সন্ধ্যা_আকাশের_সুখ_তারা
“নওশিন আদ্রিতা”
পর্ব সংখ্যা—১৩
৩১.
বউ সেজে বসে আছে নিরা নিজের ঘরে। বুকের ভিতরে আলাদায় এক আন্দোলন জারি করেছে।ভাইয়া বাবা মা সবার চোখেই কেমন একটা বিষন্নতা ছেয়ে আছে যা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে নিরা। তার নিজের ও তো কষ্ট হচ্ছে যে বাড়িতে তার বেড়ে উঠা সে বাড়ি ছেড়েই আজ যেতে হবে অন্য আঙিনায়। যতোই পরিচিত হোক তবুও সে বাড়ি তার শশুড় বাড়ি। সে লোক গুলো এতোদিন ভালোমা বাবাই নামে চিনলেও সম্পর্ক বদলাবে। দ্বায়িত্ব বদলাবে।নিশ্বাস কেমন যেনো আটকে আসছে। মন চাচ্ছে ছুটে পালিয়ে যায়। এদের ছেড়ে সারাজীবন থাকতে হবে ভাবতেই গলায় কান্না গুলো দলা পেকে যাচ্ছে।চোখের পাপড়ি গুলোতেও ঠায় হয়েছে অশ্রু গড়িয়ে পড়তে কিন্তু পরক্ষণে এটা ভাবেও শান্তি লাগছে প্রিয় মানুষ কে পাবে হালাল ভাবে নিজের করে সকালে উঠেই শ্যামাপুরুষ
এর ঘুমন্ত মুখ দেখার অদম্য ইচ্ছাটাও যে নারীর মনে রয়েছে।এরই মাঝে তার কাজিন, বান্ধবীরা বর – বউ এসেছে বলে হৈইহুল্লুর শুরু করে দিলো। নিরার তার পরণের ভারি লেহেঙ্গা তুলে এসে দাড়ালো বেলকনিতে। গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে বধূ সেজে রুহানী আর তার প্রেমিক পুরুষ লাল গোল্ডের শেড়ওয়ানিটাই যে দারুন মানিয়েছে বিনা দ্বিধাই যেকেউ তা মেনে নিতে বাধ্য।
ইতিমধ্যে রুহানীকে নিয়ে তার দুই কাজিন উপরে নিরার রুমে রুহানীকে রেখ্ব পুনরায় নিচে এসে দাড়িয়েছে রুহানীও নিরার পাশে এসে তাকে হালকা ভাবে সাইড থেকে জড়িয়ে ধরে সেও দৃষ্টি রাখলো নিচে অভ্রতে। দুইপক্ষের মেয়ে মন্ডলী আর পুরুষ মন্ডলী মিলে দাঁড়িয়েছে গেটে টাকা উশুল করতে। অভ্র দুষ্টুমি করতে চাইলেও রুদ্র গম্ভির মুখে তাদের পাওনা মিটিয়ে দিলো।রুদ্রর গম্ভির মুখ দেখে কেউ আর তাকে ঘাটলোনা অভ্রও আর কি করবে এখন সে যদি দেরি করে তাহলে কি আর সম্মান থাকবে তাকে সবাই কিপটা ভাববে না। নিরার ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস তার কপালে যে এক বেরসিক মানুষ ছিলো তা আজ বুঝলো।তার বান্ধবীরা সবসময় তাকে বলতো “তুই যতোটা প্রানবন্ত দেখিস তোর জামাই গুমরোমুখো কুমরোপটাশ হবে দেখে নিস” আজ নিরার সত্যি তাদের গালে থাপ্পড় দিতে মন চাচ্ছে।
—রুহি সত্যি করে বল তো তোর ভাইকে কি জন্মের পরে মধু খাওয়ানো হয়নি যে এরকুম গুমড়ো হয়ে থাকে। কই বাবাই তো এমন না বাবাই এর মুখ থেকে তো হাসিই সরে না তাহলে উনি এমন কেন।(ভ্রু কুচকে)
রুহানী ফোস করে শ্বাস ছাড়ে
—আমি নিজেই মাঝেমধ্যে ভাবি আমার ভাই হয়ে সে এমন হয় কিভাবে রাগলেও এমন হাসলেও এমন প্রাণখুলে আজ অব্দি হাসতে দেখলাম না আজব কাহিনী। আম্মু বলে ভাইয়া নাকি দাদুর মতো হয়েছে দাদাও নাকি এমনই ছিলেন। কিন্তু আজব কথা কি জানিস তোদের মতো দাদা দাদির এরেঞ্জ না লাভ ম্যারেজ ছিলো দাদুর আব্বু বলে অনেক অবাক হয়েছিলো তিনি কোনদিন ভাবেন নি তার গুমরো মুখো ছেলে কাউকে এইভাবে তুলে আনবে।
নিরা ফোস করে নিশ্বাস ছাড়ে তার ও বিশ্বাস হয়না এই গম্ভির পুরুষ এক নির্জন রাত্রীতে চাঁদকে সাক্ষি রেখে তাকে তার মনের কথা জানিয়েছিলো। সবটাই তার ভ্রম মনে হয়।এই বুঝি রুদ্র তাকে বললো “আমি এমন কিছুই বলিনি সব তোমার ইমিজিনেশান তোমার মতো মেয়ে আমি আমার নিরামিষ লাইফে চাইনা বুঝলে “।
৩২.
নিরা দাঁড়িয়ে আছে শিকদার বাড়ির গেটের কাছে।মিসেস শিকদার বরণ ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ির চৌকাঠে। মিস্টার শিকদার চোখের ইশারায় ছেলেকে কিছু ইশারা করছে বারবার। নিরা সেটা বুঝতে পারছেনা আবার তারা যে ঠিক দশ মিনিট ধরে এখানে দাঁড়িয়ে আছে তার মানেও বুঝসে না নিরা। হঠাৎ নিজেকে শূন্যতে উঠতে দেখেই অবাক হয় রুদ্রর গম্ভির মুখ দেখে তার খারাপ লাগে তার এমন ভাবের কারণ বুঝে উঠতে পারেনা খারাপ লাগে তার মনে হচ্ছে সব কিছু তাকে জোড় করে করানো হচ্ছে নিরা সাইডে তাকায়ে দেখে মিস্টার শিকদার খুশি মনেই পিছন পিছন আসছে সাথে তার কাজিন গুলোও মুখ টিপে হাসছে।কিন্তু নিরার মনে অভিমান জন্মায় সামান্য তাকে কোলে নেওয়ার অনিহা দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার কারণ বুঝলো।মিসেস শিকদার খুশিমনেই দুইজনকে বরণ করে নিলেন।
বাসর ঘরে প্রবেশ করতেই নিরা অবাক পুরা রুম খালি কোথাও কোন ফুলেএ ছিটা অব্দি নাই। এমন ও বাসর ঘর হয় জানা ছিলোনা নিরার।নিরাকে এমন অবাক চোখে তাকাতে দেখে রুদ্রর বড় ফুফুর মেয়ে অরিন বলে উঠে
—ভাবি তোমার জামাই এর হুকুম তার রুমে যেনো এইসব অযথা সাজাসাজি না করে তার পছন্দ না কেউ তার রুমে ঢুকে এইসব নোংরা করুক আমরা অনেক বুঝিয়েছি কিন্তু সে তো মানতেই নারাজ।
নিরা জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো
—আরে ব্যপার না। আমার ওইসব এ অস্বস্তি হতো।
অরিন বুঝলো নিরার মনের অবস্থা সে মনে করলো এরেঞ্জ ম্যারেজ হয়তো রুদ্রকে জোড় করেই করানো হচ্ছে তাই রুদ্রর এমন ব্যবহার। নিরা ঘরে ঢুকেই ওয়াসরুমে চলে গেলো লাগেজ থেকে নরম সুতির লাল শাড়ি নিয়ে।যার বাসরের প্রতি তার প্রতি এতো অনিহা তার জন্য এইরকম সঙ সেজে বসেও তো লাভ নেই। হয়তো একমাস আগে ঝোকের তালে নিরাকে ওইসব বলে ফেলেছিলো কিন্তু এখন হয়তো বুঝেছে এইসব যা হয়েছে সব ভুল কিন্তু কিছু করার ছিলোনা বলেই হয়তো চুপচাপ সব করে গেছে এই ধারণা নিয়ে দুই ফোটা অশ্রু বসর্জন দিয়েই ওয়াসরুম থেকে বেরিয়ে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লো কখন ঘুমিয়ে পড়লো টের পেলোনা সারাদিনের ধকল মনের অবস্থা যেনো নিরার মস্তিষ্ক আর নিতে পারলোনা।
রুদ্র তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ছাদে বাবা ছেলে দুইজনার হাতেই সিগারেট। রুদ্র কোন চেন স্মোকার না বা নিয়মিত সেবন না করলে কোন সুবিধাও হয়না মাস সপ্তাহ পরে ইচ্ছা হলে একটা ধরায়। মিস্টার শিকদার আবার দুই একদিন পরপরই বউ মেয়ের চোখ থেকে আড়াল করে টান দেন। আজ এই সিগারেট এর আসর বসানোর কারণ ছেলের সাথে কিছু আলোচনা।
নিস্তব্ধতা ভেংগে রুদ্র সিগারেটে একটা টান দিয়ে সেটা পা দিয়ে পিষে বলে উঠলো
—কি বলতে চাও আব্বু বলো।এতো ভাবার কিছু নেই।
মিস্টার শিকদার জোড়ালো এক নিশ্বাস ত্যাগ করে তিনিও সিগরেট ফেলে দেন
—দেখো রুদ্র ছোট থেকেই তুমি গম্ভির আর রাগী ছিলে ম্যাচুয়ার ও ছিলে যার কারণে তোমার আম্মু তোমাকে নিয়ে চিন্তিত হলেও আমি চিন্তিত ছিলাম না আমি সবসময় তোমার সকল মতামত যা তুমি তোমার জীবনকে ঘীরে নিয়েছো তাতে আমি কখনো বাধা দেয়নি সম্মান করেছি পাশে দাড়িয়েছি এমনকি বিয়েতে অসম্মতি জানানোর সময় ও। কিন্তু দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করায় তুমি নিজেই নিরব সম্মতি জানিয়েছো তাই দেখেই বিয়েটা হয়েছে।কিন্তু তোমার নিরামাকে ঘীরে এই অনিহাটা কিন্তু উচিত না এটা সবার মনেই প্রশ্ন তুলছে যা নিরা মায়ের জন্যেও অসম্মানজনক আর আমি চাইবোনা আমার ছেলে দ্বারা আমার একান্ত প্রিয় বন্ধুর মেয়ে কষ্ট পাক আমি নিজে রুহুল কে কথা দিয়েছি তার মেয়ের সুখের দায়ভার আমি নিলাম তার মেয়ে যেমন সেখানে হাসি মুখে ছিলো এখানেও থাকবে আর আমি চাইবো ছেলে হিসেবে তুমি আমার কথার মর্যাদা রাখবে।যাও রুমে যাও নিরা মা অপেক্ষা করছে।
কথাটা বলেই মিস্টার শিকদার চলে গেলেন রেখে গেলেন অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রুদ্রকে
সে কাকে কিভাবে বুঝাবে সে এমনই ছোট থেকেই হঠাৎ করে সে পারছেনা তার গম্ভির আবরণ থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা সেও করছে কিন্তু পেরে উঠছেনা সে বাকি দশটা ছেলের মতো সে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেনা
—আচ্ছা নিরাও কি ভাবছে আমি তাকে বিয়ে করে খুশিনা উফফ নিশ্চয় অভিমানী কণ্যা অভিমানের পাহাড় জমায়ে বসে আছে চল ভাই রুদ্র বউ এর রাগ ভাংগানোর কাজে লেগে পড়।
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের রুমের দিকে পা বারায়। একবার উকি দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখে নেয় নিজের অবস্থান মিসেস শিকদার কে খাবার প্লেট হাতে নিয়ে উপরে উঠতে দেখে বুঝতে বাকি নেই নিরা কিছু খাইনি দীর্ঘশান ফেলে মায়ের হাত থেকে প্লেট নিয়ে নিজেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিল।ওপর পাশ থেকে সারাশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে ভিতরে তাকাতেই অবাক।রুদ্র হাসবে না কাদবে বুঝতে পারছেনা।
চলবে??