মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-১৮

0
358

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-১৮

#আরশিয়া_জান্নাত

মণি একটা কথা বলি?

হুম মা বলো?

মাকে তুই কতটা ভরসা করিস?

হঠাৎ এই কথা কেন মা?

শারমিন আহমেদ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে বললেন, ইসরা মামণি। তোমার প্রতি আমাদের আরো যত্নশীল হওয়া উচিত ছিল।

কিছু হয়েছে মা তুমি কাঁদছো কেন?

তিনি নিজেকে সামলে বললেন, তুই যে স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তি সে একটা নর*পশু। আমি এখন বুঝতে পারছি কেন তুই এতো অসুস্থ হয়ে পড়েছিলি। সবটা আমার কাছে পানির মত ক্লিয়ার। আমি কেমন মা! মা হয়েও মেয়ের মনের খবর বুঝতে পারিনি। তুই ঐটুকু মেয়ে নিরবে সবটা সহ্য করেছিস মণি!

ইসরা চমকে তার মায়ের দিকে তাকায়। তবে কি আরুশ তাকে বলে দিয়েছে! শারমিন আহমেদ বললেন, তোরা তো দেশে ছিলি না এখানে তো তুলকালাম বেঁধে গেছে। ঐ জানোয়ারের পতন ঘটেছে। পুরা দেশে খবর হয়ে গেছে। বিস্তারিত পড়ে আমার সর্বপ্রথম তোর কথাই মনে পড়েছে।
ইসরা তুই কেন আমাদের কিছু বলিস নি!

মা বাবাও কি জানে!

শারমিন আহমেদ চোখের পানি মুছে বললেন, তোর বাবা তোকে কত ভালোবাসে সেটা অজানা তোর?

ইসরা মায়ের বুকে মাথা রেখে বললো, আমি চাই নি মা তোমরা সেসব জানো,,,

মণি মা-বাবার কাছে কিছু লুকোতে নেই। ওখানে তোর দোষ ছিল না। জানি ঘটনাটা স্বাভাবিক নয়, তবে আমাদের মেয়ের খারাপ সময়ে আমরা থাকতে পারিনি এ ভেবেই কষ্ট পাচ্ছি।যাক যা হবার হয়ে গেছে। ঐসব স্মৃতি ভুলে যা। মানুষের জীবনে খারাপ ঘটনা ঘটতেই পারে। ঐসব কিছুই না।

ইসরা চুপ করে বসে রইলো। বহুবছর পর মায়ের বুকে চোখের পানি ফেলে মনটা হালকা করলো।

আরুশ অফিস থেকে ফিরে ব্যাগটা রেখে শার্টের বোতাম খুলছিল, এমন সময় ইসরা এসে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আরুশ মৃদু হেসে তাকে সামনে টেনে আনলো। ইসরার কোমড় জড়িয়ে বললো, কি ব্যাপার বলো তো? মিস করছিলে বুঝি?

ইসরা তার গলা জড়িয়ে বললো, আপনিই করেছেন তাই না?

কি?

নক্ষত্রের পতন?

কই না তো! পতন হয়ে গেল নাকি?

একদম ঢং করবেন না, আমি জানি আপনিই করিয়েছেন।

খুশি হয়েছ?

হুম অনেক,,

তাহলে যেই করুক ঐটা ব্যাপার না। তুমি খুশি এটাই মুখ্য

ইসরা আরুশের শার্টের বোতাম সবগুলো খুলে ওর উন্মুক্ত বুক জড়িয়ে ধরলো। বুকে নাক ঘষে আদুরে গলায় বললো, এতোক্ষণ এটাকে অনেক মিস করছিলাম!

তাই নাকি!

হুহ।

তুমি তো বড্ড বেশরম হয়ে গেছ!

হলে হয়েছি! নিজের মনের কথা বললে কেউ বেশরম বললেও কি? অন্যের বুক তো চাই নি, নিজের বরেরটা চেয়েছি।

তাই বুঝি ম্যাম?

ইসরা চোখ বন্ধ করে নিজের মানুষটাকে পরম আবেশে জড়িয়ে রাখলো। আরুশ তার কপালে চুমু খেয়ে বললো, এখানেই ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? আমি ফ্রেশ হবো তো। ছাড়ো।

নাহ, এভাবেই থাকুন। আমি আগে মন জুড়িয়ে নিই।

এই রুশফিকা?

হুম?

তুমি চাইলে অফিসে জয়েন করতে পারো তো। আমার আশেপাশেই থাকবে সবসময়। ভালো হবে না বলো?

বাবা মা রাজী হবেন?

হবেনা কেন? ইনফ্যাক্ট বাবাই সেদিন বললো,,

আচ্ছা।


মাশুক সাহেব চুপচাপ বসার ঘরে বসে আছেন। একটু আগে তার বড় মেয়ে এসে কান্নাকাটি করে গেছে। এমনিতেই মেয়েটার বাচ্চা হয় না বলে শ্বশুড়বাড়িতে অশান্তির শেষ‌ নেই। এখন বাবার কীর্তির খবর শুনে ঐ বাড়িতে টেকা মরণসম হয়ে উঠেছে। কেঁদেকেটে সেই কথাই বলে গেল। ছোট মেয়ে তো মুখ ই দেখলো না। তার মাকে চেঁচিয়ে বলল, আমার যেসব বান্ধবীরা এতোদিন আমায় মাথায় তুলে রাখতো স্যারের মেয়ে বলে তারাই এখন আমাকে যা তা বলে।
মাশুক সাহেব সেসব শুনেও না শোনার ভান করে পড়ে রইলেন। তিনি জানেন এই পর্ব সবেই শুরু। ছেলেরা আসবে, পাড়া প্রতিবেশী আসবে, আত্মীয় স্বজন সব আসবে অপমান করতে। মাশুক সাহে মনে মনে যতোই বলুক এসব তিনি তোয়াক্কা করেন না তবে যে ঘটনা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে তার প্রভাব এড়ানো এতো সহজ? যার মারফত ছাড়া পেয়েছেন সেও শুরুতে অপমান করতে ছাড়েনি। কিন্তু তার একটা দূর্বলতা জানে বলেই জামিন করতে বাধ্য হলো। মাশুক সাহেব ঠিক করলেন তিনি দেশের বাইরে চলে যাবেন। সব ঠান্ডা হলেই নাহয় আসবেন। কিন্তু এখন বৈ*ধভাবে কোথাও যাওয়া সম্ভব না। গেলে অ*বৈ*ধভাবেই যেতে হবে। আপাতত ইন্ডিয়া গিয়ে গা ঢাকা দিতে হবে।
তার স্ত্রী ফারজানা এসে দরজায় দাড়ালেন, মাশুক সাহেব চিন্তায় মগ্ন থাকায় সেদিকে খেয়াল করলেন না। ফারজানা বললেন, একটা সত্যি কথা বলবা? এই রকম করে কি লাভ হলো? তোমাকে নিয়ে আমার গর্ব ছিল। সব শেষ করে দিলা,,,
ঐসব বাজে কথা ফারজানা। আমায় তুমি ভরসা করো না? আমাকে ষড়যন্ত্র করে ফাঁসানো হয়েছে। তুমিই বলো আমি যদি সত্যিই অপরাধী হতাম এতো সহজে জামিন পেতাম?

ফারজানা বেগম হাসলেন হেসে সোফায় বসে বললেন, মাশুক! তুমি যদি জেলে থাকতে আমিবিশ্বাস করতাম এসব ষড়যন্ত্র। কিন্তু তুমি এতো সহজে জামিন পেয়ে ফিরে এসে নিশ্চিত করলে তুমি সৎ নও। এদেশে সৎ মানুষদের জেল থেকে বের হওয়া কঠিন অসৎদের নয়!!

মাশুক স্ত্রীর দিকে বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাকালেন। তিনি ভাবতেন তার স্ত্রী সহজ সরল বোকা ধরনের। তিনি যা বলবেন চুপচাপ তাই মানবেন।কিন্তু সে এতো বুদ্ধিমতি এতো বছর সংসার করেও সে জানেনি। ফারজানা বেগম ঠোঁটের কোণে বিষাদমাখা হাসি ঝুলিয়ে বললেন, একটা কথা কি জানো তোমরা পুরুষরা ভাবো তোমরা ভীষণ চালাক। বাইরে যা ইচ্ছে করে বেড়াবে ঘরের স্ত্রী কিচ্ছু টের পাবেনা। তোমরা নিজেদের খুব দক্ষ ভাবো ধোঁকা দেওয়ার ক্ষেত্রে। অথচ ভুলে যাও স্ত্রীদের আল্লাহ এমনভাবে বানিয়েছেন তারা খুব সহজেই অনেক কিছু টের পায়। কিন্তু সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে, তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে চেয়ে অনেক নারী চুপচাপ সংসার করে যায়। আমি সবসম। দোআ করতাম তুমি দ্রুত মরে যাও, অন্তত তোমার মুখোশ সন্তানদের সামনে খসে পড়বার আগেই মরে যাও। কিন্তু আমার ভুললে হবে না আল্লাহ কিছু পাপের শাস্তি পৃথিবীতেই দেন।

বলে তিনি আর অপেক্ষা করলেন না। দ্রুত রুম ত্যাগ করলেন।
বাসায় বসে থাকা অসম্ভব হয়ে উঠেছে। দুনিয়ার মানুষ বাড়ির সামনে ভীড় করে মিছিল করে, জুতার মালা নিয়ে এসে তার প্রতিকৃতির গলায় ঝুলিয়ে আগুন জ্বালায়। ইট মেরে গ্লাস ফাটিয়ে দেয়। টিকটকার, সাংবাদিকদের ভীড় তো আছেই। সব মিলিয়ে বাড়িতে থাকা তার জন্য অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে।
তার দুইটা ল্যাব একটা স্কুল কর্তৃপক্ষের আরেকটা ব্যক্তিগত। ব্যক্তিগত ল্যাবটা বাড়ি থেকে কিছুটা দূর মাটির নীচে। সেটার ব্যাপারে সবাই জানে না। তাই মাশুক সাহেব সেখানে গিয়ে বসে রইলেন। ভাবতে লাগলেন চারদিকে যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে তা থেকে বাঁচার উপায় কি! তিনি যদি জানতেন বাড়ি ফিরলে এতো ঝামেলা পোহাতে হবে, তবে জেলখানাতেই থাকতেন। অন্তত এতো অশান্তি হতোনা। ভিআইপি ট্রিট পাওয়া যেত। এদিকে বাড়ি থেকে বের হয়ে বাইরে যাওয়ার সব ঠিকঠাক ও করতে পারছেন না, ফোনে যে কিছু বলবেন সেই ভরসাও নেই। কেননা ফোনের কথাও ট্র্যা*ক করা যায়‌। জীবনে এই প্রথম তিনি এতো অসহায় বোধ করছেন। চারপাশে কেউ যেন নেই তার পক্ষে,,,

হঠাৎ দরজা খোলার আওয়াজ শুনে মাশুক পেছনে তাকায়। তাকিয়ে দেখে সেদিনের ঐ লোকটা। মাশুক বিরক্তস্বরে বলে, আপনি এখানেও চলে এসেছেন! আমার সব জায়গা কি মুখস্ত করে রেখেছেন? কয় মাস নজর রেখেছেন আমার উপর?

কি করবো বলুন স্যার আমার কাজ ই এটা!

সব তো শেষ হলোই, আর কি চাই?

না না না কিছুই তো শেষ হলো না। আপনি এখনো স্বাভাবিকভাবে ল্যাবে বসে আছেন, খাচ্ছেন ঘুমাচ্ছেন। এটা তো সব শেষের লক্ষণ না!

আমার চারদিকে তাকালেও বুঝবেন কি হালে আছি!

কিন্তু এইটুকুতে যে মন ভরছেনা স্যার!

কি চাও তুমি?

বেশি কিছু না স্যার, আপনার তৈরীকৃত বিশেষ ক্যামিক্যালটা দিয়ে আপনার পুরু*ষা*ঙ্গটা পুড়িয়ে দিবো। আর হাত দুটো সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে গলাবো। আপনার বিদঘুটে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে এখানেই জারে সংরক্ষণ করবো। ব্যাস এইটুকুই চাওয়া আমার।

মাশুক সাহেব বিস্ফোরিত চোখে সামনের লোকটার দিকে চেয়ে অস্ফুট স্বরে বললেন, কে তুমি? আমার সঙ্গে তোমার কি শত্রুতা? আমাকে এভাবে হ*ত্যা করার পরিকল্পনাই বা করছো কি উদ্দেশ্যে?

আমাকে আপনার বোকা মনে হয়? আইনের উপর ছেড়ে দিয়ে আমি চুপচাপ থাকবো ভাবলেন কিভাবে? ওটা তো জাস্ট আপনার নাম ডুবাতে প্রকাশ করেছি। আপনার মতো নক্ষত্রের পতন ঘটানোর সামান্য চেষ্টা। আসল শাস্তি তো আমিই আপনাকে দিবো,,

আমি পুলিশকে ফোন করবো। আমাকে খু*ন করে তুমি পার পাবে ভাবছো?

আফসোস হচ্ছে, আপনার মতো জ্ঞানী মানুষ এমন বোকা বোকা কথা বলবে স্বপ্নেও ভাবিনি। ক্ষমতা ব্যবহার করলেন অথচ ক্ষমতার তাৎপর্য বুঝলেন না।

মানে?

একদম সোজা, যেটা ব্যবহার করে আপনি পার পেয়েছেন ওটা ব্যবহার করে আমিও পার পাবো! ইটস নট এ বিগ ডিল,,,

দেখো বাবা আমাকে অযথা মেরে ফেলো না। কি চাই তোমার বলো আমি সব দেবো।

লোকটা ভয়ঙ্কর ভাবে হাসতে লাগলো। সেই হাসির শব্দ ঐ বদ্ধ কামড়ায় প্রতিফলিত হচ্ছে তীব্রভাবে।

নরসিংদী জেলার প্রধান শিক্ষক মাশুক রহমান নৃ*শংসভাবে হ*ত্যা হয়েছেন। প্রাথমিক ধারণা করা হচ্ছে ভুক্তভোগীর কেউ এই হ*ত্যা*কান্ড ঘটিয়েছেন। গত কয়েকদিনে তার অনেক কুকীর্তির খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু পুলিশের কাস্টডিতে বেশিদিন রাখা যায়নি। এতে জনগণের মাঝে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। সারাদিন রাত তার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ মিছিল করে তাকে এক প্রকার গৃহবন্দী করে রাখা হয়। বাড়ির পেছনে ব্যক্তিগত ল্যাবে তার লাশ খুঁজে পায় পরিবারে লোকেরা। শরীরের বিশেষ অঙ্গগুলি জ*ঘ*ন্য*ভাবে ক্ষ*তবি*ক্ষত করা হয়েছে তারই তৈরীকৃত ক্যামিক্যাল দিয়ে। ডিবি পুলিশ কেইসটা তদন্ত করছে, বিস্তারিত ৪র্থ কলামে,,,

নিউজটার দিকে চেয়ে আরুশের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে।

চলবে,,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে