মিস্টার নার্সিসিস্ট পর্ব-০৬

0
333

#মিস্টার_নার্সিসিস্ট পর্ব-৬

#আরশিয়া_জান্নাত

হসপিটালের করিডর পার করে আমি যখন দাদীর কেবিনে যাচ্ছিলাম প্রতিটি পদক্ষেপে বুকটা ধুরুধুরু করছিল। কি জানি কতোটা দেরী হয়েছে আসতে? দম আছে দেখব তো?,, দাদীর সাথের অনেক স্মৃতিই পুরো রাস্তায় মানসপটে ভাসছিল, আমি মনেপ্রাণে দোআ করছিলাম সে থাকুক।

বুবুন!

আমার ডাক শুনে তিনি ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন। অস্ফুট স্বরে বললেন, ননী!

আমি দৌড়ে দাদীর বুকে গিয়ে কেঁদে ফেললাম। আমার রাগী মেজাজের খিটখিট করা দাদীটা এমন জীর্নশীর্ণ নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে আছেন এ আমার মন কিছুতেই নিতে পারছিলনা। আমি এক প্রকার মরা কান্নাই জুড়ে দিয়েছি।

বুবুন আমি আশাই রাখিনি তোমাকে পাবো, আমার মনে হয়েছে সব শেষ,,এখনি আমাকে ছেড়ে যেও না বুবুন।

ওরে আমি ঠিক আছি রে, এখনো মরিনাই। এভাবে কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে?

আমি চোখমুখ মুছে বললাম, আরো বেশি করে জর্দা দেওয়া পান খাও, মিষ্টি খাও। ওসব খেয়েই তোমার আজ এই হাল হয়েছে।

তুই আসি গেছস না, আমার সব অসুখ ভালো হয়ে যাবে।

আমি তার হাত ধরে বললাম, বুবুন আল্লাহ তোমাকে আমার হায়াৎ ও দিয়ে দিক। তবুও তুমি আমার পাশেই থাকো।

হ আমার লম্বা হায়াৎ হবে, আর তুই বিদেশ পড়ি থাকবি!

তুমি বললে এবার তোমারে সাথে করে নিয়ে যাবো।

দাদী হাসলেন। আমি ছলছল চোখে দাদীর দিকে চেয়ে রইলাম।

২দিন পর দাদীকে রিলিজ দেওয়া হয়। ডাক্তারদের মতে আর হসপিটালে রেখে লাভ নেই, যে কয়দিন আছেন পরিবারের সঙ্গেই থাকুক। বাসায় ইতোমধ্যেই অনেক আত্মীয়স্বজনের সমাগম ঘটেছে। সবাই যেন তার মৃত্যুর প্রহর গুনছেন। এই ব্যাপারটা খুব প্যাথেটিক হলেও আমাদের সবাইকে তার মধ্য দিয়েই যেতে হচ্ছে। এর মধ্যে দাদী ডিক্লেয়ার দিলেন তিনি আমার বিয়ে দেখে যেতে চান। তিনি চান না আমি কোনো ইহুদিকে বিয়ে করে সিডনীতে চিরস্থায়ী হয়ে যাই। এই চিন্তা মাথায় করে তিনি শান্তিতে মরতেও পারছেন না। আমি তখন হাসবো নাকি কাদবো বুঝলাম না। মানুষটা মৃত্যুশয্যায় থেকেও কিভাবে এমন কিছু চাইতে পারে! তখনই ছোট ফুফু আমায় বলল, ইসরা মামণি তুই তো আমাদের সবার লক্ষি মা। আমার মায়ের শেষ ইচ্ছেটা পূরণ করে দে না।

অবস্থা তখন এতোটাই নাজুক আমি হ্যাঁ না কিছুই বললাম না। আমার দাদীর শিয়রে বসেই আমাকে কাবিন নামায় স্বাক্ষর করতে হলো। পাত্র সম্পর্কে কিছু জানার ফুরসতটুকু পাই নি। না সেদিকে আমার মনোযোগ ছিল। আমি শুধু জানি আমার বুবুনের শেষ ইচ্ছটা আমি পূরণ করছি। এখন সেটা যাই হোক,,,

আমার বিয়ের কার্যক্রম শেষ হবার খানিক বাদেই তিনি সবাইকে চিরতরে বিদায় জানান। যেন এই একটা গুরুদায়িত্ব মেটাতেই সে বেঁচে ছিল।

.

বেলকনীতে দাঁড়িয়ে দাদীর কবটার দিকে চেয়ে ভাবছি গত কয়েকদিনের ঘটনার কথা। কত দ্রুত সব ঘটে গেল। দাদী মারা গেছেন আজ ৭দিন হলো। আমরা গ্রামে এসেছি মেজবান করতে। বাড়ির পূর্বদিকে পারিবারিক কবরস্থানে দাদাজানের পাশেই তাকে দাফন করা হয়েছে। অবাক করা বিষয় হলো আমি এখনো জানি না আমার কার সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। আমিও আগ বাড়িয়ে নির্লজ্জের মতো কাউকে বলতে পারি নি কোথায় সে! তবে তার পরিবারের সবার সঙ্গেই টুকটাক কথা হয়েছে।
হঠাৎ আমার ছোট ভাই ফাহিম বলল, আপি দুলাভাই এসেছেন।

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পেছন ফিরে দরজায় তাকালাম। তারপর যাকে দেখলাম নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছিল!

দুলাভাই আপনারা কথা বলুন আমি যাই।

ফাহিম চলে যেতেই সে আমার সামনে এসে বলল, কেমন আছেন মিস রুশফিকা আই মিন মিসেস আরুশ!

আপনি এখানে! আপনার সঙ্গেই তাহলে আমার…

ও মাই গড সিরায়াসলি রুশফিকা? আপনি বরের নাম না দেখেই বিয়ে করে ফেলেছেন! আই কান্ট বিলিভ‌।

আমি চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসলাম। মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠছে যেন। ঐ মুহূর্তে আগপিছ কিছু না ভেবেই কাবিনে সাইন করাটাই আমার ভুল ছিল। কেন যে দাদীর ভালোবাসায় অন্ধ হয়ে এই নার্সিসিস্টকে বিয়ে করেছি। শালা নিশ্চয়ই অন্য মতলবে বিয়েটা করেছে। তার সঙ্গে আমার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা এটাই বলছে, সে আমায় ভালোবেসে বা পছন্দ করে বিয়ে করেনি এ আমি ঠিকই বুঝতে পারছিলাম।
দাদীর শোক মুহূর্তেই কেটে গেল যেন, এখন নিজের অনাগত জীবনে কি ঘটতে চলেছে তারই আতঙ্কে শোকাচ্ছন্ন হয়ে গেছি। আমায় চুপ থাকতে দেখে আরুশ মুখোমুখি বসে বলল, আপনার ধারণাই ঠিক রুশফিকা। আমি আপনাকে পছন্দ করে বিয়ে করিনি। বিয়েটা করেছি রিভেঞ্জ নিতে। আপনাকে অশান্তিতে রাখতে। এখন থেকে আপনার জীবনে ভালো কিছুই ঘটবে না। সব খারাপ ঘটনাই ঘটবে।

এটা কি এয়ারপোর্টের সেই ঘটনার রেশ‌ ধরেই!

আরুশ মুখ শক্ত করে বললো, ওটা আপনার কাছে তুচ্ছ মনে হতে পারে, তবে আমার জন্য মোটেও তা নয়। আপনি জানেন না ঐ একটা ঘটনার প্রভাব আমার জীবনে কত কি পরিবর্তন করেছে। এর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে।

আপনি ভুল করছেন আরুশ। আমার উদ্দেশ্য তেমন ছিল না। আপনার কথার পিঠে জাস্ট উচিত কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল। আর আমি এর জন্য আগেই ক্ষমা প্রার্থনা করেছি। আপনার কি মনে হচ্ছে না আপনি বাড়াবাড়ি করছেন? এটা ওখানেই সমাপ্ত হবার ছিল। আর রিভেঞ্জ নেওয়ার থাকলে আপনার কাছে অন্য অনেক অপশন ছিল। আমার প্রেজেন্ট করা ডিলটা রিজেক্ট করলেও তো হতো। বিয়ে করে নিজের লস নিজেই কেন ডেকে আনলেন?

নিজের লস নিজেই ডেকে আনলাম মানে?

আমি তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললাম, নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রা ভঙ্গ করা” প্রবাদ টা শুনেছেন নিশ্চয়ই? ওটার জলজ্যন্ত প্রমাণ আপনি নিজে।

আরুশ থমথমে মুখে বললো, মোটেও নয়। আমি আপনাকে আমার চোখের সামনে রেখে অশান্তিতে থাকতে দেখবো। এটাই আমাকে শান্ত করবে। আপনার চোখে আমি পারফেক্ট নই। আমার অনেক খুঁত। তো বেশ এখন এই খুঁতে ভরা মানবটাই আপনার জীবনসঙ্গী।

আমি মনে মনে ভাবতে লাগলম, লোকটা আসলেই পাগল! এই সামান্য আনন্দের জন্য নিজের কি বড় ক্ষতিই না করলো। সে যদি জানে তার বিয়ে করা বউ একজন ধ*র্ষি*তা সব প্রতিশোধের আগুন দপ করে নিভে যাবে,,, উল্টো নিজেই পুড়বে বিরহের আগুনে। আমি ভাবলাম এই সুযোগে বলে দেই। জেনেশুনে কেউ নিশ্চয়ই এমন কাউকে গ্রহণ করবেনা। তারপর আমিও আরামসে সিডনী ব্যাক করতে পারবো।

কথাটা যেই বলতে যাবো অমনি আমার বোন প্রিয়ন্তি আর সারিকা রুমে আসে। সারিকা বলে, ভাবি রেডি হয়ে নাও, এখান থেকে সোজা আমাদের বাড়িতে উঠবে।

প্রিয়ন্তি বলল, আপু এটা কিন্তু মোটেও ফেয়ার হলো না। আমার একটা মাত্র বড় বোনের বিয়েটা এমন সাদাকালো হলো। না পারলাম গেইট ধরতে না পারলাম আনন্দ করতে। তাও আশা ছিল পরে অনুষ্ঠান হবে।

আরুশ‌ বলল, আশা ভঙ্গ করছো কেন? অনুষ্ঠান তো হবেই। বেশ বড় করেই হবে,,

সারিকা বলল, আমিও ওকে তাই বলছিলাম।‌কিন্তু সে মানতে নারাজ। তার মতে শ্বশুরবাড়ি চলে গেলেই সব শেষ। আর কিছুই হয় না।

আরুশ হেসে বলল, এরকম হবেনা প্রিয়ন্তি। আমি আমার একমাত্র শালিকার ইচ্ছে অপূর্ণ রাখবো ভাবছো? জানোই তো কেমন সিচুয়েশনে আমাদের বিয়েটা হয়েছে, বাড়ির পরিবেশ একটু শান্ত হোক, শোক কাটিয়ে উঠো তোমরা তারপর নাহয় অনুষ্ঠান হবে?

প্রমিজ?

প্রমিজ!

বেশ তবে তাই হোক। আপু তোর ব্যাগপত্র আমি গুছিয়ে দিবো?

লাগবেনা। আমি একাই করতে পারবো।

আচ্ছা কর তাহলে। ভাইয়া নিচে চলেন সবাই আপনার খোঁজ করছে।

ওরা চলে যাওয়ার পর আমি ভাবতে লাগলাম কি হচ্ছে এসব! হুট করে ওখানে যাওয়ার কথাই বা কেন উঠলো। কই এই কয়দিনে কেউ তো কিছু বলেনি। আমি তো জানতাম কয়েক মাস পর অনুষ্ঠান করেই নিয়ে যাবে। তবে হঠাৎ বিনা মেঘে বৃষ্টিপাত হচ্ছে কেন!

বাংলাদেশে ফিরে এমনভাবে ফেসেছি আমি না পারছি কিছু বলতে; না পারছি সইতে। আমার নিজেকে রোবট ব্যতীত কিছুই মনে হচ্ছেনা। যেন আমি চাবি দেওয়া পুতুল। সবার কথামতো হাত পা নেড়ে নেড়ে নাচ দেখাচ্ছি!! আমি কখনোই ভাবি নি আমার বিয়েটা এমন অনাকাঙ্খিতভাবে হবে, তাও আমার দাদীরই মৃত্যুদিবসে! এখন মনে হচ্ছে বিয়েটা ঠিক দিনেই হয়েছে। এটা আসলেই আমার জীবনে শোকের দিন হিসেবেই লিপিবদ্ধ থাকবে। খুশির দিন আর হবে না। এলাইনার কথাই ঠিক, আরুশের মেন্টালী সিকনেস আছে। নয়তো এতো ক্ষুদ্র বিষয় কেউ এতোদিন মাথায় রাখে? অলমোস্ট দুই আড়াই বছর হয়ে গেছে। অথচ সে তারই জের ধরে আমার পরিবার অবধি এসে গেল, ভাগ্য তার পক্ষে ছিল বলেই অমন পরিস্থিতিতে আমার মতামত নেয়ার অবকাশ পায়নি আমার পরিবার। স্বাভাবিক অবস্থায় আমার বাবা মা কখনোই কোনো সিদ্ধান্ত আমার উপর চাপাতেন না এ আমি জানি। তাই নিজের ভাগ্যের উপর আরেকবার হতাশ হয়েই সবার কথামতো আরুশদের ওখানে যাচ্ছি।
আমি জানি না আমার জীবনে আবার কোন ঝড় আসতে চলেছে। সেই ঝড়ে আমি টিকে থাকতে পারবো তো? নাকি লন্ডভন্ড হয়ে যাবো ফের পূর্বের মতো? মাথাভর্তি দুশ্চিন্তা নিয়ে গাড়িতে বসতেই দেখি এ গাড়িতে আমি আর আরুশ ছাড়া কেউ নেই। আমি ঢোক গিলে মনে মনে দোআ ইউনূস আওড়াতে লাগলাম। এই লোকটা আমায় পথেই মেরে ফেলবে না তো??

চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে