যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো পর্ব-০১

0
534

যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো
লেখনীতে : নাফিসা তাবাসসুম খান
১. ( অবতরণিকা )

গ্রীষ্মের তান্ডব যখন পুরোদমে চলছে তখনকার কোনো এক দুপুরের কথা। শান্তশিষ্ট প্রাইভেট হসপিটালটা হঠাৎ করেই কোলাহল পূর্ণ হয়ে উঠলো। একদল যুবক ধরাধরি করে একটি রক্তাক্ত ছেলেকে নিয়ে হসপিটালের ইমার্জেন্সি ইউনিটের দিকে দৌঁড়ে যাচ্ছে। ছেলেটির ধূসর রঙা শার্ট রক্তে ভিজে স্যাতস্যাতা রঙ ধারণ করেছে। দেখে মনে হচ্ছে প্রাণ প্রদীপ নিভু নিভু প্রায়। ছেলেটির নাম সিয়াম। যুবকদল ছেলেটিকে ইমার্জেন্সি ইউনিটের একটি শুভ্র রঙের বেডে শুইয়ে দিয়েই চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে। আশেপাশে ইতিমধ্যে মানুষ জোড়ো হয়ে গিয়েছে। সকলেই কৌতূহল নিয়ে ইমার্জেন্সি ইউনিটের দরজা দিয়ে উঁকিঝুকি দিচ্ছে।

ছেলেগুলোর চিৎকার চেঁচামেচিতে নার্সরা বিরক্ত হয়ে বুঝানোর সুরে বলছে,

” আপনারা দয়া করে শান্ত হন। বাকি পেশেন্টদের অসুবিধা হচ্ছে। ”

এবার যেন ছেলেগুলো নিজেদের কণ্ঠস্বর সামান্য নিচু করে। এদের মধ্যে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কিছুটা বেঁটে দেখতে আসিফ নামক ছেলেটি বলে উঠে,

” ডাক্তার কোথায়? ওর এখনি চিকিৎসা শুরু করতে হবে। ”

নার্স জবাব দেয়,

” ডাক্তার আসছে। আপনি আগে বলুন উনার কি হয়েছে? ”

যুবকদের দলবলের মধ্য থেকে একটি কণ্ঠ ভেসে আসে,

” বুকে-পিঠে কোপানো হয়েছে। ”

কথাটা শোনা যেতেই নার্সদের চোখে মুখে আতংক ছড়িয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে একজন ব্যস্ত পায়ে চলে যায় পুলিশকে খবর দিতে। আরেকজন বলে,

” পেশেন্টের ডিটেইলস নোট করতে হবে। একজন আমার সাথে কাউন্টারে চলুন। ”

সাথে সাথে একজন যুবক সেই নার্সের পিছু পিছু চলে যায়। আসিফ সিয়ামের অবস্থা দেখে কিছুটা চেঁচিয়ে বলে,

” এখানে ডাক্তার কোথায়? চিকিৎসা কেনো শুরু করছে না? ”

একজন নার্স শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠে,

” ইনফর্ম করা হয়েছে। এখুনি আসছে। ”

কথাটুকু বলেই সে-ও বাকি নার্সদের সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যুবক দলকে বেশ অশান্ত দেখাচ্ছে। তখনই পিছন থেকে একটি শান্ত স্বর ভেসে আসে,

” ও কতক্ষণ ধরে এভাবে পরে আছে? ”

সাথে সাথে সবাই পিছনে ফিরে তাকায়। শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে জোড়ানো পুরুষটিকে দেখতে পেয়েই সবাই দু’দিকে কিছুটা সরে দাঁড়ায়। যেন মাঝখানে পুরুষটির আসার জন্য রাস্তা করে দিচ্ছে৷ আসিফ পুরুষটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে উঠে,

” পার্থ ভাই, রাস্তায় জ্যামে পড়েছিলাম। মাত্রই নিয়ে আসলাম। ”

শক্তপোক্ত মুখশ্রীর পুরুষটা এগিয়ে এসে চেঁচিয়ে বলে,

” হু ইজ ইনচার্জ রাইট নাও? ”

পার্থর কথা শেষ হতেই একটি দৃঢ় নারীকণ্ঠ ভেসে উঠে,

” হসপিটালকে গরু ছাগলের বাজার বানিয়ে রাখা হয়েছে কেন? ”

কথাটা কানে যেতেই যুবক দলের মুখ অপমানে থমথমে রূপ ধারণ করে। পার্থ ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় পিছনে। পায়ে স্লিপার, গায়ে সার্জিক্যাল এপ্রোণ আর মাথায় সার্জিক্যাল ক্যাপ পরিহিত নারীর চোখে মুখে চরম বিরক্তির ছাপ। সে সবাইকে পাশ কাঁটিয়ে পেশেন্টের কাছে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠে,

” সিকিউরিটিকে ইনফর্ম করো শরীফা। নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে নাকি? আমি ১৫ সেকেন্ডের ভিতরে এখানে নার্স ব্যাতিত একটা মাছিও দেখতে চাই না। ”

শেষের কথাটা কিছুটা তেজ মিশিয়ে বলে সে। কিন্তু তার কথায় কেউ এক পা-ও নড়ে না। ডক্টর সিয়ামের অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি বলে উঠে,

” প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে। ওটি রেডি করে পেশেন্টকে এখনই অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাও। আমি ডক্টর ইরফানকে খবর দিচ্ছি। আর পেশেন্টের ব্লাড গ্রুপ জেনে তার জন্য ব্লাড এরেঞ্জ করো তাড়াতাড়ি ব্লাড ব্যাংক থেকে। ”

” ঠিক আছে ডক্টর। ”

কথাটা বলেই নার্স এবং ওয়ার্ড বয়রা মিলে সিয়ামকে একটা স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফোর্থ ফ্লোরের ওটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়। অগ্নিরূপী নারী পিছনে ফিরে দেখে সেই ছেলেপেলেরা এখনো সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে। সাথে সাথে সে আবার বিরক্তি মিশ্রিত সুরে বলে উঠে,

” কথা কানে যায়নি নাকি? ”

পার্থ থমথমে স্বরে জবাব দেয়,

” কারো হুকুম মানার অভ্যাস নেই আমার ডাক্তার। আমি যেখানে, আমার ছেলেরাও সেখানে থাকবে। ”

একজন নার্স দৌড়ে এসে ডাক্তারকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” ডক্টর তরী, আপনি আসবেন না? ”

তরী শান্ত স্বরে বলে,

” আসছি। ”

কথাটুকু বলেই তরী পার্থর দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

” ওহ। গুন্ডা মাফিয়ার দল? কিন্তু আমার হাসপাতালে কোনো দাদাগিরি চলবে না। পেশেন্টদের অসুবিধা হচ্ছে। এই মুহুর্তে যদি এই ভীড় না কমে তবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে সবগুলোকে বের করবো হসপিটাল থেকে। ”

পার্থ গম্ভীর কিন্তু বিদ্রুপের সুরে বলে,

” কেন? আপনার বাপের হাসপাতাল নাকি? যে আপনার মর্জি চলবে? ”

” হ্যাঁ। আমার বাপেরই হাসপাতাল। ”

পার্থর চোখেমুখে রাজ্যের বিরক্তি। সে এই মুহুর্তে এখানে ঝামেলা করতে চাচ্ছে না। ইতিমধ্যে আরেক ঝামেলা কিভাবে সামলাবে তা নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত সে। তাই সিন ক্রিয়েট এড়িয়ে যাওয়ার জন্য পাশ ফিরে তার দল-বলকে উদ্দেশ্য করে বলে,

” আসিফ, শামীম বাদে বাকি সবাই গিয়ে ঝামেলা সামাল দে আপাতত। বাকি কথা আমি ফোনে জানিয়ে দিবো। ”

সকলে মাথা নেড়ে সাথে সাথে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। শামীম পার্থকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,

” ভাই? সিয়ামের আম্মা মানে খালাম্মাকে বিষয়টা জানাবো? ”

পার্থ তরীর থেকে চোখ না ফিরিয়েই শক্ত গলায় জবাব দেয়,

” হ্যাঁ। খালাম্মাকে গিয়ে বাসা থেকে নিয়ে আয়। এই অবস্থায় উনার ছেলের পাশে থাকা উচিত। ”

শামীমও আদেশ পেতেই বেরিয়ে পড়ে। তরী বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

” যত্তসব মূর্খের দল। ”

তরীর কথাটা কানে যেতেই আসিফ তেঁতে উঠে। সে কাঠকাঠ স্বরে বলে উঠে,

” এইযে ম্যাডাম! ভাইরে চিনেন আপনি? পার্থ মুন্তাসির চৌধুরী। এই জেলার যুবক দলের সভাপতি উনি। সম্মান দেন। ”

তরী তাচ্ছিল্যের সুরে বলে,

” সম্মান এতো সস্তা না যে যাকে তাকে দিয়ে দিবো। সম্মান উপার্জন করতে হয়। এসব রাজনীতির নামে করা গুন্ডামী আর ভণ্ডামি করা মানুষকে তরী রশীদ কখনো সম্মান করে না। ”

কথাটা বলেই তরী বেরিয়ে যেতে নিলে পিছন থেকে পার্থ বলে উঠে,

” ডাক্তার সাহেবা। নিজের পেশেন্টের ভালো করে চিকিৎসা করেন। ওর জীবন আমার জন্য মূল্যবান। যত টাকা লাগুক না কেন, চিকিৎসায় যেন কোনো কমতি না থাকে। ”

তরী সাথে সাথে পিছনে ফিরে পার্থর দিকে কয়েক কদম এগিয়ে আসে। এক হাত উঁচু করে তুড়ি বাজিয়ে বলে,

” আমার কাজ আমি খুব ভালো করেই করতে পারি। তাই আমার কাজ আমাকে শেখানোর প্রয়োজন নেই। আপনি আপনার সো কল্ড জনসেবায় মন দেন, নেতা সাহেব। ”

কথাটা বলেই তরী গটগট পায়ে ইমারজেন্সি ইউনিট থেকে বেরিয়ে যায়। আসিফ শান্তনার সুরে বলে,

” থাক ভাই। বাদ দেন। বেডি মানুষ। কাজ কম প্যাঁচাল বেশি পারতে ভালোবাসে এই প্রজাতি। ”

__________

নিজের পার্টি অফিসে আয়েশী ভঙ্গিতে বসে ধোঁয়া উঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে রুবেল হোসেন। তখনই তার বাম হাত সুজন ব্যস্ত পায়ে এসে বলে উঠে,

” ভাই। একটা সমস্যা হইয়া গেসে। ”

চায়ের কাপ থেকে মনযোগ সরিয়ে সরু চোখে সুজনের দিকে তাকায় রুবেল। চোখের ইশারায় জানতে চায় কি সমস্যা। সুজন ইতস্ততভাবে এদিক ওদিক তাকিয়ে মিনমিনে গলায় বলে উঠে,

” আমাদের ছেলেরা পার্থ মুন্তাসির চৌধুরীর ডান হাত আসিফের জায়গায় ভুল কইরা তার দলের আরেক ছেলে সিয়ামরে কোপায় আসছে। ”

রুবেল রাগে গজগজ করতে করতে বলে উঠে,

” ভাদাইম্মার দল। তোদের একটা কাজ দিসি এটাও ঠিকঠাক করতে পারলি না। নির্বাচন হইতে মাত্র তিন মাসও বাকি নাই আর তোরা এখনো ভুল করে যাইতেসোস। সবগুলো গিয়ে বুড়িগঙ্গায় ডুব দে। ”

সুজন মনে মনে রাগ হয়। সে তো রুবেলের কথামতন ঠিকঠাকই আদেশ দিয়েছিলো। এখন ছেলেরা যদি সেই আদেশ ঠিকভাবে পালন না করে তাহলে সেটার দায়ভার তো আর তার না। রুবেল বিরক্তি নিয়ে প্রশ্ন করে,

” ওই সিয়াম কি বাইচ্চা আছে নাকি মইরা গেসে? ”

” সেই খবর তো জানিনা ভাই। হসপিটালে নাকি নিয়ে গেসে খবর পাইলাম। কিন্তু যেমনে মারসে বাইচ্চা থাকার তো কথা না। ”

রুবেল বিরক্তিকর ভঙ্গিতে মুখ দিয়ে চ জাতীয় শব্দ করে। পরপর সুজনকে আদেশ দেয় হসপিটালে গিয়ে নজর রাখতে। সিয়ামের যেকোনো আপডেট যেনো তাকে জানানো হয়। সুজন আদেশ অনুযায়ী বেরিয়ে পড়তেই রুবেল বসে বসে ছক কষতে থাকে। এইবারের নির্বাচন সে যেকোনো মূল্যেই জিততে চায়।

__________

সারাদিনের তপ্ত আবহাওয়ার ক্লান্তি গায়ে মেখে পার্থ যখন চৌধুরী ভবনে প্রবেশ করে তখন সবার আগে তার মা সাদিকা বেগম দৌড়ে তার কাছে আসে। ব্যস্ত গলায় সুধায়,

“ আব্বাজান। ঠিক আছো তুমি? “

পার্থ ক্লান্ত গলায় জবাব দেয়,

“ আমি ঠিক আছি আম্মা। চিন্তা করো না। “

লিভিং রুম হতে সেই মুহুর্তে একটি ভরাট পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে,

“ তোমার দলের একজনকে নাকি আজকে কোপানো হয়েছে। এতো বড় দুঃসাহস যে দেখিয়েছে তাকে আশা করছি সহজেই ছেড়ে দিবে না। “

পার্থ লিভিং রুমে প্রবেশ করে সোফায় আরাম করে গা এলিয়ে বসে শান্ত স্বরে জবাব দেয়,

“ এই দুঃসাহস ওই রুবেল হোসেন দেখিয়েছে। ইট ইজ এ ওপেন সিক্রেট অলরেডি। নির্বাচনের আগে ওর খুব ডানা গজিয়েছে। সেই ডানা ছাটাই করার উপায় আমি ভালো করেই জানি। তুমি চিন্তা করো না আব্বা। “

ছেলের কথা শুনে সামান্য হাসে আফজাল চৌধুরী। হেসে তিনি লিভিং রুমের বিশাল টিভির স্ক্রিনে চলমান নিউজের হেডলাইনের দিকে দৃষ্টি নিবেশ করেন। ততক্ষণে রান্নাঘর হতে জমিলা খালা এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এনে সাদিকা বেগমের হাতে দেয়। সাদিকা বেগম সেই পানির গ্লাস ক্লান্ত ছেলের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠে,

“ ওই ছেলে যে হসপিটালে, সিয়াম না নাম? ওর কি অবস্থা? এখন কেমন আছে? “

পার্থ ঠান্ডা পানির গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে উত্তপ্ত চিত্ত আগে শীতল করে নেয়। পরে সহজ স্বরে জবাব দেয়,

“ অপারেশন হয়েছে। এখন আইসিইউতে আছে। ইনশাআল্লাহ দ্রুত সুস্থ হয়ে যাবে। “

কথাটুকু বলেই পার্থ নিজের মায়ের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে,

“ শোভন এখনো ফিরে নি? “

আফজাল চৌধুরী পাশ থেকে জবাব দেয়,

“ বনানীর ওদিকে কোন ম্যানহোলে নাকি একটা লাশ পাওয়া গিয়েছে। সেই ইনভেস্টিগেশনে ব্যস্ত ও। “

পার্থ ছোট করে কেবল ওহ বলে। আফজাল সাহেব আবার বলে উঠে,

“ তোমার ভাইকে ভালো করে বুঝাও এই পুলিশের চাকরিটা ছেড়ে দিতে। আমার কি কোনো কিছুর অভাব আছে যে ও শুধু শুধু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এরকম একটা চাকরি করছে? “

“ ওর চাকরিতে তো আমি দোষের কিছু দেখি না আব্বা। জনগণের সেবা করা ওর পেশা। আর জনগণের সেবা করতে গেলে নিজের জীবনের আগে জনগণের জীবনকে প্রাধান্য দেওয়াটাই স্বাভাবিক। “

আফজাল সাহেব ছেলের কথার আর কোনো জবাব দেয় না। তিনি চুপচাপ উঠে নিজের রুমে ফিরে যান। এতক্ষণ বাপ ছেলের কথার মাঝে নীরব স্রোতার দায়িত্ব পালন করছিলেন সাদিকা বেগম। পার্থকে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে দেখে তিনি পিছন থেকে প্রশ্ন করে,

“ এখন খাবার দিবো আব্বাজান? কাচ্চি রান্না করেছি আজকে। “

পার্থ এক দন্ড মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে,

“ আচ্ছা। আমি ফ্রেশ হয়ে তাহলে আসছি। আর আম্মা সিয়ামের মা মানে খালাম্মা হসপিটালে আছে ছেলের সাথে। উনার ডায়েবিটিস আছে। তাই সেই অনুযায়ী জমিলা খালাকে রান্না করে প্যাক করে রাখতে বলবে। কালকে হসপিটালে আমাদের বাসা থেকে খাবার যাবে। আমি সময়মতো শামীমকে পাঠিয়ে দিবো খাবার নিয়ে যাওয়ার জন্য। “

সাদিকা বেগম কেবল সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে আবার ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে চলে যায়।

__________

সিয়ামের অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে প্রায় ৪৮ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে। আশংকাজনক অবস্থা থেকে মুক্তি পেতেই তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়। এর মাঝে পার্থ বেশ কয়েকবার কাজের ফাঁকে হাসপাতালে এসেছিলো। এছাড়া হসপিটালে ছিলো কেবল সিয়ামের মা, আসিফ, শামীম আর দু তিনজন দলের ছেলে পেলে। রাত ৯ টার দিকে পার্থ হসপিটালে আসার কিছুক্ষণের মধ্যেই খবর পায় সিয়ামের জ্ঞান ফিরেছে। সবার আগে সিয়ামের মা গিয়ে নিজের ছেলের সাথে দেখা করে আসেন। উনি বেরিয়ে আসতেই পার্থ ভিতরে প্রবেশ করে। সিয়াম পার্থকে দেখেই অস্ফুটে বলে উঠে,

“ ভাই। “

পার্থ শান্ত ভঙ্গিতে বলে,

“ হুশ। রেস্ট নে তুই। আগামী তিন মাস তোর একটাই ডিউটি। শুধু রেস্ট করবি। “

সিয়াম নীরব হাসে সামান্য। পরপরই সে বলে উঠে,

“ ভাই, ওইটা রুবেলের লোক ছিলো। “

পার্থের মুখভাব এখনো নির্বিকার দেখায়। সে একই ভঙ্গিতে বলে,

“ আমি জানি। তুই এসব নিয়ে চিন্তা করিস না। “

সিয়াম তবুও চিন্তিত সুরে বলে,

“ ভাই, আপনি সাবধানে থাকবেন। “

কথার এই পর্যায় পার্থ এগিয়ে এসে সিয়ামের মাথায় সামান্য হাত বুলিয়ে বলে উঠে,

“ কারো বাপের সাহস নেই আমার গায়ে হাত দেওয়ার। যে এরকম কিছু চিন্তা করবে তার হাত ভেঙে গুড়িয়ে দিবো। “

তরী কেবল ডিউটি শেষের আগে পেশেন্ট ভিজিটের জন্য রুমে প্রবেশ করেছিলো। পিছন থেকে পার্থর এই কথা শুনতেই তার চেহারা শক্ত হয়ে যায়। এই রাজনীতি পেশা তার বরাবরই অপছন্দের। রাজনীতির নাম করে মানুষ কেবল নিজের ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে গুন্ডামী করে বেড়ায় বলেই তার ধারণা। আর তার এই ধারণা আজ পর্যন্ত কেউ ভুল প্রমাণ করতে পারে নি।

তরী গটগট পায়ে ভিতরে এসে বেডের অপরপাশে দাঁড়ায়। পার্থ একবার বেখেয়ালি চোখে তরীকে দেখে আবার নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। সিয়ামকে জ্ঞান ফেরার পর প্রাথমিক টুকটাক কিছু প্রশ্ন করে তা ফাইলে নোট করতে ব্যস্ত তরীকে পার্থ প্রশ্ন করে,

“ ওর সম্পূর্ণ সুস্থ হতে কতদিন সময় লাগবে? “

তরী ফাইলের দিকে তাকিয়েই বিদ্রুপের সুরে পাল্টা প্রশ্ন করে,

“ কেন? সুস্থ হতেই আবার চামচামি শুরু করে দিবে নাকি? “

পার্থর মুখ কিছুটা শক্ত হয়ে আসে। সোজা প্রশ্নের সোজা উত্তর না পেয়ে কিছুটা বিরক্ত সে। কাটখোট্টা স্বরে বলে উঠে,

“ যতটুকু জিজ্ঞেস করা হচ্ছে কেবল ততটুকুর জবাবই দেন ডাক্তার সাহেবা। “

তরী হাতের ফাইলটা একটা টেবিলের উপর রেখে দু’হাত বুকের উপর ভাজ করে বলে,

“ উনার বুকে পিঠে কোপানো হয়েছে। পিঠের ক্ষত বেশি গভীর না হলেও বুকে বেশ গভীর ক্ষত হয়েছে। এই যাত্রায় যে উনি বেঁচে গিয়েছেন সেটার জন্য আলহামদুলিল্লাহ বলেন। এই সেলাই শুকাতে এবং সম্পূর্ণ ক্ষত সারতে বেশ কয়েক মাস লাগবে। কিন্তু আপনাদের মতো সো কল্ড নেতারা এসব বুঝার ক্ষমতা রাখেন না। পড়াশোনা এবং ক্যারিয়ার নিয়ে চিন্তা করার বয়সে এসব ছেলেপেলেদের মাথায় রাজনীতির ভূত গছিয়ে দেওয়া আর এদের দিয়ে নিজেদের চামচামি করানোই কেবল আপনাদের কাজ। “

এই পর্যায়ে সিয়াম বলে উঠে,

“ দেখেন ডাক্তার আপা, ভাইকে কিছু বলবেন না। আমি নিজে স্ব ইচ্ছায় রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি। “

তরী মনে মনে সামান্য বিরক্ত হয়। যেমন নেতা তার তেমন চামচা। দুটোর সাথেই কথা বলা অর্থহীন। সে হাত ঘড়িতে একবার সময় দেখে নিয়ে সিয়ামকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,

“ নার্সকে সব ইন্সট্রাকশন দিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাতের দিকে আপনার জ্বর আসার সম্ভাবনা আছে। তাই সেরকম অনুভব করলে সাথে সাথে নার্সকে জানাবেন। গেট ওয়েল সুন। “

কথাটা বলেই তরী আর কোনো কথা না বলার সুযোগ দিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে পড়ে। সিয়াম পার্থর দিকে তাকিয়ে কিছুটা অবাক সুরে প্রশ্ন করে,

“ ডাক্তার আপা আপনার সাথে এতো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা কেন বললো ভাই? আপনাদের মাঝে কোনো ঝামেলা হয়েছে? “

পার্থ বিরস মুখে জবাব দেয়,

“ কি জানি! হয়তো সোজা কথার ত্যাড়া জবাব দেওয়া ডাক্তার সাহেবার স্বভাব। “

চলবে…

[ কপি করা কঠিনভাবে নিষিদ্ধ ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে