হৃদয় গহীনে তুমি আছো পর্ব-১৭

0
245

#হৃদয়_গহীনে_তুমি_আছো।🦋
#লেখনীতে_ফাতিমা_তুয_যোহরা।
#পর্বঃ১৭

নব দিগন্তের কোল ছুঁয়ে আজ এলোমেলো ভাবে ভেসে চলা অবসন্ন কালো রাঙা মেঘদ্বয় থেকে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে বিদ্যুৎ চমকানোর সহিত ধরনীতে এসে বা’রি খেয়ে যাচ্ছে যেন। শ্রাবন সন্ধ্যার হিমশীতলময় পরিবেশে রিমঝিমে বর্ষায় বর্ষিত হয়ে রাস্তার পাশে জমে থাকা পানি ঠেলেঠুলে ড্রেনের দিকে লাইন লাগিয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে যেন৷ ঝমঝমে বৃষ্টির মধ্যে পাঁচ-পাঁচটা গাড়ি গাছপালায় আচ্ছাদিত রাজবাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলে ভিতর থেকে সিকিউরিটি গার্ডরা ছাতা হাতে দৌঁড়ে এসে গেট খুলে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে যেন। ইয়া বড় প্রাচীর ঘেরা বিশাল প্রশস্ত রাজবাড়িটার দিকে তাকালে বর্ষনের মৃদু শিহরনময় আবেশ গাড়ির কাঁচ ভেদ করে শীতল চোখদুটোতে ছেয়ে পরলে আপনা-আপনি বড়সড় হয়ে গেল যেন সিরাতের বিষ্ম’য়মাখা চোখদ্বয়। সাফিন সিরাতের দিকে খুব একটা নজর না দিয়ে নিজ ভাবনার অ’তল গহীনে ত’লিয়ে আছে যেন।
—কে জানে জুবায়ের আর মোহন লা’শটাকে সরাতে পেরেছে কিনা? একটা বার লা’শটা কারও চোখে পরে গেলেই সর্ব’নাশের মাথায় বা’ড়ি হয়ে যাবে তখন। কি কু’ক্ষণে যে বুড়ো আম্মার মাথায় রাজবাড়ি বেড়ানোর ভূত চা’পলো কে জানে।
কথাটা ভাবতে- ভাবতেই সমস্ত শরীর এই দক্ষিণা উত্রা হাওয়ায় বর্ষনময় পরিবেশেও ঘেমে নেয়ে একসাট হয়ে যেতে ব্যাস্ত হয়ে পরেছে যেন সাফিনের ৷ মাথা হেট করে সামনে তাকালে জুবায়ের একগাল হাসি হেসে সাফিনের দিকে ছাতা হাতে এগিয়ে আসলে সাফিন ভ্রুদ্বয় কি’ঞ্চিৎ ভাবে জাগিয়ে ইশারা করাতে জুবায়ের হেসে উঠলো যেন। বিরক্ত হলো সাফিন। জুবায়ের কাছাকাছি আসতে সাফিন গাড়ি থেকে নেমে পরলে জুবায়েরকে হালকা ভাবে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে কিছু বলার আগেই জুবায়ের মৃদুস্বরে বলে উঠলো।
—কাজ হয়ে গেছে স্যার। মোহন লা’শটাকে নিয়ে আমাদের জে’ম্মায় চলে গেছে এতক্ষণে। টেনশনের কোনো কারন নেই আপনার।
হেসে উঠলো সাফিন। জুবায়েরের পিঠ চা’পরে ধীর কন্ঠে বললো।
—গুড যব জুবায়ের। এ বিষয়ে আমরা পরে আলোচনা করছি, এখন এদিকে সামলানো যাক আগে।
জুবায়ের হাসলো শুধু।
“সাফিন রাহেলা বেগমের গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে জুবায়েরও তাঁর পিছুপিছু ছাতা হাতে ছুটলো।” সাফিন রাহেলা বেগমের গাড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে দরজাটা খুলে দিলে হেসে উঠলেন রাহেলা বেগম। সাফিন হাত বাড়িয়ে দিলে সাফিনের শীতল হাতে ভর দিয়ে লাঠি হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পরলেন রাহেলা বেগম৷ জুবায়ের বড়জোর একগাল হেসে বললো।
—আসসালামু আলাইকুম বড় ম্যাডাম।
জুবায়েরের কথা শুনে রাহেলা বেগম তাঁর তিরিক্ষি চোখদ্বয় দিয়ে একবার পরখ করে নিলেন জুবায়েরকে৷ বললেন।
—ওই ছেমরা তুই কইত্তে আইলি এহিনে? আর ওইসব ম্যাম না ট্যা’ম বুঝিনা বাপু। বুড়ো আম্মা কইরা ডাকবি নাইলে ঠ্যা’ঙ্গে’র চা’ম’ড়া একখানও আস্ত থাকব না তোর। (কথাগুলো বলার আগে রাহেলা বেগম তাঁর হাতে থাকা লাঠিটা দিয়ে জুবায়েরের পায়ের কাছে একটা বা’রি দিয়ে দিলেন।) জুবায়ের মৃদুহেসে বললো।
—ঠিক আছে বুড়ো আম্মা।
রাহেলা বেগম রাজবাড়ীর দিকে তাকিয়ে পুরো রাজবাড়ীটাতে এক নজর চোখ বো’লালেন।
— এহনও এত ঝড়বৃষ্টি লাগে কোন কামে! বাড়িডাতো চোহে পরার মতনই রং-ঢং কইরা বানাইছোত আজাদ?
রাহেলা বেগমের কথা শুনে শুনে আজাদ সাহেব গাড়ি থেকে নেমে রাহেলা বেগমের একপাশে দাঁড়িয়ে হেসে বললেন।
— সবই আল্লাহর রহমত আর আপনার আর আব্বার দোয়ায় আরকি।
রাহেলা বেগম হাসলেন।
—তা বিয়া শাদি করছোত নাকি এহনও একলা-একলা থাহোস ছেমরা?
জুবায়েরের দিকে তাকিয়ে কথাটা বললে। রাহেলা বেগমের কন্ঠ শুনে জুবায়ের মাথা চুলকালো। কন্ঠ নিচু করে বললো।
— না এখনও করিনি বুড়ো আম্মা। তবে আপনি দেখে শুনে করিয়ে দিলে ম’ন্দ হয়না ব্যাপারটা।
রাহেলা বেগম হেসে উঠলেন। বললেন।
—এত্ত বড় দা’মরা ছেরা বিয়া হরেনায় এহনও। কিরে সাফিন তুইদি বিয়া হরবার কালে কাউরে খবরও দেওনায় আর তোর চে’লাপেলারা এ্যা কি কয় আয়!
—আম্মাজান এখন এগুলান বাদ দেন ভিতরে চলেন৷ আবহাওয়া খা’রা’প এমনিনেই৷ কিরে সাফিন তোর বুড়ো আম্মারে নিয়ে ভিতরে যা৷
আজাদ সাহেবের কথার সাথে তাল মিলিয়ে মোস্তফা সাহেবও সায় দিয়ে একে-একে সবাই ভিতরে চলে গেলে সিরাতও ছাতা ছাড়া বৃষ্টিময় রাস্তায় নেমে পরলো গাড়ি থেকে। ধীর চাহনিতে সাফিন আর রাহেলা বেগমের ভিতরে চলে যাওয়া খুব মনোযোগ সহকারে দেখতে থাকলো। সিরাতের মনের কোনে বিশ্বাস ছিল যে,সাফিন একটিবার হলেও পিছুঘুরে তাকাবে তাঁর দিকে। কিন্তু সিরাতের বিশ্বাসের উপর এক গাবলা পানি ঢেলে দিয়ে সাফিন পিছু না তাকিয়েই ভিতরে চলে গেল রাহেলা বেগমকে নিয়ে।
—একটি বার তাকানোরও প্রয়োজনবোধ করলো না ব’জ্জাতটা! তবে কি আপনি কালকে রাতের জন্য এখনও আমার উপর রেগে আছেন? (মনে-মনে কথাগুলো বলতে থাকলে আমেনা বেগম গাড়ির ভিতর থেকে খাবারের বাটিগুলো নিয়ে বেড়িয়ে পরলে সিরাতকে বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে ভিজতে দেখে একজন গার্ডের কাছ থেকে ছাতাটা নিতে নিলে গার্ডটা নিজে এগিয়ে আসতে চাইলে আমেনা বেগম বাঁ’ধ সেধে নিজেই ছাতা হাতে এগিয়ে এলেন সিরাতের কাছে। সিরাতের মাথায় শীতল হাতের স্পর্শ ছুঁয়িয়ে দিলে আমেনা বেগমের উপস্থিতি টের পেয়ে সিরাত পিছুঘুরে তাকিয়ে মৃদু হাসার চেষ্টা করলো শুধু।)
আমেনা বেগম আরেক ঝলক রাজবাড়ির খালি দরজার দিকে তাকালেন৷ সাফিনরা এতক্ষণে ভিতরে চলে গেছে। আমেনা বেগম সিরাতের দিকে তাকিয়ে ধীর কন্ঠে বললেন।
— কফি করতে পারিসতো নাকি?
আমেনা বেগমের এহেন কথাশুনে সিরাত মৃদু হেসে বললো।
—জ্বী আম্মা জানি৷
—তাহলে ভিতরে গিয়ে এক কাপ করা রকমের কফি করে তোর স্বামির মুখের সামনে ধরিস রাগ কমে যাবে সাহেবের।
আমেনা বেগমের কথা শুনে ল’জ্জায় পরে গেল সিরাত৷ মাথা নিচু করে হ্যা সূচক মাথা নাড়াল শুধু।
.
সিকিউরিটি গার্ডরা গাড়িভর্তি প্রয়োজনীয় জামাকাপড়ের ব্যাগসহ টুকিটাকি জিনিসপএ এক-এক করে ভিতরে নিয়ে যেতে ব্যাস্ত হয়ে পরলো যেন৷
রাজবাড়ির ভিতরে প্রবেশ করার সময় সিরাতের ডান পা রাজবাড়ির দুয়ারে পরার সঙ্গে- সঙ্গে মৃদু বাতাস এসে চোখমুখে এসে বা’রি খেয়ে গেলে সিরাত তাঁর চোখদ্বয় বন্ধ করে নিল দ্রুত। সকাল থেকেই মাথাটা কেমন ধরে আছে সিরাতের। তাঁর উপর সমস্ত দিনের জার্নিতে ক্লান্তিতে চোখে ঘুম এসে ঝেঁ’কে বসতে চাইছে যেন তাঁর। কোনো রকমে নিজকে সামলে নিয়ে আমেনা বেগমের সাথে ভিতরে আসলে চারদিকে চোখ বু’লিয়ে সাফিনকে না দেখতে পেয়ে মনটা আরও বিষি’য়ে গেল যেন সিরাতের।
—এত রাগ! ব’জ্জা’তের হা’ড্ডি একটা। আমি কি ইচ্ছে করে কালকে রাতে যাইনি নাকি? ধুর,আমার তাতে কি? যেখানে খুশি যাক, যা খুশি করুক গিয়ে। আমার কিচ্ছু যায় আসে না। নাহ কফিও করব না ওনার জন্য। বয়েই গেল সিরাতের ওনার রাগ ভা’ঙাতে। মনে-মনে কথাগুলো বলতে থাকলেও বুকের ভিতর উথাল-পাতাল ঢেউ বইতে থাকলো সিরাতের। ইদানীং না চাইতেও সাফিনেকে যেন চোখে হারাচ্ছে সে। প্রেমে-ট্রেমে পরে যাইনি তো আবার? কথাটা ভাবতেই নিজের মাথায় নিজেই গাট্টা মারলো সিরাত।
—পাগ’ল নাকি তুই সিরাত? ওই শ’য়তা’নের প্রেমে পরার থেকে গলায় কলসি বেঁ’ধে নদীতে ঝাঁ’প দেওয়া ঢের ভালো।
.
— রুবেল তুমি তোমার ভাবিজানকে সাফিনের রুমে নিয়ে যাও। ক্লান্ত দেখাচ্ছে আমার মেয়েটাকে।
আমেনা বেগমের কন্ঠে হুঁ’শ ফিরলো সিরাতের। ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে এসে চারদিকে তাকালে সবকিছু রাজকীয় রকমের দেখে চোখ যেন বড়সড় হয়ে গেল তাঁর৷ ভাবলো বড় লোকের বড়-বড় ব্যাপার-স্যাপার।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফর্সা গোলগাল চেহারার লোকটার দিকে ধীর চাহনিতে তাকালে আজাদ সাহেব হেসে বললেন।
— এ আমাদের অনেক পুরোনো লোক বুঝলি নাতিবউ। এই রাজবাড়ির দেখাশোনা ওই করত আগে। আম্মাজান আরে একদিন আগে বললে পুরো রাজবাড়ি আরও সুন্দর করে সাজাই দিতাম লোক লাগিয়ে। সকালে হুট করেই আশার তারা পরলে এটুকু সময়ে সাদা কাপর সরিয়ে চারদিক ঝাড়পোছ করাও তো কম দমের কাজ না। আমার এই রুবেল সব একা হাতে সামলিয়েছে।
আজাদ সাহেবের কথা শুনে সিরাত হাসলো।
সরোয়ার সাহেব আর মোস্তাফা সাহেব সোফায় বসে পরলে টি টেবিলের উপরে ঝুড়িতে রাখা নানা রকমের ফল থেকে আপেলটাকেই বেছে নিয়ে খেতে থাকলে আমেনা বেগম তাঁদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললেন।
— বাড়িতে আসতে পারলো না এনাদের দুই ভাইয়ের খাওয়া শুরু। সারাক্ষণ শুধু খাই-খাই, আর কি চাই তাইতো?
— আহা আমেনা, সামনে এত খাবার থাকা সর্তেও যেন পেট ভরছে কিন্তু মনটা ঠিক ভরতে চাইছে না। কি বলিস সরোয়ার?
মোস্তফা সাহেবের কথা শুনে সরোয়ার সাহেব কলার খোসাটা টেবিলের উপর রেখে হেসে বললেন।
— ভাবি আপনার হাতের কষা মাং’সের ঝোল, বিরিয়ানি আর চিংড়ি মাছের মালাইকারি এসবে আলাদা একটা টান আছে বুঝলেন। এগুলো না হলে খাওয়াটা ঠিক জমে না আমাদের।
মোস্তফা সাহেব চোখ মারলে সরোয়ার সাহেব হেসে হাইফাইভ করলে আমেনা বেগম বললেন।
— এএএহ, এখন তো দুই ভাই মিলে আমাকে ফাইফরমাশ খাটানোর ধা’ন্ধা শুরু করেছেন আরকি।
আমেনা বেগমের কথা শুনে সবাই হেসে উঠলে সকিনা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলে আমেনা বেগম অবাক হওয়ার সহিত বললেন।
—একি সকিনা, তুমি আবার উপরে গেছিলে কখন?
— আসলে আপা খালাম্মায় উপরের রুমে থাকতাছেন তো হেইলে আমি তাঁরে একটু দিয়া আসলাম আরকি।
সকিনার কথা শুনে অবাক হলেন আমেনা বেগম৷
— দাদি আম্মা উপরে থাকছেন!
—কইলেন তো তিনি আমারে।
সকিনার কথা শুনে ড্রয়িং রুমের সবাই তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলে আমেনা বেগম বললেন।
—আচ্ছা যাইহোক, এখানে কোথায় কি আছে ঘুরে দেখে নিউ কিন্তু। রান্নাঘরটা কিন্তু ওই দক্ষিণ দিকের রুমের দিকে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি তুমিও যাও৷ রান্না করতে হবে দেখছোনা কর্তাসাহেবদের অর্ডার। আর আমরা তাঁদের কৃতদাস হই আরকি।
— কাকি রান্না তো হয়ে গেছে। নানুজান আমাকে সকালে জানানোর সঙ্গে- সঙ্গে আমি মেডদের দিয়ে রান্না করিয়ে নিয়েছি। ভাবিজান চলুন আপনাকে উপরে দিয়ে আসি ভাইজানের রুমে।
রুবেলের কথা শুনে আজাদ সাহেব সোফায় বসতে-বসতে বললেন৷
—দেখছো কি কাজের পোলা পাইছি৷ যাও আমেনা আজকে আর রান্না করতে হইব না তোমার। নাতিবউ, উপরে যাও সাফিনের কাছে৷ (সিরাতের দিকে তাকিয়ে।)
আজাদ সাহেবের কথা শুনে সিরাত খানিক হাসার চেষ্টা করলে রুবেল বলে ছেলেটা সিরাতের জামাকাপড়ের লাগেজটা হাতে নিয়ে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালে রুবেলের পিছু-পিছু সিরাতও উপরে যেতে থাকলো।
.
সাফিনের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলে রুবেল দরজায় নক দেওয়ার আগেই দরজা ঠেলে জুবায়ের বেড়িয়ে এসে তাঁদের দুজনের দিকে তাকিয়ে একগাল হাসি হেসে নিচের দিকে চলে গেলে সিরাত সেদিকে ধীর চাহনিতে তাকালে রুবেল ভিতরে ঢু’কে সিরাতের লাগেজটা একটা সাইডে রেখে রুমটার দিকে শীতল চাহনিতে তাকালে বাড়ান্দা থেকে সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে-উড়াতে সাফিন রুমের ভিতরে আসলে হাসলো রুবেল।
—আরে, কেমন আছো রুবেল? কেমন চলে দিনকাল তোমার?
সাফিনের কথা শুনে রুবেল একগাল হাসি হেসে সাফিনের দিকে তাকিয়ে বললো।
—এইতো আপনাদের দোয়া আর আল্লাহর রহমতে ভালোই চলছে৷ আচ্ছা নিচে যাই আপনার লাগেজটাও নিয়ে আসি তাহলে।
—আচ্ছা যাও।
রুবেল চলে গেলেও সিরাত দরজার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো৷ রাগ অভিমান মিলেমিশে পুরো একটা পাহাড় জমা হয়েছে তাঁর মন জুড়ে। দরজার মৃদু আড়াল থেকে সাফিনের ফর্সা তৈলাক্তময় চেহারা দেখা গেলে সেদিকে তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে খুঁটিয়ে-খঁটিয়ে দেখছে শুধু তাঁকে৷
—লুকিয়ে-লুকিয়ে আমাকে দেখা বন্ধ করে রুমে এসে চব্বিশ ঘণ্টা আমার দিকে তাকিয়ে থাকো কিচ্ছু বলব না তোমাকে সিরাত।
হুট করে সাফিনের এমন ধারা কথা শুনে ভাবনার আকাশে ছেদ পরে গেলে কেঁ’পে উঠলো যেন সিরাত। সাফিনের উপর রাগও লাগছে প্রচুর৷ রাগ নিয়ে হন-হন করে ভিতরে আসতে সাফিন পু’ড়ে যাওয়া সিগারেটের অর্থেক অংশ পায়ের নিচে পি’শে দিয়ে দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিলে সিরাত সেদিকে একবার তাকিয়ে লাগেজ থেকে ধূসর রাঙা শাড়ি বের করে ফ্রশ হতে চলে গেলে হাসলো সাফিন৷
— এ মেয়ে সত্যি পা’গল। নিজেতো আগে থেকেই পা’গল এখন আমাকেও এর মতো পা’গল বানাচ্ছে আরকি।
— হ্যা আমিতো পা’গল৷ আর আপনি এক নম্বর ছা’গল, ব’জ্জা’ত, ভে’ড়া৷
সিরাতের কথা শুনে হাসি পেল সাফিনের৷ তবুও হাসিটা চাঁ’পা রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো।
— আড়ি পাতছো কেন এখানে? ওয়াশরুমে বসে কথা বলছো আর উল্টো আমাকে পা’গ’ল- ছা’গ’ল বলছো৷ উল্টা-পাল্টা কথা কম বলো নয়তো আধা ঘন্টার বেশি সময় নিয়ে চুমু খাব বলে রাখলাম আমি।
সাফিনের কথা শুনে রাগে ফুঁ’সতে থাকলো সিরাত।
— এই লোকের মতো অস’য্য আর বিরক্তিকর লোক আর দুটো হয়না। একটু হলেই চুমু খাব, চুমু খাব! কেন রে সিরাতের গাল আর ঠোঁট কি তের বাপের কেনা হোটোল? যে, একটু হলেই চুমু খেতে মন চায়? (কথাগুলো নিজে-নিজেই বিরবির করে বলতে-বলতে ঝর্নাটা ছেড়ে দিলে ঝর-ঝর করে বর্ষার পানির শিহরন বয়িয়ে দিতে থাকলো যেন তাঁর শরীর জুরে।)
৩০ বছরের পুরনো রাজবাড়ি হলেও মেরামত করে যে নতুন করে সবকিছু তৈরি করা হয়েছে, তাঁর ছাপ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
সিরাতদের মামা বাড়ির পুরো বাড়িটা জুড়ে যা জায়গা আছে, তাঁর পুরোটা জুড়ে যেন এই একটা ওয়াশরুম। ঝর্নার পানি দিয়ে খেলা করতে-করতে রুমটার দিকে তাকালে যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তাঁর। যে,সে এই রকম এত বড় একটা রাজবাড়িতে থাকছে।
.
আকাশে মেঘের কনাগুলো কিছুক্ষণ ধরে থম মেরে থাকলে কালো রাঙা ছন্নছাড়া ভাবে ভেসে চলা মেঘদ্বয়ের দিকে তাকিয়ে আছে সাফিন।
রুবেল সময় করে লাগেজটা দরজার কাছে রেখে নক করে বলে গেছে যে লাগেজ রেখে গেছে সে।
আলসেমি কাঁ’টিয়ে তবুও সেদিকে গেল না সাফিন৷ রাজবাড়ির প্রশস্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সিগারেট ফুঁ’কছে সে।
“মাথায় টাওয়াল পেঁচি’য়ে সিরাত ফ্রেশ হয়ে বেড়িয়ে আসলে দরজার কাছে সকিনার কন্ঠস্বর শোনা গেল।”
— ভাবিজান দরজা খুলেন। আছেননি ভিতরে?
সকিনার জো’ড়ালো কন্ঠস্বর শুনে বিরক্ত হলো সাফিন। বারান্দা ছেড়ে ভিতরে আসলে এতক্ষণে দরজা খুলে দিয়েছে সিরাত৷
— আপনের দুধ৷ খালাম্মায় পই-পই করে বলে পাঠাই দিছেন৷ আর বলছেন প্রেত্যেকদিন দিতে। এইটা খাইয়া পশ্চিম দিকে তাঁর রুমে যাইতে কইছে আপনেরে৷
সিরাত নাকমুখ কুঁ’চকে ফেলল যেন। এই বিরক্তিকর খাবারটা তাঁর কোন কালেই পছন্দ ছিল না। আর এখন থেকে নাকি রেগুলার খেতে হবে। ভাবতেই কেমন গা গো’লাচ্ছে সিরাতের।
সকিনা চলে যেতে সাফিন জামা-কাপড়ের লাগেজটা টেনে ভিতরে এনে আবারও দরজাটা লক করে দিয়ে তালা এঁটে দিল এবার। সাফিনের কান্ডে অবাক হলো সিরাত।কিছু বলার আগেই সাফিন গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো।
— দুধটা ফিনিশড করো জলদি। আমি আলমারিতে জামাকাপড়গুলো গোছাচ্ছি।
— পা’গ’ল নাকি আমি। সকিনাও চলে গেছে আমার দুধ খাওয়াও ওখানেই খতম হয়ে গেছে। নিন আপনি খেয়ে নিন তো এটা ঝটপট।
সিরাতের কথা শুনে সাফিন লাগেজদুটো খাটের উপরে রেখে সিরাতের দিকে রাগ নিয়ে তাকিয়ে ধীর পায়ে তাঁর দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে সিরাতও এক পা এক পা করে পিছু হাঁটতে থাকলো যেন। একটা সময় এসে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে সাফিন সিরাতের চোখে চোখ রেখে সিরাতের মাথার বাম পাশে হাত দিয়ে আঁ’টকে দিলে ভয়ে কয়েকটা ঢোক গি’লে নিল সিরাত। সাফিনের দৃষ্টি থেকে নিজের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য চোখ নিচু করে আমতা-আমতা করে বলতে লাগল।
— কি করছেন আপ..নি! এসব কি অস’ভ্যতামি হচ্ছে? নিন দুধটা খেয়ে নিন আপনি।
—ওহ রিয়েলি বেব্বি? কোনটা অস’ভ্যতামি মনে হচ্ছে তোমার? তোমাকে ছোঁয়া’টা নাকি তোমারকে এভাবে আঁ’টকে দেওয়াটা? তাহলে তো বলতে হচ্ছে আমার পুরো রাইট আছে তোমাকে ছোঁয়ার আর তোমাকে খুব কাছ থেকে পাওয়ার। দুধটা তুমি নিজেই খাবে ওকে।আর এক্ষুনি আমার সামনেই খেতে হবে তোমাকে।
—অধিকার ফলাতে আসছেন? খাবনা আমি।
—ধরে নেও তাই।
সাফিন হেসে উঠলে সিরাত সাফিনকে সরিয়ে দিয়ে যেতে চাইলে সাফিনের শীতল হাতের স্পর্শ সিরাতের শাড়ির আঁচল ভেদ করে কোমর স্পর্শ করে গেলে কেঁ’পে উঠলো সিরাত।
সিরাতের হাতের সাথে প্রগরভাবে স্পর্শ করে সিরাতের হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নিজের হাতে নিয়ে নিলে ধীর চাহনিতে সিরাত সেদিকে তাকালে সাফিন সিরাতের মুখের কাছে গ্লাসটা ধরতে মুখ ফিরিয়ে নিল সিরাত। রাগে ফুঁ’সতে- ফুঁ’সতে দাঁতে দাঁত চে’পে ধরে বললো।
— খাবনা আমি।
—তুমি খাবে তোমার ঘাঁ’ড়ও এসে খাবে।
— অস’য্য!
—বিরক্তিকর।
—আপনাকেতো আমি।
—কিচ্ছু করতে পারবে না তুমি। দ্রুত দুধটা ফিনিশড করো এক্ষুনি। নয়তো কি হবে সেটা খুব ভালো ভাবেই জানো তুমি। অন্ধকার রাত, নির্জন জায়গা। জানোতো রাজবাড়ীর পিছনদিকে বিশাল জায়গা জুড়ে গভীরতম একটা দীঘিও আছে৷ আমাকে ক’ষ্ট করে আর নদীতে ফেলতে হবে না তোমাকে।
সাফিনের কথার রেশ শুনে সিরাতের গ’লার কাছের রগগুলো কেমন দাঁড়িয়ে গেল যেন ভয়ে। চোখদুটো ছলছল করে উঠলে সাফিন সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না দিয়ে দুধটা এক রকম জোর করেই খায়িয়ে দিল সিরাতকে। সিরাত নাক মুখ কুঁ’চকে ফেললে সাফিন হাতে থাকা খালি দুধের গ্লাসটা হাত থেকে ছেড়ে দিয়ে নিচে ফেলে দিলে গ্লাসটা ভে’ঙে গুড়ি’য়ে গিয়ে কাঁচগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফ্লোরে পরলে কেঁ’পে উঠলো সিরাত। চোখদ্বয় খিঁ’চে বন্ধ করে ফেললে এতক্ষণের ঝিম ধরে থাকা বর্ষার বর্ষনময় রেশও যেন ঝমঝমিয়ে সমস্ত শহর ভিজিয়ে দিতে ব্যাস্ত হয়ে পরেলো৷ হুট করে কারেন্টের সুইচ অফ হয়ে গেলে নিচে জুবায়েরসহ আজাদ সাহেবের গলার স্বর শোনা গেলেও সেদিকে খুব একটা ভ্রুক্ষেপ দেখালো না সাফিন। সিরাতের দিকে অনেকটা ঝুঁ’কে আসলে সাফিনের ঘন হয়ে আশা নিশ্বাসের রেশ যেন সিরাতের চোখে মুখে এসে ছেঁয়ে পরতে থাকলে চোখ বুজে আসতে চাইছে সিরাতের৷ সিরাতের মাথার পিছন থেকে মাথায় প্যাঁ’চানো টাওয়ালটা খুলে নিচে ফেলে দিলে সিরাতের ভেজা চুলগুলো কোমর অব্দি ছুঁই-ছুঁই ভাবে ছড়িয়ে পরলে দুই হাত দিয়ে সিরাতের মাথার পেছন থেকে চে’পে ধরে ঠোঁট ঠোঁট ডুবিয়ে দিল সাফিন। হুট করে এভাবে আক্র’মনে সমস্ত শরীর অব’শ হতে থাকলো যেন সিরাতের। সাফিনের হাতের স্পর্শ গভীর থেকে গভীরতম ভাবে আঁছ’রে যেতে থাকলে সিরাতের চোখের কোন বেয়ে পানি গড়িয়ে পরতে থাকলে অন্ধকারে বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজের সঙ্গে কানের কার্নিশ ঘেঁ’ষে যেন সিরাতের নীরবে হাড় মেনে নেওয়ার আত্ম’ত্যা’গ উপলব্ধি করতে পারলো সাফিন। খোলা বারান্দার দাঁড় এড়িয়ে দক্ষিণা উত্রা হাওয়া যেন শরীরে কাঁ’পুনি ধরিয়ে দিচ্ছে সিরাতের৷ সাফিন সিরাতকে ছেড়ে দিতে সিরাত দ্রুত পায়ে মুখ লুকিয়ে চলে যেতে চাইলে সিরাতের ধূসর রাঙা শাড়ির আঁচলটা টেনে ধরলো সাফিন। সিরাতের পা দুটো আপনা-আপনি ভাবে থ’মকে দাঁড়িয়ে গেলে সাফিন মৃদুস্বরে বললো।
— চাবিটা নিয়ে যাও। তালা দেওয়া আছে।
.
সকাল-সকাল ইলেক্ট্রিসিটির লোক এসে কারেন্টের সুইচটা ঠিক করে দিয়ে গেলে আজাদ সাহেব সস্থির নিশ্বাস ছারলেন যেন। অনেকদিনের লাইন লাগানো ছিল। রাহেলা বেগম এতটা তারা দেওয়ার কারনে সবকিছু এটুকু সময়ের মধ্যে ঠিকঠাক ভাবে করতেও পারেননি তিনি। তাঁর উপরে তুমুল বেগে ঝর বৃষ্টির কারনে মেইন সুইচের তারটা কেঁ’টে গেছিল।
“জানালা ঘেঁষে ভোর হওয়ার মৃদু আলো এসে চোখে-মুখে পরাতে ঘুম ভে’ঙে গেল সিরাতের।” আজকেও রাহেলা বেগমের পা টি’পতে-
টি’পতেই রাহেলা বেগমের পায়ের কাছেই মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিল সে।
বারান্দা থেকে হীমেল হাওয়া ভেসে আসতে থাকলে শাড়িটা ঠিক করে ধীর পায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলে বৃষ্টি শেষে সুন্দর এক সকালের শুরু হলো যেন। আকাশের বুক থেকে কালো রাঙা মেঘের রেখা ফুঁড়িয়ে পুরো রামধনু নেমে পরেছে যেন আজ। দূরদূরান্ত পর্যন্ত শুধু জঙ্গলের দেখা পাওয়া যাচ্ছে যেন। হালকা চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছেড়ে আবার পিটপিট করে তাকিয়ে যেতে নিতে পর্যাপ্ত পরিমানে জায়গা নিয়ে একটা দিঘি চোখে পরলো উত্তর দিকটাতে। এই দিঘির শেষ কিনারা দেখা না গেলেও বাতাসের স্রোতের সাথে ঢেউয়ে-ঢেউয়ে খেলতে থাকা পানির উপরে ফুঁটে থাকা পদ্মফুলগুলো চোখ এড়াল না সিরাতের৷ চোখগুলো খুশিতে চিকচিক করে উঠলো যেন তাঁর।
—ওই মাইয়া সক্কাল-সক্কাল এহিনে কাম কি তোর?
রাহেলা বেগমের কন্ঠ শুনে পিছু ফিরে রাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে তাঁর করা নির্দেশ অনুযায়ি মাথার ঘোমটাটা এক হাত আরও বেশি নামিয়ে দিল সিরাত। ধীর কন্ঠে বললো।
—কিছু না বুড়ো আম্মা।
.
সকালের ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই এক-এক করে চলে আসলে সরোয়ার সাহেব তাঁর লাগেজ নিয়ে নেমে পরলে আমেনা বেগম রান্নাঘর থেকে সকিনার সাথে মিলে খাবারের প্লেটগুলো এনে সাজিয়ে রাখতে থাকলে সিরাতও এগিয়ে এসে হাতে হাত লাগালে আমেনা বেগম বাঁ’ধ সাধলে রাহেলা বেগম লাঠিতে ভর দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসতে-বসতে তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমাটা ঠিক করে বললেন।
—মাইয়া মাইনষে আবার কাম-কাইজ করবে না কেন রে আমেনা? ওই ছেমরি, ভাগ্য কইরা এহেন শাশুড়ী পাইছো। শাশুড়ী যতই কাম করতে না করুক না কেন তুই তোর কাম চালাইয়া যাইবি বুঝছোসনি আমার কতা।
রাহেলা বেগমের কথা শুনে সিরাত মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললো।
হুট করেই লাগেজ হাতে করে সরোয়ার সাহেবকে নামতে দেখে আজাদ সাহেব ভ্রু জাগিয়ে ফেললেন। বললেন।
—তুই আবার কই যাচ্ছিস?
সরোয়ার সাহেব মৃদু হেসে বললেন৷
—কম দিনতো হলো না দেশে।এবার নিজের কাজে ফিরে যাই আরকি।
সাফিন উপর থেকে হাতে ঘড়ি পরতে-পরতে নামলে আর চোখে একবার সিরাতের দিকে তাকিয়ে নিচে আসলে হুট করেই রুবেল দুশ্চিন্তায় মাখা চেহারা নিয়ে রাজবাড়ির দরজায় হাজির হয়ে বললো।
— নানুজান পুলিশ আসছে গেটের সামনে….

চলবে……

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে