শোভা পর্ব-১৩

0
457

#শোভা
#পর্ব_১৩

রাতের বেলা শোভার সাথে জামিল সাহেবের ফোনে কথা হলো। জামিল সাহেব বার বার তাকে তার বাসায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলো। শেষে শোভাও অনেক ভেবে চিন্তে যেতে রাজি হলো।

পরেরদিন বেলা এগারোটার দিকে ওরা জামিল সাহেবের বাসায় গেলো। ওদের বাসা থেকে রিকশায় আধঘণ্টার দুরত্ব। বাচ্চাদুটি খুব খুশি। কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয়ে উঠেনা ওদের। যাবেই বা কোথায়? তার উপর তার মায়ের হাজার ব্যস্ততা।

– শোভা ভাবি, আপনি আসছেন। আমি অনেক খুশি হয়েছি। আসুন পরিচয় করিয়ে দেই। আমার ওয়াইফ, পারভিন।

আর পারভিন, এনার কথাতো তোমাকে কাল রাতে বলেছি। শোভা ভাবি।

শোভা আর পারভিন একে অপরের সাথে পরিচিত হলো। বেশ আলাপি মানুষ পারভিন। অল্প সময়ের মধ্যেই কাউকে আপন করে নিতে পারে এমন। শোভার সাথে রান্নার ফাঁকেফাঁকে গল্প করছে। এমন ভাবে কথা বলছে যেন কতকাল ধরে চিনে শোভাকে। আর মেয়েদুটি খেলাধুলায় ব্যস্ত জামিল সাহেবের ছেলের সাথে। খুব হাসিখুশি লাগছে আজ দুই বোন কে।

শোভা আর পারভিন গল্প করছে তখন জামিল সাহেব এসে সেখানে দাঁড়ালো।

– বাহ! মেহমান কতো রিকোয়েস্ট করে আনলাম আমি। আর গল্প করে কে দেখতো! বলে জামিল সাহেব হেসে উঠলেন। তা ভাবি, কেমন লাগছে এই গরিবের বাড়িতে?

– অসম্ভব সুন্দর! আর আপনি গরিবের বাড়িতে বলছেন কেনো? আপনি গরিব তাহলে ধনী কে বলুনতো! এটা কি আপনার নিজের ফ্লাট নাকি ভাড়ায় থাকছেন?

– না, ভাবি! নিজেরই। লোন টোন নিয়ে অনেক কষ্ট করে কিনেছি। সুন্দর হয়নি? আপনাদের দুজনের গল্প শেষ হলে আপনার সাথে কথা ছিলো ভাবি।

– কি বলেন সুন্দর হবেনা কেনো? অনেক ভালো লেগেছে। আর সবচেয়ে ভালো লাগছে পারভিন ভাবির সাথে পরিচিত হয়ে। খুবই ভালো মনের মানুষ! হ্যা, বলুন কি কথা!আচ্ছ, যাক সে কথা! আগে আপনি বলুন তো, কাল থেকে আমাকে ভাবি ভাবি করে ডাকছেন কেনো? কোন দৃষ্টিকোণ থেকে আমি আপনার ভাবি হই?

– আপনি জহির ভাইয়ের বউ। তাহলে আমার কি হন? আর থাক, কথা খাওয়া দাওয়ার পরই বলবো।

– আচ্ছা! জামিল ভাই, আপনি আমাকে ভাবি ডাকেন কারণ আমি রিনার ভাবি। তাইতো?
কিন্তু আমি ওদের কোনো পরিচয়ে পরিচিত হয়ে বেচেঁ থাকতে চাইনা? আমি ওদের কথা মনেও করতে চাইনা। জীবনটাকে নিজের মতো করে সাজাতে শুরু করেছি। সেখানে ওদের কোনো ছায়াও পরুক তা আমি চাইনা। প্লিজ!

– আমি বুঝতে পেরেছি। কতটা কষ্ট আপনার মনের ভিতর। তাহলে ঠিক আছে আপা বলেই ডাকি।

– না, জামিল ভাই! আপনি আমার অনেক সিনিয়র হবেন হয়তো বা। আপনি আমাকে ছোট বোন মনে করে নাম ধরেই ডাকতে পারেন।

– ঠিক আছে। এটাও মন্দ বলেন নি।আমার আবার কোন ছোট বোন নেই।

দুপুরবেলার খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই খাটের উপর বসে কথাবার্তা বলছিলো। বাচ্চারা খেলছে। আলোর বাহন নিয়ে কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে!

কথার মাঝপথে শোভাকে জহিরের মৃত্যু নিয়ে জামিল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। ও বাড়ির মানুষের খোঁজখবর জানতে চাইলেন।

শোভা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে পরে ধীরেধীরে সব কথা খুলে বললো। তার কথা শুনে পারভিন এর চোখ দিয়ে অঝর ধারায় পানি পরছিলো।

– উফ! কি করে সহ্য করেছিলে এতটি বছর?

– জামিল ভাই! আমি সবকিছুই সহ্য করেছি শুধুমাত্র জহিরের জন্য। জহির বেঁচে থাকলে বাকি জীবনও সহ্য করে নিতাম।
আপনার কথা বলেন! আপনার নামে তো যেসব কথা শুনেছি কিছুই মিলছে না।

– কি আর শুনবে বোন! তোমার আর আমার তো একই ইতিহাস। তুমি ওই ফ্যামিলিতে বাইরের মানুষ আমিও ছিলাম বাইরের মানুষ। তোমার সাথে ওরা যে ধরনের অমানবিক ব্যবহার করেছে তা আসলেই চিন্তা করা যায় না। জহির ভাই বেঁচে থাকতে যা করেছে করেছে। ওরা এতটা পাষাণ, জহির ভাইয়ের মৃত্যুর পর এগুলো ওরা কি করে করলো? ওদের কে চিনতে যতটুকু ভুল ছিল তাও এখন জেনে গেলাম! আসলে ওরা কি মানুষ! নাকি মানুষ নামধারী কতগুলা জানোয়ার?
তোমাকে ওরা আমার ব্যাপারে কি বলেছে না কি বুঝিয়েছে, কিছু জানিনা। তবে সবকিছু এখন বলতে চাই না। আমার সাথেও ওরা যা করেছে তা কম কিছু নয়।

– তাতো বুঝতেই পারছি। ওরা আপনাকে নিয়ে যেসব নেতিবাচক কথাবার্তা বলেছে আমার কাছে , আজ পারভিন ভাবির সাথে কথা বলে তো শুনলাম! সেগুলো কোন কিছুই আসলে সত্যি না। যেটা আমি আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি থেকে বুঝতে পেরেছি।

– রিনার সাথে বিয়ে দিয়েছিল আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে । আমার তখন পড়াশোনা প্রায় শেষের দিকে। চাকরির জন্য ঘোরাঘুরি করছি। একদিন ঢাকা থেকে ফরিদপুর যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে রিনার সাথে পরিচয়। সেখান থেকে হালকা পরিচয়ের সূত্র ধরে আমার এক আত্মীয়ের মাধ্যমে আমার আর রিনার বিয়েটা হয়। আমার এই পৃথিবীতে একমাত্র মা ছাড়া আর কেউ ছিল না। গ্রামে বেশ জমিজমা ছিল আমাদের। প্রভাবশালী হিসেবে বাবার বেশ সুনাম ছিল। আমার সবকিছুর খোঁজখবর নিয়ে ওরা বিয়েতে রাজি হয়। রিনার ও আমাকে পছন্দ। এজন্য আমার শাশুড়ি আর জহির ভাই আর কোনো অমত করলেন না। আমার ছোটখাটো একটা চাকরি হয়ে গেলো। বেতন খুব বেশি না। তবে রিনাকে আর মাকে নিয়ে ছোট একটা বাসা নিয়ে একটু হিসেব করে চলে কোন ভাবে চলে যেতো এরকম টাইপের। বিয়ের পরপরই আমি ঢাকাতে উত্তরাতে দুই রুমের ছোট্ট একটি বাসা নেই। সেখানে কয়েকদিন থাকার পর এই ছোট্ট বাসা আর অভাব-অনটনের সংসার তার আর ভালো লাগছে না। সে শুধু তার মায়ের বাড়িতে যাওয়ার জন্য আনচান করতো। তাকে তার মায়ের বাড়িতে যেতে দিতাম না তা কিন্তু নয়। সে তার মায়ের বাড়িতে যেতো আসতো কিন্তু সে চায় আমাকে সহ তার মায়ের বাড়িতে যেয়ে পার্মানেন্ট থাকতে। সোজা কথায় ঘরজামাই। আয় রোজগার করবো। ওখানে বসে থাকবো খাবো । কিন্তু আমার পক্ষে সেটা কখনোই সম্ভব না কারন আমার মেন্টালিটি কোনদিনই এরকম ছিল না। গ্রামে বসে হঠাৎ করে মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে ঢাকা নিয়ে আসলাম। পার্মানেন্ট ভাবে মাকে আমাদের বাসায় রাখার ব্যবস্থা করলাম। এতে রিনা এবং রিনার মা বোন খুব বেশি খুশি হতে পারলোনা। দিন কয়েক যেতে না যেতেই শুরু হলো মায়ের উপর বিভিন্ন ধরনের মানসিক অত্যাচার। তোমার কাছে আমি সেগুলোর বর্ণনা দিতে চাইনা তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো। মা কোনোভাবেই আর ঢাকা থাকে চাইলো না। কিন্তু তার চিকিৎসার স্বার্থে তাকে ঢাকায় থাকতে হবে। কোনো রকম জোর করে তাকে ঢাকায় রাখলাম। মাকে ঢাকায় রেখেছি কেনো, এ নিয়ে রিনার সাথে আমার দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা ঝগড়াঝাঁটি লেগেই থাকতো। আমার আর কোনো ভাইবোন নেই যে সেখানে মা যেয়ে দু’একদিনের জন্য থাকবে। প্রতিদিনের অশান্তি দেখে মা একটু সুস্থ হয়ে নিজেই গ্রামের বাড়িতে চলে গেলো। এরপর শুরু হলো রিনার আর এক প্যারা। সে এত দূরে বাসা নিয়ে থাকবে না। তার মায়ের বাসার কাছেই বাসা নিতে হবে। তার মায়ের যেখানে বাসা সেখানে থাকতে হবে। উত্তরা দিয়ে তার যাওয়া-আসা করতে সেখানে অসুবিধা হয়। শেষে অশান্তি ঠেকানোর জন্য আমি রাজি হয়ে আমার শ্বশুর বাড়ির মোটামুটি কাছেই বাসা নিলাম। ওখানে বাসা নিয়ে দেখি তো মহা বিপদ! সকালবেলা আমার বাসা রেখে, আমাকে রেখে চলে যায় আর সেই রাত বারোটা একটার সময় আসবে। বাপের বাড়ি থেকে খানাদানা প্যাকেট করে নিয়ে আমাকে সেটাই খেতে হবে। ঘরে কোনো চুলা জ্বলে না। আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। রিনার অনেক বড় বড় চাহিদা।
তাকে হীরের আংটি দিতে হবে, হীরার নাকফুল এই গোল্ডের গহনা, অমুক শাড়ি, তমুক থ্রি পিস আরো কত কি! অমুক ভাবির এইটে আছে, তমুক ভাবির ওইটা আছে! তার কি আছে? এসব কম্পেয়ার করতেই থাকতো ! আর আমার সাথে বিভিন্নভাবে ছলছাতুরি করে কারণে-অকারণে ঝগড়াঝাটি করতে থাকতো। সারাদিনই পড়ে থাকতো বাপের বাড়িতে। ঘরের কাজকর্মের তার কাছে কোনো গুরুত্বই নেই। নিজের বাপের বাড়িতে খেয়ে আসতো আমাকেও সেখানে খাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করতো। কিন্তু আমি জামাই। আমি কেন প্রতিদিন তাদের বাড়িতে যাবো? তাই আমি যেতাম না। বেতন পেয়ে পুরো টাকাটা তার হাতে ধরে দিতে হবে। তার কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে নিয়ে আমাকে সারা মাস চলতে হবে। বিবাহিত জীবনে আমি নাস্তা খেয়ে কোনদিন অফিসে গিয়েছিলাম বলে আমার মনে পড়ে না। অফিস থেকে এসে ঘর-গৃহস্থালির কাজকর্ম করতে হতো। তাকে সমস্ত কুট পরামর্শ দিতো মূলত ওর মা এবং ওর বোনেরাই। মূলত আমাকে একটা হাফলেডিস মার্কা হাজবেন্ড বানিয়ে ওর পকেটে নিয়ে ঘোরা টাই ছিল ওর মূল পরিকল্পনা। আমি কষ্ট করে সারা মাসে ইনকাম করবো আর সে সেই টাকা দিয়ে যেখানে খুশি সেখানে যেভাবে খুশি সেভাবে খরচ করবে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই নিয়ে এবং টুকটাক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায়ই আমাদের মাঝে ঝগড়া ঝাটি ছারতো না। ঝগড়া এমন পর্যায়ে পৌঁছে যেতো দেখা যেতো যে আমরা একজন আরেকজনের গায়ে হাতও তুলতাম। বা হাতের কাছে যা পেতাম তা দিয়েও অনেক সময় আমাদের মারামারি হতো। আমি তো ছেলে মানুষ লজ্জায় কাউকে কিছু দেখাতে পারতাম না বা বলতে পারতাম না। আরও কাপড় তুলে তুলে সেটা বিভিন্নজনকে দেখাতো এবং বিভিন্ন ভাবে বানিয়ে বানিয়ে গল্প তৈরি করে তাদের কাছে বলতো। আমি জানি এগুলো শুধু ওর একার মাথা থেকে বুদ্ধিগুলো বের হতো না। এগুলোর পিছনে ওর মায়ের আর বোনদেরও ইন্ধন ছিল। জহির ভাই জানতো যে, তার বোনকে আমি নেশাগ্রস্ত হয়ে এসে শ্বশুরবাড়ি থেকে টাকা নেওয়ার জন্য মারধর করি। যেভাবে ওরা জহির ভাইয়ের কাছে বলছে সে তাই বিশ্বাস করতো । সে আমার বাসায় এসে আমাকে কয়েকবার চরমভাবে অপমান করেছে এবং বিভিন্ন ধরনের গালিগালাজ করেছে তখন আমি তাকে এত বোঝানোর চেষ্টা করেছি যে আমার ব্যাপারে তার কাছে যেসব কথা বলা হচ্ছে সব মিথ্যে। কিন্তু, সে কোন কিছুই বিশ্বাস করেনি। তার কাছে তার মা বোনদের কথাই শেষ কথা।

যাক, সেসব কথা। হঠাৎ করে একদিন জানতে পারলাম যে, আমি বাবা হতে যাচ্ছি! আমি তো প্রচন্ড খুশি। আমি ভেবেছিলাম যে, এবার হয়তো রিনার পরিবর্তন হবে। অসুস্থ থাকা অবস্থায় আমি আমার মাকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। কিন্তু ও আমার মায়ের সাথে যেভাবে ব্যবহার করতো, এভাবে কেউ ঘরের চাকর এর সাথেও ব্যবহার করে না। ও সারাদিন মাকে ফেলে রেখে বাবা বাড়িতে যেয়ে পড়ে থাকতো। মা কি খেলো কি না খেলো? সেদিকে ওর কোনো মাথাব্যথা নেই। এদিকে মা ও দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। আমি চাইলেও মাকে বাড়িতে রেখে আসতে পারতাম না। কারণ মা বাড়িতে একা কার কাছে থাকবে ? মা আমার প্রতি রিনার ব্যবহার দেখে দিন দিন মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়ে। মা খুব ভোরবেলা উঠে অনেক কষ্ট করে আমার আর রিনার জন্য নাস্তা বানাতো। রিনাকে মা নাস্তা খেতে বললে রিনা মায়ের মুখের উপর ঝামটা মেরে বলতো সবার হাতে তৈরি করা খাবার নাকি সে খায় না। আমার মা হাত ধুয়ে খাবার বানিয়েছে নাকি হাত ধোয় নি এটা নিয়ে সে খুব সন্দেহ করতো।আমার মা এসব কথা শুনে কষ্টে পাথরের রূপ ধারণ করতো। সকালবেলা উঠে মা বোনদের কাছে যেতো আর আমার মা টা একা একা সারাদিন বাসায় পড়ে থাকতো। কোনদিন শরীর ভাল লাগলে দুমুঠো রান্না করত। নিজে খেতো আবার আমার জন্য রাখতো। আর কোনদিন ভালো না লাগলে সারাদিন না খেয়ে পড়ে থাকতো। সারাদিন ক্লান্তির পরে যখন বাসায় ফিরে মায়ের এই অবস্থা দেখতাম তখন আমার মাথায় রক্ত উঠে যেতো। ওর পেটে তখন আমার বাচ্চা আমি চাইলেও ওকে গায়ে হাত তুলতে পারতাম না। মুখে যতদূর পারতাম ততদূর বোঝাতাম। আমার ইনকাম ততো বেশি ভালো ছিলো না যে মায়ের জন্য আমি পার্মানেন্ট একজন বুয়া রেখে দিবো। তার পরেও আমি মার জন্য এক বেলা খাবার রান্না করার জন্য একজন বুয়া রাখলাম। এ নিয়ে বাসায় তুলকালাম অবস্থা। আমার টাকা নেই তাহলে বুয়া রাখি কিভাবে? আসলে মায়ের জন্য কোন কিছু করতে দেখলে ওর গায়ে আগুন জ্বলে যেতো।

আমি একবার অফিসের ট্রেনিং এর কাজে দুদিনের জন্য রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। আমি ওকে এত বুঝিয়ে-সুঝিয়ে রেখে গেলাম যে মাকে রেখে যেন কোনোভাবেই সে তার বাপের বাড়িতে যেয়ে না ওঠে, মা একা একা খুবই খারাপ বোধ করে। আমি যাওয়ার সময় আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার মা অনেক কান্না করেছিলেন সেদিন। তিনি কেঁদে কেঁদে শুধু একটা কথাই বলেছিলো, বাবারে তোর জীবনে আমি শান্তি দেখে যেতে পারলাম না। এ কেমন জীবন যাপন করছিস তুই? কি পাপ করেছিলাম আমি? যে সেই পাপের শাস্তি আল্লাহ তোকে এভাবে দিচ্ছে? এভাবে তো তুই বাচতে পারবি না। এভাবে কি মানুষ বাঁচতে পারে? তুই তো অসুস্থ হয়ে যাবি রে বাপ। আমি তো মরেও কোনদিন শান্তি পাব না!

যাইহোক ট্রেনিং থেকে ফিরে যা দেখতে পেলাম সেটা মনে পড়লে আজও কষ্টে বুক ফেটে যায়। চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করে কিন্তু পুরুষ মানুষ তো চিৎকার করে কাঁদতেও পারিনা। আর আমাদের কান্না কেউ বিশ্বাস ও করবে না। আমি রাত দশটার দিকে ঢাকায় এসে পৌছালাম।। এসে দেখি আমার মা মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে তাকে দেখার কেউ নেই। আগের দিন রাতে আর ওইদিন সকালে ও আমি মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। কাজের মেয়েটা দুপুরবেলা রান্না করতে এসে অনেক ডাকাডাকি করে নাকি ফেরত দিয়েছে মায়ের কোন সাড়াশব্দ সে পাইনি। তাড়াতাড়ি করে মাকে এম্বুলেন্স ডেকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে গেলাম। সেখানে যেয়ে ডাক্তারের কাছে যা শুনলাম তাতে আমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল। ডাক্তার আমাকে বলল, যে মা নাকি আরো ঘন্টা দুয়েক আগে মৃত্যুবরণ করেছে। আমার মা আর এই পৃথিবীতে নেই। আমি চিৎকার করে হাসপাতালের মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছি। আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতোও পাশে কাউকে পেলাম না। আমি কাঁদতে কাঁদতে জহির ভাইকে ফোন দিলাম। জহির ভাই খবর শোনার সাথে সাথে হসপিটালে ছুটে গেলেন। যাই হোক, মাকে দাফন করলাম আমাদের গ্রামে বাপ-দাদার জমিতে।

মা যখন অবহেলায় ধুকে ধুকে মারা গেল তখনই সিদ্ধান্ত নিলাম যে আর নয় ওর সাথে আর সংসার করার পরিস্থিতি নাই। তখন আমার বাচ্চা ওর গর্ভে। বয়স সাত মাস হবে হয়তো। ও প্রেগন্যান্ট থাকার কারণে আমি কি করবো কি না করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমি খুব বেশি ওর বাপের বাড়িতে পা রাখতাম না। বিয়ের পর পর হাতে গোনা কয়েকবার গিয়েছিলাম। এরপর ওদের স্বভাব চরিত্র সম্পর্কে অবগত হওয়ার পরে ও বাড়িতে আর পা রাখার ইচ্ছে হতো না।

কিন্তু সেদিন একরকম ইচ্ছার বাইরে যেয়েই ওদের বাড়িতে আমি পা রাখলাম শুধুমাত্র জহির ভাইয়ের কাছে ওর বোনের এই ব্যবহারের জবাব চাইতে। আমি তাদের বাড়িতে গেলাম। জহির ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমি তার কাছে সবকিছু বলতে চাইলাম। কিন্তু আমার বলার আগেই রিনা কান্নাকাটি করে তার ভাইকে এমনভাবে কানপড়া দিয়েছে যে সব দোষ যেন আমার আর আমার মায়েরই। তার বোনের কোন দোষ নেই। জহির ভাই কে এখানে দোষ দিবো। কারণ সে তার মা বোনদের ছাড়া আর কারো কথা বিশ্বাসই করতো না।

এভাবে আরো দুটো মাস কেটে গেল সে তার মায়ের বাড়িতেই থাকতো। বাসায় আর আসতো না।

মুহিবের জন্ম হলো। মুহিবের মুখ দেখে আমি সব কিছুই ভুলে গেলাম। মুহিব একটু ঝরঝরে হলে ওদেরকে আমি বাসায় নিয়ে আসতে চাইলাম। দেখলাম রিনাও সাথে সাথে রাজি হয়ে আমার সাথে বাসায় চলে আসলো। আমি ভাবলাম হয়তো রিনা বাচ্চার মুখ দেখে অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু কয়েক দিন যেতে না যেতেই সে তার আগের রূপে ফিরে এলো। রিনা আমার গ্রামে আমার বাপ দাদার যত সম্পত্তি আমি ভাগে পেয়েছি সেগুলো সব বিক্রি করে দিয়ে আর ব্যাংক থেকে কিছু লোন নিয়ে ঢাকায় আমাকে তার নামে একটা ফ্ল্যাট কিনে দিতে বলে। তার ছেলের ভবিষ্যতের চিন্তা করে। আমি কোনোভাবেই আমার বাপ দাদার সম্পত্তি বিক্রি করতে রাজি হলাম না। এরপরে শুরু হয়ে গেল নতুন করে আবার কুরুক্ষেত্রের কাহিনী। সে এবং তার মা বোনেরা মনে করেছিলো যে আমি ছেলের মায়ায় পড়ে রিনা যা বলবে তাতে রাজি হয়ে যাবো। কিন্তু আমি সেটা করলাম না। আমি ভুলেও তাদের পাতা ফাঁদে পা দিলাম না। রিনা আমার বাচ্চাকে নিয়ে তার বাপের বাড়িতে চলে গেলো আর এলো না। প্রথম প্রথম মাস ছয়েক আমি এটা সেটা কিনে নিয়ে ও বাড়িতে যেতাম মুহিবের সাথে দেখা করতে। এবং রিনাকে বোঝাতে যে, সে যেন বাসায় ফিরে আসে। আমি জহির ভাইয়ের কাছে অনেক রিকোয়েস্ট করলাম। কিন্তু জহির ভাই কে ওরা কি বুঝিয়েছিল জানিনা। জহির ভাই আমাকে দেখলেই ফোঁস করে উঠতেন। সে আমার সাথে কোন কথা বলতেই রাজী ছিলেন না। আমি নাকি মদখোর, জুয়াখোর, নেশাখোর! আমি নাকি তার বোনকে প্রায়ই মারধর করি! আমি নাকি তাদের কাছে টাকাপয়সা চাই! এসব কথা সে তার ভাইয়ের কাছে এসে বলেছে। আর জহির ভাই ও সেটা বিশ্বাস করে আমার সাথে ভালোভাবে কথাই বলতোনা।

আমার শাশুড়ি তো আমাকে ডাইরেক্ট বলে দিলো, জমি বিক্রি করে এনে তার মেয়ের নামে ফ্ল্যাট কিনে দিলেই আমার ছেলের সাথে আমাকে দেখা করতে দিবে নতুবা আমার ছেলের সাথে সে আমাকে দেখাও করতে দিবে না। সত্যি সত্যি আমাকে আর মুহিবের সাথে দেখা করতে দেওয়া হলো না। শেষে আমিও হাল ছেড়ে দিয়ে ওদের খোঁজ খবর নেয়া বন্ধ করে দিলাম। আমি ওখান থেকে বাসা পরিবর্তন করে আমার অফিসের কাছাকাছি একটা বাসায় উঠলাম।

ছেলেটার জন্য মন কাঁদতো। কিন্তু কিছুই করার ছিলনা। হঠাৎ করে দেখি একদিন আমার বাসায় থানা থেকে নোটিশ এসেছে আমার নামে মামলা হয়েছে নারী নির্যাতন মামলা। আমি কোন রকম করে মামলা থেকে বাঁচার জন্য বেশ বড়োসড়ো উকিল ধরলাম। উকিলের মাধ্যমে জানতে পারলাম বেশ কিছু টাক যদি খরচ করি, তাহলে হয়তো এই মামলার হাত থেকে আমি রক্ষা পেতে পারি। প্রথম প্রথম গা-ঢাকা দিয়ে থাকতাম। পরে অতিষ্ঠ হয়ে এত টাকা আমি কোথায় পাবো! তাই লাস্টে যেয়ে বাধ্য হয়ে বাপ-দাদার সম্পত্তি থেকে কিছু অংশ বিক্রি করে একটা বেশ ভালো পরিমাণ টাকা দিয়ে আমাকে মামলার হাত থেকে মুক্ত হতে হয়েছে।

তখন তওবা করলাম, যে আর নয়! কোনোভাবেই এই মেয়ের সাথে আর সংসার করবো না। তাতে যদি আমার জীবনও চলে যায় তাতে ও না। ছেলে যদি কোনোদিন তার বাবা হয়ে থাকি তাহলে আমার কাছে আসবেই। তাই ছেলের মায়াও ত্যাগ করলাম।

এরপরে আবার বাবার সম্পত্তি কিছু বিক্রি করলাম। বিক্রি করে সেখান থেকে কিছু টাকা নিয়ে আমি দুবাইতে পাড়ি জমালাম। দুবাই থেকে এই বছর পাঁচেক আগে ঢাকায় ফিরেছি। দুবাই থেকে ফিরে আমি মুহিবকে অনেক খুঁজেছি। ওরা যে ওদের বাসা ছেড়ে নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে সেটা আমি জানতাম না।

দেশে ফেরার পরে এক বন্ধুর মাধ্যমে আমার পরিচয় হয় পারভীনের সাথে এবং পারভীন এর সাথে পরিচয় হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের বিয়েও হয়। জীবনে যে অতৃপ্ত চাওয়া ছিলো, যে চাওয়া পূরণ হওয়ার নয় ভেবেছিলাম সেই চাওয়া গুলোকে পূর্ণ করেছে পারভীন। আমার জীবনটাতে পূর্ণতা এনে দিলো পারভিন। আমাদের ঘর আলো করে এলো আমার ছেলে অয়ন । পারভিন আমার সব পুরানো ইতিহাসই জানে। এ নিয়ে তার কোন আপত্তি নেই। দুবাই থেকে যে টাকাপয়সা নিয়ে এসেছিলাম তার সাথে আর কিছু ব্যাংক থেকে লোন তুলে আমি ফ্ল্যাট টি কিনেছি। কাপড়ের ব্যবসা করছি। সব মিলিয়ে এখন বেশ ভালোই আছি। আমি জীবনের ওই কালো অধ্যায়টাকে একদম ভুলেই গিয়েছিলাম। ওদের প্রতি যে একটা রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা ছিলো।ওদের প্রতি প্রতিশোধ নেওয়ার যে একটা তৃষ্ণা ছিলো সেটাও আমি একদম ভুলে গিয়েছিলাম।

কিন্তু ওদের প্রতি আমার মনের ভিতরে যে প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলছিল, সেটা আবার তুমি জাগিয়ে দিলে। তোমার সাথে ওরা যা করেছে সেটা কোন মানুষের কাজ না। আমার সাথে ওরা যে ধরনের অমানবিক কাজ করেছিলো সেগুলো তোমার সাথে যা কিছু করেছে তার কাছে কিছুই না। ওরা যেভাবে তোমার জীবন টাকে বিষময় করে তুলেছে, যেভাবে জহির ভাইয়ের মৃত্যুর পরে তোমাকে তোমার অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে, তোমার সন্তানদেরকে অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে এটা মেনে নেওয়া যায় না।

ওদেরকে শাস্তি পেতেই হবে। ওদেরকে নিশ্চয়ই আল্লাহ এর জন্য শাস্তি দিবেন। কিন্তু আমি নিজের হাতে ওদেরকে যদি কোনো শাস্তি না দিতে পারি তাহলে আমার অশান্ত মনটাকে কোনভাবেই আর শান্ত করতে পারবোনা।

শোভা! তুমি কোনোদিনই চিন্তা করবেনা যে তুমি এই পৃথিবীতে একা। আজ থেকে তোমার এই বড় ভাই সব সময় তোমার পাশে থাকবে। আমার কোন ছোট ভাই বোন নেই। আজ থেকে তুমি আমার ছোট বোন। তোমার সাথে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনার জন্য আল্লাহ ওদেরকে অবশ্যই শাস্তি দিবেন। তুমি দেখো, আমার কথা সত্যি হবে। তুমি শুধু অপেক্ষা করো। আজ থেকে তোমার সব ধরনের বিপদে আপদে আমাকে এবং পারভিনকে তোমার পাশে পাবে, ইনশাআল্লাহ।

পারভিনও জামিলের সাথে সায় দিল। শোভা আনন্দে আবেগাপ্লুত হয়ে পরলো।

সে বললো, জামিল ভাই আপনি আমার জন্য কিছু করেন আর নাই করেন, আপনি আমাকে যে সান্তনার কথা টুকু বলেছেন এটুকুই আমার জন্য পরম পাওয়া। এটুকুই বা আজকালকার জগতে কয়জনে করে বা কয়জনে বলে? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

– শোভা! আমি কথাগুলি বলার জন্য বলিনি। আজ থেকে তুমি সব সময় আমাকে একজন বড় ভাইয়ের মতো তোমার পাশে পাবে। এবং ওই শয়তান দের কে পরাজিত করার জন্য কি করা যায় সে নীলনকশা করার দায়িত্ব আজ থেকে আমার। তুমি শুধু আমার পাশে থেকো, আমাকে সাপোর্ট দিও।

– ঠিক আছে জামিল ভাই অনেক তো হলো আজ তাহলে উঠে অনেক রাত হয়ে গেছে। অনেকদিন পরে মন খুলে কারো কাছে কষ্টগুলোকে বলতে পেরে অনেকটা হালকা লাগছে বাচ্চা দুটির আবার সামনের সপ্তাহে পরীক্ষা। ভালো থাকবেন। আর খুব তাড়াতাড়ি আপনারা আমাদের বাসায় বেড়াতে আসার প্ল্যান করেন। অনেক গল্প হবে তবে সেই গল্পে কোন বেদনা থাকবেনা, আনন্দের গল্প হবে। আজ তাহলে উঠি!

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে