Tuesday, July 29, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1008



কাঁচের সংসার পর্ব-১১

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১১

পরেরদিন আরোহী গুছগাছ হয়ে আমেনা আহমেদের কাছ থেকে দোয়া নিয়ে বেরিয়ে গেল চাকরির উদ্দেশ্যে। মূলত চাকরিটা বড়ো-সরো নয়। এটা একটা বড়ো শপিংমলে সেলসম্যানের কাজ। তবুও আরোহীর চাই-ই চাই।
যথাস্থানে পৌঁছে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সার্টিফিকেট দেখাতেই উনারা আরোহীকে বিনা শর্তে চাকরিটা দিয়ে দিল। চাকরিটা পেতেই আরোহী আগে শুকরিয়া আদায় করে নিল। যাক এতো মানুষের ভিড়ে ভালো মানুষও অর্ধেক আছেন, নাহলে আজ এতো দ্রুত চাকরিটা পাওয়া আরোহী কোনোকালেই ভাবেনি।
পরেরদিন থেকে জয়েন্ করার কথা। আরোহী ভাবলো বাসায় গিয়ে আমেনা আহমেদকে বলে আরেকটা ছোটোখাটো ঘরে সে উঠবে। বাসা ঠিক করেই আশ্রমের খালার সাথে কথা বলবে। বাসায় উঠার কথার মাঝে আরেকটা নতুন চিন্তার উদয় হলো। তার কাছে তো এখন কোনো টাকা নেই, বাসায় উঠবে কী করে! অন্তত একমাস গেলেই টাকা পাবে তখনই তো বাসার সব গুছিয়ে নিতে পারবে। আরোহীর মন খারাপ হলো। আরও একমাস কী ওই বাড়িতে বোঝা হয়ে পড়ে থাকতে হবে। অবশ্য উনারা অনেক ভালো মনের মানুষ, আরোহীর উপর একবারও বিরক্ত হয়নি উল্টো আরোহী অন্য বাসায় উঠার কথা বললে বিরক্ত হয় কিন্তু এখন যাই হয়ে যাক না কেন আরোহীর বাসাটা থেকে চলে আসা উচিত। আরোহীর অসময়ে ইনারা না থাকলে আজ আরোহী কোথায় থাকতো তা সে নিজেও ভেবে পায় না। ইনারা তাকে এতদিন বিনা কারণে বিনা স্বার্থে রেখেছে তাতেই আরোহী ঋণী। আজ-কাল নিজের আপনজনরা খবর নেয় না অথচ ইনারা! মানবিকতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইনারা। ইনাদের ঋণ হয়ত কখনো শোধ হবে না।

আরোহী গাড়িতে বসে আছে। লাল সিগন্যাল পড়েছে। এই একটা সিগন্যালেই সব গাড়ি থেমে আছে। হয়ত এমন কোনো সিগন্যাল জীবনে এসেও জীবনকে চিরতরে থামিয়ে দিয়ে যায়। শুধু এটাই পার্থক্য যে এই সিগন্যালের পর সবুজ সিগন্যাল আসে। লাল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থামা চুপচাপ গাড়িগুলো হঠাৎ-ই চলতে শুরু করে। আর জীবনে এই লাল সিগন্যালের পর সবুজ সিগন্যালের মতো আর কোনো সুযোগ আসে না। জীবন এতো বৈচিত্রময়।

আরিয়ান গাড়ির ভেতর বসে আছে। দীর্ঘক্ষন যাবৎ লাল সিগন্যাল। ঢাকা-শহরের এই বিষয়টি তার মোটেও পছন্দ নয়। আধ-ঘন্টার রাস্তা যেতে এক-ঘন্টা পেরিয়ে যায়। এটা এখন একটা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে ব্যস্ত শহরের কোলাহল-ধ্বনি।
আরিয়ান বিরক্ত দৃষ্টিতে জানালার কাঁচ গলিয়ে বাইরে দৃষ্টি দিল। আচমকা দৃষ্টি আটকে গেল বিপরীত পাশের একটা গাড়ির দিকে। গাড়ির ভেতর মলিন চেহারার অধিকারিণী সেই মেয়ের দিকে দৃষ্টি আটকে রইল। দীর্ঘ কতদিন পর! আরিয়ান মনে করার চেষ্টা করলো। প্রায় একমাস পর সেই চিরচেনা মুখটি দেখতে পাচ্ছে। খুব পরিচিত সেই মুখ। জানালার বাইরে মলিন দৃষ্টি দিয়ে আছে আরোহী। বুঁকের কোথাও জানি তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হচ্ছে আরিয়ানের। তার দৃষ্টি এখনো ওই গাড়িটির দিকে।

আরোহী মলিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। আরিয়ানের বুক কাঁপছে। আরোহীকে একটু ছুঁয়ে দেওয়ার জেদ চেপেছে মনে। যদি পারতো! এমন কেন লাগছে তার! ‘আরু, আরু’ করে আপনমনেই বিড়বিড় করে উঠল আরিয়ান। নিজেকে পাগলপ্রায় মনে হচ্ছে। কত্তদিন পর! এই চেহারাটি দেখার জন্য কত ছটপটই না করেছিল এতদিন। এতদিনে বুঝতে পারলো আরিয়ান যে এই মেয়েটির মধ্যেই তার সব তৃষ্ণা।

আরিয়ান মাঝরাস্তাতেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। তার গন্তব্য বিপরীত পাশের গাড়িটি। সে গাড়িটির দিকে এগিয়ে যেতে নিতেই তার বুক ধড়ফড় করে উঠল। বুঁকের কোথাও অস্তির অস্তির লাগছে। আরিয়ান কাঁপা কাঁপা পায়ে কয়েক কদম পা বাড়াতেই ঠিক সে-সময় লাল সিগন্যালের বদলে সবুজ সিগন্যাল জ্বলে উঠল। সব গাড়ি হুড়মুড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আরিয়ান আর পা বাড়াতে পারলো না। অন্য গাড়িগুলোর সাথে সাথে আরোহীর গাড়িটাও চোখের পলকেই চলে গেল। আরিয়ান দ্রুত গাড়িতে উঠতেই আরোহীর ওই গাড়িটা নিমিষের মধ্যে মিলিয়ে গেল। সে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো। আরোহীকে আবারও হারিয়ে ফেলল সে। ‘না, আমি ঠিকই খুঁজে নিবে। আমার আরু এখানেই আছে।’ আপনমনেই বিড়বিড় করে বলে উঠল আরিয়ান।

————
বাসায় ফিরেই আরোহী রুম থেকে বেরিয়ে রুহানকে কোলে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো। আমেনা আহমেদ কড়ায়তে কী যেন ভাজছিলেন। আরোহীর অস্তিত্ব অনুভব করতে পেরে চুলোর কড়ায়ে ঢাকনা দিয়ে হাসিমুখে আরোহীর দিকে ফিরলো।

‘তোর ইচ্ছে পূর্ণ হলো হয়েছে?’

আরোহী হেসে আমেনা আহমেদকে জড়িয়ে ধরলো। আজ তার খুশির দিন। হোক না কোনো ছোটোখাটো চাকরি। তবুও একটা চাকরি তো। সে তো আরামসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।
আমেনা আহমেদও মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো। অবশেষে মেয়েটার মুখে রাজ্যের খুশি দেখা গেল।

‘জয়েন কখন!’
‘কাল’ বলেই আরোহী আমেনা আহমেদের দিকে তাকিয়ে উসকুশ করতে লাগলো। তা দেখে আমেনা আহমেদ আরোহীর মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল।

‘কী কিছু বলবি, মা?’

‘বলছি কী খালা। এইবার তো চাকরি পেয়ে গিয়েছি।’

‘হু, তো!’

‘সেটা দিয়েই তো আমি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো। বলছি কী, যদি আরেকটা বাসায়…’ আরোহী মিনমিনিয়ে বলে উঠল।

‘এসব কী বলিস! জীবন কাটিয়ে দিবি মানে কী! তোর জীবন তো এখনো পড়ে আছে। আর আরেকটা বাসা বলতে। এটা কী তোর বাসা নয়!’

‘কিন্তু…’

‘কোনো কিন্তু নয়। তুই আমাকে খালা দেখেছিস তো? মন থেকে ডাকলে এই কথা বলতি না।’

আরোহী কীভাবে বুঝাবে ভেবে পাচ্ছে না। এই মানুষটা তাকে বেশি ভালোবাসে সেটা বুঝতে পারছে কিন্তু এভাবে এমন একটা মেয়েকে নিজের ঘরে আশ্রয় দিচ্ছে!

‘খালা, তুমি বুঝতে পারছো না। আমার আরেকটা বাসায় যাওয়া দরকার। অন্তত নিজের জন্য হলেও। তোমরা আমাকে মেয়ের মতো করেই বিনা স্বার্থে অনেক করেছো সেজন্য আমি আজীবন ঋণী থাকবো কিন্তু তাই বলে সুযোগকে সবসময় ব্যবহার করবো!’

আরোহীর কথায় আমেনা আহমেদ কিছু সময় নিয়ে কী যেন ভাবলেন। এরপর মাথা উঁচু করে আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন,

‘আচ্ছা, বিকেলে গিয়ে আমরা একসাথে বাড়ি দেখে আসবো, ঠিক আছে?’ বলেই তিনি সবজি কাটতে নিতেই আরোহী আগ-বাড়িয়ে নিয়ে নিল।

বিকালে আরোহী আর আমেনা আহমেদ দুইজনে গিয়ে একটা বাসা দেখে আসলো। মূলত আমেনা আহমেদ নিজেই আরোহীকে সেই বাসায় নিয়ে গিয়েছিলো। বাসার মালিক আমেনা আহমেদের পরিচিত তাই বিনা কথায় আরোহীকে বাসা ভাড়া দিয়ে দিয়েছে কিন্তু অন্যরা আরোহী একা মেয়ে মানুষ থাকবে বলতেই সোজা মুখের উপর না করে দিয়েছিল। তাই আমেনা আহমেদ নিজের পরিচিত বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। বাসা বলতে দুইটা ছোট্ট রুম। তা দিয়ে আরোহী ভালোভাবেই চলে যাবে। আমেনা আহমেদ একমাসের বাসা ভাড়া অগ্রিম দিয়ে এসেছিলো। আর কিছু টুকটাক জিনিসও কিনে রেখে এসে বাসার পথে রওনা দিল।

———-

আরিয়ান আজ সারাদিন রুমের দরজা আটকে চুপচাপ বসে আছে। তার অস্তির অস্তির লাগছে। আরোহীকে পায়ে ঠেলে বড্ড বড়ো ভুল করে ফেলেছে সে। এই জীবনের প্রথম আরোহীর প্রতিই তার সব অনুভূতি এসেছিলো কিন্তু সেই মেয়েটিকেই মায়ের কথায় দূরে সরিয়ে দিয়েছিলো। কিভাবে আবার ফিরে পাবে তাকে!

গভীর নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে নিস্তব্ধতা ঘিরে ধরেছে। আরোহী ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে শান্ত দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তার কোলা এলোমেলো লম্বা চুলগুলো ক্ষনে ক্ষনে হাওয়ায় উড়ছে। কপালের উপর অবাধ্য চুলগুলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে, আরোহীর সরাতে ইচ্ছে করলো না। পরনের শাড়ির আঁচল দমকা হাওয়ায় এলোমেলো ভাবে উড়ছে। আরোহীর দৃষ্টি শান্ত।

নিহানের আজ বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হলো। অবশ্য রাত হয়েছে না সে নিজেই করেছে। তার ডিউটি অনেক আগেই শেষ হয়ে যায়। মাঝে মাঝেই দেরি হয় কিন্তু সে প্রতিদিনই মা-বাবাকে বুঝ দেয় যে ডিউটি ছিল। মূলত সে রাস্তার ধারের ব্রিজে দাঁড়িয়ে থাকে। আকাশের দিকে তাকিয়ে রই। সেই ব্রিজটা মিথিলার প্ৰিয় ছিল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে সে বায়না ধরতো যেন তাকে ওই ব্রিজের ধারে নিয়ে যায় আর তারা দুজন একাকী সময় সে ব্রিজে কাটাতে পারে। মিথিলা কান পেতে শান্ত নদীর পানির কুলকুল শব্দ উপভোগ করতো সাথে জোর করে নিহানকেও শুনাতো কিন্তু নিহানের কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। মিথিলা চলে যাওয়ার পরে নিহানও মন দিয়ে শুনে। কোনোকালেই এই জায়গাটা তার পছন্দ ছিল না কিন্তু মিথিলা চলে যাওয়ার পর সে এই জায়গার মায়ায় গভীরভাবে জড়িয়ে পড়েছে।

বাসার কাছে এসে নিহানের গাড়ি থামতেই সে গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। বাসার দিকে পা বাড়াতে নিতেই উপরে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য মনস্ক আরোহীর দিকে চোখ পড়লো। নিহান নিজেই ভাবনায় মশগুল হলো, এতো রাত জাগে মেয়েটা! সে মলিন শ্বাস ফেলল। এই পৃথিবীতে একেক জনের কষ্টের প্রকাশ একেকরকম। নিহান এক ফলক আরোহীর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে বাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-১০

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_১০

বেলা বারোটা বাজতেই স্নেহা ঘুম ছেড়ে আড়মুড়া ভেঙে উঠে বসলো। কিছুক্ষন থম মেরে বসে ওয়াশরুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ফ্রেস হয়েই রান্নাঘরে পা বাড়ালো।

রান্নাঘরে লুৎফা বেগম দুপুরের রান্না বসিয়েছেন। স্নেহাকে দেখে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলেন,
‘এভাবে চললে তো হবে না। তুমি এই বাড়ির বউ। এটা তোমারই সংসার আর যেটার জন্যই তোমাকে আনা! আশা করছি যে যে কথাগুলো বুঝাতে চাচ্ছি বুঝে নিয়েছো।’

লুৎফা বেগমের কথা শুনে স্নেহা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় হাত নাড়লো। নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে রান্নাঘর ছাড়তে ছাড়তে বললো,
‘ওহ খালা, আমি এই বাড়ির বউ হলে তুমি কী! আর এ সংসার আমার বলতে কী বুঝাতে চাচ্ছ? কাজ করতাম? তাহলে সেদিক দিয়ে তোমার সব কাজই করা উচিত কারণ এ সংসার তোমারো। আমাকে আরোহী ভাবলে ভুল করবে। আর কী বললে যেন!আমাকে যেটার জন্য আনা মানে টা কী! আমি কী মেশিন না-কি! পড়াশোনা না করার জন্য ভুল-ভাল বলো। মানুষ আর মেশিন গুলিয়ে ফেলেছো। রাতে রান্না-বান্না শেষ করে আমার কাছে এসো মানুষ আর মেশিনের মধ্যে তফাৎ বুঝিয়ে দিবো। আশা করি কী বুঝাতে চাচ্ছি বুঝতে পেরেছো।’ বলেই হাই তুলে লুৎফা বেগমের জবাবের অপেক্ষা না করে নাস্তার প্লেট নিয়ে স্নেহা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

লুৎফা বেগম বোকা বনে গেলেন। এই মেয়ে তো এমন ছিল না! রূপ এমন উল্টো হয়ে গেল! কথার জালে তাকেই ফাঁসিয়ে দিল! লুৎফা বেগম স্নেহার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রান্নায় মনোযোগ দিলেন। এই মেয়ের রূপ বিয়ের আগে যত ভালো ছিল কিন্তু বিয়ের পর পুরোই উল্টো। কিভাবে এতো বড়ো ভুল করলো লুৎফা বেগম!

স্নেহা খাওয়া শেষ করেই প্লেটটা রান্নাঘরের বেসিনে রেখে মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে গেল।
লুৎফা বেগম সবজি কাটছিলেন। একবার স্নেহার রেখে যাওয়া প্লেটটার দিকে তাকিয়ে মলিন শ্বাস ফেলল। তার শরীর আর সইছে না এসব। আরোহী থাকতে রান্নাঘরে কোনোদিন পা দিতে হয়নি। সবকিছু সময়মতো তার জায়গায় চলে যেত। তবুও সে মেয়েটাকে কথা শুনাতো। এখন বড্ড আফসোস হচ্ছে তার! এতো বছরের জীবনে মনে হচ্ছে এর চেয়ে বড়ো ভুল আর করেনি!

———–

দেখতে দেখতে আরও কয়েকদিন কেটে গেল। আরোহীর সারাটা দিন রুহানকে নিয়েই কাটায়। রুহানের বাবা সারাদিন হাসপাতালেই থাকে। মাঝে মাঝে তো আসতে গভীর রাত হয়ে যায়। মানুষটার সাথে এর মধ্যে আর কোনো কথা হয়নি। আরোহীও মানুষটা বাসায় থাকলে রুম থেকে বেরোই না কারণ তাদের পূর্ণ পরিবারের মাঝে আরোহীকে দেখলে মানুষটা বিরক্ত হয়। প্রায় সময় মানুষটা বাইরে বাইরেই থাকে। আরোহী রাতে ব্যালকনিতে প্রায় সময় কাটাই বলে দেখতে পায় মানুষটা গভীর রাতে এলোমেলো পায়ে বাসায় ঢুকে।
আরোহী বুঝতে পারে, মানুষটা হয়ত এখনো মিথিলা আপুকে ভুলতে পারেনি। হয়ত তাই ব্যস্ততায় দিনগুলো পার করিয়ে দেয়!

গভীর রাত। আজ রুহানের জ্বর ছিল অনেক। রুহানের বাবা দুইদিন ধরে শহরের বাইরে একটা সার্জারির জন্য না-কি গিয়েছে। এটা আমেনা আহমেদের কাছ থেকেই শুনেছিল আরোহী। বাইরে বিধায় রুহানের ব্যাপারটা আর বলা হয়নি। অবশ্য সারাদিন আরোহীর সেবায় রুহানের জ্বর এখন অনেকটাই কমে গিয়েছে।
রুহান বায়না ধরেছিলো সে আজ আরোহীর সাথেই ঘুমাবে। জ্বরের ঘোরে ছেলেটা আজেবাজে বকছে। মাকে ডাকছে শুধু। তাই আরোহী নিজের কাছে রেখে দেয়। এতক্ষন আমেনা আহমেদ ছিল। রুহান ঘুমিয়ে পড়ার পর আরোহী জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে উনাকে কারণ বেশি রাত জাগলে উনিও অসুস্থ হয়ে পড়ে। রাতে রুহানের জ্বর আবার বাড়লে উনাকে ডাকতে বলে গিয়েছে। উনি এসে ফাঁকে ফাঁকে দেখে যাবে বলায় আরোহী রুমের দরজা খোলাই রাখলো।
রাত জাগার অভ্যাস আরোহীর আছে। রুহানকে ঘুম পাড়িয়ে সে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো। কেন জানি রাতটাতে তার জানালার ধারে একবার না আসলে হয় না। রাতের আকাশ দেখতে হবেই হবে । অভ্যাসটা এখানে এসেই হয়েছে। বিয়ের পর ওই বাড়িতে থাকতে হয়নি। ওখানে থাকতে কোনোদিন মন দিয়ে রাতের অজস্র নক্ষত্রের আকাশ দেখা হয়নি কিন্তু আশ্রমে থাকাকালীন প্রায় সময় জানালার ধারে এসে দেখত। আরিয়ানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর আর কোনোদিন দেখা হয়নি, অবশ্য দেখবেই বা কী করে ওখানে সারাদিন এটা ওটা করতে করতে রাত আসলেই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসতো। তাই তো এই একবছর আর দেখা হয়নি।

হঠাৎ কারো গোঙানীর শব্দে আরোহী বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেখতে পেল রুহান ঘুমের ঘোরে হাতড়িয়ে কাকে যেন খুঁজছে। আরোহী দ্রুত এগিয়ে গিয়ে দেখলো জ্বর আবার বেড়েছে। আরোহী দ্রুত দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা খোলাই রেখেছে। আমেনা আহমেদকে ডাকার উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে গিয়ে আবার পিছিয়ে আসলো। থাক না, মাত্রই তো গেল মানুষটা। সে নিজেই না হয় একটু গা-টা মুছে দিক। তাই সে দ্রুত ওয়াশরুম থেকে পানি এনে রুহানের গা মুছে দিল। তাতেই রুহান একটু শান্ত হলো। সে আরোহীর একহাত জড়িয়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। আরোহী পাশেই খাটের সাথে মাথা হেলান দিয়ে রুহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। গভীর রাত হওয়ায় তার নিজেরও ক্লান্ত লাগছে। গা-টা ম্যাচ ম্যাচ করছে। আস্তে আস্তে বসা অবস্থায় চোখ বন্ধ করে ফেলল।

আরেকটু রাত হতেই দরজা ঠোকা দেওয়ার শব্দ হলো। আরোহীর চোখ মাত্রই ঘুমে বুজে আসছে বলে আর চোখ খুলে দেখতে হলো না। ঘুমের ঘোরে দরজার সেখানে আর যেতে ইচ্ছে হলো না। হয়ত আমেনা আহমেদ রুহান ঘুমিয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করতে এসেছে। দরজা তো খোলায় আছে। অনেকক্ষন হয়ে যাওয়ার পরও যখন কারো সাড়া-শব্দ পেলো না তখন আরোহী আস্তে আস্তে চোখ খুলতেই নিহান নামক মানুষটাকে দেখতে পেল। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। এই বাসায় আসার এই প্রথম বোধহয় উনি এই রুমে।

‘আপনি!’

‘রুহানকে নিয়ে যেতে এসেছি।’ নিহানের সোজাসাপ্টা উত্তর।

‘কিন্তু…’ আরোহী কিছু বলতে নিতেই নিহানের কথায় থেমে গেল।

‘এখন তো সে ঘুম। বুঝতে পারবে না।’ বলেই এগিয়ে এসে রুহানকে কোলে নিতে গিয়েই বুঝতে পারলো রুহান তার এক হাত দিয়ে আরোহীর হাত আঁকড়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। মনে হচ্ছে যেন আরোহীকে ছাড়লেই হারিয়ে যাবে। আরোহী তা বুঝতে পেরে কিছু বলতে নিতেই নিহান নিজেই এগিয়ে এসে রুহানের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে কোলে নিয়ে ফেলল। আরোহীর মন খারাপ হলো। সে ভেবেছিল, রুহানের হাত আঁকড়ে ধরা দেখে নিহান আর নিয়ে যাবে না কিন্তু তবুও নিয়ে ফেলল। তার কেন যেন মনে হয়, আরোহীর এই বাসায় থাকা মানুষটা অপছন্দ করে কিন্তু কোনোমতেই একটা চাকরি পেলেই সে বেরিয়ে যাবে। আজ অনলাইনে একটা চাকরি দেখতে পেয়েছিল। কালই গিয়ে কথা বলবে। আরোহী মলিন শ্বাস ফেলল।
নিহান বেরিয়ে যাওয়ার আগ-মুহূর্তে দরজার এখানে গিয়ে থেমে পেছনে ফিরে আরোহীর দিকে তাকালো।

‘সারাদিন অনেক করেছেন আর গভীর রাত পর্যন্ত অনেক সেবা দিয়েছেন সেজন্য ধন্যবাদ।’

আরোহী খাটের দিকেই মন খারাপ করে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে দরজার দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো নিহান রুহানকে কোলে নিয়ে অবস্থায় দরজার এখানে দাঁড়িয়ে আছে। তার দিকে তাকিয়ে কথাটা হয়ত বলেছে। আরোহী সেদিকে তাকাতেই রুহান চোখ ফিরিয়ে নিল। এই বাসায় এতদিনে মনে হয় এই প্রথম মানুষটা তার দিকে তাকিয়েছে।

‘রুহান এখানে থাকলে আপনি হয়ত আর ঘুমাতেন না। এতো রাত জাগবেন না। ঘুমিয়ে পড়ুন।’ বলেই নিহান বেরিয়ে গেল। আরোহী সেদিকে তাকিয়ে রইল। যাক, মানুষটাকে যতোটা খারাপ মনে করেছে উনি এতটা খারাপ নয় হয়ত।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০৯

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৯

ব্যালকনির এক কিনারে প্রাচীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে আরোহী। চুল-গুলো এলোমেলো হয়ে বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে উড়ছে। ক্ষনে ক্ষনে শীতল হাওয়া জানান দিচ্ছে, আজ প্রচন্ড ঠান্ডা পড়বে। আরোহী শীতের প্রকোপে কেঁপে কেঁপে উঠছে কিন্তু এই মুহূর্তে ব্যালকনি ছেড়ে যেতে তার মোটেই ইচ্ছে করছে না। তার মলিন দৃষ্টি দূরের উক গাছের দিকে। সেখানে দুইটা পাখি কী সুন্দর করে একে অপরের সাথে সুখ-দুঃখের গল্পঃ করছে। এদের কিচির-মিচির ডাকে যেন সব অনুভব করতে পারছে আরোহী। এমন কোনো দৃশ্য চোখে পড়লেই আরোহীর চোখ ভিজে উঠে। আরিয়ানের কথা মাঝে মাঝে বড্ড মনে পড়ে। কেমন আছে মানুষটা! হয়ত ভীষণ সুখে আছে নতুন বউকে নিয়ে! আচ্ছা আরোহীর সাজানো সংসার স্নেহা কী আবার নতুন করে সাঝিয়েছে! আরিয়ান আরোহীর সব অধিকার হয়ত স্নেহাকে দিয়ে দিয়েছে এতদিনে। আচ্ছা, আরিয়ান বাড়ি ফিরে আরোহীকে কী খুঁজেনি! আরোহীর মনে সাথে সাথে বার্তা এলো,’খুঁজলে কী আর তুই এখানে আসিস এখন!’ আরোহী মানতে চাইলো না কথাটা। তার মস্তিষ্ক বলে উঠল যে আরোহী তো একটা বাসায় পড়ে আছে সারাদিন, এত্তো বড়ো শহরে তাকে খুঁজলেও পাবে কই, হয়ত একটু হলেও খুজবে কিন্তু মন মানতে চাইল না। আরিয়ান একটু মন দিয়ে খুঁজলেই হয়ত আরোহীর নিশানা পেতো। এক বছরে কী আরোহীর প্রতি আরিয়ানের একটুও মায়া বসেনি! সেই মধুর দিনগুলো ভীষণ রকম স্মরণ করছে আরোহী। আজ তার শাশুড়ি লুৎফা বেগম যদি আমেনা আহমেদের মতো হতো তাহলে হয়ত আরোহী আজ আগের জায়গায় সুখে থাকতো। কেন মানুষ একেকজন একেকরকম হয়! সবাই ভালো হতে পারে না! সবাই একরকম ভালো হলে হয়ত এই নিষ্ঠুর দুনিয়াটা পাল্টে যেতে দুই মিনিট সময় নিতো না!
ভোর ফুটতে শুরু করেছে। চারদিকে আস্তে আস্তে কোলাহল বাড়ছে। সকালে ভোর ফোটার সময় এই স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে লাগলে ভীষণ ভালো লাগে। রাতে তেমন একটা ঘুম না হওয়ায় সকাল সকাল উঠে গোসল সেড়ে নিয়েছে। লম্বা চুল বেয়ে বেয়ে পানি চুপসে চুপসে পড়ছে। পরনের শাড়ি কোমরের দিকে ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে আরোহীর খেয়াল নেই। পুব আকাশে সূর্য উঁকি দিচ্ছে। দেখতে দেখতে চারদিকে সূর্যের কিরণ তির্যক ভাবে ছড়িয়ে পড়লো। আস্তে আস্তে নীরব রাস্তাটা কোলাহলে ভরে এলো। কেউ কেউ চাকরিতে যাচ্ছে আবার কেউ কেউ বাচ্চা নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে। একেকজনের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন আরোহী রাস্তা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে সূর্যের দিকে তাকালো। ছোটবেলায় আশ্রমের খেলার সঙ্গীদের সাথে খেলতে খেলতে হঠাৎ আরোহীর একটা ইচ্ছে জাগতো। সে বলে উঠতো,’এই চল, আমরা একটা খেলা করি যে আমাদের মধ্যে কে কতক্ষন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে!’ আরোহীর কথায় সবাই রাজি হতো। সূর্যের দিকে কিছুক্ষন তাকাতেই সবার চোখ দিয়ে পানি পড়ে অনেকে চোখ বন্ধ করে ফেলতো। তেমন সময় খালা দৌড়ে এসে বলতো,’এসব খেলা কী শিখিয়েছে!’ খালার কথায় সবাই আরোহীর দিকে ইশারা করলে তিনি আরোহীর পাশে এসে মাথায় একটা ছোট চাপর মেরে বলতো,’এসব ভালো না। চোখ নস্ট হয়ে যাবে।’ আরোহী তখন অবুঝের মতো বলে উঠতো,’খালা চোখ দিয়ে পানি পড়লে ভালো লাগে আমার। নাক-মুখ লাল হয়ে যাওয়া, চোখ ফুলে যাওয়া। সুন্দর না?’
তখন খালা আরোহীর কথায় তার দিকে তাকিয়ে থাকতো আর বলতো,
‘একদিন বড়ো হয়ে এসব আর ভালো লাগবে না। সুন্দরের কথা আর মাথায়ও থাকবে না।’
আরোহী কিছু বুঝে উঠতে পারতো না তখন । শুধু অবুঝের দৃষ্টিতে খালার দিকে তাকিয়ে থাকতো।

আরোহী আর বেশিক্ষন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ দিয়ে অশ্রু বেরিয়ে গেছে। সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলল। এরপর আবার চোখ খুলতেই আশপাশ অন্যরকম লাগলো। আজ অনেকদিন পর সেই ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আসলেই খালার কথায় সঠিক। একটা সময়ের পর সৌন্দর্যের আর কোনো মূল্য থাকে না। আসল তো কপাল।

আরোহী রুমে এলো। আজ রুহান এলো না একবারও। কী জানি হয়ত বাবাকে কাছে পেয়ে। এমনি এতদিন প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সোজা আরোহীর কাছে এসে তার কোলে উঠে যেত। আরোহী মুখ ধুয়ে ফ্রেশ করে খাবার খাইয়ে দিলেই খেত কিন্তু আজ আসলো না। আরোহীর হঠাৎ খারাপ লাগা কাজ করতেই সে তাচ্ছিল্য হাসলো। দুইদিনে একটু সুখ পেয়েছে বুঝি একেবারের জন্য সুখটা নিজের হয়ে গেল সেটা ভাবলো কী করে! আরোহী তো পর। হয়ত রুহান তাকে দুইদিনে নিঃসন্তানের সুখটা পূর্ণ করেছিল কিন্তু তা তো একেবারের জন্য নয়!
আরোহী আর কিছু না ভেবে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখে পানির ঝাপ্টা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে সিঁড়ির ধাপে পা বাড়াতে নিতেই বিপরীত রুমের দরজার দিকে চোখ যেতেই কালকে রাতের ঘটনাটা মনে পড়ে গেল।
কাল রাতে যখন মানুষটা এলোমেলো ক্লান্ত পায়ে দরজা খুলে বাসায় ঢুকে তখন অন্ধকারের মাঝে আরোহী ভালোভাবে মুখ দেখেনি। সে ভেবেই নিয়েছিল চোর। এক মুহূর্তও মাথায় আসেনি যে চোর কিভাবে ভদ্র পোশাকে গাড়ি নিয়ে আসবে!
যখন একবার চোর উচ্চারণ করলো ঠিক ওই সময়ে নিহানের দৃষ্টি আরোহীর দিকে পড়লো। অন্ধকার বিধায় কেউ কারো চেহারা তেমন একটা দেখেনি।

মানুষটা ভ্রু-কুঁচকে এগিয়ে এসে আরোহীকে প্রশ্ন ছুড়লো,’কে আপনি!’

‘আআরোহী ‘ সে কোনোমতেই উচ্চারণ করলো। আরোহীর নাম শুনে নিহান নামক মানুষটা চমকালো না। হয়ত আমেনা আহমেদের কাছ থেকে শুনে চিনে নিয়েছে।

‘আমি নিহান, চোর নয়!’ আরোহীর ভাবনার মধ্যেই নিহান নামক মানুষটা আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল।

এদিকে আরোহী লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেলল। শেষপর্যন্ত বাড়ির ছেলেকে কিনা চোর বানিয়ে ফেলল!

রাতের ঘটনাটা মনে করেই আরোহী হেসে দিল। কী এক লজ্জাকর পরিস্তিতি!

———–
আরিয়ানের দিন এখন শুরু হয় তিক্ততায় ঘেরা। আজও ব্যতিক্রম নয়। অ্যালার্ম এর কান-ফাটা শব্দে কপাল কুঁচকে সে উঠে বসলো। বসা অবস্থায় কিছু সময় দু-কান চেপে ধরলো। প্রতিদিন প্রতিদিন মাথার পাশে অ্যালার্মের তীব্র ঝাঁঝালো শব্দে মাথা ব্যথা উঠে যায় কিন্তু কিছুই করার নেই। স্নেহার সাথে এই অ্যালার্ম নিয়ে প্রতিদিন ঝগড়া হয়। মেয়েটা বিয়ের আগে ছিল একরকম আর বিয়ের পর আরেকরকম হয়ে গেল। বিয়ের আগে এখানে বেড়াতে আসলে অনেক তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে আরোহীর আগে নাস্তা বানিয়ে ফেলতো কিন্তু এখন আরিয়ানের অফিসের টাইম হয়ে গেলেও ঘুম থেকে উঠে না। আরও অ্যালের্মের শব্দে বিরক্ত হয়ে বলে অ্যালার্মটা যাতে আরিয়ানের একদম পাশে রাখে। স্নেহার ঘুমে যাতে ডিসটার্ব না হয়। আজও এর ব্যতিক্রম নয়। অথচ আরোহী থাকাকালীন আরিয়ানের কোনোদিন অ্যালার্ম এর প্রয়োজন পড়েনি। আরোহী সকাল সকাল উঠে নাস্তা বানিয়ে আরিয়ানের কাছে আধঘন্টা আগে এসে হাজির হতো এরপর আস্তে আস্তে ডাকতো। সে জানতো আরিয়ানের মাইগ্রেন আছে, হুট্ করে বেশি আওয়াজ করে ডাকলে মাইগ্রেনের ব্যথা উঠতে পারে তাই আস্তে আস্তে ডাকতো কিন্তু এখন এসব অতীত। সময়ের সাথে সাথে সব বদলে গেছে। এখন আরিয়ানের নিত্যসঙ্গী মাইগ্রেন।
আরিয়ান মাথা ধরে উঠে দাঁড়ালো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে রুমে এসেও স্নেহাকে ঘুমিয়ে দেখলো। আরিয়ান চুপচাপ তৈরী হয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে। ড্রয়ইং রুমে আসতেই দেখলো রান্নাঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে। আরিয়ান এগিয়ে গেল।
রান্নাঘরে মাকে কাজ করতে দেখে একটা মলিন শ্বাস ফেলল। এখন এসব সবসময় চলে। স্নেহা বেলা বারোটায় উঠে নাস্তা সেড়ে আবারও রুমে চলে যায়। সব কাজ লুৎফা বেগনকেই করতে হয়। এই বৃদ্ধ বয়সে এসব আর সহ্য করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় কাজ করতে তার শরীর সয় না।

#চলবে ইনশাআল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০৮

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৮

আমেনা আহমেদ রান্নাঘরের জানালাটা দিয়ে অদূরে তাকিয়ে বলা শুরু করলো,

‘মিথিলা যখনই এই ঘরে প্রবেশ করেছিল তখন থেকেই এই ঘরটা পরিপূর্ণ পরিপূর্ণ মনে হতো। আমার একটা মেয়ের শখ ছিল কিন্তু সেটা পূর্ণ হয়নি। আমার ইচ্ছে ছিল এই ঘর আলোকিত করে একটা মেয়ে আসবে, যে হবে অনেক বেশি চঞ্চল। সে মেয়েটা তার চঞ্চলতায় পুরো ঘর মাতিয়ে তুলবে। সেই ইচ্ছেটা নিহানের বউ আসার পর পর পূর্ব হয়েছিল। মিথিলা আসার পর ঘরটা পূর্ণ পূর্ণ মনে হতো কিন্তু আমেনা আহমেদ মনে করেছিল মিথিলা আবারও তার পেশায় ফিরে যাবে। অবশ্য, তিনি রাজিও ছিলেন। তিনি মনে করেন, মেয়েদের একটা নির্দিষ্ট খুটি থাকা উচিত। কিন্তু মিথিলা আমার ভাবনা থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে ছিল। বিয়ের পর পর সবসময় ঘরটাকে নিজের রঙের ছোঁয়াতে রাঙিয়ে তুলেছিল। মাত্র কয়েকদিনের ভেতর বাড়ির সবাইকে আপন করে নিয়েছিল। বিয়ের আগেই ডাক্তারি পুরো কোর্স শেষ করেছিল। কথা ছিল বিয়ের পর নিহানের সাথে একসাথে মিলেই পেশায় নিয়োজিত হবে, নিহানের হাসপাতালেই কিন্তু মেয়েটা বিয়ের পর পর আর পেশাটাতে নিয়োজিত হয়নি। নিহানও কত্ত করে বলেছিল কিন্তু মিথিলার একটাই কথা,সে এতো সুন্দর একটা পরিবার পেয়েছে, পুরো দমে সেটাতেই সংসার করতে মনোযোগ দিবে। আমরাও এতো করে বললাম সে গেল না। অনেক লক্ষী একটা মেয়ে ছিল আমার।’ বলেই আমেনা আহমেদ মলিন চোখে জানালা দিয়ে অদূরে তাকিয়ে রইল।
আরোহীরও বড্ড মায়া হলো।

‘জানো? রুহান হবে যে তখন আমার ছেলে-মেয়ে দুইটার কী যে খুশি!’

‘ছেলে-মেয়ে বলতে!’ আরোহী সুধালো।

‘মিথিলা আর নিহানের কথা বলছি। মিথিলাকে আমি মেয়েই ডাকতাম। মেয়েটা এই সংসারে আসার পর থেকে আমার মেয়ের শখটা পূর্ণ হয়েছিল।’

‘মিথিলা আপু রুহানকে দেখেনি খালা তাই না!’

‘না রে। মেয়েটার সেই ইচ্ছেটা পূর্ণ হলো না। দেখে যেতে চেয়েছিল। হাসপাতালে রুহান হওয়ার পর বাচ্চাকে নিহানের কোলে দিতেই নিহান হাসিমুখে চুমু একে দিল। সে বাচ্চাটিকে নিয়েই বলেছিল,’আগে আমার মিথিকে দেখিয়ে আসি।’ কিন্তু ডাক্তাররা তখন এসে মিথিলার অবস্থা জানাতেই নিহান রুহানকে আমার কোলে দিয়ে থিয়েটারের সামনে দৌড়ে গিয়েছিল। ওই হাসপাতালে নিহান কর্মরত ছিল আর বেশ জনপ্রিয় তাই ডাক্তাররা অপারেশন থিয়েটারে নিহানকে ঢুকতে দিয়েছিল। নিহানের চোখের সামনেই মিথিলা আমার মেয়েটা চলে গেল। নিহান মেয়েটাকে তার থেকে একটা ফুটফুটে বাচ্চা হওয়ার খবর দিল ঠিকই কিন্তু মেয়েটা ততক্ষনে হারিয়ে গেল। নিহান নিজে ডাক্তার হয়েও সে বিশ্বাস করেনি যে মিথিলা হারিয়ে গিয়েছে। সে ভেবেছিল, মিথিলা বুঝি জ্ঞান হারিয়েছে হয়ত। সেদিন নিহানের কী যে পাগলামি! জীবনের সেই প্রথম আমার ছেলেটাকে এভাবে কাঁদতে দেখেছিলাম। এরপর প্রায় দুই মাস হয়ে যাওয়ার পরেও নিহান স্বাভাবিক হতে পারেনি। ধীরে ধীরে আস্তে আস্তে রুহানের দিকে তাকিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছে। সেই দিন গুলো মনে পড়লে এখনো খারাপ লাগে। আমার লক্ষী মেয়েটা হুট্ করে চিরতরে হারিয়ে গিয়েছিল, এরপর থেকে এই বাসায় সবাই এমনি মুখের উপর হাসি আনতো শুধুমাত্র রুহানের জন্যই আর আমার ছেলেটা! একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল আর কোনোকিছুর বায়না ধরে না!গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। ছেলেটাকে কত করে বললাম যে আমাদের শেষ বয়স এসে যাচ্ছে একটা বিয়ে কর কিন্তু ছেলেটা কিছুই বলে না, চুপচাপ রুহানের দিকে তাকিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে তোমাদের জন্য বিয়ে করলেও আমার ছেলে মা পাবে না।’বলতে বলতেই আমেনা আহমেদের চোখের কার্নিশ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

আমেনা আহমেদের কথা শুনে আরোহীরও চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। আপুটার কপালে সুখ বুঝি বেশি সময়ের জন্য ধরা দেয়নি। খালার কথা শুনে বুঝলো, মেয়েটা টানা দুইবছর এক তরফা ভালোবেসে নিহান নামক মানুষটার পেছনে ঘুরঘুর করেছিল। যারও বিয়ের পর সব সুখ এসে ধরা দিল তখনই হুট্ করে চলে যেতে হলো! আহা জীবন!
আরোহীর হুট্ করে একটা ইচ্ছে হলো। সে ভাবলো, সেদিন মেয়েটার বদলে যদি তার জীবন চলে যেত! অন্তত আজকে একটা অনেক সুখের সংসার হতো। একটা প্রাণের বিনিময়ে যদি আরেকটা দিতে পারতো!

সেদিন সারাদিনটাই মাটি মাটি মনে হলো আরোহীর। কোনোকিছুতেই আর মন বসেনি। রুহানের সাথেও আর হেসে-খেলে কথা বলা হয়নি। রুহানকে খাবার খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেই বাধ্য ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়েছিল। এই ছেলেটাও হয়েছে একদম বুঝদার। হয়ত মা নেই, বাবা সবসময় কাছে থাকে না তাই নিজে থেকেই বুঝদার হয়ে উঠেছিল!
আরোহী জানালার কাছ থেকে এগিয়ে গিয়ে রুহানের পাশে বসলো। ঘুমন্ত ছেলেটার চেহারাতে কী যে মায়া! আরোহীর এই ছেলেটার জন্য ভীষণ মন পুড়ে। চাকরি নিয়ে এই বাসা থেকে চলে গেলে সবাই অনেক স্মরণে পড়বে। একটা অচেনা অজানা মেয়ের মুখের কথা বিশ্বাস করে এতদিন আপনের মতো রেখেছে সেই কৃতজ্ঞতার ঋণ হয়ত কখনো শোধ করা হবে না। চাইলেও সেই ঋণ এর সমান শোধ হবে না। খালা আর আঙ্কেলকে বা কোনোমতেই মানিয়ে চলে যেতে পারবে কিন্তু এই ছেলেটা! এই ছেলেটাকে ছাড়া সে কিভাবে নিজেকে একা মানিয়ে নিবে! কিন্তু এটাই যে নিয়তি! কষ্ট হলেও যে মেনে নিতে হবেই!

‘মা?’

মাথায় কারো উষ্ণ ছোঁয়া পেয়ে কারো ডাকে আরোহী সম্বিৎ ফিরে পেল। সে দ্রুত চোখ তুলে তাকাতেই দেখল আমেনা আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন। তা দেখে সে নিজেও উঠে দাঁড়ালো।

‘জি বলুন খালা!’

‘বলছি কী! তোমার যদি আপত্তি না থাকে তোমাকে নিয়ে একটু শপিং এ যেতাম!’

আরোহী ঝটপট রাজি হয়ে গেল।
‘এটা আবার জিজ্ঞেস করতে হয় খালা! আমি আপনাদের বাড়িতেই আছি, আপনাকে না করি কিভাবে বলুন!’

‘না, এটা বলে আমাকে লজ্জিত করো না। কতবার বলেছি, আমাকে তুমি খালা ডাকো, তাহলে আপনই ভেবো। তোমার ইচ্ছে থাকলে চলো! এখন রুহান ঘুমিয়ে আছে। চট করে গিয়ে চলে আসতে পারবো। আর উঠে গেলে রাহেলাকে ফোনে জানিয়ে দিতে বলেছি। তখন চলে আসবো। ততক্ষন তোমার আঙ্কেল আছেন ঘরে।’

আরোহী রুহানের ব্যাপারেই প্রশ্নঃ করতে নিচ্ছিলো। আর আমেনা আহমেদ ঝটপট তার সব প্রশ্নের উত্তর একনাগাড়ে বলে দিতেই সে জানালো সে যেতে পারবে।

এরপর দুইজনেই খুব তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল কাছের একটা শপিং সেন্টারে। সেখানে গিয়ে আরোহী ঘুরে ঘুরে আমেনা আহমেদকে এটা-ওটা পছন্দ করে দিতেই তিনি সব প্যাক করে বিল পরিশোধ করে আরোহীর হাতে তুলে দিলেন।
আরোহী ভ্রু কুঁচকে খালার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই তিনি হাসিমুখে বলে উঠলেন,

‘এসব তোমার জন্যই মা। তোমার জন্য শপিং করবো বললে আসতে চাইতে না তাই এভাবে এনেছি তোমাকে। সব তোমার পছন্দের শাড়ি।’

আরোহী প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে আমেনা আহমেদের জোরাজোরিতে নিয়ে নিল। সে কৃতজ্ঞতা চোখে তাকালো। এখানে আসার পর খালায় নিজে থেকে দুইটা শাড়ি দিয়েছিলো, সেগুলোই একেকদিন একেকটা বদলে বদলে পড়েছিল। ইনাদের ঋণ হয়ত কখনো শোধ করতে পারবে না আরোহী।

————

রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পরে আরোহী রুমের ব্যালকনিতে এসে অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। এই দুনিয়া-দারি আর ভালো লাগছে না তার। দিন শেষে রাত আসলেই ওই মানুষটার কথা মনে আসতেই না চাইতেও চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু ঝরে পরে।

ঠিক সেসময়ে বাসার নিচে একটা কালো গাড়ি এসে থামতেই আরোহী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সে রুমের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল,’রাত দুইটা। এতো গভীর রাতে ইনি কে!’

মানুষটাকে বাসার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরোহী ভয় পেয়ে গেল। উপর থেকে বিধায় চেহারাটাও দেখা যাচ্ছে না ভালোমতো। এলোমেলো পায়ে মানুষটা পা বাসার দিকে পা বাড়ালো।
ঠিক সেসময় বাসার কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। একবার বাজতেই আর কোনো শব্দ এলো না। বাসার সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে বিধায় একবারের শব্দটাও কেউ শুনলো না। আরোহী রুম থেকে বেরিয়ে ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি কয়েক ধাপ পেরিয়ে নিচে নামতেই কট করে দরজা খুলে গেল। আরোহী ওখানেই জমে গেল। কে ইনি!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০৭

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৭

আরিয়ান বিমর্ষ চেহারায় বসে আছে। মাথায় হাত দিয়ে তার নিজের চুল টেনে ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। যত খুশি হয়ে বাসায় এসেছিলো, দরজা দিয়ে ঢুকতেই সব খুশি উধাও হয়ে গিয়েছে।
পাশেই স্নেহা আর লুৎফা বেগম দাঁড়িয়ে আছে। তারা একজন আরেকজনের দিকে কিছুক্ষন পর পর তাকাচ্ছে। স্নেহাকে ভয় পাওয়া অবস্থায় দেখা গেল। লুৎফা বেগম স্নেহার এমন ভয়ের দৃষ্টি দেখে চোখ দিয়ে আশ্বাস দিল যে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। যা করার তিনি নিজেই করে নিবেন।

লুৎফা বেগম দৌড়ে রুমের দিকে এগিয়ে গেল। এরপর আবারও অস্তির চিত্তে হাতে একটা কাগজ নিয়ে হাজির হলো।

‘দেখ বাবা, দেখ।’

লুৎফা বেগমের হাত থেকে এগিয়ে দেওয়া কাগজটার দিকে আরিয়ান এক ফলক তাকালো জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে। লুৎফা বেগম ইশারা দিয়ে কাগজটা নিতে বলতেই আরিয়ান কাগজটা নিল।
দুই হাতে কাগজটা ধরে দৃষ্টি দিতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেল।

‘আরে, এটা এটা তো ডিভোর্স পেপার!’

লুৎফা বেগম যেন এই সুযোগেরই অপেক্ষায় ছিলেন। তিনি মুখটাকে কাঁদো কাঁদো করে বলে উঠলেন,

‘হু সেটাই আর কী। নিচে দেখ।’

লুৎফা বেগমের কথা অনুসারে আরিয়ান নিচের দিকে তাকাতেই আরোহীর সাইন দেখে আরও একবার শক খেল। আরোহীর সাইন জ্বলজ্বল করছে। আরিয়ানের মনে হচ্ছে ওই একটা সাইনই যেন আরিয়ানের চোখের দৃষ্টি কেড়ে নিচ্ছে । ‘আরু, আরু আমাকে ডিভোর্স দিয়েছে!’ বিড়বিড় করে আওড়ালো। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে আরোহী তাকে ডিভোর্স দিয়েছে। সে দ্রুত পদে উঠে ড্রয়ইং রুম থেকে ঘরের প্রতিটা রুমে আবার গেল। আনাচে-কানাচে সব জায়গায় খুজলো। ঘরে আরোহীর কোনো ছায়াও পেল না। আরিয়ানকে বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। তার বিশ্বাস আরোহী এখানেই আছে আর থাকবে। আরোহীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। ও কই যাবে! আরিয়ান দ্রুত সব রুম খুঁজেও যখন আরোহীকে পেল না তখন ড্রয়ইং রুমে এসে আবারও ডিভোর্সের কাগজটা নিয়ে সে ধপ করে বসে পড়লো।

আরিয়ানের এই অবস্থা দেখে স্নেহা লুৎফা বেগমকে ইশারা করলো। আগুনে ঘি ঢালার সময় এখনই।

লুৎফা বেগম ইশারা দিয়ে স্নেহাকে আস্বস্ত করলেন।

‘জানিস বাপ্, ঐদিন সকালে উঠে আমার আর স্নেহার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়েটি ডিভোর্স এর এই পেপারটি ছুঁড়ে মেরে বলেছিলো তুই যেন সাইন করে দিস। তারপর রুমে গিয়ে আমাদের সামনে সজোরে দরজা আটকে দিয়েছিল। আমাদের কিছু বলারও সুযোগ দিল না। আমরা কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি, তারপর স্নেহা সেই পেপারটা নিয়ে দেখলো সেটা ডিভোর্স পেপার আর সেখানে মেয়েটির সাইন। দেখেছিস? তার মানে মেয়েটি অনেক আগে থেকেই ডিভোর্সের বন্দোবস্ত করে রেখেছে। একদিনে কী আর এই সব করা সম্ভব!’
হরহর করে সব একনাগাড়ে বলে থামলো লুৎফা বেগম। তার বলা শেষেই তিনি আরিয়ানের দিকে তাকালেন যে তার রিঅ্যাকশন কেমন!

আরিয়ান সব শুনে মাথা চেপে বসে পড়লো। এমন জানলে সে জীবনেও ঐদিন অফিসের কাজে যেত না। এমন কেন লাগছে তার! ঐদিন আরোহীর ‘বিদায়’ বলার ধরণ আর সে-শব্দটা শুনে আরিয়ান কিছু সময়ের জন্য থমকে গিয়েছিল। আরোহী কোনোবার আরিয়ান বাইরে গেলে ‘বিদায়’ শব্দটা বলতো না, অন্য কোনো কিছু বলে বিদায় দিতো। সেদিনের কথাটি শুনে আরিয়ানের অন্য রকম লাগলেও পরে অফিসের বসের কল চলে আসায় দ্রুত পদে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। তাই আর কোনো কিছু বলার সুযোগ পায়নি। আরিয়ান নিজের মাথার চুলগুলো আরও জোরে টেনে ধরলো। সেদিনই বোঝা উচিত ছিল তার। কোথায় খুজবে সে এখন আরোহীকে! এমন কেন লাগছে তার। বুঁকের কোথাও জানি ভীষণ খালি খালি লাগছে। এতদিন মনে করেছিল, আরোহীর প্রতি তার আর কোনো মায়া নেই কিন্তু এই বিয়েটা করার পর থেকে বুঝছে আরোহী তার মনের কত্ত গভীরে রয়েছে। কিভাবে থাকবে সে আরোহীকে ছাড়া!

———–

আরোহী রান্নাঘরে আমেনা আহমেদের সাথে হাতে হাতে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছিলো। তিনি আরোহীকে গল্পঃ বলতে বলতে রান্না করছিল। তার ছেলে, ছেলের বউ এর গল্পঃ বলে বলে স্মৃতিস্মরণ করছিলো।

‘আমার নিহান অনেক জেদি একটা ছেলে। কোনো কিছু তার চাই মানেই চাই। মিথিলাকেও সেভাবেই বিয়ে করেছিল। মিথিলা বিয়ে হওয়ার পর পর তাদের প্রেম কাহিনীটা প্রায় সময় আমাকে বলে বলে হাসতো। মূলত মিথিলাই তাদের সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল।’ বলেই আমেনা আহমেদ তেলে পেঁয়াজ-মরীচ ছেড়ে দিলেন। এরপর সেখানে মশলা-পাতি দিয়ে নাড়তে নাড়তে আবারো বলা শুরু করেন,

‘জানো? মিথিলা না-কি নিহানকে প্রথম প্রথম প্রচুর বিরক্ত করতো। আমার নিহানকে না-কি প্রথম দেখেই তার মনে এক অন্য রকম অনুভূতি হয়। কী জানি একটা শব্দ বলতো মিথিলা। কাশ না-কি কী একটা জানি!’

‘ক্রাশ!’ আরোহী আমেনা আহমেদের কথার ধরণ দেখে হেসে ভুল শুধরে দিতেই উনি আবারো বলে উঠলেন,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ ঐটা। নিহানও মেডিকেলের ছাত্র ছিল কিন্তু মিথিলাদের থেকে সিনিয়র।’

‘তার মানে মিথিলা আপুও ডাক্তারি পড়েছিলেন!’ আরোহী আমেনা আহমেদের কথার মাঝে প্রশ্নঃ করলো।

‘হ্যাঁ, সেই সুবাদেই তাদের দেখা। তাদের বলতে মূলত মিথিলা প্রথম সেখানেই দেখেছিল নিহানকে। এরপর থেকে না-কি টানা এক বছর নিহানকে দেখতো। এর পরের বছর থেকে নিহানের পেছনে ঘুরঘুর করা শুরু করেছিল। নিহান প্রথম প্রথম না-কি অনেক রেগে যেত। একবার কী হয়েছে জানো?’

আরোহীর এদের প্রেম-কাহিনীর শুরুটাতে ভীষণ আকর্ষণ বোধ করছিল। তাই সেও প্রতিউত্তরে জিজ্ঞেস করলো যে কী হয়েছে!

‘নিহানের পেছনে বেশি ঘুরঘুর করতো তাই সে মিথিলার আচরণে সহ্য করতে না পেরে থা’প্প’ড় মারতে গিয়েছিল।’

‘কী বলেন! তারপর! মেরেছে না-কি!’

‘না আবার মারেনি। আমার ছেলে মেয়েদের কাছে কম ঘেঁষতো আর কোনো মেয়ে ওর পাশে ঘেঁষতে চাইলেও রেগে যেত আর মেয়েদেরকে সম্মানও করতো প্রচুর কিন্তু মিথিলার এরূপ আচরণে টানা দেড়বছর অতিষ্ট হয়ে মারতে গিয়েছিল। মিথিলা অবশ্য বুঝে গিয়েছিল যে নিহান কোনোদিনও মেয়ের গায়ে হাত তুলবে না হয়ত ভয় লাগাচ্ছে। যখন ভয় লাগানোর পরও মিথিলা ভয় পেলো না তখন নিহান বুঝে নিয়েছিল যে এই মেয়ে তাকে সহজে ছাড়বে না। এরপরের এক মাস ভালোই কাটলো তাদের দুজনের। নিহানের ডাক্তারি পড়া শেষে চাকরি নিয়েই মিথিলাকে পাঁচমাস পর একেবারে বউ রূপে বাসায় এনেছিল।’

আরোহী এদের প্রণয়ের কাহিনী শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে গেল। কত্ত কষ্টে মিথিলা সুখের সন্ধান পেল! কিন্তু সেই সুখ তার কপালে বেশিদিন সইলো না। নিয়তি এতো নিষ্ঠুরও হয়! সেই মেয়েটা সুখের সময়ে’ই হারিয়ে গেল, একেবারের জন্য চলে যেতে হলো। নিজের সবচেয়ে সুখ যার মধ্যে নিহিত, সেই বাচ্চাটাকেই দেখে যেতে পারলো না! আরোহীর হুট্ করে একটা ইচ্ছে হলো। যদি তার এই প্রাণটার বিনিময়ে হলেও মিথিলা বেঁচে থাকতো! তাহলে হয়ত একটা সুখের সংসার বেঁচে থাকতো।

হঠাৎ এমন সময় রুহানকে দৌড়ে আসতে দেখে আরোহী ফিরে তাকাতেই দেখলো রুহান হাতে মোবাইল নিয়ে আরোহীর দিকে তাক করে বলে উঠল,

‘বাবাই, বাবাই। আমার নতুন আন্টিকে দেখবে তুমি!এই দেখো!’

আরোহী স্ক্রিনে দৃষ্টি দিতেই দেখতে পেল ওই পাশের মানুষটা নিচের দিকে তাকিয়ে কী একটা যেন লিখছে। আরোহী বুঝতে পারলো ইনিই হয়ত নিহান হয়ত ছেলের সাথেও কথা বলছে আর নিজের কাজও করছে।

আমেনা আহমেদ রুহানের কথা শুনে দ্রুত এগিয়ে এসে রুহানের হাত থেকে মোবাইল নিয়ে নিল। বিপরীত পাশের মানুষটিকে কিছু একটা করতে দেখে তিনি রেগে যাওয়া কণ্ঠে বলে উঠল,

‘এই সারাক্ষন খালি এগুলো কী করিস!’

আমেনা আহমেদের কণ্ঠস্বর পেতেই মানুষটি তার সামনের কাগজপত্র সরিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিয়ে হাসলো।

‘আর বলো না মা। আরেকটা সার্জারি পড়ে গিয়েছে, কিছু কাজ করছিলাম। কেমন আছো তুমি আর বাবা কেমন আছে!’

‘হু ভালোই। ফিরবি কখন!’

‘কয়েকদিনের মধ্যে ফিরবো। বাবাকে দেখাও দেখি! রুহান জ্বালাচ্ছে না-কি!’

‘তোকে বলছিলাম না! আরোহী আসার পর থেকে তো আর তেমন জ্বালায় না। একদম লক্ষী ছেলে হয়ে গিয়েছে।’

আমেনা আহমেদ কথা বলতে বলতে মোবাইল নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। ওইপাশ থেকে আর কী বললো সেটা শোনা গেল না। আরোহী মলিন শ্বাস ফেলল। এতক্ষন পাশে ছিল বিধায় সে স্ক্রিনে দেখেছিল মানুষটাকে। হুটহাট রুহান এমন কাজ করে ফেলে না! আরেকটু হলেই তার প্রাণটাই হয়ত চলে যেত ভয়ে। এইবার বুঝতে পারলো রুহান কার মতো হয়েছে! ছেলেটা পুরোই বাবার মতো হয়েছে। ফর্সা, গুলগাল চেহারা। আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মানুষটাও হয়ত বুকে এক আকাশ সমান দুঃখ রেখে পরিবারের সাথে সুন্দরভাবে কথা বলছে! মানুষ উপরে দেখাই একরকম আর ভেতরে অন্য রকম!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০৬

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৬

কেটে গেল দুইদিন। এর মধ্যে আরোহীর সাথে বাচ্চা রুহানের প্রচুর ভাব জমে গেছে। এখন রুহান সারাক্ষন আরোহীর পেছনেই ঘুরঘুর করে। কী জানি রুহান আরোহীর কাছে মায়ের মতো ছোঁয়া পায় হয়ত। সেদিন আরোহীকে যখন আমেনা আহমেদ রুহানের মায়ের ছবি দেখালো তখন আরোহীরও ভীমরি খাওয়ার মতো অবস্থা। পুরোপুরি মিল না হলেও একটা বাইরের মেয়ে হিসেবে আরোহী আর রুহানের মায়ের মধ্যে বেশ মিল রয়েছে। আমেনা আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিলেন, বাস্তবে দেখলে আরও মিল পেতো, আচরণও একটু একটু মিল। এজন্য হয়ত ছোট্ট রুহানের মনে আরোহীর প্রতি মায়ের টান অনুভব করেছে!

আরোহী আমেনা আহমেদের কাছ থেকে শুনেছে, রুহানের বাবা যতবারই কাজে বাইরে যায় ততবারই রুহানকে রাখা মুশকিল হয়ে পড়তো কিন্তু এইবার আর মুশকিল হয়নি। প্রথম একদিন কান্না করেছিল কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকে আরোহীকে পেয়ে তার এখন বাবাকেও লাগে না। হয়ত তার ছোট মস্তিষ্কে ধারণা জন্মে গেছে যে মায়ের মতো হয়ত আরোহীও হারিয়ে যাবে। এখন তো সে আরোহীকে ছাড়া কিছু বুঝেই না। সারাক্ষন আরোহীর সাথে ঘুরঘুর করে। আর আরোহীও রুহানকে নিয়েই থাকে। রুহানকে কোলে নিলে তার নিজেরও মাতৃত্বের স্বাদের অভাব পূর্ণ হয় হয় মনে হয়।
পাশাপাশি আরোহী নিজের একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে চেয়েছিল কিন্তু আমেনা আহমেদের একটাই কথা উনি আরোহীকে চাকরি করতে দিবে না। তবুও অন্যের ঘরে আর কতদিন! এনারা নিজের মতো করে বললেও কোথাও যেন একটা বাধা কাজ করে। অনেক তো করেছেন এনারা। আর কষ্ট দিয়ে কী হবে!
তাই আজ আরোহী একপ্রকার জোর করে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাবে । চাকরি বলতে বেশি বড়ো নয়। আরোহীর নিজের যোগ্যতা অনুসারে স্বল্প বেতনের একটা চাকরি। আরোহীর বিশ্বাস, আজকে হয়ত চাকরিটা হয়েই যাবে। আর অন্যের বাড়িতে পড়ে থাকতে হবে না। মাঝে মাঝে রুহানকে এসে দেখে যাবে। অবশ্য এই দুইদিনে রুহানের প্রতি অনেক ভালোবাসা জন্মে গেছে। মনে হচ্ছে, রুহানের সাথে তার অনেক অনেক গভীর সম্পর্ক। প্রথম প্রথম ওকে ছাড়া থাকতে কষ্ট হবে কিন্তু মানিয়ে নিতে হবে। চাকরিটা পেলেই আশ্রমে গিয়ে খালাকে একেবারে নিজের সাথে নিয়ে আসবে। এই জীবনে খালাও অনেক কষ্ট করেছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে খালাকে আরোহী দেখে আসছে মাঝে মাঝে খালা ভীষণ মন-মরা হয়ে যেত। ছোট্ট ছিল বিধায় আরোহী বুঝতে পারতো না তবুও খালার ওই মলিন চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকতো আর তখন খালা অদূরে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলে উঠতো,
‘জানিস আরু, আমার না মাঝে মাঝে কিচ্ছু ভালো লাগে না। ইচ্ছে করে এসব কিছু ছেড়ে-ছুঁড়ে অনেক দূরে হারিয়ে যায় কিন্তু পারি না তোদের জন্য। আর কারো কাছে দায়িত্বটা সপে দিতে পারলেই চলে যেতাম।’
আরোহী ছোট ছিল তখন কিছুই বুঝতে পারতো না সেটা খালা নিজেই জানতেন কিন্তু তিনি তবুও বলেই যেতেন কারণ ওই যে একটা কথা শোনার মানুষ দরকার ছিল!
আরোহী খালার এরূপ কথা-বার্তা তখন বুঝে উঠতে না পারলেও কিন্তু বড়ো হওয়ার সাথে সাথে সবকিছু আয়ত্তে আনতে পেরেছে। কিন্তু যে খালা যাদের ছেড়ে যেতে পারেনি যাদের জন্য থেকে গিয়েছিল কিন্তু তারা ঠিকই খালাকে ছেড়ে গিয়েছিল। যেমন আরোহী নিজেও সুখের সন্ধান পেয়ে খালাকে ভুলতে বসেছিল অথচ আরোহীর আশ্রমের আঠারোটা বছর খালা আগলে রেখেছিল! কিভাবে পারলো আরোহী সে খালার সাথে একটা বছর সম্পর্ক না রাখতে! আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই চাকরিটা হয়ে যাক, খালার কাজটা অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিবে দরকার হলে এই চাকরির পাশাপাশি খালার কাজটা সে নিজেই নিবে এরপর খালাকে আপন করে নিয়ে আসবে নিজের কাছে। তারপর নিজে একটা ছোট্ট ঘর নিয়ে সেখানে খালা আর সে মিলেমিশে সুখে থাকবে। ‘সুখে থাকবে’ ভাবতেই তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্য হাসির আবাস দেখা গেল। তার আবার সুখ! এতো ভালো থাকার অভিনয় করলেই কী ভালো থাকা যায়। রুহান আর এই পরিবারের সাথে মিলেমিশে থাকতে থাকতে হয়ত দিনটি পার হয়ে যায় কিন্তু রাত! রাতটা তো অনেক দীর্ঘ রাত মনে হয় তার। একেকটা রাত যে কত কষ্টে কত চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শেষ হয় সেটা কে জানে!

‘আরোহী মা!’

কারো কণ্ঠস্বর শুনেই আরোহীর ধ্যন ভাঙতেই দেখলো আমেনা আহমেদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

‘জি, জি বলুন খালা।’

‘তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে। রুহান তোমাকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে, তুমি বোধহয় খেয়াল করোনি।’

আমেনা আহমেদের কথা শুনে আরোহী নিচের দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখলো, রুহান তার শাড়ির আঁচল ধরে তারই দিকে তাকিয়ে আছে। রুহানের সেই দৃষ্টি দেখে আরোহীর ভীষণ মায়া হলো। সে দ্রুত কোলে তুলে নিল রুহানকে। এই ছেলেটা দুইদিনে তার মনে সবার প্রথমেই জায়গা করে নিয়েছে। তার মা হওয়ার শখ কয়েকদিনের জন্য হলেও পূর্ণ করেছে এই ছেলেটা। চাকরিটা পেয়ে চলে গেলে সে কিভাবে থাকবে একে ছাড়া!

আরোহী আর কিছু না ভেবে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেনা আহমেদের দিকে দৃষ্টি দিল। উনি আরোহীর সামনে দাঁড়িয়ে উসখুস করছে। তা দেখে আরোহী মুচকি হেসে বলে উঠল,
‘খালা, কিছু বলবেন!’

‘না, বলছি কী! তোমার চাকরিটা না করলে হয় না। আমাকে তো খালা ডাকো। মনে করো, আমি সত্যিই তোমার খালা। আর রুহানকে ছাড়া থাকতে পারবে তুমি! ছেলেটাও দুইদিনে তোমাকে পেয়ে আর কাউকে খুঁজছে না। নিহান তো বলেই দিয়েছিল যে তার ছেলের কী হলো হঠাৎ করে যে প্রানপ্রিয় বাবাকেও আর খুঁজছে না। হয়ত ছেলের জন্য বাকি সার্জারি অন্য কাউকে বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসবে।’

আরোহী বিনিময়ে কোনো জবাব দিল না। খালাকে কোনোমতেই বুঝিয়ে ইন্টারভিউ এর জন্য পরিপাটি হয়ে বের হলো। তার মাথার উপর অনেক দায়িত্ব। সে দায়িত্বগুলো পালন করার জন্য হলেও তার চাকরি পেতে হবে। অনেক বড়ো হওয়ার বাকি আছে তার।

যথা স্থানে গিয়ে পৌঁছাতেই আরোহীর ডাক আসলো। সে উঠে অনুমতি নিয়ে ঢুকতেই একজন মধ্য বয়স্ক লোককে বসে থাকতে দেখল। আরোহী বুঝতে পারলো হয়ত উনারই অফিস এটা। সে উনার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিতেই উনি বসতে বলল।
উনি আরোহীর নেওয়া কাগজপত্র গুলো দেখে দূরে সরিয়ে রাখলো।
আরোহী ভেবেছিল উনি চাকরির যোগ্যতা নিয়ে কথা বলবেন কিন্তু না!
কাগজপত্র দেখেই উনি আরোহীর দিকে এক অন্য দৃষ্টিতে দেখল।

‘ডিভোর্সি!’

‘জি।’

‘চাকরি দরকার!’

আরোহী মাথা নাড়তেই লোকটি আবারও আগের ন্যায় দৃষ্টিতে আরোহীকে নিচ থেকে উপরে দেখে নিল।

‘চাকরি তো অনেক আছে কিন্তু তা তোমার যোগ্যতা অনুসারে নয়। কিন্তু আমি তবুও তোমাকে দিতে পারি। কোন চাকরি দরকার তোমার! টাকা চাই?’

লোকটির কথা বলা আর এমনভাবে তাকানোর অর্থ বুঝতে পেরে আরোহীর গা ঘৃণা’য় রি রি করে উঠল। সে আর চুপ না থেকে উঠে দাঁড়ালো।

‘তোদের মতো মুখোশ পড়া মানুষদের ধরে থা’প্রা’নো উচিত।’ বলতে গিয়েও আরোহী মুখ সামলে নিল। কারণ এটি লোকটির অফিস। কিছু হলেই আরোহীর বিপত্তি। সে লোকটির সামনে থেকে চৌ মেরে নিজের কাগজপত্র গুলো নিয়ে ক্যাবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
যত আশা নিয়ে বেরিয়েছিল ততটা ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বাসায় ফিরেছিল। আরোহী ভেবেছিল আজ হয়ত চাকরিটা হয়েই যাবে। অন্তত সবচেয়ে নিম্ন পদের হলেও একটা চাকরি পাবে ভেবেছিল কিন্তু দুনিয়া যে বড়োই কঠিন। এখানে ভালো মানুষের আড়ালেই কিছু কুৎসিত মানুষের বাস। একটা বাপের বয়সী মানুষও ছাড় দিচ্ছে না। এই দুনিয়াতে একেক মানুষের একেক রূপ!
সবাই কী বাবার মতো ভালো হতে পারে না! সবার মন-মানসিকতার ভেতরে যদি রাখতো যে,’আমি আমার সন্তানদের জন্য যেমন আদর্শ তেমন অন্যদের জন্যও আদর্শ হবো।’
মন-মানসিকতা বদলালেই দুনিয়াটা সুন্দর হতো! আরোহী মলিন শ্বাস ফেলল। আজকের আশাটাও গেল কিন্তু সে হাল ছাড়বে না কিছুতেই। এসব ভাবতে ভাবতেই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

———

আজ আরিয়ান ফিরবে। দুইদিনের সময়টা মনে হচ্ছে যেন অনেক দীর্ঘ। এই প্রথম আরোহীর সাথে এতদিন যোগাযোগ ছিল না। প্রতিবার এরকম কাজে বাইরে গেলেও আরোহীর সাথে দিন শেষে রাতে ঠিকই কথা হতো আর নয়তো আরোহী নিজেই দিনে কয়েকবার কল করে করে খেয়েছে কিনা! ফ্রেস হয়েছে কিনা! এসব বলে বলে আরিয়ানকে বিরক্ত বানিয়ে ফেলতো কিন্তু এইবার করেনি। উল্টো আরিয়ান রাতে কল করেই মোবাইল বন্ধ পেয়েছিল। টানা দুইদিন তার মোবাইলে সংযোগ পায়নি। স্নেহা আর মায়ের সাথে ঠিকই কথা হয়েছিল কিন্তু শুধু আরোহীর সাথেই হয়নি। তাই আরিয়ান এক রকম ফুরফুরে মেজাজে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০৫

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৫

আরোহী যখন চোখ খুলল তখন চারদিকে আলোর ছড়াছড়ি। দীর্ঘক্ষন চোখ বন্ধ ছিল বলে হঠাৎ আলো দেখে আরোহী আবারও চোখ কুঁচকে বন্ধ করে ফেলল।

‘তুমি ঠিক আছো মা?’

কারো গম্ভীর মায়াভরা কণ্ঠস্বর শুনে আরোহী আর চোখ বন্ধ করে থাকতে পারলো না। সে দ্রুত চোখ খুলতেই একটু দুরুত্বে একটা মধ্যবয়স্ক নারীকে তারই দিকে চিন্তিত চোখে তাকিয়ে বসে থাকতে দেখা গেল।

‘জি কিন্তু আমি এখানে…!’

আরোহীর কথা শুনে মধ্যবয়স্ক নারীটি সামান্য হাসলো আর এতেই যেন তার সব সৌন্দর্য পুরো মুখে বিস্তীত লাভ করলো।

‘আমরা গ্রামের বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। মাঝরাস্তায় হঠাৎ তুমি এসে পড়েছিলে আর কোনোমতেই ব্রেক কষে তোমাকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হই। তোমার কোনো ক্ষতি হয়নি সেজন্য লাখো লাখো শুকরিয়া। জানো, ভোর থেকে এই পর্যন্ত সময়টা কত চিন্তায় ছিলাম!’

উনার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।

আরোহী মনোযোগ দিয়ে শুনলো। হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই সে উত্তেজিত হয়ে পড়ল।

‘খালা, আমার হাতে সার্টিফিকেট ছিল সেগুলো কই!’

আমেনা আহমেদ আসনে বসা অবস্থায় ক্যাবিনের কর্নারে ইশারা করে বললো,
‘ঐতো আমি রেখেছি এগুলো। চিন্তা করো না।’

আর এতেই আরোহী নিশ্চিন্ত হলো কিন্তু তার টাকা! সেগুলো ছাড়া এখন কিভাবে চলবে! এখন তো কোনোমতেই সার্টিফিকেট আছে কিন্তু তাও এখন কার সময়ের জন্য অনেক নিম্নমানের। টাকা ছাড়া এই দুনিয়ায় কিচ্ছু হয় না। আরোহী ভেবেছিল, অন্তত বাসা থেকে বেরিয়ে হাতের টাকাগুলো দিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে কোনো একটা ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে আর নিজেও চলতে পারবে কিন্তু এখন টাকাগুলোও হারালো। তার হঠাৎ করে ভীষণ রকম খারাপ লেগে উঠল। কী করবে সে এখন! ইনারা তো আরোহী জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিল। ওর জ্ঞান ফিরেছে হয়ত এখন ইনারাও চলে যাবে। আরোহী কোথায় যাবে, কী করবে ভেবে উঠতে পারছে না। হাতের মুঠোয় টাকার সাথে সাথে একটা কাগজে নাম্বার লিখে নিয়েছিল, যেটা আশ্রমের খালার নাম্বার। উনার নাম্বারটাও হারালো। ভেবেছিল, উনার সাথে দেখা করে কিছু একটার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবে। অন্তত উনি আরোহীকে ফিরিয়ে দিবেন না কিন্তু এখন সেই পথটাও বন্ধ হয়ে গেল। তবে সেই আশ্রমে গিয়ে খোঁজ নেওয়া যায় কিন্তু অন্তত যেতে হলেও যে টাকাগুলো লাগবে সেই টাকার কানা-কড়িও তো আরোহীর নেই।

‘মা, তুমি কী কিছু নিয়ে চিন্তিত?’

পাশ থেকে ‘মা’ সম্বোধনে আরোহীর ধ্যন ভাঙলো। এই মানুষটির বারে বারে এমন মায়া-ভরা সম্বোধনে আরোহীর প্রাণ শীতলতায় ভরে যাচ্ছে। বুঝ হওয়ার পর থেকে কেউ তাকে এভাবে কোনোদিন বলেনি। স্কুল বা কলেজে যখন অন্য ছাত্রীদের এভাবে তাদের বাবা-মা সম্বোধন করতো তখন আরোহী চুপচাপ সেদিকে তাকিয়ে থাকতো। তারও ইচ্ছে ছিল তাকে কেউ এভাবে ডাকুক কিন্তু সেই ইচ্ছেটা কোনোদিন পূর্ণ হয়নি। ভেবেছিল, বিয়ের পর শাশুড়ির মন আদায় করে নিয়ে এভাবে ডাক শুনবে কিন্তু তা তো কোনোদিনই পূর্ণ হওয়ার নয়!

মাথায় হাতের ছোঁয়া পেতেই আরোহী তাকিয়ে দেখলো মহিলাটি এগিয়ে এসে তার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘বললে না তো! তুমি কী কিছু নিয়ে চিন্তিত। আমাকে নিশ্চিন্তে বলতে পারো।’

‘না না খালা। কিছু হয়নি।’ বলতে গিয়েও আরোহী থেমে গেল। সে এখন কিভাবে চলবে! সেটাই ভাবার বিষয়। উনারা তো চলে যাবে তাকে রেখে কিন্তু আরোহীর আশ্রমে যেতে যে টাকা লাগবে। একটু জিজ্ঞেস করে না হয় দেখায় যায়।

‘খালা,’ কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে গিয়ে আরোহীর কণ্ঠস্বর অস্বস্তিতে পড়ে গেল। যদি উনারা মনে মনে ভাবে যে কয়েকটা টাকার জন্য এমন করছে! কিন্তু পরবর্তীতে নিজের চলার কথা মাথায় আসতেই লজ্জা-শরম ত্যাগ করে সে বলেই ফেলল।

‘খালা, আমাকে হাসপাতালে আনার সময় আমার হাতে কোনো টাকা বা কাগজ পেয়েছিলেন! সার্টিফিকেট এর সাথে সাথে ছিল!’

আরোহীর কথা শুনে খালা নিচের দিকে তাকিয়ে কী যেন মনে করার চেষ্টা করলো।
‘আমার তো ঠিক মনে পড়ছে না মা। আমার মাথায় তোমাকে হাসপাতালে আনার ভাবনা মাথায় আসছিলো। আর তোমার আঙ্কেলকে বলেছি দ্রুত যেন নিয়ে আসে। সার্টিফিকেটটা সাদা আর কোনো জরুরি ভেবে নিয়েছিলাম। টাকা হয়ত রাস্তায় পড়েছে কিন্তু নেয়ার কথা মাথায় ছিল না! কোনো জরুরি কিছু ছিল না-কি!’

‘ওহ। না খালা তেমন জরুরি নয়।’

আরোহীর এমন জবাবে আমেনা আহমেদ হয়ত কিছু বুঝে উঠতে পেরেছেন কিন্তু উনি মুখে তা প্রকাশ করলো না।
ঠিক সেসময় ক্যাবিনের দরজা খুলে এক মধ্যবয়স্ক লোক ঢুকলো।

‘এখন ঠিক আছো তুমি?’

‘জি আঙ্কেল।’
আরোহীর জবাব পেতেই লোকটি আরোহীর পাশে বসা আমেনা আহমেদকে কিছু একটা ইশারা করতেই আমেনা আহমেদ হাসি-মুখে বলে উঠল,

‘আর তোমার পরিবারের নাম্বার দিও, আমি নাহয় খবর দিচ্ছি যাতে উনারা এসে তোমাকে নিয়ে যায়। এতো ভোরে কেউ বাড়ি থেকে বের হয়! পরের বার থেকে হাজার রাগ থাকলেও এতো ভোরে বের হইয়ো না। আল্লাহ না করুক, যদি কোনো বড়ো বিপদ হয়ে যায়!’

পরিবারের কথা বলতেই আরোহীর চেহারা মুহূর্তের মধ্যে মলিন হয়ে গেল। সেটা আমেনা আহমেদও ধরতে পেরেছেন।
তিনি আরোহীর দিকে এগিয়ে এসে পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিল।

তিনি আরোহীর উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
‘আমাকে বলতে পারো মা। নিজের মা মনে করে।’

এমন মায়াভরা কণ্ঠে আশ্বাস পেয়ে আরোহী আর কিছু লুকিয়ে রাখলো না। সে সবকিছু বলতেই উনারা একে-অপরের দিকে তাকালো।

‘খালা, আমার কিছু লাগবে না। এমনিও আপনারা অনেক কিছু করেছেন এই পর্যন্ত আমাকে আপনাদের মূল্যবান সময় দিয়েছেন। আমাকে একটা ছোট-খাটো চাকরি দিলেই হবে। আমার উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত সার্টিফিকেট আছে। আমাকে সেই যোগ্যতা অনুযায়ী একটা চাকরি দিলেই হবে। ‘

আরোহীর কথা শুনে আমেনা বেগমের স্বামী এগিয়ে এলেন। উনিও এসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আরোহী কোথাও যেন আপনজনের ছোঁয়া অনুভব করলো।

‘যদি কিছু মনে না করো একটা কথা বলি! তুমি আমাদের বাসায় থাকতে পারো। তোমার হয়ত প্রশ্নঃ জাগতে পারে যে এতো সহজে এসব কেন করছি! বাসায় গিয়ে সব জানতে পারবে!’

আরোহী ঝাপসা চোখে দুইজনের দিকে কৃতজ্ঞতা ভরা চোখে তাকালো।

———–

‘দাদু উনি কে!’

বাসায় ঢুকতে না ঢুকতেই একটা পাঁচ-ছয় বছরের বাচ্চা ছেলে এসেই আরোহীর দিকে একবার তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো। আরোহী বুঝতে পারলো এই বাচ্চা হয়ত এই ঘরের নাতি।

আমেনা আহমেদের স্বামী শফিয়ূল্লা চৌধুরী বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে আদর করে বলে উঠল,
‘উনি তোমার একটা আন্টি।’

বাচ্চাটি আরোহীর দিকে এগিয়ে আসলো।

‘তুমি আমার মায়ের মতো আন্টি। মাকে আমি ছবিতে দেখেছি, তোমারই মতো।’ বাচ্চাটি আরোহীর দিকে এগিয়ে এসে আদো আদো ভাঙা গলায় বলে উঠল।
আরোহীর কেন জানি মনে হলো বাচ্চাতি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুঝদার।

‘তাই! তোমার মা কই!’কথাটি বলতেই বাচ্চাটি চুপ হয়ে গেল।

আমেনা আহমেদ এগিয়ে এসে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে কেউ একজনকে ডাকতেই, একজন মহিলা দৌড়ে এসে বাচ্চাটিকে খেলতে নিয়ে যাবে বলে কোলে নিতে চাইলে বাচ্চাটি আরোহীর আঁচল ধরে দাঁড়িয়ে রইল।
আরোহী বুঝতে পারলো মহিলাটি হয়ত এই ঘরে কাজ করে।
আমেনা আহমেদ এক ফলক বাচ্চাটির দিকে তাকিয়ে আরোহীর দিকে তাকালো।

‘ওর মা বেঁচে নেই। ও আমার ছেলের বাচ্চা। ছেলেটা জন্ম দিতে গিয়ে সময় মতো র’ক্ত না পেয়ে মেয়েটা অকালে পরপারে পাড়ি জমিয়েছিল। ওর মাকে কখনো আমি ‘বৌমা’ এর চোখে দেখিনি, সবসময় আমাদের সম্পর্ক মা-মেয়ের মতো ছিল কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিল। তোমাকে প্রথম দেখেই আমি কেঁদে উঠেছিলাম কারণ তুমি দেখতে কিছুটা আমার ওই মেয়েটার মতো। তাই তো তোমাকে আর ছাড়তে পারিনি।’

আরোহী ঝাপসা চোখে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজন মানব-মানবীর দিকে তাকিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে নিয়ে জড়িয়ে ধরতেই বাচ্চাটি একেবারে তার সাথে মিশে গেল। আরোহীর কেন জানি মনে হলো বাচ্চাতি বয়সের তুলনায় একটু বেশিই বুঝদার।
এইযে মা নেই সেটা এতটুকু একটা বাচ্চা কী নির্দ্বিধায় বলে ফেলল বুঝদারের মতো। আরোহী বাচ্চাটিকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরলো। কেউ সবকিছু পেয়ে হারায় আবার কেউ না পেয়ে হারায়।

#চলবে ইন-শা-আল্লাহ।
(অগোছালো হওয়ার জন্য দুঃখিত।)

কাঁচের সংসার পর্ব-০৪

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৪

নিস্তব্ধ রাত। চারদিকে শান্ত, নির্জীব। দূরে কোথায় জানি কিছু সময় পর পর থেমে থেমে শেয়ালের হাক ভেসে আসছে। আরোহী রুমের জানালা খুলে গাঢ় আঁধারের দিকে তাকিয়ে আছে। আজ পূর্ণিমা, চারদিকে চাঁদের কী সুন্দর আলো! একদম সব স্পষ্ট। দূরের গাছের ডালটা হঠাৎ করেই নড়ে উঠল। হয়ত কোনো রাতের পাখি উড়ে নিজের নীড়ে ফিরছে। আরোহী সেদিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকালো। পাখিটারও হয়ত আরোহীর মতো মন খারাপ! তাই বোধহয় প্রিয়জনের কাছ থেকে এতক্ষন দূরে ছিল, শেষ পর্যন্ত আর না পারতে নীড়ে ফিরছে।
আরোহী নিজের ভাবনা দেখে হাসলো। তার মন খারাপ বলে আরেকটা প্রাণীরও মন খারাপ হবে না-কি! পাখির মন খারাপ হবে কেন! হয়ত সে খাবারের খোঁজে বেরিয়েছিল, অনেক পথ পাড়ি দেওয়ার ফলে রাত হয়ে গিয়েছে।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ভোর হওয়ার অপেক্ষায় আছে । ভোর হলেই এই বাসা থেকে চিরতরে বেরিয়ে পড়বে। একা একটি মেয়ে মানুষ তাই এই গভীর রাতে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছে না। হাজার হলেও এই শহরে অনেক মুখোশ পরিহিত মানুষের ভিড়ে আরোহী কোনোদিনও নিজেকে সপে দিবে না।

আরোহী জানালা বন্ধ করে এগিয়ে এলো রুমের দিকে। টেবিলের উপর ডিভোর্সের কাগজটা জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে যেন সেটা আরোহীর দিকে তাকিয়ে আরোহীকেই উপহাস করে হাসছে।

আরোহী মেঝেতে বসে কাগজটা হাতে নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। একটা সাইনের বিনিময়ে একটা পবিত্র সম্পর্ক গঠন হয় তেমনি একটা সাইনের মাধ্যমেই একটা সম্পর্ক নিমিষেই শেষ হয়ে যায়।

এই ডিভোর্সের কাগজটার ব্যাপারে হয়ত আরিয়ান জানে না। কাল সকালে আরিয়ান বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পর স্নেহা আর লুৎফা বেগম এই কাগজটা আরোহীর দিকে ছুঁড়ে মেরে বলেছিল যাতে সে খুব দ্রুতই সাইন করে আরিয়ান ফেরার আগেই এই বাড়ি থেকে বিদায় নেয়।
লুৎফা বেগম গত একমাস ধরে আরিয়ানের বিয়ে নিয়ে মেতে উঠেছিল। তিনি জানতেন, আরিয়ান হয়ত কোনোদিনও আরোহীকে ডিভোর্স দিবে না কারণ আরোহীর যাওয়ার স্থান নেই কিন্তু লুৎফা বেগম আর স্নেহার এতো কিছু দেখার সময় নেই । তারা আরিয়ান আসার আগেই এই বোঝাটাকে বিদায় করতে পারলেই হলো। হয়ত স্নেহা বিয়ের একমাস আগে থেকে লুৎফা বেগমকে কান-পড়া দিয়েছিলো যে আরোহী থাকলে তারা সুখে সংসার করতে পারবে না আর আরিয়ান হয়ত আরোহীর অসহায়ত্ব দেখে ভুলেও ডিভোর্স দিতে চাইবে না। তাই দুইজনে লুকিয়ে ডিভোর্স পেপার বানিয়েছে আর তা সফল হতে যাচ্ছেও।

আরোহী আর কিছু না ভেবে খুব দ্রুতই সাইন করে দিল। একটা পেপারওয়েট এর সাহায্যে ডিভোর্স পেপারটা টেবিলে চাপা দিয়ে রাখলো। যাতে দরজা খুলতেই সবার আগে ডিভোর্স পেপারটা চোখে পড়ে।

আরোহী উঠে দাঁড়ালো। সময় হয়েছে তার হারিয়ে যাওয়ার। সবাই যে যার রুমে শান্তির ঘুম দিচ্ছে, শুধু আরোহীরই চোখে ঘুম নেই।
আরোহী এসে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসে পড়লো ভোর ফোটার অপেক্ষায়। হাঁটুমুড়ে মাথা গুঁজে অনেকটা সময় বসেছিল। চারদিকে থেকে পাখির কিচির-মিচির ডাক ভেসে আসতেই সে উঠে পড়লো।

আলমারি খুলে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিল। সাথে আর কিছুই নিল না। কী নিবে! এই সংসারের কিছুই তো তার নয়। সবকিছুই তো আরিয়ান বিয়ের পর একটার পর একটা কিনে দিয়েছিল। শুধু পরনের শাড়িটা আর আশ্রমে যতটুক পড়েছিল উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত সার্টিফিকেটগুলো বাদে সে আর কিছুই নিল না। হাতে কিছু টাকা ছিল সেগুলোই নিল। এগুলো বিয়ের পর পর আরোহী আরিয়ানের কাছ থেকে কিছু কিনে দেওয়ার বায়না ধরলে তখন আরিয়ান কিছু টাকা গুঁজে দিতো যে আরোহী যেন নিজে কিনে নিয়ে আসে। জিনিস কেনার পর যেগুলো ফেরত পেতো সেসব আর আরিয়ান নিতো না। তখন আরোহী বলতো,
‘আরে!আমি টাকা দিয়ে কী করবো! আমার সবকিছুই তো তুমি আনো বা দেখা-শোনা করো! আমার স্বামী আছে না!’

তখন আরিয়ান হাসি-মুখে এগিয়ে এসে আরোহীর মুখ তার দুইহাতে আবদ্ধ করে বলতো,

‘কেউ একজন জানি একটা কথা বলেছিলেন যে ‘অতি সুন্দরীরা বোকা হয়’। আমিও প্রমান পেলাম তোমাকে।’
তখন আরোহী মুখ ফুলিয়ে রাখতো। আর আরিয়ান হেসে বলতো,
‘প্রত্যেক মেয়েদের উচিত দিন শেষে স্বামীর কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে অন্তত সবচেয়ে ছোট এমাউন্ট হলেও জমিয়ে রাখা। আর স্বামী না দিলেও নিজে আদায় করা। এগুলোই পরে বিপদের সময় কাজে আসে। স্ত্রী জাতিরাই টাকা বেঁধে রাখতে পারে কিন্তু তোমার অন্যদের মতো অতো বুদ্ধি-সুদ্দি নাই। তুমি টাকা হাতের লাগালে পেয়েও কাজে লাগাতে জানছ না। সাধে কী আর বোকা বলি!’

সেদিনের দৃশ্যটা চোখের উপর ভাসতেই আরোহী ঝাপসা চোখে হেসে দিল। সেদিন আরিয়ানের কথাগুলি আরোহীর মনে গেঁথে গিয়েছিল। সে সেদিন মুগ্ধ হয়েছিল আরিয়ানের ভাবনা দেখে। এরপরও অবশ্য আরোহীর টাকা খুঁজতে হতো না। দিন শেষে আরিয়ান অফিস করে ফিরতেই কিছু টাকা আরোহীর হাতে গুঁজে দিলে আরোহী বলতো,’মাত্র এই টাকা দিয়ে কী করা যাবে!’
তখন আরিয়ান মুচকি হেসে বলতো,’বিপদের সময় দেখো এই টাকাগুলোই জমে বৃহৎ আঁকার ধারণ করে কিভাবে আমাদের সাহায্য করবে! বিপদ তো আর বলে-কয়ে আসে না।’

আরিয়ানের কথায় ঠিক হলো। এখন এসবই আরোহীর মুল সম্পদ। কিন্তু এই বিপদ শুধুমাত্র আরোহীর একার। আরোহী দরজার দিকে এগিয়ে থেমে গেল। শেষবারের মতো তার নিজ হাতে সাজিয়ে তোলা সংসারটা দেখে নিচ্ছে। তার নিজের রুমটা একটু দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু স্নেহা দরজা আটকে দিয়েছে। সে অপলক দৃষ্টিতে রুমের দরজাটার দিকে তাকিয়ে মনের আশা পূর্ণ করে নিল। আরোহী চোখ মুছে নিজেকে শক্ত করলো। এই বাড়ির দিকে সে আর তাকাবে না। যতই তাকাবে ততই মায়া বাড়বে। মায়া জিনিসটা বড়োই খারাপ। আরোহী আর কিছু না ভেবে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। দরজা পেরিয়ে পা অগ্রসর হতেই না চাইতেও বিয়ের প্রথম সে আর আরিয়ান ঢোকার মুহূর্তটা মনে পড়ে গেল। সেদিন আরোহী ভয়ে ভয়ে পা ঢোকাতে না চাইলে আরিয়ান তার ডান হাত মুঠো পুরে নিয়ে আশ্বাস দিয়েছিল কিন্তু এক বছরের ব্যাবধানে সব শেষ।

আরোহী ঝাপসা দৃষ্টিতে বাড়িটির দিকে তাকিয়ে সামনের দিকে পা বাড়ালো। আর দেখবে না এই বাড়ির দিকে। যতবারই দেখবে ততবারই কোনো না কোনো দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠবে। সে চোখ মুছে মেইন রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। জিদের বশে তো বেরিয়ে গিয়েছে, এখন কোথায় যাবে ভেবে পাচ্ছে না। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কাল সারাদিন পেটে কোনো কিছুই পড়েনি যার ফলে মাথাটা তীব্র ব্যথা করছে, খিদের চোটে হাঁটতেও পারছে না। সে খাইনি তা না, খাবার দেয়নি। লুৎফা বেগম আর স্নেহা মনে করেছিল, আরিয়ান থাকতে বলেছে বিধায় আরোহী থেকে যাবে তাই তো তিনি আরোহীকে সারাদিন গাধার মতো খাঁটিয়েও কোনো খাবার দেয়নি যাতে আরোহী শেষমেষ এই বাড়ি থেকে বিদায় নেয়।
আরোহী মনে মনে হাসলো। সে তো লুৎফা বেগমকে শাশুড়ির চোখে না তাকিয়ে মায়ের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল কিন্তু উনি কেন বউ না ভেবে মেয়ে ভাবতে পারলো না!

মেইন রাস্তায় উঠতেই আরোহীর মাথা গুলাতে শুরু করলো। পেট গুলিয়ে বমি পাচ্ছে। ক্ষিদেয় পেট চৌ চৌ করছে। এখন মনে হচ্ছে এতো ভালো সেজে লাভ ছিল না, অন্তত বেরিয়ে আসার সময় হলেও রান্নাঘর থেকে কিছু খেয়ে নেওয়া উচিত ছিল। তখন তো লুৎফা বেগম আর স্নেহা ঘুমে ছিল যার ফলে ধরা খাওয়ার উপায় ছিল না।
পরে আরোহী নিজেকে নিজেই উপহাস করে হাসলো। ক্ষিদের চোটে চুরি করে খাওয়ার কথা মাথায় আসতে দুই দন্ড সময় লাগছে না।
আরোহী আরেকটু এগিয়ে গেল। দূরে একটা মুদির দোকান খুলেছে। আরোহী আশার আলো খুঁজে পেলো ভেবে অদূরের দোকানটির দিকে পা বাড়ালো।
রাস্তার মাঝে উঠতেই পেট গুলিয়ে বমি পেয়ে গেল। মাথা অসম্ভব ঘুরছে। হয়ত ক্ষিদের যন্ত্রনা আর সহ্য করতে পারছে না। ছোট বেলা থেকেই সে ক্ষিদের যন্ত্রনা সহ্য করতে পারতো না, মাথা ঘুরাতো। আজও ব্যতিক্রম হলো না। আরোহী এইতো কাছে ভেবে পা চালাতে নিতেই দূরে গাড়ির আলো এগিয়ে আসতে দেখা গেল। সে তার শক্তিতে সরে যাওয়ার অবকাশ আর পেল না। মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যেতেই ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখতে পেল গাড়িটা তারই দিকে দানবের মতো এগিয়ে আসছে।

#চলবে ইন-শা-আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০৩

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_৩

আরিয়ান মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেইন দরজার দিকে পা বাড়াতে নিতেই আবার পেছন ফিরে গেস্ট রুমের দরজার দিকে এক ফলক তাকালো। বিয়ের পর এরকম অফিসের কাজে আরিয়ান আরোহীকে বলা ছাড়া কোনোবার যায়নি। সে পেছন ফিরে গেস্ট রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পরপর কয়েকবার ডাক দিয়েও ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ আসলো না।
আরিয়ান মলিন দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। তার এইবার আরোহীকে বলা ছাড়া না যেতে একরকম খালি খালি লাগছে।
কিছু সময় দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন দরজা খোলার কোনো শব্দ পেল না তখন আরিয়ান ভাবলো – হয়ত আরোহী দরজা খুলতে অনিচ্ছুক তাই শুকনো মুখে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে সামনের দিকে পা বাড়ালো। এক পা অগ্রসর হতেই পেছন থেকে দরজা খোলার শব্দ হলো। সে দ্রুত ফিরে পেছনে তাকাতেই আরোহীর শুকনো মুখ আক্ষীযুগলে ভেসে উঠল। আরিয়ান শান্ত দৃষ্টিতে আরোহীর দিকে এক ফলক তাকালো। মনে হচ্ছে যেন কত যুগ যুগ ধরে এই মানুষটিকে দেখেনি।

সে পূর্ণ দৃষ্টি দিল আরোহীর দিকে। এক রাতেই চেহারার এমন হাল কেন মেয়েটার! মাত্র এক রাতেই মেয়েটা পাল্টে গেছে মনে হচ্ছে। সে সমবেদনা প্রকাশ করার পূর্বেই আরোহী তাড়া দিল।
আরিয়ান বুঝতে পারলো আরোহী তার সাথে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করছে না।

‘আসলে কাল রাতে তাড়াহুড়োর মধ্যে আর ক্লান্তি ভর করাই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তাই আর কথা বলা হয়নি। তুমি তো হয়ত রাতে খাওনি। এখন খেয়ে নিও।’

আরিয়ানের কথা শুনে আরোহী মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসলো। মায়া দেখাচ্ছে হয়ত! এতক্ষন সে আরিয়ানের দরজা নক করার আওয়াজ শুনেছিল, তবুও সে ইচ্ছে করে দরজা খুলেনি। খোলার ইচ্ছে হয়নি কিন্তু কেন জানি শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। এই মানুষটা হাজার হলেও আরোহীর ভালোবাসা। এই পৃথিবীতে তার একমাত্র আপন-জন। এই মানুষটাকে কিভাবে সে অগ্রাহ্য করবে! চেহারাটা শেষবারের মতো দেখার লোভটা আরোহী সামলাতে পারলো না। তাই তো সে ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে সব ভুলে দরজা খুলেছিল।

আরিয়ান আরোহীর চাহনি দেখে বুঝতে পারলো আরোহী এসবে কথা বলতে অনিচ্ছুক। তাই সে আর কথা বাড়ালো না। সে এক ফলক আরোহীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,

‘আমি অফিসের কাজে শহরের বাইরে যাচ্ছি। তাই ভাবলাম, তোমাকেও বলে যাই। তুমি এই বাড়িতে থাকতে পারো।’

আরোহী নিচের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকালো। আরিয়ানের শেষ কথাটা তার কানে বাজছে। ‘থাকতে পারো!’ আরোহী বিড়বিড় করে মনের মধ্যে লাইনটা আওড়ালো। তার মানে, আরিয়ানও বুঝে গিয়েছে বুঝি যে এই সংসার এখন আর আরোহীর নাই, এই ঘরে এখন আর আরোহীর অধিকার নেই। আরোহীর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই তাই হয়ত আরিয়ান কথাটা বললো। আরিয়ান এতোদিনেও আরোহীকে চিনে নিতে পারলো না। এতো কিছুর পরেও আরোহী নিজের সম্মান খুইয়ে এখানে থাকবে সেটা আরিয়ান ভাবলো কী করে! হয়ত আরোহীর যাওয়ার কোনো নির্দিষ্ট খুটি নেই বলেই বললো কিন্তু আরোহী অতো নরম নই। মেয়ে মানেই স্বামীর বাড়ি থেকে সব মুখ বুজে সহ্য করবে তা নয়। এতদিন ছিল বলে এখনও যে থাকবে তা নয়। এতদিন এই বাড়িটা তার নিজের সংসার ছিল তাই মুখ বুজে পড়ে রয়েছিল কিন্তু এখন আর নেই। এখন সে অধিকার আর নেই। এখন এই সংসারে আর পড়ে থেকে কী হবে! এখানে অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে পড়ে থাকার চেয়ে মানুষের বাসায় কাজ করে খাওয়া ঢের ভালো।

আরোহী সব ভেবে শুকনো হেসে মাথা তুলে আরিয়ানের দিকে চোখ তুলে তাকালো। শান্ত, নির্জীব তার চাহনি। আরোহীর এই চাহনির দিকে দৃষ্টি দিতেই আরিয়ানের বুক কেঁপে উঠল। মনে হচ্ছে, মেয়েটি এই চাহনি দিয়ে নীরবে অনেক কিছু বলে যাচ্ছে কিন্তু আরিয়ান বুঝে উঠতে পারছে না। আরিয়ান মনে করলো আরোহী হয়ত জবাব দিতে চাচ্ছে না তাই সে লুৎফা বেগম আর স্নেহার দিকে তাকিয়ে ‘আসছি’ বলে পেছন ফিরে চলে যেতে উদ্যত হতেই আরোহীর শান্ত বাক্য কর্ণগোচর হতেই আরিয়ানের পা থেমে গেল।

‘দোয়া করি, আপনার বাকি পথ সফল হোক। ভালো থাকবেন। বিদায়।’

পকেটে মুঠোফোনটা বেজে উঠতেই নিস্তব্ধ পরিবেশটাতে ঝংকার তুলে মুহূর্তের মধ্যে ভারী করে তুলল। আরিয়ান দ্রুত ‘যাচ্ছি’ বলে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। আরিয়ানের যাওয়ার দিকে আরোহী এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। যতক্ষণ না আরিয়ান চোখের আড়াল না হয় ততক্ষন তাকিয়ে রইল। আরিয়ানের মানব ছায়া পুরোপুরি চোখের আড়াল হতেই আরোহী তার ঝাঁপসা দৃষ্টিতে আরিয়ানের গমন পথ দিয়ে তাকিয়ে বিড়বিড় করে উঠল।

‘আমার সাথে আপনার আর দেখা না হোক। আমার সাথে আপনার এটাই হয়ত শেষ দেখা। এই জীবনে আমার ছায়াও যেন আপনার উপর আর না পড়ুক।’

আরোহী আপন মনেই কথাগুলো দুইবার বিড়বিড় করে উচ্চারণ করলো। চোখের অশ্রু মুছে সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। এতক্ষনে খেয়াল করলো, দুই নারী মূর্তি অগ্নিরূপ ধারণ করে তারই দিকে চেয়ে আছে।

‘মুখপুরী, আমার পোলাটারে এমনি এতদিন তো খাইয়া বইসাছিলি। কোনোমতে যারো বিয়া করাইলাম তুই এমন কইরা কথা বলছিলি ক্যান! নিজে তো একটা বংশের বাতি দিতে পারোস নাই। যাওয়ার সময়ও পোলাটারে তোর ট্যাঁরা কথা শুনাইলি! এমনি তো আছোস অন্যের সংসারে পড়ে, লজ্জা-শরম করে না তোর!’

আরোহী বিনিময়ে কোনো জবাব দেওয়ার প্রয়োজন-বোধ মনে করলো না। সে জানতো যে তার শাশুড়ি এমনই করবে। লুৎফা বেগমের এই কাজগুলো সে বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছে। আরিয়ান সারাদিন অফিস শেষে ফিরতেই কৈশোলে আরোহীর ব্যাপারে কান-পড়া দিতো কিন্তু যদি আরিয়ান বাসায় থাকতো তখন হাজার চেয়েও আরোহীর বিরুদ্ধে নিতে পারতো না কিন্তু তিনি আশা ছাড়তো না। এক বছরে আরোহীর তার শাশুড়ির এমন কাজে অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আগে এসব চুপচাপ শুনতো কিন্তু এখন আর শোনার কোনো মানে হয় না।

আরোহী চুপচাপ কোনো বাক্য ব্যায় না করে স্নেহা আর লুৎফা বেগমের মুখের উপর দরজা আটকে দিল। তা দেখেই লুৎফা বেগম তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল। আগুনে ঘি ঢালার জন্য স্নেহা বলে উঠল,

‘দেখলে তো খালা! উপস মা! দেখলে! কেমন মেয়ে, গুরুজনের মুখের উপর কীভাবে দরজা আটকে দিচ্ছে! এমন মেয়েকে তুমি আরও বৌমা বলতে!’

‘আমার পোলা আসুক। এর একটা বিহিত আমি করবোই।’

এরপর আর কোনো সাড়া-শব্দ শোনা গেল না। আরোহী বুঝতে পারলো, লুৎফা বেগম হয়ত রেগে হনহন করে প্রস্থান করেছে। স্নেহার কোনো সাড়া শব্দ শোনা যায়নি। তার কাজ তো হাসিল হয়ে গিয়েছে -শাশুড়িকে আরোহীর ব্যাপারে কান পড়া দেওয়া। সেটা আজ এইমূহুতে না হয় এতটুকুই থাক, সেজন্যই বুঝি আর কোনো জবাব দেয়নি।

আরোহী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সবকিছুর পরেও এই সংসারের মায়া সে ছাড়তে পারছে না। কীভাবে থাকবে এতদিনের মায়া মুছে! কার কাছে বুঝাবে সে তার দুঃখের কথা! এই মুহূর্তে আশ্রমের খালাকে তার ভীষণ করে মনে পড়ছে। খালাকে মনে পড়ায় আরোহী নিজের প্রতিই তাচ্ছিল্য হাসলো।
মানব জাতি বড়োই নিষ্ঠুর। সুখে থাকতে কাউকে খুঁজে না। সুখের সময় মানুষ সব সুখ শুধুমাত্র নিজের সাথেই ভাগাভাগি করে নিজেই উপভোগ করে কিন্তু দুঃখের সময়ই সবাইকে মনে পড়ে। দুঃখ পেলেই অসময়ে আগলে রাখা মানুষগুলোর কথা মনে পড়ে যায় অথচ এর আগে তেমন একটা মনেই পড়ে না। যার প্রমান, আরোহী নিজেই। আশ্রমের খালাটাও তো আরোহীকে ভীষণ মায়া করতো কিন্তু আরিয়ানের সাথে বিয়ে হওয়ার পর থেকেই আরোহী ভুলে বসেছিল। অবশ্য, ভুলে নয়। সময়ের ব্যাবধানে ভুলতে বসেছিল। এখনও হয়ত মনে তেমন একটা পড়তো না যদি না আরোহীর এই দুঃখের সময়টা না আসতো! মানুষ বড়োই নিষ্ঠুর!

#চলবে ইন শা আল্লাহ।

কাঁচের সংসার পর্ব-০২

0

#কাঁচের_সংসার
#নাজমুন_বৃষ্টি
#পর্ব_২

রাতে আর ঘুম এলো না আরোহীর। কীভাবেই বা আসবে! বিয়ের পর শত রাগ-অভিমান হলেও আরোহী কোনোদিন একা থাকেনি। তার ভীষণ ভয় হতো, যদি আরিয়ানও তার আপন-জনদের মতো হারিয়ে যায়! তাই তো সে আরিয়ানকে ছাড়া একটা রাতও পার করেনি। শেষের কয়েকমাস তাদের মনের সাথে দুরুত্ব বাড়লেও আরোহী একদিনও নিজের রুম ছাড়া কোথাও থাকেনি। বিয়ের পর আরোহী নিজের একটা দিনও আরিয়ানকে ছাড়া কাটাইনি। আর আজ! আরিয়ানকে ছাড়া আজ থেকে সে বেঁচে থাকবে। এতদিন মনের মধ্যে যে ভয়টা বাসা বেঁধেছিল সেটাই হলো। অবশেষে আরিয়ানও হারিয়ে যেতে লাগলো। আরোহীর নিজের সাজানো রুমটা আজ থেকে অন্য কারো। আজ থেকে এই সংসারে অন্য কারো ছোঁয়া। আজ থেকে আরোহীর চিরচেনা রুমটাও অন্য কারোর। সে তো চেয়েছিল, এই সংসারটাকে আপন করে নিতে কিন্তু কেন পারলো না! কেন এই সংসার তাকে দূরে ঠেলে দিল।
আরোহী অশ্রুমাখা দৃষ্টিতে রুমের ডানদিকের দেয়ালের দিকে নজর দিল। এই দেয়ালের পাশের রুমটা আরিয়ানের। মাঝখানে একটা দেয়াল, কিছুই দেখা যাচ্ছে না কিন্তু আরোহী মসৃন দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু দেখা না গেলেও সে অনুভব করছে, কল্পনা করছে এই দেয়ালের ঐপারে আজ অন্য কোনো নতুন দম্পতি স্বপ্ন বুনবে। আচ্ছা, আরিয়ান কী আরোহীর সাথে বিয়ের প্রথম দিন যেমন সুখের স্বপ্ন বুনেছিল আজও কী স্নেহার সাথে তেমন বুনবে! ভাবতেও অশ্রুতে ভরে আসলো আরোহীর চোখ। আরিয়ানের সাথে আজ অন্য কোনো নারী একই রুমে সে সহ্য করতে পারছে না!

———-
আরিয়ানের ঘুম ভাঙলো ভোরে। তাও মোবাইলে পরপর দুইবার কল এর বিরক্তি-কর শব্দে না চাইতেই ঘুম ভেঙে যাওয়াতে বাকি ঘুমটুকুও মুহূর্তের মধ্যে উবে গেল। সে আর মোবাইল ঘাটলো না। শোয়া থেকে উঠে বসে স্বভাব’তই প্রতিদিনের ন্যায় তার বামদিকে চোখ দিতেই কোথাও জানি সূচের মতো বিধলো।

‘কী!এভাবে চমকে উঠলে কেন!’

আরিয়ান বিনিময়ে কোনো জবাব না দিয়ে কিছু সময় থম মেরে বসে রইল। আস্তে আস্তে কালকের দিনের ঘটনা সব মনে পড়তেই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এতো কিছুর পরও সে কিভাবে ভাবলো যে!তার পাশে আরোহী আছে! এক মুহূর্তের জন্য মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেল বুঝি!

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ থেকে মোবাইল নিয়ে স্ক্রিনে দৃষ্টি দিতেই অফিস থেকে কল দেখে দ্রুত পদে উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগে কাপড় গুছানো শুরু করলো।

স্নেহা বুঝে উঠতে পারলো না কিছু। সে কিছু জিজ্ঞেস করার উদ্দেশ্যে মুখ খুলতেই আরিয়ান রাগী দৃষ্টিতে পাশে বসা স্নেহার দিকে তাকালো।

‘আজকে আমার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে, ডেকে দিতে বলিনি !’

‘এতো ভোরে কই যাচ্ছ! আর ব্যাগই বা কেন গুছাচ্ছ!’

‘অফিসের কাজে আজকে শহরের বাইরে যাওয়ার কথা ছিল। ভোরে ভোরে রওনা দেওয়ার কথা ছিল। এক মুহূর্তের জন্য এটা মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল।’ কাপড় গুছানো শেষ করে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে বাড়াতে জবাব দিল আরিয়ান।

‘ আজ বিয়ের পরের দিন। বিয়ে করতে না করতেই অফিসের কাজে বাইরে যাচ্ছ…!’ স্নেহার কথায় আরিয়ান বিনিময়ে কোনো জবাব দেওয়ার কোনো প্রয়োজনবোধ মনে করলো না। সে সকালের নাস্তা তৈরী করতে বলে সজোরে ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিল।

স্নেহা বিরক্ত-মাখা চেহারাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। বিয়ের একদিন পার না হতেই ফরমায়েশ খাটা শুরু করে দিয়েছে। না চাইতেই ইচ্ছের বিরুদ্ধে স্নেহা উঠে দাঁড়ালো। তার কেন এতো কষ্ট করতে হচ্ছে! আরোহী আছে না! তাকে গিয়ে বললেই তো হলো। আরিয়ান বের হতে হতে ততক্ষনে নাস্তা তৈরী হয়ে যাবে। তখন না হয় নিজে রান্না করেছে বলে স্নেহাই নাস্তা বেড়ে দিবে।

স্নেহা দ্রুতপদে রুম থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ালো। রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো। স্নেহা তা দেখে একবার মুখ বাঁকালো। জমিদারের মতো শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে আর এদিকে স্নেহা ঘরের বউ হয়ে ভোরবেলায় উঠে যেতে হয়েছে। এখন থেকে তো আরোহীর আর অধিকার নেই যে বাড়ির বউ এর মতো পড়ে পড়ে সব করবে!

স্নেহা আর কিছু না ভেবে পরপর দুইবার ডাক দিতেই ওইপাশ থেকে আরোহীর মুখ ভেসে উঠলো। আরোহীর ফোলা ফোলা চেহারা দেখে স্নেহার হঠাৎ করে খারাপ লেগে উঠলো। এই বাড়িতে আরোহীর বিয়ের পর সে যতবারই আসতো, কোনোবারই আরোহীকে হাসি ছাড়া এমন শুকনো মুখে দেখেনি কিন্তু আজ হঠাৎ এই প্রথম।

‘কিছু লাগবে!’ শুকনো মুখে আরোহী জিজ্ঞেস করতেই স্নেহার ধ্যন ভাঙলো।

‘হ্যাঁ, বলছি কী। আরিয়ান অফিসের কাজে বাইরে যাবে তাই নাস্তা তৈরী করতে ডাকলাম। আর যাই বলো না কেন, এখন তো আর শুয়ে-বসে কাটাতে নিজের মনেও সাঁই দিবে না। অন্যের বাড়িতে শুয়ে-বসে থাকতে নিজের বিবেকেও তো বাধা দিবে।’ স্নেহা নিজের খারাপ লাগা দূরে রেখে আরোহীকে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে উঠতেই আরোহী শুকনো মুখে হাসলো।

‘আচ্ছা, দ্রুত নাস্তা তৈরী করো।’ বলেই স্নেহা তরীঘরি করে প্রস্থান করলো। আর আরোহী মনে মনে আওড়ালো ‘অন্যের বাড়ি’। একদিন পার না হতেই কথাটি শুনতে হলো তার! শোনারই কথা। এখন থেকে তো এই ঘরে তার আর অধিকার নেই। এমনিও আর কয়দিনই বা আছে। থাক না বলে নিক।
আরোহী স্নেহার দিকে তাকালো। একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে আরেকটা মেয়ের সংসারে আসে! অবশ্য, সে স্নেহাকে দোষ দেয় না কারণ দোষ তো তার কপালের।

সে আর কিছু না ভেবে রুম ছেড়ে বেরিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ালো। এই ঘরে সবকিছুই তার নিজের হাতে সাজিয়ে তুলেছিল কিন্তু নিয়তি বড়োই নিষ্ঠুর। একদিন আগেও যে সংসারের আনাচে-কানাচে তারই নাম উচ্চারণ হতো সেই সংসারের আনাচে-কানাচে আজ থেকে অন্য কারোর নাম উচ্চারিত হবে। হায় নিয়তি!

রান্নাঘরে গিয়ে আরোহী চুপচাপ নাস্তা তৈরী করে নিল। নাস্তা তৈরীর মাঝে একটুও স্নেহা আরোহীকে কিছু এগিয়ে দেয়নি, সে শুধু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি দিচ্ছে। আরোহী সেদিকে না তাকিয়ে চুপচাপ কাজ সেড়ে নিল। নাস্তা তৈরী করে টেবিলে রাখতে গেলে স্নেহা দৌড়ে আগ-বাড়িয়ে সেগুলো কেড়ে নিল।
‘বলছি কী, তোমাকে আর কাজ করতে হবে না। তুমি এইবার রুমে যেতে পারবে।’

আরোহী স্নেহার কারসাজি সব বুঝতে পেরেও কিছু বললো না। সে রুমের উদ্দেশ্যে জায়গা প্রস্থান করলো।

আরিয়ান ড্রয়ইং রুমে এসেই দেখলো স্নেহা নাস্তা বেড়ে দিচ্ছে। সে চেয়ার টেনে বসতেই তার মনে হচ্ছে তার পাশে স্নেহা নয়, আরোহী দাঁড়িয়ে আছে।
এতক্ষনে আরোহীর শাশুড়িও এসে পাশে বসলো।
তিনি টেবিলে চোখ ঘুরিয়ে নাস্তা দেখে অবাক হয়ে খুশি হওয়ার ভান করে বলে উঠল,
‘বাহ্! এতকিছু করে ফেললি! এতো কষ্ট করতে গেলি ক্যান!’

‘স্বামী আর শাশুড়ি মায়ের জন্যই তো করলাম। এতে কষ্ট কীসের!’

আরিয়ান কিছু না বলে চুপচাপ শুনে গেল। গেস্ট রুমের দিকে চোখ যাচ্ছে বারবার। গেস্ট রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।

‘মা, আরু কই! ওকেও খেতে ডাকো!’

‘কোথায় আবার! পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে হয়ত। এখন তো অন্যের ঘাড়ে বসে বসেই খাচ্ছে!’

আরিয়ান বিরক্তসূচক ‘চ-ক্রান্ত’ শব্দ করে খাওয়ায় মনোযোগ দিল। খাবার মুখে দিতেই সে একবার স্নেহার দিকে তাকালো,

‘এই খাবার…!’

‘আমি! আমি রান্না করেছি।’ আরিয়ানকে মাঝে পথে থামিয়ে স্নেহা খুশি হওয়ার ভান করে উৎফুল্ল কণ্ঠে জবাব দিল।

‘আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এটা তুই না আরু বানিয়েছে!’

‘এসব কী বলছো তুমি। ও তো এখনো দরজাই খুলেনি আর আমার এতো কষ্টের রান্না করা খাবারকে তুমি আরোহীর নাম দিয়ে দিচ্ছ!’

‘ সত্যি না হলে তো এতো রিএক্ট করার তো কথা না। এতো দিন যাবৎ আরুর রান্না খেয়ে আসছি আর তুই একদিনেই এসব!’

‘আরু, আরু, আরু! এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। তুমি সব জায়গায় আমাকে ফেলে আরোহীকে টানছো কেন! বর্তমানে আমি তোমার স্ত্রী!’

‘তুই হয়ত ভুলে যাচ্ছিস আমার শর্তের কথা। তুই সবকিছু জেনে আরোহীকে মেনে নিতে পারলেই আমি বিয়ে করবো বলেছিলাম।’ বলেই আরিয়ান ব্যাগ নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।

স্নেহা আরিয়ানের শেষ কথায় চুপসে গেল।

আরিয়ান মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেইন দরজার দিকে পা বাড়াতে নিতেই আবার পেছন ফিরে গেস্ট রুমের দরজার দিকে এক ফলক তাকালো। বিয়ের পর এরকম অফিসের কাজে আরিয়ান আরোহীকে বলা ছাড়া কোনোবার যায়নি। সে পেছন ফিরে গেস্ট রুমের দিকে পা বাড়ালো। পরপর কয়েকবার ডাক দিয়েও ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ না আসাই আরিয়ান মলিন দৃষ্টিতে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। সে ভাবলো – হয়ত আরোহী দরজা খুলতে অনিচ্ছুক।

#চলবে ইন শা আল্লাহ।