মরীচিকাময় ভালোবাসা পর্ব-১৫

0
516

#মরীচিকাময়_ভালোবাসা
#পর্বঃ১৫
#লেখিকাঃদিশা_মনি

মৌরী প্লাবণকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার পর প্লাবণ অনেক চেষ্টা করেছিল মৌরীর মান ভাঙানোর। কিন্তু কোন কিছুই কাজে দেয়নি। মৌরীর মন আর গলাতে পারে নি প্লাবণ। যার ফলস্বরূপ মৌরীর থেকে এখনো আলাদা থাকছে সে।

এদিকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের ৬ মাসের সময়সীমা ইতিমধ্যেই পেরিয়ে গেছে। এখন সময় হয়ে গেছে তাদের আলাদা হয়ে যাওয়ার।

★★★
মৌরী বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আর মাত্র ১ টা দিন। তারপরেই ৬ মাস পূর্ণ হয়ে যাবে। মৌরীকে এখন তার জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আদৌ কি সে প্লাবণের সাথে সংসার করবে নাকি নিজের জীবনকে ভিন্ন দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। মৌরী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্লাবণের কথাই ভাবছিল। আগে শত অপমানের পরেও সে প্লাবণের সাথে লেপটে থাকত। কারণ সে অনেক ভালোবাসতো প্লাবণকে। আজকাল আর আগের মতো অনুভূতি নেই। এই তো প্রতিদিনই প্লাবণ তার কাছে আছে। তাকে অনুরোধ করে প্লাবণের জীবনে ফেরার জন্য কিন্তু মৌরীর মন কেন জানি মানতে চায় না। আর সে চায় না প্লাবণের জীবনে ফিরে যেতে।

কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের পেপারটা হাতে নিয়ে মৌরী প্লাবণের কথা ভেবে বলে,
“আমাদের যাত্রাপথ বোধহয় এটুকুই ছিল। হয়তো আগের আমি হলে খুব সহজেই প্লাবণক ক্ষমা করে দিতে পারতাম। কিন্তু এখনকার আমি সেটা পারব না। তোমাকে ক্ষমা করে দেওয়া মানে আমার নারীত্বকে অপমান করা।”

আচমকা মৌরীর ফোন বেজে ওঠে। মৌরী ফোনটা রিসিভ করতেই আতিফা বেগম বলে ওঠেন,
“কেমন আছিস মৌরী?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো বড় মা। তুমি?”

“আমিও আলহামদুলিল্লাহ। আচ্ছা তুই কি কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিস?”

“হুম।”

“নিশ্চয়ই তোর সিদ্ধান্ত যে কাল তুই কন্ট্রাক্ট ম্যারেজটা শেষ করে দিবি?”

“হ্যাঁ, আমি সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছি।”

“খুব ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস তুই! আমিই বোধ হয় পৃথিবীর প্রথম মা যে তার ছেলের ডিভোর্সের কারণে এত খুশি হচ্ছি। প্লাবণ তোকে ডিজার্ভ করে না। তুই একটা কাজ কর দ্রুত ডিভোর্স টা দিয়ে দে। এরপর আমি তোর যোগ্য ছেল দেখে তোর সাথে বিয়ে দেব।”

“না বড়মা। আমি আর বিয়ে করব না।”

“এসব কেমন কথা বলছিস তুই? সারাটা জীবন কি একা কা’টাবি নাকি?”

“কেন জীবন কি একা কা’টানো যায়না? একটা মেয়ে কি আজীবন একা কা’টিয়ে দিতে পারে না?”

“সারাটা জীবন কা” টানোর জন্য সঙ্গীর প্রয়োজন।”

“আপাতত আমি কাউকেই ভরসা বা বিশ্বাস করতে পারব না। ভালোবাসা, সম্পর্ক, বিয়ে এই সব কিছু এখন আমার কাছে মরীচিকার মতো।”

“আশাহত হবি না একদম। দেখবি তোর জীবনে খুব ভালো একজন কেউ আসবে৷ যে তোর লণ্ডভণ্ড জীবনটাকে সাজিয়ে দেবে নতুন করে।”

“দেখা যাক।”

অতঃপর তারা আরো কিছুক্ষণ আলাপ আলোচনা করে ফোনটা রেখে দিয়ে দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ে।

★★★
মৌরী কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের পেপারস নিয়ে কোর্টে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হবে এমন সময় প্লাবণ চলে আসলো। মৌরীর হাত থেকে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের পেপারটা কেড়ে নিয়ে বললো,
“তুই এমনটা করতে পারিস না। আমি ভালোবাসি তোকে। তুই আমার সাথে সব সম্পর্ক এভাবে শেষ করতে পারিস না।”

“তুমি আমাকে ভালোবাসলেও আমি তোমায় ভালোবাসি না প্লাবণ। তোমার এই ভালোবাসা আমার কাছে কোন মূল্য রাখে না।”

“প্লিজ আমাকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখ..”

“আমার মন মানছে না।”

“আমি তোকে ছাড়া বাঁচব না।”

“প্লিজ আমার পিছনে ছুটো না। আমি এখন তোমার কাছে মরীচিকা। আমার পেছনে ছুটলে তুমি জীবনে কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাবে না। আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে। এই সত্যটা এবার মেনে নিতে শেখো।”

“তার মানে তুই আমাকে আর সুযোগ দিবি না তাই তো?”

“অনেক দিন থেকেই আমি তোমাকে বলছি আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি৷ এখন থেকে তোমার আর আমার পথ সম্পূর্ণ আলাদা।”

“ঠিক আছে, তুই যখন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিস তখন আমি আর তোকে জোর করবো না। এর আগে তোকে জোর করেই তোকে হারিয়েছি…আসলে হয়তো আমি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেছিলাম..”

বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়ে প্লাবণ। প্লাবণকে এভাবে কাঁদতে দেখে মৌরীর খারাপ লাগে। কিন্তু তার হাতেও তো কিছু নেই। প্লাবণ একটু থেমে বলে,
“তুই আমার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাস না ঠিক আছে কিন্তু মনে রাখিস আমার মনে সবসময় তুই থাকবি। আমার মনে তোর জন্য যে যায়গা আছে সেটা কখনো কেউ নিতে পারবে না। প্রয়োজনে আজীবন আমি একা থাকবো।”

“তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না। আপাতত আমি নিজের সিদ্ধান্তটা নিয়ে নেই।”

বলেই মৌরী কন্ট্রাক্ট ম্যারেজের পেপারস নিয়ে চলে যায়। প্লাবণ করূণ দৃষ্টিতে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। এখানেই একটি সম্পর্কের পরিপূর্ণ ভাবে সমাপ্তি ঘটলো।

★★★
পাথরের মূর্তির ন্যায় নিজের প্রিয়তমার দিকে তাকিয়ে আছে প্রত্যুষ। জীবনে অনেক কষ্ট অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে ছেলেটা। ছোটবেলায় মায়ের মৃত্যু, সৎ মায়ের অত্যাচার সবমিলিয়ে তার জীবন ছিল নরক সমতূল্য। এই নরকে এক টুকরো স্বর্গের সুখ নিয়ে এসেছিল মৌ। কিন্তু আজ মৌ অন্য কারো সাথে ঘর বাধতে যাচ্ছে। প্রত্যুষের এত দিনকার নিঃস্বার্থ ভালোবাসা যেন ফিকে হয়ে গেল মৌয়ের পরিবারের ঠিক করা বড়লোক ছেলের অর্থের কাছে। তাই তো মৌ বিনাবাক্যে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল।

মৌ বিরক্ত হয়ে প্রত্যুষকে জিজ্ঞেস করল,
“তুমি এখানে এসেছ কেন? আমার সুখ কি তোমার সহ্য হচ্ছিল না?”

“এটা তুমি কিরকম কথা বলছ মৌ?”

“ঠিকই তো বলছি। দেখ প্রত্যুষ, তুমি দেখতে অনেক স্মার্ট, সুদর্শন জন্য আমি তোমার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছিলাম। তবে তোমার এই রূপ ধুয়ে তো আর আমি পানি খাবো না। জীবনে চলার জন্য টাকার প্রয়োজন।”

“আর ভালোবাসা! তার কি কোন মূল্য নেই!”

“আবেগ দিয়ে জীবন চলে না। আমি একটা সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখি। তোমার মতো বেকার ছেলেকে বিয়ে করলে যেটা কখনোই পূরণ হবে না৷ তাই আমি নিজের জীবনের গন্তব্য খুঁজে নিয়েছি।”

গগণবিদারী হাসি দিল প্রত্যুষ। নিজের হাসি দিয়ে কষ্টগুলোকে লুকানোর চেষ্টা করল৷ মৌ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করল,
“এভাবে হাসছ কেন?”

“তোমার কথা শুনে। আজ সত্যি আমি জীবনের আসল মানে বুঝতে পেরেছি। তুমি আমার জীবন একটা মরীচিকা ছিলে। যার পেছনে আমি আমার জীবনের ৫ টি মূল্যবান সময় নষ্ট করেছি। যাইহোক আজ নিজের ভুলটা বুঝতে পারলাম। তোমাকে ধন্যবাদ আমাকে পৃথিবীর আসল মানেটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। তোমার আগামীর জীবন সুখী হোক। আমি বুঝতে পেরেছি ভালোবাসা কিছুই না টাকাই সব। তাই আর আজ থেকে ভালোবাসা নয় আমি টাকার পেছনেই ছুটব।”

কথাগুলো বলেই প্রত্যুষ মৌয়ের সামনে থেকে চলে আসে। আজ থেকে তার নতুন জীবন শুরু। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার এক নতুন লড়াইয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলবে সে।

৫ বছর পর,
বড় একটি বিএমডব্লিউ গাড়িতে বসে আছে প্রত্যুষ। জ্যামে গাড়ি আটকে থাকায় বিরক্তিতে নাক মুখ কুচকে আসে। এমন সময় হঠাৎ গাড়ির মধ্যে কেউ টোকা দেওয়ায় বিরক্তির মাত্রা বাড়লো। কাচ নামিয়ে কিছু রূঢ় কথা বলতে যাবে তখনই দেখল ছোট্ট একটি মেয়েকে। তার হাতে অনেকগুলো ফুল। মেয়েটি প্রত্যুষের দিকে ফুলগুলো বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এই নেন সাব। ফুলগুলা অনেক সুন্দর। আপনার ভালোবাসার মানুষকে দিবেন সে অনেক খুশি হবে।”

প্রত্যুষ বিদ্রুপাত্মক হাসল মেয়েটার কথা শুনে। অতঃপর নিজের মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে মেয়েটার হাতে দিলো। মেয়েটা অনেক খুশি হলো। প্রত্যুষকে ফুলগুলো দিতে চাইলে সে বলে,
“আমার এগুলা লাগবে না। ফুল দিয়ে কেউ খুশি হয়না, খুশি হয় টাকা দিয়ে। আর ভালোবাসা, এই শব্দের কোন অস্তিত্বই নেই পৃথিবীতে।”

জ্যাম ছেড়ে যাওয়ার গাড়ি চলতে শুরু করে। প্র‍ত্যুষ তার বাবার কোম্পানির বেশ সামান্য অংশই পেয়েছিল। অধিকাংশই ছিল তার সৎ ভাইয়ের কাছে। কিন্তু তার সৎভাই টাকা উড়িয়ে সব শেষ করেছে সেখানে প্রত্যুষ আজ পরিশ্রম আর কঠোর অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে নিজের কোম্পানিতে কোথা থেকে কোথায় নিয়ে এসেছে।

প্রত্যুষ তার ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে,
“আজকের সিডিউলটা বলো তো।”

“স্যার আজকে আপনাকে ৪ টা মিটিং করতে হবে। এরমধ্যে সবার আগে সকাল ১০ টায় মিটিং আছে চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের নতুন কর্ণধার মৌরী চৌধুরীর সাথে।”

প্রত্যুষ আর কিছু বলল না। এভাবেই তো তার দিন চলে যাচ্ছে। সেদিনের পর থেকে সত্যিই টাকার পেছনে ছুটছে সে।

চলবে ইনশাআল্লাহ ✨

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে