মন গোপনের কথা পর্ব-৮+৯

0
830

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৮
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

ছিকুর কথা শুনে মাহিদের রাগ আরও বাড়তে লাগলো তরতরিয়ে। ছিকু দাঁত দেখিয়ে দেখিয়ে হাসছে। মাহিদ তার সামনে দাঁড়ানো পিহুর দিকে তাকালো। পিহু ও ছিকুর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসছে।

‘ এখন এগুলা মুছ৷ নইলে তোর খবর আছে। তাড়াতাড়ি মুছ।

পিহু একদৌড়ে নিজের ঘরে গেল। একটি গামছা এনে মাহিদের শার্টের কলারের কাছটায় মুছতে গিয়ে আরও বেশি লেগে গেল। গামছা ছুঁড়ে ফেলে দিল পিহু। তার হাতের সব মেহেদী এলোমেলো হয়ে গেছে। তার এখন কাঁদতে ইচ্ছে করছে।

‘ তাড়াতাড়ি মুছ বেয়াদব।

পিহু ভড়কে গেল। দূরে দাঁড়িয়ে ছিকু এখনো খিকখিক করে হাসছে। পিহু সাহস পেল। মাহিদের শার্টে তার দু হাত সোজা বসিয়ে দিল। হাতের তালু, ও হাতের সব মেহেদী ঢলে দিল শার্টে। বলল

‘ এমনিতেই তো সব শেষ। শার্টটা একটু কালারিং হোক। ভালো লাগছে মিস্টার খান।

মাহিদ হতভম্ব পিহুর দুঃসাহস দেখে। চোখ দিয়ে যেন আগুনের স্ফুলিঙ্গ বের হচ্ছে। বহুকষ্টে নিজেকে সংযত করলো সে। পিহু গালে হাত দিয়ে ঠোঁট টিপে হাসছে।
এদিকওদিক তাকিয়ে হাতের মুঠো শক্ত করলো মাহিদ। দাঁতে দাঁত চেপে পিহুকে কিছু বলতে গিয়েও বললো বলল না ।

‘ ধ্যাত।

বিরক্তিসূচক শব্দ করে চলে গেল হনহনিয়ে। পিহু আর ছিকু হাসিতে ফেটে পড়লো সে যাওয়ার পরপর। ছিকু কিছুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে কপালে ভাঁজ ফেলে পিহুর দিকে চাইলো। কোমরে হাত রেখে গালফুলিয়ে বলল

‘ মিহি পিহুকে মারেনি কেন? শুধু বুকা দিচে কেন? কেন বাপ কেন?

পিহু নাকফুলিয়ে বলল

‘ তাই? আপনি পিহুকে মার খাওয়াইতে চাইছেন? পাজি ছেলে।

মিহি কেন পিহুকে মারলো না সেটা ভাবতে ভাবতে ছিকু মাহিদ যেদিকে গেল সেদিকে ছুটলো।

নিশিতা আর নিনিতরা মাত্রই এসেছে। মাহিদকে ওরকম রংচঙ মাখা দেখে তারাসহ বাকিসবাই অবাক চোখে তাকালো। নিশিতা ছুটে এসে বলল

‘ একি মাহিদ ভাই? তোমার এই অবস্থা কেন?

নিনিত বলল

‘ তাই তো। এসব কি জিনিস?

নীরা হাঁপিয়ে উঠলো দৌড়ে এসে। মাহিদের গলা থেকে খানিকটা মেহেদী হাতে নিয়ে বলল

‘ ওমা এতো রক্ত? নাহ চেনা চেনা গন্ধ। ও হ্যা মেহেদী। মেহেদী কোথাথেকে এল রে মাহি?

পেছন থেকে ছিকু বলল

‘ পিহু দিচে। লাল লাগায় দিচে। মিহি বুকা দিচে। পিহু লাল দিচে।

সবাই বুঝার চেষ্টা করলো ছিকুর কথা। নিশিতা এসে ছিকুর সামনে দাঁড়ালো। ছিকুর গাল টেনে দিয়ে বলল

‘ ওমা রাহি সাহেব। কেমন আছেন আপনি?

‘ রাহি ভালু। নিচি কিমুন আচে?

‘ নিচি খুব ভালো আছে। পিহু কোথায়?

‘ পিহুর লাল নাই। লাল ধুতে গিছে।

নিশিতা পিহুর ঘরের দিকে ছুটলো।
ইশা এসে মাহিদকে বলল

‘ ঘরে যাহ। শার্টটা পাল্টা। গোসল নিয়ে ফেল। রঙ লেগে যাচ্ছে তো। পিহু কি করেছে এসব?

বাড়িভর্তি মানুষের সামনে ইশার অস্বস্তি লাগলো কথা বলে ফেলতেই। নিনিতের মা আর বাবাকে বলল

‘ ওসব কিচ্ছু না। ওরা সবসময় এসব মজা করতে থাকে। আপনারা আসুন না।

নিনিত মাহিদের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল

‘ বাইরে আয়। আমি ওখানে আছি।

নীরা মাহিদের হাত টেনে বলল

‘ যাহ না মাহি। রঙ লেগে যাচ্ছে। কত মানুষ আশেপাশে, কোনো রাগারাগি করিস না পিহুর সাথে। মাহি?

‘ আমি বাড়ি যাব। এখানে আমার কাজ শেষ। আব্বাকে কিছু বলার দরকার নেই মা।

বলেই বাড়ির বের হতে লাগলো মাহিদ। নীরা তার পেছনে ছুটতে ছুটতে বলল

‘ একা বাড়িতে বসে কি করবি মাহি? বাড়ির চাবি তো তোর আব্বার কাছে। এই মাহি? দাঁড়া।

মাহিদ দাঁড়ালো। নীরা তার সামনে গিয়ে বলল

‘ তোর আব্বা এখন চলে আসবে। আমাকে এখনি ফোন করলো। এভাবে যাস না। খাওয়ার সময় নিনিত তো তোকে খুঁজবে। আজকে তোর ভাগিনার এত বড় একটা অনুষ্ঠান। তুই চলে যাবি? পরী শুনলে মন খারাপ করবে। তোর জন্য কতগুলো দিন পিছালো। যাস না আব্বা।

নীরার হাতে আটকা পড়ে গেল মাহিদ। তখনি রিক,রিপ, আদি আর নিনিতের বাবা নিয়াজ আহমেদকে বাড়ির গেইট পেরিয়ে ঢুকতে দেখা গেল। নীরা বলল

‘ ওই দেখ তোর আব্বা। কোথাও যাস না। তোকে না দেখলে আমার উপর চেঁচামেচি করবে আবার।

মাহিদ আর নড়লো না। রিক তাকে দেখে বলল

‘ কি অবস্থা হয়েছে তোর?

মাহিদ কান চুলকালো। বলল

‘ চেঞ্জ করতে যাচ্ছি।

পরী এসে বলল

‘ ভাই পিহুর রুমে তোর, রাহির আর রাহির পাপার পাঞ্জাবি তিনটে রেখেছি। যাহ রাহিকে রেডি করিয়ে দে। তুই ও পড়ে নে।

‘ মাহিদ মাথা দুলিয়ে চলে গেল।

পিহুর খাটের উপর উঠে আরাম করে বসলো নিশিতা। বলল

‘ মাহিদ ভাইকে মেহেদী লাগিয়ে কি অবস্থা করেছিস?

পিহু বলল
‘ ধুর আর বলিস না। ছিকু করেছে সব। আমাকে ধাক্কা দিল। আমার হাতের মেহেদী সব লেগে গেল মাহিদ ভাইয়ের শার্টে। দিদিয়া আর দাভাইয়ের কি একটা পাজি ছেলে হয়েছে। সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে। শেষে আমি একদম সব লাগিয়ে দিয়েছি।

‘ তুই ও কম না। তাড়াতাড়ি চল। আমার ভাই ও এসেছে।

‘ কে?

পিহুর প্রশ্নে কপাল কুঁচকে তাকালো নিশিতা।

‘ মনে হচ্ছে তুই আমার ভাইকে চিনিস না।

‘ স্যার তো আসবেই। সেটা ওভাবে বলার কি ছিল।

‘ তুই কি বিয়ের পরও ভাইয়াকে স্যার স্যার করবি নাকি?

চুল আঁচড়াতে থাকা পিহুর হাতটা খানিক্ষণের জন্য থামলো। আনমনে বলল

‘ জানিনা।

ততক্ষণে মাহিদ রুমে ঢুকে পড়লো এদিকওদিক না তাকিয়ে পাঞ্জাবি কোথায় তা খুঁজতে লাগলো। নিশিতাকে বলল

‘ নিশি তোকে ফুপী নাশতা করতে ডাকছে। তারাতাড়ি যাহ।

নিশিতা দাঁড়িয়ে পড়ে বলল

‘ পিহু তাড়াতাড়ি আয়।

পিহু মাথা নাড়লো। নিশিতা যেতেই পাঞ্জাবির ব্যাগটা নিয়ে এসে মাহিদের সামনে দাঁড়ালো পিহু। মাহিদ হাত বাড়ালো নেওয়ার জন্য। পিহু দিল না। আঙুল দিয়ে ইশারায় ওয়াশরুম দেখিয়ে দিল। মাহিদের নাকে এখনো মেহেদীর গন্ধ ঠেকছে। বমি পাচ্ছে তার। ছিঃ মেয়েরা এসব দিয়ে ঘুরে? কত নোংরা।
পরীর ঘরে চলে গেল মাহিদ। পাঞ্জাবি পড়ে নিয়ে শার্টটা এনে পিহুর হাতে ধরিয়ে দিল। বলল
‘ ধুয়ে দিবি। এক ফোঁটা মেহেদীর দাগ ও যাতে না থাকে।
‘ আমি ও চাই মুছে যাক।

ছিকু পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে আয়নায় নিজেকে বারবার চাইলো। আয়নার সামনে চেয়ারের উপর দাঁড়ালো। রাইনা কপালের পাশে টিপ পড়িয়ে দিল। ছিকু তা দেখে বলল

‘ মিহি টিপ পড়েনা কেন? রেহান টিপ পড়েনা কেন? ছিকু পড়ে কেন?

রাইনা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে আদরে আদরে ভরিয়ে দিয়ে বলল

‘ আমার দাদুর উপর যাতে নজর না লাগে। আমার আদর।

ছিকুর জন্য কিনে আনা মালা মাহিদ নিয়ে আসলো। ছিকুর গলায় পড়িয়ে দিয়ে বলল

‘ জামাই রেডি। বউ কোথায় বাপ?

রাইনা হেসে বলল

‘ ধুরর কিসের বউ? ওকে নিয়ে নিচে আয়। রেহান কোথায়?

‘ রেহান ভাই নিচে আছে।

রাইনা চলে গেল। মাহিদ ছিকুর ছোট্ট বালিশটা নিল। পরীর ওয়ারড্রব থেকে একটি পাথরের লাল ওড়না বের করলো। সেটি বালিশের গায়ে পড়িয়ে দিয়ে ছিকুর গলার মালা খুলে বালিশকে পড়িয়ে দিল। ছিকুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল

‘ নিচে গিয়া সবাইরে বলবি, এইটা আমার বউ। ছিকুর বউ। ঠিক আছে বাপ।

‘ বালিচ বুউ কেন? ছিকুর বুউ বালিচ কেন? কেন বাপ কেন?

মাহিদ তার গাল টেনে টাপুসটাপুস আদর করে বলল

‘ শালা যেটা কইতাছি সেইটা বলবি। নইলে তোর খবর আছে।

‘ কেন খবর আচে কেন?

‘ ওরেব্বাপ চুপ থাক।

ছিকু চুপ করলো। বউকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখলো। যদি পড়ে যায়?

ছিকু নিচে যেতেই সবাই তার দিকে হা করে তাকালো। মাহিদ তাকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে এককোণায় গিয়ে দাঁড়ালো। ছিকু রেহানের কাছে গিয়ে বলল

‘ পাপা এটা ছিকুর বুউ।

রেহান বালিশটা নিয়ে হেসে ফেলল। সাথে বাকিরা ও। রেহান বলল

‘ এটা বউ? এসব নিশ্চয়ই মামা শিখিয়ে দিয়েছে?

‘ মিহি বুলেছে কেন? মিহি মামা কেন?

রেহান তাকে কোলে তুলে নিল। বলল

‘ সেটা মিহির কাছ থেকে জেনে নিয়েন।

ইশা বলল

‘ এই মাহিটা এত দুষ্টুমি পারে! মামা ভাগিনা দুটোই পাজি। কেউ কারো থেকে কম না।

ছিকু সবার মধ্যমণি। এই কোল ওই কোল চড়ছে সে। বাইরে উঠোনে খাওয়াদাওয়া চলছে। পিহু রুম থেকে বেরোতে দেরী হচ্ছে দেখে ইশা গেল। দেখলো পিহু ব্যালকণির কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ইশা বলল

‘ বাড়িতে মেহমান আসলে দেখা দিয়ে আসাটা ভদ্রতা পিহু।

পিহু ভড়কে গেল। আমতাআমতা করতে করতে বলল

‘ ওখানে পাপা আর মামার বন্ধুরা ছিল তাই।

‘ তাড়াতাড়ি আসো।

‘ আচ্ছা।

নিশিতা এসে বলল

‘ তোর কি সমস্যা রে। ঘর থেকে বের ও হচ্ছিস না।

পিহু বের হলো। বলল

‘ এমনি। কোথায় আঙ্কেল আন্টি?

‘ আম্মা তোর মামিদের সাথে। আব্বা তোর আব্বাদের সাথে। তুই যাহ সবাই তোর জন্য অপেক্ষা করছে।

পিহু গেল। পিহুকে দেখার সাথে সাথে নিকিতা বেগম সরে বসলো। বলল

‘ ওমা! কখন এলাম। তোমার এতক্ষণে আন্টিকে দেখতে আসার সময় হলো?

পিহু সালাম দিয়ে বলল

‘ না আন্টি। ফ্রেশ হচ্ছিলাম। তাই একটু,,,

ইশা বলল

‘ তোমার নিয়াজ আঙ্কেল তোমাকে খুঁজছিলেন। যাও দেখা করে এসো।

পিহু সেখানে যেতেই প্রথমে রিপের চোখে পড়লো। রিপ বলল

‘ ওখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন মামা? আসো।

পিহু পা টিপে টিপে গেল। নিয়াজ আহমেদকে সালাম দিতেই ওনি সালামের জবাব দিয়ে বললেন

‘ বসো তোমার মামার পাশে। মুখ শুকনো কেন?

পিহু মিনমিন করে জবাব দিল

‘ না, এমনি।

পিহুর অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো। মনে মনে জপলো, আজ যাতে বিয়ে সম্পর্কিত কোনো কথা না উঠে।
উঠলো না। পিহু স্বস্তি পেল।

খাওয়া দাওয়া চললো। খাওয়াদাওয়া শেষে মেহমানের ভার ধীরে ধীরে হালকা হয়ে এল।
তখন সোফায় বসে গল্পগুজব করছিল সবাই। কথায় কথায় এক ফাঁকে বিয়ের কথা উঠলো। আদি বলল

‘ পিহুর মামারা থাকা অবস্থায় কথা হোক। আমি তাদের অনুমতি ছাড়া আগাতে পারিনা।

রিপ বলল

‘ নিনিত ভালো ছেলে। ওদের মত থাকলে আগানো উচিত। বিয়ে আজ না হয় কাল দিতেই হবে।

আফি বলল

‘ ঠিক আছে। পিহু ও ডাক্তার হইবো কিছুদিন পর, তার সাথে ডাক্তাররেই ভালো মানাইবো। এইখানে আবার ভাবাভাবির কি আছে?

রিক বলল

‘ হ্যা তা তো ঠিক। পিহু আর নিনিতের মত কি?

নিয়াজ সাহেব বললেন

‘ নিনিত ওর মায়ের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে বলেছে। অনেক কষ্টে মত নিয়েছি। পিহু হলে তো একবারেই সমস্যা নেই।

আফি বলল

‘ পিহু লজ্জাবতী মাইয়্যা আমার। হ্যা বলবো না মুখে। মেয়েরা ওসব বলেনা ভাই।

রিক মাথা নাড়ালো। ছিকু এসে বলল

‘ চবাই গপপো করে কেন? ছিকুকে মনে নাই কেন?

রিক তাকে টেনে নিয়ে কোলে বসালো। বলল

‘ পিহুর বিয়ের কথা চলছে ভাই। বিয়ে খাবে?

‘ খাব। বিয়ে খাব। খাব কেন? পিহুর বিয়ে কেন?

ছিকু সারাবাড়িকে জানিয়ে দিল পিহুর বিয়ের কথা। পিহু তাকে ঢেকে তার ঘরের ভেতর নিয়ে এল। বলল

‘ কে বলেছে এসব পঁচা কথা?

‘ চবাই বলে কেন? পুঁচা কথা বলে কেন?

পিহু বলল

‘ চলে যাও। ভালো লাগছেনা আমার।

ছিকু চলে গেল। মাহিদের আঙুল টেনে টেনে নিয়ে এল। পিহুর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজা ঠোকা দিল। পিহু দরজা খুললো। অবাক হলো খানিকটা। মাহিদ বলল

‘ কি হয়ছে?

ছিকু পিহুর দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল

‘ পিহুর ভালো লাগছেনা কেন? পিহুর মন খারাপ কেন?

মাহিদ ছিকু থেকে চোখ সরিয়ে পিহুর দিকে তাকালো। পিহু পিঠ করে দাঁড়ালো। মনে মনে বলল

‘ তুমি এই বাচ্চাটির চাইতেও মাসুম মাহিদ ভাই।

মাহিদ ছিকুকে কোলে তুলে নিয়ে পিঠে দুমদাম মেরে বলল

‘ বিয়া মানেই তো মজা। কিন্তু তোর খালা বিয়ার কথা শুইনা মন খারাপ করছে কিল্লাই সেটা আমি কি করে জানুম বাপ। চল বিয়ার খুশিতে মিষ্টি খায়। চল।

ছিকু লাফাতে লাফাতে বলল

‘ ওহ ওহ মিষ্টি খাব। মুজা খাব। খাব কেন? কেন বাপ কেন?

চলবে,

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৯
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

অতিথির আনা মিষ্টি আর সন্দেশ খেয়ে পেট বেড়ে গিয়েছে ছিকুর। উদাম পেটে হাত বুলালো সে। পেটের দিকে নিচু হয়ে তাকিয়ে মাহিদের দিকে একবার তাকালো। কাঁদোকাঁদো চেহারায় বলল
‘ মিহি বেলী বড় হয়ে গিছে কেন? ছিকুর বেলী এত বড় কেন? কেন বাপ কেন?

মাহিদ হা হু করে হেসে ছিকুর পেটে চিমটি দিল। বলল

‘ তোর পেটে বিলাই আছে বাপ।

ছিকু বলল

‘ বিলাই ম্যাও ডাকেনা কেন?

‘ চুপ থাক শালা। তুই মিষ্টি খাইছস ভালা কথা। কিন্তু তোর যদি পায়খানা ছুটে আমার দোষ নাই বাপ।

‘ কেন মিহির দুষ নাই কেন?

‘ আবার কেন কেন করোস! মুখ বন্ধ রাখবি আমি কথা বললে।

‘ কেন মুখ বনদো রাখবো কেন?

মাহিদ চোখ গরম করে তাকালো।

‘ মিহি ওমন করে দেখে কেন? ছিকুর ভয় লাগেনা কেন? হাচি পায় কেন?

মাহিদ বলল

‘ আমার কথায় তোর হাসি পায়?

‘ হ্যা পায় কেন? হাচি পায় কেন?

মাহিদ তাকে কোলে তুলে নিয়ে সোফায় ফেলে কুশন দিয়ে চেপে ধরলো। আবার সরালো। ছিকু হাসতে হাসতে বলল

‘ মিহি ইমুন করে কেন?

মাহিদ তার পেটে সুড়সুড়ি দিতে দিতে বলল

‘ তোর হাসি পায় আমার কথায়? তাইলে হাস। শুধু হাসবি। হাসতে হাসতে বেহুশ হ বাপ।

ছিকু হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেয়ে সোফা থেকে পড়ে গেল। ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে উঠে বলল

‘ মিহি বিশিবিশি কাতুকুতু দেয় কেন? মিহি পুঁচা কেন?

মাহিদ ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসলো। পিহু এল। ছিকুকে কোলে তুলে নিয়ে বলল

‘ এভাবে অনবরত কেউ সুড়সুড়ি দেয়? শ্বাস আটকে যেতে পারে।

‘ আসছে ডাক্তারি শিখাইতে।

তাচ্ছিল্যের সুরে কথাটা বললো মাহিদ। পিহু রেগে তাকালো তার দিকে। কিছু বলতে গিয়ে ও বলল না। মাহিদ সোফায় শুয়ে পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বলল

‘ ছিকু শালা তোর লগে লগে খুশিতে বিয়ার মিষ্টি খাইয়্যা আমার অবস্থা বারোটা। বমি আইতাছে বাপ।

পিহু চলেই যাচ্ছিল। মাহিদের কথায় ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। তেড়ে গেল ছিকুকে কোলে সমেত। কুশন নিয়ে মাহিদের মুখে চাপা দিয়ে বলল

‘ বিয়ে আমার। তোমার এত খুশি কিসের?

ছিকু চিল্লিয়ে উঠলো। বলল

‘ ও বাপ পিহু মিহিকে মারি ফেলে কেন? মিহি দুক্কু পায় না কেন?

মাহিদ কুশন সরিয়ে বড় করে শ্বাস নিল। পিহু রেগে তাকিয়ে আছে। মাহিদ ও তাকালো। শান্ত চোখে। যেন কিছুই হয়নি। তারপর উঠে দাঁড়ালো। পিহুর মুখোমুখি দাঁড়ালো। বলল

‘ আমার খুশি কিসের? এইটা কোনো কথা? তুই আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হলে আত্মীয় তো। আত্মীয়ের বিয়েতে খুশি হওয়া অপরাধ? অপরাধ হলে খুশি হতাম না। মেঝেতে বসে বসে চিল্লিয়ে কাঁদতাম।

বলেই একগাল হাসলো মাহিদ৷ পিহু আরও রেগে গেল। রাগে ঘনঘন শ্বাস-প্রশ্বাস আসা যাওয়া হচ্ছে তার। চোখ ফেটে জল আসার উপক্রম। সেসময় মাহিদ হেসে ফেলল। পিহুর মাথায় হাত চেপে বলল

‘ আরেহ আরেহ কান্দোস ক্যান? আমি তো মজা করি বাপ। ছিকুশালারে দেখ কত মারি একবার ও রাগ করে না। তুই রাগ করোস কিল্লাই? সামনে তোর বিয়া, চিল কর চিল। যাহ তোরে আর রাগাইতাম না। দোয়া কইরা দিলাম। সুখী হ। সুখী হ। খাঁটি দোয়া করলাম।

পিহু অবাক চোখে তাকালো। থেমেথেমে বলল

‘ তোমার আর কতরূপ আছে মাহিদ ভাই?

‘ অগণিত।

‘ তোমার অগণিত রূপ দেখার মানুষটা খুব ভাগ্য করে পৃথিবীতে এসেছে। তুমি ও ভালো থেকো। ভুলেও তার সাথে মজা উড়াতে যেওনা কিন্তু, সবাই পিহু নয়। সবাই পিহু হতে ও পারবে না।

মাহিদের কপালের মাঝ বরাবর দেখা গেল সূক্ষ্ম ভাঁজ৷ পিহু চলে গেল। মাহিদ বিড়বিড়িয়ে বলল

‘ কি বলে গেল?

নীরা এসে বলল

‘ আব্বা ইশু এখন ছাড়বে না। আমাদের থেকে যেতে হবে। তুই যাহ ঘুমিয়ে পড়। অনেক দৌড়াদৌড়ি হয়েছে আজ।

মাহিদ জায়গা থেকে সরলো না। নীরা বলল

‘ পিহুর সাথে কি ঝগড়া হয়ছে আবার? দেখলি তো ওর আজকে বিয়ের কথাবার্তা হলো, কদিন পর ফুড়ুৎ করে শ্বশুরবাড়ি উড়াল দেবে। তখন কথা বলার জন্য ও খুঁজে পাবিনা। দুজন দুদিকের বাসিন্দা হয়ে যাবি এখন ঝগড়াঝাটি বাদ দে। আর কত করবি? দুজনেই তো বড় হয়েছিস? একসময় সেসব মনে করে অনুতপ্ত হবি। নিনিত জানলে কিন্তু খবর আছে। তুই ওর বউয়ের গায়ে হাত তুলিস!

মাহিদ নীরার দিকে তাকালো। বলল

‘ কই মারামারি করছি? আজকে তো মারিনি। আজকে বিরাট এক চড় খাওয়ার কথা ছিল পিহুর। আমার শার্টটা তো ওরজন্যই নষ্ট হলো। কই আমি মারিনি তো। আমি অন্যের জিনিসের দিকে হাত বাড়ায় না মা। আমি খারাপ, কিন্তু নষ্ট নই।

নীরা অবাক চোখে ছেলের দিকে তাকালো। বলল

‘ ওমা রাগ করছিস কেন আব্বা? কথাগুলো তো রাগের। তোকে খারাপ কে বলল? আমি তো কারো মুখ থেকে কোনোদিন শুনলাম না। তুই সবার ভালোবাসার একজন মাহি। তোকে কত ভালোবাসে সবাই। তুই আমার কলিজারে। এভাবে কেন বলিস? আমার তো খারাপ লাগে। আমি মা তোর।

‘ আমাকে চাবি দাও বাড়ির। বাড়ি যাব।

রাইনা রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। মাহিদের কথা শুনে এগিয়ে এল। বলল

‘ এটা কেমন কথা মাহি? এতরাতে বাড়ি যাবি? তুই পাগল? কোথাও যেতে পারবি না।

ইশা এসে বলল

‘ কি হয়েছে?

‘ মাহি নাকি বাড়ি চলে যাবে।

ইশা বলল

‘ কেন? পিহুর সাথে কি আবার ঝগড়া হয়েছে? কি হয়েছে মাহি?

মাহিদ কাঠকাঠ বলায় বলল

‘ কিছু হয়নি। আমি বলেছি কিছু হয়েছে?

নীরা বলল

‘ আচ্ছা আচ্ছা আয়। তোকে ঘুম পাড়ায় দিই। চল রুমে চল। আজকে পরিশ্রম হয়ছে তো সেজন্য মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। আয় আমার সাথে।

নীরা তাকে নিয়ে গেল। ইশা বলল, এই ছেলেকে বুঝা কঠিন!

পিহুর মুখোমুখি গালে হাত দিয়ে বসে আছে ছিকু। পিহুর দিকে অনেক্ক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। একসময় বলল

‘ পিহুর কাঁদে কেন?

পিহু তার সাথে হাসলো। ঝুঁকে পড়ে গাল থেকে হাত সরিয়ে গালে চেপে চুমু খেল। কোলে তুলে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

‘ চোখে অসুখ হয়েছে আব্বা।

‘ চুখে অচুখ কেন?

‘ কোনো কথা না। এইবার ঘুমান। পিহু ঘুমাবে।

বকবক করতে করতে ছিকু ঘুমিয়ে পড়লো পিহুর কোলে। ঘুমন্ত বাচ্চাটির সারামুখে অজস্র আদর দিয়ে পাশে শুয়ে দিল পিহু। পরী এসে বলল

‘ ঘুমিয়ে গেছে। আচ্ছা ঘুমাক। আমার আরেকটু কাজ আছে। আম্মাকে এগিয়ে দিচ্ছি। আমি এসে নিয়ে যাব। কেমন?

‘ নাহ। থাক আমার সাথে আজ রাত। ও থাকলে আমার ভালো লাগে।

‘ কাঁদলে?

‘ আমি শান্ত করব।

_____________________

ব্রেকফাস্ট শেষ করার সাথে সাথেই মাহিদ, চৌধুরী বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। আজ একটা ম্যাচ আছে। জায়গাটা বহুদূরে। খেলতে যেতে হবে। ছিকু সকাল সকাল মাহিদকে খুঁজতে লাগলো ঘুম থেকে উঠে। মিহিকে না পেয়ে হেঁটেহেঁটে কাঁদছে৷ ইশা স্যান্ডেল এনে বলল

‘ সোনা স্যান্ডেল পড়ো। পায়ে ময়লা হচ্ছে তো।

‘ মিহি নাই কেন?

‘ মিহি আসবে। স্যান্ডেল পড়েন।

ছিকু স্যান্ডেল পায়ে দিল। পিহু তখন মেডিকেলের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। ছিকু দৌড়ে গিয়ে তার আঙুল ধরলো। বলল

‘ মিহিকে আনিবে কিমন?

‘ কোথাথেকে আনব আব্বা?

‘ মিহি নাই কেন?

‘ আমি কি জানি?

ইশা বলল

‘ বলো, মিহিকে নিয়ে আসব। নইলে কান্নাকাটি শুরু করবে। তোমাকে বেরোতে দেবে না।

পিহু ছিকুর সামনে বসলো। দু গালে আদর করে বলল

‘ আপনার মিহিকে নিয়ে আসব কলিজা। এক্ষুণি যাব, এক্ষুণি আসব।

ছিকু খুশি হলো। হাসলো। বলল

‘ আলাভিউ পিহু।

‘ আলাভিউ ঠু মাই লিটল ফাদার।

_____________

ম্যাচ শেষ করে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা নেমে গেল মাহিদের। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ফিরতে রাত নামলো। বন্ধুদের একজন লাবীব বলল, নিনিইত্যা শালা কোনো কাজের না, কত করে খেলতে আসতে বললাম। শালা পইড়া আছে হসপিটাল নিয়ে।

মাহিদ বলল

‘ ও খেলা পারেনা নইলে আসতো। আমাকে ফোনে বলছিলো। যাক আজকে জিতছি এটাই বেশি। গতবার যা মার খেলাম।

‘ সেটাই। মামা চা খায়। চল।

মাহিদ টং দোকানে চোখ রাখলো। মাথা দুলালো। বলল, খাওয়া যায়। চা খেয়ে আবারও রাস্তা ধরলো দুজন। সামনেই এক বিরাট সেঁতু। নিচে বয়ে চলা একটি খাল। খালটি পানিতে টুইটুম্বুর। রাতের আকাশ পরিষ্কার। ঠান্ডা বাতাস বইছে। মাহিদ তাকালো পরিষ্কার আকাশে। লম্বা দম নিয়ে হাঁটা ধরলো। হঠাৎ চোখ আটকালো সেতুর রেলিঙের কাছে। একটি লম্বা চুলের মেয়ে ঝুঁকে আছে নিচে। হাওয়ায় চুল ও উড়ছে। একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ পানির দিকে তাকিয়ে থাকবে কেন? তাও এমন রাতের বেলা। একা?
মাহিদ থমকে গেল। বন্ধুরা ও তার সাথে সাথে থমকে গেল। মাহিদের চোখ অনুসরণ করে দূরে তাকাতেই ভড়কে গেল তারা। পিছু হেঁটে বলল

‘ দোস্ত, ভূতটূত নাকি?

জবাব দিল না মাহিদ। দৌড়ে গেল দ্রুত পায়ে। ঝুঁকে পড়া মেয়েটিকে ধাক্কা দিয়ে বলল

‘ কি করছিস পিহু?

মেয়েটি ছিটকে পড়লো। আর্তনাদ করে উঠলো ছিটকে পড়ায়। মাহিদ হতভম্ব। তার বন্ধুরা দৌড়ে এল। ফোনে লাইট মেয়েটির মুখে মারতেই অনেক বড় একটা পাথর নেমে গেল যেন মাহিদের বুক থেকে। ধীরপায়ে হেঁটে গেল সে মেয়েটির কাছে। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল

‘ উঠুন। নাম কি আপনার? এ সময় এখানে কি করছিলেন? মরতে যাচ্ছিলেন?

মেয়েটি ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকালো। মাহিদের হাতে ভার রাখলো। ধীরেধীরে দাঁড়িয়ে পড়লো। কোমরে হাত রেখে বলল

‘ কোমরটা গেল। এভাবে কেউ ধাক্কা দেয় মিঃ ? আমি তো খালের পানিতে কিলবিল করতে থাকা মাছ গুলোকে দেখছিলাম। ধুরর।

মাহিদ আরেকদফা বিস্মিত। মাহিদকে বিস্মিত হতে দেখে হাসলো মেয়েটি। বলল

‘ অবাক হলেন?

মাহিদ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। চুপচাপ। মেয়েটি হাত বাড়িয়ে দিল। বলল

‘ আমি মাইশা। গবেষণা আমার পেশা। সেটা হোক গাছ কিংবা মাছ। এনিওয়ে আপনার নাম?

মাহিদ হাত বাড়ালো না। হাত দেখিয়ে বলল

‘ আমার হাতে ময়লা। সরি আমি অন্যকিছু ভেবে ধাক্কা দিলাম।

মাইশা মেয়েটি হাসলো। মেয়েটি হাসলে কি চোখ ও হাসে নাকি? দেখার আগেই চোখ নামিয়ে নিল মাহিদ। হাসি দেখার শখ ফুরিয়ে গেছে তার। ইচ্ছে নেই।

‘ আমার বাবা ওই শপিংমলে। আপনারাও কি ওদিকে যাবেন নাকি? আমি ও যেতাম আর কি।

মাহিদ মাথা নাড়লো। মাইশা বলল,

‘ তাহলে যাওয়া যাক। আপনার নামটা তো বলেননি।

‘ মাহিদ।

চলবে,
রিচেক করিনি পাঠক

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে