স্বচ্ছ প্রণয়াসক্ত পর্ব-১০

0
866

#স্বচ্ছ_প্রণয়াসক্ত
#পর্ব_১০
#মুসফিরাত_জান্নাত

অপরাহ্নের অলস বেলায় সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিম আকাশের দিকে।তপ্ত দ্যূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে ধরার মাঝে।মৃদু হাওয়া বইছে চারিদিকে।পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত পরিবেশ।মৃদু পবনে উড়ছে কাশফুলের বন।সাথে উড়ছে ঐশীর ছড়ানো ওড়না।সময়টা শীতের শেষ মুহুর্ত হওয়ায় বনে শুভ্র ফুলের বিচরণ নেই।তবুও মুক্ত স্থানটা বেশ উপভোগ্য লাগছে ঐশীর নিকট।সাদাতের পাশে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে সে বন পেরিয়ে।শহর থেকে বেশ খানিকটা পথ মাড়িয়ে এখানে এসেছে ওরা।মাঝপথে এক রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করেছে একত্রে।ঐশীকে কিছু বলাটা মুখ্য নয়,মুলত কিছু প্রহর একত্রে কাটানোর জন্য নিয়ে এসেছে এখানে।কথাগুলো সে অন্যত্রও বলতে পারতো।সকালে ঐশীর অযাচিত আচরণ দেখেই এখানে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো সাদাত।তার মন খারাপের অবেলায় এখানে আসে সে।প্রকৃতির খুব কাছাকাছি এসে ম্যাজিকের মতো মন ভালো হয়ে যায়।তাই প্রেয়সীর মনের মেঘ দূর করতে এখানটাই উপযুক্ত ভাবে সে।বন পেরিয়ে একটি সুবিশাল পুকুর ধারে এলো ওরা।পুকুরের চারপাশে সুপারি গাছ লাগানো।শুধুমাত্র দক্ষিণ পশ্চিম কোনায় একটা বৃহৎ আম গাছ রয়েছে।সেখানে ঝুলছে একটি দোলনা।পুকুরের দক্ষিণে সুবিশাল মাঠ।আর পশ্চিম দিকে একটি গ্রাম।চারিদিকে চোখ বুলিয়ে ঐশী ঠাহর করে জায়গাটা চমৎকার।মন ভালো করার শক্তি আছে এখানে।দোলনার উপর বসে দোল খাচ্ছে একটি রমনী।বয়স বারো-তেরো হবে হয়তো।আর পিছন থেকে তাকে ঠেলে দিচ্ছে তার এক খেলার সাথী।ছোটবেলায় দাদুবাড়ি গেলে সেও এমন দোল খেতো।গভীর মনোযোগ দিয়ে এই দৃশ্যটা দেখে চলেছে ঐশী।তাকে যে অতি সময় ধরে কেও গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে সেদিকে ধ্যান নেই তার।সে তো মগ্ন আপন ভাবনায়।

হটাৎ কারো ভরাট গলা শুনে ধ্যান ভাঙে তার।ঘার ঘুরিয়ে তাকায় সে পাশে চলা পুরুষটির পাণে।

“দোলনায় চড়তে মন চাইছে?”

এহেন প্রশ্নে ঐশী আনমনেই বলে,

“আগে যখন দোল খেতাম তখনের স্মৃতি মনে পড়ছে।শৈশবে হারানোর সাধ জাগছে।মনে হচ্ছে দৌড়ে গিয়ে ওদের সাথে মেতে উঠি।”

ভ্রু কুটি করে সাদাত।

“তো এটা মুখ ফুটে বললেই পারতে।আমার মাঝে তো সুপার ন্যাচারাল পাওয়ার নেই যে তুমি না বললেও সবসময় তোমার ইচ্ছা বুঝতে সক্ষম হবো।যা মন চায় নির্দ্বিধায় বলে ফেলবে।”

ঐশীকে সাথে নিয়ে হাঁটা দেয় সাদাত।সম্বিৎ ফিরে ঐশীর।চারিদিকে তাকিয়ে কিছুটা ইতস্তত করে বলে,

“থাক ওদিকটায় যাওয়ার দরকার নেই।ওখানে অনেক মানুষ আছে।এতো বড় একটা মেয়ে দোল খেতে দেখলে অনেক কটুক্তি করবে ওরা।অনেক সময় ইচ্ছে থাকলেও চক্ষুলজ্জার জন্য সবকিছু করা সম্ভব হয় না মেয়েদের।”

থমকে দাঁড়ায় সাদাত।ভ্রু কুটি করে তাকায় ঐশীর পানে।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,

“মেয়ে বলেই সাধ আহ্লাদ ম’রে গিয়েছে তোমাদের?শোনো, সর্বক্ষেত্রে চক্ষুলজ্জার কথা মাথায় আনবে না।এই ঠুনকো দুনিয়ায় কে কতোদিন বাঁচবে তার কোনো গ্যারান্টি নেই।আজ আছি কাল নাও থাকতে পারি।তাই কিছু ইচ্ছে মনে জাগা মাত্রই তা পূরণ করে ফেলবে।আফসোস রেখে ম’রে যেয়ে লাভ কি বলো?অবশ্যই দোল খাবে তুমি।কোনো পাপিষ্ঠ ইচ্ছে তো পোষণ করো নি যে এতো ভাবনা।”

অবাক হয় ঐশী।তার ক্ষুদ্র মনো বাসনা পূরণে লোকটা কতো তৎপর।

ওদিকে এগিয়ে গিয়ে মেয়ে দু’টিকে কিছু একটা বলে সাদাত।ঐশীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হেসে চলে যায় ওরা।এর পুরোটাই ঐশী নিরবে দেখলো।অভিব্যক্তি শূন্য সে।তবে ভেতরে বিষ্মিত হতে ভুললো না।দৃঢ় ব্যক্তিতের অধিকারী সাদাত আজ এতো পা’গলাটে?আদৌ ভাবা যায়?এ যেন তার স্বভাবের উল্টো প্রকৃতির এক মানব।সাদাতের এই ক্ষুদ্র পা’গলামিটা মন্দ লাগে না ঐশীর।বরং ভালোই লাগে।কেও তো প্রাধান্য দিচ্ছে তার ইচ্ছেকে।ঐশীকে কাছে ডাকে সে।লজ্জায় মিইয়ে যায় মেয়েটি।মাথা নুইয়ে আবারও দ্বিরুক্তি করে ঐশী।তার এক হাত ধরে জোড় করে দোলনায় বসিয়ে দেয় সাদাত।আজকের দিনটা সে এই মেয়ের নামে বরাদ্দ করেছে।তার কোনো ইচ্ছেই অপূর্ণ রাখবে না আজ।এক অন্য রকম খুশির জোয়ারে ভেসে যায় ঐশী।লোকটার এই ক্ষুদ্র পা’গলামো মন জুড়িয়ে দেয় তার।আনমনেই সে বলে,

“আপনাকে যতোটা গম্ভীর ও খারাপ ভেবেছিলাম মানুষ হিসেবে ততোটা খারাপও আপনি নন।”

অর্ধাঙ্গিনীর বিড়বিড় শব্দটা ঠিক শুনতে পায় না সাদাত।জিজ্ঞাসু নয়নে তাকিয়ে সে শুধায়,

“কি বললে শুনতে পাইনি।”

নিরুত্তর রয় ঐশী।এই কথাটা যে সাদাতের না শোনাই মঙ্গল।শুনলে যে সে লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না।কিছু সময় ওভাবেই ঘাপটি মে’রে থাকে সে।পরমুহূর্তেই কিছু একটা মনে হয়।নিজেকে দোলনা থেকে নামিয়ে গম্ভীর হয় সে।প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,

“কি যেনো বলতে চেয়েছিলেন আপনি।বললেন না তো?”

প্রশ্নটা শুনে সাদাত সটান হয়ে দাঁড়ায়।নিজেকে কিছুটা ধাতস্থ করে।ভ্রু কুটি করে বলে,

“যদি বলি কেবল মাত্র তোমার মেন্টাল রিফ্রেশমেন্টের জন্য এই জায়গাটা দেখাতে চেয়েছিলাম তোমায়।তাই ওটা বলে নিয়ে এসেছি।”

বিষ্মিত হয় ঐশী।

“তবে আপনি মিথ্যাও বলতে জানেন?”

ঐশীর চেহারাটা বেশ স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।আজকের একদিনেই অনেকটা হালকা হয়েছে সে।সাদাতের প্রতি ভয় কেটে গিয়েছে অনেকটা।যা ঠাহর করে এক টুকরো হাসি দেয় লোকটি।এটাই তো চেয়েছিলো সে।নিজের প্রতি অর্ধাঙ্গীর যম সুলভ ভয়টা কাটাতেই তো তার এই প্রয়াস ছিলো।ঐশীর প্রশ্নটা শুনে নিজের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে বোঝে সে।মুহুর্তেই মন ভরে যায় তার।লম্বা শ্বাস টেনে বলে,

“দুই একটা মিথ্যা যদি কারো ভয় দুর করার কারণ হয়,তবে তা জানতে অসুবিধা কি?”

মাথা নিচু করে ফেলে ঐশী।অকারণেই মনটা নেচে ওঠে তার।অনুভুতিরা তাল হারায়।লোকটার এক ভিন্ন রুপ দেখছে সে।সাদাত স্বামী হিসেবে এতোটা কোমল?মনে মনে কিছু একটা ভাবে ঐশী।তার দিকে এক মনে তাকিয়ে থাকে সাদাত।হটাৎ গম্ভীর হয়ে ওঠে সে।গভীর ধ্যানে মগ্ন থেকে বলে,

“তবে একটা কথা সত্যি জিজ্ঞেস করার ছিলো।”

ঐশী চোখ তুলে বলে,

“জ্বী বলেন।”

সাদাত মন্থর কণ্ঠে বলে,

“তুমি কি আমাকে ও আমাদের সম্পর্কটা মানো?”

নিজের ভাবনায় ছেদ ঘটে তার।দ্বিধাযুক্ত কন্ঠে বলে,

“মানি তবে..।”

ভ্রু কুঁচকে তাকায় সাদাত।

“কি!”

কিছু একটা ভাবে ঐশী।অতপর নাকচ করে বলে,

“তেমন কিছুনা।”

“ভেবেচিন্তে বলো।এখনো সময় আছে। এই সম্পর্কে পুরোদমে যুক্ত হয়ে গেলে কিন্তু পিছে ফেরার অপশন থাকবে না।”

“বিয়েটা তো ছেলেখেলা নয় তাই না?বিয়ে যখন একবার হয়েছে তখন মানতে তো হবেই।”

ভাবুক ভঙ্গিতে জবাব তার।ঐশীর প্রতিউত্তরে সাদাত সন্তুষ্ট হলো নাকি অসন্তুষ্ট হলো তা বোঝা যায় না।অভিব্যাক্তি নির্বিকার তার।কিছু প্রহর গম্ভীর থেকে থমথমে কন্ঠে সে বলে,

“বিয়ে হলেই মানতে হবে এটা ঠিক নয় ঐশী।আমি চাই না শুধুমাত্র বিয়ে হয়েছে বলে বা সমাজের নিয়মের জন্য তুমি আমাদের সম্পর্কটা মানো।এমনটা করলে সেটা সংসার হবে না।সেখানে কোনো ভালোবাসার ছোঁয়া থাকবে না।এভাবে ভালোবাসা বিহীন সংসার বৈধ ধর্ষণ ব্যতিরেকে অন্য কিছু নয়।শুধুমাত্র শারীরিক চাহিদার খাতিরে একসাথে থাকতে চাই না আমি।আমি চাই আমাকে মন থেকে ভালোবেসে,নিজের ইচ্ছায় আমার সাথে থাকো।যেখানে তোমার মনে কোনো চাপ থাকবে না,কোনো দ্বিধা থাকবে না।থাকবে কেবল মাত্র একে অপরের উপর নিগূঢ় আস্থা।যদি সময় চাও আমি সময় দিব।আমার কোনো আচরণ যদি তোমার অস্বস্তির কারণ হয় তো তা বিরত রাখব।তবুও ভালোবাসা বিহীন সংসার চাইব না।তোমার মনের উপর জোড় করব না কখনো।যেদিন তোমার মনে হবে আমি তোমার স্বামী হওয়ার যোগ্য তখনই স্বামী মেনো আমাকে।এর আগে নয়।এমনকি সমাজের খাতিরেও নয়।কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমাজের চেয়ে নিজের মনের প্রাধান্য অধিক।তুমি চাইলে আমার কাছে মুক্তি চাইতে পারো।অথবা এভাবে মেনে নিয়ে সঙ্গী হতে পারো।তুমি কি এভাবে মন থেকে মেনে নিবে আমাকে?”

নিভৃতেই সবটা শুনে যায় ঐশী।মনটা ভরে যায় তার।এরকম একটা মানুষকে কি করে মন থেকে না মেনে নিয়ে থাকতে পারে সে?মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় ঐশী।সাদাত এবার ঐশীর ডান হাতটা ধরে বলে,

“দেখো ঐশী,বৈবাহিক সম্পর্কটা এমন যেখানে দুটি ভিন্ন সত্তার মানুষ মিলে একক সত্তায় পরিণত হয়।একে অপরের বেড়ে ওঠা,মন মানসিকতা, পারিবারিক পরিবেশ সম্পূর্ণ আলাদা থাকে।এমন ভাবে বড় হওয়া দু’টি মানুষ একত্রে এক সংসারে এসে অনেক কিছু কম্প্রোমাইজ করে চলতে হয়।এক্ষেত্রে সাধারণত মেয়েদের ছাড়টা বেশি থাকলেও আমার কাছে সমান ছাড় পাবে তুমি।তোমাকে তিন কবুলের মাধ্যমে যখন আপন করে নিয়েছি তখনই তোমার ভালো থাকা,তোমার মন্দটা পুরোটা দেখার দায় ভার আমার উপর বর্তেছে।আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকবে তোমার পুরো দ্বায়িত্ব পালন করার।আমি বরাবর দ্বায়িত্ব সচেতন মানুষ।তোমার প্রতি দ্বায়িত্বের আগে নিজের অধিকার বোধের প্রাধান্য থাকবে না।”

এতোটুকু বলে থামলো সাদাত।ঐশীর দিকে তাকিয়ে পরখ করলো মেয়েটিকে।নিরব শ্রোতা হয়ে এসব শুনছে সে।তার প্রতিক্রিয়া বোঝা দায়।এবার পকেট থেকে একটা চেক বের করলো সাদাত। আবারও বললো,

“তোমার প্রাপ্য দেনমোহর।নাও এটা।”

বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে আছে ঐশী।তার হাতের মুঠোয় চেকটা পুরে দিলো সাদাত।লম্বা একটা শ্বাস টেনে বললো,

“তুমি হয়তো ভাবছো এখানে কেনো এটা দিলাম?আসলে স্ত্রী হিসেবে বিয়ের প্রথম রাতেই এটা পাওনা ছিলো তোমার।সাথে আমার বলা কথাগুলোও শোনার হক ছিলো।অথচ স্ত্রীর স্থলে তোমাকে দেখে পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিলো।তাই তখন দেওয়া হয় নি।সময় বুঝে আজকে তোমার হক বুঝিয়ে দিলাম।”

কথাগুলো শেষ করে সামনের দিকে হাঁটা দেয় সাদাত।ঠায় দাঁড়িয়ে রয় ঐশী।লোকটির কথাগুলো তার কানে বাজতে থাকে।কিছু একটা ছিলো এই কথাগুলোর মাঝে।যা থমকাতে বাধ্য করে তাকে।মানুষ সাধারণত অধিকার সচেতন হয়।সেখানে তার স্বামী দ্বায়িত্ব সচেতন মানব।এতোদিন যাকে জাঁদরেল ও সবচেয়ে খারাপ মানুষ বলে বকা দিয়ে এসেছে মানুষটা এতোটা খারাপও নয়।বরং স্বচ্ছ মনের অধিকারী সে।কথাটা ভাবতেই ভালো লাগার জোয়ারে বুক ছেঁয়ে যায়।তাঁর বাবা সঠিক মানুষের কাছেই পাত্রস্থ করেছে তাকে।এই প্রথমবার নিজের বাবাকে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে ঐশীর।এমন একটা মানুষকে নিজের জিবনে জুরে দেয়ার পরও ধন্যবাদ না দিয়ে কি থাকা যায়?

সাদাত এক প্রহরেই মন কেড়ে নিয়েছে ঐশীর।আনমনেই হেসে ওঠে সে।পা বাড়ায় সাদাতের পিছে।লোকটার নাগাল পাওয়া দরকার।নইলে সারাজীবন পাশাপাশি চলবে কি করে?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে