স্বচ্ছ প্রণয়াসক্ত পর্ব-০৬

0
812

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_৬
#মুসফিরাত_জান্নাত

প্রচণ্ড শীতের হিম বাতাসে কুঁকড়ে গিয়ে একাকার শরীরগুলোকে উষ্ণতা দিতে ক্লাস রুমে জানালা গুলো বন্ধ করে বসেছে সকলে।রুমের কেও কেও খোশগল্পে মশগুল তো কেও আবার আলোচনা করছে আগতপ্রায় শিক্ষাসফর নিয়ে।শিক্ষা সফরের প্রায় অধিকাংশ দ্বায়িত্ব এসে বর্তায় ক্লাসের ভালো স্টুডেন্টদের উপর।ঐশীরা যেহেতু লেখা পড়া নিয়ে অতো সিরিয়াস নয় তাই দ্বায়িত্বের ঝামেলাও তাদের পোহাতে হবে না।এটা নিয়ে তাদের আক্ষেপ না থাকলে আক্ষেপ হচ্ছে অন্য কিছুতে।সিন্থিয়া সকাল থেকে মুখ গোমড়া করে আছে।তাকে শিক্ষাসফরে যেতে দেওয়া হবে না।বান্ধবীর মন খারাপ দেখে অর্ক বলে,

“ভাই এটা নিয়ে মন খারাপ করে থাকিস না।বরং চিল কর।আমরা তো নমুনা সংগ্রহের জন্য যাই না।শিক্ষা সফরে যাই চিল করতে।কিন্তু এবার আর কোনো ফায়দা হবে না।আমি ভাবছি নিজেও যাব না এবার।”

তাসনিম হায় হুতাশ করে বলে,

“হ ভাই আমিও যাব না।ডিপার্টমেন্ট হেড স্যারের কি অন্য কোনো স্যাররে চোখে পড়ে নাই?ওই স্টুডেন্ট কিলারকেই শিক্ষাসফরের দ্বায়িত্ব দিতে হইলো?বাসের মাঝে নাচ গান কিচ্ছু হবে না বলে দিয়েছে।শা* পিকনিকের বাসটাকে এবার ডোম ঘর বানিয়ে ছাড়বে।”

ব্যাঙ্গাত্মক কন্ঠে জেবা বলে,

“রাখ তোর নাচ গান।বাসে বসে সবার প্রান রক্ষার জন্য তসবি গুনতে হইবো।যেই স্টুডেন্ট কিলার দ্বায়িত্বে আছে একটু হেরফের করলেই ইন্না-লিল্লাহ।”

সায়ান মুখ ঘুচে বলে,

“নিজে লাগাম বান্ধা লাইফ লিড করছে বলে আমাদেরও লাগাম টেনে ধরছে।অত্যাচারী পাকিস্তানি সৈন্যের বংশধর একটা!আমি ড্যাম শিওর দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা ভুলে এই এক পিস বাংলাদেশে ফেলে রেখে গেছে। যুদ্ধে হারার প্রতিশোধ স্বরুপ ব্যাটায় এখন আমাদের অত্যাচার করতেছে।এতো মানুষের ভীরে কেও খেয়ালও করে নি ওনাকে।”

ঐশী একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে,

“উল্টাপাল্টা বকা বন্ধ করবি তোরা?দেশভাগের সময়কার সৈন্যগুলা সব বুড়া হয়ে গেছে।সাদাত স্যারকে কোন দিক দিয়ে পাকিস্তানি সৈন্য মনে হয়?”

জেবা ফোঁড়ন কেটে বলে,

“আরে সাদাত স্যার তো বুইড়াই।খালি নিয়ম মতো চলে বইলা পেটে মেদ আর মাথায় টাক পড়ে নাই।বেটা খবিশ একটা।”

তাসনিম কথার চেইন টেনে বলে,

“আরে টাক পড়তে আর কতোদিন?বিয়েটা করুক একবার দেখ।এই স্টুডেন্ট কিলারের বউ হইব হাজবেন্ড কিলার।এ বেলা ও বেলা স্যারের চুল ধরে টানবো।এক মাসের মধ্যে দেখবি সব চুল উঠে বেটার চান্দি ফাঁকা হয়ে গেছে।আর স্যারের বউ যা রান্না করব তা খেয়ে গ্যাসে স্যারের পেট ফুলে থাকবে।ওইটাই স্যারের ডিজিটাল ভুঁড়ি।তখন দেখবি বয়স চোরা বেটার আসল বয়স কতো।আমাদের নাকে দড়ি বেঁধে ঘুরায় না।আমাদের জীবনের মজা মাস্তি তুলে রাখতেছে।স্যারের বউ হবে দুলিয়ার জল্লাদ।টইটই করে সারাদিন ঘুরে বেড়াবে।স্যার কিছু বললেই মা’ইর।তার একেকটা মা’ইরের চোটে স্যার আমাদের পা ধইরা ক্ষমা চাইব।…”

একের পর এক অভিশাপ দিতে থাকে তাসনিম।একটা শুষ্ক ঢোক গেলে ঐশী।মনে মনে ভাবে এই সব দোয়া যদি কবুল হয় তবে তার কি হবে?এতোটা যঘন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী সে হয়ে যাবে।প্রতিবাদ করে সে,

“এখানে স্যারের বউকে টানিস কেন?স্যারের বউ বেচারি নির্দোষ।ভুলেও আর তাকে বদদোয়া দিবি না।এমনিতেই স্যারের ভয়ে তার বউয়ের কলিজা শুকিয়ে থাকবে।সে আর এসব করবে কেমনে?”

জেবা বলে,

“এখন বদদোয়াও দিতে পারব না তোর জন্য?আর এমন ভাবে বলতেছিস যেনো স্যারের বউ তুলে কোনোদিন অভিশাপ দেস নাই।তোর তো দুই চোখের বিষ ওই স্যার।এ বেলা ও বেলা ওই ডোমকে বদদোয়া দিতি ভুলে গেছিস?”

“সেইটার খেসারতই তো এখন দিতাছি।”

আনমনে মুখ ফসকে বাক্যটা বলে ঐশী।একসাথে পাঁচটি প্রাণ বলে ওঠে,

“মানে!”

থতমত খেয়ে যায় ঐশী।মুখ টিপে হাসে সিন্থিয়া।এদের ঝগড়া দেখে মুহুর্তেই তার মন ভালে হয়ে যায়।আর সবচেয়ে মজা পায় ঐশীকে গ্যাড়াকলে পড়তে দেখে।কিছুসময় পর অকারণে ঘাড় ঘুরায় সে।সাদাতকে তাদের পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভড়কে যায় ঐশী।

“স্যা… স্যার আপনি?”

কথাটা বেশি উচ্চশব্দে হওয়ায় সবার মনোযোগ ঐশীদের দিকে পড়ে।পিছন দরজা দিয়ে সাদাতকে প্রবেশ করতে দেখে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় সকলে।ঐশীও দাঁড়ায়।হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাদাতের দিকে।সাদাত প্রবেশের একটু পরে সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে অনিক স্যার।এই দুইজনের উপর শিক্ষা সফরের পুরো দায় ভার ন্যস্ত হয়েছে।সাদাতের মতো অনিক ততোটা গম্ভীর স্বভাবের না হলেও সাদাতের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু সে করবে না।দুইজনের শলা পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষা সফরের জন্য কয়েকটা গ্রুপ করে একেকটা গ্রুপে একেক দ্বায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়।সবার উদ্দেশ্যে গলা পরিষ্কার করে বলে,

“এবারের শিক্ষা সফর আপনাদের গতানুগতিক আয়োজিত সফর থেকে ভিন্ন হতে যাচ্ছে।শিক্ষা সফরের মুল উদ্দেশ্য যা তা এবার পরিপূর্ণ রুপে পালিত হতে যাচ্ছে।একেকটা গ্রুপে যে দ্বায়িত্ব বুঝে দেওয়া হয়েছে তা সঠিকভাবে পালন করবেন আপনারা।কোনো রকম ভুল ত্রুটি আমি দেখতে চাই না।ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”

“ইয়েস স্যার।”

সমস্বরে উচ্চারন করে সবাই।সাদাত ঐশীদের বন্ধু মহলের কাছে এগিয়ে যায়।গম্ভীর কন্ঠে বলে,

“এবারের নমুনা সংগ্রহের দ্বায়িত্ব আপনাদের উপর দেওয়া হলো।সেখানের সবকিছু আপনারা সামলাবেন।আর কে কে শিক্ষা সফরে যাচ্ছে এবং কার উপর কোন দ্বায়িত্ব বর্তেছে তার লিষ্ট আমাকে আজকেই দিবেন।বোঝা গিয়েছে?”

ঐশীরা মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।সাদাত বেড়িয়ে যায়।হায় হুতাশ করে তারা।

“এই পেইনটা মনে হয় আমাদের বদদোয়া গুলো শুনে ফেলেছে।একারণেই এইবার আমাদের দিয়ে গাধার মতো খাটাবে।জীবনে এসব করলে তো বুঝবো কেমনে কি সামলাতে হবে।ঐশীরে কপালে নিশ্চিত শনি লেখা আছে।”

অসহায় হয়ে জেবা উক্ত কথাগুলো বলে।বিরক্ত কন্ঠে ঐশী বলে,

“এইজন্য তখন থামতে বলছিলাম।শুনলি না তো আমার কথা।এখন বোঝ।একবেলায় এতোকিছু গোছাবো কেমনে?একদম ফিনিশ হয়ে যাব আজ।কাইন্দাও কুল পাবো না।”

তাসনিম দুই হাত তুলে মোনাজাত করতে থাকে,

“হে মাবুদ! এ বারের জন্য ক্ষমা করে দাও।আর জীবনে ওনার বদনাম করতাম না।এমনকি ওনার নামও উচ্চারণ করতাম না খোদা।মাফ করো।”

হায় হুতাশ করতে করতে কাজে লেগে পড়ে ওরা।
_________
কেটে যায় দুই দিন।পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে কমলা রঙা মস্ত রবি।নরম রোদ ছড়াচ্ছে গাছপালা ও দুর্বা ঘাসে।মৃদু বাতাস দিচ্ছে প্রকৃতি।স্থানে স্থানে খাদ্যের সন্ধান চালাচ্ছে বুনো পাখির দল।হরেক রঙের পেশাকে আবৃত নর নারীর দল।সকলের মুখ বাংলা পাঁচের ন্যায় হয়ে আছে।খাওয়া দাওয়া সহ সার্বিক দিক দিয়ে প্রত্যেকবারের চেয়ে উন্নত আয়োজন হলেও বিনোদনের তেমন সুযোগ নেই।সাদাত স্যারের ভাষ্যমতে প্রাকৃতিক নৈসর্গের যাবতীয় নমুনা পর্যবেক্ষন,সেগুলো সম্পর্কে জ্ঞান লাভ ও হার্বেরিয়াম শীটের জন্য নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে আসার মাঝেই বিনোদন নিহিত।এসব শুনে হতাশ প্রত্যেকটা স্টুডেন্ট।তবুও নিরুপায় তারা।আগ্রহ না থাকা সত্বেও গাধার মতো সাদাত ও অন্যান্য স্যারের পিছে পিছে ঘুরে ক্লান্ত তারা।ফিরতি পথে রওনা দেওয়ার জন্য বাসের আশেপাশে ভিড় জমিয়েছে সকলে।আসরের আযান ভাসছে দূর বাতাসে।স্টুডেন্টদের বাসে ওঠার আদেশ দিয়ে স্থানীয় মসজিদে কসর নামায আদায় করে সাদাত।বাসের বাহিরে তখন সবার বিরক্তি প্রকাশের পসরা বসেছে।তাদেরকে আবারও বাসে ওঠার আদেশ দেয় সাদাত।ক্লান্ত অবসন্ন দেহ নিয়ে একে একে সবাই যার যার সিট দখল করে।প্রত্যেকটা সিটে গিয়ে সকলে উপস্থিত আছে কি না চেক করে সাদাত।হটাৎ তার দৃষ্টি আটকায় তিন নাম্বার সিটে গা এলিয়ে দেওয়া ঐশীর পাণে।ঐশীকে দেখে সাদাত থমকালো,অনিচ্ছাকৃত ভাবে দৃষ্টি আটকালো ঐশীর উন্মুক্ত গলার কুচকুচে কালো তিলটির দিকে।সর্বদা সংযত রাখা চোখদুটো আজ প্রথমবারের মতো বেহায়াপনায় রুপান্তরিত হলো।নারীটি ক্লান্ত দেহে বাসের সিটে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে।তার চোখ দুটো বন্ধ থাকার দরুন খেয়ালই করলো না কেও গভীরভাবে তাকে পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে। সাদাত নিষ্কম্প নয়নে দেখতে লাগলো নারীটিকে।গায়ে লং থ্রি পিচ এর উপর সুন্দর কারুকার্য শোভিত সোয়েটার পড়া।অতি যত্নে পিনআপ করা জরজেট ওড়না গায়ে জড়ানো।সারাদিন খুলে রাখা লম্বা রেশমি চুল হাত খোপা করে রেখেছে।সামনের অবাধ্য ছোট ছোটো গুটি কয়েক চুল কপালে লেপ্টে আছে।গলায় ম্যাচ করে স্টোন বসানো ছোট নেকপিছ পড়া।কানে ক্ষুদ্র স্টোনের এয়ারিং রয়েছে।বাম হাতে ব্রেসলেট শোভা পাচ্ছে।এই হালকা অর্নামেন্টসে মোড়ানো অকৃত্রিম সাজে সজ্জিত রমনীর মাঝে এক অপার্থিব সৌন্দর্যের সন্ধান পেলো সাদাত।মনের মাঝে উঠলো উত্থাল ঢেউ।এই বেশে এই রমনীকে আগেও অনেক দেখেছে সাদাত।কিন্তু কখনো এমন অনুভুতি হয়নি তার।তবে আজ কেনো এতো বেসামাল হচ্ছে সে?মেয়েটির প্রতি তার অধিকার হয়েছে বলেই কি এই অনুভুতির উৎপাদন?

সাদাত এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে মেয়েটির দিকে।বাস ছেড়ে দেয়। বাইরে অসময়ের বৃষ্টি নামে।ক্লান্ত শরীরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ঘুমিয়ে পড়ে সবাই।শুধু জেগে থাকে একটি প্রাণ।বৃষ্টিতে তার তৃষ্ণা মেটেনি।আজ তার চোখের তৃষ্ণা পেয়েছে।নিজের সর্বনাশীকে দেখার তৃষ্ণা জাগিয়ে রাখছে তাকে।এক অপার্থিব ঘোরে ডুবিয়ে দিয়েছে।যেখান থেকে চাইলেও উঠে আসা যায় না।চোরাবালির ন্যায় বার বার তলিয়ে যেতে হয়।সাদাতও তলাচ্ছে।নিজের অজান্তেই হারিয়ে যাচ্ছে মেয়েটির মাঝে।হটাৎ তার দৃষ্টি আটকায় আয়াতলোচনা চোখদুটির মাঝে।মাথা নত করে সে মনে মনে বলে,

“রবীন্দ্রনাথ হয়তো চৈত্র মাসের সর্বনাশ দেখেছিলো।কিন্তু বৃষ্টির সর্বনাশ দেখেনি।যদি দেখতো তবে তিনি খরা তপ্ত চৈত্রকে নিয়ে না লিখে হীম শীতল হাওয়া দেওয়া সর্বনাশা বৃষ্টিকে নিয়ে লিখতো।অথবা কে জানে।এই সর্বনাশে ডুবে লেখাই ভুলে যেত।”

পরক্ষণেই চোখ তুলে তাকায়।ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে স্মিত হাসির রেখা।আনমনে বিড়বিড় করে,

“বাইরে বৃষ্টি হবে আর কেও পড়বে না তা তো হতে পারে না সর্বনাশিনী।বৃষ্টিতে মানুষ পড়বেই,হয় মাটিতে,না হয় প্রেমে।”

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে