লুবনা পণ করেছে সে নবনীতাকে দুই দন্ডও শান্তি দিবে না।তাকে পড়াতে শুরু করার পর থেকে আজ পর্যন্ত নবনীতা কোনোদিন তার কাছ থেকে হোমওয়ার্ক পায়নি ঠিকঠাক।লুবনার তিনটে হাত।ডান হাত,বাম হাত আর সে সবচেয়ে বেশি যেটা ব্যবহার করে তা হলো অযুহাত।লুবনার কাছে অযুহাতের শেষ নেই।
আজকের দিনে তার অযুহাতটা কিছুটা অদ্ভুত।লুবনা জানাল সে আজ বাড়ির কাজ করতে পারেনি কারণ তাদের পাশের বাড়ির বিড়ালটা কাল কোথাও হারিয়ে গিয়েছিল।
নবনীতা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,’কি?পাশের বাড়ির বেড়াল হারিয়ে যাওয়ার সাথে তোমার বাড়ির কাজ না করার কি সম্পর্ক?’
‘সম্পর্ক আছে মিস।স্বর্ণাদের বাড়ির বেড়ালটা প্রায়ই আমাদের বাড়ি আসতো।খুবই মিষ্টি একটা বিড়াল।সে হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই স্বর্ণার মন খুব খারাপ।আমি তাকে স্বান্তনা দিতে তার বাড়ি গিয়েছিলাম।যেহেতু আমি বাড়িতেই ছিলাম না,সেহেতু আমার আর বাড়ির কাজও করা হয়নি আপু।’ দু’হাত নেড়ে নেড়ে উত্তর দিল লুবনা।
নবনীতা চোখ গরম করে আপাদমস্তক লুবনাকে দেখল।তার মুখ থমথমে।দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেছে শক্ত করে।চোখের পাতা ফরফর করে লাফাচ্ছে।অনেকক্ষণ চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়ে নবনীতা শেষমেশ ফিক করে হেসে দিলো।হাত বাড়িয়ে লুবনার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,’খুবই নিম্নমানের অযুহাত লুবনা।জোর করেও বিশ্বাস করা যায় না।’
লুবনা কে পড়ানো শেষ করে নবনী কুরিয়ার অফিসে গিয়ে তার যাবতীয় কাজগুলো সেরে নিল।মাগরিবের সামান্য কিছু সময় আগে সব ঝামেলা মিটিয়ে সে বাড়ির পথ ধরল।মালিবাগ আসতেই সাদা রঙের একটি গাড়ি ঠিক তার মুখোমুখি এসে থামল।নবনীতা খুব দ্রুত হাঁটছিল।হঠাৎ সামনে একটা গাড়ি এসে থামায় সে খানিকটা চমকে গিয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল।
গাড়ির দরজা খুলে যেই লোকটি বেরিয়ে এলো তাকে নবনী চেনে।তার নাম ফাহাদ।শুভ্রাকে যখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তখন নবনী তার কাছে গিয়েছিল।ভদ্রলোক সেদিন তাকে কোনোভাবেই সাহায্য করেনি।
নবনীতাকে দেখতেই ফাহাদ দাঁত বের করে হাসল।এমনভাবে হাসল যেন নবনীতা তার খুব পরিচিত কেউ।নবনীতা কাটখোট্টা স্বরে প্রশ্ন করল,’কি হয়েছে?কি চাই?’
তৎক্ষনাৎ ফাহাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।সেদিন কতো অনুনয় বিনয় করে কথা বলছিল।আজ একদম রুক্ষভাষায় কথা বলছে।ফাহাদ সেসব পাত্তা দিল না।উল্টো আন্তরিক হেসে বলল,’আমি আসলে সেদিন আপনাকে চিনতে পারি নি।আপনি আমায় ভুল বুঝবেন না মিস।’
অত্যন্ত অমায়িক আচরণ।অথচ ফাহাদের সামনে দাঁড়ানো মেয়েটি এতেও নরম হলো না।খ্যাট খ্যাটে স্বরে বলল,’আমায় চিনবেন মানে?আমি কে?আমাকে চেনার কি আছে?পথ ছাড়ুন আমার দেরি হচ্ছে।’
কথা শেষ করেই সে বিরক্ত মুখে তাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল।ফাহাদ তার পিছু পিছু ছুটে দুই হাত ছড়িয়ে তার পথরোধ করে দাঁড়াল।তার আচরণে নবনীতার রক্ত টগবগ করে ফুটছিল।মনে চাইছিল এই মুহুর্তে একটা কষিয়ে চড় দিতে ফাহাদের গালে।কিন্তু সেটা করা সম্ভব না।ফাহাদ নেতা শ্রেণির মানুষ।এদের সাথে কথা বাড়ানোই বোকামি।
নবনীতার নির্লিপ্ততা দেখে ফাহাদ নিজেই বলা শুরু করল,’আসলে আপনি খুবই সাহসী একটা মেয়ে।ঐ লাফাঙ্গা,বেয়াদব আর উচ্ছৃঙ্খল আরহামের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার জন্য যেই সাহস প্রয়োজন সেটা আপনার আছে।আমি তো আপনার সেই ভিডিও ক্লিপটা দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম।সত্যিই,আপনার সাহসের কোনো তুলনা নেই।’
নবনীতা কপাল কুঁচকে দাঁড়িয়ে রইল যতক্ষণ না তার কথা শেষ হলো।ফাহাদ কথা শেষ করতেই সে ছোট্ট করে জবাব দিল,’জ্বী ধন্যবাদ।’
সে কোনোরকমে জবাব দিয়েই আবার দু’কদম এগিয়ে গেল।ফাহাদ ছুটে এসে তার পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বলল,’সেদিন আপনি আমার কাছে এসেছিলেন সাহায্যের জন্য।দুঃখীত,আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি নি।পরে অবশ্য আপনি আপনার বোনকে খুঁজে পেয়েছিলেন।কিন্তু আমি শুনেছি এসবের পেছনে নাকি শাহরিয়ার আরহামের হাত আছে?’
সহসা পা জোড়া থেমে গেল নবনীতার।ফাহাদ থেকে নিজের দূরত্ব আরো কিছুটা বাড়িয়ে সে শীতল কন্ঠে বলল,’দুঃখীত! আমি সে বিষয়ে কিছু জানি না।’
বলেই সে পুনরায় হাঁটা ধরল,আগের চেয়েও দ্রুত।
ফাহাদ হাল ছাড়ল না।নবনীতার সাথে পা মেলাতে মেলাতে সে খানিকটা আশ্বাস দিয়ে বলল,’আপনি কিছুতেই ভয় পাবেন না নবনীতা।আমি কথা দিচ্ছি।আপনি সম্পূর্ণ সেইফ থাকবেন।কিন্তু আমি আশা করি আপনি অন্যায় মেনে নিবেন না।যদি সত্যিই আরহাম ওমন কিছু করে থাকে,আপনাকে জিম্মি করে কোনো বিবৃতি নিয়ে থাকে তাহলে সেটাও খুলে বলুন।ঐ কপট আর ভুয়া ছেলেটার আসল চেহারা উন্মোচন করে দিন নবনীতা।’
ফাহাদ আরো কিছু বলতে চাইছিল।কিন্তু তার আগেই নবনীতা তাকে থামিয়ে দিলো।কিছুটা বিরক্ত,কিছুটা অস্থির আর কিছুটা চঞ্চল হয়ে সে উত্তর দিলো,’শুনুন জনাব।আমি খুবই সাধারণ একটি মেয়ে,সাধারণ পরিবার থেকেই উঠে এসেছি।এসব রাজনীতির বিষয় আমি বুঝি না।দয়া করে এসবের সাথে আমাকে জড়াবেন না।জনাব আরহামের সাথে আমার কোনো ব্যক্তিগত শত্রুতা নেই।আমি সেদিন যা বলেছি,বিবেকবোধ থেকে বলেছি।আপনি আমাকে এসবে জড়াবেন না প্লিজ।আমি এসবের কিছুই বুঝি না।নির্বাচনে যেই জয়ী হোক,সেটা আমার মাথাব্যথা না।আমি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ।আমি কারো ব্যপারেই কিছু বলতে পারব না।আমি এসব প্রেস-মিডিয়ার ঝামেলায় আসতে চাই না।প্লিজ,,এসব বিষয়ে আর কখনো আমাকে ডাকবেন না।ভালো থাকবেন।চললাম আমি।’
ফাহাদ নিরুত্তর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল সবুজ চুড়িদার পরিহিত মেয়েটি একটু একটু করে সামনে এগিয়ে একসময় হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।তার আর কোনো অস্তিত্ব পর্যন্ত পাওয়া গেল না।ফাহাদের ঠোঁটে ক্ষণিকের জন্য সূক্ষ্ম হাসির রেখা ফুটে উঠল।মেয়েটার স্পষ্টভাষী,স্ট্রেইট ফরওয়ার্ড।কথা বলার সময় তার মধ্যে জড়তা কিংবা ভয় কিছুই কাজ করে না।ফাহাদ মাথা ঝাকালো।বাঁকা হেসে বলল,’ইম্প্রেসিভ।ভেরি ভেরি ইম্প্রেসিভ।’
.
.
.
.
বাড়ি ফিরতেই মিসেস রোকেয়া নবনীতার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।তার চোখ মুখ শক্ত।যেন নবনীতার উপর তার কোনো কিছু নিয়ে ভীষণ রাগ।
‘এসব কি হচ্ছে পরী?’ কর্কশ গলায় প্রশ্ন করলেন রোকেয়া।
নবনীতা স্থির হয়ে জানতে চাইল,’কিসের কথা বলছ মামি?’
‘তুমি জানো না?ইফাজ যে তোমার সাথে আজ দেখা করতে চেয়েছিল,তুমি সেটা জানো না?’
জুতো জোড়া পা থেকে খুলে সেটাকে একপাশে রেখে নবনীতা ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসল।জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে সেটা মুখে দেওয়ার আগেই রোকেয়া শক্ত করে তার হাত চেপে ধরলেন।ধমক দিয়ে বললেন,’কথা কানে যায় না?বেশি লায়েক হয়েছো তুমি?’
নবনীতা থামল।ভেতরের সকল গ্লানি,সকল চাপা আর্তনাদ কেবল দু’টো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে প্রকাশ করল।তারপর সরাসরি মিসেস রোকেয়ার চোখে চোখ রেখে বলল,’ইফাজ দেখা করতে চেয়েছিল,আমি চাইনি।’
‘কেন চাওনি?সমস্যা কি তোমার?’
রোকেয়ার বচনভঙ্গি এতোটাই রুঢ় ছিল যে কিছু সময়ের জন্য নবনীতার দম বন্ধ হয়ে আসল।কন্ঠনালির কাছে অনুভূতি গুলো সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল।তবুও সে দমে গেল না।বরং অত্যন্ত শীতল কন্ঠে জবাব দিল,’আমি এই মুহূর্তেই বিয়ে করতে চাই না মামি।আমি এখন সেসবের জন্য প্রস্তুত না।’
‘কেনো?তুমি কি এখনো কচি খুকি?বিয়ে করতে সমস্যা কি তোমার?ইফাজের মতো একটা ছেলে তোমায় বিয়ে করতে চাইছে।এটা কি তোমার জন্য সৌভাগ্যের বিষয় না?তোমার কি মনে হয় এমন সম্বন্ধ তুমি অহরহ পাবে?’
নবনীতা ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে শেষ করল।একহাত কপালে রেখে নিরুদ্বেগ হয়ে বলল,’আমি আমার বিয়ে নিয়ে চিন্তিত নই মামি।শুভি আর চিত্র এখনো অনেক ছোট।তাদেরকে ফেলে আমি বিয়ে করতে পারব না।এই কথা আমি আর কয়বার বলব তোমাকে?’
মিসেস রোকেয়া তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন।চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,’তুমি চিন্তিত হবে কেমন করে?তুমি তো সারাদিন বাইরে ঢ্যাং ঢ্যাং করো।কথা তো সব আমাকে শুনতে হয়।বয়স হয়েছে বিয়ে করবে না এটা কেমন কথা?’
নবনীতা টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।দৃঢ় কিন্তু স্পষ্ট কন্ঠে বলল,’আমি কথা বাড়াতে চাই না মামি।শুধু বলে রাখি,এই মুহূর্তে আমার পক্ষে বিয়ে করা অসম্ভব।আমি আমার দুই বোনকে অথৈ সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে বিয়ের পিরিতে বসতে পারব না।আমি এতোটা বেঈমান হতে পারব না।প্লিজ মামি।একটু শান্তি দাও।আমি ইফাজকে,এমনকি পৃথিবীর কোনো ছেলেকেই বিয়ে করতে পারব না।তুমি তাকে জানিয়ে দাও দয়া করে।আর পরবর্তীতে কাউকে আমার অনুমতি না নিয়ে আমার নম্বর দিবে না।এটা আমার ভালো লাগে না।’
নবনী হনহন করে তার ঘরে চলে গেল।মিসেস রোকেয়ার উত্তর শোনার কোনো প্রয়োজনীয়তা সে অনুভব করছে না।ঘরে গিয়েই সে হাত পা ছড়িয়ে কতোক্ষণ খাটের উপর পড়ে রইল।মাথার উপর ঘটঘট শব্দ করে ফ্যান ঘুরছে।কি বিদঘুটে শব্দ! কান ধরে যায়।
শুভ্রা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।নবনীতা মাথার নিচে হাত রেখে একমনে কতোক্ষণ তাকে দেখল।শুভ্রানী যখন পড়ে তখন নবনীতার মন ভালো হয়ে যায়।শুভ্রানীর ইচ্ছে সে ডাক্তার হবে।নবনীতার স্বপ্ন সে বোনকে ডাক্তার বানাবে।নবনীতা আধ শোয়া অবস্থায় ভাবল,আচ্ছা শুভি যখন স্টেথোস্কোপ গলায় জড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়াবে,তখন তার কেমন লাগবে?সেদিন সম্ভবত নবনীতা অধিক সুখে পাগল হয়ে যাবে।তারপর একদিন কোনো একটা রাজপুত্র ঘোড়ার পিঠে চড়ে এসে শুভিকে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।শুভির একটা সংসার হবে।নবনীতা ছলছল চোখে শুভির ছোট্ট সংসারটা দেখবে।নবনীতার মন বলে শুভি খুব ভালো বউ হবে,আর চিত্র হবে দুষ্টু বউ।নিজের চিন্তায় নবনীর নিজেরই হাসি পেল।কতোদূর ভেবে ফেলেছে সে!
আচমকা বুকের ব্যাথায় তার এই চিন্তায় ভাটা পড়ল।নবনীতা দাঁত খিঁচে খাটের একপাশে পড়ে রইল,সাদা রঙের বেডশিট টা খাঁমচে ধরল শক্ত করে।ব্যথায়,যন্ত্রনায় তার চোখে আপনাআপনি পানি চলে এসেছে।সেই টলমল চোখে নবনী সম্পূর্ণ অন্যরকম দৃশ্য দেখল।সে দেখল শুভির সংসার হচ্ছে,চিত্র ঘর করছে।অথচ সেই গল্পের কোথাও নবনীতা নেই।চিত্র দেশ বিদেশ ছুটে বেড়াচ্ছে,অথচ তার মস্তিষ্কের কোথাও পরী আপাইয়ের অস্তিত্ব নেই।জীবন এগিয়ে যাবে জীবনের মতো।সেই জীবনে পরী আপাইয়ের কোনো চিহ্ন থাকবে না।
নবনীতা শক্ত করে তার মুখ চেপে ধরল।তার চোখের পানিতে বালিশ ভিজে যাচ্ছে।একটু দূরেই চিত্র খেলছে,ছুটোছুটি করছে।নবনীতার ইচ্ছে করছে এক দৌঁড়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে।কিন্তু নবনীতা সেসব কিছুই করল না।সে চুপচাপ খাটের একদিকে শুয়ে রইল।তার অভিমান হচ্ছে শুভ্রা আর চিত্রার উপর,সেটাও সম্পূর্ণ কাল্পনিক কারণে।কিন্তু অভিমান তো মিথ্যে না।নবনীতা ঘন্টার পর ঘন্টা পড়ে পড়ে শুধু কেঁদেই গেল।সে জানে না সে কেনো কাঁদছে,সে জানে না তার কি হয়েছে।সে শুধু জানে সে প্রতিদিন একটু একটু করে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে।এই মস্ত বড় পৃথিবীতে একটা মানুষও কি নেই যে কি-না নবনীতার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে?ভরসা দিয়ে বলবে,’কোনো ভয় নেই পরী,আমি আছি।আমি থাকতে তোমার কিসের ভয়?’
নবনীতা চোখ মুছে নিল।পৃথিবীতে সবাই সব পায় না।পৃথিবী সবার জন্য একরকম হয় না।লুবনার জন্য পৃথিবী একরকম,রিমির জন্য একরকম,নবনীতার জন্য আবার আরেক রকম।
পৃথিবী সবার ক্ষেত্রে দাঁড়িপাল্লার মতো সমান সমান হয় না।তবে নবনীতার জন্য পৃথিবীর পরিকল্পনা ছিল বিশাল।নবনীতার গল্প শেষ হয়নি,কেবল মাত্র শুরু হয়েছে।
রাজনীতির বিষয় গুলো বেশ জটিল।বাইরে থেকে যতখানি বোঝা যায়,ভেতরে ভেতরে ঘটে যায় তার ঠিক উল্টো।অনানুষ্ঠানিক ভাবে আরহাম মনোনয়ন প্রায় পেয়েই গিয়েছিল।কিন্তু নবনীতা নামের একটি মেয়ের দু’মিনিটের একটা ভিডিও ফুটেজ পাল্টে দিল পুরো চিত্র,সমস্ত মানচিত্র।
আরহাম সবদিক থেকে প্রস্তুত ছিল।সব রাস্তা ঝামেলামুক্ত করেই সে মাঠে নেমেছিল।নিজ দলের ভেতরেও তার অনেক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল।কিন্তু আরহাম সেসবের তোয়াক্কা করেনি।বাবার পলিটিক্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড,নিজের ক্ষমতা সবকিছুকে কাজে লাগিয়ে আরহাম তার সমস্ত প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাপিয়ে গিয়েছিল।
কোথাও তো কোনো খাদ ছিল না।তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার মতো কোনো জায়গা তো সে রাখেনি।সবাই মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে এইবার দল থেকে সেই মনোনয়ন পাবে এবং নির্বাচনে জয়ীও সেই হবে।কিন্তু কোথা থেকে একটা উটকো ঝামেলায় আরহামের সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিল।
যদিও সে ঘটনা কিছুটা সামাল দিয়ে দিয়েছিল,প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও তাকে আশ্বাস দিয়েছে মনোনয়ন টা নিশ্চিতভাবে সেই পাবে,কিন্তু আরহাম নিশ্চিত হতে পারছিল না।মনোনয়ন পাওয়ার ক্ষেত্রে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল ফাহাদ।ফাহাদ বহুদিন ধরে রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত।বয়স আর অভিজ্ঞতাও আরহামের চেয়ে ঢের বেশি।
ফাহাদ চাইছিল এইবার নির্বাচনে অংশ নিতে।কিন্তু উপরমহল থেকে তাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।তার নামে মাদক আর অর্থ পাচারের বেশ কিছু মামলা দায়ের করা হয়েছিল।প্রার্থী হিসেবে এই সূক্ষ্ম বিষয়গুলো পরবর্তীতে সমস্যা আর সমালোচনার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।এই সমস্যা গুলোকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে আরহাম খুব সহজেই ফাহাদ কে রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছিল।যত কিছুই হোক,পাবলিকের সামনে আরহামের ইমেজ ক্লিয়ার।সে তরুণ।সে যেই আসন থেকে লড়বে সেখানে বিপুল পরিমান তরুণ ভোটার।তাদের সাথে আরহামের সম্পর্ক ভালো।এছাড়া আরহামের বাবারও বেশ ভালো পরিচিতি আছে।সবদিক বিবেচনায় আরহাম যোগ্য,সবচেয়ে বেশি যোগ্য।
আরহাম প্রায় সবকিছু অর্জন করেই নিয়েছিল কিন্তু এই নবনীতার ঘটনার পর থেকে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আবার পুরোদমে তার বিরুদ্ধে চক্রান্ত শুরু করেছে।যারা এতোদিন টু শব্দটুকু করে নি,তারাও নালিশ করার সুযোগ পেয়ে গেল।প্রশ্ন ওঠল নির্বাচনের আগেই যে এমন ভাবে আলোচিত হয়েছে,তার হাতে মনোনয়ন পত্র কতোটা নিরাপদ।
সবচেয়ে বেশি তৎপর হলো ফাহাদ।এই মন্ত্রনালয় সেই মন্ত্রনালয় ঘুরে সে আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগল মনোনয়ন টা যেন তাকেই দেওয়া হয়।সে যা কিছু করেছে সেটা আরো অনেক আগের ঘটনা।জনগণ হয়তো এতোদিনে ভুলেও গেছে।কিন্তু আরহাম যেটা করেছে সেটা জনগণ কিছুতেই ভুলবে না।এই ঘটনার পর তার মতো অনভিজ্ঞ লোকের হাতে মনোনয়ন দেওয়া মানে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা।
আরহাম দুই হাত দিয়ে কতোক্ষণ নিজের চুল টানল।ডেস্কের উপর যা কিছু রাখা ছিল সব মাটিতে ছুড়ে ফেলল।সকাল থেকে এই নিয়ে সে শ’খানেক বার সামনে যা কিছু পাচ্ছে তাতেই কিল বসাচ্ছে।মাঝে মাঝে আবার রাগে,প্রচন্ড ক্রোধে হায়নার মতো চেঁচাচ্ছে।
ওয়াজিদ তখন থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।বেচারার নাকের ডগা লাল হয়ে আছে।ওয়াজেদ তাকে শুরুতে দুইবার বোঝানোর চেষ্টা করেছে।কিন্তু আজ সে কিছু বুঝবে বলে মনে হচ্ছে না।
আরহাম শেষ পর্যন্ত হাতের কাছে কিছুই না পেয়ে ইজিচেয়ারে একটা জোরালো লাথি বসাল।ফলস্বরূপ চেয়ারটা একহাত দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ল।তোফায়েল এক চোখ বন্ধ করে মুখ খিঁচে নিল।আরহামের থমথমে মুখ।তোফায়েল অনুমান করল ইজিচেয়ারের চেয়ে বেশি ব্যাথা আরহামের পা ই পেয়েছে।
আরহাম আবারো দু’হাতে মুঠ করে তার চুল টেনে ধরল।ফুসঁতে ফুসঁতে বলল,’ঐ ষ্টুপিড অসভ্য বেয়াদব মেয়েটাকে যেদিক থেকে পারিস ধরে নিয়ে আয়।আমার হাত নিশপিশ করছে।তার গলা চে/পে ধরলে শান্তি পাব।আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।ঐ অসভ্যটাকে ধরে নিয়ে আয়।’
রনি বিচলিত বোধ করল।ভাই কি সত্যি সত্যি বলছে নাকি কথার কথা বলছে?সে নিশ্চিত হওয়ার জন্য জানতে চাইল,’ভাই সত্যিই ধরে আনতে বলছেন?’
আরহাম ঘাড় বাঁকিয়ে থমথমে মুখে তার দিকে তাকাল।দু’টো শুকনো ঢোক গিলে মিইয়ে গেল রনি।আমতা আমতা করে বলল,’না মানে ইয়ে আরকি।’
‘কি মনে করে ঐ নবনীতা?সে একাই পুরো দেশের সিস্টেম পাল্টে দিবে?’ তিরিক্ষি মেজাজে জানতে চাইল আরহাম।
তোফায়েল কাঁপা গলায় শুধু বলল,’না না।তেমন কিছু না।ভাই আপনি একটু ঠান্ডা হন।’
‘ঠান্ডা মাই ফুট!’
আরহাম থামল।পরক্ষনেই আবার গজরাতে গজরাতে বলল,’অসভ্য আন কালচারড বদমাশ মেয়ে! সামনে পেলে তার মাথাটা চিবিয়ে খেতাম।একবার একে সামনে পাই।এর সাথে আমার হিসেব বাকি আছে।’
বাকিরা সবাই যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে তার অস্থিরতা দেখে গেল।তাকে কোনো প্রশ্নই ঠিক ঠাক মতো করা যাচ্ছে না।যেই প্রশ্ন করতে আসছে,তার উপরই চড়াও হচ্ছে।
আরহাম রাগে কষ্টে আর জেদে ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল,’আই উইল কিল নবনীতা।সে আমার সব সাজানো প্ল্যানে পানি ঢেলে দিয়েছে।ফালতু মেয়ে কোথাকার!’
.
.
.
.
শুভ্রানী কলেজ থেকে বেরিয়ে মূল সড়কে কেবলমাত্র পা রেখেছিল।এরই মাঝে কালো রঙের একটা মাইক্রো এসে তার সামনে থামল।ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে উঠে শুভ্রা দু’কদম পিছিয়ে গেল।
ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে গাড়ির দরজা খুলে গেল।সেখান থেকে একটি লোমশ পুরুষালি হাত বেরিয়ে এসে শুভ্রার বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।
চিৎকার করে উঠল শুভ্রা।এক ঝাটকায় হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইল,ছুটে পালাতে চাইলো সেখান থেকে।কিন্তু তার আগেই তার হাত চেপে ধরা ব্যক্তিটা তাকে হ্যাঁচকা টেনে গাড়িতে তুলে নিল।শুভ্রা ভয়ে,অজানা আতংকে গাড়ির ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে ওঠল।তার মুখ বন্ধ।সেই বিভৎস চিৎকার গাড়ির ভেতরই সীমাবদ্ধ থাকল।
****
শাহিন হতভম্ব।সে তার দুই গালে হাত চেপে আড়চোখে একবার আরহামের অভিব্যক্তি বোঝার চেষ্টা করল।আরহাম ভাই তাকে মেরেছে?কিন্তু সে মারার মতো কি করেছে?সে তো ভালো কাজই করেছে।
আরহাম দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’মূর্খ! গর্দভ! ব্রেইনলেস! কু/ত্তার বাচ্চা! তুই এটা কাকে তুলে এনেছিস? এটা নবনীতা? শালা গর্দভ! অশিক্ষিত!’
শাহিন দুইটা শুকনো ঢোক গিলল।আবার একটা ভুল করে ফেলেছে সে।আগ বাড়িয়ে নতুন আরেকটা বিপদ বাধিয়েছে শাহিন।সে ভাইকে খুশি করতে গিয়ে উল্টো ভাইকে আরো রাগিয়ে দিয়েছে।শাহিন হতাশ,ভীষণ হতাশ।
আরহাম কপাল চাপড়ে বলল,’হোয়াটস নাও?এখন কি?এখন এই মেয়ের আমি কি করব?’
তোফায়েল সামনে এসে শাহিনের মাথায় একটা গাট্টা মেরে কটমট করে বলল,’গাধা এটা কাকে এনেছিস তুই?নবনীতা কে আনলেও একটা কথা ছিল।তার বোনকে কেন এনেছিস?আর ভাই তো তখন রেগে ছিলেন।কথার কথা বলেছেন।এসব তোলা তুলি করতে কে বলেছে তোকে?দিলি তো কেসটা আরো বেশি ঘেটে।’
আরহাম রাগে গিজগিজ করতে করতে কতোক্ষণ এদিক সেদিক পায়চারি করল।তারা মাথা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।নমিনেশনের আগে যদি ভুলেও এই কথা জানাজানি হয়,তবে আরহামের পরিনতি ভাবলে সে নিজেই শিউরে ওঠে।
অবশেষে সব রাস্তা যখন ঘোলাটে হয়ে আসে তখন আরহাম ফোন করে জালালুর রহমানের নম্বরে।মহানগর কার্যালয়ের যুগ্ম সম্পাদক জালাল কল রিসিভ করতেই আরহাম ব্যস্ত হয়ে বলল,’আঙ্কেল একটা বিশাল ঝামেলা হয়ে গেছে।’
জালাল সাহেব উদ্বিগ্ন হয়ে শুধালেন,’সেকি! আবার কি হয়েছে?’
কিছুটা অস্থির,কিছুটা ব্যাকুল হয়ে আরহাম জানাল,’আমি কেবল রাগে,হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বলেছিলাম যে নবনীতাকে তুলে আমার কাছে নিয়ে আসতে।শাহিন গর্দভ সেটাকে সত্যি ভেবে আসলেই তুলে এনেছে,তাও আবার নবনীতা কে নয়,তার বোনকে।আমি এখন কি করব আঙ্কেল?ট্রাস্ট মি,আমি এসব কিছুই চাইনি।টেনশনে আমার মাথা হ্যাঙ হয়ে যাচ্ছে।’
আরহাম থামল,অন্যপাশ থেকে জবাবের আশায়।কিছু সময় নিরব থেকে জালাল সাহেব বললেন,’আরহাম! তুমি কিন্তু চাইলে এই ভুল টা থেকে চমৎকার একটা আউটকাম বের করে আনতে পারো।’
ভ্রু কুঁচকালো আরহাম।জানতে চাইলো,’মানে?একটু বুঝিয়ে বলুন প্লিজ।’
.
.
.
.
দুই আঙুলের সাহায্যে চেপে রাখা সিগারেট টা শেষবারের মতো টেনে ফাহাদ সেটাকে অ্যাশট্রে তে ছুড়ে ফেলল।পুরো ঘরে সিগারেটের ধোঁয়া ঘুরপাক খাচ্ছে।সেই ধোঁয়ার বিদঘুটে গন্ধে তার সামনে বসে থাকা মেয়েটির দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ফাহাদ পায়ের উপর পা তুলে পুনরায় জানতে চাইলো,’তা কি বলছিলেন আপনি?কি নাম আপনার?’
‘নবনীতা।নবনীতা নূর’,তরুনীর সোজাসুজি জবাব।
ফাহাদ মাথা নাড়ল।তার ঠিক বরাবর সামনে চেয়ারে বসে থাকা মেয়েটি গত পনেরো মিনিট যাবত একই কায়দায় বসে আছে।না নড়ছে,না একটু অন্য কোথাও দেখছে।মেয়েটির চুল বেশ লম্বা।বেণী করে রাখা চুলগুলো সে কাঁধের পাশ দিয়ে এনে বুকের উপর ফেলে রেখেছে।তার উপর আবার পরনের ওড়নাটি শালের মতো গায়ে জড়িয়েছে।প্রসাধনী মুক্ত একটা ঝকঝকে মুখ,চোখ দু’টো রক্তিম।কেঁদেছে নিশ্চয়ই।তবে এখানে এসে নয়,এখানে আসার আগে।
ফাহাদ দু’হাতের আঙুল গুলো আড়াআড়ি ভাবে রেখে একটু ঝুঁকে বসল।জানতে চাইল অভিযোগ কি?
নবনীতার ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে উঠল তার এই বারবার একই প্রশ্নে।সে কোনোরকম রাগ সংবরণ করে বলল,’আমার বোনকে আজ দুপুর থেকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না।কলেজ ছুটির পর তার বাসায় আসার কথা ছিল।কিন্তু সে এখনো আসেনি।আমি জানি না সে কোথায় আছে,কেমন আছে।আমার বান্ধবীর ভাই আমাকে আপনার খোঁজ দিয়েছে।বলেছে আপনি নাকি এই এলাকার মাফিয়া।আপনার কাছে সব নিখোঁজ মেয়েদের লিস্ট আছে।আপনি কি আমায় আমার বোনের খবর দিতে পারবেন দয়া করে?’
এক টানা নিঃসংকোচে কথাগুলো শেষ করে দম নিল নবনীতা।এই জায়গাটা খুব একটা সুবিধার না।তবুও তাকে বাধ্য হয়ে এখানে আসতে হয়েছে।শুভ্রা কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না দুপুর থেকে।নবনীতার বুক ফেটে কান্না আসছে।পুরো রাস্তা সে মুখ চেপে কেঁদেছে।এখন কিছুটা শক্ত হয়েছে।বিপদ এসেছে,কিন্তু নবনীতা এতো অল্পেই ভেঙে পড়বে না।সে মনে মনে একনাগাড়ে বলে যাচ্ছে,’শুভি ভালো আছে।একদম ভালো আছে।বেশি চিন্তা করিস না নবনী।শুভি একদম ঠিক আছে।’
ফাহাদ ফোন বের করে কোথাও একটা কল করল।তারপর অন্য আরেক জায়গায় কল দিলো।শেষমেশ কয়েকজনের সাথে কথা শেষে সে নবনীতার দিকে মুখ করে বলল,’নাহ।আপনার বোনের কোনো খোঁজ আমার কাছে নেই।আমি জানি না আপনার বোন কোথায়।’
নবনীতা অনুনয় করে বলল,’প্লিজ একটু দেখুন না।কিছু একটা করা যায় কিনা দেখুন।প্রয়োজনে আমি টাকাও দিতে রাজি।’
‘আহা! বললাম না আমি কিছু জানি না।আপনি বাজে না বকে যান তো এখান থেকে।’
নবনীতা গেল না।উল্টো জেদ ধরল।দু’হাত জোড় করে বলল,’প্লিজ আমাকে এভাবে নিরাশ করবেন না।আপনি ছাড়া এই ব্যাপারে আমাকে আর কেউ সাহায্য করতে পারবে না।পুলিশে চব্বিশ ঘন্টা না হলে মিসিং ডায়রি করা যাবে না।আপনি তো জানেন,চব্বিশ ঘন্টায় কতো কি হয়ে যেতে পারে।প্লিজ আপনি কিছু একটা করুন।’
ফাহাদ বিরক্ত হলো।চোখ মুখ খিঁচে বলল,’উফফ! ভারি বেয়াদব মেয়ে তো আপনি! বললাম না আমি কিছু জানি না?আবার এক কথা বলে যাচ্ছেন।যান নিজের রাস্তা নিজে মাপুন।আমি কিছু করতে পারব না।’
‘প্লিজ একবার একটু আমার দিকটা,,,,’
মুঠোফোন টা কর্কশ শব্দে বেজে ওঠল।নবনীতা তার কথা ঠিক মতো শেষও করতে পারল না। প্রথম বারেই সে কলটা রিসিভ করে নি।দ্বিতীয়বারে একপ্রকার বিরক্ত হয়ে সে ফোনটা রিসিভ করে কানের সাথে চেপে ধরল।নিরাসক্ত কন্ঠে বলল,’জ্বী কে বলছেন?’
অন্যপাশ থেকে কি উত্তর এসেছে সেটা বোঝা গেল না।কিন্তু অন্যপাশের কথা শুনতেই নবনীতা এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।ফাহাদ তার হঠাৎ এমন লাফিয়ে ওঠাতে ভড়কে গেল।চোখ বড় বড় করে বলল,’কি হয়েছে?’
নবনীতা সেসব পাত্তা দিল না।সে ফোনটা কানে চেপেই দিগবিদিক শূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করল।চোখের নিমিষে সে ফাহাদের পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে তিনতালা বেয়ে নিচে নেমে এলো।ফাহাদ ভ্রু কুঁচকে মনে মনে আওড়াল,’কি অদ্ভুত মেয়ে! দৌঁড়ে দৌঁড়ে এলো,আবার দৌঁড়ে দৌঁড়েই চলে গেল।
.
.
.
.
নবনীতার ফোনে মেসেজ করে যে লোকেশান টা পাঠানো হয়েছিল,নবনীতা জিপিএস অন করে ঘন্টাখানেকের মধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেল।
সিএনজির ভাড়া মিটিয়ে কপালের ঘাম মুছে সে ফোনে থাকা লোকেশানের সাথে আশেপাশের লোকেশন মিলিয়ে নিল।তাকে যেই জায়গায় আসতে বলা হয়েছে সেটা একটা নির্মাণাধীন দশতালা বাড়ি।এখনও সবগুলো দেয়াল ঠিকভাবে দেওয়া হয়নি।
নবনীতা নিচতলায় পা রেখে চারদিকে চোখ ঘুরিয়ে আশপাশ দেখে নিল।এতো নিরব কেন এই জায়গা?যদিও দিনের বেলা,তবুও তার গা ছমছম করছে।সে মোবাইলের স্ক্রীনে আঙুল চালিয়ে তাকে যেই নম্বর থেকে ফোন করা হয়েছিল সেই নম্বরে ডায়াল করল।
রিং হওয়ার আগেই তাকে পেছন থেকে কেউ ডাকল,’মিস নবনীতা!’
চকিতে পেছন ফিরল সে।চোখ গেল সাদা শার্ট গায়ে একটি ছেলের দিকে।ছেলেটি নিজ থেকে এগিয়ে এলো।কাছে আসতেই নবনীর মনে হলো সে এর আগেও তাকে দেখেছে।
ছেলেটি কোনোরকম বাড়তি কথায় না গিয়ে শুরুতেই বলল,’আসুন আমার পেছন পেছন আসুন।’
নবনীতা তার পেছন পেছন হাঁটা ধরল।হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে পড়ল এই ছেলেটি তার চেনা।শাহরিয়ার আরহামের পার্টি অফিসে সে একে দেখেছে।হঠাৎ করেই কেমন অজানা আতঙ্কে নবনীতার চিত্ত ব্যাকুল হয়ে ওঠল।শুভির নিখোঁজ হওয়ার সাথে কি কোনোভাবে আরহাম জড়িয়ে আছে?নবনী আর সামনের কথা ভাবল না।ভাবতে নিলেই সবার আগে বাজে কথা মাথায় আসে।
নির্মাণাধীন ভবনটির সেকেন্ড ফ্লোরে একটা রুম আছে।আশ্চর্যের বিষয়,রুমে দরজাও আছে।ছেলেটি দরজা খুলে সরে দাঁড়ালো,যার অর্থ নবনীতাকে যেতে হবে ভেতরে।নবনীতা এক সেকেন্ড কিছু একটা ভেবে চুপচাপ ভেতরে পা বাড়ালো।
নবনীর ভাবনাই সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে।ঘরের ভেতর আরহাম আর তার সঙ্গী সাথীরা ছিল।সেই সাথে আরো একজন ভদ্র মতোন লোক ছিলেন।তার হাতে ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন।
নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে ঘরের ঠিক মাঝামাঝি এসে দাঁড়ালো।আরহামকে এখনো ভালোমতো দেখেনি সে।লোকটা আরহাম বুঝতেই সে চোখ নামিয়ে নিয়েছে।আরহাম অবশ্য চোখ সরায়নি।নবনীতা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসার পর থেকে সে একটানা শুধু তাকেই দেখে গেল।আরহাম আবিষ্কার করল এই মেয়েটির সাথে তার রাগের সম্পর্ক সমানুপাতিক।যতবেশি সে নবনীতাকে দেখে,ততবেশি তার মাথায় খু/ন চেপে যায়।মাথায় টগবগ করে রক্ত ফুটে।মনে হয় এক চড় মেরে নবনীতার সব দাবাংগিরি বের দিতে।
আরহাম তার রাগটুকু বহু কষ্টে গিলে নিল।নবনীতা মেঝেতে চোখ রেখেই বলল,’শুভি কোথায়?আপনারা আমার শুভিকে কোথায় রেখেছেন?’
‘আছে।সে ভালোই আছে।নিরাপদে আছে’,চুল ঠিক করতে করতে জবাব দিল আরহাম।
‘আমার বোনের সাথে কেন এমন করছেন?তার কি দোষ?আমার অন্যায়ের শাস্তি শুভিকে কেন দিচ্ছেন?’বলতে বলতেই নবনীর কথা জড়িয়ে এলো।যেই কঠোরতা সে চোখে মুখে জড়িয়ে রাখতে চাইছে,কিছুতেই সেটা সম্ভব হচ্ছে না।শুভি আরহামের কাছে আছে।এই অবস্থায় নবনীতার হঠকারিতা পরিস্থিতি আরো বিগড়ে দিতে পারে।আরহামকে তার চেনা হয়েছে।শাহরিয়ার আরহাম ক্ষমতা পাওয়ার জন্য সবই করতে পারে।
আরহাম পকেটে হাত গুজে ঠিক নবনীতার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।বাঁকা হেসে বলল,’তোমার শুভিকে ধরতে চাইনি।ইনফেক্ট তোমাকেও ধরে আনার কোনো উদ্দেশ্য ছিল না।কিন্তু আমার আহাম্মক ছেলেরা ভুলে তোমাকে তুলে না এনে তোমার বোনকে তুলে এনেছে।’
নবনীতা দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষোভটুকু ভেতরে চেপে রাখল।শুভিকে না পাওয়া পর্যন্ত সে কোনো বোকামি করবে না।সে ক্লান্ত স্বরে বলল,’এখন তো জেনেছেন ভুল করেছেন।এখন শুভিকে ছেড়ে দিন।’
‘দিব,তার আগে তুমি একটা কাজ করবে।’
‘কি কাজ?’ অস্থির শোনাল নবনীতার কন্ঠ।
আরহাম তার তর্জনী তুলে ক্যামেরা হাতে দাঁড়ানো ভদ্রলোককে দেখিয়ে বলল,’তুমি উনার কাছে এখানে বসে একটা ইন্টারভিউ দিবে।’
একশোটা উত্তর নবনীতার মুখের সামনে এসে তার অনুমতির অপেক্ষা করছিল।অনুমতি দিলেই সেগুলো সে আরহামের মুখের ওপর উগলে দিল।কিন্তু নবনীতা তার কিছুই করল না।উল্টো বাধ্য মেয়ের মতো বলল,’কোথায় বসে ইন্টারভিউ দিতে হবে?এখানে?’
‘হ্যাঁ এখানেই।রাশিদ তোমার কথা রেকর্ড করবে।তারপর বাকিটা আমি নিজ দায়িত্বে পৌঁছে দিব বাকি নিউজ চ্যানেলের কাছে।’
নবনীতা রোবটের মতো হেঁটে চেয়ারে গিয়ে বসল।একবার কেবল চোখ তুলে জানতে চাইল,’কি বলব?আমার মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিল তাইতো?’
আরহাম একটু ভেবেচিন্তে বলল,’তা বলতে পারো।সাথে আমার প্রশংসা করবে বুঝেছ?বলবে এইবারের নির্বাচনে আমার চেয়ে পারফেক্ট আর কেউ হতেই পারে না।বুঝেছ তো?’
রাশিদ এগিয়ে এসে ক্যামেরা সেট করল।ছোট্ট মাইক্রোফোনটা নবনীর জামার গলায় সেট করে বলল,’জ্বী ম্যাম এখন বলুন।’
নবনীতা দুই হাত মুঠ করে দু’টো দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করল,’গত পরশুদিন আমি একটা ভুল করেছি।আমার ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল।জনাব শাহরিয়ার আরহাম আসলে রাস্তা ব্লকের ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।বিষয়টা আমি বুঝতে পারিনি।যা কিছু হয়েছিল সেদিন,পুরোটাই উনার অজানা ছিল।উনাকে এসবে জড়ানো ঠিক হয়নি আমার।আমি বুঝতে পারি নি।আপনারা দয়া করে উনাকে খারাপ ভাববেন না।উনার সাথে ঐ ঘটনা গুলোর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
‘হয়েছে।এবার আমার একটু প্রশংসা করে দাও।’ পাশ থেকে বলে উঠল আরহাম।
নবনীতা কটমট চোখে একনজর তাকে দেখে পুনরায় বলতে শুরু করল,’জনাব আরহাম আসলে খুবই জনদরদী মানুষ।উনি নির্বাচনে জয়ী হলে আমরা খুব ভালো কিছু পাবো বলেই আশাবাদী আমি।’
‘হয়েছে?প্রশংসা হয়েছে ঠিক মতো?’ গোমড়া মুখ করে জানতে চাইল নবনীতা।
আরহাম ডানহাত টা এপাশ ওপাশ নেড়ে মুখ বাঁকা করে বলল,’হয়েছে কোনোরকম।বিলো এভাররেজ।চালিয়ে দেওয়ার মতো।কিন্তু আমার অতোটা পছন্দ হয়নি।খুবই চাপা চাপা প্রশংসা।তোমাকে মন খুলে প্রশংসা করা শিখতে হবে।যাকগে,,আমি অতো প্যাচ ধরার মানুষ না।এটাতেই কাজ চালিয়ে নিব।’
‘শুভি কোথায়?এবার অন্তত তাকে দিন আমার কাছে।’
আরহাম ডানদিক ফিরে চুল ঠিক করতে করতে বলল,’শাহিন যা তো।শুভ্রাকে নিয়ে আয়।’
শাহিন চলে গেল আর মিনিট দু’য়ের মাথায় শুভ্রাকে সাথে নিয়ে ফিরল।শুভ্রা তার কলেজ ব্যাগটা শক্ত করে জাপটে ধরে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিল।নবনীতাকে দেখেমাত্রই সব ভয় ভুলে সে এক দৌঁড়ে ছুটে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।জড়ানো গলায় বলল,’আপাই! তুমি এসেছ?’
নবনীতা তার দুই বেণী করা মাথায় হাত ছুঁয়িয়ে তাকে শান্ত করতে করতে বলল,’তুই ঠিক আছিস তো শুভি?কেঁদে কেটে কি হাল করেছিস নিজের?’
শুভ্রা হয়তো আরো কিছু বলতে চাইছিল,কিন্তু তার আগেই নবনীতা শক্ত করে তার হাত ধরে তাকে টানতে টানতে বলল,’বাড়ি গিয়ে সব কথা হবে।এখন চল এদিক থেকে।’
দুই বোন চোখের নিমিষেই উধাও হয়ে গেল।যাওয়ার আগে সৌজন্যসূচক একটা শব্দ পর্যন্ত বলে গেল না।শাহিন চোখ বড় বড় করে বলল,’বাপরে! আপার দেখি খুব তেজ।’
আরহাম তাচ্ছিল্য করে বলল,’তেজ মাই ফুট! পুরাই বেয়াদব একটা!’
.
.
.
.
রিকশাতে উঠেই নবনীতা অনবরত প্রশ্ন শুরু করল,
‘ওরা তোর সাথে উল্টাপাল্টা কিছু করে নি তো?’
‘ছোঁয় নি তো তোকে?’
‘বাজে কথা বলেনি তো?’
‘ছবি টবি কিচ্ছু তোলেনি তো?’
‘তোর দিকে বাজে চোখ করে দেখেনি তো?’
শুভ্রানী এতো এতো প্রশ্নের রোষানলে পড়ে ভড়কে গেল।নবনীতা আর কিছু প্রশ্ন করার আগেই সে তার মুখ চেপে ধরল।ব্যস্ত হয়ে বলল,’থামো আপাই,থামো।আমি একদম ঠিক আছি।আমার কিচ্ছু হয়নি।ওরা আমায় কিছু করেনি।কেবল চুপচাপ একটা রুমে বসিয়ে রেখেছিল।আর কিছু করেনি।’
‘ঐ আরহামের সাথে তোর দেখা হয়েছে?কি বলেছে সে তোকে?’
শুভ্রা কেবল কিছু একটা বলতেই যাচ্ছিল,তার আগেই নবনীতা মাথায় হাত চেপে বলল,’থাক হয়েছে।মাথা ব্যথা করছে,পরে শুনব এসব।’
বাড়ি ফিরেই নবনীতা গোসল করে একটা ঢিলেঢালা আকাশী রঙের সুতির জামা গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে এলো।ঘরে এসেই সে দেখল শুভ্রানী আর চিত্রা খাটের এক কোণায় বসে আছে।শুভ্রার হাতে একটা প্যাকেট।
নবনীতা চুল মুছতে মুছতে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালো।জানতে চাইল,’হাতে কি?কি আছে এতে?’
শুভ্রা চোরের মতোন মুখ করে বলল,’প্যাটিস।চিকেন প্যাটিস।’
শুভ্রা কাচুমাচু মুখ করে জবাব দিলো,’শাহরিয়ার আরহাম ভাই দিয়েছে।’
নবনীতা উত্তর শুনেই আকাশ থেকে পড়ল।একমুহূর্ত দেরি না করে এক ধাক্কায় প্যাটিসের প্যাকেট টা শুভ্রানীর হাত থেকে ফেলে দিল।সেটা গিয়ে পড়ল মেঝেতে।নবনীতা দাঁতে দাঁত পিষে কিড়মিড় করে বলল,’আরহাম ভাই দিয়েছে মানে?তার দেওয়া জিনিস তুই নিয়েছিস কেন?সে তোকে কেন দিবে এসব?’
শুভ্রা চোখ পিটপিট করে বলল,’আমাকে ধরে নেওয়ার পর আরহাম ভাই যখন জানল যে ভুল করে আমাকে তুলে আনা হয়েছে তখন সে আমাকে এই প্যাকেট টা দিয়েছে।সাথে একটা কোল্ড ড্রিংকসও দিয়েছে।ঐটা ব্যাগে আছে।আর বলেছে__’
জিভ কাটল শুভ্রা।নবনীতা চোখ রাঙিয়ে বলল,’কি থামলি কেনো?আর কি বলেছে?’
‘ইয়ে মানে বলেছে যে তোমার ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে যাবো,তখন যেন আমি এটা খেয়ে নেই।এটা নাকি শহরের সবচেয়ে মজার প্যাটিস।’ বলতে বলতেই ফিক করে হেসে দিল শুভ্রা।
নবনীতা থম মেরে কয়েক পল সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।শুভি হাসছে?ঐ জানোয়ারের জিম্মায় থেকেও শুভি হাসছে?সে কি জানে না ঐ লোক কি পরিমান বদ?
শুভ্রা মাথা নিচু করে হাসি থামাল।আপাই খুব রেগে যাচ্ছে।আপাই রেগে গেলে ঠিক মতো কথা বলে না।আপার রাগের যথাযথ কারণ আছে।আরহামের চ্যালাপেলা গুলো আসলেই জঘন্য।কিন্তু অদ্ভুত কারনে আজ সে ভয় পায়নি।শুরুতে যদিও ভয়ে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল,কিন্তু ঐ ছোট্ট রুমটায় বসার পর কিংবা শাহরিয়ার আরহামকে দেখার পর তার একবারও মনে হয়নি তার সাথে খুব খারাপ কিছু ঘটে যাবে।
শুভ্রা মুখটা মলিন করে কানে হাত দিয়ে বলল,’সরি আপাই!এরপর থেকে ঐ বদলোক যদি আমায় পিৎজা বার্গারও দেয়,আমি তবুও নিব না।বলব তোর পিৎজা তুই খা।তোর মতো জন্তুর কাছ থেকে আমি পানিও খাব না।ঠিক আছে?এবার অন্তত রাগারাগি বন্ধ করো প্লিজ।’
নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে একনজর তার দুই বোনকে দেখে চুল মুছতে মুছতে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।তার মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে,তার ভয়ানক রকম রাগ হচ্ছে শুভির ওপর।
তাসনুভা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে সেটাকে বারান্দায় নিয়ে দাঁড় করালো।আজ খুব সুন্দর করে চাঁদ উঠেছে।আকাশটা একেবারে স্বচ্ছ।মেঘ নেই,মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা গুলো আকাশ দখল করে নিয়েছে।
বাগান থেকে গুনগুন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সম্ভবত সেখানে কেউ আছে।তাসনুভা বাগানে উঁকি দিলো।জসিম কাকা,মদিনা খালা আর তাদের ছোট্ট ছেলে জীবনকে দেখা যাচ্ছে।জসিম কাকার হাতে কাঁচা মাটি,আর খালার হাতে গাছ।জীবনের কোনো কাজ নেই,সে এমনিই এসেছে মা-বাবার সাথে।কোনো কাজ না থাকায় জীবন থেমে নেই।সে পুরো বাগানের এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।
তাসনুভা থমকাল।তার সমস্ত মনোযোগ গিয়ে থামল জীবনের ছুটতে থাকা পা জোড়ার দিকে।ইশশশ!! কতো সুন্দর করে দৌঁড়াচ্ছে জীবন! তার কাছে দু’টো পা আছে,যেই পা দিয়ে সে যেখানে খুশি যেতে পারে।
তাসনুভা মাথা নুয়াল।তার কাছেও দু’টো পা আছে।কিন্তু অচল।সে এদের নিয়ে এমন ছুটতে পারে না।তাসনুভা আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।স্রস্টা তো সবাইকে সব দেয় না তাই না?তিনি আরহাম ভাইয়াকে ধৈর্য দেননি,আরিশ ভাইয়াকে বুদ্ধি দেননি,আর তাসনুভাকে চলাচলের ক্ষমতা দেননি।একসময় অবশ্য দিয়েছিলেন,এখন আবার নিয়ে গেছেন।
তাসনুভা এক গালে হাত রেখে বাগানের ফুল গাছ গুলো দেখে যাচ্ছিল।তার হঠাৎ বাগানে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।ঠিক তখনি সাদা রঙের একটি গাড়ি বাড়ির মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।তাসনুভার কপালে ভাঁজ পড়ল।এই সময়ে কে এলো আবার?
গাড়ির দরজা ঠেলে একপ্রকার ঢুলতে ঢুলতে বাইরে বেরিয়ে এলো সারাহ।তার পরনে কালো রঙের স্লিভলেস পোশাক।সেটা আবার শেষ হয়েছে হাঁটুতে।তাকে দেখাচ্ছে বিচ্ছিরি! জঘন্য!
তাসনুভার নিজে নিজে ভেঙচি কাটল।দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’যেই না চেহারা,নাম রেখেছে পেয়ারা!’
গাড়ির ভেতর কে ছিল তাসনুভা দেখতে পায়নি,দেখার আগ্রহও দেখায়নি।সারাহ’র কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় না।তাসনুভা অন্তত করে না।গ্রাম থেকে শহরে আসার পরেই তার পাখা গজিয়েছে।এই জাতের মানুষের পাখা কেটে দেওয়াটা একটু কষ্টের।
তাসনুভা দ্রুত চাকা ঘুরিয়ে রুমের বাইরে এসে দোতালার করিডরে গিয়ে থামল।এদিক থেকে নিচের সবকিছু ভালো করে দেখা যায়।
সারাহ বাড়ি ফেরার পরই তার সাথে সবার প্রথমে আফরোজা বেগমের দেখা হলো।বাড়িতে অবশ্য সে সময় আফরোজা আর তাসনুভা ছাড়া আর কেউ ছিল না।আফরোজা বেগম মেয়ের এই খোলামেলা পোশাক দেখেই মৃদু ধমকে উঠে বললেন,’এসব কি সারাহ?তোকে না বলেছি এধরনের জামা পরে বাড়ি আসবি না?আরহাম অথবা আরিশ দেখে নিলে কি একটা কেলেঙ্কারি বাধবে জানিস না?
সারাহ ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে তার মা কে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল।যেতে যেতে কেবল মাথা নেড়ে বলল,’ওহহ কাম অন মা।এতোকিছু দেখার সময় আমার নেই।আমি এডাল্ট।প্রাপ্তবয়স্কা আমি।আমি তাই করব যা আমার ভালো লাগে।’
সারাহ হেলেদুলে নিজের ঘরে চলে গেল।তাসনুভা কপাল কোঁচকাল।নেশা টেশা করে নাকি?কেমন অদ্ভুত করে কথা বলছিল আর হাঁটছিল।
তাসনুভা আর সেসব ঘাটায় না।কেবল সিঁড়ির মাথায় এগিয়ে এসে আফরোজা বেগমকে ডেকে বলল,’ফুফু আমাকে একটু নিচে নামিয়ে দিবে?’
আফরোজা বেগম ঘুরে দাঁড়ালেন।এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।তাসনুভা যেন তার সেই বিরক্তিভাব ধরে ফেলতে না পারে,সেজন্যই সম্ভবত মুখে জোরপূর্বক একটা মেকি হাসি ফুটালেন।জানতে চাইলেন,’কেমন আছিস মা?শরীর ভালো?’
তাসনুভা মাথা নাড়ল,জানাল তার শরীর ভালো।আফরোজা বেগমকে তাসনুভার পছন্দ না।তার মধ্যে একপ্রকার ভন্ডামি আছে।আরহাম ভাইয়া বিচক্ষণ।আফরোজা যে একটা আস্ত ভন্ড সেটা আর না বুঝার কথা না।কিন্তু তারপরেও কেনো আফরোজা কে বাড়ি থেকে বের করছে না কে জানে?
নিচে নামার পরেই তাসনুভা দু’হাতে চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে সোজা বাগানে গেল।জীবন তাকে দেখতেই তার কাছে ছুটে এলো,তার গলা জড়িয়ে ধরল।তাসনুভা উৎফুল্ল মুখে বলল,’কেমন আছিস জীবু?’
জীবন লাজুক হাসল,একশব্দে জবাব দিল,’ভালো।’
জসিম তাকে দেখামাত্রই অবাক হয়ে বলল,’আম্মাজান! আপনি এতো রাইতে বাগানে কি করেন?’
তাসনুভা হাসিমুখে এগিয়ে এলো।চারদিক দেখে বলল,’বারান্দা থেকে তোমাদের দেখছিলাম।দেখেই আসতে ইচ্ছে হলো।কি করছ তোমরা?’
মদিনা ফুলের চারা টা তাসনুভার চোখের সামনে মেলে ধরে বলল,’এটা লাগাইতে আইসি।রাইত ছাড়া এটা লাগান যায় না।’
তাসনুভা হাত বাড়িয়ে বলল,’দেখি আমাকে দাও তো।নাম কি এই চারার?’
মদিনা শান্তভাবে হাত বাড়িয়ে চারাটা তার হাতে তুলে দিলো।নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল,’নাম কইতে পারি না।বড় বাবায় আনাইছে।বিদেশি চারা।নাম ধাম জানি না।খালি এদ্দুর জানি যে এইটা রাইতে না লাগাইলে বাঁচে না।’
তাসনুভা চারাটা নেড়েচেড়ে দেখে আবার মদিনার হাতে তুলে দিলো।এসব অদ্ভুত জিনিস তার বড় ভাইয়ের দ্বারাই কেনা সম্ভব।
মদিনা কোমরে আঁচল গুজে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে চারাটা ঠিকঠাক জায়গায় রাখলেন।জসিম তার উপর কাঁচা মাটি ফেলে প্রায় কয়েক ইঞ্চি পুরু মাটির স্তর দিলেন।তাসনুভা চোখ সরু করে বলল,’সেকি!গাছে তো কোনো ফুলও নাই!’
জসিম চারদিক পরিষ্কার করতে করতে গলা উঁচু করে জানাল,’এই গাছে কয়েক বছর পর পর একবার ফুল ফুডে।ফুল ফুডতে এখনো মেলা দেরি আম্মাজান।’
তাসনুভা নাক ছিটকাল।এতো ভালো ভালো গাছ থাকতে বড় ভাইয়া কিসব আধমরা,কয়েক বছরে একবার ফুল দিতে পারা গাছ এনেছে।বড় ভাইয়াকে নিয়ে তাসনুভার চিন্তা হয়।ভাইয়ার কাজকর্মের কোনো ঠিক নাই।বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ বিয়ের কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না।তাসনুভার কতো জল্পনা কল্পনা তার হবু ভাবিকে নিয়ে।অথচ তার ভাই আদৌ বিয়ে করবে নাকি সেটাও তার জানা নেই।
.
.
.
.
সাদেক সাহেবের বাড়িতে টেলিভিশন নেই।কাজেই শুভ্রানী পর্যন্ত তার বোনের ঘটানো লঙ্কাকাণ্ডের খবর সাথে সাথেই পৌঁছায়নি।বিকেলে যখন সে বাড়ির ছাদে গেল ঠান্ডা বাতাস খেতে,তখন তার সহপাঠী নম্রতা তাকে তার মুঠোফোনে আজকের দিনের সকল নিউজ চ্যানেলের হাইলাইটেড আর জনপ্রিয় নিউজটা দেখালো।
শুভ্রা ফ্যালফ্যাল চোখে অপলক ভিডিও ক্লিপটা দেখল।পুরোটা দেখতেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।আপাই আজ এতো বড় কান্ড ঘটিয়েছে?অথচ এতোকিছুর পরেও সে এতো শান্ত কি করে?
শুভ্রা পুরোটা ভিডিও আরো একবার দেখল।কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এতো এতো ক্যামেরার সামনে আপাই এধরনের কথা বলছে সেটা শুভ্রার বিশ্বাস হচ্ছে না।আপাই ভীষণ নরম মনের মানুষ।শুভি সেটা জানে।কিন্তু সে এও জানে যে তার পরী আপাই সহজে কোনো ঝামেলায় জড়ায় না।অন্তত এসব মিডিয়া,রিপোর্টারস এর ঝামেলায় তো মোটেই না।
সে আর এক মুহূর্ত ছাদে দাঁড়াল না।এক দৌঁড়ে বাড়িতে এসে সোজা তাদের ঘরে গেল।গিয়েই দেখল নবনীতা চিত্রাকে কোলের ওপর বসিয়ে তাকে যোগ বিয়োগ শেখাচ্ছে।চিত্রা কয়েকমাস পরেই স্কুল যাবে।নবনীতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিত্রাকে কোনো নার্সারি কিংবা কেজিতে পড়াবে না।একদম সোজা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করাবে।নার্সারি কেজিতে যা পড়ায় সেটা নবনীতা নিজেই তাকে পড়াতে পারবে।
চিত্রাকে স্কুলে না দেওয়ার আরো একটা কারণ হচ্ছে যাতায়াতের সমস্যা।তাকে স্কুলে দিলে নবনীতার তাকে প্রতিদিন আনা নেওয়া করতে হবে।এই অফুরন্ত সময়েরই বড্ড অভাব নবনীতার।
শুভ্রানী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই হড়বড় করে বলল,’তুমি এটা কি করেছ আপাই?’
নবনীতা বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাল।জানতে চাইল,’কি হয়েছে?কি করেছ আমি?’
শুভ্রা এগিয়ে এলো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুমি জানো না তুমি কি করেছ?মিডিয়ার সামনে তুমি এসব কি বলেছ?’
নবনীতা কিছুক্ষণ চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে থাকল।একটু সময় বাদে চিত্রাকে খাটে বসিয়ে সে সাবধানে উঠে এলো।ছোট ছোট পা ফেলে বারান্দায় গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো।তার খোপা ঢিলে হয়ে গেছে।ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুল বেরিয়ে যাচ্ছে।শুভ্রা বারান্দায় এলো।ঠিক নবনীতার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।আস্তে করে ডাকল,’আপাই!’
নবনীতা সেদিকে ফিরল না।আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে।স্বচ্ছ আকাশে ফালি ফালি মেঘ জমছে।নবনীতা আকাশ দেখতে দেখতে বলল,’এ জাতীয় ঝামেলা আমি সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি শুভি! আমি জানি দেশের রাজনীতির অবস্থা কতো খারাপ।কিন্তু আজ আমার কি হয়েছে আমি জানি না রে শুভি।’
বলতে বলতেই তার কন্ঠ কেঁপে ওঠল।শুভ্রা অবাক হয়ে বলল,’কি হয়েছে আপাই?তুমি এমন করছ কেন?’
নবনীতা খোলা বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিল।সুমিষ্ট স্বরে থেমে থেমে বলল,’আজকের ঐ লোকটাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেছে শুভি।আমি স্পষ্ট দেখেছি বাবা রাস্তায় পড়ে আছে,শরীরে অনেক রক্ত।বাবা কাতরাচ্ছে।আমি সত্যি বলছি শুভি।সেই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারি না।আমি রক্ত সহ্য করতে পারি না।রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া শরীর আমি সহ্য করতে পারি না।আমার অস্বস্তি হয়,পাগল পাগল লাগে।’
শুভ্রানী কিছু বলল না।কেবল চুপচাপ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল।আপাই যেই আনাড়ি হাতে খোপা বেঁধেছিল,সেটা খুলে গিয়ে মসৃণ চুলগুলো পীঠ ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে।বাইরে মৃদু বাতাস বইছে,সেই বাতাসে পরী আপার চুল উড়ছে।তাকে দেখতে ভালো লাগছে।শুভ্রা আর কিছু শুনল না।কেবল একনজরে নবনীতার অল্প অল্প কাঁপা ঠোঁট আর হাতটা দেখে নিল।কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেক দামি দামি ক্যামেরা এনে সবার ছবি তোলা হয়।এমন একটা ক্যামেরা এনে আপাইয়ের একটা ছবি তুলে নিলে কেমন হয়?আপাই কিছুতেই বিশ্বাস করে না সে কতোখানি সুন্দর।একটা ছবি তুলে নিলে নিশ্চয়ই আপাই বিশ্বাস করবে সে সত্যিই খুব সুন্দর।শুভ্রা মিথ্যে বলে না।পরী আপার মতো সুন্দর মেয়েমানুষ সে এই শহরে দু’টো দেখেনি।
সকালে যেই অসহ্য তাপদাহে রাস্তায় ঠিক মতো হাঁটা পর্যন্ত যাচ্ছিল না,এখন সন্ধ্যের একটু আগেই আকাশ মেঘলা হয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।বারান্দার গ্রিল দিয়ে বৃষ্টির ছটা নবনীতার মুখে এসে পড়ছিল।নবনীতা বিষন্ন মলিন আর ক্লান্ত মুখে বারান্দা থেকে তার ঘরে এসে খাটের এক কোণায় গিয়ে বসল।অন্যসময় হলে সে শুভ্রাকে নিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে তবেই আসতো।কিন্তু আজ সে এমন কিছুই করেনি।শুভ্রা নিজেই দরজা টেনে ঘরের ভেতর এলো।নবনীর হাত তখনো কাঁপছিল।শুভ্রা এগিয়ে গেল।উৎকন্ঠা মেশানো স্বরে জানতে চাইল,’কি হয়েছে আপাই?ঠিক আছো তুমি?’
নবনী একহাতে চাদর খাঁমচে ধরে অন্যহাতে শুভ্রার হাত চেপে ধরল।তার গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না।সে শ্বাস টানতে টানতে কোনোরকমে বলল,’ইন-ইনহেলার টা দে শুভি।’
শুভ্রার হাত থেকে ইনহেলার নেওয়ার পরেই নবনীতা শ্বাস টানতে টানতে আস্তে করে মাথাটা বালিশে রাখল।শুভ্রা ভয়াতুর গলায় বলল,’কি হয়েছে তোমার?এমন করছ কেন?’
নবনীতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।চাপা গলায় বলল,’বাতিটা নিভিয়ে দে শুভি।দরজাটা চাপিয়ে দে।আওয়াজ ভালো লাগছে না আমার।’
‘আমি শেখ শাহরিয়ার আরহাম।আমার বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য শেখ আজিজ হোসেন।আমার বাবাকে চেনে না এমন মানুষ হয়ত খুঁজে পাওয়া যাবে না।আমার বাবা জনমানুষের নেতা ছিলেন।তিনি তার জীবদ্দশায় জনমানুষের জন্যই কাজ করে গেছেন।বাবার মৃত্যুর পর আমি কিংবা আমার ভাই কেউই রাজনীতিতে আসতে চাইনি।কিন্তু রাজনীতির প্রতি যেই অপ্রতিরোধ্য টান আমি অনুভব করি,সেটাকে অস্বীকার করার সাধ্যি আমার নেই।আমি বেশি কিছু বলতে চাই না।শুধু বলতে চাই আমি আরহাম কেবলমাত্র আমার বাবার দেখানো পথে চলতে চাই,তার আদর্শ অনুসরণ করতে চাই।আমি আপনাদের মাঝে থেকেই আপনাদের প্রতিনিধি হয়ে উঠতে চাই।আমি কোনো মন্ত্রীত্ব চাই না।আমি চাই প্রতিনিধিত্ব।আমি আপনাদের সবার হয়ে কাজ করতে চাই।কাল হয়তো আনুষ্ঠানিক ভাবে মনোনয়ন পত্র পেয়ে যাব।তারপরই পুরোদমে নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হয়ে যাবে।এই সময়টুকুতে আপনাদের আমার খুব প্রয়োজন।আপনারা এভাবেই আমার পাশে থাকবেন।আমাকে অনুপ্রেরণা আর ভালোবাসা দিয়ে যাবেন।আমি আপনাদের সাহায্য চাই,সেই সাথে আপনাদের উৎসাহ আর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা চাই।আপনারা এই দুর্গম পথচলায় আমার পাশে থাকবেন তো?পাশে থেকে আমাকে সাহস জোগাবেন তো?’
আরহাম থামল।তার প্রশ্নের জবাবে সমাবেশে উপস্থিত লোকজন সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠল।স্পষ্ট করে জানাল তারা পুরোটা সময়ই আরহামের পাশে থাকবে।আরহাম পুনরায় মাইক্রোফোন হাতে নিল।মুখে চওড়া হাসি বজায় রেখে বলতে শুরু করল,’আমি জানি দেশ পরিচালনা করার জন্য অভিজ্ঞ আর সুবিবেচক ব্যক্তির প্রয়োজন।কিন্তু সেই সাথে আমি এটাও বিশ্বাস করি বর্তমানে পৃথিবী যে গতিতে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে,সেই গতির সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য আধুনিক চিন্তাধারার,অভিযোজন ক্ষমতা সম্পন্ন তরুণ নেতৃত্বের প্রয়োজন।তাই এইবারের নির্বাচনে আপনাদের পছন্দ হওয়া উচিত বর্তমান প্রজন্মের সাথে তাল মেলাতে পারে এমন ব্যক্তি।এখন আর সেই যুগ নেই যে কেবল বয়সের ভার দেখেই আপনারা প্রতিনিধি নির্বাচন করবেন।এখন থেকে,,,’
‘বন্ধ করুন এসব।’ আরহামের কথা শেষ না হতেই সমাবেশের অন্য পাশ থেকে চেঁচিয়ে ওঠল একটা সুমিষ্ট নারীকন্ঠ।
আরহাম স্তব্ধ হয়ে সামনে তাকালো।তার থেকে বেশ কয়েক হাত দূরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে একটা মাইক্রোফোন,যেটা সে সমাবেশে উপস্থিত একজন স্টাফ রিপোর্টারের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।
পুরো সমাবেশে উপস্থিত মানুষ আরহামের দিক থেকে চোখ সরিয়ে মেয়েটির দিকে মনোনিবেশ করল।মেয়েটির মাইক ধরে রাখা হাত থরথর করে কাঁপছে।আরহামের সাথে চোখাচোখি হতেই সে পুনরায় বলে ওঠল,’বন্ধ করুন এসব সমাবেশ।আপনারা এভাবে মানুষের পথরোধ করে,তাদের মূল্যবান সময় নষ্ট করে সমাবেশ করতে পারেন না।এটা অন্যায়।এটা হতে পারে না।’
যদিও তার হাত কাঁপছিল ভীষণ,কিন্তু কথাগুলো বলতে গিয়ে একটিবারের জন্যও তার কন্ঠ কাঁপলো না।সে একটানা বলে গেল,না থামল,আর না ভয় পেল।
সমাবেশ কভার করতে আসা মিডিয়াগুলো সঙ্গে সঙ্গে তাকে ঘিরে ধরল।অসংখ্য ক্যামেরার ফ্লাশ লাইটের আলোতে তরুণীটির চোখ বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম।ডজন খানেক মাইক্রোফোন এগিয়ে দেওয়া হলো তার সামনে।রিপোর্টার’রা একের পর এক প্রশ্ন করে গেল।মেয়েটি কোনো প্রশ্নই কানে তুলল না।কেবল চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’একটা দল কি করে রাস্তা অবরোধ করে সমাবেশ করতে পারে?সেই অধিকার কি তাদের আছে?শহরের সবচেয়ে ব্যস্ত রাস্তা গুলোর একটি ব্লক করে সস্তার সমাবেশ করা কোন ধরনের জনসেবার অন্তর্ভুক্ত?’
আরহাম চোয়াল শক্ত করে দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।থমথমে মুখে দু’চোখ স্থির রেখে সে নির্নিমেষ অবলোকন করে গেল নিউজ রিপোর্টার কতৃক ঘিরে ফেলা তেইশোর্ধ তরুণীর প্রতিটা বাক্য,প্রতিটা শব্দ।সেই প্রথম দিন থেকেই আরহাম লক্ষ করেছে,মেয়েটি যখন কথা বলে তখন তার চোখ দু’টোও একই সাথে কথা বলে।এই মুহূর্তেও নবনীতার চোখ কথা বলছে।যেই চোখে প্রতিবাদ আছে,ঘৃণা আছে,আর আছে আরহামের প্রতি ভয়ংকর রকমের বিরক্তি।
নবনীতা জড়ানো গলায় বলল,’দোয়েল চত্ত্বরে একটা অ্যাম্বুলেন্স আটকে আছে,ভেতরে এক্সিডেন্টের পেশেন্ট।হয়ত এতোক্ষণে তিনি বেঁচেও নেই।রাস্তা অবরোধ করে এই গাড়িটা আটকে রাখা হয়েছে কেবল সস্তার একটা সমাবেশের জন্য।কি হবে এই সমাবেশ করে?ঐ ভদ্রলোকের জীবন কি আপনাদের নেতার সস্তা দু’পয়সার ভাষণের চেয়েও বেশি মূল্যহীন?একটা দেশে এরকম অরাজকতা করে কোন সাহসে?এরা মানুষের জন্য কি করবে?নির্বাচিত হওয়ার পূর্বেই যাদের কাছে মানুষের সময় আর জীবনের কোনো মূল্য নেই,তারা নির্বাচিত হওয়ার পর কিসের জনসেবা করবে?আপনাদের নেতা কি পারবে ঐ ভদ্রলোকের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে?তাকে বলুন যদি ন্যুনতম বিবেকবোধ থাকে তাহলে যেন এই ফালতু সমাবেশ বন্ধ করে এখনই দোয়েল চত্ত্বরে গিয়ে ঐ লোকটিকে বাঁচানোর চেষ্টা করে,তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।নয়তো বলুন তার এসব লোক দেখানো ভাষণ যেন তার কাছেই রাখে।’
নবনীতা একটানে পুরো কথা শেষ করল।মিডিয়ার লোকেরা তাকে আরো বেশি ঘিরে ধরার চেষ্টা করল।কিন্তু সে তার দুই হাত তার কাঁধের একপাশে ঝুলানো ব্যাগটা খাঁমচে ধরে দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।
ঘড়ির কাঁটায় তখন একটা পনেরো বেজে গেছে।নবনীতা জোরে জোরে দু’বার টেনে শ্বাস নিল।তারপর কপালের ঘামটুকু ওড়নার একপ্রান্ত দিয়ে মুছে নিল।নিজেকে শান্ত করার প্রয়াসে নবনীতা দু’হাতে মুখ চেপে দু’চোখ বুজে এক মিনিট ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।শুভ্রানীর কলেজ ছুটি হয়ে গেছে এতোক্ষণে।নবনীতা দ্রুত পা চালাল।শুভি নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষা করছে।
শুভ্রা কে তার কলেজের সামনে থেকে নিয়ে নবনীতা সোজা একটা রিকশা ঠিক করল।শুভ্রা অবাক হয়ে বলল,’তুমি আজ রিকশা দিয়ে যাবে আপাই?’
নবনীতা হুড টানতে টানতে বলল,’আমি কি কখনো তোদের লোকাল বাসে চড়িয়েছি শুভি?’
‘থাকুক অভ্যাস।আমার সাথে যখন যাবি তখন আমি যেভাবে নিব সেভাবেই যাবি।বুঝেছিস?’
শুভ্রানী ঠোঁট টিপে হাসল।বলল,’ঠিক আছে।বুঝেছি।’
বাড়িতে আসতেই চিৎকার চেঁচামেচির শব্দে শুভ্রা আর নবনী আঁতকে ওঠল।চাবি দিয়ে লক খুলে দ্রুত ঘরে আসতেই তারা আবিষ্কার করল চিৎকার চেঁচামেচির উৎস সাদেক সাহেবের রুম।নবনীতা কাঁধের ব্যাগটা সোফায় ছুড়ে ফেলে একপ্রকার ছুটতে ছুটতে সাদেক সাহেবের ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো।
ঘরের ভেতর প্রথা কোনো কিছু নিয়ে তার বাবার সাথে অকথ্য ভাষায় কথা বলছে।নবনীতা এগিয়ে গেল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি হয়েছে প্রথা?এভাবে কথা বলছ কেনো?’
প্রথা পেছন ফিরল।নবনীতাকে দেখামাত্রই তার চোখমুখ আরো বেশি হিংস্র হয়ে ওঠল।সে কর্কশ গলায় বলল,’তুমি?তুমি আবার এখানে এসেছ কেন?আমি আমার বাবার সাথে কথা বলছি।তোমার এখানে কি?আমি কি বাড়িতে আমার বাবার সাথে কথাও বলতে পারব না এখন থেকে?’
নবনী দুই কদম এগিয়ে এলো।দু’হাত বুকে বেঁধে থমথমে মুখে বলল,’কথা কেন বলবে না?অবশ্যই বলবে।কিন্তু চিৎকার কেন করবে?তুমি কে আমার মামার সাথে চিৎকার করে কথা বলার?তোমার সেই অধিকার নেই।শুধু তুমি না,এই বাড়ির কারোই সে অধিকার নেই প্রথা।’
কথার মাঝে নবনীর এই ঝাঁঝালো উত্তর প্রথার মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে দিলো।সে প্রায় চিৎকার করে বলল,’জাস্ট শাট আপ! তুমি কেন বারবার ভুলে যাও তুমি,তোমার বোন,তোমরা সবাই এ’বাড়ির আশ্রিতা।আশ্রিতার মতোই থাকবে।সবকিছুতে কথা বলো কেন?’
‘আশ্রিতা কোথায় প্রথা?এটা আমার মামার বাড়ি।আমার মামা ভালোবেসে এ’বাড়িতে আমায় স্থান দিয়েছে।আমি তো নিজেকে আশ্রিতা ভাবছি না।’
‘তোমার ভাবা তে কি যায় আসে?তুমি অবশ্যই আশ্রিতা।’
‘ঠিক আছে।তুমি যদি তা ভেবে শান্তি পাও তবে তাই।কিন্তু আমার জানা মতে আশ্রিতারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে বাজার করে ঘর চালায় না।তোমার সংজ্ঞাকৃত আশ্রিতারা বোধহয় সেসব করে তাই না?’
খোঁচা বিভিন্নভাবে দেওয়া যায়।নবনীতা যেহেতু ভণিতা পছন্দ করে না,তাই সে সোজাসাপ্টাই সবটা বলে দিলো।সে আশ্রিতা নয়।শুভি আর চিত্র কেউই আশ্রিতা নয়।তাদের নামের পাশে এ ধরণের শব্দ কেন সহ্য করবে নবনী?এই বাড়ির ভাত রুটি খাওয়ার জন্য নবনীকে অত্যন্ত পরিশ্রম করতে হয়েছে।জীবনের সব আনন্দ বিসর্জন দিতে হয়েছে।কেবল একটু সম্মানের আশায়,কটু কথা থেকে বাঁচার আশায়।
প্রথা রাগে গজরাতে গজরাতে বলল,’উদ্ধার করেছ তুমি আমাদের।আমরা ধন্য তোমার কাছে।এবার যাও নিজের ঘরে যাও।আমার বাবা আর আমার মাঝে ঢুকবে না।’
নবনীতা তাকে এড়িয়ে গেল পুরোপুরি।তার কথায় বিন্দুমাত্র কর্ণপাত না করে সে গিয়ে সাদেক সাহেবের মুখোমুখি দাঁড়ালো।বিনয়ী সুরে জানতে চাইলো,’কি হয়েছে মামা?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’
সাদেক সাহেবের দু’চোখ জলে টইটুম্বুর।মুখটা একদম পাংশুটে দেখাচ্ছে।বিবর্ণ চোখ দু’টো অনেক কিছু বলতে গিয়েও কিছুই বলতে পারছে না।শুধু নবনীতার সাথে চোখ মিলতেই ক্লান্ত স্বরে বললেন,’কিছু না মা।তুই ঘরে যা।সবে তো এসেছিস।যা গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে নে।’
নবনী তক্ষুনি গেল না বরং আরো কিছু সময় চুপচাপ ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে রইল।প্রথা নিজে নিজে কতোক্ষণ সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে শেষটায় হনহনিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।সে বেরিয়ে যাওয়ার পর নবনীতাও বিনা বাক্য ব্যয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে শম্বুক গতিতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
নিজের ঘরে আসার পরই নবনী গলায় পেঁচানো ওড়নাটা খাটের উপর ফেলে হাত পা ছড়িয়ে খাটের উপর পড়ে রইল।চিত্র খাটের এক কোণায় ঘুমুচ্ছে।নবনীতা সামান্য উঠে এসে চিত্রার পাশাপাশি বালিশে মাথা রাখল।
শুভ্রা বাড়ি ফিরেই বই খুলে বসেছে।তার কালকে ক্লাসটেস্ট।নবনী বালিশে মাথা রেখেই নিচু গলায় বলল,’এতো কি পড়ছিস শুভি?আয় আপাইয়ের কাছে আয়।মাথায় বিলি কেটে দিব।
শুভ্রানী তৎক্ষনাৎ বই বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠে এলো।গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এসে চিত্রাকে খাটের মাঝামাঝি এনে চিত্রার গা ঘেঁষে শুয়ে পড়ল।নবনীতা হাত বাড়িয়ে শুভ্রার চুলে আলতো হাতে বিলি কেটে দিচ্ছিল।চিত্রার গাল দু’টো চোখে পড়তেই নবনী আবার টপাটপ কয়েকটা চুমু খেল।মুচকি হেসে বলল,’চিত্রটা কি সুন্দর হয়েছে! তাই না শুভি?গাল দু’টো একদম মায়ের মতো হয়েছে দেখেছিস! কি সুন্দর লাগে আমার পাখিটাকে!তোরা দু’টোই হয়েছিস একেবারে রসগোল্লা।’
শুভ্রা ভেঙচি কাটল।গাল ফুলিয়ে বলল,’রসগোল্লা না ছাই! আমার আর চিত্র’র নাক বোঁচা।দেখতে কেমন যেন দেখায়।আমরা কেউ পরী আপাইয়ের মতো সুন্দর হতে পারিনি।’
নবনীতা গোল গোল চোখ করে তার কথা শুনল।দুষ্টুমি করে বলল,’তোরা কি আমাকে বিশ্ব সুন্দরী ভাবিস রে?’
শুভ্রা ঝটপট জবাব দিল,’ভাবি না।তুমি সত্যিই বিশ্ব সুন্দরী।জীবনে কতো জায়গায় গিয়েছি,কতো মানুষ দেখেছি।তোমার মতো এতো সুন্দর মানুষ দু’টো দেখিনি।আমি হলফ করে বলতে পারি খোলা চুলে যে ছেলে তোমাকে দেখবে,সে তোমার প্রেমে পড়বেই পড়বে।’
কথা শেষ হতেই শুভ্রানী জিভ কাটল।আবেগের চোটে সে একটা নিষিদ্ধ শব্দ উচ্চারণ করে ফেলেছে।সে ভয়ে ভয়ে পাশ ফিরল।দেখল নবনীতার হাসিহাসি মুখটা আচমকা কেমন গম্ভীর হয়ে গেছে।
নবনীতা চোখ পাকিয়ে জানতে চাইল প্রেম আবার কি শুভি?কেমন করে পড়ে?দেখি আমাকে একটু খুলে বল তো।’
শুভ্রা দ্রুত চোখ বন্ধ করে মুখের উপর কাঁথা টেনে নিল।এই মুহূর্তে যত দ্রুত সম্ভব ঘুমিয়ে পড়াই শ্রেয়।
সে চোখ মুখ ঢেকে ফেলতেই নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসল।বেচারি নির্ঘাত ভয় পেয়েছে কিছুটা।সে হাতের উপর ভর করে আধশোয়া অবস্থায় চিত্রার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো।শুভি তার মুখের উপর কাঁথা দিয়ে ঢেকে রেখেছে।নবনীতা কাঁথার উপর দিয়েই তার কপালে পর পর দু’বার চুমু খেল।তারপর নিজের বালিশে মাথা রাখতেই সেকেন্ডের মাথায় গভীর ঘুমে তার দু’চোখ বুজে এলো।
.
.
.
.
মিনিট দু’য়েকের একটা ভিডিও।সেই স্বল্প সময়ের ভিডিও ক্লিপটাই সচিবালয় থেকে শুরু করে শহরের একটা সাধারণ টং দোকান পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
সাবেক এমপি আজিজ হোসেনের ছেলে শেখ আরহামের রাস্তা অবরোধ করে সমাবেশ করার প্রতিবাদে একজন তরুণীর অনর্গল কথোপকথন।পুরোটা সময় তরুনীটি এক নাগাড়ে কথা বলে গেল।এক মুহূর্তের জন্যও থামল না,দমল না।কেবল স্পষ্টভাবে তুলে ধরল রাজনীতির একটি নোংরা দিক।
শত শত মানুষের পথ আটকে রেখে নিজের দলের সমাবেশ করা কোনো প্রশংসার কাজ না।যদিও সব নেতারাই এই কাজ করে।তবে সব জায়গায় তো আর নবনীতা নামের বাঘিনীরা থাকে না।আরহামের কপাল খারাপ।ঘটনাটা ঘটেছে তার সমাবেশ কে কেন্দ্র করে।তার ভাগ্য আরো এক জায়গায় তার সহায় হয়নি।যেই অ্যাম্বুলেন্স টি দীর্ঘসময় জ্যামে আটকে ছিল,সেটার ভেতরে থাকা রোগী গাড়িতে থাকা অবস্থাতেই পরলোকগমন করলেন।একেবারে মরার উপর খরা বাগধারার মতো ব্যাপার।
চারদিক থেকে একেকটা ফোনকলে আরহাম জর্জরিত হয়ে ওঠল।প্রশাসনিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা,নিউজ রিপোর্টার,আইনজীবি প্রায় সকলেই প্রশ্ন আর সমালোচনার তোপে ফেলে তাকে কুপোকাত করে দেওয়ার চেষ্টা করল।সারাদিন একটানা ছুটোছুটি করে আরহাম শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি কিছুটা সামাল দিতে পারল।তবে এই পর্যন্ত আসার জন্য তাকে বহু বেগ পোহাতে হলো।দেখা গেল যেই মানুষ কোনোদিন আরহামের সামনে দাঁড়িয়ে কিছু বলতে পর্যন্ত পারেনি,আজ সেই মানুষই সুযোগ বুঝে তাকে কথা শুনিয়ে দিলো।কথায় কথায় বোঝাতে চাইল আরহাম রাজনীতি সামলানোর মতোন দূরদর্শী এখনো হয়ে ওঠেনি।
আরহাম সারাদিনের ক্লান্তি শেষে বাড়িতে ফিরে সোজা তার ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার ছেড়ে কিছুক্ষণ তার নিচে দাঁড়িয়ে রইল।চোখ তার সেই সকাল থেকেই রক্তিম।দীর্ঘসময় পানিতে ভেজার দরুন তা আরো বেশি ভয়ংকর দেখাল।
আরহাম মুষ্টিবদ্ধ হাতটা দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।সে আজকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ বন্ধ করতে পারছে না।চোখ বন্ধ করলেই তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে আজ সকালের ঘটে যাওয়া সমস্ত দৃশ্য।আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে সবটা সহ্য করেছে আজ।
ঝমঝম শব্দ করে শাওয়ার থেকে পানি পড়ছে ফ্লোরে।আরহাম শ্যাম্পুর বোতল থেকে শ্যাম্পু বের করে নিজের মাথা নিজেই কয়েকবার চটকালো।দুঃখে কষ্টে নিজেই কয়েকবার দেয়ালে মাথা ঠুকল।কেন?কেন?কেন?কেন এমনটা হলো?তার সাথে ঐ নবনীতার কি শত্রুতা?আরহাম তার কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে?সব ছেড়ে ঐ মেয়ের চোখে শুধু আরহামই কেন পড়ে?
রিমির কলটা প্রথমবারেই নবনীতা ধরতে পারেনি।গোসল শেষে যখন সে ফোনটা হাতে নিল,তখন নিজ থেকেই আবার কল দিলো তাকে।রিমি জানাল আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার আসতে হবে।একটা ফর্ম পূরণ করতে হবে।
নবনীতা কলটা রেখেই আলমারি ঘেটে একটা গেরুয়া রঙের কামিজ বের করল।জামা পরে সে প্রথমেই সাদেক সাহেবের ঘরে গেল।সাদেক সাহেব তখন আধশোয়া হয়ে পত্রিকা পড়ছিলেন।নবনীতা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চাপা স্বরে বলল,’মামা আসি?’
সাদেক সাহেব পত্রিকা থেকে চোখ সরিয়ে নবনীতাকে দেখামাত্রই উঠে বসার চেষ্টা করলেন।নবনীতা এক ছুটে তার কাছে গিয়ে তার কাঁধে দু’হাত রেখে বারণ করল,’আহা মামা করছ কি?উঠতে হবে না।শুয়ে থাকো তুমি।’
সাদেক সাহেব আর ওঠার জন্য কোনো তাড়া দেখালেন না।উল্টো নবনীতার দু’হাত নিজের দু’হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলেন।ক্ষীণ কন্ঠে বললেন,’কেমন আছিস পরী মা?’
নবনীতা নিশ্চুপ হাসল।মিষ্টি করে জবাব দিলো,’আমি ভালো আছি মামা।তুমি কি রাগ হয়েছ গত দু’দিন তোমার কাছে আসিনি বলে?আমার খুব মাথাব্যথা ছিল মামা।তুমি কষ্ট পাওনি তো?’
সাদেক সাহেব মলিন মুখে হাসলেন।কাশতে কাশতে বললেন,’রাগ কেন করব মা?তুই বাদে আর আমার কাছে আসে কে?’
নবনীতা মিনিট কয়েক সেভাবেই চুপ করে বসে রইল।তারপর মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে ধীরে ধীরে বলল,’মামা তুমি চিন্তা করো না।আমি চাকরি খুঁজছি।ভালো বেতনের একটা চাকরি পেলেই তোমার অপারেশন করাব।এরপর আর তোমায় এমন সারাদিন শুয়ে থাকতে হবে না।তুমিও সবার মতো করে হাঁটবে।একটু অপেক্ষা করো মামা।চাকরিটা শুধু পেতে দাও আমায়।’
সাদেক সাহেব কান্না থামালেন।দু’টো তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললেন,’কাঁদছি না রে মা।তোর কথা ভাবছি।এই যে আমরা এতোগুলো মানুষ তোর ওপর বোঝা হয়ে আছি,আর তুই কতো হাসিমুখে সবকিছু সামলে নিচ্ছিস।এইটুকু শরীরটার উপর আর কতো অত্যাচার করবি?আমার চেয়ে চিকিৎসাটা তোর বেশি প্রয়োজন পরী।’
‘আহ মামা।রাখো তো এসব কথা।আমি একদম সুস্থ আছি।’
নবনীতা কিছুসময় নিরব থেকে আবার নিজ থেকে বলতে লাগলো,’বাবা মা’র মৃত্যুর পর পৃথিবীটা কেমন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল মামা।তখন শুভি আর চিত্রকে নিয়ে আমার মনে হচ্ছিল আমি কোনো মরুভূমিতে দাঁড়িয়ে আছি।শুকনো মরু,ধু ধু প্রান্তর,চারিদিকে কোথাও কেউ নেই।সেই দিনগুলোর মতো অসহায় আমার আর কোনোদিন লাগেনি মামা।মা নেই,বাবা নেই,মাথার উপর কোনো ঠাই নেই।সেই চরম দুর্দিনে তুমি আমাদের একটা ঠাঁই দিয়েছ মামা।মাথার উপর একটা ছাদ জোগাড় করে দিয়েছ।তোমার অসুস্থতার আগ পর্যন্ত তুমি আমাদের আগলে রেখেছ,কোনোদিন একটাও মন্দ কথা বলোনি।অসুস্থ হওয়ার পরেও আমার অনুপস্থিতিতে চিত্র আর শুভিকে দেখে রেখেছ।তুমি বাদে আমাদের আর আছে কে মামা?আমরা কি করে তোমার অবদান ভুলতে পারি?’
সাদেক সাহেব জড় পদার্থের মতো নিশ্চুপ বসে রইলেন।নবনীতার কন্ঠ জড়িয়ে আসল,কিন্তু চোখ দিয়ে সামান্য জলও এলো না।সেই দু’টো চোখে সাদেক সাহেব বহু বছর ধরে জল দেখেন নি।সাদেক সাহেব টের পেলেন মেয়েটি অনন্যা।প্রেম আর প্রতিবাদের এক অনন্য মেলবন্ধনে তার নারীসত্ত্বাটি ঝলমল করে ওঠে।দুই বোনের জন্য তার ভেতরে আদর আর ভালোবাসার কোনো সীমা নেই,,ঠিক একইভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদে তার মধ্যে প্রতিরোধ আর বিদ্রোহের কোনো কমতি নেই।সে সত্যিই পরী,মানুষের মাঝে মিশে থাকা একটা চমৎকার সুন্দর পরী।
সাদেক সাহেব আবারো তার আগের কথার পুনরাবৃত্তি করলেন।শ্বাস টেনে বললেন,’নিজের স্বাস্থ্য নিয়ে অবহেলা করিস না পরী।পারলে এই সপ্তাহেই একবার চেক-আপ টা করিয়ে নে।’
নবনীতার হাসিহাসি মুখটার হাসি মিলিয়ে গেল সহসা।সে দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে তার ভ্যানিটি ব্যাগটা একপলক দেখল।এই মাসে তার হাতে একটা টাকাও অবশিষ্ট নেই।যাতায়াতের জন্য শ’আটেক টাকা আছে বোধহয়।বাকি টাকা পুরোটাই খরচা হয়ে গেছে।ডাক্তার দেখানোটা আর সম্ভব না,অন্তত এই মাসে না।
সে সাদেক সাহেবের হাত থেকে তার দু’টো হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিরবে উঠে দাঁড়ালো।মুখে জোরপূর্বক হাসি ফুটিয়ে বলল,’ঠিক আছে মামা,দেখাব ডাক্তার।এখন আমি আসি।ভার্সিটিতে একটা কাজ আছে।তুমি কিছু খাবে?কিছু খেতে ইচ্ছে হয়?আমি আসার সময় নিয়ে আসব।’
সাদেক সাহেব হাত নাড়লেন,ব্যস্ত হয়ে বললেন,’আমার কিচ্ছু লাগবে না পরী।তুই তোর চেক-আপ টা করা মা।’
নবনীতা কথা না বাড়িয়ে দ্রুত বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।যাওয়ার আগে মনে করে একটা প্যারাসিটামল খেয়ে নিল।কাল রাত থেকেই তার মাথা ঘুরছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে তার ঘন্টাখানেক লেগেছে।এই রাস্তায় বাস চলে না।হাঁটতে হাঁটতে তার পা ব্যথায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল।অবশেষে তার পথ ফুরালো।নবনীতা তার গন্তব্যে পৌঁছুল।
কার্জন হলের ভেতর প্রবেশ করেই নবনী চারদিকে চোখ বুলিয়ে রিমিকে খোঁজার চেষ্টা করল।শেষটায় বাধ্য হয়ে তাকে কল করল।রিমি কল ধরেই চেঁচালো,’ডানদিকে ফির নবনী।এই যে আমি।লাল কুর্তি।’
নবনী ফোন কানে চেপেই ডানদিকে ফিরল।অনেক দূরে লাল জামা গায়ে একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে।নবনীর থেকে তার দূরত্ব এতোটাই বেশি যে নবনী তার মুখটাও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল না।রিমি প্রায় দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ছুটে এলো।নবনীতার মুখোমুখি হতেই কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’নবনী তুই কি কোনোদিনই সময় মতো আসতে পারিস না?কতোক্ষণ ধরে বসেছিলাম আমি!’
নবনীতা কথা না বাড়িয়ে অফিস কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল।যেতে যেতে বিরক্ত মুখে বলল,’এখন তো এসে গিয়েছি।এখন চল।এমনিতেই মাথা ঘুরছে।আগে কাজটা শেষ করে নেই।’
অফিস থেকে ফর্ম তুলে সেটা পূরণ করে পুনরায় অফিসে জমা দিতে আরো ঘন্টা খানেক সময় লাগল।কাজ শেষ হতেই রিমি প্রস্তাব দিলো টিএসসির মোড়ে যাওয়ার।নবনীতা একহাত মাথায় চেপে কাঁপা গলায় বলল,’আজ না রে রিমি।ভীষণ মাথা ব্যথা করছে আজ!’
রিমি আর জোরাজুরি করল না।নবনীতা জোরাজুরির মেয়ে না।তাছাড়া সে মিথ্যা বলে না।সে সত্যিই অধিকাংশ সময় অসুস্থ থাকে।রিমি আলতো করে তার হাতটা নবনীতার কাঁধে রাখল।এই সামান্য সহমর্মিতায় নবনীতার মুখটা খুশি খুশি হয়ে গেল।সে একগাল হেসে রিমির গাল টেনে বলল,’খুব সুখি হ রিমি।আচ্ছা একটা কথা,বাড়িতে যে বলছিলি বিয়ের আলোচনা চলছে সেটা কতোদূর?’
‘গত সপ্তাহে ছেলে পক্ষ এসেছিল।মনে হচ্ছে বিয়েটা হয়েই যাবে এইবার।’
‘আরে বাবা!চমৎকার ব্যাপার তো!! বিয়ে করে আবার আমায় ভুলে যাসনে রিমি।’
রিমি ম্লান হাসল।সাইড ব্যাগের ফিতা টানতে টানতে বলল,’কেবল কথাই চলছে।এখনো কিছু শিওর না।শিওর হলে সবার আগে তোকেই জানাব।’
জবাবে নবনীতাও মিষ্টি করে হাসল।রিমি হচ্ছে গোলাপজামের মতো মিষ্টি একটা মেয়ে।শহরে তাদের একটা বাড়িও আছে।রিমির বিয়ে নিশ্চয়ই রাজপুত্রের মতোই কারো সাথে হবে।নবনীতা চায় রিমি সুখে থাকুক,ভালো থাকুক।অসহ্যকর পৃথিবীতে যে গুটি কয়েক মানুষকে নবনীতার ভালো লাগে তাদের মাঝে রিমি একজন।
রিমির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নবনীতা সোজা সিটি কলেজের পথ ধরল।দোয়েল চত্ত্বরে আসতেই যানবাহনের বিশাল লাইন দেখে আপনাআপনি তার কপালে ভাঁজ পড়ল।
সিএনজি আর গাড়ির ভিড়ে ঠিক মতো পা ফেলা যাচ্ছে না।মাথার উপর সূর্যের তেজ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে।নবনীতা একহাত শক্ত করে মাথায় চেপে ধরল।ব্যাগের মধ্যে পানির বোতল রাখা ছিল।সে ঢকঢক করে একটানে পুরোটা পানি খেয়ে শেষ করল।
চারদিক থেকে গাড়ি আর সিএনজির হর্ণে এলাকাটা মুহূর্তেই মাছ বাজারের রূপ নিয়েছে।সে কোনোরকম এলোমেলো পা ফেলে সামনে এগিয়ে এলো।সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যটি কে জিজ্ঞেস করল,’সামনের রাস্তা তো ফাঁকা।তাহলে গাড়ি থামিয়ে রেখেছেন কেনো?’
পুলিশ সদস্যটি পান চিবুতে চিবুতে দাঁত বের করে জবাব দিলো,’শাহবাগে আজ সমাবেশ চলছে।তাই এই রাস্তায় ঘন্টা দু’য়েকের জন্য যান চলাচল বন্ধ।’
নবনীতা হতবুদ্ধি হয়ে তার কথা শুনল।অভিব্যক্তি দেওয়াও তার জন্য দুষ্কর।এরকম একটা ব্যস্ত রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকতে পারে?তাও এতো ঠুনকো কারণে?একটু পর যখন সে বুঝতে পারল ট্রাফিক পুলিশ সত্যি সত্যিই দুই ঘন্টা রাস্তা ব্লক করে রাখবে তখন তার মেজাজ ভয়ংকর রকম বিগড়ে গেল।সে ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,’এসব কি ধরণের খেয়াল খুশি?সমাবেশ সম্মেলন যা খুশি হোক,তাই বলে রাস্তা ব্লক করবে?রাস্তা কি কারো পৈত্রিক সম্পত্তি?’
ট্রাফিক পুলিশটি তার কথা কানেও তোলেনি।উল্টো এমনভাব করল যেন নবনীতার কথায় সে ভীষণ বিরক্ত।নবনীতা পেছন ফিরে বিস্তীর্ণ গাড়ির সারি দেখে আবার সামনে ফিরে ট্রাফিক পুলিশের বুথের দিকে এগিয়ে গেল।সেখানে দুই জন পুলিশ অফিসার ছিল।নবনীতা তাদের কাছে অভিযোগ করল।জানতে চাইলো ঠিক কোন আইনে ঘন্টার পর ঘন্টা এভাবে রোড ব্লক করা হয়েছে।এটা অন্যায়,স্পষ্ট অন্যায়।
প্রথমেই তার দিকে যেই পুরুষ সদস্যটি এগিয়ে এলো তার বুকের কাছে ব্যাচের উপর নাম লিখা মোবারক।মোবারক নামের মাঝবয়সী লোকটা তার সামনে এসেই দায়সারা ভাব নিয়ে বলল,’দেখুন মেডাম।আমাদের এসব নিয়ে বলবেন না।আমরা কেবল উপর মহলের অর্ডার মেনে চলি।উপরমহলের নির্দেশ আছে।সমাবেশ শেষ হওয়া পর্যন্ত গাড়ি ছাড়া যাবে না।’
নবনীতা বাকরুদ্ধ হয়ে শুধু তার কথা শুনে গেল।তারপর বিনা বাক্য ব্যয়ে চুপচাপ সেখান থেকে সরে এলো।কয়েকটা গাড়ি থেকে যাত্রীরা বেরিয়ে এসে ট্রাফিক পুলিশদের সাথে তর্কে জড়িয়েছে।তবে পুলিশ সদস্যরা অনড়।উপরমহলের আদেশ,না মানলে চাকরি থাকবে না।
নবনীতা চলেই যাচ্ছিল,ঠিক তখনই কয়েকটা গাড়ি পেছনে কোনো একটা গাড়ি থেকে বিকট স্বরে কারো আর্তনাদের শব্দ তার কানে এলো।ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে ওঠল সাথে সাথে।এই আর্তনাদ গুলো নবনী সহ্য করতে পারে না।তার মাথা ঘুরে,গলা শুকিয়ে যায়,মনে হয় এক্ষুনি সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে।
লোকজন ইতোমধ্যে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আওয়াজের উৎস খোঁজার চেষ্টা করল।ভিড়ের মধ্যে থেকেই কেউ একজন বলে উঠল,’ভাই পেছনের অ্যাম্বুলেন্সে এক্সিডেন্টের রোগী।সময়মতো হাসপাতালে না নিলে পথেই মরে যাবে।’
মুহূর্তেই চারদিকে গুঞ্জন শুরু হলো।কেউ কেউ ঘটনা দেখতে এগিয়ে এলো,কেউ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখল,কেউবা আবার নানারকম পরামর্শ দিলো।অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার গাড়ির জানালা গলিয়ে মাথা বের করে জানালেন গাড়িটা কোনোরকমে ঘুরিয়ে অন্য রাস্তায় নিতে পারলেও হবে।অন্তত সেই ব্যবস্থাটা যেন করা হয়।কিন্তু দেখা গেল রাস্তার অবস্থা এমন যে গাড়ি ঘুরানোর জায়গা পর্যন্ত নেই।
নবনীতা ভঙ্গুর কাঁপা কাঁপা পায়ে এগিয়ে গেল।গাড়ির ভেতর থেকে একটা মেয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে।একটু পর পর আর্তনাদ করে যাচ্ছে।প্রচন্ড গরমে চারদিকে হাঁসফাঁস অবস্থা।দু’দিন আগেই তুমুল বৃষ্টি,এখন আবার কাঠফাটা রোদ।
আচমকা গাড়ি থেকে একটি মেয়ে হুড়মুড় করে বেরিয়ে এলো।তারপর এক দৌঁড়ে রাস্তার কিনায় গিয়ে গরগর করে বমি করল।নবনী বোকার মতো শুধু সবকিছু দেখেই গেল।সহসা তার চোখ গেল গাড়ির ভেতর।গাড়ির ভেতর একজন পুরুষ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।তার মাথা ফেটে অঝর ধারায় রক্ত গড়াচ্ছে।কি বিভৎস দৃশ্য! স্ট্রেচারে শুয়ে থাকা লোকটা কথা বলছিল না,কেবল মুখ দিয়ে অদ্ভুত রকম শব্দ করে যাচ্ছিল।শব্দের সাথে সাথে তার মুখ দিয়ে রক্ত ঝরছিল।
নবনীর গা গুলিয়ে এলো।লোকটার ঘোলাটে চোখ দু’টো দেখেই তার অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেল।ইশশশ!! কতোটা কষ্ট পাচ্ছে লোকটা।হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।স্ট্রেচারে শুয়ে গোঙাতে থাকা লোকটা হাত বাড়িয়ে নবনীকে ডাকল।কাতরাতে কাতরাতে বলল,’নবনী!! আমার সাহসী মেয়ে।শুভি আর চিত্র’র খেয়াল রেখ।বাবা হয়ত থাকব না।কিন্তু তুমি তাদের পাশে থাকবে।আর সবসময় মনে রাখবে বাবা তোমাদের খুব ভালোবাসি।’
নবনীতা ছিটকে দু’কদম পিছিয়ে গেল।কানের কাছে বিকট শব্দে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে।আকাশে মেঘের গর্জন।সেই গর্জনের সাথে মাঝবয়সী লোকটার আর্তনাদ ভেসে এলো,’পালাও পরী! শুভি আর চিত্র কে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যাও।বাবা হয়ত থাকব না।কিন্তু বাবার মেয়েরা থাকবে।পালাও পরী।তুমি আমার সাহসী মেয়ে।পালাও! পালাও! পালাও!’
নবনীতা দুই হাত কানে চেপে বিকট স্বরে চিৎকার করে ওঠল।পথচারীরা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে তাকে দেখা শুরু করল।প্রচন্ড তেষ্টায় নবনীর গলা দিয়ে শব্দ পর্যন্ত আসছিল না।
নবনীতা আর কোনো দিকে দেখলো না।দু’হাতে কান চেপে সে উন্মাদের মতো ছুটল শাহবাগের দিকে।ট্রাফিক পুলিশরা হতভম্ব হয়ে রোবটের মতো কেবল দাঁড়িয়ে রইল যার যার জায়গায়।নবনী ছুটল তো ছুটতেই থাকল।তার কান দু’টোতে একই শব্দ বার বার এসে ধাক্কা খাচ্ছে,
‘পালাও! পালাও! পালাও!’
(৩)
পল্টনে যেই বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল,সেই সমাবেশটা সফলভাবে শেষ হয়েছে।শুধু আরহাম না,সে বাদেও দলীয় আরো অনেক নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রেখেছে।সেই সাথে আসন্ন নির্বাচনে কেনো আরহামকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত সেই নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলল।আরহাম যেমনটা ভেবেছিল,দেখা গেল সমাবেশ আরো বেশি সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।বিরোধী দলের লোকরা কোনো ক্যাচাল করা তো দূর,সমাবেশ চলাকালীন সময়ে পল্টনের আশে পাশেও প্রবেশ করতে পারল না।
সমাবেশ শেষ করে যদিও আরহামের পরিকল্পনা ছিল দলীয় কার্যালয়ে যাওয়া,কিন্তু হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন আসাতে আরহাম সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সোজা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিল।
গুলশান রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে যেই বাসাটিতে তারা থাকে,সেটা তার বাবা বছর দশেক আগে বানিয়েছেন।অফ হোয়াইট রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটির নাম আজিজ ভিলা।তার প্রয়াত পিতার নাম শেখ আজিজ হোসেন।
বাড়িতে আসার পরেই সবার প্রথমে তার সাথে আফরোজা বেগমের দেখা হলো।আফরোজা বেগম সোফায় পা তুলে টেলিভিশন দেখছিলেন।আরহাম বাড়িতে আসামাত্রই তিনি রিমোট ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।
আরহাম ডানে বামে না দেখে সোজা দোতালায় উঠে এলো।তাসনুভার ঘরের দরজা সামান্য ভিড়িয়ে রাখা।আরহাম দরজার সামনে গিয়ে গলা খাকারি দিল,’তাস!আসবো?’
ভেতর থেকে আহ্লাদী স্বর ভেসে এলো,’আরহাম ভাই।তাড়াতাড়ি এসো।’
আরহাম পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে ঘরে ঢুকল।খাটের মাঝামাঝি তাসনুভা বসে আছে।তার এক হাত হাঁটুর উপর,অন্য হাত আরিশের হাতের মুঠোয়।খাটের এক পাশে সিটি হসপিটালের এসিস্ট্যান্ট নার্স শাহানা খাতুন ইঞ্জেকশনের সুই হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।আরহাম এগিয়ে গেল।জানতে চাইল,’কি হয়েছে তাস?তুই নাকি ঠিক মতো মেডিসিন নিচ্ছিস না,ইন্জেকশন দেখলেই চেঁচামেচি করছিস?’
তাসনুভার চোখ দু’টো পানিতে টইটম্বুর।যেনো ভাইয়ের আসার অপেক্ষাতেই সে পানিটুকু জমিয়ে রেখেছিল।ভাইকে দেখামাত্র সে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিল।চমকে ওঠল আরহাম।আর কিছু না ভেবে সে সোজা তাসনুভার মুখোমুখি এসে বসল।তার হাঁটুর উপর রাখা হাতটা নিজের মুঠোয় চেপে বিচলিত আর ব্যস্ত হয়ে বলল,’কি হয়েছে তাস?কাঁদছিস কেনো?ভাইয়া এসেছি তো।কি হয়েছে বল।’
তাসনুভা জবাব দিল না।সে কান্না থামাতে ব্যস্ত।আরিশ আশাহত মুখ করে বলল,’তাস কিছুতেই ইঞ্জেকশন নিতে চাইছে না ভাইয়া।গতবার অনেক জ্বর এসেছিল,এই ভয়ে সে আজ সকাল থেকেই শাহানা আন্টির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।আমি অনেক বুঝিয়েছি ভাই।কিন্তু সে কিছুতেই কথা শুনছে না।বললেই কেবল কান্না করছে।’
আরহাম ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে আবার তাসনুভার দিকে ফিরল।তাসনুভা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,’ভাইয়া অনেক যন্ত্রণা হয়।সহ্য করতে পারি না আমি সেই যন্ত্রণা।’
বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠল আরহামের।সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের এক কোণায় ফেলে রাখা হুইল চেয়ারটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।সামনে ফিরে তার ডানহাতটা তাসনুভার মাথার উপর রেখে অত্যন্ত কোমল হয়ে বলল,’আমি জানি তাস।আমি জানি তুই কতোখানি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস।কিন্তু সারাজীবন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার চাইতে এখন একটু যন্ত্রণা সহ্য করে নেওয়া ভালো না বল?একটু কষ্ট কর।দেখবি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠবি।’
‘ভাইয়া আমি কি কখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব?’ তাসনুভার সরল সোজা প্রশ্ন।
আরহাম ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল।তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,’অবশ্যই তাসনুভা।অবশ্যই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।আমি কথা দিচ্ছি তোমায়।তুমি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠবে।’
তার কথার পিঠে আরিশ নিজ থেকে বলে ওঠল,’তুই এতো কেনো ভাবছিস তাস?তুই কেবল মেডিসিন আর ইঞ্জেকশন গুলো সময় মতো নিয়ে যা।এরপর দেখবি কখন যে নিজ পায়ে হাঁটার বদলে দৌঁড়ানো শুরু করেছিস টেরও পাবি না।’
তাসনুভা ভেজা চোখ দু’টো মেলে তার দুই ভাইকে একনজর করে দেখল।তারপর ভয়াতুর কন্ঠে বলল,’আমি ঠিক হবো তো ভাইয়া?আজ রাতে আবার জ্বর আসবে না তো?’
আরহাম ধৈর্যহারা হলো না।বরং আগের চেয়েও কোমল হয়ে বলল,’কিচ্ছু হবে না তাস।ভাইয়া আজকে তোমার সাথেই থাকবো।’
শাহানা ভরসা পেয়ে ইঞ্জেকশনটা একবার পরোখ করে নিয়ে খাটের ধাঁর ঘেঁষে দাঁড়াল।তাসনুভা শক্ত করে তার দুই ভাইয়ের হাত চেপে ধরল।বোকাসোকা মেয়েটি টের পেল দুই ভাইয়ের শক্ত মুঠোর দাপটে তার ভয় ভয় ভাব কেটে যাচ্ছে।তার আর ভয় হচ্ছে না।মনে হচ্ছে না আজ রাতে তীব্র জ্বর আর মাংসপেশীর অসহনীয় যন্ত্রণায় তার কেমন লাগবে।শুধু মনে হচ্ছে আরহাম ভাইয়া আর আরিশ ভাইয়া থাকতে তার কোনো দুঃখ নেই,কোনো কষ্ট নেই।
ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর শাহানা খাতুন তাসনুভাকে আরো কয়েকটা ঔষধ খাইয়ে দিলেন।দেখা গেল ঔষধগুলো খাওয়ার মিনিট দশেকের মাথায় তাসনুভা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।আরহাম আর আরিশ ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।আরিশ জানতে চাইল সমাবেশ কেমন হয়েছে।আরহাম মাথা নাড়ল,ছোট করে বলল,’ভালোই হয়েছে।এখন শুধু ভালোয় ভালোয় নমিনেশন টা পেলেই হলো।’
দুপুর তিনটা বাজার কিছু সময় পর আরহামের ফোনে ওয়াজিদের কল এলো।আরহাম ঠিক মতো ফোন রিসিভ করার আগেই ওয়াজিদ হড়বড় করে বলল,’আরহাম তুই কোথায়?দ্রুত মালিবাগ থানায় আয়।টিটু আর মিরনকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে।’
কথা কানে যেতেই আরহাম তৎক্ষনাৎ একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল।সে সবেমাত্র গোসল করেছে।ভেজা চুলগুলো থেকে পানি পড়ে তার কলারের দিকটা সিক্ত হয়ে আছে।
আরহাম গাড়িতে উঠেই সোজা মালিবাগ থানার পথ ধরল।আজ রাস্তায় তেমন মানুষ নেই।আরহাম তার পাজেরো গাড়িটি একপ্রকার উড়িয়ে এনে মালিবাগ থানার সামনে থামাল।
থানার গেইটে ওয়াজিদ দু’হাত আড়াআড়ি রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।আরহামকে দেখতেই সে দু’কদম এগিয়ে এলো।আরহাম জানতে চাইল কোথায় আছে তারা।ওয়াজিদ তর্জনী তুলে থানার ভেতরের একটা রুম দেখাল।
আরহাম তার ট্রাউজারের পকেটে একহাত গুজে হেলেদুলে ভেতরে গেল।ইন্সপেক্টর রিদওয়ান হাফিস তখন তার ডেস্কে বসে অভিযোগ খাতায় কিছু একটা লিখছিল।আরহাম রুমে ঢুকেই ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।গলা উঁচু করে অভিবাদন জানাল,’আসসালামুআলাইকুম ইন্সপেক্টর সাহেব।’
রিদওয়ান অভিযোগের ডায়রি থেকে মাথা তুলল। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখামাত্রই সে এক লাফে উঠে দাঁড়াল।সালাম দিয়ে বলল,’স্যার আপনি?’
আরহাম গম্ভীর মুখ করে প্রশ্ন করল,’শুনেছি তুমি নাকি আমার দলের দু’জন ছেলেকে লক-আপে পুরেছ আজ?’
রিদওয়ান কপাল কুঁচকে নিল তার কথা শুনতেই।সহসা তার কপাল মসৃণ হলো।কিছু একটা বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নেড়ে সে বলল,’ঐ ছেলেগুলো আপনার দলের ছিল?সরি স্যার,জানতাম না আমি এ বিষয়ে।’
আরহাম টেবিলের সামনে রাখা কাঠের চেয়ারটি টেনে তার উপর বসল।পায়ের উপর পা তুলে বলল,’দোষ কি করেছিল এমনিতে?মারপিট করেছিল নাকি?’
‘না স্যার।এরা দু’জন একটা মেয়েকে ফলো করছিল।ফলো করতে করতে মালিবাগ পর্যন্ত এসে গিয়েছিল।পরে মেয়ের বোন এদেরকে ধরে এনে আমার হাতে তুলে দিয়েছে।’
আরহাম বিষম খেল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি অদ্ভুত!মেয়ে করেছে এসব?’
‘জ্বী স্যার।একেবারে রোগা পাতলা একটা মেয়ে।সাথে আবার অভিযোগও দায়ের করেছে।’
আরহাম উপরনিচ মাথা নাড়ল।টেবিলের উপর রাখা পেপারওয়েট টা একবার শূন্যে ছুড়ে আবারো নিজের মুঠোর পুরে নিল।তারপর ধারাবাহিক ভাবে একই কাজ বার বার করতে লাগল।মাঝখানটায় ভরাট পুরুষালি কন্ঠে আদেশের সুরে বলল,’যাও তাদের কে বের করে আনো।’
রিদওয়ান ছুটল লক-আপের দিকে।দুই মিনিটের মাথায়ই সে তার পেছনে টিটু আর মিরনকে নিয়ে হাজির হলো।আরহাম এদের মুখের অবস্থা দেখেই চোখ কপালে তুলে বলল,’কিরে তোদের মুখের এই অবস্থা হয়েছে কেনো?কে মেরেছে তোদের?’
মিরন ঠোঁটের চারপাশে লেপ্টে থাকা রক্তটুকু মুছে নিল।তাদের হয়ে জবাব দিল রিদওয়ান।আফসোস করে বলল,’আরে স্যার,আর বলবেন না।ঐ মেয়ের বোনই তাদের এই অবস্থা করেছে।বেচারাদের লাঠিপেটা করতে করতে থানায় এনেছে ঐ মেয়ে।’
আরহাম দু’হাত বুকে বেঁধে উঠে দাঁড়াল।ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল কে সেই মেয়ে?নাম কি?
রিদওয়ান দ্রুত অভিযোগের ডায়রিটা হাতে নিল।অভিযোগকারী ব্যক্তিটির নাম দেখতেই সে গলা ছেড়ে উচ্চারণ করল,’নবনীতা নূর।সেই অভিযোগ টা করেছে।’
আরহাম শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।তার কপালের শিরা গুলো ফুলে যাচ্ছে।রাগে তার শরীর রি রি করছে,দাঁত কিড়মিড় করছে।ঐ নবনীতার দাবাংগিরি বন্ধ হয়নি।আরহাম নিরুত্তর থাকায় ঐ পাজি মেয়েটা নিজেই তার দলের লোকদের লাঠিপেটা শুরু করেছে।মেয়েদের এসব দস্যিপনা আরহামের বড্ড অপছন্দ।মেয়েরা হবে কোমল,স্নিগ্ধ,বহমান নদীর মতো শান্ত।একেবারে তাসনুভার মতো।মেয়েদের কে তো এমনই মানায়।মেয়েরা কেনো নবনীতার মতো ত্যাদড় আর জেদি হবে?জেদ শব্দের সাথে মেয়েদের সম্পর্ক কি?এসব জেদ আর তেজ মেয়েদের সাথে যায় না।
আরহাম দুই বার বড়ো করে শ্বাস নিল।রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতেই মিরন আর টিটুকে দেখে বলল,’চল বাইরে চল।’
মিরন আর টিটু চুপচাপ মাথা নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।ওয়াজিদ বাইরেই হাঁটাহাঁটি করছিল।আরহামকে দেখতেই সে এগিয়ে এলো।আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল,’তুই এই খবর কোথা থেকে পেয়েছিস ওয়াজিদ?’
ওয়াজিদ ক্ষীণ স্বরে উত্তর করল,’আমি মালিবাগ এসেছিলাম একটা কাজে।তখনই মানুষের ভিড় দেখে কৌতূহল বশত এগিয়ে গিয়েছিলাম।তখনই পুরো ঘটনা বুঝতে পারলাম।’
‘যখন সামনে থেকে দেখেছিস,তখন ঐ মেয়ের গালে দু’টো কষিয়ে চড় বসাতে পারলি না?এতো স্পর্ধা পায় কোথা থেকে?’
ওয়াজিদ চমকে ওঠল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’তাকে মারব কেনো?দোষ তো তোর দলের ছেলেরা করেছে।একটা মেয়েকে ফলো করা কি কোনো ভালো কাজ?আমি তো এখানে নবনীতার কোনো দোষ দেখছি না।’
আরহাম চোখা চোখে একনজর তাকে দেখে নিল।বিদ্রুপ করে বলল,’বাপরে!খুব নবনীতার গান গাওয়া হচ্ছে দেখছি!’
‘জাস্ট শাট আপ আরহাম।সবকিছু নিয়ে ক্রিটিসাইজ করা বন্ধ কর।ফর গড সেক,’একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠল ওয়াজিদ।
‘ওকে।যেমনটা তুই বলবি।’ আরহাম মেকি হেসে জবাব দিল।
আরহাম পাশ ফিরল।টিটু আর মিরন একেবারে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।না নড়ছে,না কিছু বলছে।আরহাম গলা খাকারি দিল,ভরাট কন্ঠে বলল,’এই যে রোমিওদের দল!এসব টাফালিং আর কতোদিন চলবে?রোজ রোজ তোদের থানা থেকে ছুটিয়ে নিতে কে আসবে?কাল থেকে একটু সীমার মধ্যে থাকবে কেমন?’
দু’জন রোবটের মতোই মাথা নেড়ে জানাল তারা এখন থেকে নিজেদের সীমার মধ্যেই থাকবে।আরহাম প্রসন্ন হেসে বলল,’গুড।মনে থাকে যেন।এখন সোজা বাড়ি যা।’
ছেলে দু’টো মাথা নেড়ে থানার গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেল।আরহাম দু’হাত বগলদাবা করে মিনিট খানেক থানার প্রাঙ্গণে সটান দাঁড়িয়ে রইল।মাঝখানে আবার ট্রাওজারের পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে সেখানটায় সময় দেখে নিল।ওয়াজিদ আড়চোখে পুরোটা সময় তার কার্যকলাপ দেখে গেল,তবে মুখ ফুটে কিছু বলল না।দু’জনের মধ্যে কিছুসময় স্নায়ুযুদ্ধ চলার পর শেষে আরহাম কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’চল গাড়িতে এসে বস।এখানে ভীষণ রোদ।গরম লাগছে আমার।’
.
.
.
.
ষোলো বছর বয়সী কিশোরী মেয়েটির ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া শরীরটা তখনও থরথর করে কাঁপছিল।দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণের দরুন মুখ থেকে অদ্ভুত ধরনের শব্দ বের হচ্ছিল।
নবনীতা শুভ্রানীর গায়ে একটা কাঁথা মেলে দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।শুভ্রার ভয়ে তটস্থ শরীরটা বোনের শক্ত আলিঙ্গনে বেড়াল ছানার মতো মিইয়ে গেল।সে দু’চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ছেড়ে বলল,’আপাই আমার খুব ভয় করছে।চলো না আপাই,আমরা শহর ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই।’
‘শুভি!!’ ছোট খাটো একটা ধমক দিল নবনীতা।
‘এসব কেমন কথা শুভি?আমরা কেনো পালাবো?দোষ কি আমাদের?শোন শুভি,পৃথিবীটা ওতো সোজা না।ওমন বেড়ালের মতো থাকলে শহর কিংবা গ্রাম কোথাও গিয়েই বাঁচতে পারবি না।একটু শক্ত হতে হবে সোনা।আমরা তো কোনো পাপ করছি না তাই না?তাহলে আমরা কেন পালাবো?পাপ করছে তারা যারা বিনা দোষে একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করছে।আমরা কেনো তাদের ভয়ে নিজেদের কেই গুটিয়ে নিব?কতোবার গুটিয়ে নিব?কতোবার পিছু হটলে তারা খুশি হবে?বলতে পারিস আমাকে?’
শুভ্রানীর তরফ থেকে কোনো উত্তর আসে না।সে কেবল তার হাতের বন্ধন আরো দৃঢ় করে।আপাইয়ের দুর্বল শরীরটায় কেমন যেন আদর আদর গন্ধ মিশে আছে।শুভ্রা কি সত্যি সত্যি কোনো বেড়াল?না হয় সবকিছুতে এতো ঘ্রাণ খুঁজে নেয় কেমন করে?শুভ্রা আপাইয়ের জীর্ণ শীর্ণ শরীরের উপর নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে পড়ে রইল দীর্ঘসময়।নবনীতা তাকে সরাল না,বরং আরেকটু কাছে টেনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল,কপালে চুমু এঁকে দিল।
শুভ্রা কেবল বয়সেই বেড়েছে।আচরণে এখনো সেই ছোট্ট শুভিই রয়ে গেছে।ছোট বেলায় যেমন বিলি কেটে দিলে কয়েক মিনিটেই ঘুমিয়ে কাদা হতো,এখনও তাই।দেখা গেল দশ মিনিট পরেই সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।নবনীতা সাবধানে তার মাথাটা বালিশে রেখে নিরবে উঠে এলো।
চিত্রা ফ্লোরের উপর তার খেলনা বিছিয়ে হাড়ি পাতিল খেলছিল।নবনীতা পা টিপে টিপে তার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল।পেছন থেকে তাকে চমকে দেওয়ার জন্য অকস্মাৎ শব্দ করে ওঠল,’ভাউ!!’
চিত্রা সত্যি সত্যিই ভয়ে কেঁপে ওঠল।নবনীতা খিলখিল করে হেসে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরল।তার লাল লাল গাল দু’টোতে খুব দ্রুত চুমু খেয়ে বলল,’কিরে!ভয় পেয়েছিস চিত্র?’
চিত্রা ভয় পেয়েছি নাকি বোঝা গেল না।তার মুখে ভয়ের কোনো ছাপ নেই,তবে চোখে দু’টোতে কেমন অদ্ভুত মুগ্ধতা মেশানো আছে।নবনীতা হাসি থামিয়ে ভ্রু উঁচু করে বলল,’কিরে?ওমন হা করে কি দেখছিস?আপাই কে কি আজ প্রথম দেখছিস?’
চিত্রা উত্তর না দিয়ে উল্টো হাত বাড়িয়ে নবনীতার গালে আঙুল ছোঁয়াল।নবনীতা বোকা বোকা মুখ করে চুপচাপ বসে রইল।চিত্রার চোখ দু’টো হুট করেই কেমন ঝকমক করে ওঠল।সে চোখ বড় বড় করে বলল,’তুমি যখন হাসো,তখন তোমাকে সিন্ড্রেলার মতো লাগে আপাই।’
চব্বিশ বছরের একটা বাঙালি মেয়ের সাথে যখন ফ্রান্স পুরাণের কোনো অনিন্দ্য সুন্দর কাল্পনিক চরিত্রের তুলনা করা হয় তখন তার জবাবে ঠিক কি বলতে হয়,তাও একটা ছয় বছর বয়সী বাচ্চাকে সেটা নবনীতার জানা নেই।সে উত্তর না দিয়ে কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে চিত্রার উৎসুক আর প্রাণবন্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল।
চিত্রা ইদানিং নিজ থেকে একটু একটু পড়তে পারে।তাকে গত মাসে নবনীতা বেশ কিছু গল্পের বই কিনে দিয়েছে।সেখানে সিন্ড্রেলার গল্পটাও ছিল।খুব সম্ভবত শুভ্রানী তাকে এই গল্পটা পড়ে শুনিয়েছে।
চিত্রা আরো একবার বলল,’পরী আপাই!তুমি সত্যিই সিন্ড্রেলার মতো দেখতে।’
নবনীতা চোখ পাকাল।জানতে চাইল,’তুই কেমন করে জানলি সিন্ড্রেলা দেখতে কেমন ছিল?’
চিত্রা হাত নেড়ে নেড়ে বলল,’শুভি আমায় বলেছে।বলেছে সিন্ড্রেলা দেখতে একেবারে পরীর মতো।’
নবনীতা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে দেখে পরক্ষণেই আবার খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল।হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে গেল।চিত্রা হা করে সেই দৃশ্য দেখল।তার আপাই এত্তো সুন্দর?অথচ সে এর আগে কোনোদিন খেয়াল করে নি।সে লাজুক হেসে বলল,’তোমাকে সবসময় সিন্ড্রেলা লাগে না আপাই।যখন তুমি হাসো তখনই তোমাকে সিন্ড্রেলার মতো লাগে।’
নবনীতা আজ অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসল।হাসতে হাসতে তার গাঢ় খয়েরি চোখে কয়েকবার পানি এসে জমল।সে হাসিহাসি মুখ করে চিত্রাকে বলল,’না রে সোনা।আমি সিন্ড্রেলা নই।আমার জুতো সব আমার কাছেই আছে,কোনোটাই হারায়নি।’
নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসল।দুষ্টুমি করে বলল,’তা আমারও বুঝি রাজকুমার আছে?’
চিত্রা জেদ ধরল।জোর গলায় বলল,’আছে।সত্যি সত্যি আছে।দেখবে সে তোমাকে টুপ করে ধরে নিয়ে যাবে।’
‘তারপর?তারপর টুশ করে বিয়ে করে নিবে?’ নবনীতা হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।
চিত্রার মনঃক্ষুন্ন হলো।সে মন খারাপ করে বলল,’ভালো লাগে না আপাই।সবকিছুতে তুমি মজা করো।’
নবনীতা আবারো চট করে তার দুই গালে চুমু খেয়ে তাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বলল,’আচ্ছা আর মজা করব না।এবার তাহলে সত্যি কথা বলি।এসব সিন্ড্রেলা ফিন্ড্রেলা বলতে বাস্তবে কিছু নেই।ওগুলো সব গল্প।বাস্তবে না সিন্ড্রেলা আছে,না রাজকুমার আছে,আর না আছে সিন্ড্রেলার জাদুর জুতো।’
নবনীতা চুলগুলোকে কোনোরকম খোপায় বেঁধে চিত্রার খেলনা গুলো হাতে নিয়ে নিয়ে দেখল।অথচ সে জানল না পরী নামের সিন্ড্রেলার রাজকুমার সত্যিই এসে গেছে।বোকা নবনী বুঝলো না জুতো না হারালেও সিন্ড্রেলা হওয়া যায়।তবে সব রাজপুত্র তো আর একরকম হয় না।নবনীতার রাজপুত্র একটু ভিন্ন।কিছুটা এলোমেলো,কিছুটা মাথা গরম,আবার কিছুটা একরোখা।
মালিবাগ রেলক্রসিং আসতেই তার মুঠোফোন টি যান্ত্রিক শব্দে চতুর্থবারের মতো বেজে উঠল।নবনীতা আর সেটিকে ব্যাগ থেকে বের করল না।সে জানে কে ফোন করছে।সে একহাত রিকশার নামিয়ে রাখা হুডের উপর চেপে ধরে অনুনয়ের সুরে বলল,’আপাই চলে এসেছি সোনা।একটু অপেক্ষা কর।’
আজ নবনী একটা ভয়ংকর দুঃসাহসিকতার কাজ করেছে।মতিঝিল থেকে মালিবাগ পর্যন্ত সে সোজা রিকশা নিয়ে এসেছে।এই কাজ সে সচরাচর করে না।কেবল শুভ্রানী অথবা চিত্রা সাথে থাকলেই সে এই তিন পায়া যানে চলাচল করে।নয়তো তার জন্য লোকাল বাসই সবচেয়ে উত্তম পরিবহন।আরো ভালো হয় যদি পায়ে হেঁটে পথটুকু অতিক্রম করা যায়।
আজকের ঘটনা আলাদা।আজকে নবনীর শরীর ভালো নেই।সকাল থেকেই মাথা ঘুরছে,বুকে ব্যথা হচ্ছে।এই ক্লান্ত মূর্ছা যাওয়া শরীর নিয়ে লোকাল বাসে উঠে নতুন ঝামেলা বাধাতে সে ইচ্ছুক না।সে চাইছে দ্রুত বাড়ি ফিরতে।চিত্র নিশ্চয়ই এতোটা সময় তাকে না পেয়ে কাঁদছে।শুভি নিজেই তো ছোট মানুষ।সে আর চিত্রকে কেমন করে সামলাবে!
নবনীতা ঠিক বরাবর সাতটার দিকে বাড়িতে এসে পৌঁছাল।বাড়ির বাইরে কলিংবেল আছে।অন্যসময় সে ইচ্ছে করেই বেল বাজাতো।কিন্তু আজ সে তার ব্যাগে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি ব্যবহার করে একদম আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।বসার ঘরের বাতি নিভিয়ে রাখা হয়েছে।
নবনীতা পা টিপে টিপে তার শোয়ার ঘরের সামনে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো।চিত্রা আর শুভ্রানীকে দেখা যাচ্ছে।শুভ্রানী রং দিয়ে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করছে।ছোট্ট চিত্রা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে।
নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসলো।কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’শুভি!চিত্র!কোথায় তোমরা?’
শুভ্রানীর হাতের তিন আঙুলে চেপে রাখা রং পেন্সিলটা তক্ষুনি তার আঁকাআঁকি বন্ধ করে দিলো।দুই বোন তড়িৎ বেগে দরজার দিকে ফিরে বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল,’আপাই!!”
নবনীতা দ্রুত মুখে আঙুল চেপে শাসনের সুরে বলল,’আহা আস্তে!এতো জোরে কথা বলতে নেই।’
জোরে কথা বলা বারণ।কিন্তু ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরা তো বারণ নেই।শুভ্রানী আর চিত্রা সমস্ত কাজ ফেলে দিয়ে এক দৌঁড়ে তার দিকে ছুটে গেল।আছড়ে পড়ল চব্বিশ ছুঁই ছুঁই রমণীর দুর্বল বক্ষে।সেই বক্ষ পুরুষালী বক্ষের ন্যায় প্রশস্ত না।কিন্তু সেখানে স্বস্তি আছে,ভালোবাসা আছে,শুভ্রানী আর চিত্রার একটা সুন্দর অস্তিত্ব আছে।
দুই বোনকে মন ভরে আদর করার পর নবনীতা সামান্য ঝুঁকে চিত্রাকে কোলে তুলে নিল।চিত্রার ফোলা ফোলা গাল দু’টোতে চটপট চুমু খেয়ে মিষ্টি স্বরে বলল,’তুমি আজ আবার আপাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করেছ চিত্র?তোমাকে না আপাই বলেছি শুধু শুধু কাঁদবে না?বড় হচ্ছো না তুমি ধীরে ধীরে?’
চিত্রা ডানে বায়ে মাথা নাড়ল।সে কোথায় বড় হয়েছে?আপাইয়ের কাছে তো সে কোনোদিনই বড় হয়নি।সে তো এখনও ঐ ছোট্ট মেয়েটি আছে যার কাছে মা বাবা এমনকি পুরো পৃথিবীটাই তার পরী আপাই।
‘পরী!এ্যাই পরী?’
মিসেস রোকেয়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।নবনীতা চিত্রাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।রোকেয়া বেগম তাকে দেখা মাত্রই কর্কশ গলায় বললেন,’কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?’
নবনীতা জায়গায় জায়গায় রং উঠে যাওয়া দেয়ালের দিকে চোখ রেখে নিচু স্বরে বলল,’একটা কাজ ছিল মামি।সেখানে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।’
রোকেয়া বেগম থমথমে মুখে আবারো প্রশ্ন করলেন,’ভাড়ার টাকা জোগাড় করেছ?কাল কিন্তু ভাড়া দিতে হবে যে করেই হোক।বাড়ির মালিক রোজ রোজ ভাড়া চাইতে আসেন।আমি আর কতো টালবাহানা করব?কালকের মধ্যে টাকা না দিলে ভীষণ ঝামেলা হয়ে যাবে কিন্তু।’
নবনীতা এক মনে তার কথা শুনল।কথা শেষ হতেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের এক মাথায় গিয়ে বসলো।শরীরটা ক্লান্তিতে ছিঁড়ে যাচ্ছে।এই মুহূর্তে একটু ভালো কথা নিমিষেই তার মন ভালো করে দিতে পারে।কিন্তু মামি কি সেই কথা বুঝতে পারে?মামি কি অনুভব করতে পারে নবনীতা যে প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে?
নবনীতা পার্স ব্যাগ হাতড়ে হাতড়ে মোট পাঁচ হাজার টাকা বের করল।সেটাই মামির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিবশ কন্ঠে বলল,’আপাতত এটা রাখো মামি।কাল পরশু বাকিটা দিয়ে দিব।’
রোকেয়া বেগম এক খাবলায় পুরোটা টাকা নিজের হাতে নিলেন।কাটখোট্টা স্বরে বললেন,’ভাড়া কিন্তু ছয় হাজার।সাথে আবার গ্যাস কারেন্টও আছে।এ মাসে তো বাজারও করা হয়নি।সব মিলিয়ে আরো হাজার পাঁচেক লাগবে পরী।”
‘জোগাড় হয়ে যাবে মামি।আর দু’টো দিন অপেক্ষা করো।’
রোকেয়া বেগম শাড়ির আঁচলে নোটগুলো বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।শুভ্রানী খেয়াল করল তার পরী আপাই বৃষ্টির দিনেও দর দর করে ঘামছে।সে এক গ্লাস পানি হাতে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।কোমল গলায় ডাকল,’আপাই!’
‘কি হয়েছে?’দু’চোখ বুজেই জানতে চাইলো নবনীতা।
‘পানি খাও আপাই।তুমি কিন্তু আজকাল খুব ধকল নিচ্ছ।দয়া করে শরীরকে আর কষ্ট দিবে না আপাই।’
নবনীতা চোখ খুলে সামনে দেখল।তার সামনে পানির গ্লাস হাতে দাঁড়ানো ষোড়শী কন্যাটির চোখ দু’টো ভীষণ ঘোলাটে।মুখ জুড়ে বিষন্নতার ছড়াছড়ি।সে একটানে পানিটুকু খেয়ে শেষ করল।চিত্রা মনের আনন্দে খাটের উপর ছড়িয়ে রাখা রঙ পেন্সিল দিয়ে কাগজে আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছিল।নবনীতা হাত বাড়িয়ে ডাকল,’শুভি,এদিকে আয় তো।’
শুভ্রানী বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে এসে ঠিক তার আপাইয়ের গা ঘেঁষে বসল।নবনীতা তার ডানহাতের দুটো আঙুল পরম যত্নে তার চুলের ভাজে চালাতে চালাতে বলল,’তুই কেঁদেছিস শুভি?’
‘কেন কেঁদেছিস শুভি?আপাই আছি না?আপাই থাকতে তোদের কিসের কষ্ট শুনি?’
শুভ্রা নড়েচড়ে উঠল।চোখ দু’টোয় তার অশ্রু জমে চিকচিক করছে।দু’ফোঁটা জল তৎক্ষনাৎ মুক্তদানা রূপে ঝরে পড়ল।শুভ্রা ফুঁপিয়ে উঠল হঠাৎ করে,’আপাই আমার কলেজ যেতে ভয় করে।’
নবনীতা কোমল হাত দু’টো বাড়িয়ে তার চোখ মুছে দিলো।দু’হাতে শক্ত করে বোনকে আঁকড়ে ধরে বলল,’সেকি শুভি!কিসের ভয় তোর?আপাই বলেছি না আমি সব ঠিক করে দিব।চিন্তা করিস না শুভি।আপাই আছি তো বোকা মেয়ে।’
সুন্দর এই স্নেহের বাণী শুভ্রানীর কান্না থামালো না।বরং কিশোরী মেয়েটি তার কথা শুনতেই আগের চেয়ে বেশি শব্দ করে কেঁদে উঠল।হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,’তুমি আছো বলেই তো এতো ভালো আছি আপাই।তুমি না থাকলে কি হবে আমাদের?তুমি কেন নিজের এতো অবহেলা করো বলো তো?’
নবনীতা ভ্রু কুঁচকাল,’আমি কখন নিজের অবহেলা করলাম আবার?’
‘এই যে ঠিকঠাক ডাক্তার দেখাও না।আমাদের একটু জ্বর হলেই কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যাও আর নিজের বেলায় ঔষধ টুকুও কিনো না ঠিক মতোন।এসব করবে না আপাই।আমার খুব কষ্ট হয়।’
নবনীতা বিস্মিত নয়নে অপলক শুভ্রার আদুরে মুখটা দেখে নিল।বোকা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে।নবনী টের পেল তার দু’চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে,দুঃখে না বরং আনন্দে।এই শূন্য খা খা পৃথিবীটা যখন নবনীতার কাছে চরম অসহ্যের মতো মনে হয়,ঠিক তখনই শুভ্রানী আর চিত্রা নামের দু’টি নিয়ামত তার সাদাকালো জীবনে রংধনুর মতো আলো ছড়িয়ে দেয়।পুরো পৃথিবীর সাথে অঘোষিত লড়াই লড়তে লড়তে যখন নবনী খুব বেশি ক্লান্ত,তখন এই মানুষ দু’টো তাকে আগলে নেয়।
ক্লান্ত নিস্তেজ শরীরটা আলতো করে খাটের উপর ছেড়ে দিয়ে নবনীতা চোখ বুজে নিল।ঠোঁট দু’টোর মাঝে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে চঞ্চল কন্ঠে বলল,’আমার শরীর নিয়ে ভাবিস না শুভি।আমি একদম ভালো আছি।ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিতে দে।এরপরই একদম চাঙা হয়ে যাব।’
শুভ্রা ঘরের জানালার ভিড়িয়ে রাখা পর্দা টেনে দিলো।পাখার স্পিড কমিয়ে আলমারির তাক থেকে একটা কাঁথা নামিয়ে নবনীতার রুগ্ন শরীরটার উপর চাপিয়ে দিলো খুব যত্নে।নবনীতা ঘুমের ঘোরেই হালকা হাসল।শুভ্রা সেই অপরূপ স্নিগ্ধ সৌন্দর্য অবলোকন করে নিজ থেকেই বলল,’ইশশ!আমার পরী আপাই কতো সুন্দর!’
.
.
.
.
সমতট লেনের ছাব্বিশ নম্বর বাড়িটিতে লুবনারা ভাড়া থাকে।নবনীতা বাড়ির গেইটের কাছে এসেই কপালে লেগে থাকা ঘামটুকু মুছে নিল।কলিং বাজানোর পর প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে লুবনা ঝিমুতে ঝিমুতে দরজা খুললো।
নবনীতা তাকে দেখতেই কঠিন মুখ করে বলল,’এই অসময়ে ঘুমাচ্ছ?পরীক্ষার ডেইট দিয়ে দিয়েছে লুবনা।একটু তো পড়াশোনায় মন দাও।’
কথা শেষ করেই সে জুতো খুলে লুবনার পড়ার ঘরে গিয়ে বসলো।লুবনা চোখে মুখে পানি দিয়ে এক প্রকার বিরক্ত হয়ে পড়ার টেবিলে এসে বসলো।নবনীতা পদার্থ বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়েই মহাকর্ষ আর অভিকর্ষ নামক অধ্যায়টি খুলে জানতে চাইলো,’যেই ছয়টা প্রশ্ন দাগিয়েছিলাম,সেগুলো করেছ?’
লুবনা মাথা নাড়লো,জানাল সে করে নি।নবনীতা কড়া গলায় তাকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না।কেবল থমথমে মুখে বলল,’তাহলে এখন আগে সেগুলো করো।’
লুবনা হাই তুলতে তুলতে অঙ্ক করা শুরু করল।এই অধ্যায়টা এতো বিরক্তিকর কেন লুবনার জানা নেই।স্যাটেলাইট আকাশে গিয়ে কতো বেগে ঘুরবে এটা জেনে লুবনার কি কাজ?সে তো আর স্যাটেলাইট না।এটা তার জানার বিষয়ও না।স্যাটেলাইট নিজের মতো করে ঘুরছে ঘুরুক।এসব আবার লুবনাকে কেনো গুনে গুনে বের করতে হবে?লুবনা তো কোনো বিজ্ঞানী না।
নবনীতা গলা খাকারি দিলো।চোখ পাকিয়ে জানতে চাইল,’মনে মনে কি বিড়বিড় করছ লুবনা?আমাকে গালি দিয়ে লাভ নেই।আমি বই লিখিনি।’
‘জ্বী আপু।আপনাকে দিচ্ছি না।যারা বই লিখেছে তাদের কেই দিচ্ছি।’ লুবনা লিখার মাঝেই সোজাসাপ্টা জবাব দিলো।
নবনীতা জবাব শুনেই ফিক করে হেসে দিলো।পরক্ষণেই আবার হাসি থামিয়ে বলল,’গুড।ভেরি গুড।’
প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে লুবনার মা মিসেস ইয়াসমিন তার পড়ার ঘরে ঢুকে ঠিক নবনীতার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।তার হাতে কড়কড়ে পাঁচটা হাজার টাকার নোট।নবনী তার হাত দেখেই চোখ নামিয়ে নিল।ইয়াসমিন সুলতানা তার হাতের নোটগুলো নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,’এই নাও তোমার টাকা।’
নবনীতা হাত বাড়িয়ে চুপচাপ টাকাটা নিয়ে ব্যাগে পুরে নিল।মিসেস ইয়াসমিন বলতে শুরু করলেন,’শোনো নবনীতা,গত মাসে তুমি দুইদিন মিস দিয়েছ।জানি তুমি অসুস্থ ছিলে,কিন্তু মিস তো হয়েছেই তাই না?তাই এই মাসে তুমি যেকোনো দুই দিন মোট দুই বেলা এসে লুবনাকে পড়িয়ে দিবে বুঝেছ?’
নবনীতা মাথা নাড়ল।ছোট করে জানাল সে পড়িয়ে দিবে।মিসেস ইয়াসমিন আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না।শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।নবনীতা ব্যাগ হাতড়ে তার ইনহেলার টা বের করে দুইবার টেনে টেনে শ্বাস নিল।লুবনা গোল গোল চোখ করে বলল,’খারাপ লাগছে আপু?’
নবনীতা হাত নেড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,’না না ধুর।এমন কিছু না লুবনা।তুমি অঙ্ক করো,আমি ঠিক আছি।’
লুবনাকে পড়ানো শেষ করেই নবনীতা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো।দু’মাস আগে একটা কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে সে চাকরি নিয়েছে।অস্থায়ী চাকরি।আজ আছে কাল নেই এমন।তবে চাকরিটা নবনীর জন্য কোনো সোনার হরিণের চাইতে কম না।পার্ট টাইম জব হলেও বেতন পাওয়া যায় ছ’হাজার।এতো টাকার চাকরি নবনীতা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায় না।
সে বিকেল হতেই কুরিয়ার অফিসে এসে পৌঁছুল।আসার পথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল।অফিসের ভেতর ঢুকতেই সবার প্রথমে তার সাথে সুনীতির দেখা হলো।সুনীতি তার ঘামে ভেজা মুখটা দেখতেই একগাল হেসে বলল,’তোমার ছুটোছুটি আর থামবে না তাই না?এতো কষ্ট কি করে করছ নবনী?’
কুরিয়ার অফিসের কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সাতটা বেজে গেল।নবনীতা ক্লান্ত শরীরটা টেনে টেনে কোনোরকম বাড়ি এসে পৌঁছাল।দুপুর থেকেই তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ।এই মাসে তার ঔষধ কেনা হয়নি।মামার ঔষধ কেনার পর তার হাতে আর টাকা ছিল না নিজের ঔষধ কেনার মতো।
বাড়িতে আসতেই নবনী লক্ষ করল শুভ্রানী আজও কেমন উদাস হয়ে বসে আছে।নবনীতা হাত মুখ ধুয়ে ঠিক তার পাশটায় গিয়ে বসল।কাঁধে হাত রেখে তার নাম ধরে ডাকল,
‘শুভি!এ্যাই শুভি!কি হয়েছে তোর?মন খারাপ কেন?দেখি আপাইকে সব খুলে বল।’
শুভ্রানী জোরে জোরে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো তেমন কিছুই হয়নি,সব ঠিক আছে।অথচ সে জানে না পরী আপাই থেকে কিছুই গোপন করা সম্ভব না।নবনীতা অনেক চেষ্টার পর তার মুখ থেকে আসল ঘটনা বের করে আনতে সক্ষম হলো।জানা গেল আরহামের চ্যালা পেলা গুলো এখনো আগের মতো কলেজের সামনে ভিড় জমায়।মেয়ে দেখলেই ইশারা ইঙ্গিতে অসভ্যতা শুরু করে।
নবনীতা চোয়াল শক্ত করে তার কথা শুনল।শুভ্রার মুখটা কতো মলিন দেখাচ্ছে!নবনী বোনের গালে আলতো করে চুমু খেল।দখিনা হাওয়াতে শুভ্রার চুল উড়ছে।নবনীতা তেলের শিশি হাতে শুভ্রার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসল।শুভ্রার চুল অতো বড়ো না।পিঠ সমান।নবনীতা যত্ন করে তার সিঁথিতে অল্প অল্প করে তেল মালিশ করে দিলো।আরামে আবেশে শুভ্রার চোখ লেগে আসছিল।নবনী সমস্ত মনোযোগ তার মাথার উপর রেখে অনড় কন্ঠে বলল,’চিন্তা করিস না শুভি।এদের যদি একটা ব্যবস্থা না করি তবে আমিও নবনীতা নই।’
.
.
.
.
আজ পর পর দু’টো মিটিং হয়েছে।কাল সমাবেশ।সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য একটা স্ক্রিপ্টও রেডি করা হয়েছে।তোফায়েল স্ক্রিপ্ট টা টেবিলের উপর রেখে তার উপর পেপার ওয়েট রাখল।
এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে সে কিছুক্ষণ আরহামকে খোঁজার চেষ্টা করল।আরহাম আশেপাশে কোথাও নেই।সম্ভবত বিভিন্ন নেতাদের সাথে আলোচনা করছে কালকের সমাবেশ নিয়ে।সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে পল্টনের মোড়ে।মতিঝিল থেকে সামান্য রাস্তা।
আরহাম বেশ কিছুক্ষণ প্রবীণ নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনা করে তার রুমে এসে ইজি চেয়ারটা টেনে বসল।তোফায়েল জানতে চাইলো,’ভাই স্ক্রিপ্ট টা কি করবেন?এখন পড়বেন নাকি বাসায় গিয়ে?’
আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই নিরেট স্বরে বলল,’থাকুক এখানে।এটার প্রয়োজন পড়বে না আমার।আমি নিজ থেকেই বলতে পারব কথা।’
তোফায়েল মাথা নাড়ল।জানতে চাইল চা আনবে নাকি।আরহাম কেবল ডানে বায়ে মাথা নেড়ে জানাল তার প্রয়োজন নেই।তারপরই চেয়ারে ঠেস দিয়ে মাথাটা পেছনের দিকে ছেড়ে দিলো।
এমন সময় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে অফিস রুমের কাঁচের দরজাটা খুলে গেল।তোফায়েল দ্রুত পেছন ফিরল।অফিস রুমের ভেতর নীল জামা পরা একটি মেয়ের অস্তিত্ব টের পেতেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।আরহাম হাস্কি স্বরে শুধাল,’কে এসেছে তোফায়েল?’
‘আমি এসেছি’,কটমট করে জবাব দিলো নবনীতা।
সঙ্গে সঙ্গে আরহামের বুজে রাখা চোখ দু’টো খুলে গেল।এক লাফে আধশোয়া থেকে উঠে বসল সে।প্রথমবারেই মেয়েটিকে চিনতে পারল না।তারপর যখন মেয়েটি ক্রুদ্ধ পায়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে এলো,তখন শেখ শাহরিয়ার আরহামের নিকট তার পরিচয় স্পষ্ট হলো।
আরহাম চোখ সরু করে প্রশ্ন ছুড়ল,’তুমি?’
নবনীতা কোনো ভূমিকা কিংবা উপসংহারে গেল না।বরং তিক্ত কন্ঠে গিরগির করে উঠল,’আপনি বলেছিলেন আপনি ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন।অথচ আপনার ছেলেরা এখনও সেই আগের মতো একই কাজ করে যাচ্ছে।এসবের মানে কি?আপনি কেনো তাদের কিছু বলছেন না?আপনি তাদের,,,,’
‘মেয়েদের কাজ কি?’নবনীতার কথা শেষ হওয়ার আগেই স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন আরহামের।
প্রশ্ন শুনতেই নবনীতা ভড়কে গেল।চোখ উল্টে বলল,’কি?’
‘কথা কি একবারে বুঝো না?জানতে চেয়েছি মেয়েদের কাজটা কি?’আরেকটু জোরালো আর কঠিন শোনাল আরহামের কন্ঠ।
নবনীতা বোকার মতো কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।এটা কেমন প্রশ্ন?সে আমতা আমতা করে জবাব দিলো,’মেয়েদের কাজ পড়াশোনা করে মানুষ হওয়া।শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানো।আপনজনদের খেয়াল রাখা।আর,,’
এই উত্তরও পুরোপুরি দেওয়া হলো না তার আগেই আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।হাত তুলে বলল,’না হয়নি।এদের কোনোটাই মেয়েদের কাজ না।’
নবনীতা চমকাল।ফ্যালফ্যাল চোখ করে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো লোকটিকে দেখল।আরহাম পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,’মেয়েদের কাজ পড়াশোনা করা না।মেয়েদের কাজ সংসার করা,মেয়েদের কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া আর তাদের লালনপালন করা।’
আরহাম থামল।তার সামনে দাঁড়ানো তরুণীটির অবিশ্বাস্য চোখ দু’টো দেখে তার সামান্য হাসি পেল।নবনীতার মনে হচ্ছিল তার চোখ দু’টো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।একবিংশ শতাব্দীতে আসার পর কোনো ছেলের চিন্তাভাবনা এমন হতে পারে?এই যুগে এসেও কোনো ছেলে এমনটা ভাবতে পারে যে মেয়েদের কাজ শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া আর তাদের লালনপালন করা।নবনীতা প্রতিউত্তর করার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না।মুখ দিয়ে কোনো শব্দ সত্যিই বেরুচ্ছে না।
আরহাম পাঞ্জাবির কলার টেনে ঠিক করল।এলোমেলো চুলগুলোয় হাত ছুঁয়িয়ে খুব স্বাভাবিক কায়দায় বলল,’শুনুন মিস।মেয়েদের কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।তারা যদি সেই কাজ গুলো নিয়ে থাকতো তাহলে এমন হেনস্তার শিকার হতো না।কিন্তু যেই তারা খুন্তি ছেড়ে কলম হাতে নেওয়ার কর্মযজ্ঞে নেমেছে,সেই তাদের অবনতি হতে শুরু করেছে।ছেলেরা গঠনগত ভাবেই এমন।নারীদের প্রতি আমাদের আকর্ষণ চিরন্তন।সেটা কি আপনি জানেন না?আর তাছাড়া,,,’
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই আরহাম চট করে প্রশ্ন করল,’আপনার বোন হিজাব পরে?’
নবনীতা অতি বিস্ময়ে জবাব দেওয়া পর্যন্ত ভুলে গেল।সে এতোটাই আশ্চর্য হলো যে তাকে যে একটা প্রশ্ন করা হয়েছে সেটা পর্যন্ত তার মাথায় নেই।
আরহাম একনজর তাকে দেখে ভৎসনার সুরে বলল,’নিজেরই তো মাথায় কাপড় নেই।বোন আর কি হিজাব পড়বে!’
সূক্ষ্ম অপমানে আর খোঁচায় তেইশোর্ধ তরুণীর চোখ দু’টো রক্তিম হলো,কান দু’টো কেমন ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠল।কন্ঠে ফিরে এলো সেই চিরচেনা তেজ।এইবার গর্জন করে উঠল তার কন্ঠ,জানতে চাইলো,’আমি হিজাব পরি কি না পরি অথবা আমার বোন হিজাব পরে নাকি পরে না তাতে আপনার কি?বলতে চাইছেন আপনার দলের লাফাঙ্গাদের কোনো দোষ নেই?দোষ সব আমার,আমার বোনের,ঐ সকল মেয়েদের যারা হিজাব পরে না।তাই তো?আপনাদের সৃষ্টিগত দুর্বলতা আছে,তাই আপনারা মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করবেন।আর আমরা এর বিরুদ্ধে টু শব্দ টুকু করতে পারব না?’
আরহাম সূচালো চোখে নবনীতা নামের যুবতী মেয়েটিকে একনজর দেখে নিল।মেয়েটির কি শ্বাস কষ্টের সমস্যা নাকি?দু’লাইন বলতেই এমন হাঁপিয়ে গেল কেন?
আরহাম সিদ্ধান্ত নিল মেয়েটিকে সে আরো একটু হাঁপিয়ে দিবে।চুপচাপ নবনীতার চেয়ে শ্বাস টেনে টেনে কথা বলা নবনীতাকে তার বেশি ভালো লাগছে।আরহাম কুটিল হেসে আবার বলতে শুরু করল,’নবনীতা অর হোয়াট,আই ডোন্ট কেয়ার।একটা কথা শুনো।আমার সামনে নির্বাচন।নমিনেশন থেকে শুরু করে ইলেকশান পর্যন্ত প্রতিটা কাজে ঐ ছেলেগুলোকে আমার প্রয়োজন।তাদের কোনো কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না,আর আমি করতেও চাইছি না।তুমি বরং তোমার বোনকে একটু দেখেশুনে রাখো।কি হবে এতো পড়াশোনা করে?সেই তো স্বামীর টাই খাবে।তার চেয়ে ভালো দু’বোন মিলে রান্না শিখো।স্বামীর পাশাপাশি শ্বশুর বাড়ির বাকিদেরও খুশি রাখতে পারবে।মেয়েদের এসব দাবাংগিরি আমার একদম পছন্দ না।এখন তুমি আসতে পারো।খোদা হাফেজ।’
‘তার মানে আপনি আপনার দিক থেকে কিছুই করবেন না?’ নবনীতার সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।
আরহাম একপেশে হাসল,’নাহ।আমি কিছুই করব না।’
‘আমি কিন্তু পুলিশে কেইস করব বলে দিলাম’
‘ভেরি গুড।এটা আরো ভালো হয়।করে দেখতে পার নবনীতা।’ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উত্তর দিলো আরহাম।
নবনীতার চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠল।তার সামনে সটান দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশোর্ধ যুবকটির গা ছাড়া ভাব দেখতেই তার গা গুলিয়ে এলো।সেদিকে একবার ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নবনী থেমে থেমে বলল,’আপনি একটা জঘন্য লোক।আপনার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন।’
কথা শেষ করা মাত্রই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।তোফায়েল হা করে কিছুক্ষণ সেদিকে,কিছুক্ষণ আরহামের দিকে দেখল।আরহাম টেবিলের উপর রাখা স্ক্রিপ্ট টা হাতে তুলে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।তারপর হঠাৎ তার কি হলো কে জানে,পুরো কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সে নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
তোফায়েল শুকনো ঢোক গিললো।ভাইয়ের মাথায় কি চলছে তোফায়েল তা আন্দাজ করতে পারছে না।তবে ভাইয়ের মেজাজ খারাপের মূলে যে এই মেয়েটি,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
সূচনা পর্ব
#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(১)
‘শুনো আরহাম! রাজনীতি শব্দে নীতি থাকলেও বাস্তবে রাজনীতিতে এসব নীতি খাটে না।পলিটিক্সে ভালো কিছু করতে হলে নীতি ফিতি গুলি মেরে কেবল নিজের টার্গেটে ফোকাস করতে হবে।সেই টার্গেট অর্জন করার জন্য মাঝে মাঝে একটু পাষাণ,একটু অবিবেচক,একটু বেপরোয়া হতে হবে।মনে রাখবে,তোমার কর্মীরাই তোমার শক্তি।তুমি কিন্তু সব জায়গায় থাকতে পারবে না।তোমার কর্মীরাই তোমার ভরসা।সুতরাং কিছুতেই এমন কাজ করবে না যেটাতে তোমার দল হালকা হয় কিংবা তুমি কর্মী হারাও।বুঝেছো?’
মহানগর কার্যালয়ের যুগ্ম সম্পাদক জালালুর রহমান কথা শেষ করেই ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলেন।আরহামের চিন্তিত মুখটা দেখে বললেন,’আরে তুমি এতো টেনশন করছ কেন?নাও চা টা খাও।ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে চা।’
আরহাম চায়ের কাপ হাতে নিল।কিন্তু চুমুক দিলো না।ভীষণ ভাবুক হয়ে বলল,’যতো দিন ঘনাচ্ছে,চারপাশ থেকে চেনা অচেনা শত্রুরা সব মুখিয়ে আছে কিছু একটা করার জন্য।’
জালাল সাহেব শব্দ করে হাসলেন।চায়ের কাপে দ্বিতীয় চুমুক বসিয়ে বললেন,’পলিটিক্স ইজ নট আ কাপ অফ টি আরহাম।’
আরহাম মাথা ঝাকালো।তাই তো।কথা সত্য।জালালুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন।হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,’আজ তাহলে আসি আরহাম।পরে আবার কথা হবে।’
আরহাম চেয়ার থেকে উঠল না।বসে থেকেই জবাব দিলো,’জ্বী আঙ্কেল।আসসালামু আলাইকুম।’
জালালুর রহমান চলে যেতেই আরহাম বেশ আয়েশ করে পুরোটা চা শেষ করল।তার থেকে কিছুটা দূরে সোফায় ওয়াজিদ বসা,যে কি-না আধঘন্টা যাবত মাথা নিচু করে পা নেড়ে যাচ্ছে অনবরত।আরহাম তাকে একনজর দেখে আবার চোখ সরিয়ে নিল।চারদিকে চোখ মেলে একবার তোফায়েল কে খোঁজার চেষ্টা করল।
রাশেদ নিচু গলায় জানতে চাইলো,’কাকে খুঁজছেন ভাই?’
আরহাম এদিক ওদিক দেখতে দেখতেই জবাব দিলো ‘তোফায়েল কে।’
তোফায়েল এলো মিনিট দশেকের মাথায়।আরহাম ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো আজ কি কোনো মিটিং হচ্ছে নাকি?
তোফায়েল জানাল আজ যেই একটি মিটিং হওয়ার ছিল,সেটা বৃষ্টিতে বাতিল করা হয়েছে।
আরহাম মৃদু হেসে আবেশে চোখ বুজে নিল।আজকের জন্য তবে একটু শান্তি পাওয়া গেল।এই কয়দিন টানা মিটিংয়ে শরীরে বিরক্তি ধরে গেছে।শেখ শাহরিয়ার আরহাম ইদানিং টের পাচ্ছে রাজনীতি বিষয়টা অত্যন্ত কঠিন।দেখতে বড্ড সহজ মনে হয়,তবে একবার এসবে ঢুকে গেলে বের হওয়া মুশকিল।আরহাম অবশ্য সেসব নিয়ে বিচলিত নয়।রাজনীতি তার রক্তে মিশে আছে।এই জিনিসটা সে তার প্রতিটা ইন্দ্রিয় থেকে অনুভব করতে পারে।আরহাম রাজনীতিতে নতুন না।সে জন্ম থেকেই রাজনীতি দেখে আসছে।রাজনীতি তার নেশা,ইদানিং আবার পেশাও।
সময়টা তখন শ্রাবণের মাঝামাঝি।শ্রাবণের দিনগুলো কেমন যেন ছন্নছাড়া।সকাল বেলা আবহাওয়া কিছুটা ভালো যেতেই বিকেল হতে না হতেই ঝুম বৃষ্টিতে পুরো শহর ভেসে যায়।
আজও তেমনই একটি দিন।সকালবেলা আকাশ ছিল স্বচ্ছ,একবারে পরিষ্কার।সেই আকাশই দুপুরের পর থেকে মেঘলা আর কালো হতে হতে শেষ পর্যন্ত মুষলধারে বৃষ্টিতে রূপ নিয়েছে।টানা একঘন্টা ঝমঝম বৃষ্টির পর আকাশ কিছুটা শান্ত হয়েছে।একটু আগেই থেমে থেমে বাজ পড়ছিল।এখন সবকিছুই শান্ত,নিবিড় আর কিছুটা থমথমে।
টানা বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট ভিজে এখানে সেখানে পানি জমে ছিল।এলাকার চায়ের দোকান গুলোতে তখন কমবেশি মানুষের ভিড়।রাস্তায় স্বাভাবিকের তুলনায় লোকজনের সংখ্যা খুব সীমিত।
আতিক হোসেনের চায়ের দোকানে তখন চুমুকে চুমুকে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনার ঝড় উঠেছে।রনি দোকানের সামনে থাকা রঙ উঠে যাওয়া বেঞ্চিতে বসেই দুই আঙুল উঁচু করে বলল,’আতিক মামা।আরো দু’কাপ চা দেও।’
আতিক নামের মধ্য বয়স্ক লোকটি হাসিমুখে চা বানানোর কাজটি করে যাচ্ছিলেন।বৃষ্টিতে সব ব্যবসা বন্ধ হলেও চায়ের ব্যবসায় প্রচুর লাভ।লোকে বৃষ্টির দিনে কয়েকদফা চা খায়।আকাশের অবস্থা দেখে আতিক হোসেনের মনে হচ্ছে আজ তার ব্যবসা খুব ভালো জমবে।
ঠিক তখনই তার ছোট্ট টং দোকানে আবির্ভাব হলো জীর্ণ শীর্ণ দেহের অল্পবয়স্কা একটি তরুণীর।তরুণীর পরনে হালকা বেগুনি রঙের সাদামাটা পোশাক।হাতে একটা সাদা রঙের পার্স।গলায় ধূসর রঙের স্কার্ফ প্যাঁচানো।কোমর সমান চুলগুলো বেণী করে অতি অবেহেলায় একপাশে ফেলে রাখা হয়েছে।ছোট ছোট কিছু চুল বেণী ছেড়ে বেরিয়ে এসে বারবার মুখের উপর পড়ছে।তরুণীটি একটু পর পর বিরক্ত হয়ে সেগুলো কানের পিছে গুজে দিচ্ছে।
আতিক দু’কাপ চা রনির হাতে তুলে দিয়ে পাশ ফিরতেই মেয়েটি মৃদু স্বরে ডাকল,’আসসালামু আলাইকুম চাচা।একটা দরকার ছিল।একটু সাহায্য করতে পারবেন?’
আতিক তীক্ষ্ণ চোখে মেয়েটিকে আগাগোড়া পরোখ করে নিল।পোশাক দেখে ভদ্র ঘরেরই মনে হচ্ছে।এক দুইবার দেখে নেওয়ার পরেই সে সন্দিহান গলায় জানতে চাইলো কি সাহায্য?
মেয়েটি এদিক ওদিক দেখে ঠান্ডা গলায় বলল,’আপনি কি আমাকে জনাব শাহরিয়ার আরহামের পার্টি অফিসের খোঁজ দিতে পারবেন?আমার একটা দরকার ছিল।’
তার প্রশ্নে কেবল আতিক না,পুরো দোকানের ছেলেপেলেরা চোখ বাঁকিয়ে তাকে দেখলো।দোকানে তখন তোফায়েলও ছিল।সে তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করল,’কেন?আরহাম ভাইয়ের অফিসে যাবেন কেন?সেখানে আপনার কি কাজ?’
তোফায়েল আশা করেছিল তার প্রশ্নে মেয়েটি কিছুটা বিব্রত কিংবা অপ্রস্তুত বোধ করবে।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।উল্টো মেয়েটি তার দিকে এক কদম এগিয়ে এসে শক্ত মুখে জবাব দিলো,’কাজ কি সেটা আপনাকে কেন বলব?আপনি কি শেখ আরহাম?’
পাল্টা প্রশ্নে তোফায়েল বিষম খেল।চোখ বড় বড় করে দেখলো তার সামনে দাঁড়ান মেয়েটির কঠোর মুখখানা,অনুভব করল মেয়েটির কন্ঠে ভীষণ তেজ।সেই তেজের কাছে তোফায়েলের টিকে থাকার সাধ্যি নেই।সে কথা বাড়ায় না।কেবল সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,’আমার সাথে আসুন।আমি শেখ আরহামের অফিসেই যাচ্ছি।’
বাইরে বৃষ্টি থেমেছে অনেক আগে।বৃষ্টির পরে একটা মিষ্টি আর শরীর জুড়ানো বাতাসে আরহামের চোখ বুজে এলো।বারবার ঘুমে তার শরীর অবসন্ন হয়ে ওঠছে।আরহাম তামজিদ কে ডেকে বলল রুমের জানালাটা খুলে দিতে।এই নাতিশীতোষ্ণ বাতাসটা বেশ উপভোগ্য।এই বাতাস গায়ে মাখলে শরীর খুব ফুরফুরে আর চাঙা থাকে।
স্নিগ্ধ,ঘোলাটে আর বৃষ্টিমুখর আবহাওয়ায় যেই না আরহামের দু’চোখ তন্দ্রাঘোরে লেগে আসছিল,ঠিক তখনই কলিং বেলের কর্কশ শব্দে সেই ঘুম পুরোটাই উবে গেল।আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিলো।ওয়াজেদ সোফায় হেলান দিয়ে বলল,’কেউ এসেছে মনে হয় তোর সাথে দেখা করার জন্য।’
আরহাম ঘাড় মালিশ করতে করতে তামজিদ কে ডেকে নিদ্রাচ্ছন্ন কন্ঠে আদেশ দিলো,’যা গিয়ে দেখ কে এসেছে।ভেতরে নিয়ে আয়।’
আরহাম একহাত চোখের উপর রেখে ইজিচেয়ারে গা ছেড়ে দিয়ে বড়ো করে দু’বার শ্বাস নিল।কিছু গানের লাইন মাথায় আসছে হঠাৎ।গাইবে কি?এখানে কেউ নেই তেমন।সামান্য গাইতে দোষ কোথায়?
আরহাম গুনগুন করে সুর তুলল,
“তুমি আকাশের বুকে,
বিশালতার উপমা।
তুমি আমার চোখেতে,
সরলতার প্রতিমা।
আমি তোমাকে গড়ি,
ভেঙেচুরে শতবার।”
‘আসসালামু আলাইকুম’
রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠটি কানে যেতেই আরহাম গুনগুন বন্ধ করে চোখের সামনে থেকে হাত সরালো।ঠিকঠাক চোখ খুলতেই দেখলো তার টেবিলের সামনে ছিমছাম গড়নের একটি মেয়ে দাঁড়ানো।চোখ মুখ শক্ত।ভাব এমন যেন আরহাম আর তার এই পার্টি অফিসের সাথে তার দীর্ঘদিনের শত্রুতা।
আরহাম গম্ভীর মুখে দু’চোখ সরু করে মেয়েটিকে আপাদমস্তক দেখে নিল।মেয়েটি অধৈর্য হয়ে নিজ থেকেই আবার বলল,’আমার একটা কথা ছিল জনাব।বিশেষ প্রয়োজনে একপ্রকার বাধ্য হয়েই এখানে আসতে হয়েছে আমার।’
বেগুনি পোশাক পরা তরুণী কিছু বলার আগেই আরহাম নিজ থেকে প্রশ্ন করল,’নম্বর বাড়িয়ে পাশ করিয়ে দিতে হবে তাই তো?’
তার প্রশ্নে মেয়েটি ভড়কে গেল।আশ্চর্য হয়ে জানতে চাইলো,’জ্বী?নম্বর বাড়াতে হবে মানে?’
আরহাম বিরক্ত হলো।তৎক্ষনাৎ মুখ কুঁচকে নিল।সুদর্শন মুখটার পরতে পরতে বিরক্তি মিশিয়ে বলল,’মানে আবার কি?এসব ভণিতা ছাড়ো।তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়ে গুলোর এই এক সমস্যা।পড়াশোনা করো না ঠিকঠাক,তারপর পরীক্ষায় পাও আন্ডা।সেই ক্যাচাল সহ্য করতে হয় আমাকে।ভাই আর এমন হবে না,এবার থেকে মন দিয়ে পড়ব,এবারের মতো পাশ করিয়ে দিন স্যারকে বলে-তোমাদের এসব ঘ্যান ঘ্যান শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে।দেখি বলো,তোমার রোল বলো।প্রফেসরের সাথে কথা বলে পাশ করিয়ে দিব।আর শোনো,পরবর্তীতে ভার্সিটিতে যখন আমাদের দলের মিছিল হবে,তখন যেন তোমায় অবশ্যই সেখানে দেখতে পাই।মনে থাকবে?’
আরহাম কথা শেষ করেই কলমদানি থেকে একটা মার্কার পেন হাতে নিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা কাগজ বের করল।দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পরেও যখন মেয়েটির তরফ থেকে কোনো জবাব এলো না,তখন আরহাম একপ্রকার বিরক্ত হয়ে প্রশ্ন করল,’কি সমস্যা তোমার?স্পিক আপ!রোল কতো তোমার?’
তরুণী মেয়েটি কিছুক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখলো।তারপর নিরব নিস্তব্ধ ঘরটির ঠিক মাঝামাঝি দাঁড়ানো তরুণীটি অকস্মাৎ দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’আমি কোনো নম্বর বাড়ানোর উদ্দেশ্যে এখানে আসিনি।আমার অবৈধভাবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই।অতীতেও কোনোদিন হইনি,আর ভবিষ্যতেও কখনো হবো না।’
মেয়েটির কন্ঠে তেজ ছিল,অহংকার ছিল,সেই সাথে ছিল প্রতিবাদ আর বিদ্রোহ।সেই কন্ঠের তীব্রতা এতো বেশি ছিল যে আরহাম তার তিন আঙুলে চেপে রাখা মার্কারটা ফেলে সোজাসুজি মেয়েটির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।
মেয়েটি আরো এক কদম এগিয়ে একেবারে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়াল।একবার জোরে শ্বাস টেনে সোজা আরহামের চোখ বরাবর দেখে বলল,’সিটি কলেজের সামনে আপনার দলের ছেলেরা মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে।এটা আজকে কালকের ঘটনা না,এই কাজটা তারা রোজ রোজ করে।আজকে আমার ছোট বোন কলেজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় তারা আমার বোনের সাথে অসভ্যতা করেছে।আপনি তাদের কিছু বলেন না কেন?এরা এতো সাহস পায় কোথা থেকে?’
আরহাম পুরোটা সময় গভীর মনোযোগ সহকারে তার কথা শুনল।সে লক্ষ করল মেয়েটা যখন কথা বলে তখন তার চোখ দু’টোও কথা বলে।এই মুহূর্তেও তার দু’চোখ কথা বলছে।আরহাম চুপচাপ তার কথা শুনল।কথা শেষ করার পর মেয়েটি জ্বল জ্বল চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে রইল।আরহাম তার কথার উত্তর দিলো না।উল্টো নিজ থেকে প্রশ্ন করল,’নাম কি তোমার?’
মেয়েটি সম্ভবত এই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না।সে আশ্চর্য হয়ে বিচলিত কন্ঠে বিড়বিড় করল,’জ্বী?’
আরহাম জানে তার প্রশ্ন মেয়েটি শুনেছে।তা স্বত্তেও কেনো দ্বিতীয়বার প্রশ্ন করেছে সেটা জানার কোনো ইচ্ছে তার নেই।সে বেশ সাবলীলভাবে আবারো বলল’নাম কি?হোয়াটস ইউর নেইম গার্ল?’
মেয়েটি কিছুটা ধাতস্থ হলো।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,’নবনীতা।আমার নাম নবনীতা নূর।’
‘গুড।নাইস নেইম।সো নবনীতা,তোমার সমস্যা আমি শুনেছি।মাথায়ও রেখেছি।এবার তুমি যেতে পারো।’
নবনীতার মনে হলো শুভ্র পাঞ্জাবি পরা ভদ্রলোকটি তার উপর বিরক্ত।অথচ তার বিরক্ত হওয়ার মতো কোনো কাজ নবনীতা এখন অব্দি করেনি।সে কেবল একটা নালিশ জানাতে এসেছে যেটা জানানো তার প্রয়োজন মনে হয়েছে।অথচ ভদ্রলোকের সে নিয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ কিংবা মাথাব্যথা কোনোটাই আছে বলে মনে হচ্ছে না।
নবনীতা শুকনো মুখে জানতে চাইলো,’তারা আর কলেজের বাইরে ঝামেলা করবে না তো?আমি কিন্তু পুলিশে না গিয়ে আপনার কাছে এসেছি।আপনি এর একটা বিহিত করবেন আশা করছি।’
আরহাম এবারো সোজাসাপ্টা জবাব দিলো না।কেবল ঘাড় কাত করে বলল,’আমি আপনার কথা শুনেছি বললাম তো।এবার আপনি আসুন।’
সূক্ষ্ম এবং ধাঁরালো অপমানে নবনীতার শরীর ঝা ঝা করে ওঠল।লোকটা রীতিমতো তাকে তাড়িয়ে দিচ্ছে।তাকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেয়নি।অন্তত একবার বলতো যে তিনি এর একটা ব্যবস্থা করবেন।তাতেই তো নবনীর দুশ্চিন্তা কিছুটা দূর হতো।কিন্তু এই লোক কোনো কথাই বলছেন না ঠিক করে।
নবনীতা তার পার্স ব্যাগটা খাঁমচে ধরল।আশাহত হয়ে আরহামের ডেস্কের সামনে থেকে সরে যাওয়ার আগে কেবল ছোট করে বলল,’ভালো থাকবেন।আসসালামু আলাইকুম।’
ঘড়িতে রাত দেড়টা…
রায়হান সর্তকতার সাথে বারান্দা টপকে রুমে প্রবেশ করলো। বারান্দার দরজা খোলা থাকায় রায়হানের বেশ সুবিধা হলো।
মেহেরজান গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। রায়হান একটা মলিন মুচকি হাসি দিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো মেহেরজানের মুখের সামনে।
মনে করতে লাগল আজ সন্ধ্যার কথা। তার সাথে মেহেরজানের বাবার কথপোকথন।
তার রিকুয়েস্ট করার কথা। সে পারেনি সেই অনূরোধকৃত পিতাকে ফিরিয়ে দিতে। তাকে যে প্রমিস করতে হয়েছে যে সে সরে যাবে মেহেরজানের জীবন থেকে। তার হয়তো নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পাওয়া হলোনা এ জীবনে। রায়হান জীবনে সব কিছুই পেয়েছে। হয়তো নিজের ভালোবাসা ছাড়া। মেয়েটা বুঝতেই চাইলো না তার ভালোবাসা।
চোখের কাণিশে জমা হওয়া পানিতে আলতো করে মুছে মুচকি হাসি দিয়ে বলল
“মেহের যা হেরে গিয়ে জিতিয়ে দিলাম তোকে। ভালো থাক তুই।”
মেহেরজানের গালে হাত বুলিয়ে ওর কপালে একটা গভীর চুমু খেল। মেহেরজান ঘুমের মাঝেই কেঁপে উঠলো।
রায়হান ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, মেহেরজানের মুখের উপর একবার শেষবারের মতো তাকিয়ে নিলো। যেনো সেই মুখের প্রতিটি রেখা মনের গভীরে খোদাই করে নিতে চাইলো। সে জানে, আর কখনো এই মেয়েটির মুখে সে তাকাতে পারবে না। সিসি ক্যামেরাটা খুলে নিলো।
বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, মনে হলো যেন মনের ভেতর বিশাল এক শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ছিলো, প্রতিশ্রুতি ছিলো মেহেরজানের বাবার কাছে। সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে হবে।
বারান্দা টপকে, রায়হান অন্ধকার রাতের মধ্যে মিশে গেলো। কিন্তু তার হৃদয় জানে, সে চিরকাল মেহেরজানের ভালোবাসার জন্য অপেক্ষায় থাকবে, যদিও তা কখনোই তার হবে না।
——————-
সকালের তীব্র রোদের ঝলকানিতে ঘুম ভেঙে গেল। তখনি তার রুমে ছুটে এলো আরিয়ানা। আরিয়ার ঠোঁটে হাসি দেখে মেহেরজান ভ্রুকুচকে তাকালো সেদিকে। আরিয়ানা লাফিয়ে বেডে উঠে বলল
“আপু রায়হান ভাই বিয়েতে না করে দিছে।”
মেহেরজান নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। মেহেরজান আরিয়ানার কথা শুনে স্থির হয়ে বসে পড়লো। তার মন যেন থেমে গেছে, মাথার ভেতরে চিন্তার ঝড় বইছে। রায়হান না করে দিয়েছে? এমনটা কিভাবে সম্ভব? কাল রাতেও তো সে…
তারপর ধীরে ধীরে, মনে পড়তে লাগল সেই অদ্ভুত স্বপ্নের মতো মুহূর্তগুলো। রায়হানের উপস্থিতি, তার গালে মৃদু স্পর্শ, কপালের সেই গভীর চুম্বন। সে ঘুমের ঘোরে অনুভব করেছিল, কিন্তু বাস্তব ভেবেছিল কি না, তা নিয়ে তখন খুব একটা ভাবেনি।
আরিয়ানা হেসে বলল
“কেন জানিনা। শুধু বলেছে যে, তার সিদ্ধান্ত পাকা, বিয়ে সে করবে না। মাও অবাক, সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে সে।”
মেহেরজান যেন শূন্যে ঝুলছে। রায়হানের এমন সিদ্ধান্তের পেছনে কি কারণ থাকতে পারে? কেন সে এমন করলো? ভালোবাসার কোনো ইঙ্গিত না দিয়ে, এক রাতের মাঝেই কেন সে তাকে ছেড়ে চলে গেল?
মেহেরজানের বাবা তব্দা মেরে বসে আছে। সকালেই রায়হানের বাবা ফোন করে আফসোস নিয়ে বলেছেন ছেলে নাকি তার বেঁকে বসেছে সে কিছুতেই বিয়ে করবেনা। তার কথা যে রায়হান রাখবে ভাবেনি সে।
মেহেরজান বেশ খুশি হয়েছে। নিজেকে মুক্ত মুক্ত মনে হচ্ছে তার কাছে।
———————
দেখতে দেখতে কেটে গেছে তিনটা বছর। পরিবর্তন এসেছে সবকিছুর মাঝেই। পরিবেশ, পরিস্থিতি,মানুষিকতা এমনকি জীবনের ও। দুবছর হলো মেহেরজানের বিয়ে হয়েছে। তবে তা কাব্যের সঙ্গে। যে একজন দায়িত্বশীল পুরুষ তার একান্ত নারীর জন্য। পারিবারিকভাবে বিয়েটা হলেও দুজনের মধ্যে ভালোবাসার কোনো অভাব নেই। একে অপরকে পাগলের ন্যায় ভালোবাসে। কাব্য নিজের ব্যস্ততা পাশে রেখেই নিজের প্রিয়তমার জন্য সময় বের করে। যেমন আজকে তারা দুইজন মিলে ঘুরতে এসেছে শাপলাবিলে। কাব্য নীল রঙের পাঞ্জাবী পড়ে নৌকা চালছে। আর মেহেরজান নীল শাড়ী পড়ে শাপলা দেখছে আর মুহূর্তটাকে উপভোগ করছে।
বেশকিছু সময় সেভাবেই অতিবাহিত করে তারা নৌকা ছেড়ে বিলের কিনারার বসলো। মেহেরজানের লম্বা চুলগুলো উড়ছে মৃদু বাতাসের তালেতালে। কাব্য সেদিকে কিছুসময় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে বলল
“ভালোবাসি প্রিয়তমা।”
মেহেরজান মুচকি হেসে কাব্যের হাতে হাত রেখে ওর কাধে মাথা এলিয়ে দিলো।
কাব্য খানিকবাদে বলল
“আইসক্রিম খাবে?”
মেহেরজান হ্যাঁসূচক মাথা নাড়ালো। কাব্য উঠে দাঁড়ালো আইসক্রিম আনার জন্য।
আইসক্রিমের দোকানে যেতেই একটা এগিয়ে এলো কাব্যের কাছে। পড়নে তার কালো পাঞ্জাবী। হাতে দামি ঘড়ি। চোখে সানগ্লাস। ফর্সা লম্বা সুঠাম দেহের পুরুষটিকে একপলক দেখে কাব্য ভ্রু কুচকে বলল
“আমি কি আপনাকে চিনি!”
লোকটি হাসলো। তারপর ধীর কন্ঠে বলল
“আপনি আপনার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসেন তাইনা!”
কাব্য চোখ তুলে দূরে বসে থাকা মেহেরজানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে উঠলো
“হুম অনেক। কিন্তু আপনি কে বললেন না তো।”
লোকটি আবার ও হাসলো। তার হাসিতে কি যে ছিলো। সে আবার ও বলে উঠলো
“আগলে রাইখেন নিজের ভালোবাসাকে। সবার কপালে ভালোবাসা থাকেনা।”
কাব্য অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলো
“রায়হান”
লোকটি কাব্যকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সানগ্লাস ঠিক করে রওনা হলো। কাব্য পলকহীন তাকিয়ে রইলো তার যাওয়ার দিকে।
মুহূর্তেই তুমুল বর্ষণ শুরু হলো। ধ্যান ভাঙলো কাব্যের। লোকটি চোখের আড়াল হয়ে গেছে অনেক আগেই। মেহেরজান তার কাছে দাঁড়িয়ে বলল
“চলুন না বৃষ্টিতে ভিজি।”
কাব্য রাজি হলো মেহেরজানের কথায়। দুইজন ভিজতে লাগলো।
অন্যদিকে কালো গাড়ির কাঁচ ভেদ করে রায়হান সবটা দেখে তপ্তশ্বাস ফেলল। আর মনে মনে বলতে লাগল
“ভালোবাসা সবার কপালে থাকে না। ভালো থাকুক আমার না পাওয়া ভালোবাসা তার ভালোবাসার কাছে।”
রাফি রায়হানের এমন রূপ দেখে খানিকটা ভয় পেলেও ইশারায় মেহেরজানকে দেখিয়ে দিলো। রায়হান তাকিয়ে দেখলো মেহেরজান আর একটা ছেলে পাশাপাশি বসে আছে। রায়হান হনহনিয়ে সেদিকে গেল।
মেহেরজান হুট করেই রায়হানকে দেখে চমকে গেল। মেহেরজান একবার ওর বন্ধু নিরবের দিকে তাকিয়ে আবার ও রায়হানের দিকে তাকিয়ে বলল
“রায়হান ভাই আপনি এখানে কি করছেন!”
মেহেরজান কিছু আরো বলতে নিবে তার আগেই রায়হান হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো
“এই ছেলে এখনো এখানে কি করছো! মেহেরজান শুধু রায়হান তালুকদারের। তাড়াতাড়ি এখান থেকে চলে যাও।”
নীরব রায়হানের এমন হুঙ্কারে ভয় পেয়ে দ্রুত পায়ে সেখান থেকে চলে যায়।
নীরবকে যেতে দেখে মেহেরজান রায়হানকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়হান একটা থাপ্পড় বসিয়া দিলো মেহেরজানের গালে।
আর চেঁচিয়ে বলতে লাগলো
“আমার সঙ্গে ফাতরামি করতে আসবিনা একদম। ভালোবাসি বলে পাড় পেয়ে যাবি এটা ভাবিস না। ভুলে যাস না আমি কে!”
মেহেরজান অবাক হয়ে গেল। চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো বেশ কিছু মানুষ তাঁদের দেখছে। অপমানে মেহেরজানের চোখ ভরে এলো। মেহেরজান ছুটে চলে গেল। রায়হান চোখ বুজে পরপর কয়েকটা তপ্ত শ্বাস ফেললো। রাগ যেন এখনো কমেনি তার। মেহেরজান শুধু তার। সে কেন অন্য ছেলের সঙ্গে থাকবে।
————————
টানা চারটা ক্লাস নিয়ে বেশ ক্লান্ত কাব্য । আরো একটা ক্লাস করানোর পর আবার কোচিং করাতে হবে। কিন্তু তার শরীর আর চলছে না। ক্লান্ত ভঙ্গিতে চেয়ার এ বসে ফোন স্ক্রল করতে লাগলো সে। তখনি তার ডাক পড়লো। হেডস্যার ডেকেছে তাকে। ফোনটা পকেটে রেখে কাব্য রওনা হলো হেডস্যারের রুমের দিকে।
হেডস্যারের রুমের সামনে গিয়ে কাব্য ভিতরে যাওয়ার পারমিশন চাইলো। হেডস্যার মাথা উঠিয়ে কাব্যকে দেখে মুচকি হাসি দিয়ে কাব্যকে ভিতরে এসে বসতে বলল। কাব্যও মুচকি হাসি দিয়ে চেয়ারে বসতে বসতে বলল
“স্যার কিছু জরুরি কথা কি!”
স্যার একটু গম্ভীর কণ্ঠেই বললেন
“জরুরি বটেই। আমার মেয়েটা এই নিয়ে দুবার ম্যাথে ফেল করেছে। এমন করলে কেমন করে হয় বলো তো। আমি একটা স্কুলের হেডস্যার আর আমার মেয়ে নাকি ফেল করে প্রতিবার।”
কাব্য হেডস্যারের কথায় সম্মতি দিয়ে বলল
“আসলেই বিষয়টি বেশ জরুরি। একটা টিচার রেখে দেন তাহলে।”
হেডস্যার হেসে বললেন
“তুমি থাকতে আমার ম্যাথ টিচার খোঁজা লাগে। আমার মেয়েটাকে কোনোমতে পাশটা করিয়ে দেও কাব্য।”
কাব্য খানিকটা ইতস্তত হয়ে বলল
“কিন্তু স্যার!”
“কোনো কিন্তু না কাব্য তুমিই পারবে আমি জানি।”
কাব্য একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
“আচ্ছা স্যার। তবে আমি যেভাবেই পড়া আদায় করি আপনি তা জানেন। এই নিয়ে কিন্তু আমি কিছু শুনবোনা স্যার।”
“আমি জানি তো। মারো ওকে আমার কোনো সমস্যা নেই।”
“আচ্ছা স্যার আমি কাল থেকে আপনার মেয়েকে পড়াতে যাবো ইনশাআল্লাহ।”
কাব্যর কথায় হাসি ফুটে উঠলো হেডস্যারের ঠোঁটে। কাব্য আরো কিছু কথা বলতে লাগলো।
——————-
মেহেরজান ছুটতে ছুটতে পার্ক থেকে বেরিয়ে এলো। তার হৃদয় ভারী হয়ে আছে, মাথার ভেতর রায়হানের থাপ্পড় আর অপমানের দৃশ্যগুলো বারবার ফিরে আসছে। পার্কের লোকেরা তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল, আর সেই লজ্জা তাকে আরও পুড়িয়ে দিচ্ছিল। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে তার চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরতে লাগল, কিন্তু সে দ্রুত বাড়ির দিকে এগিয়ে চলল।
বাড়িতে ঢুকতেই তার মা চমকে উঠলেন। মেহেরজানের চোখমুখের অবস্থা দেখে তিনি সবকিছু বুঝতে পারলেন। মেহেরজানের মা কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু মেহেরজান আগে থেকেই জানত কী হতে যাচ্ছে। তার মা তাকে আগে থেকেই সাবধান করেছিলেন—রায়হানের সামনে কিছু বলা যাবে না, কারণ তাদের পরিবার রায়হানের পরিবারের কাছে ঋণী।
মেহেরজান কোনো কথা না বলে সোজা মায়ের ঘরে ঢুকে গেল। তার মা চিন্তিত মুখে বললেন
“মেহেরজান, কী হয়েছে? এইভাবে কেন আসলে?”
মেহেরজান ঠোঁট চেপে ধরে বলল
“আম্মু, তুমি জানো আমি এই বিয়ে করতে চাই না। আজ রায়হান আমাকে থাপ্পড় মেরেছে, সবার সামনে। সে আমাকে কোনো সম্মান দেয় না, আর আমি ওকে ভালোবাসি না।”
তার মা কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে ধীরে বললেন
“মা, আমি জানি রায়হান রাগী, কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। আমরা ঋণী, রায়হানের বাবা তোমার বাবাকে যখন সাহায্য করেছিলেন, তখন আমাদের হাতে বিকল্প ছিল না। এখন তারা আমাদের এই ঋণ শোধ করতে বলছে। তুমি যদি রায়হানকে বিয়ে না করো, আমরা সবাই বিপদে পড়ব।”
মেহেরজান হতাশায় বলল
“আম্মু, তোমরা ঋণ শোধ করতে পারো, কিন্তু আমি কেন নিজের জীবন বিসর্জন দেব? কেন আমাকে এই বোঝা নিতে হবে?”
তার মা চোখ মুছতে মুছতে বললেন
“তোমার বাবার কথাও ভাবতে হবে মা। আমরা সব হারিয়ে ফেলব। রায়হানকে চটিয়ে দেওয়া যাবে না।”
মেহেরজান বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে তার মা-বাবা তার পাশে নেই। তারা কেবল ঋণ শোধের কথা ভাবছে, আর সে যেন নিজের ইচ্ছের কোনো মূল্যই পায় না।
মেহেরজানের নিজেকে অসহায় লাগছে। তার সাথেই কেন এমন হলো। জীবনটা তো এমন না হলেও পারতো। তার কপালে কি রায়হানের মতোই মানুষ আছে। মেহেরজানের কিছু ভালো লাগছে না। সে তো বেশি কিছু চায়নি একটা ভালো মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে চেয়েছে। হয়তো তার কপালে নেই। কিন্তু তার বাবা মা কিভাবে পারলো তাকে এভাবে বলি দিতে। মনের মধ্যে একরাশ অভিমান এসে জমা হলো বাবা মার জন্য।
মেহেরজান একমনে ভাবতে থাকে, কিভাবে তার বাবা-মা তাকে এই কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সে যে কখনোই রায়হানের মতো একজন রাগী, অহংকারী মানুষকে নিজের জীবনসঙ্গী হিসাবে ভাবতে পারেনি। অথচ, ঋণের বোঝা আর পারিবারিক সম্মান রক্ষার জন্য তাকে এই বলি দেওয়া হচ্ছে। মেহেরজানের মনের মধ্যে এক অসম্ভব তিক্ততা ছড়িয়ে পড়ে।
মেহেরজান গভীর শ্বাস নিয়ে নিজের কক্ষে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো। তার মাথায় অনেক চিন্তা ঘুরছিল, কিন্তু সে একটাই সিদ্ধান্তে আসলো—এই বিয়েতে তার সম্মতি নেই। কিছু একটা করে তাকে এই বিয়ে থেকে মুক্তি পেতেই হবে। নিরবকে মানানোর চেষ্টা করতে গিয়েছিলো সে। যেন নিরব রায়হানকে গিয়ে বলে যে সে আর নিরব একে অপরকে ভালোবাসে। কিন্তু কাজের কাজ হওয়ার আগেই তো সবটা ঘেটে দিলো রায়হান।
মেহেরজান কয়েকটা দার্ঘশ্বাস ফেলে এগোলো ওয়াশরুমের দিকে। একটা লম্বা শাওয়ার নিতে। মনটাকে শান্ত করা বেশ প্রয়োজন তার।
——————-
অন্যদিকে রায়হান বেশ কিছুসময় তব্দা মেরে বসে রইলো পার্কেই। পরমুহূর্তেই তার মনে পড়লো রাগের বশে সে কি করছে। মেহেরজানের গায়ে হাত তুলেছে সে। রায়হান নিজের মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো। পার্কের নিস্তব্ধতা যেন তার ভেতরের অশান্তিকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। মেহেরজানের গায়ে হাত তোলা—এটা তো সে কখনোই ভাবেনি করবে! কিন্তু রাগের বশে, পরিস্থিতির চাপে, তার ভেতরের অস্থিরতা এমন একটা কাজ করিয়ে ফেলেছে, যা সে চাইলেও আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না।
রায়হানের মনে হলো, মেহেরজানকে সে যতই নিজের বলে দাবি করুক, ভালোবাসার নামে তাকে আটকে রাখুক, এই পথ সঠিক নয়। নিজের কাজের পরিণতি নিয়ে ভাবতে গিয়ে রায়হানের চোখের সামনে ভেসে উঠলো মেহেরজানের অপমানিত মুখ। সে কি মেহেরজানকে সত্যিই ভালোবাসে, নাকি নিজের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তাকে পেতে চায়?
রায়হান যেন নিজের ভেতরের দ্বন্দ্বে পুড়তে লাগল। মেহেরজান যদি সত্যিই নিরবকে ভালোবাসে, তবে কি সে তার ভালোবাসাকে বাঁধা দিতে পারে? কিন্তু আবার, রায়হান মেহেরজানকে নিজের করে পেতে চায়। এই দোটানার মধ্যে পড়ে তার ভেতরের রাগ, হতাশা, এবং দুর্বলতা একসঙ্গে তাকে গ্রাস করতে থাকে।
রায়হান উঠে দাঁড়ালো। তার মন বলছে, এবার কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। কিন্তু কীভাবে, তা সে জানে না।
নিজের উপরি নিজের রাগ হলো রায়হানের। পরপর ঘুষি বসিয়ে দিতে লাগল পাশের গাছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগলো। রাফি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল। তখনি সেখানে হাসান আসলো। রায়হানকে আটকিয়ে বলল
“কি করছিস রায়হান! রক্ত বের হচ্ছে তো। পাগল হয়ে গেছিস। কি হয়েছে বল আমায়!”
রায়হান লাল চোখ নিয়ে হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল
“আমি কি খুব খারাপ হাসান!”
হাসান ভ্রুযুগল কুচকে রায়হানের দিকে তাকালো। হাসান কিছু বলতে নিবে তার আগেই রায়হান উঠে দাঁড়ালো। হাসানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে টালমাটাল পায়ে সেখান থেকে চলে গেল রায়হান।
হাসান রায়হানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে।