কালো কুচকুচে রঙের একটা জ্যাকেট গায়ে জড়িয়ে এক যুবক তীক্ষ্ণ চোখে আয়নার দিকে তাকালো। কি যেন ভেবে সে মুচকি হেসে একটা কালো মাক্স আর কালো সানগ্লাস দিয়ে নিজের পুরো মুখটা ঢেকে ফেলল। পরপর কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘড়ির দিকে চোখ রাখলো সে। ঘড়িতে রাত দুটো বেজে পনেরো মিনিট।
ছেলেটা আর দাঁড়ালো না আলিশান বাড়ির উঁচু দেয়াল টপকে বাহিরে চলে এলো সে। চারপাশে সর্তকতার দৃষ্টি বুলিয়ে ছেলেটি সামনে আগালো। সামনে এগোতেই একটা কালো বিএমডাবলিউ গাড়ি তার জন্যই দাঁড় করানো ছিলো। ছেলেটা আবারো পিছনে ফিরে ভালো করে দেখে নিলো। পিছনে সবকিছু স্বাভাবিক দেখে ছেলেটি গাড়িতে উঠে পড়লো।
খানিকবাদেই সে পৌঁছে গেল এক পোড়া বাড়িতে। চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার, নিস্তব্ধ। পরিবেশ এতটাই নিস্তব্ধ যে সামান্য টু শব্দ হলেও ভয়ংকর আওয়াজ হয়ে শোনা যাবে।
ছেলেটা গাড়ি থেকে নেমে বাড়িটির ভিতরে ঢুকলো। বাড়ির ভিতর ঢুকতেই একটা মেয়ের চাপা কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। ছেলেটা একটা রহস্যময় হাসি দিয়ে পাশে থাকা চেয়ারটা বা পা দিয়ে নিজের সামনে এনে পায়ে পা রেখে জমিদারি ভাব নিয়ে বসলো।
কিছু ছেলে সঙ্গে সঙ্গে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো সেই যুবকটির সামনে। যুবকটি বেশ গম্ভীর কন্ঠে বলল
“কিছু বলেছে?”
যুবকটি ডান হাতের দুই আঙুল কপালে ঘষতে ঘষতে বলল
“এই মেয়ে কি আমাকে চেনে না! চিনলে এতক্ষণ বলে দিতো। সে যাইহোক আমি দেখছি তোমরা বাহিরে যাও।”
যুবকটির কথা বলতে দেড়ি ছেলেগুলোর চলে যেতে দেড়ি হলো না। যুবকটি চেয়ার থেকে উঠে মেয়েটির কাছে এগিয়ে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
“যা জানিস ভালোই ভালোই বলে দে।”
মেয়েটা ক্লান্ত দৃষ্টিতে যুবকটির দিকে তাকালো। অন্ধকার একটা সুঠাম দেহের পুরুষের অবয়ব ছাড়া তেমন কিছুই চোখে পড়লো না মেয়েটির।
যুবকটি এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। মুহুর্তেই রাগে গর্জে উঠে মেয়েটার চোয়াল চেপে ধরে বলল
“বলবি না মরবি!”
মেয়েটা আর সময় না নিয়ে গড়গড় করে সব বলে দিলো। যুবকটি এক রহস্যময় মুচকি হাসি দিয়ে জিন্সের পকেট থেকে গান বের করে মেয়েটার কপালে পরপর দুটো গুলি করে দিলো।
এই নিস্তব্ধ পরিবেশে গুলির আওয়াজগুলো যেন বিকট শব্দে বাজতে বারবার। যুবকটি হুংকার দিতেই কিছু ছেলে এসে মেয়েটির লাশ নিয়ে গেল।
————————-
সারা বিছানায় টিস্যু আর চকলেটের খোসা ফেলে রেখে কান্না করছে শুভ্রতা। তার দফা এক দাবি এক সে কলেজ থেকে আসার সময় ব্যাগে করে যে বিড়াল ছানা নিয়ে এসেছিলো সেটা তাকে ফিরিয়ে এনে দিতে হবে।
কিন্তু তার মা তাতে নারাজ। একে তো শুভ্রতা আর রুহিকে সামলাতে সামলাতে তার দিন যায়। তার উপর বিড়াল কোনোদিনও না। (রুহি শুভ্রতা বড় ভাই অভ্রের মেয়ে।)
শুভ্রতা রিতিমতো নেকা কান্না শুরু করে দিয়েছে। শুভ্রতা কান্না করছিলো তখন ছোট ছোট পা নিয়ে ছুটে শুভ্রতার কাছে এলো রুহি। শুভ্রতাকে এমন ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কান্না করতে দেখে রুহি কিছুসময় চুপ থেকে হুট করেই ফিক করে হেসে দিলো।
শুভ্রতা আড়চোখে রুহির দিকে তাকাতেই রুহি দমে গিয়ে বেডে উঠার চেষ্টা করতে করতে বলল
“ফুপি আরও একটু কান্নু করো। তাহলেই বুবু মেনে যাবে।”
শুভ্রতা রুহিকে বেডে টেনে তুলে হিসহিসিয়ে বলল
“তুইও শুরু কর। আমি কেন একলা আমার এনার্জি খোয়াবো কেন রেএ।”
রুহি ফিসফিসিয়ে বলল
“তাহলে শুলু করবো বলছো।”
“হুম হুম শুরু কর।”
রুহি মুচকি হেসে ভে ভে শুরু করলো।
রুহিকে কান্না করতে দেখে ওর মা দিয়া দৌড় এলো শুভ্রতার রুমে।
শুভ্রতা দিয়াকে দেখে ঠোঁট উল্টে বলল
“ভাবি আম্মুকে বলো না আমার মিনিকে নিয়ে আসতে।”
দিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার আর কিছুই বুঝতে বাকি রইলো না।
রুমা বেগম হাতে খুনতি নিয়ে হাজির হলো শুভ্রতার রুমের সামনে। বিরক্তি তার চোখে মুখে স্পষ্ট। রুমা বেগম গম্ভীর কন্ঠে বললেন
“যা বাগানে রেখে এসেছে নিয়ে আয়। তাও এমন করে মাথা খাস না। নিজে তো খারাপ হচ্ছে সঙ্গে নিয়ে আমার নাতনিকেও খারাপ করছে।”
বলেই হনহনিয়ে চলে গেলেন রুমা বেগম।
রুমা বেগম যেতেই শুভ্রতা আর রুহির ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। দিয়া ওদের হাসতে দেখে নিজেও হেসে চলে গেল। দিয়া যেতেই ওরা দুইজন ছুটে গেল বাগানের দিকে।
বাগানে গিয়ে দেখলো বিড়াল ছানাটা গুটিসুটি হয়ে বসে আছে আম গাছের নিচে। রুহি সেটা প্রথমে দেখে ছুটে গেল আম গাছের দিকে। বিড়াল ছানাটাকে বুকে জড়িয়ে আদর করতে লাগল।
শুভ্রতা মুচকি হেসে রুহিকে কোলে তুলে নিলো। রুহি বিড়ালছানাকে আদর করতে ব্যস্ত।
,,আজব সকাল সকাল কি বুজরুকি শুরু করেছিস।আমাকে ঘুমাতে দে ভাই,এসবে আমার কোনো ধারনা নেই,আমি কি জীবনে প্রেম করছি নাকি।
,,দেখ মাত্র দুইদিন হইলো মিতার সাথে প্রেম করা শুরু করেছি, ও বলেছে যদি ভালো প্রেমিক না হতে পারি আমাকে ড্রেনের পানিতে চুবিয়ে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে নিবে!
,,এই তোদের দুইটার ফালতু প্রেম কাহিনি শুনাবি না আমাকে,ফ্রেন্ড হইয়াই তো দুইটার জীবনে ঝ গড়া থামেনি এখন কি করে আবার প্রেম আসবে,আমি ঘুমাবো ভাই নিজেদের টা নিজেরা সামলা না হয় ব্লক মেরে দিবো দুইটাকে!
,,শোন শোন আরেকটা কথা ছিলো।
ফিহা বিরক্তি নিয়ে বলে
,,আচ্ছা বল।
,,তুই আজকে ভার্সিটি আসবি না,আমি আর মিতা আসবো তোরে নিতে।
,,আমার বাসা তুই চিনিস?আসবি কি করে?
,,যদি আন্দাজ ঠিক হয় তো ঠিক পৌঁছে যাবো।
,,যা খুশি কর।
ফিহা বিরক্তি নিয়ে বসে আছে,প্রত্যেয় ওর কথা বলার সময় উঠে গেছে এভাবে বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করে
,,কি সমস্যা?
,,কিছু না, ওই মিতা আর সৌরভ প্রেম করছে এখন আমার কাছে টিপস চায়।সকাল সকাল বিরক্ত করা ছাড়া আর কিছু পারে না এই ছেলে।আবার বললো তোর বাসায় আসতেছি তোকে নিয়ে যাবো।
,,কিহ্!
,,হ্যাঁ এতো অবাক হওয়ার কি আছে,আর আসতে পারবে নাকি সন্দেহ বাসার এড্রেসই তো কোনো দিন বলি নাই ওদের। দুইটার মাথার তার আগেই ছিঁড়া ছিলো এখন তো আবার করে প্রেম এবার পাবনার টিকিট বুক করতেই হবে।
,,সত্যি ওরা প্রেম করে?
,,হুম
,,ওকে চলো তাহলে আজ দুজন মিলে ওদের জন্য নাস্তা বানাবো!
ফিহা অবাক হয়ে বলে
,,ওরা বাসাই তো চিনে না, মজা করেও তো বলতে পারে নাকি।আপনি সিউর হচ্ছেন কিভাবে?
প্রত্যেয় উত্তর না দিয়ে ফিহার হাত ধরে ফ্রেশ হতে চলে যায়।ফিহা ভেংচি কাটে এই ছেলে যে কোনো প্রশ্নের জবাব ভালো ভাবে দিবে না তা জানা আছে ফিহার।
—–
সকাল নয়টা কলিং বেল বেজে উঠায় ফিহা যায় দরজা খুলতে, প্রত্যেয় গেছে ফ্রেশ হতে।ফিহা দরজা খুলতেই এক মেয়ে এসে দাঁড়ায় দরজায়।
ফিহা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে
,,কাকে চাই?
মেয়েটি যেনো ভুত দেখার মতো চমকেছে,প্রত্যেয়ের বাসায় মেয়ে আসলো কোথা থেকে!মেয়েটা চিল্লিয়ে বলে
,,এই মেয়ে তুমি কে?এখানে কি করছো?প্রত্যেয় কোথায়?
,,উনি তো ভিতরে আপনি কে আগে বলুন।যাকে তাকে বাসায় ঢুকতে দিবো না আমি!
,,তোমার সাহস তো কম না, আমাকে ঢুকতে দিবে না মানে।জানো আমি কে?
,,না ওইটাই জানতে চাচ্ছি তখন থেকে।বলুন আপনি কে?
,,প্রত্যেয়ের হবু স্ত্রী!
,,আর আমি প্রত্যেয় বিয়ে করা স্ত্রী!
,,এই মেয়ে কি ধরনের মজা এটা, সরো সামনে থেকে।ফিহা কে পাশ কাটিয়ে মেয়েটা ভিতরে ঢুকে পড়লো, প্রত্যেয় বের হলো তখন মেয়েটি দেরি না করে গিয়ে প্রত্যেয়কে জড়িয়ে ধরলো।আকষ্মিক ঘটনায় প্রত্যেয় অবাক হলো ফিহা তো তাকে এখনো জড়িয়ে ধরা অব্দি যায়নি তাহলে কে,ফিহাকে সে ভালো করেই চিনে।এতো ভাবনার মধ্যে চোখ পড়ে দরজার সামনে,ফিহা রাগে লাল হয়ে গেছে,প্রত্যেয় বুঝলো ভুল কিছু হচ্ছে।
ফিহা দরজা ঠা স করে লাগিয়ে এসে রুমে চলে গেলো হন হন করে।
প্রত্যেয় নিজের থেকে মেয়েটিকে সরায় এক ঝটকায়। নিলা কে দেখে মেজাজ খারা প হয়ে ওর,এই মেয়েটার জ্বা লায় শেষ, এখন বাসায় চলে এসেছে না জানি কি কি বলেছে ফিহাকে এই মেয়ে।
প্রত্যেয় নিলাকে ধ মক দিয়ে বলে
,,কি ধরনের অভদ্রতা এগুলো,তোমার সাহস তে কম না আমাকে জড়িয়ে ধরেছো কেনো?সীমা অতিক্রম করতে মানা করেছিলাম তোমাকে।
নিলা মৃদু কেঁপে উঠে আওযাজে,ওই মেয়েটা কি বলছিলো প্রত্যেয় ও নাকি তোমার বউ?
,,হ্যাঁ ঠিকই বলেছে।তাতে তোমার কি সমস্যা?
,,তুমি তো সবই জানো আমি তোমাকে ভালোবাসি,খালামনি তোমার সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে,আর তুমি এই মেয়েটা কে বিয়ে করে নিয়েছো!
,,আমি তো তোমাকে কোনো দিন বলিনি যে আমি বিয়েতে রাজি,আগ বাড়িয়ে উল্টা পাল্টা ভেবে নিয়োছো, এখন এসে সিনক্রিয়েট করছো।সরো সামনে থেকে।
প্রত্যেয় গেলো রুমের দিকে,ফিহা বো*ম হয়ে বসে আছে
প্রত্যেয় নরম গলায় ডাকলো
,,ফিহু।
,,আপনি এ কারনেই আপনার বাবা মাকে বিয়ের কথা জানাননি তাই তো?আপনি আমাকে কেনো বিয়ে করেছেন? যদি ওই মেয়েটাকে বিয়েই করার ছিলো আমার সাথে মিথ্যা অভিনয় কেনো করলেন প্রত্যেয়?
,,ফিহা কি বলছো এসব অভিনয় কেনো করতে যাবো?আমি তোমাকে ভালোবাসি!তাই বিয়ে করেছি।
এর আগে প্রত্যেয় একবারও ভালোবাসার কথা বলেনি ফিহাকে।ফিহা চমকে উঠলো কিছুটা,প্রত্যেয় এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো তাকে
,,এভাবে রাগ করছো কেনো?অন্য কারো সাথে সহ্য করতে পারছো না আমাকে?
,,না!পারছি না,পারবোও না।ওই মেয়েটা আপনাকে জড়িয়ে কেনো ধরবে,আপনি তো শুধু আমার ও কেনো তাহলে,,,
ফিহা আর কিছু বলতে পারলো না,ফুপিয়ে ফুপিয়ে কান্না করে দিয়েছে।প্রত্যেয় জানে ফিহা তাকে ভালোবাসে, এই পৃথিবীতে ওর আপন বলতে প্রত্যেয়ই আছে,ওকে কারো সাথে দেখলেও মনে হয় ফিহার বুঝি কেউ নেই।একাকিত্বের ভয়টা ঝেকে বসে মনে।এইধরনের মানুষের যে জিনিসটা নিজের তার এক ফোঁটাও অন্যকে সে দিতে নারাজ।
প্রত্যেয় ফিহাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলো।ফিসফিস করে বললো
,,বউ আমার এভাবে কাঁদলে কিন্তু আমার এখনই প্রেম প্রেম পেয়ে যাবে পরে কিন্তু আর বাঁধা দিতে পারবে না।
,,,,,
এতোকিছুর মাঝে দরজা লক করতে ভুলে গেছে ফিহা।সৌরভ, মিতা এসে হুড়োহুড়ি করে ঢুকলো ভিতরে, সৌরভ তো শতভাগ নিশ্চিত ফিহার জামাই তার নিজের ভাই আজ তো সে হাতে নাতে ধরবেই।
সৌরভ বাসায় ঢুকে প্রত্যেয়ের রুমের সামনে নিলা কে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অবাক হয়, এই আপ দ এখানে আসলো কেন?কি দেখছে এমন করে রুমের ভিতর!
মিতা সৌরভ দরজায় উঁকি মারলো,মিতা তো চোখ বড় বড় তাকিয়ে আছে,
ফিহা আর প্রত্যেয় ভাইয়া এক সাথে!চোখে কি কম দেখা শুরু করেছে নাকি?মিতা কনুই দিয়ে গুঁতো মারে সৌরভ কে।সৌরভ দাঁত কেলিয়ে বলে
,,দেখলি তো আমার কথাই ঠিক।এদের রোমান্স বের করছি আমি।
সৌরভ চেচিয়ে বলে
,,এই ভাইয়া তুমি বিয়ে করে বউ নিয়ে তিন বেলা রোমান্স করছো আর আমাদের একবার জানানোর প্রয়োজন ও মনে করোনি?
নিলা তো প্রত্যেয় ফিহা কে এক সাথে সহ্যই করতে পারছে না,ন্যাকা কান্না করে মোবাইল হাতে ফোন লাগালো তার খালামনিকে।
,,খালামনি তোমার ছেলে বিয়ে করে নিয়েছে,তুমি জলদি আসো,এর একটা বিহিত করো।
মিতা আটকাতে গিয়েও ব্যার্থ এখন যদি ওর খালামনি এখানে চলে আসে তো সব ঘেঁটে যাবে।এই মেয়েটা এমন কেনো।বিরক্ত নিয়ে গিয়ে বসলো সোফায়।
ফিহা এগিয়ে এসে সৌরভের সামনে দাঁড়ায় ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে
,,তোরা উনাকে চিনিস?
,,চিনবো না আবার, একই মায়ের পেটের ভাই।কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আমাকে চিনবেই না বউ পেয়েছে না।
তীব্র অভিমান সৌরভের কথায়।প্রত্যেয় নির্বাক, শান্ত হয়ে বসে আছে।
ফিহা এগিয়ে যায় প্রত্যেয়ের দিকে
,,আপনি বলেননি কেনো সৌরভ আপনার ভাই?
ফিহা কিছুটা ভাবুক হয়ে আবার বলে
,,ওহ এই জন্যই বুঝি ভার্সিটিতে আমাকে রেখে একদম ভুতের মতো উবে যেতেন!কথা বলছেন না কেনো এখন?
ডাকা*তের মতো বিয়ে করে এখন চুপচাপ বসে আছে, সৌরভ তোর ভাইকে নিয়ে চলে যা তো এটাকে এখন আমার একদম সহ্য হচ্ছে না!
সৌরভ বলে উঠে
,,আব্বু তো ভাইয়াকে মে*রে আকাশে পাঠিয়ে দিবে সে ভয়ে হয়তো লুকিয়ে বিয়ে করেছে।তাই না ভাইয়া?
প্রত্যেয় রাগী চোখে তাকায় সৌরভের দিকে
,,কারা যেনো প্রেম করছে,প্রেম প্রেম গন্ধ ছড়িয়েছে বলবো নাকি আব্বু কে হাওয়া সব বের হয়ে যাবে!
,,থ্রে ট দিচ্ছো তো দাও একবার আম্মু আসুক আজকে।
,,,এরই মধ্যে কলিং বেল আবার বেজে উঠলো নিলা ছুটে গিয়ে দরজা খুললো,বাকি সবাই সোফায় বসে আছে।
রুমে ঢুকেই চেচিয়ে উঠলেন সীমা বেগম
,,প্রত্যেয়ের এতো বড় সাহস বিয়ে করবে না করবে না করে একদম বিয়ে করে সংসার করছে তাও আমাকে কিছু জানায়নি আজ ওর এক দিন কি আমার একদিন।
ফিহা কে আগে থেকেই চিনতেন সীমা বেগম সৌরভের বন্ধু হিসাবে,তিনি ড্রয়িং রুমে উপস্থিত সবাইকে দেখলেন একবার,আবার বললেন
,,বউটা কোথায়?রুমে কি ঘাপটি মেরে বসে আছে নাকি,আজ দুটোকে ধরে দিবো আমি।আমাদের বললে কি বিয়ে দিতাম না নাকি!
এই মিতা,ফিহা বলতো ওর বউ কোথায় যা ধরে নিয়ে আয়।
ফিহা তো হাত কচলাচ্ছে বসে বসে। মিতার দিকে তাকালো সে কাচুমাচু হয়ে।এর মধ্যে নিলা বলে উঠলো
,,আন্টি তুমি বউ কে চোখে দেখতে পাচ্ছো না এখানেই তো আছে!
সীমা বেগম বললেন
,,এখানে তো সৌরভ আর ওর ফ্রেন্ড ছাড়া কেউ নাই।
,,ফিহা নামক মেয়েটাই তো তোমার ছেলের বউ!
,,কিহ্!!
সৌরভ ওর মাকে টেনে নিয়ে সোফায় বসায়,পানি খেতে দেয়।সীমা বেগম কিছুটা শান্ত হয়।
,,প্রথম থেকে সব বল আমায় কি হয়েছে?
,,সৌরভ সব গড়গড় করে বলে দিলো এই মুহুর্তে ভাইকে না বাঁচালে, ওর নিজের প্রেম করার সিক্রেট যে ফাঁস করে দিবে তা ভালো করেই জানে।
ফিহা মাথা নিচু করেই বলে
,,আন্টি বিশ্বাস করো আমার কোনো দোষ নাই।আমি তো জানতামই না এই দজ্জা ল মার্কা পোলাটা তোমার!
,,আজ আসুক তোর বাপ! উনি যা বলবেন তাই হবে বেশি বাড় বেড়েছে তোর প্রত্যেয়।
,,আব্বুকে ডাকার কি দরকার ছিলো আম্মু।
,,এখন গলার স্বর কমে গেছে কেনো, অফিস থেকে আসছে তোর আব্বু,ফিহার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই,ওর মতো একটা ভদ্র শান্তশিষ্ট মেয়েকে যে তোর মতো একটা রাম ছা*গল কিভাবে বিয়ে করেছে তা তো বুঝতেই পারছি,না হয় সজ্ঞানে তোরে কে বিয়ে করতো!
নিলা বলে উঠে
,,আমি করতাম আন্টি!
,,এই চুপ কর তো নিলা।তোদের এই বিয়ে বিয়ের চক্করে আমার বি পি হাই হয়ে যাচ্ছে!
বাসায় প্রবেশ করেন তাজরুল চৌধুরী, ছেলের কর্মকান্ড শুনে বিশ্বাসই করতে পারছেন না তিনি।তার এই ছেলে এরকম করেছে বিশ্বাস হচ্ছে না সৌরভ হলেও তিনি বুঝতেন ওটা একটু দুষ্টু প্রকৃতির। মাথায় হাত তার নিজেরও।কিছুক্ষণ পর আসলো ফিহার মা সবাই মিলে বেশ কিছুক্ষণ আলোচনা করার পর সব কিছু মেনে নেওয়া হলো।তবে একটাই শর্ত সীমা বেগমের, ছেলের বউ নিয়ে তিনি বাসায় চলে যাবেন।প্রত্যেয় না করতে গিয়েও পারেনি,মা বেকে বসলে তার কপালেই শনি আছে।তাই সব কিছর ঝা মে লা মিটিয়ে বিকেলের মধ্যে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে উঠলো ওরা।এতোটা দ্রুত সব কিছু ঘটেছে,যে ফিহা এখনো ঘোরের মধ্যেই আছে।
,,,,,,
দিন গুলো সুন্দর ভাবেই কাটছিলো ফিহার,যতদিন না সাদাব নামক কালো ছায়া আবার ফিরে আসে।প্রত্যেয়ের বাড়িতে যাওয়ার পর একমাস কেটেছে হেসে খেলে।বেলায়েত খন্দকার ও মেনে নিয়েছে সব কিছু শুধু মেয়ের জামাইকে মানতে পারেনি এখনো,বিয়ের প্রস্তাব দিলে তিনি ফিরিয়ে দিতেন না তিনি ওতোটাও কঠোর তো নন।
সেদিনের মতো ভার্সিটি থেকে ফিরছিলো ফিহা আজ সৌরভ মিতা ডেইটে গেছে দুটোর মাঝে হাড্ডি হতে চায়নি সে,প্রত্যেয়ও অফিসে তাই আর তাকেও বলেনি,একাই যাচ্ছে আজ কোথা থেকে সাদাব এসে সামনে দাড়ালো
ফিহা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো,দু কদম পিছিয়ে গেলো সে।
সাদাব হেসে বললো
,,কেমন আছো ফিহা?অনেক দিন পর দেখছি তোমায়!
,,এ ই তো ভালো আছি!আপনি কেমন আছেন?
,,তা জানা বেশি জরুরি না।তা বিবাহিত জীবন কেমন চলছে?
,,ভালো।আমি এখন বাসায় যাবো দেরি হয়ে যাচ্ছে।
,,এতো পালাই পালাই করো কেনো?আমার সাথেও কিছু সময় থাকো!
,,না।রাস্তা ছাড়ুন আপনার সাথে আমার কথা সেদিনই শেষ হয়ে গেছে এখন আর বলার মতো কিছু নাই।আমি আমার স্বামীর সাথে ভালো আছি।
সাদাব ফিহার হাত টেনে ধরলো,ফিহা আঁতকে উঠলো হাত ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি শুরু করে দিলো।
,,ছাড়ুন বলছি
,,না ছাড়বো না কি করবি তুই?তোকে তো কবেই আমি শেষ করে দিতাম, প্রত্যেয়টা মাঝখান থেকে এসে সব প্ল্যান বেস্তে দিলো।তোর বাপের জন্য আমার বাপের জেল হয়েছে, তোর বাপকে তো একটা না একটা শা স্তি দিতেই হবে,নিজের মেয়ের সম্মানের বিনিময়ে তাকে এর মূল্য দিতে হবে।ওইদিন তো খুব নিখুঁত পরিকল্পনা করে মিডিয়া ডেকে তোকে বেজ্জ ত করেছিলাম কিন্তু প্রত্যেয় সব মিডিয়া কোম্পানির মুখ বন্ধ করে দিলো। বিয়ে করে সারাজীবনের জন্য নর*ক দেখাতে চেয়েছিলাম তোকে৷ সেখানেও প্রত্যেয় তোকে বাঁচিয়ে নিয়েছে,আজ তোকে কে বাঁচাবে?এখন তো প্রত্যেয় ও নেই আর ও আসার আগে তুই হবি ধর্ষি*তা!পুরো দুনিয়া জানবে তুই কে। বলেই কুৎসিত হাসলো সাদাব।
ফিহা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারলো না এই ছেলেটা এতো নিকৃষ্ট!
ফিহাকে টেনে নিয়ে গেলো সাদাব,আটকে রাখলো হাত পা বেঁধে।
এদিকে বিকাল হয়ে গেছে ফিহা বাড়ি ফিরেনি,সৌরভ নিজেও অবাক ফিহা তো কখন বাড়ি চলে আসার কথা।সীমা বেগম হন্তদন্ত হয়ে কল লাগালেন প্রত্যেয়ের ফোনে।প্রত্যেয় সব ছেড়ে বেড়িয়ে পরে,তার বুঝতে বাকি নেই কার কাজ। সে পুলিশ স্টেশনে যায় আগে,পুলিশ কে ইনফর্ম করে।ফিহার মোবাইল থেকে লোকেশন জেনে ছুটে সে দিকে।
,,,,,,
সাদাব এগিয়ে আসছে ফিহার দিকে, ফিহা প্রাণ প্রণে পিছিয়ে যাচ্ছে, বার বার হাত জোর করে বলছে যেনো তার এরকম ক্ষ তি না করে।সাদাব এসে ফিহাকে বিছানায় ফেলে দেয়,টান দিয়ে সরিয়ে ফেলে ওড়না, বুকে হাত দেওয়ার আগেই কেউ একজন এসে লাথি দিয়ে ফেলে দেয় ওকে।এলোপাতাড়ি মা,রতে থাকে সাদাব কে প্রত্যেয়।ফিহা ওড়না জড়িয়ে কাঁদতে থাকে এক পাশে দাড়িয়ে। পুলিশ এসে নিয়ে যায় সাদাব কে।ফিহা গিয়ে জড়িয়ে ধরে প্রত্যেয়কে।প্রত্যেয় রাগ দেখিয়ে বলে
,,এখন আমাকে একদম ধরবে না তুমি কতোবার বলেছি একা একা আসবে না,আমাকে একবার কল করে বলতে পারলে না তুমি!আজ যদি কিছু হয়ে যেতো তখন আমার কি হতো একবার ও ভেবে দেখেছো তুমি?প্রত্যেয় ফিহাকে ছাড়াতে চাচ্ছে ততই ফিহা প্রত্যেয়কে জড়িয়ে ধরছে শক্ত করে।
একটা সময় প্রত্যেয়ও জড়িয়ে ধরে ফিহা কে।
,,হুশ!আর কাঁদে না,আমি থাকতে আমার ফিহু পাখিকে কেউ ফুলের টোকাও দিতে পারবে না।
,,সরি!আমি আর কখনো একা একা আসবো না।আমার উপর রাগ করে থাকবেন না প্লিজ।
প্রত্যেয় জবাব না দিয়ে ফিহা কে নিয়ে বাসায় চলে যায়।
——
রাতের আকাশে আজ পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, তাঁরা গুলো জ্বলজ্বল করে মুক্তোর মতো চিকচিক করছে,বারান্দায় দাড়িয়ে আছে প্রত্যেয়।ফিহার উপর উপরে উপরে রাগ দেখাচ্ছে সে আসার পর থেকে মেয়েটা কতোবার কথা বলার চেষ্টা করছে আর ও এরিয়ে যাচ্ছে বার বার।
প্রত্যেয় নিজের পিঠের উপর কিছু একটার ছোঁয়া পেলো,ফিহা পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে।
প্রত্যেয় বলতে গিয়েও বলতে পারেনি ছাড়ো!ফিহার কথা শুনে
“আপনি বলেছিলেন কোনো এক প্রণয় প্রহরে আপনি অপেক্ষা করবেন আমার ভালোবাসার!তবে আজ এসেছে সে প্রহর, এই ভরা পূর্নিমার তিথিতে প্রণয় এসে ধরা দিয়েছে আমার মনে আপনার নামের।আমি ভালোবাসি প্রত্যেয়,আপনাকে অনেক বেশি ভালোবাসি”
প্রত্যেয় ফিহাকে টেনে নিজের মুখোমুখি দাড়ি করায় চাঁদের আলো এসে মুখে পড়ছে ফিহার চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে মেয়েটি।লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছে নাকের পাটাতন,মৃদু কাঁপছে নেত্রপল্লব।
প্রত্যেয় মৃদু কন্ঠে ডাকলো
,,তাকাও ফিহা!
ফিহা চোখ খুলে তাকালো,দুজনের গভীর দৃষ্টি মিললো,যেখানে তাকিয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে দীর্ঘতম সময়।
,,আবার বলো!
ফিহা নির্দ্বিধায় বললো
,,ভালোবাসি!
প্রত্যেয় জড়িয়ে ধরে বললো আমিও ভালোবাসি ফিহু পাখি।
~সমাপ্ত ~
ফিহা কে ভার্সিটি নামিয়ে এক প্রকার গাড়ি নিয়ে ছুটে চলে যায় প্রত্যেয়,তার এমন কান্ডে কিছুক্ষণ থ মেরে দাড়িয়ে থাকে সে,কি হলো ব্যাপার টা, এই ছেলে এমন অদ্ভুত কেনো।ফিহা তাকিয়ে আছে ছুটে চলা গাড়িটির দিকে,তখনই তার মাথায় একটা গাট্টা মারে সৌরভ।সৌরভ কে হঠাৎ দেখে কিছুটা চমকে যায় ফিহা।
,,কিরে পে’ত্নী এতো মনোযোগ দিয়ে কি এমন দেখছ রাস্তায়?কখন থেকে তোর অপেক্ষায় বসে আছি আমরা,ভেবেছিলাম তো তুই বিয়ে করতে গিয়ে একদম উপরে টপকে গেছিস
ফিহা নিরস কন্ঠে বলে
,,কিছুটা ও রকমই!
সৌরভ সন্দিহান কন্ঠে বলে
,,কি হয়েছে বল তাড়াতাড়ি।
,,মিতা কই? তোকে একবার বলি আবার ওকে একবার আমাকে তো সরকারি পেয়েছিস তোরা।
এর মধ্যে মিতা হাজির,এসেই ফিহাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে।টাল সামলাতে না পেরে ফিহা প্রায় পড়েই যাচ্ছিলো, মেকি রাগ দেখিয়ে বললো
,,ওফ!মে রে ফেলতে চাস নাকি?যে ভাবে ধরেছিস মনে হয় পালিয়ে যাচ্ছি কোথাও!
মিতা ছাড়লো না উল্টো আরো কিছুটা শক্ত করে ধরে বললো
,,সত্যি দোস্ত তোকে এখন দেখে কি যে শান্তি লাগছে কি বলবো।চিন্তায় চিন্তায় খাওয়াই হয় নাই সকালে।তা এখন বল সাদাব জিজুর কি খবর?
ফিহার মুখটা চুপসে গেলো মুহুর্তে, সে কিছু না বলে চলে গেলো ভার্সিটির ভিতরে, সৌরভ,মিতা দুজন একবার নিজেদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো পরক্ষণেই রহস্যের গন্ধ পেয়ে ফিহার পেছনে দৌড় লাগালো।
ক্যাম্পাসের মাঠে ঘাসের উপর বসে পড়লো তিনজন।
,,ফিহু বলনা জান কি হয়েছে,সাদাব ভাইয়ার সাথে কি তোর বিয়ে হয়নি? আমি ওইদিন যেতে না পারায় কি রাগ করে আছিস?সরি ইয়ার হঠাৎ করে তোর বিয়ে আমার ও এক আত্মীয় অসুস্থ তাই সেখানে যেতে হয়েছে।
ফিহা থমথমে কন্ঠে বললো
,,কেনো টিভি তে কিছু দেখায় নি?
মিতা অবাক হয়ে গেলো কিছুটা কি এমন হলো যা টিভিতে দেখাবে!
,,কই না তো কিছুই তো দেখলাম না!
ফিহা নিজেই আশ্চর্য হলো, এটা কিভাবে সম্ভব!
সৌরভ বললো
,,কি কিভাবে সম্ভব?
ফিহা ওইদিনের সকল ঘটনা বর্ণনা করে দম নিলো, সৌরভ,মিতা হা করে তাকিয়ে আছে।দুজনই এক সময় চিল্লিয়ে বললো
,,কিহ্!
,,হুম!
,,আমার তো বর্তমান দুলাভাই কে দেখার শখ জেগেছে বন্ধু!
,,তো গিয়ে দেখ আমাকে কেনো বলছিস।
সাদাব কাপুরুষের মতো কাজ করবে ওটা এখনো মেনে নিতে পারি নি আমি।কিছু কিছু মানুষ দুনিয়ার সামনেই ভালো মানুষ সাজে, মহৎ সাজে, কঠিন সময় ঠিক সুযোগ বুঝে হাত ছেড়ে দেয়।
ফিহার কথায় মিতার খা রাপ লাগলো মেয়েটা সত্যি পছন্দ করতো সাদাব ভাই কে আর মানুষ টা কিনা।
,,তোর এই বিয়ের কাহিনি শুনে আমার এখন হাত পা ছুঁড়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে বইন!
সৌরভের কথায় তেতে উঠলো ফিহা
,,তুই এই সিরিয়াস মুহুর্তে মজা নিচ্ছিস।বে দ্দপ পোলা তুই জীবনে বউ পাবি না দেখিছ।
,,যা খুশি দোয়া করে নে এসব আমি গায়ে মাখি না,বল দুলাভাইয়ের সাথে কবে পরিচয় করিয়ে দিবি।
,,কাল তো আবার দিতে আসবে তখন,বুঝলাম না লোকটা এমন ভুতের মতো উবে গেলো কেনো,আজকেই তো দেখা করতে পারতি তোরা।
মিতা চিন্তত কন্ঠে বললো
,,এখন তুই কি করবি? সব মেনে নিবি,সাদাব কে ভুলে যাবি?
ফিহা চুপ রইলো কতক্ষণ হতাশ কন্ঠ শোনালো তার
,,ভুলে যাওয়া টা কি যুক্তিযুক্ত নয়?বিয়ে যে ভাবেই হোক আমি প্রত্যেয়ের স্ত্রী এখন,না চাইলেও একদিন না একদিন তো স্বামী হিসাবে মানতেই হবে বল।
সৌরভ কিছু চমকে উঠে বললো
,,কি নাম বললি?
,,কোথায় কি নাম বললাম?
,,আরে তোর অদ্ভুত জামাইয়ের নাম।
,,প্রত্যেয়! কেনো কি হইছে?
সৌরভ মিতার দিকে তাকিয়ে বললো মিতা তুই কি সেটাই ভাবছিস যেটা আমি ভাবছি?
মিতা বিরক্তি নিয়ে বললো
,,তোর মতো উদ্ভট চিন্তা আমি করি না।তা বল কি এমন মহান চিন্তা উদয় হলো তোর মনে।
,,ভাইয়ার নাম ও তো প্রত্যেয়!
মিতা না বুঝে বললো
,,কার ভাই?
,,গা ধী আমার ভাই প্রত্যেয়!
,,কি যা তা বলছিস?প্রত্যেয় ভাই করবে বিয়ে দুনিয়ায় আর মানুষ পাইলি না তুই।খালামনির ভয়ে তো বাসায় যায় না ঠিক মতো যদি ধরে বিয়ে করিয়ে দেয় সে ভয়ে।উনি করবে এমন ভাবে বিয়ে।দুনিয়ায় কি একজনের নামই প্রত্যেয় নাকি?আজাইরা চিন্তা বাদ দে তো।
সৌরভ মাথা নাড়লো,ফিহা বললো
,,দুটোতে থাম এবার, প্রত্যেয়ের সাথে দেখা করিয়ে দিবো তখনই সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।চল ক্লাসে যাই।
,,,,,,,,,,,,,
সেদিন ফিহাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে,প্রত্যেয় আবার চলে গেছে,একা বাসায় বসে বসে বিরক্ত হচ্ছে ফিহা, প্রত্যেয়ের বিষয়ে তো কিছুই জানে না সে,তার মা, বাবা, ভাই, বোন সবাইকে না জানিয়ে বিয়ে করলো কেনো?নাকি তার কেউ নেই!
রাত নয়টা অলস ভাবে কেটেছে ফিহার পুরোটা বিকাল সন্ধ্যা নিজের জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত সে।হঠাৎ কলিং বেল বেজে উঠায় কিছুটা চমকালো।কে আসলো
প্রত্যেয়ের কাছে তো চাবি আছে তাহলে?
ফিহা উঠে দরজার কাছে গেলো,কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো
,,কে,,কে?
,,আমি!
কন্ঠটা চিনতে কিছুটা অসুবিধে হলো,আন্দাজে বলে উঠলো
,,প্রত্যেয়!
,,হুম।
ফিহা দরজা খুলে পাশে দাঁড়ালো, প্রত্যেয় কপালের ঘাম মুছে ভিতরে ঢুকলো, তাকে ভীষণ ক্লান্ত মনে হলো ফিহার,গায়ের শার্ট লেপ্টে আছে ঘামে।কপালে ছড়িয়ে আছে এলোমেলো চুল।
ফিহা চোখ সরিয়ে নিলো সহসা,ভেতরে গিয়ে ফ্রিজ থেকে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসলো।প্রত্যেয় সোফায় গা এলিয়ে দিলো,প্রত্যেয়ের দিকে ফিহা গ্লাস বাড়িয়ে দিলো
প্রত্যেয় মুখের সামনে ধরে রাখা গ্লাসটা দেখে সেদিকে তাকালো,মুখে হালকা হাসি ঝুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফিহা, ঠান্ডা বাষ্পে কাঁচের গ্লাস ধোঁয়াসা হয়ে আসছে, কিছু পানি পড়ছে গ্লাসের প্রাচীর ঘেঁষে।
প্রত্যেয় হাত বাড়িয়ে নিলো,তৃপ্তি সহকারে পানি খেলো।পুরোটা সময় তাকিয়ে ছিলো ফিহা।
প্রত্যেয় হাসি মুখে বললো
,,বাহ্ আমার উপর দরদ দেখাচ্ছো যে হঠাৎ? কি ব্যাপার মেডাম!
ফিহা আবার ও হাসলো,গ্লাস নিয়ে যাওয়ার সময় বললো
,,বন্ধুর এতটুকু করতেই পারি আমি!
*****
সময় যেনো এক অদৃশ্য রেখা,কতো দ্রুত পেরিয়ে যায় তা বুঝাই যায় না মনে হয় এই চোখ বুজলাম,সেকেন্ডেই সকাল হয়ে গেলো।ফিহা,প্রত্যেয়ের সম্পর্কের সুতো বুনতে শুরু করেছে, এক মাস কেটে গেলো,দুজন মানুষ একই ছাদের নিচে থাকছে, সকাল সন্ধ্যা রাত একে অপরের সাথে কথা বলছে, অপছন্দের জিনিস গুলোও কখনো কখনো এতো প্রিয় হয়ে উঠে তা মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।তেমনই হয়তো প্রত্যেয় নামক মানুষটার ব্যক্তিত্বে আটকে গেছে ফিহা।সৌন্দর্য, ধন, দৌলত, ঐশ্বর্য ছাড়াও মানুষ কে যে কিছু একটা খুব করে মুগ্ধ করতে পারে তা হলো মানুষের মন।মন ছুঁয়ে দেওয়ার মতো কিছু মানুষের আগমনে একটা বিদগ্ধ হৃদয় ও সেরে উঠতে চায়, নতুন করে হাসতে শিখে।ভালো থাকতে শিখে,ফিহার সাথে প্রত্যেয়ের বন্ধুত্ব গাঢ়তর হয়েছে।দুজনের মাঝে অন্য কোনো সম্পর্ক আছে কিনা তা জানা নেই।তবে তারা যেনো একজন অপর জনকে বুঝতে পারে।এই এক মাসে ফিহার বিশ্বাস অর্জন করে নিয়েছে প্রত্যেয়।মেয়েটা যে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করে রেখেছে নিজের দুঃখ আড়ালে রেখেছে তা হয়তো বন্ধুত্বের মতো একটা জিনিস না থাকলে কখনো জানা হতো না প্রত্যেয়ের।
ফিহা জানতে পারে ওইদিনের মিডিয়া কনফারেন্স গুলো যাতে সবার মাঝে প্রকাশ না হয় সে জন্য সব প্রদক্ষেপ সে নিয়েছে,একটা মেয়ের সম্মান নষ্ট করাটা উচিত নয়।তার কথা সাংবাদিকরা কেনো শুনেছে ফিহা জানে না।তবে মানুষটা তার সম্মানের কথা এতোটা চিন্তা করে ভেবেই তার মন অজানা আবেশে পুলকিত হয়েছিলো।অদ্ভুত বিষয়ে হলেও সাদাব তার সাথে এই এক মাসে একবারও যোগাযোগ করার চেষ্টা করেনি।ভার্সিটেতেও আগে প্রায়ই আসতো কিন্তু এই এক মাসে তাকে দেখেনি,যার ফলে প্রত্যেয়ের সাথে তার সম্পর্কটা নিয়ে কোনো দ্বিধায় পড়তে হয়নি তার।
রোজকার মতো ভার্সিটি যাচ্ছে আজও,সৌরভ,মিতা আগে ভাগে দাড়িয়ে আছে গেইটে তাদের মনোভাব এমন আজ তো দেখেই ছাড়বো!কিন্তু ফিহাকে একা আসতে দেখে হতাশ হলো
মিতা তো রেগেই বললো
,,কি শুরু করেছিস ফিহা তোর জামাই কি ডায়মন্ড নাকি, এই এক মাস ধরে ঘুরাচ্ছিস কিন্তু মহাশয়ের মুখ দেখাতে পারলি না।
ফিহা নিজেও বিরক্ত, প্রত্যেয় কে যতবার বলেছে ততবারই সে বাহানা দিয়ে কেটে পড়েছে
,,আমি ভাবছি দোস্ত, এই আজব ছেলের সব কিছুতে রহস্য জানিস ওনার বাবা মায়ের কথা কতোবার জিজ্ঞেস করেছি শুধু বলছে সময় হলে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।এখন এসব বলেও লাভ নেই।
সৌরভের সন্দেহ যেনো বাড়লো,সে ভেবেই নিয়ে তার ভাইয়ের ফ্লাটে গিয়ে চেক করবে এবার, যদি তার ধারনা সঠিক হয় তো হাতে নাতে ধরা।
—–
মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে ফিহার কেনই বা হবে না যখন একটা মানুষের পুরো পৃথিবী আরেকটা মানুষ হয়, তার সব কিছু জুড়ে ওই মানুষটা বিরাজ করে।তখন যদি কাঙ্ক্ষিত সে ব্যাক্তি ব্যস্ততা দেখায়,সকাল থেকে রাত অব্দি একটা কল না দেয় একদম এরিয়ে চলে তখন কি মেনে নেওয়া যায় নাকি।লোকটা এমন কেনো? এখন ফিহা একটু ভালো ব্যাবহার করছে তো তাই ভাব বেড়ে গেছে, একবার আসুক আজ বাড়িতে সকাল সকাল একটা চিরকুট ধরিয়ে সারাদিন এরিয়ে যাওয়ার শা স্তি তো দিতেই হবে।রাগে একদম টইটম্বুর ফিহা নাকের পাটাতন লাল হয়ে উঠেছে এগারোটার কাটা ছুঁই ছুঁই আর এর বাড়ি ফেরার নাম নেই।দরজাই খুলবো না আজ।
কলিং বেল বাজলো কয়েকবার ফিহা খুলতে যায়নি অগত্যা প্রত্যেয় চাবি দিয়ে লক খুলে ঢুকেছে।ফিহা ড্রয়িং রুমে দাড়িয়ে আছে উল্টো দিক মুখ করে।প্রত্যেয় দেখলো কিছুক্ষণ, ফিহা কে চমকে দিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো হঠাৎ। মায়া ভরা কন্ঠে ফিসফিস করে বললো
,,সরি সরি সরি,আর এমন ভুল কখনো হবে না মহারানী প্লিজ রাগ করে থাকবেন না।আপনি রেগে কথা না বললে আমার মতো মানুষের যে ম রা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না!
ফিহা প্রত্যেয়কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো,রাগী ভাবে বললো
,,আমাকে এসব বলছেন কেনো?বাসায় আসার কি দরকা ছিলো যেখানে ছিলেন সেখানেই থাকতেন। সুন্দরী কলিগদের ছেড়ে আসতে তো মন চায় না আপনার!
,,জেলাস হচ্ছেন বুঝি?
,,আমার এতো ঠেকা পড়ে নি।সরুন কথা বলবেন না আমার সাথে। আমি একাই থাকতে পারি কাউকে দরকার নাই আমার।
প্রত্যেয় কান ধরে দাড়িয়ে পড়লো সামনে,মুখ টা বাচ্চাদের মতো করে বললো
,,আজকেই তো প্রথম, কথা দিচ্ছি আজই শেষ,মিটিং এর পর মিটিং তাই সময় হয়ে উঠেনি। দরকার পড়লে চাকরি ছেড়ে দিবো তাও বউ কে রাগাবো না আর।এবারের মতো মাফ কি পেতে পারি আমি?
ফিহা মুখ ভেংচি কাটলো।ছোট করে বললো ঠিক আছে।
চলবে…..
আজ সন্ধ্যাটা ভীষণ চমকপ্রদ। আকাশের বুকে ছড়িয়ে গেছে হলুদ কমলার মিশ্রনে অদ্ভুত এক রঙ।ফিহা গাড়ির জানালায় মাথা ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে সে দিকে,নতুন গন্তব্যে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে তা সে জানে না।তবুও নতুন সূর্যের আগমনের প্রত্যাশা করছে।
বাড়ি পৌঁছে প্রত্যেয় ফিহার দিক তাকিয়ে বললো,
,,আলমারির ওই পাশটায় তোমার কাপড় রাখা আছে যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
ফিহা চলে গেলো সেদিকে,প্রত্যেয় মোবাইল হাতে নিয়ে খাবার অর্ডার করলো।কাজের মহিলাটা কয়েকদিন ছুটি নিয়েছে,তপ্ত এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে পাশের রুমে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।
ভালোবাসার মানুষকে অতি কাছে পেয়েও যখন অনুভূতি প্রকাশ করা যায় না,মন ভরে তার সাথে কথা বলা যায় না, মুগ্ধতা নিয়ে তাকানোর অধিকার থাকে না,তার মতো নিদারুণ যন্ত্র ণা আর কি হতে পারে।
ফিহা হলদে রঙের এক থ্রি পিস পড়ে বসে আছে,পিঠে ছড়িয়ে আছে তার অর্ধ ভেজা ছোট ছোট চুল।
তার মতো শ্যামলা গরনের মেয়েকে কেনো এতো কাঠখড় পুড়িয়ে বিয়ে করলো প্রত্যেয় নামক মানুষটা কি এতো প্রয়োজন পড়লো তার।পুরুষ প্রেমে পড়ে নারীর দীঘল কালো চুলে,মায়াভরা চোখ,ফর্সা গরনে তার গুনে।তার মাঝে তো প্রেমে পড়ার মতো আহামরি কিছু নেই। না আছে কাঙ্ক্ষিত কোনো রূপ লাবণ্য! তবে কেনো এতো জল ঘোলা করা হলো, এতো এতো নাটকিয়তা করা হলো,বিয়েতে নিজের মায়ের সম্মতি তাকে ভীষণ ভাবাচ্ছে,যখন জেনেছে মা তাকে বিশ্বাস করে নিজেকে অনেকটাই হালকা মনে হয়েছিলো, পৃথিবীতে এই একটা মানুষই তার অধিক আপন।ছোট থেকেই বুঝতে শিখেছে তার এতো বড় পরিবারে তার অবস্থান খুবই ঠুনকো,বাবা নামক মানুষটা কখনো স্নেহের হাত বাড়িয়ে দেয় নি ছোট ভাই বোন দুটিও কখনো তাকে আপন ভাবেনি,দাদি, ফুফু সব মানুষের মাঝে সে ছিলো অবহেলার পাত্র। সে তো এই পরিবারেরই তাহলে কেনো এতোটা দূরে দূরে ঠেলে দিতো সবাই।সেই ছোট থেকে ফিহার মন আক্ষেপ, অভিমান নিয়ে ভরপুর থেকেছে,সবার মাঝে থেকেও নিশ্চুপ একা একা নিজের একটি জগৎ গড়ে তুলেছে,তার জীবনে ভালোবাসার বড্ড বেশি অভাব।সেই ছোট থেকেই একটা প্রশ্ন মনে গেঁথে গেছে,আমাকে কেনো কেউ ভালোবাসে না?ভালোবাসা বুঝি অনেক দামি কিছু যা তার পাওয়ার ধরা ছোঁয়ার বাহিরে?
যখন ভার্সিটিতে সাদাব কে দেখতো সেই ছোট মনটায় এই দ্বিতীয় ব্যক্তিকে নিয়ে স্বপ্ন সাজিয়েছিলো, ভালোবাসে কি না জানে না তবে মনে হতো এ মানুষ টাকে দেখলে তার কিছুটা স্বস্তি হয়।হৃদয়ের হাহাকার কিছুটা কমে।কিন্তু দিন শেষে তার ভালোবাসার পাত্র শূণ্য সেই মানুষটাও তাকে ভালোবাসার ইঙ্গিত দিয়ে হাত ছেড়ে দিয়েছে।কেনো কেউ একবার ও তার হাত শক্ত করে ধরতে চায় না?সে কি এতোটাই অযোগ্য?
বারান্দার গ্রিল পেরিয়ে রাতের অন্ধকার আকাশ কে সে তার সব অভিযোগ তুলে দিচ্ছে পৃথিবীর বুকে কেউ নেই তার এই দুঃখের ভাগ নিতে।তাকে আশার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলার মতো কেউ নেই
“এই তো আমি আছি তোমার পাশে,শুধু মাত্র তোমার হয়ে”!
গাল বেয়ে দু ফোঁটা নোনাজল গড়িয়ে পড়লো ফিহার চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেকিয়ে দিলো লোহার শক্ত পোক্ত আবরনে।নিজের চিন্তায় বিভোর ফিহা দেখলো না বুঝলো না তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে। যে মানুষটির চোখে রয়েছে এক পশরা ভালোবাসা, মুগ্ধতা!
প্রত্যেয় খুব নরম সুরে ডাকলো
,,ফিহু!
ফিহা আনমনেই বললো
,,কি!
,,কি এতো দেখো ওই আকাশে?
ফিহা মৌন রইলো, কথা বলতে ইচ্ছে হলো না কেনো জানি।চুপচাপ তাকিয়ে দেখলো চাঁদ বিহীন আকাশ।
ফিহা ঘুরলো প্রত্যেয়ের দিকে ছেলেটি তার পেছনে দাড়িয়ে আছে বুকে হাত ভাজ করে।
ফিহা নিজের এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো
,,আমরা কি বন্ধুত্ব দিয়ে নিজেদের নতুন জীবনের সূচনা করতে পারি প্রত্যেয়?
প্রত্যেয় তাকালো সামনে থাকা রমনীর দিকে,মেয়েটির চোখের ভাষা এলোমেলো, চাহনি টলমলে।চোখে মুখে ফুটে উঠেছে এক মৃদু আকুলতা।
ফিহা বেশ কিছুক্ষণ হাত উঁচিয়ে রেখে নামিয়ে ফেললো,পর পর ফিচলে হেসে বললো
,,আমার হাত ধরতে সবাই এতো ভয় পায় কেনো বলতে পারেন?আপনি চাইলে কিন্তু ধরতে পারেন, সারাজীবন ধরে রাখার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেউ কেউ ছেড়ে গেছে।তাই আপনি কথা দিয়ে কথা না রাখলেও অবাক হবো না!
প্রত্যেয় শুধু তাকিয়ে আছে,ফিহার এবার বিরক্ত লাগলো লোকটা কথা বলছে না কেনো?এভাবে তাকিয়ে থেকে অস্বস্তিতে ফেলার কি দরকার।সে সরে যেতে চাইলো রুমের দিকে।
পেছন থেকে হাতটা আটকে দিলো প্রত্যেয়,নিজ থেকেই বলতে লাগলো
,,এখন আমায় না হয় ভালো নাই বাসলে,কখনো বাসবে কিনা তাও না হয় নাই বা জানালে।
তবে এই আজ আমি তোমার হাত ধরলাম, ছেড়ে দেবার জন্য নয়।
আমি এক দমে প্রতিশ্রুতি দিতে চাই না প্রতি দিন প্রতি পদে পদে তোমাকে বুঝাতে চাই আমি আছি তোমার পাশে থাকবো আমৃত্যু!
জানি না কবে আসবে সেই প্রহর।তবুও আমি আশায় থাকবো “কোনো এক প্রণয় প্রহরে” তুমি আমার হবে, ভালোবেসে নিজের করে নিবে!
ফিহা থামলো পর পর চোখ বন্ধ করে বুঝলো কথাটির গভীরতা।ছেলেটি কি তাকে ভালোবাসে?প্রশ্ন টি করা খুব জরুরি হবে।নাকি অপেক্ষা করবে প্রকাশ পাওয়ার।
ফিহা ফিরে তাকালো দৃষ্টি রাখলো প্রত্যেয়ের চোখে।
ফিহা হাসলো কিছুটা হাত টা আবার বাড়িয়ে বললো
,,ফ্রেন্ডস!
প্রত্যেয় হাত বাড়িয়ে দিলো।
——
সকাল সকাল মিতার ফোনে কল করেছে কেউ বার বার ফোনের রিং বাজছে, মেজাজ এখন তুঙ্গে তার।কোন ইডি*য়েট সকাল সকাল জ্বা লাতে এসেছে একবার হাতের কাছে পেলে লবন মরিচ ছাড়া ব্লেন্ড করে ফেলবে একদম।
মোবাইল হাতরে কোনো রকম রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো কিছু শব্দ
,,এই চিংড়ি মাছের মালাই কারি!
ভার্সিটি কে তুই তোর নিজের শ্বশুর বাড়ি পেয়েছিস?তিন দিন যাবৎ ক্লাসে আসিছ না তুই নাই তোর দেখা দেখি ফিহার বাচ্চাটাও উদাও হইয়া গেছে।শা*লার আমার জীবনটাই শেষ তোদের মতো দুইটা জ ন্তু মার্কা ফ্রেন্ড পাইয়া।আমি এক সহজ সরল পোলা!
মিতা ফোন হাতে উঠে বসে চেচিয়ে বললো
,,ওই হারা মি সকাল সকাল তুই এসব বলতে ফোন করেছিস তোকে না বলেছি বাসায় এসে নিয়ে যাইতে। এতো সকাল সকাল প্যান প্যান শুরু করলি কেন?
,,আশ্চর্য ভাই সহজ সরল পাইয়া তোরা সবাই কথা শুনাইয়া দেস কেন বুঝি না।ফিহাদের বাসার দারোয়ান তো ঢুকতেই দিলো না কইলো ফিহা নামক কোনো প্রাণী নাকি সেখানে থাকে না!
,, গা*জা পানি খাইয়া সকাল সকাল কার বাসায় ভুল করে ঢুকছছ তুই?ফিহার মতো ঘরকুনো মেয়ে আবার কই যাবে?নিশ্চিত তুই ভুল মানুষের বাড়িতে চলে গেছিলি!
,,বিশ্বাস কর তালতো বইন। আ’ম সিরিয়াস, সত্যি ফিহার বাসা থেকে এসে রিকশায় বসেছি আমার সত্যি টেনশন হচ্ছে ওর তো ফোন বন্ধ, ওর ওই দজ্জাল বাপ ওরে আবার এডপশনে দিয়া দেয় নাই তো!
,,কি বলোস উল্টা পাল্টা ফিহা কি বাচ্চা নাকি যে এডপশনে দিবে,বিয়ে দিছে বললেও মানা যাইতো!
,,তার মানে তুই কিছুই জানিস না দেখছি ওর না সাদাব ভাইয়ের সাথে বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো? তার পর থেকেই তো উদাও।
মিতা চিন্তায় পড়লো কিছুটা সৌরভ কে বললো তুই আয় বাসায় আমি রেডি হই ভার্সিটি গিয়ে দেখি খোঁজ পাওয়া যায় কিনা!
মিতা চিন্তায় মগ্ন সাদাবের সাথে বিয়ে হবে বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হওয়ার কথা থাকলেও ওকে দাওয়াত করেছিলো কিন্তু ও যেতে পারিনি। ভেবেছিলো মেয়েটা কে পরে সরি বলে মানিয়ে নিবে কিন্তু এখন তো খোঁজই পাওয়া যাচ্ছে না।
,,মা সৌরভ এসেছে আমি ভার্সিটি চলে যাচ্ছি।
ভেতর থেকে ব্যাস্ত কন্ঠে ডলি বেগম বললেন আরে ছেলেটাকে ভিতরে তো আসতে দে তোর খালামনি বললো বাসা থেকে নাকি খেয়ে আসেনি।
সৌরভ বললো
,, খালামনি তোমার হাতের রান্না খাবো বলেই তো খেয়ে আসিনি কিন্তু তোমার মেয়ে যে একটা ডাকা ত দেখো কিভাবে টানাটানি করছে, নিজেও খাবেনা আমাতেও খেতে দিবে না।
মিতা কটমট করতে করতে বললো
,,এই ব্যাটা জীবনে কি কোনো দিন আর খেতে পারবি না?টেনশনে টেনশনে আমার পেটে সুরসুরি শুরু হয়ে গেছে।চল বলছি ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো।
সৌরভকে টানতে টানতে ভার্সিটে নিয়ে গেলো মিতা।
,,,
,,হ্যালো হ্যালো হ্যালো…….
কানের কাছে এমন শব্দ পেয়ে ধরফরিয়ে উঠলো ফিহা, খাটের পাশে দাড়িয়ে মিট মিট করে হাসছে প্রত্যেয়।ফিহা রাগে বলে উঠলো
,,এটা কি হলো?ঘুম থেকে ডেকে তোলা যেতো না?এভাবে কেউ চিল্লায় আল্লাহ আমার কান!
প্রত্যেয় ভ্রু কুঁচকে বললো
,,তোমাকে ডাকলে তুমি শোনতে পাও?
এপর্যন্ত চার বার ডেকেছি,ভার্সিটি যেতে চাও না নাকি আর,আমি তো অফিসে যাবো তোমাকে নামিয়ে দিয়ে তাই উঠো জলদি, অলরেডি লেইট হয়ে যাচ্ছে।
ফিহা আর কথা বাড়ালো না সত্যি এতকিছুর মাঝে ভার্সিটির কথা ভুলতে বসেছিলো।
এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে তৈরি হয়ে আসলো,প্রত্যেয় তৈরি হয়ে গেছে ইতিমধ্যে ফিহা একবার তাকালো, প্রত্যেয় দেখতে কি সুন্দর!
ফিহা মনে মনে জিট কা টলো একবার ছি!ছি কি ভাবছে সকাল সকাল।চোখ নামিয়ে চুল আঁচড়াতে ব্যাস্ত হলো।
প্রত্যেয় ফিহার হাত থেকে চিরুনি কেঁড়ে নিলো,ফিহা তাকালো অবাক হয়ে,প্রত্যেয় ফিহার বাহু ধরে নিজের দিকে ঘুরালো, মিষ্টি কন্ঠে বললো
,,আমি আঁচড়ে দেই?
ফিহা চমকালো, ছেলেটি কি সুন্দর করে আবদার করলো ওর কি উচিত না করে দেওয়া?
ফিহার উত্তরের আশা করলো না প্রত্যেয় নিজেই চুলে চিরুনী চালালো।ড্রেসিং টেবিলের একটা ড্রয়ার টান মেরে খুললো,বেরিয়ে আসলো চকচকে কতোগুলো ক্লিপ,রাবার বেন্ড,চুলের কাটা!হতচকিত চোখে একবার সেদিকে দেখলো ফিহা, এই বাসায় তো কোনো মেয়ে নেই তো এগুলা কার জন্য কিনে এনে রেখেছে প্রত্যেয়?
ফিহার প্রশ্নসিক্ত চাহনি দেখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো প্রত্যেয়।ফিহাকে ঘুরিয়ে চুলে লাগিয়ে দিলো একটা বো ক্লিপ।
ফিহা তাকালো চোখ পিটপিট করে।প্রত্যেয় নিজের মুখ ওর কাঁধের কাছে আনতেই মৃদু কেঁপে উঠলো শরীর চেপে ধরলো কুর্তির দুই পাশ।প্রত্যেয় ফিসফিস করে বললো
#কোন_এক_প্রণয়_প্রহরে
#পর্ব২
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
এতো মরা,র সখ তোর!তোকে তো আমি নিজে হাতে খু*ন করবো,তুই যা করেছিস তার পর এখনও তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি এটাই তো অনেক!ফাহমিদ আল প্রত্যেয়ের একটা নখ ছোঁয়ার সাহস কেউ করে না আর তুই তার একমাত্র পছ,,,!
কথা সম্পূর্ণ না করে গাড়ির স্টেয়ারিং এ জোরে এক
ঘু ষি বসিয়ে দিলো প্রত্যেয়, ফর্সা চেহারায় যেনো রক্তের ছোপ ছোপ দাগ পড়ে গেছে।রাগের ফলে পুরো মুখ এতোটাই লাল বর্ণ ধারন করেছে তা দেখে রীতিমতো কাঁপছে ফিহা।
ফিহা যখনই গাড়ির দরজা খুলে ঝা*প দিতে যাবে ঠিক সেই মুহুর্তে প্রত্যেয় গাড়ির দরজা ওপর পাশ থেকে লক করে জোরে ব্রেক কষে।ভরা রাস্তায় আচমকা ব্রেক করায় ট্রাফিক পুলিশের কবলেও পড়তে হয়।প্রত্যেয় সব কিছু সামলে এক পাশে নির্জন জায়গা দেখে গাড়ি পার্ক করে।
ফিহা মাথা নিচু করে বসে আছে,তাকানোর মতো সাহস পাচ্ছে না প্রত্যেয় নিজের চুল টেনে ধরেছে রাগ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য।
কিছুসময় পর গাড়ি স্টার্ট দেয় প্রত্যেয়।ফিহার আর কিছু করার সাহস হয় না।এখন মনে হচ্ছে সে যদি ম*রেও যায় কবর থেকে উঠিয়ে সমস্ত শক্তি দিয়ে গালে চ*ড় বসাবে এই প্রত্যেয় নামক মানুষটা।ফিহার বুঝে আসছে না কেনো এই ছেলে তার সাথে এমন করছে।তার সাথে তো এই লোকের কোনো দিন দেখা ও হয়নি, কোন সময়ের শ ত্রুতা ফলাচ্ছে এখন!
ফিহা চোখ বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলো,কিছুক্ষণ পরই গাড়ি থামলো।প্রত্যেয় নেমে ফিহার পাশের দরজাটা খুলে দিলো,ফিহা নেমে গেলো প্রত্যেয় ফিহার এক হাত চেপে ধরে সাথে এক প্রকার টেনে নিয়ে যাচ্ছে।এখানেই সে রাতে ছিলো আবছা হলেও বাড়িটা দেখে চিনতে পারছে।লিফটে উঠলো না প্রত্যেয় সিঁড়ি বেয়ে উঠছে,যেনো সব রাগ পা দিয়ে সিঁড়ির উপর ঝাড়ছে ছেলেটি, ফিহার মনে হলো তার হাত ব্যাথায় এবার খসে পড়ে যাবে।দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরেছে যতই হোক তার মনে হলো সে এখন আর্তনাদ করলেও পাশের মানুষটি রেগে যাবে।ফ্লাটের দরজা টা খোললো সশব্দে। ফিহাকে সোফার কাছে নিয়ে ছুঁড়ে মারলো প্রত্যেয়।নিজে চলে গেলো রুমের ভিতরে,কিছু সময় পর হাতে শপিং ব্যাগ নিয়ে হাজির হয়,ব্যাগ গুলো ফিহার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভরাট পুরুষালী কন্ঠে বলে
,,যাও গিয়ে রেডি হয়ে আসো!
ফিহা তাকালো ব্যাগের দিকে ব্যাগের ভিতর বেনারসি শাড়ি আর প্রয়োজনীয় সব কিছু আছে,চোখ বড় বড় করে তাকালো ফিহা,ও বউ কেনো সাজবে!নিজের উৎকন্ঠা চেপে রাখতে না পেরে ফিহা চেচিয়ে বলে উঠলো
,,আমি বউ কেনো সাজবো?কি মতলব আপনার!
প্রত্যেয় শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো ওর উপর, এতেই যেনো মেয়েটি ভয়ে কুঁকড়ে গেলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
,,তুমি কি আমার সাথে লিভ ইন এ থাকতে চাচ্ছো ফিহু!আমার কিন্তু কোনো সমস্যা নেই।
প্রত্যেয় কথাটি বলেই বাঁকা হাসলো।ফিহা অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,ছেলেটির কি মাথায় কোনো সমস্যা আছে নাকি, অস ভ্যের মতো কি সব বলে যাচ্ছে।
,,আমি আপনার মতো লোকের সাথে কোনো ভাবেই থাকতে চাই না।আমাকে যেতে দিন বাসায় যাবো আমি।
,,ফেরত পাঠানোর জন্য নিয়ে আসিনি তোমায়।বেশি কথা না বলে রেডি হয়ে এসো,আমাকে রাগিয়ে দিবে না এর পরিনাম ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।যদি সোজা কথায় রাজি না হও তো এমন কিছু করবো যাতে তুমি বিয়ে করতে বাধ্য হও।
,,আমি ম*রে গেলেও আপনাকে বিয়ে করবো না।আমি সাদাব কে ভালোবাসি অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারবো না আমি!
প্রত্যেয় এক টানে ফিহাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে,নিজের ওষ্ঠধর দিয়ে চেপে ধরে ফিহার ফিনফিনে পাতলা ঠোঁট! ফিহা হতভম্ব হয়ে যায় কি হয়েছে বুঝতে ওর কিছু সময় ব্যায় করতে হয়।নিজেকে ছাড়ানোর জন্য ফিহা নিজের হাত পা ছুটাতে থাকে,এলোপাতাড়ি কি ল ঘু ষি মারতে থাকে প্রত্যেয়ের বুকে।তবুও মানুষটিকে এক চুল পরিমাণ ও সরাতে পারেনি সে,বেশ সময় পর প্রত্যেয় এক প্রকার ছুঁড়ে দূরে ফেলে দেয় ফিহা কে।ফিহার চোখ থেকে অনবরত পানি পড়ছে।সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই প্রত্যেয়ের, প্রত্যেয় কিছু সময় পর শক্ত কন্ঠে বলে
,,আর কোনো দিন যদি আমার সামনে অন্য কাউকে ভালোবাসার কথা মুখেও আনার চেষ্টা করিস তো এখানেই মে*রে পুঁতে দিবো।
ফিহা কান্না ভেজা কন্ঠে ফুপিয়ে বলে
,,আপ,,নি একটা নি কৃষ্ট লোক। আপনার মুখ ও দেখতে চাই না আমি।
,,শুধু মুখ কেনো বেবি তোমাকে তো আরো অনেক কিছুই দেখতে হবে।
বলেই চোখ টিপ মারে।ফিহা কান্না করতে করতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে,প্রত্যেয়ের কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে
,,বিয়ে করে বাসর করতে চাও নাকি বিয়ের আগে!
একটা চুমু তে মনে হয় কোনো কাজ হয়নি, বিয়ে করা পর্যন্ত ওয়েট করতে পারছো না বুঝি ফিহু বেবি?আগে আগেই সব করার ইচ্ছে থাকলে মুখ ফুটেও তো বলতে পারো,এভাবে কান্না করে আদাই করার কি আছে।
,,আমি বিয়ে করবো না।প্লিজ আমাকে যেতে দিন!
প্রত্যেয় মুখ দিয়ে চ মূলক শব্দ করে,ফিহার দিকে তাকিয়ে বলে
,,ফিহা দেখো আমাকে রাগাবে না,যদি পাঁচ মিনিটের মধ্যে রেডি না হও তো নিজ হাতে পড়িয়ে দিবো।এটা যে আমি করতে পারবো আশা করি এটা এতোক্ষণে বুঝে গেছো!এখন সিদ্ধান্ত নেও নিজে পড়বে নাকি আমার হাতে।
ফিহা রেগে বলে উঠে
,,বললাম না পড়বো না,কোনো বিয়ে টিয়ে করবো না আমি।তোর মতো খারা প লোকের কোনো কথাই শুনবো না আমি!
,,ফিহা!
প্রত্যেয়ের এতো জোরে ডাক দেওয়াটা যেনো অন্তর আত্মা কাঁপিয়ে দিয়েছে ফিহার,তবুও সে নড়লো না, কান্না করতে করতে উজ্জ্বল শ্যামলা ত্বকের উপর পানির ছাপ পড়ে গেছে, চোখ দুটো ফুলে গেছে,পাতলা ঠোঁট গুলো সমান তালে কাঁপছে, নাক ডগা রক্ত জবার ন্যায় বর্ণ ধারন করেছে।
প্রত্যেয় হাত মুষ্টিযুদ্ধ করলো,নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত করে নরম কন্ঠে বললো
,,ফিহা সাদাব যদি তোমায় সত্যি সত্যি ভালোবাসতো তো আমি কখনো এমন কাজ করতাম না।যদি সে তোমায় ভালোবাসতো তাহলে আজ তোমাকে ওভাবে রেখে চলে যেতো না।তোমার সিদ্ধান্ত শোনার আশায় আমি বসে থাকবো না, মাত্ররো বিশ মিনিট সময় দিচ্ছি এর মধ্যে তৈরি হয়ে আসবে,না হয় সত্যি খারা প কিছু ঘটে যাবে আজকে!সব কিছু বাদ দিয়ে নিজের কথা ভাবো!
ফিহা ধীর পায়ে হেঁটে যায় রুমের দিকে,তার পা টলছে, তার চিন্তা করার শক্তি লোপ পেয়েছে,ফিহা সত্যি সাদাব কে ভালোবাসে, মানুষটির এভাবে প্রত্যাখ্যান সে মেনে নিতে পারেনি মনের কোনে কোথাও একটা খচখচ করছিলো, প্রত্যেয়ের বলা কথাটা যেনো খুব গভীর ভাবে কানে এসে বারি খেলো,যদি তোমায় ভালোবাসতো তো ছেড়ে চলে যেতো না!তবে কি সব কিছুই মিথ্যা ছিলো সাদাব তাকে ভালোবাসে না?তার অনুভূতি গুলো যে এই একটা মানুষের নামেই উৎসর্গ করেছিলো,সে মানুষটা তাকে অবিশ্বাস করলো,জনসম্মুখে একবারও হাত ধরার সাহস করলো না,এতোটা ঠুনকো ছিলো ওর বিশ্বাস, ভালোবাসা তো টিকে থাকে বিশ্বাসে।তবে কি ভালোবাসাটাই ছিলো না কোনোদিন!
ফিহা চিন্তায় ডুব দিয়ে এলোমেলো হাতে শাড়ি পড়ছে,কোনো রকম পেচিয়ে বেরিয়ে আসে রুম থেকে, কাঁধ থেকে একটু লম্বা চুল গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,চোখে মুখে বিষন্নতার ছাপ।
প্রত্যেয় দেখলো বিরহে ভেঙ্গে পড়া এক নারীকে,বিদ্ধস্ত মুখশ্রীর এই নারীর পুরোটা জুড়েই আছে এক অদ্ভুত মায়া।প্রত্যেয় চোখ সরিয়ে নেয় সহসা,চায় না জড়াতে এমন কিছুতে যা তার নয়!তার হয়েও যে অন্য কারোর।এ যে ভীষণ রকম যন্ত্র*ণার!
ফিহা চুপচাপ এসে দাড়ালো প্রত্যেয়ের সামনে,প্রত্যেয় আবারো আপাদমস্তক দেখলো মেয়েটিকে।বুক ভরে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সে,ফিহাকে সাথে করে নিয়ে বের হলো আবার।
****
গাড়ি চলছে আপন গতিতে,ফিহার সিল্কি চুল গুলো উড়ে যাচ্ছে তাল মিলিয়ে, মুখে নেই কোনো প্রসাধনীর ছোঁয়া।সদ্য ফোঁটা একটি শিশির ভেজা পদ্মের মতো লাগছে মেয়েটিকে, কারো অবাধ্য চক্ষু বার বার অমান্য করছে সব বাঁধা বিপত্তি। মেরুন রঙের শাড়িতে মেয়েটির সৌন্দর্য কেনো এতো বৃদ্ধি পেলে,আগে জানলে এই রঙের শাড়ি কিনতো না প্রত্যেয়!
যেদিন এই পদ্ম নিজে এসে ধরা দিতো তার প্রেম নদীতে সেদিন না হয় এরকম করে সাজিয়ে বসিয়ে রাখতো সামনে,দেখতো চোখ ভরা মুগ্ধতা নিয়ে।আজ যে সে অন্য কারোর জন্য আকাশ সমান স্বপ্ন বুনেছে,মন প্রাণ ওই ব্যক্তি টাকে দিয়ে, অনিচ্ছায়, অবহেলায় একরাশ
ঘৃ ণা নিয়ে তাকে গ্রহণ করছে।ভালোবাসার মানুষের মুখ ফিরিয়ে নেওয়াটা হয়তো সহ্য করা সবার সাধ্যর বাহিরে।কাউকে পাওয়া না পাওয়ার সমীকরণে পেয়ে গিয়েও ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার না পাওয়া,ভালোবাসার অধিকার নিয়ে সামনে দাঁড়াতে না পারার মতো অসহনীয় অনুভূতি আর কি দশটা আছে!
গাড়ি এসে থামলো, কাজি অফিস নামক সাইনবোর্ড টানানো একটা গেইটের সামনে।ফিহা অনুভূতিহীন যন্ত্রের ন্যায় হেঁটে যাচ্ছে কেনো যাচ্ছে সে জানে না।নিজেকে এক বদ্দ উন্মা দ মনে হচ্ছে।কেনো সে প্রত্যেয়ের কথা শুনছে জানে না।বার বার একটা কথাই ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে, এটাই তোর নিয়তি, একবার বিশ্বাস করে দেখ ঠকবি না।ভাগ্যটা তার বরাবরই বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তার পরও আজ সে ভাগ্য পরীক্ষা করতে জীবনের সব চেয়ে বড় একটা ধাপে পা দিতে এসেছে।
কাজী অফিসের ভিতরে ঢুকলো দুজন।ফিহা তখন মৃদু কাঁপা কন্ঠে বললো
,,বাবা মায়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে করাটা কতোটা যুক্তিযুক্ত প্রত্যেয়?এই বিয়েটা হয়তো আপাতত দৃষ্টি ঠিক হবে, কিন্তু কি হবে এর ভবিষ্যৎ?
প্রত্যেয় চুপ রইলো কিছুক্ষণ, গম্ভীর কন্ঠে কাউকে ডাকলো সে
,,ভিতরে আসুন!
তখন ভিতরে আসলো এক মধ্য বয়স্ক মহিলা।ফিহা তাকালো সেদিকে নিজের মাকে এখানে দেখে অবাকের চরম সীমানায় পৌঁছে গেছে সে।
কাঁপা কন্ঠে ডাকলো একবার
,,মা!
ফিহার দিকে ফিরেও তাকালেন না তিনি,চুপচাপ পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো,প্রত্যেয়ের হয়ে সাক্ষী হিসেবে এসেছে তার ফ্রেন্ড।প্রত্যেয়ের বাবা মা এখানে নেই, ফিহা শুধু অপলক তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। কাজী সাহেব সব কাজ শেষ করে সাইন করার জন্য রেজিষ্ট্রি পেপার এগিয়ে দিলো ফিহার দিকে।
ফিহার হাত কাঁপছে অনবরত, কোনো ভাবেই ধাতস্থ করতে পারছে। পর পর গড়িয়ে পড়লো কয়েক ফোঁটা অশ্রু। ফিহার মা শান্ত কন্ঠে বললেন
,,সাইন কর ফিহা।
ফিহা তাকালো তার মায়ের দিকে পৃথিবীতে এই একটা মানুষই তাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসে, ভরসা করে।মা ছাড়া ফিহার দুনিয়া যেনো শূন্য, মা ছাড়া বাড়ির বাকি সদস্য কখনো তাকে ভালো ভাবে গ্রহণ করেনি, নিজের বাবাও কোনো দিন স্নেহের হাত বাড়িয়ে বলে নি মা এতো চিন্তা কিসের তোর বাবা আছে তো!ভালোবাসা
নামক জিনিস টা খুবই কম আছে ওর জীবনে,ফিহা দৃষ্টি অনুসরণ করলেন রুমানা চোখ দিয়ে আস্বস্ত করলেন মেয়েকে।ইশারা করলেন সাইন করার জন্য। ফিহা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় কলম চালালো কাজটায়।প্রত্যেয় সাইন করে দিলো ফটাফট।বিবাহ সম্পূর্ণ হলো তিন কবুল বলার মাধ্যমে। ফিহার তার মাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে শক্ত করে মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলে বুঝি তার মা হারিয়ে যাবে অরেক দূরে।
প্রত্যেয় নিজের বন্ধুর সাথে একটু বাহিরে যায়,রুমের বাহিরে বেঞ্চে বসে আছে ফিহা আর রুমানা। রুমানা ফিহার মাথায় হাত রেখে বললেন
,,জানি তোর মনে অনেক প্রশ্ন জমেছে কেনো এতো কিছু হলো,তোর সাথেই কেনো হলো?আমি এখানে কেনো আসলাম,প্রত্যেয় কেনোই বা তোর সাথে এমন করেছে?
সব কিছুর উত্তর সময় হলে পেয়ে যাবি।
মা হিসাবে তোর খা রাপ চাই না আমি,মনে রাখবি পৃথিবীতে তুই আমার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ফিহা পরে বাকিরা।আমি শুধু তোর জন্যই বেঁচে আছি।আমার মেয়ে যেনো পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ পায় সে জন্যই আজ আমি এখানে এসেছি।তুই অনেক ভালো থাকবি মা প্রত্যেয় অনেক ভালো ছেলে।
আমি জানি তোর মনে কি চলছে,ভালোবাসাটা অন্যায় না মা ভুল মানুষকে ভালোবাসাটা নিজের জন্য
ক্ষ তিকর। প্রত্যেয় কে আমি বলছি বলে তোকে মেনে নিতে হবে না,তুই নিজে ওর সাথে থেকে নিজ থেকে উপলব্ধি কর মানুষ টা কেমন।বাহ্যিক দিক দিয়ে বিচার না করে ওর মনটাকে চিনতে শিখ, ওকে বুঝার চেষ্টা কর এইটুকুই বলবো।বলবো না সব কিছু ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেনে নে।তবে আমার বিশ্বাস তোরা দুজন দুজনের জন্য পার্ফেক্ট।ভালোবাসা দ্বিতীয় বারও আসে যদি পাশের মানুষটি মন মতো হয়।
আমি খুশি হবো যদি তুই নিজের জীবন কে আরো একটা সুযোগ দেস তো।সাদাব কে কেনো তোর অযোগ্য বলছি সে প্রশ্নের উত্তর ও সময় হলে পেয়ে যাবি।আমি এখন চলে যাবো,তুই এখন থেকে প্রত্যেয়ের দায়িত্ব ওর অর্ধাঙ্গীনি কথাটা মনে রাখবি।নিজের ভালো নিজেকেই দেখতে।এখন অনেক দিক দিয়েই তোর নিজেকে স্বার্থপর মনে হতে পারে।
তবে মনে রাখবি কিছু কিছু ক্ষেত্রে নিজের জন্য হলেও স্বার্থপর হতে হয়।সময় কঠিন একটা সত্য যা মানুষের জীবনের মোড় অনেক দিকেই ঘুরিয়ে দিতে পারে।মনে রাখবি তোর মা সব সময় তোর পাশে ছিলো থাকবে।আমি আমার ফিহা কে বিশ্বাস করি সে আমার বেস্ট বাচ্চা।
ফিহা শক্ত হাতে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরলো।রুমানা ভেজা চোখে মেয়ের মুখে হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
তাকে যে যেতেই হবে পিছুটান জিনিস টা বড্ড অবাধ্য।
প্রত্যেয়ের ফ্রেন্ড চলে গেছে প্রত্যেয় নিজেই মিষ্টি নিয়ে ফিরেছে।রুমানা তার জন্যই অপেক্ষা করছিলো,ফিহা কিছুটা দূরে বসে আছে।
বাবা প্রত্যেয় কিছু কথা ছিলো
প্রত্যেয় বিনয়ের সাথে বললো
,,হ্যাঁ আন্টি বলুন।
,,তুমি তো সবই জানো বাবা!ফিহা অনেকটা জেদি আর ছেলেমানুষ আমি জানি তুমি তাকে ভালো রাখবে,ওকে তোমার হাতে তুলে দিয়ে যাচ্ছি বাবা আমার মেয়েটাকে আগলে রেখো। জীবনে কারো ভালোবাসা পায়নি।যখন ভালোবাসার মতো বুঝ হলো সেখানেও সে ভুল করেছে।ওর বাবার কারনেই ওর শত্রু*র অভাব নেই,আমার মেয়েটার আজ থেকে কেউ নেই তুমি ছাড়া।আমি থেকেও নেই।ওকে দেখে রেখো বাবা,যেনো সে সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে হাসতে পারে, জীবনের সব দুঃখ ভুলে যেতে পারে, তোমার মাঝেই নিজের সর্বোচ্চ সুখ খুঁজে পায়! এটা এক মায়ের অনুরোধ বাবা। আমার মেয়েটাকে ভালো রেখো।
,,কথা দিলাম!
রুমানা প্রত্যেয়ের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলেন, ফাহমিদ আল প্রত্যেয় কখনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেয় না।ধীর পায়ে প্রস্থান করলেন তিনি।ফিহা দূর হতে দেখলো মায়ের চলে যাওয়া।প্রত্যেয় কাজি সাহেবের সাথে কথা বলা শেষ করে বের হলেন।
,,মিসেস প্রত্যেয় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আপনি কি এখানেই থাকার প্ল্যান করছেন নাকি রাতে?
প্রত্যেয়ের কথায় ফিহা বিরক্তি নিয়ে তাকালো সে কি এখানে সুখে বসে আছে নাকি আজব লোক কোনো কথা ভালো ভাবে বলতে পারে না নাকি!
ফিহা উঠে গটগট করতে করতে সামনে চলে গেলো,প্রত্যেয় ঠোঁট কামড়ে হাসলো।গাড়িতে উঠে বসে পড়লো ফিহা, এই অসহ্যকর ছেলেটার সাথে একই বাসায় থাকতে হবে ভেবে সে হতাশ হলো।মা যে কোন বুঝে এটাকে ভালো বললো কে জানে।
প্রত্যেয় গাড়িতে উঠে ফিহার উপর ঝুঁকে গেলো।ফিহা চোখ গরম করে তাকায়,প্রত্যেয় ফিহার কানের কাছে ফিসফিস করে বলে
,,তোমার এই রেগে টমেটো হয়ে যাওয়া রূপ টা আমার বেশি পছন্দ। মন তো চায়,,,,,,
প্রত্যেয় সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় বসে যায়।
ফিহার দিকে না তাকিয়ে বলে
,,শুধু বেল্ট লাগাতেই গিয়েছিলাম।তুমি যে এতো দুষ্টু তা তো তোমাকে দেখে বুঝাই যায় না ফিহু সোনা!
তুমি কি ভেবেছিলে? যা ভেবেছো তা কি করবো নাকি জান!
ফিহা বোকার মতো চেয়ে আছে প্রত্যেয়ের দিকে, প্রত্যেয় চোখ টিপে আবার ড্রাইবিং এ মন দেয়।
চলবে……
“বিশিষ্ট শিল্পপতি বেলায়েত খন্দকারের মেয়ে বিয়ের আগের দিন রাতে বাড়ি থেকে পালিয়েছে! ”
কথাটি বাতাসের গতিতে ছড়িয়ে পড়েছে শহরে,বাড়ির সামনে ভীড় করেছে সাংবাদিকের দল।এক পাশে দাড়িয়ে আছে পাত্র পক্ষের লোকজন। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছে না খন্দকার বংশের কেউ। সাংবাদিকরা বার বার প্রশ্ন করেই যাচ্ছে “মেয়েকে কি মতের বিরুদ্ধে বিয়ে দিচ্ছিলেন খন্দকার সাহেব?নাকি মেয়ে প্রেমিকের সাথে পালিয়েছে?
এতো মানুষের ভীড় ঠেলে হলুদের সাজে একটি মেয়ে বাড়িতে ঢুকলো খুব তাড়াহুড়ো করে, সাথে রয়েছে অতি সুদর্শন এক পুরুষ। সাংবাদিকদের মধ্যে কয়েকজন মেয়ে রিপোর্টার ইতিমধ্যে তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে।হাঁ হয়ে দেখে যাচ্ছে যুবকটিকে।যুবকটির সাথে থাকা মেয়েটি এক প্রকার ছুটে যায় বেলায়েত খন্দকারের কাছে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে
,,আ,,ব্বু আমি এসেছি, বিশ্বাস করো আমি ইচ্ছে…..
মেয়েটির মুখ থেকে আর কোনো কথা বের হওয়ার সুযোগ পেলো না কেউ একজন সর্বশক্তি দিয়ে তার গালে ক ষিয়ে এক চ*ড় বসিয়ে দিয়েছে।
মেয়েটি গিয়ে ছিটকে পড়লো মাটিতে,পুরো দৃশ্য হতভম্ব নেত্রে দেখে যাচ্ছে সবাই।সাংবাদিকদের ক্যামেরায় বন্দী হচ্ছে অকপটে সবকিছু।মেয়েটি আবার উঠে দাঁড়ালো ঠোঁটের কোন থেকে রক্ত পড়া শুরু হয়ে গেছে।মেয়েকে দেখে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসলো রুমানা খন্দকার কিন্তু তার পা স্থির হলো স্বামীর বলা কথায়
,,তুমি যদি ওই মেয়ের দিকে এক পা বাড়াও তো আমি ভুলে যাবো তোমার সাথে আদো আমার কোনো সম্পর্ক ছিলো রুমা!
এবার হু হু করে কেঁদে দিলো ফিহা,চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে তার নেতিয়ে পড়া গাল বেয়ে, এক রাতে মেয়েটির এই করুন অবস্থা দেখে আঁচলে মুখ চেপে কেঁদে উঠলো রুমানা।
ফিহা উদভ্রান্তের ন্যায় আবার ও বলতে শুরু করলো
,,আব্বু বিশ্বাস করো আমি কারো সাথে পালিয়ে যাইনি, আমাকে কিড নাপ করা হয়েছিলো!
ফিহার কথায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন বেলায়েত খন্দকার। পাশে দাড়িয়ে থাকা লম্বা চওড়া সুদর্শন ছেলেটির দিকেও একবার তাকালো,ছেলেটি কেমন নিরব দর্শকের ন্যায় সব কিছু দেখে যাচ্ছে! তার চোখে মুখে বিরক্ত, রাগ, ভয় কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।উল্টে এতোকিছুর মাঝে একধ্যানে সে তাকিয়ে আছে নিজের হাতে থাকা মোবাইলটির দিকে!
বেলায়েত খন্দকার কঠিন কন্ঠে এক প্রকার ধম কের সুরে বললেন
,,তোমার কথার কি প্রমান আছে যে তুমি পালিয়ে যাওনি?
ফিহা এবার পাশ ফিরে তাকালো যেখানে দাড়িয়ে আছে যুবকটি।ফিহা তার সামনে গিয়ে বললো
,,আপনি তো আমাকে কথা দিয়েছেন বাসায় নেওয়ার পর বাবাকে সব কিছু খুলে বলবেন।আপনি আসলে ভুলে অন্য কেউ ভেবে আমাকে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন এখানে আমার কোনো দোষ নেই।আপনি তো আমার হ্যাল্প ও করেছেন নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে এসেছেন।প্লিজ সব ঘটনা বাবাকে খুলে বলুন।
,,কি সব বলছো ডার্লিং!কবে এরকম কথা হলো আমাদের মাঝে।
প্রত্যেয়ের কথায় যেনো মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো ফিহার,ছেলেটি রাস্তায় ও তাকে আস্ব স্ত করেছে, সব কিছু খুলে বলবে,তবে এখন মিথ্যা কেনো বলছে!
,,আপনি এমন করছেন কেনো মিস্টার প্রত্যেয়?আপনি তো সব কিছু বললেন এখানে নিয়ে আসলেন এখন মিথ্যা কেনো বলছেন?প্লিজ এমন করবেন না আপনার জন্য আমি চাই না আমার বাবার কোনো অসম্মান হোক।দয়া করে সত্যি টা বলুন।
,,তুমি কেনো মিথ্যা বলছো ফিহা,আমাদের এতোদিনের সম্পর্ক তুমি অস্বীকার করছো?তোমার বাবার ভয়েই তো তুমি পালিয়েছিলে, আর তুমিই তো আমায় বলেছো বাসায়া গিয়ে বাবাকে তুমি জানাবে তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে বিয়ে করতে যাচ্ছো।তুমি তার হাতে কাঠ পুঁতলি নও!
ফিহা এবার জোরে শব্দ করে কেঁদে দিলো,সে তার বাবাকে ভীষণ ভালোবাসে, তার বাবা তাকে পছন্দ না করলেও তার প্রতি মানুষটির বিশ্বাস ছিলো,যা কিনা এই ছেলেটির জন্য ভেঙ্গে চূড় মার হয়ে গেছে।এই মুহুর্তে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসহায় মানুষ বলে মনে হচ্ছে তার।কেনো তার সাজানো গুছানো জীবনে প্রত্যেয় নামক ঝড় আসলো সব কিছু লন্ড ভন্ড করে দিলো।ফিহার চোখ গেলো দূরে দাড়িয়ে থাকা সাদাবের দিকে।মানুষ টিকে দেখেই ফিহার চোখ চকচক করে উঠলো এই মানুষটি হয়তো তাকে ফিরিয়ে দিবে না।
ফিহা দৌড়ে গেলো সাদাবের সামনে সাদাবের এক হাত ধরে বললো
,,সাদাব আপনি আমার কথা বিশ্বাস করুন প্লিজ।সত্যি আমি ওই লোকটার সাথে যাইনি,আমি তাকে এর আগে কখনো দেখিনি পর্যন্ত, বিশ্বাস করুন আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই,উনি মিথ্যা কথা বলছেন!
সাদাব তাকালো প্রত্যেয়ের দিকে,প্রত্যেয়ের মুখে বাঁকা হাসি বিদ্যমান,সে এক হাতে নিজের চুল ঠিক করতে ব্যস্ত সাদাব রাগে নিজের হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো,চোখ বুজে নিয়ে ভিতরে থাকা রাগটা দমানোর চেষ্টা করলো, মনে মনে বললো তুই কাজটা ঠিক করিসনি প্রত্যেয় এর মূল্য তোকে দিতে হবে।
ফিহার কান্নারত মুখের দিকে তাকিয়ে যেই না সাদাব কিছু বলতে যাবে।পেছন থেকে সাদাবের মা এক প্রকার চিৎকার করে উঠলেন।এক প্রকার তেড়ে এসে ফিহার হাত সাদাবের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকে ধাক্কা মেরে দিলো।তাল সামলাতে না পেরে যখনই পড়ে যেতে নিবে পিছন থেকে এক জোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে আগলে নিলো।ফিহা ভয়ে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে।সাদাবের মায়ের মুখে যেনো কথার খৈ ফুটেছে তিনি বলেই চলেছে
,,বেহায়া মেয়ে মানুষ, এক ছেলের সাথে এক রাত কাটিয়ে এসে আবার আমার ছেলেকে ফুসলানো হচ্ছে।আমার ছেলের সাথে ভালোবাসার নাটক করার কি দরকার ছিলো এক জনে মন ভরে না নাকি?কয়জন লাগে তোর।নির্লজ্জ মেয়ে মানুষ বাপ মা সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি।প্রেমিক নিয়ে পালিয়ে গিয়ে আবার এখন এই মুখ নিয়ে এখানে যাত্রা পালা করতে এসেছে।ওই মেয়ে তোর মাঝে কি লজ্জার ছিটেফোঁটা নেই নাকি।আমার ছেলের থেকে দূরে থাক।ছেলের পছন্দ বলে বিয়েতে মত দিয়েছিলাম।দেখেতো বুঝাই যায়নি মেয়ের পেটে পেটে এতো শয়*তানি!
ফিহা চোখ খুলে দেখলো নিজের অবস্থান নিজেকে প্রত্যেয় বাহুতে আবদ্ধ দেখেই গা গুলিয়ে আসলো,শুধু একটা কথাই ধরা দিলো মন মস্তিষ্কে “প্রতারক!”
নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো পুরো দমে।কিন্তু ছেলেটির শক্তির কাছে পেরে উঠলো না তার ছোট খাটো দেহটা।বাধ্য হয়ে রাগ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো
,,ছাড়ুন বলছি ছাড়ুন!আমাকে ধরার সাহস হয় কি করে আপনার?দূরে সুরন!
প্রত্যেয় হাসলো কি অমায়িক ভাবে হাসে ছেলেটি, এই হাসিতে ঘা য়েল হবে হাজারো রমনী,তবে ফিহার কাছে এই হাসিটি বিষা ক্ত লাগছে।এর থেকে বিদঘুটে কিছু হয়তো দেখেনি কখনো।
সাদাবের মা সাদাবের হাত টেনে বললো আর এক মুহুর্ত ও নয় এখানে, তোর জন্য এর থেকে সুন্দর ভালো ভদ্র মেয়ে খুঁজে এনে দিবো।তোর ভাগ্য ভালো এরকম একটা মেয়ে কে বিয়ে করা থেকে বেঁচে গেলি।সাদাবের চোখ মুখ লাল হয়ে এসেছে।সে কিছু বলতে ও পারছে না, মায়ের বাধ্য ছেলে সে।তাকিয়ে আছে অন্যের বাহু বন্ধনে আবদ্ধ দাড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে।মেয়েটির চোখে মুখে আকুতি,টানাটানা চোখ দুটো যেনো বলে যাচ্ছে
” প্লিজ আমাকে রেখে যাবেন না সাদাব,বিশ্বাস করুন আমার ভালোবাসা মিথ্যা নয়।আমাকে একবার বিশ্বাস করুন,দয়া করে আমাকে ভুল বুঝবেন না!”
নিজেকে এই মুহুর্তে বড় কাপুরুষ মনে হচ্ছে সাদাবের।কেনো সে মুখ ফুটে মায়ের বিরোধীতা করতে পারছে না, কেনো ভালোবাসার মানুষের পাশে দাড়াতে পারছে না।
ফিহা অশ্রু সিক্ত নয়নে দেখলো ভালোবাসার মানুষের প্রস্থান।
যে মানুষটিকে ঘিরে ছিলো তার হাজারো রঙিন স্বপ্ন, যে মানুষটিকে ভালোবেসে সে বুঝেছিলো ভালোবাসা কি প্রেম কি।সে মানুষটিও আজ তাকে ভুল বুঝলো,বাকি সবার মতোই দূরে ঠেলে দিলো!এতোটা নিষ্ঠু র কেনো সব কিছু।কাল সন্ধ্যায় তো সব কিছু ঠিক ছিলো,কিছু মুহুর্তে এভাবে সবটা শেষ না হলেও তো পারতো।
ফিহাকে এবারে টেনে নিয়ে গেলো প্রত্যেয় নামক মানুষটি,ফিহা রক্তশূন্য চোখে তাকিয়ে আছে শুধু,মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের মেয়েটির চোখ দুটি ফুলে গেছে,নাকের পাটাতনটি যেনো টকটকে টমেটো।ফুঁপানোর ফলে থেমে থেমে কেঁপে উঠছে লাল হয়ে যাওয়া ওষ্ঠদ্বয়।
প্রত্যেয় ফিহাকে নিয়ে এসে দাড়ালো বেলায়েত খন্দকারের সামনে,বাড়িতে নিরবতা বিরাজমান কারো মুখে কোনো রা নেই।কিছু সময় পর পর শোনা যাচ্ছে সাংবাদিকদের ফিসফিসানির শব্দ।
বেলায়েত খন্দকার তাকালেন মেয়ের দিকে,তবুও তার
পা ষাণ মন গললো না,ধরেই নিলেন মেয়ের চোখ জল শুধু লোক দেখানো।তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন
,,আর কি করার বাকি আছে তোমাদের যা তামশা দেখানোর তা তো দেখিয়েই ফেলেছো ইতিমধ্যে। আর কতো লোক হাসাবে তোমরা,এবার বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে,এই মুখ নিয়ে আর আমার কাছে ফিরবে না তুমি, মনে রেখো আজ থেকে আমার এক মেয়ে আর কেউ নেই।যে ছিলো সে কাল রাতেই মা রা গেছে।
প্রত্যেয়ের মুখে সুক্ষ্ম হাসি দেখা গেলো,সে এক হাতে শক্ত করে চেপে ধরেছে ফিহার হাত অন্য হাত পেন্টের পকেটে গুঁজে দিয়ে বললো
,,আহ্! শ্বশুর মশাই,এই মুখ দেখার কি দরকার!
দরকার পড়লে প্লাস্টিক সা র্জা রি করে আপনার মেয়েকে আবার নতুন মুখ সমেত নিয়ে আসবো।আপনার মেয়ের একমাত্র জামাই বলে কথা।তার জন্য আমি সব কিছুই করতে পারি।আপনি কোনো চিন্তাই করবেন না,তাকে আমি সুখে শান্তিতেই রাখবো।একটা মাত্র বউ আমার।আপনি শুধু দোয়া করবেন শ্বশুর মশাই!
বলেই এক লাফে পা ছুঁয়ে আবার উঠে গেলো, মাথায় হাত বুলিয়ে,চোখ মুখ শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
,,শুধু আপনি আমার কলিজার বাবা বলে ছেড়ে দিচ্ছি, না হয় যে হাত দিয়ে তাকে আ ঘাত করেছেন সে হাত আমি ভে ঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতাম!
ফিহা ভীষণ ক্ষি প্ত হলো কে এই ছেলে কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে,কখন থেকে বউ বউ করে যাচ্ছে কে তার বউ?কবের বউ,কিসের বউ?বিয়ে হলো কোন সময়!তার বাবা তাকে মারুক কা টুক যাই করুক সে তাকে ছেড়ে কোথাও যাবে, বুঝালে একদিন ঠিক বুঝবে।
,,এই আপনার সাহস হয় কি করে আমার আব্বুর সাথে এভাবে কথা বলার।কি সব বলে যাচ্ছেন কখন থেকে আপনি এখান থেকে চলে যান বলছি, আমার আব্বু আমাকে মে রে ফেললেও আমি তার কাছেই থাকবো!
বেলায় খন্দকার এবার চিৎকার করে বললেন
,,তোমরা কি, এখান থেকে যাবে নাকি আমি দারোয়ান ডেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো?
ফিহা করুন কন্ঠে ডাকলো
,,আব্বু!
,,কে তোমার আব্বু?তোমার আব্বু মা রা গেছে! এখান থেকে চলে যাও।
বলেই বাড়ির ভিতর চলে গেলেন তিনি,ফিহা সেদিকে তাকিয়ে রইলো অপলক।রুমানার চক্ষু শীতল, চেয়েও তিনি মেয়েকে আগলে রাখতে পারলেন না।চলে গেলেন দৃষ্টিগোচরে!
ফিহা তাকিয়ে দেখলো বাবা মায়ের প্রস্থান।হাতে টান অনুভব করলো সে,প্রত্যেয় নামক ব্যক্তি তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে নিজের সাথে।ফিহা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে মুখে বলছে ছাড়ুন আমায় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?আমি যাবোনা আপনার সাথে।
কিন্তু কোনো লাভ হলো না,প্রত্যেয় তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে গরু র মতো।
—-
প্রত্যেয় গাড়ির দরজা খুলে ভিতরে এক প্রকার ছুঁড়ে
মা রলো ফিহাকে।হাতের ব্যাথায় মৃদ্যু আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটি।প্রত্যেয় গাড়িতে উঠেই গাড়ি স্টার্ট দিলো,তার চোখে মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট, গাড়ি চালাচ্ছে ফুল স্প্রিডে, ফিহা চোখ বন্ধ করে ফুপিয়ে কেঁদে চলেছে।
প্রত্যেয় ধম*কে বললো
,,একদম ফ্যাসফ্যাস করবে না কানের নিচে এক ধাক্কাতে গাড়ি থেকে ফেলে দিবো বলে দিলাম।
কেঁপে উঠলো ফিহা তবে কান্না বন্ধ করলো না,
তা দেখে আরেক দফা ধ*মক দিলো প্রত্যেয়।ফিহা এবার মুখ চেপে ধরেছে নিজের যাতে শব্দ না হয়।অন্য পাশে মুখ ফিরিয়ে ভেবে চলেছে রাতের কথা।
______
গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হওয়ার পর তার এক কাজিন এসে বললো নিচে সাদাব এসেছে তাকে দেখতে।সে না গেলে নাকি সাদাব উপরে উঠে আসবে,ফিহা সাত পাঁচ না ভেবে এক ছুটে গিয়ে ছিলো প্রিয় মানুষটির কাছে।
ফিহা সেই ভার্সিটি লাইফের প্রথম থেকেই পছন্দ করতো সাদাব কে,ছেলেটি ছিলো ভার্সিটির সিনিয়র, তারা ভর্তি হওয়ার সময়ই গ্র্যাজুয়েট কমপ্লিট করে ফেলেছে।লম্বাচওড়া ফর্সা এক যুবক, যে কোনো নারীর মনেই সহজে ধরা দেওয়ার মতো।ফিহা শুধু তার রূপের প্রেমে পড়েনি ছেলেটির ব্যক্তিত্ব ও ছিলো নজর কাড়া, ভার্সিটির ছাত্রদলীয় সব কিছুতে থাকতো সে, কারো কোনো অসুবিধে হলে সলভ করে দিলো হাতের তুরিতে, সেই মানুষটির সাথে নিজের বিয়ে ঠিক হবে বিষয়টি সে কল্পনাও করতে পারিনি।ছেলে নিজে থেকে প্রস্তাব পাঠিয়েছে বাড়িতে,এতো সহজে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যাবে ভেবেই খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়েছিলো তার অবচেতন মন।
সেদিন সাদাবের সাথে দেখা করতে বাড়ির বাহিরে গিয়েছিলো ঠিকই কিন্তু পরবর্তীতে নিজেকে আবিষ্কার করেছিলো কারো রুমে তাকে বিছানায় রাখা হয়েছে।তবে বেঁধে রাখেনি, রুম ও লক করা ছিলো না।খুবই পরিপাটি একটা গুছানো ঘর।সেখানেই তার দেখা হয় প্রত্যেয়ের সাথে,প্রত্যেয় তার সাথে খারা প কিছু করেনি,ফিহার কান্না করা দেখে সে বলেছিলো সকালেই তাকে বাড়ি পৌঁছে দিবে আর নিজের ভুল স্বীকার করে নিবে।কিন্তু কিছুই ঘটলো না,যে মানুষটির ব্যক্তিত্বের প্রেমে পড়েছিলো সে মানুষটিও তাকে একা করে চলে গেছে, নিজের বাবা মাও তাকে বিশ্বাস করেনি। তার পরবর্তী জীবনে কি হবে তাও সে জানে না।এই রকম মূল্যহীন জীবনের দায় সে বয়ে বেড়াতে পারবে না, মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিলো ফিহা,একবার তাকালো ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা মানুষটির দিকে পরেই চোখ বুজে প্রস্তুতি নিলো গাড়ি থেকে ঝাপ দেওয়ার যে স্প্রিডে গাড়ি চলছে আর মেইন রোডে একবার নিচে পড়লেই সব শেষ।যে ভাবনা সে কাজ ফিহা জোরে প্রেস করলো দরজার লকের উপর, ঝা*প দিলো বাহিরে।
আজ ঐশির ট্যুরে যাওয়ার দিন। সকাল সকাল তৈরি হয়ে কাধে জামাকাপড়ের ছোট্ট একটি ব্যাগ নিয়ে সে মোড়ে দাড়িয়েছে রিকশার জন্য।
রুদ্র তখন মোড়ের দোকানে চা হাতে নিয়ে বসেছে৷ রাস্তার দিকে চোখ পড়তেই ঐশিকে নজরে পড়ে তার। গতকালের কথা মনে করে রুদ্রর মুখ থমথমে হয়ে গেলো। ঐশির বাবা কিছু বলার আগে ঐশি নিজেই রুদ্রকে টিচার হিসেবে রিজেক্ট করে দিয়েছে। ব্যাপার টা মারাত্নক লেগেছে রুদ্রর। চায়ের বিল দিয়ে সে উঠে দাড়ালো। এগিয়ে গেলো ঐশির দিকে। পকেটে হাত গুঁজে টান টান হয়ে দাড়িয়ে বলল,
‘ কোথায় যাচ্ছো ইচ্ছে? ‘
ঐশি তাকালো না। জবাব দিলো,
‘ স্কুলে যাচ্ছি। ‘
‘ স্কুল ড্রেস ছাড়া ঢুকতে দিবে? ‘
‘ আজ ক্লাস হবে না। আমরা ট্যুরে যাবো। ‘
‘ কোন জায়গায়? ‘
‘ কক্সবাজারে ‘
রুদ্র খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলালো।
‘ আমি চট্টগ্রামের ছেলে ইচ্ছে। ‘
‘ এর আগেও একবার বলেছিলেন। ‘
রুদ্র ঐশির মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। প্রথম দিনের মেয়েটির সাথে এই মেয়েটির একটু বেশিই অমিল।
রুদ্র চলে গেলো। ঐশি হাতের মুঠোয় কাগজ নিয়ে স্কুলের ভেতরে ঢুকলো। চারিদিকে হৈহৈ পড়েছে। কিছু সময় পরই বাস এলো। স্যারেরা স্টুডেন্টদের দেখেশুনে উঠতে বললেন। ঐশি জানালার পাশে বসলো। তার পাষে বসেছে ক্লাসমেইট ইশা। ঐশি জিজ্ঞেস করলো,
‘ আচ্ছা ইশা ধরো তুমি কাউকে নিয়ে কিছু ভাবো, তবে তাকে কি সেটা জানিয়ে দেওয়া উচিত? ‘
ইশা ভ্রু নাচিয়ে বলল,
‘ কোন বিষয়ে? ‘
ঐশি বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ যেকোনো বিষয়ে। ‘
‘ দেখো আমি যদি তোমাকে নিয়ে মন্দ কিছু ভাবি তবে কখনোই চাইবো না তুমি সেটা জেনে যাও। আমিও তোমাকে কখনো সেটা বলতে যাবো না নিশ্চয়ই? বলা উচিত নাকি অনুচিত সেটা তোমার বিষয়টার উপর নির্ভর করছে আসলে। ‘
ঐশি হাতের কাগজটা দেখালো।
‘ আমি একজনকে নিয়ে বিশেষ কিছু অনুভব করি, প্রথম সেটা ক্রাশ মনে হলেও আমার মনে হচ্ছে আরও বেশি কিছু অনুভব করি। আমার কি তাকে সেটা জানিয়ে দেওয়া উচিত? ‘
বাহিরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কোচিং থেকে ফিরে ঐশি একমনে বৃষ্টি দেখছে৷ সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। বিকালে যে মেয়েটা ছাঁদে হাটাহাটি করতো সে এখন তিনটায় কোচিং এ যায়। দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে একটু রেস্ট নিয়ে কোচিং এ যা-ওয়াটা এখন ঐশির রুটিন। সেদিনের পর থেকে ঐশির সাথে রুদ্রর দেখা হয়নি। রুদ্রকে ওপাশে দেখলে ঐশি আড়ালে চলে গেছে। ইচ্ছে করেই এমন করেছে সে। রুদ্র তাকে প্রথমদিনই বেহায়া মেয়ে বলেছিলো। ভুলে যায়নি ঐশি। হতে পারে সে চঞ্চল কিন্তু বেহায়া নয়। সে তার অনুভূতি চেপে রাখতে পারে না এটাই তার দোষ। রুদ্রর উপর প্রথম দেখায় সে ক্রাশ খেয়েছে এর বেশি কিছু না। অথচ দেখো কতো ভাব দেখালো। ভাবের ডিব্বা ঐশির কাছে এসে ভাব দেখায়!
‘ ইচ্ছে নাস্তা করবি না? জলদি টেবিলে এসে বোস। তোর বাবা অপেক্ষা করছেন তো। ‘
‘ ঠিক আছে যতো টাকা লাগে তোমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে যেও। কবে ট্যুর? ‘
‘ দু’দিন পরই ‘
নাস্তা করে ঐশি রুমে এলো। বই খাতা নিয়ে বসে অংক কষতে লাগলো৷ রাত আটটার দিকে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো সে। বৃষ্টির কারণে ঠান্ডা ভাব চারিদিকে।
রুদ্র যে ফ্ল্যাটে থাকে সেখানে আরও সাতজন থাকে। ফ্ল্যাটে তিনটা রুম। একটাতে তিনজন ও বাকি দুটোতে দু’জন করে থাকে তারা। শুধু এই ফ্ল্যাটটাই নয়, বিল্ডিংয়ের একটি তলাতে সবই ব্যাচেলর। নিচ তলাতে বাড়ির মালিক থাকেন। দু’তলাতে একটি সিঙ্গেল দম্পতি থাকে।
রুদ্র চট্টগ্রামের ছেলে। ঢাকাতে পড়তে আসা এ প্রথম। ঢাকায় এসে একমাস হয়ে গেছে তার। মা বাবাকে সামনাসামনি দেখতে ইচ্ছে করে ভীষণ।
‘ তোর হিরোইনের কথা ভাবছিস নাকি রুদ্র? ‘
রুদ্র ক্ষেপে গেলো। প্রায় অনেক দিন আগে ইচ্ছের সাথে ছাদে একবার কথা বলেছিলো সে। সেটা আড়ালে দাড়িয়ে শুনেছে রুমমেট’রা। সুযোগ পেলেই রুদ্রকে ক্ষেপাতে ভুলে না। রুদ্র বলতে বলতে হয়রান যে মেয়েটার সাথে তার কোনোরকম যোগাযোগ বা সম্পর্ক হওয়ার কোনো চান্স নেই।
‘ কোথায় ডুবে গেলি রুদ্র? তাকে ভাবা হচ্ছে বুঝি? ‘
রুদ্র হতাশায় দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো। যতোই মানা করুক এরা শুনবে না। সুতরাং চুপ থাকাটাই বেছে নিলো।
‘ আচ্ছা মামু তোর হিরোইনের সাথে সেদিনের পর আর দেখা হয়নি? ‘
রুদ্রর স্পষ্ট উত্তর,
‘ না, সে আমার কেউ হয়না সুতরাং দেখা হওয়ার কোনোরকম চান্স নেই। ‘
‘ সে বেচারি হয়তো তোর কথায় রাগ করেছে, তুই একবার দেখা দিতে তো পারিস। সেদিন দেখলাম মুখ গোমড়া করে হেঁটে যাচ্ছে। আহারে বেচারি৷ ‘
‘ দেখ তোরা যা ভাবছিস তা নয়। মেয়েটা হয়তো প্রথম দেখায় ক্রাশ খেয়েছিলো। এর বেশি কিছু নয়, সো এটা অফ কর। ‘
ওরা আর রুদ্রকে কিছু বললো না। রাতে খেয়ে পড়া শেষ করে ঘুমাতে ঘুমাতে এগারোটা বেজে গেলো। ঘুমে তলিয়ে যাওয়ার আগে রুদ্র ভাবলো বেকার না থেকে কয়েকটা টিউশনি করালে মন্দ হয় না।
ভাবনা অনুযায়ী সকালে রুমমেট দের বললো সে। রুদ্রের রুমমেট একজনের নাম সবুজ। সে বলল,
‘ পাশের বিল্ডিংয়ে একজন আঙ্কেল নিজের মেয়ের জন্য টিউশন টিচার খুঁজছেন। সরকারি চাকরিজীবী, ভালো বেতন দিবে কিন্তু। পড়াবি তুই? ‘
রুদ্রর ভ্রু কুঁচকে গেলো। পাশের বিল্ডিং মানে যেটাতে ইচ্ছে থাকে।
‘ মেয়ের নাম কি? ‘
‘ আরে এতো কিছু জানি নাকি আমি? আমি টিউশন করি সেজন্য আঙ্কেল আমাকে বলেছিলো। তুই যদি করতে চাস তো বল ওদের বাসায় নিয়ে যাবো তোকে। কথা বলে আসবি, ভালো মনে হলে করবি নয়তো না। তোর তো আমার মতো টাকার চিন্তা করতে হয়না। তোর বাবা আছে সো চিল। ‘
রুদ্রের মন খারাপ হয়ে গেলো। বাবা না থাকা যে কতোটা কষ্টের সেটা সবুজকে দেখলে বুঝতে পারে সে। মাথার উপর ছায়া না থাকলে জীবন দুর্বিষহ লাগে। সবুজের বাবা নেই, টিউশন করায় দিনরাত। নিজের পড়াশোনা, থাকা, খাওয়ার পর যা থাকে তা বাড়িতে পাঠাতে হয় ওর। বাড়িতে মা বোন আছে৷
রুদ্র হঠাৎ বললো,
‘ টিউশনি টা বরং তুই কর, একটা পড়ালে দুটো টিউশনি করে যেটা পাস সেটা পাবি। দুটো আমাকে দিয়ে তুই এটা কর প্লিজ। তোর সময় বেঁচে যাবে তাহলে। ‘
সবুজ মাথায় হাত দিলো।
‘ আরে বোকা আমি করলে তো কবেই করতে পারতাম। তুই যদি করিস তো বল নয়তো বাদ দে। ‘
রুদ্র ইতস্তত করে বলল,
‘ ঠিক আছে চল কথা বলে দেখি। ‘
নাকেমুখে নাস্তা খাচ্ছে ঐশি। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। ইরা কোমড়ে হাত রেখে দাড়িয়ে আছেন। ঐশী দ্রুত গিলে পানি খেলো।
‘ আর না মা, এবার আমি যাই? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। ‘
ইরা অনুমতি দিতেই ঐশি দরজা খুললো দৌড়ে গিয়ে। বের হবার আগেই সামনে দু’জন লম্বা পুরুষকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলো।
সবুজ ও রুদ্র হা করে তাকিয়ে আছে। সবুজ সবেই কলিংবেলে চাপ দিতে যাচ্ছিল তার আগেই দরজাটা খুলে গেছে৷ সবুজ রুদ্রকে টেনে সাইট দিলো। ঐশি আড়চোখে দেখে এক দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেলো।
ইরা এগিয়ে এলেন। সবুজ সালাম দিয়ে বলল,
‘ আন্টি আমি সবুজ, পাশের বাসাতেই থাকি। এটা আমার বন্ধু রুদ্র। তাহের আঙ্কেল বলেছিলেন টিউশন টিচারের কথা। আপনারা যদি চান তো রুদ্র পড়াতে পারবে। ‘
‘ টিউশন টিচার পাওয়া যায়নি, বলতে বিশ্বস্ত কাউকে পাননি তোমাদের আঙ্কেল। সেজন্য মেয়েকে কোচিং এ ভর্তি করে দিয়েছেন। যদিও কোচিং টা দূর হয়ে যায়। আমি তোমাদের আঙ্কেলের সাথে কথা বলবো। মেয়েটা ওতো দূর কোচিং করে ক্লান্ত হয়ে যায় অনেক। টিউশন টিচার ফেলে ভালোই হবে। তুমি কিসে পড়ো বাবা? ‘
রুদ্র উত্তর দিলো,
‘ অনার্স ফাস্ট ইয়ারে আন্টি। ‘
‘ এইচএসসি কোন বিভাগ থেকে পাশ করেছো? ‘
‘ সাইন্স ‘
ইরা খুশি হয়ে বললেন,
‘ বেশ তো, আমার মেয়ে ও সাইন্স নিয়ে পড়ে নবম শ্রেনীতে। দরজা খুলার পর যাকে দেখলে ওই হবে তোমার ছাত্রী। একটু চঞ্চল তবে গম্ভীর চেহারা করে পড়াবে তাহলেই দেখবে ভয়ে পড়বে। ‘
সবুজ হেসে বলল,
‘ ঠিক আছে আন্টি, আমরা তবে আজ উঠি? ‘
‘ ঠিক আছে বাবা, তোমরা এসো। আমি তোমাদের আঙ্কেলের সাথে কথা বলে তোমাদের জানাতে বলবো। ‘
সবুজ ও রুদ্র বিল্ডিং থেকে বের হলো। রুদ্র লম্বা শ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ এটা তো সেই মেয়ে দোস্ত। এই মেয়েকে আমি পড়াতে পারবো না। ‘
সবুজ বুঝানোর ভঙ্গিতে বলল,
‘ দেখ মেয়েটা তোকে একদিনই ডিস্টার্ব করেছে। ওটাকে যদিও ডিস্টার্ব বলে না, বাট যেটা করেছে তো করেছে। মেয়েটা তোকে আর ডিস্টার্ব করেনি যেহেতু তাহলে তাকে পড়াতে অসুবিধা কোথায়? তুই তো বলেছিস ক্রাশ খেয়েছিলো, এখন তার দেখাও হয়না,কথাও বলে না। তবে সমস্যা কি? ‘
রুদ্র ঠোঁট কামড়ে ভাবলো কিছুক্ষণ। মাথা চুলকে বলল,
‘ দেখ টিউশনি টা হয় কি না, যদি মেয়েটার মতিগতি ভালো না লাগে তবে কিন্তু আমি ছেড়ে দিবো। ‘
রাস্তায় গাড়ির জন্য দাড়িয়ে ছিল রুদ্র। হুট করে কারো বলা এই কথাটা কানে আসতেই নিজের পাশে তাকালো। স্কুল ড্রেস পড়োনে, দু’দিকে দুটো বেনী ঝুলিয়ে, কাঁধে ব্যাগ রেখে যে মেয়েটি রুদ্রর দিকে পিটপিট করে তাকিয়ে আছে তাকে রুদ্র এর আগে কখনো দেখেনি৷ রুদ্রর ভাবনার মধ্যে আবারও প্রশ্ন ছুড়লো মেয়েটি।
‘ বলছেন না কেন? আপনি কি সিঙ্গেল? ‘
রুদ্র রাগ করতে গিয়ে হেঁসে ফেললো। মেয়েটির গাল টেনে দিলো।
‘ তোমার নাম কি পিচ্চি? কোথায় থাকো? ‘
মেয়েটির স্বর এবার ঝাঁঝালো শুনালো।
‘ আমাকে পিচ্চি বলবেন না! ‘
রুদ্র অবাক হয়ে মেয়েটিকে দেখতে লাগলো। এইটুকু মেয়ে কতো পাকা পাকা কথা বলে।
‘ আপনি কি উত্তর দিবেন না? ‘
রুদ্র কিছু না বলে একটি রিক্সা দাড় করিয়ে উঠে চলে গেলো। পেছনে রেখে গেলো কয়েক সেকেন্ডের দেখা মেয়েটিকে।
রুদ্রের চলে যাওয়া রিক্সার দিকে তাকিয়ে থাকলো মেয়েটি। চেহারায় অভিমান। মোড় থেকে বাড়ি যাওয়ার জন্যে হাঁটতে শুরু করলো। যেতে যেতে মনে মনে নাম না জানা ছেলেটিকে বকা দিতে ভুললো না।
তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকে মেয়েটি তার মা বাবার সাথে৷ সিঁড়ি দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে গেলো তিনতলায়। কলিংবেলে চাপ দিতে লাগলো একনাগাড়ে।
রান্নাঘর থেকে খুন্তি নিয়ে ছুটে এসে দরজা খুললেন ইরা। দরজার বাহিরে দাঁড়ানো মেয়েটিকে ঝাঁঝালো স্বরে বললেন,
‘ পাড়াপ্রতিবেশির কান কি উড়িয়ে দিবি তুই? কয়বার কলিংবেল বাজাস? একবার বাজিয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারিস না? ‘
মায়ের কথাটাতে বিশেষ গায়ে মাখলো না সে। মোড়ে দেখা ছেলেটির কথা ভেবে সোফায় বসে মিটিমিটি হাসতে লাগলো। ইরা ভ্রু কুঁচকে মেয়ের কান্ড দেখছেন৷ রান্নাঘরে যেতে যেতে বললেন,
‘ বের হয়ে যেনো দেখি তুই গোসল করে টেবিলে এসে বসেছিস। ‘
দুপুরে খাওয়ার পর ঘুমানোর অভ্যাস মেয়েটির। ঘুম থেকে উঠে বিকালে ছাঁদে হাঁটাহাটি করে। আজও সবসময়ের মতো সে ছাঁদে হাঁটতে গেলো। এ সময় তেমন কেউ ছাঁদে থাকে না। মেয়েটি হাটাহাটি করার মধ্যে নজর ফেললো চারিদিকে। দৃষ্টি আটকালো ডান দিকের ছাঁদে। সকালের দেখা সেই ছেলেটি দাড়িয়ে আছে৷ মেয়েটি উঁচু আওয়াজে ডাকলো,
‘ এই হ্যান্ডসাম! ‘
রুদ্র চমকে তাকালো। কান থেকে মোবাইল নামিয়ে পকেটে রেখে ছাঁদের কিনারে এলো। মেয়েটিকে পরোখ করে বলল,
‘ তুমি দুপুরের সেই পিচ্চিটা না? ‘
মেয়েটি নাক ফুলিয়ে বলল,
‘ পিচ্চি বলবেন না। ‘
রুদ্র গম্ভীর স্বরে বলল,
‘ তো কি বলবো? ‘
‘ আমার নাম ঐশি আরা ইচ্ছে, আপনি ইচ্ছে বলে ডাকতে পারেন। আপনার নাম কি? ‘
‘ ইয়াসিফ, আমি দু’দিন হলো এই ব্যাচেলর বাসাতে এসেছি। অনার্সে চান্স পেয়েছি এখানকার একটি ভার্সিটিতে। তুমি কিসে পড়ো ইচ্ছে? ‘
ঐশি হেসে বলল,
‘ আমি নবম শ্রেনীতে পড়ি। আপনি আমাকে ঐশি ডাকতে পারেন। যদিও দুটো নামেই সবাই ডাকে। যার যেটা পছন্দ৷ ‘
রুদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসলো,
‘ আমি তোমাকে ইচ্ছে বলেই ডাকবো। ‘
‘ তাহলে তো আপনার নাম আর আমার নাম মিলে গেলো। ইয়াসিফ ও ইচ্ছে৷ সুন্দর না? ‘
রুদ্র গম্ভীর হয়ে গেলো।
‘ এই সময় ছাদে কি করছো? ‘
‘ আমি এই সময় ছাঁদে হাটাহাটি করতে আসি। ‘
‘ এখন থেকে কম আসবে। কারণ পাশের ছাঁদ মানে আমি যেটাতে দাড়িয়ে আছি সেটায় ব্যাচেলররা থাকতে পারে। আর আমার সাথে তেমন কথা ও বলবে না, কারণ কেউ দেখলে তোমার নামে বাজে কমেন্টস করতে পারে। তুমি তো ছোট তাই বুঝতে পারছো না এখন। ঠিক আছে? ‘
ঐশি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।
‘ আমি সব বুঝি। আপনাকে আমার ভালো লেগেছে, আমি আপনার সাথে কথা বলবোই। ‘
রুদ্র কন্ঠস্বর কঠিন করলো।
‘ না ইচ্ছে, তুমি যদি এরকম করো তবে আমারও বদনাম হবে। আমি এখানে নতুন এসেছি। যদি আমার নামে উল্টাপাল্টা কিছু ছড়িয়ে যায় তবে বাড়িওয়ালা আমাকে বের করে দিতে দুবার ভাববে না। ‘
ঐশি ঠোঁট উল্টে বলল,
‘ তাহলে উপায়? ‘
রুদ্র রেগে বলল,
‘ আমি তোমাকে বাচ্চা মেয়ে ভেবেছিলাম। তুমি তো দেখি নাছোড়বান্দা। আরে মেয়ে আমার সাথে তোমার এতো কিসের কথা? প্রতিবেশী হয়েছো বলে কি মাথা কিনে নিয়েছো? আমারই দোষ তোমার সাথে কেন যে কথা বলেছি। ‘
‘ আমার সাথে কথা বললে কি হবে? কেউ দেখবে না প্রমিজ। লুকিয়ে কথা বলবো। আপনার ফোন নাম্বার দিতে পারবেন? ‘
‘ কেন? ‘
ঐশি হেসে বলল,
‘ বান্ধবীর মোবাইল দিয়ে স্কুলে গেলে ফোন করতাম আরকি। আমার তো নিজস্ব মোবাইল নেই, বাবা বলেছে স্কুল পাশ করার পর মোবাইল দিবে৷ ‘
রুদ্র হতভম্ব হয়ে গেলো।
‘ আমার সাথে কথা বলে লাভ কি তোমার? ‘
‘ আরে বুদ্দু, প্রেম চিনেন না নাকি? ‘
ঐশি কোমড়ে হাত রেখে রুদ্রের সাথে কথা বলছে। পড়োনে ফতোয়া ও প্লাজু। চিকন শরীরের লিলিপুট সে। রুদ্র সবে যুবকে পরিণত হয়েছে। লম্বায় ঐশি তার পেটে পড়বে হয়তো৷ এতো অল্প বয়সে কেউ প্রেম করবে সেটা রুদ্রের কাছে অবিশ্বাস্য হলেও জগতের কাছে নয়৷ এ যুগে ফাইভের বাচ্চা ও প্রেম করে। রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
‘ প্রেমের কি চিনো তুমি? দুধের দাঁত পড়েছে তোমার? ‘
ঐশি দাঁত বের করে দেখালো।
‘ আমার সব দাঁত পড়ে আবার নতুন দাঁত উঠে গেছে। ‘
‘ দেখো তুমি বাচ্চা একটি মেয়ে। মন দিয়ে পড়াশোনা করবে এখন। প্রেম করার বয়স তোমার হয়নী। আমাকে বলেছো তো বলেছো আর কাউকে এসব বলতে যেওনা। তারা সুযোগ নিতে দু’বার ভাববে না। ‘
‘ কেন বলবো না? আপনি যদি ফোন নাম্বার না দেন তো সবাইকে বলবো৷ ‘
‘ কি বলবে? ‘
ঐশি মুখে হাত রেখে ফিক করে হাসলো।
‘ আপনি আমাকে লাভু করেন৷ ‘
রুদ্র অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখে বলল,
‘ লাভু শব্দের মানে কি ইচ্ছে? ‘
‘ ভালোবাসা ‘
‘ তুমি কি কাউকে ভালোবাসো? ‘
ঐশি থমকালো। মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘ মা বাবাকে ভালোবাসি। ‘
‘ মা বাবা তোমাকে অনেক আদর করে তাই না? ‘
‘ হু বাবা আমাকে প্রিন্সেস বলে ডাকে। ‘
‘ তুমি যে আমার সাথে কথা বলছো, তোমার যদি কোনো বদনাম হয় তবে তোমার বাবার অসম্মান হবে৷ তুমি কি চাও তোমার বাবা কষ্ট পাক? ‘
ঐশি ঠোঁট উল্টে না করলো। রুদ্র হেসে বলল,
‘ এইতো লক্ষী মেয়ে৷ এবার ছাদ থেকে চলে যাও। আর কখনো আমার সাথে কথা বলো না কেমন? ‘
ঐশি ছলছল চোখে তাকালো,
‘ আপনাকে দেখলেই আমার কথা বলতে ইচ্ছে করে। নাম্বার টা দিন তবে আমি আপনার সাথে সামনাসামনি কথা বলবো না। সত্যি! ‘
রুদ্র হতাশ, হাত জোড় করে বলল,
‘ ক্ষমা করো ভাই, তুমি আমার কেউ হও না তবুও তোমাকে এতোক্ষণ বুঝাতে চেষ্টা করেছি। তোমার বদনাম হলেও আমার কিছু আসবে যাবে না। বেহায়া মেয়ে মানুষ আমার পছন্দ না। যত্তোসব। ‘
রুদ্র ছাঁদ থেকে নেমে গেছে। ঐশি ঠোঁট উল্টে নাক টানছে৷ ইয়াসিফ তাকে পছন্দ করে না ভেবে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে৷
পড়শী বাংলাদেশ বিমানের টিকিট কেটে দেশের পথে রওয়ানা দেয়। শাহজালাল বিমানবন্দরে পৌঁছানো মাত্রই ওর মোবাইলটা বেজে উঠে। তাকিয়ে দেখে সায়েম ফোন দিয়েছে। পড়শীও ফোনটা রিসিভ করে।
—-হ্যালো,
—-শুনলাম মহারানির ডিভোর্স হয়ে গেছে?
—-হুম,
—আপনি নাকি দেশে আসছেন?
পড়শী বুঝেছে সায়েম ওর হাসব্যান্ডের কাছ থেকে সব জেনে নিয়েছে। পড়শীকে চুপ থাকতে দেখে সায়েম বলে,
—-এখন তো আর কোনো বাঁধা নাই। তুমি টাকা না দিতে পারলে সমস্যাও নাই। তুমি শুধু আমার হয়ে থাকো। বিশ্বাস করো, তোমার মতো সুখ এই পৃথিবীতে আমাকে কোনো নারী দিতে পারেনি। বিয়েও করেছিলাম। কিন্তু তোমাকে ভুলতে পারিনি।
পড়শী এই মুহুর্তে ওর প্লান বদলে ফেলে। তাই সহজ স্বাভাবিক ছন্দে বলে,
—আমাকে কোথায় আসতে হবে?
—-সত্যি তুমি আসবে?
—-কেন নয়?
—-তাহলে গাজীপুরে বাংলোবাড়িটায় আসো। যেখানে আমাদের প্রথম মিলন ঘটেছিলো। আর একটা কথা।
—-বলো,
—-দুবোতল হুইস্কি কিনে এনো।
—-ওকে।
পড়শী ওর প্লানমাফিক সব কিছু কিনে নিয়ে উবারে করে গাজীপুরের দিকে রওয়ানা হয়। বিকাল পাঁচটায় ও গাজীপুরে পৌঁছায়। ওখানে আগে থেকেই সায়েম ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো। সায়েম ওকে দেখার সাথে সাথে জড়িয়ে ধরে বলে,
—-কেমন আছো মেরি জান?
—বাংলোর কর্মচারীরা পড়শীর দিকে যেন কেমন করে তাকিয়ে থাকে। সেদিকে তাকিয়ে পড়শী ঘরে এসে ভুবনমোহিনী হাসি দিয়ে সায়েমকে বলে,
—-,আজ আমরা প্রেমাতাল হবো। কিন্তু একটা সমস্যা আছে।
—-কি সমস্যা?
—-তোমার বাড়ির এতো কর্মচারীর সামনে সেটাতো সম্ভব নয়।
—-ওকে আমি ওদের সবাইকে আজ ছুটি দিয়ে দিচ্ছি।
সায়েম ডিনারের পর ওদের সবাই চলে যেতে বলে। ওরাও চলে যায়। পুরো বাড়ি নির্জনায় ঢেকে রয়। পড়শী ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেইঞ্জ করে একটা লাল রংয়ের শর্ট নাইটি পড়ে আসে। সায়েম ওকে দেখে পাগল হয়ে যায়। পড়শীর ফর্সা রঙের পা, গলার অংশটা বড় হওয়ায় স্তন বিভাজিকা দেখে লালসার আগুনে সায়েম পুড়তে লাগলো। সেদিকে লক্ষ্য করে পড়শী মনে মনে গালি দিয়ে বলে,”কুত্তার সামনে মাংস ঝুলিয়ে দিলে যে অবস্থায় হয় শয়তান তোর অবস্থাও এখন তেমন। এরপর ও খিলখিল করে হেসে বলে,
—-এতো তাড়া কিসের? আমি তো পালিয়ে যাচ্ছি না। আমেরিকার হুইস্কি খাবে না।
—-তুমি সত্যি আমার জন্য নিয়ে এসেছো?
—-তুমি বলেছো আর আমি আনবো না, তা কি করে হয়?
পড়শী হুইস্কির বোতল বের করে গ্লাসে ঢেলে দেয়। কামনার আগুনে পুড়তে থাকা সায়েম পড়শীকে পাওয়ার তাড়নায় ঢকঢক করে খেয়ে ফেললো।এরপর ও ঘুমের কোলে ঢলে পড়লো। পড়শীও আর একমুহুর্ত অপেক্ষা না করে প্রথমে ওকে বালিশ চাপা দিয়ে মারলো। তারপর সাথে করে আনা ছুড়ি দিয়ে ওর বুক বরাবর কেটে ফেললো। ফিনকি দিয়ে রক্ত এসে পড়শীকে ভিজিয়ে দিলো। সেদিকে তাকিয়ে পড়শী পাগলের মতো কতক্ষণ হাসলো। তারপর সায়েমের চোখটাকে ছুড়ি দিয়ে গুতো দিয়ে বললো,
“তোমার ঐ চোখে আমি ধরা পড়েছিলাম। আর আমার সরলতার সুযোগে তুমি আমাকে পাপের অতলে তলিয়ে দিলে। আমি আবার উঠে দাঁড়ালাম। কিন্তু তুমি আমাকে আবারও ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলে। তাই তোমা হতে আমার পাপের শুরুটা হয়েছিলো। সে কারনেই তোমাতেই বিনাশ করলাম।”
এরপর পড়শী ড্রেস চেইঞ্জ করে জিন্স আর একটা ফতুয়া পরে নিলো। একটা ওড়না দিয়ে মাথাটা ঢেকে নিলো। এরপর সকাল হওয়ার অপেক্ষায় বসে থাকলো। হঠাৎ ভোর চারটায় মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। পড়শী সেই দখিনা জানালার কাছে দাঁড়িয়ে মনে মনে ভাবলো,
—-ও কতো স্বপ্ন নিয়ে জীবনটা শুরু করেছিলো। অনেক বড় হওয়ার তাড়নায় ঢাকা ভার্সিটি পরীক্ষা দিয়ে চান্স পেয়ে ভর্তি হলো। এই মানুষটা ওর সব স্বপ্নকে ভেঙ্গে দিয়েছে। তবে ঐ পাপিষ্টাকে ও শাস্তি দিতে পেরেছে এই সান্তনাটুকু নিয়ে ও বাকি জীবন দিব্যি কাটিয়ে দিতে পারবে। সায়েম যখন ওকে ফোন দিয়েছিলো সেই মুহুর্তে ওর মনে হলো এই নোংরা মানুষটার জন্য ও কেন মরতে যাবে? তখনই এই প্লানটা ও মাথায় এঁটে নিলো। এজন্য এয়ার পোর্টে নেমেই বাংলাদেশ বিমানে অনেক দামে ফিরতি টিকিট কেটে নিয়েছিলো।
সকাল ছ,টায় বৃষ্টি থেমে গেল। পড়শী একটা উবার ডেকে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। দুপুর আড়াইটার সময় ও বাংলাদেশ বিমানে করে কানাডায় পাড়ি জমালো। ওদিকে বাংলো বাড়িতে কর্মচারীরা এসে সায়েমকে এ অবস্থায় দেখে পুলিশে খবর দেয়। পুলিশ এসে লাশ উদ্ধার করে পড়শীকে হন্যে হয়ে খুঁজতে লাগলো। পড়শী কানাডায় পৌঁছে পুলিশের কাছে ধরা দিয়ে নিজের অপরাধ স্বীকার করে। বিচারের অপেক্ষায় পড়শীকে এখন সেইফ হোমে রাখা হয়েছে। আজ আর পড়শীর কোনো পিছুটান নেই।