রূপকথার ম্যাজিশিয়ান পর্ব-০১

0
3586

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_1

(গল্পের প্রতিটা চরিত্র, প্রতিটা ঘটনা কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে এর কোনো মিল নেই।)

অলোকপুর গ্রামের লোকজন দুপুরের পর থেকেই সকলে একাধারে ছুটে যাচ্ছে বাজারের দিকে। বাজারের শেষ মাথায় পাঁচদিনব্যাপি বিশাল মেলা বসেছে। মেলায় মানুষের ভীর যেন উপচে পড়ছে। মেলার কাজে দায়িত্বরত ছেলেগুলো শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। ভীর তো হবেই, শহর থেকে বড় ম্যাজিশিয়ান আসবে যে জাদু দেখাতে। বড়-ছোট সকলেই উৎসাহ নিয়ে বসে আছে জাদু দেখার আশায়।

গ্রামের মেম্বার রজত হাওলাদার মেলার একটা দোকানে বসে পান চিবোচ্ছেন। লোকটার বয়স পঞ্চাশ পেরিয়েছে রাজনীতি করতে করতে অথচ এখনো সে মেম্বারই রয়ে গেছে।

সে দোকানের পাশে পিচকারি ফেলে পানের দোকানি হাশেম মিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে, “বুঝলা হাশেম, শহরের পোলাডারে আকরাম চেয়ারম্যানের বাড়িতে থাকবার ব্যবস্থা করছি, শহুরে মানুষ কি আর টিনের ঘরে থাকবার পারবো কও?”

হাশেম মিয়া পান বানাতে বানাতে উত্তর দেয়, “ভালা করছেন মেম্বারসাব, চেয়ারম্যানের দালান ঘরে থাইকা আরাম পাইবো।”

রজত হাওলাদার পান চিবুতে চিবুতে পুনরায় বলে, “পোলাডার বয়স কিন্তু বেশি না, চব্বিশ কি পঁচিশ হইবো। তয় সে এতোবড় জাদুকর, তার দেখভাল তো ভালা কইরাই করন লাগবো।”

হাশেম সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলে, “লাগবোই তো, হাজার হইলেও এইডা আমাগো গেরামের ইজ্জতের ব্যাপার।”

তার জবাবে রজত হাওলাদার চিন্তিত কন্ঠে বলে, “কথা একখানা কইছো হাশেম, তয় আমার খালি চিন্তা হয় চেয়ারম্যানের বখাটে পোলাডার লিগা। হেই পোলা তো যেই জালিমের জালিম না জানি কখন কি কইরা বসে।”

তার কথায় কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছে হাশেম মিয়ার। সেও খানিকটা চিন্তিত কন্ঠে বলে, “পাঁচটা দিনের তো ব্যাপার, কোনোমতে কাটাইতে পারলেই হইলো। তয় অহন কথা হইলো, হেই মিজিশিয়ান কোনহানে? জাদু দেখাইবার বেলা তো হইয়া আইলো।”

তার কথায় দ্রুত উঠে দাঁড়ায় রজত হাওলাদার। মুখ থেকে পান ফেলে দিয়ে বলে, “মিজিশিয়ান না রে হাশেম, ঐডা ম্যাজিশিয়ান। তয় কামের কথা মনে করছো। খাঁড়াও আমি খবর লইয়া দেখি আইলো নাকি।”

মেম্বার সাহেব মাঠের ভেতর দিয়ে ছুটে চলে চেয়ারম্যানের বাড়ির উদ্দেশ্যে। চেয়ারম্যান বাড়ির দড়জায় কড়া নেড়ে ডাকে, “ও চেয়ারম্যান ভাই, আছেন নাকি বাড়ি?”

ভেতর থেকে সিগারেট হাতে বেড়িয়ে আসে চেয়ারম্যানের ছেলে পলাশ। সে রাগি স্বরে বলে, “কি হইছে মেম্বার চাচা? এমন চিল্লান ক্যান ?”

হাতের সিগারেট আর উগ্র অঙ্গভঙ্গি দেখে বিরক্ত হয় রজত হাওলাদার। নিজেকে সামলে বলে, “তোমার আব্বা কই?”

সিগারেট মুখে দিয়ে দুইটা টান দিয়ে পলাশ উত্তর দেয়, “আব্বা তো স্টেশনে গেছে, জাদুকর ছেড়াডারে আনবার লিগা।”
______________________________

গ্রামীণ রাস্তা দিয়ে ক্যারক্যার শব্দ করে ভ্যানগাড়ি এগিয়ে চলেছে অলোকপুর বাজারের দিকে। আরজান গম্ভীর মুখে বসে আছে ভ্যানের ডান পাশে, বাম পাশে বসেছে চেয়ারম্যান আকরাম মিঞা। রাস্তার ইটগুলো ভেঙে গুড়ো-গুড়ো হয়ে লাল ধুলোয় ছেয়ে গেছে রাস্তার পাশের বাড়িগুলোর টিনের চাল। রাস্তার একধার দিয়ে বেয়ে চলেছে সরু,লম্বা এক জলাশয়।

অসহ্য লাগছে আরজানের। মায়ের কথা শুনে এখানে আসাটাই তার ভুল হয়েছে। মা বলেছিলো গ্রামের সবকিছু নাকি অনেক সুন্দর হয়ে গেছে এখন। এই ভাঙাচোরা রাস্তা আর ক্যারক্যার করা ভ্যানগাড়ি নাকি সুন্দর? খানিক বিরক্ত হলেও কন্ঠ নরম করে পাশে বসা লোকটাকে জিজ্ঞেস করে, “আর কতক্ষণ ?”

চেয়ারম্যান হাসিমুখে জানায়, “এইতো চইলা আইছি বাজান, আর একটু সবুর করো।”

আরজানের বিরক্তভাব কিছুটা কমে আসে লোকটার অমায়িক ব্যবহারে। সে আবার বলে, “আপনি তো গ্রামের চেয়ারম্যান, আপনাকে আমি কি বলে ডাকবো?”

“আমারে তুমি আকরাম চাচা বইলা ডাইকো।”

তখনই ভ্যানচালক লোকটা বলে ওঠে, “বাজারে চইলা আইছি চেয়ারম্যানসাব। আর আগাইতে পারমুনা, সামনে ম্যালা ভীর।”

চেয়ারম্যান ব্যস্ত স্বরে বলে, “ভ্যান থামা দেখি।”

ভ্যান থেকে নেমে দাঁড়ায় আরজান। চারদিকে লোকজন গিজগিজ করছে। এটাই হয়তো গ্রাম্যমেলার সৌন্দর্য। লাল আর কমলা রঙের কাপর দিয়ে ঘেরা হয়েছে বৃহৎ একটা জায়গা। চা-পানের দোকান থেকে শুরু করে ভাজাপোড়ার দোকানও নজরে আসছে। মেলার মাঠের শেষ প্রান্তে স্টেজ বানানো হয়েছে কাঠ দিয়ে। কাঠের উপর সবুজ কাপড় বিছিয়ে দিলেও কোনা কোনা দিয়ে কিছুটা কাঠ নজরে আসছে।

তাদের দেখতে পেয়ে মেম্বার রজত হাওলাদার এগিয়ে আসে। তাদেরকে সাথে করে নিয়ে পৌছে দেয় স্টেজ পর্যন্ত। আরজান স্টেজে উঠে আসে জাদু সরঞ্জাম নিয়ে, জনতার হৈচৈ তীব্র হয়। রজত হাওলাদার ও আকরাম মিঞা এগিয়ে গিয়ে বসে স্টেজের উপর রাখা প্লাস্টিকের চেয়ারগুলোতে। রজত হাওলাদার ফিসফিসিয়ে বলে, “এতো দেরি হইলো ক্যান আপনাগো? বেলা পইড়া যাইবো তো।”

আকরাম মিঞা বুক পকেটে ভ্যানচালকের ফিরিয়ে খুচরো টাকাগুলো রাখতে রাখতে বলে, “রাস্তার অবস্থা তো ম্যালা ভালা, দেরি তো হইবোই।”

রজত হাওলাদার তার দিক থেকে নজর সরিয়ে ইশারা করে আরজানকে। ইশারা পেয়ে সে মুচকি হেসে হাতে তুলে নেয় একটা কাগজের টুকরো। কাগজটাতে আলতো ফু দিতেই তা রঙ-বেরঙের বেলুন হয়ে উড়ে যায় আকাশে। উত্তেজনায় চিৎকার করে ওঠে গ্রামের লোকজন। সে আবার একটা লাঠি হাতে নিয়ে দুবার ঘোরাতেই তা অদৃশ্য হয়ে যায়। লোকজনের উত্তেজনা আরো তীব্রতর হতে থাকে, হৈ-চৈ আরো বেড়ে যায়।

একের পর এক জাদু প্রদর্শন করতে থাকে আরজান। হটাৎ তার নজর গিয়ে পড়ে কিয়ৎ দূরের প্রায় জনশূন্য একটি জায়গাতে। যেখানে ছোটো একটা তেরো/চৌদ্দ বছরের মেয়ে একা একা দাঁড়িয়ে জাদু দেখছে। পড়নে সবুজ ফ্রক, পায়ে কোনো জুতো নেই। শ্যামবর্ণের মেয়েটার মাথায় সোনালি চুল বেশ হতবাক করে আরজানকে। সে বিড়বিড়িয়ে বলে, “এতো ছোট একটা মেয়েকে এই ভীরের মধ্যে একা ছেড়ে দিয়েছে? কেমন বাবা-মা কে জানে!”

সে পুনরায় জাদুতে মনোনিবেশ করে। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই তার নজর গিয়ে পড়ে সেই একি স্থানে। মেয়েটা সেখানে নেই। কোথায় গেল? বাবা-মা হয়তো নিয়ে গেছে। আর ভাবে না সে।

জাদু শেষ করে ডান হাতে জাদুর সরঞ্জাম নিয়ে নেমে আসে আরজান। চেয়ারম্যান এগিয়ে এসে বলে, “বাকি ট্যাকা কি আইজ নিবার চাও?”

খানিক অবাক হয় আরজান। অর্ধেক টাকা আগেই নেয় সে আর বাকিটা জাদুর শেষে কিন্তু মেলা তো শেষ হয়নি। আরো চারদিন বাকি এখনো। অবাক স্বরে বলে, “অর্ধেক টাকা তো আগেই দেওয়া হয়েছে, বাকিটা যাওয়ার আগে দেওয়ার কথা।”

“তোমারে দেইখা ভালা মনে হইতাছে। তুমি আইজ নিলেও নিবার পারো।”

“তার প্রয়োজন নেই। যেরকম কথা হয়েছিল সেরকম দিলেই হবে।”

মুখে এমন বাক্য বললেও মনে মনে বেশ বিরক্ত আরজান। গ্রামের লোকজনের এই সরলতার কারনেই একসময় প্রাণ গিয়েছিল তার বাবার। সেই থেকে সে দু’চোখে দেখতে পারেনা এসব সরলতা। মাকে নিয়ে কবেই পাড়ি জমিয়েছে শহরে। বাবার শেখানো জাদুবিদ্যা তাকে গড়ে তুলেছে জাদুর মেশিং। তার উদ্দেশ্য শুধু টাকা নিয়ে, তা নাহলে সে কোনোদিন আসতো না এই গ্রামে। মা মাঝে মাঝে বাড়ি দেখতে আসলেও সে আর আসেনি এই গ্রামে। ইট-পাথরের শহরটাকেই নিজের করে নিয়েছে । কত বছর পর আবার পা রাখতে হয়েছে এই গ্রামে। ১০টা বছর, কম তো নয় এই সংখ্যা। দশ বছরে কত কিছু বদলে গেছে গ্রামের। ঘিয়ে রঙা শিকদার বাড়িটি কি আগের মতোই আছে?

আকরাম মিঞার কথাতে ধ্যান ভাঙে তার। ভ্যান এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। আকরাম মিঞা বলে, “বাজান চলো।”

“হুম, চলেন।” এতটুকু বলেই ভ্যানে উঠে বসে আরজান।
কিছুক্ষণের ব্যবধানেই ভ্যান এসে থামে আকরাম চেয়ারম্যানের বাড়িতে। বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে। কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে একটু একটু করে। একটু পরেই হয়তো আজানের ধ্বনি ভেসে আসবে মসজিদ থেকে।

আরজান ভ্যান থেকে নেমে নিজের জিনিসপত্র চেয়ারম্যানের হাতে দিয়ে বলে, “আমি একটু সামনের মাঠ থেকে ঘুরে আসি।”

চমকে যায় আকরাম মিঞা। ভীত স্বরে বলে, “এই গেরামে জ্বীন-পরী আছে বাজান, রাইতে দরকার ছাড়া বাইর হইয়োনা।”

আকরাম চাচার কথায় ভ্রু কুচকে তাকায় আরজান। তাকে কিনা জ্বীন-পরীর ভয় দেখাচ্ছে? গ্রামের লোকজন আর কুসংস্কার ছেড়ে বেরোতে পারলো না। কিঞ্চিত বিরক্ত স্বরে বলে, “রাত কোথায় চাচা? এখনো মাগরিবের আজান হয়নি।”

“শীতকালের বেলা তো আগে আগেই ডুইবা যায়। ডর করতাছে শেষ বেলায় তোমারে একা ছাড়তে। আমি কি যামু তোমার লগে?”

এবার বেশ বিরক্ত হয় আরজান। সে একটু একা একা গ্রামটা ঘুরে দেখতে চাইছে। এই গ্রাম কী তার জন্য নতুন নাকি! হয়তো বদলে গেলে সবকিছু, তাই বলে কি সে চিনে নিতে পারবেনা!

তাকে উপেক্ষা করে মোবাইল হাতে বেরিয়ে পড়ে আরজান। মাঠের মধ্যে জমির আইলের উপর দিয়ে হেটে চলে সামনের দিকে। তার জানামতে কিছুটা এগোলেই বিশাল সেই সাদা বিল পাবে। বিল জুরে সাদা রঙের পদ্ম ফুলে ছেয়ে থাকায় তার নাম দেওয়া হয়েছে ‘সাদাবিল’। এই বিলের পানির গভীরতা অনেক।

ছোঠ বেলায় বাবার সাথে সে প্রায়ই আসতো এই বিলে পদ্ম তুলতে। বাবার মুখে গল্প শুনেছে এই বিলে নাকি বহু আগে ‘জলপরি’ বাস করতো। তবে লোকজনের বসতি বৃদ্ধির কারনে ধীরে ধীরে বিলের আয়তন কমে আসে। হারিয়ে যায় বিলের পূর্বের সৌন্দর্য। জলপরির দেখা কোনোদিন পায়নি গ্রামের লোকজন তবুও তাদের ভীতি কমেনা এই বিল নিয়ে। আবার একদল লোক সাহস করে বিলের পাশে লুকিয়ে থাকতো জলপরির দেখা পেতে। দেখা না পাওয়ায় ধীরে ধীরে কমে আসে জলপরির গুজব।

ভাবনার মাঝেই পৌছে যায় কাঙ্ক্ষিত স্থানে। দ্রুত বিলের পাড়ে এগিয়ে যায় সে। অনেক বছর পরে আবার দেখতে পাচ্ছে সেই সাদাবিল। তবে অনেকটা বদলে গেছে বিলের চিত্র। আগের মতো আর বিশাল নেই বিলের আয়তন, অনেকটাই কমে এসেছে। সেই সাথে বিলের চারপাশের জমির আয়তন বৃদ্ধি পেয়েছে। বিলের একধার দিয়ে সারি সারিভাবে খেজুরের গাছ লাগানো হয়েছে। গাছগুলোর আকারে বোঝা যাচ্ছে বেশ পুরোনো গাছ। গাছগুলোর উপরিভাগে কিছুটা ছেঁটে নিয়ে সেখানে মাটির হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। হয়তো রস সংগ্রহের জন্য।

তার ভাবনার মাঝেই বিলের পানিতে বেশ শব্দ করে কিছু একটা ঝাঁপিয়ে পড়ে। চকিতে তাকায় আরজান, “কি পড়লো ওখানে? এই ভর সন্ধ্যায় গ্রামের লোকজন তো বিলের ধারে কাছেও আসার কথা নয়।”

চলবে???

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে