Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 107



কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৭

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৭)

‘জানিস,আমার সাথে যেই বেটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল,তার নাকি আগেই একবার বিয়ে হয়েছে।সে ঘরে নাকি আবার একটা মেয়েও আছে।’ অত্যন্ত বিচ্ছিরি মুখ করে কথাটা বলল রিমি।

নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে বলল,’সাং’ঘাতিক ব্যাপার তো! তোদের কে কিছুই জানায়নি?’

‘উহু।কিছুই না।শা’লা যে বিয়াত্তা সেটাও জানায়নি।কতো বড় হত’চ্ছাড়া একবার চিন্তা কর।’

তার কথার ধরনেই নবনীতা ফিক করে হেসে ফেললো।জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’তো এরপর কি হলো?বিয়েটা তাহলে বাতিল?’

রিমি চোখ বড় বড় করে বলল,’বাতিল মানে?এটা একটা প্রশ্ন হলো?অবশ্যই বাতিল।কাল রাতে ফোন করে তাকে ইচ্ছে মতো কয়েকটা গালি দিয়ে ব্ল’ক করে দিয়েছি।এখন ভাবছি প্রতারণার মা’মলা করব তার নামে।কতো বড় ঠ’গ একবার ভেবেছিস?’

নবনীতা ঠোঁট উল্টায়।মাথা ঝাকিয়ে জানায় রিমি ঠিকই বলছে।বেটার নামে মা’মলা ঠুকে দেওয়া দরকার।তারপরই আবার সে নিজ থেকে বলে উঠে,’তুই চাইলে তার নামে মানহানির মা’মলাও করতে পারিস রিমি।’

‘সেটা কি করে?’ ভীষণ কৌতূহলী শোনায় রিমির কন্ঠ।

নবনীতা গম্ভীর মুখ করে বলল,’এই যে তার সাথে তার বিয়ে প্রায় হয়েই যাচ্ছিল।কাছের মানুষ জন জেনে গিয়েছিল তোর বিয়ে হবে।শেষটায় হলো না।এতে করে সবার কাছে তোর প্রেসটিজ ডাউন হলো না?তোর মানসম্মানে আঘাত করা হলো না?’

‘একদম একদম।ঠিক বলেছিস এভাবে তো ভেবে দেখেনি।’
রিমি থামলো।সেকেন্ডের মাথায়ই আবার উত্তে’জিত হয়ে বলল,’তাহলে তো আমি তার নামে অর্থ আত্ম’সাৎ এর মা’মলাও করতে পারি। সে যেদিন বাড়ি এলো,সঙ্গে পুরো গোষ্ঠী নিয়ে এলো।এই পঙ্গপালের দলকে খাওয়াতে গিয়ে আব্বুর পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার বাজার করতে হয়েছে।শা’লা রা’ক্ষসের দল!’ শেষ কথাটা বলতে গিয়েই দাঁত কিড়মিড় করে উঠে রিমির।

নবনীতা তাকে দেখল।তার কথা শেষ হতেই সে নিজের মুখটা আরো বেশি গম্ভীর করে ঠান্ডা গলায় বলল,’আমরা কিন্তু তার নামে খু’নের মা’মলাও দায়ের করতে পারি।’

হকচকিয়ে ওঠে রিমি।বি’স্ফারিত চোখে নবনীতাকে দেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে জানতে চায়,’সেটা কিভাবে?’

নবনীতা আগের চেয়েও শীতল কন্ঠে বলল,’সে তোর লেহেঙ্গা পরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করার শখের খু’ন করেছে।আমাদের পেট ভরে কাচ্চি খাওয়ার পরিকল্পনার খু’ন করেছে।রিমন ভাইয়া বলেছিল তোর বিয়েতে ফ্রিতে ফুচকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবে।সেই স্বপ্নের খু’ন করেছে তোর হতে হতে না হওয়া বর।শুধু কি মানুষ মা’রলেই খু’নী হয়?ইচ্ছে গুলো যারা মা’রে তারা কি খুনী না?’

নবনীতা থামে।থমথমে মুখে পাশ ফিরে।রিমি বোকার মতো হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।দু’জনের দৃষ্টি মিলতেই দু’জন খিলখিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।রিমি পেটে হাত চেপে হাসি থামাতে থামাতে বলল,’সহমত সহমত।ভুল কিছু বলিস নি কিন্তু নবনীতা।’

নবনীতা হাসি থামিয়ে তার কাঁধে হাত চেপে বলল,’হয়েছে।অনেক উদ্ভট কথাবার্তা হয়েছে।এখন আসল কথায় আসি।আমার মনে হচ্ছে তোর কপালে আল্লাহ খুব বেশি ভালো কাউকে রেখেছেন।সেজন্যই তোর এই বিয়ে টা ভেঙে গেছে।’

রিমি সন্দিহান চোখে তার দিকে দেখে বলল,’সত্যি?আমার তো মনে হয় না।’

‘আমার মনে হয়।মিলিয়ে নিবি ভবিষ্যতে।আর তারপর আমায় এসে ধন্যবাদ দিবি।’

দুই বান্ধবী কথা শেষে রমনার পুরোনো কাঠের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।রমনার প্রশস্ত খোলা রাস্তায় কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায়।নবনীতা লুবনাকে পড়ানো শেষ করে এদিকে এসেছে।রিমির নাকি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তার সাথে।নবনীতা জানত তার গুরুত্বপূর্ণ কথা ঠিক কেমন গুরুত্বপূর্ণ।তবুও সে এসেছে।কারণ রিমির সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে।সমবয়সী মানুষদের সান্নিধ্যে মানুষের সময় এমনিতেই ভালো যায়।বন্ধু শব্দটা ব্যক্তিভেদে একেকরকম অর্থ বহন করে।কিন্তু এই আত্মিক সম্পর্ক কে উপেক্ষা করে কি মানুষ বাঁচতে পারে?সম্ভবত না।এই সমমনা মানুষ গুলোকে আমাদের ভীষণ প্রয়োজন।খুব বেশি না,বন্ধুর মতো বন্ধু একজন থাকাটাই কি পরম সৌভাগ্যের বিষয় না?
.
.
.
.
পরের তিনটে দিন আরহামের কেটেছে চূড়ান্ত রকমের ব্যস্ততায়।এতো এতো ব্যস্ততায় নিজের হাতের কথাও সে বেমালুম ভুলে যাচ্ছে।ব্যস্ততার পাশাপাশি যতোই দিন যাচ্ছে ততোই উৎকন্ঠা কাজ করছে তার ভেতর।কি হবে সামনে?রাকিব নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকবে না।কিছু একটা ফন্দি তো ঠিকই আঁটছে মনে মনে।আবার সাথে ঐ ফাহাদও আছে।কে জানে আবার কোন নতুন ছক কষছে সে!

আরহাম আর বেশি ভাবে না।ভাবলেই মাথার দুই পাশ চিনচিন করে।সে পার্টি অফিসের সব ঝায় ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি এসে ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি পরেই হাত পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে পড়ে।আদি আর আরিশ আজকে উত্তরা গিয়েছে।আদির দূর সম্পর্কের কোনো এক আত্মীয় থাকে সেখানে।তার সাথে দেখা করতে গিয়েছে সে।

আরহাম পকেট থেকে ফোন বের করে তার নম্বরে ডায়াল করে।কল রিসিভ হতেই বলে,’কিরে?দেখা করেছিস?এখন কোথায়?’

রাস্তায় গাড়ির হর্ণের শব্দে কিছুই ঠিক মতো শোনা যাচ্ছিল না।আদি গলার স্বর চওড়া করে বলল,’হ ভাই।মাত্র বেরিয়েছি।বুঝিসই তো দেশে আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নাই।কোথাও গেলেই জগত সংসারের সব আলাপ আমার সাথে শুরু করে দেয়।’

আদি হয়তো আরো কিছু বলতো,কিন্তু তার আগেই আরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,’অতো কাহিনী শুনে আমার লাভ নাই ভাই।তুই দেখা করেছিস নাকি সেটা জানতেই ফোন দিয়েছিস।’

‘হ্যাঁ,দেখা করেছি।আর জানিস আজ ঐ বাড়িতে গিয়ে কি দেখেছি?’

আরহাম কল কেটে মোবাইল ফোনটা নিজের থেকে কিছুটা দূরে রাখল।নাক মুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করল,’বাচাল একটা!’

বিকেলের একটু আগে তার ঘরের সামনে তাসনুভা এলো।অত্যন্ত নরম গলায় ডাকলো,’বড় ভাইয়া!’

আরহাম চোখ বুজে ঝিমুচ্ছিল।তার আওয়াজের ধরন দেখেই সে ভারি গলায় বলল,’কি হয়েছে তাস?কি লাগবে?’

তাসনুভা ভ্যাবাচ্যাকা খায়।ভাইয়া কি বুঝে গেছে নাকি?সে কন্ঠ স্বর আরো নমনীয় করে শুধায়,’ভাইয়া তোমার কি আজ সন্ধ্যায় কোনো কাজ আছে?’

আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই ভরাট কন্ঠে বলল,’আমার সারাদিনই কাজ থাকে।তোর কি দরকার সেটা বলল।’

তাসনুভা একটা ঢোক গিলে শুকনো মুখে বলল,’ভাইয়া, আদি ভাইয়া দেশে আসার পর আমরা কোথাও বের হইনি।চলো না আজ আমরা কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি সবাই মিলে।’

‘তোরা যা।আমি যেতে পারব না।ক’দিন পর নির্বাচন।আমার মনে এতো রং নাই।ভালো হয় যদিও তোরাও না যাস।সিকিউরিটিরও তো একটা বিষয় আছে।’ বরফ শীতল কন্ঠে উত্তর দেয় আরহাম।

‘ভাইয়া প্লিজ।’ অনুনয়ের সুরে বলল তাসনুভা।

‘সব সময় জেদ করবি না তাস।ভালো লাগে না।’

‘প্লিজ ভাইয়া।’

‘তাসনুভা!’

‘ভাইয়া!’

‘পারব না আমি যেতে।আমার ইচ্ছে নেই।বাড়িতে কাজ আছে আমার।তোরা যা।আরিশ তো সব চেনে।আমাকে কেন নিতে হবে?’ কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি মিশিয়ে উত্তর দেয় সে।

তাসনুভা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’ভাইয়া এমন করো কেন?এমন কি চেয়েছি তোমার কাছে?চলো না প্লিজ।প্লিজ ভাইয়া।আর কিছু চাব না তোমার কাছে।’

আরহাম চোখ খুলে সামনে দেখে।চূড়ান্ত রকমের বিরক্ত হয়ে বলে,’আচ্ছা বাপ,যাব নে তোদের সাথে।এবার যা এদিক থেকে।’

খুশিতে তাসনুভার দুই চোখে ঢেউ খেলে যায়।সে যাওয়ার আগে তর্জনী আঙুল তুলে চোখ পাকিয়ে বলল,’খবরদার! ঐ সারাহ কে নিবে না ভুলেও।সে গেলে কিন্তু আমি যাব না বলে দিলাম।’ কথা শেষ করেই সে হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

আরহাম মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল,’তাস যে মাঝেমধ্যে কি করে না! দুনিয়ার সবাইকে তার ভালো লাগে।শুধু ফুফু আর সারাহ বাদে।’

______________________________________________

চিত্রার আজ ঘুম ভেঙেছে পরী আপাইয়ের শত শত চুমু খেয়ে।সকাল হতেই নবনীতা তার মুখের সামনে থেকে এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে তার সমস্ত মুখে অগনিত চুমু খেল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’শুভু জন্মদিন সোনা।আল্লাহ তোমায় নেক হায়াত দান করুক।’

চিত্রা পিটপিট চোখ মেলে তাকায়।পরী আপাই তার দিকে ঝুকে আছে।আপাইয়ের মিষ্টি মুখটা দেখতেই সে আলগোছে হাসে।মাথা তুলে আপাইয়ের গালে ছোট করে একটা চুমু দেয়।নবনীতা তার বুকে আস্তে করে মাথা রেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আমার ছোট্ট চিত্র পাখিটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে।কষ্টও হয়,আবার ভালোও লাগে।’

‘কষ্ট কেন হয়?’ ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চায় চিত্রা।নবনীতা এক গাল হেসে বলল,’তুই বুঝবি না।বাচ্চারা বড়ো হয়ে গেলে বড়দের কষ্টই হয়।’

কথা শেষ করেই সে দ্রুত উঠে বসে।চিত্রার এক হাত ধরে টানতে টানতে তাকে তাড়া দিয়ে বলে,’দেখি তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে একটু পড়তে বসো তো চিত্র।পড়া শেষে আমরা খেলা করব।’

চিত্রা চোখে আঙুল ডলতে ডলতে জানতে চায়,’তুমি বাইরে যাবে না আজকে?’

‘নাহ,আজ ছুটি নিয়েছি আমি।আজ শুধু আমি আমার মিষ্টি মিষ্টি দুইটা পাখির সাথে ঘুরবো।’

নবনীতার সারাটা দিন কাটলো অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ অন্যরকম।আজ সে সারাদিন বাসায় ছিল।কেবল চিত্রার সাথে বসে বসে গল্প করেছে।মাঝখানটায় আবার চিত্রার ড্রয়িং বুকে একটা গাছও এঁকেছে।

বিকেলে শুভ্রানী কোচিং থেকে বাড়ি ফিরেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’আপাই মনে আছে তো,আজ আমরা বাইরে যাব।’

নবনীতা চোখ বাঁকা করে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে।তোর আসার অপেক্ষাই করছিলাম।যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।’

শুভ্রানী হাত মুখ ধুয়েই ঝটপট রেডি হলো।নবনীতা সেই ফাঁকে চিত্রাকে একটা নীল রঙের ফ্রক পরিয়ে দিলো।তারপর নিজেও একটা কুর্তি গায়ে জড়ালো।একেবারে গাঢ় লাল রঙের কুর্তি।রিমি তার জন্মদিনে এটা গিফট করেছিল।দেখেই বোঝা যায় খুব দামি হবে।শুভ্রা তাকে দেখতেই মুখ হা করে বলল,’তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আপাই।একদম লাল পরী।’
জবাবে নবনীতা কেবল ম্লান হাসে।গাঢ় লাল ওড়না টা শালের মতো করে গায়ে জড়িয়ে কালো রঙের পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়েই এক হাতে চিত্রার হাত ধরে তাড়া দিলো,’চল চল।পরে আবার দেরি হয়ে যাবে।’

বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিন বোন সিএনজি ঠিক করে মিরপুর-০১ এ গেল।শুভ্রানী তার বৃত্তির টাকার একটি অংশ জমিয়ে রেখেছিল আজকের জন্য।ঢাকা শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আছে।শুভ্রার ভীষণ ইচ্ছে হয় এমন খোলা আকাশের নিচে আর সুউচ্চ ভবনের ছাদে অবস্থিত সুসজ্জিত রেস্টুরেন্ট গুলোতে গিয়ে গিয়ে খেতে।বৃত্তির টাকা দিয়ে সে এমনই একটা রুফটপে খেতে চেয়েছিল।নবনীতা তার বরাদ্দকৃত ১৫০০ টাকার সাথে নিজের ১০০০ টাকা মিলিয়ে মোট ২৫০০ টাকা আলাদা রেখেছিল।সাথে আবার আরো হাজার তিনেক নিজের সাথে রেখেছে।যদি হুট করে কিছু কিনতে মন চায়?

সোনি স্কয়ারের সামনে এসেই সে রিমিকে কল দেয়।সোনি স্কয়ারের উপরে নাকি খুব সুন্দর একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট আছে।রিমিই তাকে এটার খোঁজ দিয়েছে।সেজন্যই সে মালিবাগ থেকে চারশো টাকা গচ্চা দিয়ে এতো দূর এসেছে।রিমি কল ধরেই হড়বড় করে বলল,ভাই দাঁড়া দাঁড়া।রাগ করিস না প্লিজ।একটু লেইট হয়ে গেছি আমি।’

নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কোথায় তুই?’

রিমি কাচুমাচু মুখে জবাব দেয়,’টিনশেড কলোনি।’

‘কি?এতো দূর?এখনো চৌদ্দ তে তুই?’ আশ্চর্য হলো নবনীতা।

রিমি ফোন কানে ধরেই বলল,’তুই এক কাজ কর না।লিফট দিয়ে একদম টপ ফ্লোরে চলে যা।উপরে অনেক বাতাস।হাঁটাহাঁটি কর।ভালো লাগবে।’

বলেই সে ফোন কেটে দিলো।নবনীতা বিরক্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।শেষে মাথা তুলে একবার উপরে দেখে তারপর শুভ্রা আর চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বলে,’চল তো দেখি।উপরে গিয়ে দেখি কি অবস্থা।’

রিমি ঠিকই বলেছিল।জায়গাটা আসলেই অনেক সুন্দর।নবনীতা তার দুই বোনকে নিয়ে উপরে উঠেই বড় বড় চোখে চারদিক দেখল।ছোটবেলায় বাবা মায়ের সাথে ঘুরতে গেলে যেই পাঁচ তারকা হোটেল গুলোতে তারা উঠত,এই রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র ঠিক ঐ হোটলগুলোর মতো।চিত্রা গোল গোল চোখে সেসব দেখে।তারা এখন দশম তালায় আছে।যারা খোলা মেলা জায়গা পছন্দ করে না,তাদের জন্য ভেতরে বসার ব্যবস্থা আছে।নবনীতা ছাদে যাওয়ার আগেই চিত্রা আর শুভ্রার কয়েকটা ছবি তুলে।তারপর কাঁচের থাই গ্লাস ঠেলে ভেতরে এক পা দিতেই কোথা থেকে একজন গার্ড ছুটে এসে বলল,’দুঃখিত ম্যাম।আজকে আমাদের রুফটপে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।রুফটপ আগে থেকেই বুকড।’

‘বুকড মানে?এতো বড় জায়গা আগে থেকেই বুকড?এই যে সামনের পুরোটাই তো খালি।বুকড কোথায়?’

‘সিকিউরিটি পারপাসে বুক করা হয়েছে ম্যাডাম।আরহাম স্যারের ফ্যামিলি আজ এখানে এসেছেন।রাত পর্যন্ত এদিকে বাকি মানুষের আসা নিষেধ।’

নবনীতা চোখ গরম করে বলল,’এসব কেমন কথা?সে আসলে আমরা আসতে পারব না কেন?সে টাকা দিয়ে খেলে আমরাও তো টাকা দিয়েই খাবো।তার ফ্যামিলি আসলে আমাদের কি?’

গার্ডের পোশাক পরে থাকা লোকটা বিরক্ত হয়।মুখ খিঁচে বলে,’এতো কিছু জানি না তো আপা।আমাকে যা করতে বলা হয়েছে আমি তাই করছি।’

নবনীতা ঝাঁঝালো চোখে একবার তাকে দেখে।এরই মাঝে চিত্রা সামনে কাউকে দেখতে পেয়েই নবনীতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল।নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে বলল,’আরে চিত্র কি করছ?কোথায় যাচ্ছ?’

গার্ডের দায়িত্বে থাকা লোকটাও ভীষণ আশ্চর্য হলো।তিনি সেদিকে হাত তুলে হড়বড় করে বললেন,’এ্যাই বাবু কোথায় যাও।দাঁড়াও দাঁড়াও।’

‘আরাম ভাই! আরাম ভাই!’
স্বল্প পরিচিত বাচ্চার গলায় নিজের অদ্ভুত নাম শুনেই পেছন ঘুরে আরহাম।দেখে নীল ফ্রক পরা সেই ছোট্ট মেয়েটা এলোমেলো পায়ে তার দিকে ছুটে আসছে।তার দৌঁড়ানো দেখে আপনাআপনি মুখে হাসি ফোটে আরহামের।সে কাছে আসতেই একহাতে তাকে টেনে তুলে নিজের কোলে।আগের বারের মতোই সতর্ক করে বলে,’আমার কিন্তু এক হাত অচল।শক্ত করে ধরে রাখো,নয়তো পড়ে যাবে।’

চিত্রা শক্ত করে তার গলা জড়িয়ে ধরে।দু’জনের চোখাচোখি হতেই চিত্রা মিষ্টি করে হাসল।আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’এখানে কি করে এসেছ বাবু?’

‘আপাই নিয়ে এসেছে।’

‘আপাই?’ কিছুটা অবাক হয় আরহাম।তারপরই তাকে কোলে নিয়ে হেঁটে যায় সামনের দিকে।নবনীতা তাদের দু’জনকে দেখেই চোখ সরু করে বলল,’তুমি একে চেনো চিত্র?’

‘চিনবে না কেন?শাহরিয়ার আরহামকে এই শহরের সবাই চেনে।’ চিত্রার হয়ে উত্তরটা আরহামই দিলো।নবনীতা থমথমে মুখে অন্যদিকে চোখ সরায়।আরহাম তার পাশে দাঁড়ানো গার্ড কে বলল,’এদের আসতে দাও।সমস্যা নেই।আর কাউকে আসতে দিও না।’

‘জ্বী স্যার।’

নবনীতা এক টানে চিত্রাকে আরহামের কাছ থেকে নিজের কাছে নিল।চাপা স্বরে বলল,’চলো আমরা সামনে যাই।’

সে দুই কদম সামনে যেতেই আরহাম তাচ্ছিল্য করে বলল,’হাউ আনগ্রেটফুল! একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়নি।’

নবনীতা শুনল।কিন্তু প্রতিউত্তর করল না।সে কথা বাড়াতে চায় না।এদের হাতে ক্ষমতা আছে।এরা চাইলে সবই করতে পারে।কখনো রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করবে,কখনো আবার পাবলিক রেস্টুরেন্টে পাবলিকেরই প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে।নবনীতা আর কি বলবে?দেশটাই এমন।জোর যার মুলুক তার।

***

রিমি রিকশা থেকে নেমেই তাড়াহুড়ায় সামনে এগিয়ে গেল।ভাড়ার টাকা দেওয়ার পর যেই ভাঙতি টাকা তাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে,সেটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাকেই সে ছুটল সোনি স্কয়ারের ভেতরের দিকে।

আচমকা কারো সাথে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা খেতেই সে হুড়মুড় করে ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।সে একা পড়েনি,যার সাথে ধাক্কা খেয়েছে,সে সহ ধাম করে মাটিতে পড়েছে।রিমি ফ্লোরে বসেই আঁতকে উঠে পাশ ফিরে।

ওয়াজিদ ফোনে কথা বলছিল।আরহাম একটু আগে ফোন করে তাকে এখানে আসতে বলেছে।গ্র্যান্ড ফ্লোরে পা দিয়ে সে কেবল এক কদম সামনে গিয়েছিল।হুট করে পেছন থেকে কেউ ছুটে এসে তার শরীরের উপর আছড়ে পড়ল।এমন হঠাৎ সং’ঘর্ষের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না।তাল হারিয়ে মেঝেতে পড়তেই সে তাজ্জব বনে গেল।এটা কি হলো?

রিমির মতো সেও পাশ ফিরে অবাক হয়ে তাকে দেখল।রিমি তাকে দেখতেই মুখটা দুখী দুখী করে বলল,’সরি ভাইয়া খেয়াল করিনি।’

ওয়াজিদ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।ঠান্ডা গলায় বলে,’ইটস ওকে।’

তারপরই রিমির দিকে একহাত বাড়িয়ে দেয়।রিমি দ্রুত সেই হাতটা চেপে ধরে উঠার চেষ্টা করে।তখনই বাধে আরেক বিপত্তি।ফকফকে ফ্লোরে তার জুতোটা পিছলে গিয়ে সে পুনরায় ধাম করে ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।তার টানে ওয়াজিদ নিজেও হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুমি কি হাঁটতে পারো না?’

রিমি দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়ে।কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,’জ্বী ভাইয়া পারি।কিন্তু আজকে তাড়াহুড়োয় মিস্টেক হয়ে যাচ্ছে।নেভার মাইন্ড।’
সে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।উঠে দাঁড়াতেই টের পেল তার ওড়নার একটা অংশ ওয়াজিদের শার্টের বোতামের সাথে আটকে আছে।

ওয়াজিদ গোল গোল চোখ করে সামনে দেখে।হাত বাড়িয়ে ওড়না টা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু তার আগেই রিমি তাকে বাধা দিয়ে বলল,’না না আপনার কিছু করতে হবে না।আমি সব ঠিক করছি।’

বলেই সে তার ওড়নার এক মাথা চেপে ধরল।তারপর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে একটা হ্যাচকা টান দিলো সেটা।শুধু ওড়না না,তার শক্তিশালী টান খেয়ে শার্টের বোতামটা টা সহ ছিঁ’ড়ে শার্ট থেকে খুলে এলো।ছিটকে গিয়ে পড়ল দূরে কোথাও।

এক চিৎকার দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল রিমি।তার দুই চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।বোতামটা শার্টের পেটের দিকে ছিল।সেটা ছিঁ’ড়ে আসাতে শার্টের ফাঁক দিয়ে ওয়াজিদের পেট দেখা যাচ্ছিল সামান্য।

ওয়াজিদ অবিশ্বাস্য চোখে সামনে তাকায়।একটা মানুষ এতো নিষ্কর্মা কেমন করে হতে পারে?এতো গুলো ভুল কেউ একসাথে কেমন করে করতে পারে?
সে একপ্রকার চমকে উঠে বলল,’তোমার কি মাথায় সমস্যা?এতো জোরে কেউ টান দেয়?জানো না শার্টের বোতাম গুলো কতো নড়বড়ে?’

রিমি দ্রুত মাথা নাড়ে।কাচুমাচু মুখে বলে,’জ্বী ভাইয়া সবই জানি।’

‘সব জানলে এতো জোরে চেনেছো কেন?’ বিক্ষিপ্ত মেজাজে প্রশ্ন করে ওয়াজিদ।

রিমি অসহায় মুখ করে একবার তার দিকে তাকায়।বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট উল্টে বলে,’সরি ভাইয়া।সিস্টেক হয়ে গেছে।নেভার মাইন্ড।’

ওয়াজিদ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না।একটু পর দেখা যাবে তার গায়ের শার্টটাও আর নাই।এই মেয়ে কোনো না কোনো ভাবে সেটাও গা থেকে টেনে খুলে নিয়েছে।সে দ্রুত সামনে হাঁটা ধরল।রিমি নিজেও তার পিছু পিছু হাঁটা ধরল।হাঁটতে হাঁটতেই তার পা গিয়ে পড়ল ওয়াজিদের পলিশ করে রাখা সু জুতার পেছনটায়।সঙ্গে সঙ্গেই তার পা বেরিয়ে এলো জুতা থেকে।

রিমির মনে হচ্ছে তার মাথায় গোটা আকাশটাই ভেঙে পড়েছে।কি হচ্ছে এগুলো?সবকিছু এমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন?

ওয়াজিদ বিস্ফারিত চোখে কয়েক পল তাকে দেখে যায়।পরক্ষণেই এক আঙুল তুলে মৃদু ধ’মকে উঠে বলে,’তুমি আমার পিছু পিছু আসবে না বলে দিলাম।’

বলেই সে জুতাটা পুনরায় পায়ে দিয়ে এক প্রকার ছুটে গিয়ে লিফটে ওঠল।রিমি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে বলল,’ভাইয়া আমিও তো উপরে যাবে।প্লিজ ভাইয়া আর ভুল হবে না।আমাকেও সাথে নিন।’

ওয়াজিদ আশপাশ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বিনা বাক্য ব্যয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে এসে বলে,’ঠিক আছে তুমি যাও।আমি পরে যাব।’

রিমি হাসি হাসি মুখ করে লিফটে উঠল।ওয়াজিদ কেবল মাথা নামিয়ে নিজের শার্টের বোতাম বিহীন অংশটুকু দেখে।দেখতেই দুই হাতে টেনে টেনে সে জায়গাটা ঠিক করে।

নাহ,এতোটাও বাজে দেখাচ্ছে না।খুব বেশি বোঝা যায় না।ক্লান্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।অন্যমনস্ক হয়ে বলে,’নির্ঘাত পাবনা থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছে।শী কা’ন্ট বি নরমাল।নাহ,সে স্বাভাবিক মানুষ হতেই পারে না।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৬

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৬)

‘নবনীতা’

পিছুডাকে থমকে যায় রমণীর পদযুগল।পেছন ফিরে আওয়াজের উৎস খুঁজতে ব্যস্ত হয় সে।দেখে তার থেকে অনেকটা দূরে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে।তার মাথায় হেলমেট।মুখ দেখা না গেলেও তাকে চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি রমণীর।মুখ দেখা না গেলেও পরণের টি-শার্ট আর ট্রাউজার বলে দিচ্ছে সামনে দাঁড়ানো লোকটি কে।

নবনীতা তখন হাসপাতালের সামনের খোলা পার্কিং এরিয়া অতিক্রম করছিল।হঠাৎ ডাকে তার যাত্রায় ভাটা পড়ল।আরহাম এগিয়ে এলো তার দিকে।দু’জন দাঁড়ালো ঠিক মুখোমুখি।নবনীতার কোনো বিকার নাই।শুরুতে যদিও কপালে ভাঁজ পড়েছিল,তবে সেটা সময়ের সাথে মিলিয়ে গিয়েছে।তাকে খুবই নিরুদ্বেগ দেখাচ্ছে।

আরহামের দিক থেকে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন।তার মন খচখচ করছে,প্রচন্ড রকম অপ্রস্তুত বোধ করছে সে।শেষটায় নিজের সব জড়তা একপাশে সরিয়ে সে বলল,’নবনীতা তোমায় ধন্যবাদ।’

‘কেন?’ কিছুটা অবাক হয়ে শুধায় সে।

আরহাম অন্যদিকে ফিরে নির্বিকার হয়ে বলল,’সেদিন এতো গো’লাগু’লির মাঝেও নিজের লাইফ রিক্স নিয়ে আমাকে হেল্প করার জন্য।’

উত্তরে সে আশা করেছিল সামনের মেয়েটির অমায়িক হাসি,মিষ্টি কন্ঠ।যেটা একটু আগেই আদি আর তাসনুভার সামনে প্রকাশ পেয়েছিল।সে ভেবেছিল নবনীতা হাসবে,একেবারে স্বচ্ছ হাসি।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।নবনীতা গম্ভীর মুখে নিচু স্বরে বলল,’ধন্যবাদের কিছু নেই।আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি এটাই করতাম।এমন কিছু বিশেষ করিনি আমি।’

নবনীতা কথা বলেই মাথা নামিয়ে নেয়।আবারও কি বেশি কাটখোট্টা উত্তর দিয়ে দিয়েছে সে?কিন্তু সে তো ভুল কিছু বলে নি।আরহামের জায়গায় অন্য কেউ ভুক্তভোগী হলেও তো সে ছুটে যেত।

আরহাম উত্তর পেতেই কিছুক্ষণ সটান দাঁড়িয়ে রইল।না কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো,না কিছু বলল।সে জানে না কেন,কিন্তু কথাটা তার ভীষণ বুকে বি’ধেঁছে।অন্য কেউ থাকলেও এটাই করত মানে?সে কি পৃথিবীর সবাইকে বাঁচানোর ঠেকা নিয়েছে?সবাই আর আরহাম কি এক?এই ‘সবাই’ শব্দটা ব্যবহার করে সে স্রেফ আরহামকে একটা নিচু কাতারে নামিয়ে এনেছে।এর বেশি কিছুই না।

নিজের ভেতরের ক্রো’ধ কিংবা চাপা রা’গ,দু’টোই আরহাম হজম করে নিল।ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে যতগুলো টাকার নোট হাতে পেল,সবগুলোই বের করে আনল।তারপর সাবলীল কায়দায় হাতটা বাড়িয়ে দিলো নবনীতার দিকে।

নবনীতা নত চোখেই তার হাত দেখে।হাতে থাকা নোটগুলো চোখে পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে।আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি?’

‘চোখে দেখো না?এসব টাকা।নোট।মানি।’

‘আমি জানি।আমাকে কেন দিচ্ছেন?’

আরহাম গোমড়া মুখে জবাব দেয়,’তুমি আমাকে সাহায্য করেছ।আমি ঋণী তোমার কাছে।ঋণ শোধ করছি।আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে চাই না।’

নবনীতা শীতল চোখে একবার তাকে দেখে।সেই শীতল চোখ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে র’ক্তিম হয়।লোকটা তাকে টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করছে?প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারীর কাছে এই নোট এগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অপমান জনক ঠেকায়।কিছু টাকাতেই কি সবকিছুর শোধ বোধ হয়?অতিশয় শীতল কন্ঠে সে প্রশ্ন করে,’আপনার সত্যিই মনে হয় সেদিন আমি যা করেছি,সেটা আপনি কোনো অর্থের বিনিময়ে শোধ করতে পারবেন?’

‘পারব না?’

‘না পারবেন না।মূল্যবোধের মূল্যায়ন টাকা দিয়ে হয় না।আমাকে অন্তত এসব টাকা কড়ি দিবেন না দয়া করে।’ কটমট চোখ করে উত্তর দেয় নবনীতা।

সেই চাহনি আরহামের একদমই অপছন্দ।মেয়েরা কেন এভাবে তাকাবে?এগুলো সবই পড়াশোনার ফল।মেয়েরা একটু শিক্ষিত হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে।অহংকার আর দ’ম্ভে এদের মাটিতে পা পড়ে না।সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’তোমাকে না,তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলেও আমি এটাই করতাম।’

‘আমি অন্য কোনো মেয়ে নই।আমি নবনীতা।আমার স্বতন্ত্র পরিচয় আছে।নবনীতা অন্য মেয়ে না।টাকার ফুটানি অন্য কোথাও দেখান গিয়ে।’

কাঠকাঠ গলায় জবাব দিয়েই নবনীতা চিত্রার হাত ধরে ব্যস্ত কদম চালিয়ে মিনিটের মাঝেই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।আরহামের থেকে কোনো জবাব সে চায় না।তার কথাটুকু সে বলে দিয়েছে।এখন আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।

আরহাম তার প্রস্থান দেখতে দেখতেই দুই হাত মুঠ করে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’সেটাই তো।তুমি অন্য মেয়ে হবে কেমন করে?তুমি নবনীতা।ঘাড়’ত্যাড়া নবনীতা।তুমি তো এক পিসই।মার’কাটারি মেয়ে মানুষ!’
.
.
.
.
বাড়ির দুয়ারে পা রাখতেই বসার ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুটা বিরক্ত হলো নবনীতা।আপনাআপনি ললাট কুঞ্চিত হয় তার।পায়ের জুতা জোড়া যথাস্থানে রেখে ভেতরে পা বাড়ায় সে।বসার ঘরের মাঝামাঝি সোফায় দুই পা এক করে মাথা নামিয়ে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখা মাত্র সে বিরক্তি দ্বিগুন হয়।সমস্যা কি এর?আবার কেন এসেছে?
তার সাথে চোখাচোখি হতেই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।পুরুষালি কন্ঠে আওড়ায়,’নবনীতা! তুমি এসেছ?আমি তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।’

ইফাজের দিকে একনজর দেখেই নবনীতা ক্ষীণ স্বরে বলে উঠে,’কেন?আমার অপেক্ষা কেনো করছিলে?’

‘কারণটা তুমি জানো।’

‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না ইফাজ।তুমি কি বাংলা বোঝ না?’ চোখে মুখে চরম বিরক্তি এনে উত্তর দেয় নবনীতা।

ইফাজ কিছুটা এগিয়ে আসে।ব্যাকুল কন্ঠে শুধায়,’কিন্তু কেন নবনীতা?আমি কি এতোটাই অযোগ্য?’

নবনীতা তার কথা শুনল।সে থামতেই বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেঝেতে দৃষ্টি নামিয়ে বলল,’তুমি অযোগ্য নও।যোগ্যতার কথা আসছে কেন?বললামই তো চিত্র আর শুভির একটা ব্যবস্থা না করে আমি বিয়ে করতে পারব না।’

‘হ্যাঁ,তাতে সমস্যা কোথায়?তুমি তো বিয়ের পরেও তাদের ব্যবস্থা করতে পারো তাই না?আমি তো তোমার চাকরি করা নিয়ে কোনো বাধা দিবো না।’

নবনীতা চোখ তুলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।সামনের ঘর থেকে হলদে-সোনালি আলোর আভা এই ঘরেও আসছে।সে সেদিকে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’আগে তো একটা পাকাপোক্ত চাকরি পেতে হবে?আমি এখনো তেমন চাকরি পাইনি ইফাজ।আর তাছাড়া বিয়ের পর আমি মন খুলে তাদের জন্য কিছু করতেও পারব না।এসব সংসারের জঞ্জালে আমাকে জড়িয়ো না,প্লিজ।’

ইফাজ আশাহত হয়ে সামনে তাকায়।এই মেয়েটার কি কোনোদিনই মন গলবে না?এমন কেন সে?সে ভগ্ন কন্ঠে আস্তে আস্তে বলল,’নবনীতা! শুভ্রানী আর চিত্রার জন্য তো তোমার জীবন কিংবা বিয়ে থেমে থাকবে না।তাই না?’

‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না ইফাজ।তুমি নিজের বিয়ে নিয়ে ভাবো।’ কাঠকাঠ স্বরে উত্তর আসে অন্যদিক থেকে।

ইফাজ আশাহত ভঙ্গিতে দু’টো তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।নবনীতা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।রোজ রোজ বাড়িতে আসলেই একটা না একটা কাহিনী ঘটতেই থাকে।মামি কে বলা স্বত্তেও কি কারণে তিনি বার বার ইফাজকে এখনো সোজাসুজি কিছু বলছেন না নবনীতার জানা নেই।বারবার বারণ করা স্বত্তেও বিয়ের প্রসঙ্গ কেন উঠছে?

সে নিজের ঘরে গিয়েই চিত্রার হাতে তার মোবাইল ফোন দেখে আরো এক দফা বিরক্ত হয়।মুখ দিয়ে চ’কারান্ত শব্দ করে বলে,’এসব হচ্ছে টা কি চিত্র?সারাদিন কেবল ফোন নিয়ে পড়ে থাকো?দেখি এদিকে আসো।হাসপাতাল থেকে এসেছ না?চটপট গোসল করে ফেলতে হবে।আসো আসো।আপাইয়ের কাছে আসো।’

চিত্রাকে গোসল করিয়ে নবনীতা নিজেও লম্বা সময় ধরে গোসল করল।হাসপাতালে গেলেই স্ট্র্যাচারের ক্যাচ ক্যাচ শব্দে তার মাথা ধরে যায়।জং ধরা লোহার ঝরনা থেকে বৃষ্টির ফোটার মতো পানি নেমে এসে মেঝেতে ঝম ঝম শব্দ করে।নবনীতা ঝরনা ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘসময়।আজ তার বাবাকে মনে পড়ছে ভীষণ।বাবা নামের বটবৃক্ষ যখন ছায়া দেওয়ার জন্য আর মাথার উপর থাকে না,তখন গোটা পৃথিবীটাই মরুভূমির মতো শূন্য লাগে।নবনীতা বাবাকে দেখে না আজ কতো গুলো দিন।বাবা থাকলে নবনীতার এমন ছাপোষা পশু পাখির মতো জীবনে মানিয়ে নিতে হতো না।বাবা থাকলে এই কাঠফাটা রোদের ভেতর তাকে চাকরির খোঁজে ছুটোছুটি করতে হতো না।বাবা থাকলে আজ তাদের একটা সুন্দর জীবন হতো।চিত্র তখন আর রাস্তাঘাটের যেকোনো মানুষের মাঝে বাবাকে খুঁজত না।তার তখন সত্যিই একটা বাবা থাকতো।

নবনীতা আচমকা ফুঁপিয়ে উঠলো শব্দ করে।আওয়াজ যাতে বাইরে না যায় তাই সে মুখটা শক্ত করে চেপে ধরল।মুখ চেপেই হাউমাউ করে বলল,’বাবা,আমি তোমার সাহসী মেয়ে হওয়ার লড়াইয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি বাবা।তুমি জানো না বাবা,তুমি ছাড়া পৃথিবীটা কতো কষ্টের! তুমি জানো না ছেলে মানুষদের চোখ কতো নোংরা,মন কতো সংকীর্ণ! আমি না হয় সাহসী হলাম,সংগ্রামী হলাম।কিন্তু ঐ নোংরা চোখ গুলো থেকে কীভাবে বাঁচবো বাবা?আমি নিজের অস্তিত্ব কেমন করে ভুলে যাবো বাবা।চিত্র আর শুভির মাথা রাখার একটা জায়গা আছে।দুঃখ ঝাড়ার জন্য একজন মানুষ আছে।তাদের একটা পরী আপাই আছে।আমার কেউ নেই বাবা।কেমন করে আমি শুভি কে বলি ‘আপাই কিছুদিন বিশ্রাম নিব,তোরা নিজেদের কাজ নিজেরা করে নে।’ কেমন করে আমি চিত্র কে বোঝাই আমাদের বাবা মা কোনোটাই নেই চিত্র?যাকে তাকে সে নামে ডাকবে না।কেমন করে বোঝাই আপাই সত্যি সত্যি ফুরিয়ে যাচ্ছি অল্প অল্প করে?একটু স্বস্তি চাই,আর কিছু না।’

স্বস্তির কথা উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে।একটা মমতাময়ী মুখ।নবনীতা যথাসাধ্য চেষ্টা করে সেই মুখটা ভুলে থাকতে।মনে পড়লেই কান্না আসে।নবনীতা হলফ করে বলতে পারে মা থাকলে আজ এই করুণ অবস্থাতেও নবনীতা ভীষণ খুশি থাকতো।সারাদিনের ভোগান্তি শেষে সে এক ছুটে মায়ের নরম কোলটায় মাথা রেখে সব দুঃখ ঝেড়ে দিত।যতো অভিযোগ আছে সব মায়ের কাছে খুলে বলত।মা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে তার মন ভালো করে দিত।তখন কি জীবন এতো দুর্বি’ষহ ঠেকাতো তার কাছে?

গোসল শেষে চুপচাপ বেরিয়ে আসে সে।চোখ দু’টো তার তখনও পানিতে টইটম্বুর।চিত্রা আবারো তার ফোন হাতে নিয়ে কার্টুনের ভিডিও দেখা শুরু করেছে।সে এবার আর তাকে কিছু বলল না।পিঠটা দেয়ালে ঠেকিয়ে সে মেঝেতে গিয়ে বসল।বেশি কিছু না,জীবনে একটা মাথায় হাত ছোঁয়ানো মানুষ থাকলেই হতো।নবনীতা হাউমাউ করে কেঁদে তার কাছে সব দুঃখ উজার করে দিত।ইফাজ কি সেই একজন পুরুষ হতে পারবে?সে কি পারবে একটা চূড়ান্ত বিরক্তিকর দিনে নবনীতা বাড়ি ফিরতেই এককাপ চায়ের সাথে তাকে তার বিরক্তিটুকু উগড়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে?নাহ পারবে না।ইফাজকে সে বহুদিন ধরে চেনে।সে কখনোই পারবে না নবনীতার শুকনো খাঁ খাঁ জীবনে স্বস্তির বর্ষণ এনে দিতে।

_____________________________________________

‘নবনীতা নাম?’ আরিশ তড়িঘড়ি করে জানতে চায়।

আদি জবাব দেয়,’হু।নবনীতা নূর।ভীষণ সুইট।’

‘সে কথা ছাড়ো।দেখতে কেমন?ফর্সা মতোন,হ্যাংলা পাতলা,চুলে সবসময় বেণী করে রাখে,চুল গুলো কোমর সমান।আর গলাটা খুব মিষ্টি,নিউজ চ্যানেলের উপস্থাপিকা দের মতো?’

তাসনুভা আশ্চর্য হয়ে বলল,’অদ্ভুত! তুমি কেমন করে জানো?তুমি তাকে চেনো?’

আরিশ মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে জানায় সে সামনাসামনি দেখেনি তবে সে তাকে চেনে।শুধু সে না,আরহাম সহ তার দলের সবাই তাকে চেনে।

আদি উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,’বলো কি?আরহামের সাথে শুভ দৃষ্টি আগেই শেষ নাকি?’

‘দেখা হয়েছে।তবে সেটা শুভ বলে তো মনে হয়নি।’ গোমড়া মুখে জবাব দেয় আরিশ।
তারপরই সে সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে তাসনুভা কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আরে তোর মনে নেই নবনীতার কথা?ভাইয়ার সমাবেশে গিয়ে যে ভাইয়াকে ধুয়ে দিয়েছিল?’

তাসনুভা আঁতকে উঠে বলল,’কি?এটা সেই নবনীতা?আমি তো তাকে খুবই কড়া ভেবেছিলাম।কিন্তু সে তো খুবই মিষ্টি।হেসে হেসে কথা বলছিল আমাদের সাথে।’

আরিশ তুড়ি বাজিয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’মিষ্টিই তো।কেবল আমার গোয়ার ভাইয়ের সাথে তেতো।সে যেই মানুষ! তার সাথে কেই বা ভালো থাকবে?’

তাসনুভা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।চিন্তিত হয়ে বলে,’কেস টা তাহলে খুব জটিল।’

আদি মন খারাপ করে বলল,’ধুর আমরা আরো কতোদূর ভেবে নিয়েছিলাম।পরিকল্পনা সব মাঠেই মা’রা গেল।’

আরহাম বাড়িতে এসেই লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিল।ঘুম শেষে দোতালার করিডোরে দাঁড়িয়ে লিভিং রুমের জটলা দেখেই কপাল কুঁচকে বলল,’কিরে?তোরা এমন গোল হয়ে কি ফন্দি আঁটছিস?’

আদি মাথা তুলেই ভাব নিয়ে বলল,’আমরা একটা মিশনে নেমেছি।সফল না হওয়া পর্যন্ত ডিসক্লোজ করা যাবে না।’

আরহাম আর ঘাটায় না।সে তাদের মতো বেকার না।তার মাথায় অনেক রকম চিন্তা ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ।তার অনেক কাজ জমা আছে।সে দুই দিন প্রচারণায় যেতে পারেনি।সামনের দিনগুলো তার খুব ব্যস্ত যাবে।

সে তাদের আলোচনায় ভ্রক্ষেপ না করে আবার নিজের ঘরে চলে গেল।কয়েকটা জরুরি কল করতে হবে।কালকে সে কোন কোন এলাকায় যাবে সেটার একটা পরিকল্পনা আগে থেকেই করে নিতে হবে।

সব কাজ শেষ করতে করতে রাত দশটা বাজল।নিচ থেকে আফরোজা বেগমের ডাক শোনা যাচ্ছে।তিনি হয়তো খেতে ডাকছেন তাকে।সে গলা উঁচু করে বলে,’কাউকে দিয়ে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন ফুফু।আমি নিচে নামতে পারব না।’

রাজনীতি বাদেও শেখ আজিজ হোসেনের নিজস্ব কিছু ব্যবসা ছিল।রাজনীতিতে তার পদচারণা হয়েছে অনেক পরে।তিনি এর আগে বহুদিন ব্যবসা করেছেন।তার কয়েকটা ফার্ম হাউজ আছে।রাঙামাটি আর কক্সবাজারে তার রিসোর্ট আছে।এছাড়া একটা রেস্টুরেন্ট আর বেশ কিছু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তিনি নিজের জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।তার মৃ*ত্যুর পর সবটাই আরহাম সামলায়।যদিও জালালুর রহমান তাকে ব্যবসায়িক কাজে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন,কিন্তু আরহাম নিজ থেকেই সবটা সামলে নিয়েছে।বয়স কম দেখে জালাল সাহেব সন্দিহান ছিল তাকে নিয়ে।তবে আরহাম বয়সের অপরিপক্কতার অযুহাতে ব্যবসা সামলাতে কোনোরকম গড়িমসি করেনি।জালাল সাহেব এমনিতেই রাজনৈতিক ব্যাপারে তাকে অনেক সাহায্য করেছেন।আবার এই ব্যবসার বিষয়টা উনার উপর চাপিয়ে দিয়ে উনার চাপ বাড়াতে চায়নি আরহাম।

আরহাম আলমারির ড্রয়ার থেকে কিছু ব্যবসায়িক কাগজপত্র বের করে কাউচের সামনের টি-টেবিলের উপর সেসব ছড়িয়ে রাখল।বাইরে থেকে নাতিশীতোষ্ণ ঠান্ডা বাতাস পর্দা ভেদ করে ঘরে আসছে।আরহাম রিমোট দিয়ে এসি বন্ধ করে সেই হাওয়া গায়ে মাখে।এখন তো বর্ষার মৌসুম।বৃষ্টি হবে নাকি?

আরহাম কাউচ থেকে উঠে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে ব্লুটুথ স্পিকার দিয়ে লো ভলিউম গান ছাড়ে।দেশি বিদেশি নানা ব্যান্ডের গান তার প্লে লিস্টে আছে।মিউজিক অন হতেই সে চুপচাপ হেঁটে কাগজ গুলো হাতে নিয়ে বসল।বল পয়েন্ট কলম টা খুলে বিভিন্ন হিসেবে কা’টাছেঁ’ড়া করতে করতে নিজের কাজে মন দিলো।

সময় গড়ায়।দূর আকাশ থেকে ভারিক্কি শব্দে মেঘের গ’র্জন ভেসে আসে।পুরো ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য বিরাজ করে।স্পিকারে লো ভলিউমে একের পর একের গান বাজতে থাকে।বাজতে বাজতেই এক সময় ‘ব্লু জিন্স’ ব্যান্ডের এক গুচ্ছ কদম গানটি সামনে আসে।

আরহাম নিজের কাজে বেশ মনোযোগী ছিল।আচমকা গানের কিছু লাইন কানে যেতেই সে থমকাল।হাতের বল পয়েন্ট কলমটি যেই গতিতে চলছিল,সেই গতিতে ভাটা পড়ল।মন্থর হলো তার আঙুলের চলন।হাতের কলম টা আস্তে করে টেবিলের উপর রেখে সে উঠে দাঁড়াল।স্পিকারটা হাতে নিয়ে মোবাইলের প্লে লিস্ট থেকে পুনরায় সে অংশটুকু বাজালো।ভরাট পুরুষালী কন্ঠে আবারো উচ্চারিত হলো সেই কয়েক লাইন,

“দেখি তোমাকে আছো দাঁড়িয়ে,
আনমনে নীল শাড়িতে।
হাজার ভীড়ে,সব ছাড়িয়ে,
শুধু তুমি আমার চোখে।”

আরহাম সেই অংশটুকুই আবারো রিভার্সে গিয়ে শুনল।একবার দুইবার বার বার।তার চোখের সামনে সেই পুরোনো দৃশ্য গুলো আরো একবার ভেসে উঠে।

অবচেতন মন আবারো কল্পনা করে সেই দৃশ্যটুকু।একটি গু’লিবি’দ্ধ অসাড় দেহ,হুট করেই মৃদু আর্ত’নাদে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।সেই শব্দেই চমকে উঠে পেছন ফিরেছে একটি মেয়ে।মেয়েটির চোখে বিস্ময়,সাথে আবার কিছুটা উৎকন্ঠা।কি অদ্ভুত! তার পরনেও নীল শাড়ি।চারদিকে লোকজনের ছুটোছুটি।কিন্তু নিস্তেজ হয়ে আসা দেহ টা কেবল নিভু নিভু চোখের পাতায় দেখে যাচ্ছিল সেই মেয়েটিকে।মেয়েটি তারপর কি করল?

আরহাম আলগোছে হাসে।মেয়েটি তারপর ছুটে এলো।ছুটে এসেই হাঁটু গেড়ে বসল আরহামের কাছে।শক্ত করে চেপে ধরল র*ক্তে ভিজে যাওয়া সেই ক্ষ’তস্থান।আবার মাঝখানটায় একবার ধ’মকও দিলো বোধহয়,’মানা করেছি না চোখ বন্ধ করতে?চোখ বন্ধ করছেন কেন?’
আচ্ছা মেয়েটা কি কোনো স্কুলের টিচার?সারাক্ষণ এমন শা’সনের সুরে কথা বলে কেন?আরহাম কি তার অবাধ্য ছাত্র?যাকে দেখতেই সে চোখ গরম করে?
আরহাম জানে না,সত্যিই জানে না।

আচমকা কাছে কোথায় শব্দ করে বজ্রপাত হয়।তব্দা খেয়ে হুশ ফেরে আরহামের।চারদিক দেখে কি হচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে সে।চোরা চোখে দরজার দিকে তাকায়।কেউ দেখেনি তো?পরক্ষণেই আবার মনে হয়,দেখলেই বা কি?এই গান সে শুনতেই পারে।আগেও শুনেছে।এতে এতো চিন্তার কি আছে?

আবেগ অনুভূতি বড়ই ভয়াবহ জিনিস।আরহাম এদের কখনো তার ধাঁর ঘেঁষতে দেয়নি।ব্যাপারটা এমন না যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে,আসল কথা তার কোনোদিনও সেরকম কোনো অনুভূতি তৈরিই হয়নি।তার কাছে নারী শব্দের অর্থ তাসলিমা ইউসুফ,তার মা।মেয়ে বলতে সে তাকেই চিনে এসেছে।এরপর আর তার কোনোদিন মেয়ে চিনতে ইচ্ছে হয়নি।সারাহ কিংবা আফরোজা ফুফু কাউকে নিয়েই সে মাথা ঘামায় না।তাসনুভা বাদে এই পৃথিবীর কোনো মেয়ে কি মিনিটের জন্য হলেও তার বক্ষপিঞ্জরে স্থান করে নিতে পেরেছিল?পারে নি তো।

আরহাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।নিজের গালে নিজেই দু’টো চড় মা’রে।কি হচ্ছে এসব?বিড়বিড় করে সে নিজেই নিজেকে ধ’মকায়,’তোর কি গু’লি খেয়ে মাথার তার ছিঁ’ড়ে গেছে আরহাম?এসব কেন ভাবছিস?সে তোর জন্য কিছু করেনি।বলেই তো দিয়েছে তোর জায়গায় যে কেউ থাকলে সে এটাই করতো।সে খুব মহান।সে জগতের সকলের সেবা করার ব্রত নিয়েছে।তুই কেউ না,কেউ না।’

আরহামের আর সে রাতে কাজ করা হয়নি।এক লাফে খাটে শুয়ে শুভ্র রঙের কম্ফর্টার টা গায়ে চাপিয়ে এসির পাওয়ার ১৭ডিগ্রি তে নামিয়ে দীর্ঘসময় সে সেভাবেই পড়ে রইল।শেষে কতোক্ষণ নিজেই নিজের চুল টানল।শেষমেশ নিজের ভেতরের প্রচন্ড অস্থিরতার কাছে পরা’স্ত হয়ে সে হাত পা ছড়িয়ে কতোক্ষন শান্ত হয়ে শুয়ে থাকল।মেয়েটির জন্য সে কেউ না।তাকে বাঁচানো টা নেহাৎই তার বিবেকের তাড়না ছিল।কিন্তু আরহাম কি করে তাকে সব মেয়েদের কাতারে রাখবে?এই মস্ত বড় পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের মাঝে সেই ছিল প্রথম মেয়ে যে কি-না ক’রুন সময়ে শাহরিয়ার আরহাম কে আগলে ধরেছিল।চারিদিকের বিশাল হট্টগোলের তোয়াক্কা না করে নবনীতা নূর ছুটে এসেছিল তার দিকে।নি’স্তেজ হয়ে আসা শরীরটা নিজের বিবশ দেহের ভার ছাড়ার জন্য একটা কাঁধ খুঁজে পেয়েছিল সেদিন।সেই কাঁধের মালিক ছিল নবনীতা।সেদিন মেয়েটার চোখে উৎকন্ঠা দেখেছে আরহাম।কই সে বাদে তো আর কোনো মেয়ে কখনো তার জন্য উৎকন্ঠা দেখায়নি।তাসনুভা দেখায়।কিন্তু তাসনুভা তো তার রক্ত।নবনীতা কে?তার চোখে কেন উৎকন্ঠা থাকবে?মেয়েদের কে চিরকাল যেই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে আসছিল আরহাম,নবনীতা কেন সেই সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে আরহাম কে ভুল প্রমান করে দিলো?কেন দিকবিদিক ভুলে ছুটে এসে দেখিয়ে দিয়েছে মেয়েরাও অন্যের বিপদে নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাঁ’পিয়ে পড়তে পারে?আরহাম জানে নবনীতা তাকে ‘সব’ শব্দটা দিয়ে গণমানুষের কাতারে নিয়ে আসতে পারলেও সে কোনোদিন তাকে সেভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না।কিছুতেই পারবে না।

মাথার উপর আরো একটা বালিশ চেপে ধরল আরহাম।এমন চলতে থাকলে সে খুব দ্রুতই পাবনা চলে যাবে।সে বড় করে শ্বাস টানে।আর না,আর না।অনেক হয়েছে।চুলোয় যাক নবনীতা।তার কি?তার সামনে নির্বাচন।সেই নির্বাচনে জয়ী হতেই হবে তাকে।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৫(খ)

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৫)[দ্বিতীয় অংশ]

তাসনুভা তার কথা শুনেই এক গাল হাসল।হাসিমুখে বলল,’থ্যাংক ইউ আপু।আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

নবনীতা চারদিক দেখে ভ্রুদ্বয় উঁচু করে জানতে চায়,’সাথে কেউ আসেনি?একা কেন তুমি?’

‘এসেছে।কিন্তু আমাকে ফেলে উপরে চলে গেছে।’

‘আহারে! আপু উপরে নিয়ে যাব তোমায়?তুমি বললে নিয়ে যেতে পারি।’

নবনীতার অবশ্য তাকে নিয়ে যেতে হয়নি।তার আগেই আদি তিনতালায় এসে এদিক সেদিক তাসনুভাকে খুঁজে শেষটায় তাকে দেখতে পেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসে।তাসনুভার সামনে এসেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,’এ্যাই মেয়ে,তোমাকে না এক জায়গায় রেখে এসেছিলাম?তুমি আবার এদিকে চলে এসেছ?তোমাকে নিয়ে যে কি করি আমি!’

‘সে আসে নি।একটা বাচ্চার পায়ের ধাক্কা লেগে ওর হুইলচেয়ার টা নিজ থেকেই চলছিল।আমি আরেকটু দেরি করলে মেয়েটা দেয়ালের সাথে গিয়ে ধা’ক্কা খেত।’

আদি কথা শুনতেই দ্রুত পাশ ফিরে।তাসনুভার চেয়ারের দু’টো হাতল মেয়েটির হাতের মুঠোয় ব’ন্দি।তার সাথে চোখাচোখি হতেই আদি অবাক হয়ে বলল,’বলো কি?এই দু’মিনিটে এতো কিছু ঘটে গেছে?’

তার কথার ধরনেই নবনীতা হেসে ফেললো।মাথা নেড়ে বলল,’জ্বী,এতোকিছু হয়ে গেছে।’

আদি মুচকি হেসে আহ্লাদী স্বরে বলল,’ইউ আর সো কিউট! নাম কি তোমার?’

অন্য কেউ এই কথা বললে সাথে সাথে নবনীতা মুখের উপর ধাম করে একটা উত্তর দিত।কিন্তু সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার উদ্দেশ্য খারাপ না।বরং তার কথার মাঝে একটা বাচ্চামো ছিল।নবনীতা খুব ভালো করে মানুষ চেনে।এই ছেলেটা সম্ভবত স্বভাবতই একটু এমন।তবে তার কথায় কোনো অশোভন ইঙ্গিত ছিল না।উল্টো মুখ জুড়ে ছিল স্বচ্ছ হাসি।নবনীতা স্মিত হেসে উত্তর দেয়,’আমার নাম নবনীতা নূর।’

‘নাইস নেইম।জাস্ট লাইক ইউ।তোমার মতোই মিষ্টি তোমার নাম।’ আদি চঞ্চল হয়ে উত্তর দেয়।
তাসনুভা তার হাঁটুতে এতটা কি’ল বসিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’তুমি এখানেও শুরু হয়ে গেছ?লজ্জা নেই তোমার?’
***

চিত্রা জন্মগত ভাবেই ছটফটে আর চঞ্চল প্রকৃতির।তাকে বারণ করা স্বত্তেও সে নবনীতা সামনে থেকে সরে যেতেই ছুটোছুটি শুরু করে দিলো।এদিক সেদিক যেতে যেতে চার তালায় যাওয়ার সিঁড়ির সামনে আসতেই সে কারো সাথে ধাক্কা খেল।শক্তপোক্ত শরীরটার সাথে তার কোমল শরীরের সং’ঘর্ষ হতেই সে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে ধপ করে ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।

সামনে থাকা সুঠাম দেহের লোকটি তৎক্ষনাৎ হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসল।মাথা নিচু করে তার একটা হাত চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,’আয়হায়! তুমি পড়ে গেলে কেমন করে?’

চিত্রা মাথা তুলল।তার সামনে বসে থাকা লোকটাকে সে প্রথম দেখাতেই চিনে নিল।বাচ্চাদের স্মৃতি শক্তি প্রখর।সে তাকে চিনতেই হাসিমুখে বলল,’আরাম ভাই!’

এহেন অদ্ভুত সম্বোধনে ভড়কে গেল যুবকটি।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,’কি?কি ভাই?’

চিত্রা কিছুটা দমে গেল।সে কিছু ভুল কিছু বলেছে?সে তো খুব দ্রুত মানুষের মুখ চিনে ফেলে।এবার কি সেটা কাজে লাগেনি?সে কাচুমাচু মুখে আবারো বলে,’আরাম ভাই!’

যুবকটি থমকায়।কয়েক মুহূর্ত ভাবে।তারপরই কিছু একটা অনুধাবন করেই শব্দ করে হেসে ফেলে।হাসতে হাসতেই বলে,’ভালো বলেছো তো।আরাম ভাই।’
তার হাসির জবাবে চিত্রাও হাসল।যুবকটি জানতে চায়,’তুমি আমায় কেমন করে চিনো?’

‘আমি তুমাকে দেখেছি।পরী আপাইয়ের সাথে বেড়াতে গিয়ে।তুমি মাইকে কথা বলো তাই না?’

আবারও একগাল হাসে সে।মাথা নেড়ে জানায়,’ঠিক বলেছ একদম।আমিই মাইকে কথা বলি।’
কথাটা বলেই সে এদিক সেদিক দেখে বলল,’তুমি কার সাথে এখানে এসেছ?’

‘পরী আপাইয়ের সাথে।’

‘কোথায় তোমার পরী আপাই?’

চিত্রা এদিক সেদিক দেখে মলিন মুখে জবাব দেয়,’খুঁজে পাচ্ছি না।হারিয়ে গেছে।’

একপেশে হেসে উঠে দাঁড়ায় আরহাম।চিত্রার দিকে একহাত বাড়িয়ে বলে,’চলো তো,আমরা মিলে তোমার পরী আপাইকে খুঁজি।’

চিত্রা একনজর তাকে দেখে,আবার দেখে তার হাতের ব্যান্ডেজ।তার ভাবনার মাঝেই তার আরাম ভাই তাকে এক হাতে কোলে তুলে নিল।চোখ দিয়ে নিজের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা দেখিয়ে বলল,’আমার কিন্তু একহাত অচল।অতো শক্ত করে ধরতে পারব না।তুমি একটু শক্ত করে ধরে রাখো তো আমায়।’

চিত্রা শক্ত করে তার গলা জড়িয়ে ধরল।আরহাম সামনে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল,’নাম কি তোমার?’

চিত্রা বেশ স্পষ্ট করে বলল,’হুমায়রা নূর চিত্রা।’

‘ওয়াও নাইস নেইম।এখন আমাকে বলো তো তোমার পরী আপাই দেখতে কেমন?এই পরীর ডানা কয়টা?’

চিত্রা ফিক করে হেসে দিলো।মুখে হাত চেপে মাথা নেড়ে বলল,’ডানা নেই।’

‘সর্বনাশ! ডানা ছাড়া এ আবার কেমন পরী?’ হাসল আরহাম নিজেও।চোখ সরু করে বলল,’দেখতে কি পরীদের মতো?’

চিত্রা সম্মতিসূচক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’নাহ,সিন্ড্রেলার মতো।’

আরহাম চোখ উল্টায়।অল্প হেসে বলে,’চলো আমরা সিন্ড্রেলা কে খুঁজি তাহলে।’

একটু দূর যেতেই চিত্রা দ্রুত হাত নেড়ে বলল,’ঐ যে,ঐ যে! ঐ দেখো পরী আপাই।’

আরহাম থামল।চিত্রার হাত অনুসরণ করেই সামনে দেখল।সামনের দৃশ্য দেখতেই আপনাআপনি তার সমস্ত মুখে বিস্ময় ছেয়ে গেল।আদি আর তাসনুভা একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে।মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তাসনুভার পেছনে।তার মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেপ্টে আছে।অবাক হয় আরহাম।এই মেয়ে হাসতেও জানে?কোথায়,তার সাথে তো কোনোদিন এমন হাসি মুখে কথা বলে নাই।অথচ আদি আর তাস’এর সাথে কতো মিষ্টি করে কথা বলছে!

‘নামাও আমাকে।’

চিত্রার আওয়াজ কানে যেতেই হুশ ফেরে তার।বিনা বাক্যে দ্রুত তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় সে।চিত্রা ছুটে যায় সামনের দিকে।দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে নবনীতাকে।

নবনীতা মাথা নিচু করে তাকে দেখতেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,’তোকে না এক জায়গায় দাঁড়াতে বলেছিলাম?তুই আবার চলে এসেছিস?’
চিত্রা উত্তর না দিয়ে কেবল দাঁত বের করে হাসল।

আদি বলল,’সে কে?’

‘আমার ছোট বোন।চিত্রা।ভালো নাম হুমায়রা নূর।’

‘উমমম নাইস নেইম।সেও কিন্তু খুব কিউট।’

নবনীতা হাসি চেপে বলল,’জ্বী জনাব।আমরা তিনবোনই ভীষণ কিউট।’

‘আরেকজন আছে নাকি?’

নবনীতা মাথা নেড়ে জানাল আছে।আদি লাজুক হেসে বলল,’আমি না দেখেই বলে দিতে পারি সেও খুব কিউট।’

তার বলার ধরনেই নবনীতা ফিক করে হেসে দিলো।আদি ছেলেটার মধ্যে এখনো কৈশোরের একটা ছাপ আছে।একদম নির্ভেজাল মিশুক প্রকৃতির ছেলে।নবনীতা চিত্রার এক হাত ধরে বলল,’ঠিক আছে,তোমরা থাকো।আমি আসি।’

বলেই সে তাসনুভার থুতনিতে হাত রাখে।আদুরে স্বরে বলে,’আমি আসি তাসনুভা।ঠিক আছে?ভালো থেকো তুমি।’

তাসনুভা মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বলল,’তুমিও ভালো থাকবে আপু।’

নবনীতা তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আদির দিকে তাকায়।কিছুটা থমথমে মুখ করে বলে,’মিস্টার আদি! আপনিও ভালো থাকবেন।’

আদি মুচকি হাসে।বলে,’তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।বুঝেছ?’

নবনীতা কিছু বলার আগেই তাসনুভা সামনে দেখে বলল,’ভাইয়া তুমি?’

তার কথা শুনতেই সামনে তাকায় নবনীতা।তাদের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে।লোকটা না গু*লি খেয়েছিল?এতো তাড়াতাড়ি হাঁটাচলা করছে কেমন করে?ইনি তাসনুভার ভাই?

আরহাম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।তার আর নবনীর মাঝে দূরত্ব কেবল দেড় হাতের।সে যারপরনাই শান্ত।মুখ ফুটে কিছুই বলার প্রয়োজন বোধ করে না।নবনীতা ভদ্রতার খাতিরে জানতে চায়,’কেমন আছেন আপনি?’

আরহাম গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো,’আছি।আগের চেয়ে ভালো আছি।’

‘তোমরা দু’জন দু’জনকে চেনো?’ প্রায় একইসাথে বলে উঠল তাসনুভা আর আদি।

নবনীতা কিছুটা চাপা স্বরে বলল,’হু।’

আরহাম চোখ তুলে একবার তাকে দেখে।এতোক্ষণ কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিল হেসে হেসে! যেই আরহামকে দেখেছে,মুখটা এমন করে রেখেছে যেন আরহাম একটা জ’ন্তু।সে সামনে এলেই তার হাসি বন্ধ হয়ে যায়।আরহাম দারাজ গলায় বলে,’তুমি কেমন আছ?’

‘ভালো।’ ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয় সে।

কথা শেষে নবনীতা আর এক মুহূর্তও দেরি করে না।চিত্রার হাত টা শক্ত করে ধরে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।মিনিট খানেকের মধ্যেই সে তিনতালার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।নিচে নামতেই তার মনে হলো সে আরেকটু নমনীয় হলেও পারতো।সাথে সাথেই আবার মনে হলো ‘আর কতো নমনীয় হবো?জিজ্ঞেস তো করেছি কেমন আছে?আর কি বলার আছে আমার?’

সে চলে যেতেই আরহাম একহাত ট্রাউজারের পকেটে রেখে হাস্কি স্বরে বলল,’দাঁড়া।আমি একটু আসছি।কাজ আছে একটা।’

আদি মাথা নাড়ে।জানতে চায় ওয়াজিদ কোথায়?আরহাম বলল,’নিচে আছে।রিসেপশনে।কিছু কাগজপত্রের ঝায় ঝামেলা আছে।ঐ গুলো শেষ হতে দে।তারপর আমরা বেরিয়ে যাবো।’

কথা শেষ করেই সে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পদযুগল সামনের দিকে এগিয়ে নেয়।সে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতেই আদি সামান্য ঝুঁকে তাসনুভার কানের কাছে গিয়ে হিশহিশিয়ে বলল,’নবনীতা মেয়েটা খুব কিউট না?’

‘অনেক বেশি।’

‘আমার কিন্তু তাকে পছন্দ হয়েছে।কিন্তু নিজের জন্য না।’ চটপটে স্বরে উত্তর দেয় আদি।

চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাসনুভা।আনন্দিত কন্ঠে বলে,’আমি যা ভাবছিলাম,তুমিও তাই ভাবছ?’

তার কথার জবাবে তারই মতো করে উৎসাহী হয়ে মাথা নাড়ে আদি।জানায়,’দু’জন কে একসাথে দেখার পরেই এই অদ্ভুত ভাবনা জেগেছে মনে।’

তনসনুভা কিছুক্ষণ কল্পনা করে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’হেব্বি মানাবে না দু’জনকে একসাথে?’

‘একদম।খাপে খাপ,আমেনার বাপ।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৫

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৫)[প্রথম অংশ]

পুরোটা রাস্তা নবনীতা পাড়ি দিয়েছে রাশেদুল হক কে গা’লি দিতে দিতে।তার র’ক্ত টগবগ করে ফুট’ছিল।মানুষ এতো নোংরা হয় কেমন করে?প্রকাশ্যে এই কথা গুলো বলতে তার লজ্জা হয়নি একটুও?

বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে সে যখন ঘরে এলো তখন সাদেকের সাহেবের ঘরের চি’ৎকার চেঁচামেচি তে তার মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে গেল।প্রথার উচ্চবাচ্য ঘরের দুয়ার থেকে তার কানে আসছে।সে বড় বড় পা ফেলে সোজা সেদিকে গেল।ঘরে ঢুকেই কাঠকাঠ স্বরে বলল,’কি সমস্যা প্রথা?এমন ষাঁড়ের মতো চেঁ’চাচ্ছ কেন?’

প্রথা পেছন ফিরল।নবনীতার উপস্থিতি টের পেতেই তি’রিক্ষি মেজাজে বলল,’তুমি আবার এসেছ?তোমাকে বলেছি না আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে না?’

নবনীতা দুই কদম এগিয়ে এসে দু’হাত বুকে বেঁধে দাঁড়ায়।নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,’তোমাকেও তো বলেছিলাম আমার মামার সাথে এমন ব্যবহার করবে না,এমন বাজে গলায় কথা বলবে না।তুমি শুনেছ আমার কথা?’

‘আমার বাবা।’

‘আমার মামা।’

‘আমার বেশি আপন।অধিকার আছে আমার।’

‘অধিকার আমারও আছে।’ শক্ত মুখে জবাব দেয় নবনীতা।

মিসেস রোকেয়া তার একের পর এক উত্তরে বিরক্ত হয়ে বললেন,’তুমি সবকিছুতে এতো বাড়াবাড়ি কেন করো বলো তো?আগে তো জানবে প্রথা কেন এসেছে?না শুনতেই এতো কথা কেন বলছ?’

‘কেন?কেন এসেছে প্রথা?কি কারণে তার বাবার সাথে এতো জোর গলায় কথা বলছে সে?আমাকে বলো।শুনি আমি।’ চোখ সরু করে জানতে চায় নবনীতা।

মিসেস রোকেয়া জোরাল গলায় বললেন,’প্রথা আর তার কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ব্যবসা করতে চাচ্ছে।সেজন্য তার কিছু টাকা প্রয়োজন।তোমার মামার কাছে সেই টাকাই চাইতে এসেছে।খারাপ কিছু তো করেনি।নিজের ভবিষ্যতের কথাই ভাবছে।’

নবনীতা কপাল কুচকায়।সেরকম মুখ করেই বলে,’প্রথা ব্যবসা করবে?গ্র্যাজুয়েশন টা তো আগে শেষ করুক।এখনই ব্যবসার কি প্রয়োজন?’

‘আমি কখন কি করব সেটাও এখন তোমাকে বলে করতে হবে?’ গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে প্রথা।

মিসেস রোকেয়ার থেকে নজর সরিয়ে নবনীতা প্রথার দিকে নজর দেয়।একবার আপাদমস্তক তাকে দেখে কড়া গলায় বলে,’একদম এমন উঁচু গলায় কথা বলবে না আমার সাথে।বয়সে তোমার যথেষ্ট বড় আমি।আমি শুভি নই,চিত্র নই।আমি নবনীতা।তোমার উচ্চবাচ্যে আমি ভয় পাই না।কিসের ব্যবসা করবে তুমি?একটু খুলে বলো তো আমাকে?’

প্রথা চোখ নামায়।রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দেয়,’যেই ব্যবসাই করি না কেন,ভালো মন্দ বুঝেই করব।’

নবনীতা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকে দেখে বলল,’কতো টাকা প্রয়োজন?’

প্রথা গমগমে স্বরে উত্তর দেয়,’দশ লক্ষ টাকা!’

‘কি?দশ লক্ষ টাকা?’ একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠল নবনীতা।পরক্ষণেই নিজের বিস্ময় নিয়ন্ত্রণ করে বলল,’তোমার মাথা ঠিক আছে প্রথা?ব্যবসার শুরুতেই দশ লক্ষ টাকা পুঁজি খাটাবে?দশ লক্ষ টাকা কি চাট্টে খানি কথা?এতো টাকা কোথা থেকে আসবে?’

প্রথা নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’কেন?এতো চিন্তার কি আছে?বাবার পেনশনের টাকা আছে না ব্যাংকে?ঐটা থেকে দশ লাখ টাকা দিলেই তো হলো।’

নবনীতা চূড়ান্ত রকমের আশ্চর্য হয়ে বলল,’তোমার কি মাথা ঠিক আছে প্রথা?ঐ টাকা টা মামার টাকা।মামার চিকিৎসার জন্য রাখা হয়েছে।তুমি কি করে ঐ টাকায় হাত দিতে চাইছো?মামার ব্যাংকে রাখা টাকায় তোমার কোনো অধিকার নেই।’

‘কেন?কেন অধিকার নেই?আমি তার সন্তান।আমার অধিকার আছে।’ গজরাতে গজরাতে উত্তর করে প্রথা।

‘না অধিকার নেই।তোমার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পেছনে প্রতি মাসে বিশাল টাকা খরচা হয়।এর মাঝে তুমি অন্য কোনো টাকা চাইতে পারো না।আগে ভালো মতো গ্র্যাজুয়েট হও,তারপর এসব ব্যবসা নিয়ে ভেবো।’ কিছুটা শাসন,কিছুটা তিরষ্কারের সুরে জবাব আসে।

তার সোজাসাপ্টা কথাবার্তায় প্রথা খৈ হারিয়ে পুনরায় একই কথা বলল,’তুমি আমার বাড়িতে থেকে আমার উপরই খবরদারি করো।তোমার লজ্জা করে না?’

নবনীতা মাথা নাড়ল।তর্জনী নেড়ে বলল,’না,একদমই না।আমার লজ্জা করে না।ঠিক যেমন আমার টাকায় ভাড়া দেওয়া বাড়িতে থেকে,আমার টাকায় বাজার করা খাবার খেয়ে আমারই সাথে কাটখোট্টা ভাষায় কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না,তেমন আমারো লজ্জা করে না।’

প্রথার থোতা মুখ ভোঁ’তা করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে যুতসই উত্তর সম্ভবত আর কিছুই হতো না।মুখের উপর এমন উত্তর পেতেই সে চুপশে গেল।কেবল চাপা ক্রোধে অজানা কোনো জ’ন্তুর মতো ফোস ফোস শব্দ করে শ্বাস ছাড়ছিল।

নবনীতা নড়বড়ে হয়ে যাওয়া খোপা টা খুলে শক্ত করে বেঁধে নেয়।সাদেক সাহেবের কাছে হেঁটে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে।সাদেক সাহেবের চোখ মুহূর্তেই আদ্র হয়।সংসারের এই পর্যায়ে এসে বাবা নামক স্বত্ত্বাটি উপলব্ধি করতে পারে,সংসারে তার মূল্য নির্ধারণ করা হয় অর্থ উপার্জনের পরিমানের উপর ভিত্তি করে।যখন সে প্রতি মাসে বিশাল অঙ্কের টাকা কামাই করে আনতো,তখন নিশ্চয়ই বাবার সাথে প্রথা এমন আচরণ করত না।এখন বাবা অচল।তাকে ভালোবাসা কিংবা সম্মান কোনোটাই দেখানো প্রয়োজন নেই।প্রয়োজন কেবল বুড়িয়ে যাওয়া লোকটির অবশিষ্ট শেষ সম্বল টুকু।সেটার জন্যই বাড়ির একটি ঘর এখনো তার ভাগ্যে জুটেছে।

নবনীতা তার একহাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিল।দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানাল,’সবকিছুতে মন খারাপ করবে না মামা।মন খারাপ জিনিসটা মূল্যবান।যার তার উপর করা যায় না।সবার উঁচু আওয়াজে মনে কষ্ট নিবে না।যারা কোনোদিনও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবে না তাদের সাথে কিসের মন খারাপ?আগে তারা তোমার পূর্বের সকল ঋণ শোধ করুক।তারপর না হয় তাদের গলাবাজি দেখা যাবে।’

স্পষ্ট আর জড়তাহীন কিছু বাক্য,অথচ সাদেক সাহেবের মনে হলো মেয়েটি তার মাঝে একটা নব প্রাণের সঞ্চার করে গেছে।সত্যিই তো,প্রথার আচরণে সে কেন কষ্ট পাবে?প্রথা কি কোনোদিন পারবে অতীতের সব ঋণ শোধ করতে?তার কথায় সাদেক সাহেব কেন মন খারাপ করবে?

তিনি মুগ্ধ চোখে তার সামনে দাঁড়ানো যুবতী কন্যাটি কে দেখেন।অপলক শুধু দেখতেই থাকেন।আর কতো বিশেষণ এসে যুক্ত হবে এই মেয়েটির নামের পাশে?সাদেক সাহেবের জানা নেই।তবে তিনি এইটুকু জানেন এই মেয়েটি অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন।তার ভেতর এমন এক বিশেষ ক্ষমতা আছে যেই ক্ষমতায় সে তার আশেপাশের মানুষজন কে আচ্ছন্ন করে রাখে।তার ভেতর শক্তি আছে,সাহস আছে।যেই শক্তি আর সাহস দাবা’নলের আ’গুনের মতো তার আশেপাশের সবার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে।সাদেক সাহেব এই মেয়েটিকে স্নেহ করেন,স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই ভালোবাসেন।

নবনীতা তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঁথা টা তার বুক পর্যন্ত টেনে দিলো।ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে থমথমে স্বরে বলল,’আমি যেন আর কোনো আওয়াজ না পাই আর এই ঘর থেকে।’
বলেই সে লম্বা লম্বা কদম ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।মিসেস রোকেয়া তার প্রস্থান দেখতেই চাপা স্বরে বললেন,’অহংকারের ঠেলায় বাঁচে না।দম্ভে মাটিত পা টাও পড়ে না এই মেয়ের।দু’টো পয়সা রোজগার করে,আবার সুযোগ বুঝে খোঁচাও দিয়ে দেয়।’
***

নবনীতা তার ঘরে গিয়েই প্রথমে হাত মুখ ধুয়ে খাটের এক পাশে গিয়ে আধ শোয়া হয়ে হেলান দিলো।চিত্রাকে এক হাত তুলে ডেকে বলল,’চিত্র সোনা! আপাইয়ের কাছে আয় তো।’

চিত্র ছোট ছোট পায়ে তার সামনে এলো।নবনীতা একটানে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে আদুরে গলায় বলল,’চুল গুলো এমন অবস্থা করেছ কেন চিত্র?সকালে না আপাই বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলাম?’

‘খুলে গেছে খেলতে খেলতে’ অত্যন্ত স্বাভাবিক কায়দায় জবাব দেয় চিত্রা।

নবনীতা আলগোছ হেসে বলল,’আচ্ছা যাও ,চিরুনী আর ব্যান্ড টা নিয়ে আসো,আপাই আবার বেঁধে দিচ্ছি।’

চিত্রার চুল বাঁধার সময়ই আচমকা ধাম করে বিকট শব্দে ঘরের দরজা খুলল।চিত্রা আর নবনীতা দু’জনই সে শব্দে ধড়ফড়িয়ে ওঠল।আওয়াজের উৎস খুঁজতে সামনে দেখেই নবনীতা তিতিবিরক্ত হয়ে ধ’মকে উঠে,’এসব কি শুভি?এতো জোরে কেউ দরজা খোলে?অদ্ভুত কাজ কারবার করিস মাঝে মাঝে!’

শুভ্রা তার ধ’মক গায়ে মাখল না।উল্টো কাঁধে ঝুলানো কলেজ ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে সোজা শূণ্যে উড়িয়ে দিলো।নবনীতা ব্যাগটা দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’আরে কি করছিস তুই?ধর ব্যাগটা।’

শুভ্রার অবশ্য ব্যাগ ধরতে হয়নি।ব্যাগটা শূন্যে উড়তে উড়তে তার পড়ার টেবিলেই গিয়ে পড়েছে।শুভ্রানী সে দৃশ্য দেখেই গর্ব করে বলল,’আমার নিশানা কখনো মিস যায় না।’

কথা শেষ করেই সে এক ছুটে নবনীতার কাছে গিয়ে তাকে আধশোয়া অবস্থাতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।নবনীতা তার আচরণে বোকা বনে গেল।শুভ্রা তাকে আরো কিছুটা অবাক করার জন্যই দ্রুত তার দুই গালে পর পর দু’টো চুমু খেল।তারপর চিত্রাকে তার কাছ থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিজে তার পাশাপাশি বসে বলল,’যা চিত্র! অনেক আদর খেয়েছিস তুই।এবার একটু আমাকেও আদর দেও আপাই।বড় হয়েছি বলে তুমি আমায় পাত্তা দাও না একটুও।’

নবনীতা বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকে দেখে।নিজের বিস্ময়ভাব কাটতেই সে খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো।শুভ্রার মাথায় হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’আয় তোরও মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’

শুভ্রানী তার মাথা থেকে হাত নামিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,’উফফ আজ আর তার দরকার নেই।’

সে আরেকটু এগিয়ে গেল।মুখটা একদম নবনীতার কানের কাছে নিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল,’একটা খুবই ভালো খবর আছে আপাই।’

নবনীতা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় কি?

শুভ্রা এক দৌঁড়ে তার টেবিলের সামনে গিয়ে ব্যাগ খুলে একটা খাম আর একটা ফাইল বের করল।তারপর আগের মতোই আবার দৌঁড়ে দৌঁড়ে নবনীতার কাছে এসে সেগুলো তার হাতে তুলে দিলো।

নবনীতা সবার প্রথমে ফাইল খুলে তার ভেতর থাকা লেমিনেটিং করা কাগজ টাই বের করল।কাগজের লিখা টুকু পড়েই তার দু’চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে।শুভ্রানী মাস খানেক আগে একটা বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।নবনীতাই সে পরীক্ষার জন্য ফর্ম তুলেছিল।সেটার রেজাল্ট বেরিয়েছে।শুভ্রানী বৃত্তি টা পেয়ে গেছে।

নবনীতা কিছু বলার আগেই শুভ্রা উৎফুল্ল স্বরে বলল,’আজ কলেজের প্রিন্সিপালের হাতে রেজাল্ট এসেছে।ছুটির পর আমাকে ডেকে নিয়ে সার্টিফিকেট আর টাকা দিয়েছে।বলেছে পরবর্তীতে কলেজ ফেস্টেও আমাকে কলেজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।’

কথা শেষ করেই সে মুচকি হাসে।নবনীতা অভিভূত হয়।মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনে।দুই চোখে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ছলকে উঠে।সহসা শুভ্রা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে।প্রচন্ড আবেগী হয়ে বলল,’খুব খুশি হয়েছি আমি শুভি।আমার ভেতরটা গর্বে আর আনন্দে ফুলে ফেঁ’পে যাচ্ছে সোনা।মনে হচ্ছে বৃত্তিটা আমি নিজেই পেয়েছি।’

শুভ্রা লাজুক হাসল।খামের থেকে টাকাটা বের করে নবনীতার হাতে তুলে দিলো।এককালীন সাত হাজার টাকা।নবনীতা টাকাগুলো হাতে নিয়ে জড়ানো গলায় বলল,’দেখি তোর মাটির ব্যাংক টা আন তো।এই টাকাটা আমি তোর ব্যাংকে জমাবো।’

বাড়িতে মোট তিনটে মাটির ব্যাংক আছে।নবনীতা সেগুলো কিনেছিল বছর চারেক আগে।নবনীতা শুভ্রানী আর চিত্রার যার যার ব্যাংক।সাদেক সাহেব যখন শারীরিক ভাবে সুস্থ ছিলেন তখন তিনি প্রায়শই তিন বোনকে কারণে অকারণে টুকটাক সালামি দিতেন।নবনীতা সেগুলো যার যার ব্যাংকে জমা করেছে।চিত্রার ব্যাংকে অবশ্য সে নিজেও মাঝে মাঝে টাকা দেয়।তার বিশ্বাস একদিন এই ব্যাংক গুলোতে অনেক অনেক টাকা জমবে।সেই টাকা দিয়ে তারা তিনবোন অনেক দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে।কতো চমৎকার না বিষয় টা?

শুভ্রা বিরোধ করে বলল,’না না।এই টাকা আমি ব্যাংকে ফেলব না।আমি আগেই ভেবে নিয়েছি এই টাকায় আমি কি কি করব।’

নবনীতা কপালে ভাঁজ ফেলে সন্দিহান চোখে বলল,’কেন?কি করবি তুই এই টাকায়?’
.
.
.
.
‘এ্যাই বাচ্চা! একা একা কোথায় যাচ্ছ?’

তাসনুভা বাড়ির বাইরের ইয়ার্ডে ঘুরাঘুরি করছিল।আদির ডাক কানে যেতেই সে হুইলচেয়ার থামিয়ে ঘাড় ঘুরালো।আদি বাড়ির বাইরের খোলা জায়গা থেকে হেঁটে ভেতরে আসছিল।তাসনুভা তাকে দেখতেই বলল,’কি হলো?তুমি না ভাইয়াকে সাথে নিয়ে আসার কথা?’

আদি হাঁটতে হাঁটতে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।ক্লান্ত স্বরে বলল,’তোমার ভাইয়াকে বিকেলে রিলিজ দিবে।তখন আনব।’

‘তাহলে তুমি এখন এসেছ কেন?একটু আগেই তো গেলে।’ চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে তাসনুভা।

‘কেন?তোমার কি অসুবিধে হচ্ছে আমি বাড়িতে ঘন ঘন আসাতে?’ কোমরে হাত রেখে জানতে চায় আদি।

তাসনুভা মুখ চেপে হাসে।গালে হাত রেখে বলে,’হ্যাঁ হচ্ছে।তুমি কি এখন মন খারাপ করে অন্য কোথাও চলে যাবে?’

‘নাহ বাচ্চা।আমার এতো রাগ টাগ হয় না।আমি কোথাও যাচ্ছি না।’
কথা শেষ হতেই আদি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ভারি গলায় বলল,’তোমার বিগ ব্রাদার পাঠিয়েছে আমায়।তোমার নাকি এই সপ্তাহে হসপিটালে গিয়ে চেক আপ করানোর কথা?তোমার ভাই বলেছে আমি যেন বাড়ি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসি।আরিশের তো সেমিস্টার ফাইনাল চলছে।মতিন চাচা অসুস্থ,কাজে আসেনি আজ।তোমার ভাইয়ের আবার ট্রাস্ট ইস্যু আছে।যাকে তাকে ভরসা করতে পারে না।তাই আমাকে বলেছে তার বোনকে নিয়ে হসপিটাল যেতে।বুঝেছ পিচ্চি?’

তাসনুভা কপালে হাত চাপল।অবাক হয়ে বলল,’তুমি এতো কথা কেমন করে বলো?তোমরা তিন বন্ধু একেবারে তিন রকম।’

‘এদের মাঝে সবচেয়ে কিউট আর সবচেয়ে সুইট আমি।তাই না?’ শার্টের কলার উঁচিয়ে গদো গদো হয়ে প্রশ্ন করে আদি।

তাসনুভা শব্দ করে হেসে ফেলল।এক হাত মুখে চেপে বলল,’হ্যাঁ,একদম তাই।’

আদি তার মাথায় এক হাত রেখে তাড়া দিয়ে বলল,’চলো চলো।আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।বড্ড লেইট হয়ে যাচ্ছি আমরা।’
_____________________________________________

‘মিস নবনীতা।আপনার সমস্যা টা আপনি বেশ ভালো করেই জানেন।আপনি যথেষ্ট সচেতন মানুষ।তা স্বত্ত্বেও রোগ নিয়ে আপনার এই অবহেলা সত্যিই ডিসাপয়েন্টং।আপনার রেগুলার চেক-আপ করানোর কথা।অন্তত প্রতিমাসে একবার।কিন্তু আপনি এসেছেন পাক্কা তিন মাস পরে।আপনাকে যে মেডিসিন গুলো দিয়েছিলাম আপনি সেগুলো নিয়ম করে নেন না।সবকিছু বাদ দেন।আপনার প্রতি মাসে রক্ত নেওয়া প্রয়োজন।আপনি কি নিচ্ছেন?’

বার্ডেম হসপিটালের হেমাটোলোজি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ডাক্তার মতিন আহমেদ খসরু কথা গুলো বললেন খুবই থমথমে মুখে।নবনীতা সে কথা শুনেই মাথা নামিয়ে নিল।ঠিক যেমন প্রিন্সিপালের বকুনি শুনে কেউ মস্তক নত করে,ঠিক সেভাবে।

তার পাশের চেয়ারেই চিত্রা ভদ্র বাচ্চার মতো চুপটি করে বসে আছে।মতিন সাহেবের গম্ভীর মুখটা দেখেই তার সমস্ত চঞ্চলতা উধাও হয়ে গেছে।সে বসে আছে একটা পুতুলের মতো।না কোনো নড়াচড়া করছে,না কোনো শব্দ করছে।নবনীতা আর চিত্রা আজ হসপিটালে এসেছে।শুভ্রা এখন কোচিং-এ।বৃত্তির টাকার একটা অংশ সে নবনীতার চেকআপের জন্য দিয়েছে।একটা অংশ নিজের ব্যাংকে রেখেছে।চিত্রার সামনে জন্মদিন।তার জন্মদিনের কেক কিনার জন্যও শুভ্রা টাকা রেখেছে।এছাড়া আরো অনেক টুকটাক ইচ্ছে আছে তার।সে সবগুলোই পূরণ করতে চায়।নবনীতা তাকে বাঁধা দেয়নি।এটা তার অর্জন।সে যেভাবে চাইবে সেভাবেই খরচ করবে।নবনী তাকে বারণ করার কে?

‘মিস নবনীতা! শুনছেন তো?’

চমকে উঠে সে।দ্রুত মাথা তুলে জানায়,’জ্বী স্যার।শুনছি।’

‘আপনি দয়া করে আর এতো অবহেলা করবেন না নিজের।আপনি খুব স্ট্রং একজন মেয়ে।সেই স্ট্রেগথ্ হারাবেন না প্লিজ।ইউ শ্যুড ইমিডিয়েটলি টেইক ব্লা’ড।বুঝছেন তো মিস?’

‘জ্বী বুঝেছি।এ মাসেই র’ক্ত নিব।আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।’

ডাক্তার মতিনের সাথে আরো কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর নবনীতা চিত্রাকে সাথে নিয়ে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।হসপিটালের নিচে ফার্মেসি আছে।সেখান থেকে কিছু ঔষধ কিনতে হবে তাদের।সে কেবল মাত্র চেম্বার থেকে বেরিয়ে তিনতালার মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছিল।ঠিক তখনই আনমনে এদিক সেদিক দেখতেই কিছু একটা দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।সে পাশ ফিরে চিত্রকে দেখে তাড়াহুড়ো করে বলল,’একদম এদিকে দাঁড়িয়ে থাকবে চিত্র।আপাই এক্ষুনি চলে আসব।’

কথা শেষ করে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল সামনের দিকে।

তাসনুভার চেক আপ শেষে আদি গিয়েছিল আরহামের কেবিনে।আরহামের কেবিন চার তালায়।যাওয়ার আগে আদি তাসনুভা কে করিডোরের একটা পাশে রেখে গিয়েছে।বলেছে দুই মিনিটে যাবে আর তিন মিনিটে আসবে।কিন্তু দশ মিনিট শেষ হতেও তার কোনো দেখা নাই।তাসনুভা বিরক্ত হয়ে এদিক সেদিক দেখল।তার থেকে একটু দূরেই চাইল্ড স্পেশালিষ্ট আকরামুল হোসেনের চেম্বার।চেম্বারের বাইরে বাচ্চা নিয়ে তাদের মা বাবারা বসে আছেন।কিছু কিছু বাচ্চা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।তাদের চিৎকারে তাসনুভার কান ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।হঠাৎই একটি বাচ্চা ছুটতে ছুটতে তাসনুভার হুইল চেয়ারের চাকায় ধা’ক্কা খেল।সঙ্গে সঙ্গে স্টিলের হুইল চেয়ারটি হুড়হুড় করে চলতে শুরু করল।আঁতকে উঠে তাসনুভা।দ্রুত চাকায় হাত রেখে সেটা থামানোর চেষ্টা করে।কিন্তু চাকা পর্যন্ত ঠিকঠাক তার হাত পৌঁছায় না।বিষয়টা এমন না যে তাসনুভা হুইল চেয়ারটা থামাতে অক্ষম।কিন্তু হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তে পড়ে সে কি করবে সেটাই ঠাহর করতে পারছিল না।ঘাবড়ে গিয়ে সে কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে সামনে দেখে যাচ্ছিল।কোনো নার্স কি আশেপাশে নেই?কেউ কি নেই যে তাকে দেখে বাঁচাতে আসবে?

হঠাৎই তাসনুভার হুইলচেয়ারের গতি কমল।পেছন থেকে কেউ শক্ত করে সেটা টেনে ধরল।সাথে সাথেই চাকা দুটো থামল।তাসনুভা বুকে হাত চেপে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।তারপর দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দেখল।

তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।পরনে হালকা আকাশী রঙের জামা।চুলে বেণী বাঁধা।তাসনুভার সাথে চোখাচোখি হতেই সে মিষ্টি করে হাসল।জানতে চাইল,’কি হলো?ভয় পেয়েছ নাকি?ভয়ের কিছু নেই সোনা।এই দেখো আমি তোমাকে ধরে ফেলেছি।’

চলবে-

(সময় পেলে আজ রাতে অতিরিক্ত অংশ দিয়ে দিব)

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৪

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৪)

ব্যস্ত সড়কের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে আটতলা বহুতল ভবনটির অবস্থান।পুরো ভবনজুড়েই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শো রুম।নয়তো অফিস ভাড়া নেওয়া।ভবনের চতুর্থ তালায় একটা কোচিং সেন্টারও আছে।নবনীতার গন্তব্য সেখানেই।

রিমির পাঠানো ঠিকানার সাথে একবার আশেপাশের ঠিকানা মিলিয়ে সে নিশ্চিত হয় এটাই সে কোচিং সেন্টার।সে এখানে এসেছে একটা পাকাপোক্ত চাকরির খোঁজে।বিশাল বড় কোচিং সেন্টারে স্টুডেন্ট পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল।রিমির থেকে নবনীতা এই জায়গার সন্ধান পেয়েছে।রিমি বলছিলো বেতন নাকি মাসিক ত্রিশ হাজার টাকা।শুনেই নবনীতা বিষম খেয়েছে।এতো গুলো টাকা!

লিফটের বাটন চেপে চারতালায় পৌঁছে সে বড় বড় দু’টো শ্বাস ছাড়ে।ভাইবা দেওয়ার আগে যেমন নার্ভাস লাগে,তারও ঠিক তেমনই নার্ভাস লাগছে।বুক একটু পর পর ভার হয়ে আসছে।দুশ্চিন্তায় শরীর ঘেমে ঘেমে একাকার।

নবনীতা কোচিংয়ের অফিস রুমে গিয়েই নিজের পরিচয় দিলো।সুমিষ্ট কন্ঠে জানতে চাইল,’কোন রুমে গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে?একটু জানিয়ে দিবেন কষ্ট করে?’

ডেস্কে বসা লোকটি কাজের ফাঁকে চোখ তুলে একবার তাকে দেখে।তার চাহনিতেই ভড়কে গেল নবনীতা।এমন অদ্ভুত করে তাকাচ্ছে কেন?নবনীতা কি কোনো চোর?

লোকটি খাতা কা’টছিলো।কাজ করতে করতেই সে বিরক্ত মুখে বলল,’সামনে যান।নিজেই পেয়ে যাবেন।’

নবনীতার কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে।কি পরিমান রূঢ় হলে কেউ এমন কর্কশ ভাষায় কথা বলতে পারে?নবনীতার জানা নেই।সে নিজের দুই হাত কচলাতে কচলাতে সামনের দিকে পা বাড়ায়।যেতে যেতে বিড়বিড় করে,’তুই বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো?যতসব গোয়ারের দল!’

কোচিং সেন্টারের মাঝামাঝি একটা রুম আছে।চারপাশে থাই গ্লাস।নবনীতা কক্ষের সামনে গিয়ে একটু দূরে থাকা একজন মেয়ে কে ডেকে জানতে চায়,’ভেতরে যাওয়া যাবে কি?আমি আসলে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছিলাম।শুনেছি নতুন শিক্ষক নাকি নিয়োগ দেওয়া হবে?’

যে মেয়েটিকে প্রশ্ন করা হয়েছে তার বয়স নিতান্ত অল্প।সে রিনরিনে স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী আপু।আপনি ভিতরে যান।রাশেদ স্যার ভেতরে আছেন।আপনি গিয়ে কথা বলুন।’

নবনীতা শেষ বারের মতো বড় করে একটা শ্বাস টেনে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।বেশ পরিপাটি একটা রুম।রুমের মাঝখানটায় ডেস্ক।পেছনের ওয়ালে খোদাই করে কোচিং সেন্টারের নাম লিখা।ডেস্কের সামনে ইজিচেয়ারে বসা একজন ভদ্রলোক।তিনি তখনও নবনীতাকে দেখেন নি।তার কানে মুঠোফোন,তিনি কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত।

নবনীতা চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।অপেক্ষা করল তার ফোন কাটার।লোকটি ফোন রেখেই সামনে দেখে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত কক্ষে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়েই নড়েচড়ে বসে।
নবনী বিনয়ী কন্ঠে সালাম দেয়।
রাশেদ নামের লোকটি সালামের জবাব দিয়ে ইশারায় তাকে বসতে বলে।কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায়,’কেন এসেছেন?কোনো প্রয়োজন?’

***

‘মিস নবনীতা নূর।গ্র্যাজুয়েটেড ফ্রম ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা।ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট।সিজি থ্রি পয়েন্ট সিক্স এইট।উমমম বেশ ইম্প্রেসিভ পারফরম্যান্স।’
হাতে থাকা কাগজ গুলো উল্টাতে উল্টাতে বিড়বিড় করে জনাব রাশেদ।

নবনীতা হাত দু’টো কোলের উপর ফেলে উৎসুক চোখে জনাব রাশেদের কার্যকলাপ দেখে।মনটা ভীষণ ছটফট করছে।তিনি কি তার সিভি পছন্দ করেছেন?এই মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি টা কি সে পাবে?যদি পেয়ে যায় তাহলে কি হবে সেটা ভেবেই তার আনন্দ হচ্ছে।

জনাব রাশেদুল হক তার সিভি দেখা শেষ করে ফাইলটা ডেস্কের উপর রাখলেন।চোখ দিলেন নবনীতার মুখে।সেই দৃষ্টি সময়ে সময়ে একটু একটু করে নামতে নামতে নবনীতার বুকে এসে থামল।

মুহূর্তেই মুখোভঙ্গি পাল্টে গেল তেইশোর্ধ রমণীর।ওড়না তো ছিলোই,রাশেদুল হকের লোলুপ দৃষ্টি অনুসরণ করতেই কাঁধের ব্যাগটাও দ্রুত বুকের উপর এনে চেপে ধরল সে।রাশেদ অবশ্য সেসবে ভ্রুক্ষেপ করে না।গলা খাকারি দিয়ে জানতে চায়,’ম্যারিড নাকি আন-ম্যারিড?’

চোয়াল শক্ত হয়ে রমণীর।কোচিংয়ে শিক্ষকতা করার সাথে এই প্রশ্নের সম্পর্ক কোথায়?তবুও সে কাঠকাঠ স্বরে জবাব দেয়,’আন-ম্যারিড।’

রাশেদ সাহেব দাঁত বের করে হাসলেন।উত্তর তার পছন্দ হয়েছে।তার হাসি দেখেই নবনীতার মনে হলো তার বলা উচিত ছিল সে ম্যারিড।চার বাচ্চার মা।অদ্ভুত ধরনের প্রশ্ন করছে এই লোক!

‘তো মিস,বাড়ি কোথায় আপনার?’

‘মালিবাগ’ বিরক্ত কন্ঠে উত্তর দিলো সে।

রাশেদ সাহেব ডেস্কের উপর দুই হাত রাখলেন।সামান্য ঝুঁকে বললেন,’পড়ানো ছাড়া আর কি পারেন?’

আবারও চোয়াল শক্ত হয় নবনীতার।মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত,জ্বল জ্বল করে উঠে দুই চোখ।প্রশ্ন করার ধরন দেখেই রাগ উঠছে তার।সে বসে থেকেই একটু পিছিয়ে গিয়ে কটমট করে বলে,’এখানে যেহেতু শিক্ষকতা করার জন্য এসেছি,তাই পড়ানো বাদে অন্য কিছু পারার যৌক্তিকতা দেখছি না।’

রাশেদ সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।ভীষণ ত্যাদড় এই মেয়ে।যাকগে ত্যাদড় মেয়েদের রশিদ সাহেবের মন্দ লাগে না।কয়েকটা নোট সামনে ফেললেই এদের সব তেজ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

তিনি দমলেন না।উল্টো কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,’ভা*র্জিন নাকি না?’

থতমত খায় নবনীতা।বিস্ফারিত চোখে সামনে দেখে।কি প্রশ্ন করল লোকটা এই মাত্র?নবনীতা কি ঠিক শুনেছে?প্রশ্ন শুনতেই চোখ জোড়া আপনাআপনি র*ক্তিম হলো তার।কেমন প্রশ্ন এটা?সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করে উঠে।চেঁচিয়ে জানতে চায় সে,’এটা কি ধরনের প্রশ্ন?কি ধরনের অসভ্যতা এগুলো?’

রশিদ সাহেব দাঁত বের করে হাসে।পূর্ণ দৃষ্টি মেলে নবনীতাকে এক নজর দেখে আমোদে গলায় বলে,’এতো রাগ হচ্ছো কেন?শুধু ছাত্রদের পড়ালেই হবে?মাঝে মাঝে আমাকেও খুশি করতে হবে না?’

রাশেদুল হক থামলেন।সামনে বসে থাকা মেয়েটার থমথমে রূপ তার বোধগম্য হচ্ছে না।সে এমন থম মেরে বসে আছে কেন?অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায় তরুণীটি।চোখ মুখ খিঁচিয়ে সশব্দে একটা চ’ড় বসায় রাশেদ সাহেবের গালে।স্তম্ভিত হয় রাশেদ সাহেব নিজেও।অবিশ্বাস্য চোখে গালে হাত রেখে সামনে দেখে।মেয়েটি তার গালে হাত তুলল?তারই কোচিং সেন্টারে এসে তাকেই চ’ড় মারল?

তিনি গালে হাত চেপেই চেঁচিয়ে উঠেন,’তোমার সাহস কতো! তুমি আমার গায়ে হাত তুলো! দুই টাকার মেয়ে হয়ে,,,,’

‘খবরদার! একদম জিভ টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলব যদি আমার নামে আর নোংরা কিছু বলেছেন তো।দুই টাকার মানে?আপনি আমার মূল্য ঠিক করার কে?চরিত্র*হীন কোথাকার! কোচিং সেন্টার খুলে এসব কাজ করেন?শিক্ষার মতো সুন্দর বিষয়টির সাথে নিজের সব নোংরামি জড়িয়ে রেখেছেন।অ’সভ্য একটা!’ দ্বিগুন শব্দে চেঁচিয়ে ওঠল সামনে থাকা মেয়েটি।মেয়েটির চোখে আ’গুন ছিল।কন্ঠে সীমাহীন তেজ ছিল।কথায় ছিল তলো’য়ারের ন্যায় ধাঁর।রাশেদ সাহেব সেই ধাঁরের কাছে দমে গেলেন।তোতলাতে তোতলাতে বললেন,’তোমার নামে আমি কেস করব বে’য়াদব মেয়ে।’

নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে ক্ষে’পাটে সুরে বলল,’আপনি কেন কেস করবেন?আমাকে বলেন,আমিই করে দিব কেস।লু’চ্চা ই’তর একটা।বুড়ো বয়সেও বদ’মাইশি শেষ হয় না।লাগবে না আপনার নোংরা কোচিং-এ চাকরি।আর পরের বার থেকে কথা বলার আগে এই চ’ড় টা মাথায় রাখবেন।যতোসব ফা’লতু আর ন’ষ্ট চিন্তাভাবনার মানুষ! নিজের নাই শিক্ষা,আবার এসেছে অন্যকে শিক্ষা দিতে।’

নবনীতা বেরিয়ে গেল হনহনিয়ে।যতটা বিনয় নিয়ে সে ভেতরে এসেছিল,ততটাই বিরক্তি আর রা’গ নিয়ে সে বের হলো।বের হতেই দরজার কাছে সেই মেয়েটির সাথে তার দেখা হলো।মেয়েটি জানতে চায়,’কি হয়েছে আপু?স্যার কি বলেছেন?’

নবনীতা চোখ গরম করে তাকে দেখল।তার চাহনিতেই মেয়েটা ভড়কে গেল।এতো রে’গে আছে কেন মেয়েটা?নবনীতা কোনো উত্তর না দিয়েই গটগট করে হেঁটে ভবন থেকে বেরিয়ে এলো।তার মুঠোফোন বাজছে।নিশ্চয়ই রিমির কল।কিন্তু সে আজ ফোন রিসিভ করবে না।কিসব ফালতু আর নষ্ট কোচিং সেন্টারের খোঁজ এনেছে গা’ধা টা! নবনীতার শরীর তখনও গিজগিজ করছিল রাগে।একটা চ’ড় কম হয়েছে।ঐ শয়’তান টাকে জুতো পে’টা করা উচিত ছিল।
.
.
.
.
আরহামের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হা’মলা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ’য় ভী’তি সঞ্চার করা।এতে করে তার দলের সমর্থন কমে যেত।মানুষ ভয়েই তার আয়োজন করা আর কোনো অনুষ্ঠানে আসত না।ফল সরূপ তার দল হালকা হয়ে যেত।রাকিবের পরিকল্পনা মূলত এমনই ছিল।

অথচ হলো হিতে বিপরীত।আপামর জনতার একটা বিশাল অংশ আরহামের প্রতি গভীর সহানুভূতি দেখাল।অল্প বয়সী একটা ছেলে নতুন নতুন নির্বাচন করছে।সে তো কেবল একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।অথচ এই অপ’রাধে তার উপর হামলা হলো,ছেলেটা গু’লি খেল।স্বাভাবিক ভাবেই জনগণের উপর এর একটা প্রভাব পড়ল।দেখা গেল একটা বিরাট সংখ্যার মানুষ আরহামের প্রতি দরদে গদো গদো হলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাকিবের কাজকর্মের জোরাল প্রতিবাদ করল।সংবাদ মাধ্যমে গুলোতে অগনিত আর্টিকেল ছাপা হলো।মোদ্দা কথা প্রতিটা বিষয়ই রাকিবের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াল।সে চেয়েছিল লোকজন যেন ভয়ে আর আরহামের কোনো সম্মেলনে না যায়।কিন্তু ঘটনা এই পর্যায়ে এসেছে যে লোকজন এখন আরহাম বলতে অ’জ্ঞান।

অতীত জিনিসটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।আরহামের অতীত ভালো।যোগ্য বাবার সন্তান সে।নিজের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও কোনো কেলে’ঙ্কারি তে জড়ায়নি সে।তার উপর তার বয়স অল্প।দেখতে নিরেট ভদ্রলোক।স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের একটা বিশেষ টান কাজ করে তার প্রতি।সেদিনের ঘটনার পর তর তর করে তার জনপ্রিয়তা বাড়ল।যে কখনোই তাকে চিনত না বা তার কথা জানত না সেও দেখা গেল তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার নিন্দা জানাল।আরহাম এমন একটা বাজি জিতে গেল যেই বাজি সে কোনোদিন লাগেই নি।

পরেরদিন বিকেলে সে হাঁটাচলা করতে পারছিল।ব্যথাটা কেবল একটা হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।বাকি শরীরে দুর্বলতা ছিল,কিন্তু যন্ত্র’ণা কমে গিয়েছিল অনেকটাই।জালালুর রহমান সাহেব প্রতিদিনই সময় করে তার কেবিনে আসতেন।সেদিন বিকেলে কেবিনে এসেই তিনি প্রশস্ত হাসলেন।আরহামের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,’কেমন আছ আব্বাজান?’

আরহাম হাসল।জড়ানো গলায় বলল,’একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি আঙ্কেল।তবে অথোরিটি রিলিজ দিচ্ছে না।বলছে আরো একদিন অবজারভেশনে রাখতে।’

জালালুর রহমান কেবিনের একপাশের কাউচে গিয়ে বসলেন।নিরুদ্বেগ হয়ে বললেন,’রাখুক না।সমস্যা কি?চিন্তা করো না।অলরেডি অর্ধেক নির্বাচন তুমি জিতে গেছ।’

আরহাম আশ্চর্য হলো।জিতে গেছ মানে?তার কোঁচকানো চোখ জোড়া দেখতেই জালাল সাহেব হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,’রাকিবের এই কাজের প্রচন্ড সমালোচনা হচ্ছে।লোকজন তার নিন্দা করছে।তোমাকে সবাই ভীষণ পছন্দ করছে আরহাম।বিগত একদিনেই বিশাল ফ্যান বেজ হয়েছে তোমার।তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না।কেবল নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত এই মানুষদের নিজে পক্ষে রাখবে।এমন কিছু করবে না যেন কেউ তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।গট ইট?’

আরহাম মাথা নাড়ে।তাকে ভাবুক দেখাচ্ছে ভীষণ।একটু সময় বাদে সে নিজ থেকেই বলল,’বুঝেছি।রাকিব আমাকে ভিক্টিম বানিয়েছে।আমি এখন নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ভিকটিমই থাকব।’

‘এক্স্যাক্টলি! এদেশের মানুষ আবেগে ধরাশায়ী হয়।তুমি নির্বাচন জিতবে সেই আবেগ কে পুঁজি করে।’

জালালুর রহমান থামলেন।কাউচ থেকে উঠে আরহামের মুখোমুখি এসে বললেন,’শোন আরহাম,কাল কিন্তু তোমাকে রিলিজ দেওয়ার পর হসপিটালের সামনে অনেক সাংবাদিক আসবে।অনেক রকম প্রশ্ন করা হবে।তুমি সবগুলো প্রশ্নের বিনয়ের সাথে উত্তর দিবে।কিছুতেই রাকিব কে নিয়ে কিংবা ফাহাদকে নিয়ে কটু কথা বলবে না।কেবল বলবে যে বা যারা এসব করেছে তাদের প্রতি তোমার কোনো রাগ নেই,কিন্তু ভবিষ্যতে যেন তোমাকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে এতো গুলো মানুষকে ঝুঁকিতে না ফেলে।মানুষ গুলোর তো কোন দোষ নেই।বুঝেছ?এই ভাবে গুছিয়ে কথা বলবে।একজন ভালো রাজনীতিবিদ কখনো অন্য কারো নাম নিয়ে কাঁদা ছো’ড়া’ছু’ড়ি করে না বুঝেছ?তুমি ওয়ান ম্যান আর্মি হবে।রাজনীতিতে একটা স্বতন্ত্র নাম হবে তোমার,যেমনটা তোমার বাবা জনাব আজিজ হোসেনের ছিল।তুমি কোনো সং’ঘাতে জড়াবে না কেমন?’

আরহাম বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল।কৃতজ্ঞতা সরূপ জালাল সাহেবের হাত মুঠ করে ধরল।নিরেট স্বরে বলল,’ধন্যবাদ আঙ্কেল।আপনার গাইডেন্স ছাড়া আমার পক্ষে এতটুকু আশা সম্ভব হতো না।’

বিনিময়ে জালাল সাহেবও স্মিত হেসে বললেন,’এতে এতো ধন্যবাদের কিছু নেই।আজিজ স্যারের হাতে আমার রাজনীতির হাতেখড়ি।তার ছেলেকে এই পথে সাহায্য করাও আমার সৌভাগ্য।’
.
.
.
.
‘হেই বাচ্চা! কেমন আছো?’

তাসনুভা ঘুম থেকে উঠেই হাত মুখ ধুয়ে করিডোরে এসেছিল।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন তার হুইল চেয়ার টেনে ধরল।তাসনুভা অবাক হয়ে পেছন ফিরে।আদি ভ্রু কপালে তুলে আবার জিজ্ঞেস করল,’হেই বাচ্চা কেমন আছো?’

তাসনুভা চোখ পাকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’তুমি কাল দেশে এসেছ।আর এতোক্ষণে জিজ্ঞেস করছ কেমন আছি?’

আদি ফিচেল হাসে।মাথা চুলকে বলে,’কাল তো সে সুযোগ ছিলই না।দৌঁড়াদৌড়ি তে সেসব মনে ছিল না।এখন মনে পড়েছে পিচ্চি টা কে তো জিজ্ঞেসই করা হয়নি সে কেমন আছে।বলো পিচ্চি কেমন আছো?’

তাসনুভা মিষ্টি হেসে বলল,’ফাইন।আই অ্যাম ভেরি ভেরি ফাইন।হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?’

আদিও তার মতো করেই জবাব দিলো,’আই অ্যাম ভেরি ভেরি ফাইন টু।’

কথা শেষ করেই সে তাসনুভার দিকে দেখে বলল,’নিচে নামবে নাকি?’

‘হু।আরিশ ভাইয়া কে ডেকে দাও তো।অথবা আফরোজা ফুফু কে।’

‘কাউকেই ডাকতে হবে না।আমি নামিয়ে দিচ্ছি।’ ভরাট গলায় জবাব দেয় আদি।

তাসনুভা কে নিয়ে নিচে নামার একটু বাদেই আরিশও নিচে নেমে এলো।আদির সাথে মুখোমুখি হতেই উৎফুল্ল হয়ে বলল,’গুড মর্নিং আদি ভাইয়া।’

‘গুড মর্নিং আরিশ।’

তিনজন খাবার টেবিলের সামনে আসতেই আফরোজা বেগম রান্নাঘর থেকে হটপট হাতে ছুটে এলেন।চেয়ার টানতে টানতে আহ্লাদী স্বরে বললেন,’বসো না,বসো না।দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

বলেই তিনি হটপট টা টেবিলে রেখে পুনরায় ছুটে গেলেন রান্না ঘরে।আদি কৌতূহলী হয়ে বলল,’ইনি কি তোদের সাথেই থাকে?’

তাসনুভা বিষন্ন মুখে জবাব দেয়,’হু।সাথে এনার মেয়েও থাকে।’

আদি মাথা নাড়ে।ফিসফিস করে বলে,’দেখে তো ভ’ন্ড মনে হচ্ছে।’

তাসনুভা চকিতে তার দিকে ফিরে।চোখ বড় বড় করে বলে,’কীভাবে বুঝলে তুমি?’

আদি টি-শার্টের কলার ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলল,’আমি সব বুঝি।আইনস্টাইন লেভেলের আই-কিউ আমার।’

তাসনুভা মুখ কালো করে বলল,’একটু আই-কিউ তোমার বন্ধু কেও দিও।সে যে কেন এদের বাড়িতে রেখেছে কে জানে! ভাইয়া যে কেন এদের ছলচা’তুরি ধরতে পারে না সেটাও বুঝি না।’

‘কারণ তোমার ভাই ত্যাড়ামি করতে ভালোবাসে।এছাড়া আর কোনো কারণ নেই।নিজেকে সব’জান্তা সর্ব’জ্ঞানী ভাবে তোমার ভাই।’

আরিশ মাথা নাড়ে।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,’তা অবশ্য ঠিক।সে যা ভাবে তাই করে।আমাদের কথা তো পাত্তাই দেয় না।’

তার কথা শেষ না হতেই ডাইনিং রুমে সারাহ এসে উপস্থিত হলো।তাকে দেখতেই তাসনুভা মুখ ভে’ঙচায়।বিড়বিড় করে বলে,’এসেছে আরেক ঢংগী!’

সারাহ টেবিলের কাছে আসতেই সবার আগে আদি কে দেখে।বাড়িতে নতুন কেউ এসেছে সেটা সে জানত না।আদি চোখ তুলে একবার তাকে দেখে পুনরায় খাবার খাওয়ায় মন দিলো।

সারাহ চেয়ার টেনে বসেই গলা ছেড়ে ডাকল,’মা নাস্তা দাও।বের হতে হবে আমার।’

‘তুই আবার কোথায় যাবি?’ সরু চোখে প্রশ্ন ছুড়ে আরিশ।

সারাহ মেকি হেসে জবাব দেয়,’ঐ তো।একটু কাজ আছে ভাইয়া।’

আফরোজা বেগম পরোটার প্লেট হাতে ডায়নিং রুমে এলেন।প্লেট টা সামনে রেখেই অন্যদিকে চলে গেলেন।আদি পরোটা ছিঁ’ড়ে মুখে দিতেই আরিশ পাশ থেকে বলল,’আজকের পরোটা টা খেতে বেশ ভালো হয়েছে তাই না?’

আদি দিরুক্তি করে।মাথা নেড়ে বলে,’উহু।এখানে পরোটার কোনো বিশেষত্ব নেই।সুন্দর মানুষের সামনে বসে যা কিছুই খাবে,সেটাই অমৃত মনে হবে।এটাই বাস্তব।সামনে সুন্দরী থাকলে যে কোনো রান্নার স্বাদই বহুগুন বেড়ে যায়।’

আদি থামল।চোখ তুলে দেখল সারাহ’র মুখটা খুশিতে গদো গদো হয়ে গেছে।সেই খুশির ঝিলিক তার সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।তাসনুভা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।আদি ভাইয়া ঐ চুর’নির সাথে এতো রসের আলাপ করছে কেন?

সারাহ দ্রুত আরেকটা পরোটা আদির প্লেটে তুলে দিয়ে ন্যাকা সুরে বলল,’নিন না ভাইয়া আরেকটা খান।খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে।’

আদি পরোটা টা না খেয়েই দ্বিগুন ন্যাকা স্বরে উত্তর দেয়,’উহু।বলার কিছু নেই।সুন্দর মানুষের হাত থেকে নেওয়া জিনিস সুস্বাদু হবে সেটা জানা কথা।না খেয়েই এই কথা বলে দিতে পারি আমি।’

সারাহ আবারও খুশিতে গদো গদো হয়।আদি আরেকটু পরোটা ছি’ড়ে মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,’যার হাত থেকে নেওয়া পরোটাই এতো মজা,তার হাতে বানানো বিরিয়ানি না জানি কতোটা ভালো হবে! হেই বিউটিফুল! তুমি বিরিয়ানি রান্না করতে পারো?’

সারাহ বিরিয়ানি রাঁধতে জানে না।তবে এতো এতো প্রশংসায় সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে জানায় সে রাঁধতে জানে।আদি মুচকি হাসল।বলল,’আজ একটু রেঁধে খাওয়াবে কি?’

এক কথাতেই রাজি হলো সারাহ।তাসনুভা গোল গোল চোখ করে তাকে দেখে।তার মুখটা সামনে এলেই তাসনুভার মেজাজ গরম হয়।আদি ভাইয়ের কি তার সাথেও আদিক্ষেতা করা লাগে?

সারাহ খাওয়া শেষেই কিচেনে ছুটল।সে আজ বিরিয়ানি রান্না করবে।সে যেতেই আদি শব্দ করে হেসে উঠল।আরিশ অবাক হয়ে বলল,’তোমার ফ্লার্ট করার স্বভাব আর গেল না তাই না?’

আদি তার কাঁধ চাপড়ে চঞ্চল হয়ে বলে,’না ভাই।এখনো সেই স্কিল ধরে রেখেছি।আরহাম রাজনীতি করে,ওয়াজিদ সোশ্যাল এক্টিভিটিজ এর সাথে যুক্ত।আর আমি এখনো সেই রোমিও গিরিই করে যাচ্ছি।

আরিশ খেতে খেতে বলল,’তোমার স্কিল সেই আগের মতোই আছে।এমন ভাবে বলো যে মেয়েরা এক কথাতেই কাবু।’

তাসনুভা খাওয়া থামিয়ে মুখ কালো করে বলল,’সেজন্য এই চুর’নি সারাহ-র সাথেও এসব করতে হবে?’

আদি ঘাড় ঘুরায়।তাসনুভার মলিন মুখটা দেখেই কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,’এ্যাই বাচ্চা,তুমি রাগ করেছ?ভাইয়া কিন্তু জাস্ট মজা করেছি।’

‘ঐ সারাহ-র সাথে মজা করার কি আছে?ভালো লাগে না আমার তাকে।’

আদি গালের নিচে হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে তার মুখটা দেখল।দু’জনে চোখাচোখি হতেই সে দুই হাত কানে চেপে ব্যস্ত হয়ে বলল,’আচ্ছা আচ্ছা সরি।আর কখনো এমন মজা করব না।রাগ করে না বাচ্চা।তুমি না ভালো বাচ্চা?হু?’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৩

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৩)

আরহাম তার শক্তপোক্ত শরীরের ভার নবনীতার উপর ছেড়ে দিয়েই দু’চোখ বুজে নিল।তার ইন্দ্রিয় সমূহ অবশ হয়ে যাচ্ছে।নবনীতা পাশ ফিরে একবার তাকে দেখল।কম্পমান হাতটা কোনোরকমে তার গালে ছোঁয়াল।কাঁপা কন্ঠে বলল,’আরহাম প্লিজ এভাবে চোখ বন্ধ করবেন না।আপনার নার্ভস গুলোকে সচল রাখুন।আরহাম! কথা শুনতে পাচ্ছেন তো আমার?’

আরহাম চোখ বুজেই অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলল।নবনীতা তার কিছুই শুনল না।চারদিকে গো’লাগু’লির বিকট শব্দ।টিয়ার’শেলের ধোঁয়ায় চারদিক ঘোলাটে।নবনীতা সেসব নিয়ে ভয় পাচ্ছে না।নিজেকে নিয়ে সে কবেই বা ভয় পায়?কিন্তু এই যে তার কাঁধে মাথা রাখা যুবকটা,যার হাতে সে কিছু সময় আগেই গুলি খেয়েছে,তার জন্য নবনীতার চিন্তা হয়।

তাকে নবনীতার ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ না।শুধু সে না,যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই নবনীতার পছন্দ না।কিন্তু ছেলেটা নিশ্চয়ই এমন কোনো অপরাধ করেনি যার জন্য তার গু*লি খেতে হবে?
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।প্রতি*হিংসার এই নোংরা রাজনীতির শেষ কোথায়?

মিনিট দু’য়েক বাদে ফেরারি’র একটা লেটেস্ট মডেলের গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল।গাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ওয়াজিদ।ছুটে গেল তাদের দিকে।সে গিয়েছিল ফার্মগেট,ছোট্ট একটা কাজে।এরই মাঝে এতো কিছু ঘটে গেছে।ওয়াজিদ কাছে আসতেই আরহামের হাত দেখে আঁ’তকে উঠে।ব্যস্ত হয়ে বলে,’মাই গড! কিভাবে হয়েছে এসব?আরহাম! এ্যাই আরহাম!’

নবনীতা বিরস মুখে জবাব দেয়,’সেন্স নেই।আপনি দয়া করে উনাকে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে নিন।’

মাথা নাড়ল ওয়াজিদ।শক্ত করে আরহামের একহাত চেপে ধরে বলল,’জ্বী।ওকে আমার গাড়িতে করে নিয়ে যাব।’

দূর থেকে তোফায়েলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।সে কাছে এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’দলের আরো কয়েকটা ছেলেও গুলি খেয়েছে।তাদের সবাইকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।’
নবনীতা আরহামকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।ওয়াজিদ আর তোফায়েল মিলে ধরাধরি করে তাকে গাড়িতে তোলে।নবনীতা নিঃশব্দে দু’কদম পিছিয়ে যায়।তোফায়েল দ্রুত ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসল।ওয়াজিদ পেছন ফিরে নবনীতাকে দেখতেই শীতল কন্ঠে বলল,’চারপাশের অবস্থা ভালো না নবনীতা।আপনি কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে একটা সেইফ জায়গা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি।আপনি কি কষ্ট করে গাড়িতে উঠে বসবেন?’

নবনীতা বিচলিত বোধ করল।ওয়াজিদ ভুল কিছু বলেনি।কিন্তু তার গাড়িতে চড়তেও নবনীতার সংকোচ কাজ করবে।কিন্তু কিছু তো করার নেই আর।সে কয়েক পল চুপ থেকে ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির সামনে এলো।কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ঠিক আরহামের মাথার কাছটায় গিয়ে বসল।ওয়াজিদ গাড়ি লক করে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখে।কালো রঙের গাড়িটি চলতে শুরু করে।

নবনীতা একটু হাঁফ ছেড়ে ডানদিক ফিরল।আরহাম কে দেখতেই পুনরায় এক হাত বাড়িয়ে আরহামের ক্ষ’তস্থানে সেটা চেপে ধরল।তার হাত কাঁপছে।কিন্তু সে আজ ভয় পাবে না বলে পণ করেছে।

ত্রিশোর্ধ যুবকের মাথা গাড়ির সিটে কেমন অবহেলায় পড়েছিল।নবনীতার দেখতেই মায়া হলো।নিশ্চয়ই লোকটা কষ্ট পাচ্ছে।গু’লি খাওয়ার পর শরীরে কম যন্ত্রণা হওয়ার কথা না।

নবনীতা দুই দিক দেখে বড় করে শ্বাস নেয়।মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।একটু এগিয়ে এসে আলতো হাতে আরহামের মাথা টা ফোমের সিট থেকে তুলে তার কোলে রাখে।নিজের কাজে নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করে সে।নিজের এতো কাছাকাছি কোনো পুরুষের অস্তিত্ব বুকের ভেতর কেমন অ’সহ্যকর অনুভূতি সৃষ্টি করে।সে তো লোকটিকে পছন্দ করে না।কিন্তু তার স্বভাবসুলভ কোমল হৃদয় কারো করুণ দশা সইতে পারে না।সে একহাত আরহামের বাহুতে আর এক হাত তার মাথায় রাখে।চোখ বুজে একটানা দোয়া ইউনুস পাঠ করে।মনে মনে বলে,’আল্লাহ! তুমি তাকে শেফা দান করো।’

আধঘন্টা পর ওয়াজিদের গাড়ি বার্ডেম হসপিটালের সামনে এসে পৌঁছায়।সে আগে থেকেই অথোরিটি কে জানিয়ে রেখেছিল,তাই তারা স্ট্রেচার নিয়েই রেডি ছিল।আরহামকে হসপিটালাইজ করার পর সব ফর্মালিটি শেষ করে ওয়াজিদ ভঙ্গুর পায়ে করিডোরের সিটে এসে বসে।নবনীতা দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণায়।ওয়াজিদ যদিও তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত ড্রপ করে আসতে চেয়েছিল,সে জানিয়েছে তার কোনো প্রয়োজন নেই,সে নিজেই চলে যেতে পারবে।কিছু সময় যেতেই সে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে ডাকল,’ভাইয়া!’

মাথা তুলল ওয়াজিদ।তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি অনুসরণ করে নবনীতা জবাব দেয়,’ভাইয়া আমি এখন আসি?’

‘হুম।আসো।’

‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’

আর কথা বাড়ায় না সে।মাথা নিচু করে শম্বুক গতিতে বেরিয়ে আসে জনমানবপূর্ণ হসপিটাল থেকে।

নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ায় ওয়াজিদ।এগিয়ে যায় হাসপাতালের একেবারে সামনে কাঁচের থাই গ্লাসের দিকে।দৃষ্টি রাখে বাইরের দিকে।দুই মিনিট গড়াতেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে একজন তরুণী।বের হতেই চলার গতি বাড়ায় সে।ওয়াজিদ ডান হাত তুলে কাঁচের গ্লাসে তার প্রতিবিম্ব ছুঁয়ে দেয়।ঠোঁটে ফুটে ওঠে অস্পষ্ট হাসি,পরক্ষণেই আবার সেই হাসি মিলিয়ে যায়।নীল শাড়ি জড়ানো নীলাঞ্জনা এতো চমৎকার কেন?তার ভেতর যেই স্বচ্ছ হৃদয় আছে,সেই হৃদয়ের প্রশংসা কেমন করে করবে ওয়াজিদ?

তেইশোর্ধ তরুণী সময়ের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।ওয়াজিদ নিরবে হেঁটে তার আগের জায়গায় গিয়ে বসে।আরহাম হাতে গু*লি খেয়েছে।প্রা’ণনা’শের আশঙ্কা নেই।কিন্তু যদি সুস্থ হতে খুব বেশিদিন লেগে যায়?এই সময়ে তো প্রতিটা সেকেন্ড তার জন্য মূল্যবান।ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে নেয়।দুশ্চিন্তারা যেন পিছুই ছাড়ছে না।
.
.
.
.
কাগজপত্রের ঝুট ঝামেলা সামলে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখতেই সূর্যের প্রখর তাপে কপাল কুঁচকায় আদি।গলার কাছে ঝুলানো সানগ্লাসটা চোখে পড়েই বিরক্ত হয়ে বলে,’বাপরে বাপ! বাংলাদেশ কি দুবাই হয়ে গেল নাকি?এতো গরম কেন?’

সে দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে আরহামের নম্বরে ডায়াল করে।যতবারই ফোন দিচ্ছে ততবারই রোবটির সুরে নারী কন্ঠটি বলে উঠছে,’দুঃখীত! আপনার ডায়ালকৃত নম্বরে ই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’।
আদি কান থেকে ফোন সরিয়ে বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলে উঠল,’ধুর বা*ল! শা’লা ঢাক ঢোল বাজিয়ে দাওয়াত দিয়ে এখন নিজেই আর ফোন ধরে না।’

আরহামকে না পেয়ে আদি ওয়াজিদের নম্বরে ডায়াল করে।পঞ্চম বার রিং হতেই ওয়াজিদ কলটা রিসিভ করল।সে কিছু বলার আগেই আদি চটে যাওয়া মেজাজে বলল,’কিরে ভাই! দেশে আয়,দেশে আয় বলে মা’থা খে’য়েছিস।এখন দেশে আসতেই আর কোনো পাত্তা নেই?’

অন্য পাশ থেকে কি জবাব এলো জানা নেই কিন্তু জবাব শুনতেই আদি ভড়কে গিয়ে বলল,’কি?কি বলিস ওয়াজিদ?কখন হলো এসব?কিভাবে হলো?মাই গড! আর ইউ সিরিয়াস?’
.
.
.
.
রিমি দের বাড়ি গিয়ে চিত্রাকে নিয়ে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না নবনীতা।রিমি যদিও তাকে বলছিল একটু বিশ্রাম করে যেতে কিন্তু নবনীতা সে কথা শুনেনি।তার মাথা ঘুরছে।বাড়ি গিয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমুতে হবে।

চিত্রাকে নিয়ে বাড়ি আসতেই নবনীতা টের পেল বাড়ির পরিবেশ আজ থমথমে।মামি কেমন থম মেরে বসে আছে।মুখটা গোমড়া।নবনীতা চুপচাপ তার ঘরে গেল।তাকে দেখতেই শুভ্রা এগিয়ে এলো।নবনীতা তার কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণ স্বরে জানকে চায়,’খেয়েছিস শুভি?’

শুভ্রা কেবল অসহায় চোখে ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।মুখ কালো করে বলে,’আজ নাকি রান্না হয়নি।’

নবনীতা এক হাত মাথায় চেপে খাটের ধাঁর ঘেঁষে বসল।ক্লান্ত স্বরে জানতে চাইল,’কেন?কারণ টা কি?’

‘প্রথা আজ বাড়ি এসে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করেছে।মামার পেনশনের টাকা টা যেন ব্যাংক থেকে তুলে তাকে দিয়ে দেয়।সে নাকি কিসব বিজনেস করবে।ক্যারিয়ার গোছাবে।’

‘সে ক্যারিয়ার গোছাবে?তার মধ্যে সেই তাড়না আছে?’ তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে জানতে চায় নবনীতা।

শুভ্রা নিচু স্বরে বলে,’ঐ আরকি! টাকা নিয়ে খুব চিল্লাফাল্লা করেছে।মামিও এটা সেটা বলেছে।’

‘মামি কার পক্ষে?প্রথা না মামা?’ চোখ সরু করে জানতে চায় নবনীতা।

‘প্রথার পক্ষে।বলছিল যে প্রথা বড় হয়েছে।এখন তো তার ভবিষ্যৎ তাকেই গোছাতে হবে।টাকা পয়সা তো সব তার জন্যই।হেন তেন কতো কিছু।’

জবাবে নবনীতা কেমন মাথা নিচু করে হাসল।তারপর তার ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট টা বের করে শুভ্রার হাতে তুলে দিলো।অফিস রুমে যাওয়ার আগে সে রিমির কাছে তার ব্যাগটা রেখে গিয়েছিল।এতো কিছুর মাঝেও রিমি সেটা হাতছাড়া করেনি।

শুভ্রা প্যাকেট হাতে নিয়েই বলল,’তুমিও এতোক্ষণ না খেয়ে আছো আপাই?এটা নিশ্চয়ই তোমাকে দিয়েছিল খেতে।’

নবনীতা দু’হাত খাটে রেখে মাথাটা আস্তে করে পেছনের দিকে এলিয়ে দেয়।বিবশ কন্ঠে বলে,’হুম।খাইনি।তুই একটা প্লেটে নিয়ে নিজে খেয়ে আমাকেও একটু খাইয়ে দে তো শুভি।’

শুভ্রানী তার কথা মতোই প্লেট এনে নিজে খাওয়ার ফাঁকে তাকে খাইয়ে দিলো।চিত্রা বাড়ি ফিরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।খাওয়া শেষে নবনীতাও শাড়ি পরা অবস্থা তেই বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে।ভেতর টা কেমন অস্থির লাগছে।হাত টা এখনো কাঁপছে।কে জানে লোকটার জ্ঞান ফিরেছে নাকি?

নবনীতা চোখ বুজতেই শত রকম দুশ্চিন্তা এসে তার মস্তিষ্কে হানা দিলো।সে মনে করার চেষ্টা করে ঘটনাস্থলে সে সময় কোনো সাংবাদিক ছিল কি?সে খুব করে চাইছে তার আর আরহামের কোনো ফুটেজ যেন মিডিয়ার হাতে না যায়।সে এই লাইট ক্যামেরার জগৎ থেকে দূরে থাকতে চায়।সে চায় না আর কোনো নতুন সমস্যায় জড়াতে,চায় না অন্য কোনো নাম কিংবা অন্য কোনো বিশেষণ এসে তার পাশে যুক্ত হোক।সে চায় নির্ঝঞ্ঝাট সাদামাটা জীবন।সেই জীবনে সে কিছুতেই লেমলাইটে আসতে চায় না,হতে চায় না আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।কি অ’সহ্যকর একটা সময় পার করছে সে!
.
.
.
.
আরহামেন জ্ঞান ফিরেছে কিছু সময় আগে।হাসপাতালের করিডোরে তার দলের ছেলেদের ভীড়।তাদের গুঞ্জন আর কোলাহলে তৃতীয় তালার পরিবেশ ভারি হয়ে যাচ্ছিল।

জ্ঞান ফিরতেই আরহাম সবার প্রথমে ওয়াজিদ কে দেখল।তার নিষ্প্রাণ চোখ জোড়া দেখতেই ওয়াজিদ মলিন হেসে বলল,’শা’লা পাক্কা রাজনীতিবিদ হয়েছিস দেখছি।ছু*রি চা*কু না,সোজা একদম গু*লি খেয়ে ফেলেছিস।’

কথার পিঠে আরহাম নিজেও হাসল।শরীরটা দুর্বল লাগছে।হাতে গু*লি খে’লেও ব্যথা সমস্ত শরীরেই হচ্ছে।আরহাম যন্ত্রনায় কা*তর হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সে নড়েচড়ে উঠে।চঞ্চল চোখে কেবিনের এদিক ওদিক দেখে।চোখ জোড়া ব্যস্ত হয় একটি স্বল্প পরিচিত মুখ দেখার আশায়।ওয়াজিদ জানতে চায়,’কাকে খুঁজিস আরহাম?’

উত্তর দেয় না সে।উত্তর দিতে তার অস্বস্তি হচ্ছে।শেষমেশ এক প্রকার বাধ্য হয়ে সে মিনমিনে স্বরে বলে,’সে কোথায়?’

‘সে টা কে? ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো ওয়াজিদ।

আরহাম পড়েছে মহা বিপাকে।কি জবাব দিবে সে?তার জবাবে ওয়াজিদ তাকে ক্ষেপাবে না তো?সে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,’ঐ নবনীতা আরকি।সে কোথায়?’

‘ওহহ সে! সে তো তোকে এডমিট করার পর পরই চলে গেছে।আমাকে অবশ্য বলেই গেছে।আমি ভাবলাম হয়তো তাড়া আছে।তাই বলেছি চলে যেতে।ঠিক করেছি না বল?’

অপরপাশের ব্যক্তিটি নিশ্চুপ থাকে কিছু সময়।শেষটায় তপ্ত শ্বাস ছেড়ে জানায়,’হু,ঠিকই করেছিস’

‘এসব কি ভাই?আমাকে পুরো শহর ঘুরাবি বলে দেশে এনে নিজেই গু*লি খে’য়ে হসপিটালে পড়ে আছিস!’ কেবিনের দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে মজার ছলে প্রশ্ন করে আদি।

তাকে দেখতেই মুখোভঙ্গি পাল্টে যায় আরহামে।চোখ দু’টো আনন্দে চকমক করে উঠে।এক লাফে উঠে বসার চেষ্টা করে সে।ওয়াজিদ আলতো করে তার কাঁধ চেপে ধ’মক দেয়,’পা*গল নাকি?চুপচাপ শুয়ে থাক।’

আদি নিজ থেকেই ভেতরে এলো।সে কাছে আসতেই আরহাম উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,’আদি! তুই! ফাইনালি দেশে এসেছিস তুই।’

‘হু ভাই।হাতে এবার বিশাল সময় নিয়ে এসেছি।তোর নির্বাচন,বিয়ে,বাচ্চা সবকিছু হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশেই আছি।’

আরহাম হাসল।চোখ ঘুরিয়ে ওয়াজিদ কে দেখে বলল,’আমার আগে তো ওয়াজিদের বিয়ে হবে।আমরা মাথা*গরম মানুষ।আমাদের বউ হবে কে?ওয়াজিদ তো মেয়েদের সেই সো কল্ড গ্রিন ফ্ল্যাগ।দেখবি ক’দিন বাদেই মেয়েরা সব হুম’ড়ি খেয়ে পড়বে।’

ওয়াজিদ আড়চোখে একবার তাকে দেখে।এটা যে প্রশংসার আড়ালে খোঁচা সে ভালো করেই জানে।আদি হাই তুলতে তুলতে বলল,’ঘুমে চোখ ভে’ঙে যাচ্ছে ভাই।’

আরহাম সরু চোখে শুধায়,’কেন?বাড়ি যাসনি এখনো?’

‘আর কোথায়?আরিশ আর তাসনুভা এসেছিল।তাদের গাড়ির সাথে লাগেজ দু’টো পাঠিয়ে দিয়েছি।আসার পর থেকে এই হসপিটালেই ঘুরপাক খাচ্ছি।’

‘আরিশ আর তাসনুভা এসেছে?’ অবাক হয়ে জানতে চায় আরহাম।

‘অবশ্যই এসেছে।এখনো আছে,ওয়েটিং রুমে।’

আরহাম দুই দিকে মাথা নাড়ে।হতাশ ভঙ্গিতে বলে,’কি যে করে না ছেলে মেয়ে দুইটা! দেখি একটু ডেকে দে তো।দেখা করে বাড়ি যাক।তাসনুভার তো রাতে আগে আগে ঘুমুতে হয়।’

তাসনুভা আর আরিশ কেবিনে আসতেই আরহাম মলিন হাসল।তার এই জীর্ন রূপ থেকেই তাসনুভা ঠোঁট ভে’ঙে কেঁদে দিলো।সে আগেও কয়েক দফা কেঁদেছে।আরহাম মুচকি হেসে তার মাথায় হাত ছোঁয়ায়।মিছেমিছি ধ’মক দিয়ে বলে,একদম মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি না তো তাস! অসহ্য লাগে।’

তাসনুভা কান্না থামালো।কিন্তু থেমে থেমে আবার ফুপিয়ে উঠছিল।আরহাম হাসপাতালের বেডের সাথে হেলান দিয়ে বলল,’বুঝলিরে তাস,আমি অনেক বড় মাপের রাজনীতিবিদ হয়ে গেছি।শত্র*তার বশে কেউ আমাকে গু*লি করতে পারে সেটা তো আমি ভাবতেই পারিনি।মন্দ না ব্যাপারটা।নিজেকে খুব উঁচু মানের মানুষ মনে হচ্ছে।’

তাসনুভা আর আরিশ আরো কিছুক্ষণ ছিল।পরে রাত হয়ে যাওয়ায় তারা দু’জন বাড়ি ফিরে গেল।তাদের সাথে আদিও বাড়ি গেল।বেচারা একটানা জার্নি করে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকুও পায় নি।তারা যাওয়ার পর আরহামের দলের ছেলেরা একবার একবার করে একনজর তাকে দেখে গেল।আরহাম কেবল স্মিত হেসে বলল,’একদম ভালো আছি।কালকেই ডিসচার্জ হয়ে বাড়ি ফিরব।’

ওয়াজিদ আড়চোখে তাকে দেখে পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়।বিড়বিড় করে বলে,’এসেছে আমার ডাক্তার! নিজে নিজে ঘোষণা দিচ্ছে কবে তার ডিসচার্জ হবে।যত্তসব!’

আরহাম তাকে দেখে সন্দিহান চোখে বলল,’কি রে?তুই যাবি না?’

‘নাহ,রাতটা এখানেই আছি।’ গম্ভীর মুখে জবাব দেয় ওয়াজিদ।

এতো এতো শারীরিক যন্ত্রণার মাঝেও আরহাম শব্দ করে হাসল।একহাত বাড়িয়ে ওয়াজিদের পিঠ চাপড়ে বলল,’ওয়াজিদ! বন্ধু তুই আমার,বাপ না।’

ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার কাঁধ ছাড়িয়ে নিল।বিরক্ত মুখে বলল,’বাজে বকিস না তো।ভালো লাগছে না।’

আরহাম চুপ থাকল কিছুক্ষণ।স্থির চোখে সামনে বসা ছেলেটা কে দেখল।তারপরই এক গাল হেসে বলল,’লাভ ইউ ম্যান।তোর মতো করে কেউ আমার কথা ভাবে না।’

ওয়াজিদ শুধু মাথা নামিয়ে মুচকি হাসে।কোমল এবং নিচু স্বরে বলে,’তোর মতো অবুঝপনাও কেউ করে না আরহাম।’

ওয়াজিদ বেডে পাশের টুল থেকে উঠে কেবিনের এক পাশের কাউচে গিয়ে শোয়।ঘাড় ঘুরিয়ে আরহাম কে দেখে বলে,’ঘুমিয়ে যা আরহাম।একটু ঘুমালে শরীরটা ভালো লাগবে।’

আরহাম ঘুমানোর চেষ্টা করল।অক্ষ’ত হাতটা গালের নিচে রেখে আস্তে করে চোখ বুজল।চোখ বুজতেই বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে ওঠে একেবারে অন্যরকম এবং অপ্রত্যাশিত একটি দৃশ্য।

আরহামের শক্ত পোক্ত শরীরটা এক আ’ঘাতেই তাল হারিয়ে ক্যাম্পাসের মাটিতে লু’টিয়ে পড়েছে।ঘটনার আকস্মিকতার সে একেবারে বিস্মিত,বাকরুদ্ধ।কেবল টের পেল গু*লিটা তার বাহু ছে’দ করে গিয়েছে।চারদিকে লোকজনের ছুটোছুটির শব্দ।সবাই নিরাপদ জায়গার খোঁজে ছুটছে।জীবন বাঁচানো ফরজ।আরহাম তো এখানে ভুল কিছু দেখে না।এরই মাঝে বুজে আসা চোখে সে দেখল তার থেকে কয়েক হাত দূরে একটি নারী কায়ার উপস্থিতি।অকস্মাৎ শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে।তার চোখেও একই রকম বিস্ময়।যেন সে মানতে পারছে না এই জায়গায় আরহাম আছে।

আর তারপর?নীল শাড়ি গায়ে জড়ানো নীলিমা কি জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে পালিয়ে গিয়েছিল বাকিদের মতো?সে কি বাকি মেয়েদের মতো চিৎকার করে উঠেছিল?
নাহ,নীলিমা পালায়নি।কিছু সময় থমকে ছিল অবশ্য।তারপরই সম্বিৎ ফিরে পেতে একদৌঁড়ে ছুটে এসেছিল আরহামের কাছে।সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চে’পে ধরেছিল আরহামের ক্ষ’তস্থান।একদম অপছন্দের মানুষটি কে বাঁচানোর জন্য তার সে কি ব্যকুলতা! চটচটে র*ক্ত দেখতেই সে কেমন মিইয়ে গেল।কিন্তু হাত ছাড়ল না।আগলে ধরল গু*লিবি*দ্ধ শরীরটাকে।কথায় কথায় চোখ মুখ শক্ত করে ফেলা মেয়েটা ঐরকম পরিস্থিতিতেও ধ’মকে উঠল।মনে হলো যেন আদেশ করছে ‘চোখ বন্ধ করতে মানা করেছি না?’

আরহাম দ্রুত চোখ খুলে।বেডসাইড টেবিলে পানির বোতল রাখা ছিল।সে এক হাতে কোনোরকম সেটা খুলে কয়েক ঢোক পানি খেল।তারপর আবার চোখ বুঝল।এবার তার বন্ধ চোখ স্মরণ করল অপ্সরীর ন্যায় দেখতে একটি মুখ।যদিও দীর্ঘদিনের অবহেলায় তার মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ পড়েছে,চোখের নিচে একটু আধটু কালি জমেছে,সুন্দর মুখটা হয়তো দায়িত্বের জাঁ’তাকলে পি’ষে নিজের লাবন্য হারিয়েছে কিছুটা,কিন্তু যেই অপার্থিব সৌন্দর্যে স্রষ্টা তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন,সেই সৌন্দর্য কি একটুও মলিন হয়েছে?হয়নি তো।আরহাম তো খুব কাছ থেকে সেই সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করেছে।

অকস্মাৎ চোখ খুলে আরহাম।নিজের অবচেতন মনের কার্যকলাপে নিজেই ভীষণ বিরক্ত হয়।এসব কেমন আচরণ?সে এতো কেন ভাবছে মেয়েটি সে নিয়ে?কে ঐ মেয়ে?সাহায্য করেছে এজন্য আরহাম তার কাছে কৃতজ্ঞ।এই তো।আর তো কিছু ভাবার নেই তাকে নিয়ে।

কিন্তু মনের উপর কবেই বা কোনো ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ছিল?সে তো ভেবে যায় নিজের মতোন করে,সকল বাস্তব অবাস্তবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।বার বার মনে হয় সে তো চলে গেলেও পারতো।কিন্তু সে যায়নি।কেন যায় নি?কেনো এতোখানি সহানুভূতি দেখাল?সে তো আরহামের কাছের কেউ না।

আরহাম রাতভর ছটফট করে।তার জেদ হচ্ছে,রাগ হচ্ছে।এতো এতো গন্ড*গোলেও যখন নিজের বিপদের চিন্তা না করে আরহামের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছিল,তখন আরো কিছু সময় অপেক্ষা করে আরহামের জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না কেন?এতো কিসের তাড়া তার?

নিজের গালে নিজেই চড় মা’রে সে।বিড়বিড় করে কতোক্ষণ নিজেকেই আচ্ছা মতোন বকু’নি দেয়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’বা*লের সাবকনশাস মাইন্ড! ঘুমা আরহাম ঘুমা।তোর মতিভ্রম হচ্ছে।পটাপট ঘুমিয়ে যা।সকালে উঠতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১২

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
কলমে #মেহরিমা_আফরিন

(১২)

“আপাই এই লাল শাড়িটা পরে দেখো না,ভীষণ মানাবে তোমায়।নতুন বউয়ের মতো দেখাবে একদম।”

শুভ্রানী আলমারির তাক থেকে গাঢ় লাল শাড়িটা বের করে নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা চোখ কপালে তুলে বলল,’ধ্যাত।এটা কেমন কড়া রং।আমি কি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি?’

শুভ্রানী বিরক্ত হয়ে আলমারি ঘেটে আরো একটা শাড়ি বের করল।গাঢ় নীল রঙের শাড়ি,ধূসর পাড়।সেটা নেড়ে চেড়ে সে বলল,’তাহলে এটা পরো।সুন্দর লাগবে তোমায়।’

নবনীতা চোখ রাঙিয়ে একটানে তার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে ঈষৎ ধ’মকে উঠে বলল,’আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।তুই যা,পড়তে বস গিয়ে।’

শুভ্রা কাচুমাচু মুখ করে বলল,’এমন করো কেন আপাই?এটা তো সত্যি অনেক সুন্দর।এ্যাই চিত্র! বল তো এই শাড়িটা খুব সুন্দর না?’

চিত্রা একনজর শাড়িটা দেখে ঠোঁট গোল করে বলল,’খুব’

নবনীতা জহুরি চোখে ধূসর পাড়ের গাঢ় নীল শাড়িটা দেখল।এটা কি কালচারাল ফেস্ট হিসেবে বেশি চকমকে দেখাচ্ছে?তার মস্তিষ্ক জবাব দেয়,’এটাতে অতো কাজ নেই নবনী,এটাই পরে নে।’
নবনীতা শাড়িটা হাতে নিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।ক্লান্ত স্বরে বলল,’শাড়ি সামলাতে ভীষণ কষ্ট হয় রে শুভি! সেজন্য পরতে চাই না।’

‘অথচ শাড়িতে তোমায় খুব ভালো লাগে আপাই! তুমি অতো ভেবো না তো,আমি সুন্দর করে পিন আপ করে দিবো।তুমি চটপট পরে নাও এটা।’

নবনীতা নির্বিকার ভঙ্গিতে শাড়ির ভাজ খুলে আরো একবার সেটা দেখল।আজ তাপমাত্রা কতো?এই গরমে সে শাড়ি পরে টিকবে কেমন করে?সে জানালার ধাঁরে গিয়ে বাইরে উঁকি দেয়।ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে বলে,’বাপরে! কি ভ্যাপসা গরম পড়েছে দেখেছিস?’

শুভ্রানী ঠিক পাখার নিচ বরাবর বসে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,’ভ্যাপসা গরমের পর প্রচন্ড বৃষ্টি হয়।আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে।চট্টগ্রামে কালকে সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে।’

নবনীতা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে অলস ভঙ্গিতে বলল,’ইশশ! কোথায় চট্টগ্রামের আবহাওয়া,আর কোথায় এই ঢাকার আবহাওয়া! কয়দিন পর দেখবি ঢাকায় উট চলছে।’

শুভ্রা মুখ টিপে হাসে।আপাইের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।গরমে অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।নবনীতা এগিয়ে এসে শাড়িটা শুভ্রার হাতে ধরিয়ে বলল,’পুরোটা তুই পরাবি।আমি পরতে পারব না।আলসেমি লাগছে।’

শুভ্রা এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করল।শাড়ি পরতে আর পরাতে,দু’টোই শুভ্রার ভীষণ ভালো লাগে।সে মিনিট দশেকের মাথায় খুব সুন্দর করে নবনীতাকে শাড়ি পরালো।সেফটিপিন দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাকও করে দিলো।শাড়ির আঁচল টা ফেললো নবনীতার হাতের উপর।নবনীতা চোখ সরু করে বলল,’এভাবেই থাকবে?কাঁধে তুলবি না?’

‘না না।ওভাবে ভালো লাগে না।এটাই সুন্দর।’ তাড়াহুড়ো করে জবাব দেয় শুভ্রানী।
নবনীতা চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পরে আর বলল না।আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে।নাহ,তাকে একদমই মন্দ দেখাচ্ছে না।

শুভ্রানী তাকে শাড়ি পরানোর পর চিত্রাকেও খুব সুন্দর একটা জামা পরিয়ে দিলো।চিত্রার জামার রং ও নীল।নবনীতা পেছন ঘুরে তার জামাটা না দেখেই বলল,”আরামের জামা পরিয়েছিস তো?খুব গরম কিন্তু বাইরে।অতো ভারি কিছু পরাস না কিন্তু।”

শুভ্রা চিত্রার চুল বাঁধার ফাঁকে জবাব দেয়,”একদম নরম জামা! কোনো সমস্যা হবে না।”

নবনীতা আয়নার সামনে দাঁড়ায়।শাড়ির সাথে সামান্য সাজলে মন্দ হয় না।সমস্যা হচ্ছে তার কাছে অতো শত সাজের জিনিস নেই।দুইটা লিপস্টিক,ভ্যাসলিন,কাজল আর পাউডার-প্রসাধনী বলতে নবনীতার ছোট্ট ঘরে এগুলোই আছে।

নবনীতা কাজল হাতে নিয়েই আবার কি মনে করে সেটা রেখে দিলো।দ্রুত তার ফোনটা হাতে নিয়ে রিমিকে কল দিলো।রিসিভ হতেই দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ল,”রিমি রে! তুই কি কাজল দিবি?”

অন্যপাশ থেকে রিমি আশ্চর্য হয়ে জবাব দেয়,’অদ্ভুত প্রশ্ন করছিস নবনী! কালচারাল ফেস্ট! শুধু কাজল কেন,ঘরে যা আছে সব মেখে আসবো।’

নবনীতা জবাবে কেবল হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’

‘তুই রেডি?’

‘হু।তুই?’

‘এই তো।এখনই বের হবো।’

‘আমিও।’

নবনীতা কথা শেষ করে ফোন কা’টে।শুভ্রা এগিয়ে এসে বলল,’আপাই তোমার চুলে একটা খোপা করে দেই সুন্দর করে?’

নবনীতা ভ্র কুঁচকে জানতে চায়,’খোপা আবার সুন্দর করে কীভাবে করে?খোপা তো খোপাই।’

শুভ্রা তার কাঁধে হাত চেপে তাকে খাটে বসাতে বসাতে জবাব দেয়,’আহা তুমি বসো তো।আমাকে বাকি কাজ করতে দাও।’

নবনীতা বসল।শুভ্রা গুনে গুনে সতেরো মিনিট সময় নিল।নবনীতা শেষমেষ অধৈর্য হয়ে বলল,’শুভি আমি কেবল একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছি,কারো বিয়ে তে না।’

শুভ্রা তার ধ’মক গায়ে মাখল না।চুল বেঁধে সে নিজেই তার চোখে কাজল পরালো,ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো।নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’তোরা সবসময় আমাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করিস কেন?আমি কি শাবানা নাকি ববিতা?এতো বিউটিফাই করবি না তো আমাকে।আমি খুব অর্ডিনারী পার্সন।’

কথা শেষ করেই সে উঠে দাঁড়ালো।আয়নায় তাকে দেখা যাচ্ছে।অনেক দিন পর তার মুখটা সামান্য প্রসাধনীর ছোঁয়া পেয়েছে।শুভ্রা তার চুল খুব সুন্দর করে বেঁধেছে। খোপা করার পাশাপাশি সিঁথির দুই পাশে চুল গুলোকে খুব সুন্দর করে হেয়ার ক্লিপ দিয়ে সেট করেছে।নবনীতা একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে পেছন ঘুরে শুভ্রাকে দেখতেই তার গালে হাত রেখে বলল,’চুল বাঁধা টা তো খুব সুন্দর হয়েছে।কোথায় শিখলি?’

শুভ্রা হাসি মুখে জানায় এন্যুয়াল ফাংশনে একজন এভাবে বেঁধেছিল।সেখান থেকেই শিখলাম।তোমাকে একদম পুতুলের মতো লাগছে আপাই।মনে হচ্ছে তুমি সত্যি সত্যি পরী আপাই!’

নবনীতা হাসল।পরক্ষণেই আবার শুভ্রাকে তাড়া দিয়ে বলল,’যা তুই তাড়াতাড়ি ড্রেস পর।তোকে কলেজে নামিয়ে আমি আর চিত্র ভার্সিটি যাবো।’
.
.
.
.
‘ভাই,ভাই! ঐ দেখেন লেডি ডন আসছে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের ভেতরে তখন আরহাম আর তার দলের ছেলেরা দাঁড়িয়েছিল।আরহাম অবশ্য এতোক্ষণ অফিসরুমের ভেতরে ছিল।কয়েক মিনিট আগেই সে বেরিয়ে এসেছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে অসংখ্য ছেলে মেয়ারা আসছে।এরই মাঝে তোফায়েলের কথায় চোখ জোড়া আপনাআপনি সরু হয় আরহামের।সহসা সে ঘুরে দাঁড়ায়,চোখ রাখে মূল ফটকের দিকে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে তখন ভেতরে প্রবেশ করছিল একটি তরুণী।তার এক হাত শাড়ির কুচি সামলাতে ব্যস্ত,অন্য হাতের মুঠোয় একটা ছোট্ট হাত বন্দি।আরহাম গভীর চোখে সেই দৃশ্য দেখে।মেয়েটি আরহামের পূর্ব পরিচিত।যদিও খুব একটা মধুর না সেই পরিচয়,তবুও পরিচিত তো।মেয়েটির নাম নবনীতা।

পাশ থেকে তামজিদ মজার ছলে বলল,’বাংলার মাদার তেরেসা এসেছেন।সাইড হয়ে দাঁড়া সব।’

ভীড়ের মাঝে অন্য কেউ বলল,’ধুর হয় নি।বল যে ফাটাকেষ্ট নবনীতা এসেছে,যে কি-না এক নিমিষেই পুরো সিস্টেম চেঞ্জ করে দিতে চায়।’

রনি দাঁত কেলিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,’আমার কাছে কিন্তু আপার দাবাংগিরি সেই লাগে।আমার জন্য সে দাবাং নবনীতা।’

অন্য দিক থেকে মত আসে,’উহু।সে হলো দাঁত কিড়মিড় নবনীতা।দেখিস না,সারাক্ষণ কেমন দাঁত কিড়মিড় করে কথা বলে।যেন আমাদের সাথে তার পুরোনো শত্রু*তা।’

আরহাম হাসল।কটাক্ষ করে বলল,’স্টুপিড।পুরাই একটা স্টুপিড মেয়ে।আত্মসম্মানে ভরপুর সো কল্ড সুশীল নাগরিক।হেহহহ!! সামনে এলেই রাগ ওঠে।’

এতো এতো মতামতের মাঝে সবচেয়ে ভিন্ন মতামত দিলো ওয়াজিদ।সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনে দেখে বলল,’নীলাঞ্জনা।নীল পরী নীলাঞ্জনা।’

আরহাম নাক ছিটকে বলল,’কি?নীল পরী নাচে না?কেনো নাচে না?’
বলেই ফিক করে হেসে দিলো।ওয়াজিদ থমথমে মুখে বলল,’ইয়ার্কি হচ্ছে?’

আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’তবে কি হচ্ছে?তুই ও তো ইয়ার্কিই করছিস।’

হকচকিয়ে ওঠে ওয়াজিদ।সে কি সবার সামনেই কথাটা বলেছে?কি সর্বনাশা কথা।সে দ্রুত মাথা নেড়ে বোকা বোকা হেসে বলল,’ঐ আরকি।একটু মজা করলাম।’

আরহাম সামনে ফিরল।নবনীতার থেকে তাদের দূরত্ব বেশ কয়েক মিটারের।নবনীতার সাথে থাকা ছোট্ট মেয়েটিকে আরহামের ভালো লেগেছে।মেয়েটির মুখ গোলগাল,মায়াভরা মুখ।দেখলেই আদর দিতে ইচ্ছে হয়।অথচ এর সাথেই যে মেয়েটি দাঁড়ানো তার ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন।একে দেখলেই আরহামের মন চায় তার দুই গালে চটাশ চটাশ করে চ/ড় দিতে।কি ভোগান্তিই না ভুগতে হয়েছে আরহাম কে এই মেয়ের জন্য!

নবনীতা চিত্রার হাত ধরে অন্য পাশে চলে গেল।আজ সে শাড়ি পরেছে।সচরাচর সে শাড়ি পরে না।তোফায়েল সে দিকে দেখেই বলল,’তবে যাই বলেন মেয়েটা কিন্তু হেব্বি ভাই।একেবারে নায়িকা।কেবল মুখ খুললেই আসল রূপ বেরিয়ে আসে।’

আরহাম সে কথায় কর্ণপাত করে না।সে কেবল পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে এপাশ ওপাশ দেখে গম্ভীর মুখে বলে,’আমরা কিন্তু আজ একটা কাজে এসেছি এদিকে।আমাদের সেটাতেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
.
.
.
.
রিমি অপরাধীর মতো মুখ করে চোখ তুলে সামনে তাকায়।তার সামনে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে নবনীতা।রিমি বসে আছে অডিটোরিয়ামের বেঞ্চে।তার পাশের সিটে বসে আরামে পা দোলাচ্ছে চিত্রা।নবনীতা এখনো বসে নি।অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করা মাত্র তার মেজাজ বিগড়ে গেছে।

অডিটোরিয়ামের স্টেজে বড় ব্যানারে লিখে রাখা হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা’
আয়োজনে-সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ
পৃষ্ঠপোষকতায়-শেখ শাহরিয়ার আরহাম

নাম দেখেই নবনীতা আকাশ থেকে পড়ল।এই কালচার ফেস্ট মূলত আরহামের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ মাত্র।রিমি নিশ্চয়ই সবটা জানতো।তা স্বত্বেও তাকে কিছুই খুলে বলে নি।নবনীতা কটমট করে বলল,’এটা ঠিক না রিমি।তুই জেনে বুঝে আমাকে ঐ আরহামের আয়োজন করা অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিস।এমনটা তুই না করলেই পারতি।’

রিমি কাচুমাচু মুখে জবাব দেয়,’আরহাম ভাই একা তো আয়োজন করেনি।আমরা স্টুডেন্ট রা করতে চাইছিলাম।ভাইয়া কেবল সেটার পরিধি বাড়িয়েছেন আর পারমিশন এনে দিয়েছেন।ব্যাস এই টুকু।’

‘ব্যাস এইটুকু?বাইরে যে তোর ভাই বিশাল বহর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,এদের কাজ কি?আলোচনার নামে তো নিজেরই গুনগান করবে।’

রিমি তার দুই হাত চেপে মোলায়েম স্বরে বলল,’আচ্ছা তুই প্লিজ বোস।এটা তো আমাদের জন্যই আয়োজন করা হয়েছে।আমরা ভার্সিটির স্টুডেন্ট।সমস্যা কি?কেউ আয়োজন করলে সেটাতে উপস্থিত হতে তো সমস্যা নেই তাই না?’

নবনীতা কিছু বলার আগেই রিমি আঙুল তুলে বলল,’দেখ তুই কিন্তু বলেছিস আরহাম ভাইয়ের সাথে তোর কোনো ব্যক্তিগত শত্রু*তা নেই।তাহলে সে অনুষ্ঠানে এলো কি এলো না,আয়োজন করল কি করল না তাতে আমাদের কি?আমরা আমাদের মতো এসেছি।মজা করবো,তারপর চলে যাবো।শেষ।আর কিছু তো জানার দরকার নেই আমাদের।’

নবনীতা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এদিক ওদিক মাথা নেড়ে।রিমির সাথে কথা বলে পারা যাবে না।সে একশো রকম যুক্তি দিয়ে তার কথাই ঠিক প্রমাণ করবে।সে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চিত্রার পাশটায় গিয়ে বসল।অডিটোরিয়াম আজ চমৎকার করে সাজানো হয়েছে।নিশ্চয়ই পুরোটাই আরহামের টাকা।অডিটোরিয়াম ভর্তি ছেলে মেয়ের মুখে শুধু আরহাম ভাইয়ের নাম।নবনীতা ভেঙচি কাটে।টাকা দিলেই সবাই ভালো হয়ে যায়।আজ আরহাম ভাই টাকা দিয়েছে,তাই সে ভালো।কাল অন্য কোনো ভাই টাকা দিলে দিনভর শুধু তার নামই জপতে থাকবে।এই হলো দেশের সামগ্রিক অবস্থা!

নবনীতার পেঁচার মতো করে রাখা মুখটা দেখেই রিমি ঠোঁট টিপে হাসল।মিষ্টি সুরে বলল,’চল না একটু হেঁটে আসি।’

নবনীতা তার এক কথাতেই রাজি হলো।চিত্রার হাত টা শক্ত করে ধরে নির্বিকার হয়ে বলল,’চল তাহলে।’

***

রিমি একটা ফুচকা মুখে দিয়েই দু’চোখ বন্ধ করে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল এক করে আমোদে গলায় বলল,’উফফ! দারুন হয়েছে! একদম মুচমুচে ফুচকা!’

নবনীতা অসহায় চোখে সেদিকে তাকায়।ইশশশ! রিমি বেয়া’দব টা কি সুন্দর ফুচকা খাচ্ছে! এভাবে চোখের সামনে কেউ ফুচকা খেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?নবনীতার ইচ্ছে করছে এক ছুটে স্টলের সামনে গিয়ে গপাগপ কয়েকটা ফুচকা মুখে ঠুস’তে।কিন্তু প্রবল আত্মসম্মানবোধ তাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছে।এই স্টলের ব্যবস্থাও আরহাম নিজস্ব অর্থায়নে করেছে।নবনীতা তার টাকায় ফুচকা খাবে না।

কিন্তু মন তো মানে না।একদিক থেকে সতর্কবাণী আসে ‘নবনী তুই ভুলেও ঐ আরহামের টাকায় খাবি না’।প্রখর আত্মসম্মান যেখানে নবনীতার হাত পা বেঁধে রাখে,সেখানে মনের গহীন থেকে বার্তা আসে-‘কয়েকটা ফুচকা খেয়েই নে নবনী।এতো এতো মানুষের ভীড়ে কেই বা তোকে দেখবে?তাছাড়া তোর রাগ আরহামের সাথে।ফুচকার সাথে তোর কিসের রাগ?খেয়ে নে নবনীতা।কেউ দেখবে না।’

নবনীতা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে।কি সুন্দর ফুচকা আর টকের ঘ্রাণ আসছে।নবনীতার ইন্দ্রিয় সমূহ টেনে টেনে সেই ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত।অবাধ্য মন আকুপাকু করছে।কি হয় একটু খেলে?

নবনীতা বড় বড় দু’টো শ্বাস টানে।সব চিন্তা ভাবনা মান অভিমানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শাড়ির আঁচল সামলে এক ছুটে চিত্রাকে নিয়ে স্টলের সামনে যায়।ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলে,’মামা আমাকে একদম ঝাল ঝাল এক প্লেট ফুচকা দিন তো।অনেক বেশি ঝাল দিবেন।’

রিমি আড়চোখে তাকে দেখে আবার নিজের খাওয়ায় মন দেয়।সে নবনীকে চেনে।সে জানত নবনীতা কিছুতেই এই লোভ সামলাতে পারবে না।নবনীতা ভয়ংকর রকমের ফুচকা প্রেমি।তার পৃথিবী একদিকে,আর ফুচকা অন্যদিকে।খাওয়ার ফাঁকে দু’জনের একবার চোখাচোখি হতেই দু’জন শব্দ করে হেসে উঠল।নবনীতা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে লাজুক মুখ করে বলল,’ভাবলাম ফ্রিই যখন আছে,তখন একটু খেয়েই নেই।’

সে সময় আরহাম আর তার ছেলেরা খোলা করিডোরে জড়ো হয়ে কথাবার্তা বলছিল।আরহাম কে দেখতেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীরা সালাম দিলো।কেউবা সামনে এসে হ্যান্ডশেক করল,কোলাকুলি করল।আরহাম পুরোটা সময় মেকি হাসি বজায় রেখে সবার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলল।রোজ রোজ এতো মানুষের সাথে মিষ্টি কথা বলতে বলতে সে বিরক্ত।গত কয়েকদিন যাবত টানা হাসতে হাসতে তার গাল ব্যথা হয়ে গেছে।কিন্তু কিছুই করার নেই।জয়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মেকি হাসি নিয়েই তাকে থাকতে হবে।

হঠাৎই তার চোখ পড়ল করিডোর থেকে একটু দূরে ক্যাম্পাসের খোলা মাঠে।যেখানে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে ফুচকার স্টল বসানো হয়েছে।এগিয়ে গেল আরহাম।চোখের সানগ্লাসটা খুলে তীক্ষ্ণ নজরে দেখার চেষ্টা করল সামনের দৃশ্য।সামনে তাকাতেই তার চোখ জোড়া ক্ষণিকের জন্য স্থির হলো।সে করিডোর থেকে বেরিয়ে মাঠে এসে দাঁড়ায়।আশ্চর্য চোখে সামনে দেখে।

শুরু থেকেই ভীষণ তেজী আর গম্ভীর স্বভাবের যে মেয়েটিকে সে চিনে আসছে,সেই মেয়েটি কে সে আজ আবিষ্কার করল সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে।নীল শাড়ি গায়ে জড়ানো রমণীকে এই মুহূর্তে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে।গভীর দু’টো চোখে সে কি চঞ্চলতা! ব্যস্ত কন্ঠে সে স্টলে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী লোকটিকে বলছে,’মামা এই ফুচকায় একদমই ঝাল দেবেন না।বাচ্চা মানুষ।এতো ঝাল খেতে পারে না।’
বলা শেষ করেই সে তার প্লেট থেকে আরো একটা ফুচকা মুখে নিয়ে প্রসন্ন হাসল।সেই হাসি দেখে আরহামের নিজেরও হাসি পেল।জনদরদি,মারকাটারি আর প্রতিবাদী রমণীর এই কিশোরী রূপটা মন্দ না।তাকে কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মতো দেখাচ্ছে।নবনীতার এই রূপের সাথে আরহাম পরিচিত না।

আরহাম এগিয়ে গেল।তার পেছন পেছন তোফায়েল আর তামজিদ হেঁটে আসে।তাদের দেখতেই আশেপাশের মানুষজন সরে দাঁড়ায়।আরহাম স্টলের সামনে গিয়েই কয়েকজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,’কেমন হয়েছে ফুচকা?’

মেয়েরা মিষ্টি করে হাসল।কেউ আবার আহ্লাদী গলায় বলল,’খুব ভালো হয়েছে ভাইয়া।’

নবনীতা তাকে দেখতেই বিষম খেল।মুখের ফুচকাটা ঠিক মতো খেতেও পারছে না।কেবল থমথমে আর বিষন্ন মুখে সে সামনে দেখে।এতো সুন্দর মন মেজাজ পুরোটাই বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে তার।আরহাম তাকে দেখেই একপেশে হাসল।এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইল,’মিস নবনী! ফুচকা কেমন হয়েছে?’

নবনীতা অন্যদিকে ফিরে কাঠকাঠ স্বরে জবাব দেয়,’ভালো।’

আরহাম মুচকি হাসে।একবার নবনীতাকে আর একবার তার হাতে প্লেট টা দেখে।তারপরই কি ভেবে তার প্লেট থেকে একটা ফুচকা তুলে মুখের কাছে নিতে নিতে বলল,’দেখি তো নবনী আপা,ফুচকা কেমন হয়েছে।’

হকচকিয়ে ওঠে নবনীতা।অপ্রস্তুত হয়ে আশপাশ দেখে।সবাই চোখ গোল গোল করে তাদেরই দেখছে।সে চাপা স্বরে ধ’মকে উঠে,’এগুলো কেমন অ’সভ্যতা!’

আরহাম ফুচকা মুখে দেওয়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে চোখ বড় বড় করে নবনীতার দিকে দেখল।এটা ফুচকা নাকি মরিচের চচ্চড়ি?তার লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতেই নবনীতার হাসি পেল।একদম ঠিক হয়েছে।আর করবি এমন অ’সভ্য কাজ কারবার?

আরহাম ঝালে হু হা করতে করতে মুখ চেপে ধরল।তার চোখে পানি এসে গেছে।কিন্তু এতো মানুষের সামনে সে নিজের এই বেহাল দশা প্রকাশ করতে চায় না।সে শক্ত করে মুখ চেপে বহু কষ্টে ফুচকাটা গলাধঃকরণ করে।ভেতরটা ঝালে ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে।রিমি দ্রুত তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো।আরহাম একটানে পুরোটা পানি খেয়ে শেষ করল।এখন একটু ভালো লাগছে।পানি শেষ হতেই সে নবনীতাকে দেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এতো ঝাল মানুষ খায়?এজন্যই তো কথা বার্তার এই অবস্থা।সাংঘা’তিক মেয়ে মানুষ!’

কথা শেষ হতেই আরহাম হনহনিয়ে চলে গেল।নবনী বাঁকা চোখে একবার সেদিকে দেখে পরক্ষণেই আবার গা ছাড়া ভাব নিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিলো।তার কি দোষ?ঐ লোক নিজেই এসেছিলেন জব্দ হতে।

রিমি এগিয়ে এসে উৎফুল্ল মুখে বলল,’ইশশ! তোর কি ভাগ্য! এতো এতো মেয়ের মাঝে আরহাম ভাই শুধু তোর সাথে কথা বলেছেন। আবার তোর প্লেট থেকে ফুচকাও খেয়েছেন। ইশশ! এমন ভাগ্য যদি আমার হতো! কি একটা ফাটাফাটি সিন! একেবারে দেখার মতো।আমার সাথে এমন কিছু ঘটে না কেনো?’

‘ভাগ্য না ছাই।’ ভেঙচি কেটে জবাব দেয় নবনীতা।
‘এসেছিল আমার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে।এখন ঝালের চোটে কোনো কথা ছাড়াই কেটে পড়েছে।যত্তসব নেতা ফেতার দল!’
.
.
.
.
নবনীতা যা ভেবেছিল একদম তাই হয়েছে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে দীর্ঘসময় কেবল নির্বাচনী প্রচারণা চলল।আরহাম সহ আরো অনেক নবীন নেতারা ভাষণ দিলো।আসন্ন নির্বাচন কে ঘিরে চলল দীর্ঘ আলোচনা।নবনীতা পাথরের মতো বসে বসে সবটা দেখল।মানুষ নিজের প্রশংসা নিজে কীভাবে করে এটা রাজনৈতিক নেতাদের না দেখলে বোঝা যায় না।এরা একটানা অনর্গল নিজের ঢোল নিজেই পেটায়।মানুষ এদের কি প্রশংসা করবে?নিজেরাই তো নিজেদের প্রশংসা করে কূল পায় না।সাথে আবার এদের কিছু চ্যালাপেলা আছে,যারা পুরো ঘটনা না শুনতেই সহমত ভাই সহমত ভাই করে চেঁচায়।এদের দেখলেই শরীর গিজগিজ করে নবনীতার।

দুপুর আড়াইটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হলো।সবার জন্য খাবারের আয়োজনও করা হয়েছে।নবনীতা মুখ শক্ত করে খাবারের প্যাকেট টা হাতে নিল।তোফায়েল তাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে হাসে।এই মেয়েটার কটমট চেহারা তোফায়েলের ভালো লাগে।রাগ চেপে রাখার কারণে তাকে অদ্ভুত দেখায়।নবনীতা প্যাকেট টা নিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়।তার খিদে নেই একটুও।বাড়িতে গিয়ে শুভির সাথে ভাগ করে খাওয়া যাবে।

রিমি জানতে চাইল,’একটু পরে সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করা হবে।তুই কি থাকবি?’

‘পা’গল নাকি?মাথা খারাপ আমার?তুই থাকলে থাক।আমায় বাড়ি যেতে হবে।শুভির আসার সময় হয়েছে।’

রিমি তার পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,’ধ্যাত! আমারও বাড়ি ফিরতে হবে।চল তাহলে।বেরিয়ে যাই আমরা।’

ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই নবনীতাদের ব্যাচমেট মোহনা তাদের সামনে এসে ঠান্ডা গলায় বলল,’নবনী একটু দাঁড়া তো।ইসমাইল স্যার রিসেন্ট প্রোজেক্ট নিয়ে কি যেন কথা বলবেন।তুই একটু অফিসে আয় তো।’

কথা শেষ করেই সে দ্রুত অফিস রুমের দিকে পা বাড়ায়।নবনীতা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে চিত্রার হাত টা রিমির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,’দেখি চিত্রা কে একটু ধর তো।আমি গিয়ে দেখে আসি আবার কি সমস্যা হয়েছে।’

রিমি চিত্রার হাত ধরেই মিষ্টি হেসে বলল,’চলো তো চিত্র।আমরা একটু হাঁটাহাঁটি করি।’

নবনীতা আঁচল সামলায়।ক্রদ্ধ পায়ে এগিয়ে যায় অফিস রুমের দিকে।ঘড়িতে দুইটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট।শুভি নিশ্চয়ই বাড়ি এসে গেছে।কি খাবে মেয়েটা?মামি তো ঠিক মতো রান্নাও করে না ইদানিং।

অফিস রুমে যেতেই নবনীতা দেখল সে বাদেও প্রজেক্টের সাথে যুক্ত সবাইকেই এখানে ডাকা হয়েছে।তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।টুকটাক আলোচনার জন্যই সবাইকে ডাকা হয়েছে।নবনীতা এক পাশে দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে ইসমাইল স্যারের কথা শুনছিল।

আচমকা বিকট শব্দে পুরো অফিস রুম কেঁপে উঠল।ধড়ফড়িয়ে উঠল নবনীতা।একই শব্দের পুনরাবৃত্তি হলো পর পর কয়েকবার।আশেপাশের সবাই একজন অন্য জনের মুখ দেখাদেখি করছিল।ঘটনা কি সেটা কেউই ঠাহর করতে পারছে না।নবনীতা আতঙ্কিত নয়নে এদিক সেদিক তাকায়।এই শব্দ সে চেনে।এই শব্দে তার খুব ভয়।

কিছু সময় যেতেই বাইরে থেকে মানুষ জনের ছুটোছুটি আর চিৎকারের শব্দে তার শরীর হিম হয়ে এলো।শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল শীতল ধারা।কেউ একজন ছুটতে ছুটতে অফিস রুমে এসে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল,’কেউ রুম থেকে বের হবে না।বাইরে ভীষণ গোলা’গু’লি হচ্ছে।বিরোধী দলের রাকিবের লোকজন বাইরে খুব ঝামেলা করছে।সবাই ভেতরেই থাকুন।’

কথা শেষ করেই সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অন্য রুমের দিকে ছুটল।খবর টা সবার নিকট পৌঁছে দেওয়া জরুরি।কক্ষে উপস্থিত সবার মুখ আতঙ্কে ছেয়ে গেল।নবনীতার শরীর ক্রমশ শীতল হয়ে যাচ্ছে।গো’লাগু’লি হচ্ছে মানে?কি বলছে এসব?বাইরে তো চিত্র আছে,রিমি আছে।

চিত্র’র কথা ভাবতেই আঁতকে উঠে সে।বড় বড় করে শ্বাস টানে।আর্ত’চিৎকার করে বলে,’আমার চিত্র! আমার চিত্র!’

সে প্রাণপণ ছুটে যায় দরজার দিকে।মোহনা তার হাত ধরে চমকে উঠে বলে,’কি করছিস নবনী?বাইরের পরিস্থিতি খারাপ।এখন বাইরে যাসনে।’

নবনীতা এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।উন্মা’দের মতো ছুটে যায় বাইরের দিকে।ফুঁপিয়ে উঠে বলে,’আমার চিত্র বাইরে।আমি এদিকে কেমন করে থাকব?’

অফিস রুম থেকে বেরিয়ে সামনে দেখতেই নবনীতা স্তব্ধ হয়ে গেল।চারদিকে কেমন বিবর্ণ বি’ধ্বস্ত অবস্থা।একটু আগেই যেই উৎসব উৎসব আমেজ ছিল চারদিকে,তার পুরোটাই মাটি হয়ে গেছে।কি বিবর্ণ দেখাচ্ছে সবকিছু! চারদিকে শুধু হা’হা’কার আর হা’হা’কার!

নবনীতা ছুটে এলো ঠিক সে জায়গায় যেখানে সে রিমি আর চিত্রকে রেখে এসেছিল।অথচ সে জায়গা এখন একদম ফাঁকা।ব্যাগে রাখা মুঠোফোন টা কর্কশ শব্দে বাজছে।নবনীতা দ্রুত সেটা বের করল।রিমির কল।রিসিভ করেই নবনীতা প্রচন্ড উৎকন্ঠা মেশানো গলায় বলল,’রিমি তুই কোথায়?আমার চিত্র কোথায়?’

ফোনের ওপাশে সাউন্ড গ্রে’নেড ছোঁড়ার শব্দে অন্য শব্দ ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছিল না।রিমি গলায় আওয়াজ চওড়া করে জানাল চিত্রা তার সাথেই আছে।গো’লাগু’লি শুরু হতেই রিমি একটা সিএনজি ঠিক করে চিত্রাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছে।কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় নবনীতা।হাঁফ ছেড়ে বলে,’একটু দেখে রাখিস রিমি।আমি এখানের ঝামেলা শেষ হতেই তোর বাসায় এসে চিত্রকে নিয়ে যাব।’

অত্যাধিক শব্দে সব কথা শোনা যায় না।নবনীতা ফোন রাখার আগেই বিকট শব্দে গু*লি চালানোর শব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন কেঁ*পে উঠে।কেঁ*পে উঠে নবনীতা নিজেও।আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথেই মৃদু আর্ত’নাদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে একটি বলিষ্ঠ দেহ।আশ্চর্য হয়ে পেছন ফিরে নবনীতা।পেছন ফিরতেই চোখ কপালে উঠল তার।

তার থেকে সামান্য কিছুটা দূরে আরহাম।তার একহাত দিয়ে অঝোরে র*ক্ত ঝরছে।সে হাতে গু*লি খেয়েছে।বাহুর কাছটায় র*ক্ত মেখে বি’ভৎস দেখাচ্ছে তাকে! নবনীতা পেছন ফিরতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো।হতবাক হয় নবনীতা।আরহাম একা কেন এদিকে?তার লোকজন কোথায়?সে কেন এই পরিস্থিতিতে বাইরে বেরিয়েছে?ভাবনার মাঝেই আরো একবার অস্ফুট আর্ত’নাদ করে সে।নবনীতার বুকে ধ্বক করে উঠে।মস্তিষ্কে হানা দেয় সেই পুরোনো স্মৃতি।একটা ক্লান্ত শরীর,মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে,দু’টো ঘোলাটে চোখ,সেই চোখে শত শত চাপা কষ্ট।
দ্রুত চোখ বন্ধ করে নবনীতা।এই দৃশ্য সে আর মনে করতে চায় না।সে সহ্য করতে পারে না এই দৃশ্য।

সময় গড়ায়।কিছুটা ধাতস্থ হয় নবনীতা।শরীরে শক্তি আর সাহস সঞ্চার করে।চোখ মেলে সামনে তাকায়।নাহ,সে ভয় পাবে না।র*ক্ত দেখে সে পালাবে না।সে এই লোকটিকে বাঁচাবে।তার সামনে থাকা এই লোকটি যেমনই হোক,নবনীতা তাকে নোংরা রাজনীতির খপ্পরে পড়ে ম’রে যেতে দিবে না।কিচ্ছু হবে না তার,নবনীতা কিছু হতেই দিবে না।

শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে সে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।তারপরই এক দৌঁড়ে ছুটে যায় আরহামের দিকে।মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আঁকড়ে ধরে তার গু’লিবি’দ্ধ সুঠাম দেহ।বিস্মিত হয় আরহাম।অবাক হয়ে পাশে দেখে।নবনীতা তার একহাত দিয়ে শক্ত করে আরহামের বাহু চেপে ধরে।র*ক্তে তার হাত ভিজে যাচ্ছে।দাঁত দিয়ে ঠোঁট কা’মড়ে ধরে সে।নিজেকে বোঝায় ‘র*ক্ত দেখে ভয় পাবি না নবনী।সাহস কর,দেখিয়ে দে তুই ভীতু না।’

সে শক্ত করে হাত চেপেই এক প্রকার ব্যকুল হয়ে বলল,’চোখ বন্ধ করবেন না আরহাম।প্লিজ চোখ খোলা রাখুন।চোখ বন্ধ করবেন না প্লিজ।’

আরহাম দেখে।দেখতেই থাকে।টের পায় এতো গুলো দিনে এই প্রথম মেয়েটা তার এতো কাছাকাছি এসেছে।মেয়েটা কি কোনো জ্বীন পরী?নয়তো এমন গো’লাগু’লির মাঝে সে কেমন করে আরহামের দিকে ছুটে এলো?সে তো পাশ কাটিয়ে চলেও যেতে পারত।অথচ সে ছুটে এলো যেন আরহাম তার খুব কাছের কেউ।

আরহাম এক হাতে মাটি আঁকড়ে ধরে।নিভু নিভু চোখে তাকে শক্ত করে ধরে রাখা মেয়েটি কে দেখে।খুটিয়ে খুটিয়ে তার মুখটা পর্যবেক্ষণ করে।একটা ক্লান্ত মুখ যেখানে দীর্ঘদিনের অবহেলা জমা হয়েছে।কাজল দেওয়া দু’টো গভীর চোখ যেখানে শতাব্দীর মলিনতা এসে ভীর করেছে।মেয়েটা কি জানে এই ছুটোছুটিতে তার সুন্দর করে বেঁধে রাখা খোপা খুলে তার ঘন কালো কেশ উন্মুক্ত হয়ে তার পিঠ ছাপিয়ে গেছে?হয়তো জানে না।আরহাম দেখে,কেবল দেখতেই থাকে।আচমকা মেয়েটিকে তাকে ধ’মকে উঠে।কড়া গলায় বলে,’চোখ বন্ধ করতে মানা করেছি না?চোখ বন্ধ করছেন কেন?’

আরহাম টেনে টেনে চোখ খোলার চেষ্টা করে।কিন্তু শরীর সে কথায় সায় দেয় না।সে তার অর্ধেক শরীরের ভার নবনীতার উপর ছেড়ে তার মাথাটা আলতো করে নবনীতার কাঁধে রাখে।ত্যাড়া গলায় বলে,’পারব না চোখ খোলা রাখতে।শরীর ব্য’থায় ছি’ড়ে যাচ্ছে।তুমি কি করে বুঝবে আমার অবস্থা?’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১১

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১১)

‘এটা আবার কি এনেছো তুমি?’ কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল তাসনুভা।

আরহাম তার হাতের সাদা কাঁচের টবে থাকা গাছটার দিকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল,’এটা স্পাইডার প্লান্ট।এটা রুমে থাকা ভালো।এটা থাকলে বাতাস পরিষ্কার থাকে।’

তাসনুভা আড়চোখে বড় ভাইকে দেখল।মনে মনে বলল,’শুরু হয়েছে আবার নতুন পাগলামি।’ অথচ মুখে বলল,’এটা কি আজ থেকে আমার রুমে থাকবে?’

আরহাম বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।দ্বিরুক্তি করে বলে,’হু,শুধু তোর রুমে না।তোর,আমার,আরিশের সবার রুমে থাকবে।অনেক গুলো আনিয়েছি আমি।’

তাসনুভা নাক ছিটকাল।
‘দেখতে একদমই সুন্দর না ভাইয়া।ঘাসের মতো লাগে।’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে বলল,’সুন্দর দিয়ে কি যায় আসে?সুন্দর চিবিয়ে ঘাস খাবো আমি?আমার প্রয়োজন আউটকাম।জিনিসটা থেকে আমি কি ফল পাচ্ছি এটাই আমার প্রয়োজন।’

‘কিন্তু তবুও।এমন ঘাসের মতো গাছ ঘরে আনিয়ে খামোখা সৌন্দর্য নষ্ট করছ।আমাদের বাড়ির বাতাস এমনিতেই পরিষ্কার।এসব গাছ এনে পরিষ্কার করার দরকার নাই।’

তাসনুভার উত্তর আরহামের পছন্দ হয়নি।সে মুখটাকে পেঁচার মতো করে বলল,’বেশি বুঝিস তুই?এগুলোর কতো ডিমান্ড জানিস তুই?আমি ভাবছি সামনের মাসে লেভেনডার প্লান্ট আনাবো।’

‘সেকি! ঐটা তো শীতপ্রধান দেশে হয়।এই গরমে কেমন করে বাঁচবে?’ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করল তাসনুভা।

আরহাম কাঁধ উঁচিয়ে বলল,’সো হোয়াট?আমাদের বাসায়ও তো এসি থাকে।এটার বেঁচে থাকার মতো টেম্পারেচার আমাদের বাসাতেই আছে।এটার খুব ডিমান্ড।বাতাসের টক্সিন দূর করে এটা।’

তাসনুভা কপাল চাপড়ায়।আফসোস করে বলে,’তুমি কি সবকিছুতে শুধু লাভ লোকসান খুঁজো?সবকিছু কি লাভ লোকসান দিয়ে বিচার হয়ে ভাই?মাঝে মাঝে তো ভালোবাসা আর চোখের সৌন্দর্যও ম্যাটার করে তাই না?’

আরহাম তার কথা শুনতেই নাক ছিটকাল।ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,’ওসব সৌন্দর্য টৌন্দর্য আমি গুনি না।ভালোবাসা আবার কি?একটা জিনিস থেকে হয় আমি ভালো কিছু পাবো,নয়তো খারাপ কিছু।আমি সেই জিনিস গুলোই চ্যুজ করবো যেগুলো আমাকে ভালো কিছু দিতে পারবে।মানুষের ক্ষেত্রেও তাই।যাদের কাছ থেকে আমার কিছু পাওয়ার আছে আমি তাদের সাথেই মিলেমিশে চলি।নয়তো অপ্রয়োজনে মানুষের কাছাকাছি অন্তত আরহাম যায় না।’

‘সর্বনাশ! বিয়ের ক্ষেত্রেও এই টেক্টিস ফলো করবে নাকি?’ দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল আরিশ।

আরহাম ত্যারছা চোখে আরিশকে দেখে।আরিশ ঘরে ঢুকেই এক লাফে বিছানার মাঝামাঝি গিয়ে বসেছে।আরহাম চুল ঠিক করতে করতে বলল,’অবশ্যই।বিয়ের ক্ষেত্রেও নিজের লাভ দেখেই বিয়ে করব।আমার কথা মতো উঠবস করবে এমন মেয়েই আমার চাই।’

তাসনুভা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়,’ তুমি কি সত্যি সত্যিই ফাইভ পাশ মেয়ে বিয়ে করবে নাকি?’

আরহাম মাথা ঝাকায়।গর্ব করে বলে,’ফাইভ পাশ মেয়ে যদি আমার কথা মতো চলতে পারে,তবে তাই করব।আমি আগেই বলেছি,অতো পড়াশোনা জানা মেয়ে আমি বিয়ে করব না।’

আরিশ আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’তার মানে তুমি সত্যি সত্যি এমন কাউকে বিয়ে করবে যে কেবল দিন রাত তোমার হুকুম মেনে চলবে?’

‘একদম তাই।আমি যা বলব তাই শুনবে।আমার কথার উপর কোনো কথা বলবে না।আমার আদেশ ছাড়া কোনো কাজ করবে না।আর মোস্ট ইম্পরট্যান্ট,একবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই বাড়ির গন্ডি পেরিয়ে কোথাও যাবে না।এই বাড়িতেই থাকবে,তাসের যত্ন করবে,রান্না করবে,সংসার সামলাবে,স্বামীর সেবা করবে,বাচ্চা পেলে পেলে বড় করবে-দ্যাটস ইট।’

তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,’কিন্তু এটা কেমন কথা?একটা মেয়ে সারাদিন ঘরে থাকবে?তার ও তো কিছু প্রয়োজন থাকতে পারে।’

‘কেন?সমস্যা কি?তুই থাকিস না সারাদিন বাড়িতে?’

তাসনুভা মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,’সেটা তো আর শখ করে থাকিনা।হাঁটতে পারি না বলে সারাদিন ঘরে থাকি।ঐ মেয়ে কেন খামোখা সারাদিন ঘরে থাকবে?তারও তো কিছু স্বপ্ন থাকতে পারে,চাকরি বাকরি থাকতে পারে।’

‘কি?চাকরি থাকবে মানে?’ খ্যাক করে চেঁচিয়ে উঠল আরহাম।দু’হাত নেড়ে কড়া গলায় বলল,’অসম্ভব।এসব চাকরিজীবী স্বপ্নওয়ালী মেয়েকে আমি বিয়েই করব না।পা’গল নাকি আমি?বাড়িতে কি আরেকটা তাসলিমা আনবো নাকি অমন মেয়ে বিয়ে করে?’

আরিশ কোনো প্রতিউত্তর করল না।এই নাম শুনলে সে কেমন যেনো গম্ভীর আর শান্ত হয়ে যায়।আরহাম ভাইয়ের অত্যন্ত অপছন্দের এই নাম।অথচ এই নামের মানুষটার সাথে তাদের তিনজনের সম্পর্ক কতো গভীর!

তাসনুভা মন খারাপ করে বলল,’এমন করে বলছ কেন ভাইয়া?সব মেয়েই কি খারাপ হয়?’

আরহাম কাটখোট্টা স্বরে জবাব দেয়,’এতো প্রশ্ন করিস না তো তাস।ঐ তাসলিমাকে দেখেও কি তোদের শিক্ষা হয় না?এসব মেয়েদের জীবনেও বাড়ির বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত না।আমার বাবা মহামানব।স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।সেই স্ত্রী ই দুই গালে জুতো মে’রে আরেক লোকের সাথে ঘর পেতেছে।তাও আবার স্বামী আর তিন বাচ্চাকে ফেলে।চরিত্র’হীনা মহিলা একটা!’

তাসনুভা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’এভাবে বলো না ভাই,প্লিজ!’

‘কেন?কেন বলব না?ঐ তাসলিমা কে নিয়ে বললে তোদের এতো লাগে কেন?ঐ দুশ্চ’রিত্রা আমাদের কি হয়?’

‘তুমি জানো না সে আমাদের কি হয়?’ থমথমে মুখে জানতে চাইল আরিশ।

আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দেয়,’জানি,কিন্তু মানি না।আর তাকে আমার পক্ষে কোনোরকম সম্মান করাও সম্ভব না।তোরা পারলে তার পূজো কর।আমি এসবে নাই।তাসলিমা আমার চোখে দেখা সবচেয়ে জ’ঘন্য মানুষ।আমার বাবার বিশ্বাস ভালোবাসাকে সে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।সুযোগ পেলে সব মেয়েই এমন করে।আমার বউকে আমি সেই সুযোগ দেবই না।’

তাসনুভা মলিন মুখে বলে,’আমিও তো মেয়ে ভাই।’

‘চুপ কর তো।তুই মেয়ে ছেলে এসব পরে।সবার আগে তুই আমার বোন।তুই আরহামের বোন।তুই আলাদা।’

‘আমি আলাদা।আর বাকি সব মেয়ে এক?’

আরহাম অন্যদিকে ফিরে ছোট করে জবাব দেয়,’হু,এক।’

তাসনুভা ম্লান হাসল।হাসি মুখেই বলল,’আমার কি মনে হয় জানো ভাইয়া?’

আরহাম চোখ পাকায়।জানতে চায় কি?

‘আমার মনে হয় তুমি খুব ভালো বর হবে।এই যে তুমি মুখে বলছ তুমি তোমার বউকে কিছুই করতে দিবে না,আসলে তার কিছুই হবে না।তুমি তোমার বউকে খুব খুব খুব ভালোবাসবে।বাবার চেয়েও বেশি।’

‘আর সে কি করবে?তাসলিমার মতো আমার ভালোবাসা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরেক লোকের সাথে বিয়ে বসবে?’ তাচ্ছিল্যের সুরে জানতে চায় আরহাম।

তাসনুভা ভীষণ বিরক্ত তার বড় ভাইয়ের উপর।সবকিছুতে ঘুরে ফিরে সে এক নামই নিয়ে আসে।তাসনুভা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’বার বার এক কথা বলবে না ভাই।একজন এমন করেছে মানেই সবাই এমন করবে তা না।’

তাসনুভা একটু দম নিল।সামান্য কিছু সময় পরেই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,’আমার মনে হয় তোমার বউ খুব মিষ্টি হবে।মনে নাই নানু কি বলত?বলত যে বদমেজাজী ব্যাটাদের বউ হয় মিষ্টি।আমারও মনে হয় সে খুব মিষ্টি হবে।তোমাকে,আমাকে,ছোট ভাইয়াকে-আমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসবে।’

আরহাম চোখ বাঁকিয়ে বলল,’ইশশ রে! বউ তো নয় যেন ভালোবাসার টাংকি! শোন তাস,এসব মেয়ে মানুষরা ভালোবাসা বোঝে না।তারা শুধু নিজের টা বোঝে,নিজেকে নিয়ে ভাবে।ছেলেরা পরিবারের প্রতি যত্নশীল হয়,দায়িত্ববান হয়।’

আরিশ চট করে প্রশ্ন করে,’মেয়েরা যত্নশীল হয় না?’

আরহমান হাসে।অবজ্ঞা করে বলে,’অসম্ভব।মেয়েদের কখনো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দেখেছিস?মেয়েরা উপার্জন করলেও নিজের জন্য করে।ঘুরে ফিরে সবাই ঐ তাসলিমার মতোই।’

‘ভাইয়া! প্লিজ তুমি চুপ করো!’ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে দুই ভাই বোন।

আরহাম সেসব গায়ে মাখে না।তাসলিমা কে নিয়ে কটু কথা বললে আরিশ আর তাসনুভার খুব গায়ে লাগে।তাতে আরহামের কি?লাগুক গায়ে।সে কোনো মিথ্যা কথা বলে না।ঐ তাসলিমা তার জন্য কি করেছে?তাকে পেটে ধরেছে।এজন্য কি এখন আরহামের উচিত তার গুনগান করা?যতোসব ফালতু লজিক!

সে ঘর থেকে বরিয়ে যেতে যেতে গাঢ় স্বরে বলল,’খুব গায়ে লাগে তাই না?লাগবেই তো।তোরা তো আর তার পায়ে পড়িস নি।তোরা তো আর চোখের সামনে মা কে অন্য বাড়ির বউ হতে দেখিসনি।তোরা তো স্কুলের ক্লাসরুমে হেনস্তার শিকার হোস নি।তোদের কাছে তো আমার টাই বাড়াবাড়ি মনে হবে।যাক গে,আমি চললাম।তোরা দু’জন ইচ্ছে হলে কতোক্ষণ গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদ।তাসলিমার কাছে কবুতরের পায়ে বেঁধে উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দে।’

শেষ কথাটা বলতে গিয়েই আরহাম আওয়াজ করে হেসে ফেলল।পরক্ষণেই আবার তাসনুভা আর আরিশের থমথমে মুখটা দেখতেই মুখে হাত চাপল।আরিশ বিরক্ত হয়ে বলল,’অদ্ভুত! তুমি আবার হাসছ ভাইয়া?’

আরহাম সে কথার উত্তর দেয় না।কেবল ন্যাকা সুরে গান ধরে,
‘মেঘের খামে আজ তাসলিমার নামে,
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম।
পড়ে নিয়ো তুমি,মিলিয়ে নিয়ো খুব যতনে তা লিখেছিলাম।
~বাণীতে মা ভক্ত আরিশ তাসনুভা’

কথা শেষ করেই আরহাম আরো কতোক্ষণ খ্যাকখ্যাক করে হাসল।তাসনুভা তার হাতের কাছের বালিশটা সবেগে ছুড়ে মারল তার দিকে।ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’তুমি যাবো ভাইয়া?সবসময় এসব ভালো লাগে না।’

আরহাম বালিশটা ক্যাচ ধরে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,’আচ্ছা যা।চলে গেলাম আমি।তোরা যা খুশি কর।আরিশের ফোনে তাসলিমার ছবি আছে।দরকার পড়লে সেটা দেখেও কাঁদতে পারিস।আই হ্যাভ নো প্রবলেম।’
.
.
.
.
নবনীতার আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের তুলনায় ভালো।ভালো হওয়ার একটা বিশাল কারণ আছে।কুরিয়ার অফিসের যে চাকরিটা সে করত,সেখানে আজ তার বেতন হয়েছে।

সে জানতো তার বেতন ছ’হাজার।কিন্তু পরবর্তীতে অফিসের ম্যানেজার জানাল বেতন ছ’হাজার থেকে বাড়িয়ে সাত হাজার করা হয়েছে।অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বেতনের টাকায় একটা হাজার টাকার নোট বেশি যোগ হওয়াতে নবনীতার মন খুশিতে বাক-বাকুম।সে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা রিকশা নিল।আজ একটু খরচা করাই যায়।এ হাজার টাকা তার হিসেবের বাইরে।

বাড়িতে ফিরতেই সে শুভ্রানীকে তাড়া দিলো,’শুভি তাড়াতাড়ি পড়া শেষ কর।আজ আমরা ঘুরতে বের হবো।’

শুভ্রা অবাক হয়ে জানতে চায়,’কোথায় বের হবো?কি উপলক্ষে বের হবো?’

নবনীতা তাড়াহুড়ো করতে করতে জবাব দেয়,’ছয় হাজারের জায়গায় সাত হাজার পেয়েছি বেতন।এই খুশিতে বের হবো।এখন পড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি রেডি হ।’

শুভ্রানী কেবল গোল গোল চোখে তার বোনের চঞ্চলতা দেখে।নবনীতা আলমারি থেকে চিত্রার জন্য একটা জামা বের করল।লাল টুকটুকে একটা জামা।তারপর সেটা চিত্রাকে পরিয়ে তার চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে দিলো।চুল বাঁধার পর চিত্রাকে দেখাচ্ছিল মিষ্টি একটা বাচ্চা।নবনীতা গালে হাত চেপে প্রফুল্ল মুখে বলল,’আল্লাহ রে!! আমার চিত্র সোনাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে।একদম পামকিন পামকিন!’

বয়স যাই হোক না কেন,মেয়ে মানুষ প্রশংসায় গলে যায়।চিত্রাও গলে গেল।কিছুটা লাজুক হেসে সে ঘরের আয়নায় একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নেয়।নবনীতা তাকে পেছন করে জাপ্টে ধরে প্রশ্ন করে,’কি?কেমন দেখাচ্ছে চিত্র কে?’

চিত্রা হাত নেড়ে নেড়ে জবাব দেয়,’সু বিউতিফুল।সু ইলিগ্যান।’

নবনীতা চোখ বড় বড় করে বলল,’সর্বনাশ! এ কথা কে শেখালো?নির্ঘাত শুভি,তাই না?’

চিত্রা ইশারায় জানাল নবনীতার ধারণাই ঠিক।নবনীতা পেছন ফিরে শুভ্রার বোকা বোকা মুখটা দেখতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।কয়েক পল বাদেই আবার চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে তার দুই গালে ঠেসে ঠেসে দু’টো চুমু খেয়ে আহ্লাদী গলায় বলে,’কি পাকা পাকা কথা বলে এই দুষ্টুটা!’
কিছু সময় বাদে নবনীতা নিজ থেকেই বলে উঠল,’জাস্ট লুকিং লাইক আ ওয়াও চিত্র।’

শুভ্রানী এগিয়ে এলো।অবাক হয়ে বলল,’আপাই তুমিও এই কথা জানো?’

‘হু।লুবনার কাছ থেকে জেনেছি।ঐটা তো আরেকটা মোবাইলের পোকা।সারাদিন কিসব রিলস টিলস দেখতে থাকে।পড়াশোনা বাদে সে সবকিছুতেই ভীষণ পারদর্শী।’

শুভ্রার পড়া শেষ করে সব কিছু গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।আধ ঘন্টা বাদেই হয়তো আযান দিবে।নবনীতা মাথার ঘোমটা টা আরো একটু সামনে টেনে হতাশ গলায় বলল,’ধ্যাত।সেই তো আবার দেরি ই করে ফেললাম।মাঝখান টায় মাগরিবও গেলো।’

সেদিন তিন বোন মিলে সোজা নিউমার্কেট গেল।নবনীতা ফুচকা খেল,তাও আবার দু’প্লেট।একেকটা ফুচকা মুখে দেওয়ার পর তার চোখে মুখে যে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠে,সেটা দেখেই শুভ্রা ঠোঁট টিপে হাসে।আপাই ফুচকার ভক্ত।এসবে কোনো ভাগযোগ করে না আপাই।যার যার প্লেট তার তার।নবনীতা যখন দু’চোখ বন্ধ করে ফুচকার স্বাদ নিতে ব্যস্ত,তখন শুভ্রা অতি সন্তর্পণে তার প্লেটের একটা ফুচকা নবনীতার প্লেটে তুলে দিলো।এই একটা খাবারই আছে যেটা পরী আপাই খুব আয়েস করে খায়।যেই আপাই নিজের সব বিসর্জন দিয়ে শুভ্রা আর চিত্রাকে ভালোবাসতে পারে,সেই আপাইকে ভালোবেসে তার অগোচরে তার প্লেটে একটা ফুচকা দেওয়াই যায়।

শুভ্রা মুগ্ধ চোখে দেখে।নবনীতা ফুচকা চিবুতে চিবুতে অস্পষ্ট গলায় বলে,’ফাটাফাটি হয়েছে একদম।মন ভালো হয়ে গেছে আমার।’

ফুচকা খাওয়া শেষ করে তারা কতোক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল।চিত্রাকে চিপস আর চকোলেট কিনে দিয়েছে নবনীতা।তারপর তার যায় স্টেশনারি দোকানে।চিত্রার কালার পেপার লাগবে,শুভির লাগবে প্র্যাক্টিক্যাল খাতা।নবনীতা আর শুভ্রা ব্যবহারিক খাতা গুলো পাতা উল্টে দেখছিল।নবনীতা জিজ্ঞেস করে,’তিনটা এক সাথে কতো দিব ভাইয়া?’

চিত্রা এসব ঝামেলায় নেই।সে নিজের জিনিসপত্র সব পেয়ে গেছে।সে সেগুলো হাতে নিয়ে ফুটপাতে হাঁটাহাঁটি করছিল।তার দুই হাত ভর্তি এটা সেটা।হাঁটতে হাঁটতে আচমকা সে হোঁচট খেল।হাঁটু ভোঙে মাটিতে বসতেই ব্যথায় ফুপিয়ে উঠল।ঠোঁট ভেঙে ডাকল,’আপাই!’

নবনীতার কানে তার আওয়াজ যেতেই নবনীতা আঁতকে উঠল।হাতে রাখা খাতাটা দ্রুত ডেস্কের উপর ফেলে সে ছুটল ফুটপাতের দিকে।তার পিছু পিছু শুভ্রাও দোকান থেকে হম্বিতম্বি করে বের হলো।

নবনীতা ফুটপাতে পা রাখতেই দেখতে পেল চিত্রার এক হাত একটা শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি।সেই হাতের মালিক তার অন্য হাতে চিত্রার হাঁটুর কাছের ধুলো ময়লা গুলো সব ঝেড়ে দিচ্ছে।ঝাড়তে ঝাড়তেই আদুরে স্বরে বলছে,’কিচ্ছু হয়নি বাবু।এই দেখো তুমি একদম ঠিক আছো।’

একছুটে নবনীতা সেখানে গেল।প্রচন্ড অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল,’কি হয়েছে?কি হয়েছে আমার চিত্র’র?’

ওয়াজিদ মাথা তুলল।নবনীতা প্রথমেই তাকে চিনতে পারেনি।যখন চিনল,তখন এক থাবায় চিত্রকে তার কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে এলো।চিত্র’র গালে হাত রেখে ব্যস্ত হয়ে বলল,’কিভাবে পড়লি চিত্র?বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’

চিত্রা কেবল ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।ওয়াজিদ অমায়িক হেসে উত্তর করে,’না না।সে তেমন ব্যথা পায় নি।হোঁচট খেয়েছিল।আমি ধরে নিয়েছি।বাসায় গিয়ে ভ্যাসলিন লাগিয়ে দিবেন।তাহলেই একদম ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’

নবনীতা তার কথার পিঠে কেবল সৌজন্যসূচক হাসল।ওয়াজিদের কন্ঠ অত্যন্ত মোলায়েম।মুখ জুড়ে সবসময় অমায়িক হাসি লেপ্টে থাকে।আরহামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া স্বত্বেও আরহামের চেয়ে ওয়াজিদের আচার আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।নবনীতার এই লোকটি কে খারাপ লাগে না।

ওয়াজিদ কথা শেষ করে আড়চোখে একবার তার মুখোমুখি দাঁড়ানো রমণীকে দেখে নেয়।তার চোখেমুখে সে কি ভীষণ উৎকন্ঠা! ওয়াজিদ ঠিক করে বুঝিয়ে বলার পরেও সে দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছে না।ওয়াজিদ স্মিত হেসে বলল,’মিস নবনীতা! রিলাক্স।ওর কিচ্ছু হয়নি।পড়ে গিয়েছে কেবল।বাচ্চারা এমন একটু আধটু পড়েই।’

এবার সম্ভবত কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে নবনীতা।সে চোখ তুলে একগাল হেসে বলল,’ধন্যবাদ ভাইয়া।আসলে একে নিয়ে আমি খুব চিন্তায় থাকি।বাচ্চা মানুষ তো,তাই ভয় হয়।আপনাকে ধন্যবাদ।আল্লাহ আপনার ভালো করুক।আমরা তাহলে আসি।’

কথা শেষ হতেই নবনীতা চিত্রার হাতের জিনিসগুলো নিজের হাতে নিল।ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে শুভ্রার হাতে দিয়ে বলল,’যা তো খাতা গুলো নিয়ে আয়।’
শুভ্রা খাতা আনার পরেই তিনজন একটা রিকশা ডেকে মিনিটের মাঝেই সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল।

কেবল পেছনে পড়ে রইল একটি যুবক,যার চোখে মুখে তখনো রাজ্যের মুগ্ধতা।সাদামাটা পোশাক,প্রসাধনী বিহীন একটা ক্লান্ত মুখ,গভীর দু’টো চোখে মলিনতার ছাপ,একপাশে বেণি করে অযত্নে ফেলে রাখা চুল,অথচ এতো অযত্নেও তার সৌন্দর্যের এইটুকুও ম্লান হয়নি।কি আছে এই রমণীর মাঝে?সেই প্রথম দিন থেকে ওয়াজিদের চোখ জোড়া মুগ্ধ হয়ে কেবল সেই প্রশ্নের জবাবই খুঁজে যাচ্ছে।মেয়েটি অত্যন্ত সাধারণ,তবে ওয়াজিদের কেন তাকে এতো বেশি অসাধারণ বলে মনে হয়?কেন মনে হয় এই মেয়েটি যেখানেই যায়,কেবল মুগ্ধতা ছড়ায়?

নবনীতাদের রিকশা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।ওয়াজিদ দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত বেঁধে।মেয়েটাকে তার ভালো লাগে,ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে।

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১০

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১০)

একটা A4 সাইজের কাগজ।কতোই বা মূল্যবান হতে পারে সেই কাগজটা?কিন্তু আরহামের কাছে এই কাগজটার মূল্য কোটি টাকার চেয়েও বেশি।অবশেষে,,অবশেষে একশো একটা ঝামেলার শেষে আরহাম তার দল থেকে আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছে।

মনোনয়ন পত্র হাতে পাওয়ার পর সে কয়েক মিনিট কোনো প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত প্রকাশ করতে পারছিল না।মনোনয়ন পাওয়া নির্বাচনের একটা অংশ মাত্র।এরপরই শুরু হয় মূল লড়াই।তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই নিয়মে কিছু ব্যতিক্রম আছে।এখানে সরকার দল থেকে যেই প্রার্থী মনোনয়ন পায়,তার অর্ধেক নির্বাচন সেখানেই জেতা হয়ে যায়।আরহাম সরকার দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছে।সবকিছু ঠিক থাকলে মোটামুটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় আসন্ন নির্বাচনে এই আসন থেকে শেখ শাহরিয়ার আরহামই বিজয়ী হবে।

নমিনেশন লেটারটা হাতে পাওয়া মাত্রই আরহাম খুশিতে চেঁচিয়ে উঠল,’ইয়েস! ইয়েস! ইয়েস!’
তারপর দীর্ঘসময় সে সেটাকে হাতে নিয়ে বসে রইল।চারদিক থেকে কতো জনের কতো রকম ফোনকল আসছিল।সে কোনোটাই রিসিভ করল না।

প্রশাসনিক কার্যালয়ের সামনে তার ছেলেরা ভিড় জমিয়েছিল।মনোনয়নের বিষয়টি নিশ্চিত হতেই তারা এক প্রকার আনন্দ উল্লাসে মেতে উঠল।লম্বা সময় স্লোগান চলল।সচিবালয়ের সামনে অগণিত মানুষ আর গাড়ির ভিড়ে চারদিক কেমন গিজগিজ করছিল।আরহাম কয়েক বার হাত তুলে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করল।অথচ মনে মনে সে চাইছে এরা যেন গলা ছেড়ে চিৎকার করে।সেই চিৎকারে যেন ফাহাদ আর তার দলের লোকদের কানের পর্দা ফেটে যায়।

ফাহাদ আর তার লোকজন দাঁড়িয়েছিল প্রশাসনিক ভবনের উত্তর দিকে,আরহামের লোকজনের চেয়ে বেশ কিছুটা দূরে।তাদের উল্লাস,উচ্ছ্বাস সবকিছুই ফাহাদের কান পর্যন্ত আসছিল।ফাহাদ দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করে নিল।এতো চেষ্টা,এতো কৌশল অবলম্বন করার পরেও মনোনয়ন পেয়েছে ঐ আরহাম।অথচ দলের জন্য ফাহাদ কি না করেছে?আরহামেরও বহু আগে সে রাজনীতিতে জড়িয়েছে।রাজনীতির চক্করে তাকে জেলের ভাতও খেতে হয়েছে।দলের জন্য তার অবদান কি ঐ দুইদিনের ছেলে শাহরিয়ার আরহাম থেকে বেশি না?আরহামের যোগ্যতা কি?তার বাবা খুব বড় রাজনীতিবিদ ছিলেন,মানুষ তাকে খুব পছন্দ করত।এই ঠুনকো কারণে আরহাম নমিনেশন পেয়ে গেল?বাবা ভালো রাজনীতিবিদ।এর মানে কি ছেলেও ভালো রাজনীতিবিদ হবে?ফাহাদ কি প্রতিদান পেল?সে তো কেবল দলের জন্য করেই গেল।

ফাহাদ শীতল চক্ষু মেলে সবটা দেখল।এই উচ্ছ্বাস,এই আনন্দ।সবকিছু।শরীরের ভেতরটা পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।আরহামের সাথে তার চোখাচোখি হতেই আরহাম কুটিল হাসল।হাত তুলে সালাম দিল।তার চোখে মুখে রাজ্য জয়ের হাসি।

ফাহাদ চোখ সরিয়ে নিল।ঐ ছেলেকে দেখলেই তার মাথায় খুন চেপে যায়।অস্থির লাগে।নিজেকে কলুর বলদ বলে মনে হয়।ফাহাদ আর এক মুহুর্তও দাঁড়াল না।পার্কিং এরিয়া তে তার গাড়ি রাখা ছিল।সে দ্রুত গাড়িতে উঠে সেখান থেকে কেটে পড়ল।তার গন্তব্য তার বাসভবন।

সে চলে যেতেই আরহামের দলের ছেলেরা সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠল।তোফায়েল দাঁত কেলিয়ে বলল,’শালা লজ্জায় পালাইছে।’

আরহাম সানগ্লাসটা একবার খুলে পুনরায় সেটা চোখের উপর চাপিয়ে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’অনেক হয়েছে।এবার চল।হাতে তেমন সময় নেই।কাজে লেগে পড়তে হবে।’
.
.
.
.
রাগ উঠলে জিনিস ভাঙচুর করা কিছু মানুষের জন্মগত স্বভাব।ফাহাদ তাদের একজন।বাড়িতে ফিরতেই সে সবার প্রথমে তাদের ড্রয়িং রুমের খুব দামি টি টেবিলটি এক আছাড় মেরে ভেঙে গুড়িয়ে দিল।কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দে পুরো ঘর ঝনঝন করে উঠল।

আমেনা খাতুন আওয়াজ পেয়েই এক প্রকার ছুটে এলেন।আঁতকে উঠে বললেন,’কি হয়েছে ফাহাদ?এমন করছিস কেন?’

ফাহাদ টি-টেবিল ভেঙেই ক্ষান্ত হয়নি।সে তারপর খুব সুন্দর দেখতে কয়েকটা ফুলদানি ভাঙল।শো কেসে অসংখ্য কাঁচের জিনিস,মার্বেল পাথরের শো পিস সহ আরো অনেক জিনিস তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল।ফাহাদ সেগুলোর অর্ধেকের বেশি ভাঙলো।আমেনা খাতুন সাবধানে পা ফেলে তার কাছে এগিয়ে এসে শক্ত করে তার হাত ধরে বললেন,’এসব কি ফাহাদ?এভাবে জিনিস ভাঙছিস কেনো?’

ফাহাদ থামল।মায়ের উৎকন্ঠা মেশানো মুখটা দেখে সে তার হাতে থাকা মার্বেল পাথরের শো পিস টি না ভেঙে সোফার উপর ছুড়ে মেরে হনহনিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

তাসলিমা ভাঙচুরের আওয়াজ পেয়ে এলোমেলো পা ফেলে ড্রয়িং রুমের দরজা পর্যন্ত এসেছিলেন।ফাহাদের এসব ভাঙচুর নতুন না।তবে আজ তাকে বেশ ক্ষিপ্ত দেখাচ্ছে।আমেনা খাতুন তাকে দেখামাত্রই আদেশের সুরে বললেন,’তাসলিমা ঝাড়ু এনে দ্রুত রুমটা পরিষ্কার করো তো।’

তাসলিমা মাথা নিচু করে মিনমিন করে জবাব দিলেন,’জ্বী আপা করছি।’

আমেনা খাতুন ছেলের দুশ্চিন্তায় মরিয়া হয়ে ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।তাসলিমা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে কাজে লেগে পড়লেন।দোতালা থেকে নোমান সাহেবের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।তিনি গলা উঁচিয়ে ডাকছেন,’তাসলিমা! এ্যাই তাসলিমা।তোমাকে না বলেছিলাম আমার পাঞ্জাবিটা ইস্ত্রি করে রাখতে?কোথায় আমার পাঞ্জাবি?’

তাসলিমা ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁচগুলো দেখতে দেখতেই দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’একটু অপেক্ষা করুন।আমি আসছি।’

ফাহাদদের যৌথ পরিবার।কাজের কোনো শেষ নেই।বাড়িতে কাজ করার জন্য পরিচারিকা থাকলেও সব কাজ তাদের হাতে করানো হয় না।বাড়ির অধিকাংশ কাজ করতে হয় তাসলিমাকে।তাসলিমার অবস্থান এই বাড়িতে ঠিক ধুলো মাখানো ফার্নিচারের মতো।যাকে ভালোবাসা তো হয়ই না,উল্টো যেই ন্যুনতম যত্ন করার প্রয়োজন সেই টুকুও করা হয় না।তাসলিমা হাসলেন।সেই হাসির আড়ালে অসংখ্য গল্প লুকিয়ে আছে।অনেকগুলো দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে আছে।তাসলিমা জানে তার সাথে কোনো অন্যায় হচ্ছে না বরং প্রকৃতি তার কাছে একটু একটু করে সব ফিরিয়ে দিচ্ছে।

পুরো ঘর পরিষ্কার করে তাসলিমা গেলেন তার আর নোমান সাহেবের শোয়ার ঘরে।আলমারিতে পাঞ্জাবি রাখা আছে।তিনি পটু গৃহিণীর মতো নিঃশব্দে একে একে সবগুলো কাজ করলেন।পাঞ্জাবি আর পায়জামা ইস্ত্রি করার পর আলমারির ভেতর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাপড় গুলো ভাজ করলেন।

নোমান সাহেব বিরক্ত মুখ করে বললেন,’এতোক্ষণে তোমার ইস্ত্রি করার কথা মনে পড়েছে?সারাদিন কি করো তুমি?’

তাসলিমা জবাব না গিয়ে কাজে মন দিলেন।সে সারাদিন কি করে এটা বাড়ির কারো অজানা না।বাড়ির ছোট বড় সব কাজই তাসলিমা তার হাতে সামলান।তাসলিমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই কাজ গুলো তার প্রাপ্য।এই অবহেলা,ভৎসনা,বাজে ব্যবহার কিংবা তুচ্ছতাচ্ছিল্য-পুরোটাই তার প্রাপ্য।তাসলিমা তো কর্মফল ভোগ করছে।কথায় আছে,পাপ বাপকেও ছাড়ে না।তাহলে সেটা তাসলিমাকে ছাড়বে কেনো?

বিকেল হতেই নাস্তার টেবিলে নোমান সাহেব,তার ভাই খালেদ সাহেব আর ফাহাদকে পাওয়া গেল।বাকিরা কেউ বাড়ি নেই।খালেদ সাহেব তার ছেলের আজকের আচরণে খানিকটা বিরক্ত।তিনি কিছুটা শাসনের সুরেই ছেলেকে বললেন,’এসব বাচ্চামো কেন করছ ফাহাদ?তুমি তো এতোটাও অবুঝ নও।অল্প বিষয়েই ভাঙচুর করার অভ্যাসটা বাদ দাও।যা হয়েছে তা মেনে নাও।’

‘মেনে নেব?যা হয়েছে সেটা মেনে নেব বাবা?’ চেঁচিয়ে উঠে ফাহাদ।
‘আমি এই দলের জন্য কি না করেছি?পরিশ্রম করে করে এই জায়গা পর্যন্ত আসতে হয়েছে।যখন এই সরকার ক্ষমতায় ছিল না,তখন আমাকে জেলেও যেতে হয়েছে।চৌদ্দ শিকের ভাত খেয়ে আজ আমি এখানে এসেছে।রাজনীতির জন্য কতোটা পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আমার জানো?আর নমিনেশন পেয়ে গেল ঐ আরহাম?কি যোগ্যতা আছে তার?কি স্যাক্রিফাইস করেছে সে তার দলের জন্য?কিছুই তো না।কেবল বাবার রাজনৈতিক ট্যাগ গায়ে মাখিয়ে দিব্যি নমিনেশন নিয়ে নিল।রাস্তা অবরোধের বিষয়টি নিয়ে কয়জন তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে?তার উপর ঐ মেয়েটিও নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়েছে।সবকিছু তো ঐ আরহামের মন মতোই হচ্ছে।আমি কিভাবে শান্ত আর নির্লিপ্ত থাকবো কেউ বলতে পারো?’

তাসলিমা কেতলি থেকে সবার কাপে চা ঢেলে দিচ্ছিলেন।ফাহাদের কথা শুনতেই আচমকা তার হাত থেকে কেতলিটা সামান্য অবস্থানচ্যুত হলো।ফলস্বরূপ কিছুটা চা ছিঁটকে এদিক সেদিক গিয়ে পড়ল।নোমান সাহেব বিরক্ত হয়ে কর্কশ গলায় বললেন,’সমস্যা কি তোমার?দেখো না নাকি?এভাবে এদিক সেদিক চা ফেলছ কেন?’

তাসলিমা দ্রুত টিস্যু দিয়ে টেবিলের উপর পড়ে থাকা তরল টুকু মুছে নিলেন।সামনে থাকা কাপে ঠিকমতো চা ঢালতেই নিঃশব্দে সরে এলেন।ফাহাদ একটু আগে কার নাম বলল?আরহাম?আরহামের কথাই কি বলছিল সে?তাসলিমার ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠে।চোখ দু’টো মনের অজান্তেই আর্দ্র হয়।

তিনি ধীর গতিত এগিয়ে লিভিং রুমে আসেন।দরজা চাপিয়ে দেন অতি সন্তর্পণে।তার হৃদপিণ্ড চলছে স্বাভাবিকের চেয়েও ভীষণ দ্রুত গতিতে।তাসলিমা নিজেকে শান্ত করতে গিয়ে আবিষ্কার করল তিনি সময়ের সাথ সাথে ভীষণ রকমের অস্থির হয়ে যাচ্ছেন।

আর কিছু না ভেবে তিনি টেবিলের উপর পড়ে থাকা রিমোট চেপে টেলিভিশন চালু করলেন।দেশীয় সংবাদ মাধ্যম গুলোতে নির্বাচন নিয়ে বিভিন্ন সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে,কোথাও আবার টক শো চলছে মনোনীত প্রার্থীদের নিয়ে।কোথাও আবার মনোয়ন পাওয়ার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কিংবা অনুভূতি ব্যক্ত করার ভিডিও ক্লিপ প্রচার করা হচ্ছে।

তাসলিমা প্রচন্ড উৎকন্ঠা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।একটি চ্যানেলে সরকার দল থেকে মনোনীত প্রার্থীদের নাম আর মনোনয়ন পাওয়ার পর তাদের প্রতিক্রিয়ার পর্যায়ক্রমিক ভিডিও দেখানো হচ্ছে।প্রতিটি আসন থেকে মনোনীত প্রার্থীরা কয়েক বাক্যে সামান্য কিছু বলেই যার যার গাড়িতে চেপে প্রশাসনিক ভবন ছেড়ে চলে যাচ্ছে।

তাসলিমা অপেক্ষা করছেন একটি মুখ দেখার।তার সেই কাঙ্ক্ষিত মুখটি কখন আসবে?একটার পর একটা প্রার্থীর মুখ স্ক্রিনের সামনে ভেসে উঠে আর তাসলিমার নিশ্বাসের গতি বাড়ে।মনে হয় একটু পরেই তার দম বন্ধ হয়ে আসবে।

অবশেষে তাসলিমার অপেক্ষার পালা শেষ হলো।৪২ ইঞ্চি টেলিভিশনের বিরাট পর্দায় ভেসে উঠল একটি হাস্যোজ্জ্বল মুখ।বাকি সদস্যদের চেয়ে সে আলাদা,বয়সে তাদের চেয়ে বেশ খানিকটা ছোট।কতই বা হবে বয়স?একত্রিশ কিংবা বত্রিশ।সে মহানগর-০৪ আসনের মনোনীত প্রার্থী।তার নাম শেখ শাহরিয়ার আরহাম।

তামলিমা শাড়ির আঁচলটা মুখে চেপে ধরে পিছিয়ে গেলেন দুই কদম।টেলিভিশনের পর্দায় দেখানো ছেলেটার মুখটা এতো স্নিগ্ধ কেন?সাংবাদিক তার হাতের মাইক যুবকের দিকে বাড়িয়ে দেয়,জানতে চায় তার প্রতিক্রিয়া।যুবকটি হাসে।স্নিগ্ধ হাসি ধরে রেখেই জবাব দেয়,’মনোনীত হয়েছি।বিজয়ী হইনি এখনো।বাবার আদর্শে দেশ গড়তে চাই।ইনশাআল্লাহ দেখা হবে বিজয়ে।”

তাসলিমা এক দৌঁড়ে ছুটে গেলেন টেলিভিশনের সামনে।হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন পর্দায় ফুটে উঠা সেই সুপুরুষ মুখখানা।কতো বড় হয়ে গেছে আরহাম! তীব্র অভিমানে মুখ ফুলিয়ে নেওয়া,দিনভর মায়ের ন্যাওটা হয়ে ঘুরে বেড়ানো ছেলেটার কথা তাসলিমা কেমন করে ভুলবে?ঐটুকু বাচ্চা ছেলেটা নাকি নির্বাচন করবে।আবার নাকি প্রথম চেষ্টায় মনোনয়নও পেয়ে গেছে।

তাসলিমার চোখ একটু পর পর ভিজে যাচ্ছে।মুখে শাড়ির আঁচল গুজে কান্না থামানোর ব্যর্থ প্রয়াসে তিনি ব্যস্ত।এই যুবকটিকে তিনি একবারের জন্য ছুঁয়ে দেখতে চান,জড়িয়ে ধরতে চান শক্ত করে।যুবকটি কি তার সেই আর্তনাদ বুঝতে পারবে,শুনবে কি তাসলিমার বিভৎস জীবনের গল্প?

আচমকা ফুপিয়ে উঠলেন তাসলিমা।ধপ করে বসে পড়লেন মেঝেতে।ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন,’আরহাম! আমার আরহাম! খুব বড় হও বাবা।জয়ী হও।দূর থেকে জানবে কেউ একজন তোমার জন্য এক আকাশ ভালোবাসা পাঠিয়েছে।তুমি বড্ড অভিমানী! কিন্তু তা সত্ত্বেও মা তোমায় ভালোবাসি!’

চলবে-

কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-০৯

0

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৯)

শুভ্রানী কি অনেক বেশি সুন্দর?কই সে তো খুবই সাধারণ দেখতে।তাহলে তার পিছে এই বখাটে গুলো সবসময় পড়ে থাকে কেন?কলেজে কতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে।লাইন মারতে চাইলে তাদের সাথে গিয়ে মারুক।শুভ্রার সাথে এতো কি?

প্রথম প্রথম শুভ্রা এসব ভীষণ ভয় পেত।এখন আর তেমন ভয় পায় না।কেবল তারা আশে পাশে থাকলে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।তবে মাঝে মাঝে তার সত্যিই ক্লান্ত লাগে ভীষণ।তার জন্য পরী আপাইয়ের ভোগান্তি আরো বেড়েছে।আপাই মাঝে মাঝেই সময় করে তাকে নিতে আসে কলেজ থেকে।এমনিতেই আপার এতো কাজ।তার উপর এর সাথে যুক্ত হয়েছে শুভ্রানীর উটকো ঝামেলা।

মেইন রোডে আজ ডজন খানেক ছেলে।এদের সামনে দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কিংবা সাহস কোনোটাই শুভ্রার নেই।সে সিদ্ধান্ত নিল সে অন্য রাস্তা দিয়ে সামান্য ঘুরে যাবে।

সে আজ মূল সড়কের বদলে অন্য একটা গলি দিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে ঠিক করেছে।এই গলি দিয়ে সে আগে বাড়ি ফিরেছে কয়েকবার।তবে আজকে চারদিক বেশ নিরব।শুভ্রা গুনগুন করে গান ধরে দুই হাতে ব্যাগের ফিতা টানতে টানতে হাঁটা শুরু করল।

গলির শেষ মাথায় কয়েকটা কুকুর ঘুরাঘুরি করছিল।এদের দেখামাত্রই শুভ্রা থেমে গেল।সামনে দেখতেই তার মুখটা শুকিয়ে কিসমিসের মতো চুপসে গেল।সে কুকুর সাংঘাতিক রকমের ভয় পায়।হাত দিয়ে নাকের চারপাশের ঘামটুকু মুছে নিল সে।গান বন্ধ করে যত রকম দোয়া জানা ছিল তার,সেগুলোই সে এক নাগাড়ে পড়তে শুরু করল।আপাই বলেছে কুকুর দেখে ভয় পেলে কুকুর আরো বেশি ভয় দেখায়।কুকুর দেখলে ভয় পাওয়া যাবে না।বরং কুকুরকে পাত্তা না দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।

শুভি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে কুকুরকে পাত্তা দিবে না।কিন্তু এক পা সামনে এগোতেই তার মনে হলো তার কলিজা এক লাফে তার গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে।আর এক পা সামনে ফেললেই সেটা ফুড়ুৎ করে তার হাতে এসে যাবে।

দু’টো কুকুর রাগী রাগী চোখ করে শুভ্রানীকে দেখছিল।ভাব এমন যেন শুভ্রা তাদের হাড্ডির লোভ দেখিয়ে ঘাস ধরিয়ে দিয়েছে।শুভ্রা চোখ মুখ খিঁচে দুরুদ পড়তে পড়তে দুই কদম সামনে গেল।ঠিক তক্ষুনি রাগী রাগী মুখের কুকুর দু’টো প্রচন্ড শব্দ করে ডেকে ওঠল।ব্যাস,এতেই শুভ্রা ভয়ে এক লাফে কয়েক হাত পিছিয়ে গেল।ভয়ে ভয়ে বলল,’আল্লাহ গো,আজ বাঁচিয়ে দাও প্লিজ।’

আপাই ঠিকই বলত।কুকুরের সামনে ভয় পেলেই কুকুর ভয় দেখায়।এই যে সামান্য ডাকেই শুভ্রানী ভয়ে আঁতকে উঠেছে,এতেই কুকুর দু’টো ঘেউ ঘেউ করতে করতে তার দিকে ছুটল।ব্যাস,শুভ্রা কে আর পায় কে?সে হাত পা ছুড়ে এক চিৎকার দিয়ে ভোঁ দৌড় দিল উল্টো পথে।

শুভ্রা ছুটতে তো ছুটছেই।তার পেছন পেছন ছুটছে দু’টো কুকুরও।শুভ্রা কোথায় যাচ্ছে,চারপাশে কি হচ্ছে সেসব কিছুই সে জানে না।সে কেবল উন্মাদের মতো ছুটছে আর মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।কুকুর দু’টো খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছে।শুভ্রা দৌঁড়ের গতি বাড়াল।তার পা অবস হয়ে যাচ্ছে,গলা এতোক্ষণে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।তবুও শুভ্রা থামল না।দৌঁড়ের মাঝেই সে এক দফা কেঁদে নিল।চিৎকার করে বলল,’আপাই! বাঁচাও আমাকে!’

গলির মাথায় তখন কুচকুচে কালো একটি টয়োটার গাড়ি প্রচন্ড গতি নিয়ে গলির ভেতর প্রবেশ করল।ফাঁকা রাস্তা দেখেই গাড়ির চালক স্বাভাবিকের তুলনায় সামান্য বেশি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল।কিন্তু যখনই সে দেখল একটি মেয়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে গলির ভেতর ছুটোছুটি করছে এবং তার গতি একেবারে গাড়ির অভিমুখে তখনই গাড়ির চালক সজোরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরল।

শুভ্রা যখন দেখল তার আর কালো রঙের গাড়িটির মাঝে দূরত্ব কেবল কয়েক হাতের,তখনই সে দু’হাত কানে চেপে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিকট চিৎকার দিলো।গাড়িটি থামল।একেবারে শুভ্রার গা ঘেঁষে থামল।গাড়ির চালক তৎক্ষণাৎ সিট বেল্ট খুলে বেরিয়ে এলো।শুভ্রা যতখানি ভয় পেয়েছে,সে ভয় পেয়েছে তার চেয়েও বেশি।

আরিশ গাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।শুভ্রা এখনো চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে যাচ্ছে।আরিশ ভয়ে ভয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।মিনমিনে গলায় বলল,’চিৎকার বন্ধ করো।এক্সিডেন্ট হয়নি তোমার।ঠিক আছো তুমি?’

মেয়েটি সাথে সাথেই চিৎকার থামাল না।যখন টের পেল সে একদম ঠিক আছে,কালো গাড়িটি তাকে পিষিয়ে দেয়নি,তখনই সে আস্তে আস্তে কান থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলল।দেখতে পেল তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে সাদা টি শার্ট গায়ে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ বড় বড় হয়ে গেল শুভ্রার।এতো সুন্দর ড্রাইভার!

ছেলেটি এগিয়ে এলো।সন্দিহান গলায় বলল,’ঠিক আছো তো?’

শুভ্রা উপরনিচ মাথা নাড়ল কেবল।তার প্রচন্ড পানি খেতে ইচ্ছে করছে।ছেলেটার কাছে চাইবে কি?

তার অবশ্য পানি চাইতে হলো না।ছেলেটি নিজেই গাড়ির ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে সেটা শুভ্রার দিকে এগিয়ে দিল।শুভ্রা বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটি লুফে নিল।চুপচাপ কয়েক ঢোক পানি খেয়ে পুনরায় সেটি আরিশের নিকট ফিরিয়ে দিলো।

আরিশ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,’নাম কি তোমার?অমন করে ছুটছিলে কেন?’

লজ্জায় শুভ্রা দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল।সে কেমন করে বলবে এই ছেলেকে যে সে কুকুরের দৌঁড়ানি খেয়ে এই অব্দি এসেছে?সে দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না।কেবল অল্প কথায় জবাব দিলো,’আমার নাম পুষ্পিতা নূর।ডাক নাম শুভ্রানী।’

আরিশ মাথা নাড়ল।নিরেট স্বরে বলল,’নাইস নেইম।শুভানী।’

শুভ্রা পাল্টা প্রশ্ন করল,’আপনার নাম কি?’

আরিশ হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আমার নাম শেখ সাদিকুর আরিশ।’

জবাবে শুভ্রা ঠিক তার মতো করেই ঠোঁট নেড়ে বলল,’নাইস নেইম।আরিশ।’

তার বলার ধরন দেখেই আরিশের হাসি পেল।শুভ্রা কপাল কোঁচকাল।সে কি ভুল কিছু বলেছে?লোকটা এমন হাসছে কেন?

‘তো মিস শুভ্রানী,আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন এমন দৌঁড়ে দৌঁড়ে?বাসা কোথায়?’ বেশ সাবলীলভাবে প্রশ্ন করল আরিশ।

শুভ্রা রিনরিনে স্বরে জবাব দিলো,’জ্বী মালিবাগে।আমি সেখানেই থাকি।’

আরিশ মাথা ঝাকালো।গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বলল,’তুমি কিছু মনে না করলে আমি তোমাকে ড্রপ করে দিতে পারি।আমি মতিঝিল যাচ্ছি।’

শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত নেড়ে হড়বড় করে জবাব দিল,’না না,তার কোনো দরকার নেই।আমি চলে যেতে পারব।’

আরিশ স্মিত হাসল।টি শার্টের গলার কাছ ঝুলিয়ে রাখা সানগ্লাসটা চোখের উপর চাপিয়ে সে হাত দিয়ে তার চুলগুলো ঠিক করে নিল।অমায়িক হেসে বলল,’ওকে।আমি তাহলে আসি।’

‘এটা কি আপনার গাড়ি?’ ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল শুভ্রা।

নিজের প্রশ্নে শুভ্রা নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করল।তার মনে হচ্ছে এই প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি।অথচ তার কৌতূহলী মন।সেই তখন থেকেই এই প্রশ্ন তার মনে খচখচ করে যাচ্ছিল।

আরিশ ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,’আমার না আসলে,এটা আমার ভাইয়ার গাড়ি।বাড়ির সবাই এটা ব্যবহার করে।আজ আমি নিয়ে বেরিয়েছি এই যা।’

শুভ্রা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল।এক শব্দে বলল,’ওহহ’

তারপর আর কথা না বাড়িয়ে দুই হাত ব্যাগের ফিতায় চেপে মাথা নিচু করে সে পুনরায় বাড়ির পথ ধরল।হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে হলো বাবা বেঁচে থাকলে আজ শুভ্রাও এমন গাড়িতে চড়তে পারত।বাবা মায়ের কিছু স্মৃতি শুভ্রার মনে আছে।মনে আছে স্যুট-টাই পরা একটা লোক খুব দামি গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরতেন।কখনো কখনো আপাই আর শুভ্রাকে নিয়ে মাঝরাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।মা ভীষণ চেঁচামেচি করতেন এই নিয়ে।কিন্তু বাবা নামের মানুষটা সে কথা কানে তুলতেন না।কতো সুন্দর ছিল সেই জীবন! অর্থ বিত্ত আভিজাত্য কোনো কিছুরই তো কমতি ছিল না।মাঝে মাঝে শুভ্রানীর মনে খুব কৌতূহল জাগে।মনে হয় আপাই কেমন করে এই নিম্নবিত্ত জীবনে মানিয়ে নিচ্ছে?আপাই তার জীবনের দীর্ঘসময় কাটিয়েছে অর্থ বিত্ত আর জৌলুসের মধ্যে থেকে।তারপর হঠাৎ এই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এই রকম জীবনে কেমন করে মানিয়ে নিয়েছে আপাই?

শুভ্রানীর ধারণা সারাদিন পরী পরী শুনতে শুনতে আপাই সত্যিই পরী হয়ে গেছে।পরী আপাই শুভ্রার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ।আপাই এতোটাই ভালো যে মাঝে মাঝে তাকে মানুষের সাথেও মেলানো যায় না।আপাই কোনোদিন নিজের খাওয়া,নিজের পরা নিয়ে ভাবে না।তার জীবনের সমস্ত ধ্যান জ্ঞান শুধু তার শুভি আর চিত্রকে নিয়ে।আপাই কেবল তাদের দিয়েই যাচ্ছে।শুভ্রার ভীষণ ইচ্ছে হয় একদিন সেও আপাইয়ের জন্য কিছু করবে।খুব বড়ো ডাক্তার হবে সে।তারপর আপার চিকিৎসা করবে।আর কোনো কাজ করতে দিবে না আপাকে।তখন আপাইয়ের ছুটি।

আকাশে গম গম শব্দ হয়।শুভ্রার চোখ ভিজে যায়।তার মস্তিষ্কে মা বাবার অস্তিত্ব অনেকটাই ঘোলাটে।পরী আপাই বাদে তার আর চিত্র’র জীবনে কেউ নেই।খুব বেশি বিপদে পড়লে কিংবা খুব বেশি কষ্ট পেলে যেই চেহারাটা শুভ্রার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটা তার পরী আপাই।আপাই রোজ রোজ বলে তার পুরো পৃথিবীটাই নাকি শুভি আর চিত্র।শুভ্রা কোনোদিন জোর গলায় বলতে পারে না আমাদের পৃথিবীটাও শুধু তুমি আপাই।শুভ্রা আলগোছে চোখ মুছে।আপাই এতো ভালো কেন?এতো কেন ভালোবাসে তাদের?একটু কম ভালোবাসলে কি ক্ষতি?
.
.
.
.
কাল আরো একটা ক্লাস টেস্ট আছে।শুভ্রা বাড়ি ফিরে গোসল শেষ করে চিত্রাকে খাইয়ে দিলো।তারপর ঠান্ডা মাথায় পড়তে বসল।এখন সময় বিকেল চারটা।চিত্র ঘুমাচ্ছে খাটের ঠিক মাঝামাঝি হাত পা ছড়িয়ে।এই সময়টা বাড়ি নিরব থাকে।মামি এসময় বাড়ি থাকে না,পাড়া বেড়ায়।প্রথা তো কখনোই ঠিক মতো বাড়ি থাকে না।কেবল টাকার প্রয়োজন হলে বাড়ি আসে আর চিৎকার চেঁচামেচি করে।

চারটা বাজার একটু পরেই বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠল।কপালে ভাঁজ পড়ল শুভ্রার।অদ্ভুত তো! এই সময় কে এসেছে?কেমিস্ট্রি বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো শুভ্রা।অসময়ে বাড়িতে কেউ এলে বুক টিমটিম করে।শুভ্রারও করছে।তার ভাবনার মাঝেই কলিংবেলে আবারো চাপ পড়ল।

শুভ্রা গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গেল।দরজার কাছে গিয়ে আওয়াজ উঁচু করে জানতে চাইল,’কে?কে এসেছেন?’

অপরপাশ একদম নিরব।শুভ্রা কড়া গলায় বলল,’নাম না বললে দরজা খুলব না।’

দরজার অন্যপাশ থেকে এবার উত্তর এলো।তেইশোর্ধ তরুণী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,’আমি শ্যাওড়া পাড়ার পেতনী।এবার দরজা খোল বেয়াদব।’

চমকে গেল শুভ্রা।এটা তো আপাইয়ের গলা।এক দৌঁড়ে ছুটে গিয়ে সে দরজা খুলে দিলো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপাই তুমি?এই সময়ে?’

নবনীতা ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে কোনোরকম ঘরে ঢুকল।শুভ্রার কথার জবাব না দিয়ে উল্টো তাকে ধমকে ওঠল,’সমস্যা কি তোর?এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?ঘুমিয়ে যাস নাকি?’

শুভ্রা দরজা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিল,’আরে আপাই তুমি আসবে সেটা কি আমি জানতাম নাকি?তুমি তো কখনো এই সময়ে আসো না।’

‘কেন?এই সময়ে আসাতে কি তোর সমস্যা হচ্ছে?কষ্ট হচ্ছে?হলে বলে দে।চলে যাই আমি।’

শুভ্রা পড়েছে মহা বিপাকে।সে কখন চলে যেতে বলল?আপাই সবকিছুতে এমন রেগে যাচ্ছে কেন?সে ঝটপট একগ্লাস পানি তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।তড়িঘড়ি করে বলল,’তুমি পানি খাও।মাথা ঠান্ডা করো তোমার।’

নবনীতা চেয়ার টেনে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসল।একটু পানি খেয়েই প্রশ্নাত্মক চাহনি তে জানতে চাইল,’চিত্র কোথায়?খেয়েছে কি দুপুরে?’

‘হু।আমি এসে খাইয়ে দিয়েছি।’

‘কালকে পরীক্ষা আছে?’

‘আছে।কেমিস্ট্রি সেকেন্ড পেপার।পরিমানগত রসায়ন।’

‘যা গিয়ে পড়তে বস।’

শুভ্রা গটগট করে হেঁটে চলে গেল।আপার আজ মাথা গরম।কাছে থাকলেই কথা শুনতে হবে।এর চেয়ে দূরে দূরে থাকাই ভালো।

নবনীতা কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিল।আজ লুবনাকে পড়াতে হয়নি।লুবনা মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে।লুবনা ছাড়াও নবনীতা আরো দুই জায়গায় টিউশন করে।সৌভাগ্যক্রমে আজ কোনোটাই করাতে হয়নি।কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নবনীতা হাতের প্যাকেট টা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

আসার সময় সে আধা লিটার দুধ কিনে এনেছে।সে মাঝে মাঝেই এমন হুটহাট কেনাকাটা করে।আধা লিটার দুধ খুব বেশি কিছু না,তবে নবনীতার কমজোর পকেটের কাছে সেই খরচা টাও নগন্য না।

সে রান্নাঘরে গিয়েই দুধটা ভালো মতো জ্বাল করে নিল।তারপর একটা বড়ো কাপে প্রায় অর্ধেকের বেশি দুধ ঢেলে বাকিটা অন্য একটা চোখ কাপে ঢেলে নিল।

মিসেস রোকেয়া বাড়িতে এসেই সবার প্রথমে রান্নাঘরে গেলেন।দুই হাতে দু’টো গ্লাস নিয়ে নবনীতা রান্নাঘর থেকে বের না হতেই রোকেয়া তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।কাপের দিকে চোখ রেখে বললেন,’এটা কি?কার জন্য এনেছ?’

নবনীতা একটা শ্বাস ছেড়ে জবাব দিল,’মামার জন্য এনেছি।মামার এখন এই ধরনের খাবার দরকার।’

‘আরেকটা?আরেকটা কার জন্য? চোখ পাকিয়ে জানতে চাইলেন মিসেস রোকেয়া।

নবনীতা নিরাসক্ত,খানিকটা বিরক্তি মেশানো গলায় বলল,’আরেকটা শুভির জন্য।’

‘কেন?শুভ্রা কি বিশেষ কেউ?’

‘বিশেষ কেউ না।কাল তার পরীক্ষা।তাই ভাবলাম বাকিটুকু তাকে দিয়ে দেই।’

‘বাহ খুব ভালো।নিজের দুই বোন ছাড়া তো আর কিছুই তোমার চোখে পড়ে না।’

নবনীতা ক্লান্ত চোখে একবার মিসেস রোকেয়াকে দেখল।গুরুজনদের সাথে বেয়াদবি করা তার পারিবারিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত না।কিন্তু মামিকে কেমন করে ঠান্ডা মাথায় সহ্য করতে হয়,সেটাও নবনীতার জানা নেই।নবনীতা তার সামনে নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না।উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট নিশপিশ করে।

তবুও সে ধৈর্য না হারিয়ে একেবারে ঠান্ডা গলায় বলল,’মামি আমি কখনোই চিত্র কিংবা শুভির জন্য খুব বেশি আলাদা কিছু করি না।কিন্তু শুভির তো অনেক পড়ার চাপ।একটু ভালো খাবার না খেলে এতো পড়াশোনার চাপ নেবে কেমন করে?’

মিসেস রোকেয়া মুখটাকে পেঁচার মতো করে ন্যাকা সুর টেনে বললেন,’বোন তো তোমার আরেকজনও আছে।তার কথা তো কখনো ভাবো না।তার সাথে তোমার যতো হিংসে!’

নবনীতা হাসল।ঠিক কোনো একটা রসিকতার জবাবে যেমন করে হাসে,ঠিক তেমন করে হাসল।প্রথাকে সে কেনো হিংসে করবে?প্রথার মাঝে কি আছে যেটা দেখে নবনীতা তাকে হিংসে করবে?এই প্রশ্নটা মামিকে করা যায়।কিন্তু মামি এক উত্তরে আধ ঘন্টা চিল্লাফাল্লা করবে।তার বেরস ফাঁটা বাঁশের মতো গলা শুনলেই নবনীতার মাথা ব্যথা শুরু হয়।

সে মিসেস রোকেয়াকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল।যেন সে তার কোনো কথা শুনতেই পায়নি।রোকেয়া দাঁত চেপে গিরগির করে উঠলেন,’অন্যের বাড়িতে থাকে,কিন্তু ভাব এমন যেন এটা তার বাড়ি।দু’পয়সার যোগান দিয়েই নিজেকে বাড়ির মালিক ভাবে।’

****

সন্ধ্যার পর নবনীতার ফোনে রিমির কল এলো।রিসিভ করার সাথে সাথেই অন্যপাশ থেকে চটপটে গলায় রিমি বলল,’নবনী তেইশ তারিখ কিন্তু অবশ্যই ভার্সিটিতে আসবি।সাথে চিত্র আর শুভিকেও নিয়ে আসবি।’

নবনীতা চোখ সরু করে বলল,’কিন্তু কেন?তাদের কে কেন সাথে নিবো?’

‘কাল কলেজে একটা কালচারাল ফেস্ট।সবাই সবার ভাই বোনদের নিয়ে আসবে।তুইও তাদের নিয়ে আসবি।বুঝলি?’

‘ধ্যাত।এসব ফেস্ট টেস্ট আমার ভালো লাগে না।তুই যা।আমি যেতে পারব না।’

‘তোর ভালো না লাগলে নাই।শুভি আর চিত্র’র তো ভালো লাগে।তুই তাদের নিয়ে আয়।তুই না হয় চব্বিশ না হতেই বুড়িয়ে গিয়েছিস।বাচ্চাগুলো তো এখনো ছোট।তাদের দিকটা তো অন্তত ভাব।’

নবনীতা আর না পেরে বলল,’থাক হয়েছে।এদেরকে আমি সময় করে ঠিকই বেড়াতে নিয়ে যাই।তাছাড়া শুভির ক্লাস টেস্ট আছে তেইশ তারিখ।কীভাবে যাব বল?’

‘চিত্র কে নিয়ে আয়।শুভি তো কলেজের জন্য প্রায়ই বাইরে যায়।চিত্র তো সারাদিন এই চার দেয়ালে বন্দি।চিত্রকে সাথে নিয়ে আয়।’

নবনীতা পরাজিত সৈনিকের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল,’আচ্ছা বাবা হয়েছে।দেখছি আমি ব্যাপারটা।কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি আমি কিন্তু কোনো শিওরিটি দিতে পারব না।না আসলে মন খারাপ করিস না কিন্তু আবার।’

রিমি বোধ হয় প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।এরপর আর সে কোনো জোরাজুরি করল না।নবনীতা ফোন রেখে চিত্রার কাছে গিয়ে চিত্রার চুলের ঝুটিতে আলতো করে টান দিয়ে বলল,’এই চিত্র! তুই কি আপাইয়ের সাথে বাইরে যেতে চাস?’

প্রশ্ন শুনতেই চিত্রার চোখ দু’টো খুশিতে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠল।সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে জানাল সে যেতে চায়।নবনীতা চোখ পাকিয়ে আঙুল তুলে কড়া গলায় বলল,’নিয়ে যেতে পারি।তবে আমার শর্ত আছে একটা।’

চিত্রা গাল ফুলিয়ে মুখটাকে দুখী দুখী করে বলল,’আবার কি শর্ত আপাই?’

‘শর্ত হচ্ছে তুমি আপাইয়ের হাত ছাড়বে না।এদিক সেদিক কোথাও যাবে না।চুপটি করে ভালো মেয়ের মতো বসে থাকবে।রাজি তো?’

চিত্রা দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়ল।বুড়ো আঙুল তুলে পাকামো করে বলল,’ওকে।রাজি পরী।আমি রাজি।’

নবনী তার গালে ছোট করে চিমটি কেটে বলল,’খুব পাকা হয়েছিস না?পরী পরী করে ডাকছিস যেন তোর ছোট আমি।’
.
.
.
.
‘ভাই একেবারে অথেনটিক নিউজ।ঐ ফাহাদ সেদিন রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নবনীতা মেয়েটার সাথে কি যেন কথা বলেছে।’

রনি থামল।চোখ তুলে দেখল আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।সে থামতেই আরহাম চোখ সরু করে বলল,’কিন্তু কেন?কেস কি?কিছু জানিস?’

‘না ভাই।তবে এটাই প্রথম না।শুনেছি ঐ নবনীতা নাকি এর আগেও ফাহাদের অফিসে গিয়েছিল একবার।’

আরহাম উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন অশালীন ইঙ্গিত করে বলল,’বাপরে! একেবারে অফিস পর্যন্ত ঢুকে গেছে।ঠিক মতো খবর নিলে জানা যাবে শোয়ার ঘরেও যাতায়াত আছে।’

সবুজ ভেবেছিল ভাইয়ের অপছন্দের মানুষটি কে নিয়ে নিছক মজার ছলে একটা কুৎসিত বাক্য বলে দিলেই হয়তো ভাইসহ পুরো রুমের মানুষ হাসিতে ফেটে পড়বে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,তেমন কিছুই হলো না।ঘর ভর্তি ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে তাকে দেখল যেন সে খুবই বড়সড় অন্যায় করেছে।তোফায়েল চোখ গরম করে বলল,’বাজে বকবি না সবুজ।ঠিক আছে,নবনীতার সাথে ভাইয়ের বিভিন্ন ঝামেলা হয়েছে।আমাদের কারোই তাকে পছন্দ না।কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা তার চরিত্র নিয়ে যা তা বলব।মেয়েটি সাহসী,অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা।তাই বলে তাকে চরিত্রহীন বলবি?আমার কিন্তু তাকে সেরকম লাগে নি একবারও।’

দেখা গেল তোফায়েলের কথার সাথে মোটামুটি সবাই একমত।অদ্ভুত বিষয়! মেয়েটিকে তাদের কারো পছন্দ না,তবুও তার নামে কুৎসিত কথা শুনতে তারা নারাজ।আরহাম সূচালো চোখে একনজর তার ছেলেপেলে দের দেখে নিল।তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল,’তা অবশ্য ঠিক বলেছিস তোফায়েল।আমারও তাকে তেমন মেয়ে মনে হয়নি।তবে ফাহাদ কেনো তার সাথে দেখা করল?কেসটা ঠিক কি বুঝতে পারছি না।’

চলবে-