Tuesday, June 24, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 114



চক্রব্যূহ পর্ব-০৪

0

#ধারাবাহিক গল্প
#চক্রব্যূহ
পর্ব-চার
মাহবুবা বিথী

পড়শীর বারবার মনে হতে লাগলো এভাবে ওর হাসব্যান্ডকে ঠকানো ঠিক হলো না। এ অন্যায়। ওকে হয়তো একদিন এই অন্যায়ের শাস্তি পেতে হবে। ওদিকে সায়েম পড়শীকে বিছানায় না পেয়ে চোখ খুলে খুঁজতে থাকে। রাত্রির আবছায়ায় পড়শীকে তখন ও জানালার ধারে মন খারাপ করে বসে থাকতে দেখে। ও উঠে এসে পড়শীকে পিছনদিক থেকে জড়িয়ে ধরে বলে,
—কি ভাবছো?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়শী বলে,
—-এভাবে আমার হাসব্যান্ডকে ঠকানো ঠিক হলো না।
—-কে তােমার হাসব্যান্ড? ঐ বয়স্ক লোকটাকে আমি তোমার হাসব্যান্ড হিসাবে মানি না।
—-তুমি নাই মানতে পারো। কিন্তু আমি তো উনাকে আল্লাহপাকের কালাম স্বাক্ষী রেখে বিয়ে করেছি। সেজন্য ঐ মানুষটার প্রতি আমার দায়বদ্ধতা আছে।
—-কিন্তু ঐ মানুষটার আগে আমি তোমাকে ভালোবেসেছি। তুমি উনার কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। এখন থেকে তুমি শুধুই আমার।

ভোর হওয়ার সাথে সাথে ওরা দু,জন ঢাকার পথে রওয়ানা দেয়। রাস্তায় জ্যাম না থাকার কারনে পড়শী খুব দ্রুত হোস্টেলে ফিরে যায়। এতো সকালে জয়নব পড়শীকে ফিরতে দেখে কোনো ভনিতা না করেই জিজ্ঞাসা করে,
—-কাল সারা রাত তুমি কোথায় ছিলে? তোমার ফোন বন্ধ পেয়ে তোমার আব্বা আমার মোবাইলে ফোন দিয়েছিলো।
—-আপু তুমি কি বলেছো?
—-তুমি ঘুমিয়ে পড়েছো এ কথা বলেছি।
—-তুমি তো বললে না কাল রাতে কোথায় ছিলে?
—-সায়েমের সাথে ছিলাম।
—-তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো? তুমি যে পাপের অতলে তলিয়ে যাচ্ছো পড়শি। আমি তোমার কাজ থেকে এরকম কাজ আশা করিনি।
—আপু এখানে পাপের কিছুই নাই। আমি আমার হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স দিয়ে সায়েমকে বিয়ে করবো।
—-সায়েম কি তোমাকে বিয়ে করবে?
—-ও বলেছে করবে।
—-,করলে তো ভালোই আর না করলে এই পাপের বোঝা তুমি কিভাবে বইবে?
জয়নবের কথা শুনতে পড়শীর আর ভালো লাগছে না। তাই গলার স্বরে কাঠিন্য ভাব এনে পড়শী বললো,
—-আমি তোমার সাথে এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাইছি না।
জয়নবও বুঝতে পারলো পড়শীর কাছে আজ আর ওর কোনো গুরুত্ব নাই। তাই ও আর কথা বাড়ালো না।

এরপর থেকে সায়েম আর পড়শী গাজীপুরের ঐ বাংলো বাড়িতে প্রায় সময় কাটাতে যায়। এদিকে ওদেরকে নিয়ে ভার্সিটিতে বেশ কানাঘুষা চলতে থাকে। এমনকি কারা যেন পড়শী আর সায়েমের বিষয়টা ওর হাসব্যান্ডকে জানিয়ে দেয়। যেখানে রাশেদের ছ,মাস পর আসার কথা সেখানে মাস তিনেকের মধ্যে ও পড়শীদের বাসায় সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে চলে আসে। রাশেদ ওর কাছে সায়েমের বিষয় জানতে চাইলে পড়শী সব ঘটনা ওর কাছে খুলে বলে। পড়শী রাশেদকে ডিভোর্স দিতে বলে। একথা শুনে রাশেদ পড়শীকে বলে,
—-তুমি আগে দেখো সায়েম তোমাকে বিয়ে করতে চায় কিনা? সে যদি তোমাকে বিয়ে করে তাহলে আমি তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবো।
কিন্তু সায়েম পড়শীকে বিয়ে করতে চায় না। বিয়ের কথা বললে নানা টালবাহানা শুরু করে। পড়শী এর মাঝে ভার্সিটিতে সায়েমের বিষয়ে নানা নেগেটিভ কথা শুনতে পায়। ও নাকি এভাবেই মেয়েদের ব্যবহার করে। পড়শীর তখন মনে হয় জয়নব নিশ্চয় সায়েমের বিষয়ে কিছু জানে। তাই জয়নবকে জিজ্ঞাসা করলে ও বলে,”ওর অফিসের একটা মেয়ের সাথে সায়েম একই কাজ করেছে। মেয়েটা সায়েমের সাথেই ভার্সিটিতে পড়তো।”
এসব কথা জানার পর ও ওর হাসব্যান্ডের কাছে ফিরে যেতে চায়। রাশেদও ওর সব অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে কানাডায় নিয়ে যায়।

চারবছর রাশেদের সাথে ও সুখে সংসার করে। রাশেদের ব্যবসা ভালোই চলে। পড়শীও পার্টটাইম জব করে। ওর দুটো সন্তান হয়। এর মাঝে একদিন ওর ম্যাসেঞ্জারে একটা ভিডিও কে যেন পাঠিয়ে দেয়। ভিডিও লিংক ওপেন করে দেখে এখানে সায়েম আর ওর শারীরিক মিলনের ভিডিও চিত্র। ওর সুখে পৃথিবীটা মুহুর্তে দুলে উঠে। ও সায়েমকে ফোন দিয়ে বলে,
—-এটা তুমি কেন করলে?
—-বুঝতে পারছো না কেন করেছি? তোমার প্রিয়তম স্বামীকে সব জানিয়ে দিবো। আর তোমার সুখের সংসারটা তছনচ করে ভেঙ্গে পড়বে।
একথা বলে অট্টহাসিতে সায়েম ফেটে পড়ে। পড়শী সেই মুহুর্তে খুব মুষড়ে পড়ে। ওর বাচ্চা দুটোর চেহারা বারবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠে। ও তখন সায়েমকে বলে —–তুমি এই ডিডিও ক্লিপ আমাকে দিয়ে দাও। বিনিময়ে যা চাইবে তাই দিবো।
সায়েম ওর কাছে প্রতিমাসে মোটা অংকের টাকা দাবী করে। পড়শীও রাজি হয়। পড়শী দিনরাত এককরে টাকা উপার্জন করে সায়েমের চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে। এভাবে আরো ছ,বছর সময় পার হয়। এখন ওর মেয়েটার বয়স দশ বছর আর ছেলেটার বয়স আট বছর। সায়েম ওর চাহিদা আরো বাড়িয়ে দেয়। যেটা পড়শীর পক্ষে যোগান দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এবার প্রতিবাদ করে বলে,
—-আমি তোমাকে আর একটা টাকাও দিবো না। তুমি যা পারো করো।
এবার সায়েম পড়শীর হাসব্যান্ডের কাছে আরো একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠিয়ে অনেক টাকা দাবি করে। টাকার হিসাবে প্রায় দশকোটি টাকা। রাশেদ মনে মনে পড়শীর উপর খুব অসন্তষ্ট হয়। যদিও টাকাটা দিতে রাশেদ রাজি হয়েছিলো। কিন্তু পড়শী রাশেদকে বলে,
—-তুমি ওকে একটা কানাকড়ি দিবে না।
এতে রাশেদ তেতে উঠে বলে,
—-এতে যে তোমার গুনকীর্তন ফাঁস হবে। আর আমার মান সম্মান সব ধুলোয় মেটাবে।
তখন পড়শী ওকে বলে,
—-তুমি আমাকে ভিভোর্স দিয়ে দাও। তাহলে সবকুল রক্ষা হবে। বাচ্চারা এখন বড় হয়ে গিয়েছে। তুমি ভালে মেয়ে দেখে আবার বিয়ে করে সংসার শুরু করো। আমার মতো পাপিষ্টার ছায়া তোমার জীবন থেকে চিরজনমের মতো মুছে ফেলো।
অবশেষে রাশেদ পড়শীকে ডিভোর্স দেয়। পড়শীও মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয় দেশে এসে ও আত্মহত্যা করবে। এ জীবনটাকে ও আর বাঁচিয়ে রাখবে না। কার জন্য বাঁচিয়ে রাখবে। কেউ তো ওকে ওর মতো করে বোঝার চেষ্টা করেনি। বাবাকে বলেছিলো ও পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। কিন্তু বাবা সাত সকালে বিয়ে দিলো। সায়েমের কাছে ভালোবাসা চেয়েছিলো। বিনিময়ে প্রতারিত হলো। এখন স্বামীও ওর মতো পাপিষ্টার হাত থেকে বাঁচতে চাইছে। তাই ডিভোর্স চাওয়া মাত্রই দিয়ে দিলো।

চলবে

চক্রব্যূহ পর্ব-০৩

0

#ধারাবাহিক গল্প
#চক্রব্যূহ
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

পড়শী আজ ক্লাস শেষ করে রাত এগারোটার বাসে নীলফামারীর উদ্দেশ্য রওয়ানা দিয়েছে। ওর বাবা ফোনে জানিয়েছে উনি খুব অসুস্থ। পড়শী যেন খুব শীঘ্রই বাড়ী চলে আসে। তাড়াহুড়ো করে রওয়ানা দেওয়ায় সায়েমকে জানাতে পারেনি। এদিকে সায়েম তার ফন্দি হাসিল করার জন্য পড়শীকে ফোন দেয়। পড়শী ফোনটা রিসিভ করতেই সায়েম বলে,
—-মেরি জান, তোমার কাছে একটা আব্দার আছে। সাহস দিলে বলতে পারি।
—-বলনা,এতো ভনিতা কেন করছো?
—-আগে কথা দাও তুমি আমার আব্দারটুকু রাখবে?
পড়শী একটু ইতস্তত করে বললো,
—-ঠিক আছে কথা দিলাম।
—-কাল তো শুক্রবার। তোমার ভার্সিটি অফ আছে। গাজীপুরে আমার বাবার একটা রিসোর্ট আছে। কাল ওখানে আমরা দু,জন নিয়ে নিরিবিলিতে সময় কাটাবো।
—-আসলে তোমাকে একটা কথা বলা হয়নি। বাবা হঠাৎ অসুস্থ হওয়াতে আমি নীলফামারীতে রওয়ানা দিয়েছি। তবে তোমাকে কথা দিচ্ছি নীলফামারী থেকে ঘুরে এসে তোমার সাথে সময় কাটাবো।
—+আঙ্কেল অসুস্থ, তুমি তো আমাকে জানাতে পারতে? আমিও তোমার সাথে গিয়ে আঙ্কেলকে দেখে আসতে পারতাম।
—-তোমার কথা শুনে আমার মনটা জুড়িয়ে গেল।
—–সাবধানে যেও।
—ওকে।
প্লানটা ভেস্তে যাওয়াতে সায়েম মনে মনে একটু বিরক্ত হলো। কিন্তু পড়শীর কাজ থেকে কথা আদায় করতে পেরেছে মনে মনে এই সান্তনাটুকুতে সায়েম নিজেকে সন্তষ্ট রাখলো।

পড়শী সকাল সাতটার মধ্যে হিজলতলী গ্রামে পৌঁছে গেল। বাড়িতে পৌঁছে পড়শী অবাক হয়ে গেল। আত্মীয়স্বজনে পুরো বাড়ি ভরপুর। পড়শী একটু অবাক হলো। বাড়িতে সাজগোছ করে অপরিচিত কিছু মেহমানও এসেছে। ওকে দেখে ওর মা দৌড়ে এসে বললো,
—-ঘরে আয় মা।
—-আব্বা কোথায়? আব্বার নাকি শরীর খারাপ? আর বাড়িতে এতো লোকজন কেন?
—-ঘরে আয় সব বলছি।
পড়শী ওর মায়ের পিছু পিছু ঘরে আসলো। ও ওর মায়ের কাছে এক গ্লাস পানি খেতে চাইলো। ওর মা কিচেনে গিয়ে পানির গ্লাস পড়শীর ছোটো বোন আরশীর হাতে পাঠিয়ে দিলো। আরশি পড়শীর হাতে গ্লাস তুলে দিয়ে বললো,
—বুজান,আজ তো তোমার বিয়ে।
আরশির মুখে একথা শুনে পানি মুখে পড়শী বিষম খেলো।এবং ওর মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। এমনসময় ওর বাবা ঘরে এসে বললো,
—-পানিটা ধীরে সুস্থে খাও। রাস্তায় তোর কোনো অসুবিধা হয়নি তো মা?
—-না, তোমার শরীর কেমন?
—-দু,দিন আগে প্রেসারটা একটু বেড়েছিলো। এখন ঠিক আছে।
—-তাহলে আমাকে কেন বললে, তোমার শরীর খারাপ?আমার তো সামনে পরীক্ষা। পড়াশোনার চাপ আছে।
—-দু,একদিনে তোর এমন কোনো সমস্যা হবে না। তোকে বলা হয়নি। একটা ভালো সম্বন্ধ এসেছে। তোর স্কুলের হেডস্যার এই প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। ছেলে কানাডার সিটিজেন। ওখানে নিজের বাড়ি আছে। ব্যবসা আছে। শুধু ছেলের বয়স একটু বেশী। আজ তোকে ওরা দেখতে আসছে। পছন্দ হলেই আকদ করে ফেলবে।
—–আব্বা আমি এখন বিয়ে করবো না।
—-আমি ওদের কথা দিয়েছি। তুইও অমত করিস না।
—-বাবাব আমি পড়াশোনা শেষ করতে চাই।
—-ওরা বলেছে, তোকে পড়াবে।
পড়শীর কোনো আপত্তি আর ধোপে টিকলো না। পড়শী সায়েমকে ফোন করে বলে,ওকে বিয়ে করতে। কিন্তু সায়েম ওকে জানায় লেখাপড়া শেষ না করে ওর পক্ষে পড়শীকে বিয়ে করা সম্ভব নয়। পড়শী খুবই আহত হয়। রাগ করে পড়শী সায়েমের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। অবশেষে ওর থেকে প্রায় পনেরো বছরের বড় পাত্রের সাথে আকদ হয়ে যায়। পড়শীর হাসব্যান্ডের নাম রাশেদ। পড়শীদের পাশের গ্রামে ওদের বাড়ি। এখন পড়শী বাবার বাড়িতেই থাকবে। ছ,মাস পর কানাডার কাগজপত্র ঠিক করে রাশেদ দেশে এসে পড়শীকে নিয়ে যাবে। আর তখনি অনুষ্ঠান করে পড়শীকে তুলে নিবে।

এক সপ্তাহ পর পড়শী ঢাকায় ফিরে আসে। ভার্সিটিতে আবার ক্লাস শুরু করে। পড়াশোনার মাঝে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চায়। কিন্তু পেরে উঠে না। পড়শী আস্তে আস্তে ডিপ্রেশনে চলে যায়।সায়েমও যেন এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলো। ও পড়শীর কাছে মাফ চায়। পড়শীও ডিপ্রেশন থেকে বের হতে ওকে ক্ষমা করে দেয়। আবারও পড়শী সায়েমের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। এরমাঝে পড়শীর পরীক্ষা শুরু হয়।
যেদিন ওর পরীক্ষা শেষ হবে সেদিন সায়েমের জন্মদিন। সায়েম ওকে নিয়ে জন্মদিন সেলিব্রেট করতে চায়। পড়শী ও আর অমত করে না। পরীক্ষা শেষ করে ক্লাস থেকে বের হয়ে এসে দেখে সায়েম বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সায়েম পড়শীকে বাইকে উঠতে বলে। পড়শী জিজ্ঞাসা করে,
—-আমরা কোথায় যাচ্ছি?
—-গাজীপুরে,আমার বাবার একটা বাংলো বাড়ি আছে। ওখানেই জন্মদিনটা উদযাপন করবো।
—-আমি আবার রাত দশটার মধ্যে হোস্টেলে ফিরতে পারবো তো?
—-আমার উপর তোমার বিশ্বাস নেই?
—-বিশ্বাস আছে বলেই তো এতো কিছুর পর আবারো তোমার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছি।
ঘন্টা দুয়েক পর একটা নির্জন বাংলোবাড়ির সামনে পৌঁছাতেই কেয়ারটেকার এসে দরজা খুলে দেয়। সায়েম পড়শীকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে। প্রথমে ঢুকতেই বিশাল হলরুম, পাশে লিভিং রুম। লিভিংরুমের পাশে দোতলায় উঠার সিঁড়ি। দোতলায় তিনটা বেড রুম। বাড়ীটার সামনে রান্নাঘর আর গ্যারেজ। পড়শীর কাছে বাড়ীটা ভীষণ সুন্দর লাগে। অত্যাধুনিক ফার্ণিচার দিয়ে রুমগুলো সাজানো হয়েছে। এমন একটা বাড়িতে পড়শী জীবনে প্রথম আসলো তাই অবাক হয়ে চারপাশটা দেখছিলো। একসময় সায়পম এসে ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
—-সারা রাত কি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে?
সায়েমের কথায় পড়শী ভীষণ লজ্জা পায়। নিজেকে সামলে সায়েমের পিছুপিছু দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। একটা বেশ বড় সড় বেডরুমে সায়েম পড়শীকে নিয়ে প্রবেশ করে। ঘরটা খুব সুন্দর। দখিন দিকে জানালা আছে। ঠান্ডা শীতল বাতাস বইছে। একটা পালঙ্ক রয়েছে। ডেসিং টেবিল আর একসেট সোফা আছে। একটা বড় সেন্টার টেবিলও রয়েছে। জানালার পাশে একটা রকিং চেয়ার রাখা আছে। পড়শী সোফায় বসে পুরো ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে নেয়। পড়শী মনে মনে ভাবছে সায়েমরা বেশ বড়লোক। অথচ ও খুব সাধারণ ভাবেই থাকে। ওর পরিবার আর সায়েমদের পরিবার রাত আর দিনের তফাৎ।
সায়েম পড়শীকে নিরব থাকতে দেখে বললো,
—-এতো চুপচাপ কেন পড়শী? তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
পড়শী একটু অস্বস্তি নিয়ে বললো,
—-না, আমি ঠিক আছি। আচ্ছা তোমার জন্মদিনে ইনানরা আসবে না?
—-আজ আমি কাউকে ডাকিনি। পুরো সময়টা আমি তোমার সাথে কাটাবো। তুমি একটু বসো। আমি আসছি।
সায়েম পড়শীকে বসিয়ে রেখে বাইরে চলে গেল। বেশ কিছুক্ষণ পড়শী একা বসে থাকলো। ঘন্টাখানিক পর এ বাড়ির অ্যাসিসটেন্ট ট্রেতে করে কাচ্চিবিরানী, কাবাব, দেশী মুরগীর ভুনা,কাঁচা রসগোল্লা আর আপেলের জুস নিয়ে আসলো। সায়েমও ওর সাথে এসে খাবারগুলো টেবিলে রাখতে সাহায্য করলো। ছেলেটা পড়শীর দিকে কিভাবে যেন তাকালো। ওর তাকানো দৃষ্টি দেখে একটা অস্বস্তিবোধ পড়শীর পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। ছেলেটা খাবারগুলো রেখে চলে গেল। সায়েম পড়শীর পাশে এসে বসলো। তারপর ওর হাত ধরে সায়েম বললো,
—-আমি জানি,তুমি আমার উপর অনেক অভিমান করে আছো। আমি যে তোমার কথা রাখতে পারিনি সে জন্য মর্মে মর্মে শেষ হয়ে যাচ্ছি। আসলে আমি তো এখন নিজের পায়ে দাঁড়াইনি। বিয়ে করে তোমাকে রাখবো কোথায়? তবে এবছর আমার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হবে। ইনশাআল্লাহ গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গেলে একটা চাকরি নিশ্চয় যোগাড় করতে পারবো। তখন তুমি যদি চাও তোমাকে আমার বিয়ে করতে আপত্তি নেই।
সায়েমের কথা শুনে পড়শীর মনে হলো এরকম হলে তো ভালোই হয়। ও আসলে দেশের বাইরে যেতে চায় না। সেক্ষেত্রে হয়তো ওর হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে হবে। পড়শীকে নিরব থাকতে দেখে সায়েম বললো,
—-তোমার কি এতে মত নেই?
—-না,মানে অনেক ঝামেলা পোহাতে হবে। আমার হাসব্যান্ডকে ডিভোর্স দিতে হবে।
—-তুমি চাইলেই সব সম্ভব। আসো আমরা খেয়ে নেই।
ওরা দু,জনে বসে খুব তৃপ্তি করেই খাবারগুলো খেয়ে নিলো। পড়শীরও অনেক খিদে পেয়েছিলো। সকালে একরকম না খেয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছে। আসলে পরীক্ষার সময় খেলে টেনশনে ওর বাথরুমের চাপ লাগে। সেজন্য না খেয়ে পরীক্ষা দিতে আসে। এখন বেলা চারটা বাজে। খিদেটাও বেশ চনমনে ছিলো। খাওয়া শেষ করার পর সায়েম ওর গ্লাসে আপেল জুসটা ঢেলে দিলো। নিজের গ্লাসে ঢেলে নিয়ে অ্যাসিসটেন্টকে ডাকার জন্য কলিং বেল বাজালো। ছেলেটা এসে টেবিল পরিস্কার করে এঁটো বাসনগুলো নিয়ে চলে গেল। সায়েম সোফায় পড়শীর পাশে খুব ঘনিষ্ট হয়ে বসলো। পড়শীর কপালে নিজের চুম্বনের তিলক এঁকে দিলো। পড়শীর তরফ থেকে কোনো বাধা না আসাতে সায়েম যেন আরো সাহসী হয়ে উঠলো। পড়শীর রক্তিম অধরে নিজের অধরখানি ডুবিয়ে দিলো। সায়েমের এমন আদরে পড়শী সারাশরীরে শিহরণ ছড়িয়ে পড়লো। এদিকে অক্টোবর মাস। পাঁচটার মধ্যেই ঝুপ করে সন্ধা নেমে যায়। সায়েম পড়শীকে বসিয়ে রেখে আবারও বাইরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটা কেক নিয়ে ঘরে আসে। দু,জনে কেক কেটে জন্মদিন সেলিব্রেট করে। এদিকে সন্ধার আলো আঁধারিতে চারিদিক ঢেকে যাচ্ছে। হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য পড়শী সায়েমকে তাড়া দেয়। কিন্তু সেসময় আকাশ কালো করে তুমুল বেগে বাতাস বইতে থাকে। মনে হচ্ছে আশ্বিনি ঝড়। কারেন্ট চলে যায়। সায়েম ঘরে রাখা মোমবাতিটা জ্বালিয়ে দেয়। কিন্ত বাতাসের তোড়ে মোমবাতিটা নিভে যায়। পড়শী জানালা লাগাতে গেলে বাঁজ পড়ার শব্দ শুনতে পায়। ও জানালা না লাগিয়ে সায়েমের পাশে এসে বসে। সায়েম ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। পড়শীও ওকে ধরে রাখে। বাহিরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরছে। এরকম শীতল ঠান্ডা পরিবেশে দুটো মানুষ নিজেদের অস্তিত্ব ভুলে একে অপরের মাঝে ডুবে যায়।

হঠাৎ পড়শীর ঘুম ভেঙ্গে যায়। তখন এই ঘটনার জন্য ওর ভিতরে পাপবোধ কাজ করতে থাকে।

চলবে

চক্রবূহ্য পর্ব-০২

0

#ধারাবাহিক গল্প
#চক্রবূহ্য
পর্ব- দুই
মাহবুবা বিথী

লাঞ্চের পর ভার্সিটিতে এসে সায়েম সবটা শুনে পড়শীকে দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো। তাই আর অপেক্ষা না করে খুব সুন্দর একটা মেসেজ লিখে পড়শীকে সেন্ড করলো। রাজনীতি করার কারনে অফিসরুমের মামাদের কাছ থেকে পড়শীর মোবাইল নাম্বার যোগাড় করতে খুব বেশী বেগ পেতে হয়নি। পড়শী তখন কেবল ভার্সিটি থেকে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় শুয়ে লেকচার সিটগুলো দেখছিলো। এমনসময় মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠলো। ওপেন করে দেখে একটা অচেনা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে।
“তোমাকে দেখিনি। তবে তোমার সাহসিকার পরিচয়ে মনের আঙ্গিনায় তোমার একটা অবয়ব গড়ে নিয়েছি। আমি সায়েম। ছাত্র সংসদের আমি একজন নেতা। তবে নেতা হয়ে নয় আমি আমার সহপাঠি বন্ধু ও ছোটোভাইবোনদের একজন সেবক হতে চাই। কাল লাইব্রেরীতে বিকাল চারটায় আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। ওখানে যে কাউকে আমার কথা বললে তোমাকে চিনিয়ে দিবে।”
পরদিন ক্লাস শেষ করে পড়শী লাইব্রেরীতে গিয়ে একটা ছেলেকে সায়েমের নাম বলতেই ও কোনার টেবিলটা দেখিয়ে দিয়ে চলে যায়। পড়শী টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। বেশ সুদর্শন দেখতে একটা ছেলে আপনমনে বই পড়ছে। পড়শী একটু ইতস্তত করে বললো,
—-হ্যালো, আপনি তো সায়েম?
—-হুম,
—-আমি পড়শী। আপনি চারটার সময়ে আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন। আমার সাথে কি আপনার কোনো দরকার আছে?
—-হুম, মনে আছে। তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি। আমার দলের ছেলেদের সাথে আজঅবদি কেউ চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেনি। আর আপনিতো সোজা থাপ্পড় মেরে দিলেন। আপনার সাহস আছে বলতে হবে।
পড়শী খুব মনোযোগ দিয়ে সায়েমের কথাগুলো শুনে গম্ভীর হয়ে গলায় কাঠিন্য ভাব এনে বললো,
—দেখুন, ওরা কিন্তু আমাকে অসম্মানিত করেছে। ওভাবে আমার হাত ধরে টানাটানি না করলে আমি ওদের গায়ে ফুলের টোকাও দিতাম না।
—অবশ্যই ওরা তোমার সাথে অন্যায় করেছে। আমি ওদের হয়ে তোমার কাছে মাফ চাইছি। আর ওদেরকেও আপনার কাছে মাফ চেয়ে নিতে বলবো।
—-তার আর দরকার হবে না। আমি ওদের সবাইকে মাফ করে দিয়েছি। আমাকে এখুনি বাস ধরতে হবে।
—আমার সাথে গাড়ি আছে। তোমাকে লিফট দিতে পারি।
—-আমি বাসে যেতেই স্বাচ্ছন্দ বোধ করি। অফার করার জন্য ধন্যবাদ।
—-রাতে মেসেজ বা কল করতে পারি?
পড়শী মুচকি হেসে চলে গেল। সায়েম ওর গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইলো।

রাতে ডিনার করে সবে পড়শী বই নিয়ে পড়তে বসেছে। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে সায়েম ফোন দিয়েছে। সায়েমের ফোনটা পেয়ে পড়শীর ঠোঁটের কোনে হাসির আভা দেখা দিলো। পড়শী ফোনটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো
—হ্যালো, তোমাকে ডিস্টার্ব করলাম নাতো?
—না,না আমি কেবলই রাতের খাওয়া শেষ করে বই নিয়ে পড়তে বসেছি। কাল একটা টিউটোরিয়াল আছে।
—-তাহলে তুমি পড়াশোনা করো। তবে বেশী রাত জেগো না। চোখের নীচে ডার্ক সারকেল পড়লে এতো সুন্দর চেহারাটা বড্ড মলিন দেখাবে। তোমাকে তুমি করে বলছি বলে কিছু মনে করো না। আমি আবার জুনিয়রদের আপনি বলতে পারি না।
—-ঠিক আছে,সমস্যা নাই।
—-ফোন রাখছি। গুড নাইট।
এরাতের পর থেকে প্রায় প্রতি রাতেই সায়েম পড়শীকে ফোন দিয়েছে। ভার্সিটির ক্যান্টিনে কিংবা লাইব্রেরীতে ওদের দু,জনকে অনেকে আড্ডা দিতে দেখেছে। যে ছেলেগুলোর সাথে পড়শীর দ্বন্দ হয়েছিলো ওরা সায়েমের বন্ধু হওয়াতে পড়শী ওদের সাথে বিবাদ মিটিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। এবং ওদের সাথে পড়শীর সখ্যতা গড়ে উঠে। এরমাঝে সায়েমের বাইকে চড়ে পড়শী নানান জায়গা ঘুরে বেড়িয়েছে। কখনও বা বসুন্ধরা সিনোপ্লেক্সে মুভি দেখেছে। কখনও বা পুরান ঢাকায় গিয়ে কাচ্চি খেয়েছে।

ভার্সিটিতে দু,মাস পার হয়ে গেল। আর একমাস পর ফাস্ট ইয়ারের টিউটোরিয়াল গুলো শুরু হবে। পড়শীরও পড়ার চাপ বাড়তে লাগলো। এখন এই শহরটাকে পড়শীর বেশ ভালো লাগে। তবে ভালো লাগার কারনটা যে সায়েম পড়শী সেটা ভালোই অনুভব করছে।

ভার্সিটির ক্লাস শেষ করে হোস্টেলে ফেরার সাথে সাথে জয়নবের মুখোমুখি হতেই পড়শী অবাক হয়ে বললো,
—-এসময় তুমি হোস্টেলে, শরীর ঠিক আছে তো?
—মাথাটা একটু ব্যথা করছে। তাই ছুটি নিয়ে চলে আসলাম। তবে তোমার দেখা তো আজকাল পাওয়াই যায় না। ভার্সিটি থেকে আসার পর তোমাকে তো ফোনেই ব্যস্ত থাকতে দেখি। কি ব্যাপার কারো প্রেমে পড়েছো নাকি? আমার কথা তুমি মনে হয় ভুলে গিয়েছো?
পড়শী জয়নবকে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-তোমাকে ভুলে গেলে আমি তো নিজেকেই ভুলে যাবো। সামনে পরীক্ষা তো। তাই পড়াশোনার চাপটা বেড়েছে।
—-কিন্তু তুমি সারাক্ষণ ফোনে যেভাবে কথা বলো তাতে মনে হচ্ছে তুমি অন্য খেলায় মেতেছো।
জয়নবের কথায় পড়শী ভীষণ লজ্জা পেলো। ওকে ছেড়ে দিয়ে চেয়ারে বসে বইয়ের পাতা উল্টানোর সময় বললো,
—-তুমি যা ভাবছো বিষয়টা আসলে তেমন নয়। ও শুধুই আমার বন্ধু। ওর নাম সায়েম।
—- কি নাম বললে সায়েম? নামটা খুব চেনা মনে হচ্ছে।

এদিকে ইনান সায়েমকে পড়শীর প্রেমে হাবুডুবু খেতে দেখে মেজাজ খারাপ করে সায়েমকে বললো,
—তুই শেষ পর্যন্ত ঐ গেঁয়ো ভুতটার কাছে হার মানলি? তুই তো পোশাক বদলানোর মতো করে নারী পাল্টাস। তাহলে এই মেয়েকে তুই এতোদিন কি কারনে ধরে রেখেছিস? আমার মাথায় তো কিছু ঢুকছে না। যে মেয়ের তোর পায়ের নখের সমান যোগ্যতা নেই তার প্রেমেতে তুই এতো মজেছিস? এটা তো তোর সাথে যায় না।
ইনানের কথা শুনে সায়েমের পুরেনো অভ্যাস মাথা চাড়া দিলো। ধিকি ধিকি করে জ্বলা প্রতিশোধের আগুনে মনে হয় ঘি ঢেলে দেওয়া হলো। ওখানে ইনান আর সায়েম ছাড়াও আরো দু,জন উপস্থিত ছিলো। সায়েম আসলেই পড়শীর উপর একটু দুর্বল হয়ে পড়েছিলো। মেয়েটা যতই ওর সাথে মিশুক না কেন নিজেকে শামুকের মতো শক্ত মোড়কে ঢেকে রাখে। যেটা ভেদ করে সায়েমের ওর ঘৃন্য উদ্দেশ্যেটা হাসিল করতে পারে না। তবে বন্ধুদের কথায় ও ওর চিরাচরিত স্বভাবে ফিরে আসলো। গম্ভীর স্বরে সায়েম বললো,
—-আমাকে আর দুটো দিন সময় দে তোরা। তারপর দেখ ওর আমি কি হাল করি?
একথা বলেই সায়েম ওখান থেকে বের হয়ে গেল। ইনানের ঘনিষ্ট সহযোগী পলক এগিয়ে এসে বললো,
—-সায়েম ভাই মনে হয় মেয়েটার উপর অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। উনি আমাদের উদ্দেশ্য সফল করতে পারবেনা।
ইনান একটা ফিচেল হাসি দিয়ে বললো,
—-আজকে যে ওষুধ দিয়েছি তাতে ঠিক কাজ হবে।

চলবে

চক্রব্যূহ পর্ব-০১

0

#সামাজিক থ্রিলার
#চক্রব্যূহ
পর্ব-এক
মাহবুবা বিথী

নীলফামারী জেলার বাবুর হাট থানার হিজলতলা গ্রামের মেয়ে পড়শী। খুবই মেধাবী। গ্লোডেন জিপিএ পেয়ে এসএসসি, এইচএসসি পাশ করেছে। এরপর ভর্তি যুদ্ধের ময়দানে লড়াই করে ঢাকাভার্সিটির অর্থনীতি বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। গ্রামের একটা সাধারণ মেয়ে ঢাকা শহরে এসেই থতমত খেয়ে গেল। প্রথমদিন ভার্সিটিতে ক্লাসে ঢোকার পর সবাই ওর দিকে যেন কেমন করে তাকিয়েছিলো। ও চুলে তেল দিয়ে লম্বা বেনী করে আয়রন বিহীন সালোয়ার কামিজ পড়ে পায়ে এক জোড়া চটি গলিয়ে ভার্সিটিতে এসেছিলো। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ,মুখে কোনো প্রসাধনীর বালাই ছিলো না। ক্লাসে সবাই ওকে দেখে মিটমিট করে হাসছিলো।আসলে এর বাইরে খরচ বহন করার মতো সামর্থ ওর বাবার ছিলো না। বাবা একজন কৃ ষক। ওরা দু,বোন একভাই। ভাইটা সবার ছোটো। পড়শী ওর স্কর্লাশিপের টাকা দিয়ে এই পোশাকটুকু কিনেছে। ক্লাসে একদম পিছনের বেঞ্চটায় বসে কোনোরকমে পড়শি ক্লাসটা শেষ করলো। স্যার চলে যেতেই ও ক্লাস থেকে বের হয়ে একটা নিরিবিলি ফাঁকা জায়গা দেখে বসে পড়লো। ওর গ্রামের কথা খুব মনে পড়ছে। বাবা মায়ের কথা,ভাই বোনের কথা খুব মনে পড়ছে। গ্রামের মেঠাপথ আর সবুজ বনানী ওকে যেন হাত ইশারা করে ডাকছে। ওর স্কুল, কলেজের কথা মনে হতেই কান্নার বেগ যেন উথলে উঠলো। কোনো ক্রমে নিজেকে সামলে হেস্টেলে ফিরে এলো।

এভাবেই ওর ক্লাসগুলো চলছিলো। এক সপ্তাহ পার হয়ে যাবার পরও কেউ ওর বন্ধু হয়নি। তবে হোস্টেলে একটা মেয়ের সাথে ওর ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। ওর নাম জয়নব। ও একটা কোম্পানীতে রিসিপশনিস্ট পদে চাকরি করে। ও গ্রাম থেকে এসেছে। সরকারী কলেজ থেকে অনার্স পাশ করে এই অফিসে জয়েন করেছে। জয়নব খেয়াল করেছে পড়শী মনমরা হয়ে ভার্সিটিতে যায়। মাঝে মাঝে রুমে আনমনা হয়ে বসে থাকে। চোখের পাপড়িগুলো ভেজা থাকে। জয়নব অফিস থেকে ফিরে আজ আর চুপ থাকলো না। পড়শীকে জিজ্ঞাসা করলো,
—-ভার্সিটি ক্লাস কেমন চলছে? তুমি সবসময় মনমরা হয়ে বসে থাকো কেন?
এই কথাটা বলার সাথে সাথে পড়শি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলে। ওর কান্না দেখেই জয়নব বুঝলো গাঁয়ের এই সহজ সরল মেয়েটার কিছু একটা হয়েছে। তাই ওকে সাহস দিয়ে বললো,
—-,পড়শী এভাবে কাঁদলে তো কোনো সমস্যার সমাধান হবে না। তুমি আমাকে বলো ভার্সিটিতে কেউ কি তোমার সাথে খারাপ কিছু করেছে? দেখো পড়শী তুমি আমাকে সবটুকু খুলে বলো। আমি সমাধান করার চেষ্টা করবো।
পড়শী এই সাতদিনের সব ঘটনা খুলে বললো। জয়নব সবটা শুনে বললো,
—-আমি তো ভেবেছি না জানি কি হয়েছে? এতো সামান্য ঘটনা। এতো অল্পতে চোখের পানি ফেলতে নেই। চোখের পানির অনেক মুল্য।
—-না,আপু।আমিও সহজে চোখের পানি ফেলি না। কিন্তু একদিকে ভার্সিটিতে মানিয়ে নিতে পারছি না অন্যদিকে বাবা মা ভাই বোন,আমার গ্রাম আমার স্কুল কলেজ কিছুই ভুলতে পারছি না। বার বার মনে হচ্ছে এই ঢাকা শহর আমার জন্য নয়।
—-শোনো, তুমি তো হেরে যেতে ঢাকা শহরে আসোনি। নিজের যোগ্যতায় চান্স পেয়েছো। জিততে তোমাকে হবে। ইনশাআল্লাহ তোমার নীতি আদর্শ ঠিক থাকলে দিন শেষে তুমি জিতে ফিরতে পারবে।

এরপর দুপুরে খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে জয়নব পড়শীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। প্রথমে পারলারে গিয়ে চুলটা একটু ফ্যাশনেবল করে কেটে দেয়। মুখটা ফেসিয়াল করে দেয় যাতে চেহারার উজ্জ্বলতা বাড়ে। জীবনে পড়শী প্রথম পারলারে এসেছে। সব কিছু করার পর আয়নায় নিজের দিকে নিজে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেদিকে লক্ষ্য করে জয়নব বললো,
—-তুমি তো দেখতে এমনিতেই অনেক সুন্দর। ঘষা মাজার ফলে সেটা পরিপূর্ণভাবে পরিস্ফুটিত হওয়াতে তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে।

তারপর জয়নব আর পড়শী ঢাকা কলেজের অপজিটে দোজা মার্কেটে গিয়ে দুটো জিম্স আর চারটে ফতুয়া আর দুটো ওড়না কিনে দেয়। পড়শী যদিও বলেছিলো এই মুহুর্তে ওর কাছে টাকা নাই। কিম্তু জয়নব বললো,”তোমাকে ধার দিলাম। যখন হাতে টাকা আসবে আমাকে দিয়ে দিও।”
পড়শী এমনিতেই দেখতে বেশ সুন্দর। চুলগুলো কাটার ফলে রুপ যেন উপচে পড়ছে। হোস্টেলে ফিরে ও নিজেকে আয়নায় আবারও দেখলো। ওর চেহারায় খুশী উপচে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে জয়নব বললো,
—-দেখো আবার,কারো প্রেমে পড়ে যেও না। কারণ ভালোবাসার জন্য সঠিক মানুষটাকে পছন্দ করতে হয়। তা,না হলে সারাজীবন ধরে পস্তাতে হয়।

পরদিন ভার্সিটিতে ঢুকার সময় সবাই আবারও ওর দিকে তাকিয়েছিলো। কিন্তু ওদের এই দৃষ্টিতে কোনো তাচ্ছিল্য ছিলো না। সেখানে ছিলো একরাশ মুগ্ধতা। চুলগুলো পিঠের উপর ছড়ানো, মুখে হালকা প্রসাধনী,জিন্সের প্যান্টের সাথে ফতুয়া গলায় ওড়না প্যাঁচানো চোখে রিমলেজ চশমা সবমিলিয়ে পড়শীকে দেখে যেন চোখ ফেরানো যাচ্ছে না। পড়শীর আজ ভার্সিটিতে এসে ভীষণ ভালো লাগছে। ক্লাস শেষ করে ও লাইব্রেরীর দিকে গেল। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠার সময় ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামছিলো। সিঁড়ির গোড়ায় পড়শীকে দেখে ঐ মাস্তানের দল থেকে একজন বলে উঠলো,
—-এই মালটা মনে হয় ফাস্ট ইয়ারের। হেব্বি সেক্সি।
কথাগুলো পড়শীর কানে আসাতে কান মাথা সব গরম হয়ে গেল। এরমাঝে একটা ওর হাত ধরে টেনে বুকের কাছে এনে বললো,
—-তোমারে দেখার পর শরীরটা যে গরম হয়ে গেল। এখন এর দায় তো তোমাকে নিতে হবে।
ওদের এমন অসভ্যতায় পড়শীর মাথা গরম হয়ে গেল। ও চটাশ করে ঐ মাস্তানের গালে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
—-মেয়ে মানুষকে একলা দেখলেই শয়তানী বুদ্ধি মাথায় ঘুরপাক খায় তাই না? এখন দেখ কেমন লাগে। গাঁয়ের কাদামাটি ছেনে বড় হওয়া এই আমাকে ভালো করে চিনে রাখ।
ওরা পড়শিকে একলা পেয়ে ওর দিকে তেড়ে আসতে গেল। তখনি পড়শি আর ঐ মাস্তানগুলোর চিৎকার চেঁচামেচিতে স্টুডেন্টরা জড় হতে থাকলো। অবস্থা বেগতিক দেখে চড় খাওয়া পাবলিক ওকে বললো,
—-এই চড়টার কথা আমার মনে থাকবে। তবে এর শোধ আমি তুলবো।
একথা বলে মাস্তানগুলো ওখান থেকে চলে গেল।
পড়শি ওদের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসি হেসে লাইব্রেরীতে চলে গেল। ওখানে সবাই বলাবলি করছে নতুন এসে মেয়েটার এতো সাহস দেখানো ঠিক হয় নাই। বলা যায় না কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়িয়ে পড়ে। তবে কেউ কেউ এটাও বললো,
—-,আমাদেরও ভয় না পেয়ে ওর মতো করে প্রতিবাদ করা উচিত।
ঐ ছেলেগুলো সংসদের রুমে চলে গেল। চড় খাওয়া ছেলেটি চেয়ার ছুড়ে মেরে সোফায় বসে পড়লো। দলের একটা ছেলে বললো,
—-ইনান ভাই তুমি মাথা গরম করো না। এর শোধ আমরা তুলবো। সায়েম ভাইকে ফোন দিবো?
—-দে,ফোনটা ধরলে হয়। এখন কোন মেয়ের বুকে মুখ গুজে আছে কে জানে? এসব কাজে ব্যস্ত থাকলে ব্যাটাতো ফোন রিসিভ করবে না।ব্যাটা একটা মাগীবাজ।
সায়েম যখনি ওর শিকারী মেয়েটার ঠোঁটে ঠোঁটটা ডুবাতে যাবে অমনি ফোনটা আর্তনাদ করে বেজে উঠলো। সায়েমের মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। ফোনটা রিসিভ করে বললো,
—-ঐ শালার ব্যাটা শালা ইনান ফোন করার আর সময় পেলি না তাই না? আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছি। তোদের এই সময়ে বাগড়া না দিলে হতো না?
—-তুমি কি নিয়ে ব্যস্ত থাকো সেটা আমরা জানি। আজ ভার্সিটিতে একটা মেয়ে আমার গালে থাপ্পড় মেরেছে।
—-খুব ভালো কথা। এখন চুড়ি পরে বসে থাক।
—-বস এটা তুমি কি বললে? এর শোধ তোমাকে নিতে হবে।
সায়েম ফিচেল হাসি হেসে বললো,
—-লাঞ্চের পর ভার্সিটিতে আসছি।
চলবে

ভেনম পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব

0

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৬) – শেষ পর্ব

১.
শামসুন্নাহার গম্ভীরমুখে বসেছিল। সেদিনের সেই পুলিশ অফিসার একটু আগে এসেছে। চা নাস্তা দেওয়া হয়েছে। পিংকির নানা একটু বাসার বাইরে আছে। একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। এই পুলিশ অফিসার যেসব বিব্রতকর প্রশ্ন করছে তাতে করে বাসায় কেউ না থাকাটাই ভালো। পিংকি অবশ্য ভেতরের রুমে আছে।

শামসুন্নাহার গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘হ্যাঁ, ফারিয়া একটা সময় জড়িয়ে পড়েছিল। এই নিয়ে ওদের দুজনের মাঝে সেই সময় অনেক অশান্তি হয়েছিল। মানুষ তো ভুল করে। আবার নিজেকে শুধরিয়েও নেয়। আমার মেয়ে নিজেকে শুধরে নিয়েছিল। আমার কাছে ও বার বার অনুতাপ করত কেন অমন করে আরেকটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিল। আর গত একটা বছর ফারিয়ার দিক থেকে কোনো ঝামেলাই হয়নি। আমিও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিলাম। কিন্তু ও হঠাৎ এমন কেন সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ল আমি জানি না। মুরাদ তো কিছু স্বীকার করেনি। কিছু জানলে পিংকি জানতে পারে। বাসায় কিছু না কিছু ঘটেছিল যার জন্য এমন হলো।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘আচ্ছা, একটু পিংকিকে ডাকবেন? যাবার আগে একটু কথা বলে যাই। কেসটা নিয়ে আর বিশেষ কিছুই ভাবার নেই।’

শামসুন্নাহার মাথা নাড়ে। তারপর ভেতরে যায়। খানিকবাদে পিংকিকে নিয়ে ভেতরে ঢোকে। পিংকি সালাম দিতেই রাহাত সালাম নিয়ে তাকায়। আজ মেয়েটাকে অনেকটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। মানুষ বুঝি ধীরে ধীরে সব শোকই কাটিয়ে ওঠে।

রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘তোমার কলেজ কেমন চলছে? সব ঠিকঠাক?’

পিংকি ছোট্ট করে মাথা নাড়ে।

রাহাত এবার ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘একটা ছোট্ট ব্যাপার জানার ছিল। আমি ফারিয়ার ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। উনি যেটা বললেন ফারিয়ার মানসিক অবস্থা অতটা খারাপ ছিল না যে উনি সুইসাইড করে ফেলতে পারেন। আচ্ছা, ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর একটা মাস নতুন করে কি কিছু হয়েছিল? জানলে আপনাদের দুজনের মধ্যে কেউ জানবেন, বিশেষ করে পিংকি।’

শামসুন্নাহার একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘বলার মতো একটা ঘটনাই ঘটেছিল। আর সেটা হলো ওর ছাদে উঠে পড়ে যাবার ঘটনাটা। আট তলার জারিফ ছেলেটা ওকে দেখেছিল পড়ে যেতে। ও বলছিল ফারিয়া নাকি ছাদের পাঁচিল থেকে বিপদজনকভাবে ঝুলছিল। যে কেউ দেখলে ভাববে সুইসাইড করছিল। কিন্তু ফারিয়ার সাথে পরে আমার কথা হয়েছে। ফারিয়া আমাকে বলেছিল ও নাকি ভাবতেই পারে না যে সেদিন ও ওই কাজ করছিল। আমি ভালো করেই ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ও সুইসাইড করার চেষ্টা করেছিল কিনা। কিন্তু ও নিজেই কেমন হতবাক হয়ে গিয়েছিল এমন একটা কাজের জন্য। কেমন যেন আনমনে হয়ে যাচ্ছিল দিন দিন। অনেক কিছুই ভুলে যেত।’

পাশ থেকে এবার পিংকি বলে ওঠে, ‘হ্যাঁ, আম্মু সব ভুলে যেত। বাবা ডাক্তার দেখিয়ে আনার পর প্রেসক্রিপশনটাও হারিয়ে ফেলেছিল। বাবা ভীষণ রাগ করেছিল সেদিন। সারা বাসা তন্নতন্ন করে খুঁজেও প্রেসক্রিপশনটা পাওয়া যায়নি। আমার মনে হয় আম্মু ওটা ফেলে দিয়েছিল। ভাগ্যিস বাবার কাছে প্রেসক্রিপশনের সফটকপি ছিল। সেটা আম্মুকে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে রেখেছিল। আম্মু আবার আমাকেও পাঠিয়ে রেখেছিল যাতে আর না হারায়।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘কিন্তু তোমার আব্বু তো আমকে অরিজিনাল প্রেসক্রিপশনটা দিয়েছিল। ফারিয়ার যে মানসিক চিকিৎসা চলছিল সেটা প্রমাণ করতে। হারিয়ে গেলে সেটা আবার কোথা থেকে আসলো? ওটা কি পরে আবার খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল?’

পিংকি একটু অবাক হয় তারপর মাথা নেড়ে বলে, ‘না তো, সেরকম কিছু আম্মু আমাকে বলেনি। বরং আম্মু আমাকে নিয়ে ওষুধের দোকানে গিয়ে মোবাইল থেকে প্রেসক্রিপশনের ছবি দেখিয়ে ওষুধ কিনে এনেছিল।’

রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, ‘পিংকি তোমার কাছে প্রেসক্রিপশনটা এখনো আছে হোয়াটসঅ্যাপে?’

পিংকি মোবাইলটা বের করে হোয়াটসঅ্যাপ খোলে। কিছুক্ষণ স্ক্রল করে, তারপর অবাক গলায় বলে, ‘আরে, আম্মুর পাঠানো মেসেজ থ্রেডটা নেই!!’

রাহাতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। এটা নিশ্চয়ই মুরাদের কাজ। তারপর বলে, ‘তুমি তোমার মোবাইলে ডাউনলোড ফোল্ডারে একবার খুঁজে দেখো। ছবিটা ডাউনলোড করা থাকলে ওখানে থাকার কথা। অথবা রিসাইকেল বিনে।’

পিংকি ভ্রু কুঁচকে এবার মোবাইলে ডাউনলোড ফোল্ডার খুলে। একটু খুঁজতেই পেয়ে যায়। মুখে হাসি ফোটে। ছবিটা বের করে বাড়িয়ে ধরে, ‘হ্যাঁ পেয়েছি প্রেসক্রিপশনটা।’

রাহাত আগ্রহের চোখে প্রেসক্রিপশনটা দেখে, তারপর ওর মোবাইল নম্বরটা দিয়ে বলে, ‘আমাকে একটু পাঠাও তো প্রেসক্রিপশনটা।’

পিংকি প্রেসক্রিপশন পাঠাতেই ও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকে। কোনো ঝামেলা নাই তো?

সেদিন আর ও বসে না। থানায় যেতে হবে এখুনি। অরিজিনাল প্রেসক্রিপশনের সঙ্গে এটা মিলিয়ে দেখতে হবে।

ঘন্টাখানেক পর থানায় পৌঁছে ও হাঁক দেয়, ‘হাফিজ, সেদিন মুরাদ যে প্রেসক্রিপশনটা দিয়েছিল ওটা ফারিয়ার সুইসাইডের ফাইল থেকে নিয়ে আসো তো।’

হাফিজ একটু পর প্রেসক্রিপশনটা এনে টেবিলে রাখে, তারপর হেসে বলে, ‘স্যার, আপনি এই সুইসাইডের কেসটা নিয়ে শুধু শুধু বেশি চিন্তা করছেন।’

রাহাত মৃদু হেসে বলে, ‘আজকের পর আর ভাবব না এটা নিয়ে।’

রাহাত এবার মোবাইল খুলে পিংকির পাঠানো প্রেসক্রিপশনের ছবিটা খোলে। তারপর টেবিলে রাখা আসল প্রেসক্রিপশন এর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে। একই প্রেসক্রিপশন। ওষুধগুলোও একই। নাহ! এক না। একটা ওষুধ ভিন্ন। এটা কী করে হলো??

রাহাত এবার ভালো করে পুরো প্রেসক্রিপশন মেলায়। দুটো প্রেসক্রিপশন একই তারিখের। রোগীর নাম, বয়স সবকিছু হুবহু মিল আছে। শুধু দুই নম্বরে যে ওষুধটা লিখা আছে সেখানে গড়মিল। রাহাত জুম করে দেখতেই ওর চোখ বড়ো হয়ে যায়। পিংকিকে ফারিয়া যে প্রেসক্রিপশনটা ফরওয়ার্ড করে রেখেছিল সেটাতে দুই নম্বর ওষুধটা পাল্টে দেওয়া হয়েছে। কেন??

রাহাত নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তারপর ডাক্তার সুশান্তের নম্বরে ফোন দেয়।

ওপাশে ডাক্তার সাহেব ফোন ধরতেই রাহাত সালাম দিয়ে বলে, ‘স্যার, আপনাকে ফারিয়ার একটা প্রেসক্রিপশন হোয়াটসঅ্যাপে পাঠাই। একটু দেখে আমাকে কনফার্ম করতে পারবেন এটা কি আপনি দিয়েছিলেন?’

সুশান্ত সম্মতি দিতেই রাহাত ছবিটা পাঠায়। তারপর দমবন্ধ করা দশটা মিনিট কাটে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই প্রেসক্রিপশনে কোনো গন্ডগোল আছে।

শেষ পর্যন্ত ফোনটা আসে। ওপাশ থেকে সুশান্তের উত্তেজিত গলা পাওয়া যায়, ‘এটা তো আমার প্রেসক্রিপশনকে ওভার রাইট করে লেখা হয়েছে। দুই নম্বর ওষুধটা তো আমি লিখিনি। আর এখানে যে ওষুধটা ওভার রাইট করে লিখা হয়েছে সেটা খুবই বিপদজনক এবং ডাবল ডোজে লেখা হয়েছে। রাহাত সাহেব আপনি একটু আমার চেম্বারে আসতে পারবেন। এটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে আমার কাছে। ফারিয়া সুইসাইড করেনি ওকে করতে বাধ্য করা হয়েছে।’

রাহাত সোজা হয়ে বসে। টের পায় বুকের ভেতর হাতুড়ি পেটা হচ্ছে। ও জোরে নিশ্বাস নিয়ে বলে, ‘আমি এখুনি আসছি স্যার।’

ফোন রেখে রাহাত উত্তেজিত গলায় বলে, ‘হাফিজ এখনই গাড়ি বের করো। ডাক্তার সুশান্ত সাহেবের চেম্বারে যেতে হবে।’

হাফিজ প্রশ্ন করতে গিয়েও থেমে যায়। স্যারের এই রূপ ওর চেনা। নিশ্চয়ই কেসে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘটনা ঘটেছে। মরা কেসটা কি তবে গতি পেলো?

ঘন্টাখানেকের মধ্যে ওরা ডাক্তার সুশান্ত সাহেবের চেম্বারে পৌঁছে যায়। এতক্ষণে সব রোগী চলে গিয়েছে। সুশান্ত সাহেব তার চেম্বারে একাই বসে ছিলেন। রাহাতকে দেখে উঠে দাঁড়ায়, চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

প্রায় এক ঘন্টা ধরে ডাক্তার সুশান্তের সঙ্গে রাহাতের কথা হয়। একটা সময় রাহাতের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যেতে থাকে আর ডাক্তার সুশান্তকে দেখে মনে হয় প্রচন্ড হতাশায় ভুগছেন।

২.
বাসাটা একদম ফাঁকা। ইদানীং কেমন ভয় ভয় লাগে এই বাসাতে। মনে হয় ফ্যানের দিকে তাকালেই ফারিয়ার ঝুলন্ত শরীরটা দেখবে। মুরাদ লম্বা একটা নিশ্বাস নেয়। রেডি হতে হবে। সেই পুলিশ অফিসারটা আবার থানায় যেতে বলেছে। কে জানে কেন।

মুরাদ প্রথমে সাদা ফুলহাতা শার্ট পরে, তারপর আন্ডারওয়্যার পরে প্যান্ট হাতে নেয় পরার জন্য। কী মনে হতে চেয়ারে বসে পড়ে। মাথা নিচু করে বসেই থাকে। একটা শান্তি হয়েছে এখন, ফারিয়ার কথার খোঁচাগুলো আর এখন নেই। এই একটা বছর প্রতিদিন একটা যন্ত্রণায় কাটত।

এমন সময় বাসার কলিংবেল বাজে। মুরাদ উঠে গিয়ে দরজা খোলে। দু’জন কনস্টেবল আর একজন পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে। ওদের চোখে অবাক দৃষ্টি।

আজ সকালেই রাহাত স্যার নির্দেশ দিয়েছেন এই মুরাদ হাসানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে। কিন্তু লোকটা এমন শুধু শার্ট আর আন্ডারওয়্যার পরে বসে আছে কেন? এরও কি মানসিক সমস্যা?

হাফিজ গলা খাঁকারি দিয়ে বলে, ‘প্যান্ট পরে নিন। আপনাকে থানায় যেতে হবে।’

মুরাদের হুঁশ ফেরে। আরে তাই তো, ও এমন এলোমেলো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন। ঘুরে দ্রুত পায়ে ভেতরে যায়। তারপর প্যান্ট পরে রেডি হয়ে বাইরে আসে।

হাফিজ ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠে থানার উদ্দেশে রওনা দেয়। আচ্ছা, আজ এরা ওর বাসা পর্যন্ত কেন এল? ও তো নিজেই যাচ্ছিল। কোনো ঝামেলা হলো আবার?

৩.
ছোট একটা কাঠের টেবিলের দু’পাশে দুটো চেয়ার। একপাশে রাহাত অন্যপাশে মুরাদ বসে আছে। শেষ দু’বার রাহাতের রুমে বসেছিল ওরা। আজ যে রুমটায় বসেছে এটাতে আলো কম। এই দিনের বেলাতেও একটা বাতি জ্বলছে। রুমটায় ছোট্ট একটা জানালা আছে তা দিয়ে অল্প একটু আলো আসে।

মুরাদের কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে। কোথাও কোনো বড়ো ধরনের ঝামেলা হয়েছে। না হলে আজ হঠাৎ করে এই রুমটায় কেন নিয়ে এলো?

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘মুরাদ সাহেব, আপনি তো একজন ওষুধ বিজ্ঞানী। কোন ওষুধ কিসে কাজ করে আপনি জানেন, তাই না?’

মুরাদ একটু থমকায়। এই পুলিশ অফিসার আসলে কী জানতে চায়? ও মাথা নেড়ে বলে, ‘হ্যাঁ, তা তো জানতেই হয়। এটাই তো আমার কাজ।’

রাহাত হেসে বলে, ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। আচ্ছা, আপনি তো এটাও জানেন কোন ওষুধের ডোজ কত এবং সেগুলো খেলে কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয়?’

মুরাদ মনে মনে সতর্ক হয়। গম্ভীরমুখে বলে, ‘হ্যাঁ, সেটাও জানতে হয়। কেন বলুন তো?’

রাহাত এবার কতগুলো ওষুধ সামনে রাখে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘এই ওষুধগুলো আপনার স্ত্রী খেতো। এগুলোর ডোজ কী, আর তাতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হয় আপনার তো জানা। তাহলে এই ওষুধটা ওনাকে কেন খেতে দিলেন?’

মুরাদ ওষুধটার দিকে তাকায়, তারপর অসহিষ্ণু গলায় বলে, ‘আমি খেতে দেবার কে? ডাক্তার সাহেব যেভাবে প্রেসক্রিপশন করেছেন সেভাবেই ও খেয়েছে। আর এসব ওষুধের কী কী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হয় সেগুলো জেনে বুঝেই তো ডাক্তার দিয়েছেন।’

রাহাত গম্ভীরমুখে বলে, ‘ডাক্তার সাহেব জেনে বুঝেই দিয়েছিলেন। আপনি তার মধ্যে একটা ওষুধ চেঞ্জ করে দিয়েছেন। আর যেটা দিয়েছেন সেটা ফারিয়ার জন্য ক্ষতিকর ছিল। এটার একটা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলো এই ওষুধ মানুষের সুইসাইড করার প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। আর সেটা দিয়েছেন ডাবল ডোজে।’

মুরাদ অবাক হবার ভান করে, ‘আমি! আমি কেন করব। ওষুধ তো ফারিয়াই কিনেছে।’

রাহাত কঠিন গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, ওষুধ ফারিয়াই কিনেছিল। আর সেটা আপনার ষড়যন্ত্রের অংশ। আপনি ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর দিন আসল প্রেসক্রিপশনটা সরিয়ে ফেলেন। তারপর সেই প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে দুই নম্বর যে ওষুধটা ছিল সেই নামটা মুছে আপনি এই ক্ষতিকর ওষুধের নামটা লিখে দেন। আর ফারিয়াকে এই ছবিটা হোয়াটসঅ্যাপে আপনি পাঠিয়েছিলেন। বেচারী ভেবেছিল ও আসলেই প্রেসক্রিপশনটা হারিয়ে ফেলেছে। এটা যেন আবার হারিয়ে না যায় সেজন্য এটা মেয়েকে দিয়ে রেখেছিল। ভাগ্যিস পিংকির সাথে আমার কথা হয়েছিল। না হলে তো জানতেই পারতাম না যে প্রেসক্রিপশন হারিয়ে গিয়েছিল। আর আপনি সেই সুযোগে একটা ক্ষতিকর ওষুধ যোগ করে নতুন প্রেসক্রিপশন দিয়েছিলেন। ওষুধ ফারিয়াই কিনেছে, তার মৃত্যুর পরোয়ানা সে নিজেই লিখেছে। একটা মানুষকে আপনি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছেন। আপনি জানতেন এই ওষুধটা ডাবল ডোজে খেলে ওর মাঝে সুইসাইডের প্রবণতা অনেক বেশি বেড়ে যাবে। সুইসাইডের ব্যাপারটা ওর মাঝে অল্প কিছু হলেও ছিল। এই ওষুধ সেটা আরো বেশি করে বাড়িয়ে দিয়েছিল। কেন এমন করলেন, বলুন?’

শেষ কথাটা বেশ জোরের সঙ্গেই বলে রাহাত।

মুরাদ মাথা নিচু করে থাকে। দীর্ঘসময় পর মাথা তুলে, তারপর বিষণ্ণ গলায় বলে, ‘হ্যাঁ আমি ওষুধ চেঞ্জ করে দিয়েছলাম। আমি জানতাম এতে ওর সুইসাইডের প্রবণতা বাড়বে। যখন ও আমাকে কথায় কথায় সন্দেহ করা শুরু করল তখন খুব রাগ হতো। যে মানুষ নিজে সন্দেহের কাজ করেছে এখন সে-ই উলটো আমাকে কারণে অকারণে সন্দেহ করা শুরু করল। বুঝতে পারতাম ও আসলে একটা হীনমন্যতায় ভুগত। আমাকে ওর মতো দোষী প্রমাণ করতে চাইত৷ আর সেটা না পেয়ে বার বার অমন করত। একটা সময় ব্যাপারটা অসহ্য পর্যায়ে চলে গেল। তখন আমি একদিন ঠান্ডা মাথায় প্ল্যানটা করি। ওর সন্দেহ আরও বাড়াতে কিছু কাজ করি। সেবার আমি অফিসে কাজের সিলেটে গিয়েছিলাম সাথে তাবাসসুম। বাসায় বলে গিয়েছিলাম আমি একাই যাচ্ছি। পরে সিলেট থেকে ফিরে আসার পর আমার আর তাবাসসুমের কিছু ছবি ওর ইনবক্সে আমি একটা ফেক আইডি থেকে পাঠাই। এই নিয়ে অনেক ঝামেলা হলো। ওর সন্দেহটা আরও উস্কে দিতে আমি একদিন ইচ্ছে করে আমার একটা সাদা শার্টে লাল দাগ দিয়ে রেখেছিলাম। সেটা দেখে ওর মাথা আরো বেশি করে খারাপ হয়ে গেল। একটা সময় ওর আম্মুকে নিয়ে বোঝালাম যে ওকে মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার।

প্রথমটায় রাজি হয়নি, পরে রাজি হলো। তারপর ডাক্তার দেখিয়ে আসার পর ওর একটা কাজ আমার প্ল্যানকে সফল করতে সাহায্য করেছিল। ওকে একদিন ওষুধ খাবার কথা জিজ্ঞেস করতে ও বলেছিল ফেলে দিয়েছে। তখনই আমি সুযোগটা নেই। আমি আসল প্রেসক্রিপশনটা লুকিয়ে ফেললাম। দোষ দিলাম ও হারিয়ে ফেলেছে। তারপর আমার প্ল্যানমতন ওষুধ পালটে দিলাম। আর সেদিন থেকে অপেক্ষা করতাম কবে ঘটনাটা ঘটবে।

একদিন বিকেল বেলা বাসায় ফিরে জানতে পারলাম ফারিয়া নাকি ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ার চেষ্টা করেছিল। সেদিন আমি মনে মনে খুব উত্তেজিত ছিলাম। আমার প্ল্যান ঠিকঠাক কাজ করছে।

আমি জানতাম ফারিয়া কিছুদিনের মধ্যেই সুইসাইড করবে। তাই যখন আবার সামান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়া করল তখন আলাদা রুমে ঘুমানো শুরু করলাম। তাতে করে ওর মনের ওপর চাপটা বাড়ল। আর শেষ পর্যন্ত ঠিকই ও ভেঙে পড়ল।’

রাহাত তাকিয়ে থাকে। মানসিকভাবে ভীষণ অসুস্থ একটা মানুষকে ও এখন দেখছে। সবার আগে তো মুরাদের চিকিৎসা হবার দরকার ছিল। কী ভয়ংকর একটা সাইকোপ্যাথ!

ও সামনে ঝুঁকে বলে, ‘আপনার সঙ্গে বনিবনা হচ্ছিল না আপনি ওকে ডিভোর্স দিয়ে দিতেন। এমন মেরে ফেলার প্ল্যান করলেন কী করে?’

মুরাদ শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর আনমনে বলে, ‘আমি ওকে ভালোবাসতাম। কিন্তু ও বার বার আমার বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে। ক্ষমাও করেছিলাম। কিন্তু এরপর কখনও মন থেকে কাছে টেনে নিতে পারেনি। অথচ ওর আগের জায়গাটা চাচ্ছিল। আর আমি সেটা দিতে পারছিলাম না বলেই ও সন্দেহ করা শুরু করল। একটা সময় মনে হলো ওর একটা শাস্তি হওয়া দরকার। অফিসার আপনি কি মনে করেন, এটা হওয়া উচিত ছিল না?’

রাহাত এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘আপনি ভীষণ ভুল করেছেন। উনি শুধু আপনার স্ত্রী না আপনার সন্তানেরও মা। আপনি সারা জীবন আপনার সন্তানের কাছে একজন ঘৃণিত পিতা হিসেবে পরিচিত হবেন। ফারিয়াকে যদি ভালোইবাসতেন, ক্ষমা করে দিয়েছেন, তাহলে কাছে টেনে নিতে পারেননি কেন? আপনার উচিত ছিল একজন মনোচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। আপনি একজন মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষ। আপনাকে আমি ফারিয়া হত্যা মামলায় গ্রেফতার করছি।’

মুরাদ মাথা নাড়ে, কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো হাসে। তারপর বলে, ‘আমাকে যে এমন করে মানসিকভাবে অসুস্থ মানুষে পরিণত করল তার বিচার হবে না অফিসার?’

মুরাদকে দু’জন কনস্টেবল হাতকড়া পরিয়ে বাইরে নিয়ে যায়। আর রাহাত মন খারাপ করে ভাবতে থাকে, ঠিকঠাক ভালোবাসা না পেলে মানুষ কী ভীষণভাবে বদলে যেতে পারে৷ সন্দেহ, বিশ্বাসভঙ্গ – একজন সাধারণ মানুষকে ভয়ংকর মানুষে পরিণত করতে পারে৷

(সমাপ্ত)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
১০/০৭/২০২৪

ভেনম পর্ব-০৫

0

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৫)

১.
মুরাদের মোবাইল কল লিস্ট আর মেসেজের রিপোর্ট এসেছে। বেশিরভাগ মেসেজ অফিসের, বন্ধুদের আর ফারিয়ার। রাহাত মুরাদকে পাঠানো ফারিয়ার মেসেজগুলো ভালো করে দেখে। দেখতে দেখতে ভ্রু কুঁচকে ওঠে। গত ছয়মাসের বেশিরভাগ মেসেজই এমন – আমি মরে যাব কিংবা এই সংসার করব না। মেয়েটা তো দেখি সত্যিই মারাত্মক সন্দেহপ্রবণ ছিল। এদিকে মুরাদের পাঠানো মেসেজগুলোতে এমন কিছু ছিল না যাতে ফারিয়াকে বাজে কিছু লেখা ছিল। উলটো বুঝিয়ে বলার মতো কিছু মেসেজ। সব দেখে মনে হয় মুরাদ চেষ্টা করেছিল ফারিয়াকে ভালো করে তুলতে। মুরাদের দিক থেকে কোনো ত্রুটি ছিল না।

তাহলে মেয়েটারই কি সমস্যা ছিল? একটা মেয়ে কখন এমন করে? নিশ্চয়ই ওই মুরাদের কোনো গোপন সম্পর্ক ছিল যেটা হয়তো ফারিয়া জেনে ফেলেছিল। আর সেজন্যই এমন সন্দেহ করত সবসময়।

কথাটা মনে হতেই এবার ও মুরাদের কল রিপোর্ট ভালো করে দেখে। বেশিরভাগ কল অফিস কলিগ, বন্ধু, আর ফারিয়া, পিংকি। বাইরের মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে তাবাসসুম নামে একটা মেয়ের সঙ্গে। খোঁজ নিয়ে জেনেছে মেয়েটা ওর অফিসের কলিগ। এই মেয়েটার নাম ফারিয়ার পাঠানো মেসেজে কয়েকবার করে এসেছে। এর সঙ্গে একটু কথা বলা দরকার।

রাহাত এবার হাফিজকে ডাকে, ‘হাফিজ, মুরাদের কলিগ তাবাসসুমকে কাল আসতে বলো তো। আমি একটু কথা বলব।’

হাফিজ কপাল কুঁচকে বলে, ‘স্যার, এই কেস তো ক্লোজ। পরিস্কার আত্মহত্যা। শুধু শুধু সময় নষ্ট করে লাভ কী?’

রাহাত চিন্তিত গলায় বলে, ‘একটা খুঁতখুঁত রয়ে গেছে মনের মধ্যে। পুরো কেসটায় ফারিয়াকেই এক তরফাভাবে দোষী মনে হচ্ছে। কোথাও যেন কোনো খুঁত নেই। এমনটা হবার কথা না। মেয়েটা কেন শুধু শুধু মুরাদকে সন্দেহ করত? আর এই সন্দেহ থেকেই মেয়েটা আত্মহত্যা করেছে। সেক্ষেত্রে মুরাদ যদি সত্যিই কোনো সন্দেহ করার মতো কাজ করে থাকে তাহলে ওর বিচার হওয়া দরকার। আত্মহত্যায় প্ররোচনার দায়ে।’

হাফিজ এবার বুঝদার ভঙ্গিতে বলে, ‘এবার বুঝেছি স্যার। আমি তাবাসসুম নামের ওই মেয়েটাকে থানায় আসার জন্য বলে দিচ্ছি।’

পরদিন সকালেই তাবাসসুম চলে আসে। রাহাত সবে সকালের প্রথম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিল। ওকে দেখে বসতে বলে। একজন কাউকে চা দিতে বলে।

তাবাসসুম বসে। রাহাত খেয়াল করে দেখে, মেয়েটা সুন্দর। চুলগুলো বাদামী, টিকালো নাক, চোখ দুটো হরিণের মতো টানা টানা, কাজল দেওয়া। চোখমুখে একটা আত্মবিশ্বাসের ছাপ। থানায় এলে মানুষ যেমন সংকুচিত হয়ে থাকে এই মেয়েটা তেমন না।

চা আসে। রাহাত একটু হেসে বলে, ‘চা নিন। আপনিই তো তাবাসসুম?’

তাবাসসুম চা নিতে নিতে বলে, ‘হ্যাঁ অফিসার, আমি মুরাদের বন্ধু এবং কলিগ, তাবাসসুম। আমরা একই ইউনিভার্সিটিতে পড়ে একই কোম্পানিতে অনেকদিন চাকরি করছি৷ বলুন আপনাকে কী সাহায্য করতে পারি?’

এই তথ্যটা রাহাতের জানা ছিল না তাবাসসুম আর মুরাদ একই ইউনিভার্সিটিতে পড়েছে। ও আগ্রহের গলায় বলে, ‘সেক্ষেত্রে আপনিই সবচেয়ে সঠিক মানুষ যিনি মুরাদ সম্পর্কে ঠিকঠাক খবরটা বলতে পারবেন।’

তাবাসসুম চায়ের কাপ রেখে তির্যক গলায় বলে, ‘ঠিকঠাক খবর বলতে আপনি আসলে কী জানতে চান?’

রাহাত কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, ‘মুরাদের কি অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল?’

তাবাসসুম গম্ভীরমুখে বলে, ‘আমার জানামতে এমন কিছুই ছিল না ওর। খালাতো বোনকে ভালোবেসেই বিয়ে করেছিল। সুখেই ছিল। কিন্তু গত এক বছর ধরে ওর বউ কারণ ছাড়াই সন্দেহ করত। সে কথা আমার সঙ্গে শেয়ারও করেছিল।’

রাহাত মাথা নাড়ে, ‘এগুলো আমি জানি। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়া কেউ কাউকে সন্দেহ করে? আচ্ছা, আপনার সঙ্গে ওনার সম্পর্ক কেমন ছিল? ফারিয়া কিন্তু একাধিক মেসেজে আপনার নাম উল্লেখ করেছে।’

তাবাসসুমের চোখ জ্বলে ওঠে, কেটে কেটে বলে, ‘মুরাদ আমার ভালো বন্ধু। আপনি আমার আর ওর কল রিপোর্ট কিংবা মেসেজ চেক করে দেখতে পারেন। কোথাও একটা বেচাল কথা পাবেন না। অফিসার, আপনি এই কথা বলে আমাকে অসম্মান করলেন। আপনার আর কিছু জানার থাকলে বলতে পারেন, না হলে আমি এখন অফিস যাব।’

রাহাত মাথা নাড়ে, ‘আচ্ছা, আসুন। দরকার হলে আবার ডাকব।’

তাবাসসুম ভ্রুকুটি করে উঠে পড়ে। ও চলে যেতেই রাহাত উঠে দাঁড়ায়। পায়চারি করতে করতে ভাবে, আচ্ছা মুরাদ যদি এত ভালোই হবে তাহলে ফারিয়া এমন করল কেন? একেবারে সুইসাইড?নাহ, এই কেসে কোনো একটা ক্লু নজর এড়িয়ে যাচ্ছে।

ভাবতে ভাবতে হঠাৎ রাহাতের মনে হয় ফারিয়াকে যে মনোচিকিৎসকের কাছে নেওয়া হয়েছিল উনি নিশ্চয়ই কোনো তথ্য দিতে পারবেন। বিশেষ করে ফারিয়ার এমন সন্দেহপ্রবণ আচরণের একটা ব্যাখ্যা ওনার কাছে পাওয়া যেতে পারে। কথাটা মনে হতেই সেদিনের সেই প্রেসক্রিপশনটা আনতে বলে হাফিজকে। ডাক্তার সাহেবের চেম্বার এড্রেসে একবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নেয়।

২.
ডা. সুশান্ত জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে সামনে বসা পুলিশ অফিসারের দিকে তাকিয়ে আছেন। গতকালই লোকটা ফোন করেছিল কোনো একজন রোগীর ব্যাপারে নাকি কথা বলবে। আজকাল কিছু হলেই তো মানুষ কোর্ট কাচারি করে। রোগীর কিছু হলেই ডাক্তারের দোষ।

রাহাত ফারিয়ার প্রেসক্রিপশনটা বাড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘স্যার, এই প্রেসক্রিপশনটা তো আপনার?’

সুশান্ত চোখ কুঁচকে প্রেসক্রিপশন দেখেন, তারপর মাথা নেড়ে অসহিষ্ণু গলায় বলে, ‘হ্যাঁ, আমারই। কেন কী হয়েছে?’

রাহাত স্বাভাবিক গলায় বলে, ‘এই মেয়েটা কিছুদিন আগে সুইসাইড করেছে। তার মাসখানেক আগে আপনার কাছে এসেছিল চিকিৎসার জন্য।’

সুশান্ত একটু চমকায়। মুখ থেকে আফসোসের শব্দ বের হয়। তারপর বলে, ‘খুবই দুঃখজনক।’

রাহাত মাথা নাড়ে, ‘হ্যাঁ, আসলেই। স্যার, ফারিয়ার মানসিক সমস্যাটা কী ছিল আসলে, বলা যাবে? আমি সুইসাইড কেসটা তদন্ত করছি।’

সুশান্ত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমার কাছে তো অনেক রোগীই আসে। এর কথা আলাদা করে মনে নেই। প্রেসক্রিপশন দেখে মনে হচ্ছে একবারই এসেছিল। অসুবিধে নেই। আমার কাছে এই ধরনের রোগীদের সব তথ্য কম্পিউটারেই থাকে। আমি দেখে বলছি।’

সুশান্ত এবার ঘুরে পাশে ওর ডেস্কটপে একটা ফাইল খুলে। তারপর কিছুক্ষণ সার্চ করতেই ফারিয়ার ফাইলটা পেয়ে যায়। বের করে একটু পড়তেই এবার সব মনে পড়ে।

সুশান্ত রাহাতের দিকে ঘুরে বলে, ‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে। মেয়েটা তার হাজব্যান্ডকে অন্য কোনো সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে সন্দেহ করত। যদিও সরাসরি কোনো প্রমাণ সে পায়নি, কিন্তু করত। আর এই সন্দেহবাতিক স্বভাবটা ওসিডি এর মতো হয়ে গিয়েছিল। ঘুরেফিরে কোনো কারণ ছাড়াই সন্দেহ করত। আর এটা থেকে সে কিছুতেই বেরোতে পারছিল না। আমি কিছু কাউন্সেলিং করেছিলাম। মেয়েটার হাজব্যান্ড এর সাথেও কথা বলেছি।’

রাহাত এবার ঝুঁকে বলে, ‘স্যার, ওনার হাজব্যান্ডের কোনো সমস্যা ছিল? মানে উনি কি আসলেই কোনো অন্য কোনো সম্পর্কে ছিল?’

সুশান্ত বিরক্ত গলায় বলে, ‘দেখুন সেটা বার করা আমার কাজ না। আমি ফারিয়াকে এই সমস্যা থেকে বের করার জন্য চেষ্টা করছিলাম। ধরুন ওনার হাজব্যান্ড যদি সত্যি সত্যি কারো সঙ্গে জড়িয়েও থাকে তাহলে সেটার মোকাবিলা কেমন করে করবে তার জন্য পথ দেখানো। ওর নিজের উপর আত্মবিশ্বাসটা আগে ফিরিয়ে আনা জরুরি ছিল।’

রাহাত মাথা নাড়ে, তারপর একটু ভেবে বলে, ‘স্যার, ফারিয়ার মনের অবস্থাটা কি এতটাই খারাপ ছিল যে আপনার কাছে আসার এক মাসের মধ্যেই ও সুইসাইড করে ফেলল?’

সুশান্ত কপাল কুঁচকায়। চিন্তিত গলায় বলে, ‘ফারিয়ার কেস হিস্টোরি যতটুকু দেখলাম আর আমি যতখানি মনে করতে পারছি ফারিয়ার অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না। কেন যেন মনে হয় এর মাঝে খারাপ কিছু একটা হয়েছে যেটা ওর অশান্ত মনকে আরও বেশি করে অশান্ত করে তুলেছিল।’

রাহাত তাকিয়ে থাকে। তার মানে ওর সন্দেহ কিছুটা হলেও সত্য। এই মুরাদকে ভালো করে জিজ্ঞাসাবাদ করা দরকার। সুইসাইড করার আগে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু ঘটেছে।

৩.
মুরাদ মনে মনে একটা অস্থিরতা অনুভব করছে। সেদিন তাবাসসুমকে নাকি এই পুলিশ অফিসার ডেকেছিল। ওর সঙ্গে কোনো গোপন সম্পর্ক আছে কিনা তাই নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আজ আবার ওকে ডেকেছে। সকাল সকালই মুরাদ থানায় চলে এসেছে।

রাহাত ফারিয়ার কেস হিস্টোরি দেখছিল। সেদিন আসার সময় এটা ডাক্তার সুশান্ত সাহেবের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে এসেছিল।

মুখ তুলে তাকায়। আজ মুরাদকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। সরাসরি তাকাচ্ছে না, বার বার চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘আচ্ছা মুরাদ সাহেব, আমাকে একটা সত্য কথা বলুন তো। আপনার স্ত্রীকে ডাক্তার দেখিয়ে আনার পরবর্তী এক মাসে বড়ো ধরনের কোনো ঝগড়া বা ঝামেলা হয়েছিল?’

মুরাদ মনে করার চেষ্টা করে। মাথা নেড়ে বলে, ‘না, তেমন কিছু হয়নি। মাঝে একবার ও ছাদ থেকে নাকি পড়ে যেতে নিয়েছিল। আর সেটা নিজের অসাবধানতার কারণে। যদিও বিল্ডিংয়ের লোকজন বলছিল ও নাকি সুইসাইড করতে নিয়েছিল।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘এখানেই আমার প্রশ্ন। আমি ডাক্তার সুশান্ত সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছি। উনি বলেছেন ফারিয়ার মানসিক অবস্থা এতটা খারাপ ছিল না যে সে আত্মহত্যা করবে। নিশ্চয়ই এমন কিছু হয়েছিল যেটা আপনি বলছেন না। ওই তাবাসসুম মেয়েটাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিল না তো?’

সেদিন তাবাসসুম ভীষণ মন খারাপ করেছিল। পুলিশ ওকে হেনস্তা করছে। ওর উপর মিথ্যে দোষ চাপাচ্ছে। তাতে করে যে ওর নিজের সংসারও টালমাটাল হয়ে যাবে৷

মুরাদ এবার উষ্ণ গলায় বলে, ‘অফিসার, আপনি আমার পেছনে না লেগে ফারিয়ার কল লিস্ট, মেসেজ চেক করুন। আমার কারও সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। উলটো ফারিয়ারই ছিল।’

রাহাত এবার চমকে ওঠে। কী বলছে এসব লোকটা। গম্ভীরমুখে বলে, ‘আপনি এসব কী বলছেন?’

মুরাদ ম্লান হেসে বলে, ‘একটা সময় ফারিয়ার বিভিন্ন ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। সেগুলো নিয়ে খুব ঝামেলা হতো। অনেক ঝগড়াঝাটি হতো ওর সাথে। শেষ একটা সম্পর্কে ও এমন বেশি জড়িয়ে গেল যে আমাকে বাসা চেঞ্জ করতে হলো। এরপর অবশ্য ফারিয়া আর কারো সঙ্গে জড়ায়নি। কিন্তু আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমি মন থেকে ফারিয়াকে আর কখনও মেনে নিতে পারিনি। নিজের মতো থাকতাম, আলাদা ঘুমোতাম। তখন ফারিয়া আমার কাছে নতুন করে ফিরে আসার চেষ্টা করত। আমি নিস্পৃহ থাকতাম। আমার এই নিস্পৃহতা দিনে দিনে ওকে সন্দেহপ্রবণ করে তুলল। প্রথম প্রথম পাত্তা দিতাম না। কিন্তু দিন দিন এটা বাড়ছিল। তখন আমি সম্পর্ক ঠিক করার জন্য আবার একসাথে ঘুমাতে শুরু করলাম। কিন্তু ওর সঙ্গে শারীরিক ব্যাপারটায় আমি আর আগেরমতো সহজ হতে পারিনি। এটা নিয়ে ও প্রায়ই কথা শোনাত। আমি নাকি ওকে আগেরমতো আদর করি না। যার ফলে আবার সন্দেহ শুরু হলো। আমি চেষ্টা করেছি সব ঠিকঠাক করতে। কিন্তু পারিনি।’

কথাগুলো বলে মুরাদ মাথা নিচু করে বসে থাকে। আর রাহাত বিমূঢ় হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। মানুষের জীবনে কতশত ঘটনা থাকে। বাইরে থেকে দেখে সেসব গল্পের খোঁজ পাওয়া যায় না। উপর থেকে একটা মানুষ যতটা সুখী ভেতরে ভেতরে তার চেয়েও দ্বিগুণ বা তিনগুণ দুঃখী।

রাহাতের হঠাৎ একটা কথা মনে হয়, মুরাদের শাশুড়ি কিংবা মেয়ে এই কথাগুলো বলেনি। ইচ্ছে করেই নিজের মেয়ের দোষ লুকিয়েছে? নাকি মুরাদ মিথ্যে বলল? নাহ, ফারিয়ার আম্মার সঙ্গে আরেকবার বসতে হবে ব্যাপারটা জানার জন্য। এই কেসে এখন শুধু এটুকুই জানার আছে। ফারিয়া কেন সন্দেহ করত সেটা তো এখন পরিস্কার হয়ে গেল।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৯/০৭/২০২৪

ভেনম পর্ব-০৪

0

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৪)

১.
মোবাইল বাজার শব্দে রাহাতের ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কুঁচকে একবার দেখে, ওর সহকারী হাফিজের ফোন। কয়টা বাজে? ফোনটা ধরতে ধরতে একবার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়, ছয়টা বিয়াল্লিশ। কাল অনেক রাতে থানা থেকে ফিরেছে। ভেবেছিল আজ একটু দেরি করে যাবে। নাহ, এই সাত সকালেই আবার কী হলো?

রাহাত ফোন ধরে বিরক্ত গলায় বলে, ‘হাফিজ, কী ব্যাপার? কোনো সমস্যা?’

ওপাশ থেকে হাফিজ সালাম দিয়ে বলে, ‘স্যার, ইকবাল রোডে একজন মহিলা সুইসাইড করেছে। আমি ফরেনসিক টিমকে খবর পাঠিয়েছি। ওরা ঘন্টাখানেকের মধ্যেই চলে আসবে। ওরা আসলে তারপর ক্রাইমসিনে রওনা দেব।’

রাহাত উঠে বসে। ইতোমধ্যে ঘুম চলে গেছে। এই থানায় এসেছে বছরখানেক। সুইসাইড কেস যে এর আগে আসেনি তা না। কিন্তু কেন যেন সুইসাইড ব্যাপারটা ঠিক মেনে নিতে পারে না রাহাত। ও চিন্তিত গলায় বলে, ‘বাইরে যে বৃষ্টি হচ্ছে, ফরেনসিকের লোক সময়মতো এলেই হয়। আচ্ছা, আমি রেডি হয়ে আসছি।’

ফোনটা রেখে নামতে গিয়েই করবী ওর হাত টেনে ধরে, ‘এই, কই যাচ্ছ? তুমি না কাল বললে দেরি করে অফিস যাবা আজ?’

রাহাত ওর দিকে ঝুঁকে মন খারাপ গলায় বলে, ‘একটা স্যাড নিউজ পেলাম। একজন মহিলা নাকি আত্মহত্যা করেছে। যেতে হবে।’

করবীর চোখ বড়ো হয়ে যায়, ‘কী বলছ! ইশ, এগুলো শুনলে আমার খুব খারাপ লাগে। দেখা যাবে পরিবারের মানুষগুলো হয়তো কথা শোনাত। সইতে না পেরে মরে গেল।’

রাহাত ওকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুমি এগুলো নিয়ে ভেব না। ঘুমাও, আমি আজ থানায় গিয়েই নাস্তা করব।’

করবী গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে, ‘আরে না। তুমি হাতমুখ ধুয়ে রেডি হতে হতে আমি নাস্তা বানিয়ে ফেলব।’

রাহাত হাসে। করবী কখনোই ওকে বাসা থেকে না খেয়ে বেরোতে দেবে না। দেখা যায় সারাদিনের মধ্যে সকালের খাবারটাই ঠিকমতো বাসায় খাওয়া হয়।

আধাঘন্টার মধ্যে রাহাত বেরিয়ে পড়ে। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ অন্ধকার। কেমন মন খারাপ করা আবহাওয়া। রাহাত গাড়িতে উঠে মনে মনে গুছিয়ে নেয় কী কী করতে হবে।

ঘন্টাখানেক পর পুলিশের পুরো টিমটা যখন ইকবাল রোডের সেই বাসার সামনে এসে দাঁড়ায় ততক্ষণে ঘড়িতে আটটা চল্লিশ বেজে গেছে। মানুষজন সব অফিসের দিকে ছুটছে। ফরেনসিক টিমের অফিসার নাজমুল এসেছে। ওর কাজ খুব নিখুঁত।

গেট খুলে ভেতরে ঢুকতেই দারোয়ান ইদ্রিস সালাম দেয়, তারপর ভীত গলায় বলে, ‘স্যার, লিফটের পাঁচে। ভয়ংকর ঘটনা। ফ্যানের লগে ফাঁস দিছে।’

রাহাত কড়া চোখে তাকাতেই লোকটা মিইয়ে যায়। পুরো টিমটা নিয়ে লিফটে উঠে পাঁচতলায় নামে। প্রতি ফ্লোরে একটাই ইউনিট। দরজা খোলাই ছিল। ভেতর থেকে করুণ সুরে কেউ একজন বিলাপ করছে। আর কৌতুহলী মানুষজন বাসায় ঢোকার মুখে জটলা পাকিয়ে আছে।

রাহাত প্রথমেই এদের সবাইকে সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দেয়, ‘হাফিজ, শুধু কাছের মানুষ ছাড়া সবাইকে বের করে দাও।’

পুলিশ দেখে এবার সবাই সরে দাঁড়ায়। রাহাত ভেতরে ঢুকতেই একজন মাঝবয়েসী লোক এসে সালাম দেয়, ‘আমি মুরাদ হাসান। আপনাদের আমিই ফোন দিয়েছিলাম। আমার স্ত্রী ফারিয়া কাল ভোর রাতের দিকে ডাইনিং রুমে সুইসাইড করেছে।’

রাহাত লোকটার দিকে তাকায়। মাথার চুল অবিন্যস্ত, চোখেমুখে রাত জাগার ক্লান্তি। একটা নীল ট্রাউজার সাথে সাদ টি-শার্ট পরা। লম্বায় কত হবে? পাঁচ ফুট সাত-আট। হ্যাংলা পাতলা গড়ন।

রাহাত মাথা নেড়ে ডাইনিংয়ের দিকে এগোয়। এসব বাসায় যেমন থাকে, একপাশে বসবার ঘর আরেকপাশে খোলা জায়গায় ডাইনিং টেবিল। রাহাত সিলিংয়ের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। গলায় শাড়ি প্যাঁচানো, সিলিং ফ্যান থেকে নিথর দেহটা ঝুলছে। চোখ নামিয়ে নেয় রাহাত। হঠাৎ করেই করবীর কথা মনে হয়। মেয়েরা যখন এমন করে মরে যায় তখন তার পেছনে অনেকদিনের মানসিক কষ্ট থাকে।

রাহাত ফরেনসিক টিমের অফিসার নাজমুলকে উদ্দেশ করে বলে, ‘তোমাদের কাজ শুরু করে দাও। যদিও তোমাকে বলার কিছু নাই, তারপরও ভাল করে সব কিছু খুঁটিয়ে দেখে নিও।’

রাহাত এবার মুরাদের দিকে ফিরে, ‘আপনিই প্রথম দেখেছেন?’

মুরাদ মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘রাত তিনটার দিকে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তারপর ডাইনিংয়ে আসতেই দেখি এই দৃশ্য।’

রাহাত গম্ভীরমুখে মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘বাসায় আর কে কে ছিল রাতে?’

মুরাদ মন খারাপ গলায় বলে, ‘আমি আর আমার মেয়ে পিংকি। ও কলেজে পড়ে। রাত এগারোটার দিকে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি ওই রুমটায় ঘুমিয়ে ছিলাম।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আপনার স্ত্রীর সঙ্গে কাল ঘুমাননি?’

মুরাদ মাথা নিচু করে বলে, ‘কয়েকদিন যাবত মনোমালিন্য চলছিল। তাই আলাদা ঘুমোতে হচ্ছিল।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তার মানে হাজব্যান্ডের উপর রাগ করেই এই আত্মহত্যা। কিন্তু মেয়েটা নিজের বেডরুমে আত্মহত্যা না করে ডাইনিং-য়ে এসে আত্মহত্যা করল কেন?

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘উনি কাল রাতে কোন রুমে ঘুমিয়েছিলেন?’

মুরাদ হাত তুলে দেখায়, ‘ওই রুমটায়।’

রাহাত গম্ভীরমুখে ফারিয়ার বেডরুমে ঢোকে। একপাশে একটা ডাবল খাট। আরেকপাশে বড়ো একটা ওয়ারড্রব। রাহাত সিলিংয়ের দিকে তাকায়, ফ্যানটা খাটের মাঝামাঝি উপরে সিলিং-য়ে। ফারিয়া যদি সুইসাইডই করতে চায় তাহলে নিজের বেডরুমেই করার কথা। নাহ, এটা নিয়ে একটু ভাবতে হবে।

রাহাত এবার ডাইনিং টেবিলের কাছে যায়। কাচের টেবিল। এটাতে উঠেই শাড়ি বেঁধেছে। একটা ছোট প্লাস্টিকের টুল নিচে পড়ে আছে। মেয়েটা নিশ্চয়ই টেবিলের উপর টুল নিয়ে তারপর শাড়িটা বেঁধেছিল। তারপর শেষ মুহুর্তে পা দিয়ে ধাক্কা দিয়ে টুলটা ফেলে দিয়েছে। আর সেই শব্দেই মুরাদের ঘুম ভেঙেছিল। এটা একটা সহজ ব্যাখ্যা। কিন্তু ব্যাপারটা যদি মার্ডার হয়? কথাটা ভাবতেই এবার ভালো করে ও পুরো ডাইনিং রুম, শোবার ঘর ভালো করে দেখে। অস্বাভাবিক কোনো কিছু চোখে পড়ে না।

ভেতরের দিকে বেডরুমে আত্মীয়স্বজন সবাই জড়ো হয়ে কান্নাকাটি করছে। এমন সময় একজন বয়স্ক মহিলা আহাজারি করতে করতে বাসার ভেতর ঢোকে। মুরাদ এগিয়ে গিয়ে কান্না কান্না গলায় বলে, ‘আম্মা, ফারিয়া নেই।’

মুরাদ ওনাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরের বেডরুমে নিয়ে যায়।

কাউকে পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানা যায় ভদ্রমহিলার নাম মনোয়ারা, মুরাদের মা, যিনি বড়ো ছেলের বাসায় থাকেন।

দুপুরের দিকে লাশ নামিয়ে যখন ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয় তখন মেয়ের বাবা আরিফুল হক আকুল গলায় বলে, ‘অফিসার, আমার মেয়ের ময়নাতদন্তের দরকার নেই। লাশটা দিয়ে দিন। আমরা চাই না কাটাকুটি হোক।’

রাহাত ভ্রু কুঁচকায়। তারপর বলে, ‘আপনার মেয়েকে খুন করা হয়েও তো থাকতে পারে? আর সেটা জানার জন্যে হলেও আপনার উচিত ময়নাতদন্ত চাওয়া।’

আরিফুল হক বিষণ্ণ গলায় বলে, ‘আসলে ও অনেকদিন ধরেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল। তার চিকিৎসাও চলছিল। পনের বিশ দিন আগে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছিল। তাই বলছি এখানে কোনো খুনের ঘটনা ঘটেনি। আর মুরাদ ফারিয়া আপন খালাতো ভাইবোন ছিল।’

রাহাত থমকায়। ফারিয়া নামের মেয়েটার মানসিক সমস্যা ছিল?

এই সময় ভেতর থেকে একজন মোটাসোটা বয়স্ক মহিলা বেরিয়ে আসে। চিৎকার করতে করতে বলে, ‘ওই মুরাদ আমার মেয়েরে মেরে ফেলেছে। ও আত্মহত্যা করার কথা না। অফিসার ওই মুরাদকে ধরে নিয়ে যান।’

আরিফুল এবার ধমক দেয়, ‘তুমি চুপ করো। এক ঝামেলার মধ্যে আরেক ঝামেলা পাকিও না।’

শামসুন্নাহার হিস্টিরিয়াগ্রস্ত মানুষের মতো বলে, ‘ওই খুনি। ও আমার মেয়েকে খুন করে ফ্যানে ঝুলিয়ে দিয়ে এখন আত্মহত্যা বলছে। আপনি ওকে ধরে নিয়ে যান।’

পেছনে মুরাদের মা মনোয়ারা বোনকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করে। ‘তুই এসব কী উল্টোপাল্টা কথা বলছিস!’

শামসুন্নাহার এক ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে বলেন, ‘আমি ঠিকই বলছি আপা। ওই মুরাদকে গ্রেফতার করুক পুলিশ।’

রাহাত এবার শান্ত গলায় বলে, ‘সেক্ষেত্রে আপনার নাতনি পিংকিকেও গ্রেফতার করে নিয়ে যেতে হয়।’

শামসুন্নাহার থমকে যায়, কপাল কুঁচকে বলে, ‘আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে? পিংকি ওর মাকে মেরে ফেলেছে? আপনার মুখে কিছু বাঁধে না?’

রাহাত এবার মাথা নেড়ে বলে, ‘পিংকি সাহায্য না করলে কাউকে অত উঁচুতে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া সম্ভব না। কাউকে মেরে অত উঁচুতে ফ্যানে ঝোলাতে হলে নিচ থেকে কেউ একজনকে লাশটা ধরে রাখতে হবে। আর এই বাসায় কাল আপনার নাতনি আর মেয়ে জামাই ছিল। পিংকি যদি সাহায্য না করে তাহলে এটা পরিস্কার আত্মহত্যা।’

শামসুন্নাহার এবার থেমে যান। তারপর হাতজোড় করে বলেন, ‘আমার মেয়েকে বেশি কাঁটাছেড়া করবেন না। ওর লাশটা আমাদের তাড়াতাড়ি দিয়ে দেবেন।’

রাহাত মাথা নাড়ে। তারপর হাফিজকে উদ্দেশ করে বলে, ‘পুরো বাসা ভালো করে সার্চ করে দেখো তো কোথাও কোনো সুইসাইড নোট পাওয়া যায় কিনা।’

বের হয়ে যাবার সময় ফরেনসিক অফিসার নাজমুলকে ডেকে বলে, ‘ডাইনিং টেবিলের উপর পায়ের ছাপগুলো ভালো করে নিয়েছ তো? কাচের টেবিলে পায়ের ছাপগুলো স্পষ্ট।’

নাজমুল হেসে বলে, ‘এটা তো রুটিন কাজ স্যার। দেখে মনে হচ্ছে একজনেরই পায়ের ছাপ। মাল্টিপল মানুষের পায়ের ছাপ না।’

রাহাত মাথা নাড়ে। পায়ের ছাপটা ফারিয়া নামের মেয়েটারই হবে। আর এটা যে পরিস্কার আত্মহত্যা সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

রাহাত মন খারাপ করে বেরিয়ে আসে। ফারিয়ার মেয়ে পিংকির সঙ্গে কথা হলো না। শোকের ধাক্কাটা কমুক, তারপর একদিন কথা বলা যাবে।

২.
ফারিয়ার লাশ হস্তান্তর করে দেওয়া হয়েছে। ওদের পক্ষ থেকে কেউ কেস করতে রাজি হয়নি। যদিও মেয়েটার মা বার বার মুরাদের দোষ দিচ্ছিল। ফরেনসিক থেকে প্রাথমিক রিপোর্ট পাওয়া গেছে তাতে সুনিশ্চিত যে এটা আত্মহত্যা। শাড়ির গিঁটটায় একটা লুপ ছিল। ৮০% সুইসাইড কেসে এমন থাকে। আর কাচের টেবিলের উপর থেকে একজন মানুষেরই পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে। আর সেটা হলো ফারিয়ার। অন্য কেউ মেরে লাশটা ঝোলালে সেক্ষেত্রে তার পায়ের ছাপও পাওয়া যেত। মেয়েটা সুইসাইড করেছে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু কেন করল সেটা জানা দরকার। মেয়েটা যে একজন মানসিক চিকিৎসকের অধীনে চিকিৎসা করছিল সেটা বাসা থেকে পাওয়া প্রেসক্রিপশন আর ওষুধ থেকেই বোঝা গেছে। কিন্তু মেয়েটার মানসিক অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল নাকি তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়া হয়েছে সেটা জানা দরকার। আর সেটা জানতেই আজ মুরাদকে থানায় ডেকেছে।

একজন কনস্টেবল দু’কাপ চা দিয়ে যায়। রাহাত সামনে বসা মুরাদকে উদ্দেশ করে বলে, ‘নিন, চা খেতে খেতে কথা বলি।’

মুরাদ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চুমুক দেয়। রাহাত ভালো করে ওর মুখটা খেয়াল করে। চেহারায় বিষণ্ণতা। মাথা নিচু করে চা খাচ্ছে।

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘মুরাদ সাহেব, আপনার শ্বশুর সেদিন বলছিল যে ফারিয়া মানসিকভাবে অসুস্থ ছিল। একবার নাকি আত্মহত্যা করার চেষ্টাও করেছিল। ওনার এই মানসিক অসুখ কবে থেকে?’

মুরাদ মাথা তুলে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে, ‘বছরখানেক ধরে ওর একটা সমস্যা তৈরি হয়। সব কিছুতে খুব সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে। আমার ফোন বিজি পেলেই উল্টোপাল্টা কথা বলত। তারপর শুরু হলো আমার কলিগকে নিয়ে সন্দেহ। কিন্তু কোনোটাই সত্যি ছিল না। আমি প্রথম দিকে খুব চেষ্টা করতাম বোঝাতে। কিন্তু এতে উলটো ফল হতো। একটা সময় আমি ওকে মানসিক চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। উনি অনেক কথা বলেন, কিছু ওষুধও দেন। আপনাকে তো আমি ইতোমধ্যে ওর প্রেসক্রিপশনটা দিয়েছিও। ভেবেছিলাম ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু হলো না।’

হঠাৎ করেই কথা শেষ করে চুপ হয়ে যায়। রাহাতের কাঁধের উপর দিয়ে ও সামনের দেয়ালের দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে।

রাহাত একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আচ্ছা, যেদিন উনি আত্মহত্যা করে সেদিন রাতে আপনি ক’টা সময় ঘুমোতে যান?’

মুরাদ একটু ভাবে, তারপর বলে, ‘এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটা। আমি মেয়ের রুমে একবার উঁকি দিয়ে কথা বলে আমার রুমে চলে আসি। ফারিয়া তখন নিজের রুমেই শুয়ে ছিল।’

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনাদের কী নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল যার জন্য এমন আলাদা রুমে ঘুমাতেন?’

মুরাদের হাত মুঠো হয়ে যায়। ঠোঁট দুটো চেপে ধরে শক্ত করে। নিচু গলায় বলে, ‘ক’দিন আগে ও আমার একটা সাদা শার্টে লালচে একটা দাগ খুঁজে পায়। আর তাতেই যা হবার হয়। ওর সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। এটা নিয়ে বার বার আমাকে কথা শুনিয়েছিল। মাঝে ব্যাপারটা মিটেও গিয়েছিল। কিন্তু সেদিন আবার ঝগড়া শুরু করে। রাগ করে বলেছিল আমাকে অন্য রুমে গিয়ে ঘুমোতে। আগেও এমন হয়েছে। তিন চার দিন পর ওর রাগ কমে যেত। এবারও ভেবেছিলাম তাই হবে। কিন্তু ও চলে গেল, সারাজীবনের জন্য।’

রাহাত এক দৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। কেন যেন মনে হচ্ছে এই লোকটার অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। আর তার জেরেই এই আত্মহত্যা। নাহ, মুরাদের কললিস্ট থেকে শুরু করে সব খতিয়ে দেখতে হবে। তার আগে ওদের মেয়ে পিংকির সঙ্গে কথা বলে মিলিয়ে দেখতে হবে আসলেই এটা নিয়ে অশান্তি ছিল নাকি অন্য কিছু।

রাহাত জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘আপনার মেয়ে কি এখন এই বাসাতেই?’

মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘নাহ, ওর নানুর বাসায়। এই বাসাটা ছেড়ে দেব। এখানে আমি বা পিংকি কেউই থাকতে পারব না।’

রাহাত মাথা নাড়ে, ‘ঠিক আছে, বাসা পালটালে আমাদের জানাবেন। আর আপনার শাশুড়ির বাসার ঠিকানা দিন। আপনার মেয়ের সঙ্গে আমি একটু কথা বলব।’

মুরাদ একটা কাগজে ঠিকানা লিখে দেয়। তারপর বিদায় নিয়ে চলে যায়।

কয়েকদিন পর এক সন্ধ্যায় রাহাত পিংকির নানু বাড়িতে আসে। ভদ্রমহিলার সঙ্গে গতকালই কথা বলে আসার কথা জানিয়েছিল।

পিংকির নানা আরিফুল হক ওকে নিয়ে বসবার ঘরে বসায়। একটু পরেই শামসুন্নাহার আসেন। এসেই আক্ষেপের গলায় বলেন, ‘এখন আর কথা বলে কী করবেন? আমিই বুঝতে পারি নাই আমার মেয়ে ভেতরে ভেতরে এতটা একলা হয়ে গিয়েছিল।’

রাহাত সহানুভূতির গলায় বলে, ‘আসলে মনের ব্যাপারগুলো বাইরে থেকে তেমন করে বোঝা যায় না। তাই এমন হয়। খুবই দুঃখজনক ঘটনা। আমি কেসের স্বার্থে পিংকির সঙ্গে একটু একা কথা বলতে চাই।’

শামসুন্নাহার মাথা নেড়ে বলেন, ‘আমি ডেকে দিচ্ছি। কিন্তু ওর মনের ক্ষতটা এখনও কাঁচা। মনের উপর চাপ পড়ে এমন কোনো কথা জিজ্ঞেস করবেন না প্লিজ।’

ওরা দুজন চলে যায়। রাহাত অপেক্ষা করতে থাকে। একটু পর পায়ের আওয়াজ পেতেই তাকায়। পিংকি দাঁড়িয়ে আছে, মুখটা বিষণ্ণ। মেয়েটা লম্বায় পাঁচ ফুটের উপর, হালকা পাতলা গড়ন, মুখে কৈশোরের নরম ছাপ।

রাহাত নরম গলায় বলে, ‘এখানে এসে বোসো পিংকি।’

পিংকি বাধ্য মেয়ের মতো সামনের সোফায় এসে বসে। রাহাত ওর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘পিংকি, তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পারি। কোনো সান্ত্বনাই যথেষ্ট না। কিন্তু এটা একটা পুলিশ কেস। তদন্ত করে দেখতে হয় মানুষটা কেন এমন করল।আমাকে কিছু তথ্য দিয়ে সাহায্য করবে?’

পিংকি মুখ তুলে তাকায়, তারপর ছোট্ট করে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।

রাহাত গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘তোমার আম্মু আর বাবার কি প্রায়ই ঝগড়া হতো?’

পিংকি নিচু গলায় বলে, ‘হ্যাঁ।’

একটু চুপ থেকে আবার বলে, ‘আসলে আম্মু আর বাবার সম্পর্ক এমন ছিল না। ইদানীং আম্মু প্রায়ই বাবাকে সন্দেহ করত আর তাই নিয়ে ঝগড়া হতো। এমনকি আমাকেও রাতে মোবাইল ব্যবহার করতে দিত না। আমাকেও খুব সন্দেহ করত। বাবা তো আম্মুকে ডাক্তারও দেখাল। কেন যে আম্মু এমন করত বুঝতেই পারি না।’

রাহাত তাকিয়ে থাকে। তার মানে মুরাদের কথা সত্য। ফারিয়ার মানসিক সমস্যা ছিল। একটু ভেবে ও বলে, ‘আচ্ছা, তোমার বাবা কি কখনও তোমার আম্মুর গায়ে হাত তুলেছিল?’

পিংকি জোরে মাথা নাড়ে, ‘নাহ। বাবা, আম্মুকে কখনও উঁচু গলায়ও কিছু বলত না।’

রাহাত নিচের ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ে। তারপর বলে, ‘শেষ প্রশ্ন। সেদিন রাতে তুমি ক’টায় ঘুমিয়েছিলে?’

পিংকি একটু মনে করে বলে, ‘বারোটা নাগাদ। এর আগে বাবা এসে একবার খোঁজ নিয়ে গিয়েছিল।’

রাহাত মাথা নেড়ে বলে, ‘আচ্ছা। তুমি যাও।’

পিংকি চলে যায়। আরিফুল আর শামসুন্নাহার ভেতরে ঢোকে। আরিফুল অনুরোধের গলায় বলে, ‘এই কেসটা আপাতত শেষ করে দিন। সাংবাদিকরা নানা গল্প লিখছে পেপারে। মাঝখান দিয়ে সেটা পিংকির জন্য খুব অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে। ও তো বন্ধুদের সাথে মিশতেই পারবে না।’

রাহাত আশ্বাস দিয়ে বলে, ‘ভাববেন না। সময়ের সাথে সাথে সবকিছু মানুষ ভুলে যাবে। আমি উঠছি আজ।’

সেদিন রাহাত থানায় ফেরার পথে ভাবে, ফারিয়া ওদের দু’জনকেই সন্দেহ করত। আচ্ছা যাকে সন্দেহ করা হয় তার নিশ্চয়ই রাগ হতো ফারিয়ার উপর? মেয়েকে মোবাইল ব্যবহার করতে দিত না। সেক্ষেত্রে মেয়েরও একটা রাগ ছিল। আর এই বয়সের মেয়েরা একটু জেদি হয়, মুখে মুখে তর্ক করে। এটাও হয়তো ফারিয়াকে কষ্ট দিত। ফারিয়া একে তো মুরাদের উপর সন্দেহ করে করে শেষ হয়ে যাচ্ছিল তার উপর মেয়ের ব্যাপারেও হয়তো হতাশ ছিল।

মেয়ের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু মুরাদের ব্যাপারটা একটু খতিয়ে দেখতে হবে। আসলেই ওর অন্য কোন মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল কি-না। ফারিয়া কি ওকে শুধু শুধু সন্দেহ করত?

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৮/০৭/২৪

ভেনম পর্ব-০৩

0

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ৩)

১.
সকালে ঘুম থেকে উঠেই ফারিয়া টের পায় মাথার একটা পাশ ভীষণ ব্যথা করছে। চোখ বন্ধ করে ব্যথাটা সামলায়। অনেক কাজ, কেমন যেন সব হিবিজিবি লাগে আজকাল।

ফারিয়া প্রথমেই ময়লা জামা কাপড়গুলো নিয়ে ওয়াশিং মেশিনের কাছে আসে। অনেক কাপড় জমে গেছে। একটা একটা করে কাপড় উল্টেপাল্টে দেখে ওয়াশিং মেশিনের ভেতর দেয়। বিশেষ করে মুরাদের প্যান্ট শার্টে প্রায়ই টাকা না হয় কাগজ থাকেই। ফারিয়া ওর প্রতিটি পকেট ভালো করে দেখে তবেই দেয়। সাদা একটা শার্টের পকেট হাতড়ে দেখতে যেতেই ও থেমে যায়। শার্টটা চোখের সামনে মেলে ধরে ভ্রু কুঁচকে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করে। শার্টের বুকপকেটের কাছে হালকা একটা লালচে দাগ। কিসের দাগ এটা?

ফারিয়া টের পায় ওর নিশ্বাস দ্রুত পড়ছে। ভাবনাটা ভাবতে চায় না। কিন্তু একটা সময় ভাবনাটা ওর পুরো মাথা গ্রাস করে নেয়। এটা নিশ্চয়ই লিপস্টিকের দাগ। কথাটা মনে হতেই মাথায় আগুন ধরে যায়। দ্রুত টেবিল থেকে মোবাইলটা নিয়ে ছবি তোলে। তারপর মেসেঞ্জার খুলে পাঠাতে গিয়ে থেমে যায়। ডাক্তার সাহেবের কথা মনে পড়ে। মনের ইমোশনাল স্টেট এখন শক্তিশালী। এটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। মনের রিজনাবেল স্টেটটা সক্রিয় করার চেষ্টা করে। ফারিয়া এবার ভাবনাটা উলটো করে ভাবার চেষ্টা করে। হয়তো ওর নিজের লিপস্টিক লেগে গিয়েছিল কখনও। কিন্তু ও তো অনেকদিন লিপস্টিক দেয়৷ না। তাহলে? এটা হয়তো লিপস্টিকের দাগ না। অন্য কোনো কিছুর দাগ।

ফারিয়া লম্বা করে নিশ্বাস নেয়। মাথাটা কয়েকবার নেড়ে ভাবনাটা তাড়াবার চেষ্টা করে। মনকে বোঝায় এটা ও ভুল ভাবছে। মুরাদ বাসায় ফিরলেই সব সত্যি জানা যাবে। কিন্তু ও কি সত্যিটা বলবে?

ফারিয়া সাদা শার্টটা এক পাশে সরিয়ে রেখে অন্য জামা কাপড়গুলো ওয়াশিং মেশিনে দেয়। স্টার্ট বাটন চেপে দাঁড়িয়েই থাকে। নাহ, ও কেন যেন এই মানসিক সমস্যা থেকে বেরোতেই পারছে না। আর এই উল্টোপাল্টা জিনিসগুলো ওর চোখেই পড়ে।

ঘরে এখন কেউ নেই। পিংকি কলেজে, মুরাদ অফিসে। পুরো ঘরটা যেন ওকে গিলে খেতে চাচ্ছে। ফারিয়া টের পায় ওর কেমন অস্থির লাগছে। ঘরের ভেতর দম বন্ধ হয়ে আসছে।

কী মনে হতে ও বাসার দরজা লক করে বাইরে আসে। তারপর লিফট চেপে একদম টপ ফ্লোরে চলে আসে। তারপর সিঁড়ি বেয়ে ছাদে ওঠে। দুপুর বেলা পুরো ছাদটা খালি। না খালি না একদম। একটা কম বয়েসী ছেলে সিগারেট খাচ্ছিল। ওকে দেখে সিগারেট লুকায়। ফারিয়া না দেখার ভান করে সামনে এগিয়ে যায়।

ছাদ জুড়ে নানা ধরনের গাছ। চারপাশটা কেমন সবুজ। অনেকগুলো টবে ফুল ফুটেছে। কোনোটা গোলাপি, কোনটা সাদা, কোনোটা লাল। আচ্ছা, মুরাদের শার্টে ওই লাল দাগটা আসলে কিসের? ওই জায়গাটায় লিপস্টিক ছাড়া অন্য কিছুর দাগ তো লাগার কথা না। ওই তাবাসসুম মেয়েটার সঙ্গে ওর নিশ্চয়ই কোনো গোপন সম্পর্ক চলছে। ফারিয়া টের পায় ওর আবার ইমোশনাল স্টেট শক্তিশালী হয়ে উঠছে। ডাক্তার সাহেব যেমন করে বললেন ব্যাপারটা এত সহজ না আসলে। এই যে ও এখন কিছুতেই ব্যাপারটা মাথা থেকে সরাতে পারছে না। মুরাদকে একটা সময় ও পাগলের মতো ভালোবাসত। দিনে বিশ পঁচিশ বার ফোন দিয়ে খবর নিত। সারারাত বুকে ঘুমিয়ে থাকত। আর মুরাদ এখন সারারাত একটা কোলবালিশ নিয়ে ঘুমিয়ে থাকে। দিন দিন এমন হয়ে গেল কেন সব?

ছাদের কাছটায় বুক সমান উঁচু পাঁচিল। ফারিয়া পায়ে পায়ে পাঁচিলের কাছে যায়। তারপর পাঁচিলের উপর বিপদজনকভাবে ঝুঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক উঁচু বিল্ডিং এটা, আট তলা। ফারিয়া কেমন মোহগ্রস্তের মতো নিচের পিচ ঢালা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে শরীরটা আরও খানিকটা উঠে আসে পাঁচিলের উপর।

কোথাও থেকে একটা বাতাস আসছে। তাতে করে কপালের কাছে চুলগুলো উড়ছে। ফারিয়া চোখ বন্ধ করে। কেমন যেন একটা শান্তি অনুভব করছ। শরীরটা এখন অর্ধেকের বেশি পাঁচিলের বাইরে বিপদজনকভাবে দুলছে। দূর থেকে একটা শব্দ কানে আসছে। ফারিয়ার ইচ্ছে হয় না ঘুরে দেখতে। ওর অবশ্য এখন পেছনে ফিরে তাকানোর উপায়ও নেই। বরং নিচে পড়ে যাওয়াই সহজ।

ফারিয়া শরীরে একটা হ্যাঁচকা টান অনুভব করে। সেইসাথে একটা তীক্ষ্ণ গলার স্বর পাওয়া যায়, ‘আপনি কী করছেন আন্টি! পড়ে যাবেন তো এখুনি।’

ছেলেটা সর্বশক্তি দিয়ে ওকে টেনে তুলে। তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘আন্টি, আপনি তো আরেকটু হলে পড়ে যাচ্ছিলেন।’

ফারিয়া শূন্য চোখে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ওর কথাগুলো বোধগম্য হয় না। এই ছেলে ওকে ধরে রেখেছে কেন? ও পড়ে যাচ্ছিল মানে?

ফারিয়া এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তীক্ষ্ণ গলায় বলে, ‘অ্যাই ছেলে, তুমি আমার হাত ধরেছ কেন?’

ছেলেটা অবাক গলায় বলে, ‘আপনাকে টেনে না ধরলে এতক্ষণে নিচে পড়ে ভর্তা হয়ে যেতেন। মানুষের উপকার করে উলটো কথা শুনতে হলো।’

ফারিয়া ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ ছাদের পাঁচিলের দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা হয়তো ঠিকই বলছে। অযথা ওকে বকাঝকা করল।

ফারিয়া নরম গলায় বলে, ‘আমি আসলে বেখেয়ালে একটু বুঝি বেশিই ঝুঁকে গিয়েছিলাম। তুমি টেনে না ধরলে সত্যিই পড়ে যেতাম।’

ছেলেটার চোখেমুখে এবার স্বস্তি ফোটে। তারপর চোখ বড়ো বড়ো করে বলে, ‘হ্যাঁ আন্টি! আমি তো দূর থেকে দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আপনি পিংকির আম্মু না? পাঁচতলার ফ্ল্যাটে থাকেন, তাই না? চলুন আপনাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি।’

ফারিয়া এবার হেসে মাথা নাড়ে, ‘লাগবে না, আমি একাই নামতে পারব।’

ফারিয়া ছাদ থেকে নেমে আসে। ছেলেটা অদ্ভুত চোখে ওর নেমে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিকেলে মুরাদ বাসায় ফিরতে ফিরতে কেমন করে যেন পুরো বিল্ডিংয়ের সবাই ঘটনাটা জেনে যায়।

সবার প্রথমে দারোয়ান ইদ্রিস হড়বড় করে বলে, ‘স্যার, আপনি এতক্ষণে বাসায় আসছেন। ভাবি নাকি আইজ ছাদ থেকে পইড়া যাইতে নিছিল। ভাগ্যিস ছাদে তখন আটতলার জারিফ ছিল। নাইলে তো একটা অঘটন ঘইটা যাইত।’

বুকটা ধক করে ওঠে। কপাল কুঁচকে বলে, ‘কী সব আবোলতাবোল কথা বলছ। ফারিয়া ছাদ থেকে পড়ে যাবে কেন, ও কি ছোট মানুষ?’

ইদ্রিস এবার জোর দিয়ে বলে, ‘স্যার, সত্যই কইতাছি। ভাবি আইজ দুপুরে ছাদ থেকে নিচে পইড়া যাইতে নিছিল।’

মুরাদ আর দাঁড়ায় না। দ্রুত পায়ে লিফটে ওঠে। বাসায় পৌঁছে ব্যস্ত হাতে বেল বাজায়। পিংকি দরজা খুলে দেয়। ওর পরনে কলেজের ড্রেস পরা। বোধহয় মাত্রই এল।

মুরাদ জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘তোর আম্মু কই?’

পিংকি কাঁদো কাঁদো গলায় বলে, ‘বাবা, আম্মু নাকি আজ ছাদ থেকে পড়ে যেতে নিয়েছিল। আমি মাত্রই বাসায় এসে শুনলাম। তোমাকে এখুনি ফোন করতে যাচ্ছিলাম।’

মুরাদ মেয়ের হাত ধরে বলে, ‘এসব কী বলছিস! কই তোর আম্মু?’

মুরাদ ওকে নিয়ে বেডরুমে এসে দেখে ফারিয়া চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ঘুমুচ্ছে কিনা বোঝা যায় না। কাছে গিয়ে বসে নিচু গলায় ডাকে, ‘ফারিয়া ঘুমুচ্ছ?’

ফারিয়া চোখ না খুলেই বলে, ‘না।’

মুরাদ এবার কাছে এসে বসে, তারপর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, ‘আচ্ছা, নিচের দারোয়ান কীসব উল্টোপাল্টা কথা বলল। তুমি নাকি আজ দুপুরে ছাদ থেকে নিচে পড়ে যাচ্ছিলে?’

ফারিয়া চোখ খুলে তাকায়। চোখে কেমন একটা পাগলাটে দৃষ্টি। কেটে কেটে বলে, ‘পড়ে গেলেই তো ভালো হতো, তাই না? তোমার শার্টে যার ঠোঁটের লিপস্টিকের দাগ লাগানো তাকে বিয়ে করে আনতে পারতে।’

মুরাদ দ্রুত ঘুরে মেয়ের দিকে তাকায়। পিংকি মাথা নিচু করে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। আবার অশান্তি শুরু হলো।

মুরাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘আমার শার্টে আবার কার লিপস্টিকের দাগ পেলে? অদ্ভুত তো।’

ফারিয়া ঝট করে উঠে বসে। তারপর দ্রুত বিছানা থেকে নেমে সকালের সেই সাদা শার্টটা নিয়ে এসে ওর চোখের সামনে মেলে ধরে। তারপর তীব্র গলায় বলে, ‘এই দাগ কোথা থেকে এলো?’

মুরাদ চোখ কুঁচকে দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু ও কোনো দাগ খুঁজে পায় না। বিরক্ত গলায় বলে, ‘কোথায় দাগ পেলে তুমি?’

ফারিয়া এবার বুকপকেটের কাছটা দেখিয়ে বলে, ‘এই যে, দেখতে পাও না?’

মুরাদ চোখ ছোট ছোট করে দেখে হালকা একটা লালচে দাগ। ও অবাক গলায় বলে, ‘এই দাগ! বাপরে, আতশ কাচ দিয়ে দেখতে হয়। আমি জানি না এই দাগ কোথা থেকে এলো। আমি তো শার্ট খুলে রেখে ওয়াশিং মেশিনের উপরে রেখে দিয়েছিলাম। হয়তো অন্য কোনো জামা থেকে রঙটা লেগেছে। বা অন্য কিছু। তুমি প্লিজ এসব ভাবনা ভেব না।’

ফারিয়া তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে ওঠে, ‘তুমি অন্য মেয়ের লিপস্টিপ এর দাগ শার্টে লাগিয়ে আনবে আর আমি ভাবব না?’

মুরাদ পিংকির রুমের দিকে তাকায়। কথাটা নিশ্চয়ই ওর কানে গেছে। ফারিয়া আবার আগেরমতো সন্দেহপ্রবণ আচরণ করছে।

মুরাদের হঠাৎ করেই মনে হয় ফারিয়া কি তবে আজ সুইসাইড করতেই ছাদে উঠেছিল? কথাটা মনে হতেই পুরো শরীর কেঁপে ওঠে। ও হঠাৎ করে ওকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ফারিয়া, তুমি কি আজ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে যেতে চেয়েছিলে? ফারিয়া, সত্যি করে বলো।’

ফারিয়ার টের পায় ওর খুব কষ্ট হচ্ছে বুকের ভেতর। বুক ভেঙে কেমন কান্না আসছে। ও মুরাদের বুকের ভেতর ঢুকে যেতে যেতে বলে, ‘আমি জানি না, আমার কী হয়েছিল।’

মুরাদ পরম মায়ায় ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।

পিংকি ওর রুম থেকে বেরিয়ে একবার উঁকি দেয়। কতদিন পর এমন দৃশ্য দেখল!

২.
আড়ংয়ে এলে ফারিয়ার মন ভালো হয়ে যায় সবসময়। এদের সবকিছু কেমন পরিপাটি করে সাজানো গোছানো থাকে। তাতে করে মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু আজ কিছুতেই মন ভালো হচ্ছে না। কেমন যেন বিক্ষিপ্ত লাগছে।

ফারিয়া ঘুরতে ঘুরতে শাড়ির সেকশনে আসে। কত রঙবেরঙের শাড়ি। নীল রঙ, সবুজ রঙ, আকাশি, মেরুন, লাল। আচ্ছা, মুরাদের শার্টে লাল রঙয়ের দাগটা কি লিপস্টিকের ছিল?

এই সময় শোরুমের একটা অল্প বয়েসী মেয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘ম্যাডাম, কী খুঁজছিলেন? সুতী শাড়ি নাকি সিল্ক?’

ফারিয়া ঘুরে তাকায়। মেয়েটা ধবধবে ফর্সা, নাকটা বোচা, চোখে কালো কাজল, আর ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কেমন একটা ঘোর ধরে যায়।

ফারিয়া ওর দিকে তাকিয়ে কেমন একটা গলায় বলে, ‘আচ্ছা, গলায় ফাঁস দিতে সুতী শাড়ি ভালো হবে নাকি সিল্কের শাড়ি?’

মেয়েটা থতমত খেয়ে যায়। তোতলানো গলায় বলে, ‘জি ম্যাডাম, কী বললেন! বুঝিনি।’

ফারিয়া মাথা নাড়ে, ‘নাহ, কিছু না। চিকন সুতার সুতী শাড়ি খুঁজছিলাম।’

মেয়েটা এবার হাত তুলে একদম শেষের দিকে দেখিয়ে বলে, ‘ওদিকটায় পাবেন ম্যাডাম।’

ফারিয়া গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে সুতী শাড়ির সেকশনের দিকে চলে যায়। তারপর বেছে বেছে হালকা গোলাপি রঙের চিকন পাড়ের একটা শাড়ি কেনে। তারপর পিংকির জন্য একটা টপস নেয়।

বিল দিয়ে বাইরে আসতেই দেখে এই ভর দুপুরে আকাশ রাতের মতো অন্ধকার। এখনই বৃষ্টি নামবে। ফারিয়ার মধ্যে অবশ্য তাড়াহুড়া দেখা যায় না৷ ও ধীরেসুস্থে একটা রিক্সা নেয়। এখান থেকে পনের বিশ মিনিট লাগবে বাসায় যেতে৷

অর্ধেক পথ যেতে না যেতেই হুড়মুড় করে বৃষ্টি নামে। রিক্সাওয়ালা দ্রুত রিক্সা থামিয়ে বলে, ‘আপা, একটু নামেন, পলিথিন দেই।’

ফারিয়া হাত তুলে থামায়, তারপর বলে, ‘লাগবে না। আপনি রিক্সা চালান। হুড খোলাই থাক।’

রিক্সাওয়ালা কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। তারপর রিক্সায় উঠে প্যাডেলে চাপ দেয়। খুব একটা অবাক হয় না। অনেকেই এমন বৃষ্টিতে ভিজে।

বাসার কাছে আসতেই ফারিয়া ভিজে একসা হয়ে যায়। কাগজের শপিং ব্যাগগুলোও ভিজে কেমন চুপসে গেছে।

বাসায় ফিরে ফারিয়া ভেজা জামা কাপড় পাল্টে নেয়। শপিং ব্যাগ থেকে শাড়ি আর পিংকির টপ্স বের করে দেখে। খুব একটা ভিজে নাই। বারান্দায় গিয়ে মেলে দিয়ে ভেতরে আসে।

পিংকি আসে একটু পরেই। ফারিয়া ওর দিকে তাকিয়ে রাগী গলায় বলে, ‘তুই এমন ভিজে এলি কেন? গাড়ি যায়নি?’

পিংকি ঠোঁট উল্টে বলে, ‘গিয়েছিল। কিন্তু আমার আজ ভিজতে ইচ্ছে করছিল আম্মু।’

ফারিয়া ধমক দিতে গিয়েও থেমে যায়। মেয়েটা ওর মতোই হয়েছে। ফ্রিজ থেকে কালকের রাতের তেহারি বের করে গরম করে খেতে দেয় ওকে। তারপর বারান্দা থেকে টপসটা এনে ওকে দেখায়, ‘পরে দেখিস তো, লাগে কিনা?’

পিংকি একবার চেয়ে দেখে, তারপর বলে, ‘পরে পরব। আমি এখন ঘুমোব।’

ফারিয়া আহত চোখে তাকিয়ে থাকে। মোবাইলের ইস্যুতে মেয়েটা প্রায়ই ওর সাথে এখন দূরত্ব বজায় রাখে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিয়া প্লেট, গ্লাস ধুয়ে নিজের রুমে আসে। তারপর পাতলা একটা কাঁথা গায়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

মুরাদ আসে সন্ধ্যাবেলা। এসে চুপচাপ নাস্তা খায়, তারপর চা। অন্যান্য দিনের মতো রাত দশটা পর্যন্ত টিভি দেখে। তারপর রাতের খাবার খেয়ে ফারিয়ার আশেপাশে কয়েকবার ঘুরে। কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু ও কোন উত্তর দেয় না। তারপর গেস্ট বেডে চলে আসে ঘুমাতে। গত কয়েকদিন ধরেই আলাদা ঘুমুচ্ছে। মানে বাধ্য হচ্ছে আলাদা ঘুমোতে। ফারিয়া সেদিন হুট করে আবার সেই শার্টের কথা তুলল। আর সেই নিয়ে কুৎসিত একটা ঝগড়া হলো। তারপর থেকেই রাতে শোবার এই ব্যবস্থা।

সেদিনের ছাদের সেই ঘটনার পর মাত্র এক মাস পেরিয়েছে। ডাক্তারের কাছে আবার যাওয়া দরকার। কিন্তু ফারিয়া কেন যেন যেতে চাচ্ছে না।

মুরাদ ডাইনিংয়ে এসে এক গ্লাস পানি খায়। ফারিয়ার রুম অন্ধকার। ডাইনিংয়ের আলো গিয়ে পড়েছে, তাতে ওকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। মুরাদ এবার মেয়ের রুমে উঁকি দিয়ে বলে, ‘ঘুমুবি না? সাড়ে এগারোটা বাজে তো।’

পিংকি একটু হাসে। মেয়েটা কেমন মন খুলে হাসে না। নিচু গলায় বলে, ‘এই তো বাবা, বারোটা বাজলেই ঘুমিয়ে পড়ব।’

মুরাদ নিজের রুমে চলে আসে। সেই বিয়ের পর থেকেই এমন। কিছু হলেই ফারিয়া কথা বন্ধ করে দেবে, আলাদা ঘুমোবে। একটা মানসিক অশান্তি সবসময়। মাথায় একটা চাপ অনুভব করে মুরাদ। এমন জীবন আর ভালো লাগছে না।

মুরাদ নিজের রুমের লাইট অফ করে ঘুমোতে যায়। আজ আবহাওয়া ঠান্ডা। মুরাদ একটা পাতলা কাঁথা টেনে নেয়।

ঠিক কতক্ষণ ঘুমিয়েছে বলতে পারবে না। হঠাৎ করেই ওর ঘুম ভেঙে যায়। চোখ কুঁচকে ও বোঝার চেষ্টা করে ঘুমটা ভাঙল কেন? কোথাও কোনো শব্দ হলো? মুরাদ এবার ঘুরে মাথাটা একটু উঁচু করে ডাইনিং রুমের দিকে তাকায়। কী ব্যাপার, ডাইনিং এর লাইট অফ কেন?

মুরাদ বিছানা থেকে নামে। দরজার কাছে এসে রুমের সুইচ হাতড়াতে হাতড়াতে হঠাৎ করেই থেমে যায়। বাইরে থেকে হালকা একটা আলো এসে পড়েছে ডাইনিং-য়ে। তাতে করে আলো অন্ধকারে আবছা একটা কিছু শূন্যে ঝুলে থাকতে দেখা যায়। মুরাদ টের পায় ওর সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে আসছে। কোনোমতে লাইট জ্বালায়। আর তাতে করে দৃশ্যটা স্পষ্ট হয়। ফারিয়ার শরীরটা ডাইনিংয়ের ফ্যান থেলে ঝুলছে। চোখ দুটো বিস্ফারিত। ঘাড়টা একপাশে হেলে আছে।

মুরাদ চিৎকার করার চেষ্টা করে, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বেরোয় না। মাথাটা কেমন ঘুরছে। পা দুটো যেন মাটিতে গেঁথে গেছে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৮/০৭/২৪

ভেনম পর্ব-০২

0

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ২)

১.
ফারিয়ার আজ বেলা করে ঘুম ভাঙে। ঘুম ঘুম চোখে একবার দেয়ালঘড়ির দিকে তাকায়। এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। একটা হাই তুলে উঠে বসে। সকালে একবার উঠেছিল। পিংকি কলেজ যায় সাতটায়। ওকে নাস্তা খাইয়ে বিদায় দিয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিল। মুরাদ সকালে বাসায় নাস্তা করে না। অফিসে গিয়েই নাস্তা করে।

ফারিয়া এবার আড়মোড়া ভেঙে অলস পায়ে বেসিনের কাছে এসে চোখেমুখে পানি দিতেই ঘুমটা কাটে। বেসিনের আয়নাটা নতুন লাগিয়েছে মুরাদ। আগেরটায় চেহারা ঘোলা দেখা যেত। এটাতে একদম পরিস্কার দেখা যায়। ফারিয়া আয়নার দিকে ঝুঁকে নিজের মুখের দিকে চেয়ে থাকে। দুই চোখের নিচে কালি পড়েছে। দেখতে অনেকটা অর্ধবৃত্তাকার চাঁদের মতো। এর ঠিক নিচেই মেছতার দাগ। আগে এটা ছিল না। গত কয়েক মাস ধরে লক্ষ করছে ও। ফারিয়া ফ্রিজ থেকে এক টুকরো এলোভেরা বের করে মেছতার জায়গাটা একটু ঘষে। কে যেন বলেছিল এটা করলে নাকি মেছতার দাগ চলে যায়।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফারিয়া আবার মুখ ধোয়। চেহারায় বয়সের ছাপ পড়ে গেছে। আগের মতো মুখটা মসৃণ না। আচ্ছা, মুরাদ কি এজন্যই ওর কাছে আসে না? অন্য কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে? প্রায়ই ফোন বিজি পাওয়া যায়। বারান্দায় লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে। ইদানিং নতুন নতুন শার্ট-প্যান্ট পরে, সাথে ম্যাচিং করে জুতো বেল্ট, ঘড়ি। এগুলো আগে ছিল না। মানুষ এগুলো করে কাউকে মুগ্ধ করার জন্যই। যদিও সরাসরি কোনো প্রমাণ পায়নি, কিন্তু কোথাও একটা ঝামেলা আছে ওর।

মন খারাপ হয়ে যায় ফারিয়ার। কত ধুমধাম করে বিয়ে হলো। সম্পর্কে ওরা দু’জন খালাতো ভাইবোন। আব্বা রাজি ছিল না প্রথমে। কিন্তু তারপরও দুই বোনের প্রবল আগ্রহেই ওদের বিয়েটা হয়। সুখীই তো ছিল। কিন্তু এই বয়সে এসে হঠাৎ করে এমন হয়ে গেল কেন?

ডাইনিং-এ এসে এক কাপ চা আর একটা পরোটা নিয়ে বসে। ডিম ভেজে খেতে ইচ্ছে করছে না। ফারিয়া পরোটা রোল করে নেয়, তারপর একটা মাথা চায়ে ডুবিয়ে রাখে। মুখে দিতেই তুলতুলে নরম, মিষ্টি একটা স্বাদ। ভালো লাগছে খেতে। পরোটাটা আবার ডোবায়। যখন তুলতে যাবে ঠিক তখন মোবাইলের মেসেঞ্জারে ‘টুন’ করে একটা শব্দ হয়। ফারিয়া পরোটা মুখে পুরে মোবাইল খোলে। অপরিচিত একটা একাউন্ট থেকে মেসেজ এসেছে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকায়। ফেসবুকে কিছু মানুষ এতটাই বিকৃত রুচির যে সারাক্ষণ মেয়েদের ইনবক্সে আজেবাজে মেসেজ পাঠাতে থাকে।

ফারিয়া মোবাইল রেখে পরোটা আর চা শেষ করে। তারপর চায়ের মগটা ধুয়ে টেবিলে রাখতেই আবার মোবাইলে মেসেজ আসার শব্দ হয়। কপাল কুঁচকে দেখে সেই একই আইডি থেকে মেসেজ এসেছে। আইডির নামটাও কেমন যেন – ভেনম।

খুলবে না ভেবেও স্প্যাম ফোল্ডারে গিয়ে মেসেজটা খুলে। চোখ স্থির হয়ে যায়, টের পায় দ্রুত নিঃশ্বাস পড়ছে। মাথার ভেতর কেমন যেন লাগছে। ইনবক্সে মুরাদের সঙ্গে একটা মেয়ের দুটো ছবি – একটা চা বাগানে, আরেকটা কোনো একটা হোটেলের লবিতে। ক’দিন আগেই মুরাদ সিলেট গিয়েছিল অফিসের কাজে। যাবার আগে খুব ঝগড়া হয়েছিল। মুরাদ বলেছিল ও নাকি মিথ্যা সন্দেহ করে ওকে। অথচ আজ হাতে ঠিক প্রমাণ এলো। তার মানে এতদিন ধরে ও যে সন্দেহটা করে আসছিল সেটা সত্য। মুরাদ অফিসের ট্যুরের নাম করে অন্য কাউকে নিয়ে সিলেট থেকে ঘুরে এসেছে। মাথায় আগুন ধরে যায়। ইচ্ছে করছে পুরো ঘরে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিতে৷

ও দ্রুত ছবি দুটো ডাউনলোড করে নেয় আগে। তারপর মুরাদের মেসেঞ্জারে ছবি দুটো পাঠিয়ে লিখে, ‘মিথ্যাবাদী, ভন্ড।’

মুরাদ মনোযোগ দিয়ে একটা সেলস রিপোর্ট দেখছিল। এমন সময় মোবাইলে মেসেজ আসতেই চেয়ে দেখে ফারিয়ার মেসেজ। ভ্রু কুঁচকে ও মেসেজ খুলতেই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। টের পায় বুকের ভেতর ড্রাম বাজছে৷ মোবাইলটা হাতে নিয়ে দ্রুত তাবাসসুমের রুমে ঢোকে। উত্তেজিত গলায় বলে, ‘তাবাসসুম, এই ছবিগুলো আমার বউকে কে পাঠাল! আমার তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।’

তাবাসসুম অবাক চোখে ছবিগুলো দেখে, তারপর বিস্মিত গলায় বলে, ‘তোর বউ এটা পাঠিয়েছে তোকে? কী করে? আমি তো আমার ফেসবুকে সিলেট ট্যুরের এই ছবিসহ আরও অন্যান্য ছবি পোস্ট করেছিলাম। আর সেটা শুধু আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড যারা তারাই দেখতে পাবে৷ তোর বউ তো আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড না। এই ছবি ওর কাছে গেল কী করে?’

মুরাদ হাহাকার করে বলে, ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেল। এমনিতেই ফারিয়া সারাক্ষণ কথা শোনায়। আর এখন তো এই ছবি দেখার পর ও পাগল হয়ে যাবে। তোর ফেসবুক ফ্রেন্ডদের কেউ এটা করেছে।’

তাবাসসুম থতমত খেয়ে যায়। ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘এই অফিসের প্রায় সবাই আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড। এছাড়া বাইরের মানুষও আছে। মুরাদ, এটা ওই তালেবের কাজ না তো?’

কয়েক মাস ধরেই তালেব ভীষণ পিছে পড়েছে। ইনিয়ে বিনিয়ে তাবাসসুমকে ভালোবাসে সেটা বলার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাবাসসুম ওকে একবিন্দুও পাত্তা দেয়নি। তাই নিয়ে সেদিন কথা শুনিয়েছিল, ‘মুরাদের সঙ্গে তো খুব ভাব। সারাক্ষণ একসাথে লেগে থাকো।’

সেদিন তাবাসসুম ইচ্ছেমতো কথা শুনিয়েছিল। এরপর আর জ্বালায়নি। ভেবেছিল ও থেমে গেছে। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে থামেনি। ঈর্ষাপরায়ণ হয়েই এই ছবিগুলো মুরাদের বউকে পাঠিয়েছে।

মুরাদ হতাশভাবে মাথা নাড়ে, তারপর বলে, ‘আমি বাসায় যাচ্ছি। বসকে সামলাস। না হলে ফারিয়া কখন যে কী করে ফেলে।’

তাবাসসুম এবার বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘শোন, তুই ওকে গিয়ে সত্যিটা বলবি। আমাদের তো অফিসের ট্যুর ছিল। আর চা বাগানটা তো হোটেলের পাশেই, তাই ছবি তোলা হয়েছিল। তুই তো এর আগেও অনেকবার আমার সঙ্গে ট্যুরে গিয়েছিস। এরপর থেকে বউকে সত্যিটা বলে যাবি। এই দেখ, এখন শুধু শুধু একটা সন্দেহ সৃষ্টি হলো।’

মুরাদ বের হতে হতে বলে, ‘আমি তো বলতেই চাই। কিন্তু ওর ভয়েই বলি না। আচ্ছা আমি যাই। আর শোন, বাসায় গিয়ে আমি ফারিয়াকে একবার ফোনে ধরিয়ে দেব। তুই একটু বুঝিয়ে বলিস।’

তাবাসসুম সহানুভূতির চোখে তাকায়। একটা অযাচিত অপরাধবোধ ওকে ঘিরে ধরে৷ মুরাদ যে ভয়টা পাচ্ছিল সেটাই হলো।

ঘন্টাখানেকের মধ্যে ও বাসায় পৌঁছে যায়। দুরুদুরু বুকে বেল বাজাতেই দরজা খুলে যায়। মুরাদ দরজা বন্ধ করে দৌড়ে এসে পেছন থেকে ফারিয়াকে ঝাপটে ধরে, আকুল গলায় বলে, ‘তুমি যা ভাবছ তা সত্যি না।’

ফারিয়া এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তীব্র গলায় বলে, ‘এতদিন তাই জানতাম, কিন্তু আজ তো হাতে হাতে প্রমাণ পেলাম। আমি আজকেই এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। আম্মুকে ফোন করে বলেছি আসতে। তুমি আর তোমার মেয়ে থাকো। তারপর আরাম করে এসব কাজ কোরো।’

মুরাদ ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘খালাকে আসতে বলেছ! তুমি কী পাগল হয়ে গেলে? আরে ওই মেয়েটা তো আমার কলিগ, তাবাসসুম। এর আগেও ওকে অফিসের অনুষ্ঠানে দেখেছ। সিলেট ট্যুরে ও সঙ্গে ছিল। আমদের মাঝে মাঝে একসাথে যেতে হয়, আর সেটা পুরোটাই অফিসের কাজে। বিশ্বাস না হলে ওকে ফোন দাও।’

ফারিয়া থমকায়। মেয়েটাকে তখন খুব চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। মুরাদ বলাতে এখন মনে পড়ল। এই মেয়েটার সাথে এক দুবার কথা হয়েছে। কিন্তু ও যাবার দিন তাহলে মিথ্যে বলল কেন? এই তাবাসসুম মেয়েটার সাথে ওর কোন চক্কর চলছে না তো?

ফারিয়া কেটে কেটে বলে, ‘এখন ফোন দিয়ে কী হবে? সব তো শিখিয়ে পড়িয়ে এসেছ। আমি আর থাকব না এই সংসারে।’

মুরাদ এবার গম্ভীর গলায় বলে, ‘কিছু হলেই তুমি এই কথা বলো। কেন বলো? আর আমাকে এত অবিশ্বাস কেন করো? তোমার আসলে মানসিক অসুখ হয়েছে। ডাক্তার দেখানো দরকার।’

ফারিয়া চিৎকার করে বলে, ‘তোমার হয়েছে। তুমি গিয়ে ডাক্তার দেখাও।’

কথাটা বলে ও গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে ঢোকে। হাড়িপাতিলের সশব্দ আওয়াজ পাওয়া যায় যা ওর রাগের সমানুপাতে বাড়তে থাকে৷
মুরাদ মন খারাপ করে লিভিংয়ে বসে থাকে। একটা কথা মনে হতেই ও সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। খালা মানে ফারিয়ার আম্মা কাছেই থাকেন। কিছু হলেই ফারিয়া মাকে ডাকবে। খালা অবশ্য মুরাদের পক্ষেই সবসময় বলেন। তারপরও একটা অদৃশ্য চাপ অনুভব করে মুরাদ।

সেদিন বিকেলে ফারিয়ার মা শামসুন্নাহার ঠিক আসেন। হাতে বিকেলের নাস্তা – পরোটা আর চিকেন চাপ। পিংকি ওর রুম থেকে বেরিয়ে আসে। শামসুন্নাহার নাতনিকে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘তুই তো আমার চেয়েও লম্বা হয়ে গেছিস। আর সুন্দর হচ্ছিস দিন দিন।’

পিংকি লাজুক গলায় বলে, ‘তোমার মতো ফর্সা কেউই না নানু।’

শামসুন্নাহার হাসেন। তারপর বলেন, ‘নে, পরোটা আর চিকেন চাপ এনেছি।’

ফারিয়া গম্ভীরমুখে বলে, ‘পিংকি, তুমি তোমার রুমে যাও। আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

পিংকি একবার মায়ের দিকে বিরক্তি নিয়ে তাকায়, তারপর ধুপধাপ করে নিজের রুমে চলে যায়। আজ বাসায় এসেই বাবাকে অসময়ে বাসায় দেখে অবাক হয়েছিল। পরে বুঝেছে আম্মু আবার বাবার সঙ্গে ঝগড়া করেছে। আর সেজন্যই নানুর এমন হঠাৎ করে বাসায় আসা।

বেডরুমের দরজা চাপিয়ে দিয়ে ফারিয়া বসে। তারপর উত্তপ্ত গলায় বলে, ‘তোমার বোনের ছেলে একটা আস্ত বদমাশ। সারাক্ষণ অন্য মেয়েদের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। বুড়ো হয়ে গেছে তাও নোংরামো কমে না। ঢাকার বাইরে মেয়ে নিয়ে ঘুরতে যায়।’

শামসুন্নাহার কপাল কোঁচকান। ফারিয়ার মুখে ইদানিং কোনো লাগাম নেই। যা আসে তাই বলতে থাকে। ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘চুপ কর তুই। অ্যাই মুরাদ, কী হয়েছে বল তো?’

মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব খুলে বলে। শামসুন্নাহার মাথা নাড়েন, তারপর ফারিয়ার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলে, ‘তুই শুধু শুধু এমন কেন করিস? ও তো এর আগেও ট্যুরে যেত। তখন তো এমন করতি না। আর মুরাদ, তুই যা করবি ওকে বলে কয়েই করবি।’

মুরাদ ফোঁস করে একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘আমি তো সব বলতেই চাই। কিন্তু ও এমন করে চিৎকার করে, উল্টোপাল্টা কথা বলে যে আমি ভয়েই আর কিছু বলি না। কিন্তু খালা, ও দিন দিন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ওকে মানসিক ডাক্তার দেখানো দরকার। আমি বলেছি উলটো রাগ করে।’

ফারিয়া রাগী গলায় বলে, ‘তুমি দেখাও। আমি যাব না। নিজেকে ঠিক করো, তাহলেই আমি ভালো হয়ে যাব।’

শামসুন্নাহার এবার বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘ফারিয়া, তুই রাগ করিস না। তুই একবার ওর সঙ্গে ডাক্তারের কাছে যা। মানুষের যেমন শরীরের অসুখ হয় তেমন মনেরও অসুখ হয়।’

ফারিয়া মাথা নিচু করে বিড়বিড় করতে থাকে। কেন যেন এই জীবন আর ভালো লাগে না। মেয়াটাও ইদানিং মুখে মুখে কথা বলে। কেউ ওর কথা শোনে না।

২.
মনোচিকিৎসক ডাক্তার সুশান্ত মনোযোগ দিয়ে ফারিয়ার সব কথা শুনছেন। মাঝে মাঝে গম্ভীর হয়ে যাচ্ছেন আবার মাঝে মাঝে ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে।

ফারিয়ার কথা শেষ হতেই সুশান্ত নরম গলায় বলেন, ‘বয়সের এই পর্যায়ে এসে এমন হতে পারে। নিজের উপর আত্মবিশ্বাস কমে যায়। লাইফ পার্টনার তার ক্যারিয়ারে আগের চেয়ে এই বয়সে অনেক উঁচুতে উঠে যায় তাতে করে মনে হয় সে বুঝি নাগালের বাইরে চলে গেল। আর আপনার কথায় যেটা মনে হলো আপনি নিজের চেহারা নিয়েও গ্লানিতে ভোগেন এখন। সব মিলিয়ে আপনার মনে একটা হীনমন্যতা সৃষ্টি হয়েছে যেখান থেকে এই সন্দেহগুলোর সৃষ্টি। আমি সন্দেহগুলো অহেতুক বলব না। আবার সত্যিও বলব না। আপনার লাইফ পার্টনার মি. মুরাদ যদি সত্যিই জড়িয়ে থাকে তাতেও আপনাকে মানসিকভাবে দৃঢ় হতে হবে। আপনি যা চোখে দেখবেন শুধু সেটাই বিশ্বাস করবেন। যুক্তি দিয়ে নিজেকে বোঝাবেন। এজন্য নিজের মনকে তৈরি করতে হবে।’

ফারিয়া তাকিয়ে থাকে। তারপর জিজ্ঞাসু গলায় বলে, ‘সেটা কী করে?’

সুশান্ত বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘মানুষের মনের তিনটা স্টেট – রিজনাবেল স্টেট, ইমোশনাল স্টেট আর ওয়াইজ স্টেট। বাংলায় বললে, যৌক্তিক মন, অনুভূতিপ্রবণ মন আর জ্ঞানী মন। যখন আমরা আমাদের যৌক্তিক মন দিয়ে কোন কিছু চিন্তা করি তখন আমরা ব্যাপারটা যুক্তি দিয়ে ভাবি, আবেগকে পাশে সরিয়ে রেখে। এটার রঙ নীল। আবার যখন আমরা আবেগ দিয়ে ভাবি তখন আমরা আমাদের মনের ভেতরের কথা শুনি, যুক্তির কথা কম শুনি। এটার রঙ ধরুন লাল। আর এই দুটোকে এক করে যা হয় তা হলো আমাদের জ্ঞানী মন যেটা যুক্তি দিয়ে আমাদের আবেগের মনকে একটা জায়গায় নিয়ে আসে। আমাদের মনের দুটো অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখে। আপনি খেয়াল করে দেখবেন আপনি যে কাজগুলো করেন তার বেশিরভাগই আবেগ দিয়ে দিয়ে করেন। আপনার ইমোশনাল মাইন্ড খুব শক্তিশালী। এটা হতে দেওয়া যাবে না।’

ফারিয়া এখন কৌতুহল বোধ করছে। ও আগ্রহের গলায় বলে, ‘সেটা কী করে পারব?’

সুশান্ত নিচের ঠোঁট কামড়ে বলে, ‘আপনি যখনই এমন পরিস্থিতিতে পড়বেন আপনি তখনই সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া দেখাবেন না। সময় নিন, যতক্ষণ না যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেন ততক্ষণ চুপ থাকুন। দেখবেন সময় দিলে যে ব্যাপারটা নিয়ে আপনি অনেক রেগে যাচ্ছেন সে ব্যাপারটাতে রাগ অনেকটাই কমে যাচ্ছে। এই যে আপনি বললেন যে আপনি আপনার হাসব্যান্ডের সঙ্গে একটা মেয়ের ছবি পেয়ে সেটা সঙ্গে সঙ্গে তাকে ফরোয়ার্ড করেছেন। তার মানে আপনি আপনার ইমোশনাল মনের কাছে হেরে গেছেন। আপনার উচিত ছিল অপেক্ষা করে সবটা জানা, যুক্তি দিয়ে বিচার করা। এটা অভ্যাসের ব্যাপার। চট করে আয়ত্ত্বে আসবে না। আপনি আজ থেকেই শুরু করুন অভ্যাসটা। আমি সেই সাথে কিছু ওষুধ লিখে দিচ্ছি নিয়মিত খাবেন। এক মাস পরে আবার আসবেন।’

ডাক্তার সাহেব মুরাদের সাথেও বিস্তারিত কথা বলে। যাবার সময় উপদেশ দেবার গলায় বলে, ‘আপনি যেহেতু আপনার স্ত্রীকে সুস্থ করতে চান সেক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি দরকার। আপনি যাই করবেন সেটা খোলামেলাভাবে আপনার স্ত্রীর সাথে শেয়ার করবেন। ওনার সন্দেহ হয় এমন কাজ কম করবেন। আপাতত এটুকুই।’

সেদিন ফেরার পথে ফারিয়া কোনো কথাই বলে না। চুপ করে ভাবতে থাকে। ডাক্তার সাহেব যেমন এত সহজে কথাগুলো বলতে পারেন আসলে কি এত সহজ? মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে তো ওনার সাহায্যই লাগে না। বড়ো বড়ো কথা। ডাক্তার নিজে যদি এমন পরিস্থিতিতে পড়ত তাহলে বুঝত।

বাসায় ফিরে মুরাদ গম্ভীরমুখে বলে, ‘এই যে প্রেসক্রিপশন আর এক মাসের ওষুধ। মনে করে খেও।’

ফারিয়া কিছু না বলে ওয়াশরুমে ঢোকে। ভেতর থেকে পানি পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। মুরাদ অপেক্ষা করে বসে থাকে ও কখন বেরোবে।

ক’টা দিন বেশ ভালো যায়। ফারিয়া এর মাঝে নতুন করে কোনো ঝামেলা করেনি। সেদিন সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে মুরাদ স্বস্তির গলায় বলে, ‘ডাক্তারটা বেশ ভালোই, তাই না?’

ফারিয়া টিভিতে একটা সিরিয়াল দেখছিল। ও মুখ না তুলে বলে, ‘হ্যাঁ, ভালো।’

মুরাদ গলাখাঁকারি দিয়ে বলে, ‘ওষুধগুলো খাচ্ছ তো?’

ফারিয়া এবার ঘুরে তাকায়, ঠান্ডা গলায় বলে, ‘না খাচ্ছি না। ফেলে দিছি। আমার ওষুধ লাগবে না।’

মুরাদ চেষ্টা করে রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারে না, চাপা গলায় বলে, ‘এক মাসের পুরো ওষুধ ফেলে দিয়েছ? তুমি কী? ওষুধ না খেলে শুধু শুধু ডাক্তার কেন দেখালে?’

ফারিয়া মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর হয়ে বসে থাকে। মুরাদ এবার ওর কাছে এসে বসে। একটা হাত দিয়ে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, ‘ফারিয়া, আমরা সবাই চাই তুমি ভালো হয়ে যাও আগেরমতো। ডাক্তার যেভাবে বলে সেভাবেই চলো ক’টা মাস।’

ফারিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ছোট্ট করে বলে, ‘আচ্ছা। আমি কিনে নেবনি ওষুধ।’

মুরাদ স্বস্তির একটা নিশ্বাস ছাড়ে। যাক ফারিয়া শেষ পর্যন্ত ওর কথা শুনছে। দেখে মনে হয় ও বুঝি সত্যিই অনুতপ্ত। মুরাদ সে রাতে ফারিয়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে থাকে। ফারিয়া নিশ্চয়ই ভালো হয়ে যাবে। ফারিয়াও ভাবছিল ওর মনের অসুখটা এবার সেরে যাবে। ও ঠিক ডাক্তারের কথামতো চলবে এখন থেকে। সন্তান, স্বামী – সবার কাছ থেকে ও দূরে সরে যাচ্ছে। কাল থেকে ওষুধগুলো খাবে, আর অবহেলা করবে না। তাতে করে ও ঠিক ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু ফারিয়া জানত না ও আর কোনোদিন ভালো হতে পারবে না।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৬/০৭/২৪

ভেনম পর্ব-০১

0

#গল্প২২৮

#ভেনম (পর্ব ১)

১.
কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক টানা বৃষ্টি না। কিন্তু যখন হচ্ছে তখন পুরো একটা বেলা আকাশ অন্ধকার করে বৃষ্টি হচ্ছে। তার পর পরই আবার রোদ। এবারের বর্ষার শুরুটা খুব অদ্ভুত। এই যে আজও মনে হচ্ছিল সারাদিন বুঝি আর সূর্যের দেখা পাওয়া যাবে না। কিন্তু বিকেল হতেই বৃষ্টি থেমে আকাশ পরিষ্কার। মুরাদ আর আলসেমি করে বাসায় বসে থাকে না। বাসায় একদম শাকসবজি নেই। বেরোবার আগে একবার ফারিয়ার রুমে উঁকি দেয়। চোখের উপর হাতটা ভাঁজ করে শুয়ে আছে, ঘুমুচ্ছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

মুরাদ গলাখাঁকারি দিয়ে নিচু গলায় বলে, ‘বাজারে যাচ্ছি। শাকসবজি বাদে অন্য কিছু লাগলে মেসেজ দিও।’

ফারিয়া চোখের উপর থেকে হাত নামিয়ে ঘুম ঘুম চোখে একবার তাকায়, তারপর ছোট্ট করে বলে, ‘আচ্ছা।’

মুরাদ আর দেরি করে না। আবার না কখন বৃষ্টি নেমে পড়ে। লিভিং রুম পেরিয়ে দরজা খুলতে যেতেই পেছন থেকে কলেজপড়ুয়া মেয়ে পিংকি ডাক দেয়, ‘বাবা, আমার জন্য দুইশ পেজের দুটো খাতা নিয়ে এসো।’

মুরাদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ে। মেয়েটা সবে কলেজে ঢুকেছে, সাইন্স নিয়ে। ওদের কলেজে পড়াশোনার ভীষণ চাপ। এরই মধ্যে চারজনের কাছে টিউশন নিতে হচ্ছে।

এখানকার বাজারটা একদম কাছেই, হাঁটা দূরত্বে। বিকেলে আগে আগে গেলে মাঝে মাঝে টাটকা শাকসবজি পাওয়া যায়। মুরাদ সেই লোভেই ছুটির দিনগুলোতে একবার হলেও বিকেলে বাজারে ঢুঁ মারে। ঢোকার মুখেই কচি সবুজ পুঁই শাক দেখতে পেয়ে ও থমকে দাঁড়ায়। তারপর পায়ে পায়ে কাছে যায়। পুঁই শাকের কচি পাতাগুলো কেমন সতেজ। দাম জিজ্ঞেস করতেই মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। আশি টাকা কেজি। অথচ গত সপ্তাহেই এটা চল্লিশ টাকা কেজি ছিল। সে কথা বলতে দোকানি তেড়িয়া গলায় বলে, ‘কেমুন বিষ্টি দেহেন না? এর মধ্যে যে শাক পাইছেন এই তো বেশি।’

মুরাদ গজগজ করতে করতে আধা কেজি পুঁইশাক নেয়। পাশেই কয়েকটা কচি জালি কুমড়া। এগুলো চাক চাক করে কেটে ভেজে খেতে খুব মজা। দরদাম করে একটা নিয়ে নেয়। দামটা অবশ্য অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশিই পড়ে যায়। বৃষ্টির দোহাই দিয়ে এরা সব কিছুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিড়বিড় করতে করতে মুরাদ আরও কিছু কাঁচাবাজার করে। হাতে এখন চার পাঁচটা পলিথিনের ব্যাগ। বাজার থেকে বেরোবার মুখে কাঁচামরিচ কিনতে গিয়ে আরেকদফা মেজাজ খারাপ হয়। আড়াইশ টাকা কেজি! মুরাদ আড়াইশ গ্রাম কাঁচামরিচ নেয়। দাম মিটিয়ে খুচরো টাকাটা পকেটে ভরতেই ফোন আসে। সবগুলো ব্যাগ এক হাতে নিয়ে অন্য হাতে মোবাইলটা পকেট থেকে বের করে। বড়ো আপা শাম্মীর ফোন।

‘মুরাদ, তুই কই?’

মোবাইলটা কানে চেপে ধরে মুরাদ বলে, ‘এই তো আপা, বাজারে। কেন, ফোন দিয়েছ কেন?’

শাম্মী আপা এবার উত্তর দেবার গলায় বলে, ‘তোর দুলাভাইয়ের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। একজন ভালো মেডিসিনের ডাক্তার দেখানো দরকার। তুই একটু খোঁজ নিয়ে সিরিয়াল দিলে যেতাম ওকে নিয়ে।’

মুরাদ কিছু বলতে যেয়েও থেমে যায়। মোবাইলে আরেকটা কল ঢুকেছে। একবার স্ক্রিনে তাকাতেই বুক চলকে ওঠে, ফারিয়ার ফোন। ও তাড়াহুড়ো করে বলে, ‘আচ্ছা আপা, আমি জেনে তোমাকে শীঘ্রি জানাব। এখন ছাড়ছি।’

ফোনটা রেখে ও দ্রুত ফারিয়ার নম্বরে ডায়াল করে। কয়েকটা রিং হতেই কেটে যায়। মুরাদ আবার রিং করে। এবারও কেটে যায়। যা ভেবেছিল তাই। ফারিয়া রাগ করে মোবাইল ধরছে না।

অগত্যা মেয়ের নম্বরে ফোন দেয়, ‘পিংকি, তোর মাকে ফোনটা দে তো।’

একটু পরেই ফারিয়ার তীক্ষ্ণ গলা পাওয়া যায়, ‘যার সঙ্গে কথা বলছিলে তার সঙ্গেই কথা বলো। যখনই ফোন করি, ফোন বিজি।’

গত কয়েকমাস ধরে ফারিয়ার এই সমস্যা হয়েছে। নাহ, আরও আগে থেকে। কিন্তু এখন বেড়েছে। সব কিছুতেই সন্দেহ। কোনো কারণে ফোন ব্যস্ত পেলে তো কথাই নেই। প্রথম প্রথম ও ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দিত। কিন্তু দিন দিন এটা সহ্যের সীমার বাইরে চলে গেছে।

মুরাদ স্থান কাল ভুলে চিৎকার করে বলে, ‘সবসময় উল্টোপাল্টা কথা কেন বলো। বড়ো আপা ফোন দিয়েছিল। বিশ্বাস না হলে ওনাকে জিজ্ঞেস করো।’

কথাটা বলে ফোনটা কেটে পকেটে রাখে। খেয়াল করে আশেপাশের মানুষ হা করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মুরাদের কপাল কুঁচকে যায়, ঠোঁট দুটো তীব্র অসন্তোষে বেঁকে যায়। হনহন করে বাসার পথ ধরে। ইচ্ছে হচ্ছে বাজারের ব্যাগগুলো ছুড়ে ফেলে দিতে।

কিছুদূর যেতেই হঠাৎ মনে পড়ে পিংকির খাতা কেনা হয়নি। এদিকে আকাশ আবার কালো মেঘে ঢেকে গেছে। মুরাদ হন্তদন্ত হয়ে লাইব্রেরিতে যায়। দ্রুত দুইশ পেজের দুটো খাতা কিনে একটা রিকশা নেয়। রিকশায় উঠতে না উঠতেই বৃষ্টি নামে। মুরাদ টের পায় ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে। খাতা দুটো যতটুকু পারে ভেতরের দিকে চেপে ধরে যাতে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে না যায়।

বাসায় পৌঁছাতেই মাগরিবের আজান পড়ে। পিংকি দরজা খুলে দিতেই মুরাদ আগে খাতা দুটো ওর হাতে দেয়। তারপর বাজারের ব্যাগগুলো কিচেনের সামনে নামিয়ে রাখে। ফারিয়া ইতোমধ্যে ঘুম থেকে উঠেছে। মুরাদের ইচ্ছে হয় না কথা বলতে।

হাতমুখ ধুয়ে টিভি সেটের সামনে বসে চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে আড়চোখে খেয়াল করে ফারিয়া নাস্তা বানাচ্ছে। ফর্সা গোলগাল মুখটা গম্ভীর। একটা কাঠিন্য সারা মুখে। চুলগুলো কাঁধ পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। একটা সময় এত চুল ছিল যে সামলাতেই পারত না। বয়সের সাথে সাথে অনেকটাই মিইয়ে গেছে সব। এসব নিয়েই কি ওর মনটা এমন খিটমিটে হয়ে থাকে?

একটু পর পিংকি একটা হাফ বাটিতে নুডুলস নিয়ে এসে ওর সামনে রাখে। তারপর বলে, ‘বাবা, আম্মু বলেছে লবন নেই। লবন আনতে হবে।’

মুরাদ এবার বিরক্তি নিয়ে গলা চড়িয়ে বলে, ‘কেন, আমি যখন বাজারে ছিলাম তখন বলা গেল না?’

রান্নাঘর থেকে ফারিয়া ফোঁস করে বলে, ‘সে কথা বলতেই তো ফোন দিয়েছিলাম। দেখলাম ফোন বিজি। বাসার বাইরে গেলেই ফোন বিজি হয়ে পড়ে।’

মুরাদ সবে নুডুলস মুখে দিচ্ছিল। ও থেমে যায়, তারপর কেটে কেটে বলে, ‘তোমার এই অযথা সন্দেহ কবে যাবে? এমন কেনো করো?’

ফারিয়া উত্তর দেয় না। মুখ আরও গম্ভীর করে রান্নার জোগাড় করতে থাকে। পিংকি মাথা নিচু করে নিজের রুমে পড়তে চলে যায়। আম্মু ইদানীং কেমন যেন করে। সারাক্ষণ দু’জনের ঝগড়া লেগেই থাকে।

মুরাদের এখন সবকিছু বিস্বাদ লাগছে। কোনো শান্তি নেই এই ঘরে। নুডুলসটা কোনোমতে খেয়ে আবার বের হয়, লবন আনতে। চায়ের তেষ্টা পেয়েছিল, সেটা আর বলা হয় না।

সেদিন রাতে খাওয়া শেষে মুরাদ বেডরুমে শুয়ে শুয়ে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখছিল। এমন সময় মেয়ের রুম থেকে কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেতেই ও উঠে আসে।

পিংকির তীক্ষ্ণ গলা পাওয়া যায়, ‘আমার মোবাইল নিচ্ছ কেন?’

ফারিয়া চোখে আগুন নিয়ে বলে, ‘কেন নিচ্ছি বোঝ না? রাত জেগে বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করবে, আমি বুঝি না? রাতের বেলা মোবাইল আমার কাছে থাকবে।’

মুরাদ রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে বিরক্তির গলায় বলে, ‘ওর মোবাইলে আবার কী সমস্যা?’

ফারিয়া ঘুরে তাকায়, ‘খবরদার তুমি কোনো কথা বলবে না। নিজে তো নষ্টামি করে বেড়াও এখন মেয়েটাও বিপথে যাচ্ছে।’

পিংকি এবার ফুঁপিয়ে বলে, ‘আম্মু শুধু শুধু আমাকে সন্দেহ করে। আমি কলেজের গ্রুপে পড়াশোনা নিয়ে একটু কথা বলি, আর কিছু না।’

ফারিয়া ফোঁস করে ওঠে, ‘পড়াশোনা নিয়ে কথা বলো নাকি কী নিয়ে কথা বলো জানা আছে আমার। এখন থেকে রাতে মোবাইল আমার কাছে থাকবে।’

মুরাদের মন খারাপ হয়। ফারিয়া এখন মেয়ের সঙ্গেও যা তা ব্যবহার করছে। মেয়ের যে টিন এজ বয়স চলছে সেটা মাথায় নেই।

মুরাদ ভেতরে ঢোকে, তারপর বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘মা, ইন্টারমিডিয়েট-এ কিন্তু পড়ার চাপ অনেক। আম্মু যেটা করেছে সেটা তোমার ভালোর জন্যই করেছে।’

পিংকির চোখমুখ লাল হয়ে আছে৷ একটা একরোখা ভাব চোখেমুখে। ইতোমধ্যে ফারিয়া ওর মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেছে।

মুরাদ বেডরুমে ঢুকে কপাল কুঁচকে বলে, ‘মেয়ে যে বড়ো হয়েছে এটা বোঝ? ওর হাত থেকে অমন করে মোবাইল কেড়ে নিলে কেন?’

ফারিয়া চোখ পাকিয়ে বলে, ‘তুমি বেশি বোঝ? সেদিন আমি দেখেছি ও একটা ছেলের সঙ্গে মেসেঞ্জারে কথা বলছে। কখন কী করে ফেলবে তার ঠিক আছে।’

মুরাদ থমকায়। তারপর বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে বলে, ‘সেটা বুঝলাম। কিন্তু এই বয়সটা ভালো না। অল্পতেই ভীষণ অভিমান হয়। তাতে করে সুইসাইড করে ফেলতে পারে।’

ফারিয়া কেমন অসুস্থ মানুষের মতো হাসে। তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, ‘তোমরা বাবা মেয়ে যা শুরু করেছ তাতে আমিই সুইসাইড করব।’

মুরাদ টের পায় ওর আবার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। কিছু হলেই সুইসাইডের হুমকি দেয়। বিয়ের সেই প্রথম থেকেই এটা দেখে আসছে। এই একটা ব্যাপার ও ভীষণ ভয় পায়। সারাক্ষণ মনের ভেতর একটা টেনশন কুড়ে কুড়ে খায়। এখন দুটো টেনশন যোগ হয়েছে। পিংকিও যদি রাগ করে কিছু করে ফেলে?

মুরাদ নরম গলায় বলে, ‘আমি ওকে বুঝিয়ে বলব। তুমি ওকে নিয়ে এত টেনশন কোরো না। এই বয়সে এক আধটা প্রেম হয়। আবার সময়ের সাথে সাথে সেটা কেটেও যায়। ওর মাথায় পড়াশোনার গুরুত্বটা ঢুকিয়ে দিতে হবে। ভালো কোথাও পড়ার সুযোগ পেলে জীবন কেমন করে পাল্টে যাবে সেই স্বপ্ন দেখাতে হবে। তাহলে দেখবে ও আর কোন ভুলভাল করবে না।’

ফারিয়া কোনো উত্তর দেয় না। চুপ করে বসেই থাকে। মুরাদ আজ নিজেই বিছানা করে ডাকে, ‘আসো, ঘুমিয়ে পড়ো।’

ফারিয়া উঠে দাঁড়ায়, ‘আমি পরে ঘুমাব।’

সেদিন রাতে একটু পর পর মুরাদের ঘুম ভেঙে যায়। আর যতবারই ঘুম ভেঙ্গে যায় ততবারই একবার করে মেয়ের রুমে উঁকি দিয়ে আসে।

২.
‘কী রে, এখনও বের হোস নি?’
তাবাসসুমের রিনরিনে গলায় মুরাদ মাথা তুলে তাকায়। নিজের টেবিলে বসে ঝিমোচ্ছিল। অফিস ছুটি হয়ে গেছে অনেক আগেই। ওর মতো এক দুজন এখনও রয়ে গেছে। তাবাসসুম ওর মতোই এই ওষুধ কোম্পানির একজন ম্যানেজার। পাশাপাশি রুমেই বসে।

মুরাদ মাথা নাড়ে, ‘এই তো যাব।’

তাবাসসুম ওর সামনে এসে বসে। তারপর ভ্রু কুঁচকে বলে, ‘তোর কী হয়েছে? সেই সকাল থেকেই মুড অফ দেখছি? বউয়ের সঙ্গে আবার ঝগড়া হয়েছে?’

ফারিয়ার ব্যাপারটা তাবাসসুমের সঙ্গে শেয়ার করেছিল। মানে করতে হয়েছিল। অফিসের প্রয়োজনে প্রায়ই তাবাসসুমকে ফোন করতে হতো। আর ফারিয়া এটা কিছুতেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারত না। শেষ পর্যন্ত ওকে অনুরোধ করতে হয়েছে যাতে বাসায় থাকলে ওকে ফোন না দেয়।

মুরাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ‘হুম। আচ্ছা বল তো একজনকে সারাক্ষণ এমন করে খোঁচালে সে বাঁচে কী করে?’

তাবাসসুমের মায়া হয়। আট বছর ধরে ওরা একসাথে কাজ করছে। মুরাদকে কখনও উল্টোপাল্টা কিছু করতে দেখেনি।
ও ধারালো গলায় বলে, ‘তুই অমন ছেড়ে দিস কেন? কড়া গলায় কিছু বলতে পারিস না?’

মুরাদ হতাশ গলায় বলে, ‘কড়া করে কিছু বলতে গেলে খালি সুইসাইডের হুমকি দেয়। আর এই বিষয়টা আমি ভীষণ ভয় পাই। কী করি বল তো? কেন আমার সঙ্গে এমন করে?’

তাবাসসুম একটা নিশ্বাস ফেলে বলে, ‘তোর এই সমস্যাটা আমার কাছে আজব লাগে। আচ্ছা মুরাদ, সত্যি করে বল তো, তুই কোনো আকাম করে বউয়ের হাতে ধরা পড়িসনি তো?’

মুরাদ এবার হাসে, তারপর কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলে, ‘কী যে বলিস। করলে তো তোর সঙ্গেই করতাম।’

তাবাসসুমের গালটা একটু লাল হয়। ও চোখ পাকিয়ে বলে, ‘তাই, না? চল ওঠ। বাসায় যা। বউকে বেশি করে সময় দিবি। দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মুরাদ মাথা নাড়ে, ‘হুম। আমার পরিস্থিতিতে পড়লে বুঝতি। আচ্ছা থাক সে কথা। ট্যুরের সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছিস তো?’

অফিসের কাজে সামনের সপ্তাহেই ওদের একসঙ্গে সিলেট যাবার কথা। তাবাসসুম উত্তর দেয়, ‘হ্যাঁ, আমি গাড়ি রিকুইজিশন দিয়েছি। তোকে বাসা থেকে তুলে নেব।’

মুরাদ জোরে মাথা নাড়ে, ‘আমি অফিস আসব ওইদিন। অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে আমিই তোকে তুলে নেব।’

তাবাসসুম উত্তর দিতে যেয়েও থেমে যায়। ওর বাসায় আসা মানে উলটো পথে আসা। আহারে বেচারা, বউয়ের ভয়ে এমন করতে হচ্ছে!

তাবাসসুম ওকে আশ্বস্ত করে বলে, ‘আচ্ছা, তুইই আসিস। আমার সমস্যা নেই।’

মুরাদ ব্যাগ গুছিয়ে বলে, ‘চল, নামি।’

গাড়িতে উঠে একটা কথা মনে হয়, ইদানীং ওর বাসায় ফিরতেই ইচ্ছে করে না। ফারিয়ার জন্য মনটা বিষিয়ে উঠেছে।

সেদিন রাতে খাওয়ার পর ট্যুরের কথাটা বলতেই ফারিয়া সন্দিগ্ধ গলায় বলে, ‘কাকে নিয়ে যাচ্ছ?’

মুরাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়, ‘কাকে নিয়ে যাচ্ছি মানে?’

ফারিয়া মুখ গম্ভীর করে মশারী করে। তারপর বাতি নিভিয়ে দেয়। অন্ধকারে চুপচাপ কিছুক্ষণ বিছানায় বসে থাকে। তারপর কেমন একটা গলায় বলে, ‘আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি সিলেটে কাউকে সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছ অথবা ওখানে কারও সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছ।’

মুরাদ টের পায় মাথায় রক্তচাপটা বেড়ে যাচ্ছে। কপালের দুইপাশ কেমন দপদপ করছে। রাগী গলায় বলে, ‘তুমি সবকিছু নিয়ে এমন বাজে কথা কেন বলো? সমস্যা কী তোমার? কোনোদিন আমার উল্টাপাল্টা কিছু দেখেছ?’

ফারিয়া ঠান্ডা গলায় বলে, ‘দেখিনি। কিন্তু আমি টের পাই তোমার মধ্যে কোনো না কোনো ঝামেলা আছে। শোনো মুরাদ, একবার যদি প্রমাণ পাই আমি সেইদিনই এই বাসা ছেড়ে চলে যাব। না হয় সুইসাইড করব। আর মরার আগে তোমার নাম লিখে যাব।’

মুরাদ টের পায় ওর কেমন যেন শীত শীত লাগছে। রাগটা গিলে ফেলে। গম্ভীর গলায় বলে, ‘ফারিয়া, কথায় কথায় এই কথা কেন বলো? মেয়ে বড়ো হয়েছে। ওর সামনেও ইদানীং এসব বলো। একদিন দেখবে তোমার মেয়ে তোমাকে এই হুমকি দেবে।’

কথাটায় কাজ হয়। ফারিয়া আর কোনো উত্তর দেয় না। ওর দিকে পিঠ দিয়ে শুয়ে থাকে। মুরাদ একবার তাকিয়ে কোলবালিশ টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ে।

কিছুক্ষণ পর ফারিয়া হঠাৎ উঠে বসতেই মুরাদ চোখ কুঁচকে তাকায়। তারপর বিরক্ত গলায় বলে, ‘কী হলো, উঠে পড়লে কেন? ঘুমাবে না?’

ফারিয়া হিসহিসিয়ে বলে, ‘তোমার তো খালি ঘুম। বউকে আদর করতে ইচ্ছে করে না? আমি না বললে তো ইদানিং আমাকে ছুঁয়েও দেখো না। কার সাথে তোমার সম্পর্ক তাই বলো। অসভ্য লোক একটা।’

মুহুর্তেই মুরাদের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, ‘আদর ব্যাপারটার সঙ্গে মন জড়িয়ে থাকে। তুমি সারাক্ষণ এমন ঝগড়া করবে আর আমি তোমাকে রাত হলে আদরের জন্য টেনে নেব?’

ফারিয়া তীব্র শ্লেষের গলায় বলে, ‘আমাকে টেনে নিতে হবে না। যার পাল্লায় পড়েছ তারে টেনে নিও। আমি এই সংসারেই থাকব না।’

কথাটা বলেই ফারিয়া দুই হাতে মশারীটা হ্যাঁচকা টানে উঠিয়ে খাট থেকে নেমে পড়ে। তারপর এলোমেলো পায়ে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসে থাকে।

মুরাদ ঘড়ির দিকে তাকায়। রাত পোনে একটা। কাল সকালে অফিস আছে। কিন্তু ঘুমাবে কী করে? ফারিয়ার রাগ না কমা পর্যন্ত ওকেও জেগে থাকতে হবে। দুই দিন পর পর এই অশান্তি আর ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে সব অশান্তি শেষ করে দিতে।

মুরাদ উঠে বসে। গলা বাড়িয়ে ডাইনিং-এর দিকে তাকায়। ফারিয়ার পা দেখা যাচ্ছে।পায়ের আঙুলগুলো কেমন সাদা টাইলস খামচে ধরে আছে।

রাত বাড়ে। মুরাদ ঢুলুঢুলু চোখে ফারিয়ার ফেরার অপেক্ষায় বসে থাকে। আর ফারিয়া কেমন শুন্য চোখে ডাইনিংয়ের সিলিংয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

(চলবে)

মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান সুবাস
শিমুলতলী, গাজীপুর
০৬/০৭/২৪