” তার কোনো দরকার নেই।এভাবে পুতুল সাজিয়ে মেয়ে দেখার কোনো মানে হয় না ভাই।ওরা আলাদা করে কথা বলুক ।ইরা আম্মু তুমি বরং আমার ছেলেকে তোমার আপাইয়ের রুমে নিয়ে যাও ওরা ওখানেই কথা বলুক।
“ঠিক আছে আন্টি।
দোতলার সিঁড়ি বেয়ে আরহান ইরার সাথে উপরে উঠছিলো।আরহান আশেপাশে দেখছিল। ইরা নিজের মনেই কথা বলছে। সেগুলোর একটাও আরহান শুনেছে কি না সন্দেহ। আরহান শুধু ভাবছে কখন এখান থেকে যেতে পারবে।ঠিক সে সময় ইকরা কোনো একটা কাজের জন্য নিজের ঘর থেকে ইরার ঘরে গিয়েছিল। হন্তদন্ত পায়ে ফেরার পথে শাড়ীর সাথে পা লেগে ধপাস করে ফ্লোরে পরে যায় ।সেই সময় আরহান তার সামনে।দুটো পুরুষালী পা দেখে থমকে যায় ইকরা।থমকায় আরহান, ইরাও।আরহানকে ইকরা চেনে।অন্তরা বেগম ছবি দিয়েছিলেন ইকরাকে।কিন্তু আরহান ইকরাকে চেনে না।প্রথম দেখা যে এভাবে হবে সেটাও ছিলো কল্পনার বাইরে।ইকরা বেশ লজ্জা পায় এমন পরিস্থিতিতে।
” আপাই এভাবে ছুটছিলে কেন!ইসস লাগেনি তো তোমার?
ইরাকে খুব বড়ো একটা ধমক দিতে চেয়েও আপাতত সেই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে নিলো ইকরা।একে তো পরে যাওয়ার ফলে কোমড়ে ব্যাথা পেয়েছে।তারওপর আবার আরহানের সামনে মান সম্মান যা ছিলো সবটার ফেলুদা হয়ে গেছে।এর মধ্যে এই মেয়ের প্রশ্ন।এতো প্রশ্ন করার কি আছে বাপু।দেখাই তো যাচ্ছে পরে গেছি প্রশ্ন না করে উঠতে সাহায্য করলেই তো হয়।এতো লজ্জায় বোধহয় এর আগে কখনো পরতে হয়নি ইকরাকে।
“এই আপাই কোথায় হারিয়ে গেলে?
” তোর অহেতুক প্রশ্ন করা শেষ? সব উত্তর পরে দিবো। তার আগে আমাকে এখান থেকে তোল আহাম্মক।
ইকরাকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে ইরা চলে যায় সেখান থেকে।যদিও কোমড়ে ব্যাথা আছে তবুও আরহানের সামনে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছে ইকরা।
“সরি।আসলে তারাহুরো করতে গিয়ে এমন একটা উদ্ভট ঘটনা ঘটলো। আপনি প্লিজ কিছু মনে করবেন না।
“এখনো নিজেই চলতে পারেন না ঠিক করে আমার মেয়েকে কি করে দেখে রাখবেন আপনি?
অপমান। চরম অপমান করলো লোকটা। প্রথম সাক্ষাৎ, প্রথম কথাই যদি এতো তেতো হয় তাহলে ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাই ভাবছে ইকরা।নিজেকে ধাতস্থ করলো কোনো রকম।হজম করে নিলো সবটা।
“দেখুন এটা একটা এক্সিডেন্ট মাত্র।ইচ্ছে করে তো পরিনি।
” তবুও দেখেশুনে চলা উচিৎ ছিল আপনার।এবার বলুন আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার কারণ কি?আপনি জানেন তো আমি বিবাহিত। মেয়েও আছে।আপনি আমার থেকেও ভালো একজনকে বিয়ে করতে পারতেন।তাহলে আমিই কেন?মায়ের মুখে শুনেছি আপনি বিনা বাক্যেই বিয়ের জন্য রাজি হয়েছেন।
“সবটাই জানি আমি।আপনি বিবাহিত। আপনার মেয়ে আছে।বিয়েটাও করতে চাননি।আপনার মায়ের যেমন আপনি আছেন,আপনার ও আপনার মেয়ে আছে।কিন্তু মেয়েটার কি আছে বলুন তো।হ্যাঁ ওর বাবা আছে, দাদি আছে কিন্তু আসল মানুষ টাই নেই।আর আমি সেই মানুষ টাই হতে চাই।ওর একজন মা প্রয়োজন। আমি ওর মা হতে চাই।
“কিন্তু আপনি তো ওর নিজের মা নন।তাছাড়া অন্য কোথাও বিয়ে করলেও তো আপনার বেবি হবে।সেটা ছেড়ে কেন আমার মেয়েকেই বেছে নিলেন?
“হ্যাঁ এটা ঠিক যে অন্য কোথাও বিয়ে হলে আমার নিজের বাচ্চা হবে।স্বামী পাবো।সংসার পাবো।কিন্তু মানহাকে তো পাবো না।তাছাড়া আরো একটা বড়ো কারণ আমি নিজেও মা হতে পারবো না।
এই কথা শুনে আরহান কি বলবে ভেবে পেলো না।একটা মেয়ে যখন মা হওয়ার ক্ষমতা হারায় বা বিয়ের আগেই জানতে পারে সে কোনদিন মা হতে পারবে না।তার মনের অবস্থা কেমন হয় তা আরহান জানে।ওর নিজের ফুপুর ও এমন হয়েছিল। শেষে বেচারি সবার কথা সহ্য করতে না পেরে নিজের প্রাণ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
” আমাকে বিয়ে করলে কিন্তু আপনার অনেক কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে।মানে টা বুঝতে পারছেন তো?
“আপনি চিন্তা করবেন না।আমি রাজি আছি।
আরহানরা চলে গেছে। আরহান বিয়ের জন্য রাজি এটা নিজের মা-কে জানিয়েছে।অন্তরা বেগম যেন হাতে চাঁদ পেয়েছে এমন অবস্থা। যাওয়ার আগে অন্তরা বেগম নিজের গলায় একটা চিকন চেন ছিল সেটা ইকরাকে পরিয়ে দিয়ে যায়।দুই পক্ষের কথা অনুযায়ী ঠিক হয় সামনের সপ্তাহেই বিয়ে হবে।সেই মোতাবেক হাতে সময় খুব কম।প্রস্তুতির ও একটা ব্যাপার আছে।একেবারে দেরি করতে চাইছে না অন্তরা বেগম।ছেলের এখন মত আছে পরে নাও থাকতে পারে এই ভেবেই এতো তাড়া তার।
‘
‘
রাতে ইকরা নিজের ঘরে বসে কবিতা আবৃত্তি করছিল।এটা ও মাঝে মাঝেই করে থাকে।জীবনে ভালোকিছু বা খুব খারাপ কিছু হলেই একা একা আবৃত্তি করতে ভালোবাসে ইকরা।এতে নাকি ওর মন ভালো হয়।
” তুই কি এই বিয়েটা সত্যিই করতে চাস মা? দেখ আমি কিন্ত রাজি হয়েছি শুধু তোর জন্য।তুই রাজি বলে।আরেকবার কি ভেবে দেখবি?
“বাবা কখন এলে তুমি?
” কথা এড়িয়ে যাচ্ছিস।
“আচ্ছা বাবা তোমার মায়ের কথা মনে পরে?
” হঠাৎ এই কথা কেন।
“বলই না।
” সত্যি বলবো?তুই তো কখনো তোর মায়ের ছবি দেখতে চাস না।তাহলে বুঝতি মনে পরে কি না।কারণ তুই তোর মায়ের কপি। তাই চাইলেও তাকে ভুলতে পারি না।তুই মানহাকে খুব ভালোবাসিস তাই না?
“সত্যি বলতে ওকে দেখলে আমার নিজের ছোট বেলাটা ভেসে ওঠে বাবা।আমিও নিশ্চয়ই ছোট বেলায় মায়ের জন্য কান্না করতাম আর তুমি আমাকে সামলে উঠতে পারতে না।তাই না? আমি যতবার ওই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখি আমার মনে হয় ওটা আমিই।ওকে কোলে নিলে বুকে জরিয়ে নিলে আমার অন্যরকম একটা তৃপ্তি লাগে বাবা।তোমাকে আমি বোঝাতে পারবো না।আমি ওর মা হতে চাই বাবা খুব ভালো মা।আমি ছোট মাকে দেখিয়ে দিতে চাই জন্ম না দিলেও মা হওয়া যায়।নিজের মা না হলেও মা হয়ে ওঠা যায়।আচ্ছা তুমিই বলো না বাবা মায়েদের কি কোনো ভেদাভেদ হয়।আপন পর বলে শব্দ টা কি মায়েদের সাথে যায়?আমি এই ধারণা টা পালটে দিতে চাই।মানহাকে নিজের মেয়ের পরিচয় দিতে চাই।মাকে দেখিয়ে দিতে চাই, সমাজকে দেখিয়ে দিতে চাই সৎ বলতে কিছু নেই।জন্ম না দিয়েও মা হয়ে ওঠা যায়।
” তোর ওপর আমার আস্থা আছে।আমি জানি তুই পারবি।তবে মা তুই যেটা করতে চাইছিস তা কিন্তু এতোটা সহজ নয়।তুই সবটা সহজ ভাবে নিলেও বাকিরা কিন্তু নিবে না।তাই তোকে শক্ত থাকতে হবে।
“আমি পারবো বাবা।আমাকে পারতেই হবে।তাছাড়া আমি তো মা হতে পারবো না। তাই তো মামি দিদান ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক টা মেনে নিলো না।ভাবো তো একটা মেয়ে পাচ্ছি এটাই বা কম কিসে?
” আচ্ছা বেশ এবার ঘুমিয়ে পর।অনেক রাত হলো।
“তুমিও ঘুমিয়ে পরো।
খুব সাদামাটা ভাবেই ইকরা আরহানের বিয়েটা সম্পন্ন করা হয়।বৃদ্ধা দাদি ও বাবাকে ছেড়ে আসতে খুব কষ্ট হচ্ছিলো ইকরার সাথে ছোট ভাই বোন দুজনকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট হয়েছে।ছোট মায়ের সাথে সম্পর্ক যেমন হোক ভাই বোন একে অপরকে খুব ভালোবাসে তারা।বিশেষ করে ভাই ইমন। বড় আপাই তার সবচেয়ে কাছের মানুষ। বয়সে ইকরার চেয়ে দুই বছরের ছোট ইমন।কিন্তু বোনকে যথেষ্ট ভালোবাসে।মায়ের নানান ছলা-কলায় ও কোনো কাজ হয়নি।ইমন ছোট বেলা থেকেই খুব বুঝদার ও বুদ্ধিমান । তাই কারো কথায় তাকে কিছুতেই কাবু করতে পারে না।বিশেষ করে বড় বোনের ব্যাপারে।
” শোনো আপাই বিয়ে করে চলে যাচ্ছো বলে ভাববে না আমাদের তুমি পর করে দিলে।আমি কিন্তু যখন তোমাকে দেখতে ইচ্ছে করবে চলে যাবো।তুমিও আসবে মনে থাকবে তো?
“থাকবে।আমার অবর্তমানে কিন্তু এই বাড়ির বড় সন্তান তুই ভাই।বড়দের কিন্তু অনেক দায়িত্ব থাকে। তুই সব পালন করবি।আর ইরাকে একটু কম বকিস।ছোট তো ঠিক ভুল বুঝতে পারে না।আমার পুতুলটাকে অযথা বকিস না।বাবা, মা আর দাদিকে দেখে রাখবি।নিজের যত্ন নিবি।
” তুমি চিন্তা করো না।সব দেখে রাখবো।
“অনেক হয়েছে।এবার তোরা এগো মা।রাস্তা তো অনেক।ঠিক সময় যেতে হবে তো।
” তুমি এখনই আমাকে পর করে দিচ্ছো বাবা?
“বোকা ছেলেমেয়েরা কখনো বাবা মায়ের কাছে পর হয় না।আর তুই তো আমার মা রে।
” তাই! আপাই তোমার মা আর আমি বুঝি কেউ না।আমি তোমার মা হই না বাবা?
“আরে তুমিও তো আমার মা।আমার ছোট মা।রাগ করে না।
” হ অহন তো তোর দুই মা আছেই আমি তাইলে কি হই তোর?
কথাটা ইকরার দাদি মোর্শেদা বললেন ছেলেকে উদ্দেশ্য করে।বয়স ৭০ এর উপরে অথচ ছেলের সাথে বাচ্চাদের মতো এখনো অভিমান করেন তিনি।
সবাই এবার তার কথায় হেসেই দিলো।
“আচ্ছা মা আপনার যায়গা কি আমি কাউকে দিতে পারি?আপনিও দেখছি দিন দিন বাচ্চা হচ্ছেন।এসেছি মেয়েটাকে এগিয়ে দিতে আর এখানেও মান অভিমান চলছে।
” আচ্ছা ঠিক আছে বেয়াই সাহেব আমরা তবে এবার আসি।এখন না গেলে অনেক রাত হয়ে যাবে।
“মহুয়া ছাড়া আমি অন্য কাউকে স্ত্রী হিসেবে মানতে পারবো না মা।কেন এসব বলছো?
” তুই শুধু মেয়েটাকে দেখ না বাবা।আমি বলছি ওকে দেখলে তুই আর এই কথা বলবি না।আমি দেখেছি ও মানহাকে কতটা ভালোবাসে।তুই বল না এক দিনের পরিচয়ে কেউ কাউকে এতটা আপন করে নিতে পারে?
“কিন্তু তাই বলে বিয়ে?মহুয়া মারা গেছে ৬ মাস ও হয়নি আর তুমি এখনই বিয়ের কথা বলছ।তাছাড়া উনি যে আমার মেয়েকে নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসবে এটা কে বলেছে তোমায়।না মা আর যাই বলো প্লিজ বিয়ে করতে বলো না।
” ও এখন বুঝি আমি তোর কেউ না।এখন মেয়েই তোর সব?এখন তো মনে হচ্ছে মহুয়ার যায়গায় আমি চলে গেলেই ভালো হতো।
“মা!
” দেখ আরহান।আমি তোর মা।আমি জানি ছেলেমেয়েদের জন্য বাবা মায়েরা কতটা ভাবে।মানহার জন্য তুই ভাবিস এটাও জানি।কিন্তু মেয়েটা তো ছোট। ওর একটা মায়ের খুব প্রয়োজন। আর বিশ্বাস কর ইকরা মেয়েটা খারাপ নয়।পারলে একমাত্র ও-ই পারবে মানহাকে মায়ের ভালোবাসা দিয়ে বুকে আগলে রাখতে।কারণ ওই মেয়েটার মা নেই।
“কি বলছো!
” হ্যাঁ। আর আমি তো তোকে বলছি না যে ওকেই বিয়ে কর।দেখতে তো দোষের কিছু নেই তাই না।
“আচ্ছা ঠিক আছে।কিন্তু আমি গিয়ে বেশি সময় থাকতে পারবো না।
” এতেই হবে।আমি তাহলে ওর বাবার সাথে কথা বলছি। আমরা কালই যাবো কেমন।
অন্তরা বেগম খুশি মনে আরহানের ঘর ত্যাগ করলেন।আরহান পরেছে দোটানায়।একমাত্র মেয়ে মানহার জন্মের সময় স্ত্রী মহুয়া মারা যায়।ভালোবেসে বিয়ে করেছিল।দুই বছর সংসার করেছে তারা।এভাবে রাস্তা বদলে যাবে কেউ ভাবেই নি।শেষ সময় বাবার বাড়ির কাউকে দেখতে পায়নি মহুয়া।একরাশ অভিমান নিয়ে পরপারে চলে গেছে।
“ক্ষমা করো প্রিয়তমা। তোমাকে ছাড়া আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না।কাউ কে না।
★ফ্ল্যাশব্যাক ★
“তোমাকে কতোবার বলেছি করিম।বাইরে বা দূরে কোথাও যাওয়ার আগে গাড়িটা ভালো করে দেখে নিতে।এখন এই রাতের বেলা বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো?আমেনারর বাড়ি থেকেও অনেকটা দূরেই চলে এসেছি।এতোটা পথ এখন ফিরে যাওয়াও সম্ভব নয়।গ্রামের বাড়ি গুলোও দূরে দূরে থাকে।
” আমি সত্যিই আসার সময় চেক করেছি খালা আম্মা। হুট করে কি যে হলো।
“হয়েছে। এবার গাড়ি ঠিক করতে পারো কি না দেখো।মেয়েটার খিদেও পেয়েছে।আল্লাহ কি বিপদে আপনি ফেললেন।
অসুস্থ বান্ধবীকে দেখে নিজ বাড়িতে ফিরছিল ইকরা।সাথে আছে একজন মধ্যবয়স্ক লোক। সোলেমান মিয়া।রাস্তায় কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থামে ইকরা।
” কি হইছে আম্মা দাঁড়াইলা যে?
“ওই দিকে দেখুন সোলেমান চাচা।কে যেন দাঁড়িয়ে আছে ।কিন্তু এতো রাতে এখানেই বা কি করছে।দেখে তো মনে হচ্ছে কিছু হয়েছে।কোলে একটা বাচ্চাও আছে।
” তাই তো মনে হয়।পাশে তো একটা গাড়িও আছে।কোনো সমস্যা হইছে বোধহয়।
“চলো তো গিয়ে দেখি।
” তুমি কি পাগল হইছো আম্মা।যদি খারাপ মানুষ হয়?এখন তো কাউরেই বিশ্বাস করা যায় না।তুমি চলো আমি তোমারে বাড়িতে দিয়া আসি।তারপর না হয় আমিই আইসা দেখমু কি হইছে।তোমার কিছু হইলে চেয়ারম্যান সাহেব আমারে মাইরা ফেলাইব।
“তোমার মনে হয় আমার ক্ষতি করার সাহস কারো আছে।তাছাড়া দেখে মনে হয় না ওনারা খারাপ লোক।আমার মনে হয় ওরা বিপদে পরেছে।চলোই না গিয়ে দেখি।
” ঠিক হলো করিম।মানহা কান্না শুরু করেছে। এখন কি করবো আমরা।তোমার বোকামির জন্য এখন না আজ এই নির্জন রাস্তার মধ্যে রাত্রি পার করতে হয়।
“খালা আম্মা অনেকগুলো তার পুড়ে গেছে।এটা গ্যারেজ এ না নিলে ঠিক হবে না।
” মানে কি? তাহলে তুমিই বলো এখন কি করব।এখন তো মনে হচ্ছে ওই বাড়ি থেকে বেরিয়েই ভুল করেছি।
“বলছি আপনারা কারা?এতো রাতে এখানেই বা কি করছেন?
কারো কথায় পিছন ফিরে তাকায় অন্তরা বেগম।একটা মেয়ে সাথে একজন মধ্যবয়স্ক লোক। দেখে এখানকার স্থানীয় বলেই মনে হচ্ছে।
“আর বলো না মা।আমরা শহর থেকে এসেছি।আমার ছোট বেলার বান্ধবীর ছেলের বিয়ে ছিল।এতো করে বলল যে না এসে থাকতে পারলাম না।কিন্তু দেখো বাড়ি ফেরার পথে গাড়িটা খারাপ হয়ে গেলো।এখন এই রাতের বেলা নাতনীটাকে নিয়ে যে কি করি।
” ও তো কাঁদছে। ওর মা আসেনি?
“ওর মা নেই। ওর জন্মের সময় আমাদের ছেড়ে চলে গেছে।
কথাটা শুনে মনের মধ্যে ধুক করে উঠলো ইকরার।নিজের সাথে এই বাচ্চা মেয়েটার মিল খুঁজে পেলো।মনে হচ্ছে এ যেন ছোট্ট সেই ইকরাটাই।মা না থাকার কষ্ট ইকরা বুঝে।ওর নিজের ও তো মা নেই।
” কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?আপনারা চাইলে আমার সাথে আমার বাড়িতে যেতে পারেন।ওই তো একটু সামনে গেলেই আমাদের বাড়ি।আমি এই গ্রামের চেয়ারম্যান আবদুল আজিজ এর বড় মেয়ে ইকরা।আপনাদের কোনো সমস্যা হবে না।আর আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে যে কোনো সময় বৃষ্টি হবে।আপনার নাতনীর ও হয়তো খিদে পেয়েছে।আসলে এটা তো গ্রাম চার পাশে অন্ধকার নেমে এসেছে।আর গ্যারেজ ও এখান থেকে অনেকটাই দূরে।সকাল ছাড়া খোলা পাবেন না।
“কিন্তু গাড়িটা।আর ড্রাইভার?
” উনিও আমাদের সাথেই যাবেন।আমি বাবাকে বলে আপনার গাড়ি আমাদের বাড়িতে নেয়ার ব্যবস্থা করছি।আর এমনিতেও এখানে চুরি ডাকাতি হয় না।সে নিয়ে আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।
“হ্যাঁ তাই চলো।এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও দেখতে পাচ্ছি না।ভাগ্যিস তুমি এসেছিলে নইলে যে কি হতো।
বাবার সাথে কথা বলে ইকরা অন্তরা বেগমকে দুতলার একটা রুমে থাকতে দিল।রুম টা ছোট তবে বেশ গোছানো।
” এখানে আপনাদের থাকতে কোনো সমস্যা হবে না তো?
“সমস্যা কেন হবে।তাছাড়া তুমি তোমার বাবা আমাদের জন্য যা করলে এটাই বা আজকাল কে করে?
” এটা মানুষ হিসেবে আমাদের কর্তব্য। যাই হোক আপনার ড্রাইভারকে পাশের রুমে থাকতে দেয়া হয়েছে।আমার ছোট ভাইয়ের সাথে।আপনারা বসুন আমি আপনাদের খাবার নিয়ে আসছি।
“খাবার লাগবে না মা।আমরা খেয়েই এসেছি।তুমি শুধু আমাকে একটু গরম পানি দিলেই হবে।মানহার জন্য।
” তা না হয় দিলাম।কিন্তু আমাদের বাড়িতে এলেন অথচ কিছু খাবেন না তা কি করে হয়।
“সময় তো চলে যাচ্ছে না মা।সকালে খাবো।
” ঠিক আছে আমি তাহলে পানিই নিয়ে আসি।
‘
‘
“কোথা থেকে একটা মহিলা নিয়ে এলো আর আপনিও থাকতে দিলেন।কে বলতে পারে ওই মহিলার উদ্দেশ্য খারাপ কি না?
কথাটা বলছিলেন ইকরার ছোট মা মানে সৎ মা রেহানা বানু।ইকরার মা মারা যাওয়ার পর ইকরার দাদি মোর্শেদা বেগম ছেলের আবার বিয়ে দেন।কিন্তু তখন রেহানা বানু একদম অন্য রকম ছিলেন। প্রথম প্রথম ইকরাকে আদর যত্ন করলেও আস্তে আস্তে কেমন যেন পালটে যান।
” তুমি সব সময় একটু বেশিই ভাবো ইরার মা।আমার ইকরা আর যাই করুক কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেবে না।আমার বাড়িতে কেউ সাহায্য চেয়ে পায়নি এটা কি কখনো হয়েছে?আর উনি তো একটা বিপদে পরেই এই বাড়িতে এসেছেন।গাড়ি ঠিক হলেই চলে যাবেন।
এখানে খারাপের কি দেখলে তুমি?
“ওমনি মেয়ের গুনগান শুরু হয়ে গেলো।এই বাপ মেয়ে নিয়ে আর পারি না।আপদ একটা।
” তোমাকে অনেকবার বলেছি ইরার মা।আমার মেয়েকে নিয়ে এই ধরনের কথা তুমি বলবে না।আর তোমাকেই বা কি বলবো। আমার সবচেয়ে বড় ভুল কি যানো তোমাকে বিয়ে করা।কেন যে তখন মায়ের কথা শুনেছিলাম।এখন বুঝতে পারছি আমি কতো বড়ো ভুল করেছি জীবনে।না পারলাম মেয়েটাকে মায়ের ভালোবাসা দিতে।না বাবা হিসেবে ওর পাশে থাকতে পারলাম।আর না মেয়েটাকে একটু সুখের মুখ দেখাতে পারলাম।
“বাবা!
” এই মেয়ে আড়ি পেতে কথা শুনছিলিস?
“মা আড়ি পেতে কথা শুনবার মেয়ে আমি নই এটা তুমি খুব ভালো করেই জানো। আমি তোমার সাথে কথা বলতে আসিনি।আর না কোনো আড়ি পেতেছি।এখান দিয়েই যাচ্ছিলাম তাই কথাগুলো কানে এলো।আগেও বলেছি ওনারা বিপদে পরেছে তাই আমার যেটা মনে হয়েছে আমি সেটাই করেছি।তখন আমার মনে হয়েছিলো ওনাদের সাহায্য করা উচিৎ তাই বাড়িতে এনেছি।তাছাড়া সারাজীবনের জন্য তো নয় মাত্র একটা রাত।যাক সেসব কথা।বাবা শোনো আমাকে যে যাই বলুক আমি কিন্তু কখনো কোনো প্রতিবাদ করিনি।কিন্তু ওনাদের সামনে বা ওনাদের যেন কেউ কিছু না বলে।এইটুকু তো এই বাড়ির মেয়ে হিসেবে আমি চাইতেই পারি তাই না। এটা বলতেই এসেছি।আসছি আমি।
” দেখলেন আপনার মেয়ে কি বলে গেলো।আর আপনি চুপ করে শুনলেন?
“বলার মতো তো কিছু রাখোনি। আমি বুঝতে পারিনা ইরার মা আমার মেয়েটা তোমার কি ক্ষতি করেছে বলো তো?সব সময় ওর সাথে এমন ব্যবহার কেন করো।আসলেই আমি একজন ব্যার্থ বাবা।বাইরে আমি সবার বিচার করি অথচ নিজের ঘরে নিজের মেয়েকেই সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে পারি না।
মানহাকে খাইয়ে দিয়েছে ইকরা নিজেই।কেন জানি বাচ্চাদের সাথে ইকরার ছোট বেলা থেকেই অল্প সময়েই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে যায়।যদিও মানহার বয়স খুবই কম।মানহার অবস্থা দেখে বুঝাই যাচ্ছে যে ইকরাকে তার বেশ ভালো লেগেছে।অথচ এই মেয়ে বাবা আর দাদির কোলে ছাড়া কারো কোলেই থাকে না।
” তোমার কোলে বাবুটাকে খুব মানিয়েছে আপাই।দেখে মনে হচ্ছে তুমি ওর মা।ভালো করে বসো তো তোমাদের একটা সুইট ছবি তুলে রাখি।
“এসব কি বলছিস ইরা!আমি কেন ওর মা হবো?
” আমি কখন বললাম তুমি ওর মা।আমি শুধু বললাম তোমাকে ওর মায়ের মতো লাগছে।বিশ্বাস না হলে আন্টিকেই জিগ্যেস করো না।আন্টি আমি ঠিক বলছিনা বলুন?
“কথাটা মন্দ বলোনি মা।কিন্তু এটাও তো ঠিক যে ওরা কেউ কাউকে চেনেই না।আশ্চর্যের কথা কি জানো, মানহা আমি আর আমার ছেলের কোল ছাড়া কারো কোলেই থাকে না।কিন্তু সেই রেকর্ড ও ভেঙ্গে দিলো।এই প্রথম মেয়েটা তোমার আপাইয়ের কোলে থাকলো তাও এতো সময়।
” ওয়াও!তাহলে এক কাজ করুন আন্টি আপনার ছেলের সাথে আপাইয়ের বিয়ে দিয়ে দিন।খুব ভালো হবে।
“ইরা এসব কি হচ্ছে!খুব পাকা পাকা কথা বলছিস। যা এখান থেকে।তোর না আর দুদিন পর পরিক্ষা।এভাবে পাকামো করে বেরালে পরিক্ষায় তো গোল্লা পাবি।
” আপাই তুমিও না শুধু পড়তে বলো ভালো লাগে না।যচ্ছি।
“ওর কথায় কিছু মনে করবেন না আন্টি।বাচ্চা মানুষ তো তাই বুঝতে পারেনি কোথায় কি বলতে হয়।
যদিও কথাটা অন্তরা বেগম বললেন কিন্তু তার মনে ইরার সরল উক্তিই নাড়া দিচ্ছে।বাচ্চা মেয়েটা হয়তো না বুঝে বলেছে কিন্তু কথাটা ভুল বলেনি।তাছাড়া এই অল্প সময়ে মানহা ও ইকরা দুজন দুজনকে যতটা আপন করে নিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে ওরা একে অপরের সঙ্গ পেলে ভালো থাকবে।আমাকে ওর বাবার সাথেই কথা বলতে হবে।তারপর আরহান।
*বর্তমান *
“ইকরাকে দেখতে কাল মানহার বাবা আর দাদি আসবে ।ইরার মা তুমি খাবারের ব্যবস্থা করে রেখো।
“আপনার যে মেয়ে ওকে কে বিয়ে করবে?ওরা শহরের মানুষ আপনার মেয়েকে পছন্দ হবে?তার চেয়ে ভাবার বিষয় ছেলেটা বিবাহিত।
” সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।ইকরা নিজেই যখন রাজি আমার মনে হয় ব্যপার টা ওর ওপরে ছেড়ে দিলেই ভালো হবে।
“হ্যাঁ সেই।তাছাড়া যে চরিত্র তাতে এর চেয়ে ভালো ছেলে পাওয়াও যাবে না।
” কি বললে তুমি?
“শুনেন আপনি রাগ করেন আর যাই করেন এটা তো সত্যি।ওর মামার ছেলে (দিদান) এর সাথে তো একটা সময় সম্পর্ক ছিলো।ছেলেটা তো এখন অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে।কেন নিয়েছে কারণ ও বুঝেছে যে এই মেয়ে ওর যোগ্য নয়।তাছাড়া ও তো ভবিষ্যতে মা হতে পারবে না।তাই অবিবাহিত কোনো ছেলে কেনই বা বিয়ে করবে খামোখা?
” কে কার যোগ্য সেটা সময় বলে দেবে।আর ওই বেইমান ছেলের নাম এই বাড়িতে যেন আর কোনোদিন না শুনি এই আমি বলে রাখলাম।আমার মেয়ে পবিত্র। হ্যাঁ মানছি একটা সম্পর্কে ও ছিলো কিন্তু ওরা কখনো কেউ কারোর হাত পর্যন্ত স্পর্শ করেনি। তুমি তো এসব বুঝবে না।আর এই বিয়েটা হলে তোমারই ভালো।আর আমার মেয়েকে তোমার দেখতে হবে না।
“সুযোগ পেলেই আমাকে কথা শুনানো তাই না।আমি বলছি এই বিয়ে আমি ভেস্তে দিব।
আজ বৃহস্পতিবার।বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ শ্রাবণের ত্রিশ তারিখ।কাল বর্ষার শেষ দিন।ওহহ হ্যাঁ,কাল নবনীতা নূরের শুভ বিবাহ।সন্ধ্যা নামতেই মেঘলা আকাশের মেঘপুঞ্জের আড়াল হতে উঁকি দিলো শত শত মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা,ভালো নাম নক্ষত্র।সেই নক্ষত্রগুলো জ্বলছিল।সেই দীপ্তিমান নক্ষত্র গুলোকে দেখে শুভ্রানী মলিন মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।কাল আপাইয়ের বিয়ে।আপাই আর তাদের থাকছে না।বিয়ের পর কাগজে কলমে সে শাহরিয়ার আরহামের স্ত্রী হয়ে যাবে।তখন তার একটা নতুন জীবন শুরু হবে।নিশ্চয়ই সে জীবনে শুভ্রা আর চিত্রার এখনের মতো এতো অধিকার থাকবে না?এখনের মতো আপাই আর চব্বিশ ঘন্টা তাদের নিয়ে ভাববে না।
শুভ্রা আলগোছে চোখ মুছে।আপাই কাল থেকে শুরু করে সকাল বিকাল সারাক্ষণ চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে।অথচ শুভ্রাকে দেখতেই এড়িয়ে যায়।চিত্রাকে সে মন ভরে আদর করে,কিন্তু শুভ্রা সামনে আসতেই সে না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে যায়।অবহেলার মতো তীব্র যন্ত্রণা শুভ্রানী তার জীবনে আর দুটি পায় নি।এই নতুন শব্দের সাথে সে গত দুইদিনে পরিচিত হয়েছে।আপাই তাকে অবহেলা করছে।শুভিকে অবহেলা করছে তার আপাই?
‘শুভ্রা!’
ছাদের দরজা থেকে ডাক দিলো রিমি।দ্রুত এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো।শুভ্রা দুই হাত ছাদের রেলিংয়ে রেখে ঘাড় কাত করে তাকে দেখল।রিমি তাকে দেখতেই আঁতকে উঠে বলল,’সে কি! তুমি কাঁদছিলে?’
শুভ্রা দ্রুত মাথা নাড়ে।রিমি মন খারাপ করে বলল,’এদিকে তুমি কাঁদছো,ঐদিকে তোমার বোন।কাল তার বিয়ে।তোমরা যদি এখন এমন করো তাহলে কেমন করে হবে শুভি?’
শুভ্রা চোখ মুছে।আর্দ্র গলায় বলে,’আমি আপাইয়ের কাছে মাফ চেয়েছি আপু।সেদিন রাতেই চেয়েছি।আপাই আমার কোনো কথারই জবাব দেয় না।এখন মনে হয় সেদিন তিনটার জায়গায় আরো কয়েকটা চড় মারতো,তাও ভালো ছিল।অন্তত মারার পর ঠিক মতো কথা তো বলতো।আপাইয়ের অবহেলা আমি নিতে পারছি না।তুমিই বলো এই শব্দটা কি আমার পরী আপাইয়ের সাথে যায়?’
রিমি সহানুভূতি দেখিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রাখল।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য অল্প হেসে বলল,’মাফ চাইলে তো সব মিটে যায় না শুভি।তুমি তাকে সত্যিই আঘাত করেছ।ছু’রির আঘাতে শরীরে ক্ষ’ত হয়,আর কথার আঘাতে মনে।তুমি কথা দিয়ে আঘাত করেছ।তাও তোমার বোনকে।যে বোন জীবনের সকল আনন্দ বিসর্জন দিয়ে তোমাকে আর চিত্রকে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল।কেবল একটি বাক্যে বলে দিলে,বাঁচতে দাও আমাদের।নবনী কি তোমাদের বাঁচতে দিচ্ছিলো না শান্তিতে?তোমরা একটু শান্তিতে বাঁচার জন্য মেয়েটা নিজের শান্তি শেষ করেছে।আমি অবাক হয়েছি শুভ্রা।যেই নবনীতার বোনদের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি তাকে ভালোবেসেছি,সেই নবনীতার বোন হয়ে তুমি এই কাজ কেমন করে করলে?সে তোমার পরী আপাই ছিল।যেই আপাইয়ের নিজের বলতে কেবল তুমি আর চিত্রই ছিলে।’
রিমি থামল।টের পেল শুভ্রার শরীর কাঁপছে।একটু সময় গড়াতেই সকল নিরবতাকে ছাপিয়ে শুভ্রা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।দু’হাত মুখে চেপে অস্ফুটস্বরে বলল,’সেভাবে বলতে চাইনি আপু।কসম করে বলছি।বলতে চেয়েছিলাম একভাবে,বলে ফেলেছি আরেকভাবে।আমি আপাইকে কষ্ট দিতে চাইনি।সত্যি বলছি।আমি মুখ ফসকে যা তা বলেছি।’
শুভ্রা থামল।কান্নার দরুন তার হেঁচকি উঠে গেছে।সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল,’কলেজে ব্যাচমেট রা ভীষণ নোংরা কথা বলে আপাইকে নিয়ে।তারা বলে আরহাম ভাই অনেক বড়লোক।তাই আপার সাথে সময় কাটাতো।কিন্তু সে তো আর আপাইকে বিয়ে করবে না।কিন্তু তারা তো জানে না আমার বোনই আরহাম ভাইয়ের সাথে বিয়ে টা বাতিল করে দিয়েছে।তুমি বলো তো আপু,আরহাম ভাই কি এতো জঘন্য?আপাই কি একটি বারের জন্যও তার সাথে বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারত না?’
রিমি ঠান্ডা স্বরে বলল,’শুভ্রা! নবনীতার একটা নিজস্ব জীবন আছে।তার সেই অধিকার আছে যে কাকে বিয়ে করবে,আর কাকে করবে না সেটা নির্ধারণ করার।নবনীর তো আগেও অনেক বিয়ে এসেছিল।তখন তো তুমি এমন করোনি।উল্টো তখন চেয়েছ বিয়েটা যেন ভেঙে যায়।তোমার বোন তোমারই থাকুক।এখন একজনকে পছন্দ হওয়াতে তুমি তোমার বোনকে জোর করতে পারো না।তারও একটা পছন্দ আছে।বিয়ের মতো নাজুক বিষয়ে তারও মতামত থাকতে পারে।তুমি কি একটু বেশিই বলে ফেলেছ না সেদিন শুভ্রা?’
শুভ্রা মিনমিনে স্বরে জবাব দেয়,’সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতেই তো শেষ হয়ে যাচ্ছি আপু।আপাই তিনদিন যাবত আমার সাথে কথা বলে না।এর চেয়ে বড় শাস্তি জীবনে আর কি হতে পারে?আপাইয়ের কাল বিয়ে হবে।তারপর হয়তো আমি আর চিত্র কখনোই মন খারাপের দিনগুলোতে আপাইয়ের বুকে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে পারব না।সেই আপাইকে কেবলই আমাদের আপাই হিসেবে পাওয়ার আজকে শেষ দিন।অথচ আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না।’
কথা শেষ করেই শুভ্রা পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠে।সে মন থেকে সেরকম কিছু বলতে চায়নি।একদিকে কলেজের মানুষের কথা,অন্যদিকে বিয়ে তে আপাইয়ের প্রত্যাখ্যান,সব মিলিয়ে সে যা তা বলেছে।কিন্তু এখন এসব ভেবে কি লাভ?যা বলার তা তো বলেই ফেলেছে।আর তো সেটা ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।
রিমি মৃদু স্বরে বলল,’থাক শুভি।এসব ছাড়ো।যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।আমি তোমার বোনকে চিনি।তোমাদের ছাড়া সে থাকতে পারে না।বিয়ের আগে সে অবশ্যই তোমার সাথে কথা বলবে।নবনীতা এমনই।তার দু’টো কলিজার টুকরোর সাথে সে এতো লম্বা সময় অভিমান করে থাকতেই পারবে না।’
রিমি কথা শেষ করে ধীর পায়ে নিচে চলে গেল।এই ক’দিন যাবত ভীষণ ব্যস্ততায় দিন যাচ্ছে তার।নবনীতা বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে।মন থেকে যদিও বিয়েতে মত দেয়নি।কিন্তু বিয়েটা তো হচ্ছে।রিমি হচ্ছে দুই পক্ষের কমন ম্যান।সে কনে পক্ষের সাথেও আছে,আবার বর পক্ষের সাথেও আছে।আদি কিংবা আরহাম যেকোনো প্রয়োজনে তাকেই ফোন দেয়।একটু আগেও আদি তাকে ফোন দিয়েছে।নবনীতার জন্য নাকি আরিশ আর তাসনুভা মিলে একটা শাড়ি কিনেছে।সেটা নাকি তারা পাঠিয়ে দিবে রাতেই।রিমি নিচে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেয়।শারমিন নামের একজন ভদ্রমহিলা কে আরহাম বিকেলের দিকে পাঠিয়েছে নবনীতার ফ্ল্যাটে।শারমিনের রান্নার হাত ভালো।নবনীতার ক্ষুদ্র পরিসরের বিবাহ অনুষ্ঠানের সব রান্না শারমিনই করবেন।রিমি কেবল তাকে টুকটাক সাহায্য করে।রিমি রান্না ঘরে উঁকি দিতেই দেখল শারমিনের পাশাপাশি সেখানে নবনীতাও আছে।সে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এলো।পাশে দাড়িয়ে জানতে চাইল,’কিরে তুই এদিকে?’
নবনীতা দুধ জ্বাল দিতে দিতে গাঢ় স্বরে বলল,’চিত্র কাস্টার্ড খেতে চেয়েছে।তাই বানাচ্ছি।’
রিমি বিরক্ত হয়ে বলল,’তো এটা আমাকে বলা যেত না?তুই আবার রান্নাঘরে আসতে গেলি কেন?কাল না তোর বিয়ে?’
নবনীতা স্টোভের আঁচ কমিয়ে পাশ ফিরে রিমিকে দেখল।কিছুটা ক্লান্ত আর বিরক্ত স্বরে বলল,’বিয়ে হলে কি রান্নাঘরে আসা যায় না?আর আমি তো এই বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিও না।এখানেই আছি আমি।রান্নাঘরে আসলে সমস্যা টা কি?’
‘নাহ সমস্যা কিছু নেই।এমনিই বললাম আরকি।’
রিমি তার থেকে চোখ সরিয়ে শারমিন খালাকে দেখে।তার হাতে একটা স্টিলের বাটি।রিমি তার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’এটা কি?হলুদ?’
শারমিন কেবল উপরনিচ মাথা নাড়ে।আড়চোখে একবার নবনীতা নামের মেয়েটিকে দেখে।এর সাথে নাকি কাল বড় সাহেবের বিয়ে হবে।শারমিনের তো একে দেখলেই বুক ধুকধুক করে।বড় সাহেবের যা রাগ! তার উপর তার সাথে যুক্ত হয়েছে এই মেয়ে।দু’জন মিলে দু’জনকে মে’রে ফেললেও তো কেউ টের পাবে না।
মেয়েটি সুদর্শনা,তাতে তোনো সন্দেহ নেই।তার গায়ের বাসন্তী রঙের জামাটি তে তাকে খুব মানাচ্ছে।বড় সাহেবের সাথে এই মেয়ের জুটি বাইরে থেকে বেশ চমৎকার হবে।মেয়েটির মুখে মায়া আছে,একটা অস্পষ্ট অসহায়ত্ব আছে।কিন্তু কন্ঠের তেজ এক বিন্দুও কমে নি।শারমিন তাকে বলেছিল একটা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি গায়ে জড়াতে।এতেই সে যা কটমট করে জবাব দিলো,তাতেই শারমিন পুরোপুরি দমে গেছে।
রিমি তার হাত থেকে হলুদের বাটি নিজের হাতে নিল।তারপর নবনীতার কাছে এসে সেখান থেকে অল্প একটু হলুদ আঙুলে নিয়ে নবনীতার দুই গালে ছোঁয়াল।চরম বিরক্তিতে নবনীতার কপাল কুঁচকে গেল,অথচ মুখে সে কিছুই বলল না।তার সমস্ত মনোযোগ তার কাজে।তার চুলগুলো এলোমেলো করে বেঁধে রাখা।এক ফালি চুল মুখের উপর পড়ে আছে।চোখ জোড়া অতিশয় শান্ত।গালে হলুদ ছোঁয়ানোর পর তাকে নববধূর মতো লাগছে।
এমন সময়ই কলিংবেল বেজে উঠল।রিমি দরজার দিকে ছুটতে ছুটতে বলল,’শুভি এসেছে নিশ্চয়ই।বেচারির মন খারাপ।তাকেও হলুদ ছুঁয়িয়ে দেই।’
সে এক দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলেই সাথে সাথে তার হাত বাড়িয়ে সামনে থাকা মানুষকে হলুদ ছোঁয়ায়।অথচ সামনে দাঁড়ানো মানুষটি শুভ্রা ছিল না।রিমি তাকে দেখেই হকচকিয়ে ওঠে।তাজ্জব হয়ে বলে,’ভাইয়া আপনি?’
সে ভেবেছিল শুভ্রা।তাই শুভ্রার গালে লাগানোর মতো আন্দাজে হলুদ মেখেছিল।অথচ সেই হলুদ লেগেছে ওয়াজিদের ঘাড়ে আর গলায়।রিমির চেয়েও বেশি চমকাল ওয়াজিদ।সে চোখ বড় বড় করে বলল,’এসব কি?’
রিমি সে উত্তর দেয় না।হঠাৎই তার মনে হলো তার গায়ে কোনো ওড়না নেই।কেবল আছে ঢিলেঢালা একটা কুর্তি।সে সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিদের মুখের উপর ধাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।ওয়াজিদ নিজেই তার এমন আচরণে হকচকিয়ে গেল।এই মেয়ের কি সত্যি সত্যি কোনো মানসিক সমস্যা আছে নাকি?এমন মুখের উপর দরজা বন্ধ করে কেউ?
রিমি এক দৌঁড়ে নিজের ওড়না হাতে নিয়ে আবারও দরজার দিকে ছুটল।দরজা খুলেই বোকা হেসে বলল,’সরি সরি।আমি ভেবেছিলাম আপনি শুভি।নেভার মাইন্ড।’
রিমি তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে বলল,’আদি ভাইয়া আর আরিশের না আসার কথা ছিল?আপনি কেন এসেছেন?’
ওয়াজিদ শীতল চোখে একবার তাকে দেখে।সেই চাহনিতে ভড়কে গিয়ে রিমি বলল,’না মানে।জানতে চাইলাম আরকি তারা কোথায়।’
ওয়াজিদ কিছু বলতে যাচ্ছিল,তার আগেই আদি ব্যস্ত পায়ে এপার্টমেন্টে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’গুড ইভিনিং রিমি।’
রিমি সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরল।আদিকে দেখেই প্রশস্ত হেসে বলল,’ভাইয়া আপনি এসেছেন!’
আদি আরাম করে সোফায় বসে গা ঝাড়া দিয়ে বলল,’তো আসবো না?আমাকে ছাড়া ফেসটিভ জমে নাকি?’
রিমি জোরে জোরে মাথা নাড়ে,’না একদমই না।’
আদি সরু চোখে একবার ওয়াজিদকে দেখতেই প্রশ্ন করল,’কি রে?তুই এমন হলুদ মেখে বসে আছিস কেন?বিয়ে টা কি তোর হচ্ছে?’
ওয়াজিদ থমথমে মুখে একবার রিমির দিকে তাকায়।তারপরই কোনো কথা না বলে টি-টেবিলের উপরে রাখা টিস্যুর বক্স থেকে টিস্যু হাতে নিয়ে বেসিনের দিকে এগিয়ে যায়।আরিশ লিফট থেকে বেরিয়ে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে এপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।গাড়ি পার্কিং করে আসতে আসতে তার আর আদির দেরি হয়ে গিয়েছে।যাওয়ার পথেই তার শুভ্রার সাথে দেখা হয়।শুভ্রা ছোট ছোট পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে এসেছে মাত্র।
আরিশ তাকে দেখেই সৌজন্যসূচক হাসল।পরক্ষণেই শুভ্রার ফোলা ফোলা চোখ দু’টো দেখে অবাক হয়ে বলল,’কি হয়েছে শুভ্রা?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
শুভ্রা চোখ তুলে একনজর তাকে দেখল।তারপরই আবার চোখ নামিয়ে নিল।আরিশ কিছু একটা বুঝে ফেলার ভান করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,’বুঝেছি।তোমার আপাইয়ের বিয়ে হয়ে যাবে সেজন্য মন খারাপ।তাই না?মন খারাপের কিছু নেই।তোমার আপাই তো তোমার কাছেই থাকবে।মন খারাপের কি আছে?’
শুভ্রা অন্যদিনের মতো আজ আর হাসিমুখে কিছু বলল না।যেমন করে মাথা নামিয়ে রেখেছিল তেমন করে মাথা নামিয়েই সে প্রস্থান নিল।আরিশ কিছুটা চমকালো,কিন্তু গায়ে মাখল না।হয়তো কোনো কারণে মন খারাপ।হতেই পারে।তার কি?
সে বসার ঘরে গিয়েই আদির পাশাপাশি বসল।তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ।আজ বসুন্ধরা থেকে সে আর তাসনুভা মিলে নবনীতার জন্য শাড়ি আর জুয়েলারি পছন্দ করে কিনেছে।আফরোজা ফুফুর বিয়ে নিয়ে কোনো আগ্রহ কিংবা কৌতূহল নেই।আরিশ আর তাসনুভাই সবকিছু নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
আরিশ তার হাতের ব্যাগটা রিমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’আপু এটা রাখো তোমার কাছে।আমি আর তাস এটা আপুর জন্য পছন্দ করেছি।’
রিমি হাসিমুখে ব্যাগটা হাতে নেয়।মন খারাপ করে বলে,’তাসনুভা কে আনলে না কেন?সে থাকলে ভালো লাগতো।’
আদি চুল ঠিক করতে করতে খানিকটা আফসোস করে বলল,’আর বলো না।এইটুক কেনাকাটা করেই সে টায়ার্ড।রাতে আবার ঔষধ খেতে হয়।তাই আর আনি নি।সমস্যা কি?কাল তো আসবেই।’
রিমি জবাবে কেবল মাথা নাড়ল।তখনি নবনীতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।সে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে।তাকে সত্যি সত্যি নববধূর মতো দেখাচ্ছে।ওয়াজিদ তাকে দেখেই দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল।তার দৃষ্টি মার্বেলের টাইলস বসানো ফ্লোরের দিকে।নবনীতা তাদের সামনে এসেই থমথমে মুখে বলল,’খেয়ে যাবেন আপনারা।রান্না হয়ে গেছে।’
কথা শেষ করেই সে একটা ট্রে তে কয়েকটা কাস্টার্ডের বাটি তুলে তাদের সামনে নিয়ে রাখল।নিচু স্বরে বলল,’আগে এটা খেয়ে নিবেন।’
বলেই সে শম্বুক গতিতে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল।আরিশ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,’এখনো মন খারাপ আপুর?’
আদি নিজেও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’তাই তো মনে হচ্ছে।যাক গে,এসব কোনো ব্যাপার না।ঠিক হয়ে যাবে সব।একটু সময় দে।’
সে রাতে তারা রাতের খাবার নবনীতার ফ্ল্যাটেই করল।চিত্রা পুরোটা সময় তাদের সাথে ছিল।আর শুভ্রা ছিল নিজের ঘরে,বইয়ের পাতায় মুখ গুজে।তার বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো ভিজে যাচ্ছিল তার চোখের পানিতে।সে পানি মুছে আবার পড়ার চেষ্টা করল।কিন্তু গত তিনদিনে সে সত্যি বলতে কিছুই পড়েনি।মনটা ভীষণ আকুপাকু করছিল তার।সে শেষমেশ উঠে দাঁড়ায়।এক দৌঁড় দেয় নবনীতার ঘরের দিকে।
নবনীতা তখন ঘরেই ছিল।সে একটু আগে নামাজ শেষ করেছে।তারপর এই বাদল দিনেই ঠান্ডা পানিতে গোসল করেছে।চুলে প্যাচানো তোয়ালেটা দিয়ে চুল মোছার সময় কোথা থেকে ছুটে এসে শুভ্রা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।নবনীতা তার আকস্মিক ছুটে আসাতে দুই কদম পিছিয়ে গেল।তাল সামলে নিতেই কঠিন গলায় বলল,’আমাকে ছাড়ো শুভ্রানী।কাজ আছে আমার।’
শুভ্রা মাথা তুলে।হতবাক হয়ে বলে,’আপাই! আমি তোমার শুভি।শুভ্রানী কেনো বলছ?’
নবনীতা নিজেকে তার থেকে সরিয়ে নিল।চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে গাঢ় স্বরে বলল,’তুমি কি আমি জানি।যাও খাবার রান্না হয়েছে।খেয়ে নাও।’
সে এগিয়ে যায় কিছুটা সামনে।হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে শুভ্রাকে দেখে হাসি মুখে বলে,’বিয়ে করছি আমি কাল।তোর ন’ষ্টা বোন কাল বিয়ে করছে।এবার থেকে তোরা শান্তিতে বাঁচবি।’
.
.
.
.
আরহাম তার জীবনে জীবনসঙ্গী রূপে চেয়েছিল একেবারে স্বামীভক্ত,ঘরকোণে,সংসারী আর স্বল্প শিক্ষিত মেয়ে।যতটুকু শিক্ষা না জানলেই নয়,অতটুকু জানাই যথেষ্ট।এর বেশি জানার তো কোনো প্রয়োজন নেই।আরহাম স্ত্রী হিসেবে যে মেয়েটিকে চেয়েছিল,সেই মেয়ের মাঝে অবশ্যই নিজেকে আরহামের বাড়ির চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখার মতো মানসিকতা থাকা দরকার ছিল।
অথচ আরহামের সাথে এমন কিছুই হয়নি।যে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হচ্ছে,সেই মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত।পদার্থবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে।মেয়েটা মোটেই নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখার মতো চিন্তাভাবনা পোষণ করে না।স্বামীভক্ত হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।উল্টো স্বামীর নাম শুনতেই সে মুখ কুঁচকে নেয়।
মেয়েটি চাকরি করে।আশ্চর্যের ব্যাপার আরহামই তাকে চাকরি দিয়েছে।সে প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ।মেয়েটি সাহসী,প্রতিবাদী,স্পষ্টভাষী।মোদ্দা কথা,মেয়েদের ব্যাপারে যা কিছু আরহামের অপছন্দ তার সবটাই এই মেয়ের মাঝে আছে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,এতোগুলো অপছন্দের বিষয় তার মাঝে বিদ্যমান থাকা স্বত্তেও আরহামের তাকে পছন্দ।
সবকিছু ছাপিয়ে তার যেই স্বত্তাটি শাহরিয়ার আরহামকে মুগ্ধ করেছে,তা হলো তার ‘পরী আপাই’ নামক রূপভেদ।একটি তেইশোর্ধ তরুণী।যে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বয়সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।অথচ সেই সুন্দর সময়টা সে নষ্ট করছে তার বোনদের মানুষ করার কাজে।অদ্ভুত বিষয়! তার চোখে দেখা মা নামক স্বত্তাটি যেখানে নিজের স্বামী সন্তান ফেলে অন্যত্র চলে গিয়েছে,সেখানে পরী আপাই নামের একটি চমৎকার মানবী কেবল তেইশ বছর বয়সে নিজেকে মাতৃসম বোন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।দুইটা বোনকে নিয়ে সে যেই বাস্তবিক সংগ্রামে নেমেছে,সেই সংগ্রামে আরহাম তার সহযোদ্ধা হতে যায়।পরী যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে,তখন সে তার মাথায় হাত রেখে বলতে চায়,’ভয় নেই পরী।আমি আছি।এই দেখো,আমি আছি।’
পরদিন সকালেই আরহাম আলমারি ঘেটে একটা কালো পাঞ্জাবি বের করল।আজ শুক্রবার।জুমার নামাজ শেষ করে তারা নবনীতাদের বাড়ি যাবে।খুবই সাধারণভাবে তাদের বিয়ে হবে।নবনীতা চেয়েছিল রিসেপশনের আগ পর্যন্ত কিছুদিন যেন সে নিজের বাড়িতেই থাকে।এ কথা সে আদিকে বলেছে।আরহাম অবশ্য তাতে কোনো দ্বিমত পোষণ করেনি।দ্বিমত পোষণ করার মতো কিছু সে পায়নি।সে চেয়েছে পরীকে সমাজের লোকজনের কটু কথা থেকে মুক্তি দিতে।সে চেয়েছে পরীকে মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ করে দিতে।এক সাথে ঘর বাঁধা তো তার উদ্দেশ্য ছিল না।ঘর বাঁধা পর্যন্ত তো সে কখনো ভাবে নি।
আফরোজা বেগম সকাল থেকেই মুখ ফুলিয়ে রেখেছেন।তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বিয়েতে তিনি যাবেন না।মাথাব্যাথার বাহানা দিয়ে বাড়িতে পড়ে থাকবেন।এই বিয়ে উপলক্ষে তার কোনো আগ্রহ কিংবা উচ্ছ্বাস নেই।তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আরহাম এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করছে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বাভাবিকের চাইতেও অনেক বেশি।এতোগুলো দিনে তো আরহাম কখনোই এমন কোনো মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলেনি।
আফরোজা বেগম তার স্বামীর মৃ’ত্যুর পর তাদের গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন।দেবর ভাসুরদের নানা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে তিনি তার মামাতো ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।আজিজ হোসেন তখন শয্যাশায়ী।তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল ম’রণব্যাধি ক্যা’ন্সার।তাসলিমা তখন সংসার ছেড়ে আজিজ সাহেবেরই সহকর্মী নোমান কে বিয়ে করেছিলেন।
আফরোজার চিঠির জবাব এসেছিল অনেক পরে।ডাকযোগে কোনো ফিরতি পত্র আসেনি।বরং তাদের মফস্বলে একটি ছেলে এসেছিল তার খোঁজে।তার নাম শাহরিয়ার আরহাম।সে এসেই আফরোজা বেগম কে অনুরোধ করেছিল।বলেছিল,’ফুফু আমার একটা ছোট বোন আছে বাড়িতে।তাকে দেখার মতো কেউ নেই।সে সিঁড়ি থেকে পড়ে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।আপনি কি তার একটু যত্ন করবেন?’
ব্যাস,তখন থেকেই শেখ আজিজের প্রাসাদ তুল্য বাড়িতে আফরোজা আর তার মেয়ে সারাহ’র ঠাই হলো।তখন থেকেই আফরোজা মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলেন সারাহ’র বয়স হতেই তিনি তার সাথে আরহামের বিয়ে দিবেন।আরহামের এমনিতেও বিয়ে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।আফরোজার কথা সে নিশ্চয়ই ফেলে দিতো না।অথচ আফরোজা কে আশ্চর্য করে নিয়ে তার সাথে একটু আলোচনা না করেই আরহাম নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।আফরোজা কে বুঝিয়ে দিয়েছে সে তার জীবনের ব্যাপারে ভ্রক্ষেপ করার কেউ না।যাক গে,সে যখন কেউ না তখন তার আর বিয়েতে গিয়ে কাজ নেই।সে বাড়িতেই থাকবে।বাকিরা যাক বিয়ে খেতে।আফরোজা ঐ মেয়ের মুখও দেখতে চায় না।
***
আজ তাসনুভা জীবনে প্রথমবার শাড়ি পরেছে।তার শাড়ি পরার এই অদ্ভুত আবদার পূরণ করেছে আদি।পার্লার থেকে দু’টো মেয়ে ঘরে এনে সে তাদের বলেছে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে।তারাই ধরে ধরে তাকে শাড়ি পরিয়েছে।একটু কষ্ট হয়েছে,তবে তাসনুভাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে শাড়ি পরার পর থেকে।সে একেবারে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে।পার্লারের মেয়ে দু’টো তার চুল সেট করে চলে গেল।আদি তাদের বিল পে করেই তাসনুভার দরজায় টোকা দিয়ে বলল,’আসবো বাচ্চা?’
তাসনুভা দ্রুত জবাব দেয়,’আসো না।দেখো কতো সুন্দর করে শাড়ি পরিয়েছে!’
আদি তার ঘরে গেল।তাকে উপরনীচ দেখেই অবাক হয়ে বলল,’তোমাকে এখন আর বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে না।মেয়ে মেয়ে মনে হচ্ছে।’
আদি হাত নেড়ে দায়সারাভাবে বলল,’সে যাই হোক।আমার কাছে তুমি বাচ্চাই।’
নামাজ শেষ করে ঐ বাড়িতে রওয়ানা দিতে দিতে দু’টোর উপরে বেজে গেল।তাসনুভা গাড়িতে উঠেই পেছন ফিরে একবার পেছনের সিটে বসা সারাহ কে দেখল।এক বস্তা মেকআপ মুখে ঢেলে দিয়েছে সে।কালো রঙের একটা শাড়ি আর হাতাকাটা ব্লাউজ।তাসনুভা তাকে দেখেই নাক ছিটকায়।আরিশের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,’এই ছাগলটা এসব কি পরেছে?বড় ভাইয়া কি এসব দেখে না?দেখে একটা চড় মারতে পারে না?’
আরিশ তাকে আলতো করে চিমটি কেটে বলল,’আহা থাম তো।এসব কথা পরে বলিস।এখন বিয়ের চিন্তা কর।’
তাসনুভা থামল।কিছু একটা চিন্তা করেই খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’আমি চিন্তা করছি আমাদের কেনা শাড়িটা গায়ে জড়ানোর পর আপুকে কত্তো সুন্দর লাগবে! ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে আমার।’
আদি তাকে বাঁধা দিলো।সংশোধন করে বলল,’আপু না।বলো ভাবি।সে আজ থেকে আমাদের ভাবি।মিসেস আরহাম।’
নবনীতা বসে আছে কোনো একটা জড় পদার্থের মতো।না নড়ছে,না মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদ করছে।সে আনমনে একবার আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে।গাঢ় লাল জামদানী,গলায় আর কানে কুন্দনের গয়না।কপালে টিকলি,এর পাশে আবার ঝাপটা।রিমি আধ ঘন্টার উপরে তাকে সাজিয়েছে।এখন তাকে দেখাচ্ছে পুরোপুরি নতুন বউ।
শুভ্রা ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল।মুগ্ধ চোখে সে একবার তার আপাইকে দেখে।কি সুন্দর! কি স্নিগ্ধ! আপাইকে এতো চমৎকার দেখাচ্ছে কেন?রিমি মনে করে তার খোপায় গাজরা লাগাতেও ভুলল না।সব মিলিয়ে নবনীতাকে দেখাচ্ছিল বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর।বিবাহের পাত্রী হিসেবে খুব বেশি মোহনীয়।
রিমি তাকে সাজিয়ে নিজে শাড়ি পরল।সাদা আর নীলের মিশেলে কারুকাজ করা একটা শাড়ি।শাড়ি পরেই সে বিভাকে সামান্য একটু কিছু খাইয়ে দিলো।তারপর চিত্রা কে রেডি করল।তারপর শুভ্রার কাছে এসে বলল,’যাও না শুভি।বসে আছো কেন?তুমিও রেডি হয়ে যাও।’
শুভ্রা মলিন হেসে বলল,’যাবো আপু।’
চিত্রা রেডি হতেই পুরো বাড়ি ছুটাছুটি করছিল।সে ঘরে আসতেই নবনীতা খপ করে তার হাতটা ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে আনল।কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’এভাবে কেউ ছুটোছুটি করে?ব্যাথা পাবে না তুমি?’
এরই মাঝে শারমিন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এলো রিমির খোঁজে।ব্যস্ত হয়ে বলল,’রিমি ম্যাডাম কোথায়?বরের গাড়ি তো চলে এসেছে।’
রিমি মাশকারা লাগাতে লাগাতে তাড়াহুড়ো করে বলল,’সর্বনাশ! এতো আগে এসে পড়েছে?’
‘আগে কোথায়?তিনটা বাজে।’
রিমি সব সাজগোজের জিনিস ফেলে দরজার দিকে ছুটল।শারমিন কে তাড়া দিতে দিতে বলল,’শরবতের গ্লাস গুলো রেডি না খালা?তাড়াতাড়ি আমার হাতে দাও।’
আরহাম রিমিকে দেখেই একগাল হাসল।রিমি তাকে সালাম দিলো।সবাই কে বসার ঘরে বসিয়ে শরবত খেতে দিলো।আদি শরবত খেয়েই বলল,’কাজি সাহেব আমাদের সাথেই আছে রিমি।আপাতত খাওয়ার ঝামেলা টা থাকুক।অনেক বেলা হয়েছে।আগে বিয়ে টা হয়ে যাক।তাতেই সবার ভালো।’
রিমি মাথা নাড়ল।নবনীতার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,’জ্বী জ্বী কোনো সমস্যা নেই।আমি নবনীতাকে নিয়ে আসি।’
সাদেক সাহেবকে ওয়াজিদ আর আদি মিলে ধরে ধরে বসার ঘরে এনেছে।তাকে বসানো হয়েছে আরহামের মুখোমুখি থাকা সোফাতে।যেখানে একটু পরে নবনীতাকে বসানো হবে।আরহাম তাকে দেখতেই উঠে গিয়ে সালাম করল।তারপর আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
রিমি ঘরে যেতেই নবনীতা তাকে দেখে কাঠকাঠ স্বরে বলল,’কি হয়েছে?এখনই বিয়ে হবে নাকি?’
রিমি ছোট করে জবাব দেয়,’হু’
সে তাকে ধরার আগেই নবনীতা নিজ থেকে উঠে দাঁড়ায়।খুবই সাবলীল গতিতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।শুভ্রা দরজার এক কোণায় গুটিগুটি মেরে দাঁড়িয়েছিল।নবনীতা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।ম্লান হেসে বলল,’আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি শুভ্রানী।তোমাকে আর আমার কারনে হেনস্তা হতে হবে না,আমার কারণে আর তোমার কোচিং মিস দিতে হবে না।দোয়া করি আমার মতো জঘন্য মানুষ যেন তোমার জীবনে আর না আসে।দুঃখীত! আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি।আর কোনোদিন তোমার কষ্টের কারণ হবো না।তুমি ভালো থাকো।’
নবনীতা কথা শেষ করেই সোজা হেঁটে গেল বসার ঘরের দিকে।শুভ্রা দু’হাতে মুখ চেপে ছুটলো নিজের ঘরের দিকে।রিমি স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।তারপরই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
নবনীতা খুব স্বাভাবিক ভাবে সাদেক সাহেবের পাশে গিয়ে বসল।তার ইদানিং নিজেকে অনুভূতিশূণ্য মনে হয়।আরহাম চোরা চোখে একনজর তাকে দেখে।একবার দেখার পরই সে সব ভুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকে দেখতেই থাকে।এই মেয়েটিকে দেখে তার মাথায় একটি শব্দই আসছে।সেটা হলো-“ভয়ংকর সুন্দর”।
কাজি গোলাম সিদ্দিক রেজিস্টার খাতা খুলে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।নবনীতা টের পায় এই মুহূর্তে এসে সে সাংঘাতিক রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছে।আশ্চর্যের বিষয় তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।সে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না।আজ তার দু’জন মানুষের কথা খুব মনে পড়ছে।তার বাবা আর তার মা।বাবা নামের বটবৃক্ষটি আর তার পাশে নেই।সেই মায়াভরা মুখের অধিকারী লোকটা তার সাথে নেই।তার পরীর আজ বিয়ে হচ্ছে,অথচ সে দেখতে পাচ্ছে না।নবনীতা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারছে না।মা নামের পৃথিবীর অমূল্য রত্নটি তার কাছে নেই।নবনীতা একা,খুব বেশি একা।
কবুল বলতে গিয়ে সে টের পেল তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।সে কিচ্ছু বলতে পারছে না।তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।সে শেষমেশ কাঁপা কন্ঠে রিমিকে বলল,’চিত্রকে একটু এদিকে পাঠা রিমি।প্লিজ।’
রিমি দ্রুত চিত্রার খোঁজে এদিক সেদিক তাকায়।সে একটু সামনে যেতেই নবনীতা তাকে পিছু ডাকে।জড়ানো কন্ঠে বলে,’আমার শুভিকেও পাঠিয়ে দিস প্লিজ।’
পরী আপাই পরাজিত হয়েছে।যেই স্বচ্ছ আর নির্মল ভালোবাসায় সে এতোটা বছর শুভি আর চিত্রকে আগলে রেখেছিল,সেই পরী আপাই জীবনের এমন একটি মুহূর্তে অভিমান ধরে রাখতে পারে নি।শুভ্রা তার সামনে আসতেই সে খপ করে তার হাত টা ধরে নিল।কান্না গিলে অসহায় গলায় বলল,’আপাইকে মাফ করে দিস শুভ্রা।আপাই তোদের খুব বেশি ভালো রাখতে পারি নি।ভাবিস না অভিমান থেকে বলছি।অভিমান না,আমি সত্যিই ভালো রাখতে পারি নি তোদের।’
শুভ্রা সোফাতে বসেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কতোক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদলো।নবনীতা অবশ্য শব্দ করে কাঁদে নি।কেবল দীর্ঘশ্বাসের সাথে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়েছে।সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাতে শক্ত করে তার দুই বোনকে আগলে ধরে।
কাজি গোলাম সিদ্দিক আবারো বললেন,’গুলশান নিবাসী মরহুম শেখ আজিজ হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ শাহরিয়ার আরহাম তোমায় নগদ চার লক্ষ টাকা দেনমোহর প্রদানে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক।তুমি কি এই প্রস্তাবে রাজি?রাজি থাকলে বলো কবুল।’
নবনীতা দীর্ঘসময় চুপ থাকে।কাজি সাহেব কিছুটা ভড়কে গিয়ে তাকে দেখে।লাল শাড়ি পরিহিত অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটি দীর্ঘসময় কাঠের পুতুল হয়ে বসে থাকার পর একটু নড়েচড়ে উঠে।অনুভূতি গুলো সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে গেছে।সে কথা বলবে কেমন করে?
শেষটায় শুভ্রা আর চিত্রাকে ছেড়ে সে নিজের শাড়ির কুচির দিকটা খাঁমচে ধরে।সব অনুভূতি গিলে নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,’কবুল কবুল কবুল।’
তারপরই দায়সারাভাবে কাবিননামায় সাক্ষর করে।একবার চোখ তুলে সামনে বসে থাকা যুবকটিকে দেখে।তার সাথে এই মাত্র নবনীতার বিয়ে হয়েছে।সে এখন থেকে তার স্বামী।যেই স্বামী কে দেখামাত্রই কিছু কৎসিত স্মৃতি নবনীতার মস্তিষ্কে ভেসে উঠে।
আর তারপর?একটি সাক্ষর আর কবুল বলার মাধ্যমে দু’টি প্রাণ বাঁধা পড়ল পরিণয় নামক বন্ধনে।যারা কেউ জানে না সামনের দিনগুলো কেমন করে যাবে।যারা কেউ এখনো ঠিক মতো নিজেদের চিনেই উঠতে পারেনি।শুধু পরিস্থিতির পরিক্রমায় আজ তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।প্রকৃতি কিংবা নিয়তি,যাই বলা হোক না কেন।সেটাই তাদের এই অব্দি নিয়ে এসেছে।জুতো জোড়া হারায়নি,তবে চিত্রার কথা কে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে সিনড্রেলার রাজকুমার সত্যিই তাকে খুঁজে নিয়েছে।যে তাকে টুপ করে ধরে নিয়ে টুশ করে বিয়ে করে ফেলেছে।
****সমাপ্ত****[প্রথম অধ্যায়]
{প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছে।পরশু থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় অধ্যায়।যেটা পুরোটাই হবে আরহাম আর নবনীতার বিবাহিত জীবনকে কেন্দ্র করে।উনত্রিশ মিনিটের মধ্যে প্রায় ১৮০ জন ভোট দিয়েছিলেন আমি যেন ধীরে সুস্থে সবগুলো চরিত্র নিয়ে গল্পটা লিখি।আমিও সেটাই করব।আরহাম আর নবনীতার বিবাহিত জীবনের সবকিছু আমি গুছিয়ে সময় নিয়ে লিখবো।সাথে পার্শ্ব চরিত্র গুলোকেও তুলে ধরব।যারা এতো এতো ভালোবাসা দিয়ে এ পর্যন্ত পড়েছেন তাদের কে অনেক অনেক ধন্যবাদ।দ্বিতীয় অধ্যায়ে আবারো আপনাদের ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।আরেকটি বিষয়,দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ের চেয়ে তাদের সংসার জীবনের বর্ণনাই বেশি থাকবে।আগেই জানিয়ে দিলাম।}
নবনীতা তার ফ্ল্যাটে এসেই এক দৌঁড়ে নিজের ঘরে গেল।দরজা বন্ধ করে দীর্ঘসময় সে দরজার সাথে ঠেস দিয়ে বসে থাকল।পুরো রাস্তা যে কান্না সে আটকে রেখেছিল,দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই সেটা বাঁধ ভাঙা জলের মতো তার চোখ ছাপিয়ে গাল পর্যন্ত নেমে এলো।সে এতোটাই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে এসেছে যে শুভ্রাকে সাথে আনার কথাও তার মাথায় ছিল না।
ঘরের বাইরে শুভ্রার কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।নবনীতা তবুও দরজা খুলল না।ঘড়ির কাঁটা তখন সন্ধ্যা সাতটা ছুঁয়েছে কেবল।নবনীতা চোখ মুছে তার কপালে হাত ছোঁয়ায়।এখানটায় ই তো ঐ লোকটা চুমু খেয়েছিল তাই না?সে দুই হাঁটুতে মুখ গুজে আবারো কিছুক্ষণ কাঁদলো।সে এখন কি করবে?নিশ্চয়ই এই খবর মানুষের কাছে দাবা’নলের মতো ছড়িয়ে যাবে?এরপর?এরপর কি হবে?
ঘন্টা খানেক সেভাবেই বসে থাকার পর সে উঠে দাঁড়ায়।বারান্দা থেকে তোয়ালে হাতে নিয়ে বাথরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে দাঁড়ায়।সে গোসল থেকে বেরিয়েই দু’টো ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে যাবে।এরপর কি হবে সে জানে না।আপাতত একটু ঘুমাতে না পারলে সে পা’গল হয়ে যাবে।
***
আরহামের যখন ঘুম ভাঙে তখন সে নিজেকে আবিষ্কার করে নিজের ঘরে,তার খাটে।পুরো ঘরে তখন ডিম লাইটের মৃদু হলদে আলো আভা ছড়াচ্ছিল।আরহাম চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসল।তার শরীর এখনও কেমন মেজমেজ করছে।সে আড়মোড়া ভাঙে।এদিক সেদিক তাকায়।টের পায় বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে আছে।সে খাটে বসে থেকেই সেদিকে উঁকি দেয়।জড়ানো কন্ঠে জানতে চায়,’কে?আদি?’
আদি তার ডাক শুনেই পেছন ফিরে।শম্বুক গতিতে এগিয়ে এসে তার খাটের এক কোণায় এসে বসে।আরহাম চোখ পাকিয়ে বলল,’কি রে?এমন মন খারাপ করে আছিস কেন?’
আদি বেডশিটের দিকে চোখ রেখেই ঠান্ডা স্বরে বলল,’তুই জানিস আজ কি হয়েছে?’
আরহাম পুনরায় চোখ ডলতে ডলতে বলল,’কি হয়েছে?’
আদি আগের চেয়েও শীতল কন্ঠে উত্তর দেয়,’তুই আর নবনীতা সিটি কলেজের টিচার্স রুমে ছিলি।দুই তাকে জড়িয়ে ধরেছিস।কলেজের টিচার আর অথোরিটি নিজ চোখে সবটা দেখেছে।আমাকে একটা কথা বল তো।তুই কি সেখানে গিয়ে কোনো ড্রাগস নিয়েছিস?তুই এসব খাস আরহাম?লাইক ওয়াইন কিংবা হুইস্কি না।সেগুলো খেয়ে কেউ এমন করে না।তুই কি কো’কেইন টাইপ কিছু খাস?’
আরহাম চোখ বড় বড় করে কতোক্ষণ তাকে দেখল।আদি এসব কি বলছে?সে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে অস্থির হয়ে বলল,’তোর মাথা খারাপ হয়েছে আদি?তুই আমাকে কতো ভালো করে চিনিস।তবুও এসব কেন বলছিস আমার নামে?আমি সেরকম হাই পাওয়ার ড্রাগস কখনোই নেই না।নেভার।’
‘সেটা আমিও জানি।বাট তোকে যখন বাড়িতে আনা হলো,তুই পুরাই আউট অব সেন্স ছিলি।ইভেন তুই কি করেছিলি তুই নিজেও জানিস না।’
আরহাম দুই হাত মাথার দুই পাশে রাখল।দুই পক্ষই দীর্ঘসময় নিশ্চুপ বসে থাকল।কিছু সময় যেতেই নিরবতা ভেঙে আরহাম চাপা স্বরে বলল,’আমাকে আর নবনীকে নিয়ে মানুষ বাজে কথা বলছে?’
আদি ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,’এটা বাংলাদেশ।এতো বড়ো কাহিনী হবে আর মানুষ কিছু বলবে না এটা তো হতে পারে না।’
ফোন পেতেই সে দ্রুত কাউকে কল দেয়।কল রিসিভ হতেই অধৈর্য হয়ে জানতে চায়,’সে কেমন আছে রিমি?তুমি প্লিজ একবার তার কাছে যাবে?’
***
একটা মেয়েকে হেনস্তা কিংবা অপমান করার সবচেয়ে সহজ উপায় কি?অবশ্যই সেটা তার চরিত্রে দাগ লাগিয়ে দেওয়া।ছেলেদের কখনো চরিত্রে দাগ লাগে না,মেয়েদের লাগে।দুই বাচ্চার বাপ হয়ে যাওয়া ছেলেটা ডিভোর্সের পরেও অনায়াসে ষোলো বছর বয়সের অল্পবয়স্কা মেয়েটিকে বিয়ে করে ফেলতে পারে।সমাজ তাতে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ করে না।কিন্তু সদ্য বিবাহিত মেয়েটি,যার হাতের মেহেদির রঙ শুকানোর আগেই স্বামী পরকালে পাড়ি জমান,তার নতুন করে সংসার বাঁধা নিয়ে সুশীল সমাজের বহু ফতোয়া আছে।
একটি মেয়ে,যাকে কিছুতেই দমানো যায় না,কোনো ক্রমেই হারানো যায় না,তাকে হারানোর একটি সহজ উপায় তার চরিত্রে কাদা ছুড়ে দাও।যেকোনো অন্যায়ের তীব্র প্রতিবাদ করা মেয়েটি মিথ্যা অপবাদ থেকে নিজেকে কেমন করে বাঁচাবে?কেমন করে প্রমাণ করবে তার চরিত্র খারাপ না?মানুষের ভেতরে যে বিশ্বাস একবার ঢুকে যায় সেটা কি কোনোভাবেই দূর করা যায়?
নবনীতার পরবর্তী দু’টো দিন কেমন গিয়েছে সে নিজেও জানে না।তার প্রতিনিয়ত মনে হয়েছে সে ম’রে যাচ্ছে।আতঙ্কে ভয়ে লজ্জায় সে নিজের মুঠোফোন টা হাতে পর্যন্ত নিতে পারত না।মানুষ তাকে নিয়ে যা তা বলছে।যেভাবে পারছে সেভাবে হেনস্তা করছে।নবনীতা এদের মুখ কেমন করে বন্ধ করাবে?কেউ যখন তোমায় বলে তুমি একটা চরিত্র’হীনা,তখন তাকে কেমন করে জবাব দিতে হয়?কেমন করে তাকে বিশ্বাস করানো যায় যে সে ভুল?বিশ্বাসের উপর তো কারো নিয়ন্ত্রণ নেই।
নবনীতা,প্রখর আত্মসম্মানে ভরপুর একটি মেয়ে,যে দৃপ্ত কদমে আত্মবিশ্বাসের সাথে শহরের রাস্তায় হেঁটে বেড়াতো,সে মেয়েটা একটা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনার জের ধরে নিজেকে গৃহবন্দী করল।সে নিজের সোশ্যাল মিডিয়াতেও যেতে পারত না।কারণ তার ভয় হয়।নিজেকে নিয়ে বানানো কুৎসিত কেচ্ছা গুলো পড়তে তার গা ঘিনঘিন করে।
মূলধারার নিউজ চ্যানেল গুলো কখনোই মানুষের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে বাড়াবাড়ি করে না।এসব বিষয়ে তারা বরাবরই নির্লিপ্ত থাকে।তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংবাদ চ্যানেল গুলো কেবল মুখিয়ে থাকে এধরনের ঘটনার নিউজ করার জন্য।দেখা গেল ঘটনা যা ঘটেছে,তার চেয়েও দ্বিগুন ভাবে সেটা প্রকাশ করা হচ্ছে।’নেতার সাথে তরুণীর বন্ধ ঘরে ভিডিও ফাঁস’ এধরনের কুৎসিত শিরোনামে সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে।নবনীতা এসব দেখতেই দুই হাত মুখে চেপে ধরে।
সে অফিসে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে সে কয়দিন ছুটি চায়।বরাবরের মতোই অফিস বিনাবাক্যে তার ছুটি মঞ্জুর করেছে।সে ইদানিং চব্বিশ ঘন্টা নিজের ঘরেই থাকে।একটা বন্ধ ঘর।যেখানে নবনী নিস্তেজ হয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে থাকে।
তার মাঝে মাঝে মনে হয় এই ফেইসবুক চ্যানেল গুলো যারা চালায়,তাদের কি সামান্য বিবেকটুকুও নেই?শুধুমাত্র সামান্য ভিউয়ের আশায় এতো বড় মিথ্যা কথা ছড়াচ্ছে?নবনীতার চরিত্রে কালি মাখিয়ে নিজেদের ব্যবসা জমাচ্ছে?সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত একটি ঘটনাকে তারা রীতিমতো অবৈধ সম্পর্ক বলে চালিয়ে দিচ্ছে।কিসের অবৈধ সম্পর্ক?তার সাথে আরহামের কবেই বা সম্পর্ক ছিল?
নবনীতা পুরোপুরি হাল ছেড়ে দিলো।সে হেরে যাওয়ার মানুষ না।কিন্তু নিজের চরিত্রের সাফাই গেয়ে গেয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার বৃথা চেষ্টাও সে করবে না।সে জানে,তার কথা কেউ মানবে না।সে যতোই চিৎকার করে বলুক সে ন’ষ্ট মেয়ে না,তবুও সমাজ এটাই বলবে তুমি নষ্ট,তুমি নেতাদের ভোগ্যপণ্য।
রিমি দু’দিন ধরেই তার কাছে।সে একটু পর পর তার ঘরে যায়,কথা বাড়ানোর চেষ্টা করে।কিন্তু কথা আগায় না।নবনীতার মাথার নিচের বালিশ টা তার চোখ বেয়ে নেমে আসা পানিতে ভিজে উঠে বারবার।রিমি হতাশ হয়ে সে দৃশ্য দেখে।বিগত দিনগুলোতে সে কখনোই এমন করে কাঁদেনি।রিমি তাকে কখনো কাঁদতে দেখেনি।এমনকি যেদিন ঘটনা ঘটেছে সেদিনও সে খুব শক্ত ছিল সবার সামনে।কেবল মোবাইল ফোন হাতে পাওয়ার পর থেকেই সে পুরোপুরি বি’ধ্বস্ত হয়ে পড়েছে।
রিমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মেয়েটা জীবনের শত শত প্রতি’ঘাতে এমন করে ভেঙে পড়েনি কখনো।সে তো বার বার পড়ে গিয়ে পুনরায় উঠে দাঁড়ানোর মানুষ।প্রখর রোদে ঝলসে গিয়েও শক্ত হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা অবেলার বৃষ্টিতে বার বার মূর্ছা যাচ্ছিল।যত বারই সে রিমিকে দেখল,ততবারই একটা কথাই বলল।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাকে নিয়ে ভুল বলা হচ্ছে।সেদিন সেখানে এমন কিছু হয় নি।সে কিছু করে নি।সে এসবের কিছুই জানে না।সে চরিত্র’হীনা নয়।
রিমি ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে তাকে দেখে।একটা সম্পূর্ণ মিথ্যা অপবাদে মেয়েটা নিজেকে এমন করে গুটিয়ে নিচ্ছে।সে বার কয়েক তার হাত থেকে মোবাইল ফোন কেড়ে নিল।এটা দেখেই সে আরো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে।দুই দিন নির্ঘুম থাকার পর তৃতীয় দিন নবনীতা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমায়।
রিমি বারান্দায় গিয়ে ফোন হাতে নেয়।আরহাম কল রিসিভ হতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলে,’পরী কেমন আছে রিমি?’
‘ভালো না ভাইয়া।সেই এক কথাই বার বার বলছে।সে কিছু করে নি।মানুষ মিথ্যা বলছে।মানুষ তাকে ভুল ভাবছে।সে কোনো নেতার সাথেই কিছু করে নি।’
আরহাম ঠান্ডা গলায় বলল,’ফোন দেখতে দিচ্ছ কেন?কয়দিন মোবাইল হাতে না নিলে কি হয়?মানুষের কথায় সে এতো কান দিচ্ছে কেন?’
‘জানি না ভাইয়া।এই এতো বছরে তার চরিত্র নিয়ে কেউ কিছু বলে নি।এখন বলছে।সে এটা নিতে পারছে না।’
আরহাম কেবল দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।দীর্ঘসময়ের নিরবতা ভেঙে রিমি নিজ থেকে বলে,’ভাইয়া! সে যদি অফিস আর ফ্ল্যাটের বিষয়টি জেনে যায়,তখন?’
আরহাম মাথা নিচু করে চাপা স্বরে বলল,’জানি না রিমি।লোকাল চ্যানেল গুলো যেভাবে আমাকে আর পরীকে নিয়ে ঘাটাচ্ছে,খুব দ্রুতই সে সবকিছু জেনে যাবে মনে হচ্ছে।আমি সমালোচনা নিয়ে ভয় পাই না।রাজনীতিবিদ দের নামে এমন তকমা লাগেই।নাথিং সিরিয়াস।কিন্তু আমার তার জন্য খারাপ লাগে।শি ওয়াজ ইনোসেন্ট।তার কোনো দোষ নেই।’
***
শ্রাবণের কোনো এক বৃষ্টি মুখর দিনে নবনীতার সুন্দর করে গোছানো এপার্টমেন্টে তিনজনের অতিথির আগমন হয়।শুভ্রা দরজা খুলে তাদের দেখেই অবাক হয়ে বলে,’তোমরা?’
রিমি রান্নাঘর থেকে ছুটে এসে তাদের দেখেই আশ্চর্য হয়ে বলল,’তোমরা এসে গেছ?আসো আসো।ঘরে এসে বসো।’
নবনীতা তখনও তার খাটের এক কোণায় জড় পদার্থের মতো পড়েছিল।রিমি গিয়ে তার শিয়রে বসে।তার হাত টা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে কোমল গলায় বলে,’নবনী! তুই কি একটু বসার ঘরে আসতে পারবি?’
নবনীতা নিরুত্তর।তার চোখ দু’টো সিলিংয়ের দিকে।চোখের পানি শুকিয়ে গালের কাছটায় লেপ্টে আছে।একটু আগে সে ফুঁপিয়ে কেঁদেছে।একটি চ্যানেলে নিউজ করা হয়েছে কলেজের টিচার্স রুমে নাকি তরুণীকে হাতে নাতে ধরা হয়েছে।এটা দেখার পর নবনীতা বালিশে মুখ চেপে গলা ছেড়ে চিৎকার করেছে কতোক্ষণ।হাতেনাতে?এই শব্দটা কি আদৌ তার সাথে যায়?সে কি কোনো পাপ করেছে যে ধরা খাবে?তার সাথে এতো অবলীলায় এই বিশেষণ জুড়ে দিলো?
রিমি আবারো বলল,’আদি ভাইয়া,আরিশ আর তাসনুভা এসেছে নবনী।তুই একটু কথা বল প্লিজ।’
নবনীতা সিলিং দেখতে দেখতেই ক্ষীণ স্বরে বলল,’তাদের চলে যেতে বল রিমি।আমার কোনো কথা নেই তাদের সাথে।’
‘প্লিজ নবনী।অতো দূর থেকে এসেছে।একটু তো কথা বল।’
নবনীতা তক্ষুনি উঠে নি।আরো কিছু সময় শুয়ে থেকে সে অবশেষে উঠে বসে।শুভ্রার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আগের দিন সে সোফা কিনেছিল।আদি,আরিশ সোফার মাঝামাঝি বসে ছিল।তাসনুভা আর কষ্ট করে হুইলচেয়ার ছেড়ে সোফায় যায়নি।নবনীতা তাদের সামনে আসতেই তাসনুভা আঁতকে উঠে বলল,’আপু! তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?তুমি ঠিক আছো তো?’
নবনীতা উত্তর না দিয়ে চুপচাপ সামনের সোফায় গিয়ে বসে
আদি তার এলোমেলো ছন্নছাড়া মুখটা দেখেই কোমল গলায় বলল,’প্লিজ নবনীতা।তুমি এমন মন খারাপ করে থেকো না।প্লিজ,আই অ্যাম রিকোয়েস্টিং।’
তাসনুভা তার হাত টা চেপে ধরে বলল,’আপু তুমি কেন এমন অদ্ভুত আচরণ করছ?আমরা তো কথা বলেও সবটা ঠিক করতে পারি তাই না?’
নবনীতা পাশ ফিরে।আশ্চর্য হয়ে বলে,’কথা দিয়ে কেমন করে সব ঠিক হবে তাসনুভা?কিসের কথা?কথা বললে আমার সম্মান ফিরে আসবে?লোকে বিশ্বাস করে নিবে যে আমি কোনো ন’ষ্টা নই?’
‘আপু প্লিজ।এধরনের শব্দ বলো না প্লিজ।’
নবনীতা কথা না বাড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।একনজর সবাইকে দেখে নিরাসক্ত কন্ঠে বলে উঠে,’প্লিজ তোমরা চলে যাও।তোমরা বাড়িতে এসেছ এই খবর জানা জানি হলে আরো এক দফা ঝামেলা হবে।সেই ঘুরে ফিরে আমার উপরই সবটা আসবে।আমার তোমাদের করুণা চাই না।তোমরা যেতে পারো।’
কথা শেষ করেই সে সোজা নিজের ঘরের দিকে হাঁটা দেয়।সে একটু দূর যেতেই আদি উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,’আমরা কোনো করুণা করতে আসি নাই নবনী।আমরা একটি কথা বলার জন্য এসেছি।’
নবনীতা নিজ থেকে আর কিছু জিজ্ঞেস করল না।সে জানে আদি নিজেই খুলে বলবে সবটা।সে অপেক্ষা করে আদির মুখ থেকে কথাটা শোনার।আদি একটু ধাতস্থ হয়ে স্পষ্ট গলায় বলল,’নবনীতা আরহাম তোমাকে বিয়ে করতে চায়।’
আদি শান্ত মুখে বলল,’আমি ইয়ার্কি করছি না।আম সিরিয়াস।এগুলা আমার কথা না।আরহামই আমাকে বলেছে তোমাকে এটা বলার জন্য।হি ওয়ান্টস টু ম্যারি ইউ।’
নবনীতা হুট করেই হেসে ফেলল।তার হাসি দেখেই আদি ভড়কে যায়।অদ্ভুত! সে হাসছে কেন?নবনীতা হাসি থামিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলল,’ঐ তো।ঘুরে ফিরে করুণাই করা হচ্ছে।’
নবনীতা কয়েক দফা টেনে টেনে শ্বাস নেয়।নিজেকে একটু সামলে নিয়ে সে চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’আপনার বন্ধুকে বলবেন নবনীতা এতোও পচে যায়নি যে লোকের নিন্দে থেকে বাঁচ’তে তার মতো উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষের সাথে বিয়ে করবে।আমার জীবনে খারাপ সময় যাচ্ছে।সেই খারাপ কেটে যাবে।কিন্তু নিজের জীবন কে তার মতো লোকের সাথে জড়িয়ে আমি সারাজীবন এভাবে কাঁদতে পারব না।’
সে কথা শেষ করে আর জবাবের অপেক্ষা করে না।সোজা হেঁটে পা বাড়ায় নিজের ঘরের দিকে।ঐ লোক এখন করুণা দেখাচ্ছে।মহান সাজার ভন্ডামি করছে।
আদি অবশ্য হাল ছাড়েনি।সে সেদিন সাদেক সাহেবের সাথে ঘন্টা খানেক কথা বলল।কথা শেষে লিভিং রুমে এসেই আরিশ আর তাসনুভা কে নিয়ে বেরিয়ে গেল।রিমি দরজা বন্ধ করেই শুভ্রার দিকে তাকায়।এই ক’দিনে নবনীতার সাথে সাথে সেও কেমন চুপশে গেছে।রিমি রান্নাঘরে যেতে যেতে আদুরে গলায় বলল,’কিছু খেয়ে নাও শুভি।শরীর খারাপ করবে না হয়।’
.
.
.
.
ডেস্ক ক্যালেন্ডারে আরো চারটে দিনের সমাপ্তি হয়েছে।কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি শেষে ঝলমলে রোদ্দুর উঁকি দিয়েছে মেঘের আড়াল থেকে।এমনই এক রৌদ্রজ্বল দিনে নবনীতা নূর লম্বা গোসল শেষে খুবই প্রাণবন্ত মুখে আলমারির তাক থেকে নিজের বাইরে পরার একটি জামা বের করল।তাকে দেখাচ্ছে খুবই স্বাভাবিক,সেই সাথে ভীষণ হাস্যোজ্জ্বল।
টানা এক সপ্তাহ নিজেকে ঘরের ভেতর বন্দি রাখার পর নূর আহমেদের সাহসী মেয়েটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবে না।সে মুখোমুখি হবে।সবকিছুর মুখোমুখি হবে।হাসিমুখে জীবনের সকল সংঘাত সে মোকাবিলা করবে।লোকে বললেই কি সে খারাপ হয়ে গেছে নাকি?লোকে তো কতো কথাই বলে।নবনীতা সাহসী।সে কেনো এসবে মূর্ছা যাবে?সে ভেবে নিয়েছে এসব আর সে গায়ে মাখবে না।সব অপবাদ গায়ে মাখলে এক সময় দেখা যাবে লোকে বলছে নবনীতা খু’নী।তখন কি সে সেটা মেনে নিয়ে নিজেকে গৃহবন্দী করবে?নাহ,কক্ষনো না।
রিমি চায়ের কাপ হাতে ঘরে ঢুকেই বলল,’তুই তাহলে আজ থেকেই অফিস যাওয়া শুরু করবি?’
নবনীতা হাসি মুখে বলল,’উহু,আজ থেকে নয়।কাল থেকে।’
‘তাহলে রেডি হচ্ছিস যে?’
নবনীতা হাতের জামাটি নেড়ে চেড়ে দেখতে দেখতে বলল,’ভাবছি শুভি আসলে আজ আমরা বাইরে যাবো।একটু ঘুরে আসবো।মাইন্ড ফ্রেশ হবে।’
রিমি স্মিত হেসে বলল,’ভালোই ভেবেছিস।গুড ডিসিশন।’
কলেজ শেষে শুভ্রার একটা প্রাইভেট থাকে।সে আজ প্রাইভেটে না গিয়ে সোজা বাড়ি ফিরেছে।নবনীতা তাকে দেখেই কপাল কুঁচকে বলল,’কি রে?তুই কোচিং-এ যাসনি?’
শুভ্রা কাঁধের ব্যাগটা যথাস্থানে রেখে ধপ করে তার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটায় বসে পড়ল।ছোট করে জবাব দিলো,’না, যাই নি।’
‘কেন?’ কড়া গলায় প্রশ্ন করল নবনীতা।
সে তার সামনে গিয়েই বুকে হাত বেঁধে খানিকটা ধ’মকে উঠে বলল,’কেন যাসনি?কোচিং কি কোনো ঘুরার জায়গা?যে মন চাইলে যাবি,আর মন না চাইলে যাবি না?’
শুভ্রা উত্তর না দিয়ে কেবল মাথা নামিয়ে চুপচাপ বসে রইল।নবনীতা কঠিন মুখে বলল,’কি হচ্ছে কি শুভি?উত্তর চাইছি না?কেন যাসনি?’
শুভ্রা শেষ পর্যন্ত অধৈর্য হয়ে বলল,’যাইনি কারণ গেলেই বাজে কথা শুনতে হয়।ওসব কথা আমি নিতে পারি না।’
নবনীতা দুই কদম পিছিয়ে গেল।ভাঙা গলায় বলল,’কি বলে শুভি?কি বাজে কথা বলে?’
শুভ্রা বড় করে শ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,’ছাড়ো এসব।কাল থেকে মিস দিব না প্রাইভেট।’
নবনীতা অস্থির হয়ে বলল,’শুভ্রা আমার কথার উত্তর দে।কি বলে তারা?বল আমাকে।’
‘কিছু না আপাই।তুমি যাও।তুমি জেনে কি করবে?’
‘শুভি! বলতে বলেছি না?’
শুভ্রার ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।সে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে বলল,’শুনতে চাও তারা কি বলে?তারা বলে আমি নাকি শাহরিয়ার আরহামের প্রেমিকা নবনীতার বোন।আমার বোনের সাথে আরহামের বহু দিনের অবৈধ সম্পর্ক।আমার বোন দেখতে হেব্বি সুন্দর।সেই শরীর দিয়েই সে শাহরিয়ার আরহামকে কাবু করেছে।আরহাম জাস্ট তাকে ভো’গ করে।কিন্তু বিয়ে করে না।’
শুভ্রার প্রতিটা বাক্য নবনীতার বুকে গিয়ে বিঁধলো ধাঁরালো কোনো তীরের মতো।তার মনে হচ্ছে তার হৃদযন্ত্রে কেউ ছু’রি বসিয়ে বারংবার তাতে আঘাত করছে।তার চোখ ছলছল করে ওঠে।সে কাঁপা কন্ঠে বলে,’শুভি!’
‘আমাকে বলে কোনো লাভ নেই আপাই।মানুষ এটাই ভাবে।আমার কলেজের প্রতিটা মানুষ এটাই ভাবে তোমাদের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।তোমাদের কে তো বহুবার একসাথে দেখা গিয়েছে।তুমি হচ্ছো তার প্রেমিকা,যাকে সে কোনোদিনই বিয়ে করবে না।’
‘শুভি! তুই তো জানিস এগুলো সব মিথ্যা।তাহলে কেন তাদের মুখের উপর কোনো জবাব দিলি না?’
শুভ্রা একহাত সামনে তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,’থাক আপাই।হয়েছে।এতো শত মানুষের মুখের উপর জবাব দেওয়ার গাটস আমার নেই।আমি কয়জনের মুখ বন্ধ করাবো বলো?আমার পক্ষে তোমার মতো এতো সাহসী হওয়া সম্ভব না।ক্ষমা করবে আমায়।তুমি তোমার প্রতিবাদ চালিয়ে যাও।আমি পারবো না।’
শুভ্রা থামল।কয়েকবার শ্বাস ছেড়ে পুনরায় বলতে লাগল,’তোমার তো কোনো সমস্যা নেই আপাই।তোমার সামনে তো কেউ কিছু বলে না।বলে তো সবাই তোমার পেছনে।সেগুলো আমাদের শুনতে হয়।তোমার কি?তুমি তো দিব্যি সুখে আছো।’
নবনীতা নির্বাক হয়ে কেবল তার কথা শুনল।এতো জোর গলায় শুভি তার সাথে কথা বলছে?তার বোন শুভ্রা তাকে এমন করে বলছে?নবনীতাকে চূড়ান্ত রকমের হতবাক করে দিয়ে শুভ্রা তার তর্জনী নবনীতার দিকে তাক করে বলল,’তুমি জানো আপাই তুমি যে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত জেদ ধরো?আরহাম ভাইয়ের সাথে বিয়েতে রাজি হলে কি এমন হতো?তুমি ম’রে যেতে?ভাইয়া তোমায় জানে মে’রে ফেলতো?নাহ কিছুই হতো না।মাঝখানটায় আমি,মামা,চিত্র আমরা সবাই বেঁচে যেতাম।কিন্তু নাহ,তুমি তো জেদ ধরবেই।তেজ তো তুমি দেখাবেই।তোমার এই ইগো আর তেজের কারণে তুমি বিয়েটা ভেঙে দিলে।যাও একটু সবকিছু ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা ছিল,তুমি সব ভেস্তে দিয়েছ।খুব ভালো করেছ।তুমি জিতে গেছ আপাই।কিন্তু কখনো সময় পেলে আমাদের কথাও ভাববে আপাই।আমরা কোনো কু’কুর বিড়াল না।আমাদেরও একটু শান্তিতে রাস্তাঘাটে যাওয়ার অধিকার আছে।আমরাও,,,’
শুভ্রা কথা শেষ করার আগেই নবনীতা গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তার গালে একটা চড় বসায়।শুভ্রা ধাতস্থ হওয়ার আগেই সে তাকে আরো একটা চড় দেয়।রিমি আওয়াজ শুনেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।নবনীতা তাকে তৃতীয় বার প্র’হার করার আগেই রিমি তাকে শক্ত করে জাপ্টে ধরল।একপ্রকার ধ’মকে উঠে বলল,’কি করছিস এসব?তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে নবনীতা?তুই শুভ্রাকে মারছিস?’
নবনীতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে চিৎকার করে বলল,’আমি ঠিক আছি রিমি।আমি খুব ঠিক আছি।আমার চোখের সামনে একটা বে’ঈমান দাঁড়িয়ে আছে।নিজে না খেয়ে ঐ বে’ঈমান কে খাইয়েছি।নিজের ভাগের খাবার সব ঐ বে’ঈমান কে দিয়েছি।নিজে ঔষধ কিনি না,কিন্তু বোনের টিউশন ফি মিস যায় না।সেই বোন আমাকে সুন্দর প্রতিদান দিয়েছে।সে জানতে চাইছে আমি কি করেছি।’
শুভ্রা সাথে সাথে বিরোধ করে বলল,’মিথ্যে কথা।আমি সেটা বলি নি একবারও।’
নবনীতা ছুটে গিয়ে তাকে আরেকটা চড় মে’রে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’একদম চুপ।একদম মে’রে ফেলব বলে দিলাম মুখের উপর তর্ক করলে।আমি মিথ্যেবাদী তাই না?বেয়াদব কোথাকার!তুই আর কোনোদিন আমাকে বোন ডাকবি না।যাহ,চোখের সামনে থেকে দূর হ।’
রিমি নবনীতার দুই কাঁধে হাত চেপে শুভ্রার কাঁদো কাঁদো মুখটা দেখেই তড়িঘড়ি করে বলল,’আচ্ছা শুভি তুমি এখন অন্য রুমে যাও আপু।তোমার আপাই একটু শান্ত হোক।তুমি আপাতত যাও আপু।’
শুভ্রা চোখ ভর্তি পানি নিয়েই সেখান থেকে চলে গেল।সে যেতেই নবনীতা কাঁপতে কাঁপতে বলল,’মানুষ ঠিকই বলে।মা বাপ ছাড়া দুনিয়াতে কেউ কারো আপন না।সব ঐ ঘুরেফিরে নিজের স্বার্থই দেখে।’
‘নবনীতা! তুই দিনদিন মেন্টালি সিক হয়ে যাচ্ছিস।এই নবনীতা আর সত্যিকারের নবনীতার মাঝে অনেক তফাৎ।তুই ইদানিং অস্বাভাবিক আচরণ করছিস।’
নবনীতা তার কথা শুনেই মুখ শক্ত করে বলল,’আমি এমনই।ভালো লাগলে থাক,নয়তো যা।আমার তোদের কাউকে প্রয়োজন নেই।’
______
রাত আটটার পরে সাদেক সাহেব রিমিকে দিয়ে নবনীতাকে তার ঘরে ডেকে পাঠালেন।নবনীতা ঘরে এসেই তাকে সালাম দিলো,স্মিত হেসে তার পাশ ঘেঁষে বসল।
সাদেক সাহেব বলতে থাকেন,’বিয়ে মানুষের জীবনের একটি অংশ পরী।আমরা কেউই একে উপেক্ষা করতে পারি না।একজন মানুষ বাহ্যিক দিক থেকে কেমন,তার উপর বিচার করে আমরা তার বৈবাহিক স্বত্তার বিচার করতে পারি না মা।অনেক মানুষ বাইরে থেকে খুবই একরোখা প্রকৃতির হয়,কিন্তু স্বামী হিসেবে চমৎকার হয়।আমরা কেউই বিয়ের আগে জানি না আমাদের বিবাহিত জীবন কেমন হবে।তাই না মা?’
নবনীতা ছোট করে জবাব দেয়,’জ্বী মামা।’
‘বিয়ে জিনিসটা আল্লাহর থেকে নির্ধারিত।আমাদের জোড়া আসমানেই বানানো হয়।তোমার জোড়াও বানানো হয়েছে কারো সাথে।তাই না?তুমি যতোই পালাও।তার সাথেই তোমার বিয়ে হবে এটা জানো?’
‘জ্বী জানি।’
সাদেক সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,’তোমার মনের অবস্থা মামা বুঝি।কিন্তু সেই সাথে মামা পরিস্থিতিও বুঝি।তোমার চেয়ে জীবনের জ্ঞান আমার বেশি।আমি জানি পরী,সামনের দিনগুলো তোমার খুব একটা ভালো যাবে না।সব ক্ষেত্রে জেদি হওয়া যায় না পরী।মাঝে মাঝে একটু শান্ত থেকে বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত নিতে হয়।পরিস্থিতি এখন যেই জায়গায় আছে সেই জায়গা থেকে আরহামকে তোমার বিয়ে করে নেওয়া উচিত বলে আমার মনে হয়।অবশ্যই সেটা আমার মনে হয়।বাকিটা আমি তোমার উপর ছেড়ে দিলাম।তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি।তোমার যা ভালো মনে হয় তাই করবে।’
নবনীতা ফিচেল হাসল।মাথা নিচু করে মলিন হাসি মুখে মেখে বলল,’না মামা।আমার আর কিছু মনে হয় না।তোমাদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।তুমি যা ভালো বলে মনে করছ,তাই হোক।এই বিয়েতে আমার কোনো আপত্তি নেই।আমি রাজি মামা।তুমি তাদের বলে দেও।আমার বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।’
সাদেক সাহেব একদৃষ্টিতে তাকিয়ে তার মুখশ্রী দেখেন।নবনীতা নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে কান্না গিলে নেয়।আনমনে হেসে জড়ানো কন্ঠে বলে,’আমি আর তোমাদের স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকতে বাঁধা সৃষ্টি করতে চাই না।আমার জন্য এতোগুলা মানুষের অসুবিধা হোক আমি চাই না।সবাই সুখে থাকুক।কেবল দোয়া করবে,আল্লাহ যেন আমায় আরো বেশি ধৈর্য দেয়।’
নতুন কিনে আনা ড্রেসিং টেবিলটি শুভ্রানীর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।এতে তার চেহারা খুব ভালো দেখায়।পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালে তাকে জঘন্য দেখাতো।সে তার হাতে থাকা কলাপাতার রঙের জামাটা কাঁধের কাছে চেপে ধরে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নেয়।
নবনীতা আধশোয়া হয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল।শুভ্রাকে দেখেই সে চোখ তুলে বলল,’শুভি! তুই কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস না।এতো সাজার কিছু নেই।’
শুভ্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,’বিয়ের অনুষ্ঠান না হোক।সংবর্ধনা অনুষ্ঠান তো।এটাও আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
সে আবার নিজের কাজে মন দেয়।আবার কিছু একটা মনে পড়তেই পেছন ফিরে বলল,’তুমি রেডি হচ্ছো না কেন?’
শুভ্রা চোখ বাঁকিয়ে একনজর তাকে দেখে।যেকোনো অনুষ্ঠানে যেতে নিলেই তার যত আলসেমি শুরু হয়।আজ তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।কলেজ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।কতো মানুষ আসবে।শুভ্রার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।আর আপাইয়ের মাঝে কোনো উৎসাহ নেই এ’নিয়ে।যখন থেকে সে শুনেছে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শাহরিয়ার আরহাম,তখন থেকে সে এমন একটা চেহারা বানিয়ে রেখেছে যেন এই অনুষ্ঠানটা কোনো অনুষ্ঠানের পর্যায়েই পড়ে না।তার না আছে কোনো আগ্রহ,না আছে কোনো চঞ্চলতা।
অনুষ্ঠান ছিল বিকেল তিনটায়।নবনীতা আর শুভ্রার পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেজে গেল তিনটা বিশ।তারা যে সময় সেখানে গিয়ে পৌঁছুলো,তখনই আরহামের গাড়িও সেখানটায় এসে থামল।কলেজের সামনে থাকা গার্ডরা এগিয়ে এসে চারদিক ঘিরে ধরল।একজন পাশ ফিরে নবনীতাকে দেখতেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,’আরে আপনি দূরে যান।দেখছেন না স্যারের গাড়ি আসছে?’
নবনীতা চোখ বড় বড় করে বলল,’দূরে যাব মানে?আমরাও তো অনুষ্ঠানে এসেছি।আপনারা কি আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে এমন ব্যবহার করেন?এগুলো কেমন কথা?’
লোকটা তার কথায় ভ্রুক্ষেপ তো করলোই না,উল্টো দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বলল,’অন্য কোথাও গিয়ে প্রতিবাদ করেন আপা।আমন্ত্রিত অতিথি আর প্রধান অতিথির মাঝে অনেক পার্থক্য আছে।যান সরেন আপনি।’
নবনীতা চোয়াল শক্ত করে সরে দাঁড়ায়।গার্ডরা ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়।গাড়ির ভেতর থেকে ফিটফাট বেশভূষায় বেরিয়ে আসে একজন যুবক।তার নাম শেখ শাহরিয়ার আরহাম।কলেজের প্রিন্সিপাল তাকে দেখতেই এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।কুশল বিনিময় করলেন।আরহামও হাসিমুখে তার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলল।
কলেজের ভেতর যেতেই ছাত্রছাত্রীরা দুই দিক থেকে ফুল ছিটিয়ে তাকে স্বাগতম জানাল।আরহাম হাসিমুখে তাদের আপ্যায়ন গ্রহণ করল।এটাই তো তার প্রাপ্তি।তার পরিচিতি,সম্মান,মানুষের ভালোবাসা সবকিছুই তো তার কাছে দারুণ উপভোগ্য মনে হয়।
অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক চোখ নিতেই সে দেখল দূরে একটা বিশালাকার জাম গাছের নিচে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বরাবরের মতোই তার দুই হাত বুকে বাঁধা।দৃষ্টি শান্ত,মুখটা থমথমে।আরহাম একপেশে হাসল।সে সব সময়ই এমন গ্যাংস্টার হয়ে থাকে কেন?সে কি সত্যিই নিজেকে দাবাং ভাবে নাকি?
আরহাম আর সেসব ঘাটায় না।রোদচশমা টা চোখের উপর চাপিয়ে সে সোজা সামনে হেঁটে যায়।কিন্তু শেষ মুহূর্তে না চাইতেও সে আরো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।মেয়েটার চুলগুলো আজও বেণি বাঁধা।তাকে হয় খোপা,নয়তো বেণিতে দেখা যায়।সে কি একটু চুল ছাড়তে পারে না?সেদিন যখন সে ছুটে এসে তাকে আগলে ধরেছিল,তখন তো তার চুল খোলা ছিল।তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।আরহাম তাকে সেই রূপে আরো একবার দেখতে চায়।পরী আপাই কি তাকে সে সুযোগ করে দিবে?
আরহাম মুচকি হাসে।কখনোই না।
অনুষ্ঠান শুরু হতেই একে একে সবাই বক্তব্য রাখল।নবনীতা অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গায় বসেছিল।মানুষের এতো ঘ্যান ঘ্যান তার ভালো লাগে না।আরহামকে যখন তার বক্তব্য রাখার জন্য মাইক্রোফোনের সামনে ডাকা হলো তখন নবনীতা তার কন্ঠ নকল করে ন্যাকা সুরে বলল,’আমি শেখ শাহরিয়ার আরহাম।আমার বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য শেখ আজিজ হোসেন।আমি খুব চালাকির সাথে জনগণের টাকা মে’রে দিব।আর জনগণ টেরও পাবে না।তারা অবাক হয়ে বলবে এই সুন্দর ছেলেটা কতো সুন্দর করে চুরি করে! হেহেহে,দেখছ আমি কতো চালাক।’
শুভ্রা মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।প্রতিবাদ করে বলে,’একদমই না।আরহাম ভাই সেরকম মানুষ না।সব নেতাই অমন হয় না।’
নবনীতা তার কথা গ্রাহ্য করল না।উল্টো গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’হয়েছে হয়েছে।তোর আরহাম ভাই কতো ভালো জানা আছে।মাত্র তো রাজনীতিতে আসল।বছর যেতেই দেখবি আমেরিকায় রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলেছে।এদের আমার চেনা আছে।’
সে নাক ছিটকে সামনে দেখে।নিজের কাজে সে মোটেই লজ্জিত না।শুভ্রা আর চিত্রার ঐ লোকের জন্য একটু বেশিই টান।এতো টান থাকা ভালো না।মাঝে মাঝে তার নিন্দে করলে সেই টানে কিছুটা ভাটা পড়বে।সে সামনে তাকায়।কটমট চোখে আরহাম কে দেখে।আরহাম মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই বলল,’আমি শেখ শাহরিয়ার আরহাম।আমার বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য শেখ আজিজ হোসেন।’
নবনীতা মুখে ওড়না চেপে কতোক্ষণ হাসল।সে জানতো এই লোক মাইক পেলেই শুরুর দুই মিনিট বাপের কেচ্ছা শুনাবে।বাপ ভক্ত পুত্র একদম।হঠাৎই কিছু মনে পড়তে নবনীতা একটু ভাবুক হলো।এর কি মা নেই?সারাদিন বাবা বাবা করে,মায়ের কথা তো বলে না।মা কি বেঁচে আছে নাকি সেও প্রয়াত?নবনীতা আনমনে বিড়বিড় করে,’ম’রে গেলে তো মুখ ফুটে বলার কথা।’
নিজের কথায় সে নিজেই লজ্জিত হয়।দ্রুত তওবা কাটে।তার সমস্যা আরহামের সাথে।খামোখা এখানে মা বাবাকে টেনে আনার কোনো মানে নেই।
সে চটপট সংবর্ধনায় মন দেয়।আরহাম কথার ফাঁকেই তাকে একনজর দেখে।দেখতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়।একে দেখলেই সে ভুলভাল কিছু বলে ফেলবে।আপাতত সেদিকে না দেখাই ভালো।
সবার বক্তব্য শেষ হতেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হলো।শিক্ষা,ক্রিড়া,আবৃত্তি,সঙ্গীত,নৃত্য সব ক্যাটাগরিতেই পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।নবনীতা মাথা নিচু করে নিজের হাতটা দেখছিল।সে আজকে ধূসর রঙের জামা পরেছে।বুকের উপর ফেলে রাখা ওড়নাটার রং কুচকুচে কালো।আজ তার অফিস নেই।তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে।সে মাঝে মাঝে অবাক হয়।যেদিনই তার কাজ থেকে সেদিনই কেন তাকে বিনাবাক্যে ছুটি দেওয়া হয়?এই অফিসের অথোরিটি এতো ভালো কেন?নবনীতা রোজ দোয়া করে,অফিসের সিইও যেন একশো বছর বাঁচে।
মাইক্রোফোনে শিক্ষা ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করার সময় যখন ডাকা হলো,’পুষ্পিতা নূর,তুমি যেখানেই আছো,মঞ্চে আসো’ তখনই নবনীতা নড়েচড়ে উঠে।দ্রুত হাতে থাকা মুঠোফোনটি উপরে তুলে ক্যামেরা অন করে।আনন্দে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।শুভ্রা ছুটে যায় মঞ্চের দিকে।নবনীতা শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে।তার চোখ আর্দ্র হয়।শুভিটা কতো বড় হয়ে গেছে! সে দ্রুত ক্যামেরা তাক করে তার দিকে।
আরহাম শুভ্রাকে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো।একগাল হেসে বলল,’কনগ্রেচুলেশানস শুভ্রা।জীবনে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাও।’
জবাবে শুভ্রাও হাসল।স্বচ্ছ হাসি।স্টেজের সামনেই ক্যামেরা ম্যান দাঁড়ানো ছিল।শুভ্রা আরহামের হাত থেকে পুরষ্কার নিতে নিতে সেদিকে ফিরে হাসল।আরহামও সামনে দেখল।তবে তার দৃষ্টি অন্যদিকে।সে দেখছে অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীটির দিকে।যে কি-না শুভ্রা আর আরহামের এমন হাসিখুশি মুখটা দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে যাচ্ছে।এমন ভাবে কটমট করে তাকাচ্ছে যেন আরহাম তার থেকে তার বোনদের কেড়ে নিচ্ছে।
নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে কয়েকটা ছবি তুলল দু’জনের।শুভ্রা আর চিত্রা এই লোককে মারাত্মক পছন্দ করে।অথচ নবনীতা ভেবে পায় না এর মধ্যে পছন্দ করার মতো কি আছে?এ তো একটা আস্ত ভন্ড।সে যেটা দেখায় সেটা সে মোটেও না।নেতাদের সে ভালো করে চেনে।এদের মতো হিপোক্রেট আর দু’টো নেই।
***
‘জ্বী ভাই।একদম অথেনটিক নিউজ।ঐ নবনীতা আরহামের কোম্পানির অফিসেই চাকরি নিয়েছে।পাশাপাশি এখন সে যে বাড়িতে থাকে,সেটার মালিকও আরহাম।’
মিলন কথা শেষ করেই উৎসুক চোখে সামনে তাকায়।ফাহাদ তখন তার বাড়ির ড্রয়িং রুমের ইজিচেয়ারে বসে দোল খাচ্ছিল।মিলন থামতেই সে সরু চোখে বলল,’ঐ নবনীতা জানে এসব?’
‘না ভাই।তাকে বলা হয়েছে এ বাড়ি ভাড়ায় চলে।অফিসের এমপ্লয়ি হিসেবে তার জন্য কিছুটা কম রাখা হয়েছে ভাড়া।’
ফাহাদ কুটিল হাসল।পায়ের উপর পা তুলে ভরাট গলায় বলল,’বাপরে! জল তাহলে এতোদূর।’
সে থামে।পুনরায় নিজ থেকে বলে,’আরহামকে আমি চিনি।অতো দরদী তো সে না।অন্তত নিজের কোম্পানিতে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সে কখনোই এতো উদাসীন থাকে না।রাজনীতিতে সে ঘোড়ার আন্ডা,কিন্তু তার ব্যবসায়ীক বুদ্ধি চমৎকার।সে খুব চ্যুজি মানুষ।এতো সহজে সে কখনোই কাউকে নিয়োগ দেয় না।তার মনে যে অন্যকিছু আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
মিলন চাপা স্বরে বলল,’ভাই আমার মনে হয় সে মেয়েটিকে পছন্দ করে।তার পারসোনাল গাড়িটা প্রতিদিন ধানমন্ডি এরিয়াতে যায়।গিয়ে নবনীতা যেই বিল্ডিং এ থাকে,সেই বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।’
‘বাহ চমৎকার।এবার তো তাহলে একটা কেলো বাঁধাতেই হয় দেখছি।’
সে আয়েসি ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে দোল খেতে খেতে বলল,’আরহাম আজ কোথায়?’
মিলন চট করে জবাব দেয়,’সে তো আজ সিটি কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছে।’
কথা শেষ করে সে আরেকটু এগিয়ে আসে।ফাহাদের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে,’নবনীতাও আজ সেখানে আছে ভাই।’
.
.
.
.
কো’কেইন,মেথাম’ফেটুমিন,এ্যাভা’নাফিল-বহুল ব্যবহৃত তিনটি ড্রা’গ।প্রথমটি নেশা’দ্রব্য হিসেবে অহরহ ব্যবহৃত হয়।বাকি দুইটি নেশা দ্রব্য হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ না হলেও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এদের কার্যকারিতা যথেষ্ট ভালো।এ্যাভা’নাফিল ব্যবহৃত হয় উত্তেজনা বর্ধক হিসেবে।দীর্ঘদীন ডিপ্রেশন কিংবা মনোরোগে ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের প্রফুল্ল রাখার জন্য এবং আনন্দদায়ক অনুভূতি তৈরি করার জন্য মেথাম’ফেটুমিন ব্যবহার করা হয়।এরা প্রত্যেকেই সুনির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত হলেও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শরীরে এরা কাজ করে অন্যভাবে।এদের প্রভাবে স্নায়ু কিছু সময়ের জন্য অবশ হয়ে যেতে পারে,ব্যক্তি নিজের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে অযোচিত কাজ করতে পারে,কখনো আবার নিজের ফিজিক্যাল নিডস গুলো প্রকট আকারে প্রকাশ করে ফেলতে পারে।
বিকেলের দিকে যখন আরহাম সহ বাকি অতিথিদের জন্য শরবত বানানো হলো তখন নাফিজ প্রিন্সিপালের রুমে ছুটে গিয়ে বলল ট্রে টা সে নিয়ে যেতে চায়।সে নিজেও কলেজের স্টুডেন্ট।তার কথা শুনে বিনা কোনো প্রশ্নের তার হাতে শরবতের গ্লাস সাজানো ট্রে টা তুলে দেওয়া হলো।সে ট্রে টা নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে এসেই একটা গ্লাসে তার পকেটে থাকা কাগজের টুকরোয় রাখা পাউডার জাতীয় মিশ্রণটি ঢেলে দিলো।তাকে এটা দিয়েছে মিলন।বলেছে শরবতে এটা মিশিয়ে আরহামকে খাওয়াতে পারলেই পাঁচ হাজার টাকা দেবে।সাথে আরো একটা কাজ করতে হবে।সেটা করলে সে পাবে আরো পাঁচ হাজার।নাফিজ দ্রুত পাউডারের মিশ্রণ টি শরবতে মেশায়।যেখানে তিনটা শক্তিশালী ড্রাগ আছে,সাথে আছে হাই ফ্লেভাবের অরেঞ্জ পাউডার,যেন বাকি ঔষধের উটকো গন্ধ কারো নাকে না লাগে।
সে গিয়েই সবার প্রথমে সেটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিলো।আরহাম সেটা হাতে নিয়েই ঢক ঢক করে একটানে খেয়ে শেষ করল।তার সত্যিই ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল।খাওয়া পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই ছিল।বিপত্তি বাঁধে একটু পরে।আরহাম টের পায় তার হাত কাঁপছে।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।অডিটোরিয়ামের এসির বাতাসেও তার পুরো শরীর ঘেমে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি টের পেয়েই সে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।তার পাশাপাশি চেয়ারে থাকা ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,’কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন?’
আরহাম পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছে।সে ঠিক নেই।তার ভেতর অদ্ভুত কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে।তার দাঁত কিড়মিড় করছে।নিষিদ্ধ অনুভূতি তাকে জেঁকে ধরেছে।সে আঁতকে উঠে।কি হচ্ছে এসব তার সাথে?এমনটা কেন হচ্ছে?হি ইজ নট ড্রাঙ্ক।ইভেন হি নেভার ডাজ।তাহলে?সে দ্রুত ঢোক গিলে গলা ভিজায়।নিজের দুই হাত শক্ত করে মুঠ করে বলে,’প্লিজ আমাকে কি কোনো খালি রুমে থাকতে দিবেন কিছুক্ষণের জন্য?আই অ্যাম নট ফিলিং ওকে।’
একজন কর্মচারী তক্ষুনি তাকে কলেজের টিচার্স রুমে নিয়ে গেল।আরহাম সেখানে গিয়ে একটা সোফাতে বসেই বলল,’প্লিজ এসিটা ছেড়ে দিন আর আমার জন্য কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে আনুন।প্লিজ।’
মধ্য বয়স্ক লোকটি চুপচাপ চলে গেল।আরহাম শক্ত করে নিজের মুখ চেপে ধরল।কতোক্ষণ নিজের চুল নিজে টানল।তার অসহ্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।সে নির্ঘাত কোনো একটা ভুল করে ফেলবে এখানে থাকলে।দুই মিনিট অতিবাহিত হতেই সে বুঝল কফির অপেক্ষায় বসে থাকাও তার জন্য সম্ভব না।সমস্ত শরীর,এমনকি অনুভূতিটুকুও তার নিয়ন্ত্রণে নেই।কাঁপা হাতে সে ড্রাইভারকে কল দিলো।তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব না।সে টেনে টেনে আরেকটু শ্বাস নেয়।সোফার কুশন খাঁ’মচে ধরে ঠোঁ’ট কামড়ে পড়ে থাকে চুপচাপ।এদিকে কেউ নেই।সবাই অডিটোরিয়ামে।
হঠাৎই তার ঘরের দরজা খুলে একটি মেয়ে হনহনিয়ে ভেতরে আসে।কাঠকাঠ স্বরে জানতে চায়,’সমস্যা কি আপনার?আমায় ডেকেছেন কেন হ্যাঁ?’
আরহাম মাথা তুলে।ধড়ফড়িয়ে উঠে বলে,’তুমি?’
___
নবনীতা চুপচাপ তার চেয়ারে বসেছিল।শুভ্রা তখন অন্য সারিতে তার বান্ধবীদের সাথে কথা বলছিল।তখনি একটি ছেলে এসে খুব বিনয়ী স্বরে বলল,’আপু আপনি কি নবনীতা?’
নবনীতা আড়চোখে তার দিকে তাকায়।গাঢ় স্বরে বলে,’জ্বী আমিই নবনীতা।কেন কি হয়েছে?’
ছেলেটি আঙুল তুলে অডিটোরিয়ামের সামনের বিল্ডিং টা দেখায়।নবনীতা পার্স হাতে নিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে দ্রুত সেদিকে পা বাড়ায়।সে চোখের আড়ালে যেতেই নাফিজ দ্রুত ফোন বের করে একটা নম্বরে কল করে।রিসিভ হতেই তাড়াহুড়ো করে জানায়,’কাজ হয়ে গেছে ভাই।এখন শুধু দরজা বন্ধ করে লোক ডাকার পালা।’
____
নবনীতা তার কথা শেষ করে এক কদম এগিয়ে আসতেই সশব্দে টিচার্স রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।হঠাৎ আওয়াজে নবনীতা কেঁপে উঠল।পেছন ফিরে বলল,’কি আশ্চর্য! দরজা বন্ধ করল কে?’
‘নবনীতা!’ ঘোর লাগা কন্ঠে ডাক দেয় আরহাম।
নবনীতা সোজা হয়ে তার দিকে দেখে।নাক মুখ খিঁচে বলে,’সমস্যা কি?কি হয়েছে?’
আরহাম সেই কথা গায়ে মাখে না।সে একটানে নবনীতাকে তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়।নেশাক্ত কন্ঠে বলে,’নো আই অ্যাম নট ড্রাঙ্ক।বাট আই অ্যাম ইন লাভ।’
নবনীতা এক ধাক্কায় তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়।র’ক্তিম চোখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’একটা চ’ড় দেব ধরে! নে*শাখো*র একটা! মদ খেয়ে মাতলামি করছে।’
আজ আর তার চোখ রাঙানিতে কোনো কাজ হয়নি।আরহাম পুনরায় হ্যাঁচকা টানে তাকে নিজের কাছে আনল।নবনীতাকে চূড়ান্ত রকমের বিস্মিত করে সে নবনীতার কপালে অধর ছোঁয়াল।নবনীতা তার এই আচরণে এতোটাই স্তব্ধ হলো যে সে নড়ে গিয়ে নিজেদের দূরত্ব টুকু বাড়ানোর মতো স্বাভাবিক কাজটুকুও তার দ্বারা হলো না।সে পাথরের মূর্তির ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
আরহাম ঝুঁকে এসে তার মাথাটা নবনীতার কাঁধে রাখল।তার দুই হাত চেপে ধরে জড়ানো গলায় বলল,’ইউ আর লুকিং সো স্টানিং।তোমাকে ভীষণ ভালো দেখাচ্ছে পরী।আমার তোমাকে ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে।এই লোক এসব কি বলছে?উনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?সে এবার নিজেকে তার কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।আরহাম তার দুই হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরল।ঘোরলাগা গলায় বলল,’প্লিজ ডোন্ট গো পরী।”
ঠিক তখনি খটখট শব্দে টিচার্স রুমের দরজা খুলে যায়।নবনীতা হতভম্ব হয়ে দেখে কলেজ অথোরিটির কিছু মানুষ,সাথে কয়েকজন শিক্ষক দরজার সামনে এসে ভীড় করেছে।তারা তাদের দেখছে।তাদের দৃষ্টিতে বিস্ময়।নবনীতার দৃষ্টিতে যতখানি বিস্ময়,ঠিক ততখানি বিস্ময়।
নবনীতা গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিলো।আরহাম তাল হারিয়ে পুনরায় সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল।তার দৃষ্টি ঘোলাটে।সে কি করেছে এতোক্ষণ সে নিজেও জানে না।
নবনীতা নিজের পরনের জামাটা শক্ত করে খাঁমচে ধরে।ভীতু চোখে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষ গুলোর নোংরা দৃষ্টি দেখে।গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটুকু গিলে নেয়।তারপরই কোনোদিক না দেখে এক ছুটে বেরিয়ে যায় টিচার্স রুম থেকে।তার চোখ ছাপিয়ে জল এসে যাচ্ছে।লোকজন তাকে বাজে চোখে দেখছে।অথচ নবনীতা নিজেও জানে না একটু আগে এসব কি হয়েছে,কেন হয়েছে।’
জীবনের প্রতিটি দিনেরই নিজস্ব তাৎপর্য থাকে।কোনো কোনো দিন আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।কোনো কোনোদিন আবার খুবই সাধারণ।শাহরিয়ার আরহামের আজকের দিনটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।কোনো সন্দেহ নেই,আজ তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
আগের রাতে সে ঘুমাতে পারেনি কিছুতেই।ভেতরটা কেবল ছটফট করছিল।এতো উৎকন্ঠা নিয়ে মানুষ বাঁচে কেমন করে?আরহামের জানা নেই।মাঝে মাঝে তার মনে হয় এসবে না জড়ালেই ভালো হতো।কতো সুন্দর ছিলো তার জীবনটা! আলমারি খুলে পাঞ্জাবি বের করার সময় পাশের তাকে থাকা টি-শার্ট আর ট্রাউজার গুলো অসহায় মুখ করে তার দিকে তাকায়।আরহামও অসহায় মুখে একবার তাদের দেখে।এসব পরে পরে আর বাইরে বাইরে টইটই করা হবে না।এখন সে পুরোদস্তুর জেন্টেলম্যান হয়ে গেছে।
সে পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে যায়।রাজনীতিতে সে জড়িয়েছিল কৌতূহল,আগ্রহ আর জেদের বশে।তার মাথায় রাজনীতির ভূত চেপেছিল।একপ্রকার নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল।মনে হচ্ছিল যে করেই হোক জিততেই হবে।হয়তো সে আজ জিতবে।হয়তো না,সে সত্যিই আজ জিতবে।সব কেন্দ্র তার দখলে,হারার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।একদিকে মন্ত্রী হওয়ার আনন্দ যেমন তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে,অন্যদিকে নিজের উড়াধুরা ব্যাচলর লাইফের হঠাৎ পরিবর্তন তাকে হতাশ করে।
সে আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।জীবনে তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না।সব নেশাকে ছাপিয়ে সে না হয় রাজনীতিকেই বেছে নিল।সে ঝটপট তৈরি হয়ে নেয়।আতরের শিশি থেকে গায়ে আতর মাখে।পাঞ্জাবির সাথে পারফিউম টা ঠিক যায় না।আতরই ঠিক আছে।যেদিন টি-শার্ট আর ট্রাউজার গায়ে জড়াবে সেদিন সে ভরে ভরে বডি স্প্রে লাগাবে।
সে তৈরি হয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসে।আদি তাকে দেখতেই ভ্রু উঁচু করে বলে,’কিরে?নার্ভাস?’
আরহাম স্মিত হেসে জবাব দেয়,’কিছুটা।’
‘ব্যাপার না।তুই জিতবি।আমার মন বলে।’
সেদিন সকালের নাস্তায় অনেক কিছু রান্না হয়েছিল।কিন্তু আরহাম তার কিছুই খেতে পারেনি।সে যতই মুখে বলুক সে নার্ভাস না,ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ নার্ভাস।তার কেমন অ’সহ্য লাগছে সবকিছু।মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড টা এখনই ফুড়ুৎ করে বেড়িয়ে তার হাতে চলে আসবে।
সে আর বাড়িতে বেশি সময় নষ্ট করল না।খাওয়া শেষে আদিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।ওয়াজিদ ইতোমধ্যই কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে।তাদেরও যতো দ্রুত সম্ভব কেন্দ্রে যেতে হবে।
নবনীতার আজকে তার নতুন বাড়িতে পঞ্চম দিন।গত পরশু সে বেতনের টাকা হাতে পেয়েছে।টাকা পেয়েই সে হাবিজাবি বহুত কেনাকাটা করেছে।আপাতত এই দুইদিন সে সেগুলো গোছাতেই ব্যস্ত।তার এপার্টমেন্ট এগারো তালায়।এতো উঁচু থেকে বাইরের দৃশ্য খুবই মনোরম দেখায়।একে তো আবাসিক এলাকা।তার উপর আবার এতো উঁচুতে ফ্ল্যাট।নবনীতা প্রতিদিন বিকেলে এক কাপ চা হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।সে দুই হাজার টাকা খরচা করে একটা টুলও কিনেছে।শুধু মাত্র বারান্দায় বসে চা খাওয়ার জন্য সে এই খরচা টুকু করেছে।
মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে হয় পুরো দুনিয়াটা কিনে ফেলতে।রাস্তায় যা দেখে তাই কিনতে মন চায় তার।বহু কষ্টে সে নিজেকে আজগুবি খরচাপাতি থেকে বাঁচায়।এই যে সত্তর হাজার টাকা হাতে পেতেই সে এলোপাতাড়ি কতো টাকা খরচা করেছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই।সে একটা নতুন মেট্রেস কিনেছে।এটাতে একবার পিঠ রাখলে সে আর এই দুনিয়ায় থাকে না।গত কয়েকদিন যাবত সে সময় পেলেই শুধু ঘুমায়।
নতুন অফিসের লোকজন এতো ভালো যে নবনীতার মাঝে মাঝে মনে হয় সে অফিসের কর্মচারী না,বরং অফিসের বসের বউ।তারা তাকে এত্তো সম্মান করে।সে কোনো কিছুতে আটকে গেলেই একবার বললেই সাহায্য করে দেয়।নিজের চিন্তাভাবনায় তার নিজেরই হাসি পায়।তার অফিসের বসের নাম রোকন।তিনি বিবাহিত আর দুই বাচ্চার বাবা।সুতরাং তাকে বসের বউ ভেবে এতো যত্ন করার কোনোই সুযোগ নেই।
নবনীতা এই ছয় বছরে জীবনের সবচেয়ে চমৎকার দিনগুলো কাটিয়েছে বিগত পাঁচদিনে।সারাদিনে সে যতো ক্লান্তই হোক না কেন,দিন শেষে এতো সুন্দর একটা এপার্টমেন্ট তার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়।তার দু’টো বোন এতোটা সময় একটা খুপরি ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে অবশেষে এতো বড় একটা ফ্ল্যাট পেয়েছে।চিত্রার খুশি দেখলেই নবনীতার মন ভালো হয়ে যায়।তার সুদিন ফিরেছে।এমন একটা অফিসে তার চাকরি হয়েছে যেখানে তাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়।অফিসের গভার্নিং বডির সদস্যরা নিশ্চয়ই খুব ভালো মনের মানুষ।নবনীতা অপেক্ষায় আছে কবে একটা অফিসিয়াল ফেস্টিভ হবে আর সে অফিসের সিইও কে নিজ চোখে দেখবে।কতো দয়ালু এই মানুষটা! নিজের নামটা পর্যন্ত প্রকাশ করতে চায় না।নবনীতার ফাইলে কোথাও তার নাম নেই।জনদরদী মানুষরা বোধহয় এমনি হয়।যারা নাম নিয়ে কোনো বড়াই করে না।নবনীতা নিজের মনেই বিড়বিড় করে,’সবাই কি ঐ শাহরিয়ার আরহাম নাকি যে নিজের ঢোল নিজেই পেটায়?সারাক্ষণ একই গান গেয়ে যায় আমি শাহরিয়ার আরহাম।আমাকে কে না চেনে! যত্তসব।’
নবনীতা ভালো আছে।ভীষণ ভালো আছে।লুবনাকে পড়ানো বাদে সে তার সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছে।তার আর টিউশনের প্রয়োজন নেই।তবে লুবনাকে সে পড়ায় ভালোবেসে,টাকার চিন্তা থেকে নয়।কুরিয়ার অফিসের চাকরিটাও এখন আর করতে হয় না।নবনীতা কেবল সকাল থেকে বিকাল অফিস করে।বাড়ি এসে টুকটাক রান্না করে।এশার নামাজ শেষে লম্বা একটা ঘুম দেয়।কি আনন্দ! কি আনন্দ! এতো সুখ নবনীতা রাখবে কোথায়?
রিমি তাকে আবারো ডাক দিলো,’আজ তো নির্বাচন।তুই ভোট দিতে যাবি না?’
রিমি অধৈর্য হয়ে বলল,’ধ্যাত।আগ বাড়িয়ে এতো কথা বলিস না তো।এমন কিছুই হবে না।উঠ তুই।রেডি হ।’
নবনীতা তক্ষুনি উঠল না।আরো কিছুক্ষণ সেভাবেই নরম বিছানায় পড়ে রইল।দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল নয়টা ত্রিশ।নবনীতা মুচকি হাসে।আজকাল সে বড্ড দেরি করে ঘুম থেকে উঠছে।ঘুম থেকে উঠেই সে প্রথমে গেল রান্নাঘরে।গিয়েই স্টোভ জ্বালায়।আনাড়ি হাতে চুলে খোপা বাঁধে।সে ইদানিং টুকটাক রান্নাও করছে।আগে মিসেস রোকেয়াই সব রান্না করতেন।এখন নবনীতা ইউটিউব ঘেঁটে নিজেই রান্না করে।এটা তার সংসার,এটা পরীর সংসার।এ সংসার পরী নিজের মতো করেই সামলাবে।
রিমি গতকাল এসেছিল বিভাকে নিয়ে।আর যায়নি।শাহাদাতের অবস্থা একটু ভালো।আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আশা করা যায় আরো মাসখানেকের মাঝে সে সুস্থ হয়ে যাবে।বিভা আপাতত রিমির কাছেই আছে।নবনীতা এখনো সব গুছিয়ে উঠতে পারেনি।তাছাড়া তার অফিস টাইমে বিভাকে রাখবে কে?নবনীতার এখন নিজেকে একেবারে পাক্কা গৃহিণী মনে হয়।যার কাজের কোনো শেষ নেই।স্বামী বাদে তার সংসারে সবই আছে।
শুভ্রা এই বছর নতুন ভোটার হয়েছে।তার এক কথা।সে আরহাম ভাইকে ভোট দিতে যাবেই যাবে।নবনীতা কয়েক দফা তাকে চোখ রাঙিয়েও কোনো লাভ হয়নি।শেষ পর্যন্ত টুকটাক রান্না শেষে নবনীতা বিভা আর চিত্রকে ঘুম পাড়িয়ে সাদেক সাহেবের কাছে রেখে বেলা বারোটার দিকে বাড়ি থেকে বের হলো।
সে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর একটা বেজে গেল।এই সময়টাতে তেমন ভীড় থাকে না।জনমানব বলতে গেলে খুবই কম।নবনীতা রিকশা ভাড়া মিটিয়েই ক্লান্তিতে দু’টো শ্বাস ছাড়ে।তারপর পাশ ফিরে শুভ্রাকে দেখে চোখ গরম করে বলে,’চলুন ম্যাডাম।আপনার মূল্যবান ভোট দিয়ে রাষ্ট্র কে ধন্য করুন।’
নবনীতা দ্রুত হেঁটে ভেতরের দিকে পা বাড়ায়।তারা যেই কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছে,সেটা একটা পুরোনো স্কুল।তার পরনে আজ কালো রঙের জামা।গায়ের ওপর শালের মতো জড়িয়ে রাখা ওড়নার রং ও কালো।
আরহাম তখন তোফায়েলের হুন্ডার উপর বসে এই কেন্দ্রে তার কর্মীদের সাথে কথা বলছিল।তার হাতের সিগারেট টা কেবল অর্ধেকই শেষ হয়েছিল।এমন সময় গেটের দিকে দেখতেই সাথে সাথে সে সেটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল।গভীর দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্য টুকু দেখল।দেখল কালো জামা গায়ে জড়িয়ে একটি মেয়ে মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।বরাবরের মতোই প্রসাধনী বিহীন মুখশ্রী।তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে খুব বেশি প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে তাকে।তার চুলগুলো বেণি করে একপাশে ছেড়ে রাখা হয়েছে।চোখে মুখে তার বিরক্তির ছাপ।আরহাম মুচকি হাসে।সে ভালো মুখে থাকে কখন?
তার পিছন পিছন হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে আসে রিমি।এসেই এদিক সেদিক চোখ নিয়ে কাউকে খুঁজল।খুঁজে পেতেই একগাল হাসল।ইশারায় সালাম দিলো।আরহামও সে সালামের জবাব দিলো,ইশারায়।
আরহাম আজকে অনেক গুলো কেন্দ্রে গিয়েছে।আদি,আরিশ,ওয়াজিদ সবাই ই নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত।এতো এতো কেন্দ্রে ছুটতে ছুটতে রীতিমতো পা ব্যথা হচ্ছে তার।এতোকিছুর মাঝেও আরহাম এই কেন্দ্রে এসেছে।আসার আগে অবশ্য রিমির থেকে খোঁজ নিয়ে এসেছে।রিমিই এখন তার ভরসা।
সেসময় ভীড় কম ছিল।নবনীতা,রিমি আর শুভ্রা পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভোট দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলো।শুভ্রা বেরিয়ে এসেই রিমিকে জিজ্ঞেস করল,’কাকে ভোট দিয়েছ?’
‘কেন বলবো?এটা কি বলার জিনিস?বলার জিনিস হলে তো পর্দা দিয়ে ঢেকে ভোট দিত না মানুষ।’ খুবই কাটখোট্টা স্বরে উত্তর দেয় নবনীতা।এক উত্তরেই শুভ্রা দমে গেল।মিন মিন করে বলল,’না ঐ আরকি।’
শ্রেণিকক্ষের বাইরে করিডোরের মতো জায়গা ছিল।তারা বের হতেই দেখল আরহাম বুকে হাত বেঁধে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।তার সামনে বয়স্ক মতোন একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন।দু’জন নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কথা বলছে।
নবনীতা তাদের একটু কাছাকাছি যেতেই রিমি ইচ্ছা করে তাকে একটা ধাক্কা দিলো।ধাক্কা খেয়েই নবনীতা তাল হারিয়ে দুই কদম সামনে এগিয়ে গেল।তার রোগা পাতলা শরীরটা মাটিতে পড়ার আগেই আরহাম একটু এগিয়ে এসে দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে তার দুই কাঁধ চেপে ধরল।নবনীতা ঠিক মতো উঠে দাঁড়াতেই সবার প্রথমে আরহামকে দেখল।তারপরই দেখল তার কাঁধ।দেখতেই সে এক ঝাড়ায় নিজেকে সরিয়ে নেয়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’এসব হচ্ছে টা কি?গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?’
আরহাম আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি?আমি গায়ে হাত দিয়েছি?তুমি আমার নামে যা তা বলছ।পড়ে যাচ্ছিলে তুমি।আমি তোমায় বাঁচিয়েছি।’
‘উদ্ধার করেছেন আমায়।আপনি না ধরলে তো নিচে পড়ে আমি মরেই যেতাম নির্ঘাত।নিচে তো গভীর উপত্যকা তাই না?জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি আমার!’
আরহাম চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’তুমি একটা বে’য়াদব আর এরোগেন্ট মেয়ে।কৃতজ্ঞতা বোধ বলতে নেই তোমার।’
‘জ্বী আপনার অনেক আছে।’ কটমট করে জবাব দেয় সে।
জবাব দিয়েই ধুপ ধাপ পা ফেলে দ্রুত করিডোর থেকে বেরিয়ে মূল ফটকের দিকে এগিয়ে যায়।আরহাম তার প্রস্থান দেখতেই বিড়বিড় করে,’এর এলার্জি আছে আমার সাথে।অদ্ভুত মেয়ে!’
.
.
.
.
নির্বাচনের ফলাফল অনেক টা আগে থেকেই জানা ছিল।তবুও বলা তো যায় না।কখন কি হয়ে যায়! আরহাম বিকেল থেকে তার পার্টি অফিসে বসেছিল।ভোট গণনা শুরু হতেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।ওয়াজিদ আর আদি তখনও কেন্দ্রে।আরহাম অধৈর্য হয়ে ওয়াজিদ কে কল দেয়।ওয়াজিদ ফোন ধরেই তাকে আশ্বস্ত করল,’আরে এতো প্যানিকড হওয়ার কিছু নেই ভাই।তুই জিতে যাবি।সবকিছুই তোর ফেভারে আছে।’
আরহামকে অপেক্ষা করতে হলো আরো দুই ঘন্টা।সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকেই ওয়াজিদ তাকে ফোন দিলো।ফোন রিসিভ করতে গিয়েই আরহাম টের পেল সে কাঁপছে।কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করে কোনোরকম ফোনটা কানে চেপে ধরতেই শুনল ওয়াজিদ অন্যপাশ থেকে এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে বলছে,’আরহাম তুই জিতে গিয়েছিস।তুই জিতে গিয়েছিস আরহাম।’
তার কথা শুনেই আরহাম এক লাফে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।সে কি সত্যি শুনছে?সে জিতে গেছে?ওয়াজিদ সত্যি বলছে?সে চিৎকার করে বলল,’ওয়াজিদ সত্যি?তুই কোনো কাগজ পেয়েছিস হাতে?’
‘অফিসিয়ালি পাইনি।কিন্তু আন-অফিসিয়ালি পেয়ে গেছি।’
আরহাম মোবাইলটা কানে চেপেই কতোক্ষণ আনন্দে চেঁচায়।পার্টি অফিসের বাইরে তার ছেলেরা ইতোমধ্যেই বিজয় উল্লাস শুরু করেছে।দশ মিনিট পরেই আদি কোথা থেকে ছুটে এসে শক্ত করে জাপটে ধরল তাকে।জড়ানো গলায় বলল,’প্রাউড অফ ইউ ম্যান।আমি জানতাম তুই পারবি।’
ওয়াজিদ এসেছে আরো অনেক পরে।সে আসার আগেই আরহামের পার্টি অফিস রাজনৈতিক নেতা আর সাংবাদিক দের পদচারণায় কোলাহলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।তাকে দেখতেই আরহাম সব ফেলে তার দিকে ছুটে গেল।সে তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ওয়াজিদকে জড়িয়ে ধরল।ওয়াজিদ এমন হঠাৎ জাপটে ধরায় তাল হারিয়ে সোজা ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।আরহামের এমন অদ্ভুত কাজ কারবারে হেসে উঠে বলল,’কি রে তুই পাগল হয়েছিস?দেখ আমার জামাটাও নোংরা হয়ে গেছে।’
‘হোক নোংরা।আমারটাও তো হয়েছে।আজ একটু আধটু নোংরা হলে কিছু হবে না।’
আরহাম একটু থামে।পর পরই আবার বলতে শুরু করে,’ওয়াজিদ,থ্যাংক ইউ ভাই।তুই না থাকলে এসব কিছুতেই সম্ভব হতো না।লাভ ইউ ব্রো।’
আদি তাদের দেখেই তাদের দিকে ছুটে গেল।ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে নিজেও তাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’তোরা আমাকে ছাড়াই এতো খিলখিল করছিস কেন?বিদেশে থাকি বলে পর হয়ে গেছি নাকি?দেখি আমাকেও জায়গা দে।ওয়াজিদ সর তো।সর সর।’
তিন বন্ধুর স্বচ্ছ,সুন্দর আর নির্মল মুহূর্ত।কতোটা ভ্রাতৃত্ব,টান আর ভালোবাসা মিশে আছে সেই সম্পর্কে! তাদের এই সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্প্রচার করা হলো প্রায় প্রতিটা চ্যানেলে।শেখ আজিজ হোসেনের ছেলে এমপি হয়েছে।তাও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে।লোকজনের তার প্রতি বিশেষ টান আছে।কতো সুদর্শন এই ছেলেটা!
ফাহাদদের বাড়িতে অবশ্য সেদিন টেলিভিশন চলে নি।পুরোটা বাড়িই কেমন নিস্তব্ধ হয়েছিল সারাটা দিন।সবাই যার যার মতো খেয়ে নিল।বাড়ির সবাই শুয়ে পড়তেই মাঝবয়সী একজন মহিলা শোয়া থেকে উঠে বসলেন।পাশ ফিরে দেখলেন তার স্বামী গভীর ঘুমে নিমগ্ন।তিনি ধীর পায়ে হেঁটে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন তার ঘর থেকে।পা টিপে টিপে লিভিং রুমে গিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন।টি-টেবিলের উপর রাখা রিমোটের বাটন চেপে টেলিভিশন চালু করলেন।খুঁজতে থাকলেন দেশীয় সংবাদ মাধ্যমে গুলোর রাতের নিউজ।
তার ভেতর চাপা উৎকন্ঠা।সে উড়ো খবর শুনেছে আরহাম নাকি জিতে গেছে।সে একবার নিজ চোখে সেটা দেখতে চায়।অবশেষে তার প্রতিক্ষার অবসান হলো।এলাকাভিত্তিক প্রচারণা মাধ্যমে গুলোতে খুব তোড়জোড় করে আরহামের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ দেখানো হচ্ছে।তাসলিমা তাকে দেখতেই নিজের শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরেন।এক দৌঁড়ে ছুটে যায়,যেমনটা সে বারবার করে আসছে।
চোখ মেলে দেখে ওয়াজিদ আর আদির হাস্যোজ্জ্বল মুখ।দেখতেই তার চোখ ভিজে যায়।সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে।ছেলেগুলো কত্তো বড় হয়ে গেছে! এই তো সেদিনের কথা,যখন এরা স্কুল শেষে বাড়ি ফিরেই ফালুদা খাওয়ার বায়না ধরত।তাসলিমা আলগোছে হাসেন।কতো বড় হয়ে গেছে এরা! কতো ছোট ছোট ছিলো বাচ্চাগুলো।কাঁধে একটা স্কুল ব্যাগ।হাতে ব্যাডমিন্টনের র্যাকেট।সেই আদি আর ওয়াজিদ আজ এতো বড় হয়ে গেছে! তাদের কি এখন মনে আছে তাসলিমার কথা?তারা কি তাদের সোনা মায়ের কথা মনে রেখেছে?নাকি তাদের অভিমানী আর জেদী বন্ধুর মতো তারাও তাকে ঘৃণা করে?
তাসলিমা আচমকা একলা ঘরটায় ফুঁপিয়ে উঠেন।ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেছে! নির্বাচনে জিতে গেছে।অথচ তিনি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারছেন না।কপালে একটা চুমু খেতে পারছেন না।এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে?
তাসলিমা কয়েক দফা কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।বারবার হাত বাড়িয়ে স্ক্রিনে দেখানো ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে রাখা ছেলেটিকে ছুঁয়ে দিলেন।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন,’আমায় মাফ করো বাবা।দয়া করে আর আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।আমায় একটু ভালোবাসার সুযোগ দাও বাবা।তুমি কি জানো তোমার স্বার্থ’পর,বে’ঈমান মা টা যে একদমই ভালো নেই?তুমি কি একটি বারের জন্যও মা কে ক্ষমক করবে না?তুমি কি একটি বারের জন্যও মায়ের দিকে ফিরে তাকাবে না?আর কতো শাস্তি দিবে বাবা?এই আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে কি তুমি নিজে ভালো আছো বাবা?আমি তো আমার ছেলেকে চিনি,আমি জানি সে ভালো নেই।’
চলবে-
গল্পের যেকোনো আপডেট পাওয়ার জন্য এই গ্রুপে যুক্ত হোন-
ওয়াজিদ আরো একটু পেছাতেই নির্দিষ্ট বেগ নিয়ে ছুটে আসা একটি তরুণী তার পিঠের কাছে এসে আছড়ে পড়ল।সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে সে।রিমি মাথা ডলতে ডলতে ব্যথাতুর কন্ঠে চেঁ’চিয়ে উঠে,’কে রে এটা?সিস্টেমে গন্ডগোল আছে নাকি?মানুষ সামনের দিকে হাঁটে।এমন হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা দের মতো পিছে হাঁটে কে ভাই?’
কথা শেষ করেই সে বিরক্তমুখে সামনে থাকা লোকটা কে দেখল।তাকে দেখতেই তার চক্ষু চড়াক গাছ।সে আঁতকে উঠে বলল,’ভাইয়া আপনি?’
ওয়াজিদ একনজর তাকে দেখে কোনো জবাব না দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।রিমি নখ কা’মড়াতে কা’মড়াতে কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,’বাপরে! রাগ হয়েছে নাকি?’
সেও তার পিছু পিছু ছুটল।তার পাশাপাশি এসে বলল,’সরি ভাইয়া।আবারো মিস্টেক হয়ে গেছে।নেভার মাইন্ড।’
ওয়াজিদ সে কথা কানে তুলে না।সে নির্বিকার হয়ে সামনে এগিয়ে যায়।রিমি আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে আলতো করে তার একহাত মুঠোয় নিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল,’ভাইয়া সরি তো।এতো রাগ হয়ে আছেন কেন?একটু কথা বলুন প্লিজ।’
ওয়াজিদ থামল।র’ক্তিম চোখে কিছুক্ষণ তার হাতটা দেখল।তারপর দেখল রিমিকে।রিমি তার চোখ দেখেই চুপশে গেল।এতো ভয়ংকর লাগছে কেন তাকে?
ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।সম্ভবত এই প্রথমবার সে অতিমাত্রায় কর্কশ ভাষায় তাকে ধ’মকে উঠে,’এক চড় দেব পেছন পেছন আসলে।ফা’লতু মেয়ে একটা!’
সে থামে।কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস ছাড়ে।রিমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তাকে দেখে।ওয়াজিদ পুনরায় চেঁ’চিয়ে উঠে বলল,’তোমাদের কি মনে হয় আমাকে?আমি জোকার?আই হ্যাভ নো স্ট্রং ফিলিংস?অ্যাম আই আ জোক টু ইউ গাইস?আমি কি কোনো খেলনা?আমার জীবনে কোনো আবেগ থাকতে পারে না?কেন?সবসময় কেন ত্যাগটুকু আমাকেই করতে হবে?কারণ আমি ইন্ট্রোভার্ট।ওহহহ হ্যাঁ,আমাদের তো কোনো অনুভূতিই নেই।প্রকাশ করতে না পারলে সেটা আবার কিসের অনুভূতি।তাই না?’
রিমি মুখ হা করে তার কথা শুনল।আমতা আমতা করে বলল,’ভাইয়া আপনি কি আমাকে বলছেন?’
ওয়াজিদ সে কথার জবাব দিলো না।একনাগারে আবোল তাবোল বলেই গেল কতোক্ষণ।সে চাপা স্বভাবের মানুষ।তার পক্ষে আরহামের মতো এক্সপ্রেসিভ হওয়া সম্ভব না।কিন্তু তার অনুভূতি মিথ্যা না।সে সত্যিই মেয়েটির জন্য টান অনুভব করে।আজকে কালকে না,সেই প্রথম দিন থেকেই।আরহামের পার্টি অফিসে তাকে দেখার পর থেকে তার চোখ জোড়া শুধু তাকেই খুঁজত।মেয়েটি অনন্যা,এটা সে প্রথম দিনেই বুঝেছে।তার চলন,তার বচন,তার মূল্যবোধ সবকিছুই ওয়াজিদকে মুগ্ধ করে।এই মেয়েটিকে ওয়াজিদ পছন্দ করে।পছন্দ করার কোনো স্কেল নেই।যদি থাকতো তাহলে সে প্রমাণ করতে পারতো আরহামের চেয়ে বেশি সেই তাকে ভালোবেসেছে।
সে শেষ একবার রিমির দিকে দেখে তাকে তর্জনী তুলে শা’সায়,’খবরদার।এরপরের বার থেকে দূরে দূরে থাকবে আমার।’
কথা শেষ করেই সে হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।রিমি কতোক্ষণ হতভম্ব হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।অদ্ভুত বিষয়?লোকটি কি তাকে এসব বলল?কিন্তু তাকে কেন এসব বলবে সে?সে তার কি লাগে?সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতে দেখতে ক্ষেপাটে স্বরে বলল,’এর আসলেই সিস্টেমে সমস্যা।ঝ’ড়ে মাথার অ্যান্টেনা নড়ে গেছে নিশ্চিত।’
সে আর সেসব নিয়ে ভাবে না।দ্রুত কদমে এগিয়ে যায় নবনীতার মেসেজ করা ওয়ার্ডের দিকে।যাওয়ার পথেই আরহাম আর তার পেছনে গুটি কয়েক লোককে দেখতে পায় সে।আরহাম তাকে দেখামাত্রই সে সালাম দেয়,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
আরহাম সালামের জবাব দিলো।জানাতে চাইল,’বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছ?’
‘জ্বী ভাইয়া।’
আরহাম আঙুল তুলে ডান দিকে দেখিয়ে বলল,’ঐ দিকটায় যাও।সেখানেই আছে সে।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
রিমি এগিয়ে যায়।আরহাম তাকে পিছু ডাকে,’একটু দাঁড়াও তো রিমি।’
রিমি থামল।আরহাম এগিয়ে এসে জানতে চাইল,’তুমি কি আমাকে তোমার নাম্বার টা দিতে পারবে রিমি?’
রিমি অবাক হয়ে বলল,’জ্বী ভাইয়া।কেন না?’
সে ঝটপট আরহামকে তার ফোন নম্বর দিলো।আরহাম নম্বর নিয়েই হাসিমুখে বলল,’আচ্ছা আমি আসি।’
রিমি দ্রুত মাথা নেড়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।শাহাদাতের কেবিনের বাইরেই নবনীতা চুপচাপ বসেছিল।তার কোলে ছোট্ট বিভা,যে এই মুহূর্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।রিমি তার কাছে এসেই চোখ গোল গোল করে বলল,’এটা কে নবনী?’
নবনীতা ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,’বিভা।ওর নাম বিভা।শাহাদাতের ছোট বোন।’
রিমি কয়েক পলক তাকে দেখল।কিছুটা আফসোস করে বলল,’ইশশশ রে! কতো মিষ্টি এই বাবুটা।মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ!’
নবনীতা আলতো করে তার মাথায় হাত রেখে বলল,’আমি ঠিক করেছি শাহাদাতের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত বিভাকে আমি আমার কাছেই রাখব।’
সে থামল।একটু শ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল,’সম্ভব হলে শাহাদাত কেও আমি নিজের কাছে রাখতাম।রেখে পড়াশোনা করাতাম।কিন্তু আমার তো নিজেরই চলার টাকা নেই।নিজের বাড়ির বাজার করতেই জান যায়।আরো দু’জনকে পালবো কেমন করে?তবে আমি ভেবে নিয়েছি আল্লাহ না করুক যদি শাহাদাতের কিছু হয় তাহলে আমি বিভার সব দায়িত্ব নিব।’
রিমি হাসিমুখে তার পাশে বসল।তার কাঁধে হাত রেখে বলল,’গুড ডিসিশন।আমি তোর পাশে আছি।তুই একা না,আমিও বিভার দায়িত্ব নিতে চাই।আপাতত কিছুদিন বিভা আমার কাছেই থাকুক।তোর একটা পাকাপোক্ত চাকরি হলে তুই বিভাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখিস কেমন?’
নবনীতা চোখ সরু করে বলল,’তুই বাচ্চা রাখতে জানিস?’
‘উহু জানি না।কিন্তু শিখে নিব।’
আরো ঘন্টাখানেক নবনীতা সেখানে ছিল।শেষ পর্যন্ত বিভাকে রিমির কাছে দিয়ে সে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।বিভাকে রিমির কাছে দেওয়াটাই তার কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে।তার চেয়ে বেশি রিমিই বিভার যত্ন করতে পারবে।সে সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে।বিভাকে যে একটু যত্ন করবে,আদর দিয়ে আগলে রাখবে,সে সময় কোথায়?
***
পুলিশের হাজতে ফাহাদকে আরো দুইদিনের মতো থাকত হয়েছিল।দলীয় নেতাদের কেউই তার জন্য থানায় যাননি।কেবল খালেক সাহেব আর নোমান সাহেবই বার কয়েক এ জায়গা সে জায়গা ছুটোছুটি করে তাকে জেল থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে।জেল থেকে বেরিয়েই সে বড় বড় পায়ে হেঁটে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসল।
খালেক সাহেব কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,’তোমাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না ফাহাদ যে,তুমি আর কোনো কিছু করেই আরহামকে হারাতে পারবে না।সে অনেক বেশি এগিয়ে আছে জনপ্রিয়তায়।এছাড়া সে সরকার দল থেকে মনোনয়ন প্রাপ্ত।তুমি খুব ভালো করেই জানো তাকে হারানো সম্ভব না।তবুও কেন তুমি রাকিবের সাথে মিলে এসব করেছ?আরহামের তো কিছুই হয়নি,মাঝখানটায় তুমি দল থেকে বহি’ষ্কৃত হলে।লাভ টা কার হলো বলো তো আমায়?’
ফাহাদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’তো কি করা দরকার ছিল আমার ছোট চাচ্চু?আরহামের বিজয়ে তালি বাজাবো আমি?আমার কি চুপ করে বসে বসে সব দেখা উচিত ছিলো?’
নোমান সাহেব মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বললেন,’আহা সেটা করবে কেন?কিন্তু তুমি আর আরহাম তো একই দলের হয়ে রাজনীতি করছ।তোমার আরেকটু সাবধান থাকা উচিত ছিল।আরহামের বিরোধিতা করতে গিয়ে তুমি নিজের দলের সাথেই বিরোধিতা করে ফেলেছ।আর তাছাড়া কেন বারবার ভুলে যাও সে আজিজ হোসেনের ছেলে।তার জনপ্রিয়তা এমনিতেই বেশি হবে।’
ফাহাদ তেঁতেঁ উঠে বলল,’কেন?তার বাবা রাজনীতিতে নাম করেছে বলে তারও নাম হয়ে গেছে?সে কি করেছে?ঐ এক বাপের নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছে।শেখ আজিজের ছেলে,শেখ আজিজের ছেলে।কান পচে গেছে এই কথা শুনতে শুনতে।’
‘পচে গেলেও কিছু করার নাই।আজিজ হোসেন পনেরো বছর যাবত এমপি ছিলেন।বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও তিনি এমপি ছিলেন।হি হ্যাজ দ্যাট স্টারডম।ইউ ক্যান নট ডিনাই দ্যাট।’
‘স্টারডম মাই ফুট।’ গজরাতে গজরাতে উত্তর দেয় ফাহাদ।
তারপরই তার মুখটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে।তার ভেতরে ক্রো’ধের আ’গুন জ্বল’ছে।ঐ নবনীতার জন্য তার এই দশা হয়েছে।আরহামকে দোষ দিয়ে লাভ কি?দোষ তো ঐ মেয়ের।সে যদি এমন ছুটে না আসতো,তবে ফাহাদ ঠিকই পালিয়ে আসতে পারত।কোনো ভাবেই ধরা খেত না।ফাহাদ কাঁপতে কাঁপতে দাঁতে দাঁত পি’ষে গা’লি দেয়,’মা***গি একটা!’
তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।তার হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই।কিন্তু নবনীতাকে জব্দ করার মতোন ক্ষমতা তার অবশ্যই আছে।ঐ ফকিন্নি দুই টাকার মেয়েকে সে চাইলেই জব্দ করতে পারবে।আর সে জব্দ করবেই।
***
পরের দুই দিন নবনীতার গিয়েছে কোনোরকম।না খুব ভালো,না খুব মন্দ।আরহাম তার কথা রেখেছে।অবস্থা বুঝে শাহাদাত কে স্কয়ারে ট্রান্সফার করা হয়েছে।তার সেখানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সব শাহরিয়ার আরহামের নামে লিখা হবে।
নবনীতা দিনে একবার সেখানে গিয়ে তার খোঁজ নেয়।ডাক্তার বলেছেন শাহাদাত বাঁচবে।হয়তো পুরোপুরি সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে,কিন্তু সে বাঁচবে।নবনীতাও আশায় বুক বাঁধে।অপেক্ষা করে এগারো বছরের ছোট্ট ছেলেটির সুস্থ হওয়ার।সে সুস্থ হবে,নবনীতার কথাকে সত্য প্রমাণ করে সে জীবনে অনেক বড় হবে।
রিমি বিভাকে ভীষণ যত্নে রাখছে।সেদিনই নাকি সে চার হাজার টাকার বেবি ফুড কিনেছে।নবনীতার মনে হয় বিভা তার কাছেই আপাতত বেশি ভালো থাকবে।নবনীতা আগে একটা চাকরি পাক,তারপর বিভাকে তার কাছে নিয়ে আসবে।
কোনো এক বিকেলে বাড়ি ফিরতেই সে দেখতে পেল চিত্রা আর শুভ্রা অসহায় মুখে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।সে দ্রুত এগিয়ে এসে জানতে চায়,’কি হয়েছে?এমন মন খারাপ করে আছিস কেন তোরা?’
শুভ্রা তার শুভ্র মুখখানা অমাবস্যার রজনীর মতো কালো করে বলল,’বাড়ির মালিক ফোরকান চাচা বলেছেন কালকের মধ্যে আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।’
‘কি?বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে মানে?’ এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে নবনীতা।
‘হু আপাই।এটাই বলে গেছে।মামি কে জিজ্ঞেস করো না হয়।’
নবনীতা হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর যায়।মিসেস রোকেয়া তখন তার ব্যাগ গোছানো তে ব্যস্ত।নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’এসব কি মামি?এসব কেন গোছাচ্ছ?’
মিসেস রোকেয়া তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,’নয়তো কি করব?তুমি কি আর আমাদের ভালো ভাবে বাঁচতে দিবে?কি দরকার ছিল তোমার ঐ ফাহাদকে চ’ড় থা’প্পড় মারার?তুমি তার সাথে পারবে কিছুতে?তার টাকা পয়সা ক্ষমতা কোনোটা তোমার চেয়ে কম আছে?তুমি যাও,আরো বেশি লাগো নেতাদের সাথে।তোমার ঐ আচরণের কারণে আজ ফাহাদের দলের লোকরা এসে ফোরকান সাহেবকে ধম’কে গেছে।বলেছে কালকেই বাড়ি ছাড়তে।’
নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’এগুলা কেমন কথা?দেশে কি আইন কানুন কিছু নেই?সে কেন আমাদের উ’চ্ছেদ করবে?কি করেছি আমরা?মগের মুলুক নাকি?তার মন চাইলেই সে আমাদের বাড়ি ছাড়া করবে?আমি কেইস করব তার নামে।’
মিসেস রোকেয়া তার কথা শুনেই দুই হাত জোর করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন,’আল্লাহর দোহাই লাগে।তোমার এই প্রতিবাদ তুমি অন্য কোনো সময় করবে।এখন আপাতত আমি আর আমার মেয়ে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার হয়ে নেই।এরপর তুমি কেস ঠুকো,যা মন চায় তা করো।আমি কিছু বলব না।’
নবনীতা তার জামাকাপড়ের স্তুপ দেখে সন্দিহান চোখে বলল,’তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
মিসেস রোকেয়া কাপড়গুলো স্যুটকেসে রাখতে রাখতে বললেন,’আমি আর প্রথা আমার বাপের বাড়ি যাচ্ছি।আপাতত সেদিকেই থাকব।’
‘আর আমরা?’ চটপট প্রশ্ন করল নবনীতা।
মিসেস রোকেয়া গজরাতে গজরাতে বললেন,’জাহা’ন্নামে যাও তোমরা।আমার কি?এসব করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?যত বড়ো মুখ না অতো বড়ো কথা! গিয়েছে ফাহাদের সাথে ঝামেলা বাঁধাতে।এখন বুঝো ঠেলা!’
নবনীতা ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,’আর মামা?মামার কি হবে?’
‘তোমার মামার কি হবে আমি জানি না।তুমি তো খুব গলাবাজি করো তোমার মামা,তোমার মামা করে।এখন দেখ তোমার মামার তুমি কি করবে।’
কথা শেষ করেই তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।নবনীতা তার পিছু পিছু গিয়ে অস্থির হয়ে বলল,’না মামি।এটা হয় না।ফাহাদের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।আমি তো কোনো ভুল করিনি।তাই না মামি?’
মিসেস রোকেয়া বেগম ব্যঙ্গ করে বললেন,’না না তুমি কি করে ভুল করবে?তুমি তো ফেরেস্তা।ভুল সব আমাদের।এবার আমাদের মুক্তি দাও।যেখানে খুশি যাও।আমাদের টা আমরা বুঝে নিব।’
নবনীতা যখন কয়েক দফা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো তখন সে ফোরকান সাহেবের শরণাপন্ন হয়।ফোরকান সাহেব তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার কিছুই করার নেই।এসব রাজনৈতিক ঝামেলায় তিনি জড়াতে পারবেন না।এই বাড়ি ভাড়া দিয়েই তার পেট চলে।নবনীতাকে বাড়ি ছাড়া না করলে ফাহাদ তার বাড়িঘর ভেঙে দিবে।তাই তিনি কিছুতেই নবনীতাকে এদিকে রাখতে পারবেন না।
নবনীতা বাড়ি ফিরল এক বুক হতাশা নিয়ে।পুরো রাত সে জেগে রইল।সকালে কি হবে সে জানে না।মিসেস রোকেয়া আর প্রথা ঘরের অর্ধেক মালামাল নিয়ে তার বাবার বাড়ি চলে গেছেন।কেবল বাড়িতে ফেলে গেছেন তার প’ঙ্গু স্বামীকে।তাকে নিয়ে কি লাভ?বাড়তি আব’র্জনা যত কম থাকবে ততই ভালো।
সারারাত নবনীতার কেটেছে প্রচন্ড উৎ’কন্ঠার।সে জানে এ বাড়ি ছাড়া বাদে তার আর কোনো পথ নেই।কিন্তু সে কোথায় যাবে?কার কাছে আশ্রয় নিবে?কি করবে সে?
রাত বারোটা বাজে রিমি তাকে ফোন দিয়েছিল।সে সব খুলে বলতেই রিমি বলেছে সে যেন তার বাসায় গিয়ে উঠে।কিন্তু নবনীতা তার বাড়ি গিয়ে তার বোঝা বাড়াতে চায় না।সে চায় একটা চাকরি।যেটা তাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে সাহায্য করবে।
রিমির কলটা কাটার পরেও সে চুপচাপ দীর্ঘসময় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসেছিল।ফজরের দিকেই রিমি তাকে আবারো কল দেয়।ধরতেই হড়বড় করে জানায়,’নবনী একটা চাকরির খোঁজ পেয়েছি।ধানমন্ডি তে অফিস।খুব ভালো জব।তুই কি কালকে ইন্টারভিউ দিবি একটা?’
নবনীতা সাথে সাথেই সে প্রস্তাব লুফে নেয়।খুশিতে গদো গদো হয়ে বলে,’অনেক অনেক ধন্যবাদ রিমি।তুই যে কি করে এতো অল্প সময়ে চাকরির খোঁজ আনতে পারিস কে জানে।অনেক ধন্যবাদ।’
জবাবে রিমি কেবল আমতা আমতা করে বলে,’ঐ আরকি।নেটওয়ার্ক ভালো আমার।’
সে ফোন রাখে।তারপর দ্রুত ডায়াল করে অন্য একটি নম্বরে।কল রিসিভ হতেই বলে,’ভাইয়া সে রাজি হয়েছে।’
অন্যপাশ থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,’কিছু টের পায়নি তো?’
‘না ভাইয়া।এখনো টের পায়নি।’
‘গুড।সামনেও পাবে না আশা করি।’
রিমি কল কাটে।নবনীতার চেয়েও সে বেশি খুশি আজ।নবনীতার দুঃখ গুলো সে নিজের চোখে দেখেছে।এবার একটু সুখ মেয়েটা ডিসার্ভ করে।তাই না?সে কল্পনা করে নবনীতার সামনের দিনগুলো স্বপ্নের মতো সুন্দর হবে।সে জানে কালকের চাকরি টা নিশ্চিত হওয়ার পর নবনীতা সারাদিন খুশিতে পুরো শহর চষে বেড়াবে।সে তার সই কে চেনে।সে এমনই।বাইরে থেকে কঠিন,অথচ ভেতর থেকে বাচ্চামো স্বভাবে ভরপুর।
***
ধানমন্ডির যেই অফিসের ঠিকানা রিমি নবনীতাকে মেইল করে পাঠিয়েছিল,সেটার সামনে গিয়েই নবনীতার মাথা ঘুরে গেল।এত্তো সুন্দর অফিস?বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো রিসোর্ট।এতো সুন্দর অফিসে তার মতো সদ্য গ্রেজুয়েটের চাকরি হবে?সে এক প্রকার হতাশা নিয়েই ইন্টারভিউ এর উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।সে জানে এতো বড় অফিসে তার চাকরি কিছুতেই হবে না।
তার ইন্টারভিউ নিয়েছিল দুই জন ভদ্রলোক।সেখানে তাকে খুব জটিল কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।কেবল জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সার্কিট সংক্রান্ত ছোটখাটো বিষয় আর ওয়েব ডেভেলপমেন্ট নিয়ে একদম বসিক কিছু প্রশ্ন।নবনীতা প্রত্যেকটা প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিয়েছে।তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সেদিনই তার চাকরি কনফার্ম করা হয়।
সে আনন্দে উচ্ছ্বাসে কোনো প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত ব্যক্ত করতে পারছিলো না।তার চাকরি টা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছে?সে একটা পারমানেন্ট রোজগারের উৎস পেয়ে গেছে?হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তে সে কিছুটা ভাবুক হয়ে গেল।বেতনের ব্যাপারে তো কিছু জানা হয়নি।বেতন কতো হবে?দশ হাজারের কম হলে তো তার জন্য ঝামেলা হয়ে যাবে।পরক্ষণেই আবার তার মনে হয়,’ধুর! এতো বড় অফিসের চাকরি নিশ্চয়ই এতো কম বেতনের হবে না।’
সে শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল,’কিছু মনে না করলে আমাকে একটু বলবেন স্যালারি টা কতো?’
দুইজনের মাঝে একজন মাথা তুলে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,’সত্তর হাজার।’
নবনীতা তার কথা শুনতেই এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।তার এমন হঠাৎ উঠে দাঁড়ানো তে সামনে বসে থাকা দু’টো লোক কিছুটা চমকে উঠল।জানতে চাইল,’এনি প্রবলেম?আপনার কাছে কম মনে হলে আমরা গভর্নিং বডির সাথে কথা বলে আরো কিছুটা বাড়াতে পারি স্যালারি।’
নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত নাড়তে নাড়তে বলল,’না না।এমন কিছু না।আমি খুব খুশি।আমার কোনো সমস্যা নাই।প্লিজ গভর্নিং বডিকে এমন কিছু বলবেন না।’
দুই জনের মধ্যে একজন জানতে চাইল,’রেসিডেন্স কোথায় আপনার?’
নবনীতা পড়েছে নতুন বিপাকে।সে কেমন করে বলবে তার আপাতত কোনো রেসিডেন্সই নেই?তার উদভ্রান্ত দৃষ্টি দেখেই চেয়ারে বসে থাকা একজন বললেন,’মিস আপনাকে কিন্তু ধানমন্ডি এরিয়াতেই থাকতে হবে।রেসিডেন্সের অসুবিধা হলে জানাতে পারেন।আমাদের কোম্পানির অনেক গুলো এপার্টমেন্ট আছে এদিকে।সেগুলো তে আমাদের এমপ্লয়িদের আমরা কিছুটা ডিসকাউন্টে থাকার ব্যবস্থা করে থাকি।’
একটা প্রবাদ আছে না?মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।নবনীতার মনে হচ্ছে আজ তার সাথে সেই প্রবাদ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।সে চেয়েছিল হাজার দশেকের একটা চাকরি।অথচ পেল সত্তর হাজার টাকার চাকরি।সত্তর হাজার! উচ্চারণ করতেও কষ্ট হয় নবনীতার।সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।আবার নাকি তারাই স্বল্পমূল্য রেসিডেন্স প্রোভাইড করবে।নবনীতার সাথে এসব হচ্ছে টা কি?সে তো এতোকিছুও আশা করেনি।
সেদিন বিকেলেই তাকে তার এপার্টমেন্ট দেখানো হলো।এত্তো সুন্দর বাসা দেখেই নবনীতার মনে হচ্ছিল সে খুশিতে কেঁদে ফেলবে।কাল রাত সে একটা আশ্রয়ের জন্য ছটফট করছিল।আর আজ এই এতো সুন্দর এপার্টমেন্ট টা তার! সে জানে এর ভাড়া ডিসকাউন্টেও বেশ চওড়া হবে।তবে তাতে কি?বেতন টাও তো কম না।এই টাকায় সে আরামে সবকিছু করতে পারবে।নবনীতা সারাদিন মনে মনে বিড়বিড় করল,’সত্তর হাজার! সত্তর হাজার! সত্তর হাজার!’
বিকেলে তার এপার্টমেন্টের চাবি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।বলা হলো প্রথম মাসের বেতন পেয়েই সে যেন ভাড়া মিটিয়ে দেয়।বাড়ির ভাড়া চল্লিশ হাজার টাকা।কিন্তু নবনীতার জন্য ভাড়া মাত্র বিশ হাজার টাকা।সে তাদের কর্মচারী বলে কথা!
নবনীতার কথা অত্যাধিক খুশিতে জড়িয়ে যাচ্ছিল।সে তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,’আপনারা কি প্লিজ আপনাদের গভর্নিং বডির কাউকে আমার সাথে কথা বলিয়ে দিবেন?আমি তাকে একটি বারের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই।’
ফর্মাল ড্রেসে থাকা লোকটা কিছুটা বিব্রত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’একচ্যুয়ালি ম্যাম,স্যারের সাথে তো এমন হুটহাট কথা বলানো যায় না।বুঝেনই তো বিষয়টা।’
নবনীতা কপাল চাপড়ায়।জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে,’সেই তো! সে তো কতো বড়ো কোম্পানির মালিক।তার কি এতো সময় আছে?আমারই মাথা ঠিক নেই।আচ্ছা আপনি একটু তার সাথে দেখা হলে জানিয়ে দিবেন প্লিজ।’
নবনীতা সেদিন ইচ্ছে মতো টাকা খরচা করল।তার হাতে যত টাকা ছিল,পুরোটাই ঢেলে দিল আজেবাজে কেনাকাটায়।বিকেলের একটু পরেই সে উবার বুক করে সাদেক সাহেব,শুভ্রা আর চিত্রাকে তার নতুন বাড়িতে নিয়ে আসে।সবকিছু একটু গুছিয়ে সে রিমিকে চতুর্থ বারের মতো কল দিয়ে বলল,’কোথায় তুই?এখনো এলি না যে?’
বিভাকে নিয়ে রিমি নবনীতার নতুন এপার্টমেন্টে পা রাখতেই কোথা থেকে নবনীতা ছুটে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।শুধু জড়িয়ে ধরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি।চট করে তার দুই হাতে দু’টো চুমুও খেল।কৃতজ্ঞতা ভরা কন্ঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,’থ্যাঙ্ক ইউ রিমি।তুই যে কোথা থেকে এতো ভালো চাকরির খোঁজ পেয়েছিস জানি না।ঐ দিকের মানুষ গুলো এত্তো ভালো! জানিস কি বলেছে ওরা আমায়?’
‘না তো।কি বলেছে?’
‘বলেছে এই মাসের বেতন টা আমায় আগে আগে দিবে।কারণ আমি স্টুডেন্ট।’
নবনীতা জবাবে কেবল মুচকি হাসে।রিমির কাঁধে আলতো চাপড় মেরে বলে,’ধুর! এমন কিছু না।’
সেদিন সন্ধ্যার পর পর খুব বৃষ্টি হলো।নবনীতা শুভ্রা আর সাদেক সাহেবের কাছে বিভা আর চিত্রাকে রেখে রিমিকে নিয়ে বহুতল ভবনটি থেকে বেরিয়ে এলো।চারদিকে ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দে পরিবেশ টা ভীষণ উৎসবমুখর হয়ে উঠছে।নবনীতা দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজল।রিমি খেয়াল করল বৃষ্টির পানির সাথে তার চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা সম্ভবত এই পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কাটানো যা’যাবর জীবনে এই প্রথম একটু শান্তি একটু আনন্দের দেখা পেয়েছে।যে মানুষটা তাকে এই আনন্দ টুকু এনে দিয়েছে,সে মানুষটার কথা জানলে কি সে খুশি হবে?রিমি আনমনে হাসে।খুশি হতেই হবে।এই ভালোবাসার কাছে নবনীতাকে পরাস্ত হতেই হবে।
নবনীতা বিল্ডিংয়ের সামনের খোলা জায়গায় দু’চোখ বন্ধ করে দু’হাত মেলে ভিজছিল।অদূরেই গাঢ় নীল তথা কালচে নীল রঙের ল্যান্ড ক্রুজারটা দীর্ঘসময় ধরে থেমে তাকেই দেখছিল।এর মালিক নিজের সমস্ত ব্যস্ততা কে একপাশে সরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই এদিকে ছুটে এসেছে।কেবল এই হাস্যোজ্জ্বল মুখটিকে সামনাসামনি একনজর দেখার জন্য।গাড়ির জানালায় নবনীতার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল।সে হাত বাড়িয়ে সেটা ছুঁয়ে দেয়।ইশশ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে এই মেয়েটাকে! যাক,পরীর একটা সুন্দর ঘর হয়েছে এতোদিনে।
সে তার প্রতিচ্ছবি ছুঁয়ে দিয়েই বলল,’তুমি কি তোমার এই ছোট্ট সংসারে আমায় ঠায় দিবে পরী?কথা দিচ্ছি,নিজেকে শুধরে দেখাবো।’
‘নাচ না জানলে উঠান বাঁকা
যে বলে বলুক রে।
তাল বেতালে হেলেদুলে
কোমর টা দুলুক রে।’
সাউন্ড বক্সে এইটুকু অংশ বাজার পর আরহাম,আদি আর আরিশ সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠল,
‘লে চান্স রে
লে চান্স রে
লে চান্স চান্স চান্স
লে পাগলু ডান্স ডান্স ডান্স ডান্স ডান্স ডান্স।’
তাদের চিল্লাফাল্লায় অ’তিষ্ঠ হয়ে তাসনুভা দুই হাত কান চেপে ধরে।এরা সেই তখন থেকে বেরস গলায় চেঁ’চিয়ে চেঁ’চিয়ে গান গাইছে আর উড়াধুরা নাচ দিচ্ছে।কোনো স্টেপ নাই,কোনো ছন্দ নাই।কেবল ইচ্ছে মতো লাফালাফি।তাসনুভা বিরক্ত হয়ে বলল,’থামবে তোমরা?তোমাদের চিৎ’কারে মাথা ধরে যাচ্ছে আমার।’
আদি শ্বাস টানতে টানতে বলল,’ভাইরে পা ব্যথা হচ্ছে আমার।তবুও শুধু নাচতে ইচ্ছে হচ্ছে।ফাহাদ কট,ফাহাদ কট।ইয়েসসস ইয়েসসস।শা’লা একদম জায়গা মতো ধরা খেয়েছে।
আরহাম চি’ৎকার করতে করতে আর লাফালাফি করতে করতে রীতিমতো হাঁ’পিয়ে উঠেছে।তার গায়ে এখন শুধুমাত্র ফকফকে সাদা এক্সারসাইজ গেঞ্জি।পাঞ্জাবি সে সেই কখনোই খুলে ফেলেছে খুশির ঠেলায় তার কোনো ইয়াত্তা নেই।
সে ক্লান্ত পায়ে হেঁটে সোফার কাছে গেল,ঠিক ওয়াজিদের পাশটায় গিয়ে বসল।ওয়াজিদ তার দিকে ফিরে কিছুটা চোখ গরম করে বলল,’বাচ্চা হয়ে যাস তুই মাঝে মাঝে?হাতের ঘা শুকায়নি এখনো,আর তুই এই হাত নিয়ে নাচাকুদা করছিস?
আজ আরহামের রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে অন্যরকম একটি দিন।বলা যায় যেদিন মনোনয়ন পত্র হাতে পেয়েছিল,তারপর থেকে এই দিনটিই তার সবচেয়ে ভালো দিন।
সে জানতো রাকিব আর ফাহাদ মিলে কোনো না কোনো ফন্দি আটছে।কিন্তু সেটা কি সে ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারছিল না।সে গু’লি খাওয়ার পর থেকে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছিল জনগণের মনে।এছাড়া রাকিবও তীব্র সমালোচনার মুখোমুখি হচ্ছিল।তাই তারা পরিকল্পনা করে নিজেরাই নিজেদের সম্মেলনে হা’মলা করেছে,যেন জনগণ ভাবে এই কাজ আরহাম করেছে প্রতি’শোধ নেওয়ার জন্য।মোদ্দা কথা আরহামকে টেনে নিচে নামানোর জন্য আর নিজে নতুন করে সিম্পেথি পাওয়ার জন্য রাকিব এই কাজ করেছে।নিজের লোক দিয়ে নিজের সমাবেশে ঝামেলা বাধিয়েছে,যেন সব দোষ আরহামের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে।
কিন্তু হলো টা কি?তার দলের ছেলেরাই পুলিশের কাছে ধরা খেয়ে স্বীকার করে নিল যে রাকিবই তাদের নির্দেশ দিয়েছিল নিজের সমাবেশে হা’মলা করে চারদিকে গন্ড’গোল বাধানোর জন্য।
আরহাম ফিচেল হাসে।লিভিং রুমের বড়ো টেলিভিশনের স্ত্রিনে প্রচার হওয়া সংবাদগুলো দেখে।আজকের পুরো ঘটনার খন্ড চিত্র গুলো টেলিভিশনে প্রচার করা হচ্ছে।রাজারবাগ থেকে শুরু করে শান্তিনগর।পুরো রাস্তার কিছু কিছু জায়গায় ভিডিও ফুটেজ কালেক্ট করা হয়েছে।দেখা যাচ্ছে রাকিবের দলের ছেলেরাই চোখ মুখ বেঁধে দু’র্বৃত্ত সেজে এই কাজ করছে।আরহাম হঠাৎই শান্ত হয়।স্থির দৃষ্টিতে টেলিভিশনের দিকে চোখ নেয়।অপেক্ষা করে কর্ণফুলী শপিং মলের সামনের ফুটেজটি সামনে আসার।
সেই ফুটেজ সামনে আসতেই সে প্রশস্ত হাসে।এ নিয়ে কয়বার সে এটা দেখেছে সে নিজেও জানে না।চারদিকে গু’লি আর সাউন্ড গ্রে’নেডের শব্দ।এদিকে সেদিকে পুলিশ।মুখ পেঁচিয়ে রাখা দুর্বৃ’ত্তরা এলোপাতাড়ি গু’লি ছু’ড়ছে।এরই মাঝে কোথা থেকে উল্কা বেগে একটি মেয়ে ছুটে এলো তার দিকে।এসেই এক থা’বায় তার মুখের সামনে থাকা কাপড়টি সরিয়ে নেয়।সজোরে একটা চ’ড় বসায় তার গালে।এই দৃশ্য আরহামের বুকের মাঝে এক পশলা বৃষ্টি নামায়।ইশশ কি শান্তি! ফাহাদকে এমন একটা দাবাং চট’কনা খাওয়ানোর কতো শখ ছিল তার।কিন্তু তার মনে রাখা উচিত ছিল দাবাং নবনীতা ছাড়া এই শখ পূরণ হওয়া সম্ভব না।
ফাহাদ আপাতত হাজতে আছে।হয়তো ছাড়া পাবে,নয়তো দুই একদিন থাকতে হবে।সেটা বড় বিষয় না।বড় বিষয় হচ্ছে ফাহাদ নিজেই প্রতি’হিংসার বশবর্তী হয়ে নিজের দলের ক্ষতি করেছে।আরহামকে ডিফেম করার জন্য সে অন্য দলের সাথে হাত মিলিয়ে।এই খবর জানাজানি হতেই কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে তাকে চিরতরে বহিষ্কার করা হয়েছে।উফফ! এতো আনন্দ আরহাম একদিনে কি করে সইবে?
সে উঠে দাঁড়িয়ে টেলিভিশনের সামনে যায়।বার বার শুধু এই মেয়েটিকেই দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে তার।এতো সাহস এই মেয়ের! তোফায়েল ঠিকই নাম দিয়েছে তার।আরহাম একপেশে হাসে।হাসতে হাসতেই বলে,’পুরাই একটা লেডি ডন!’
আদি ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,’আমি শিউর নবনীতা কোনো ছদ্মবেশী বাঘ।সে মানুষ হতেই পারে না।’
আরিশ চঞ্চল হয়ে বলল,’সেই সেই।নবনীতা আপু আমার দেখা সবচেয়ে স্ট্রংগেস্ট গার্ল।কি সাহস তার! চোখে মুখে কি তেজ! আপুর একটা বায়োপিক বানানো যাবে।’
আরহাম তার কথা শুনেই একগাল হাসে।আদি ঠিকই বলেছে।সে সত্যিই বাঘ।একে আরহাম কেমন করে নিজের মনের কথা বলবে?তার পরিনতিও কি ফাহাদের মতো হবে?আনমনেই সে একহাত তার গালে ছোঁ’য়ায়।কিছু একটা কল্পনা করতেই নড়েচড়ে উঠে।নাহ ভাই,লেডি ডন দূর থেকেই সুন্দর।কাছে গেলেই বিপদ।আরহাম আবারো কিছু মনে করে হাসল।বিড়বিড় করে বলল,’আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ পরী।তোমার তুলনা শুধু তুমিই।তোমায় কি করে বোঝাই তোমায় আমি কতোখানি পছন্দ করি! তুমি তো সেই কথা শুনলেই তেড়ে আসবে আমাকে মা’রার জন্য।তোমার কোনো ভরসা নেই।’
কয়েক মিনিট পরেই আরহামের মোবাইল ফোনটি শব্দ করে বেজে উঠে।আরহাম ফোন রিসিভ করতেই অন্যপাশ থেকে তোফায়েল চিন্তিত গলায় বলল,’ভাই আজকে রাকিবের দলের লোকদের গু’লিতে যে কয়জন আহত হয়েছে তার মধ্যে একটা এগারো বছরের বাচ্চাও আছে,শাহাদাত নাম।তার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।পেটে গু’লি খেয়েছে বেচারা।’
আরহাম আঁতকে উঠে বলল,’বলিস কি?ঐ শা’লা বাচ্চাকেও ছাড়ে নাই।যাকগে,অবস্থা কি বেশি খারাপ?’
‘জ্বী ভাই একটু খারাপই।আমি এতোক্ষণ সেখানেই ছিলাম।ঐ নবনীতা নূরও এখানে আছে ভাই।’
আরহাম গাঢ় স্বরে জবাব দেয়,’আচ্ছা তুই থাক।আমি আর ওয়াজিদ এখনি আসছি।’
.
.
.
.
স্ট্রেচারের কটকটে শব্দে নবনীতার মাথা ধরে যাচ্ছিল।তবুও সে চুপচাপ হাসপাতালের করিডোরে ফালানো বেঞ্চিতে বসে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা।বাড়ির বাটন ফোনে ফোন দিয়ে সে জানিয়েছে তার ফিরতে দেরি হবে।
সে নিজের মুখটা দুই হাতে ঢেকে একটা ক্লান্তির নিশ্বাস ছাড়ে।তার চোখ একটু পর পর আর্দ্র হয়ে যাচ্ছে।কিন্তু সে মানুষের সামনে কাঁদতে পারে না।সে কান্নাটুকু গিলে নেয়।তারপর পাশ ফিরে তার পাশের চেয়ারে বসে থাকা তিন বছর বয়সী ফুটফুটে কন্যা শিশুটিকে দেখে।তার নাম বিভা।যার পৃথিবীতে ভাই বাদে কেউ নেই।সেই ভাইটিও হাসপাতালে।হয়তো বাঁচবে,নয়তো চিরতরে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাবে।তারপর?তারপর কি হবে?বিভার কি হবে?
সে হাত বাড়িয়ে তাকে নিজের কোলে নেয়।তার চুলগুলো ঠিক করতে করতে বলে,’কিছু খাবে সোনা?খিদে পেয়েছে?’
বিভা কিছু বলল না।কেবল বড় বড় চোখ করে তাকে দেখল।নবনীতা তার কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বলল,’কোনো ভয় নেই পাখি।তোমার শাহাদাত ভাইয়ার কিচ্ছু হবে না।সে বলেছিল আমার দোয়া কবুল হবে।আমি দোয়া করেছি সে খুব বড় হবে।সেই দোয়া পূরণ করা অব্দি তার কিচ্ছু হবে না বিভু।’
সে শক্ত করে বিভাকে নিজের সাথে চেপে ধরে।বিভা আজ থেকে তার ছোট্ট বাচ্চা।সে বিভাকে এই নোংরা পৃথিবীতে একা ছাড়বে না।এখন থেকে বিভাও তাদের সাথে থাকবে।কোথায় রাখবে,কি খাওয়াবে সে জানে না।কিন্তু নবনীতার ভেতরের মাতৃসত্ত্বাটি বিভাকে এভাবে ফেলে দিতে পারবে না।
আরো আধঘন্টা অতিক্রম হওয়ার পর হাসপাতালের স্টাফদের মাঝে একটু হম্বিতম্বি দেখা গেল।নবনীতা কয়েকজনের কথা শুনে বুঝল শাহরিয়ার আরহাম এসেছেন হাসপাতালে গু’লিবি’দ্ধ রোগীদের দেখতে।সবাইকে দেখার পর সবশেষে সে এলো শাহাদাতের ওয়ার্ডের সামনে।
শাহাদাতের তখন হুশ নেই।তার পাকস্থলীর তেমন ক্ষতি হয়নি,তবে কিডনিতে আঘাত লেগেছে।সেখানে গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে।আরহাম তার ওয়ার্ডের সামনে আসতেই ত্যাছড়া নজরে একবার নবনীতাকে দেখল।তারপরই আবার চোখ সরিয়ে ডিউটিরত নার্স কে বলল এই ওয়ার্ডের ডাক্তার কে ডেকে পাঠাতে।
সরকারি হাসপাতাল।ওয়ার্ডে শাহাদাত বাদেও আরো অনেকে ছিল।ডাক্তার হাফিজ ঘর্মাক্ত শরীরে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলেন।আরহাম কে দেখতেই করমর্দন করলেন।আরহাম জানতে চাইল শাহাদাতের অবস্থা কেমন।জনাব হাফিজ কিছুটা মলিন মুখে বললেন খুব একটা ভালো না।প্রচুর র’ক্তক্ষ’রণ হচ্ছে।
‘মা বাবা আসেনি এখনো?’
‘মা বাবা নেই তার।’
ডাক্তার হাফিজ চোখ দিয়ে নবনীতার দিকে ইশারা করে বললেন,’এই মেয়েটাই তাকে নিয়ে এসেছে।’
আরহাম কোনো উত্তর না দিয়ে কেবল মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।কোমল গলায় বলে,’এটা কে নবনী?’
নবনীতা উদাস মুখে জবাব দেয়,’বিভা।শাহাদাতের বোন।’
আরহাম ছোট করে কেবল বলল,’ওহহ আচ্ছা।’
কথা শেষ করেই সে চটপট কিছুক্ষণ নবনীতাকে দেখে নেয়।কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে তাকে! তার কোলের বাচ্চাটি তার কেউ না,অথচ সে এমন করে তাকে বুকে চেপে রেখেছে যেন এটা তার সন্তান।আরহামের ইচ্ছে হচ্ছে তাকে শক্ত করে জাপটে ধরে বলতে,’তুমি এতো ভালো কেন পরী?তুমি কি সত্যিই কোনো পরী?’
অথচ সে তেমন কিছুই বলল না।কেবল গম্ভীর স্বরে বলল,’চিন্তা করো না তুমি।আমি শাহাদাতের চিকিৎসা করাবো।আমি সমস্ত খরচ বহন করব।এখানে না,প্রয়োজনে স্কয়ার কিংবা বার্ডেমে ট্রান্সফার করব।’
আরহাম থমথমে মুখে শুধু তাকে দেখে।হাসপাতাল মন ভরে ঝগড়া করার জন্য উপযুক্ত না।তাই সে আর কথা বাড়ায় না।সমস্যা কি?ঝগড়া করার জন্য তো পুরো জীবনই পড়ে আছে।পরে না হয় কোনো একদিন তাকে বলা যাবে,’শুনো নবনীতা।তুমি যে সবসময় সবকিছুতে ভাবো আমি শুধু রাজনৈতিক স্বার্থে সবকিছু করি,এটা একদমই ঠিক না।আমি মাঝে মাঝে মন থেকেও মানুষের জন্য করি।এই যে বিগত কিছুদিন ধরে আমি তোমার বিরহে বদ্ধ উ’ন্মাদ হয়ে যাচ্ছি,এটাতে কি কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ আছে বলো?পরীকে না দেখলে যে আমার বুকে ঝ’ড় উঠে সেটার পেছনে কি কোনো রাজনৈতিক স্বার্থ আছে বলো তো?’
সে অবশ্য সবটাই মনের ভেতর চেপে গেল।কেবল বিভার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,’দেখি আমাকে একটু দাও তো।’
নবনীতা চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়।হাত বাড়িয়ে বিভাকে আরহামের কাছে দেয়।আরহামের বাম হাতটা হঠাৎ ছুটে যাওয়ার নবনীতা দ্রুত তার হাতটা বিভার পিঠের সাথে চেপে ধরল।আরহামের শক্ত খড়খড়ে হাতটি স্থান পেল নবনীতার রুগ্ন আর কোমল হাতের নিচে।ঘটনার আকস্মিকতায় দু’জনই চমকে উঠে দু’জনের দিকে তাকায়।দু’জনের দৃষ্টি বিনিময় হতেই নবনীতা চোখ সরিয়ে নেয়।কিন্তু আরহাম সাথে সাথেই চোখ সরায় না।সে আরেকটু মন ভরে দেখে,দেখতেই থাকে।সে অনুভব করতে পারছে কোনো এক গভীর মহাসমুদ্রে সে রোজ একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে।সে হেরে গেছে।তার পক্ষে আর এই মোহ থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব না।কিছুতেই সম্ভব না।
ওয়াজিদ তাদের দেখতেই দুই কদম পিছিয়ে গেল।বাস্তব কিংবা কল্পনা,সবকিছু থেকেই পিছিয়ে গেল।তার হাত কাঁপছে।গলার কাছে কিছু একটা এসে কাঁ’টার মতো বিঁ’ধেছে।সে ঢোক গিলে।আরো দু’কদম পিছায়।পেছাতেই থাকে।
নবনীতা গোমড়া মুখ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকে দেখে।দেখা শেষ হতেই চোখ সরু করে বলে,’সত্যি করে বলুন তো,আপনি মনে মনে আবার কি ছক কষছেন?’
আরহাম তার কথা শুনতেই হো হো করে হেসে ফেলল।তার হাসি দেখে নবনীতার শরীর ছ্যান্যান করে উঠে।সে কি কোনো উপহাস করেছে?এমন করে হাসছে কেন ঐ লোক?আরহাম এক হাত পেটে চেপে হাসি থামাতে থামাতে বলল,’মাই গড! তুমি এখানেও ছক ফক নিয়ে পড়ে আছ?তোমার কাজই আমাকে সন্দেহ করা।যাও তো তুমি।সামনে থাকলেই উল্টা পাল্টা বকে যাও তুমি।’
নবনীতা কিছুক্ষণ চুপ থাকে।পরক্ষণেই থমথমে মুখে বলে,’ইফাজ আমার আত্মীয় হয়।আপনি পরবর্তী তে এসবে নাক গলাবেন না বলে দিলাম।আমার টা আমাকে দেখে নিতে দিন।’
‘ইফাজ তোমার কি এমন আত্মীয় হয় একটু শুনি?তোমার মামির ভাইয়ের ছেলে।অনেক দূরের আত্মীয়।’ কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলল আরহাম।
নবনীতা জোর গলায় জবাব দেয়,’আমি যেহেতু আমার মামা মামির সাথে থাকি,তাই এটাও আমাকে মানিয়ে চলতে হয়।কাছে দূরে বিষয় না।আপনি এখন থেকে দূরে থাকবেন এসব থেকে।’
সে থামে।হঠাৎই চোখ সরু করে বলে,’শুধু ইফাজ না।আপনি আমার চিত্র থেকেও দূরে থাকবেন।বুঝেছেন?’
আরহাম চোখ তুলে তাকে দেখল।দেখতেই শব্দ করে হেসে ফেলল।মুখে সে হাসি ধরে রেখেই বলল,’আর ইউ জেলাস?’
‘কোন দুঃখে জেলাস হবো আমি?’
‘এই যে চিত্র আমাকে এতো ভালোবাসে সেজন্য।তুমি তো আবার চিত্র’র ভালোবাসা কে তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করো।’
নবনীতা থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল।আড়চোখে একবার আরহাম কে দেখে চাপা স্বরে বলল,’সে যাই হোক।আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবুন।নির্বাচন নিয়ে ভাবুন।নিজের চ্যালাপেলা দের কন্ট্রোল করুন।আমার সিকিউরিটি আমি নিজেই এনশিউর করতে পারি।’
কথা শেষে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।যেরকম হনহনিয়ে এসেছিল,ঠিক সেরকম করেই বেরিয়ে গেল।সে যেতেই ওয়াজিদ অবাক হয়ে বলল,’ইফাজ তাহলে নবনীতার পরিচিত?’
আরহাম দায়সারা ভাবে জবাব দেয়,’হু।’
‘সে নবনীতার হাত ধরেছিল রাস্তায়?’
অন্য দিক থেকে আগের মতোই জবাব আসে,’হু’
ওয়াজিদ চোখ মেলে সামনে দেখে।বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যথা করছে তার।কেন করছে?আরহামের দিকে সে নির্নিমেষ কয়েক পল তাকিয়ে থাকে।সে কিছু একটা অনুধাবন করতে পারছে।যা সে অনুধাবন করছে সেটা তার জন্য সুখকর না।তার সামনে বসে থাকা যুবকটিকে সে চেনে।খুব ভালো মতো জানে সে যখন কোনো কিছু নিয়ে উঠে পড়ে লাগে,তখন সে সেটা হাসিল করেই ছাড়ে।সে ছোট থেকেই লাগাম’হীন,বে’পরোয়া আর নিজের খেয়ালখুশির মালিক।
ওয়াজিদ কাউচ ছেড়ে উঠে ঠিক তার মুখোমুখি চেয়ারে বসল।নিচু আওয়াজে ডাকল,’আরহাম!’
আরহাম তাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকায়।জিজ্ঞাসু হয়ে বলে,’কিরে?কিছু বলবি?’
ওয়াজিদ একটা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,’হু,বলব।’
‘কি?’
‘তুই কি নবনীতাকে পছন্দ করিস আরহাম?’ কোনো ভনিতা না করে ওয়াজিদের সোজাসাপটা প্রশ্ন।
আরহাম তার কথা শুনতেই এক গাল হাসে।কপালে আঙুল ঠেকিয়ে গাঢ় স্বরে বলে,’নাথিং লাইক দ্যাট।জাস্ট ইনফেচুয়েশন।’
ওয়াজিদ অধৈর্য হয়ে বলল,’নো ম্যান।দ্যাট কান্ট বি ইনফেচুয়েশন।কেবল ইনফেচুয়েশন থেকে কেউ এতোটা বাড়াবাড়ি করে না।তুই কতোটা বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস তুই জানিস?’
আরহাম মুচকি হাসে।ওয়াজিদের চোখে চোখ রেখে শুধায়,’তাহলে তুই বল এটা কি?শুনি আমি।’
আরহাম আলগোছে হেসে বলল,’না আমি বুঝি না।তুই আর আদি আছিস না সবকিছু বুঝার জন্য?আমি অতো বুঝতে চাই না।অনুভূতি অর ইনফেচুয়েশন,হোয়াটএভার ইট ইজ,আমি নবনীতার আশেপাশে ঐ ইফাজ টিফাজকে সহ্য করতে পারি না।এখন তুই প্লিজ জ্ঞান ঝাড়িস না যে আমি প্রেমে পড়েছি হ্যান ত্যান।এমন কিছু না ভাই।প্রেম টেমের কোনো ফাংশন নেই আমার।এসব অনুভূতি ইনফেচুয়েশন সময়ের সাথে কেটে যাবে।’
সে থামে।হঠাৎ কিছু একটা ভেবে তিরিক্ষি স্বরে বলে,’শা’লা ঐ সময়টাই তো পাচ্ছি না।রোজ রোজ কোনো না কোনো ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে।মাইন্ড ডাইভার্ট করার সময়টুকুও পাচ্ছি না বা’ল।’
ওয়াজিদ তার কথা শুনেই নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।আরহাম চোখ পাকিয়ে বলল,’কিরে?কোথায় যাচ্ছিস তুই?’
ওয়াজিদ চুপচাপ সামনে পা বাড়ায়।নিরাসক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে,’শরীর খারাপ লাগছে আমার।বাড়ি গিয়ে একটু রেস্ট করব আমি।তুই থাক,আমি একটু আসি।’
.
.
.
.
সিটি কলেজের সামনে রোজই আড্ডাবাজ বেকার ছেলেপুলে গুলো ভীড় জমায়।আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।শুভ্রা কলেজ শেষে বাইরে আসতেই এদের দেখা পেল।
এদের মাঝে একজনের নাম বিনয়।নাম নাকি মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলে।এই কথা শুভ্রা সেদিন থেকে অবিশ্বাস করা শুরু করেছে যেদিন থেকে সে বিনয় কে দেখেছে।এর মতো বদ’মাইশ আর উচ্ছৃ’ঙ্খল সে তার জীবনেও দু’টো দেখেনি।এর নাম নাকি বিনয়! বিনয়ের ব টাও নেই তার মাঝে।
শুভ্রানী খুব বেশি মেধাবী না।কিন্তু সে খুব পরিশ্রমী।নিজেদের অ’সহায়ত্ব তাকে পরিশ্রমী করে তুলেছে।বাবা মায়ের মৃ’ত্যুর পর সে যখন দেখত আপাই নামের মানুষটি সবে মাত্র কলেজ জীবন শেষ করে একহাতে বই আর অন্য হাতে চিত্রা কে আগলে নিচ্ছে,তখন থেকেই শুভ্রা প্রতিজ্ঞা করেছে সে খুব পড়াশোনা করবে,সে আপাইয়ের দুঃখ দূর করবে।শুভ্রার বই খাতা কিনতে আপাই কখনো কার্পন্য করে না।শুভ্রা বেঁচে থাকতে কোনোদিনও তার ঋণ শোধ করতে পারবে না।কিন্তু সে এর কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চায়।আপাই আর কতো ধুকে ধুকে ম’রবে?এখন তো শুভ্রা বড় হচ্ছে।সে নিজেই এখন আপার ঢাল হবে।
শুভ্রা খুব মন দিয়ে পড়ে।ছিমছাম গড়নের যে অসম্ভব ভালো মেয়ে মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে তাকে আর চিত্রকে আগলে রেখেছে,ঐ মেয়েটিকে শুভ্রা গর্ববোধ করাতে চায়।সে খুব বেশি পড়তে চায়।পড়াশোনার পাশাপাশি সে বিতর্ক ক্লাবেও নাম লিখিয়েছিল।সেই থেকেই কলেজে তার টুকটাক পরিচিতি।তখন থেকেই সে টিটু,মিরন আর বিনয়ের চোখে পড়েছে।টিটু আর মিরন যদিও আপাইয়ের পি’টুনি খেয়ে তার দিকে নজর দেওয়া বন্ধ করেছে,কিন্তু বিনয় সেই আগের মতোই আছে।সে তাকে দেখলেই অ’শালীন অঙ্গভঙ্গি করে,শিশ বাজায়,অসভ্য আচরণ করে।
আজকেও সে বেরিয়ে আসতেই বিনয় তাকে দেখে শিশ বাজালো।সে আটসাট হয়ে আরেকটু সামনে যেতেই বিনয় তার মুখোমুখি এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়।শুভ্রা দ্রুত তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে সে দুই হাত প্রসারিত করে তার যাওয়ার পথ বন্ধ করে।জিভ দিয়ে দুই ঠোঁ’ট ভিজিয়ে কুৎ’সিত ইশারা করে বলে,’আহা ময়না যাচ্ছো কোথায়?একটু কথা তো বলো।’
শুভ্রা একটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বলল,’প্লিজ রাস্তা ছাড়ুন।’
বিনয় লোলুপ দৃষ্টিতে একবার উপর নিচ তাকে দেখে।সেই দৃষ্টি দেখলেই শুভ্রার বুক ফে’টে কান্না আসে।সে তড়িঘড়ি করে অন্যদিক দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।সে অন্য পথে যেতেই বিনয় দ্রুত পায়ে তার পিছু নেয়।
শুভ্রা শ্বাস বন্ধ করে ছুটে যায় এক প্রকার।বিনয় নিজেও তার পেছনে ছুটে আসে।তাকে থামানোর উদ্দেশ্যে যেই না সে তার হাত ধরার জন্য নিজের হাতটা এগিয়ে নিল ,ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এসে একটা শক্ত হাত বিনয়ের কুৎসিত হাতটাকে খপ করে ধরে ফেলল।
বিনয় থামল।শুভ্রা নিজেও থামল।পেছন ঘুরে বড় বড় চোখ করে তাকে বিনয়ের নোং’রা স্পর্শ থেকে বাঁচানো লোকটিকে দেখল।বিনয় নিজেও চোখ তুলে সামনে তাকায়।সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখা মাত্রই সে তব্দা খেয়ে বলল,’আরিশ ভাই।আপনি?’
আরিশ শান্ত চোখে একবার তাকে আর একবার শুভ্রাকে দেখে।গম্ভীর গলায় জানতে চায়,’এদিকে কি করছিস?শুভ্রার পিছু নিয়েছিস কেন?’
বিনয় ভড়কে গেল।মেয়েটি কি আরিশ ভাইয়ের পরিচিত?সে তো তাদের পরিচিত মেয়ে বলতে সারাহ আর তাসনুভা কেই চিনে।সে আমতা আমতা করে বলে,’না মানে,ইয়ে ভাই,আসলে ইয়ে হইছে,,,’
আরিশ তাকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলো।একহাত তুলে কিছুটা শা’সিয়ে বলল,’আর কখনো এমন শুভ্রার পিছু নিবি না।বুঝেছিস?’
বিনয় দ্রুত মাথা নাড়ে।আরিশ কাঠকাঠ স্বরে বলে,’এখন যা এদিক থেকে।’
বিনয় যাওয়ার আগে আরো একবার তাকে সালাম দিলো।যেতে যেতেই বলল,’আরহাম ভাইকে আমার সালাম দিবেন ভাই।’
সে চলে যেতেই আরিশ সোজাসুজি শুভ্রার দিকে দেখে বলল,’ঠিক আছ শুভ্রা?’
‘আমি ড্রপ করে দেই?’ খুবই নম্র হয়ে প্রশ্ন করে আরিশ।
তার কথা শুনতেই শুভ্রা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল।তার এলোমেলো দৃষ্টি দেখতেই আরিশ অমায়িক হেসে বলল,’আনইজি ফিল করার কিছু নেই।আমরা তো এখন অল্প সল্প চিনি নিজেদের তাই না?’
শুভ্রা কেবল আস্তে করে মাথা নাড়ে।আরিশ পুনরায় জিজ্ঞেস করে,’ড্রপ করে দিব শুভ্রা?’
কলেজ ইউনিফর্মের পেটের দিকটা খাঁ’মচে ধরে শুভ্রা মিনমিন করে জবাব দেয়,’জ্বী,ঠিক আছে।’
গাড়িতে বসেই আরিশ সবার প্রথমে এসি অন করল।তারপর গাড়িতে থাকা পানির বোতল টা শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’নাও পানি খাও।একটু ঠান্ডা হও।’
শুভ্রা বাধ্য মেয়ের মতো বোতল হাতে নেয়।আরিশ সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে বলে,’ঐ ব’খাটে গুলো কি রোজই এমন করে?’
কয়েক ঢোক পানি খেয়ে শুভ্রা মলিন মুখে জবাব দেয়,’জ্বী দেখতে পেলেই এমন করে।’
আরিশ স্মিত হেসে বলল,’আর করবে না।নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’
শুভ্রা মিষ্টি করে হাসল।একটু পরে কিছু একটা মনে পড়তেই বলল,’আপনি যেন কোন ইউনিভার্সিটি তে পড়েন?’
আরিশ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে গাঢ় স্বরে বলল,’এদিকে এসেছি কাজে।ভাইয়া পাঠিয়েছিল।তোমাদের কলেজের অফিসে একটা কাজ ছিল।তাই।’
শুভ্রা ছোট করে জবাব দিলো,’ওহহ বুঝেছি।’
প্রতিউত্তরে আরিশ কেবল একগাল হাসল।কুচকুচে কালো টয়োটার গাড়িটা নির্দিষ্ট গন্তব্য নিয়ে চলতে শুরু করে।সেই সাথে চলতে শুরু হয় দু’জন মানব মানবীর পথ চলা।তারা কি জানে তাদের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় গিয়ে থামবে?
_____________________________________________
শান্তিনগর বাজারের বিপরীত দিকের রাস্তায় কর্ণফুলী শপিং মলের সামনে প্রায় রোজই অস্থায়ী ভাবে কম বয়সী ছেলেরা তাদের জিনিসপত্র সাজিয়ে বেচাকেনার উদ্দেশ্যে বসে।
নবনীতা সেদিকে আসতেই হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে তার কদম শ্লথ হয়।সে এগিয়ে যায় তার দিকে।শ্যাম বর্ণের রোগা পাতলা ছেলেটিকে দেখতে খুবই অল্প বয়সের মনে হচ্ছে।তার পরনের সাদা গেঞ্জিটা ধুলো ময়লা জমে আর সাদা নেই,সেটা রীতিমতো ছাইরঙা হয়ে গেছে।তার মুখটা কতো মলিন! দায়িত্বের ভারে ঝুকে যাওয়া কাঁধটা নবনীতার কোমল হৃদয়ে আ’ঘাত করে।
সে এগিয়ে এসে বলে,’নাম কি তোমার বাচ্চা?’
ছেলেটি অবাক হয়ে তাকে দেখে।দেখেই গোল গোল চোখ করে বলে,’শাহাদাত।’
নবনীতা মিষ্টি করে হেসে বলে,’বাহ! খুব সুন্দর নাম তো।তোমার বয়স কতো শাহাদাত?’
শাহাদাত নামের ছেলেটি দায়সারাভাবে উত্তর দেয়,’এগারো।’
নবনীতার বুকটা ধ্বক করে উঠে।সে একহাত শাহাদাতের থুতনিতে রেখে মলিন মুখে জানতে চায়,’বাড়িতে আর কেউ নেই সোনা?তুমি এতো ছোট বয়সেই এসব করছ কেন?তোমার বাড়িতে কেউ নেই?’
শাহাদাত দুই দিকে মাথা নাড়ে।স্বাভাবিক গলায় বলে,’না আপা।আমার বাপ অনেক আগেই মই’রা গেছে।মা আমারে আর আমার বইনরে থুইয়া আরেক খানে গেছে গা।’
‘তোমার বোনও আছে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নবনীতা।
শাহাদাত উত্তর দেয়,’হ আছে।তিন বছর বয়স।’
নবনীতা আঁতকে উঠে বলল,’তাকে কোথায় রেখে এসেছ তুমি?’
শাহাদাত তার তর্জনী তুলে মার্কেটের প্রবেশ পথের একটু ডানদিকে একজন মাঝবয়েসী মহিলার কোলে থাকা একটা ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চাকে দেখিয়ে বলে,’ঐ যে বাচ্চাটা,এটাই আমার বইন।নাম বিভা।’
‘আর এই মহিলাটা কে?’
‘ফরিদা খালা।আমগোর লগেই থাকে বস্তিতে।’
নবনীতা ম্লান মুখে জবাব দেয়,’ওহহ আচ্ছা।’
তারপরই সে শাহাদাতের হাতে থাকা বইগুলো দেখে।ছোট বাচ্চাদের পড়ার বই।গত মাসেই সে চিত্রার জন্য এমন কয়েকটা বই কিনেছিল।সে ঠিক করেছে সে আজও কয়েকটা বই কিনবে।
সে দুইটা বই হাতে নিয়ে বলল,’কত রাখবে এই দু’টো?’
শাহাদাত জানায়,’একশো টাকা।’
নবনীতা তার পার্স থেকে দু’শো টাকা বের করে।টাকাটা শাহাদাতের হাতে গুজে দিয়ে বলে,’এই নাও দু’শো টাকা।একশো টাকা বইয়ের,আর বাকি একশো তোমার আর বিভার জন্য আমার ভালোবাসা।আপুর হাত খালি ভাই।নয়তো একটু বেশিই দিতাম।তুমি এই টাকায় বিভাকে কিছু কিনে খাওয়াবে কেমন?সাথে নিজেও খাবে,বুঝলে?’
এই সামান্য ভালোবাসা আর স্নেহের বাণীতে শাহাদাত নামের অনাথ ছেলেটির দুই চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।এতোক্ষণ নির্লিপ্ত আর নির্বিকার থাকা ছেলেটা আচমকাই ভীষণ আবেগী হয়ে নবনীতার হাতটা তার মাথায় রাখল।অনুভূতি জড়ানো গলায় বলল,’আপা আপনি একটু আমার জন্য দোয়া কইরা দেন।আপনে আসমানের হুর।আপনার দোয়া আল্লাহ কবুল করব।’
নবনীতা তার কথা শুনেই শব্দ করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতে বলল,’কেন?তোমার কেন আমাকে হুর মনে হচ্ছে?’
নবনীতা আরো কিছুক্ষণ খিলখিলিয়ে হাসল।তারপর শাহাদাতের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,’অনেক বড়ো হও শাহাদাত।তোমার সাফল্যে যেন মানুষ ভীষণ আশ্চর্য হয়।খুব নাম করো সোনা।’
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দূর থেকে কোথাও গো’লাগু’লির শব্দে আশপাশ চঞ্চল হয়ে উঠল।ঘটনার আকস্মিকতায় নবনীতা নিজেও কেঁপে উঠে।ঘটনা কি সেটা ঠাহর করতেই তার কয়েক মিনিট লেগে যায়।একটু সময় যেতেই সে বুঝল যে এটা গু’লি চালানোর শব্দ।আরো এক দফা সমস্ত শরীর অ’বশ হয়ে আসে তার।সে চোখ মেলে দেখে লোকজন সব ছুটে শপিং মলের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
গো’লাগু’লির শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে।ব্যস্ত রাস্তাটা হঠাৎই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে।চারিদিকে লোকজনের চিৎ’কার শোনা যায় শুধু।নবনীতা একটু ধাতস্থ হয়েই শাহাদাতের একহাত ধরে বলল,’চলো শাহাদাত,আমরা ভেতরে গিয়ে একটু অপেক্ষা করি সবকিছু ঠিক হওয়ার।’
শাহাদাত তার হাতে থাকা বইগুলো বাদেও আরো অনেক বই ফুটপাতে বিছিয়ে রেখেছিল।সে সেগুলো দেখতে দেখতে তাড়াহুড়ো করে বলল,’আপনে যান।আমি এডি গুছায়া আসতাছি।’
কাছেই কোথাও এবার আবারো গু’লি চালানোর শব্দ হয়।নবনীতা একহাত নিজের মাথায় চে’পে ধরে।সে যদি আর এক মুহূর্তও এদিকে থাকে তাহলে নির্ঘাত সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।এই শব্দ গুলোতে তার অস্বস্তি হয়।সে কোনোরকমে মার্কেটের দিকে ছুটে যায়।নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।
আশপাশ থেকে উড়ো খবর কানে আসে আজ নাকি রাকিবের সমাবেশ ছিল রাজারবাগের দিকে।সে সমাবেশ কে ঘিরেই নাকি এই গো’লাগু’লির সূত্রপাত।কেউ কেউ বলছে শাহরিয়ার আরহাম প্রতি’শোধ পরায়ন হয়ে এই কাজ করেছে।কেউ আবার বলছে এটা নতুন কোনো ষড়’যন্ত্র।
দূর থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বাজানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।সময়ের সাথেই শব্দ গুলো স্পষ্ট হতে থাকে।নবনীতা টের পায় দুর্বৃ’ত্তরা খুব কাছাকাছি কোথাও চলে এসেছে।
হঠাৎই তার চোখ যায় সড়কের অন্যপাশে।মুখে কাপড় বাঁধা একটা যুবক সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তার হাতে উন্নত মডেলের একটা পি’স্তল।তার এক আঙুল ট্রিগারে রাখা।সে গু’লি করছে এলোপাতাড়ি।কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই।কেবল গু’লি করেই যাচ্ছে।রাস্তায় থাকা একটা কুকুরের গায়ে সে গুলি লাগতেই সেটা ছি’টকে মাটিতে গিয়ে পড়ল।তার র’ক্তে সড়কের বেশ খানিকটা অংশ র’ঞ্জিত হলো।নবনীতা পরনের ওড়না টা মুখে চাপে।তার বমি পাচ্ছে ভীষণ।
শাহাদাত তখনো তার বেচার জন্য কেনা বইগুলো গোছাতে ব্যস্ত।নবনীতা তাকে দেখেই চিৎ’কার করে বলল,’আর বই গোছাতে হবে না শাহাদাত।তুমি এদিকে আসো।এক্ষুনি আসো।’
শাহাদাত কেবলই তার কন্ঠ শুনে পেছন ফিরেছিল,তক্ষুনি এলোপাতাড়ি ছুড়’তে থাকা গু’লি গুলোর একটি তার পেটের কাছ দিয়ে ফুটো করে বেরিয়ে গেল।এগারো বছরের ছোট্ট ছেলেটা তার স্বপ্নেও এমনকিছু কল্পনা করেনি।সে ফ্যালফ্যাল চোখে নিজের পেটের দিকে দেখে।মুহূর্তেই তার ছোট্ট শরীরটা মাটিতে ঢলে পড়ে।নবনীতা গগন কাঁপিয়ে চিৎ’কার দেয়,’শাহাদাত!!!’
লোকজন কেউ কেউ ছুটে যায় শাহাদাতের দিকে।চেপে ধরে তার গু’লিবি’দ্ধ স্থান।আর নবনীতা?সে কি করল?
প্রচন্ড ঘৃ’ণা আর বুক ভর্তি সাহস নিয়ে তরুণীটি ক্ষি’প্র গতিতে ছুটে যায় সড়কের অন্যদিকে।ইতোমধ্যে পুলিশ পৌঁছে গেছে সেখানে।দুর্বৃ’ত্তরা যে যেখানে পালানো শুরু করেছে।ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া,টিয়ার’শেলের ধোঁয়া আর রাবার বু’লেটের শব্দে চারদিক কেমন গমগমে হয়ে ছিল।এরই মাঝে তরুণী টি সব ভয় ভীতি কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছুটে যায় অবৈধ অ’স্ত্র হাতে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে,যার ছোঁ’ড়া গু’লিতে শাহাদাতের ছোট্ট শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।সে গিয়েই এক থা’বায় তার মুখের সামনে থেকে কাপড় সরায়।
তার অকস্মাৎ আক্র’মনের জন্য যুবকটি প্রস্তুত ছিল না।মুখের উপর কেউ থা’বা দিতেই সে হকচকিয়ে ওঠে।নবনীতা একনজর তার মুখটা দেখেই গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তার গালে একটা চ’ড় দেয়।চেঁ’চিয়ে উঠে বলে,’জানো’য়ার কোথাকার! তোর মতো জানো’য়ারের কাছে আরহাম কিচ্ছু না।’
ফাহাদ গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখল।মেয়েটা তাকে মে’রেছে?সে কি ধ’রা পড়ে গেছে?এটা কি করে সম্ভব?এই মেয়ের কি জানের ভয় নেই?পেছন থেকে পুলিশের একটি টিম ছুটে আসছিল তাদের দিকে।অবস্থা বেগতিক দেখে ফাহাদ এক ধা’ক্কায় নবনীতা কে মাটিতে ছু’ড়ে ফেলল।তারপরই তীব্র বেগে সামনের দিকে দৌঁড়ে পালায়।
মাটিতে পড়েও নবনীতা হাল ছাড়ল না।সে অস্থির হয়ে এদিক সেদিক খুঁজে একটা বড়ো সড়ো ইটের টুক’রো দেখতে পেল।সঙ্গে সঙ্গে সেটা হাতে তুলে সে ছু’ড়ে মারে ফাহাদের দিকে।
অব্যর্থ নিশানা।ইট টা গিয়ে পড়ে ফাহাদের ঘাড় বরাবর।সঙ্গে সঙ্গে তাল হারিয়ে সে মাটিতে গিয়ে পড়ে।আর উঠার সময়টুকুও পায়নি ফাহাদ।ব্যথা সহ্য করে উঠে বসতেই সে দেখল পুলিশের টিম টি তাকে ঘিরে ফেলেছে।এর মধ্যে একজন তার দিকে ব’ন্দুক তাক করে বলল,’নড়বে না একদম।ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।’
নবনীতা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়।পুলিশদের পেছনে সব সাংবাদিকরা এসেছিল নিউজ কভার করতে।তাদের কেউ কেউ নবনীতাকে দেখেই ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে ছুটে যায় তার দিকে।জানতে চায়,’এখানে কি হচ্ছিল খুলে বলুন ম্যাম।আপনি ঠিক আছেন তো?’
‘তুই ঐ ছেলেকে ধরে এনেছিস কেন?কে এই ছেলে?তুই আবার নির্বাচনের আগে এসব হঠকারিতা শুরু করেছিস?’
আরহাম জবাব দেয় না।তার এই নির্লিপ্ত,বে’পরোয়া ভাব ওয়াজিদের দুশ্চিন্তা বাড়ায়।সে তার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে।অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,’আবারো তুই ভুলভাল করছিস ভাই।এই ছেলে কে?দোষ কি তার?’
আরহাম অল্প হাসে।কপালে দুই আঙুল ছুঁয়িয়ে বলে,’আছে,দোষ আছে তার।’
‘সেটাই জানতে চাইছি।দোষটা কি?’
‘সে একজন কে ছুঁয়েছে।এটাই তার দোষ।’ থমথমে মুখে জবাব দেয় আরহাম।
ওয়াজিদ তব্দা খেয়ে বলল,’অদ্ভুত!এটাই তার অপ’রাধ?’
পরক্ষণেই আবার চোখ সরু করে বলল,’কাকে ছুঁয়েছে সে?’
আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলে,’তাতে তোর কি?যাকে ছুঁয়েছে,সেটা আমার বিষয়।আমি মিটমাট করব।’
কথা শেষ করেই সে টেবিলের একপাশে রাখা মার্লবোরো এর পাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটা দুই ঠোঁটের সাহায্য চে’পে ধরল।লাইটার দিয়ে খুব সাবধানে সেটা ধরিয়ে একটা টান দিলো।ওয়াজিদ আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুই এখনো এতো শান্ত আছিস?’
সে ভরাট গলায় উত্তর দেয়,’অশান্ত হওয়ার মতো কিছু হয়নি ওয়াজিদ।আমি তাকে কিড*ন্যাপ করিনি।জাস্ট একটু জেরা করে তারপর ছেড়ে দিব।ডোন্ট বি সো প্যানিকড।’
ওয়াজিদ গোল গোল চোখ করে বলল,’তুই এতো স্বাভাবিক কথা বলছিস একজনকে তুলে এনে?মাই গড! তোর মাঝে মাঝে কি হয় কে জানে!’
আরহাম দুই আঙুলের সাহায্যে সিগা’রেট টা চেপে ধরে একহাত পকেটে গুজে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে হেঁটে পাশের ঘরটায় চলে গেল।এই মুহূর্তে তারা তাদের সেই পুরোনো আস্তানায় এসেছে।লোকালয় থেকে একটু নিবিড়ে,জনমানব বিহীন আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংয়ের দোতালায়।
ইফাজ জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারের উপর বসে ছিল।সে কিছুটা ঘা’বড়ে আছে,আবার কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে আছে।আরহামের ছেলেরা তাকে এখানে নিয়ে এলো কেন?সে কি করেছে?
তাকে একটা ঘরে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে।এখনো তার সাথে কেউ কথা বলেনি।খুব সম্ভবত আরহামই তার সাথে কথা বলবে।ইফাজ অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।তার মতো সাধারণ মানুষের সাথে শাহরিয়ার আরহামের কি কথা থাকতে পারে?
তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়।ঘরের বন্ধ দরজা আচমকা খুটখুট শব্দ করে খুলে যায়।ইফাজ মাথা তুলে সামনে দেখে।দেখল ত্রিশোর্ধ সুদর্শন যুবকটি ধীর পায়ে হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।তার মুখে একটা সিগা’রেট,যেটা থেকে এতটু পর পর সে ধোঁয়া ছাড়ছে।তার চোখ মুখ অতিশয় শান্ত।
ইফাজ তাকে দেখতেই বিনয়ী স্বরে বলল,’আসসালামু আলাইকুম ভাই।’
আরহাম জবাবে মাথা নাড়ল।ঝলমলে হেসে উত্তর দিলো,’ওয়ালাইকুমুস সালাম ইফাজ।’
সে চেয়ার টেনে তার ঠিক মুখোমুখি বসল।ইফাজকে জহুরি চোখে একনজর দেখতেই প্রশ্ন করল,’কেমন লাগে ইফাজ বার বার রিজেকশন সহ্য করতে?হু?’
হকচকিয়ে ওঠে ইফাজ।আশ্চর্য হয়ে সামনে দেখে বলে,’জ্বী ভাইয়া?’
আরহাম আবারো বরফ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,’বার বার একটি মেয়ে প্রত্যা’খ্যান করা স্বত্তেও বে’হায়ার মতো তার পেছন পেছন ঘুরতে কেমন লাগে?’
ইফাজ প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কতোক্ষণ সামনে দেখে।প্রশ্নটা ঠিকঠাক বুঝতেই সে মাথা নামিয়ে নেয়।স্বচ্ছ গলায় উত্তর দেয়,’মেয়েটা যদি নবনীতা হয় তাহলে ভালোই লাগে।’
আরহাম পুনরায় সি’গারেটে একটা টান দেয়।থমথমে গলায় বলে,’নবনীতার আশেপাশে যেন কোনোদিনও তোকে না দেখি।বুঝেছিস?সে তোকে পছন্দ করে না।’
তার কন্ঠে কিছু তো ছিল।ইফাজ স্তব্ধ হয়ে কয়েক পল তাকে দেখে।যেই প্রশ্নটা তা মনে খচখচ করছিল,সেটা সে আর মুখ ফুটে বলে না।সবটা হজম করে নিয়ে সে শুধু চাপা কন্ঠে বলে,’সম্ভব না ভাই।আমি তাকে ভালোবাসি।সে যতোই টালবাহানা করুক,দিনশেষে তার একটা ঠাই প্রয়োজন।আমি সেই ঠাই হতে চাই।’
এই সোজাসাপটা জবাবে সামনে থাকা যুবকের দুই চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে।সে টের পায় তার শিরা উপশিরায় ছুটে যাওয়া র*ক্ত কোনো কারণ ছাড়াই ফু’টছে।নিজের এই পরিবর্তনে তার চেয়ে বি’রক্ত আর কেউ নেই।কেন তার সাথে এমন হচ্ছে?ইফাজ যদি তাকে ভালোও বাসে ,তবে তার কি?ইনফেচুয়েশন বলে সে যেটাকে আখ্যা দিয়েছে,সেটা কেন ইনফেচুয়েশন থেকেও বেশি কিছু হয়ে যাচ্ছে?
সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’তোর ঠাই হতে হবে না।তোর কাছে কেউ ঠায় চায়নি।সাবধান করে দিচ্ছি তোকে।আর যেন তার আশেপাশে তোকে না দেখি।’
আরহাম থামল।একবার বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে ইফাজের একটা হাত চেপে ধরল।ইফাজ ফ্যালফ্যাল চোখে শুধু সবটা দেখে গেল।আরহাম তার হাত চেপে ধরেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এরপর যদি এই হাত দিয়ে রাস্তাঘাটে বা অন্য কোথাও তাকে ছুঁয়েছিস,তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।’
আরহাম তার হাত ছাড়ল।চেয়ারে হেলান দিয়ে নিরেট স্বরে বলল,’আমার সামনে নির্বাচন।আজাইরা সময় নাই হাতে।এজন্য আর কোনো বাড়াবাড়ি তে গেলাম না।তোকেও ভালো বাড়ির ছেলেই মনে হচ্ছে।পরের বার থেকে রাস্তাঘাটে এসব বে’য়াদবি করবি না ঠিক আছে?নয়তো কিন্তু হাতগুলো আর হাতের জায়গায় থাকবে না।’
ইফাজ নির্লিপ্ত হয়ে জবাব দেয়,’ভাই নবনী ব্যতীত কোনো মেয়ের সাথেই আমি এমন আচরণ করিনি।আপনি চাইলে খোঁজ নিতে পারেন।’
ইফাজ থমকায়।কয়েক মুহূর্ত শুধু নিশ্চুপ হয়ে সামনে দেখে।শেষটায় ভারি গলায় বলে,’বউ লাগে না,তবে আমার বিশ্বাস সে একদিন আমার বউ হবে।’
আরহাম তার জবাব পেতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তার মেজাজ চূড়ান্ত রকমের বি’ক্ষিপ্ত।হঠকারিতা আর ভুলভাল করাটা যার স্বভাব,তার কাছে বুদ্ধিমানের মতো কাজ আশা করা বোকামি।মাথা গরম করে নিজের খেয়ালখুশি মতো আচরণ করতে অভ্যস্ত আরহাম আজও সেই একই কাজ করল।সে ওঠে গিয়ে একহাত ইফাজের গলায় রেখে তার মা’থাটা পেছনের দেয়ালের সাথে চে’পে ধরল।
ধড়ফড়িয়ে ওঠল ইফাজ।সে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি এমন কিছু হবে।আরহাম ঝুকল।দাঁতে দাঁত পি’ষে বলল,’থা’প্পড় চিনস?বউ বউ করছিস কেন?বিয়ে হয়েছে তোদের?আরেকবার বউ বউ করলে এদিকেই পু*তে দেব শা’লা।’
ইফাজ বাকরুদ্ধ হয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখল।তার মুখে বুলি ফুটতেই সে থেমে থেমে বলল,’আপনি রে’গে যাচ্ছেন কেন?’
আরহামের রাগ কমল না।উল্টো সে আগের চেয়েও ক্ষে’পাটে সুরে বলল,’রা’গবো না তো কি করব?তুই বি’য়ে করবি মানে?শোন ইফাজ না টিফাজ,আই ডোন্ট কেয়ার।তুই দুনিয়ার সব মেয়ের দিকে তাকা,সব মেয়েকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখ।কিন্তু পরীর দিকে তাকাবি না।কথা ক্লিয়ার?’
‘ঐ শা’লা।তুই আবার আমার দেখাদেখি পরী পরী শুরু করেছিস কেন?এক চ’ড় দেব তোকে বে’য়াদব।কোনো পরী টরী করবি না।বলবি নবনীতা ম্যাম।ঠিক আছে?বল তো কি বলবি?’ইফাজের গাল চেপে রা’গে গিরগির করে উঠল আরহাম।
ইফাজ নির্নিমেষ তাকে দেখে।এই পা’গলামো এই উ’ন্মাদনার সবটাই ইফাজ বোঝে।এই রো’গের সে পুরোনো রো’গী।তবে আরহামের সাথে তার অনেক চারিত্রিক পার্থক্য আছে।সে আরহামের মতো এমন পা’গলামো করে নি।করবেও না।সে নবনীতাকে চেনে।যেই নবনীতা তার মতোন ছেলেকেই গ্রাহ্য করে না,সেই নবনীতা এই আরহামকে সুযোগ দিবে?কক্ষনো না।নবনীতা এমন বে’পরোয়া,বদ’মেজাজি ছেলেদের কখনোই নিজের ধাঁর ঘেঁষতে দিবে না।
ইফাজ পেছন ফিরে।আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে নম্র সুরে বলে,’শনিবার আমায় ভোট দিবি বুঝেছিস?’
ইফাজ একটু চুপ থেকে তারপর বলল,’জ্বী।আপনাকেই দিব।’
বলেই সে আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,’দিব।ভালো করে ভোট দিব তোকে।ডেস্পারেট ছেলে একটা!’
***
নবনীতা কেবলই তার পড়ার বই টা কোলে নিয়ে খাটে বসেছিল।ঠিক তখনিই বাইরের কোলাহলে তার কপালে ভাঁজ পড়ে।এই সময় কে এসেছে?কিছু সময় বাদেই মিসেস রোকেয়া হন্তদন্ত পায়ে তার ঘরে এলেন।এক প্রকার চেঁ’চাতে চেঁ’চাতে বললেন,’নবনীতা! তুই এসব কি করেছিস?’
নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’আমি?আমি আবার কি করেছি?’
‘তুই নাকি ইফাজের নামে আরহামের কাছে না’লিশ করিস?আরহামের ছেলেরা আজ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছে।’
কথা শুনেই নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে।আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি বলছ মামি?ইফাজকে তুলে নিয়ে গেছে মানে?’
মিসেস রোকেয়া কিছু বলতে পারলেন না।তার আগেই তার বড় ভাইয়ের বউ সাবিনা ধপ ধপ পা ফেলে নবনীতার ঘরে এলেন।এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে বললেন,’তুমি জানো না এটার মানে?তুমি কিচ্ছু জানো না তাই না?আমার ছেলেটাকে কি পেয়েছ তুমি?যা’দু টোনা করেও ক্ষ্যান্ত হওনি।এখন বিচার দিচ্ছ তার নামে?’
নবনীতা শক্ত মুখে জবাব দেয়,’প্রথম কথা আমি কোনো বিচার দেইনি।দ্বিতীয় কথা আমি কোনো যা’দু টোনাও করিনি।বারবার এক কথা বলবেন না আন্টি।’
মিসেস রোকেয়া একটু পিছিয়ে গেলেন।তার মুখে সুক্ষ হাসির রেখা।সাবিনা কে তিনি দুই চোক্ষে সহ্য করতে পারেন না।সাবিনার ছেলে লক্ষী মন্ত মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে সুখে থাকবে।এটাও কি মিসেস রোকেয়া হতে দিবে?তিনি চায় ইফাজ যেন নবনীতা কে বিয়ে করে।নবনীতার মতোন চ্যাটাং চ্যাটাং মুখের উপর জবাব দেওয়া পুত্রবধূই যথেষ্ট ঐ সাবিনা চু’ন্নি কে শা’য়েস্তা করার জন্য।সাবিনা নিজেকে বাঘিনী ভাবে তাই না?রোকেয়া হলফ করে বলতে পারে,তার বাড়িতে যে বাঘিনী আছে,এর সামনে গেলে সাবিনা স্রেফ একটা মেনি বেড়াল বৈ আর কিছু না।
মিসেস রোকেয়া ঠোঁট টিপে হাসেন।বেচারি সাবিনা নিজেই নিজের পরবর্তী অবস্থার জন্য দায়ী হবে।
মিসেস সাবিনা ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,’তুমি দয়া করে এসব নাটক করবে না।ইফাজকে তুমি তোমার রূপের জালে ফাঁসিয়েছ।আমার ছেলে কখনো কোনো মেয়ের পেছনে এভাবে বে’হায়ার মতো ঘুরেনি।তুমি তার মাথায় কি বীজ ঢুকিয়েছ কে জানে।তোমার কি সব ছেলেদেরই ঝুলিয়ে রাখার স্বভাব?ঐ নেতার সাথে তোমার এতো যোগাযোগ কিসের?কি লাগে সে তোমার?’
নবনীতা হাতের বইটা বন্ধ করে শব্দ করে সেটা খাটে রাখল।চিত্রা ফ্লোরে বসে ড্রয়িং করছিল।নবনীতা বই রাখতেই সে মুখ টিপে মুচকি হাসে।পরী আপাই এখন ঐ সাবিনার বাচ্চাকে তেল ছাড়া ভুনা করবে।শুভ্রা নিজেও পড়ার টেবিলে বসে সেদিকে চোখ দেয়।মনে মনে বলে,’বেচারি সাবিনা।নিজেই নিজের বেইজ্জতি করতে এসেছে।’
নবনীতা উঠে গিয়ে ঠিক মিসেস সাবিনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।তার প্রগাঢ় এবং তীক্ষ্ণ চাহনিতে সাবিনা কিছুটা দমে গেলেন।আমতা আমতা করে বললেন,’কি হয়েছে?এভাবে কি দেখ?’
নবনীতা বুকে হাত বাঁধে।অতিশয় শীতল কন্ঠে বলে,’ইফাজকে বহুবার প্রত্যাখ্যান করেছি।এর কারণটা নিশ্চয়ই জানেন।দোষটা ইফাজ না,দোষটা তার মা।ইফাজের সাথে যদিও বা আমি সংসার করতে পারি,কিন্তু তার মায়ের মতো মহিলার সাথে এক ছাদের নিচে থাকা আমি অসম্ভবই মনে করি।’
এক জবাবেই মিসেস সাবিনার থোতা মুখ ভোতা হয়ে গেল।তিনি কেবল গোল গোল চোখে তার সামনে দাঁড়ানো আ’গুনের স্ফু’লিঙ্গটি কে দেখেন।কি ধাঁরালো আর শানিত তার বচন! নবনীতা একটু জিরোয়।তারপর আবার বলতে শুরু করে,’আপনার মাথায় বুদ্ধি কম আন্টি।আপনি একবার বলছেন আমি ইফাজকে ফাঁসিয়েছি,আবার বলছেন আমি তার নামে না’লিশ করেছি।দু’টো কথার কোথাও কোনো যোগসাজশ নেই।যদি তাকে ফাঁসানোই আমার উদ্দেশ্য হয়,তাহলে তার নামে নালিশ করব কেন?মানুষ নিশ্চয়ই তার নামে অভি’যোগ দায়ের করে না যার উপর সে যা’দুটোনা করে?পরের বার আমার উপর অভিযোগের আঙুল তোলার আগে একটু গুছিয়ে যুক্তি তৈরি করে আনবেন।আর আপনার ছেলেকে আমি কোনোদিনই বিয়ে করব না।এটা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিবেন।আর শেষ কথা,ঐ নেতার সাথে আমার কিছু নেই।সে কেন এমন করেছে আমি জানি না।করে থাকলে সেটা ঠিক হয়নি।তাই বলে সবকিছুতে আমার নাম এনে জড়াবেন না।পারলে আপনি নিজের ছেলের উপর যা’দুটো’না করে তাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করুন।এতে আমি ভীষণ খুশি হবো।’
নবনীতা কথা শেষ করল।মিসেস সাবিনা পাথরের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন।অপমানে তার চোখ ছলছল করে উঠেছে।ভেতরে ক্রো’ধের আ’গুন,অথচ মুখে কোনো কথা নেই।এই ত্যাদড় মেয়ের সাথে তিনি কথায় পারবেন?
নবনীতা পুনরায় খাটে গিয়ে বসল।খাটে থাকা বইটা খুলে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল,’যখন তখন মানুষের বাড়ি এসে আন্দাজের ওপর যা তা বলে চেঁ’চাবেন না আন্টি।এটা আপনার বাড়ি না,আমরা আপনার খাই না।এবার আপনি যেতে পারেন।ধন্যবাদ।’
নবনীতা বইয়ের পাতায় মন দেয়।খুবই শান্ত দেখাচ্ছে তাকে।যেন কিছুই হয়নি।মিসেস রোকেয়া ঠোঁট টি’পে হাসেন।আজ তিনি মাংসের সবচেয়ে বড় টুক’রো টা নবনীতাকে দিবেন বলে ঠিক করেছেন।সাবিনার যেই না’জেহাল দশা করেছে সে,এর বিনিময়ে এই টুকু পুরষ্কার তিনি তাকে দিতেই পারেন।
সাবিনা রা’গে ফুঁসতে ফুঁসতে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।মিসেস রোকেয়া সেদিকে দেখেই কুটিল হাসেন।বিড়বিড় করে বলেন,’বেশ হয়েছে।খুব খুশি হয়েছি আমি।শাক’চু’ন্নি কোথাকার!’
.
.
.
.
পরেরদিন আরহাম প্রায় বেলা দু’টো পর্যন্ত প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল।শুরুতে এই ছুটোছুটি তার অ’সহ্য লাগতো,এখনও লাগে,তবে এখন এসব সা সওয়া হয়ে গেছে।সে মহানগর অফিসে ফিরে তার রুমের চেয়ারে বসেই হাঁসফাঁস করতে করতে বলল,’এসি অন কর তোফায়েল।ম’রে যাচ্ছি গরমে।’
তোফায়েল এসি অন করে।ওয়াজিদ ক্লান্ত পায়ে রুমে এসেই কাউচের উপর গা ছেড়ে দিলো।পাশে থাকা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেল।আরহাম মা’র্লবো’রো এর প্যাকেট থেকে সি’গারেট বের করতে করতে ওয়াজিদ কে দেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’খাবি?’
ওয়াজিদ হাত নাড়ল।কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,’না,তুই খা।আমি পরে খাবো।’
আরহাম কেবলই সিগারেটে লাইটার দিয়ে আ’গুন ধরিয়েছিল,তক্ষুনি কোথা থেকে তামজিদ ছুটে এসে বলল,’ভাই রাস্তায় লেডি ডন কে দেখলাম।মনে হলো আপনার অফিসেই আসছে।’
আরহাম কপাল কুঁচকায়।বলে,’লেডি ডন কে?’
তামজিদ কিছু বলার আগেই তোফায়েল জানালা দিয়ে বাইরে দেখে আঁতকে উঠে বলল,’কেলো হয়েছে বস।দাবাং নবনীতা তো একদম অফিসের সামনে এসে গেছে।একেবারে গ্যাংস্টারের মতো হেঁটে হেঁটে আসছে।’
তার কথা শুনেই ওয়াজিদ সব ক্লান্তি ফেলে ছুটে গেল থাই গ্লাস টেনে বন্ধ করে রাখা জানালার দিকে।নিচে দেখতেই আশ্চর্য হয়ে বলল,’সত্যিই তো।নবনীতাই তো এটা।’
আরহাম সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের সিগারেটা ফ্লোরে ফেলে পা দিয়ে পি’ষে ফেলল।তারপর সেটাকে একটা লা’থি দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,’দূরে যা বা’লসা’ল।’
তারপর সি’গারেটের প্যাকেট টা ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ার থেকে একটা সেন্টার ফ্রেশ বের করল।সে টের পেল সে আচমকা দরদর করে ঘামছে।অদ্ভুত বিষয়! সে ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন?’
মিনিট খানেক বাদে তার দরজায় টোকা পড়ল।আওয়াজের ধরন দেখেই আরহাম বুঝল এটা নবনীতা।সে বাদে এমন ধাম ধাম করে দরজা ধাক্কানোর সাহস আর কার আছে?
আরহাম গলা খাঁড়া করে বলল,’কাম ইন।দরজা খোলাই আছে।’
নবনীতা শব্দ করে দরজা খুলে।কোনোদিক না দেখে সোজা এগিয়ে যায় আরহামের টেবিলের দিকে।সেই প্রথমদিনের মতো টেবিলের ধাঁর ঘেঁষে দাঁড়ায়।গলা উঁচিয়ে জানতে চায়,’এসব কি?আবার কি নতুন নাটক শুরু করেছেন আপনি?’
‘আমি আবার কি করলাম?আমি তো জনসেবায় ব্যস্ত।নাটক করার সময় কোথায়?’ চমকে উঠে প্রশ্ন করে আরহাম।
নবনীতা চোয়াল শক্ত করে বলে,’আপনি কেন ইফাজ কে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছেন?কারণ কি এটার?’
আরহাম ভাবলেশহীন ভাবে বলল,’ওমা সেকি! সে রাস্তাঘাটে তোমায় উত্ত্য’ক্ত করেছে।এটা তো একটা শা’স্তি যোগ্য অপ’রাধ।তাই না?’
‘সে আমায় উত্ত্য’ক্ত করলে আপনার কি?আমি আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছি?’
‘চাও নি?তুমিই তো সেদিন বললে ছেলেরা যেন মেয়েদের রাস্তাঘাটে বিরক্ত না করে,আমি যেন সে ব্যবস্থা করি।এখন তুমিই আবার কথা ঘুরাচ্ছ?’ আরহাম বেশ অবাক হয়ে জানতে চায়।
নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’আমি আপনার দলের লোকদের সিটি কলেজের সামনে মেয়েদের উত্ত্য’ক্ত করতে মানা করতে বলেছিলাম।আপনি সেটা করেছেন?উল্টো আমাকে কে কি করল সেটা নিয়ে পড়ে আছেন!’
আরহাম গালের নিচে হাত রেখে অবাক হওয়ার ভান করে বলল,’তো তুমি মেয়ে না?তোমাকে রক্ষা করা আমার একটা নৈতিক দায়িত্ব না?’
‘আমি মেয়ে,কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারি।’ কটমট করে জবাব দেয় নবনীতা।
আরহাম হাসল।তিরষ্কার করে বলল,’বাপরে! রোমান রেইন্স নাকি তুমি?নাকি আন্ডারটেকার?হেহ?যাও তো।আমার সাথে পায়ে পায়ে ঝগড়া করো না তো সবকিছুতে।’
নবনীতা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’আমি আপনার সাথে লাগতে চাই না।কিন্তু আপনি কাজই করেন এমন।’
সে থামে।মুহুর্তেই আবার চোখ সরু করে বলে,’আরেকটা কথা।আপনি নাকি ইফাজকে বলেছেন আমি বাদে সব মেয়েদের দিকে দেখতে।এটা কি সত্যি?’
‘সে বলেছে না কে বলেছে আপনার জেনে কাজ নেই।আপনি বলেছেন নাকি বলেন।’
আরহাম মাথা নাড়ে।মুখ দিয়ে শব্দ করে বলে,’নাহ।আমি এমন কিছু বলিনি।সে মিথ্যা বলেছে তোমাকে।’
কথা শেষ করেই সে নবনীতাকে দেখে।একটা ঢোক গিলে বলে,’এভাবে দেখার কিছু নেই।আমি ইফাজ টিফাজকে এমন কিছু বলি নাই।আমি কেবল জনস্বার্থে নারীদের সম্মান রক্ষার্থে তাকে সচেতন করেছি।তোমার উচিত খুশি হয়ে আমার প্রশংসা করা।সেই তুমি আবার আমাকেই দোষ দিচ্ছ।’