মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-০৭

0
338

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৭

#আরশিয়া_জান্নাত

রুশফিকা আপনি কি ভয় পাচ্ছেন? চেহারা এমন করে আছেন কেন?

ভয় পাওয়ার কি আছে? আপনি বাঘ না ভাল্লুক?

তাই নাকি?

হুম।

এমন যদি হয় আমি আপনাকে এই ফ্লাইওভার থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেই?

এমন কাঁচা খেলোয়াড় আপনি নন!

হাহাহা,,,চা খাবেন?

খেতে পারলে মন্দ হয় না। ভীষণ মাথা ধরেছে।

ফ্লাইওভার থেকে গাড়ি নেমে কিছুদূরে সাইড করে সে দু’কাপ চা নিয়ে আসে। সাথে গরম গরম পিয়াজু। ইসরা বেশ আয়েশ করেই চা আর পিয়াজু খেলো। আরুশ মোবাইল বের করে স্ক্রল করতে লাগলো। বেশকিছুক্ষণ পর ফের গাড়ি চলতে শুরু করে। ইসরা খেয়াল করে বুঝল আরুশ অযথাই ঘুরছে, ইসপাহানী মোড় দিয়ে চকবাজার গিয়ে আবার ২নং গেইট দিয়ে বের হলো, ফের সিআরবির পথ ধরে কাজীর দেউরী। মোট কথা সে অযথাই চক্কর খাচ্ছে।
ইসরা খানিকটা বিরক্ত হয়েই বলল,আপনাদের বাসাটা কোথায়? ভুলে গেছেন নাকি?

আমার স্মৃতিশক্তি নিয়ে ডাউট আছে?

তো এমন চক্কর খাচ্ছেন কেন?

এমনি ইচ্ছে হচ্ছে ড্রাইভ করতে তাই করছি!

আজীব!

হুম আজীবই,,,

দেখুন রাউজান থেকে এইখান পর্যন্ত আসার পথটা কম ছিল না, আপনার তারপরো ড্রাইভ করা শেষ হয়নি?

সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে পাশে নিয়ে ড্রাইভ করায় অন্যরকম আনন্দ আছে, খেয়াল করলাম ক্লান্তিও আসে না!

আপনার মনে কি চলছে বুঝতে পারছি না।

আমার মন বোঝার চেষ্টা করছেন কেন?

সে আর কথা বাড়ায় না ফোন বের করে ছোটভাই ফাহিমকে কল করে এড্রেস জিজ্ঞাসা করতে। আরুশ অমনি তার ফোন নিয়ে কল কেটে দিলো।
ইসরা ভ্রু কুঁচকে বলল, এমনটা করলেন কেন?

রুশফিকা ম্যাম আপনি কিডন্যাপড হয়েছেন, আপনার শরীরের অর্গান বেচে আমি কোটিপতি হবো। ক্লায়েন্টের অপেক্ষা করছি তাই এমন চক্কর কাটছি।

আপনি কি আমার সঙ্গে ফাজলামি করছেন? এটা মোটেও হাস্যকর ছিল না।

ফোনে মেসেজের টিউন হতেই আরুশ এবার সোজা রুটে ড্রাইভ করা স্টার্ট করল।
ইসরা সতর্ক দৃষ্টিতে রাস্তা দেখছে।সাথে মনে মনে নিজেকে রক্ষা করার বুদ্ধি ভাবছে!

অবশেষে গাড়িটা এসে খুলশীর একটা বাড়ির সামনে থামে। আরুশ গাড়ি থেকে বের হয়ে দরজা খুলে বলে, আসুন।

ইসরা তার পিছু পিছু ভেতরে প্রবেশ করতেই বাজি ফুটে। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ে তার আত্মা কেঁপে উঠেছিল। তাকিয়ে দেখে কেক হাতে নিয়ে অনেকগুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে তাদের জন্য। তখন সে বুঝল এজন্যই এতোক্ষণ ঘোরাঘুরি চলছিল।
সারিকা বলল, ভাবি সব তো সাদামাটা হলো, ভাবলাম প্রথমবার আমাদের বাড়িতে পা রাখবে এটা অন্তত সেলিব্রেট করি! তাই এসে মাত্রই সবাই ডেকোরেশনে বিজি হয়ে গেছি। এখন নাও কেক কাটো।

ইসরা কেক কেটে ভিতরে ঢুকল। আরুশ তার পাশেই। আরুশের বন্ধু, কাজিন সবাই উপস্থিত ছিল। সবাই হৈ হুল্লোড় করে পুরো বাড়ি মাথায় তুললো। খাওয়া দাওয়া শেষ করে ইসরা যখন রুমে ঢুকে তখন রাত প্রায় বারোটা। রুমে ঢুকতেই সে ভীষণ চমকে যায়।
“এরা দেখি তুলকালাম করে ফেলেছে! ফুল দিয়ে বাসর সাজিয়ে রেখেছে,,,,”

আরুশের চাচাতো ভাবী তার হাত চেপে দুষ্টুমিভরা ইঙ্গিত দিয়ে বলল, এক সপ্তাহ আমার দেবরটাকে উপোস রেখেছ। আজ আর রেখো না ভাই।

ইসরা অসাড় হয়ে বেডে বসল।সারাদিন একটার পর একটা ঝাটকা পেতে পেতে সে আসলেই হয়রান হয়ে গেছে।
মাথায় পানি ঢালতে হবে, বিপি হাই হয়ে গেছে নিশ্চিত।

চুলে টাওয়েল পেঁচিয়ে যখন ইসরা বের হয় আরুশ তখন বেলকনীতে দাঁড়িয়ে ছিল। তাই ইসরা তাকে খেয়াল করে নি। মানুষের ঘরে সাধারণত একটা আয়না থাকে। কিন্তু এই ঘরে ছোট বড় অনেকগুলো আয়না। তবে বেশিরভাগই পর্দা দিয়ে ঢাকা। ইসরা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে পর্দাটা উপরে তোলে। ভেজা চুলগুলো ঝেড়েমুছে নেয়। শাওয়ার নিয়ে ক্লান্তিটা অনেকখানিই দূর হলো বোধহয়। সে আপন মনে নিজের ব্যাগ থেকে লোশন বের করে হাতেপায়ে মাখতে থাকে। মনে মনে ভাবে ঐ পাগল লোকটা আসবার আগেই ঘুমিয়ে পড়তে হবে। কিন্তু সে বিচারী তো জানে না বেলকনীর গ্লাস দিয়ে তার প্রতিটি গতিবিধি কেউ একজন খুব মন দিয়েই দেখছে। ইসরা জানালার পর্দা টেনে যেই বেলকনীর কাচের দরজা আটকাতে হাত বাড়ালো, অমনি আরুশ তার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। ইসরা ভয়ে চিৎকার দিতেই আরুশ তার মুখ চেপে বলে, এমন ভুবন ফাটিয়ে চিৎকার করছেন কেন? লোকে কি ভাববে বলুন তো?

ইসরা মুখ থেকে ওর হাত সরিয়ে তেজি গলায় বললো, এসব কেমন অসভ্যতা। এরকম হঠাৎ করে কেউ উদয় হয়ে টান দেয়? আপনি এতোক্ষণ এখানে ছিলেন শব্দ করেন নি কেন?

আরুশ ওর কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না। বরং তাকে ঘুরিয়ে দু’ হাতে কোমর জড়িয়ে ভেজা চুলে নাক ডুবিয়ে গাঢ় গলায় বললো, এতো রাতে চুল ভেজালেন কেন? বরকে পাগল করতে? বেশ স্মার্ট তো আপনি!

ঘাড়ের কাছে তপ্ত শ্বাসের উপস্থিতি টের পেতেই ইসরা মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেল, তার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে, আরুশের পুরুষালী বাহুতে নিবদ্ধ হয়ে সে আবেগী হবার পরিবর্তে ভয়ার্ত হয়ে গেল। মাশুক স্যারের বিভৎস স্পর্শ যা সে আজও ভুলতে পারেনি সবটাই যেন তার শরীরে পুনরায় উজ্জীবিত হচ্ছে।
ইসরার পুরো পৃথিবী টলতে থাকে। মনে হয় চারদিকে এতো অন্ধকার কেন! সব যেন আধারে তলিয়ে যাচ্ছে। সে নিস্তেজ গলায় বলতে থাকে, আমাকে ছেড়ে দিন স্যার, আমার এতো বড় সর্বনাশ করবেন না…

ইসরা অজ্ঞান হয়ে আরুশের হাতের মাঝেই ঝুলে পড়ে। আরুশ দ্রুত তাকে কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দেয়, ইসরার গালে হাত নেড়ে ডাকতে থাকে। কিন্তু তার কোনো সাড়াশব্দ পায় না। নিজেকে মনে মনে গালি দিয়ে বলে, ধুর আমি একটা ইডিয়ট! আমার উচিত হয় নি এমন হুট করে তাকে কাছে টানার। বেচারী মেন্টালি প্রিপেয়ার ছিল না হয় তো। কিন্তু তাই বলে এভাবে সেন্সলেস হয়ে পড়ে যাবে? আমিতো কিছুই করলাম না, জাস্ট জড়িয়ে ধরতেই কেউ বেহুশ হয়?!

সেই রাতে ইসরার গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে, আরুশ বেচারা তাকে কি জব্দ করবে বরং নিজেই ভয়ে জব্দ হয়ে গেল। ফুলে ফুলে সাজানো ঘরটায় সারারাত জেগে ইসরাকে জলপট্টি করলো। যদিও তার ইচ্ছে ছিল ওকে হটপিটালাইজ করার, কিন্তু ঘরভর্তি মানুষরা কি না কি ভেবে বসে তাই আর রুম থেকে বের হয় নি। ডাক্তার বন্ধুর পরামর্শে রাতটা কোনোমতে পার করে।
শেষ‌ রাতে ক্লান্তিতে চোখ লেগে আসতেই সে শুনতে পায় ইসরা প্রলাপ বকছে, আরুশ ওর মুখের কাছে কান পেতে বোঝার চেষ্টা করে ইসরা কি বলছে। কিন্তু স্পষ্টভাবে কিছুই বোঝা যায় না। তাকিয়ে দেখে ইসরা কাঁদছে, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কেঁদে কেঁদে কি যেন একটা অনুরোধ করছে,,,

তিন দিন জ্বরে ভুগে ইসরা এখন অনেকটাই সুস্থ। এই কয়দিন আরুশ প্রয়োজন ব্যতীত তার সামনেও আসেনি, না কোনো কথা বলেছে। বরং একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখেছে। নিজেকে কেন যেন খুব ছোট মনে হচ্ছিল, তাই ইসরার মুখোমুখি হয়নি। ওদিকে ইসরাও বেশ অস্বস্তিতে আছে সেই রাতের কথা ভেবে।
সে জানে বিবাহিত জীবনে শরীর এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আরুশের সম্পূর্ণ অধিকার আছে তাকে স্পর্শ করার। কিন্তু সে কি করবে! ওর ভয়ঙ্কর অতীত ওকে সহজ হতে দিচ্ছেনা। ভেতরে ভেতরে তার যে তীব্র ভয়, সেই ভয় কাটাবে কিভাবে? এজন্যই সে বিয়ে করতে চায় নি। অনাকাঙ্খিতভাবে এই ডোরে বাধা পড়েছে ঠিকই, কিন্তু এগিয়ে নিতে পারবে তো?! আচ্ছা সে কি আরুশকে বলবে সে যেন তাকে ডিভোর্স দেয়? তার নামের পাশে ডিভোর্সী খেতাব লাগালে আরুশের প্রতিশোধের আগুন কি নিভবে না? একবার কি কথা বলে দেখবে সে?

আরুশ রুমে প্রবেশ করতেই ইসরা নড়েচড়ে বসে। গলা ঝেড়ে বলে, আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে। আপনি কি ফ্রি আছেন?

বলুন কি বলবেন?

আমি এই বিয়েটা কন্টিনিউ করতে চাইছি না, আপনি কি দয়া করে আমাকে ডিভোর্স দিবেন?

আরুশ ভ্রু উচিয়ে জিজ্ঞাসু গলায় বলল, স্যরি?

দেখুন আমাদের বিয়েটা জাস্ট একটা কাগজের সম্পর্ক। এখানে মায়া মোহাব্বত হবার মতো কিছুই নেই। আপনি জাস্ট একটা জেদের বশে বিয়েটা করেছেন। আর আমি জানি এই জেদের পরিণতি আপনার জন্য লাভজনক হবেনা। তাই বলছি মিচুয়ালি ডিভোর্স টা করে ফেলি।

এতে আমার লাভ হবে বলছেন?

অবশ্যই! আপনাকে যে হার্ট করেছে সে যদি ডিভোর্সী খেতাব পেয়ে যায় এই সমাজে কেউই তাকে ভালো চোখে দেখবে না। এটা কি এনাফ হবে না আপনার ঝাজ মেটার?

আরুশ নিজের চুলে দ্রুত হাত চালিয়ে রাগ দমানোর চেষ্টা করলো। তারপর রাগীস্বরে বলল, এখানে আমিও যে ট্যাগটা পাবো সেটা মাথায় আসছে না আপনার?

আপনি ছেলে, আপনার উপর বিশেষ এফেক্ট হবেনা।

রুশফিকা আপনার কি মনে হয় আমি আপনার পরামর্শ শুনবো?

শুনতে আপনাকে হবেই,

আমি বাধ্য নই।

জেদ ধরবেন না আরুশ। আমি যা বলছি এতে আমাদের দুজনেরই ভালো হবে।

তাহলে ১০০% নিশ্চিত থাকুন এটা আমি কখনোই করবো না।

ইসরা হতাশ হয়ে বালিশে মাথা রেখে দেয়ালের দিকে মুখ ফিরালো। আরুশ কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে