মন গহীনের শব্দ
| ১ |
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মেকাপের ফাইনাল টাচ দিতে দিতে আড়চোখে বিছানায় বসা দাদির দিকে তাকালাম আমি। দাদি পান খাচ্ছে। তার ঠোঁটদুটো লাল হয়ে আছে৷ সত্তর বছর বয়সী এই বৃদ্ধা যৌবনে যে ঠিক কী পরিমাণে সুন্দর ছিল, সেটা তার পান খাওয়া টকটলে লাল ঠোঁট দেখলেই বোঝা যায়৷ এই মুহূর্তে সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে ভ্রু কুঞ্চিত করে৷
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “দাদি, দেখ তো আমাকে কেমন লাগছে?”
“ন/টী বেডি। এত সাজছিস ক্যান? তোর কি বিয়া লাগছে আজ? নাকি দেখবার আসছে তোরে? আসবো তো মাস্টারে পড়াইতে। তার সামনে এত সাজন গোজন কিসের?”
ন/টী বেডি শব্দ দুটি দাদির মুদ্রাদোষ। শুধু সে নিজে বাদে পৃথিবীর আর সব মেয়েদেরই তার ন/টী বেডি মনে হয়।
আমি হেসে বললাম,
“তুমি বুঝবে না দাদি। তোমার মাস্টারের মনে আমাকে নিয়ে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে৷ সেই হাওয়া যাতে কালবৈশাখী ঝড়ে পরিণত হয় সেজন্যই সেজেগুজে যাচ্ছি।”
“সর্বনাশ! হাবলা মাস্টার একটা। তোর বাপের সামনে গেলেই চোরের মত জি জি করে। আর তোর দিকে হা কইরা তাকাইয়া থাকে। শ্যাষম্যাশ তুই কিনা ওই হাভাইত্যার পেরেমে পড়লি?”
“উফ! দাদি, ভালোবাসা হলো পবিত্র একটা ব্যাপার। এত নিয়ম-কানুন মেনে কখনও প্রেমে পড়া যায় না। তুমি এসব বুঝবে না বুড়ি। তুমি বসে বসে পান খাও। আমি গেলাম।”
দাদিকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই আমি রুম থেকে বের হয়ে গেলাম। পিছন থেকে সে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছে, “রুনি, ওই রুনি, আজমলরে ডাক। ওর সাথে এখনই আমার কথা আছে। ওর মাইয়ায় তো বংশের ইজ্জত ডুবাইলো বইল্যা। যত জলদি পারা যায় এইটারে বিয়া দেওয়া লাগবো৷ আজমল গ্যালো কই?”
দাদীর অহেতুক চিৎকার যেন কানে না আসে সেজন্য স্টাডি রুমের মধ্যে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলাম আমি। তখনই পিছন থেকে মৃদু আপত্তি জানালেন তিনি,
“একি সুজাতা, দরজা চাপালে কেন?”
আমি সামনের মায়াময় সৌম্য মুখটির দিকে তাকালাম। মহাশয়ের নাম আবির। আমার হোম টিউটর। নামকরা একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে পড়ছে। এবার ফাইনাল ইয়ার। বোকার হদ্দটা পড়াশোনা ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। আমি বললাম, “যাতে নির্বিঘ্নে পড়াশোনা করতে পারি সেজন্যই দরজা ভেজিয়ে রেখেছি৷”
“দরজাটা খুলে দাও।”
“কেন?”
“তুমি বুঝতে পারছ না। এভাবে দরজা বন্ধ করে দুজন একসাথে থাকাটা ভালো দেখায় না।”
আমি না বোঝার ভান করে জিজ্ঞাসা করলাম, “কেন ভালো দেখায় না?”
“তোমাকে কীভাবে যে বোঝাই।”
“আশ্চর্য, আপনি এমন ভাব করছেন যেন দরজা লক করে আমি আপনার শ্লীল/তাহানি করছি।”
আমার কথা শুনে আবির স্যার হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষন। তারপর বললেন, “ছি, সুজাতা। তুমি কী বলছ এসব?”
“একদম ছি ছি করবেন না। আর আপনাকে কতবার বলেছি, আমাকে শুধু ‘সু’ বলে ডাকবেন। আমার কাছের মানুষেরা আমাকে এভাবেই ডাকে।”
“আমি তোমার কাছের মানুষদের মধ্যে কেউ নই। আমি তোমার শিক্ষক।”
“কে বলেছে আপনি আমার কাছের মানুষ না? আপনি তো আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ। আমার মনের মানুষ। দাদির ভাষায় বলতে গেলে আমার পিরিতের মানুষ।”
মাস্টার সাহেব আমার কথা শুনে খুকখুক করে কেশে উঠলেন। মনে হয় আমাকে কিছু বলার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। আমি তাকে কিছু বলার সুযোগ দিলাম না। ব্যস্ত হয়ে বললাম, “অনেক হয়েছে প্রেমের আলাপ। এখন আমাদের পড়াশোনা শুরু করা উচিৎ।”
তিনি হতাশ চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে ম্যাথামেটিক্স এর বই খুললেন। দেড় ঘন্টার মত পড়ালেন আমাকে। এরমধ্যে তাকে যতরকম জ্বালাতন করা যায় সবই করলাম আমি। বেচারা আমাকে পড়াতে এসে ভালোভাবেই ফেঁসে গেছে। পড়ানো শেষ করে উঠে যাওয়ার জন্য দাঁড়াতেই আমি তার হাত ধরে ফেললাম। তিনি আঁতকে উঠে হাত সরিয়ে ফেললেন।
আমি আবারও হাত ধরে কাতর কন্ঠে বললাম, “আপনার জন্য আজ এত সুন্দর করে সেজেছি। অথচ আপনি শুধু কয়েকবার আড় চোখে দেখে আর তাকালেন না। প্লিজ, আমাকে ভালো করে দেখুন একবার।”
“এসব তুমি কি শুরু করেছ সুজাতা৷ আমার হাত ছাড়ো, কেউ এসে পড়তে পারে। প্লিজ, আই বেগ।”
আমি হাত ছেড়ে দিলাম। স্যার চলে যাওয়ার পরপরই আমার ডাক পড়ল বাবার রুমে।
আমার বাবার নাম আজমল তালুকদার। এই শহরের সবচেয়ে প্রভাবশালী মানুষগুলোর মধ্যে সে একজন। সামনের মেয়র ইলেকশনের জন্য আজকাল আটঘাট বেঁধে প্রস্তুতি নিচ্ছে বাবা।
কারণে অকারণে বিভিন্ন সময়েই আমার ডাক পড়ে বাবার রুমে। আমি রুমের সামনে গিয়ে খোলা দরজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিয়ে বললাম, “মে আই কাম ইন স্যার?”
“আরে আম্মা। এদিকে এসো। আমার রুমে আসতে আবার তোমার পার্মিশন নেয়া লাগবে নাকি?”
“অবশ্যই নিতে হবে। ভবিষ্যতের মেয়র তুমি। কিছুদিন পর পুরো শহরই তো চালাবে তুমি।”
“কী যে বলো আম্মা। তুমি আমার মা। তোমার কোনো পার্মিশন লাগবে না। আসো তো, আমার কাছে এসে বসো এখন। তোমার সাথে কথা বলি একটু।”
“কথা কি দাদীজান সংক্রান্ত?”
“আরে না। তাকে নিয়ে আর কী বলব। প্রত্যেকদিন নতুন কোনো না কোনো নিষয় নিয়ে বাড়ি মাথায় তোলা তো তার পুরোনো অভ্যাস। গত দুইদিন কাজের ব্যস্ততায় তোমার সাথে দেখা হয়নি। সেজন্যই ডাকলাম। তোমার সাথে কথা বললে মনের মধ্যে শান্তি লাগে আম্মাজান। তুমি চেহারা পেয়েছ আমার আর তোমার দাদির মত। কিন্তু তোমার হাঁটাচলা, কথাবার্তা বলার ধরন হুবহু তোমার মায়ের। তোমার সাথে কথা বললে তাই কলিজায় শান্তি লাগে।”
“বাবা, তোমাকে অনেকবার বলেছি মায়ের কথা কখনও আমার সামনে বলবে না। যে মহিলা স্বামী সংসারের কথা চিন্তা না করে এমন বিশ্রী একটা কাজ করল, তার জন্য এখনও এত দরদ কেন তোমার?”
“এইভাবে বলে না আম্মা। সে তোমার মা হয়। তার সাথে আমার অনেক সুখ দুঃখের স্মৃতি আছে। আমার হাত ধরে এক কাপরে সে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল, তখন আমার কিচ্ছু ছিল না। কতদিন যে অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছি আমরা। তারপরেও তোমার মা একটা অভিযোগ পর্যন্ত করে নাই কখনও। একসময় আমার গাড়ী বাড়ি সব হলো, অথচ তখনই তোমার মা আমাকে আর তোমাকে একা করে দিল। আমার ভুলেই আমি তাকে হারালাম। তার প্রতি ভালোবাসায় কমতি ছিল বলেই হয়তো সে চলে গিয়েছিল। তবুও তার উপরে আমি রাগ করতে পারি না। তুমিও তার উপর এত রাগ পুষে রেখ না, আম্মা।”
“আমি তোমার মতো মহান নই বাবা। কখনও যদি তাকে আমার সামনে পাই। সেদিন তার করা সব অন্যায়ের কৈফিয়ত তাকে দিতেই হবে। আমার বাবাকে একা করে চলে যাওয়ার মতো এত জঘন্য কাজ কীভাবে করল সে, তার জবাব আমি অবশ্যই চাইব তার কাছে।”
মুখে কঠিন জবাব দিলেও মনের মধ্যে একরাশ অভিমান জমা হলো আমার। থম মেরে বসে রইলাম। কিছুক্ষন পরেই রুমে এলো সুলেখা আন্টি। সুলেখা আন্টি বাবার দ্বিতীয় পক্ষ। মা চলে যাওয়ার পর আমার দেখভালের জন্যই বাবা তাকে বিয়ে করে এনেছিল।
সুলেখা আন্টি রুমে ঢুকে অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কী ব্যাপার সু? এইমাত্রই তো হাসতে হাসতে এই রুমের দিকে আসতে দেখলাম তোমাকে। এখন দেখছি বাবা মেয়ে দুজনেই মুখটাকে বাংলার পাঁচ করে রেখেছ। হলোটা কী তোমাদের?”
আমি গিয়ে সুলেখা আন্টির গলা জড়িয়ে ধরে বললাম, “কিছুই না। এই বাবা মেয়ের সামান্য মতবিরোধ। হাতের ট্রেতে কী? পায়েস করেছ?”
“হ্যা, তোমাদের দুজনের জন্য এনেছি।”
আমি পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে বললাম, “তোমার পায়েসটা বরাবরই দুর্দান্ত হয়। আমাকে যখন পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে, সেদিন তুমি এই পায়েস বানাবে। তারপর পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বলবে মেয়ে নিজের হাতে এই পায়েস বানিয়েছে। ব্যাস, তোমার এই পায়েসের গুনেই আমার বিয়ে হয়ে যাবে।”
“বুঝলাম। কিন্তু এরকম মিথ্যে বলাটা কি ঠিক হবে?”
“শোনো আন্টি, আমাদের দেশে নাইনটি পার্সেন্ট লোক মেয়ে দেখানোর সময় এই মিথ্যেটা বলে। বরং এটা না বললে সেটা অস্বাভাবিক লাগবে।”
“তবুও। মিথ্যে বলতে আমার ভালো লাগে না৷ তাছাড়া আমাদের সু দেখতে এত সুন্দর মাশাল্লাহ। তাকে দেখেই ছেলেপক্ষের মাথা ঘুরে যাবে। আর কোনো গুনের কথা শোনানোর প্রয়োজনই পরবে না।”
“আমি তো দেখতে আমার বাবার মত হয়েছি। আমাকে সুন্দর বলা মানে বাবাকেও সুন্দর বলা। আচ্ছা বাবাকে প্রথমবার দেখে কি তোমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল?”
আমার কথা শুনে বাবা কেশে উঠল। সুলেখা আন্টিও লজ্জা পেয়ে তড়িঘড়ি করে চলে গেল। কিছুক্ষন আগে মনের মধ্যে জমা হওয়া অভিমানগুলো হাওয়াই মিঠাইয়ের মত মিলিয়ে গেল। এইতো বেশ আছি। বাবা, সুলেখা আন্টি আমার পাশে আছে। আর আছে ঝগড়ুটে দাদি। দাদির ঝগড়ার আড়ালেও যে এক পৃথিবী ভালোবাসা লুকিয়ে আছে সেটা সে না বললেও আমি বুঝতে পারি। এত এত আপনজনের মধ্যে অন্য কাউকে মনে করার সময় কোথায় আমার। পায়েস খেয়ে সোজা পড়ার টেবিলে গিয়ে বসলাম আমি। দাদী সম্ভবত আরেকচোট ঝগড়ার প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, আমাকে পড়ার টেবিলে দেখে নিঃশব্দেই চলে গেল আবার।
ডিনার টাইমে ডাকতে এলো সুলেখা আন্টি। রাতের খাওয়া শেষ করে আমি তাকে বললাম, “আমাকে কড়া করে এককাপ কফি বানিয়ে দিও তো। আমি বাগানে যাচ্ছি রিফ্রেশমেন্টের জন্য। কিছুক্ষন পরে আবার পড়তে বসব।”
“ইদানীং তুমি প্রচন্ড রাত জাগছো সু। আজকে না হয় জলদিই শুয়ে পড়ো।”
“এখন ঘুমানোর সময় নেই। আর ঠিক দেড় মাস পরে এইচএসসি। তাক লাগিয়ে দেওয়া রেজাল্ট করতে হবে আমার। একবার এক্সামটা হয়ে যাক, তারপর শুধু নাকে তেল দিয়ে ঘুমাব।”
“বুঝলাম। কিন্তু এই রাতে বাগানে যাওয়ার কী দরকার। ঘরে বসেই কিছুক্ষন রেস্ট করো, তারপরে নাহয় পড়তে বোসো।”
“তুমি কি ভয় পাচ্ছ? গেটের বাইরে তো আর যাচ্ছি না। কিছুক্ষন শুধু কৃষ্ণচূড়া গাছটার নিচে বসে থাকব।”
“এই রাতের বেলা বাগানে পোকামাকড় বা সাপ থাকতে পারে। ব্যালকনি থেকেও তো তোমার কৃষ্ণচূড়া গাছটা দেখা যায়।”
“আচ্ছা বাবা, তুমি যখন এত করে বলছ। তাহলে যাবো না৷”
“সু, তোমার কৃষ্ণচূরা ফুল খুব পছন্দ, তাই না?”
“হ্যাঁ।”
“এই গাছটা তোমার বাবা লাগিয়েছিলেন সেই তোমার ছোটোবেলায়।”
“জানি তো।”
“কিন্তু আরেকটা ব্যাপার তুমি জানো না।”
“কি সেটা?”
“তোমার মায়েরও ভীষণ পছন্দ ছিল কৃষ্ণচূড়া ফুল। যেদিন তোমার মা নিখোঁজ হলেন, ঠিক তার পরের দিনই তোমার বাবা এই ফুল গাছটা লাগিয়েছিলেন। মাঝেমধ্যেই ব্যালকনি থেকে এই গাছটার দিকে তিনি অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকেন। আমি বুঝতে পারি, তখন নিশ্চই তোমার মায়ের কথা মনে পড়ে তার।”
“আন্টি, বাবা এখনও মায়ের কথা মনে করে বলে তুমি খুব কষ্ট পাও, তাই না?”
“একদমই না। তোমার মা তার স্ত্রী ছিলেন। তার কথা মনে করাটাই তো স্বাভাবিক।”
“কিন্তু সে বাবাকে ফেলে অন্য একজন লোকের হাত ধরে পালিয়েছিল। তবুও তাকে কেন মনে রাখতে হবে বাবার?”
“তোমার বাবা তাকে মনে রেখেছেন বলেই আমার আরো বেশি ভালো লাগে মানুষটাকে। এরকম নিঃস্বার্থ ভাবে আজকাল কজনই বা ভালোবাসতে পারে।”
“ধ্যাৎ, তোমাদের মতো এমন অতিরিক্ত ভালো মানুষ আমার দুচোখে দেখতে ইচ্ছে করে না।”
আমি ধুপধাপ পা ফেলে রুমে চলে এলাম। তার কিছুক্ষন পরেই রুনি এলো কফিমগ নিয়ে। রুনি হলো এই বাসার হেল্পিং হ্যান্ড। দুনিয়ার যাবতীয় সব বিষয়েই রুনির আগ্রহ প্রবল, একমাত্র কাজ করা ছাড়া। এখনও রুনির চোখমুখ চকচক করছে। নতুন কোনো ইস্যু পেলেই রুনির চেহারা এমন হয়ে থাকে।
(চলবে ইনশাআল্লাহ)
#আমাতুল্লাহ_স্বর্ণা