ভালোবাসার অন্যরূপ পর্ব-০৬

0
1280

#ভালোবাসার_অন্যরূপ🍁

#লেখিকা:- Nishi Chowdhury

#ষষ্ঠ_খন্ড

কিছুক্ষণ আগে আরিশার বাবার বাসার সামনে আরিশাকে নামিয়ে দিয়ে গেছে আহনাফ। পুরো রাস্তাটায় তাদের মধ্যে কোনো কথা হয়নি।

সকালে আরিসা ঘুম থেকে উঠে নিজেকে বিছানায় দেখে কিছুটা অবাক হলেও পরে বুঝতে পারল এটা আহনাফ এর কাজ।

বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখতে পেল আহনাফ শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। থ্রি কোয়াটার প্যান্ট আর স্যান্ডো গেঞ্জি পরনে । আরিশা একটা জিনিস খেয়াল করেছে । আহনাফ কে এ ছয় দিনে একদিনও খালি গায়ে তার সামনে আসতে দেখেনি সে। ওয়াশ রুমেও সে জামাকাপড় নিয়ে যায়। আরিশা কে এক নজরে তাকিয়ে থাকতে এবং অন্য মনস্ক দেখে আহনাফ তাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,

— কিছু বলবে আরিশা?

— হ্যাঁ আসলে আমি আজকে বাবার বাড়িতে যেতে চাই। আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। তাই আজই যেতে হবে।

প্রতিউত্তরে একনাগাড়ে কিছুক্ষণ আরিশার দিকে তাকিয়ে থেকে শুধু শুকনো হেসেছিল আহনাফ। তারপর বলল,

— আজ আমার সন্ধ্যা পর্যন্ত ডিউটি সিডিউল আছে। যদি আমার সাথে যেতে চাও তাহলে সকালেই আমার সাথে বেরোতে হবে তোমাকে। আদার ওয়াইজ তুমি বাড়ির গাড়িতে যেতে পারো।

— আমি এখন তোমার সাথে যেতে চাই।

— ঠিক আছে তৈরী হয়ে নাও। আমরা নাস্তা খেয়ে বের হব।

আরিশা হয়তো খেয়াল করলে বুঝতে পারত এত সহজে কেন আহনাফ একদিন আগে তার বাপের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রাজি হয়ে গেল। যে বলেছিল এক মাস না হলে তাকে যেতে দেবে না। কিন্তু তার মাথায় তো এখন অন্য চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে।

🌸 🌺 🌸

গাড়িটা এসে এখানে থামতে আরিশা যখন নামছে গাড়ি থেকে তখন দুজন দুজনের উদ্দেশ্যে একসাথে একটা কথাই বলেছিল,

— ভালো থেকো।

আহনাফ শুধু মুচকি হেসে ছিল। হাসিটা ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যেত তা তাচ্ছিল্য পূর্ণ ছিল। আহনাফ আরিশার থেকে আরও কিছু আশা করেছিল। হয়তো মনে মনে চেয়েছিল আজ

” আরিশা তাকে জড়িয়ে ধরবে। তার বুকে মাথা রেখে বলবে আমি তোমাকে খুব মিস করব। আমাকে ফোন করো। আমি তোমার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতে চাই। না হলে আমার এ বাড়িতে মন টিকবে না, সময় কাটবে না। আমার কোন কিছুই ভালো লাগবে না।”

এসব ভেবে ও আহনাফ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। কার কাছে কি চাইছে সে। এই কয়েকটি দিন এক রুমে এক ছাদের নিচে থেকেও যার বুক পিঞ্জরেই কড়া নাড়তে পারল না। সে তাকে চাওয়ার কথা ভাববে কিভাবে? তার মনজুড়ে তো এখনও অন্য কারোর বসবাস।

🌺 🌸 🌺

কাল রাতে ফিরতে আহনাফের একটু বেশি দেরি হয়ে গিয়েছিল। রুমে ঢুকে দেখি পুরো রুম ফাঁকা পড়ে আছে। ওয়াশ রুমের দরজা ভেজানো। তারমানে আরিশা ওয়াশরুমে নেই। তাহলে গেল কোথায় বারান্দায় এসে দেখলো। আরিশা দোলনার উপরে মাথা কাত করে ঘুমিয়ে আছে।

আহনাফ তা দেখে আনিসার কাছে গিয়ে সোফা সেটের ওপর থেকে একটা কুশন নিয়ে আরিশার মাথার তলায় দিয়ে দিল। কাত করে শুইয়ে দিতে গিয়ে ফোনটা নিচে পড়ে গেল। আহনাফ সেটা সেন্টার টেবিলের ওপর তুলে রাখলো। এরপর ফ্রেশ হতে চলে গেল ওয়াশরুমে।

ফিরে এসে দোলনা থেকে নিজের কোলে তুলে নিল আরিশা কে। তারপর বিছানায় গিয়ে ঠিকঠাকমতো শুইয়ে দিল তাকে। খিদে তে পেটে চোঁ চোঁ করছে। তাই দেরি না করে নিচে চলে গেল খাওয়া দাওয়ার জন্য। গিয়ে দেখল মা ডাইনিং টেবিলে দুই হাত জোট করে তাতে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে কোন বিষয় নিয়ে চিন্তিত। সামনে খাবার বেড়ে রাখা। আহনাফ গিয়ে মায়ের কাঁধে হাত রাখল এবং বলল,

— কি হয়েছে আম্মু শরীর খারাপ লাগছে তোমার?

আহনাফের আম্মুর শীতল চোখে তাকালেন ছেলের দিকে। তারপর ইশারায় মাথা নাড়িয়ে বললেন কিছু হয়নি। তুই খেয়ে নে। আহনাফ আর দেরী করলো না। চুপচাপ খেতে বসলো। খাবার মেখে মায়ের মুখের সামনে এক লোকমা ধরতে, আহনাফের আম্মু বললেন,

— আমি খেয়েছি পাগল তুই খা।

— জানো তো এটা আমার অভ্যাস। লোকমা টা নিয়ে নিলেই আমি খাওয়া শুরু করতে পারি।

আহনাফের আম্মু ছেলের হাতের থেকে এক লোকমা খেয়ে । চুপচাপ বসে রইলেন। আহনাফ খাবার মাখতে মাখতে বলল,

— আরিশা খেয়েছে আম্মু?

— না আব্বু। বিকেলে কফি খেয়ে ছিল। বলছিল ওর নাকি খুব মাথা যন্ত্রণা করছে। তাই বলেছিলাম রেস্ট নিতে। ঠিক হয়ে যাবে।

আহনাফ এর ব্যাপারটা খটকা লাগলো। তার মা তো এমন নয়। এ বাড়িতে সবাইকে না খাইয়ে মা কখনো রাত্রে ঘুমাতে দিতে চান না আরিশা কে তিনি ডাকতে ও যায়নি। ব্যাপারটা কেমন হল…

আহনাফের আম্মু ও ছেলের মত মনে মনে কিছু ভাবছেন। আজ সকালে তার কাজের মেয়েটা এসে তাকে জানানো। আহনাফের ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে নাকি সে সোফা সেটের নিচে চাদর, বালিশ ইত্যাদি পেয়েছে। তাহলে কি আহনাফ আরিশা এক বিছানায় ঘুমায় না।

তাদের মধ্যে কি তাহলে কিছু ঠিক নেই। আবার বিকালে তিনি যখন আরিশার রুমে যাচ্ছিল এটা জিজ্ঞাসা করতে যে মেয়েটার মাথা যন্ত্রণা কমেছে কিনা? তখন তিনি আহনাফের বেডরুমের সামনে দাঁড়িয়ে গেলেন আরিশার কিছু কথা শুনে কিছুক্ষণ থেকে ওখান থেকে চুপচাপ চলে আসলেন তিনি। এখন তার মনের ভেতরে প্রচন্ড কু গাইছে।

ছেলের উপরে পরিপূর্ণ বিশ্বাস করে মেয়ের ব্যাপারে তেমন কোনো কিছুই খোঁজ খবর না নিয়ে তিনি বড় ভুল করে ফেললেন না তো। আরিশা কি অন্য কাউকে পছন্দ করে যার কারণে আহনাফকে সে মেনে নিতে পারছিনা?

কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তিনি আহনাফের দিকে তাকালেন,

— মনে মনে বললেন ছেলেকে কি সবকিছু বলব? না না থাক সারাদিন বেচারা অনেক কষ্ট করে। এসব বললে ও দুশ্চিন্তা বাড়বে বৈ কমবে না। বরং যার কাছে জিজ্ঞাসা করলে উত্তর পাওয়া যাবে তাকে করতে হবে।

দুজনার ভাবনা চিন্তার মধ্যদিয়েই আহনাফ খাওয়া-দাওয়া কমপ্লিট করে উঠে পড়ল। রুমে এসে ঘুমানোর প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বিছানার কাছে যেতে কানে একটা চাপা ভাইব্রেশনের শব্দ শুনতে পেল আহনাফ। শব্দ টা কোথা থেকে আসছে খুঁজতে খুঁজতে গিয়ে দেখল বারান্দায় সেন্টার টেবিলের ওপর আরিশার ফোনটা ভাইব্রেট হচ্ছে।

কাছে গিয়ে দেখল আননোন নাম্বার। ফোনটা ধরতে গিয়ে কেটে গেল। তাই ফোনটা হাতে করে নিয়ে আরিশার বেড সাইড টেবিলের ওপর রাখতে গিয়ে ক্রিং করে একটা মেসেজ টিউন বেজে উঠল। অন্যমনস্ক ভাবে ফোনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেল ওই নাম্বার থেকে একটা মেসেজ এসেছে।

আহনাফ না চাইতেও মেসেজটা ক্লিক করে ওপেন করলো। আর যা দেখলো তাতে তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মেসেজটা পড়ে স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে আপনাফ যে আরিশা অন্য কাউকে ভালোবাসে। এবং তারা কাল কফিশপে মিট করবে। আরিশার সাথে নাকি কি গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে। ওখানে আরো লেখা আছে যে,

— বুঝতে পেরেছি তোমার ডাক্তার জামাই চলে এসেছে বাসায় তাই না। তাই আমার ফোনটা রিসিভ করতে পারছ না। ওকে ডোন্ট ওয়ারি। তোমার ইউনিভার্সিটির পাশে যে কফিশপে আমরা নিয়মিত মিট করতাম।

সেখানেই আগামীকাল চলে এসো বিকেলে। তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে। শুধু একটা কথাই বলবো তোমার পরিবার তোমার সাথে প্রতারণা করেছে আমাদের ভালবাসাকে ঠকিয়েছে তারা, মিথ্যে বলেছে সব কিছু আমার সম্পর্কে। শুধুমাত্র ঐ পয়সাওয়ালা ডাক্তারের সাথে বিয়ে দেবে বলে।

তুমি আসো। তারপর আমি সব কিছু প্রমান করে দেবো যে তোমার মা আমার সম্পর্কে যা কিছু বলেছি সব মিথ্যে।

তারপর দুজন মিলে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব আমরা কোথায় যাব। শুধু এটুকু বলব তোমাকে আর বেশিদিন ওই নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হবে না। আমি জানি মনে একজনকে রেখে কখনোই অন্যজনের সাথে সংসার যায় না। আমি জানি তুমি আমার উপর অভিমান করেছো কিন্তু আমার প্রতি ভালোবাসা তোমার একচুল ও কমেনি। নিজের খেয়াল রেখো। লাভ ইউ আরু, কাল দেখা হচ্ছে।

কাল রাতের কথা ভাবতে ভাবতে আহনাফ নিজের গাড়ি নিজেই ড্রাইভ করছে। এখন তার গাড়ি ছুটছে হসপিটালের উদ্দেশ্যে। কাল রাতের ঘটনাগুলো মনে করতে করতে নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে এসেছিল আহনাফ এর। টুপ করে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো তার গাল বেয়ে।

ভালোবাসা কখনো টাইম টেবিল মেপে হয় না। হঠাৎ করে হয়ে যায়। যেমন আহনাফ আরিশার সাথে প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছিল। কিন্তু সে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি যে আরিশা অন্য কাউকে ভালোবাসে।

জানলে সে জীবনেও আরিশার উদ্দেশ্যে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাত না। আরিসা কেন তাকে সবকিছু খুলে বলে নি। আর সেও তো আর বাড়িয়ে কিছু শুনতে চাইনি। দোষটা উভয় পক্ষেরই হয়েছে। তাই আরিশা যদি ওই ছেলেটার কাছে ফিরে যেতে চায় সে কখনো বাধা দেবে না। কিন্তু সে কি নিয়ে থাকবে ? সে-ও তো আরিশা কে ভালোবাসে। খুব ভালোবাসে।

🌸 🌺 🌸

আরিসা কলিং বেল বাজাতে হাত মুছতে মুছতে এসে দরজা খুলে দিলেন আরিশার আম্মু। দরজার ওপাশে আজকে মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলেন। তারপর মেয়ের পেছনের দিকে তাকিয়ে বললেন ,

— জামাই আসেনি?

আরিশা কিছুক্ষণ পর মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,

— রাত্রে আসবে। এখন কিছু ইম্পর্টেন্ট কাজ আছে। তাই এখন কি জামাই ছাড়া আমাকে ঘরে ঢুকতে দিবেনা।

আয়েশার আম্মু মুচকি হেসে বললেন,

— শোনো পাগল মেয়ের কথা। আরে তোর যখন ইচ্ছা হবে তুই চলে আসবি। আয় ভেতরে আয়। রুমে গিয়ে বিশ্রাম কর। আমি হাতের কাজ শেষ করে আসছি।

আরিশা নিজের রুমে চলে গেল। সে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আজ বিকালে সে অভি সাথে দেখা করবে। কিন্তু একা নই। ওর দুজন বন্ধুর সাথে থাকবে যারা ওদের ব্যাপারে সবকিছু জানতো। সবকিছু শুনে এবার সে ডিসিশন নিবে। এই ঘটনার সত্যতা জানা তার খুব দরকার।

আরিসার আম্মু রান্না করছিলেন ।রাতে মেয়ের জামাই আসবে বলে আরো দুই তিনটা আইটেম রান্না করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। এমন সময় আহনাফ এর আম্মু ফোন দিলেন তার নাম্বারে।হাত পরিস্কার করে তিনি কল ব্যাক করলেন। ফোন কল রিসিভ হতেই, উভয় পক্ষ একে অপরের সাথে সালাম ও কুশল বিনিময় করলেন। তারপর আনিসার আম্মু বললেন,

— আপা বাসায় তো এখন আপাতত আপনি একাই আছেন। ভাই তো চট্টগ্রাম চলে গেছে। মেয়ের সাথে আপনিও চলে আসতেন। আমাদের সাথে কিছু মুহুর্ত কাটিয়ে যেতেন। আপনারও ভালো লাগতো। আমারও গল্প করার জন্যে একজন সাথী হতো।

— আসবো আপা। একদিন হুট করে চলে আসব আপনাদের বাসায়। আশা ফুরিয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু..

কিন্তু শুনে আরিশার আম্মুর কপাল কিঞ্চিৎ কুঁচকে গেল। মুখে হাসি ধরে রেখে জিজ্ঞেস করলেন,

— কিন্তু কি আপা?

— যদি কিছু মনে না করেন আপা কিছু প্রশ্ন করতে চাই আরিশার ব্যাপারে। এই বিষয়টা জানা আমার জন্য জরুরী। খুব জরুরী…..!

চলবে………..🌼🌼

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে