#শোভা
#পর্ব_৬
আমার শাশুড়ি আর ননদেরা যে কি ধরনের মানুষ সেটা আমি বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই টের পাওয়া শুরু করলাম। আমি বাসার মোটামুটি কাছাকাছি দূরত্বের একটা কলেজে ইংরেজি সাবজেক্টে অনার্স ভর্তি হলাম। ভর্তি হওয়ার পরে আমি এক সপ্তাহ ক্লাস করছিলাম রেগুলার। হঠাৎ করে আমার শাশুড়ি অসুস্থ হয়ে পরলেন। আমি উনি অসুস্থ দেখে আর কলেজে গেলাম না। ভাবলাম উনি সুস্থ হলে আমি আবার ক্লাস কন্টিনিউ করব। কিন্তু ওনার অসুস্থতা দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। ওটা আসলে ওনার অসুস্থতা ছিল না ওটা ছিল পুরোটাই অভিনয়। আমি যাতে কলেজে যেতে না পারি সেজন্যই ওনার এই অভিনয়। আমি প্রথম প্রথম বুঝতে না পারলেও কয়েক দিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে এটা আসলে ওনার অভিনয় ছিল। অসুস্থতা কিছুই না। উনি সারাদিন ভালই থাকেন। কেউ আসছে তার সাথে গল্প করছেন, মেয়েদের সাথে আড্ডা মারছেন, খাওয়া দাওয়া, চলা-ফেরা সবই ঠিক আছে। শুধুমাত্র সন্ধ্যার পরে জহির বাসায় আসার একটু আগে থেকেই শুরু হয় তার উরি মা, গেলাম গো! উরি বাবা, বাঁচাও গো! কি হবে আমার? কে কোথায় আছিস ? আমার একটা ব্যবস্থা কর? আমি আর মনে হয় বাঁচবো না! উরিবাবা! কেন আমার এমন হইলো? কি ব্যারাম হইলো আমার? এভাবে আর কতদিন? আর পারছি না! ওরে জহির কিছুতো কর! আমি অসহ্য হয়ে যাচ্ছি! আরো কত কি বলতে বলতে কান্নার রোল তুলে দিত! জহির সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে এসে তার মায়ের এই আহাজারি শুনে পাগলের মত হয়ে যেত। সে তার মায়ের কি করবে কি না করবে এইসব চিন্তা করতে করতে থাকতো । মা কে কি খাইয়েছো, ওটা দিয়েছো, এটা করেছ, সেটা করেছো, মাথায় পানি দিব কি, এটা করো, সেটা করো, ঔষধ খেয়েছো, ডাক্তার কি বলেছে, হাজার হাজার প্রশ্ন করতে থাকতো!
– কিরে বীণা! ডাক্তার কি বলেছে? তোকে না বললাম মাকে নিয়ে ভালো ডাক্তার কাছে যেতে! যাসনি? আমি তো সারাদিন ব্যস্ত থাকি জানিস না। তোকে না বলেছি নতুন একটা কাজের অর্ডার পেয়েছি। অনেক বড় ক্লায়েন্ট। আমি কারখানাতে না গেলে ওরা ঠিকমত কাজ করেনা। টাইম মতন ডেলিভারি না দিলে অনেক বড় একটা অ্যামাউন্ট হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই আমাকে ওখানে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকতেই হবে যে কোনো মূল্যে। আমি ওখান থেকে দুপুরবেলা খাওয়ার জন্য পর্যন্ত নড়ি না। কারখানাতেই খাচ্ছি। তুই কি মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাস নি? মা এত অসুস্থ কেন? তাছাড়া, আমিতো ডাক্তারের তেমন ভালো কিছু বুঝিও। কাকে দেখাবো না দেখাবো। সব সময় তুইই তো মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসা যাওয়া করিস।
– ভাইয়া! কি বলছো এসব কথা! মাকে নিয়ে গিয়েছি তো! মাকে দেখো কত ওষুধ দিয়েছে! এগুলো খাওয়াচ্ছি তো। কিন্তু ডাক্তার বলেছে এ ওষুধে কাজ না হলে মার অনেক টাকার টেস্ট করতে হবে। টেস্টের জন্য কালকে টাকা জমা দিতে হবে। তাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
– টাকা জমা দিতে হবে তাহলে টাকা জমা দে। টাকা নিয়ে কিসের সমস্যা? মায়ের কাছে তো গত সপ্তাহেও ত্রিশ হাজার টাকা রাখলাম। ওখান থেকে নিয়ে নিতি। আমাকে কি দরকার ! আজকেই টাকা জমা দিয়ে আসতি। কালকেই টেস্টগুলো করে ফেলতি। শুধু শুধু একটা দিন নষ্ট হলো।
– ভাইয়া মাকে সিটি স্ক্যান, এমআরআই এধরনের বেশ কয়েকটা টেষ্ট করতে হবে। তাহলে হাজার দশেক টাকা এখন নিচ্ছি। পরে লাগলে বলবো।
– আমাকে বলার কি আছে? যখন যা লাগবে ওখান থেকে নিয়ে নিস! আরো প্রয়োজন হলে আমাকে ফোন দিস! আমি টাকা পাঠিয়ে দিব।
– কি বলো ভাইয়া? তোমার টাকা খরচ করবো আর তোমাকে জানাবো না! এটা কোন কথা হলো! আর এখন তো আর আগের মত নাই সবকিছু! এখন তো তুমি বিবাহিত। তোমার বউ আছে, কয়দিন পরে তোমার বাচ্চাকাচ্চা হবে। তোমার ভবিষ্যৎ আছে না! আমরা তো এভাবে তোমার টাকা না বলে খরচ করতে পারিনা। দেখা যাবে দুদিন পরে তুমি আর সাথে তোমার বউও প্রশ্ন তুলবে এত টাকা কি করেছো? আমাদের তো শুধুশুধু ওসব ঝামেলায় জড়ানোর দরকার নাই। তাই তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে টাকা-পয়সা নেওয়া উচিত। টাকা-পয়সার লেনদেনে কখনোই কোনো লুকোচুরি করতে নাই।
– কিরে বীণা! তুই এসব কথা আবার কবে থেকে বলা শুরু করলি? মায়ের পিছনে টাকা খরচ করে ডাক্তার দেখাতে হবে আর আমি এসে টাকার হিসাব নিবো ভাবলি কি করে? তাও আবার তোদের কাছে? কোনদিন নিয়েছি কোন টাকা পয়সার হিসাব তোদের কাছ থেকে? আমার টাকা তো তোদেরই টাকা। পাগল হয়েছিস নাকি। যত্তসব কথা! আর আমার বউও কোনদিন তোদেরকে টাকা-পয়সার হিসাব জিজ্ঞেস করতে আসবে না। আমিও আসবো না তোরা নিশ্চিন্তে যেখানে যা লাগে খরচ কর। আমার মা তো শোভার ও মা। তাইনা শোভা?
আমি হালকা করে মাথা ঝাকিয়ে হ্যা সূচক সায় দিলাম।
– শোভা, এক কাজ করো আমি মায়ের জন্য ফল এনেছি। ওগুলো ব্লেন্ডারে দিয়ে জুস বানিয়ে মায়ের জন্য জুস বানিয়ে নিয়ে এসো। খেলে মায়ের শরীরে শক্তি পাবে।
– জহির, বাবা আমার ওই সমস্ত জুস ফুস লাগবে না। তুই একটু আমার পাশে বয়। আমি একটু তোর মাথায় হাত দিব। তুই একটু আমার পাশে বসলে আমার সব রোগবালাই দূর হইয়া যায়, আমার ভালো লাগে।
আমি খেয়াল করে দেখলাম টাকার ব্যাপারটা সেট হওয়ার পরে আস্তে আস্তে আমার শাশুড়ির কান্নাকাটি করার টা কমে আসলো।
– ওরে বাবা তুই তো অফিস থেকে এসে হাতমুখ ও ধুইসনি। আহারে সোনারে! যা যাহ, তাড়াতাড়ি হাতমুখ ধুইয়া নে। হাত মুখ ধুইয়া আগে কিছু খা। তারপর এসে আমার পাশে বসবি। যা তাড়াতাড়ি যা। এই রিনা! যা, ওর খাবার দে টেবিলে!
আমি বিয়ের দু’ তিনদিন পর থেকেই বাসার রান্নাবান্না করি ।ধীরেধীরে অন্যসব কাজও আমার শাশুড়ি নিজেই আমাকে বুঝিয়ে দেন। আর সংসারের সব কাজে আমাকে সাহায্য করার জন্য ছোট একটা মেয়ে থাকে। ও এই বাসাতেই থাকে। ওর মা, বাবা, ঠিকানা কিছুই নেই। বয়স বারো কি চৌদ্দ হবে হয়তো। জহির একদিন রাস্তায় বসে কান্না করতে দেখে নাকি সাথে করে নিয়ে এসেছে। সে আরো দুই তিন বছর আগে। সেই থেকে এরাই ওর সব। ওকে সাথে করেই সমস্ত কাজবাজ নিজেই করি। আর কোনো কাজের মানুষ ছিলোনা। আমি বাড়িতে বসে ছোটমাকে অনেক কাজে সাহায্য করতাম। তাই আমার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিলো। তেমন কষ্ট হতোনা। আমার শাশুড়ি বা ননদেরা উকি মেরেও দেখতোনা, সাহায্য করা থাক দূরের কথা। কিন্তু, একটা কাজ কখনই ভুল করতো না। টেবিলে ভাত দেয়ার কাজ সবসময়ই তাদের মধ্যে কেউ না কেউ একজন করে। আমি কোনোসময় শখ করে জহিরকে খাবার দিতে গেলে তারা না করে দেয়। জহিরকে খাবার দিয়ে পাশের চেয়ারে বসে থাকে। ওর কিছু লাগলে ওরাই তুলে দিতো। আমাকে ডাকতো শুধুমাত্র কোনোকিছু রান্নাঘর থেকে কিছু আনা লাগলে। প্রথম প্রথম ভাবতাম জহিরকে সবাই অনেক ভালোবাসে তাই হয়তো এমন করে। কিন্তু ধীরেধীরে আমার এই ভুল ধারণা দূর হতে থাকে।
যাই হোক, আমি জুস বানিয়ে নিয়ে আমার শাশুড়ির রুমের দিকে যাচ্ছি, হঠাৎ আমার ছোট ননদ কণার চাপা কণ্ঠে শুনতে পেলাম,
– দেখলে মা, মেজ আপা কি করলো! আমি বললাম আমার পুরো ত্রিশ হাজার টাকাই লাগবে। ও ভাইয়ার কাছে বললো,তোমার দশ হাজার লাগবে। বাকি বিশ হাজার কই পাবো? ত্রিশ হাজার না হলে ওরা আমার পোর্টফলিও করবেই না। ওরা অনেক কমার্শিয়াল।
– আরে গাধা! ওয়েট কর তুই পুরো টাকাই নিয়ে যা। ভাইয়া কি জানতে চায় নাকি কি খরচ হলো আর কি না হলো? ওটা তো বলার জন্য বললাম। ওটাতো ভাইয়ার কাছে একটু শোনালাম। আর বলে ও তো রাখছি শুনিসনাই যে আরো লাগতে পারে।
ও মা! তুমি সকালে উঠেই আমার সাথে আমার বাসায় যাবা। সন্ধ্যায় বাসায় আসলেই চলবে। ওর বউ যাতে বুঝে তুমি ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলে। আর হ্যা, তোমার আগের রিপোর্ট গুলি বের করে রেখো। ভাইয়া দেখতে চাইলে দেখাবা।
– মেজ আপু, ওটায় তো ডেট দেয়া আছে?
– আরেহ! ভাইয়াকে যা বলবো তাই! ভাইয়া কি দেখতে আসে নাকি? যাস্ট শো অফ! বুঝিস না!
– হুম, বুঝলাম! কিন্তু মেজ আপু, আমরা কিন্তু এইবার একঢিলে দুই পাখি মারলাম খেয়াল করেছো? আমার পোর্টফলিওর জন্য টাকাটা ও অ্যারেঞ্জ হয়ে গেলো আর ওদিকে ভাবির কলেজে যাওয়াও বন্ধ করলাম। হুররে! মাকে এই রকম অসুস্থ রেখে ভাইয়া কোনোদিন ওকে কলেজে যেতে দিবেনা এইটা তুমি শিওর থাকো।
– আস্তে বল! দেয়ালেরও কান থাকে। জহির বা শোভা শুনে ফেলবে!
– ঠিক আছে, মা। তুমি টাকাটা দাও। আমি আবার ভোরবেলা বের হবো। দোয়া করো এইবার যেন সাক্সেস হই।
– হুম, দোয়া তো করি। খালি টাকা নষ্ট করিস। কি পোর্টফলিও না কোন কচু বানায় আর দুই দিন বাদে বাদে টাকা। ভালো লাগেনা। এই কিন্তু শ্যাষ আর দিতে পারবো না। এই বয়সে এই সমস্ত রুগী সাজার অভিনয় করতে কষ্ট হয় বুঝলি। এমনিতে প্রেসার হাই থাকে সবসময়।
আমি এতক্ষণ এসব শুনে অবাক হয়ে গেলাম। সবই তাহলে শুধু টাকার জন্য নাটক। ওরা চায় না যে আমি পড়াশুনা করি! তাহলে ভর্তির সময় যে জহিরের সামনে আমাকে খুব উৎসাহ দিলো সবাই, সবই তাহলে ওদের জহিরকে দেখানো। ছোট বেলা থেকে ছোট মায়ের অভিনয় দেখতে দেখতে বড় হয়েছি। তাই, ওদের অভিনয় ধরতে খুব বেশি সময় লাগলো না। ওরা তাহলে শুধু জহিরকে ভালোবাসে এই টাকার জন্য? কিন্তু আমি তো ছোট মায়ের নিজের মেয়ে না, জহিরতো ওদের আপন। তাইলে ওরা এমন করছে কেন? কিছুই মাথায় আসছেনা। আমি অনেক কষ্টে কান্না আগলে রাখলাম। আমি আর ভিতরে গেলাম না। খুশি কে দিয়ে জুসের গ্লাস পাঠালাম।
আমি আর খুশি সবার শেষে ভাত খাই। খুশি বললো,
– ভাবি, আফনে আওনের ফর আমার আর এল্লা এল্লা ভাত খাওন লাগেনা। আফনের লগেই খাইতাম ফারি। ফয়েলা এল্লা খাইত বইতাম আর ডরের ঠেলায় ভালা কইরা খাইত ফারতাম না। আর আমনে আওনের ফর আমার আরো ম্যালা উফকার অইছে, ভাবি!
– আমি মৃদু হেসে বললাম, আচ্ছা! আর কি কি উপকার করছি তোর ?
– ভাবি, কি যে কয়েন! আগে সারাদিন একলা একলা হেগো সব কাম হরন লাগতো। এহন অবশ্য আমার চাইত হেগোই উফকার বেশি অইছে।
– কেমন?
– আগে তো হেগো ফাকের গরে ফাকশাক কইরতে আইতো। এহন তো আর লাগেনা। আগে অবশ্য একজন খালায় কাম কইরতো। ঘর মুছতো আর কাফুর ধুইতো।
– সে কই এখন?
– আফনের যে মাসে এই বাড়িত আইলেন সেই মাসেই বাদ দিয়া দিচে।
– কেনো? কাজ বাজ পারতো না?
– ফারতো তো। খালা আমারে কইলো, বউ আইব দেইহা আমারে বাদ দিয়া দিলো। বউয়ে আইলে নাকি সব কাম দেইখফ।
– তোর ভাইজান জানেনা?
– খালাম্মায় ভাইজানরে কইছে, খালায় নিজে কাম ছাইড়া গেছে?
– ওহ! বুঝেছি। খা! অনেক রাত হইছে! সবাই ঘুমাই পড়ছে। আচ্ছা, খুশি তোর ছোট আপায় কি চাকরি করে জানিস কিছু!
– নাহ! তয় ছুড আফায় ম্যালা ছবি তুলে। এইহানে ওইহানে যাইয়া যাইয়া ছবি তুলে। কি সোন্দর ছবি! মাঝেমদ্দে হেই ছবি এই টেবিলের উফরে বিছাইয়া আমগোরে দেহায়। সবাই হেই ছবি দেইহা মজা ফায়। তয় ভাইজানরে কইত মানা। আফনে আবার ভাইজানরে কইয়া দিবাম না তো?
– কেনো! তোর ভাইজান কে বললে কি হবে?
– ভাইজানে মানা কইরছে এই ছবি তুইলতে।
– ও বুঝেছি। যা তুই ঘুমা। বলবো না।
– থাল বাসুন ডি ধোওন লাগতো না?
– আমি ধুয়ে নিবো। তুই যা! অনেক রাত হয়েছে!
– আইচ্ছা।
আমি দুয়ে দুয়ে চার মিলাচ্ছিলাম। ছবি তুলে, আবার কি যেন পোর্টফলিওর কথা বলেছিলো। তাহলে, কণা মডেলিং করে। প্রায়ই ভোরে বের হয় আর রাত বারোটার দিকে বাসায় আসে তবে সেটা জহিরকে বুঝতে দেয়া হয়না। ওর রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে আমার শাশুড়ি কে কয়েকদিন দেখেছি জহির জিজ্ঞেস করলে বলে, কণা ঘুমাই গেছে। কিন্তু, আমি তো জানি কণা ফিরেনাই। আমার শাশুড়ির কড়া নিষেধ আমদের কোনো বিষয়ে জহিরের কাছে কুটনামি করবানা। তাইলে সংসারের শান্তি ধ্বংস হইয়া যাবে। আর এর জন্য তুমি দায়ি থাকবা।
আমিও শাশুড়ির কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালাম।
রাতে শোয়ার সময় পেটের মধ্যে কথাগুলি জহিরের কাছে বলার জন্য গুড়্গুড় করছে। কিন্তু, সাহস পেলাম না। আমি ভালো করেই জানতাম যে, আমি নালিশ করলে আমার শাশুড়ি আমাকে আস্ত রাখবেন না। তা আমি তাদের ভাবভঙ্গি আর কথাবার্তা শুনেই বুঝতে পেরেছি। আমি মুখ বন্ধ করে থাকাটাকেই শ্রেয় মনে করলাম।
এভাবে একের পর এক কাহিনী চলতে থাকতো ও বাড়ি তে। জহির কিছুই টের পেতো না।
আমার বড় ননদ রিনা বিয়ে হইছে সাত বছর আগে। একটা বাচ্চা ও আছে, মুহিব। পাচ বছর বয়স। ভালো ঘর দেখে বিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু স্বামী নাকি জুয়াখোর, নেশাগ্রস্ত ছিল। তাই দুই বছরের বেশি সংসার টেকেনি! আমার শাশুড়ি নাকি একরকম জোর জবরদস্তি করে তার মেয়েকে ওই সংসার থেকে নিয়ে এসেছে। সব খুশির কাছেই শোনা আমার। তখন মুহিবের বয়স নাকি ছিল এক বছর। এরপরে নাকি কয়েকবার আমার ননদের জামাই রিনাকে ফিরিয়ে নিতে এসেছিল, কিন্তু আমার শাশুড়ি কোনোভাবেই তার মেয়েকে ওই ঘরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি। আর রিনা ও যেতে চাইনি। ওই ভাবেই আছে। এরপরে আর ওদের কোনো দেখা সাক্ষাত ও নেই, যোগাযোগ ও নেই। আর ওদের যতদূর জানি, ডিভোর্স ও হয়নি। তাদের কথাবার্তা শুনে যেটা বুঝলাম আর কি!
আমার শাশুড়ি আর ঘরের সবার কলিজার অর্ধেক হলো তার ছেলে মুহিব। মুহিব যদি একটু ব্যাথা পায় তাহলে মনে হয় ওর থেকে আমার শাশুড়িই বেশি ব্যাথা পায়। মুহিব একদিকে আর তার পৃথিবী আরেকদিকে। ও মুখ থেকে চাওয়া মাত্র সবকিছু হাজির হয়ে যায়। আমার উপরে কড়া নির্দেশ যেন কোনদিন কোন ধরনের কষ্ট আমি না দেই তাদের আদরের নাতীকে। যা কিছু চাইতো চাওয়ার সাথে আমাকে সেগুলো রেডি করে দিতে হতো। আর ছেলেটা অনেকটা হয়েছে মা, খালা আর নানীর মত। একগুয়ে স্বভাবের। যখন যেটা চাই তখন সেটা দিতেই হবে। না দিলে ঘরদোর ভেঙেচুরে একাকার করে দেয়। একদিন আমি আমার শাশুড়িকে বললাম, বাচ্চাদের মধ্যে জিদ থাকে। কিন্তু সেটাকে কন্ট্রোল করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদের। আমরা যদি ধীরে ধীরে সেটাকে না ঠিক করি তাহলে দেখা যাবে বড় হয়ে এ অভ্যাস ছাড়তে পারবেনা। তখন বিশাল বড় ধরনের প্রবলেম তৈরি হবে। এ কথার পরে আমার শাশুড়ি এ কথা শুনে যে রিয়েক্ট করলো তাতে জীবনে আমি আর ওই ছেলের বিষয়ে কোন ধরনের নীতি কথা শোনানোর জন্য রাজি ছিলাম না।
উনি বললেন, আমার নাতি কি করে, কি না করে, সমস্যা করে সেটা নিয়া তোমার মাথা ব্যাথার করার দরকার নাই। যত বড় সমস্যাই হোক যতদিন ওর নানি বেঁচে থাকবে ততদিন এটা নিয়ে কাউকে চিন্তা করতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো যেয়ে।
এইতো গেলো বড় ননদের গল্প। আমার মেজো ননদ বীনা। ওর ও বিয়ে হয়েছে রিনার বিয়ের দু বছর পরে। স্বামী ব্যবসা করে। স্বামী তার বউয়ের কথায় উঠে আর বসে। বউয়ের ঝাড়ি মারলে সে তিনবার চিৎ হয়ে পড়ে টাইপের পুরুষ। শাশুড়ি আর বউ সারাদিন ঝাড়ির উপর রাখে। শুধুমাত্র নামেই শ্বশুরবাড়ি গেছে,কিন্তু সে দেখা যায় যে মাসের ত্রিশ দিনের ত্রিশ দিনই থাকে তার বাবার বাড়িতে মায়ের কাছে। শশুর আছে, শাশুড়ি আছে, কিন্তু তাদেরকে দেখার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না বলে দিয়েছে। তাই শ্বশুর-শাশুড়ি গ্রামে যেয়ে মেয়ের বাড়িতে থাকে। সারাদিন পড়ে থাকে আমাদের বাসাতে। ওর একজন মেয়ে আছে। মেয়ের বয়স দেড় বছরের মত হবে। তাকে নিয়েও আমার শাশুড়ির আদিখ্যেতার শেষ নাই সেগুলো বলতে শুরু করলে সারাদিনেও আমার কাহিনী শেষ হবে না। নাতি-নাতনি কে নিয়ে তার সেকি সারাদিন হৈ-হুল্লোড়! আর আদিখ্যেতা! ওদের ফরমায়েশ খাটতে খাটতে মাঝেমাঝে মেজাজটা গরম হয়ে যেত। বীনা সারাদিন এ বাড়িতেই থাকতো। রাতের বেলা জামাই আসলে একসাথে সবাই খেয়ে দেয়ে তারপরে বাসায় যেত। পরদিন সকালবেলা ঠিক আবার জামাই অফিসের জন্য বের হলেই চলে আসতো আমাদের বাসাতে। এভাবেই তার দিনকাল যেত।
এবার বলে ছোট ননদ কনার কাহিনী। বয়স কম হয়নি। আমার থেকে দুই এক বছরের বড় থেকে ছোট হওয়ার কথা না। তার বিয়ের কথা কেউ এখন পর্যন্ত চিন্তাও করে না। আমার শাশুড়ি আর ওদের মতে কোন এখনো কচি খুকি। চেহারা খুব একটা বেশি সুন্দর না। গায়ের রং শ্যামা বর্ণের। তবে গঠন খুব বেশি ভালো না। কিন্তু নিজেকে মনে করত সিনেমার কোনো নায়িকার থেকে কোন কিছুতেই কম নয়। সারাদিন যত সময় বাসায় থাকত তার ততক্ষণ মুখে এইটা মাখায়, সেইটা মাখায়! চুলে এটা লাগায়, সেটা লাগায়! তার লাগানোর যেন শেষ নেই! আর ওগুলো রেডি করতে ও আমার বারোটা বাজতো। নিজে থেকে কোনো কিছু করত না। সবকিছু আমাকে অথবা খুশি কি দিয়ে করাতো। এই ডাল বাটো, এই হলুদ বাটো, ডিম ফেটো, মেথি বাটো! আরো কত কি! বাটাবাটি যেন শেষ নেই! কোথা থেকে কোথা থেকে কি পাতা নিয়ে আসতো সাথে বিভিন্ন ধরনের ফল,সবজি! এ সমস্ত বেটে বেটে সারাদিন মুখে লাগানোই তার কাজ, আর একটা কাজ ছিল। তা হলো সারাদিন ফোনে কথা বলা। সে এত আস্তে আস্তে কি কথা বলতো কাছে থেকেও কোন কিছু শুনতে পেতাম না। আর বেশিরভাগই দেখা যেত ফোন আসলে রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে কথা বলতো।
সকালবেলা ভোরে যেত আর সন্ধ্যার পরে বা কোন দিন রাত বারোটা একটা বেজে যেত বাসায় ফিরতে ফিরতে। সারাদিন পর ক্লান্ত হয়ে ফিরতো জহির। রিনা বা বীণা কেউ একজন ওকে খাবার বেড়ে দিতো। খেয়ে দেয়ে বিছানায় যেয়ে ঘুমানোর সময় হয়তো ওর সাথে আমার টুকটাক কথাবার্তা হতো। কিন্তু আমাদের মাঝে খুব বেশি গল্প হতো না। যদি কোনদিন একটু তাড়াতাড়ি সন্ধ্যার দিকে চলে আসতো ও। সন্ধ্যার চা নাস্তা খাওয়ার পরে আমার সাথে বসে একটু গল্প করতে চাইতো, অমনি ওর বোনেরা কেউ বা মা এসে সেখানে আমাদের সাথে বসে যেত। গল্প জুড়ে দিতো সেটা আমার রুমেই হোক বা যেখানেই হোক। আমাদের একান্ত ভাবে একসাথে কথা বলার খুব বেশি সময় হয়েছে বলে আমার মনে পরেনা।
ওই বিছানায় যেয়ে দরজা বন্ধ করার পরে দু-একটা যা কথা। আমি ধীরে ধীরে বুঝতে পারি যে ওরা আসলে চায় না যে আমি আর জহির একান্ত ভাবে একটু সময় কাটাই। বিয়ের পরে বাপের বাড়ি গিয়েছি হাতে গোনা দুই একবার। তাও খুব বেশি দিনের জন্য না। মাঝে মাঝে জহির বাইরে যাওয়ার জন্য প্ল্যান করতো যে কোথাও নিয়ে আমাকে ঘুরতে যাবে। কিন্তু, দেখা যেত আগে-পিছে আমার শাশুড়ি কোন কিছুই বলতো না। কিন্তু, ঠিক যাওয়ার আগ মুহূর্তে কোনো না কোনো নাটক সাজাবে। যে নাটকের কারণে আমাদের বাইরে যাওয়ার প্ল্যান টা বাতিল করতে হতো। অথবা ওরা তিন বোনের কেউ-না-কেউ আমাদের সাথে যাবে বলে বায়না ধরত। এরপর আমি এটা বুঝতে পারার পর থেকে জহির কোথাও নিয়ে যাওয়ার চাইলেও আমি আর রেসপন্স করতাম না। বিয়ের বছর খানেক পরে একদিন আমার শাশুড়ি আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে জোরে জোরে কাকে যেন বলছে, আজকাল কি যুগ জামানা আসছে! আমরা তো শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাসুরের সামনে স্বামীর সাথে কথা কইতেই লজ্জা পাইতাম। আর আজকালকার বউয়েরা দরজা লাগাই ঘুমায়। লজ্জা-শরম দুনিয়া দিয়ে উইঠা গেছে।
এরপর থেকে আমি রাতে শোয়ার সময় কখনই দরজায় ছিটকিনি লাগাতাম না। হালকা করে দরজাটা চাপিয়ে রাখতাম। আর পর্দাটা টেনে দিতাম। একদিন জহির জিজ্ঞেস করলো, কি ব্যাপার? তুমি দরজা দিচ্ছো না যে? তখন আমি তাকে বললাম যে, মা বাইরে থাকে! কিনা কি মনে করে! আমরা দরজা দিয়ে ঘুমাই। মায়ের কথা বলার পরে দেখলাম জহির আর কোন কথা বললো না। সে শুধু বলল, ঠিক আছে যেটা ভালো মনে করো।
সৎ মায়ের সংসার বড় হয়েছি। আমি জানি সংসারে অশান্তি কাকে বলে। তাই আমি চাচ্ছিলাম না যে আমি আমার শাশুড়ি আর জহির এর সাথে কোন ধরনের অশান্তি বাধুক। তাই ওনাদের অনেক কথা বলতে গেলে কোন কথাই আমি জহিরের কাছে কোন সময় লাগাতাম না। জহির এর দিক থেকে আমি কখনো ভালোবাসার কমতি পায়নি এই কঠিন পরিস্থিতিতেও সে তার সাধ্যমত চেষ্টা করেছে আমাকে ভালোবাসার। সে আমাকে কখনই কোনভাবে ছোট করে দেখেনি। তাছাড়া বিয়ের প্রথম দিকেই জহির আমাকে বলে দিয়েছে যে আমার মা আর বোনেরা যা বলবে সব সময় তা মাথা নত করে শোনার চেষ্টা করবে। কারন আমার মা হচ্ছে আমার জান্নাত! আমি আমার মায়ের বিরুদ্ধে কোনো কথা তোমার মুখ থেকে যেন কোনদিন না শুনি! আর আমার মাকেও যেন না দেখি তোমার বিরুদ্ধে কোনো নালিশ করতে! আমি চাই তুমি দুইয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করে চলবে। এবং আমি জানি তুমি সেটা পারবে। তোমার মধ্যে এই গুণটা আছে দেখেই আমি তোমাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। তোমাকে ভালবেসেছি! তুমি পারবে দেখেই আমি তোমাকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছি।
আমি খেয়াল করে দেখেছি আমি যদি সারাদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমার শ্বশুর বাড়ির সবার ফরমায়েশ মুখ বন্ধ করে সহ্য করি, সেদিন তারা খুব খুশি! যদি কোনদিন আমি কোনও কারনে শারীরিক অসুস্থতার কারণ হোক বা যে কোন কারণে হোক কোন কাজে যদি একটু গাফিলতি করি তাহলে আমার শাশুড়ির কথা শুনতে শুনতে সেদিন আমার দিন ফুরিয়ে যেত।
আমার বিয়ের সাত আট মাসের মাথায় ছোটমামার সাথে একবার আভা বেড়াতে এসেছিল। ওই একবারই এসেছিল আমাদের বাসায়। এসে এক সপ্তাহ ছিল। আভার সাথে আমার শাশুড়ি আর ননদেরা ওর উঠাবসা, খাওয়া-দাওয়া সবকিছুতে এমন ব্যবহার করত যেন আভা আমার বোন না ওই বাড়ির কাজের মেয়ে খুশির বোন। আমি যতটা সম্ভব চেষ্টা করতাম আভাকে ওনাদের সামনে কম পাঠাতে। আর আভার কাছে আমি এগুলো লুকানোর চেষ্টা করতাম। ও যাতে বুঝতে না পারে সেভাবে থাকার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ও তো অনেক চালাক ও সবকিছুই ঠিকই বুঝত। ও আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপু! আমার তো মনে হয় তুই বাড়িতে যে অবস্থায় থাকতি, এখানে তার চাইতেও খারাপ অবস্থায় থাকছিস! তুই কিভাবে থাকছিস? এখানে তো তোর দুই পয়সারও দআম নেই। এখানে তোর দম বন্ধ হয়ে যায় না? দুলাভাই ছাড়া ওরা তো কেউই তোর সাথে সারাদিন একটু ভালো ব্যবহার করে না, মন খুলে কথাও বলেনা। সারাদিন দরজা দিয়ে কয় মা বেটি মিলে শুধু ফুসুরফাসুর ।
আমি হেসে দিয়ে বললাম কই আমি তো ভালোই আছি। কি উল্টাপাল্টা বুঝছিস তুই!
আমার লেখাপড়া চলছিল কোনোরকম নামের নাম। আমি হয়তো মাসে একদিন কি দুদিন কলেজে যেতে পারতাম। তাতেও আমার শাশুড়ি অখুশি হয়ে যেত। সারাদিন গাধার মত খাটুনির পরে আর মন চাইত না রাতের বেলা বারোটার পরে ঘুমানোর সময় আর একটু পড়তে বসি।
আমার বিয়ের প্রথম প্রথম ছোট মামা মাঝে মাঝে আমার শ্বশুর বাড়িতে আসতো। কিন্তু আমার শাশুড়ি আমার মামাকে দেখে এমন ধরনের মুখ করতো, এমন ধরনের বিহেভ করতো যে তাতেই আমার ছোট মামা যা বুঝার বুঝতে পেরেছিল। আমি আসলে কেমন সংসারে এসে পড়েছি। মামা মাঝে মাঝে আমার কাছে ক্ষমা চাইত। খুব আফসোস করতো। বলতো, মারে আগেও দু’একবার আমি জহিরদের বাসায় গিয়েছি কিন্তু তখন ওর মা বোনের যে রূপ দেখেছি সেটা ছিল অন্যরকম। কিন্তু সোহেলের মামাশ্বশুর হয়ে তাদের বাড়িতে যাওয়ার পরে তোর শাশুড়ির বিহেভিয়ার দেখে ও বাড়িতে যেতে আমার এখন লজ্জা হয়। তাছাড়া আমি আভার কাছে যা শুনেছি তাতে মা আমার কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আমি জেনেশুনে তোকে কোথায় রেখে এলাম। কিন্তু আমি মামাকে বুঝিয়ে বলতাম, মামা আমার জন্ম থেকেই আমি এরকম পরিবেশে থেকে বড় হয়েছি তাই আমার জন্য এটা কোন সমস্যাই না। তুমি শুধু শুধু নিজেকে দোষ দিবা না। আমি ভালোই আছি। আভার তো বাড়াই বলার স্বভাব জানোনা।তবে মামা, তুমি শুধু জহিরকে আমার লেখাপড়া টা একটু করার সুযোগ করে দিতে বলো, মামা।
জহিরকে সেদিন মামা কি বলেছিল জানি না। তবে ওইদিন সন্ধ্যায় জহির তার মায়ের কাছে যেয়ে মাথা নিচু করে বলল,
– মা, একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম?
– হ্যাঁ, বাবা বল। একটা কথা কবি, এরকম করার কি আছে? কইয়া ফেল।
– মা! কণা, রিনা, বীনা ওদের মত শোভাও তোমার একটা মেয়ের মতো, তাইনা! মা, কনাও তো লেখাপড়া করছে। তো শোভা যদি লেখাপড়াটা শেষ করতে চায়, সেই সুযোগটুকু কি আমরা ওকে দিতে পারি না?
– কেন! তোর বউকে কি আমরা লেখাপড়া করতে দিচ্ছি না। তুই তোর বউকে ভর্তি করছিস। আমরা কখনো কিছু কইছি। তুই তো পুরাই আমাদের দোষ দিতেছিস। ওরে বাবারে! আমার জহির দেখি আজকাল বউয়ের কথায় কথা বলে। আমার শাশুড়ি হৈচৈ শুরু করে দিলো। সাথে তার মেয়েরাও।
– না, মা! তুমি যেটা বুঝতে পারছ সেটা বলিনি! তুমি ওকে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিচ্ছো! কিন্তু ও তো কলেজে যেতে পারছে না। দুপুরবেলা রান্নাবানার দায়িত্বটা যদি রিনা নিত, তাহলে হয়তো ও ক্লাসটা ঠিকমত করতে পারতো। তাছাড়া, রিনা তো সারাদিন বসেই থাকে। আর ও একা না পারলে সাথে বীনা থাকে, আর কণাও মাঝে মাঝে বাসায় থাকে। ওরা একটু সাহায্য করলেই তো হয়। সামনে ওর পরীক্ষা। ও তো সারা বছর কিছুই পড়েনি। একদম যদি কিছু না পারে তাহলে ও পরীক্ষা দিবে কি দিয়ে?
– জহির, কি বলছিস তুই এ সব! তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? ওদের দুজনের কোলে ছোট ছোট বাচ্চা! ওরা কিভাবে ওর কাজ করবে? তাছাড়া কণাতো কলেজে যায়। কত লেখাপড়ার চাপ ওর। ওর এত সময় হবেনা ঘরের কাজে সাহায্য করার। আর আমি তো অসুস্থ তুই তো জানিসই আমি চুলার কাছে গেলে আমার প্রেসার হাই হয়ে যায়। আমার পক্ষে আর বুড়ো বয়সে কাজবাজ করা সম্ভব না।
পাশ থেকে তার বোন রিনা বলে উঠলো,
– ভাইয়া, তুই এমন ভাবে কথা বলছিস, মনে হচ্ছে আমরা কোন কাজই করি না। সারাদিন সব কাজ তোর বউই কি করে? আমি মুহিবকে স্কুলে ভর্তি করছি! ওকে নিয়ে আমার স্কুলে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। বাসায় পড়াতে হয়। আর তাছাড়া স্কুল থেকে আসার পরে তো আমি যতটুকু পারি তোর বউয়ের সাথে কার সব কাজে সাহায্য করি। এমন ভাবে কথা বলছিস মনে হচ্ছে তোর বউই সারাদিন সব কাজ করে। আর আমরা পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খালি তোর বউকে কাজ করাই। ভালোই বলছিস। ভেবেছিলাম, তুই অন্য ভাইদের থেকে আলাদা। কিন্তু নাহ! তুই ঠিকই তোর রং দেখিয়ে দিলি। বলতে বলতে আমার ননদ কান্নাকাটি করে একাকার।
এদিকে আমার শাশুড়িও সে চিৎকার-চেঁচামেচি কান্নাকাটি করে একাকার! দুইদিন ধরে আমাদের বাসায় তুলকালাম অবস্থা। কেউ কারো সাথে ভালোভাবে কথা বলে না। আর ওদের মুখের দিকেতো তাকানোই যায়না। জহির ভয়ে এ বিষয়ে আর কোন কথাই বললো না। আমি বুঝতে পারলাম যে, আমি লেখাপড়া করলে এ ঘরে অশান্তি বেড়েই চলবে। তাই লেখাপড়া করার স্বপ্ন ওই পর্যন্তই বাদ দিয়ে দিলাম। বললাম, জহির আমি আর পড়তে চাই না। আসলে আমার মধ্যেই লেখাপড়ার কোন উদ্যোগ নেই। শুধু শুধু ঝামেলা বাড়ানোর দরকার নেই। তুমি চিন্তা করোনা। জহির হয়তো কিছু বুঝতে পারলো। শুধু একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস। নিলো। কিছুই বললো না।
এভাবেই শেষ হয়ে গেল আমার লেখাপড়ার স্বপ্ন!
চলবে………