বৃষ্টি হয়ে অশ্রু নামে পর্ব-০১

0
736

#বৃষ্টি_হয়ে_অশ্রু_নামে [১]
#প্রভা_আফরিন
[কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ]

আজ শুভ্রা আপার প্রথম বিবাহবার্ষিকী। অথচ আজকের দিনটিই যে তার মৃ’ত্যুদিন হবে কে জানত? শান্ত, ভদ্র মানুষটি গতকাল প্রথম বিবাহবার্ষিকী উদযাপনের আকাঙ্ক্ষা ও উচ্ছ্বাস নিয়ে বাড়ি এসেছিল। এরপর কী থেকে কী হলো, আমাদের সুখী পরিবারটি একেবারে তছনছ হয়ে গেল।

ছুটির দিনে আমি একটু বেলা করে ঘুমাতে পছন্দ করি। কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সেদিনই ঘুমটা জলদি ভেঙে যায়। অবশ্য উচ্চমাধ্যমিক অবধি আমি আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইস কথায় বিশ্বাসী ছিলাম। ভার্সিটিতে উঠে ইন্টারনেটের রঙিন দুনিয়ায় মগ্ন হওয়ার পর মুঠোফোনের প্রতি এতটাই আ’স’ক্ত হয়ে গেছি যে একবার ওয়াইফাই চালু করতেই দিন-দুনিয়া ভুলে যাই। কখন যে রাত শেষ হয়ে যায় বুঝতেই পারি না। আজও ঘুমাতে ঘুমাতে তিনটে পেরিয়ে গেছে। ভেবেছিলাম বেলা বারোটা অবধি ঘুমাব। কিন্তু সকাল হতেই প্রবল চেঁচামেচিতে ঘুম ছুটে গেল। বিরক্তিতে মাথা চেপে ধরে উঠে বসলাম। ঠিক তখনই মায়ের কান্নার স্বর আমার আদুরে ঘুমের রেশ কাটিয়ে দিলো। ধড়মড় করে ঘর থেকে বের হয়ে দেখলাম বসার ঘরে বাবা স্তব্ধ মুখে বসে আছেন। মা কান্নাকাটি করছে। ভাইয়া-ভাবীও উপস্থিত। আমি ছুটে গিয়ে মাকে ধরলাম। তিনি ঝাড়া মে’রে আমার হাত সরিয়ে দিলেন। চিৎকার করে বললেন,
“দূরে সর। তোদের জন্ম দিয়ে পাপ করেছি। সেই পাপের শা’স্তি এখন পেতে হচ্ছে! এসব দেখার আগে ম’রে কেন গেলাম না?”

মায়ের চিৎকার, গালা’গা’লি বেড়ে গেল। আমি অসহায়ের মতো সকলের মুখের দিকে তাকালাম। ভাইয়া রাগে ফুঁসছে। ভাবি ঘৃণার দৃষ্টিতে এক পলক তাকিয়ে ঘরে চলে গেল। আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এই ঘৃণা কার জন্য? বুকের ভেতরটা অস্থির হয়ে উঠল। চোখ ফিরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আপার ঘরের দরজা বন্ধ। আপা কেন বের হচ্ছে না? মায়ের কান্না কি শুনতে পাচ্ছে না? কাউকে কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস না পেয়ে পিয়াসা ভাবির ঘরে গেলাম। কী হয়েছে জানতে চাইলে ভাবি তাচ্ছিল্য করে আমার দিকে ফোন এগিয়ে দিলো। আমি ফোনটা ধরে রাখতে পারলাম না। হাত থেকে ছুটে যেতেই ভাবির গলার স্বর চড়ে গেল। উনার এত দামী ফোনের স্ক্রিন ভাঙার অ’প’রাধে গাল’মন্দ করতে ছাড়ল না। সেসব কথায় আমার কোনো হেলদোল হলো না। ফোনে দেখা ক্ষণিকের দৃশ্যটা আমার দেহে কাঁপন ধরিয়েছে। নিশ্বাসের গতি বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ।

ঘর থেকে আমার ফোন বাজার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। উদ্ভ্রান্তের মতো এলোমেলো পায়ে ভাবির ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। মনে হচ্ছিল এখনই পড়ে যাব। কোনোমতেই রুমে গিয়ে ফোন হাতে নিয়ে দেখলাম ইতু কল করেছে। রিসিভ করতেই সে উৎকন্ঠার সঙ্গে হড়বড় করে বলে উঠল,
“অনন্যা, এসব কী দেখছি? শুভ্রা আপার অশ্লীল ফটো…”

ফোন কে’টে দিলাম। এরপর পরিচিতজনদের কাছ থেকে একের পর এক ফোন, ম্যাসেজ আসতেই থাকল। একপর্যায়ে বিরক্ত হয়ে নিজেরসহ মায়ের ফোনটাও বন্ধ করলাম।
আমার বড়ো আপা শুভ্রা। একজন নম্র, ভদ্র মেয়ে, সুখী স্ত্রী ও সোস্যাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় মুখ। ছোটো থেকে সারাজীবন আমাকে আপার সঙ্গে তুলনা দিয়ে খোঁটা দেওয়া হতো। আপার মতো হতে বলত। আর আজ! দুই চোখ ছাপিয়ে কান্না আসছে। আপা! আমার আপা তো এতটা জঘন্য মানুষ নয়! তবে এতটা নোং’রামো, হীন কাজ কী করে করল? চিন্তাভাবনায় জট পাকিয়ে আসতে চাইছে। কিছুতেই স্থির হতে পারছিলাম না। এমন সময় ভাইয়া ও মায়ের সম্মিলিত আর্ত’নাদ শুনলাম। ছুটে গিয়ে দেখলাম বাবা শরীর ছেড়ে দিয়েছে। সকলের হুড়োহুড়িতে আপাও দরজা খুলে ছুটে এসেছে। অগোছালো পোশাক, চোখ টকটকে লাল হয়ে ফুলে আছে। বাবা মুখ ফিরিয়ে বুজে আসা ক্ষীণ গলায় বললেন,
“ওই মেয়ের মুখ যেন আমাকে দেখতে না হয়।”

মা আপাকে দেখা মাত্রই ক্ষে’পে গেল। পায়ের জুতো খুলে আপাকে মা’রতে মা’রতে গালা’গা’লি করতে লাগল। কেউ মাকে থামাল না। আমিও সাহস পেলাম না। একসময় মা নিজেই ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। ঘৃ’ণা নিয়ে আওড়ালো,
“এই শিক্ষা দিয়েছিলাম আমরা? এই দিন দেখতে বেঁচে ছিলাম? তুই ম’রে যেতে পারিস না?”

আপা মেঝেতে পড়ে কাঁদছে। আমি এগোলাম না। এই মানুষটাকে ছোটো থেকে আমি সবচেয়ে ভালো মানুষটা ভেবে এসেছি। তাহলে কী করে পারল এমন নোং’রা কাণ্ড ঘটাতে? মুহূর্তেই চোখে ভেসে উঠল রাশেদ ভাইয়ের মুখটা। রাশেদ ভাই আপার স্বামী। গত বছর ঠিক এই দিনে শুভ্রা আপা ও রাশেদ ভাই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়। কত সুখের সংসার ছিল তাদের! প্রথম বিবাহ বার্ষিকী নিয়ে আপার কত কত ভাবনা ছিল। তাহলে কী করে রাশেদ ভাইকে ঠকিয়ে অন্য একজনের সঙ্গে…! আর ভাবতে পারছি না।

মধ্যবিত্তদের কাড়ি কাড়ি অর্থ থাকে না। তাদের কাছে সম্মানটাই সবচেয়ে বড়ো সম্পদ। সে সম্মানে কালি লাগা অস্তিত্বে আঘা’ত লাগার মতো। আপার অধঃপতন ও মানসিক চাপ সইতে না পেরে বাবা হার্ট অ্যাটাক করলেন। ভাইয়া বাবাকে নিয়ে ছুটল হাসপাতালে। আপা বসার ঘরের মেঝেতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। ভাবী ব্যঙ্গ করে বলল,
“বছর না যেতেই স্বামীর ওপর থেকে মন উঠে গেল? শেষে কিনা ননদের দেবরের সঙ্গে এমন কাণ্ড ঘটালে? ছোটোলোক হঠাৎ করে বড়োলোক হলে যা হয় আরকি। স্বামীর টাকায় আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে খুব তো ভাসছিলে। শেষে সম্মানটাই ডুবিয়ে দিলে! ছিহ!”

ভাবী হনহন করে চলে গেল। আপা বোধহয় মুখ লুকানোর জায়গা পেল না। আমার দৃষ্টিতে তখন ঘৃ’ণা ফুটে উঠেছে নাকি অসহায়ত্ব ঠিক বুঝলাম না। আপা অ’প’রাধীর মতো ডাকল,
“অনন্যা, তুই অন্তত আমার কথা শোন।”
আমি কান্নাটুকু গিলে নিয়ে শুধু বললাম,
“এমনটা করতে পারলে আপা? সবার কথা বাদ দাও, রাশেদ ভাইয়ের কথাও একবার ভাবলে না?”

বেলা গড়াতেই আপার ঘটনা মুঠোফোনে মুঠোফোনে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবেশীরাও কথা শোনাতে ছাড়ছে না। ছি! ছি! করছে আমাদের ওপর। আপার শ্বশুর বাড়ি থেকেও ফোন এলো। কিন্তু ধরার সাহস কারোই হলো না। আপা নিরবে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে গিয়ে ঘরের দরজা দিলো। সেই দরজা আর খুলল না। দুপুরে রাশেদ ভাই এসে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকল। কিন্তু ততক্ষণে আপা ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে নিজের চব্বিশ বছরের জীবনের ইতি টেনেছে। ফ্যানের সঙ্গে বাঁধা তার সেই শখের নীল ওড়না যেটা নিয়ে আমার ও আপার মধ্যে সব সময় কাড়াকাড়ি হতো। আজ থেকে আর কেউ কাড়াকাড়ি করবে না। সেই ওড়নাটিরও প্রয়োজন ফুরালো।

একেরপর এক ধাক্কা সইতে সইতে যখন পরিবারের বেহাল দশা, আপার মৃ’ত্যু সেখানে ভুমি’কম্প হয়ে এলো। আপার মৃ’ত্যু আমি মানতে পারলাম না। কাঁদতে ভুলে গেলাম। শরীরের শেষ শক্তিটুকুও হারিয়ে গেল। মেঝেতে বসে শুধু নিরব আঁখি মেলে দেখলাম রাশেদ ভাই আপাকে বুকে নিয়ে বসে আছে। উনার দৃষ্টি আপার মুখের ওপর স্থির। সেই চোখে নেই কোনো ঘৃণা, নেই কোনো ক্ষোভ। এতকিছুর পরেও কি মানুষটা আপাকে ঘৃ’ণা করতে পারেনি?

বাড়িতে পুলিশ এলো খানিক বাদে। তাদের সঙ্গে ভাইয়া ও রাশেদ ভাই কথা বলল। আপাকে নিয়ে যাওয়া হলো ময়নাত’দন্তের জন্য। মিডিয়া জগত রসিয়ে রসিয়ে লিখল শুভ্রা নামের মেয়েটির পর’কিয়া ও আত্মহ’ত্যার কাহিনি। বাবা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। উনাকে আপার মৃত্যুর খবর জানানো হলো না। মা তার বড়ো মেয়ের ঝুলন্ত দেহ দেখে সেই যে জ্ঞান হারিয়েছে আর ফেরেনি।

এমন হুলুস্থুল মুহূর্তে সবচেয়ে শান্ত মানুষটা আমি। নিরবে কাঁদছি। কিন্তু কোনো কথা বলতে পারছি না। নড়তেও পারছি না। মনে হচ্ছে দেহের ওপর ভারী পাথর চাপা দেওয়া। অসহায় চোখে নিজের পরিবারকে দেখছি। আমাদের সুখের সংসারের এ কী হাল! এ দিনটা কী কোনোভাবে মুছে দেওয়া যায় না? চেঁচামেচি শুনে ফুলে ওঠা চোখদুটি তুলে তাকালাম। আপার শ্বশুর বাড়ির মানুষের সঙ্গে ভাইয়ার কথা-কা’টা’কা’টি হচ্ছে। তারা আপার চরিত্র নিয়ে কথা শোনাচ্ছে। আপার জন্য নাকি রাশেদ ভাইয়ের বোনের সংসারেও ঝামেলা শুরু হয়েছে। আমার ভাইয়াও ছেড়ে কথা বলছে না। রাশেদ ভাইয়ের বোনের দেবরই তো আপার সঙ্গে এসব কাণ্ড ঘটিয়েছে। রাশেদ ভাই উভয় পক্ষকেই থামাতে চাইছে। এই মুহূর্তে মৃ’ত মানুষটিকে নিয়ে কারো মাঝে শোক-তাপ নেই। আপা সেই পথ খোলা রেখে যায়নি।

বাড়ি ভরা মানুষ। কত কথা, কত নিন্দা, আফসোস। মুরুব্বিদের একাংশ আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তা করতেও ছাড়ল না। এমন পরিবারের মেয়েকে কে বউ করে ঘরে তুলবে? শুভ্রা নিজের হাতে ছোটো বোনের ভবিষ্যত নষ্ট করে গেছে। জ্ঞান ফিরতে সেসব শুনে মা আমার দিকে তেড়ে এলেন। সপাটে গালে চ’ড় মে’রে বললেন,
“আর কত কথা শুনতে হবে তোদের জন্য? আমাদের কী একটুও শান্তি দিবি না? আজ থেকে তোর বাইরে বের হওয়া বন্ধ।”
মা কী বলছে, কী করছে কিছুই বুঝতে পারছে না হয়তো। কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো বিড়বিড় করছে। অস্থিরতা চেপে আছে দৃষ্টিতে। মা আমাকে টেনে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

আমি ঘোরগ্রস্তের মতো বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম। মাগরিবের আযান কানে এলো। একটু আগেই না সকাল হলো! সময়, ক্ষণ, পরিস্থিতির জ্ঞান যেন লোপ পাচ্ছে আমার। বাইরে তখন আঁধার ঘিরে বৃষ্টি নামছে। আঁধার হয়তো আমাদের জীবনেও নামতে শুরু করেছে। আর বৃষ্টি! আমাদের জীবনে সব বৃষ্টিরা আজ অশ্রু হয়ে নামছে।

চলবে…?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে