সকালে অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হয়। আসবো? কন্ঠ শুনে বুঝতে পারলাম দরজায় লাবণ্য দাঁড়িয়ে। পেছনে না তাকিয়েই তাই জবাব দিলাম, আসো। নিঃশব্দে লাবণ্য আমার পাশে এসে দাঁড়ায়। আয়নার ভেতর দিয়েই দৃষ্টি যায় ওর দিকে। চোখ মুখ স্বাভাবিক। কেউ দেখলে বলতেই পারবে না এখন, গতকাল রাতে এই মেয়েটি প্রচন্ড এক অভিমানে হো হো করে কেঁদেছে। গায়ে সুগন্ধি পারফিউম মাখা শেষে ওর দিকে ফিরে তাকালাম। তারপর? লেখাপড়া কেমন চলছে? ভালো। ছোট্ট করে ওর জবাব। ব্যাগটা হাতে নিতে নিতে অতি ব্যস্ততার সহিত প্রশ্ন করলাম, কিছু বলবে? নিচের দিকে তাকানো অবস্থায় ওর জবাব, আমার কিছু কেনাকাটা করতে হবে। আন্টি বলেছে আপনার সাথে… পুরো কথা বলতে পারেনি লাবণ্য। তার আগেই আমার ঝটপট জবাব, অফিসের কাজে দু’দিনের জন্য ঢাকার বাহিরে যেতে হবে। আমাকে তাই এখনই বের হতে হচ্ছে। আশা কোচিং থেকে ফিরলে তুমি বরং ও’কে নিয়ে যেও। জবাবে ‘ওহ, আচ্ছা’ বলে নিঃশব্দে রুম ত্যাগ করে লাবণ্য। ২দিন পর — অফিসের কাজ শেষে ঢাকায় নিজ বাসায় ফিরতেই দেখি ব্যলকনিতে কারো জন্য গভীর প্রতীক্ষায় মা দাঁড়িয়ে। ‘কি হলো মা! এভাবে দাঁড়িয়ে আছ যে? কারো জন্য অপেক্ষা করছো কি?’ চটজলদি মায়ের জবাব, ফ্ল্যাট কেনার ব্যাপারে তোর বাবা গিয়েছিল মালিকের সাথে কথা বলতে। দেখ্, না! এতো রাত হয়ে গেছে। এখনো তো ফিরলো না…. পেছন থেকে জড়িয়ে ধরি মাকে। হাসোজ্জল মুখে বলে ওঠি, ওহ, মা! তোমাদের ভালোবাসা দেখলে না আমার বড্ড হিংসে হয়। এত বয়স হয়েছে, এখনো তোমাদের ভালোবাসা কমেনি! সামান্য চোখের আড়াল হতেই একজন আরেকজনের জন্য উতলা হয়ে….. পুরো কথা বলতে পারিনি। তার আগেই মা আমার কান টেনে ধরে। খুব হিংসে হয় না? দাঁড়া তোর বাবাকে বলে তাড়াতাড়ি বাড়িতে নতুন বউ নিয়ে আসার ব্যবস্থা করছি…… নতুন বউ! কথাটা বলতেই দরজার সম্মুখে এসে দাঁড়ায় লাবণ্য। আমাকে দেখে দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় সে। অন্য দিকে তাকিয়ে মা’কে জানান দেয়, টেবিলে খাবার দিয়েছি আন্টি, খেতে আসুন…. লাবণ্য চলে গেলে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য মা এবং আমি দু’জনেই ড্রয়িংরুমের দিকে রওনা দিলাম। রাতের খাবার শেষে রুমে এসে বিছানায় গা’টা এলিয়ে দিয়েছিলাম। ভেতরে প্রবেশ করে পাশে এসে বসে মা। — কিরে! ঘুমাসনি? — এইতো, আয়োজন চলছে। — তারপর, বললি না তো কি করবো?! — কি করবে মানে? তোমাদের টাকা, থাকবেও তোমরা। এখানে আমাকে কেন জিজ্ঞেস করছো এসব? — আমরা আর কতদিন থাকবো! তারপর তো তুই’ই…. — মা! খুব খারাপ হয়ে যাবে কিন্তু! একদম বাজে কথা বলবে না… — আচ্ছা, এটা বল তোর ফ্লাটটা পছন্দ হয়েছে কি না! — অনেক। — ভেবে বলছিস তো?! — এত ভাবাভাবির কি আছে মা? বিগত অনেকগুলো বছর যাবৎ আমরা তো এখানেই আছি, তাই না? স্বভাবতই মায়া জমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। আর সেই মায়ার টানেই হয়তো বা তোমরা বাকি জীবনটা এখানেই কাটাতে চাচ্ছো। ভালো কথা। অতি উত্তম সিদ্ধান্ত। কিনে ফেলো। — তারপরও তোর’ও তো একটা…. — মা, তোমাদের পছন্দ’ই আমার পছন্দ। — আলহামদুলিল্লাহ! — হুম। — আচ্ছা, ঘুমা তবে। চাকরি জীবন থেকে অবসর গ্রহন করেছে বাবা। চাকরির শেষ টাকা দিয়ে বাবা এই ফ্ল্যাট কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। আমরাও সানন্দে তাই বাবার সিদ্ধান্তকে সাদুবাদ জানালাম। চলবে….
অনন্ত বিষাদময় করি, ভালোবাসা গেছে আমায় ছাড়ি। তুমি চলে যাওয়ার পরই বুঝলাম- আমাদের অনেককিছু’ই বাকি রয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছে ভোরে ঘুম থেকে ওঠার আগে তোমার একটা চুমুর আবদার আমার কাছে। বাকি রয়ে গেছে বহু আয়োজন, বহু কাজ আর… আর তোমার মুখের ঐ মিষ্টি আবদার — লক্ষ্মী! বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে চলো না বৃষ্টিতে ভিঁজি আজ। বাকি রয়ে গেছে বিকেলে সমস্ত কাজ সেরে ক্লান্ত আমার ব্যলকনির হাতলওয়ালা বেতের চেয়ারে বসে চেম্বার থেকে তোমার ফেরার অপেক্ষায় থাকা গভীর ভালোবেসে। বাকি রয়ে গেছে নোটখাতা ভরে তোমার নামটি লিখা, তারপর প্রচন্ড এক অভিমানে নামগুলো কেটেকুটে ছিড়ে ফেলে দেয়া, বাকি রয়ে গেছে ‘ লক্ষ্মী ভালোবাসি তো’ বলতে বলতে কপালে তোমার দেয়া চুমুর উষ্ণ পরশ নেয়া। বাকি রয়ে গেছে ক্লান্ত বিকেলে একসাথে ঘুরতে যাওয়া, বাকি রয়ে গেছে রুপকথা’দের গল্প বলা, একসাথে পথচলা। হ্যাঁ, তুমি চলে যাওয়ার পর’ই বুঝলাম আমাদের অনেককিছুই বাকি রয়ে গেছে। বাকি রয়ে গেছে কাঁধে কাঁধ রেখে দুঃখ সুখের গল্প বলা। বাকি রয়ে গেছে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত একসাথে পথচলা।
আমাকে আপনার কেমন লেগেছে?
– মানুষকে যেমন লাগে আপনাকে ও ঠিক তেমনি লেগেছে
– নাহ মানে এই যে আমার আর আপনার বিয়ের কথা চলছে, লাইফ পার্টনার হিসেবে কেমন লেগেছে
ইতি এই প্রশ্নের উত্তর দেয়নি কি বা দিবে, বলবে যে আপনাকে আমার পছন্দ হয়নি এই তো, এই নিয়ে বারোজন পাত্র পক্ষ এসে দেখে গেলো ইতি কে
সব গুলোর কোন না কোন খুঁত বের করে বিয়ে ভেঙে দিয়েছে ইতি আজ তের নাম্বার পাত্রে সামনে দাঁড়িয়ে
এই তেরো নাম্বার পাত্রের নাম তন্ময়, সরকারের উচ্ছপদস্থ কর্ম কর্তা সে
ইতি কে চুপপ করে থাকতে দেখে তন্ময় বল্লো
– কি হলো চুপ করে আছেন যে
ইতি- আমার কিছু বলার নেই
তন্ময়- তা হলে কি বুঝে নিবো আপনি আমায় পছন্দ করেন নি
ইতি- আপনার যা ইচ্ছে বুঝতে পারেন আমার কিছু করার নেই
তন্ময় চলে যাচ্ছিলো কি ভেবে থেমে গিয়ে ইতিকে বল্লো
– আপনাকে আমার খুব পছন্দ হয়েছে
নাহ আপনি এতো সিরিয়েসলি নেবেন না, মেয়ে দেখতে আসলে পছন্দ হবেই তাই বলে সে পছন্দ বিয়ে অব্দি যায় না, আপনার ইচ্ছে না থাকলে বিয়ে হবে না
পাত্র পক্ষ চলে গেছে অনেক্ষন
আকাশ ঘোমরা হয়ে আছে যে কোন মুহুর্তেই কান্না শুরু করে দিতে পারে
ইতি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে চেয়ে আছে
কিছুক্ষন পর ইতির মা এসে ইতির পাশে দাড়ালো
মেয়ে কে তিনি বললেন
– কি রে মন খারাপ কেনো তোর
ইতি মায়ের দিকে না তাকিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– মা মনে হয় বৃষ্টি আসবে তাই না চারিদিকের পরিবেশ টা কেমন ঘুমোট বেধে আছে
ইতির আম্মু বল্লো আমি কিন্তু আমার প্রশ্নের উত্তর পাইনি
ইতি আকাশের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মায়ের দিকে তাকালো
মা বলো তো এতো তাড়া কেনো তোমাদের আমার বিয়ে নিয়ে সবে মাত্র কলেজে উঠলাম এখন বিয়ে না দিলে ই নয়
ইতির আম্মু মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বল্লো
– এখন বিয়ে হলে সমস্যা কি মা,তন্ময় ছেলেটা খুব ভালো, তোকে ওর খুব পছন্দ হয়েছে,এবার আর না করিস না মা বিয়েটা করে নে,আমরা তোর ভালো চাই
ইতি- মা তোমার সাথে কথা টা না বললেই ভালো হতো এই বলে ইতি রাগ দেখিয়ে চলে যায় ব্যালকেনি থেকে
রুমের সব দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে রুম টা কে অন্ধকার করে খাটের মাঝ খানে বসে আছে ইতি
ভাবছে ছোট বেলার কথা কি সুন্দর ছিলো জীবন টা তখন সারা দিন ক্লাস করে ফেরার পথে হৃদয়ের সাথে দুষ্টুমি করতে করতে বাড়ি ফেরা তার পর বাড়িতে এসে ও বিকেল হৃদয়ের সাথে খেলতে বের হওয়া, কি যে ভালো লাগতো, ঝগড়া বাধতো তখন যখন হৃদয় অন্য ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে যেত,
তখন ইতির খুব কষ্ট হতো, কান্না চলে আসতো কিন্তু ইতি চোখের পানি কাউকে দেখতে দিতো না,লজ্জা করতো ইতির কারো সামনে কাঁদতে গেলে
এই সময় ছোট নিহা দরজা ধাক্কা তে শুরু করলো
ইতি কল্পনা থেকে বাস্তবে ফিরে এলো
দরজা খুলে দিলো
ইতি- নিহু এতো জোরে দরজা ধাক্কালি কেনো
নিহু- আপি বাইরে খুব বৃষ্টি হচ্ছে চলো ভিজি
ইতি- আমার ভালো লাগছে না তুই যা
নিহু মুখ কালো করে চলে যায়
ইতি আবার ভাবনাতে ডুবে গেলো ইদানীং খুব বেশি হৃদয়ের কথা মনে পড়ে জানতে ইচ্ছে করে হৃদয় এখন দেখতে কেমন হয়েছে, ও কি আমার কথা মনে রেখেছে
ভাবনার মধ্যে ইতির সময় কেটে গেলো
পরদিন সকালে স্নেহার ফোন, স্নেহা ইতির বান্ধুবী ক্লাস সিক্স থেকে তাদের এই বন্ধুত্ব,এখন কলেজ অব্দি টিকিয়ে রেখেছে স্নেহা
স্নেহা ফোন করে বল্লো
– কিরে ইতি আজ তিন দিন কলেজে আসিস না, আজ ও কি আসবি না নাকি
ইতি-কলেজে যেতে ইচ্ছে করছে না
স্নেহা- আজ কলেজে না গেলে বিরাট কিছু মিস করবি
ইতি- কেনো কলেজে কি হয়েছে?
স্নেহা- আজ হৃদয়, সায়নি কে প্রপোজ করবে তা ও ক্যাম্পাসে সবার সামনে
ইতি- ঠিক আছে আমি আসছি
ইতি কল অফ করে দেয়
হৃদয় নাম টার প্রতিই তার একটা মায়া জমে গেছে হৃদয় নামের কেউ যদি কোন মেয়ে কে ভালোবাসে এটা শুনতে ও ইতির ভালো লাগে
তার উপর কলেজ সুন্দরী সায়নি কে প্রপোজ করবে তার থেকে বয়সে দু বছরের ছোট হৃদয় ব্যাপার টা সত্যি মিস করা যায় না
ইতি কলজের জন্য রেডি হয়ে বেরিয়ে পড়লো
কলেজে গিয়ে ইতি ক্যাম্পাসে বসে আছে পাশে স্নেহা, কখন শুরু হবে সায়নিদের প্রপোজ পর্ব কে জানে
স্নেহা অনেক্ষন চুপ করে থেকে ইতি কে বল্লো
– কিরে শুনলাম তোকে নাকি আবার ও কালকে পাত্র পক্ষ দেখে এসেছে
ইতি একটা নিশ্বাস ফেলে বল্লো এ আর নতুন কি
স্নেহা- হুম সেটাই,কিন্তু সব সময় শুনতাম ছেলেরা মেয়েদের রিজেক্ট করে আর তোর বেলায় পুরো ভিন্ন তুই সব ছেলে কে রিজেক্ট করিস তা ও ছেলেদের কোন ক্রুটি না থাকলে ও তুই ঠিক খুজে বের করে বিয়ে ভেংগে দিস, কিন্তু কেনো এমন করিস তুই আজ ও বললি না
ইতি- এমনি, এখন বিয়ে করার ইচ্ছে নেই তাই
স্নেহা- আন্টি আংকল আসলেই বোকা এতো ভালো প্রপোজাল গুলো আসে তবু ও তারা তোর ইচ্ছের বিরুদ্ধে না গিয়ে বিয়ে ভেংগে দেয়,আর আমার বাবা মা হলে আমাকে জিজ্ঞাস ও করতো না নিজেরাই বিয়ে দিয়ে দিতো
ইতি- হয়তো আমার মা বাবা বেশি ভালো
স্নেহা- হয় তো,কিন্তু তুই আমার কাছে সত্যি কথা বলছিস না
ইতি- তোকে আমি মিথ্যা বলবো কেনো
স্নেহা- মিথ্যা ই তো বলছিস, তোকে কখনো ক্লাসের ছেলেদের সাথে কথা বলতে দেখিনি, কোন প্রপোজাল একসেপ্ট করিসনি তুই, সব সময় ছেলেদের এড়িয়ে গেছিস, কিন্তু কেনো এই সব জানতে ইচ্ছে করে প্লিজ বলনা
ইতি – যে কথা আমি জীবনে ও কাউকে বলিনি আজ তোকে সে কথা বলবো কিন্তু তুই হাসতে পারবি না আমার কথা শুনে
স্নেহা- আরেহ আগে তো বল তার পর না হয় ঠিক করবো
ইতি বলতে শুরু করলো
আমি তখন ক্লাস ফোর থেকে ফাইভে উঠবো হঠ্যাৎ ই বাবা কে টান্সফার করে ফেনি নেয়া হয়,বুঝিস ই তো সরকারি চাকরি করলে যা হয় আর কি
নতুন স্কুল নতুন সব কাউকে ই চিনতাম না
ক্লাসের প্রথম দিন ই আমি একে বারে পিছনে গিয়ে বসি, টিপিনের সময় সবাই যখন খেলতে গেলো তখন আমি একা একা বসে আছি
এমন সময় একটা ছেলে আমাকে বল্লো,এই মনি খেলবি আমার সাথে
আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললাম
আমার নাম মনি নয় ‘ইতি’
ছেলেটি বল্লো ঠিক আছে আমার নাম হৃদয়, চল আমরা খেলবো
তখন আমি সহ হৃদয় আর তিন চার টা মেয়ে মিলে ‘বউ সি’ খেলি
তার পর ছুটির পর হৃদয় আমাকে ডেকে বল্লো এই মনি তোর বাসা কোথায় রে
আমি আমার বাসার এড্রেস দিলাম
হৃদয়- আরেহ সেখানে তো আমার ও বাসা, তোকে তো আগে দেখিনি
ইতি- আমরা এই কয়েকদিন আগেই এসেছি
হৃদয়- তা হলে চল দুজনে মিলে বাসায় যাই
ইতি- নাহহ আমার আম্মু আমাকে নিতে আসবে
হৃদয়- দুজনের বাসা তো এক ই জায়গাতে চল আমরা যাই, হৃদয়ের সাথে কথা বলতে বলতে চলে এলাম বাসায়
আম্মু বল্লো কিরে একা একা কি করে এলি
আমি বললাম আম্মু উপরের প্লাটে থাকে না হৃদয় সে আর আমি এক ই ক্লাসে পড়ি তার সাথে এলাম
এভাবেই হৃদয়ের হয়ে উঠে আমার খেলার সাথি একি সাথে অন্যতম একজন বন্ধু ক্লাসে ও হৃদয়ের সাথে বসতাম, অন্য মেয়েরা আমাকে খেফাতো বলতো ইতি হৃদয় জামাই বৌ,
শুনে আমি খুব কান্না করতাম আর হৃদয় লজ্জা পেতো ও আমার সাথে বসতে চাইতো না
বাসায় ও আমার এক সাথে ই খেলতাম হৃদয় পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলতে গেলে আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম মাঝে মাঝে প্লেয়ার কম হলে আমি বলতাম হৃদয় আমি ও খেলবো নে না
আমাকে সাথে,
একদিন তো প্রথম বলে আমি ছক্কা মারি, তার পর সে ম্যাচে হৃদয় কে হারিয়ে দিই হৃদয় সেদিন কি রাগ না ই করেছে
হৃদয় আমাকে কেনো জানি মনি নামেই বেশি ডাকতো কিন্তু আমি মনি নাম টা পছন্দ করতাম না
একদিন হৃদয় বল্লো তোকে মনি বললে তুই রেগে যাস কেনো
আমি বললাম
-মনি তো কালো মেয়েদের নাম হয়,আর আমি তো সুন্দর
হৃদয় অনেক হাসে
আর আমার খুব রাগ লাগছিলো তখন।
হৃদয় বল্লো কে বল্লো তুই সুন্দর আমি তো দেখি তুই ফেত্নি” মনি ফেত্নি”
সেদিন আর হৃদয়ের সাথে খেলতে বের হইনি
ইতি – একদিন আমরা ঠিক করলাম পাশের বাসার সানিয়াদের পেয়ারা চুরি করবো কিন্তু কি করে পেয়ারা পাড়বো জানিই না হৃদয় তো গাছে উঠতে পারে না
আমি ও পারি না
হৃদয় বল্লো
– ইতি তুই গাছে উঠ আমি তোকে পিছন থেকে ঠেলে ধরবো
হলো ও তাই, তবুও পেয়ারা পাড়তে পারিনি বরং পড়ে হাতে ব্যাথা পেয়েছি
ফাইভের বছরের পরেই বাবা আবার এখানে চলে আসে তার পর তুই আমার বন্ধু এই তো
স্নেহা- সেকি মজনুর সাথে আর কখনো কথা হয়নি
ইতি- স্নেহায়ায়ায়া
স্নেহা- ওকে ফাইন আর মজা করবো না এই জন্য ই তো বলি ফেজবুকে তোর ফ্রেন্ডলিস্টে হৃদয় নামের এতো ছেলে কেনো
ইতি- হুম বলতে পারিস হৃদয় নামটা ই এখন আমার অনেক প্রিয়ো,হৃদয় নামের সব ছেলের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আমি একসেপ্ট করি আর তাদের ব্যাক গ্রাউন্ড চেক করি, কিন্তু কাউকে আমার হারানো হৃদয়ের মতো লাগে না
স্নেহা- আচ্ছা একটা কথা বল,তুই যখন কার কথা বলছিস তখন তুই ভালোবাসার ‘ভ’ টা ও বুঝতি না তা হলে এখন ও তাকে ভুলতে পারিসনি কেনো
ইতি- জানি না কেনো ভুলতে পারিনি যতো ই বড় হতে লাগলাম ততই হৃদয় কে এক নজর দেখার লোভ হতে শুরু করে, আজ ও মনটা হা হাকার করে হৃদয় কে একটু দেখতে,শুধু দেখবো বড় হওয়ার পর এখন ও দেখতে কেমন হয়েছে,ও কি অনেক মেয়ের সাথে প্রেম করে নাকি, আমার মতো একা থাকে
স্নেহা- হৃদয় তোর মতো পাগল হয়তো নয় বুঝলি,ছোট বেলার কথা কেউ মনে রাখে নাকি
ইতি- আচ্ছা চল বাসায় যাই
স্নেহা- হুম চল,আচ্ছা মনি নামের মেয়েরা কালো তোর এই ধারনা কি এখন ও আছে
ইতি- তুই কি পাগল,তখন আমাদের কাজের মেয়েটার নাম মনি ছিলো আর সে ছিলো কুচকুচে কালো,তাই আমি ভাবতাম বুঝি মনি নামের মেয়েরা ই কালো,এখন আর সে ধারনা নেই
ইতি বাসায় চলে আসলো বাসায় এসেই শুনে
এবার বাবা অতিস্ট হয়েগেছে আমার উপরে আর তাই তিনি নিজেই তন্ময়ের সাথে বিয়ের কথা ফাইনাল করে
ইতি কথা শুনেই অনেক রেগে যায় তার পর কাদতে কাঁদতে স্নেহাকে ফোন করে সব বলে
স্নেহা বল্লো- ইতি পাগলামি ছাড়,তন্ময় কে বিয়ে করে নে,দেখবি হৃদয়ের কথা আর মনে হবে না,আর দেখ তুই তাকে মনে রেখেছিস সে তোকে মনে না ও রাখতে পারে,ঐ বয়সের কথা অনেক ই বড় হলে আর মনে রাখে না
ইতি- তুই ও বলছিস
স্নেহা- হুম বলছি কারন আমরা সবাই তোর ভালো চাই,এবার স্মৃতির পাতা বন্ধ কর বাস্তবতার পাতা উলটা দেখবি সব ঠিক আছে
ইতি কল অফ করে দেয় স্নেহার কথা গুলো শুনতে ভালো না লাগলে ও কথা গুলো যুক্তিযুক্ত, ইতি মেনে নেয় তার ভাগ্যকে তৈরী হয় তন্ময়ের বউ হওয়ার জন্য
কিন্তু সত্যি কি ইতি স্মৃতির পাতা বন্ধ করতে ফেরেছে
হয়তো পারেনি,কোন এক ক্লান্ত দুপুরে হয়তো স্মৃতির পাতায় খুজবে তার প্রিয়ো নাম টা, হৃদয়ে হৃদয়
তখন আদনান আর নিহার ড্রইং রুমে বসে গল্প করছিলো
গাইথির চিৎকার শুনে দুজনেই দৌড়ে আসে,
চুহেস কে ফ্লোরে পড়ে থাকতে দেখে
দুজনেই ভয় পেয়ে যায়
নিহার আর আদনান চুহেস কে ধরে বেডে নিয়ে শোয়ায়
নিহার গাইথি কে উদ্দেশ্য করে বলে ম্যাডাম স্যার সেন্সলেস হলো কি করে
গাইথি তখন কাঁদছিল, কান্নার জন্য কথা ই বলতে পারছে না
আদনান নিহার কে বল্লো
– চুহেস কে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে তুমি ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলো
নিহার হুম বলছি, কিন্তু স্যারের জ্ঞান ফিরছে না কেনো
নিহার গাড়ি রেডি করে ফিরে আসে
আদনান আর নিহার চুহেস কে ধরে গাড়িতে উঠায়
গাইথি চুহেসের মাথার পাশে বসে অঝরধারায় কাঁদছে সে
হোসপিটালে ইমারজেন্সিতে চুহেস কে রাখা হয়
খবর পেয়ে ঐশী নিধিপা চলে আসে হোসপিটালে
ঐশী- কিন্ত হঠ্যাৎ কি হলো চুহেসের
নিহার- রিপোর্ট দেখার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না ভাবি
এই সময় ডাক্তার এসে বল্লো
-চুহেস মেহেরার বাড়ি লোক কে আছে,তারা আমার সাথে আসুন
গাইথি উঠে দাড়িয়েছে যাওয়ার জন্য
নিহার আর আদনান গাইথি কে থামিয়ে দিয়ে বল্লো,আমরা যাচ্ছি
আদনান ঐশী কে বল্লো তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখো,
নিহার আর আদনান ডাক্তারের ক্যাবিনে যায়,
ডাক্তার ওদের কে দেখে বসতে বলে
নিহার না বসেই অনেক টা ব্যাস্ত কন্ঠে বল্লো
– স্যারের কি হয়েছে বলুন
ডাক্তার – বসুন, বলছি
নিহার বসার পর ডাক্তার বল্লো
– রোগীর কি আর কখনো এমন হয়েছে
নিহার- নাহ আমি সব সময় স্যারের সাথে থাকতাম আমি কখনো স্যারের এমন কিছু দেখিনি
ডাক্তার- কিন্তু মিঃ মেহেরার দুটো কিডনিই ড্যামেজ হয়ে গেছে,
ডাক্তারের কথা শুনে আদনান আর নিহার এক ই সাথে বলে উঠলো
– কি বলছেন আপনি, মানে এটা কি করে সম্ভব
ডাক্তার- দেখুন রিপোর্ট এ যা আছে তাই বল্লাম
আদনান- এখন কি করা যায় বলুন ডাক্তার
ডাক্তার- দেখুন আল্লাহ কে ডাকুন, উনার জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত কিছু বলা যাচ্ছে না
নিহার- ডক্টর যতো টাকা লাগে দিবো স্যার কে সুস্থ করে দিন
ডাক্তার- দেখুন একটা কিডনি দিয়ে ও মানুষ বাছে,কথা হচ্ছে উনার জ্ঞান না ফিরলে কিছু বলা যাচ্ছে না যেহেতু উনার দুটি কিডনি খারাপ হয়ে গেছে
সো আল্লাহ কে ডাকুন
ডাক্তারের ক্যাবিন থেকে নিহার আর আদনান বের হলেই গাইথি আদনান কে ঝড়িয়ে ধরে বলে
– ভাইয়া কি হয়েছে ওর সত্যি করে বলো
আদনান নিজেকে সামলে নিয়ে বল্লো
– তুই এতো ভয় পাচ্ছিস কেনো গাইথি চুহেসের জ্ঞান ফিরলেই বলা যাবে, এতো ভয় পাওয়ার কিছু হয়নি, চল আমরা বসি
কেনো জানি গাইথি আদনানের কথা বিশ্বাস করতে পারছে না,বার বার মনে হয় ভাই কিছু লুকাচ্ছে
কেটে গেলো কয়েক ঘন্টা চুহেসের এখনো জ্ঞান ফেরেনি
গাইথির হতাশা আর আতংক আর ও বেড়ে গেলো
এমন সময় নার্স এসে বল্লো
মিঃ মেহেরার সেন্স ফিরেছে, উনি নিহার কে ডাকছে
নার্সের কথা শুনে গাইথি অবাক হলো চুহেস আমাকে না ডেকে নিহার কে ডাকলো কেনো
নিহার চুহেসের কাছে যায়
– স্যার ডেকেছিলেন
চুহেস নিহারের দিকে তাকিয়ে বল্লো একটা কথা বলার ছিলো তোকে
নিহার- বলুন স্যার
চুহেস নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে নাম টা উচ্ছারন করলো
– সাইমুম কে একটু ডেকে আনো,বলবে যে একজন মৃত্যু পত যাত্রি ভাই তাকে ডাকছে
নিহার- স্যার আপনি কি বলছেন আপনি ভালো হয়ে যাবেন
চুহেস হালকা হেসে বল্লো যাও দেরি করো না
আর সবাইকে আসতে বলো
নিহার বেরিয়ে যায় গাইথির দিকে তাকিয়ে বল্লো
– ভাবি সবাইকে ডাকছে স্যার
আদনান ঐশী, আহমদ মেহেরা সবাই চুহেসের ক্যাবিনে যায়
চুহেস চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো
গাইথি চুহেস কে বল্লো
– আপনি একদম কথা বলবেন না,ডাক্তার রা অপারেশনের ব্যাবস্থা করছে আপনি ভালো হয়ে যাবেন
চুহেস ম্লান হেসে গাইথির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আহমদ মেহেরার দিকে তাকালো বল্লো
– বাবা আপনার উপর আমার কোন অভিমান নেই ভুল বুঝবেন না আমাকে,
আমার বাবুই পাখি টার অভিযোগ ছিলো আমি কেনো আপনাকে বাবা বলে ডাকি না, এই শেষ বারের মতো ডাকলাম
বাবুই আর কোন অভিযোগ আছে তোমার
আহমদ মেহেরা কিছু বলার আগে গাইথি ডুকরে কেদে উঠলো
– আপনি এমন কথা বলছেন কেনো প্লিজ আপনি এসব কথা বলবেন না
চুহেস গাইথির কথার কোন উত্তর করলো
আদনানের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– ভাইয়া জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে তোমাদের এতো কাছে পেয়েছি যে খুব কষ্ট হচ্ছে স্রষ্টার ডাকে সাড়া দিতে তোমাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে ই করছে না
ঐশী ভেজা গলায় বল্লো
– চুহেস চুপ করো তুমি, তুমি ভালো হয়ে যাবে,তুমি না থাকলে তোমার বাবুই কে, কে দেখবে
চুহেস দরজার দিকে তাকিয়ে আছে কিছুক্ষন পর নিহার সাইমুম কে নিয়ে চুহেসের ক্যাবেনি আসলো
সাইমুম কে দেখে গাইথি রেগে যায়
– উনি এখানে কেনো? একে কে ডেকেছে
চুহেস হালকা স্বরে বল্লো
– আমি ডেকেছি বাবুইপাখি টা
গাইথি- তুমি? তুমি কেনো ডেকেছো ওকে
গাইথি এই প্রথমবার চুহেস কে তুমি বল্লো, চুহেস কিছুক্ষন অপলক চাহনিতে গাইথির দিকে তাকিয়ে থাকলো
তারপর সাইমুম কে বল্লো
– ভাই মনে আছে তোমার গাইথি কে যখন নিহার বিয়ের আসর থেকে নিয়ে আসে তখন আমি তোমায় একটা চিরকুট লিখে দিলাম,”গাইথি তোমার,সে তোমার আছে,তোমারি থাকবে” আজ ও বলছি গাইথি তোমার,মাঝখানের এই দিন গুলো কে দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যেয়েও
সাইমুম- ভাইয়া আমি ছেয়েছিলাম গাইথি আমার হোক,এখন ও চাই,কিন্তু আপনার এই অবস্থা হোক তা আমি কখনো চাইনি,আপনি ভালো
হয়ে যাবেন ভাইয়া
চুহেস ম্লান হাসলো বল্লো
– আমি ভালো হয়ে গেলে গাইথি তোমার হবে না
সাইমুম- না হোক তাতে কি,ভালোবাসলেই যে তাকে নিজের করে পেতে হবে এমন কোন কথা নেই,কথা টা আমি আগে না বুঝলে ও এখন বুঝি
চুহেস- রাইট, ভালোবাসলেই যে নিজের করে পায় না এটা সত্যি,
এই বলে চুহেস গাইথির দিকে তাকায়
– বাবুই ভালোবেসেছি তোমায় সে ছোট্ট বেলা থেকে, কিন্তু তার প্রকাশ হয়েছে অবেলায়,তাই বেলা থাকতে তোমায় পাইনি,তবে এই নিয়ে আমার কোন দুঃখ নেই কারন জীবনের অন্তিম লগ্নে এসে তোমার এতো ভালোবাসা পেয়েছি যে, সব না পাওয়ার বেদনা দূর হয়ে গেছে
গাইথি স্টাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মনে হচ্ছে চুহেসের কথা গুলো তার কান অব্দি পৌছায় নি
চুহেস কিছুক্ষন চুপ করলো হয়তো কিছু একটা গোপন করার চেষ্টা করলো তার পর নিহার কে বল্লো
– ভাই তুই আমার ছোট হয়ে ও বড় ভাইয়ের মতো আমাকে আগলে রেখেছিস তোর জন্য আমি কিছুই করিনি,আমার বিজনেস এর ফিফটি পার্সেন্ট সেয়ার তোর নামে আছে,কাজ টা আমি অনেক আগেই করেছি কিন্তু তোকে বলা হয়নি,তোর আর নিধিপার জন্য আমার শুভ কামনা রইলো,
তার পর আদনান কে বল্লো
– ভাইয়া আমার অনেক প্রোপার্টি আছে সেগুলা এই মুহুর্ত থেকে আমার কাজে আসবে না,,, সেগুলা কে এমন ব্যাবস্থা করবেন যেন মৃত্যুরর পর আমার কাজে আসে
উপস্থিত সবার চোখে পানি
কারো মুখে কোন কথা
চুহেস আবা বল্লো
– এখন সবাই যেতে পারো আমার কথা শেষ
গাইথি চুহেসের হাত ধরে বসে পড়লো পাশে,
– আমি যাবো না তোমায় ছেড়ে,
এই বলে নিহারের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– ভাইয়া আপনি গিয়ে খোজ নিন অপারেশনের সব কিছু রেডি হয়েছে কি না
নিহার বেরিয়ে গেলো গাইথির কথা মতো
বাকিরা ও বেরিয়ে গেলো
শুধু সাইমুম আর গাইথি থেকে গেলো
চুহেস কথা বলতে গেলে গাইথি বাধা দিয়ে বল্লো আর কোন কথা নয় বেশি কথা বলে ফেলেছেন এবার চুপ করুন
চুহেস- এই তো একেবারে ই চুপ হয়ে যাবো আর কখনো কথা বলতে আসবো না, যাবার আগে দু একটা কথা বলে যেতে চাই
– বাবুই, ফ্রান্সে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি রাবেয়া খালা আমায় সেখানে ডাক্তার দেখায়, সেখান কার ডাক্তার রা বলেছে আমার দুটো কিডনি ড্যামেজ হয়ে গেছে,অবশ্য যদি নতুন করে একটা কিডনি দেয়া যায় তা হলে বাচার সম্ভবনা আছে
কিন্তু আমি নিষেধ করি,একদিন স্বপ্নে দেখলাম বাবা মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে তাই আমি তাদের অপেক্ষার অবসান করাতে চাই
গাইথি- তুমি আমাকে আগে বলোনি কেনো
চুহেস- পাগলি আগে বলি আর তুমি কাঁদতে কাঁদতে আমাকে পাগল করে দাও এটা আমি চাইনি
সাইমুমের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– সাইমুম আমার বাবুইপাখিটাকে কখনো ই কষ্ট দিবে না,আজ সে কাদবে আমার বিয়োগ তাকে কাদাবে কিন্তু এর পর থেকে আর তাকে কাঁদতে দিও না,বাবুইপাখির চোখে যে কান্না মানায় না
সাইমুম- ভাইয়া আপনি ভালো হয়ে যাবেন আপনার বাবুই পাখিকে আপনার ছেয়ে বেশি ভালো আর কেউ বাসতে পারবে না
চুহেস- অবুঝ হয়ওনা সাইমুম, বাবুই কে বুঝিয়ে রেখো
তার পর গাইথির দিকে তাকিয়ে বল্লো
– বাবুই তোমার প্রিয়ো নেইজিনের নীড় তোমারি থাকবে,
গাইথি- আমার এই সব কিছু চাইনা, এমন সময় ক্যাবেনি কয়েক জন নার্স ডুকলো ট্রলি ঠেলে
গাইথি চুহেস কে বল্লো
– তুমি ভালো হয়ে যাবে, অপারেশন টা হয়ে যাক তার পর দেখবে
চুহেস কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে গেলো
সাইমুম এসে গাইথির পাশে দাঁড়ায়
গাইথি- চুহেস অসুস্থ সে,সজ্ঞানে কথা গুলো বলেনি বুঝলেন
সাইমুম কিছু বলেনি
চার ঘন্টা পর ডক্টর বের হয় অপারেশ থিয়েটার থেকে
গাইথি ডাক্তার বের হতে দেখে দৌড়ে গিয়ে ডাক্তার কে জিজ্ঞাস করে চুহেস কেমন আছে
ডাক্তার মলিন মুখে গাইথির দিকে তাকিয়ে বলল স্যরি অপারেশন সাকসেস হয়নি,আমরা অনেক চেষ্টা করেছি
গাইথির গলাতে কথা আটকে আসছে তবুও অনেক কষ্টে বল্লো
– সাকসেস হয়নি মানে চুহেস কোথায় ডক্টর
কিছুক্ষন পর নার্সরা স্টেচারে করে চুহেস কে নিয়ে আসে গাইথি সে দিকে তাকিয়ে দেখে চুহেস ঘুমিয়ে আছে
সবাই কান্নায় ভেঙে পড়ে
চুহেসের দাফন হয় নেইজিনের নীড়ে গাইথির ইচ্ছেতেই হয়,
গাইথি রোজ এসে নেইজেনের নীড়ে সময় কাটায়, দিনের অর্ধেক সময় গাইথি এখানেই থাকে কারো সাথে কথা বলে না নিজের মতো চুপ থাকে আর নিজে নিজে কথা বলে,
গাইথির এই অবস্থা দেখে আদনান সহ সবাই সিদ্ধান্ত নেয় সাইমুমের সাথে গাইথির বিয়ে দিয়ে দিবে এতে যদি গাইথি একটু সহজ হতে পারে
তাড়া হুড়া করেই সাইমুমের সাথে গাইথির বিয়ে সম্পূর্ন হলো
আজ তাদের বাসর রাত
গাইথি চুহেসের ছবি হাতে বসে আছে আর চুহেস কে বলছে
– কোথায় তুমি, তোমার ইচ্ছে মতো আমি বউ সেজে বসে আছি, তুমি না বলেছিলে নেইজিনের নীড়ে আমাদের বাসর হবে, আমি তো সেখানেই বসে আছি কিন্তু তুমি আসছো না কেনো
কিছুক্ষন পর সাইমুম রুমে প্রবেশ করে গাইথিকে চুহেসের ছবির সাথে কথা বলতে দেখে নিঃশব্দে গাইথির পাশে গিয়ে বসে
নিচু স্বরে গাইথি কে ডাকে
– বাবুই
ডাকটা শুনে চমকে উঠে তাকিয়ে দেখে সাইমুম পাশে বসে আছে
গাইথি- একি আপনি,আপনি এখানে কেনো
সাইমুম- বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে চলো ব্যালকনিতে বসি
গাইথি- আপনি যান আমি যাবো না আপনার সাথে
সাইমুম গাইথি কে পাঁজাকোলা করে নিয়ে যায়
বাইরে অঝরধারায় বৃষ্টি হচ্ছে বাতাসের কারনে বৃষ্টির চাট এসে ওদের ভিজিয়ে দিচ্ছে
সাইমুম- গান শুনবে বাবুই
গাইথি- আপনি আমায় এই নাম ধরে ডাকবেন না
সাইমুম- আমি তো ডাকবো ই,তুমি দেখো চুহেস ঐখানে শুয়ে শুয়ে আমাদের দেখছে, আর তোমাকে বাবুই বলে ডাকাতে সে খুশি হয়েছে
গাইথি- মোটেই না,ও কখনো চাইতো না এই নাম টা বলে আমায় অন্য কেউ ডাকুক
সাইমুম-বাবুই চুহেস আমাদের মাঝে বেছে থাকবে তাই আমি চাইনা ওর সাথে ওর দেয়া নাম টা হারিয়ে যাক
গাইথির আর কিছু বল্লো না সাইমুম আর ও ক্লোজ হয়ে দাড়ালো গাইথির পাশে
গাইথি- আপনি গান গাইতে চেয়েছেন না, গাইতে থাকুন
সাইমুম গাইথির দিকে এক পলক তাকিয়ে গান ধরলো
“যদি মন কাদে তুমি চলে এসো,চলে এসো
এক ভরসায়
এসো ঝরো ঝরো বৃষ্টিতে
জ্বলোভরা দৃষ্টি তে
এসো কমলো শ্যামলো ছায়া
চলে এসো তুমি চলে এসো
এক ভরসায়
যদি মন কাদে তুমি চলে এসো এক ভরসায়
যদি ও তখন আকাশ থাকবে বৈরী
কদম ও গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরী
তুমি চলে এসো চলে এসো
এক ভরসায়
যদি মন কাদে তুমি চলে এসো
এক ভরসায়
নামিবে আধার বেলা পুরাবার ফলে
মেঘ মুল্য বৃষ্টির ও মনে মনে ”
সাইমুমের গান শেষ হতেই
গাইথি কান্না আর ও বেড়ে গেলো
সাইমুম গাইথি কে বুকে ঝড়িয়ে নিলো
গাইথি কাঁদুক সাইমুম বাধা দিলো না,আজকের পরে আর কাঁদতে দিবো না আমি আমার বাবুই কে,
সাইমুম আর শক্ত করে গাইথিকে ঝড়িয়ে ধরলো
গাইথির কান্নার আওয়াজ কমে আসছে
হয়তো গাইথি ভরসা পাওয়ার স্থান টা খুজে পেয়েছে তাই
গাইথি মাথার ঘোমটা টা আরেকটু টেনে দেয় যেন নিহার তার চোখের পানি না দেখতে পায়
নিহার- ম্যাডাম কোন বাসায় যাবেন আপনি
গাইথি- বনশ্রী তে চলুন
নিহার- কিন্তু ভাই, ভাবি, আংকেল, রা তো ঐ বাসায়
গাইথি- এতোক্ষনে এসে পড়ার কথা আপনি যান
গাইথি বাসায় এসে ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে বিতরে ডুকে আদনান রা এখন ও আসেনি
গাইথি ঐশী কে ফোন করে
– ভাবি তোমরা আসছোনা কেনো এখনো
ঐশী- তুই কোথায়
গাইথি- আমাদের বাসায়
ঐশী- ওহ আমরা তো তোর জন্য ই অপেক্ষা করছিলাম, আচ্ছা তুই থাক আমরা আসতেছি
গাইথি কল অফ করে দেয়
কিছু ই ভালো লাগছে না গাইথি মনকে শান্ত করার জন্য একটা গল্পের বই নিয়ে বসে
এমন সময় গাইথির মোবাইলে কল আসে
মোবাইলে স্কিনে তাকিয়ে দেখে সাইমুমের নাম্বার
গাইথির বুকের বিতর কেমন যেন করে উঠলো, ভয় কাজ করছে গাইথির মাঝে কল রিসিভ করবে কি করবে না এই নিয়ে টেনশনে পড়ে গেলো
কল কেটে যায় আবার কল আসে
দুবার রিং হয়ে যাওয়ার পর গাইথি কল রিসিভ করে
গাইথি হ্যালো বলার আগেই ওপাড় থেকে ব্যাস্ত কন্ঠে সাইমুম বলে
– কি করছিলে এতোক্ষনে কল রিসিভ করছিলে না কেনো, আমি কতো ভয় পেয়েছিলাম জানো, কেমন আছো তুমি, এক নাগাড়ে কথা গুলো বলে সাইমুম থামলো
গাইথি- ভালো আছি,,অনেক টা বিরক্ত কন্ঠে বলে
সাইমুম- কি করছিলে তুমি
গাইথি সাইমুমের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করে সাইমুম কে
– আপনি ভয় পেয়ে ছিলেন কেনো
সাইমুম- ভেবেছি তুমি আমার কল রিসিভ করবে না, এই জন্য
গাইথি- কল রিসিভ না করাটা ই স্বাভাবিক নয়,
(শান্ত আর কঠোর কন্ঠে গাইথি কথা টা বলে)
সাইমুম- ওহ তাই তো আসলে ই কল রিসিভ করার কথা না,তবু ও রিসিভ করেছো তার জন্য তোমাকে অন্তর থেকে ভালোবাসা জানাই,
যদিও আমার ভালোবাসা না বাসা দিয়ে তোমার কিছু যায় আসে না,
তো যাই হোক শুনলাম নতুন করে বিয়ের পিড়িতে বসছো, কথা টা কি সত্যি
গাইথি গম্ভীর কন্ঠে বলে
– হ্যা সত্যি,আপনি যে ভাবে বলছেন নতুন করে বিয়ের পিড়িতে বসছি,মনে হয় এর আগে আমি হাজার বার বিয়ে করেছি
সাইমুম – বিয়ের পিড়িতে না বসো,কারো সাথে বিয়ের আসরে বসার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে,
গাইথি- ভুল বলছেন আমক কাউকে নিজের মুখে এই প্রতিশ্রুতি দিই নি
সাইমুম- হুম নিজের মুখে দাওনি বলে ই বিয়েটা ভাংগতে ফেরেছো কংগ্রাচুলেশনস, নতুন মানুষ টা কে নিশ্চয়ই এই পতিশ্রুতি নিজে দিয়েছো
গাইথি- এটা আমার পার্সোনাল ম্যাটার, আমি এই নিয়ে আপনার সাথে কথা বলতে চাই না
সাইমুম- চমৎকার কথা বলতে শিখেছো,আগে এমন কথা বলতে জানতে না,নিশ্চয়ই এই ক্রেডিট টা ও নতুন মানুষ টার
গাইথি- প্লিজ আপনি ফোন রাখুন নইলে আমি লাইন কেটে দিবো
সাইমুম- বিরক্ত হচ্ছো? আচ্ছা আর বেশি বলবো না মাত্র কয়েকটা কথা বলেই লাইন কেটে দিবো,,শ্রুতি ভাবির সাথে কথা হলো উনি বল্লো তোমার সে কাজিন চুহেসের সাথে ই নাকি এখন তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে
গাইথি- হুম আপু ঠিক বলেছে
সাইমুম- তুমি নিশ্চই ওর মাঝে এখন মুগ্ধতা খুঁজে পাও যা তুমি আমার মাঝে পাওনি
গাইথি……
সাইমুম- কিন্তু ঐ লোকটার সাথে তোমার বয়সের ফাক অনেক, সেটা ভেবে দেখেছো তো,
গাইথি- আপনি চুহেস কে নিয়ে কথা না বললে আমি খুশি হবো
সাইমুম- দেখো না একটা সময় আসবে তুমি বাচ্ছা ই থেকে যাবে আর তোমার বরের চুল পেকে যাবে দাত পড়ে যাবে হা হা হা হা কেমন লাগবে তোমাদের ঝুটিটা কে দেখতে আমি সেটা ই ভাবছি,একটা বার ভাবো তোমার লাইফ টা একদম নষ্ট হয়ে যাবে চুহেস কে বিয়ে করলে
গাইথি- ধন্যবাদ আমার জন্য এতো টা ভেবেছেন তাই”নিজের খেয়ে বনের মহিষ তাড়ানো আপনা সবাব”বুঝতে ফেরেছি আমি কিন্তু স্যরি আমি এখন কল অফ করে দিবো আপনার একটা কথা শুনার ধৈর্য্য। আর আমার নেই
এই বলে গাইথি কল অফ করে দেয়
গাইথি মোবাইল হাত থেকে রাখার পর ই আবার কল আসে
এবার চুহেস কল দিয়েছে
গাইথি- কোথায় আপনি পৌছে গেছেন সেখানে, মিঃ চিকি কি আপনাকে এয়ারপোর্ট এ রিসিভ করতে এসেছে
চুহেস- বাবাহ গাইথি তুমি এক সাথে এক নিশ্বাস এ এতো কথা বলতে পারো, ভালো ই লাগলো শুনতে,হুম আমি পৌছেছি, এখন একটু রেষ্ট নিচ্ছি,
গাইথি- ওহ আন্টি কেমন আছে
চুহেস- আছে তেমন ভালো নেই তোমার কথা বলেছি আন্টি কে, শুনে খুব খুশি হয়েছে তোমাকে দেখতে ছেয়েছে, বলেছি আপনি সুস্থ হোন তার পর আপনাকে নিয়ে সোজা দেশে চলে যাবো আপনার বউমার কাছে
চুহেসের কথা শুনে গাইথি লজ্জা পেয়ে যায়
কোন কথা ই বলতে পারেনি
চুহেস- কি হলো তুমি চুপ করে আছো কেনো
গাইথি- ফিরছেন কখন?
চুহেস- কেনো খুব মিস করছো বুঝি
গাইথি- দূর আপনি কি যে বলেন, এমনি আসতে বলতে পারি না নাকি
চুহেস- পারো তবে আমি আজ ই এসেছি আর আজ ই তুমি আসতে বলতে পারো না
গাইথি মন খারাপ করে বল্লো
– ওহ তাই তো
চুহেস হেসে বল্লো
– সুইট হার্ট মন খারাপ করো না এখানে একটু কাজ আছে কাজ টা সেরে খুব শিগ্রই আসছি তোমার কাছে
গাইথি- ঠিক আছে আসুন, এখন রাখছি বাই
গাইথি কল অফ করে দিয়ে মোবাইল সুইচস্টপ করে দেয় যদি আবার সাইমুম কল করে বসে এই ভয়ে
এভাবে আতঙ্ক আর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে কেটে গেলো অনেক দিন, দুপুরে চুহেস কল দিয়ে জানায় সে আগামি কাল আসছে
অনেক দিন পর গাইথির নিজেকে হালকা লাগছে
আর নিশ্চিন্তে ঘুমাতে যায়
এমন সময় গাইথির মোবাইল বেজে উঠলো
স্কিনে নামটা দেখে নিলো গাইথি আমেরিকা থেকে শ্রুতি ফোন করেছে
গাইথি ফোন রিসিভ করে সালাম দিলো শ্রুতি কে
ওপার থেকে শ্রুতি সালামের উত্তর নিয়ে বল্লো
– কেমন আছিস,অবশ্য এখন তো ভালো থাকার ই কথা তোর
গাইথি- খোঁচা মেরে কথা বলছো কেনো আফা
শ্রুতি – খোঁচা মারবো কেনো তোকে, অবশ্য এখন তোকে আমার খোঁচা মেরে কথা বলা ও সাজে না,বিরাট বড় লোকের বউ হতে যাচ্ছিস
গাইথি- আফা তুমি কেনো আমার সাথে এমন করে কথা বলছো,শুধু সাইমুমের জন্য ই তো,এই রকম অনেক হয় আফা কতো মানুষের তো বিয়ের আসর থেকে ও বিয়ে ভেঙে যায়
শ্রুতি কর্কশ কন্ঠে বলে
– সেই রকম এক্সিডেন্ট হলে আমি মেনে নিতাম গাইথি, কিন্তু যেটা তুই ইচ্ছে করে করেছিস সেটা আমি কি করে মেনে নিই,সাইমুম তোর জন্য কতো টা কষ্ট পাচ্ছে তুই জানিস
গাইথি- আফা সাইমুম কষ্ট টা তুমি বুঝো, একটা বার তুমি চুহেসের কষ্ট টা বুঝতে চাইলে না,আল্লাহ কাকা, কাকি কে নিয়ে গেছে আমরা তার আপন হয়ে তার প্রতি কতোটা ন্যায় কাজ করেছি বলতে পারো,পারো না,যখন চুহেস নিজের প্রচেষ্টায় আজকের জায়গায় এসেছে,তখন ও তুমি তার বিরুদ্ধতা করছো,
সাইমুম আমাকে ভালোবাসে এটা তুমি বুঝেছো,কিন্তু সাইমুমের অনেক আগে থেকে চুহেস আমাকে ভালোবাসে সেটা তুমি বুঝলে না,তোমার ও সাইমুমের মতো নিজের খেয়ে বনে মহিষ তাড়ানোর অভ্যাস
শ্রুতি রেগে গিয়ে অনেক টা চিৎকার করে বলে গাইথি
তুই কার সাথে এমন করে কথা বলছি,তুই ভুলে যাচ্ছিস
গাইথি- ভুলিনি আফা তুমি আমার বড় বোন তুমি আমার কাছে থেকে সম্মান পাওয়ার অধিকার রাখো, কিন্তু বড়দের ছোটদের প্রতি কিছু দায়িত্ব থাকে,যখন কেউ নিজের ইগোর কারনে দায়িত্ব এড়িয়ে যায় তখন সেখানে, দায়িত্ব আর অধিকার দুটো ই হারিয়ে যায়
শ্রুতি- খুব বড় বড় কথা বলতে শিখেছিস,দেখবো তোর বড় কথা কয়দিন থাকে,এই বলে শ্রুতি কল অফ করে দেয়
গাইথি বড় বোনের সাথে এই আচরন করতে চায়নি কিন্তু কেউ যদি চুহেস কে ছোট করে কথা বলে সেটা সহ্য করা যায় না
এভাবেই গাইথির রাত টা কেটে যায় ঘুম আর হয়নি
পরদিন সকালে আদনান গাইথি নিহার এয়ারপোর্টে যায় চুহেস কে আনতে
দুপুর বারোটায় প্লেন ল্যান্ড করে চুহেস এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সবার সাথে সাক্ষাত করে কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি অন্যকাউকে খুজছে
আদনান- তুমি কি কিছু খুজছো?
চুহেস মৃদু হেসে বল্লো
– না তো
নিহার- স্যার আপনি যাকে খুজছেন তিনি গাড়িতে অপেক্ষা করছে আপনার জন্য
আপনি আরর ম্যাডাম আলাদা গাড়িতে যান আমি আর আদনান ভাই আসছি অন্য গাড়িতে
চুহেস আর কথা না বলে গাড়ির দিকে হাটা ধরলো,মাঝখানে একটু থেমে বল্লো
– নিহার ড্রাইভার কে আমাদের গাড়িতে পাঠিয়ে দাও আমি এখন ড্রাইভ করতে পারবো না
নিহার একটু অবাক হলো চুহেসের কথায়,কোথায় এতোদিন পর ম্যাডামের সাথে দেখা হবে দুজন একা কথা বলবে তা না,ড্রাইভার কে নিচ্ছে সাথে,
নিহার ড্রাউভার কে পাঠিয়ে দিলো
চুহেস এসে গাইথির পাশের সিটে বসলো
ড্রাইভার গাড়ি স্ট্রাট দিয়েছে
দুজনেই নিরব কারো মুখে কোন কথা নেই, গাইথি নিরাবতা ভাংলো প্রথমে
গাইথি- কেনো আপনি ই তো বলেছেন আমাদের বিয়েতে আন্টি কে নিয়ে আসবেন
চুহেস- বলে ছিলাম নাকি
গাইথি সংকোচ দূর করে অনেক্ষন থেকে চুহেসের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে, চুহেস কেমন যেন হয়ে গেছে এই কয়দিনে,শুকিয়ে গেছে চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে কি রকম রোগা দেখাচ্ছে
চুহেস- কি দেখছো
গাইথি- আপনি ঠিক আছেন তো
চুহেস- কেনো আমাকে দেখে কি তোমার বেঠিক মনে হয় নাকি
গাইথি- তা নয়,আচ্ছা থাক এখন এই সব কথা
গাইথি মনকে বুঝালো হয়তো লং জার্নি করাতে এমন লাগছে
বাকি পথ কেউ কারো সাথে কথা বলেনি বাসায় পৌছে
গাইথি চুহেস কে বল্লো
– আপনি যান ফ্রেশ হয়ে আসুন খুব গরম পড়ছে আমি আপনার জন্য ঠান্ডা কিছু ব্যাবস্থা করছি
চুহেস- কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না বাবুই তুমি শুধু ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে রাখো
চুহেস ফ্রেশ হয়ে ডাইনিং এ আসলো
চুহেস- এখানে ই খাবে নাকি
গাইথি- আপনার ইচ্ছে, ব্যালকনিতে নিয়ে আসবো নাকি
চুহেস- হুম তাই নিয়ে এসো
ব্যালকেনিতে দাঁড়িয়ে দুজনেই আইসক্রিম খাচ্ছে
হঠ্যাৎ চুহেস বল্লো
– গাইথি আমার মাথা ঘুরাচ্ছে মনে হয় বমি আসবে
গাইথি ব্যাস্ত হয়ে বল্লো
– আসুন মাথায় পানি দিই,, আপনি রেষ্ট নিন আমি ডাক্তার কে কল করছি
চুহেস কিছু না বলে ওয়াশরুমে ডুকে গেলো
অনেক্ষন পরে গাইথিইই বলে একটা ডাক দিলো
গাইথি হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশ রুমের দরজা নক করে না দরজা খোলা আছে লক করেনি গাইথি ওয়াশ রুমে গিয়ে দেখে চুহেস চেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছে
গাইথি ভাইয়া বলে এক চিৎকার দিলো
চুহেস গাইথির রুমের দরজায় নক করে
গাইথি- এই সময় আবার কে এলো,
গাইথি দরজা খুলে চুহেস কে দেখে বল্লো
– আরেহ আপনি আসুন
চুহেস বিতরে গিয়ে বসে
গাইথি পাশে আরেক টা সোফায় বসে বলে কিছু বলবেন
চুহেস- নাহ তেমন কিছু বলবো না এমনি দেখতে এলাম, তুমি কি করছিলে এতোক্ষন?
গাইথি- ভাবছিলাম
চুহেস- কি ভাবছিলে
গাইথি- বলবো না
চুহেসের ঠোটের কোনে মিষ্টি একটা হাসি ফুটে উঠলো
পরক্ষনেই হাসিটা মিলিয়ে গেলো চুহেস গম্ভীর হয়ে উঠলো, গাইথির একটা হাত টেনে নিজের হাতের উপর রাখলো
– জানো বাবুই যেদিন থেকে তোমার চোখের আড়াল হয়েছি সেদিন থেকেই তোমার শূন্যতা একটু একটু করে উপলব্ধি করেছি তখন ও তোমায় ভালোবাসি কি না বুঝি নি,
কিন্তু তোমার কথা ভাবতে আমার ভালো লাগতো, কি ভাবে যেন কতো গুলো বছর পার হয়ে গেলো টেরই পাইনি,
গাইথি চুহেস কে থামিয়ে বল্লো।
– আপনার কি কখন বউ সংসার এগুলার কথা মনে হয়নি
চুহেস- সব সময় ব্যাস্ত রাখতাম নিজেকে যদি একটু অবসর পেতাম তোমার ছোট্ট মায়াবী মুখটা ভেসে উঠতো চোখের সামনে, তোমাকে দেখার কৌতূহল জাগতো মনে
কিন্তু আমি মনকে প্রশ্রয় দিতাম না আর ও অনেক বেশি ব্যাস্ততার মাঝে ডুবিয়ে ফেলতাম নিজেকে
তার পর এমনি একদিন নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে আর না ফেরে ছুটে যাই গ্রামে তোমাকে একটু দেখবো বলে,
কিন্তু মনে আশংকা ছিলো তুমি আমাকে ছিনবে না, আর সেটা আমি কি করে মেনে নিবো…..
গাইথি- আমার তো মনে হয় প্রথম দেখে আপনি নিজেই আমাকে চিনতে পারেননি
চুহেস- মিথ্যা বলবো না,কিন্তু পরে তোমাকে ঠিকই চিনেছি, কিন্তু তুমি আমাকে ছিনতে অনেক সময় নিয়েছো
গাইথি চুহেসের ঠোঁটে আংগুল ছেপে বলে
-সে কথা বলবেন না,আমার নিজের ই মনে হলে খারাপ লাগে,আমার মন যাকে খুজছিলো তাকে এতো কাছে পেয়ে ও ছিনতে আমার অনেক দেরি হলো
চুহেস গাইথি কে থামিয়ে বল্লো
– সে সব কথা মনে করে কষ্ট পেয়ে ও না বাবুই, পরিস্থিতি টা ই তখন এমন ছিলো, এতে তোমার,আমার কারো ই কোন দোষ নেই
আচ্ছা বাদ দাও যখন আমি গ্রামে তোমাকে দেখি ঠিক তখন থেকে ই তোমাকে বউ করার স্বপ্ন টা মনে জেগে উঠে,আর সেটা সত্যি ও হতে চলছে
গাইথি- হাম তাই, আমার কেমন যেন সব কিছু স্বপ্নের মতো লাগছে,মনে হচ্ছে এই বুঝি ঘুম ভেংগে যাবে আর….
চুহেস- আর বলতে হবে না বাবুই, আমি নিজেই কেমন যেন ঘোরের মধ্যে আছি
আজকের দিনটা সত্যি ভুলে যাওয়ার মতো নয়, না চাইতে ই অনেক অধিকার আজকের এই অনুষ্ঠান শেষে আমি পেয়ে গেছি
গাইথি ঠোঁটে হাসি টেনে বল্লো
– কি অধিকার পেয়েছেন শুনি
চুহেস মুচকি হেসে বল্লো
– এই যে তুমি আমার হয়েছো
গাইথি – এখন ও হইনি মিঃ
চুহেস- পঞ্চাশ পার্সেন্ট অধিকার পেয়ে গেছি, কয়েকদিন পর বাকি টা ও পাবো তার পর
গাইথি- তার পর কি
চুহেস- তার পর “আদি, নীড়’ এর কথা ভাববো
চুহেসের কথা শুনে গাইথি লজ্জা পেয়ে যায়,দ্রুততার সাথে চুহেসের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে মুখটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে নেয়
চুহেস- বাহ লজ্জা ফেলে তো তুমি আর ও সুন্দর হয়ে যাও, আচ্ছা শুনো একটা কথা দিতে হবে তোমাকে
গাইথি চুহেসের দিকে মুখ না ফিরিয়ে বলে
– কি কথা বলুন
চুহেস- তুমি আমার দিকে তাকাও আর আমার হাতে হাত রেখে কথা দাও আমার কথা শুনে তুমি কষ্ট পাবে না
চুহেসের কথা শুনে গাইঠি হৃদয়টা কেপে উঠে,মুহুর্তেই লজ্জা রঙ টা মুখ থেকে উবে গেলো, আর সেখানে এসে জমা হলো ভয় আর আশংকা
চুহেস গাইথির দিকে তাকিয়ে বল্লো
– আমার কথা না শুনেই মুখের এই হাল করে ফেলেছো,থাক বলবো না
গাইথি নিজেকে সামলে নিয়ে বল্লো
– আসলে ভয় হয়, এক রকম জোর করেই সাইমুমের সাথে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছিলো, আমি সাইমুমের মাঝে কখনো ই কোন মুগ্ধতা খুঁজে পাইনি, কিন্তু আপনাকে একনজর দেখে ই আমার মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন এসে যায়, আর না চাইতে আমি আপনার মনের উজাড় করা ভালোবাসা পেয়ে যাই
গাইথির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে চুহেস বল্লো
– আমি ভেবেছি আমার অবেলায় ভালোবাসা মেঘেডাকা আকাশের অনাকাঙ্ক্ষিত সূর্যের মতো ডুবে থাকবে মেঘের আড়ালে, কিন্তু তুমি এসে তোমার ছোয়াতে মেঘ দূর করে সেখানে এক উদিয়মান সূর্যের আলো জ্বেলেছো, সত্যি বাবুই যা কিছুর যোগ্য আমি নই,তুমি এর থেকে ও অনেক বেশি ভালোবাসা নিয়ে আমার দরজায় এসেছো
গাইথি- এ ভাবে বলবেন না,নিজেকে বড় অপরাধি মনে হয়,
আপনি অনন্য ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার রাখেন,আমার মনে হয় আমি তত টা দিতে পারছি না আপনাকে
চুহেস গাইথিকে থামিয়ে দিয়ে বল্লো
– তোমার মনে হওয়ার মধ্যে ভুল আছে,
গাইথি- ঠিক আছে হার মানলাম, এবার বলুন কি কথা বলতে এসেছেন
চুহেস – কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাওনি যে তুমি…..
গাইথি- অফসস, কোন রকম ভনিতা না করে মূল কথা বলুন
চুহেস- ওকে তা হলে শুনো,রাবেয়া খালা অসুস্থ,তিনি শেষ বার আমাকে দেখতে চেয়েছে, এখন কি করবো তুমি বলো
চুহেসের কথা শুনে গাইথির মুখের হাসি টা উবে যায়, তবু ও মুখের হাসি ধরে রাখার জন্য ম্লান হেসে বল্লো
– আপনার সেখানে অবিলম্বে যাওয়া উচিত,রাবেয়া খালা আপনার জন্য অনেক করেছে
চুহেস- আমি ও তাই ভাবছি, কিন্তু ব্যাপার টা তুমি কি ভাবে নিবে সেটা ভেবেই মন অস্থির হয়ে উঠছিলো আমার
গাইথি- ওতো অস্থির না হয়ে প্রথমে ব্যাপার টা আমার সাথে সেয়ার করা উচিত ছিলো নয়কি
চুহেস- এখন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে বুঝতে ভুল করেছি
গাইথি- ঠিক আছে আজকের পর থেকে তো আর ভুল হবে না,যাচ্ছেন কখন?
চুহেস- আগামি কাল সকাল দশটায় ফ্লাইট
চুহেসের কথা শুনে গাইথির মন টা আর ও খারাপ হয়ে যায়, মনের অজান্তেই মুখ থেকে একটি কথা বের হয়ে যায়
– কাল ই যাচ্ছেন
চুহেস- তুমি নিষেধ করলে কালকের টিকেট ক্যান্সেল করে দিবো
গাইথি- টিকেট ক্যান্সেল করার দরকার নেই, আপনি কাল ই যাচ্ছেন
চুহেস- কিন্তু আদনান,ভাবি,তোমার বাবা উনারা ব্যাপার টা কি ভাবে নিবে
গাইথি- আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না আমি ম্যানেজ করে নিবো
চুহেস- থ্যাংস বাবু টা. ঠিক আছে এখন একটু ঘুমাও তুমি, আমি যাই সব গুছিয়ে নিতে হবে
গাইথি- একটা কথা
চুহেস- কি?
গাইথি- আপনি এখন ও বাবা কে ক্ষমা করতে পারেন নি তাই না
চুহেস- আমি তো আগে ই বলেছি আমার উনার উপর কোন রাগ নেই
গাইথি- তা হলে আমার ভাইয়া আমার ভাবি যদি আপনার হয়,আমার বাবা কেনো আপনার বাবা হবে না
চুহেস একটু গম্ভীর হয়ে বল্লো
– গাইথি এটা তোমার কাছে আমার অনুরোধ তুমি কখনো, তোমার বাবা কে আমি বাবা বলে ডাকি না কেনো এ জন্য মন খারাপ করবে না, এটা ঠিক যে উনি আমার শ্বশুর হতে চলছে কিন্তু আমার বাবাকে ছাড়া অন্য কাউকে বাবা ডাকতে পারবো না, প্লিজ তুমি আমাকে মাফ করে দিও
গাইথির চোখের কোনে পানি চিক চিক করছে,এই উত্তর টা সে চুহেসের কাছে থেকে আশা করেনি,তবু ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলে
– ঠিক আছে আমি কখনো এই নিয়ে আপনাকে ঝোর করবো না,
তার পর গাইথির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বল্লো ভোর হতে আর বেশি দেরি নেই
চলুন আপনাকে জামা কাপড় গুছাতে হেল্প করবো
চুহেস- আমার এই সব নিহার ই গুছিয়ে দিবে তোমার ব্যাস্ত হতে হবে না
গাইথি কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে বল্লো
– বিয়েটা কি আমাকে করছেন নাকি নিহার কে
চুহেস মিষ্টি হেসে বল্লো
– কি যে বলো না তুমি,আমার শুধু একটা ই বাবুই পাখি আছে বুঝলে
গাইথি- তা হলে চলুন, আমার দায়িত্ব আমাকে বুঝে নিতে দিন,
চুহেস গাইথিকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো
সকালে আদনান আর ঐশী কথা টা শুনেই ওরা খুব রিয়েক্ট করে
গাইথি সবাই কে বুঝিয়ে বলে, তার পর গাইথির যুক্তির কাছে সবাই হার মানে
নিহার আর গাইথি চুহেসের সাথে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যায়
ড্রাইভিং সিটে নিহার বসেছে তার পিছনে গাইথি আর চুহেস
চুহেস- বাবুই একদম মন খারাপ করবে না কেমন আমি সেখানে পৌছেই তোমার সাথে কথা বলবো
গাইথি কিছু বল্লো না হয়তো কান্না ভেজা কন্ঠ টাকে আড়াল করার জন্য ই কিছু বলেনি
চুহেস গাইথির দিক থেকে কোন রেসপন্স না পেয়ে বল্লো
– তুমি এমন করছো মনে হয় আমি জীবনে ও আর ফিরবো না এটা ই যেন আমার শেষ যাওয়া
চুহেসের কথা শুনে গাইথি আঁতকে উঠে বলে
– এমন করে বলবেন না,শুনতে ভয় লাগে, আমি চাই আপনি ভালো ভাবে ফিরে আসুন
চুহেস- ওকে মাই ডিয়ার বাবুই,
গাড়ি গিয়ে এয়ারপোর্ট এ পৌছলো
চুহেস গাইথির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্লেনের দিকে অগ্রসর হয়
গাইথি চুহেসের যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছে যতক্ষন না চুহেস চোখের আড়ালে গেছে
নিহার গাইথিকে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বল্লো
– ম্যাডাম চলুন এবার ফেরা যাক
গাইথি- ওহ হা চলুন,গাইথি হাত দিয়ে মাথার ঘোমটা টা আরেকটু টেনে দেয় যেন নিহার তার চোখের পানি না দেখতে পায়
গাইথি- তুমি তো রাজি হবে সাথে তোমার গাড় ও রাজি হবে, এভাবে গল্পগুজবের মধ্যে সবাই গিয়ে পৌছলো,
আর একদিন পর অনুষ্ঠান দুই বাড়িতে সবাই ব্যাস্ত
চুহেস বল্লো অনুষ্ঠান টা তার বাড়িতেই হবে
এতে আহমদ মেহেরা প্রথমে রাজি না হলে ও পরে রাজি হয়
আমেরিকা থেকে শ্রুতিদের আসতে বলা হয়েছিলো
কিন্তু শ্রুতি সাইমুমের সাথে বিয়ে না দেয়ায় আসবে না বলে দিয়েছে
কথা টা শুনে গাইথির মন খারাপ হলে ও পরে নিজেকে মানিয়ে নেয়
চুহেস- তার রুমে বসে আছে এমন সময় নিহার আগমন
চুহেস- কিছু বলবে নিহার
নিহার- স্যার আপনার ফ্রান্সে যাওয়ার ডেইট টা আর ও এগিয়ে আনতে হয়েছে
চুহেস ভ্রু কুঁচকে বল্লো
– কেনো
নিহার- রাবেয়া খালা খুব বেশি অসুস্থ উনি আপনাকে শেষ বার দেখতে চাইছে
চুহেস- কি বলছো এখন কি হবে কাল তো আবার এংগেজমেন্ট
নিহার- তাতে কোন প্রব্লেম নেই স্যার পরশু আপনার ফ্লাইট
চুহেস- ওহ তা হলে ঠিক আছে কিন্তু গাইথি কে কথা টা বলতে হয়
নিহার- স্যার একটা বলতে চাই
চুহেস- বল
নিহার- গাইথিকে এখন কিছু বলার দরকার নেই কাল অনুষ্ঠান মিছামিছি মন খারাপ করে বসে থাকবে,অনুষ্ঠানের পরে বুঝিয়ে বলবেন
চুহেস- ঠিক বলেছে নিহার, তোমাকে ধন্যবাদ
নিহার- ওয়েলকাম স্যার, তা হলে আমি আসি
অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যা পরে বিকেল থেকেই গেস্টরা আসা শুরু করেছে
চুহেসের বিজনেস পার্টনার দের ইনভাইট করা হয়েছে, সব মিলিয়ে দু শোর উপরে মেহমান ইনভাইট ফেল,
গাইথি আর নিধিপা পার্লারে চলে গেছে, অনেক আগেই
নিহার চুহেস কে রেডি করছে
নিহার- স্যার আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে আজকে, বিশেষ করে স্যুট টা আপনাকে অনেক মানিয়েছে
চুহেস- ধন্যবাদ, তোমাকে ও কম লাগছে না আজ
ঘন্টা খানেকের মধ্যে গাইথিরা চলে এসেছে
এই পুরো অনুষ্ঠান দেখা শুনা করবে নিধিপা
নিধিপা- ঘোষণা দিলো প্রথমে নাচ গান,
তার পর হবে আংটি পরানো
সবাই এক সাথে হাত তালি দিয়ে উঠলো
এবার ঐশী ঘোষনা দিলো এখন আপনাদের সামনে পরিবেশিত হবে একটা কাপল ডান্স,আর এতে পার্ফম করবে নিধিপা এন্ড নিহার
সবাই এক যোগে হাত তালি দিয়ে উঠলো
নিহার আর নিধিপা নাচে স্টেজে গেলো, কিন্তু দুজনেই দাঁড়িয়ে আছে কি ভাবে কি দিয়ে শুরু করবে বুঝতে পারছে না, এদিকে একটা হিন্দি গান বেজে উঠলো
নিধিপা নিহারের কানে কানে বল্লো
– হিন্দি গানের তালে নাচতে পারবো না আমি
নিহার- ওকে গান চেঞ্জ করতে বলি
গান শুরু হলো নিহার আর নিধিপা নাচ ও শুরু করলো
“আমার মনে ঘরে একটু একটু করে ভালোবাসার ঘর বুনেছি রঙিন স্বপ্ন দিয়ে
যেমন করে পাখি বাদে নিজের সুখের ঘর সুতো ছাড়া বুনে বুনা ভালোবাসার ঘর”
এই গানের সাথে তারা নাচ দিলো, নাচ শেষে সবাই হাত তালি দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো তাদের কে
এর পর নিধিপা, উপস্থিত সম্মানিত গেষ্ট দের উদ্দেশ্য ঘোষনা করলো,এবার পার্ফম করবে, ঐশী এন্ড আদনান
আদনান তো ঘোষনা শুনে চমকে উঠে বলে কি আমি নাচবো?
ঘোষনা শেষ করে নিধিপা আর নিহার এলো আদনানের কাছে
নিহার- ভাইয়া চলুন ভাবির সাথে ডান্স করবেন
আদনান- তোমাদের কি মাথা খারাপ হয়েছে আমি ডান্স করবো,আমি সকলের মুরুব্বী, ভুলে যাচ্ছো কেনো কন্যা পক্ষ থেকে আমি কন্যারর বড় ভাই
নিধিপা- এতো কিছু শুনছি না ভাইয়া,আপনি আমাদের মুরুব্বী নয়,আমাদের মুরুব্বী হচ্ছে চাচাজান,আমরা কিন্তু উনা কে বলিনি আপনাকে বলেছি,
নিহার- সো আসুন ডান্স ফ্লোরে
আদনান কে নিহার আর নিধিপা টেনে নিয়ে এলো মিউজিক শুরু হলো আদনান তো নাচতে পারেই না বরং নিহার আর নিধিপা আদনাকে নাচার চেষ্টা করে অনেক মজা করলো
এর পর একে সবার পার্ফম শেষ হলো অনুষ্ঠানের শেষ পর্যায় চলে এলো এবার ঐশী ঘোষনা করলো
-এবার কাপল ডান্স নিয়ে আসছে আপনাদের মাঝে আজকের এই আয়োজন যাদের কে ঘিরে, চুহেস মেহেরা এন্ড গাইথি মেহেরা, এখন পার্ফম করবে আমাদের বিশেষ এই দুই ব্যাক্তি,সবাই জোরসে হাত তালি দাও ওদের জন্য
গাইথি যদি ও ঐদিন ঝোকের মাথায় ডান্স করতে হ্যা বলেছিলো কিন্তু এখন সত্যি তার মাঝে একটা ঝড়তা কাজ করছে, এতো মানুষের সামনে চুহেসের সাথে ডান্স করবে কি করে
নিধিপা টেনে নিয়ে এলো গাইথি কে
নিহার টেনে নিয়ে এলো চুহেস কে, ওদের কে স্টেজে রেখে ওরা সরে গেলো
গাইথি লাজরাংগা চাহনিতে চুহেসের দিকে তাকিয়েছে
চুহেসে ও গাইথির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিলো
মিউজিক শুরু হলো
নিধিপা গাইথি কে ইশারা করে ডান্স শুরু করতে বল্লো।
গাইথি সব ঝড়তা সংকোচ দূর করে ডান্স শুরু করলো, চুহেস ও তার সাথে যোগ দিলো
” দিলখোগায়া হোগায়া কিসিকা
আবরোসেতা মিলগায়া খুশিকা
আখোমে খাবেসা কিসিকা
আবরোসেতা মিলগায়া খুশিকা
ইশতানায়াহা রাফবা
দিলচুরায়াহা হে কিউজে মুঝে
কয়িডো,তেরিও,তেরিও,তেরিও,হায় রাফবা
তেরিও,তেরিও,তেরিও,
ডান্স শেষে দুজনেই ফিরে এলো স্টেজে থেকে গেষ্টরা সবাই এসে তাদের শুভেচ্ছা জানালো,
খুব ভালো পার্ফম করেছে গাইথি আর চুহেস
নিধিপা এসে গাইথি কে বল্লো
– দোস্ত হিন্দি গানের তালে ডান্স করে একদম ফাটিয়ে দিয়েছিস,তুই যে এতো ভালো ডান্স জানিস এটা জানতাম না
নিহার চুহেস কে বল্লো
– স্যার আপনাদের পার্ফম পাটাপাটি হয়েছে
নিহার আর ও কিছু বলতে যাচ্ছিলো
নিধিপা নিহার কে থামিয়ে দিয়ে বল্লো
– আর কথা নয় চলো এখন ও আসল কাজ বাকি, এনাউন্স টা সেরে ফেলি আগে
নিধিপা এনাউন্স করলো গেস্টদের উদ্দেশ্য করে
চমৎকার একটা ডান্স করেছে আমাদের স্যারর এন্ড ম্যাডাম,এবার শুরু হতে যাচ্ছে অনুষ্ঠানে অন্তিম এন্ড স্বরনীয় অধ্যায়, সবাই এসে ঘিরে দাড়ালো চুহেস এন্ড গাইথি
চুহেস গাইথির অনামিকা আংগুলে আংটি পরিয়ে দিলো
গাইথি ও চুহেস কে আংটি পরয়ে দিলো
সবার হাত তালি ও ফুলের পাপড়ি ছোড়াছুড়ির মাঝে চমৎকার একটা সময় কেটে গেলো এন্ড অনুষ্ঠান সমাপ্তি হলো
খাওয়া দাওয়ার পরে গেস্টরা চলে গেলো
এই রাতে আদনান রা আর তাদের ফ্লাটে ফিরে যায়নি, চুহেস দের এখানে তাদের থাকার ব্যাবস্থা করেছে
গাইথি নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শরির টা এলিয়ে দিলো,আজ অনেক ধকল গেছে, তবু ও আজকের দিন টা ভুলে যাওয়ার মতো নয় চোখ বন্ধ করলেই যেন সব চোখের সামনে ভেসে উঠে
এদিকে সারাদিন ব্যাস্ত সময় পার করে চুহেস যখন রুমে এলো রেস্ট নেয়ার জন্য তখন তার মনে হলো দেশের বাইরে যাওয়ার কথা টা এখন ও গাইথি কে জানানো হয়নি
মিথ্যা কথা বলবেন না আপনি ইচ্ছে করে এমন করেছেন
চুহেস- তুমি ভুল বুঝতেছো আমাকে গাইথি
গাইথি- ভুল বুঝিনি আমি,আসল কথা হলো আপনি আমায় ভালো ই বাসেন না
চুহেস আর কোন কথা বল্লো না
একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে গাড়ি থামিয়ে চুহেস বল্লো
– নেমে এসো গাইথি
গাইথি- আমি নামবো না, আমি বাসায় যাবো
চুহেস গাড়ির দরজা খুলে হাত ধরে টেনে নামালো গাইথি কে, তার পর সবুজ ঘাসের উপর বসে পড়লো
গাইথিকে ও টেনে বসালো
তার পর গাইথির একটা হাত ধরে বল্লো
– কবিতা শুনবে
গাইথি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে বল্লো
– না শুনবো না
চুহেস- রাগ করে আছো
গাইথি- না রাগ করিনি
চুহেস- অভিমান করেছো
গাইথি- যখন রাগ করিনি,তখন অভিমান করতে যাবো কেনো
চুহেস গাইথির হাত ধরে বল্লো
– দেখো আমি তোমার সাথে কফিশপে যেতেই পারতাম, কিন্তু কোন লাভ হতো না, সাইমুম আনইজি ফিল করতো,যার ফলে সে তার কথা গুলো তোমায় বলতে পারতো না
আর তুমি ও ঠিক ভাবে তার কথার জবাব দিতে পারতে না,
যার অর্থ হলো, সাইমুম এটা বুঝতো না যে তুমি তাকে কেনো বিয়ে করতে চাও না
গাইথি চুহেসের দিকে মুখ ফিরিয়ে বল্লো
– সত্যি আমি এতো টা ভেবে দেখিনি
তা ছাড়া এখন সাইমুম জানে ওকে আমার পছন্দ নয়,তখন বুঝতো আমি আপনার কারনে, তাকে রিজেক্ট করেছি,ফলে তোমার প্রতি একটা ক্ষভ সৃষ্টি হতো
চুহেস- এই তো লক্ষিটি সব বুঝেছে,ওতো রেগে না গিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবলে আর ও আগে পুরো ব্যাপার টা ক্লিয়ার হয়ে যেত
গাইথি কথা ঘুরিয়ে বল্লো
– আপনার সাথে বের হলে আপনি কখনো আমাকে কোন পার্কে ঘুরতে নিয়ে যান না,শুধু নিরিবিলি প্রাকৃতিক সুন্দর্য ভরা,এমন জায়গা বেছে নেন কেনো
চুহেস- এমন জায়গা ই কথা বলার জন্য উপযুক্ত, আর পার্ক আমার কাছে ভালো লাগে না
গাইথি- ভালো লাগে না কেনো
চুহেস- অনেক কারন আছে, এখন ওসব বলতে ভালো লাগছে না,,,জানো আমি তোমাকে নিয়ে দু লাইনের একটা কবিতা লিখেছি
গাইথি হেসে ফেল্লো
– দুই লাইনের কবিতা হয় নাকি,বিশেষ উক্তি গুলো হয় দুই লাইনের
চুহেস- আহ শুনো ই না আগে,শুনার পর যদি বিশেষ উক্তি মনে হয় তা হলে সেটা বিশেষ উক্তি
গাইথি -ঠিক আছে বলো
চুহেস-
‘তোমার রুপে মুগ্ধতায়
আমি যে হয়েছি সারা
কাজল কালো আখি তোমার
করেছে আমায় পাগল পারা
এলোকেশী তুমি
করেছো আমায় পাগল ‘
গাইথি- তার পর
চুহেস- এই টুকুই আর নাই
গাইথি- হুম, একেবারে ভালো হয়………….নি
চুহেস- হা কি বললে তুমি
গাইথি- ঠিক ই বলেছি
চুহেস আচ্ছা দেখাচ্ছি মজা এই বলে গাইথির মাথার চুল এলোমেলো করে দিলো
গাইথি- ওকে, তা হলে চলে আসতে বলুন আমাদের সাথে সে ও যাবে
চুহেস- ওকে মাই ডিয়ার তুমি এসো
চুহেস মোবাইলের কল অফ করে দিয়ে নিহার কে কল দিয়ে আসতে বলে,নিহার শপিং এর কথা শুনে চলে আসে
চুহেস আর নিহার বসে বসে গল্প করছিলো,কলিংবেল বেজে উঠলো এমন সময়
চুহেস উঠতে যাচ্ছিলো নিহার চুহেস কে থামিয়ে দিয়ে বল্লো স্যার আমি যাচ্ছি
চুহেস- আবার স্যার? তুমি তো দেখছি আমার বাড়ি টা কে অফিস বানিয়ে ছাড়বে নিহার
নিহার- অনেক দিনের অভ্যাস তো চেঞ্জ হতে সময় লাগবে,
নিহার যাচ্ছিলো দরজার দিকে আর ভাবছে, পরিস্থিতি মানুষকে কতো টা বদলে দেয়,তা স্যার কে না দেখলে বুঝা ই যেতো না
এক সময় অফিস বাড়ি এই দুয়ের মধ্যে স্যারের কাছে সবটা ই সমান ছিলো,
ভাবতে,ভাবতেই দরজা খুলে দিলো, নিহার
দরজা খুলেই সামনে নিধিপা কে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে
নিহার- তু তুমি
নিহারের নার্ভাসনেস দেখে গাইথি আর নিধিপা দুজনের শব্দ করে হেসে উঠলো
নিধিপা- ভয় পেয়েছো নাকি নিহার
নিহার দরজার পাশ থেকে সরে দাড়াতে দাড়াতে বল্লো ভয় পায় নি আকস্মিক দেখতে পেয়ে এমন হয়েছে,,তুমি যে এখানে আসবে সেটা বলো নি কেনো
নিধিপা- বলে আসলে কি আর এই মজার দৃশ্য টা দেখতে পেতাম
গাইথি আর নিধিপা এসে বসলো ড্রইং রুমে
চুহেস গাইথির দিকে তাকিয়ে বল্লো
– তো এই জন্য বুঝি নিহার কে অফিস থেকে এতো তাড়া দিয়ে আনালে
গাইথি- হুম ঠিক ধরেছেন,কিন্তু শপিং এ যাওয়ার ব্যাপার টা ও সত্ত, চলুন যাওয়া যাক
চুহেস- হুম, চলো
সবাই মিলে শপিং এ গেলো,গাইথির ড্রেস চুহেস পছন্দ করে দিয়েছে, চুহেসের ড্রেস গাইথি পছন্দ করেছে
শপি শেষে সবাই বেরিয়ে এলো
চুহেস – শপিং করতে এতো টাইম লাগে তোমার
গাইথি- এতো টাইম কোথায় মাত্র তো চার ঘন্টা
চুহেস অবাক হয়ে বল্লো
– চার ঘন্টা আবার মাত্র
গাইথি – দেখুন আমার শপিং করতে খুব কম সময় লাগে,তার পরে ও যদি….
চুহেস গাইথিকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলে,চলো গাড়িতে বসি
নিহার আর নিধিপা এসে গাড়িতে বসলো
কিছুক্ষন পর চুহেসরা ও এলো
নিধিপা- এই গাইথি এই অনুষ্ঠানে কি কি আয়োজন করবি
গাইথি- নাচ গান সব হবে
চুহেস – কি বলছো, এংগেজমেন্টে নাচ গান, হয় নাকি
গাইথি- হয় না তবে এবার হবে ,
চুহেস- নাচবে কে
গাইথি- কেনো আমার নিহার ভাইয়া আর মিসেস নিহার ভাবি
নিধিপা- গাইথি এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না।
গাইথি-ওকে ফাইন, ফাজলামি বাদ,সিরিয়েস ভাবে বলছি তোরা নাচবি
নিহার- ঠিক আছে আমরা রাজি তবে একটা শর্তে
চুহেস- কি শর্ত
নিহার- আপনাদের ও নাচতে হবে
নিধিপা নিহারের সাথে এক যোগ হয়ে বলে,হুমম নিহার ঠিক বলেছে এটা আমার ও ইচ্ছে
চুহেস- এই প্রথম শুনলাম, নিজেদের এংগেজ মেন্ট অনুষ্ঠানে নিজেদের কে ই নাচতে হবে
গাইথি- আমি কিন্তু নাচতে পারি না
নিধিপা- তা বললে ও শুনছি না
তুমি প্লিজ কেদো না
গাইথি- আপনি আমাকে কাঁদতে নিষেধ করছেন, আপনি জানেন আমি ঐ ছেলের সামনে যেতে কতোটা ভয় পাই
চুহেস- শুনো তুমি এখন যা কান্না করার করে নাও, বিয়ের পর একদম কাদবে না,নইলে আমার কাছে তোমার একটা ই নাম থাকবে’চিচকাদুনে’
গাইথি ওপাড় থেকে রেগে গিয়ে বলে
– কিহ আপনি আমার সাথে মজা করছেন, আপনি ও আমার কষ্ট টা বুঝলেন না,যান আপনাদের কারো সাথে আর কথা বলবোনা, গাইথি রাগ করে কল অফ অরে দেয়
চুহেস – যাক বাবা কি এমন বললাম যে এতো রেগে গেলো,
পরদিন চুহেস গাড়ি নিয়ে বসে আছে গাইথিদের বাসার সামনে কিন্তু গাইথির নিচে নামার কোন নাম গন্ধ ও নেই
চুহেস কল দিচ্ছে কল ও রিসিভ করছে না
চুহেস- ভাবি তুমি উনাকে বলে দাও আমি রাক্ষস হলে উনি রাক্ষসী হা হা হা
গাইথি-আবার দাঁত কেলিয়ে হাসছে দেখো
এবার আহমদ মেহেরা কথা বল্লো
– আহ গাইথি ছেলেটা কে এতো কথা বলছিস কেনো তুই,ছুপ ছাপ খা তো
গাইথি আর কথা বল্লো না
চুহেস খাওয়া শেষ করে বল্লো, চলো রেডী হয়ে নাও
গাইথি- আমি রেডী আপনি আসুন
গাইথি আর চুহেস গিয়ে গাড়িতে বসলো
গাইথি – আমার খুব টেনশন হচ্ছে,সাইমুম না জানি কি বলে বসে, আপনি কিন্তু ওর সাথে কথা বলার সময় আমার পাশে থাকবেন
চুহেস- এটা আমি পারবো না, আর এটা ভালো দেখাবে না আমি পার্কিং এ গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবো,
গাইথি- ঠিক আছে, কিন্তু আমি যদি আধা ঘন্টার মধ্যে গাড়িতে ফিরে না আসি, তা হলে আপনি কফিশপের বিতরে যাবেন , ঠিক আছে
চুহেস- ওকে ডান
কিছুক্ষন পর গাড়ি থেমে যায়
চুহেস- তুমি যাও আমি পার্কিং গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করবো
গাইথি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বল্লো
– আমি যা বলেছি তা যেন আপনার মনে থাকে
চুহেস- আচ্ছা ঠিক আছে
গাইথি- ভুলবেন না যেন
চুহেস- ঠিক আছে ভুলবো না
গাইথি চলে যাওয়ার পর চুহেস আবার ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লো,,বসে বসে ভাবছে গাইথির কথা, একদম বাচ্ছা ই রয়ে গেলো, একজন মানুষের সাথে দেখা করতে যাবে, এই জন্য এতো ভয়,আর যদি ব্যাতিক্রম কিছু হতো, তা হলে জানি কি করতো
গাইথি কফিশপের বিতরে যেতেই দেখে পাশে একটা টেবিলে সাইমুম বসে আছে
গাইথি গিতে সাইমুমের সামনে একটা চেয়ার টেনে বসলো
সাইমুম যেন কিছু একটা নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো , গাইথির চেয়ার টানার শব্দে বাস্তবে ফিরে এলো
সাইমুম- ওহ তুমি এসেছো,বলো কি খাবে, কি অর্ডার দিবো
গাইথি- স্যরি আমি কিছু খাবো না, আপনি কি বলবেন তাড়া তাড়ি বলুন
সাইমুম গাথির মুখের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– মনে হয় তুমি এখানে অস্বস্তি ফিল করছো, তুমি কি আমাকে…….
গাইথি সাইমুমের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বল্লো
– এতো ক্যাছাল না করে, সোজাসুজি বলুন কি বলতে চান
সাইমুম গাইথি গম্ভীর কন্ঠ শুনে একটু অবাক হয়,গাইথির এই রুপের সাথে সে একদম অপরিচিত, তার পর বল্লো
– শুনলাম তুমি নাকি বিয়েটা করতে চাইছো না, কেনো করতে চাইছো না আমি তোমাকে সেটা জিজ্ঞাস করবো না, শুধু বলবো এংগেজমেন্টের এতো দিন পর তোমার কাছে থেকে এই উত্তর আসা টা অবাঞ্ছিত
গাইথি শান্ত আর কঠোর কন্ঠে বল্লো
– অবাঞ্ছিত হলে এটা সত্যি
সেই প্রথম থেকে ই আপনাকে আমার পছন্দ নয়,শুধু ফ্যামেলীর উপরে কোন কথা বলিনি
সাইমুম- তখন ফ্যামেলির উপরে কথা বলোনি এখন বলছো কেনো
গাইথি- এখন বলছি তার কারন…
সাইমুম- কারন কি?
গাইথি- কারন, আমি ভেবেছি এই লম্বা সময়ের মধ্যে, আপনাকে মেনে নিতে পারবো,কিন্তু আমি দুঃখিত মিঃ সাইমুম আপনার সাথে সারা জীবন কাটানো সম্ভব নয়
সাইমুম হঠাৎ করে গাইথি কিছু বুঝার আগেই গাইথির পায়ের কাছে বসে পড়ে বলে
– প্লিজ গাইথি আমাকে একটু সময় দাও আমি তোমার মনের মতো হতে চাই প্লিজ এভাবে আমাকে ফিরিয়ে দিও না,আমি তোমাকে ভা….
গাইথি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলে
– কি করছেন কি আপনি হুম, লোকে কি বলবে তাড়া তাড়ি উঠে বসুন
সাইমুম- না আমি উঠবো না আগে তুমি বলো আমায় ছেড়ে যাবে না
গাইথি- প্লিজ মিঃ সাইমুম পাগলামি করবেন না, দেখুন আপনি এই রকম পাগলামি করলে আমি কিন্তু এখনি এখান থেকে চলে যাবো
সাইমুম এবার উঠে বসে মুখ নিচু করে বল্লো স্যরি গাইথি,আমি বুঝতে পারছি আমার কথা গুলো শুনতে তোমার ভালো লাগছে না, কিন্তু কি করবো তোমাকে ছাড়া যে আমি অচল
গাইথি- দেখুন, বাস্তববাদী হোন,বাস্তবতা কে মেনে নিন , আমার আর কিছু বলার নেই আপনাকে এই বলে গাইথি বেরিয়ে যায় কফিশপ থেকে
সাইমুম নির্বাক হয়ে গাইথির যাওয়ার পথে ছেয়ে আছে,
গাইথি গাড়ির কাছে এসে ধুম করে গাড়ির দরজা খুলে পিছনের সিটে বসে
চুহেস হেসে বল্লো
– কি ব্যাপার আমার পাশে বসতে কি লজ্জা করছে নাকি
গাইথি এতোক্ষন রাগে ফুলছিলো, চুহেসের কথা শুনে বোমা পাটানো কন্ঠে বল্লো
– একদম কথা বলবেন না আপনি চুপ করে থাকবেন
চুহেস- অমা বলে কি আমি তো বোবা না কথা বলতে জানি চুপ করে থাকবো কেনো
গাইথি- একদম ফাজলামি করবেন না, কি বলে গিয়েছিলাম আমি, আমি যাওয়ার আধা ঘন্টা পর বিতরে যাবেন,কিন্তু আপনি যাননি তো
ভীতু বলছো কেনো নিজের বিয়ের প্রস্তাব নিজে নিয়ে যাবো তা ও আবার দুজন মুরুব্বীর কাছে একজন হলে ভিন্ন ছিলো
গাইথি- হইছে হইছে আর সাফাই গাইতে হবে না
চুহেস- ঠিক আছে গাইলাম না, চলো,পাড়ে যাই,তুমি মূল ভবন দেখতে ছেয়েছে, সেটা না দেখিয়ে পারি
গাইথি- হুম চলো, দুজনে বাড়ির বিতর টা দেখতে আসে,
গাইথি – ঘরের সব আসবাবপত্র দেখে মনে হচ্ছে এগুলা সব আগের যুগের রাজাদের, যেমন মিউজিয়াম এ দেখেছিলাম
চুহেস- হুম ঠিক ধরেছো,এই পুরো ঘরে যে সব আসবাবপত্র আছে সব আধুনিক জিনিষের থেকে তিন গুন বেশি দাম দিয়ে কেনা
গাইথি- এতো দাম দিয়ে কেনার কি দরকার ছিলো, এর থেকে লেটেস্ট মডেলের গুলো অনেক ভালো
চুহেস- তোমার পছন্দ হয়নি তাই তো,ঠিক আছে চেঞ্জ করে দিবো
গাইথি- আমি কখন বললাম আমার পছন্দ হয়নি,খুব পছন্দ হয়েছে,
আচ্ছা আপনি যে বললেন এই বাড়ির নামের অর্থ টা করতে সেটা কি?
চুহেস- আমি তোমাকে বলেছি, তুমি বের করো
গাইথি- নাহ আমি পারবো না আপনি বলেন
চুহেস- নেইজিনের নীড়, মানে” আদি নিবাস”
গাইথি- খুব ই সুন্দর একটা অর্থ
গাইথি কে থামিয়ে দিয়ে চুহেস বল্লো – আমি কি ভাবছিলাম বলো তো
গাইথি- আমি তো মাইন্ড রিডিং করতে জানি না,আপনি বলুন আপনি কি ভাবছেন
চুহেস একটা দুষ্টুমির হাসি দিয়ে বলে, আমাদের যখন সন্তান হবে তখন একটা ছেলে একটা মেয়ে হবে,আমি ছেলের নাম রাখবো’ আদি’ মেয়ের নাম রাখবো ‘নীড়’
গাইথি তো চুহেসের কথা শুনে লজ্জায় মুখ লাল করে ফেল্লো
চুহেস- লজ্জা ফেয়োনাতো,আমরা আমরাই তো,এখন বলো নাম দুটো কেমন
গাইথি মুখ অন্য দিকে ফিরিয়ে বল্লো – অদ্ভুত শুনতে হলে ও ভালো লাগলো আমার কাছে,কিন্তু যদি আমাদের দুটো ই মেয়ে হয়,কিংবা দুটো ই ছেলে তখন কি হবে
চুহেস- তাই তো,এমন টা তো আমি ভেবে দেখিনি, আচ্ছা পরে ভেবে দেখবো,তুমি ও কিন্তু এই ভাবনার জন্য আমাকে সাহায্য করবে কেমন
গাইথি সে দিকে কান না দিয়ে বল্লো,ঐরুম টা বন্ধ কেনো
চুহেস- ওটা একটা স্পেশাল রুম,শুধু স্পেশাল দিনেই খুলবো বলে বন্ধ করে রেখেছি
গাইথি- আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করছে
চুহেস- চলো চলো আর দেখতে হবে না
গাইথি- না আমি ঐ রুম টা না দেখে যাবো ই না
চুহেস- যাবে না?
গাইথি- না
চুহেস- ওকে ঠিক আছে শুনো ওটা আমাদের বাসর ঘর, মানে ঐ রুমে আমরা আমাদের স্পেশাল রাত টা কাটাবো,
গাইথি লজ্জা পেয়ে বল্লো
কি যে বলেন আপনার মুখে কিছুই আটকায় না
চুহেস- আমার কি দোষ তুমি তো দেখতে চেয়েছিলে,আমি তো শুনালাম মাত্র,শুনে এই অবস্থা,দেখলে তো উপায় নেই
গাইথি কথা ঘুরানোর জন্য বল্লো
– চলুন ফেরা যাক
গাইথি আর চুহেস মিলে গাড়িতে উঠলো
চুহেস সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে বল্লো তুমি কি এমন ই থাকবে
গাইথি- কেমন
চুহেস- এই যে আপনি আপনি ছাড়া কথা ই বলছো না
গাইথি চুহেস কে থামিয়ে দিয়ে বল্লো
আপনি কি বলতে চাইছেন,তুমি করে না বললে বুঝি ভালোবাসা প্রকাশ পায় না,
তবে আমি আপনাকে বলছি ভালোবাসা তুমি আপনিতে নয়,ভালোবাসা সেখান থেকে ই হয় যেখানে সম্মান শ্রদ্ধা থাকে,সম্মান শ্রদ্ধা ছাড়া ছাড়া ভালোবাসা গুলো খুব অল্প সময়ে হারিয়ে যায়
চুহেস মুগ্ধ হয়ে গাইথির কথা গুলো শুনছিলো
তার পর কিছুক্ষন চুপ থেকে বল্লো
– ম্যাডাম আপনি যদি পড়া শুনা করে অধ্যাপক হোন তা হলে খুব ভালো মানাবে
গাইথি- থাক পাম্প দিতে হবে না
#
আয়েশা বেগম বাসায় এসেই সোপায় বসে পড়ে, মুখে তার কোন কথা নেই
জেরীন এসে আয়েশা বেগমের পাশে বসলো, জিজ্ঞাস করলো
– মা তুমি কোথায় গিয়েছিলে আর এমন করে বসে আছো কেনো
আয়েশা বেগম- সামুম কোথায়
জেরীন- রুমেই আছে
আয়েশা বেগম- ডাক ওকে
জেরীন- তোমাকে দেখে মনে হয় কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু কি হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি না, কি হয়েছে মা বলো আমাকে
আয়েশা বেগম- সাইমুম কে ডাক বলছি,
জেরীন উঠে গিয়ে সাইমুম কে ডেকে আনলো
সাইমুম মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে কিছু একটা হয়েছে,
সাইমুম- কিছু বলবে আম্মু, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেনো
আয়েশা বেগম কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো হয়তো সব কথা গুছিয়ে নিচ্ছিলো
তার পর বল্লো
আদনান আমাকে ফোন করে যেতে বলেছে,ওখান থেকে আসলাম
সাইমুম- খুশি হয়ে বলে নিশ্চয়ই বিয়ের ডেইট ফাইনাল করেছো তাই না
আয়েশা বেগম- নাহ
সাইমুম – তা হলে
আয়েশা বেগম- আমি জানি গাইথির উপর তুই দূর্বল হয়ে পড়েছিস, কিন্তু সত্য এটা ই যে হয়তো গাইথি তোর ভাগ্যে নেই
সাইমুম মাকে থামিয়ে দিয়ে বল্লো
– নেই মানে কি বলছো মা
আয়েশা বেগম- হুম আদনান আমাকে যেতে বলে, আর তার পর তারা আমাকে বলে মূলত গাইথি এই বিয়েতে রাজি নয়, তারা জানিয়ে দিয়েছে তাদের বোনের অমতে তারা কিছু করতে পারবে না
সাইমুম- মানেহ,বললেই হলো,এই বিয়ে সে মেনে নিতে পারবে না, এক বছর আগে আমাদের এংগেজমেন্ট হয়,তখন কিছু বলেনি,মাঝখানে এতো গুলো দিন গেলো তবু ও বলেনি,এখন হঠ্যাৎ করে বল্লো বিয়ে সে করবে না,তা হলে এতো আয়োজন কেনো ,
ঐ ফ্যামেলী আমাকে এই ভাবে ঠকাতে পারে না, আমি গাইথির সাথে কথা বলবো আমি এখনি ফোন করবো
আয়েশা বেগম- তুই তোর মতো করে চেষ্টা করে দেখতে পারিস কিন্তু আমার মনে হয় এতে কোন লাব হবে না
সাইমুম বিষন্ন মন নিয়ে উঠে যায়
জেরীন নিরব দর্শকের মতো কথা গুলো শুনছিলো সাইমুম চলে যাওয়ার পর এবার সে কথা বল্লো
– আম্মু মেহেরা পরিবার আমাদের সাথে সিটিং করেছে, এতো ধড়িবাজ ঐ ফ্যামেলি,দেখে বুঝা যায় না,ভদ্র মানুষের মুখোশ পরে আছে
আয়েশা বেগম- এমন করে বলছিস কেনো এখানে উনাদের কি দোষ, আজ কালকার মেয়েদের বুঝে উঠাই কষ্টকর
মায়ের কথা শুনে জেরীন চলে যায় সাইমুমের রুমে
*
চুহেস- গাইথি তুমি কি আমাদের বাসায় যাবে নাকি, তোমাদের বাসায় নেমে যাবে
গাইথি- বাসায় যাবো, বাবা ভাইয়া চিন্তা করবে,
গাইথি তাদের বাসার সামনে নেমে যায়
গাইথি- আপনি বিতরে আসুন
চুহেস- না বিতরে যাবো না এখন, তুমি যাও
গাইথি চুহেস কে বাই বলে বাসার বিতরে চলে যায়
কলিংবেল বাজাতেই ঐশী দরজা খুলে দেয়
ঐশী গাইথিকে দেখেই কৌতক করে বলে
– বাহ আজ সারাদিন তো বেশ কেটেছে একেবারে কাক ডাকা ভোরে বের হয়ে রাত আট টায় ফেরা,তা ননদী আজ সারাদিন কি কি কথা হলো উনার সাথে
গাইথি কৃতিম রাগ দেখিয়ে বল্লো
– ভাবি আগে তো বাসার বিতরে ডুকতে দিবে তাই না
ঐশী- ওহ তাই তো, আসুন আসুন মিসেস চুহেস মেহেরা,
গাইথি লজ্জা পেয়ে দৌড়ে নিজের রুমে চলে যায়
ঐশী ও পিছন পিছন যায়,
– আরেহ ননদী আসল কথা ই তো বলা হয়নি
গাইথি- না ভাবি তুমি আর একটি কথা ও বলবে না
ঐশী- ঠিক আছে আমি মিসেস চুহেস মেহেরাকে কিছু বলবো না কিন্তু মিশমির ফুফু আম্মা কে একটা সুখবর দিতেই পারি,
এই খবর টা হলো মিশমির ফুফা চেঞ্জ হয়েছে,আগের টা ক্যান্সেল করে, নতুন জন কে স্বাগত জানিয়েছে,মিশমির আব্বু,মিশমির দাদা ভাই
গাইথি অবাক হয়ে বল্লো,
-ভাবি সত্যি বলছো, এই বলে ঐশীকে ঝড়িয়ে ধরলো
ঐশী – আরেহ আরেহ আমাকে কেনো,উনি তো এখানে নেই ডাকবো নাকি তাকে
গাইথি ঐশী কে ছেড়ে দিয়ে বল্লো তোমার মুখে কিছুই আটকায় না ভাবি, যাও তোমার সাথে আমার কোন কথা নেই
ঐশী হাসতে হাসতে বেরিয়ে যায় গাইথির রুম থেকে
চুহেস বাসায় এসে দেখে নিহার টিভি দেখছে, চুহেস কে দেখে নিহার উঠে যায়
চুহেস- উঠতে হবে না,তুমি দেখো, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি
চুহেস ফ্রেশ হয়ে এসে নিহারের পাশে বসে
নিহার চুহেসের দিকে তাকিয়ে বল্লো
– স্যার একটা কথা বলবো
চুহেস- বলো
নিহার- আজ আপনাকে খুব ফ্রেশ দেখাচ্ছে
চুহেস মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, যে কাজ টা দিয়েছি সেটা হয়েছে,
নিহার মুচকি একটা হাসি দিয়ে বল্লো,
– শুধু হয়েছে বললে ভুল হবে, একদম দিন তারিখ সব পাকা করে এলাম
চুহেস- কি বলছো, তুমি তো দেখছি এদিকে দিয়ে একেবারে ফাস্ট
নিহার উচ্চাস ভরা কন্ঠে বল্লো,ফাস্ট হবোনা এই প্রথম আপনার জীবনে আনন্দের একটা মুহুর্ত আসতে চলছে, আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে সে কাজে দেরী করা কি আমার উচিত
চুহেস- তুমি শুধু আমার শুভাকাঙ্ক্ষী নও, আমার ভাই বটে,ব্যাপার টা আমি অনেকক দিন আগে ই ফিল করছি, কিন্তু বলতে দেরী হয়েছে
নিহার- তাতে কি স্যার, আমি অনেক আগেই আপনার স্নেহ মমতা বুঝে নিয়েছি
এখন সব ছেয়ে খুশির খবর টা হলো,আগামি ৭-৪-১৯, আপনার এংগেজমেন্ট,
দিন টা আমি ঠিক করিনি, আদনান ভাই নিজেই ই ঠিক করেছে
চুহেস নিহারকে ঝড়িয়ে ধরে বল্লো,তুমি একদম আমার বড় ভাইয়ের মতো কাজ করেছো নিহার
নিহার ও চুহেস কে ঝড়িয়ে ধরে বলে,
আপনার ছন্নছাড়া জীবন টা আমি দেখতে পারছিলাম না আর,স্যার
চুহেস- আর স্যারর নয় ভাইয়া বলো
নিহার- বলবো একটা শর্ত আমি আপনার ছোট আমাকে তুই করে বলতে হবে,অফিসের ব্যাপার টা ভিন্ন, তার বাইরে ছোট ভাইয়ের চোখে দেখলে আমি খুশি হবো
এমন সময় চুহেসের মোবাইলে কল আসে
নিহার মুচকি হাসি দিয়ে বল্লো,
ভাবি ফোন দিয়েছে হয়তো কথা বলুন, আমি আসছি
চুহেস কল রিসিভ করে
– বাবুই বলো
গাইথি- আপনি ঠিক ভাবে বাসায় উঠেছেন তো
চুহেস- হুম,তুমি নিশ্চয়ই শুধু এই কথা বলতে ফোন করোনি
গাইথি- হুম, ঠিক বলেছেন,সাইমুম ফোন করেছে,সে আমার সাথে দেখা করতে চায়,বলতে বলতে গাইথি কেদে দেয়
চুহেস- সাইমুম দেখা করতেই চাইবে,তাই বলে তুমি কাদছো কেনো
গাইথি কাঁদতে কাঁদত ই বলে
– ও আমার সাথে বাইরে কোথায় ও দেখা করতে চায়,
চুহেস- ঠিক আছেন আমি যাবো কাল তোমার সাথে, তুমি প্লিজ কেদো না
আফতাব হোসেন তার চেম্বারে বসে ঝিমুচ্ছিলেন। রশীদ আলমের আসার কথা ১০ টায় কিন্তু এখনো আসেননি। কোনো সমস্যা হলো নাকি? রোগী দেখাও শুরু করতে হয়। রোগী দেখা শুরু করলেন আর রশীদ আলম আসলেন তখন একটা ঝামেলা সৃষ্টি হবে। সিরিয়ালের ব্রেক কেউই করতে চাননা। এসিস্ট্যান্ট কে ডেকে বললেন
– রোগী পাঠাও।
রোগী দেখা শেষ করে বের হবেন এইসময় রশীদ আলম এসে হাজির। হায়েস্ট ১০ মিনিট লেট হতে পারে তাই বলে এতো সময় লেট?
ডাক্তারের বিরক্তির চাহনিতে বুঝতে পারলেন রশীদ আলম যে এতোটা দেরি করা ঠিক হয়নি তার। তার আসার ইচ্ছা ছিলোনা। এই মেয়ের জন্য তার অনেক অশান্তি সংসারে। এই মেয়েকে তার কেনো যেন হঠাৎ করেই অসহ্য মনে হচ্ছে।
– আপনার প্রথম স্ত্রীকে আমার সামনাসামনি দেখা খুব দরকার।
রশীদ আলম অস্বস্তি নিয়ে বললেন
– সেটা সম্ভব না। আমি তাকে কীভাবে আপনার কাছে নিয়ে আসবো?
– আমি তো বলিনি আপনি নিয়ে আসবেন। আমি বলেছি আমার দেখা,কথা বলা খুব প্রয়োজন। আপনি ঠিকানা দিন আমি একটা ব্যবস্থা করে নিবো।
– সম্ভব না।
– দেখুন রশীদ সাহেব আপনার মেয়ের সমস্যার সমাধানের জন্য তার জন্মদাত্রী মায়ের সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন। বুঝতে পারছেন কী বলেছি?
– ঠিকানা আমি বলছি আপনি লিখুন।
ঠিকানা লিখে আফতাব হোসেন শান্তস্বরে বললেন
– আপনি সময়ের জ্ঞান কম রাখেন মনে হচ্ছে।
– বুঝলাম না ঠিক।
– আপনাকে বুঝতে হবেনা। এখন আসতে পারুন।
রশীদ আলম চলে যাচ্ছিলেন, আফতাব হোসেন বললেন
– আপনার প্রথম স্ত্রীর নাম কী?
রশীদ আলম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন
– রিনি।
নামের উচ্চারণে বুঝতে পারলেন, মানুষ কে ভুলে যাওয়া খুব কঠিন।
আফতাব হোসেনের নিজের মধ্যে অপরাধ বোধ জাগলো, নামটা জিজ্ঞেস করা ঠিক হয়নি। কিন্তু না করেও তো উপায় ছিলোনা।
বিকালের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ওই ঠিকানায় পৌঁছে তো গেলেন কিন্তু দারোয়ান কি তাকে ঢুকতে দিবেন? বাড়ির মূল গেটের সামনে এভাবে একজন অপরিচিত কে হাঁটাহাঁটি করতে দেখে দারোয়ানের মনে সন্দেহ জাগলো। চোর, ডাকাত নাকি?
গেট না খুলেই ভেতর থেকে অচেনা লোকটাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন
– এই বাড়ির সামনে এতো ঘোরাঘুরি কীসের শুনি?
আফতাব হোসেন বিনয়ের সাথে বললেন
– আমি রিনি ম্যাডামের সাথে দেখা করতে এসেছি।
দারোয়ান সরু চোখে তাকিয়ে আফতাব হোসেন কে পা থেকে মাথা অবদি দেখে নিলেন।
– আপনি কে?
– আমি একজন সাইক্রিয়াট্রিস্ট।
শার্টের পকেট থেকে নিজের ভিজিটিং কার্ড দারোয়ানের হাতে দিয়ে বললেন
– বিশ্বাস না হলে দেখতে পারেন। কার্ডে আমার ছবিও দেয়া আছে।
দারোয়ান কার্ড নিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। আফতাব হোসেন একটু আশার আলো খুঁজে পেলেন। এবার যদি একটু কাজ হয়।
অনেকক্ষণ যাবত দাঁড়িয়ে থাকতে তার ভালো লাগছেনা কিন্তু ফিরে যেতেও ইচ্ছে করছেনা। প্রায় ১৫ মিনিট পর, আফতাব হোসেন ঘড়িতে সময়ের হিসাব রাখছিলেন, দারোয়ান ফিরে এসে মূল গেট খুলে দিলেন।
– সোজা গিয়ে হাতের ডানে দরজা খোলা আছে। ওই দরজা দিয়ে ঢুকলেই ড্রয়িংরুম। ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করতে হবে আপামনি আসবেন।
আফতাব হোসেন বিনয়ের সাথে বললেন
– আপনাকে ধন্যবাদ।
দারোয়ান বা এসব বাড়ির কেয়ার টেকার, কাজের লোকদের সাথে ভালো ব্যবহার করে সম্পর্ক তৈরি করতে হয়। তাহলে অনেক ভেতরের খবর সহজেই পাওয়া যায়। আফতাব হোসেন এইজন্যই এতোটা বিনয়ী আচরণ করছেন। যদিও তিনি সবার সাথেই ভালো ব্যবহার করার চেষ্টা করেন।
বেশ সুন্দর করে সাজানো ড্রয়িংরুম। এতো বড়লোকদের বাড়িঘর অবশ্য এভাবেই সাজানো থাকে। তার স্ত্রীরও এরকম বাড়ির খুব সখ। কখনো প্রকাশ করেনা কিন্তু তিনি বুঝতে পারেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ট্রে হাতে নিয়ে ৩০-৩২ বছর বয়সী একজন নারী এসে ড্রয়িংরুমে ঢুকলেন। বেশ সুন্দরী কিন্তু মুখে হাসি না থাকায় কেমন যেন লাগছে। আফতাব হোসেনের সামনে রাখা টি টেবিলে ট্রে রেখে ডান পাশের সোফায় বসে বললেন
– চা ঠান্ডা হচ্ছে।
আফতাব হোসেন খেয়ালই করেননি ট্রে তে চা আর কয়েক রকম মানে তিন রকমের বিস্কুট আছে। এই এক কাপ চা দিয়ে এতো রকমের বিস্কুট খাবেন কীভাবে? এই বিস্কুট গুলো খাওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে ১ কেজি চায়ের মগ লাগবে।
আফতাব হোসেন চায়ের কাপ নিয়ে বললেন
– আমি ড. আফতাব হোসেন। আপনার সাথে জরুরি কিছু কথা বলার আছে। আপনি রিনি ম্যাডাম তো?
হাসার চেষ্টা করে বললেন
– হ্যাঁ আমি রিনি।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আফতাব হোসেন তার প্রথম প্রশ্নটি করলেন
– আপনার প্রথম স্বামীর নাম রশীদ আলম?
– হ্যাঁ, প্রথম বলতে ওই লাস্ট। আর বিয়ে করিনি।
– আপনার একটা মেয়ে আছে ফারিয়া তাই না?
– আমার মেয়ে আছে তবে ফারিয়া না ওর নাম।
আফতাব হোসেন খেয়াল করলেন রিনি তেমন বিব্রতবোধ করছেন না। বেশ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নের উত্তর গুলো দিচ্ছেন।
– তাহলে ওর নাম কী?
– আমি আর রশীদ ওর নাম রেখেছিলাম রাদিয়া। হয়তোবা ওর দাদী নাম চেঞ্জ করেছেন।
– চা টা শেষ করে কথা বলুন। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবেনা।
আফতাব হোসেনের চা খাওয়া শেষ হবার পর রিনি বলতে শুরু করলেন
– রশীদের জুয়া খেলার অভ্যাস ছিলো। বিয়ের আগে থেকেই জানতাম। বিয়ের পর এবং আগে অনেক চেষ্টা করেছি ছাড়ানোর, ও ছাড়েনি। মেয়েটা যখন আমার পেটে তখন ওর জুয়া খেলার কারণে অনেক দেনা হয়েছে জানতে পারলাম। ওর মা বাবা অতোটা জানতেন না। মেয়েটা হবার পর দেনাদাররা বাসায় আসা শুরু করলেন। খুব খারাপ পরিস্থিতি। প্রায় না খেয়েই থাকতে হতো আমাকে। মেয়েটাও দুধ পাচ্ছিলো না। ওর মা সব দোষ আমার আর আমার মেয়ের ঘাড়ে দিলেন। আমি আসার পরে নাকি তার ছেলে জুয়া খেলায় মেতেছে। আর মেয়ে হচ্ছে অলক্ষী। তাই জন্ম নেবার সাথে সাথেই বাবার ঘরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। সারাদিন কানের কাছে এই এক কথা!
মেয়েটাও অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে। কী করবো বুঝে উঠতে না পেরে বাবাকে ফোন দিলাম। লজ্জাসংকোচ ছেড়ে বাবার কাছে টাকা চাইলাম। টাকার এমাউন্ট টা যদি কম হতো। রশীদ ১৫ লাখ টাকা দেনা ছিলো। বাবা এমনিতেই আমার উপর রাগ ছিলেন তার অমতে বিয়ে করেছি বলে।
টাকা দিতে রাজি হলেন কিন্তু শর্ত জুড়ে দিলেন।
– ওই সংসার ছেড়ে চলে আসতে হবে। মেয়েকেও রেখে আসতে হবে। অনেক কান্নাকাটি করে বোঝালাম মেয়েকে রেখে আসতে পারবোনা।
বাবা রাজি হলেন।
তাই করলাম মেয়েকে নিয়েই চলে এলাম। ওকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু আমার মেয়েটাকেও তো বাঁচাতে হবে।
রিনির গাল ভিজে উঠেছে চোখের জলে। মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠছিলো। ওকে নিয়ে ঘুরতে বের হয়েছিলাম। তখন ওর বয়স কতো মনে পড়ছেনা।
রশীদ আমার কাছ থেকে মেয়েটাকে জোর করে নিয়ে গেলো। আমি কিছুই করতে পারিনি।
আফতাব হোসেন বললেন
– আপনার বাবা তো পারতেন কোর্টে গিয়ে মেয়েকে ফিরিয়ে আনতে।
– বাবা রাজি হলেন না। সুইসাইড করতে গেলাম তাতেও না।
– আপনি রশীদ আলমের কাছে ফিরে যেতে পারতেন৷
– আমি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছিলাম।
– আপনি কি জানেন আপনার মেয়েটা অনেক দিন যাবত অসুস্থ?
– হ্যাঁ, জানি। লিমা আমাকে সব জানিয়েছে।
– তার সাথে আপনার কীভাবে পরিচয়?
– লিমা নিজেই ওদের বিয়ের ৩ মাস পরে এসেছিলো।
– ফারিয়াকে নিয়ে আসতো না?
– না, ও কখনোই আনতো না। আমি অনেক অনুরোধ করতাম। তবে ও রাদিয়াকে অনেক আদর করে এজন্য এখন আর বলিনা। আর রাদিয়া আমাকে ঘৃণা করে। আমিই লিমাকে সাইক্রিয়াট্রিস্ট এর কাছে নেয়ার কথা বলেছিলাম।
– মেয়ের জন্য খারাপ লাগেনা?
রিনি মুচকি হেসে বললেন
– অভ্যস্ত হয়ে গেছি। দূর থেকে মেয়েটাকে দেখি। আমার মতোই নাকি হয়েছে।
– ড. আফতাব হোসেন আমার মেয়েটাকে যেমন করেই হোক বাঁচান। ওর মানসিক অবস্থা খুবই খারাপ। লিমা ওকে বেশ খেয়াল রাখে কিন্তু জন্ম তো আর দেয়নি।
– ঠিক বুঝলাম না।
রিনি বললেন
– মেয়েটাই আমার সব এখন। রশীদ তো আমাকে চিনতেই পারলোনা। মেয়েটা আমার কাছে থাকলে হয়তোবা এমন হতোনা। ওর মা খুব খারাপ মহিলা। আমার রাদিয়াকে বেশ আজেবাজে কথা শোনায়। আমি এখনো বেঁচে আছি ওই মেয়েটার জন্যই। ওর কিছু হয়ে গেলে আমি ঠিক থাকতে পারবোনা।
– লিমার বাড়ি কোথায়?
– ও তো গ্রামের মেয়ে। গ্রামের নামটা মনে পড়ছেনা। আপনার নাম্বার টা দিয়ে যান আমি ফোনে জানিয়ে দিবো। আর কিছু মনে করবেন না আমার এখন একটু বের হতে হবে। আপনি রাতে খেয়ে যাবেন।
– নাহ, অন্য একদিন। আজ আমি উঠি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
– আপনাকেও ধন্যবাদ দিবো যদি রাদিয়া আগের মতো হাসিখুশি বাবু হয়ে যায়।
রিনি একিটু শব্দ করেই হাসলেন। আফতাব হোসেন খেয়াল করলেন
– এখন তাকে খুব নিখুঁত সুন্দরী মনে হচ্ছে।
সন্ধ্যার দিকে চেম্বারে রোগী দেখা শুরু করলেন আফতাব হোসেন। আজকাল মনে হচ্ছে মানসিক রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়ছে। বাড়ছেনা, আগেও ছিলো শুধু লোকে পাগল বলবে বা সাইক্রিয়াট্রিস্ট এর অভাবেই কেউ প্রকাশ করতো না। এ দেশের প্রত্যেকটা পরিবারে অন্ততপক্ষে একজন অস্বাভাবিক মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে। কিন্তু তারা প্রকাশ করবেনা। লোকে বলবে – ওই বাড়ির অমুক বদ্ধ পাগল। ওই বাড়ির ছেলের সাথে মেয়ে বিয়ে দেয়া যাবেনা বা ওই বাড়ির মেয়েকে বিয়ে করা যাবেনা তাহলে বংশে পাগলের রক্ত চলে আসবে। মানুষ গুলো কী বাজে মানসিকতার! একজন অস্বাভাবিক মানুষকে সুস্থ তো হতে দিবেই না বরং আরো অসুস্থ বানিয়ে ছাড়বে।
রাতে বাসায় ফিরে বেশ আরামে ঘুম দিলেন। রেহান টিয়াপাখি টা নিয়ে বেশ ব্যস্ত থাকে। টিয়াপাখিটা অবশ্য ওকে একদমই পছন্দ করেনা। একটু হাত দিয়ে রেহানা ধরতে গেলেই ঠোঁট দিয়ে হাতের চামড়ায় কামড় বসিয়ে দেয়। তারপরও রেহানা হাল ছাড়েনি। লেগেই আছে। আফতাব হোসেন বেশ হেসেছেন বিষয়টা নিয়ে। তার স্ত্রী এখনো আগের মতো হাসিখুশি আছে।
লিমার গ্রামের বাড়িতে খোঁজ নেয়া দরকার কিন্তু এতো সময় তার হাতে নেই। আবার যাওয়াটা খুব দরকার।
রেহানাকে জিজ্ঞেস করলেন
– বলোতো কী করি?
রেহানা ভাজি প্লেটে দিয়ে বললেন
– কোন বিষয়ে?
– ফারিয়ার দ্বিতীয় মা, লিমার সম্পর্কে পুরোটা জানা দরকার। কিন্তু ওর বাবার বাড়ি গ্রামে। আমার সময় হচ্ছেনা পুরো ১ দিনের জন্য।
– শুক্রবার যাও।
– অনেক দেরি হয়ে যাবে। এর মধ্যে মেয়েটার বড় কোনো ক্ষতি হলে?
– এক কাজ করো তোমার এসিস্ট্যান্ট কে পাঠিয়ে দেও। ও তো তোমার সাথে থাকতে থাকতে এসব বিষয়ে পটু হয়ে গেছে।
– তারপরও।
– আর মোবাইলের যুগ। যা জানার দরকার বা প্রশ্ন করা দরকার মোবাইলে বলে দিবা। আচ্ছা ওর যে আসল মা সে কেমন?
– ভালোই তো মনে হলো। সব বলবো তবে এখন না। এখন আমি নিজেই জানিনা কী কারণে ফারিয়ার এরকম সমস্যা হচ্ছে।
পরিবার, আশেপাশের পরিবেশ সবকিছুই একজন মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। সেটা নেতিবাচক বা নীতিবাচক দুটোই হতে পারে।
আফতাব হোসেনের মোবাইলে অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসলো। আফতাব হোসেন মনে মনে ভাবলেন রিনি ম্যাডাম হবেন।
ফোন রিসিভ করে বললেন
– রিনি ম্যাডাম বলছেন নাকি?
– হ্যাঁ। লিমার বাবার বাসার ঠিকানা টা লিখুন।
ঠিকানা লিখে রাখার পর আফতাব হোসেন কিছু বলতে যাবেন তখন রিনি বললেন
– ঠিকানা যে আমি দিয়েছি এটা যেন ফাঁস না হয়। বুঝতে পারছেন?
– হ্যাঁ।
ফোন কেটে গেলো নাকি রিনি কেটে দিলেন আফতাব হোসেন ঠিক বুঝতে পারলেন না।
ফারিয়া আবারও সেই স্বপ্নটা দেখছে। বারবার চেষ্টা করছে স্বপ্নটা যেন না দেখে ঘুমের ঘোরে। রাজা রাণীর গল্পের কথা কিন্তু হচ্ছেই না। সেই একই স্বপ্ন, একই অনুভূতি!
নিশানাথবাবু রাতের বেলা খবর নিতে এলেন। এই মানুষটি সাধারণত খুব হাসিখুশি। কিন্তু আজ কেমন যেন গম্ভীর লাগছে। মুখে খুব চিন্তিত একটা ভঙ্গি। অপালা বলল, ‘ম্যানেজারকাকু, আপনার কি শরীর খারাপ?
‘না, শরীর ভালােই আছে। ‘বাবার কোনাে খবর পেয়েছেন?
‘না। ইংল্যাণ্ডে পৌছেছেন, সেই খবর জানি। তারপর আর কিছু জানি না। স্যার মাঝে-মাঝে এ-রকম ডুব মারেন, তখন সব সমস্যা একসঙ্গে শুরু হয়।
কোনাে সমস্যা হচ্ছে কি? ‘না, তেমন কিছু না।
নিশানাথবাবু এড়িয়ে গেলেন। অপালার মনে হল, বড় কোনাে সমস্যা হয়েছে। কারখানাসংক্রান্ত কোনাে সমস্যা, যা এরা অপালাকে বলবে না। অপালারও এ-সব শুনতে ইচ্ছে করে না। সমস্যা থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালাে।
ম্যানেজারকাকু! ‘কি মা?
‘ফিরােজ বলে যে-ছেলেটি আমাদের ঘর ঠিক করে দিল, তাকে একটি চিঠি দিতে বলেছিলাম, দেন নি কেন?
নিশানাথবাবু বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘দিয়েছি তাে! ‘ও, তাহলে উনি বােধহয় পান নি। রেজিস্ট্রি করে দেয়া দরকার ছিল।
‘রেজিস্ট্রি করেই তাে দিয়েছি। চিঠির সঙ্গে একটা রেভিনিউ স্ট্যাম্প-বসানাে রিসিট ছিল। উনি তাে সেখানে সই করে ফেরত পাঠিয়েছেন। কাজেই আমার চিঠি না পাওয়ার তাে কোনাে কারণ নেই। আমি বরং কাল তাঁকে জিজ্ঞেস করব।
‘না, জিজ্ঞেস করার দরকার নেই। নিশানাথবাবু ইতস্তত করে বললেন, ‘ছেলেটি আজ এখানে এসেছিল, তাই না? ‘হা।।
এদের বেশি প্রশ্রয় দেয়া ঠিক না, মা। কাজ করেছে টাকা নিয়েছে, ব্যস, ফুরিয়ে গেল। আবার এসে এত কিসের চা খাওয়াখাওয়ি। * অপালা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। নিশানাথবাবুর হঠাৎ এখানে আসার উদ্দেশ্য স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি এমনি-এমনি আসেন নি। নিশ্চয়ই তাঁকে খবর দেয়া হয়েছে।
টেলিফোনে জানানাে হয়েছে।
‘মা অপালা।
‘তুমি একা-একা থাক, তােমার বােধহয় খারাপ লাগে। “না, আমার খারাপ লাগে না।
‘খারাপ না-লাগলেও লােনলি তাে নিশ্চয়ই লাগে। আমি তােমার কাকিমাকে বলেছি, সে এসে থাকবে।
‘কোনাে দরকার নেই। ‘না, দরকার আছে।
‘বেশ, দরকার থাকলে তাঁকে নিয়ে আসুন। তবে আপনি কিন্তু কাকু শুধু-শুধু ভয় পাচ্ছেন। ঐ ছেলে আর এখানে আসবে না।
নিশানাথবাবুকে কোনাে কথা বলার সুযােগ না দিয়ে অপালা উঠে গেল। তার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে।
ফখরুদ্দিন সাহেব মৃদু স্বরে বললেন, ‘আমি একটা টেলিফোন করব। দয়া করে ব্যবস্থা করে দিন।
যে-নার্স তাঁর মুখের ওপর ঝুঁকে আছে, সে বলল, ‘আরাে একটু ভালাে হয়ে নাও, তারপর করবে।
‘আমি ভালাে আছি। ‘তুমি মােটেও ভালাে নও। খুবই অসুস্থ। ‘কতটা অসুস্থ? ‘অনেকটা। তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে—ঈশ্বরের অনুগ্রহে ফিরে এসেছ। ‘এখন ঈশ্বরের অনুগ্রহে আমাকে একটি টেলিফোন করতে দাও।’
‘নিশ্চয়ই করবে। আত্মীয়স্বজনকে খবর দিতে চাও তাে? সে-ব্যবস্থা আমরা করেছি। তােমাদের এম্বাসিকে জানানাে হয়েছে। তারা নিশ্চয়ই প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিয়েছে।
আমাদের এ্যাসির কাজকর্ম সম্পর্কে তােমার কোনাে ধারণা নেই। ওরা কিছুই করে নি। যে-নােট তােমরা পাঠিয়েছ, সেই নােট ওরা এখনাে পড়ে নি। খাম খােলা হয় নি বলেই আমার ধারণা।
নার্স কোনাে কথা বলল না। ফখরুদ্দিন সাহেবের বাঁ হাতে একটি ইনজেকশন করল। ফখরুদ্দিন সাহেব আবার ঘুমিয়ে পড়লেন। ঘুম ভাঙল রাত নটায়। টেলিফোনে প্রথম কথা বললেন অপালার সঙ্গে।
‘বাবা, তুমি! সবাই চিন্তায় অস্থির। তােমার কোনাে খোঁজ নেই। মা’র সঙ্গে ঐ দিন কথা হল, মাও তােমার কোনাে খোঁজখবর জানে না। তুমি আছ কেমন?
খুব ভালাে আছি।
৪৪
গলার স্বর এমন লাগছে কেন? ‘সর্দি লেগেছে। কথাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, এখন তাে তাও কথা বলতে পারছি।
তুমি কথা বলছ কোথেকে? ‘লণ্ডন থেকেই বলছি।
এতদিন ডুব মেরে ছিলে কেন?’ ‘দেখলাম ডুব মেরে থাকতে কেমন লাগে। এক দিন তাে ডুব মারতেই হবে। হা হা হা। তােমার খবর কি?’
| ‘আমার কোনাে খবর নেই। বসার ঘর ঠিক করা হয়েছে বাবা। এত সুন্দর করে সাজিয়েছে যে, দেখলে তােমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।
তােমার কথা বুঝতে পারছি না মা। কিসের ঘর ? ও-মা, ভুলে গেছ! বসার ঘরের ডেকোরেশন বদলানাে হল না? ও, আচ্ছা। ‘তােমার তাে এটা ভুলে যাবার কথা নয় বাবা! তুমি তাে কিছুই ভােল না।
এখন মনে হয় কিছু-কিছু ভুলে যাচ্ছি। বয়স হয়ে যাচ্ছে। গেটিং ওল্ড। বসার ঘরটা খুব সুন্দর হয়েছে বুঝি?
‘খুব সুন্দর! এক বার বসার ঘরে ঢুকলে তােমার বেরুতে ইচ্ছা করবে না।’ ‘তাহলে তাে ডেকোরেশন ঠিক হয় নি। বসার ঘর এমন হবে, যেন কেউ বেশিক্ষণ বসে। যেন খুব অস্বস্তি বােধ করে। চট করে চলে যায়। হা হা হা।
‘বাবা।
কি মা? ‘তােমার হাসিটাও কেমন যেন অন্য রকম লাগছে।
কী-রকম লাগছে? ‘মনে হচ্ছে হাসির তেমন জোর নেই।’ “আচ্ছা, দেখ তাে এখন কেমন মনে হয় হা হা হা।
ফখরুদ্দিন সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রেখে ক্লান্ত ভঙ্গিতে চোখ মুছলেন। তাঁর আরাে কয়েকটি কল করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল না। মনে হচ্ছে শরীর একেবারেই গেছে। দেশে ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে। দেশের মাটিতে মরতে হবে, এ রকম কোনাে সেন্টিমেন্টাল চিন্তা-ভাবনা তাঁর নেই। এ-রকম চিন্তা-ভাবনা থাকবে। বড়-বড় কবি-সাহিত্যিকদের, দেশপ্রেমিক-রাজনীতিবিদদের। তিনি তাঁদের কেউ নন। নিতান্তই এলেবেলে ধরনের এক জন মানুষ। তাঁর কোনাে রােমান্টিক চিন্তা-ভাবনা থাকার কথা নয়। কিন্তু তবু রাতে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তিনি বৃষ্টির শব্দ শুনলেন। ঝমঝম বৃষ্টি। আষাঢ় মাসের প্রবল বর্ষণ। তিনি বেল টিপে নার্সকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে নার্স?
নার্স অবাক হয়ে বলল, ‘কই, না তাে।
“হয়তাে হচ্ছে, তুমি বুঝতে পারছ না। দয়া করে একটু বারান্দায় দেখে আসবে? এ-রকম বৃষ্টি শুধু আমাদের দেশেই হয়। তুমি বােধহয় জান না, আমাদের দেশ হচ্ছে বৃষ্টির দেশ।
আমি তাে শুনেছিলাম তােমাদের দেশ হচ্ছে অভাবের দেশ।
৪৫
‘আমাকে দেখে কি খুব অভাবী লােক বলে মনে হচ্ছে? ‘তােমাদের দেশের সবাই তােমার মতাে? ‘হ্যা। এখন দয়া করে একটু দেখে এস বৃষ্টি হচ্ছে কি না।
বললাম তাে, হচ্ছে না।’ ‘আমি শুনতে পাচ্ছি, তুমি পাচ্ছ না? দয়া করে একটু দেখে এস না! বারান্দায় যেতে তােমার খুব কি কষ্ট হবে?
‘না, হবে না।’
নার্স বারান্দায় গেল না, এক জন ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এল। ডাক্তার রুগীর প্রেসার মাপলেন, গায়ের তাপ দেখলেন এবং কড়া সিডেটিভ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলেন।
লােকাটকে এই বসার ঘরে ঠিক মানাচ্ছে না। রােগা ধরনের অভাবী টাইপের এক জন মানুষ। চোখে মােটা কাচের চশমা। স্যাণ্ডেল ঘরের বাইরে খুলে রেখে এসেছে। সেই স্যাণ্ডেলগুলিরও জরাজীর্ণ অবস্থা। অন্য কেউ হলে ফেলে দিত। এই পােক ফেলতে পারছে না।
এই ঘরে যে লােকটিকে মানাচ্ছে না, তা সে নিজেও বুঝতে পারছে। বসে আছে জড়ােসড়াে হয়ে। হাত দু’টি অবসন্ন ভঙ্গিতে কোলের ওপর ফেলে রাখা। গায়ে হলুদ রঙের একটা চাদর। কড়া হলুদ। এই নীল-নীল বসার ঘরে হলুদ রঙ বড় চোখে লাগে। লােকটির বয়স পঞ্চাশের মতাে হবে কিংবা তার চেয়ে কমও হতে পারে। অভাবী লােকদের অল্প বয়সেই চেহারা নষ্ট হয়ে যায়।
| অপালা পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। লােকটি এক বার শুধু তাকিয়েছে। তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিয়েছে। অথচ অপলা এমন একটি মেয়ে, যার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। অপালা বলল, আপনি কি বাবার কাছে এসেছেন?
| লোেকটি হা-সূচক মাথা নাড়ল। কিন্তু অপালার দিকে তাকাল না। মাথা ঘুরিয়ে জলরঙা ছবিটির দিকে তাকিয়ে রইল।
‘বাবা তাে দেশে নেই। সপ্তাহখানেক পরে ফিরবেন। আপনি বরং এক সপ্তাহ পরে আসুন।
| ‘আচ্ছা।
লােকটি কিন্তু উঠে দাঁড়াল না, বসেই রইল। এইবার সে তাকিয়ে আছে জানালার পর্দার দিকে। যেন পৃথিবীর সমস্ত রহস্য ও সৌন্দর্য জানালার ঐ পর্দাটিতে। অপালা বলল, আপনি কি কিছু বলবেন?
‘তােমার মা আছেন?
অদ্ভুত ব্যাপার তাে, এই লােক তাকে তুমি করে বলছে। অপালাকে তুমি করে বলার মতাে বাচ্চা এখনাে নিশ্চয়ই দেখাচ্ছে না। তার বয়স একুশ। একুশ বছরের একটি মেয়েকে শাড়ি পরলে অনেকখানি বড় দেখায়। কিংবা কে জানে, লােকটি
৪৬
হয়তাে ভালাে করে তাকে লক্ষই করে নি।
‘আমার মাও দেশের বাইরে। চিকিৎসার জন্যে গিয়েছেন। লােকটি ঠিক আগের মতাে ভঙ্গিতে পর্দার দিকে তাকিয়ে বসে রইল।
আপনার যদি জরুরি কিছু বলার থাকে, আমাকে বলতে পারেন।
লােকটি হলুদ চাদরের ভেতর থেকে একটা কার্ড বের করল। বিড়বিড় করে বলল, আমার বড় মেয়ের বিয়ে ১৭ই পৌষ।
অপালা হাত বাড়িয়ে কার্ডটি নিল। ‘বাবা এলেই আমি তাঁকে দিয়ে দেব। তিনি কি আপনাকে চেনেন? ‘হ্যা। আমাকে অনেক সাহায্য করেছেন।
অপালা হাসিমুখে বলল, ‘বাবার মন ভালাে থাকলে তিনি সাহায্য-টাহায্য করেন। তাঁর কাছে যেতে হয় মুড বুঝে।
| লােকটি উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বেরােবার সময় হঠাৎ বলে বসল, ছেলেটা ভালাে পেয়েছি। ব্যাঙ্কে কাজ করে। অগ্রণী ব্যাঙ্ক।
‘বাহ্, খুব ভালাে। ‘অফিসার্স গ্রেড। কোয়ার্টার পেয়েছে।
অপালার বড় মায়া লাগল। সে নিতান্তই অপরিচিত একটি মেয়ে। অথচ এই লােকটি কত আগ্রহ করে তার সৌভাগ্যের কথা বলছে। নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে কিছু সাহায্যের জন্যে এসেছিল। লােকটি নিচু গলায় বলল, “যাই।’
অপালা তার পিছনে-পিছনে বারান্দা পর্যন্ত এল। গেটের বাইরে বার-তের বছরের একটি ফুটফুটে মেয়ে। লােকটি গেট খুলে বেরােতেই এসে তার হাত ধরল। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই লােকটির সঙ্গে এসেছে। ভেতরে ঢোকে নি। অপালা ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলল। মেয়েটি এলেই পারত। বিশাল বাড়ি দেখে হয়তাে ভরসা পায় নি। আগ্রহ এবং কৌতূহল নিয়ে অপেক্ষা করেছে বাইরে। ভারি মিষ্টি চেহারা মেয়েটির! লােকটি কেমন—মেয়েটিকে গেটের বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে।
‘অপা, এই অপা।।
অপালা বিরক্ত মুখে তাকাল। দোতলার গেট থেকে নিশানাথকাকুর স্ত্রী তাকে ডাকছেন। অপালা জবাব দিল না। এই মহিলা গত তিন দিন ধরে এ-বাড়িতে আছেন। প্রথম দিন থেকেই অপালাকে আদর করে অপা ডাকছেন। এই আদর তার সহ্য হচ্ছে
। এক বার ভেবেছির বলবে—আপনি আমাকে অপা ডাকবেন না। বলতে পারে নি। বয়স্ক এক জন মহিলাকে মুখের ওপর এমন কঠিন কথা বলা যায় না। তা ছাড়া ভদ্রমহিলা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন অপালাকে খুশি রাখতে। প্রথম রাতে অপালার ঘরে ঘুমুতে এলেন। অপালা বলল, ‘এই ঘরে আপনার ঘুমানাের দরকার নেই।
কেন, দু’টা খাট তাে আছে।’ থাকুক। আমার একা-একা থাকতে ভালাে লাগে।’
‘ও-মা, কেমন কথা! ঘুমুবার আগে খানিকক্ষণ গল্পগুজব করলে তােমার ভালােই লাগবে মা। আমি খুব মজার-মজার গল্প জানি মা।’
মজার মজার গল্প আমার শুনতে ভালাে লাগে না। না-শুনেই কী করে বলছ, শুনতে ভালাে লাগে না। আচ্ছা, এইটা শােন, তারপর
৪৭
দেখি না-হেসে থাকতে পার কি না। একটা মেয়েকে জিজ্ঞেস করা হল কোনটা বেশি দরকারি–চেহারা না ব্রেইন। মেয়েটি বলল, চেহারা। কারণ চেহারা দেখা যায়, ব্রেইন দেখা যায় না। কী, গল্পটা মজার না?
‘হ্যা, মজার।
‘স্লমালিকুম। ‘ওয়ালাইকুম সালাম। কেমন আছেন ফিরােজ সাহেব? ‘জ্বি, ভালাে। ‘ক’দিন ধরে দেখি না আপনাকে?
‘দারুণ ব্যস্ত। আজ একটু ফাকা পেয়েছি, ভাবলাম আপনাকে জরুরি কথাটা বলে যাই।’
কী জরুরি কথা? ‘ঐ যে আপনার মেয়ের ছবি নিয়ে গেলাম যে ‘ও, আচ্ছা। বসেন, চা খাবেন? ‘তা খাওয়া যায়।
হাজি সাহেব ভেতরে গিয়ে চায়ের কথা বলে এলেন। ফিরে এসে আগ্রহী চোখে তাকিয়ে রইলেন।
| ‘ঐ যে আপনার কাছ থেকে ছবি নিয়ে গিয়েছিলাম, ছবি দেখে সবার এক কথা—মেয়ে কি ছবির মত সুন্দর? ফটোজেনিক ফেস ভালাে থাকলে অনেক সময় এলেবেলে মেয়েকেও রাজকন্যার মতাে লাগে।
হাজি সাহেব ছােট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেললেন।
‘মেয়ে যদি ছবির কাছাকাছিও হয়, তাহলেও ওদের কোনাে আপত্তি নেই। যেদিন বলবেন, সেদিনই বিয়ে।
আপনি কি মেয়ের অসুবিধার কথাটা বলেছেন?
‘পাগল হয়েছেন। এখন আমি এইসব বলব? কথাবার্তা মােটামুটি পাকা হয়ে যাবার পর খুব কায়দা করে…….
‘না, যা বলবার এখনই বলবেন। মেয়েকে আমি একটা বাড়ি লিখে দেব, এটাও বলবেন। ৪৩ কাঁঠাল বাগান। একতলা বাড়ি। ইচ্ছা করলে বাড়ি দেখে আসতে পারেন
মেয়েই দেখলাম না, আর বাড়ি। ‘বাড়িটাই লােকে আগে দেখে, মেয়ে দেখে পরে। তবে মেয়েকে আপনি দেখবেন। আসতে বলেছি। আসুন, ভেতরে গিয়ে বসি।
তারা বসার ঘরে পা দেয়ামাত্র হাজি সাহেবের ছােট মেয়েটি ঘরে ঢুকল। কী শান্ত, স্নিগ্ধ মুখ। গভীর কালাে চোখে ডুবে আছে চাপা কষ্ট। সেই কষ্টের জন্যেই বুঝি এমন টলটলে চোখ।
ফিরােজ বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন, বস।”
মেয়েটি সঙ্গে-সঙ্গে বসল। তার আচার-আচরণে কিছুমাত্র জড়তা লক্ষ করা গেল । সে সরাসরি তাকিয়ে আছে, চোখ নামিয়ে নিচ্ছে না।
‘কি নাম তােমার?
লতিফা।
‘প্রায় চার বছর তােমাদের এদিকে আছি। নামটা পর্যন্ত জানি না। খুবই অন্যায়। তুমি কি আমার নাম জান?
‘জানি। হাজি সাহেব বললেন, লতিফা, তুই এখন ভেতরে যা। চা দিতে বল।”
লতিফা সঙ্গে-সঙ্গে উঠে চলে গেল। ফিরােজ একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস চেপে ফেলল। তার ইচ্ছে করছে, বলে—পাত্র হিসেবে আমাকে আপনার কেমন লাগে? | বলা হল না। আধুনিক সমাজে বাস করার এই অসুবিধে। মনের কথা খােলাখুলি কখনাে বলা যায় না। একটি মেয়েকে ভালাে লাগলেও তাকে সরাসরি সেই কথা বলা যাবে না। অনেক ভণিতা করতে হবে। অনেক চড়াই-উত্রাই পার হতে হবে।
হাজি সাহেব বললেন, ‘আমার মেয়েটা বড় আদরের। ফিরােজ কিছু বলল না। সে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছে। এই মুহূর্তে রাস্তায় বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটার একটা আলাদা মজা আছে। যে-কোনাে দিকে যাওয়া যায়, যেখানে ইচ্ছে সেখানে থেমে যাওয়া যায়। এই সৌভাগ্য ক’জনার হয়? সবাই ব্যস্ত। সবাই ছুটছে। এর মধ্যে দু’-এক জন অন্য রকম থাকুক না, যাদের ছােটার ইচ্ছে নেই, প্রয়ােজনও নেই। | এখন প্রায় বিকেল। হাঁটতে-হাঁটতে অপালাদের বাড়ির সামনে চলে যাওয়া যায়। কেন জানি এই অহঙ্কারী মেয়েটিকে দেখতে ইচ্ছে করছে। তার কঠিন মুখ, চোখের তীব্র দৃষ্টিও কেন জানি মধুর। এর ব্যাখ্যা কী? কোনাে ব্যাখ্যা নেই। এই রহস্যময় পৃথিবীর অনেক কিছুই ব্যাখ্যা করা যায় না। কবি, দার্শনিক, শিল্পীরা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। সেই চেষ্টা কত যুগ আগে শুরু হয়েছে, এখনও চলছে। ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ হয় নি।
‘ফিরােজ সাহেব, কী ভাবছেন? ‘কিছু ভাবছি না। শরীরটা খারাপ লাগছে।
সে কী! আজ আর চা-টা কিছু খাব না। ডাক্তারের কাছে যাব। বমি-বমি লাগছে।” ফিরােজ বমির ভঙ্গি করে চোখ-মুখ উল্টে দিয়ে বলল, ‘কাল রাতেও চার বার বমি হয়েছে। আমি উঠলাম।
অপালাদের বাড়ির সামনে ফিরােজ দাঁড়িয়ে আছে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন তাকে দেখা না-যায়। মানুষের অদৃশ্য হবার ক্ষমতা থাকলে বেশ হত। মেয়েটির পাশে দাঁড়িয়ে দেখা যেত সে কী করছে। এই মুহূর্তে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। চেইনে বাঁধা ভয়াবহ কুকুর দুটি চেইন ছিড়ে ফেলবার একটা কসরত করছে। মালীকে নিড়ানি হাতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া সব ফাঁকা।।
‘স্যার। ফিরােজ চমকে উঠল।
‘আপনাকে ডাকে স্যার। ‘কে ডাকে?’ ‘আপা আপনাকে যাইতে বলছে।
‘কোন আপা? ‘অপালা আপা। ‘সে কী। কোথায় তিনি?
অপালাদের দারােয়ান তার উত্তর দিল না। দারােয়ান-শ্রেণীর লােকেরা কথা কম বলে।
মেয়েটিকে সম্পূর্ণ অন্য রকম লাগছে। ফিরােজ ভেবে পেল না একই মেয়েকে একেক দিন একেক রকম লাগে কেন। এর পিছনের রহস্যটা কী? সাজগােজের একটা ব্যাপার থাকতে পারে। তার ভূমিকা কতই-বা আর হবে? চোখে কাজল দিয়ে চোখ দুটিকে টানা-টানা করা যায়। চুল মাঝখানে সিথি না-করে বাঁ দিকে করে খানিকটা বদলানাে যায়। পার্ম করে চুলে ঢেউ খেলানাে নিয়ে আসা যায়, কিন্তু তার পরেও তাে মানুষটি ঠিকই থাকবে।
‘বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ফিরােজ বসল। বসতে-বসতে মনে হল অপালার গলার স্বরও এখন অন্য রকম লাগছে। একটু যেন ভারী। আগেকার তরল কণ্ঠস্বর নয়।
‘আপনি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন। এর আগেও একদিন এসে ছিলেন। বেশ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে যান। কেন বলুন তাে?
ফিরােজ কী বলবে ভেবে পেল না। কিছু এই মুহূর্তেই বলা উচিত। মেয়েটি জবাব শােনবার জন্যে অপেক্ষা করছে। জবাবের ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। জবাব যদি তার পছন্দ হয়, তাহলে সে ফিরােজের সামনের চেয়ারটায় বসবে, পছন্দ না হলে বসবে না। অহঙ্কারী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকবে।
অপালা বলল, আপনার যদি আপত্তি থাকে তাহলে বলার দরকার নেই।
‘না, কোনাে আপত্তি নেই। আপনার সঙ্গে দেখা হবে এই আশাতেই দাঁড়িয়ে থাকি। দু’ দিন মাত্র নয়, তার আগেও কয়েক বার এসেছি।
ফিরােজ লক্ষ করল, মেয়েটির চেহারা কঠিন হতে শুরু করেছে। কী প্রচণ্ড রাগ এই মেয়ের! গাল কেমন টকটকে লাল হয়ে গেল—ঠোঁট কাঁপছে। মেয়েটি নিজেকে সামলাবার চেষ্টা করছে। সামলাতে পারছে না। মানুষের সঙ্গে কথা বলে এই মেয়ের তেমন অভ্যাস নেই। অভ্যাস থাকলে খুব সহজেই নিজেকে সামলাতে পারত। ফিরােজ বলল, আমার সব কথা না শুনেই আপনি রেগে যাচ্ছেন। সবটা আগে শােনা ভালাে নয় কি?
‘বলুন, শুনছি।
‘আপনি বসুন, তারপর বলছি। আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন আর আমি বসে-বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে কথা বলব, তা তাে হয় না। আর আপনি যদি মনে করেন যে আমার স্তর আর আপনার স্তর আলাদা, তাহলে অবশ্যি ভিন্ন কথা।
অপালা বসল। সে তাকিয়ে আছে ফিরােজের দিকে, এক বারও চোখ ফিরিয়ে
৪০
নিচ্ছে না। এটিও একটা মজার ব্যাপার। এই বয়সের অবিবাহিত মেয়েরা দীর্ঘ সময় পুরুষমানুষের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। অসংখ্য বার তারা চোখ নামিয়ে নেয়।
‘কি বলবেন, বলুন।
‘আমি নিজের মতাে করে আপনাদের একটা ঘর সাজিয়ে দিয়েছি। সেটা আপনাদের পছন্দ হয়েছে কি হয় নি আমাকে কিছু বলেন নি। আমার জানতে ইচ্ছা করে। জানবার জন্যেই আসি।’
‘আসেন তাে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন কেন?
‘আপনাদের দু’টি বিশাল কুকুর আছে। আমি কুকুর ভয় পাই। ছােটবেলায় আমাকে দু’ বার পাগলা কুকুরে কামড়েছে।
অপালার কঠিন মুখ স্বাভাবিক হয়ে আসছে। গালের লাগ রঙ এখন অনেকটা কম, নিঃশ্বাস সহজ।
‘আপনার কাজ আমার খুব পছন্দ হয়েছে। আমি ম্যানেজারকাকুকে বলেছিলাম, চিঠিতে আপনাকে জানানাের জন্যে। তিনি বােধহয় জানাতে ভুলে গেছেন।
‘চিঠিতেই যখন জানানাের জন্যে বলেছেন, আপনি নিজেও তাে জানাতে পারতেন। পারতেন না?
‘হা, পারতাম। ‘কাজ আপনার ভালাে লেগেছে শুনে খুশি হলাম। এখন তাহলে উঠি।
ফিরােজ উঠে দাঁড়াল। মনে ক্ষীণ আশা, মেয়েটি বলবে, বসুন, চা খেয়ে যান। সন্ধ্যাবেলা এইটুকু ভদ্রতা সে কি করবে না?
অপালা বলল, আপনি বসুন। আমার সঙ্গে চা খান।
ফিরােজ সঙ্গে-সঙ্গে বসে পড়ল। একবার ভেবেছিল রাগ দেখিয়ে বলবে—চা লাগবে না। সেটা বিরাট বােকামি হত। এ যে-ধরনের মেয়ে, দ্বিতীয় বার অনুরােধ করবে না। দু’ জন চুপচাপ বসে আছে। মেয়েটি চায়ের কথা বলার জন্যে ভেতরে যাচ্ছে
, কিংবা কাউকে ডেকেও কিছু বলছে না। এই পয়েন্টটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মানে হল, মেয়েটি তাকে ডাকতে পাঠাবার আগেই বলে দিয়েছে—আমরা খানিকক্ষণ গল্প করব, তখন আমাদের চা দেবে। অর্থাৎ কিছুক্ষণ সে গল্প করবে।
অপালা বলল, ‘আসুন, আমরা বারান্দায় বসে চা খাই। আমার চা খাবার একটা আলাদা জায়গা আছে। বিকেলের চা বন্ধ ঘরের ভেতর বসে খেতে ইচ্ছা করে না।
চা খাবার জায়গাটি অপূর্ব। যেন একটি পিকনিক স্পট। চারদিকে ফুলের টব। বড় বড় কসমস ফুটে রয়েছে। দিনের সামান্য আলােতেও তারা আনন্দে ঝলমল করছে। টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম। সেই সরঞ্জাম দেখে ফিরােজ একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপল। কারণ একটিমাত্র চায়ের কাপ। ওরা এক জনের চা-ই দিয়েছে। | অপালা টেবিলের পাশে দাঁড়ানাে মেয়েটিকে বলল, অরুণা ও বরুণাকে বেঁধে রাখতে বল। আরেকটি চায়ের কাপ দিয়ে যাও।’
কাজের মেয়েটি সন্দেহজনক দৃষ্টি ফেলতে-ফেলতে যাচ্ছে। কর্মচারীর মতাে যে ঢুকেছে, সে মুনিবের মেয়ের সঙ্গে চা খাচ্ছে, দৃশ্যটিতে সন্দেহ করার মতাে অনেক কিছুই আছে।।
‘আমার চায়ের জায়গাটা আপনার কেমন লাগছে?
খুব ভালাে লাগছে।’ ‘আপনার বােধহয় একটু শীত-শীত লাগছে। এরকম একটা পাতলা জামা পরে কেউ শীতের দিনে বের হয়। | আহ্, কী সহজ-স্বাভাবিক সুরে মেয়েটি কথা বলছে! কী প্রচুর মমতা তার গলায়। ফিরােজের মন কেমন যেন অন্য রকম হয়ে গেল।
‘আপনার বিয়েটা এখনাে হয় নি, তাই না?
কোন বিয়ে ? ‘ঐ যে একটি মেয়ের ছবি দেখালেন। বলছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ে হবে।
‘ও, আচ্ছা। না, এখনাে হয় নি। সামনের মাসে হবার সম্ভাবনা। মেয়ের এক চাচা আমেরিকাতে থাকেন। ছুটি পাচ্ছেন না বলে আসতে পারছেন না। মেয়ে আবার খুব আদরের। কেউ চায় না যে, তার অনুপস্থিতিতে বিয়ে হােক। বাঙালি হচ্ছে সেন্টিমেন্টাল জাত, বুঝতেই পারছেন। | প্রচুর মিথ্যা বলতে হয় বলেই মিথ্যা বলার আর্ট ফিরােজের খুব ভালাে জানা। মিথ্যা কখনাে এক লাইনে বলা যায় না। মিথ্যা বলতে হয় আঁটঘাট বেধে। সত্যি কথার
কোনাে ডিটেল ওয়ার্কের প্রয়ােজন হয় না, কিন্তু মিথ্যা মানেই প্রচুর ডিটেল কাজ।
| অপালা বলল, আপনি যে এখনাে বিয়ে করেন নি, সেটা কীভাবে বুঝলাম বলুন
=
কীভাবে বুঝলেন? ‘আপনার গায়ের পাতলা জামা দেখে। এই ঠাণ্ডায় আপনার স্ত্রী কিছুতেই এমন একটা জামা গায়ে বাইরে ছাড়তেন না।
ফিরােজ লক্ষ করল, মেয়েটি ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে হাসছে, যেন এই বিরাট আবিষ্কারে সে উল্লসিত।
আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন? ‘হ্যা, খাব। এক কাপ খেলে খালে পড়ার সম্ভাবনা।
‘আপনি নিশ্চয়ই আমাকে খুব অহঙ্কারী মেয়ে ভেবে বসে আছেন, তাই না? আমি কিন্তু মােটেই অহঙ্কারী না।’
তাই তাে দেখছি।’ ‘একা-একা থাকতে-থাকতে স্বভাবটা আমার কেমন অন্য রকম হয়ে গেছে।
একা-একা থাকেন কেন? ‘ইচ্ছা করে কি আর থাকি? বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। মা অসুস্থ। বাবা সারাক্ষণই বাইরে-বাইরে ঘুরছেন।
‘অন্য আত্মীয়স্বজনরা আসেন না?
‘কেন? ‘জানি না কেন। আমাকে বােধহয় পছন্দ করেন না। | ‘আপনাকে পছন্দ না-করার কী আছে? আমার তাে মনে হয় আপনার মতাে চমৎকার মেয়ে এই গ্রহে খুব বেশি নেই।’
ফিরােজ লক্ষ করল, মেয়েটি আবার রেগে যাচ্ছে। তার মুখে আগের কাঠিন্য ফিরে
৪২
আসছে। ফিরােজের আফসােসের সীমা রইল না। অপালা বলল, ‘আসুন, আপনাকে গেট পর্যন্ত আগিয়ে দিই।
অর্থাৎ অত্যন্ত ভদ্র ভাষায় বলা—বিদেয় হােন। ফিরােজের মন-খারাপ হয়ে গেল। আরেক বার আসার আর কোনাে উপলক্ষ নেই। দিন সাতেক পর সে যদি এসে বলে—ঐদিন একটা খাম কি আপনার এখানে ফেলে গেছি—তাহলে তা কি বিশ্বাসযােগ্য হবে? মনে হয় না। এই মেয়েটি অসম্ভব বুদ্ধিমতী।’
সে গেট পর্যন্ত ফিরােজের সঙ্গে-সঙ্গে এল, কিন্তু একটি কথাও বলল না। ফিরােজ যখন বলল, ‘যাই তাহলে। সে তার জবাবেও চুপ করে রইল। শুধু দারােয়ানকে বলল, ‘অরুণা এবং বরুণাকে এখন ছেড়ে দাও।
ফিরােজ কাজে লেগে পড়ল। মতিনের ডিজাইন রাখল না। সম্পূর্ণ নিজের পরিকল্পনা। পছন্দ হলে হবে, না হলে হবে না। এক সপ্তাহ সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত কাজ। এর মধ্যে অপালাকে একটি বারের জন্যেও নিচে নামতে দেখা গেল না। এক বার কিছু সময়ের জন্যে বারান্দায় এসেছিল, ফিরােজের দিকে চোখ পড়তেই চট করে সরে গেল। অপমানিত হবার মতাে ঘটনা, কিন্তু ফিরােজকে তা স্পর্শ করল না। এক বার কাজে ডুবে গেলে অন্য কিছু তার মনে থাকে না। দেয়ালের ডিসটেম্পার বদলাতে গিয়ে মনে-মনে ভাবল—এই অহঙ্কারী মেয়ে থাকুক তার অহঙ্কার নিয়ে, আমার কিছুই যায় আসে না। ডিসটেম্পারের রঙ কিছুতেই পছন্দ হচ্ছে না। তার প্রয়ােজন আকাশি রঙ, কিন্তু সেটা পাওয়া যাচ্ছে না। হয় বেশি গাঢ় হয়ে যাচ্ছে কিংবা বেশি হালকা। কড়া হলুদ এক বার দিয়ে দেখলে হয়। এতে রােদের এফেক্ট চলে আসতে পারে। হলুদ সবার অপছন্দের রঙ। ঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারলে ম্যাজিকের মতাে এফেক্ট সৃষ্টি হতে পারে। সে চতুর্থ বার ডিসটেম্পার বদলে আবার আগের নীল রঙে ফিরে গেল। গৃহসজ্জায় দেয়াল খুবই জরুরি। এই দেয়ালের রঙ ঘরকে বন্দি করে ফেলবে কিংবা মুক্তি দেবে।
কাজ শেষ হবার পরও অপালা দেখতে গেল না। রমিলাকে বলল, ‘চলে যেতে বল। আর ম্যানেজারবাবুকে বল টাকাপয়সা মিটিয়ে দিতে।
দাড়িওয়ালা লােকটা আফনের পছন্দ হয়েছে কি না জানতে চায়। পছন্দ হয়েছে। বেশ পছন্দ হয়েছে। দেখলেন না তাে আফা! দেখতে ইচ্ছা করছে না।
অপালা তার দু’ দিন পর নিশানাথবাবুর সঙ্গে ঘর দেখতে গেল। তার বিস্ময়ের সীমা রইল না। এ কী অদ্ভুত কাণ্ড! কি-রকম ফাঁকা-ফাঁকা শান্তি-শান্তি ভাব। মেঝেতে এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত কার্পেটের মতাে শীতল পাটি। ছােট-ছােট বেতের চেয়ারে হালকা নীল রঙের গদি। চেয়ারগুলি একটি গােল সেন্ট্রাল টেবিলের চারপাশে এমনভাবে সাজান, যেন পদ্মফুল ফুটে আছে। শীতল পাটিটিকে লাগছে। দিঘির কালাে জলের মতাে। দেয়ালে একটিমাত্র জলরঙ ছবি। ঘন বন, মাঝখানে ছােট্ট একটি জলা। সেই জলার পানিতে আকাশের নীল রঙের ছায়া পড়েছে। একটি ছােট্ট মেয়ে সেই পানিতে ভাসছে। সমস্ত ঘরটায় একটা স্বপ্ন-স্বপ্ন ভাব চলে এসেছে। অপালার বিস্ময় কাটতে দীর্ঘ সময় লাগল।
‘ম্যানেজারকাকু, কেমন লাগছে আপনার কাছে?
৩২
‘ভালােই তাে’ ‘শুধু ভালােই তাে! আরাে কিছু বলুন।
‘ছােকরা এলেমদার, তবে বিরাট ফক্কড়। যত টাকা নিয়েছে এই ঘর করতে, এর সিকি টাকাও লাগে না। ছাের্করা বিরাট ফোরটোয়েন্টি।
অপালা খিলখিল করে হেসে উঠল। এ-রকম শব্দ করে সে কখনাে হাসে না। নিশানাথবাবু এই মেয়েটির হঠাৎ এই উচ্ছ্বাসের কারণ বুঝতে পারলেন না।।
‘ম্যানেজারকাকু। ‘বল মা।
‘আপনি ফিরােজ সাবেহকে জানিয়ে দেবেন যে তাঁর সাজানাে ঘর আমার খুব পছন্দ হয়েছে। তাঁকে আন্তরিক ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাবেন।
‘দরকার কী? কাজ করেছে পয়সা নিয়েছে।
‘না, আপনি লিখবেন। আজই লিখবেন। কী লিখলেন, সেটা আমাকে দেখিয়ে নেবেন।
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।
‘ম্যানেজারকাকু, ঐ ছবিটার দিকে দেখুন। একটা ছােট্ট মেয়ে পানিতে ভাসছে। আচ্ছা, মেয়েটা কি সাঁতার কাটছে, না পানিতে ডুবে মারা গেছে?
হবে একটা কিছু। ‘ছবিটার মধ্যে একটা গল্প আছে। ভালাে করে তাকিয়ে দেখুন, আপনার মধ্যে একটা কষ্টের ভাব হবে।’
নিশানাথবাবু অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অবাক হয়ে বললেন, ‘কই, আমার তাে কিছু হচ্ছে না!
অপালা আবার খিলখিল করে হেসে ফেলল।
ফখরুদ্দিন সাহেবের মেজাজ অল্পতেই খারাপ হয়। দেশের মাটিতে সেই মেজাজ প্রকাশের যথেষ্ট পথ থাকলেও বিদেশে সম্ভব হয় না। আজ একের পর এক যে-সব কাণ্ড ঘটেছে, তাতে তাঁর মাথা খারাপ হয়ে গেলেও দোষের ছিল না। কিন্তু তিনি মাথা ঠাণ্ডা রেখেছেন। প্লেনে তাঁর পাশের সহযাত্রিণী অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে হড়-হড় করে বমি করল, তার খানিকটা এসে পড়ল তাঁর গায়ে। তিনি মুখ বিকৃত করে বললেন, ‘ইটস অলরাইট।’ এয়ার হােস্টেস সাবান-পানি দিয়ে তাঁর কোট কয়েকবার মুছে দিল। তবু বমির উৎকট গন্ধ গেল না। টয়লেটে গিয়ে কাপড় বদলানাে যেত। কিন্তু তাঁর সঙ্গে একটিমাত্র ব্রিফকেস। বড় স্যুটকেস দু’টি লাগেজ-কেবিনে।।
| প্লেন থেকে নামার সময়ও ছােট্ট দুর্ঘটনা ঘটল। সিঁড়িতে বেকায়দায় পা পড়ে পা মচকে গেল।
ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গেও কিছু কথা-কাটাকাটি হল। অফিসারটি বলল, তুমি লণ্ডনে কী জন্যে যাচ্ছ।?
তিনি বললেন, ‘তা দিয়ে তােমার কী দরকার? আমার পাসপাের্টে ভিসা দেয়া আছে। সেই ভিসায় আমি ঢুকব।
‘তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও। কেন যাচ্ছ, বিজনেস ট্রিপ, না প্লেজার ট্রিপ?
ফখরুদ্দিন সাহেব বিরস গলায় বললেন, ‘সর্দি ঝাড়ার জন্যে যাচ্ছি। তােমার এই দেশ নাকের সর্দি ফেলার জন্যে অতি উত্তম।
‘তুমি কি আমার সঙ্গে রসিকতা করবার চেষ্টা করছ? ‘হা, করছি।’
তােমার ব্রিফকেস খােল, ত্যাণ্ডব্যাগ খােল। চেকিং হবে।’ এক বার হয়েছে। ‘আরাে দশ বার হবে। তােমার সঙ্গে টাকাপয়সা কী পরিমাণ আছে?
যথেষ্টই আছে।’ ‘পরিমাণটা বল।
‘পরিমাণ তােমাকে বলার প্রয়ােজন দেখছি না। লিখিতভাবে আগেই এক বার বলা হয়েছে।
‘সুবােধ বালকের মতাে আরাে এক বার বল।’ ‘যদি বলতে না চাই? ‘তুমি এস আমার সঙ্গে। ‘কোথায়? ‘তােমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।’ ‘অতি উত্তম প্রস্তাব। চল, যাওয়া যাক।
ফখরুদ্দিন সাহেবকে তিন ঘন্টা বসিয়ে রাখা হল। যখন ছাড়া পেলেন, তখন তাঁর শরীর অবসন্ন। একটু পর পর বমি আসছে। বমির বেগ সামলাতে হচ্ছে। মাথায় তীব্র যন্ত্রণা।
| হােটেলে পৌছেই বাংলাদেশে কল বুক করতে চাইলেন। বলা হল—স্যাটেলাইটে ডিসটারবেন্স আছে, ওভারসিজ কল ছ’ ঘন্টার আগে করা যাবে না।
. হেলেনার খোঁজে তাঁর নার্সিং হােমে টেলিফোন করলেন। এ্যাটেনডেন্ট নার্স বলল, ‘পেসেন্ট ঘুমুচ্ছে।
ফখরুদ্দিন সাহেব বললেন, আমি ওর স্বামী।
নার্স মধুর হেসে বলল, তুমি পেসেন্টের স্বামীই হও বা প্রেমিকই হও, হার্টের রুগীকে ঘুম থেকে ডেকে তােলা যাবে না। সকাল আটটায় টেলিফোন করাে, কেমন? এখন শান্ত হয়ে ঘুমাও। রাত কত হয়েছে সেটা বােধহয় তুমি জান না। গুড নাইট।
রুম-সার্ভিসকে কফি দিতে বলেছিলেন। সেই কফি এল এক ঘন্টা পর। চুমুক দিয়ে তাঁর মনে হল, তিনি কুইনাইন-গােলা গরম পানি খাচ্ছেন। | সারা রাত তাঁর ঘুম হল না। ছটফট করতে লাগলেন। শেষরাতের দিকে প্রবল জ্বরে সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন হয়ে এল। তাঁর মনে হল এই হােটেলে তাঁকে মরতে হবে। আত্মীয়-পরিজনহীন নির্জন একটি ঘরে। শেষ মুহুর্তে পানি-পানি করে চেচাবেন কেউ শুনবে না। কোনাে প্রিয় মানুষের মুখ দেখতে চাইবেন, দেখতে পারবেন না।
প্রিয় মুখ এই সংসারে তাঁর নেই। বাবার মুখ আবছাভাবে মনে পড়লেও মা’র মুখ।
৩৪
মনে পড়ে না। বাবার মুখও অস্পষ্ট, তাঁর মুখে বসন্তের দাগ ছিল। মাথায় চুলগুলি ছিল লালচে ধরনের কোঁকড়ানাে। স্মৃতি বলতে এই। অবশ্যি এ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা কোনােকালেই ছিল না। যা চলে গিয়েছে, তা নিয়ে বুক চাপড়ানাে এক ধরনের বিলাসিতা। এই বিলাসিতা কবি এবং শিল্পীর জন্যে ঠিক আছে। তার জন্যে ঠিক নয়।
তাঁর চোখ পিছনের দিকে নয়, সামনের দিকে। | তিনি রুম-সার্ভিসের বােম টিপলেন। লাল বাতি জ্বলে জ্বলে উঠছে। কেউ আসছে
। অসম্ভব ক্ষমতাবান লােকেরা প্রায় সময়ই নিঃসঙ্গ অবস্থায় মারা যায়।
দরজায় নক হচ্ছে। কেউ বােধহয় এসেছে। ফখরুদ্দিন সাহেব বহু কষ্ট্রে বললেন, ‘কাম ইন। | লালচুলের বেঁটেখাটো এক জন মহিলা উকি দিল। ভয়-পাওয়া গলায় বলল, তােমার কী হয়েছে?
ফখরুদ্দিন সাহেব জবাব দিতে পারলেন না। শূন্যদৃষ্টিতে তাকালেন।
মনে হচ্ছে ফিরােজের বৃহস্পতি এখন তুঙ্গে। | বি. করিম সহেবের বন্ধু তাঁকে সহকারী ডিজাইনার হিসেবে নিয়েছেন। ভদ্রলােক ছােটখাটো। মাগুর মাছের মতাে কালােরও। ফিটফাট বা ধূ সেজে থাকেন। প্রীর কাছে গেলেই আফটার শেভ লােশনের কড়া গন্ধে মাথা ধরে যায়। তাঁর নাম মন্তাজ মিয়া। ছবির লাইনে পনের বছর ধরে আছেন। এখন পর্যন্ত কোনাে ছবি হিট করে নি। তার ধারণা, এবারের ছবিটি করবে। ছবির নাম ‘নয়া জিন্দেগি’—ইংরেজিতে ফ্রেশ লাইফ, নিউ লাইফ নয়।
এই ছবি হিট করবে, এ-রকম আশা করার সঙ্গত কারণ আছে। ছবিতে তিন জন হিরােইন। দু’ জন মারা যায়। শেষ পর্যন্ত এক জন টিকে থাকে। হিরাে এবং হিরােইন নয়া জিন্দেগি শুরু করে। ছটা গান আছে। প্রতিটি গানই কোলকাতার আর্টিস্টদের দিয়ে গাওয়ানাে। ব্যালে ড্যান্স আছে, যা রেকর্ড করা হয়েছে কোলকাতার এক ক্যাবারেতে। প্রিন্সেস সুরাইয়া এমন এক ড্যান্স দিয়েছে, যা দেখে এই বুড়াে বয়সেও মন্তাজ মিয়ার বুক ধরফড় করে। সেন্সর এই জিনিস কেটে দিলে সর্বনাশ হবে। ছবির অর্ধেক কাজ বিদেশে হয়েছে, বাকি অর্ধেক দেশে হবে। বেশির ভাগই আউটডােরে। ইনডােরে হিরাের বসার ঘর এবং বারান্দা। এমন সেট করতে হবে, যাতে রিকশাওয়ালা শ্রেণীর দর্শকদের চোখ কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসে। ক্রমাগত সিটি বাজাতে থাকে।
মন্তাজ মিয়ার সঙ্গে ফিরােজের নিম্নলিখিত কথাবার্তা হল ; “তুমি করে বললে আপত্তি আছে?” ‘জ্বি-না।
‘গুড। সবাইকে আমি তুমি করে বলি। এ-দেশের যে টপ নায়িকা, যার সাইনিং মানি পচিশ হাজার টাকা, তাকেও তুমি করে বলি।
ফিরােজ তাকিয়ে রইল, কিছু বলল না।
‘তুমি কাজে লেগে পড়। কীভাবে কী করতে হয়, আগে শেখ। আমি যা চাই সেটা হচ্ছে গ্ল্যামার। জি এল এ এম ও ইউ আর। বুঝলে?
‘জি, বুঝলাম। ‘বােম্বের ছবিগুলি দেখ। দেখে কাজ শেখ। ‘হ্যা, তাই করব।’ ‘বি করিম সাহেব বলেছেন, তুমি প্রতিভাবান লােক। সত্যি নাকি? ‘জি-না, সত্যি না।
‘গুড। ভেরি গুড। জি ও ও ডি। প্রতিভাবান লােকদের দিয়ে কিছু হয় না। আমি চাই কাজ। ওয়ার্ক। ডাবলিউ ও আর কে। বুঝলে?
‘জ্বি, বুঝলাম। ‘মদ্যপানের অভ্যাস আছে? ‘না।
‘অল্পসল্প খেতে পার। এতে দোষ নেই। অল্প খেলে মেডিসিনের মতাে কাজ করে। ব্রেইন শার্প হয়। ওয়েস্টার্ন কান্ট্রিগুলি যে এতদুর এগিয়ে গেছে জ্ঞানে, বিজ্ঞানে, শিল্পে, সংস্কৃতিতে—এর পিছনে অ্যালকোহলের একটা ভূমিকা আছে বলে আমার ধারণা।
‘আপনার ধারণা সত্যি হবারই সম্ভাবনা। | ‘নায়িকাদের সঙ্গে খাতির জমাবার চেষ্ট করবে না। দূর থেকে ম্যাডাম বলে স্নামালিকুম দেবে। তারপর ভ্যানিশ হয়ে যাবে। ফিল্ম লাইনে তােমার হবে বলে আমার ধারণা।’
‘তাই নাকি?
‘হা। আমার ই এম পি ক্ষমতা আছে। আগেভাগে বলে ফেলতে পারি। মন্দিরা যখন প্রথম ফিল্ম লাইনে আসে, তাকে দেখেই আমি বললাম, তােমার হবে।’
হয়েছে?
হয়েছে মানে! দু’ লক্ষ টাকার আর্টিস্ট এখন। শিডিউল নিতে হয় এক বছর আগে। আমাকে এখনাে খুব মানে। সেদিন এক পত্রিকার ইন্টারভুতে আমার নাম বলেছে।
‘মন্দিরা কাজ করছে নাকি আপনার ছবিতে?
‘তুমি এখন ফিল্ম লাইনের লােক। নায়িকাদের নাম ধরে কথা বলবে না। এখন থেকে প্রাকটিস কর। বল—মন্দিরা ম্যাডাম।’
ফিরােজ হেসে বলল, মন্দিরা ম্যাডাম।’
‘হাসবে না। ফিল্ম লাইনে দাঁত বের করতে নেই। আচ্ছা, এখন যাও। কাল দু’ নম্বর স্টুডিওতে চলে আসবে।
ফিরােজ সেট তৈরি করে দিল। মন্তাজ মিয়া চোখ-মুখ কুঁচকে দীর্ঘ সময় সেই সেটের সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ফিরােজ বলল, মনে হচ্ছে আপনার মনমতাে হয় নি? মন্তাজ মিয়া তারও জবাব দিলেন না। ‘পছন্দ না হলে অদলবদল করে দেব। হাতে তাে সময় আছে। ‘পছন্দ হয়েছে। ছােকরা, তােমার হবে।
| সেই সপ্তাহেই মধুমিতা মুভিজ-এর ব্যানারে নতুন যে-ছবিটি হবে, তার চীফ ডিজাইনার পদের অফার ফিরােজের কাছে চলে এল। ফিরােজ বলল, ‘ভেবে দেখি।”
মধুমিতা মুভিজ-এর মালিক বললেন, ‘ক’দিন লাগবে ভাবতে? ‘সপ্তাহখানেক লাগবে।’
‘বেশ, ভাবুন। সপ্তাহখানেক পর আবার যােগাযােগ করব। আপনার টেলিফোন আছে?
একটা টেলিফোন নিয়ে নিন। ছবির লাইনে টেলিফোনটা খুবই দরকারি। | ‘নিয়ে নেব। শিগগিরই নিয়ে নেব। তারপর একটা গাড়ি কিনব। লাল রঙের। টু ডাের। গাড়ি সম্পর্কে আপনার কোনাে ধারণা আছে? মানে কোনটা ভালাে, কোনটা মন্দ?
পর-পর দু’ দিন ফিরােজ ঘুমিয়ে কাটাল।
এ-রকম সে করে। তার ভাষায়, দুঃসময়ের জন্যে ঘুম স্টক করে রাখা। সেই স্টক-করা ঘুমের কারণে ভবিষ্যতে কোনাে রকম আলস্য ছাড়াই নাঘুমিয়ে থাকতে পারে। উট যেমন দুঃসময়ের জন্যে পানি জমা করে রাখে, অনেকটা সে-রকম। শুধু দুপুরে খাবার সময় পাশের ‘ইরাবতী’ হােটেলে খেতে গেছে। বাংলাদেশ হওয়ায় এই একটি লাভ ; সুন্দর-সুন্দর নামের ছড়াছড়ি। পানের দোকানের নাম ‘ময়ূরাক্ষী; জুতাের দোকানের নাম সােহাগ পাদুকা’।।
ইরাবতী রেস্টুরেন্টের নাম হওয়া উচিত ছিল- ‘নালাবতী’। পাশ দিয়ে কর্পোরেশনের নর্দমা গিয়েছে। নর্দমাগুলি বানানাের কায়দা এমন যে, পানি চলে যায়, কিন্তু ময়লা জমা হয়ে থাকে। সেই পূতিগন্ধময় নরকের পাশে খাবার ব্যবস্থা। তবে রান্না ভালাে। পচা মাছও এমন করে বেঁধে দেয় যে দ্বিতীয় বার যেতে ইচ্ছে করে। ইরাবতী রেস্টুরেন্টে ফিরােজের তিন শ’ টাকার মতাে বাকি ছিল। সে বাকি মিটিয়ে আরাে দু’ শ’ টাকা অ্যাডভান্স ধরে দিল। দিনকাল পাল্টে গেছে। অ্যাডভান্স পেয়েও লােকজন খুশি হয় না। ম্যানেজার এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন কিছুক্ষণ আগে একটি জ্যান্ত ইদুর গিলে ফেলেছে। সেই ইদুর হজম হয় নি, পেটে নড়াচড়া করছে।
ফিরােজ বলল, ‘আছেন কেমন ভাইসাব ? ‘ভালােই। আপনারে তাে দেখি না। ‘সিনেমা নিয়ে ব্যস্ত। সিনেমায় নেমে পড়েছি, বুঝলেন? ম্যানেজার ফুস করে বলল, “ভালােই।
‘আপাতত হিরােইনের বড় ভাইয়ের রােল করছি। মােটামুটি একটা সেন্ট্রাল ক্যারেক্টার। বই রিলিজ হলে দেখবেন। পাস দিয়ে দেব।’
‘নাম কী বইয়ের?
নয়া জিন্দেগি। হিট বই হবে।’ ফিরােজ রেস্টুরেন্ট থেকে বের হয়ে মিষ্টি পান কিনল। রাতে আর খেতে আসবে । ঘরেই যা হােক কিছু খেয়ে নেবে, কাজেই পাউরুটি, কলা এবং এক কৌটা মাখন কিনল। বাজারে নতুন বরই উঠেছে, খেতে ইচ্ছা করছে। ভাংতি টাকা সব শেষ। একটা
৩৭
পাঁচ শ টাকার নোেট আছে, সেটা ভাঙাতে ইচ্ছা করছে না। বরই না-কিনেই সে ফিরে এল। ছেলেমানুষি একটা আফসােস মনে জেগে রইল।
হাজি সাহেব বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে আছেন। ফিরােজ হাসিমুখে এগিয়ে গেল।
‘আমার কি সৌভাগ্য। গলা চিনে ফেলেছেন। ‘ঠাট্টা করছেন নাকি ভাই? ‘পাগল হয়েছেন। আপনার সঙ্গে কি আমার ঠাট্টার সম্পর্ক? ‘আমার চিঠিটা নিয়ে গিয়েছিলেন? ‘হা, গিয়েছিলাম। বহু কষ্টে ব্যাটার ঠিকানা বের করতে হয়েছে। ‘কী বলেছেন উনি?
‘আপনার পারসােনাল টাচওয়ালা পেনসিলের চিঠিটা পড়ে মুখ বিকৃত করে বলল, বি. করিম—এই শালা আবার কে? আমার কাছে পেনসিলে চিঠি লেখে, আস্পর্ধা তাে কম নয়।
করিম সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে মেঘস্বরে বললেন, ‘ফিরােজ সাহেব, একটা কথা শুনুন।
‘বলুন।’
কেন সবসময় এ-রকম উল্টোপাল্টা কথা বলেন? ‘সত্যি কথা বলছি। শুধু-শুধু মিথ্যা বলব কেন?’
‘ঐ ভদ্রলােকের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছে। আপনি তাঁর কাছে এখনাে যান নি। তিনি ঠিকানা বদলেছেন, এখন থাকেন রামকৃষ্ণ মিশন রােডে।
ও, আচ্ছা। ‘আপনি গেলেই উনি আপনাকে কাজ দেবেন। ‘মেনি থ্যাংকস। ‘ফিরােজ সাহেব।
‘আচার-আচরণ সাধারণ মানুষের মতাে করার চেষ্টা করুন। ইয়ারকি- ফাজলামি তাে যথেষ্ট করলেন। বয়স কত আপনার?
‘পঁয়ত্রিশ। ‘বয়স তাে মাশাআল্লাহ্ কম হয় নি। আরেকটা কথা। ‘বলুন, শুনছি।
ফখরুদ্দিন সাহেবের বাড়িতে একবার যাবেন।
কেন? ‘ওনার মেয়ে টেলিফোনে আপনাকে চাচ্ছিল।
বলেন কী! কীরকম গলায় চাইল? কীরকম গলায় মানে! প্রেম-প্রেম গলা, না রাগ-রাগ গলা?
বি করিম সাহেব তার উত্তর দিলেন না। টেলিফোন নামিয়ে রাখলেন। রাগে তাঁর গা জ্বলে যাচ্ছে। ফিরােজ হৃষ্টচিত্তে খেতে বসল। প্রচুর আয়ােজন। টেবিলের দিকে তাকাতেই মন ভরে যায়।।
‘সিরিয়াস এক বড়লােকের মেয়ের সঙ্গে প্রেম হয়ে গেছে, বুঝলে আপা। একেবারে লুদকালদকি প্রেম।
তাজিন কিছু বলল না। একটা বিশাল আকৃতির সরপুটি ভাজা ফিরােজের পাতে তুলে দিল।
| ‘ঐ মেয়ে আমার খোঁজে দিনে চার বার পাঁচ বার করে অফিসে টেলিফোন করছে। বি করিম সাহেবের কান ঝালাপালা।
‘সত্যি-সত্যি বলছিস?’
এই যে মাছ হাতে নিয়ে বলছি। বাঙালির ছেলে মাছ হাতে মিথ্যা কথা বলে না। মেয়েটার নাম কি? ‘অপালা। বিয়ের পর অপা করে ডাকব। অপালা শব্দটার মানে কী, জানিস নাকি? জানি না। মেয়েটাকে ছবিতে যে-রকম দেখাচ্ছে আসলেও কি সে-রকম
ফিরােজ ভাত মাখতে-মাখতে বলল, ‘তুই একটা মিসটেক করে ফেললি রে আপা। ছবির মেয়ে আর ঐ মেয়ে দুই ভিন্ন ব্যক্তিত্ব। তুই গুবলেট করে ফেলেছিস।
| তাজিন রাগ করতে গিয়েও করতে পারল না। তাদের পাঁচ বােনের পর এই এক ভাই। আদরে-আদরেই ওর মাথা নষ্ট হয়েছে। জীবনে কিছুই করল না। কোনাে দিন যে করতে পারবে তাও মনে হচ্ছে না।
‘ফিরােজ। ‘ব।’ ‘সবটাই কি তাের কাছে একটা খেলা?’ ‘খেলা হবে কেন?
তাজিন আর কিছু বলল না। ফিরােজের খাওয়া দেখতে লাগল। কেমন মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে খাচ্ছে। গালভর্তি দাড়ি। হঠাৎ দাড়ি রাখার শখ হল কি জন্যে কে বলবে? জিজ্ঞেস করলে অদ্ভুত কিছু বলে হাসাতে চেষ্টা করবে। ইদানীং আর ফিরােজের কথায়
তার হাসি আসে না, রাগ ধরে যায়। চড় মারতে ইচ্ছে করে।
‘দাড়িতে আমাকে কেমন লাগছে রে আপা? ‘ভালাে।’ ‘রবীন্দ্রনাথ-রবীন্দ্রনাথ ভাব চলে এসেছে না?
তাজিন কিছু বলল না। ‘রবীন্দ্রনাথের মুখের গঠনের সাথে আমার মুখের গঠনের অদ্ভুত মিল আছে।
২৬
চুলদাড়িগুলি আরেকটু লম্বা হােক, দেখবি।
‘তখন কী করবি? একটা আলখাল্লা কিনবি?’ | ‘এটা মন্দ বলিস নি আপা। একটা আলখাল্লা কিনলে হয়। রেডিমেড বােধহয় পাওয়া যায় না। অর্ডার দিয়ে বানাতে হবে। তারপর সেই আলখাল্লা পরে বাংলা একাডেমীর কোনাে একটা অনুষ্ঠানে গিয়ে সবাইকে ভড়কে দেব। চারদিকে ফিসফাস শুরু হবে—গুরুদেব এসে গেছেন।
চুপ কর দেখি!
‘সরি, আমার আবার মনেই থাকে না তুই বাংলার ছাত্রী। দে, একটা পান দে। চমনবাহার থাকলে চমনবাহার দিয়ে দে।’
অপালা যে-বার ক্লাস এইটে বৃত্তি পেল, সে-বার তার বাবা তাকে চমৎকার একটা উপহার দিয়েছিলেন। লিসবন থেকে কেনা মরক্কো চামড়ায় বাঁধাই-করা পাঁচ শ’ পাতার বিশাল একটা খাতা। মলাটে একটি স্প্যানিস নর্তকীর ছবি। চামড়ায় এত সুন্দর ছবি কী করে আকা হল কে জানে! দেখলে মনে হয় মেয়েটি চামড়া ফুড়ে বের হয়ে এসে নাচা শুরু করবে।
ভেতরের পাতাগুলির রঙ মাখনের মতাে। কী মসৃণ। প্রতিটি পাতায় অপূর্ব সব জলছাপ। গাছপালা, নদী, আকাশের মেঘ।
ফখরুদ্দিন সাহেব হাসতে-হাসতে বললেন, ‘উপহারটি মনে হয় খুব পছন্দ হয়েছে?
আনন্দে অপালার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সে নিজেকে সামলে গাঢ় গলায়। বলল, হ্যা।
এখন থেকে এই খাতায় গল্প, কবিতা, নাটক—এইসব লিখবে। এইসব তাে আমি লিখতে পারি না বাবা। ‘লিখতে-লিখতেই লেখা হয়। চেষ্টা করবে। ঐ সব না পার, জীবনের বিশেষ বিশেষ ঘটনা লিখে রাখবে। এই যে তুমি বৃত্তি পেলে, এটা তাে বেশ একটা বড় ঘটনা। সুন্দর করে এটা লিখবে। তারপর তােমার যখন অনেক বয়স হয়ে যাবে, চুল হবে সাদা, চোখে ছানি পড়বে—তখন ঐ খাতাটা বের করে পড়বে, দেখবে কত ভালাে লাগে।’
‘আমি কোনােদিন বুড়াে হব না বাবা। ‘তাই বুঝি? ফখরুদ্দিন সাহেব ঘর কাঁপিয়ে অনেকক্ষণ ধরে হাসলেন।
চমৎকার সেই খাতায় প্রথম এক বছর অপালা কিছুই লিখল না। তার অনেক বার লিখতে ইচ্ছে করল, কলম নিয়ে বসল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুন্দর পাতাগুলি নষ্ট করতে ইচ্ছে করল না। সে খাতা খুলে রেখে মনে-মনে পাতার পর পাতা লিখে যেতে লাগল। অনেক লেখা পছন্দ হল না, সেগুলি মনে-মনেই কেটে নতুন করে লিখল।
১৭
ক্লাস নাইনে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষার শেষ দিনে সে প্রথম বারের মতাে লিখল। সাধু ভাষায় লেখা সেই অংশটিই এই
আজ আমার পরীক্ষা শেষ হইয়াছে। আমার মনে কোনাে আনন্দ হইতেছে না। পরীক্ষা বেশ ভালাে হইয়াছে। তবে কেন আমার আনন্দ হইতেছে না? আমি সঠিক জানি না। মাঝে-মাঝে খুব আনন্দের সময় আমার দুঃখ লাগে। আমি কাঁদিয়া ফেলি। গত বছর আমরা নেপালের পােখরা’ নামক একটি স্থানে গিয়াছিলাম। চারিদিকে বিশাল পাহাড়। কত সুন্দর দৃশ্য। বাবা এবং মা’র মনে কত আনন্দ হইল। বাবা ক্যামেরা দিয়া একের পর এক ছবি তুলিতে লাগিলেন। কিন্তু কোনাে কারণ ছাড়াই আমার মনে খুব দুঃখ হইল। গলা ভার-ভার হইল। চোখ দিয়া পানি আসিতে লাগিল। ভাগ্যিস কেহ দেখিতে পায় নাই।” | অপালার খাতাটি ক্রমে ভরে উঠতে লাগল। ক্লাস টেনে উঠে প্রথম গল্প লিখল। বয়সের সঙ্গে তার গল্পটি মিশ খায় না। গল্পের নাম রাজ-নর্তকী। গল্পের বিষয়বস্তু পনের বছরের মেয়ের কলমে ঠিক আসার কথা নয়। শুরুটা এ-রকম ?
রাজ-নর্তকী মহিমগড়ের রাজপ্রাসাদে থাকে এক নর্তকী। রাজসভাতে গান করে, নাচে। তার নাচ যে-ই দেখে সে-ই মুগ্ধ হয়। সেই রাজসভায় এক দিন এলেন ভিনদেশি এক কবি। তিনি নর্তকীর নাচ দেখে মুগ্ধ হলেন। হাত জোড় করে বললেন, ‘দেবী, আমি কি আপনার নাম জানতে পারি? নর্তকী হাসিমুখে বলল, আমার নাম অপালা। ‘দেবী, আমি কি নিভৃতে আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারি?
হ্যা, পারেন। আসুন গােলাপ বাগানে।। তারা দু জন গােলাপ বাগানে গেল। ফুলে-ফুলে চারদিক আলাে হয়ে আছে। রাজ-নর্তকী অপালা বলল, ‘কী আপনার নিবেদন, কবি? আপনি আমার কাছে কী চান?
যা চাই তাই কি আমি পাব? এত বড় সৌভাগ্য সত্যিই কি আমার আছে? তা তো বলতে পারছি না। আগে আমাকে বলতে হবে, আপনি কী চান? ‘আমি আপনাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখতে চাই।’ ‘বেশ তাে, লিখুন। ‘আপনার অপূর্ব দেহ-সুষমা নিয়ে একটি কবিতা লিখতে চাই।
বেশ তাে।’ কিন্তু দেবী, তার জন্যে আপনার দেহটিকে তাে আমার দেখতে হবে। দেখতেই তাে পাচ্ছেন। পাচ্ছেন না? ‘না, পাচ্ছি না। আপনার অপূর্ব দেহটি আড়াল করে রেখেছে কিছু অপ্রয়ােজীয়-পােশাক। এইগুলি। খুলে ফেলুন। পােশাক আপনার জন্যে বাহুল্য। এত সুন্দর একটি শরীরকে পােশাক ঢেকে রাখবে এটা কিছুতেই আমি মেনে নিতে পারি না। সে খানিকক্ষণ ভাবল, তারপর একে একে খুলে ফেলল সব। শুধু গলায় রইল একটি চন্দ্রহার। সে চলুহারও খুলে ফেলতে গেল। কিন্তু কবি চেচিয়ে উঠলেন, না না, চন্দ্রহার খােলার সরকার নেই। চন্দ্রহার সরিয়ে ফেললে দেহের সমস্ত সৌন্দর্য একসঙ্গে আমার চোখে এসে পড়বে। আমি তা সহ করতে পারব না। গলায় শুধুমাত্র চন্দ্রহার পরে সে বাগানে হাঁটতে লাগল। আর রাজকবি একটি গাছের ছায়ায় তাঁর কবিতার খাতা নিয়ে বসলেন। আকাশ ঘন নীল। সূর্য তার হলুদ ফুল ছুঁড়ে দিচ্ছে চারদিকে। বাতাসে সেই হলুদ ফুলের নেশা ধরানাে গন্ধ। গাছে-গাছে পাখি ডাকছে।
গল্পের শেষ অংশ বেশ নাটকীয়। হঠাৎ বাগানে প্রবেশ করলেন রাজা। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। রাজ-নর্তকী অপালার মৃত্যুদণ্ড ইল | কবির চোখ অন্ধ করে দেয়া হল। অন্ধ কবি পথে-পথে ঘুরে বেড়ান এবং নর্তকীকে নিয়ে গীত রচনা করেন। অপূর্ব সব গীত। তিনি নিজেই তাতে সুর দেন। নিজেই গান। বনের পশু পাখিরা পর্যন্ত সেই গান শুনে চোখের জল ফেলে।
পরবতী কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে কবির লেখা গীত। গীতগুলি গদ্যের মতাে সরল নয়। ছেলেমানুষি ছড়া।
| এই লেখার পর প্রায় দু বছর আর কিছু লেখা হয় নি। দু’ বছর পর হঠাৎ লেখা—আমার জীবন। গদ্য এখানে অনেক স্বচ্ছ, গতিময়। হাতের লেখাও বদলে গেছে। আগের গােটা-গােটা হরফ উধাও হয়েছে। এসেছে প্যাচানাে ধরনের অক্ষর। আগের কোনাে লেখায় কোনাে রকম কাটাকুটি নেই। মনে হয় আগে অন্য কোথাও লিখে পরে খাতায় তােলা হত। আমার জীবন লেখাটিতে প্রচুর কাটাকুটি।
T
আমার জীবন আমি কি খুব বুদ্ধিমতী ? মনে হয় না। কেউ কোনাে হাসির কথা বললে আমি বুঝতে পারি না। আজ বড় খালার বাসায় সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছিল। এটা যে ঠাট্টা, আমি বুঝতে পারি নি। কী নিয়ে কথা হচ্ছে তাও বুঝতে পারছি না। অবাক হয়ে সবার মুখের দিকে তাকাচ্ছি। বড় খালার মেয়ে বিনু হেসে গড়িয়ে পড়ছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, আমি তাে কিছু বুঝতে পারছি না। বড় খালা বললেন, কম বােঝাই তােমার জন্যে ভালাে। বেশি বুঝলে বা বুঝতে চাইলে ঝামেলায় পড়বে। আমি এই কথার মানে বুঝলাম না। মন-খারাপ করে বাসায় চলে এলাম। সারা দুপুর ডাবলাম। তখন একটা জিনিস আমার কাছে পরিষ্কার হল আমাকে বাবা এবং মা ছাড়া কেউ পছন্দ করেন না। যেমন বড় খালা, তিনি ছােট খালার ছেলেমেয়েকে তুই করে বলেন, মেজো খালার ছেলেমেয়েকে তুই করে বলেন; আমাকে বলেন তুমি করে।। সন্ধ্যাবেলা বাবাকে আমি এই কথাটা বললাম। বাবা চট করে খালাদের উপর রেগে গেলেন এবং বলতে লাগলেন—যা কেন তাদের বাসায় ? আর যাবে না। ‘ওঁরাও এ-বাড়িতে আসবে না। দারােয়ানকে বলে দেব এলে যেন গেট খােলা না হয়। বাবার রাগ যেমন চট করে ওঠে তেমনি চট করে নেমে যায়। এইবার তা হল না। কী লজ্জার কাণ্ড! পরদিন সকালবেলা বাবা বড় খালাকে টেলিফোন করে বললেন—আপনি সবাইকে তুই-তুই করে বলেন, আমার মেয়েটাকে তুমি বলেন কেন? ভাগ্যিস বাবার এসব কাণ্ডকারখানা মা জানতে পারেন নি। জানলে খুব মন খারাপ করতেন। মার হার্টের অসুখ খুব বেড়েছে। নড়াচড়াই করতে পারেন না। এই অবস্থায় মল-খারাপ করার মতো কোনাে ঘটনা ঘটতে দেয়া উচিত নয়। কিন্তু বাৰা এসব কিছু শুনবেন না। যা তাঁর মনে আসে, করবেন। আমার মাঝে-মাঝে মনে হয় মার এই অসুখের মূল কারণ হয়তাে-বা বাবা। কী লিখছি আবােল-তাবােল, হার্টের অসুখের কারণ বাবা হতে যাবেন কেন? তাঁর মতাে ভালাে মানুষ ক’জন আছে?
আজ অনেক দিন পর অপালা তার খাতা নিয়ে বসেছে। কোনাে কিছু লেখার উদ্দেশ্যে নয়। পুরনাে লেখায় চোখ বােলানাের জন্যে। রাজ-নর্তকী গল্পটি সে পড়ছিল। এ-রকম একটা অদ্ভুত গল্প এত অল্প বয়সে সে কেন লিখেছিল ভাবতে-ভাবতে লজ্জায় গাল লাল হয়ে উঠল। এই গল্পটি ছিড়ে ফেলতে হবে। কিন্তু খাতা থেকে পাতা ছিড়তে মায়া লাগে। এই গল্পটি এখন ভালাে লাগছে না, আজ থেকে কুড়ি বছর পর
হয়তাে-বা ভালাে লাগবে।
‘আফা।
অপালা চমকে তাকাল। রমিলা যে উঠে এসেছে, তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে, সে লক্ষই করে নি।
‘আফনেরে নিচে ডাকে।
কে? ‘ঐ যে দাড়িওয়ালা লােকটা, ঘর ঠিক করে যে।
ও আচ্ছা। বসতে বল, আমি আসছি।’
রমিলা গেল না, দাঁড়িয়ে রইল। অপালা শান্ত স্বরে বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছ কেন? কিছু বলবে?
‘আপনে দুপুরে কিছু খাইলেন না আফা। ‘খিদে ছিল না।” ‘অখন এটু নাস্তাপানি আনি?
‘আন। আর ঐ লােকটাকে আগামী কাল আসতে বল। আমার নিচে নামতে ইচ্ছা। করছে না।
‘জি আচ্ছা।
ফিরােজ ঘড়ি আনতে ভুলে গিয়েছে, কাজেই কতক্ষণ পার হয়েছে বলতে পারছে না। এই অতি আধুনিক বসার ঘরটিতে কোনাে ঘড়ি নেই। সাধারণত থাকে। কোকিল-ঘড়ি বা এই জাতীয় কিছু। এক ঘন্টা পার হলেই খুট করে দরজা খুলে একটা কোকিল বের হয়। কুকু করে মাথা ধরিয়ে দেয়। সময় পার হয়ে যাচ্ছে, ব্যাপাটাই যন্ত্রণাদায়ক। এর মধ্যে কু-কু করে কেউ যদি সেটা মনে করিয়ে দেয়, তাহলে আরাে খারাপ লাগার কথা। ঘড়ি চলবে নিঃশব্দে। কেউ জানতে চাইলে সময় দেখবে। যদি কেউ জানতে না চায়, তাকে জোর করে জানানাের দরকার কী?
অ্যাসট্রেতে চারটি সিগারেট পড়ে আছে। এই থেকে বলা যেতে পারে, পঞ্চাশ মিনিটের মতাে পার হয়েছে। পঞ্চাশ মিনিট অবশ্যি এক জন রাজকন্যার দর্শনলাভের জন্যে যথেষ্ট নয়। রাজকন্যাদের জন্যে পঞ্চাশ ঘন্টা বসে থাকা যায়।
পর্দা সরিয়ে রমিলা ঢুকল, দাঁত কেলিয়ে বলল, আফা আসতাছে। ফিরােজ মনে মনে বলল, ধন্য হলাম। রাজকন্যার আগমনবার্তা নকিব ঘোষণা করল। এখন সম্ভবত জাতীয় সঙ্গীত বাজবে—আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি।
‘ফিরােজ সাহেব, আপনি কি ভালাে আছেন? ‘জি, ভালাে।’ ‘আপনি ঐ দিন এসেছিলেন, আমার মনটা খুব খারাপ ছিল, নিচে নামতে ইচ্ছা ছিল না। আপনি কিছু মনে করেন নি তাে?’।
“না না, কিছু মনে করি নি। একা-একা বসে থাকতে আমার ভালােই লাগে।’
32
‘আপনার ঐ কাজের ব্যাপারটা নিয়ে বাবার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। তিনি ওকে বলেছেন।
প্রথমে তাে আপনি “নাে” বলে দিয়েছিলেন, আবার কেন…… ‘আপনার চাকরি চলে যাবে বলছিলেন যে, তাই। আপনি বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
ফিরােজ বসল। বসতে গিয়ে মনে হল, এই মেয়েটি বসবে না। কথা বলবে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে। যে-কোনােভাবেই হােক, বুঝিয়ে দেবে, তুমি আর আমি একই আসনে পাশাপাশি বসতে পারি না। সেটা শােভন নয়। কিন্তু অবাক কাণ্ড, মেয়েটি বসল। ফিরােজ বলল, আমি অবশ্যি খুব ভয়েভয়ে এসেছি। ভেবেছি আপনি গালাগালি করবার জন্যে আমাকে ডেকেছেন।
কী আশ্চর্য। গালাগালি করব কেন?
যেদিন আপনি আমার কাজ বন্ধ করে দিলেন, সেদিন রাগ করে আপনাদের একটা দামী কাপ ভেঙে ফেলেছিলাম। ‘তাই নাকি! বাহ, বেশ তাে!’
আপনি জানতেন না?’ অপালা অবাক হয়ে বলল, ‘সামান্য কাপ ভাঙার ব্যাপারে আমি জানব কেন? ‘ও, আচ্ছা।
‘আপনি যে-দিন ইচ্ছা কাজ শুরু করতে পারেন। যে-কোনাে প্রয়ােজনে আমাদের ম্যানেজারবাবুর সঙ্গে কথা বললেই হবে। আমি পড়াশােনা নিয়ে ব্যস্ত, নিচে সাধারণত নামি না।
কিসের এত পড়াশােনা? ‘অনার্স ফাইন্যাল।
‘ও, আচ্ছা। আপনাকে অবশ্যি অনার্স ফাইন্যালের ছাত্রী মনে হয় না। মনে হয় কলেজ-টলেজে পড়েন।
| অপালা কিছু বলল না। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হল। ফিরােজ সেটা লক্ষ করল না। ফুর্তির ভঙ্গিতে বলতে লাগল, পড়াশােনা করতে-করতে যদি ব্রেইন টায়ার্ড হয়ে যায়, তাহলে চলে আসবেন, আমি কাজ বন্ধ রেখে আপনার সঙ্গে গল্প-গুজব করব, ব্রেইন আবার ফ্রেশ হয়ে যাবে।’
তার মানে? আপনি কী বলতে চাচ্ছেন? | ফিরােজ অবাক হয়ে দেখল, মেয়েটির মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। ঠোট অল্প অল্প কাঁপছে। এতটা রেগে যাবার মতাে কিছু কি সে বলেছে?
| ‘আপনি হঠাৎ এমন রেগে গেলেন কেন? আমি অন্য কিছু ভেবে এটা বলি নি। আপনার চেয়ে অনেক-অনেক রূপবতী একটি মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। সেই মেয়েটিকে আগামী সপ্তাহে আমি বিয়ে করছি। দেখুন, তার ছবি দেখুন। | ফিরােজ হাজি সাহেবের মেয়ের ছবিটি টেবিলে রাখল। ভাগ্যিস ছবিটি সঙ্গে ছিল! মেয়েটি একদৃষ্টিতে ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছি। ফিরােজ সহজ স্বরে বলল, ‘আপনাকে গল্প করতে এখানে আসতে বলার পেছনে কোনাে উদ্দেশ্য ছিল না। আশা করি এটা আপনি বুঝতে পারছেন। আরেকটি কথা, যদি সেরকম কোনাে উদ্দেশ্য
আমার থাকে, তাহলে সেটা কি খুব দোষের কিছু? ভাগ্যগুণে বিরাট এক বড়লােকের ঘরে আপনার জন্ম হয়েছে, আমার ভাগ্য তেমন সুপ্রসন্ন ছিল না। তাই বলে আমার যদি আপনাকে ভালাে লাগে, সেটা আমি বলতে পারব না? যদি বলি সেটা দোষের হয়ে যাবে? | অপালা উঠে দাঁড়াল। ফিরােজ বলল, ‘কথার জবাব না-দিয়েই চলে যাচ্ছেন? আমি কাজ করব কি করব না, সেটা অন্তত বলে যান।
‘কাজ করবেন না কেন? অবশ্যি আপনার ইচ্ছা না-করলে ভিন্ন কথা।
‘খুশি হয়েছি।’ ‘গলার স্বর কিন্তু কেমন শুকনাে-শুকনাে লাগছে।
এই বয়সে কি আর খুশিতে নেচে ওঠা ঠিক হবে? ‘খুশি হবার কোনাে বয়স নেই মা, যে-কোনাে বয়সে খুশি হওয়া যায়। ‘তা যায়।’
‘তুমি বাবার সঙ্গে চলে এসাে। ‘যদি সব ঠিকঠাক থাকে, তাহলে চলে আসব। ‘সব ঠিকঠাকই থাকবে।
থাকলেই ভালাে। ‘মা, তােমার শরীর কি সত্যি-সত্যি সেরেছে? ‘হ্যা। ‘কিন্তু এমন করে কথা বলছ কেন? যেন কোনাে উৎসাহ পাচ্ছ না। একটু হাস তাে মা।
| তিনি হাসলেন। বেশ শব্দ করেই হাসলেন। আজ সারা দিনই তিনি খানিকটা বিষন্ন বােধ করছিলেন। সেই ভাবটা কেটে গেল। তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। সুন্দর রােদ উঠেছে। আকাশ অসম্ভব পরিষ্কার। রােদে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখতে তাঁর ভালাে লাগছে। বাতাস অবশ্যি খুব ঠাণ্ডা। সুচের মতাে গায়ে বেঁধে। ভেতর থেকে ওভারকোটটি নিয়ে এলে ভালাে হত। কিন্তু ভেতরে যেতে ইচ্ছে করছে না।
চোখ মেলতেই প্রিয় দৃশ্যটি দেখা গেল।
জানালার কাছে চায়ের কাপ। একটি চড়ুই পাখি কাপের কিনারায় বসে ঠোঁট ডুবিয়ে চা খাচ্ছে। মাঝে-মাঝে তাকাচ্ছে ফিরােজের দিকে। এই ব্যাপারটি প্রথম ঘটে। ডিসেম্বর মাসের ১১ তারিখে। চায়ের দোকান থেকে যথারীতি জানালার পাশে গরম চা রেখে ডাক দিয়েছে স্যার উঠেন। ফিরােজ ঘুম-ঘুম চোখে দেখেছে। হাত বাড়াতে বাড়াতে আবার ঘুম। ঘুম ভাঙল এগারটার দিকে কিচিরমিচির শব্দে। চায়ের কাপ ঘিরে পাঁচ-ছটা চড়ুই পাখি। মহানন্দে কাপে ঠোঁট ডুবিয়ে কিচিরমিচির করছে। সেই থেকে রােজ হচ্ছে। পাখিগুলি মনে হয় অপেক্ষা করে থাকে কখন চা আসবে। সেই চা ঠাণ্ডা হবে। রােজ তাদের সে-সুযােগ হয় না। বিছানায় আধশােয়া হয়ে ফিরােজ কাপ টেনে নেয়। চুমুক দিয়ে মুখ বিকৃত। তিক্ত, কষা ও মধু—এই তিন স্বাদের সমাহার। ভােরের প্রথম শারীরিক আনন্দ।
আজ ফিরােজের কোনােই কাজ নেই। কোথাও যেতে হবে না। দেনদরবার করতে হবে না। সাধারণত যে-দিন কোনাে কাজ থাকে না, সে-দিন সূর্য ওঠার আগেই ঘুম ভেঙে যায়। কাজের দিনে কিছুতেই ঘুম ভাঙতে চায় না। মনে হয় আরাে খানিকক্ষণ শুয়ে থাকি। আজ উল্টো ব্যাপার ঘটল। কোনাে কাজকর্ম নেই, তবু বেশ খানিকক্ষণ ঘুমুনাে গেল। চড়ুই পাখিটি কৃতজ্ঞ চোখে তাকাচ্ছে।
তার সঙ্গীরা আজ কেউ আসে নি। এলেও চা-পর্ব সমাধা করে চলে গিয়েছে। এই ব্যাটা যাচ্ছে না। হিন্দি ভাষায় ফিরােজ পাখিটির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাল। পশু পাখিরা বাংলা ভাষাটা তেমন বােঝে না। | ‘কেয়া ভাই চিড়িয়া, হালত কেয়া?
‘চিকির চিকির চিক।
২০
‘চিনি উনি সব ঠিক থা? ‘চিকির চিকির। ‘আউর এক দফা হােগা কেয়া নেহি? ‘চিক চিকির চিকির।
ফিরােজের ধারণা, পাখিরা মাের্স কোডে কথা বলে। চিকির এবং চিক এই দু’টি শব্দই নানান পারমুটেশন কম্বিনেশনে বেরিয়ে আসছে। এই বিষয়ে একটা গবেষণা হওয়া উচিত। সময় থাকলে দু-একজন পক্ষীবিশারদের সাথে কথা বলা যেত। পশু পাখিদের ভাষাটা জানা থাকলে নিঃসঙ্গ মানুষদের বড় সুবিধে হত।।
ফিরােজ টুথপেস্ট হাতে বারান্দায় এল। তার ঘর দোতলায়। একটি শােবার ঘর। জানালাবিহীন অন্য একটি কামরা এক শ’ ওয়াটের বাতি জ্বাললেও অন্ধকার হয়ে থাকে। সেই ঘরের উল্টো দিকে বাথরুম, যা অন্য এক জন ভাড়াটে রমিজ সাহেবের সঙ্গে শেয়ার করতে হয়। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, যখনি ফিরােজের বাথরুমে যাবার দরকার হয়, তখনি রমিজ সাহেবকে বাথরুমের ভেতর পাওয়া যায়। ভদ্রলােকের ব্যাপার সব অদ্ভুত। বাথরুমে এক বার ঢুকলে আর বেরুবেন না। ফিরােজের ধারণা, বসে থাকতে-থাকতে ভদ্রলােক ঘুমিয়ে পড়েন।
এই যে ব্রাদার, অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। রমিজ সাহেব খুকখুক করে দু’ বার কাশলেন। ‘আজ অফিসে যান নি? এগারটা বাজে, এখনাে বাথরুমে বসে আছেন?
আবার খুকখুক কাশি। নাক ঝাড়ার শব্দ।
বেরিয়ে আসুন ভাই। খানিকক্ষণ পর না-হয় নতুন উদ্যমে আবার যাবেন। বাথরুম তাে পালিয়ে যাচ্ছে না।’
রমিজ সাহেব ভয়ঙ্কর বিরক্ত হয়ে বের হয়ে এলেন। কড়া গলায় বললেন, ‘রােজ রােজ এইসব কী বাজে কথা বলেন ?
“বাজে কথা কি বললাম?
‘এইসব আমি পছন্দ করি না। খুবই অপছন্দ করি। দরজায় ধাক্কাধাক্কি করেন কেন? এইটা কী ধরনের ভদ্রতা? ‘আজ কিন্তু ধাক্কা দিই নি।
অভদ্র ছােকরা।
রমিজ সাহেব রাগে গরগর করতে-করতে নিজের ঘরে গেলেন। ভদ্রলােক সম্ভবত অসুস্থ। গলায় মােটা মাফলার। চোখমুখ ফোলাফোলা। অফিসেও যান নি। ফিরােজ কিঞ্চিৎ লজ্জিত বােধ করল। এক জন অসুস্থ মানুষকে নিয়ে রসিকতা করা ঠিক হচ্ছে না। রসিকতার প্রচুর বিষয় আছে। | বেরুতে-বেরুতে সাড়ে বারটা বেজে গেল। একতলার বারান্দায় বাড়িওয়ালা বসে আছেন। আজ তাঁকে দেখে চট করে সরে যাওয়ার প্রয়ােজন নেই। দু’ মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি ছিল। গত সপ্তাহেই সেটা দিয়ে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাড়িওয়ালার ছােট মেয়েটির জন্যে সে এক জন পাত্রের খোঁজে আছে, এমনও বলেছে। এটা বলার দরকার ছিল। কারণ বাড়িওয়ালা হাজি আসমত আলি ওপরের দু’ জন ভাড়াটেকে। উৎখাত করতে চাইছেন। সেখানে নাকি তাঁর বড় জামাই আসবেন। বড় জামাইয়ের
চাকরি নেই। বাড়িভাড়া দিয়ে থাকতে পারছেন না। চাকরিবাকরির কোনাে ব্যবস্থানা হওয়া পর্যন্ত এখানেই থাকবেন।
ফিরােজ আঁতকে উঠে বলেছে, খাল কেটে লােকজন কুমির আনে, আপনি তাে হাঙর আনার ব্যবস্থা করছেন। জামাই এক বার ঢুকলে উপায় আছে?
হাজি আসমত আলি বলেছেন, “করব কী তাহলে, ফেলে দেব?’
‘অফকোর্স ফেলে দেবেন। জামাই, শালা এবং ভাগ্নে—এই তিন জিনিসকে কাছে ঘেঁষতে দেবেন না যদি বাঁচতে চান।
‘আপনি সবসময় বড় আজেবাজে কথা বলেন।
কোন কথাটা আজেবাজে বললাম?”
এই নিয়ে আপনার সঙ্গে বকবক করতে চাই না। আপনি ভাই ডিসেম্বর মাসের ত্রিশ তারিখে বাড়ি ছেড়ে দেবেন। এক মাসের নােটিশ দেবার কথা দিলাম।
‘আচ্ছা, ছেড়ে দেব। ঊনত্রিশ তারিখেই ছেড়ে দেব। এক দিন আগে।
মেয়ে বিয়ের প্রসঙ্গ এর পরপরই ফিরােজকে আনতে হয়েছে। কাল্পনিক এক পাত্র দাঁড় করাতে হয়েছে। এই ব্যাপারে হাজি সাহেব যে-আগ্রহ দেখাবেন বলে আশা করা গিয়েছিল, তার চেয়েও বেশি দেখালেন। ফিরােজ যথাযোেগ্য গাম্ভীর্যের সঙ্গে বলল, ছেলে এম এ পাশ করেছে গত বছর। ফার্স্ট ক্লাস পাওয়ার কথা ছিল, পায় নি। সেকেণ্ড ক্লাস ফোর্থ হয়েছে। একটা পেপার খুবই খারাপ করেছে। দেখতে রাজপুত্র নয়, সেটা আগেই বলে দিচ্ছি। চেহারা মােটামুটি, তবে ভালাে ফ্যামিলির ছেলে। ঢাকায় নিজের বাড়ি। পুরনাে ধরনের বাড়ি। তবে ময়মনসিংহ শহরে বিরাট বাড়ি। চার বােন তিন ভাই। ছােট বােনের বিয়ে হয় নি। ভাইরা সবাই স্ট্যাব্লিশড।
‘ছেলে করে কী?’ | ‘এখনাে কিছু করে না। মাত্র তাে পাস করল। তবে পারিবারিক অবস্থা যা, কিছুনা করলেও হেসে-খেলে দু’-তিন পুরুষ কেটে যাবে।’
ওদের সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে? ‘আমার আপন ফুপাতাে ভাই। আপনি আপনার মেয়ের একটি ছবি দিয়ে দেবেন, বাকি যা করার আমি করব। আরাে ছেলে আছে আমার হাতে, নাে প্রবলেম। ভালাে কথা, ব্ল্যাক এ্যাণ্ড হােয়াইট এবং কালার—দু’ ধরনের ছবিই দেবেন।’
“আচ্ছা দেব। ছবি দেব। যদি মেয়ে দেখতে চান, কোনাে অসুবিধা নাই, যেখানে বলবেন। কালার ছবি ঘরে নাই, স্টুডিওতে তুলতে হবে।
‘তুলে ফেলুন। কালারের যুগ এখন।
বিয়ের ঐ আলাপ-আলােচনার পর বাড়ি ছাড়ার প্রসঙ্গ চাপা পড়ে গেল। দু মাসের ভাড়াও হাজি সাহেব চাওয়া বন্ধ করলেন। অবশ্যি ভাড়া দিয়ে দেয়া হয়েছে, তবু মনে সন্দেহ, আবার বাড়ি ছাড়ার প্রসঙ্গ ওঠে কি না।’
হাজি সাহেব ফিরােজকে বেরুতে দেখেও কিছু বললেন না। বিষন্ন ভঙ্গিতে বসে রইলেন। ফিরােজ এগিয়ে এল, রােদ পােহাচ্ছেন?
খুব ভালাে, শরীরে ভিটামিন সি প্রডিউস হচ্ছে।’ ঐ ছেলের ব্যাপারে তাে আর কোনাে খবর দিলেন না।
ছবি? ছবি চাচ্ছে তাে!’ ছবি তাে তুলে রেখেছি। চান না, তাই…… ‘কী মুশকিল, চাইব না কেন। যান, নিয়ে আসুন। আজ ছেলের বড় ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হবার সম্ভাবনা আছে। দেখা যে হবেই তা বলছি না—একটা প্রবাবিলিটি।
ছবি দেখে ফিরােজের মন উদাস হয়ে গেল। ভারি মিষ্টি চেহারার একটি মেয়ে। চোখ ছলছল করছে। হাজি সাহেবের মেয়েগুলি বােরকা পরে। ফিরােজ কখনাে এদের মুখ দেখে নি। ভাগ্যিস দেখে নি। দেখলেই এই বােরকাওয়ালির প্রেমে পড়ে যেতে হত।
আপনার মেয়ে তাে খুবই রূপবতী।’
হাজি সাহেব কিছুই বললেন না। ফিরােজ বলল, ‘এই রকম একটা মেয়ের বিয়ে নিয়ে কেউ চিন্তা করে? আশ্চর্য!
হাজি সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘অন্য সমস্যা আছে।
কী সমস্যা? ‘ওর পায়ে একটু দোষ আছে।” ‘কী দোষ? ‘পােলিও হয়েছিল।
বলেন কী। ‘হাঁটা-চলায় কোনাে অসুবিধা নাই কিন্তু।
ফিরােজের অসম্ভব মন খারাপ হয়ে গেল। তার প্রচণ্ড ইচ্ছে হতে লাগল বলে ফেলে—আমি এই মেয়েকে বিয়ে করতে চাই। শেষ পর্যন্ত বলল না। তার আবেগ দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
‘আমি টাকাপয়সা যথেষ্ট খরচ করব। এই মেয়েটা আমার খুব আদরের। যদি একটা ভালাে ছেলে দিতে পারেন।’
‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
ফিরােজ লম্বা-লম্বা পা ফেলে বেরিয়ে গেল। যদিও তার খুব মন-খারাপ ছিল, রাস্তায় নেমে মন ভালাে হয়ে গেল। কী সুন্দর ঝকঝকে রােদ। ঘন নীল আকাশ। বাতাস কত মধুর। বেঁচে থাকার মতাে আনন্দ আর কী হতে পারে?
| ফিরােজ হাঁটছে ফুর্তির ভঙ্গিতে। কোনাে কাজকর্ম নেই, চিন্তা করতেই ভালাে লাগছে। যদিও উল্টোটাই হওয়া উচিত ছিল। তার ফুতির মূল কারণ হচ্ছে পকেট একেবারে ফাঁকা নয়। আট শ’ ত্রিশ টাকা আছে। এতগুলাে টাকা পকেটে নিয়ে শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করার কোনাে মানে হয় না। দুশ্চিন্তা মানেই পেপটিক আলসার, ক্ষুধামান্দ্য, অনিদ্রা। তারচেয়ে হাসিমুখে ঢাকার রাস্তায় হাঁটা অনেক ভালাে।
ঢাকার রাস্তাগুলি এখন বেশ সুন্দর। হেঁটে বেড়ানাের জন্যে এবং ভিক্ষা করবার জন্যে আদর্শ। ফুটপাতে ভিক্ষুকরা কী সুন্দর ঘর-সংসার সাজিয়ে ভিক্ষা করছে।
| ফিরােজ এই মুহূর্তে কৌতূহলী হয়ে একটি ভিক্ষুক-পরিবারকে দেখছে। এক বুড়াে তার দু পাশে দুটি ছােট-ছােট বাচ্চাকে নিয়ে ভিক্ষা করছে। তাদের একটু পিছনেই ইটের চুলায় রান্না হচ্ছে। ঘােমটা-দেয়া গৃহস্থ প্যাটার্নের একটি মেয়ে মাটির
হাঁড়িতে চাল দিচ্ছে। এই পরিবারটির চোখে-মুখে দুঃখ-বেদনার কোনাে ছাপ নেই। বরং বুড়াের মুখে একটা প্রশান্তির ভাব আছে। বাচ্চা দুটি একটু পর-পর দাত বের করে হাসছে। ফিরােজ কী মনে করে একটা চকচকে পাঁচ টাকার নােট বুড়াের থালায় ফেলে দিল। ভিখিরিরা এই জাতীয় ঘটনায় আবেগে উদ্বেলিত হয়। এই বুড়াে নিস্পৃহ ভঙ্গিতে নােটটা নিজের বুকপকেটে রেখে দিল। খুবই বুদ্ধিমানের কাজ। থালায় একটি নােট থাকলে পয়সাকড়ি পড়বে না। ফিরােজের আফসােসের সীমা রইল না। টাকাটা জুলে গেল। দাতা সাজবার কোনাে প্রয়ােজন ছিল না। অদূর ভবিষ্যতে তাকে যদি এ রকম টিনের থালা নিয়ে বসতে হয় এবং কেউ যদি একটা পাঁচ টাকার নােট ফেলে দেয়, তাহলে সে আনন্দের এমন প্রকাশ দেখাবে যে চারদিকে লােক জমে যাবে। দর্শকদের আনন্দের জন্যে সে বাঁদর-লাফ দিতেও রাজি আছে।
| বাচ্চা দুটির মধ্যে কী-কারণে যেন মারামারি লেগে গেছে। দু জনই এলােপাতাড়ি কিল-ঘুষি মারছে। এক জন মনে হচ্ছে খামচিবিশারদ। একেক বার খামচি দিয়ে ছাল চামড়া নিয়ে আসছে। জমাট দৃশ্য। কিন্তু বুড়াের এই দৃশ্যেও কোনাে ভাবান্তর হচ্ছে না! সন্ন্যাসীর নির্লিপ্ততা নিয়ে সে বসে আছে, রন্ধনরতা ঘােমটা দেয়া মেয়েটিও কিছু বলছে
ফিরােজের ইচ্ছে করছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে এই পরিবারটিকে দেখে-দেখে দুপুরটা কাটিয়ে দেয়। সেটা করা ঠিক হবে না। লােকে অন্য অর্থ করবে। যে-মেয়েটি রাঁধছে তার বয়স অল্প। মুখে লাবণ্য এখনাে খানিকটা আছে। এই মেয়ের আশেপাশে দীর্ঘ সময় থাকার একটি মানেই হয়। বুড়াে যে পাঁচটি টাকা পেয়েও বিরস মুখে বসে রইল তার মানেও এই। বুড়াে অন্য কিছু ভেবে বসেছে। ফিরােজ মগবাজারের দিকে লম্বা-লম্বা পা ফেলতে লাগল। এখন সে যাবে তাজিনদের বাসায়। তাজিন তার বড় বােন। মগবাজার ওয়ারলেস কলােনিতে থাকে। ফিরােজের যখন টাকাপয়সার টানাটানি হয় তখন দুপুরে এই বাড়িতে খেতে আসে। | ‘কেমন আছিস রে আপা? তাের পুত্র-কন্যারা কোথায়? বাসা একেবারে খালি মনে হচ্ছে।
তাজিন মুখ অন্ধকার করে রাখল। হয়েছে কী? কথা বলছিস না কেন? কর্তার সঙ্গে আবার ফাইটিং? তাজিন থমথমে গলায় বলল, ‘তুই কি একটা মানুষ, না অন্য কিছু?
কেন? ‘রুমি এত করে বলে দিল তার জন্মদিনে আসার জন্যে, তুই আসতে পারলি না? মেয়ে কাঁদতে-কাঁদতে অস্থির। বাচ্চাগুলি তােকে এত পছন্দ করে, আর তুই এ-রকম করিস? ভালবাসার দাম দিতে হয় না?
“খুব কেদেছিল?
‘জিনিসপত্র ফেলে-ছড়িয়ে একাকার করেছে, শেষে তাের দুলাভাইকে পাঠালাম তাের খোঁজে।
‘আপা, হয়েছে কি জান…… আমাদের এক কলিগ…… ‘চুপ কর, আর মিথ্যা কথা বলতে হবে না। ভাত খেতে এসেছিস, খেয়ে বিদায়
‘আজ তােদের রান্না কী? তাজিন জবাব না দিয়ে টেবিলে ভাত বাড়তে লাগল। ‘তােদের টেলিফোন ঠিক আছে আপা? ‘আছে।’
‘তুই রেডি কর সবকিছু, আমি টেলিফোন করে আসছি। দারুণ একটা খবর আছে। আগামী সপ্তাহে বিয়ে করছি।”
এই দারুণ খবরেও তাজিনকে বিচলিত মনে হল না। ‘বিশ্বাস হচ্ছে না? এই নে, মেয়ের ছবি দেখ। কি, এখন বিশ্বাস হচ্ছে?”
ফিরােজ টেলিফোন করতে গেল। বি: করিম সাহেবকে জিজ্ঞেস করবে, মতিন কাজটা করেছে কি না। বি করিম সাহেবকে পাওয়া গেল। তিনি অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, ‘কে, ফিরােজ সাহেব নাকি?
এখন অবস্থা যা দাঁড়াচ্ছে, তাতে ফিরােজেরই চোখ ট্যারা হয়ে যাবার যােগাড়। বি: করিম লােকটি মহা তাড়। হয়তাে বলে বসবে, ফিরােজ সাহেব, এই ফার্মে আপনার কাজ ঠিক পােযাচ্ছে না। দু’দিন পর-পর ফার্মকে একটা ঝামেলায় জড়িয়ে ফেলছেন। আপনি ভাই অন্য পথ দেখুন। | করিম সাহেবের পক্ষে এটা বলা মােটেই অস্বাভাবিক নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক। ব্যাটা অনেকদিন থেকেই সুযােগ খুজছে। মাঝে-মাঝে ইশারা-ইঙ্গিতও করছে। গত সপ্তাহে বেতনের দিন বলল, ‘খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে গেছে। কাজের চেয়ে মানুষ বেশি। বার হাত কাঁকুড়ের আঠার হাত বিচি।
| ফিরােজ আধ-খাওয়া সিগারেট ফেলে দিয়ে অপালার দিকে তাকাল। অপালা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখ হাসি-হাসি। মনে হচ্ছে কায়দা করে এই মেয়েটিকে রাজি করিয়ে ফেলা যাবে। উনিশ-কুড়ি বছর বয়সী মেয়েদের মন তরল অবস্থায় থাকে। দুঃখ-কষ্টের কথা বললে সহজেই কাবু হয়ে যায়। মুশকিল হচ্ছে বলাটাই। এই বয়সী। মেয়েদের সঙ্গে ভিখিরির গলার স্বরে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। তাতে নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয়।
‘আমি বরং কাজটা শেষ করি। আমার ধারণা, আপনার বাবা যখন দেখবেন একটা চমৎকার কাজ হয়েছে… মানে চমৎকার যে হবে এই সম্পর্কে…
অপালা হাসি মুখে বলল, ‘না।’ ফিরােজ স্তম্ভিত। হাসিমুখে কাউকে না বলা যায়।
এইভাবে আমি যদি চলে যাই তাহলে আমার নিজের খুব অসুবিধা হবে। চাকরিটা হয়তাে থাকবে না। আপনি আপনার বাবাকে বুঝিয়ে বলতে পারেন। আমার ধারণা, আপনার কথা উনি শুনবেন।
‘আপনার ধারণা ঠিক নয়।
এই বাজারে আমার চাকরি নিয়ে সমস্যা হলে কী যে অসুবিধায় পড়ব, আপনি বােধহয় বুঝতে পারছেন না। আপনাদের বােঝার কথাও নয়। নিজ থেকে বলতে আমার খুবই লজ্জা লাগছে…’
অপালা মৃদু স্বরে বলল, ‘যাবার আগে ঘরটা আগের মতাে করে যাবেন। এ-রকম এলােমেলাে ঘর দেখলে বাবা খুব রাগ করবেন।
ফিরােজ দ্বিতীয় সিগারেট ধরাল। তার সঙ্গের লােক দু’টি চিন্তিত মুখে ফিরােজের দিকে তাকাচ্ছে। ফিরােজ নিচু গলায় বলল, ‘যাও, ঘরটা গুছিয়ে ফেল। | অপালা চলে যাচ্ছে। ফিরােজের গা জ্বালা করছে, মেয়েটি এক বার বলল না— সরি। মানবিক ব্যাপারগুলি কি উঠেই যাচ্ছে? গল্প-উপন্যাস হলে এই জায়গায়
মেয়েটির চোখে পানি এসে যেত। সে ধরা গলায় বলত—আমার কিছু করার নেই ফিরােজ ভাই। আমার বাবাকে তাে আপনি চেনেন না—একটা অমানুষ।
ফিরােজ বলত, তুমি মন খারাপ করাে না? তােমার মন খারাপ হলে আমারও মন খারাপ হয়। এই বলে সে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকত।
কিন্তু জীবন গল্প-উপন্যাস নয়। জীবনে কুৎসিত সব ব্যাপারগুলি সহজভাবে ঘটে যায়। অপরূপ রূপবতী একটি মেয়ে হাসতে-হাসতে কঠিন-কঠিন কথা বলে।
‘চা নিন।
ফিরােজ দেখল, কাজের মেয়েটি ট্রেতে করে এক কাপ চা নিয়ে এসেছে। ফিরােজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, ‘চা কেন?
‘আপা দিতে বললেন।
তার এক বার ইচ্ছা হল বলে—চা খাব না। কিন্তু এ-রকম বলার কোনাে মানে হয় না। শীতের সকালবেলা এক কাপ চা মন্দ লাগবে না। সে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল। চা খাওয়া শেষ হলে আছাড় দিয়ে কাপটা ভেঙে ফেললেই হবে।
বি. করিম সাহেব বেশ কিছুক্ষণ মুখ ছুঁচালাে করে রাখলেন। | চেঁচামেচি হৈচৈ কিছুই করলেন না। করলে ভালাে হত। স্টীম বের হয়ে যেত। স্টীম বের হল না—এর ফল মারাত্মক হতে পারে। ফিরােজ ফলাফলের অপেক্ষা করছে। তার মুখ দার্শনিকের মতাে। যা হবার হবে এই রকম একটা ভাব।।
‘ফিরােজ সাহেব।
‘হাজার পাঁচেক টাকার ক্ষতি হয়ে গেল, কি বলেন? ‘ক্ষতি হবে কেন? মতিন এইগুলি দিয়েই কাজ করবে। ‘পাগল, মতিন এই সব ছোঁবে? সে সবকিছু আবার নতুন করে করাবে। ‘তা অবশ্যি ঠিক। ‘বেকায়দা অবস্থা হয়ে গেল ফিরােজ সাহেব। ‘তা খানিকটা হল।
‘আপনাকে আগেই বলেছিলাম, যাবেন না। কথা শুনলেন না। রক্ত গরম, কারাে কথা কানে নেন না।
‘রক্ত এক সময় গরম ছিল, এখন ঠাণ্ডা মেরে গেছে।
আমার যা সবচেয়ে খারাপ লাগছে তা হচ্ছে, আপনি আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলেছেন। আপনি বলেছিলেন, ফখরুদ্দিন সাহেবের মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে। আপনার কথার উপর ভরসা করে……’
করিম সাহেব বাক্য শেষ করলেন না। পেনসিল চাঁছতে শুরু করলেন! এটি খুব অশুভ লক্ষণ। পেনসিল চাঁছা শেষ হওয়ামাত্র বুলেটের মতাে কিছু কঠিন বাক্য বের হবে। তার ফল সদূরপ্রসারী হতে পারে।
১৪
ফিরােজ সাহেব।
‘আপনি বরং সিনেমা লাইনে চলে যান। ‘অভিনয় করার কথা বলছেন?
“আরে না! অভিনয়ের কথা বলব কেন? সেট-টেট তৈরি করবেন। আপনি ক্রিয়েটিভ লােক, অল্প সময়েই নাম করবেন। জাতীয় পুরস্কার এক বার পেয়ে গেলে
দেখবেন কাঁচা পয়সা আসছে।
| ফিরােজ মনে-মনে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল। কাঁচা পয়সা জিনিসটা কী, কে জানে? পয়সার কাঁচা-পাকা নেই। পয়সা হচ্ছে পয়সা।
‘ফিরােজ সাহেব।
‘ঐ করুন। ‘সিনেমা লাইনে চলে যেতে বলছেন?
‘হ্যা। আমরা বড়-বড় কাজটাজ পেলে আপনাকে ডাকব তাে বটেই। আপনি হচ্ছেন খুবই ডিপেণ্ডেবল। এটা আমি সবসময় স্বীকার করি।’
‘শুনে অত্যন্ত খুশি হলাম। আগে জানতাম না। ‘সিনেমা লাইনের লােকজন আপনাকে লুফে নেবে।’ ‘কেন বলুন তাে?
‘সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, আপনার আর্ট কলেজের ডিগ্রি নেই। ডিগ্রিধারী কাউকে এরা নিতে চায় না। ওদের তেল বেশি থাকে। ডিরেক্টারের উপর মারি করতে চায়। আপনি তা করবেন না।
| ‘ডিগ্রি না-থাকার তাে বিরাট সুবিধা দেখছি! এই ফার্মের চাকরি কি আমার
শেষ?
করিম সাহেব কথার উত্তর দিলেন না। তাঁর পেনসিল চাঁছা শেষ হয়েছে। তিনি সেই পেনসিলে কী যেন লিখতে শুরু করেছেন। ফিরােজ হাই তুলে বলল, আপনি কি আমাকে আরাে কিছু বলবেন, না আমি উঠব?’
| ‘আমার পরিচিত একজন ডিরেক্টর আছে। তার কাছে আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। চিঠি নিয়ে দেখা করুন, একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
‘আপনি তাে দেখছি রীতিমতাে মহাপুরুষ ব্যক্তি। চিঠিটা পেনসিলে না লিখে দয়া করে কলম দিয়ে লিখুন।
‘ইচ্ছা করেই পেনসিল দিয়ে লিখছি। পেনসিলের চিঠিতে একটা পারসােনাল টাচ থাকে, যে-জিনিসটা টাইপ করা চিঠিতে বা কলমের লেখায় থাকে না।
‘গুড। এটা জানতাম না। এখন থেকে যাবতীয় প্রেমপত্র পেনসিলে লিখব।
ডিরেক্টর সাহেবের বাসা কল্যাণপুর। সারা দুপুর খুঁজে সেই বাড়ি বার করতে হল। ডিরেক্টর সাহেবকে পাওয়া গেল না। অত্যন্ত ক্রুদ্ধ বাড়িওয়ালার কাছে জানা গেল, ডিরেক্টর সাহেব ছ’ মাসের বাড়িভাড়া বাকি ফেলে চলে গেছেন। শুধু তাই নয়, যাবার সময় বাথরুমের দু’টি কমােড হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ভেঙেছেন।’
১৫
ফিরােজ চোখ কপালে তুলে বলল, ‘বলেন কী! ‘ফিল্ম লাইনের পােক। বাড়িভাড়া দেয়াই উচিত হয় নি। আপনি তার কে হন? ‘আমি কেউ হই না। আমিও এক জন পাওনাদার।
কত টাকা গেছে? ‘প্রায় হাজার দশেক।’
‘ঐ টাকার আশা ছেড়ে দিন। ঐটা আর পাবেন? টাকা এবং স্ত্রী—এই দুই জিনিস হাতছাড়া হলে আর পাওয়া যায় না।’
ফিরােজ প্রায় বলেই বসছিল—আপনার স্ত্রীও কি তাঁর সাথে ভ্যানিশ হয়েছেন? শেষ মুহুর্তে নিজেকে সামলাল। এখন রসিকতা করতে ইচ্ছা করছে না। সে ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এক গ্লাস পানি খাওয়াতে পারেন ?
‘নিশ্চয়ই পারি। আসুন, ভেতরে এসে বসুন। এত মন-খারাপ করবেন না। কী। করবেন বলুন, দেশ ভরে গেছে জোচ্চোরে। আমার মতাে পুরনাে লােক মানুষ চিনতে পারে না, আর আপনি হচ্ছেন দুধের ছেলে!
| শুধু পানি নয়। পানির সঙ্গে সন্দেশ ও লুচি চলে এল। ভদ্রলােকের স্ত্রী পর্দার ও পাশ থেকে উকি দিচ্ছেন। দেখছেন। দেখছেন কৌতূহলী চোখে।
ভদ্রলােক ফুর্তির স্বরে বললেন, ‘এই ছেলের কথাই তােমাকে বলছিলাম। একে ফতুর করে দিয়ে গেছে। কীরকম অবস্থা একটু দেখ। হায়রে দুনিয়া! | দশ মিনিটের ভেতর এই পরিবারটির সঙ্গে ফিরােজের চূড়ান্ত খাতির হয়ে গেল। ভদ্রলােক এক পর্যায়ে বললেন, ‘দুপুরবেলা ঘােরাঘুরি করে লাভ নেই। হাত-মুখ ধুয়ে ভাত খেয়ে ফেল। বড়-বড় পাবদা মাছ আছে।’
| ফিরােজের চোখ প্রায় ভিজে উঠল। এই জীবনে সে অনেকবারই অযাচিত ভালবাসা পেয়েছে। এই জাতীয় ভালবাসা মন খারাপ করিয়ে দেয়।
অপালার মা হেলেনা প্রথমে লণ্ডনের সেন্ট লিউক হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। তাঁর হার্টের একটি ড্যামেজড় ভান্তু এখানেই রিপেয়ার করা হয়। রিপেয়ারের কাজটি তেমন ভালাে হয় নি। ডাক্তাররা এক মাস পর আর একটি অপারেশন করতে চাইলেন। তবে এও বললেন যে, অপারেশন নাও লাগতে পারে। তবে তা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। এক মাস অবজারভেশনে রাখতেই হবে। | ফখরুদ্দিন সাহেব লণ্ডনের সাবাবে লাল ইটের ছােটখাটো একটি নার্সিং হােম খুঁজে বের করলেন। এই হাসপাতালটি ঘরােয়া ধরনের। সবার প্রাণপণ চেষ্টা, যেন কিছুতেই হাসপাতাল মনে না হয়। কিছু অংশে তারা সফল। চট করে এটাকে হাসপাতাল মনে হয় না। তবে তার জন্যে রুগীদের প্রচুর টাকা দিতে হয়। এখানে বড় হাসপাতালের খরচের দেড়গুণ বেশি খরচ হয়। টাকাটাও আগেভাগেই দিয়ে দিতে হয়। ফখরুদ্দিন সাহেবের জন্যে সেটা কোনাে সমস্যা হয় নি। টাকা খরচ করতে তাঁর ভালােই লাগে। ফখরুদ্দিন সাহেব নিজে যখন দরিদ্র ছিলেন, তখনাে তাঁর এই স্বভাব
ছিল। পড়াশােনার খরচ দিতেন বড়মামা। তাঁর অবস্থা নড়বড়ে ছিল, তবু তিনি মাসের তিন তারিখে একটা মানিঅর্ডার পাঠাতেন। প্রায়ই এমন হয়েছে, মাসের ছ’ তারিখেই সব শেষ। তখন ছােটাছুটি দৌড়াদৌড়ি। ফখরুদ্দিন সাহেবের জীবনের উদ্দেশ্য ছিল একটিই—প্রচুর টাকা রােজগার করা, যাতে দু’হাতে খরচ করেও শেষ করা না যায়। ফখরুদ্দিন সাহেবের মেধা ছিল। ভাগ্যও প্রসন্ন ছিল। মাত্র পয়ত্রিশ বছর বয়সে ব্যবসা জমিয়ে ফেললেন। চারদিক থেকে টাকা আসতে শুরু করল। বিয়ে করলেন সাঁইত্রিশ বছর বয়সে। বাসর রাতে স্ত্রীকে বললেল, টাকাপয়সা তােমার কাছে কেমন লাগে?
| হেলেনার বয়স তখন মাত্র সতের। আই এ পরীক্ষা দিয়ে বড় ফুপার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে। সেখানেই চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে বিয়ে। বাসর রাতে টাকা প্রসঙ্গে স্বামীর এই অদ্ভুত প্রশ্নের সে কোনাে আগামাথা পেল না। সে চুপ করে রইল। ফখরুদ্দিন সাহেব অত্যন্ত উৎসাহের সঙ্গে বললেন, আমার জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্যই হচ্ছে—টু বিকাম রিচ। ভেরি রিচ। টাটা-বিড়লাদের মতাে। তােমার কি ধারণা, আমি পারব?
হেলেনা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তার কেন জানি মনে হতে লাগল,এই লােকটি ঠিক সুস্থ নয়। সুস্থ মানুষ বিয়ের প্রথম রাতে স্ত্রীকে নিশ্চয়ই এই জাতীয় কথা বলে না।। | ‘বুঝলে হেলেনা, আমার মনে হয় আমি পারব। আমি খুব দ্রুত ভাবতে পারি। ভবিষ্যৎ চোখের সামনে দেখতে পাই। এটা একটা মেজর এ্যাডভানটেজ। অন্যারা যা আজ চিন্তা করে, আমি সেটা দু’বছর আগেই চিন্তা করে রেখেছি। | হেলেনার বিয়ে হয়েছিল শ্রাবণ মাসে। হুট করে বিয়ে। আত্মীয়স্বজন দূরের কথা, নিজের মা পর্যন্ত খবর জানেন না। টেলিগ্রাম করা হয়েছে, এখনাে হয়তাে পৌছে নি। ঘটনার আকস্মিকতা, বিয়ের উত্তেজনায় এমনিতেই হেলেনার মাথার ঠিক নেই, তার ওপর লােকটি ক্রমাগত কী-সব বলে যাচ্ছে।
‘হেলেনা।
‘আমি আজ কিঞ্চিৎ মদ্যপান করেছি, যেটা আমি কখনাে করি না। আজ বাধ্য হয়ে নার্ভ স্টেডি রাখার জন্যে করতে হল। তুমি সম্ভবত গন্ধ পাচ্ছ।
| হেলেনা কোনাে গন্ধটন্ধ পাচ্ছিল না। এখন পেতে শুরু করল। তার ইচ্ছে করল চেঁচিয়ে কেঁদে ওঠে।
এই পৃথিবীতে আমি মােটামুটিভাবে একা। মানুষ করেছেন বড়মামা। তাঁর সঙ্গে কিছুদিন আগে বিরাট একটা ঝগড়া হয়েছে। আজ তােমাকে বলব না, পরে বলব। আজ বরং আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলি তােমাকে বলি। | ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়তে শুরু করেছে। খােলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির ছাট আসছে। ফখরুদ্দিন সাহেব হাতে সিগারেট ধরিয়ে চক্রাকারে হাঁটছেন এবং কথা বলছেন। সিগারেটের ধোঁয়ায় হেলেনার দম বন্ধ হবার যােগাড়। লােকটি একটির পর একটি সিগারেট ধরাচ্ছে। পুরােটা টানছেনা, কয়েকটি টান দিয়েই ফেলে দিচ্ছে। হেলেনার ভয়
ভয় করতে লাগল। এ-কেমন ছেলে ! কার সঙ্গে তার বিয়ে হল ?
এখনকার ট্রেণ্ডটা হচ্ছে কি, জান ? চট করে ইণ্ডাসট্রি দিয়ে দেয়া। এতে সমাজে প্রেস্টিজ পাওয়া যায়। লােকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেইণ্ডাষ্ট্রিয়ালিস্ট। কিন্তু এইসব
১৭
ইণ্ডাস্ট্রি শেষ পর্যন্ত হাতিপােষার মতাে হয়। হাতির খাবার যােগাতে গিয়ে প্রাণান্ত। বুঝতে পারছ, কী বলছি?
‘র মেটিরিঅ্যাল নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। ইণ্ডাস্ট্রির খাবার হচ্ছে র মেটিরিঅ্যাল, যার প্রায় সবই আনতে হয় বাইরে থেকে। আমি তা করব না। আমি যখন কোনাে ইণ্ডাস্ট্রি দেব তার প্রতিটি র মেটিরিঅ্যাল তৈরি করব আমি নিজে।
| হেলেনা হাই তুলল। ফখরুদ্দিন সাহেব অবাক হয়ে বললেন, তােমার ঘুম পাচ্ছে নাকি?
‘না।” ‘শুধু ব্যবসা নিয়ে কথা বলছি বলে কি বিরক্তি লাগছে?
‘টাকা খুব ইম্পর্ট্যান্ট জিনিস, বুঝলে হেলেনা। যে-সােসাইটির দিকে আমরা যাচ্ছি, সেই সােসাইটির ঈশ্বর হচ্ছে টাকা। একটা সময় আসবে, যখন তুমি টাকা দিয়ে সব কিনতে পারবে। সুখ, শান্তি, ভালবাসা—সব।’
হেলেনা দ্বিতীয় বার হাই তুলল। ফখরুদ্দিন সেই হাই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললেন, ‘খুব বেশি দূর তােমাকে যেতে হবে না। আজকের কথাই ধর। তােমার যদি প্রচুর টাকা থাকে, তাহলে তুমি সেই টাকায় বেহেশতে নিজের জন্যে একটা জায়গার ব্যবস্থা করতে পার।
কীভাবে? | ‘টাকা খরচ করে হাসপাতাল দেবে, স্কুল-কলেজ দেবে, এতিমখানা বানাবে, লঙ্গরখানা বসাবে। এতে পুণ্য হবে। সেই পুণ্যের বলে বেহেশত। কাজেই টাকা দিয়ে তুমি পরকালের জন্যে ব্যবস্থা করে ফেললে, যে-ব্যবস্থ্য এক জন ভিখিরি করতে পারবে না। ইহকালে সে ভিক্ষা করেছে, পরকালেও সে নরকে পচবে—কারণ তার টাকা নেই। হা হা হা।
তাঁর হাসি আর থামেই না। মাঝে-মাঝে একটু কমে, তার পরই আবার উদ্দাম গতিতে শুরু হয়। হেলেনা ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল। বন্ধ দরজার পাশে বাড়ির মেয়েরা এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের এক জন দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘কী হয়েছে?
ফখরুদ্দিন সাহেব হাসতে-হাসতেই বললেন, ‘নাথিং। এ্যাবসলুটলি নাথিং। পানি খেলেই ঠিক হয়ে যাবে। ব্রিং মি সাম ওয়াটার।
হেলেনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে পুরনাে কথা ভাবেন।
স্মৃতি রােমন্থনের জন্যে নয়, সময় কাটানাের জন্যে। বইপত্র ম্যাগাজিন স্কুপ হয়ে আছে। বেশিক্ষণ এ-সব দেখতে ভালাে লাগে না। টিভির অনুষ্ঠানও একনাগাড়ে দেখা যায় না। কথাবার্তা বােঝা যায় না। সবাই কেমন ধমক দেয়ার মতাে করে ইংরেজি বলে। পুরােটাও বলে না। অর্ধেক গলার মধ্যে আটকে রাখে। যেন কথাগুলি নিয়ে গার্গল করছে।
হেলেন। তিনি তাকালেন। সিস্টার মেরি এসে দাঁড়িয়েছে। এরা সবাই তাঁকে হেলেন ডাকে,
১৮
যদিও তিনি অনেক বার বলেছেন, তাঁর নাম হেলেনা—হেলেন নয়।
| ‘তােমার একটি টেলিফোন এসেছে। কানেকশন এ-ঘরে দেয়া যাচ্ছে না। টেলিফোন সেটটায় গণ্ডগােল আছে। তুমি কি কষ্ট করে একটু আসবে?
“নিশ্চয়ই আসব।’ | তিনি বিছানা থেকে নামলেন। এই হাসপাতালে সিস্টার মেরিই একমাত্র ব্যক্তি, যার প্রতিটি কথা তিনি বুঝতে পারেন। এই মহিলার গলার স্বরও সুন্দর। শুনতে ইচ্ছে করে। সে কথাও বলে একটু টেনে-টেনে।।
টেলিফোন ঢাকা থেকে এসেছে। অপালার গলা। ‘মা, কেমন আছ?” ‘ভালাে। ‘আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করলে না তাে?
কেমন আছিস? ‘ভালাে। আমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে জিজ্ঞেস কর।
পরীক্ষা কেমন হচ্ছে? ‘ভালাে না। মাঝারি ধরনের। ‘বলিস কি তুই এমন সিরিয়াস ছাত্রী, তাের পরীক্ষা মাঝারি ধরনের হবে কেন?
এখন হলে আমি কী করব? ‘তুই কি আমার কথা ভেবে-ভেবে পরীক্ষা খারাপ করলি ?
হতে পারে। তবে কনশাসলি ভাবি না। অবচেতন মনে হয়তাে ভাবি। সেটা বুঝলি কীভাবে?
‘প্রায়ই স্বপ্নে দেখি, তােমার অপারেশন হচ্ছে। অপারেশনের মাঝখানে ডাক্তাররা গণ্ডগােল করে ফেলল…… এইসব আর কি।
সেকেও অপারেশনটা আমার বােধহয় লাগবে না। ‘তাই নাকি। এতবড় একটা খবর তুমি এতক্ষণে দিলে? ‘এখনাে সিওর না। ডাক্তাররা আরাে কী-সব টেস্ট করবে।
কবে নাগাদ সিওর হবে? ‘এই সপ্তাহটা লাগবে। তাের বাবা কেমন আছে? ‘জানি না। ভালােই আছে বােধহয়। একটা ভালাে খবর দিতে পারি না।’ ‘দিতে পারলে দে।
এখন থেকে ঠিক আটচল্লিশ ঘন্টার মধ্যে বাবার সঙ্গে তােমার দেখা হবে। বাবা সিঙ্গাপুর থেকে ইংল্যাণ্ড যাচ্ছে।
‘ভালো ।’ ‘তুমি মনে হচ্ছে তেমন খুশি হও নি।
আমাদের পরিচয় ২০১২ সাল এর অক্টোবর এর ১২ তারিখ থেকে।পরিচয় এফবি থেকে।কিন্তু কখনো কেও কাওকে নিজ থেকে নক দিয়ে কথা বা চ্যাট করতাম না।আর আমি তখন নতুন এফবি খুলি যার কারণে আমি যাকে তাকে এড করতাম।সে আমাকে রিকুয়েষ্ট দিয়ার পর আমি একসেপ্ট করি বাট নিজ থেকে কখনো কাওকে নক দিতাম না (পার্ট এ থাকতাম আর কি?)
২০১২ সালের মার্চ মাসে সে রিকুয়েষ্ট পাঠানোর পর প্রায় ৭মাস পর সে আমাকে হাই দিয়ে নক দেই আমি ২দিন পর রিপ্লাই দিতাম।কারণ আমি চুরি করে আম্মুর মোবাইল থেকে এফবি চালাতাম।এইভাবে টুকটাক কথা বলার পর অক্টোবর ৩০ তারিখ তার বার্থডে তে আমি উইশ করি। এরপর হাই হ্যালো কথা বলার পর এইভাবে আমার এস.এস.সি এক্সাম চলে আসে আর এফবি ২মাস অফ রাখি। যখন এক্সাম শেষ হয় তখন এফবি অন করার পর দেখি তার অনেক গুলা মেসেজ লিস্ট।এরপর আমার কলেজে ভর্তি নিয়ে টেনশনে ছিলাম।সে আমাকে কিছুটা হেল্প করছিল কলেজ আর ভর্তি হওয়ার অনেক ইনফরমেশন দিছিলো।তার নাম্বার দিছিলো আমি ফোন এ কথা বলে সব ইনফরমেশন নিয়ে নিই।এরপর টুকটাক মোবাইল এ কথা হত।যাই হক এইভাবে তার সাথে পরিচয় হওয়ার প্রায় ৩বছর পার হয়ে যাই।
২০১৫ সালের এপ্রিল এর ১তারিখ সে আমাকে প্রপোস করে।তাকে আমি আগেই পছন্দ করতাম কিন্তু বলা হইনি।এইভাবে রিলেশন চলার ৩বছর এর মাথাই বাসায় ধরা খাই।অনেক প্রব্লেম চলে।সবাই বুঝাইছে অকে ছেড়ে দিতে।ওর থেকে ভালো ছেলে এস্টাবলিশ পয়সাওয়ালা ছেলে আমার জন্য ডিজার্ব করে।কিন্তু আমি নাছোড় বান্দা ছিলাম তাকে আমি ছাড়িনি।সে যখন বিজনেস এ অনেক লাখ টাকার লস খায় সে সিদ্ধান্ত নেই সৌদি যাবে।২বছর এর ভিসা নিয়ে সে সৌদি আরব চলে যাই ২০১৭ সালের পহেলা বৈশাখ এর পরদিন।অনেক চেস্টা করে সে থাকার জন্য।সে ভালো জব পেয়েও সে সৌদি থাকেনি।সে চেষ্টা করছিল থাকার বাট তার নাকি আমাকে ছাড়া একা থাকতে কষ্ট হয়।তাই সে সাড়ে তিন মাসের মাথাই সৌদি আরব থেকে দেশ এ চলে আসে।অনেক কষ্ট করে সে তার ফ্যামিলিকে বুঝ দিয়ে তার আগের ব্যবসায় নামে।আমার ফ্যামিলি তাকে দিতে প্রথম এ রাজি ছিলনা।আমি বাবা মার একমাত্র মেয়ে যার কারনে তারা আমার দিকে চেয়ে তাকে মেনে নেই।অনেক ঝড় তুফান যাই তার আমার রিলেশন আর বিয়ে নিয়ে।
আমার ক্লোজ রিলেটিভরা আমাকে অনেক ধরণের কথা বলছি ওকে বিয়ে না করতে।অনেক এ অনেক কটুর কথা বলছিল।কিন্ত তাদের কথায় আমি পাত্তা দিনাই।ও শুকনো হওয়ার কারণে অকে আমার ফ্যামিলি রিজেক্ট করছিল।ও বিজনেস এ লস খাওয়ার পর টেনশেন এ অনেক শুকিয়ে গেছিল।অনেক ঝড় ঝাপ্টা পেড়িয়ে আমাদের শেষ এ এনগেজমেন্ট হয়ে গেলো ২০১৮ সালের নভেম্বর এর ২৩ তারিখ শুক্রবার এ।তার ঠিক ১ সপ্তাহ এরপর নভেম্বর এর ৩০ তারিখ আমাদের আকদ (কাবিন) হয়। আর ২০১৯ সালে ২৩শে মার্চ আমাদের বিয়ে হয়।
কিছু কথা☺☺
কখনো কাওকে যদি মন দিয়ে ভালোবাসেন চেষ্টা করবেন ভালোবাসাটা কে প্রবিত্র রাখতে আর অটুট রাখতে।এফবিতে পরিচয় রিলেশন টিকে না এই সেই এইসব কথা না শুনে নিজের মন কি বলতে চাই তা শুনুন আর বুঝুন আর সময়ের অপেক্ষা করুন।আপনার মন যদি পবিত্র থাকে তাহলে আপনি সাকসেসফুল হবেন ইনশাআল্লাহ।
আমাকে অনেক এ বলছিল বাপ্পি ছেলে ভালো না।ওর চেয়ে ভালো ছেলে ডিজার্ব করি।আসলে কপালে যার নাম লিখা আছে তার সাথে মিলন হবে এইটা আল্লাহর ইচ্ছা।
আমি খুব রাগি মেয়ে আর আমার হাজবেন যেমন রাগি আবার তেমন ঠান্ডা।আমি খুব ঝগড়া করি আর সে খুব সুন্দর করে আমাকে বুঝাই আর রাগ ভাংগাই।সংসার জীবন টাই এমন।কখনো সুখ কখনো দুঃখ। ঝগরা হবে কথা কাটাকাটি হবে কিন্তু সেটা অতিরিক্ত নই।ঝগরা হবে তাই বলে কি ছেড়ে দিব?রিলেশন ব্রেকাপ করব? না তা কখনো করবেন না।ঝগরা হলে তার সাথে বসে সমাধান করার চেস্টা করবেন।কিন্তু কখনো অতিরিক্ত মাত্রা কিছু করলে তা কখনো সহ্য করা যাই না। অনেক এ অনেক কিছু বলবে।আমাকে বলছে ওর থেকে বেটার ছেলে আমি পাব।আমি বেটার পেতাম ওর থেকে ঠিক কিন্ত আমি ত আর আমার ভালোবাসার মানুষ টা কে পেতাম না।আমরা জীবনে বেটার খুজতে গিয়ে অনেক সময় মূল্যবান জিনিসটা কে হারিয়ে ফেলি।কি দরকার সে বেটার দিয়ে?? টাকা পয়সা ত তাই না??টাকা আজ আছে কাল নাই। আজ ভালোবাসার মানুষটি যে ছেড়ে আপনি টাকাওয়ালাকে বিয়ে করছেন দেখলেন ১/২ বছর পর সে টাকা পুড়ে গেছে বা বিজনেস এ লস খাইছে আর আপনি পথের ফকির হয়ে গেলেন।তখন কি করতেন?বেটার খুজে নিয়ে অই মানুষটা কে কস্ট দিয়ে আজ আপনিও কস্ট পেলেন।তাহলে আর কি দরকার সে ভালোবাসা টা?
আমার হাজবেন্ড এর টাকা না থাকতে পারে কিন্তু মন আছে।আর সে আমাকে প্রতিটা পদে পদে আমাকে হেল্প করছে সাপোর্ট দিছে।আমাকে বুঝে এবং বুঝাই।আমার দোষ থাকলে সে নিজের ঘাড়ে দোষটা নিয়ে নেই।আমার চোখের পানি তার সহ্য হইনা।আমার বিয়ের পর আমি রান্না করলেও আমার হাজবেন্ড আমাকে সব কিছু ধুয়ে দেয় ঘরের কাজ করে।তাই বলে কি সে বউয়ের গোলাম হয়ে গেল?? না।তার আমার প্রতি যে দায়িত্ব আছে সে তার দায়িত্ব পালন করে।আর দিন শেষ এ সে সবার আড়ালে আইসক্রিম,চকলেট,চিপস,ফুসকা খাওয়ায়।সে চাই আমার মুখে হাসি ফুটুক।আর আমি চাই আমি যেন তার হাত ধরে শেষ নিঃশাষ পর্যন্ত তার সাথে জীবন কাটিয়ে দিতে??
আমার হাজবেন্ড অনেক শুকনা।কিন্তু তাতে আমার কোনো কিছু যাই আসেনা।তার মন আর তার সাপোর্ট গুলো আমার জন্য এনাফ।সুন্দর দিয়ে কি হবে??সুন্দর ত আর সারাজীবন থাকবেনা।মন যদি সুন্দর না হই তার সুন্দর চেহেরার কোনো দাম নেই।আর রইলো টাকা পয়সা??কবরে গেলেও কি এই টাকা নিয়া যাবে??যাদের টাকা বেশি তাদের অহংকার ও বেশি।কম টাকা থাকলে ভালো।সে টাকার মুল্য বুঝা যাই আর মানুষেদের ও মূল্য দিয়া যাই।মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে সুখ বেশি।অতিরিক্ত টাকা পয়সাওয়ালা মানুষরা সুখের দেখা খুব কম দেখে।
আমার বাবা আমার বিদায়ের সময় বলেছিল আমাকে লাল শাড়ি পরে তাদের ঘরে যাব আর সাদা কাফন পরে যেন তাদের ঘর থেকে লাশ হয়ে বের হই।আমার বাবার কথা আমার সারাজীবন মনে থাকবে❤❤আমার বাবা একজন সৎ মানুষ আর আমার মা হচ্ছে আমার পৃথিবী?
পবিত্র ভালোবাসুন আর সে ভালোবাসার মুল্য বুঝুন আর সৎ ভাবে জীবন যাপন করুন
আমাদের জন্য সবাই দোয়া করবেন???
প্লিস নো বাজে কমেন্ট?
ছাপ্পান্ন মিনিট পার হল। | ফিরােজ বসে আছে। কারাে কোনাে খোঁজ নেই। ঘুমন্ত রাজপুরীর মতাে অবস্থা। কোনাে শব্দটব্দও পাওয়া যাচ্ছে না, যা থেকে ধারণা করা যায় এ-বাড়িতে জীবিত লােজন আছে। সে যে এসেছে, এ-খবরটি ছাপ্পান্ন মিনিট আগে পাঠানাে হয়েছে। বেঁটেখাটো এক জন মহিলা বলে গেল—আফা আসতাছে। ব্যস, এই পর্যন্তই। ফিরােজ অবশ্যই আশা করে না যে, সে আসামাত্র চারদিকে ছােটাছুটি পড়ে যাবে। বাড়ির কর্তা স্বয়ং নেমে আসবেন এবং এনাকে চা দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন? বলে চেচামেচি শুরু করবেন। তবে এক ঘন্টা শুধুশুধু বসে থাকতে হবে, এটাও আশা করে না। সময় এখনাে এত সস্তা হয় নি।
‘আপনি কি আমাকে ডাকছিলেন?
পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ফিরােজ মনে-মনে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল । চমৎকার মেয়েগুলি সব এমন-এমন জায়গায় থাকে যে, ইচ্ছা করলেই হুট করে এদের কাছে যাওয়া যায় না। দূর থেকে এদের দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলতে হয় এবং মনে-মনে বলতে হয়—আহা, এরা কী সুখেই না আছে। | ফিরােজ উঠে দাঁড়াল। সালামের মতাে একটা ভঙ্গি করল। এটা করতে তার বেশ কষ্ট হল। উনিশ-কুড়ি বছরের একটি মেয়েকে এ-রকম সম্মানের সঙ্গে সালাম করার কোনাে মানে হয়!
ফিরােজ বলল, আমি আপনার বাবার কাছে এসেছি।’ ‘বাবা তাে দেশে নেই, আপনাকে কি এই কথা বলা হয় নি?”
হয়েছে। ‘তাহলে? মেয়েটির চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। যেন কৈফিয়ত তলব করছে, কেন তাকে
ডাকা হল। ফিরােজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার বাবা নেই বলেই আপনাকে খবর। দিতে বলেছি। গল্পগুজব করার উদ্দেশ্যে খবর দেয়া হয় নি।
অপালা পর্দা ছেড়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। লােকটিকে চট করে রেগে যেতে দেখে তার বেশ মজা লাগছে। বয়স্ক মানুষেরা মাঝে-মাঝে খুবই ছেলেমানুষি করে।
| ‘আপনার বাবা আমাকে কমিশন করেছেন বসার ঘরটি বদলে নতুন করে সাজিয়ে দিতে। এই সাজ তাঁর পছন্দ নয়।
‘আপনি কি একজন আর্টিস্ট?
‘না। আর্টিস্টরা মানুষের ঘর সাজায় না। তারা ছবি আঁকে। আমার কাজ হচ্ছে আপনাদের মতাে পয়সাওয়ালাদের ঘর সাজিয়ে দেয়া।
‘বেশ, সাজিয়ে দিন।
‘আপনি জানেন তাে, আপনার বাবা ড্রইংরুমটা বদলাতে চাচ্ছেন? | ‘না, জানি না। বাবার মাথায় একেকটা খেয়াল হঠাৎ করে আসে, আবার হঠাৎ করে চলে যায়। আপনি বসুন।
ফিরােজ বসল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এইসব পরিবারের মেয়েরা অসম্ভব অহঙ্কারী হয়। এক জন হাউস ডেকোরেটরের সঙ্গে এরা বসবে না। এতে এদের সম্মানের হানি হবে।
‘আমি ভাবছিলাম আজই কাজ শুরু করব।’ ‘করুন।”
‘আপনার বাবা আমাকে টাকাপয়সা কিছু দিয়ে যান নি। জিনিসপত্র কিনতে আমার কিছু খরচ আছে।
‘আপাতত খরচ করতে থাকুন। বাবা এলে বিল করবেন।
এত টাকা তাে আমার নেই। আপনি কি কোনাে ব্যবস্থা করতে পারেন? আমি কী ব্যবস্থা করব? | ‘আপনার বাবা বলেছিলেন, যে-কোনাে প্রয়ােজনে আপনাদের এক জন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে-নিশানাথবাবু। কিন্তু তাঁর ঠিকানা আমাকে দিয়ে যান। নি।
‘আপনি অপেক্ষা করুন, আমি ম্যানেজার কাকুকে খবর দিয়ে নিয়ে আসছি। আপনাকে কি ওরা চা দিয়েছে?
‘চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
আপনার অসীম দয়া।
অপালা হেসে ফেলল। অসীম দয়া বলার ভঙ্গির জন্যে হাসল, না অন্য কোনাে কারণে, তা বােঝা গেল না। সে দোতলায় উঠে ম্যানেজার সাহেবকে টেলিফোনে আসতে বলল। নিশানাথবাবুকে এ-বাড়িতে সবাই ম্যানেজার ডাকে, তবে ম্যানেজারি ধরনের কোনাে কাজ উনি করেন না। উনি বসেন মতিঝিল অফিসে। গুরুত্বহীন কাজগুলি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে করেন। টাটকা মাছ কেনার জন্যে প্রায়ই ভােররাতে দাউদকান্দি চলে যান। এই জাতীয় কাজে তাঁর সীমাহীন উৎসাহ।।
অপালার টেলিফোন পেয়েই বললেন, এক্ষুণি চলে আসছি মা। এই ধর পাঁচ
মিনিট। এর সঙ্গে আরাে দু’মিনিট যােগ করে নাও, রাস্তাঘাটের অবস্থা তাে বলা যায়
না! ঠিক না মা?
‘তা তাে ঠিকই।’
‘এক মাইল চওড়া রাস্তা; এর মধ্যেও ট্রাফিক জ্যাম। দেশটার কী হচ্ছে, তুমি বল? একটা অনেস্ট অপিনিয়ন তুমি দাও … | নিশানাথবাবু বকবক করতে লাগলেন। তিনি দশ মিনিটের আগে টেলিফোন ছাড়বেন না। কথার বিষয় একটিই-দেশ রসাতলে যাচ্ছে। মুক্তির কোনাে পথ নেই। দেশের সব কটা মানুষকে বঙ্গোপসাগরে চুবিয়ে আনতে পারলে একটা কাজের কাজ হত ইত্যাদি।
| অপালা রিসিভার কানে নিয়ে সুযােগের অপেক্ষা করতে লাগল কখন বলা যাবে, কাকা, টেলিফোন রাখলাম।
| ফিরােজ ভেবেছিল একটি খুব সুদৃশ্য কাপে এক কাপ চা-ই শুধু আসবে। অন্য কিছুই থাকবে না। অসম্ভব বড়লােকরা এককথার মানুষ—যখন চায়ের কথা বলেন তখন শুধু চা-ই আসে, অন্য কিছু আসে না। অথচ প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। ভাের সাতটায় পরােটা-ভাজি খাওয়া হয়েছিল, এখন বারটা দশ। খিদেয় নাড়ি পাক দিয়ে উঠছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এতটা হৃদয়হীন হবে না। সঙ্গে কিছু-না-কিছু থাকবে। এদের ফ্রীজ খাবারদাবারে সবসময় ভর্তি থাকে। চট করে চমৎকার একটা স্যাণ্ডউইচ বানিয়ে দেয়া এদের কাছে ছেলেখেলা। দু’টি রুটির মাঝখানে কয়েক টুকরাে পনির, শসার কুচি, এক চাকা টমেটো। ফ্রেঞ্চ ড্রেসিং-এর আধচামচ। গােলমরিচের গুড়। চমৎকার!
| কাজের মেয়েটি ট্রে নিয়ে ঢুকল। যা ভাবা গিয়েছে তাই। সুদৃশ্য কাপে চা এবং রুপপার একটা গ্লাসে এক গ্লাস হিমশীতল পানি। খিদে নষ্ট করার জন্যে ফিরােজ সিগারেট ধরাল। সেন্ট্রাল টেবিলে চমৎকার একটি অ্যাশটে। নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ করে কেনা। একটি পরী নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরীটির গা থেকে কাপড় খুলে যাচ্ছে। সে কাপড় সামলাতে ব্যস্ত। অগােছালাে কাপড়ের কারণে লজ্জায় তার গাল রক্তিম। এ জাতীয় অ্যাশট্রেগুলিতে কেউ ছাই ফেলে না। এতটা দুঃসাহস কারাে নেই। ফিরােজ ছাই দিয়ে সেটা মাখামাখি করে ফেলল। তার খুব ইচ্ছা করছে উঠে যাবার সময় এদের কোনাে একটা ক্ষতি করতে। কার্পেটের খানিকটা সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, কাপটা ভেঙে ফেলা। এ-রকম ইচ্ছা তার প্রায়ই হয়।
ম্যানেজার নামক জীবটির এখনাে কোনাে দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি খবর দিয়েছে কি না কে জানে। নিজের ঘরে গিয়ে হয়তাে গান শুনছে কিংবা ভিসিআর-এ ‘আকালের সন্ধানে’ চালু করে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের চিন্তায় মগ্ন।
ফিরােজ কাপ হাতে নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। ছাগল-দাড়ির এক লােক দু’টি অ্যালসেশিয়ানকে গােসল দিচ্ছে। সাবান দিয়ে হেভি ডলাডলি। কুকুর দু’টি বেশ আরাম পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। নড়াচড়া করছে না। লােকটি কুকুর দু’টির সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে। কাম কাম, সিট ডাউন, নটি বয়, বি কোয়ায়েট জাতীয় শব্দ শােনা যাচ্ছে। কুকুররা বিদেশি ভাষা এত ভালাে বােঝে কেন কে জানে। দেশি ঘিয়ে ভাজা কুত্তাকেও ‘কাম হিয়ার’ বললে কুঁই-কুঁই করে এগিয়ে আসে। ফিরােজের বাথরুম
পেয়ে গেল। কোনাে বাড়িতে গিয়ে ফট করে বলা যায় না—ভাই, আপনাদের বাথরুম কোথায় ? মালদার পার্টিদের ড্রইং রুমের পাশেই ব্যবস্থা থাকে। এখানে নেই। ড্রইং রুম নাম দিয়ে কুৎসিত একটা জিনিস বানিয়ে রেখেছে। ছাদ পর্যন্ত উচু শাে-কেসে রাজ্যের জিনিস। যেন একটা মিউজিয়াম। পয়সার সঙ্গে-সঙ্গে রুচি বলে একটা বস্তু নাকি চলে আসে। ডাহা মিথ্যে কথা। এই জিনিসটি সঙ্গে নিয়ে জন্মাতে হয়। | একটা পাঁচ বাজে। ম্যানেজারবাবুর দেখা নেই। ফিরােজের উচিত স্নামালিকম বলে উঠে যাওয়া। স্নামালিকুম বলারও কেউ নেই। অহঙ্কারী মেয়েটি এ-ঘরে আর ঢােকে নি। হয়তাে ভেবেছে এ-ঘরে ঢুকলেই থার্ড রেট একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যাবে। আরে বাবা, প্রেম এত সস্তা নয়। হুট করে হয় না। হুট করে প্রেম হয় কনজারভেটিভ ফ্যামিলিগুলিতে। ঐ সব ফ্যামিলির মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে মিশতে পারে না, হঠাৎ যদি সুযােগ ঘটে যায়—তাহলেই বড়শিতে আটকে গেল। উপরতলার মেয়েদের এই সমস্যা নেই। কত ধরনের ছেলের সঙ্গে মিশছে! | ফিরােজ উঠে দাঁড়াল। শশা-কেসটির সামনে কিছুক্ষণ কাটানাে যায়। ভদ্রলােক দেশ-বিদেশ ঘুরে এত সব জিনিস এনেছেন, কেউ এক জন দেখুক। এই বাড়িতে যারা বেড়াতে আসে তাদের শাে-কেসও এ-রকম জিনিসে ভর্তি। এরা নিশ্চয়ই দেখার ব্যাপারে কোনাে উৎসাহ বােধ করে না। আর থাকা যায় না, চলে যাওয়া উচিত। ডেকোরেশনের ফার্মটা ভার হলে এতক্ষণে চলেই যেত। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, ফার্মটা তার নয়। এক দিন যে এ-রকম একটা ফার্ম তার হবে, সে-রকম কোনাে নমুনাও বােঝ যাচ্ছে না।
ম্যানেজার বাবু ঠিক দেড়টার সময় এলেন। ফিরােজ প্রথম যে-কথাটি বলল, তা হচ্ছে—বাথরুমটা কোথায়, আপনার কি জানা আছে?
অনেকক্ষণ থেকেই টেলিফোন বাজছে। | অপালা বারান্দায় ছিল, শুনতে পায় নি। ঘরের দিকে রওনা হওয়ামাত্র শুনল। টেলিফোন বেজেই যাচ্ছে, আহানা জনি কে টেলিফোনের রিং হলেই অপালার কেন জানি মনে হয়, কেউ ব্যাকুল হয়ে ডাকছে। তার খুব একটা বড় সমস্যা। এই মুহূর্তেই তার কথা শােনা দরকার। এক বার সত্যি-সত্যি হলও তাই। রিসিভার তুলতেই ভারি মিষ্টি গলায় একটি মেয়ে বলল, ‘সালাম ভাইকে কি একটু ডেকে দেবেন? আমার খুব বিপদ।’
অপালা বলল, ‘সালাম ভাই কে? ‘আপনাদের একতলায় থাকে। প্লীজ, আপনার পায়ে পড়ি। আমাদের একতলায় তাে সালাম বলে কেউ থাকে না। ‘তাহলে এখন আমি কী করব?
বলতে-বলতে সত্যি-সত্যি মেয়েটি কেঁদে ফেলল। অপালা নরম স্বরে বলল, আপনার রং নাম্বার হয়েছে, আবার করুন, পেয়ে যাবেন। আমি রিসিভার উঠিয়ে
১০
রাখছি, তাহলে আর এই নাম্বারে চলে আসবে না।’
মেয়েটি ফোঁপাতে-ফোঁপাতে বলল, নাম্বার ঠিক হলেও লাভ হবে না। ওরা ডেকে দেয় না।’
‘তাই নাকি?
‘হ্যা। শুধু যূথী বলে একটা মেয়ে আছে, ও ডেকে দেয়। কে জানে, আজ হয়তাে যূথী নেই।
‘থাকতেও তাে পারে, আপনি করে দেখুন। | ‘আমাকে আপনি-আপনি করে বলছেন কেন? আমি মাত্র ক্লাস টেনে উঠেছি। আমাকে তুমি করে বলবেন।
| মেয়েটির সঙ্গে তুমি-তুমি করে কথা বলার আর সুযােগ হয় নি। তার টেলিফোন নাম্বার জানা নেই। মেয়েটিও অপালার নাম্বার জানে না। রং নাম্বারের একটি ব্যাপারে অল্প পরিচয়। কত দিন হয়ে গেল, এখনও সেই মিষ্টি গলার স্বর অপালার কানে লেগে আছে। টেলিফোন বেজে উঠলেই মনে হয়, ঐ মেয়েটি নয়তাে?
, ঐ মেয়ে না। সিঙ্গাপুর থেকে অপালার বাবা ফখরুদ্দিন টেলিফোন করেছেন। ‘কেমন আছ মা? ‘খুব ভালাে। ‘তােমার মা’র কোনাে চিঠি পেয়েছ?
আজ সকালেই একটি পেয়েছি। মা এখন প্রায় সুস্থ। সেকেও অপারেশনের ডেট পড়েছে? সে-সব কিছু তাে লেখেন নি। ‘এই মহিলা প্রয়ােজনীয় কথাগুলি কখনাে লেখে না। তুমি সন্ধ্যা সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে টেলিফোন করে জেনে নিও। এখানে সন্ধ্যা সাতটা মানে লণ্ডনে ভাের ছয়টা।
‘আচ্ছা, আমি করব।’ ‘খুব একা-একা লাগছে নাকি?” “না, লাগছে না। তুমি আসছ কবে? ‘আরাে দু’দিন দেরি হবে। কোনাে খবর আছে?
না, কোনাে খবর নেই।’ বসার ঘরটা নতুন করে সাজাতে বলে গিয়েছিলাম। কিছু হচ্ছে? ‘হা, হচ্ছে। ভীষণ রােগা আর লম্বা একটা ছেলে রােজ এসে কী—সব যেন করছে। তার সাথে মিস্ত্রি-টিস্ত্রিও আছে।”
কাজকর্ম কতদূর এগােচ্ছে? ‘তা তাে জানি না বাবা! আমি নিচে বিশেষ যাই না।
একটু বলে দিও তাে, যাতে আমি আসার আগে-আগে কমপ্লিট হয়ে থাকে। আমি এক্ষুণি বলছি। আর শােন, তােমার মাকে কিছু জানিও না। সে এসে সারপ্রাইজড় হবে। ‘আচ্ছা।’
ঐ ছেলেটার নাম কি?
কোন ছেলেটার? ‘কাজ করছে যে। ‘নাম তাে বাবা জানি না। জিজ্ঞেস করি নি। নাম দিয়ে তােমার কী দরকার?
‘কোনাে দরকার নেই। মতিন বলে একটা ছেলেকে দিতে বলেছিলাম। ওর কাজ ভালাে। কিন্তু তুমি তাে বলছ রােগা, লম্বা। ঐ ছেলে তাে তেমন লম্বা নয়।
‘আমি নাম জিজ্ঞেস করব। যদি দেখি ও মতিন নয়, তাহলে কী করব?
‘কাজ বন্ধ রাখতে বলবে। আমি স্পেসিফিক্যালি বলেছি মতিনের কথা। তােমার পরীক্ষা কেমন হচ্ছে মা?
‘তালাে হচ্ছে না।
খুব বেশি খারাপ হচ্ছে? ‘কেমন যেন মাঝামাঝি হচ্ছে! মাঝামাঝি কোনাে কিছুই আমার ভালাে লাগে না।
ফখরুদ্দিন সাহেব উঁচু গলায় হাসতে লাগলেন। অপালার এই কথায় হঠাৎ করে । তিনি খুব মজা পেলেন।
‘আচ্ছা মা, রাখলাম। ‘তুমি ভালাে আছ তাে বাবা? ‘অসম্ভব ভালাে আছি। খােদা হাফেজ।
অপালা নিচে নেমে এল। ঐ ভদ্রলােক বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে আছেন। তার সঙ্গের দু’ জন লােক করাত দিয়ে কাঠ টুকরাে করছে। অপালা বসার ঘরে উকি দিল। সমস্ত ঘর লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। পেইনটিংগুলি নামিয়ে রাখা হয়েছে, শাে-কেসটি নেই। কার্পেট ভাঁজ করে এক কোণায় রাখা। অপালা বলল, আপনি কেমন আছেন?
ফিরােজ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। ‘আমাকে বলছেন? ‘হ্যা, আপনাকেই। আপনার নাম কি মতিন? ‘আমার নাম মতিন হবে কী জন্যে? আমার নাম ফিরােজ। ‘আপনার নাম ফিরােজ হলে বড়াে রকমের সমস্যা কাজ বন্ধ।’
কাজ বন্ধ মানে?’ ‘কাজ বন্ধ মানে হচ্ছে আপনি আপনার জিনিসপত্র গুছিয়ে বাড়ি চলে যাবেন।
ফিরােজের মুখ হাঁ হয়ে গেল। যেন এমন অদ্ভুত কথা এর আগে সে শশানে নি। অপালা হেসে ফেলল। সে অবশ্যি হাসি মুহুর্তের মধ্যেই সামলে ফেলল। শান্ত গলায় বলল, ‘বাবা টেলিফোনে বললেন, মতিন নামের একজনের নাকি কাজটা করার কথা।
| কিন্তু আমি তাে ঠিক তার মতােই করছি।
‘আপনি করলে হবে না।’ ‘মতিন এখন ছুটিতে আছে। তার বড়াে বােনের অসুখ। বরিশাল গেছে।
বরিশাল থেকে ফিরে এলে আবার না-হয় করবেন। | ফিরােজ সিগারেট ধরাল। মেয়েটির কথা তার এখন বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে ঠাট্টা করছে। যদি ঠাট্টা না হয়, তাহলে তার জন্যে বড়াে ধরনের ঝামেলা অপেক্ষা করছে। এই কাজটি সে জোর করে হাতে নিয়েছে। করিম সাহেবকে বলেছে, কোনাে
অসুবিধা নেই, মতিনের চেয়ে কাজ খারাপ হবে না। করিম সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছেন, “আরে না। ভদ্রলােক মতিনের কথা বলেছেন।
| ‘আমি নিজে তাঁর মেয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সে বলেছে, আমি করলেও চলবে। কাজ ভালাে হলেই চলবে। | ‘দেখেন, পরে আবার ঝামেলা না হয়। বড়লােকের কারবার। মুডের উপর চলে। মাঝখানে যদি বন্ধ করে দেয়…..’
‘পাগল হয়েছেন! কাজ দেখে চোখ ট্যারা হয়ে যাবে।
লাবণ্যর সঙ্গে আমার সেভাবে কখনো চোখাচোখি হয়নি। আমি যখনই ওর চোখের দিকে তাকাতাম তখনই ও চোখ ফিরিয়ে নিত। আবার আমি যখন এদিক ওদিক তাকাতাম তখন ও আমার দুই চোখে বিচরণ করত। আমি আড়চোখে দেখতাম। কখনো ধরা পড়ে যেত। কিছুক্ষণের মধ্যেই গন্তব্যে পৌঁছালাম। নদীর পাড়ে কোলাহলমুক্ত একটি জায়গায় গিয়ে বসলাম। কাটালাম স্বপ্নময় একটা দিন। এভাবেই অতিবাহিত হলো অনেকগুলো দিন। সেদিন বিষণ্ন মনে শুয়েছিলাম বিছানায়। মা এসে পাশে বসলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করেন, কিরে! এই অবেলায় শুয়ে আছিস যে? শরীর খারাপ? মাথা নেড়ে না-বোধক জবাব দিলাম। মা আমার আরো কাছে এসে হাতটা ধরলেন। প্রশ্ন করলেন, তাহলে মন খারাপ? মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। জবাব দিতে পারলাম না কোন। তথাপি মা আমার নিরবতার ভাষা বুঝে নেন। বুঝে নেন বিষণ্ণতার কারণ। পরদিন কাঁধে ব্যাগ আর লাগেজ হাতে সবার থেকে বিদায় নিয়ে লাবণ্যর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমার চলে যাওয়ার কথা আগের দিন রাতেই সে শুনেছিল। এখন তাই বারান্দায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে সে। লাবণ্যর কাছে গেলাম আমি। ছোট্ট করে বললাম, আসি। লাবণ্য কথা বলল না। পলক ফেলল না। শুধু ঠোঁটটা কিঞ্চিৎ নড়ে উঠল। পড়াশুনা শেষে বাবা’র ইচ্ছেতেই দাদার ব্যবসায়ে যোগ দিয়েছিলাম। সেদিন তাই ব্যবসায়ের কাজেই আমাকে বিদেশে পাড়ি জমাতে হলো। ৬মাস পর। ব্যবসায়িক নানা কাজ সেরে যখন দেশে ফিরি আমার ভেতরটা আঁতকে ওঠে। হাসি-খুশি আর প্রাণচঞ্চল লাবণ্যর হঠাৎ বদলে যাওয়াটা ভাবিয়ে তুলে আমায়। প্রশ্ন করি ছোট বোন আশাকে। কিরে! তোর আপুর কি হয়েছে? বোন আমার চোখ বড় বড় করে পাল্টা প্রশ্ন করে, ওমা! আপুর আবার কখন কি হলো? আমতাআমতা স্বরে বললাম, না মানে এভাবে কাকতাড়ুয়ার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে যে! আমার কথা শুনে আশা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। বোনের মাথায় হালকা আঘাত করে বললাম, প্রশ্ন’ই তো করেছি। তার জন্য এত হাসির কি আছে? গোমড়া মুখে বোনের জবাব, হাসছি কি স্বাদে? বিগত ৬মাস ধরে আপু এরকম কাকতাড়ুয়ার ন্যায় কখনো ছাদে কখনো বা ব্যলকনিতে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। কি হয়েছে জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলেনা। কেমন যেন এড়িয়ে যা… বোনকে কথার মধ্যিখানে থামিয়ে দিলাম। ওয়েট, ওয়েট। বিগত ৬মাস ধরে মানে? ঘটনা কি? এবার কিছুটা বিরক্তিকর মুখে বোনের জবাব, ভাই তুই সামান্য বিষয়কে নিয়ে এত প্যাঁচাচ্ছিস কেন? ঘটনা কি? সম্বিত ফিরল আমার। সত্যিই তো। একটা সামান্য বিষয়কে এভাবে বড় করে কেন দেখছি? বোনের রুম থেকে চলে আসলাম আমি। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি আমার কাজ নিয়ে। কেটে যায় অনেকগুলো মাস। লাবণ্যর খুঁজ সেভাবে আর নেয়া হয়নি অনেকদিন। যদিও আমাদের বসতটা ছিল একই ছাদের তলায়। মধ্য রাতে চাপা কান্নার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায় আমার। বিছানা থেকে উঠে ধীর পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে বাহিরে এলাম। ব্যলকনির যে পাশ থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছিল সে পাশে গেলাম। নাহ! কাউকে পাইনি সেখানে। বিষয়টাকে মনের ভ্রম ভেবে চলে আসছিলাম। পাশেই কিছু একটা ভাঙ্গার আওয়াজে চমকে উঠলাম। ফিরে তাকালাম ডানে। শব্দটা এ বাসার অতিথি লাবণ্যর রুম থেকে আসছে। জানালাটা হালকা মেশানো ছিল। ফাঁক দিয়ে চাইলেই দেখতে পারি আমি ভেতরে কি চলছে। তা সত্ত্বেও কিছুটা ক্ষণ দ্বিধায় ভোগী এই ভেবে, লুকিয়ে রুমে উঁকি দেয়া ঠিক হবে কি না…! সাতপাঁচ ভেবে একটা সময় জানালাটা আংশিক ফাঁকা করে রুমে উঁকি দিয়েই দিলাম। তারপর যা দেখলাম তাতে কিছুটা চমকে গেলেও অস্বাভাবিক হইনি। ফ্লোরে বসে খাটে মাথা ঠেকিয়ে আছে লাবণ্য। হাতে ডায়েরীর মতো কিছু একটা। আমার আন্দাজ সঠিক হলো বোধ হয়। মনে হচ্ছে মেয়েটি প্রেমে পড়েছে। চলবে….