Saturday, July 19, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1082



সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-১১

0

সেই মেয়েটি আমি নই
১১ পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

বিনোদিনী আর তুষার বিব্রতবোধ করছে৷ এরকম পরিবেশে ঠিক কি করতে হয় তারা বুঝতে পারছে না।
ইশতিয়াক বের হয়ে যাওয়ার পর বিনোদিনী আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আন্টি আপুর সাথে কি একটু কথা বলতে পারি? উনার সঙ্গে কথা বলে আমরা চলে যাব।’

হুস্না বেগমের মেয়েটিকে ভীষণ ভালো লাগছে। কিন্তু এমন একসময় দেখা হয়েছে যখন মন-মেজাজ কিছুই ভালো নেই। তিনি যথাসম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে বললেন,

– ‘রহিমা যা তো, গিয়ে তোর আপাকে বল আসতে। বলিস ইশতিয়াক চলে গেছে।’

রহিমা তুলির দরজায় গিয়ে আবার নক করে। তুলি দরজা খুলতেই সে অনেকটা ইশতিয়াকের পক্ষ নিয়েই যেন বললো,

– ‘খালাম্মা দুলাভাইকে তাড়িয়ে দিয়েছে আপা। আর কত গালাগালি যে করলো। শেষে ঘর থেকে না গেলে জুতা দিয়েও মারতে বলছিল৷ তাই দুলাভাই চুপচাপ চলে গেছে। আহারে দেইখা আমার কান্না চইলা আসছিল আপা।’

কথাগুলো শুনে তুলি গিয়ে বিছানায় মুখ ঢেকে বসে কান্নায় কেঁপে কেঁপে উঠে। রহিমা এগিয়ে এসে কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

– ‘হায় আল্লাহ আপা কাঁদতাছো কেন? আপনেই না বইলা আইলেন বাসা থেকে বাইর কইরা দিতে।’

তুলি কোনো জবাব দিল না৷ রহিমা ছুটে গেল সিটিং রুমে।

– ‘খালাম্মা দুলাভাইকে বাইর কইরা দিছো শুনে তো আপা কাঁদতাছে।’

– ‘কি বলিস।

– ‘হ দেইখা যান নিজের চউক্ষে।’

রহিমা বেগম তুলির রুমে এলেন৷ তুলি সত্যি সত্যি মুখ ঢেকে কাঁদছে।

– ‘কিরে মা, তুই না বললি বাসা থেকে বের করে দিতে?’

তুলি মুখ তুলে বললো,

– ‘তাই বলে এভাবে বের করে দেবে? মানুষের সামনে গালাগালি করবে? তাও জুতোপেটা করতে বলছো।’

– ‘আচ্ছা মা চল। ওরা অপেক্ষা করছে তোর সঙ্গে কথা বলবে। দেখেছিস মেয়েটা একদম তোর মতো দেখতে।’

তুলি চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। মেয়েটির সঙ্গে ওর নিজেরও কথা বলতে ইচ্ছা করছে। সিটিং রুমে এসে ওদের সামনের সোফায় বসে৷ তুষার আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘আসলে আপু আমি খুবই লজ্জিত আমার কারণে এতবড় একটা ঝামেলা হয়ে গেল..।’

তুলি থামিয়ে দিয়ে বললো,

– ‘এসব বাদ দেন আমার কপালে যা ছিল তাই হয়েছে। আপনাদের কথা বলুন। অবশেষে তাকে পেলেন।’

– ‘জি আপু, পার্কে দেখা হওয়ার পরই ওর কল আসে।’

– ‘তাই না-কি? আর আপনি কোথায় লুকাইছিলেন উনাকে রেখে।’

বিনোদিনী মিষ্টি করে হেঁসে বললো,

– ‘আমি লুকাইনি, বন্দী ছিলাম বলা চলে। আজ পালিয়ে এলাম ওর সঙ্গে।’

– ‘ও আচ্ছা তাই? বন্দী কেন?’

– ‘আমাদের দুই পরিবারই মানছে না আপু তাই।’

– ‘তো এখন কি করবেন?’

– ‘এখন আমি আলাদা কোথাও থাকবো। আর সে তার ফুপুর বাসায় আছে। এই মাসে নতুন বাসা দেখবো আর আগামী মাসেই বিয়ে করে নিব।’

– ‘সন্ধ্যা তো হয়েই যাচ্ছে। কোথায় থাকবেন ঠিক হয়নি?’

তুষার ব্যস্ত হয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ, এটাই সে বুঝতে পারছে না। আজই এসেছি, ডায়রেক্ট এদিকে চলে এলো।’

তুলির ইচ্ছা হলো বলে আমাদের এখানেই আপাতত থাকুক। কিন্তু অচেনা কোনো মেয়েকে বলা কি ঠিক হবে? আর অচেনা হলেও তো তারা দু’জন একইরকম দেখতে। কণ্ঠও অবিকল একইরকম। বড়ো আপন আপন লাগছে। হুস্না বেগম এলেন চা-নাশতা নিয়ে। তুলি আমতা-আমতা করে বললেন,

– ‘ও আজ আমাদের সঙ্গেই থাকুক। পালিয়ে ঢাকা এসে কোথায় থাকবে সেটা না ভেবে আমাদের ঝামেলা ঠিক করতে চলে এসেছে।’

হুস্না বেগম যেন খুশিই হলেন। ঝামেলার মাঝে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলা হয়নি। ওর পরিচয় জানা দরকার৷ কত কথা বলতে ইচ্ছা করছে। আজ ওকে নিজের বিছানায়ই রাখবেন। তুলি আবার ওর কাছে নিতে চাইলে রাখতে পারবেন না। তাতেও সমস্যা নেই৷ দরকার হয় ঘুমানোর আগপর্যন্ত ওদের রুমে থাকবেন।

– ‘নাও মা চা নাও। তোমার নাম যেন কি?’

– ‘বিনোদিনী।’

– ‘বাহ সুন্দর নাম।’

নাশতা করার পর তুলি তুষারকে বললো,

– ‘তাহলে আপনি চলে যান। সে আপাতত থাকুক। আপনি ওদিক গুছিয়ে নিন। আর আরেকটা কথা। আমি পার্কে ভ্যানিটিব্যাগ ফেলে চলে এসেছিলাম৷ রহিমাকে পাঠানোর পর গিয়ে পায়নি। দেখেছিলেন কোথাও?’

– ‘আরে ওটা আমার কাছেই আছে। আমি পার্কে অপেক্ষা করছিলাম। তখন ওর কল আসে। তাই বাসায় ভ্যানিটিব্যাগ রেখে চলে গেলাম। যাইহোক কাল সন্ধ্যায় নিয়ে আসবো।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

সে হুস্না বেগমকে সালাম দিয়ে বাইরে গেল। খানিক পর বিনোদিনীর মোবাইলে তুষারের কাছ থেকে মেসেজ আসে,

– ‘ওদেরকে আগ বাড়িয়ে তুমি হিন্দু বলতে যেও না। আপাতত এখানে থাকতে পারলেই ভালো৷’

বিনোদিনী মেসেজ দেখে মুচকি হেঁসে তুলিকে বললো,

– ‘আমি তো হিন্দু, আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না?’

তুলি আর হুস্না বেগম মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছেন৷ তুলি বললো,

– ‘আরে না কোনো সমস্যা নেই৷ তবে আপনার সমস্যা থাকলে আলাদা রুম দিয়ে দেবো।’

– ‘না আপু আমার কোনো সমস্যা নেই।’

হিন্দু শুনে হুস্না বেগমের মুখটা মলিন হয়ে গেল। উনার ক্ষীণ আশা ছিল এই মেয়ে কলি না হলেও আত্মীয় কেউ হতে পারে৷ তবুও তিনি বিনোদিনীর পাশে গিয়ে বসলেন।

– ‘তোমার বাড়ি কোথায় মা?’

– ‘সিলেট।’

– ‘সিলেট কোথায়?’

– ‘কোমলগঞ্জ, জগন্নাথপুর।’

হুস্না এবং তুলি একজন আরেকজনের দিকে অবাক চোখ তাকাচ্ছেন। তুলি ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘আমার নানাবাড়ি রাণীগঞ্জ। কোমলগঞ্জের পাশে।’

হুস্না বেগম তাড়াতাড়ি উঠে গেলেন উনার রুমে। ছুটে এলেন একটা ছবি নিয়ে।

– ‘এই দেখো মা এটা হচ্ছে কলি আর তুলির ছোটবেলার ছবি। দু’জন জমজ ছিল। ১৯৯৮ এ ওদের নিয়ে বাবার বাড়ি থেকে লঞ্চে ফিরছিলাম। তখন লঞ্চ দূর্ঘটনা হয়। তখন আমরা তিনজন বেঁচে যাই। কিন্তু কলিকে পাওয়াই যায়নি। বড়ো হলে অবিকল তোমার মতো হতো আমার কলি।’

বিনোদিনী উনার চোখের দিকে তাকায়। যেন উনি চাচ্ছেন কলি বলুক আমি আপনার হারিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি। বিনোদিনী আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘তখন আমরা কোমলগঞ্জ ছিলাম না। আব্বা কোমলগঞ্জ মাস্টারি করতেন। আমরা চাচার সঙ্গে সিলেট থাকতাম।’

তিনি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,

– ‘ও আচ্ছা।’

এতো বছর এই ঘরে কলিকে নিয়ে আলাপ-আলোচনা বন্ধ ছিল। কলি একটা আক্ষেপের নাম। হুস্না বেগম বহু বছর প্রায় পাগল ছিলেন। তাই কেউই কলির আলোচনা করতো না। খানিক পর কলিংবেল বেজে উঠলো। হুস্না বেগম গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মুহিব খান এসেছেন। তিনি ফ্রেশ হওয়ার আগেই টেনে নিয়ে এলেন সিটিং রুমে। তুলি আর বিনোদিনীকে এক সঙ্গে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন।

– ‘আমার বাবা।’

বিনোদিনী সালাম দিল। হুস্না বেগম চোখের জল মুছে বললেন,

– ‘ও আমার আরেক মেয়ে। কিছুদিন এখানে থাকবে। তুমি ফ্রেশ হও গিয়ে।’

মুহিব খান পরিবেশ বুঝতে পেরে বললেন,

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আমি যাচ্ছি।’

বিনোদিনীর সবার সঙ্গে মিলে-মিশে গল্প-গুজব করে সন্ধ্যা কাটিয়ে দেয়৷ রাতে থাকে তুলির সঙ্গেই। ভোরে সবাই নাশতা করছেন। মুহিব খান বাইরে যাবেন। তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো৷ রহিমা গিয়ে দরজা খুলতেই সে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকলো।

বিনোদিনী একটু সিটিং রুমে আসো। কিছু জরুরি কথা আছে৷ আর এই নিন তুলির আপুর ব্যাগ।

বিনোদিনী চেয়ার থেকে উঠে বললো,

– ‘কি হয়েছে?’

তুলি বললো,

– ‘যান সমস্যা নেই, সিটিং রুমে গিয়ে শুনে আসুন।’

বিনোদিনী বিব্রতবোধ করছে। মুহিব খান নিশ্চয় বিরক্ত হচ্ছেন বাইরের মানুষের আনাগোনা দেখে। তারা সিটিং রুমে গেল৷

– ‘কি হয়েছে?’

– ‘তোমার ফোন বন্ধ পাচ্ছি, স্যার কি কল দিয়েছিলেন আমি যাওয়ার পর?’

– ‘না আমি সন্ধ্যার সময় নিজেই ফোন অফ করে রেখেছি। দিনে মাঝে মাঝে অন করেছিলাম।’

– ‘মনে হয় তোমাকে না পেয়ে স্যার রাতে আমাকে কল দিয়েছিলেন।’

– ‘কি বললেন?’

– ‘তুমি শান্ত হয়ে বসো, বলছি।’

– ‘হ্যাঁ বলো।’

– ‘স্যার প্রথমে বললেন বিনোদিনী নিশ্চয় তোমার কাছেই আছে। তাতে কোনো সমস্যা নেই বাবা। আমার বা বিনোদিনীর মায়ের তোমার সঙ্গে বিয়ে দিতে কখনও বাঁধা ছিল না। সমস্যা হলো গ্রামের হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়। তাছাড়া তোমার পরিবার বিনোদিনীকে মানছে না। এই অবস্থায় আমি কিভাবে মেয়ে বিয়ে দেবো? এভাবে তো সে সুখী হবে না। যাইহোক, তোমরা যখন পালিয়ে চলে গেছো। এখন একটা কথা বলি। তোমার পরিবারকে বলো ও হিন্দু না। আমাদের সন্তানই না বিনোদিনী৷ আমি দরকার হয় ওর পরিবারের সন্ধান বের করে দেবো। তবুও দেখো তোমার পরিবার মেনে নেয় কি-না৷ এরকম বাড়ি-ঘর ছাড়া পালিয়ে পালিয়ে তোমরা সুখী হবে না বাবা। আমি চাই বিনোদিনী সুখে থাকুক। এতদিন যে কথাগুলো গোপন রেখেছি। আজ ওর সুখের জন্য বলছি৷ আর তোমাদের ঠিকানা দাও৷ আমি আর ওর মা আসবো। আমরা নিজেই দাঁড়িয়ে বিয়ে দেবো তোমাদের।’

বিনোদিনী সোফায় দুই হাতে কপাল চেপে ধরে বসে আছে। এগুলো কি শুনছে সে! তাহলে ওর বাবা-মা কোথায়? কোনোভাবে কি তুলি তার আপন বোন? এতো কাকতালীয় ঘটনা ঘটছে কেন? কোনো স্বপ্ন দেখছে না-কি নাট্যমঞ্চে অভিনয় করছে? তুষার তার পিঠে হাত রেখে বললো,

– ‘এখন কি করবো?’

তুলি চোখ তুলে বললো,

– ‘তুমি আব্বুকে কল দাও, দিয়ে জিজ্ঞেস করো আমাকে কিভাবে পেয়েছিল। লঞ্চ ডুবিতে কি-না।’

– ‘তা কেন?’

– ‘তুমি জিজ্ঞেস করো।’

– ‘তুমি কথা বলো।’

– ‘না তুমিই কথা বলো।’

তুষার কল দেয়৷ একবার রিং হয়ে কেটে এলো। আবার কল দিতেই সঙ্গে সঙ্গে রিসিভ হলো।

– ‘হ্যালো।’

– ‘তুমি কেন কল দিছো?’

তুষার বিনোদিনীকে বললো,

– ‘আন্টি।’

– ‘জিজ্ঞেস করো তাকে।’

– ‘আন্টি বিনোদিনীকে আপনারা কিভাবে পেয়েছিলেন? কোনো লঞ্চডুবিতে না-কি?’

ওপাশে হাউমাউ করে কান্না ভেসে এলো৷

– ‘খুঁজে পাব কেন? ও আমার মেয়ে। তোমরা ওকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চাচ্ছ…।’

কথা শেষ হওয়ার আগেই ফোন যেন কেউ ছিনিয়ে নিল।

– ‘হ্যাঁ বলো তুষার।’

গলা শুনে সে বুঝলো স্যার। সালাম দিয়ে বললো,

– ‘আসলে কল দিয়েছিলাম একটা বিষয় জানতে। কোনো সমস্যা না থাকলে আমাকে কি বলবেন ওকে ঠিক কিভাবে পেয়েছিলেন?’

– ‘কোনো সমস্যা নেই বাবা। আমি নিজেই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেবো ওর বাবা-মায়ের সন্ধানে। ওরা নিশ্চয় এখনও বেঁচে আছেন। কোমলগঞ্জের পাশে একবার লঞ্চ ডুবেছিল। সেখানে আমি ওকে উদ্ধার করে সিলেট নিয়ে চলে এসেছিলাম। কারণ আমাদের কোনো সন্তান হবে না ডাক্তারই বলে দিয়েছিল। এদিকে তোমার আন্টি একটা সন্তানের জন্য পাগল প্রায়। তাই আমি সুযোগ পেয়ে এই কাজটা করেছিলাম। আর ওর বাবা-মা তখন নদীতে জ্বাল ফেলেও ওকে খুঁজে পায়নি৷ যাইহোক সবকিছু আমি নিজেই বলবো এসে বাবা।’

ফোন লাউডস্পিকারে থাকায় বিনোদিনী সবকিছু শুনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– ‘বলো বিজ্ঞাপন দেয়া লাগবে না। তারা আগে ঢাকায় আসুক।’

– ‘কি বলো?’

– ‘যা বলছি তা করো।’

তুষার ওর কথা মতো বললো,

– ‘বিজ্ঞাপন দেয়া লাগবে না স্যার। আমি ঠিকানা দিচ্ছি আপনারা চলে আসুন।’

– ‘বাবা বিনোদিনী কথা বলছে না কেন?’

– ‘এমনিতেই স্যার, সেইই বলছে বিজ্ঞাপন না দিয়ে এখানে আসতে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

অতি উৎসুক রহিমা আগেই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিল। তুষার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে আলাদা রুমে নিয়ে মেয়েটিকে কি বলবে তা না শুনে থাকা রহিমার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু লাইডস্পিকারে থাকায় সে যা শুনেছে তারজন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। কথাগুলো শুনে ছুটে গেল নাশতার টেবিলে।

– ‘খালাম্মা আমি শুনছি ওরা কলে কথা কইতাছে। মাইয়াটা মনে অয় আমাদের ছোট আপা। ওর আব্বা কলে বইলা দিছে উনাকে তারা লঞ্চ ডুবছিল তখন পাইছে।’

– ‘কি বলিস আবোল-তাবোল কথা।’

– ‘হ্যাঁ খালাম্মা, আপনি গিয়া জিগান।’

তারা ছুটে গেল সিটিং রুমের দিকে। বিনোদিনী দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে।
হুস্না বেগম তুষারের দিকে গিয়ে বললেন,

– ‘বাবা সত্য করে বলো তো ওকে না-কি ওর বাবা লঞ্চডুবিতে পেয়েছিলেন?’

সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘জি, ওর বাবা একটু আগেই বললেন এই কথা।’

– ‘কখন কোথায় লঞ্চ ডুবি হয়েছিল?’

বিনোদিনী সোফা থেকে উঠে জড়িয়ে ধরলো গিয়ে হুস্না বেগমকে।

– ‘আমিই আপনার কলি মা। ওরা কোমলগঞ্জ লঞ্চডুবিতে পেয়েছে আমায়। তাও ছোট্ট শিশু তখন। তারমানে ১৯৯৮ সালে।’

তুলি মুহিব খান সবাই বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছেন। ভাগ্য কলিকে কিভাবে ফিরিয়ে এনে দিয়েছে৷ মুহিব খান চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলেন না। কলি আর হুস্না বেগমকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

– ‘হুস্না আজ আমাদের বড়ো আনন্দের দিন। আমাদের এতো বছরের কান্না, আহাজারি আল্লাহ-তায়ালা শুনেছেন। আর এই লঞ্চ ডুবেছিল একেবারে কিনারায়। কারও কোনো ক্ষয় ক্ষতি হয়নি। এমনকি তুমি তুলিকে নিয়ে উঠে গেলে। আমি বাবা হয়ে কলিকে রাখতে পারিনি। আমার হাত থেকে কিভাবে পানিতে হারিয়ে গেল। আমি কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারিনি।’

তুষার অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কি হচ্ছে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। বিনোদিনী কি তাহলে তাদের সন্তান? কিভাবে কি হয়েছে? তবে যেরকমই হোক, এখন আর বিনোদিনীকে বিয়ে করতে ওর পরিবারের বাঁধা থাকবে না।

খানিক পরেই রহিমা হুস্না বেগমের মোবাইল নিয়ে এলো।

– ‘খালাম্মা ফোন আইছে আপনার।’

তুলি সোফায় বসে একা একা মুখ ঢেকে কাঁদছে। হারানো বোনকে অপ্রত্যাশিতভাবে খুঁজে পাওয়ার আনন্দাশ্রু। হুস্না বেগম নাম্বার দেখে ফোন রিসিভ করলেন না।
কলি বললো,

– ‘কার কল?’

– ‘তুলির শ্বাশুড়ি।’

কলি শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,

– ‘দেখো মা, কাল বাইরের মেয়ে ছিলাম তাই কিছু বলিনি। তুমি দুলাভাইয়ের সঙ্গে কিন্তু বাড়াবাড়ি করেছো। জানো উনি রেস্তোরাঁয় বলেছে, ‘লজ্জা লাগছে তুলির সামনে দাঁড়াতে, আমার মতো নোংরা মানুষের সঙ্গে তুলি আর সংসার করুক আমি তা চাই না, এখন আমার উচিত গাড়ির নিচে পড়ে আ’ত্মহত্যা করা।’ তারপর আমিই টেনে এনেছি। আর তুমি কি-না যাচ্ছে-তাই ব্যবহার করেছো। এখন কল রিসিভ করে সুন্দর করে কথা বলবে। রিসিভ করো।’

হুস্না বেগম কলির মুখে ‘মা’ ডাক শুনে অভিভূত হয়ে গেলেন। ওর কথামতো ফোন রিসিভ করলেন তিনি।

– ‘হ্যালো।’

ওপাশে অস্থির গলা,

– ‘একটা দূর্ঘটনা ঘটে গেছে৷ ইশতিয়াক গতকাল আমাদের ওখানে এসে কাঁদতে কাঁদতে বললো তুলির কোনো দোষ নেই। সে ভুল বুঝে ওর গায়ে হাত তুলেছে। আমি তাকে বললাম আচ্ছা আমি আর তার বাবা গিয়ে কথা বলে সব ঠিকঠাক করে নিব। কিন্তু আজ সকালে ওর রুমে গিয়ে দেখি রক্ত ফ্লোর ভেসে যাচ্ছে। ওর দুই-হাত ব্লেড দিয়ে ফালিফালি করে ফেলেছে। অজ্ঞান অবস্থায় আমরা হসপিটাল নিয়ে এসেছি। দোয়া করবেন আমার ছেলেটার জন্য। আর পারলে তুলিকে পাঠাবেন বুঝিয়ে। ছেলেটা নিজের ভুল বুঝতে পেরে গতকাল অনেক কেঁদেছে।’

– ‘কোন হসপিটাল?’

তুলি হসপিটাল শুনেই মাথা তুলে তাকায়। হুস্না বেগম হসপিটালের নাম শুনে ফোন রাখেন। মুহিব খান বললেন,

– ‘কি হয়েছে?’

তিনি আমতা-আমতা করে বললেন,

– ‘ইশতিয়াক হসপিটাল।’

___চলবে__

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-১০

0

সেই মেয়েটি আমি নই
১০ পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

বিনোদিনীর ক্লান্ত শরীর। এতদিন বলতে গেলে বন্দীই ছিল সে। ছিল তুষারের জন্য বিরহ। আজ আবার পুরো রাত মাজারে বসে বসে কাটিয়েছে৷ তাই আর তুলির প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলার শক্তি পেল না। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল তুষারের বুকে। বাস চলছে দ্রুত গতিতে। হঠাৎ বেজে উঠলো তুষারের ফোন। বিনোদিনীরও ঘুম ভেঙে গেল। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখে তার ফুপু। নয়টার দিকেও একবার কল দিয়েছেন সে রিসিভ করেনি। ভেবেছিল উনি ব্যাংকে চলে গেলেই আর কল দেবেন না। কিন্তু এখন অফিস টাইমে আবার কল দেয়ার কারণ কি?
বিনোদিনী বললো,

– ‘রিসিভ করলে সমস্যা কি? করো রিসিভ।’

তুষার কল রিসিভ করে,

– ‘হ্যালো।’

– ‘কিরে তুই কোথায়, কল রিসিভ করিস না কেন?’

– ‘ফুপু খেয়াল করিনি। আর এখন আমি বাসেই আছি।’

– ‘আচ্ছা আগে এটা বল। তুই যে রুমে ঘুমাস সেখানে বিছানায় একটা ভ্যানিটিব্যাগ দেখলাম, সেটা কার?’

তুষার কি বলবে ভেবে না পেয়ে আমতা-আমতা করতে লাগলো। তখন ফুপু আবার বললেন,

– ‘ওই ব্যাগ খুলে একটা মোবাইল পেলাম। মোবাইল লক করা। কিন্তু ক্লিক করতেই ডিসপ্লেতে আমার কলিগ ইশতিয়াক আর একটা মেয়ের ছবি দেখলাম। হয়তো উনার স্ত্রী। বুঝলাম না এই ব্যাগ তুই কোথায় পেলি। তুমি কি ছিনতাই-টিনতাই শুরু করলি না-কি?’

তুষার ব্যস্ত হয়ে বললো,

– ‘না ফুপু, উনার বউকে আমি চিনি। আর ওটা ভুলে ফেলে চলে গেছে তাই নিয়ে রাখছিলাম। ফেরত দিয়ে দিব।’

– ‘কি বলিস এসব? তুই চিনিস কিভাবে।’

– ‘এগুলো এখন থাক, বাড়িতে এসে বলবো ফুপু।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ফোনলাপ শুনেই বিনোদিনীর মুখ ঝলমল করে উঠলো। ভাগ্য ভালো মেয়েটির স্বামীর সন্ধান কাকতালীয়ভাবে পেয়ে গেছে। কিন্তু কল রাখতেই দাঁত কটমট করে বললো,

– ‘আশ্চর্য তুমি আন্টির কাছ থেকে লোকটির বাসার ঠিকানা বা ফোন নাম্বার নিয়ে নিলে না কেন?’

– ‘ও স্যরি খেয়ালই ছিল না। তবে তাড়াহুড়োর কিছু নেই। বাসায় গিয়েও ফুপুর কাছ থেকে পাব।’

– ‘বোকা না-কি? তুমি কি বুঝতে পারছো না আমাদের জন্য আরেকজনের অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুল ভাঙানো দরকার।’

– ‘এখন কি করবো?’

– ‘তুমি ওই লোকটির নাম্বার আনো। তারপর কল দিয়ে বলো যে ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেছে৷ তুমি যাকে ভালোবাসো ওর চেহারা অবিকল উনার স্ত্রীর মতো।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

তুষার আবার ওর ফুপুকে কল দিল। কিন্তু রিং হয়ে কেটে এলো।

– ‘উনি ব্যস্ত হয়তো এখন।’

– ‘তা হবেনই। আচ্ছা দেখো ব্যাক করেন কি-না।’

তারা পাঁচটার দিকে ঢাকা এসে পৌঁছে। মহাখালী বাসস্টেশনে নামতেই কল এলো তার ফুপুর। ফুপু কল ব্যাক করেছেন।

– ‘রিসিভ করো।’

তুষার কল রিসিভ করল,

– ‘হ্যালো ফুপু।’

– ‘হ্যাঁ বল, তখন ব্যস্ত থাকায় ধরতে পারিনি।’

– ‘তোমার এই কলিগের নাম্বারটা দাও তো টেক্সট দিয়ে।’

– ‘ঘটনা কি বলতো? এই লোকটাকেও আজ ব্যাংকে দেখলাম চোখের নিচ কালো হয়ে গেছে৷ সারাক্ষণ কালো মুখ করে ছিল অফিসে৷ কারও সঙ্গে কথাও বলেনি।’

– ‘তেমন কিছু না ফুপু। পরে বলবো। এখন নাম্বার দাও।’

– ‘আচ্ছা দিচ্ছি।’

তিনি নাম্বার দিলেন টেক্সটে।

– ‘চলো কোনো রেস্টুরেন্টে বসি। নাশতা করতে করতে কল দেয়া যাবে।’

– ‘হ্যাঁ, আচ্ছা চলো।’

দু’জন পাশের একটা রেস্তোরাঁয় গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে বসে।

– ‘আবার দিয়ে দেখো।’

তুষার আবার কল দেয়। খানিকক্ষণ রিং হতেই রিসিভ হয়। ওপাশে গাড়ির শব্দ শোনা যাচ্ছে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘হ্যাঁ বলুন, কে বলছেন।’

তুষার কেশে নিয়ে বললো বললো,

– ‘ভাইয়া গতকাল আপনার ওয়াইফের সঙ্গে যাকে দেখেছিলেন।’

– ‘হোয়াট, তুই আমাকে কল দিয়েছিস কেন?’

– ‘ভাই একটা বড়ো ধরণের ভুল বুঝাবুঝি হয়ে গেছে।’

– ‘কি ভুল বুঝাবুঝি, নাটক না করে বল। না হয় রাখ ফোন।’

– ‘ভাই অস্থির হইয়েন না। আসলে কথা হলো আপনার ওয়াইফ আর আমার প্রেমিকা একজন না। দু’জনের, কণ্ঠ চেহারা সবকিছু এক, কিন্তু মানুষ ভিন্ন।’

– ‘কি বললি? আবার বল।’

– ‘আপনার ওয়াইফ নির্দোষ৷’

– ‘ফাজলামি করতে কল দিয়েছিস?’

– ‘ফাজলামো না ভাই, সত্য।”

– ‘তুলি টাকা-পয়সা দিয়ে মানাইয়া ফেলছে, এখন নাটক করছিস?’

বিনোদিনী মোবাইল কান থেকে নিয়ে বললো,

– ‘ভাইয়া আমি সেই মেয়ে। যার সঙ্গে আপনার স্ত্রীর চেহারার মিল। আমরা এখন মহাখালী আছি, চাইলে আসুন। সরাসরি কথা বলি।’

ইশতিয়াক ওর কণ্ঠ শুনে থমকে যায়। অবিকল তুলির মতো।

– ‘আচ্ছা আমি আসছি৷ আপনারা মহাখালী কোথায় এখন?’

– ‘বাস-স্টেশনের কাছেই আপনি এসে কল দিন।’

– ‘আচ্ছা আসছি।’

কল রাখতেই তুষার রূঢ় গলায় বললো,

– ‘এই লোকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে কেন? জানো কেমন বদমেজাজি এই লোক। এখানে এসে আবার কি থেকে কি শুরু করবে।’

– ‘যাইই শুরু হোক। তাদের ভুল বুঝাবুঝি দূর করে আমাদের ক্ষমা চাওয়া দরকার। কারণ তোমার আর আমার কারণে এক নিরপরাধ মেয়ে মানসিক শাস্তি পাচ্ছে।’

– ‘শুধু মানসিক না। ওর হাসবেন্ড এমন লোক শারীরিক শাস্তিও দেবে।’

– ‘তো সেটা কার জন্য?’

তুষার চোখ নামিয়ে চুপচাপ বসে রইল। বিনোদিনী ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘অবিকল আমার মতো বলে একেবারে কাছে যাওয়ার পরও বুঝবে না? না-কি ইচ্ছা করে অন্যের বউকে জড়িয়ে ধরলে?’

– ‘আরে না, একদম সবকিছু একইরকম। শুধু ওই মেয়ে একটু মোটা। আমি ভাবলাম বিয়ের পর তো একটু-আধটু পরিবর্তন হতেই পারো।’

– ‘দেখতে ইচ্ছা করছে মেয়েটিকে।’

– ‘এতো ইচ্ছার দরকার নাই। ঝামেলা বাড়িয়ে কি লাভ। নিজেদেরই এখন বহুত ঝামেলা আছে।’

এভাবে তাদের আলাপচারিতা চলছে। হঠাৎ কল এলো ইশতিয়াকের।

– ‘হ্যালো কোথায় আপনারা?’

হোটেলের নাম বললো তুষার। খানিক পরেই ভেতরে এসে ঢুকলো ইশতিয়াক। তুষারের পাশের মেয়েকে দেখে যেকেউ বিভ্রান্ত হবে তুলি ভেবে। এটা কিভাবে সম্ভব? জমজ কিংবা আত্মীয় ছাড়াও কি অবিকল দু’জন মানুষ একইরকম হয়? কিন্তু এখন সে কি করবে? তুলির সঙ্গে সে যা করেছে মাফ চাইতে ওতো লজ্জা লাগবে।

– ‘বসুন ভাই।’

ইশতিয়াক চেয়ার টেনে বসে এক গ্লাস পানি খেল।

বিনোদিনী মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘এখন বিশ্বাস হইছে?’

ইশতিয়াক টেবিলে কনুই ঠেকিয়ে দুই হাতে মুখ অজলা করে বসে অস্ফুটে বললো,

– ‘বিশ্বাস করে আর কি হবে? সর্বনাশ যা হওয়ার তো হয়েই গেছে।’

তুষার আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘পার্কে ভাই আরেকটু সময় গেলে হয়তো ধীরে ধীরে সব খোলাসা হয়ে যেতো। উনি এসেছিলেন আমাকে বুঝাতে যে উনি ছবির মেয়েটি না। আমি যেন আর কল না দেই। উনার সংসারে সমস্যা হচ্ছে। রাতেও এগুলো বলেছেন। তবুও আমি বুঝতে পারিনি। আমার আসলে মাথাই ঠিক ছিল না ওকে হারিয়ে। আমি ভেবেছি উনি মিথ্যে বলছে। আর পার্কে দেখেই আমি জড়িয়ে ধরলাম উনি কিছু বলার আগেই। আপনিও ঝাপিয়ে পড়লেন। দোষ আপনার আর আমার। মাঝখান থেকে উনি….।’

কথা শেষ করার আগেই ‘টাস’ করে চড় এসে পড়লো তার গালে।

– ‘থাম তুই বলদের বাচ্চা।’

দুই হাতে মুখ ঢেকে ইশতিয়াক কান্না আঁটকে রাখতে পারছে না। বিনোদিনী তুষারের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে ইশতিয়াককে বললো,

– ‘ভাই শান্ত হোন। সবাই তাকাচ্ছে৷ আপুর বাসায় না হয় চলুন। আমরাও আপুর কাছে মাফ চাইব, আপনার পক্ষ হয়েও বুঝাবো। দেখবেন আপু আর রেগে থাকবে না। আশাকরি সব ঠিক হয়ে যাবে।’

– ‘ঠিক হবার নয়। আমি যা করেছি লজ্জায় আর ওর সামনেও দাঁড়াতে পারবো না।’

– ‘ভাই এসব ভাববেন না। এখন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আপুর রাগ ভাঙাতে হবে। উনিও হয়তো কষ্ট পাচ্ছেন আপনাকে ছাড়া। অকারণ উনার আর কষ্ট বাড়াবেন না।’

– ‘সে আর আমাকে ছাড়া কষ্ট পাবে না। এখন আমাকে ঘৃণা করে। আমি যা করেছি ঘৃণা করারই কথা। আমি আর ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো না।’

তুষার অবাক হয়ে দেখলো।
বিনোদিনী লোকটির হাত ধরে টেনে বলছে,

– ‘উঠুন তো ভাই, যা হবার হয়ে গেছে। ভুল বুঝাবুঝি হয়েছিল। আপনিও না বুঝে হয়তো অতিরিক্ত করেছিলেন। এই শিক্ষার কারণে ভবিষ্যতে আর এমন করবেন না এটাই নিয়ম।’

ইশতিয়াকের চোখ দু’টো লাল হয়ে আছে৷ সে বিনোদিনীর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘আমি লোকসম্মুখে ওর গায়ে হাত তুলেছি। বাসায় নিয়েও মেরেছি। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করেছি৷ মাফ চাওয়ার আর কিছু নেই। আমিও আর চাই না আমার মতো নোংরা মানুষের সঙ্গে তুলি থাকুক। আমার উচিত এখনই বের হয়ে গাড়ির নিচে পড়ে মরা।’

– ‘এসব কথা একদম বলবেন না। উনি মাফ করবে কি-না উনার বিষয়। আপনার আগে নিজের ভুলের জন্য মাফ চাওয়া উচিত।’

ইশতিয়াক কিছু না বলে চুপচাপ বসে আছে।

বিনোদিনী আবার হাত ধরে টেনে বললো,

– ‘চলুন ভাই আমরাও সঙ্গে যাব। আপনি কিন্তু নতুন করে আরেকটা ভুলের দিকে যাচ্ছেন।’

ইশতিয়াক মনে মনে ভাবলো কথাটা ঠিক। সব সময় সে ভুল সিদ্ধান্তই নেয়। অন্যের ভালো কথাও গ্রহণ করে না। তার নিজের কাছে এখন নিজেকে অস্বাভাবিক মানুষ মনে হচ্ছে। উঠে দাঁড়াল ইশতিয়াক৷ বিনোদিনীর বাড়াবাড়ি দেখে তুষার দাঁত কটমট করে তাকাচ্ছে। সেদিকে ওর খেয়াল নেই। বিনোদিনী রেস্তোরাঁর বাইরে এসে বললো,

– ‘একটা সিএনজি আনো।’

তুষার বাধ্য হয়ে গেল সিএনজি ডাকতে। খানিক পর তারা সিএনজিতে উঠে বসে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যামজট ঠেলে মুগদা পৌঁছাতে অনেক্ষণ লেগে যায়। বাসার গেইট খুলে কলিংবেল চাপলো বিনোদিনী। ইশতিয়াক বিধ্বস্ত অবস্থায় পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা খুলে দিল রহিমা। সে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে আছে। তার আপুর তো এরকম ড্রেস নেই। দেখতেও আরেকটু মোটা। তাছাড়া একটু আগেই রুমে দেখে এসেছে। তাহলে অবিকল আপুর মতো এই মেয়েটি কে?

– ‘আমরা কি ভেতরে আসব?’

– ‘হ্যাঁ আসেন।’

তিনজনকে সিটিং রুমে বসতে দিয়ে রহিমা দৌড়ে গেল হুস্না বেগমের কাছে।

– ‘খালাম্মা নিজের চউক্ষে দেখেন আইসা। পুরা আপার মতো একটা মেয়ে।’

– ‘কি বলিস, কোথায়?’

– ‘দুলাভাইয়ের সঙ্গে এসেছে।’

– ‘তোর দুলাভাই আসছে না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

তিনি বের হয়ে গেলেন সিটিং রুমে। মেয়েটিকে দেখে সত্যিই অবাক হলেন। কিন্তু এখন এসব নিয়ে ভাবার সময় নেই। ইশতিয়াক কেন এসেছে। ঘটনা কি এসব জানতে হবে। তুষারই প্রথমে বললো,

– ‘আন্টি আমরা এসেছি আপুর কাছে ক্ষমা চাইতে। আর দুলাইভাইয়েরও ভুল ভেঙ্গেছি। এখন উনিও অনুতপ্ত।’

কথাগুলো শুনে রহিমা নিজ থেকেই ছুটে গেল তুলির রুমের দিকে৷ সে ভেতরে ভেতরে ভীষণ উত্তেজিত। দু’টো একইরকম মানুষ একসঙ্গে দেখতে কেমন লাগে? কি ঘটে সে দেখতে চায়। তুলির দরজা বন্ধ। ছিটকিনিতে সে লাগাতার ‘ঝনঝন’ শব্দ করতে থাকে। তুলি দরজা খুলে ধমকের সুরে বললো

– ‘পাগলের মতো এমন করছিস কেন, কি হয়েছে?’

– ‘আপা যা দেখেছি আপনিও পাগল হয়ে যাবেন।’

– ‘মানে?’

– ‘সিটিং রুমে কে বসে আছে শুধু দেখেন আইসা।’

– ‘কে বসে আছে?’

– ‘পুরাই আপনার মতো এক মাইয়া আপা। আল্লাহর দুনিয়ায় কত কিসিমে’র লোক।’

রহিমার এতো উত্তেজনা দেখে। তুলিও আর বসে থাকতো পারলো না। অবিকল তার মতো দেখতে আবার কে এলো। ওড়না মাথায় দিয়ে বের হয়ে গেল সে।

দরজা দিয়ে সোজা দেখা যাচ্ছে তুষার আর বিনোদিনীকে। অপর পাশে ইশতিয়াক থাকায় দেখেনি। বিনোদিনীর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রুমে ঢুকে, কিন্তু হুট করে চোখ পড়ে যায় ইশতিয়াকের দিকে। পুনরায় সে বের হতে হতে বলে এলো,

– ‘মা এই জঘন্য মানুষকে এই বাড়িতে দেখতে চাই না। এখান থেকে বের করে দাও।’

তুলি ছুটে চলে গেল নিজের রুমে। হুস্না বেগম তুষারকে বললেন,

– ‘আচ্ছা ঠিক কি হয়েছে সবকিছু খুলে বলো তো।’

তুষার পেছনের সবকিছু বলে সেদিন পার্কের প্রসঙ্গে এলো। যখনই বললো আমি বিনোদিনী ভেবে আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছি। তখন হুট করে ভাইয়া আমাকে হেঁচকা টেন দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। সঙ্গে আপুও গিয়ে পড়ে গাছের গোড়ায়। আমি আপুকে তুলে উনার দিকে আসতেই আমাকে আবার মারতে শুরু করবেন। ঠিক তখন আপু দৌড়ে এসেছিল ছাড়িয়ে নিতে।
তখন উনি আপুকেও চড় মেরে বলে,
নষ্টা চরিত্রহীন মেয়ে, বিয়ের পরও আগের নাগরের সঙ্গে পার্কে এসেছিস।
আপু তখন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। তারপর উনি হাত ধরে টেনে পার্ক থেকে নিয়ে বেরিয়ে গেল।

হুস্না বেগম কথাগুলো শুনে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না৷ তিনি আগে শুধু ভেবেছিলেন বেল্ট দিয়ে মেরেছে৷ তাও সেরকম কোনো দোষ করেছে হয়তো৷ কিন্তু সবকিছু শুনে উনার কলিজা ফেটে যাচ্ছে। উনার একমাত্র মেয়েকে অকারণ কেউ লোক সম্মুখে অশ্রাব্য গালাগাল করে মারবে? আবার বাসায় নিয়েও বেল্ট দিয়ে প্রহার করেছে৷ কথাগুলো ভেবে তিনি প্রচণ্ড রেগে গেলেন। হুট করে দাঁড়িয়ে তেড়ে গেলেন ইশতিয়াকে দিকে।

– ‘এই ব্যাটা তুই উঠ। আমার বাড়ি থেকে বের হয়ে যা এখনই। তুই আমার নির্দোষ মেয়েকে পার্কে নষ্টা চরিত্রহীন বলবি। চড় মারবি। বাসায় হাত ধরে টেনে নিয়ে বেল্ট দিয়ে মারবি। এখন আবার এখানে এসেছিস, তুই পেয়েছিস কি? দোষ করলে তো তুই মেরে ফেলতি…।’

ইশতিয়াক মাথা নুইয়ে বসে আছে। বিনোদিনী তাড়াতাড়ি উঠে এসে ধরলো হুস্না বেগমকে।

– ‘আন্টি বাদ দিন, সংসারে এরকম কত হয়। আপনি মুরব্বি মানুষ এমন কইরেন না।’

তিনি চোখ লাল করে বললেন,

– ‘ছাড় আমাকে, এমন ব্যাটার ঘর করার চেয়ে আমার মেয়ে এখানেই সারাজীবন থাকবে। পড়ালেখা করিয়ে বড়ো করেছি কি ওর মতো গ’রুর বা’চ্চার সংসার করতে? এই ব্যাটা তুই বের হয়ে যা চোখের সামন থেকে। তোকে আমি পুলিশে দেবো। আমার মেয়ের পিঠে এখনও বেল্টের দাগ আছে। চলে যা না হয় জুতোপেটা করবো বলে দিলাম।’

ইশতিয়াক লজ্জায়-আপমানে চুপচাপ সিটিং রুম থেকে বের হয়ে গেল।

___চলবে__

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৯

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৯ম পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

ইশতিয়াক বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে একের পর এক সিগারেট টানছে। তার এখনও মেজাজ গরম হয়ে আছে। একদম ন’ষ্টা মেয়ে। আবার কত বড়ো বেয়াদব তাকে চ’ড় মেরেছে। এই মেয়েকে সে ডিভোর্স দেবে। এমন মেয়েকে সে কিভাবে ভালোবেসেছিল? কিভাবে ওর প্রেমে পড়েছিল? নিজের রুচির প্রতি ঘে’ন্না লাগছে তার। খানিক পরেই তার ফোন বেজে উঠলো৷ মেয়ের কল। রিসিভ করলো সে।

– ‘হ্যালো।’

– ‘ইশতিয়াক, বাবা হঠাৎ কইরা কি সমস্যা হইছে রে?’

– ‘কি সমস্যার কথা বলছো?’

– ‘তুলির মা কল দিয়েছেন৷ তুই না-কি তুলির গায়ে হাত তুলেছিস? এটা তুই কি করলি বাবা? মেয়েটা না-কি তাদেরকে কারণ কিছুই বলছে না এখন সে শুধু ডিভোর্স চায়।’

ইশতিয়াক ক্রোধে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল।

– ‘সে আবার ডিভোর্স চাইবে কি? আমি তাকে ডিভোর্স দেবো। আর চাইবেই তো ডিভোর্স। কোন মুখে আর সংসার করবে ন’ষ্টা মাইয়া।’

– ‘বাবা মাথা ঠান্ডা কর। সংসার করতে গেলে অনেক ঝামেলাই হয়। তাই বলে গালাগাল দিতে হয় না, গায়ে হাত তুলতে হয় না, ডিভোর্স দিতে হয় না৷ তোর বাবা তুলির মা’কে বলেছেন এখনই ডিভোর্স ডিভোর্স না করে তোদের দু’জনকে নিয়ে আগে বসতে। কি হয়েছে সবকিছু আগে আমরা বুঝি৷ এর আগপর্যন্ত মেয়ে ওর মা-বাবার কাছেই থাকুক।’

– ‘এতো বুঝাবুঝির কিছু নাই মা৷ এই মেয়ের সঙ্গে সংসার করতে পারবো না।’

– ‘তুই কোনো মেয়ের সাথেই সংসার করতে পারবি না ইশতিয়াক৷ এই মেয়ে ভালো তাই এতদিন থেকেছে।’

তুলি ‘ভালো’ শুনে ওকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল শুরু করলো ইশতিয়াক৷ তার বাবা মোবাইল নিয়ে বললেন,

– ‘হ্যালো আমার কথা শোন।’

– ‘হ্যাঁ বলো কি বলবা।’

– ‘তোর সংসার করা লাগবে না। মেয়ে তো এখন মায়ের কাছে আছেই। আজ সোমবার। আগামী শুক্রবারে আমি আর তোর মা যাব তুলিদের বাসায়। তোর ইচ্ছা হলে যাবি। না হলে তোর যেতেও হবে না৷ শুধু নতুন কোনো বাড়াবাড়ি করবি না। আমরা আগে যাই, সবকিছু শুনি। ডিভোর্স তখন দিতে হলে দেয়া যাবে।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। যাই করো এই মেয়ে এখানে আর আসতে পারবে না।’

– ‘আচ্ছা, এবার নিজের অফিস-টফিস সব স্বাভাবিকভাবে কর। রাখলাম।’

কল কেটে গেল। ইশতিয়াক আবার সিগারেট ধরায়। অফিস তো সে স্বাভাবিকভাবেই করবে। সবকিছুই স্বাভাবিকভাবে চলবে। এই মেয়ের জন্য কিছুই আঁটকে থাকবে না। খালি ফ্ল্যাট। বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডা দেবে, তাস খেলবে। দরকার হয় ম’দ আনাবে।

পরেরদিন ইশতিয়াক স্বাভাবিকভাবেই অফিসে গেল। তুলি সারাক্ষণ রুমেই দরজা বন্ধ করে কাটাচ্ছে৷ ভোরে হুস্না বেগম নাশতা দিতে এলে বলেছে সে মাস্টার্সে ভর্তি হবে আর জব দেখবে। হুস্না বেগম তখন ইশতিয়াকের মায়ের কথা বললেন। তারা কিছু সময় চেয়েছেন। শুক্রবারে এসে কি হয়েছে জানতে চাচ্ছেন। তুলি উত্তরে বলেছে। বসাবসির কিছু নেই মা। আমি এসব বিষয়ে কাউকে কিছু বলবো না। তারা তাদের ছেলের কাছ থেকেই জানুক কি হয়েছে। আর কোনো কথা বাড়াননি হুস্না বেগম। মেয়েটি আপাতত নিজেত মতো থাক। ‘নাশতা কর মা’ বলে তিনি বের হয়ে গেলেন।

*
তুষার রাত এগারোটায় সিলেট এসে পৌঁছেছিল। রাস্তায় অনেক জ্যাম থাকায় এতো দেরি হয়েছে৷ মাজারে এসে যখন সে বিনোদিনীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তখন বারোটা ছুঁইছুঁই৷ এই সময়ে ঢাকা ফিরে যাওয়া সম্ভব ছিল না। এদিকে অচেনা এই শহরে অবিবাহিত দু’জন ছেলে-মেয়ে কোথায় হোটেল পাবে তাও জানা নেই তাদের। তাই মাজারেই আলাদা বসে সময় কাটিয়েছে। এর ভেতরে দু’জন নিজেদের কৌতূহলী প্রশ্ন করে সেরে নিয়েছে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা। সবকিছু জেনে বিনোদিনী হতবাক। ওর মতো অবিকল একটা মেয়ে আছে শুনে বিশ্বাসই হচ্ছে না। অন্যদিকে বিনোদিনী সিলেট কিভাবে এসেছে। এতদিন কোথায় ছিল। কেন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি। সবকিছু শুনে তুষারও অবাক। তারা দু’জনের বাড়িই কোমলগঞ্জ। তুষার মুসলিম, বিনোদিনী হিন্দু৷ ওর বাবা স্কুল শিক্ষক। তুষার বিনোদিনী একই স্কুলে পড়তো। তুষার ছিল ওর দুই ক্লাস উপরে। কিন্তু পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় এক সঙ্গেই যাওয়া-আসা হতো তাদের। সেই থেকেই ধীরে ধীরে তাদের প্রেম হয়ে যায়। উঠতি বয়সের এই প্রেম এক সময় গড়ায় শারিরীক সম্পর্কে। কিন্তু বছর কয়েক আগে থেকে গ্রামে হিন্দু মুসলিমদের মাঝে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে ক্ষমতার লড়াই। একে অন্যের প্রতি হিংসা-বিভেদ৷ বিনোদিনীর বাবা এই গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না। স্ত্রী থাকতেন সিলেট আর তিনি কোমলগঞ্জ থেকে শিক্ষকতা করাতেন৷ কিন্ত একটা সময় এই গ্রামেই স্ত্রীকে এনে ঘর-বাড়ি করে বসবাস শুরু করেন। কারণ গ্রামে নিজের সম্প্রদায়ের প্রচুর মানুষ আছে। সবার সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন অনেক। কয়েক বছর থেকে হিন্দু-মুসলিম ছেলে-মেয়েদের প্রেম নিয়ে দুই ধর্মালম্বীর লোকই বিরক্ত। এসব নিয়ে কিছুদিন পর পর দুই গোত্রে ঝামেলা হয়, বিচার-আচার হয়৷ তাই যখন তুষার আর বিনোদিনীর বিষয় ছড়িয়ে পড়ে এবং তুষার বাড়াবাড়ি শুরু করে। তখনই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোক বসে সীদ্ধান্ত নেয় তারা এখন থেকে এসব মিলে-মিশে প্রতিরোধ করবেন৷ কিছুদিন পর পর প্রেম করে মেয়েরা মুসলমান হবে। এগুলো আর মানা যায় না৷ বিনোদিনী হঠাৎ পালিয়ে যেতে পারে এই ভয়ে তারা মাস্টারকে ডেকে বললেন মেয়েকে নিয়ে কোথাও চলে যেতে। এর ভেতরে তারা সবাই মিলে নিজের সম্প্রদায়ের ছেলে খুঁজে বিনোদিনীকে বিয়ে দেবেন। আর এভাবেই এখন থেকে সবাই মিলে-মিশে এই সমস্যাগুলোর প্রতিরোধ করবে। মাস্টার পড়লেন বিপদে। একদিকে স্বজাতির চাপ, অন্যদিকে মেয়ে। তাছাড়া বিনোদিনীকে এখান থেকে নিয়ে যাবেন কিভাবে? অনেক ভেবে ওর খাবারে ঘুমের ওষুধ দিলেন। ঘুমানোর পর মুখ-হাত বেঁধে রাতেই গাড়ি করে গ্রাম থেকে সিলেট নিয়ে যান৷ সিলেট উনার ভাই চা বাগানে থাকে। বিনোদিনী সেখানেই কড়া নজরদারিতে ছিল। এদিকে তুষার ওর খুঁজে পাগল। বিনোদিনীর কোনো খুঁজ নেই। পাগল হয়ে ঘুরে। মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকও হিন্দু-মুসলিম ছেলে-মেয়েদের এসব বিব্রতকর পরিস্থিতি নিয়ে বিরক্ত। তাই তুষারের বাবার কাছে নানান কথা আসতে লাগলো। তিনি অনেক ভেবে সিদ্ধান্ত নিলেন ছেলেকে আপাতত গ্রামে রাখবেন না। তাই ফুপুর বাসায় পাঠিয়ে দিলেন। এলাকায় কখন কোন ঝামেলায় জড়াবে বলা যায় না। শোনা যাচ্ছে মাস্টারের পরিবারের কাউকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরিবারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তুষার ঢাকা ফুপুর বাসায় উঠে। এখানে বেশ কিছুদিন থাকার পর হঠাৎ একদিন কাকতালীয়ভাবে রাস্তার অপর পাশ থেকে তুলিকে দেখে ফ্লেক্সিলোডের দোকান থেকে বের হতে। তুলিকে দেখে ভাবে এটা তার বিনোদিনী৷ ছুটে যায় রাস্তা পার হতে। কিন্তু রাস্তা দ্রুত গাড়ি চলাচলের কারণে যেতে যেতেই হারিয়ে ফেলে ওকে। তখনই মাথায় আসে ফ্লেক্সিলোডের দোকানের কথা। নিশ্চয় সেখানে নাম্বার পাবে ওর। সে গিয়ে দোকানিকে বললো মোবাইলে রিচার্জ করবে। দোকানী তখন খাতা মেলে বললো নাম্বার বলুন। নাম্বার মুখস্থ থাকলেও তুষার তখন এমনভাবে নাম্বার বলে যেন মোবাইল দেখেই বলতে হচ্ছে তার৷ এই সুযোগে ক্যামেরায় গিয়ে খাতার পুরো পেইজের ছবি তুলে নেয়। বাসায় এসে শেষের নাম্বার তুলে সেভ করতেই ইমু হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে তুলির ছবি দেখে ভাবে এটাই তার বিনোদিনীর নাম্বার।

এখন সকাল এগারোটা। তুষার আর বিনোদিনী বাসে বসে আছে৷ কপালের অবাধ্য চুল সরিয়ে নিয়ে বিনোদিনী বললো,

– ‘মেয়েটার জন্য কষ্ট হচ্ছে। তোমার কারণে সে লাঞ্চিত হলো। ওদের সংসারে ঝামেলা সৃষ্টি হলো। যাইই বলো ওদেরকে খুঁজে বের করে মাফ চেয়ে সব খুলে বলা উচিত।’

– ‘তোমার কি মাথায় দোষ? আমরা এখন কি করবো সেটা ভাবো। ফুপুর বাসায় আর যেতে পারবো না। আমি মোবাইলের শো-রুমে কাজ পেয়েছি কিছুদিন হল। টাকা-পয়সাও নেই। থাকবো কোথায়, বিয়ে করবো কিভাবে সেটাই ভাবছি।’

– ‘তুমি আপাতত ফুপুর বাসায়ই থাকতে পারবে। ওরা তো আর জানে না আমাকে নিয়ে এসেছো। সুতরাং তুমি ফুপুর বাসায় থাকো আর আমাকে কোথাও থাকার ব্যবস্থা করে দাও। তারপর মাস শেষ হলে বেতন পাবে। এরমাঝে বাসাও খুঁজে নেবে।’

– ‘কিন্তু তোমাকে রাখবো কোথায়?’

– ‘আমার কাছে কিছু টাকা আছে। তুমি কোথাও রাখার ব্যবস্থা না করতে পারলে আমি আপাতত একটা জায়গায় উঠতে পারবো।’

– ‘কে?’

– ‘মিলন আর রাধিকা যে পালিয়ে বিয়ে করেছিল ওরা ঢাকায়ই থাকে। আমার সঙ্গে যোগাযোগ আছে।’

– ‘তাহলে তো ভালোই। ওরাও তো আমাদের মতো।’

– ‘হ্যাঁ, সব রকম সহযোগিতা করবে। কিন্তু তুমি যেভাবেই হোক ওই মেয়েটির স্বামীকে বের করে সব খুলে বলো। আমার বিষয়টা শুনে কষ্ট হচ্ছে। বেচারি নির্দোষ হয়েও কি ঝামেলায় পড়েছে। চরিত্রে কলংক লেগেছে। আমার চেহারার সঙ্গে মিল হওয়ায় এই ঝামেলা হয়েছে বলে নিজেকেও অপরাধী মনে হচ্ছে।’

– ‘কিন্তু ওদের আমি পাব কোথায়? যে নাম্বারে যোগাযোগ করতাম সেটা মোবাইল সহ ভ্যানিটিব্যাগ ফুপুর বাসায়। কল দিয়েও পাব না।’

– ‘ভ্যানিটিব্যাগে খুঁজে পাওয়ার মতো কিছু নেই?’

– ‘না, মোবাইলও লক করা।’

– ‘কি আশ্চর্য, এখন এভাবেই থাকবে না-কি? তুমি যেরকম বলছো ওর স্বামী চ’ড় মেরে টেনে নিয়ে গেছে। বুঝতে পারছো কি অন্যায়টা হয়েছে। ইশ মেয়েটা নির্দোষ হয়েও।’

তুষার ওর পেছনে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ‘বাদ দাও এসব। যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন খুঁজেও পাব না। নিজেদের চিন্তা করি।’

বিনোদিনী ওর বুকে মাথা রেখে উষ্ণ শ্বাস ছেড়ে হ্যাঁ সূচক গোঙানি করলো, ‘হু।’

__চলবে__

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৮

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৮ম পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

ছেলেটি তুলিকে জড়িয়ে ধরে একের পর এক অভিযোগ করে যাচ্ছে।
তুলি কোনো জবাব দিতে পারছে না। নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। কারণ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে অদূরে দাঁড়িয়ে আছে ইশতিয়াক। চোখ দু’টো থেকে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে। কেমন বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে মানুষটিকে। ইশতিয়াক এদিকে এগিয়ে আসছে। তার এখন কি করা উচিত? কি হচ্ছে এসব। তুলি কিছু বুঝে উঠার আগেই ছেলেটার গলা আর ঘাড় ধরে ইশতিয়াক হেঁচকা টান দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। তুলিও টাল সামলাতে না পেরে পড়লো গিয়ে একটা গাছের গোড়ায়। পলকে ছেলেটি মাটি থেকে উঠে তুলিকে তুলে দিয়ে ইশতিয়াকের দিকে ধেয়ে এসে বললো,

– ‘এই মিয়া আপনি কে?’

– ‘আমি ওর হাসবেন্ড।’

ছেলেটি খানিক্ষণ ইশতিয়াকের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে পায়ে পড়ে গেল।

– ‘ভাই বিশ্বাস করেন ওকে ছাড়া আমি বাঁচবো না। আমি জানি ওকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হইছে। প্লিজ ভাই আপনি আমার হাতে তুলে দেন ওকে…।’

কথাটি শেষ করার আগেই ইশতিয়াক প্রচণ্ড জোরে ছেলেটির গালে চড় দিয়ে পা ছাড়িয়ে নিয়ে বুকে লাত্থি মেরে ফেলে দেয় মাটিতে। তুলি বিস্ময়ে এতক্ষণ নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চেতনা যেন ফিরে পেল সে। ছুটে গিয়ে ইশতিয়াকের হাত ধরে বাঁধা দিল। পার্কের অন্য উৎসুক জনতাও এদিকে ছুটে এসেছে। ইশতিয়াক ঘুরে লোকসম্মুখেই তুলির গালে দিল চড় বসিয়ে,

– ‘চরিত্রহীন মেয়ে, বিয়ের পরও আগের নাগরের সঙ্গে পার্কে এসেছিস।’

তুলির বিস্ময়ের চড়ম সীমা অতিক্রম হয়ে যায়। সে গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ইশতিয়াকের মুখের দিকে। আর কিছুই বলার নেই তুলির। সে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার শক্তি হারিয়ে বোবা হয়ে গেছে। তুলিকে জনসম্মুখে টেনে-হেঁচড়ে পার্ক থেকে নিয়ে বের হয়ে গেল ইশতিয়াক। রিকশা ডেকে নিয়ে এলো বাসায়। তুলি পুরো রাস্তা চুপচাপ শূন্য দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে৷ রিকশা যাচ্ছে, টুংটাং শব্দ, গাড়ির হর্ণ, রঙ-বেরঙের পোশাক পরা মানুষ কিছুই যেন তুলি দেখছে না, শুনছে না৷ থমথমে মুখ, শূন্য দৃষ্টি। একেবারে যেন অনুভূতিহীন পাথর সে। বাসার গেইটের সামনে রিকশা থেকে নেমে ইশতিয়াক হাত ধরেই টেনে নিয়ে এলো ওপরে। তুলি কেবল হতবুদ্ধি হয়ে দেখছে। ইশতিয়াকের এই অচেনা রূপ দেখে সে মূক হয়ে গেছে। বাসায় আসার পর দরজা বন্ধ করে হেঁচকা টান দিয়ে যেন তাকে ছুড়ে ফেললো বিছানায়। তুলি বিছানায় পড়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ইশতিয়াকের দিকে। একদম অচেনা এক হিংস্র পুরুষ। চোখের সামনে ইশতিয়াক প্যান্টের বেল্ট খুলে মোবাইলে সেই ছবিগুলো বের করে বললো, ‘তোর মতো নষ্টা মেয়ে আমার বউ ভাবতেই ঘেন্না লাগছে। এই খানকি এই ছবিগুলো কি? তুই না আর কোনো পুরুষের ছোঁয়াই পাসনি?’

তুলি যেন কথাগুলো শুনতেই পারছে না। চোখের সামনে যা দেখছে সবই যেন স্বপ্নদৃশ্য৷ ইশতিয়াকের হাতে বেল্ট। ‘খানকি’ শব্দ ভীষণ কানে এসে লাগলো। আর কি বাকি আছে? সে আর ছবিগুলোর কি ব্যখ্যা দেবে? দিয়ে কি হবে? লোকসম্মুখে চড়, রিকশা থেকে টেনে উপরে নিয়ে আসা। এখন আবার প্যান্টের বেল্ট..।
তুলি ভাবতেই পারে না। আচমকা পিঠে আঘাত পেয়ে তুলি আর্তনাদ করে উঠলো।

– ‘এখন কথা বেরুচ্ছে না, তাই না? হাতেনাতে জড়াজড়িতে ধরা পড়ে মুখবন্ধ? নাগরকে যখন ভুলতেই পারবি না বিয়ে বসলি কেন? টাকার লোভ? ব্যাংকার জামাই শুনেই বিয়ে বসে গেছিস?’

আবার বেল্ট দিয়ে প্রহার করলো ইশতিয়াক৷
মোবাইলে ভিডিয়ো প্লে করে বললো,
– ‘মিথ্যুকের বাচ্চা বলেছিলি তোকে কেউ স্পর্শ করেনি, তাহলে এসব কি?’

তুলির বিস্ময় আর ধৈর্যের বাঁধ যেন ভেঙে গেল। যেন চেতনা ফিরে পেল এখন। তাকে বেল্ট দিয়ে আঘাত করছে ইশতিয়াক? লোকটি তার গায়ে হাত তুললো। অশ্রাব্য বাসায় গালাগাল করছে।
কিছু বুঝার আগে, জিজ্ঞেস করার আগেই জনসম্মুখে চড় মেরে অপমান করলো? তাকে নিজের মা-বাবাও কখনও এরকম গালি দেয়নি। আর ইশতিয়াক কি-না…।
ঘেন্না লাগছে তুলির। এমন একটা জঘন্য মানুষ তার স্বামী৷ যে স্ত্রীকে কিছু না বুঝে, অন্যায়ভাবে অশ্রাব্য ভাষায় গালি দেয়। গায়ে হাত তুলে। এই ঘটনা না ঘটলে তো সে ইশতিয়াকের এমন হিংস্র রূপ দেখতে পেত না। সে এখনও এখানে কি করছে?

‘খানকি বিয়ের আগে শুয়েছিস তো শুয়েছিস এখন আবার পার্কে গিয়ে জড়াজড়ি।’ কথাগুলো বলে ইশতিয়াক পুনরায় প্রহার করতেই বেল্ট ঢুকে গেল তুলির হাতের মুঠোয়। এলোমেলো চুল। শূন্য পাথর দৃষ্টি। চোখের পলকে একটা চড় গিয়ে লাগলো ইশতিয়াকের গালে।

– ‘পাগলের বাচ্চা ‘সেই মেয়েটি আমি নই’।

ইশতিয়াক হেঁসে উঠে চুল মুঠো ধরে বললো,

– ‘আবার মিথ্যে কথা। ছবিগুলো মিথ্যে হলে নাগরের সঙ্গে দেখা করে জড়াজড়ি করতে গেলি কেন?’

তুলি হেঁচকা টানে হাত ছাড়িয়ে বললো,

– ‘তোর কাছে আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার চেষ্টা করে নিজেকে ছোট করার ইচ্ছা নাই।’

তুলি বিছানা থেকে ওড়না নিয়ে দরজা খুলে বেরিয়ে গেল।

ইশতিয়াক আঁটকে রাখার চেষ্টা করলো না। অস্ফুটে বললো,

‘হ্যাঁ চোরের মেয়ের বড় গলা তো থাকেই। ছবি মিথ্যে, জড়াজড়ি মিথ্যে। সেই মেয়েটি তুমি নও, সেটা ভূত। খানকি ভাগ এখান থেকে৷’ কথাগুলো বলে ঘেন্নায় সে ‘থুথু’ ফেললো মাটিতে। কথাগুলো শুনে তুলির মুখে বিষাদমাখা হাসি ছড়িয়ে গেল। পেছনে না তাকিয়ে প্রস্থান করলো সে বাসা থেকে।

*
তুষারের হাতে তুলির ভ্যানিটিব্যাগ। সে ঘটনার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গিয়েছিল। খানিক পর রিকশার পিছু পিছু ছুটে গিয়েও তুলিদের হারিয়ে ফেলে৷ দুঃখ-কষ্টে ফিরে যাবে ফুপুর বাসায় তখনই মনে পড়লো তুলির ভ্যানিটিব্যাগ পার্কে গাছের গোড়ায় পড়ে আছে। সেটা নিয়ে যায়নি তুলি। কেউ পেয়ে গেল কি-না কে জানে। পুনরায় সে দৌড়ে ছুটে যায় পার্কে। গাছের নিচেই পেয়ে যায় ব্যাগ। ব্যাগের ভেতরে তেমন কিছুই নেই। কিছু টাকা, মোবাইল আর মেয়েলি সাজগোজের জিনিসপত্র। তুষার মোবাইল হাতে নিয়ে দেখেছে লক করা। এই মোবাইল সে তুলির কাছে ফিরিয়ে না দিলে কিভাবে যোগাযোগ করবে ওর সঙ্গে? এই নাম্বার ছাড়া আপাতত তার কাছে কিছুই নেই। ওর বাসার ঠিকানা সে জানে না। নাম্বারটাও খুঁজে পেয়েছে ভাগ্যগুণে। তুলি ব্যাগের খুঁজে এখানে আসবে এই আশায় সে পার্কের বেঞ্চে শুয়ে আছে। চোখের সোজা গাছের ডালে কিছু কাক বসে কর্কশ গলায় কা-কা করছে। সে ভাবছে তুলির বরকে নিয়ে। লোকটা ভালো না। লোক সম্মুখে স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে। টাকা-পয়সা হলেই হয় না। এই সংসার ওর ছেড়ে দেওয়াই উচিত। লোকটা নিশ্চয় মদ-গাঁজা খায়। না হলে এমন বদমেজাজি হয় না-কি? কিন্তু ওর সঙ্গে সে এখন কিভাবে যোগাযোগ করবে? মোবাইলই তো ফেলে চলে গেছে। এটা পৌঁছে যে দেবে বাসার ঠিকানাও সে জানে না। জোহরের আজান দিচ্ছে মসজিদগুলোতে। সে তো এখনও এলো না। মোবাইলের জন্য কি মনে পড়া মাত্রই ছুটে আসার কথা না? তুষারের মোবাইল ফোন বেজে উঠে। নাম্বার দেখে সে অবাক হয়ে অস্ফুটে বলে ‘স্যারের কল।’
রিসিভ করলো তুষার। ভয়েজ শুনেই সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

– ‘তোমার ভ্যানিটিব্যাগ আমার কাছেই আছে।’

ওপাশ থেকে বললো,

– ‘ভ্যানিটিব্যাগ মানে, কি যা-তা বলছো। আগে আমার কথা শুনো। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে।’

তুষার নাম্বার আবার দেখে। কিছুই সে বুঝতে পারছে না। ভ্যানিটিব্যাগ তো ওরই। তবুও সে এসবে না গিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ বলো কি করতে হবে।’

– ‘আমি এই মুহূর্তে সিলেট শাহজালাল মাজারে আছি। খুব কষ্টে বাবার মোবাইল নিয়ে পালিয়ে এসেছি। এখানকার কিছুই আমি চিনি না। টাকা-পয়সাও আমার কাছে নেই। তুমি এখনই রাওনা দাও।’

তুষার অবাক হয়ে বললো,

– ‘আশ্চর্য তুমি সিলেট গেলে কখন?’

– ‘এসব এখন শোনার সময় নেই তুষার। আগে আমাকে নিতে আসো। এই মোবাইলেও খুব বেশি চার্জ নাই। আর বাড়ি থেকে কল আসতে শুরু হবে। আমি এখনই অফ করবো৷’

তুষারের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে আমতা-আমতা করে বললো,

– ‘সেখানে পৌঁছাতে ৭-৮ ঘণ্টা লাগবে।’

– ‘সমস্যা নেই আমি অপেক্ষা করবো।’

– ‘কিন্তু আমাকে তো বলো তুমি সিলেট গেলে কিভাবে৷ আমার সঙ্গে রসিকতা করছো না-কি?’

ওপাশ থেকে ঝাঁঝালো কণ্ঠে ভেসে এলো,

– ‘এখন রসিকতার সময়? আমি কি বিপদে আছি তুমি জানো? এতো কথা না বলে রওনা দেবে না-কি আমি ফিরে যাব।’

– ‘আচ্ছা আচ্ছা আমি আসছি।’

ফোন রেখে সে কিছুই মেলাতে পারছে না। একটু আগে যে মানুষটি ঢাকা দেখা করেছে, সে আবার সিলেট কিভাবে যায়? কি হচ্ছে এসব? সে কি ভূত-পেত্নীর পাল্লায় পড়েছে না-কি? এখন তার কি করা উচিত? সিলেট যাবে? সত্যিই ওখানে সে? কিভাবে সম্ভব? তাছাড়া ভ্যানিটিব্যাগ কি করবে এখন? আচ্ছা কোনোভাবে কি এই দু’জন মানুষ আলাদা? তুষারের মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে আর কিছু ভাবতে চায় না। এখন সোজা বাসায় যাবে। রেডি হয়ে তাড়াতাড়ি বের হতে হবে সিলেটের উদ্দ্যশ্যে।
সে বাসায় গিয়ে ফুপুকে বুঝিয়ে রেডি হয়ে বের হতে হতে তিনটা হয়ে গেছে। সায়দাবাদ থেকে সে বাসে উঠলো সাড়ে তিনটায়। বাস ছেড়ে দিয়েছে। তখনই মনে পড়লো ওর ভ্যানিটিব্যাগ বাসায় ফেলে চলে এসেছে। ওকে একটা কল কি দেবে? মোবাইল বন্ধ করে ফেলবে বলেছিল। তবুও তুষার কল দিল। রিং হচ্ছে৷

– ‘হ্যালো।’

– ‘হ্যাঁ আমি বাসে আছি এখন। আসবো? আসলেই তুমি সিলেট?’

– ‘এরকম কথা বলছো কেন? কয়বার বলবো আমি সিলেট। আর ফোনে চার্জ নেই। আমি অফ করে দিচ্ছি এখন। তুমি সোজা মাজারে আসবে। আমার এই নাম্বার টাকা দিয়ো পারলে। তাহলে আমি নিজেই মোবাইল অন করে কল দিতে পারবো।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে। কিন্তু আমি ভ্যানিটিব্যাগ বাসায় ফেলে চলে এসেছি। কিন্তু যে আমার সঙ্গে দেখা করছে সেই মেয়েটি তুমি হলে তো এখন সিলেট থাকার কথা না। তাহলে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে যাবই বা কেন?’

– ‘আরে ধুরো তোমার কিসের ভ্যানিটিব্যাগ আর সেই মেয়ে। কি আবোল-তাবোল বকছো।’

– ‘আচ্ছা আচ্ছা আমি আসি। তারপর সব বলছি।

*
হুস্না বেগম তুলির দরজায় ডাকাডাকি করছেন।

– ‘কি হয়েছে বলবি তো তুলি? সেই যে এসে দরজা বন্ধ করে ভেতরে আছিস আর তো বেরই হচ্ছিস না।’

তুলি ভেতর থেকে বললো,

– ‘কিছুই হয়নি মা। আমি ঠিক আছি।’

– ‘সেই কখন থেকে তো বলছিস ঠিক আছিস। কিন্তু দেখেও তো মনে হয়েছিল কিছু একটা সমস্যা আছে রে মা।’

কাজের মেয়েটি বললো, ‘আন্টি আপার হাতে ব্যাগও ছিল না আসার সময়ে।’

– ‘হ্যাঁ বের হয়েছিল হাতে ভ্যানিটিব্যাগ নিয়ে।’

তিনি আবার ডাকলেন,

– ‘তুলি তোকে ছিনতাইকারী ধরেছিল না-কি?’

ওপাশ থেকে কোনো জবাবই এলো না।

– ‘রহিমা দেখতো আমার মোবাইল কোথায়। তুলির নাম্বারে কল দিয়ে দেখি।’

রহিমা গিয়ে মোবাইল নিয়ে এলো। তিনি তুলির নাম্বারে অনেকগুলো কল দিলেন রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। রহিমা কান লাগিয়ে দেখে এসে বললো,

– ‘আপার রুমে কোনো রিং হয় নাই আন্টি। তাইলে আপারে ছিনতাইকারী ধরেছিল মনে অয়।’

হুস্না বেগম আবার ডাকতে লাগলেন,

– ‘দরজা খুল তো মা, কি হয়েছে তোর?’

তুলি দরজা খুলে দিয়ে বিছানায় গিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগলো। হুস্না বেগম গিয়ে তুলের পাশে বসে আঁতকে উঠলেন। ওর ঘাড়ের নিচে এটা কিসের দাগ। কি হয়েছে তুলির?

– ‘কি হয়েছে মা, কাঁদছিস কেন? তোর পিঠে কিসের দাগ? আর মোবাইল কোথায় ফেলে এসেছিস?’

তুলি উঠে মা’কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো,

– ‘আমি আর ওই পশুর কাছে ফিরে যাব না মা। আমি তোমাদের সঙ্গেই থাকবো। তোমরা ডিভোর্সের ব্যবস্থা করো।’

হুস্না বেগম মেয়ের কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেলেন। সে বের হয়ে গেল একটা কাজে। হুট করে ইশতিয়াককে পেল কোথায় আর ওর সঙ্গেই বা কি হয়েছে?

তিনি মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,

– ‘কি হয়েছে বলতো মা?’

তুলি কিছুই বলতে পারছে না। মায়ের বুকে মুখ গুঁজে কেবল কেঁদে যাচ্ছে। উনার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। এই মেয়েটির মুখের দিকে তাকিয়েই তারা বেঁচে আছেন। ও ছাড়া তাদের আর কে আছে? মেয়েটি যদি সুখী না হয় তাহলে এই বিয়ে সংসার দিয়ে কি হবে?

তিনি মেয়েকে শীতল গলায় বললেন,

– ‘মা কি হয়েছে বলতো, তোর ঘাড়ে নিচে কিসের দাগ। দেখি কামিজ তুলতো।’

– ‘কিছু না মা এগুলো।’

তিনি নিজেই কামিজ তুলে দেখে বিস্মিত হয়ে গেলেন। ওর পিঠে অনেকগুলো মারের দাগ। কে মারলো তাদের মেয়েকে? যাকে তারা ফুলের টোকাও দেননি কখনও। ইশতিয়াক? কিন্তু ইশতিয়াককে তুলি এখন পেল কোথায়? আর কেনই বা মারবে সে? মারার মতো কি কারণ থাকতে পারে? তারা তো এটা বরদাস্ত করবেন না। কত বড়ো সাহস তাদের মেয়ের গায়ে হাত দেয়! তিনি তুলির মাথা টেনে তুলে বললেন, ‘কে তোকে এমন করেছে বল তো মা? সব বল আমাকে।’
তুলি আস্তে আস্তে মা’কে সব বলতে শুরু করে।

ইশতিয়াক বেলকনিতে চেয়ার নিয়ে বসে একের পর এক সিগারেট টানছে। নষ্টা মেয়ে। আবার কত বড়ো বেয়াদব তাকে চড় মেরেছে। এই মেয়েকে সে ডিভোর্স দেবে। এমন মেয়েকে সে কিভাবে ভালোবেসেছিল? কিভাবে ওর প্রেমে পড়েছিল? নিজের রুচির প্রতি ঘেন্না লাগছে তার।
___চলবে__

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৭

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৭ম পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

ইশতিয়াকের ঘুম ভাঙলো অচেনা এক নাম্বার থেকে কল পেয়ে। তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে মাত্র সাতটা বাজে। অনেকটা বিরক্তি নিয়ে ফোন রিসিভ করে সে,

– ‘হ্যালো।’

– ‘আসসালামু আলাইকুম ভাই, আমি রফিক। ওইদিন কাশবনে পুলিশের সঙ্গে ছিলাম। পরনে ছিল হলুদ গেঞ্জি।’

ছেলেটির পরিচয় শুনে ইশতিয়াক শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,

– ‘হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, কিন্তু এখন আবার আপনি আমার কাছে কি চান?’

ফোনের ওপাশ থেকে রহস্যের হাসি ভেসে এলো। তারপর ছেলেটি বললো।

– ‘ভাই চাওয়ার তো কথা আপনার। আপনার অগোচরে কত কিছু যে হয়ে যাচ্ছে টেরই পাচ্ছেন না।’

– ‘দেখুন ভাই, সাত-সকালে কল দিয়ে নাটক করবেন না। আমার অফিস আছে। আমি আটটায় উঠে গোসল খাওয়া-দাওয়া করে অফিসে বের হই। আপনি ভোরে কল দিয়ে ঘুম নষ্ট করেছেন।’

– ‘ভাই জীবনই যেখানে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, সেখানে ঘুমিয়ে কি হবে? সত্যি বলতে আপনাকে দেখে ভালো মানুষ মনে হইছে। দুদিন থেকে ভেবেই যাচ্ছি, দুনিয়াতে বুঝি ভালো মানুষের সঙ্গেই শুধু এমন হয়।’

– ‘ভাই আপনি কি বলতে চাচ্ছেন বলুন। না হয় আমি কল কেটে দেবো।’

– ‘ভাই আপনাকে জরুরি কিছু তথ্য দিতে চাচ্ছি। ওইদিন ভাবী টাকা দিয়ে বললেন আপনাকে না শোনাতে। তাই কিছু বলিনি। কিন্তু আজ ভেবে দেখলাম তাতে আপনার বিরাট ক্ষতি হচ্ছে।’

ইশতিয়াকের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে গেছে, পায়ের তালু ঘেমে যাচ্ছে। সে শঙ্কিত হলেও বুঝতে দিল না রফিককে। বিরক্তি নিয়ে বললো,

– ‘আরে ধুর ভাই, কথা এতো না প্যাঁচিয়ে বলুন কি হইছে।’

– ‘ভাই এভাবে তো বলা যাবে না। ভাবী আমাকে ভ্যানিটিব্যাগে যত টাকা ছিল সব দিয়ে গেছে আপনাকে না বলার জন্য।’

– ‘কিসব আবোল-তাবোল কথা বলছেন। ও কখন টাকা দিল?’

– ‘টাকা যে দিছে সেটারও ভিডিয়ো আছে ভাই।’

– ‘টাকা কেন দিছে?’

– ‘আমি ভাবীর ফোন হাতে নেয়ার পর দেখি একটা নাম্বার থেকে অনেক কল এসেছে, সঙ্গে একটা মেসেজ। সেখানে লেখা আমাদের পুরনো কিছু ছবি দিয়েছি হোয়াটসঅ্যাপ দেখো। আমি তখন হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে পাই।’

– ‘কিসের ছবি?’

– ‘এরকম তো হবে না ভাই। ভাবী আমাদের টাকা দিয়ে গেছে আপনাকে না দিতে। আর ভাই আরেকটা সমস্যা দেখা দিছে। আমার সাথের ছেলেটা ভিডিয়ো আর ছবিগুলো যখন-তখন নেটে দিয়ে ভাইরাল করে দিতে পারে। ওর না-কি কিসের একটা পেইজ আছে৷ সেটার রিচের জন্য, ভাইরাল করার জন্য এগুলো না-কি একেবারে পারফেক্ট। তখন তো আপনার ইজ্জৎও যাবে…।

ইশতিয়াক ধমক দিয়ে উঠলো,

– ‘আরে ব্যাটা ভূমিকা বন্ধ কর। কি চাস সেটা বল। ছবি-ভিডিয়ো কি আছে পাঠা দেখি।’

– ‘ভাই হোয়াটসঅ্যাপে বিকাশ নাম্বার দিচ্ছি। পাঁচ হাজার টাকা পাঠান আগে। আর সব তথ্য পেয়ে গেলে আরও পাঁচ হাজার পাঠাবেন।’

ইশতিয়াকের ক্রোধে শরীর কাঁপছে। সে নিজেকে সামলে নিয়ে অবিকৃত গলায় বললো,

– ‘আগে পাঁচ হাজার পাঠানোর পর এডিট করা ছবি দিলে? অথবা কিছুই না পাঠালে?’

– ‘ভাই আপনাকে আগে পাঠাচ্ছি ভাবী যে আমাকে টাকা দিচ্ছিলেন তার ভিডিয়ো। তারপর আপনি টাকা পাঠান।’

ইশতিয়াকের মনে হচ্ছে কেউ তার কলিজা মুঠোয় নিয়ে মোচড়ে ধরেছে। সে প্রাণপণে চাচ্ছে এই ছেলেটার ভিডিয়ো যেন এডিট করা থাকে। সবকিছু যেন মিথ্যে হয়। তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেন প্রতারণা করে কিছুই না পাঠায়।
সে শঙ্কিত গলায় বললো,

– ‘আচ্ছা ‘

– ‘তাহলে ফোন রাখছি, আপনি হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাক করুন। ভিডিয়ো এর সঙ্গে বিকাশ নাম্বার দিচ্ছি।’

ইশতিয়াক ফোন রেখে চোখবন্ধ করে দুইহাতে মুখ আঁজলা করে ধরে বসলো। হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশন টিউন বাজতেই মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ছেলেটি ভিডিয়ো পাঠিয়েছে। ইশতিয়াকের বুকে ধুকপুকানি বেড়ে যায়, পা যেন অসাড় হয়ে আসে। মাথার রগগুলো ফুলে যাচ্ছে। কান দিয়ে গরম ভাপ বেরুচ্ছে। তার কাছ থেকে তথ্যগুলো লুকোতে তুলি এই ছেলেদের টাকা দিয়েছে ভাবতেই পারে না সে। কাঁপা কাঁপা হাতে ভিডিয়োতে ক্লিক করে। নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারছে না। ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে সে পুলিশের সঙ্গে কথা বলছে। তুলি তার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে ভ্যানিটিব্যাগ আঁড়াল করে টাকা দিচ্ছে ছেলেটিকে। অথচ রিকশায় কিংবা বাসায় এসেও তাকে একথা বলেনি তুলি। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। মোবাইল বিছানায় রেখে দুই আঙুল দিয়ে কপাল ঘষছে। মস্তিষ্কের ভেতর খুব দ্রুত সন্দেহের গাছ রোপণ হয়ে, সেই গাছ বড়ো হয়ে ডালপালাও ছাড়তে শুরু করেছে। তার বিকাশে এত টাকা এখন নেই।
মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ দিল,

– ‘বিকাশ নাম্বার দেন, আমি টাকা পাঠাচ্ছি। আপনি আমাকে সবকিছু হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ড করেন। আর আমাকে দিয়ে সবকিছু ডিলিট করে দেবেন। টাকা লাগলে আরও দেবো। তবুও এগুলো ডিলিট চাই। নেটে ছাড়লে আমি মামলা করতে বাধ্য হবে।’

ছেলেটি মেসেজ দিল,

– আরে ভাই এগুলো ভাববেন না। বিকাশ নাম্বার দিছি দেখুন। টাকা ছাড়েন তাড়াতাড়ি।’

বিকাশ নাম্বার পেয়ে ইশতিয়াক উঠে দাঁড়ায়। একটা গেঞ্জি গায়ে দেয়৷ মানিব্যাগ মোবাইল নিয়ে বের হয়ে পড়ে। রাস্তায় গিয়ে মনে পড়লো সিগারেট আনেনি। পাশের দোকানে গিয়ে সিগারেট নিল একটা। ঘন ঘন টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে গেল মোড়ের বিকাশের দোকানে। সে টাকা পাঠিয়েই হোয়াটসঅ্যাপ আর চ্যাক করলো না। কোলাহলের এই রাস্তায় কিছুই দেখতে চায় না। দোকান থেকে বের হয়ে হাঁটতে থাকে৷ নিজেকে বুঝায় যাই-ই ঘটুক, যাই-ই হোয়াটসঅ্যাপে দিক, সে তুলিকে এভাবেই ভালোবেসে যাবে৷ সময় সবকিছু ঠিক করে দেবে। এতো রেগে যাওয়ার মানেই হয় না। তার জায়গায় অন্যকেউ হলে এগুলো হয়তো খেয়ালই করতো না। সে এমন তো নিজেই জানে। বাড়ির সবাইই বলে। এখন বিবাহিত। আগের স্বভাব ছাড়তে হবে। নিজেকে শাসন করতে করতে ইশতিয়াক বাসায় চলে আসে। হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাক না করে বিছানায় বসে আরেকটা সিগারেট ধরায়। ধোঁয়া ছাড়ে ঘন ঘন। ডাটা অন করে সে। টংটাং শব্দ করে একের পর এক ছবি আসতে থাকে। এগুলো তাকে না দেয়ার জন্য তুলি লুকিয়ে টাকা দিয়ে এসেছে ছেলেদের। কথাটা মনে পড়তেই ইশতিয়াক সিগারেট ছুড়ে মারে দেয়ালে। মোবাইল হাতে নেয়। কাঁপা কাঁপা হাতে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে।

প্রথম ছবিই একটা ছেলের সঙ্গে ধান ক্ষেতের জমির আইলে বসা। আরেকটা সবুজ ঘাসে ওই যুবকটির বুকে শুয়ে আছে। আরেকট খড়ের স্তুপের ওপর বসে ঠোঁটে চুম্বনরত অবস্থায়। কিছু ন্যুড পিকচার। একটা ভিডিয়ো সেল্ফি ক্যামেরায় তোলা। যেখানে দেখা যাচ্ছে দু’জনই একটা জমির আলে বসে আছে। সামনে পেছনে সবুজ ধান তাদেরকে ঢেকে রেখেছে নিরাপত্তার চাদরে। ছেলেটি ওর স্তনে হাত রেখে চোরা চাহনিতে চারদিকে তাকিয়ে দেখছে কেউ আসছে কি-না। ইশতিয়াক আর ভিডিয়োটি দেখতে পারে না। মোবাইল ছুড়ে ফেলে বিছানায়। সে জন্মের পর থেকে কখনও তার কিছুতেই অন্যের ভাগ, অন্যের ছোঁয়া সহ্য করতে পারে না। ছোট ভাইটিকে একবার তার গেঞ্জি পরায় বেধড়ক মারধর করেছিল। সেই তারই স্ত্রীকে অন্য কেউ…?
আর তুলি? ভাবতেই তার গা গুলিয়ে উঠলো। এত জঘন্য মিথ্যেচার। বাসর রাতেই বলেছিল সেইই না-কি প্রথম পুরুষ, কোনো পরপুরুষের ছোঁয়া এর আগে সে কখনও পায়নি। আর এই ছবি ভিডিয়োগুলো গোপন রাখতে তার অগোচরে টাকাও দিয়ে এসেছে? জায়গাটা গ্রাম এলাকা মনে হলো, ছেলেটা ওর মামার বাড়ির হয়তো। আচ্ছা তুলি যে ছেলের সঙ্গে এতো ঘনিষ্ঠ ছিল তাকে কেন বিয়ে করেনি? ভাবতেই ইশতিয়াকের ঘেন্নায় গা ‘রিরি’ করে উঠলো। সে একজন ব্যাংকার বলে ওই ছেলেকে ফেলে বিয়ে বসেছে? তাহলে এসব প্রেম-ভালোবাসা, প্রণয়বাক্য সবই মনভোলানো? একদলা ‘থুতু’ টাইলসের মেঝেতেই ফেলে দিল ইশতিয়াক। মোবাইল বেজে উঠলো। রফিক কল দিয়েছে। সে রিসিভ করে বিধ্বস্ত অবস্থায় বললো,

– ‘হ্যালো।’

– ‘ভাই বাকি পাঁচ হাজার পাঠান।’

ক্রোধে অশ্রাব্য ভাষার গালিগালাজ শুরু করে দেয় ইশতিয়াক। ছেলেটি অবস্থা বুঝতে পেরে ‘পরে যোগাযোগ করব’ বলে হাসতে হাসতে ফোন রেখে দেয়।

দুই হাতে মুখ ঢেকে ইশতিয়াক বিছানায় বসে। নিজেকে শান্ত রাখতে হবে। তুলি তো তার সঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই সংসার করছে। তবে কেন সে এতো ভেঙে পড়বে? কেন রেগে যাবে? তার এসব বাজে স্বভাবের জন্যই কারও সঙ্গে থাকতে পারে না। মিশতে পারে না। এখন থেকে এসব ছাড়তে হবে। সবকিছুরই সমাধান থাকে। যা হবার হয়ে যায়৷ বাঁচতে হয় বর্তমান নিয়ে।
সে মনস্থির করে ঠাণ্ডা মাথায় বিষয়টা নিয়ে তুলির সঙ্গে কথা বলবে। সে এখন থেকে ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। ব্যাংকে চাকরি করা ভদ্রলোক। জীবনে এই প্রথম সে নিজেকে সামলে নিতে পারলো। এখন থেকে সব সময় পারবে। একেবারে শান্তশিষ্ট হয়ে গেল। এভাবেই শান্ত থাকবে। সে এখন গোসল করবে। গোসল করতে আরাম। গোসল তার প্রিয়৷ আই লাভ ইউ গোসল। গোসল থেকে শান্তির কিছু নাই। ইশতিয়াকের মনে হলো মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখে ঝাপসা লাগছে৷ সকালে কিছু খায়নি বলে হয়তো। প্রেশার কি লো না-কি হাই? মেঝেতে শুয়ে যাবে সে, অনেক আরাম। ইশতিয়াক মেঝেতে খানিক্ষণ পড়ে রইল। ঘাম ছাড়লো তার পুরো শরীর থেকে। ফোটা ফোটা ঘামে টাইলস ভিজে যাচ্ছে। কানে কেমন ‘ঝিমঝিম’ শব্দ হচ্ছে। শরীর খুব দূর্বল লাগছে। ইশতিয়াক খাবে এখন। সকালে উঠে হাত-মুখ ধুয়ে দাঁত ব্রাশ করতে হয়। নাশতা করতে হয়। সে কি-না কোথাকার রফিক-টফিকের পাল্লায় পড়েছে। ইশতিয়াক উঠে ধীরে ধীরে। এলোমেলো পায়ে হেঁটে টেবিলে গিয়ে এক চুমুকে পুরো গ্লাস পানি খেল। সকালে বেশি পানি খাওয়া নিয়ম। ইশতিয়াক একের পর এক গ্লাসে পানি ঢেলে খায়। খালি পেটে শুধু পানি খেলে হয় না। সঙ্গে কিছু খেতে হয়। ইশতিয়াক ব্রেড আর জেলি নিয়ে এলো। ব্রেডে জেলি লাগিয়ে এক পিস শেষ করে তার মনে পড়লো দাঁত ব্রাশ করেনি। ব্রেড জেলি রেখে চলে গেল বাথরুমে। আয়নায় তাকালো সে। চোখ অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেছে। ঘুম হয়নি ঠিকঠাক। মনে মনে গালি দিল ধান্ধাবাজ রফিককে। সে আর বেশিক্ষণ নিজের সঙ্গে প্রতারণা করতে পারলো না। শাসিয়ে রাখতে পারলো না। কান্না দলাপাকিয়ে এলো গলায়। তাড়াতাড়ি শাওয়ার ছেড়ে দেয় ইশতিয়াক। বসে পড়ে মেঝেতে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। তুলিকে কেউ চুমু দিয়েছে, বিশেষ অঙ্গে স্পর্শ করেছে৷ তুলি সেটা উপভোগ করেছে। এখন আবার তার সঙ্গে একেবারে নিষ্পাপ বালিকার অভিনয় করে সংসার করছে। ইশতিয়াক যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছে না৷ তার নিজের রুচি নিয়েই এখন হতাশ হচ্ছে। সে কি করে তুলির মতো…।
না তুলিকে নিয়ে এগুলো ভাববে না সে। তুলিকে আগের মতোই ভালোবাসবে। ছবিগুলো এডিট করা, ভিডিয়ো এডিট করা। দুনিয়া কোথায় গেছে তার জানা নেই। প্রযুক্তি কোথায় গেছে তার জানা নেই। এগুলো নিখুঁত এডিট। তুলির সঙ্গে সে কথা বলবে। শাওয়ারের পানির সঙ্গে তার চোখের জলগুলো মিশে যায়। উঠে দাঁড়ায় ইশতিয়াক। ভেজা কাপড় ছেড়ে, টাওয়েল দিয়ে শরীর মুছে নেয়। কাপড় পালটে নাশতা করতে বসে। নিজেকে বুঝায় যেন কিছুই হয়নি। সবকিছু ঠিকঠাক আছে। খাওয়া গোসল সবকিছু ঠিকঠাক করতে হবে। অফিসে কল দিয়ে আজকের জন্য ছুটি নিয়ে নেয়। নাশতা শেষে বের হয় রিকশা নিয়ে। তুলিদের বাসার কাছাকাছি যখন পৌঁছে গেছে তখন ঠিক দুপুর বারোটা। ইশতিয়াক বাড়ির গেইটের অনেক দূরে থাকতেই দেখে তুলি একটা রিকশা নিয়ে কোথাও যাচ্ছে। সেও রিকশা নিয়ে ফলো করে পিছু পিছু যায়। খানিক পর একটা পার্কের সামনে গিয়ে থামে ওর রিকশা। ভাড়া চুকিয়ে তুলি গেইট দিয়ে ঢুকে পড়ে। ইশতিয়াকও তাড়াতাড়ি রিকশা ভাড়া দিয়ে সাবধানে ছুটে যায় সেদিকে। তুলি একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কাউকে কল দিচ্ছে। খানিক পর ফোন কানে নিয়ে তুলির দিকে এগিয়ে এলো ছবির সেই ছেলেটি। তুলিকে দেখেই ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো।

– ‘তুমি কিভাবে পারলে আমাকে রেখে বিয়ে বসতে? কিভাবে পারলে তুমি? আমাদের কত স্মৃতি, আমরা একে অন্যের শরীরের প্রতিটা পশম পর্যন্ত চিনি। আর তুমি এখন বলো আমাকে চেনোই না। এরকম কেন করলে আমার সঙ্গে? জানি তুমি বাধ্য হয়ে বিয়ে বসেছো। আমার তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। চলো আমরা পালিয়ে যাই এখান থেকে কোথাও।

কথাগুলো শুনে ইশতিয়াকের মাথায় যেন আগুন ধরে যায়। পুরো শরীরের লোম মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। কান দিয়ে বেরুচ্ছে গরম ভাপ। হাতের মুষ্টি শক্ত হয়ে এসেছে। তার চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছে না। সে কি কোনো স্বপ্নদৃশ্য দেখছে?

___চলবে___

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৬

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৬ষ্ট পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

তুলির ফোনালাপের কিছুই স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে না বিছানা থেকে। তবুও অতি উৎসুক হয়ে ইশতিয়াক শুনতে গেল না। চোখবুজে চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। এক অজানা ভয়ানক আশংকায় বুক ধুকপুক করছে। এই আশংকার মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস হয়ে উঠেনি তার। যতটুকু পারা যায় দূরে থাকবে, একসময় হয়তো সবকিছু তার অগোচরেই ঠিক হয়ে যাবে।
খানিক পর টের পায় তুলি তার পাশে এসে শুয়েছে। চোখবুজেই থাকে সে। এভাবে দু’জনই পুনরায় গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়।

ভোরে ইশতিয়াকের ঘুম ভাঙে কপালে কারও হাতের কোমল স্পর্শে। সে ঘুম ঘুম চোখ মেলে তাকায়। তুলি মিষ্টি করে ডাকে,

– ‘উঠুন, নাশতা করবেন।’

বেলকনির দরজা ভেজানো। রাতে বোধহয় তুলি লাগিয়ে আসেনি। দরজার ফাঁক গলে ভোরের মিহি আলো টাইলসে এসে পিছলে পড়ে নৃত্য করছে। সেই আলোয় তুলির চুলগুলো দেখাচ্ছে হালকা লালচে। কি মিষ্টি মুখশ্রী। চুল, ঠোঁট সবকিছুই কেমন মোহময়। ভোরের পবিত্র স্নিগ্ধ চেহারা। যেন সদ্য প্রস্ফুটিত ফুল।
ইশতিয়াক তাকে টেনে বুকে এনে গলায়, চোখে, মুখে এলোপাথাড়ি চুমু খায়। তুলি খিলখিল করে হেঁসে উঠে।

– ‘ছাড়ুন তো, সাত-সকালে কি শুরু করছেন।’

ইশতিয়াক বাধ্য ছেলের মতো ছেড়ে দেয়। বাথরুমে আসে ফ্রেশ হতে। ইশতিয়াকের মনে হলো তুলিকে ছাড়তে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে অন্যদিন ছাড়ে না। আজ কেন এমন করলো? তার উপর কি অজানা আশংকার প্রভাব পড়েছে? ঘুড়ির সুতো কি কাটা পড়েছে? ছন্দ কি পতন হচ্ছে? তা হতে পারে না। সে সব সময় একইভাবে তুলিকে ভালোবেসে যাবে। বাথরুম থেকে বের হতেই তুলি টাওয়েল নিয়ে এগিয়ে এলো। ইশতিয়াক হাত বাড়ায়। তুলি পলকে সরিয়ে নেয় টাওয়েল। চোখভর্তি মমতা নিয়ে বুকের কাছাকাছি এসে নিজেই মুছিয়ে দেয় মুখ।

ইশতিয়াকের এই মুহূর্তে তুলির কোমড় জড়িয়ে ধরা উচিত। আদান-প্রদান করা উচিত প্রণয়বাক্য। সম্পর্কে কোনো অশুভ অশংকার প্রভাব পড়তে দেবে না সে। তুলিকে একইভাবে ভালোবেসে যাবে। ইশতিয়াক কোমড় জড়িয়ে ধরে টেনে কাছে নিয়ে কানে ফিসফিস করে বলে,

– ‘জানো, আমি তো বিয়েই করতে চাইতাম না। আমার সঙ্গে কেউ এক বিছানায় থাকবে। আমার সবকিছু ব্যবহার করবে। মানে সর্বপরি আমার সঙ্গেই কেউ আছে। এগুলো আমি মানতে পারতাম না।’

– ‘বলো কি!’

– ‘হ্যাঁ ম্যাডাম। আমি আলাদা বাসা নিয়ে থাকি কেন? বাড়ির কারও সঙ্গে যায় না তাই। সবার সঙ্গে ঝামেলা হয়। আমার বিছানায় কেউ শুইলে মেজাজ খারাপ হয়ে যেত। আমার প্লেট, গ্লাস সব আলাদা থাকতো।’

– ‘বাবা তাই না-কি। কিন্তু আমার সঙ্গে তো সবই ঠিক আছে। মনে হচ্ছে এত ভালো বর পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি হয় না।’

– ‘শুধু তোমার সঙ্গে আমি এমন। তোমাকে দেখেই প্রথম ভেবেছিলাম বিয়ে করবো। এর আগে চিরকুমার থাকার সিদ্ধান্ত ছিল।
কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের একটা উক্তি আছে, “সবাই তোমাকে কষ্ট দিবে, তোমাকে শুধু এমন একজন কে খুঁজে নিতে হবে যার দেয়া কষ্ট তুমি সহ্য করতে পারবে” তুমিই আমার সেই মানুষ। যার সবকিছু আমার কাছে সহনীয়।’

– ‘কিন্তু আপনি যেগুলো বলেছেন। তাতে তো মনে হয় না কেউ আপনাকে কষ্ট দেয়, মিছেমিছি আপনিই কষ্ট পান। মানুষ সামাজিক জীব। আদিকাল থেকে দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। কিন্তু আপনার বিছানায় কেউ থাকতে পারবে না। প্লেটে হাত দিতে পারবে না, তা কি হয়?’

– ‘এসব আমি জানি, তবুও আমি কেন যেন মেনে নিতে পারি না। কিন্তু তোমার বেলায় সবকিছু ঠিকঠাক। জানো, তোমাদের বাসায় যখন থাকতাম। একদিন বাথরুমে গিয়ে মাথায় শ্যাম্পু দিয়েছি তখনই দেখি পানি নাই। আঙ্কেলের ফোনে কল দিচ্ছি রিসিভ হয় না। তারপর মাথা ধুয়ে গামছা গায়ে দিয়ে তোমাদের কলিংবেল চাপলাম। তখন তুমি দরজা খুলে দিলে, মনে আছে?’

– ‘হ্যাঁ, একদম মনে আছে। কিন্তু এখন তো ছাড়ুন আমাকে। জড়িয়ে ধরে আর কতক্ষণ থাকবেন?’

– ‘আরে আগে শুনো, তখন তুমি দরজা খুলে দিয়ে আমার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হেসেছিলে না?’

– ‘হুম, কিন্তু নাশতা করে নিন, তারপর শুনবো।’

– ‘ব্যস্ত হইয়ো না তো, আগে শুনবে তো। মুখ টিপে হাসলে তখন তোমার গালের মাংস ডিমের কুসুমের মতো একপাশে দলা পাকায়..।’

তুলি পুরো কথা শেষ করতে না দিয়ে বললো,

– ‘মানে?’

– ‘আরে তুমি মুখ টিপে হাসলে গালের মাংস চোখের নিচের ওদিকে এইযে এই জায়গায় গিয়ে ডিমের কুসুমের মতো হয়ে যায়। সেদিন দেখেই আমার কামড় দিতে ইচ্ছা করেছিল।’

তুলি কাঁচভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ে।

– ‘তারপর?’

– ‘তারপর ভাবলাম এই মেয়েকেই বিয়ে করবো। যখন ব্যাংকে চাকরি হলো তখনই নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিলাম।’

– ‘ঠিক আছে জনাব, কিন্তু এখন নাশতা করুন।’

– ‘হ্যাঁ চলো।’

ইশতিয়াকের মুখোমুখি বসার জন্য তুলি সামনের চেয়ার টানতেই টুংটাং শব্দ করে চেয়ার থেকে চামচ পড়ল মেঝেতে। চামচ এখানে কখন রেখেছিল কে জানে। মাথা নুইয়ে তুলতে গিয়ে ইশতিয়াকের নগ্ন পায়ের দিকে চোখ যায়। একপায়ের ওপর আরেক পা রাখা। কি নান্দনিক দৃশ্য। ফরসা পায়ের বুড়ো আঙুলে পাতলা লোম। পুরুষ মানুষের পাও এতো সুন্দর হয় বুঝি? তুলির ইচ্ছা করছে পা দু’টো কোলে তুলে বিড়ালের মতোন আদর করতে।

– ‘কি হলো টেবিলের নিচে ঘুমিয়ে গেলে না-কি।’

তুলি মুচকি হেঁসে উঠতে উঠতে বললো,

– ‘চুম্বকে আঁটকে রেখেছে।’

– ‘কিসব আবোল-তাবোল বলো।’

– ‘আচ্ছা আপনার পা লম্বা করে আমার কোলে রাখবেন?’

ইশতিয়াক ভুরু কুঁচকে বললো,

– ‘কিভাবে?’

– ‘চেয়ারে বসে আছেন তো। সেখান থেকে বসে আমার কোলে রাখবেন পা।’

– ‘তা কেন।’

– ‘রাখুন না প্লিজ।’

ইশতিয়াক পা লম্বা করে কোলে দেয়। তুলি বা হাতে দু’পা জড়িয়ে ধরে বসে।

– ‘প্রতিদিন এভাবে খাব। আপনি পা কোলে দেবেন।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘কিন্তু আরও কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে আমার পা অবশ হয়ে যাবে। তখন আবার পঙ্গু বলে ছেড়ে চলে যাবে।’

তুলি মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘তা কেন?’

– ‘আমার উরু টেবিলে বেজে গেছে।’

– ‘ইশ আচ্ছা নামান।’

ইশতিয়াক পা নামাতেই তুলি নিজের পা জুতো থেকে বের করে ইশতিয়াকের পায়ের পাতায় রাখে।

– ‘একবার আপনার পা উপরে থাকবে, আরেকবার আমার পা।’

– ‘আচ্ছা।’

– ‘দেখুন ছুটির দু’দিন কেমন চলে যাচ্ছে। কাল থেকে আবার তোমার অফিস।’

ইশতিয়াক কিছু বললো না। খানিক পর তুলি পুনরায় বললো,

– ‘এই শুনুন না, আজ তো শনিবার। আপনার অফিস ছুটি আছে। চলুন না আমাদের বাসায়। আম্মুকে দেখতে ইচ্ছা করছে।’

ইশতিয়াক খানিক ভেবে বললো,

– ‘তোমাকে দিয়ে চলে আসবো। যখন বলবে আবার গিয়ে নিয়ে আসবো।’

– ‘আপনার একা থাকতে সমস্যা হবে না?’

– ‘না, একা থেকে আমি অভ্যস্ত। তবে তোমাকে মিস করবো। আর মিস করলেই চলে যাব সমস্যা নেই।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে জনাব।’

দুপুরে দু’জন বের হয় রিকশা নিয়ে।

– ‘মামা মুগদা যাওয়ার আগে একটা মিষ্টি-মাস্টির দোকান দেখে থামাবেন।’

তুলি চোখ পাকিয়ে বললো,

– ‘তা কেন?’

– ‘দামান যাবে শ্বশুরবাড়ি।’

– ‘ধ্যাৎ আমাদের বাড়িতে বাচ্চা-কাচ্চাও নেই। এসব লাগবে না।’

– ‘তুমিই তো ওই বাড়ির বাচ্চা। যে কি-না খেতে বসে বলে পা কোলে দিন। যেন না দিলে খাবে না৷’

তুলি ফিক করে হাসে।

– ‘তাই বলে বাচ্চা মেয়ে?’

– ‘তো বাচ্চা মেয়ে না? বাচ্চা ছাড়া কেউ বলবে ‘একবার আপনার পা উপরে থাকবে, আরেকবার আমার পা।’

তুলি মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হাসে,

– ‘তো আমি বাচ্চা হলে কি হলো?’

– ‘বাচ্চা বলেই তুমি যে কয়দিন থাকবে, তারজন্য আইস্ক্রিম, চকলেট এসব নিব।’

দোকানের কাজ সেরে দু’জন খুনসুটি করতে করতে চলে এলো মুগদা। তুলি আগে গেইট খুলে ভেতরে গেল। এখান থেকে প্যাসেজ গিয়ে লেগেছে মেইন দরজায়। বাঁ পাশে বাউন্ডারি ঘেঁষে কিছু ফুল গাছ আর টবে চারা দেখা যাচ্ছে।
তুলি কলিংবেল চাপতেই কাজের মেয়ে এসে দরজা খুলে দিয়ে ‘আপা আসছে’ বলে জড়িয়ে ধরলো তুলিকে। ইশতিয়াক ব্যাগ-প্যাক দিল ওর কাছে। তাকে সিটিং রুমে বসিয়ে তুলি ভেতরে গেল। তুলির মা হুস্না বেগম এলেন। ইশতিয়াক সালাম দিল।

– ‘তোমরা আসবে জানতাম না বাবা। বোকা মেয়েটাও বলেনি। জানলে ওর বাবা বাসায় থাকতেন। তুমিও না-কি আজ থাকবে না।’

– ‘সমস্যা নেই আম্মু, আমি আবার নিতে আসবো তো।’

– ‘থাকবে না কেন বাবা, এখান থেকে তো একটু আগে বের হলে অফিসে যেতে পারবে।’

– ‘আজ একটু কাজ আছে।’

কুশল বিনিময় শেষে তুলি সহ তারা চলে গেলেন।
ইশতিয়াক সিটিং রুমে বসে টিভি দেখছে। কাজের মেয়ে নাশতা দিয়ে গেল। তুলি একটু পরই শাড়ি চেঞ্জ করে সেলোয়ার-কামিজ পরে এলো।

– ‘আহ সেলোয়ার-কামিজ পরতে কি আরাম।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘তাহলে তাই পরবে, শাড়ি পরো কেন?’

– ‘আপনার জন্যই।’

– ‘আমি কিন্তু বেশিক্ষণ বসবো না।’

– ‘কি বলেন খেয়ে-দেয়ে যাবেন।’

– ‘আরে না, আমার কলিগদের সঙ্গে আজ আড্ডা দেবো।’

– ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে।’

– ‘কিন্তু বিদায় তো এখান থেকে নেয়া যাবে না।’

– ‘আব্বু কখন ফিরবে ঠিক নাই। আর আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি।’

– ‘আরে না, সেটা না।’

– ‘তো?’

– ‘তোমার রুমে নিয়ে চলো।’

তুলি চোখ পাকিয়ে বললো,

– ‘কেন?’

– ‘বিদায় নেব।’

– ‘তারজন্য রুমে যাওয়ার কি আছে?’

– ‘রুমে নেয়া কি নিষেধ? তাহলে থাক।’

– ‘আরে না চলুন।’

ইশতিয়াক রুমে এসেই দরজা লাগিয়ে দেয় ভেতর থেকে। তুলি আঁতকে উঠে বলে,

– ‘এটা কি হলো?’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে ওর দিকে এগিয়ে গেল৷ তুলি পিছু যেতে যেতে খাটের কাছে গিয়ে আঁটকে যায়। ইশতিয়াক ওর মুখটা আঁজলা করে ধরে। চোখে চোখ রেখে শ্লথ গতিতে দু’জনের ঠোঁট ঢুকে পড়ে অপর ঠোঁটে। তুলি নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ইশতিয়াকের পুরো মুখে চুমু খায়।

– ‘ঠিক আছে এবার যেতে পারি, বিদায় নেয়া হয়ে গেছে।’

ইশতিয়াক পা বাড়িয়ে দরজা খোলার আগেই আবার তুলি জাপ্টে ধরে পেছন থেকে। পিঠে গাল চেপে ধরে থাকে।

– ‘কি হলো?’

তুলি অস্ফুটে বলে,

– ‘যেতে দিতে ইচ্ছা করছে না, থেকে যান প্লিজ।’

ইশতিয়াক ঘুরে তাকে বুকে জড়িয়ে নেয়৷

– ‘আমি কাল আবার অফিস থেকে সোজা চলে আসবো ম্যাডাম, এখন যাই।’

তুলি মাথা তুলে তাকিয়ে বললো,

– ‘আচ্ছা যান, কিন্তু কাল রাতে শিওর আসবেন।’

‘আচ্ছা’ বলে ইশতিয়াক আবার কপালে চুমু খেয়ে বের হয়ে গেল।

ইশতিয়াক কলিগদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে রাতে ফিরেছে বাসায়। খাওয়ার ঝামেলা বাইরেই চুকিয়ে এসেছে। এখন হাত-মুখ ধুয়ে লম্বা ঘুম দেবে। বিছানায় যেতেই এলো তার মায়ের কল। ভালো-মন্দ কথা বলে ফোন রেখে ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙলো অচেনা নাম্বার থেকে কল পেয়ে। ইশতিয়াক তাকিয়ে দেখে ঘড়িতে সাতটা বাজে। বিরক্ত হয়ে ফোন রিসিভ করলো।

– ‘হ্যালো।’

– ‘আসসালামু আলাইকুম ভাই, আমি রফিক। ওইদিন কাশবনে পুলিশের সঙ্গে ছিলাম। পরনে ছিল হলুদ গেঞ্জি।’

__চলবে__

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৫

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৫ম পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

ইশতিয়াক টাকা দিয়ে তুলির কাছে আসে। ওর মুখের দিকে ভালোভাবে তাকায়, কেমন বিপর্যস্ত চেহারা, হয়তো ভয় পেয়েছে ভীষণ। সে হাত পিঠের দিকে নিয়ে তুলিকে জড়িয়ে ধরে বললো,

– ‘চলো যাই।’

খানিক হেঁটে ইশতিয়াক পুনরায় বললো,

– ‘তোমাকে এরকম দেখাচ্ছে কেন? মন খারাপ?’

তুলি নিজেকে আর সামলাতে পারে না। ইশতিয়াকের বুকে মুখ লুকোয়, পুরো শরীর ‘ফ্যাসফ্যাস’ কান্নায় কেঁপে উঠে।

ইশতিয়াক বাঁ হাতে ওর থুতনি ধরে তুলে চোখের জল মূছে দিতে দিতে বললো,

– ‘আরে কাঁদছো কেন বোকা? এরকম কত হয় মানুষের সঙ্গে। তাছাড়া আমরা বিবাহিত হয়েও ওইখানে কিছুই তো করিনি। তবুও পুলিশ বলেছে ভিডিয়ো-টিডিয়ো করে থাকলে ডিলিট করে দিতে। কেঁদো না, চলো আস্তে আস্তে যাই। সামনে গিয়েই রিকশা নিয়ে সোজা বাসায় চলে যাব। টিস্যু দিয়ে চোখ-মুখ মূছে নাও।’

ইশতিয়াকের স্বাভাবিক আচরণ দেখে তুলি মনে মনে ভীষণ খুশি হয়। সবকিছুই পজিটিভলি নিচ্ছে মানুষটা। ভ্যানিটিব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে তুলি মুখ মূছে নেয়।
এবার একফাঁকে ওই নাম্বারও ব্লক করে দিতে হবে। আগেরটা ব্লক করে দেয়ার পরও আরেকটা দিয়ে কল আর মেসেজ দিয়েছে! কয়টা সিম কে জানে। যখন-তখন কল এলে তাদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝি হতে পারে। আচ্ছা ইশতিয়াককে কি ছবিগুলোর বিষয়ে বলবে? আগবাড়িয়ে বলার পর যদি সন্দেহ করে? বিয়েটাও হয়েছে বেশিদিন হয়নি। সবেমাত্র এক মাস হল। তবে চেনা-জানা অনেক আগে থেকেই।
তখন মুগদা তাদের বাসায় ইশতিয়াক ভাড়াটিয়া হিসাবে উঠে। পড়ালেখা শেষ করে একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করছিল। নিজের পরিবারের সঙ্গে তার সব সময় ঝামেলা লেগে থাকে। কারও সঙ্গে বনি-বনা হয় না। এখনও তেমন নেই। এটাইই মূল সমস্যা কি-না আরও কিছু আছে তুলি জানে না। ব্যাংকে চাকুরি হওয়ার পর মা-বাবাকে দিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয় ইশতিয়াক৷ তুলিও রাজি হয়ে যায়। খুবই ঘরোয়া পরিবেশে বিয়েটা হয়। বলতে গেলে ইশতিয়াকই এতো আয়োজন চায়নি। বিয়ের সময় ইশতিয়াকের বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। বিয়ে শেষে সোজা নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে আসে ইশতিয়াক। তার মা-বাবাও ছেলের কথার বিরুদ্ধে যাননি। কেন যেন ওরা ইশতিয়াককে নিজের মতো থাকতে দেন। কোনো কিছুতে ঘাটাতে যান না। এর পুরোপুরি কারণ তুলি বের করতে পারেনি। কেবল ওরা বলেছিল, ‘বউমা আমাদের ছেলেটা হুটহাট অনেক বেশি রেগে যায়। তুমি মানিয়ে নিয়ো মা’ তার মানে ওরা হয়তো ইশতিয়াককে কিছুটা ভয়ও পায়।

– ‘কি হলো এতো চুপচাপ কেন?’

ইশতিয়াকের প্রশ্নে তুলি ভাবনার ভুবন থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।

– ‘না কিছু না।’

– ‘মন খারাপ?’

– ‘না, শুধু একটু ক্লান্ত লাগছে।’

– ‘এইতো রাস্তায় চলে এসেছি। একটা রিকশা নিয়ে সোজা চলে যাব।’

ইশতিয়াক রিকশা ডেকে আনে। দু’জন রিকশায় উঠে বসে। ওর পিঠের দিকে হাত নিয়ে জড়িয়ে ধরেছে ইশতিয়াক। তুলিও কাঁধে মাথা রেখে। কিন্তু আশপাশের কিছুই যেন দেখছে না, শব্দ কানে আসছে না। মাথায় কেবল উপর্যুপরি চিন্তার ঝড় বইছে৷ অচেনা নাম্বারের ছেলেটি আসলে কে? তাকে চেনে কিভাবে? নাম্বারই বা পেল কোথায়? আর তার সঙ্গে অন্তরঙ্গ ছবি, লিপকিসের ভিডিয়ো? এগুলো কিভাবে সম্ভব? যে ছেলেকে চেনেই না তার সঙ্গে নিজের এমন ছবি কিভাবে? নিশ্চয়ই এডিট করা। তার তো আর স্মৃতিশক্তি লোপ পায়নি যে অতীত ভুলে গেছে। কেউ চাচ্ছে হয়তো ইশতিয়াকের সঙ্গে তার সুখের সংসার ভেঙে যাক। ছেলেগুলোকে যেহেতু টাকা দিয়েই এসেছে। ওদের দিক শেষ। সুতরাং বিষয়টি আপাতত ইশতিয়াককে না জানানোই ভালো। সম্পর্কে সেধে সেধে তৃতীয় পক্ষ ঢোকানোর মানেই হয় না।

– ‘ওই লোকাল দুইটা ছেলে কিসব বলাবলি করলো?’

ইশতিয়াকের প্রশ্নে তুলি ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠে।

– ‘কি বলেছে?’

– ‘আমি পুরোপুরি শুনিনি। তোমাকে কিসের জন্য ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছিল। তুমি না-কি টাকা নেই বলেছো এসব দূর থেকে শুনলাম।’

তুলি সুস্থির নিশ্বাস নেয়, তারমানে ইশতিয়াক বিষয়টি ভালোভাবে বোঝেনি।

– ‘হ্যাঁ, ওরা টাকা চাইছিল। বললো আমরা কি করেছি সব ভিডিয়ো আছে৷ আমি টাকা দিলে এগুলো ডিলিট করে দেবে। আমরা কি এমন করেছি বলো? তাদের কেন ভয় পেয়ে টাকা দেবো। তাই বলেছি আমার কাছে টাকা নেই।’

– ‘ভালো করেছো, সবগুলোই ধান্ধাবাজের দল। তুমি বোর হচ্ছ দেখে ঝামেলা মিটমিট করে চলে এলাম। না হয় দেখতাম কিভাবে টাকা নেয়।’

তুলি আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বললো,

– ‘থাক ঝামেলা না করায় ভালোই হইছে।’

খানিক দূরে যেতেই রাস্তায় জ্যাম৷ রিকশা থেমে আছে অনেক্ষণ। তুলি ওর কাঁধে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে চোখবুজে মাথা রাখে। পাশেই ফুসকা ও বাদামওয়ালা দেখে ইশতিয়াক হাত ইশারায় ডেকে ফুসকা এবং বাদাম নেয়। তুলি কিছুই বুঝতে পারছে না। সে হয়তো ঘুমিয়েই গেছে। ইশতিয়াক এক হাতে তাকে বেঁধে রেখেছে।

বাসায় পৌঁছাতে তাদের সন্ধ্যা হয়ে গেল।
তুলির মাথা ভীষণ ভার ভার লাগছে। তাই এসেই ফ্রেশ না হয়ে বিছানায় শুয়ে গা ছেড়ে দেয়। ইশতিয়াক ফ্রেশ হয়ে এসে বললো,

– ‘শুয়ে থাকো, কিন্তু অসময়ে ঘুমিয়ে যেও না। আমি কফি জ্বাল দিয়ে নিয়ে আসছি।’

তুলি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। লোকটা এতো যত্ন নেয়। দিনকে দিন ভীষণ মায়ায় জড়িয়ে গেছে। ইশতিয়াক রুম থেকে বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতেই তুলির মনে পড়ে যায়। ফোনটা হাতে নেয়। প্রথমেই ওই নাম্বার ব্লক করে, তারপর হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে ক্রোধে লিখে,

“tui asob picture r video Edite korachis ken? kun gorur baccha re tui? Tore j bollam chini na tar por o call dis ken? Basai ki ma bun nai? Ami ekjon bibahito meye agei bolechi, toke chini o na.. Tarpor o ken message ar call diyechis? Abar Amar picture edite kore pataiye voy dekhacchis kukurer baccha.. Tore nam A mamla korbo Ami.. Jelar vat khawabo.. Ager number block dichi ekhon arek number diye jalacchis.. R kokhono message dibina bollam..”

মেসেজটা সেন্ড করে ব্লক দেয় নাম্বার। রাগে এখন রীতিমতো তুলির শরীর কাঁপছে। আজ কেমন বিপদেই না পড়েছিল এই অচেনা লম্পটটার কারণে। খানিক পরেই ট্রে করে কফি নিয়ে এলো ইশতিয়াক।

– ‘এইযে ম্যাডাম, অবেলায় ঘুমানোর দরকার নেই। চলো বেলকনিতে বসে কফি খাই।’

– ‘উঠতেই ভালো লাগছে না।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আচ্ছা শুয়ে থাকো।’

কথাটি বলে সে ট্রে নিয়ে বেলকনিতে যায়। সেখানে দু’টা চেয়ার আছে। জায়গাটা ছোট্ট হলেও বসতে ভালো লাগে। মন ফুরফুরে হয়ে যায়। এখান থেকে রাতের আকাশ দেখতে দারুণ লাগে। নিচে তাকালেও পাড়ার বাসাগুলোর জানালার ফাঁক গলে রাতের তারার মতো বিন্দু বিন্দু আলো উঁকি দেয়।

ইশতিয়াক ট্রে রেখে তুলির পাশে গিয়ে বসে। তুলি ওর হাতটা গালে চেপে ধরে তাকায়। মানুষটা এত যত্ন করে, ভালোবাসে। ওকে কখনও হারাতে পারবে না তুলি। হাজার রাগী হোক, সে মানিয়ে নেবে।
‘কি হলো ম্যাডাম, এভাবে তাকিয়ে না থেকে উঠো’ কথাটি বলে ইশতিয়াক মাথার দিকে হাত নিয়ে আস্তে করে তুলে। আরেক হাত হাঁটুর দিকে নিয়ে পাঁজাকোলা করে কোলে নেয়। তুলি আবার কাঁচভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ছে। ইশতিয়াক তাকে বুকের সঙ্গে আরও চেপে ধরে বললো,

– ‘এভাবে হাসলে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছা করে।’

তুলি ওর কাঁধে মুখ লুকিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– ‘আমার এত ভাগ্য ভালো কেন আমি ভেবে পাই না৷ কি করে আপনার মতো বর পেলাম?’

– ‘বাব্বাহ তাই?’

– ‘জি, তবে আমার প্রায়ই মনে হয় এই সুখ আমার দীর্ঘস্থায়ী হবে না।’

– ‘তা কেন?’

– ‘জানি না, অবচেতন মন বলে।’

বেলকনিতে এসে ইশতিয়াক তাকে চেয়ারে বসায়। তুলি রসিকতা করে বলে,

– ‘আপনার কোলেই ভালো লাগছিল, শরীরের উষ্ণতায় কেমন ওম ওম লাগে।’

ইশতিয়াক ওর হাতে কফির কাপ তুলে দিয়ে বললো,

– ‘আমার বউটা যেরকম চাচ্ছে সেরকমই হবে, আগে কফি খেয়ে নাও তারপর।’

– ‘তারপর কি হবে?’

– ‘পরেরটা পরে, আগে কফি শেষ হোক। তোমার ঘুম ঘুম ভাব কেটে যাবে।’

তুলি কফিতে চুমুক দেয়। খানিক্ষণ নীরবতায় কেঁটে যায়৷ নীরবতা ভাঙে ইশতিয়াক।

– ‘তুমি এখনও ‘আপনি’ বলো। ‘তুমি’তে কবে আসবে আর?’

– ‘আসবো না, ‘আপনি’ বলতেই ভালো লাগে।’

– ‘তা কেন? তাহলে কি আমিও আপনি ডাকবো না-কি?’

– ‘জীবনেও না, ‘তুমি’ বলবেন। আপনার মুখে আমার নামও ভীষণ ভালো লাগে।’

ইশতিয়াক রসিকতা করে বললো,

– ‘তাহলে আমি ‘তুই’ ডাকবো।’

– ‘একদম না, বরের মুখে ‘তুই’ খুবই বিশ্রী লাগে। ‘তুমি’ সুন্দর।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

দু’জনের কফি শেষ হতেই ইশতিয়াক কাপ রেখে শীতল পাটি নিয়ে এলো।

– ‘একটু রুমে যাও তুলি।’

তুলি গেলে সে চেয়ার দু’টা বের করে শীতল পাটি বিছিয়ে নেয় বেলকনিতে।

– ‘আসো, বসো এসে।’

– ‘এত আয়োজন কিসের জনাব?’

– ‘বসো, আসছি আমি।’

ইশতিয়াক গিয়ে বাদাম আর ফুসকার ব্যাগ নিয়ে এলো৷ মোবাইলে মৃদু শব্দে ছেড়ে দিল তার প্রিয় কবির প্রিয় গান,

‘সেদিন দুজনে দুলেছিনু বনে……. যেতে যেতে পথে পূর্ণিমারাতে…… এখন আমার বেলা নাহি আর বহিব একাকী বিরহের ভার……’

ইশতিয়াক পলিথিনের ব্যাগ থেকে ফুসকা আর বাদাম বের করে সামনে রাখে।

তুলি অবাক হয়ে বললো,

– ‘এগুলো কখন নিলেন খেয়াল করিনি তো।’

– ‘তুমি ঘুমাচ্ছিলে তখন।’

– ‘কিন্তু রিকশা থেকে নেমে রুমে এলাম তাও খেয়াল করিনি।’

– ‘হুম তুমিই জানো কোথায় মন পড়ে আছে তোমার।’

তুলি আর সেদিকে কথা বাড়াতে গেল না। সে এড়িয়ে গিয়ে বললো,

– ‘জায়গাটা অনেক ভালো লাগছে। পাটিও মাপমতো এনেছো দেখছি।’

– ‘আমি রোজই এখানে এসে সন্ধ্যায় একা একা বসে গান ছেড়ে সিগারেট টানতাম।’

– ‘এই ভালো কথা মনে করছেন। আপনি সিগারেট খান জানি৷ কিন্তু গন্ধও তেমন পাই না, আবার আমার সামনেও খান না, তা কেন?’

– ‘তুমি অপছন্দ করতে পারো ভেবে।’

– ‘আরে না, আমার না ছেলেদের সিগারেট খেতে দেখলে অসম্ভব ভালো লাগে। ছেলেদের সিগারেট খাওয়ার ভাবটাই আলাদা। কেমন টান দেয়, আর ধোঁয়া ছাড়ে। কিন্তু আমি দেখেছি অনেক মেয়েরা নিয়মিতও খায়, তবুও তাদের মানায় না। সিগারেট যেন ছেলেদের একান্ত ব্যক্তিগত অলংকার। যেরকম মেয়েদের নাক, কানে দুল, কপালের টিপ।’

– ‘বাবা সিগারেটকে মহিমান্বিত করে ছাড়বে দেখছি।’

তুলি ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘সিগারেট খাওয়া অবশ্যই ক্ষতিকর, না খাওয়া ভালো। মানে সিগারেট খাওয়া অবস্থায় ছেলেদের দেখতে আরকি কেমন হিরো হিরো লাগে।’

ইশতিয়াক হেঁসে বললো,

– ‘যাইহোক, এখন তুমি আমার কোলে বসে বুকে পিঠ ঠেকিয়ে উষ্ণতা আর ওম ওম ভাব নিয়ে ফুসকা খেতে পারো।’

– ‘এভাবে তো আপনাকে দেখা যাবে না।’

– ‘বাইরের আকাশ দেখবে।’

– ‘না আমার আপনাকেই দেখে গল্প করে করে ফুসকা খেতে হবে।’

ইশতিয়াক ওকে টেনে কোলে বসিয়ে বললো,

– ‘কিন্তু আমার তো এরকম বসে গল্প করতে ইচ্ছা করে।’

তুলি খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। ওর হাসিকে ছাপিয়ে রুম থেকে ভেসে এলো মোবাইলের রিং টিউন। বুকটা কেঁপে উঠল তুলির।

– ‘তোমার ফোনে কল এসেছে মনে হয়।’

তুলি উঠতে যাচ্ছিল। ইশতিয়াক তাকে বাঁধা দিয়ে বললো,

– ‘তোমার উঠতে হবে না, আমি এনে দিচ্ছি।’

ইশতিয়াক মোবাইল নিয়ে ফিরে এসে তুলির দিকে বাড়িয়ে দেয়। নাম্বার দেখে তুলির বুকে ধুকপুকানি বেড়ে যায়,

– ‘আবার অপরিচিত নাম্বার।’

– ‘সকালের?’

– ‘না এটা আরেকটা।’

– ‘তাহলে রিসিভ করো। অন্যকেউ হতে পারে।’

– ‘না থাক।’

ইশতিয়াক আর কিছু বললো না। তুলি অস্বস্তিবোধ করছে। খানিক পর মেসেজ টিউন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে তুলির শরীর যেন অসাড় হয়ে এলো। এই অচেনা নাম্বার থেকেই মেসেজ এসেছে।

– ‘কি হলো? কোনো সমস্যা? কিসের মেসেজ?’

তুলি যথাসম্ভব নিজেকে অবিকৃত রেখে বললো,

– ‘আর কিসের মেসেজ, গ্রামীণের অফিস থেকে।’

ইশতিয়াক ভুরু কুঁচকে তাকায়। তবুও কিছু বলে না। বেলকনিতে আড্ডা দিয়ে আজ রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমোতে যেতে দেরি হয় তাদের। তবুও মাঝ রাতে হঠাৎ ইশতিয়াকের ঘুম ভেঙে যায়। পাশে তুলি নেই। তখনই রাতের পিনপতন নীরবতায় বেলকনি থেকে কানে ভেসে এলো তুলির নিম্নস্বরে ফোনালাপ।

___চলবে___

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৪

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৪র্থ পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

পুলিশ দেখে তুলি আর ইশতিয়াক মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। কিছুই বুঝতে পারছে না তারা। ইশতিয়াক এগিয়ে গেল বাইকের কাছে।

– ‘আমাদের ডাকছেন স্যার?’

– ‘হ্যাঁ, আপনাদের ডাকলাম। এখানে কি? বাড়ি কোথায়?’

– ‘এখানে কি মানে? এখানে বেড়াতে এসেছি।’

– ‘বাসা?’

ইশতিয়াক বাসার ঠিকানা বলার পর পুলিশ পুনরায় বললো,

– ‘আপনারা সম্পর্কে কি হন?’

– ‘স্বামী-স্ত্রী।’

এই উত্তর শুনে পুলিশ যেন আশাহত হলো। তবুও হাল না ছেড়ে বললো,

– ‘স্বামী-স্ত্রী বললেই তো হবে না। ঐ গাছের নিচে চলুন। ছায়া আছে, এই যে ম্যাডাম আপনিও চলুন।’

এতদূর হেঁটে যেতে হবে দেখেই তুলির বিরক্তি এসে গেল। ইশতিয়াক কোমড়ে দুই হাত রেখে একদলা ‘থুথু’ ফেলে বললো,

– ‘বুঝলাম না স্যার, এই রোদের মাঝে গাছের নিচে যেতে হবে কেন? হয়রানি করার কারণ কি বলুন?’

– ‘আরে মিয়া হয়রানি মানে? আপনারা ঝোপঝাড়ে শুয়ে থাকবেন। পুলিশ খোঁজখবর নেবে না? আগে গাছের নিচে চলুন। সেখানে গিয়ে আলাপ হবে। এখানে মাঝ রাস্তায় কি?’

দু’জন বিরক্তি নিয়ে বাইকের পিছু পিছু গেল। রোদে পিচঢালা রাস্তা ধরে হেঁটে একটি গাছের ছায়ায় এসে দাঁড়িয়েছে তারা। সেই গাছ থেকে একটি ছেলে নেমে এলো। আরেকজন দূরে হাঁটাহাঁটি করছে। পুলিশ এবার বাইক থামিয়ে বললো,

– ‘আপনারা কি হন?’

– ‘স্বামী-স্ত্রী।’

– ‘প্রমাণ কি?’

ইশতিয়াক আর মেজাজ ধরে রাখতে পারলো না।

– ‘ধরুন আমরা স্বামী স্ত্রী না। আমরা প্রেমিক প্রেমিকা, এখন সমস্যা কি হয়েছে? এই দেশে কি প্রেমিক-প্রেমিকা কোথাও বেড়াতে যেতে পারবে না?’

– ‘বেড়াতে যেতে পারবে, তাই বলে ঝোপঝাড়ে কি?’

– ‘প্রেমিক-প্রেমিকা হলে ঝোপঝাড়ে যেতেই পারে। পাব্লিক প্লেসে কি চুমাচুমি করবে?’

– ‘এসব জায়গায় অনৈতিক কাজ হয়, ধর্ষণও হয়।’

– ‘আপনার কাছে আমরা দু’জনের কেউ অভিযোগ করেছি? এখানে জোরাজুরির কিছুই হয়নি, ধর্ষণের প্রশ্ন আসছে কেন।’

– ‘এতো কথা নেই, আপনারা বিবাহিত হলে কাগজ দেখান। পরকীয়াও করতে পারেন।’

ইশতিয়াক তাকিয়ে দেখে পাশের ছেলেটা তুলিকে দূরে নিয়ে নানান প্রশ্ন শুরু করেছে। তুলির মোবাইলও দিতে বলছে তাকে। সে বিস্মিত হয়ে বললো,

– ‘আপনি আইনের লোক, কিন্তু এই ছেলে কে? সে ওকে বিরক্ত করছে কেন? মোবাইল চাচ্ছে কেন?’

পুলিশ বাইকে ভালোভাবে হেলান দিয়ে বসে বললো,

– ‘সমস্যা নেই, ও আমাদের লোক। আপনি কাগজ পত্র দেখান।’

– ‘মানুষ কি কাগজপত্র সাথে নিয়ে ঘুরে? সবচেয়ে বড়ো কথা আমরা স্বামী স্ত্রী না হলেই বা সমস্যা কি? দু’টা ছেলে মেয়ে কি বেড়াতে আসতে পারে না?’

– ‘বুঝেছি আপনারা বিবাহিত না। প্রেমিক-প্রেমিকা মনে হচ্ছে।’

ইশতিয়াক রেগে গিয়ে বললো,

– ‘হ্যাঁ প্রেমিক-প্রেমিকা, তাতে হয়েছেটা কি?’

– ‘প্রেমিক-প্রেমিকা হলে এখানে যে এসেছেন দু’জনের পরিবার কি জানে?’

দূরের সেই তৃতীয় ব্যক্তিও তাদের কাছে এলো।
ইশতিয়াক আঙুল দিয়ে কপালের ঘাম মূছে বললো,

– ‘প্রেমিক-প্রেমিকা কি মা-বাবাকে জানিয়ে সব জায়গায় যায়?’

পুলিশ এবার যেন দূর্বলতা খুঁজে পেল। মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘আমরা সেক্ষেত্রে দুজনের পরিবারের কাছে কল দিয়ে জানাই, নাম্বার দিন অভিভাবকদের।’

– ‘আপনি এটা কেন করবেন? একটা পরিবারের কাছে পুলিশ কল দিলে তো এমনিতেই ওরা বাজে কিছু ভেবে ভয় পাবে। সাধারণ বিষয় আপনি বড়ো করবেন কেন?’

– ‘সাধারণ কিভাবে? আপনি মা-বাবাকে না জানিয়ে ঝোপঝাড়ে যাবেন এটা কি অন্যায় নয়?’

– ‘আমরা কি বাচ্চা ছেলে-মেয়ে? সবকিছু মা-বাবাকে জানিয়ে আমাদের করতে হবে কেন? তাছাড়া মা-বাবাকে লুকিয়ে বাচ্চারাও তো অনেক কিছুই তো করে। খেলায় যায়, ঠান্ডায় আইসক্রিম খায়। অনেকে সিগারেট খায়। স্কুল পালায়। অন্যায় হলেও এসবের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক কি?’

তৃতীয় লোকটা এবার ইশতিয়াকের হাত ধরে টেনে দূরে নিয়ে বললো,

– ‘আরে ভাই, আপনি বোকা না-কি? এসব ঝামেলায় যাচ্ছেন কেন? থানায় নেবে, পরিবারের মানুষ ডাকবে। এর চাইতে দশ-বারো হাজার টাকা দিয়ে কেটে পড়ুন।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘জানতাম তোমাদের এসব ধান্ধা।’

সে আবার পুলিশের কাছে এসে বললো,

– ‘এই পোশাক পরে ব্ল্যাকমেইলের কাজ করেন। যাইহোক কোনো টাকা-পয়সা পাবেন না। আপনি যা ইচ্ছা করেন। থানায় নিতে হলে নেন। আর গাছের উপর থেকে ভিডিও করিয়েছেন তো। পারলে সাংবাদিক ডাকেন, রিপোর্টার এনে চ্যানেলে লাইভ দেখান। আমারও দরকার লোকজন জানানো। আর আমরা বিবাহিত কি-না তার কাগজ দেখাতে পারবো না। আমরা বিবাহিত না, এবার কি করবেন করুন।’

পুলিশ খানিকটা থমথমে খেয়ে গেল। তাকে রক্ষা করলো তুলির সঙ্গে কথা বলা ছেলেটি। ফিসফিস করে এসে কি যেন বললো। পুলিশের চেহারায় হাসির ঝলক।
পুলিশ ছাড়াও অন্য দুই ছেলে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করলো। ওরা কিছু একটা তুলির কাছে পেয়েছে। তিনজনকেই খুশি খুশি দেখা যাচ্ছে।
ইশতিয়াকের কানেও এলো ওদের কিঞ্চিৎ কথাবার্তা।

হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি, যে তুলির সঙ্গে কথা বলেছে, সে বললো,

– ‘মেয়েটির সঙ্গে টাকাইই নাই। ওকে ব্ল্যাকমেইল করে তেমন লাভই হবে না।’

– ‘পরে তো পাবো? মেয়েটির ফোন থেকে সবকিছু আমাদের মোবাইলে নিয়ে রাখি।’

– ‘ওর জামাইকে দেখাই, তাকে ব্ল্যাকমেইল করলে টাকা মিলবে।’

– ‘আরে না, তাতে জামাই বউয়ের মাঝে ঝামেলা হবে। আমরা টাকা পাব কিভাবে?’

– ‘তাও ঠিক।

– ‘আচ্ছা বউকে আরও প্রেশার দিয়ে দেখি। আর জামাইয়ের নাম্বার রাখি।’

তৃতীয় ব্যক্তি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ইশতিয়াক পুরোপুরি কোনোকিছু বুঝতে পারছে না। তুলির দিকে তাকায়। খুবই বিপর্যস্ত দেখাচ্ছে ওকে।

হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি এগিয়ে এসে তাকে বললো,

– ‘আপনার নাম্বারটা দিন। কিছু জরুরি কথা আছে। পরে যোগাযোগ করবো। আপনার ভালোর জন্যই বলছি।’

ইশতিয়াক আমতা-আমতা করে নাম্বার দিয়ে দিল।

তুলির ভয়ে হাত-পা কাঁপছে। বুক ধড়ফড় করছে। এসব কি হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। ছেলেটি কে? তাকে একটা নাম্বার থেকে ক’দিন আগে কল দিয়ে ছলনাময়ী, আমার জীবন নষ্ট করেছিস, এমন অনেক এলোমেলো কথা বলে অভিযোগ করেছিল। এমনভাবে কথা বলেছে তুলি নিজেই ভয় পেয়ে যায়। যেন সবকিছুই সত্য বলছে। কেউ শুনলে ভাববে আসলেই সে ছেলেটির সঙ্গে এমন কিছু করেছে। আজ সকাল থেকে কল রিসিভ করেনি। নাম্বারও ব্লক দিয়েছে। যখন হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটির হাতে মোবাইল দিয়েছিল। ঠিক তখনই দেখে অন্য নাম্বার থেকে অনেকগুলো কল এসেছে। মোবাইল সাইলেন্ড থাকায় সে বুঝতে পারেনি। কলের সঙ্গে একটা মেসেজও এসেছে। হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি তুলির হাত থেকে ফোন নিয়ে মেসেজে ক্লিক করে
“কল রিসিভ করছো না কেন? আমাকে না চেনার অভিনয় করা বন্ধ করো। তোমার হোয়াটসঅ্যাপে কিছু ছবি আর ভিডিও পাঠিয়েছি দেখো। এসব কি ভুলে গেছো?”

মেসেজ দেখে তুলি নিজেই আঁতকে উঠে। হোয়াটসঅ্যাপে আবার কি পাঠাবে? তাও এই জঘন্য লোকদের হাতে পড়বে। ততক্ষণে হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেটি ডাটা অন করে হোয়াটসঅ্যাপে ঢুকে সব পেয়ে যায়। তুলির ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটায় তৃতীয় ব্যক্তি।

– ‘ম্যাডাম কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে এখানেই মিটমাট করে দিন। আপনার হাসবেন্ডকে কিছুই জানানো হবে না।’
ম্যাডাম হলুদ গেঞ্জি পরা যে ছেলেটিকে দেখছেন। সে কিন্তু খুবই খারাপ। আপনার হাসবেন্ডকে সব বলে দিতে পারে। কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে মিটমাট করে নিন। ছবি আর ভিডিয়োগুলো একেবারে ফকফকা। আপনার জামাই দেখলে যতই যা বলেন কাজ হবে না, সংসার কিন্তু শেষ।’

তুলি দুই হাতে মুখ ঢেকে নিজেকে সামলাচ্ছে। যা করার দ্রুত করতে হবে। এই ছবি আর ভিডিয়োগুলো ইশতিয়াকের কাছে কোনোভাবে যেতে দেওয়া যাবে না। তার সঙ্গে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। আর এরাও টাকা না পেলে ঝামেলা করবে। ইশতিয়াককে তো দেখাবেই, পারলে নেটে দিয়ে দুনিয়ার মানুষকে দেখিয়ে ছাড়বে। সে এখন কি করবে? টাকাই দেবে, আগে এখান থেকে ঝামেলা চুকিয়ে যাওয়া যাক। বাকি সব পরে ভেবে দেখবে। তুলি ইশতিয়াকের দিক থেকে পাশ ফিরে লুকিয়ে ভ্যানিটিব্যাগ থেকে সকল টাকা বের করে দিয়ে বললো,

– ‘ভাই আমার সঙ্গে যা ছিল দিয়ে দিয়েছি। এখানে কত টাকা তাও জানি না। দয়া করে এবার যেতে দিন।’

ছেলেটি টাকা মুঠোয় নিয়ে হলুদ গেঞ্জি পরা ছেলেকে ডেকে আড়ালে নিয়ে গেল। দু’জন ফিসফিস করে কথা বলছে।

পুলিশ বাইকে বসে সিগারেট টানছে। ইশতিয়াককে ডেকে কাছে নিয়ে বললো,

– ‘আরে ভাই এই ছেলেরা এখানকার লোকাল। আমাকে কল দিল এখানে এনেছে অনৈতিক কাজ হচ্ছে বলে। ওরা বোধহয় ভিডিয়ো-টিডিয়ো করেছে।’

– ‘তো করলে সমস্যা কি? আমরা তেমন কিছুই করিনি।’

– ‘সেটা ঠিক আছে, তবুও ওদেরকে খুশি করে দিয়ে চলে যান। বলবেন ছবি-টবি ডিলিট করে দিতে।’

ইশতিয়াকের ইচ্ছা করছিল বলতে, ‘ছবি-টবি ডিলিট করাবেন আপনি। আর আমি অকারণ টাকা দেবো কেন?’
কিন্তু সে আর ঝামেলা করতে চাইছে না। অনেক হয়েছে। তুলিরও বিপর্যস্ত চেহারা। ক্লান্ত লাগছে। এরা সহজে যেতে দেবে না। সে পাঁচশো টাকা বাড়িয়ে দিল পুলিশের দিকে।

– ‘আরে ভাই আমার কাছে না, ওদেরকেই দেন। তবে আরও পাঁচশো দেন। দাঁড়ান আমি ডেকে আনছি।’

পুলিশ দু’জনকে ডেকে এনে বললো, ‘ভাই তোমাদেরকে এক হাজার টাকা দিয়ে যাচ্ছেন৷ চা-নাস্তা করে নিয়ো। আর ভিডিয়ো-টিডিয়ো করে থাকলে ডিলিট দিয়ে দিয়ো, ঠিক আছে?’

দু’জন সম্মতি জানায়। ইশতিয়াক পুলিশের নাটক সবই বুঝতে পারছে। তবুও টাকা বাড়িয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে তুলির দিকে গেল।

–চলবে–

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০৩

0

সেই মেয়েটি আমি নই
৩য় পর্ব
লেখা: জবরুল ইসলাম

তুলি নিজের ওপর ভীষণ বিরক্ত হলো। সে এই নাম্বার এতক্ষণ থেকে ব্লক মারছে না কেন? ফোন সাইলেন্ট করে নাম্বারটি ব্লক দিতে আর দেরি করলো না তুলি।

ইশতিয়াক এক আনাড়ি মাঝি। প্যাডেল দিয়ে ভুল-ভাল ঘোরাচ্ছে। বোট অন্য পাড়ে এসে ঘাসের ঝোপঝাড়ের ওপর আঁটকে গেছে। তুলি ওর অবস্থা দেখে খিলখিল করে হাসছে।

– ‘এত হাসাহাসির কি আছে? আমরা এই পাড় দিয়েও উঠে যেতে পারি।’

– ‘কিন্তু ছেলেটি তো বলে দিয়েছে তাদের ঘাটে বোট দিয়ে যেতে। এক কাজ করি, আমি প্যাডল দেই, আপনি ঘাস ধরে টানেন।’

– ‘পারবে?’

– ‘দেখি চেষ্টা করে।’

তুলি বসলো প্যাডেল দিতে। ইশতিয়াক এক হাতে বোট ধরে আরেক হাতে ঘাস টানছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না৷ এবার সে উঠে ভালোভাবে বসে ঘাসে ধরে জোরসে টেনে ধরলো। খানিক পরই ঘটলো বিপত্তি। ঘাস ছিঁড়ে গিয়ে সে টাল সামলাতে না পেরে বাজেভাবে পড়ে গেল নদীতে। বোটও একটুর জন্য উলটে যাচ্ছিল, তুলি ‘হায় আল্লাহ’ বলে কোনোভাবে বোট শক্ত করে আঁকড়ে ধরে বেঁচে গেল। ইশতিয়াক পানিতে পড়েই সঙ্গে সঙ্গে তার মোবাইল মানিব্যাগ পকেট থেকে বের করে হাত উঁচিয়ে ধরলো,

– ‘তুলি তাড়াতাড়ি নাও, দেখো মোবাইল ঠিক আছে কি-না।’

তুলি মোবাইল হাতে নিতে নিতে বললো,

– ‘আপনি উঠুন বোটে।’

– ‘পাগল না-কি, বোটে ভর দিয়ে উঠতে গেলে উলটে যাবে। এই নাও জুতা রাখো। ভাগ্য ভালো কেডস পরিনি।’

তুলি জুতো হাতে নিয়ে বললো,

– ‘তাহলে কি করবে এখন? আমরা এদিকে উঠে যাই? ওদের বললে নিজেরা নেবে এসে।’

– ‘এখান থেকে ঘুরে ওদের কাছে যাওয়াটাও অনেক সময় লাগবে। তারচেয়ে আমি সাঁতরাই আর নৌকা টানি।’

– ‘কিন্তু এভাবে তো আপনার অনেক কষ্ট হয়ে যাবে।’

– ‘সমস্যা নেই আসো।’

ইশতিয়াক এক হাত দিয়ে নৌকা ধরে আছে। আরেক হাতে টানছে। খানিক পর পর জিরান নিচ্ছে। মাঝামাঝি গিয়ে আর পারলো না সে। হাঁপিয়ে গেছে ভীষণ।

– ‘তুলি তুমি দেখো আস্তে আস্তে প্যাডল দিতে পারো কি-না। আমি পেছন থেকে ঠেলে-ঠুলে বোট সোজা রাখবো।’

– ‘আচ্ছা পারবো।’

কথাটি বলে তুলি ভ্যানিটিব্যাগে মোবাইল মানিব্যাগ ঢুকিয়ে গলায় ঝুলিয়ে নেয়। আসনে বসে আস্তে আস্তে প্যাডেল দিতে শুরু করে।

– ‘যাচ্ছে তো, আপনি ঠিক আছেন?’

– ‘হ্যাঁ, তবে আমিও পা দিয়ে সাঁতার কেটে বোট সোজা রাখছি।’

– ‘শুধু পা দিয়ে সাঁতার কাটা যায় বুঝি?’

– ‘হ্যাঁ, মানুষ পা দিয়ে সাঁতার কাটতে পারে, কিন্তু এভাবে সামনে এগুলেও মাথা ডুবে যায়।’

– ‘তাহলে আপনি ভেসে আছেন কিভাবে?’

– ‘বোটে ধরে আছি, আর এত কথা বলো কেন। আমার কথা বললে মুখে পানি ঢুকে যায়।’

প্যাডল বন্ধ করে তুলি কাঁচভাঙা হাসিতে ফেটে পড়ে৷

ইশতিয়াক হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,

– ‘হাসছো কেন? তুমি মজা পাচ্ছ না-কি?’

– ‘হ্যাঁ।’

– ‘হ্যাঁ মানে? আজাইরা কথা না বলে প্যাডেল দাও।’

তুলি প্যাডেল বন্ধ করে বললো,

– ‘দেবো না, দিলে তো তাড়াতাড়ি চলে যাব।’

– ‘আমি কিন্তু বোট ডুবিয়ে দেবো তুলি।’

– ‘এটা ভাড়া বোট।’

– ‘তুমি তো ভাড়া নও, টান দিয়ে ফেলে দেবো।’

তুলি ওর কথায় মনযোগ না দিয়ে সেল্ফি তুলতে শুরু করে। ক্যামেরা এদিক-ওদিক করে ঠিক করে ইশতিয়াককে ধরিয়ে তোলার জন্য।

– ‘তুলি ভালো হচ্ছে না কিন্তু।’

– ‘আরে, স্মৃতি হিসাবে থাকবে তো।’

ইশতিয়াক বোট থেকে হাত ছেড়ে ডুব দিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে ভেসে উঠে বললো,

– ‘আমি সাঁতার কেটে চলে যাচ্ছি। তুমি একা একা আসো এবার।’

তুলি আঁতকে উঠে। মোবাইল ভ্যানিটিব্যাগে রেখে হাঁক ছাড়ে,

– ‘প্লিজ, আমাকে নিয়ে যান মাঝি।’

– ‘তোমার চেহারায় এখনও দুষ্টামির হাসি। কান ধরে বলো তাহলে নেব এসে।’

– ‘শুনুন ‘এই পৃথিবী শুধু আপনার আমার না’ আশেপাশে অনেক লোক আছে৷ নদীর পাড় থেকে, স্টল থেকে তাকাচ্ছে। লোক সম্মুখে আপনার বউ কান ধরবে বলুন?’

ইশতিয়াক কথাগুলো শুনে হেঁসে ফেলায় পানি মুখে গিয়ে বিষম খেল। তারপর পুনরায় বললো,

– ‘কিন্তু তুমি এখনও দুষ্টামির ধান্ধায় আছো। কাতর হয়ে বললো তবেই নেব।’

– ‘আপনি কি পাথর? কাতর হয়ে বলতে হবে কেন? আপনারই তো বউ।’

– ‘হাসির কথা বলবে না তো তুলি। হাসলে পানি মুখে চলে যায়।’

কথাটি শুনে তুলি মুখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বারংবার নুইয়ে পড়ছে। ততক্ষণে ইশতিয়াক ডুব দিয়ে বোটের কাছে চলে এলো।

– ‘এত না হেঁসে প্যাডল দাও।’

– ‘মাঝি আসছেন?’

– ‘আমি মাঝি হলাম কবে থেকে?’

– ‘আপনি আমার মাঝি।’

– ‘হ্যাঁ আমি তোমার নদীর ব্যক্তিগত মাঝি।’

তুলি চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বললো,

– ‘আমার নদী মানে?’

– ‘তুমি প্যাডল দেবে?’

– ‘ঐ দেখা যায় বক, আমি প্যাডল দেই আপনি বকের কাছে নিয়ে যান।’

– ‘তুলি আশপাশের মানুষ তাকাচ্ছে। প্লিজ তাড়াতাড়ি যাও, আমারও হাত ব্যথা এসে গেছে।’

– ‘জি আচ্ছা জনাব, যাচ্ছি।’

তুলি প্যাডেল দিতে শুরু করে। প্যাডেলের তীব্র শব্দ। সে হাঁক ছেড়ে বললো,

– ‘মাঝি আপনি আমার পেছনে তাই ভালো লাগছে না৷ দেখা গেলে ভালো লাগতো।’

– ‘ঢং করো না তো তুলি, তাড়াতাড়ি পাড়ে যাও।’

– ‘ভেজা কাপড় নিয়ে তো আর কাশফুল দেখা যাবে না।’

– ‘মন খারাপ হচ্ছে? চিন্তা করতে হবে না। আগে পাড়ে যাই।

দু’জন খানিক পর চলে এলো কিনারায়। উৎসুক জনতার ভীড় হবার আগেই ইশতিয়াক দোকানে বোট বুঝিয়ে দিয়ে তুলিকে নিয়ে সেখান থেকে কেটে পড়লো।

– ‘কি করবেন এখন? ভেজা কাপড়ে আর না হেঁটে বাসায় চলে যাই।’

ইশতিয়াক পিছু ফিরে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘ভিজেই তো গেছি। এভাবে বাসায়ও ফিরতে হবে। সুতরাং ঘুরাঘুরি করেই যাই।’

– ‘লোকে দেখে কি বলবে।’

– ‘আরে মানুষ তো বুঝবেই পড়ে গিয়েছিলাম। এগুলো ব্যাপার না। তাছাড়া গ্রামে কত বছর আগে সাঁতার কেটেছিলাম, আজ পড়ে যাওয়ায় সাঁতরানো হলো।’

তুলি হেঁসে বললো,

– ‘আহা মন বুঝ।’

ইশতিয়াক ভেজা হাতে ওর গাল টিপে ধরে বললো,

– ‘তাছাড়া আমার বউটা যদি বরের বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে মজা পায়, তাহলে মাঝে-মধ্যে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত কাণ্ড হলে মন্দ কি।’

তুলি আর কিছু বললো না। ইশতিয়াকের এক হাত বাহুডোরে বেঁধে গাল চেপে ধরে হাঁটতে লাগলো। ইশতিয়াক খানিক পর বললো,

– ‘আমার পাঞ্জাবি ভেজা, তুমি ভিজে যাবে তো।’

– ‘ভিজে যাক।’

– ‘হ্যাঁ, তাও ঠিক। বরকে ধরেই তো ভিজবে। আমার জলেই ভিজবে তুমি।’

– ‘আপনি এমন ডাবল মিনিং শিখছেন কোত্থেকে? ব*দ আছেন অনেক।’

– ‘আমি আগে তো এতকিছু জানতাম না, তোমার সঙ্গ পেয়ে ব*দ হয়ে গেছি।’

– ‘আমি এরকম প*চা কথা কখনও বলি না।’

সামনে তাকিয়ে মুগ্ধতায় দু’জনের আলাপচারিতা কমে এলো।
হেঁটে হেঁটে কাশফুলের মাঝামাঝি রাস্তায় চলে এসেছে তারা। দুইপাশে সারি সারি কাশফুলের গাছগুলো বাতাসে মৃদু কাঁপছে।
তুলি গুন-গুন করলো রবীন্দ্রনাথের কবিতার দু’টো লাইন,
‘চিক চিক করে বালি কোথাও নেই কাদা,
একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।’

ইশতিয়াক আকাশের দিকে তাকায়। সাদা সাদা নরম মেঘের ফাঁক গলে কাশবেন ঝরে পড়ছে রোদ।
নিচে যতদূরে চোখ যায় দৃষ্টিজুড়ে শুধু কাশফুল আর কাশফুল। বিস্তীর্ণ এলাকা যেন শুভ্রতার চাদরে মোড়া এক অপরুপ সৌন্দর্যের রাজ্য।

– ‘কেমন লাগছে তুলি?’

– ‘ভালো, তবে ছবির মতো নয়।’

ইশতিয়াক খানিক হেঁসে বললো,

– ‘চলো ঐদিকে যাই, দেখি পাঞ্জাবি খুলে চিপে দেয়ার মতো আড়াল পাই কি-না।’

কাশবেনর চারপাশে ঝকঝকে আঁকা-বাঁকা ছোট ছোট রাস্তা পিচঢালা রাস্তা। তারা হাঁটছে সেসব পথ ধরে, হঠাৎ একখন্ড নির্জন জায়গা চোখে পড়ে তুলির।

– ‘চলো এদিকে যাই।’

ইশতিয়াক দেখলো রাস্তার বাঁ পাশে অনেকটা জায়গাজুড়ে বন। কেটে খালি করা হয়েছে। সেখানকার মাটিতেও সবুজ নরম ঘাস উঠেছে। জায়গাটা ভীষণ পছন্দ হলো দু’জনের।
ইশতিয়াক বললো,

– ‘আচ্ছা চলো।’

– ‘কি সুন্দর গোল করে বন কাটা।’

– ‘হ্যাঁ।’

দুজন ভেতরে গেল। ঠিক মাঝখানে গিয়ে বসে তারা।

– ‘আহ এখন শান্তি লাগছে। হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম হাঁটতে হাঁটতে।’

– ‘কিন্তু আমার শার্ট খুলে চিপতে হবে।’

– ‘প্যান্ট খুলেও চিপে নিতে পারেন৷’

– ‘তুমি না পচা কথা বলো না।’

– পচা কথা কোথায়? প্যান্টের নিচে তো আন্ডারওয়্যার আছেই।

– ‘হঠাৎ কেউ আসবে।’

– ‘আমার বরের ইজ্জত রক্ষার্থে আমি সদা প্রস্তুত জনাব।’

– ‘তুমি এখনও মজা নিচ্ছ।’

– ‘আরে না, আপনি ওইখানে একেবারে কাশবনের কাছে যান। তাহলে পেছনে কাশবন থাকবে। আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে আপনার বউ। কেউ কি আর এলে দেখবে? তখন শান্তিমতো চিপে ঝেড়ে নিবেন।’

– ‘হ্যাঁ দারুণ আইডিয়া।’

ইশতিয়াক আর তুলি একেবারে গোল জায়গার মাঝখান থেকে বনের কাছে গেল। তুলি সামনে দাড়ায়। ইশতিয়াক পাঞ্জাবি খুলতেই তুলি বললো,

– ‘পাঞ্জাবি আমার কাছে দেন আমি চিপে দিচ্ছি। আর আপনি প্যান্ট খুলুন।’

– ‘ধ্যাৎ ‘প্যান্ট খুলুন’ এত বাজেভাবে বলছো কেন?’

তুলি ফিক করে হেঁসে পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে চিপে ঝাড়ছে।

– ‘আপনিও খুলে ঝেড়ে নিন ভালো করে।’

– ‘তা তো করবোই। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি শুকাইবে না।’

– ‘না শুকাইল, কিন্তু পানি না থাকলে গায়ে লেপ্টে থাকবে না৷ অস্বস্তি হবে না আপনার। তাছাড়া দূর থেকে কেউ দেখে বুঝবেও না।’

– ‘তা ঠিক।’

ইশতিয়াক প্যান্ট চিপে ঝেড়ে নিয়ে বললো,

– ‘শেষ আমার।’

– ‘ঠিক আছে এবার চিপা থেকে বের হন।’

কথাটি বলে তুলি পাঞ্জাবি উলটে বনের উপরে মেলে দিল।

– ‘এটা কি হলো? আমি কি খালি গায়ে থাকবো?’

– ‘এটা আপনার শাস্তি। আপনি পাঞ্জাবির নিচে কিছু পরে আসেননি কেন?’

– ‘ফাজলামো করো না তুলি, এদিকে দাও।’

– ‘আরে না, পাঞ্জাবি শুকিয়ে গেলে আপনার প্যান্ট ভেজা থাকলেও ক্ষতি নেই। কারণ প্রায় হাঁটু পর্যন্ত পাঞ্জাবি ঢেকে রাখে।’

– ‘তাই বলে খালি গায়ে থাকবো?’

– ‘ঘাসে শুয়ে থাকবে। কেউ আসবে না।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

ইশতিয়াক ঘন ঘাস দেখে বসে গেল। তুলি গিয়ে বসলো ওর বুকে পিঠ ঠেকিয়ে।
ইশতিয়াক ওকে দুই হাতে বেঁধে কাঁধে থুতনি রাখে। তুলি দুষ্টামি করে গা ছেড়ে দিয়ে ঠেলে ওকে শুইয়ে দেয় সবুজ কোমল ঘাসে। কাশফুলের গাছগুলো যেন তাদেরকে জনমানব থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। তুলি পাশে শুয়ে ইশতিয়াকের বুকে হাত রাখে। ফরসা চ্যাপ্টা বুক। কোমল কিছু কালো লোম। তুলি ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– ‘জানেন, আমার সবচেয়ে ভালো লাগে আপনার বুক।’

– ‘তাই না-কি।’

– ‘হুম।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে বললো,

– ‘জায়গাটা কেমন নীরব। মনে হচ্ছে আমরা স্বামী-স্ত্রী না। প্রেমিক-প্রেমিকা লোকালয় থেকে পালিয়ে এসেছি চুটিয়ে প্রেম করার জন্য।’

তুলি ঠোঁট টিপে হাসে। ইশতিয়াক মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে ওর গালে। তুলি নিজেকে মুক্ত করে এক পা ওর ওপরে তুলে আরেক হাত দিয়ে ওকে ধরে গলায় মুখ লুকিয়ে গরম শ্বাস-প্রশ্বাস ছেড়ে বললো,

– ‘আমি আপনার মতো বিয়ে করবো না কখনও ভাবিনি ঠিক। কিন্তু কখনও ভাবতে পারিনি বিয়ের পর জীবনটা এতো সুন্দর, উপভোগ্য হতে পারে। মনজুড়ে এত প্রশ্রান্তি আমি কখনও পাইনি।’

ইশতিয়াক ওর কথা খেয়াল করছে না।
বন থেকে কোনো কিছুর শব্দ তার কানে ভেসে আসছে। সে তুলিকে ছাড়িয়ে তাকাতেই শব্দ থেমে গেল। কোথাও যেন কিছু নেই। ভুল শুনছে না-কি সে?

তুলি এবার ওর বুকে মাথা রেখে চোখবুজে নেয়। খানিক পর ইশতিয়াক দেখে একটা বাইক বনের চারপাশের রাস্তা দিয়ে ঘুরছে। একজন বাইকের পেছনে বসা। কিন্তু কেউই এদিকে তাকাচ্ছে না। তবুও ইশতিয়াকের কাছে কোনো একটা সমস্যা আছে বলে মনে হচ্ছে। সে তুলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে চোখ কান সজাগ রাখছে। আরও খানিক সময় যেতেই দেখে একটা গাড়ি বনের চারপাশ দিয়ে ঘুরে চলে গেল। চারদিকে আবার পিনপতন নীরবতা। তুলি চুপচাপ শুয়ে আছে বুকে। আবার পেছনের বনে পায়ের শব্দ। ইশতিয়াক আবার তাকিয়ে কিছুই দেখতে পায় না। সন্দেহ আরও তীব্র হয়। সে এখন নিশ্চিত কিছু একটা ঘটতে চলেছে৷

– ‘তুলি এখান থেকে যাই চলো।

– ‘না আমি ঘুমাবো আপনি পারলে উপুড় হন।’

– ‘উপুড় হব কেন?’

তুলি মাথা তুলে বললো,

– ‘কান আগান।’

– ‘কেন?’

– ‘কামড় দেবো না আগান।’

ইশতিয়াক মাথা তুলে কান এগিয়ে দিল।

– ‘আপনার পিঠও আমার প্রিয়। পিঠে গাল চেপে ধরতে ভালো লাগে, শুয়ে থাকতে ভালো লাগে।’

ইশতিয়াক মাথা তুলে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললো,

– ‘জায়গাটা ভালো না মনে হচ্ছে তুলি।’

অবাক হয়ে তাকিয়ে বললো,

– ‘বাবা ভূ*ত পে*ত্নী আছে না-কি এখানে?’

– ‘আরে তা না, এখানে এভাবে বন কেটে রেখেছে কে? এটা কোনো ফাঁদ হতে পারে।’

– ‘বলছে আপনাকে, এই জন্য গোয়েন্দা আর থ্রিলার বই এসব না পড়াই ভালো। প্রেমের বই পড়লে এত সুন্দর জায়গায় এসব ভাবতেন না।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে এক হাত তুলির পিঠে রেখে কপালে চুমু খেল।
আবার বনের দিকে পায়ের শব্দ। তুলিও এবার তাকালো। কিছুই নেই। ইশতিয়াক আর দেরি না করে বললো,

– ‘উঠে পড়ো, এখান থেকে বের হব।’

তুলি ভয়ে ঢোক গিলে বললো,

– ‘ভূ*ত আছে না-কি?’

ইশতিয়াক হেঁসে ফেললো,

– ‘তোমারও উচিত হরর মুভি আর বই না পড়া। ভূত ছাড়া আর কিছুই ভাবছো না।’

কথা বলতে বলতে তারা এখান থেকে বের হয়ে এলো।

– ‘চলো নদীর পাড়ের দোকানের দিকে যাই।

তুলি ওর হাত ধরে সম্মতি জানায়। দু’জন পাকা রাস্তা ধরে হাঁটছে তখনই একটা বাইক এসে সামনে দাঁড়ায়।

– ‘এই দাঁড়ান, দাঁড়ান এখানে।’

—চলবে—

সেই মেয়েটি আমি নই পর্ব-০২

0

সেই মেয়েটি আমি নই
২য় পর্ব
লেখা:জবরুল ইসলাম

টেবিলে ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, কই মাছ ভুনা, লাল শাক আর ডাল এনে রেখেছে তুলি।
ঘুম থেকে উঠে তাকে শাড়ি পরতে দেখে এমনিতেই ইশতিয়াকের মেজাজ ফুরফুরে হয়ে আছে। এখন খাবার টেবিলে গিয়ে তার মন ভালো হওয়ার উপলক্ষ যেন আরেকটা বেড়ে গেল। আজ দিনটা এতো সুন্দর কেন? আজ কি বারবার মন ভালো হওয়ার ঘটনা ঘটবে? কই মাছ ভুনা তার ভীষণ পছন্দের খাবার। ভাজা কই মাছে একটু ঝোল বেশি হতে হবে, ভেসে থাকবে ফালি-ফালি করা কাঁচা মরিচ। লবণ বেশি হতে হবে, যেন একদম লাগিয়ে খেতে না হয়। বাটির দিকে তাকিয়েই মনে হচ্ছে সবকিছু ঠিকঠাক। জিভে জল চলে এসেছে। অন্যদিন সে ডালে লালশাক মিশিয়ে নিয়ে শখ করে খায়। সঙ্গে থাকে কাঁচামরিচ আর লেবু। কিন্তু আজ এসব অবহেলিত।
দু’দিন আগে এই টাটকা কই মাছগুলো ইশতিয়াকদের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছে৷ তার মা পাঠিয়েছেন এখানে। কারণ সবাই জানেন ইশতিয়াক কই মাছ ভুনা ভীষণ পছন্দ করে।

তুলি চেয়ার টেনে না বসে ইশতিয়াকের আগ্রহ নিয়ে খাওয়া দেখে ঠোঁট টিপে হাসছে। সেটা চোখ এড়ালো না তার।

– ‘আরে তুমি এই সময় আবার এভাবে হাসছো কেন? আমাকে আজ মেরে ফেলবে না-কি তুলি?’

তুলি চেয়ার টেনে বসে হাতের মুঠোয় থুতনি ঠেকিয়ে বললো,

– ‘কিভাবে হাসলাম?’

– ‘ঠোঁট টিপে।’

– ‘তো কি হয়েছে?’

– ‘খাওয়ার সময় এত ব্যখ্যা করতে পারবো না তো, অন্যদিন বলবো।’

তুলি নির্লিপ্ত চেহারায় বললো,

– ‘কাকে বেশি ভালোবাসেন, কই মাছ না-কি আমাকে?’

– ‘মহিলা মানুষের অদ্ভুত চিন্তাভাবনা, তোমাকে ভালোবেসে যা করি, কই মাছকে কি তা করতে পারবো? তোমার যা আছে কই মাছের কি তা আছে?’

তুলি ফিক করে হেঁসে আবার নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

– ‘তবুও বলুন।’

– ‘হ্যাঁ জানি তো, মহিলা মানুষের “তবু্ও” আরেকটা আছে। কই মাছকে খাওয়া যায় তোমাকেও কি খাওয়া যাবে?’

– ‘আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন?’

– ‘কিভাবে?’

– ‘কেমন রেগে রেগে।’

– ‘তুমি খাও তো।’

– ‘না খাব না।’

– ‘তাহলে এভাবে তাকিয়ে থেকো না।’

– ‘কেন?’

– ‘এভাবে তাকিয়ে থাকলে অস্বস্তি লাগে।’

– ‘বলেন কি? কেন?’

– ‘এভাবে তাকালে যে অস্বস্তির লাগে জানো না?’

– ‘না তো।’

– ‘তুমি ধরো একা একটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছ। তোমার দুই হাতে কোনো ভ্যানিটিব্যাগ নেই, কলম নেই। মানে হাতকে ব্যস্ত রাখার কিছুই নেই । আশেপাশে তাকিয়ে দেখে দেখে যাওয়ার মতো বিশেষ কিছু নেই। এই পরিবেশে তুমি হাঁটছো, আর কেউ খানিক দূর থেকে বসে তোমাকে দেখছে। এবং সেটা তুমি বুঝতে পারছো। তখন কেমন লাগে জানো? এক ধরনের অস্বস্তিবোধ হয়। মানুষকে বিব্রত করার জন্য আগে এগুলো করতাম।’

– ‘মানুষকে না, বলুন মেয়েদেরকে একা পেলে এভাবে দেখতেন।’

ইশতিয়াক তাকিয়ে দেখে তুলির মুখময় দুষ্টু হাসি ছড়িয়ে আছে। সে শাসানোর ভঙ্গিতে বললো,

– ‘এই তুমি কি খাবে না?’

– ‘একটু আগেই বললাম তো খাব না।’

– ‘খাবে না কেন?’

– ‘এমনিই।’

– ‘চুপ, খাও তাড়াতাড়ি।’

তুলি অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বললো,

– ‘হাত কাঁটা।’

– ‘বলো কি! কিভাবে?’

– ‘এইতো আমার সতীন কই মাছগুলোকে কাঁ*টতে গিয়ে বুড়ো আঙুল কেঁ*টে গেল।’

– ‘এই জন্য খাচ্ছ না?’

– ‘হু, ভাবছিলাম আপনি খাইয়ে দেবেন। কিন্তু কই মাছ দেখে তো দিন-দুনিয়া ভুলে গেছেন।’

ইশতিয়াক পুরুষালি গলায় হেঁসে উঠলো। তার হাতের প্লেট নিয়ে গেল তুলির পাশের চেয়ারে।

– ‘চলো এক প্লেটেই খাই। আমি নিজে এক লোকমা খাব, তোমাকে দেবো এক লোকমা।’

– ‘জি না, আপনার খাওয়ায় সমস্যা হবে, থাক পরে খাওয়াবে। না হয় আমি চামচ দিয়ে খাই।’

– ”দুটি দেহ একটি মন’ বলে প্রেমিক মহলে একটা কথা আছে না?’

– ‘হুম।’

– ‘আমাদের দু’টি মুখ, একটি পেট।’

তুলির কাঁচভাঙা হাসিতে পুরো ঘর ভরে উঠলো।
ইশতিয়াক এক লোকমা ভাত বাড়িয়ে দিল ওর দিকে। তুলি ইচ্ছা করে ভাত মুখে নিয়ে দাঁত দিয়ে মৃদ চাপ দিয়ে ওর আঙুল ছাড়লো।

– ‘আশ্চর্য তুমি ভাতের সঙ্গে আমার আঙুল খাবে না-কি?’

– ‘কেন কি হয়েছে?’

– ‘কা*মড় দিচ্ছিলে যে।’

– ‘কা*মড় দেবো কেন আপনাকে? আমি বাচ্চা না-কি?’

ইশতিয়াক নিজে এক লোকমা খেয়ে ওর দিকে আবার বাড়িয়ে দেয়। তুলি এবার আরেকটু তীব্র করলো দাঁতের চাপ।
অস্ফুটে ‘উফ’ করে ছাড়িয়ে নেয় ইশতিয়াক।

– ‘আবার!’

– ‘কি?’

– ‘আমি মুখে ভাত দিয়ে যখন বের করে আনতে যাই, তখনই তুমি একটু চাপ দিয়ে দিয়ে আঙুল আনতে দিচ্ছ।’

– ‘আরে না, আমার মুখ ছোট, আর আপনার হাত হা*তির মতো মোটা।’

– ‘হাতির হাত থাকে? আ*জাইরা কথা না বলে চুপচাপ খাও তো।’

– ‘পানি দেন।’

– ‘তোমার কাছেই তো, নিজে খাও।’

– ‘না আপনিই যখন কষ্ট করে খাওয়াচ্ছেন, আপনি পানিও খাওয়ান।’

ইশতিয়াক টেবিলে প্লেট রেখে পানি ঢেলে নিজ হাতে ওকে খাওয়াচ্ছে। তখনই তুলি বিষম খেয়ে ওর পুরো পাঞ্জাবিতে পানি ফেলে ভিজিয়ে দিল। ইশতিয়াক গ্লাস রেখে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,

– ‘ইচ্ছা করে এমন করলে কেন?’

– ‘কি ইচ্ছা করে করলাম?’

– ‘তোমার মোটেও কাশি আসেনি অথচ ইচ্ছা করে পাঞ্জাবি ভিজিয়ে দিয়েছো।’

– ‘অযথা অপবাদ দেবেন না তো, আমি ইচ্ছা করে এমন করিনি।’

– ‘হইছে তাড়াতাড়ি খাও, পাঞ্জাবি চেঞ্জ করতে হবে আমার।’

খাওয়া-দাওয়ার পর তুলি টেবিল পরিষ্কার করে এসে দেখে ইশতিয়াক পাঞ্জাবি চেঞ্জ করে নিয়েছে। এখন আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ঠিক করছে। তুলি পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে ওর পিঠে গাল চেপে ধরে বললো,

– ‘স্যরি।’

ইশতিয়াক আয়নার দিকে তাকিয়েই বললো,

– ‘কেন?’

– ‘আমি ইচ্ছা করে ভিজিয়ে দিয়েছি।’

আয়না থেকে ঘুরে তুলির মুখোমুখি হয়ে বললো,

– ‘এমন করলে কেন?’

তুলি ফিক করে হেঁসে বললো,

– ‘আপনার বাড়ির সবাই আমাকে বুঝিয়েছেন, আপনি না-কি খুব বদমেজাজি, হুটহাট প্রচন্ড রেগে যান। তাই আমি যেন একটু বুঝে-শুনে মানিয়ে চলি। কিন্তু এতদিন থেকে রাগের কিছুই দেখছি না৷ তাই আজ হুট করে রাগানোর দুষ্টুমি মাথায় চাপলো। অথচ রাগেননি একটুও, ফেইল হয়ে গেলাম।

– ‘ও তাহলে এই ঘটনা, ঠিক আছে রেডি হয়ে যাও, বের হই।’

দু’জন সাড়ে তিনটার দিকে বের হয়ে পড়ে। রিকশা নিয়ে ছুটে চলে যায় ইট কংক্রিটের কর্মব্যস্ত শহরকে পেছনে ফেলে। রাস্তায় প্রচুর ধুলোবালির কারণে বিরক্ত হয়ে উঠে দু’জনই। কিন্তু সকল ক্লান্তি-বিরক্তি কেটে যেতে সময় লাগলো না, তারা ক্রমশই এক টুকরো সবুজের জগতে ঢুকে পড়ছে। উপর শুভ নীল আকাশ আর সবুজের প্রান্তরে হারিয়ে যাবার হাতছানি। খানিক পর তারা পৌঁছে যায় দিয়াবাড়ির বটতলায়।

তুলি মুগ্ধ হয়ে বললো,

– ‘সুন্দর না? বিশাল বটগাছের দুইপাশে রাস্তা গেছে।’

– ‘এই জায়গাটার নামই বটতলা। এখানে অনেক নাটকের শুটিং হয়। ভাগ্য ভালো থাকলে তোমার তাহসান বাবুকেও পেয়ে যেতে পারো।’

– ‘ধ্যাৎ, একদিন বলেছিলাম সেটা মনে রাখছেন।’

আরেকটু সামনে গিয়ে দেখা গেল মরা নদী। এটি তুরাগ নদীরই একটি শাখা।

ইশতিয়াক আঙুল দিয়ে দেখালো,

– ‘এইযে নদীর দুই পাড় সংযোগ করছে সেতু, এটার উপরে উঠলে আঁকা-বাঁকা নদীর, নজরকাড়া সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে। আমি অনেক আগে এসেছিলাম কয়েকবার। সেখান থেকে দেখা যায় পরিত্যক্ত নৌকা। জাল ফেলে মাছ ধরছে জেলেরা।’

– ‘চলো যাই।’

– ‘রোদ যাক, পরে গেলে ভালো লাগবে।’

রিকশা বিদায় করে তারা চলে এলো লেকের পাড়ে, লেকের বাঁধানো পাড়। উদাস হয়ে বসে থাকা ছাড়াও পা চালিত নৌকা নিয়ে ঘুরছে মানুষ।

নদীর পাড় ঘেঁষে ছোট ছোট দোকান। একটায় বসে চা দিতে বলে হাতমুখ ধুয়ে নিল তারা। চা এনে দিল ছোট্ট একটা ছেলে। তুলি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নদীতে বোট দেখে ফিসফিস করে বললো,

– ‘চড়বো আপনার সঙ্গে।’

ইশতিয়াক মুচকি হেঁসে কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

– ‘আমি থাকতে নৌকা চড়বে কেন?’

তুলি দাঁত কটমট করে তাকিয়ে উরুতে ঘুসি মারলো একটা।

ইশতিয়াক ছোট্ট ছেলেটিকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো,

– ‘বোট ভাড়া কত?’

– ‘ঘণ্টায় দুইশো টেকা, বেশি দূরে যাইয়েন না। আর এইখানে আবার বোট ভিড়াবেন আইসা।’

– ‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

দু’জন চা খেয়ে দোকানে কথা বলে বোটের দিকে গেল। পা দিয়ে কিভাবে প্যাডেল দিয়ে চালাতে হবে দেখিয়ে দিল ছেলেটি। দু’জন বোটে উঠে চড়তে গিয়ে মনে হলো হাসের পিঠে বসে আছে তারা। বোট দেখতেও অবিকল হাসের মতো। টলটলে সচ্ছ পানি। উপরে নীল আকাশ। নদীর পাড়ে চা-ফুসকার দোকান। তুলি ডাক শুনে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ‘ওয়াও বিমান এত কাছ দিয়ে যাচ্ছে যে।’

– ‘হ্যাঁ এখানে এলে এই দৃশ্য দেখা যায় প্রায়ই। কিন্তু সমস্যা হলো আমি তো বোট চালাতে পারছি না ভালোভাবে। বিমান তো আমাদের উদ্ধার করবে বলে মনে হয় না।’

তুলি চেহারা বিকৃত করে বললো,

– ‘তাহলে মাঝখানে এলো কিভাবে নৌকা?’

– ‘প্রথম ধাক্কা আর বাতাসে এসেছে। এখন ঢেউয়ের সঙ্গে এদিক-ওদিক যাচ্ছে।’

তুলির ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়ে দেখে সেই নাম্বার৷ কেটে দিল পলকে।

– ‘কি হলো রিসিভ করলে না যে।’

– ‘অপরিচিত নাম্বার।’

তুলির ভেতরে ভেতরে বোকামির জন্য নিজের উপরেই প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে।

–চলবে—-