#ভালোবাসার_অন্যরূপ🍁
#লেখিকা:- Nishi Chowdhury
#পঞ্চম_খন্ড
কবুল শব্দ টা ভারী অদ্ভুত তাই না….!
এই শব্দটা তিনবার উচ্চারণ করতে একটা আস্ত মানুষ একজন অজানা অপরিচিত মানুষের নামে দলিল হয়ে যায়। সারা জীবনের জন্য একে অপরের সাথে জড়িয়ে যায়। সুখ-দুঃখ হাসি আনন্দ একসাথে ভাগ করে নিতে শিখে যায়।
এ এক অদৃশ্য মায়া….!
যারা দুদিন আগেও একে অপরকে চিনত না কিন্তু বিয়ের পরে একজন আরেকজনকে অনুভব করতে শুরু করে। একজনের কষ্ট হলে অন্য জনের বক্ষপিঞ্জর কেঁপে ওঠে। একজন আরেকজনের জন্য নিজের বদ অভ্যাস, সখ আহ্লাদ গুলো মুহূর্তে বিসর্জন দিতে পিছপা হয় না।
ভারী অদ্ভুত তাই না এই বিয়ে শব্দটা….!
🌺 🌸 🌺
দুই পরিবারের পূর্ণ সম্মতিতে এবং উপস্থিতিতে অবশেষে বিয়ে সম্পন্ন হল আহনাফ ও আরিশার। দুই পরিবারের খুশি দেখার মতো । তাদের আনন্দ দেখে মনে হচ্ছে কতদিনের শখ আহ্লাদ তাদের পূরণ হলো। কারণ দুই পরিবারের কাছে যে তাদের ছেলে মেয়ে দুটো অমূল্য। প্রতিটা মা-বাবারই তো ছেলে মেয়ের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। আর যখন তারা সেই স্বপ্নটা নিজের হাতে পূরণ করতে পারে। তখন তাদের মনে বাধভাঙ্গা আনন্দে জোয়ার বয়ে।
আসলেই বিয়েটা কখনো দুটো মানুষের মধ্যে হয় না দুটো পরিবারের মধ্যে হয়। একটা অচেনা অজানা পরিবার আরেকটা পরিবার কে আপন করে নেওয়ার মধ্যে দিয়েই একটা সামাজিক অনুষ্ঠানের সূচনা ঘটে। আর সেই সামাজিক অনুষ্ঠান টাই হচ্ছে বিয়ে।
ডবল সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আহনাফ আর আরিশা। সামনে পরিবারের লোকজন থাকার কারণে আহনাফ ভালভাবে আরিশা কে দেখতে পারছে না। ওই আড়চোখে যেটুকু দেখা যায় আর কি। সে বিষয়টা খেয়াল করে আহনাফের চাচাতো ভাই আরাফ ব্যঙ্গাত্মক স্বরে হাহুতাশ করে বললেন,
— আহাহাহা… এ কষ্ট কি চোখে দেখা যায়। ভাই আমার বিয়ে করা বউ কে ভালোভাবে দেখতে ও পারছে না আমাদের জ্বালায়। ওরে তোরা চলে যা আর আমাকেও নিয়ে যা এখান থেকে। ভাইয়ের আর তর সইছেনা বউয়ের মুখটা ভালোভাবে দেখার জন্য।
আরাফের কথা শুনে উপস্থিত সবাই জোরে হাসতে না পারলেও মুখ টিপে হাসলেন। আহনাফ লজ্জায় আর কারো দিকে তাকাতে পারছে না। আড়চোখে রাগী দৃষ্টিতে তাকাল আরাফের দিকে। কিন্তু আরাফ ভাইকে লেক পুল করতে পেরে খিক খিক করে হাসছে। আহনাফ না পেরে নিজের বাম পা দিয়ে আরাফের পায়ে জোরে একটা পাড়া দিল। আরাফ তাতে মৃদু আর্তনাদ করে বলল,
— আহা ভাই মুখে বললেই তো চলে যাচ্ছি। এভাবে পায়ে পাড়া দিয়ে বোঝানোর কোন দরকার ছিল না , যে তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাও আমি এখানে বসে একটু বউয়ের সাথে কথা বলব। এখনই এতো। সামনে তো পুরো জিন্দেগি পড়ে আছে। কথা কি তোর ফুরিয়ে যাচ্ছে। বাপরে বাপরে বাপ। সর তো আমার ভাবির সাথে কিছু কথা আছে।
কথাগুলো বলে তিন সিটের সোফার আরিশার পাশের জায়গাটা ফাঁকা ছিল। সেখানে দুম করে বসে পড়ে আরিশার উদ্দেশ্যে বলল,
— ভাবি মনি তুমি আমার ভাইয়ের উপরে কি মায়াজাল ছড়িয়েছো বলতো? একেবারে এই এক সপ্তাহ ওর পুরো লাইফটা “আরিশাময়” হয়ে গেছে। তুমি কি জানো ভাবি মনি তোমার এই বর সারারাত জেগে তোমার নাম জপে তাও আবার পানির ট্যাংকিতে ঝুলে।
আহনাফ তো পারলে চোখ দিয়ে ভব্স করে ফেলে আরাফ কে।
আমি নিজের চোখে দেখেছি ওর কষ্ট। আহা ওর কষ্ট দেখে আমার বুকটা ফেটে সাহারা মরুভূমি হয়ে গেছে। তাইতো সকাল না হতেই সাজাইয়া গুজাইয়া নিয়ে এই বাসায় এসে হাজির হয়েছি। দেখলে না, তুমি কত সময় নিয়ে কবুল বললে আর ও দেখলে..! উসাইন বোল্টের দৌড় এর আগে কবুল বলছে। ভাই তোমার নাম কিন্তু গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড এ উঠে গেছে। এই ভিডিও আমি পাঠাই দিবো তাদের কাছে। খুব শিগগিরই তোমার ডাক পড়বে।
আরিশা আর চুপ করে থাকতে পারলো না এবার শব্দ করে হেসে উঠলো। হেসে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ ও হেসে বলল,
— দ্যাটস লাইক মাই ভাবি মনি। তোমার মন খারাপ আমার মোটেও ভালো লাগে না। এ ভাবেই হাসবে। এই প্রথম আমি তোমাকে হাসতে দেখলাম। তুমি তো দারুণ করে হাসতে পারো।
আরিশা হাসছে। আহনাফ তা মুগ্ধ হয়ে দেখছে। তার হাসি দেখতে দেখতে আহনাফের মাথা ঝিমিয়ে উঠলো। আহনাফ চোখের সামনে তার নিজের সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছে। পরিষ্কার বুঝলো। তার পক্ষে কোনদিনও এই মানুষটা ছাড়া অন্য কিছু ভাবা সম্ভব হবে না। একদম সম্ভব না।
সামনে তুড়ি বাজানো শব্দ আহনাফের হুশ ফিরল। আরাফ শয়তানি মার্কা হাসি দিয়ে বলল,
— কিরে ভাবিমনির হাসি দেখে ক্লিন বোল্ড হয়ে গেলি নাকি?
আহনাফ হেসে মুখটা কিছুটা এগিয়ে নিয়ে গিয়ে আরাফের কানে কানে বলল,
— এক মাঘে কিন্তু শীত যায়না। আমারও দিন আসবে। সেদিন আমিও তোর কি হাল করি সেটা শুধু বসে বসে দেখবি। আর আফসোস করবি যে কেন ভাইয়ের পেছনে লেগে ছিলাম।
কথাগুলো ধীর কন্ঠে বললেও প্রত্যেকটা কথা কানে গিয়েছে আরিশার। মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলল সে।
🌺🌸🌺
ভালো সময় গুলো যেন চোখের পলকে কেটে যায়। আরিশা তার শ্বশুর বাড়িতে এসেছি ইতিমধ্যে দুইদিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এই দুটো দিন যে কিভাবে কেটে গেল আরিসা নিজেও ভেবে পেল না।
সবার সাথে হাসি আনন্দে এতটাই ব্যস্ত ছিল যে সময় কখন পিছন দিয়ে ফুরুত করে পালালো সেটা তার বোধগম্য হয়নি। এই পরিবারের সাথে খুব সুন্দর ভাবে মিশে গেছে আরিশা। মামনি বাবাই, বড় চাচ্চু, চাচী আম্মা। আর আরাফ তো আছিই কমেডি করার জন্য।
এমন একেকটা কথা বলবে যা শুনে পেট ব্যথা হয়ে যাবে। অধিকাংশ আহনাফকে জড়িয়ে। মাঝে মাঝে আপনাফ সহ্য করতে না পেরে তেড়ে যাবে ভাইকে শায়েস্তা করতে। তখন আরাভ নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নাহয় মামণির পিছনে গিয়ে লুকাবে আর না হয় আরিশার পেছনে। কারণ এই দুজনের পেছনে লুকালে আহনাফ আর সামনে এগিয়ে যায় না। ওকে মারতে।
আহনাফ ও আরিশার মধ্যে সম্পর্কটা ঠিকঠাক চললেও তাদের মধ্যে জড়তা টা কেউ এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তারপরও আহনাফ চেষ্টা করছে আরিসাকে নিজের সাথে সহজ করে তুলতে। আরিশা ও চেষ্টা করছে। কারণ ও বাড়ির ছেড়ে বিদায়ের সময় তার মা তার কানে কানে বলে দিয়েছিল,
👉আজ যেখানে যাচ্ছ? ওটাই আজ থেকে তোমার নিজের বাড়ি। আরো দুজন মা-বাবা পাচ্ছ। স্বামী হিসেবে বন্ধু পাচ্ছ।একটা কথা মনে রেখো ভালোবাসা পেতে হলে আগে ভালবাসার দিতে হয়। কখনো তাদের অমর্যাদা কোরো না। তুমি তোমার নিজের মা-বাবা ভাইয়ের প্রতি যেমন দায়িত্ব পালন করেছো তেমনি শশুর শাশুড়ি ও বিশেষ করে স্বামীর প্রতি তেমন দায়িত্ব পালন করবে। আমি চাই ওই পরিবারে প্রত্যেকটা লোকজন বলে তুমি ওই বাড়ির যোগ্য বৌমা। আর তাদের কথা কি বলব। আমি জানি আমার নেওয়া সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি। ঠিক মানুষের হাতেই আমি আমার মেয়েকে তুলে দিয়েছি। তাই আমার আর চিন্তা নেই।
মায়ের কথাগুলো এতক্ষণ মনে মনে ভাবছিল আরিশা। সত্যিই এই বাড়ির মানুষের কোন তুলনা হয় না। একটা অপরিচিত মানুষের সাথে এত সুন্দর ভাবে মিশে যেতে পারে এরা, তাদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছে যেন আমি তাদের কতকালের চেনা।
এসব কথাই আরিশা ভাবছিল আর কফি খেতে খেতে বারান্দায় বসে গোধূলি বিকেলের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করছিল। এখন বাড়িতে আহনাফ নেই। তার চেম্বারে আজ রোগীর প্রচণ্ড চাপ। কিছুক্ষণ আগে আরিশা কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে তার আজকে ফিরতে একটু দেরি হবে। শুধু আচ্ছা বলে কেটে দিয়েছিল ফোন।
এই চার পাঁচ দিনে বিকেলে একসাথে বসে কফি খেতে খেতে আহনাফ এর সাথে গল্প করা আরিশার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। আজ যেন আরিশার বিকেলের এই সময়টা কাটছে চাচ্ছে না। একা একা কফি খেতে মজা লাগছে না।
আজ তার শ্বশুরবাড়িতে পঞ্চম দিন। আগামীকালটা এখানে থেকে তারপরের দিন সে বাপের বাড়ি যাবে। একদিকে মা-বাবাকে দেখার জন্য মন উতলা হলেও অন্যদিকে এদেরকে ছেড়ে যাবে ভেবে কষ্ট হচ্ছে আরিশার।
হঠাৎ তার মোবাইলে ফোন আসতেই ঘোর কাটল আরিশার। পাশ থেকে নিজের সেলফোনটা তুলে নিয়ে স্ক্রিনে দেখল আননন নাম্বার। ভ্রু কুঁচকে নাম্বারটা কয়েকবার দেখল আরিশা। না এই নাম্বারটা তার চেনা লাগছে না। কে হতে পারে? রিসিভ করবে কি করবেনা দ্বিধায় থাকতে থাকতে ফোনটা কেটে গেল হাঁফ ছেড়ে বাঁচল আরিশা।
কিন্তু কিছু সেকেন্ডের মাথায় ফোনটা আবার বেজে উঠল। আবার সেই একই নাম্বার। এবার আরিশার কিছু না ভেবে ফোনটা রিসিভ করল। তখনই অপর পাশ থেকে ভেসে আসলো সেই পরিচিত কণ্ঠ।
— হ্যালো আরু আমি বলছি। কেমন আছো তুমি?
আরিশা বারান্দায় রাখা দোলনায় হেলান দিয়ে বসে ছিল। প্রায় 15 দিন পর সেই চিরচেনা কন্ঠটা কানে আসতে লাফিয়ে উঠল আরিশা। কয়েকটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
— কে?
— আমি অভি। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে কীভাবে আমাকে আরু……!
চলবে…..🌼🌼