রূপকথার ম্যাজিশিয়ান পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0
1404

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_31

দিন-দুপুরে আকাশের নীলচে আভা বিলীন হয়ে সেখানে নিজের স্থান গড়ে নিয়েছে কালো মেঘ। প্রবল বেগে ঝড়ো হাওয়া বইছে চতুর্দিকে। খানিক পরপরই শ্রবণগোচর হচ্ছে বজ্রপাতের বিকট শব্দ। অগোছালো হয়ে উঠেছে গাছপালাগুলো। হাওয়ার বেগে তাল হারিয়ে এদিক-ওদিক দুলছে মাঠের ফসল। বিশাল বিশাল গাছগুলোর ছোট ছোট শুকনো ডাল, পাতা দিক ভুলে আছড়ে পড়ছে টিনের চালে। অসময়ের এই তান্ডবলীলা কীসের ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে? হয়তো কারোর কঠিনতর বিষন্নতার সাক্ষী দিচ্ছে প্রকৃতি নিজ নিয়মে। বৃষ্টি আসবে বুঝি আজ জোর কদমে!

শিকদার বাড়ির পুকুর পাড়ে চেয়ার পেতে বসে আছে কেউ বিষন্ন মনে। চোখ-মুখে তার কালো আঁধার। দৃষ্টি সীমাবদ্ধ পুকুরের টলমলে পানির দিকে। বাতাসের প্রকোপে মৃদু দুলছে পুকুরের পানি। ঝড়ো বাতাসে এলোমেলো হয়েছে তার চুলগুলো। দিকহীন এই বাতাস ধুলোবালি উড়িয়ে এনে মাখিয়ে দিচ্ছে চোখে-মুখে। তবুও সে নির্বিকার। কঠিনভাবে বজায় রেখেছে নিজের স্তব্ধতা। সুন্দর চোখদু’টি লালচে বর্ণ ধারন করেছে। পড়নের ধূসর বর্ণের শার্টটার বেহাল দশা। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ো হাওয়ার সাথে প্রতিযোগিতায় নামে ঝিরঝির বৃষ্টি। বৃষ্টির ফোঁটা চোখে এসে লাগতেই চোখদুটো বন্ধ করে নেয় সে। বৃষ্টির পানির সাথে গড়িয়ে পড়ে তার অশ্রুকণা। হাতঘড়িটা এতো তাণ্ডবের মাঝেও টিকটিক করে সরিয়ে দিচ্ছে সময়ের কাঁটা।

বৃষ্টির বেগ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিজে চুপচুপে তার শরীর। ভেজা শার্টটা চিপকে গেছে শরীরের সাথে। ভেজা চুপচুপে চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। তার দৃষ্টি পূর্বের ন্যায় স্থির। ঝড়-বৃষ্টির প্রবল তোলপাড়ও তার এই কঠিন নীরবতা ভাঙতে সক্ষম নয়। সে স্থির, সে নির্বিকার, তার বিষাদ রাঙা মুখমণ্ডলে নেই কোনো প্রতিক্রিয়া। বিকট বিকট বজ্রপাতও যেন তার ধ্যান ভাঙাতে অক্ষম।

তখনই চিন্তিত ভঙ্গিতে বারান্দার কোনায় এসে দাঁড়ায় সোফিয়া শিকদার। পুকুরপাড়ের দিকে কয়েকবার উঁকিঝুঁকি মেরে দৌড়ে চলে যায় ঘরের ভেতর। হাতে বিশাল একটা ছাতা হাতে নিয়ে ছুটে যায় পুকুরের দিকে। আজ সাতটা দিন হলো ছেলে তার মূর্তির ন্যায় আচরন করছে। ঠিকমতো খায় না, ঘুমায় না, রাত-দিন সব ভুলে বসে থাকে ঐ পুকুরপাড়ে। রূপকথাকে দিয়ে সেই যে এলো সাতদিন আগে তারপর থেকেই ছেলেটার এমন পরিবর্তন। তার মনে পড়ে যায় সাতদিন পূর্বের কথা। যেদিন তার ছেলে বিধ্বস্ত হয়ে পা রেখেছিল সদর দরজায়। সাথে ছিলো না রূপকথা। বারকয়েক জিজ্ঞাসা করার পরেও কোনো উত্তর মেলেনি তার থেকে। বর্তমানে সে সব চিন্তা ফেলে ছুটে গিয়ে ছাতা ধরে আরজানের মাথায়। বাতাসের কারনে ছাতা ধরে রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।

“আরজান”

আচমকা ডাকে চোখ তুলে তাকায় আরজান। মাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, “এই বৃষ্টির মাঝে তুমি এখানে কী করছো মা? ঘরে যাও। ভিজে ঠান্ডা, জ্বর বাঁধবে।”

আমলে নেয় না সোফিয়া শিকদার বরং চিন্তিত স্বরে বলে ওঠেন, “ঠান্ডা, জ্বর আমার একার বাঁধবে না। দেখি ওঠতো। ঘরে যাবি আমার সাথে।”

মায়ের থেকে নজর সরিয়ে পুনরায় পুকুরের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আরজান। বৃষ্টির কারনে পুকুরের পানি খলবলিয়ে উঠছে। তার মস্তিষ্ক বারংবার আশা বাঁধছে এই বুঝি তার সমস্ত ব্যথার অবসান ঘটিয়ে পানির বুক চিরে উঠে আসবে তার জলরূপসী। তার ভাবনার মাঝেই সোফিয়া শিকদার তাড়া দিয়ে বলেন, “আবার ওদিকে কী দেখছিস? ভিজে যাচ্ছি তো আমি।”

চকিতে ফিরে তাকায় আরজান। হ্যাঁ, মা ঠিকই বলেছে, ভিজে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। মায়ের হাতের পাশে হাত রেখে আঁকড়ে ধরে ছাতাটা। মায়ের মাথার দিকে ছাতাটা এগিয়ে দিয়ে বলে, “ঠিকঠাকমতো ছাতাটা ধরো আর ঘরে চলো। আমার ছাতা লাগবে না। আমি তো পুরো ভিজেই গিয়েছি। তাড়াতাড়ি চলো।”

অমত করেন না সোফিয়া শিকদার। দ্রুত পায়ে হেঁটে যান ঘরের দিকে। মায়ের সাথে পায়ে পায়ে হাঁটছে আরজান। বারান্দায় পৌঁছাতেই ছাতাটা বন্ধ করে বারান্দার খুঁটির সাথে ঝুলিয়ে দেন সোফিয়া শিকদার। আরজানের দিকে চেয়ে দেখে সে চুল ঝাড়তে ব্যস্ত। তিনি তাড়াতাড়ি একটা গামছা এনে আলগোছে মুছে দেন চুলগুলো। অতঃপর তাড়া দিয়ে বলেন, “ঘরে যা। তাড়াতাড়ি জামাকাপড়টা বদলে নে। ভেজা শরীরে বেশিক্ষণ থাকলে জ্বর বেঁধে যাবে।”

ঘরে চলে যায় আরজান। ভিড়িয়ে দেয় দরজাটা। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চিন্তায় মগ্ন হয়ে পড়েন সোফিয়া শিকদার। তার জানা নেই কী করলে ছেলে তার এই বিমর্ষতা ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। আরজান বুঝতে দিতে না চাইলেও সে তো মা। সে ঠিকই বুঝতে পারে রূপকথাকে ছাড়া ভালো নেই তার ছেলে। কতগুলো দিন বাদে ছেলে আবার হাসতে শিখেছিল। নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছিল। মেয়েটা সত্যিই জাদু জানতো। কতো অল্প দিনেই সকলের হৃদয়ে নিজের জন্য জায়গা করে নিয়েছিল। ভালোবাসা সৃষ্টি করেছিল নিজের জন্য। এক নিমেষেই আবার সব শেষ। হারিয়ে গেল তার সমস্ত সুখের ঠিকানা। মেয়েটাই বা কোথায় কেমন আছে তাও তার অজানা। বোধহয় ভালোই আছে। চিন্তা ফেলে দ্রুত রান্নাঘরে ছোটে সে। ভাত-তরকারি বেড়ে নেয় একটা প্লেটে। আরজান দরজা খুলতেই সে প্লেট নিয়ে হাজির হয় তার ঘরে। টেবিলের উপর প্লেট রেখে জগ থেকে পানি ঢালতে ঢালতে বলেন, “এখানে একটা চেয়ার টেনে বসে যা তো। মাছ রান্না করেছি, খেয়ে নে।”

“তুমি আবার এগুলো আনতে গেলে কেন? এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। পরে খাবো।”

ধমকে ওঠেন সোফিয়া শিকদার, “সকাল থেকে খাসনি আবার পরে কখন? এখনি খেতে হবে। তোর জন্য আমিও খাইনি সকাল থেকে।”

এবার আর দ্বিমত করে না আরজান। চেয়ার টেনে বসে যায় মায়ের পাশে। সোফিয়া শিকদার ভাত মেখে তার মুখের সামনে ধরতে ধরতে বলে, “এমন কেন করছিস বলতো?”

ভাতের লোকমা মুখে পুরে নেয় আরজান। কী বলবে মাকে? সে যে স্বস্তি পাচ্ছে না কোনোকিছুতে। অস্বস্তি লাগছে তার। বুকটা কেমন ভার হয়ে আসছে। সে শান্তি পাচ্ছে না কোনোকিছু করেই। পুনরায় শুধায় সোফিয়া শিকদার, “আবার কী ভাবতে বসলি?”

“রূপ ভালো নেই, মা।” আনমনে বলে আরজান।

চকিতে তাকায় সোফিয়া শিকদার। ব্যস্ত স্বরে শুধান, “ভালো নেই মানে? তোর সাথে যোগাযোগ হয় ওর? তুই না ওকে নিরাপদ জায়গায় রেখে আসলি তাহলে আবার এসব বলছিস কেন?”

“জানিনা আমি, কিছুই জানিনা। ভুল করে ফেললাম বোধহয়।”

হতবুদ্ধির ন্যায় চেয়ে থাকেন সোফিয়া শিকদার। হঠাৎ এসব কী বলছে আরজান! মেয়েটা ঠিক আছে তো! নাকি এসব শুধুই আরজানের ভ্রান্ত কল্পনা।

গভীর সমুদ্রের কোনো অজানা লুকায়িত স্থানে অদ্ভুত রকমের এক শেকলে আটকে তড়পে চলেছে কোনো মৎসকন্যা। তাকে ঘিরে হাজার হাজার মৎসমানব ও মৎসকন্যার সমাগম। সকলের মধ্যমণি শেকলে আটকে থাকা মৎসকন্যা। যাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে এই সমাজের নিয়মভঙ্গের অপরাধে। খুনের আসামির চেয়েও বোধহয় বড় অপরাধ করে ফেলেছে সে! যার কোনো ক্ষমা চলে না। মৎসকন্যা হয়ে এক মানবের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে সে! এর চেয়ে অলক্ষুনে কথা আর কী হতে পারে! এই সমাজের সর্বপ্রথম এবং শক্তিশালী একটি নিয়ম হলো কোনো মৎসকন্যা বা মৎসমানব ভুলেও কোনো মানুষের সংস্পর্শে আসতে পারবে না। সেখানে বিবাহ! এই অপরাধের চেয়ে বড় অপরাধ বোধহয় আর হয় না। এই সমাজের নিয়ম এতোটাই কঠোর যে কেউ যদি শ্যামবর্ণা সন্তান জন্ম দেয় তাকে জনসম্মুখে হত্যা করা হয় এই সমাজকে অভিশপ্ত করার অপরাধে। সেই সাথে সেই শ্যামবর্ণা বাচ্চাকে গুপ্ত স্থানে আটকে রাখা হয় দশ বছর বয়স পর্যন্ত। অতঃপর তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় দূরে কোথাও। যেখান থেকে সে নিজের পঁচিশ বছর পূর্ণ হলেই ফিরতে পারবে তবেই তার অভিশাপ কাটবে।

এই মৎসকন্যা ফিরে তো এসেছে নিজের অভিশাপ কাটিয়ে তবে করে এসেছে সবচেয়ে বড় অপরাধ। এক মানুষকে বানিয়েছে নিজের জীবনসঙ্গী। তাইতো তার শাস্তি দেখতে সকলের এতো উৎসাহ। সকলের সম্মুখে তাকে শাস্তি প্রদান করা হবে যেন দ্বিতীয়বার এই অপরাধ করার দুঃসাহস কেউ না দেখাতে পারে। সমগ্র সমাজের নিয়ম ভঙ্গ করেছে সে। তার শাস্তি নেহাত কম হবে না। মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। তবে সেটা নির্ভর করে তার শাস্তি সহ্য করার ক্ষমতার উপর। একমাস তাকে এই শেকলে বদ্ধ করে রেখে নির্দিষ্ট সময়ে তাকে আঘাত করা হবে রোজ নিয়ম করে। সে যদি সহ্য করে থাকতে পারে তবেই তাকে একমাস পর মুক্ত করা হবে অন্যথায় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে।

শেকলের ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে আছে এই সমাজের সবচেয়ে বৃদ্ধা এবং প্রধান মৎসমানবী। যাকে বলা হয়ে থাকে দাদিমা। তার উপস্থিতিতেই এখানে সমস্ত কর্ম সম্পাদন হয়ে থাকে। সে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে শেকলে আবদ্ধ মৎসকন্যার দিকে। যে কি-না ব্যাথা-বেদনায় নিজের মাথাটা নুইয়ে আছে। মুখের বিভিন্ন স্থান কেটে রক্ত চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে তার সোনালি চুল বেয়ে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে সৃষ্টি হয়েছে গভীর ক্ষত। শেকলে আবদ্ধ হাতদুটো কালচে হয়ে উঠেছে রক্ত জমে। নড়াচড়ার শক্তি খুইয়ে বসেছে সে। পড়ে আছে একটা জীবন্ত লাশের ন্যায়। মৃত্যু বোধহয় তার খুব নিকটেই অবস্থান করছে।

দাদিমাকে নিজের দিকে আসতে দেখে মাথা তুলে তাকায় রূপকথা। চোখদুটো তার গাঢ় লাল রং ধারন করেছে। ঠোঁট ফেটে বেরোনো রক্তটুকু শুকিয়ে গেছে ঠোঁটের উপরেই। দাদিমাকে দেখে ফিচলে হাসে সে। তার বাবা-মায়ের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল এই দাদিমা অথচ সে জানতোই না। দশটা বছর যখন সে বদ্ধ ছিল তখন শুধু এই দাদিমাকেই দেখেছিল সে নিজের কাছে। তাইতো বোকার মতো ভেবে বসেছিল দাদিমা বুঝি তাকে ভালোবাসে। অথচ একবারও বুঝতে পারেনি সেই সমস্ত নিয়মনীতির মূলে রয়েছে। তার হাত ধরেই সংঘটিত হয় সমস্ত শাস্তি। দাদিমার হাতের কালচে চাবুকটা জ্বলজ্বল করছে। তার কিছু কিছু জায়গায় রক্ত লেগে শুকিয়ে গেছে। সে জানে এখন এটা দ্বারাই আঘাত করা হবে তাকে। রোজকার ন্যায় শুরু হবে তার উপর অমানুষিক অত্যাচার। তবুও নির্বিকার সে।

দাদিমা গম্ভীর স্বরে শুধায়, “বলো, সেই মানব কি জোরপূর্বক বিবাহ করেছিল তোমায়? দুষ্ট ছিল সে? তুমি বাধ্য হয়ে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলে?”

রোজকার ন্যায় সেই একই প্রশ্ন। অনিমেষ চেয়ে থাকে রূপকথা। তার ম্যাজিশিয়ান খারাপ ছিল না। দুষ্ট নয় তার ম্যাজিশিয়ান। সে সেচ্ছাই তার দ্বারস্থ হয়েছিল। এদের কোনো প্রশ্নের জবাব দেওয়ার ইচ্ছা নেই তার। এতে যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তবুও না। দাদিমার প্রশ্ন অগ্রাহ্য করায় ক্ষেপে ওঠে সেখানে উপস্থিত প্রতিটি প্রাণী। হিংস্র হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে নিলে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় দাদিমা। রূপকথার উদ্দেশ্যে পুনরায় শুধায়, “সেই মানব দুষ্ট ছিল? এই বিবাহে তোমার মত না থাকলে এবং এটা যদি ঐ মানব জোরপূর্বক করে থাকে তবে তোমার শাস্তি লাঘব করা হবে। উত্তর দাও আমার প্রশ্নের?”

সকলে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার উত্তর শোনার আশায়। সকলকে নিরাশ করে সে চিৎকার করে বলে ওঠে, “খারাপ ছিল না সে। তোমাদের মতো নিকৃষ্ট নয় সে।”

অমনি চাবুকের শক্ত আঘাত পড়ে তার শরীরে। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় সে। চোখ-মুখ কুচকে দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যায় সেই অসহনীয় যন্ত্রণা। চাবুকের একের পর এক আঘাতে নুইয়ে পড়েছে সে। ইতিমধ্যে তাজা হয়ে উঠেছে তার ক্ষতস্থান। জমাট বাঁধা রক্ত ডিঙিয়ে চুইয়ে পড়ছে তাজা রক্ত। এলোমেলো সোনালি চুলগুলোতে ছিটকে পড়ছে লাল রক্ত। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবিরত চলতে থাকে এই আঘাত। সময় ফুরিয়ে এলে বন্ধ হয় শাস্তি। একে একে সকলেই ত্যাগ করে সেই স্থান। সকলে বেরিয়ে যাওয়ার পর ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে আসে দাদিমা। তার আহত মুখের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ত্যাগ করে সেই স্থান।

একলা পড়ে রয় রূপকথা। মাথা তুলে তাকানোর মতো শক্তিটাও অবশিষ্ট নেই তার মাঝে। সে আনমনে নিজের কাঁটা ঠোঁটটা নাড়িয়ে খুবই ক্ষীণ স্বরে বলে ওঠে, “তুমি কি আসবে না ম্যাজিশিয়ান? দেখবে না কেমন ভালো আছে তোমার রূপ?”

মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা যেদিন তাকে রেখে গিয়েছিল ম্যাজিশিয়ান। তার সঙ্গে ম্যাজিশিয়ানকে দেখে নিয়েছিল এক মৎসমানব। সে ফিরে আসতেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় তাকে। কিছুক্ষণ চুপ থাকলেও যখন তারা ম্যাজিশিয়ান সম্পর্কে আজেবাজে বলতে শুরু করেছিল তখনই সে বলে দিয়েছিল তাদের সম্পর্কের কথা। সেদিন থেকেই তার উপর চলছে এই নির্যাতন। তার বড্ড জানতে ইচ্ছে করে কেমন আছে তার ম্যাজিশিয়ান? ভালো আছে তো? তার কথা কি মনে পড়ে ম্যাজিশিয়ানের? নাকি সত্যিই ভুলে বসেছে এই মৎসকন্যাকে?

চলবে,,,,,,,,,

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_32

গভীর সমুদ্রে উত্তাল ঢেউ। তার গহীনে হাজারো রহস্যের মায়াজাল। মৎস সমাজের নিয়মের কঠিন জালে আটকে পড়েছে রূপকথা। শেকলে আটকে থাকতে থাকতে শাস্তি প্রদানের সেই নির্ধারিত কক্ষেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তার জানা নেই। টানা সাতটা দিন ব্যথা, যন্ত্রণা, নিজ সমাজের নিয়মের প্রতি আক্রোশ এবং নিজ জাতিগোষ্ঠীর বিরূপ আচরনের আক্ষেপে ঘুমাতে পারেনি সে। শরীরের যন্ত্রণায় ঘুম ধরা দেয়নি তার নয়নজোড়ায়। যখনই একটু ঝিমিয়ে পড়েছে তৎক্ষণাৎ আঁতকে উঠে পড়েছে এই বুঝি পুনরায় আঘাত পড়লো তার শরীরে। এতোগুলো দিন নির্ঘুম কাটিয়ে আজ আর যেন ঘুম কোনো বাঁধা মানছে না। নিশ্চিত মৃত্যুর দুয়ারে থেকেও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়েছে সে। বেশ কিছুটা সময় পেরিয়ে গেছে অথচ তার ঘুম ভাঙার কোনো নাম নেই। সমস্ত মৎসমানব, মৎসমানবী নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত। তার দিকে ধ্যান দেওয়ার সময় কোথায় তাদের?

ধীর পায়ে সেই কক্ষে প্রবেশ করে কেউ। দরজা ভিড়িয়ে নিঃশব্দে এগিয়ে যায় রূপকথার দিকে। বেশ কিছুটা সময় নিঃশব্দে তার দিকে চেয়ে থাকে সে। রূপকথার সমস্ত ক্ষত খুবই সন্তর্পণে পর্যবেক্ষণ করে কোনো এক অচিন মায়ায় চোখদুটো ভিজে এসেছে তার। হাতে ধরে থাকা জড়িবুটি চিপে রস লাগিয়ে দেয় সমস্ত ক্ষততে। ঘুমের মাঝেই কিছুটা মুখ বিকৃত করে রূপকথা। বোধহয় জ্বালাপোড়া করছে। তবে এ জ্বালাপোড়া বেশিক্ষণ থাকবে না। দ্রুতই কাজ করতে শুরু করবে এই জড়িবুটি। নির্মূল করবে খানিক যন্ত্রণা। তবে সে নিজেও জানে এটা কোনো সমাধান নয়। রাত পোহালেই নতুন করে আঘাত করা হবে এই শরীরে। ক্ষতগুলো পুনরায় স্বরূপ ধারণ করবে। কিছুই যে করার নেই। তার সাধ্য কোথায় এই সমাজের নিয়ম ভঙ্গ করার? সে যে জড়িয়ে আছে এই সমাজের সাথে গভীরভাবে। যা কখনোই ছিন্ন করা সম্ভব নয়।

সে ধীর স্বরে বলে ওঠে, “তোমার বাঁচার একমাত্র উপায় তুমি নিজে। বিবাহের কারন হিসেবে ঐ মানবকে দোষী করতেই পারলেই শাস্তি লাঘব হবে তোমার। আশা করি, দ্রুতই তুমি নিজের বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগাবে। এভাবে মানবপ্রেমে বিলিয়ে দিও না নিজের অস্তিত্ব।”

অতঃপর যেভাবে এসেছিল ঠিক সেভাবেই নিঃশব্দে সে ত্যাগ করে সেই স্থান। পূর্বের ন্যায় ভিড়িয়ে দিয়ে যায় দড়জাটা। বেশ খানিকটা সময় বাদে হুট করে চোখ মেলে তাকায় রূপকথা। উত্তেজিত স্বরে ডেকে ওঠে, “ম্যাজিশিয়ান, এসেছো তুমি?”

উত্তর মেলেনা অপরপাশ থেকে। আহত দৃষ্টিতে চারপাশ পর্যবেক্ষণ করে সে। নাহ! কোথাও নেই তার ম্যাজিশিয়ান। তার শরীরের সেই সুঘ্রাণ পর্যন্ত নেই এই চার দেয়ালের মাঝে। আসেনি ম্যাজিশিয়ান! আসবে না সে। কী করে আসবে? এ স্থান যে মানবদৃষ্টির বাইরে। হাজার খুঁজলেও সে আবিষ্কার করতে পারবে না। এই স্থান তার নাগালের বাইরে তবে কীভাবে আসবে সে? বৃথায় আশা বাঁধছে সে!

আচমকা অনুভূত হয় তার যন্ত্রণা কমে এসেছে খানিকটা। পূর্বের ন্যায় বেদনা দিচ্ছে না ক্ষতস্থানগুলো। হতবাক নয়নে নিজের শরীরের দিকে চেয়ে থাকে রূপকথা। সে স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পারছে তার শরীরে মৎস সমাজের সেই কার্যকরী জড়িবুটির উপস্থিতি। কে এসেছিল এই ঘরে! শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীকে মায়া-দয়া দেখানোর মতোও কি কেউ আছে এই সমাজে! জানপ্রাণই অবাক করেছে তাকে এই ঘটনা!

অবাক দৃষ্টিতে সে চেয়ে থাকে বন্ধ দরজার দিকে। দাদিমা এসেছিল কি! তার হৃদয়ে দয়া-মায়ার কিছুটা অংশও কি অবশিষ্ট রয়েছে? নাহ! এই অসম্ভব ভাবনা তাকে শুধুই যন্ত্রণা দেবে। আসেনি দাদিমা! আসতে পারে না সে! যে তার বাবা-মাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল চরম নিষ্ঠুরতার সাথে সেই হৃদয়ে কী করে মায়ার সঞ্চার হবে! দুষ্কর নয় শুধু এ যেন অসম্ভবও বটে! সমাজের প্রধান হয়ে সে নিশ্চয়ই নিয়ম ভঙ্গ করবেন না?

হূট করেই যেন তার হৃদয়ের দহনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় কয়েকগুণ। এই জড়িবুটি তার বাহ্যিক কষ্ট কিছুটা নির্মূল করতে পারলেও কমাতে পারেনি তার হৃদয়ের দহন। পারেনি তাকে মানসিক শান্তি এনে দিতে। মানসিক শান্তি! সে তো কেবল একজন মানুষই পারে তার শিয়রে এনে দিতে। পারবে না কোনো মৎসমানব-মৎসমানবী তাকে এই শান্তির কিনারা খুঁজে দিতে। ম্যাজিশিয়ানকে তার খুব প্রয়োজন। সেই তো পারে তার মানসিক শান্তির কারন হতে। ম্যাজিশিয়ান, তার কথা মনে পড়তেই সে করুন দৃষ্টিতে তাকায় চারপাশে। কেন কোথাও নেই তার ম্যাজিশিয়ান? সে চিরজীবনের জন্য ছেড়ে এসেছে তাকে। এই ধ্রুব সত্য মেনে নিতে বড্ড সময় নিচ্ছে সে।

বারংবার তার মনে হচ্ছে এই বুঝি ম্যাজিশিয়ান এলো। চোখ পাকিয়ে বলবে, “এতো কষ্ট সহ্য করে এখানে পড়ে আছো কী দেখতে? ফিরে আসছো না কেন?”

মুচকি হাসে রূপকথা। তাকে এভাবে আহত অবস্থায় দেখে কষ্ট পাবে কি সে? নাকি বকবে তাকে চোখ রাঙিয়ে? শেকলে আবদ্ধ জলরূপসীর মাঝেও কি সে রূপকথার গল্পের সেই জলরূপসীকে খুঁজে পাবে? তার হাজারটা ক্ষতস্থানের জন্য নাক সিটকাবে না তো? এই কাঁটা-ফাটা ঠোঁট দিয়ে ব্যক্ত করা অনুভূতির বাক্যগুলো কি সে শুনবে মনোযোগ দিয়ে? শত কষ্টের মাঝেও হাসি ফুটেছে রূপকথার চোখে-মুখে। তার খুব ইচ্ছা করছে ফিরে যেতে ম্যাজিশিয়ানের কাছে। যেখানে সে নিজের জীবনের সুন্দর মুহুর্তগুলো কাটিয়েছে সেই শিকদার বাড়ির আঙিনায় ফিরতে।

হঠাৎ মনে পড়ে আরজানের বলা সেই বিষবাক্য। কতো সাবলীলভাবেই না ম্যাজিশিয়ান বলে দিলো মৎসকন্যার সঙ্গে সংসার করতে আগ্রহী নয় সে। খোলা চোখদুটো পুনরায় বন্ধ করে নেয় সে। বিড়বিড়িয়ে বলে ওঠে, “মৎসকন্যার সাথে সংসার করতে কি খুব সমস্যা হতো তোমার ম্যাজিশিয়ান? একটুও কি মানিয়ে নিতে পারতে না? দেখো না, যাকে তুমি পানির শূন্যতায় মারতে চাওনি বলে এই সমুদ্রে পাঠালে তাকে এরা আঘাতে আঘাতে মৃত্যুর দুয়ারে পৌঁছে দিচ্ছে। তুমি বোধহয় কোনোদিন জানতেও পারবে না ম্যাজিশিয়ান, তোমার জলরূপসী শুধু এই বিশাল সমুদ্রের মাঝেই চিরতরে বিলীন হয়নি বরং তার জীবনটাও বিলীন হবে অতি দ্রুত। আমার মরনের পরেও কি তুমি ভাববে যে আমি ভালো আছি এই অজস্র পানির মাঝে। ভালো নেই আমি ম্যাজিশিয়ান, একদম ভালো নেই।”

অশ্রুর কণাগুলো বাঁধ মানছে না। গড়িয়ে পড়ছে তার চোয়াল বেয়ে। বন্ধ চোখদুটো যেন হাজার কষ্টের সাক্ষী দিচ্ছে। সময় পেরোয়। গড়িয়ে পড়া অশ্রু শুকিয়ে আসে। কষ্ট কমে না বিন্দু পরিমাণ। ধীরে ধীরে পুনরায় ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় সে। সময়ের কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে কখন যে রাত পেরিয়েছে তার খবর নেই। শেকলে আবদ্ধ জলরূপসীর দিন-রাত কেটে যায় একই স্থানে বন্দি থেকেই।

চোখ মেলে তাকায় রূপকথা। দরজার বাইরে থেকে কথা কাটাকাটির শব্দ ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই শাস্তি প্রদানের সময় হয়ে এসেছে। তাই হয়তো সকলে এসে ভীর জমিয়েছে দরজার বাইরে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সেদিকে চেয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার থাকে না রূপকথার। তার ভাবনায় সত্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার খুলে হুরমুর করে সেখানে প্রবেশ করে সমস্ত মৎসমানব ও মৎসমানবী। মুহুর্তেই ঘর ভরে ওঠে। নিঃসঙ্গ রূপকথা শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তাদের দিকে। সকলের মধ্যেই কেমন যেন চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। হয়তো নতুন কোনো শাস্তির পূর্বাভাস এটা।

হঠাৎ তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ে দূরে দাঁড়ানো একজন মৎসমানবীর উপর। যার শরীরের বর্ণ তার মতোই চাপা। চোখে-মুখে নেই বাকিদের মতো উত্তেজনা। একদম চুপচাপ সে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনে। তাকেও কি শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তারই মতো? সকলেই মাঝে মাঝে ঘুরে ঘুরে দেখছে দরজার দিকে। হয়তো দাদিমার জন্য অপেক্ষা করছে তারা।

সকলের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দরজা দিয়ে প্রবেশ করে দাদিমা। চাবুক হাতে এগিয়ে যায় রূপকথার দিকে। গম্ভীর দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তাকে। কেমন যেন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকায় সে। শক্ত চোখে তার দিকেই চেয়ে আছে রূপকথা। দাদিমা হয়তো জড়িবুটির উপস্থিতি টের পেয়েছে তাই এভাবে চেয়ে আছে তবে এতে তার বিন্দুমাত্র যায় আসে না।

সমস্ত নীরবতা কাটিয়ে দাদিমা গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, “শাস্তির প্রহর আরম্ভ হয়েছে তুমি কি টের পাচ্ছো?”

উত্তর দেয় না রূপকথা বরং চেয়ে থাকে পূর্বের ন্যায় শক্ত চোখে। হতাশ হয় দাদিমা। পুনরায় শুধায়, “রোজকার ন্যায় আবারো বলছি। সেই মানব কি জোরপূর্বক বিবাহ করেছিল তোমায়?”

কোনো হেলদোল লক্ষ্য হয় না রূপকথার মাঝে। রোজ রোজ একই প্রশ্নে বড্ড বিরক্ত সে। মৃত্যুদণ্ড কেন তার চেয়ে বড় কোনো শাস্তিও যদি তাকে দেওয়া হয় তবুও তার উত্তর একই থাকবে। এক চুল পরিমাণ বদলাবে না। তাহলে কেন রোজ রোজ এভাবে নিজের সময় নষ্ট করছে দাদিমা?

দাদিমা পুনরায় বলে, “উত্তর দাও আমার প্রশ্নের? এভাবে চুপ থাকলে তোমার শাস্তি বৃদ্ধি হবে ছাড়া লাঘব হবে না।”

এবারো নিশ্চুপ রূপকথা। তেতে ওঠে উপস্থিত সকলে। এবার যেন সহ্যের বাঁধ ভেঙে যায় দাদিমার। নিয়ম অনুযায়ী নিয়ে আসা হয় পাথরের তৈরি পাত্র ভর্তি করে অদ্ভুত এক তরল। ভীত হয় রূপকথার দৃষ্টি। এই তরল যেকোনো মৎসকন্যার শরীরে অবাধ যন্ত্রণা দিতে সক্ষম। এরা কি এটা তার শরীরে ছুড়ে ফেলবে? তার ভাবনার মাঝেই আকস্মাৎ একজন মৎসমানব এগিয়ে এসে সেই তরল ছুড়ে মারে তার শরীরে। তৎক্ষণাৎ গগণবিদারি চিৎকারে ফেটে পড়ে রূপকথা। পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছে তার। শরীর কেটে কাঁচা মরিচ ঢেলে দিলেও বোধহয় এমন যন্ত্রণা হয় না। ক্ষতস্থানগুলোতে মনে হচ্ছে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই তরল কতটা ভয়ঙ্কর তা শুধু এতোদিন শুনেই এসেছে সে। আজ উপলব্ধি করতে পারছে তার ভয়াবহতা। এ যে মৃত্যু যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। তার চিৎকারে বিন্দুমাত্র বিচলিত হয় না সেখানে উপস্থিত কোনো প্রাণী। এই তরলের সঙ্গে পরিচিত তারা। তাছাড়া এই শাস্তির খেলা তাদের জন্য নতুন নয়।

শেকলে আবদ্ধ হরিণীর মতোই ছটফট করছে রূপকথা। চোখদুটো দিয়ে অঝোর ধারায় গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। সামনে দাঁড়িয়ে তা উপভোগ করছে তার জাতিগোষ্ঠী। বেশকিছুটা সময় চিৎকার-চেঁচামেচি করে সে যখন হাঁপিয়ে উঠেছে। আর যখন চিৎকার করে নিজের যন্ত্রণা প্রকাশ করার শক্তি অবশিষ্ট নেই তার মাঝে তখনই শুরু হয় চাবুকের আঘাত। একের পর এক চাবুকের আঘাত পড়তে থাকে তার শরীরে। অসাড় হয়ে এসেছে তার শরীর। দ্রুতই জ্ঞান হারিয়ে এলিয়ে পড়ে সে। বন্ধ হয় চাবুকের আঘাত। তৎক্ষণাৎ একজন মৎসমানব দাদিমার উদ্দেশ্যে বলে ওঠে, “সে সহ্য করতে পারেনি এই শাস্তি। নিয়মমাফিক তাকেও মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।”

“হ্যাঁ হ্যাঁ, মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে।” তার সাথে সুর মিলিয়ে আরোও কয়েকজন বলে ওঠে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসাড় রূপকথার দিকে তাকায় দাদিমা। অতঃপর গম্ভীর স্বরে বলে, “নিজের স্বামী-সন্তানকে পর্যন্ত নিয়ম বহির্ভূত করিনি আমি। নিজ হাতে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছি তাদের। এই কন্যাকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে। কাল দিনের শেষ প্রহরে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।”

বাক্য সম্পূর্ণ করেই সে হনহন করে ত্যাগ করে সেই স্থান। তার পেছনে একে একে বেরিয়ে যায় সকলেই। বদ্ধ শেকলে পড়ে রয় অসাড় রূপকথা। তার তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ছে শরীর বেয়ে। কিন্তু হায়! সে নিজের মৃত্যুদণ্ডের ঘোষণাটাও শুনতে পারলো না। জানতেও পারছে না কালই তার জীবনের শেষ দিন। জ্ঞান ফিরলে সে হয়তো নতুন করে অপেক্ষা করবে তার ম্যাজিশিয়ানের জন্য। অতঃপর অচিরেই হারিয়ে যাবে তার অস্তিত্ব। সে বোধহয় খুব অবাক হবে যখন সে জ্ঞান ফিরে জানতে পারবে নিজের মৃত্যুদণ্ডের সময়সূচি। শেষ আশাটাও পূরণ হবে না তার। দেখা হবে না তার ম্যাজিশিয়ানকে।

এই স্থানে কখনোই আসতে পারবে না তার ম্যাজিশিয়ান। সেই মানুষটা কখনোই জানতে পারবে তার জলরূপসী আর নেই। বিলীন হয়েছে সে, হারিয়ে গেছে চিরতরে।

আচমকা ঘুম থেকে লাফিয়ে ওঠে আরজান। চারপাশে তাকিয়ে চাতক পাখির ন্যায় খুঁজতে থাকে কাউকে। কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে না পেয়ে হতাশ দৃষ্টিতে তাকায় মায়ের দিকে।

সোফিয়া শিকদার অবাক চোখে চেয়ে আছেন ছেলের দিকে। জোর করে ধরে তাকে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল সে। তবে বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না আরজানের ঘুম। সে এখনো তার মাথায় হাত বুলিয়েই যাচ্ছে অথচ উঠে বসে পড়েছে আরজান। সে অবাক স্বরে শুধান, “উঠলি কেন? দুঃস্বপ্ন দেখেছিস?”

অসহায় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরজান। তবে কি ভুল দেখলো সে! আসেনি রূপ!

সোফিয়া শিকদার পুনরায় শুধান, “কী রে? ঘুমাবি না? এভাবে বসে থাকলি কেন?”

“ঘুম আসছে না মা।”

হতাশ হয় সোফিয়া শিকদার। বাবার ভালোবাসা হারিয়ে সারাজীবন ভালোবাসার জন্য ছটফট করেছে তার ছেলেটা। মেয়েটাকে পেয়ে বোধহয় সে ফিরে পেয়েছিল সবকিছু। অথচ সেই ভালোবাসাও সহ্য হলো না বেশিদিন। তার ভাবনার মাঝেই আরজান শুধায়, “রূপ ফিরে না আসলে তুমি কি আবার আমাকে বিয়ে করতে বলবে মা?”

শূন্য দৃষ্টিতে তাকালো সোফিয়া শিকদার। আরজানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে ওঠেন, “আমি কখনোই সে কথা বলবো না। তুই চিন্তা করিস না। আমরা মা-ছেলে অপেক্ষা করবো রূপকথার জন্য।”

স্বস্তি পায় আরজান। আনমনে বলে ওঠে, “জানো মা, যেদিন প্রথম রূপের সাথে দেখা হলো আমি মোটেই পাত্তা দেয়নি তাকে। তারপর দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার, চতুর্থবার কতোবার দেখা হয়েছে হিসেব নেই। তার হাজার মায়াও আমলে নেয়নি আমি। তবুও কীভাবে যেন কবে তার মায়া আমায় ঘায়েল করলো তা জানা নেই আমার। উপলব্ধি করতে পারিনি আমি। বিয়েটাও করেছিলাম শুধুমাত্র লামিয়াকে বিয়ে করবো না বলে। একরকম জোর করেই। রাজি ছিল না রূপ। বিয়ের পরেও বুঝতে অনেক সময় লেগেছে আমার। কবুলের প্রভাব বুঝি পড়লো আমার উপর। হুট করে একদিন উপলব্ধি করলাম ভালোবাসায় পেয়ে বসেছে আমাকে। শক্ত করে আগলে নিতে চাইলাম তাকে। তা আর হলো কোথায়? তাকে বলতেই পারলাম না নিজের অনুভূতি। এক্ষেত্রে কেমন দূর্বল লাগত নিজেকে। চেয়েও ব্যক্ত করতে পারিনি আমি। সবকিছু কতো দ্রুত হয়ে যায় তাই না মা?”

চলবে,,,,,,,,,,,,,

#রূপকথার_ম্যাজিশিয়ান
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_33

কেটেছে পুরো একটা দিন। অনেক পূর্বেই জ্ঞান ফিরেছে রূপকথার। তবে জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে ব্যতীত একটা প্রাণীও তার চোখে পড়েনি। শূন্য এই ঘরখানা। ক্ষুধায়, তেষ্টায় ছটফট করছে সে। টেনে খোলার চেষ্টা করছে শেকলের বন্ধন। তবে এ কাজ তার সাধ্যের বাইরে। আজকের আঘাতে পুনরায় তাজা হয়েছে ক্ষতস্থানগুলো। ব্যথার পরিমাণও নেহাত কম নয়। শত ব্যথার মাঝেও ক্ষুধার যন্ত্রণা তাড়িয়ে তুলছে তাকে। এতোদিন তাকে টুকটাক খাবার দেওয়া হলেও আজ তাকে খাবার দিতেও কেউ আসেনি এই ঘরে। হয়তো আজ আর খাবার দেওয়া হবে না তাকে। এর সঠিক কোনো কারন খুঁজে পায় না রূপকথা। ক্ষুধার যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতেই সময় গড়িয়ে রাত নেমেছে। ঘুম আসে না রূপকথার। সে আগ্রহী নয়নে চেয়ে থাকে দরজার দিকে। আর যাই হোক, ক্ষুধার যন্ত্রণা অন্তত সহ্য করা যায় না। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কবে এই অসহনীয় যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাবে তার জানা নেই। তৃষ্ণায় অতিরিক্ত কাতর হয়ে পড়েছে সে।

রাত কত হয়েছে টের পাওয়ার উপায় নেই এই বদ্ধ ঘরে। বোধহয় রাতের মধ্যম প্রহর অথবা না! সঠিক জানা নেই। তবে এতটুকু আন্দাজ করতে পারছে এখন আর জেগে নেই কেউ। বিশাল এই নিস্তব্ধতাই তার সাক্ষী দিচ্ছে। ক্ষুধার যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ঘুমানোর চেষ্টা করে সে। পেটে পাথর বেঁধে কি আর ঘুম হয়! এমন সময় দরজা ঠেলে ঘরে প্রবেশ করে কেউ একজন। ক্লান্ত চোখে সেদিকে তাকায় রূপকথা। একজন মধ্যবয়সী মৎসমানবী এসেছে। তাকে দেখে ভ্রু কুঞ্চিত করে রূপকথা। কিছুটা সময় চেয়ে থেকে সে চেনার চেষ্টা করে তাকে। হুট করে স্মরণে আসে এই মৎসমানবীকে তো সে দেখেছে। হ্যাঁ, ইনিই তো তাকে শাস্তি দেওয়ার সময় সবার থেকে আলাদা হয়ে এক কোনে দাঁড়িয়ে ছিল। সেই চাপা বর্ণের মৎসমানবী। তবে সে এ সময় এখানে কেন! বড্ড বিস্মিত হয় সে!

তার হাতে থাকা জড়িবুটিগুলো আরো বেশি অবাক করে রূপকথাকে। হঠাৎ তার দিকে ছুটে আসে সেই মৎসমানবী। কাঁপা কাঁপা হাতে তার শরীরের ক্ষতস্থানে জড়িবুটির প্রলেপ লাগাতে গেলে খানিক নড়ে ওঠে রূপকথা। তার নড়াচড়াতে ঝনঝন শব্দ তোলে শেকল। শব্দ হতেই ভীত হয়ে সরে যায় সেই মৎসমানবী। চোরা দৃষ্টিতে এদিক-ওদিক চেয়ে পুনরায় ছুটে যায় দরজার দিকে। ভেতর থেকে জব্দ করে দরজা আটকে এগিয়ে আসে রূপকথার দিকে। সাবধানী কন্ঠে বলে ওঠে, “নড়াচড়া করো না, শব্দ হলে তুমি-আমি কেউই বাঁচতে পারবো না।”

হতবাক হয় রূপকথা। তার হাতে থাকা জড়িবুটির দিকে চেয়ে শুধায়, “তাহলে এর আগেও আপনি এসেছিলেন আমার কাছে। জড়িবুটি লাগিয়ে লাঘব করেছিলেন আমার যন্ত্রণা। আমি ঠিকই ধরেছিলাম দাদিমা আসেনি, সে তো নিষ্ঠুরতার চাদরে আবৃত এক মৎসমানবী। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়। আমার জন্য কেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এসব করছেন আপনি? যেখানে কেউ আমার আপন নেই সেখানে আপনি এতো মায়া দেখাচ্ছেন কেন? কারন কী?”

“তোমার মা আমার সখি ছিলেন। আমরা একইসাথে এই সমুদ্রে সাঁতরেছি কতবার তার হিসেব নেই। তোমার মা চোখ ধাঁধানো সুন্দরী হওয়ার পরেও আমার মতো চাপা বর্ণের কারোর সাথে মিশতে তার বিন্দুমাত্র জড়তা ছিল না। জানি না কোন দোষে তুমি এই অভিশপ্ত বর্ণ পেলে। এই বর্ণের কারনে কম কষ্ট করিনি আমি। অভিশাপ কাটানোর নামে কত অত্যাচার সহ্য করেছি তার হিসেব নেই। সখির কন্যাকে চোখের সামনে এভাবে অকালে বিলীন হতে দেই কী করে?” গড়গড়িয়ে বলে যায় মৎসমানবী। দৃষ্টিতে তার অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।

“তা বলে নিজের প্রাণের ঝুঁকি নিবেন? এতটা উদারও কেউ আছে এই সমাজে?”

উত্তর দেয় না মৎসমানবীটি। উল্টো বলে ওঠে, “রাত পোহালেই তোমার মৃত্যুদণ্ডের তোড়জোড় শুরু হবে। দিনের শেষ প্রহরে তা কার্যকরও করা হবে। তুমি তো এটাও জানো না এই রাতটাই তোমার জীবনের শেষ রাত।”

“মৃত্যুদন্ড?” হতবাক নয়নে শুধায় রূপকথা।

“হ্যাঁ, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে তোমাকে। তুমি যখন শাস্তি সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছিলে তখনই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

“দাদিমা নিজে হুকুম দিয়েছে?”

এবার খানিকটা সময় নিশ্চুপ থাকে মৎসমানবীটি। সে বেশ ভালোই টের পেয়েছে এই কন্যার দাদিমার প্রতি গাঢ় দুর্বলতা রয়েছে। যার দরুন এসব মেনে নিতে তার মানসিক কষ্টটাই বেশি হচ্ছে। সে ক্ষীণ স্বরে বলে ওঠে, “তিনিই তো এই সমাজের প্রধান। সে ছাড়া আর কে হুকুম দেবে? তবে সেও তো বাধ্য। এই নিয়ম ভাঙার অধিকার নেই তার। একজন সমাজপ্রধান হিসেবে এগুলো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।”

পুনরায় হতাশ হয় রূপকথা। যখন সে দশটা বছর একটা ঘরে বন্দি থেকে কাটিয়েছিল তখন শুধু সেই ঘরে একমাত্র দাদিমাই প্রবেশ করতে পারতো। সে যত্ন করে তাকে খাইয়ে দিত, ঘুম পাড়াতো, আগলে রাখতো অথচ আজ সে কত অচেনা! বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।

মৎসমানবীটি পুনরায় ব্যস্ত স্বরে বলে ওঠে, “তুমি পালিয়ে যাও এখান থেকে। ফিরে যাও সেই মানবের কাছে। এই সমাজ তোমার জন্য নয়। এরা বাঁচতে দেবে না তোমাকে। যেই মানবের সঙ্গে তোমার বিবাহ হয়েছে সে নিশ্চয়ই তোমাকে মেনে নেবে।”

“সে আমাকে চায় না। কোনো মৎসকন্যার সাথে সংসার করতে আগ্রহী নয় সে।” থমথমে স্বরে বললো রূপকথা।

হতাশ হয় মৎসমানবীটি। করুন গলায় বলে, “অন্তত বেঁচে তো থাকবে তুমি। আমার সখির শেষ চিহ্ন তুমি। যেভাবেই হোক তোমাকে বাঁচতে হবে। আমার কথা মেনে নাও। পালিয়ে যাও তুমি। আমি সাহায্য করবো তোমাকে।”

“কিন্তু কেউ টের পেলে আপনাকেও মরতে হবে আমার সাথে। তা আমি চাই না। আমার জন্য কেউ বিপদে পরুক সে কথা আমি সহ্য করতে পারবো না। চলে যান আপনি। মৃত্যু যদি ভাগ্যে থেকে থাকে তবে তাই হোক। এমনিতেও আমার কোনো পিছুটান নেই।”

“একবার ফিরে গিয়ে দেখো সেই মানবের কাছে। সে বিবাহ যখন করেছে তখন নিশ্চয়ই ফেলে দেবে না তোমাকে।”

“আমি জানি সে আমায় ফেলে দেবে না। নিজের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখবে কিন্তু আমি তার উপর সারাজীবনের জন্য একটা বোঝা মাত্র।” কন্ঠে কোনো খাদ নেই রূপকথার। শক্তভাবে কথাগুলো বলে ফেলে সে।

“ভালোবাসারা কখনো বোঝা হয় না কন্যা।”

চকিতে তাকায় রূপকথা। বাক্যটা যেন ঝনঝন শব্দ তুলল তার নিকট! সে হতবাক হয়ে বিড়বিড়িয়ে আওড়ালো শব্দটা, “ভালোবাসা!”

তার কথাতে আর ধ্যান দেয় না মৎসমানবীটি। ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার শরীরে জড়িবুটির প্রলেপ লাগিয়ে দিতে। পালাতে হলে তার শক্তির প্রয়োজন। এই জড়িবুটি তাৎক্ষণিকভাবে অনেকটা যন্ত্রণা কমিয়ে আনতে সক্ষম। জড়িবুটির ছোঁয়া পেতেই চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে নেয় রূপকথা। জ্বালাপোড়া করছে ক্ষতস্থান। কিছুক্ষণের ব্যবধানেই কমে যায় জ্বালাপোড়া সেই সাথে উপশম হতে থাকে বাহ্যিক যন্ত্রণা। আরো বেশ কিছুটা সময় অপেক্ষা করে মৎসমানবীটি অতঃপর সন্তর্পণে খুলে দেয় শেকলের বাঁধন। হাত আলগা হতেই তাল হারিয়ে পড়ে যেতে ধরে রূপকথা। তৎক্ষণাৎ তাকে জাপটে ধরে মৎসমানবীটি। এতোগুলো দিন একটানা এভাবে বদ্ধ থাকার ফলে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করতেও বেশ খানিকটা সময় লেগে যায় রূপকথার। রক্ত জমাট বেঁধে কালশিটে পড়েছে সুন্দর হাতখানাতে! দেখতেও বড্ড বাজে লাগছে হাতটা। সে যে ভালো নেই এটা তার জলজ্যান্ত প্রমাণ। শুধু যে পরিচর্যাই পারে সুন্দর করে তুলতে সে কথা মোটেও সত্য নয়। সুখ মানুষকে এনে দেয় আসল সৌন্দর্য যা হাজার পরিচর্যাও পারে না এনে দিতে। সুন্দর থাকতে হলে সুখ প্রয়োজন, বড্ড বেশিই প্রয়োজন।

নিজেকে সংবরণ করে ধীরে সুস্থে দাঁড়িয়ে পড়ে রূপকথা। বারবার তাল হারাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নেয় সে। মৎসমানবীটি তার হাত আকড়ে ধরে নিজের হাতের মাঝে। এগিয়ে চলে দরজার দিকে। রূপকথাকে দাঁড় করিয়ে খুবই সাবধানে খুলে দেয় দরজার কপাট। অল্প একটু ফাঁকা করে সাবধানী দৃষ্টিতে বাইরেটা পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে পুনরায় রূপকথার হাত ধরে বেরিয়ে যায় সে। সকলে এ সময় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তাই চারপাশে বেজায় রকম নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। এটাই তাদের জন্য মোক্ষম এবং সুবর্ণ সুযোগ। এ সুযোগ হেলায় না উড়িয়ে তারা দ্রুত ছুটে যায় এই সমাজের সীমানা পেরিয়ে বিশাল সমুদ্রের বুকে আছড়ে পড়তে। এই সীমানা পেরোলেই যে শেষ হবে সমস্ত নিয়মনীতির মায়াজাল। একবার এ সীমানা পেরোতে পারলেই মুক্ত তারা।

দৌড়াতে চায় মৎসমানবীটি তবে ততটা শক্তি যুগিয়ে উঠতে পারছে না রূপকথা। তার শরীর বড্ড ক্লান্ত। তার উপর ক্ষুধার অসহনীয় যন্ত্রণা। তবুও তাকে নিজের সাথে জাপটে ধরে এগিয়ে যায় মৎসমানবীটি। চারপাশ শূন্য, কারোর চিহ্ন অব্দি নেই। খুব সহজেই তারা পেরিয়ে আসে সেই সীমানা। গুপ্ত সেই স্থান ছেড়ে আছড়ে পড়ে সমুদ্রের বুকে। পানির বিশাল এক স্রোত এসে ধাক্কা খায় তাদের শরীরে। পানির পরশে খলবলিয়ে ওঠে রূপকথা। কতগুলো দিন বাদে এই প্রশান্তি পাচ্ছে সে। চোখ বন্ধ করে নিজেকে সে এলিয়ে দেয় পানির মাঝে। আচমকা মৎসমানবীটি তার হাত ছেড়ে দেয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে ফিরে তাকায় রূপকথা। শুধায়, “কী হলো?”

পিছিয়ে যায় মৎসমানবী। সীমান্তের কাছাকাছি ফিরে এসে অসহায় কন্ঠে বলে ওঠে, “বিদায়, বিদায় মৎসকন্যা! ভালো থেক তোমার জীবনসঙ্গীর সাথে। আর কখনো ফিরে এসো না এই সমাজে। তোমায় মেনে নেবে না তারা। এই বর্ণ কাল হয়ে দাঁড়াবে তোমার প্রতিটা পদক্ষেপে। তোমার জীবনসঙ্গীই একমাত্র মূল্যায়ন করবে তোমার এই বর্ণকে। ভালো থেক তুমি, অনেক ভালো থেক।”

বাক্য সম্পূর্ণ করেই হুট করে সে ডুবিয়ে নেয় নিজেকে। জোড়ালো হয় পানির শব্দ। কিছুক্ষণ শুধুই ধোঁয়াশা অতঃপর স্বাভাবিক হলো পানি। তবে স্থানটা শূন্য। নেই, সেখানে কেউ নেই। রূপকথার আর বুঝতে বাকি থাকে না সেই মৎসমানবী ফিরে গেছে নিজ স্থানে। তবে আফসোস! এতোবড় উপকারীকে সামান্য কৃতজ্ঞতাটুকুও জানানোর সুযোগ হলো না!

অপরদিকে মৎসমানবী নিজ সমাজের দুয়ারে পৌঁছে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। পুনরায় সাবধানী দৃষ্টিতে তাকায় চারপাশে। যখন বুঝল কেউ নেই আশেপাশে তখন হুট করে সে গলা খাকারি দিয়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে কেউ। অন্ধকারে তার চেহারা দৃশ্যমান নয়। সে ক্রমেই এগিয়ে আসছে মৎসমানবীটির কাছে। এগোতে এগোতে ঠিক তার সামনে এসে দাঁড়ায়।দৃষ্টিগোচর হয় তার চেহারা। মৎসমানবীটি তাকে দেখতেই সম্মান প্রদর্শন করে ঝনঝন শব্দ তুলে বলে ওঠে, “দাদিমা।”

ঠোঁটদুটো প্রসারিত করে দাদিমা। কন্ঠে এক আকাশ সমপরিমাণ মায়া মিশিয়ে বলে ওঠে, “দিয়ে এসেছো? চলে গেছে সে? বিপদসীমা অতিক্রম করে রেখে এসেছো তো?”

মৎসমানবীটি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই দাদিমা পুনরায় বলে ওঠে, “জড়িবুটির প্রলেপ ভালো করে লাগিয়েছিলে তো? যন্ত্রণা উপশম হয়েছে? আগেরদিন জড়িবুটিগুলো আমি ঠিকঠাকভাবে লাগাতে পারিনি যার দরুন সেভাবে কাজ করেনি হয়তো।”

বিস্মিত নয়নে তাকায় মৎসমানবীটি। হতবাক স্বরে শুধায়, “এই জন্যই কি মেয়েটা আমাকে বলছিল আগেরদিনও আমি এসেছিলাম কি-না?”

ভীত হয়ে ওঠে দাদিমার মুখভঙ্গি। চিন্তিত স্বরে শুধায়, “তুমি আবার মুখ ফসকে বলে দাওনি তো আমার কথা? তোমাকে যে আমি পাঠিয়েছিলাম সে ব্যপারে কি অবগত করেছো তাকে? আমি নিষেধ করেছিলাম তোমায়।”

“না না, আমি বলিনি আপনার কথা। সে জানে না তাকে মুক্ত করার পেছনের মূল ব্যক্তিটা কে। সে তো আমাকেই কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছে হয়তো মনে মনে কিন্তু আপনি তাকে জানাতে চাচ্ছেন না কেন? নিজের এই উদার রূপ প্রকাশ পাবার আশঙ্কায়?”

চকিতে তাকায় দাদিমা। গম্ভীর স্বরে বলে ওঠে, “তাকে আমি নিজের সবটুকু মায়া উগরে দিয়ে যত্ন করে বড় করেছি এভাবে অকালে বিলীন হবার জন্য নয়। সকলের সম্মুখে নিয়ম ভঙ্গ করার সাধ্যিও আমার নেই। আমি চাই না সে জানুক এখানে কেউ তার আপন আছে, খুব আপন। যার টানে সে আবার ফিরে আসবে এই সমাজে। আমি চাইনি সে কখনো ফিরে আসুক।”

“কিন্তু সে তো আপনার জন্য এক আকাশ পরিমাণ ঘৃণা বুকে চেপে ফিরে গিয়েছে।”

ফিচেল হাসে দাদিমা। দৃঢ় স্বরে বলে ওঠে, “সে ঘৃণা করতে পারে না কাউকে। তাকে ভালোবাসতে শিখিয়েছি আমি, ঘৃণা করতে নয়। অভিমান করেছে সে। তবে তার অভিমানের মাঝেও যে সুপ্ত ভালোবাসাটুকু আছে সেটাই নাহয় নিজের করে নেব আমি।”

তার প্রতিটা কথা যেন বড্ড বেশিই অবাক করে মৎসমানবীটিকে। দাদিমার এমন রূপের সঙ্গে তারা পরিচিত নয়। আজ যখন দাদিমা তাকে জরুরি তলব করলো সে ভয় পেয়েছিল তার দ্বারা কোনো নিয়মভঙ্গ হলো কি-না ভেবে। অতঃপর দাদিমা যখন মেয়েটাকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতে বললো সে যেন আকাশ থেকে পরেছিল। কাল হয়তো হুলুস্থুল কান্ড বাঁধবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে না পেয়ে। হৈ-চৈ পড়ে যাবে পুরো সমাজে। তবে এর পেছনের মূল রচয়িতার খোঁজ কেউ পাবে না। এমনকি মেয়েটা নিজেও না। তার কোনোদিন জানা হবে না তার দাদিমা তাকে বাঁচাতে নিজের কঠিন সেই কঠোরতা ত্যাগ করেছে! নিয়মভঙ্গ করেছে! সে কতটা মায়ার প্রলেপ লেপেছে দাদিমার হৃদয়ে তাও তার জানা হবে না!

সাঁতরে তীরে এসে থামল রূপকথা। উজ্জল চন্দ্রশোভা আলোকিত করেছে চতুর্দিক। জোৎস্না উঠেছে আজ!
রূপকথা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে নেয় চারপাশ। কাউকে দেখতে না পেয়ে বালুর উপরেই এলিয়ে দেয় ক্লান্ত শরীরটা। ভেজা সোনালি চুল বেয়ে টুপ টুপ করে পানির ফোঁটা পড়ছে বালুর ওপর। নিমেষেই বালু তা শুষে নিচ্ছে নিজের গভীরে। এতোক্ষন পানিতে থাকার কারনে তার হাতের কালশিটে পড়া সেই কুচকুচে দাগ মিলিয়ে গেছে খানিক তবে পুরোপুরি নয়। ফাটা ঠোঁটদুটো চাইছে নিজের স্বরূপ ফিরে পেতে তবে সময়ের স্বল্পতায় তা হয়ে ওঠে না। এখন বিশ্রাম প্রয়োজন তার। সুন্দর সেই মুখশ্রীতে ভর করেছে মলিনতা। নেই পূর্বের সেই সতেজতা। ক্লান্তিতে বন্ধ হয়ে আসছে চোখদুটো।

এমন সময় শ্রবণগোচর হয় কারোর বেসামাল কথোপকথন। যেন বেশ কয়েকজন একসাথে ঘোরের মাঝে প্রলাপ বকছে। মুহুর্তেই চোখদুটো বড়বড় করে তাকায় রূপকথা। ঘার ঘুরিয়ে দেখে তার থেকে কিছুটা দূরেই অবস্থান করছে তিনজন মাতাল। হ্যাঁ, মাতালই লাগছে তাদের হাবভাবে। বয়স বেশি না বোধহয় ছেলেগুলোর। বিশ কী একুশ হবে হয়তো। হাতে কোনো পানীয় ভর্তি বোতল নিয়ে হেলতে-দুলতে এগিয়ে আসছে তার দিকেই। মুখে অবিরত বলে যাচ্ছে আজগুবি কথাবার্তা। দ্রুত উঠে বসে পড়ে রূপকথা। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করে তার আশপাশটা। নাহ, লুকানোর মতো কোন জায়গা নজরে আসছে না। ছেলেগুলোর হাবভাবও খুব একটা ভালো ঠেকছে না। মস্তিষ্ক যেন তৎক্ষণাৎ দিয়ে যায় সাবধানী বার্তা। পালাতে হবে, হ্যাঁ, পালাতে হবে তাকে।

সে হন্তদন্ত হয়ে উঠে দাঁড়াতেই হঠাৎ নজরে পড়ে যায় ছেলেগুলোর। তারা নিজেদের চোখ কচলে কচলে পর্যবেক্ষণ করে তাকে। বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হাতের বোতল ফেলে ছুটে আসে তার দিকে। গলা শুকিয়ে আসে রূপকথার। দিক্বিদিক ভুলে সে ছুট লাগায় উল্টো দিকে। বালুর উপর দৌড়ানো কষ্টসাধ্য হয়ে যাচ্ছে তার এই ক্লান্ত শরীরে। অপরদিকে ছেলেগুলো ক্রমেই তার কাছে চলে আসছে। দ্বিধায় ভুগছে সে। আবারো কি তাকে নামতে হবে এই পানিতে! যদি কোনো মৎসমানব সেখানে এসে থাকে তার খোঁজে! আবারো কি তবে ফিরতে হবে সেই সমাজে!

চলবে,,,,,,,,,,,,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে