটে গেল, সত্যি প্রিয়জনের ছোট ছোট কথায় অনেক বেশি ভরসা পাওয়া যায়)

এক সপ্তাহ পর…

বাসায় চলে আসলাম, আজ হসপিটাল থেকে আমাকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে। এই এক সপ্তাহ মেঘ আমাকে ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্য দূরে যায়নি এমনকি বাসায় পর্যন্ত আসেনি। সবসময় মেঘ আমার পাশে থেকেছে, মেঘের বদলে যাওয়া, আমার প্রতি ওর ভালোবাসা বিশ্বাস আর কেয়ার সবকিছু দেখে নতুন করে মেঘের প্রেমে পড়ে যাচ্ছি বারবার।
মেঘ: এইযে মেডাম একা একা দাঁড়িয়ে কি ভাবছ? (জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম মেঘ এসে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো)
আমি: কি হচ্ছে তোহা আছে তো রুমে।
মেঘ: তোহা তো ওর পুঁচকে পুতুল নিয়ে ব্যস্ত আছে।
তোহা: এইযে পুঁচকে পুতুল ওদিকে তাকাস না, দেখতে পাচ্ছিস না আব্বু আর নতুন আম্মু রোমান্স করছে। (তোহার কথা শুনে মেঘ আমি দুজনে হেসে উঠলাম)
মেঘ: মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষ গুলোর থেকে কিছুটা দূরে যাওয়া প্রয়োজন। তুমি আমার থেকে দূরে গিয়েছিলে বলেই আমি তোমার শূন্যতা অনুভব করতে পেরেছি। আর তাইতো নিজেকে শোধরে নিতে পেরেছি।
আমি: কষ্ট যে হয়েছে দুজনেরই।
মেঘ: সারাজীবনের সুখের জন্য একটু কষ্ট করলে মন্দ কিসের?
আমি: (মৃদু হাসলাম)
মেঘ: এই কয়েক মাস শুধু তুমি আমাকে নীরবে ভালোবাসনি আমিও তোমায় নীরবে ভালোবেসে গেছি।
মেঘ আমার কোমর জড়িয়ে ধরে আমাকে ওর কাছে টেনে নিলো, আমার কপালে আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁয়ালো। একটা সস্থীর নিঃশ্বাস ফেলে মেঘের বুকে মাথা রাখলাম, মেঘ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আজ আর কোনো ভয় নেই, নেই আমার প্রতি মেঘের অবিশ্বাস। এই বুকে মাথা রেখে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে চাই হাজারটা শতাব্দী।

সমাপ্ত?

(বেঁচে থাকুক প্রতিটি ভালোবাসার বন্ধন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ সবাইকে ধৈর্য নিয়ে গল্পটি পড়ার জন্য। নতুন গল্প নিয়ে খুব শীঘ্রই ফিরে আসবো টাটা?)

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২৯

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৯

লেখিকা: সুলতানা তমা

নিশ্চুপ হয়ে বসে আছি কেউ আমার সাথে কোনো কথা বলছে না। মেঘ বারবার আমাকে ডেকে উত্তেজিত হয়ে পড়ছিল বলে ডক্টর ওকে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে, জানিনা মেঘের ঘুম কখন ভাঙবে ওদিকে ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। চাচ্চু তো আমাকে রেখে যাবে না, মেঘের ঘুম না ভাঙলে হয়তো মেঘের সাথে শেষ কথাটুকুও হবেনা।
তোহা: নতুন আম্মু ও নতুন আম্মু… (তোহার ধাক্কায় যেন ঘোর কাটলো)
আমি: হুম মামুনি বলো।
তোহা: আব্বুর কি হয়েছে?
আমি: কিছু হয়নি মামুনি তোমার আব্বু তো একটু পরই ভালো হয়ে যাবে।
বাবা: ডক্টর তো বললো অবস্থা খুব খারাপ এতো তাড়াতাড়ি ভালো হবে না। (বাবার কথা শুনে মেঘের দিকে তাকালাম হাতে ব্যান্ডেজ, মাথায় ব্যান্ডেজ, পায়ের গোড়ালিটা বোধহয় ভেঙ্গে গেছে)
বাবা: দোষ তো আমার ছেলের তাই তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি এবার আমার ছেলেটাকে ক্ষমা করে দাও মা।
চাচ্চু: এখন এসব ব্যাপারে কথা না বলাই ভালো। আর হ্যাঁ একটু পর আমাদের ফ্লাইট আমরা কণাকে নিয়ে কানাডা চলে যাচ্ছি।
মা: আমার ছেলেকে এই অবস্থায় রেখে তুমি যেতে পারবে বৌমা?
চাচ্চু: কণা আমি আবারো বলছি তুই আমার কথা না শুনলে আমি তোদের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিবো।
আমি: শেষ করতে হবে না চাচ্চু আমি কানাডা যাবো।
চাচ্চু: হুম এটাই ভালো হবে, এমন ছেলের সাথে সংসার করার কোনো মানে হয়না। এক্সিডেন্ট করেছে বলে যে মেঘ শোধরে যাবে তাতো নয়।
রুহান: চলে যাবে যখন এখনি চলে যাও কেন বসে আছ এখানে?
চাঁচি: বৌমা আমি জানি তুমি আমাকে কখনো ক্ষমা করবে না তাও বলছি মেঘকে ছেড়ে যেওনা। (চাঁচির কথা শুনে এতোক্ষণে চাঁচির দিকে নজর পড়লো, যাবার আগে তো রুহান আর চাঁচিকে এক করে দিতে পেরেছি)
আমি: ক্ষমা না করলে কি আপনি বাসায় ফিরে আসতে পারতেন? আমার কারো উপর কোনো রাগ নেই আ…
পপি: তাহলে চলে যেতে চাইছ কেন?
চাচ্চু: মেঘ এতোকিছু করার পর এই প্রশ্নটা করা তোমাদের মানায় না।
চাচ্চুর কথা শুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। চাচ্চুর রাগ এখনো কমেনি তাই কানাডা যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই আমার কাছে। তাছাড়া আমারো এখন কানাডা চলে যেতে মন চাইছে, অনেক তো অপেক্ষা করেছি মেঘ ভুল বুঝতে পারবে এই ভেবে কিন্তু মেঘ তো শোধরায়নি উল্টো এখনো আমাকে অবিশ্বাস করে।

মেঘের ঘুম তো ভাঙ্গছে না ওদিকে ফ্লাইটের সময় হয়ে যাচ্ছে। মেঘের সাথে শেষ কথাটুকুও মনে হয় হবেনা।
ভাবি: কণা.. (কাঁধে কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে পাশ ফিরে তাকালাম, ভাবি দাঁড়িয়ে আছে)
আমি: কেন এসেছ?
ভাবি: তুমি এমন পরিস্থিতিতে আছ আমি না এসে পারি?
আমি: আজ মেঘ এক্সিডেন্ট করেছে তাই এসেছ সেদিন তো আমাকে ফেলে রেখে ঠিকি চলে গিয়েছিলে। হ্যাঁ সেদিন আমি এক্সিডেন্ট করিনি ঠিকি কিন্তু মেঘের থেকে দূরে থেকে আমি কেমন পাগলের মতো ছিলাম তুমি তো দেখেছিলে তারপরও…
ভাবি: কণা তুমি অজতা আমার উপর রেগে আছ। তুমি সারাক্ষণ মেঘের জন্য কাঁদতে আর তোমার এই অবস্থা দেখে নিজেকে অপরাধী মনে হতো কারণ তোমাদের দুজনের আলাদা হওয়ার জন্য আমিতো কম দায়ী নই, আর তাই আমি তোমার সামনে থাকতে পারিনি…
আমি: এজন্য অন্য বাসায় চলে গিয়েছিলে। কি পেয়েছ অন্য বাসায় গিয়ে? একা একাই তো থাকতে হয়েছে, আমাদের সাথে থাকলে কি হতো? ভাইয়া তো তোমাকে আম্মুর কাছে দিয়ে গিয়েছিল আর তুমি…
ভাবি: তোমার প্রতি করা অন্যায় গুলো আমাকে রোজ কষ্ট দেয় কণা আর সেটা অনেক বেশি বেড়ে যায় যখন তোমাকে মেঘের জন্য কাঁদতে দেখি।
আমি: আরে আমিতো তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছি এসবে তো তোমার কোনো দোষ ছিল না।
পপি: ভাইয়া.. (পপির ডাকে মেঘের দিকে তাকালাম, ও আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে)
মেঘ: কণা..
মা: কথা বলিস না বাবা তোর কষ্ট হবে।
মেঘ: ওর সাথে যে আমার কথা বলতে হবে আম্মু।
আমি: কিছু বলতে হবে না তুমি রেস্ট নাও।
মেঘ: তুমি আমার পাশে বসে থাকবে তো?
আমি: (নিশ্চুপ)
আম্মু: না ও বসে থাকবে না তোমার পাশে কারণ আমাদের ফ্লাইটের সময় হয়ে গেছে।
মেঘ: কণা যেওনা প্লিজ!
আম্মু: কণা তুই কিন্তু বলেছিলি এখানে তোকে আসতে দিলে তুই আমার সব কথা শুনবি, চল এবার।
মেঘ: কণা প্লিজ যেওনা। (মেঘ আমার হাত ধরে ফেললো, ওর হাতটা আস্তে আস্তে সরিয়ে দিয়ে দৌড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসলাম)

জোহা: আপু আর কেঁদো না এখন তো আর কিছু করার নেই।
চাচ্চু: চল মা।
ভাবি: দাঁড়াও কণা। (ভাবির ডাকে পিছনে তাকালাম, পপি আর ভাবি আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে)
ভাবি: মেঘের এই অবস্থা দেখেও চলে যাচ্ছ এই তোমার ভালোবাসা?
পপি: কাকে কি বলছ ও তো আমার ভাইকে ভালোবাসে না, বাসলে হসপিটালের বেডে ফেলে রেখে চলে যেতে পারতো না।
ভাবি: তোমার কাছে তোমার রাগটা বড় হয়ে গেল মেঘের অসুস্থতা কিছুই না?
পপি: তোহা? তোহার জন্য তো থাকতে পারো, তোহা তো তোমার মেয়ে। ওহ এখন হয়তো তোহাও তোমার কেউ না, যদি সত্যি তোহা তোমার মেয়ে হতো তাহলে নিজের সন্তানকে ফেলে রেখে কখনো কানাডা চলে যেতে পারতে না।
আমি: চুপ করো তোমরা।
জোহা: আপু.. (একটা চেয়ারে বসে পড়লাম, আর এসব কথা শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে না মাথা ঘুরছে)
জোহা: তোমরা আপুকে কেন এসব কথা শুনাচ্ছ? আব্বু আর চাঁচি যদি আপুকে জোড় করে কানাডা নিয়ে যায় তাতে আপুর দোষ কোথায়? আপু কানাডা চলে যাচ্ছে এইটা তোমাদের চোখে পড়ছে আর ভাইয়া যে বারবার আপুকে অবিশ্বাস করছে সবার সামনে ছোট করছে এইটা চোখে পড়ছে না?
চাচ্চু: জোহা আস্তে কথা বল ভুলে যাসনা এইটা হসপিটাল।
আম্মু: কোনো মা সন্তানকে অসুখী দেখতে চায় না। আমিও চেয়েছিলাম আমার মেয়েটা সবার সাথে মিলেমিশে সুখে সংসার করুক। কিন্তু মেঘ বারবার আমার মেয়েকে কষ্ট দিয়েছে এবার তোমরা বলো আমি মা হয়ে কিভাবে আমার মেয়েকে এমন ছেলের কাছে রাখি। (আম্মুর কথা শুনে পপি ভাবি দুজনেই চুপ হয়ে আছে)
আম্মু: মেঘের সাথে আমার মেয়ের কোনো বন্ধন থাকুক তা আমি চাই না তাই আমি ঠিক করেছি কানাডা গিয়ে কণার আবার বিয়ে দিবো। তোমরা এবার আসতে পারো আমাদের যেতে হবে নাহলে ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে। (ভাবি আর পপি মাথা নিচু করে চলে গেল। আমি বসা থেকে উঠতে চাইলাম কিন্তু সবকিছু ঝাপসা লাগছে মনে হচ্ছে এখনি পরে যাবো)
জোহা: আপু কি হয়েছে এমন করছ কেন?
আম্মু: কণা… (চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসলো আস্তে আস্তে লুটিয়ে পড়লাম)

চোখ খুলে নিজেকে হসপিটালের বেডে দেখতে পেলাম, জোহা পাশের চেয়ারে বসে আছে। আম্মু আর চাচ্চু দূরে দাঁড়িয়ে ডক্টর এর সাথে কথা বলছেন।
নার্স: মেডাম প্যাসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। (নার্সের কথা শুনে ডক্টর আমার দিকে এগিয়ে আসলো, সাথে আম্মু আর চাচ্চুও এগিয়ে আসলো)
আম্মু: কিরে মা এখন কেমন লাগছে?
ডক্টর: এই অবস্থায় কেউ এতোটা কেয়ারলেস হয়ে থাকে হুম? তোমার শরীর তো খুব দূর্বল, এভাবে চললে বেবির খুব বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। (ডক্টর এর কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম কি বলছে ডক্টর এসব)
ডক্টর: অবশ্য এখনো বেবির অবস্থা খুব বেশি ভালো না এভাবে চললে বেবির কন্ডিশন আরো খারাপ হয়ে যাবে তখন কিন্তু বাচ্চাটা বাঁচানো সম্ভব হবেনা।
আমি: আম্মু ডক্টর এসব কি বলছে?
ডক্টর: তোমার আম্মুকে জিজ্ঞেস করে লাভ কি উনি নিজেই তো বুঝতে পারননি তুমি যে প্রেগন্যান্ট। দেখো তোমার শরীরের এখন যা অবস্থা তোমাকে কিছুদিন বেডরেস্টে থাকতে হবে। আর হ্যাঁ অবশ্যই ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করতে হবে নিজের খেয়াল রাখতে হবে, তুমি সুস্থ থাকলেই তো বাচ্চা সুস্থ থাকবে। তুমি কি চাওনা তোমার বাচ্চা সুস্থ থাকুক। (ডক্টর এর কথা গুলো শুনে সব কেমন যেন গুলিয়ে যাচ্ছে কি বলছে এসব? আমি মা হবো অথচ আমিই বুঝতে পারিনি)
চাচ্চু: ডক্টর ওকে কি এখানে রাখতে হবে নাকি…
ডক্টর: আপনারা চাইলে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন তবে অবশ্যই মেয়ের খেয়াল রাখতে হবে।
আম্মু: ঠিক আছে। (ডক্টর চলে যেতেই আম্মু এসে আমার পাশে বসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন)
চাচ্চু: বাসায় চলে যাই কণাকে এই হসপিটালে না রাখাটাই ভালো হবে, যদি প্রয়োজন হয় একজন নার্স বাসায় নিয়ে যাবো ওর দেখাশোনা করার জন্য।
জোহা: তার আর প্রয়োজন হবে না আমিই আপুকে দেখে রাখতে পারবো।
আম্মু: ঠিক আছে চলো।
জোহা: একটা কথা বলবো আব্বু?
চাচ্চু: হুম বল।
জোহা: যদিও এমন পরিস্থিতিতে এই খুশির খবরটা আমরা শুনেছি তাও আমার মনে হয় ও বাড়ির সবাইকে বিশেষ করে ভাইয়াকে জানানো প্রয়োজন। আর ওরা তো সবাই এই হসপিটালেই আছে।
চাচ্চু: না কাউকে জানানোর প্রয়োজন নেই। মেঘের সন্তান হলেও মেঘের মতো ছেলের ছায়া বেবির উপর পরুক আমি চাইনা। আর হ্যাঁ তোরা জোড় করলে আমি কণাকে এই অবস্থাতেই কানাডা নিয়ে যেতে বাধ্য হবো।
আমি: না চাচ্চু এমন করো না আমি মেঘের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না তাও কানাডা নিয়ে যেওনা প্লিজ!
চাচ্চু: ঠিক আছে আপাতত বাসায় চল। নতুন বাসা কিনে ওখানে তোদের রেখে আমি কানাডা যাবো আর মেঘ জানবে তুই কানাডা আছিস।
আমি: হুম।

বাসায় এসে ড্রয়িংরুমে দাঁড়ালাম না সোজা রুমে চলে আসলাম, ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদি। তোহা সবসময় বলতো নতুন আম্মু একটা পুঁচকে পুতুল এনে দাও আর তোহার এই কথা নিয়ে মেঘ কতো দুষ্টুমি করতো, আজ এতো বড় খুশির সংবাদটা না মেঘকে জানাতে পারছি না তোহাকে।
আম্মু: কণা.. (আম্মু আসছে শুনে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম। আম্মু এসে আমার পাশে বসলেন)
আম্মু: কাঁদছিস কেন? বুঝতে পারছি তোর কষ্ট হচ্ছে মেঘকে খবরটা জানাতে পারবি না ভেবে কিন্তু তুই বল যে তোকে এতো কষ্ট দেয় তার সাথে তোকে আমরা কিভাবে থাকতে দেই।
আমি: আম্মু বাদ দাও এসব।
আম্মু: দেখ আগে আমরা ভেবেছিলাম তোর বিয়ে দিবো আবার কিন্তু এখন তো তা সম্ভব নয়। তুই মেঘের জন্য অপেক্ষা কর আমি মানা করছি না, মেঘ যদি ভালো হয়ে ফিরে আসে তাহলে আমরা তোদের আর আলাদা রাখবো না কিন্তু মেঘ ভালো না হলে আমাদের কিছু করার নেই।
আমি: না আম্মু আমি কারো জন্য অপেক্ষা করছি না আর করবোও না। আমার সন্তানকে আমি নিজেই লালনপালন করতে পারবো।
আম্মু: রাগ করিস না দেখ মেঘ তোকে এতো কষ্ট দেয় এখন যদি তুই সবকিছু ভুলে ওর কাছে ফিরে যাস তাহলে ও তোকে আরো বেশি কষ্ট দিতে দিদ্ধাবোধ করবে না। তারচেয়ে ভালো হবে তুই ওর চোখের আড়ালে থাক তোর শূন্যতা অনুভব করে হয়তো ছেলেটা ভালো হয়ে যাবে, আর মেঘ যদি সত্যি তোকে ভালোবেসে থাকে তাহলে একদিন ঠিক ফিরে আসবে।
আমি: হুম।
আম্মু: তোর আব্বু নেই এই সময় যদি তোর চাচ্চু আমাদের উপর রাগ করে কানাডা চলে যায় তাহলে আমাদের কি হবে বল, তাছাড়া তোর চাচ্চু তো তোর ভালোর জন্যই তোকে মেঘের থেকে দূরে রাখতে চাইছে। আপাতত মেঘের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখার প্রয়োজন নেই।
আমি: হুম।
আম্মু: আর কান্নাকাটি করিস না নিজের প্রতি যত্নবান হ, তুই ভালো থাকলে তবেই তো বেবি ভালো থাকবে। আর এখন তো বেবিটাই তোর সবকিছু তাইনা? আসছি আমি তোর জন্য খাবার রেডি করি তুই ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।
আমি: ঠিক আছে।
আম্মু চলে যেতেই উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেলাম।

ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে রুমে ঢুকলাম তখনি আয়নার দিকে নজর পড়লো, আস্তে আস্তে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। সত্যি অনেক রোগা হয়ে গেছি এভাবে চললে আমার বেবির ক্ষতি হয়ে যাবে। পেটে হাত রেখে আয়নায় তাকালাম, আম্মু ঠিকি বলেছেন এই বেবিটাই এখন আমার সবকিছু। মেঘকে ভুলে গিয়ে এখন আমার বেবির কথা ভাবতে হবে, ও ছাড়া তো এখন আমার কেউ নেই ওর কিছু হলে আমি কি নিয়ে বাঁচবো?
জোহা: আপু খাবে এসো।
আমি: আসছি।

আমি: চাচ্চু কোথায়রে? (চাচ্চুকে কোথাও দেখতে না পেয়ে চেয়ার টেনে বসতে বসতে জোহাকে প্রশ্ন করলাম)
জোহা: বাইরে গেছেন।
আমি: এই সন্ধ্যাবেলায় বাইরে কেন?
জোহা: আব্বুকে কাল চলে যেতে হবে তাই আমাদের জন্য বাসা খুঁজতে গেছেন।
আমি: বাসা এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে সম্ভব?
আম্মু: টাকা হলে সব সম্ভব তুই এসব নিয়ে টেনশন করিস নাতো। খেয়ে নে আর এবার একটু নিজের খেয়াল রাখতে শিখ, এখন তো মা হবি নিজের সাথে সাথে সন্তানের যত্নও নিতে হবে। পাগলামি ছেড়ে বেবিটার কথা ভাব।
আমি: এতো জ্ঞান দিওনা তো আর এসব কি দিয়েছ আমি এসব ফলমূল খাই নাকি? আমার নোডলস দাও।
জোহা: নাশতায় এখন থেকে ফলই খেতে হবে ভাজাভুজি একদম খাওয়া যাবে না।
আমি: ডক্টর হলি কবে?
জোহা: যখন শুনেছি আমি খালামণি হবো তখন থেকে।
চাচ্চু: জোহা দেখছি খালামণি হবে শুনে খুব খুশি। (চাচ্চুর কথা শুনে দরজার দিকে তাকালাম, বাসা হয়তো পেয়ে গেছেন তাই চলে এসেছেন)
জোহা: হ্যাঁ আমিতো অনেক খুশি, তোমরা বুঝি খুশি নও?
চাচ্ছ: খুশি হবো না আবার নানা হবো যে হাহাহা।
আম্মু: বাসা পেয়েছ?
চাচ্চু: হ্যাঁ, সকালে তোমাদের নতুন বাসায় নামিয়ে দিয়ে আমি চলে যাবো।
আম্মু: ঠিক আছে।
চাচ্চু: জোহা তুই কি সিদ্ধান্ত নিলি এখানেই থাকবি নাকি?
জোহা: হ্যাঁ আমি আপুকে রেখে কোথাও যাচ্ছি না, ভাবছি এখানেই ভালো কোনো ইউনিভারসিটিতে ভর্তি হয়ে যাবো।
চাচ্চু: ঠিক আছে যা ভালো মনে হয় কর। আমি কাল চলে যাচ্ছি কয়েক মাসের মধ্যে আর আসা হবে না।
জোহা: ঠিক আছে।
চাচ্চু: আর কণা মেঘের সাথে কোনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করবি না একদম।
আমি: হুম।

জোহা: আপু হলো তোমার তাড়াতাড়ি এসো।
আমি: আসছি। (নতুন বাসায় চলে যাচ্ছি মেঘের সাথে তো আর দেখা হবেনা ওর ছবিটা লুকিয়ে সাথে নিলাম)
জোহা: এতো দেরী করলে হবে আব্বু আর চাঁচি গাড়িতে বসে ওয়েট করছেন।
আমি: এইতো শেষ চল।
জোহা: চলো।

চাচ্চু আমাদের নতুন বাসায় নামিয়ে দিয়ে এয়ারপোর্ট চলে গেলেন। একই শহরে হলেও আগের বাসা থেকে এই বাসা অনেক দূরে মেঘ চাইলেও আমাকে খুঁজে পাবে নাহ।
আম্মু: কিরে বাসা পছন্দ হয়েছে তোদের?
জোহা: হুম অনেক।
আম্মু: নিজেদের রুম গিয়ে গুছিয়ে নে।
জোহা: ওকে।

রুমে এসে চারপাশটা ভালোভাবে দেখে নিলাম, এই চার দেয়ালের মধ্যেই তো এখন জীবন কাটাতে হবে। বিছানার সামনের দেয়ালে মেঘের ছবিটা রাখলাম যেন ঘুমানোর সময় দেখতে পারি। মেঘের ছবির দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আর ভাবছি সামান্য একটা অবিশ্বাস আজ আমাদের দুজনকে কতোটা দূরে নিয়ে গেল। একই শহরে থাকবো অথচ মেঘের সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারবো না, দেখা হবে না কখনো দুজনের। এজন্যই লোকে বলে অবিশ্বাস করে পস্তানোর চেয়ে বিশ্বাস করে ঠকে যাওয়া অনেক ভালো।

চলবে?

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২৮

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৮

লেখিকা: সুলতানা তমা

বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি, মেঘ বারান্দার এদিক থেকে ওদিকে পায়চারী করছে। অনেক গুলো প্রশ্ন করে একটা উত্তরও পায়নি আমার কাছ থেকে তাইতো মেঘ অস্থির হয়ে এভাবে পায়চারী করছে। মেঘ অধৈর্য হয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়ালো, আমার হাতের উপর ওর একটা হাত রাখলো।
মেঘ: কণা আর কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবো? (ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে আনলাম)
আমি: তোমাকে কি আমি আটকে রেখেছি?
মেঘ: তা রাখোনি কিন্তু আমার কোনো প্রশ্নের উত্তরও তো দিচ্ছ না যে আমি..
আমি: কোনো উত্তর নেই তুমি আসতে পারো।
মেঘ: প্লিজ লক্ষীটি এমন করো না।
আমি: নষ্টা থেকে লক্ষী? তুমি তো খুব ভালো রূপ বদলাতে পারো।
মেঘ: সবকিছুর জন্য সরি তো, দেখো সেদিন আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম ঠিকি কিন্তু পরে তো আমি আমার ভুল বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ এতোদিন লজ্জায় তোমার সামনে আসতে পারিনি কিন্তু এখন না এসে আর থাকতে পারছিলাম না তাইতো..
আমি: মেঘ বলতো ভালোবাসতে হলে কোনটা প্রথমে প্রয়োজন।
মেঘ: বিশ্বাস।
আমি: শুধু বিশ্বাস নয়, বিশ্বাস এবং সম্মান দুটুই সবার আগে প্রয়োজন। এই দুটুর মধ্যে কোনোটাই তো তুমি আমাকে করো না।
মেঘ: (নিশ্চুপ)
আমি: তুমি আমাকে না বিশ্বাস করো না সম্মান করো, তাহলে আমি কিভাবে তোমার কাছে ফিরে যাবো বলো।
মেঘ: এখন তো আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, আগেও করতাম শুধু…
আমি: মেঘ বিশ্বাস করি বলাটা যতো সহজ তারচেয়ে অনেক বেশি কঠিন বিশ্বাস করাটা।
মেঘ: কণা আমিতো আমার ভুল স্বীকার করছি যে সেদিন আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম।
আমি: সেদিন লোকটা আমার হাত ধরেছিল দেখে তুমি বলেছিলে আমি নষ্টামি করতে গিয়ে তোহার এই অবস্থা করেছি, মানছি সেদিন তোমার দেখায় ভুল ছিল। কিন্তু সেদিন তো তুমি আমাকে অসম্মান করতেও দুবার ভাবোনি, সবার সামনে তুমি আমার ভালোবাসাকে বারবার ছোট করেছ। আরে তোমার থেকে তো রাহুল আমাকে বেশি সম্মান করে।
মেঘ: রাহুল কে?
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: বলো বলছি রাহুল কে?
আমি: ওইযে নীল রঙের দুতলা বাড়িটা দেখছ ওই বাসার ছেলে। (মেঘ হা হয়ে আমাদের পাশের বাসার দিকে তাকিয়ে আছে)
মেঘ: এই ছেলের সাথে তোমার কি সম্পর্ক?
আমি: তোমার কি মনে হয় এই দুমাস আমি তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে কাটিয়েছি? না মেঘ আমি রাহুলের সাথে প্রেম করেছি আর এই বারান্দাতে দাঁড়িয়েই। জানো তো রাহুল এখন… (আমার পুরো কথা শেষ হবার আগেই মেঘ আমার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। মেঘ রাগি চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে, গালে হাত রেখে মেঘের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলাম)
মেঘ: তুমি আসলেই আমার ভালোবাসার যোগ্য নও। (আবারো হাসলাম)
আমি: বলেছিলাম না মেঘ বিশ্বাস করি বলা সহজ কিন্তু বিশ্বাস করাটা খুব কঠিন।
মেঘ: মানে?
আমি: তুমি আমাকে কতোটা বিশ্বাস করো পরীক্ষা করে নিলাম। ওই বাসায় কেউ থাকে না মেঘ সবাই বাহিরে থাকে আর ওদের পরিবারে ওরা দুবোন শুধু কোনো ছেলে নেই।
মেঘ: তারমানে..
আমি: মিথ্যে বলেছি তোমাকে পরীক্ষা করার জন্য যদিও ভালোবাসায় কোনো পরীক্ষা চলে না তাও করতে হলো শুধুমাত্র তোমার…
মেঘ: কণা আমি সরি..
আমি: থাপ্পড়টা খুব জোড়েই দিয়েছ হয়তো তোমার হাতের আঙ্গুলের দাগ বসে গেছে।
মেঘ: বিশ্বাস করো তোমার মুখে অন্য ছেলের নাম শুনে আমার মাথা ঠিক ছিল না, আমি তোমাকে থাপ্পড় দিতে চাইনি কিন্তু.. (মেঘ আমার গালে স্পর্শ করতে চাইলো পিছিয়ে আসলাম)
আমি: এবার বুঝতে পেরেছ তো তুমি যে আমাকে বিশ্বাস করো না? যে নিজের ভালোবাসাকে বিশ্বাস করেনা সম্মান করেনা তার সাথে সারাজীবন না কাটানোটাই মঙ্গল।
মেঘ: কণা আমার কথা শুনো।
আমি: চলে যাও মেঘ।
মেঘ: শুনো প্লিজ!
আমি: তুমি কি চাইছ আমি কাল কানাডা চলে যাই?
মেঘ: না না তুমি কানাডা চলে গেলে আমি..
আমি: তাহলে আমার চোখের সামনে থেকে চলে যাও নাহলে আমি কাল সত্যি কানাডা চলে যাবো।
মেঘ: কণা আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি।
মেঘের দিকে না তাকিয়ে রুমে এসে বারান্দার দরজা লাগিয়ে দিলাম। খুব কষ্ট হচ্ছে যাকে আমি এতো ভালোবাসি সে কিনা আমাকে এতোটুকু বিশ্বাস করেনা। যে মেঘের জন্য আমি অপেক্ষা করছি সে কিনা আমার ভালোবাসাকেই বিশ্বাস করেনা। আমিতো ভেবেছিলাম মেঘ নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফিরে আসবে কিন্তু এভাবে মনের মধ্যে অবিশ্বাসের বীজ রেখে ফিরে আসবে ভাবিনি।

জোহা: আপু এই আপু..
আমি: হুম।
জোহা: সোফায় ঘুমিয়ে আছ কেন? (জোহার কথায় চোখ খুলে তাকালাম, রাতে কাঁদতে কাঁদতে সোফাতেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম)
জোহা: আপু কি হয়েছে? রাতে অনেক কেঁদেছ তাই না?
আমি: মেঘকে সবকিছু কেন বলেছিলি?
জোহা: এভাবে দুইটা ভালোবাসার মানুষ আলাদা হয়ে যাক তা আমি চাই না।
আমি: বারান্দার দরজা কে খুলা রেখেছিল?
জোহা: আমিই।
আমি: খুব বড় হয়ে গেছিস তাই না?
জোহা: আপু ভাইয়ার কাছে ফিরে যাও প্লিজ।
আমি: কার কাছে যাবো হ্যাঁ যে আমাকে বিশ্বাসই করেনা।
জোহা: আরে আস্তে চেঁচাও ড্রয়িংরুমে আব্বু আছে সাথে রুহান ভাইয়া।
আমি: রুহান কেন এসেছে?
জোহা: তোমার সাথে নাকি দেখা করবে তাইতো তোমাকে ডাকতে আসলাম।
আমি: গিয়ে বল আমি ওই বাড়ির কারো সামনে যাবো না।
জোহা: রুহান ভাইয়া কি দোষ করলো?
আমি: (নিশ্চুপ)
জোহা: নিচে চলো।
আমি: গিয়ে বল রুমে আসতে।
জোহা: ঠিক আছে।

চুপচাপ বিছানায় বসে আছি, রুহান কেন এসেছে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছি না। মেঘ পাঠিয়েছে? নাকি অন্য কোনো কারণ?
রুহান: আসতে পারি?
আমি: হ্যাঁ এসো।
রুহান: বিরক্ত হচ্ছ মনে হচ্ছে। (সোফায় বসতে বসতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, আসলে তো বিরক্ত হচ্ছি না কেন জানি ওই বাড়ির কাউকে দেখলেই রাগ হচ্ছে)
আমি: বিরক্ত হবো কেন?
রুহান: এইযে গতকাল আমাদের তাড়িয়ে দেওয়ার পর আজ আবার আসলাম। (রুহানের কথায় এবার নিজেই লজ্জা পেলাম, কাল ওদের সাথে এমন ব্যবহার করা ঠিক হয়নি। কিন্তু আমি কি করবো আমিও তো একটা মানুষ আর যে এসব সহ্য হচ্ছে না)
রুহান: আজ কিন্তু আমি অন্য প্রয়োজনে এসেছি।
আমি: কি প্রয়োজন বলো।
রুহান: কাল তো কিছু বলার সুযোগই দাওনি কিন্তু আজ না বললে আর হয়তো আম্মুকে ফিরে পাবো না, তোমরা তো কানাডা চলে যাচ্ছ আজ।
আমি: চাঁচিকে ফিরে পাবেনা মানে?
রুহান: দুদিন আগে আম্মুর সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আম্মু তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে চান আর মুক্তি চান। (রুহানের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালাম, এই মহিলা এতো তাড়াতাড়ি শোধরে গেল)
রুহান: আজ যদি তোমরা কানাডা চলে যাও তাহলে তো…
আমি: কানাডা কে যাবে? আমিতো কানাডা যাচ্ছি না।
রুহান: আমি জানতাম তুমি রাজি হবেনা কারণ তুমি তো ভাইয়াকে ভালোবাস, ভাইয়াকে ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কথা তুমি ভাবতেই পারো না।
আমি: আমি কাউকে ভালোবাসি না।
রুহান: হুম তাতো তোমার চোখই বলে দিচ্ছে।
আমি: যে কাজে এসেছ সেটা নিয়ে কথা বলো।
রুহান: একবার যদি থানায় যেতে আর আম্মুকে..
আমি: উনি সত্যি শোধরে গেছেন তো?
রুহান: হুম।
আমি: ঠিক আছে তুমি ড্রয়িংরুমে গিয়ে বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
রুহান: হুম।

ফ্রেশ হয়ে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি আম্মু আর জোহা সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। আমাকে দেখেই চাচ্চু হাসলেন।
চাচ্চু: রেডি হয়ে নে দুঘণ্টা পর আমাদের ফ্লাইট।
আমি: একটু থানা থেকে আসছি তাড়াতাড়ি চলে আসবো।
আম্মু: কি বলছিস দুঘণ্টা পর তো..
আমি: ফ্লাইট মিস হবেনা তাড়াতাড়ি চলে আসবো আমি।
চাচ্চু: ও এসব বলে বেরুচ্ছে আসবে না দুঘন্টার মধ্যে।
আম্মু: কোথাও যাওয়া হবেনা চুপচাপ বাসায় বসে থাক।
আমি: আম্মু বলছি তো আমি চলে আসবো।
চাচ্চু: একদম চুপ তোর চালাকি আমরা বুঝিনা মনে করেছিস, রুমে যা। (দ্যাত বেরুতে না পারলে তো চাচ্চু জোড় করে আমাকে নিয়ে যাবে আর একবার কানাডা নিয়ে যেতে পারলে বিয়ে দিয়ে দিবে)
আমি: চাচ্চু..
চাচ্চু: তুই কি চাচ্ছিস আমি তোদের ফেলে রেখে চলে যাই? তুই এমন করলে আমি চলে যাবো তোদের সাথে কোনো যোগাযোগ রাখবো না।
আম্মু: কণা খুব খারাপ হচ্ছে কিন্তু।
আমি: রুহান তুমি থানায় যাও আমি পুলিশ আঙ্কেলের সাথে ফোনে কথা বলবো।
রুহান: ঠিক আছে।

পুলিশ আঙ্কেলের সাথে কথা বলা শেষ করে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আম্মুর সাথে কানাডা চলে যাবো নাকি একা থাকবো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। কানাডা যাওয়া মানে মেঘকে সারাজীবনের জন্য হারানো আর না যাওয়া মানে চাচ্চুকে হারানো, এখন আমি কোনটা বেছে নিবো?
আম্মু: কণা দরজা খুল মা।
আমি: (নিশ্চুপ)
আম্মু: তুই এমন করলে তোর চাচ্চু আমাদের ছেড়ে চলে যাবে তুই কি তা চাস? তোর চাচ্চু তো তোর ভালোর জন্যই সবকিছু করছে।
আমি: আম্মু আমি মেঘকে ভালোবাসি আমি ওকে ছেড়ে কানাডা যেতে পারবো না।
আম্মু: ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি তুই আমাকে কখনো ফোন করবি না থাক তুই মেঘের অপেক্ষায়। (আম্মু কাঁদছেন শুনে তাড়াতাড়ি দরজা খুললাম, ততক্ষণে আম্মু চলে গেছেন। দৌড়ে আম্মুর রুমে আসলাম)

আম্মু বিছানায় বসে কাঁদছেন, চুপচাপ আম্মুর পাশে এসে বসে আম্মুকে জড়িয়ে ধরলাম।
আম্মু: কেন এসেছিস আমার কাছে আমি তোর কে? মেঘ তো তোর সবকিছু মেঘের কাছে ফিরে যা।
আমি: এই একটা মানুষ আর এই বিয়েটা আমাদের সবকিছু উলটপালট করে দিয়েছে তাই না আম্মু?
আম্মু: কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে? বুঝার চেষ্টা কর মেঘ তোকে ভালোবাসে না আর সে জন্যই আমরা তোর আবার বিয়ে দিতে চাইছি।
আমি: কিন্তু আমিতো মেঘকে ভালোবাসি আম্মু।
আম্মু: (নিশ্চুপ)
আমি: মেঘকে আমি সত্যি ভালোবাসি আম্মু আর সারাজীবন বাসতে চাই। আমি কানাডা যাবো কিন্তু বিয়ের জন্য তোমরা আমাকে জোড় করতে পারবে না, যদি করো তাহলে আমি সুইসাইড করবো।
আম্মু: কণা আমার কথা শুন।
আম্মুর ডাকে না দাঁড়িয়ে রুমে চলে আসলাম।

সবকিছু গুছিয়ে নিচ্ছি, কানাডা যাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই আমার কাছে। মেঘের জন্য তো আমি আম্মুকে কষ্ট দিতে পারিনা।
জোহা: আপু..
আমি: হুম।
জোহা: নাও। (জোহার দিকে তাকালাম আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো)
আমি: কে?
জোহা: ভাইয়া।
আমি: (নিশ্চুপ)
জোহা: চলেই তো যাচ্ছ শেষবার কথা বলে নাও। (ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায় চলে আসলাম)

ফোনের দুপাশে দুজন চুপচাপ হয়ে আছি কেউ কোনো কথা বলছি না। মেঘ কাঁদছে বুঝতে পারছি কিন্তু এখন আর কিছু করার নেই। শুধুমাত্র মেঘের একটা ভুলের জন্য আজ সবকিছু উলটপালট হয়ে গেল। একটা মাত্র অবিশ্বাস সবকিছু কেড়ে নিলো।
মেঘ: চলেই তো যাচ্ছ একটু কথা বলো প্লিজ!
আমি: (নিশ্চুপ)
মেঘ: একটা ভুলের শাস্তি এভাবে দিচ্ছ? আরে ভুল তো সবারই হয় তাই বলে ক্ষমা করা যায়না?
আমি: রাখছি বেরুতে হবে।
মেঘ: শুনোনা কণা তুমি যেওনা প্লিজ! আমি তোমার চাচ্চুর কাছে ক্ষমা চাইবো।
আমি: এই কাজটা আগে করলে হয়তো লাভ হতো এখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে মেঘ।
মেঘ: কিচ্ছু শেষ হয়নি আমি আসছি।
আমি: মেঘ শুনো..
মেঘ তো ফোন কেটে দিলো, মেঘ বাসায় আসবে নাতো?
আম্মু: কণা তাড়াতাড়ি আয়।
জোহা: আপু চাঁচি ডাকছে।
আমি: হুম।
জোহা: আপু সব কেমন যেন আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে তাই না?
আমি: যে সম্পর্কে বিশ্বাস থাকেনা সে সম্পর্ক একদিন এভাবেই শেষ হয়ে যায়। (চুপচাপ বেরিয়ে আসলাম)

এয়ারপোর্টে বসে আছি আর চারদিকে চোখ বুলাচ্ছি, কেন যেন মনে হচ্ছে মেঘ এখানে আসবে। আর তো কিছুক্ষণ একবার চলে গেলে আর ফিরে আসতে পারবো না চাচ্চু আসতে দিবে না।
জোহা: আপু তোমার দুচোখ এভাবে কাকে খুঁজছে?
আমি: ককই কাকাউকে নাতো।
জোহা: ভালোই যখন বাসো তাহলে ছেড়ে চলে যাচ্ছ কেন?
আমি: সে যে ভালোবাসে না। (জোহার ফোন বেজে উঠলো, ফোন হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
আমি: কি?
জোহা: পপি আপু, নাও তুমিই কথা বলো।
আমি: হুম। (ফোন রিসিভ করে আমি কিছু বলার আগেই পপি কেঁদে উঠলো)
পপি: ভাবি ভাইয়া এক্সিডেন্ট করেছে।
আমি: কি?
পপি: হসপিটালে আছে খুব খারাপ অবস্থা তোমাকে দেখতে চাইছে তুমি একবার আসবে প্লিজ!
আমি: আসছি। (ফোন রেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই আম্মু আমার হাত ধরে ফেললো)
আম্মু: কোথায় যাচ্ছিস?
আমি: আম্মু মেঘ হসপিটালে আমাকে যেতে দাও প্লিজ!
আম্মু: কোথাও যেতে হবেনা।
আমি: আম্মু আমি তোমার সব কথা শুনবো একবার যেতে দাও শুধু।
জোহা: কেন তোমরা এমন করছ? ওরা তো প্রেম করছে না যে তোমরা আলাদা করে দিবে, ওদের বন্ধন তো আল্লাহ্‌ দিয়েছেন তাহলে তোমরা আলাদা করতে চাইছ কেন? ছাড়ো বলছি আপুর হাত। (জোহা আম্মুর হাত সরিয়ে নিতেই দৌড়ে চলে আসলাম)

রাস্তা যেন আজ শেষ হচ্ছে না গাড়ি যেন খুব আস্তে চলছে, জানিনা মেঘের এখন কি অবস্থা। খুব অস্থির লাগছে সবকিছুর জন্য আমি দায়ী, আমার কাছে আসতে গিয়েই তো মেঘের এক্সিডেন্ট হলো।

অক্সিজেন মাস্ক লাগানো অবস্থায় বেডে শুয়ে আছে মেঘ, মা পাশে বসে কাঁদছেন। তোহা একটু দূরে ছিল আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জাপটে ধরলো আমাকে। তোহার হাতটা ধরে এক পা দুপা করে এগিয়ে যাচ্ছি মেঘের কাছে…

চলবে?

নীরবে ভালোবাসি পার্ট: ২৭

0

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৭

লেখিকা: সুলতানা তমা

দু মাস পর…

সকালের মৃদু বাতাস সাথে মিষ্টি রোদের লুকোচুরি খেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে উপভোগ করছি। ইদানীং নিজেকে বেশ অন্যরকম লাগে, কেমন যেন নিজেকে গুছিয়ে নিতে পেরেছি। এখন আর মেঘের কথা ভেবে রোজ রাতে চোখের নোনাজলে বালিশ ভিজাই না। হ্যাঁ মাঝে মাঝে কষ্ট হয় মেঘের সাথে কাটানো স্মৃতি গুলো ভেবে, আবার তোহার কথা ভেবেও কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় লুকিয়ে গিয়ে একবার তোহাকে দেখে আসি, একবার কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরে ওর মুখে নতুন আম্মু ডাক শুনি। কিন্তু এসব কিছুই করতে পারিনা মেঘের প্রতি একটু একটু করে জমা হওয়া অভিমান গুলো আমাকে এসব করতে দেয় না। এখন নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছি মেঘের কাছে এখন আর ছুটে যেতে ইচ্ছে করে না। সেদিনের পর আর কখনো মেঘের সাথে যোগাযোগ করিনি, অবশ্য করবোই বা কিভাবে সেদিন রাতেই তো আমার ফোনটা ভেঙে ফেলেছিলাম। মাঝে মাঝে আমার অজান্তেই আমার অবচেতন মন মেঘের জন্য অপেক্ষা করতো, মনে হতো এই বুঝি মেঘ এসে বলবে কণা ফিরে চলো। কিন্তু মেঘ আসেনি, এখন আমার অবচেতন মনটাও বুঝে ফেলেছে তাই এখন আর অপেক্ষাও করে না। দু মাসের মধ্যে মেঘ আমার সাথে কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি, হ্যাঁ মাঝে মাঝে ওই বাসা থেকে ফোন আসতো মা বাবা অথবা দাদী কেউনাকেউ ফোন করতো কিন্তু আমি কথা বলতাম না আজো বলিনা আর হয়তো বলা হবেও না।
জোহা: আপু আপু… (জোহার ডাকে ভাবনা জগৎ থেকে বেরিয়ে আসলাম, নিজেকে স্বাভাবিক করে পিছন ফিরে তাকালাম)
আমি: কিরে কিছু বলবি?
জোহা: নিচে চলো দেখো কারা এসেছে।
আমি: কে এসেছে?
জোহা: নিচে চলো তাহলেই দেখতে পাবে।
জোহা চলে গেল, পিছু পিছু আমিও চলে আসলাম।

দুমাস পর প্রিয় মানুষ গুলোকে আবারো দেখতে পাবো ভাবিনি। মা, বাবা, দাদী আর রুহানকে ড্রয়িংরুমে বসে থাকতে দেখে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললাম, এ কান্না তো কোনো কষ্টের কান্না নয় প্রিয় মানুষ গুলোকে আবারো একনজর দেখার আনন্দের কান্না।
আম্মু: কণা দেখ কারা এসেছে। (ওদের সবার দিকে তাকিয়েই এক পা দুপা করে সিঁড়ি দিয়ে নামছি)
বাবা: বৌমা সাবধানে পরে যাবে তো। (বাবার কথায় যেন ঘোর কাটলো, মৃদু হাসলাম মানুষ গুলো আমাকে নিয়ে এখনো এতো ভাবে)
মা: কেমন আছ মা? (মায়ের প্রশ্নে কোনো জবাব দিতে পারলাম না চুপচাপ একপাশে দাঁড়িয়ে রইলাম)
দাদী: অনেক রোগা হয়ে গেছিস।
আমি: কেন এসেছেন আপনারা? (হুট করে আমার এমন প্রশ্ন করা বোধহয় ঠিক হয়নি সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে)
রুহান: এইটা কেমন প্রশ্ন কণা?
বাবা: রুহান থাম, মা তোমার এমন প্রশ্ন করা স্বাভাবিক। আমিও সহজভাবেই উত্তর দিচ্ছি, আমরা এসেছি তোমাকে ফিরিয়ে নিতে।
আম্মু: মানে?
চাচ্চু: ভাবি আজ সবকিছু কণাকে বলতে দাও, ওর সিদ্ধান্তের উপর আজ অনেক কিছু নির্ভর করছে।
আম্মু: হুম।
দাদী: কিরে ফিরে যাবিনা আমাদের সাথে?
আমি: কেন যাবো কার কাছে যাবো?
মা: মেঘ ওর নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে তাইতো…
আমি: (মৃদু হাসলাম)
মা: হাসছ যে?
আমি: এমনি। (আমিতো জানতামই মেঘ একদিন ওর নিজের ভুল ঠিক বুঝতে পারবে আর ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভোগবে)
বাবা: মা অনেক হয়েছে এবার ফিরে চলো।
আমি: না ওই বাড়িতে ফিরে যাওয়ার মতো কোনো পিছুটান আমার নেই।
রুহান: তোহা? তোহার জন্যও ফিরে যাবে না?
আমি: তোহার মা হবার অধিকার মেঘ আমার থেকে কেড়ে নিয়েছে।
দাদী: কিন্তু দাদুভাই তো এখন নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।
আমি: তাতে আমার কিছু করার নেই আমি ফিরে যাবো না।
বাবা: যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে অনুশোচনায় ভোগে তাকে একটা সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন বৌমা।
আমি: সেদিন আমার কোনো ভুল ছিল না তাও বারবার ভিখারির মতো মেঘের হাত ধরেছিলাম পা ধরেছিলাম একবার আমাকে বুঝার জন্য অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু মেঘ আমাকে কোনো সুযোগ দেয়নি সেদিন।
মা: তাই বলে তুমিও…
আমি: হ্যাঁ আমিও মেঘকে কোনো সুযোগ দেবো না। আপনারা আসতে পারেন।
দাদী: আরে কণা আমার কথা তো শুন।
রুহান: কণা শুনো..
কারো ডাকে না দাঁড়িয়ে রুমের দিকে দৌড়ে চলে আসলাম।

রুমের দরজা লাগিয়ে চুপচাপ ফ্লোরেই বসে পড়লাম। কেন এসেছে ওরা? আমিতো সব ভুলেই গিয়েছিলাম নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছিলাম তাহলে কেন ওরা আবার এসে নতুন করে যন্ত্রণা দিচ্ছে আমাকে?

জোহা: আপু চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি। (চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম জোহার কথায় চোখ খুলে তাকালাম ওর দিকে)
আমি: হঠাৎ বাইরে কেন?
জোহা: আঙ্কেল আন্টি চলে যাওয়ার পর থেকে তো এই বিছানাতেই শুয়ে আছ, সকাল গড়িয়ে বিকেল হলো এখনো শুয়েই আছ। বাইরে থেকে ঘুরে আসলে তোমার মন ভালো হবে।
আমি: আমার আবার মন, চাচ্চু বকা দিবে।
জোহা: আব্বু আর চাঁচি তো বাসায় নেই তাইতো যেতে চাচ্ছি।
আমি: বাসায় নেই? কোথায় গেছে?
জোহা: তাতো জানিনা দুজন একসাথেই বেরিয়েছে।
আমি: হুম।
জোহা: চলোনা আপু প্লিজ! এইতো আশেপাশেই ঘুরবো একটু।
আমি: হুম চল।

জোহাকে নিয়ে বাসার থেকে কিছু দূরে একটা পার্কে আসলাম, জোহা আর আমি পাশাপাশি হাটছি। জোহা বারবার আমার দিকে তাকাচ্ছে শুধু।
আমি: কিরে কিছু বলবি?
জোহা: হ্যাঁ যদি বকা না দাও।
আমি: বল।
জোহা: তুমি কিন্তু চাইলে ফিরে যেতে পারতে।
আমি: তুই বলছিস এই কথা?
জোহা: হ্যাঁ। আগে আমি ভাইয়াকে ভুলে যেতে বলেছি কারণ ভাইয়া তখন ভুল করেছিল কিন্তু এখন তো ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে…
আমি: তুই জানিস মেঘ..
জোহা: আসলে আপু ভাইয়া আমাকে ফোন করেছিল।
আমি: (নিশ্চুপ)
জোহা: ভাইয়া খুব কাঁদছিল প্লিজ আপু তুমি…
আমি: বাসায় চল।
জোহা: আপু শুনোনা..
আমি: বাসায় যাবি কিনা?
জোহা: ভাইয়া আসছে এখানে তোমাকে দেখার জন্য। (কথাটা বলে জোহা মাথা নিচু করে ফেললো, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি ওর দিকে)
আমি: এসবের মানে কি জোহা?
জোহা: ভাইয়া খুব রিকুয়েস্ট করছিল তা…
আমি: তাই তুই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিস? ওর সাথে আমি কেন দেখা করবো ও কে আমার?
জোহা: আপু শুনো প্লিজ যেও না।

পার্ক থেকে বেরুতেই সামনে মেঘকে দেখে থমকে দাঁড়ালাম, মেঘের কোলে তোহা। মেঘ এসে আমার সামনে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তোহা: নতুন আম্মু। (নিজেকে সামলে নিয়ে তোহাকে মেঘের কোল থেকে আমার কোলে নিয়ে আসলাম)
তোহা: তুমি কোথায় ছিলে নতুন আম্মু?
আমি: কোথাও না মামুনি এইতো আমি।
মেঘ: কণা.. (মেঘের ডাকে ওর দিকে তাকালাম, মেঘ শান্ত হয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ সরিয়ে ফেললাম মেঘের দিক থেকে)
মেঘ: কথা বলবে না আমার সাথে?
তোহা: তুমি কি আবার হারিয়ে যাবে?
জোহা: না মামুনি তোমার আম্মু আজ থেকে তোমার সাথেই থাকবে।
তোহা: সত্যি?
আমি: না আম্মু আমি আবার হারিয়ে যাবো তবে চিরত… (মেঘ আমার মুখ চেপে ধরলো, ওর দিকে তাকালাম নিশ্চুপে কাঁদছে মেঘ)
মেঘ: প্লিজ এসব বলো না, তুমি হারিয়ে গেলে…
আমি: আমি হারিয়ে গেলে কারো কিচ্ছু না। (ধাক্কা দিয়ে মেঘ’কে সরিয়ে দিলাম। তোহার কপালে একটা চুমু খেয়ে হনহন করে চলে আসলাম ওদের সামনে থেকে)

জোহা: আপু শুনো প্লিজ।
আমি: হাত ছাড় আমার।
জোহা: আমার কথা তো শুনো প্লিজ।
আমি: বল কি বলবি। (জোহার দিকে ঘুরে তাকালাম, আমার রাগি চোখ দেখে জোহা ভয়ে চুপসে গেল)
আমি: মেঘ’কে ক্ষমা করে ওর কাছে ফিরে যেতে বলবি তো? কেন ফিরে যাবো? তুই তো বলতি এমন ছেলের সাথে সারাজীবন কাটানো যায় না তাহলে এখন কে…
জোহা: আপু ভাইয়া নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে আমাকে সব বলেছে।
আমি: ও কেঁদে কেঁদে বললো আর এমনি তুই সব বিশ্বাস করে নিলি? শুন জোহা বিশ্বাস করি বলা সহজ কিন্তু বিশ্বাস করাটা খুব কঠিন। মেঘ তো খুব বলছে নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে কিন্তু কাল যদি আবারো আগের মতো কিছু ঘটে তাহলে মেঘ আমাকে আবারো অবিশ্বাস করতে দুবার ভাববে না। যে একবার বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে সে বারবার অবিশ্বাস করবে এটাই স্বাভাবিক।
জোহা: হুম বুঝতে পারছি তোমার ভয় হচ্ছে ভাইয়া আবারো এমন করতে পারে এইটা ভেবে কিন্তু আপু আমার মনে হয় ভাইয়াকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত।
আমি: পুরো দু সপ্তাহ আমার মেয়েটা হসপিটালের বেডে শুয়ে ছিল কিন্তু আমি একবারো ওর কাছে যেতে পারিনি ওর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতে পারিনি। আর এসব হয়েছে শুধুমাত্র মেঘের জন্য। প্রতিদিন রাতের আধারে লুকিয়ে তোহাকে দেখতে গিয়েছি এজন্য চাচ্চুর কাছে আম্মুর কাছে কতো বকা শুনেছি তুই তো সব জানিস। এতো কষ্ট করে তোহাকে দেখতে যেতাম, মেয়েটা নতুন আম্মু বলে বারবার ডাকতো দূর থেকে শুনতে পেতাম কিন্তু একবারো ওর কাছে গিয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে নিতে পারিনি শুধুমাত্র মেঘের জন্য। সেদিন তো মেঘ আমাকে দয়া করেনি একবার তোহার কাছে আমাকে যেতে দেয়নি তাহলে আজ কেন আমি ওকে দয়া করবো?
জোহা: আপু শু…
আমি: চুপচাপ বাসায় চল আর হ্যাঁ মেঘের সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখবি না।
জোহা: হুম।

আম্মু: কিরে কোথায় গিয়েছিলি তোরা? (বাসায় এসে ঢুকতেই আম্মু প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন, পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি আম্মু আর চাচ্চু সোফায় বসে আছেন সাথে উকিল। আশ্চর্য হলাম বাসায় হঠাৎ উকিলকে দেখে)
জোহা: এইতো চাঁচি কাছেই একটু হাটতে গিয়েছিলাম।
চাচ্চু: এবার বস এখানে কথা আছে।
আমি: বাসায় হঠাৎ উকিল..
চাচ্চু: এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। অনেকদিন ধরে এই কাজটা করবো ভাবছিলাম কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছিলাম না, তবে আজ যখন তুই ও বাড়ির সবাইকে ফিরিয়ে দিলি তখন আমি সাহস পেয়ে গেছি।
আমি: তোমার কথার কোনো কিছুই আমি বুঝতে পারছি না চাচ্চু।
চাচ্চু: এইনে। (চাচ্চু আমার দিকে চারটা টিকেট এগিয়ে দিলেন, টিকেট গুলো হাতে নিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছি)
আমি: টিকেট কেন চাচ্চু?
আম্মু: আমরা সবাই কানাডা চলে যাচ্ছি।
আমি: মানে?
চাচ্চু: তুই যেভাবে বেঁচে আছিস সেভাবে সারাজীবন কাটানো সম্ভব নয়, তাই আমরা ঠিক করেছি তোর আর মেঘের ডিভোর্স দিয়ে তোকে কানাডা নিয়ে যাবো। আর হ্যাঁ শুধু তাই নয় কানাডা গিয়ে ভালো ছেলে দেখে তোর আবার বিয়ে দিবো আমরা।
আমি: মানে কি চাচ্চু? আমার আর মেঘের ডিভোর্স? আবার অন্যকারো সাথে বিয়ে? কি বলছ এসব চাচ্চু তোমাদের মাথা ঠিক আছে তো?
আম্মু: আমাদের মাথা ঠিক আছে, ঠিক নেই তো তোর মাথা। একটা মরীচিকার জন্য তুই দিনের পর দিন অপেক্ষা করছিস। এভাবে জীবন চলে না কণা, এভাবে দুমাস কাটিয়েছিস হয়তো আরো কয়েক মাস কাটাতে পারবি কিন্তু সারাটা জীবন? কণা তোর সারাটা জীবন পরে আছে সামনে, তুই এভাবে থাকতে চাইলেও আমরা তোকে এভাবে থাকতে দিতে পারিনা।
আমি: কিন্তু কেন আম্মু?
চাচ্চু: কারণ আমরা তোর ভালো চাই।
আমি: আমি ভালো আছি চাচ্চু আর এভাবেই থাকতে চাই।
চাচ্চু: একদম চুপ। তোর কথামতো সবকিছু হবে না শুনেছিস তুই? এইযে ডিভোর্স পেপার সাইনটা করে দে আর আগামীকাল আমাদের ফ্লাইট।
আমি: মেঘকে ভালোবাসি আমি, কোথাও যাবো না আমি এইদেশ ছেড়ে। মেঘ আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে তো কি হয়েছে আমি ওকে ভালোবাসি আর সারাজীবন বাসবো শুনেছ তোমরা? আমাকে জোর করো না তাহলে কিন্তু…
চিৎকার করে কথাগুলো বলে দৌড়ে রুমে চলে আসলাম।

বিছানায় শুয়ে মেঘের ছবিটা দেখছি আর কাঁদছি। কেন করলো মেঘ এমন? ভালোই তো ছিলাম দুজন একসাথে, মেঘ আমাকে অবিশ্বাস করে সবকিছু কেন উলটপালট করে দিলো? এখন আমি কি করবো আম্মু আর চাচ্চু তো সবকিছু ঠিক করে ফেলেছে। ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কান্না করি আর সবাইকে বলি “আমি মেঘকে ভালোবাসি আর সারাজীবন ভালোবাসতে চাই, মেঘ আমাকে ভালো বাসুক বা না বাসুক আমি ওকে এভাবেই নীরবে ভালোবেসে যেতে চাই”

জোহা: আপু উঠনা খাবে না অনেক রাত হয়েছে তো।
আমি: (নিশ্চুপ)
জোহা: আর কতক্ষণ এভাবে অন্ধকার রুমে শুয়ে থাকবে? কিছু খেয়ে নাও প্লিজ।
আমি: খাবো না যা তুই।
জোহা: আমিও কিন্তু খাইনি, প্লিজ চলো তুমি না খেলে খাবো না।
আমি: কেন জেদ করছিস?
জোহা: চলো না লক্ষী আপু। (জোহা কাঁদছে দেখে আর শুয়ে থাকতে পারলাম না উঠে খাবার খাওয়ার জন্য চলে আসলাম)

আমি: সবাই খেয়েছে?
জোহা: উঁহু কেউ খায়নি তোমার জন্য।
আমি: আমার জন্য কারো এতো ভাবতে হবে না।
জোহা: হুম তুমি খেয়ে নাও।
চাচ্চু: পছন্দ হয় কিনা দেখতো। (খাবার মুখে দিতে যাবো তখনি চাচ্চু একটা ছবি টেবিলে ছুড়ে দিলেন)
আমি: এইটা কি চাচ্চু?
চাচ্চু: একটা ছেলের ছবি।
আমি: তাতো আমিও দেখতে পারছি কিন্তু ছেলেটা কে?
চাচ্চু: কানাডাতেই থাকে ওর সাথে তোর বিয়ে ঠিক করছি। (চাচ্চুর কথা শুনে রাগ উঠে গেল একবারো আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন মনে করলো না)
চাচ্চু: ছেলে খুব ভালো অনেক সুখে থাকবি তুই।
আম্মু: কণা রাগ করিস না তোর ভালোর জন্যই…
আমি: আমার ভালো ভাবতে কে বলেছে তোমাদের?
চাচ্চু: ভাইয়ার অবর্তমানে আমিই তোর…
আমি: বিয়ে করবো না আমি শুনেছ তোমরা? আর হ্যাঁ মেঘ’কেও আমি ডিভোর্স দিবো না।
চাচ্চু: তুই মেঘকে ডিভোর্স দিলেও মেঘের কাছে আর ফিরে যেতে পারবি না, ডিভোর্স না দিলেও আর ফিরে যেতে পারবি না।
জোহা: মানে কি আব্বু?
আম্মু: আগামীকাল আমরা কানাডা চলে যাচ্ছি এটাই ফাইনাল।
আমি: যাবো না আমি।
আম্মু: তুই যা বলবি তাইতো আমরা শুনবো না, আমরা ঠিক করেছি মেঘের কাছে আর তোকে ফিরিয়ে দিবো না। আর হ্যাঁ এই ছেলের সাথেই তোর বিয়ে হবে।
আমি: করবো না বিয়ে আর কানাডাও যাবো না। (টেবিলের সব খাবার ছুড়ে ফেলে দিয়ে রুমে চলে আসলাম)

ঘড়ির কাটায় রাত বারোটা পনেরো মিনিট, ঘুম আসছে না কিছুতেই। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছি আর নিশ্চুপে কাঁদছি। বড্ড ভয় হচ্ছে সত্যি যদি কাল চাচ্চু আর আম্মু কানাডা নিয়ে যায় আমাকে তখন আমি কি করবো?
হঠাৎ বারান্দায় কি যেন শব্দ হলো কেঁপে উঠে আস্তে আস্তে বারান্দার দিকে এগিয়ে গেলাম। বারান্দার দরজা খুলা দেখে বেশ অবাক হলাম, দরজা খুললো কে? দরজায় হাত রাখতেই আচমকা কে যেন আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে বারান্দায় নিয়ে আসলো, ভয়ে চিৎকার দিতে যাবো তখনি আমার মুখ চেপে ধরলো। চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছি মেঘের দিকে, একহাতে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে রেখেছে অন্যহাতে মুখ চেপে ধরে রেখেছে। ওর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই আমার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো তারপর কোমরে টান দিয়ে আমাকে ওর কাছে নিয়ে গেল।
আমি: তুতুমমি এএতো রাতে?
মেঘ: কেন ভয় পাচ্ছ?
আমি: কেন এসেছ?
মেঘ: পরে বলছি। (মেঘ আমাকে ওর বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলো, চুপচাপ ওর বুকের সাথে লেপ্টে রইলাম)
মেঘ: আম্মু আর চাচ্চু আমার উপর রেগে আছে দেখে ভয় পাচ্ছ?
আমি: তুমি এসব জানলে কিভাবে?
মেঘ: জোহা বলেছে সবকিছু।
আমি: কাল আমরা কানাডা চলে যাচ্ছি। (মেঘকে ছেড়ে দিয়ে দূরে এসে দাঁড়ালাম। মেঘ এক পা দুপা করে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। আমি দেয়ালে আটকে যেতেই মেঘ আমার সামনে এসে দাঁড়ালো)
মেঘ: আমি তোমাকে যেতে দিলে তো তুমি যাবে।
আমার কপালে আসা চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে আমার কপালে আলতো করে ওর ঠোঁট ছুঁয়ালো, আমি চোখদুটো বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি…

চলবে?

একটি পানকৌড়ির গল্প ৮

0

একটি পানকৌড়ির গল্প……

৮.
রাতের খাওয়াটা আজকে বেশ মজার হয়েছে। অনেক দিন পরে আফতাব হোসেন বেশ আরাম করে খেয়েছেন! মুগ ডালের স্বাদ অমায়িক হতে পারে তার জানা ছিলোনা। ঘরের খাবার খেতে খেতে জিহবাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রশীদ আলমের স্ত্রীর রান্না এতো ভালো কিন্তু তার স্ত্রীর রান্না দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রাত ১০ টা বাজে একবারও রেহানা তাকে ফোন করেনি। অন্যদিন তো ৯ টা বাজার সাথে সাথেই ফোন করতে শুরু করে। যেন সে একজন অবুঝ শিশু! স্ত্রীর এরকম কাজ তিনি মোটেও পছন্দ করেননা। রাত ১০ টা বাজুক না ১২ টা বাজুক সে পুরুষ মানুষ বাহিরে থাকতেই পারেন। এতে এতো বিচলিত হবার কিছুই নেই। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন আর ভাবছিলেন আফতাব হোসেন, আজকে বাড়ি না গেলে কেমন হয়? মেয়ে মানুষ দের একটু শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন আছে।
না, বাড়িতে যাওয়াই ভালো। একসময় এই স্ত্রীর জন্য তিনি পাগল ছিলেন। অনেকেই তাকে বউ পাগলা বলতেন। সেগুলো বিয়ের প্রথম প্রথমে রেহানা দেখতে অনেক আকর্ষণীয় ছিলো। এখন তো পেটে চর্বি জমেছে, গায়ের রঙটা নষ্ট হয়ে গেছে। চুলের অবস্থা তো খুবই বিশ্রী। এখন রেহানাকে তার ভালোই লাগেনা। আরেকটা বিয়ে করার চিন্তায় আছেন আফতাব হোসেন। যদি অল্পবয়সী কাউকে পেয়ে যান তাহলে রেহানাকে তালাক দিয়ে দিবেন। তালাক দেয়ার পর অবশ্য ওর যাওয়ার জায়গা নেই। না থাক, তার দেখার বিষয় না।
রেহানা রাত ৯ টা থেকে স্বামীর অপেক্ষা করছেন। আজ তার জন্মদিন, আফতাবের ভুলে যাওয়ার কথা না। ইচ্ছাকৃতভাবে আফতাব হোসেন দেরি করছেন। তাকে রাগানোর জন্য, কিন্তু সে রাগবে না। রেহানা শেষ কবে সেজেছিলো তার মনে পড়ছেনা। জন্মদিন উপলক্ষে সাজুগুজু করলেন। আফতাব হোসেন জাম রঙের একটা কাতান গিফট করেছিলেন বিয়ের দ্বিতীয় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। সেই জাম রঙের কাতান টাই পড়েছেন। ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, ছেলেদের সামনে তার সাজতে লজ্জা লাগে।
অপেক্ষা করতে রেহানার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।আফতাব মনে হয় ভুলে গেছে। আবার একটু পরেই ভাবছেন গতবারও মনে ছিলো, এবারও আছে। তার সাথে দুষ্টিমি করছে।
রেহানা কাঁদতে শুরু করলেন, এখন আফতাব আর তাকে আগের মতো ভালোবাসে না। কথাও বলতে চায়না, জোর করে কথা বলেন। ছেলেদের খোঁজও তেমন রাখেন না। রাত কতো হচ্ছে কিন্তু আফতাব আসছেনা। বাধ্য হয়ে রেহানা আফতাব হোসেন কে ফোন দিলেন। রিসিভ করে আফতাব হোসেন বললেন
– কী সমস্যা?
রেহানা কান্না অনেক কষ্টে থামিয়ে রেখেছিলেন। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আফতাব হোসেন চুপচাপ সেই কান্না শুনতে লাগলেন। তার ভেতরের সেই ভালোবাসাটা আবার জেগে উঠছে, যার উপর মরিচা ধরেছিলো। রেহানার কান্না মরিচা সরিয়ে ফেলছে। আফতাব হোসেন ফোন কেটে দিয়ে হোটেল রুম থেকে বের হয়ে ম্যানেজারের কাছে গেলেন।
ম্যানেজার বললেন
– কিছু লাগবে স্যার?
– আমি এখন চলে যাচ্ছি, রুমের চাবি রাখুন। আর টাকা তো আগেই দিয়েছি।
– কোনো সমস্যা হয়েছে আমাদের হোটেলে?
– না। আমার স্ত্রীর সাথে মান অভিমান টা বহুদিন পর ভাঙলো। আমি এখন বাসায় না গেলে ও খুব কষ্ট পাবে।
ম্যানেজার কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
আফতাব হোসেন রাস্তায় নেমে জোরে হাঁটতে শুরু করলেন। আশেপাশে কোনো বা কোথাও পেস্ট্রি শপ খোলা পেলে বেশ ভালো হতো। রাত তো অনেক হয়েছে এখন খোলা থাকার কথা না। রেহানার জন্মদিন টা এভাবে মাটি করে দেয়া যাবেনা। রেহানা খুব কষ্ট পাবে। এই মেয়ে তাকে খুব বেশি ভালোবাসে। আফতাব হোসেন নিজের চোখের কোণে ভিজে উঠেছে বুঝতে পেরেও হাত দিয়ে মুছলেন না। থাক, মানুষ দেখুক। এখন তার একটাই কাজ রেহানার জন্য কিছু একটা নিয়ে যাওয়া।
অঅল্পবয়সী, হুর-পরী, বিশ্বসুন্দরী যেই আসুক না কেন তিনি আর বিবাহ করবেন না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন। রেহানা আধা পাগলী টাই থাকুক জীবনে! আর রেহানা খাঁটি ভালোবাসা দিয়ে তাকে মুড়িয়ে রাখুক শেষ নিশ্বাস অবদি।
রেহানা বসার ঘরে ঝিমুচ্ছেন আর কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ির দিকে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে সময় দেখছেন। এই মনে হচ্ছে আফতাব চলে আসবে কিন্তু না আসছেনা।
১১ টা ১৫ তে কলিং বেল টুং করে বেজে উঠলো! রেহানা প্রায় পাগলের মতো দরজা খুলে দিলো। আফতাব হোসেন স্মিত হেসে স্ত্রীকে বললেন
– My Dear পাগলা বউ, Happy birthday to you!
স্বামীর মুখে পুরোনো কথা শুনে আবারও কাঁদতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আফতাব হোসেন বললেন
– কাঁদবেন না। আপনার জন্য কি এনেছি জানেন?
রেহানা ঘাড় নাড়িয়ে না বোঝালো। আফতাব হোসেন তার পিছনে লুকিয়ে রাখা পাখির খাঁচাটা বের করে স্ত্রীকে বললেন
– টিয়াপাখি এনেছি। সারাক্ষণ এ চিল্লাবে আর তুমি ভাববা আমি তোমাকে ভালোবাসি বলছি। বুঝতে পারছো?
– আস্তে বলো, ছেলেরা শুনবে তো।
– আগে আমাকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে তো দিবা!
রাত ৩ টা রেহানার ছোট্ট বারান্দায় টিয়াপাখি টা তার খাঁচায় ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। নতুন পরিবেশে সে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেনা। বারবার ভেতরের ঘর থেকে খিলখিল হাসির শব্দ আসছে। যাও একটু ঘুম আসছে তাও ওই মহিলার হাসিতে দফারফা হয়ে যাচ্ছে।

ফজরের আজান দিবে ঠিক তার আগে ফারিয়া আবারও সেই স্বপ্নটা দেখলো। ঠিক প্র‍থমদিন যেমন দেখেছিলো ঠিক তেমনই। কোনো পরিবর্তন আসেনা। ফারিয়ার ঘুম ভাঙলো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। পুরো শরীরে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নাকের কাছের গন্ধটা গতকাল রাতেও তেমন ছিলোনা। ব্যথাটাও কম ছিলো। বেশ ভালো লাগছিলো ফারিয়ার। মায়ের টুকটাক কাজ করে দেয়াতে মা বেশ বিরক্ত হয়েছিলো। ফারিয়া বুঝতে পেরে বলেছিল
– আবারো তো অসুস্থ হয়ে যাবো। তখন তো আর পারবো না।
ডাক্তার লোকটার সাথে তার মায়ের খুব ইম্পরট্যান্ট কথা হয়েছে। তাকে শুনতে দেয়া হয়নি। মাকে জিজ্ঞেস করেও জানা সম্ভব হয়নি।
ফারিয়ার পেট গুলিয়ে বমি আসছে। অনেক কষ্টে বমি চাপিয়ে রেখেছে। স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটেনি। এখনো ফারিয়ার মনে হচ্ছে তার মাথা ভারি গাড়ির চাক্কায় পিষে রাস্তার পিচের সাথে একদম মিশে গেছে! ভোর হচ্ছে, লোকজন আসছে তাকে মর্গে নেয়ার জন্য। না না, সে তো এক্সিডেন্টে মারা গেছে তাকে নিয়ে যাবে লাশ কাটা ঘরে। তারপর এই শরীর কে যাচ্ছেতাই ভাবে কাটা হবে। কী অসহ্য স্বপ্ন! ফারিয়ার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে! ভেতরের ফারিয়া প্রতিনিয়ত একটু একটু করে মারা যাচ্ছে। কেউই খেয়াল করছেনা। তার মাও বুঝতে পারছেনা। বুঝবেই বা কীভাবে ফারিয়া তো তাকে কিছুই জানতে দেয়নি।
আফতাব হোসেনের ঘুম ভাঙলো তার ছেলেদের ডাকে। চোখ মুছতে মুছতে মোবাইলে সময় দেখে প্রায় আঁতকে উঠলেন। ৯ টা বাজে কিন্তু এখনো তার ঘ ভাঙেনি কেনো? প্রতিদিন ঠিক ৬ টায় তার ঘুম ভেঙে যায়। তাহলে আজকে এমন কেনো হলো? রাতের কথা তার মনে পড়লো। রাত ৩ টা পর্যন্ত রেহানা আর সে গল্প করেছে। সে গল্প করেছে ব্যাপারটা ওরকম না। রেহানা গল্প করেছে আর সে আদর্শ লিসেনারের মতো শুনেছে। অন্যদিন রেহানার সাথে ২ মিনিট কথা বললেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। কিন্তু গতরাতে একটুও বিরক্ত আসেনি তার মধ্যে। বরং তার ইচ্ছা করছিলো রেহানা আরো গল্প করুক। গল্প গুলো যে খুব জরুরি কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা না। পাশের বাসার ভাবী শুকনা মরিচ ধার নিয়ে আর দেননি। চাল ধার নিয়েছিলো আগে তাও দেয়নি ফেরত। এবার কিছু চাইতে আসলে সে কিছুই দিবেনা।
মেয়ে জাত বড্ড অদ্ভুত। সামান্য ব্যাপার গুলোকে অসামান্য করে তুলতে এদের জুরি নেই। এসব বিষয় গুলো যে গল্প হতে পারে এটা নারী ছাড়া কারও বের করা সম্ভব না।
দেরি হওয়াতে মেজাজ খারাপ ছিলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
– কী ব্যাপার বাপ জানেরা, আজকে আপনারা ডাকতে আসছেন?
ছোটো ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বললো
– জানো বাবা, আম্মু আজকে খুব মজার খাবার রান্না করেছে। আর বলেছে আজকে সবাই সকালে একসাথে খাবো। তুমি তো উঠছো না আর এদিকে আমাদেরও খিদে পেয়েছে। উঠো না বাবা।
আফতাব হোসেন বললেন
– আচ্ছা আমি উঠছি। তোমাদের মাকে বলো খাবার টেবিলে দিতে।
ছেলেরা হুড়োহুড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
আফতাব হোসেন নিজের অজান্তেই হাসলেন। ছোটো ছেলেটা পুরো মায়ের ফটোকপি। মায়ের মতোই গল্প করতে পটু।
এতো সুন্দর সুখ থেকে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। আহাম্মকের মতো কাজ করেছেন। এখন আর না।

চলবে……

© Maria Kabir

নীরবে_ভালোবাসি পার্ট: ২৬

0
ভালোবাসি

নীরবে_ভালোবাসি

পার্ট: ২৬

লেখিকা: সুলতানা তমা

আম্মু: কণা আর কতক্ষণ এখানে পাগলের মতো বসে কাঁদবি?
আমি: তোহা সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত।
আম্মু: এসব পাগলামি কেন করছিস?
জোহা: ভাইয়া তোমাকে কেবিনের ভিতর যেতে দিচ্ছে না আর তুমি বারান্দায় বসে এমন পাগলামি করছ এসবের কোনো মানে হয় আপু?
আমি: তুই তো জানিস আমি তোহাকে কতোটা ভালোবাসি?
চাচ্চু: কিন্তু মেঘ তো সেটা বুঝতে চাইছে না। রাত এগারোটা বাজে আর কতক্ষণ এখানে বসে থাকবি এবার বাসায় চল মা।
আমি: ওই তো ভাবি আসছে। (ভাবিকে রুম থেকে বেরুতে দেখে দৌড়ে ওর কাছে আসলাম)
আমি: তোহা কেমন আছে?
ভাবি: ভালো আছে এখন, তুমি বাসায় চলে যাও অনেক রাত হয়েছে।
আমি: তোহাকে একবার দেখতে চাই আমি।
ভাবি: কিন্তু কিভাবে সম্ভব মেঘ তো তোহার পাশে বসে আছে।
আমি: আচ্ছা তোহা আমাকে দেখতে চাইছে না?
ভাবি: হুম অনেক বার নতুন আম্মু বলে ডেকেছে কিন্তু মেঘ তোহাকে বলেছে ওর নতুন আম্মু মারা গেছে।
আমি: ওহ আমি মারা গেছি ওর কাছে।
ভাবি: তুমি বাসায় গিয়ে রেস্ট নাও তোমার শরীর একদম ভালো নেই।
আমি: আর ভালো হয়ে কি হবে সব তো হারিয়ে ফেললাম।
ভাবি: আরে কোথায় যাচ্ছ দৌড়ে? (ভাবির ডাকে সাড়া না দিয়ে দৌড়ে হসপিটালের বাইরে চলে আসলাম। আমাদের গাড়ি পার্ক করা দেখেই গাড়িতে উঠে বসলাম, পিছু পিছু আম্মু জোহা আর চাচ্চু আসলেন)
চাচ্চু: কণা তুই পিছনে যা আমি ড্রাইভ করছি।
আমি: (নিশ্চুপ)
চাচ্চু: আরে এক্সিডেন্ট করে ফেলবি তো।
আমি: এটাই তো চাই আমি, কেন এসেছ তোমরা?
আম্মু: এটাই চাস মানে? পাগল হয়ে গেছিস নাকি এমন একটা ছেলের জন্য মরতে চাইছিস যে তোকে বিশ্বাসই করে না।
আমি: ওর কাছে নাকি আমি মৃত…
জোহা: তাই বলে মরে যেতে হবে? জীবন থাকলে এমন দুটাকার ছেলে অনেক আসবে।
আমি: জোহা..
জোহা: চিৎকার করো না, তুমি ওর জন্য কাঁদছ আবার? আমি হলে তো ডিভোর্স পেপারটা ওর মুখে ছুড়ে দিয়ে আসতাম। যে আমাকে বিশ্বাস করে না সবার সামনে আমার ভালোবাসাকে ছোট করে তার জন্য কেন কাঁদবো আমি? এসব আবেগ ছাড়ো আপু আর ওকে ভুলে যাও।
চাচ্চু: জোহা একদম ঠিক বলেছে, এবার বাসায় চল আর পাগলামি করিস না। (চুপচাপ পিছনে এসে বসে পড়লাম। সত্যিই তো মেঘ আমার ভালোবাসাকে সবার সামনে ছোট করেছে। হ্যাঁ ওর থেকে দূরে থাকতে পারবো যতো কষ্টই হউক। কিন্তু ভুলতে পারবো না ওকে, কারণ মেঘকে যে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি)

ঘড়ির কাটায় রাত তিনটা বাজে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে রাতের আকাশ দেখছি। দুচোখের পাতা কিছুতেই এক হচ্ছে না, জানিনা আমার তোহা এখন কি করছে। মেঘকে ফোন করলে তো রেগে যাবে কিযে করি। আচ্ছা ভাবিকে তো ফোন করতে পারি? ভাবির কথা মনে পড়তেই সাথে সাথে ফোন দিলাম।
ভাবি: কণা..
আমি: ভাবি তোহা কি করছে কেমন আছে ও?
ভাবি: শান্ত হও বলছি, তোহা ভালো আছে ঘুমুচ্ছে তুমি টেনশন করো না।
মেঘ: শায়লা কার সাথে কথা বলছ?
ভাবি: না মামানে…
মেঘ: তুমি কি চাইছ আমি তোমাকেও তোহার কাছে আসতে না দেই?
ভাবি: না না…
মেঘ: তাহলে ফোনটা রেখে দাও কাউকে আমার মেয়ের খবর দেওয়ার প্রয়োজন নেই।
ভাবি: হুম। (ভাবি ফোনটা কেটে দিলো। বিশ্বাসই করতে পারছি না মেঘ আমার সাথে এমন করছে)

বারান্দায় রেলিং এ হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে আছি আর মেঘের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্ত গুলোর কথা ভাবছি, হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো রাত সাড়ে তিনটার দিকে কে ফোন দিলো ভাবতে ভাবতে রিসিভ করলাম।
আমি: হ্যাল…
মামা: মামুনি রাতের ঘুম কেড়ে নিলাম তো?
আমি: (নিশ্চুপ)
মামা: আরো করবো মেঘ আর তোমাকে পুরোপুরি আলাদা করে তবেই আমার শান্তি হবে।
আমি: মানুষ এতোটাও খারাপ হয় মামা?
মামা: আমি খারাপ আর আমার খারাপি আরো দেখবে জাস্ট ওয়েট করো।
আমি: আর কি করার বাকি আছে তোমার?
মামা: অনেক কিছু বাকি আছে এখনো তো কিছুই করিনি, তোর আম্মু আমাকে যতটা যন্ত্রণা দিয়েছে তারচেয়ে বেশি যন্ত্রণা আমি তোকে দিবো।
আমি: তুমি অন্যায় করেছিলে আম্মু তো মামিকে মেনে নিয়েছিল এমনকি সবাইকে বুঝিয়েছিল তাহলে আম্মুর দোষ কোথায় আম্মুর উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছ কেন?
মামা: সম্পত্তি পাওয়ার জন্য তোর আম্মু বাবা মা’কে বলে আমাকে পুলিশে দিয়েছিল..
আমি: ভুল ভাবছ মামা, আম্মুর যদি সম্পত্তির লোভ থাকতো তাহলে সবকিছু নিজের নামে করে নিতো ডোনেট করতো না।
মামা: সব মিথ্যে নাটক আমি জানি এখন তোদের যা কিছু আছে স…
আমি: সব আব্বুর গড়ে তুলা তুমি আম্মুকে ভুল ভাবছ।
মামা: আমি ভুল নই তোর আম্মুর শাস্তি আমি তোকে দিবো। মেঘ আর তোকে তো আলাদা করেছি শুধু এখন তোদের ডিভোর্স হবে।
আমি: সে সুযোগটা আমি তোমাকে দেবো না মামা, অনেক পাপ করেছ এবার তো আমি তোমাকে শাস্তি দিবোই।
মামা: ট্রাই করতে পারো মামুনি।
ফোন কেটে দিলাম, এবার সব আমাকেই করতে হবে।

চাচ্চু: আমি যখন বলেছি তাহলে আজকের মধ্যেই ওকে এরেস্ট করতে হবে নাহলে…(সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখি চাচ্চু কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছেন, পাশে আম্মু বসে কাঁদতেছেন। কিছু না বুঝে আম্মুর পাশে এসে বসলাম)
চাচ্চু: হ্যাঁ আজকেই আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে। (চাচ্চু ফোন রাখতেই চাচ্চুর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম)
চাচ্চু: ওহ তুই উঠে পড়েছিস?
আমি: কার সাথে কথা বলছিলে চাচ্চু?
চাচ্চু: পুলিশের সাথে।
আমি: কাকে এরেস্ট করার কথা বললে?
চাচ্চু: কাকে আবার সামাদ কে, অনেক জ্বালিয়েছে আর সেটা পুলিশের বোকামির জন্য। এতোদিন হয়ে গেল এখনো এরেস্ট করতে পারছে না…
জোহা: আব্বু চা, আপু নাও..
আমি: ভালো লাগছে না খাবো না।
জোহা: এমন করলে হবে নাকি?
আম্মু: রাতে তো ঘুমাসনি ভোরবেলায় ঘুমিয়ে এখনি উঠে পড়েছিস চা’টা খেয়ে গিয়ে রেস্ট নে।
আমি: একটু হসপিটালে যা…
চাচ্চু: আর একবার যদি তোর মুখে এই কথা শুনেছি তাহলে…
আম্মু: আহ বকো না ওকে, বুঝিয়ে বলো।
জোহা: আপু পিচ্ছি নাকি যে বুঝাতে হবে? গতকাল ভাইয়া আপুকে সবার সামনে এতো অপমান করলো আপু ভাইয়ার পা ধরলো আর ভাইয়া কি করলো আপুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো, এতোকিছুর পরও আপুকে নতুন করে বুঝাতে হবে?
আমি: আমিতো গিয়েই চলে আস…
চাচ্চু: যেতে হবে না চুপচাপ রুমে যা।
আমি: হুম।

হাটুতে মাথা নিচু করে রেখে রুমের এক কোণে ফ্লোরে বসে আছি কিছু ভালো লাগছে না, তোহাকে একটাবার দেখার জন্য মন চটপট করছে। মেঘের এমন ব্যবহারের পর চাচ্চু বা আম্মু কেউই আমাকে হসপিটালে যেতে দিবে না সেটা ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি। কিন্তু মন যে মানছে না তোহাকে একবার দেখার জন্য মন পাগল হয়ে আছে। ভাবিকেও ফোন দিতে পারছি না মেঘ যদি রেগে গিয়ে ভাবিকে তোহার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। মেঘ এমন কিভাবে করতে পারলো ভাবতেই পারছি না, এতগুলো মাস মেঘের সাথে ছিলাম কিন্তু মেঘ আমাকে এতটুকুও বিশ্বাস করতে পারেনি উল্টো কিসব বাজে বাজে কথা বলেছে আমাকে সবার সামনে।
জোহা: আপু.. (জোহার ডাকে তাড়াতাড়ি চোখের পানি মুছে নিলাম)
জোহা: জানালা গুলো বন্ধ করে রুম এতো অন্ধকার করে রেখেছ কেন?
আমি: (নিশ্চুপ)
জোহা: আপু আমি বুঝতে পারছি তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে কিন্তু তুমিই বলো যে তোমাকে সম্মান করেনা বিশ্বাস করেনা তোমার ভালোবাসাকে সম্মান করেনা তার সাথে কি তোমার সারাজীবন কাটানো সম্ভব? (জোহা জানালা গুলো খুলে দিয়ে এসে আমার পাশে বসে চুলে হাত বুলিয়ে দিলো, ওর দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছি)
জোহা: এভাবে অন্ধকার রুমের এক কোণে পরে থাকলে হবে না আপু নিজেকে শক্ত করো।
আমি: হুম।
জোহা: আচ্ছা তুমি কয়েকটা দিন ভাইয়ার থেকে দূরে থাকো তারপর দেখো ভাইয়া তোমার কাছে ফিরে আসে কিনা, কি এইটুকু তো পারবে নাকি?
আমি: হুম পারবো কিন্তু তোহার থেকে দূরে থাকতে পারবো না।
জোহা: আরে কেঁদো না, দেখো ভাইয়া যদি তোমাকে তোহার কাছে যেতে না দেয় তাহলে তো আমাদের কিছু করার নেই, নিজেকে শক্ত করো দেখো সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমি: (নিশ্চুপ)
জোহা: এবার উঠে খাবারটা খেয়ে নাও আমি টেবিলের উপর রেখে গেলাম।
জোহা খাবার রেখে চলে গেল। পাশে রাখা ফোনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি মেঘের ফোনের, হয়তো মেঘ ফোন করবে না কিন্তু মন চাইছে ওর ফোনের অপেক্ষা করতে।

সকাল পেরিয়ে বিকেল নেমে আসলো কিন্তু মেঘ একটা ফোনও করলো না, হয়তো আর কখনো করবেও না কারণ আমাদের পথ যে এখন আলাদা।
চাচ্চু: কণা মা একটা গুড নিউজ আছে। (জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম চাচ্চুর কথা শুনে পিছন ফিরে তাকালাম, চাচ্চু হাসি হাসি মুখে দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন)
আমি: কি বলো।
চাচ্চু: সামাদ এরেস্ট হয়েছে আ..
আমি: অহ!
চাচ্চু: কিরে তুই খুশি হসনি?
আমি: আমার যা ক্ষতি হবার তাতো হয়েই গেছে এখন আর খুশি হয়ে কি লাভ।
চাচ্চু: দেখিস সব ঠিক হয়ে যাবে, এখন চল তো খুনিটাকে একবার দেখে আসি।
আমি: না চাচ্চু আমার ভালো লাগছে না তুমি গিয়ে দেখে এসো।
চাচ্চু: আমিতো ভেবে ছিলাম তুই গিয়ে ওকে কয়েকটা থাপ্পড় দিয়ে আসবি।
আমি: (মৃদু হাসলাম)
চাচ্চু: আসছি তাহলে।
চাচ্চু চলে গেলেন, এখন আর ওকে থাপ্পড় দিয়ে কি হবে মেঘ তো আর আমার জীবনে ফিরে আসবে না।

সন্ধ্যা নেমে এসেছে একটু পর চারদিক অন্ধকার হয়ে আসবে, ফ্লোরে বসে মেঘের ফোনের অপেক্ষা করছি আর ভাবছি মেঘ ফোন না করলে এই অন্ধকারে লুকিয়ে একবার তোহাকে দেখতে যাবো। হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো, মেঘ নয় ভাবি ফোন করেছে হয়তো তোহার কোনো খবর দিবে তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম।
আমি: হ্য..
ভাবি: তুমি তাড়াতাড়ি হসপিটালে চলে এসো।
আমি: কেন?
ভাবি: মেঘ বাসায় গেছে ঘণ্টা দুয়েক এর মধ্যে আসার সম্ভাবনা নেই। এখানে আমি আর পপি ছাড়া আর কেউ নেই তোহাকে দেখার জন্য তাড়াতাড়ি চলে আসো।
আমি: ঠিক আছে আমি এক্ষণি আসছি।
ফোন রেখে বেরিয়ে পড়লাম চাচ্চু থানায় গেছে এটাই সুযোগ।

আমি: আমার তোহা কোথায়? (দৌড়ে এসে কেবিনের ভিতর ঢুকলাম, আমার কন্ঠ শুনেই তোহা চোখ খুলে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো)
তোহা: নতুন আম্মু তুমি এসেছ?
আমি: হ্যাঁ আম্মু এসেছি। (তোহার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম, তোহা আমার হাত ওর একটা হাত দিয়ে ধরে আমার দিকে তাকালো)
আমি: কি মামুনি?
তোহা: তুমি তো বলেছিলে কেউ আকাশের তারা হয়ে গেলে আর ফিরে আসতে পারে না তাহলে তুমি ফিরে আসলে কিভাবে? আব্বু তো বলেছে তুমি আকাশের তারা হয়ে গেছ।
আমি: (নিশ্চুপ)
পপি: তোমার আব্বু তো পঁচা তাই তোমাকে মিথ্যে বলেছে।
মেঘ: বাহ্ অসাধারণ… (মেঘের কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠে পিছনে তাকালাম, মেঘ রাগি চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে)
পপি: ভাইয়া প্লিজ আমার কথা শুনো।
মেঘ: আমি বেরিয়ে যেতেই ওকে খবর দিয়ে আনা হয়েছে? তারমানে আমার আন্দাজ ঠিক ছিল..
ভাবি: আন্দাজ?
মেঘ: কিছুটা রাস্তা যাওয়ার পর আমার মনে হলো আমি নেই এই সুযোগে তোমরা ওকে ফোন করে আসতে বলতে পারো তাইতো ফিরে আসলাম আর এসেই…
আমি: মেঘ আমার কথা শুনো ওদের কোনো দোষ নেই আমি নিজে থেকেই এসেছি।
মেঘ: একদম চুপ আমি তোমার সাথে একটা কথাও বলতে চাই না।
তোহা: আব্বু নতুন আম্মুকে বকো না থাকুক না আম্মু আমার কাছে।
মেঘ: ওর হাতটা ছেড়ে দাও তোহা, এমন খারাপ কোনো মেয়ের সাথে আমি তোমাকে…
পপি: কাকে খারাপ বলছ তুমি ভাইয়া?
মেঘ: যার নষ্টামির জন্য আমার মেয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে।
আমি: মেঘ ওই লোকটা আমাকে আটকে রেখেছিল তোহাকে যেন আটকাতে না পারি আর তুমি কিনা এসব খারাপ কথা ভাবছ ছিঃ।
মেঘ: আটকে রেখেছিল? আচ্ছা মানলাম আটকে রেখেছিল কিন্তু কাজটা তো তোমার মামা করেছে আমার মামা নয়।
ভাবি: আজ যদি এই একি কাজ কণার মামা না করে তোমার মামা করতো তাহলে কি করতে মেঘ?
মেঘ: আর যাই করতাম নষ্টামি… (ঠাস করে মেঘের গালে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলাম)
আমি: দুদিন ধরে তোমার মুখে এসব খারাপ কথা শুনছি কিন্তু আর নয়, আর শুনবো না। কেন শুনবো আমি খারাপ নাকি? তোমাকে যখন বারবার ফাঁসানো হয়েছিল তখন তোমাকে আমি বুঝার চেষ্টা করেছি দুজন মিলে সবটা সামলে নিয়েছি কিন্তু তুমি? সবার সামনে আমাকে অসম্মান করছ, আমাকে বিশ্বাস করছ না উল্টো খারাপ কথা বলে আমার ভালোবাসাকে ছোট করছ…
মেঘ: বেশ করেছি আরো করব, তুমি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নও।
আমি: ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য তো তুমি না, যে মনের দিক থেকে এতো ছোট তাকে আর যাই হউক ভালোবাসা যায় না।
মেঘ: বেসো না কে বলেছে ভালোবাসতে? আ…
আমি: বাসি না তোমার মতো ছোট মনের মানুষকে আমি ঘৃণা করি। আজ থেকে তোমার আর আমার পথচলা আলাদা। তোহাকে আমার থেকে কেড়ে নিয়েছ তো? আর কখনো আমাকে ফিরে পাবে না। যখন নিজের ভুল বুঝতে পেরে হাউমাউ করে কাঁদবে তখন আর আমি ফিরে আসবো না।
তোহার কপালে একটা চুমু দিয়ে বেরিয়ে আসলাম।

এলোপাথাড়ি ভাবে গাড়ি চালাচ্ছি ইচ্ছে হচ্ছে এক্সিডেন্ট করে মরে যাই, এমন অপমান অবহেলার চাইতে মরে যাওয়া অনেক ভালো। কিন্তু নিজের মনকে শক্ত করে নিলাম আমাকে বাঁচতে হবে, মেঘের অনুশোচনায় ভোগা আর হাউমাউ করে কান্না দেখার জন্য আমি বেঁচে থাকবো। কিন্তু সেদিন আর মেঘের কাছে ফিরে যাবো না। মেঘকে সেদিন বুঝাবো অবহেলার যন্ত্রণা কতটুকু।

রাতের আধারে বারান্দায় দাঁড়িয়ে বারবার চোখের পানি মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টা করছি। মেঘকে তো খুব করে বলে আসলাম ওর মতো ছোট মনের মানুষকে আমি ঘৃণা করি কিন্তু সত্যি তো এটাই আমি মেঘকে আগের মতোই ভালোবাসি আর সারাজীবন বাসবো। চাইলে তো আমি মেঘকে ডিভোর্স দিয়ে কানাডা চলে যেতে পারি কিন্তু আমি এসব করতে পারবো না কারণ মেঘকে যে আমি বড্ড বেশি ভালোবাসি। কিন্তু মেঘ? মেঘ আমাকে ভালোবাসে না ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো… “আমাকে তুমি যতো দূরেই ঠেলে দাওনা কেন মেঘ তোমাকে আমি সারাজীবন এভাবেই নীরবে ভালোবেসে যাবো”

চলবে?

মোরগ-মুরগির প্রেমলীলা

0

মোরগ-মুরগির প্রেমলীলা

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

মানুষ বাড়ি থেকে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যায়। আর আমার মতো যারা দীর্ঘ দিন ধরে হোস্টেলে থাকে তারা বাড়িতে বেড়াতে যায়।

ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি আমাদের বাড়িতে দেশি মুরগি বা মোরগ জবাই করা হয়। সেবার বাড়িতে গিয়ে মোরগ আর মুরগির একটি জুটির দিকে আমার চোখ আটকে গেল।
মুরগিটি আমাদের হলেও মোরগটি ছিল পাশের বাড়ির। লক্ষ্য করলাম, মোরগটি সব সময় বডিগার্ডের মতো মুরগিটির পিছনে লেগে থাকে। মুরগিটি যেখানে যেত মোরগটিও সেখানে যেত। মোরগটি কক কো শব্দ করে খাবারে ঠোক দিত। আর মুরগিটি সেই খাবার খেত। এ যেন প্রেমিকাকে পটানোর এক দারুণ পন্থা। মাঝেমধ্যে তারা মিলিত হয়।
কখনো কখনো মোরগটি অন্য মুরগির সঙ্গে মিলিত হলেও আবার ফিরে আসত। প্রেমিকের এমন কীর্তিতে প্রেমিকা মুরগির তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখা যেত না। তা যেন স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু মুরগিটির কাছে যদি অন্য কোনো মোরগ আসার চেষ্টা করত তাহলে তার নিস্তার ছিল না। প্রেমিক মোরগ সেই মোরগকে অনেক দূরে তাড়িয়ে দিয়ে আসত।

মানুষের ক্ষেত্রে মেয়েদের বৈশিষ্ট্য মুরগিটির মত না হলেও ছেলেদের ক্ষেত্রে মোরগটির বৈশিষ্ট্য দেখতে পাওয়া যায়।
মোরগ-মুরগির এমন বৈশিষ্ট্য অনেকেই স্বাভাবিক ভাবলেও আরেকটি বৈশিষ্ট্যে অবাক হয়েছিলাম, যা আগে কখনো দেখিনি। তা হলো, মোরগটি সাধারণত আমাদের বাড়িতে আসত না। কিন্তু যখন মুরগিটি ডিম দিতে বাড়িতে আসত তখন প্রেমিক মোরগও আসত। মুরগিটি যেখানে ডিম দিতে বসত তার পাশে সে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থেকে থেকে হাপিয়ে গেলে বসে পড়ত। মোরগটিকে তাড়ানোর চেষ্টা করলে সে যেতে চাইত না।
বেশি তাড়ানোর ফলে মোরগটি চলে গেলে মুরগিটিও তার সঙ্গে যেত। এ যেন প্রেমিককে আসতে না দেয়ার জন্য মুরগির নীরব প্রতিবাদ। আমার প্রেমিককে থাকতে না দিলে আমিও তোমাদের ডিম দেব না –
মুরগিটি যেন এ কথাই বলতে চাইত। তাই কেউ আর মোরগটিকে তাড়াত না।
মোরগ-মুরগির এমন প্রেমলীলা দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। আমি ভাবতাম, এদের মধ্যে কত ভালোবাসা!
এ জুটির প্রেমলীলা আর কত দিন চলবে? মুরগিটি যখন বাচ্চা ফোটাবে তখন কি মুরগিটির সঙ্গে বা বাচ্চাগুলোর সঙ্গে এই বাবা মোরগ থাকবে?

সার্থক হোক মোরগ-মুরগির প্রেমলীলা সেই কামনা করি।

#মোরগ-মুরগির প্রেমলীলা

ভুলের মাসুল

0

ভুলের মাসুল

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

২০০০-এর নভেম্বরে সড়ক দুর্ঘটনায় শুভ্রকে হারায়। চার দেয়ালের মধ্যে নিজেকে বন্দি করে কাটিয়ে দেই জীবনের ১১টি বছর। মানসিক আহত হয়ে আমি যখন চার দেয়ালের মধ্যে হতাশায় ঘুরপাক খাচ্ছিলাম তখনই আপনজনদের পাশাপাশি সবচেয়ে কাছে এসেছিল প্রতিবেশী মিলন।
আঠারো বছর বয়সী মিলন ছেলেটি চমৎকার বাঁশি বাজাত। কন্ঠ ছিল সুমধুর। শুধু আমি নই, এলাকার পরিচিত সবাইকে মিলনের সৌজন্যবোধ মুগ্ধ করেছিল।
মিলন বোধ হয় আমার হতাশাগ্রস্থ জীবনে হৃদয়ের আকুলতা উপলব্ধি করতে পারছিল। সে সময়ে-অসময়ে বাঁশি বাজিয়ে, গান শুনিয়ে, তার শিল্পী সত্ত্বার বিভিন্ন অভিজ্ঞতা বিনিময় করে আমার যন্ত্রণা লাঘবে সচেষ্ট ছিল। তবে মাঝেমধ্যেই সে তার বাউল গোষ্ঠীর সঙ্গে পালাগানের উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছুদিন কাটিয়ে আসত।

মিলন হঠাৎ পনেরো বছরের এক কিশোরীকে বিয়ে করে সবাইকে অবাক করে দিল। ফুলের মতো মেয়েটার মধ্যে গ্রামের সবুজ সরলতার মুগ্ধতা আমাকে কৌতূহলী করল। কিছু মুখ আছে, তাদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে পার করে দেয়া যায় সারাটা জীবন।
রুপা ছিল ওরকমই এক মেয়ে। মিলন পালাগান করতে একাধিকবার মাদারীপুর জেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে গিয়ে মেয়েটির হৃদয় জয় করেছিল। গানের টানে, হৃদয়ের অনুভবে মেয়েটি চালচুলোহীন অজ্ঞাত উঠতি বয়সী যুবকের হাত ধরে আপনজনদের ছেড়ে চলে এসেছিল। অপটিপক্ব মিলন দম্পতিকে দেখে আমার অবিবাহিত বত্রিশ বছরের জীবনে নানা আগ্রহ সৃষ্টি হচ্ছিল। ওদের টুনাটুনির সংসার দেখে কেবলই মনে হচ্ছিল, ভালোবাসা ব্যাপারটি আসলে কি? ভালোবাসা কি অশান্ত-অবিবেচক কান্ডজ্ঞানহীন দুরন্ত পাগলা ঘোড়া? জীবন মানে না, সংসারের প্রতি তোয়াক্কা করে না, ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা খুঁজে দেখে না। কি রহস্য লুকিয়ে আছে এতে? কিসের আশায় ব্যাকুল হয়ে দেহ-মন চলে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পানে?
সত্য বলতে কি, ওদের নিত্যদিনের খুনসুটি দেখে সংসার বৈরাগী আমিও ক্ষাণিকটা প্রভাবিত হয়েছিলাম।
নানা প্রতিবন্ধকতা, অর্থনৈথিক টানাপোড়নের মধ্য দিয়েও উচ্ছ্বলতার সঙ্গে বেশ চলছিল দুজনের জীবন।
ওদের সংসারে ছিল অফুরন্ত অবসর। তাই অবসর সময়ে মেয়েটি আমার মাকে নানা কাজে সহযোগীতা করত। সে তার কর্মগুনে মায়ের আদর-স্নেহ লাভ করেছিল।
রুপা ছিল অজপাড়া- গায়ের সাধারণ ঘরের অসাধারণ রূপসী। সময়ের ধারাবাহিকতায় রূপার মধ্যে ক্রমেই শহুরে চাতুর্য, কূটকৌশল স্পর্শ করতে শুরু করেছিল। তার মধ্যে ক্রমেই ভোগ-বিলাসীতার প্রতি দুর্বলতা বাড়তে থাকল। অথচ ঢাকায় আসার প্রথম দিকে তার চাহিদা ছিল সীমিত। কিছু চাহিদা আমার মা মেটাতে চেষ্টা করতেন। কিন্তু রুপার ইচ্ছা ও ইচ্ছা পূরণের সাধ আর সাধ্য, পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের ছিল বিস্তর ফারাক। সে ক্রমেই গন্ডির বাহিরে চলে যাচ্ছিল।
একদিন রুপাকে অভিমানের সঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুনলাম, তার একজোড়া সোনার কানের দুলের খুব শখ। কিন্তু মিলন আর্থিক সংকটের অজুহাতে কিনে দিচ্ছে না। অথচ পাশের বাসার জেসমিনের স্বামী কি সুন্দর চেইন তার স্ত্রীকে দিয়েছে।

আমি চিকিৎসার কারণে বিদেশে অবস্থানকালে রুপার ব্যাপারটি প্রায় ভুলে গিয়েছিলাম। দেশে ফিরে মিলন দম্পতির ছন্দপতনের কাহিনী শুনে বিস্মিত হলাম।
গান শেখার জন্য শহরের এক ধনীর দুলাল মাঝেমধ্যে ওদের বাসায় প্রাইভেট কার হাকিয়ে আসা যাওয়া করত। ছেলেটি ওদেরকে আর্থিকভাবে সাহায্যও করে আসছিল। রুপা ছেলেটির হাতছানিতে লোভের কাছে পরাজিত হয়ে তার হাত ধরে বাউলের সংসার ছেড়েছিল।
রুপা মিলনকে ছেড়ে যাবার পর তার সুতোয় টান পড়ল। সে লজ্জা, সংকোচ এবং আপনজনকে হারানোর ব্যথায় কাউকে কিছু না বলে এলাকা ছেড়ে চলে গিয়েছিল।

শুভ্রর মৃত্যুবার্ষিকীতে শহরের দুস্থ ও অসহায় মানুষদের হাতে সাধ্যানুযায়ী দানসামগ্রী দিয়ে ফিরছিলাম। হঠাৎ’ই এই এলাকার শিমুল বলে ছোট্ট ছেলেটা আমার শাঁড়ির আঁচল টেনে ধরে। মিষ্টি হেসে তাকে কোলে নিয়ে কাছেই ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলাম। কারণ, ওর রোজকার আবদার একটা চিপসের জন্য এই ফাস্ট ফুডের দোকানাটাই যথেষ্ট। চিপস কিনার সময় খেয়াল করলাম, এক মহিলা খদ্দের আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু দ্বিধায় পড়ে বলছে না। পরে একজনের থেকে আমার থেকে নিশ্চিত হয়ে আমার মুখোমুখি হলো। ওই মহিলা খদ্দেরটি ছিল রুপা।
রুপার সেদিনের আচার- আচরণে আধুনিকতার সুস্পষ্ট ছাপ ধরা পড়ছিল। অনেকক্ষণ খেয়াল করেই তাকে আমার চিনতে হলো। গুছিয়ে বেশ শুদ্ধ ভাষায় রুপা আমার সঙ্গে সেদিন কথা বলল। তবে বেশভূষা- আভিজাত্যের খোলসে রুপার চোখে- মুখে বিষাদের ছায়া লক্ষ্য করছিলাম। সেদিন সে আমার কাছে তার যাপিত জীবনের কিছু নেতিবাচক চিত্র তুলে ধরেছিল। যা তার প্রকৃত জীবনের সঙ্গে, বিশ্বাসের সঙ্গে বেমানান মনে হচ্ছিল।
সে ভুল মানুষের ফাঁদে পড়েছিল। হাসিফ ওকে ঠকিয়েছে। ওকে রেখে বিদেশ চলে গেছে। সেখানে স্ত্রী এবং দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে হাসিফের সুখের সংসার।
রুপাকে বাউলের আর্থিক দৈন্যের চেয়ে তার সহজ- সরল মন বেশী স্পর্শ করছিল। আজো রুপা অত্যন্ত সংগোপনে আমাদের এলাকায় এসে তার বাউলকে খুঁজে বেড়ায়।

# ভুলের মাসুল
লেখা- অনামিকা ইসলাম ” অন্তরা”

চোরাবালি

0

চোরাবালি

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

হসপিটালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে আমার প্রথম ভালোবাসার মানুষ, আমার অবহেলিতা স্ত্রী মায়া। ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম ওকে। হ্যাঁ, ভালোবেসেই বটে!
শুরুটা হয়েছিল ২০১১সালের এপ্রিলে। মায়া সাহিত্যের নবদিগন্ত আলো ছড়িয়ে পথ চলা এক কিংবদন্তি তরুণী। যার লেখা পড়লে যেকোনো যুবক প্রেমে পরার স্বপ্ন দেখবে।
মন খারাপের কোনো এক দিনে মায়ার লেখা পড়ে ওর লেখার প্রেমে পরে যাই আমি। আমাদের মধ্যে ভালো একটা ফ্রেন্ডশিপ হয়। তারপর ভালো লাগা, ভালোবাসা। কখনো ভাবিনি, ভালোবাসার ব্যাপারে এত সিরিয়াস হব। এত ভালোবাসব ওকে। কখনো প্রেম করব, এটা মাথায়ই ছিল না। ঝগড়া করা আমার মোটেও ভালো লাগত না। কিন্তু ও ঝগড়া করত বেশি। সামান্য ব্যাপারেও অনেক রাগারাগি করত, অভিমান করত। আমাকে বকা দিত। বিষয়টা আমার খুব বিরক্ত লাগত। ভাবতাম, ব্রেক করব। পরে নিজেই থাকতে পারতাম না।
আমাদের রিলেশনের ১বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। এর মধ্যে মায়াকে একবারও দেখিনি। এ নিয়ে বন্ধু বান্ধবরা অনেক হাসাহাসি করত। আমার রাগ উঠে যায়। সেদিন সামান্য পিকের জন্য আমি মায়ার সাথে একটু বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলি। পরিষ্কার বাক্যে জানিয়ে দেই-
” হয় পিকচার, না হয় ব্রেকআপ…..”
সেদিন রাত্রে মায়া আমায় ছবি দেয়। ছবি দেখে আমি তো মুগ্ধ, যতটুকু না ভেবেছি তার থেকেও অনেক বেশী সুন্দরী ছিল ছবির মেয়েটি। আমাদের ভালোবাসাটা ভালোই চলছিল।
তারপর এলো সেদিন। যেদিন আমি মায়াকে প্রথম দেখি। সাদা কলেজ ড্রেস পরিহিত মায়া যখন আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে কলেজ গেইট দিয়ে বের হচ্ছিল তখন নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল আমার। আমি হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। মায়ার প্রতি এতদিনের যে বিশ্বাস ছিল তা নিমিষেই ভেঙ্গে চূরমার হয়ে গেল। মায়ার দেয়া সেদিনের সেই ছবির সাথে আজকের এই মায়ার কোনো মিল নেই। মনে কষ্ট পেলাম, কিন্তু প্রকাশ করলাম না। মায়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরলাম।

জানি না, কোন সে কারণে সেদিনের পর থেকে মায়ার প্রতি আকর্ষণটা আমার একটু একটু করে কমতে থাকে। যে মায়ার সাথে একমুহূর্ত কথা না বলে থাকতে পারতাম না, সেই মায়াকে একটু একটু করে আমি এড়িয়ে যেতে থাকলাম। কারণে অকারনে মায়ার সাথে রাগ দেখাতাম।
মায়া হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমার জীবনে ওর প্রয়োজনটা ফুরিয়ে গেছে কিংবা ওর প্রতি আমার কোনো টান নেই। আর সে কারণেই হয়তো প্রায় কল করে চুপচাপ আমার হ্যালো বলাটা শুনতো নতুবা খুব করে কাঁদতো।
এভাবে একটু একটু করে আমি মায়ার জীবন থেকে সরে যায়, অনেক দুরে সরে যায়। চেঞ্জ করে ফেলি ফোন নাম্বার, ফেসবুকেও ব্লক করে দেই ওকে।

কিন্তু ভাগ্যের লিখন, না যায় খন্ডন। যে মায়াকে মিথ্যে পিকচার দেয়ার জন্য একটু একটু করে এভাবে দুরে সরে আসা, কাকতালীয় ভাবে সেই মায়ার সাথে পারিবারিক ভাবে আমার বিয়ে ঠিক হয়। মায়া দেখতে খুব বেশী মন্দ ছিল না, গায়ের রঙটা চাপা, তবুও এভাবে মিথ্যে পিক দেয়াটা মেনে নিতে পারিনি….

এরপর বেশ কিছুদিন এগিয়েছে। মায়াও বুঝে গিয়েছিল আমার থেকে ভালোবাসা পাওয়ার আশা নেই। সে বিশেষ কিছু বলত না। সকাল সন্ধ্যে রান্না করত, কাজ শেষে বাসায় ফিরলে খাবার এগিয়ে দিত। স্ত্রী হিসেবে এটুকুই ছিল ওর অধিকার। একসাথে শুতাম না, কারণটা ও আমায় মিথ্যে বলেছে।

প্রত্যেকটা সকালে আমি যখন চেম্বারের উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যেতাম,
তখন ও দৌঁড়ে বারান্দায় যেত। বারান্দার গ্রিল ধরে কেমন যেন উদাস দৃষ্টি মেলে আমার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকত। আমি যখন বাসায় আসতাম তখনো সাথে সাথেই দরজা খুলে দিত, মনে হতো যেত যেন এতক্ষণ আমারই প্রতিক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল।
আমি যখন গোসল করে,
গায়ে তোয়ালে জড়িয়ে রুমে আসতাম, তখন কেমন যেন ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। হয়তো আমার মুখ থেকে অপ্রত্যাশিত কিছু শুনার জন্য’ই এভাবে চেয়ে থাকা।

এভাবেই চলছিল দিনগুলো। কোনো এক কারণে একদিন চেম্বার থেকে একটু তাড়াতাড়ি’ই বাসায় ফিরি। দরজাটা খুলায় ছিল। ভিতরে ঢুকলাম। পাশের রুম থেকে একটা চাঁপা কান্নার আওয়াজ আসছিল। কি হচ্ছে দেখার জন্য পা বাড়াতেই দেখলাম আমার মায়া বিছানায় শুয়ে আমার ফ্রেমে বন্দি ছবিটাকে বুকে আঁকড়ে ধরে কান্না করছে আর বলছে_
” আমি চাইনি বাঁধন, আমি চাইনি তোমায় ঠকাতে। আবার নিজের ছবি দেয়ারও সাহস পাইনি। ভয় হচ্ছিল বাঁধন, আমাকে দেখার পর যদি হারিয়ে যায় ভালোবাসার এই তীব্রতাটুকু।”
তাই আমি তোমায় মিথ্যে ছবি দিয়েছি। আমায় শাস্তি দাও বাঁধন, কঠিন শাস্তি। তবুও এভাবে দুরে সরিয়ে রেখো না। আমার যে বড্ড কষ্ট হয় বাঁধন। বুকে জায়গা না দাও, অন্তত পায়ের কাছে একটু জায়গা দাও। ছবি বুকে জড়িয়ে করুণ স্বরে আর্তনাদ করছিল মায়া। সেটা দেখে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে জড়িয়ে ধরি। কিন্তু এতদিন যা করিনি, সেদিনও তা আবেগের বশে করতে চাইলাম না।

কেটে গেল চার বছর। গতমাসে একবার মায়ার খুব জ্বর হয়। সেদিনই প্রথম ওকে বলেছিলাম রাতে আমার পাশে শুতে। মাথায় জলপট্টিও লাগিয়ে দিয়েছিলাম। ও আমার হাত দুটো জাপটে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। পরদিন মায়াকে ডাক্তারের কাছে নিলাম। ডাক্তারের টেস্টে ধরা পরল মায়ার ব্লাড ক্যানসার হয়েছে। লাস্ট স্টেজ। মায়াকে একটা সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করালাম। প্রথমবার আল্লাহর কাছে খুব কেঁদেছিলাম। বলেছিলাম একটা সুযোগ দিতে সব ভুল শুধরে নেবার।

হঠাৎ ডাক্তারের ডাকে চমক ভাঙল। এগিয়ে গেলাম মায়ার বেডের দিকে। ওর পাশে বসে মাথায় হাত রাখলাম। মায়া জল ছলছল চোখে আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, “ইহকালে না হোক, পরকালে আমায় ভালোবাসবেন তো?” আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। মায়া বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। বললাম, ” ক্ষমা করে দাও মায়া। একটু সুযোগ দাও, খুব ভালোবাসব তোমায়। এভাবে ছেড়ে যেও না।”

মায়া কোনো উত্তর দিল না, চোখের পাতাও ফেলল না। শুধু চোখের কোণ দিয়ে দু’ফোঁটা জল গড়িয়ে পরল। এতদিন যে কথাটি সে মুখ ফুটে বলতে পারেনি, আজও পারল না। মায়া হারিয়ে গেল ভালোবাসার চোরাবালিতে। শুধু হারিয়ে যাবার আগে শিখিয়ে গেল ভালোবাসার আসল মানে…

#চোরাবালি
লেখা- অনামিকা ইসলাম “অন্তরা”

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

0

ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

“লেখা- অনামিকা ইসলাম।

টানা তিনঘন্টা মিটিং শেষে ক্লান্ত দেহটাকে ইজি চেয়ারে এলিয়ে দিয়েছিলাম। চোখে তন্দ্রা ভাব এসেছিল। এমন সময় পাশে রাখা মোবাইল ফোন বেজে উঠল। মায়ার মায়ের নাম্বার। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করল, শুভ্র?
কন্ঠ শুনে হবু শাশুড়িকে চিনতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। বিণয়ের সহিত সালাম দিতে গিয়ে টের পেলাম, ওপাশে যেন কান্নার রুল পড়ে গেছে।
তন্দ্রা ভাবটা চোখ থেকে চলে গেল। চমকে উঠে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে আন্টি?
মায়া হসপিটালে, বলেই কান্নায় ভেঙে পরলেন।
ঠিকানা নিয়ে ছুটে গেলাম সিটি হসপিটালে। আমাকে দেখেই কান্না করে দিলেন মায়ার মা।
আমার মেয়েটা বোধ হয় বাঁচবে না আর।
কিছু না বলে ছুটে গেলাম হসপিটালের কেবিনে, যেখানে নিথর হয়ে পরে আছে আমার মায়া। আমাকে দেখে কিছুটা নড়ে উঠল সে। ভেঁজা গলায় বলল, আমাকে ভুলে যেও শুভ্র। আমাদের বিয়েটা আর হওয়ার নয়।
মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলাম। মায়ার পুরো মুখ ঝলসে গেছে। প্রিয়তমার এ অবস্থা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছিল।
হাঁটুগেড়ে বসে পরলাম ফ্লোরে।

অতীতে ফিরে গেলাম আমি।
২০০৬ সালে মায়ার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। সে আমার এক আত্মীয়ের দুর সম্পর্কের আত্মীয়। পরিচয় থেকে শুরু থেকে ওর পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। মিতভাষী মায়া সেসময় আমার সঙ্গে তেমন কথা বলত না। খুব সংক্ষেপে ওর সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে কথা হতো। সে ছিল তখন আমার দৃষ্টিসীমার বাইরে।
প্রথম দেখাতেই মায়াকে আমার ভালো লেগেছিল। দেখতাম ও বান্ধবীদের সঙ্গে হাসছে। মজা করছে। সাহস পেতাম না তার কাছে গিয়ে মনের কথা খুলে বলতে। ভয় হতো, যদি ফিরিয়ে দেয়। মনের কথা মনেই চেপে রাখতাম। কিন্তু হৃদয় তরীরে যে ঢেউ শুরু হয়েছিল, তা তো শান্ত হচ্ছিল না।
একদিন বীরপুরুষের মতো সাহস দেখিয়ে বললাম, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। তুমি কি কাল একটু সময় দেবে?
মায়া কিছু বলল না। তবে ওর চোখে-মুখে সম্মতির ভাব দেখলাম।

মিয়াবাড়ির ভেতরের রাস্তা দিয়ে আমি আর মায়া হাটছিলাম।
চোখে- মুখে দ্বিধা- দ্বন্দ্বের স্পষ্ট ছাপ। ভালোবাসি কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলাম অজানা ভয়ে। মায়া নিরবতা ভেঙে বলল, কি যেন বলতে চেয়েছিলেন, বললেন না তো।
থাক, আরেক দিন বলব। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললাম কথাটি।
পড়ন্ত বিকেলের আলোয় ওর মুখটি বিষণ্ন লাগছিল। কিছু সময় নিরব থেকে বলল, আমি যাই। আপনাকে আর বলতে হবে না।
ওর চোখে মুখে হতাশার চিত্র ফুটে উঠল।
ও আমার উল্টো দিকে হাঁটা শুরু করল। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। বুকটা শূন্য শূন্য লাগছিল। আমিও একপা দু’পা করে সামনে এগুতে লাগলাম। চিৎকার করে বলতে চাইলাম, মায়া, আমি তোমাকে ভালোবাসি।
কিন্তু মুখ থেকে কোনো শব্দই বের হলো না।
বাসায় এসে দরজা বন্ধ করে কাঁদলাম। যে করেই হোক, মায়াকে ভালোবাসার কথা জানাতে হবে। আবার সাহস সঞ্চয় করলাম।

পরদিন সকাল বেলা লাল গোলাপ হাতে হাজির হলাম মায়ার সম্মুখে। লাল গোলাপ ধরে রাখা ক্রমেই শ্লথ হয়ে আসছিল। আমাকে পাশ কাটিয়ে মায়া চলে যাচ্ছিলো সুদূরের শহরে। সুযোগ হারিয়ে ফেলার আশঙ্কায় দ্রুত পথ আগলে দাঁড়ালাম ওর। চমকে গিয়েছিল মায়া। কিন্তু অস্বাভাবিক হয়নি। মনে হলো এমন পরিস্থিতির জন্য ও প্রস্তুত ছিলে। লাল গোলাপের কলিটি মায়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নির্দ্বিধায় বলেছিলাম সেদিন আই লাভ ইউ মায়া।
সেই মুহূর্তটা কেমন কেটেছিল, মন দিয়ে অনুভব করা ছাড়া লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। কিছুক্ষণ কারো মুখেই কোনো কথা সরছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো একে অপরের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। মনে হয় দুজনের বুকের ভেতর ধুকপুক শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল। যা ছিল একান্ত নিরব ও গোপন। আর সেটা প্রমাণ করছিল সেই শীতের সকালেও মায়ার নাকে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু ঘামের কণাগুলো। ডান হাত দিয়ে মায়া গোলাপটি নিয়েছিল।
মৃদু কন্ঠে বলেছিল, এত দেরি করলে কেন তুমি? তুমি কি জানো না আমিও যে তোমাকে নিয়েই কল্পনার প্রাসাদ গড়েছি? কিন্তু আমি নারী। আমি লজ্জার দেয়ালে আবদ্ধ। এ কারণে তোমাকে বলতে পারিনি। কিন্তু তুমিও কি আমার মনের কথাটি বুঝতে পারো নি? কেন এত দেরি করলে তুমি? জানো না, অপেক্ষা করা কত কষ্টের?
আমাদের প্রেমের শুরুটা এখান থেকেই। তারপর বিরামহীনভাবে চলছিল দুজনের মন দেয়া-নেয়া। হাসি-ঠাট্টা আর মান-অভিমানে ভরপুর আমাদের সে সম্পর্কটা ছিল অনেকের চোখেই ইর্ষার।
মায়া ছিল পরিবারের বড় মেয়ে। ওর বাবা ছোট বেলায় মারা গেছেন। অনেক কষ্টে লেখাপড়া শেষ করে ঢাকায় একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরী নিয়েছে মায়া।
সেই চাকুরীর টাকা দিয়েই মায়া ওর গরীব মায়ের চিকিৎসা এবং ছোট ভাই বোনদের লেখাপড়া করায়।
এদিকে বয়স তো আর থেমে থাকে না। এত বয়স হয়ে গেছে, এখনো অমুকের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না ব্যাপারটা মায়ার অসুস্থ মায়ের কানে যায়। ওনি মেয়ের বিয়ের জন্য উঠে পরে লাগেন। ঠিক সেই মুহূর্তে আমি মায়ার বাসায় খালাতো বোনকে পাঠাই। ত্রিভুবনে আমার কেউ ছিল না বিধায়, খালাতো বোনের মাধ্যমে মায়ার বাসায় বিয়ের পয়গাম পাঠাই। মায়ার মা, খালারা রাজি হয়ে যায়। আসছে নভেম্বরের ১৩তারিখ বিয়ে। হাতে আছে আরো অনেক সময়।

সেদিন রাত্রে অফিস থেকে ফিরছিল মায়া।
হঠাৎ একটা আর্তনাদ শুনে থমকে দাঁড়ায় সে। হ্যাঁ, আর্তনাদ’ই তো। একটা কিশোরীর আর্তনাদ। গলির মোড়ে উঁকি দিতেই দেখে স্কুল ড্রেস পরোয়া একটি মেয়েকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে দু’যুবক। একজন কিশোরীর জামা ছিড়ছে, আরেকজন মুখ চেপে ধরে আছে। ঘৃণায় পুরো শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়। এগিয়ে গিয়ে একটা যুবককে থাপ্পর দেয় মায়া। কিশোরীকে ছেড়ে দিয়ে ওরা মায়ার দিকে তেড়ে আছে। জামা ধরে টানাটানি করতে থাকতে। দিগ্বিদিক শূন্য মায়া আচমকা একজন বখাটের তলপেটে লাথি মারে। ‘উহ্’ স্বরে আর্তনাদ করতে করতে ওরা চলে যায়। যাওয়ার আগে শাসিয়ে যায়-
” দেখে নিব তোকে….”
ঐ কিশোরীর থেকে ঠিকানা নিয়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিয়ে বাসায় ফিরে মায়া।
পরের দিন এসব ঘটনা শুনে আমি রীতিমতো উদ্ভিগ্ন হয়ে উঠি। আমার চিন্তা বেড়ে গেল। মায়াকে চোখে চোখে রাখতাম। আজ জরুরী একটা মিটিংয়ে আটকা পরে যাওয়ার কারনে ওকে বাসায় পৌঁছে দিতে পারিনি। কে জানতে আজকেই এমন একটা ঘটনা ঘটবে?
সেদিন রাতে মায়া অফিস থেকে বাসায় ফিরছিল। তখনই ঘটে যায় মায়ার জীবনে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। বাইকে চড়ে আসা ৪জন ছেলে মায়ার দিকে বোতল থেকে পানি জাতীয় কিছু ছুঁড়ে মারে। মুহূর্তেই ঝলসে যায় মায়ার একটা চোখ সহ পুরো মুখ। একটা আর্তনাদ দিয়ে লুটিয়ে পড়ে রাস্তায়। মায়ার আর্তনাদে মানুষজন ছুটে আসে। কিন্তু সেটা সাহায্য করতে নয়। ওরা মায়ার দিকে এগিয়ে না গিয়ে মায়ার ঝলসে যাওয়া মুখের ছবি তুলতে, ভিডিও করতে ব্যস্ত হয়ে পরে। এক বয়স্ক দয়ালু লোক সেই সময় উপস্থিত হয়। এম্বুলেন্সে খবর দিলে সে রাতেই ভর্তি করে হসপিটালে।
মাসখানেক পর মায়ার মুখের ব্যান্ডেজ খুলে দেয়া হয়। হাসপাতালে মায়ার পাশে বসলে ও মুখ ফিরিয়ে নেয়। ক্ষাণিক ক্ষণ চুপ থাকার পর বলে, আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। আমায় ক্ষমা করে দাও। কথাটা বলেই চোখের জল ছেড়ে দেয় মায়া।
ওর মুখটা ঘুরিয়ে জানতে চাই, কেন মায়া?
যে মায়াকে দেখে তুমি আমায় ভালোবেসেছিলে, আমি আর সে মায়া নেই।
আমি শেষ হয়ে গেছি। আমি চাই না আমায় বিয়ে করে তোমার জীবনটাও শেষ হয়ে যাক। লোকে সারাজীবন তোমায় নিয়ে হাসাহাসি করবে। একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে নিও, ভুলে যেও আমায়। কান্না লুকাতে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয় মায়া।
চোখ থেকে অজান্তেই জল গড়িয়ে পরছিল। বহু কষ্টে নিজেকে সংবরন করে মায়ার হাতটা মুঠোয় পুরে বলি, “তুমি আমার সেই আগের মায়ায় আছো। সেই আগের মতই সুন্দরী। ওরা তোমার মুখ বিকৃত করলেও হাসিটা বিকৃত করতে পারেনি। এই হাসি দেখেই প্রেমে পরেছিলাম কি না।”
দুঃখের মধ্যেও মায়া হেসে দিল।

এসিড ছুঁড়ে মারা ছেলেগুলো ৬বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত হয়েছিল। অপরাধের তুলনায় শাস্তি অনেকটা কম হলেও আমি প্রতিশোধের বদলে মায়ার জীবন বদলে দিতে চেয়েছিলাম নতুন আঙ্গিকে। মায়ার মতো হাজারো মেয়ে প্রতিদিন প্রতিহিংসার এসিডে দগ্ধ হচ্ছে, বর্বাদ করে দিচ্ছে গোটা জীবন। আমি মায়াকে সুখী করে তাদেরকে বুঝাতে চেয়েছিলাম যে, প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসা’ই পারে সবকিছু বদলে দিতে।

মায়াকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। হাতে সময় আছে ২মাস। এই ২মাসে মায়া অনেকটা সুস্থ হলেও স্বাভাবিক হতে পারেনি। অনেকবার চেষ্টা করেছে আত্মহননের কিন্তু প্রতিবার’ই কেউ না কেউ টের পেয়ে পাওয়াতে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিয়ের ৭দিন বাকি ছিল। একে তো খালা খালু এ বিয়ে হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে, তারউপর মায়ার এমন মানসিক অবস্থা। রিস্ক নিতে পারিনি। রিলেটিভদের অমতে গিয়ে খুব সাদামাটাভাবেই আমি আমার মায়াকে আমার বউ করে আনি।
বিয়ের ১বছর অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও আমি আমার মায়াকে গুমড়ে কাঁদতে দেখতাম। মাঝরাত্রিতে আমার মায়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠত, কখনো বা বালিশ মুখ লুকিয়ে গুমড়ে কাঁদত।
প্রতিটা রাত আমি ওকে বুকে নিয়ে ঘুমাতাম কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রায়’ই আমি আমার মায়াকে আমার পা জড়িয়ে পায়ের নিচে পরে থাকতে দেখতাম। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসত, মাঝে মাঝে খুব করে কাঁদতে ইচ্ছে হতো, কিন্তু কাঁদতাম না। কারণ, আমি কাঁদলে কে দিবে আমার মায়াকে শান্তনা।

বিয়ের ৫বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। মায়া পেরেছে ওর ভয়ংকর অতীত ভুলে সম্মুখে এগিয়ে যেতে। আমি কখনো বুঝতে দেইনি ও সবার থেকে আলাদা। আমাদের ভালোবাসা প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে। আমাদের একটা ৪বছরের ছোট্ট মেয়ে আছে। লাবণ্য……
ওকে ঘিরেই আমাদের যত স্বপ্ন।
পড়ন্ত বিকেলে ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে আমরা দুজন বের হয়ে যায়, পাশাপাশি আঙ্গুল ধরে হাঁটা, একসাথে বৃষ্টিতে ভেঁজা, জোৎস্না বিলাস সব, সব পেরেছি আমরা। সর্বোপরি ঐ বখাটেগুলোর চোখে আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পেরেছি, তোরা ব্যর্থ হয়ে গেলি। আমরা সুখে আছি, অনেক সুখে। হেরে গেলি তোরা, ভিষণ রকম ভাবে হেরে গেলি।

তবে লাবণ্য একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, আব্বু! আম্মু সবার থেকে আলাদা কেন? আমি আমার মেয়েকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে শুধু এটুকু বললাম, “তোমার মা সবার থেকে আলাদা, কারণ সবার মত তোমার মা অন্যায় মুখ বোজে সহ্য করে নি। প্রতিবাদ করেছিল।”

# ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প
লেখা- অনামিকা ইসলাম “অন্তরা”

দহন

0

দহন

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

সেদিন খালার জ্ঞান ফিরার পর আমাকে দেখে খুশি হলেন। মায়ার ছোট ভাই বোনরা বাসায় ছিল। ওরা ভয় পাবে। তাই মায়াকে নিয়ে বাসায় যেতে বলল।
একটা রিক্সা ভাড়া করে রওয়ানা দিলাম। দুজন রিক্সার পাশাপাশি বসে। মনে মনে খুব খুশি হলাম। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা ছিল না।
এভাবে চলল প্রায় ১০মিনিট। হঠাৎ রিক্সা ব্রেক করায় প্রচন্ড ঝাকুনি খেলাম। মায়া পরে যাচ্ছিল বলে ওকে জাপটে ধরলাম। হয়তো রিক্সা থেকে পড়েই যেত। হঠাৎ প্রশ্ন, আমাকে জড়িয়ে ধরলে কেন?
প্রশ্নটা ছিল অনেকটা আবেগপ্রবণ।
বান্ধবীরা তোমাকে নিয়ে অনেক কথা বলে। কিন্তু তুমি তো আমাকে পছন্দ করো না।
হাসলাম, মুখে কিছু বলার সাহস পেলাম না। মনে মনে বললাম, সেটা হয়তো ওরা জানে না। আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি সেটা ঐ বিধাতা জানেন। ইচ্ছে হচ্ছে তোমার হাত ছুঁয়ে বলতে। কিন্তু পারছি না। খুব ভয় করছে। যে বিশ্বাস করে তোমার ভাই মানে আমার বন্ধু আমাকে তোমাদের বাসায় তোমাকে, তোমার ভাইকে পড়ানোর দায়িত্ব দিয়েছে, সে বিশ্বাস আমি কি করে ভাঙি?
মা বাবার আদর কি জিনিস সেটা কখনো বুঝতাম’ই না যদি না তোমাদের বাসায় আসতাম। কি করে সেই মানুষগুলোর সাথে প্রতারণা করি? আমি যে বড্ড নিরুপায় মায়া।
মায়া অনর্গল বলতে শুরু করে, ভাইয়া!
আজকাল আমার যেন কি হয়েছে? খাওয়া দাওয়া করতে পারি না। শুধু তোমার স্বপ্ন দেখে দিন কাটছে। বললে না, কেন?
এবারো হাসলাম।
মনে মনে বললাম, বোকা মেয়ে! তুমি পারবে আমাকে তোমার মাঝে ধরে রাখতে?
ততক্ষণে মায়ার হাতদুটো আমার হাতের উপর এসে ভর করল। ওর চোখের দিকে তাকালাম। কেমন জল ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে। মনে হচ্ছে অশ্রু ভেঁজা চোখ দুটো বলছে, অবশ্যই পারব। হয়তো মরতেও পারি তোমার জন্য।

সেদিন বাসায় ফিরতে রাত ১টা বেজে গেল। বাসায় এসে কারো খাওয়া দাওয়া হলো না। প্রিয়তমা কাছে থাকলে এমনই হয় বুঝি? সে আমার বেড যত্ন করে গুছিয়ে দিল। আমার পাশে এসে বসল। জানিনা কেন যেন ইচ্ছে হচ্ছিল, জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে একটা কিস করি। জড়িয়েও ধরেছিলাম। কিন্তু পরমুহূর্তে ছেড়ে দিলাম।
নিজেকে নিজেই শান্তনা দিলাম, এগুলো কি না করলে কি হয় না? সে তো আমার’ই আছে।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম, তাই হবে। আমাদের ভালোবাসা হবে একদম পবিত্র, পরিচ্ছন্ন। দুজনে জ্বলে জ্বলে দগ্ধ হব কিন্তু এতটা কাছে আসব না।

এভাবেই আমাদের চোখে চোখে প্রণয় চলছিল। পূর্ণ হলো আমাদের ভালোবাসার ৪বছর। ক্লাস নাইনের সেই ছোট্ট মেয়েটি কলেজের গন্ডি পেরিয়ে ভার্সিটিতে ভর্তি হলো। আমি তখন ঢাকায় মাস্টার্স ফাইনাল ইয়ারে। দুর থেকে আমার উৎসাহ পেয়ে মায়া মন দিয়ে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছিল।
পরীক্ষার মাত্র ১মাস বাকি। বন্ধুকে দেখার ছলে মায়াকে দেখতে এলাম। এসেই প্রচন্ড জ্বরে আক্রান্ত হলাম। সাত দিন জ্বর ছিল। তার যে কি টেনশন। পাশে বসে মাথায় পানি দেয়া। ঔষধ খাওয়ানো। সব দায়িত্ব যেন তার। একদিন দোকান থেকে রেজার কিনে এনে শেভ পর্যন্ত করে দিল। নেইল কাটার দিয়ে নখগুলো কেটে দিত। এ কাজগুলো সবার সামনে করত। কাউকে ভয় পেত না।
সাত দিন পর গরম পানি দিয়ে গোসল করিয়ে দিল। নিজের ওড়না দিয়ে আমার শরীর মুছে দিল। তার সেবায় খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠলাম। আমার অসুস্থতায় আমি যেন তার আরো কাছে চলে গেলাম। একেই হয়তো বলে ভালোবাসার গভীরতা।

সেবার মায়া অনেক কথা বলল। যেমন, আচ্ছা, তুমি আমাকে বউ করে নিচ্ছ না কেন? আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছে তোমার বউ হতে। ভাইয়া, তুমি আমাকে কষ্ট দিও না। ভুলে যেও না।
বার বার এই প্রলাপগুলো শুনছিলাম আর হাসছিলাম।
এর ছাড়া যে আমি আর কিছুই বলতে পারছিলাম না। কারণ, আমার যে হাত পা বাঁধা। বন্ধুত্বের কাছে আমি যে নতজানু। আমি জানি, ওরা কখনো আমার সাথে মায়াকে বিয়ে দিবে না। উল্টো বন্ধুত্বটাকেও চিরকালের জন্য হারাতে হবে।
যে হারে লোক লেগেছে মায়ার বিয়ের জন্য, এবার মনে হয় বিয়েটা হয়েই যাবে। যায় হোক চেষ্টা তো করতে পারি?
খালা মানে মায়ার মায়ের সাথে বিষয়টা শেয়ার করলাম। জানালাম, মায়াকে বিয়ে করতে চাই। যে ভয়ের জন্য আমি আমার পাগলীটাকে কখনো চার অক্ষরের একটি ছোট্ট শব্দ বলতে পারিনি, সেটাই হলো।
আমার দুর্বলতার খবর প্রকাশ হওয়ায় সবাই গর্জে উঠল। জনমের মত বন্ধুত্ব হারালাম। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
মাস্টার্স পাস করে একটা চাকরির চেষ্টা করতে লাগলাম। তাহলে কিছু একটা করা যাবে।
চেষ্টা চলছিল অবিরাম। মায়াকে অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে এসেও অপেক্ষা করতে বলেছিলাম। কিন্তু কতদিন অপেক্ষা করতে হবে তা বলিনি।

ঢাকায় চলে আসলাম। আমি ঢাকায় আসার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ফার্স্ট ক্লাস অফিসারের সঙ্গে একরকম জোর করেই মায়াকে বিয়ে দেয়া হলো।
বিয়ের খবর শুনার পর অনেক কেঁদেছিলাম। ৫ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। পড়তে গেলেই কান্না আসত। কেন এমন হলো? হযরত শাহজালাল (রহঃ) মাজারে গিয়েও ২দিন কান্নাকাটি করেছিলাম।
কাঁদতে কাঁদতে অসুস্থ হয়ে গেলাম। খাওয়া দাওয়া কেনোকিছুই ভালো লাগত না। বাড়িতে চলে এলাম। কাকিমা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। কাকিমার আদরে খুব কান্না পেল।
আমার স্বাভাবিক হতে প্রায় চার মাস চলে গেল। এর মধ্যে চাকরি পেলাম। পোস্টিং নিয়ে সিরাজগঞ্জ চলে এলাম। বিয়েটা আর করা হলো না। ভাবলাম, এভাবেই না হয় বাকি দিনগুলো কাটিয়ে দেব।

জানতে পারলাম, স্বামীর সঙ্গে মায়ার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছিল না। স্বামীকে সহ্য করতে পারছিল না। বিয়ের প্রথম রাতেই স্বামীকে বলেছিল, আমার সবকিছুর মালিক আমার জান। তুমি আমাকে স্পর্শ করবে না।
বেচারা মায়ার মন পাওয়া অনেক চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কিছুই হলো না।
ওদের বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছর পার হলো। কিন্তু কোনো বাচ্চা- কাচ্চা হয়নি।
একদিন ব্যাংকের বার্ষিক বনভোজনে কক্সবাজার বেড়াতে গেলাম। সেখানে গিয়ে হঠাৎ ওর দেখা পেলাম। ওরা বেড়াতে এসেছিল। আমাকে দেখে মায়া দৌঁড়ে কাছে এলো। এসেই জড়িয়ে ধরে বলল, তুমি কেমন আছ? আমি কিন্তু একদম ভালো নেই। তুমি আমাকে কেন তোমার কাছে নিয়ে যাও না?
মায়া, তা কি হয়?
কিছুক্ষণ পর তার স্বামী এলো। বলল, এই দেখো, কাকে নিয়ে এসেছি। আমার বাঁধন ভাই।
স্বামী বলল, শুধু ভাইয়া নয়, তোমার জান। তোমরা কথা বলো, আমি ওদিকে যাচ্ছি।
বাঁধন ভাইয়া, সবাই বলেছে তোমার মনে খুব কষ্ট দিয়েছি। আমার বিয়ের পর তুমি খুব কেঁদেছ। এই জন্য আমি অসুখী। তোমার অভিশাপ আমার জীবনে জড়িয়ে আছে। তোমার কান্নার জন্যই আমি অসুখী। সবাই বলে, এটা ভালোবাসার অভিশাপ।

আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে মায়া মানসিক রোগী। একদিন খবর এলো, হসপিটালে দেখতে যাওয়ার জন্য। কিন্তু আমি গেলাম না। কাছে গেলে হয়তো আরো জ্বালা বাড়ত। নতুবা দুটি প্রাণীকে আজীবন জ্বলতে উঠো। কিন্তু সুখ তো হলো না কারো।
ভালোবাসার অভিশাপে মায়ার ক্ষতিটা বেশী হলো।

 

আনন্দ অশ্রু

0

 আনন্দ অশ্রু

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

০৫.০৭.২০০৬
আরেকটা বিয়ের সম্বন্ধ এসেছে শুনলাম। প্রথমটা যৌতুক এত বেশি চেয়েছিল যে, হলো না। ছেলেটা দেখতে ছিল সালমান শাহ্’র মতো। আমি আরেকটু সুশ্রী হলে হয়তো ওরা এ দিকটাতে একটু ছাড় দিত।
জন্মান্তরে বিশ্বাসী না আমি, তথাপি কেন যেন মনে হচ্ছে গত জন্মে বোধ হয় বড়লোক বাবার অহংকারী, সুন্দরী মেয়ে ছিলাম। মানুষকে মানুষ বলে গণ্যই করতাম না। যার শাস্তি সরূপ এ জন্মে হয়েছি গরীবের কালো মেয়ে। একে তো কালো, তারউপর ভিষণ রকম কুশ্রী। আবার নাম রেখেছে মায়া।
ধূর! আর লিখব না। ভালো লাগছে না। কাল আবার শিমু আপুর বিয়ে। সকাল সকাল উঠতে হবে।

০৭.০৭.২০০৬
শিমু আপু চলে গেল। কাল রাতে ও বাড়িতেই ছিলাম। অনেক মজা হলো বিয়েতে। ছেলে বাড়ির লোকেরা তো রাজিই ছিল না এ বিয়েতে। ছেলে আবার শিমু আপুকে না পেলে আত্মহত্যা করবে, তাই বাধ্য হয়েই ওদেরকে রাজি হতে হলো।
কত বড়লোক ওরা!
কোনো যৌতুক দিতে হয়নি। অবশ্য প্রেমের বিয়েতে ওসব লাগেও না।
সবার কপাল কি আর ওরকম হয়? বাবা নেই, মা শয্যাশায়ী। মামার সংসারে কড়াকড়ির মধ্যে মানুষ। যেখানে পান থেকে চুন খসলে রটে যায়, সেখানে ওসব ভাবাও যায় না।
কিন্তু বয়সের দোষ বলে একটা কথা আছে। খালাতো ভাই চোখের ভাষায়, ঠাট্টার ছলে অনেক বার আমায় বুঝানোর চেষ্টা করত, সে আমায় ভালোবাসে। আমি সায় না দিলেও হৃদয়টা তাকে নিয়েই স্বপ্ন দেখত।
টনক নড়ে সেদিন, যেদিন সে খালার পছন্দের ফর্সা মেয়েকে নিয়ে ঘরে এলো। আর আনবেই বা কেন? আমি তো আর সেই কপাল নিয়ে জন্মাইনি যে আমার জন্য কেউ শিমু আপুর বর যা করল তাই করবে!
যাক নিয়তিকে মেনে নিতেই হবে। কাল নাকি পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।

০৮.০৭.২০০৬
আমার বিয়ে মোটামুটি ঠিক। সকালে দেখতে এসেছিল। কথাবার্তা সবই মিলেছে। মামা ছেলের প্রশংসায় যতই পঞ্চমুখ হোক না কেন, আমার জন্য যে কোনো রাজপুত্র আসবে না, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। তবে সকাল থেকে কেমন যেন মনের মধ্যে অন্য রকম এক অনুভূতি কাজ করছিল।
ইস! মশা খুব বিরক্ত করছে। আজ আর লিখতে পারছি না।

১৩.০৭.২০০৬
অনেকদিন পর ডায়েরীটা হাতে নিলাম। আমার বিয়ের কাজ দ্রুতগতিতে এগোচ্ছিল। বাড়িতে অনেক লোক। নিকটাত্মীয়রা মোটামুটি সবাই চলে এসেছে। নিরিবিলি জায়গার অভাবে ডায়েরী লেখা হচ্ছিল না। আমিই যে পাত্রী!
খালাতো বোন লিমা এসেছিল বরকে নিয়ে। গয়নায় গা-ভর্তি ছিল ওর। দুলাভাই ওর সব আবদার পূরণ করত।
করবেই বা না কেন? প্রেমের বিয়েতে এমনই হয়। আর আমারটা তো একটা চুক্তি মাত্র। ঐ ছেলে কি আমার সুখ দুঃখের কথা ভাববে? লিমাকে দেখার পর নতুন করে নিজেকে অসুখী মনে হচ্ছিল।
১৬তারিখে আমার বিয়ে। পাত্র বাঁধন মাহমুদ। সেনাবাহিনীতে চাকরী করত। ছেলের মা- বাবা ছিল না। চাচার কাছে মানুষ। সেই চাচা অসুস্থ থাকায় বিয়েতে এত তাড়াহুড়া। তিনি ভাতিজার বউ দেখে মরতে চান।
ভাবি ডাকছে। কাল- পরশুর মধ্যেই সব আত্মীয় স্বজন এসে যাবে। আর বোধ হয় লেখা হবে না।

১৮.০৭.২০০৬
না, আমি শ্বশুর বাড়িতে না, এ বাড়িতেই। এমন অবস্থায় লিখতে পারার কথা নয়। কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছিল, কাউকে কিচ্ছু বলতে পাচ্ছিলাম না।
তবুও লিখছি। লিখে যদি কষ্টটা একটু হালকা হয়।
একটু দেরীতে পাত্রপক্ষ আসল, তাও মাত্র হাতে গুনা ১৫জন। চিরাচরিত নিয়মে আয়নার দৃষ্টি বিনিময়ের সময় তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মুখটা কেমন ফ্যাকাসে হয়ে আছে। যেন কেউ তাকে জোর করে বন্দুক ধরে বিয়ে করাতে নিয়ে এসেছে। বিয়ের কার্যক্রম শেষ হতেই মামাকে বলল, তার অতি দরকারি কাজ আছে, যেতে হবে। না গেলে চাকরী থাকবে না।
সবার সব কথা না শুনেই চলে গেল। যাওয়ার বেলায় আমার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল, আসি।
মামাকে বলল, আমাকে খুব তাড়াতাড়ি একদিন এসে নিয়ে যাবে।
জীবন খুব প্রেমময় হবে না, সেটা জানতাম। তাই বলে এতটা অবহেলা? আর লিখতে পারছি না। মাথাটা ঘুরছে।

১৯.০৭.২০০৬
চোখের পানি সামলাতে পারছিলাম না আমি। এও কি সম্ভব? সকালে দুটি চিঠি এলো। একটা আমার, আরেকটা মামার নামে। প্রেরক বাঁধন। চিঠিটা নিয়ে আমার ঘরে রেখে দিলাম। পড়তে ইচ্ছে করছিল না।
একটু পর দেখলাম, মামা তৈরি হচ্ছে আমার শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। মামি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলল, বড় ভালো কপাল নিয়ে জন্মেছিস।
আমি কিছু বুঝলাম না। ঘরে এসে চিঠিটা খুললাম।

মায়া,
জানি তোমার মন ভালো নেই। সে দায় আমার। কিন্তু কি করব বলো? বরযাত্রী নিয়ে রওনা হব, এমন সময় বাড়িওয়ালার বাসায় টেলিফোনে খবর এলো চাচা মারা গেছেন। তুমি তো জানো, আমি এতিম। চাচার কাছেই মানুষ। ওনার বড় সাধ ছিল আমার বউ দেখার। সে কথা ভাবতেই তোমার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। তখন যদি আমি না যেতাম তবে তুমি হতে অপয়া। আর আমাদের মা- চাচীরা এখনো সব দায় মেয়েদের কাধেই দেন। আমার জন্য তোমার এই কখনোই মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই আত্মীয়দের মৃত্যু সংবাদ না দিয়ে বেশি সংকটাপন্ন অবস্থার কথা বলে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলাম। পরে আমি কয়েকজন পড়শি আর বন্ধুদের নিয়ে তোমাদের বাড়িতে গিয়েছিলাম।
সেখানে হয়তো মামাকে সত্যটা বলতে পারতাম। কিন্তু কথাটা একবার আত্মীয় মহলে ফাস হলে তোমায় অলক্ষ্মী অপবাদ দিতে কেউ থামত না। এর চেয়েও বড় কথা, চাচা নেই- এ কথা একবার মুখ দিয়ে বের করলে আমি আর স্থির থাকতে পারতাম না।
আমি বোধ হয় এলোমেলো কি সব লিখছি। আসলে সব দায়িত্ব আমার কাধে, তাই তাড়াহুড়া করে শেষ করতে হচ্ছে। আর হ্যা, আমি আমার লক্ষ্মী বউটাকে খুব তাড়াতাড়ি নিতে আসব। ভালো থেকো।
তোমার বাঁধন।

 

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ

0

হৃদয়ের রক্তক্ষরণ

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

২০১০সালে ঢাকা ইউনিভার্সিতে ভর্তি হয়েছিলাম অনেক আশা নিয়ে।
শিক্ষক, বাবা মায়ের কারণে, অনেকটা রক্ষণশীল পরিবেশে বড় হবার কারণে হল জীবনে নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম।
একদিন পরিচয় হয় মারুফের সাথে। মারুফের সাথে পরিচয়টা মূলত বান্ধবী শিখার মাধ্যমেই হয়। শিখার খুব ভালো বন্ধ মারুফ। মারুফ ছিল একজন সুন্দর ও সুদর্শন যুবক। যাকে দেখলে যেকোনো মেয়ে প্রেমে পরার স্বপ্ন দেখবে। একদিন সেই মারুফ একটু সময় চাইল আমার কাছে। সময় দিলাম। এরপর থেকে দেখা হতো প্রতিদিন।
মারুফের পরিবর্তিত আচরণ আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল আমাদের সম্পর্কের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু প্রেম ভালোবাসার ব্যাপারে আমার সাহসটা বরাবরই একটু কম ছিল। যার কারণে সম্পর্কটা বন্ধুত্বের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত, যদি না মারুফ ভালোবাসার প্রস্তাব দিত।
শুরু হলো এক নতুন জীবন, যেখানে সম্ভব সুন্দর আগামীর স্বপ্ন, সীমাহীন প্রত্যাশা, বর্ণিল আনন্দময় প্রতিটি দিন। খুব বেশী স্বপ্ন দেখতাম আমি। আমাদের থাকবে একটা ছোট্ট সংসার, দুটি ছোট কচি হাত।
আমি মাস্টার্সে উঠে গেলাম। কিন্তু তখনো জানতাম না আমার জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে।

একদিন আমার সেই স্বপ্নের ইতি ঘটল, আমি তাকে বিয়ের কথা বললাম। “বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি আর পারছি না। এবার তো কিছু একটা করো।”
মারুফের স্পষ্ট জবাব, আমায় তুমি ভুলে যাও অন্তরা। আমার পক্ষে তোমাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। আমি এনগেজড।
সাজানো স্বপ্ন ভঙ্গের যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠলাম, সবকিছু মিথ্যে হয়ে গেল আমার। মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে কয়েক মাস মনোরোগ বিভাগে থাকতে হয়েছিল। অন্য দিকে মারুফ বিয়ে করে বউ নিয়ে বিদেশ চলে গেল।

খুব কষ্ট পেলাম, অথচ আমি তার অযোগ্য ছিলাম না।
প্রবাদ আছে, যে বেশী ঠেকে, সে বেশী শেখে। আমিও শিখলাম আমাকে দিয়ে ভালোবাসা হবে না। তখন উল্টো চিন্তা করলাম, তার দেওয়া কষ্টগুলো চার্লস ডিকেন্সের মত ব্যবহার করব।
চার্লস ডিকেন্সের প্রথম ভালোবাসার দুঃখজনক পরিণতি ঘটেছিল। তখন তিনি তার ভালোবাসাকে লেখার মধ্যে সঞ্চার করলেন। ফলে তার ভাঙা হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা ডেভিড কপারফিল্ড উপন্যাসটি খুব জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
আমি তখন আমার লেখালেখি আর পড়াশুনাতে মন দিলাম। প্রচুর বই পড়তে শুরু করলাম। ইদুর যেমন সামনে যা পায় তাতেই মুখ দেয়, আমিও সামনে যে বই পেতাম তাই পড়তাম। তার জায়গা দখল করল বই।
শিক্ষকতা শুরু করলাম। আমার সময় কাটত শিক্ষকতা আর লেখালেখি করে। অল্প কিছুদিনের ব্যবধানে দেশের সাহিত্যের পাতায় নাম উঠল। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হাজারো পাঠক/পাঠিকার মন জয় করে নিলাম। সাহিত্য সম্মাননার মুকুট উঠল আমার মাথায়।

জীবন বহতা নদীর মতো। কারো জন্য থেমে থাকে না। সৃষ্টির অনাদিকাল থেকে এ নিয়মই চলছে বিরামহীনভাবে। ভালোই আছি। মাঝে মধ্যে মনে হয় কি যেন নেই।
তখন ডেল কার্নেগীর কথা মনে হয়। তিনি লিখেছেন, একজন বিশেষ লোকের ভালোবাসা হয়তো তুমি হারিয়ে ফেলতে পারো কিন্তু মন থেকে ভালোবাসা নামক বস্তুটি কখনো হারায় না। সেটা আরেকজনকে খুঁজে নেয়। একজনের প্রতি ভালোবাসা আরেকজনে সঞ্চার হয়ে যায়। জেনে রেখো- আরেকজন আছে।
তাই নষ্ট হলাম না, ধ্বংস করলাম না নিজেকে।

# হৃদয়ের রক্তক্ষরণ
লেখা- অনামিকা ইসলাম “অন্তরা”

একটি পানকৌড়ির গল্প ৮

0
একটি পানকৌড়ির গল্প......  ৮
একটি পানকৌড়ির গল্প......  ৮
একটি পানকৌড়ির গল্প…… ৮.
রাতের খাওয়াটা আজকে বেশ মজার হয়েছে। অনেক দিন পরে আফতাব হোসেন বেশ আরাম করে খেয়েছেন! মুগ ডালের স্বাদ অমায়িক হতে পারে তার জানা ছিলোনা। ঘরের খাবার খেতে খেতে জিহবাটাই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। রশীদ আলমের স্ত্রীর রান্না এতো ভালো কিন্তু তার স্ত্রীর রান্না দিন দিন খারাপ হচ্ছে। রাত ১০ টা বাজে একবারও রেহানা তাকে ফোন করেনি। অন্যদিন তো ৯ টা বাজার সাথে সাথেই ফোন করতে শুরু করে। যেন সে একজন অবুঝ শিশু! স্ত্রীর এরকম কাজ তিনি মোটেও পছন্দ করেননা। রাত ১০ টা বাজুক না ১২ টা বাজুক সে পুরুষ মানুষ বাহিরে থাকতেই পারেন। এতে এতো বিচলিত হবার কিছুই নেই। ফুটপাত দিয়ে হাঁটছিলেন আর ভাবছিলেন আফতাব হোসেন, আজকে বাড়ি না গেলে কেমন হয়? মেয়ে মানুষ দের একটু শিক্ষা দেয়ার প্রয়োজন আছে।
না, বাড়িতে যাওয়াই ভালো। একসময় এই স্ত্রীর জন্য তিনি পাগল ছিলেন। অনেকেই তাকে বউ পাগলা বলতেন। সেগুলো বিয়ের প্রথম প্রথমে রেহানা দেখতে অনেক আকর্ষণীয় ছিলো। এখন তো পেটে চর্বি জমেছে, গায়ের রঙটা নষ্ট হয়ে গেছে। চুলের অবস্থা তো খুবই বিশ্রী। এখন রেহানাকে তার ভালোই লাগেনা। আরেকটা বিয়ে করার চিন্তায় আছেন আফতাব হোসেন। যদি অল্পবয়সী কাউকে পেয়ে যান তাহলে রেহানাকে তালাক দিয়ে দিবেন। তালাক দেয়ার পর অবশ্য ওর যাওয়ার জায়গা নেই। না থাক, তার দেখার বিষয় না।
রেহানা রাত ৯ টা থেকে স্বামীর অপেক্ষা করছেন। আজ তার জন্মদিন, আফতাবের ভুলে যাওয়ার কথা না। ইচ্ছাকৃতভাবে আফতাব হোসেন দেরি করছেন। তাকে রাগানোর জন্য, কিন্তু সে রাগবে না। রেহানা শেষ কবে সেজেছিলো তার মনে পড়ছেনা। জন্মদিন উপলক্ষে সাজুগুজু করলেন। আফতাব হোসেন জাম রঙের একটা কাতান গিফট করেছিলেন বিয়ের দ্বিতীয় বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে। সেই জাম রঙের কাতান টাই পড়েছেন। ছেলেরা ঘুমিয়ে পড়েছে, ছেলেদের সামনে তার সাজতে লজ্জা লাগে।
অপেক্ষা করতে রেহানার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।আফতাব মনে হয় ভুলে গেছে। আবার একটু পরেই ভাবছেন গতবারও মনে ছিলো, এবারও আছে। তার সাথে দুষ্টিমি করছে।
রেহানা কাঁদতে শুরু করলেন, এখন আফতাব আর তাকে আগের মতো ভালোবাসে না। কথাও বলতে চায়না, জোর করে কথা বলেন। ছেলেদের খোঁজও তেমন রাখেন না। রাত কতো হচ্ছে কিন্তু আফতাব আসছেনা। বাধ্য হয়ে রেহানা আফতাব হোসেন কে ফোন দিলেন। রিসিভ করে আফতাব হোসেন বললেন
– কী সমস্যা?
রেহানা কান্না অনেক কষ্টে থামিয়ে রেখেছিলেন। ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আফতাব হোসেন চুপচাপ সেই কান্না শুনতে লাগলেন। তার ভেতরের সেই ভালোবাসাটা আবার জেগে উঠছে, যার উপর মরিচা ধরেছিলো। রেহানার কান্না মরিচা সরিয়ে ফেলছে। আফতাব হোসেন ফোন কেটে দিয়ে হোটেল রুম থেকে বের হয়ে ম্যানেজারের কাছে গেলেন।
ম্যানেজার বললেন
– কিছু লাগবে স্যার?
– আমি এখন চলে যাচ্ছি, রুমের চাবি রাখুন। আর টাকা তো আগেই দিয়েছি।
– কোনো সমস্যা হয়েছে আমাদের হোটেলে?
– না। আমার স্ত্রীর সাথে মান অভিমান টা বহুদিন পর ভাঙলো। আমি এখন বাসায় না গেলে ও খুব কষ্ট পাবে।
ম্যানেজার কী বলবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না।
আফতাব হোসেন রাস্তায় নেমে জোরে হাঁটতে শুরু করলেন। আশেপাশে কোনো বা কোথাও পেস্ট্রি শপ খোলা পেলে বেশ ভালো হতো। রাত তো অনেক হয়েছে এখন খোলা থাকার কথা না। রেহানার জন্মদিন টা এভাবে মাটি করে দেয়া যাবেনা। রেহানা খুব কষ্ট পাবে। এই মেয়ে তাকে খুব বেশি ভালোবাসে। আফতাব হোসেন নিজের চোখের কোণে ভিজে উঠেছে বুঝতে পেরেও হাত দিয়ে মুছলেন না। থাক, মানুষ দেখুক। এখন তার একটাই কাজ রেহানার জন্য কিছু একটা নিয়ে যাওয়া।
অঅল্পবয়সী, হুর-পরী, বিশ্বসুন্দরী যেই আসুক না কেন তিনি আর বিবাহ করবেন না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন। রেহানা আধা পাগলী টাই থাকুক জীবনে! আর রেহানা খাঁটি ভালোবাসা দিয়ে তাকে মুড়িয়ে রাখুক শেষ নিশ্বাস অবদি।
রেহানা বসার ঘরে ঝিমুচ্ছেন আর কিছুক্ষণ পর পর ঘড়ির দিকে উদাসীন ভাবে তাকিয়ে সময় দেখছেন। এই মনে হচ্ছে আফতাব চলে আসবে কিন্তু না আসছেনা।
১১ টা ১৫ তে কলিং বেল টুং করে বেজে উঠলো! রেহানা প্রায় পাগলের মতো দরজা খুলে দিলো। আফতাব হোসেন স্মিত হেসে স্ত্রীকে বললেন
– My Dear পাগলা বউ, Happy birthday to you!
স্বামীর মুখে পুরোনো কথা শুনে আবারও কাঁদতে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। আফতাব হোসেন বললেন
– কাঁদবেন না। আপনার জন্য কি এনেছি জানেন?
রেহানা ঘাড় নাড়িয়ে না বোঝালো। আফতাব হোসেন তার পিছনে লুকিয়ে রাখা পাখির খাঁচাটা বের করে স্ত্রীকে বললেন
– টিয়াপাখি এনেছি। সারাক্ষণ এ চিল্লাবে আর তুমি ভাববা আমি তোমাকে ভালোবাসি বলছি। বুঝতে পারছো?
– আস্তে বলো, ছেলেরা শুনবে তো।
– আগে আমাকে ঘরের মধ্যে ঢুকতে তো দিবা!
রাত ৩ টা রেহানার ছোট্ট বারান্দায় টিয়াপাখি টা তার খাঁচায় ঘুমানোর চেষ্টায় আছে। নতুন পরিবেশে সে ঠিক মানিয়ে নিতে পারছেনা। বারবার ভেতরের ঘর থেকে খিলখিল হাসির শব্দ আসছে। যাও একটু ঘুম আসছে তাও ওই মহিলার হাসিতে দফারফা হয়ে যাচ্ছে।
ফজরের আজান দিবে ঠিক তার আগে ফারিয়া আবারও সেই স্বপ্নটা দেখলো। ঠিক প্র‍থমদিন যেমন দেখেছিলো ঠিক তেমনই। কোনো পরিবর্তন আসেনা। ফারিয়ার ঘুম ভাঙলো ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে। পুরো শরীরে ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। নাকের কাছের গন্ধটা গতকাল রাতেও তেমন ছিলোনা। ব্যথাটাও কম ছিলো। বেশ ভালো লাগছিলো ফারিয়ার। মায়ের টুকটাক কাজ করে দেয়াতে মা বেশ বিরক্ত হয়েছিলো। ফারিয়া বুঝতে পেরে বলেছিল
– আবারো তো অসুস্থ হয়ে যাবো। তখন তো আর পারবো না।
ডাক্তার লোকটার সাথে তার মায়ের খুব ইম্পরট্যান্ট কথা হয়েছে। তাকে শুনতে দেয়া হয়নি। মাকে জিজ্ঞেস করেও জানা সম্ভব হয়নি।
ফারিয়ার পেট গুলিয়ে বমি আসছে। অনেক কষ্টে বমি চাপিয়ে রেখেছে। স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটেনি। এখনো ফারিয়ার মনে হচ্ছে তার মাথা ভারি গাড়ির চাক্কায় পিষে রাস্তার পিচের সাথে একদম মিশে গেছে! ভোর হচ্ছে, লোকজন আসছে তাকে মর্গে নেয়ার জন্য। না না, সে তো এক্সিডেন্টে মারা গেছে তাকে নিয়ে যাবে লাশ কাটা ঘরে। তারপর এই শরীর কে যাচ্ছেতাই ভাবে কাটা হবে। কী অসহ্য স্বপ্ন! ফারিয়ার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে! ভেতরের ফারিয়া প্রতিনিয়ত একটু একটু করে মারা যাচ্ছে। কেউই খেয়াল করছেনা। তার মাও বুঝতে পারছেনা। বুঝবেই বা কীভাবে ফারিয়া তো তাকে কিছুই জানতে দেয়নি।
আফতাব হোসেনের ঘুম ভাঙলো তার ছেলেদের ডাকে। চোখ মুছতে মুছতে মোবাইলে সময় দেখে প্রায় আঁতকে উঠলেন। ৯ টা বাজে কিন্তু এখনো তার ঘ ভাঙেনি কেনো? প্রতিদিন ঠিক ৬ টায় তার ঘুম ভেঙে যায়। তাহলে আজকে এমন কেনো হলো? রাতের কথা তার মনে পড়লো। রাত ৩ টা পর্যন্ত রেহানা আর সে গল্প করেছে। সে গল্প করেছে ব্যাপারটা ওরকম না। রেহানা গল্প করেছে আর সে আদর্শ লিসেনারের মতো শুনেছে। অন্যদিন রেহানার সাথে ২ মিনিট কথা বললেই মেজাজ খারাপ হয়ে যেতো। কিন্তু গতরাতে একটুও বিরক্ত আসেনি তার মধ্যে। বরং তার ইচ্ছা করছিলো রেহানা আরো গল্প করুক। গল্প গুলো যে খুব জরুরি কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা না। পাশের বাসার ভাবী শুকনা মরিচ ধার নিয়ে আর দেননি। চাল ধার নিয়েছিলো আগে তাও দেয়নি ফেরত। এবার কিছু চাইতে আসলে সে কিছুই দিবেনা।
মেয়ে জাত বড্ড অদ্ভুত। সামান্য ব্যাপার গুলোকে অসামান্য করে তুলতে এদের জুরি নেই। এসব বিষয় গুলো যে গল্প হতে পারে এটা নারী ছাড়া কারও বের করা সম্ভব না।
দেরি হওয়াতে মেজাজ খারাপ ছিলো কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন
– কী ব্যাপার বাপ জানেরা, আজকে আপনারা ডাকতে আসছেন?
ছোটো ছেলেটা চোখ বড় বড় করে বললো
– জানো বাবা, আম্মু আজকে খুব মজার খাবার রান্না করেছে। আর বলেছে আজকে সবাই সকালে একসাথে খাবো। তুমি তো উঠছো না আর এদিকে আমাদেরও খিদে পেয়েছে। উঠো না বাবা।
আফতাব হোসেন বললেন
– আচ্ছা আমি উঠছি। তোমাদের মাকে বলো খাবার টেবিলে দিতে।
ছেলেরা হুড়োহুড়ি করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
আফতাব হোসেন নিজের অজান্তেই হাসলেন। ছোটো ছেলেটা পুরো মায়ের ফটোকপি। মায়ের মতোই গল্প করতে পটু।
এতো সুন্দর সুখ থেকে তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। আহাম্মকের মতো কাজ করেছেন। এখন আর না।
চলবে……
© Maria Kabir

সত্যিকারের ভালোবাসা

1

সত্যিকারের ভালোবাসা

লাইব্রেরিতে প্রয়োজনীয় কিছু বই কিনতে গিয়েছিল অন্তরা,সঙ্গে বান্ধবি মিতু। কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছিলনা। অদূরে দাঁড়িয়ে এক জোড়া চোখ অপলক ভাবে যে তাকেই অনুসরণ করছে বেশ বুঝতে পারছে সে। অন্তরা আদর্শ রূপবতী বলতে যেমনটি বোঝায় ঠিক তেমন। গায়ের রং কাঁচা হলুদের মতই, উচ্চতা ৫ফিট ৩। কোমর ছাড়ানো চুলে ঢাকা পিঠ। অসম্ভব সুন্দর শারীরিক গড়ন যে কোন মেয়ের হিংসার কারণ। এমনকি তার হেঁটে চলার ধরণটাও দৃঢ় অথচ নমনীয়। এমন মেয়েকে কার না পছন্দ?!!!
কোনরকমে কাজ মিটিয়ে বাসায় ফিরে এলো দু’বান্ধবি।
পরদিন কলেজে যাওয়ার সময় বাস থেকে নেমে চোখ আটকে গেলো অন্তরার। হ্যাঁ, গত কালকের সেই ছেলেটাই তো দাঁড়িয়ে।
দেখে তো মনে হচ্ছে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমি যদি ওকে কিছু বলতেও যায় আর সেটা যদি ঐ জল্লাদ স্যারটার কানে যায় তাহলে কপালে নির্ঘাত শনি আছে।
না, না! এখানে এক মুহূর্তও দাঁড়ানো যাবে না। ছেলেটাকে কথা বলার কোনো সুযোগ না দিয়ে অন্তরা দৌঁড়ে সে স্থান ছেড়ে পালায়। কলেজ ছুটির পর বান্ধবি মিতুর অনুরোধে নাইনটি নাইনে গিয়েছিল অন্তরা।
দোকানের কাচের গ্লাসের দিকে চোখ যায় অন্তরার। মনে হচ্ছে সানগ্লাসের আড়ালে একজোড়া চোখ যেন ওর দিকেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বান্ধবীকে একা রেখেই চটজলদি সে স্থান ত্যাগ করতে চাচ্ছিল অন্তরা, কিন্তু পারে নি।
ছেলেটি সামনে এসে দাঁড়ালো-
“একটি মাত্র কথা বলবো প্লিজ….”

অন্তরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বললো, ভালোবাসি…..
– এত সহজে? কতটা চেনেন আমাকে??? —–জবাব আসে, ঘুম হয়নি সারারাত।
– এটা জবাব হলো?
——অপছন্দের অধিকার আপনার আছে। তবে না করবেন না প্লিজ, যদি না অন্য কোথাও এনগেজড থাকেন। খুব ভালোবাসবো ,বললো বাঁধন।
কিন্তু অন্তরা চায়না প্রেম করতে। সৌন্দর্য দেখে তার ভালবাসা, সান্নিধ্য পেতে চায় হাজারো যুবক। এটা তার পছন্দ না, তাকে জেনে বুঝে কেউ ভালবাসুক সেটাই চায় সে।
ছেলেটার একটাই প্রশ্ন ছিলো, “আপনি কি কোথাও এনগেজড?”
জবাবে অন্তরা বিরক্তিভাব নিয়ে ‘না’ বলে চলে গেলো। কিন্তু ভেবে পেলনা, ছেলেটি তার কলেজ চিনলো কি করে?
পরদিন ভয়ে ভয়ে কলেজ গেলো, না সে আসেনি। খুশী হলো অন্তরা।
সন্ধ্যায় মা এলো দু’মগ কফি নিয়ে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে একটি বায়োডাটা হাতে দিয়ে বললো, দেখতো ছেলেটা কেমন??? কথা বলা যাবে? তোর বাবার বেশ পছন্দ হয়েছে।
– পর করে দিতে চাও?
—– নারে পাগলী তুই তো নিজে পছন্দ করবিনা পণ করে বসে আছিস। তাই তো আমাদের ভাবতে হচ্ছে।
– আমাকে কেন বলছো মা? তোমরা যেটা ভালো বুঝবে। তবে পরীক্ষার আগে এ বিষয়ে কিছু ভেবো না। ছয় মাস পর ।
কথা এগুলো দুই পরিবারের মধ্যে। ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ভাল জব করে, ফ্যামিলিও ভালো। যদি উভয় পক্ষের পছন্দ হয় তবে অন্তরার পরীক্ষার পর বিয়ে। এখন এনগেজমেন্ট করে রাখা হবে। দেখাদেখির দিন নির্ধারণ হলো। অন্তরা গোলাপী শাঁড়িতে হালকা সেজে সামনে এলো। কিন্তু একি?!
এ যে সেই ছেলে যাকে দেখেছিল সে বাসস্টপের সামনে কলেজ গেটে।
ছেলে মেয়েকে কথা বলবার সুযোগ করে দিয়ে অন্যরা পাশের ঘরে যেতেই অন্তরা বললো, আপনি???
—- হ্যাঁ, আমি বাঁধন। জানি প্রশ্ন করবেন , আমার কলেজ চিনলেন কি করে ???
ফলো করে। লাইব্রেরি থেকে বাসা, পরদিন বাসা থেকে কলেজ। সেখান থেকে বাসায় ফিরে মাকে বলা। এরপর সব ব্যবস্থা মা’ই করছেন।

সকলের সম্মতিতে বিয়ে ঠিক হলো,
পরের সপ্তাহে এনগেজমেন্টও হয়ে গেলো। শুরু হলো ফোনালাপ, মাঝে মাঝে কফিসপে দেখা। বাঁধন ভীষণ ভালো ছেলে, ভীষণ কেয়ার করে। অন্তরা খুশী হলো। বাঁধন তো হাতে চাঁদ পাওয়ার মত খুশী।
পরীক্ষা শেষ।
বিয়ের কেনাকাটা শুরু।
এলো হলুদ লগ্ন।
একদিন পর বিয়ে।
সন্ধ্যায় অন্তরার ফোন-
“মিতুদের বাসাতে একবার আসবে?”
অন্তরার গলাটা কাঁপছে কেন?
বাঁধন ধরে নিলো বিয়ের উত্তেজনাতে হয়তো। কিন্তু আজ দেখা কেন করতে চাইলো অন্তরা? বাঁধন ভাবে মনে হয়,
বিয়ের আগে শেষ বারের মত দেখা করতে । খুশী মনে অন্তরার প্রিয় চিপস ও একটা বেলির মালা নিয়ে বাঁধন হাজির হলো মিতুদের বাসায়। মিতু তাকে ছাদে নিয়ে গেলো, আঙুল ইশারা দিয়ে অন্তরাকে দেখিয়ে দিয়ে নীচে নেমে গেলো মিতু।
অন্তরা ছাদের গ্রিল ধরে বাঁধনের বিপরীতমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। বাঁধন কাছে গিয়ে ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে, লক্ষ্মী! বাঁধন অন্তরাকে লক্ষ্মী বলেই ডাকে। দু’হাত দিয়ে ধরে অন্তরাকে সামনে ফেরাতে ফেরাতে ভাবে আজ অন্তরাকে সে প্রথমবার ভালোবাসার উষ্ণ আদরে অধর ছুঁয়ে বুকে টেনে নিবে। ভাবতে গিয়ে প্রবল উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে বাঁধন। মনে মনে ভাবে অন্তরা কিছু ভাববে নাতো? কিন্তু অন্তরা মুখ ফেরাতেই চমকে ওঠে বাঁধন।
একি???
অন্তরার পুরো মুখ কেটে ছিড়ে একাকার। মুখের এক দিকে ব্যান্ডেজ করা।
কি করে হলো?
অন্তরার শান্ত জবাব এক্সিডেন্ট…..
প্রায় বিশটার মত সেলাই লেগেছে।
বাঁধন শোকে যেন পাথর, চোখ জ্বালা করছে ওর। কখন হলো?
জবাব না দিয়ে অন্তরা বললো বিয়েটা ভেঙে দিন, যে অন্তরাকে আপনি পছন্দ করেছিলেন সে তো অন্যকেউ। আমার এ দাগ চিরদিনের। বাঁধন আঙুল দিয়ে অন্তরার ঠোঁট চেপে ধরে বলে, তুমি একথা বলতে পারোনা লক্ষ্মী। আমার কিছু হলে তুমি কি ছেড়ে যেতে বা যদি বিয়ের পর হতো??? বিয়ে হবে এবং তা কালই কথাটা বলেই অন্তরাকে দু’হাতে বুকে জড়িয়ে নেয় বাঁধন। অন্তরার তখন চোখে জল।
ইয়া বড় ঘোমটা পরে বিয়ের আসরে আসে বৌ বেশে অন্তরা। বিয়ের আচার অনুযায়ী আসে আয়নাতে মুখ দেখা পর্ব। মিতু বলে, দেখুন কে বেশী সুন্দরী? আমার বান্ধবী না চাঁদ? বাঁধন আয়নাতে তাকিয়ে পাগলের মত চিৎকার দিয়ে ওঠে,
এ আমি কি দেখছি? আমাকে…..(…..)…??আর বলতে দেয় না অন্তরা। আচলের নীচ দিয়ে বাঁধনের হাত চেপে ধরে ফিসফিসিয়ে বলে, যা বলার পরে বলো। সুসম্পন্ন হলো শুভ কাজ। পুণ্য চোখের জলে বিদায় নিলো অন্তরা। এলো বাসর লগ্ন।
— তুমি এমন কেন করলে???
এত পরীক্ষা নিতে হয়? আমার ভালবাসার উপর বিশ্বাস ছিল না বৌ?
আমি শুধুই দেখতে চেয়েছিলাম, আমার রূপকে না আমাকে ভালোবাসো তুমি? ক্ষমা করে দাও, তুমি জিতে গেছো।
মেকাপটা কেমন ছিল বলো তো???
বাঁধন বললো, নিখুঁত। কে সাজিয়েছিল?
মিতুদের ভাড়াটিয়া, টিভির মেকআপ আর্টিস্ট। হাসতে হাসতে বাঁধন বললো, তার তো এ্যওয়ার্ড পাওয়া উচিত।

অন্তরার মুখ এতক্ষণে বাঁধনের হাতের তালুতে বন্দী। অন্তরার কপাল ভিঁজে যাচ্ছে আনন্দ অশ্রুতে বাঁধনের অপলক চাহনির সামনে। অন্তরার কথা বলবার ক্ষমতা চুষে নিলো বাঁধন। অন্তরা এখন বাকরুদ্ধ ।।

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

কতো দিন ভুলে গেছি ঘুম

0

কতো দিন ভুলে গেছি ঘুম !!

জানো প্রিয়তম__
মনে পড়ে না,
শেষ কবে বালিশে মাথা রেখে
তলিয়ে গেছি গভীর ভারী
মৌগন্ধী কোনো ঘুমের অতলে !!

যখনই চোখ বন্ধ করি,
বন্ধ চোখের পাতায় অন্ধকার নামে না,
কেমন যেন আলোয় আলোময় হয়ে ওঠে চারিদিক। জানো,
বুক থেকে উঠে আসা একটা
তিরতিরে ব্যথা গলা বেয়ে
উঠে এসে একটা মস্তো বড়ো
পুকুর হয়ে টলটল করতে
থাকে চোখের কোলে !!!
সেই আলোর মধ্যে আঁতিপাতি
করে করে খুঁজি,
একটা চেনা মুখ,
একটা চেনা হাসি,
দুটো চেনা চোখ….
ব্লটিং কাগজর মতো মনটা
তৃষ্ণার্ত হয়ে খালি শুনতে চায়
একটি চেনা স্বর…
লক্ষ্মী কী করছো ?
ভালো আছো ?
খেয়েছো ? কী খেলে???

হাত বাড়িয়ে ছুঁতে যাই ঐ
স্বর,
প্রাণপণে সব আলোকে
তাড়িয়ে আঁকড়ে ধরতে চাই
অন্ধকার,
যে অন্ধকারে স্বপ্নরা
নেমে আসবে হাত ধরাধরি করে;
যে স্বপ্নের মধ্যে থাকবে তুমি,
যে স্বপ্নের মধ্যে খেলে বেড়াবে
তোমার শব্দেরা….

কিন্তু অন্ধকার আসে না!! স্বপ্নেরা আসে না !!!
স্বপ্নের বাইরে দাঁড়িয়ে চুপি চুপি
হাসো তুমি,
তোমার ছায়া,
টলটল করে কাঁপে
চোখের পুকুরে ………..

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

বিশ্বাস

0

 বিশ্বাস

লেখা- অনামিকা ইসলাম।

একবার ; হ্যাঁ একবার যখন তোমায় ভালোবেসেই
ফেলেছি-
তুমি আমাকে চাইলেই এখন একটি ট্রাকের নীচে
ধাক্কা মেরে ফেলে দিতে পারো মজা করতে করতে,
আমি তোমার মজাতেও বিশ্বাস রাখি যে!
হয়তো একটু খেলাচ্ছলে আমাকে ফেলে দিতে
পারো পাহাড় থেকে,
আমি গড়িয়ে পড়তে পড়তে তোমাকে দেখার চেষ্টা
করতে পারি,
তখন মনে হবে তুমি নও, আমিই বোধহয় পা ফসকে
পড়ে গেছি।
আমি তোমাতে এত বিশ্বাস রাখি যে!
আমি তোমাকে একবার ভালবেসেছি,
মাত্র একবার-
তারপর থেকে অবিরাম বিশ্বাস করে যাই।
আর তাই তুমি চাইলেই আমার হৃৎপিন্ডকে একটা
ব্লেন্ডারে ফেলে কুচিকুচি করে ফেলতে পারো উল্লাসে!
তোমার ইশারায় আমার চোখ পাথর হতে পারে
এখন,
তোমার ইশারায় আমি থমকে যেতে পারি ক্যান্সারের
খবর পাওয়া সাতাশ বছরের যুবকটির মত।
তোমার ইশারাকে যদিও আমি খুব বিশ্বাস করি-
এবং তোমার একটি মাত্র ইশারায় ভেঙে যেতে পারে সাতআসমান!
আমি মাত্র একবার তোমার প্রেমে পড়েছিলাম,
তারপর বহুবার কেঁদে ভাসার মত ভালোবেসেছি!
মাত্র একবার বুঝতে পেরেছিলাম তোমাকে আমি
ভালোবাসি,
তারপর বহুবার মাঝরাতে কেঁপে উঠেছি দুঃস্বপ্নে!
কিন্তু আমি তোমাকে বিশ্বাস করি-
আর তুমি চাইলেই চুমু খেতে খেতে বুকে ঢুকিয়ে দিতে পারো তীব্র ছুড়িকা!
একটা একটা করে কেটে দিতে পারো রক্তনালী,
ফিনকি দিয়ে বের হবে বিশ্বাস,
বিশ্বাসের রঙ লাল!
আমি তোমাকে একবার ভালোবেসেছি, তখন থেকেই আমার ভালো থাকা মন্দ থাকার কারণ হয়ে উঠেছো তুমি।
তুমি চাইলেই আমি দেবদূতের মত জ্যোতির্ময়,
তুমি চাইলেই আমি পঁচা গলা এক মরা মাংসপিন্ড!
তবে আমি তোমাকে বিশ্বাস করি-
বিশ্বাস করি বলেই তুমি আমার কাছ থেকে চুমু
খেয়েও অন্যকারো সাথে শুতে পারো!
তুমি কারো সাথে ফোনালাপে জমজমাট প্রেম
করতে পারো,
তুমি চাইলেই হঠাৎ করে কেড়ে নিতে পারো আমার
সুস্থতা।
তুমি চাইলেই আমাকে নিখোঁজ করে দিতে পারো,
আর আমি তোমাকে বিশ্বাস করি বলেই-
তুমি বিষকে অমৃত বলে খাওয়াতে পারো!
আমি তোমাকে একবার ভালোবেসেছিলাম,
সেই থেকে নিজের উপর বিশ্বাস হারিয়ে আমি
তোমাকে বিশ্বাস করছি।