হঠাৎ হাওয়া (১৭)

0
1090

হঠাৎ_হাওয়া (১৭)

হালকা আবছা আলো আঁধারের একটা খেলার মধ্যে মায়া ট্রেন থেকে নামলো, ওর শহরে এই শহরে ওর সবচেয়ে কাছের মানুষ সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা একসময় থাকতো, আচ্ছা হিমালয় কি দেশে আসে?কথা আপু সাথে থাকে?মায়া আকাশ পাতাল চিন্তা মাথা ঝেড়ে ফেলে দিতে চাইলো এজন্যই এই শহরটা ওর ভালো লাগে না, খুব বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মায়া স্টেশনে দাড়িয়ে রইলো তবে বেশিক্ষণ না একটা পরিচিত অবয়ব দেখতে পেলো জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ওর দিকে হেটে আসছে, মায়া নিজ মনেই একটু হাসলো, ছেলেটা পাগল নাকি? এত ভোরে ওর ঘুম ভাঙলো কি করে?
—দে তোর পা টা দে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি এই শহরে তুই তোর পায়ের ধুলো দিলি এই শহর ধন্য হয়ে গেলো
মায়া হাসলো,
—তুই তোর পা এগিয়ে দে, এত সকালে তোর ঘুম ভাঙলো,
সাহিত্য নির্বিকার ভাবে উদাস গলায় বলল,
—আমি রাতে বাসায় যাই নাই।
মায়া এবার অবাক হলো ভীষণ অবাক, তবে কিছু বলল না,
—বাবাই এর কাছে এখন কে আছে?
—তোর ফুপি
—আমার ফুপি তোর কি হয় সাহিত্য?
—এ চুপ কর তো, তোর লেকচার আমার শুনতে ইচ্ছা করে না।
—আচ্ছা এই চুপ করলাম, আর লেকচার দিব না।
—তোর ব্যাগ কই
মায়া হাত দিয়ে ইশারা করে বুঝালো আনে নি,সাহিত্য চোখ ছোট করে বলল,
—কি? জাদু দেখাচ্ছিস? তুই প্রতিবন্ধীর মত হাত পা নাড়াইলেই ব্যাগ চলে আসবে?
মায়া শীতল চোখে তাকিয়ে থেকে বলল,
—আমি প্রতিবন্ধী?
—আমি বললেই কিছু হয়ে যায় না মায়া, আমার বেশিরভাগ কথাই ইগনোর করবি,
মায়া চোখ নামিয়ে ফেলল, এই ছেলেটা এমনই যখন মায়া মজা করে কিছু বলে ও সিরিয়াস হয়ে যায় আর মায়া যখন সিরিয়াস হয় তখন এমন সব কথা বলে মায়ার সিরিয়াসনেস আর টেকে না সাহিত্য হাই তুলতে তুলতে বলল,
—চল ভাই এখন যাই আর ভাল্লাগতেছে না, ব্যাগ তো আনিস নাই তাই না?
মায়া আর কিছু বলল না হাটতে থাকলো, খুবই ক্লান্ত ভঙ্গিতে, সকাল বেলাটা মায়ার খুব প্রিয় ওর কাছে সকাল মানে মন খারাপের সময় একান্ত ব্যাক্তিগত কিছু সময়,আচ্ছা ওর কি মন ভালো করার সময় আছে এখন?কিসে ওর মন ভালো হয়?সাহিত্য একমনে মায়ার দিকে চেয়ে রইলো,সকাল ওর খুব একটা কপালে জোটে না তবে সকালটা সুন্দর তার চেয়েও সুন্দর এই মৃদু কুয়াশায় হেটে যাওয়া রমনীটা এই মেয়ের দিকে হাজার বছর এভাবেই তাকিয়ে থাকা যায় কোনো ক্লান্তি আসে না ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে সাহিত্য মায়ার সাথে হাটতে থাকলো,
—চা খাবি সাহিত্য?
—কি জন্যে?এই যে তোরে নিতে আসলাম তার জন্য পে করতিছিস?তুই কি ভাবছিস দশ টাকার চা খাওয়াইলে শোধবোধ হয়ে যাবে এত সহজ?
মায়া আর কিছু বলল না, এরে কিছু বইলেও লাভ নাই।সাহিত্য একটা টং এর সামনে এসে দাড়ালো মাত্রই দোকানদার দোকান খুলেছে,
—মামা দেরি হবে নাকি?
—পানি বসাইছি মামা
—আচ্ছা দুইটা চা দিয়েন একটা লাল চা আরেকটা দুধ চা, লাল চা তে কড়া লিকার দিবেন মিষ্টিও বেশি
—তুই খালি পেটে দুধ চা খাবি?এসিডিটি হবে না?
—আমার সাথে ডাক্তারি দেখাইতে আসবি না, রোগ শোক তাদের হয় যাদের ডাক্তারের সাথে পরিচয় থাকে আমার পরিচিত কোনো ডাক্তার নাই অতএব আমার ওইসব কিছু হয় না।

মায়া শকড হয়ে তাকিয়ে রইলো এই ছেলেটা দেখতে যতটা সুন্দর ওর কথাগুলো ততটা তিক্ত, ও এমন সহজ ভাবে কঠিন কথা বলে যে কলিজা এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে যায় আর ও এমন নির্বিকার থাকে যেন কিছুই হয় নি।মায়ার চোখ ছলছল করে উঠলো চোখের পানি লুকাতে মায়া একটু তফাতে গিয়ে দাড়ালো, এই ছেলের সামনে কেদে ফেললেও ঝামেলা, এখনো চারপাশ পরিষ্কার হয় নি আলো পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি মায়া দিগন্তে দৃষ্টি রেখে চোখ ভর্তি পানি বাচ্চাদের মত মুছে ফেলল,সাহিত্য মায়ার পাশে গিয়ে দাড়িয়ে বলল,
—কাদিস না মায়া তুই কান্না করলে আমার সহ্য হয় না,
মায়ার চোখের পানি এবার আর বাধ মানলো না,সাহিত্য মায়ার দিকে তাকিয়ে দেখলো বটলগ্রীন কালারের গোল জামার উপরে সাদা রঙের চাদর জড়ানো বেণির ফাকে বেরিয়ে আসা এলোমেলো চুলের একটা মেয়ের এই আবছা ভোরে কান্নার দৃশ্য খুবই অপ্রীতিকর অথচ অদ্ভুত সুন্দর।
—আই এম সরি মায়া,তুই কাদিস না প্লিজ আমি দুধ চা খাবো না দাড়া এক্ষুনি লাল চা বলে আসছি,সামান্য একটা চা খাওয়া নিয়ে তুই যদি এভাবে পরীক্ষায় ফেল করার মত কাদিস তাইলে তো সমস্যা তাই না?
মায়া কপট রাগ নিয়ে তাকালো সাহিত্য বুকের ডানপাশে হাত দিয়ে বলল,
—আহ! ভয় পাইছি হার্ট ধুকপুক করতেছে দেখ?
মায়া খুবই আহত ভঙ্গিতে বলল,
—হার্ট বাম পাশে থাকে
তারপর দুজনেই একসাথে হেসে ফেললো।

প্রাইভেট হসপিটালের একটা কেবিনে আপাতত মায়ার বাবা আছেন ডাক্তার বলেছেন হার্টে রিং বসাতে হবে, তবে যে ডাক্তার অপারেশন করবেন তিনি একটা সেমিনারের জন্য জাপানে আছেন তাই ডাক্তার ফিরলে দুদিন পরেই অপারেশন টা হবে, মায়া ওর বাবার কেবিনে গিয়ে বাবার পাশে বেশ কিছুক্ষণ বসে রইলো ওর বাবার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো ওর জন্যেই হয়তো বাবার এত চিন্তা খুব কষ্ট দিয়ে ফেলে ও বাবাকে, খুব বেশি।মায়ার বাবা ঘুম ভেঙে মেয়েকে দেখে শুকনো করে হাসলো,মায়ার বুকের ভেতর গিয়ে হাসিটা বিধলো
—আমি তোমার বুকের ওপর একটু মাথা রাখব বাবা?
—তোর কি মনে হয় তোর বাবা খুব দুর্বল নারে মা?
—উহুহ আমার কাছে আমার বাবা সবচেয়ে শক্তিশালী,
—আমি যতই দুর্বল হই তোকে ধারণ করার ক্ষমতা আমার আছে, আয় তো মা আমার কাছে আয়,
মায়া আলতো করে ওর বাবার হাতের উপর মাথা রাখলো মায়ার বাবা অনুভব করলো তার মেয়েটা কাদছে
—মায়া
—হু
—কষ্ট হচ্ছে মা?
—উহুহ,তোমার কষ্ট হচ্ছে বাবা?
—আমার মেয়েটাকে দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে।মা?
—হু?
—তুমি তোমার কষ্ট আমাকে বলো না কেন?
মায়া চুপ করে রইলো,
—পৃথিবী এমন কেন বাবা, খুব আকাঙ্খার জিনিসগুলো এত কষ্ট দেয় কেন বাবা?আমি কেন তোমায় এত কষ্ট দেই?
মায়ার বাবা চুপ করে রইলেন তার মেয়েটা আসলে বড় হয় নি এখনো এলোমেলো কথাই বলে।

মায়া ফুপির হাতে হাত রেখে বলল,
—থ্যাংক ইউ ফুপি তুমি বাবার খুব যত্ন করেছো আমি তোমার প্রতি খুব গ্রেটফুল,
মায়ার ফুপি মায়াকে দেখে মুখ ঝামটা মেরে বলল,
—এসেছিস তাহলে?তা কতদিন থাকবি ব্যাগ রেডি রাখিস পালাইতে সুবিধা হবে, তোর তো লুকোচুরি খেলা খুব প্রিয়।আর তোর বাবা আমার ভাই হয় কথাটা ভুলিস না তোর গ্রেটফুল থাকার জন্য আমি কিছু করি নি।
মায়া মাথা নিচু করে বসে রইলো ওর কারো সাথে কথা বলতে ভালো লাগে না সাহিত্য কঠিন মুখ করে বলল,
—কি করবে মা, বলো যে হারে ছ্যাচড়া চোর ডাকাত বেরে গেছে ওর বাধ্য হয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়, বলাতো যায় না কে কখন কি প্লান বানায়।তুমি কি জন্য মামাকে দেখছো তাও তো বলতে পারি না।
—সাহিত্য! আজকাল খুব মুখে মুখে তর্ক করো তুমি।ভুলে যাচ্ছ আমি তোমার মা।
—ইশ যদি ভুলতে পারতাম!ভাইয়া কি সুন্দর ভুলতে পারলো আমি যে কেন পারি না!
মায়ার ফুপি চোখ গরম করে বলল,
—তনয়টার মাথাটাতো তো ওই বেয়াদব মেয়ে ছেলেটার পাল্লায় পড়ে এক্কেবারে গেছে
—ভাবির সম্পর্কে বাজে কথা বলো না মা।এই মায়া তুই কি চলে যাবি?
—নারে অপারেশন টা যতদিন না হয় থাকি, বাবাইকে দেখে খুব মায়া হচ্ছে
—তুই তো ড্রেস ফ্রেস কিছু আনিস নাই এই এক কাপড়েই থাকবি নাকি? সন্ন্যাসী হবি?এই কাপড়েই খাবি, ঘুমাবি?গোসল করে একাই শুকাবি?এই প্লান
মায়া ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
—কিনে নেব দু একটা।
—তাহলে বসে আছিস কেন চল।মামা তো এখন ঘুমুচ্ছে, আমি অনেক ব্যস্ত সারাদিন তোর পেছনে ঘুরতে পারব না।
মায়ার ফুপি রাগ করে বললেন,
—দিন তো শেষ ই সাহিত্য তুই তো সারাদিনই এখানে।
—অনেক শেষ মানেই সমাপ্ত না মা, আফসোস তুমি এসব বোঝো না। তোর কি চেয়ারের সাথে প্রেম হয়ে গেছে এইখানেই থাকবি? তাইলে থাক আমি গেলাম।

সাহিত্য কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরে এসে মায়ার হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকলো
—কিছুই বুঝিস না তুই মায়া কিচ্ছু না।

চলবে….
সামিয়া খান মায়া

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে