শোভা পর্ব-০৯

0
603

#শোভা
#পর্ব_৯

তিন ননদ আর আমার শাশুড়ির একের পর এক নাটকের সফলতা দেখে আমার ভিতরে ভিতরে এতদিনে জমতে থাকা ক্ষোভগুলি যেন আগুনের ফুলকির মতো ফুসে ফুসে উঠতে লাগলো। এভাবে চুপ করে আর কতদিন সহ্য করবো! মাঝে মাঝে আমি বিভিন্ন বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করলাম। ভেবে দেখলাম, যে অশান্তি দূর করার জন্য আমি মুখ বন্ধ করে থাকছি সে অশান্তিতো দূর হচ্ছে না! তাহলে শুধুশুধু মুখ বন্ধ করে থেকে আর কি লাভ!

জান্নাতের বয়স যখন আড়াই বছর হবে, তখন জিনাতের জন্ম হলো। জহির ধীরেধীরে ওর মা আর বোনদের কাছ থেকে আগের থেকে দূরে সরে আসতে লাগলো। ও হয়তো অনেক কিছু বুঝতে শুরু করেছিলো। এখন আর আগের মতো বোনদের সাথে বসে আড্ডা দিতো না। বাসায় যতটুকু সময় পেতো ততক্ষণ মেয়ে দুইটার সাথেই থাকতো। মুহিব আর বীনার মেয়ে আশার সাথে জান্নাতের প্রায়শই এইটা সেইটা নিয়ে ঝগড়া মারামারি লাগতো। ওর বোনেরা আর আমার শাশুড়ি সব সময়ই এ নিয়ে জান্নাতকে বকাবকি করতো। মাঝেমধ্যে ওরা জান্নাতের গায়েও হাত তুলতো। জান্নাত ওর বাবা আসলে তার কাছে কেঁদে কেঁদে আধো আধো বোলে নালিশ করতো!

– বাবা, মুহিব ভাই মারে শুধু আমাকে। আশা আপু আর ফুপিও মাইর দেয়! দাদিও মাইর দেয়! আমাকে খেলনা দেয়না, চকলেট ও দেয়না। ওরা ভালোনা! ওরা আম্মুকেও বকা দেয়। ওরা পচা।ওদের কাছে যাবো না।

জহির শুনে কষ্ট পেতো আমি বুঝতাম। সে বলতো, এটা বলেনা, মা। দাদি, ফুপি ভালো তো। তোমাকে কত্ত আদর করে! আমি তোমার জন্য দেখ কত্ত চকলেট এনেছি! দেখো!

– না, ওরা পচা। আমাকে আর আম্মুকে কখনো আদর করেনা। রুমের সামনে গেলে ওরা দরজা দিয়ে দেয়। আমাকে ঢুকতে দেয় না। ওরা পচা! ওদের কাছে আমি ও যাবোনা। তুমিও যাবেনা, আর বাবুটাও যাবেনা।

– ঠিক আছে, মা! আসো! আমি তোমাকে আদর দিবো।

আমার শাশুড়ি বা ননদেরা কখনো যদি এইগুলা শুনে ফেলতো তখন তো আর রক্ষা নেই। শুরু হয়ে যেতো আবার!

– হ্যা,হ্যা, আমরা আদর করিনা। আমরা ভালোনা। বেয়াদবের পেটে বেয়াদবই জন্মে। এইটুক মেয়ে সারাদিন মায়ের কাছে থেকে থেকে শিখছে শুধু মায়ের মতো শয়তানী বুদ্ধি। বড় হলে না জানি কি হবে?

– কণা, উল্টাপাল্টা কথা বন্ধ কর। ওরা যা দেখে তাই শেখে। বাচ্চারা কারো শিখানো কথা বলেনা।

– বাহ, ভাইয়া! তার মানে তোমার ওইটুকুন পুচকি মেয়ে যেটা বললো সেটাই সঠিক তাহলে। আমরা তোমার মেয়েকে মারি তাইতো? ভালোই বলেছো।

এরপরে শুরু হয়ে যেতো কাহিনী আর কাহিনী। আর সেই কাহিনী রচনায় আমি অংশগ্রহণ না করলেও মেইন ভিলেইন থাকতাম আমি।

ক্ণার জন্য বিয়ের ঘটকের সাথে কথাবার্তা চলছিল। হয় পাত্রপক্ষের কণাকে পছন্দ হয়, কণার তাদেরকে পছন্দ হয় না আর যাদেরকে কণার পছন্দ হয় তাদের আবার কণাকে পছন্দ হয় না। এভাবে একটার পর একটা সম্বন্ধ আসছিল আর ভাংছিল।

আর বীনার একটা মেয়ে নিয়েই সেই আগের মতো করে চলছিলো। সারাদিন বাপের বাড়ি রাতের বেলা শশুরবাড়ি।

যাই হোক এভাবে দুইমেয়েকে নিয়ে একই ভাবে চলছিলো আমার সংসার। জান্নাতের বয়স চার আর জিনাতের দুই এর কিছু বেশি চলছিলো।

তবে এর মধ্যে একটু শান্তি ছিলো যে, জহির মাঝেমধ্যে আমার হয়ে তার মা বোনদের সাথে মাঝেমধ্যে প্রতিবাদ করতো। জহিরের ব্যবসাও ভালোই চলছিলো। তাদের আগের বাড়ি ভেঙে সেই জমিতে আট তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে বাড়ির কাজ শুরু করেছে। দোতলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। তিনতলার কাজ চলছে। কণা আগের চাইতেও বেশি স্বাধীনভাবে ঘোরাফেরা করতো। আমার শাশুড়ি মাঝেমাঝে বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেও কোনো লাভ হতোনা। আর জহির ও ব্যস্ততার কারণে আর আগের মতো ঘরের কে কি করলো, কি না করলো সে সব দিক নিয়ে খোঁজখবর নেয়ার সময় পেতোনা।

একদিন আমাকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্য বাবুরা ঘুমিয়ে যাবার পরে জহির তার অফিসের ব্যাগ থেকে আমার জন্য পুরো একটা সোনার গয়নার সেট বের করলো। এর আগে এত দামি কিছু আমাকে কখনো দেয়নি। আমি তো অবাক! এত্ত কিছু!

– কি ব্যাপার! এত্ত কিছু একসাথে! এত টাকা কেনো নষ্ট করতে গেলে? বালা, কানের দুল, নেকলেস, সব একসাথে এনেছো। কত্ত টাকা নষ্ট হলো বলোতো! আমার কি এগুলি পড়ার সময় আছে বলো?

– আস্তে বলো! কেউ শুনবে। আমি কাউকে জানায়নি। বিয়ের সময় তো তেমন কিছুই দিতে পারিনি। তাই এখন কিছু টাকা পেলাম হাতে হুট করে ডিসিশন নিয়ে ফেললাম। অনেকদিন ধরেই প্লান করছি কিন্তু হচ্ছিলো না। তাছাড়া আমাকে তুমি দুই দুইটা মা আমার জান্নাত আর জিনাতকে দিয়েছো এতটুকুতো আমি তোমার জন্য করতেই পারি। তোমার জন্য তো কোনোকিছুই করতে পারলাম না। কোনোসময় যদি আমি না থাকি তাহলে এটা তোমার একটা সম্পদের মতো তোমার কাজে আসবে। এখানে প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার গহনা আছে। সাবধানে রাখবে।

আমার ওর এই কথা শুনে বুকের মধ্যে তুফান শুরু হয়ে গেলো। আমি হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলাম। জানিনা কেন সেদিন ও একথা বলেছিলো। আমার চোখদুটি দিয়ে তুফানের বেগে পানি গড়িয়ে পড়ছে যেন!

– এসব কথা কি বলছো তুমি? আল্লাহ আমার হায়াত তোমাকে দিক! আমি তোমাকে ছাড়া এই গয়না দিয়ে কি করবো? এসব কথা আর কোনোদিন মুখে আনবেনা। আমি চাইনা কোনো গহনা। শুধু তুমি এভাবে পাশে থাকলেই চলবে। আমি এই সংসারে শুধুমাত্র তোমার ভালোবাসা টুকু আছে বলেই এত বছর টিকে আছি। এমন কথা আর ভুলেও বলবেনা। বলতে বলতে আমি কাঁদতে কাঁদতে জহিরকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম।

– জহিরও আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,দূর পাগলি আমি কি এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছি নাকি! ওটা তো কথার কথা বললাম! এজন্য কাঁদতে হয়! আর আজ হোক বা কাল হোক আমাদের সবাইকেই তো একদিন চলে যেতে হবে! এজন্য এভাবে কাঁদতে হবে! আর আমি এত তাড়াতাড়ি যাচ্ছি না, আমার সুন্দরী বউকে একা রেখে! মনে করো না এত তাড়াতাড়ি তোমাদের মুক্তি দিয়ে দিচ্ছি!
আমি জানি এই বাড়িতে থাকতে তোমার অনেক কষ্ট হয়। সবার সাথে তোমার এডজাস্ট করতে একটু কষ্ট হচ্ছে! কিন্তু দেখো একসময় ওরাই বুঝতে পারবে যে তোমার থেকে ভালো বউ আমি আর কোনদিনও পেতাম না। আসলে বিয়ের পরে কেন যে মায়েরা, বোনেরা বোঝেনা যে ছেলের একটা আলাদা জগত থাকে। সেখানে তাদের একটা আলাদা অস্তিত্ব থাকে। হয়তো তুমি যখন শাশুড়ি হবে তখন তুমিও একই রকম করবে বলতে বলতে জহির হেসে উঠলো।

– কোনদিনও না আমি কোনদিনই আমার ছেলে বউয়ের সাথে এরকম ব্যবহার করবো না আমি জানি একজন মেয়ে অনেক স্বপ্ন বুকে নিয়ে শ্বশুর বাড়িতে পা রাখে। আমি ভেবেছিলাম ছোটবেলা মাকে হারিয়েছি আমি তোমাদের বাড়িতে এসে আমার মাকে পাব, আমি বোন পাব, কিন্তু আমার সে স্বপ্ন এরা পূরণ করতে পারেনি। আমি ঠিকই তোমার মাকে আমার মায়ের মত ভেবেছি, কিন্তু সে আমাকে মেয়ের মত জায়গা দেয়নি। যাইহোক যা পাবোনা তা নিয়ে বিলাপ করে আর কি হবে? এটা আমার দূর্ভাগ্য। আল্লাহর কাছে শুধু এতটুকুই আমার চাওয়া, তুমি যেন ঠিক এরকমই থাকো! কোনদিনও পরিবর্তন হয়ো না। এভাবেই ভালোবেসে যেয়ো আমাকে। তিনি তোমাকে সব সময় সুস্থতা দান করুক। আমি শুধু তোমার ভালোবাসার জোরেই এ বাড়িতে থাকতে পারছি জহির, বিশ্বাস করো!

– আসলে আমি মায়ের আর ওদের সাথে ছোটবেলা থেকে খুব বেশি এটাচ্ট ছিলাম দেখে হয়তো হঠাৎ করে আমি একটু দূরে সরে যাওয়াতে ওদের মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু দেখো, ধীরে ধীরে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। একটু সময়ের জন্য অপেক্ষা করো।

– আর কত, জহির! সাতটি বছর তো পেরিয়ে গেল। আর কত অপেক্ষা করতে হবে?

– আমার মায়ের মন-মানসিকতা অনেক ভালো। হয়তো তোমাকে মেনে নিতে তাদের একটু কষ্ট হচ্ছে। তার ইচ্ছে ছিল, তার পছন্দে আমাকে বিয়ে দেবে। কিন্তু আমি তোমাকে পছন্দ করেছি দেখে, শুধুমাত্র আমার পছন্দের জন্যই তোমাকে আমার জন্য বউ করে নিয়ে এসেছে। তার উপর রিনাকে নিয়ে মায়ের টেনশনের শেষ নেই। ওর বর সেই যে গেল আর কোন খোজ খবর নাই। সারাটা জীবন রিনা কি এভাবেই চলবে! তার উপর মুহিব বড় হচ্ছে! কি হবে ওর পিতৃপরিচয়? এসব নিয়ে মা সারাক্ষণই ভাবে।
এদিকে কনার বিয়ে নিয়েও সে টেনশনে। ওর জন্য ভালো পাত্র পাচ্ছি না। বয়স তো কম হলো না। লেখাপড়া সেই কবেই শেষ। সবই তো বোঝো একজন মায়ের ছেলেমেয়ের দের জন্য কত টেনশন থাকে, তুমি নিজেও একজন মা হয়েছ এখন! তুমি ও বুঝবে।
আসলে মা সবসময় এ সব নিয়ে ইনসিকিউরিটি তে ভোগে। এজন্যই হয়তো তার মেন্টালিটি একটু এরকমের। তাছাড়া তুমি শুনেছো কি না জানিনা,
বাবার যখন মৃত্যু হয় তখন আমার বয়স মাত্র পনেরো বছর! মায়ের বয়স ও খুব বেশি ছিল না ত্রিশ বত্রিশ এর মত হবে হয়তো। ওরা তিনজন তখন বেশ ছোট ছোট। বাবা একটা বেসরকারি চাকরি করতেন তাই সঞ্চয় ও তেমন বেশি ছিল না।
আমরা ভাড়া বাসায় থাকতাম। মাস গেলে কতগুলো টাকা ভাড়া, তার উপর আমাদের চার ভাই বোনের পড়াশোনার খরচ সব মিলিয়ে মা চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করল। আমাদের সংসার চলবে কি করে তাই বুঝে উঠতে পারছিল না মা।
আমাদের বাড়ির ওই জমিটাই ছিল তখন একমাত্র ভরসা। জমিটা আমার দাদার সম্পত্তি। অন্যান্য চাচা ফুপুরা তাদের ভাগের টা নিয়ে অনেক আগেই বাড়ি করে ফেলেছিলো। কিন্তু বাবার বেতন কম ছিলো বিধায় সে ওখানে কোন কিছুই করতে পারেনি। জমিটা খালি পরেছিলো।

জমি খালি পড়েছিলো দেখে আমার বড় চাচা বাবার কাছ থেকে বলে ওখানে একটা গ্যারেজের মতো করে ব্যবসা করছিলো। বাবা ওই জমি খালি পড়ে আছে অন্যরা দখল করে নিয়ে যাবে ভেবে বড় চাচার কথায় রাজি হয়ে গেলেন। সে সেখান থেকে কোন ব্যবসায়ের শেয়ার বা কোন লাভ কিছুই নিতো না। শুধুমাত্র কথা ছিল যে আমরা যখন বাড়ি করবো তখন চাচা জমিটা ছেড়ে দিবে।

বড় মামা মাকে বুদ্ধি দিল ওই জমিতে টিনশেড একটা বাড়ি করে থাকার জন্য। তাতে মাস গেলে অন্তত পক্ষে ভাড়ার হাত থেকে বাঁচা যাবে।
মা বড় চাচার কাছে গেলেন জমি খালি করে দেওয়ার কথা বলতে।
বড় চাচা মায়ের কথা শুনে যেন আকাশ থেকে পড়লো। সে মাকে বললো, এই জমি নাকি সে বাবার কাছ থেকে লিজ নিয়েছে দশ বছরের জন্য। বড় চাচার কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে গেলাম।মা পাগলের মত হয়ে গেলো। এসব কথা কি শুনছি।

আমরা বুঝতে পারলাম যে বড় চাচা জমি না ছাড়ার জন্য এসব মিথ্যে অভিনয় শুরু করেছে। বড় মামা সবকিছু শুনে বড় চাচার কাছে যেয়ে এটা নিয়ে অনেক তর্ক বিতর্ক করলো। কিন্তু কোনভাবেই জমি ছাড়ার কোনো ফয়সালা হচ্ছিলো না। এভাবে কেটে গেলো এক বছর। আমরা আগের বাসা ছেড়ে দিয়ে একটা কমদামি বাসায় যেয়ে ভাড়া উঠলাম। এদিকে বড় চাচার জমি ছাড়ার কোনো নাম নেই। তার একই কথা আমার বাবা জমি লিজ বাবদ যে টাকা নিয়েছে সেই টাকা দিলেই একমাত্র জমি ছাড়বে অন্যথায় দশ বছরের আগে নয়।

কিন্তু আমরা জানতাম যে বাবা চাচার কাছ থেকে বাবা কোন টাকা নেয় নি। তাহলে শুধু শুধু চাচাকে আমরা কেনো টাকা দিবো? এরপরে মামাদের সাথে নিয়ে মা অনেক মামলা-মোকদ্দমা করে জমিটা হাতে পেল। এর জন্য মাকে অনেক কষ্ট, দৌড়াদৌড়ি আর টাকাও খরচ করতে হয়েছিলো। জমিটা হাতে পাওয়ার পরে মা কোন রকম করে দুই রুমের ছোট একটা টিনশেড ঘর তুললো। মাস শেষে ভাড়ার টেনশন হতে মুক্তি পেল মা। বাবার জমানো যে কয় টাকা ছিল তা মামলা করে দৌড়াদৌড়ি করতে করতে প্রায় শেষ।

এরপরে আমাদের প্রাত্যাহিক সাংসারিক কাজকর্ম ছাড়াও সংসার চালাতে মাকে অনেক ধরনের কাজ করতে হয়েছে। মা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ব্যাগ সেলাই এর কাজ করতো। ফাঁকে ফাঁকে রান্নাবান্নার কাজ করতো। ঘরের সামনে যে ফাঁকা জায়গা ছিলো সেখানে ছোট একটা খামারের মতো করেছিলো। সেখানে হাঁস-মুরগি পালতো। ওগুলো দিয়েও কিছু পয়সা আসতো। এভাবে করতে করতে আমি এইচ এস সি শেষ করলাম। এইচ.এস.সি শেষ করার পরে আমি মায়ের কাছে ব্যবসা করার কথা বললাম। আমার এক বন্ধুর বাবার গার্মেন্টস এর বিভিন্ন যন্ত্রপাতির খুচরো পার্টস এর ব্যবসা করতো। তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ার পরে আমার বন্ধু এই ব্যবসাটি দেখাশোনা করতো। ওর কাছ থেকে আমি ওই ব্যবসার অনেক কিছুই শিখে ফেললাম। ওর সাথে আমি শেয়ারে ব্যবসা করার চাইলাম। ও রাজি হলো। কিন্তু এর জন্য বেশ কিছু টাকার দরকার ছিল। মায়ের কাছে এসে সব কিছু খুলে বললাম। মা নিজে গিয়ে আমার বন্ধুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সবকিছু খোঁজখবর নিয়ে দেখলেন যে না আমি অনেক কিছুই বুঝি এবং এই ব্যবসা করলে আমি হয়তো কিছু লাভ করতে পারবো। মা টাকা দেওয়ার জন্য আমাকে আশ্বস্ত করলেন। মার বেশ কিছু গয়না ছিল। মা এত কষ্টের মধ্যেও তার গয়নাগুলো কোন সময় বিক্রি করেনি। জমিয়ে রেখেছিলো হয়তো আমার তিন বোনের জন্য । কিন্তু আমার টাকা লাগবে দেখে সে তার সেই সব গয়না বিক্রি করে দিলো। ওই টাকায় শর্ট হয় দেখে মা তার বাবার বাড়িতে যে অংশটুকু ভাগে পেয়েছিলো সেটুকু মামাদের কাছেই বিক্রি করে দিল। এভাবে যোগাড় হলো আমার ব্যবসার পুঁজি। মায়ের দোয়াতে যে ব্যবসা আমি শুরু করেছিলাম সেই ব্যবসা থেকে কোনদিনও আমাকে আর পিছনের দিক তাকাতে হয়নি বেশ ভালোই চলছে। ধীরে ধীরে আমার ব্যবসার পরিসর এখন বড় হয়েছে। আমার সেই বন্ধু ওর শেয়ারের অংশটুকুও আমার কাছে বিক্রি করে দিয়ে বিদেশে চলে গেছে। এরপরে আমরা যে বাড়িটাতে থাকতাম ঐ বাড়ির কাজে হাত দেই। পরবর্তীতে এই ফ্ল্যাটটাও কিনলাম তা তো তুমি জানোই। তাহলে তুমি বলো, যে মা আমার জন্য এত কষ্ট করেছে, এত ত্যাগ স্বীকার করেছে, সেই মায়ের জন্য একটা ফ্ল্যাট কেন, একটা বাড়ী কেন, আমার পুরো জীবনটা লিখে দিলেও তো কম হবে! তাই নয় কি?
আমি জানি আমি বুঝি আমার মা আর বোনেরা তোমাকে পছন্দ করেনা! তারপরেও তোমাকে ওদের সাথে মানিয়ে চলতে হবে! কারণ, সে আমার মা! ওরা আমার বোন। ধীরে ধীরে দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।

– জহির, আমি সবই বুঝেছি। আমি বলছিনা কোনদিনই তুমি তোমার মাকে বা তোমার বোনদেরকে কষ্ট দাও। কিন্তু,ওরা আমার সাথে কেনো এমন করে? আমি কি অন্যায় করেছি? আমি তো সব সময় মা যেভাবে বলে, সেভাবে চলার চেষ্টা করেছি। তারপরও তো আমি তাদের মন পাইনি আজও। আমি কি এমন ক্ষতি করেছি তাদের? বলো? আর কবে তারা আমার জন্য একটু সহনশীল হবে? আর আমি না হয় তাদের জন্য পর কিন্তু আমার বাচ্চারা তাদের কি করেছে? আমার বাচ্চাদেরও তো কেউ দেখতে পারে না। এগুলো কেন? এগুলো তো আমি সহ্য করতে পারছিনা, জহির!

– আসলে তুমি কোনো অন্যায় করোনি। অন্যায় করেছি আমি। আগেই তোমাকে বিষয়টি বলা উচিত ছিল কিন্তু তুমি বিষয়টি কিভাবে নিবে এজন্য আমি এত বছর তোমার কাছে গোপন রেখেছিলাম। নাজমা কে তো তুমি চেনো। আমাদের বিয়ের দুই মাস পরে ওর বিয়ে হয়েছিলো। মা ওরা গিয়েছিলো ওর বিয়েতে গ্রামে, মনে পড়ে তোমার? আমার বড় মামার মেয়ে। আবার বীনার খুব ভালো বান্ধবী! বীনার সাথে খুব ভাব ছিলো একসময় ওর। এস.এস.সির পর গ্রাম থেকে এসে ভালো কলেজে পড়ার জন্য আমাদের বাসায় বসেই ও পড়াশোনা করতো। বীনার ক্লাসেই পড়তো । বিনা কে আমরা ভাল পাত্র পেয়ে এইচ এস সি র পরেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু নাজমার তখনো বিয়ে হয়নি। আমার জন্যই অপেক্ষা করছিলো। বড় মামা আমাদের বিপদের সময় অনেকভাবে সাহায্য করেছিলো দেখেই মা বড় মামার প্রতি সবসময় একটু দুর্বল। তাছাড়া নাজমাকে ও মা বেশ পছন্দ করতো। মার মনে মনে ইচ্ছা ছিল নাজমাকে আমার বউ করার। আমিও সেটা বুঝতাম। কিন্তু আমি নাজমাকে কখনো বোনের অতিরিক্ত কোন কিছুই চিন্তা করিনি। তাই আমার কাছে বিষয়টা মোটেই পছন্দ ছিল না। বড় মামারও মায়ের সাথে মত ছিলো। মা হয়তো ভেবেছিলো ব্যাপার টা আমার পছন্দ না হলেও কোনভাবে আমাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে নাজমাকেই এ ঘরের বউ করবে। এ নিয়ে মায়ের সাথে আমার কয়েকবার তর্কাতর্কিও হয়েছিলো। সত্যি কথা বলতে বড় মামার সম্পত্তির দিকেও মায়ের একটু নজর ছিল। বড় মামার আর কোন ছেলেমেয়ে ছিলোনা। নাজমাই তার একমাত্র মেয়ে। মামি অসুস্থ হয়ে পড়ার কারণে অনার্সের পরে নাজমা বাড়িতে চলে গেলো। কিন্তু মার আশা ছিলো যে নাজমাই হবে তার ছেলের বউ।

যাইহোক, এরপরে হঠাৎ করে কি মনে করে একটু রিল্যাক্সের জন্য সাদেকের সাথে গেলাম তোমার মামার বাড়িতে ঘুরতে। সেখানে গিয়ে তোমার সাথে পরিচয়। তোমাকে দেখে জানিনা আমার কি হয়েছিলো? তোমাকে দেখার পর থেকে আমার ভেতর থেকে কেমন যেন একটা অনুভব হতো। মাত্র এক সপ্তাহের পরিচয়ে তোমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে আপনজন মনে হতো। এরপরে যা হয়েছে তা তো তুমি জানো!

বাসায় এসে মা এবং ওদের কাছে তোমার কথা বলার পরে ওরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। মায়ের হাত পা ধরে তোমার জন্য অনেক কান্নাকাটি করলাম। ছোটবেলা থেকে আমি কোনোদিন মায়ের উপর দিয়ে কোনো কথা বলতাম না। আর মাও আমার কোনো কথা ফেলতো না। আমার মনে কষ্ট দিতে পারতো না। অনেক বুঝানোর পরেও অনেক কান্নাকাটি করার পরে মা আমার কথায় রাজি হলো। কিন্তু আমার তিন বোন কোনো ভাবেই রাজী হচ্ছিলো না। কিন্তু ওরা মায়ের উপরে আর কোন কথা বলতে পারলো না। যেহেতু মা আমার কথায় রাজি হয়েছিলো, সে ক্ষেত্রে ওদের আর বলার কিছুই ছিল না। হয়তো এজন্যই আমার ঘরের সবার তোমাকে মেনে নিতে একটু কষ্ট হচ্ছে কিন্তু বিশ্বাস করো এটা একসময় ঠিকই ঠিক হয়ে যাবে।

– সেই দিনের আশায় থাকতে থাকতে আমার অপেক্ষার প্রহর যে আর কাটছেনা, জহির!

– সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। এই তো আর কটা দিন!

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে