বেলা শেষে পর্ব-২৭ + বোনাস পর্ব

0
1244

#বেলা_শেষে। [২৭]

আরাভের বাবা আর দাদু মিলে সিদ্ধান্ত নেয় তারা ভূমিকার গ্রামের বাড়ি যাবে।আরাভ আর ভূমিকার বিয়ের ব্যপারে তারা ভূমিকার বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে। ওনারা রাজি হলে ভূমিকা কিছুতেই অমত করতে পারবে না। যেমনি ভাবা তেমনি কাজ। দুদিন পরে আজহার মাওদুদ তার ছেলে ওর নাতিকে নিয়ে রওনা দেয় ভূমিকার গ্রামের উদ্দেশ্যে। আরাভের শহর ছেড়ে যাওয়ার কথা মাহিনের কান পর্যন্ত পৌছাতে সময় লাগে না । আসলে মাহিন ভূমিকা আর আরাভের পিছনে গুপ্তচর লাগিয়ে রেখেছিলো। কে কখন কোথায় যায় সেটারই খবর নেওয়ার জন্যে। সে দিন আরাভ গ্রামে চলে যাওয়ার এক ঘন্টার মধ্যে খবর পৌছায় মাহিনের কানে। মাহিন ও কম কিসে সে তখন থেকে প্রস্তুুত থাকে ভূমিকার ক্ষতি করার। কিন্ত মাহিনের দুর্ভাগ্য সেদিন ভূমিকা বাসা থেকেই বের হয়নি। কারন সেদিন নয়না আর আর রাকিব এসেছিল ভূমিকাদের বাসায়। পরে অবশ্য সবাই জানতে পেরেছিলো আরাভ গ্রামে যাওয়ার আগে রাকিবকে ওদের বাসায় যেতে বলেছিলো। মাহিনের শকুনের মতো চোখ সে যখন তখন হামলা করতে পারে ভূমিকার উপর।

ভূমিকার বাবা মা দুজনেই আরাভের সাথে ভূমিকার বিয়ে কথা শুনে খুশি হয়। তারা তো আরাভকে আগে থেকেই চিনে। আরাভ ভূমিকাকে বিয়ে করবে শুনে তারা খুব খুশি হয়। তারপর তারা গ্রামের চেয়ারম্যান মাশহুদ তালুকদারের বাড়ি যায়। মাশহুদ তালুকদার কিছুদিন যাবৎ অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে উঠতে পারেন না। ছেলের উপর অভিমান করে কিছু জানায়ও নি তাকে। মাশহুদের স্ত্রী দিগন্তকে এ ব্যপারে জানাতে চাইলে মাশহুদ তাকেও মানা করে দেয়। মাশহুদ চায়না দিগন্ত গ্রামে আসুক।

গ্রাম থেকে ফিরে আসার দুই সপ্তাহ পরে ভূমিকার সাথে আরাভের বিয়ে সম্পন্ন হয়। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা হয়েছিলো তাদের। ততদিনে মাহিন ওদের কোন ক্ষতিই করতে পারেনি। আর তাদের দুজনের ভালোবাসার ফল হলি তুই। আরাভ আর ভূমিকার একমাত্র ছেলে খন্দকার জুবায়ের আহসান অভি।

জুবাইদার কথা শুনে চোখ ছোট ছোট করলো অভি। তারপর বলল,

-আমার আম্মু নাম তো ভূমি। ভূমিকা না। আর ভূমিকা আইনজীবি পড়ছিলো কিন্তু আমার আম্মু তো হসপিটালে থাকে।

জুবাইদা অভির মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ থাকে। কারন নার্সিং হোমই এখন তোর আম্মুর ঘর। নে এবার ঘুমিয়ে পরতো দেখি। কাল সকাল সকাল উঠতে হবে তো নাকি। স্কুলে যাওয়ার নিয়ত আছে না নাই। জুবাইদার কথার প্রতিউত্তরে প্রথমে মাথা নাড়িয়ে না সূচক জবাব দিলো অভি। তারপর আবার হ্যাঁ সুচক জবাব দিলো। বালিশে মাথা রেখে দু-চোখ বন্ধকরে কোমল সুরে বলল,

-দাদু কাল আম্মু আসবে তাইনা। অভির করা প্রশ্নের কোন জবাব দিতে পারলো না জুবাইদা। কাল অভির স্কুলে প্যারেন্স কল করেছে। ভূমি আসবে তো।

হসপিটালে সাধারণত কখন রাত হয় আর কখন দিন হয় তা বুঝা মুশকিল। এখানে রাত আর দিন দুটোই এক মনে হয়। পার্থক্য শুধু ঘড়ি দেখায়। ঘড়ির দিকে তাকালেই বুঝা যায় এখন দিন নাকি রাত। কেবিনের ভেতরে বেডের উপর শুয়ে আছে আরাভ। মুখে অক্সিজেন মাক্স হাতে সেলাইন লাগানো। তার পাশেই আরাভের একটা হাত ধরে বসে আছে ভূমি। চোখের কোনে অশ্রুর ভীড় তার। ঠোট চেপে কান্না আটকিয়ে রেখেছে সে। কতরাত কত দিন যে এভবে বসে থেকে পার করেছে তার হিসাব নেই। দু বছর ধরে এই নার্সিংরুমকে নিজের বাসা বানিয়ে নিয়েছে ভূমি। শুধু একটা আশায় কখন আরাভ জেগে উঠবে আর বউ বলে ওকে সম্বোধন করবে। ভূমির চোখের কোটর গড়িয়ে দু ফোটা পানি পড়লো। অতঃপর সে বলতে লাগলো,

-আমাকে কষ্ট দিয়ে তুমি খুব শান্তি পাও তাই না আরাভ। দেখে আরাভ আমি কাঁদছি তোমার কষ্ট হচ্ছে না। তুমিই তো বলেছিলে, তোমার চোখের পানি দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়, আমি তোমার চোখের পানি সহ্য করতে পারি না। দেখো আরাভ আমি কাঁদছি। এখন কষ্ট হচ্ছে না তোমার। একবার আখি খুলো আরাভ। জানো আরাভ আমাদের ছেলেটা আজ কত বড় হয়েছে। ও বাবা বলে ডাকতে পারে। ওর সাথে যখনই দেখা করতে যাই। প্রতিবার শুধু একটা কথাই বলে, আমার পাপা কোথায়? তুমি তো বলেছিলে পরের বাবা পাপাকে নিয়ে আসবে তাহলে কি পাপা আসে নি। অভির কথার জবাব দিতে পারি না আমি। ছেলেটাকে একটা মিথ্যের মধ্যে আটকিয়ে রেখেছি। জানো আরাভ আমি মাহিনকে শাস্তি দিয়েছি। মাহিনের পাপে শাস্তি পেয়েছে সে। আমি নিজে কোর্টে ওর প্রতিপক্ষ লো ইয়ার হিসাবে লড়েছি। একজন আইনজীবি না হয়েও মাহিনকে তার প্রাপ্যা শাস্তি দিয়েছি।তুমি খুশি হওনি আরাভ। কবে জাগবে তুমি আরাভ। আমি যে আর পারছিনা। তোমাকেএই অবস্থায় মেনে নিতে পারছিনা আমি। দু দুটো বছর ধরে বেচে থেকেও মৃত মানুষের মতো বেচে আছো। আর কত কাঁদাবে আমাকে। রোজ রোজ তো একটা আশায়ই থাকি তুমি চোখ মেলে এই সুন্দর পৃথিবীটাকে দেখবে। আমাকে আবার কাছে টেনে নিবে। আচ্ছা তোমার সেই দিনের কথা মনে আছে। আমাদের বিয়ের দিনের কথা। কি বোকাটাই না বানাইছিলে তুমি আমাকে। আর আমিও কি সুন্দর তোমাকে বিশ্বাস করেছিলাম। তোমার করা দুষ্টুমি গুলো আমাকে প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা দেয়। সেটা তুমি বুঝতে পারো না। তুমি কবে ফিরবে আরাভ। বিয়ের পর তিনটা বছর ছিলো আমার জিবনের সবচেয়ে গুরত্বপূর্ন সময়। সেই সময়ের মতো বাকিটা জিবন কাটাতে চাই আমি। আর তার জন্যে তোমাকে প্রয়োজন আরাভ। প্লিজ কাম ব্যাক। আরাভের হাতদুটো দিয়ে ধৃষ্টতায় স্পর্শ করে ভূমি।ভূমির অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে আরাভের হাতের উপর। এটা আজ নয় বরং দু বছর ধরেই এমনটা হচ্ছে।

পরের দিন খন্দকার জুবাইদা আর খন্দকার আদনাদ দুজনে মিলে অভিকে নিয়ে স্কুলে যায়। প্রি- ক্যাডেট স্কুলের নার্সারির স্টুডেন্ট অভি। পড়ালেখায় বাবা মায়ের মতোই ব্রিলিয়ান্ট হয়েছে অভি। খন্দকার আদনান মাহবুব ওদের স্কুলে পৌছে দিয়ে সে কলেজে চলে যায়। খন্দকার জুবাইদা তার একমাত্র নাতিকে নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে ভূমির জন্যে।

কিছুক্ষণ পর গোলাপি থ্রি-পিছ পরিহিত একটা রমনী প্রবেশ করে স্কুলের ভিতরে। মাথায় তার সাদা হিজাব আর হাতে একটা পার্স। চোখের নিচে কালচে দাগ পরে আছে। ঠোটগুলো কেমন ড্রাই হয়ে আছে। রমনীকে আসতে দেখে অভি অস্ফুটভাবে বলে উঠলো,

-আম্মু। অভির কনা শুনে পাশে তাকায় খন্দকার জুবাইদা। সামনে ভূমিকে দেখে তার অধরে হাসি ফুটে উঠে। ভূমি এসেছে তাহলে। ভূমি ওদের কাছে এসে অভিকে কোলে তুলে নিয়ে অভির পুরো মুখ চুমুতে ভরিয়ে দিলো। ছেলেকে কাছে পেয়ে আনন্দ অশ্রুতে তার চোখ ভরে উঠেছে। অভি তার মাকে কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে বলে উঠল,

-পাপা আজও আসেনি তাইনা মাম্মা। অভির কথার এবারও কোন জবাব দিল না ভূমি। মৌনতা অবলম্বন করলো সে।

শ্বাশুড়ি আর ছেলেকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে যায় ভূমি। লাঞ্চ করে হসপিটালে ফিরে যাবে সে। ভূমি নিজে হাতে অভিকে খাইয়ে দিচ্ছে আর খন্দকার জুবাইদা তাকিয়ে আছে তার ছেলের বৌ আর নাতির দিকে।

-এভাবে কি দেখছো মা?? অভিকে খাইয়ে দিতে দিতে বলল ভূমি।

-আমার বাড়িটা বড্ড ফাঁকা। বাড়ি ফিরে চল।

-তোমার ছেলেকে না নিয়ে আমি ফিরবো না মা। আরাভকে সাথে নিয়ে তবেই ফিরবো।

-এই বলে বলে তো দুই বছর কাটিয়ে দিলি। আমাদের কথা বাদ দিলাম এই ছোট অভির কথা একবার ভেবে দেখেছিস। বাবা মাকে ছাড়া ওর থাকতে কতটা কষ্ট হয়।

-আমি তো অভিকে আমার সাথেই রাখতে চাই। তোমারাই ওকে রেখে দিচ্ছো।

-এভাবে আর কত লড়াই করবি নিজের সাথে। আরাভের ফিরবে সেই আশা আমি বাদ দিয়ে দিয়েছি। তোকে আর অভিকে নিয়েই তো এখন আমাদের সব আশা। ফিরে আয়।আমার বাড়িটাকে আবার ভরিয়ে তুল।

-নিজের সাথে লড়াই করে তো এতদিন কাটিয়ে দিলাম। মাঝপথে এসে পা পিছলে পরে যাব। না মা। এটা হতে পারে না। আমি আরাভকে,,, মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো ভূমিকার। অভিকে মুখ পরিষ্কার করে দিয়ে কল রিসিভ করলো ভূমিকা। ওপাশ থেকে কি বলল সেটা জানা নেই। ভূমিকা অভিকে তার শ্বাশুড়ির কোলে বসিয়ে দিয়ে বলল,

-আমাকে যেতে হবে মা। তুমি অভিকে নিয়ে সাবধানে যেও ঠিক আছে।

-কোথায় যাচ্ছিস??

-এখন যাচ্ছি, পরে তোমাকে সবটা বলল কেমন। জুবাইদাকে কিছু বলার সুযোগই দেয় না। চলে যায় ভূমি।

ইন হসপিটাল,

কেবিনের সামনে এসে থ মেরে দাঁড়িয়ে যায় ভূমি। ভেতর থেকে অনেক মানুষের আওয়াজ আসছে। তার মধ্যে দুজনের গলার আওয়াজ তার চেনা। বাকিগুলো কে?? ধীর পায়ে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে সে। ভেতরে ডুকতেই স্তব্ধ হয়ে যায় সে।

চলবে,,,,,,,

#বেলা_শেষে। [বোনাস পার্ট]

ভূমিকে কেবিনের ভিতরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা নার্স বলে উঠে,ওইতো মিসেস আরাভ। কোথায় ছিলেন আপনি? আপনার স্বামীর ঞ্জান ফিরেছে। নার্সের কথা ভূমিকার কান পর্যন্ত পৌঁছালো কিনা সেটা বুঝা গেল না। ভূমিকার কোন রিয়্যাকশন ই হলো না। ভূমি কোন কথাই বলছে না। অপলক তাকিয়ে আছে বেডের এক সাইডে বসে থাকা আরাভের মুখের দিকে। আরাভ ও তাকিয়ে আছে তার প্রিয়সির দিকে। ঠিক কতদিন পরে সে তার প্রিয়সির মুখটা দেখতে পেয়েছে। সেটা জানা নাই তার। ডক্টর এবং নার্সরা আরাভ আর ভূমির অবস্থা বুঝতে পারছে।সবাই ওদের স্পেসস দিয়ে এক এক করে প্রস্থান করে। সবার চলে যাওয়ার পর ভূমি ধীর পায়ে আরাভের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। ততক্ষণে আরাভও বেড থেকে উঠে দাঁড়ায়। এতদিন পর ঞ্জান ফিরে আরাভের কোন রিয়্যাকশন – বুঝা যাচ্ছে। সে শুধু তাকিয়ে তার প্রিয়সির মুখের দিকে। ভূমি তার নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যিই কি আরাভ ভালো হয়েছে। চোখের দেখাকে সত্যি প্রমাণিত করার জন্যে সে আরাভের মুখে হাত বুলাতে থাকে। হ্যাঁ সত্যিই তো আরাভ সুস্থ হয়ে গেছে। আরাভের গালে হাত রাখতেই আরাভ ভূমির হাত ধরে ফেলে। হাতের উল্টোদিকে আলতো করে চুমু খেয়ে অস্ফুটভাবে বলে,

-আমার ভূমি। তারপর ভূমির দু গালে হাত রাতে আরাভ। অতঃপর বলে, তুমি ঠিক আছো ভূমি। মাহিন তোমার ক্ষতি করেনি তো। ভূমি মৃদু হাসে তারপর আরাভের হাতের উপর হাত রেখে বলে,

-আমার কিচ্ছু হয়নি আরাভ। আমি একদম ঠিক আছি।এবার কেঁদেই দেয় ভূমি। সাথে সাথে আরাভ ভূমিকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। ভূমিকাও আরাভকে দু হাতে শক্তকরে চেপে ধরে। এতদিন ধরে জ্বলতে থাকা মনের আগুনটা আজ একটু প্রশমিত হলে বলে।

খন্দকার বাড়িতে আজ খুশির আমেজ। পুরো বাড়ি উল্লাসে মাতোয়ারা। দুই বছর পর তার ছেলে আর ছেলের বউ বাড়ি ফিরছে বলে কথা। অভি তো দুপুর থেকে ড্রয়িংরুমেই বসে আছে। আজ তার পাপা আসবে। খন্দকার জুবাইদা শত বুঝিয়েও ওকে ভিতরে নিয়ে যেতে পারে নি। ড্রয়িংরুমে বসে মেইন দরজার দিকে তাকিয়ে আছে সে। কখন সে তার পাপাকে দেখতে পাবে। রাকিব আর নয়নাও এসেছে ওদের বাড়িতে। রাকিব নয়নার দুই বছরের একটা মেয়ে আছে। সে ছোট ছোট পায়ে হাটে আর আধো আধো গলায় কথা বলে। নিতু ইভান করে বিয়ে করে তার গ্রামে চলে গিয়েছে। আরাভ কুমায় চলে যাওয়ার পর অফিসের সব দায়িত্ব রাকিবই পালন করেছে। ভূমি মাঝেসাজে একটু আকটু যেত আর কি? ম্যানেজার কাকা তো কোনদিন সঠিক হিসাব করতে পারে না। মাস শেষে স্টাফদের বেতন আর অফিসের সমস্ত হিসাব নিকাশের জন্যে হলেও ভূমিকে যেতে হতো। ভূমি অবশ্য তেমন অফিসে যেতে চাইতো না। রাকিবের জুড়াজুরিতে ওকে অফিসে যেতে হতো। আরাভের ঞ্জান ফেরার কথা শুনে রাকিব অফিসের কাজ ফেলে রেখে চলে আসছে। এমনকি টুকে পাশ করা ম্যানেজারও চলে এসেছে। খন্দকার জুবাইদা ব্যস্ত ছেলের পছন্দের সব রান্না করায়।

বিকেলের দিকে ভূমি আরাভকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে। মেইন দরজায় পা রেখে পুরো বাড়িটা পরখ করে নেয় আরাভ। দুই বছর পা বাড়িতে পা রাখলো সে।ভাবতেই তাসছিল্যের হাসি দিলো সে। আসলে তার মতো হতভাগা আর কে আছে এই দুনিয়ায়। দরজার সামনে আরাভ আর ভূমিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে অভি দৌড়ে আসে আরাভের কাছে। অভির বুঝতে বাকি রইলো না এটাই তার পাপা। দাদির কাছে যার গল্প শুনেছে এটাই তো সে। কিন্তু গল্পের আরাভের তো মাথায় চুল বড় ছিলো না। গোঁফ দাড়ি কিছুই ছিলো না। তার পাপার গোঁফ হয়েছে। অভির ধরনা তার পাপা আগে অবিবাহিত ছিলো আর এখন বিবাহিত তাই বড় গোঁফ হয়েছে দাড়ি হয়েছে। এমনকি মাথার চুলগুলো বড় বড়। আরাভের কাছে এসে কোমড় জড়িয়ে ধরে অভি। আরাভ অভির দিকে ভালোকরে লক্ষ করে বুঝতে পারলো এটা তার অভি। সেদিনের সেই ছো্ট্ট অভি আর কতটা বড় হয়ে গেছে। চোখ থেকে দু-ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো আরাভের পিঠে। কেমন বাবা সে। নিজের ছেলেকে চিনতে সময় লাগছে তার। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা সে। আরাভ অভিকে কোলে তুলে নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো তারপর সুফার বসে পরলো। তখনি রান্নাঘর হতে বেড়িয়ে আসে খন্দকার জুবাইদা। জুবাইদা এসে আরাভকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। আজ আর আরাভ তাকে বাধা দেয় না। কাদুক না, কাঁদলে যদি মনটা হালকা হয় তাহলে ক্ষতি কিসের। একে একে সবার সাথে সাক্ষাৎ হয় আরাভের। রাকিব তো এসেই আরাভকে জড়িয়ে ধরে।সবাই সুফায় বসে কথা বলছে। আরাভের কোলে এখনও অভি বসে আছে। অভি আরাভের গলা জড়িয়ে রেখেছে।পাপাকে কাছে পেয়ে বাকি সব ভূলে গিয়েছে সে।সবাই ড্রয়িংরুমে বসে কথা বলছে আর ভূমি ওদের থেকে একটু দূরে দাড়িয়ে সবাইকে দেখছে। কতদিন পর তার পরিবারের সবাই একসাথে এক ছাদের নিচে আছে। ভাবতেই চোখ ছল ছল করে উঠলো ভূমির। এমন সময় একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে এসে ভূমির উড়নার আচল ধরে টানতে থাকে। উড়নার টান অনুভব করে নিচের দিকে তাকায় ভূমি।নিচে ছোট্ট এই বাচ্চা মেয়েটাকে দেখে মৃদু হাসে সে। তারপর তাকে কোলে তুলে নেয়। দু গাল টেনে আদর করে দেয় বাচ্চাটার। ভূমি বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে আরাভের কাছে গিয়ে বলে, বাড়িতে তো আরেকটা নতুন মেহমান আসছে তাকে আদর করবে না। ভূমিকার কথা শুনে ভ্রু কুচকিয়ে তাকায় আরাভ। তার মনে প্রশ্ন, কে এই নতুন মেহমান?

ভূমি বাচ্চাটাকে আরাভের কোলেদেয়। তখন আরাভ অভিকে সুফায় বসিয়ে দেয়। এটা দেখে অভির খুব রাগ হয়। কিন্তু তার পাপার সামনে নিজের রাগটাকে প্রকাশ করতে চায়না আরাভ। নাহলে যে পাপা তাকে পচা বলবে। এই মুহূর্তে পাপার কাছ থেকে পচা ছেলের ট্যাগ নিতে চাচ্ছে না অভি। সে রাগে কটমট করে তাকিয়ে আছে সেই দুই বছরের বাচ্চা মেয়েটার দিকে।

আরাভ মেয়েটাকে কোলে নিয়ে বলে, কি কিউটি, এক্কেবারে আমার বউয়ের মতো সফট্ গাল। গুলুমুলু একটা বেবী। আরাভের কথা শুনে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভূমিকা। আর আরাভ অধরোষ্ঠ চেপে হাসে। আদনান মাহবুব গলা খাকড়ি দিয়ে বলে তোমরা কথা বলো আমরা আসছি কেমন। তিনি তার স্ত্রী জুবাইদাকে নিয়ে প্রস্থান করেন। আরাভ বাচ্চা মেয়েটার গালে চুমু খেয়ে বলে,

-ছোট্ট নয়না। এই রাজকুমারীটাকে কি নামে ডাকি বলতো??

– ভূমি তো মিষ্টি বলেই ডাকে এখন তুইও একটা নাম দে। রাকিবের কথা শুনে স্মিত হাসে আরাভ। আসলে নামটা কিন্ত সুইট। আমার বউয়ের দেওয়া নাম কখনো মন্দহতে পারে না। আজ থেকে আমিও এই রাজকুমারীকে মিষ্টি বলেই ডাকবো। আরাভ মিষ্টির অপর গালে চুমু খেল।এটা দিতে অভি রাগে ফুসছে। এই মুহূর্তে ওর ইচ্ছে করবে কিং কোবরা সাপের বিষ মুখে দিয়ে মিষ্টিকে ছোবল দিতে। বাজে মেয়ে একটা আমার পাপার আদরে ভাগ বসাচ্ছে। এই মেয়েকে তো আমি ছাড়বো না কিছুতেই। না।

আরাভ এখানে বসেই রাকিব নয়না আর ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে থাকে। ভূমি অভিকে নিয়ে তার রুমে চলে যায়। তারপর অভিকে ফ্রেশ করিয়ে দিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়। এদিকে আরাভ এক কথা দুই কথায় অফিসের কাজের প্রাসঙ্গে কথা উঠে। সেই নিয়ে কথা বলতে বলতে বিকাল গড়িয়ে সন্ধা হয়ে যায়।

বিছানায় বসে অভিকে পড়াচ্ছে ভূমি এমনি সময় রুমে আরাভের প্রবেশ। আরাভকে দেখে তো অভি লাটে উঠে যায়। সে পড়া বাদদিয়ে আরাভের কোলে উঠে গিয়ে। ভূমিও কিছু বলে না। আরাভ অভিকে কোলে নিয়ে ভূমির পাশে এসে বসে। বাবা ছেলেকে দেখে ভূমি আনমনে হেসে উঠে। আরাভ ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে থেকে এক হাত দিয়ে তাকেও নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। তখন অভি আরাভের লম্বাচুলে হাত ডুকিয়ে দিয়ে বলে,

-পাপা তুমি কি ফোক গান গাও তোমার চুল এত বড় কেন? জানো পাপা ফোক গান আমার অনেক ভালো লাগে। ছেলের কথার কোন জবাব দেয় না আরাভ। ভূমি বলে উঠে,

-আসলে অনেক দিন চুল কটেনি তো তাই বড় হয়ে গেছে। কাল সকালে উঠেই দেখবে পাপার চুল ছোট ছোট হয়ে গিয়েছে। ভূমির কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো অভি। তারপর সে বলল,

-তুমি আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না তো পাপা??জানো স্কুলে সবার পাপা মাম্মা যায় শুধু আমার পাপাই যায় না। আরাভ অভিকে শক্তকরে জড়িয়ে ধরে বলে,

-কোথাও যাব না। তোমাদের ছেড়ে আমি আর কোথাও যাব না।

-কি মজা, কি মজা, পাপা এখন আমাদের সাথেই থাকবে। অভি আরাভের কোল থেকে নেমে দৌড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। ভূমি উঠে ওর পিছু যেতে চাইলে আরাভ ভূমির হাত ধরে ফেলে। ভূমি হাতের দিকে এক পলক তাকিয়ে থেকে আরাভের দিকে তাকায়। তখন আরাভ ভূমির হাত ধরে টান দিয়ে নিজের কোলে বসিয়ে নেয়। ভূমির কোমড়ে হাত গুজে দেয় আরাভ। তারপর ভূমির গলায় মুখ গুজে দিয়ে বলে,

-তোমাকে বলেছিলাম সব সময় শাড়ি পরতে। বর তুমি থ্রি-পিছ পরেছো। আমার কথা অমান্য করাটা তোমার ধর্ম তাইনা। কথা বলার সময় আরাভের অধর স্পর্শ করছে ভূমির গলায়। আর ভূমি কেপে কেপে উঠছে।

-আ-আমিও বলেছিলাম তোমাকে, যতবার শাড়ি পরবো ততবার তুমি শাড়ির কুচি ঠিক করে দিবে।

-ওকে ফাইন, যাও শাড়ি নিয়ে এসো। শুধু কুচি ঠিক করেই দিবো না। শাড়িটাও পড়িয়ে দিবো আজ।

-মানে!!!!

-এত অবাক হওয়ার কি আছে। আজ প্রথম দিবো নাকি?? ভূমির কোমড়ে শক্ত করে চেপে ধরে বলল আরাভ।

-তুমি না সত্যিই একটা অসভ্য। সারাক্ষণ অসভ্যতামি করো। ছাড়ো আমাকে।

-তোমার এই ছটফটানি আর গেলো না। চুপচাপ বসে থাকো এখানে নাহলে।

-না হলে কি? ভ্রু কুচকিয়ে বলল ভূমি।

-অসভ্য বললে না আমাকে। সেটা প্রেকটিক্যালি করে দেখাবো। আরাভের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো ভূমিকা। তারপর বলল,

-এক ছেলের বাপ হয়েছে এখনো অসভ্যতামি করছো এটা ঠিক না।

-শুরুটা তো তুমিই করেছিলে জান। বলেই চোখ টিপ দিলো আরাভ। ভূমি লজ্জা পেয়ে আরাভের শার্টের কলার ধরে বুকে মুখ গুজে দিলো।

চলবে,,,,,,,

#লেখিকা- মাহফুজা আফরিন শিখা।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে