মন গোপনের কথা পর্ব-৫৪

0
823

#মন_গোপনের_কথা
#পর্ব_৫৪
লেখনীতে, পুষ্পিতা প্রিমা

গায়ে পড়া লাল শার্টের কলারটি তুলে তুলে বারবার নাক দিয়ে শুঁকছে ছিকু। ক্লাবে এসেছে অনেক্ক্ষণ হলো। মিহিকে সে কোথাও পাচ্ছেনা। দুঃখে তার বিরক্ত লাগছে৷ কান্না পাচ্ছে। ফ্লোরে শুয়ে গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পরী মারবে। সুন্দর কাপড় পড়েছে সে। পারফিউমের গন্ধ শুঁকতে আর ও কিছুদূর হেঁটে গেল সে। পরী ডাক দিয়ে বলল

সোনা বেশিদূর নয়৷ চলে এসো।

ছিকু ঘাড় ঘুরিয়ে পরীর দিকে চাইলো। এমনিতে তার মেজাজ খারাপ। মিহিকে পাচ্ছেনা৷ তার উপর পরী তাকে ডাক দিচ্ছে। রেগে বলল

চলি যেতে মন চায় কেন?

পরী আইমির সাথে কথা বলতেই আছে। ছিকু উত্তর না পেয়ে আর ও কিছুদূর গেল। নিচ তলায় নামবে সে। রেলিঙের কাছাকাছি গিয়ে উঁকিঝুঁকি দিল । পরী ডাক দিল

রাহি কতবার বলতে হয়? চলে আসো। নইলে মার দেব।

ছিকু চেঁচিয়ে উঠে বলল

পরীকে মার দিতে মন চায় কেন? মিহিকে দিখিনা কেন?

পরী আবার ও কথায় ব্যস্ত হলো। ছিকু হেঁটে হেঁটে সিঁড়ি ধরলো। বসে বসে এক সিঁড়ি করে করে নামলো। কয়েকটা মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতেই তাকে দেখলো৷ বলল

এই পিচ্চি কই যাও?

ছিকু নিচে দেখিয়ে দিয়ে বলল,

ওখানে যেতে মন চায় কেন? হেসে উঠলো সবাই। একজন কোলে তুলে নিয়ে নামিয়ে দিল। ছিকু তো মহাখুশি৷ মেয়েগুলোর সাথে খিক করে হাসলো। কোল থেকে নেমে এক দৌড় দিল৷

পরী তাকে না দেখে এদিকওদিক চাইলো৷ আইমি বলল

এখানেই তো ছিল তোমার ছেলে।

পরীর ডাক দিল

রাহি? কোথায় লুকিয়েছ? চলে এসো। রাহি?

তার ডাকে ইশা রাইনা মুনা ছুটে এল। বলল

কি হয়েছে?

রাহিকে পাচ্ছিনা৷ এখানেই তো ছিল৷

মুনা বলল

নিচে নেমে গেল নাকি?

নিচে কি করে নামবে? ও নিচে নামতে পারবে নাকি এত তাড়াতাড়ি? ওখানে খাওয়াদাওয়া হচ্ছে।

রেহানকে ফোন দে তাড়াতাড়ি।

পরী ফোন লাগালো সিঁড়ি ধরে নামতে নামতে। নীরা এসে বলল

কি হলো?

ইশা বলল

ছিকুসোনা কোথায় যেন চলে গেল? এত দুষ্টুমি কেমনে যে করে ছেলেটা৷ এক জায়গায় দাঁড়াবে না।

এখানে আশেপাশে কোথাও থাকবে। ভালো করে খুঁজে দেখতে বল। মাহিকে একটা ফোন দেই। দাঁড়া।

নীরা ফোন নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

পরী কাঁদোকাঁদো মুখে ফিরে এল। বলল

আম্মা ও তো নিচে নেই।

রেহান হন্যি হয়ে এসে বলল

তুমি কোথায় ছিলে? ওকে দেখা রাখতে পারোনি? আশ্চর্য!

পরী এদিকওদিক তাকাতে লাগলো হন্য হয়ে। রেহানের কথায় কান্না পাচ্ছে। তার কি দোষ?

রাইনা বলল

ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে আমি একটু বসেছিলাম ওদের সাথে। আমার সাথেই তো ছিল সারাক্ষণ।

পিহু হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এল মাইশার সাথে। বলল

এখনো পাওয়া যায়নি? সবখানে দেখেছ দাভাই?

হ্যা। বাইরে ও দেখলাম। কেউ কেউ বলছে একা একা নাকি হাঁটছিল। এই অল্প সময়ের মধ্যে কোথায় চলে যাবে ও?

আদি,রিপ,রিক,আফি, নিনিতের বাবা এসে জড়ো হলো। নিনিত,লাবীব আর তপু ও এল। লাবীব বলল

মাহিদের কাছে হয়ত। ও কোথায়?

নীরা এসে বলল

মাহির কাছে ফোন দিলাম। ও বলল ওর কাছে নেই। ও আসতেছে এখন। বাইরে ছিল। এটা কোনো কথা? ছেলেটা কি কোথাও উদাও হয়ে গেল নাকি?

পরী এবার ফুঁপিয়ে উঠলো। পিহু গিয়ে তাকে ধরলো। চেয়ারে বসিয়ে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল

কেঁদোনা দিদিয়া। ও খুঁজে নিয়ে আসবে।

ততক্ষণে সবাই তন্নতন্ন করে খুঁজছে ছিকুকে। মাহিদ ক্লাবের নিচে রাস্তায়। ছিকুকে পাওয় যাচ্ছেনা শুনে তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে। শালা হুট করে যাবে কোথায়? ক্লাবে এসে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলো। একটি নয় দশ বছরের বাচ্চা খোঁজ দিতে পারলো৷ বলল

ওই বাবুটা একা একা দৌড়াচ্ছিল আঙ্কেল। হোঁচট খেয়েছিল। আমি ধরতে চেয়েছিলাম। ও আমাকে বলল, কামুড় দি লকতো আনি দিব কেন?

অজান্তেই মাহিদের হাসি পেল। শালা তাইলে সবাইরে ভয় দেখাতে ও জানে।

তারপর আমি ওকে ধরিনি। পিছু পিছু গিয়েছি। ও বাইরে বেরিয়ে গিয়েছিল। তারপর কিছু ছেলে ওর সাথে কথা বলে কোলে করে রাস্তার ওপাশে চলে গেল।

মাহিদ ছেলেটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল

থ্যাংকস। দেখি ও আছে কিনা।

বলেই দৌড় দিল বাইরে। শালারে পাইলে আজ খবর আছে।
মাহিদ রাস্তার এপাশে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি দিতেই হঠাৎ রাস্তার বিপরীত পাশে আইসক্রিমওয়ালার পাশে একটা বাচ্চা ছেলেকে দেখতে পেল। ছেলেটির হাতে কমলা রঙের আইসক্রিম
মাহিদ দেখামাত্র দৌড় লাগালো। রাস্তা পার হতেই ছিকু তাকে দেখে চিল্লিয়ে উঠলো। মাহিদ গিয়ে তাকে কোলে তুলে গাল টিপে দিল জোরে। গালে ঠোঁট দিয়ে চেপে ধরে আদর দিল।

ছিকু হাসতে হাসতে বলল

মিহি আলাভিউ।

তোর আলাভিউর মারে বাপ শালা। তোর মা বাপ চৌদ্দ গুষ্ঠি তোরে না পাইয়্যা কান্তেছে। আর তুই এইখানে ঢং করোস। শালা! এইখানে কেমনে আসছোস?

পাশে কয়েকটা তরুণ ছিল। নবম দশম শ্রেণির ছাত্র হবে হয়ত৷ বলল

ভাইয়া ও দেখলাম একা একা এলোমেলো হাঁটছিল বকবক করতে করতে । কোথায় যাচ্ছ জিজ্ঞেস করতেই রাস্তার এপাশে আঙুল দেখিয়ে দিল। আমরা নিয়ে এলাম। বললাম
কার কাছে যাবে?
বলে মিহির কাছে যাবো। এখানে এসে দেখলাম মিহি নামের কেউ নেই। পরে বলল, আইসক্রিম খাবে। তাই আইসক্রিম কিনে দিলাম। আপনি ওর বাবা?

মাহিদ ছিকুর দিকে তাকালো। নাক দিয়ে ছিকুর নাকে দুম করে মেরে বলল

তুই কহ আমি তোর কে?

মিহি চচুর কেন?

বলোতো কি বলেছে?

ছেলেগুলো বলল

বুঝিনি।

আমি ওর শ্বশুরমশাই । আরেকটা বাপ। কিন্তু শালা বেয়াদব। আমাকে নাম ধরে ডাকে।

ছেলেগুলো একসাথে হেসে উঠলো। মাহিদ বলল

যাইহোক তোমরা বিয়েতে এসেছ না?

হ্যা।

খেয়েছ?

হ্যা।

ওকে না পেয়ে সবাই চিন্তা করছে। আমি যাই।

মাহিদ ছিকুকে নিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল। ছিকু বলল

মিহি লুকি ছিল কেন?

তো কি তোরে কোলে নিয়া বইসা থাকুম? শালা ধান্ধাবাজ। আমার বইনরে কাঁদাইছোস তুই। তোরে মাইয়্যা দিতাম না শালা।

ছিকু মাহিদের গলা জড়িয়ে খিকখিক করে হাসতে লাগলো। মিহিকে সে পেয়ে গেছে আর কিছু লাগবে না তার।

মাহিদের কোলল ছিকুকে দেখে যেন প্রাণ ফিরে এল সবার। রেহান ছুটে এসে কোলে তুলে নিল। গালে আদর দিয়ে বলল

কোথায় গিয়েছ বাবা? এভাবে না বলে কেউ যায়? কোথায় পেয়েছ মাহি?

রাস্তার ওইপাশে।

সবাই আঁতকে উঠলো। পিহু বলল

ওখানে কি করে গেল?

মাহিদ সবটা খুলে বলল সবাইকে। আদি বলল

এই ছেলেকে নিয়ে তো ভয় আছে। এই বয়সে এত পন্ডিত। একা একা মিহিকে খুঁজতে চলে গেছে৷

সবাই হেসে উঠলো।

পরী রেহানের কোল থেকে কেড়ে নিল ছিকুকে৷ গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে বলল

আজ হাত পা সব রশি দিয়ে বেঁধে রাখবো। নইলে যারা বলে আমি দেখে রাখতে পারিনা তাদের গলায় ঝুলিয়ে দেব৷ বলেই ছিকুকে নিয়ে হনহনিয়ে চলে গেল।

সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। পিহু রেহানের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো৷ রেহান মাথার পেছনে হাত ঝেড়ে যেতে যেতে বিড়বিড় করলো

কিছু বলা ও যায় না এই মেয়েকে৷

অবশেষে সবাই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। লাবীব নিনিতকে বলল

আমি ভাবছিলাম আজ তোর বিয়া গেছে। পুঁচকুরে পাওয়া না গেলে তো কেয়ামত হতো৷

তপু বলল

মাহিদ্দে থাকতে কারো বিয়া আটকাইতো না বাপ।

সবাই হেসে উঠলো একসাথে। পিহু লাবীব আর মাইশাকে উদ্দেশ্য করে হেসে বলল

ঠিক বলেছ তপু ভাই। লাবীব ভাই, মাইশা আর তোমার বিয়েও আটকাবে না।

মাইশা সেখান থেকে ধীরেধীরে সরে পড়লো। উফফ।

________

বিয়ে পড়ানো শুরু হলো দোতলায়। জালিশাকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মুখের উপর ঘোমটা দিয়ে। আশেপাশে মুরব্বিরা ছিল। জাবির গিয়ে মেয়ের পাশে বসলো। রেজিস্ট্রি খাতায় সাইন করার পর বাকি নিয়মকানুন মেনে বিয়ে হলো। তারপর মোনাজাত। মাহিদ উঠে গেল মোনাজাত পরেই।
পিহুকে গিয়ে বলল
ছিকু কোথায়?
দিদিয়া রুমাল দিয়ে ওর হাত পা বেঁধে সাজঘরে শুয়ে রেখেছে। কাউকে যেতে দিচ্ছেনা। রেগে আছে ভীষণ৷
মাহিদ চলে গেল ছিকুর কাছে। এদিকে নিনিতের হাতে জালিশাকে তুলে দেওয়ার পালা চলছে। জাবিরের আর চিন্তা নেই। একটি ভালো পরিবারে মেয়ের সংসার হবে। তার কত আদরের মেয়ে! মেয়েটা ভালো থাকুক। স্বামী সংসার তাকে আপন হোক। সুখী হোক তার রাজকন্যা।
আইমি পুরোটা সময় চুপচাপ। সে ভাইয়ের কাছেই মেয়ে দিয়েছে। ভাই নিজের মেয়ের মতোই আগলে রাখবে জালিশাকে। তারপর ও চোখের জল বাঁধা মানেনা। বারণ শোনেনা। জালিশা মা বাবার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে শুধু কেঁদেই গেল৷
নিনিত তার হাতের মুঠোয় থাকা হাতটার দিকে চেয়ে রইলো। এই যে হাতটা ধরে ফেলল এত অনায়াসে। একটা মানুষ আজ তার নিজের হয়ে গেল৷ তার উপর একজন মানুষের সুখে থাকা, ভালো থাকা এসে থমকে দাঁড়ালো। সে কি আদৌ ভালো রাখতে পারবে? বিয়ে তো শুধু সামাজিক নিয়ম নয়। লোক দেখানো আনুষ্ঠানিকতা নয়। বিয়ে মানে একে অপরের সুখদুঃখের সাথী হয়ে যাওয়া। ভালোবাসা দিয়ে বানানো ঘরে ভালো থাকা। আমি তুমি শব্দদুটো আমাদের হয়ে যাওয়া।

ফোনে কথা বলা শেষ করে নিশিতার কাছে আসতেই মুখোমুখি পড়ে যাওয়া লাবীবকে দেখে থমকালো মাইশা। ভুরু কুঁচকে তাকালো। লাবীব চোখ সরিয়ে নিল। মাইশা বলল

সাইড।

অনেক রাস্তা খালি আছে।

মাইশা সরেই যাচ্ছিল। লাবীব বলল

গুড। এভাবেই সরে দাঁড়ানো উচিত। ভেরি গুড।

মাইশা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। দাঁতে দাঁত গিজগিজ করতে করতে বলল

খারাপ লোক৷

খারাপ মহিলা।

হনহনিয়ে চলে গেল মাইশা। লাবীব হেসে উঠলো ।

___________

জালিশাকে গাড়িতে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। নিনিত জাবির, আদি আর রিপের সাথেই কথা বলছিল। মাহিদ ছিকুকে কোলে করে নিয়ে এল। হাত পা বাঁধা। নাকমুখ লাল ফোলা৷ ঠোঁট উল্টে উল্টে বলল

পুরী হাত বাধি দিচে কেন? পা বাধি দিচে কেন? কিউ খুলি দেয় না কেন? মিহি খুলি দেয় না কেন?

মাহিদ তার গালে ঠোঁট চেপে বলল

না তোর মা অনেক শর্ত দিয়ে তোরে আমার কোলে দিছে। তোর হাত পা খুলা যাইতো না।

রেহান এগিয়ে এল। বলল

এদিকে দাও মাহিদ। কি অবস্থা হয়েছে চোখে মুখের? ব্যাথা লাগছে বাবা?

ছিকু মাথা নাড়ালো।

মাহিদ সরে পড়লো। বলল,

না তোমার বউ আমার আস্ত রাখতো না বাপ। দেখা যাইবো আমারে সহ হাত পা বাইন্ধা ছিকুশালার লগে ফালায় রাখছে। না খুলোন যাইতো না।

সবাই ছিকুকে ওই অবস্থায় দেখে হাসতে লাগলো। পিহু এসে বলল

হায় হায় কলিজা তো হাঁটতে পারছেনা। কি কষ্ট!

মাহিদ বলল

তোর শ্বাশড়ি কি কয় দেখ।

পিহু হেসে বলল

যাহ কি বলো এসব?

ছিকু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল

পিহু চাচুরি কেন? চাচুরি হাসে কেন? খুলি দেয় না কেন?

পিহু মাথায় হাত দিল। বলল

কিসের শ্বাশুড়ি আল্লাহ!

মাহিদ হো হো করে হেসে উঠলো। ছিকু খিকখিক করে হেসে উঠলো। আবার ঠোঁট উল্টে বলল

চবাই দুক্কু দেয় কেন?

পিহু তাকে কোলে নিয়ে ফেলল। পাঁজাখোলা করে নিয়ে গালে কপালে চুমু খেয়ে বলল

দুষ্টুমি করেছেন কেন? পরী আপনাকে না পেয়ে কেঁদেছে সেটা জানেন? কাউকে না বলে আর কোথাও যাবেন? মিহি নিজেই আপনার কাছে আসতো। আর কখনো এমন করবেন?

ছিকু ড্যাবড্যাব চোখে রইলো পিহুর দিকে। ঠোঁট উল্টে বলল

মাথা ফাটি ফিলতে মন চায় কেন?

পিহু চোখ গরম করে বলল

আর কখনো করবেন? না বললে জীবনে ও কেউ খুলে দেবে না।

করবো না” সেটা ছিকু বলল না একবার ও। সে আর ও বিশিবিশি এমন করবে। তাকে বাঁধি রাখছে কেন?

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে